ইসলাম ধর্মের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাসের একটি হলো, কোন দ্বিধা বা সন্দেহ ছাড়াই এই কথাতে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা যে, রিজিক (অর্থ, খাদ্য, জীবিকা, আয়-উপার্জন) একমাত্র আল্লাহই নির্ধারণ করেন, প্রদান করেন, বান্দাদের কাছে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেন এবং তিনি যার ইচ্ছা রিজিক বৃদ্ধি করেন এবং যার ইচ্ছা কমিয়ে দেন। এটি শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, কোন অবস্থাতেই বান্দার ওপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু এই বিশ্বাস বাস্তবিক ও যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি কেবল একটি ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস এবং এটি বাস্তব জীবনে এই বিশ্বাস নিতান্তই অর্থহীন কিছু গালভরা কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। একইসাথে, এই বিশ্বাস কেবলমাত্র মানুষকে ধর্মীয় কুসংস্কারের ওপর নির্ভরশীলতার দীক্ষা দেয়, তাদের অলস করে তোলে, পরনির্ভরশীলতা এবং সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যা উপেক্ষা করতে শেখায়। যা একটু দুষ্টু চক্রের মত, যার ফলে সামাজিকভাবে দারিদ্র আরও শক্তিশালী হয়। সমাজে বৈষম্য এবং অধিকারহীনতা বৃদ্ধি পায়। আলোচনার শুরুতেই আসুন প্রখ্যাত আলেম আহমদুল্লাহর কিছু বক্তব্য শুনে নিই,
ইসলামের বিশ্বাস ও তার বিপরীত বাস্তবতা
আসুন কোরআন ও হাদিসের কিছু বক্তব্য পড়ে নিই, [1] [2] [3] [4] [5]
আল্লাহ যদি তাঁর সকল বান্দাহদের জন্য রিযক পর্যাপ্ত করে দিতেন, তাহলে তারা অবশ্যই যমীনে বিদ্রোহ সৃষ্টি করত; কিন্তু তিনি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে যতটুকু ইচ্ছে নাযিল করেন। তিনি তাঁর বান্দাহদের সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল, তিনি তাদের প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখেন।
— Taisirul Quran
আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবনোপকরণের প্রাচুর্য দিলে তারা পৃথিবীতে অবশ্যই বিপর্যয় সৃষ্টি করত; কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছা মত সঠিক পরিমানেই দিয়ে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে সম্যক জানেন ও দেখেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আল্লাহ যদি তার বান্দাদের জন্য রিয্ক প্রশস্ত করে দিতেন, তাহলে তারা যমীনে অবশ্যই বিদ্রোহ করত। কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণে যা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত, সম্যক দ্রষ্টা।
— Rawai Al-bayan
আর যদি আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের রিযিক প্রশস্ত করে দিতেন, তবে তারা যমীনে অবশ্যই সীমালংঘন করত; কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছেমত পরিমানেই নাযিল করে থাকেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক অবহিত ও সর্বদ্ৰষ্টা।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আল্লাহ রিযক সম্প্রসারিত করেন যার জন্য ইচ্ছে করেন, আর যার জন্য চান সীমিত পরিমাণে দেন। তারা পার্থিব জীবনে আনন্দে মেতে আছে অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন অতি নগণ্য বস্তু।
— Taisirul Quran
আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন কিংবা সংকুচিত করেন; কিন্তু তারা পাথির্ব জীবন নিয়েই উল্লসিত, অথচ ইহজীবনতো পরজীবনের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগ মাত্র।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন রিযক বাড়িয়ে দেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে উৎফুল্লতায় আছে, অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন খুবই নগণ্য।
— Rawai Al-bayan
আল্লাহ্ যার জন্য ইচ্ছে তার জীবনোপকরণ বৃদ্ধি করেন এবং সংকুচিত করেন; কিন্তু এরা দুনিয়ার জীবন নিয়েই আনন্দিত, অথচ দুনিয়ার জীবন তো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগমাত্র [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হয়েছে এবং তারা বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরকে উপহাস করে থাকে, এবং যারা ধর্মভীরু তাদেরকে উত্থান দিনে সমুন্নত করা হবে; এবং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন অপরিমিত জীবিকা দান করে থাকেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
যারা কুফরী করেছে, দুনিয়ার জীবনকে তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। আর তারা মুমিনদের নিয়ে উপহাস করে। আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তারা কিয়ামত দিবসে তাদের উপরে থাকবে। আর আল্লাহ যাকে চান, বেহিসাব রিয্ক দান করেন।
— Rawai Al-bayan
যারা কুফুরী করে তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন সুশোভিত করা হয়েছে এবং তারা মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে থাকে। আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে কেয়ামতের দিন তারা তাদের উর্ধ্বে থাকবে। আর আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে অপরিমিত রিযিক দান করেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
যমীনে বিচরণশীল এমন কোন জীব নেই যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর উপর নেই, তিনি জানেন তাদের থাকার জায়গা কোথায় আর কোথায় তাদেরকে (মৃত্যুর পর) রাখা হয়, সব কিছুই আছে সুস্পষ্ট লিপিকায়।
— Taisirul Quran
আর ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যাদের রিয্ক আল্লাহর যিম্মায় না রয়েছে, আর তিনি প্রত্যেকের দীর্ঘ অবস্থানের স্থান এবং অল্প অবস্থানের স্থানকে জানেন, সবই কিতাবে মুবীনে (লাউহে মাহফুযে) রয়েছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিয্কের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল* । সব কিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে**। * এখানে مستقر বা আবাসস্থল বলতে মাতৃগর্ভে অবস্থান মতান্তরে মৃত্যু পর্যন্ত দুনিয়ায় অবস্থানকে বুঝানো হয়েছে। আর مستودع দ্বারা কবরস্থ করার স্থান মতান্তরে জন্মের পূর্বে পিতৃমেরুদন্ডে অবস্থান কিংবা মৃত্যুর সময় বা স্থান বুঝানো হয়েছে।
— Rawai Al-bayan
আর যমীনে বিচরণকারী সবার জীবিকার [১] দায়িত্ব আল্লাহ্রই [২] এবং তিনি সেসবের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি [৩] সম্বন্ধে অবহিত; সবকিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে আছে [৪]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৩৪/ দুনিয়াবী ভোগবিলাসের প্রতি অনাসক্তি
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. আল্লাহ তা’আলার উপর পুরোপরি নির্ভরশীল হওয়া
২৩৪৪। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিযিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরকেও রিযিক দেয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ (৪১৬৪)।
আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ। আমরা এই হাদীসটি শুধুমাত্র উপরোক্ত সূত্রেই জেনেছি। আবূ তামীম আল-জাইশানীর নাম আবদুল্লাহ ইবনু মালিক।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
তাহলে, অপুষ্টির শিকার এই বালকটির রিজিক কে সংকুচিত করে দিয়েছে? তার রিজিক কে সীমিত করে দিয়েছে?

নবীর প্রতারণাঃ অলসতার প্রশ্রয় ও প্রতারণামূলক বিশ্বাস
আসুন একটি হাদিস পড়ি এবং পড়ার পরে হাদিসটির মূল্যায়ন করি,
সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৩৪/ দুনিয়াবী ভোগবিলাসের প্রতি অনাসক্তি
পরিচ্ছেদঃ ৩৩. আল্লাহ তা’আলার উপর পুরোপরি নির্ভরশীল হওয়া
২৩৪৫। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে দুই ভাই ছিল। তাদের একজন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত থাকত এবং অন্যজন আয়-উপার্জনে লিপ্ত থাকত। কোন একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সেই উপার্জনকারী ভাই তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তিনি তাকে বললেনঃ হয়তো তার ওয়াসীলায় তুমি রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছ।
সহীহ, মিশকাত (৫৩০৮), সহীহাহ (২৭৬৯)।
আবূ ঈসা বলেন, এ হাদীসটি হাসান সহীহ গারীব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
এই হাদিসটি নবী মুহাম্মদের বক্তব্যের মাধ্যমে একটি গভীর প্রতারণামূলক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে, যেখানে একজন শ্রমজীবী ব্যক্তির উপার্জনের কৃতিত্ব এমন একজনকে দেওয়া হচ্ছে, যে আদতে কোনো পরিশ্রমই করছে না। এটি ইসলামের “রিজিকের মালিক আল্লাহ” ধারণার আরেকটি ব্যর্থতা প্রকাশ করে, যেখানে বাস্তবিকভাবে যে পরিশ্রম করছে, তার প্রশংসা না করে বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে কোন কাজ না করা ব্যক্তিকে কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই হাদিসে এক ভাই জীবিকা নির্বাহের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে, আরেক ভাই কোনো কাজ না করে নবীর দরবারে বসে থাকছে এবং ধর্ম করছে, অথচ নবী সেই শ্রমজীবী ভাইকেই বলে দিচ্ছেন যে, হয়তো তার উপার্জনের কারণ তার অলস ভাইটি!
এই বক্তব্য বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং কুসংস্কারকে উসকে দেয়। এটি এমন একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে যারা পরিশ্রম করে তাদের সাফল্যের কারণ হিসেবে অলস বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভূমিকা দেখানো হয়। বাস্তবে একজন পরিশ্রমী মানুষের উপার্জন তার পরিশ্রমের ফল, অন্য কোনো অলস ব্যক্তির কারণে নয়। কিন্তু এই হাদিসে নবী মুহাম্মদ পরিশ্রমী ব্যক্তিকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তার উপার্জনের পেছনে তার অলস ভাইয়ের ধর্মকর্মের ভূমিকা রয়েছে। এটি মূলত সেই অলস ব্যক্তিকে সমাজে অর্থহীনভাবে মূল্যবান করে তুলতে একটি প্রতারণামূলক চেষ্টা।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে নবী আসলে পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়নকে নস্যাৎ করছেন এবং অলসতাকে অযৌক্তিকভাবে বৈধতা দিচ্ছেন। এটি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ তৈরি করে যেখানে পরিশ্রমী মানুষদের শ্রমের উপযুক্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, বরং অলসদের জন্য তাদের শ্রমের কৃতিত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। ইসলামের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, রিজিকের মালিক আল্লাহ, তাই যে পরিশ্রম করছে, সে তার উপার্জন আসলে নিজের পরিশ্রমের জন্য নয়, বরং অন্য কোনো অলস ব্যক্তির জন্য হচ্ছে! এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং সমাজে পরিশ্রমের মূল্য কমিয়ে দেয়।
আসল বাস্তবতা হলো, একজন মানুষ তার পরিশ্রমের ফল নিজেই উপভোগ করে, অন্য কেউ নয়। যদি এই হাদিস সত্য হতো, তাহলে পৃথিবীতে যারা অলস ও কর্মহীন, তারা সবচেয়ে ধনী হয়ে যেত, আর যারা পরিশ্রম করে, তারা সবসময় গরিব থাকত। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে। পরিশ্রমী মানুষই উন্নতি করে, আর যারা অলস তারা পিছিয়ে পড়ে। এই হাদিস মূলত ইসলামী বিশ্বাসের, বিশেষ করে রিজিকের একমাত্র মালিক আল্লাহ ধারণার ব্যর্থতাগুলোর একটি উদাহরণ যেখানে বাস্তবিক শাসনব্যবস্থার এবং যুক্তিবাদের পরিবর্তে অলৌকিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এটি এমন এক চিন্তাধারা তৈরি করে, যেখানে শ্রমিকদের শ্রমের প্রকৃত মূল্যকে অস্বীকার করা হয় এবং অলসদের জন্য অযৌক্তিক মর্যাদা তৈরির চেষ্টা করা হয়।
এই হাদিসের মাধ্যমে নবী আসলে অলস ও ধর্মীয় উপাসনায় ব্যস্ত ব্যক্তিদের জন্য সমাজে এক প্রকার অযৌক্তিক সম্মান তৈরির চেষ্টা করেছেন, যেখানে তারা কোনো কাজ না করেও সমাজের উপার্জনশীল অংশের কৃতিত্বের অংশীদার হয়ে যায়। ধরুন একজন বিজ্ঞানী ৪০ বছর গবেষণা করে একটি ঔষধ আবিষ্কার করেছে। তার ভাইটি সেই ৪০ বছর ধরে আল্লাহু আল্লাহু জিকির করে কাটিয়েছে। এই দুইজনার মধ্যে তাহলে কাকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া উচিত? আল্লাহু বলে জিকির করা লোকটিও কী সেই নোবেলের অর্ধেক দাবীদার হবে? এটি ধর্মীয় প্রতারণার একটি উদাহরণ যেখানে মানুষের শ্রমের প্রকৃত মূল্য উপেক্ষা করে অকার্যকর বিশ্বাস ও অলসতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এভাবে ইসলাম শুধু অলসতাকে উৎসাহিত করে না, বরং প্রকৃত পরিশ্রমী মানুষদের শ্রমের উপযুক্ত মূল্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
খলিফাদের আমলের দুর্ভিক্ষঃ আল্লাহর ব্যর্থতা
খলিফা উমর ইবন খাত্তাবের শাসনামলে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে “রামাদাহ দুর্ভিক্ষ” নামে পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষ এতটাই মারাত্মক ছিল যে, বহু মানুষ না খেয়ে মারা যায় এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। নবী মুহাম্মদের পরে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস এবং নির্ভরশীল বলতে নিশ্চয়ই খলিফাদেরকেই বোঝায়। কিন্তু আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হওয়ার পরেও, উমরের শাসনামলে এই দুর্ভিক্ষ ইসলামের “রিজিকের একমাত্র মালিক আল্লাহ” বিশ্বাসের ব্যর্থতাকে প্রকাশ করে। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে (১৮ হিজরি) আরবের হিজাজ অঞ্চলে প্রবল খরা দেখা দেয়। এই খরার কারণে কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয় এবং খাদ্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়। এ সময় বৃষ্টি একেবারেই হয়নি, ফলে পশুপালনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, মানুষ গবাদি পশুর চামড়া সিদ্ধ করে খেতে বাধ্য হয় এবং অনেকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। আসুন একটি হাদিস পড়ে নিই, [6]
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছেদঃ ২০৯০. আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রাঃ) এর আলোচনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩৪৪৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৭১০
৩৪৪৫। হাসান ইবনু মুহাম্মদ (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, উমর (রাঃ) (এর খিলাফত কালে) অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) এর ওয়াসিলা নিয়ে বৃষ্টি বর্ষণের দু’আ করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আমরা অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমাদের নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াসিলা নিয়ে দু’আ করতাম তুমি (আমাদের দু’আ কবূল করে) বৃষ্টি বর্ষণ করতে, এখন আমরা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা আব্বাস (রাঃ) এর ওয়াসিলায় বৃষ্টি বর্ষণের দু’আ করছি। তুমি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর। তখন বৃষ্টি হত।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
উমর ইবন খাত্তাব এই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য যদি আল্লাহর ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করতেন, তাহলে বোঝা যেতো যে, নবীর হাদিসকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করে সেই অনুসারে আমল করছেন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা বাস্তব জীবনে জরুরি। তাই এই ঘটনাটি ইসলামের “আল্লাহ রিজিকের মালিক” ধারণার বিপরীত বাস্তবতা তুলে ধরে। তিনি মদিনা এবং অন্যান্য অঞ্চলের ধনী মুসলমানদের থেকে খাদ্য ও সম্পদ সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন এবং মিসর ও সিরিয়া থেকে খাদ্য আমদানির চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এই প্রক্রিয়া ধীরগতির হওয়ায় দুর্ভিক্ষ দূর করতে পারেনি। যদিও তিনি ইসলামে সম্পুর্ণভাবে বিশ্বাসী ছিলেন, তথাপি দুর্ভিক্ষ চলাকালীন তিনি বুঝতে পারেন যে, কেবলমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হলে সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। খাদ্য সরবরাহ, কৃষি উন্নয়ন, এবং পানির সংকট নিরসনের মতো বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ না থাকলে দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
কোরআনে বলা হয়েছে, “পৃথিবীর সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর।” (কোরআন ১১:৬)। কিন্তু যদি আল্লাহ সত্যিই প্রতিটি প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব নিতেন, তাহলে উমরের শাসনামলে এত মানুষের অনাহারে মৃত্যুবরণ করার কারণ কী? নবী মুহাম্মদ বলেছেন: “তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের মতো রিজিক দেয়া হতো। তারা সকালে খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে।” (সুনান আত-তিরমিজি, ২৩৪৪, সহিহ)। তাহলে উমরের সময় এত লোক না খেয়ে মারা গেল কেন? তারা কি যথেষ্ট আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ছিল না?
উমর-এর শাসনের পরও ইসলামী খিলাফতের ইতিহাসে বহুবার দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্ভিক্ষ (৮৭০-৮৭১ খ্রিস্টাব্দ) এত ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যে, কিছু অঞ্চলে মানুষ মানুষের মাংস খেতে বাধ্য হয়। ১৭৭০ সালে মুঘল আমলে বাংলা দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়, যদিও তারা ধর্মীয়ভাবে পরিপূর্ণ ইসলাম অনুসরণ করছিল। তাহলে কি এই সময়ের মুসলমানরা যথেষ্ট ঈমানদার ছিল না? নাকি আসল সত্য হলো – রিজিক নির্ভর করে প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনীতি, ও মানুষের শ্রমের উপর?
উমর নিজেও দুর্ভিক্ষের সময় আল্লাহর উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে, এসব প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দেয় যে, “রিজিকের মালিক আল্লাহ” – এই ধারণাটি বাস্তবে কার্যকর নয়। যদি শুধুমাত্র ঈমান ও আল্লাহর উপর নির্ভরতা যথেষ্ট হতো, তাহলে ইসলামের ইতিহাসে এত দুর্ভিক্ষ ঘটতো না। খাদ্য ও অর্থনীতি পরিচালনার জন্য বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা দরকার, শুধু আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হলে মানুষ অনাহারে মারা যাবে। উমর ইবন খাত্তাব-এর শাসনামলের দুর্ভিক্ষ ইসলামের রিজিক সংক্রান্ত বিশ্বাসের ব্যর্থতাকে প্রকাশ করে। ইতিহাস দেখিয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জীবনযাত্রা নির্ভর করে অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রযুক্তি, এবং মানুষের পরিশ্রমের উপর – কোনো অদৃশ্য সত্তার ইচ্ছার উপর নয়। অতএব, আধুনিক সমাজে রিজিকের ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত চিন্তাধারাই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। বিজ্ঞান ও বাস্তবতা বলে, রিজিক নির্ভর করে ব্যক্তিগত পরিশ্রম, অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং রাজনৈতিক নীতির উপর।
খিলাফত আমলে আরও দুর্ভিক্ষ
আসুন আরও কিছু দুর্ভিক্ষের বর্ণনা পড়ি,
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৭/ আহার সংক্রান্ত
পরিচ্ছেদঃ ২১৪৮. একসঙ্গে মিলিয়ে একাধিক খেজুর খাওয়া
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৫০৫২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৪৪৬
৫০৫২। আদম (রহঃ) … জাবালা ইবনু সুহায়ম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু যুবায়র এর আমলে আমাদের উপর দুর্ভিক্ষ পতিত হল। তখন তিনি খাদ্য হিসাবে আমাদের কিছু খেজুর দিলেন। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় আমরা খাচ্ছিলাম। তিনি বললেনঃ একত্রে একাধিক খেজুর খেয়ো না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একত্রে একাধিক খেজুর খেতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, তবে কেউ যদি তার ভাইকে অনুমতি দেয় তাহলে এতে কোন দোষ নেই। শুবা বলেন, অনুমতির বিষয়টি ইবনু উমরের নিজের কথা।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ জাবালাহ (রহঃ)
অধিক সন্তান জন্ম দেয়া এবং রিজিক
ইসলামের একটি মৌলিক অবস্থান হচ্ছে, যতটা সম্ভব জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা। ইসলাম মুসলিমদেরকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে শিক্ষা দেয়। বিশেষভাবে, নবী মুহাম্মদের খুব পরিষ্কার নির্দেশনাই রয়েছে যে, সংখ্যায় যেন মুসলিমরা এগিয়ে যায়। ইসলামের এরকম বিশ্বাস মানুষের জীবনে কী ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১৩: বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৩০৯২-[১৩] ’আব্দুর রহমান ইবনু সালিম ইবনু ’উতবাহ্ ইবনু ’উওয়াইম ইবনু সা’ইদাহ্ আল আনসারী তাঁর পিতা, তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কুমারী রমণী বিয়ে কর, কেননা কুমারী রমণীর মুখের মধুময়তা বেশি, অধিক গর্ভধারণযোগ্য এবং অল্পতুষ্টের অধিকারী। (ইবনু মাজাহ মুরসালসূত্রে)[1]
[1] সহীহ : ইবনু মাজাহ ১৮৬১, সহীহাহ্ ৬২৩, সহীহ আল জামি‘ ৪০৫৩।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১৩: বিবাহ
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
৩০৯১-[১২] মা’ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা বিবাহ কর স্বামীভক্তি ও অধিক সন্তান প্রসবকারিণীকে। কেননা, (কিয়ামত দিবসে) তোমাদের সংখ্যাধিক্যের গর্ব অন্যান্য উম্মাতের উপর বিজয় প্রকাশ করতে চাই। (আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]
[1] হাসান : আবূ দাঊদ ২০৫০, নাসায়ী ৩২২৭।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ)
নাস্তিক অধ্যুষিত দেশগুলোর অবস্থা কী?
পৃথিবীর শীতপ্রধান দেশগুলো, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে, যেখানে দীর্ঘ শীতকাল এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কৃষিকাজ অত্যন্ত কঠিন, সেখানে মানুষ আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক নীতিগুলোর মাধ্যমে উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করেছে। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, এবং আইসল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে জমি বছরের একটি দীর্ঘ সময় বরফাচ্ছন্ন থাকে এবং প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে স্বাভাবিকভাবে ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না। তবুও এই দেশগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, ধনী এবং বসবাসযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর মূল কারণ হচ্ছে, তারা ঈশ্বর বা আল্লাহর উপর ভরসা না করে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, এবং উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের জীবনযাত্রাকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ করেছে।
শীতপ্রধান দেশগুলোর কৃষিজ উৎপাদন সীমিত হলেও, তারা খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয় না। কারণ তারা কৃত্রিম কৃষি, গ্রিনহাউজ প্রযুক্তি এবং অত্যাধুনিক সংরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। এই দেশগুলোতে আধুনিক সারের ব্যবহার, উন্নত জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফসল এবং সর্বোচ্চ প্রযুক্তির কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ফলে, যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভরশীল নয়; তারা তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বহুস্তরীয় করেছে, যেখানে শিল্প, প্রযুক্তি, এবং সেবা খাতের বিকাশের ফলে মানুষ কর্মসংস্থান ও উচ্চমানের জীবনযাত্রা উপভোগ করতে পারে।
এই দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি এবং জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত উন্নত। এদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক, যেখানে রোগের কারণ খুঁজে বের করার জন্য কুসংস্কার বা ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তে গবেষণা এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়। নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের মতো দেশগুলোতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, যা নাগরিকদের সুস্থ ও দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে। ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন এবং সমাজব্যবস্থার কারণে, এই দেশগুলোতে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস খুবই কম এবং এখানকার মানুষ জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধানে যুক্তি ও বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেয়।
শুধু অর্থনীতি ও কৃষি খাতেই নয়, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ক্ষেত্রেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো শীর্ষে রয়েছে। তারা উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদ এবং বিজ্ঞানী তৈরি করেছে। উন্নত মানের শিক্ষাব্যবস্থা এবং গবেষণার ওপর জোর দেওয়ার ফলে, এই দেশগুলো উন্নততর জীবনধারা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে পড়ে এবং তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও গবেষণার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি দেয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে তারা যুক্তিবাদ ও বাস্তবতাকে বেশি মূল্যায়ন করে, যার ফলে তাদের সমাজ কুসংস্কারমুক্ত এবং বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছে।
এই দেশগুলোর সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে ধনী-গরিবের ব্যবধান অনেক কম, কারণ এখানে সমাজতান্ত্রিক মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, যেখানে সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা হয়। এখানে দুর্নীতি নেই বললেই চলে এবং রাষ্ট্রের সম্পদ জনকল্যাণে ব্যয় করা হয়। ফলে জনগণ তাদের জীবনযাত্রা নির্বিঘ্নভাবে চালিয়ে যেতে পারে, খাদ্য সংকটে পড়তে হয় না, এবং তারা দারিদ্র্যের কষ্টে ভোগে না।
আল্লাহর উপর বিন্দুমাত্র নির্ভর না করেও এই দেশগুলো সামাজিক সম্প্রীতি ও নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রেখেছে। অনেক ধর্মপ্রধান দেশ, যেখানে মানুষ ঈশ্বরের নামে বিভক্ত এবং সংঘাতে লিপ্ত, সেখানে নাস্তিক অধ্যুষিত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতা, মানবতাবাদ, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখা যায়। এরা বিশ্বাস করে যে, নৈতিকতা আসে যুক্তি, মানবতা ও সামাজিক সংহতি থেকে, কোনো ধর্মগ্রন্থের বাধ্যবাধকতা থেকে নয়। এই সমস্ত বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার জন্য কোনো পুরনো কুসংস্কার, ধর্মীয় শাসন, ঈশ্বর বা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। বরং বিজ্ঞান, উন্নত প্রযুক্তি, কার্যকর প্রশাসন, এবং সুশিক্ষাই মানুষের উন্নতির মূল চাবিকাঠি। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো যেখানে প্রাকৃতিকভাবে চরম প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থিত, সেখানে যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা নিজেদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে পেরেছে, অথচ বিশ্বের অনেক ধর্মভিত্তিক দেশ, যেখানে জলবায়ু অনুকূল, সেখানে মানুষ দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও দুর্ভিক্ষে ভুগছে। অতএব, এটি স্পষ্ট যে, উন্নতির জন্য আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা নয়, বরং যুক্তি ও বিজ্ঞানই মূল চালিকা শক্তি।
দৃষ্টিভঙ্গি | অভিগমন | ফলাফল |
বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ = আল্লাহ নির্ভরশীলতা (বিজ্ঞান ও পরিশ্রমের অভাব) | আল্লাহতে পূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা, যার ফলাফল হিসেবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে উদাসীনতা, পরিশ্রমের অভাব কারণ পরিশ্রম অগুরুত্বপূর্ণ। | দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, অগ্রগতির অভাব, নিম্নমানের শিক্ষা ও চিকিৎসা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি |
যুক্তিবাদী সমাজ = জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভরশীলতা (গবেষণা, পরিশ্রম, নিজের ভাগ্য নিজের গড়া) | বিজ্ঞান, গবেষণা, প্রযুক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের উপর গুরুত্ব। দুর্যোগ আসলেওতার বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যবহার করা। | খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও চিকিৎসা, মানবাধিকারের রক্ষা |
উপসংহার
“রিজিকের মালিক আল্লাহ” – এই বিশ্বাস কেবলমাত্র ধর্মীয় মিথ যা বাস্তব জীবনের সাথে কোনোভাবেই মিলে না। এটি মানুষকে অলসতা ও পরনির্ভরশীলতায় ঠেলে দেয় এবং অর্থনৈতিক উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের রিজিক নির্ভর করে তার পরিশ্রম, দক্ষতা, ও সমাজের নীতির উপর, কোনো অদৃশ্য ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর নয়। তাই, আধুনিক সমাজের উচিত এই ধর্মীয় কুসংস্কার পরিত্যাগ করে বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা।
তথ্যসূত্র
- কোরআন ৪২:২৭ [↑]
- কোরআন ১৩:২৬ [↑]
- কোরআন ২:২১২ [↑]
- কোরআন ১১:৬ [↑]
- সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিসঃ ২৩৪৪ [↑]
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৪৪৫ [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"