ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিধান হচ্ছে, দাস-দাসীর উপর যাকাত ধার্য করা হয় না। এটি শুনতে আপাতদৃষ্টিতে সামান্য বিষয় মনে হলেও, গভীরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এর ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর সমস্যা, যা দাসপ্রথা বিলুপ্তির পরিবর্তে তা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে কর ফাঁকি দেয়া এবং কম খরচে সর্বাধিক সুবিধা অর্জন করা। যখন কোনো সম্পদ করমুক্ত হয়, তখন তা মানুষের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মানুষ সেই খাটে বিনিয়োগ করে, সেই খাতটি যে বিনা ট্যাক্সের সম্পদ বা এসেট হিসেবে বিবেচনা করে।
একজন মুসলিম যদি দাস কিনে রাখেন, তবে তার সেই দাসের উপর যাকাত দিতে হবে না। অর্থাৎ, দাস থাকা একধরনের “ট্যাক্স ফ্রি বিনিয়োগ”। আর ঠিক এখানেই সমস্যার শুরু। সমাজে যখন কর এড়ানোর সহজ উপায় হিসেবে দাস কেনা সহজলভ্য হয়ে যায়, তখন মানুষ সহজেই সেই পথ বেছে নেয়। ফলস্বরূপ, দাস কেনাবেচা বৃদ্ধি পায় এবং দাসবাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ইসলামের এই বিধান তাই দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার পরিবর্তে উল্টো তার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছে। ঠিক এই কারণেই সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো ইসলামিক দেশ দাস প্রথা বিলুপ্ত করতে একদমই রাজি ছিল না। সর্বশেষ যেই দেশগুলো দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করার আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে, তাদের মধ্যে মৌরিতানিয়া অন্যতম। ১৯৬২ সালে গ্রেইট ব্রিটেনের সরাসরি চাপের মুখে সৌদি আরব এবং ইয়েমেন দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করতে সম্মত হয়, এবং ১৯৭০ সালে একইভাবে ব্রিটেনের ক্রমাগত চাপের কারণে ওমানও দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করে [1]।
ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি ১০০টি উট বা ১০০টি গরু পালন করলে তার উপর যাকাত দিতে হবে। কিন্তু একই ব্যক্তি যদি সেই অর্থ দিয়ে দাস কিনে রাখে, তবে যাকাতের দায় থেকে মুক্ত থাকবে। এই আর্থিক সুবিধা মানুষকে দাস কেনার প্রতি উৎসাহিত করবে না? দাস কেনা অর্থে বিনিয়োগে করমুক্ত থাকার সুবিধা এমন একটি প্রলোভন, যা যে কোনো যুগের মানুষকে দাস রাখায় আগ্রহী করে তুলবে। অর্থাৎ, করমুক্ত সুবিধা প্রদান করে ইসলাম নিজেই দাস ব্যবসার প্রসারে ভূমিকা রেখেছে।
এই বিধানটি বলবৎ থাকলে দাস ব্যবসা কখনই এই বিধানের কারণে বিলুপ্ত হবে না। কারণ এই বিধানের ফলে দাসব্যবসা একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে। ট্যাক্স ফ্রি বিজনেস সবসময়ই মানুষের আগ্রহের কারণ। আসুন দেখি এই বিষয়ে ইসলামের বিধান কী [2] [3] –
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
১৩। যাকাত
পরিচ্ছেদঃ ২. মুসলিম ব্যক্তির ক্রীতদাস ও ঘোড়ার উপর কোন যাকাত নেই
হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ২১৬৩, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৯৮২
২১৬৩-(৮/৯৮২) ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া আত তামীমী (রহঃ) ….. আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিম ব্যক্তির ক্রীতদাস ও ঘোড়ার উপর কোন যাকাত নেই। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২১৪২, ইসলামীক সেন্টার ২১৪৫)
গহাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
সূনান তিরমিজী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৭/ যাকাত
পরিচ্ছেদঃ ঘোড়া ও দাস-দাসীর যাকাত নেই।
৬২৬. আবূ কুরায়ব মুহাম্মাদ ইবনু আলা ও মাহমুদ ইবনু গায়লান (রহঃ) ….. আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিমের ঘোড়া ও দাসের উপর কোন যাকাত নেই। – ইবনু মাজাহ ১৮১২, যইফা ৪০১৪, বুখারি ও মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৬২৮ [আল মাদানী প্রকাশনী]
এই বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনু আমর ও আলা (রাঃ) থেকেও হাদিস বর্ণিত আছে। ইমাম আবূ ঈসা (রহঃ) বলেন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদিসটি হাসান সহীহ্। আমিগণের আমল এই হাদীছের অনুযায়ী যে, সাইমা ঘোড়ার উপর যাকাত নেই। আর খিদমতের জন্যে নিয়োজিত দাস-দাসীদের উপর যাকাত নেই। কিন্তু ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে হলে ভিন্ন কথা। অর্থাৎ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে হলে, এক বছর পূর্ণ হলে মূল্যের উপর যাকাত ধার্য হবে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
প্রশ্ন হলো, ইসলাম ধর্ম যদি ন্যায়বিচার ও সমতার শিক্ষা দিয়ে থাকে, সেই ধর্মের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এমন বৈষম্যমূলক নীতি কীভাবে থাকতে পারে? একজন অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ব্যক্তি যে সামান্য সম্পদের মালিক, সে তার সম্পদের ওপর যাকাত দিতে বাধ্য থাকবে, অথচ একজন ধনী ব্যক্তি তার সব সম্পত্তি দিয়ে দাস কিনে রাখলে যাকাত দেয়ার দায় থেকে মুক্ত থাকবে? এটি যে এক ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং নৈতিক অবিচার তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরেকটি দিক বিবেচনা করা যাক: ইসলামে পশুপালনের উপর যাকাত থাকায় মুসলিমরা অনেক সময় পশুপালন থেকে বিরত থাকত, কারণ এতে বাড়তি ব্যয় জড়িত ছিল। কিন্তু দাস কেনায় যাকাত না থাকায় ধনী মুসলিমরা সেই দিকে ঝুঁকেছে। এভাবে করনীতি একদিকে পশুপালন নিরুৎসাহিত করেছে, অন্যদিকে দাসপালনকে উৎসাহিত করেছে। করনীতি কীভাবে একটি সমাজের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্ধারণ করে, ইসলামের এই বিধান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সবশেষে, যদি ইসলামের উদ্দেশ্য সত্যিই দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হতো, তবে অর্থনৈতিক নীতিমালায় দাসপালনকে নিরুৎসাহিত করা উচিত ছিল। বরং উল্টোভাবে দাস পালনে করমুক্ত সুবিধা দিয়ে ইসলামের এই বিধান দাসব্যবসাকে সমৃদ্ধ করেছে। কর ফাঁকি দেয়ার মানুষের চিরন্তন স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে দাসপ্রথাকে টিকিয়ে রাখার এমন নীতির নৈতিকতা ও যৌক্তিকতা গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
তথ্যসূত্র
- Martin A. Klein (2002), Historical Dictionary of Slavery and Abolition, p. xxii, ISBN 0810841029 [↑]
- সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিসঃ ২১৬৩ [↑]
- সূনান তিরমিজী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৬২৬ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"