সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধারণা ছিল, দুইটি নদী বা নদীর সাথে সমুদ্র যখন মিলিত হয়, তখন তাদের পানি মেশে না। মূলত উপর থেকে দেখে দুই ধরণের রঙ এর পানি দেখে তাদের এরকম ধারণা হতো। একইসাথে তারা এটিও জানতো যে, নদীর পানি পান যোগ্য, আর সমুদ্রের পানি লবণাক্ততার কারণে পান যোগ্য নয়। তাই তারা এই দুই ধরণের পানির পার্থক্য বুঝতে পারতো সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তাদের এরকম ধারণার কারণ ছিল, পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা। পৃথিবীকে তারা মূলত সমতল ভূমিই মনে করতো। তারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখতো, সমুদ্রের পানি নদীর পানিগুলোকে লবণাক্ত করে দিচ্ছে না, এই কারণে তারা মনে করতো এই দুই পানি মেশে না। বর্তমান সময়েও আপনারা যারা নদীর মোহনা কিংবা সমুদ্রের সাথে নদীর মিলনস্থলে যাতায়াত করেছেন, তারা দেখে থাকবেন, দুই ধরণের রঙ এর পানি দেখলে মনে হয়, সেগুলো মিশছে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, তারা অবশ্যই মিশ্রিত হয়। লবণাক্ততা, পানির ঘনত্বের কারণে তার জন্য কিছুটা সময় লাগে, তবে মিশ্রিত হবে অবশ্যই।
মোহনায় যেখানে নদীর মিষ্টি হালকা পানি সমুদ্রের লবণাক্ত ভারী পানির সাথে মিশে যায় সেখানে উভয় ধরনের পানির মিশ্রণ পাওয়া যায়। জোয়ারের সময় খেয়াল করলে দেখবেন, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি নদীর ভেতরে ঢুকে যায়, আবার ভাটার সময় নেমে যায়। সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এই অঞ্চলে পানিতে লবণাক্ততার মাত্রাও যেরকম থাকে, আবার থাকে স্বাদু পানি প্রবাহের মাত্রাও। এই বৈচিত্র্যই এই অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ গাছপালার জন্ম দেয়, যা অন্যত্র পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সুন্দরবনের নদীতে আপনি লবণাক্ততাও পাবেন, আবার স্বাদু পানি প্রবাহও পাবেন।
পৃথিবীর বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সংস্থা নাসা ( National Aeronautics and Space Administration (NASA), ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা। সংস্থাটি পৃথিবীর মহাসাগরসমূহের পানির গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য অতি ক্ষুদ্র কিছু কণা বিভিন্ন স্থানের পানিতে ছেড়ে দিয়েছিল। সেই কণাসমূহ স্যাটেলাইটের কাছে সিগন্যাল প্রেরণ করে, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ সমুদ্রসমূহের পানির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পান। সেই কণাসমূহের চলাফেরা থেকে সহজেই বোঝা যায়, দুটি সমুদ্রের পানি মিশে যায় কিনা। যদি দুটি সমুদ্রের পানি না মিশতো, তাহলে সেই কণাসমূহের গতি পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যেত যে, কোন নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থেমে যাচ্ছে [1]
কোরআনে পরিষ্কারভাবেই প্রাচীনকালের এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে, দুই সমুদ্রের পানি অথবা লোনা পানি ও মিষ্টি পানি মেশে না। তাদের মধ্যে রয়েছে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল, যে কারণে এগুলো পরস্পরের সাথে মিশতে পারে না, আলাদাই থাকে। এটি পরিষ্কারভাবে ভুল তথ্য। দুই সমুদ্রের পানি মিলিত হলে তাদের ঘনত্ব এবং তাপমাত্রার কারণে মিশতে কিছু ক্ষেত্রে সময় লাগলেও, সেগুলো অবশ্যই মিশ্রিত হয়। লোনা পানি এবং মিষ্টি পানিও মিশ্রিত হয়, যার প্রমাণ আমরা পাই নদী ও সমুদ্রের মোহনায়। নদীর স্রোতের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি নদীতে ঢুকতে পারে না বটে, কিন্তু জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি অবশ্যই নদীতে ঢুকে পড়ে। [2] [3] [4] –
তিনিই সমুদ্রকে দু’ ধারায় প্রবাহিত করেছেন- একটি সুপেয় সুস্বাদু আরেকটি লবণাক্ত কটু, উভয়ের মাঝে টেনে দিয়েছেন এক আবরণ- এক অনতিক্রম্য বিভক্তি-প্রাচীর।
— Taisirul Quran
তিনিই দুই সমুদ্রকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন; একটি মিষ্টি, সুপেয় এবং অপরটি লবণাক্ত, খর; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তিনিই দু’টো সাগরকে একসাথে প্রবাহিত করেছেন। একটি সুপেয় সুস্বাদু, অপরটি লবণাক্ত ক্ষারবিশিষ্ট এবং তিনি এতদোভয়ের মাঝখানে একটি অন্তরায় ও একটি অনতিক্রম্য সীমানা স্থাপন করেছেন।
— Rawai Al-bayan
আর তিনিই দুই সাগরকে সমান্তরালে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট, সুপেয় এবং অন্যটি লোনা, খর; আর তিনি উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
দু’টি সমুদ্রকে তিনিই প্রবাহিত করেন যারা পরস্পর মিলিত হয়,
— Taisirul Quran
তিনি প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া, যারা পরস্পর মিলিত হয়,
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি দুই সমুদ্রকে প্রবাহিত করেন, যারা পরস্পর মিলিত হয়।
— Rawai Al-bayan
তিনি প্রবাহিত করেন দুই সমুদ্র যারা পরস্পর মিলিত হয়,
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
(কিন্তু তা সত্ত্বেও) উভয়ের মাঝে আছে এক আড়াল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না।
— Taisirul Quran
কিন্তু ওদের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা ওরা অতিক্রম করতে পারেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
উভয়ের মধ্যে রয়েছে এক আড়াল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না।
— Rawai Al-bayan
কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না [১]
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আসুন এবারে তাফসীর গ্রন্থ থেকে আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পড়ে দেখি [5] [6] –
এবারে আসুন তাফসীরে মাযহারী থেকে দেখে নেয়া যাক, এই আয়াতটি সম্পর্কে কী বলা আছে, [7] –
তথ্যসূত্র
- Ocean Current Flows around the Mediterranean Sea for UNESCO [↑]
- কোরআন, সূরা ফুরকান, আয়াত ৫৩ [↑]
- কোরআন, সূরা আর রাহমান, আয়াত ১৯ [↑]
- কোরআন, সূরা আর রাহমান, আয়াত ২০ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ২২৭ [↑]
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৫৮৮-৫৮৯ [↑]
- তাফসীরে মাযহারী, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬৩, ৫৬৪ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"