হিন্দুধর্মের বর্ণবিভাগে নারী

নারী

হিন্দুধর্মের বর্ণবিভাজনে নারীদের অবস্থান কোথায়? আমাদের বেশিরভাগেরই ধারণা, নারীর পিতা যে বর্ণের হবে বা স্বামী যে বর্ণের হবে হিন্দু নারীর বর্ণও তাই হবে। কিন্তু সেই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে খোদ হিন্দুধর্মেরই বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র। শাস্ত্রের অনেক শ্লোকেই দেখা যায় নারীদেরকে চার বর্ণের বাইরে আনা হচ্ছে। আবার যখন বর্ণের বিশুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারটি সামনে আসছে, নিচু জাতের পুরুষের সাথে উঁচু জাতের নারীর প্রেম, বিবাহের ব্যাপার সামনে আসছে তখন দেখা যাচ্ছে হিন্দু নারীর বর্ণ আছে। নারীর ক্ষেত্রে যেন ব্রাহ্মণ্যবাদ চরম সুবিধাবাদী অবস্থান নেয়। সম্মান রক্ষার সময় জাতের কথা মনে করায়, আর অধিকার দেবার বেলায় জাতের কথা ভুলে যায়। বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে এই ব্যাপারটাই এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।

হিন্দুধর্মে শাস্ত্রমতে মূলত চারটি বর্ণ আছে, এবং সাধারণত দেখা যায় নারীদেরকে কোন বর্ণের অন্তর্গত করা হচ্ছে না। হিন্দুধর্মে এরকম অনেক রেফারেন্সই দেয়া যায় যেখানে বলা হচ্ছে নারীরা সকল বর্ণের বাইরে। বিশ্বাস না হলে উদাহরণ দেয়া যাক…

যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায় চ।।
প্রিয়ো দেবা নাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ।
ভূয়াসময়ং মে কাম” সমৃধ্যতামুপ।।

যজুর্বেদ – ২৬/২

অর্থাৎ, আমি যেমন করে এই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র-স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সমস্ত জনগণকে এই কল্যাণদায়িনী পবিত্র বেদমন্ত্র বলছি, তোমরা তেমনি কাজ কর। বেদবাণীর উপদেশ পালন করে আমি বিদ্বানের প্রিয় হয়েছি, বেদবিদ্যা দানের জন্য দানশীল পুরুষের প্রিয় হয়েছি, তোমরাও এমনই কর। বেদবিদ্যার প্রচার হোক, বেদবিদ্যা গ্রহণ ও প্রচার দ্বারা মোক্ষ লাভ কর।

এখানে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে নারীকে ব্রহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চার বর্ণ থেকে আলাদা করে ভাবা হয়েছে। আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক –

মনুসংহিতায় আছে –

ত্রিরাচামেদপঃ পূর্বং দ্বি সমৃজ্যাত্ততো মুখম্‌।
শারীরং শৌচমিচ্ছন্‌ হি স্ত্রী শূদ্রস্তু সবৃৎ সকৃৎ।।

মনুসংহিতা

অর্থাৎ, উচ্চবর্ণের লোকজন দেহ শুদ্ধি করার জন্য তিনবার জলপান, দুইবার মুখমার্জন করবেন, তবে স্ত্রীলোক ও শূদ্রবর্ণের লোকজন এই কাজ একবার করবে।

এই শ্লোক থেকে দেখা যাচ্ছে কোন নারী উচ্চবর্ণে জন্ম নিলেও তাকে উচ্চবর্ণ হিসেবে বা কোন বর্ণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে না, বরং সকল বর্ণ থেকে ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে আর তুলনা করা হচ্ছে সবচেয়ে নিচু বর্ণ শূদ্রের সাথে।

সবই বোঝা গেল। কিন্তু সবসময় যে নারীর বর্ণ থাকে না তা নয়। ভিন্ন বর্ণের লোকের সাথে যখন বিবাহের প্রশ্ন আসে বা ভজন করার প্রশ্ন আসে, তখন আবার নারী যেন বর্ণপ্রাপ্ত হয়, স্বভাবতই এর কারণ হচ্ছে তখন পুরুষের সম্মানহানি বা উত্তরপুরুষের জাত যাওয়ার ভয় আছে তাই। উদাহরণ দেয়া যাক –

ব্রাহ্মণাদ্বৈশ্যকন্যায়ামম্বষ্ঠো নাম জায়তে।
নিষাদঃ শূদ্রকন্যায়াং যঃ পারশব।।

মনুসংহিতা – ১০ঃ৮

অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ পুরুষ বৈশ্যা কন্যা থেকে জাত যে সন্তান – সে ‘অম্বষ্ঠ’; ব্রাহ্মণ পুরুষ ও শূদ্র কন্যা থেকে জাত সন্তান হল ‘নিষাদ’, এর অন্য নাম ‘পারশব’।

মনুর মতে, নিষাদ বা পারশব, এমন কি অম্বষ্ঠও এরা বর্ণ হিসেবে অতি হীন, বস্তুত – ব্রাহ্মণ পুরুষকে শূদ্র ও বৈশ্য নারী থেকে দূরে রাখার জন্যই মনু এমন কথা বলেছেন। এবারে এর একটু পরের শ্লোকও শোনা যাক –

শূদ্রাদয়োগবঃ ক্ষত্তা চাণ্ডালশ্চাধমো নৃণাম্‌।
বৈশ্যারাজন্যবিপ্রাসু জায়ন্তে বর্ণসঙ্করাঃ।।

মনুসংহিতা – ১০ঃ১২

অর্থাৎ, শূদ্র পুরুষ ও বৈশ্যা নারীর সন্তান – ‘আয়োগব’, শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয়া নারীর সন্তান – ‘ক্ষত্তা’ শূদ্র পুরুষ ও ব্রাহ্মণ রমণীর সন্তান হল ‘চণ্ডাল’, সকল বর্ণের মধ্যে এরাই অধম।

এখানেও স্পষ্ট যে বস্তুত শূদ্র পুরুষ থেকে ব্রাহ্মণ নারীকে দূরে রাখার জন্যই মনুর এমন কূট-কৌশলের অবতারণা। আরও শুনুন …

কন্যাং ভজন্তীমুৎকৃষ্টং ন কিঞ্চিদপি দাপয়েৎ।
জঘন্যং সেবমানান্ত সংযতাং বাসয়েদ গৃহে।।

মনুসংহিতা – ৮ঃ৩৬৫

অর্থাৎ, অপকৃষ্ট (নিচু জাতের) কন্যা যদি সম্ভোগের জন্য উৎকৃষ্ট (উঁচু জাত) বর্ণের পুরুষের ভজনা করে, তবে তাকে দণ্ড দেয়া হবে না। কিন্তু সে যদি অপকৃষ্ট পুরুষের ভজনা করে তবে তাকে ঘরে আটকে রাখতে হবে।

অমরকোষ এর ২য় কাণ্ডে শূদ্রবর্গে পিতা ও মাতা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের হলে সন্তানের বর্ণ কী হবে আর তার জীবিকা বা পেশা কী হবে তাও খুব স্পষ্ট করে লিখে দেয়া হয়েছে। সেগুলোও উল্লেখ করছি –

১। পিতা বৈশ্য ও মাতা শূদ্রা হলে সন্তানের বর্ণ হবে করণ বা কায়স্থ, পেশা হবে লিপিলেখন
২। পিতা ব্রাহ্মণ ও মাতা বৈশ্যা হলে সন্তানের বর্ণ হবে অম্বষ্ঠ বা বৈদ্য, পেশা হবে চিকিৎসা
৩। পিতা ব্রাহ্মণ ও মাতা শূদ্রা হলে সন্তানের বর্ণ হবে উগ্র বা আগরি, পেশা হবে যুদ্ধক্রিয়া
৪। পিতা বৈশ্য ও মাতা ক্ষত্রিয়া হলে সন্তানের বর্ণ হবে মাগ বা ভাট, পেশা হবে স্তুতিপাঠ
৫। পিতা ক্ষত্রিয় ও মাতা বৈশ্যা হলে সন্তানের বর্ণ হবে মাহিষ্য, পেশা জ্যোতিষ ও সংগীত শাস্ত্র বিষয়ক
৬। পিতা শূদ্র ও মাতা বৈশ্যা হলে সন্তানের বর্ণ হবে ক্ষর্তৃ, পেশা সেবাবৃত্তি
৭। পিতা ক্ষত্রিয় ও মাতা ব্রাহ্মণী হলে সন্তানের বর্ণ হবে সূত, পেশা সারথী
৮। পিতা বৈশ্য ও মাতা ব্রাহ্মণী হলে সন্তানের বর্ণ হবে বৈদেহক, পেশা বাণিজ্য
৯। পিতা মাহিষ্য ও মাতা করণি বা কায়স্থা হলে সন্তানের বর্ণ হবে রথকার, পেশা রথপ্রস্তুত
১০। পিতা শূদ্র ও মাতা ব্রাহ্মণী হলে সন্তানের বর্ণ হবে চণ্ডাল, পেশা মৃতব্যক্তির দ্রব্যগ্রহণ ও শবদাহ

শূদ্রবর্গ, দ্বিতীয় কাণ্ড, অমরকোষ

উল্লেখ্য যে, পিতা ও মাতা দুটি ভিন্ন বর্ণের হবার ফলে তাদের সন্তান মিশ্রবর্ণের সদস্যপদ লাভ করে। এখানে নতুন যে সব বর্ণ দেখা যাচ্ছে এগুলো সবই মিশ্রবর্ণ। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, ভিন্ন বর্ণের পুরুষ ও শূদ্র নারীর মিলনে গর্ভজাত যে সন্তান তার জাত বা পেশার বড় ধরণের অবনমন নেই, মানে খুব বেশি নিচু বর্ণে তারা যায় না। কিন্তু শূদ্র পুরুষের সাথে ভিন্নবর্ণের নারীর গর্ভজাত সন্তানের বেলায় তাদের জাত ও পেশার বড় রকমের অবনমন ঘটানো হয়েছে, যেমন শূদ্র ও বৈশ্য নারীর মিলনে ক্ষর্তৃ বর্ণ তৈরি হয় যাদের পেশা হল সেবাবৃত্তি, আবার শূদ্র ও ব্রাহ্মণ নারীর মিলনে চণ্ডাল বর্ণের সৃষ্টি হয় যাদের পেশা হল শবদাহ। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে নারীকে এখানে কিভাবে দেখা হত আর বর্ণভেদের উপর ভিত্তি করে নারীকে কিভাবে নিম্নবর্ণের পুরুষের সাথে মিলনের সম্ভাবনাকে রহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে আমি যা বলেছি তাই প্রকাশ পায়। নিচু জাতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটা যখন আসে তখনই যেন নারীর বর্ণ প্রকট হয়ে ওঠে, অন্যান্য সময়ে নারীর বর্ণ বিবেচনা সেভাবে করা হয়না, তাকে দেখা হয় শূদ্রের মত নিম্নবর্ণ হিসেবেই।

এবারে আরেকটা মজার বিষয় দেখাই। ‘গভীর নির্জন পথে’ নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থের লেখক সুধীর চক্রবর্তী, বিমান বিহারী মজুমদারের লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন –

শ্রীচৈতন্যের ৪৯০ জন প্রত্যক্ষ শিষ্যের মধ্যে ২৩৯ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ, ৩৭ জন বৈদ্য, ২৯ জন কায়স্থ, ২ জন মুসলমান, ১৬ জন স্ত্রীলোক, আর ১১৭ জন শূদ্র।

গভীর নির্জন পথে, পৃষ্ঠা ২২৮, সুধীন চক্রবর্তী

প্রাচীন গ্রন্থসমূহে নারীর অবস্থান বিচার করতে গিয়ে আমরা চমকে উঠি বটে, কিন্তু নারীর বেলায় বর্তমানকালের গবেষক, পণ্ডিত বিমান বিহারী মজুমদার বা তাদের মত লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গি ‘প্রাচীন-প্রবণতা’কে অতিক্রম করতে পারেনি। এই উদ্ধৃতিটি পড়েই বোঝা যায় যে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য, কায়স্থ এমনকি শূদ্রেরও জাত আছে, কিন্তু নারী কেবলই নারী – এদের ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বলতে কিছুই নেই, এরা ‘মানুষ’ হিসেবেও গণ্য নয় – এদের একটাই পরিচয় – নারী, ঠিক যেমনি হিন্দুধর্মের প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতেও বর্ণিত হয়েছে।

View Comments (1)

  • এই সব বক্তব্য হিন্দুধর্মের অসবর্ন বিবাহকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে এবং এই ধরনের চন্ডাল সারথীর সমাজে উপস্হিতি ও প্রয়োজন এই ধরনের সম্পর্কের বহুল উদাহরন হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে.

Leave a Comment