ইসলামি হাদিস ও ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলাম ধর্মের নবী এবং তার সাহাবীদের আচরণে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুতর কিছু প্রশ্ন তোলে। বিশেষত, কিছু হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, নারীকে নিপীড়নের ঘটনাগুলোকে ততটা গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি বরং অনেক সময় তা প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। নারীর স্বাধীন চলাফেরা এবং শিক্ষা গ্রহণের অধিকার একটি সভ্য ও ন্যায়সংগত সমাজের অন্যতম মৌলিক দাবি। বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে, যেখানে নারীদের প্রতি রক্ষণশীলতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখানে নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বহু সমাজে এখনো নারীদের বাইরে চলাফেরার ক্ষেত্রে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর বাধা। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বা কর্মস্থলে যোগদানকে পরিবার ও সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে কঠিন করে তোলা হয়। এতে একদিকে যেমন নারী শিক্ষার হার কমে, অন্যদিকে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়।
এ ধরনের পরিস্থিতির ফলে নারীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় তারা কর্মসংস্থানে প্রবেশের আগেই বঞ্চিত হয়, যা তাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে একটি বিশাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অথচ নারীর শিক্ষার প্রসার এবং তাদের নিরাপদ চলাফেরা নিশ্চিত করা হলে সমাজে সমতা ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, এবং নারীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা, যেখানে তারা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারে।
নবী ও সাহাবীদের প্রশ্রয় দান
কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায়, একবার নবীর এক সাহাবী এক বিবাহিত নারীকে মিথ্যা বলে ঘরের ভেতর নিয়ে বিনা অনুমতিতেই জোরপূর্বক চুম্বন করেছিলেন। একজন নারীকে প্রতারনামূলকভাবে ঘরের ভেতরে নিয়ে ঐ সাহাবী নিশ্চয়ই শুধু চুম্বনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, যা হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ থেকে বোঝা যায়। হযরত উমর এবং হযরত আবু বকর দুইজনই ঘটনাটি জানার পরেও লুকাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সবচাইতে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, নবী মুহাম্মদ বিষয়টি জানার পরে সাহাবীটিকে কোন শাস্তি না দিয়ে সৎ কাজ করার পরামর্শ দেন! কারণ সৎ কাজ খারাপ কাজের দোষ কাটিয়ে দেয়! নামাজের মাধ্যমে নাকি এই পাপ কেটে যাবে। কিন্তু সেই ভুক্তভোগী নারীর কী হবে? এই ঘটনাটি যদি আয়িশা কিংবা ফাতিমার সাথে ঘটতো, নবী কী সেই সাহাবীকে ছেড়ে দিতেন?
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৪৫। কুতায়বা ইবনু সাঈদ ও আবূ কামিল ফুযায়ল ইবনু হুসায়ন জাহদারী (রহঃ) … আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি এক স্ত্রীলোককে চুম্বন করে ফেলে। এরপর সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে এ কথা উল্লেখ করল। রাবী বলেন, তখন নাযিল হলঃ “সালাত কায়িম করবে দিবসের দুই প্রান্তে রজনীর কিছু অংশে। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে ইহা তাদের জন্য এক উপদেশ।” বর্ণণীকারী বলেন, তারপর লোকটি বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এ হুকুম কি একমাত্র আমার জন্য? তিনি বললেনঃ আমার উম্মাতের যে কেউ আমল করবে তার জন্যও।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৪৬। মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল আলা (রহঃ) … ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললো, সে এক মহিলাকে চুমু দিয়েছে বা হস্ত দ্বারা স্পর্শ করেছে অথবা তেমন কিছু করেছে। এ বলে সে এর কাফফারা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে জানতে চাইছে। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আল্লাহ তা’আলা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করলেন। পরবর্তী অংশ ইয়াযীদের হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৪৭। উসমান ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) … সুলায়মান তায়মী (রহঃ) এর সুত্রে উক্ত সনদে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যাক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া ব্যতীত এক স্ত্রীলোকের সাথে কিছু অসৌজন্যমূলক আচরণ করল। তারপর সে উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) এর নিকট আসল। উমার (রাঃ) তার এ কাজটিকে গুরুতর অপরাধ মনে করলেন। এরপর সে আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর নিকট আসল। তিনিও এ কাজটিকে গুরুততর অপরাধ মনে করলেন। অবশেষে সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল। তারপর বর্ণনাকারী হাদীসটি ইয়াযীদ এবং মু’তামির (রাঃ) এর হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সুলাইমান আত তাইমী (রহঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৪৮। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, কুতায়বা ইবনু সাঈদ ও আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) … আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! মদীনার এক প্রান্তে এক স্ত্রীলোককে আমি উপভোগ করেছি। সহবাস ব্যতিরেকে তার সাথে আমি মিলিত হয়েছি। আমিই সেই ব্যক্তি। আপনি আমার সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছা ফয়সালা দিন। তখন উমার (রাঃ) তাকে বললেনঃ আল্লাহ তোমার অপরাধ গোপন রেখেছেন। তুমিও যদি তোমার নিজের ব্যাপারটি গোপন রাখতে! বর্ণনাকারী বলেন, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আর কোন উত্তর দেননি। তারপর লোকটি উঠে যেতে লাগল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে তার পশ্চাতে পাঠালেন। সে তাকে ডেকে আনল। তিনি তার সামনে এ আয়াত পাঠ করলেনঃ “সালাত কায়িম করবে দিবসের দুই প্রান্তে এবং রজনীর কিছু অংশে। সৎকর্ম নিশ্চয়ই অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে, এ হল তাদের জন্য এক উপদেশ।” তখন লোকদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর নবী! এ হুকুম কি তার জন্য খাস? উত্তরে তিনি বললেনঃ না, বরং সমস্ত মানুষের জন্যই এ হুকুম প্রযোজ্য।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৪৯। মুহাম্মাদ ইবনু মুসান্না (রহঃ) … আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আবূল আহওয়াসের অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে এ হাদীসের মধ্যে আছে, তখন মুআয (রাঃ) প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এ হুকুম কি শুধু তার জন্য, না আমাদের সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য? উত্তরে তিনি বললেনঃ না, বরং তোমাদের সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৫০। হাসান ইবনু আলী হুলওয়ানী (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি হদ্দ কায়িম হওয়ার যোগ্য কাজ করে ফেলেছি। সুতরাং আপনি আমার উপর তো কায়িম করুন। রাবী বলেন, তখন সালাতের ওয়াক্ত হল এবং লোকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সালাত আদায় করল। সালাত আদায় হয়ে গেলে লোকটি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার উপর হদ্দ কায়েম হওয়ার মত অপরাধ করে ফেলেছি। সুতরাং আপনি আল কুরআনের বিধান অনুসারে আমার উপর শাস্তি কায়িম করুন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কি আমাদের সঙ্গে সালাতে ছিলে? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫১/ তাওবা
পরিচ্ছেদঃ ৭. আল্লাহ্ তা’আলার বানীঃ পুণ্যবান পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদঃ ১১৪)
৬৭৫১। নাসর ইবনু আলী জাহযামী ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) … আবূ উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে উপবিষ্ট ছিলেন এবং আমরা তাঁর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! হদ্দ প্রযোজ্য হওয়ার অপরাধ করে ফেলেছি। সুতরাং আপনি আমার উপর হদ্দ বাস্তবায়িত করুন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে রইলেন। সে পুনরায় বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার দ্বারা হদ্দ প্রযোজ্য হওয়ার মত অপরাধ হয়ে গেছে। সুতরাং আপনি আমার উপর হদ্দ বাস্তবায়িত করুন। এবারও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে রইলেন। লোকটি তৃতীয়বার অনুরূপ বলল। এমতাবস্থায় সালাত শুরু হল।
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত সমাপ্ত করলেন, রাবী আবূ উমামা (রাঃ) বলেন, সাকাত শেষে লোকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ করতে লাগল। [আবূ উমামা (রাঃ)] বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে কি উত্তর দেন তা দেখার জন্য আমিও তাঁর অনুসরণ করলাম। এরপর প্রশ্নকারী লোকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গিয়ে আবার বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার উপর ’হদ্দ হওয়ার মত অপরাধ করে ফেলেছি। সুতরাং আমার উপর বাস্তবায়িত করুন।
আবূ উমামা (রাঃ) বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তুমি কি উত্তমরূপে উযু করোনি? সে বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি কি আমাদের সঙ্গে সালাত আদায় করোনি? সে বলল, হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা তোমার হদ্দ ক্ষমা করে দিয়েছেন, অথবা বললেনঃ তিনি তোমার গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ উমামাহ্ বাহিলী (রাঃ)
সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫০/ কুরআন তাফসীর
পরিচ্ছেদঃ সূরা হুদ
৩১১৫. আবদুল্লাহ্ ইবন আবদুর রহমান (রহঃ) … আবুল ইউসর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ এক মহিলা একবার আমার কাছে খেজুর কিনতে আসল। আমি বললামঃ ঘরে আরো ভাল খেজুর আছে, সে তখন আমার সাথে ঘরে প্রবেশ করল। আমি তার দিকে ঝুঁকে তাকে চুমু দেই। পরে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে তার বিষয়টি বললাম। তিনি বললেনঃ নিজের মধ্যে তা গোপন রাখ, আর তওবা কর। এ বিষয়ে কাউকে জানাবে না। কিন্তু (অনুশোচনায়) আমি স্থির থাকতে পারলাম না। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে বিষয়টি বললাম, তিনিও বললেনঃ নিজের মধ্যেই তা গোপন রাখ, আর তওবা কর। এ বিষয়ে কাউকে জানাবে না। কিন্তু (অনুশোচনায়) আমি স্থির তাকতে পারলাম না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বিষয়টি বললাম। তিনি বললেনঃ আল্লাহর পথে জেহদরত একজন যোদ্ধার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রীর বিষয়ে তুমি কি এ ধরনের আচরণ করলে? ফলে সে কামনা করতে লাগল সে যদি পূর্বে ইসলাম গ্রহণ না করে এ মুহূর্তে ইসলাম গ্রহণ করত এবং ধারণা করতে লাগল যে, সে জাহান্নামী হয়ে গেছে। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে রইলেন অবশেষে তাঁর কাছে ওহী এলঃ
أَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ
সালাত (নামায)কায়েম কর দিনের দু’প্রান্ত ভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। সৎকাজ অবশ্যই অসৎ কাজ মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে এ তাদের জন্য এক উপদেশ (১১ : ১১৪)।
আবুল ইউসর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি তাঁর কাছে হাযির হলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এই আয়াত তিলাওয়াত করে শোনালেন। সাহাবীগণ বললেনঃ এটি কি বিশেষ করে এরই জন্য না সব মানুষের জন্য। তিনি বললেনঃ না বরং এ সব মানুষের জন্যই।
এ হাদীসটি হাসান-সহীহ-গারীব। রাবী কায়স ইবন রবী কে ওয়াকী’ (রহঃ) প্রমুখ হাদীসবিদগণ যঈফ বলেছেন। শরীক (রহঃ)-ও এটি উছমান ইবন আবদুল্লাহ্ সূত্রে কায়স ইবন রবী’ (রহঃ) এর রিওয়ায়াতের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে আবূ উসামা, ওয়াছিলা ইবন আসকা’ ও আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকেও হাদীস বর্ণিত আছে। আবুল ইউসর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নাম কা’ব ইবন আমর।
হাসান, তিরমিজী হাদিসঃ ৩১১৫ [আল মাদানী প্রকাশনী]
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
এবারে আসুন হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে এই হাদিসের ব্যাখ্যা জেনে নেয়া যা [1]



হাদিসের ঘটনা ও বিশ্লেষণ
উপরে হাদিস এবং হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থে যেই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যেখানে এক সাহাবী এক নারীর সাথে প্রতারণা করে তাকে ঘরে নিয়ে যান এবং বিনা অনুমতিতে চুম্বন করেন, শরীর স্পর্শ করেন এবং যৌন কর্ম না করেও সেই নারীর শরীর উপভোগ করেন। পরে তিনি অনুশোচনা বোধ করে প্রথমে হযরত আবু বকর ও পরে হযরত উমরের কাছে পরামর্শ চান। উভয়েই তাকে পরামর্শ দেন যেন তিনি এ ঘটনা গোপন রাখেন এবং তওবা করেন। কিন্তু তিনি স্থির থাকতে না পেরে অবশেষে নবী মুহাম্মদের কাছে বিষয়টি জানান। নবী মুহাম্মদ শাস্তি বা নিন্দা করার পরিবর্তে তাঁকে নামাজ পড়ার পরামর্শ দেন এবং কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করেন যেখানে বলা হয়েছে, “সৎকাজ অবশ্যই অসৎ কাজ মিটিয়ে দেয়”। সেইসাথে এটি বলে দেন যে, এই বিধানটি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে! অথচ তার এই কাজটিকে তীব্রভাবে প্রতিহত করা উচিত ছিল, সেই সাহাবীকে শাস্তি দেয়া উচিত ছিল। সেটি না করে পুরো বিষয়টিকে তিনি খুব সামান্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ক্ষমা করে দেন!
হাদিসের নৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
এই হাদিসে অন্তত তিনটি বড় সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়:
- নারীর সম্মতির প্রতি অগ্রাহ্যতা: সাহাবীর আচরণ স্পষ্টতই যৌন হয়রানির একটি রূপ। আজকের সমাজে এটি নিঃসন্দেহে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত অনুসারে, নবীর কাছে এটি কোন গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। বরং উমর ও আবু বকর তাকে পরামর্শ দিয়েছেন বিষয়টি চেপে যেতে, যা মূলত অপরাধীর সুরক্ষাকেই নিশ্চিত করে।
- শাস্তির অভাব: নবী মুহাম্মদ সাহাবীর এই কর্মকাণ্ডকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করেননি, বরং নামাজ পড়ার মাধ্যমে এর পরিত্রাণ খুঁজেছেন। এর ফলে অপরাধী উৎসাহিত হতে পারে যে, শুধুমাত্র নামাজ পড়ে বা তওবা করে নারী নিপীড়নের শাস্তি এড়ানো সম্ভব।
- ভিকটিম ব্লেমিং-এর প্রবণতা: হাদিসটি এমন এক সংস্কৃতির প্রতিফলন, যেখানে নারীর প্রতি অপরাধ সংঘটিত হলেও অপরাধীর পরিবর্তে তার ধর্মীয় আনুগত্যকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি ভিকটিম ব্লেমিং-এরই একটি রূপ, যা আধুনিক সমাজে নারীবিরোধী মনোভাবকে উসকে দেয়।
ইসলামের বিচার ব্যবস্থা ও নারীর অধিকার
এ ধরনের হাদিস ইসলামের ন্যায়বিচার ও নারীর সুরক্ষার বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। ইসলামে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্যের বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে নারীদের অধিকারকে পুরুষদের স্বার্থের নিচে রাখা হয়েছে। যদি একটি ধর্মীয় আইনে নারী নিপীড়নের ঘটনাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করা হয়, তবে সেই ধর্মীয় নীতি আদতে নারী নিপীড়কদেরই রক্ষা করে। আধুনিক সমাজে এ ধরনের বিচার ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। হযরত মুহাম্মদ, হযরত উমরের ক্ষেত্রেও নানা ধরণের নারী নির্যাতনের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, যা প্রতিটিই মারাত্মক! শুধু তাই নয়, নারীর ওপর নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের মত ঘটনায় ধর্ম খুব পরিষ্কারভাবেই ভিক্টিম ব্লেইমিং করে, যার প্রমাণ অসংখ্য। আসুন এই ভিডিটি শুনি,
উপসংহার
এই হাদিসটি ইসলামে নারী নিপীড়নের প্রশ্রয়কে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। একজন ব্যক্তি যে নারীর অনুমতি ছাড়া তাকে স্পর্শ করেছে, তার কোনো শাস্তি না হয়ে বরং ধর্মীয় উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং ইসলামের নৈতিক কাঠামোর একটি বড় দুর্বলতা। নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য ইসলামের এই ধরনের বিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত এবং নারী সুরক্ষার জন্য আধুনিক আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করাই অধিক যৌক্তিক।
তথ্যসূত্র
- সহীহ মুসলিম শরীফ (প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ), আল হাদিস প্রকাশনী, ২২ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৫ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"