আসিফ মহিউদ্দীনের সাক্ষাৎকার – শাহিনুর রহমান শাহিন

আসিফ মহিউদ্দীন

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ জার্মানপ্রবাসী লেখক আসিফ মহিউদ্দীন এখন দেশের সেক্যুলার সমাজের মধ্যে পরিচিত একটি মুখ। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবিরাম লিখে যাচ্ছেন। ক্রমাগত হুমকি-জেল-জুলুম-হত্যাচেষ্টার পরেও তিনি তার লেখা অব্যাহত রেখে নিজের শক্ত মেরুদণ্ডের পরিচয় দিয়েছেন। মোল্লা সম্প্রদায়ও ইদানীং তাদের ওয়াজে মাহফিলে হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরীন প্রমুখের সাথে ঘন ঘন তার নাম নিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের জন্য আসিফ মহিউদ্দিনকে সত্যিই একটি সম্পদ হিশেবে বিবেচনা করি। খুব কম সংখ্যক মুক্তমনা লেখক তার মতো স্পষ্ট ও পরিশীলিত রচনা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। নিশ্চিতভাবে এর জন্য তাকে প্রচুর পড়াশোনা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ সম্পর্কে বিশদ ধারণা নিতে হয়েছে। সাংবাদিক নই, তবু গতকাল তাকে একটি সাক্ষাৎকার দিতে আমি অনুরোধ করি। তিনি এতে সম্মতি জানিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে আমি অনেক কিছু শিখতে পারবো।

এই পোস্টের কমেন্ট অংশে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকবে। এটি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এতে কাউকে কমেন্ট না করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করছি।

আসিফ মহিউদ্দীনঃ ধন্যবাদ শাহীন। আপনার লেখা আমার বেশ পছন্দ। আশাকরি এই সাক্ষাতকারটি বাঙলা ব্লগ এবং অনলাইন জগতে সুস্থ আলোচনার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
শাহিনুর রহমান শাহিনঃ ধন্যবাদ। আপনি তো এখন বিবাহিত, এক মাস পার হয়ে গেলো। বিবাহিত জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা।

আসিফ মহিউদ্দীনঃ শুভ কামনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। বিয়ে করে আমি অসম্ভব খুশি। 🙂
শাহিনুর রহমান শাহিনঃ হাঃ হাঃ আশা করছি, আমাদের শুভকামনা আপনার বিবাহিত জীবনকে পাহারা দেবে। সর্বশেষ পোস্টে বিবাহ প্রথায় আপনার কোন সমর্থন নেই বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ যদি স্বেচ্ছায় ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে বিবাহ করে, তাতে আপনি কতোটুকু আপত্তি জানাবেন?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ বিয়ে করতে পারে, তাতে আমি আপত্তি কেন করবো, বা আমার আপত্তিও কেউ কেন শুনবে? আমি যেটা প্রথা হিসেবে প্রচলিত তার বিরোধী। যেখানে নারীকে কাবিন নামায় দেনমোহরের নামে মূল্য নির্ধারন করা হয়, যেখানে মেয়ের বাবা মা কন্যা বিদায় দেয়ার সময় এমনভাবে কাঁদে যেন মেয়েটা মারা যাচ্ছে। এই কান্নার অর্থ হলো তাদের কাছে এখন থেকে মেয়েটি মৃত। মেয়েটার ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হলে যেন দায় এড়ানো যায়, বাবা মা সে কারনেই বেশি কাঁদে। আবার বিদায় বেলা বলে দেয়, লাল শাড়ি পড়ে যাচ্ছো সাদা কাফন পরে ফিরবা। এই প্রথাগুলো সরাসরি নারী বিরোধী, এক ধরণের নির্যাতন। সেই সাথে হিল্লা বিবাহের প্রথা, মু’তাহ বিবাহ সহ নানান প্রথাই অত্যন্ত অসম্মানজনক, নারী পুরুষ উভয়ের জন্য। আমি এই সকল প্রথার বিরুদ্ধে। তবে এসব প্রথা না মেনে কেউ যদি বন্ধুদের ডেকে বিয়ের অনুষ্ঠান করে, নরনারী একসাথে থাকে, বিয়ে করে বা বিয়ে ছাড়া, কোন কিছুতেই আমার আপত্তি নেই। ভালবাসা থাকলেই হলো, সেটা না থাকলেই সমস্যা।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ অর্থাৎ, আপনি দোয়া/মন্ত্র পড়ে বিবাহ করাকে সমর্থন করছেন না। কিন্তু, তবু যদি কেউ পরস্পরকে ভালবেসে এভাবে বিয়ে করে? আপনি তার সমালোচনা করবেন?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ হ্যা হয়তো সমালোচনা করবো কিন্তু বাধা দেবো না। ধরুন আপনি একজন মুক্তমনা মানবতাবাদী হিসেবে যদি নিজেকে পরিচয় দেন, এবং বিয়ের আসরে সুরা লাহাবের মত কুৎসিত বর্বর গালাগালি এবং হুমকিধামকি পূর্ণ সুরা পড়ে বিয়ে করেন, তখন আপনার সমালোচনা করবো। কিন্তু বাধা তো দিতে পারবো না। বাধা দেয়ার সামর্থ্য থাকলে হিংসা এবং বিদ্বেষপূর্ণ সুরা কালাম, যেগুলোতে হত্যা বা অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণার কথা বলা হয়েছে সেগুলো প্রকাশ্যে পাঠ করার বিষয়ে বিশেষ নীতিমালা তৈরি করতাম।

আসিফ মহিউদ্দীনঃ স্যরি আপনার এডিটেড কমেন্ট পরে দেখেছি।
এর উত্তরঃ
কেউ ভালবেসে বিয়ে করলে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। করতেই পারে, আমার আপত্তি নেই। দেনমোহর না থাকলেই ভাল সেখানে। আর পরস্পরের সম্মান বজায় থাকলেই হলো।
শাহিনুর রহমান শাহিনঃ সামর্থ থাকলে আপনি এভাবে ধর্মীয় নিয়মে বিবাহের প্রথায় বাঁধা দিতেন। নামাজের ক্ষেত্রেও কি আপনি একই অবস্থান নেবেন?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ হ্যাঁ, নামাজ শুধু নয় যেকোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ পায়, নারীর প্রতি অসম্মান প্রকাশ পায়, সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এরকম সবকিছু বিষয়ে বিশেষ নীতিমালা প্রকাশ করতাম। বিশেষ করে শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে যেন কোন অবস্থাতেই এসব বর্বর কথা না ঢোকে, তার ব্যবস্থা করতাম।
ধরুন নামাজের খুতবায় যদি কেউ গনিমতের মাল হিসেবে নারী ভোগ হালাল বলে, বা তাদের দৃষ্টিতে কম কাপড় পড়া নারী বেশ্যা বলে গালাগালি করা হয়, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে, এমন নিয়ম করতাম। বা কাউকে ধর্ষণ বা কতলের হুমকি দেয়া হয়, তাদের শাস্তির বিধান রাখতাম।
পরিপূর্ণ বাক স্বাধীনতা অবশ্যই থাকবে তবে হত্যা ধর্ষনের হুমকি, বা রেইসিস্ট মন্তব্য, সেক্সিস্ট বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুরো সভ্য জগতেই। সেটা নামাজের নামে দিলেও খারাপ। ধর্মের ঢাল ব্যবহার করে রেইসিস্ট সেক্সিস্ট কথা বলা যাবে না।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ আপনার কি ধারনা, ধর্মের বিধিনিষেধ পালনের ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি অনেকটা কমে যায়নি? যদি আমরা এক শতাব্দী আগের সাথে বর্তমানের তুলনা করি? বিশেষত আগে দেখা যেতো, পরিবার কিংবা সমাজ থেকে সাধারনত যে ধরনের চাপ আসতো, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো থেকে আমরা রেহাই পেয়েছি। গনিমতের মাল কিংবা দাসী ভোগ কিংবা কতল ইত্যাদির কথা এখন খুব কম মসজিদের খুতবায় বলা হয়। মানে আমি বলতে চাইছি, আগের তুলনায় একটা পরিবর্তন আসছে কিনা?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ আমার তো মনে হয় বাঙলাদেশ দিনে দিনে ধর্মপ্রবণ হয়ে উঠছে। আমার ছোটবেলায় এত বোরখা দেখতাম না। আমি দেশ ছাড়ার সময় ঢাকা শহর ভরে উঠেছিল বোরখা হিজাবে। এক সময় বাম দল করা সংগ্রামী জাঁদরেল মেয়েরা এখন বোরখা হিজাব পড়ছে। স্বামীর সেবা করছে। কিসের পরিবর্তনের কথা বলছেন? পরিবর্তনটা তো উল্টো দিকে হচ্ছে। মধ্যযুগে ফেরত যাচ্ছে দলবেধে।
আমি লেখালেখি শুরু করেছি ২০০৭ সালে। সেই সময়ের আগে পরে জাকির নায়েক হয়ে উঠেছিল ডিজিটাল নবী। দিকে দিকে তার জয়ধ্বনি। সাইদীর ওয়াজ ছাত্রলীগ আর সিপিবির নেতারা পর্যন্ত শুনতে যেতো। এগুলো নিজের চোখে দেখা। পরিবার থেকে এখন মেয়েদের বোরখা হিজাবে বেশি উৎসাহিত করা হয়। পারিবারিকভাবে একটা ইসলামী পরিবেশ তৈরি হয়েছে অনেক পরিবারে।
গনিমতের মাল, দাসীভোগ, কতল, এগুলো হচ্ছে ধর্মের সেকেন্ডারি বিষয়। প্রাথমিকভাবে নামাজ রোজা বোরখা ওয়াজ ইসলামী এক ধরনের ভাবগাম্ভীর্য্য তৈরি করে এক ধরণের সম্মতি তৈরি করা হয়। এরপরে সেগুলো আসে। সেগুলো যখন আসে, তখন সেগুলো আর কেউ যুক্তি দিয়ে বাতিল করতে পারে না। কারণ প্রাথমিক পর্যায়েই সে মেনে নিয়েছে, ধর্ম মানেই হচ্ছে ভাল কিছু।
যেই ছেলে এই ধর্মীয় আবেশের মধ্যে ঢুকেছে, সে নাস্তিক কতলকেও খুব সহজে জাস্টিফায়েড ভাববে। প্রাথমিকভাবে তার মধ্যে ঢোকানো হয়েছে চুরি করো না, ব্যাভিচার করো না ইত্যাদি টাইপের মাইল্ড বিষয়গুলো। সেগুলো শুনে সে ধরেই নেবে, ধর্ম যা বলে সেটাই সঠিক। পরে তার কাছে দাসীভোগ এবং বহুবিবাহ বা কতল খুবই স্বাভাবিক এবং নৈতিক বলে মনে হবে।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ আপনার সমর্থনে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থের ছোট একটা অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে যা বলা হয়েছে, তার মর্ম অনেকটা এরকম – প্রায় এক শতাব্দী আগে শিখ ড্রাইভার অমর সিং বিনা পর্দায় ইরাকি মেয়েদের ছাগল চরাতে দেখেছেন। তার অভিজ্ঞতা সমর্থন করে কাবুলি বেতার কর্মকর্তা বলেছেন, কাজকর্মে অসুবিধা হয় বলে গ্রামের মেয়েরা পর্দা মানে না, অন্তত নিজ গাঁয়ে মানে না। শহরে গেলে পর্দা মেনে ভদ্র সাজার চেষ্টা করে। অর্থাৎ, নিজের সমস্যা হলে মানুষ ধর্মীয় বিধিনিষেধ সহজেই অগ্রাহ্য করতে পারে।
কিন্তু হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, প্রতিটি নতুন শতাব্দী আগের শতাব্দীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি, দাসপ্রথা কিংবা সতীদাহ প্রথা এখন প্রায় সবটাই হারিয়ে গেছে। বর্ণপ্রথাও তো এখন দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া কেউ মানছে না। এই পরিবর্তনগুলো কি অনেক বড়ো অর্জন নয়?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ এখন সভ্যতা এগিয়েছে অনেক। সেটাই স্বাভাবিক। বরঞ্চ আমাদের আগাবার গতি অনেক বেশি হবার কথা ছিল। সেটা হচ্ছে না। কিছু কিছু অংশে পেছাচ্ছে।

জুনায়েদ বাবুনগরীর সাক্ষাতকার নিতে গিয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস। সেখানে বাবুনগরী বলেছে, যে কেউ ইচ্ছা হলে নাস্তিক হতেই পারে। কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করলে তারা শুধু কতল করবে।
এটা সে বলেছে পশ্চিমের মিডিয়ার ভয়ে। নিজ থেকে না। তার সামর্থ্য থাকলে সব নাস্তিককেই সে জবাই করতো। এখন চাইলেও কেউ চারটা বিবি ঢাকা শহরে রাখতে পারে না। রাখলে সমালোচনা হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেশিরভাগই বোরখা হিজাবের ধার ধারে না। সমাজের এগিয়ে যাওয়া সব সময়ই ছিল এবং থাকবে। পুরনো ধ্যান ধারণার পরিবর্তনও হবে। কিন্তু ইসলামী দেশগুলোতে যা হচ্ছে, একদল আধুনিক হচ্ছে, শিক্ষিত হচ্ছে, আরেকদল মৌলবাদী হচ্ছে।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের আগে মেয়েরা অনেক স্বাধীন ছিল। বিকিনি পড়লেও কেউ কিছু বলতো না। এখন তারা বোরখা পড়ে। আফগানিস্তানে কয়েক দশক আগেও এরকম অবস্থা ছিল না।

সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সেই কোন আমলে বাঙালি লড়াই করেছে। এখন আর সতীদাহ হচ্ছে না, এই খুশিতে গদগদ হবার মত কিছু আমি তো দেখছি না। এটা অর্জন অবশ্যই, তবে আমাদের আরো অনেক এগিয়ে থাকা উচিত ছিল। এখন যদি আমরা সতীদাহ হচ্ছে না ভেবে খুশিতে নাচতে থাকি, তার তো কোন অর্থ নেই। এখন যেই সমস্যা আছে সেগুলো নিয়ে বরঞ্চ ভাবা দরকার। এই যেমন মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ কিছু মৌল ও কিছু গৌণ বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে বলছেন, যা মোটেও যথেষ্ঠ নয়। আর এই পরিবর্তনটা মূলত কীভাবে এসেছে? পরিবর্তনটি কি সমাজের স্বাভাবিক বিবর্তনে অনিবার্য ছিল, নাকি এটি ছিল বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমের ফলাফল?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ আমার মনে হয় সেটা অনিবার্যই ছিল, তবে বুদ্ধিজীবীদের কাজ হচ্ছে সেটাকে গতিশীল করা। সমাজে ক্রমাগত প্রেশার ক্রিয়েট করা। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিবিদদের মতই অসৎ এবং ভণ্ড। উল্টো দিকে ধর্মান্ধরা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। তাই ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেছে, এবং উল্টা দিকে যাচ্ছে সবকিছু।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি, সমাজের পরিবর্তনে স্বয়ং সমাজেরই খানিকটা ভুমিকা আছে?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ সমাজ তো আসলে আলাদা কোন সত্ত্বা না। হ্যাঁ, সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শিক্ষাকাঠামো রাজনীতি এগুলোর সাথে সম্পর্কিত। ধর্মও সমাজের পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখে। এই সব মিলিয়েই সমাজ পরিবর্তন হয়।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ মানুষ নিয়েই তো সমাজ। আপনার মন্তব্য অনুসারে আমরা দেখছি, সমাজের কিছু কিছু পরিবর্তন সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ীই ঘটছে। আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, পাশ্চাত্য সমাজই অন্যান্য সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্যগুলো তাদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে এবং তাদেরকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছে। পিছিয়ে পড়া সমাজগুলোর জন্য অগ্রসর পাশ্চাত্য সমাজকে কি আপনি আশীর্বাদ বলবেন?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ সমাজের সব পরিবর্তন প্রয়োজন অনুযায়ী হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। এখানে ক্ষমতার ব্যাপার আছে। সমাজ বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন, সেটার সাথে ক্ষমতা কীভাবে সম্পর্কিত তার ওপর নির্ভর করছে। যেমন এখন বোরখা হিজাব বেড়ে যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় সমাজ ক্রমশ পুরুষতান্ত্রিক হচ্ছে, পুরুষের ক্ষমতা পারিবারিক এবং সামাজিক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরুষের স্বস্তির জন্য নারীকে মূল্য চোকাতে হচ্ছে। এটাকে আমি প্রয়োজন ধরবো না, এটাকে ক্ষমতার ব্যবহার গণ্য করবো। পুরুষ তার ক্ষমতার ব্যবহার করছে।
আবার যেসব গার্মেন্টস শ্রমিক নারী বোরখা পড়ছে না, তারা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। তাই তাদের পরিবারে তাদের মতামত প্রদানের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই এখানে ক্ষমতার কাঠামো বোঝা জরুরি। ক্ষমতার ডিস্ট্রিবিউশন জরুরি।

পশ্চিমে ক্ষমতার ব্যালেন্স তৈরি হয়েছে। পিছিয়ে পড়া সমাজগুলো সেখান থেকে শিখবে। মানব সমাজ তো আর বদ্ধ না। আরব থেকেও আমার শিখতে আপত্তি ছিল না, যদি তারা সভ্য হতো। পাশ্চাত্য বা পশ্চিম সম্পর্কে যেই ঘৃনা আমাদের দেশের মোল্লারা আর বাম মোল্লারা প্রচার করে, সেগুলো বড় ধরণের হিপোক্রেসি। শিল্প সভ্যতা সব দিক দিয়েই ইউরোপ অনেক এগিয়ে। তার সুফলটুকু সবচাইতে নির্বোধ মোল্লাটিও ভোগ করছে। আর নামাজে বসে পশ্চিমের ওপর গজবের দোয়া করছে।

অবশ্যই অগ্রসর সমাজ থেকে আমাদের শিখতে হবে। সেগুলো বাইরের দিকের অনুকরণ নয়, অবকাঠামোগত দিক দিয়ে। যেমন কাল থেকে পশ্চিমের স্ট্যাইলে আমি চুল কাটলেই অগ্রসর হলাম না। পশ্চিমে বাসে ট্রেনে পড়ার জন্য বই রাখা হয়। যেতে যেতে যাত্রীরা সেগুলো পড়ে। এই ধরণের ব্যাপার শিখতে হবে। কাজে লাগাতে হবে।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ ক্রিশ্চিয়ান সমাজ ব্যবস্থা এখন অকার্যকর হয়েছে বলেই তদস্থলে ধীরে ধীরে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্ম নিয়েছে, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য ও সুষ্ঠু বন্টন হচ্ছে – এই প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ কোন সমাজ ব্যবস্থা অকার্যকর হলেই যে উন্নত কিছুর জন্ম হবে, এমনটা আমি মনে করি না। ইরানের শাহের আমল অনেকাংশেই অকার্যকর ছিল, তা থেকে যেটা এসেছে সেটা মোটেও ভাল কিছু না। তুরষ্কে সেক্যুলার সমাজ ছিল, তা থেকে এখন ধীরে ধীরে মোল্লাতান্ত্রিক সমাজ তৈরি হচ্ছে।
ইউরোপে ক্রিশ্চিয়ান সমাজ থেকে যেই আধুনিক সভ্যতার সৃষ্টি, সেটার জন্য বহু উত্থান পতন সংগ্রাম রয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। শিল্প সাহিত্য সংগীত ভূমিকা রেখেছে। ফরাসী বিপ্লবের কথাই যদি ধরি, বা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির উত্থানের কথাই যদি ধরি। এগুলো তো নিজে নিজে হয় নি কিছুই। ক্রমাগত প্রেশার ক্রিয়েটের মাধ্যমে হয়েছে। এখনো সেই প্রেশার দেয়া হচ্ছে।

রিচার্ড ডকিন্সরা এখন ইংল্যান্ডে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। সেক্যুলার শিক্ষা, বিবর্তনবাদ পড়াবার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন। সমাজ তো অবধারিত ভাবে উন্নত হয় না। এরকম হাজার হাজার মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমেই সমাজ উন্নত এবং সভ্য হয়। আবার ইরানে খোমেনিরা সমাজ পরিবর্তন করে ফেলেছে। সেটাও তো পরিবর্তনই।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ আপনি তাহলে খানিকটাও একমত নন যে, ক্রিশ্চিয়ান সমাজ তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে বলে এমনটা সম্ভব হয়েছে?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই হারিয়েছিল। তবে সেখান থেকে উন্নত নাকি অনুন্নত সমাজের উদ্ভব হবে, সেটা নির্ভর করে সমাজের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সাহিত্যিকদের কাজের ওপর। রাজনীতিবিদদের ওপর। চার্চের প্রতি অনেক আগে থেকেই জনমনে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধের পরে মোল্লাদের প্রতি এক ধরণের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল জনমনে। এখন সেটাকে আবার পাল্টাবার চেষ্টা হচ্ছে।

গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল, এই যে গ্রহণযোগ্যতা হারাবার ব্যাপারটা, আমরা কীভাবে বুঝবো? জিওনার্দো ব্রুনোকে হত্যা করা হলো। পৃথিবী যে ঘোরে, এটা তো আপনা আপনি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এরকম অনেকের সংগ্রামের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রহণযোগ্যতা যে হারিয়েছে, সেটা যে আর কার্যকর না, এটা ক্রমাগত সমালোচনা এবং আক্রমণের কারণেই তো জনগণের বোধগম্য হলো।

আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, এগুলো কিছুই কোন অমোঘ সূত্র বা নিয়ম মেনে চলে না। যে, কোন ব্যবস্থা অকার্যকর তাই আপনা আপনি কোন উন্নত ব্যবস্থা এসে যাবে। সেটা যে অকার্যকর সেটা ক্রমাগত সমালোচনা এবং আঘাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা, সেই সাথে নতুন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানো।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ অবশ্যই একমত পোষণ করছি। ক্রিশ্চিয়ান সমাজ একসময় প্রচণ্ড গোড়া ছিল। বাইবেলের বিরুদ্ধে দু’লাইনের একটা ধারনা প্রকাশ করায় গ্যালিলিও-ব্রুনোকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, আরো অসংখ্য মানুষকে সীমাহীন নির্যাতিত হতে হয়েছে। এরকম একটা পরিস্থিতি থেকে উত্তরিত হয়ে তারা বর্তমান অবস্থানে এসেছে। তাদের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সারকথা জেনে ও সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে কি আমরা মুসলিম সমাজকে তাদের পরিবর্তনের পথে সহায়তা করতে পারি না?
কিংবা এই পরিবর্তনের একই সূত্র কি ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে না? মানে আবারও বলছি, ক্রিশ্চিয়ান সমাজ যেভাবে বদলে গিয়ে আধুনিক হচ্ছে, ইসলামি সমাজও অনুরূপভাবে এই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে কিনা?

আসিফ মহিউদ্দীনঃ ক্রিশ্চিয়ানিটি আর ইসলামের মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য আছে। ইউরোপে আসার পরে বেশিরভাগ মানুষকেই দেখেছি, তারা ক্রিশ্চিয়ানিটির ওপর ভিত্তি করে সব ধর্মকে মূল্যায়ন করে। কিন্তু প্রতিটি ধর্মই আলাদা এবং সেগুলো বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিকর।
বিবেচনা করা দরকার, কোন ধর্মের সর্বোচ্চ অথরিটি কে বা কী। যেমন ক্রিশ্চিয়ানিটির সর্বোচ্চ অথরিটি হিসেবে চার্চ নিজেকে দাবী করে। তবে এর থেকে অনেকেই বের হয়ে আলাদা অথরিটি হিসেবে দাড়িয়ে গেছে। এভাবে অনেকগুলো আলাদা আলাদা অথরিটি তৈরি হওয়ায় তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা করতে হয়েছে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার। তাই এখন পোপ পর্যন্ত ঘোষনা করছে, নাস্তিকরাও স্বর্গে যেতে পারবে। এটা তারা সামাজিক প্রেশারের কারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছে। নাস্তিকরা যেন তাদের ওপর ক্ষুব্ধ না হয়, তার চেষ্টা আর কি।

সেইসাথে বাইবেলে যা লেখা আছে, সেগুলোকে অধিকাংশ ক্রিশ্চিয়ান খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে না। তাদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের সাথে বাইবেল সাংঘর্ষিক হলে তারা বাইবেলকে ভুল বলে ধরে নেয়। সেটা ভাবার সুযোগ তাদের আছে।

অন্যদিকে, ইসলামের মূল অথরিটি কোরান এবং মুহাম্মদের জীবন। এছাড়া আর কোন অথরিটি নেই। কোরানকে ভুল ভাবার কিছুমাত্র সুযোগ কারো নেই। কোরানকে যেহেতু পাল্টাবার সুযোগ নেই, এবং ব্যাখ্যাগুলোও আসলে হাদিস সহকারে এমনভাবে ওয়েল ডকুমেন্টেড যে, এদিক সেদিক হওয়ার সুযোগ খুবই অল্প। কিছু প্রতারক শব্দের ভুল অর্থ বের করে কিংবা মানবিক ব্যাখ্যা হাজির করে সামান্য সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারবে, তবে সেগুলো আসলে প্রতারণাই। টিকবে না।

যতদিন পর্যন্ত ইসলামের মূল অথরিটি কোরান এবং মুহাম্মদের জীবনী, ততদিন তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। সংস্কার, সংশোধন যাই করেন, পুরনো জিনিসই ক’দিন পরে ফেরত আসবে। খেলাফত আমলে তো কম চেষ্টা হয় নি। লাভ কী হয়েছে?

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ এই অবস্থায় তাহলে মূল করণীয় কী? মুসলমানদের কীভাবে সংশোধন করা যেতে পারে?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ আমরা কী করতে পারি তা আমি বলতে পারি। করণিয় তো অনেক কিছুই। বুদ্ধিজীবীদের, রাজনীতিবিদদের। তারা তো করছে না বা করবে না।

এই অবস্থায় আমাদের করণীয় হচ্ছে, ক্রমাগত সমালোচনা আর আঘাতের মাধ্যমে ক্ষমতার ছোট ছোট কেন্দ্র তৈরি করা। একসময়ে এই ছোট ছোট কেন্দ্রগুলো বড় হবে, এবং বড় ক্ষমতাকে বড় ধরনের আঘাত করতে সক্ষম হবে। সেটা যতদিন না হচ্ছে, দেয়ালে ছোট হাতুরি দিয়েই আঘাতের পরে আঘাত করে যেতে হবে। কাজ হচ্ছে না ভেবে হতাশ হওয়া যাবে না। প্রতিটা বিষয় ধরে ধরে আক্রমণ চালাতে হবে। কোন কিছুতেই ছাড় দেয়া যাবে না।

আমি দেখেছি, তরুন লেখকরা ক’দিন লিখেই ভেবে নেয় অনেক হয়ে গেছে। অনেক বিপ্লব করে ফেলেছি। কিন্তু এটা একটা লেখা লিখে সব পাল্টে দেয়ার মত বিষয় না। ক্রমাগত লিখে যেতে হবে, আঘাতের পরে আঘাত করতে হবে। এটা সহজ কাজ না, জানি। কিন্তু সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরের কী ভয়।

আক্রমণ করতে হবে ধর্মের প্রতিটি বিষয় নিয়ে। প্রশ্ন তুলতে হবে, বেয়াদবের মত উঠে দাঁড়াতে হবে। কোন কিছুই যেন বিনা যুদ্ধে পাড় না পায়। আমি সেটা করার চেষ্টা করছি। অনেকেই করছেন। গত কয়েকবছরে হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হয়েছেন, এখনো যুক্ত হচ্ছেন। আমাদের ক্ষমতা সীমিত, তারপরেও তো আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

টাকাপয়সা থাকলে এবং দেশে থাকা সম্ভব হলে এতদিনে আরো কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতাম। লাইব্রেরি দেয়া, সেক্যুলার স্কুল করা। কিন্তু সেগুলো পারছি না। হয়তো ভবিষ্যতে পারবো।
শাহিনুর রহমান শাহিনঃ আপনি সমালোচনার কথা বললেন। সমালোচনা তো কেউই সহজে সহ্য করেন না। সেক্যুলার লেখকরাও সহ্য করতে পারছেন না। আপনার মতো কয়েকজন প্রশংসনীয়ভাবে ব্যতিক্রম, কিন্তু তসলিমা নাসরীন থেকে শুরু করে প্রায় অধিকাংশ লেখকের ফেইসবুক আইডিতে অন্যরা মন্তব্য করার সুযোগ পান না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের বন্ধুতালিকার কেউ বিরোধিতা করে মন্তব্য করলে তাকেও আনফ্রেন্ড করে দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে লেখা শেয়ার করেছি বলে গত দুই সপ্তাহে আমাকে অন্তত দেড়শ জন আনফ্রেন্ড করেছেন। যতোজনকে বুঝেছি, তাদের প্রায় সকলেই সেক্যুলার। এরকম কেন হচ্ছে?

আসিফ মহিউদ্দীনঃ এখন অন্যেরা কে কী করছে তা তো আমি জানি না। আমি অনেক মুক্তচিন্তার মানুষ বলে দাবী করা লোককে দেখেছি, আমাকে ব্লক করে আমার বিরুদ্ধে নানা কথা লিখতে। নিম্নমানের কুটনামী আর ফাতরামি করতে। আমার যেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলারও সুযোগ নেই। অনেক মুক্তচিন্তার মানুষই সেখানে গিয়ে আবার লাইকও দিয়েছে। এদের আমি কী বা বলতে পারি!

যতক্ষণ না আপনি সেক্সিস্ট, রেইসিস্ট, সাম্প্রদায়িক বক্তব্য না দিচ্ছেন, বা আমাকে গালি না দিচ্ছেন, বা ব্যক্তি আক্রমণমূলক লেখায় লাইক না দিচ্ছেন, ততক্ষণ আপনাকে আমি বন্ধু ভাববো। বন্ধু না ভাবলেও আমার প্রোফাইল তো খোলাই রইলো সবার জন্য।

একটা ছেলে আছে, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই। রাফিন না কী নাম, গনসংহতি করে। এক সময়ে আমাকে নিয়ে খুব মাতামাতি করতো। আমার প্রশংসা করে অনেক লেখাও লিখেছিল সে। হৌলি আর্টিজান হামলার সময় লিখলো সব মার্কিন ষড়যন্ত্র। ঐ নিষ্পাপ ছেলেগুলো ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি গিয়ে প্রতিবাদ করলাম, আমাকে ব্লক করে গালাগালি শুরু করলো। আমি আর কিছু বলি নি। বলে কী হবে?

আমার বিরুদ্ধে কিছু লিখলে যে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখতে হয়, এই সাধারণ ভদ্রতাটুকু যদি না থাকে তাহলে কী বলার আছে? এগুলো আমি তাই ইগনোর করি। কে বন্ধু তালিকায় থাকছে কে যাচ্ছে আমার আর কিছু যায় আসে না। আমার কাজ আমি করি। কেউ গালি দিলেই কী আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেই কী, কিছুই পাত্তা দিই না। যেহেতু প্রশংসাও গ্রহণ করি না, তাই গালিতেও তেমন কিছু যায় আসে না।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ তাহলে আত্মসমালোচনার জন্য বলতে হবে, আমাদের সেক্যুলারদের মধ্যেই অনেক সমস্যা আছে। আমরা নিজেরাই অন্যদেরকে তাদের মতামত প্রকাশ করতে দিচ্ছি না। এটা কি আমাদেরই লেখালেখি’র নীতির বিরোধী নয়?
আসিফ মহিউদ্দীনঃ সমস্যা তো সবার মধ্যেই কমবেশি আছে থাকবে। আমার মধ্যেও আছে। আমরা তো নবী রাসুল বা অবতারদের মত পারফেক্ট হয়ে তৈরি হই নাই। সমস্যা আছে থাকুক, সেসব নিয়েই আগাতে হবে। ব্যাপারটা বিবর্তনের মত ক্রমাগত চলতে থাকবে। পারফেক্ট কিছু কখনই পাওয়া যাবে না, তাতে কী!

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ একই বিষয়ে আমার আরো একটি আপত্তি রয়েছে। দেশের মানুষজনের কাছে আমাদের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই, এর কারণ সম্ভবত, আমরা প্রচুর গালিগালাজ করে লিখি, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায় মুসলমানদের প্রতি কমবেশী ঘৃণা নিয়ে লিখি। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কাছে আমি শুনেছি, ইংরেজী ভাষার গালির ভাণ্ডার অতো সমৃদ্ধ নয় বাংলা ভাষার মতো। আর আমি নিজে দেখেছি, দেশের ভেতরে যারা হিউম্যানিজম নিয়ে লেখালেখি করেন, তারা প্রায়ই তাদের লেখায় ধার্মিকদের গালিগালাজ করেন।
আসিফ মহিউদ্দীনঃ দেশের মানুষজনার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রয়োজন কোথায় আমি বুঝলাম না। গ্রহণযোগ্য হবে তো আল্লামা সাইদী এবং আল্লামা শফী। কিংবা ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা, জাকির তালুকদার কিংবা ইমদাদুল হক মিলনেরা। প্রথম আলো কিংবা কালের কণ্ঠরা। আরজ আলী বেশিরভাগ মানুষের কাছেই গ্রহনযোগ্য না, আহমদ শরীফ বা হুমায়ুন আজাদও না।

আমরা কোথায় ঠিক গালাগালি করে লিখি তাও আমি জানি না। মুহাম্মদকে যুদ্ধবাজ শিশুকামী ধর্ষক বলা নিশ্চয়ই গালি নয়। ফ্যাক্ট। কোরানকে বর্বরতম কেতাব বলা নিশ্চয়ই ভুল বলা নয়। এখানে গালির কী আছে?

আল্লামা শফীকে গালি তো দেয়া যেতেই পারে। আমি নিজেই ওটাকে বৃদ্ধ খচ্চর বলি।

ধার্মিকদের গালাগালি আর মুক্তচিন্তার মানুষদের গালাগালি কোন অবস্থাতেই তুলনীয় নয়। আমাকে কেউ গালি দিলে আমি পাল্টা গালি দিতেই পারি। আমাকে কেউ কতলের হুমকি দিলে আমি তাদের বিরুদ্ধে লিখতেই পারি। তাদের নিয়ে হাসাহাসি স্যাটায়ার করতেই পারি।

আর ধার্মিকদের গালাগালি বলতে যেটা বোঝাচ্ছেন, হ্যা, অনেকেই মুসলিমদের উল্টাপাল্টা গালাগালি করে বটে। সেটা তো প্রতিক্রিয়া মাত্র। ডেইলি যখন আপনাকে শুধুমাত্র মত প্রকাশের জন্য এক হাজার গালি দেয়া হবে, এমন কৌশলে যেন আপনি গালি খেয়ে লেখা বন্ধ করে দেন, আপনার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হবে, তখন আপনিও দুই একটা গালি দেবেনই। সেটাই স্বাভাবিক।

ধর্মান্ধরা চাপাতির কোপ দেবে, গালাগালি করে চেষ্টা করবে আপনি যেন হাল ছেড়ে দেন। আপনি কতটা সেসব সামলাতে পারছেন সেটাই মূখ্য। সামলাতে না পারলে মাঝে মাঝে গালি আপনিও দিতে পারেন। সেটা নির্ভর করছে আপনার ম্যাচিউরিটির ওপর।

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ আপনার মতো যারা কমেন্টবক্স খোলা রেখেছেন, তাদের লেখায় মোল্লাশ্রেণীর কাছ থেকে প্রচুর গালিগালাজ আসে, আবার সেই কমেন্টারগণ এই লেখা দিয়ে প্রভাবিতও হয় বলে আমার ধারণা। তাছাড়া, মোল্লারা গালি দিলে আমাদেরও পালটা গালি দিয়ে তাদের সমান্তরালে চলে যেতে হবে!!!
আর দেশের মানুষজনার সাথে এতোটা দূরত্ব তৈরী করে আমরা কীভাবে তাদের ও দেশের কল্যাণে ব্রতী হতে পারি??? আপনাকে অতি সম্প্রতি লেখা আমার কিছু ফেইসবুক বন্ধুর কিছু স্ট্যাটাসের কিছু অংশ লিখে জানাতে চাই।
“ইসলামে ইসলামে চুদির ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই”।
“আমাদের গ্রুপ প্রচুর এই দুই খানকির বাচ্চায় ভরা। এই শুয়ারের বাচ্চাগুলার জন্য দুনিয়ায় যত অশান্তি, কিন্তু যত দোষ নাস্তিক ঘোষ।”
“আমাদের বুইড়া নবী মুহাম্মদ সালারপুত জীবনে কোন দিন ইহুদি বীর ডেভিড এবং গ্যালিয়াতের মতো……ডুয়েল ফাইট লড়েনি……মতো শক্তি সাহস নবী মুহাম্মদ সালারপুতের ছিল না। নবী মুহাম্মদ কোরআনের দাসী সম্ভোগের আয়াতের নামে শুধু মাগি লাগাত। আর বলতো ৩০ জনের যৌন শক্তি আছে চুদিরভায়ের”।
এই লেখকগণ সেক্যুলার শ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয় (লাইক দ্বারা জনপ্রিয়তা মাপছি), এবং তারা নিয়মিত লিখেন।

আসিফ মহিউদ্দীনঃ সেক্যুলার লেখকেরা আমাদের সমাজ থেকেই এসেছে। তাদেরও মেজাজ গরম হতে পারে, তাদেরও ক্ষোভ থাকতে পারে। ধার্মিকেরা যখন যুক্তির কাছে পরাজিত হয় তখন গালিই শেষ ভরসা। আর সেক্যুলার অনেকে এই উৎকট গালাগালি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গালাগালি দিলে আমি সেগুলা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই যেখানে সেক্যুলারদের নানাভাবে অপমান অপদস্থ করা হয়, চাপাতির কোপ আর গালাগালি, শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত করা হয়, মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়, প্রেমিকা চলে যায়, বউ ছেড়ে যায় নাস্তিকতার কারনে, সেখানে তারা কোন ফেসবুক গ্রুপে দুটো গালি দিলো, তাতে কী এমন আসলো গেল!

শাহিনুর রহমান শাহিনঃ বুঝলাম। গতকাল আপনি আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করলেন,
“ভাব দেখে মনে হয় তাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো অন্যদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। তারা শিক্ষিত হবে না, সভ্য হবে না, কার্টুন দেখে বোমা মারবে, আল্লাহো আকবর বলে কল্লা নামাবে, গাল ফুলিয়ে বলবে আমরা অবহেলিত, নির্যাতিত, আর তাদের আহারে আহারে বলে গাল টিপে আদর করে দিতে হবে! তামাশা আর কী!”
“আমি লিখেছি অশিক্ষিত মূর্খ রেইসিস্ট আহাম্মক আমেরিকানরা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে।”
“আমি সেইসব ভোটারদের রীতিমত বর্বর ইতর শয়তান বলেছি। প্রয়োজনে সেইসব আহাম্মক ভোটারদের আমি উষ্টা মারতেও দ্বিধা করবো না”।
“জার্মানিতে যদি কাল উগ্রডানপন্থী খ্রিস্টানরা ভোটে জয়ী হয়, আমি নির্দ্বিধায় লিখবো এই খ্রিষ্টান আহাম্মকগুলাকে জুতানো দরকার……আমি স্যাটায়ার করে তখন যীশুর নেংটু নেংটু ছবি পোস্ট করবো”।
আপনার এধরনের মনোভাব তথা মন্তব্যকে আপনি কতোটুকু গঠনমূলক সমালোচনা হিশেবে আখ্যায়িত করতে পারেন? আপনার উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ এবং আমি আপনাকে মানবতাবাদী মানুষ ভাবি। আশা করছি, আপনি নিজেও নিজেকে তা-ই ভাবেন। সত্যিই কি আপনার ধারনা, এভাবে সমালোচনা করলে দেশ-বিদেশের মানুষের মানবাধিকার আরো বেশী করে সুরক্ষিত থাকবে?

আসিফ মহিউদ্দীনঃ আমরা যারা লেখালেখি করি, তারা সারাক্ষণ প্রতিটা শব্দ লিখে সমাজ উদ্ধার করি তা তো না। বা এমনো না যে, এরকম কিছু লেখায় সমাজ রসাতলে চলে গেল। প্রতিটা কথায় মানব অধিকার উদ্ধার করতে কেউই আসে না। অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরে আমি লিখেছিলাম, ফাক ইসলাম। তাতে তো নাস্তিকতা ধ্বসে যায় নাই।

আমার কোন কথা পছন্দ নাও হতে পারে আপনার। তাহলে সমালোচনার পথ তো খোলাই আছে। লিখুন। আমি তো আপনার কল্লা নামাতে আসছি না।

কোন সেক্যুলার মুক্তমনার কথা ভাল না লাগলে লিখবেন। তাহলেই তো হলো। কল্লা যাবে বলে মনে হয় না। দুই একটা গালি হয়তো খাবেন। কিন্তু সেগুলো তো ফেইসবুকের গালিই। সেই গালিতে বিশ্ব মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়ে যাচ্ছে না তো।

আমি আমার ফেইসবুক প্রফাইলে আমার বিয়ের কথা বলি, ভ্রমণের কথা লিখি, স্যাটায়ার করি, লেখালেখিও করি। সবকিছু সমাজ উদ্ধারের জন্য তো না। আপনার সেগুলো ভাল না লাগলে পড়বেন না। ল্যাটা চুকে গেল।

কোনভাবে সমালোচনা করলে ঠিক হবে, সেটা যার যারটা তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন। যারা রামপালের বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা পাঁড় আওয়ামী লীগারদের বেইমান বলছে। যারা আওয়ামী লীগার, তারা তেলগ্যাস আন্দোলনের কর্মীদের অশ্রাব্যভাষায় গালি দিচ্ছে। যারা ধর্মান্ধ, তারা নাস্তিকদের রুটিন করে গালাগালি করে যাচ্ছে। সেসবের মাঝে আপনি শুধু কোন নাস্তিক কী বলেছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন মনে করছেন?

আর অন্য কারো লেখা গঠনমূলক মনে না হলে আপনিই গঠনমূলক লিখে একটা ধারা সৃষ্টি করুন, যেন আপনার লেখা দ্বারা অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। তাহলেই তো হলো।

আসিফ মহিউদ্দীনঃ আচ্ছা আমি এখন যাচ্ছি। সাক্ষাতকারের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আর কোন আলাপ থাকলে পরে সময় করে উত্তর দেবো। আপাতত যাই। ভাল থাকবেন, শুভ কামনা।
শাহিনুর রহমান শাহিনঃ অনেক দীর্ঘ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ডয়েচে ভেলে। 

Leave a Comment