মাননীয় হেডমাস্টার! কোথায় আপনি?

হেডমাস্টার

ছোটবেলায় আমাকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল। আমাকে বলা হল যেহেতু আমার বাবা মা এই স্কুলেরই ছাত্র ছিল তাই আমিও এখানে পড়তে বাধ্য। আরো বলা হল এই স্কুলই নাকি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুল। আর এই স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোন সুযোগও নেই। আমাকে সারাজীবন এখানে পড়তে হবে। শুধু তাই নয়, অন্য স্কুল থেকে এখানে যারা একবার আসবে, তাদেরও জীবনভর এখানেই কাটাতে হবে। এটাই নাকি এখানকার নিয়ম।

আমার হাতে একটা বই ধরিয়ে দেয়া হল। বলা হল এই একটা মাত্র বই পড়লেই নাকি আমি সবকিছু শিখে ফেলবো। ভিন্ন ভাষার ঐ বই আমার কাছে উদ্ভট লাগলো। তন্নতন্ন করে খুঁজেও শেখার মত কিছু পেলাম না। শুধু পেলাম অমুক স্কুল খারাপ, তমুক স্কুলের ছেলেদের সাথে মেশা যাবেনা , অমুককে মারো, তমুককে পেটাও এসব। খালি মারামারি, কাটাকাটি আর আজগুবি সব বিষাক্ত আর হাস্যকর কাহিনীতে ভরা। আমার বিরক্ত লাগে, আবার হাসিও পায়। কাউকে বলতে পারিনা ভয়ে। এই বই নিয়ে কথা বলা নিষেধ।

শুনেছি এই স্কুলের একজন হেডমাস্টার আছেন। কিন্তু তিনি কখনো কারো সামনে আসেননা। অনেক আগে একজন এসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ছিলেন। তাকেও কেউ কখনো দেখেনি। ওই সহকারী হেডমাস্টারের সাথে নাকি হেডস্যারের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। হেডমাস্টার তার সহকারীকে নিয়মিত চিঠি দিয়ে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন। সেগুলোকেই এখানে বই হিসেবে পড়ানো হয়। আমার মনে অনেক প্রশ্ন আসে। করতে ভয় পাই। এই স্কুলে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ।

আমরা সকাল বিকাল নিয়ম করে হেডস্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমি বুঝে উঠতে পারিনা। এই স্কুল ভবনের ইট, সিমেন্ট বানিয়েছে মানুষ, ভবনের কারিগর মানুষ। যে বই পড়ানো হয় তার কাগজ, কালি বানিয়েছে মানুষ। চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ বানিয়েছে মানুষ। তাহলে কেন তাকে সকাল সন্ধ্যা স্মরণ করতে হবে? আর আমাদের এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তারই বা কি লাভ? তার কৃতিত্বটাই বা কি?

আমাদের স্কুলের সামনে একটা প্রকান্ড মাঠ। স্কুলের বারান্দা থেকে দূরের স্কুলগুলোও দেখা যায়। তাদের আনন্দ উদযাপন দেখে হিংসা হয়। কত উৎসবমুখর পরিবেশ সেখানে। ওখানে নাচ, গান, মেলা হয়। কেউ আবার ফানুস ওড়ায়। নানারকম খেলাধুলা করে। আমাদের এখানে সব নিষেধ। এসব করলে হেডস্যার নাখোশ হন। হেডস্যার অবশ্য আমাদের খাওয়া, পড়া, থাকার কোন খরচই দেননা। তবুও তিনি শুধু শুধু অভিমান করেন। তার অনেক রাগ, অনেক জেদ, অনেক অহংকার। হেডস্যারের কথা অমান্য করলে কঠিন শাস্তি হবে শুনেছি।

এত এত নিয়ম নিষেধাজ্ঞা পালন করে এখান থেকে পাশ করে বের হলে আমাদের জন্য অবশ্য পুরষ্কারের ব্যবস্থা আছে। পাশকৃতরা পাবে দুধের নদী, সুন্দরী নারী, নানান রকম ফলমূল। শুনেছি এই স্কুল থেকে পাশ করার পর নাকি হেডস্যারের পার্সোনাল সেক্রেটারীরা আসবে ইন্টারভিউ নিতে। কিন্তু এখানকার ডিগ্রীধারীরা চিরতরে হারিয়ে যায়। তাই তারা ইন্টারভিউতে উত্তীর্ণ হচ্ছে কিনা আর আদৌ কোন পুরষ্কার পাচ্ছে কিনা তা যাচাই এর কোন সুযোগ নেই।

দূরের স্কুলের একটা মেয়েকে ভালো লাগে আমার। কিন্তু ঐ স্কুল যে আমার জন্য নিষিদ্ধ। সাহস করে একদিন স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে আসি। জানি স্কুল পালানোর শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। হঠাৎ পেছন থেকে তীর এসে এফোড় ওফোড় করে দেয় আমার হৃদপিন্ড। আমি মারা যাই। মৃতদেহটা পড়ে থাকে মাঠের ঠিক মাঝখানে। যে জায়গাটা সব স্কুলের সীমানার বাইরে। মৃত মানুষের কোন স্কুল থাকেনা।

হেডস্যার! কোথায় আপনি? কোথায় আপনার পিয়নেরা? আপনাদের তো দেখছিনা কোথাও।

View Comments (2)

  • বার্ধক্য জনিত কারনে হেডমাস্টারের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।তাই তিনি এখন চোখে দেখেন না,কানে ও শোনেন না।প্রতিবন্ধী ও বলতে পারেন। এমন অবস্থান থেকে কি বা করতে পারেন তিনি।

Leave a Comment