10.সর্বপ্রথম সৃষ্ট পদার্থ কোনটি?

ইসলাম অনুসারে আল্লাহর প্রথম সৃষ্ট বস্তু বা পদার্থ কি? সর্বপ্রথম সৃষ্টি হওয়া বস্তু বা পদার্থটি চিহ্নিত করতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়াই সহজ হয়ে যাবে। আসুন তার আগে কিছু বিষয় জেনে নিই।

আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে আমরা জানি, মহাবিশ্বের সকল পদার্থ মৌলিক পদার্থগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়। স্কুল জীবনে আমরা শিখেছি, মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১০৯ টি। বর্তমান সময়ে মোট ১১৮টি মৌল চিহ্নিত হয়েছে যার মধ্যে ৯৮টি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, বাকী ২০টি কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়। সাধারণত, একটি মৌলের পরমাণুতে প্রোটন সংখ্যা নির্দিষ্ট বা একই মৌলের প্রতিটি পরমাণুতে সমান সংখ্যা প্রোটন থাকে (অর্থাৎ, তাদের প্রত্যেকের পারমাণবিক সংখ্যা একই এবং ভিন্ন ভিন্ন মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ভিন্ন)। তাই, সাধারণভাবে প্রোটন সংখ্যা দ্বারা কোন মৌল চেনা যায়।

তবে, একই মৌলের ভিন্ন নিউট্রন সংখ্যা বিশিষ্ট পরমাণুও রয়েছে, যাদেরকে আইসোটোপ বলে। একই মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপে একই সংখ্যক প্রোটন থাকে, নিউট্রন সংখ্যা এবং ভর সংখ্যা বা পারমাণবিক ভরে ভিন্নতা থাকে।

সমগ্র মহাবিশ্বে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, যেগুলো তৈরি হয়েছে মহাবিষ্ফোরণ বা বৃহৎ সম্প্রসারণের প্রাথমিক পর্যায়ে। হাইড্রোজেনে একটি প্রোটন থাকায় এটিই সর্বপ্রথম মৌলিক পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত। এর অর্থ হচ্ছে, হাইড্রোজেনই প্রথম পদার্থ।

কিন্তু ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর। অর্থাৎ মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের সকল পদার্থ সৃষ্টির পূর্বে পানি তৈরি হয়েছে, হাইড্রোজেন তৈরির আগেই পানি বানানোর চিন্তা খুবই অবৈজ্ঞানিক এবং হাস্যকর কথা। কারণ পানি তৈরিতে হাইড্রোজেন প্রয়োজন হয়। হাইড্রোজেনের আগে পানির অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এবং হাইড্রোজেনের সৃষ্টি মহাবিশ্বের উৎপত্তির সাথে সাথে। কোরআন বা বাইবেলে বা মহাভারতের এই সকল ভুল তথ্য যে আসলে প্রাচীন দার্শনিক থেলিসের দ্বারা প্রভাবিত, তা বুঝতে খুব সমস্যা হয় না।

প্রাচীনকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং যাকে রীতিমত দর্শনের জনক হিসেবেও ধরা হয়, তার নাম থেলিস বা মাইলেটাসের থেলিস। তার জন্ম অনুমানিক ৬২৪–৬২৫ খ্রিস্টপূর্ব মৃত্যু ৫৬৯-৫৮৬ খ্রিস্টপূর্ব সালে। তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক, এবং তার মতবাদই সারা পৃথিবীতে একসময় সবচাইতে প্রভাবশালী মতবাদ বলে বিবেচিত হতো। তিনি মনে করতেন, “সবকিছুর আদিমতম উপাদান হচ্ছে পানি”[1] । তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী দার্শনিক এবং তার এই মতবাদও অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় পরবর্তী সময়ের প্রায় সকল দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের ওপরই এই মতবাদ প্রভাব বিস্তার করেছে। সেই প্রভাব আমরা দেখতে পাই বাইবেলের মধ্যে, একইসাথে কোরআনের মধ্যেও।

সৃষ্ট

কোরআনে বলা হয়েছে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর [2]

তিনিই সর্বশক্তিমান, যিনি সৃজন করিয়াছেন আসমান ও জমীনকে ছয় দিবসে আর তিনি সিংহাসনে আসীন ছিলেন যা ছিল পানির উপরে।

হাদিসেও অসংখ্যবার বলা হয়েছে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর। কিন্তু যখন মহাবিশ্বের পদার্থসমূহ তৈরি হয়নি, তখন পানি আসলো কোথা থেকে? [3]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৯৭/ তাওহীদ
পরিচ্ছেদঃ ৯৭/২২. আল্লাহর বাণীঃ তখন তাঁর আরশ পানির ওপর ছিল- (সূরাহ হূদ ১১/৭)। তিনি আরশে ‘আযীমের প্রতিপালক- (সূরাহ আত্-তাওবাহ ৯/১২৯)।
৭৪২৭. আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন সব মানুষ বেহুঁশ হয়ে পড়বে। (আমার হুঁশ ফিরলে) তখন আমি মূসা (আঃ)-কে আরশের একটি পায়া ধরে দাঁড়ানো দেখতে পাব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ)

এবারে আসুন দেখা যাক, কোরআনের বহু পূর্বে লিখিত বাইবেলে কী বলা আছে [4]

আদিপুস্তক ১
১ শুরুতে, ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। প্রথমে পৃথিবী সম্পূর্ণ শূন্য ছিল; পৃথিবীতে কিছুই ছিল না।
অন্ধকারে আবৃত ছিল জলরাশি আর ঈশ্বরের আত্মা সেই জলরাশির উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
৬ তারপর ঈশ্বর বললেন, “জলকে দুভাগ করবার জন্য আকাশমণ্ডলের ব্যবস্থা হোক।”
তাই ঈশ্বর আকাশমণ্ডলের সৃষ্টি করে জলকে পৃথক করলেন। এক ভাগ জল আকাশমণ্ডলের উপরে আর অন্য ভাগ জল আকাশমণ্ডলের নীচে থাকল।
৯ তারপর ঈশ্বর বললেন, “আকাশের নীচের জল এক জায়গায় জমা হোক যাতে শুকনো ডাঙা দেখা যায়।” এবং তা-ই হল।

এবারে আসুন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে এই বিষয়ে কী বলা আছে সেটি পড়ে নিই [5]

सर्वं सलिलमेवासीत्पृथिवी यत्र निर्मिता।
तत: स‌मभवद्ब्रह्मा स्वयम्भूर्दैवतै: स‌ह।।2.110.3।।

At the beginning, all this was water from which the earth was created. Thereafter, the selfexistent Brahma along with the gods came into existence.

প্রায় কাছাকাছি কথা বলা আছে মহাভারতেও। আসুন মহাভারতে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কী বলা আছে সেটিও পড়ি [6]

প্রথমে কেবল একমাত্র সনাতন ভগবান্ ব্রহ্মা বিদ্যামান ছিলেন। অনন্তর তাঁহার মরীচি, অত্রি,অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ এই সাত অগ্নিতুল্য পুত্রের উৎপত্তি হয়।
সমগ্র বিশ্ব এক ঘোরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, পরমব্রহ্ম নিজ তেজে সেই অন্ধকার দূর করে জল সৃষ্টি করলেন। সেই জলে সৃষ্টির বীজ নিক্ষেপ করলে একটি অতিকায় সুবর্ণ অণ্ড বা ডিম সৃষ্টি হয়। সেই অণ্ডের মধ্যে পরমব্রহ্ম স্বয়ং প্রবেশ করেন। এরপর অণ্ড দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এর একভাগ দ্বারা আকাশ ও অপর ভাগ দ্বারা ভূমণ্ডল তৈরি হয়। এরপর ব্রহ্মা মন থেকে দশজন প্রজাপতি সৃষ্টি করেন। এই প্রজাপতিরাই মানবজাতির আদিপিতা। এই দশজন প্রজাপতি হলেন- অঙ্গিরা, অত্রি, ক্রতু, দক্ষ, নারদ,পুলস্ত্য, পুলহ, বশিষ্ঠ, ভৃগু ও মরীচি। ব্রহ্মার আদেশে এঁরা বিভিন্ন প্রাণী সৃষ্টি করলেন। বাকি একজন অর্থাৎ নারদকে সৃষ্টি রক্ষার ভার দিলেন। কিন্তু ব্রহ্ম-সাধনায় বিঘ্ন হবে বলে নারদ সে ভার গ্রহণ করলেন না। এই কারণে ব্রহ্মা তাঁকে মানুষ ও গন্ধর্বরূপে জন্মগ্রহণ করার অভিশাপ দিলেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, অন্য আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে সর্বপ্রথম সৃষ্ট বস্তু হচ্ছে কলম। বোঝাই যাচ্ছে নবী মুহাম্মদ ব্যাপারগুলো নিয়ে তালগোল ভালই পাকিয়েছেন, যেগুলো জায়েজ করতে এখনকার ইসলামিক আলেমদের নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়। আবোলতাবোল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অন্ধবিশ্বাসীদের বুঝ দিতে হয়। কিন্তু কলম তো মানুষের মানবীয় একটি আবিষ্কার। মহাবিশ্বের সর্বপ্রথম সৃষ্ট বস্তু হচ্ছে কলম, এই কথাটিও অত্যন্ত হাস্যকর। এতটাই হাস্যকর যে, এর সত্যতা নিয়ে বেশি চিন্তাও করতে হয় না। আসুন হাদিসটি পড়ি [7]

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৫/ সুন্নাহ
পরিচ্ছেদঃ ১৭. তাকদীর সম্পর্কে
৪৭০০। আবূ হাফসাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাঃ) তার ছেলেকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পাবে না যতক্ষণ না তুমি জানতে পারবে ’’যা তোমার উপর ঘটেছে তা ভুলেও এড়িয়ে যাওয়ার ছিলো না। পক্ষান্তরে, যা এড়িয়ে গেছে তা তোমার উপর ভুলেও ঘটবার ছিলো না।
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম যে বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে কলম। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, লিখো! কলম বললো, হে রব! কি লিখবো? তিনি বললেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক বস্তুর তাকদীর লিখো। হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাস ছাড়া মারা যায় সে আমার (উম্মাতের) নয়।[1]
সহীহ।
[1]. তিরমিযী, আহমাদ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এবারে আসুন এই হাদিসটি নিয়ে একটু চিন্তা করি। উপরের হাদিস থেকে জানা যাচ্ছে, কলমকে আল্লাহপাক নির্দেশ দিলেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সবকিছু লিখে ফেলতে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কলম কী একটি সচেতন সত্ত্বা? অর্থাৎ চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম? নিজের মগজ খাটিয়ে কথাবার্তা বলতে সক্ষম? সেটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কুদরতি কলম হয়ে থাকলে, সেই কলম কি গায়েব জানে? অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী হবে না হবে, এটি তো ইসলাম ধর্ম অনুসারে শুধুমাত্র আল্লাহ পাক জানেন। তাহলে আল্লাহ না বলে দিলে কলম সেটি জানবে কীভাবে? লিখবেই বা কীভাবে? এখানে তো আল্লাহ পাকের ধারা বিবরণী দেয়ার প্রয়োজন ছিল যে, অমুকটি লেখো তমুকটি লেখো। কলমটি আল্লাহর ধারা বর্ণনা অনুসারে শুধু লিখে যাবে। কিন্তু আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সবকিছু লিখে ফেলতে। ধারা বিবরণী তো তিনি দিলেন না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কলমও জানে যে, ভবিষ্যতে অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত কী হবে সবকিছু। তাহলে এই কলমটিও তো আল্লাহর গুণসম্পন্ন, অর্থাৎ গায়েব জানে। এটা তো তাহলে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী হয়ে যাচ্ছে। কারণ গায়েব জানার কথা শুধুমাত্র আল্লাহর। তাহলে কলমটিও কি আরেকজন আল্লাহ? এরকম প্রশ্ন কী আপনার মাথায় আসেনি?

সেইসাথে, যখন কোন কিছুই আর ছিল না, এই কথা বলা কুদরতি কলমটি লিখবে কিসের ওপর? কালি এবং কাগজ না থাকলে কীভাবে হবে?

তথ্যসূত্র

  1. মো. আবদুল হালিম (মে ২০০৩)। দার্শনিক প্রবন্ধাবলি : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ। প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমি []
  2. সূরা হুদ, আয়াত ৭ []
  3. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ৭৪২৭ []
  4. বাইবেল, আদিপুস্তক ১ []
  5. Script: Devanagari, Kanda:AYODHYAKANDA, Sarga:110, Sloka:3 []
  6. মহাভারত, শান্তিপপর্ব, অষ্টাধিকদ্বিশততম অধ্যায়, প্রজাপতি বিবরণ-সৃষ্টিবিস্তার []
  7. সুনান আবু দাউদ(তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৭০০ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"