সেলিব্রিটি গসিপ আমাদের কেন এত প্রিয়?

গসিপ

“Gossip” শব্দটার বাংলা হচ্ছে পরচর্চা। অনেক মানুষকেই পরচর্চা করতে দেখা যায়, তবে সেলিব্রিটিদের গসিপ করার ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অনলাইনে এটা যেন পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। এদিকে কোন সেলিব্রিটির স্ক্যান্ডাল বের হলে তো আর কথাই নেই। তাছাড়া গত কয়েক দশক ধরে নিউজ পেপার, ম্যাগাজিন, ট্যাবলয়েডের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে সেলিব্রিটিদের নিয়ে নানান ধরণের গসিপ ছাপানো হয়েছে। কারণ এরকম খবরের মারকেট সবসময়ই অনেক বেশি থাকে। কেন মানুষ পর্নোগ্রাফি দেখার চেয়ে সেলিব্রিটিদের স্ক্যান্ডাল দেখতে বা তাদের ব্যাপারে গসিপ শুনতে বেশি ভালবাসে?- নিউজফিডে ইউটিউবার সালমান মুক্তাদিরের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নিয়ে এরকম একটি লেখা দেখে এই প্রশ্নটি মাথায় আসল – মানুষ সেলিব্রিটি গসিপ কেন ভালবাসে?

সেলিব্রিটি গসিপ নিউজের ইতিহাস খুব একটা নিকট অতীতের নয়। এর সূচনা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে! সেই ১৮৪০ এর দশকের দিকে হাংগেরিয়ান মিউজিক কম্পোজার ফ্রাঞ্জ লিসৎকে (Franz Liszt) ঘিরেই শুরু হয়েছিল সেলিব্রিটি গসিপের সূচনা। লিসৎকে নিয়ে তার ফ্যানদের পাগলামি এতই বেশি ছিল যে, বর্তমানে যেমন বিয়ন্স এর জন্য বে হাইভ, জাস্টিন বিবারের জন্য বিবার ফিভার এর মত শব্দের প্রচলন ঘটেছে, লিসৎকে নিয়েও তখন একটি শব্দ ছিল “লিসতোমেনিয়া”। লিসৎ যাই করত তা নিয়েই সবাই আগ্রহী ছিল। সে কী করতে চায়, কার সাথে মিশছে সবই সেলিব্রিটি গসিপের বিশাল বিশাল খবর সেইসময়। যাই হোক, সেলিব্রিটি গসিপ নিয়ে আমাদের ক্ষুধা আজও আছে। আর কেনই বা থাকবে না? এখানে আমাদের খুবই পছন্দের দুটি জিনিসের মিশ্রণ থাকে যে। এই পছন্দের দুটি জিনিস হচ্ছে খ্যাতি ও দুঃসংবাদ।

গসিপ এর প্রতি আগ্রহের জন্য আমাদের মস্তিষ্ক যেন একরকম হার্ডঅয়ার্ড হয়ে আছে। আমরা প্রায় সবাই পরচর্চা, মানে ক, খ, গ, ঘ এর সাথে ঙ-কে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে ভালবাসি। কিন্তু সেলিব্রিটি গসিপ নিয়ে আগ্রহ যেন একটু অন্য মাত্রার। আর এটি চলে আসছে সমগ্র মানবেতিহাস জুড়েই । হ্যাঁ, তা নয়তো বলছি কী? লেখক টম পেইন তো তার বই “FAME: What the Classics Tell Us About Our Cult of Celebrity”-তে “Cult of Celebrity” নামে একটি শব্দগুচ্ছই বানিয়ে বসলেন! লেখক এই বইতে আমাদের সভ্যতার সূচনাসময় থেকে ধর্মীয় মহাপুরুষ, শহীদদের মত বিখ্যাতদের প্রতি আমাদের পূর্বপুরুষদের অকৃত্রিম ফ্যানডম সম্পর্কে লিখেছেন।

কাজের কথায় আসা যাক। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী ডেনিয়েল ক্রুগার বলেন, এই যে উচ্চ-মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আমাদের জানবার এত আগ্রহ, এটা কিন্তু অন্যান্য প্রাইমেটদের মধ্যেও দেখা যায়। আর আমাদের এই আগ্রহটি আমাদের কোন বিবর্তনীয় কৌশল হয়ে থাকতে পারে যা আমাদেরকে বছরের পর বছর ধরে টিকে থাকতে সুবিধা দান করেছে। তিনি বলেন, সেলিব্রিটি গসিপের দুটো বিবর্তনীয় সুবিধা আছে। একটি হচ্ছে, আমাদের ব্যক্তিগত সুবিধা। এর দ্বারা আমরা জানতে পারি, উচ্চ-মর্যাদার লোকেরা কী কী করে। এই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে আমরা আরও সহজে সেই উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির মত হতে পারি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাজনৈতিক, আমাদের জটিল সামাজিক চক্র কিকরে তৈরি হয়েছে তার সাথে এটি সম্পর্কিত। উচ্চ-মর্যাদার লোকেদের সাথে কী হচ্ছে এটা জানার মাধ্যমে আমরা আরও ভালোভাবে সমাজের বিভিন্ন ব্যাপার বা ঘটনাকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

এবার নিজেকে একটু প্রশ্ন করে দেখুন, সব সেলিব্রিটি নিউজ কি সমান জনপ্রিয় হয়? সত্যি করে বলুন তো, ঠিক কোন খবরগুলো নিয়ে আমরা সবচাইতে বেশি আগ্রহী হই? উত্তরটা সেলিব্রিটিদের ভাল দিকগুলোকে ইঙ্গিত করছে না, খারাপ দিকগুলোকেই করছে, বিশেষ করে সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোকে ইঙ্গিত করছে যেগুলোকে আমরা স্ক্যান্ডল বলি।

গসিপ আমাদের মস্তিষ্কে কিভাবে প্রভাব ফেলে?

সেলিব্রিটি স্ক্যান্ডালগুলো আমাদের মস্তিষ্কে কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে ২০১৫ সালে কিছু চাইনিজ গবেষক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সোশ্যাল নিউরোসায়েন্স জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষণার জন্য ১৭ জন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসা হয়, এরপর তাদেরকে তাদের নিজের সম্পর্কে গসিপ শোনানো হয়, এরপর বন্ধুদের সম্পর্কে শোনানো হয়, আর তারপর এমন একজন বিখ্যাত সেলিব্রিটিকে নিয়ে গসিপ শোনানো হয় যার কথা সেই ব্যক্তি জানেন, কিন্তু তার ব্যাপারে পূর্বে কখনও বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। এই স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে এরকম ভাল মানুষও ছিল, আবার নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়ে পুলিস কেস হয়েছে এরকম মন্দ মানুষও ছিল। এই গসিপগুলোর প্রভাবে এদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে, বা মস্তিষ্কে কী প্রভাব পড়ে তা জানার জন্য সেই গসিপগুলো শোনার সময় এদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হয়।

স্বেচ্ছাসেবকদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে একেকটা গসিপ শোনা শেষ হবার পর তারা কিরকম অনুভব করেন? তাদের উত্তরের সাথে ব্রেইন স্ক্যানের ফলাফল মেলানো হয়। স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীরা স্বীকার করে যে তারা নিজেদের বেলায় ইতিবাচক গসিপ ও অন্যদের বেলায় নেতিবাচক গসিপ শুনতে বেশি পছন্দ করে। এই কথাটি সত্যি ছিল। কিন্তু তারা একটা মিথ্যা কথাও বলে। তারা বলেছিল যার সম্পর্কেই নেতিবাচক গসিপ শোনা যাক, তাদের একই রকম ভালো লাগে, সেলিব্রিটিদের নেতিবাচক গসিপ শোনায় তাদের যে বেশি ভাল লাগছে তেমনটা নয়। কিন্তু ব্রেইন স্ক্যানের রেজাল্ট বলল অন্য কথা।

ব্রেইন স্ক্যান করে দেখা গেল, আমাদের মস্তিষ্কের প্লিজার এন্ড রিওয়ার্ড (সন্তুষ্টি ও পুরস্কার) এর সাথে সম্পর্কিত একটি অঞ্চল এই গসিপের সাথে সম্পর্কিত। এই অঞ্চলটির নাম হল কডেট নিউক্লিয়াস (caudate nucleus)। দেখা যায় ব্যক্তি নেগেটিভ পিয়ার গসিপ বা সঙ্গী-সাথীদের ব্যাপারে নেতিবাচক গসিপ শুনলে তার মস্তিষ্কের এই অংশ যতটা না সক্রিয় হয় তার তুলনায় আরও বেশি সক্রিয় হয় নেতিবাচক সেলিব্রিটি গসিপ শুনলে। আর সেলিব্রিটি গসিপ শোনার সময় মস্তিষ্কের এই অংশের সক্রিয়তা ছিল “moderately strong” বা মোটামুটি শক্তিশালী। এছাড়া আরেকটি জিনিস পাওয়া যায় ব্রেইন স্ক্যানের রেজাল্ট থেকে। দেখা যায়, সেলিব্রিটি গসিপগুলো শোনার সময় স্বেচ্ছাসেবকদের মস্তিষ্কের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত অঞ্চলগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠছে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, যখন তারা সেলিব্রিটিদের নেতিবাচক গসিপ শোনে, অর্থাৎ যখন সেলিব্রিটিরা তাদের কোন কাজের ফলে জনসাধারণের চোখে ছোট হয়ে যায়, তখন সেই গসিপ শুনে ব্যক্তি আনন্দ পেলেও, ব্যক্তি নিজের এই আনন্দকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

আরও একটু দুঃসংবাদ দেবেন, প্লিজ?

মানুষের কাছে সেলিব্রিটিদের দুঃসংবাদ কতটা পছন্দনীয় তা আমরা জানলাম। এবার আরেকটা নতুন বিষয় জানুন, আমরা যেকোন ধরণের দুর্ভাগ্য সম্পর্কে পড়তে ভালোবাসি। Pew গবেষকগণ ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের কিরকম সংবাদ পছন্দ তা নিয়ে তাদের একটি সার্ভে এর ফলাফল প্রকাশ করেন। অদ্ভুতভাবে দেখা গেল ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে মানুষের পছন্দের সংবাদগুলো সব একই রকমের! যুদ্ধ ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক সংবাদগুলো ছিল সবচাইতে বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া খারাপ আবহাওয়া, অপরাধ – এসবের জনপ্রিয়তাও ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।

মানুষের এই খারাপ খবর শোনার প্রবৃত্তিটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী দেখা যায়। ২০০৩ সালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এটায় দেখা যায় মানুষ ইতিবাচক শব্দ যেমন “হাসি”, “আনন্দ” যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়, নেতিবাচক শব্দ যেমন “ক্যানসার”, “বোম্ব”, “যুদ্ধ” ইত্যাদির বেলায় তার চেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটি খারাপ খবরের দিকে আমাদের স্বভাবগত প্রবণতাকেই নির্দেশ করে। একটি জনপ্রিয় জার্নালিজম প্রবাদ হচ্ছে, “If it bleeds, it leads.”!

আমাদের এই খারাপ খবরের দিকে আগ্রহকে কখনও কখনও নেগেটিভিটি বায়াস বা নেতিবাচকতা পক্ষপাতও বলা হয়। আমাদের সবার মাঝেই এটা কম বেশি আছেই, আর এই বায়াস আমাদের কাজেও আসে। ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স বা লড়ো নয়তো পালাও প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এটা আমাদের সাহায্য করে। ধরুন আপনার সামনে একটা নতুন কোন কিছু আসল (প্রাণী বা ব্যক্তি বা বস্তু যেকোন কিছু)। এটা আপনার জন্য ভালোও হতে পারে আবার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। যদি ভাল হয় তাহলে তো বেঁচেই গেলেন, কিন্তু খারাপ হলে যাতে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন বা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন সেরকম রেসপন্স আপনার বেঁচে থাকার দরকার হবে। আর আপনার ভেতরের নেগেটিভ বায়াস আপনাকে বেশি করে মনে করাবে যে কোন সময় এর জন্য খারাপ কিছু হতে পারে, এর জন্য সাবধান হতে হবে, যে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর এই অতিরিক্ত সচেতনতার জন্য আপনার জীবনও বেঁচে যেতে পারে।

এই নেগেটিভিটি বায়াসকে বর্তমানে আমাদের যৌক্তিক দৃষ্টিতে অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে এরকম অহেতুক নেতিবাচক বিষয়ে ফোকাস করাটা অযৌক্তিক। যদি এরকম মনে করেন তবে আমি বলছি আপনিই সঠিক। এটা অযৌক্তিক বলেই তো এটি বায়াস বা পক্ষপাত। কিন্তু কয়েক লক্ষ বছর আগে যখন টিকে থাকাই আমাদের লক্ষ্য ছিল তখন এই নেগেটিভিটি বায়াস আমাদেরকে প্রজাতিকে টিকে থাকার সুবিধা দান করেছিল, আর তাই আমরা বিবর্তনের ফলে এই প্রবৃত্তি লাভ করে থাকতে পারি। এই নেগেটিভিটি বায়াস এর সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় প্রভাবও রয়েছে। দেখা গেছে রক্ষণশীলদের মধ্যে নেগেটিভ বায়াস উদারপন্থীদের তুলনায় বেশি থাকে। তাই এদের রাজনীতিও দক্ষিণপন্থী হয়ে থাকে যা মূলত সামাজিক হুমকির প্রশমন ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার দিকে মনোযোগ দেয়। নতুন ধরণের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা পূর্বের ধ্যান ধারণার পরিবর্তনকে এরা সহজে মেনে নিতে পারেন না। যাদের মধ্যে এই নেগেটিভিটি বায়াস কম থাকে তারা উদারপন্থী হন, রাজনীতিতে তাদেরকে বহুত্ববাদ, বিভিন্ন রকম সংখ্যালঘু ও সামাজিক গোষ্ঠীদের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে দেখা যায়, সামাজিক পরিবর্তন এর ক্ষেত্রেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উদার থাকে। যাই হোক, বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কত ইনটারেস্টিং। এই বায়াস বা পক্ষপাত নিয়ে অন্য কোন পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, এখন মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক।

মনোবিজ্ঞানী টম স্ট্যাফর্ড বলেন, খারাপ খবর হুমকি হিসেবে কাজ করে। এটা আমাদেরকে এই সংকেত দেয় যে বিপদ এড়াবার জন্য আমাদেরকে আমাদের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে, অর্থাৎ আমরা যা করছি, বা সমাজে যা চলছে তাতে নিশ্চই কোন সমস্যা আছে। অন্য ভাষায়, আমরা এটা জানতে ভালোবাসি যে সেলিব্রিটিরা তাদের জীবনে কী কী ভুলগুলো করছে যাতে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারি।

আবার এটি পালাবার সুযোগও বটে

সেলিব্রিটি গসিপ কেবল আমাদের অন্তস্থলের মানব প্রবৃত্তিগত চাহিদাকেই সন্তুষ্ট করে না, এটি আমাদেরকে সত্যিকারের আনন্দও দেয়। কিছু কিছু লোকের জন্য সেলিব্রিটিদের গোপন জীবন সম্পর্কে জানা, পর্দার পেছনে কী হয় সেসম্পর্কে জানা, দৈনন্দিন জীবন থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পাবার বা পালাবারও একটা পথ। খবর যত চটকদার হবে, ততই ভাল।

UCLA বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া সাইকোলজি বিষয়ক প্রফেসর এমিরেটাস স্টুয়ার্ট ফিশার বলেন, সেলিব্রিটিদের জীবন নিয়ে সব সময় চিন্তামগ্ন থাকাটা আসলে অস্বাস্থ্যকর নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরকারেও আসে। যেমন ধরুন যেসব ব্যক্তির সামাজিক দক্ষতার অভাব আছে, তারা এরকমই আগ্রহ আছে এরকম অন্য ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে সামাজিক বন্ধন তৈরি করতে পারেন। সুতরাং এদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটা “কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ” বলতে পারেন।

এছাড়া ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ মিশৌরি এর গবেষক এমান্ডা হিন্নান্ট ও এলিজাবেথ হেন্ড্রিকসন এর দ্বারা প্রকাশিত একটি পেপারে বলা হয়, সেলিব্রিটি গসিপ সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। গবেষকগণ দেখেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক গণপ্রচারণার চেয়ে, যদি কোন স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে কোন সেলিব্রিটি জড়িত থাকেন তবে সেই ব্যাপারে পাঠক গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এই বিষয়ে একটি মজার কাহিনী আছে আমেরিকান এক্টর চার্লি শিনকে নিয়ে। ২০১৫ সালে তিনি জনসম্মুখে স্বীকার করেন যে তিনি এইচ আই ভি পজিটিভ। দেখা যায়, তার এই ঘোষণার তিন সপ্তাহের মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এইচ আই ভি নিয়ে সচেতনতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। সাধারণত গুগলে এইচ আই ভি সংক্রান্ত যেরকম ওয়েব সার্চ হয়ে থাকে, তার চেয়ে এই সার্চ ২৭.৫ লক্ষ বেশি সার্চ হয়েছে। কন্ডোম, এইচ আই ভি এর লক্ষণ, এইচ আই ভি টেস্টিং নিয়ে সার্চ বেড়েছে ১২.৫ লক্ষ! বাসায় এইচ আই ভি টেস্ট করার যন্ত্র কেনা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯৫%। জাতি সংঘের যেকোন ইভেন্ট এইচ আই ভি নিয়ে জনগণকে যে শিক্ষা দিতে পারে, এই ঘটনা সাধারণ মানুষকে তার চাইতেও অনেক বেশি শিক্ষা দিয়েছে। জন আয়ার শিনের এই ঘোষণার ফলাফল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, যার ফলাফল এর কিছু অংশ এতক্ষণ ধরে উপরে দেখানো হয়েছে। এটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি এই বিশেষ ঘটনাটির নাম দিয়েছেন “The Charlie Sheen Effect”।

তাহলে এতক্ষণ ধরে সেলিব্রিটি গসিপ আমাদের কাছে কেন এত প্রিয় তা নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলাম। সেই সাথে বললাম, আমাদের ভেতরের দুঃসংবাদ বা খারাপ খবর পছন্দ করার প্রবৃত্তির কথা, বললাম এটা অনেকের কাছেই মজাদার আবার ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও উপকারী হতে পারে। আবার আমাদের এই প্রবণতা ব্যবহৃত হতে পারে বিভিন্ন সমাজ সচেতনতামূলক কাজ ও সমাজের বিভিন্ন রকম উপকারের জন্য। তবে যারা সেলিব্রিটি তাদের জন্য এই ব্যাপারটা সবসময় সুখের হয়না। সেলিব্রিটিদের সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহের উপর ভিত্তি করে নিয়ন্ত্রিত হয় ম্যাগাজিন, ট্যাবলয়েড সহ বিভিন্ন নিউজ প্লাটফর্মের মার্কেট। পাপারাজ্জিরা হন্যে হয়ে পড়ে থাকে সেলিব্রিটিদের সম্পর্কে নিত্য নতুন খবর সংগ্রহের জন্য। আর কোন স্ক্যান্ডল বের হলে তো কথাই নেই। আমরা যেমন সেলিব্রিটিদের বিখ্যাত করে তুলেছি, সেই সাথে তাদেরকে দান করেছি খ্যাতির বিরম্বনাও। তবে এই এত কিছুর পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণটি, অর্থাৎ আমাদের ভেতরের প্রবৃত্তি ও তার উৎস্যের অনুসন্ধান করার জন্য বিজ্ঞান সদাসচেষ্ট। আর এই বিজ্ঞানের অবদানে আমরাও চিনতে পারছি আমাদের “আমি”টাকে। বুঝতে পারছি সেলিব্রিটি গসিপ সহ বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে লুকিয়ে থাকা আমাদের মনের সাদাকালো দিকগুলোকে।

তথ্যসূত্র

1. https://en.wikipedia.org/wiki/Lisztomania
2. http://www.scientificamerican.com/article/the-science-of-gossip/
3. http://www.medicaldaily.com/gossip-good-office-242788
4. http://www.theatlantic.com/entertainment/archive/2010/12/from-the-iliad-to-us-weekly-the-history-of-celebrity-gossip/67997/
5. http://www.livescience.com/18649-oscar-psychology-celebrity-worship.html
6. http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/25580932
7. http://www.wired.com/2015/02/brain-celebrity-gossip/
8. http://www.cjr.org/behind_the_news/what_kind_of_news_do_people_re.php?page=all#sthash.LKHqHlwB.dpuf
9. http://pss.sagepub.com/content/14/1/14.short
10. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/24970428
11. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/24970450
12. https://onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1111/j.1467-9221.2006.00447.x%EF%BB%BF
13. http://www.bbc.com/future/story/20140728-why-is-all-the-news-bad
14. http://www.livescience.com/18649-oscar-psychology-celebrity-worship.html
15. http://www.medicaldaily.com/gossipping-strengthens-social-networks-and-lengthens-lives-only-when-its-done-right-337366
16. http://journalism.missouri.edu/2010/10/mu-researchers-find-celebrity-journalism-may-contribute-positively-to-consumer-health-behaviors/
17. http://www.telegraph.co.uk/news/8083811/Celebrity-gossip-is-good-for-your-health-scientists-find.html
18. http://www.latimes.com/health/la-sci-charlie-sheen-hiv-20151118-story.html
19. http://www.medicaldaily.com/pulse/charlie-sheen-breaks-silence-hiv-positive-diagnosis-hopes-kick-door-open-hiv-stigma-361882
20. http://www.medicaldaily.com/charlie-sheen-says-it-impossible-him-transmit-his-hiv-through-unprotected-sex-what-361958
21. https://link.springer.com/article/10.1007%2Fs11121-017-0792-2
22. https://jamanetwork.com/journals/jamainternalmedicine/fullarticle/2495274

Leave a Comment