দেবতাদের আমরা সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ভাবতেই ভালোবাসি। ভক্ত বিশ্বাস করে, ভগবান কেবলই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে থাকেন। কিন্তু সেই দেবতাই যদি হয়ে ওঠে শয়তান, লম্পট ও ধর্ষক? তবে কি মানুষ তার বিবেকের কাঠগোড়ায় দেবতাকেও দাঁড় করাবে? নাকি ক্ষমতাবলে ছাড় পেয়ে যাবে ভ্রষ্ট দেবতা? বর্তমান সময়ে নারীদের উপর বেড়ে চলা সহিংসতা,ধর্ষণ আমাদের যখন বিব্রত করে চলেছে তখন ধর্মগ্রন্থগুলোতে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে সত্যযুগ থেকে কলিযুগ অবধি কিছুই বদলায়নি। কলির অধঃপতিত পুরুষের মত সত্যের পরমপূজ্য ঋষি,দেবতারাও ধর্ষণের ন্যায় অপকর্মে জড়িত।
সূচিপত্র
বৃহস্পতি
প্রথমে দেবগুরু বৃহস্পতির কথা দিয়ে শুরু করা যাক।দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি তার ভ্রাতৃবধূ মমতাকে ধর্ষণ করেন। বৃহস্পতির ভাই ছিলেন উতথ্য ঋষি। তার স্ত্রী হলেন মমতা। একদিন বৃহস্পতি কামাতুর মনে মমতার কাছে উপস্থিত হন। তাকে দেখে মমতা জানান তিনি তার স্বামী অর্থাৎ বৃহস্পতির দাদা উতথ্য ঋষির দ্বারা গর্ভবতী হয়েছেন। এক গর্ভে যেহেতু দুই সন্তানের স্থান হওয়া অসম্ভব এবং বৃহস্পতিও অমোঘরেতাঃ তাই মমতা বৃহস্পতির সাথে মিলিত হতে অসম্মতি জানান। মমতা বৃহস্পতিকে বলেন,
“হে মহাভাগ! আমি তোমার দাদার দ্বারা গর্ভবতী হয়েছি, অতএব সঙ্গম করার ইচ্ছা সংবরণ কর। আমার গর্ভের কুক্ষির মধ্যেই উতথ্যের পুত্র ষড়ঙ্গবেদ অধ্যয়ণ করছে। তুমিও অমোঘরেতাঃ ; এক গর্ভে দুইজনের সম্ভব নিতান্ত অসম্ভব। আজ এই দুষ্কর্ম হতে নিবৃত্ত হও।”
মমতার অসম্মতি সত্বেও দেবগুরু তাকে ধর্ষণ করেন। বৃহস্পতিকে ধর্ষণ করতে দেখে মমতার গর্ভস্থ শিশু বলে ওঠে, “ভগবন! মদন-আবেগ সংবরণ করুন। স্বল্পপরিসরে উভয়ের সম্ভব অত্যন্ত অসম্ভব। আমি পূর্বে এই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছি, অতএব অমোঘরেতঃপাত দ্বারা আমাকে পীড়িত করা আপনার নিতান্ত অযোগ্য কর্ম হচ্ছে, সন্দেহ নেই।”
বৃহস্পতি গর্ভস্থ শিশুটির কথায় কর্ণপাত না করে তার নিকৃষ্ট কাজ করতে থাকেন। গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতির এই অন্যায় আচরণ দেখে নিজের পা দিয়ে শুক্রের পথ রোধ করেন।বীর্য মমতার গর্ভে প্রবেশ করতে না পেরে মাটিতে পতিত হয়। এতে রেগে গিয়ে বৃহস্পতি সেই শিশুটিকে অন্ধ হওয়ার অভিশাপ দেন।পরে ওই শিশুটির নাম হয় দীর্ঘতমা।
(কালিপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক অনুবাদিত মহাভারত / আদিপর্ব / ১০৪ অধ্যায়)
চন্দ্র
পৌরাণিক কাহিনী হতে জানা যায় চন্দ্র তার গুরুপত্নী তারাকে ধর্ষণ করেছিলেন। চন্দ্রের এই অপকর্ম সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে-
“… পূর্বকালে চন্দ্রমা ভাদ্রমাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থীতে তারাকে হরণ করত কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীতে ত্যাগ করিলে গুরু তাকে গ্রহণ করেন। পরে গুরু সগর্ভা তারাকে ভর্ৎসনা করাতে তারা লজ্জিত হইয়া লজ্জাবশতঃ সকোপে কামাতুর চন্দ্রকে শাপ প্রদান করেন , তুমি আমার শাপে কলঙ্কী হও ; যে দেহী তোমাকে দর্শন করিবে সে পাপীও কলঙ্কী হইবে।”
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড/ ১২২ অধ্যায়; নবভারত পাবলিশার্স)
চন্দ্রের তারা হরণের আভাস ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ৬১ তম অধ্যায়েও মেলে-
” পুনরায় কালান্তরে ইন্দ্রের দর্প হইলে ভগবান দুর্বাসা দ্বারা তাহার শ্রী হরণ করিয়াছিলেন এবং পুনরায় কৃপাবশত কৃপাময় ভক্ত বৎসল শ্রীকৃষ্ণ সেই শ্রী দান করিলে, পুনরায় সম্পন্মত্ত হইয়া ইন্দ্র গৌতমপ্রিয়াকে হরণ করেন। তখন ইন্দ্র গৌতম মুনির শাপপ্রভাবে ভগাঙ্গ হইয়া গাত্রবেদনায় অশেষ যাতনা ভোগ করিয়াছিলেন। মুনি ঋষিগণ তাহাকে তদবস্থ দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিতেন এবং দেবগণ অতিশয় লাঞ্ছিত এবং বৃহস্পতি মৃততুল্য হইয়াছিলেন। সেই সময় ইন্দ্র সহস্র বর্ষ সূর্যের আরাধনা করিয়া তাহার বরে গাত্রের সহস্র যোনিচিহ্ন, সহস্র নেত্ররূপে পরিণত হওয়ায় সহস্রাক্ষ নামে প্রসিদ্ধ হন। তারা হরণ নিমিত্ত চন্দ্রের কলঙ্ক রেখার ন্যায় তাহার সেই নেত্রনিকর কলঙ্করূপে অবস্থিত রহিল।”
অশ্বীনিকুমার
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অশ্বীনিকুমারের এক ব্রাহ্মণীকে ধর্ষণের ঘটনা উক্ত হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে,
” মহর্ষি শৌনক সৌতির এইরূপ বাক্যশ্রবণে অতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইয়া কহিলেন , মুনে- কোন বিপাক হেতু কি প্রকারে সূর্য পুত্র অশ্বিনীকুমার অসদৃশ ব্রাহ্মণীতে উপগত হইয়া সন্তানোৎপাদন করিলেন, সবিশেষ বর্ণন করিয়া কৌতূহল দূর করুন। তখন ঋষিসত্তম সৌতি কহিলেন – মুনিবর, দৈবের অসম্ভব ঘটনা। একদা সেই শান্তপ্রকৃতি বলবান সূর্যকুমার এক পরম সুন্দরী ব্রাহ্মণীকে তীর্থ যাত্রায় গমন করিতে দেখিয়া তাহার প্রতি সাতিশয় কামাসক্ত হইলেন এবং বারংবার বহুযত্নে ব্রাহ্মণী কর্তৃক নিবারিত হইয়াও বলপূর্বক নিকটস্থ এক পুষ্পোদ্যানে আনয়ন করত, তাহাতে উপগত হইয়া গর্ভাধান করিলেন। অনন্তর ব্রাহ্মণপত্নী লজ্জাভয়ে ভীত হইয়া সেই গর্ভ ত্যাগ করিবামাত্র , তৎক্ষণাৎ দৈবপ্রভাবে সেই রমণীয় পুষ্পোদ্যানে তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ এক মনোহর পুত্র জন্মিল। তখন সেই ব্রাহ্মণ-রমণী পুত্রস্নেহবশতঃ কুমারকে ক্রোড়ে লইয়া লজ্জিতান্তঃকরণে স্বামী নিকটে উপস্থিত হইয়া পথিমধ্যে যে দৈব ঘটনা হইয়াছিল তাহা সবিশেষ কহিলেন। অনন্তর ব্রাহ্মণ অতি ক্রুদ্ধ হইয়া সে পুত্রের সহিত নিজ ভার্যাকে পরিত্যাগ করিলেন। পরে ব্রাহ্মণপত্নী সাতিশয় লজ্জিতা ও দুঃখিতা হইয়া যোগাবলম্বনপূর্বক স্বদেহ পরিত্যাগ করত গোদাবরী নামে স্রোতস্বতী হইলেন। এদিকে সেই অশ্বীনিকুমার স্বীয় পুত্রকে মাতৃহীন দেখিয়া স্বয়ং বহুযত্নে রক্ষা করত সমুদায় চিকিৎসা শাস্ত্র ও নানাবিধ শিল্প এবং মন্ত্রবিষয় শিক্ষা দান করিলেন। হে শৌনক, পরে সেই অশ্বিনীকুমার বংশোদ্ভব কোনো ব্যক্তি ক্রমশ বৈদিক ধর্ম পরিত্যাগ করত নিরন্তর জ্যোতিঃশাস্ত্র গণনা দ্বারা বেতন গ্রহণ করায় এই ভূমণ্ডলে গণক নামে প্রসিদ্ধ হন। তদ্বংশীয় অন্য ব্রাহ্মণ লোভপ্রযুক্ত শূদ্রদিগের অগ্রে দান গ্রহণ করেন ও প্রেতশ্রাদ্ধাদির সামগ্রী স্বীকার করায় অগ্রদানী নাম লাভ করিয়াছেন।”
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ ব্রহ্মখণ্ড/ ১০ম অধ্যায়; নবভারত পাবলিশার্স)
বরুণ
মহাভারতে বরুণদেবকে চন্দ্রের কন্যা উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও বরুণ যখন ভদ্রাকে ফিরিয়ে দিলেন না, উতথ্য তখন সমস্ত জলরাশি পান করতে উদ্যত হলে ,বরুণ ভয় পেয়ে ভদ্রাকে ফিরিয়ে দেন-
” এক্ষণে অঙ্গীরার পুত্র মহর্ষি উতথ্যের বিষয় কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ভগবান চন্দ্রের এক সর্বাঙ্গসুন্দরী কন্যা ছিল । চন্দ্র অনেক অনুসন্ধানের পর মহর্ষি উতথ্যকেই ঐ কন্যার অনুরূপ পাত্র বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। ঐ কন্যাও উতথ্যকে আপনার উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া তাহার সহিত পরিণীত হইবার অভিলাষে অতি কঠোর তপোনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। কিয়দ্দিন পরে মহর্ষি অত্রি উতথ্যকে আহ্বান পূর্বক চন্দ্রের সেই কন্যাটি তাহার হস্তে প্রদান করিলেন। জলাধিপতি বরুণের পূর্বাবধিই ঐ সোমকন্যার পাণিগ্রহণের অভিলাষ ছিল। এক্ষণে তাহার সেই ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়াতে তিনি নিতান্ত দুঃখিত হইলেন এবং একদা ঐ কন্যাকে যমুনাজলে অবগাহন করিতে দেখিয়া তথায় আগমন পূর্বক তাহাকে গ্রহণ করিয়া স্বীয় পুরমধ্যে আনয়ন করিলেন। ঐ পুরী ছয়লক্ষ হ্রদে সুশোভিত, বিবিধ প্রাসাদ সমাকীর্ণ ও সর্বকাম সম্পন্ন। উহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পুরী আর কুত্রাপি নাই। জলেশ্বর বরুণ সেই রমণীরত্নকে সেই পুরমধ্যে সমানীত করিয়া তাহার সহিত পরমসুখে বিহার করিতে লাগিলেন।
এদিকে দেবর্ষি নারদ এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া উতথ্যের কর্ণগোচর করিলেন । উতথ্য নারদের মুখে স্বীয় পত্নীহরণসংবাদ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, নারদ! তুমি অবিলম্বে বরুণের নিকট গমন করিয়া বল যে , হে জলেশ্বর, তুমি কি নিমিত্ত উতথ্যের ভার্যা অপহরণ করিয়াছ? তুমি লোকপালক, লোকের ত বিলোপক নহ? ভগবান চন্দ্র উতথ্যকে কন্যা সম্প্রদান করিয়াছেন; তুমি কেন সেই কন্যা অপহরণ করিলে? বরুণ তাহার মুখে উতথ্যের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, নারদ! তুমি আমার বাক্যানুসারে সেই মহর্ষিরে কহিও যে, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী আমার নিতান্ত প্রিয়। আমি ইহারে কদাচই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। জলাধিপতি এই কথা কহিলে মহর্ষি নারদ অচিরাৎ উতথ্যের নিকট গমন পূর্বক অপ্রফুল্লমনে তাহারে কহিলেন, তপোধন! বরুণের নিকট গমন পূর্বক তাহারে তোমার ভার্যা প্রত্যর্পণ করিতে সবিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলাম; তাহাতে সে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমারে গলহস্ত প্রদান পূর্বক বিদায় করিয়াছে। সে কিছুতেই তোমার ভার্যা তোমারে প্রদান করিবে না। অতঃপর তোমার যা কর্তব্য হয় কর । দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিবামাত্র মহর্ষি উতথ্য বরুণের প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া অচিরাৎ সলিল সমুদায় স্তম্ভন পূর্বক পান করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় নীরাধিপতি বরুণ উতথ্য কর্তৃক সলিল সমুদায় পীয়মান দেখিয়া এবং সুহৃদগণ কর্তৃক বারংবার তিরস্কৃত হইয়াও সেই সোমকন্যারে পরিত্যাগ করিলেন না।
অনন্তর মহর্ষি উতথ্য ক্রোধভরে ভূমিরে আহ্বান পূর্বক কহিলেন , ধরিত্রি! এখন তোমার সেই ছয় লক্ষ হ্রদযুক্ত স্থান কোথায়? মহর্ষি উতথ্য এইরূপ কহিবামাত্র সমুদ্র তৎক্ষণাৎ বরুণের পুর হইতে অপসৃত হইল এবং সেই স্থান উষর ক্ষেত্রের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতে লাগিল। তখন মহর্ষি উতথ্য সরস্বতীরে সম্বোধন পূর্বক কহিলেন, ভদ্রে! তুমি অবিলম্বে এই স্থান হইতে অপসৃত হইয়া মরুদেশে প্রবাহিত হও। এই স্থানটি তোমা কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া অপবিত্র হউক। স্রোতস্বতী সরস্বতী উতথ্যের এইরূপ আদেশ প্রাপ্ত হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইলেন। তখন বরুণ স্বীয় পুরী নিতান্ত জলশূণ্য দেখিয়া ভীতচিত্তে সেই সোমকন্যারে গ্রহণ পূর্বক উতথ্যকে প্রদান করিয়া তাহার শরণাপন্ন হইলেন। মহর্ষি উতথ্য ভার্যারে পুনরায় প্রাপ্ত হইয়া প্রসন্নভাব ধারণ পূর্বক সমুদায় জগতকে জলকষ্ট হইতে ও বরুণকে এই বিপদজাল হইতে নির্মুক্ত করিয়া দিলেন। অনন্তর তিনি বরুণকে সম্বোধন পূর্বক কহিলেন, জলাধিরাজ! এই আমি স্বীয় তপোবলে তোমারে নিতান্ত বিষন্ন করিয়া স্বীয় ভার্যা প্রত্যাহরণ করিলাম। অতঃপর আর তোমার ইহার নিমিত্ত রোদন করা বৃথা। মহর্ষি উতথ্য এই বলিয়া তথা হইতে আপনার আবাসে প্রস্থান করিলেন। হে মহারাজ, মহর্ষি উতথ্যের এইরূপ প্রভাব ছিল । এক্ষণে বল দেখি, কোন ক্ষত্রিয় তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ? ”
(কালিপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক অনূদিত মহাভারত/ অনুশাসন পর্ব/ ১৫৪ অধ্যায়)
সূর্য
ঘটনাটি কুন্তির বিবাহের আগের। কুন্তির সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা মুনি কুন্তিকে একটি মন্ত্র দিয়েছিলেন, যে মন্ত্রবলে দেবতাদের সঙ্গমের জন্য ডাকা যেত। মন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য কুন্তি মন্ত্রবলে সূর্যকে ডাকেন। সূর্যও সত্যি সত্যি মানুষের রূপ ধরে কুন্তির সামনে এসে উপস্থিত হন। অবিবাহিতা কুন্তি সূর্যকে দেখে ভয় পেয়ে যান এবং তাকে ফিরে যেতে বলেন। সূর্য ফিরে যেতে সম্মত হন না বরং কুন্তিকে অভিশাপের ভয় দেখিয়ে তার সাথে সহবাস করেন।
ভয় দেখিয়ে নারী সহবাসকে ধর্ষণ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
দেবী ভাগবত পুরাণ হতে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দেওয়া হচ্ছেঃ
” সূত কহিলেন, ঋষিগণ! শূরসেন কন্যা কুন্তীর বাল্যাবস্থায় কুন্তিভোজ রাজা তাহাকে নিজ কন্যা করিবার মানসে প্রার্থনা করেন। ১৩ অনন্তর কুন্তীরাজ, সেই চারুহাসিনী কন্যাকে নিজ কন্যারূপে লালন পালন করেন । পরে কুন্তীর কিঞ্চিৎ বোধের উদয় হইলে তাহাকে অগ্নিহোত্রীয় বহ্নির পরিচর্যার জন্য নিয়োজিত করিলেন। ১৪ পরে এক দিবস চাতুর্মাস্য ব্রতাবলম্বী দুর্বাসা ঋষি সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হন, কুন্তী তাহার সেবা করিলে পর তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে একটি মন্ত্র প্রদান করেন। এই মন্ত্র পাঠ করিয়া যেকোনো দেবতাকে আহ্বান করিলে তিনি সমাগত হইয়া আহ্বানকারীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকেন। ১৫-১৬ অনন্তর, দুর্বাসা গমন করিলে সেই গৃহস্থিতা কুন্তী মন্ত্রের পরীক্ষার্থ কোন দেবকে আহ্বান করি ইহা চিন্তা করিতে লাগিলেন। ১৭ এই সময় দিবাকর সূর্যকে উদিত দেখিয়া কুন্তী সেই মন্ত্র পাঠ করিয়া তাহাকে আহ্বান করিলেন। ১৮ সূর্যদেব মন্ত্রপ্রভাবে নিজ মন্ডল হইতে অতিসুন্দর মানুষ মূর্তি ধারণ করিয়া আকাশ মার্গ হইতে সেই গৃহে কুন্তীর সম্মুখে অবতরণ করিলেন। ১৯ চারুলোচনা কুন্তী সূর্যদেবকে সমাগত দেখিয়া অতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তৎক্ষণাৎ রজঃস্বলা হইয়া পড়িলেন এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিলেন, দেব ! আপনার দর্শনেই আমি কৃতার্থ হইয়াছি এক্ষণে নিজ মণ্ডলে গমন করুন। ২০-২১
এই কথা শ্রবণ করিয়া সূর্য কহিলেন, কুন্তী! তুমি মন্ত্রবলে কিজন্য আমাকে আহ্বান করিলে এবং আহ্বান করিয়া কিজন্যই বা সম্মুখাগত আমাকে ভজনা করিতেছ না। হে চারুলোচনে, আমি এক্ষণে কামার্ত হইয়াছি , বিশেষত তোমার প্রতি আমার প্রেমাসক্তি হইয়াছে , অতএব আমাকে ভজনা কর। আমি মন্ত্রবলে তোমার অধীন হইয়াছি , অতএব রতিক্রিড়ার জন্য আমাকে গ্রহণ কর। ২২-২৩
সূর্যদেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া কুন্তী কহিল , হে ধর্মজ্ঞ! আপনিই সকলেই সাক্ষীস্বরূপ। এক্ষণে আমি ত কন্যা, আপনাকে নমস্কার করি। হে সুব্রত! আমাকে কুলকন্যা বলিয়া জানিবেন , অতএব কোনোরূপ দুর্বাক্য বলিবেন না । ২৪
সূর্যদেব ইহা শুনিয়া বলিলেন ,কুন্তী! যদি আমি অদ্য বৃথা ফিরিয়া যাই তাহা হইলে সমস্ত দেবগণের নিকট নিন্দাভাজন হইব এবং ইহা আমার অতিশয় লজ্জার বিষয় তাহাতে সন্দেহ নাই। কুন্তি! অদ্য তুমি যদি আমাকে ভজনা না কর তাহা হইলে তোমাকে এবং যে ব্রাহ্মণ তোমায় এই মন্ত্র প্রদান করিয়াছে তাহাকে অতি কঠোর শাপ প্রদান করিব। ২৫-২৬ (আর যদি তুমি আমায় ভজনা কর তাহা হইলে) হে বরাননে! তোমার কন্যা ধর্ম স্থির থাকিবে , কেহই এই বিষয় জানিতে পারিবে না এবং আমার সদৃশ তোমার একটি সন্তান হইবে। ২৭
দেবপতি সূর্য এই কথা বলিয়া একাগ্রচিত্তা এবং অতিলজ্জিতা কুন্তীকে উপভোগ করিয়া অভিলষিত বর প্রদান করত প্রস্থান করিলেন। ২৮ অনন্তর সেই সুশ্রোণী কুন্তী গৃহে থাকিয়া গোপনে গর্ভধারণ করিতে লাগিল। ইহা কেবল তাহার প্রিয় ধাত্রী জানিত অন্য কেহ অধিক কি তাহার মাতা পর্যন্ত জানিতে পারেন নাই। ২৯ এইরূপে কিছুদিন গত হইলে অতি গোপনে সেই গৃহে একটি মনোহর পুত্র জন্মিল । পুত্রটি সুরম্য কবচ ও কুণ্ডলযুগল সুশোভিত এবং দ্বিতীয় সূর্য বা কার্তিকের ন্যায় তেজঃপুঞ্জে কলেবর হইল। ৩০-৩১ তদ্দর্শনে কুন্তী অতিশয় লজ্জিতা হইলে ধাত্রী তাহার হস্ত ধরিয়া বলিল , সুন্দরি! যখন আমি রহিয়াছি তখন তোমার চিন্তা কি? ৩২ পরে সন্তানটিকে পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছুক হইয়া মঞ্জূষামধ্যে তাহাকে রক্ষা করত কুন্তী বলিল , পুত্র! আমি দুঃখিতা হইলেও প্রাণবল্লভস্বরূপ তোমাকে পরিত্যাগ করিতেছি, কি করি এক্ষণে আমি এমনই মন্দভাগ্য হইয়াছি যে সর্বলক্ষণান্বিত তোমাকে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছি। ৩৩ পুত্র, আশীর্বাদ করিতেছি ; সেই গুণাতীতা ও গুণময়ী সর্বেশ্বরী বিশ্বজননী কাত্যায়নী অম্বিকা আমার অভিলাষ পূর্ণ করিবার জন্য তোমাকে স্তন দুগ্ধ প্রদান করিয়া রক্ষা করুন।হায়! আমি এক্ষণে দুষ্টা স্বৈরিনীর ন্যায় রবির পুত্র তোমাকে নির্জন বনে পরিত্যাগ করিয়া কবে আবার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় এই সুললিত মুখপদ্ম দর্শন করিব। ৩৪ পুত্র! নিশ্চয়ই আমি পূর্বজন্মে ত্রিজগতের মাতা জগদম্বিকার আরাধনা করি নাই ; সেই জন্যই আমি ভাগ্যহীনা হইয়াছি সন্দেহ নাই। প্রিয় পুত্র এক্ষণে তোমাকে বনে পরিত্যাগ করিয়া বুদ্ধিপূর্বক নিজকৃত এই পাতক স্মরণ করিয়া নিরন্তর সন্তাপে দগ্ধ হইব সন্দেহ নাই। ৩৫
( শ্রীমদ্ দেবী ভাগবতম্ পুরাণ/ দ্বিতীয় স্কন্ধ / ষষ্ঠ অধ্যায় ; হরিচরণ বসু কর্তৃক সম্পাদিত; শব্দকল্পদ্রুম কার্যালয় )
ইন্দ্র
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অহল্যা নামের এক অপরূপা নারীকে সৃষ্টি করেছিলেন। ‘অহল্যা’ শব্দের অর্থ হল ‘অনিন্দনীয়া’। ‘যার মধ্যে কোনো বিরূপতা নেই তিনিই অহল্যা’। এই জন্যেই ব্রহ্মা নারীটির ‘অহল্যা’ নামকরণ করেন। ‘অহল্যা কার পত্নী হবেন- এই নিয়ে স্রষ্টা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। দেবতাদের রাজা হওয়ার কারণে ইন্দ্র ভাবলেন, অহল্যা তারই পত্নী হবেন কিন্তু ব্রহ্মা অহল্যাকে গৌতম মুনির কাছে গচ্ছিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বহুকাল পরে গৌতম অহল্যাকে পুনরায় ব্রহ্মার কাছে ফিরিয়ে দেন। গৌতমের সংযম দেখে ব্রহ্মা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং অহল্যাকে তার স্ত্রী করে দেন। অহল্যাকে গৌতমের স্ত্রী হতে দেখে দেবতারা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এতে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র ভীষণ রেগে যান এবং গৌতমের আশ্রমে উপস্থিত হয়ে ক্রুদ্ধ ইন্দ্র অহল্যাকে দেখতে পান।
এর পর একই ঘটনার দুই ধরণের বিবরণ বাল্মীকির রামায়ণে পাওয়া যায়। একটি অনুসারে ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন। অপরটি অনুসারে অহল্যা ইন্দ্রের সাথে ব্যভিচারে রত হয়েছিলেন।
ব্রহ্মা ইন্দ্রকে তার অহল্যা ধর্ষণ এর কথা মনে করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছেন, “তুমি কামপরতন্ত্র; অতএব কোপবশত তখন সেই (গৌতম) মুনির আশ্রমে যাইয়া জ্বলন্ত অনলের ন্যায় প্রদীপ্তা সেই স্ত্রীকে দেখিলে । ইন্দ্র তুমি কামপীড়িত হইয়া অহল্যাকে বলাৎকার করিলে”
অহল্যাকে ধর্ষণ করে পালানোর সময় ইন্দ্র গৌতমের কাছে ধরা পড়ে যান।ক্রুদ্ধ গৌতম ইন্দ্রকে দেখতে পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন, “ ইন্দ্র! তুমি নির্ভয় চিত্তে আমার পত্নীকে বলাৎকার করেছ। সুতরাং দেবরাজ ,তুমি যুদ্ধে শত্রুর হস্তগত হবে। দেবেন্দ্র! এইজন্যই তোমার দশা পরিবর্তন ঘটেছে। তুমি ইহলোকে যে ভাব প্রবর্তিত করলে, তোমার দোষে মনুষ্যলোকেও এই জারভাব প্রবর্তিত হবে, পাপের অর্ধেক অংশ তার হবে এবং পাপের অর্ধেক অংশ তোমাকে স্পর্শ করবে; আর তোমার স্থান স্থির থাকবে না, এতে সংশয় নাই। যিনি যিনি দেবতাদের রাজা হবেন তিনি স্থির থাকবেন না”
এরপর গৌতম তার পত্নী অহল্যাকে অতীব তিরস্কার করেন। গৌতম বলেন,“ আমার আশ্রমের কাছে তুমি সৌন্দর্যহীনা হয়ে থাক। তুমি রূপবতী এবং যুবতী বলেই গর্বে অস্থির হয়েছ, বিশেষত এতদিন পর্যন্ত তুমি একাকিনীই ইহলোকে রূপবতী ছিলে, কিন্তু এখন আর তা হবে না, তোমার একত্রস্থিত রূপরাশি দেখেই ইন্দ্রের দেহবিকার জন্মেছে; সুতরাং তোমার রূপ প্রজামাত্রেই পাবে, সন্দেহ নাই।“
এই কথা শুনে অহল্যা বলেন,“বিপ্রশ্রেষ্ঠ! স্বর্গবাসী ইন্দ্র তোমার রূপ ধরে অজ্ঞানবশত আমাকে বলাৎকার করেছে, বিশেষত আমার কামাচারবশত এটা সংঘটিত হয়নি”
(বাল্মীকি রামায়ণ/ উত্তর কাণ্ড/ ৩৫ সর্গ; পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত; বেণীমাধব শীল’স লাইব্রেরী)
বিষ্ণু
পুরাণ অনুযায়ী,শঙ্খচূড় বরপ্রাপ্ত ছিল, যতক্ষণ অবধি তার পত্নী তুলসীর (তথাকথিত) সতীত্ব বজায় থাকবে, ততক্ষণ শঙ্খচূড় যুদ্ধে অপরাজেয় থাকবে। সুতরাং শঙ্খচূড়কে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য ভগবান বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের রূপ ধরে শঙ্খচূড়ের পত্নী তুলসীকে ধর্ষণ করেন। তুলসীকে ধর্ষণ করার পর শঙ্খচূড়কে সহজেই হত্যা করা হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ভগবান বিষ্ণুর ধর্ষণ লীলা বর্ণিত হয়েছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডের ২০ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ” অনন্তর ভগবান হরি মায়াবলে শঙ্খচূড়রূপে তুলসীর নিকটে গমন পূর্বক তাহার সতীত্ব অপহরণ করিলেন।”
প্রকৃতি খণ্ডের ২১ তম অধ্যায়ে বিষ্ণুর তুলসীকে ধর্ষণ করার কাহিনীর বিস্তারিত উল্লেখ আছে-
“নারদ কহিলেন, ভগবান! নারায়ণ তুলসীর গর্ভে কি প্রকারে বীর্যাধান করিলেন, তাহা আমার নিকটে বর্ণন করুন। নারায়ণ কহিলেন, ভগবন হরি দেবগণের কার্য সাধন নিমিত্ত শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করিয়া তুলসীর সহিত বিহার করিয়াছিলেন। ভগবান বিষ্ণু মায়ায় শঙ্খচূড়ের কবচ গ্রহণ পূর্বক তাহার রূপ ধারণ করিয়া তুলসীর গৃহে গমন করিলেন। পরে তুলসীর দ্বার সন্নিকটে উপস্থিত হইয়া দুন্দুভি বাদন পূর্বক “জয় মহারাজের জয়” চরদ্বারা এইরূপ রব করিয়াই তুলসীকে প্রবোধিত করিলেন। তখন সাধ্বী তুলসী তৎশ্রবণে পরম আনন্দিত হইয়া গবাক্ষ দ্বারা পরমাদরে রাজমার্গ অবলোকন করিতে লাগিলেন। পরে ব্রাহ্মণগণকে ধন দান করিয়া মঙ্গল কার্যের অনুষ্ঠান করাইতে লাগিলেন এবং বন্দি, ভিক্ষুক ও আশীর্বাদক ব্রাহ্মণদিগকে বহুতর ধন দান করিতে লাগিলেন। অনন্তর ভগবান হরি রথ হইতে অবতরণ পূর্বক অমূল্য রত্ন নির্মিত মনোহর দেবী ভবনে গমন করিলেন। তখন তুলসী সানন্দচিত্তে সম্মুখস্থিত শান্ত মূর্তি কান্তকে অবলোকন করিয়া তাহার পাদ প্রক্ষালন পূর্বক তাহাকে প্রণাম করিলেন এবং রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন । পরে কামুকী তুলসী রমণীয় রত্নসিংহাসনে তাহাকে উপবেশন করাইয়া কর্পূরাদি সুবাসিত তাম্বুল প্রদান পূর্বক মনে মনে চিন্তা করিলেন , আজ আমার জন্ম সফল ও কার্যসকল সফল হইল; যেহেতু প্রাণেশ্বরকে রণ হইতে পুনরায় গৃহে প্রত্যাগত দেখিলাম। তখন পুলকাঞ্চিতা সকামা তুলসী ঈষৎ হাস্য সহকারে কটাক্ষপাত পূর্বক মধুর বাক্যে কান্তকে রণবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন – হে কৃপাময় প্রভো! যিনি অসংখ্য বিশ্বের সংহারকারী তাহার সহিত যুদ্ধে কি প্রকারে জয় হইল? তাহা আমার নিকটে প্রকাশ করুন। তখন শঙ্খচূড়রূপী কমলাপতি তুলসীর বাক্য শ্রবণে হাস্য করিয়া মিথ্যা বাক্য বলিতে লাগিলেন, হে কামিনী, হে কান্তে, পূর্ণ এক বৎসর কাল আমাদিগের যুদ্ধ হয় , তাহাতে সমুদায় দানবগণই বিনষ্ট হইয়াছে। স্বয়ং ব্রহ্মা সমরক্ষেত্রে আগমন করিয়া আমাদিগের উভয়ের প্রীতি সম্পাদন করেন, পরে তাহারই আজ্ঞায় দেবগণের পূর্বাধিকার প্রদান করিয়া আমি স্বভবনে উপস্থিত হইয়াছি , মহাদেবও শিবলোকে গমন করিয়াছেন ; জগতের নাথ হরি এই বলিয়া শয়ন করিলেন ; হে নারদ! পরে রমাপতি সেই রামার সহিত রমণ করিলে সাধ্বী তুলসী সুখসম্ভোগ ও আকর্ষণ ব্যতিক্রমহেতু সন্দেহান্বিত হইয়া কহিতে লাগিলেন ; হে মায়েশ! তুমি কে? বল, তুমি মায়াবলে আমাকে উপভোগ করিয়া আমার সতীত্ব নাশ করিয়াছ , অথবা যেই হও তোমাকে অভিসম্পাত করিব। ব্রহ্মন! ভগবান হরি তুলসীর বাক্য শ্রবণ করিয়া শাপভয়ে সুমনোহর স্বমূর্তি ধারণ করিলেন। তখন দেবী তুলসী সম্মুখে সেই নবীন নিরদশ্যাম দেবদেব সনাতনকে দেখিতে লাগিলেন । দেখিলেন, তাহার নয়নদ্বয় শরৎ পঙ্কজের সদৃশ মনোহর এবং বদনমণ্ডলে ঈষৎ হাস্যরেখা থাকায় প্রসন্ন; তিনি রত্নভূষণে ভূষিত ও পীতবসনে শোভিত ; তাহার লাবণ্য কোটি কন্দর্পের তুল্য। সেই কামিনী মনোহরমূর্তি হরিকে দর্শন করিবামাত্র কামবশে মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন ; পরে চেতনা লাভ করিয়া হরিকে কহিতে লাগিলেন , হে নাথ! আপনার দয়া নাই, আপনি পাষাণ হৃদয় , আপনি ছল পূর্বক ধর্ম নষ্ট করিয়া আমার স্বামীকে নিহত করিলেন। হে প্রভো! যেহেতু আপনি পাষাণ সদৃশ দয়াহীন , সেই কারণে দেব! এক্ষণে আপনি সংসারমধ্যে পাষাণরূপী হইবেন। যাহারা আপনাকে দয়াসিন্ধু বলিয়া থাকেন , তাহারা নিশ্চয় ভ্রান্ত ; বলুন দেখি কি কারণে নিরপরাধী ভক্তকে পরের জন্য বিনষ্ট করিলেন। আপনি সর্বাত্মা ও সর্বজ্ঞ হইয়া পরের দুঃখ জানিতেছেন না – এই কারণে আপনি এক জন্মে আত্মবিস্মৃত হইবেন । সেই মহাসাধ্বী তুলসী এই বলিয়া হরির চরণে পতিত হইলেন এবং শোকার্তা হইয়া অতিশয় রোদন ও বারংবার বিলাপ করিতে লাগিলেন। ”
( ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ; পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক অনুবাদিত ও সম্পাদিত; নবভারত পাবলিশার্স)
ভগবান বিষ্ণু বৃন্দা নামক এক নারীকেও ধর্ষণ করেন। স্কন্দপুরাণে ঘটনাটির উল্লেখ আছে। অসুরদের রাজা জলন্ধর ক্রুদ্ধ হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিল। জলন্ধরের পরাক্রমে দেবতারা তার বশীভূত হয়েছিল।
এরপর একসময় শিবপত্নী পার্বতীর প্রতি মোহিত হয়ে শিবের কাছ থেকে পার্বতীকে নিয়ে আসার জন্য জলন্ধর দূত প্রেরণ করে। জলন্ধরের সেই ইচ্ছা পূরণ না হলে জলন্ধর বিশাল সৈন্য নিয়ে শিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। শিবের সাথে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এক মায়ার দ্বারা শিবকে জলন্ধর বশীভূত করলে, শিবের হাত হতে সকল অস্ত্র পতিত হয়। এই সময়ে জলন্ধর কামার্ত হয়ে, শিবের রূপ ধারণ করে শিবপত্নী গৌরি যেখানে উপস্থিত ছিলেন সেখানে উপস্থিত হন। দূর থেকে পার্বতীকে দেখে জলন্ধরের বীর্য পতিত হয়। পার্বতীও শিবরূপী জলন্ধরকে চিনতে পেরে, সেখান থেকে পালিয়ে যান। জলন্ধরও শিবের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ফিরে আসেন। এরপর, পার্বতী বিষ্ণুকে স্মরণ করতে থাকেন। পার্বতীর আহ্বানে বিষ্ণু উপস্থিত হলে পার্বতী তাকে বলেন,
” হে বিষ্ণু! দৈত্য জলন্ধর আজ এক পরম অদ্ভুত কর্ম করিয়াছে; তুমি কি সেই দুর্মতি দৈত্যের ব্যবহার বিদিত নহ?” (3)
বিষ্ণু উত্তর দেন,
” হে দেবী! জলন্ধরই পথ দেখাইয়াছে, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করিব, ইহা না করিলে জলন্ধরও বধ হইবে না এবং আপনারও পাতিব্রাত্য রক্ষিত হইবে না।” (4)
“জলন্ধর যখন শিবের সাথে যুদ্ধে রত, তখন “বিষ্ণু দানবরাজপত্নী বৃন্দার পাতিব্রাত্য ভঙ্গ করিবার অভিলাষে বুদ্ধি করিলেন এবং তখনই জলন্ধরের রূপ ধারণ করিয়া, যথায় বৃন্দা অবস্থিত ছিলেন, সেই পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।” (5)
এইখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বৃন্দা হল জলন্ধরের স্ত্রী।
সেইসময়ে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা এক দুঃস্বপ্ন দেখে তার স্বামীর জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং এক ঋষির দেখা পায়। বৃন্দা সেই ঋষির কাছে জলন্ধরের অবস্থা জানতে চাইলে, মুনির আদেশে দুটি বানর জলন্ধরের মাথা ও ধর নিয়ে উপস্থিত হয়। তা দেখে বৃন্দা শোকগ্রস্ত হয়ে মূর্ছিত হয়ে ভূমিতে পতিত হয়। পরে জ্ঞান ফিরলে জলন্ধরের স্ত্রী সেই ঋষির কাছে তার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। তার অনুরোধে সেই ঋষি নিজে সেই স্থান হতে অদৃশ্য হয়ে যান এবং সাথে সাথেই বৃন্দা জীবিত জলন্ধরকে সেই স্থানে দেখতে পায়।
জলন্ধর জীবিত হয়ে, ” প্রীতিমান বৃন্দাকে আলিঙ্গন করিয়া তাহার গলদেশে চুম্বন করিল”। “অনন্তর বৃন্দাও স্বামীকে জীবিত দেখিতে পাইয়া সুখীমনে সেই কাননমধ্যে অবস্থিত হইয়া তাহার সহিত রতি করিতে লাগিল।” একদিন বৃন্দা জলন্ধররূপী বিষ্ণুকে চিনতে পারে। (6)
ক্রুদ্ধ হয়ে বৃন্দা বলে,
” হে হরে! তুমি পরদারগামিনী (অন্যের স্ত্রীকে সম্ভোগকারী), তোমার চরিত্রে ধিক!” (7)
বিষ্ণুকে তীরস্কার করে, অভিশাপ দিয়ে , আত্মহত্যা করার জন্য বৃন্দা আগুনে প্রবেশ করে। “বৃন্দাসক্তমনা (বৃন্দার প্রতি আসক্ত) বিষ্ণু তাঁহাকে বারণ করিলেও তিনি তাহা শুনিলেন না। অনন্তর হরি বারবার তাঁহাকে স্মরণ পূর্বক দগ্ধদেহ বৃন্দার ভস্ম-রজো দ্বারা শরীর আবৃত করিয়া সেই স্থানেই অবস্থিত হইলেন, সুর ও সিদ্ধগণ তাঁহাকে সান্ত্বনা দান করিলেও তিনি শান্তি লাভ করিলেন না।” (8)( স্কন্দ পুরাণ/ বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২০-২১ অধ্যায় )
ব্রহ্মা
বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায় প্রজাপতি তার শরীর থেকে এক নারীকে সৃষ্টি করে তার সাথেই মিলিত হয়েছিলেন। এই অজাচারের ফলেই নাকি মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল! কিন্তু নারীটির কাছে প্রজাপতির এই আচরণ নিন্দনীয় বলে মনে হয়েছিল, কেননা প্রজাপতির দেহ থেকেই তো তিনি সৃষ্টি হয়েছেন! তাই সেই নারীটি পলায়ণ করতে শুরু করেন। তিনি গাভী, অশ্বা, গর্দভী প্রভৃতির রূপ ধরে পলায়ন করতে থাকেন; আর প্রজাপতিও বৃষ, অশ্ব, গর্দভ প্রভৃতির রূপ ধরে তার সাথে সঙ্গম করেন। এর মাধ্যমেই নাকি এইসকল প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে! সেই নারীটি সব রকমের প্রাণীর রূপ ধারণ করেই পলায়ন করছিলেন আর প্রজাপতিও সকল প্রাণীর রূপ ধরেই তার সাথে সম্ভোগ করেছিলেন। এইভাবেই নাকি সকল প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল। (1)
পলায়নরতা নারীর সাথে তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও সহবাস করাকে ধর্ষণ ব্যতীত আর কি বলা যেতে পারে? আর প্রজাপতিকে ধর্ষক ব্যতীত আর কিই বা বলা যেতে পারে? সৃষ্টিকর্তার কি ধর্ষণ ছাড়া সৃষ্টিকার্য করার সামর্থ্য ছিল না? নাকি সেই স্রষ্টা মানবসমাজের কোনো ধর্ষকের মানসপুত্র মাত্র? মানুষ কি তার মত করেই স্রষ্টার কল্পনা করেছিল?
বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাটির আক্ষরিক বিবরণ দেওয়া হলঃ
“(কিন্তু) তিনি আনন্দ পাইলেন না; সেইজন্য কেহ একা থাকিয়া আনন্দ পায় না। তিনি দ্বিতীয় (সঙ্গী লাভ করিতে) চাহিলেন। স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গিত হইলে যে পরিমাণ হয়, তিনি ততখানিই ছিলেন। তিনি নিজের দেহকে দুইভাগে ভাগ করিলেন। এইভাবে পতি ও পত্নী হইল।এই জন্য যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন- ‘প্রত্যেকে নিজে অর্ধবিদলের মত’ ; এই জন্য শূন্য স্থান স্ত্রী দ্বারা পূর্ণ হয়। তিনি সেই পত্নীতে মিথুনভাবে উপগত হইয়াছিলেন। তাহার ফলে মানুষের উৎপত্তি হইল।“
“সেই স্ত্রী এইপ্রকার চিন্তা করিল- ‘আমাকে আপনা হইতে উৎপন্ন করিয়া ইনি কিভাবে আমাতে উপগত হইতেছেন? আমি অদৃশ্য হই।‘ সে গাভী হইল; অন্যজন (প্রজাপতি) বৃষ হইয়া তাহাতেই উপগত হইলেন; এইরূপে গরু উৎপন্ন হইল। একজন অশ্বা হইল, অপরজন অশ্ব হইলেন; একজন গর্দভী, অপরজন গর্দভ হইলেন।তিনি তাহাতে উপগত হইলেন। একজন অজা, অন্যজন অজ হইলেন। এইরূপে ছাগ ও মেষ উৎপন্ন হইল। পিপীলিকা পর্যন্ত যতপ্রকার মিথুন আছে, সেই সবই তিনি এইভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন।“
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/ ৩- ৪|হরফ প্রকাশনী)
এ ছাড়াও ভগবান ব্রহ্মার ধর্ষণের সাথে জড়িত আরেকটি কাহিনী রয়েছে। স্রষ্টা ব্রহ্মা শান্তনু নামে এক ঋষির স্ত্রীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও এতে তিনি সক্ষম হননি। এই কাহিনীটি কালিকা পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। কালিকা পুরাণ থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাটি শোনা যাক-
শান্তনু নামে এক ঋষি ছিলেন। তার অমোঘা নামে এক রূপবতী স্ত্রী ছিল। একদিন তপস্বী শান্তনু ফলমূল সংগ্রহ করার জন্য বনে গমন করেন। তখন পিতামহ ব্রহ্মা অমোঘার কাছে উপস্থিত হন। কামপীড়িত ব্রহ্মা নিজের ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসতী অমোঘাকে ধরার জন্য ছুটে যান। অমোঘা ব্রহ্মাকে ছুটে আসতে দেখে ‘না, না এমন করবেন না’ বলে তার পর্ণশালার মধ্যে ঢুকে যান। পর্ণশালায় ঢোকার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে অমোঘা ব্রহ্মাকে বলতে থাকেন, “ আমি মুনির পত্নী, স্বেছায় কখনো নিন্দনীয় কাজ করবো না, আর যদি বলাৎকার করো, তাহলে তোমাকে অভিশাপ দেব।“
অমোঘা এই কথা বলতে বলতে শান্তনু মুনির আশ্রমেই ব্রহ্মার বীর্য পতিত হয়।বীর্যপাত শেষে ব্রহ্মা তার হংসযানে করে তার আশ্রমের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
ব্রহ্মা চলে যাওয়ার পর শান্তনু মুনি তার আশ্রমে ফিরে আসেন। তিনি তার আশ্রমের বাইরে হাসের পায়ের ছাপ দেখতে পান।
তার আশ্রমে ঠিক কি ঘটেছিল, তা শান্তনু তার স্ত্রী অমোঘার কাছে জানতে চান। অমোঘা শান্তনুকে জানান-
“ একজন কমণ্ডলুধারী চার মাথাওয়ালা লোক হংসবিমানে করে এখানে এসে আমার সাথে সহবাস করতে চায়। এরপর আমি যখন পর্ণশালার ভেতর ঢুকে তাকে ভর্ৎসনা করি , তখন সে বীর্যপাত করে আমার অভিশাপের ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে যায়।“
অমোঘার বিবরণ শুনে শান্তনু বুঝতে পারেন, পিতামহ ব্রহ্মাই সেখানে এসেছিলেন। (15)
(কালিকা পুরাণ/৮২ অধ্যায়; পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ অবলম্বনে; নবভারত পাবলিশার্স)
শিব
শ্রীমদ্ভাগত পুরাণে অসুর ও দেবতাদের অমৃত আহরণের জন্য সমুদ্র মন্থনের জনপ্রিয় কাহিনীটি পাওয়া যায়। বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে অসুরদের কাছ থেকে অমৃত অপহরণ করে দেবতাদের তা প্রদান করেছিলেন। এই সময় বিষ্ণুর মোহিনী রূপ দেখে কামার্ত হয়ে শিব মোহিনীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং এ সময় শিবের বীর্যও পতিত হয়েছিল। যদিও এ কার্যকে ঠিক ধর্ষণ হয়তো বলা যায় না কিন্তু অন্যের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে শিব তার উপর বলপ্রয়োগ করেছিলেন।
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ হতে সম্পূর্ণ ঘটনাটি সকলের জন্য বর্ণনা করা হচ্ছেঃ
শিব বিষ্ণুর মোহিনী রূপ দেখতে চাইলে বিষ্ণু শিবকে বলেন, “অসুরেরা যখন অমৃতভাণ্ড অপহরণ করেছিল তখন আমি এক সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ পূর্বক তাদের মোহিত করে দেবতাদের কার্যোদ্ধার করেছিলাম। হে সুরসত্তম! যেহেতু আপনি ইচ্ছা করেছেন , তাই আমি আপনাকে কামার্ত ব্যক্তিদের অত্যন্ত আদরণীয় আমার সেই রূপ দেখাব। ” “এই কথা বলতে বলতে ভগবান শ্রীবিষ্ণু তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়েছিলেন এবং মহাদেব উমা সহ চতুর্দিকে তার চক্ষু সঞ্চালন করে তাকে খুঁজতে লাগলেন।তারপর নানাবিধ ফুল এবং অরুণবর্ণ পল্লবযুক্ত বৃক্ষশোভিত নিকটবর্তী একটি উপবনে মহাদেব এক অপূর্ব সুন্দরী রমণীকে কন্দুক নিয়ে খেলা করতে দেখলেন। তার নিতম্বদেশ উজ্জ্বল বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং মেখলা শোভিত। সেই কন্দুকের অবক্ষেপণ এবং উৎক্ষেপণ করে সেই রমণীটি যখন খেলছিলেন , তখন তার স্তনদ্বয় কম্পিত হচ্ছিল এবং তার সেই স্তনের ভারে এবং ভারী ফুলমালার ভারে মনে হচ্ছিল তার দেহের মধ্যভাগ যেন প্রতি পদক্ষেপে ভগ্ন হয়ে যাবে, এইভাবে তিনি তার প্রবালতুল্য কোমল চরণ ইতস্ততঃ সঞ্চালন করছিলেন। সেই রমণীর মুখমণ্ডল আয়ত, সুন্দর, চঞ্চল চক্ষুর দ্বারা সুশোভিত ছিল এবং তার সেই নয়নযুগল কন্দুকের উৎক্ষেপণ এবং অবক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল। দুটি অতি উজ্জ্বল কর্ণকুণ্ডল তার উজ্জ্বল গণ্ডদেশকে নীলাভ প্রতিবিম্বের দ্বারা সুশোভিত করেছিল এবং তার এলোমেলো কেশরাশি তার মুখমণ্ডলকে আরও দর্শনীয় করে তুলেছিল। সেই কন্দুক নিয়ে খেলতে খেলতে তার গায়ের শাড়ি শ্লথ হয়েছিল এবং তার কেশ স্খলিত হয়েছিল । তিনি তারা সুন্দর বাম হস্তের দ্বারা তার কেশ বন্ধনের চেষ্টা করছিলেন এবং সেই সঙ্গে তিনি তার ডান হাত দিয়ে কন্দুকে আঘাত করে সেই কন্দুকটি নিয়ে খেলা করছিলেন। এইভাবে ভগবান তার আত্মমায়ার দ্বারা সারা জগৎ বিমোহিত করেছিলেন। মহাদেব যখন সুন্দরী রমণীটিকে কন্দুক নিয়ে খেলা করতে দেখেছিলেন, তখন সেই রমণীও তার প্রতি কখনও কখনও দৃষ্টিপাত করেছিলেন এবং লজ্জায় ঈষৎ হেসেছিলেন। সেই সুন্দরী রমণীকে নিরীক্ষণ করে এবং সেই রমণীকে প্রতিনিরীক্ষণ করতে দেখে মহাদেব তার পরমা সুন্দরী পত্নী উমা এবং নিকটস্থ তার পার্ষদদের বিস্মৃত হয়েছিলেন। তার হাত থেকে কন্দুকটি যখন দূরে পতিত হল , তখন সেই রমণী তার পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন । তখন মহাদেবের সমক্ষেই বায়ু হঠাৎ কাঞ্চি সহ তার কটিদেশের সূক্ষ্ম বস্ত্র উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। মহাদেব দেখলেন, সেই রমণীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ অত্যন্ত সুন্দর , এবং সেই সুন্দরী রমণীও তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তাই সেই রমণী তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বলে মনে করে , মহাদেব তার প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়েছিলেন। সেই রমণীর সঙ্গে রমণ করার বাসনায় শিব তাঁর জ্ঞান হারিয়ে তাকে পাবার জন্য এমনই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে , ভবানীর সমক্ষেই তিনি নির্লজ্জভাবে সেই সুন্দরীর কাছে গিয়েছিলেন। সেই সুন্দরী রমণী ইতিমধ্যেই বিবসনা হয়ে পড়েছিলেন এবং তিনি যখন দেখলেন শিব তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন , তখন তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে হাসতে হাসতে বৃক্ষের অন্তরালে লুকিয়েছিলেন ; তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেননি। মহাদেবের ইন্দ্রিয় তখন অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিল। কামান্ধ হস্তী যেভাবে হস্তিনীর প্রতি ধাবিত হয় , মহাদেবও ঠিক সেইভাবে সেই সুন্দরীর প্রতি ধাবিত হয়েছিলেন। অত্যন্ত দ্রুতবেগে তাঁর পশ্চাতে ধাবিত হয়ে , মহাদেব সেই সুন্দরীর চুলের বেণী ধরে তাকে কাছে টেনে এনেছিলেন এবং অনিচ্ছুক হলেও তাকে তাঁর বাহুর দ্বারা আলিঙ্গন করেছিলেন। … হস্তির দ্বারা আলিঙ্গিত হস্তিনীর মত সেই ভগবানের যোগমায়া নির্মিতা স্থূল নিতম্বিনী সুন্দরী মহাদেবের দ্বারা আলিঙ্গিতা হয়ে , আলুলায়িত কেশে মহাদেবের বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে দ্রুতবেগে পলায়ন করলেন। মত্ত হস্তী যেমন ঋতুমতী হস্তিনীর অনুগমন করে , অমোঘবীর্য মহাদেবও তেমন সেই সুন্দরীর অনুসরণ করতে লাগলেন এবং তখন তাঁর বীর্য স্খলিত হয়েছিল। … পৃথিবীর যে যে স্থানের মহাত্মা শিবের বীর্য পতিত হয়েছিল , সেই সেই স্থান স্বর্ণ ও রৌপ্য খনিতে পরিণত হয়েছিল। মোহিনীকে অনুসরণ করতে করতে শিব নদী, সরোবর , পর্বত, বন ও উপবনে এবং যেখানে ঋষিগণ অবস্থান করতেন , সেই সমস্ত স্থানে গিয়েছিলেন। … মহাদেবের বীর্য সম্পূর্ণরূপে স্খলিত হলে তিনি দেখেছিলেন কিভাবে তিনি ভগবানের মায়ায় বশীভূত হয়েছেন। তখন তিনি সেই মোহ থেকে নিবৃত্ত হয়েছিলেন।” ( ৮/১২/১৪-৩৫ )
রাক্ষস বিবাহ
হিন্দু শাস্ত্রে আটপ্রকারের বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যথাঃ ব্রাহ্ম,দৈব,আর্য,প্রাজাপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ। (মনু ৩/২৩) এই বিবাহগুলির মধ্যে আমাদের আলোচ্য বিবাহ হল রাক্ষস বিবাহ। মনুসংহিতায় রাক্ষস বিবাহ সম্বন্ধে বলা হয়েছে,
“কন্যাপক্ষের লোকদের হত্যা করে,আহত করে কিংবা তাদের বাসস্থান আক্রমণ করে রোদনরত কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে যে বিবাহ তাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। (মনু ৩/৩৩)
এই ধরণের অপহরণ করে বিবাহকে ধর্ষণ না বলে আর কি বলা যায়? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল আগেকার হিন্দু সমাজে এই প্রকারের ধর্ষণ তুল্য বিবাহ বৈধতা পেয়েছিল। রাক্ষস বিবাহকে ক্ষত্রিয় জাতির জন্য বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল-
“… শেষ চারটি বিবাহ অর্থাৎ আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বৈধ”। (মনু ৩/২৩)
এমনকি রাক্ষস বিবাহকে ধর্মজনক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে-
- “… এই মানবশাস্ত্র মতে প্রাজাপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ – এই পাঁচ প্রকারের বিবাহের মধ্যে প্রাজাপত্য,গান্ধর্ব ও রাক্ষস- এই তিনপ্রকার বিবাহ ধর্মজনক।“ (মনু ৩/২৫)
- “ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব ও রাক্ষস বিবাহ পৃথক পৃথকভাবে অথবা মিশ্রিতভাবে যেভাবেই সম্পাদিত হোক না কেন, দুই প্রকার বিবাহই ধর্মজনক…” (মনু ৩/২৬)
শাস্ত্রে রাক্ষস বিবাহের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। ভীষ্ম তার ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশিরাজের তিন কন্যা অম্বা,অম্বিকা ও অম্বালিকাকে অপহরণ করে এনেছিলেন। (9) দুর্যোধনের সাথে কলিঙ্গ রাজ চিত্রাঙ্গদের কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য স্বয়ংবরসভা থেকে তাকে বলপূর্বক হরণ করে আনেন কর্ণ।(10)দেবকের রাজসভা থেকে দেবকীকে শিনি বলপূর্বক অধিকার করে এনেছিলেন বসুদেবের সাথে বিবাহ দেবার জন্য। (11) কৃষ্ণের মন্ত্রণায় অর্জুন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করেছিলেন। সুভদ্রাকে দেখে অর্জুনের পছন্দ হলে কৃষ্ণ অর্জুনকে সুভদ্রা লাভের পরামর্শ দেওয়ার সময় বলেন, ” হে অর্জুন! স্বয়ংবরই ক্ষত্রিয়দিগের বিধেয়, কিন্তু স্ত্রীলোকের প্রবৃত্তির কথা কিছুই বলা যায় না, সুতরাং তদ্বিষয়ে আমার সন্দেহ জন্মিতেছে। আর ধর্ম শাস্ত্রকারেরা কহেন, বিবাহোদ্দেশ্যে বলপূর্বক হরণ করাও ক্ষত্রিয়দিগের প্রশংসনীয়। অতএব স্বয়ংবরকাল উপস্থিত হইলে তুমি আমার ভগিনীকে বলপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া যাইবে। কারণ স্বয়ংবরে সে কাহার প্রতি অনুরক্ত হইবে, কে বলিতে পারে?” কৃষ্ণের পরামর্শ মত অর্জুন সুভদ্রাকে রৈবতক পর্বতে পূজা সেরে ফেরার সময় অপহরণ করেন। এ ঘটনায় সুভদ্রার পরিবার ও বংশের লোকেরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে কৃষ্ণ তাদের শান্ত করেন। কৃষ্ণ বলেন, ” … স্বয়ংবরে কন্য লাভ করা অতীব দুরূহ ব্যাপার, এই জন্য (অর্জুন) তাহাতেও সম্মত হন নাই এবং পিতামাতার অনুমতি গ্রহণপূর্বক প্রদত্তা কন্যার পাণিগ্রহণ করা তেজস্বী ক্ষত্রিয়ের প্রশংসনীয় নহে।অতএব আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, কুন্তিপুত্র ধনঞ্জয় উক্ত দোষ সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া বলপূর্বক সুভদ্রাকে হরণ করিয়াছেন…” (12)
উপনিষদের অমানবিকতা
সঙ্গমে আগ্রহহীনা নারীকে লাঠি দিয়ে প্রহার করে সঙ্গমের জন্য রাজি করানোর কথা বলা হয়েছে উপনিষদে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হচ্ছে-
“সা চেদস্মৈ ন দদ্যাৎ কামমনোমবক্রীণীয়াৎ সা চৈদস্মৈ নৈব দদ্যাৎ
কামমেনাং যষ্ট্যা পাণিনা বোপহত্যাতিক্রামেদিন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ
আদদ ইত্যযশা এব ভবতি।।
সরলার্থঃ যদি সেই স্ত্রী এই পুরুষকে কামনা না যোগায় তবে সে সেই স্ত্রীলোককে উপহারাদি দ্বারা বশীভূত করিবে। তাহাতেও যদি সে পুরুষের কামনা চরিতার্থ না করে তবে সেই স্ত্রীকে সে হাত বা লাঠি দ্বারা আঘাত করিয়া বলিবে-‘আমি ইন্দ্রিয়রূপ যশদ্বারা তোমার যশ গ্রহণ করিতেছি।‘ এই বলিয়া তাহাকে বশীভূত করিবে।ইহাতে সেই স্ত্রী যশোহীনা হইবে।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬/৪/৭ ; হরফ প্রকাশনী)
নারীর সাথে এমন ব্যবহারকারী পুরুষ আজকের যুগে ঋষি হিসাবে পূজিত হত না বরং কারাগারে তার ঠাই হত।
তথ্যসূত্র ও টীকা-
(3) স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২০/২২-৩১
(4) স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২০/২২-৩১
(5) স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১-৫
(6) স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১৯-৩১
(7) স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১৯-৩১
(8) স্কন্দ পুরাণ/বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিক মাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২১/১৯-৩১
(9) মহাভারত/আদি পর্ব/ দ্বধিকশততম (১০২) অধ্যায়
(10) ভারতে বিবাহের ইতিহাস, লেখক- অতুল সুর
(11) ভারতে বিবাহের ইতিহাস, লেখক- অতুল সুর
(12) কালিপ্রসন্নসিংহের মহাভারত/ আদিপর্ব/ ১২০-১২১ অধ্যায়
Leave a Comment