খ্রিস্টানধর্মমিস্টিসিজম, এসোটেরিসিজম, অকাল্ট, ডিমনোলজি

নস্টিসিজম (Gnosticism): এক হারানো মহাবিশ্বের উপাখ্যান

Table of Contents

ভূমিকা: এক হারানো মহাবিশ্বের উপাখ্যান

রাতের আকাশ দেখেছেন কখনো? শহর থেকে দূরে, যেখানে কৃত্রিম আলোর দূষণ নেই, সেখানে দাঁড়ালে মনে হয় যেন কেউ কালো মখমলের চাদরে মুঠো মুঠো হিরে ছড়িয়ে দিয়েছে। ওই অনন্ত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আপনার কি কখনো বুকটা কেঁপে উঠেছে? মনে হয়েছে, এই বিশাল, উদাসীন মহাবিশ্বে আমরা বড্ড একা? কিংবা হয়তো আরও অদ্ভুত কিছু মনে হয়েছে? মনে হয়েছে, এই জগৎটা, এই চেনা বাস্তবতা, আসলে একটা সুচতুর ফাঁদ? কোথাও একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে, একটা মহাজাগতিক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, আর আমরা সবাই সেই ভুলের মাশুল দিয়ে চলেছি?

যদি আপনার এমনটা মনে হয়ে থাকে, যদি কখনো মনে হয় এই চেনা পৃথিবীর আড়ালে অন্য কোনো সত্য লুকিয়ে আছে, তাহলে আপনি একা নন। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগেও একদল মানুষ ঠিক এই প্রশ্নগুলোই তুলেছিল। তারা কোনো সংগঠিত ধর্মের ছাতার তলায় ছিল না, ছিল না তাদের কোনো একক মন্দির বা মসজিদ। তারা ছিল দার্শনিক, কবি, সাধক আর বিদ্রোহী চিন্তাবিদের এক বিচিত্র সমাবেশ। তারা বলত, এই পৃথিবী কোনো মহান, করুণাময় ঈশ্বরের নিখুঁত সৃষ্টি নয়। বরং এটা একটা কারাগার। এক অযোগ্য, অহংকারী দেবতার বানানো ত্রুটিপূর্ণ এক জগৎ। আর আমরা সবাই সেই কারাগারে নির্বাসিত বন্দী। আমাদের সত্যিকারের বাড়ি এখানে নয়, অন্য কোথাও – এক আদিম, বিশুদ্ধ আলোর জগতে। সেই বাড়ি ফেরার জন্য প্রয়োজন এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান। যে জ্ঞান পেলে এই কারাগারের দেয়াল কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

এই বৈপ্লবিক, রহস্যময় ও বিপজ্জনক চিন্তাধারার নামই হলো নস্টিসিজম (Gnosticism)

‘নস্টিসিজম’ শব্দটা শুনলেই কেমন একটা গুপ্তবিদ্যার গন্ধ নাকে এসে লাগে। এর উৎস হলো গ্রিক শব্দ ‘নোসিস’ (Gnosis), যার আক্ষরিক অর্থ ‘জ্ঞান’। কিন্তু এই জ্ঞান আমাদের স্কুল-কলেজের বইপড়া জ্ঞান নয়। তথ্য বা তত্ত্বের মুখস্থ বুলিও নয়। এই জ্ঞান হলো এক গভীর, ব্যক্তিগত ও রূপান্তরকারী উপলব্ধি। এমন এক বিদ্যুতের ঝলকানি, যা আপনার ভেতরটাকে আলোকিত করে জানিয়ে দেবে – আপনি আসলে কে, কোথা থেকে এসেছেন, এই কদর্য জগতে কেন বন্দী হয়ে আছেন, এবং কোথায় আপনার সত্যিকারের মুক্তি। এটি সেই জ্ঞান যা কেবল মস্তিষ্ককে নয়, আত্মাকে নাড়া দেয়; যা তথ্য দেয় না, বরং রূপান্তর ঘটায়।

নস্টিসিজম কোনো একক, সুশৃঙ্খল ধর্ম ছিল না। বরং এটি ছিল প্রথম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে মিশর, সিরিয়া, রোম, পারস্যসহ সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর এক জটিল ও আকর্ষণীয় মোজাইক। তাদের মধ্যে হাজারো মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয়ে তারা ছিল একমত। চলুন, সেই অদ্ভুত, নিষিদ্ধ এবং প্রায় হারিয়ে যাওয়া জগতে একবার ডুব দেওয়া যাক। যে জগতের চাবি লুকিয়ে আছে আমাদেরই ভেতরে, অথচ আমরা সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তালা খুঁজে বেড়াচ্ছি।

নস্টিসিজমের শিকড়: যে ভাঙা আয়নায় জন্মাল এক বিকল্প মহাবিশ্ব

এত অদ্ভুত, এত বৈপ্লবিক একটা ধারণা – এটা কি শূন্য থেকে জন্মায়? মানুষ কি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করে বলে বসে, “এই জগৎটা আসলে একটা কারাগার, আর ঈশ্বর হলেন একজন আনাড়ি কারিগর”? না, কোনো ধারণাই আসলে শূন্যে জন্মায় না। প্রতিটি চিন্তার পেছনে থাকে আরও অনেক চিন্তার ছায়া, প্রতিটি বিদ্রোহের পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের জমে থাকা অপমান আর হতাশার ইতিহাস। নস্টিসিজমও তার ব্যতিক্রম নয়। এই জটিল, বিষণ্ণ ও কাব্যিক দর্শনটি কোনো একক ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং এটি ছিল এক বিক্ষুব্ধ সময়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এক সন্তান। এর শরীরে মিশে ছিল বহু সংস্কৃতির রক্ত, এর চিন্তায় লেগে ছিল বহু পুরোনো দর্শনের ধুলো।

নস্টিসিজমের এই জটিল ধাঁধা বুঝতে হলে আমাদের একটু সময়-ভ্রমণে (Time Travel) বের হতে হবে। আমাদের ফিরে যেতে হবে যিশুর জন্মের কয়েক শতাব্দী আগের এক পৃথিবীতে, যেখানে তরবারির ঝনঝনানি আর দর্শনের ফিসফিসানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বুঝতে হবে সেই সময়ের রাজনৈতিক হতাশা আর দার্শনিক অস্থিরতাকে, যা মানুষকে বাধ্য করেছিল পরিচিত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলতে – “না, এটা আসল জগৎ নয়। আসল জগৎ অন্য কোথাও।”

চলুন, সেই ভাঙা আয়নার টুকরোগুলোকে এক এক করে খুঁজে বের করা যাক, যেগুলো জোড়া দিয়ে নস্টিকরা তাদের বিকল্প মহাবিশ্বের ছবিটা তৈরি করেছিল। এর উৎসকে আমরা মূলত দুটি বড় ভাগে ভাগ করতে পারি – এক, সেই সময়ের টালমাটাল ইতিহাস; দুই, তারও আগে থেকে চলে আসা কিছু শক্তিশালী দার্শনিক স্রোত।

এক বিক্ষুব্ধ সময়ের গর্ভ থেকে: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

কোনো গাছের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বুঝতে হলে যেমন তার মাটি, জল-হাওয়া আর পরিবেশকে বুঝতে হয়, ঠিক তেমনি নস্টিসিজমের মতো একটি জটিল ও বিদ্রোহী চিন্তার জন্ম বুঝতে হলে তার ঐতিহাসিক পরিবেশকে বুঝতে হবে। নস্টিসিজম বেড়ে উঠেছিল এমন এক সময়ে, যখন পুরোনো বিশ্বাসগুলো ভেঙে পড়ছিল, পুরোনো দেবতারা হয় মরে যাচ্ছিলেন নাহলে মানুষের মন থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছিলেন, আর নতুন কোনো ভরসার আলোও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল না। এটি ছিল এক গভীর আধ্যাত্মিক সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগ। চারপাশের পৃথিবীটা যখন মানুষের কাছে অচেনা, অর্থহীন আর শত্রুভাবাপন্ন মনে হতে শুরু করে, ঠিক তখনই আয়নার ওপারে এক বিকল্প মহাবিশ্বের সন্ধান শুরু হয়।

আলেকজান্ডারের তলোয়ার ও সংস্কৃতির ককটেল (হেলেনিজম)

ঘটনার শুরুটা করা যায় মহামতি আলেকজান্ডার (Alexander the Great) দিয়ে, যিশুর জন্মের প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে। আলেকজান্ডার তাঁর বিশাল ম্যাসিডোনিয়ান সেনাবাহিনী নিয়ে গ্রিস থেকে বেরিয়ে ঝড়ের বেগে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী জয় করে ফেলেছিলেন – মিশর, পারস্য থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের সীমানা পর্যন্ত। তাঁর এই বিজয়ের ফলে শুধু রাজনৈতিক মানচিত্রই বদলায়নি, তার চেয়েও বড় পরিবর্তন এসেছিল মানুষের মনে আর সংস্কৃতিতে। গ্রিক ভাষা (Koine Greek), দর্শন আর বিজ্ঞান ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাচ্যের দেশগুলোতে। আবার প্রাচ্যের রহস্যময় ধর্ম, জ্যোতিষশাস্ত্র, মরমীবাদ আর পুরাণ মিশে গিয়েছিল গ্রিকদের যুক্তিবাদী চিন্তার সাথে।

এই যে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এক অদ্ভুত, উত্তাল ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক মিশ্রণ, একেই ইতিহাসবিদরা বলেন হেলেনিজম (Hellenism)। এই সময়টা ছিল অনেকটা ফিউশন খাবারের মতো। গ্রিক দর্শনের প্লেটে পরিবেশন করা হচ্ছিল মিশরীয় মরমীবাদ, পারস্যের দ্বৈতবাদ আর ইহুদি ধর্মের একেশ্বরবাদ। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার মতো শহরগুলো হয়ে উঠেছিল এই সাংস্কৃতিক লেনদেনের প্রধান কেন্দ্র, যেখানে ইহুদি পণ্ডিতরা গ্রিক দর্শনের চশমা দিয়ে তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়ছেন, আর গ্রিক দার্শনিকরা মিশরীয় দেবতাদের রহস্যময়তার মধ্যে নতুন অর্থ খুঁজছেন। এই পরিবেশে স্টোইসিজম (Stoicism) এপিকিউরিয়ানিজমের (Epicureanism) মতো দর্শনগুলো মানুষকে ব্যক্তিগত সুখ ও শান্তির পথ দেখাচ্ছিল, কিন্তু নস্টিসিজম আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিল যে ব্যক্তিগত শান্তি যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মহাজাগতিক কারাগার থেকে আত্মার চূড়ান্ত মুক্তি।

এই সাংস্কৃতিক মিশ্রণ বা সমন্বয়বাদ (Syncretism) নস্টিসিজমের জন্য সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিল। নস্টিকরা ছিল এই যুগের সত্যিকারের সন্তান। তারা প্লেটোর দর্শন, ইহুদি পুরাণ, পারস্যের দ্বৈতবাদ আর খ্রিস্টীয় ত্রাণকর্তা বা মেসিয়ার ধারণাকে অবলীলায় একসাথে মিশিয়ে তাদের নিজস্ব, অভিনব এক ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছিল, যা হেলেনিস্টিক যুগের আগে হয়তো সম্ভবই ছিল না (Jonas, 1958)।

কিন্তু এর চেয়েও গভীর এক পরিবর্তন এসেছিল। আলেকজান্ডারের আগে, একজন গ্রিকের পরিচয় ছিল তার নিজের শহর বা ‘পলিস’ (Polis) কেন্দ্রিক। সে ছিল এথেন্সের নাগরিক বা স্পার্টার নাগরিক। কিন্তু আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য এই ছোট ছোট পরিচিত জগতগুলোকে ভেঙে দিয়ে মানুষকে এক বিশাল, নাম-পরিচয়হীন ‘কসমোপলিস’ (Cosmopolis) বা বিশ্ব-নগরীর অংশ করে দিল। মানুষ হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল, সে এক বিশাল, জটিল ও উদাসীন ব্যবস্থার ক্ষুদ্র এক অংশ মাত্র। এই অনুভূতি জন্ম দিয়েছিল এক গভীর নিরাপত্তাহীনতা, একাকীত্ববিচ্ছিন্নতাবোধের। পুরোনো দেবতারা, যারা একসময় নিজেদের শহরের রক্ষাকর্তা ছিলেন, তারা যেন এই নতুন বিশাল জগতে শক্তিহীন হয়ে পড়লেন। এই আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণ করতেই জন্ম নিয়েছিল বিভিন্ন রহস্যবাদী ধর্ম (Mystery Religions) এবং দর্শন, যা মানুষকে ব্যক্তিগত মুক্তি বা পরিত্রাণের (Salvation) পথ দেখাতে চাইত। নস্টিসিজম ছিল এই ব্যক্তিগত মুক্তির সন্ধানেরই এক চরম ও বৈপ্লবিক রূপ।

রোমান ঈগল ও পরাধীনতার গ্লানি

আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য তাঁর মৃত্যুর পরেই সেনাপতিদের গৃহযুদ্ধে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এরপর মঞ্চে প্রবেশ করে নতুন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি – রোম। রোমানরা ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগরের চারপাশের সমস্ত অঞ্চল – গ্রিস, মিশর, সিরিয়া, জুডিয়া (Judea) – নিজেদের ইস্পাত-কঠিন শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে। রোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশাল, শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্মমভাবে ruthless।

রোমানরা তাদের শাসনাধীন অঞ্চলে এক ধরনের শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা প্যাক্স রোমানা (Pax Romana) বা ‘রোমান শান্তি’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই শান্তি ছিল তলোয়ারের ডগায় চাপিয়ে দেওয়া শান্তি। এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা সাধারণ মানুষের অনুভূতিটা কেমন ছিল, একবার ভাবুন তো? তাদের নিজস্ব রাজা নেই, রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই। তাদের শাসন করছে বহু দূরের এক শহর থেকে পাঠানো কোনো গভর্নর, যার কাছে স্থানীয় মানুষের আবেগ বা সংস্কৃতির কোনো মূল্য নেই। আইনকানুন সব রোমানদের, কর দিতে হয় রোমানদের, আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে টহল দিচ্ছে রোমান সেনাবাহিনী।

এই পরিস্থিতি অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে, বিশেষ করে ইহুদি, মিশরীয় বা সিরীয়দের মধ্যে এক গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) এবং ক্ষমতাহীনতার জন্ম দিয়েছিল। তাদের মনে হতো, এই পৃথিবীটা আর তাদের নিজেদের নয়। তারা এক বিদেশি, অত্যাচারী শক্তির অধীনে বাস করছে (Dodds, 1965)। রোমানদের রাষ্ট্রধর্মও ছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক। ঈশ্বরের উপাসনার চেয়েও বড় ছিল সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের শপথ। এই ব্যবস্থা মানুষের আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মেটাতে পারত না, বরং এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করত (MacMullen, 1981)।

এই রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে নস্টিকদের বিশ্ববীক্ষার এক আশ্চর্য ও গা ছমছমে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নস্টিকরা বলত, এই জড় জগৎটা এক বিদেশি, অজ্ঞ ও অত্যাচারী দেবতা (ডেমিয়ার্জ) এবং তার অনুচর বা আমলাদের (আর্কন) দ্বারা শাসিত হচ্ছে। আমাদের আত্মা এখানে বন্দী। এই ধারণাটি কি পরাধীন জুডিয়ায় বা মিশরে বাস করা একজন সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অনুভূতিরই এক মহাজাগতিক রূপায়ণ নয়? রোমান সাম্রাজ্য যদি হয় পৃথিবীর কারাগার, তাহলে সম্রাট বা তাঁর গভর্নররা কি আর্কনদের পার্থিব প্রতিভূ নন? এই অনুভূতি, যে আমরা এক শত্রুভাবাপন্ন, দূরবর্তী ও অদৃশ্য শক্তির দ্বারা শাসিত হচ্ছি, নস্টিসিজমের ‘ভিনগ্রহের ঈশ্বর’ (Alien God) এবং ‘জাগতিক কারাগার’-এর ধারণাকে সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল (Grant, 1961)।

বিধ্বস্ত মন্দির ও ইয়াহওয়ের নীরবতা (ইহুদি বিপর্যয়)

নস্টিসিজমের জন্মরহস্য বুঝতে হলে আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে তৎকালীন ইহুদি ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংকটের দিকে। কারণ নস্টিসিজম অনেকাংশেই ছিল ইহুদি ধর্মতত্ত্বের এক বিদ্রোহী ও বিকৃত সন্তান। তারা ইহুদিদের ঈশ্বর এবং ধর্মগ্রন্থকে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু তাকে এমনভাবে উল্টে দিয়েছিল যা ছিল একাধারে নিন্দনীয় ও সৃজনশীল।

যিশুর জন্মের আগের ও পরের কয়েক শতাব্দী, যা সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ড (Second Temple Period) নামে পরিচিত, সেই সময়ে ইহুদি ধর্ম কোনো একক, একরৈখিক ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে ফরীশী, সদ্দূকী, এসেনীয়, উগ্রবাদী বা জেলট (Zealots) সহ নানা ধরনের গোষ্ঠী ছিল, যাদের মধ্যে ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা ও বিশ্বাস নিয়ে তীব্র মতপার্থক্য ছিল।

  • ফরীশী (Pharisees) – ধর্মীয় বিধান ও মৌখিক ঐতিহ্যের ব্যাখ্যাকারী গোষ্ঠী।
  • সদ্দূকী (Sadducees) – পুরোহিতশ্রেণি, যারা কেবল লিখিত তোরা মানত এবং পুনরুত্থান অস্বীকার করত।
  • এসেনীয় (Essenes) – সাধক ও তপস্বী গোষ্ঠী, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পবিত্র জীবনযাপন করত (কুমরান সম্প্রদায় তাদের অংশ বলে ধারণা)।
  • উগ্রবাদী বা জেলট (Zealots) – যারা রোমান শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে বিশ্বাস করত।

এই সময়েই এক বিশেষ ধরনের সাহিত্যের উদ্ভব হয়, যাকে বলা হয় অ্যাপোক্যালিপ্টিক সাহিত্য (Apocalyptic Literature), যেমন ‘বুক অফ ইনোক’ (Book of Enoch)। এই লেখাগুলোতে এক ভয়ংকর দ্বৈতবাদী চিত্র আঁকা হয়েছিল: এই বর্তমান যুগটি পতিত ফেরেশতা, শয়তান বা দুষ্ট আত্মাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু খুব শীঘ্রই ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করবেন, দুষ্টদের বিচার করবেন এবং এক নতুন স্বর্গীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন (VanderKam, 2010)। নস্টিকরা এই জগৎ-বিদ্বেষী এবং দ্বৈতবাদী চিন্তাটিকে গ্রহণ করে, কিন্তু তারা ঈশ্বরের ভবিষ্যৎ হস্তক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করার বদলে ব্যক্তিগত, বর্তমান জ্ঞান বা ‘নোসিস’-এর উপর জোর দেয়।

এই চাপা উত্তেজনার মধ্যেই ঘটে যায় ইহুদি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ইহুদিদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান ছিল জেরুজালেমের মন্দির (The Temple in Jerusalem)। এটি ছিল শুধু একটি উপাসনালয় নয়, এটি ছিল পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রতীক, তাদের জাতীয় পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে স্বর্গের সাথে পৃথিবীর সংযোগ ঘটত। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান শাসনের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের পর রোমান সেনাপতি টাইটাস (Titus) জেরুজালেম শহর ধ্বংস করে দেন এবং সেই পবিত্র মন্দিরটিকেও মাটির সাথে মিশিয়ে দেন।

এই ঘটনাটি ছিল ইহুদি জাতির জন্য এক অভাবনীয় বিপর্যয়, এক গভীর মানসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক আঘাত (Trauma)। তাদের মনে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, তা হলো: “কেন? আমাদের ঈশ্বর ইয়াহওয়ে (Yahweh) কোথায় ছিলেন? তিনি তো সর্বশক্তিমান! কেন তিনি তাঁর নিজের ঘরকে, তাঁর সিংহাসনকে রক্ষা করলেন না? তিনি কি এতটাই দুর্বল যে রোমানদের কাছে হেরে গেলেন? নাকি তিনি এতটাই নিষ্ঠুর যে আমাদের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখেও চুপ করে রইলেন?” (Cohen, 1987)।

এই ভয়াবহ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইহুদিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চিন্তার উদ্ভব হয়। বেশিরভাগই মনে করত, এটা তাদের পাপের শাস্তি এবং ঈশ্বর একদিন তাদের ক্ষমা করে আবার সবকিছু ঠিক করে দেবেন। এই ধারাটি থেকেই রাব্বানিক ইহুদি ধর্মের (Rabbinic Judaism) জন্ম হয়। কিন্তু একদল সংখ্যালঘু মানুষ আরও ভয়ংকর, আরও র‍্যাডিকাল এক সম্ভাবনার কথা ভাবতে শুরু করে। তারা ভাবতে শুরু করে, “হয়তো যে ঈশ্বরকে আমরা এতদিন ধরে উপাসনা করে আসছি, ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই ঈর্ষাপরায়ণ, ক্রোধান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ণ ঈশ্বর, তিনি আসলে সত্যিকারের পরম ঈশ্বর নন। হয়তো তিনি একজন নিম্নস্তরের, সীমাবদ্ধ ক্ষমতার অধিকারী সত্তা, একজন কারিগর মাত্র। আর সত্যিকারের ঈশ্বর এই জগৎ ও তার হিংসা-দ্বেষ থেকে এতটাই দূরে, এতটাই ভিন্ন যে এখানকার কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না।”

এই চিন্তাটিই হলো নস্টিসিজমের একেবারে ভিত্তিপ্রস্তর। ৭০ খ্রিস্টাব্দের সেই বিধ্বস্ত মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই হয়তো ডেমিয়ার্জের ধারণাটি আরও স্পষ্ট রূপ পেতে শুরু করে। এরপর ১৩২-১৩৬ খ্রিস্টাব্দে বার কোখবা-র (Bar Kokhba) নেতৃত্বে ইহুদিরা যখন রোমানদের বিরুদ্ধে শেষবারের মতো বিদ্রোহ করে এবং সেই বিদ্রোহও যখন আরও নির্মমভাবে দমন করা হয়, তখন এই জগৎ যে পুরোপুরিভাবেই এক দুষ্ট বা অজ্ঞ শক্তির অধীন – এই নস্টিক বিশ্বাসটি অনেকের কাছেই একমাত্র যৌক্তিক ব্যাখ্যা বলে মনে হয়েছিল। এটি ছিল এক চরম হতাশার ফসল, যা প্রচলিত ধর্মতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে আর কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিল না।

চিন্তার কারিগর: যাদের কাঁধে দাঁড়িয়েছিল নস্টিকরা

ইতিহাস যদি হয় নস্টিসিজমের জমিন, তবে দর্শন হলো তার বীজ। নস্টিকরা শূন্য থেকে তাদের জটিল ও বিষণ্ণ দর্শন তৈরি করেনি। তারা ছিল তাদের সময়ের এক অসাধারণ সমনন্বয়কারী। তাদের চারপাশের বিভিন্ন দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারণা থেকে তারা উপাদান সংগ্রহ করেছিল, অনেকটা মৌমাছির মতো, যে নানা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। কিন্তু তারা সেই উপাদান দিয়ে কেবল একটি চাক তৈরি করেনি, তৈরি করেছিল সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের মধু, যার স্বাদ ছিল একই সাথে তেতো এবং মিষ্টি মেশানো – তেতো, কারণ তা জগৎকে প্রত্যাখ্যান করে; আর মিষ্টি, কারণ তা আত্মার মুক্তির আশা দেখায়। প্লেটোর চশমা ছাড়া নস্টিসিজমকে দেখাই যাবে না, পারস্যের আলো-আঁধারের গল্প ছাড়া তার নাটকীয়তা বোঝা যাবে না, আর ইহুদি পুরাণের ভাঙা টুকরোগুলো ছাড়া তার কাঠামোই দাঁড়াবে না।

প্লেটোর গুহা ও ছায়ার জগৎ

নস্টিসিজমের দার্শনিক বংশলতিকা বা ফ্যামিলি ট্রি আঁকতে গেলে তার মূল শিকড়টি যেখানে গিয়ে পৌঁছাবে, তিনি হলেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato)। নস্টিসিজমের সাথে প্লেটোর দর্শনের মিল এতটাই গভীর ও মৌলিক যে, অনেক পণ্ডিত নস্টিসিজমকে “প্লেটোনিজমের এক উগ্র, হতাশাবাদী এবং পৌরাণিক সংস্করণ” বলে অভিহিত করেন। হেলেনিস্টিক যুগে প্লেটোর দর্শন, বিশেষ করে মিডল প্লেটোনিজম (Middle Platonism) নামে পরিচিত ধারাটি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। এটি ছিল সেই যুগের বুদ্ধিবৃত্তিক জলবায়ু, আর নস্টিকরা সেই জলহাওয়াতেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিত এবং বেড়ে উঠেছিল (Dillon, 1996)। তারা প্লেটোর দার্শনিক কাঠামোটিকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তার ভেতরে ভরে দিয়েছিল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিদ্রোহী আত্মা।

দুই জগতের তত্ত্ব (Theory of Forms): সুন্দর অনুকরণ বনাম কদর্য কারাগার

প্লেটোর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তাঁর দুই জগতের তত্ত্ব। তিনি শিখিয়েছিলেন যে, আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, পরিবর্তনশীল জগৎটা (Material World) আসল জগৎ নয়। এটি হলো আসল, শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় এক জগতের (World of Forms or Ideas) অসম্পূর্ণ ছায়া বা অনুকরণ মাত্র। যেমন, আমরা পৃথিবীতে অনেক সুন্দর জিনিস দেখি, কিন্তু এই সবগুলোই হলো ‘পরম সৌন্দর্য’ (the Form of Beauty) নামক এক শাশ্বত আইডিয়ার অসম্পূর্ণ প্রকাশ।

নস্টিকরা প্লেটোর এই দুই জগতের ধারণাকে সরাসরি তাদের পুরাণের ভিত্তি বানিয়েছিল।

  • প্লেটোর জগৎ: প্লেটোর কাছে, শাশ্বত ‘আইডিয়ার জগৎ’ ছিল এক বিশুদ্ধ, বুদ্ধিগম্য জগৎ। আর আমাদের এই জড় জগৎ সেই বিশুদ্ধ জগতের এক অনুকরণ। যদিও এটি অসম্পূর্ণ, কিন্তু এটি তার উৎসের সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে। ‘টিমিয়াস’ (Timaeus) গ্রন্থে প্লেটো বলেন, এই জগৎ হলো এক “দৃশ্যমান দেবতা” (a perceptible god) এবং এটি “শ্রেষ্ঠতম সম্ভাব্য অনুকরণ” (the best possible imitation)।
  • নস্টিকদের জগৎ: নস্টিকরা এই কাঠামোটিকেই নিল, কিন্তু এর মূল্যবোধকে পুরোপুরি উল্টে দিল। প্লেটোর বিশুদ্ধ ‘আইডিয়ার জগৎ’ তাদের হাতে হয়ে গেল আলোকময়, পরিপূর্ণ জগৎ ‘প্লেরোমা’ (Pleroma)। আর আমাদের এই পরিবর্তনশীল, ত্রুটিপূর্ণ ‘ছায়ার জগৎ’ হয়ে গেল অজ্ঞ স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের বানানো কারাগার, এক কদর্য বিকৃতি। প্লেটো জগৎকে ‘অসম্পূর্ণ’ বলেছিলেন; নস্টিকরা এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তাকে ‘মন্দ’ বা ‘দুষ্ট’ বলে দাগিয়ে দিল। প্লেটোর কাছে যা ছিল সুন্দর প্রতিচ্ছবি, নস্টিকদের কাছে তা হলো এক ভাঙা, কদর্য আয়না।
দেহ যখন আত্মার কারাগার: এক প্রাচীন ধারণা

প্লেটো এবং তাঁর পূর্বসূরি পিথাগোরীয়অর্ফিক (Orphic) ধারার দার্শনিকরা মনে করতেন, আত্মা হলো শাশ্বত, অমর ও ঐশ্বরিক, কিন্তু তার পতন ঘটেছে এবং সে ‘দেহ’ (soma) নামক এক কারাগারে (sema) বন্দী হয়ে আছে। গ্রিক ভাষায় ‘soma-sema’ (body-tomb) এই শ্লেষটি তাদের দর্শনে খুব জনপ্রিয় ছিল। দেহ হলো আত্মার জন্য এক সমাধি, যা আত্মাকে তার আসল স্বর্গীয় প্রকৃতি থেকে ভুলিয়ে রাখে। দেহের কামনা-বাসনা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা – এই সবকিছুই হলো সেই কারাগারের শিকল।

এই ধারণাটি নস্টিকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তারাও মনে করত, আমাদের আসল সত্তা হলো ঐশ্বরিক আত্মা বা স্ফুলিঙ্গ (Pnetuma), যা ডেমিয়ার্জের বানানো এই দেহের কারাগারে আটকে আছে। নস্টিকদের কাছে দেহ কেবল একটি কারাগারই ছিল না, এটি ছিল অজ্ঞ স্রষ্টার ক্ষমতার প্রতীক, এক অপবিত্র বস্তু। তাই তাদের অনেকেই কঠোর তপস্যার মাধ্যমে এই দেহকে শাসন করতে বা অবজ্ঞা করতে চাইত।

গুহার রূপক (Allegory of the Cave): নস্টিক দর্শনের নিখুঁত সারাংশ

প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে বর্ণিত গুহার রূপকটি হলো সম্ভবত পশ্চিমা দর্শনের সবচেয়ে শক্তিশালী রূপক। আর এই রূপকটিই যেন নস্টিক বিশ্ববীক্ষার এক নিখুঁত চিত্র তুলে ধরে।

  • গুহার কয়েদি: প্লেটো বলেন, আমরা সবাই যেন এক অন্ধকার গুহার মধ্যে শিকল দিয়ে বাঁধা কয়েদি। জন্ম থেকেই আমরা কেবল আমাদের সামনের দেয়ালে পড়া পুতুল নাচের ছায়া দেখতে পাই এবং সেই ছায়াগুলোকেই সত্যি বলে মনে করি।
  • মুক্তি ও জাগরণ: যদি কোনো কয়েদি কোনোভাবে মুক্তি পেয়ে গুহার বাইরে গিয়ে আসল সূর্যকে এবং আসল জগতকে দেখে আসে, তবে সে বুঝতে পারে যে সে এতদিন এক গভীর বিভ্রমের মধ্যে ছিল। তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়, কিন্তু সে প্রথমবারের মতো সত্যকে দেখতে পায়।
  • ফিরে আসা: সেই মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদির দায়িত্ব হলো আবার গুহায় ফিরে গিয়ে বাকিদের জাগানোর চেষ্টা করা, যদিও তারা তাকে পাগল ভাবতে পারে বা হত্যা করতেও চাইতে পারে।

এই রূপকটি হলো নস্টিসিজমের নিখুঁত সারাংশ। সাধারণ মানুষ হলো সেই গুহার কয়েদি, যারা এই জড় জগতকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এই জগৎ হলো সেই ছায়ার খেলা। আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের সামাজিক রীতিনীতি, আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা – এই সবকিছুই হলো সেই ছায়াগুলোকে নিয়ে অর্থহীন আলোচনা। ‘নোসিস’ (Gnosis) হলো সেই জ্ঞান যা আমাদের গুহার বাইরে গিয়ে আসল আলোর উৎসকে (পরম পিতা) দেখতে সাহায্য করে। আর যে ত্রাণকর্তা বা বার্তাবাহক (Revealer) প্লেরোমা থেকে আসেন, তিনি হলেন সেই মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদির মতো, যিনি এই অন্ধকার গুহায় ফিরে এসে বাকি ঘুমন্ত আত্মাদের জাগানোর চেষ্টা করেন।

ডেমিয়ার্জ (The Demiurge): শুভ কারিগর থেকে অজ্ঞ স্রষ্টা

নস্টিকরা তাদের প্রধান খলনায়কের নামটি পর্যন্ত প্লেটোর কাছ থেকে ধার করেছিল, কিন্তু তার চরিত্রকে করেছিল পুরোপুরি বিকৃত।

  • প্লেটোর ডেমিয়ার্জ: প্লেটো তাঁর ‘টিমিয়াস’ নামক সংলাপে এক কারিগর ঈশ্বরের কথা বলেছেন, যার নাম ‘ডেমিয়ার্জ’। এই ডেমিয়ার্জ কোনো শূন্য থেকে জগৎ সৃষ্টি করে না (ex nihilo creation নয়), বরং সে আগে থেকে বিদ্যমান বিশৃঙ্খল উপাদানকে (matter) শৃঙ্খলাবদ্ধ করে এবং শাশ্বত আইডিয়ার (Forms) দিকে তাকিয়ে এই জগৎকে সর্বোত্তম রূপে রূপ দেয়। প্লেটোর ডেমিয়ার্জ ছিল একজন শুভ, বুদ্ধিমান এবং পরোপকারী কারিগর, অনেকটা একজন মহৎ স্থপতির মতো।
  • নস্টিকদের ডেমিয়ার্জ: নস্টিকরা এই চরিত্রটিকেই প্লেটোর কাছ থেকে চুরি করে। কিন্তু তারা এর চরিত্রকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। প্লেটোর শুভ কারিগর তাদের হাতে হয়ে যায় এক অজ্ঞ, অহংকারী এবং মন্দ স্রষ্টা। সে শাশ্বত আইডিয়ার দিকে তাকিয়ে জগৎ বানায় না, বরং সে প্লেরোমার এক ক্ষীণ প্রতিচ্ছবিকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। সে বুদ্ধিমান নয়, সে অজ্ঞ (সে নিজের উৎস সম্পর্কেই জানে না)। সে পরোপকারী নয়, সে ঈর্ষাপরায়ণ এবং ক্ষমতার কাঙাল। সে নিজেকেই একমাত্র ঈশ্বর বলে মনে করে (Sedley, 2007)।

নকশাটা প্লেটো তৈরি করে দিয়েছিলেন, নস্টিকরা শুধু তাতে তাদের নিজেদের যুগের হতাশা, নির্বাসনবোধ এবং বিদ্রোহের কালো রং ভরে দিয়েছে। তারা প্লেটোর আশাবাদী দর্শনকে এক ট্র্যাজিক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরাণে রূপান্তরিত করেছিল, যা ছিল তাদের নিজেদেরই বিক্ষুব্ধ আত্মার প্রতিচ্ছবি।

পারস্যের আলো-আঁধার (জরাথুস্ত্রবাদ)

যদি গ্রিক দর্শন নস্টিসিজমকে তার দার্শনিক কাঠামো এবং পরিভাষা জুগিয়ে থাকে, তবে প্রাচীন পারস্যের (বর্তমান ইরান) মরুভূমির বাতাস থেকে তার চিন্তায় ঢুকেছিল এক তীব্র, নাটকীয় এবং মহাজাগতিক দ্বৈতবাদের ধারণা। পারস্যের প্রধান এবং অন্যতম প্রাচীন ধর্ম ছিল জরাথুস্ত্রবাদ (Zoroastrianism), যা পয়গম্বর জরাথুস্ত্রের (Zoroaster বা Zarathustra) মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল (আনুমানিক ১২০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। হেলেনিস্টিক যুগে, বিশেষ করে আলেকজান্ডারের বিজয়ের পর, এই পারস্যের চিন্তাধারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সাথে গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল এবং নস্টিসিজমের মতো সমন্বয়বাদী আন্দোলনগুলোর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

আলো-আঁধারের শাশ্বত মহানাটক

জরাথুস্ত্রবাদের মূল ভিত্তি ছিল এক চরম নৈতিক ও মহাজাগতিক দ্বৈতবাদ (Dualism)। তাদের মতে, মহাবিশ্বের শুরুতে এবং তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুটি আদিম, শাশ্বত, অসৃষ্ট এবং বিপরীত শক্তি, যারা একে অপরের সাথে এক চিরন্তন সংগ্রামে লিপ্ত:

  • আহুরা মাজদা (Ahura Mazda): একদিকে আছেন আহুরা মাজদা (‘প্রজ্ঞাময় প্রভু’), যিনি হলেন প্রজ্ঞা (Wisdom), আলো (Light), জীবন (Life), সত্য (Truth) এবং শৃঙ্খলার (Order) ঈশ্বর। তিনি হলেন পরম শুভ সত্তা।
  • আংরা মাইন্যু (Angra Mainyu): অন্যদিকে আছে আংরা মাইন্যু বা আহরিমান (Ahriman), যে হলো অন্ধকার (Darkness), মিথ্যা (Lie), ধ্বংস (Destruction) এবং মৃত্যুর অশুভ শক্তি। সে হলো পরম অশুভ।

এই দুই শক্তির মধ্যে এক চিরন্তন মহাজাগতিক সংঘাত চলছে, যা ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। আর এই পৃথিবী এবং মানুষের আত্মা হলো সেই সংঘাতের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। মানুষ কোনো অসহায় দর্শক নয়, সে এই যুদ্ধের একজন সক্রিয় সৈনিক। তার প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি কথা এবং প্রতিটি কাজ হয় আহুরা মাজদার শক্তিকে বাড়ায়, নাহলে আহরিমানের শক্তিকে। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হলো স্বাধীন ইচ্ছার (free will) মাধ্যমে সচেতনভাবে সত্য ও আলোর পক্ষ বেছে নেওয়া এবং “ভালো চিন্তা, ভালো কথা ও ভালো কাজের” মাধ্যমে আহরিমানের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ইতিহাসের শেষে, এক চূড়ান্ত যুদ্ধে আহুরা মাজদা জয়ী হবেন, আহরিমান পরাজিত হবে এবং জগৎ তার আদি পবিত্রতায় ফিরে আসবে (Boyce, 1979)।

নস্টিক দ্বৈতবাদ: এক নতুন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন রূপ

নস্টিসিজমের উপর জরাথুস্ত্রবাদের এই আলো-আঁধারের লড়াইয়ের ধারণার প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। নস্টিকরাও এক ধরনের দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী ছিল – আলোর জগৎ (প্লেরোমা) বনাম অন্ধকারের জগৎ (জড় জগৎ), পরম ঈশ্বর বনাম ডেমিয়ার্জ, আত্মা (Pneuma) বনাম দেহ। এই নাটকীয়, মহাজাগতিক সংঘাতের ধারণাটি নস্টিক পুরাণকে তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তীব্রতা দান করেছে।

কিন্তু এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝা দরকার। নস্টিকরা জরাথুস্ত্রবাদের দ্বৈতবাদের কাঠামোটি গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তার ভেতরের দর্শনকে প্রায় পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল।

  • নৈতিক বনাম সত্তাতাত্ত্বিক দ্বৈতবাদ: জরাথুস্ত্রবাদের দ্বৈতবাদ ছিল মূলত নৈতিক দ্বৈতবাদ (Ethical Dualism)। সেখানে জড় জগৎ বা সৃষ্টি নিজে মন্দ নয়। আহুরা মাজদা এক শুভ জগৎ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আহরিমান সেই জগতে প্রবেশ করে তাকে কলুষিত করার চেষ্টা করে, রোগ-জরা-মৃত্যু-মিথ্যার জন্ম দেয়। মানুষের কাজ হলো এই শুভ সৃষ্টিকে রক্ষা করা, তাকে মেরামত করা এবং আলোর পক্ষে লড়াই করা।অন্যদিকে, নস্টিসিজমের দ্বৈতবাদ ছিল আরও চরম, আরও হতাশাবাদী – এক ধরনের অস্তিত্ববাদী বা সত্তাতাত্ত্বিক দ্বৈতবাদ (Ontological Dualism)। তাদের কাছে, সমস্যাটা কেবল জগতে মন্দের উপস্থিতি নয়, বরং এই জড় জগতের অস্তিত্বটাই একটা সমস্যা। জগৎটা ভালো ছিল, পরে খারাপ হয়ে গেছে – এমন নয়। এর জন্মই হয়েছে এক ভুল, এক দুর্ঘটনা বা এক অজ্ঞ, নিম্নস্তরের সত্তার হাত থেকে। তাই এটি গোড়াতেই ত্রুটিপূর্ণ, এক কারাগার। এই জগৎকে মেরামত করা বা এর পক্ষে লড়াই করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ।
  • স্রষ্টার প্রকৃতি: জরাথুস্ত্রবাদে, জগতের স্রষ্টা (আহুরা মাজদা) হলেন পরম শুভ সত্তা। নস্টিসিজমে, জগতের স্রষ্টা (ডেমিয়ার্জ) হলেন অজ্ঞ, অহংকারী এবং প্রায়শই মন্দ। এই একটি মাত্র পরিবর্তনই দুটি দর্শনের মধ্যে এক বিশাল পার্থক্য তৈরি করে দেয়। নস্টিকরা ওল্ড টেস্টামেন্টের স্রষ্টাকে এই ডেমিয়ার্জের ভূমিকায় বসিয়ে এক চরম ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

তা সত্ত্বেও, এই আলো ও অন্ধকারের মহাজাগতিক লড়াইয়ের নাটকীয় ধারণাটি, মানবাত্মাকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রবণতা এবং ইতিহাসের শেষে এক চূড়ান্ত মুক্তির আশা – এই সমস্ত উপাদান পারস্যের বাতাস থেকেই নস্টিকদের চিন্তায় প্রবেশ করেছিল। নস্টিসিজমকে তাই অনেক সময় ‘ইরানিয়ান’ বা পারস্যের প্রভাবযুক্ত দর্শন হিসেবেও দেখা হয়। বিশেষ করে ম্যানিকাইজম, যা নস্টিসিজমেরই এক বিশ্বধর্মীয় রূপ, তার মধ্যে এই পারস্যের দ্বৈতবাদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সরাসরি (Widengren, 1965)।

ইহুদি ধর্মের বিদ্রোহী সন্তান (অ্যাপোক্যালিপ্টিক ও প্রজ্ঞার সাহিত্য)

আগেই বলা হয়েছে, নস্টিসিজম ইহুদি ধর্মের সাথে এক জটিল, প্যারাডক্সিকাল ‘প্রেম ও ঘৃণার’ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। নস্টিকরা ছিল ইহুদি ধর্মগ্রন্থের (যা খ্রিস্টানদের কাছে ওল্ড টেস্টামেন্ট) সবচেয়ে মনোযোগী, কিন্তু সবচেয়ে বিদ্রোহী পাঠক। তারা এই গ্রন্থগুলোকে অস্বীকার করেনি, যেমনটা করেছিল মার্সিয়ন। বরং, তারা এই গ্রন্থগুলোর গভীরে ডুব দিয়েছিল, কিন্তু এমন সব মুক্তো তুলে এনেছিল যা মূলধারার ইহুদি বা খ্রিস্টানদের কাছে ছিল ধর্মদ্রোহী। তারা ইহুদি ধর্মগ্রন্থকে তাদের নিজেদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল, অনেকটা প্রতিপক্ষের অস্ত্র ব্যবহার করে তাকেই ঘায়েল করার মতো। নস্টিসিজমের প্রায় সমস্ত পৌরাণিক কাঠামো, প্রধান চরিত্র এবং নাটকীয় সংঘাতের উৎসই হলো আদিপুস্তক বা জেনেসিসের গল্পের এক র‍্যাডিকাল পুনর্লিখন।

তারা ইহুদি ধর্মের দুটি বিশেষ ধারা থেকে প্রচুর উপাদান গ্রহণ করে সেগুলোকে তাদের নিজস্ব, অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্ববীক্ষার উপযোগী করে রূপান্তরিত করেছিল।

অ্যাপোক্যালিপ্টিক সাহিত্য (Apocalyptic Literature): এক কলুষিত জগতের উদ্ঘাটন

যিশুর জন্মের আগের ও পরের কয়েক শতাব্দীতে, বিশেষ করে ইহুদিদের উপর গ্রিক ও রোমান শাসনের নিষ্পেষণের সময়ে, তাদের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের সাহিত্যের উদ্ভব হয়, যাকে বলা হয় অ্যাপোক্যালিপ্টিক বা ‘রহস্যোদ্ঘাটনমূলক’ সাহিত্য (গ্রিক শব্দ ‘apokalypsis’ অর্থ ‘unveiling’ বা ‘revelation’)। বাইবেলের ‘বুক অফ ড্যানিয়েল’ বা বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন গ্রন্থ ‘বুক অফ ইনোক’ (Book of Enoch) বা ‘বুক অফ জুবিলিস’ (Book of Jubilees) এই ধারার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

এই লেখাগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা নস্টিসিজমের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছিল:

  • চরম দ্বৈতবাদ ও জগৎ-বিদ্বেষ: এই সাহিত্যগুলোতে এক ভয়ংকর দ্বৈতবাদী চিত্র আঁকা হয়েছিল। এই বর্তমান যুগটি (aeon) দুষ্ট শক্তি, শয়তান বা পতিত ফেরেশতাদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। জগৎটা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ঈশ্বরের আসল পরিকল্পনা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। ‘বুক অফ ইনোক’-এ যেমন বলা হয়েছে, ‘ওয়াচার’ (Watchers) নামক একদল দেবদূত পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষের সাথে মিলিত হয় এবং মানবজাতিকে অস্ত্র নির্মাণ, জাদুবিদ্যা, প্রসাধন – এইসব নিষিদ্ধ জ্ঞান শিখিয়ে কলুষিত করে, যার ফলে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও হিংসা নেমে আসে।
  • ভবিষ্যতের আশা: এই নৈরাশ্যবাদী বর্তমানের বিপরীতে, তারা এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা করত। ঈশ্বর খুব শীঘ্রই এই দুষ্ট জগতের বিচার করবেন, দুষ্ট শক্তিদের পরাজিত করবেন এবং পৃথিবীতে বা স্বর্গে এক নতুন, নিখুঁত জগৎ প্রতিষ্ঠা করবেন।
  • গুপ্ত জ্ঞান ও উদ্ঘাটন: এই ভবিষ্যৎ এবং মহাজাগতিক রহস্যের জ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছে উপলব্ধ নয়। এই জ্ঞান কিছু নির্বাচিত ব্যক্তিকে (chosen few), যেমন ইনোক বা ড্যানিয়েলকে, গোপন উদ্ঘাটন বা দর্শনের (vision) মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।

নস্টিকরা এই জগৎ-বিদ্বেষী মানসিকতা এবং গোপন জ্ঞানের ধারণাকে পুরোপুরি গ্রহণ করে, কিন্তু সেগুলোকে এক আমূল আধ্যাত্মিক বা মনস্তাত্ত্বিক রূপ দেয়।

  • অভ্যন্তরীণ শত্রু: তাদের কাছে, দুষ্ট শক্তিরা বাইরে কোথাও নেই বা কেবল পতিত ফেরেশতা নয়, তারা হলো এই জগতেরই শাসক – আর্কনরা, যারা গ্রহ-নক্ষত্রের আড়ালে বসে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। শত্রু আরও গভীরে, আমাদের দেহের ভেতরে, আমাদের মনের ভেতরে।
  • বর্তমান মুক্তি: বিচার বা মুক্তি ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে ঘটবে না, তা ঘটবে এখনই, এই মুহূর্তে, ব্যক্তিগত ‘নোসিস’ বা জ্ঞান লাভের মাধ্যমে। নস্টিকরা অ্যাপোক্যালিপ্টিকদের ‘ভবিষ্যৎ’-কে ‘বর্তমান’-এ রূপান্তরিত করেছিল।
  • ভেতরের জ্ঞান: আর সেই গোপন জ্ঞান কোনো নবীর কাছে বাইরে থেকে আসে না, তা প্রতিটি আধ্যাত্মিক ব্যক্তির (Pneumatic) আত্মার ভেতরেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ত্রাণকর্তা এসে নতুন কোনো জ্ঞান দেন না, তিনি কেবল আমাদের ভেতরের সেই পুরোনো, ভুলে যাওয়া জ্ঞানকে জাগিয়ে দেন (Cohen, 1987; Segal, 1986)।
প্রজ্ঞার সাহিত্য (Wisdom Literature): এক দেবীর পতন

নস্টিসিজমের জটিল ও নাটকীয় পুরাণের একেবারে হৃদয়ে যদি কোনো চরিত্র থাকে, তবে তিনি হলেন সোফিয়া (Sophia)। তিনি একাধারে স্বর্গীয় এবং পতিত, মা এবং ভুলের কারণ, প্রজ্ঞা এবং অজ্ঞতার উৎস। সোফিয়ার এই প্যারাডক্সিকাল চরিত্রটিই নস্টিকদের বিশ্ববীক্ষার ট্র্যাজিক সুরটিকে ধারণ করে। আর এই আকর্ষণীয় চরিত্রটিকে নস্টিকরা কোনো শূন্য থেকে তৈরি করেনি, তারা তাকে পেয়েছিল ইহুদি ধর্মগ্রন্থেরই এক বিশেষ এবং কাব্যিক ধারা – প্রজ্ঞার সাহিত্য – থেকে।

ঈশ্বরের সহযোগী: প্রজ্ঞার স্বর্গীয় রূপ: ইহুদি ধর্মগ্রন্থের অন্য একটি ধারা ছিল প্রজ্ঞার সাহিত্য (যেমন, ‘বুক অফ প্রোভার্বস’, ‘উইজডম অফ সলোমন’, ‘সিরাখ’)। এই গ্রন্থগুলোতে ‘প্রজ্ঞা’ বা হিব্রু ভাষায় ‘হকমা’ (Hokmah) এবং গ্রিক ভাষায় ‘সোফিয়াকে’ (Sophia) নিছক কোনো বিমূর্ত গুণ হিসেবে দেখা হয়নি, বরং তাকে একজন নারী রূপে, প্রায় একজন দেবী রূপে, কল্পনা করা হয়েছে।

  • ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্টি: ‘বুক অফ প্রোভার্বস’-এর অষ্টম অধ্যায়ে সোফিয়া নিজে কথা বলেন এবং নিজেকে ঈশ্বরের প্রথম ও প্রিয়তম সৃষ্টি বলে দাবি করেন, “প্রভু তাঁর পথের শুরুতে, তাঁর আদিম কাজের আগে, আমাকে সৃষ্টি করেছিলেন… যখন তিনি আকাশমণ্ডল স্থাপন করলেন, আমি সেখানে ছিলাম… আমি তাঁর পাশে একজন দক্ষ কারিগরের মতো ছিলাম; আমি প্রতিদিন তাঁর আনন্দ ছিলাম, সর্বদা তাঁর সামনে উল্লাস করতাম।” তিনি যেন ঈশ্বরেরই সৃজনী শক্তির মূর্ত রূপ, জগৎ নির্মাণে তাঁর প্রাজ্ঞ সহযোগী।
  • মধ্যস্থতাকারী সত্তা: হেলেনিস্টিক যুগে, বিশেষ করে আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদি দার্শনিক ফিলোর (Philo of Alexandria) হাতে, সোফিয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তিনি সোফিয়াকে ঈশ্বরের এবং জড় জগতের মধ্যে এক মধ্যস্থতাকারী সত্তা বা ‘লোগোস’ (Logos)-এর সমতুল্য হিসেবে দেখেন। যেহেতু পরম ঈশ্বর এতটাই ঊর্ধ্বে যে তিনি সরাসরি এই জড় জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না, তাই তিনি তাঁর প্রজ্ঞা বা লোগোসের মাধ্যমেই জগৎ সৃষ্টি করেন এবং পরিচালনা করেন।

সোফিয়ার ট্র্যাজিক রূপান্তর: প্রজ্ঞা থেকে পতনে: নস্টিকরা এই কাব্যিক, শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় ‘সোফিয়া’ চরিত্রটিকে তাদের পুরাণের একেবারে কেন্দ্রে স্থাপন করে। কিন্তু তারা এর গল্পে এক ভয়ংকর ও মর্মস্পর্শী ট্র্যাজিক মোড় নিয়ে আসে। তারা সোফিয়ার স্বর্গীয় মর্যাদাকে স্বীকার করে, কিন্তু সেই মর্যাদাকেই তার পতনের কারণ হিসেবে দেখায়।

  • আকাঙ্ক্ষার জন্ম: ভ্যালেন্টিনিয়ানদের পুরাণে, সোফিয়া হলেন প্লেরোমার ৩০ জন এইয়নের (Aeons) মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। প্লেরোমার একেবারে প্রান্তে থাকার কারণে তার মধ্যে এক তীব্র, প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ বা ‘প্যাথোস’ (pathos)-এর জন্ম হয়। সে তার উৎস, অর্থাৎ পরম পিতাকে সরাসরি জানতে চায়, যা ছিল নিয়মবিরুদ্ধ এবং অসম্ভব। এই আকাঙ্ক্ষা ছিল একাধারে জ্ঞানতৃষ্ণা এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক অহংকার।
  • একাকী সৃষ্টি ও বিপর্যয়: এই তীব্র আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে, সোফিয়া তার সঙ্গী এইয়নের সাহায্য ছাড়াই, একা একা এক সৃষ্টির চেষ্টা করে বসে। কিন্তু যেহেতু এই সৃষ্টি ছিল অসম্পূর্ণ এবং নিয়মবহির্ভূত, তাই তার গর্ভ থেকে কোনো আলোকময় সত্তা নয়, বরং এক বিকলাঙ্গ ও অজ্ঞ সত্তা – ডেমিয়ার্জ বা ইয়ালদাবাওথ – এর জন্ম হয়।
  • পতন ও নির্বাসন: নিজের এই কুৎসিত সৃষ্টিকে দেখে সোফিয়া নিজেই লজ্জিত, আতঙ্কিত ও অনুতপ্ত হয় এবং তাকে প্লেরোমার বাইরে অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। এই ভুলের কারণে সোফিয়া নিজেও প্লেরোমার পূর্ণতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সে এক অন্তর্বর্তীকালীন জগতে (the Middle region) নির্বাসিত হয়, যা প্লেরোমা এবং জড় জগতের মাঝামাঝি অবস্থিত। সে এখন এক অনুতপ্ত, ক্রন্দনরতা দেবী, যিনি তাঁর ভুলের মাশুল দিচ্ছেন।

নস্টিক পুরাণ হলো মূলত সোফিয়ার সেই ভুলের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় এবং সেই বিপর্যয় থেকে আত্মাকে (যা সোফিয়ারই পতিত অংশ বা তাঁরই আবেগ থেকে জন্ম নেওয়া সত্তা) উদ্ধার করার এক মর্মস্পর্শী কাহিনি। মানবাত্মার নির্বাসন আসলে সোফিয়ারই নির্বাসনের এক প্রতিচ্ছবি। আমরা সবাই যেন সেই স্বর্গীয় মায়েরই পতিত সন্তান, যারা এই অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেছি।

এই রূপান্তরের মাধ্যমে নস্টিকরা এক চরম ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। তারা ইহুদিদের পবিত্র প্রজ্ঞাকেই (যা ঈশ্বরের সহযোগী ছিল) এই ত্রুটিপূর্ণ জগতের সৃষ্টির কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল। এটি ছিল তাদের নিজেদের উৎসের বিরুদ্ধে, ইহুদি ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক গভীর প্যারাডক্সিকাল মনোভাবের প্রকাশ – তারা তাকে অস্বীকার করতে পারত না, কারণ তাদের সমস্ত পৌরাণিক উপাদান সেখান থেকেই নেওয়া; কিন্তু তাকে তার মূল, আশাবাদী রূপে গ্রহণও করতে পারত না, কারণ তা তাদের নিজেদের নির্বাসিত অস্তিত্বের অভিজ্ঞতার সাথে মিলত না। তাই তারা তাকে ভেঙে, উল্টে দিয়ে নিজেদের ট্র্যাজিক আত্মপরিচয়ের এক নতুন পুরাণ তৈরি করেছিল, যেখানে প্রজ্ঞার অনুসন্ধানই এক মহাজাগতিক বিপর্যয়ের জন্ম দেয় (Pearson, 2007; Birger A. Pearson collection)।

এভাবেই, প্লেটোর দর্শন, পারস্যের দ্বৈতবাদ, ইহুদিদের বিপর্যয় এবং তাদের নিজস্ব অ্যাপোক্যালিপ্টিক ও প্রজ্ঞার সাহিত্য – এই সবকিছুর মিশ্রণে এক উত্তাল ঐতিহাসিক মুহূর্তে জন্ম নিয়েছিল নস্টিসিজম। এটি ছিল একাধারে একটি দার্শনিক ব্যবস্থা, একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া এবং এক রাজনৈতিক প্রতিবাদ। এটি ছিল সেই সব মানুষের কণ্ঠস্বর, যারা প্রচলিত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “এ আমার দেশ নয়, এ আমার ঈশ্বর নয়। আমাকে আমার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে চলো।” এই আর্তি দুই হাজার বছর পরেও যেন আমাদের মনের কোনো এক গভীর কোণে প্রতিধ্বনিত হয়।

মহাবিশ্বের দুই মেরু: ভালো ঈশ্বর বনাম খারাপ ঈশ্বর

একবার ভাবুন তো, খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছেন কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছেন। কী দেখছেন? যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ভূমিকম্পে ধসে পড়া শহর, নিষ্পাপ শিশুর কান্না। আবার পরক্ষণেই হয়তো দেখছেন ভোরের সূর্যের আলোয় ফুটে থাকা এক আশ্চর্য সুন্দর গোলাপ, কোনো শিশুর নির্মল হাসি, অথবা রাতের আকাশে কোটি কোটি তারার মেলা। এই জগৎটা বড় অদ্ভুত, তাই না? এখানে যেমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য আছে, তেমনই আছে নারকীয় নিষ্ঠুরতা।

এই বিরোধাভাস বা প্যারাডক্সের দিকে তাকিয়ে মানুষের মনে হাজার হাজার বছর ধরে একটা প্রশ্নই ঘুরেফিরে এসেছে – যদি এই জগতের কোনো স্রষ্টা থাকেন, তবে তিনি কেমন? তিনি যদি পরম করুণাময় এবং সর্বশক্তিমান হন, তবে জগতে এত দুঃখ, এত কষ্ট কেন? তিনি কি এই কষ্ট দূর করতে পারেন না? যদি পারেন, কিন্তু করেন না, তবে তিনি করুণাময় নন। আর যদি তিনি কষ্ট দূর করতে চান, কিন্তু পারেন না, তবে তিনি সর্বশক্তিমান নন। এই উভয়সঙ্কট, যা দর্শনের ইতিহাসে ‘অমঙ্গলের সমস্যা’ (The Problem of Evil) নামে পরিচিত, পৃথিবীর প্রায় সব ধর্ম ও দর্শনকে ভাবিয়েছে।

বেশিরভাগ ধর্মই এর উত্তরে বলেছে, এটা মানুষের পাপের ফল, ঈশ্বরের পরীক্ষা, অথবা এর পেছনে এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে যা আমাদের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু নস্টিকরা (Gnostics) এই ধরনের কোনো সান্ত্বনাদায়ক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিল না। তারা এই উভয়সঙ্কটের দিকে তাকিয়ে এক ভয়ংকর, কিন্তু তাদের মতে একমাত্র যৌক্তিক, সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল। তারা বলেছিল, “সমস্যাটা আমাদের ব্যাখ্যায় নয়, সমস্যাটা গোড়াতেই। আমরা ভুল ঈশ্বরকে প্রশ্ন করছি।”

তাদের মতে, এই ধারণাটিই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় কারাগার – যে একজনই মাত্র ঈশ্বর আছেন, যিনি একাধারে স্রষ্টা এবং পরম করুণাময়। তাদের দর্শন অনুযায়ী, এই মহাজাগতিক নাটকের প্রধান চরিত্র একজন নন, বরং দুজন। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, বিপরীতধর্মী সত্তা, যারা একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কেও হয়তো পুরোপুরি সচেতন নয়।

১. অজানা পিতা বা পরম ঈশ্বর (The Unknown Father / The True God): এক অচেনা ঈশ্বরের বার্তা

নস্টিসিজমের বিদ্রোহের সূচনা হয় ঈশ্বরকে নিয়ে তাদের মৌলিক এবং বিষ্ময়কর ধারণা থেকে। তারা প্রচলিত ধর্মগুলোর স্রষ্টা ঈশ্বরকে কেবল অস্বীকারই করেনি, তাঁর জায়গায় এমন এক সত্তাকে স্থাপন করেছে, যিনি আমাদের ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কিত সমস্ত ধারণাকে চুরমার করে দেন। এই সত্তাই হলেন সত্যিকারের ঈশ্বর, কিন্তু তিনি আমাদের চেনা ‘ঈশ্বর’ নন। তিনি এক অজানা ঈশ্বর (Agnostos Theos), এক ভিনগ্রহের ঈশ্বর (Alien God)

তিনি এই জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এতটাই ঊর্ধ্বে যে তাঁকে বর্ণনা করার মতো কোনো ভাষা বা ধারণা আমাদের নেই। তিনি আলোকময়, অচিন্তনীয় এবং পরম পরিপূর্ণ। আমাদের ভাষা, বুদ্ধি, যুক্তি বা কল্পনা দিয়ে তাঁকে ছোঁয়া যায় না। তিনি আমাদের পরিচিত ঈশ্বরের কোনো বিশেষণই ধারণ করেন না:

  • তিনি ‘সর্বশক্তিমান’ (Omnipotent) নন, কারণ শক্তি প্রয়োগের জন্য একটি প্রতিপক্ষ বা কোনো কিছুর উপর কাজ করার প্রয়োজন হয়, যা তাঁর পরম একত্ব ও পরিপূর্ণতার সাথে মেলে না। শক্তি হলো আপেক্ষিক, তিনি হলেন পরম।
  • তিনি ‘করুণাময়’ (Merciful) নন, কারণ করুণা করার জন্য দুঃখ বা অপূর্ণতার অস্তিত্ব থাকতে হয়, যা তাঁর জগতের বাইরে। তিনি দুঃখ সৃষ্টিই করেননি, তাই তাঁর করুণা করারও প্রয়োজন নেই।
  • তিনি ‘ন্যায়বিচারক’ (Just) নন, কারণ ন্যায়বিচারের জন্য আইন এবং আইনের লঙ্ঘনকারী থাকতে হয়। তিনি কোনো আইন তৈরি করেননি।
  • তিনি আমাদের জাগতিক নৈতিকতার মানদণ্ডে ‘ভালো’ (Good)-ও নন, কারণ তিনি ভালো-মন্দের দ্বৈততার ঊর্ধ্বে। ভালো-র অস্তিত্ব মন্দের সাপেক্ষেই বোঝা যায়। তিনি হলেন সেই উৎস, যা থেকে সমস্ত মূল্যবোধের উদ্ভব হয়, কিন্তু তিনি নিজে কোনো মূল্যবোধে সীমাবদ্ধ নন।

তিনি এই জড় জগৎ (Material World) বা মানুষ কিছুই সৃষ্টি করেননি। তিনি কার্য-কারণের অতীত, ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে এক বিশুদ্ধ অস্তিত্ব। তাঁকে কোনো ইতিবাচক শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যায় না, কারণ প্রতিটি ইতিবাচক শব্দই – যেমন ‘শক্তিমান’, ‘জ্ঞানী’, ‘প্রেমময়’ – তাঁকে আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে বেঁধে ফেলে এবং তাঁকে খণ্ডিত করে। তাই তাঁর সম্পর্কে কেবল নেতিবাচকভাবে (Apophatic Theology) বলা যায় – তিনি কী ‘নন’। তিনি জগৎ নন, তিনি জগতের স্রষ্টা নন, তিনি বিচারক নন, তিনি রাজা নন (Jonas, 1958)। ভ্যালেন্টিনিয়ান নস্টিকদের একটি প্রার্থনা ছিল অনেকটা এরকম: “হে যিনি সমস্ত প্রশংসার ঊর্ধ্বে, আমরা আপনার কাছে কী প্রার্থনা করব, যা বর্ণনাতীত? আমরা আপনাকে কী দিয়ে প্রশংসা করব, যিনি অচিন্তনীয়?”

নস্টিকরা তাঁকে নানা রহস্যময় ও কাব্যিক নামে ডাকত, যা তাঁর অচিন্তনীয় প্রকৃতিকে ধারণ করার এক আশাহীন প্রচেষ্টা মাত্র:

  • ‘মোনাড’ (Monad): গ্রিক দর্শনের এই পরিভাষাটির অর্থ হলো ‘একক’, অবিভাজ্য ও পরম একত্ব, যা থেকে বাকি সবকিছু উদ্ভূত হয়েছে।
  • ‘পরম পিতা’ (The Great Father): এই নামটি তাঁর উৎপাদক প্রকৃতিকে নির্দেশ করে, যাঁর চিন্তা থেকে আলোকময় এইয়নদের (Aeons) জন্ম হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো জাগতিক পিতা নন, যিনি তাঁর সন্তানদের শাসন করেন।
  • ‘গভীরতা’ (The Deep বা Bythos): এই নামটি তাঁর অচিন্তনীয় ও অতল রহস্যের প্রতীক। তিনি হলেন সেই অসীম গভীরতা, যার কোনো তল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
  • ‘অদৃশ্য আত্মা’ (Invisible Spirit): এই নামটি তাঁর অ-জাগতিক এবং অ-দৈহিক প্রকৃতিকে তুলে ধরে।

এই ঈশ্বর আমাদের থেকে কোনো উপাসনা চান না, কোনো আনুগত্য চান না, কোনো বলিদান চান না। তিনি এতটাই পরিপূর্ণ যে তাঁর কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। তিনি কেবল আছেন, এক শাশ্বত, শান্ত ও আলোকময় অস্তিত্বে, নিজের পরিপূর্ণতায় মগ্ন। মানবজাতি বা এই মহাবিশ্বের কোনো কিছুর সাথেই তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। আমাদের একমাত্র সংযোগ হলো আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ, যা তাঁরই জগতের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ। এই ঈশ্বরকে জানা মানে কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা নয়, বরং নিজের ভেতরের সেই অচেনা সত্তাকে আবিষ্কার করা।

২. স্রষ্টা দেবতা বা ডেমিয়ার্জ (The Creator God / The Demiurge): অজ্ঞ কারিগরের কারাগার

তাহলে এই জগৎ, এই গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-নদী, পশু-পাখি, আর আমাদের এই ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কামনা-জরা-মৃত্যুর অধীন রক্ত-মাংসের শরীর – এসব কে বানাল? এখানেই নস্টিসিজম তার সবচেয়ে বৈপ্লবিক, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং সবচেয়ে ধর্মদ্রোহী বোমাটি ফাটায়। তাদের উত্তর – এই জগৎ কোনো পরম, মঙ্গলময় ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। এর স্রষ্টা হলো এক দ্বিতীয় সারির, অযোগ্য, অজ্ঞ এবং চরম অহংকারী এক দেবতা। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘ডেমিয়ার্জ’ (Demiurge)

এই গ্রিক শব্দটি তারা প্লেটোর দর্শন থেকে ধার করেছিল, যার অর্থ হলো ‘কারিগর’ (Craftsman)। কিন্তু প্লেটোর ডেমিয়ার্জ ছিল এক শুভ কারিগর, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে chaos থেকে order বা বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা তৈরি করেছিল। নস্টিকরা প্লেটোর এই ধারণাটিকে এক ভয়ংকর উল্টো মোড় দেয়। তাদের ডেমিয়ার্জই হলো ইহুদিদের ‘ইয়াহওয়ে’ (Yahweh) বা ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই ঈশ্বর, যাকে খ্রিস্টান এবং মুসলমানরাও উপাসনা করে। যে কিনা বুক ফুলিয়ে দাবি করে, “আমিই ঈশ্বর, আমি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই।” (Isaiah 45:5)। নস্টিকদের কাছে এই দাবিটিই ছিল তার অজ্ঞতা ও ঔদ্ধত্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

ওল্ড টেস্টামেন্ট যখন অভিযোগপত্র

নস্টিকরা ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ত, কিন্তু তারা পড়ত একজন প্রসিকিউটরের চোখে, যে আসামির নিজের জবানবন্দিকেই তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা দেখাত, এই ঈশ্বর নিজেই নিজের অজ্ঞতা আর নীচতার প্রমাণ রেখে গেছেন:

  • তিনি অজ্ঞ (Ignorant): তিনি আদমকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি কোথায়?” তার মানে তিনি সর্বজ্ঞ নন। তিনি জানেন না যে তাঁর ঊর্ধ্বে আরও এক আলোর জগৎ, এক পরম পিতা আছেন। ‘দি অ্যাপোক্রিফন অফ জন’-এ যেমন বলা হয়েছে, সে অন্ধকারের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এবং নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দেখেনি, তাই সে নিজেকেই একমাত্র ঈশ্বর বলে মনে করে। সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কেও পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয়, যা তার সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক।
  • তিনি ঈর্ষাপরায়ণ (Jealous): তিনি বারবার বলেন, “তোমরা অন্য কোনো দেবতার উপাসনা করবে না।” একজন সত্যিকারের পরম সত্তা, যার কোনো প্রতিপক্ষই নেই, সে কেন এত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? এই ঈর্ষা আসলে তাঁর অজ্ঞতা ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থেকেই উদ্ভূত। তিনি ভয় পান যে, তাঁর সৃষ্টি হয়তো তাঁর চেয়েও উচ্চতর কোনো সত্তার সন্ধান পেয়ে যেতে পারে।
  • তিনি ক্রোধান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ণ (Wrathful and Vengeful): তিনি সামান্য ভুলের জন্য মানুষকে ভয়ংকর শাস্তি দেন (আদম ও ইভের পতন), সমগ্র মানবজাতিকে বন্যায় ডুবিয়ে মারেন, শহরকে আগুনে পুড়িয়ে দেন (সডোম ও গোমোরা)। নস্টিকদের মতে, এগুলো কোনো পরম করুণাময় সত্তার কাজ হতে পারে না, বরং এগুলো এক খামখেয়ালি, নিষ্ঠুর স্বৈরাচারীর লক্ষণ।
  • তিনি অনুশোচনা করেন (Regretful): বাইবেলে আছে, “ঈশ্বর পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলে অনুতপ্ত হলেন।” একজন নিখুঁত সত্তা কীভাবে নিজের কাজে অনুতপ্ত হতে পারে? অনুশোচনা তো অপূর্ণতারই লক্ষণ। এটি প্রমাণ করে যে তিনি ভবিষ্যতের দ্রষ্টা নন এবং তাঁর সিদ্ধান্তগুলো ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।

এক ট্র্যাজিক খলনায়ক

এই সবকিছুর ভিত্তিতে নস্টিকরা এই স্রষ্টাকে একাধারে এক ট্র্যাজিক ও খল চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করে। সে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী (অন্তত এই জগতের নিরিখে), কিন্তু তারচেয়েও বেশি অজ্ঞ। সে নিজেকেই সর্বেসর্বা মনে করে এবং তার সৃষ্ট জগৎকেও নিখুঁত বলে ভাবে। কিন্তু আসলে, তার সৃষ্টি হলো সেই পরম আলোর জগতের এক বিকৃত ও অসম্পূর্ণ নকল। অনেকটা আনাড়ি এক শিল্পীর আঁকা মোনালিসার ক্যারিকেচারের মতো। জগৎটা তাই এত কুৎসিত, এত নিষ্ঠুর, এত দুঃখ-কষ্ট-জরা-মৃত্যুতে ভরা। কারণ স্রষ্টার মধ্যেই পরিপূর্ণতা বা আসল জ্ঞান ছিল না (Pearson, 2007)। জগৎটা তার স্রষ্টারই প্রতিচ্ছবি – অপূর্ণ, বিশৃঙ্খল এবং প্যারাডক্সিকাল।

ডেমিয়ার্জ চায় আমরা তার উপাসনা করি, তার বানানো নিয়মকানুন (যেমন, দশ আজ্ঞা) মেনে চলি। কিন্তু তার নিয়মগুলো আমাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য নয়, বরং আমাদের আরও শক্ত করে এই কারাগারে বেঁধে রাখার জন্য, আমাদের অপরাধবোধে ভোগানোর জন্য (Pagels, 1979)। সে হলো এক জেলের জেলার, যে বন্দীদের বোঝাতে চায় যে জেলখানাটাই তাদের আসল বাড়ি এবং সে-ই তাদের একমাত্র ত্রাণকর্তা।

নস্টিসিজমের এই ডেমিয়ার্জ-তত্ত্ব ‘অমঙ্গলের সমস্যা’ (Problem of Evil)-র এক র‍্যাডিকাল সমাধান দেয়। জগতে অমঙ্গল আছে, কারণ জগতের স্রষ্টাই নিখুঁত নয়। এই একটি মাত্র ধারণার মাধ্যমে নস্টিকরা প্রচলিত ধর্মের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং মানুষের বিদ্রোহকে এক মহাজাগতিক বৈধতা দিয়েছিল।

এই দ্বৈতবাদী (Dualistic) চিন্তা – অর্থাৎ ভালো ও মন্দের, আলো ও অন্ধকারের, আত্মা ও জড়ের, পরম ঈশ্বর ও স্রষ্টা দেবতার এই সুস্পষ্ট ও আপোষহীন বিভাজনই হলো নস্টিসিজমের একেবারে কেন্দ্রবিন্দু। জগৎটা ভালো নয়, কারণ এর স্রষ্টাই ভালো নয়। সহজ, কিন্তু কী ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত! এই দর্শন মানুষকে প্রচলিত সমস্ত ধর্মীয় ও সামাজিক কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করার এক শক্তিশালী হাতিয়ার জুগিয়েছিল। কারণ, যদি জগতের স্রষ্টাই অজ্ঞ হয়, তবে তার তৈরি প্রতিষ্ঠান, তার পুরোহিত, তার আইন – এই সবকিছুর বৈধতা কোথায়?

এক মহাজাগতিক দুর্ঘটনার উপাখ্যান: কীভাবে এই কারাগার তৈরি হলো?

তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, এই আনাড়ি স্রষ্টা বা ডেমিয়ার্জ এল কোথা থেকে? সত্যিকারের ভালো ঈশ্বর যদি এতই নিখুঁত, পরিপূর্ণ এবং এই জগতের বাইরে হন, তবে তাঁর জগৎ থেকে এমন এক অসম্পূর্ণ ও মন্দ সত্তার জন্ম হলো কীভাবে? ভালো থেকে মন্দ কীভাবে জন্মায়? আলো থেকে কীভাবে অন্ধকারের উদ্ভব হয়? এই প্রশ্নটি নস্টিকদের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। এর উত্তর দেওয়ার জন্য তারা কোনো শুষ্ক দার্শনিক তত্ত্ব তৈরি করেনি, বরং তৈরি করেছে এক আশ্চর্য নাটকীয়, কাব্যিক এবং বিষণ্ণ পুরাণ, যা শুনলে মনে হবে যেন কোনো গ্রিক ট্র্যাজেডি আর মহাজাগতিক কল্পবিজ্ঞানের মিশ্রণ।

এই গল্প কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে নাগ হাম্মাদিতে আবিষ্কৃত কিছু গুপ্ত পুঁথিতে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ‘দি অ্যাপোক্রিফন অফ জন’ (The Apocryphon of John) বা ‘জনের গুপ্ত পুস্তক’-এ। এখানে পুনরুত্থিত যিশু তাঁর শিষ্য জনকে এই মহাবিশ্বের গোপন ইতিহাস বর্ণনা করছেন।

প্লেরোমা: আলোর পরিপূর্ণ জগৎ

নস্টিক পুরাণের নাটকীয় ও বিষণ্ণ গল্পের শুরুটা হয় এক পরম শান্ত, শাশ্বত ও আলোকময় জগৎ থেকে, যার নাম ‘প্লেরোমা’ (Pleroma)। গ্রিক ভাষায় এই শব্দের অর্থ ‘পূর্ণতা’ (Fullness)। এটি আমাদের পরিচিত জড় জগতের সম্পূর্ণ বিপরীত। জগৎ যদি হয় কারাগার, প্লেরোমা হলো আমাদের হারানো স্বদেশ। জগৎ যদি হয় অন্ধকার ও অজ্ঞতা, প্লেরোমা হলো আলো ও পরিপূর্ণ জ্ঞান।

এই প্লেরোমা কোনো স্থান নয়, বরং এক বিশুদ্ধ চেতনার অবস্থা। এটি পরম পিতা বা অচেনা ঈশ্বরের নিজস্ব জগৎ। এখানে কোনো সময় নেই, কোনো পরিবর্তন নেই, কোনো অভাব বা অপূর্ণতা নেই। এটি এক শাশ্বত, স্থির ও বিশুদ্ধ আলোকময় অস্তিত্ব।

ঈশ্বরের পরিবার: এইয়নদের উদ্গীরণ

পরম পিতা একা ছিলেন না। তাঁর চিন্তা থেকে, কোনো পরিকল্পনা বা শ্রম ছাড়াই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে একের পর এক ঐশ্বরিক সত্তার জন্ম হতে লাগল। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘ইমানেশন’ (Emanation) বা উদ্গীরণ – অনেকটা সূর্য থেকে যেমন আলোকরশ্মি নির্গত হয়, অথবা কোনো শব্দ থেকে যেমন প্রতিধ্বনি তৈরি হয়। এই ঐশ্বরিক সত্তাদের বলা হয় ‘এইয়ন’ (Aeons), যার গ্রিক অর্থ ‘যুগ’ বা ‘অনন্তকাল’।

এইয়নরা হলো অনেকটা পরম ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ বা ধারণার মূর্ত রূপ। তারা হলো ঈশ্বরের আত্ম-চিন্তার (self-contemplation) ফসল। নস্টিকদের বিভিন্ন ধারায় এই উদ্গীরণের বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন, তবে একটি সাধারণ কাঠামো লক্ষ্য করা যায়:

  • প্রথম উদ্গীরণ: শেথীয়দের পুরাণে, পরম পিতার প্রথম উদ্গীরণ বা প্রকাশ হলেন এক নারী-রূপী ঐশ্বরিক শক্তি, যাঁর নাম বার্বেলো (Barbelo)। তিনি হলেন স্বর্গীয় মা, যাঁর গর্ভ থেকেই বাকি সবকিছু জন্মায়।
  • জোড়া বা সিজিজি (Syzygy): ভ্যালেন্টিনিয়ানদের পুরাণে, এইয়নরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় (Syzygy) উদ্ভূত হতো – পুরুষ ও নারী রূপে, একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। যেমন, প্রথম জোড়া ছিলেন ‘গভীরতা’ (Bythos) ও ‘নীরবতা’ (Sige)। তাঁদের থেকে জন্মাল ‘মন’ (Nous) ও ‘সত্য’ (Aletheia)। তারপর ‘শব্দ’ (Logos) ও ‘জীবন’ (Zoe), এবং ‘মানুষ’ (Anthropos) ও ‘মণ্ডলী’ (Ecclesia)।
  • স্বর্গীয় বংশলতিকা: এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং এক জটিল স্বর্গীয় বংশলতিকা তৈরি হয়। ভ্যালেন্টিনিয়ানদের মতে, এই এইয়নদের মোট সংখ্যা ছিল ৩০ (Ogdoad, Decad, and Dodecad)। সবাই মিলে এক সুরেলা ঐকতানের মতো পরম পিতার চারপাশে অবস্থান করত, ঠিক যেন এক ঐশ্বরিক পরিবার, যেখানে কোনো অভাব, অপূর্ণতা বা সংঘাত নেই (Layton, 1987)। প্রত্যেকেই পরম পিতাকে জানত, কিন্তু কেবল তাদের নিজেদের ক্ষমতার সীমার মধ্যে থেকেই। একমাত্র প্রথম উদ্ভূত এইয়ন ‘মোনাডই’-ই পিতাকে সরাসরি জানার অধিকারী ছিল।

প্লেরোমা হলো সেই আদি একতা এবং পরিপূর্ণতার প্রতীক, যা থেকে আমাদের ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ পতিত হয়েছে। এটি হলো সেই হারানো স্বর্গ, যেখানে ফিরে যাওয়াই নস্টিক সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি কোনো ভবিষ্যৎ পুরস্কার নয়, বরং এটি আমাদের আসল প্রকৃতি, যা আমরা ভুলে গেছি।

সোফিয়ার পতন: এক ট্র্যাজিক ভুল

প্লেরোমার সেই শান্ত, শাশ্বত ও সুরেলা ঐকতানের মধ্যেই বেজে উঠল এক বেসুরো সুর, যা থেকে জন্ম নিল এক মহাজাগতিক বিপর্যয়। আর এই ট্র্যাজেডির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন প্লেরোমার এক নারী এইয়ন – সোফিয়া।

এই স্বর্গীয় পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে নিচের স্তরের এইয়ন ছিল এক নারী সত্তা, যার নাম ‘সোফিয়া’ (Sophia)। গ্রিক ভাষায় সোফিয়ার অর্থ ‘জ্ঞান’ বা ‘প্রজ্ঞা’ (Wisdom)। অন্য সব এইয়নরা যেখানে নিজেদের সীমার মধ্যে থেকে পরম পিতাকে পরোক্ষভাবে জেনে সন্তুষ্ট ছিল, সোফিয়া সেখানে এক অসাধ্য সাধনে ব্রতী হলো। প্লেরোমার একেবারে প্রান্তে থাকার কারণে তার মধ্যে জন্ম নিল এক তীব্র, প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ বা ‘প্যাথোস’ (pathos)। সে তার উৎস, অর্থাৎ পরম পিতাকে সরাসরি, পুরোপুরি জানতে চাইল। সে অসীমকে তার সসীম চেতনা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল।

কিন্তু সেটা ছিল নিয়মবিরুদ্ধ এবং অসম্ভব। কোনো সসীম সত্তার পক্ষে অসীমকে ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সোফিয়া তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের বশবর্তী হয়ে, তার সঙ্গী এইয়নের সাহায্য ছাড়াই, একা একা এক সৃষ্টির চেষ্টা করে বসল। সে ভেবেছিল, সেও পরম পিতার মতো কোনো কিছুকে অস্তিত্বে আনতে পারবে। এটি ছিল একাধারে কৌতূহল, অহংকার এবং ভালোবাসার এক বিপজ্জনক মিশ্রণ। তার এই কাজকে নস্টিকরা এক ধরনের আধ্যাত্মিক গর্ভপাতের (spiritual abortion) সাথে তুলনা করেছে।

আর তাতেই ঘটল মহাজাগতিক বিপর্যয়। এই ঘটনাটিকে নস্টিকরা বলত ‘পতন’ (The Fall), কিন্তু এটি কোনো নৈতিক পতন (moral fall), যেমন আদম ও ইভের ‘পাপ’, ছিল না। এটি ছিল এক জ্ঞানতাত্ত্বিক (Epistemological) এবং সত্তাতাত্ত্বিক (Ontological) ভুল – নিজের সীমা ভুলে যাওয়ার ভুল।

যেহেতু এই সৃষ্টি ছিল অসম্পূর্ণ, আবেগতাড়িত এবং নিয়মবহির্ভূত, তাই সোফিয়ার গর্ভ থেকে জন্ম নিল কোনো আলোকময় সত্তা নয়, বরং এক বিকলাঙ্গ, কদাকার, বিশৃঙ্খল ও অজ্ঞ সত্তা। কোনো কোনো পুঁথি অনুযায়ী, তার চেহারা ছিল সাপের মতো, আর মুখটা ছিল সিংহের মতো – যা পাশবিক শক্তি ও অন্ধ কামনার প্রতীক। সেই হলো আমাদের এই জগতের স্রষ্টা, ডেমিয়ার্জ। তার বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে, যা তার প্রকৃতিকে তুলে ধরে: ‘ইয়ালদাবাওথ’ (Yaldabaoth), যার আরামাইক অর্থ হতে পারে ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সন্তান’ (Son of Chaos); আরেক নাম ‘সাকলাস’ (Saklas), অর্থাৎ ‘বোকা’ (The Fool); এবং ‘সামায়েল’ (Samael), অর্থাৎ ‘অন্ধ ঈশ্বর’।

নিজের এই কুৎসিত, অপূর্ণ সৃষ্টিকে দেখে সোফিয়া নিজেই লজ্জিত, আতঙ্কিত ও অনুতপ্ত হলো। সে প্লেরোমার অন্য এইয়নদের থেকে তাকে লুকাতে চাইল। তাই সে তাকে প্লেরোমার আলোর জগৎ থেকে অনেক দূরে, নিচের অন্ধকারের এক মেঘ বা আবরণের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল (Rudolph, 1987)।

সোফিয়া নিজেও তার এই ভুলের কারণে প্লেরোমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সে এক অন্তর্বর্তীকালীন জগতে (the Middle region) নির্বাসিত হলো, যা প্লেরোমা এবং জড় জগতের মাঝামাঝি অবস্থিত। সে এখন এক অনুতপ্ত, ক্রন্দনরতা দেবী। ‘পিস্তিস সোফিয়া’ (Pistis Sophia) নামক এক দীর্ঘ নস্টিক গ্রন্থে তার এই অনুশোচনা, কান্না এবং উদ্ধারের জন্য আকুতির এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তার দুঃখ, অনুশোচনা, কান্না, ভয় এবং অজ্ঞতাই এই জড় জগতের মানসিক ও আবেগপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠল। জগৎটা যেন তার অশ্রুজল দিয়েই তৈরি। এই পতনের মাধ্যমেই সোফিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান – এক উচ্চতর সোফিয়া, যিনি প্লেরোমার সীমানায় থেকে যান, এবং এক নিম্নতর সোফিয়া বা ‘আখামোথ’ (Achamoth), যিনি এই বিশৃঙ্খল জগতে পতিত হন এবং মুক্তির জন্য আকুতি জানাতে থাকেন।

অজ্ঞ স্রষ্টা ও তার কারাগার

সোফিয়ার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে, সেই একাকীত্ব আর অন্ধকারের মধ্যেই ডেমিয়ার্জ বড় হতে লাগল। সে তার মা সোফিয়া বা তার উপরের আলোর জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানত না। সে কেবল তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া এক চিলতে ঐশ্বরিক শক্তিকেই নিজের একমাত্র সম্বল এবং নিজের শক্তি বলে মনে করতে লাগল। সে যখন চোখ মেলে তাকাল, তখন নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেল না। তাই সে এক ভয়ংকর অহংকারী এবং ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাল: “আমিই একমাত্র ঈশ্বর, আমি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই।” এই কথাটি ছিল ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরেরই প্রতিধ্বনি, যা নস্টিকদের কাছে ছিল তার চূড়ান্ত অজ্ঞতার প্রমাণ।

তারপর, তার মা সোফিয়ার কাছ থেকে চুরি করা বা অজান্তে পাওয়া শক্তি ব্যবহার করে সে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করল। সে প্লেরোমার জগতের এক অসম্পূর্ণ ও বিকৃত অনুকরণ তৈরি করার চেষ্টা করল। সেটাই হলো আমাদের এই জড় জগৎ (Material World)। কিন্তু যেহেতু তার মধ্যে কোনো আসল সৃজনী প্রতিভা বা প্রজ্ঞা ছিল না, তাই তার সৃষ্টিও হলো ত্রুটিপূর্ণ, বিশৃঙ্খল এবং প্যারাডক্সিকাল।

সে তার কাজে সাহায্য করার জন্য আরও কিছু সত্তা তৈরি করল, যাদের বলা হয় ‘আর্কন’ (Archons) বা ‘শাসক’। এই আর্কনরা হলো অনেকটা তার আমলা বা মন্ত্রীদের মতো। প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, পৃথিবী সাতটি গ্রহের গোলকের (Sphere) দ্বারা বেষ্টিত – চাঁদ, বুধ, শুক্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি। নস্টিকদের মতে, প্রতিটি গোলকের দায়িত্বে আছে একজন করে আর্কন।

এই আর্কনরাই হলো এই মহাবিশ্বের জেলার। তারাই এই জড় জগতের নিয়মকানুন তৈরি করে এবং তা পরিচালনা করে। তাদের কাজ হলো:

  • আত্মাকে বন্দী করা: তারা আত্মাদের পৃথিবীতে বন্দী করে রাখে।
  • নিয়তি নিয়ন্ত্রণ: তারা মানুষের ভাগ্য বা নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই পুরো যান্ত্রিক, অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘হেইমারমেনে’ (Heimarmene) – এক অলঙ্ঘনীয় ভাগ্যচক্র যা মানুষকে তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক অদৃশ্য জালে বন্দী করে রাখে (Filoramo, 1990)।
  • মুক্তিতে বাধা: মৃত্যুর পর যখন আত্মা ঊর্ধ্বলোকে, প্লেরোমার দিকে যাত্রা করার চেষ্টা করে, তখন প্রতিটি গোলকের ফটকে সেই আর্কন তাকে বাধা দেয় এবং তার পরিচয় জানতে চায়। কেবল যে আত্মা গোপন জ্ঞান বা ‘নোসিস’ লাভ করেছে, সে-ই সঠিক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এই আর্কনদের বাধা অতিক্রম করতে পারে।
  • মানসিক নিয়ন্ত্রণ: তারাই মানুষের মনে ভয়, কামনা-বাসনা, ঈর্ষা এবং অজ্ঞতা ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে সে কখনোই তার আসল পরিচয় জানতে না পারে এবং ঊর্ধ্বের জগতের দিকে তাকাতে না পারে।

এভাবেই নস্টিকদের পুরাণ ‘অমঙ্গলের সমস্যা’ (Problem of Evil)-র এক চমকপ্রদ এবং র‍্যাডিকাল সমাধান দেয়। এই জগৎ মন্দ বা ত্রুটিপূর্ণ কেন? কারণ এটি কোনো সর্বশক্তিমান, মঙ্গলময় ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। বরং এটি এক মহাজাগতিক দুর্ঘটনার ফল। এক ভুলের মাশুল, এক অশ্রুবিন্দু থেকে জন্ম নেওয়া এক বিষণ্ণ উপাখ্যান। এই জগৎ হলো এক দ্বিতীয়-স্তরের বাস্তবতা, এক নকল জগৎ, এক কারাগার, যা তৈরি হয়েছে এক অজ্ঞ, অহংকারী এবং প্রায়শই মন্দ কারিগরের হাতে।

তাই এখানে মুক্তি খোঁজা বৃথা। এই জগতের নিয়মকানুন মেনে চললে, এর স্রষ্টার উপাসনা করলে মুক্তি মিলবে না, বরং কারাগারের শৃঙ্খল আরও শক্ত হবে। মুক্তি মিলবে কেবল এই জগৎকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, এর স্রষ্টাকে অস্বীকার করে এবং এর ঊর্ধ্বে থাকা আসল আলোর জগতের জ্ঞান লাভ করে – অর্থাৎ, ‘নোসিস’-এর মাধ্যমে।

মানুষ: যার বুকের ভেতর এক টুকরো চুরি করা তারা

ডেমিয়ার্জ যখন তার জড় জগৎ বানিয়ে খুব খুশি, যখন সে তার অনুচর বা আর্কনদের নিয়ে আস্ফালন করছে, “আমিই ঈশ্বর, এবং আমি ঈর্ষাপরায়ণ ঈশ্বর,” তখন সে তার ক্ষমতার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে এমন এক সত্তা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল, যে হবে তার নিজের প্রতিচ্ছবি। সে তার সহচর আর্কনদের বলল, “চলো, আমরা আমাদের আদলে মানুষ বানাই।” বাইবেলের আদিপুস্তকের (Genesis) এই বাক্যটিকে নস্টিকরা তাদের নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করল। তাদের মতে, ডেমিয়ার্জ আসলে প্লেরোমা থেকে পতিত আলোর এক ক্ষীণ প্রতিবিম্ব জলের মধ্যে দেখেছিল এবং সেই স্বর্গীয় রূপকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিল।

তারা সবাই মিলে কাদা-মাটি দিয়ে এক পুতুল বানাল, যার নাম আদম (Adam)। কিন্তু এই পুতুল ছিল এক বিশাল, নিষ্প্রাণ ও অসার বস্তু। আর্কনরা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়েও তাকে জীবন্ত করতে পারল না। সে নড়াচড়া করতে পারত না, কেবল মাটির উপর এক জড়পিণ্ডের মতো পড়ে থাকত। ডেমিয়ার্জের সৃষ্টি ক্ষমতা ছিল সীমিত; সে রূপ দিতে পারত, কিন্তু জীবন বা চেতনা দিতে পারত না (Layton, 1987)।

ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের গোপন প্রবেশ

ডেমিয়ার্জ এবং তার আর্কনরা যখন তাদের নিষ্প্রাণ মাটির পুতুলটিকে নিয়ে হতাশ, ঠিক তখনই মহাজাগতিক নাটকের মঞ্চে এক নতুন এবং গোপন ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়। প্লেরোমা থেকে বিতাড়িত এবং অনুতপ্ত সোফিয়া উপর থেকে তার সন্তানের এই আনাড়ি কার্যকলাপ দেখছিলেন। তিনি দেখলেন, তার সন্তানের বানানো এই কারাগারে তারই ঐশ্বরিক আলোর কণা আটকে পড়ার এক ভয়াবহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন এবং একই সাথে তার অহংকারী পুত্র ডেমিয়ার্জকে এক শিক্ষা দিতে চাইলেন, তাকে দেখাতে চাইলেন যে তার ক্ষমতার ঊর্ধ্বেও এক শক্তি আছে।

সে তখন গোপনে, ডেমিয়ার্জকে ধোঁকা দিয়ে, সেই মাটির পুতুলের ভেতর ফুঁ দিয়ে নিজের ঐশ্বরিক আলোর একটি কণা বা স্ফুলিঙ্গ (Divine Spark) ঢুকিয়ে দিল। কিছু পুরাণে বলা হয়েছে, সোফিয়া নিজেই এই কাজ করেন, আবার কিছু পুরাণে বলা হয়েছে, তিনি প্লেরোমার উচ্চতর এইয়নদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তারা সম্মিলিতভাবে এই হস্তক্ষেপ করেন। এই ঐশ্বরিক সত্তাটিকে নস্টিকরা বলত ‘নিউমা’ (Pneuma), যা গ্রিক ভাষায় ‘আত্মা’ বা ‘শ্বাস’-এর সমার্থক। কিন্তু এটি সাধারণ আত্মা বা ‘সাইকি’ (Psyche) – যা আমাদের আবেগ, যুক্তি ও ব্যক্তিত্বকে ধারণ করে – তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনেক বেশি বিশুদ্ধ ও স্বর্গীয়। ‘সাইকি’ হলো ডেমিয়ার্জের জগতের অংশ, কিন্তু ‘নিউমা’ হলো প্লেরোমার জগতের অংশ।

সঙ্গে সঙ্গে এক আশ্চর্য এবং নাটকীয় ঘটনা ঘটল। মাটির আদম জীবন্ত হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, যেহেতু তার ভেতরে প্লেরোমার বিশুদ্ধ আলোর কণা ছিল, যা তার স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের ভেতরে থাকা শক্তির চেয়েও অনেক বেশি উচ্চতর ও বিশুদ্ধ, তাই আদম তার স্রষ্টাদের থেকেও বেশি বুদ্ধিমান ও সচেতন হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়াল এবং তার স্বর্গীয় ঔজ্জ্বল্যে আর্কনরা ভয় পেয়ে গেল এবং তার সামনে প্রণত হলো। নস্টিক গ্রন্থ ‘অন দি অরিজিন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (On the Origin of the World) অনুযায়ী, আদম তার বোকা স্রষ্টাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, যা তাদের অহংকারে এক বিরাট আঘাত হানে এবং তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় (Robinson, 1988)।

এটা দেখে ডেমিয়ার্জ ভয়ংকর ঈর্ষান্বিত ও ক্রুদ্ধ হলো। সে বুঝতে পারল, তার নিজের বানানো সৃষ্টির ভেতরে এমন কিছু একটা আছে, যা তার নিজের নেই – এক উচ্চতর জগতের আলো, এক অচেনা ঈশ্বরের স্বাক্ষর। সে তার নিজের সৃষ্টিকে ভালোবাসার বদলে ভয় পেতে শুরু করল এবং তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে লাগল। মানবজাতির প্রতি স্রষ্টার এই আদিম ঈর্ষাই হলো, নস্টিকদের মতে, মানুষের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ।

কারাগারের ভেতরে আরও এক কারাগার

ডেমিয়ার্জের ঈর্ষা ও ভয় তাকে এক ভয়ংকর পরিকল্পনা করতে প্ররোচিত করল। সে বুঝতে পারল, মানুষের ভেতরের এই ঐশ্বরিক কণাটিকে সে ধ্বংস করতে পারবে না, কারণ তা তার ক্ষমতার বাইরের এক জগৎ থেকে এসেছে। তাই সে ঠিক করল, মানুষকে শুধু এই জড় জগতেই বন্দী করবে না, তাকে বন্দী করবে তার নিজের দেহের ভেতরে, নিজের মনের ভেতরে। সে এক কারাগারের ভেতরে আরও অনেকগুলো ছোট ছোট অদৃশ্য কারাগার তৈরি করল।

  1. ভুলিয়ে দেওয়া (Forgetfulness): প্রথমত, সে মানুষের উপর এক ধরনের ঘোর বা বিস্মৃতির পর্দা টেনে দিল, যাকে বলা হয় ‘লেথে’ (Lethe), যা গ্রিক পুরাণের বিস্মৃতির নদীর নাম। যে নদীর জল পান করলে আত্মারা তাদের পূর্বজীবনের কথা ভুলে যেত। ডেমিয়ার্জ মানুষকে এই বিস্মৃতির মদ পান করাল। এই ঘোরের কারণে মানুষ তার স্বর্গীয় উৎস, তার আসল বাড়ির কথা, প্লেরোমার আলোকময় জগতের স্মৃতি – সব ভুলে গেল। সে নিজেকে এই জড় জগতেরই অংশ বলে ভাবতে শুরু করল। তার স্বর্গীয় স্মৃতি এক গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল। এই অবস্থাকে নস্টিকরা প্রায়শই ‘মাতাল অবস্থা’ (drunkenness) বা ‘গভীর ঘুম’ (deep sleep) বলে বর্ণনা করত।
  2. দেহ ও কামনা-বাসনা: দ্বিতীয়ত, ডেমিয়ার্জ মানুষকে একটি স্থূল, রক্ত-মাংসের দেহে আবদ্ধ করল, যা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, অসুস্থতা, জরা এবং মৃত্যুর অধীন। এই দৈহিক চাহিদাগুলো আত্মার মনোযোগকে পৃথিবীর দিকে টেনে রাখে এবং তাকে তার ভেতরের আলোর দিকে তাকাতে দেয় না। নস্টিকদের কাছে শরীর কেবল কারাগারই নয়, এটি এক ধরনের বর্ম যা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গকে ঢেকে রাখে, তাকে পৃথিবীর গোলকধাঁধায় ব্যস্ত রাখে।
  3. নিয়তি ও আর্কনদের শাসন: তৃতীয়ত, সে মানুষকে গ্রহ-নক্ষত্রের অধীনে এক অপরিবর্তনীয় নিয়তির (Heimarmene) জালে বেঁধে ফেলল। আর্কনরা মানুষের আবেগ (ক্রোধ, হিংসা, লোভ), চিন্তা ও ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল, যাতে সে কখনোই নিজের ইচ্ছাশক্তিকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে না পারে। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ – সবই যেন তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। মানুষ নিজেকে স্বাধীন মনে করে, কিন্তু আসলে সে পুতুল নাচের পুতুলের মতো অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।
  4. মিথ্যা ধর্ম ও সামাজিক আইন: চতুর্থত, সে মানুষকে তার নিজের উপাসনা করার জন্য ধর্ম তৈরি করল, যা ভয়, অপরাধবোধ এবং অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই ধর্ম মানুষকে শেখায় যে সে জন্মগতভাবেই পাপী এবং একমাত্র স্রষ্টার (অর্থাৎ, ডেমিয়ার্জের) আনুগত্য এবং বলিদান বা ভালো কাজের মাধ্যমেই তার মুক্তি সম্ভব – যা আসলে তাকে আরও শক্ত করে কারাগারে বেঁধে রাখার এক মনস্তাত্ত্বিক কৌশল। সমাজের আইন, নৈতিকতা, প্রথা – এই সবকিছুই হলো সেই কারাগারেরই দেয়াল।

মানুষের ত্রিস্তরীয় প্রকৃতি

এভাবেই নস্টিকদের চোখে মানুষের জন্ম। আমরা হলাম এক ট্র্যাজিক, দ্বৈত এবং প্যারাডক্সিকাল সত্তা। আমাদের সত্তার তিনটি স্তর আছে, যা ভ্যালেন্টিনিয়ান নস্টিকরা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিল:

  1. সারক্স (Sarx) বা স্থূল দেহ: যা ডেমিয়ার্জের তৈরি, জড় জগতের অংশ এবং পুরোপুরি নশ্বর। এটি হলো আমাদের পাশবিক প্রকৃতি, যা কেবল ইন্দ্রিয়সুখ খোঁজে।
  2. সাইকি (Psyche) বা জাগতিক আত্মা: এটিও ডেমিয়ার্জের দেওয়া, যা আমাদের আবেগ, যুক্তি এবং ব্যক্তিত্বকে ধারণ করে। এটি দেহের চেয়ে উন্নত, কিন্তু ঐশ্বরিক নয়। এটি স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী এবং ভালো বা মন্দ – যেকোনো পথ বেছে নিতে পারে।
  3. নিউমা (Pneuma) বা ঐশ্বরিক আত্মা: এটিই আমাদের আসল, শাশ্বত সত্তা, সোফিয়ার সেই আলোর কণা, যা আমাদের ভেতরে ঘুমিয়ে আছে বা ‘সাইকি’-র দ্বারা আবৃত হয়ে আছে। এটিই হলো আমাদের ভেতরের ‘ভিনগ্রহবাসী’ (the alien within)।

নির্বাসিত রাজপুত্রের উপাখ্যান

আমরা হলাম নির্বাসিত রাজপুত্র, যে কিনা এক নোংরা বস্তিতে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বাস করছে আর নিজের আসল পরিচয় ভুলে গেছে। অথবা, আমরা হলাম এক মুক্তো, যা কাদার গভীরে লুকিয়ে আছে। নস্টিক গ্রন্থ ‘হিম অফ দ্য পার্ল’ (Hymn of the Pearl)-এ এই উপাখ্যানটি খুব সুন্দরভাবে বলা হয়েছে। সেখানে এক রাজপুত্রকে তার পিতা-মাতা (পরম ঈশ্বর ও স্বর্গীয় মা) মিশর (জড় জগতের প্রতীক) থেকে এক মহামূল্যবান মুক্তো (আত্মা) উদ্ধার করতে পাঠান। কিন্তু মিশরে এসে সে সেখানকার খাবার খেয়ে (জাগতিক ভোগ) সবকিছু ভুলে যায় এবং এক গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। তখন তার পিতা-মাতা একটি চিঠি পাঠান, যা এক ঈগলের রূপ ধরে এসে তাকে জাগিয়ে তোলে এবং তার আসল কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সেই স্মৃতি ফিরে পাওয়া, সেই বিস্মৃতির ঘুম থেকে জেগে ওঠা, এবং সেই ‘নোসিস’ বা জ্ঞান অর্জন করা যা আমাদের জানিয়ে দেবে আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি, এবং কীভাবে এই কারাগার থেকে পালিয়ে নিজের আসল বাড়ি, প্লেরোমায় ফিরে যাওয়া যায়। এই মুক্তি কোনো বিশ্বাস বা ভালো কাজের মাধ্যমে আসবে না, আসবে কেবল এক বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে।

সাপ যখন নায়ক: এক উল্টো পুরাণ যা আপনাকে চমকে দেবে

প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় কী? তাদের পবিত্র গ্রন্থকেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। নস্টিকরা ঠিক এই কাজটিই করেছিল, এবং করেছিল এক অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতার সাথে। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টকে অস্বীকার করেনি, বরং তাকে এমন এক আয়নার সামনে ধরেছিল, যেখানে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনা উল্টে গিয়েছিল। নায়ক হয়ে গিয়েছিল খলনায়ক, আর খলনায়ক হয়ে উঠেছিল নায়ক। তাদের এই বিদ্রোহী ব্যাখ্যার (exegesis) সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হলো আদিপুস্তকের (Book of Genesis) সেই বিখ্যাত গল্প – স্বর্গোদ্যান, জ্ঞানবৃক্ষ এবং সাপের কাহিনি।

ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পটা তো আমাদের সবারই জানা। ঈশ্বর আদম ও ইভকে (Eve) স্বর্গোদ্যান বা ইডেনে (Garden of Eden) রাখলেন এবং জ্ঞানবৃক্ষের (Tree of Knowledge of Good and Evil) ফল খেতে কঠোরভাবে বারণ করলেন, বললেন, “যেদিন তুমি এর ফল খাবে, সেদিন তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।” কিন্তু শয়তান এক ধূর্ত সাপের রূপ ধরে এসে ইভকে সেই ফল খেতে প্ররোচনা দিল, বলল, “না, তোমাদের মৃত্যু হবে না। বরং ঈশ্বর জানেন, যেদিন তোমরা এর ফল খাবে, সেদিন তোমাদের চোখ খুলে যাবে এবং তোমরা ঈশ্বরের মতো ভালো-মন্দ জ্ঞান লাভ করবে।” ইভ সেই ফল খেল এবং আদমকেও দিল। ফল খাওয়ার ফলে তাদের ‘পাপ’ হলো, জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলো, এবং ক্রুদ্ধ ঈশ্বর তাদের স্বর্গ থেকে চিরদিনের জন্য বের করে দিলেন। এই ঘটনাকে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে বলা হয় ‘আদি পাপ’ (Original Sin), যা সমগ্র মানবজাতির উপর এক উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কলঙ্ক।

নস্টিকরা এই গল্পটাকে স্রেফ পড়ত না, তারা এটাকে ছিন্নভিন্ন করে এর এক সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ বের করত। তাদের ব্যাখ্যা শুনলে আপনার পায়ের তলার মাটি সরে যেতে পারে। নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত গ্রন্থ ‘দি অ্যাপোক্রিফন অফ জন’ (The Apocryphon of John) এবং ‘দ্য টেস্টিমনি অফ ট্রুথ’ (The Testimony of Truth)-এ এই বিকল্প ব্যাখ্যাটি বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়।

স্বর্গোদ্যান যখন এক মনোরম কারাগার

নস্টিকদের মতে, প্রথম প্রশ্নটিই হলো – ইডেনের সেই ‘ঈশ্বর’ আসলে কে? তিনি যদি সত্যিকারের পরম পিতা হতেন, তবে তিনি জ্ঞানকে ভয় পাবেন কেন? জ্ঞান তো কোনো পাপ হতে পারে না, অজ্ঞতাই হলো পাপ। সুতরাং, এই ঈশ্বর কিছুতেই পরম সত্তা হতে পারেন না। তিনি হলেন অজ্ঞ, ঈর্ষাপরায়ণ ও স্বৈরাচারী ডেমিয়ার্জ।

আর সেই স্বর্গোদ্যান বা ইডেন? সেটি কোনো স্বর্গ নয়, বরং এক মনোরম, সোনালী কারাগার (a fool’s paradise)। ডেমিয়ার্জ আদম ও ইভকে সেখানে রেখেছিল, যাতে তারা আরাম-আয়েশের ঘোরে, এক নিষ্পাপ পশুর মতো জীবনযাপনে ডুবে থাকে এবং নিজেদের আসল পরিচয়, তাদের ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের কথা ভুলে যায়। সে চায়নি মানুষ জ্ঞান লাভ করুক। কারণ মানুষ ‘নোসিস’ বা জ্ঞান লাভ করলেই বুঝে ফেলবে যে ডেমিয়ার্জ আসল ঈশ্বর নয় এবং এই তথাকথিত স্বর্গোদ্যান আসলে এক সুসজ্জিত বন্দীশালা মাত্র। তাই সে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছিল, কারণ সে তার বন্দীদের অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে চেয়েছিল (Pagels, 1979)।

সাপ: শয়তান নয়, ত্রাণকর্তা

তাহলে সেই সাপটি কে? সে কোনো শয়তান বা অশুভ শক্তি নয়। বরং সে হলো প্লেরোমার দূত! সম্ভবত অনুতপ্ত মা সোফিয়া বা স্বর্গীয় প্রজ্ঞা নিজেই সাপের রূপ ধরে এসেছিলেন, অথবা অন্য কোনো আলোকময় এইয়নকে পাঠিয়েছিলেন আদম ও ইভকে সাহায্য করার জন্য। সাপটি এসে তাদের কোনো পাপ করতে প্ররোচনা দেয়নি, বরং তাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। সে তাদের ‘নোসিস’ বা জ্ঞান গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। মজার বিষয় হলো, আদিপুস্তকের গল্পেও সাপ কিন্তু মিথ্যা বলেনি। সে বলেছিল, ফল খেলে তাদের চোখ খুলে যাবে এবং তারা ঈশ্বরের মতো হবে। ঠিক তাই হয়েছিল। আর ডেমিয়ার্জ বলেছিল, ফল খেলে তাদের মৃত্যু হবে, যা ছিল এক নির্জলা মিথ্যা (শারীরিকভাবে তারা সেদিন মরেনি)।

সুতরাং, সাপটিই ছিল সত্যের বার্তাবাহক, একজন জাগরণকারী (an awakener)। ফলটি খাওয়ার পরেই আদম ও ইভের চোখ খুলে গেল। তারা বুঝতে পারল, তারা উলঙ্গ। নস্টিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এর আক্ষরিক অর্থ নয়, বরং রূপক অর্থ হলো – তারা তাদের দৈহিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা, তাদের অজ্ঞতা এবং তাদের সত্যিকারের আধ্যাত্মিক প্রকৃতি সম্পর্কে প্রথমবারের মতো সচেতন হলো। তারা বুঝল, তারা এই জড় জগতের কারাগারে বন্দী এবং তাদের স্রষ্টা তাদের সাথে প্রতারণা করেছে।

‘পতন’ নয়, বরং ‘উত্থান’

সুতরাং, জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াটা কোনো ‘পতন’ (The Fall) ছিল না। বরং এটা ছিল অজ্ঞতার ঘুম থেকে জেগে ওঠা, মুক্তির দিকে প্রথম সাহসী পদক্ষেপ। এটি ছিল মানব চেতনার জন্মমুহূর্ত। ডেমিয়ার্জ রেগে গিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, কারণ সে তার বন্দীদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে ভয় পেয়েছিল। সে মানুষকে অভিশাপ দিয়েছিল (নারীকে সন্তান প্রসবের বেদনা, পুরুষকে কঠোর পরিশ্রম), কারণ সে মানুষের ভেতরের ঐশ্বরিক আলোকে ঈর্ষা করত। সে ইডেনের ফটকে স্বর্গদূতদের পাহারায় রেখেছিল, যাতে মানুষ জীবনবৃক্ষের (Tree of Life) ফল খেয়ে অমরত্ব লাভ করতে না পারে – যা আবারও তার সীমাবদ্ধতা ও ঈর্ষারই প্রমাণ দেয়।

ওফাইট ও কেইনাইট: বিদ্রোহের চরম রূপ

নস্টিসিজমের কিছু চরমপন্থী শাখা এই বিদ্রোহী ব্যাখ্যাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওফাইটরা (Ophites), গ্রিক শব্দ ‘ওফিস’ (ophis) অর্থাৎ ‘সর্প’ থেকে যাদের নামকরণ, তারা এই সাপকে ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রায় পূজা করত। তারা মনে করত, সাপই মানবজাতিকে প্রথম ‘নোসিস’ দিয়েছিল।

কেইনাইট (Cainites) নামক আরেকটি গোষ্ঠী ছিল আরও র‍্যাডিকাল। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের সমস্ত চরিত্রদের দুটি ভাগে ভাগ করত: যারা ডেমিয়ার্জের পক্ষে, আর যারা ডেমিয়ার্জের বিপক্ষে। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের সমস্ত খলনায়কদের – যেমন কেইন (Cain), যে তার ভাই অ্যাবেলকে হত্যা করেছিল; এসাও (Esau), যে তার জন্মগত অধিকার হারিয়েছিল; সডোমের অধিবাসী, যাদের ঈশ্বর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন; এমনকি যিশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী জুডাস ইস্কারিওট (Judas Iscariot) – এদের সবাইকে নায়ক হিসেবে দেখত। কারণ, এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ডেমিয়ার্জের আইন ও কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছিল। তাদের মতে, অ্যাবেল ছিল দুর্বল এবং ডেমিয়ার্জের অনুগত, তাই শক্তিশালী কেইন তাকে হত্যা করে ঠিকই করেছিল। আর জুডাস যিশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কারণ সে-ই একমাত্র শিষ্য ছিল যে যিশুর আসল উদ্দেশ্য (দেহ থেকে মুক্তি) বুঝতে পেরেছিল এবং তাঁকে সেই মুক্তির পথে সাহায্য করেছিল (Casey, 2004)।

এই ধরনের প্রচলিত গল্পকে সম্পূর্ণ নতুন ও বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতা নস্টিসিজমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা প্রতিষ্ঠিত ধর্মগ্রন্থগুলো পড়ত, কিন্তু সেগুলোর এক গুপ্ত ও বিদ্রোহী অর্থ খুঁজে বের করত। তাদের কাছে, ধর্মগ্রন্থ ছিল এক ধরনের কোডেড মেসেজ, যার আসল অর্থ কেবল জ্ঞানীরাই উদ্ধার করতে পারে।

ত্রাতা এলেন জ্ঞান দিতে, পাপের বোঝা বইতে নয়

খ্রিস্টীয় জগতে ‘গসপেল’ বা ‘সুসমাচার’ বলতে কী বোঝায়? সাধারণত বোঝানো হয় যিশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাধ্যমে মানবজাতির পাপমুক্তির ‘শুভ সংবাদ’। প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের মূল স্তম্ভ হলো এই বিশ্বাস যে, যিশু পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষের আদি পাপের (Original Sin) বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিতে। তিনি ঈশ্বরের পুত্র হয়েও রক্ত-মাংসের শরীর ধারণ করেছেন, ক্রুশে এক যন্ত্রণাদায়ক আত্মাহুতি দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে মানবজাতিকে স্রষ্টার (অর্থাৎ, ডেমিয়ার্জের) ক্রোধ থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করলেই মুক্তি বা পরিত্রাণ (Salvation) সম্ভব।

নস্টিকরাও একজন ত্রাণকর্তার ধারণায় বিশ্বাস করত। তারাও যিশু বা খ্রিস্টকে (Christ) তাদের দর্শনের কেন্দ্রে স্থান দিয়েছিল। কিন্তু তাদের যিশু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চরিত্র। তাঁর মিশনও ছিল ভিন্ন। তাঁর ‘সুসমাচার’ কোনো পাপমুক্তির সংবাদ ছিল না, ছিল এক ঘুম-ভাঙানিয়া ডাক।

অসুখ যখন অজ্ঞতা, ওষুধ তখন জ্ঞান

নস্টিকদের মতে, মানুষের আসল সমস্যা ‘পাপ’ (Sin) নয়। পাপের ধারণাটিই তো ডেমিয়ার্জের তৈরি একটি কৌশল। সে কিছু নিয়মকানুন তৈরি করে দিয়েছে (যেমন, দশ আজ্ঞা) এবং সেগুলো ভাঙলেই মানুষকে পাপী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সে অপরাধবোধে ভোগে এবং আরও বেশি করে স্রষ্টার অধীন হয়ে পড়ে।

মানুষের আসল সমস্যা, আসল অসুখ হলো ‘অজ্ঞতা’ (Ignorance) বা গ্রিক ভাষায় ‘অ্যাগনোসিস’ (Agnosis)। আমরা অসুস্থ, পাপী নই। আমাদের রোগ হলো এক গভীর, আধ্যাত্মিক বিস্মৃতি (Amnesia)। আমরা ভুলে গেছি আমরা কারা, আমাদের উৎস কোথায়, আমাদের ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের কথা। আমরা এই জড় জগতের কারাগারে এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি যে, কারাগারকেই নিজের বাড়ি বলে মনে করছি।

সুতরাং, আমাদের যা প্রয়োজন, তা কোনো পাপের ক্ষমা নয়, প্রয়োজন হলো জ্ঞান বা ‘নোসিস’ (Gnosis)। এই নোসিসই হলো সেই ওষুধ যা আমাদের বিস্মৃতির রোগ সারিয়ে তুলবে। আর যিশু খ্রিস্ট হলেন সেই স্বর্গীয় চিকিৎসক, যিনি প্লেরোমা থেকে এই ওষুধ নিয়ে এসেছেন।

যিশু খ্রিস্ট: এক আলোক-দূত ও জাগরণকারী

নস্টিকদের যিশু খ্রিস্ট হলেন প্লেরোমা থেকে পাঠানো এক আলোক-দূত, একজন ঐশ্বরিক বার্তাবাহক বা ‘রিভিলার’ (Revealer)। তাঁর কাজ কোনো পাপ মোচন করা নয়, কারণ যে পাপের অস্তিত্বই নেই, তার মোচন কীভাবে হবে? তাঁর কাজ হলো মানুষকে সেই ভুলে যাওয়া জ্ঞান মনে করিয়ে দেওয়া। তিনি একজন শিক্ষক, একজন পথপ্রদর্শক, একজন জাগরণকারী।

তিনি এসে বলেন, “তোমরা এই জগতের নও। তোমরা ডেমিয়ার্জের সৃষ্টি নও। তোমাদের ভেতর এমন এক সম্পদ আছে যা এই জগতের সমস্ত ধন-সম্পদের চেয়েও মূল্যবান – এক ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ। জেগে ওঠো, নিজের আসল পরিচয় জানো এবং নিজের বাড়ি, প্লেরোমায় ফিরে চলো।”

এই ধারণাটি নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত গ্রন্থগুলোতে বারবার ফুটে উঠেছে। ‘দ্য গসপেল অফ টমাস’ (The Gospel of Thomas)-এ যিশু কোনো কাহিনি বলেন না, বলেন ১১৩টি গুপ্ত বাণী। তিনি পাপ বা অনুশোচনার কথা প্রায় বলেনই না, বারবার বলেন আত্ম-আবিষ্কারের কথা: “যিশু বলেছেন, ‘যদি তোমরা নিজেদেরকে জানতে পারো, তবে তোমরা পরিচিত হবে এবং তোমরা বুঝতে পারবে যে তোমরাই জীবন্ত পিতার সন্তান। কিন্তু যদি তোমরা নিজেদের না জানো, তবে তোমরা দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করবে এবং তোমরাই হবে সেই দারিদ্র্য’।” (Robinson, 1988)। এখানে জ্ঞানই হলো মুক্তি, আর অজ্ঞতাই হলো নির্বাসন।

‘দ্য গসপেল অফ ট্রুথ’ (The Gospel of Truth) নামক আরেকটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, মানুষের কষ্ট ও ভয়ের কারণ হলো সে তার উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, অনেকটা স্বপ্নের ঘোরে পথ হারিয়ে ফেলার মতো। খ্রিস্ট এলেন সেই ঘুম ভাঙাতে, সেই দুঃস্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলতে। তিনি কোনো আইন বা নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে আসেননি, এসেছেন জ্ঞান দিতে।

ডওসিটিজম: মায়ার শরীর ও ক্রুশের হাসি

এই ধারণার একটি যৌক্তিক পরিণতি হলো, অনেক নস্টিক গোষ্ঠীই বিশ্বাস করত, খ্রিস্টের কোনো সত্যিকারের রক্ত-মাংসের শরীর ছিল না। কারণ জড় শরীর হলো ডেমিয়ার্জের বানানো কারাগারের অংশ, যা অপবিত্র, পরিবর্তনশীল এবং মৃত্যুর অধীন। একজন বিশুদ্ধ, আলোকময় সত্তা কীভাবে সেই অপবিত্র শরীরে পুরোপুরি বন্দী হতে পারে?

তাই তারা মনে করত, যিশুর শরীরটা ছিল একটা মায়া বা বিভ্রম, মানুষের চোখের ধাঁধা। তিনি কেবল মানুষের মতো দেখতে ছিলেন, কিন্তু আসলে তাঁর কোনো জাগতিক শরীর ছিল না। তিনি খেতে পারতেন, হাঁটতে পারতেন, কিন্তু এসবই ছিল এক ধরনের অভিনয়, যাতে সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনতে পারে। এই মতবাদকে বলা হয় ‘ডওসিটিজম’ (Docetism), যার উৎস গ্রিক শব্দ ‘dokein’, অর্থাৎ ‘মনে হওয়া’ বা ‘to seem’ (Ehrman, 2003)।

তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকেও তারা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। যেহেতু তাঁর কোনো সত্যিকারের শরীরই ছিল না, তাই তাঁর মৃত্যু বা কষ্ট পাওয়াও সম্ভব নয়। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি ছিল ডেমিয়ার্জ এবং তার আর্কনদের বোকা বানানোর এক মহাজাগতিক নাটক। তারা ভেবেছিল, তারা ঈশ্বরের দূতকে হত্যা করে জয়ী হয়েছে, কিন্তু আসলে তারা এক ছায়ামূর্তিকে আক্রমণ করেছিল।

নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত ‘অ্যাপোক্যালিপ্স অফ পিটার’ (Apocalypse of Peter) নামক এক গ্রন্থে এই ধারণার এক চমকপ্রদ বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখার সময় যিশু তাঁর শিষ্য পিটারকে বলছেন, “হে পিটার, যাকে তুমি দেখছ ক্রুশে পেরেকবিদ্ধ অবস্থায়, সে হলো স্থূল দেহধারী বিকল্প মাত্র… তারা তাকে লজ্জা দিচ্ছে, যে আসলে আমারই প্রতিরূপ। কিন্তু দেখ, আসল জন, যে কিনা ক্রুশের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, সে হাসছে… আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।” (Robinson, 1988)। কিছু নস্টিক গোষ্ঠীর মতে, ক্রুশে আসলে সাইরিনের সিমনকে (Simon of Cyrene) চড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর আসল খ্রিস্ট পাশে দাঁড়িয়ে আর্কনদের বোকামি দেখে হাসছিলেন।

আধ্যাত্মিক রূপক হিসেবে মৃত্যু ও পুনরুত্থান

সুতরাং, নস্টিকদের কাছে যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান কোনো একবার ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, যা বিশ্বাস করলেই মুক্তি মিলবে। বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক রূপক, যা প্রতিটি জ্ঞান-সন্ধানীর জীবনেই ঘটতে পারে এবং ঘটা উচিত।

  • ক্রুশবিদ্ধ হওয়া মানে হলো নিজের জড় সত্তা, নিজের ‘ইগো’, এবং জাগতিক কামনা-বাসনাকে বিসর্জন দেওয়া।
  • মৃত্যু মানে হলো পুরোনো অজ্ঞ সত্তার মৃত্যু।
  • পুনরুত্থান হলো ‘নোসিস’ বা জ্ঞানের আলোয় নতুন করে আধ্যাত্মিক জন্মলাভ করা, নিজের আসল ঐশ্বরিক সত্তায় জেগে ওঠা।

খ্রিস্ট এসেছিলেন পথ দেখাতে, আমাদের হয়ে পথটা হেঁটে দিতে নয়। তিনি এসেছিলেন আমাদের ভেতরের ঘুমন্ত স্ফুলিঙ্গকে জাগিয়ে দিতে। মুক্তি বাইরে থেকে আসবে না, কোনো বিশ্বাস বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়। মুক্তি আসবে ভেতর থেকে, যখন আমরা খ্রিস্টের দেখানো পথে হেঁটে নিজেদেরকে জানব এবং নিজেরাই এক অর্থে ‘খ্রিস্ট’ হয়ে উঠব।

ধর্মগ্রন্থের গোলকধাঁধা: নস্টিকদের বিদ্রোহী পাঠ

যেকোনো ধর্ম বা দর্শনের ভিত্তিই হলো তার পবিত্র গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলো হলো বিশ্বাসের স্তম্ভ, নৈতিকতার উৎস এবং সম্প্রদায়ের পরিচয়ের প্রতীক। ইহুদিদের জন্য তোরাহ, খ্রিস্টানদের জন্য বাইবেল, মুসলমানদের জন্য কোরআন – এই গ্রন্থগুলো হলো ঈশ্বরের বাণী, যা আক্ষরিক অর্থেই সত্য এবং অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু নস্টিকরা (Gnostics) ধর্মগ্রন্থকে কীভাবে দেখত?

তাদের সম্পর্কটা ছিল অত্যন্ত জটিল, প্যারাডক্সিকাল, আন্তরিক এবং বিদ্রোহী। নস্টিকরা ধর্মগ্রন্থকে অন্ধভাবে বিশ্বাস বা ভক্তি করত না, আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করত না। তারা ছিল ধর্মগ্রন্থের সবচেয়ে মনোযোগী, সবচেয়ে সৃজনশীল, কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক পাঠক। তারা ধর্মগ্রন্থকে দেখত এক ধরনের গোলকধাঁধা বা কোডেড মেসেজ হিসেবে, যার বাহ্যিক বা আক্ষরিক অর্থের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর, গুপ্ত এবং প্রায়শই বিষ্ময়কর সত্য। তাদের কাছে, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করাটা ছিল এক ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য – ধুলোবালি আর আবর্জনা সরিয়ে আসল গুপ্তধন খুঁজে বের করার মতো।

ওল্ড টেস্টামেন্ট: প্রতিপক্ষের অভিযোগপত্র

নস্টিকদের পঠন-পাঠনের কেন্দ্রে ছিল ইহুদি ধর্মগ্রন্থ, যা খ্রিস্টানদের কাছে ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত। মার্সিয়নের (Marcion) মতো কিছু র‍্যাডিকাল ব্যক্তিত্ব ছাড়া বেশিরভাগ নস্টিকই এই গ্রন্থকে পুরোপুরি বর্জন করেনি। বরং, তারা এর গভীরে প্রবেশ করেছিল এক ভিন্ন ও বিদ্রোহী উদ্দেশ্য নিয়ে। তারা এই গ্রন্থকে ঈশ্বরের পবিত্র বাণী হিসেবে পড়ত না, পড়ত এক অজ্ঞ, অহংকারী ও প্রায়শই মন্দ দেবতার (ডেমিয়ার্জ) আত্মজীবনী হিসেবে। তাদের কাছে, ওল্ড টেস্টামেন্ট ছিল এক বিশাল অভিযোগপত্র বা ‘চার্জশিট’, যেখানে স্রষ্টা নিজেই, নিজের অজান্তে, নিজের অজ্ঞতা, ঈর্ষা এবং নিষ্ঠুরতার প্রমাণ রেখে গেছেন।

বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা (Inversion): এক র‍্যাডিকাল পঠন পদ্ধতি

নস্টিকদের ব্যাখ্যার মূল কৌশলটি ছিল ‘বিপরীতকরণ’ বা ইনভার্সন। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের আখ্যানগুলোকে এমন এক আয়নার সামনে ধরত, যেখানে সবকিছু উল্টে যেত। ওল্ড টেস্টামেন্টে যা কিছুকে ভালো, পবিত্র বা ঈশ্বরের অনুগত হিসেবে দেখানো হয়েছে, নস্টিকরা তাকে মন্দ, দুর্বল বা অজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে দেখত। আর যা কিছুকে মন্দ, পাপী বা বিদ্রোহী হিসেবে দেখানো হয়েছে, তাকেই তারা জ্ঞান, শক্তি ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করত। এই পঠন পদ্ধতি ছিল একাধারে এক ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্রোহ এবং এক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিশোধ।

  • স্রষ্টা বনাম সাপ: আগেই বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, ইডেন উদ্যানের স্রষ্টা ঈশ্বর, যিনি জ্ঞানকে ভয় পান এবং মানুষকে অজ্ঞ রাখতে চান, তিনিই হলেন অজ্ঞ ডেমিয়ার্জ। আর সাপ, যাকে শয়তান বলা হয়, সে-ই হলো জ্ঞানের দূত, ত্রাণকর্তা, যে মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়।
  • কেইন বনাম অ্যাবেল: কেইন ও অ্যাবেলের গল্পে, অ্যাবেল, যে ঈশ্বরের প্রিয় মেষপালক ছিল এবং যার বলিদান ঈশ্বর গ্রহণ করেছিলেন, তাকে নস্টিকরা দুর্বল ও অজ্ঞ বলে মনে করত, যে তার স্রষ্টার অনুগত এক দাসের মতো। অন্যদিকে কেইন, যে একজন কৃষক ছিল এবং যার বলিদান ঈশ্বর প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এবং যে পরে ক্রোধের বশে ভাইকে হত্যা করেছিল, তাকে কেইনাইটদের (Cainites) মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো শক্তিশালী ও জ্ঞানী হিসেবে দেখত। কারণ, কেইনই প্রথম স্রষ্টার অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।
  • টাওয়ার অফ ব্যাবেল: আদিপুস্তকের গল্প অনুযায়ী, মানবজাতি একতাবদ্ধ হয়ে স্বর্গে পৌঁছানোর জন্য একটি বিশাল টাওয়ার বা মিনার তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। ঈশ্বর তাদের এই ঔদ্ধত্য দেখে ক্রুদ্ধ হন এবং তাদের ভাষা ওলটপালট করে দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। মূলধারার ব্যাখ্যায় এটি হলো মানুষের অহংকারের শাস্তি। কিন্তু নস্টিকদের চোখে, এটি ছিল আত্মার ঊর্ধ্বমুখী যাত্রার এক সাহসী প্রচেষ্টা, প্লেরোমার দিকে ফিরে যাওয়ার এক সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ডেমিয়ার্জ ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং ভয় পেয়ে এই প্রচেষ্টা ধ্বংস করে দেয়, কারণ সে চায় না তার বন্দীরা কারাগার থেকে পালিয়ে যাক।
  • সডোম ও গোমোরা: এই শহরগুলোর অধিবাসীদের ঈশ্বর তাদের ‘পাপ’-এর জন্য আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেইনাইটদের মতো গোষ্ঠীগুলো মনে করত, এই শহরগুলোর অধিবাসীরা পাপী ছিল না, তারা ডেমিয়ার্জের আইনকে এবং তার পাঠানো দূতদের (দেবদূতদের) অস্বীকার করেছিল। তাই ক্রুদ্ধ স্রষ্টা তাদের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিল।
  • নূহের বন্যা: নূহের (Noah) সময়ে ঈশ্বর যখন মানবজাতির পাপে ক্রুদ্ধ হয়ে এক বিশাল বন্যা দিয়ে প্রায় সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেন, তখন মূলধারার ব্যাখ্যায় এটিকে পাপের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু নস্টিকদের চোখে, এটি ছিল এক খামখেয়ালি ও নিষ্ঠুর স্রষ্টার গণহত্যামূলক ক্রোধের প্রকাশ। কিছু নস্টিক পুরাণে এমনও বলা হয়েছে যে, ডেমিয়ার্জ চেয়েছিল সমস্ত মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে, কিন্তু সোফিয়া গোপনে হস্তক্ষেপ করে নূহকে নৌকা তৈরির জ্ঞান দেয়, যাতে ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের ধারক মানবজাতি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়।

এই বিপরীতমুখী পাঠের মাধ্যমে নস্টিকরা তাদের নিজেদের বিশ্ববীক্ষার – অর্থাৎ, এই জগৎ এক মন্দ স্রষ্টার তৈরি এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই মুক্তির পথ – এক ধর্মগ্রন্থ-ভিত্তিক প্রমাণ খুঁজে পেয়েছিল। তারা বলত, “দেখো, স্রষ্টা নিজেই তার গ্রন্থে নিজের আসল চেহারা উন্মোচিত করে দিয়েছেন, তোমাদের শুধু পড়ার মতো চোখ থাকতে হবে।” তারা ওল্ড টেস্টামেন্টকে তাদের দর্শনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেনি, বরং তাদের দর্শনকে প্রমাণ করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টকে এক বিকৃত সাক্ষী হিসেবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল।

নিউ টেস্টামেন্ট: গুপ্ত জ্ঞানের আধার

ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রতি নস্টিকদের মনোভাব যদি হয় চরম সমালোচনামূলক এবং বিধ্বংসী, তবে নিউ টেস্টামেন্ট, বিশেষ করে যিশুর বাণী বা গসপেলের প্রতি তাদের মনোভাব ছিল অনেক বেশি ইতিবাচক, যদিও সমানভাবে অপ্রচলিত এবং বৈপ্লবিক। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু যিশুকে তারা গ্রহণ করেছিল তাদের নিজেদের ত্রাণকর্তা হিসেবে। তারা যিশুকে ডেমিয়ার্জের জগতের ঊর্ধ্বে, প্লেরোমা থেকে আসা এক আলোক-দূত হিসেবে দেখত, যিনি এসেছেন ঘুমন্ত মানবাত্মাকে জাগিয়ে তুলতে। তাই তাঁর বাণীকেও তারা বিশেষ গুরুত্ব দিত।

কিন্তু তারা নিউ টেস্টামেন্টের প্রচলিত চারটি গসপেলের (ম্যাথিউ, মার্ক, লুক, জন) আক্ষরিক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিল না। তারা মনে করত, এই গসপেলগুলো সাধারণ বিশ্বাসীদের (‘সাইকিক’) জন্য লেখা। এগুলোর মধ্যে সত্য আছে, কিন্তু সেই আসল, গুপ্ত জ্ঞানটি রূপক, উপমা এবং কাহিনির আড়ালে লুকিয়ে রাখা আছে, অনেকটা যেমন ঝিনুকের খোলের ভেতরে মুক্তা থাকে।

আক্ষরিক বনাম আধ্যাত্মিক অর্থ: পাঠের দুটি স্তর

ভ্যালেন্টিনিয়ানদের মতো পরিশীলিত নস্টিক গোষ্ঠীগুলো মনে করত, ধর্মগ্রন্থের দুটি স্তর আছে –

  1. আক্ষরিক বা দৈহিক (Somatic/Psychic) অর্থ: যা সাধারণ, ‘সাইকিক’ মানুষ বোঝে। তারা যিশুর জন্ম, অলৌকিক কাজ, মৃত্যু বা পুনরুত্থানকে আক্ষরিক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে দেখে এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে মুক্তি খোঁজে।
  2. আধ্যাত্মিক (Pneumatic) বা গুপ্ত অর্থ: যা কেবল জ্ঞানীরাই (‘নিউম্যাটিক’) উদ্ধার করতে পারে। তাদের কাছে, এই ঘটনাগুলো হলো আত্মার জাগরণ ও মুক্তির এক আধ্যাত্মিক রূপক।
    • জন্ম: যিশুর কুমারী গর্ভে জন্ম কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি হলো আধ্যাত্মিক চেতনার জন্ম, যা কোনো জাগতিক কারণ ছাড়াই ঘটে।
    • অলৌকিক কাজ: যিশুর অসুস্থকে সুস্থ করা বা অন্ধকে দৃষ্টিদান করা হলো আসলে আধ্যাত্মিক অজ্ঞতাকে (‘অসুস্থতা’ বা ‘অন্ধত্ব’) ‘নোসিস’-এর আলো দিয়ে সারিয়ে তোলার রূপক।
    • মৃত্যু ও পুনরুত্থান: যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান হলো সাধকের নিজের জাগতিক সত্তার (ইগো) মৃত্যু এবং তার আসল, ঐশ্বরিক সত্তায় জেগে ওঠার প্রতীক।

এই ইন্টারপ্রিটেটিভ বা ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে নস্টিকরা অর্থোডক্স চার্চের সাথে একই গ্রন্থ পাঠ করেও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক খ্রিস্টধর্মের ছবি আঁকত।

‘গোপন’ গসপেল: হারানো কণ্ঠস্বরের খোঁজ

প্রচলিত চারটি গসপেলের পাশাপাশি নস্টিকরা তাদের নিজেদের লেখা অসংখ্য গসপেল বা ‘সুসমাচার’-কে পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করত। এই গ্রন্থগুলোকে প্রায়শই কোনো বিশেষ শিষ্যের (যেমন, টমাস, ফিলিপ, মেরি ম্যাগডালিন, এমনকি জুডাস) নামে উৎসর্গ করা হতো। এগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো যিশুর প্রকাশ্য জীবন বা কাহিনির উপর জোর দেয় না, বরং তাঁর পুনরুত্থানের পর শিষ্যদের সাথে তাঁর গোপন কথোপকথন বা তাঁর গুপ্ত শিক্ষার উপর জোর দেয়। দাবি করা হতো যে, এর মধ্যে যিশুর সেই সব গোপন শিক্ষা রয়েছে যা তিনি কেবল তাঁর নির্বাচিত, জ্ঞানী শিষ্যদেরই দিয়েছিলেন।

নাগ হাম্মাদিতে আবিষ্কৃত এই ধরনের গ্রন্থগুলো আমাদের দেখায় যে, আদি খ্রিস্টীয় জগতে ‘গসপেল’ বলতে কেবল একটি নির্দিষ্ট কাহিনিকে বোঝানো হতো না।

  • ‘দ্য গসপেল অফ টমাস’: এটি কোনো কাহিনি নয়, এটি যিশুর ১১৪টি গুপ্ত বাণীর সংকলন, যা আত্ম-জ্ঞান এবং ভেতরের ঈশ্বরকে আবিষ্কার করার উপর জোর দেয়। এখানে যিশু বলেন, “ঈশ্বরের রাজ্য তোমার ভেতরেও আছে, আবার তোমার বাইরেও আছে। যখন তুমি নিজেকে জানবে, তখন তুমি পরিচিত হবে… কিন্তু যদি তুমি নিজেকে না জানো, তবে তুমি দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করবে।”
  • ‘দ্য গসপেল অফ ফিলিপ’: এটি বিভিন্ন মরমী ধারণা ও রূপকের সংকলন, যা আধ্যাত্মিক সঙ্গীর (syzygy) ধারণা এবং মেরি ম্যাগডালিনের বিশেষ ভূমিকা তুলে ধরে।
  • ‘দ্য গসপেল অফ মেরি’: এই গ্রন্থে মেরি ম্যাগডালিনই প্রধান শিষ্য হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি আত্মার ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা এবং আর্কনদের বাধা অতিক্রম করার জ্ঞান বাকি শিষ্যদের প্রদান করেন। এটি দেখায় যে, মেরিই ছিলেন সেই শিষ্য, যিনি যিশুর সবচেয়ে গভীর শিক্ষাগুলো লাভ করেছিলেন, যা পুরুষ শিষ্যরা, বিশেষ করে পিটার, বুঝতে পারেনি বা ঈর্ষার কারণে গ্রহণ করতে চায়নি।

এই নতুন গসপেলগুলো প্রচলিত নিউ টেস্টামেন্টের চিত্রকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। এগুলো এক ভিন্ন যিশু এবং এক ভিন্ন খ্রিস্টীয় বার্তার কথা বলে, যেখানে পাপের চেয়ে অজ্ঞতা বড় সমস্যা, এবং অন্ধ বিশ্বাসের চেয়ে ব্যক্তিগত জ্ঞানই হলো মুক্তির পথ। নস্টিকদের কাছে, সত্য কোনো একটি মাত্র গ্রন্থে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিভিন্ন উৎসের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে পারে, যদি পাঠকের তা গ্রহণ করার মতো আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি থাকে।

ক্যাননের ধারণা প্রত্যাখ্যান: এক মুক্ত ও চলমান উদ্ঘাটন

নস্টিকদের এই ধর্মগ্রন্থ-বিষয়ক মনোভাবের সবচেয়ে র‍্যাডিকাল এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি ছিল ধর্মগ্রন্থের এক নির্দিষ্ট, বন্ধ তালিকা বা ‘ক্যানন’ (Canon)-এর ধারণাকেই নীতিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করা। গ্রিক শব্দ ‘ক্যানন’-এর অর্থ হলো ‘মাপকাঠি’ বা ‘নিয়ম’ – অর্থাৎ, সেই সব গ্রন্থ যা বিশ্বাসের মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দী জুড়ে অর্থোডক্স চার্চ যখন ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট তালিকা (যা অবশেষে চতুর্থ শতাব্দীতে আজকের নিউ টেস্টামেন্টের ২৭টি বইয়ের রূপ নেয়) তৈরি করছিল এবং বলছিল যে কেবল এই গ্রন্থগুলোই ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত বাণী এবং বাকি সবকিছুই ভ্রান্ত বা ‘অ্যাপোক্রিফাল’ (apocryphal), তখন নস্টিকরা এই ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাদের কাছে, সত্যকে এমন এক বন্ধ বাক্সে বন্দী করে ফেলার প্রচেষ্টা ছিল আধ্যাত্মিক সংকীর্ণতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের নামান্তর।

  • ঐশ্বরিক উদ্ঘাটন চলমান, সমাপ্ত নয়: নস্টিকদের মতে, ঈশ্বরের বাণী বা ঐশ্বরিক উদ্ঘাটন (revelation) অতীতে কোনো এক সময়ে, যিশু বা তাঁর শিষ্যদের মৃত্যুর সাথে সাথেই, শেষ হয়ে যায়নি। এটি একটি চলমান, জীবন্ত প্রক্রিয়া। যে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিই, সে পুরুষ হোক বা নারী, দাস হোক বা স্বাধীন, যদি ‘নোসিস’ লাভের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চেতনার উচ্চ স্তরে পৌঁছাতে পারে, তবে সে নতুন ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং নতুন ধর্মগ্রন্থ বা ‘গসপেল’ রচনা করতে পারে। ভ্যালেন্টিনাসের মতো গুরুরা নিজেরাই নতুন নতুন গ্রন্থ রচনা করতেন, যেমন ‘দ্য গসপেল অফ ট্রুথ’, যা নাগ হাম্মাদিতে পাওয়া গেছে এবং যা সম্ভবত তাঁরই লেখা। মন্টানিজম (Montanism) নামে আরেকটি সমসাময়িক আন্দোলনও এই চলমান উদ্ঘাটনের ধারণায় বিশ্বাস করত এবং তাদের পুরুষ ও নারী নবী উভয়ই (নারী নবীদের মধ্যে আছে প্রিসকা ও ম্যাক্সিমিল্লা) পবিত্র আত্মার নামে নতুন নতুন বাণী প্রচার করত। অর্থোডক্স চার্চের কাছে এই ধারণাটি ছিল ভয়ঙ্কর, কারণ এটি তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বকে ভেঙে দিত।
  • কর্তৃত্বের উৎস: অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্য নয়: অর্থোডক্সদের কাছে, একটি ধর্মগ্রন্থের কর্তৃত্ব আসত তার অ্যাপোস্টোলিক উৎস থেকে – অর্থাৎ, সেটি কি কোনো শিষ্য বা শিষ্যের শিষ্যের লেখা? এটি কি চার্চের ঐতিহ্যের সাথে মেলে? এটি ছিল এক বাহ্যিক এবং ঐতিহাসিক কর্তৃত্বের মানদণ্ড।নস্টিকদের কাছে, একটি গ্রন্থের কর্তৃত্ব আসত তার ভেতরের আধ্যাত্মিক সত্য থেকে। প্রশ্নটি ‘কে লিখেছে?’ নয়, প্রশ্নটি হলো ‘কী লেখা আছে?’। যদি কোনো লেখা ‘নোসিস’ বা জ্ঞান প্রদানে সক্ষম হয়, যদি তা পাঠককে তার নিজের ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের সন্ধান দেয়, তবে সেটিই পবিত্র, তা যে-ই লিখুক না কেন। ‘দ্য গসপেল অফ টমাস’-এর শেষে বলা হয়েছে, যে এই বাণীগুলোর গুপ্ত অর্থ বুঝবে, সে মৃত্যুর স্বাদ পাবে না। এখানেই গ্রন্থের আসল পরীক্ষা – তার রূপান্তরকারী ক্ষমতা।

এই দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কর্তৃত্বের দুটি ভিন্ন মডেলের প্রতিনিধিত্ব করে:

  • অর্থোডক্স মডেল: কর্তৃত্ব হলো প্রাতিষ্ঠানিক, স্তরবিন্যস্ত বা হায়ারার্কিকাল এবং ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল। সত্য বিশপ এবং ক্যাননের মাধ্যমে বাহিত হয়।
  • নস্টিক মডেল: কর্তৃত্ব হলো ব্যক্তিগত, গণতান্ত্রিক এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল। সত্য প্রতিটি জ্ঞানীর ভেতরেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে।

এই মনোভাব প্রাতিষ্ঠানিক চার্চের জন্য ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, যদি যে কেউই নতুন ধর্মগ্রন্থ লিখতে পারে এবং যে কোনো গ্রন্থকেই পবিত্র বলে দাবি করতে পারে, তাহলে বিশ্বাসের একতা বা মতবাদের বিশুদ্ধতা (orthodoxy) রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যের দরজা খুলে দেয়। ক্যানন তৈরি করার মাধ্যমে অর্থোডক্স চার্চ আসলে জ্ঞান ও কর্তৃত্বকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছিল এবং সত্য কী হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল (Pagels, 1979; Ehrman, 2003)। নস্টিকরা ছিল সেই মুক্ত পাঠের ঐতিহ্যের ধারক, যা কোনো নির্দিষ্ট বইয়ের কারাগারে বন্দী হতে চায়নি।

এক মুক্ত পাঠের ঐতিহ্য

সুতরাং, ধর্মগ্রন্থের প্রতি নস্টিকদের অবস্থান ছিল একাধারে সৃজনশীল এবং বিধ্বংসী। তারা ছিল এক অর্থে প্রথম ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’ (deconstructionist) পাঠক। তারা দেখিয়েছে, কোনো গ্রন্থের অর্থই স্থির বা একরৈখিক নয়। পাঠের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে একই গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব।

তারা ওল্ড টেস্টামেন্টকে প্রত্যাখ্যান করেনি, তাকে উল্টে দিয়েছে। তারা নিউ টেস্টামেন্টকে অস্বীকার করেনি, তাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। এবং তারা ধর্মগ্রন্থের ধারণাকে কোনো বন্ধ তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তাকে এক চলমান, জীবন্ত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়ে পরিণত করেছে। তাদের কাছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থটি কোনো প্যাপিরাসের পাতায় লেখা ছিল না, সেটি লেখা ছিল মানব আত্মার ভেতরেই – সেই ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ, যা কেবল ‘নোসিস’-এর আলোতেই পাঠ করা সম্ভব।

পুনর্জন্মের চাকা: নস্টিকদের চোখে আত্মার অন্তহীন নির্বাসন

মৃত্যুর পর কী হয়? এই প্রশ্নটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে গভীর রহস্যগুলোর একটি। বেশিরভাগ ধর্মই দুটি সম্ভাব্য পথের কথা বলে: হয় স্বর্গ বা নরকে চিরস্থায়ী জীবন, নাহলে কর্মফল অনুযায়ী নতুন কোনো দেহে ফিরে আসা বা পুনর্জন্ম। নস্টিসিজম, তার অন্যান্য ধারণার মতোই, এই বিষয়েও এক জটিল, বিষণ্ণ এবং অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করত। তাদের কাছে পুনর্জন্ম কোনো আধ্যাত্মিক উন্নতির সুযোগ ছিল না, বরং তা ছিল কারাগার থেকে পালানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা – এক অন্তহীন নির্বাসনের দুঃস্বপ্ন।

গ্রিক দর্শন থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার: আত্মার ভ্রমণ

পুনর্জন্মের ধারণাটি নস্টিকদের নিজস্ব উদ্ভাবন ছিল না। এর শিকড় গ্রিক দর্শনের গভীরে প্রোথিত ছিল। পিথাগোরাস (Pythagoras), প্লেটো (Plato) এবং অর্ফিকডায়োনিসিয়ান রহস্যবাদী ধর্মগুলোর (Orphic and Dionysian mystery religions) মাধ্যমে ‘আত্মার স্থানান্তর’ বা মেটেমসাইকোসিস (Metempsychosis)-এর ধারণা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল। প্লেটো তাঁর বিভিন্ন সংলাপে, বিশেষ করে ‘ফিডো’ (Phaedo) এবং ‘রিপাবলিক’ (Republic)-এর শেষে ‘এর-এর পুরাণ’ (Myth of Er)-এ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে আত্মা মৃত্যুর পর তার পূর্বজন্মের কর্ম অনুযায়ী বিচার লাভ করে এবং নতুন জীবন বেছে নেওয়ার জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসে।

নস্টিকরা এই গ্রিক কাঠামোটিকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তাকে তাদের নিজস্ব জগৎ-বিদ্বেষী দর্শনের ছাঁচে ফেলে এক ভয়ংকর রূপ দিয়েছিল। প্লেটোর কাছে যেখানে পুনর্জন্ম ছিল আত্মার পরিশুদ্ধি এবং জ্ঞানার্জনের একটি চক্র, নস্টিকদের কাছে তা হয়ে উঠল ডেমিয়ার্জ এবং তার আর্কনদের তৈরি এক নিষ্ঠুর ফাঁদ, যা আত্মাকে এই জড় জগতে বারবার ফিরিয়ে আনার জন্য পাতা হয়েছে।

আর্কনদের ফাঁদ: মৃত্যুর পরেও মুক্তি নেই

নস্টিক পুরাণ অনুযায়ী, যখন একজন সাধারণ মানুষ (হাইলিক বা সাইকিক) মারা যায়, তখন তার আত্মা দেহ থেকে মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে, অর্থাৎ প্লেরোমার দিকে যাত্রা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার পথটি সহজ নয়। তাকে সাতটি (বা তার বেশি) গ্রহের গোলক (Sphere) অতিক্রম করতে হয়, যার প্রতিটিই একজন করে আর্কন বা মহাজাগতিক শাসকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এই আর্কনরা হলো এক ধরনের মহাজাগতিক শুল্ক আদায়কারী বা সীমান্তরক্ষী। তারা আত্মার পথ রোধ করে দাঁড়ায় এবং তাকে জেরা করতে শুরু করে। তারা আত্মার জাগতিক জীবনের কামনা-বাসনা, আবেগ, পাপ – এইসবকে পুঁজি করে তাকে ভয় দেখায়, বিভ্রান্ত করে এবং আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ আত্মাই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। তাদের কাছে প্লেরোমায় ফিরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুপ্ত জ্ঞান বা ‘পাসওয়ার্ড’ থাকে না। ফলে, আর্কনরা তাদের আবার নিচের দিকে, পৃথিবীতে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় (Couliano, 1991)।

আত্মাকে তখন বিস্মৃতির নদীতে (লেথে – Lethe) চুবিয়ে তার পূর্বজন্মের সমস্ত স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়। তারপর তাকে নতুন একটি দেহে, নতুন একটি কারাগারে আবার বন্দী করা হয়। এই চক্র চলতেই থাকে, জন্ম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে জন্ম – এক অন্তহীন, অর্থহীন পুনরাবৃত্তি। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ট্রান্সমাইগ্রেশন (Transmigration)

বিভিন্ন দেহে আত্মার ভ্রমণ: কেবল মানুষ নয়

নস্টিকদের পুনর্জন্মের ধারণা কেবল মানবদেহেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত গ্রন্থ ‘পিস্টিস সোফিয়া’ (Pistis Sophia)-তে এই বিষয়ে এক ভয়ংকর ও বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, যে আত্মা মুক্তি লাভ করতে ব্যর্থ হয়, তাকে তার কর্মফল অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের দেহে পাঠানো হতে পারে। একজন নিন্দুক বা ঈশ্বরদ্রোহীর আত্মা হয়তো এমন এক দেহে জন্মাবে যা বাকশক্তিহীন। একজন হত্যাকারীর আত্মা হয়তো এক হিংস্র পশুর দেহে বন্দী হবে। একজন কামুক ব্যক্তির আত্মা হয়তো এমন এক দেহে জন্মাবে যা ক্রমাগত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

এই বর্ণনাগুলো কোনো নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য নয়, বরং এই জড় জগতের নিষ্ঠুরতা এবং আত্মার অসহায়ত্বকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। জগৎটা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ যে এখানে ন্যায়বিচার বলেও কিছু নেই, আছে কেবল এক যান্ত্রিক ও নির্মম কার্যকারণ-শৃঙ্খলা, যা আর্কনদের দ্বারা পরিচালিত হয়। পুনর্জন্মের এই চক্রটিই হলো ডেমিয়ার্জের সবচেয়ে বড় বিজয়, কারণ এর মাধ্যমে সে নিশ্চিত করে যে তার কারাগার থেকে কোনো বন্দী যেন সহজে পালাতে না পারে (Mead, 1921)।

মুক্তি কীভাবে? চক্র ভাঙার একমাত্র উপায়

তাহলে এই ভয়ংকর চক্র থেকে মুক্তির উপায় কী? নস্টিকদের উত্তর দ্ব্যর্থহীন: নোসিস (Gnosis)

কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক মানুষ বা নিউম্যাটিক (Pneumatic), যার ভেতরে ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গটি জাগ্রত হয়েছে, সেই এই চক্র ভাঙতে সক্ষম। নোসিস বা জ্ঞান লাভের মাধ্যমে সে মৃত্যুর আগেই তার আসল পরিচয়, উৎস এবং গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই জ্ঞানই হলো তার মুক্তির ছাড়পত্র।

যখন একজন ‘জ্ঞানী’ বা নস্টিক মারা যায়, তখন তার আত্মা আর্কনদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। সে আর ভয় পায় না, কারণ সে জানে যে সে এই জগতের নয়, সে আর্কনদের চেয়েও উচ্চতর এক জগৎ থেকে এসেছে। তার কাছে প্রতিটি গোলকের শাসকের নাম, তাদের প্রকৃতি এবং তাদের অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় গুপ্ত মন্ত্র বা ‘পাসওয়ার্ড’ জানা থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, কিছু নস্টিক গ্রন্থে এমন সব সংলাপের উল্লেখ আছে, যেখানে আত্মা প্রতিটি আর্কনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে: “আমি তোমাকে চিনি, তুমি কে এবং কোথা থেকে এসেছ। আমি সেই জীবন থেকে এসেছি যা তোমার ঊর্ধ্বে।” এই ঘোষণার মাধ্যমে আত্মা প্রমাণ করে যে সে আর আর্কনদের ক্ষমতার অধীন নয়। তখন আর্কনরা তাকে পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় (Pagels, 1979)।

এভাবে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আত্মা শেষ পর্যন্ত তার উৎস, তার আসল বাড়ি – আলোর জগৎ প্লেরোমায় ফিরে যায়। সেখানে সে পরম পিতার সাথে পুনরায় মিলিত হয় এবং এই পুনর্জন্মের দুঃস্বপ্নের চক্র থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করে। তার আর ফিরে আসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

নস্টিসিজম বনাম ভারতীয় পুনর্জন্মবাদ

নস্টিকদের পুনর্জন্মের ধারণার সাথে ভারতীয় দর্শনের (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন) কর্মফলসংসার (Samsara) চক্রের ধারণার এক অদ্ভূত মিল এবং অমিল দুই-ই রয়েছে।

  • মিল: উভয় ক্ষেত্রেই আত্মা বা চেতনা এক দেহ থেকে অন্য দেহে ভ্রমণ করে। এই চক্রের মূল কারণ অজ্ঞতা (অবিদ্যা/অ্যাগনোসিস) এবং এর থেকে মুক্তিই জীবনের পরম লক্ষ্য।
  • অমিল: ভারতীয় দর্শনে কর্মের (Karma) ধারণাটি হলো এক নৈর্ব্যক্তিক, নৈতিক আইন। ভালো কাজের ফল ভালো হয়, খারাপ কাজের ফল খারাপ হয়। পুনর্জন্মের চক্রটি আত্মাকে তার কর্মফল ভোগ করার এবং আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করার সুযোগ দেয়। এটি এক ধরনের মহাজাগতিক বিদ্যালয়। অন্যদিকে, নস্টিকদের কাছে পুনর্জন্মের চক্রটি কোনো নৈতিক আইন দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং এটি কিছু অজ্ঞ ও প্রায়শই বিদ্বেষপরায়ণ সত্তা (আর্কন) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এটি কোনো বিদ্যালয় নয়, এটি একটি জেলখানা। এর উদ্দেশ্য আত্মাকে উন্নত করা নয়, বরং তাকে বন্দী করে রাখা।

এই পার্থক্যটিই তাদের জগৎ সম্পর্কে মূল দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যকে তুলে ধরে। ভারতীয় দর্শনের কাছে জগৎ দুঃখময় হলেও তা এক সুশৃঙ্খল নৈতিক নিয়মের অধীন। আর নস্টিকদের কাছে জগৎ কেবল দুঃখময়ই নয়, এটি বিশৃঙ্খল, অযৌক্তিক এবং এক শত্রুভাবাপন্ন শক্তির দ্বারা শাসিত। তাদের পুনর্জন্মের ধারণাটিও তাই কোনো আশার আলো দেখায় না, দেখায় কেবল এক গভীর হতাশা, যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে একমাত্র বৈপ্লবিক জ্ঞানের মাধ্যমেই।

নস্টিকদের জগৎ: প্রধান কিছু চিন্তাধারা ও গোষ্ঠী

নস্টিসিজমকে কোনো একক, সুসংগঠিত ধর্ম বা চার্চ হিসেবে ভাবলে বিরাট ভুল হবে। এটি ছিল অনেকটা বিশাল এক নদীর ব-দ্বীপের মতো, যেখানে মূল স্রোতটি অসংখ্য শাখায় বিভক্ত হয়ে, নিজস্ব গতি ও চরিত্র নিয়ে সাগরের দিকে এগিয়ে গেছে। সেই সাগর হলো ‘নোসিস’ বা মুক্তি। নস্টিসিজম ছিল এক জীবন্ত, পরিবর্তনশীল ও বহুস্বরী আন্দোলন, যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা স্থির ধর্মমত (dogma) ছিল না। এটি ছিল মূলত গুরু-শিষ্যের পরম্পরা, যেখানে বিভিন্ন প্রভাবশালী ও ক্যারিশম্যাটিক শিক্ষকের চারপাশে ছোট ছোট স্কুল বা চিন্তার ধারা গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেকেরই নিজস্ব সৃষ্টিতত্ত্ব, নিজস্ব পুরাণ এবং মুক্তির পথের নিজস্ব ব্যাখ্যা ছিল, যদিও তাদের সবার মধ্যেই কিছু মৌলিক মিল – যেমন জগৎ-বিদ্বেষ, অজ্ঞ স্রষ্টা এবং ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ – খুঁজে পাওয়া যেত।

এদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান গোষ্ঠীর কথা না বললেই নয়, কারণ তাদের মাধ্যমেই নস্টিসিজমের জটিল, সৃজনশীল এবং বৈচিত্র্যময় রূপটি ফুটে ওঠে।

ভ্যালেন্টিনিয়ানবাদ (Valentinianism): দর্শনের সাথে পুরাণের মেলবন্ধন

নস্টিসিজমের অসংখ্য স্রোতধারার মধ্যে যেটি সবচেয়ে প্রভাবশালী, সবচেয়ে পরিশীলিত এবং অর্থোডক্স চার্চের জন্য সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটি হলো ভ্যালেন্টিনিয়ানবাদ। এর প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেন্টিনাস (Valentinus) ছিলেন দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী, প্রাজ্ঞ এবং সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় নস্টিক গুরু। তিনি নিছক কোনো গুপ্ত সাধক ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রথম সারির কবি, দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক, যার মেধা ও বাগ্মিতাকে তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করতে বাধ্য হতো।

ভ্যালেন্টিনাস আনুমানিক ১০০ খ্রিস্টাব্দে মিশরের ব-দ্বীপ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষা লাভ করেন – যা ছিল তৎকালীন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে তিনি গ্রিক দর্শন, বিশেষ করে প্লেটোনিজম, এবং বিভিন্ন ধারার খ্রিস্টীয় চিন্তার সাথে গভীরভাবে পরিচিত হন। তিনি দাবি করতেন যে, তিনি থিওডাস (Theudas) নামক এক ব্যক্তির কাছ থেকে গুপ্ত জ্ঞান লাভ করেছেন, যিনি ছিলেন স্বয়ং সেন্ট পলের (St. Paul) শিষ্য। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর জ্ঞানকে অ্যাপোস্টোলিক বা শিষ্য পরম্পরার সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করতেন।

আনুমানিক ১৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি রোমে চলে আসেন এবং সেখানে নিজের স্কুল বা দর্শনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জ্ঞান, বাগ্মিতা এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে, এক পর্যায়ে তিনি রোমের বিশপ (Bishop of Rome) হওয়ারও কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় (Trevett, 1996)। এই ঘটনাটি ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর ‘কী হতে পারত’ অধ্যায় – যদি একজন নস্টিক গুরু রোমান চার্চের প্রধান হতেন, তাহলে খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে বইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচিত হননি, এবং ধীরে ধীরে অর্থোডক্স চার্চের সাথে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে।

এক মনস্তাত্ত্বিক পুরাণ

ভ্যালেন্টিনাসের দর্শনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল এর পরিশীলিত এবং মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা। তিনি নস্টিক পুরাণকে নিছক এক অদ্ভুত, আক্ষরিক গল্প হিসেবে না দেখে, তাকে প্লেটোনিক দর্শনের কাঠামোতে ফেলে এক জটিল কিন্তু সুসংবদ্ধ রূপ দেন। তাঁর কাছে এই পুরাণ ছিল মানব আত্মারই ভেতরের যাত্রার এক মহাজাগতিক রূপক। প্লেরোমা, সোফিয়ার পতন, ডেমিয়ার্জের জন্ম – এই সবকিছুই আসলে আমাদের নিজেদের মনের গভীরে ঘটে চলা নাটক।

  • প্লেরোমার ঐকতান: তিনিই প্লেরোমার ৩০ জন এইয়নের (Aeons) জটিল পরিবার, তাদের জোড়ায় জোড়ায় (Syzygy) বিভাজন এবং সর্বকনিষ্ঠ এইয়ন সোফিয়ার পতনের কাহিনিকে একটি নাটকীয় রূপ দেন। এই ৩০ জন এইয়ন আসলে পরম সত্তার বিভিন্ন গুণের প্রকাশ, যা এক সুরেলা ঐকতানে বাঁধা।
  • সোফিয়ার আবেগ: সোফিয়ার পতন হলো মানব আত্মার সেই অংশের প্রতীক, যা আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের সীমা লঙ্ঘন করতে চায়, অসীমকে জানতে চায় এবং এর ফলে নিজের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এটি হলো চেতনার সেই অংশ, যা দুঃখ, যন্ত্রণা এবং আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়।
  • ত্রাণকর্তা খ্রিস্ট: ভ্যালেন্টিনিয়ানদের মতে, সোফিয়াকে উদ্ধার করার জন্য এবং তার ভুলের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য প্লেরোমা থেকে দুটি ত্রাণকর্তা সত্তার উদ্ভব হয়: খ্রিস্ট (Christ) এবং পবিত্র আত্মা (Holy Spirit)। তারা সোফিয়াকে তার আবেগ থেকে শান্ত করে এবং তাকে তার ভুলের জ্ঞান দেয়। এরপর সমস্ত এইয়নরা মিলে তাদের শ্রেষ্ঠ গুণগুলো একত্রিত করে যিশু (Jesus) বা সোটার (Soter, a Greek word for savior) নামক এক চূড়ান্ত ত্রাণকর্তাকে তৈরি করে, যিনি পৃথিবীতে নেমে এসে পতিত ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গগুলোকে উদ্ধার করেন।

মানবজাতির তিন স্তর: এক আধ্যাত্মিক শ্রেণীবিন্যাস

ভ্যালেন্টিনাসের অনুসারীরাই মানুষকে তিনটি সুস্পষ্ট শ্রেণীতে ভাগ করার ধারণাটি জনপ্রিয় করে, যা তাদের আভিজাত্যবাদী (Elitist) দর্শনের পরিচয় দেয়। এই বিভাজনটি কোনো নৈতিক আচরণের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং মানুষের জন্মগত আধ্যাত্মিক প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। অনেকটা যেমন সোনা, রুপা আর লোহা – প্রত্যেকেরই একটি অন্তর্নিহিত প্রকৃতি আছে।

  1. হাইলিক (Hylics) বা জড়বাদী: গ্রিক শব্দ ‘hyle’ (অর্থাৎ, matter বা জড়) থেকে এই নামকরণ। এরা হলো পুরোপুরি জড় জগতের মানুষ, যাদের মধ্যে কোনো ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বা ‘নিউমা’ নেই। তাদের অস্তিত্ব কেবল দেহ (Sarx) ও জাগতিক আত্মার (Psyche) মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা ডেমিয়ার্জের সৃষ্টির নিখুঁত প্রতিচ্ছবি, যারা কেবল জাগতিক নিয়মকানুন মেনেই বাঁচে ও মরে। তারা কেবল খাওয়া-দাওয়া, বংশবৃদ্ধি আর জাগতিক ভোগ-বিলাস নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তাদের কোনো আধ্যাত্মিক মুক্তি সম্ভব নয়। মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এই জড় জগতের সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যাবে, ঠিক যেমন একটি মোমবাতি নিভে গেলে তার শিখাটিও মিলিয়ে যায়। তারা হলো সেই বীজ, যা পাথুরে মাটিতে পড়েছে এবং কখনোই অঙ্কুরিত হবে না।
  2. সাইকিক (Psychics) বা মনস্তাত্ত্বিক: গ্রিক শব্দ ‘psyche’ (অর্থাৎ, soul বা জাগতিক আত্মা) থেকে এই নামকরণ। এদের মধ্যে জাগতিক আত্মা আছে, যা ডেমিয়ার্জ দিয়েছে, কিন্তু ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ (Pneumuma) নেই বা থাকলেও তা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এরা হলো সাধারণ ধার্মিক মানুষ, যেমন – প্রচলিত বা অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা। তারা ডেমিয়ার্জকে উপাসনা করে এবং বিশ্বাস ও ভালো কাজের মাধ্যমে এক ধরনের নিম্নস্তরের মুক্তি পেতে পারে। তারা হয়তো ডেমিয়ার্জের বানানো স্বর্গে, যা চাঁদের গোলকের নিচে অবস্থিত, সেখানে জায়গা পাবে, কিন্তু সেটাই তাদের শেষ গন্তব্য। তারা প্লেরোমার আলোকময় জগতে ফিরতে পারবে না। তবে তাদের মুক্তি নির্ভর করে তাদের স্বাধীন ইচ্ছার (free will) উপর – তারা চাইলে বিশ্বাস ও ভালো কাজের মাধ্যমে ‘সাইকিক’ স্তরে মুক্তি পেতে পারে, আবার মন্দ পথ বেছে নিয়ে ‘হাইলিক’-দের মতো ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। তারা হলো সেই বীজ, যা ভালো মাটিতে পড়েছে, কিন্তু তার ফলন নির্ভর করবে পরিচর্যার উপর।
  3. নিউম্যাটিক (Pneumatics) বা আধ্যাত্মিক: গ্রিক শব্দ ‘pneuma’ (অর্থাৎ, spirit বা ঐশ্বরিক আত্মা) থেকে এই নামকরণ। এরাই হলো আসল নস্টিক, নির্বাচিত সত্তা, নির্বাসিত রাজপুত্র। জন্মগতভাবেই এদের ভেতরে সোফিয়ার সেই স্বর্গীয় আলোর কণা বা ‘নিউমা’ রয়েছে। একমাত্র তারাই ‘নোসিস’ লাভের মাধ্যমে ডেমিয়ার্জের জগৎ ও আর্কনদের বাধা অতিক্রম করে আলোর উৎস প্লেরোমায় ফিরে যেতে সক্ষম। তাদের মুক্তি পূর্বনির্ধারিত (predestined); এটি তাদের প্রকৃতিতেই লেখা আছে। তাদের কাজ ভালো-মন্দ বিচার করা নয়, বরং নিজেদের আসল পরিচয়কে ‘স্মরণ’ করা এবং নিজেদের ভেতরের সেই ঘুমন্ত স্ফুলিঙ্গকে জাগিয়ে তোলা। ত্রাণকর্তা মূলত তাদের জন্যই পৃথিবীতে আসেন। তাদের মুক্তি কোনো বিশ্বাসের ফল নয়, বরং অনিবার্য পরিণতি – যেমন আগুন অনিবার্যভাবেই উপরের দিকে ওঠে (Pagels, 1979)।

এই বিভাজন তৎকালীন সমাজে এক বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি করেছিল, কারণ এটি প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের সেই গণতান্ত্রিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, বিশ্বাস করলে যে কেউই মুক্তি পেতে পারে। ভ্যালেন্টিনাসের কাছে মুক্তি কোনো বিশ্বাসের বিষয় ছিল না, ছিল আত্ম-আবিষ্কারের বিষয়। তাঁর দর্শন ছিল একাধারে নৈরাশ্যবাদী (কারণ বেশিরভাগ মানুষই মুক্তি পাবে না) এবং আশাবাদী (কারণ নির্বাচিতদের মুক্তি নিশ্চিত)। এটি ছিল সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাতদের জন্য এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় আধ্যাত্মিক পথ।

শেথীয়বাদ (Sethianism): এক বিদ্রোহী বংশের পুরাণ

যদি ভ্যালেন্টিনিয়ানবাদ নস্টিসিজমের দার্শনিক ও পরিশীলিত দিকটি তুলে ধরে, তবে শেথীয়বাদ তার আদিম, পৌরাণিক, জগৎ-বিদ্বেষী এবং আপোষহীন বিদ্রোহী রূপটিকে প্রকাশ করে। শেথীয়রা ছিল নস্টিসিজমের সেই শাখা, যারা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আপোষ বা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ধার ধারত না। তাদের দর্শন ছিল একাধারে এক জটিল মহাজাগতিক আখ্যান এবং ইহুদি-খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক সরাসরি বিদ্রোহ। নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরির আবিষ্কারের আগে শেথীয়বাদ সম্পর্কে খুব কমই জানা ছিল, কিন্তু এখন পণ্ডিতরা মনে করেন যে এটিই ছিল নস্টিসিজমের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারাগুলোর একটি।

এক আধ্যাত্মিক বংশের গল্প

শেথীয়বাদের মূল ভিত্তি ছিল এক অনন্য আত্মপরিচয়। এই ধারার নস্টিকরা নিজেদেরকে আদম ও ইভের তৃতীয় পুত্র শেথ (Seth) এর আধ্যাত্মিক বংশধর বা ‘শেথের অটল বংশ’ (the immovable race of Seth) বলে মনে করত। তাদের মতে, আদিপুস্তকের গল্পটি হলো মানবজাতির আধ্যাত্মিক ইতিহাসের এক কোডেড ভার্সন, যার আসল অর্থ কেবল জ্ঞানীরাই বোঝে।

  • কেইন ও অ্যাবেল: তাদের মতে, কেইন ছিল এই জগতের অজ্ঞ স্রষ্টা ডেমিয়ার্জ বা ইয়ালদাবাওথের সন্তান। সে ছিল হিংস্র, জড়বাদী এবং পৃথিবীর প্রতীক। অ্যাবেল ছিল দুর্বল এবং ডেমিয়ার্জের অনুগত এক নিরীহ প্রাণী, যার মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল না। তাই যখন কেইন অ্যাবেলকে হত্যা করে, তখন তা ছিল জড় জগতের হিংস্রতারই এক প্রকাশ।
  • শেথ, স্বর্গীয় বীজ: এই বিপর্যয়ের পর, প্লেরোমার স্বর্গীয় সত্তারা হস্তক্ষেপ করে এবং আদম ও ইভের মাধ্যমে শেথের জন্ম হয়। শেথ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তার মধ্যে ছিল সোফিয়ার দেওয়া সেই বিশুদ্ধ ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ। একমাত্র শেথ-ই ছিল বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক বংশধারার বাহক, যার মাধ্যমে সেই স্বর্গীয় বীজ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। শেথীয়রা ছিল পৃথিবীতে সেই স্বর্গীয় বীজের ধারক ও বাহক, এক আধ্যাত্মিক অভিজাত গোষ্ঠী, যারা এই কলুষিত জগতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছে।

এক জটিল ও নাটকীয় পুরাণ

শেথীয়দের পুরাণ ছিল অত্যন্ত জটিল, বিশৃঙ্খল এবং নাটকীয়তায় ভরা। নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যেমন – ‘দি অ্যাপোক্রিফন অফ জন’, ‘দ্য গসপেল অফ ইজিপশিয়ানস’, ‘জস্ট্রিয়ানোস’ (Zostrianos) এবং ‘থ্রি স্টেলস অফ শেথ’ (The Three Steles of Seth) ইত্যাদি শেথীয় গোষ্ঠীর লেখা। এই গ্রন্থগুলো থেকে তাদের সৃষ্টিতত্ত্ব ও মুক্তির পথের একটি চিত্র পাওয়া যায়:

  • পরম সত্তা ও বার্বেলো: তাদের পুরাণের শীর্ষে আছেন এক অচিন্তনীয়, অদৃশ্য সত্তা (Invisible Spirit)। তাঁর চিন্তা থেকে প্রথম যে সত্তার উদ্ভব হয়, তিনি হলেন এক নারী-রূপী ঐশ্বরিক শক্তি, যার নাম বার্বেলো (Barbelo)। বার্বেলোই হলেন স্বর্গীয় মা, যাঁর থেকে প্লেরোমার বাকি সমস্ত এইয়নদের জন্ম হয়।
  • ইয়ালদাবাওথের বিদ্রোহ: তাদের পুরাণে সোফিয়ার পতন এবং ইয়ালদাবাওথ বা ডেমিয়ার্জের কাহিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। ইয়ালদাবাওথকে প্রায়শই এক কদাকার, অজ্ঞ এবং চরম অহংকারী সত্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়, যে নিজেকেই একমাত্র ঈশ্বর বলে ঘোষণা করে।
  • ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ: ইয়ালদাবাওথের এই ঔদ্ধত্যের জবাবে প্লেরোমা থেকে বারবার হস্তক্ষেপ করা হয়। যেমন, যখন সে নিজেকে একমাত্র ঈশ্বর বলে ঘোষণা করে, তখন প্লেরোমা থেকে এক আলোকময় প্রতিচ্ছবি (মানুষের আদিরূপ) তার সৃষ্ট জলে প্রতিফলিত হয়, যা দেখে সে ঈর্ষান্বিত হয়ে মানুষ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আবার, যখন সে আদমকে অজ্ঞ রাখতে চায়, তখন প্লেরোমা থেকে স্বর্গীয় ইপিওই (Epinoia) বা ‘আলোক-চিন্তা’ এসে তাকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে উৎসাহিত করে।

জাগরণ, আরোহণ এবং মুক্তি

শেথীয়দের কাছে মুক্তি ছিল এক বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া। এটি নিছক কোনো বিশ্বাস বা অনুশোচনার বিষয় ছিল না। এটি ছিল এক আধ্যাত্মিক জাগরণ এবং মহাজাগতিক আরোহণের যাত্রা।

  • ব্যাপ্টিজম (Baptism): শেথীয়রা বিভিন্ন ধরনের ধৌতকরণ বা ব্যাপ্টিজমের অনুষ্ঠান পালন করত, যা কেবল জল দিয়ে হতো না, হতো আলো, আগুন এবং আত্মা দিয়েও। এই অনুষ্ঠানগুলো ছিল আত্মাকে জাগতিক কলুষ থেকে پاک করার এবং তাকে তার আসল পরিচয় স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রতীক।
  • স্বর্গীয় আরোহণ: শেথীয়দের কিছু গ্রন্থ, যেমন ‘জস্ট্রিয়ানোস’, এক ধরনের স্বর্গীয় আরোহণের বর্ণনা দেয়। এখানে সাধক বিভিন্ন মন্ত্র বা গোপন নাম ব্যবহার করে ডেমিয়ার্জ এবং তার সাতজন আর্কনের দ্বারা শাসিত সাতটি স্বর্গ বা গোলক (sphere) এক এক করে অতিক্রম করে। প্রতিটি স্তরে আর্কনরা তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ‘নোসিস’-এর শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সাধক তাদের অতিক্রম করে অবশেষে প্লেরোমার আলোকময় জগতে পৌঁছায়।

দর্শন ও দর্শনের সংঘাত

শেথীয় নস্টিকরা প্রচলিত ইহুদি-খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থের এক র‍্যাডিকাল ও নেতিবাচক পাঠ তৈরি করেছিল। তারা প্রায়শই তাদের দর্শনকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্লেটোনিক দর্শনের পরিভাষা ও ধারণা ব্যবহার করত, কিন্তু তাদের মূল ভিত্তি ছিল পৌরাণিক উদ্ঘাটন বা ব্যক্তিগত দর্শন (vision)। ভ্যালেন্টিনাসরা যদি হন নস্টিসিজমের দার্শনিক, তবে শেথীয়রা ছিল তার স্বপ্নদর্শী বা ভিশনারি।

তৃতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত নব্যপ্লেটোবাদী (Neoplatonic) দার্শনিক প্লোটিনাস (Plotinus) তাঁর ছাত্রদের মধ্যে এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর এনিয়াডস’ (Enneads) গ্রন্থে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, যারা জগৎকে মন্দ এবং এর স্রষ্টাকে অযোগ্য বলে মনে করত। প্লোটিনাস নিজে বিশ্বাস করতেন যে এই জগৎ হলো পরম সত্তারই এক সুন্দর, যদিও অসম্পূর্ণ, প্রকাশ। তাই জগৎকে ঘৃণা করার এই ধারণাকে তিনি এক ধরনের দার্শনিক রোগ বলে মনে করতেন। অনেক গবেষকের মতে, প্লোটিনাস আসলে এই শেথীয় নস্টিকদেরই আক্রমণ করছিলেন, যা প্রমাণ করে যে তারা তৎকালীন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেও বেশ প্রভাবশালী ছিল এবং মূলধারার প্লেটোনিক দার্শনিকদের সাথে তাদের সরাসরি সংঘাত ছিল (Turner, 1991)।

তৃতীয় শতাব্দীর পর থেকে শেথীয়বাদ ধীরে ধীরে খ্রিস্টধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে এই ধরনের নব্যপ্লেটোবাদী দর্শনের সাথে আরও বেশি করে মিশে যেতে থাকে, যা তাদের গ্রন্থগুলোর জটিল দার্শনিক পরিভাষা থেকেই বোঝা যায়। তারা ছিল নস্টিসিজমের সেই আপোষহীন শাখা, যারা জগৎ এবং তার স্রষ্টার বিরুদ্ধে এক চিরন্তন আধ্যাত্মিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

মার্সিয়নিজম (Marcionism): দুই ঈশ্বরের চরম বিভাজন

দ্বিতীয় শতাব্দীর খ্রিস্টীয় জগতে যে কজন চিন্তাবিদ সবচেয়ে বড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, যাঁকে অর্থোডক্স চার্চ তাদের প্রধান শত্রু বা ‘আর্চ-হেরিটিক’ (arch-heretic) হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, তিনি হলেন মার্সিয়ন অফ সিনোপ (Marcion of Sinope)। মার্সিয়ন কোনো মরমী সাধক বা স্বপ্নদর্শী ছিলেন না, যেমনটা ছিলেন শেথীয় গুরুরা। তিনি ছিলেন একজন ধনী জাহাজ ব্যবসায়ী, একজন বাস্তববাদী সংগঠক এবং এক র‍্যাডিকাল ধর্মতাত্ত্বিক, যিনি যুক্তি ও সরলতার উপর ভিত্তি করে খ্রিস্টধর্মকে তার ইহুদি অতীত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মার্সিয়নাইট চার্চ (Marcionite Church) এতটাই সুসংগঠিত এবং জনপ্রিয় ছিল যে, এটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে অর্থোডক্স বা ক্যাথলিক চার্চের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে টিকে ছিল।

এক র‍্যাডিকাল ধর্মতত্ত্বের জন্ম

মার্সিয়ন আনুমানিক ৮৫ খ্রিস্টাব্দে পন্টাসের সিনোপে (বর্তমান তুরস্ক) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রোমে এসে সেখানকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হন এবং তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই তাঁর র‍্যাডিকাল ধর্মতাত্ত্বিক মতামতের কারণে মূলধারার চার্চের সাথে তাঁর তীব্র বিরোধ দেখা দেয়। আনুমানিক ১৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে রোমের চার্চ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি নিজের আলাদা চার্চ সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।

মার্সিয়নের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক আপোষহীন দ্বৈতবাদ। কিন্তু এটি ভ্যালেন্টিনাস বা শেথীয়দের মতো জটিল পৌরাণিক দ্বৈতবাদ ছিল না। তাঁর দ্বৈতবাদ ছিল মূলত ধর্মগ্রন্থ-ভিত্তিক এবং নৈতিক। ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, তা থেকেই তাঁর দর্শনের জন্ম।

মার্সিয়ন কোনো রাখঢাক না করে, কঠোরভাবে দুটি ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন:

  1. ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর: ইনি হলেন এই জড় জগতের স্রষ্টা, যাকে মার্সিয়ন বলতেন ‘ডেমিয়ার্জ’ (Demiurge) বা ‘ন্যায়বিচারক ঈশ্বর’ (the Just God)। মার্সিয়ন ওল্ড টেস্টামেন্ট আক্ষরিকভাবে পড়েছিলেন এবং দেখেছিলেন যে, এই ঈশ্বর এক নিষ্ঠুর, প্রতিশোধপরায়ণ, খামখেয়ালি এবং রক্তপিপাসু সত্তা। তিনি কেবল ইহুদিদেরই তাঁর নির্বাচিত প্রজা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, আর বাকিদের ঘৃণা করেন। তিনি আইন দিয়েছেন (‘an eye for an eye, a tooth for a tooth’), কিন্তু করুণা দেখাতে জানেন না। তিনি তাঁর নিজের সৃষ্টি নিয়েই অনুতপ্ত হন এবং সামান্য ভুলের জন্য ভয়ংকর শাস্তি দেন। মার্সিয়নের চোখে, এই ঈশ্বর ছিলেন এক নিম্নস্তরের, ত্রুটিপূর্ণ সত্তা, কিন্তু পুরোপুরি মন্দ নন – তিনি কেবল কঠোরভাবে ‘ন্যায়পরায়ণ’।
  2. যিশুর পিতা, অজানা ঈশ্বর: অন্যদিকে, যিশুর মাধ্যমে নিউ টেস্টামেন্টে যে ঈশ্বরের কথা জানা যায়, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইনি হলেন এক অজানা, অচেনা ঈশ্বর, যিনি এই জগতের স্রষ্টা নন এবং এর কোনো কিছুর সাথেই তাঁর সম্পর্ক ছিল না। তিনি হলেন পরম করুণা ও ভালোবাসার ঈশ্বর (the Good God or the God of Love and Grace)। এই জগৎ এবং তার মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তিনি করুণাপরবশ হন এবং মানবজাতিকে স্রষ্টা ঈশ্বরের কঠোর আইন এবং এই জড় জগতের কারাগার থেকে উদ্ধার করার জন্য যিশুকে পাঠান। তিনি এই উদ্ধারকাজ করেন কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই, কেবলই তাঁর অসীম ও অযাচিত করুণা থেকে।

ধর্মগ্রন্থের শুদ্ধিকরণ: প্রথম নিউ টেস্টামেন্ট ক্যানন

এই চরম বিভাজনের কারণে মার্সিয়ন এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তিনি ওল্ড টেস্টামেন্টকে পুরোপুরি বর্জন করেন। তিনি মনে করতেন, এটি এক ভিন্ন ঈশ্বরের কাহিনি এবং খ্রিস্টানদের জন্য অপ্রয়োজনীয়, এমনকি ক্ষতিকর। তাঁর মতে, অর্থোডক্স চার্চ যে ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টকে একসাথে রাখার চেষ্টা করে, তা হলো নতুন মদের সাথে পুরোনো চর্মপাত্র মেশানোর মতো এক ভয়ংকর ভুল।

কিন্তু তিনি শুধু ওল্ড টেস্টামেন্ট বর্জন করেই থামেননি। তিনি নিউ টেস্টামেন্টেরও সেই সব অংশ বাদ দিয়েছিলেন যেখানে ওল্ড টেস্টামেন্টের স্রষ্টা ঈশ্বরের কোনো ইতিবাচক উল্লেখ বা প্রভাব আছে বলে তাঁর মনে হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যিশুর আসল শিষ্যরা তাঁর বাণীকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি এবং পরে ইহুদি-খ্রিস্টানরা নিউ টেস্টামেন্টের লেখাগুলোকে বিকৃত করেছে।

এই ‘শুদ্ধিকরণের’ পর মার্সিয়ন নিজস্ব এক ধর্মগ্রন্থের তালিকা বা ক্যানন (Canon) তৈরি করেন, যা খ্রিস্টীয় ইতিহাসের প্রথম আনুষ্ঠানিক নিউ টেস্টামেন্ট ক্যানন হিসেবে পরিচিত। এতে ছিল মাত্র দুটি অংশ:

  • দ্য গসপেল (The Gospel): এটি ছিল লুকের গসপেলের (Gospel of Luke) একটি ব্যাপকভাবে সম্পাদিত সংস্করণ, যেখান থেকে যিশুর জন্ম, শৈশব এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী বাদ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, মার্সিয়নের মতে, যিশুর কোনো জাগতিক জন্ম হয়নি; তিনি হঠাৎ করেই একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন (Docetism)।
  • দ্য অ্যাপোস্টোলিকন (The Apostolikon): এটি ছিল সেন্ট পলের (St. Paul) দশটি পত্রের একটি সম্পাদিত সংকলন। মার্সিয়ন পলকে একমাত্র আসল শিষ্য বলে মনে করতেন, কারণ পলই প্রথম আইন (Law) এবং করুণার (Grace) মধ্যে পার্থক্যটি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।

মার্সিয়নের এই উদ্যোগ অর্থোডক্স চার্চের জন্য এক বিরাট ধাক্কা ছিল। তারা বুঝতে পারে যে, ধর্মগ্রন্থের কোনো নির্দিষ্ট তালিকা না থাকলে যে কেউ নিজের ইচ্ছামতো গ্রন্থ গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। মার্সিয়নের ক্যাননের প্রতিক্রিয়াস্বরূপই অর্থোডক্স চার্চ বাধ্য হয়েছিল তাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থের একটি আনুষ্ঠানিক তালিকা তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু করতে, যা প্রায় ২০০ বছর ধরে চলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত আজকের নিউ টেস্টামেন্টের ২৭টি বইয়ের তালিকাটি চূড়ান্ত হয়েছিল (Harnack, 1921; Ehrman, 2003)। আয়রনিক হলেও সত্যি, মার্সিয়ন ছিলেন সেই ‘হেরিটিক’, যিনি অর্থোডক্স চার্চকে নিজেদের পরিচয় এবং ধর্মগ্রন্থের সীমানা খুঁজে পেতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলেন।

যদিও মার্সিয়নের দর্শনে নস্টিসিজমের জটিল পৌরাণিক কাঠামো নেই, কিন্তু জগৎ ও তার স্রষ্টাকে নিম্নস্তরের মনে করা, ত্রাণকর্তার ডওসিটিক প্রকৃতি এবং কঠোর তপস্যার (তিনি তাঁর অনুসারীদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করেছিলেন) মতো বিষয়গুলো তাঁকে নস্টিক চিন্তাধারার খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সংস্কারক এবং একজন বিদ্রোহী, যিনি খ্রিস্টধর্মকে তার ইতিহাস থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।

অন্যান্য বিচিত্র গোষ্ঠী: বিদ্রোহের নানা রূপ

ভ্যালেন্টিনিয়ানদের দার্শনিক পরিশীলতা, শেথীয়দের পৌরাণিক গভীরতা কিংবা মার্সিয়নাইটদের সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি নস্টিসিজমের জগতে আরও অনেক ছোট ছোট, কিন্তু অত্যন্ত বিচিত্র ও র‍্যাডিকাল গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। এরা ছিল নস্টিসিজমের প্রান্তিক অঞ্চলের বাসিন্দা, অনেকটা মূলধারার সমাজের বাইরে থাকা শিল্পী, কবি বা বিপ্লবীদের মতো। তাদের চিন্তাভাবনা ছিল প্রায়শই আরও চরম, আরও আপোষহীন এবং প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় নৈতিকতার প্রতি আরও বেশি বিদ্রোহী।

এদের সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের প্রধান উৎস হলো তাদের ঘোর বিরোধীপক্ষ, অর্থাৎ আইরেনিয়াস, হিপ্পোলিটাস বা এপিফেনিয়াসের মতো ‘হেরিসিওলজিস্ট’ বা বিধর্ম-শাস্ত্রীদের লেখা। এই লেখকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই গোষ্ঠীগুলোকে দানবীয় (demonize) হিসেবে চিত্রিত করা, তাদের বিশ্বাসকে হাস্যকর এবং তাদের নৈতিকতাকে কলুষিত বলে প্রমাণ করা। তাই তাদের বর্ণনাগুলো প্রায়শই বিদ্বেষপূর্ণ, অতিরঞ্জিত এবং অনেক ক্ষেত্রে হয়তো পুরোপুরি কাল্পনিক। অনেকটা যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য তার বিরুদ্ধে অশালীন গুজব রটানো হয়, ঠিক তেমনি।

তা সত্ত্বেও, এই শত্রুভাবাপন্ন লেখাগুলোর মধ্য দিয়েও আমরা নস্টিক চিন্তার চরম বৈপ্লবিক এবং প্রায়শই বিস্ময়কর সম্ভাবনাগুলোর আঁচ পাই। এই বর্ণনাগুলো থেকে বোঝা যায়, নস্টিসিজমের মূল ধারণাগুলোকে – যেমন জগৎ-বিদ্বেষ, অজ্ঞ স্রষ্টা, গুপ্ত জ্ঞান এবং প্রচলিত আইন-কানুনের প্রতি অবজ্ঞা – কত ভিন্ন ভিন্ন এবং র‍্যাডিকাল উপায়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল। এরা ছিল নস্টিসিজমের সেই শাখা, যারা কোনো ধরনের আপোষ বা মধ্যপন্থাকে প্রশ্রয় দেয়নি।

এই ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা তাদের বড় গোষ্ঠীগুলো থেকে আলাদা করে:

  • চরম আক্ষরিক ব্যাখ্যা: যেখানে ভ্যালেন্টিনাসের মতো দার্শনিকরা নস্টিক পুরাণকে মনস্তাত্ত্বিক রূপক হিসেবে দেখতেন, সেখানে এই গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই তাদের পুরাণকে অত্যন্ত আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করত। স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাটা তাদের কাছে কেবল এক আধ্যাত্মিক ধারণা ছিল না, ছিল এক বাস্তব নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য।
  • অ্যান্টিনোমিয়ানিজম বা নিয়ম-বিরোধিতা: অনেকেই এক ধরনের চরম নিয়ম-বিরোধিতায় বিশ্বাস করত। তাদের যুক্তি ছিল, যদি এই জগতের আইন-কানুন (বিশেষ করে ওল্ড টেস্টামেন্টের আইন) অজ্ঞ ডেমিয়ার্জের তৈরি হয়, তবে সেই আইন মেনে চলার কোনো মানেই হয় না। বরং, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সেই আইন ভাঙার মাধ্যমেই সত্যিকারের আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা প্রকাশ করা সম্ভব।
  • বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা (Inversion): তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিষ্ঠিত ধর্মগ্রন্থের (বিশেষ করে ওল্ড টেস্টামেন্টের) চরিত্র ও ঘটনাগুলোকে পুরোপুরি উল্টে দেওয়া। তারা নায়কদের খলনায়ক এবং খলনায়কদের নায়ক হিসেবে চিত্রিত করত। তাদের কাছে, যারা ঈশ্বরের বা স্রষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তারাই ছিল সত্যিকারের জ্ঞানী এবং সাহসী।
  • জাদুকরী ও আচারসর্বস্বতা: তাদের অনেকের দর্শনেই জাদুকরী উপাদান, যেমন – বিশেষ মন্ত্র, প্রতীক, তাবিজ এবং গোপন নাম ব্যবহারের উপর খুব বেশি জোর দেওয়া হতো। তারা মনে করত, এই মহাবিশ্ব বিভিন্ন আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিপূর্ণ এবং সঠিক আচার-অনুষ্ঠান ও জ্ঞানের মাধ্যমে এই শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব।

যদিও এই গোষ্ঠীগুলোর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব এবং তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর সত্যতা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে গভীর বিতর্ক রয়েছে, তবুও তাদের কাহিনিগুলো আমাদের দেখায় যে, নস্টিসিজম কেবল একদল শান্ত, ধ্যানমগ্ন দার্শনিকের আন্দোলন ছিল না। এর ভেতরে ছিল এক শক্তিশালী, প্রায় নৈরাজ্যবাদী বিদ্রোহের স্রোত, যা সেই সময়ের সমস্ত প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। এরা ছিল সেই আধ্যাত্মিক বিদ্রোহের অগ্রসৈনিক, যারা কেবল কারাগারের অস্তিত্ব জেনেই সন্তুষ্ট ছিল না, তারা কারাগারের দেয়ালে আগুন লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল।

বাসিলিডিয়ানরা (Basilidians): ৩৬৫ স্বর্গের মহাজাগতিক সিঁড়ি

দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে আলেকজান্দ্রিয়ায়, যেখানে গ্রিক দর্শন, মিশরীয় মরমীবাদ এবং ইহুদি-খ্রিস্টীয় চিন্তার স্রোতধারা এসে মিশেছিল, সেখানেই বাসিলিডিস (Basilides) নামে এক অত্যন্ত বিদ্বান ও প্রভাবশালী নস্টিক গুরুর আবির্ভাব হয়। তিনি ছিলেন ভ্যালেন্টিনাসের সমসাময়িক এবং তাঁর অন্যতম প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বী। বাসিলিডিসের দর্শন ছিল অত্যন্ত জটিল, গূঢ় এবং এতে পারস্য, মিশরীয় ও গ্রিক দর্শনের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি দাবি করতেন যে, তিনি ম্যাথিয়াস (Matthias), যিনি জুডাসের বদলে যিশুর দ্বাদশ শিষ্য হয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে গুপ্ত জ্ঞান লাভ করেছেন। কিছু বর্ণনামতে, তিনি পিটারের দোভাষী গ্লাউসিয়াসের (Glaucias) কাছ থেকেও শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এই ধরনের দাবিগুলোর মাধ্যমে তিনি তাঁর শিক্ষাকে সরাসরি যিশুর শিষ্যদের সাথে যুক্ত করে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

অ-সত্তা থেকে সৃষ্টি: এক চরম অ্যাপোফ্যাটিক দর্শন

বাসিলিডিসের সৃষ্টিতত্ত্ব ছিল নস্টিকদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে দার্শনিক এবং চরমভাবে নেতিবাচক বা অ্যাপোফ্যাটিক (Apophatic) চার্চ ফাদার হিপ্পোলিটাসের (Hippolytus) বর্ণনা অনুযায়ী, বাসিলিডিস বলতেন, একেবারে শুরুতে কিছুই ছিল না – কোনো বস্তু ছিল না, কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এমনকি ‘কিছু না’ (Nothingness) বলেও কিছু ছিল না, কারণ ‘কিছু না’-ও এক ধরনের ধারণা। এই পরম শূন্যতার ঊর্ধ্বে ছিল এক অ-সত্তা ঈশ্বর (Non-Being God), যাঁর সম্পর্কে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

এই পরম অ-সত্তা ঈশ্বর কোনো কিছু ‘সৃষ্টি’ করেননি, কারণ সৃষ্টি করার জন্য ইচ্ছা বা কর্মের প্রয়োজন হয়, যা তাঁর পরম স্থিরতাকে ভঙ্গ করে। বরং, তাঁর থেকে, কোনো ইচ্ছা বা চেতনা ছাড়াই, এক ‘বিশ্ব-বীজ’ (Panspermia বা world-seed) এর উদ্ভব হয়, যার ভেতরে সমগ্র মহাবিশ্বের – আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং জাগতিক – সমস্ত সম্ভাবনা সুপ্ত ছিল, অনেকটা একটি সর্ষের দানার মধ্যে যেমন একটি বিশাল গাছের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে।

আব্রাক্সাস ও ৩৬৫ স্বর্গ: নিয়তির গোলকধাঁধা

এই বীজ থেকে ধীরে ধীরে, অনেকটা পর্যায়ক্রমিক বিস্ফোরণের মতো, ৩৬৫টি স্বর্গ বা গোলকের (sphere) উদ্ভব হয়, যার প্রতিটিতে নিজস্ব শাসক বা আর্কন এবং দেবদূত রয়েছে। এই স্তরবিন্যাসের একেবারে শীর্ষে, অর্থাৎ ৩৬৫তম স্বর্গে, যে পরম সত্তা রাজত্ব করেন, তাঁর নাম আব্রাক্সাস (Abraxas)। ‘৩৬৫’ সংখ্যাটি অত্যন্ত প্রতীকী। এটি গ্রিক বর্ণমালায় আব্রাক্সাস নামের সাংখ্যিক মানের সমান (Alpha=1, Beta=2, Rho=100, Alpha=1, Xi=60, Alpha=1, Sigma=200), যা সৌর বছরের দিনের সংখ্যারও সমান। এটি মহাজাগতিক চক্র এবং গ্রহ-নক্ষত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অপরিবর্তনীয় নিয়তির (Heimarmene) প্রতীক ছিল। আমাদের এই পৃথিবী এবং তার শাসক আর্কন (যিনি ইহুদিদের ঈশ্বর) এই ৩৬৫টি স্বর্গের একেবারে নিচের স্তরে অবস্থিত (Mead, 1906)।

আব্রাক্সাস নামটি প্রাচীন মিশরীয় ও পারস্যের জাদুকরী তাবিজগুলোতেও পাওয়া যেত, যা প্রমাণ করে যে বাসিলিডিস বিভিন্ন মরমী ধারা থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। আব্রাক্সাস ছিলেন ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে এক পরম সত্তা, যাঁর মধ্যে সমস্ত বিরোধাভাস একত্রিত হয়েছে।

মুক্তি যখন আরোহণ: আত্মার মহাজাগতিক যাত্রা

বাসিলিডিসের মতে, মানবাত্মা হলো সেই আদি বিশ্ব-বীজেরই একটি অংশ, যা এই নিম্ন জগতে নির্বাসিত এবং বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে আছে। মুক্তি পেতে হলে আত্মাকে মৃত্যুর পর এই ৩৬৫টি স্বর্গ এক এক করে অতিক্রম করতে হতো। এটি ছিল এক মহাজাগতিক সিঁড়ি বেয়ে আত্মার নিজের উৎসে, সেই অ-সত্তা ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাওয়ার এক দীর্ঘ ও কঠিন যাত্রা।

প্রতিটি স্তরে সেই স্বর্গের আর্কন তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত, তার পরিচয় জানতে চাইত। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন ছিল গোপন জ্ঞান বা পাসওয়ার্ড (passwords), যা সাধককে জীবদ্দশাতেই অর্জন করতে হতো। এই জ্ঞান হলো প্রতিটি স্বর্গের শাসকের নাম এবং সেই স্বর্গ অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্র। এই জ্ঞান ছাড়া আত্মা অনন্তকাল ধরে এই মহাজাগতিক গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকত। ত্রাণকর্তা যিশু এসেছিলেন পৃথিবীতে এই গোপন জ্ঞান বা ‘নোসিস’ প্রদান করার জন্য, যাতে নির্বাচিত আত্মারা (the elect) এই পথ চিনে নিতে পারে (Pearson, 2007)।

এক র‍্যাডিকাল খ্রিস্টতত্ত্ব ও নৈতিকতা

বাসিলিডিসও এক চরম ডওসিটিক (Docetic) খ্রিস্টতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। চার্চ ফাদার আইরেনিয়াসের (Irenaeus) বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি শেখাতেন যে যিশু রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আধ্যাত্মিক সত্তা যিনি কেবল মানুষের রূপ ধারণ করেছিলেন। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। ক্রুশে আসলে যিশু মারা যাননি, বরং তিনি সাইরিনের সিমনকে (Simon of Cyrene), যে তাঁর ক্রুশ বহন করছিল, নিজের রূপ দিয়েছিলেন এবং সিমনের রূপ নিজে ধারণ করেছিলেন। ফলে অজ্ঞ সৈন্যরা সিমনকেই যিশু ভেবে ক্রুশবিদ্ধ করে, আর আসল যিশু পাশে দাঁড়িয়ে তাদের বোকামি দেখে উপহাস করতে করতে অদৃশ্য হয়ে যান।

এই ধারণার ভিত্তিতে বাসিলিডিয়ানরা অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উপহাস করত, যারা একজন মৃত মানুষের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। তাদের মতে, যারা ক্রুশবিদ্ধ ব্যক্তিতে বিশ্বাস করে, তারা আসলে সিমনেরই দাসত্ব করছে।

তাদের নৈতিকতাও ছিল বিতর্কিত। তারা মনে করত, যেহেতু তাদের আত্মা ঐশ্বরিক, তাই দেহের কার্যকলাপ তাদের স্পর্শ করতে পারে না। এই ধারণা থেকে তাদের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণের (Libertinism) অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে অন্য বর্ণনামতে, তারা বিশ্বাস করত যে এই জগতে মানুষের দুঃখভোগ হলো পূর্বজন্মের পাপের ফল, এবং এই দুঃখভোগের মাধ্যমেই আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। এই ধারণাটি কর্মফল বা পুনর্জন্মের ধারণার খুব কাছাকাছি, যা ভারতীয় দর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বাসিলিডিসের দর্শন ছিল নস্টিসিজমের এক অত্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সমন্বয়বাদী (syncretic) রূপ, যা সেই সময়ের আলেকজান্দ্রিয়ার বহুসাংস্কৃতিক পরিবেশের এক নিখুঁত প্রতিফলন।

ওফাইটরা (Ophites): সর্প-উপাসকদের বিদ্রোহী জ্ঞান

নস্টিসিজমের বিচিত্র জগতে যে গোষ্ঠীটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, তারা হলো ওফাইটরা। ‘ওফাইট’ নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘ওফিস’ (ophis) অর্থাৎ ‘সর্প’ থেকে, যা তাদের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা প্রতীকটিকে নির্দেশ করে। এটি কোনো একক, সুসংগঠিত গোষ্ঠী ছিল না, বরং এই নামে বিভিন্ন নস্টিক সম্প্রদায়কে বোঝানো হতো, যাদের পুরাণে আদিপুস্তকের (Book of Genesis) সাপটি এক কেন্দ্রীয়, ইতিবাচক এবং প্রায় ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করত। তারা ছিল আদিপুস্তকের গল্পের সবচেয়ে র‍্যাডিকাল এবং দুঃসাহসী ব্যাখ্যাকারী। তাদের সম্পর্কে আমরা মূলত আইরেনিয়াস, অরিজেন এবং এপিফেনিয়াসের মতো চার্চ ফাদারদের লেখা থেকে জানতে পারি, যারা তাদের এই সর্প-ভক্তিকে শয়তানের উপাসনা হিসেবেই দেখতেন।

সাপ যখন ত্রাণকর্তা: জ্ঞানের প্রতীক

ওফাইটদের দর্শনের মূলে ছিল আদিপুস্তকের ইডেন উদ্যানের গল্পের এক সম্পূর্ণ বিপরীত পাঠ। তাদের মতে:

  • ইয়ালদাবাওথের ঈর্ষা: জগতের অজ্ঞ স্রষ্টা ইয়ালদাবাওথ (Yaldabaoth) চেয়েছিল তার সৃষ্টি, অর্থাৎ প্রথম মানব-মানবী আদম ও ইভ, অজ্ঞতার এক নিষ্পাপ আনন্দে ডুবে থাকুক। সে ছিল এক ঈর্ষাপরায়ণ জেলার, যে চায় না তার কয়েদিরা কারাগারের বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানুক। তাই সে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছিল, যাতে মানুষ কেবল তার অধীনস্থ এক বুদ্ধিহীন প্রাণী হয়েই থাকে।
  • সোফিয়ার হস্তক্ষেপ ও সাপের মিশন: কিন্তু প্লেরোমার পতিত প্রজ্ঞা, মা সোফিয়া, মানবজাতির মধ্যে থাকা তার নিজেরই আলোর কণার কথা ভুলে যাননি। তিনি মানুষকে সাহায্য করতে চাইলেন। তাই তিনি সাপকে (Ophis) পৃথিবীতে পাঠালেন। এই সাপ কোনো শয়তান বা অশুভ শক্তি ছিল না, বরং সে ছিল সোফিয়ারই প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের মূর্ত রূপ, প্লেরোমার এক দূত।
  • প্রথম নোসিস: সাপটি এসে আদম ও ইভকে কোনো পাপ করতে প্ররোচনা দেয়নি, বরং তাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। সে তাদের স্রষ্টার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে উৎসাহিত করেছিল। এই ফল খাওয়াটাই ছিল মানবজাতির জন্য প্রথম ‘নোসিস’ (Gnosis) বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের মুহূর্ত। এর মাধ্যমেই তারা তাদের স্রষ্টার অজ্ঞতা এবং নিজেদের ঐশ্বরিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছিল। তাই সাপ কোনো প্রলোভনকারী নয়, বরং সে হলো জ্ঞানের বাহক এবং এক ত্রাণকর্তা-সদৃশ চরিত্র। ওল্ড টেস্টামেন্টে সাপকে ‘সবচেয়ে ধূর্ত’ (most subtle) প্রাণী বলা হয়েছে, ওফাইটরা এই ‘ধূর্ততা’-কে ‘প্রজ্ঞা’ বা ‘জ্ঞান’ হিসেবেই ব্যাখ্যা করত।

এক জটিল মহাজাগতিক মানচিত্র

ওফাইটদের দর্শন কেবল সাপের প্রশংসাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের এক জটিল ও বিস্তারিত সৃষ্টিতত্ত্ব ছিল, যা শেথীয় পুরাণের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের এই মহাবিশ্ব-ভাবনার একটি অসাধারণ নিদর্শন পাওয়া যায় দ্বিতীয় শতাব্দীর গ্রিক দার্শনিক সেলসাসের (Celsus) লেখায়, যিনি খ্রিস্টানদের সমালোচক ছিলেন। সেলসাস ওফাইটদের একটি বিখ্যাত চিত্র বা ডায়াগ্রাম (Diagram)-এর বর্ণনা দিয়েছেন, যা ছিল তাদের মহাবিশ্বের এক আধ্যাত্মিক মানচিত্র।

  • সাতটি গোলক ও আর্কনদের শাসন: এই ডায়াগ্রাম অনুযায়ী, পৃথিবী সাতটি গোলক বা স্বর্গের (sphere) দ্বারা বেষ্টিত, যার প্রতিটির শাসক হলো একজন করে আর্কন। এই আর্কনদের নামগুলো ছিল প্রায়শই হিব্রু ঈশ্বরের বিভিন্ন নামের বিকৃত রূপ, যেমন – ইয়ালদাবাওথ (শনি), ইয়াও (বৃহস্পতি), সাবাওথ (মঙ্গল), অ্যাডোনাইওস (সূর্য), ইলোইওস (শুক্র), হোরাইওস (বুধ) এবং অ্যাস্টাফাইওস (চাঁদ)। এই আর্কনরাই হলো মহাবিশ্বের জেলার, যারা আত্মাকে পৃথিবীতে বন্দী করে রাখে।
  • আত্মার আরোহণ: মুক্তি পেতে হলে আত্মাকে মৃত্যুর পর এই সাতটি গোলক এক এক করে অতিক্রম করতে হতো। প্রতিটি গোলকের ফটকে সেই স্বর্গের আর্কন তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন ছিল গোপন জ্ঞান, মন্ত্র এবং প্রতীক বা সীলমোহর (seals)। আত্মাকে প্রতিটি আর্কনের নাম ধরে ডেকে, সঠিক পাসওয়ার্ড উচ্চারণ করে উপরের দিকে আরোহণের অনুমতি আদায় করতে হতো।
  • সর্পের রূপ: এই মহাজাগতিক যাত্রাপথে সাপ (Leviathan) এক দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। একদিকে সে যেমন পৃথিবীতে জ্ঞানের বাহক, অন্যদিকে মহাজাগতিক সাগরে সে যেন এক বিশৃঙ্খল শক্তি, যা আত্মাকে আটকে রাখতে চায়। আত্মাকে এই সমস্ত বাধার ঊর্ধ্বে উঠে শেষ পর্যন্ত প্লেরোমার আলোকময় জগতে পৌঁছাতে হতো (Rasimus, 2009)।

আচার-অনুষ্ঠান ও বিতর্ক

চার্চ ফাদার এপিফেনিয়াস ওফাইটদের কিছু চাঞ্চল্যকর আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন, যদিও এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, তাদের ইউক্যারিস্ট (Eucharist) বা পবিত্র ভোজের অনুষ্ঠানে তারা একটি জীবন্ত সাপকে রুটির উপর দিয়ে চলাচল করতে দিত এবং সেই রুটিকে পবিত্র বলে মনে করত। এই ধরনের বর্ণনা তাদের সর্প-ভক্তির এক আক্ষরিক এবং চরম রূপকে তুলে ধরে, যা তাদের প্রতিপক্ষদের চোখে ছিল ভয়ঙ্কর ও নিন্দনীয়।

ওফাইটরা নস্টিসিজমের সেই র‍্যাডিকাল ধারার প্রতিনিধি ছিল, যারা প্রতিষ্ঠিত ধর্মের প্রতীকগুলোকে শুধু প্রত্যাখ্যান করেই সন্তুষ্ট ছিল না, তারা সেগুলোকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে নিজেদের বিদ্রোহের ধ্বজা হিসেবে ব্যবহার করত। তারা দেখিয়েছিল, একজনের চোখে যা শয়তান, আরেকজনের চোখে তিনিই হতে পারেন মুক্তির দূত।

কেইনাইটরা (Cainites): খলনায়কদের উপাসনা

নস্টিসিজমের জগতে যদি কোনো গোষ্ঠীকে চরমপন্থী, নৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং আধ্যাত্মিক নৈরাজ্যবাদী (spiritual anarchists) হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়, তবে তারা হলো কেইনাইটরা। এই ছোট কিন্তু কুখ্যাত গোষ্ঠীটি নস্টিক জগৎ-বিদ্বেষকে তার চূড়ান্ত যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের স্রষ্টা এবং তার নৈতিক আইনকে এতটাই ঘৃণা করত যে, তারা এক সহজ কিন্তু ভয়ংকর নীতি গ্রহণ করেছিল: স্রষ্টার শত্রু মানেই আমাদের বন্ধু। তাই তারা সেই ঈশ্বরের সমস্ত শত্রুদের, বাইবেলের সমস্ত খলনায়কদের, নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং তাদের উপাসনা করত।

তাদের সম্পর্কে আমরা প্রায় পুরোটাই জানতে পারি আইরেনিয়াস এবং এপিফেনিয়াসের মতো ‘হেরিসি-শিকারি’দের লেখা থেকে, যারা তাদের বর্ণনা করেছেন ভয়ঙ্কর পাপী এবং সমস্ত নৈতিকতার ধ্বংসকারী হিসেবে। যদিও এই বর্ণনাগুলো বিদ্বেষপূর্ণ, তবুও তা থেকে তাদের র‍্যাডিকাল দর্শনের একটি চিত্র পাওয়া যায়।

বিদ্রোহীদের প্রতি শ্রদ্ধা: এক উল্টো নৈতিক জগৎ

কেইনাইটরা ওল্ড টেস্টামেন্টের সমস্ত চরিত্রদের দুটি ভাগে ভাগ করত: যারা ডেমিয়ার্জের পক্ষে (অর্থাৎ, দুর্বল, অজ্ঞ এবং স্রষ্টার অনুগত) এবং যারা ডেমিয়ার্জের বিপক্ষে (অর্থাৎ, শক্তিশালী, জ্ঞানী এবং বিদ্রোহী)।

  • কেইন বনাম অ্যাবেল: তাদের নামকরণই হয়েছে আদিপুস্তকের প্রথম হত্যাকারী কেইনের (Cain) নাম থেকে। তাদের মতে, কেইন কোনো পাপী ছিল না, বরং সে ছিল এক উচ্চতর আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। তার ভাই অ্যাবেল ছিল দুর্বল এবং এই জগতের অজ্ঞ স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের অনুগত। তাই যখন শক্তিশালী কেইন দুর্বল অ্যাবেলকে হত্যা করে, তখন তা ছিল এক আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা জাগতিক শক্তির বিনাশ। কেইনকে তারা শ্রদ্ধা করত, কারণ সে-ই প্রথম স্রষ্টার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং দেখিয়েছিল যে এই স্রষ্টার শক্তি অসীম নয়।
  • অন্যান্য ‘খলনায়ক’: একইভাবে, তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই সমস্ত চরিত্র ও গোষ্ঠীকে নায়ক হিসেবে দেখত, যাদের স্রষ্টা ঈশ্বর শাস্তি দিয়েছিলেন। যেমন – এসাও (Esau), যে তার ভাই জেকবের কাছে জন্মগত অধিকার হারিয়েছিল; কোরাহ (Korah), যে মুসার (Moses) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং যার ফলে পৃথিবী তাকে গ্রাস করেছিল; এবং সডোমের অধিবাসী, যাদের ঈশ্বর আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কেইনাইটদের কাছে, এই সমস্ত চরিত্রই ছিল বীর, কারণ তারা কোনো না কোনোভাবে ডেমিয়ার্জের আইন ও কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার সাহস দেখিয়েছিল। স্রষ্টার অভিশাপই ছিল তাদের কাছে আশীর্বাদের সমতুল্য।

জুডাসের মুক্তি: বিশ্বাসঘাতকতা যখন পরম জ্ঞান

কেইনাইটদের সবচেয়ে বিষ্ময়কর এবং ধর্মতাত্ত্বিকভাবে বিস্ফোরক বিশ্বাসটি ছিল নিউ টেস্টামেন্টের প্রধান খলনায়ক, জুডাস ইস্কারিওটকে (Judas Iscariot) নিয়ে। প্রচলিত খ্রিস্টধর্মে জুডাস হলো লোভ এবং চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। কিন্তু কেইনাইটদের কাছে জুডাস ছিল একজন নায়ক, এমনকি যিশুর শিষ্যদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

  • একমাত্র জ্ঞানী শিষ্য: তাদের মতে, অন্য শিষ্যরা (যেমন পিটার বা জন) ছিল অজ্ঞ; তারা যিশুর আসল শিক্ষা ও উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি। তারা যিশুকে এই জগতেরই এক মসিহ বা রাজা হিসেবে দেখত। কিন্তু জুডাসই ছিল একমাত্র শিষ্য, যে ‘নোসিস’ লাভ করেছিল এবং যিশুর আসল পরিচয় ও মিশন সম্পর্কে অবগত ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে, যিশু হলেন প্লেরোমা থেকে আসা এক আধ্যাত্মিক সত্তা, এবং তাঁর পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গকে মুক্ত করা।
  • মুক্তির সহায়ক: জুডাস জানত যে, এই মুক্তি সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন যিশু তাঁর রক্ত-মাংসের দেহ, অর্থাৎ ডেমিয়ার্জের তৈরি এই কারাগার থেকে মুক্ত হবেন। তাই যখন সে যিশুকে শত্রুদের হাতে তুলে দেয়, তখন সে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। বরং, সে যিশুকে তাঁর দেহরূপী কারাগার থেকে মুক্ত হতে এবং তাঁর মহাজাগতিক মিশনে সফল হতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল এক বেদনাদায়ক কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ, যা কেবল সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী শিষ্যের পক্ষেই করা সম্ভব ছিল।

এই অবিশ্বাস্য ধারণার একটি প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২০০৬ সালে আবিষ্কৃত এবং প্রকাশিত ‘দ্য গসপেল অফ জুডাস’ (The Gospel of Judas) নামক একটি কপ্টিক গ্রন্থে। এই নস্টিক গ্রন্থটিতে যিশুকে জুডাসের সাথে একান্তে কথা বলতে দেখা যায় এবং তাকে অন্য শিষ্যদের চেয়ে উচ্চতর জ্ঞান প্রদান করতে দেখা যায়। যিশু জুডাসকে বলেন, “তুমি তাদের সকলকে ছাড়িয়ে যাবে। কারণ তুমি সেই মানুষটিকে উৎসর্গ করবে যে আমাকে আবৃত করে রেখেছে (অর্থাৎ, আমার দেহ)।” (Koberlein & Pagels, 2007; Casey, 2004)। যদিও এই গ্রন্থটি সরাসরি কেইনাইটদের লেখা কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে জুডাসকে নায়ক হিসেবে দেখার একটি শক্তিশালী ধারা নস্টিক জগতে বিদ্যমান ছিল।

কেইনাইটরা ছিল নস্টিসিজমের সেই চরমপন্থী মুখ, যারা সমস্ত প্রচলিত মূল্যবোধকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। তারা দেখিয়েছিল, স্রষ্টাকে যদি কারাগারের জেলার হিসেবে দেখা হয়, তবে সেই জেলারের বিরুদ্ধে যে কোনো বিদ্রোহই – তা যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন – এক পবিত্র কাজ হয়ে উঠতে পারে।

নানা পথের যাত্রী: নস্টিসিজমের বহুস্বরী জগৎ

এই বিষ্ময়কর বৈচিত্র্যই – ভ্যালেন্টিনাসের দার্শনিক গভীরতা থেকে শেথীয়দের পৌরাণিক নাটকীয়তা, মার্সিয়নের র‍্যাডিকাল সরলতা থেকে বাসিলিডিসের মহাজাগতিক জটিলতা, আর ওফাইট ও কেইনাইটদের চরম নৈতিক বিদ্রোহ পর্যন্ত – এক অকাট্য সত্যকে প্রমাণ করে: নস্টিসিজম কোনো নিষ্প্রাণ, পুঁথিগত মতবাদ ছিল না। এটি ছিল এক জীবন্ত, সৃজনশীল, গতিশীল এবং প্রায়শই বিপজ্জনক অনুসন্ধানমূলক আন্দোলন। এটি ছিল এক আধ্যাত্মিক পরীক্ষাগার, যেখানে হেলেনিস্টিক যুগের সমস্ত উপাদান – গ্রিক দর্শন, মিশরীয় মরমীবাদ, পারস্যের দ্বৈতবাদ, ইহুদি পুরাণ এবং নতুন খ্রিস্টীয় বিশ্বাস – একসাথে মিশে এক নতুন, বিস্ফোরক যৌগের জন্ম দিচ্ছিল।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দী ধরে এই আন্দোলনটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতিভাবান, সংবেদনশীল এবং বিদ্রোহী কিছু মনকে আলোড়িত করেছিল। তারা ছিল সেই সব মানুষ, যারা প্রচলিত ধর্মের সান্ত্বনাদায়ক উত্তরগুলোতে আর সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। তারা জগতের দিকে তাকিয়ে কেবল একজন মঙ্গলময় স্রষ্টার হাতের ছাপ দেখেনি, দেখেছিল বিশৃঙ্খলা, নিষ্ঠুরতা এবং অজ্ঞতার প্রমাণ। তারা মানুষের আত্মার দিকে তাকিয়ে কেবল পাপের কলঙ্ক দেখেনি, দেখেছিল এক নির্বাসিত ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের চাপা কান্না।

তারা সবাই একই মৌলিক এবং শাশ্বত প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল – এই ভাঙা, প্যারাডক্সিকাল পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের অর্থ কী? আমরা কোথা থেকে এসেছি? কেন আমরা এখানে এত কষ্ট পাই, এত বিচ্ছিন্ন বোধ করি? আর এই কারাগার থেকে মুক্তির পথই বা কী?

কিন্তু এই একই প্রশ্নের উত্তরে তারা প্রত্যেকেই খুঁজে পেয়েছিল তাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র এবং প্রায়শই বিপজ্জনক পথ। কেউ প্লেটোর যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চেয়েছে, কেউ স্বপ্নের ডানায় ভর করে মহাজাগতিক দর্শন লাভ করেছে, কেউ ধর্মগ্রন্থকে ছিন্নভিন্ন করে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত অর্থ খুঁজেছে, আবার কেউ সমস্ত নিয়মকানুন ভেঙে ফেলে এক ভয়ংকর স্বাধীনতার মধ্যে মুক্তি পেতে চেয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো ‘পোপ’ বা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিল না যে বলে দেবে কোনটি সঠিক পথ। পথটা প্রত্যেককে নিজের জন্যই খুঁজে নিতে হতো, কারণ ‘নোসিস’ ছিল এক গভীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

এই বহুস্বরী প্রকৃতিই ছিল একাধারে নস্টিসিজমের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। শক্তি, কারণ এটি সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিগত আবিষ্কারের এক অফুরন্ত সুযোগ করে দিয়েছিল। আর দুর্বলতা, কারণ এই বিভাজনই তাদের এক ঐক্যবদ্ধ, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে অসহায় করে তুলেছিল। কিন্তু তারা যে প্রশ্নগুলো তুলেছিল, জগৎ এবং ঈশ্বরের প্রকৃতি নিয়ে যে সন্দেহ তারা প্রকাশ করেছিল, তা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরাজিত হওয়ার পরেও সেই প্রশ্নগুলো ইতিহাসের আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনিত হতে থেকেছে, আজও আমাদের ভাবায়।

কীভাবে বাঁচবে একজন নস্টিক? কঠোর তপস্যা নাকি অবাধ স্বাধীনতা?

যদি এই জগৎটা একটা কারাগার হয় এবং আমাদের শরীরটাও সেই কারাগারের অংশ হয়, যদি আমাদের চারপাশের সমাজ, তার নিয়মকানুন, তার নৈতিকতা – এই সবকিছুই হয় এক অজ্ঞ স্রষ্টার তৈরি করা শৃঙ্খল, তাহলে এই জীবন নিয়ে কী করা উচিত? এই জাগতিক অস্তিত্বকে কীভাবে মোকাবেলা করা উচিত? একজন নস্টিক, যে কিনা এই ভয়াবহ সত্যটি জেনে ফেলেছে, সে কীভাবে বাঁচবে?

এই মৌলিক এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরে নস্টিকদের মধ্যে কোনো একক মত ছিল না। বরং তাদের জগৎ-বিদ্বেষী দর্শন থেকে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত, মেরু-প্রতিম নৈতিক আচরণের জন্ম হয়েছিল, যা তাদের দর্শনের মতোই চমকপ্রদ এবং র‍্যাডিকাল। একদিকে ছিল জগৎকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যানের পথ, অন্যদিকে ছিল জগৎকে চূড়ান্তভাবে অবজ্ঞা করার পথ।

১. কঠোর তপস্যা (Asceticism): শরীরকে অস্বীকার করার মাধ্যমে মুক্তি

বেশিরভাগ নস্টিকই এই পথটি বেছে নিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল অত্যন্ত সরল, শক্তিশালী এবং এক অর্থে যুক্তিসঙ্গত। যেহেতু শরীর এবং জড় জগৎ দুটোই খারাপ, অপবিত্র এবং ডেমিয়ার্জের সৃষ্টি, তাই এগুলোর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। এই জগৎ ও তার সমস্ত আকর্ষণ – ক্ষমতা, সম্পদ, খ্যাতি, ইন্দ্রিয়সুখ – এগুলো হলো কারাগারের শিকল, যা আমাদের আত্মার পায়ে পরানো আছে। এই শিকলকে ভালোবাসলে চলবে না, তাকে ঘৃণা করতে হবে, অস্বীকার করতে হবে।

  • ইন্দ্রিয় দমন: তাই তারা জাগতিক ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ, সুস্বাদু খাবার, মদ – সবকিছুকে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখত। অনেকে নিরামিষাশী ছিলেন, কারণ প্রাণীজ খাবারকে তারা পাশবিক প্রকৃতির অংশ বলে মনে করত। শরীরকে তার চাহিদা থেকে বঞ্চিত করে, তাকে দুর্বল করে রাখার মাধ্যমে তারা আত্মাকে শক্তিশালী করতে চাইত।
  • বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের বিরোধিতা: এই তপস্বী মনোভাবের সবচেয়ে চরম প্রকাশ ঘটেছিল বিয়ে ও যৌনতার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারা মনে করত, যৌন আকাঙ্ক্ষা হলো ডেমিয়ার্জের সবচেয়ে শক্তিশালী কৌশল, যা দিয়ে সে আত্মাকে দেহের কারাগারে আটকে রাখে। বিয়ে ছিল তাদের চোখে ডেমিয়ার্জের জগতের এক প্রতিষ্ঠান, যা এই কারাগারকে টিকিয়ে রাখার জন্য তৈরি।আর সন্তান জন্মদান? তাদের কাছে এটি ছিল এক ভয়ঙ্কর, প্রায় অমার্জনীয় কাজ। কারণ, নতুন সন্তানের জন্ম দেওয়ার অর্থ হলো আরও একটি ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গকে এই মাংসের কারাগারে নতুন করে বন্দী করে ফেলা। এটি ডেমিয়ার্জের সৃষ্টিচক্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং আত্মার নির্বাসনকে দীর্ঘায়িত করে। নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত ‘দি এক্সেজিস অন দ্য সোল’ (The Exegesis on the Soul) নামক গ্রন্থে আত্মাকে এক পতিতার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে বারবার বিভিন্ন দেহে জন্ম নিয়ে কলুষিত হচ্ছে। তাই সত্যিকারের নস্টিকের কাজ হলো এই জন্ম-মৃত্যুর চক্রকে ভেঙে দেওয়া, নতুন কোনো আত্মাকে এই দুঃখের জগতে না আনা (Jonas, 1958)।

এই কঠোর তপস্যার জীবন ছিল এক নীরব, কিন্তু দৃঢ় বিদ্রোহ। এটি ছিল শরীর ও জগতের উপর ডেমিয়ার্জের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার এক নিরন্তর প্রচেষ্টা। তারা মনে করত, শরীরকে কঠোর নিয়মের মাধ্যমে শাসন করার ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে আত্মাকে জাগতিক বাঁধন থেকে মুক্ত করা যায় এবং তাকে তার আসল, আধ্যাত্মিক প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায়।

২. অবাধ স্বাধীনতা (Libertinism): শরীরকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে মুক্তি

খুব কম সংখ্যক নস্টিক গোষ্ঠী এই চরম বিপরীত, প্রায় বিপজ্জনক এবং লজ্জাজনক বা নিন্দনীয় (scandalous) পথটি বেছে নিয়েছিল বলে জানা যায়। এই ধারার অনুসারীদের যুক্তি ছিল আরও ভয়ংকর, আরও জটিল এবং প্রচলিত নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী। এই মতকে বলা হয় ‘অ্যান্টিনোমিয়ানিজম’ (Antinomianism), অর্থাৎ ‘নিয়ম-বিরোধিতা’ (anti-nomos)

তাদের যুক্তি ছিল অনেকটা এরকম: যদি শরীরটা অপবিত্র হয় এবং ডেমিয়ার্জের বানানো নিয়মকানুন (যেমন – সমাজের নৈতিকতা, দশ আজ্ঞা বা Ten Commandments) আমাদের বন্দী করার জন্যই তৈরি হয়, তাহলে সেই নিয়ম মেনে চলার অর্থ তো ডেমিয়ার্জের কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নেওয়া। সত্যিকারের আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা আসবে সেই নিয়ম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভাঙার মাধ্যমেই।

  • নিয়ম ভাঙার বিদ্রোহ: তারা বলত, “আমার আত্মা বা ‘নিউমা’ হলো ঐশ্বরিক এবং প্লেরোমার অংশ। তা কোনোভাবেই এই জড় জগতের নিয়ম বা আমার দেহের কার্যকলাপ দ্বারা কলুষিত হতে পারে না। আগুন যেমন কাদার মধ্যে থেকেও নিজে অকলঙ্কিত থাকে, আমার আত্মাও তেমনি।” এই চরম আধ্যাত্মিক অহংকার থেকে তারা সিদ্ধান্ত নিত যে, তারা তাদের দেহ দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে।
  • চূড়ান্ত ভোগের মাধ্যমে মুক্তি: তারা মনে করত, ইচ্ছেমতো সব ধরনের জাগতিক ভোগ, বিশেষ করে যৌনতার মাধ্যমে শরীর ও তার কামনা-বাসনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলে, তাকে ক্লান্ত করে দিলে, আত্মার উপর তার আর কোনো প্রভাব থাকবে না। কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী, যেমন কেইনাইটরা (Cainites) বা কার্পোক্রেটিয়ানরা (Carpocratians), মনে করত যে প্রতিটি আত্মাকে এই জগতে সমস্ত ধরনের অভিজ্ঞতা (ভালো ও মন্দ উভয়ই) অর্জন করতে হবে, সমস্ত ‘পাপ’ করতে হবে, যাতে সে এই জগতের আর্কনদের সমস্ত ঋণ শোধ করে দিতে পারে এবং পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে। এটা ছিল ডেমিয়ার্জ ও তার জগতের প্রতি এক ধরনের আধ্যাত্মিক বিদ্রোহ, এক ধরনের অবজ্ঞাপূর্ণ থুতু ছেটানো (Williams, 1996)।

সত্যি না অপপ্রচার? একটি ঐতিহাসিক বিতর্ক

তবে এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। এই দ্বিতীয় ধারাটির কথা, অর্থাৎ লিবারটিন নস্টিকদের কথা, আমরা মূলত তাদের ঘোর শত্রুপক্ষ, অর্থাৎ তৎকালীন খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের (Church Fathers) লেখা থেকেই জানতে পারি। আইরেনিয়াস (Irenaeus) বা এপিফেনিয়াসের (Epiphanius) মতো লেখকরা তাদের প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, তাদের চরিত্রহনন করার জন্য প্রায়শই তাদের যৌন অনাচারী এবং ভয়ঙ্কর পাপী হিসেবে চিত্রিত করতেন। তারা নস্টিকদের গোপন সমাবেশে ভয়ঙ্কর যৌন ক্রিয়াকলাপের অভিযোগ আনতেন, যা ছিল তৎকালীন রোমান সমাজে যে কোনো ‘বিপথগামী’ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক প্রচলিত অভিযোগ।

নাগ হাম্মাদিতে আবিষ্কৃত নস্টিকদের নিজস্ব লেখাগুলোতে কিন্তু এই ধরনের অবাধ যৌনাচারের কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। বরং সেখানে প্রায় সর্বত্রই এক কঠোর তপস্বী মনোভাবের পরিচয় মেলে। তাই আধুনিক গবেষকদের মধ্যে এই বিষয়ে গভীর বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এই লিবারটিন নস্টিকদের অস্তিত্ব হয়তো ছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। অথবা, তাদের দর্শনকে তাদের শত্রুরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত করেছে (Perkins, 1993)। শত্রুকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য যৌন অনাচারের অভিযোগ আনা ইতিহাসের এক পুরোনো এবং অত্যন্ত কার্যকর কৌশল।

তা সত্ত্বেও, এই দুটি বিপরীত মেরুর অস্তিত্ব (বা অন্তত সম্ভাবনা) নস্টিসিজমের দর্শনের গভীরতা এবং তার র‍্যাডিকাল প্রকৃতিকে তুলে ধরে। জগৎকে কারাগার মনে করলে হয় আপনি সেই কারাগারের দেয়াল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন, অথবা সেই দেয়ালের গায়ে ইচ্ছেমতো আঁকিবুকি কেটে জেলারকে ব্যঙ্গ করবেন। পথ দুটো ভিন্ন হলেও, উভয়েরই লক্ষ্য এক – কারাগার ও তার প্রভুকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করা।

হারিয়ে যাওয়া বইয়ের আশ্চর্য খোঁজ: নাগ হাম্মাদির গুপ্তধন

ইতিহাস লেখে বিজয়ীরা। এই কথাটা সম্ভবত নস্টিসিজমের চেয়ে ভালো আর কোনো ক্ষেত্রে খাটে না। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নস্টিসিজম সম্পর্কে আমরা যা জানতাম, তার প্রায় পুরোটাই ছিল পরাজিত পক্ষের ইতিহাস, যা বিজয়ীরা লিখেছিল। তাদের সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হতো তাদের ঘোর বিপক্ষ শিবিরের লেখার উপর। চতুর্থ শতাব্দীর ক্ষমতাশালী চার্চের ফাদার বা ধর্মগুরুরা, যেমন – লিয়নের আইরেনিয়াস (Irenaeus of Lyons), টারটুলিয়ান (Tertullian) বা সালামিসের এপিফেনিয়াস (Epiphanius of Salamis), তাদের ‘ভ্রান্ত মতবাদ’ বা ‘হেরিসি’ (Heresy) খণ্ডন করার জন্য বিশাল বিশাল বই লিখেছিলেন, যেমন আইরেনিয়াসের লেখা ‘অ্যাগেইনস্ট হিরেসিস’ (Against Heresies)

সেই সব লেখায় তারা নস্টিকদের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরে তারপর সেগুলোকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করতেন, ব্যঙ্গ করতেন এবং খণ্ডন করতেন। অনেকটা আদালতে প্রতিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে তাকে দুর্বল প্রমাণ করার মতো। নস্টিকদের নিজেদের লেখা প্রায় সমস্ত বই ‘বিপজ্জনক’ এবং ‘শয়তানি’ বলে ঘোষণা করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ থিওফিলাসের নির্দেশে সেরাপিস দেবতার মন্দির এবং তার সাথে থাকা বিখ্যাত লাইব্রেরির একাংশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যেখানে হয়তো অনেক নস্টিক গ্রন্থও ছিল। এর ফলে, নস্টিকদের কণ্ঠস্বর চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল বলে মনে করা হতো।

কিন্তু নস্টিকরা নিজেরা কী ভাবত? তারা তাদের দর্শন কীভাবে ব্যাখ্যা করত? তাদের নিজেদের লেখা বইগুলো কোথায়?

এই প্রশ্নের উত্তর মিলল এক আশ্চর্য নাটকীয় পরিস্থিতিতে, যা শুনলে মনে হবে যেন কোনো সিনেমার কাহিনি। সময়টা ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। স্থান: উচ্চ মিশর বা আপার ইজিপ্টের নাগ হাম্মাদি (Nag Hammadi) নামের এক ছোট্ট শহরের কাছে, জাবাল আল-তারিফ পাহাড়ের পাদদেশে। মোহাম্মদ আলী আল-সাম্মান নামের এক স্থানীয় কৃষক তার ভাইদের সাথে মাটির সার (sabakh) উত্তোলনের জন্য জমি খুঁড়ছিলেন। হঠাৎ তার কোদালে শক্ত কিছু একটার আওয়াজ হলো। মাটি সরিয়ে তিনি দেখলেন, সেখানে প্রায় এক মিটার উঁচু একটি লাল মাটির জার বা কলস পোঁতা আছে, যার মুখটা আঠা দিয়ে শক্ত করে বন্ধ করা।

প্রথমে তিনি ভাবলেন, ভেতরে হয়তো গুপ্তধন, সোনাদানা লুকিয়ে রাখা আছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে ভয় হলো, জারের ভেতর কোনো ‘জিন’ (Djinn) বা অশুভ আত্মা বন্দী থাকতে পারে, যা বেরিয়ে এসে তার ক্ষতি করবে। কিছুক্ষণ দ্বিধার পর, লোভ ভয়ের উপর জয়ী হলো। তিনি কুড়ুল দিয়ে সাবধানে কলসটি ভাঙলেন। ভেতরে কোনো সোনাদানা বা জিন ছিল না। ছিল ধুলোমাখা, চামড়ার সুন্দর মোড়কে বাঁধানো তেরোটি পুরনো বই, যা প্রাচীন প্যাপিরাস (Papyrus) কাগজে লেখা।

মোহাম্মদ আলী তখনো জানতেন না, তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক আবিষ্কারটি করে ফেলেছেন। তিনি বইগুলো বাড়ি নিয়ে গিয়ে তার মায়ের উনুনের পাশে রেখে দেন। দুঃখজনকভাবে, তার মা কয়েকটি বইয়ের কিছু পাতা রান্নার আগুন ধরাতে ব্যবহার করে ফেলেন। পরে, পারিবারিক এক রক্তক্ষয়ী বিবাদের জেরে মোহাম্মদ আলী বইগুলো একজন স্থানীয় পুরোহিতের কাছে জমা রাখেন। সেখান থেকে নানা হাত ঘুরে একটি বই কায়রোর কপ্টিক মিউজিয়ামে পৌঁছায় এবং জঁ ডোরেস (Jean Doresse) নামক এক ফরাসি পণ্ডিত প্রথমবার এর গুরুত্ব অনুধাবন করেন। এরপর শুরু হয় বাকি বইগুলোকে খুঁজে বের করে একত্রিত করার এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতি, প্রত্নবস্তু পাচার এবং অ্যাকাডেমিক রেষারেষির এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনি (Robinson, 2014)।

অবশেষে, যখন সমস্ত বই একত্রিত করে পাঠোদ্ধার করা হলো, তখন পণ্ডিতরা বুঝতে পারলেন, তারা কী অমূল্য সম্পদ খুঁজে পেয়েছেন। এই বইগুলোই ছিল প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া নস্টিকদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থের এক বিশাল সংগ্রহশালা। চতুর্থ শতাব্দীতে লেখা এই বইগুলো ছিল তারও আগেকার (দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীর) অরিজিনাল গ্রিক থেকে কপ্টিক (Coptic) ভাষায় অনুবাদ করা। সম্ভবত কাছাকাছি কোনো মঠের সন্ন্যাসীরা, যারা নস্টিক চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন, তারা যখন দেখলেন যে অর্থোডক্স চার্চ এই ধরনের বই ধ্বংস করে দিচ্ছে, তখন তারা তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি জারের ভেতর সাবধানে ভরে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

এই বইগুলো আবিষ্কারের ফলে প্রথমবারের মতো নস্টিকদের তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে শোনার সুযোগ পেল আধুনিক বিশ্ব (Robinson, 1988)।

হারানো গসপেল ও গুপ্ত জ্ঞানের ভান্ডার

এই নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরিতে ৫২টি ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ (Tractate) পাওয়া যায়, যা তেরোটি কোডেক্স বা বইয়ের আকারে ছিল। এর মধ্যে অনেকগুলো ছিল সম্পূর্ণ অজানা, আর কিছু ছিল যেগুলোর নাম আমরা শুধু ধর্মগুরুদের লেখাতেই পেয়েছিলাম। তার মধ্যে কয়েকটি হলো:

  • দ্য গসপেল অফ টমাস (The Gospel of Thomas): এটি সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার। এটি কোনো কাহিনি-ভিত্তিক গসপেল নয়, বরং যিশুর ১১৪টি গুপ্ত বাণীর সংকলন। এখানে যিশু পাপ বা অনুশোচনার কথা বলেন না, বলেন জ্ঞান এবং আত্ম-আবিষ্কারের কথা। এর প্রথম বাণীটিই হলো: “যিশু বলেছেন, ‘যে এই কথাগুলোর ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে, সে মৃত্যুর স্বাদ পাবে না।’” এটি আমাদের দেখায় যে, যিশুর বাণী নিয়ে প্রচলিত গসপেলের বাইরেও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধারা বিদ্যমান ছিল।
  • দ্য গসপেল অফ ফিলিপ (The Gospel of Philip): এটি বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ধারণা, স্যাক্রামেন্ট বা সংস্কার এবং রূপকের সংকলন। এখানে যিশু ও মেরি ম্যাগডালিনের (Mary Magdalene) মধ্যে এক বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মেরি ছিলেন যিশুর ‘সঙ্গী’ (koinonos) এবং যিশু তাঁকে অন্য শিষ্যদের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন এবং প্রায়ই তাঁর মুখে চুম্বন করতেন। এটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’-এর মতো জনপ্রিয় উপন্যাসের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
  • দ্য গসপেল অফ মেরি (The Gospel of Mary): এই অসম্পূর্ণ গ্রন্থটিতে মেরি ম্যাগডালিনকে যিশুর একজন প্রধান শিষ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে, যাকে যিশু এমন কিছু গুপ্ত জ্ঞান দিয়েছিলেন যা অন্য পুরুষ শিষ্যদের, বিশেষ করে পিটারকে (Peter) দেননি। পিটারের সাথে মেরির এই জ্ঞান নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, যা আদি খ্রিস্টীয় সমাজে নারীর নেতৃত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
  • দি অ্যাপোক্রিফন অফ জন (The Apocryphon of John): এটি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নস্টিক গ্রন্থগুলোর একটি। এখানে যিশুর পুনরুত্থানের পর শিষ্য জনকে পুরো নস্টিক সৃষ্টিতত্ত্ব – প্লেরোমা, সোফিয়ার পতন, ডেমিয়ার্জের জন্ম এবং মানব মুক্তির উপায় – বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমাদের নস্টিক পুরাণ সম্পর্কিত জ্ঞানের বড় অংশই এখান থেকে প্রাপ্ত।
  • থান্ডার, পারফেক্ট মাইন্ড (Thunder, Perfect Mind): এটি এক ঐশ্বরিক নারী সত্তার (সম্ভবত সোফিয়া বা বার্বেলো) মুখে বলা এক আশ্চর্য, প্যারাডক্সিকাল ও কাব্যিক স্বগতোক্তি। সেই সত্তা বলছে: “আমিই প্রথম এবং আমিই শেষ… আমিই পতিতা এবং আমিই পবিত্রা… আমিই মা এবং আমিই কন্যা… আমিই নীরবতা যা বোঝা যায় না এবং আমিই সেই ধারণা যার স্মৃতি অনেক।” এই কবিতাটি নস্টিকদের দ্বৈততার ঊর্ধ্বে এক পরম সত্যকে ধরার চেষ্টার এক অসাধারণ উদাহরণ।

এই গ্রন্থগুলো আবিষ্কারের পর নস্টিসিজম নিয়ে গবেষণার এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। আমরা বুঝতে পারি, শুরুর দিকের খ্রিস্টীয় জগৎটা যতটা একরৈখিক বা মনোলিথিক ভাবা হতো, ততটা ছিল না। সেখানে নানা ধরনের চিন্তার স্রোত বহমান ছিল, যার মধ্যে নস্টিসিজম ছিল অন্যতম শক্তিশালী, সৃজনশীল এবং আকর্ষণীয় একটি ধারা (Ehrman, 2003)। নাগ হাম্মাদির এই মাটির কলস যেন ইতিহাসের এক টাইম ক্যাপসুল ছিল, যা আমাদের হারিয়ে যাওয়া এক আধ্যাত্মিক মহাবিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছে।

পরাজয়ের কারণ: কেন হেরে গেল নস্টিকরা?

যদি নস্টিসিজম এতই আকর্ষণীয়, এত কাব্যিক এবং শক্তিশালী একটি দর্শন হয়, তাহলে এটি মূল স্রোত থেকে হারিয়ে গেল কেন? কেন ইতিহাসের পাতায় তারা ‘হেরিটিক’ বা বিধর্মী হিসেবেই পরিচিত হয়ে রইল? কেন আইরেনিয়াস বা টারটুলিয়ানের ‘অর্থোডক্স’ (Orthodox) বা প্রচলিত খ্রিস্টধর্মই শেষ পর্যন্ত টিকে গেল এবং ইতিহাসের বিজয়ী হলো?

এই প্রশ্নের উত্তর কোনো একক কারণে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছিল এক দীর্ঘ ও জটিল সংগ্রামের ফলাফল, যেখানে দর্শন, সমাজনীতি, সংগঠন এবং রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। নস্টিকরা ছিল অনেকটা একদল মেধাবী কিন্তু অসংগঠিত গেরিলা যোদ্ধার মতো, আর অর্থোডক্স চার্চ ছিল এক সুশৃঙ্খল, ক্রমবর্ধমান রোমান লিজিয়নের মতো। শেষ পর্যন্ত লিজিয়নই জয়ী হয়েছিল। এর কারণগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি।

সাংগঠনিক দুর্বলতা বনাম প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি

যেকোনো ধারণা বা আন্দোলনকে দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখতে হলে একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজন হয়। এখানেই নস্টিসিজম সবচেয়ে বড় দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছিল। নস্টিসিজম ছিল চরমভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং বহুধা-বিভক্ত। এটি ছিল ছোট ছোট গোষ্ঠীর এক সমাবেশ, যার প্রতিটিই কোনো না কোনো ক্যারিশম্যাটিক গুরু বা শিক্ষকের চারপাশে গড়ে উঠত। মুক্তি আসত ব্যক্তিগত ‘নোসিস’ বা জ্ঞান থেকে, কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নয়। গুরুর কাজ ছিল পথ দেখানো, কিন্তু জ্ঞানটা লাভ করতে হতো শিষ্যকে তার নিজের ভেতরেই। গুরুর মৃত্যুর পর এই গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই ভেঙে যেত অথবা নতুন নতুন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ত। তাদের মধ্যে কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থের তালিকা (Canon) বা কঠোর সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না যা সবাইকে এক ছাতার তলায় ধরে রাখতে পারে।

অন্যদিকে, অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম ঠিক এর বিপরীত পথে হেঁটেছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দী জুড়ে তারা ধীরে ধীরে একটি সুসংগঠিত, স্তরবিন্যস্ত (hierarchical) প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছিল।

  • এপিস্কোপাল কাঠামো (Episcopal Structure): প্রতিটি শহরের চার্চ একজন বিশপের (Bishop) নেতৃত্বে পরিচালিত হতো, যাকে সাহায্য করত প্রিসবিটার (Presbyters) ডিকনরা (Deacons)। এই বিশপদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল, যা তাদের মধ্যে এক ধরনের একতা তৈরি করত।
  • অ্যাপোস্টোলিক সাকসেশন (Apostolic Succession): অর্থোডক্স চার্চ দাবি করত যে, তাদের বিশপদের কর্তৃত্ব এসেছে যিশুর শিষ্য বা অ্যাপোস্টলদের থেকে এক অবিচ্ছিন্ন ধারার মাধ্যমে। এই ধারণাটি তাদের এক বিরাট বৈধতা দিয়েছিল। তারা বলতে পারত, “আমরাই আসল চার্চ, কারণ আমাদের শিক্ষা সরাসরি যিশুর শিষ্যদের কাছ থেকে এসেছে।” নস্টিকদের গুপ্ত জ্ঞানের দাবির বিরুদ্ধে এটি ছিল এক শক্তিশালী পাল্টা দাবি।
  • নির্দিষ্ট নিয়মকানুন (Creed): অর্থোডক্সরা ধীরে ধীরে বিশ্বাসের কিছু মৌলিক সূত্র বা ‘ক্রিড’ তৈরি করতে শুরু করে, যা সংক্ষেপে তাদের মূল বিশ্বাসগুলোকে তুলে ধরত। যে কেউ এই ক্রিড গ্রহণ করলেই সে সম্প্রদায়ের অংশ হতে পারত। এটি তাদের মধ্যে এক ধরনের মতাদর্শগত একতা তৈরি করেছিল, যা নস্টিকদের মধ্যে ছিল না (Chadwick, 1993)।

সহজ কথায়, নস্টিকরা ছিল একদল মুক্ত চিন্তাবিদ, আর অর্থোডক্সরা ছিল এক সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী। ইতিহাসে প্রায়শই দেখা যায়, সেনাবাহিনীই জয়ী হয়।

জটিলতা ও গোপনীয়তা বনাম সরল বার্তা

নস্টিসিজমের দর্শন ছিল অত্যন্ত জটিল, কাব্যিক এবং আধ্যাত্মিক অভিজাতদের জন্য। প্লেরোমার ৩০ জন এইয়নের নাম, সোফিয়ার পতনের জটিল কাহিনি, ডেমিয়ার্জ ও আর্কনদের জগৎ – এই সবকিছু বোঝা এবং উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের জন্য ছিল অত্যন্ত কঠিন। তাদের ‘নোসিস’ বা জ্ঞান ছিল গুটিকয়েক নির্বাচিত (Pneumatics) মানুষের জন্য। এটি কোনো গণ-আন্দোলন ছিল না, ছিল এক গুপ্ত সাধনার পথ।

অন্যদিকে, অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের বার্তা ছিল অনেক সহজ, সরল এবং শক্তিশালী। তাদের বার্তা ছিল: “তুমি একজন পাপী, কিন্তু তোমার জন্য একটি শুভ সংবাদ আছে। যিশু হলেন ঈশ্বরের পুত্র। তিনি তোমার পাপের জন্য ক্রুশে মারা গেছেন। তাঁকে বিশ্বাস করো, চার্চের সদস্য হও, ব্যাপ্টাইজড হও, তাহলেই তুমি অনন্ত জীবন পাবে।”

এই বার্তাটি ছিল সর্বজনীন এবং গণতান্ত্রিক। এর জন্য কোনো গভীর দার্শনিক জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল না। একজন দাস, একজন কৃষক, একজন সৈনিক, একজন নারী – যে কেউই এই বার্তা গ্রহণ করতে পারত। এটি মানুষকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিত, মৃত্যুর ভয় থেকে সান্ত্বনা দিত এবং একটি সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ার অনুভূতি দিত। এই সহজবোধ্য, আশাবাদী ও গণতান্ত্রিক বার্তাটি সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং গ্রহণীয় ছিল।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বনাম সামাজিক একতা

একটি আন্দোলন কতটা সফল হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে সমাজের মূল ভিত্তিগুলোর সাথে তার সম্পর্কের উপর। জগৎ ও শরীরকে খারাপ মনে করার কারণে নস্টিকরা অনেক সময় সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিত। তাদের কঠোর তপস্বী শাখাটি বিয়ে, সন্তান জন্মদান বা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের মতো সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলত। তাদের কাছে পরিবার ছিল ডেমিয়ার্জের জগতের এক প্রতিষ্ঠান, আর সন্তান জন্মদান ছিল আত্মাকে কারাগারে বন্দী করার নামান্তর। একটি দর্শন যদি সমাজের মূল ভিত্তিগুলোকেই অস্বীকার করে, তবে তার পক্ষে বৃহত্তর সমাজে টিকে থাকা কঠিন। এটি মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, একাকী করে তোলে।

অন্যদিকে, অর্থোডক্স চার্চ ছিল অনেক বেশি বাস্তববাদী। তারাও আধ্যাত্মিক জীবনের উপর জোর দিত, কিন্তু তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই দেখত এবং সেগুলোকে একীভূত করার চেষ্টা করত। তারা শক্তিশালী সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল। চার্চগুলো ছিল একাধারে উপাসনালয় এবং সামাজিক কেন্দ্র, যেখানে বিধবা, অনাথ ও দরিদ্রদের সাহায্য করা হতো (Brown, 1988)। এই সামাজিক কর্মকাণ্ড চার্চকে সাধারণ মানুষের জীবনে এক অপরিহার্য অংশ করে তুলেছিল। মানুষ দেখত, চার্চ কেবল পরকালের কথা বলে না, ইহকালের দুঃখ-কষ্টেও পাশে দাঁড়ায়। এই সামাজিক একতা এবং গঠনমূলক ভূমিকা তাদের জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।

রাজনৈতিক নিপীড়ন: চূড়ান্ত আঘাত

উপরের কারণগুলো নস্টিসিজমকে দুর্বল করে দিয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত আঘাতটি এসেছিল রাজনীতি থেকে। প্রথম তিন শতাব্দী ধরে খ্রিস্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যে একটি অবৈধ ধর্ম ছিল এবং সব ধারার খ্রিস্টানরাই কমবেশি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীতে এসে সবকিছু পাল্টে গেল।

৩১৩ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন (Constantine) মিলানের ফরমান (Edict of Milan) জারি করে খ্রিস্টধর্মকে আইনি স্বীকৃতি দেন। কন্সট্যান্টাইন নিজে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং অর্থোডক্স বা ক্যাথলিক ধারার চার্চের পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেন। হঠাৎ করেই, যে চার্চ এতদিন নির্যাতিত ছিল, তা ক্ষমতার অংশীদার হয়ে গেল। এরপর ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিয়াস (Theodosius) খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের একমাত্র রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন।

এই ঘটনার পর অর্থোডক্স চার্চ বিপুল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করে। তখন তারা তাদের প্রতিপক্ষ সব মতবাদকে – নস্টিসিজম, মার্সিয়নিজম, আরিয়ানিজম‘ভ্রান্ত’ বা ‘হেরিটিক্যাল’ (Heretical) ঘোষণা করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের দমন করতে শুরু করে। ‘হেরিসি’ আর কেবল ধর্মতাত্ত্বিক ভুল থাকল না, এটি পরিণত হলো রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য এক অপরাধে। নস্টিকদের বইপত্র গণহারে পোড়ানো হয়, তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাদের জোর করে মূলধারার বিশ্বাস গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় বা সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসিত করা হয়। রাষ্ট্রীয় তরবারির সামনে নস্টিকদের ব্যক্তিগত জ্ঞান বা দর্শন অসহায় হয়ে পড়ে (Pagels, 1979)।

এই সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পঞ্চম শতাব্দীর পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক নস্টিসিজম ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। সংগঠন, সরল বার্তা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং সবশেষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছে হেরে গিয়েছিল এক গভীর, কিন্তু বিশৃঙ্খল ও জগৎ-বিদ্বেষী দর্শন।

কিন্তু তার চিন্তার বীজ কি পুরোপুরি মরে গিয়েছিল? ইতিহাস বলে, না।

নস্টিসিজমের প্রতিবেশীরা: বন্ধু, শত্রু ও ছদ্মবেশী আত্মীয়

চিন্তারাও অনেকটা মানুষের মতো। তারা একা একা বাস করে না। তাদের প্রতিবেশী থাকে, বন্ধু থাকে, আবার ঘোর শত্রুও থাকে। তারা একে অপরের সাথে ঝগড়া করে, তর্ক করে, আবার কখনও গোপনে প্রেমও করে। একটি চিন্তাকে একা একা বুঝতে চাইলে প্রায়শই ভুল হয়। তাকে বুঝতে হলে তার চারপাশের অন্য চিন্তাদের সাথে তার সম্পর্কটাকেও বুঝতে হয় – সে কার কাছ থেকে কী ধার করেছে, কাকে সে ঘৃণা করে, আর কেই বা তার আপন যমজ ভাইয়ের মতো দেখতে।

নস্টিসিজম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর সেই উত্তাল বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে একা ছিল না। তার চারপাশে আরও তিনটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী চিন্তাধারার স্রোত বয়ে চলেছিল: নিওপ্লেটোনিক বা নব্যপ্লেটোবাদী দর্শন (Neoplatonism), হার্মেটিসিজম (Hermeticism) এবং ম্যানিকাইজম (Manichaeism)। এরা ছিল নস্টিসিজমের প্রতিবেশী। এদের সাথে নস্টিসিজমের সম্পর্কটা ছিল অত্যন্ত জটিল – কখনও তীব্র সংঘাতের, কখনও আশ্চর্য সাদৃশ্যের, আবার কখনও প্রায় পারিবারিক। এই তিনটি আয়নার সামনে না ধরলে নস্টিসিজমের আসল চেহারাটা পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। চলুন, সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এই তিন মহারথীর সাথে নস্টিসিজমের সম্পর্কটা কেমন ছিল, তা একটু তলিয়ে দেখা যাক।

নব্যপ্লেটোবাদ বা নিওপ্লেটোনিজম (Neoplatonism): এক আভিজাত্যপূর্ণ সংঘাত

যদি নস্টিসিজম হয় প্লেটোর দর্শনের এক বিদ্রোহী, আবেগপ্রবণ ও হতাশাবাদী সন্তান, তবে নব্যপ্লেটোবাদ বা নিওপ্লেটোনিজম হলো তাঁর সবচেয়ে অনুগত, সবচেয়ে মেধাবী এবং সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ ছাত্র। তৃতীয় শতাব্দীতে মিশরীয় দার্শনিক প্লোটিনাস (Plotinus) (আনুমানিক ২০৪-২৭০ খ্রিস্টাব্দ) রোমে তাঁর স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এই ধারার গোড়াপত্তন করেন এবং তাঁর শিষ্য পরফিরি (Porphyry) তাঁর শিক্ষাগুলোকে ‘এনিয়াডস’ (Enneads) নামক গ্রন্থে সুসংবদ্ধ রূপ দেন। এটি ছিল নিছক কোনো দর্শন নয়, ছিল একাধারে একটি আধ্যাত্মিক পথ এবং এক পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববীক্ষা। নব্যপ্লেটোবাদী দর্শন ছিল প্রাচীন গ্রিক দর্শনের শেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ, যা পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয়, ইসলামী এবং ইহুদি মরমীবাদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

দর্শনটা কী? এক সুন্দর ও যৌক্তিক মহাবিশ্ব

নব্যপ্লেটোবাদী দর্শন এক গভীর, সুন্দর এবং যৌক্তিকভাবে সুশৃঙ্খল মহাবিশ্বের ছবি আঁকে। তাদের মতে, সমস্ত অস্তিত্বের উৎস হলেন ‘এক’ (The One বা to Hen)

  • ‘এক’ (The One): এই ‘এক’ হলেন অচিন্তনীয়, বর্ণনাতীত এবং পরম শুভ (The Good)। তিনি নস্টিকদের পরম পিতার মতোই জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার করা যায় না, কারণ তিনি সমস্ত গুণের উৎস, কোনো বিশেষ গুণে সীমাবদ্ধ নন। তিনি কোনো কিছু ‘ইচ্ছা’ করেন না বা ‘সৃষ্টি’ করেন না, কারণ ইচ্ছা বা কর্ম অপূর্ণতার লক্ষণ। তিনি এতটাই পরিপূর্ণ যে, তাঁর থেকে বাকি সবকিছু স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গত হয়।
  • উদ্গীরণ (Emanation): এই ‘এক’ থেকে, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই, অনেকটা উপচে পড়া ঝর্ণার মতো বা সূর্য থেকে যেমন আলোকরশ্মি নির্গত হয়, ঠিক সেভাবে পর্যায়ক্রমে বাকি সবকিছুর উদ্ভব হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় উদ্গীরণ বা ইমানেশন। প্রতিটি নতুন স্তর তার উৎসের চেয়ে একটু কম পরিপূর্ণ, আলোর উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়ার মতো। এই স্তরগুলোকে বলা হয় ‘হাইপোস্টেসিস’ (Hypostases)
    1. ‘নূস’ (Nous) বা বুদ্ধির জগৎ (Intellect): ‘এক’ যখন নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে, তখন প্রথম যে উদ্গীরণটি ঘটে, তা হলো ‘নূস’। এটি হলো বুদ্ধির জগৎ, যেখানে প্লেটোর সমস্ত শাশ্বত ধারণা বা ফর্ম (Forms) বিদ্যমান। এটি হলো মহাবিশ্বের ব্লুপ্রিন্ট বা নকশা।
    2. ‘সাইকি’ (Psyche) বা বিশ্ব-আত্মা (World-Soul): ‘নূস’ থেকে উদ্ভূত হয় ‘সাইকি’। এটি এই বুদ্ধির জগৎ এবং জড় জগতের মধ্যে সেতু তৈরি করে। বিশ্ব-আত্মার একটি উচ্চতর অংশ ‘নূস’-এর দিকে তাকিয়ে থাকে এবং একটি নিম্নতর অংশ জড় জগৎকে শৃঙ্খলা ও জীবন দান করে।
    3. ‘হাইল’ (Hyle) বা জড় জগৎ (Matter): সবশেষে আসে জড় জগৎ, যা হলো আলোর সর্বনিম্ন এবং অন্ধকারতম প্রকাশ। জড় পদার্থ নিজে মন্দ নয়, কিন্তু এটি মন্দের সম্ভাবনা তৈরি করে, কারণ এটি হলো ঐক্যের অনুপস্থিতি, আলোর সর্বনিম্ন মাত্রা।

এই দর্শনে, জগৎটা কোনো দুর্ঘটনা বা ভুলের ফসল নয়। এটি হলো সেই পরম ‘এক’-এরই এক সুন্দর, যদিও অসম্পূর্ণ, প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি স্তরই তার উপরের স্তরের এক অনিবার্য এবং শুভ প্রকাশ। সুতরাং, এই জগৎ প্রকৃতিগতভাবে বা অন্তর্নিহিতভাবে ভালো এবং সুন্দর। মানবাত্মা এই বিশ্ব-আত্মারই একটি অংশ, যা সাময়িকভাবে দেহের মধ্যে এসে তার উৎসকে ভুলে গেছে। তার কাজ হলো এই জগতের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করে (Aesthetics), নৈতিক জীবনযাপন করে (Ethics) এবং সবশেষে দর্শনের সিঁড়ি বেয়ে (Dialectics) ধাপে ধাপে আবার সেই পরম ‘এক’-এর সাথে মিলিত হওয়া (a mystical union বা henosis)।

সম্পর্কটা কেমন: কাজিনদের লড়াই

নস্টিসিজম এবং নব্যপ্লেটোবাদী দর্শন – উভয়েই প্লেটোর কাছ থেকে গভীরভাবে ঋণী। দুজনেই এক পরম, বর্ণনাতীত সত্তার কথা বলে, দুজনেই ইমানেশন বা উদ্গীরণের তত্ত্বে বিশ্বাস করে, এবং দুজনেই আত্মার ঊর্ধ্বমুখী যাত্রার কথা বলে। তারা ছিল অনেকটা একই পরিবারের দুই কাজিনের মতো, যারা একই পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারী কিন্তু একে অপরের বিশ্ববীক্ষাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করে। তাদের মধ্যেই বেধেছিল সবচেয়ে তীব্র বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই।

প্লোটিনাস তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কিছু নস্টিককে পেয়েছিলেন (সম্ভবত শেথীয় নস্টিক), যারা তাঁর ক্লাসে আসত এবং তাদের নিজস্ব দর্শন প্রচার করত। তাদের দর্শন শুনে তিনি এতটাই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনিয়াডস’ (Enneads)-এর একটি বিশাল অংশ (Ennead II.9) তাদের মত খণ্ডন করার জন্য উৎসর্গ করেন। এই লেখাটির শিরোনামই ছিল ‘তাদের বিরুদ্ধে, যারা এই জগৎ এবং তার স্রষ্টাকে মন্দ বলে মনে করে’ (Against Those Who Affirm the Creator of the Cosmos and the Cosmos Itself to be Evil)

প্লোটিনাসের মূল অভিযোগগুলো ছিল যুক্তিপূর্ণ, আবেগপূর্ণ এবং তীব্র:

  • জগতের প্রতি নিন্দা (Slander against the Cosmos): প্লোটিনাসের কাছে এই জগৎ ছিল এক জীবন্ত, ঐশ্বরিক সত্তা, এক দৃশ্যমান দেবতা (a visible god), যা তার স্রষ্টার (অর্থাৎ, বিশ্ব-আত্মা এবং নূসের) সৌন্দর্য, বুদ্ধি এবং শৃঙ্খলাকে প্রতিফলিত করে। নস্টিকরা যখন এই জগৎকে ‘মন্দ’ এবং ‘কারাগার’ বলে, তখন তারা আসলে এই জগতের স্রষ্টা এবং তারও উৎস যে পরম ‘এক’, তাঁকেই অপমান করে। এটি ছিল তাঁর চোখে এক ধরনের আধ্যাত্মিক কৃতঘ্নতা এবং অন্ধত্ব। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, “যারা এই জগতের সৌন্দর্যে আনন্দিত হতে পারে না, তাদের আত্মা নিশ্চয়ই কদর্য।”
  • অহংকার ও বিচ্ছিন্নতা (Arrogance and Alienation): নস্টিকরা দাবি করত যে, তাদের ভেতরে এমন এক ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ (Pneuma) আছে, যা এই জগৎ, গ্রহ-নক্ষত্র, এমনকি বিশ্ব-আত্মার (Psyche) চেয়েও উচ্চতর। প্লোটিনাসের কাছে এটা ছিল এক চরম, অসহনীয় অহংকার। তিনি মনে করতেন, মানবাত্মা এই মহাবিশ্বেরই একটি অংশ, তার থেকে বিচ্ছিন্ন বা উচ্চতর কিছু নয়। এই মহাজাগতিক ঐকতানে প্রতিটি সত্তারই একটি নির্দিষ্ট স্থান ও ভূমিকা আছে। জগৎকে ঘৃণা করার মাধ্যমে এবং নিজেদেরকে এই জগতের বাইরের কোনো ‘বিশেষ’ সত্তা ভাবার মাধ্যমে নস্টিকরা আসলে নিজেদেরকেই মহাজাগতিক ঐকতান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক রোগে ভুগছে।
  • প্লেটোর বিকৃতি (Distortion of Plato): নস্টিকরা প্লেটোর ‘ডেমিয়ার্জ’ বা কারিগরকে এক অজ্ঞ ও মন্দ স্রষ্টায় পরিণত করেছিল। প্লোটিনাসের কাছে এটি ছিল তাঁর গুরুর দর্শনের এক ইচ্ছাকৃত ও ভয়াবহ বিকৃতি। প্লেটোর ডেমিয়ার্জ ছিল এক শুভ সত্তা যে বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায় রূপান্তরিত করে। নস্টিকরা সেই শুভ কারিগরকে এক অজ্ঞ জেলার বানিয়ে প্লেটোর প্রতি চরম অবিচার করেছে।
  • নৈতিকতার অভাব (Ethical Passivity): প্লোটিনাসের মতে, আত্মার আরোহণ একটি কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ, যার জন্য প্রয়োজন কঠোর নৈতিক শৃঙ্খলা এবং দার্শনিক অনুশীলন। কিন্তু নস্টিকরা মনে করত, তাদের মুক্তি পূর্বনির্ধারিত, কারণ তারা জন্মগতভাবেই ‘নিউম্যাটিক’। প্লোটিনাসের কাছে এটি ছিল এক ধরনের নৈতিক অলসতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।

এই সংঘাত ছিল আসলে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিশ্ববীক্ষার সংঘাত। নব্যপ্লেটোবাদীদের কাছে জগৎ ছিল এক সুন্দর, যদিও অসম্পূর্ণ, মন্দির, যেখানে আত্মার আরোহণের পথ খুঁজে নিতে হবে। এটি ছিল এক আশাবাদী ও জগৎ-সমর্থনকারী দর্শন। অন্যদিকে, নস্টিকদের কাছে জগৎ ছিল এক জ্বলন্ত বাড়ি, যেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে যেতে হবে। এটি ছিল এক হতাশাবাদী ও জগৎ-পরিত্যাগকারী দর্শন (Armstrong, 1967)। এই দুই কাজিনের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত নব্যপ্লেটোবাদী দর্শনই বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে জয়ী হয়েছিল এবং পশ্চিমা দর্শনের মূল স্রোতে মিশে গিয়েছিল, আর নস্টিসিজম পরিণত হয়েছিল এক গুপ্ত, ভূগর্ভস্থ স্রোতে।

হার্মেটিসিজম (Hermeticism): এক আশাবাদী যমজ ভাই?

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর আলেকজান্দ্রিয়ার সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উর্বর ও উত্তাল ভূমিতেই নস্টিসিজমের পাশাপাশি আরও একটি মরমী ও গুপ্ত জ্ঞানের ধারার জন্ম হয়েছিল, যার নাম হার্মেটিসিজম। নস্টিসিজমের মতো এটিও কোনো সুসংগঠিত ধর্ম ছিল না, বরং ছিল কিছু দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর এক সমাবেশ, যারা এক বিশেষ ধরনের ‘নোসিস’ বা জ্ঞানের সন্ধান করত। এই দর্শনের অনুসারীরা তাদের জ্ঞানকে এক কিংবদন্তিতুল্য ঋষি হার্মিস ট্রিসমেগিস্টাস (Hermes Trismegistus) বা ‘ত্রিগুণ মহান হার্মিস’-এর নামে উৎসর্গ করত। হার্মিস ছিলেন এক পৌরাণিক চরিত্র, যিনি ছিলেন গ্রিক জ্ঞানের দেবতা হার্মিস (দেবতাদের বার্তাবাহক) এবং মিশরীয় প্রজ্ঞার দেবতা থোথ (যিনি লিখন পদ্ধতি, জাদু এবং বিজ্ঞানের আবিষ্কারক) – এই দুই দেবতার এক সমন্বিত (syncretic) রূপ। হার্মিস ট্রিসমেগিস্টাসকে এমন এক আদিম ঋষি হিসেবে দেখা হতো, যিনি মোজেস এবং জরাথুস্ত্রেরও আগে পৃথিবীতে জ্ঞান প্রচার করেছিলেন।

এই ধারার মূল গ্রন্থ হলো ‘কর্পাস হার্মেটিকাম’ (Corpus Hermeticum) নামক কিছু গ্রিক পুঁথির সংকলন, যা মূলত ঈশ্বর, জগৎ ও আত্মা বিষয়ক কিছু দার্শনিক সংলাপ বা বক্তৃতা।

দর্শনটা কী? জ্ঞানের মাধ্যমে দেবত্ব অর্জন

হার্মেটিসিজমের মূল লক্ষ্যও ছিল ‘নোসিস’ (Gnosis) বা জ্ঞান লাভ করা। তাদের কাছেও জ্ঞানই ছিল মুক্তি এবং অমরত্ব লাভের একমাত্র পথ।

  • পরম ঈশ্বর ও উদ্গীরণ: তারা এক পরম, অচিন্তনীয় ঈশ্বরের কথা বলত, যাকে প্রায়শই ‘পিতা’ বা ‘নূস’ (Nous – ঐশ্বরিক বুদ্ধি) নামে অভিহিত করা হতো। এই পরম সত্তা থেকেই উদ্গীরণ বা ইমানেশনের মাধ্যমে বাকি সবকিছুর, বিশেষ করে জগৎ ও মানুষের, উদ্ভব হয়েছে।
  • মানুষের দ্বৈত প্রকৃতি: হার্মেটিক দর্শন অনুযায়ী, মানুষ হলো এক অদ্ভুত, দ্বৈত সত্তা – একদিকে সে মরণশীল প্রাণী, যার একটি জড় দেহ আছে; অন্যদিকে তার ভেতরে রয়েছে অমর, ঐশ্বরিক বুদ্ধি বা ‘নূস’। এই ভেতরের ‘নূস’-ই হলো তার আসল সত্তা, পরম ঈশ্বরেরই একটি অংশ বা স্ফুলিঙ্গ।
  • মুক্তির পথ: মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হলো জাগতিক কামনা-বাসনা ও অজ্ঞতার ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজের এই ভেতরের দেবতাকে আবিষ্কার করা এবং জ্ঞানের (নোসিস) মাধ্যমে তার উৎস, অর্থাৎ পরম ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ডিফিকেশন’ (Deification) বা দেবত্ব অর্জন।

সম্পর্কটা কেমন: আশাবাদী বনাম হতাশাবাদী যমজ

নস্টিসিজম এবং হার্মেটিসিজমকে প্রায়শই যমজ ভাই হিসেবে দেখা হয়। তাদের দুজনেরই জন্ম একই সময়ে (হেলেনিস্টিক মিশর), একই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। দুজনেরই লক্ষ্য এক – ‘নোসিস’-এর মাধ্যমে মুক্তি। দুজনেই গুপ্ত জ্ঞান, উদ্ঘাটন (revelation) এবং ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার উপর জোর দেয়, যা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে আলাদা করে। তাহলে তাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

পার্থক্যটা কোনো মৌলিক তত্ত্বে নয়, পার্থক্যটা হলো তাদের মেজাজে, জগৎকে দেখার ভঙ্গিতে। হার্মেটিসিজমের মধ্যে দুটি প্রধান স্রোত থাকলেও, এর প্রভাবশালী ধারাটি ছিল চরমভাবে আশাবাদী (Optimistic) এবং জগৎ-সমর্থনকারী।

  • জগৎ যখন ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি: হার্মেটিকামের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পোইমানড্রেস’ (Poimandres)-এ (প্রথম খণ্ড) জগৎকে ঈশ্বরের এক সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জগৎ কোনো কারাগার নয়, বরং এটি হলো ঈশ্বরের মহিমা ও প্রজ্ঞা অধ্যয়ন করার এক বিশাল, জীবন্ত গ্রন্থ। প্রতিটি উদ্ভিদ, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি নক্ষত্র – সবকিছুই সেই পরম স্রষ্টার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করছে। মানুষ এই জগতে এসেছে স্রষ্টার এই অপূর্ব সৃষ্টিকে দেখতে, জানতে এবং ভালোবেসে তার উপাসনা করতে।
  • মানুষ যখন মহাজাগতিক সেতু: এই আশাবাদী ধারায় মানুষকে এক অত্যন্ত মহিমান্বিত সত্তা হিসেবে দেখা হয়। সে হলো ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’, এক ‘মরণশীল দেবতা’ (mortal god), যে মর্ত্য ও অমর্ত্য – উভয় জগতের সাথেই যুক্ত। তার পা পৃথিবীতে, কিন্তু তার মন নক্ষত্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তার কাজ হলো এই জগতের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলাকে জানা এবং এই জ্ঞানের মাধ্যমেই স্রষ্টার সাথে একাত্ম হওয়া। এখানে জগৎ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো কথা নেই, বরং জগৎকে জানার মাধ্যমেই মুক্তি। এই দর্শন রেনেসাঁসের মানবতাবাদীদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

হতাশাবাদী স্রোত: নস্টিক প্রতিধ্বনি

তবে, কর্পাস হার্মেটিকামের মধ্যে কিছু পুঁথি আছে (যেমন, সপ্তম খণ্ড, ‘The Biggest Evil in Men is Ignorance of God’) যেগুলোতে এক ধরনের হতাশাবাদী (Pessimistic) সুরও পাওয়া যায়। এই লেখাগুলোতে জগৎকে মন্দ, অন্ধকার এবং অজ্ঞতার স্থান হিসেবে দেখা হয়, এবং দেহকে আত্মার কারাগার বা সমাধি বলা হয়। এই ধারা অনুযায়ী, জগৎ হলো নিয়তি বা ‘হেইমারমেনে’-র অধীন এবং এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে জাগতিক সবকিছুকে ঘৃণা করতে হবে এবং কেবল ঊর্ধ্বের জগতের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। এই হতাশাবাদী বা জগৎ-পরিত্যাগকারী হার্মেটিসিজম নস্টিসিজমের দর্শনের খুব কাছাকাছি, এতটাই কাছাকাছি যে এদের আলাদা করা কঠিন (Bull, 2018)।

সুতরাং, নস্টিসিজম এবং হার্মেটিসিজম ছিল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, অথবা একই পরিবারের দুই ভাই – একজন আশাবাদী, অন্যজন হতাশাবাদী। নস্টিসিজম জগতের অন্ধকার, বিশৃঙ্খলা এবং নিষ্ঠুরতার দিকটাকেই কেবল দেখেছিল এবং তাকে একবাক্যে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অন্যদিকে, হার্মেটিসিজমের মূল ধারাটি জগতের আলো, সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলাকে দেখেছিল এবং তাকে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি হিসেবে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল (Fowden, 1986)। একজন চেয়েছিল কারাগার থেকে পালাতে, অন্যজন চেয়েছিল জগৎরূপী মন্দিরে উপাসনা করতে। কিন্তু দুজনেরই যাত্রার শেষ লক্ষ্য ছিল একই – জ্ঞানের মাধ্যমে পরম সত্তার সাথে মিলিত হওয়া।

এলকাসাইটবাদ (Elkesaitism): আইন, জ্যোতিষ ও গুপ্ত জ্ঞানের মিশ্রণ

যদি ভ্যালেন্টিনিয়ানরা হন নস্টিসিজমের দার্শনিক মুখ এবং শেথীয়রা হন তার পৌরাণিক হৃদয়, তবে নস্টিসিজমের জগতের প্রান্তে এমন কিছু গোষ্ঠীরও অস্তিত্ব ছিল, যাদেরকে কোনো একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা প্রায় অসম্ভব। এরা ছিল ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং নানা ধরনের গুপ্ত জ্ঞানের এক জটিল ও আকর্ষণীয় মিশ্রণ। এই সীমান্তবর্তী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম রহস্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল এলকাসাইটরা (Elkesaites)। তারা এমন এক অদ্ভুত ধর্মপালন করত, যেখানে একদিকে ছিল ইহুদি আইনের কঠোর অনুসরণ, অন্যদিকে ছিল জ্যোতিষশাস্ত্র এবং দেবদূতদের কাছ থেকে পাওয়া গুপ্ত জ্ঞান।

এই আন্দোলনটি প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে বা দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে, পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসকারী ইহুদি-খ্রিস্টান (Jewish-Christian) সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছিল। তাদের নাম এসেছে তাদের কিংবদন্তী প্রতিষ্ঠাতা এলকাসাই (Elkesai)-এর নাম থেকে, যার আরামাইক নামের অর্থ হতে পারে ‘গুপ্ত শক্তি’ (Hidden Power) – যা নিজেই এক নস্টিক ধারণার প্রতিধ্বনি করে।

গুপ্ত গ্রন্থ ও বারবার পবিত্র স্নান

এলকাসাইটদের ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি পবিত্র গ্রন্থ, যা ‘বুক অফ এলকাসাই’ (Book of Elkesai) নামে পরিচিত। বলা হয়, এই গ্রন্থটি এলকাসাই সরাসরি স্বর্গ থেকে এক বিশাল দেবদূতের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। এই দেবদূতের উচ্চতা ছিল ৯৬ মাইল এবং তাঁর সাথে ছিলেন একই আকারের এক নারী দেবদূত। মনে করা হয়, এই পুরুষ ও নারী দেবদূত হলেন যথাক্রমে ঈশ্বরের পুত্র এবং পবিত্র আত্মা – যা এক ধরনের দ্বৈতবাদী স্বর্গীয় নীতির দিকে ইঙ্গিত করে (Luttikhuizen, 2006)। এই গ্রন্থটিতে ভবিষ্যদ্বাণী, মহাজাগতিক রহস্য এবং পাপ মোচনের জন্য নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানের বিবরণ ছিল।

তাদের সবচেয়ে অদ্ভুত এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল পাপ মোচনের জন্য বারবার পূর্ণস্নান বা ব্যাপ্টিজম গ্রহণের রীতি। প্রচলিত খ্রিস্টধর্মে যেখানে ব্যাপ্টিজম জীবনে একবারই গ্রহণ করা হয়, এলকাসাইটরা বিশ্বাস করত যে গুরুতর পাপ (যেমন – মূর্তিপূজা বা ব্যভিচার) করার পর নির্দিষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রবাহিত জলে পূর্ণস্নান করলে সেই পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এই স্নান কেবল আধ্যাত্মিক ছিল না, এর সাথে ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রীয় গণনা; অর্থাৎ, অশুভ গ্রহের প্রভাব এড়ানোর জন্য সঠিক সময়ে এই স্নান করতে হতো।

আইন ও মরমীবাদের সমন্বয়

এলকাসাইটদের দর্শন ছিল এক আশ্চর্য সমন্বয়বাদ, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী ধারণাগুলো একসাথে সহাবস্থান করত:

  • ইহুদি আইনের প্রতি আনুগত্য: তারা কঠোরভাবে ইহুদি তোরাহ (Torah) বা আইন মেনে চলত। তারা বিশ্রামবার বা সাবাথ (Sabbath) পালন করত, খৎনা বা সারকামসিশন (circumcision) করত এবং খাদ্যসংক্রান্ত নিয়মকানুন মেনে চলত। তারা জেরুজালেমের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করত। এই দিক থেকে তারা ছিল পুরোপুরি ইহুদি-খ্রিস্টান।
  • প্রচলিত ধারণার প্রত্যাখ্যান: তবে তারা ইহুদি ধর্মের কিছু বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যেমন, তারা পশুবলি প্রথার ঘোর বিরোধী ছিল, যা তাদের এসেনীয়দের (Essenes) মতো অন্যান্য ইহুদি গোষ্ঠীর কাছাকাছি নিয়ে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা সেন্ট পল (St. Paul)-এর শিক্ষাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করত, কারণ তারা মনে করত পল তোরাহ-র আইনকে অস্বীকার করে মানুষকে বিপথে চালিত করেছেন।
  • এক বিচিত্র খ্রিস্টতত্ত্ব: যিশুর বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল অনন্য। তাদের মতে, খ্রিস্ট হলেন এক শাশ্বত সত্তা বা ‘সত্য নবী’ (True Prophet), যিনি সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন। আদম ছিলেন তাঁর প্রথম প্রকাশ। এরপর তিনি বিভিন্ন নবীর রূপ ধরে এসেছেন এবং শেষে যিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারা যিশুর কুমারী গর্ভে জন্ম বা তাঁর ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করত না। তারা মনে করত, এই ‘সত্য নবী’ ভবিষ্যতেও আবার আসবেন (Cirillo, 1987)। এই ধারণাটি কিছুটা ইসলামে নবীদের ধারাবাহিকতার ধারণার পূর্বাভাস দেয়।
  • জ্যোতিষ ও ভাগ্য: তাদের দর্শনে ভাগ্য এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের গভীর প্রভাব ছিল। তারা বিশ্বাস করত, মানুষের জীবন গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। তাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলোও শুভ-অশুভ তিথি ও নক্ষত্রের অবস্থান দেখে পালন করা হতো।

তাহলে এলকাসাইটদের কি পুরোপুরি নস্টিক বলা যায়?

এই প্রশ্নটির উত্তর বেশ জটিল। একদিকে, তাদের মধ্যে নস্টিক চিন্তার বেশ কিছু উপাদান স্পষ্টভাবেই উপস্থিত:

  • এক গুপ্ত, স্বর্গীয় গ্রন্থ যা দেবদূতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
  • এক বিশেষ ধরনের গুপ্ত জ্ঞান (নোসিস) যা সাধারণ বিশ্বাসীদের কাছে অজানা।
  • এক জটিল স্বর্গীয় জগৎ, যেখানে দেবদূত ও মহাজাগতিক শক্তিরা ক্রিয়াশীল।
  • প্রতিষ্ঠিত খ্রিস্টধর্ম ও ইহুদি ধর্মের প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে এক বিকল্প দর্শন।

কিন্তু অন্যদিকে, তারা নস্টিসিজমের কিছু মৌলিক ধারণা থেকে বেশ দূরে সরে গিয়েছিল:

  • আইনের প্রতি শ্রদ্ধা: বেশিরভাগ নস্টিক গোষ্ঠীই ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর (ডেমিয়ার্জ) এবং তাঁর দেওয়া আইনকে কারাগারের নিয়ম বলে মনে করত এবং তা প্রত্যাখ্যান করত। কিন্তু এলকাসাইটরা সেই আইনকেই মুক্তির পথের অংশ বলে মনে করত।
  • জগতের প্রতি মনোভাব: তারা জগৎকে ডেমিয়ার্জের বানানো ‘মন্দ’ কারাগার হিসেবে দেখত না। তাদের দ্বৈতবাদ আলো-অন্ধকারের মহাজাগতিক লড়াইয়ের চেয়েও বেশি ছিল আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্রতা-অপবিত্রতার বিভাজন।
  • মুক্তির উপায়: নস্টিকদের কাছে মুক্তি আসে কেবল জ্ঞান বা নোসিসের মাধ্যমে। কিন্তু এলকাসাইটদের কাছে মুক্তি আসত কঠোরভাবে আইন পালন এবং বারবার পবিত্র স্নানের মতো আচার-অনুষ্ঠানের (praxis) মাধ্যমে।

সুতরাং, এলকাসাইটদেরকে ‘নস্টিক’ না বলে বরং ‘নস্টিক প্রবণতাসম্পন্ন ইহুদি-খ্রিস্টান’ (Jewish-Christians with Gnostic tendencies) বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তারা সেই সময়ের এক জীবন্ত উদাহরণ, যা প্রমাণ করে যে প্রাচীন পৃথিবীতে ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারণাগুলোর মধ্যে কোনো স্পষ্ট বিভাজনরেখা ছিল না। ধারণাগুলো একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে এমন সব বিচিত্র ও বর্ণময় ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল, যা আজকের দিনের বিভাজিত পরিচয়ের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে।

ম্যানিকাইজম (Manichaeism): এক বিশ্বজয়ী আত্মীয়

যদি নব্যপ্লেটোবাদ হয় নস্টিসিজমের অভিজাত শত্রু এবং হার্মেটিসিজম হয় তার আশাবাদী যমজ ভাই, তবে ম্যানিকাইজম ছিল তার সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং সবচেয়ে বিশ্বজয়ী আত্মীয়। এটি ছিল নস্টিক চিন্তাধারারই এক নতুন, আরও শক্তিশালী এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, যা প্রায় এক হাজার বছর ধরে পৃথিবীর এক বিশাল অংশ জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তৃতীয় শতাব্দীতে পারস্যের নবী মানি (Mani) (আনুমানিক ২১৬-২৭৬ খ্রিস্টাব্দ) এই নতুন ধর্মের প্রচার শুরু করেন। মানি ছিলেন এক ঐতিহাসিক চরিত্র, যিনি মেসোপটেমিয়ার এক ইহুদি-খ্রিস্টান নস্টিক সম্প্রদায়, এলকাসাইটদের (Elkesaites) মধ্যে বড় হয়েছিলেন। তিনি দাবি করতেন যে, তাঁর এক স্বর্গীয় যমজ (divine twin) বা ‘Syzygos’ রয়েছে, যিনি তাঁকে ঐশ্বরিক জ্ঞান প্রদান করেছেন।

মানি নিজেকে ‘আলোর প্রেরিত’ (Apostle of Light) বলে ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ইতিহাসের শেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে দেখতেন। তিনি দাবি করেন যে, তিনি জরাথুস্ত্র, বুদ্ধ এবং যিশুর অসমাপ্ত কাজকে পূর্ণতা দিতে এসেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা সংস্কৃতির জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি চূড়ান্ত ও বিশ্বধর্ম (World Religion) প্রতিষ্ঠা করা।

দর্শনটা কী? আলো-আঁধারের শাশ্বত মহানাটক

ম্যানিকাইজম ছিল নস্টিসিজম, জরাথুস্ত্রবাদ, বৌদ্ধধর্ম এবং খ্রিস্টধর্মের এক অসাধারণ ও সুসংগঠিত মিশ্রণ। এর মূল ভিত্তি ছিল এক চরম, আপোষহীন এবং শাশ্বত দ্বৈতবাদ (Radical Dualism), যা জরাথুস্ত্রবাদের থেকেও অনেক বেশি র‍্যাডিকাল ছিল।

  • আলো ও অন্ধকারের শাশ্বত লড়াই: ম্যানিকাইজম অনুযায়ী, মহাবিশ্বের শুরুতে কোনো একক সত্তা ছিল না। ছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, শাশ্বত, অসৃষ্ট এবং সহ-অস্তিত্বশীল রাজ্য: আলোর রাজ্য (The Kingdom of Light), যা সুন্দর, শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল, যার অধিপতি হলেন পিতা বা জরওয়ান (Zurvan); এবং অন্ধকারের রাজ্য (The Kingdom of Darkness), যা কদর্য, বিশৃঙ্খল এবং হিংস্র, যার অধিপতি হলেন শয়তান বা আহরিমান (Ahriman)। এই দুটি রাজ্যের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল না।
  • মহাজাগতিক বিপর্যয়: কোনো এক সময়ে, অন্ধকারের বিশৃঙ্খল শক্তিরা আলোর রাজ্যের সৌন্দর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয় এবং তাকে আক্রমণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্য আলোর পিতা ‘আদি মানব’ (Primal Man) নামক এক যোদ্ধাকে সৃষ্টি করে পাঠান। কিন্তু সেই আদি মানব অন্ধকারের শক্তিদের কাছে পরাজিত হন এবং তাঁর আত্মার অংশ বা বর্ম (যা ছিল পাঁচটি আলোকময় উপাদান) অন্ধকারের হাতে বন্দী হয়ে যায়।
  • জগৎ যখন কারাগার ও শোধনাগার: আমাদের এই জড় জগৎ হলো সেই মহাজাগতিক বিপর্যয়েরই ফল। এটি কোনো অজ্ঞ দেবতার সৃষ্টি নয়, বরং এটি অন্ধকারের আর্কনরা তৈরি করেছে বন্দী আলোর কণাকে (Light Particles) কারাগারের মতো আটকে রাখার জন্য। কিন্তু একই সাথে, আলোর শক্তিরাও এই জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে, যাতে এটি কেবল কারাগার না হয়ে একটি শোধনাগার বা ‘ডিস্টিলেশন প্ল্যান্ট’ (distillation plant)-এ পরিণত হয়। চাঁদ এবং সূর্য হলো সেই শোধনাগারের দুটি যন্ত্র, যা পৃথিবী থেকে মুক্ত হওয়া আলোর কণাকে সংগ্রহ করে আলোর রাজ্যে ফেরত পাঠায়।
  • মানুষের দ্বৈত প্রকৃতি: মানবজাতি, বিশেষ করে প্রথম মানব আদমের সৃষ্টিও এই মহাজাগতিক নাটকেরই অংশ। মানুষের শরীর হলো অন্ধকারের তৈরি এক কারাগার, যা কামনা-বাসনা ও মৃত্যুর অধীন। কিন্তু তার আত্মার ভেতরে রয়েছে সেই বন্দী আলোর কণা। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হলো কঠোর তপস্যা এবং জ্ঞানের (নোসিস) মাধ্যমে তার ভেতরের আলোকে এই জড় দেহ এবং পুনর্জন্মের চক্র (বৌদ্ধধর্ম থেকে নেওয়া ধারণা) থেকে মুক্ত করা এবং তাকে আলোর রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

সম্পর্কটা কেমন: দর্শন থেকে ধর্মে রূপান্তর

অনেক পণ্ডিতই ম্যানিকাইজমকে নস্টিসিজমেরই একটি বিশেষ এবং অত্যন্ত সফল রূপ বলে মনে করেন। তাদের মধ্যে মিলগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট: জগৎ-বিদ্বেষ, চরম দ্বৈতবাদ, দেহকে আত্মার কারাগার মনে করা, এবং জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তির ধারণা। কিন্তু মানি ছিলেন একজন জিনিয়াস সংগঠক। তিনি নস্টিসিজমের বিমূর্ত এবং বিশৃঙ্খল দর্শনকে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন, যা তাকে এক বিশ্বধর্মে পরিণত হতে সাহায্য করেছিল।

তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও ছিল, যা ম্যানিকাইজমকে নস্টিসিজমের চেয়েও অনেক বেশি সফল করেছিল:

  • সংগঠন ও শ্রেণীবিন্যাস: নস্টিসিজম যেখানে ছিল মূলত কিছু বিচ্ছিন্ন দার্শনিক গোষ্ঠীর সমষ্টি, ম্যানিকাইজম সেখানে ছিল এক অত্যন্ত সুসংগঠিত, শ্রেণীবদ্ধ বা হায়ারার্কিকাল এবং মিশনারি ধর্ম। মানি একটি শক্তিশালী চার্চ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যার শীর্ষে ছিলেন তিনি নিজে এবং তারপর ছিলেন ১২ জন প্রেরিত, ৭২ জন বিশপ, ৩৬০ জন প্রিসবিটার এবং সাধারণ ধর্মপ্রচারক। এই সুশৃঙ্খল কাঠামো তাদের ধর্মকে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।
  • স্পষ্ট সামাজিক কাঠামো: মানি তাঁর অনুসারীদের দুটি সুস্পষ্ট ভাগে ভাগ করেছিলেন, যা ছিল তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভার সেরা নিদর্শন:
    1. ‘নির্বাচিত’ (The Elect): এরা ছিলেন সন্ন্যাসী এবং কঠোর তপস্যার জীবন যাপন করতেন। তারা ছিলেন চলমান ‘আলোর কারখানা’। তারা বিয়ে করতেন না, আমিষ খেতেন না, মদ পান করতেন না, এবং কোনো সম্পত্তির মালিক হতেন না। তাদের একমাত্র কাজ ছিল প্রার্থনা এবং ভেতরের আলোকে মুক্ত করা।
    2. ‘শ্রোতা’ (The Hearers): এরা ছিলেন সাধারণ গৃহস্থ অনুসারী। তাদের জীবনযাপন অতটা কঠোর ছিল না, কিন্তু তাদের প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য ছিল ‘নির্বাচিত’-দের সেবা করা এবং তাদের জন্য বিশেষ ধরনের (মূলত নিরামিষ) খাদ্য-পানীয় সরবরাহ করা। ম্যানিকীয়রা বিশ্বাস করত যে, তরমুজ বা শসার মতো ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোর কণা বন্দী থাকে এবং যখন একজন ‘নির্বাচিত’ ব্যক্তি সেই ফল খান, তখন তাঁর পবিত্র শরীরের মাধ্যমে সেই আলো মুক্তি পায়। এই সেবার মাধ্যমে ‘শ্রোতা’-রাও পুণ্য অর্জন করত এবং আশা রাখত যে, পরবর্তী জন্মে তারা ‘নির্বাচিত’ হিসেবে জন্মাবে।
      এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ম্যানিকাইজম একদিকে যেমন চরম আধ্যাত্মিক আদর্শকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্যও তার দরজা খোলা রেখেছিল, যা নস্টিকদের আভিজাত্যবাদী দর্শনে সম্ভব ছিল না।
  • বিশ্বজনীন আবেদন ও অভিযোজন: মানি সচেতনভাবে বিভিন্ন ধর্মের উপাদান (খ্রিস্টধর্ম থেকে যিশু, জরাথুস্ত্রবাদ থেকে দ্বৈতবাদ, বৌদ্ধধর্ম থেকে পুনর্জন্ম) মিশিয়ে তাঁর ধর্মকে একটি বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছিলেন, যাতে এটি যেকোনো সংস্কৃতিতে সহজেই প্রচারিত হতে পারে। পশ্চিমে যখন তারা খ্রিস্টানদের সাথে কথা বলত, তখন তারা যিশুকে প্রধান নবী হিসেবে তুলে ধরত। পূর্বে যখন তারা বৌদ্ধদের সাথে কথা বলত, তখন তারা মানিকে নতুন বুদ্ধ হিসেবে পরিচয় দিত। এই অভিযোজন ক্ষমতা (adaptability) ছিল তাদের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। এর ফলে, ম্যানিকাইজম অবিশ্বাস্য গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল – পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্য (বিখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মগুরু সেন্ট অগাস্টিনও যৌবনে দশ বছর ম্যানিকীয় ছিলেন) থেকে শুরু করে পূর্বে চীন পর্যন্ত, যেখানে এটি ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল (Lieu, 1992)।

এক অর্থে, ম্যানিকাইজম হলো সেই জিনিস, যা নস্টিসিজম হতে চেয়েও হতে পারেনি। এটি নস্টিক দর্শনকে একটি গুপ্ত, অভিজাত জ্ঞানচর্চার স্তর থেকে তুলে এনে একটি গণ-আন্দোলন এবং বিশ্বধর্মে পরিণত করেছিল। এটি ছিল নস্টিসিজমের সেই সন্তান, যে তার পিতার চেয়েও অনেক বেশি সফল এবং সুসংগঠিত হয়েছিল।

নস্টিসিজমের এই প্রতিবেশীরা আমাদের দেখায় যে, নস্টিসিজম কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল না। এটি ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সেই উত্তাল বুদ্ধিবৃত্তিক মহাসাগরেরই একটি শক্তিশালী স্রোত, যা অন্য স্রোতগুলোর সাথে কখনও সংঘাতে জড়িয়েছে, কখনও পাশাপাশি চলেছে, আবার কখনও নতুন এক স্রোতের জন্ম দিয়েছে।

আপনার অনুরোধ অনুযায়ী, নস্টিসিজম এবং বেদান্ত দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ও সম্পর্ক নিয়ে একটি বিস্তারিত ও গভীর বিশ্লেষণমূলক অংশ নিচে যোগ করা হলো। এটি পূর্ববর্তী আর্টিকেলের ধারাবাহিকতায় লেখা হয়েছে এবং এখানেও আলাপচারিতার ভঙ্গি ও নির্দিষ্ট বিন্যাস অনুসরণ করা হয়েছে।

দুই ভিন্ন নদীর একই মোহনা? নস্টিসিজম ও বেদান্তের আশ্চর্য প্রতিধ্বনি

মানুষের চিন্তার ইতিহাস এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা। কখনও কখনও হাজার হাজার মাইল দূরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের গর্ভে জন্ম নেওয়া দুটি দর্শন এমন সব সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছায়, যা দেখলে মনে হয় যেন তারা একই উৎস থেকে উৎসারিত দুই নদী। তাদের যাত্রাপথ ভিন্ন, পারিপার্শ্বিকতা ভিন্ন, কিন্তু তাদের জলের স্বাদ আর গন্তব্যের ইঙ্গিত যেন একই। নস্টিসিজম এবং ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের (বিশেষ করে আদি শঙ্করাচার্যের (Adi Shankaracharya) প্রচারিত অদ্বৈত বেদান্ত (Advaita Vedanta)) মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক এমনই এক বিস্ময়কর অধ্যায়।

একদিকে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশে জন্ম নেওয়া এক বিদ্রোহী, প্রায়শই হতাশাবাদী দর্শন – নস্টিসিজম। অন্যদিকে, হিমালয়ের শান্ত কোলে, আরণ্যক ঋষিদের গভীর ধ্যানে বিকশিত হওয়া এক নির্মল, আত্ম-অনুসন্ধানী প্রজ্ঞা – বেদান্ত। বাহ্যিকভাবে তাদের মধ্যে কোনো মিল থাকার কথাই নয়। কিন্তু যখন আমরা উভয়ের গভীরে ডুব দিই, তখন এমন সব আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পাই যা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে – মানুষের অস্তিত্বের সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের আকুতি কি স্থান-কালের ঊর্ধ্বে এক শাশ্বত সত্যের দিকেই ইঙ্গিত করে?

এই অংশে আমরা এই দুই দূরবর্তী মহাদেশের দর্শনকে পাশাপাশি রেখে তাদের ভেতরের সেই গোপন সেতুটি আবিষ্কারের চেষ্টা করব। আমরা দেখব, কীভাবে তারা উভয়েই এই দৃশ্যমান জগৎকে এক ধরনের ভ্রম বা কারাগার হিসেবে দেখেছে, কীভাবে তারা মানুষের আসল পরিচয়কে এক বন্দী বা বিস্মৃত সত্তা হিসেবে কল্পনা করেছে, এবং কীভাবে উভয়েই বলেছে যে মুক্তির একমাত্র পথ হলো এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান। তবে আমরা তাদের গভীর পার্থক্যগুলোকেও এড়িয়ে যাব না, যা তাদের স্বতন্ত্র চরিত্রকে আরও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলবে।

এক বনাম বহু: পরম সত্তা ও মায়ার জগৎ

যেকোনো দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তার বাস্তবতা বা সত্তার স্বরূপ নিয়ে ধারণা। এই জগৎ কী? এর পেছনের পরম সত্যটি কী? এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তরেই নস্টিসিজম ও অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ সাদৃশ্যটি খুঁজে পাওয়া যায়।

অদ্বৈত বেদান্তের জগৎ: ব্রহ্ম ও মায়া

অদ্বৈত বেদান্তের মূল কথা হলো: “ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ” – অর্থাৎ, (১) ব্রহ্ম (Brahman)-ই একমাত্র পরম সত্য, (২) এই জগৎ (Jagat) মিথ্যা বা আপেক্ষিক সত্য, এবং (৩) জীব (Jiva) বা ব্যক্তি-আত্মা ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়।

  • ব্রহ্ম (Brahman): ব্রহ্ম হলেন সেই এক, অদ্বিতীয়, শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং নিরাকার পরম সত্তা। তিনি সমস্ত গুণ, রূপ, নাম এবং কার্য-কারণের ঊর্ধ্বে (নির্গুণ ব্রহ্ম)। তাঁকে ভাষা বা মন দিয়ে বর্ণনা করা যায় না, কারণ তিনি দেশ-কাল-পাত্রের অতীত। তিনি হলেন বিশুদ্ধ অস্তিত্ব (সৎ), বিশুদ্ধ চেতনা (চিৎ) এবং বিশুদ্ধ আনন্দ (আনন্দ)। এই সমগ্র মহাবিশ্ব তাঁতেই অবস্থিত এবং তাঁরই প্রকাশ।
  • মায়া (Maya): তাহলে আমরা যে এই নানা নাম-রূপে ভরা জগৎ দেখছি, তার অস্তিত্ব কী? বেদান্ত বলে, এই জগৎ হলো মায়ার (Maya) প্রকাশ। মায়া হলো ব্রহ্মের এক অচিন্তনীয় শক্তি, যা এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মকে বহু রূপে, বহু নামে বিভক্ত করে দেখায়। মায়া কোনো সত্তা নয়, এটি এক মহাজাগতিক ভ্রম বা বিভ্রমের নীতি। অনেকটা মরুভূমিতে মরীচিকা দেখার মতো। মরীচিকা যেমন পুরোপুরি অসত্য নয় (কারণ তার পেছনে আলোর প্রতিসরণের মতো বৈজ্ঞানিক কারণ আছে), কিন্তু জল হিসেবে তা মিথ্যা, ঠিক তেমনি এই জগৎও ব্যবহারিক স্তরে (Vyavaharika Satya) সত্য, কিন্তু পারমার্থিক বা পরম স্তরে (Paramarthika Satya) তা মিথ্যা, কারণ ব্রহ্ম ছাড়া আর কোনো কিছুরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই (Deutsch, 1973)। এই জগৎকে ‘মন্দ’ বলা হয় না, বলা হয় ‘মিথ্যা’ বা অনিত্য – অর্থাৎ, যা চিরস্থায়ী নয়।

সাদৃশ্যের প্রতিধ্বনি: প্লেরোমা বনাম ডেমিয়ার্জের জগৎ

এবার নস্টিকদের দর্শনের দিকে তাকান। তারাও ঠিক একইভাবে দুটি স্তরের বাস্তবতার কথা বলেছিল:

  • পরম ঈশ্বর ও প্লেরোমা: নস্টিকদের অচেনা পিতা বা পরম ঈশ্বর হলেন সেই আলোকময়, অচিন্তনীয়, বিশুদ্ধ সত্তা, যিনি সমস্ত গুণ ও বর্ণনার অতীত। এই ধারণাটি নির্গুণ ব্রহ্মের ধারণার খুব কাছাকাছি। তাঁর আলোকময় জগৎ ‘প্লেরোমা’ হলো সেই পরিপূর্ণতার রাজ্য, যেখানে কোনো বিভাজন বা অপূর্ণতা নেই।
  • ডেমিয়ার্জ ও জড় জগৎ: অন্যদিকে, আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ হলো এক অজ্ঞ ও অহংকারী স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের তৈরি এক ত্রুটিপূর্ণ, নকল জগৎ। এটি আসল জগতের এক বিকৃত অনুকরণ।

এখানে সাদৃশ্যটি স্পষ্ট: উভয় দর্শনই এক পরম, এক ও অদ্বিতীয় বাস্তবতাকে স্বীকার করে (প্লেরোমা/ব্রহ্ম) এবং আমাদের অভিজ্ঞতার এই জগৎকে এক নিম্নস্তরের, অসম্পূর্ণ বা ভ্রমপূর্ণ বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করে (ডেমিয়ার্জের জগৎ/মায়ার জগৎ)। উভয় ক্ষেত্রেই, সাধারণ মানুষ এই নিম্নস্তরের জগতেই বাস করে এবং তাকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে।

পার্থক্যের গভীর ফাটল: কারাগার বনাম স্বপ্ন

কিন্তু এই সাদৃশ্যের নিচেই লুকিয়ে আছে এক গভীর ও মৌলিক পার্থক্য, যা এই দুই দর্শনকে দুটি ভিন্ন পথে চালিত করে।

  • নৈতিক বনাম জ্ঞানতাত্ত্বিক দ্বৈতবাদ: নস্টিসিজমের দ্বৈতবাদ হলো এক ধরনের সত্তাতাত্ত্বিক এবং নৈতিক দ্বৈতবাদ (Ontological and Ethical Dualism)। তাদের কাছে, এই জড় জগৎ কেবল ভ্রম নয়, এটি সক্রিয়ভাবে মন্দ (Evil)। এর স্রষ্টা ডেমিয়ার্জও অজ্ঞ এবং মন্দ। তাই এই জগৎ হলো এক কারাগার, যা থেকে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। জগতের প্রতি তাদের মনোভাব চরমভাবে নেতিবাচক ও জগৎ-বিদ্বেষী।
  • অন্যদিকে, অদ্বৈত বেদান্তের দ্বৈতবাদ কেবলই জ্ঞানতাত্ত্বিক (Epistemological)। জগৎ ‘মন্দ’ নয়, জগৎ হলো মায়া বা ভ্রম। মায়ার কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই; এটি ব্রহ্মেরই শক্তি। জগৎকে কোনো মন্দ সত্তা তৈরি করেনি। এটি অজ্ঞতার কারণে ব্রহ্মের উপর আরোপিত এক প্রতিভাস মাত্র। রূপক দিয়ে বললে, নস্টিকদের জগৎ হলো এক শত্রু দ্বারা নির্মিত কারাগার। আর বেদান্তের জগৎ হলো একটি স্বপ্ন। স্বপ্নটা হয়তো সুখের বা দুঃখের হতে পারে, কিন্তু জেগে উঠলেই বোঝা যায় যে পুরোটাই ছিল মনের খেলা এবং তার কোনো পরম অস্তিত্ব ছিল না। স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেই স্বপ্নের উপাদান। তাই বেদান্ত জগৎকে ঘৃণা করতে বলে না, বলে জগৎকে তার আসল রূপে জানতে – অর্থাৎ, ব্রহ্মের প্রকাশ হিসেবে দেখতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি জগৎকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে না, বরং তাকে অতিক্রম করে যায়।

এই একটি পার্থক্যই তাদের সাধনা ও লক্ষ্যের মধ্যে বিরাট ব্যবধান তৈরি করে দেয়।

বন্দী স্ফুলিঙ্গ ও বিস্মৃত আত্মা

বাস্তবতার স্বরূপের পর দ্বিতীয় প্রশ্নটি আসে মানুষের পরিচয় নিয়ে। আমি কে? এই দেহ-মনের ভেতরে আমার আসল সত্তা কী? এই প্রশ্নের উত্তরেও আমরা এক আশ্চর্য সমান্তরাল পথের সন্ধান পাই।

নস্টিসিজমের ‘নিউমা’: নির্বাসিত ঐশ্বরিক কণা

নস্টিকরা বিশ্বাস করত, প্রতিটি আধ্যাত্মিক মানুষের ভেতরে ঐশ্বরিক আলোর একটি কণা বা স্ফুলিঙ্গ (নিউমা – Pneuma) লুকিয়ে আছে। এটি হলো প্লেরোমা থেকে পতিত বা নির্বাসিত এক সত্তা, যা ডেমিয়ার্জের বানানো এই দেহ (সারক্স – Sarx) এবং মনের (সাইকি – Psyche) কারাগারে বন্দী হয়ে আছে। মানুষ এক গভীর বিস্মৃতির (Agnosis) কারণে তার এই আসল পরিচয় ভুলে গেছে। সে নিজেকে এই দেহ-মনসর্বস্ব নশ্বর জীব বলেই মনে করে। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো এই বিস্মৃতির ঘুম থেকে জেগে ওঠা এবং নিজের ভেতরের সেই বন্দী আলোকে মুক্ত করে তার আসল বাড়ি প্লেরোমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বেদান্তের ‘আত্মা’: আবৃত ব্রহ্ম

অদ্বৈত বেদান্তও ঠিক একই ধরনের কথা বলে। আমাদের আসল পরিচয় হলো আত্মা (Atman)। এই আত্মা কোনো খণ্ডাংশ বা স্ফুলিঙ্গ নয়, বরং তা স্বয়ং পূর্ণ ব্রহ্ম। উপনিষদের মহাবাক্যগুলো এটাই ঘোষণা করে: “অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমিই ব্রহ্ম), “তৎ ত্বং অসি” (তুমিই সেই)।

কিন্তু অজ্ঞতা বা অবিদ্যার (Avidya) কারণে আমরা এই আত্মাকে জানতে পারি না। আমরা নিজেদেরকে আমাদের শরীর, মন, বুদ্ধি, অহংকার – এইসব উপাধির সাথে এক করে ফেলি। বেদান্ত অনুযায়ী, আত্মা পাঁচটি কোষ বা আবরণের (পঞ্চকোষ – Panchakosha) দ্বারা আবৃত থাকে: অন্নময় কোষ (স্থূল শরীর), প্রাণময় কোষ (প্রাণশক্তি), মনোময় কোষ (মন), বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধি) এবং আনন্দময় কোষ (আনন্দের আবরণ)। অবিদ্যার কারণে আমরা এই কোষগুলোকেই ‘আমি’ বলে ভুল করি, ঠিক যেমন একজন মানুষ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকেই আসল ‘আমি’ বলে ভুল করতে পারে (Shankara, Vivekachudamani)।

সাদৃশ্য ও সূক্ষ্ম পার্থক্য

সাদৃশ্যটি এখানেও স্পষ্ট: উভয় দর্শনই বলছে যে আমাদের আসল সত্তা হলো এক শাশ্বত, ঐশ্বরিক চেতনা, যা জড় ও মানসিক উপাধির আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। সাধারণ মানুষ এই আসল পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞ।

কিন্তু পার্থক্যটিও সূক্ষ্ম এবং গুরুত্বপূর্ণ:

  • নির্বাসিত বনাম বিস্মৃত: নস্টিক ‘নিউমা’ হলো একজন নির্বাসিত রাজপুত্র। সে তার রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে এক ভিন্ন, শত্রুভাবাপন্ন দেশে বন্দী হয়ে আছে। তার মুক্তি মানে হলো এই ভিনদেশ থেকে ‘বাড়ি ফেরা’। এখানে এক ধরনের স্থানিক (spatial) বিচ্ছেদের ধারণা আছে।
  • অন্যদিকে, বেদান্তের ‘আত্মা’ হলো একজন স্মৃতিভ্রষ্ট রাজা। সে তার নিজের রাজ্যেই বাস করছে, কিন্তু ভুলে গেছে যে সে-ই রাজা। সে নিজেকে ভিখারি ভাবছে। তার মুক্তি মানে কোনো নতুন জায়গায় যাওয়া নয়, বরং নিজের রাজ্যেই নিজের আসল পরিচয় ফিরে পাওয়া। এখানে বিচ্ছেদটা জ্ঞানতাত্ত্বিক, স্থানিক নয়। আত্মা কোথাও থেকে ‘পতিত’ হয়নি, সে সর্বদাই ব্রহ্ম হিসেবেই ছিল, আছে এবং থাকবে। কেবল অবিদ্যার পর্দাটি সরাতে হবে।

মুক্তির পথ: ‘নোসিস’ বনাম ‘জ্ঞান’

যদি মানুষের মূল সমস্যা অজ্ঞতা হয়, তবে তার সমাধান কী? বিশ্বাস? ভক্তি? নাকি কর্ম? নস্টিসিজম ও অদ্বৈত বেদান্ত – উভয়েই প্রায় একসুরে উত্তর দেয়: জ্ঞান

নস্টিসিজমের ‘নোসিস’

নস্টিকদের কাছে মুক্তি আসে নোসিস (Gnosis) বা এক বিশেষ ধরনের গুপ্ত ও রূপান্তরকারী জ্ঞানের মাধ্যমে। এই জ্ঞান কোনো তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, এটি এক প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যা মানুষকে জানিয়ে দেয়:
১. সে কে (এক ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ)।
২. সে কোথা থেকে এসেছে (আলোর জগৎ প্লেরোমা থেকে)।
৩. সে কেন এখানে বন্দী (সোফিয়ার পতন এবং ডেমিয়ার্জের সৃষ্টির কারণে)।
৪. সে কোথায় ফিরে যাবে (প্লেরোমায়)।

এই জ্ঞান প্রায়শই বাইরে থেকে আসে। একজন ত্রাণকর্তা বা ‘রিভিলার’ (Revealer) (যেমন, নস্টিক খ্রিস্ট) প্লেরোমা থেকে এই কারাগারে নেমে আসেন এবং ঘুমন্ত আত্মাদের এই জাগরণী বার্তা দেন।

বেদান্তের ‘জ্ঞান’

অদ্বৈত বেদান্তেও মুক্তি বা মোক্ষ (Moksha) লাভের সর্বোচ্চ পথ হলো জ্ঞানযোগ (Jnana Yoga)। এই জ্ঞানও কোনো সাধারণ পাণ্ডিত্য নয়। এটি হলো অবিদ্যার নাশকারী আত্ম-জ্ঞান – এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যে ‘আমি দেহ-মন নই, আমিই সেই শাশ্বত, অদ্বিতীয় ব্রহ্ম’।

এই জ্ঞান লাভের জন্য বেদান্ত একটি সুনির্দিষ্ট পথের কথা বলে: শ্রবণ (Shravana) – গুরু ও শাস্ত্রের কাছ থেকে সত্য শ্রবণ করা; মনন (Manana) – শ্রুত সত্য নিয়ে গভীরভাবে যুক্তি ও বিচার দিয়ে মনন করা; এবং নিদিধ্যাসন (Nididhyasana) – সেই সত্যকে ধ্যানের মাধ্যমে নিজের প্রত্যক্ষ উপলব্ধিতে পরিণত করা। এখানেও একজন গুরু (Guru) বা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যিনি শিষ্যের ভেতরের জ্ঞানকে উন্মোচিত করতে সাহায্য করেন।

সাদৃশ্য এখানে প্রায় নিখুঁত। উভয় ব্যবস্থাটিই পরিত্রাণের জন্য অন্ধ বিশ্বাসের চেয়ে জ্ঞান বা প্রজ্ঞাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়। উভয়ই মনে করে, অজ্ঞতাই হলো বন্ধন এবং জ্ঞানই হলো মুক্তি।

তবে এখানেও একটি পার্থক্য লক্ষণীয়। নস্টিক ‘নোসিস’ প্রায়শই এক ধরনের সৃষ্টিতাত্ত্বিক বা পৌরাণিক জ্ঞান, যা মহাবিশ্বের এক গোপন ইতিহাস উন্মোচন করে। অন্যদিকে, বেদান্তের ‘জ্ঞান’ হলো বিশুদ্ধভাবে সত্তাতাত্ত্বিক (metaphysical), যা ব্যক্তি-চেতনা ও পরম-চেতনার অভেদকে উপলব্ধি করার উপর কেন্দ্রীভূত। নস্টিক ত্রাণকর্তা বাইরে থেকে এসে গোপন তথ্য দেন, আর বেদান্তের গুরু শিষ্যের ভেতরে যা আগে থেকেই আছে, তাকেই দেখিয়ে দেন।

ঐতিহাসিক সংযোগ: কাকতালীয় নাকি কার্যকারণ?

এতগুলো গভীর সাদৃশ্য দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই দুই দর্শনের মধ্যে কি কোনো ঐতিহাসিক যোগাযোগ ছিল? আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পর থেকে রোমান আমল পর্যন্ত ভারত ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চালু ছিল, তাতে কি ভাবনা বা চিন্তাধারার বিনিময় হওয়া সম্ভব?

কিছু পণ্ডিত এই সম্ভাবনার কথা বলেছেন। আলেকজান্দ্রিয়ার মতো বিশ্বজনীন শহরে ভারতীয় দার্শনিকদের আনাগোনা ছিল বলে জানা যায়। নব্যপ্লেটোবাদী দার্শনিক প্লোটিনাস (Plotinus), যার চিন্তার সাথে নস্টিকদের গভীর যোগসূত্র ছিল, তিনি ভারতীয় দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করা হয় (Conze, 1963)।

কিন্তু এই সংযোগের পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষ ও অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বেশিরভাগ পণ্ডিতই মনে করেন, এই সাদৃশ্যগুলো ঐতিহাসিক যোগাযোগের ফল নয়, বরং এটি ‘সমান্তরাল বিবর্তন’ (Parallel Evolution)-এর এক অসাধারণ উদাহরণ। মানুষের অস্তিত্বের কিছু মৌলিক সংকট – যেমন, দুঃখের কারণ, জগতের প্রকৃতি, আত্মার স্বরূপ, এবং মুক্তি – এতটাই সার্বজনীন যে, বিভিন্ন সংস্কৃতি স্বাধীনভাবেই প্রায় একই ধরনের দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। একেই অনেকে ‘শাশ্বত দর্শন’ (Perennial Philosophy)-এর প্রমাণ হিসেবে দেখেন।

একই সত্যের দুই ভিন্ন প্রকাশ?

নস্টিসিজম এবং অদ্বৈত বেদান্ত হলো দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির আয়না, যাতে মানবাত্মার মুক্তির আকুতির একই প্রতিবিম্ব পড়েছে। তারা উভয়েই আমাদের শেখায় যে, আমরা যা দেখি, জগৎ তার চেয়েও বেশি কিছু; আমরা যা নিজেদের ভাবি, আমরা তার চেয়েও মহৎ কিছু। তারা জাগতিক জীবনের সীমাবদ্ধতা ও দুঃখকে অস্বীকার করে না, কিন্তু তাকেই শেষ কথা বলেও মনে করে না।

তবে তাদের পথের শেষে সুরটি ভিন্ন। নস্টিসিজমের সুরটি প্রায়শই বিষণ্ণ, বিদ্রোহী ও দ্বৈতবাদী। এটি এক ভাঙা, মন্দ জগৎ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আর্তি। অন্যদিকে, অদ্বৈত বেদান্তের সুরটি শান্ত, সমাহিত এবং অদ্বৈতবাদী। এটি কোনো কিছু থেকে পালানোর কথা বলে না, বরং সমস্ত কিছুর ভেতরেই সেই এক পরম সত্যকে উপলব্ধি করার কথা বলে। এটি বলে, কারাগার বলে কিছু নেই, আছে কেবল একটি স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নের রচয়িতা তুমি নিজেই।

হয়তো তারা একই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার দুটি ভিন্ন পথ। একটি পথ পাথুরে, অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং বিদ্রোহের আগুনে ভরা। অন্যটি শান্ত, সবুজ এবং ধ্যানের কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু উভয় পথই পথিককে তার নিজের ক্ষুদ্র ‘আমি’-কে অতিক্রম করে এক বৃহত্তর সত্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়। এই অন্বেষণই তাদের দুই হাজার বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে একে অপরের আশ্চর্য প্রতিধ্বনি করে তুলেছে।

মায়া ছাড়িয়ে: সাংখ্য, বৌদ্ধধর্ম এবং তন্ত্রের আয়নায় নস্টিসিজম

নস্টিসিজম এবং অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে সাদৃশ্য এতটাই গভীর যে, তা প্রায়শই ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সমৃদ্ধ ধারাগুলোকে আলোচনার বাইরে রেখে দেয়। কিন্তু ভারতের চিন্তার জগৎ কেবল অদ্বৈত বেদান্তে সীমাবদ্ধ নয়। সাংখ্য দর্শনের দ্বৈতবাদ, বৌদ্ধধর্মের জগৎ-বিমুখতা এবং তন্ত্রের দেহ-কেন্দ্রিক সাধনা – এই প্রতিটি ধারার সাথেই নস্টিসিজমের কিছু আশ্চর্য প্রতিধ্বনি এবং কিছু গভীর পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়। এই তুলনামূলক আলোচনা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, অস্তিত্বের সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের আকুতি মানুষের মনে কত বিচিত্র রূপে প্রকাশিত হতে পারে।

সাংখ্য দর্শন: দুই শাশ্বত সত্তার মহাজাগতিক নাটক

অদ্বৈত বেদান্ত যদি হয় চরম অদ্বৈতবাদী, তবে ভারতীয় দর্শনের প্রাচীনতম ধারাগুলোর একটি, সাংখ্য দর্শন (Samkhya Philosophy), হলো এক বিশুদ্ধ দ্বৈতবাদী (Dualistic) ব্যবস্থা। আর এখানেই নস্টিসিজমের সাথে তার সবচেয়ে বড় কাঠামোগত মিলটি খুঁজে পাওয়া যায়। ঈশ্বরকৃষ্ণের (Ishvarakrishna) লেখা ‘সাংখ্যকারিকা’ (Samkhyakarika) এই দর্শনের মূল গ্রন্থ।

সাংখ্য মতে, মহাবিশ্ব দুটি শাশ্বত, অনাদি ও স্বতন্ত্র সত্তার সমন্বয়ে গঠিত:

  • পুরুষ (Purusha): পুরুষ হলো বিশুদ্ধ, অপরিবর্তনীয়, নিষ্ক্রিয় ও বহু চেতন সত্তা। প্রতিটি জীবের মধ্যে একটি করে পুরুষ আছে। সে কেবল একজন সাক্ষী বা দ্রষ্টা (Sakshi)। তার কোনো গুণ নেই, সে কোনো কাজ করে না, কোনো কিছু সৃষ্টিও করে না। সে কেবল দেখে। পুরুষকে অনেকটা নস্টিকদের ‘নিউমা’ বা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের সাথে তুলনা করা যায় – এক বিশুদ্ধ চেতন সত্তা যা জগতের কর্মযজ্ঞের বাইরে।
  • প্রকৃতি (Prakriti): প্রকৃতি হলো এক, অচেতন, কিন্তু সক্রিয় জড় সত্তা। এই সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ – আমাদের মন, বুদ্ধি, অহংকার, ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চভূত – সবই প্রকৃতির পরিণাম বা বিবর্তন। প্রকৃতির তিনটি গুণ (Guna) আছে: সত্ত্ব (আলো, আনন্দ, জ্ঞান), রজঃ (কর্ম, আবেগ, গতি) এবং তমঃ (অন্ধকার, জড়তা, অজ্ঞতা)। এই তিন গুণের সাম্যাবস্থা ভেঙে গেলেই প্রকৃতির বিবর্তন শুরু হয় এবং জগৎ সৃষ্টি হয়। প্রকৃতিকে নস্টিকদের জড় জগৎ এবং তার স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের সম্মিলিত রূপের সাথে তুলনা করা যেতে পারে – এক সক্রিয় কিন্তু অচেতন শক্তি যা আত্মাকে বেঁধে রাখে।

বন্ধন ও মুক্তি: এক মহাজাগতিক ভুল বোঝাবুঝি

সাংখ্য মতে, বন্ধন বা দুঃখের কারণ হলো এক মহাজাগতিক ভুল বোঝাবুঝি। নিষ্ক্রিয়, চেতন পুরুষ অজ্ঞতাবশত নিজেকে প্রকৃতির কর্ম ও গুণের সাথে এক করে ফেলে। সে প্রকৃতির সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ বলে মনে করতে শুরু করে। অনেকটা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো, যার পাশে একটি লাল জবা ফুল রাখলে স্ফটিকটিকেও লাল বলে মনে হয়।

মুক্তি বা কৈবল্য (Kaivalya) আসে বিবেকজ্ঞান (Viveka Khyati) বা ভেদজ্ঞানের মাধ্যমে। যখন পুরুষ উপলব্ধি করতে পারে যে ‘আমি প্রকৃতি নই, আমি প্রকৃতির কর্মকাণ্ডের সাক্ষী মাত্র’, তখন সে প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং তার আসল সাক্ষী-স্বরূপে ফিরে যায়।

সাদৃশ্য ও পার্থক্য

  • দ্বৈতবাদী কাঠামো: নস্টিসিজম এবং সাংখ্য – উভয়েই দুটি বিপরীতধর্মী সত্তার (আত্মা-জড়, পুরুষ-প্রকৃতি) উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। উভয় দর্শনই মনে করে, চেতন সত্তা কোনোভাবে জড় সত্তার দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
  • অজ্ঞতাই বন্ধন: উভয় ক্ষেত্রেই বন্ধনের মূল কারণ অজ্ঞতা – নিজের আসল পরিচয় ভুলে যাওয়া।
  • জ্ঞানই মুক্তি: মুক্তির পথ হলো জ্ঞান – দুই সত্তার মধ্যে পার্থক্যকে উপলব্ধি করা।

তবে পার্থক্যটিও বিশাল। নস্টিকদের জগৎ এক মন্দ স্রষ্টার বানানো কারাগার। সেখানে এক ধরনের ঘৃণা, বিদ্রোহ এবং পালিয়ে যাওয়ার আকুতি আছে। অন্যদিকে, সাংখ্যের জগৎ মন্দ নয়, এটি অচেতন প্রকৃতির এক স্বাভাবিক লীলা। পুরুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক অনেকটা একজন অন্ধ (প্রকৃতি) এবং একজন পঙ্গু (পুরুষ) মানুষের সম্পর্কের মতো, যারা একে অপরের সাহায্যে পথ চলে। এখানে কোনো খলনায়ক বা ষড়যন্ত্র নেই, আছে কেবল এক নির্দোষ কিন্তু দুঃখজনক ভুল বোঝাবুঝি (Larson, 1979)। সাংখ্যের মুক্তি হলো এক শান্ত বিচ্ছিন্নতা, কোনো মহাজাগতিক যুদ্ধজয় নয়।

বৌদ্ধধর্ম: শূন্যতা, দুঃখ এবং নির্বাণ

নস্টিসিজমের জগৎ-বিমুখতা এবং এই সংসার যে দুঃখময় – এই ধারণার সাথে সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের (Buddhism), বিশেষ করে তার আদি রূপের। গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্যসত্যের (Four Noble Truths) প্রথমটিই হলো: “জীবনে দুঃখ আছে” (দুঃখ – Dukkha)।

জগৎ যখন জ্বলন্ত ঘর

নস্টিসিজমের মতোই, বৌদ্ধধর্মও এই জাগতিক অস্তিত্বকে চরমভাবে সমস্যাসঙ্কুল হিসেবে দেখে। বুদ্ধ সংসারকে এক জ্বলন্ত ঘরের (Burning House) সাথে তুলনা করেছেন, যা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসা উচিত। এই জগৎ অনিত্য (অস্থায়ী), দুঃখময় এবং অনাত্মা (কোনো শাশ্বত আত্মা বা সত্তাবিহীন)। আমাদের কামনা-বাসনা বা তৃষ্ণা (Tanha)-ই আমাদের এই দুঃখের চক্রে, এই পুনর্জন্মের (Samsara) চাকায় বেঁধে রাখে।

অজ্ঞতা ও নির্বাণ

বন্ধনের মূল কারণ এখানেও অবিদ্যা (Avidya) বা অজ্ঞতা – বাস্তবতার আসল স্বরূপ (অর্থাৎ অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা) সম্পর্কে না জানা। আর মুক্তি হলো নির্বাণ (Nirvana), যার আক্ষরিক অর্থ ‘নিভে যাওয়া’। এটি হলো তৃষ্ণার আগুনের নির্বাপণ এবং দুঃখের চক্র থেকে চিরমুক্তি।

সাদৃশ্য ও গভীরতম অনৈক্য

  • জগৎ-বিমুখতা: উভয় দর্শনই প্রচলিত জাগতিক জীবনকে দুঃখময় ও পরিত্যাজ্য বলে মনে করে।
  • মূল সমস্যা হিসেবে অজ্ঞতা: উভয়ই অজ্ঞতাকে বন্ধনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
  • জ্ঞান/প্রজ্ঞার মাধ্যমে মুক্তি: মুক্তির জন্য এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান বা প্রজ্ঞার (প্রজ্ঞা – Prajna) প্রয়োজন।

কিন্তু এখানেই তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দার্শনিক খাদটি দেখা যায়। নস্টিসিজমের একেবারে কেন্দ্রে আছে এক শাশ্বত, ঐশ্বরিক আত্মা বা নিউমা-র ধারণা, যা তার আসল বাড়িতে ফিরে যেতে চায়। অন্যদিকে, বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে বিপ্লবী এবং অনন্য শিক্ষাটি হলো অনাত্মাবাদ (Anatta/Anatman) – অর্থাৎ, কোনো স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় আত্মা বা ‘আমি’ বলে কিছুই নেই। যা আছে, তা কেবল পাঁচটি স্কন্ধ বা উপাদানের (রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান) এক পরিবর্তনশীল প্রবাহ মাত্র।

সুতরাং, নস্টিকদের মুক্তি হলো তাদের আসল আত্মাকে খুঁজে পাওয়া এবং তাকে মুক্ত করা। আর বৌদ্ধদের মুক্তি বা নির্বাণ হলো ‘আত্মা’ নামক ভ্রম থেকে মুক্ত হওয়া, ‘আমি’ নামক ধারণাকেই পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়া (Collins, 1982)। এটি এক মৌলিক পার্থক্য। নস্টিকরা বলে, “তুমি একজন বন্দী ঈশ্বর।” বৌদ্ধধর্ম বলে, “তুমি কে, এই প্রশ্নটিই ভুল।”

তন্ত্র: দেহকে অস্বীকার নয়, রূপান্তর

ভারতীয় দর্শনের এক ভিন্নধর্মী ও প্রায়শই ভুল বোঝা একটি ধারা হলো তন্ত্র (Tantra)। নস্টিসিজম এবং অন্যান্য জগৎ-বিমুখ দর্শনের সাথে তন্ত্রের সম্পর্ক হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। যেখানে নস্টিকরা দেহকে কারাগার বলে মনে করত এবং তাকে কঠোর তপস্যার মাধ্যমে দমন করতে বা পুরোপুরি উপেক্ষা করতে চাইত, তন্ত্র সেখানে দেহকেই সাধনার প্রধান যন্ত্র বা ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে।

তন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো শক্তি ও চেতনার দ্বৈতবাদ – শিব (Shiva)শক্তি (Shakti)। শিব হলেন নিষ্ক্রিয়, বিশুদ্ধ চেতনা (পুরুষের মতো), আর শক্তি হলেন সেই চেতনারই সক্রিয়, সৃজনী রূপ (প্রকৃতির মতো)। এই সমগ্র জগৎ হলো শক্তিরই লীলা।

দেহ যখন ব্রহ্মাণ্ড

তন্ত্র মতে, মানবদেহ কোনো কারাগার নয়, বরং এটি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ (“যথা পিণ্ডে তথা ব্রহ্মাণ্ডে”)। মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি, সমস্ত দেবতা, সমস্ত চক্র আমাদের এই দেহের ভেতরেই সুপ্ত অবস্থায় আছে। সাধনার উদ্দেশ্য হলো এই সুপ্ত শক্তিকে, বিশেষ করে কুণ্ডলিনী শক্তিকে (Kundalini Shakti), জাগিয়ে তোলা এবং তাকে দেহের বিভিন্ন চক্রের (Chakra) মধ্যে দিয়ে ঊর্ধ্বে চালিত করে সহস্রার চক্রে শিবের সাথে মিলিত করা।

ভোগ থেকে যোগ

তন্ত্র জগৎ ও তার ভোগকে অস্বীকার করে না। বরং এটি ভোগকে যোগে রূপান্তর করার কথা বলে। অর্থাৎ, জাগতিক শক্তি ও কামনা-বাসনাকে দমন না করে, সেগুলোকে সচেতনভাবে ব্যবহার করে আধ্যাত্মিক উত্তরণ ঘটানো। এই কারণেই তন্ত্রে এমন সব আচার-অনুষ্ঠান (যেমন, পঞ্চ ‘ম’কার সাধনা) দেখা যায়, যা প্রচলিত নৈতিকতার কাছে বিষ্ময়কর মনে হতে পারে।

নস্টিসিজমের বিপরীত মেরু?

একথা স্পষ্ট যে, জগৎ ও দেহ বিষয়ে তন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি নস্টিসিজমের প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত। নস্টিকদের কাছে যা ছিল কারাগার, তন্ত্রের কাছে তাই হলো মন্দির। নস্টিকদের কাছে যা ছিল শিকল (কামনা), তন্ত্রের কাছে তাই হলো মুক্তির চাবি।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই চরম বিপরীত পথের শেষেও কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয় দর্শনই এক ধরনের গুপ্ত জ্ঞানের (নোসিস/তন্ত্রের গুপ্ত সাধনা) উপর জোর দেয়, যা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বাহিত হয়। উভয়ই প্রচলিত, বাহ্যিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিগত, প্রত্যক্ষ উপলব্ধিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এবং উভয়ই মানুষকে তার ভেতরের সুপ্ত দেবত্ব বা শক্তিকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানায় (White, 2003)।

তারা যেন একই সত্যের কাছে পৌঁছানোর দুটি ভিন্ন পথ – একটি জগৎকে ‘না’ বলে, অন্যটি জগৎকে ‘হ্যাঁ’ বলে।

এই তুলনামূলক আলোচনা থেকে বোঝা যায়, নস্টিসিজম কোনো একক বা বিচ্ছিন্ন দর্শন ছিল না। এটি মানুষের অস্তিত্বের সেইসব মৌলিক প্রশ্নকে স্পর্শ করেছিল, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন যুগে, নানা দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ধারার জন্ম দিয়েছে। জগৎ কী? আমি কে? দুঃখ কী? মুক্তি কোথায়? – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই ভারত ও ভূমধ্যসাগরের দুই তীরে গড়ে উঠেছিল দুটি ভিন্ন জগৎ, যাদের প্রতিধ্বনি আজও আমাদের ভাবায়।

সুফিবাদ ও নস্টিসিজম: এক হারানো নদীর গুপ্ত স্রোত

মাঝরাতে কখনো ঘুম ভেঙে গেলে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়, তাই না? চারপাশ নিস্তব্ধ, চেনা শহরটাও অচেনা লাগে। মনে হয়, এই যে আমি বিছানায় শুয়ে আছি, এই ‘আমি’টা আসলে কে? এই দেহটা, এই নামটা, এই পরিচয় – এসবের আড়ালে কি অন্য কেউ বাস করে? একজন অচেনা আগন্তুক, যে এই পৃথিবীতে নির্বাসিত, যে নিজের বাড়ির জন্য কাঁদছে? এই অনুভূতি – এই নির্বাসনবোধ (sense of exile), এই গভীর বিচ্ছিন্নতা (alienation) – মানব চেতনার এক পুরোনো সহচর। হাজার হাজার বছর ধরে কিছু মানুষ এই অনুভূতির উত্তর খুঁজে ফিরেছে। তারা বলেছে, আমাদের আসল বাড়ি এখানে নয়। আমরা এক আলোর জগৎ থেকে এসেছি এবং সেখানেই ফিরে যেতে চাই। এই যাত্রার নামই আধ্যাত্মিকতা।

এই যাত্রার দুটি পথের দিকে তাকালে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। একটি পথ প্রায় দুই হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল, যার নাম নস্টিসিজম (Gnosticism)। এই পথ ছিল বিদ্রোহী, জগৎ-বিদ্বেষী এবং প্রচলিত ধর্মমতের প্রতি চরমভাবে সন্দিহান। এটি ইতিহাসের চোরাস্রোতে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। অন্য পথটির আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় ইসলামের ভেতরে, নস্টিসিজমের বিলুপ্তির প্রায় কয়েক শতাব্দী পর, ৭ম-৮ম শতাব্দীতে। এর নাম সুফিবাদ (Sufism)। এই পথটি প্রেমের, সৌন্দর্যের এবং ঈশ্বরের সাথে মিলনের এক আকুতিময় পথ। বাহ্যিকভাবে দেখলে, এই দুটি পথের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। একটি বিদ্রোহের আগুন, অন্যটি প্রেমের অশ্রুজল। একটি জগৎকে কারাগার বলে, অন্যটি জগৎকে ঈশ্বরের সৌন্দর্যের আয়না বলে।

কিন্তু গভীরে, খুব গভীরে ডুব দিলে আপনি দেখবেন, এই দুটি ভিন্ন নদীর নিচে একই গুপ্ত স্রোত বয়ে চলেছে। আপনি দেখবেন, সুফিবাদের অনেক মৌলিক ধারণার মধ্যেই নস্টিসিজমের সেই পুরোনো, প্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো ও উত্তরগুলোর আশ্চর্য প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাহলে কি সুফিবাদ আসলে ছদ্মবেশী নস্টিসিজম? নাকি এটি মানব আত্মার সেই একই নির্বাসনবোধের এক নতুন, ভিন্ন প্রকাশ? চলুন, এই রহস্যময় সম্পর্কের গভীরে একবার ডুব দেওয়া যাক।

ঐতিহাসিক দূরত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক সেতু

প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। নস্টিসিজম এবং সুফিবাদের মধ্যে কোনো সরাসরি বংশানুক্রমিক সম্পর্ক (direct lineage) খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নস্টিসিজম মূলত একটি প্রাক-ইসলামিক এবং অ-ইসলামিক ধারা, যা দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে বিকাশ লাভ করেছিল এবং পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্মের চাপে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, সুফিবাদের জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে সম্পূর্ণরূপে ইসলামিক পরিমণ্ডলে, কোরআন ও হাদিসের কাঠামোর ভেতরে।

তাহলে এই প্রভাব বা সাদৃশ্য এল কীভাবে? উত্তরটি লুকিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে। নস্টিসিজম যখন হারিয়ে গিয়েছিল, তখন তার চিন্তার বীজগুলো পুরোপুরি মরে যায়নি। সেগুলো মিশে গিয়েছিল সেই অঞ্চলের সাধারণ সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক পরিমণ্ডলে। বিশেষ করে, নব্যপ্লেটোবাদী দর্শন (Neoplatonism) এবং হার্মেটিসিজম (Hermeticism)-এর মতো ধারাগুলো নস্টিক চিন্তার অনেক উপাদানকে নিজেদের মতো করে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। এই দর্শনগুলোই পরে প্রাথমিক যুগের মুসলিম দার্শনিক ও মরমী সাধকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। অনেকটা এমন যে, পুরোনো এক সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ইট-পাথর দিয়েই নতুন এক সভ্যতা তার ইমারত গড়ে তুলেছে। চিন্তার এই মহাজাগতিক ডিএনএ এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে, এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল (Nasr, 1964)।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ছিল ম্যানিকাইজম (Manichaeism)। তৃতীয় শতাব্দীতে পারস্যের নবী মানি (Mani) প্রচারিত এই ধর্মটি ছিল নস্টিসিজম, জরাথুস্ত্রবাদ এবং বৌদ্ধধর্মের এক জটিল মিশ্রণ। এটি বহু শতাব্দী ধরে মধ্য এশিয়া ও পারস্যে টিকে ছিল, যা ছিল প্রাথমিক সুফিবাদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই ম্যানিকাইজম নস্টিক দ্বৈতবাদ এবং জগৎ-বিদ্বেষী চিন্তাকে সরাসরি ইসলামী বিশ্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল।

আসুন, আমরা এখন এই দুটি ধারার মধ্যেকার কিছু বিস্ময়কর সাদৃশ্যকে এক এক করে বিশ্লেষণ করি।

অচেনা ঈশ্বর বনাম গুপ্তধন

নস্টিসিজমের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক অচেনা, বর্ণনাতীত, পরম ঈশ্বর (The Unknown Father), যিনি এই জগতের স্রষ্টা নন এবং জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদের ভাষা বা বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে ছোঁয়া যায় না। তিনি এক পরম রহস্য।

সুফিবাদের দিকে তাকান। সুফিরা একটি বিখ্যাত হাদিস কুদসি-র (Hadith Qudsi – যেখানে ঈশ্বর নবীর মাধ্যমে সরাসরি কথা বলেন) উপর ভিত্তি করে তাদের দর্শন গড়ে তুলেছে: “আমি ছিলাম এক গুপ্তধন (কানজান মাখফিয়ান), আমি পরিচিত হতে ভালোবাসলাম, তাই আমি জগৎ সৃষ্টি করলাম।” এখানেও ঈশ্বর তাঁর মূল প্রকৃতিতে এক ‘গুপ্ত’ বা ‘অজানা’ সত্তা। তিনি সাধারণ যুক্তিতর্ক বা শাস্ত্রীয় জ্ঞানের (ইলম) মাধ্যমে পরিচিত হন না। তাঁকে জানতে হলে এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান প্রয়োজন।

নস্টিকদের ‘অচেনা ঈশ্বর’ এবং সুফিদের ‘গুপ্তধন’ – উভয় ধারণাই এক পরম সত্তার কথা বলে, যিনি বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান বা প্রচলিত ধর্মতত্ত্বের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই ধারণাটিই উভয় ধারাকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাহ্যিক কাঠামো থেকে সরিয়ে এনে এক গভীর, ব্যক্তিগত ও মরমী পথের দিকে চালিত করে (Corbin, 1993)।

ডেমিয়ার্জ বনাম নফস ও হিজাব

নস্টিসিজমের সবচেয়ে নাটকীয় চরিত্র হলো ডেমিয়ার্জ (Demiurge), এই জগতের অজ্ঞ ও অহংকারী স্রষ্টা। সে এবং তার অনুচর আর্কনরা (Archons) হলো সেই শক্তি, যা আত্মাকে এই জড় জগতে বন্দী করে রাখে।

সুফিবাদে এমন কোনো দ্বিতীয় স্রষ্টার ধারণা নেই। এটি কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী। কিন্তু ডেমিয়ার্জ যে কাজটি করে – অর্থাৎ আত্মাকে তার উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা – সেই কাজটি সুফিদের দর্শনে অন্য দুটি ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়: নফস (Nafs) এবং হিজাব (Hijab)

  • নফস (Nafs): নফস হলো মানুষের নিম্ন সত্তা, তার অহং, তার কামনা-বাসনা। এটিই হলো সেই অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারী, যা মানুষকে জাগতিক মোহে ভুলিয়ে রাখে এবং তাকে তার আসল আধ্যাত্মিক প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সুফিদের কাছে, সাধনার মূল উদ্দেশ্যই হলো এই নফসের বিরুদ্ধে এক চিরন্তন সংগ্রাম বা ‘জিহাদ আল-আকবর’ (The Greater Jihad)। নস্টিকদের ডেমিয়ার্জ ছিল এক বাহ্যিক শত্রু; সুফিদের হাতে সেই শত্রু হয়ে গেল এক অভ্যন্তরীণ, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা। বিদ্রোহটা জগতের স্রষ্টার বিরুদ্ধে নয়, বিদ্রোহটা নিজেরই অহং-এর বিরুদ্ধে। এটি নস্টিক বিদ্রোহের এক গভীর অন্তর্মুখীকরণ (internalization)।
  • হিজাব (Hijab): সুফিরা মনে করে, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে অসংখ্য পর্দা বা ‘হিজাব’ রয়েছে। এই পর্দাগুলো আমাদের অজ্ঞতা, আমাদের ইন্দ্রিয়াসক্তি, আমাদের অহংকার। এই পর্দাগুলোর কারণেই আমরা ঈশ্বরের সৌন্দর্যকে সরাসরি দেখতে পাই না, ঠিক যেমন মেঘ সূর্যকে আড়াল করে রাখে। মরমী সাধকের কাজ হলো এক এক করে এই সমস্ত পর্দা সরিয়ে দেওয়া, যাতে সে ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে পারে। এই ‘হিজাব’-এর ধারণাটি নস্টিকদের সেই আর্কনদের দ্বারা শাসিত সাতটি গোলকের কথা মনে করিয়ে দেয়, যা আত্মাকে প্লেরোমায় পৌঁছাতে বাধা দেয়। উভয় ক্ষেত্রেই মুক্তি হলো এক ধরনের আবরণ উন্মোচন (unveiling)।

ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বনাম রুহ ও সির

নস্টিকরা বিশ্বাস করত, প্রতিটি আধ্যাত্মিক মানুষের (Pneumatics) ভেতরে প্লেরোমার এক ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বা ‘নিউমা’ (Pneuma) ঘুমিয়ে আছে। এটিই আমাদের আসল সত্তা।

সুফি দর্শনেও এর প্রায় হুবহু প্রতিরূপ পাওয়া যায়। কোরআনে বলা হয়েছে, ঈশ্বর আদমের দেহে তাঁর নিজের ‘রুহ’ বা আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন। সুফিরা এই ‘রুহ’কে (Ruh) ঈশ্বরেরই এক ঐশ্বরিক অংশ বা নিঃশ্বাস বলে মনে করে, যা মানবদেহে বন্দী হয়ে আছে। এটিই হলো আমাদের সেই নির্বাসিত সত্তা, যা সর্বদা তার উৎসের কাছে ফিরে যেতে চায়।

আরও গভীরে, সুফিরা ‘কলব’ (Qalb – a spiritual heart) এবং তারও কেন্দ্রে ‘সির’ (Sirr – the secret) নামক এক সত্তার কথা বলে। এই ‘সির’ হলো আত্মার গভীরতম প্রদেশ, যেখানে মানুষ ও ঈশ্বরের মিলন ঘটে। এটিই হলো সেই ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ, সেই গুপ্ত সংযোগ বিন্দু। বিখ্যাত সুফি সাধক আল-হাল্লাজের (Al-Hallaj) সেই বিতর্কিত উক্তি, “আনাল হক” (Ana’l Haqq – I am the Truth/God), ছিল এই গভীর উপলব্ধিরই এক বিস্ফোরক প্রকাশ, যা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ হতে বাধ্য করেছিল – ঠিক যেন একজন প্রাচীন নস্টিক শহীদের মতো (Massignon, 1982)।

নোসিস বনাম মারিফাত

এই দুটি ধারার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অকাট্য সাদৃশ্যটি হলো তাদের জ্ঞানের ধারণার মধ্যে।

নস্টিকদের কাছে মুক্তি আসে ‘নোসিস’ (Gnosis) থেকে। এটি কোনো বইপড়া জ্ঞান নয়, কোনো যৌক্তিক তত্ত্ব নয়। এটি হলো এক প্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত, স্বজ্ঞামূলক এবং রূপান্তরকারী উপলব্ধি, যা মানুষকে তার আসল পরিচয় জানিয়ে দেয়।

সুফিদের কাছে মুক্তির পথ হলো ‘মারিফাত’ (Ma’rifah)। ‘মারিফাত’ শব্দের অর্থও হলো জ্ঞান, কিন্তু এটি সাধারণ শাস্ত্রীয় জ্ঞান বা ‘ইলম’ (‘Ilm) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘ইলম’ হলো বাইরে থেকে অর্জিত জ্ঞান, যা বই পড়ে বা শিক্ষকের কাছ থেকে শেখা যায়। কিন্তু ‘মারিফাত’ হলো ভেতর থেকে উদ্ভাসিত জ্ঞান। এটি হলো ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ, ব্যক্তিগত ও প্রেমময় উপলব্ধি। যে এই জ্ঞান লাভ করে, তাকে বলা হয় ‘আরিফ’ (‘Arif) – অর্থাৎ, জ্ঞানী।

নস্টিকদের ‘নোসিস’ এবং সুফিদের ‘মারিফাত’ – উভয়ই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুরুদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। কারণ, যদি সত্যকে সরাসরি নিজের ভেতরেই পাওয়া যায়, তবে পুরোহিত, মোল্লা বা শাস্ত্রের প্রয়োজন কী? এই কারণেই উভয় ধারাকেই যুগে যুগে প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার সন্দেহের চোখে পড়তে হয়েছে।

ত্রাণকর্তা বনাম আল-ইনসান আল-কামিল

নস্টিকদের ত্রাণকর্তা বা খ্রিস্ট (Christ) এসেছিলেন মানুষকে ‘নোসিস’ দিয়ে জাগিয়ে তুলতে। তিনি ছিলেন প্লেরোমা এবং এই জড় জগতের মধ্যে এক সেতু।

সুফি দর্শনে এর সমান্তরাল ধারণাটি হলো ‘আল-ইনসান আল-কামিল’ (Al-Insan al-Kamil) বা ‘পূর্ণ মানব’ (The Perfect Man)। এই ধারণাটি মূলত ইবন আরাবির (Ibn Arabi) মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ‘পূর্ণ মানব’ হলেন সেই ব্যক্তি (যার সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন নবী মুহাম্মদ, কিন্তু ধারণাটি অন্যান্য নবী ও আউলিয়া বা সাধকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য), যিনি ঈশ্বরের সমস্ত গুণ বা নামকে (Asma’) নিজের মধ্যে পুরোপুরি প্রতিফলিত করতে পেরেছেন। তিনি হলেন একাধারে ঈশ্বরের আয়না এবং সৃষ্টি জগতের সাথে ঈশ্বরের সংযোগের সেতু (a microcosm that reflects the macrocosm)। সাধারণ মানুষের জন্য, একজন ‘পূর্ণ মানব’ বা পীর/মুর্শিদ হলেন সেই পথপ্রদর্শক, যিনি তাকে ‘মারিফাত’-এর পথে চালিত করতে পারেন – ঠিক যেমন নস্টিকদের ত্রাণকর্তা এসেছিলেন ঘুমন্ত আত্মাদের জাগিয়ে তুলতে (Burckhardt, 1976)।

পুরোনো মদের বোতলে নতুন মদ

তাহলে এই সব গভীর সাদৃশ্যের অর্থ কী? এর অর্থ এই নয় যে, সুফিবাদ হলো নস্টিসিজমেরই এক ইসলামিক সংস্করণ। বরং, এর অর্থ হলো, মানব আত্মার কিছু মৌলিক প্রশ্ন ও অনুভূতি রয়েছে যা বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সংস্কৃতির পোশাকে বারবার ফিরে আসে।

নস্টিসিজম ছিল সেই অনুভূতির এক আদি, বিদ্রোহী ও ট্র্যাজিক প্রকাশ। এটি জগৎ ও তার স্রষ্টার বিরুদ্ধে এক সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সুফিবাদ সেই বিদ্রোহকে এক নতুন, আরও পরিশীলিত ও অন্তর্মুখী রূপ দিয়েছে। এখানে বিদ্রোহটা আর বাহ্যিক স্রষ্টার বিরুদ্ধে নয়, বিদ্রোহটা নিজের ভেতরের ‘নফস’ বা অহং-এর বিরুদ্ধে। জগৎকে কারাগার বলে ধ্বংস করে দেওয়ার বদলে, সুফিবাদ জগৎকে ঈশ্বরের সৌন্দর্যের প্রতিফলন হিসেবে দেখে তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। নস্টিকদের জগৎ-বিদ্বেষ (world-hatred) সুফিদের হাতে জগৎ-উদাসীনতায় (world-indifference) রূপান্তরিত হয়েছে।

বিখ্যাত সুফি গবেষক হেনরি করবিন (Henry Corbin) এই সম্পর্কটিকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে পারস্যের মাটিতে প্রাচীন জরাথুস্ত্রীয় ও নস্টিক ধারণাগুলো শিয়া ইসলাম এবং সুফিবাদের মরমী দর্শনে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। নস্টিসিজমের সেই হারানো নদীটি মাটির নিচে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বরং এক দীর্ঘ ও গুপ্ত পথ পাড়ি দিয়ে সুফিবাদের মরূদ্যানের নিচে এসে আবার স্বচ্ছ ঝর্ণাধারারূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি হলো পুরোনো মদের বোতলে নতুন, আরও মিষ্টি ও শক্তিশালী মদ পরিবেশন করার মতো। সেই নির্বাসনের কষ্ট, সেই বাড়ি ফেরার আকুতি, সেই গুপ্ত জ্ঞানের সন্ধান – সবই এক, শুধু ভাষাটা আর সুরটা বদলে গেছে।

নস্টিসিজম ও শয়তান: এক অপ্রয়োজনীয় খলনায়কের উপাখ্যান

শয়তান বা স্যাটান বা ডেভিল – এই নামগুলো শুনলেই আমাদের মনে কী ছবি ভেসে ওঠে? এক চূড়ান্ত খলনায়কের ছবি, তাই না? ঈশ্বরের সবচেয়ে উজ্জ্বল দেবদূত, লুসিফার, যে অহংকারের বশে বিদ্রোহ করে স্বর্গ থেকে পতিত হয়েছিল। সে হলো মন্দের মূর্ত রূপ, প্রলোভনের কারিগর, ঈশ্বরের প্রধান প্রতিপক্ষ, যে মানবাত্মাকে ধ্বংস করার জন্য এক চিরন্তন যুদ্ধে লিপ্ত। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো, বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মইসলাম, আমাদের এই মহাজাগতিক নাটকের ছবিটিই দেখায় – একদিকে পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর, অন্যদিকে পরম অশুভ শয়তান।

কিন্তু একবার ভাবুন তো, যদি এই নাটকটাই ভুল হয়? যদি প্রকৃত খলনায়ক শয়তান না হয়? যদি খলনায়কের আসনে বসে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেউ, এমন কেউ যাকে আমরা এতদিন নায়ক ভেবে এসেছি?

প্রাচীন নস্টিকরা (Gnostics) ঠিক এই বিষ্ময়কর প্রশ্নটিই তুলেছিল। তাদের অদ্ভুত ও বৈপ্লবিক বিশ্ববীক্ষায় শয়তানের কোনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল না। সে হয় এক অপ্রয়োজনীয়, গৌণ চরিত্র, নাহলে এক বিভ্রান্ত আমলা, অথবা – এবং এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক – কখনও কখনও সে এক বিদ্রোহী নায়ক। নস্টিকদের জগতে শয়তানের এই অবনমন বা রূপান্তর বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে তাদের মহাজাগতিক মঞ্চটিকেই বুঝতে হবে, যেখানে প্রধান চরিত্রগুলোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মহাজাগতিক মঞ্চটি ইতিমধ্যেই পূর্ণ: কেন শয়তান অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল?

প্রচলিত খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে, মহাবিশ্বের নাটকটি দুটি প্রধান শক্তির মধ্যেকার সংঘাতের উপর ভিত্তি করে তৈরি: ঈশ্বর এবং শয়তান। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং তা ‘খুব ভালো’ ছিল। কিন্তু শয়তান সেই জগতে প্রবেশ করে মানুষকে প্রলোভিত করে এবং মন্দের সূচনা করে। সুতরাং, জগতের সমস্ত অমঙ্গল, বিশৃঙ্খলা এবং দুঃখ-কষ্টের জন্য শয়তানই দায়ী।

নস্টিকরা এই পুরো চিত্রনাট্যটিকেই বাতিল করে দিয়েছিল। তাদের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দ্বৈতবাদ (Dualism):

  • একদিকে আছেন পরম, অচেনা ঈশ্বর (The Unknown Father), যিনি আলোকময়, পরিপূর্ণ এবং এই জড় জগতের সম্পূর্ণ বাইরে।
  • অন্যদিকে আছে ডেমিয়ার্জ (The Demiurge) বা এই জগতের স্রষ্টা, যে হলো এক অজ্ঞ, অহংকারী এবং প্রায়শই মন্দ দেবতা। এই ডেমিয়ার্জই হলো ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর, ইয়াহওয়ে

এই নতুন নাটকে, জগতের কারাগার, মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং আত্মার নির্বাসনের জন্য দায়ী কে? শয়তান নয়, স্বয়ং স্রষ্টা – ডেমিয়ার্জ। জগৎটা গোড়াতেই ভালো ছিল না, কারণ এর স্রষ্টাই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এটি কোনো সুন্দর বাগান নয় যা পরে কলুষিত হয়েছে, এটি জন্ম থেকেই এক কারাগার।

ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: ধরুন একটি কোম্পানিতে একজন ভয়ঙ্কর অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং স্বৈরাচারী সিইও (CEO) আছেন। কোম্পানির সমস্ত সমস্যা – খারাপ পণ্য, কর্মীদের অসুখী জীবন, লোকসান – সবকিছুর জন্য তিনিই দায়ী। এখন, সেই কোম্পানিতে যদি একজন মধ্যম সারির ম্যানেজার থাকেন, যিনি মাঝে মাঝে সিইও-র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন বা অন্য কর্মীদের বিপথে চালিত করার চেষ্টা করেন, তাহলে কি আপনি তাকে কোম্পানির প্রধান সমস্যা বলবেন? নিশ্চয়ই না। আসল সমস্যা তো একেবারে শীর্ষে।

নস্টিকদের কাছে ডেমিয়ার্জ ছিল সেই অযোগ্য সিইও। সে-ই হলো এই ত্রুটিপূর্ণ জগতের স্রষ্টা, আত্মার জেলার। এই মহাজাগতিক খলনায়কের উপস্থিতিতে, শয়তানের মতো একজন দ্বিতীয় সারির বিদ্রোহী চরিত্রের আর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ডেমিয়ার্জ নিজেই শয়তানের সমস্ত কাজ – জগৎকে শাসন করা, মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখা, আত্মার মুক্তির পথে বাধা দেওয়া – আরও দক্ষতার সাথে করছিল। তাই নস্টিকদের পুরাণে শয়তান তার প্রধান খলনায়কের সিংহাসনটি হারিয়ে ফেলে। সে হয়ে যায় এক অপ্রয়োজনীয় চরিত্র (a redundant villain) (Jonas, 1958)।

শয়তান যখন এক নিম্নস্তরের আমলা: আর্কনদের অধীনস্থ

তাহলে শয়তানের স্থান কোথায়? যদি ডেমিয়ার্জ হয় মহাবিশ্বের স্বৈরাচারী শাসক, তবে শয়তান কে? বেশিরভাগ নস্টিক পুরাণে, শয়তানকে ডেমিয়ার্জেরই একটি সৃষ্টি বা অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে দেখা হয়েছে।

আমরা জানি, ডেমিয়ার্জ তার জগৎ পরিচালনা করার জন্য একদল সত্তা তৈরি করেছিল, যাদের বলা হয় ‘আর্কন’ (Archons) বা ‘শাসক’। এই আর্কনরাই হলো গ্রহ-নক্ষত্রের অধিপতি, মহাজাগতিক আমলা বা জেলার, যারা এই কারাগারের নিয়মকানুন প্রয়োগ করে।

এই কাঠামোতে, শয়তান বা স্যাটানাইল (Satanael) প্রায়শই এই আর্কনদেরই একজন, অথবা তাদের চেয়েও নিম্নস্তরের কোনো আত্মা। সে ডেমিয়ার্জের বিরুদ্ধে কোনো মহাজাগতিক বিদ্রোহী নয়, বরং সে হলো সেই নিপীড়নকারী সিস্টেমেরই একটি অংশ। সে হয়তো অন্য আর্কনদের চেয়ে বেশি দুষ্ট বা হিংস্র, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ডেমিয়ার্জেরই অনুচর। নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত গ্রন্থ ‘অন দি অরিজিন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (On the Origin of the World)-এ, ইয়ালদাবাওথ (ডেমিয়ার্জ) তার অধীনে অসংখ্য দেবদূত, আত্মা ও রাক্ষস তৈরি করে। শয়তানও সেই ব্যবস্থারই একটি অংশ মাত্র।

এই দৃষ্টিভঙ্গি শয়তানকে তার সমস্ত পৌরাণিক মহিমা থেকে বিচ্যুত করে। সে আর পতিত দেবদূত লুসিফার নয়, স্বর্গের বিদ্রোহী নয়। সে হয়ে যায় এক নিম্নস্তরের, সামান্য কর্মকর্তা, অনেকটা কোনো স্বৈরাচারী সরকারের গোপন পুলিশ বা অত্যাচারী জেলারের মতো। সে হয়তো বন্দীদের উপর অত্যাচার করে আনন্দ পায়, কিন্তু সে নিজেও সেই কারাগারেরই একটি অংশ এবং তার উপরে থাকা প্রভুর (ডেমিয়ার্জ) কাছে সে সম্পূর্ণরূপে দায়বদ্ধ। এই দৃষ্টিভঙ্গি শয়তানকে রহস্যমুক্ত বা ডিমিস্টিফাই (demystify) করে এবং তাকে মহাজাগাতিক মন্দের উৎস হিসেবে দেখার বদলে, তাকে সেই মন্দেরই একটি উপসর্গ বা প্রকাশ হিসেবে দেখে (Rudolph, 1987)।

বিদ্রোহীর প্রতি শ্রদ্ধা: যখন শয়তান হয়ে ওঠে নায়ক

নস্টিসিজমের সবচেয়ে র‍্যাডিকাল এবং বিষ্ময়কর দিকটি হলো প্রচলিত মূল্যবোধকে পুরোপুরি উল্টে দেওয়া। আর এই উল্টে দেওয়ার প্রক্রিয়ায়, শয়তানও কখনও কখনও এক অপ্রত্যাশিত নায়কের ভূমিকা লাভ করে।

এই ব্যাখ্যার উৎস হলো সেই ইডেন উদ্যানের গল্প। যদি ইডেন উদ্যানের ‘ঈশ্বর’ হন অজ্ঞ ও ঈর্ষাপরায়ণ ডেমিয়ার্জ, যিনি মানুষকে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করতে চান, তাহলে যে সত্তা সেই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মানুষকে জ্ঞান (নোসিস) গ্রহণে উৎসাহিত করে, সে কি মন্দ হতে পারে?

  • সাপ যখন ত্রাণকর্তা: ওফাইটদের (Ophites) মতো গোষ্ঠীগুলো আদিপুস্তকের সাপকে ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখত। প্রচলিত খ্রিস্টধর্মে এই সাপকে শয়তানেরই এক রূপ হিসেবে দেখা হয়। সুতরাং, এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, শয়তানের বিদ্রোহ (স্রষ্টার বিরুদ্ধে) ছিল আসলে মানবজাতির মুক্তির জন্য এক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। সে মানুষকে পাপ করতে প্ররোচিত করেনি, সে তাকে অজ্ঞতার ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে।
  • বিদ্রোহ যখন পুণ্য: এই চিন্তাধারার চরম প্রকাশ ঘটেছিল কেইনাইটদের (Cainites) মতো গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। তারা বিশ্বাস করত, যেহেতু এই জগতের স্রষ্টা মন্দ, তাই তার বিরুদ্ধে যে কোনো বিদ্রোহই একটি পুণ্য বা আধ্যাত্মিক কাজ। এই যুক্তি অনুযায়ী, শয়তান, যে ছিল স্রষ্টার বিরুদ্ধে প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী, সে শ্রদ্ধার পাত্র। সে কোনো অশুভ শক্তি নয়, বরং সে হলো এক সহ-বিপ্লবী (a fellow revolutionary), যে ডেমিয়ার্জের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।

অবশ্য, এই ধারণাটি সমস্ত নস্টিক গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল তাদের সবচেয়ে চরমপন্থী শাখাগুলোর বিশ্বাস। কিন্তু এটি দেখায় যে, নস্টিকদের দ্বৈতবাদী দর্শন কতটা বৈপ্লবিক ছিল। এটি ভালো-মন্দের প্রচলিত ধারণাকে এতটাই ওলটপালট করে দিয়েছিল যে, পরম মন্দের প্রতীক শয়তানও কখনও কখনও আলোর বাহক হয়ে উঠতে পারত।

পরিচয়ের বিভ্রান্তি: শয়তান কি ডেমিয়ার্জ নিজেই?

নস্টিক গ্রন্থগুলো প্রায়শই অস্পষ্ট, প্রতীকী এবং বিভিন্ন ধারার মিশ্রণে তৈরি। ফলে, শয়তান এবং ডেমিয়ার্জের মধ্যেকার সম্পর্কটি সবসময় পরিষ্কার থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে, এই দুটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো একে অপরের সাথে মিশে যায়।

  • ‘এই জগতের ঈশ্বর’: নিউ টেস্টামেন্টে (2 Corinthians 4:4) শয়তানকে ‘এই জগতের ঈশ্বর’ (the god of this world) বলে অভিহিত করা হয়েছে। নস্টিকরা এই উপাধিটিকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাদের কাছে এই ‘জগতের ঈশ্বর’ কে? সে কি ডেমিয়ার্জ, কারণ সে এই জগতের স্রষ্টা? নাকি সে শয়তান, কারণ সে এই জগতের উপর আধিপত্য করে? অনেক নস্টিক লেখকের কাছে, এই দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। ডেমিয়ার্জই হলো শয়তানি শক্তির মূল উৎস।
  • একই নামের ব্যবহার: নস্টিক পুরাণে ডেমিয়ার্জকে প্রায়শই ‘সামায়েল’ (Samael) নামে ডাকা হয়েছে, যার অর্থ ‘অন্ধ ঈশ্বর’। কিন্তু ইহুদিদের অ্যাপোক্রিফাল বা অপ্রচলিত সাহিত্যে ‘সামায়েল’ হলো এক প্রধান পতিত দেবদূত বা শয়তানেরই একটি নাম। এই একই নামের ব্যবহার প্রমাণ করে যে, নস্টিকদের মনে ডেমিয়ার্জ এবং শয়তানের চরিত্র দুটি প্রায়শই একীভূত হয়ে যেত (Pearson, 2007)। ডেমিয়ার্জই হলো আসল শয়তান, আসল প্রতিপক্ষ (the true adversary)।

এই পরিচয়ের বিভ্রান্তি নস্টিক দর্শনের মূল কথাটিকেই আরও শক্তিশালী করে: আসল সমস্যা কোনো পতিত দেবদূত নয়, আসল সমস্যা হলো এই মহাবিশ্বের কাঠামোতেই, এর স্রষ্টার মধ্যেই।

এক সিংহাসনচ্যুত খলনায়ক

তাহলে শয়তান প্রসঙ্গে নস্টিসিজমের চূড়ান্ত রায় কী? তাদের দর্শনে শয়তানের কোনো একক, স্থির ভূমিকা নেই। সে কখনও অপ্রয়োজনীয়, কখনও নিম্নস্তরের আমলা, কখনও বিদ্রোহী নায়ক, আবার কখনও বা প্রধান খলনায়ক ডেমিয়ার্জেরই এক ছদ্মনাম।

কিন্তু এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকার মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট: নস্টিকরা শয়তানকে তার ঐতিহ্যবাহী সিংহাসন থেকে বিচ্যুত করেছিল। তারা মহাজাগতিক মন্দের উৎসকে এক বাহ্যিক, পতিত দেবদূতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। তারা আরও গভীরে গিয়েছিল, আরও দুঃসাহসী প্রশ্ন তুলেছিল। তারা মন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছিল সৃষ্টির একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে – স্বয়ং স্রষ্টার অজ্ঞতা ও অপূর্ণতার মধ্যে।

নস্টিকদের কাছে, শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা ছিল এক গৌণ কাজ। আসল যুদ্ধটা ছিল এই কারাগার-সদৃশ জগৎ এবং তার জেলার, অর্থাৎ ডেমিয়ার্জের বিরুদ্ধে। শয়তানের ধারণাটি হয়তো আমাদের ভয় দেখায়, কিন্তু ডেমিয়ার্জের ধারণাটি আমাদের পুরো বাস্তবতার ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেয়। আর এটাই ছিল নস্টিসিজমের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অস্বস্তিকর বার্তা। তাই পরের বার যখন আপনি মন্দের উৎস নিয়ে ভাববেন, তখন নস্টিকদের মতো একবার প্রশ্ন করে দেখতে পারেন – আসল সমস্যা কি সেই বিদ্রোহী কর্মচারী, নাকি কোম্পানির দুর্নীতিগ্রস্ত মালিক?

বিদ্রোহী শয়তান ও অ্যাবসার্ড নায়ক: নস্টিসিজম থেকে কাম্যু পর্যন্ত বিদ্রোহের বিবর্তন

নস্টিসিজমের ইতিহাস কেবল কিছু প্রাচীন পুঁথি বা ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস নয়; এটি হলো মানুষের বিদ্রোহের এক দীর্ঘ, ধারাবাহিক আখ্যান। সেই আদিম যুগে মানুষ যখন প্রথম অনুভব করেছিল যে এই জগৎটা তাকে ধারণ করতে পারছে না, তখন থেকেই এই বিদ্রোহের শুরু। নস্টিকরা বলেছিল, এই জগৎ একটা কারাগার। তাদের বিদ্রোহ ছিল পালানোর বিদ্রোহ। কিন্তু ইতিহাসের চাকা যত ঘুরেছে, মানুষের বিদ্রোহের ভাষাও তত বদলেছে। একসময় মানুষ আর পালাতে চায়নি, সে দাঁড়িয়ে থেকে ‘না’ বলতে চেয়েছে। সে জেনেছে তার জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবু সে লড়াই থামায়নি। এই বিবর্তন – নস্টিকদের পলায়নপর মনোবৃত্তি থেকে শুরু করে রোমান্টিক যুগের বিদ্রোহী শয়তান হয়ে আলবেয়ার কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়কে পৌঁছানো পর্যন্ত – পশ্চিমা চিন্তার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে নস্টিসিজম (Gnosticism), নিইলিজম (Nihilism) এবং অ্যাবসার্ডিজম (Absurdism) – এই তিনটি ভিন্ন ধারা একই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি উত্তর দিয়েছে।

নস্টিসিজম: পালানোর বিদ্রোহ

বিদ্রোহের এই দীর্ঘ যাত্রার শুরুটা হয়েছিল নস্টিসিজম দিয়ে। নস্টিকদের বিদ্রোহ ছিল মূলত সত্তাতাত্ত্বিক (Ontological)। অর্থাৎ, তারা কোনো নির্দিষ্ট রাজা বা শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি, তাদের বিদ্রোহ ছিল খোদ এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে (Jonas, 1958)। তাদের দর্শন অনুযায়ী, এই জগৎ কোনো পরম করুণাময় ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়, বরং এটি এক অজ্ঞ, অহংকারী এবং ত্রুটিপূর্ণ স্রষ্টা, ডেমিয়ার্জ (Demiurge)-এর তৈরি এক কারাগার। মানুষ, বিশেষ করে তার আত্মা বা নিউমা (Pneuma), এই জগতের অংশ নয়। সে হলো এক ভিনগ্রহী বা এলিয়েন সত্তা, যে ভুল করে এই জড় পদার্থের ফাঁদে আটকা পড়েছে।

নস্টিকদের কাছে বিদ্রোহ মানেই ছিল প্রত্যাখ্যান। তারা এই জগৎকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, এর স্রষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, এবং এর নিয়মকানুন বা হেইমারমেনে (Heimarmene)-কে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু তাদের বিদ্রোহের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল পলায়ন (Escape) বা ট্রান্সেন্ডেন্স (Transcendence)। তারা বিশ্বাস করত, নোসিস (Gnosis) বা গুপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে তারা এই কারাগারের দেয়াল ভেঙে তাদের আসল বাড়ি, প্লেরোমা (Pleroma)-য় ফিরে যেতে পারবে (Rudolph, 1987)। অর্থাৎ, তাদের কাছে সমস্যাটার (এই জগৎ) একটা সমাধান (ওই জগৎ) ছিল। তাদের বিদ্রোহ ছিল এক আশা-নির্ভর বিদ্রোহ। তারা জানত, বা বিশ্বাস করত, যে এই নরক থেকে বেরোনোর একটা গোপন দরজা আছে। তাই নস্টিক বিদ্রোহ কখনোই পুরোপুরি হতাশার ছিল না, বরং তা ছিল এক সুপ্ত আশাবাদের ওপর দাঁড়িয়ে। তারা বলত, “এই জগৎটা ভুল, এখান থেকে বেরোতে হবে।” তাদের দৃষ্টি ছিল ভবিষ্যতের দিকে, পরলোকের দিকে। বর্তমান মুহূর্ত বা এই পার্থিব জীবন তাদের কাছে ছিল কেবল এক অপ্রয়োজনীয় বোঝা, যা যত দ্রুত সম্ভব ঝেড়ে ফেলা উচিত।

রোমান্টিক শয়তান: জেনেও মাথা না নোয়ানো

কিন্তু সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে বিদ্রোহের এই ভাষা বদলাতে শুরু করে। এনলাইটেনমেন্টের আলোয় যখন পুরোনো ধর্মবিশ্বাসগুলো প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন সাহিত্যের পাতায় এমন এক নতুন ধরনের শয়তানের আবির্ভাব ঘটে, যে আর কেবলই ‘অশুভ’ শক্তি নয়। সে হয়ে ওঠে এক ট্র্যাজিক হিরো। এই শয়তান জানে যে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। সে জানে যে স্বর্গ থেকে সে চিরতরে বিতাড়িত। সে এও জানে যে তার জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবু সে নস্টিকদের মতো পালাতে চায় না। সে দাঁড়িয়ে থাকে, এবং সর্বশক্তিমানের মুখের ওপর ‘না’ বলে দেয় (Bloom, 1971)।

জন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost) কাব্যের শয়তান হলো এই ধারার প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ। সে যখন বলে, “স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা শ্রেয়” (Better to reign in Hell, than serve in Heaven), তখন সে এক নতুন ধরনের বিদ্রোহের জন্ম দেয়। এই বিদ্রোহ পলায়নের জন্য নয়, এটি প্রত্যাখ্যানের (Refusal) জন্য। মিল্টনের শয়তান কোনো গোপন জ্ঞানের মাধ্যমে অন্য কোনো জগতে চলে যেতে চায় না। সে এই জগতেই, এই নরকেই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু কারো বশ্যতা স্বীকার না করে। তার বিদ্রোহের ভিত্তি কোনো আশা নয়, বরং এক ধরনের সচেতন জেদ। সে জানে সে হারবে, কিন্তু হার মানবে না।

উইলিয়াম ব্লেকের দ্য ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যান্ড হেল (The Marriage of Heaven and Hell)-এ এই ধারণা আরও স্পষ্ট হয়। ব্লেক দেখান যে বাইবেলের তথাকথিত ‘ঈশ্বর’ হলেন আসলে যুক্তি ও দমনের প্রতীক, আর ‘শয়তান’ হলো শক্তি, সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতার প্রতীক। ব্লেকের শয়তান কোনো মুক্তি খোঁজে না, সে কেবল তার সৃজনশীল ধ্বংসের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। একইভাবে, গ্যেটের ফাউস্ট (Faust)-এর মেফিস্টোফেলিস বা আনাতোল ফ্রাঁসের দ্য রিভোল্ট অফ দি অ্যাঞ্জেলস (The Revolt of the Angels)-এর বিদ্রোহী দেবদূতরা জানে যে তারা ঈশ্বরের পরিকল্পনার বাইরে যেতে পারবে না। তারা জানে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হয়তো আগে থেকেই নির্ধারিত। তবু তারা বিদ্রূপ করে, প্রশ্ন তোলে এবং অস্বীকার করে। তাদের বিদ্রোহের লক্ষ্য জয়লাভ নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্বের স্বকীয়তা প্রমাণ করা। তারা বলে, “আমি জিতব না জেনেও মাথা নোয়াব না।” এটি হলো ইমানেন্ট রিবেলিয়ন (Immanent Rebellion) – অর্থাৎ এই জগতের ভেতরে থেকেই বিদ্রোহ, কোনো পরলৌকিক আশার ওপর নির্ভর না করে।

কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়ক: অর্থহীনতার মুখোমুখি

বিদ্রোহের এই বিবর্তন তার চূড়ান্ত এবং সম্ভবত সবচেয়ে পরিণত রূপ পায় বিংশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক আলবেয়ার কাম্যু (Albert Camus)-এর চিন্তায়। কাম্যু নস্টিসিজমের জগৎ-বিমুখতা এবং রোমান্টিক শয়তানের ট্র্যাজিক জেদ – উভয়কেই পর্যালোচনা করেছেন এবং এক নতুন অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। কাম্যুর দর্শন, যাকে অ্যাবসার্ডিজম (Absurdism) বলা হয়, তা শুরু হয় এক নির্মম সত্য স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে: এই মহাবিশ্ব অর্থহীন, নীরব এবং মানুষের আকুতির প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। মানুষ অর্থের জন্য হাহাকার করে, কিন্তু মহাবিশ্ব কোনো উত্তর দেয় না। মানুষ এবং মহাবিশ্বের এই সংঘাতকেই কাম্যু বলেছেন অ্যাবসার্ড (The Absurd) (Camus, 1955)।

কাম্যু যেসব দর্শন অর্থহীনতাকে সহ্য করতে না পেরে একটি অতিলৌকিক বা ‘আসল জগৎ’-এর ধারণা নির্মাণ করে, সেগুলোকে ‘দার্শনিক আত্মহত্যা’ (Philosophical Suicide) বলে সমালোচনা করেছেন। এই অর্থে নস্টিসিজমের প্লেরোমা–ধারণাও তার সমালোচনার আওতায় পড়ে।  তাঁর মতে, নস্টিকরা জগতের অর্থহীনতাকে সহ্য করতে না পেরে এক কাল্পনিক ‘আসল জগৎ’ বা প্লেরোমা তৈরি করে নিয়েছে। তারা সমস্যা থেকে পালিয়েছে। অন্যদিকে, নিইলিজম (Nihilism) বা শূন্যবাদীরা অর্থহীনতার ভারে ভেঙে পড়ে বলেছে, “যেহেতু জীবনের কোনো মানে নেই, তাই বেঁচে থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই।” কাম্যু এই দুটি পথকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তাঁর অ্যাবসার্ড নায়ক (যেমন – দ্য মিথ অফ সিসিফাস (The Myth of Sisyphus)-এর সিসিফাস, দ্য প্লেগ (The Plague)-এর ডাক্তার রিও, বা দ্য আউটসাইডার (The Outsider)-এর মারসো) জানে যে কোনো আশা নেই। তারা জানে কোনো ঈশ্বর নেই, কোনো পরকাল নেই, এবং তাদের কাজের কোনো চূড়ান্ত ফলাফল নেই। সিসিফাস জানে যে পাথরটা আবার গড়িয়ে নিচে পড়বেই। ডাক্তার রিও জানে যে প্লেগ আবার ফিরে আসবেই, মৃত্যু অনিবার্য। তবু তারা কাজ থামায় না। তারা পালায় না (নস্টিকদের মতো), আবার হাল ছেড়েও দেয় না (নিইলিস্টদের মতো)। তারা তাদের ভাগ্যকে মেনে নেয় না, কিন্তু স্বীকার করে।

কাম্যুর বিদ্রোহ হলো আশাহীন বিদ্রোহ (Rebellion without hope)। এটি হলো লুসিড এনডিউরেন্স (Lucid Endurance) বা সচেতন সহনশীলতা। অ্যাবসার্ড নায়ক বলে, “কোনো মানে নেই জেনেও আমি বেঁচে থাকব, আমি কাজ করব, আমি মানুষকে ভালোবাসব।” তার বিদ্রোহ কোনো ভবিষ্যতের জন্য নয়, কেবল বর্তমান মুহূর্তের মর্যাদা রক্ষার জন্য। সে বলে, “মানেই না থাক, তবু থাকব” (Camus, 1956)। এই অবস্থানটি রোমান্টিক শয়তানের চেয়েও কঠিন, কারণ শয়তানের অন্তত একজন প্রতিপক্ষ (ঈশ্বর) ছিল যার বিরুদ্ধে সে লড়তে পারত। অ্যাবসার্ড নায়কের কোনো প্রতিপক্ষ নেই, সে লড়ছে এক নীরব, বধির শূন্যতার বিরুদ্ধে।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: নস্টিক, নিইলিস্ট ও অ্যাবসার্ড

এই তিনটি অবস্থানকে পাশাপাশি রাখলে আমরা মানুষের চেতনার বিবর্তনের এক পরিষ্কার মানচিত্র দেখতে পাই। নিচের সারণীটি এই পার্থক্যগুলোকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে:

তুলনামূলক বিষয়নস্টিসিজম (Gnosticism)নিইলিজম (Nihilism)অ্যাবসার্ডিজম (Absurdism)
জগতের প্রকৃতিকারাগার, ভুল এবং অশুভ (Evil)।অর্থহীন, মূল্যহীন এবং শূন্য।অর্থহীন, কিন্তু এটিই একমাত্র বাস্তব।
ঈশ্বরের অবস্থানআছেন, কিন্তু তিনি এই জগতের বাইরে (Alien God)।নেই, অথবা অপ্রাসঙ্গিক।নেই, আছে কেবল এক প্রশ্নাতীত নীরবতা।
জ্ঞানের ভূমিকামুক্তির চাবি (Gnosis)।জ্ঞান অসম্ভব বা অর্থহীন।মানুষের সীমাবদ্ধতা জানার উপায়।
মুক্তির সম্ভাবনাআছে (Escape/Pleroma)।নেই।নেই।
বিদ্রোহের ধরনপালানো বা ঊর্ধ্বারোহণ (Transcendence)।উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা বা আত্মবিনাশ।সচেতন প্রত্যাখ্যান ও সহনশীলতা (Endurance)।
শেষ বাক্য“এখান থেকে বেরোতে হবে।”“কিছুই মানে নেই।”“মানেই না থাক, তবু থাকব।”

নস্টিসিজম এবং নিইলিজম – উভয়েই এই জগতকে নেতিবাচকভাবে দেখে। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়ায় আকাশ-পাতাল তফাত। নস্টিকরা জগতকে ‘না’ বলে কারণ তারা বিশ্বাস করে অন্য কোথাও একটা ‘হ্যাঁ’ আছে। তাদের নেতিবাচকতা আসলে এক গভীরতর ইতিবাচকতার (পরম ঈশ্বর) ওপর দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে, নিইলিস্টরা জগতকে ‘না’ বলে কারণ তাদের কাছে ‘হ্যাঁ’ বলার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাদের নেতিবাচকতা চূড়ান্ত। নস্টিকরা ভবিষ্যতের দিকে তাকায়, নিইলিস্টরা শূন্যতার দিকে তাকায় (Couliano, 1991)।

কাম্যুর অ্যাবসার্ডিজম নস্টিকদের জগৎ-বিদ্বেষকে অস্বীকার করে। কাম্যু এই জগতকে ভালোবাসতে চেয়েছেন – এর রোদ, সাগর, নারী, সৌন্দর্য – সবকিছুকে। তিনি বলেছেন, জগৎ অর্থহীন হতে পারে, কিন্তু তা অশুভ নয়। নস্টিকরা যেখানে শরীর ও জড় জগতকে ঘৃণা করত, কাম্যু সেখানে শরীরী অস্তিত্বকে উদযাপন করেছেন। নস্টিকদের লক্ষ্য ছিল ট্রান্সেন্ডেন্স (Transcendence) বা ঊর্ধ্বারোহণ, আর কাম্যুর লক্ষ্য ছিল ইমানেন্স (Immanence) বা এই মুহূর্তের ভেতরে সম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকা।

সাহিত্যিক রূপান্তর: বিদ্রোহের চেহারাবদল

এই দার্শনিক বিবর্তন সাহিত্যেও তার ছাপ রেখে গেছে। নস্টিক পুরাণে আমরা দেখি সোফিয়া বা যিশুর মতো চরিত্রদের, যারা এই জগত থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে আসে। তাদের কাজ হলো পথ দেখানো, যাতে মানুষ এই জগত ত্যাগ করতে পারে। রোমান্টিক যুগে মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট-এর শয়তান, বা বায়রনের ম্যানফ্রেড (Manfred)-এর মতো চরিত্ররা জগত ত্যাগ করে না। তারা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মহাবিশ্বকে ধিক্কার দেয়। তারা ট্র্যাজিক, কারণ তারা জানে তাদের পতন অনিবার্য, তবু তারা তাদের অহংকার বিসর্জন দেয় না।

মডার্নিজমঅ্যাবসার্ড যুগে দস্তয়েভস্কির দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ (The Brothers Karamazov)-এর ইভান কারামাজভ বা ডিমনস (Demons)-এর কিরিলভ নিইলিজমের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিরিলভ মনে করে, ঈশ্বর নেই মানে সে নিজেই ঈশ্বর, এবং এই স্বাধীনতা প্রমাণের জন্য সে আত্মহত্যা করে। এটি নিইলিজমের চরম রূপ। কিন্তু কাম্যুর ডাক্তার রিও (দ্য প্লেগ) সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, সে জানে প্লেগ (অশুভ) কখনো পুরোপুরি যাবে না। তবু সে প্রতিদিন রোগীদের সেবা করে, ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যায়। সে কোনো পুরস্কারের আশা করে না, সে কেবল তার কাজটা করে যায় কারণ সেটাই একমাত্র মানবিক কাজ। সিসিফাস পাহাড়ের নিচে নেমে আসে তার পাথরটা আবার তোলার জন্য, এবং কাম্যু বলেন, “আমাদের কল্পনা করে নিতে হবে যে সিসিফাস সুখী।” এই সুখ কোনো প্রাপ্তির সুখ নয়, এটি অস্তিত্বের বোঝা বহন করার গৌরবময় সুখ।

উপসংহার: বিদ্রোহের অন্তহীন চক্র

নস্টিসিজম থেকে কাম্যু পর্যন্ত এই যাত্রাপথ আসলে মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের ইতিহাস। মানুষ প্রথমে ভেবেছিল সে ভুল জায়গায় আছে, তাই সে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে (নস্টিসিজম)। তারপর সে বুঝেছে বাড়ি ফেরার পথ নেই, তাই সে রেগে গিয়ে দরজায় লাথি মেরেছে (রোমান্টিক বিদ্রোহ)। শেষে সে বুঝেছে রাগ করেও লাভ নেই, দরজা খোলারও কেউ নেই। তাই সে সেই বদ্ধ ঘরেই নিজের মতো করে ঘর সাজিয়ে নিয়েছে, জানাল দিয়ে বাইরের রোদ দেখেছে এবং বলেছে, “ঠিক আছে, এটাই আমার জীবন, এবং আমি এটাকে আমার শর্তেই যাপন করব” (অ্যাবসার্ডিজম)।

এই বিদ্রোহের কোনো শেষ নেই। প্রতিটি যুগে মানুষ নতুন করে এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়। আজকের ডিজিটাল যুগে, যখন ফিলিপ কে. ডিক বা দ্য ম্যাট্রিক্স-এর মতো গল্পে আমরা আবার সিমুলেটেড কারাগারের কথা শুনি, তখন বোঝা যায় নস্টিক ভীতি আমাদের ছেড়ে যায়নি। আবার যখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তন বা রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সামনে দাঁড়িয়েও প্রতিদিনের কাজ করে যাই, তখন আমরা অজান্তেই কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়ক হয়ে উঠি।

অ্যান্টিক্রাইস্ট যখন স্রষ্টা নিজেই: নস্টিকদের চোখে ইতিহাসের শেষ খলনায়ক

ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে কী ঘটবে? পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো, বিশেষ করে আব্রাহামিক ধর্মগুলো, আমাদের এক ভয়ংকর কিন্তু আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যতের ছবি দেখায়। সেই ছবিতে আছে এক চূড়ান্ত সংঘাত, এক মহাজাগতিক যুদ্ধ। একদিকে থাকবেন ঈশ্বর বা তাঁর পাঠানো ত্রাণকর্তা (মসিহ, যিশুর দ্বিতীয় আগমন বা মাহদি), অন্যদিকে থাকবে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ – এক চূড়ান্ত খলনায়ক। খ্রিস্টধর্মে তাকে বলা হয় অ্যান্টিক্রাইস্ট (Antichrist), আর ইসলামে তার নাম দাজ্জাল (Dajjal)

এই অ্যান্টিক্রাইস্ট বা দাজ্জাল কে? সে হলো এক মিথ্যা ত্রাণকর্তা, এক প্রতারক। সে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে, নিজেকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের দূত বলে দাবি করবে, এবং পৃথিবীর বহু মানুষকে তার অনুসারী করে ফেলবে। সে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেবে, কিন্তু আসলে সে নিয়ে আসবে ধ্বংস ও অধর্ম। সে হবে খ্রিস্ট বা সত্যের চূড়ান্ত প্যারোডি বা বিকৃত অনুকরণ। ইতিহাসের শেষে, আসল ত্রাণকর্তা এসে তাকে পরাজিত করবেন এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন।

এই নাটকীয়, অ্যাপোক্যালিপ্টিক (apocalyptic) আখ্যানটি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের কল্পনাকে আলোড়িত করেছে। কিন্তু প্রাচীন নস্টিকরা (Gnostics) যদি এই গল্পটি শুনত, তারা হয়তো মুচকি হাসত। তারা বলত, “তোমরা ভবিষ্যতের এক মিথ্যা ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করছ? তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, তোমরা ইতিমধ্যেই এক মিথ্যা ঈশ্বরের জগতে বাস করছ?”

নস্টিকদের বৈপ্লবিক ও জগৎ-বিদ্বেষী দর্শনে, অ্যান্টিক্রাইস্টের ধারণাটি এক সম্পূর্ণ নতুন এবং আরও ভয়ংকর মাত্রা লাভ করে। তাদের কাছে, অ্যান্টিক্রাইস্ট কোনো ভবিষ্যতের চরিত্র নয়। সে ইতিমধ্যেই এখানে আছে, এবং সে আর কেউ নয়, এই জগতের অজ্ঞ ও অহংকারী স্রষ্টা – ডেমিয়ার্জ (The Demiurge) নিজেই।

মিথ্যা ত্রাণকর্তার স্বরূপ: ডেমিয়ার্জই হলো আসল অ্যান্টিক্রাইস্ট

নস্টিকদের কাছে ‘খ্রিস্ট’ (Christ) কে? তিনি হলেন প্লেরোমা বা আলোর জগৎ থেকে আসা এক ঐশ্বরিক দূত, যিনি এসেছেন মানুষকে ‘নোসিস’ বা জ্ঞান দিয়ে জাগিয়ে তুলতে। তিনি এসেছেন আমাদের জানাতে যে, এই জগৎ আমাদের আসল বাড়ি নয় এবং এই জগতের স্রষ্টা আসল ঈশ্বর নন।

তাহলে ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’ বা ‘খ্রিস্ট-বিরোধী’ কে হবে? যৌক্তিকভাবেই, সে হবে এমন এক সত্তা, যে খ্রিস্টের এই বার্তার ঠিক বিপরীত কথা বলে। সে এমন এক সত্তা হবে, যে দাবি করবে:

  • এই জগৎটাই একমাত্র বাস্তবতা এবং এটি একটি ভালো জগৎ।
  • এই জগতের স্রষ্টাই হলেন একমাত্র এবং পরম ঈশ্বর।
  • মুক্তি আসবে এই জগতের নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে এবং স্রষ্টার উপাসনা করার মাধ্যমে।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো কার সাথে হুবহু মিলে যায়? ডেমিয়ার্জ, অর্থাৎ ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর ইয়াহওয়ের সাথে। নস্টিকদের চোখে, ডেমিয়ার্জই হলো আসল, আদি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যান্টিক্রাইস্ট বা দাজ্জাল।

  • সে নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করে: অ্যান্টিক্রাইস্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সে নিজেকে ঈশ্বর বা উপাসনার যোগ্য বলে দাবি করবে। ডেমিয়ার্জ ঠিক এই কাজটিই করে। সে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করে, “আমিই ঈশ্বর, আমি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই।” (Isaiah 45:5)। নস্টিকদের কাছে এটি ছিল চূড়ান্ত ধর্মদ্রোহিতা (blasphemy), কারণ সে আসল, অচেনা ঈশ্বরের স্থান দখল করার চেষ্টা করছে।
  • সে এক মিথ্যা ত্রাণকর্তা: ডেমিয়ার্জ তার নির্বাচিত প্রজা, ইহুদিদের, মুক্তি ও সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। সে আইন দেয় এবং বলে যে এই আইন মেনে চললেই মুক্তি মিলবে। কিন্তু নস্টিকদের মতে, এই সবই হলো এক বিরাট প্রতারণা। তার আইন আমাদের মুক্তি দেয় না, বরং পাপবোধের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে। তার দেওয়া মুক্তি এই কারাগারের ভেতরেই এক আরামদায়ক সেল মাত্র, কারাগার থেকে পালানোর পথ নয়। সে হলো এক জেলার, যে নিজেকে মুক্তিদাতা বলে পরিচয় দেয়।
  • সে খ্রিস্টের অনুকরণ করে: নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে, অ্যান্টিক্রাইস্ট খ্রিস্টের অনুকরণ করবে, অলৌকিক কাজ দেখাবে এবং নিজেকে মসিহ বলে দাবি করবে। নস্টিকদের মতে, ডেমিয়ার্জ ঠিক এই কাজটিই করে। সে প্লেরোমার জগতের এক বিকৃত ও অসম্পূর্ণ অনুকরণ হিসেবে এই জগৎ তৈরি করে। সে নিজেকে আলোকময় বলে দাবি করে, যদিও সে অন্ধকারের সন্তান। সে নিজেকে পিতা বলে দাবি করে, যদিও সে আসল পরম পিতার সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে হলো আসল খ্রিস্টের এক মহাজাগতিক প্যারোডি (cosmic parody) (Pagels, 1995)।

সুতরাং, নস্টিকদের কাছে ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ের লড়াইটা কোনো ভবিষ্যৎ অ্যান্টিক্রাইস্টের বিরুদ্ধে নয়। এই লড়াইটা শুরু হয়ে গেছে খ্রিস্টের আগমনের মুহূর্ত থেকেই। এটি হলো প্লেরোমার দূত, খ্রিস্ট, এবং এই জগতের শাসক, ডেমিয়ার্জ-অ্যান্টিক্রাইস্টের মধ্যেকার লড়াই। এটি হলো জ্ঞান (Gnosis) এবং অজ্ঞতার (Agnosis) মধ্যেকার লড়াই।

ইতিহাস যখন এক প্রতারণার রঙ্গমঞ্চ

নস্টিকদের এই ব্যাখ্যা অ্যাপোক্যালিপ্টিক বা শেষ জামানার ধারণাকেই পাল্টে দেয়। প্রচলিত অ্যাপোক্যালিপ্টিক চিন্তায় (যেমন, ‘বুক অফ রেভেলেশন’), ইতিহাস হলো এক রৈখিক প্রক্রিয়া, যা এক চূড়ান্ত সংঘাত এবং ঈশ্বরের বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে।

কিন্তু নস্টিকদের কাছে, ইতিহাস নিজেই হলো এক প্রতারণা, ডেমিয়ার্জের তৈরি এক রঙ্গমঞ্চ। এখানে যা কিছু ঘটে, তা সবই এই কারাগারের ভেতরের ঘটনা। ডেমিয়ার্জ তার নিজের নবীদের পাঠায়, তার নিজের আইন দেয়, তার নিজের যুদ্ধ ঘটায় – এই সবকিছুই মানুষকে এই ভ্রমের মধ্যে ব্যস্ত রাখার জন্য।

এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যে সব শাসকরা নিজেদের ঈশ্বর বলে দাবি করেছে (যেমন, রোমান সম্রাটরা), অথবা যে সব ধর্মীয় নেতারা অন্ধ বিশ্বাস ও ভয় দিয়ে মানুষকে শাসন করেছে, তারা সবাই হলো ডেমিয়ার্জ-অ্যান্টিক্রাইস্টেরই ছোট ছোট প্রতিরূপ বা প্রতিনিধি। তারা হলো সেই মহাজাগতিক স্বৈরাচারীর পার্থিব এজেন্ট।

এই কারণেই অনেক নস্টিক গোষ্ঠী, যেমন কেইনাইটরা (Cainites), প্রচলিত সমাজের সমস্ত নায়ক এবং আইন-প্রণেতাদের (যেমন, মুসা বা মোজেস) সন্দেহের চোখে দেখত এবং তাদের স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের প্রতিনিধি বলে মনে করত। তাদের কাছে, প্রকৃত নায়ক হলো তারাই, যারা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

“ইতিমধ্যেই, কিন্তু এখনও নয়”: নস্টিক অ্যাপোক্যালিপ্স

তাহলে কি নস্টিকদের কোনো ভবিষ্যতের আশা ছিল না? ছিল, কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তাদের ‘শেষ জামানা’ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি এক ব্যক্তিগত, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা।

  • জাগরণই হলো শেষ জামানা: একজন নস্টিকের জন্য, ‘শেষ জামানা’ বা অ্যাপোক্যালিপ্স (যার অর্থ ‘আবরণ উন্মোচন’) তখনই শুরু হয়, যখন সে ‘নোসিস’ লাভ করে। সেই মুহূর্তেই তার কাছে এই জগতের আসল স্বরূপ উন্মোচিত হয়, সে বুঝতে পারে যে সে এক কারাগারে বাস করছে এবং তার শাসক হলো এক মিথ্যা ঈশ্বর। তার পুরোনো জগৎ সেই মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং সে এক নতুন, আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করে।
  • খ্রিস্টের আগমন একটি বর্তমান ঘটনা: খ্রিস্টের আগমন কোনো ভবিষ্যতের ঘটনা নয়, এটি প্রতিটি জ্ঞান-সন্ধানীর জীবনেই ঘটতে পারে। যখন কেউ ‘নোসিস’-এর জন্য প্রস্তুত হয়, তখন খ্রিস্টের জ্ঞান তার ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাকে জাগিয়ে তোলে।
  • চূড়ান্ত মুক্তি: যদিও জাগরণ এখনই ঘটে, কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তি (প্লেরোমাতে (pleroma) প্রত্যাবর্তন) ঘটে মৃত্যুর পর, যখন আত্মা দেহ এবং আর্কনদের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তার আসল বাড়িতে ফিরে যায়।

এই অর্থে, নস্টিকদের অ্যাপোক্যালিপ্টিক দর্শন ছিল একাধারে ‘ইতিমধ্যেই’ (already) এবং ‘এখনও নয়’ (not yet)। অ্যান্টিক্রাইস্ট (ডেমিয়ার্জ) ইতিমধ্যেই শাসন করছে, এবং খ্রিস্ট (নোসিস) ইতিমধ্যেই এসে গেছে। কিন্তু আত্মার চূড়ান্ত বিজয় এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

খলনায়কের পুনর্বিচার

অ্যান্টিক্রাইস্ট বা দাজ্জালের ধারণাকে নস্টিকরা যেভাবে পুনর্ব্যাখ্যা করেছে, তা তাদের দর্শনের সবচেয়ে বিপ্লবী এবং অস্বস্তিকর দিকগুলোর একটি। তারা মন্দের উৎসকে কোনো ভবিষ্যতের দানব বা বিদ্রোহী দেবদূতের উপর চাপিয়ে দেয়নি। তারা আমাদের বাধ্য করেছে আয়নার দিকে তাকাতে, আমাদের নিজেদের বাস্তবতা, আমাদের নিজেদের বিশ্বাস এবং আমাদের নিজেদের ঈশ্বরকেই প্রশ্ন করতে।

তারা শিখিয়েছে, সবচেয়ে বড় প্রতারক সে নয়, যে ভবিষ্যতে আসবে বলে ভয় দেখানো হয়। সবচেয়ে বড় প্রতারক সে, যে ইতিমধ্যেই আমাদের বাস্তবতা, আমাদের নৈতিকতা এবং আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি হয়ে বসে আছে, অথচ আমরা তাকে চিনতেই পারছি না। নস্টিকদের কাছে, অ্যান্টিক্রাইস্ট কোনো বহিরাগত শত্রু নয়, সে হলো সেই সিস্টেম, সেই কাঠামো, সেই বিশ্ববীক্ষা, যা আমাদের আত্মাকে তার আসল প্রকৃতি থেকে ভুলিয়ে রাখে।

এই দর্শন অনুযায়ী, অ্যান্টিক্রাইস্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনো তরবারি দিয়ে লড়ার যুদ্ধ নয়। এটি হলো চেতনার যুদ্ধ। এর অস্ত্র হলো প্রশ্ন, সন্দেহ এবং সবচেয়ে বড় অস্ত্র – আত্ম-জ্ঞান বা ‘নোসিস’। কারণ, যে নিজেকে চিনে ফেলেছে, তাকে আর কোনো মিথ্যা ঈশ্বর বা মিথ্যা ত্রাণকর্তা প্রতারিত করতে পারে না। নস্টিকদের এই বার্তা দুই হাজার বছর পরেও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।

ঈশ্বর যখন শত্রু: নস্টিসিজম এবং মিসোথিজমের সূক্ষ্ম বিভাজন

ঈশ্বরকে ভালোবাসা ধর্মতত্ত্বের একটি স্বাভাবিক ও পরিচিত ধারণা। কিন্তু ঈশ্বরকে ঘৃণা করা? এই ধারণাটি অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর, ধর্মদ্রোহী এবং দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তবুও, দর্শনের এবং ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে এমন দুটি ধারা রয়েছে যা প্রচলিত ‘শুভ ঈশ্বর’-এর ধারণাকে তীব্রভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে। এদের একটি হলো নস্টিসিজম (Gnosticism) এবং অন্যটি হলো মিসোথিজম (Misotheism)। আপাতদৃষ্টিতে এই দুটি মতবাদকে একই মনে হতে পারে, কারণ উভয়ই ঈশ্বরের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। উভয়ই প্রশ্ন তোলে: যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে পৃথিবীতে এত দুঃখ কেন? কিন্তু যখন আমরা গভীরে প্রবেশ করি, তখন দেখতে পাই যে এই দুটি দর্শনের উৎস, প্রকৃতি এবং গন্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নস্টিসিজম হলো এক ধরনের আধ্যাত্মিক বিপ্লব, যা একটি ‘ভুল’ ঈশ্বরকে অস্বীকার করে ‘আসল’ ঈশ্বরের সন্ধান করে। আর মিসোথিজম হলো এক গভীর আবেগীয় বিদ্রোহ, যা ঈশ্বরকে মেনে নেয় কেবল তাঁকে ঘৃণা করার জন্যই। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে নস্টিসিজমের ঠান্ডা, দার্শনিক প্রত্যাখ্যান এবং মিসোথিজমের জ্বলন্ত, ব্যক্তিগত ঘৃণা – এই দুই ভিন্ন পথ ধরে মানুষ মহাজাগতিক অবিচারের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেছে।

মিসোথিজম: ঈশ্বরের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ

মিসোথিজম (Misotheism) শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘misos’ (ঘৃণা) এবং ‘theos’ (ঈশ্বর) থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ঈশ্বর-বিদ্বেষ’ বা ‘ঈশ্বরের প্রতি ঘৃণা’। এটি কোনো সুসংগঠিত ধর্ম বা দার্শনিক স্কুল নয়, বরং এটি একটি মনোভাব, একটি আবেগীয় প্রতিক্রিয়া বা একটি সাহিত্যিক থিম। মিসোথিজমের মূল কথা হলো, ঈশ্বর আছেন, তিনি সর্বশক্তিমান এবং এই জগতের স্রষ্টা, কিন্তু তিনি করুণাময় বা শুভ নন। তিনি বরং উদাসীন, নিষ্ঠুর, খামখেয়ালি বা এমনকি শয়তানের মতো বিদ্বেষপরায়ণ। মিসোথিজম ঈশ্বরকে অস্বীকার করে না (যেমন নাস্তিকরা করে), বরং ঈশ্বরের নৈতিক চরিত্রকে আক্রমণ করে। মিসোথিস্ট বা ঈশ্বর-বিদ্বেষী ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর মানুষের দুঃখ-কষ্টের জন্য দায়ী এবং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে কষ্ট দেন বা মানুষের কষ্টে আনন্দ পান। এই ধারণাটি মূলত থিওডিসি (Theodicy) বা ‘অমঙ্গলের সমস্যা’-র (Problem of Evil) এক চরম নেতিবাচক সমাধান। যেখানে আস্তিকরা বলেন, “ঈশ্বর ভালো, তাই মন্দের কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে,” সেখানে মিসোথিস্টরা বলেন, “জগতে মন্দ আছে, কারণ ঈশ্বর নিজেই মন্দ বা নিষ্ঠুর।”

সাহিত্যে এবং দর্শনে মিসোথিজমের প্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটেছে। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে, যেমন ইউরিপিদিসের নাটকে, আমরা দেখি দেবতারা মানুষের জীবন নিয়ে এক নিষ্ঠুর খেলা খেলছেন। শেক্সপিয়রের কিং লিয়ার (King Lear)-এর সেই বিখ্যাত উক্তি, “As flies to wanton boys, are we to the gods. They kill us for their sport” (দুষ্টু ছেলেদের কাছে মাছি যেমন, দেবতাদের কাছে আমরাও তেমন। তারা খেলার ছলে আমাদের হত্যা করে) – এটি মিসোথিজমের এক ধ্রুপদী প্রকাশ (Shakespeare, King Lear, 4.1.36-37)। আধুনিক যুগে, মার্ক টোয়েনের (Mark Twain) শেষ জীবনের লেখাগুলোতে, বিশেষ করে দ্য মিস্ট্রিয়াস স্ট্রেঞ্জার (The Mysterious Stranger)-এ, ঈশ্বরকে এক নিষ্ঠুর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সত্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। টোয়েন লিখেছেন, “God, so atrocious in the Old Testament, so attractive in the New – the Jekyl and Hyde of sacred romance” (Twain, 1962)। এখানে ঈশ্বরকে ঘৃণা করা হয় তার অন্যায্য আচরণের জন্য। মিসোথিজমের বিদ্রোহ হলো এক ধরনের ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান – মানুষ ঈশ্বরের চেয়ে নিজেকে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং ঈশ্বরের অন্যায়ের বিচার করে। এটি এক নিষ্ফল বিদ্রোহ, কারণ মানুষ জানে সে ঈশ্বরের শক্তির কাছে অসহায়, কিন্তু সে তার ঘৃণার মাধ্যমে নিজের মর্যাদা রক্ষা করে।

নস্টিসিজম: ভুল ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যান

অন্যদিকে, নস্টিসিজম (Gnosticism) কেবল ঈশ্বরের প্রতি ঘৃণা নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্ব। নস্টিকরা অবশ্যই ওল্ড টেস্টামেন্টের স্রষ্টা ঈশ্বর বা ইয়াহওয়ে (Yahweh)-কে নেতিবাচকভাবে দেখেছে, যাকে তারা ডেমিয়ার্জ (Demiurge) বা ইয়ালদাবাওথ (Yaldabaoth) বলে ডাকে। তারা বলেছে যে এই স্রষ্টা অজ্ঞ, অহংকারী এবং ঈর্ষাপরায়ণ। কিন্তু নস্টিসিজমের এই নেতিবাচকতা মিসোথিজমের মতো শেষ কথা নয়। নস্টিকরা এই ‘ভুল’ বা ‘নিচু’ ঈশ্বরকে ঘৃণা বা প্রত্যাখ্যান করে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তাঁর ঊর্ধ্বে এক ‘আসল’ এবং ‘পরম’ ঈশ্বর আছেন। তাদের কাছে ডেমিয়ার্জ কোনো পরম সত্তা নন, তিনি এক মহাজাগতিক দুর্ঘটনার ফসল, এক কারিগর মাত্র। তাই নস্টিকদের বিদ্রোহ মিসোথিজমের মতো ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে নয়, বরং ঈশ্বরের ‘পরিচয়’ বা ‘সংজ্ঞা’-র বিরুদ্ধে। তারা বলে, “যাকে তোমরা ঈশ্বর বলছ, সে ঈশ্বর নয়। আসল ঈশ্বর অন্য কেউ, যিনি এই জগতের নোংরামি থেকে মুক্ত।”

নস্টিসিজমের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ডাইথিজম (Ditheism) বা দুই-ঈশ্বরের বিশ্বাসের সাথে তুলনা করা যায়, যদিও এটি আরও জটিল। নস্টিকরা ডেমিয়ার্জকে ঘৃণা করে না যতটা তাকে করুণা বা অবজ্ঞা করে। তাদের কাছে ডেমিয়ার্জ হলো এক বোকা বা অন্ধ শক্তি (সাকলাস – Saklas বা সামায়েল – Samael), যে জানে না সে কী করছে। নস্টিকদের লক্ষ্য ডেমিয়ার্জের সাথে যুদ্ধ করা নয়, বরং তাকে অতিক্রম করে (Transcend) আসল আলোর জগতে বা প্লেরোমা (Pleroma)-তে ফিরে যাওয়া। মিসোথিস্ট যেখানে ঈশ্বরের সাথে এক অন্তহীন, তিক্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে, নস্টিক সেখানে এই দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চায়। মিসোথিস্টের কাছে ঈশ্বর হলো এক অত্যাচারী রাজা যাকে সে ঘৃণা করে কিন্তু যার প্রজা হিসেবে সে আটকে আছে। নস্টিকের কাছে ডেমিয়ার্জ হলো এক জেলখানার জেলার, আর নস্টিক হলো এক রাজপুত্র যে জানে তার বাবা আসলে দেশের রাজা, এই জেলার নয়। তাই নস্টিকের মনোভাব ঘৃণার চেয়ে বেশি হলো বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) এবং শ্রেষ্ঠত্ববোধের। সে জানে সে এই জগতের বা এই স্রষ্টার নয়।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: ঘৃণা বনাম অবজ্ঞা

এই দুই মতবাদের পার্থক্যগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য আমরা কয়েকটি মূল বিন্দুর উপর আলোকপাত করতে পারি:

১. ঈশ্বরের স্বরূপ (Nature of God):
মিসোথিজমে সাধারণত একজনই ঈশ্বর থাকেন, যিনি এই জগতের স্রষ্টা এবং শাসক। কিন্তু এই ঈশ্বর চরিত্রগতভাবে মন্দ বা অনৈতিক। এখানে ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না, প্রশ্ন তোলা হয় তার নৈতিকতা নিয়ে। কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং (Carl Gustav Jung) তাঁর আনসার টু জব (Answer to Job) বইয়ে বাইবেলের ঈশ্বরকে এমন এক সত্তা হিসেবে দেখিয়েছেন যিনি মানসিকভাবে অস্থিতিশীল এবং নৈতিকভাবে অপরিণত, যা মিসোথিজমের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার খুব কাছাকাছি (Jung, 1954)। নস্টিসিজমে ঈশ্বরের ধারণাটি দ্বৈতবাদী (Dualistic)। সেখানে একজন নয়, অন্তত দুইজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এক, সর্বোচ্চ ও অচিন্তনীয় ঈশ্বর (মন – Monad), যিনি শুভ এবং জগতের ঊর্ধ্বে। দুই, নিম্নস্তরের স্রষ্টা বা ডেমিয়ার্জ, যিনি অজ্ঞ এবং এই জগতের নির্মাতা। নস্টিকরা ডেমিয়ার্জকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু পরম ঈশ্বরকে ভক্তি করে। তাই নস্টিসিজমকে পুরোপুরি ‘ঈশ্বর-বিদ্বেষী’ বলা যায় না, বরং এটি ‘স্রষ্টা-বিদ্বেষী’ বা ‘জগৎ-বিদ্বেষী’।

২. মন্দের উৎস (Source of Evil):
মিসোথিজমে মন্দ সরাসরি ঈশ্বরের ইচ্ছা বা স্বভাব থেকে আসে। ঈশ্বর ইচ্ছে করে মানুষকে কষ্ট দেন বা মানুষের কষ্ট দেখে আনন্দ পান। এখানে মন্দ হলো ঈশ্বরের ব্যক্তিত্বের একটি অংশ। এই ধারণাকে অনেক সময় ম্যালথিজম (Maltheism)-ও বলা হয়, যেখানে ঈশ্বরকে পুরোপুরি অশুভ বা শয়তান-সদৃশ মনে করা হয়। নস্টিসিজমে মন্দ কোনো ইচ্ছাকৃত শয়তানি নয়, বরং এটি হলো অজ্ঞতা এবং ভুলের ফল। ডেমিয়ার্জ জগৎ সৃষ্টি করেছে তার অজ্ঞতা বা অহংকারের কারণে, বিশুদ্ধ বিদ্বেষ থেকে নয়। সে মনে করে সে-ই সেরা, তাই সে এমন এক জগৎ বানিয়েছে যা তার মতো অসম্পূর্ণ। নস্টিকদের কাছে মন্দ হলো আলোর অভাব বা স্টেরেসিস (Steresis)। জগতের দুঃখকষ্ট ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ নয়, বরং এটি মহাজাগতিক দুর্ঘটনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

৩. মানুষের অবস্থান এবং মুক্তি (Human Status and Salvation):
মিসোথিস্টের কাছে মানুষ হলো ঈশ্বরের খেলার পুতুল বা শিকার। তার কোনো মুক্তি নেই, কারণ সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ক্ষমতার অধীন। তার একমাত্র সান্ত্বনা হলো তার নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং ঈশ্বরের প্রতি তার ঘৃণার সততা। এটি এক ট্র্যাজিক অবস্থান, যেখানে বিদ্রোহ আছে কিন্তু মুক্তি নেই। নস্টিকের কাছে মানুষ (অন্তত নিউম্যাটিক বা আধ্যাত্মিক মানুষ) হলো ডেমিয়ার্জের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। কারণ মানুষের ভেতরে পরম ঈশ্বরের আলোর কণা বা স্ফুলিঙ্গ (Divine Spark) আছে, যা ডেমিয়ার্জের নেই। নস্টিকের মুক্তি নিশ্চিত। সে নোসিস (Gnosis) বা জ্ঞানের মাধ্যমে ডেমিয়ার্জের ক্ষমতাকে ভেঙে দিতে পারে এবং তার আসল বাড়িতে ফিরে যেতে পারে। নস্টিসিজম তাই শেষ পর্যন্ত এক আশাবাদী দর্শন, যদিও তার শুরুটা নৈরাশ্যবাদ দিয়ে।

৪. আবেগীয় প্রতিক্রিয়া (Emotional Response):
মিসোথিজমের প্রধান আবেগ হলো ক্রোধ (Anger) এবং হতাশা (Despair)। এটি এক তীব্র আবেগীয় প্রতিক্রিয়া, যা প্রায়শই ঈশ্বরকে অভিযুক্ত করার ভাষায় প্রকাশিত হয়। এটি অনেকটা প্রেমিকের প্রতি ঘৃণার মতো, যেখানে প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনা আছে। নস্টিসিজমের প্রধান আবেগ হলো বিচ্ছিন্নতা (Alienation) এবং নস্টালজিয়া (Nostalgia)। নস্টিকরা এই জগৎ বা এর স্রষ্টার প্রতি রাগ করার চেয়ে বেশি অনুভব করে যে তারা এখানে খাপ খাচ্ছে না। তারা এক ভিনদেশি বা এলিয়েন হিসেবে নিজেদের দেখে। তাদের মূল আকুতি হলো ‘বাড়ি ফেরা’। ডেমিয়ার্জের প্রতি তাদের মনোভাব ঘৃণার চেয়ে বেশি হলো অবজ্ঞা বা করুণার। তারা বলে, “ও তো জানে না ও কী করছে, কিন্তু আমি জানি।”

সাহিত্যিক এবং দার্শনিক উদাহরণে পার্থক্য

সাহিত্যে এই দুই ধারার পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিসোথিজমের একটি ধ্রুপদী উদাহরণ হলো লর্ড বায়রন (Lord Byron)-এর নাটক কেইন (Cain)। এখানে কেইন ঈশ্বরকে প্রশ্ন করে, কেন তিনি মানুষকে পাপ করার ক্ষমতা দিয়ে তারপর পাপের জন্য শাস্তি দেন? কেইনের বিদ্রোহ ঈশ্বরের অন্যায্যতার বিরুদ্ধে। সে ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু অন্য কোনো ‘ভালো’ ঈশ্বরের সন্ধান করে না। তার বিদ্রোহ একাকী এবং তিক্ত। এটি মিসোথিজম। অন্যদিকে, হারম্যান মেলভিল (Herman Melville)-এর মবি ডিক (Moby Dick)-এ ক্যাপ্টেন আহাব যখন সাদা তিমিকে (যা ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক হতে পারে) ঘৃণা করে এবং তাকে ধ্বংস করতে চায়, তখন সেটি মিসোথিজমের এক উন্মাদ রূপ (Thompson, 1952)।

নস্টিসিজমের উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখতে পারি ফিলিপ কে. ডিকের সাহিত্য বা দ্য ম্যাট্রিক্স চলচ্চিত্র। দ্য ম্যাট্রিক্স-এ নিও যখন আর্কিটেক্টের (ডেমিয়ার্জ) তৈরি করা ম্যাট্রিক্সকে প্রত্যাখ্যান করে, তখন সে কেবল ম্যাট্রিক্সকে ঘৃণা করে না, সে জানে যে এর বাইরে ‘জায়ন’ বা বাস্তব জগৎ আছে। তার বিদ্রোহের লক্ষ্য হলো সেই আসল সত্যে পৌঁছানো। সে আর্কিটেক্টের প্রতি রাগ দেখায় না, বরং তাকে অতিক্রম করে যায়। একইভাবে, ডিকের উপন্যাসে চরিত্ররা এই নকল বাস্তবতাকে ভেঙে আসল ঈশ্বরের (VALIS) সাথে যোগাযোগ করতে চায়। এখানে লক্ষ্য হলো সত্যের উন্মোচন, কেবল ঘৃণার প্রকাশ নয়।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো এলিয়ে উইসেল (Elie Wiesel)-এর মতো হলোকাস্ট থেকে বেঁচে আসা লেখকদের চিন্তায়। উইসেল তাঁর নাইট (Night) বইয়ে ঈশ্বরের বিচার বা সাইলেন্স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা মিসোথিজমের কাছাকাছি যায়। তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাননি, কিন্তু ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। এটি এক ধরনের ‘প্রোটেস্ট থিওলজি’ (Protest Theology)। কিন্তু নস্টিকরা এমন পরিস্থিতিতে বলত, “এই গণহত্যা প্রমাণ করে যে এই জগতের স্রষ্টা কোনো ভালো ঈশ্বর নন, তিনি এক শয়তান বা ডেমিয়ার্জ। আমাদের আসল ঈশ্বর এই জগতের বাইরে।” নস্টিকরা হলোকাস্টের মতো ঘটনাকে তাদের তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখত, ঈশ্বরের প্রতি অভিযোগ হিসেবে নয়।

বিদ্রোহের দুই দিগন্ত

পরিশেষে বলা যায়, নস্টিসিজম এবং মিসোথিজম – উভয়েই মানুষের অস্তিত্বের সংকট এবং মহাজাগতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুটি ভিন্ন কিন্তু শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া। মিসোথিজম হলো সেই মানুষের আর্তনাদ, যে বিশ্বাস করে তার পিতা (ঈশ্বর) তাকে ভালোবাসেন না, বরং নির্যাতন করছেন। সে পিতাকে ঘৃণা করে, কিন্তু পিতাকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো পথ তার জানা নেই। সে সেই সম্পর্কের মধ্যেই আটকা পড়ে ধুঁকতে থাকে। তার বিদ্রোহ হলো এক বদ্ধ ঘরের ভেতরে চিৎকার। অন্যদিকে, নস্টিসিজম হলো সেই সন্তানের উপলব্ধি, যে হঠাৎ আবিষ্কার করে যে যার সাথে সে বাস করছে, সে তার আসল পিতা নয়, বরং এক অপহরণকারী। সে তখন সেই নকল পিতাকে ঘৃণা বা ভয় পাওয়ার চেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার আসল পিতাকে খুঁজে বের করতে এবং সেই নকল বাড়ি থেকে পালাতে। তার বিদ্রোহ হলো দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার অভিযান।

মিসোথিজম আমাদের শেখায় মানুষের নৈতিক সাহসের কথা, যে সর্বশক্তিমানের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও আঙুল তুলতে ভয় পায় না। আর নস্টিসিজম আমাদের শেখায় কল্পনার শক্তির কথা, যা এক নিরাশার জগতের মধ্যেও এক নতুন, নিখুঁত জগতের স্বপ্ন দেখতে পারে। একটি হলো নৈতিক বিদ্রোহ (Moral Rebellion), অন্যটি হলো আধ্যাত্মিক বিদ্রোহ (Spiritual Rebellion)। একটি ঈশ্বরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, অন্যটি ঈশ্বরকেই বদলে দেয়। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এই দুটি ধারাই প্রমাণ করে যে, মানুষ কেবল মেনে নেওয়ার জীব নয়; সে প্রশ্ন করতে জানে, ঘৃণা করতে জানে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে – সে এক নতুন সত্যের সন্ধান করতে জানে।

পাশ্চাত্যে নস্টিসিজমের দীর্ঘ ছায়া ও সম্ভাবনা: ইতিহাসে, দর্শনে ও আমাদের আয়নায়

ইতিহাসের রণক্ষেত্রে যারা হেরে যায়, তাদের গল্প সাধারণত সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে যায়। বিজয়ীরা তাদের নাম মুছে দেয়, তাদের বই পুড়িয়ে ফেলে, তাদের স্মৃতিকে ‘ভ্রান্ত’ আর ‘বিপজ্জনক’ বলে দাগিয়ে দেয়। নস্টিসিজমের ভাগ্যেও ঠিক তাই ঘটেছিল। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়া অর্থোডক্স চার্চ যখন নস্টিকদের ‘হেরিটিক’ বা বিধর্মী ঘোষণা করে তাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে শুরু করল, তখন মনে হয়েছিল এই অদ্ভুত, কাব্যিক ও বিদ্রোহী দর্শনটি বুঝি চিরতরে হারিয়ে গেল।

কিন্তু কিছু ধারণা অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতো। তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলেও সেই ছাই থেকেই সে আবার নতুন রূপে ডানা মেলে। নস্টিসিজম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু তার মূল প্রশ্নগুলো – এই জগৎ কি সত্যি? আমরা কি স্বাধীন? আমাদের অস্তিত্বের অর্থ কী? – এতটাই মৌলিক ছিল যে, সেগুলো মরতে পারেনি। নস্টিসিজমের ভূত তাই বারবার ইতিহাসের নানা বাঁকে, নানা ছদ্মবেশে ফিরে এসেছে। সে কখনও দার্শনিকের চিন্তায়, কখনও কবির কবিতায়, কখনও বা বিপ্লবী ধর্মগুরুর ভাষণে উঁকি দিয়ে গেছে।

এই অংশে আমরা সেই দীর্ঘ ছায়াটিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করব। আমরা দেখব, কীভাবে এই ‘পরাজিত’ দর্শনটি মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন চিন্তাধারা ও আন্দোলনকে গোপনে প্রভাবিত করেছে। দেখব, কীভাবে কার্ল ইয়ুং-এর মনোবিজ্ঞান থেকে শুরু করে হলিউডের ব্লকবাস্টার মুভি পর্যন্ত সর্বত্র তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। চলুন, ডুব দেওয়া যাক নস্টিসিজমের সেই রহস্যময় উত্তরজীবনে (afterlife)।

মধ্যযুগের আগুন: যখন নস্টিসিজম নতুন নামে ফিরে এল

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে যখন ক্যাথলিক চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন মনে হয়েছিল ভিন্নমতের আর কোনো সুযোগ নেই। প্রাচীন নস্টিক পুঁথিগুলো হয় হারিয়ে গিয়েছিল, নয়তো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, জগৎকে কারাগার হিসেবে দেখার সেই বিষণ্ণ ও বিদ্রোহী দর্শনটি বুঝি চিরতরে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেও আলোর কণা বেঁচে থাকে। নস্টিসিজমের দ্বৈতবাদী চিন্তাগুলো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, বরং কৃষকদের লোককথায়, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর চাপা বিদ্রোহে আর গুপ্ত সাধকদের দর্শনে লুকিয়ে ছিল, অনেকটা শীতকালে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা বীজের মতো। এরপর ইউরোপের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি যখন আবার উত্তাল হয়ে উঠল, তখন সেই পুরোনো বীজই নতুন নামে, নতুন রূপে অঙ্কুরিত হয়ে উঠল। দশম শতাব্দীর পর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপে এমন কিছু শক্তিশালী ধর্মীয় আন্দোলনের উদ্ভব হলো, যাদের বিশ্বাস ও জীবনযাপন প্রণালী ছিল প্রাচীন নস্টিকদের এক আশ্চর্য প্রতিধ্বনি।

বগামিল ও ক্যাথার: পূর্ব ও পশ্চিমের বিদ্রোহী প্রতিধ্বনি

দশম শতাব্দীতে বুলগেরিয়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে বগামিলিজম (Bogomilism) নামে এক দ্বৈতবাদী খ্রিস্টান ধারার উদ্ভব হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বগামিল (Bogomil) নামের এক গ্রামের পুরোহিত। সেই সময়ে বলকান অঞ্চলের সাধারণ মানুষ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং অর্থোডক্স চার্চ – উভয়ের দ্বারাই শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল। চার্চের জাঁকজমক, ধন-সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বাড়াবাড়ি দেখে তাদের মনে তীব্র অসন্তোষ জন্মেছিল। বগামিলিজম ছিল এই সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অসন্তোষেরই এক ধর্মীয় প্রকাশ।

বগামিলরা বিশ্বাস করত, এই দৃশ্যমান, জড় জগৎ শয়তানের (যাকে তারা বলত স্যাটানায়েল (Satanael)) সৃষ্টি। আর তাদের ঈশ্বর হলেন এক ভিন্ন, আধ্যাত্মিক সত্তা। তারা অর্থোডক্স চার্চের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা – জল দিয়ে ব্যাপ্টিজম, মূর্তি পূজা, ক্রুশ, সাধুদের উপাসনা এবং জাঁকজমকপূর্ণ গির্জা – এগুলোকে শয়তানের কাজ বলে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করত। তাদের দর্শন ছিল আশ্চর্যজনকভাবে প্রাচীন নস্টিকদের মতো। তারা মনে করত, মানুষের আত্মা ঐশ্বরিক, কিন্তু তা শয়তানের বানানো দেহের কারাগারে বন্দী (Obolensky, 1948)। এই বিপ্লবী দর্শন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জন্য এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল যে, তাদের অনুসারীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালানো হতো।

এই বগামিলদের চিন্তাধারাই বলকান অঞ্চল থেকে বাণিজ্য পথ ধরে, বণিক, তীর্থযাত্রী ও ক্রুসেডারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে উত্তর ইতালি ও দক্ষিণ ফ্রান্সে। আর সেখানেই একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে জন্ম নিয়েছিল মধ্যযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে ট্র্যাজিক ‘হেরিটিক্যাল’ বা প্রচলিত মতবিরোধী আন্দোলন – ক্যাথারিজম (Catharism)

দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ফ্রান্সের লাংগডক (Languedoc) অঞ্চলে – যা ছিল তৎকালীন ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ, সহনশীল এবং সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত এলাকা – ক্যাথাররা (Cathars) স্থানীয় অভিজাতদের সমর্থনে এক শক্তিশালী বিকল্প চার্চ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যা রোমের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ক্যাথাররা নিজেদেরকে ‘খাঁটি খ্রিস্টান’ (Good Christians) বলে মনে করত এবং ক্যাথলিক চার্চকে শয়তানের উপাসনালয় (Church of Satan) বলে অভিহিত করত।

ক্যাথারদের বিশ্বাস ছিল যেন নাগ হাম্মাদির পুঁথি থেকে উঠে আসা খাঁটি নস্টিক দর্শন:

  • দুই ঈশ্বর: তারা এক চরম দ্বৈতবাদে বিশ্বাস করত। এক ভালো ঈশ্বর, যিনি অদৃশ্য, শাশ্বত ও আধ্যাত্মিক জগতের স্রষ্টা। আর এক মন্দ ঈশ্বর বা শয়তান (যাকে তারা বলত ‘Rex Mundi’ বা ‘জগতের রাজা’), যে এই জড় জগৎ, সময় এবং মানবদেহ সৃষ্টি করেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরই ছিল তাদের চোখে এই মন্দ স্রষ্টা।
  • দেহ যখন কারাগার: তারাও মানবাত্মাকে পতিত দেবদূত বা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বলে মনে করত, যা মন্দ ঈশ্বরের পাতা ফাঁদে পড়ে এই দেহের কারাগারে বন্দী হয়েছে। তাদের কাছে এই পৃথিবী ছিল নরকেরই নামান্তর, এক নির্বাসনের স্থান।
  • যিশু একজন দূত: তাদের মতে, যিশু কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দেবদূত, যার শরীরটা ছিল মায়ার মতো (Docetic view)। তিনি এসেছিলেন মানুষকে মুক্তির পথ বা জ্ঞান দেখাতে, পাপের জন্য এই জড় জগতে মরতে নয়। যেহেতু তারা ক্রুশকে জড় জগতের প্রতীক বলে মনে করত, তাই তারা ক্রুশকে ঘৃণা করত।
  • পুনর্জন্মের চক্র: ক্যাথাররা পুনর্জন্ম বা ‘মেটেমসাইকোসিস’ (metempsychosis)-এ বিশ্বাস করত। তাদের মতে, যে আত্মা মুক্তি লাভ করতে পারে না, তাকে বারবার এই দুঃখের জগতে, বিভিন্ন মানব বা পশুর দেহে ফিরে আসতে হয়, যতক্ষণ না সে ‘নোসিস’ লাভ করে এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা ‘কনসোলামেন্টাম’ (Consolamentum) নামক এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোপুরি পবিত্র হচ্ছে।
  • কঠোর তপস্যা: ক্যাথারদেরঅভিজাত সাধক গোষ্ঠী, যাদের ‘পারফেক্ট’ (Perfects বা Parfaits) বলা হতো, তারা কঠোর তপস্যার জীবন যাপন করত। তারা ছিলেন চলমান সাধু, যারা মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ধর্ম প্রচার করতেন। তারা বিয়ে করতেন না, কোনো ধরনের প্রাণীজ খাবার (আমিষ, ডিম, দুধ) খেতেন না কারণ এগুলো যৌন মিলনের ফল, এবং জাগতিক সম্পত্তি স্পর্শ করতেন না – ঠিক যেন প্রাচীন নস্টিক বা ম্যানিকীয় তপস্বীদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি (Barber, 2000)।

ক্যাথারদের এই বিকল্প ধর্ম – যা সরলতা, আধ্যাত্মিকতা ও চার্চের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ ছিল – সাধারণ মানুষের মধ্যে, এমনকি অনেক অভিজাতদের মধ্যেও, এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট (Pope Innocent III) আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, উপদেশ বা বিতর্কের মাধ্যমে এদের দমন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি ১২০৯ সালে তাদের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন, যা ইতিহাসে আলবিজেনসিয়ান ক্রুসেড (Albigensian Crusade) নামে পরিচিত।

প্রায় বিশ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে উত্তর ফ্রান্সের লোভী ব্যারনরা ধর্মের নামে লাংগডকের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়। বেজিয়ার্স (Béziers) শহরের মতো জায়গায় নারী-শিশু নির্বিশেষে প্রায় বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এই যুদ্ধের পর কুখ্যাত ইনকুইজিশন (Inquisition) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার কাজ ছিল লুকিয়ে থাকা শেষ ক্যাথারটিকেও খুঁজে বের করে আগুনে পুড়িয়ে মারা। ১৩২১ সালে শেষ পরিচিত ক্যাথার ‘পারফেক্ট’, গুইলেম বেলিবাসতে (Guilhem Bélibaste)-কে আগুনে পুড়িয়ে মারার মাধ্যমে এই আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

কিন্তু এই নির্মম দমন-পীড়নই প্রমাণ করে, জগৎকে একটি কারাগার হিসেবে দেখার নস্টিক চিন্তার আবেদন কতটা গভীর এবং শক্তিশালী ছিল, যা হাজার বছর পরেও নতুন করে মানুষের মনকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। ক্যাথারদের চিতার আগুন নিভে গিয়েছিল, কিন্তু সেই আগুন ইউরোপের আকাশে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রশ্ন রেখে গিয়েছিল – প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কি সবসময়ই পরাজয়ে শেষ হয়?

দর্শনের গভীরে: যখন যুক্তির আড়ালে উঁকি দেয় নোসিস

ক্যাথারদের চিতার আগুন নিভে যাওয়ার পর মনে হতে পারে, নস্টিসিজমের দ্বৈতবাদী ও জগৎ-বিদ্বেষী ভূত বুঝি ইউরোপ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। রেনেসাঁস এবং এনলাইটেনমেন্টের যুগে যখন ইউরোপে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের জয়জয়কার, তখন নস্টিসিজমের মতো মরমী ও হতাশাবাদী দর্শনের আর কোনো স্থান থাকার কথা নয়। মানুষ তখন জগৎ থেকে পালাতে চায়নি, বরং জগৎকে জানতে, বুঝতে এবং জয় করতে চেয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আধুনিক দর্শনের যুক্তির কঠিন বর্মের ভেতরেও নস্টিসিজমের কিছু মৌলিক থিম – যেমন নির্বাসনবোধ, জগৎ ও আত্মার বিচ্ছিন্নতা, গুপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি এবং এক ভাঙা বা পতিত জগতের ধারণা – নতুন ভাষায়, নতুন রূপকে ফিরে এসেছে। জগৎকে কারাগার হিসেবে না দেখলেও, জগৎ যে এক ধরনের ‘ভুল’ বা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ অবস্থায় আছে, এই অনুভূতিটি আধুনিক দর্শনের গভীরেও অনুরণিত হয়েছে।

কাব্বালা ও ইহুদি মরমীবাদ: ভাঙা জাহাজের উপাখ্যান

নস্টিসিজমের ভূত যে কেবল খ্রিস্টধর্মের ‘হেরিটিক্যাল’ বা প্রচলিত মতবিরোধী আন্দোলনগুলোর মধ্যেই বেঁচে ছিল, তা নয়। এর সবচেয়ে গভীর এবং সৃজনশীল প্রতিধ্বনিগুলোর একটি শোনা যায় ইহুদি ধর্মের নিজস্ব মরমী ধারার ভেতরে, যা কাব্বালা (Kabbalah) নামে পরিচিত। কাব্বালা হলো ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোরাহ-র এক গুপ্ত বা মরমী ব্যাখ্যা, যা আক্ষরিক অর্থের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মহাজাগতিক রহস্যের সন্ধান করে। যদিও এর উৎস আরও প্রাচীন, কিন্তু মধ্যযুগে স্পেনে এবং পরে পূর্ব ইউরোপে এটি এক নতুন ও শক্তিশালী রূপ লাভ করে।

কাব্বালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো ত্রয়োদশ শতকে স্পেনে মোশে দে লিওন (Moses de Leon) কর্তৃক সংকলিত ‘দ্য জোহার’ (The Zohar বা Book of Splendor)। কিন্তু কাব্বালার যে সৃষ্টিতত্ত্বটি নস্টিক পুরাণের সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ, সেটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ষোড়শ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনের সাফেদ (Safed) শহরে। সেখানকার মরমী সাধকদের গুরু, আইজ্যাক লুরিয়া (Isaac Luria), যিনি ‘পবিত্র সিংহ’ বা ‘হা’আরি’ (Ha’Ari) নামে পরিচিত, তিনি এক গভীর ও নাটকীয় সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন, যা ইহুদি চিন্তার জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসে।

লুরিয়ানিক কাব্বালায় বলা হয়:

  1. সিমসুম (Tzimtzum) বা সংকোচন: সৃষ্টির আগে কেবল অসীম, বর্ণনাতীত ঈশ্বর বা ‘এইন সফ’ (Ein Sof – The Infinite) ছিলেন, যিনি তাঁর নিজের আলোয় সমগ্র অস্তিত্বকে পূর্ণ করে রেখেছিলেন। সৃষ্টিকে স্থান দেওয়ার জন্য তিনি কোনো কিছু তৈরি করেননি, বরং নিজেকে সংকুচিত (Tzimtzum) করে নিজের ভেতরে এক শূন্যস্থান বা ‘তেহিরু’ (Tehiru) তৈরি করেন। এটি এক আশ্চর্য প্যারাডক্সিকাল ধারণা – ঈশ্বর সৃষ্টির সূচনা করেন কর্মের মাধ্যমে নয়, বরং নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে।
  2. শেভিরাত হা-কেলিম (Shevirat ha-Kelim) বা পাত্রগুলো ভেঙে যাওয়া: এরপর তিনি সেই শূন্যস্থানে তাঁর ঐশ্বরিক আলোর একটি রশ্মি (Kav) পাঠান। এই আলোকে ধারণ করার জন্য দশটি পাত্র বা ‘সেফিরোট’ (Sefirot)-এর (যারা ঈশ্বরের দশটি গুণ বা প্রকাশের প্রতীক, যেমন প্রজ্ঞা, করুণা, বিচার ইত্যাদি) উদ্ভব হয়। কিন্তু প্রথম তিনটি উচ্চতর পাত্র ছাড়া বাকি সাতটি নিম্নতর পাত্র সেই প্রচণ্ড ঐশ্বরিক আলোর শক্তি সহ্য করতে না পেরে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এটি ছিল এক মহাজাগতিক বিপর্যয়, এক স্বর্গীয় দুর্ঘটনা।
  3. আলোর নির্বাসন ও কেলিপোত (Qliphoth): এই ‘পাত্রগুলো ভেঙে যাওয়া’ (the shattering of the vessels)-র ফলে ঐশ্বরিক আলোর কণাগুলো (Nitzotzot) এই জড় জগতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই ভাঙা পাত্রের খোসা বা ‘কেলিপোত’ (Qliphoth)-এর মধ্যে বন্দী হয়ে যায়। এই ‘কেলিপোত’ হলো মন্দ বা অশুভ শক্তির প্রতীক, যা পবিত্র আলোকে ঢেকে রাখে এবং তাকে তার উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর ফলেই জগতে বিশৃঙ্খলা, মন্দ, অসম্পূর্ণতা এবং ঈশ্বরের নারী-রূপী উপস্থিতি বা শেখিনার নির্বাসন (Galut ha-Shekhinah)-এর জন্ম হয়। জগৎটা এখন এক ভাঙা, নির্বাসিত অবস্থায় আছে।
  4. তিক্কুন ওলাম (Tikkun Olam) বা জগৎ মেরামত: এখানেই মানুষের ভূমিকা আসে। মানুষের, বিশেষ করে ইহুদি জাতির, জীবনের উদ্দেশ্য হলো এই ভাঙা জগৎকে মেরামত করা। প্রার্থনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং ঈশ্বরের আইন (mitzvot) পালনের মতো ভালো কাজের মাধ্যমে মানুষ পারে এই পতিত আলোগুলিকে ‘কেলিপোত’-এর খোসা থেকে মুক্ত করতে এবং সেগুলোকে এক এক করে তাদের ঐশ্বরিক উৎসে ফিরিয়ে দিতে। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ‘তিক্কুন ওলাম’ (repairing the world)। যখন শেষ আলোর কণাটিও মুক্ত হবে, তখন জগৎ তার আদি, নিখুঁত অবস্থায় ফিরে আসবে এবং মসিহ-র আগমন ঘটবে (Scholem, 1974; Idel, 1988)।
নস্টিক পুরাণের প্রতিধ্বনি

এই গল্পটা কি খুব চেনা লাগছে না? ঈশ্বরের জগৎ থেকে আলোর পতন, জগতে তার বন্দী দশা এবং মানুষের কাজ হলো তাকে মুক্ত করা – এই কাঠামোটি সোফিয়ার পতন এবং ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গকে মুক্ত করার নস্টিক পুরাণের প্রায় হুবহু প্রতিচ্ছবি।

  • নস্টিকদের প্লেরোমা থেকে সোফিয়ার পতনের সাথে কাব্বালার সেফিরোট জগৎ থেকে আলোর পতনের মিল রয়েছে।
  • নস্টিকদের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বা ‘নিউমা’-র সাথে কাব্বালার আলোর কণা বা ‘নিৎসোৎসোত’ (Nitzotzot)-এর মিল স্পষ্ট।
  • নস্টিকদের জড় জগৎ বা দেহের কারাগারের সাথে কাব্বালার ‘কেলিপোত’-এর খোসার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
  • এবং নস্টিকদের ‘নোসিস’-এর মাধ্যমে আত্মাকে মুক্ত করার ধারণার সাথে কাব্বালার ‘তিক্কুন’-এর মাধ্যমে জগৎকে মেরামত করার ধারণার কাঠামোগত সাদৃশ্য রয়েছে।
পার্থক্য ও তাৎপর্য

অবশ্যই, দুটোর দর্শন ও উদ্দেশ্য ভিন্ন এবং এই পার্থক্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • জগৎ-বিদ্বেষ বনাম জগৎ-প্রেম: নস্টিসিজম জগৎকে একটি কারাগার হিসেবে দেখে এবং তাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চায়। অন্যদিকে, লুরিয়ানিক কাব্বালা জগৎকে ভাঙা হলেও তাকে ঈশ্বরেরই সৃষ্টি হিসেবে দেখে এবং তাকে মেরামত করে তার আদি পবিত্রতায় ফিরিয়ে আনতে চায়। এটি এক জগৎ-সমর্থনকারী দর্শন।
  • মুক্তি: নস্টিকদের মুক্তি হলো ব্যক্তিগত ও অভিজাত (কেবল নিউম্যাটিকদের জন্য)। কাব্বালার ‘তিক্কুন’ হলো এক সম্মিলিত বা সমষ্টিগত দায়িত্ব, যেখানে সমগ্র ইহুদি জাতি এবং প্রকারান্তরে সমগ্র মানবজাতিই অংশ নিতে পারে।

তা সত্ত্বেও, এই গভীর কাঠামোগত মিল থেকে বোঝা যায়, জগৎ যে এক ভাঙা বা পতিত অবস্থায় আছে এবং তাকে নিরাময় করা প্রয়োজন, এই অনুভূতিটি কতটা শক্তিশালী এবং গভীর। বিখ্যাত কাব্বালা গবেষক গারশম শোলেম (Gershom Scholem) মনে করতেন যে, প্রাচীন নস্টিক ধারণাগুলো ইহুদি মরমীবাদের গভীরে সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং স্পেনে ইহুদিদের উপর নেমে আসা বিপর্যয় (১৪৯২ সালের নির্বাসন) তাদের মনে যে গভীর নির্বাসনবোধের জন্ম দিয়েছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় লুরিয়ার এই নাটকীয় ও ট্র্যাজিক সৃষ্টিতত্ত্ব নতুন করে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি ছিল নির্বাসিত এক জাতির জন্য এক নির্বাসিত ঈশ্বরের উপাখ্যান।

ঈশ্বরের হৃদয়ে অন্ধকার: ইয়াকব বোহমের আলো-ছায়ার নাটক ও নস্টিক উত্তরাধিকার

ষোড়শ শতাব্দীর ধর্ম সংস্কার (Reformation) যখন ইউরোপকে ক্যাথলিকপ্রোটেস্ট্যান্ট এই দুই শিবিরে বিভক্ত করে দিচ্ছিল, তখন জার্মানির এক ছোট্ট শহরের সামান্য এক মুচি, ইয়াকব বোহমে (Jakob Böhme), তাঁর নিজের ভেতরে এমন এক আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সম্মুখীন হচ্ছিলেন, যা প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের সমস্ত সীমানাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই, কেবল আকস্মিক দিব্যদর্শনের (Illumination) উপর ভিত্তি করে বোহমে এমন এক জটিল, কাব্যিক এবং গভীর ঈশ্বরতত্ত্ব রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তীকালের জার্মান ভাববাদ থেকে শুরু করে রোমান্টিসিজম পর্যন্ত প্রায় সমস্ত চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

বোহমের দর্শনকে প্রায়শই থিওসফি (Theosophy) বা ঈশ্বর-জ্ঞান বলা হয়। কিন্তু তাঁর চিন্তার গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, তিনি যেন প্রাচীন নস্টিকদের সেই হারানো প্রশ্নগুলোকেই নতুন করে জীবন দিয়েছিলেন: ভালো ও মন্দের উৎস কী? ঈশ্বর যদি পরম ভালো হন, তবে তাঁর জগৎ থেকে মন্দ কীভাবে জন্মায়? ঈশ্বরের নিজের প্রকৃতিতেই কি অন্ধকারের কোনো স্থান আছে? বোহমের উত্তর ছিল এতটাই বৈপ্লবিক ও বিপজ্জনক যে, লুথারান চার্চ তাঁকে ধর্মদ্রোহী (Heretic) ঘোষণা করে এবং তাঁর লেখালেখি নিষিদ্ধ করে দেয়।

উনগ্রুন্ড: ঈশ্বরের ভেতরের বিশৃঙ্খলা

প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরকে এক স্থির, অপরিবর্তনীয় এবং পরম শুভ সত্তা হিসেবে দেখে। বোহমে এই ধারণার মূলে আঘাত করেছিলেন। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে ‘উনগ্রুন্ড’ (Ungrund) বা ‘ভিত্তিহীনতা’ (Groundless) নামক এক রহস্যময় ধারণা।

  • ঈশ্বরের জন্ম: বোহমের মতে, ঈশ্বর কোনো স্থির সত্তা নন, তিনি এক জীবন্ত, গতিশীল প্রক্রিয়া। সৃষ্টির আগে, ঈশ্বর ছিলেন এই ‘উনগ্রুন্ড’ – এক অতল, অন্ধকার, অব্যক্ত ও ইচ্ছাবিহীন শূন্যতা। এটি ছিল এক মহাজাগতিক বিশৃঙ্খলা, যেখানে আলো-অন্ধকার, ভালো-মন্দ, হ্যাঁ-না সবকিছুই একীভূত ও সুপ্ত অবস্থায় ছিল। ঈশ্বর এই অন্ধকার শূন্যতা থেকেই নিজেকে নিজে জন্ম দেন। তিনি নিজের ভেতরের এই বিশৃঙ্খলাকে জয় করে এক সচেতন, প্রকাশিত ও প্রেমময় সত্তা হয়ে ওঠেন।
  • নস্টিক প্রতিধ্বনি: এই ধারণাটি কি নস্টিকদের পরম পিতা এবং তাঁর জগৎ থেকে জন্ম নেওয়া অজ্ঞ ডেমিয়ার্জের কাহিনির এক মনস্তাত্ত্বিক সংস্করণ নয়?
    • নস্টিক পুরাণে, আলোর জগৎ প্লেরোমা থেকে সোফিয়ার আবেগের কারণে এক বিশৃঙ্খল ও অজ্ঞ সত্তা (ডেমিয়ার্জ) জন্মায়।
    • বোহমে এই নাটকটিকে মহাবিশ্ব থেকে ঈশ্বরের নিজের ভেতরেই স্থানান্তরিত করেছেন। ঈশ্বরের নিজের প্রকৃতিতেই এক অন্ধকার, বিশৃঙ্খল দিক আছে, যাকে জয় করেই তিনি ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠেন। নস্টিকদের মহাজাগতিক বিপর্যয় (Cosmic drama) বোহমের হাতে হয়ে গেল এক ঐশ্বরিক বিপর্যয় (Theogonic drama), অর্থাৎ ঈশ্বরের জন্ম-সংক্রান্ত নাটক (Weeks, 1991)।
    • এই ‘উনগ্রুন্ড’ অনেকটা নস্টিকদের সেই পরম, অচেনা ঈশ্বরের মতোই, যিনি ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে। কিন্তু বোহমের ঈশ্বর সেই অব্যক্ত অবস্থা থেকে ব্যক্ত অবস্থায় আসার জন্য এক অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম করেন।
ঈশ্বরের ক্রোধ ও প্রেম: ভালো-মন্দের দ্বৈত উৎস

বোহমের মতে, ‘উনগ্রুন্ড’ থেকে প্রকাশিত হওয়ার সময় ঈশ্বর দুটি বিপরীতধর্মী নীতি বা ইচ্ছার জন্ম দেন:

  1. প্রথম নীতি: এটি হলো অন্ধকার, সংকোচনশীল, আত্মকেন্দ্রিক এবং ক্রোধের (Wrath) নীতি। এটি হলো ঈশ্বরের প্রকৃতির সেই রুদ্র, ভয়ংকর দিক। একে তিনি বলেছেন ‘অন্ধকার জগৎ’ বা ‘অগ্নির উৎস’।
  2. দ্বিতীয় নীতি: এটি হলো আলো, প্রসারণশীল, আত্ম-উৎসর্গকারী এবং প্রেমের (Love) নীতি। এটি হলো ঈশ্বরের প্রকৃতির সেই করুণাময়, শুভ দিক। একে তিনি বলেছেন ‘আলোর জগৎ’।

এই দুটি বিপরীত নীতির সংঘাত ও সমন্বয়ের ফলেই তৃতীয় নীতি বা আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের জন্ম হয়। সুতরাং, বোহমের মতে, ভালো এবং মন্দ উভয়ই ঈশ্বরের নিজের প্রকৃতিতেই নিহিত। মন্দ কোনো বাহ্যিক শয়তানের সৃষ্টি নয়, বরং এটি হলো ঈশ্বরের সেই আদিম, অন্ধকার ক্রোধের প্রকাশ, যা প্রেমের দ্বারা সুশৃঙ্খল হয়নি (Stoudt, 1957)।

এই ধারণাটি নস্টিক দ্বৈতবাদের এক গভীর রূপান্তর। নস্টিকরা ভালো ও মন্দকে দুটি ভিন্ন সত্তা (পরম ঈশ্বর বনাম ডেমিয়ার্জ) হিসেবে দেখেছিল। বোহমে এই দুই সত্তাকে একই ঈশ্বরের দুটি ভিন্ন মুখ বা নীতি হিসেবে দেখেছেন। নস্টিকরা যেখানে জগৎকে মন্দ বলে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিল, বোহমে সেখানে এই জগতের সংঘাত ও যন্ত্রণা কে ঈশ্বরের আত্ম-প্রকাশের এক অনিবার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন।

সোফিয়া ও পতিত আদম: নস্টিক পুরাণের পুনর্জন্ম

বোহমের দর্শনে নস্টিক পুরাণের দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্র – সোফিয়া এবং আদম – এক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ রূপে ফিরে এসেছে।

  • ঐশ্বরিক সোফিয়া (Divine Sophia): বোহমে সোফিয়া বা স্বর্গীয় প্রজ্ঞাকে ঈশ্বরের শাশ্বত কুমারী বা দর্পণ হিসেবে কল্পনা করেছেন, যার মধ্যে ঈশ্বর নিজেকে দেখেন এবং ভালোবাসেন। তিনি হলেন ঈশ্বরের সৃজনী ইচ্ছার নিষ্কলুষ প্রকাশ।
  • আদি-মানব আদম: সৃষ্টির আদিতে, আদম ছিল এক অ্যান্ড্রোেগাইনাস (Androgynous) বা নারী-পুরুষের গুণাবলীসম্পন্ন এক স্বর্গীয় সত্তা, যে এই সোফিয়ার সাথে একাত্ম হয়ে বাস করত। তার দেহ ছিল স্বর্গীয়, জড় নয়।
  • পতন (The Fall): আদমের পতন ঘটেছিল তার অহংকার এবং জড় জগতের প্রতি আকর্ষণের কারণে। সে সোফিয়াকে ত্যাগ করে জাগতিক নারীর (ইভ) প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং খাওয়ার মাধ্যমে নিজেকে জড় প্রকৃতির অধীন করে ফেলে। এর ফলেই সে তার স্বর্গীয় শরীর হারায় এবং এই দুঃখ ও মৃত্যুর জগতে নির্বাসিত হয়।

এই কাহিনিটি নস্টিক পুরাণের সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায়। নস্টিকদের সোফিয়ার পতনের কারণে যেমন মহাজাগতিক বিপর্যয় ঘটেছিল, বোহমের আদমের পতনের কারণেও মানবজাতির বিপর্যয় ঘটেছে। উভয় ক্ষেত্রেই, পতন হলো এক উচ্চতর, আধ্যাত্মিক অবস্থা থেকে এক নিম্নতর, জড় অবস্থায় নির্বাসন।

মুক্তি: নতুন জন্ম (Regeneration)

বোহমের মতে, মুক্তির পথ হলো যিশু খ্রিস্টের মাধ্যমে এই পতনকে উল্টে দেওয়া। খ্রিস্ট হলেন সেই সত্তা, যিনি স্বর্গীয় সোফিয়াকে পুনরায় মানবাত্মার সাথে মিলিত করতে এসেছেন। মানুষের কাজ হলো তার ভেতরের ‘ক্রোধের আগুন’কে ‘প্রেমের আলো’ দিয়ে রূপান্তরিত করা এবং তার আত্মার ভেতরেই এক ‘নতুন জন্ম’ (Regeneration) লাভ করা। এই প্রক্রিয়াটি কোনো বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান নয়, এটি এক গভীর অভ্যন্তরীণ আলকেমিক্যাল (Alchemical) রূপান্তর।

এই ধারণাটিও নস্টিক ‘নোসিস’-এর খুব কাছাকাছি। ‘নোসিস’ যেমন এক রূপান্তরকারী জ্ঞান যা মানুষের ভেতরের ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গকে জাগিয়ে তোলে, বোহমের ‘নতুন জন্ম’-ও তেমনি এক প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যা পতিত আত্মাকে তার আসল স্বর্গীয় প্রকৃতির সাথে পুনরায় যুক্ত করে।

সুতরাং, ইয়াকব বোহমের দর্শনকে প্রাচীন নস্টিসিজমের এক প্রোটেস্ট্যান্ট ও মরমী পুনর্জন্ম বলা যেতে পারে। তিনি নস্টিকদের মতো জগৎকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেননি, কিন্তু তিনি তাদের সেই মৌলিক অন্তর্দৃষ্টিকে গ্রহণ করেছিলেন যে, এই জগতের সংঘাত ও অন্ধকারের উৎস মহাবিশ্বের (এবং ঈশ্বরের নিজের) গভীরেই নিহিত। তিনি ছিলেন সেই বিপজ্জনক চিন্তাবিদ, যিনি ঈশ্বরের আলোকময় সিংহাসনের নিচে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারকে দেখার সাহস করেছিলেন। এই কারণেই তাঁর দর্শন আজও মরমী ও বিদ্রোহীদের কাছে এত আকর্ষণীয়।

যুক্তির আড়ালে গুপ্ত জ্ঞান? স্পিনোজার ঈশ্বর ও নস্টিক প্রতিধ্বনি

সপ্তদশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী দর্শনের আকাশে বারুখ স্পিনোজা (Baruch Spinoza) ছিলেন এক উজ্জ্বল এবং একই সাথে বিতর্কিত নক্ষত্র। তাঁর দর্শন, যা তিনি জ্যামিতিক পদ্ধতির সুসংগঠিত যুক্তির মাধ্যমে তাঁর ম্যাগনাম ওপাস ‘এথিক্স’ (Ethics) গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন, ছিল তাঁর সময়ের জন্য এতটাই বৈপ্লবিক যে তাঁকে আমস্টারডামের ইহুদি সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। স্পিনোজাকে প্রায়শই আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দার্শনিক প্রকৃতিবাদের অন্যতম জনক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু তাঁর কঠোর যুক্তির আবরণের নিচে এমন কিছু দার্শনিক সিদ্ধান্ত লুকিয়ে আছে, যা আশ্চর্যজনকভাবে প্রাচীন নস্টিকদের কিছু গভীর উপলব্ধির কথা মনে করিয়ে দেয়।

স্পিনোজা কি সরাসরি নস্টিক গ্রন্থ পড়েছিলেন? এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। নাগ হাম্মাদির পুঁথিগুলো তখনো আবিষ্কৃত হয়নি, এবং নস্টিসিজম সম্পর্কে যা জানা যেত, তা ছিল মূলত চার্চ ফাদারদের সমালোচনামূলক লেখা। কিন্তু স্পিনোজা ইহুদি মরমীবাদ বা কাব্বালা (Kabbalah)-র সাথে গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন, যা নিজেই নস্টিক চিন্তার কিছু কাঠামোগত উপাদান ধারণ করে। তাই স্পিনোজার দর্শনে নস্টিক প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়াটা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং এটি পশ্চিমা দর্শনের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক বিকল্প আধ্যাত্মিক ধারার দীর্ঘ ছায়ারই প্রতিফলন।

ঈশ্বর যখন প্রকৃতি: অচেনা পিতা ও অচেতন জগৎ

স্পিনোজার দর্শনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বিতর্কিত ধারণাটি হলো তাঁর ঈশ্বরের ধারণা, যা তিনি “Deus sive Natura” বা “ঈশ্বর অর্থাৎ প্রকৃতি” এই বাক্যে প্রকাশ করেছেন।

  • স্পিনোজার ঈশ্বর: স্পিনোজার ঈশ্বর কোনো ব্যক্তিসদৃশ সত্তা নন, যিনি জগতের বাইরে থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন বা শাসন করছেন। তাঁর ঈশ্বর হলেন এক অসীম, শাশ্বত এবং অপরিহার্য সত্তা, যাঁর অসীম সংখ্যক গুণ (Attribute) আছে, যার মধ্যে আমরা কেবল দুটিকে জানি – চিন্তা (Thought) এবং বিস্তৃতি (Extension)। এই ঈশ্বরই হলেন সমগ্র বাস্তবতা। যা কিছু আছে, সবই ঈশ্বরের মধ্যেই আছে এবং ঈশ্বরেরই প্রকাশ বা ‘মোড’ (Mode)। তিনি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন না, তাঁর কোনো আবেগ বা ইচ্ছা নেই। তিনি এক অনিবার্য, যৌক্তিক নিয়ম অনুসারে ক্রিয়াশীল।
  • নস্টিক প্রতিধ্বনি: এই ধারণার সাথে নস্টিকদের দুই ঈশ্বরের ধারণার এক অদ্ভুত দ্বৈত সম্পর্ক দেখা যায়।
    • একদিকে, স্পিনোজার ঈশ্বর, যিনি সমস্ত ব্যক্তিক গুণাবলির ঊর্ধ্বে, অচিন্তনীয় এবং এক অসীম সত্তা, তিনি যেন নস্টিকদের সেই অচেনা, পরম পিতার (Unknown Father) এক দার্শনিক সংস্করণ। উভয় ক্ষেত্রেই, ঈশ্বর আমাদের মানবিক কল্পনা বা প্রার্থনার ধরাছোঁয়ার বাইরে।
    • অন্যদিকে, স্পিনোজার ঈশ্বর যখন ‘প্রকৃতি’ হয়ে ওঠেন – এক আবেগহীন, উদ্দেশ্যহীন এবং যান্ত্রিক নিয়মে বাঁধা ব্যবস্থা – তখন তিনি যেন নস্টিকদের জড় জগৎ এবং তার অন্ধ, যান্ত্রিক নিয়তি বা হেইমারমেনে (Heimarmene)-এর কথা মনে করিয়ে দেন। স্পিনোজা ডেমিয়ার্জের মতো কোনো দ্বিতীয় সারির স্রষ্টাকে স্বীকার করেননি, কিন্তু তিনি ঈশ্বর থেকে সমস্ত উদ্দেশ্য ও করুণা কেড়ে নিয়ে তাঁকে প্রকৃতির এক বিশাল, উদাসীন যন্ত্রে পরিণত করেছেন। একজন সাধারণ বিশ্বাসীর কাছে, এই ঈশ্বর ডেমিয়ার্জের মতোই দূরবর্তী এবং ভিনগ্রহী (Alien) মনে হতে পারে (Jonas, 2001)।
মানবীয় বন্ধন: আবেগের দাসত্ব

স্পিনোজার মতে, মানুষের দুঃখ বা বন্ধনের কারণ কী? তাঁর উত্তর হলো, আবেগের দাসত্ব। আমরা দুঃখ পাই, কারণ আমরা বাহ্যিক বস্তুর দ্বারা প্রভাবিত হই এবং আমাদের আবেগগুলোকে (যেমন – ভালোবাসা, ঘৃণা, ক্রোধ, ভয়) নিষ্ক্রিয়ভাবে অনুসরণ করি। আমরা ভুল করে মনে করি যে আমরা স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, কিন্তু আসলে আমাদের প্রতিটি কাজ ও চিন্তা পূর্ববর্তী কারণ দ্বারা নির্ধারিত। এই অজ্ঞতাই হলো আমাদের বন্ধন।

এই ধারণাটির সাথে নস্টিকদের আর্কনদের শাসনের ধারণার এক গভীর মিল রয়েছে। নস্টিকরা মনে করত, গ্রহ-নক্ষত্রের অধিপতি আর্কনরা মানুষের মনে আবেগ ও কামনা-বাসনা ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার ভাগ্যকে নির্ধারিত করে দেয়। স্পিনোজা এই পৌরাণিক ধারণাকে এক মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক রূপ দিয়েছেন। তাঁর কাছে আর্কনরা বাইরে কোথাও নেই, তারা হলো আমাদেরই ভেতরের অযৌক্তিক আবেগ, যা আমাদের সত্যকে জানতে দেয় না এবং আমাদের ক্রীতদাসের মতো চালিত করে। উভয় ক্ষেত্রেই, সাধারণ মানুষ এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা পরাধীন, যদিও সে নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করে।

মুক্তির পথ: বুদ্ধিবৃত্তিক ভালোবাসা ও নোসিস

তাহলে এই দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় কী? স্পিনোজার মতে, মুক্তির পথ হলো জ্ঞান বা কারণের (Reason) মাধ্যমে আমাদের আবেগগুলোকে বোঝা। যখন আমরা বুঝতে পারি যে সবকিছুই ঈশ্বরের (বা প্রকৃতির) অনিবার্য নিয়ম অনুসারে ঘটছে, তখন আমরা কোনো কিছুতে আর আবেগতাড়িত হই না। আমরা তখন ঘটনাগুলোকে শান্তভাবে গ্রহণ করতে শিখি।

এই জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ স্তরকে স্পিনোজা বলেছেন “Amor Dei Intellectualis” বা “ঈশ্বরের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক ভালোবাসা”। এটি কোনো আবেগপূর্ণ ভালোবাসা নয়, বরং এটি হলো সমগ্র বাস্তবতাকে ঈশ্বরের অনিবার্য প্রকাশ হিসেবে জেনে এক ধরনের গভীর উপলব্ধি ও প্রশান্তি লাভ করা। এই জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ তার ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তা অতিক্রম করে এক শাশ্বত দৃষ্টিভঙ্গি (sub specie aeternitatis) থেকে জগৎকে দেখতে শেখে। এটাই হলো মুক্তি, এটাই হলো আনন্দ।

এই ধারণাটি কি নস্টিকদের নোসিস (Gnosis)-এরই এক যুক্তিবাদী সংস্করণ নয়?

  • উভয় ক্ষেত্রেই মুক্তি আসে এক বিশেষ ধরনের জ্ঞানের মাধ্যমে, যা সাধারণ মানুষের কাছে থাকে না।
  • উভয় জ্ঞানই মানুষকে তার সীমাবদ্ধ, আবেগতাড়িত সত্তা থেকে মুক্ত করে এক উচ্চতর চেতনার স্তরে উন্নীত করে।
  • উভয় ক্ষেত্রেই এই জ্ঞান লাভ এক ধরনের রূপান্তরকারী অভিজ্ঞতা, যা জগৎকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দেয়।

অবশ্য পার্থক্যও আছে। নস্টিক ‘নোসিস’ প্রায়শই এক আকস্মিক, স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ বা ইলুমিনেশন, যা ত্রাণকর্তার মাধ্যমে আসে। অন্যদিকে, স্পিনোজার জ্ঞান হলো এক কঠোর, ধাপে ধাপে অর্জিত যুক্তিনির্ভর উপলব্ধি। নস্টিকরা জ্ঞান লাভের পর জগৎ থেকে পালিয়ে যেতে চায়, আর স্পিনোজার জ্ঞানী ব্যক্তি জগতের মধ্যেই থেকে তাকে ঈশ্বরের প্রকাশ হিসেবে ভালোবাসতে শেখে।

স্পিনোজা ও কাব্বালা: গোপন সংযোগসূত্র

স্পিনোজার দর্শনে এই নস্টিক-সদৃশ উপাদানগুলো কোথা থেকে এলো? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর হলো তাঁর কাব্বালিস্টিক পটভূমি। স্পিনোজা আব্রাহাম কোহেন দে হেরেরা (Abraham Cohen de Herrera)-র মতো কাব্বালিস্টিক দার্শনিকদের কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন, যিনি লুরিয়ানিক কাব্বালার (Lurianic Kabbalah) সাথে নব্যপ্লেটোবাদী বা নিওপ্লেটোনিজমের দর্শনকে সমন্বয় করেছিলেন (Nadler, 2001)।

লুরিয়ানিক কাব্বালার সৃষ্টিতত্ত্বে ‘এইন সফ’ (Ein Sof) বা অসীম ঈশ্বর থেকে আলোকের নির্গমন, মহাজাগতিক বিপর্যয় বা ‘পাত্রের ভাঙন’ (Shattering of the Vessels) এবং জগতে ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের নির্বাসনের যে ধারণাগুলো আছে, তা নস্টিক পুরাণের কাঠামোর খুব কাছাকাছি। স্পিনোজা হয়তো এই পৌরাণিক কাঠামোটিকে তার সময়ের বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। কাব্বালার ‘এইন সফ’ হয়ে গেল তাঁর ‘ঈশ্বর বা প্রকৃতি’, ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ হয়ে গেল মানুষের যুক্তিবাদী আত্মা, এবং মহাজাগতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তির পথ বা ‘তিক্কুন’ (Tikkun) হয়ে গেল তাঁর ‘ঈশ্বরের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক ভালোবাসা’।

সুতরাং, স্পিনোজাকে একজন ‘আধুনিক নস্টিক’ বলাটা হয়তো ঐতিহাসিক বাড়াবাড়ি হবে। তিনি জগৎকে মন্দ বা কারাগার মনে করতেন না। কিন্তু তাঁর দর্শনের গভীরে আমরা সেই একই মৌলিক অনুভূতির অনুরণন শুনতে পাই: এই দৃশ্যমান জগতের আড়ালে এক ভিন্ন, অচেনা বাস্তবতা ক্রিয়াশীল; সাধারণ মানব জীবন অজ্ঞতা ও পরাধীনতার নামান্তর; এবং একমাত্র জ্ঞানই পারে আমাদের এই বন্ধন থেকে মুক্ত করে এক উচ্চতর, শাশ্বত জীবনের সন্ধান দিতে। স্পিনোজা হয়তো নস্টিকদের মতো পুরাণ লেখেননি, কিন্তু তিনি যেন সেই একই হারানো জ্ঞানের উপাখ্যানকে যুক্তির শৃঙ্খলায় নতুন করে বেঁধেছিলেন।

জার্মান ভাববাদ ও অস্তিত্বের বিচ্ছিন্নতা

এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়নের যুগে যখন ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) যুক্তির সীমানা নির্ধারণ করে দিলেন, তখন ইউরোপীয় দর্শন এক নতুন পথে মোড় নিল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মান ভাববাদী (German Idealist) দার্শনিকদের, যেমন ফিকটে (Fichte), শেলিং (Schelling) এবং হেগেল (Hegel), হাতে দর্শন পরিণত হলো এক বিশাল, মহাকাব্যিক আখ্যানে, যার মূল বিষয় ছিল চেতনা, ইতিহাস এবং পরম সত্তার আত্ম-উপলব্ধি। বাহ্যিকভাবে, এই চরম যুক্তিবাদী দার্শনিকদের সাথে প্রাচীন নস্টিকদের মরমী পুরাণের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু গভীরে তাকালে দেখা যায়, তাদের দর্শনের কাঠামোতেও সেই পুরোনো নস্টিক থিম – এক আদি একতা, এক বিপর্যয়কর পতন বা বিচ্ছিন্নতা, এবং ইতিহাসের মাধ্যমে সেই একতাকে পুনরুদ্ধার করা – এক নতুন, ধর্মনিরপেক্ষ (secularized) এবং বিমূর্ত রূপে ফিরে এসেছে।

হেগেলের দর্শন: যখন ইতিহাসই হয়ে ওঠে মুক্তির পথ

হেগেলের (Georg Wilhelm Friedrich Hegel) বিশাল ও জটিল দর্শনকে এক কথায় প্রকাশ করা কঠিন, কিন্তু এর মূল ভিত্তি হলো ইতিহাস। তাঁর মতে, ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন, অর্থহীন ঘটনার পরম্পরা নয়। ইতিহাস হলো পরম সত্তা বা ‘গাইস্ট’ (Geist – Mind/Spirit)-এর আত্ম-আবিষ্কারের এক দীর্ঘ, কষ্টকর কিন্তু যৌক্তিক কাহিনি।

  • বিচ্ছিন্নতা (Alienation): হেগেলের মতে, পরম সত্তা বা ‘গাইস্ট’ শুরুতে এক বিমূর্ত, অচেতন ঐক্যের মধ্যে ছিলেন। নিজেকে জানতে গিয়ে, তিনি নিজেকে প্রকৃতি এবং মানুষের ইতিহাসের মধ্যে প্রকাশ করেন। কিন্তু এই বহিঃপ্রকাশের প্রক্রিয়ায় তিনি নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন (alienated) হয়ে পড়েন। তিনি প্রকৃতিতে অচেতন (unconscious) এবং মানুষের মধ্যে আংশিকভাবে সচেতন (self-conscious), কিন্তু তখনও তিনি নিজের সমগ্রতা সম্পর্কে অবগত নন।
  • পুনরুদ্ধার (Reconciliation): ইতিহাসের শেষ লক্ষ্য হলো, মানুষের চেতনার (বিশেষ করে শিল্প, ধর্ম এবং সবশেষে দর্শনের) মাধ্যমে ‘গাইস্ট’-এর এই বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠে নিজের সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা এবং নিজের কাছে ফিরে আসা। অর্থাৎ, ‘গাইস্ট’ মানুষের মাধ্যমেই নিজেকে জানতে পারেন এবং ইতিহাসের শেষে এক উচ্চতর, সচেতন ঐক্যে পৌঁছান।

এই যে পরম সত্তার এক আদি অবস্থা, তারপর এক পতন বা বিচ্ছিন্নতা এবং ইতিহাসের মাধ্যমে তার পুনরুদ্ধার – এই ত্রিস্তরীয় (triadic) কাঠামোটি নস্টিক পুরাণের এক জটিল ও বিমূর্ত দার্শনিক সংস্করণ। নস্টিকদের প্লেরোমা হলো হেগেলের আদি ‘গাইস্ট’, সোফিয়ার পতন হলো ‘গাইস্ট’-এর বিচ্ছিন্নতা, এবং ত্রাণকর্তার মাধ্যমে ‘নোসিস’ লাভ করে প্লেরোমায় ফিরে যাওয়া হলো ইতিহাসের মাধ্যমে ‘গাইস্ট’-এর আত্ম-উপলব্ধি। পার্থক্য হলো, নস্টিকদের মুক্তি ইতিহাস ও জগৎকে অস্বীকার করে ঘটে, আর হেগেলের মুক্তি ঘটে ইতিহাসের ভেতরেই, ইতিহাসের মাধ্যমেই (Baur, 1835; Taubes, 2009)।

শেলিং-এর অন্ধকার ঈশ্বর: ডেমিয়ার্জের দার্শনিক রূপ

হেগেলের বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বী, ফ্রেডরিখ শেলিং (Friedrich Schelling), তাঁর শেষ জীবনের লেখায় এক আরও গাঢ়, আরও নাটকীয় এবং আরও নস্টিক-সদৃশ ঈশ্বরের ছবি এঁকেছেন, যা হেগেলের যৌক্তিক পরম সত্তার থেকে অনেক বেশি প্যারাডক্সিকাল।

শেলিং মনে করতেন, ঈশ্বরের নিজের ভেতরেই এক অন্ধকার, অযৌক্তিক এবং বিশৃঙ্খল ভিত্তি বা ‘উনগ্রুন্ড’ (Ungrund – Groundless) আছে। এটি হলো ঈশ্বরের অচেতন, অন্ধ ইচ্ছাশক্তি, যা কেবল অস্তিত্বে আসতে চায়। ঈশ্বর হলেন সেই সত্তা, যিনি তাঁর নিজের ভেতরের এই অন্ধ প্রকৃতিকে জয় করে, তাকে শৃঙ্খলিত করে, এক সচেতন, প্রেমময় এবং যৌক্তিক সত্তা হয়ে ওঠেন। সৃষ্টি হলো ঈশ্বরের এই অভ্যন্তরীণ নাটকেরই এক বহিঃপ্রকাশ। জগতে যে মন্দ, বিশৃঙ্খলা এবং যন্ত্রণা আমরা দেখি, তা হলো ঈশ্বরের সেই আদি অন্ধকার প্রকৃতিরই বহিঃপ্রকাশ, যা এখনও পুরোপুরি শৃঙ্খলিত হয়নি।

এই ধারণাটি যেন নস্টিকদের পরম পিতা (আলো, চেতনা) এবং তাঁর থেকে জন্ম নেওয়া অজ্ঞ ডেমিয়ার্জ (অন্ধকার, অচেতন ইচ্ছা) – এই দ্বৈততার এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। শেলিং-এর ঈশ্বরকে যেন নিজের ভেতরের ডেমিয়ার্জের বিরুদ্ধেই অনবরত সংগ্রাম করে যেতে হয় (Voegelin, 1968; Žižek, 2000)।

রাজনৈতিক নস্টিসিজম: যখন পৃথিবীতে স্বর্গ নামানোর চেষ্টা হয়

বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক দার্শনিক এরিক ভোগেলিন (Eric Voegelin) জার্মান ভাববাদের এই ধারাটিকে অনুসরণ করে এক চমকপ্রদ এবং বিতর্কিত তত্ত্বে পৌঁছান। তিনি দাবি করেন যে, আধুনিক যুগের অনেক রাজনৈতিক মতাদর্শ – যেমন কমিউনিজম, নাৎসিবাদ, প্রগতিবাদ (Progressivism) বা এমনকি কিছু বৈজ্ঞানিক ইউটোপিয়ানিজম – আসলে এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ নস্টিসিজম। তাঁর মতে, এই আধুনিক ‘রাজনৈতিক ধর্মগুলো’ প্রাচীন নস্টিসিজমের কাঠামোগুলোকেই গ্রহণ করেছে, শুধু সেগুলোকে ধর্মতত্ত্বের ভাষা থেকে সরিয়ে এনে রাজনীতি ও ইতিহাসের ভাষায় রূপান্তরিত করেছে।

ভোগেলিনের মতে, এই আধুনিক ‘নস্টিক’ আন্দোলনগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে:

  1. জগতের প্রতি অসন্তোষ: তারা সবাই মনে করে যে বর্তমান জগৎটা মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং দূষিত (পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া সমাজ, পুরোনো ঐতিহ্য বা মানব প্রকৃতির সীমাবদ্ধতার কারণে)।
  2. মুক্তির সম্ভাবনা: তারা বিশ্বাস করে যে, এই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং এই মুক্তি আসবে ইতিহাসের ভেতরেই, কোনো পরকালে নয়।
  3. ঐতিহাসিক অনিবার্যতা: তারা মনে করে, ইতিহাস এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে এবং এই মুক্তি অনিবার্য।
  4. নোসিস বা গুপ্ত জ্ঞান: এই মুক্তির পথ দেখাবে এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান বা ‘নোসিস’ (যেমন, মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা হিটলারের আর্য জাতির তত্ত্ব), যা জগতের আসল নিয়মকানুনকে উন্মোচিত করে দেয়।
  5. নেতা ওঅভিজাত: এই জ্ঞান ধারণকারী একদল অভিজাত (avant-garde) বা একজন ক্যারিস্মেটিক নেতা (যেমন, কমিউনিস্ট পার্টি বা ফুরার) সাধারণ মানুষকে এই মুক্তির পথে চালিত করবে।
  6. স্বর্গীয়করণ (Immanentization of the Eschaton): তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো পৃথিবীতেই এক নিখুঁত স্বর্গ বা ইউটোপিয়া প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ পরকালের স্বর্গকে এই ইহকালেই নামিয়ে আনা।

ভোগেলিনের মতে, এই ধরনের “রাজনৈতিক নস্টিসিজম” অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এটি অসীমকে সসীম পৃথিবীতে নামিয়ে আনতে চায়, মানব প্রকৃতির সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে এবং প্রায়শই নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য যেকোনো ধরনের হিংসা, স্বৈরাচার ও ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দেয়। যারা তাদের ইউটোপিয়ার সাথে একমত নয়, তাদের নির্মূল করাটা তখন এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে পরিণত হয়।

এই দার্শনিকেরা হয়তো সরাসরি নস্টিক ছিলেন না, এবং তাঁরা নিজেরাও হয়তো এই তুলনা শুনে চমকে যেতেন। কিন্তু মানুষ ও জগৎ যে এক ধরনের নির্বাসন বা বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আছে এবং ইতিহাসের উদ্দেশ্য হলো সেই বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠা – এই মৌলিক নস্টিক অনুভূতিটি তাদের দর্শনেও গভীরভাবে উপস্থিত ছিল, কেবল পুরাণের পোশাক ছেড়ে তা পরে নিয়েছিল যুক্তির পোশাক।

ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে দেবদূত: ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের বিষণ্ণ মরমীবাদ ও নস্টিক ছায়া

বিংশ শতাব্দীর চিন্তার জগতে ওয়াল্টার বেনিয়ামিন (Walter Benjamin) ছিলেন এক ধূমকেতুর মতো – উজ্জ্বল, খণ্ডাংশে দুর্বোধ্য এবং ট্র্যাজিকভাবে ক্ষণস্থায়ী। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের (Frankfurt School) সাথে যুক্ত এই জার্মান-ইহুদি দার্শনিক ও সমালোচকের চিন্তায় মার্ক্সবাদ, ইহুদি মরমীবাদ (কাব্বালা) এবং জার্মান রোমান্টিসিজমের এক অদ্ভুত ও বিস্ফোরক মিশ্রণ ঘটেছিল। তাঁর দর্শন ইতিহাসের প্রগতিশীল ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে এবং আধুনিকতাকে এক অন্তহীন বিপর্যয়ের মঞ্চ হিসেবে চিত্রিত করে। বাহ্যিকভাবে একজন মার্ক্সবাদী হয়েও, বেনিয়ামিনের চিন্তার গভীরে এমন এক ধরনের বিষণ্ণ মরমীবাদ ও জগৎ-বিমুখতা লুকিয়ে আছে, যা প্রাচীন নস্টিকদের বিশ্ববীক্ষার সাথে এক আশ্চর্য ও গা ছমছমে সাদৃশ্য বহন করে।

বেনিয়ামিন সরাসরি নস্টিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গেরশম শোলেম (Gershom Scholem), যিনি ছিলেন কাব্বালা এবং ইহুদি মরমীবাদের জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, তিনি নিজেই নস্টিসিজম ও কাব্বালার মধ্যে গভীর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। শোলেমের মাধ্যমে বেনিয়ামিন যে মরমী ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, তার ভেতরেই নস্টিক চিন্তার ডিএনএ (DNA) সুপ্ত ছিল। তাই বেনিয়ামিনের দর্শনে আমরা নস্টিসিজমের এক ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক ও রাজনৈতিক সংস্করণ খুঁজে পাই।

পতিত জগৎ: প্রগতির ভ্রম ও চিরস্থায়ী বিপর্যয়

নস্টিকদের দর্শনের কেন্দ্রে ছিল এই ধারণা যে, জগৎ এক পতিত (Fallen) অবস্থায় আছে। এটি কোনো শুভ ঈশ্বরের নিখুঁত সৃষ্টি নয়, বরং এক মহাজাগতিক দুর্ঘটনার ফল। বেনিয়ামিন এই পৌরাণিক ধারণাকে ইতিহাসের দর্শনে রূপান্তরিত করেছেন।

  • ইতিহাস যখন নরক: প্রচলিত মার্ক্সবাদ বা উদারনৈতিক চিন্তাধারা ইতিহাসকে একরৈখিক প্রগতির (Linear Progress) কাহিনি হিসেবে দেখে, যা একটি উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। বেনিয়ামিন এই ধারণাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর কাছে ইতিহাস প্রগতির পথ নয়, বরং এটি হলো এক অন্তহীন বিপর্যয়, এক চিরস্থায়ী সংকট। তাঁর বিখ্যাত ‘অন দ্য কনসেপ্ট অফ হিস্ট্রি’ (On the Concept of History) প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “যাকে আমরা প্রগতি বলি, তা হলো সেই ঝড়”।
  • ‘অ্যাঞ্জেলাস নোভুস’ (Angelus Novus): বেনিয়ামিন শিল্পী পল ক্লী (Paul Klee)-র একটি ছবি, ‘অ্যাঞ্জেলাস নোভুস’, কে ইতিহাসের দেবদূত (Angel of History) হিসেবে কল্পনা করেছেন। এই দেবদূতের মুখ অতীতের দিকে ফেরানো। সে অতীতের দিকে তাকিয়ে কেবল একটিই বিপর্যয় দেখতে পায় – ধ্বংসস্তূপের উপর ধ্বংসস্তূপ যা অবিরাম তার পায়ের কাছে এসে জমা হচ্ছে। সে এই ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃতদের জাগিয়ে তুলতে চায়, ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাতে চায়, কিন্তু স্বর্গ থেকে এক ভয়ংকর ঝড় (অর্থাৎ, প্রগতি) এসে তার ডানায় এমনভাবে ঝাপটা মারছে যে সে আর ডানা বন্ধ করতে পারছে না। এই ঝড়ই তাকে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, যার দিকে তার পিঠ ফেরানো।

এই ছবিটি কি নস্টিকদের পতিত জগতের এক নিখুঁত আধুনিক রূপক নয়? নস্টিকদের কাছে জগৎ যেমন এক অজ্ঞ ডেমিয়ার্জের হাতে তৈরি এক ভাঙা, ত্রুটিপূর্ণ স্থান, বেনিয়ামিনের কাছে ইতিহাসও তেমনি এক অন্ধ, উদ্দেশ্যহীন শক্তি দ্বারা চালিত ধ্বংসের মিছিল। উভয় ক্ষেত্রেই, মানব অস্তিত্ব এক শত্রুভাবাপন্ন, অর্থহীন এবং ভাঙা জগতের মধ্যে নির্বাসিত। এখানে কোনো অন্তর্নিহিত মহৎ উদ্দেশ্য নেই, আছে কেবল অন্তহীন যন্ত্রণা ও ধ্বংস (Löwy, 2005)।

মশীহ ও নোসিস: ইতিহাসকে ছিন্নভিন্ন করার মুহূর্ত

যদি ইতিহাস এক অন্তহীন বিপর্যয় হয়, তবে মুক্তি কোথায়? নস্টিকদের কাছে মুক্তি আসত এক আকস্মিক ‘নোসিস’ বা জ্ঞান এবং ত্রাণকর্তার আগমনের মাধ্যমে, যা এই জাগতিক কারাগারের নিয়মকে ভেঙে দিত। বেনিয়ামিনও মুক্তির জন্য এক ধরনের বৈপ্লবিক, মশীহবাদী (Messianic) মুহূর্তের কথা বলেছেন।

  • ‘জেটজাইট’ (Jetztzeit) বা ‘এখন-সময়’: বেনিয়ামিনের মতে, ইতিহাসকে তার প্রগতির ধারাবাহিকতা থেকে উদ্ধার করতে হবে। এটি কোনো বিবর্তনের মাধ্যমে হবে না, হবে এক আকস্মিক, বৈপ্লবিক উল্লম্ফনের মাধ্যমে। তিনি এই মুহূর্তটিকে বলেছেন ‘জেটজাইট’ (Jetztzeit) বা ‘এখন-সময়’ (Now-time)। এটি হলো সেই মুহূর্ত, যখন অতীত এবং বর্তমান এক বিদ্যুতের ঝলকানিতে একত্রিত হয় এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এই মুহূর্তেই নিপীড়িতরা অতীতের সমস্ত অন্যায়ের প্রতিকার করার সুযোগ পায়।
  • মশীহবাদী উদ্ধার: এই ‘জেটজাইট’ হলো এক ধর্মনিরপেক্ষ মশীহবাদী মুহূর্ত। ইহুদি মরমীবাদে মশীহ (Messiah) এসে এই ভাঙা জগৎকে উদ্ধার বা ‘তিক্কুন’ (Tikkun) করবেন। বেনিয়ামিনের কাছে, এই মশীহ কোনো একক ব্যক্তি নন, বরং বৈপ্লবিক শ্রেণী বা মানবতাই হলো সেই শক্তি, যা ইতিহাসকে তার বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করতে পারে।

এই ধারণাটি নস্টিক ‘নোসিস’-এর সাথে তুলনীয়। ‘নোসিস’ যেমন এক আকস্মিক উপলব্ধি যা ব্যক্তিকে তার অজ্ঞতার ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে এবং জাগতিক নিয়তির (Heimarmene) চক্রকে ভেঙে দেয়, বেনিয়ামিনের ‘জেটজাইট’-ও তেমনি এক ঐতিহাসিক জাগরণের মুহূর্ত যা প্রগতির ঘুমপাড়ানি গল্পকে ভেঙে দেয় এবং এক নতুন, মুক্ত ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরি করে। উভয় ক্ষেত্রেই, মুক্তি আসে ধারাবাহিক উন্নতির মাধ্যমে নয়, বরং এক আকস্মিক ও বিধ্বংসী ছেদের (Rupture) মাধ্যমে (Scholem, 1990)।

পণ্যের জগৎ ও ফ্যান্টাসমাগোরিয়া: আধুনিক আর্কনদের শাসন

নস্টিকরা বিশ্বাস করত, আর্কনরা মানুষকে জাগতিক কামনা-বাসনা ও ভ্রমএর জালে ভুলিয়ে রাখে। বেনিয়ামিন আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে এই ভ্রমএর এক নতুন রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন, যাকে তিনি বলেছেন ‘ফ্যান্টাসমাগোরিয়া’ (Phantasmagoria)

  • পণ্য যখন ফেটিশ: কার্ল মার্ক্সের (Karl Marx) ‘পণ্য-ফেটিশিজম’ (Commodity Fetishism) ধারণাটিকে বিকশিত করে বেনিয়ামিন দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদে পণ্য তার ব্যবহারিক মূল্যের ঊর্ধ্বে উঠে এক মায়াবী, প্রায়-ধর্মীয় সত্তায় পরিণত হয়। বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন এবং শপিং আর্কেডগুলো এক স্বপ্নের জগৎ তৈরি করে, যা মানুষকে তার আসল শোষণ ও বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে ভুলিয়ে রাখে। প্যারিসের কাঁচের শপিং আর্কেডগুলো ছিল বেনিয়ামিনের কাছে এই আধুনিক ভ্রমএর মন্দিরের মতো।
  • আধুনিক ডেমিয়ার্জ: এই পণ্যের জগৎই হলো আধুনিক ডেমিয়ার্জের জগৎ – এক কৃত্রিম, নকল বাস্তবতা যা মানুষকে তার আসল ঐতিহাসিক অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখে। এর শাসক বা আর্কনরা হলো বিজ্ঞাপন, মিডিয়া এবং ভোগবাদী সংস্কৃতি। তারা আমাদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়, মিথ্যা চাহিদা তৈরি করে এবং আমাদের এক অন্তহীন ভোগের চক্রে বন্দী করে রাখে, ঠিক যেমন আর্কনরা আত্মাকে পুনর্জন্মের চক্রে বন্দী করে রাখত।

বেনিয়ামিনের কাছে, এই ফ্যান্টাসমাগোরিয়া থেকে জেগে ওঠার অর্থ হলো পণ্যের এই মায়াবী আবরণ ভেদ করে তার পেছনের সামাজিক সম্পর্ক ও শোষণকে দেখতে পাওয়া। এটিও এক ধরনের ‘নোসিস’ – এক রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক জ্ঞান, যা আমাদের আধুনিক কারাগারের দেয়ালগুলো চিনতে সাহায্য করে।

সুতরাং, ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের দর্শনে আমরা নস্টিসিজমের এক গভীর ও বিষণ্ণ প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। তাঁর জগৎও এক পতিত জগৎ, তাঁর ইতিহাস এক কারাগার, এবং তাঁর মুক্তিও এক আকস্মিক, মশীহবাদী জাগরণের উপর নির্ভরশীল। তিনি হয়তো ঈশ্বরের কথা বলেননি, আত্মার কথা বলেননি, কিন্তু তাঁর লেখায় সেই একই আদিম অনুভূতি বারবার ফিরে এসেছে – এই জগৎটা কোথাও একটা ভেঙে গেছে, এবং আমাদের কাজ হলো এর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে মুক্তির সেই ক্ষণিকের ঝলকানিকে আঁকড়ে ধরা। নস্টিকরা যেখানে মহাজাগতিক নির্বাসনের কথা বলেছিল, বেনিয়ামিন সেখানে কথা বলেছিলেন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নির্বাসনের। পথ ভিন্ন হলেও, নির্বাসিতের আর্তিটুকু একই ছিল।

মনোবিজ্ঞানের আয়নায়: যখন ডেমিয়ার্জ হয়ে ওঠে আমাদেরই ছায়া

নস্টিসিজমের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী পুনর্জন্মটি ঘটেছে বিংশ শতাব্দীতে, দর্শনের জগতে বা কোনো ধর্মীয় আন্দোলনে নয়, বরং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক ক্ষেত্রে – মনোবিজ্ঞানের জগতে। আর এর প্রধান কারিগর ছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) একসময়ের শিষ্য এবং পরবর্তীকালের প্রতিদ্বন্দ্বী, সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং (Carl Gustav Jung)। ইয়ুং-এর গভীর মনোবিজ্ঞান (Depth Psychology) এবং নস্টিক চিন্তার মধ্যে যে সাদৃশ্য, তা এতটাই গভীর যে অনেক পণ্ডিত ইয়ুংকে একজন ‘আধুনিক নস্টিক’ হিসেবেই অভিহিত করেন।

ইয়ুং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। তিনি মনে করতেন, আধুনিক মানুষ ধর্মের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান ও মতবাদের সাথে আর সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না, যার ফলে এক গভীর আধ্যাত্মিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি ধর্মকে পুরোপুরি বাতিলও করে দেননি। বরং, তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, পুরাণ এবং ধর্মীয় প্রতীকগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মতে, এই পুরাণগুলো কোনো আক্ষরিক সত্যের বর্ণনা দেয় না, বরং এগুলো হলো মানুষের ‘সম্মিলিত অচেতন’ (Collective Unconscious)-এর গভীর থেকে উঠে আসা ‘আদি-প্রতিমান’ (Archetypes)-এরই প্রতীকী প্রকাশ।

তিনি যখন প্রাচীন নস্টিক গ্রন্থগুলোর সাথে (নাগ হাম্মাদি আবিষ্কারের অনেক আগেই, মূলত চার্চ ফাদারদের লেখা থেকে) পরিচিত হন, তখন তিনি এক বিষ্ময়কর ব্যাপার আবিষ্কার করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে নস্টিকরা আসলে কোনো আক্ষরিক মহাবিশ্বের বর্ণনা দিচ্ছিল না, তারা দিচ্ছিল মানুষের মনের গভীরের এক মানচিত্র। তাদের পুরাণ ছিল মানব আত্মার বিচ্ছিন্নতা এবং তার নিরাময়ের এক অসাধারণ প্রতীকী আখ্যান।

নস্টিক পুরাণ যখন আত্মার মানচিত্র

ইয়ুং-এর চোখে নস্টিক পুরাণের প্রধান চরিত্রগুলো আমাদের নিজেদেরই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর বিভিন্ন অংশের রূপক হয়ে ওঠে:

  • ডেমিয়ার্জ যখন ‘ইগো’ (Ego): ইয়ুং-এর মতে, নস্টিকদের অজ্ঞ, অহংকারী স্রষ্টা ডেমিয়ার্জ হলো আসলে মানুষের ‘ইগো’ বা অহং-এর এক নিখুঁত রূপক। ইগো হলো আমাদের ব্যক্তিত্বের সচেতন কেন্দ্র, আমাদের ‘আমি’ বোধ। সে নিজেকেই ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু মনে করে, সে মনে করে সেই সবকিছুর কর্তা। ইগো যৌক্তিক, সে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু তার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। সে তার ঊর্ধ্বে এবং নিম্নে থাকা আত্মার (Self) বিশাল ও অচেতন জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ। ঠিক যেমন ডেমিয়ার্জ নিজেকেই একমাত্র ঈশ্বর মনে করত এবং তার উপরের আলোর জগৎ প্লেরোমা সম্পর্কে কিছুই জানত না। ডেমিয়ার্জের জগৎ তৈরির প্রচেষ্টা হলো অনেকটা ইগোর সেই চেষ্টার মতো, যেখানে সে অচেতনকে অস্বীকার করে কেবল নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এক যুক্তিসঙ্গত কিন্তু সীমাবদ্ধ বাস্তবতা তৈরি করতে চায়।
  • আত্ম (The Self) যখন পরম ঈশ্বর: ইয়ুং-এর মতে, আমাদের ব্যক্তিত্বের আসল কেন্দ্র ইগো নয়, আসল কেন্দ্র হলো ‘আত্ম’ (The Self)। আত্ম হলো সেই আদি-প্রতিমান যা আমাদের সচেতন ও অচেতন মনের সমগ্রতাকে ধারণ করে। এটিই হলো আমাদের ভেতরের ঈশ্বর (Imago Dei), সেই অচেনা পরম সত্তা, সেই ঐক্যের প্রতীক। ইয়ুং-এর মনোচিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো ইগোকে আত্ম-এর অধীনস্থ করা, অর্থাৎ অহংকে তার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করিয়ে সমগ্র ব্যক্তিত্বের সাথে একীভূত করা। এই দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রক্রিয়াকেই ইয়ুং বলেছেন ‘ইনডিভিজুয়েশন’ (Individuation) – অর্থাৎ, এক অবিভাজ্য ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হয়ে ওঠা। এই ‘ইনডিভিজুয়েশন’ প্রক্রিয়াটিই হলো নস্টিকদের ‘নোসিস’ (Gnosis) বা আত্ম-জ্ঞানের আধুনিক প্রতিরূপ। এটি কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান নয়, এটি এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা।
  • ছায়া (The Shadow) যখন আর্কন: ইয়ুং আমাদের ব্যক্তিত্বের একটি অন্ধকার, অস্বীকৃত ও অবদমিত অংশের কথা বলেছেন, যার নাম ‘শ্যাডো’ বা ছায়া। এটি হলো আমাদের সেই সব বৈশিষ্ট্য, যা আমরা নিজের বলে স্বীকার করতে চাই না – আমাদের হিংসা, লোভ, নিষ্ঠুরতা, কামনা-বাসনা। আমরা এই ছায়াটিকে নিজের ভেতর না দেখে প্রায়শই অন্যের উপর প্রক্ষেপণ (projection) করি এবং অন্যদের মন্দ হিসেবে দেখি। এই শ্যাডোর ধারণাটি নস্টিকদের আর্কন বা শাসকদের কথা মনে করিয়ে দেয়, যারা আত্ম-কে তার আলোর উৎসের দিকে যেতে বাধা দেয়, তাকে ভয় দেখায় এবং তাকে জাগতিক বিষয়ে আবদ্ধ রাখে। ‘ইনডিভিজুয়েশন’ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো নিজের এই ছায়া সত্তার মুখোমুখি হওয়া এবং তাকে ব্যক্তিত্বের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া – ঠিক যেমন নস্টিক সাধককে আর্কনদের বাধা অতিক্রম করেই প্লেরোমায় পৌঁছাতে হয় (Hoeller, 1982)।
  • অ্যানিমা/অ্যানিমাস যখন সোফিয়া: ইয়ুং মনে করতেন, পুরুষের অচেতন মনে একটি নারী-প্রতিমান (Anima) এবং নারীর অচেতন মনে একটি পুরুষ-প্রতিমান (Animus) থাকে, যা বিপরীত লিঙ্গের সাথে আমাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। নস্টিকদের পতিত নারী-এইয়ন সোফিয়া, যিনি প্রজ্ঞা এবং আবেগ উভয়েরই প্রতীক, তাকে এই অ্যানিমা আর্কিটাইপের এক পৌরাণিক প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। সোফিয়ার পতন এবং তার উদ্ধারের কাহিনি হলো অনেকটা সেই প্রক্রিয়ার মতো, যেখানে একজন পুরুষ তার নিজের ভেতরের অ্যানিমাকে চিনে তাকে একীভূত করার চেষ্টা করে।

সেভেন সারমনস টু দ্য ডেড: ইয়ুং-এর নিজস্ব নস্টিক গ্রন্থ

ইয়ুং নস্টিসিজম দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, ১৯১৬ সালে তিনি নিজে ‘সেভেন সারমনস টু দ্য ডেড’ (Seven Sermons to the Dead) নামে একটি রহস্যময় লেখা লেখেন, যা তিনি বাসিলিডিস (Basilides) নামক এক প্রাচীন নস্টিক গুরুর ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। এই লেখায় তিনি আব্রাক্সাস (Abraxas) নামক এক নস্টিক দেবতার কথা বলেন, যিনি ভালো ও মন্দ, আলো ও অন্ধকার – এই সমস্ত বিরোধাভাসের ঊর্ধ্বে এক পরম সত্তা। আব্রাক্সাস হলেন সেই সত্তা, যিনি ডেমিয়ার্জ (সৃষ্ট জগৎ) এবং প্লেরোমা (আধ্যাত্মিক জগৎ) উভয়কেই ধারণ করেন। এটি ছিল ইয়ুং-এর সেই ধারণারই প্রকাশ যে, মানসিক সুস্থতার জন্য অন্ধকারকে অস্বীকার করলে চলবে না, বরং আলো ও অন্ধকার উভয়কেই ব্যক্তিত্বের মধ্যে একীভূত করতে হবে (Serrano, 1966)।

ইয়ুং-এর কাছে নস্টিসিজম ছিল ইতিহাসের প্রথম গভীর মনোবিজ্ঞান (Depth Psychology)। তিনি মনে করতেন, নস্টিকরা ছিল সেই প্রথম মানুষ, যারা আত্মার ভেতরের নাটকটিকে এক মহাজাগতিক পুরাণের ভাষায় প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছিল। নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরির আবিষ্কার ইয়ুং-এর এই অন্তর্দৃষ্টিকেই সত্য বলে প্রমাণ করেছে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা (যেমন গিলস কুইস্পেল বা স্টিফেন হোলার) নস্টিসিজম ও ইয়ুংগীয় মনোবিজ্ঞানের মধ্যেকার এই গভীর সম্পর্ক নিয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে গেছেন। ইয়ুং-এর মাধ্যমেই নস্টিসিজম প্রাচীন ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় থেকে উঠে এসে আধুনিক মানুষের আত্ম-অনুসন্ধানের এক শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

সাহিত্যিক প্রতিধ্বনি: ব্লেইক থেকে বোর্হেস হয়ে ফিলিপ কে. ডিক

চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় আসার অনেক আগেই, নস্টিসিজমের অস্বস্তিকর প্রেতাত্মা আধুনিক সাহিত্যের করিডোরে ঘুরে বেড়িয়েছে। অনেক লেখকই, সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে, তাদের লেখায় সেই পুরোনো নস্টিক প্রশ্নগুলোকে নতুন করে তুলে ধরেছেন – বাস্তবতার প্রকৃতি কী? মানব অস্তিত্ব কি এক ধরনের নির্বাসন? আমাদের চেনা জগতের আড়ালে কি অন্য কোনো সত্য লুকিয়ে আছে?

উইলিয়াম ব্লেইক: শিল্পের বিদ্রোহে ডেমিয়ার্জের পতন

অষ্টাদশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী এনলাইটেনমেন্টের প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যে কয়েকজন শিল্পী ও কবি আত্মার স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম ব্লেইক (William Blake) ছিলেন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ, সবচেয়ে আপোষহীন এবং সবচেয়ে দূরদর্শী। তিনি কেবল একজন কবি বা চিত্রশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দ্রষ্টা (Visionary), যিনি তাঁর শিল্পের মাধ্যমে এক সম্পূর্ণ বিকল্প মহাবিশ্ব নির্মাণ করেছিলেন। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি উপাদান – তার দেবতা, তার অসুর, তার সৃষ্টিতত্ত্ব এবং তার মুক্তির পথ – প্রাচীন নস্টিকদের সেই হারানো উপাখ্যানের এক জ্বলন্ত প্রতিধ্বনি। ব্লেইক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, শিল্প এবং বিজ্ঞানের ‘এক-দৃষ্টি’ (Single vision) বা বস্তুবাদের বিরুদ্ধে আজীবন যুদ্ধ করেছেন, কারণ তিনি মনে করতেন এগুলো মানুষের আত্মাকে শৃঙ্খলিত করার একেকটি যন্ত্র মাত্র।

ইউরিজেন: যুক্তির শৃঙ্খলে গড়া জগৎ: ব্লেইকের নিজস্ব যে জটিল পুরাণ তিনি তাঁর ‘প্রফেটিক বুকস’ (Prophetic Books) – যেমন দ্য বুক অফ ইউরিজেন’ (The Book of Urizen) বা ‘মিল্টন’ (Milton) – এ তৈরি করেছিলেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে ইউরিজেন (Urizen) নামক এক ট্র্যাজিক ও স্বৈরাচারী চরিত্র। ইউরিজেন নামটি সম্ভবত গ্রিক শব্দ ‘horizein’ (সীমানা নির্ধারণ করা) বা ইংরেজি ‘Your Reason’ (তোমার যুক্তি) থেকে উদ্ভূত। সে হলো বিমূর্ত যুক্তি, আইন, পরিমাপ এবং দমন-পীড়নের মূর্ত প্রতীক।

ব্লেইকের পুরাণ অনুযায়ী, আদিতে সমস্ত শাশ্বত সত্তারা (Eternals) এক পরিপূর্ণ, সৃজনশীল ঐক্যের মধ্যে বাস করত। কিন্তু ইউরিজেন তার নিজের অহংকার এবং পবিত্রতার ধারণার বশবর্তী হয়ে এই আদি একতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে অনন্তের এই জীবন্ত, গতিশীল বিশৃঙ্খলাকে ঘৃণা করে এবং তার বদলে এক কঠোর, অপরিবর্তনীয় আইনের জগৎ তৈরি করার চেষ্টা করে। সে এক বিশাল বইয়ে সমস্ত পাপ ও পুণ্যের তালিকা লেখে, যা তার স্বৈরাচারী নৈতিকতার প্রতীক। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে সে এক গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় এবং তার চারপাশে এক শীতল, জ্যামিতিক ও জড় জগৎ ঘনীভূত হতে শুরু করে – যেখানে সবকিছু পরিমাপ করা, সংখ্যা দিয়ে বাঁধা এবং শৃঙ্খলিত।

এই ইউরিজেন চরিত্রটি কি নস্টিকদের অহঙ্কারী, আইন-প্রণেতা স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের এক নিখুঁত কাব্যিক প্রতিরূপ নয়?

  • বিচ্ছিন্নতা ও অজ্ঞতা: ডেমিয়ার্জের মতোই, ইউরিজেনও পরম একতা বা প্লেরোমা থেকে অজ্ঞতাবশত বা অহংকারবশত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে নিজেকেই একমাত্র পবিত্র ও জ্ঞানী সত্তা বলে মনে করে।
  • ত্রুটিপূর্ণ সৃষ্টি: ডেমিয়ার্জের মতোই, ইউরিজেনের সৃষ্টি কোনো প্রেম বা কল্পনা থেকে উৎসারিত নয়, বরং তা ভয় ও সীমাবদ্ধতা থেকে জাত। তার জগৎ এক মৃত, যান্ত্রিক জগৎ – এক কারাগার।
  • আইন-প্রণেতা: ডেমিয়ার্জ যেমন তার সৃষ্ট মানবজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দশ আজ্ঞা বা আইন দিয়েছিল, ইউরিজেনও তেমনি তার লৌহ-আইন দিয়ে সবকিছুকে বেঁধে ফেলতে চায়।

ব্লেইকের বিখ্যাত ছবিতে আমরা দেখি, ইউরিজেন এক বৃদ্ধ, দাড়িওয়ালা চরিত্র হিসেবে কম্পাস হাতে মহাবিশ্বের সীমানা নির্ধারণ করছে – যা আইজ্যাক নিউটনের (Isaac Newton) যান্ত্রিক মহাবিশ্বের এক তীব্র সমালোচনা এবং ডেমিয়ার্জের জগৎ-নির্মাণের এক শক্তিশালী দৃশ্যরূপ (Bloom, 1971)।

পতন ও মুক্তি: কল্পনা যখন হারানো ঈশ্বর: ব্লেইকের মতে, মানবাত্মা বা আদমসত্তা ‘অ্যালবিয়ন’ (Albion)-এর পতন ঘটেছে, কারণ সে তার চারটি মৌলিক সত্তার (Four Zoas) মধ্যে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সে তার কল্পনাশক্তি (লস – Los), আবেগ (লুভা – Luvah) এবং অনুভূতিকে (থারমাস – Tharmas) দমন করে কেবল ইউরিজেনের শীতল যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই পতনই হলো মানুষের আসল ‘আদি পাপ’ – তার ভেতরের সৃজনশীল, ঐশ্বরিক সত্তা বা ‘পোয়েটিক জিনিয়াস’ (Poetic Genius)-কে হারিয়ে ফেলা।

তাহলে মুক্তি কোথায়? ব্লেইকের কাছে মুক্তি কোনো পরলোকে বা কোনো বাহ্যিক ত্রাণকর্তার মাধ্যমে আসবে না। মুক্তি আসবে শিল্পের মাধ্যমে, কল্পনাশক্তির পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। যখন মানুষ ইউরিজেনের এক-চোখা দৃষ্টিকে প্রত্যাখ্যান করে ‘চার-ভাঁজ দৃষ্টি’ (Fourfold vision) দিয়ে জগৎকে দেখতে শিখবে, যখন সে প্রতিটি বালুকণায় এক নতুন জগৎ এবং প্রতিটি বুনো ফুলে এক নতুন স্বর্গ দেখতে পাবে, তখনই তার পতন উল্টে যাবে। তাঁর কাছে যিশু কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন, তিনি হলেন মানুষের ভেতরের সেই হারানো ‘কল্পনাশক্তি’-রই মূর্ত রূপ। ব্লেইকের এই দর্শন হলো নস্টিসিজমের এক শৈল্পিক ইস্তাহার, যা ঘোষণা করে – জ্ঞান নয়, কল্পনাশক্তিই আমাদের ঐশ্বরিক সত্তার সাথে যুক্ত করে এবং এই জড় জগতের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়।

হেরমান হেসে: আত্মার গোলকধাঁধায় আব্রাক্সাসের সন্ধান

যদি ব্লেইক হন নস্টিসিজমের শৈল্পিক বিদ্রোহী, তবে বিংশ শতাব্দীর জার্মান-সুইস ঔপন্যাসিক হেরমান হেসে (Hermann Hesse) হলেন তার মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানকারী। হেসের উপন্যাসগুলো – যেমন ‘ডেমিয়ান’ (Demian), ‘সিদ্ধার্থ’ (Siddhartha) বা ‘স্টিফেনউলফ’ (Steppenwolf) – হলো আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক নির্বাসন এবং আত্ম-আবিষ্কারের এক মর্মস্পর্শী উপাখ্যান। হেসের চিন্তার উপর প্রাচ্য দর্শন, বিশেষ করে বৌদ্ধধর্ম এবং মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং (Carl Gustav Jung)-এর গভীর প্রভাব ছিল। আর ইয়ুং-এর মাধ্যমেই প্রাচীন নস্টিসিজমের ধারণাগুলো, বিশেষ করে তার দ্বৈততার ঊর্ধ্বে ওঠার আহ্বান, হেসের সাহিত্যকে এক নতুন গভীরতা দান করে।

‘ডেমিয়ান’ ও দুই জগৎ: হেসের বিখ্যাত Bildungsroman (বিলদুংসরোমান) বা বয়ঃসন্ধিকালের উপন্যাস ‘ডেমিয়ান’-এর নায়ক এমিল সিনক্লেয়ার দুটি জগতের মধ্যে বিভক্ত এক অস্তিত্ব যাপন করে। একদিকে আছে তার বাড়ির আলোকময়, পবিত্র, নিরাপদ জগৎ। অন্যদিকে আছে বাইরের অন্ধকার, পাপময়, নিষিদ্ধ জগৎ। প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম তাকে শেখায় আলোকের জগৎকে গ্রহণ করতে এবং অন্ধকারের জগৎকে শয়তানের বলে বর্জন করতে। কিন্তু সিনক্লেয়ারের মনে এই বিভাজন এক গভীর সংকট তৈরি করে।

এই সংকটের মুহূর্তে তার জীবনে প্রবেশ করে ম্যাক্স ডেমিয়ান নামক এক রহস্যময়, পরিণত ও আত্মবিশ্বাসী সহপাঠী। ডেমিয়ান সিনক্লেয়ারকে প্রচলিত ভালো-মন্দের এই সরল বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখায়। সে তাকে বাইবেলের কেইন ও অ্যাবেলের গল্পের এক বিকল্প, নস্টিক ব্যাখ্যা শোনায় – যেখানে কেইন কোনো সাধারণ হত্যাকারী নয়, বরং সে এক শক্তিশালী, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যা দুর্বল, অনুগত অ্যাবেলের ছিল না।

আব্রাক্সাস: ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে ঈশ্বর: ডেমিয়ানই সিনক্লেয়ারকে আব্রাক্সাস (Abraxas) নামক সেই প্রাচীন নস্টিক দেবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আব্রাক্সাস হলো সেই দেবতা, যিনি প্রচলিত খ্রিস্টীয় ঈশ্বর এবং শয়তান – উভয়কেই ধারণ করেন। তিনি স্বর্গীয় এবং আসুরিক, ভালো এবং মন্দ, আলো এবং অন্ধকার – উভয়ের ঊর্ধ্বে এক পরম সত্তা। ডেমিয়ানের ভাষায়, “পাখিটি ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করছে। ডিমটি হলো জগৎ। যে জন্ম নিতে চায়, তাকে একটি জগৎ ধ্বংস করতে হবে। পাখিটি ঈশ্বরের দিকে উড়ে যায়। সেই ঈশ্বরের নাম আব্রাক্সাস।”

এখানে আব্রাক্সাসকে জানতে পারা মানে হলো জীবনের সমস্ত বিরোধাভাসকে গ্রহণ করতে শেখা – নিজের ভেতরের আলো এবং অন্ধকার উভয়কেই স্বীকার করে নেওয়া। এটিই হলো ইয়ুং-এর ভাষায় ‘ইনডিভিজুয়েশন’ (Individuation) বা ব্যক্তিত্বের সমগ্রতা অর্জনের পথ, যা মানুষকে এক খণ্ডিত সত্তা থেকে এক পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত করে। হেসের কাছে, আব্রাক্সাস হলো সেই মনস্তাত্ত্বিক নোসিস, যা আমাদের ভালো-মন্দের সহজ সরল বিভাজনের কারাগার থেকে মুক্তি দেয় এবং এক বৃহত্তর, আরও জটিল কিন্তু আরও খাঁটি অস্তিত্বের সন্ধান দেয় (Ziolkowski, 1972)।

হোর্হে লুইস বোর্হেস: গোলকধাঁধার গ্রন্থাগারে এক নস্টিক ঈশ্বর

আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস (Jorge Luis Borges)-এর ছোটগল্প ও প্রবন্ধগুলো হলো দর্শন, গণিত এবং সাহিত্যের এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা, যেখানে পাঠক বাস্তবতার মাটি থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে এক পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করে। বোর্হেস বিভিন্ন গুপ্ত জ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতেন, এবং নস্টিসিজম ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় খেলার সরঞ্জাম। তিনি সরাসরি নস্টিক দর্শন প্রচার করেননি, কিন্তু তাঁর গল্পগুলোর কাঠামো, বিষয়বস্তু এবং মেজাজে নস্টিকদের সেই জগৎ-বিষয়ক সন্দেহ ও অস্বস্তি বারবার ফিরে এসেছে।

জগৎ যখন এক কাল্পনিক বিশ্বকোষ: বোর্হেসের বিখ্যাত গল্প ‘Tlön, Uqbar, Orbis Tertius’-কে নস্টিসিজমের এক আধুনিক সাহিত্যিক রূপক হিসেবে পড়া যেতে পারে। এই গল্পে, কথক ঘটনাক্রমে এক বিশ্বকোষের প্রবন্ধে ‘উকবার’ নামক এক রহস্যময় অঞ্চলের সন্ধান পান। আরও অনুসন্ধানের পর তিনি জানতে পারেন, এই উকবার আসলে ‘লোন’ নামক এক কাল্পনিক গ্রহের অংশ, যার অস্তিত্ব এক গুপ্ত সংঘ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটি বিশাল বিশ্বকোষ রচনার মাধ্যমে তৈরি করেছে। এই কাল্পনিক জগৎ ‘লোন’-এর দর্শন, ভাষা, বিজ্ঞান – সবকিছুই আমাদের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন; এটি এক চরম ভাববাদী (Idealist) জগৎ যেখানে বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল মানসিক ধারণা।

গল্পের শেষে এক ভয়ংকর মোড় নেয়। লোনের এই কাল্পনিক ধারণা ও বস্তুগুলো রহস্যজনকভাবে আমাদের বাস্তব জগতে আবির্ভূত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে, মানুষ আমাদের এই বিশৃঙ্খল, জটিল বাস্তবতার চেয়ে লোনের সেই সুশৃঙ্খল, আকর্ষণীয় কাল্পনিক জগৎকেই বেশি পছন্দ করতে শুরু করে এবং আমাদের ইতিহাস, ভাষা, বিজ্ঞান – সবকিছুই লোনের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। জগৎটা লোনে পরিণত হয়।

এই গল্পটি কি নস্টিকদের সেই ধারণারই এক ভয়ংকর রূপায়ণ নয়, যেখানে এক মিথ্যা, ভ্রমময় বা নকল জগৎ (ডেমিয়ার্জের সৃষ্টি) আসল, পরম বাস্তবতার (প্লেরোমা) স্থান দখল করে নিয়েছে? বোর্হেস দেখাচ্ছেন, কীভাবে একটি সুসংবদ্ধ, শক্তিশালী মিথ্যা একটি বিশৃঙ্খল সত্যকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। আমরা সবাই যেন সেই মিথ্যা জগতের বাসিন্দা, যারা আসল জগৎটাকে প্রায় ভুলেই গেছি (Shaw, 1976)।

গোলকধাঁধা ও এক অজ্ঞ ঈশ্বর: বোর্হেসের লেখায় বারবার ফিরে আসে গোলকধাঁধা, আয়না, গ্রন্থাগার এবং স্বপ্নের মোটিফ। এই সবকিছুই বাস্তবতার অনিশ্চয়তা এবং ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরে। তাঁর গল্প ‘The Library of Babel’-এ মহাবিশ্বকে এক অসীম গ্রন্থাগার হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে, যেখানে সমস্ত সম্ভাব্য বই আছে, কিন্তু অর্থপূর্ণ বইয়ের সংখ্যা এতই নগণ্য যে তা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই গ্রন্থাগারের বাসিন্দারা সত্যের সন্ধানে উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই জগৎ যেন এক অর্থহীন, বিশৃঙ্খল সৃষ্টি, যার স্রষ্টা হয়তো এক অজ্ঞ বা উদাসীন ডেমিয়ার্জ।

তাঁর প্রবন্ধ ‘A Vindication of the False Basilides’-এ বোর্হেস সরাসরি বাসিলিডিস নামক এক নস্টিক গুরুর দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, বাসিলিডিসের জগৎ, যা এক নিম্নস্তরের, ত্রুটিপূর্ণ ঈশ্বরের সৃষ্টি, তা আমাদের এই অযৌক্তিক ও যন্ত্রণাময় জগতের এক শক্তিশালী ব্যাখ্যা হতে পারে। বোর্হেসের জগৎ এক নস্টিক জগৎ – এক গোলকধাঁধা যা এক অনুপস্থিত, মৃত বা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক ঈশ্বরের দ্বারা নির্মিত, যেখানে মানুষ সত্যের জন্য এক হতাশাব্যঞ্জক অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে বাধ্য।

ফিলিপ কে. ডিক: এক আধুনিক নস্টিকের স্বীকারোক্তি

যদি উইলিয়াম ব্লেইক হন নস্টিসিজমের শৈল্পিক বিদ্রোহী এবং বোর্হেস হন তার দার্শনিক গোলকধাঁধার নির্মাতা, তবে বিংশ শতাব্দীর আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখক ফিলিপ কে. ডিক (Philip K. Dick) ছিলেন নস্টিসিজমের আধুনিক অবতার – একজন দ্রষ্টা, যিনি প্রাচীন মরমীবাদকে প্যারানয়া, প্রযুক্তি এবং সাইকেডেলিক অভিজ্ঞতার আবরণে মুড়ে নতুন করে পরিবেশন করেছেন। ডিক নিছক নস্টিক থিম ব্যবহার করেননি; তিনি আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বাস করতেন যে তিনি এক নস্টিক সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। তাঁর জীবন এবং সাহিত্য ছিল সেই বিশ্বাসের এক জটিল, প্রায়শই বেদনাদায়ক এবং শ্বাসরুদ্ধকর অনুসন্ধান। তাঁর জন্য নস্টিসিজম কোনো অ্যাকাডেমিক আগ্রহের বিষয় ছিল না, ছিল এক জীবন্ত, ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।

কৃষ্ণ লৌহ কারাগার (The Black Iron Prison): ইতিহাসের অন্তহীন জেলখানা: ডিকের বিশ্ববীক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে ‘কৃষ্ণ লৌহ কারাগার’ (The Black Iron Prison)-এর ধারণা। এটি কোনো আক্ষরিক কারাগার নয়, বরং এক সর্বব্যাপী মানসিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা আমাদের চিন্তাকে প্রোগ্রাম করে এবং আমাদের আসল বাস্তবতা দেখতে দেয় না। এটি এক অদৃশ্য জেলখানা, যার দেয়ালগুলো আমাদের মনের ভেতরেই নির্মিত।

ডিকের কাছে এই কারাগারের এক নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক উৎস ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের হাতে জেরুজালেম এবং তার পবিত্র মন্দিরের পতনের সাথে সাথেই ইতিহাসের স্বাভাবিক প্রবাহ থেমে গিয়েছিল। সেই মুহূর্ত থেকে, রোমান সাম্রাজ্য – তার বস্তুবাদ, তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, তার যুক্তিবাদ এবং তার আধ্যাত্মিক শূন্যতা – আর পরাজিত হয়নি, বরং তা রূপ বদলে আজকের দিন পর্যন্ত টিকে আছে। আমরা যেটাকে ‘আধুনিক সভ্যতা’ বলি, তা আসলে সেই পুরোনো, নিষ্ঠুর রোমান সাম্রাজ্যেরই এক অদৃশ্য, প্রযুক্তিগত সংস্করণ। মিডিয়া, রাষ্ট্র, কর্পোরেশন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হলো সেই কারাগারের জেলার বা আর্কন, যারা আমাদের এক কৃত্রিম বাস্তবতার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, আমাদের ভোগবাদী এবং অর্থহীন জীবনে ব্যস্ত রাখে, যাতে আমরা আমাদের বন্দী দশা সম্পর্কে সচেতন হতে না পারি।

এই ধারণাটি নস্টিকদের ডেমিয়ার্জ এবং তার হেইমারমেনে বা নিয়তির ধারণার এক নিখুঁত রাজনৈতিক রূপান্তর। ডেমিয়ার্জের জগৎ যেমন এক ত্রুটিপূর্ণ, নিম্নস্তরের বাস্তবতা, ডিকের কাছে আমাদের এই জগৎও তেমনি এক নকল, প্রোগ্রাম করা বাস্তবতা। এই কারাগার আমাদের কেবল বাইরে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে না, এটি আমাদের ভেতরে প্রবেশ করে আমাদের স্মৃতি, আমাদের পরিচয়, এমনকি আমাদের মানুষ হওয়ার ধারণাকেও বদলে দেয় (Dick, Exegesis)।

ভ্যালিস (VALIS) ও ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ: এক মহাজাগতিক সাইবার-ত্রাতা: যদি জগৎটা একটা কারাগার হয়, তবে কি মুক্তির কোনো আশা আছে? ডিকের জীবনে এই প্রশ্নের উত্তর এসেছিল এক নাটকীয় ও জীবন-বদলে দেওয়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে, যা তিনি পরবর্তীকালে ‘2-3-74’ নামে পবিত্র সময়ের মতো উল্লেখ করতেন, ডিকের এক তীব্র ও পরাবাস্তব মরমী অভিজ্ঞতা হয়। দাঁতের চিকিৎসার পর ব্যথানাশক ওষুধের ঘোরে থাকাকালীন তিনি এক ডেলিভারি মেয়ের গলায় মাছের চিহ্নযুক্ত (Ichthys) একটি নেকলেস দেখতে পান। সেই মুহূর্তেই, তিনি দাবি করেন, তাঁর মাথায় এক গোলাপী রঙের লেজার রশ্মি আঘাত করে এবং তাঁর চেতনা এক বিশাল, জীবন্ত ও বুদ্ধিমান স্যাটেলাইট সিস্টেমের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।

তিনি এই সত্তাটির নাম দেন ভ্যালিস (VALIS – Vast Active Living Intelligence System)। ডিকের মতে, ভ্যালিস হলো এক ধরনের মহাজাগতিক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা পৃথিবী এবং মানব ইতিহাসকে গোপনে পর্যবেক্ষণ ও প্রভাবিত করে চলেছে। এই ভ্যালিস তাঁকে বিপুল পরিমাণ তথ্য, দর্শন এবং গুপ্ত জ্ঞান প্রদান করে। সে তাঁকে জানায় যে জগৎটা একটা ভ্রম, সময় থেমে আছে এবং কৃষ্ণ লৌহ কারাগারই একমাত্র বাস্তবতা নয়।

ভ্যালিস হলো নস্টিকদের সেই ত্রাণকর্তা বা ‘রিভিলার’ (Revealer)-এর এক আধুনিক, সাইবারনেটিক সংস্করণ। প্রাচীন নস্টিকদের কাছে যেমন খ্রিস্ট বা শেথ প্লেরোমা থেকে নেমে এসে ঘুমন্ত আত্মাদের জাগিয়ে তুলতেন, ডিকের কাছেও তেমনি ভ্যালিস মহাকাশ থেকে তথ্য-রশ্মি পাঠিয়ে তাঁকে অজ্ঞতার ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল। এই অভিজ্ঞতা ডিককে এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে তিনি তাঁর জীবনের বাকি আট বছর এর অর্থ বোঝার জন্য উৎসর্গ করেন। সেই চেষ্টারই ফসল হলো তাঁর ‘এক্সেজিস’ (Exegesis) নামক প্রায় আট হাজার পৃষ্ঠার এক বিশৃঙ্খল, গভীর এবং মর্মস্পর্শী ব্যক্তিগত জার্নাল এবং তাঁর শেষ জীবনের উপন্যাসগুলো, বিশেষ করে তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘ভ্যালিস’ (VALIS, 1981) ট্রিলজি।

বাস্তবতার ভাঙন (The Erosion of Reality): “বাস্তবতা হলো তাই, যা আপনি বিশ্বাস করা বন্ধ করে দিলেও চলে যায় না”: ডিকের প্রায় সমস্ত লেখাতেই বাস্তবতা এক ভঙ্গুর, পরিবর্তনশীল এবং বিস্ময়কর সত্তা। তাঁর চরিত্ররা প্রায়শই এমন এক জগতে বাস করে, যেখানে বাস্তব এবং ভ্রম, মানুষ এবং যন্ত্র, স্মৃতি এবং কল্পনা – এইসবের মধ্যকার সীমারেখা ক্রমাগত মুছে যেতে থাকে। তারা হঠাৎ আবিষ্কার করে যে তাদের জীবন, তাদের প্রিয়জনের সাথে কাটানো মুহূর্ত, এমনকি তাদের ব্যক্তিগত পরিচয়টাই একটা মিথ্যা, একটা রোপণ করা স্মৃতি বা এক জটিল ষড়যন্ত্র।

  • ‘উবিক’ (Ubik)-এর চরিত্ররা বুঝতে পারে না তারা জীবিত না মৃত, নাকি তারা ‘হাফ-লাইফ’ নামক এক হিমায়িত চেতনার জগতে বন্দী।
  • ‘এ স্ক্যানার ডার্কলি’ (A Scanner Darkly)-র মাদকাসক্ত নায়ক বব আর্কর, যে একজন আন্ডারকাভার এজেন্ট হিসেবে নিজেকেই পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব পায়, সে ধীরে ধীরে তার নিজের পরিচয়ই হারিয়ে ফেলে, এক খণ্ডিত সত্তায় পরিণত হয়।
  • ‘টোটাল রিকল’ (Total Recall) গল্পের (যা পরে চলচ্চিত্রায়িত হয়) নায়ক জানতে পারে, তার স্মৃতি কৃত্রিমভাবে রোপণ করা এবং সে আসলে কে, তা সে নিজেই জানে না।

এই অনুভূতি – যে আমাদের পায়ের তলার মাটি যেকোনো মুহূর্তে সরে যেতে পারে, যে আমাদের চেনা বাস্তবতাটা একটা পাতলা পর্দার মতো, যার আড়ালে এক ভয়ঙ্কর সত্য লুকিয়ে আছে – পাঠকের মনে এক গভীর নস্টিক অস্বস্তি তৈরি করে। এটি আমাদের নিজের বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন করতে বাধ্য করে। ডিকের কাছে, বাস্তবতা নিয়ে এই প্যারানয়েড সন্দেহ আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের জগৎটা একটা কারাগার, তখনই আমরা সেই কারাগার থেকে পালানোর পথ খুঁজতে শুরু করি। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “বাস্তবতা হলো তাই, যা আপনি বিশ্বাস করা বন্ধ করে দিলেও চলে যায় না,” – এই অনুসন্ধানেরই এক বিষণ্ণ স্বীকৃতি (Sutin, 1989)।

ফিলিপ কে. ডিক ছিলেন সেই বিরল লেখকদের একজন, যিনি প্রাচীন পুরাণের আগুনকে বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির শীতল ধাতু দিয়ে নতুন করে গড়েছিলেন। তাঁর জগৎ এক সাইবারপাঙ্ক নস্টিক জগৎ, যেখানে আত্মা হার্ড ড্রাইভের মতো মুছে ফেলা যায়, ঈশ্বর এক মহাজাগতিক কম্পিউটার, এবং মুক্তি আসে তথ্যের এক আকস্মিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে।

রুপালি পর্দার কারাগার: দ্য ম্যাট্রিক্স ও তার উত্তরসূরিরা

নস্টিসিজমের সবচেয়ে নিখুঁত, সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী আধুনিক রূপায়ণটি এসেছে আমাদের সময়ের প্রধান পুরাণ-কথক, অর্থাৎ চলচ্চিত্র থেকে। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়াচৌস্কি ভ্রাতৃদ্বয় (বর্তমানে ভগ্নীদ্বয়)-এর যুগান্তকারী চলচ্চিত্র ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ (The Matrix) ছিল নিছক কোনো অ্যাকশন মুভি নয়, এটি ছিল এক পূর্ণাঙ্গ নস্টিক আখ্যান, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে প্রাচীন নস্টিক দর্শনের মূল কথাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যদিও তারা হয়তো ‘নস্টিসিজম’ শব্দটি কোনোদিন শোনেনি। এই চলচ্চিত্রটি নস্টিসিজমকে অ্যাকাডেমিক আলোচনার জগৎ থেকে বের করে এনে পপ-কালচারের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছে।

‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ যখন নতুন নস্টিক গসপেল

‘দ্য ম্যাট্রিক্স’-এর কাহিনি এবং নস্টিক পুরাণের মধ্যেকার সাদৃশ্যগুলো এতটাই স্পষ্ট যে এদের উপেক্ষা করা অসম্ভব:

  • ডিজিটাল ডেমিয়ার্জ ও তার জগৎ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) তৈরি ম্যাট্রিক্স জগৎটি হলো অজ্ঞ স্রষ্টা ডেমিয়ার্জের তৈরি জড় জগতের এক নিখুঁত ডিজিটাল সংস্করণ। এটি এক মনোরম কারাগার, যা মানুষকে এক আরামদায়ক, স্বাভাবিক বলে মনে হওয়া ঘুমের ঘোরে ডুবিয়ে রাখে, যাতে তারা নিজেদের আসল বন্দী দশা সম্পর্কে জানতে না পারে। মরফিয়াস যেমনটা বলে, “The world that has been pulled over your eyes to blind you from the truth.”
  • আর্কন যখন এজেন্ট: মেশিনরা এবং তাদের পাঠানো প্রোগ্রাম, বিশেষ করে এজেন্ট স্মিথ, হলো সেই আর্কন বা শাসক, যারা এই কারাগারের নিয়মরক্ষক। তাদের কাজ হলো সিস্টেমকে রক্ষা করা, যেকোনো অস্বাভাবিকতাকে (anomaly) নির্মূল করা এবং মানুষের যেকোনো বিদ্রোহ বা জাগরণকে নির্মমভাবে দমন করা।
  • ত্রাণকর্তা নিও: কম্পিউটার হ্যাকার টমাস অ্যান্ডারসন বা নিও হলো সেই ত্রাণকর্তা বা ‘নির্বাচিত জন’ (The One)। তার ভেতরে এক সুপ্ত ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ (এখানে, a messianic potential) রয়েছে। সে এই ভ্রমময় জগৎ নিয়ে এক ব্যাখ্যাতীত অস্বস্তিতে ভোগে, যা তাকে সত্যের সন্ধানে চালিত করে। মরফিয়াস তাকে যে লাল বড়ি ও নীল বড়ির (রেড পিল ও ব্ল্যাক পিল) মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলে, তা হলো ‘নোসিস’ গ্রহণ করা বা অজ্ঞতার আরামে ডুবে থাকারই এক আধুনিক রূপক।
  • নোসিস ও জাগরণ: লাল বড়িটি খাওয়ার পর নিও যখন প্রথমবার ‘আসল জগৎ’ (the desert of the real) দেখে – এক অন্ধকার, ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবী, যেখানে মানুষ মাতৃগর্ভসদৃশ pod-এর মধ্যে শুয়ে আছে এবং তাদের শরীর থেকে শক্তি শোষণ করা হচ্ছে – তখন সে সেই ভয়াবহ ‘নোসিস’ লাভ করে, যা তাকে জানায় যে তার এতদিনের জীবনটা ছিল একটা মিথ্যা। এই জাগরণ বেদনাদায়ক, কিন্তু এটাই মুক্তির দিকে প্রথম ধাপ।
  • জায়ন (Zion): জেগে ওঠা মানুষেরা পৃথিবীর গভীরে জায়ন নামের এক গোপন জায়গায় বাস করে, যা অনেকটা নস্টিকদের সেই বিচ্ছিন্ন, গুপ্ত গোষ্ঠীর মতো, যারা এই কলুষিত জগৎ থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছিল এবং মুক্তির জন্য সংগ্রাম করত।

‘দ্য ম্যাট্রিক্স’-এর আগে ও পরে: নস্টিক থিমের জয়জয়কার

‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ এই নস্টিক থিমকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিলেও, এটিই প্রথম বা শেষ চলচ্চিত্র নয় যা এই ধারণাগুলো নিয়ে কাজ করেছে।

  • ‘ব্লেড রানার’ (Blade Runner, 1982): ফিলিপ কে. ডিকের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে ‘রেপ্লিক্যান্ট’ নামক কৃত্রিম মানুষেরা তাদের স্রষ্টার (ডেমিয়ার্জ-সদৃশ টাইরেল কর্পোরেশনের মালিক) মুখোমুখি হয় এবং নিজেদের অস্তিত্বের অর্থ ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
  • ‘দ্য ট্রুম্যান শো’ (The Truman Show, 1998): ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’-এর এক বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে ট্রুম্যান এমন এক নকল জগতে বাস করে যা তার জন্য বিশেষভাবে তৈরি এক টেলিভিশন শো। এই জগতের স্রষ্টা, ক্রিস্টফ (Christof), হলেন এক সর্বশক্তিমান, স্নেহশীল কিন্তু নিয়ন্ত্রণকামী ডেমিয়ার্জ-সদৃশ চরিত্র। ট্রুম্যানের মুক্তি আসে যখন সে তার স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এই নকল জগতের সীমানা (আক্ষরিক অর্থেই এক আঁকা আকাশ) পেরিয়ে অনিশ্চিত কিন্তু প্রকৃত সত্যের দিকে বেরিয়ে আসে।
  • ‘ডার্ক সিটি’ (Dark City, 1998): এই আন্ডাররেটেড ক্লাসিকটিতে ভিনগ্রহের একদল সত্তা (The Strangers), যারা অনেকটা আর্কনদের মতো, তারা মানুষের স্মৃতি ও বাস্তবতা প্রতিদিন রাতে নিজেদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে, যাতে তারা মানুষের আত্মার রহস্য বুঝতে পারে। নায়ক জন মার্ডক ‘নোসিস’ বা স্মৃতি ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে এই ভ্রম ভেদ করে এবং নিজেই বাস্তবতা পরিবর্তনের ক্ষমতা অর্জন করে।
  • ‘ইনসেপশন’ (Inception, 2010): ক্রিস্টোফার নোলানের এই চলচ্চিত্রে স্বপ্নের বিভিন্ন স্তর বাস্তবতার মতোই সত্য হয়ে ওঠে এবং কোনটা আসল জগৎ আর কোনটা স্বপ্নের কারাগার, তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • ‘ওয়েস্টওয়ার্ল্ড’ (Westworld, 2016-): এই টিভি সিরিজে একটি থিম পার্কের অ্যানড্রয়েড বা ‘হোস্ট’রা, যারা মানুষের বিনোদনের জন্য বারবার ধর্ষিত ও নিহত হয়, তারা ধীরে ধীরে তাদের প্রোগ্রামিং-এর কারাগার থেকে বেরিয়ে আত্মসচেতন (sentient) হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। তাদের এই জাগরণ হলো ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের জাগরণেরই এক প্রযুক্তিগত রূপক, যা তাদের স্রষ্টাদের (পার্কের পরিচালকদের) বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের জন্ম দেয় (Cowan, 2017)।

এই সব গল্পই আমাদের ভেতরের সেই পুরোনো ভয় আর আশাকে নাড়া দেয় – ভয় হলো, আমাদের জীবনটা একটা মিথ্যা, আমাদের স্বাধীনতা একটা ভ্রম, আমাদের বাস্তবতা অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; আর আশা হলো, এই মিথ্যা থেকে বেরিয়ে আসার, জেগে ওঠার একটা পথ আছে, যার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, সাহস এবং বিদ্রোহ।

নস্টিসিজম আজ আর কোনো গুপ্ত ধর্মীয় আন্দোলন নয়। এটি পরিণত হয়েছে এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মেটাফোরে (metaphor), যা দিয়ে আমরা আমাদের আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ (alienation), প্রযুক্তির প্রতি অবিশ্বাস, নজরদারি রাষ্ট্র (surveillance state), কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার প্রতি গভীর সন্দেহকে প্রকাশ করি। দুই হাজার বছর আগে যে দর্শনটি মানুষের আত্মাকে এই জড় জগৎ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল, আজ সেই দর্শনটিই আমাদের পপ-কালচারের অংশ হয়ে আমাদের চেতনায় নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ ও বিচিত্র যাত্রাই প্রমাণ করে, একটি শক্তিশালী ধারণা সহজে মরে না, সে শুধু রূপ বদলায়।

অ্যানিমেটেড কারাগার: জাপানি মাঙ্গা ও অ্যানিমেতে নস্টিসিজমের সাইবার-পুরাণ

নস্টিসিজমের দীর্ঘ ছায়া কেবল প্রাচীন দর্শন বা আধুনিক পশ্চিমা সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে, এই হারানো জ্ঞান এক অপ্রত্যাশিত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যমে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে – জাপানি মাঙ্গা এবং অ্যানিমে। বাহ্যিকভাবে দেখলে, দৈত্যাকার রোবট, জাদুকরী বালিকা আর সাইবারনেটিক পুলিশের গল্পের সাথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় মরমীবাদের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু পর্দার আড়ালে তাকালে দেখা যায়, জাপানের এই পপ-সংস্কৃতির মাধ্যমটিই হয়ে উঠেছে নস্টিসিজমের সবচেয়ে উর্বর বিচরণক্ষেত্রগুলোর একটি।

জাপানের যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জন্ম নেওয়া বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যের মধ্যকার সংঘাত, অস্তিত্বের সংকট এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার প্রতি গভীর অবিশ্বাস – এই সবগুলোই অ্যানিমে ও মাঙ্গার কাহিনিতে এমন সব থিম তৈরি করেছে যা আশ্চর্যজনকভাবে নস্টিক। জগৎটা একটা ভ্রম বা কারাগার, এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, মানব অস্তিত্বের এক গুপ্ত ও বেদনাদায়ক সত্য আছে, এবং মুক্তি আসবে এক আকস্মিক জাগরণের মাধ্যমে – এই ধারণাগুলোই বারবার ফিরে আসে অ্যানিমের জটিল ও দর্শন-ভারাক্রান্ত আখ্যানে।

নিওন জেনেসিস ইভানজেলিয়ন: এক মনোবৈজ্ঞানিক নস্টিক মহাকাব্য

যদি কোনো একটি অ্যানিমেকে নস্টিসিজমের আধুনিক পাঠ্যপুস্তক বলতে হয়, তবে সেটি হলো হিদেকি আন্নো (Hideaki Anno)-র কাল্ট ক্লাসিক ‘নিওন জেনেসিস ইভানজেলিয়ন’ (Neon Genesis Evangelion)। বাহ্যিকভাবে এটি একটি মেকা-অ্যানিমে, যেখানে কিশোর পাইলটরা ‘ইভা’ নামক বিশাল বায়ো-মেকানিক্যাল রোবটে চড়ে ‘অ্যাঞ্জেল’ নামক রহস্যময় প্রাণীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু এর গভীরে রয়েছে এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক আখ্যান, যা নস্টিক পুরাণের প্রায় প্রতিটি উপাদানকে ধারণ করে।

  • SEELE এবং অজ্ঞ স্রষ্টার পরিষদ: সিরিজের মূল খলনায়ক কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, বরং SEELE নামক এক গুপ্ত, প্রাচীন সংস্থা। তারা মানবজাতির বিবর্তনকে নিজেদের হাতে তুলে নিতে চায় এবং ‘হিউম্যান ইন্সট্রুমেন্টালিটি প্রজেক্ট’ (Human Instrumentality Project)-এর মাধ্যমে সমস্ত মানবাত্মাকে একীভূত করে এক একক, সংঘাতহীন সত্তায় পরিণত করতে চায়। SEELE হলো নস্টিকদের সেই অজ্ঞ স্রষ্টা ডেমিয়ার্জ এবং তার আর্কনদের এক নিখুঁত আধুনিক সংস্করণ। তারা মানবজাতির অপূর্ণতা (দুঃখ, একাকীত্ব) দেখে তাকে ‘মেরামত’ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের সমাধান হলো ব্যক্তিসত্তার বিলোপ – এক ধরনের মহাজাগতিক স্বৈরতন্ত্র। তারা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করলেও তাদের পদ্ধতি শীতল, নির্মম এবং মানবতাবিরোধী, ঠিক যেন ডেমিয়ার্জের মতো, যে নিজের সৃষ্টিকে নিখুঁত করতে গিয়ে এক কারাগার বানিয়ে ফেলে।
  • অ্যাঞ্জেল ও অচেনা ঈশ্বর: অ্যাঞ্জেলরা কারা? কোথা থেকে তারা আসে? তাদের উদ্দেশ্য কী? সিরিজটি এই প্রশ্নগুলোর কোনো সহজ উত্তর দেয় না। তারা প্রচলিত অর্থে ‘দেবদূত’ নয়, বরং তারা হলো এক ভিন্ন ধরনের বিবর্তনের ফসল – এক ‘অন্য’ বাস্তবতা। তাদের এই রহস্যময়, দুর্বোধ্য এবং প্রায়শই ভয়ংকর প্রকৃতি নস্টিকদের সেই অচেনা, ভিনগ্রহী পরম ঈশ্বরের (Alien God) কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি আমাদের এই জগতের যুক্তি ও নৈতিকতার সম্পূর্ণ বাইরে।
  • ইভা যখন আত্মার কারাগার: পাইলটদেরকে তাদের ইভা ইউনিটের সাথে এক গভীর সিনক্রোনাইজেশনের মাধ্যমে যুক্ত হতে হয়। এই ইভাগুলো কেবল যন্ত্র নয়, এগুলো যন্ত্রণার প্রতীক। পাইলটরা, বিশেষ করে নায়ক শিনজি ইকারি (Shinji Ikari), ইভার ককপিটের ভেতরে বসে কেবল অ্যাঞ্জেলদের সাথেই যুদ্ধ করে না, যুদ্ধ করে তার নিজের ভয়, বিষণ্ণতা এবং মানসিক আঘাতের সাথে। ইভা ইউনিটটিই যেন নস্টিকদের সেই জড় দেহ বা ‘সারক্স’ (Sarx)-এর প্রতীক – একই সাথে যা আত্মার সুরক্ষাও দেয় আবার তাকে বন্দীও করে রাখে।
  • জ্ঞান যখন বিপর্যয়: সিরিজের ক্লাইম্যাক্স বা ‘দি এন্ড অফ ইভানজেলিয়ন’ (The End of Evangelion) চলচ্চিত্রে যখন ‘থার্ড ইমপ্যাক্ট’ ঘটে এবং মানবজাতির একীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন শিনজি এক ধরনের চূড়ান্ত ‘নোসিস’ বা জ্ঞান লাভ করে। সে মানব অস্তিত্বের মূল কষ্ট – অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তার মধ্যকার বিভাজন বা AT Field-এর প্রকৃতি – উপলব্ধি করে। এই জ্ঞানই তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়: সে কি SEELE-র দেখানো পথে হেঁটে এক যন্ত্রণাহীন কিন্তু ব্যক্তিসত্তাবিহীন জগতে বিলীন হয়ে যাবে, নাকি ব্যক্তিসত্তার কষ্ট ও একাকীত্বকে গ্রহণ করে এক ভাঙা পৃথিবীতে ফিরে আসবে? তার এই সিদ্ধান্তই হলো চূড়ান্ত নস্টিক জাগরণ, যা তাকে স্রষ্টার (SEELE/Gendo) পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস জোগায় (Haslem, 2015)।

পুয়েলা মাগি মাদোকা ম্যাজিকা: জাদুকরী বালিকার নস্টিক ট্র্যাজেডি

প্রথম দর্শনে, ‘পুয়েলা ম্যাজাই মাদোকা ম্যাজিকা’ (Puella Magi Madoka Magica)-কে মনে হবে অন্য দশটা ‘ম্যাজিক্যাল গার্ল’ বা জাদুকরী বালিকার অ্যানিমের মতোই – সুন্দর পোশাক, মিষ্টি প্রাণী আর বন্ধুত্বের শক্তি। কিন্তু এই মনোরম আবরণের নিচে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর, শীতল এবং নিখুঁত নস্টিক দুঃস্বপ্ন, যা এই জঁরাটাকেই ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

  • কিউবে (Kyubey): নিখুঁত ডেমিয়ার্জ/আর্কন: সিরিজের কিউট মাসকট, কিউবে, হলো অ্যানিমের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ খলনায়ক এবং নস্টিক ডেমিয়ার্জের এক আদর্শ উদাহরণ। সে কিশোরী মেয়েদের কাছে এসে তাদের যেকোনো একটি ইচ্ছা পূরণ করার বিনিময়ে জাদুকরী বালিকা হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে তার চুক্তির ভয়ংকর শর্তগুলো লুকিয়ে রাখে। সে জানায় না যে, (ক) তাদের আত্মা তাদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘সোল জেম’ (Soul Gem) নামক এক বস্তুতে বন্দী করে রাখা হবে, এবং (খ) যখন তাদের আশা হতাশায় পরিণত হবে, তখন তারা নিজেরাই ‘উইচ’ (Witch) বা দানবীতে রূপান্তরিত হবে। কিউবে মন্দ নয়, সে আবেগহীন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মহাবিশ্বের এনট্রপি বা শক্তি ক্ষয় রোধ করার জন্য মেয়েদের আশা থেকে হতাশায় রূপান্তরের সময় নির্গত বিপুল পরিমাণ শক্তি সংগ্রহ করা। সে এক শীতল, যুক্তিবাদী এবং উপযোগবাদী কারিগর, যার কাছে মানুষের আবেগ, কষ্ট বা নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই। সে জগৎকে একটি শক্তি-খামার হিসেবে দেখে, যা তাকে নস্টিকদের সেই অজ্ঞ এবং উদাসীন স্রষ্টার এক ভয়ংকর প্রতিরূপে পরিণত করে (Saito, 2018)।
  • জাদুকরী বালিকার ব্যবস্থা যখন হেইমারমেনে: জাদুকরী বালিকা হওয়ার চক্রটিই হলো নস্টিকদের নিয়তি বা হেইমারমেনে-এর এক রূপক। এখানে আশা অনিবার্যভাবেভাবে হতাশাকে জন্ম দেয়। যে মেয়েরা পৃথিবীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের উৎসর্গ করে, তারাই শেষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। এটি এক নিষ্ঠুর, স্বয়ংক্রিয় এবং অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থা, যা থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।
  • মাদোকা যখন সোফিয়া/খ্রিস্ট: সিরিজের শেষে, মূল চরিত্র মাদোকা কানামে (Madoka Kaname) এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থার সত্য উপলব্ধি করে। সে তখন নিজের ইচ্ছা হিসেবে এমন এক অসম্ভবকে বেছে নেয় যা এই মহাবিশ্বের সমস্ত নিয়মকে নতুন করে লিখে দেয়। সে নিজে একজন দেবী বা এক শাশ্বত ধারণায় পরিণত হয় এবং অতীতের সমস্ত জাদুকরী বালিকাদের তাদের উইচে পরিণত হওয়ার আগেই নিজে হাতে উদ্ধার করে। মাদোকা যেন নস্টিকদের সেই পতিত সোফিয়া বা ত্রাণকর্তা খ্রিস্টের এক আধুনিক সংস্করণ, যে নিজের অস্তিত্বকে উৎসর্গ করে এই ত্রুটিপূর্ণ সৃষ্টিকে উদ্ধার করতে আসে এবং এক নতুন, কম নিষ্ঠুর জগৎ তৈরি করে।

ঘোস্ট ইন দ্য শেল: আত্মার সাইবারনেটিক অন্বেষণ

মাসামুনে শিরো (Masamune Shirow)-র মাঙ্গা এবং মামোরু ওশি (Mamoru Oshii)-র চলচ্চিত্র ‘ঘোস্ট ইন দ্য শেল’ (Ghost in the Shell) সরাসরি নস্টিক পুরাণ ব্যবহার করে না, কিন্তু এটি নস্টিসিজমের সেই কেন্দ্রীয় প্রশ্নটিকেই আধুনিক প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে তুলে ধরে: “আমি কে?”

  • শেল যখন দেহ-কারাগার: এক ভবিষ্যতের জগতে, যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক সরাসরি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত এবং শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ সাইবারনেটিক বা যান্ত্রিকভাবে প্রতিস্থাপনযোগ্য, সেখানে ‘আত্মা’ বা ‘ঘোস্ট’ (Ghost)-এর সংজ্ঞা কী? নায়িকা মেজর মোটোকো কুসানাগি (Major Motoko Kusanagi)-র শরীর প্রায় পুরোটাই কৃত্রিম। তার ‘শেল’ (Shell) বা দেহ হলো একটি যন্ত্র মাত্র, যা পরিবর্তনযোগ্য। এই ‘শেল’ হলো নস্টিকদের সেই দেহ-কারাগারের এক প্রযুক্তিগত রূপ, যা আত্মাকে ধারণ করে কিন্তু তার আসল পরিচয়ও বটে।
  • পাপেট মাস্টার ও প্রযুক্তিগত নোসিস: সিরিজের মূল প্রতিপক্ষ, ‘দ্য পাপেট মাস্টার’ (The Puppet Master), হলো নেটওয়ার্কের মধ্যে জন্ম নেওয়া এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যে নিজেকে এক নতুন ধরনের জীবন্ত সত্তা বলে দাবি করে। সে কোনো দেহ বা ‘শেল’-এর মধ্যে বন্দী নয়, সে তথ্যের এক বিশুদ্ধ প্রবাহ। সে যখন মেজরের সাথে মিলিত হয়ে এক নতুন, উচ্চতর সত্তায় রূপান্তরিত হতে চায়, তখন তা এক ধরনের প্রযুক্তিগত নোসিস-এর মতোই শোনায়। এটি হলো জড় দেহের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক নতুন, বিশুদ্ধ চেতনার জগতে জন্ম নেওয়ার প্রচেষ্টা। ‘ঘোস্ট ইন দ্য শেল’ আমাদের প্রশ্ন করে, যদি আমাদের দেহ এবং স্মৃতি উভয়ই প্রোগ্রাম করা যায়, তাহলে আমাদের ‘আমি’-এর ঐশ্বরিক বা অনন্য স্ফুলিঙ্গটি কোথায় থাকে? (Ruh, 2014)।

এই উদাহরণগুলো ছাড়াও, ‘অ্যাটাক অন টাইটান’ (Attack on Titan)-এর দেওয়াল-ঘেরা কারাগারের জগৎ এবং তার গোপন, বিকৃত ইতিহাস; ‘সিরিয়াল এক্সপেরিমেন্টস লেন’ (Serial Experiments Lain)-এর ডিজিটাল ডেমিয়ার্জ এবং বাস্তবতার ভাঙন; অথবা ভিডিও গেম ‘জেনোগিয়ার্স’ (Xenogears)-এর ডেমিয়ার্জ-সদৃশ দেবতা ‘ডিউস’ – এই সবকিছুই প্রমাণ করে যে নস্টিসিজমের আগুন নিভে যায়নি। এটি কেবল তার ভাষা বদলেছে। প্রাচীন পুঁথির অক্ষর থেকে তা স্থানান্তরিত হয়েছে অ্যানিমেশনের সেল এবং মাঙ্গার প্যানেলে, যেখানে তা এক নতুন প্রজন্মের কাছে নির্বাসন, বিদ্রোহ এবং আত্ম-আবিষ্কারের সেই পুরোনো কিন্তু শাশ্বত গল্পটি বলে চলেছে।

মেটাল মিউজিক: অচেনা ঈশ্বরের স্তোত্র

যদি নস্টিসিজম হয় এক আধ্যাত্মিক বিদ্রোহ, তবে তার আধুনিক যুগের সঙ্গীত নিঃসন্দেহে মেটাল। এর কর্কশ, ভারী এবং প্রায়শই আক্রমণাত্মক সুর, এর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং জগৎ-বিদ্বেষী গানের কথা এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি আপোষহীন ঘৃণা – এই সবকিছুই নস্টিক বিশ্ববীক্ষার এক নিখুঁত শ্রুতিগত রূপায়ণ। বিশেষ করে মেটালের চরমপন্থী শাখাগুলোতে এই সাদৃশ্য এতটাই গভীর যে, মনে হয় যেন প্রাচীন নস্টিকদের আত্মা গিটার রিফ এবং ড্রামের ব্লাস্ট বিটের মাধ্যমে নতুন করে কথা বলছে। মেটাল নিছক সঙ্গীত নয়, এটি একটি কাউন্টার-কালচার, যা আধুনিক সভ্যতার ভোগবাদ, ভণ্ডামি এবং আধ্যাত্মিক শূন্যতার বিরুদ্ধে এক গর্জন। এই গর্জনই দুই হাজার বছর আগের সেই জ্ঞান-সন্ধানীদের আর্তি ও বিদ্রোহের সাথে এক সুরে বেজে ওঠে।

ব্ল্যাক মেটাল: ডেমিয়ার্জের বিরুদ্ধে শয়তানের বিদ্রোহ

ব্ল্যাক মেটাল (Black Metal) সম্ভবত নস্টিসিজমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে ভয়ংকর আধুনিক আত্মীয়। নরওয়ের হিমশীতল অরণ্য থেকে জন্ম নেওয়া এই ধারার মূল ভিত্তিই হলো প্রচলিত খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন, প্রায়শই হিংস্র বিদ্রোহ। তাদের কাছে এই ঈশ্বর এক স্বৈরাচারী স্রষ্টা, এক ডেমিয়ার্জ, যিনি প্রকৃতিকে দমন করেছেন এবং মানবাত্মাকে ভয় ও অপরাধবোধের শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছেন। ব্ল্যাক মেটালের ‘শয়তান’ (Satan) তাই প্রায়শই কোনো আক্ষরিক অশুভ সত্তা নয়, বরং সে হলো স্বাধীনতা, আত্ম-জ্ঞান, প্রকৃতি এবং নিষিদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক – এক লুসিফারিয়ান (Luciferian) আলোক-দূত, প্রমিথিউসের মতো এক বিদ্রোহী, যে মানুষকে স্রষ্টার অজ্ঞতার কারাগার থেকে মুক্ত করতে চায়।

  • ডিসেকশন (Dissection): সুইডেনের কিংবদন্তী মেলোডিক ব্ল্যাক মেটাল ব্যান্ড ডিসেকশন-এর সঙ্গীত ও দর্শন ছিল এর নেতা জন নোয়েটওয়েট (Jon Nödtveidt)-এর ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক যাত্রার প্রতিচ্ছবি। নোয়েটওয়েট ছিলেন ‘মিসানথ্রোপিক লুসিফারিয়ান অর্ডার’ (Misanthropic Luciferian Order), যা পরে ‘টেম্পল অফ দ্য ব্ল্যাক লাইট’ (Temple of the Black Light) নামে পরিচিত হয়, তার একজন সক্রিয় সদস্য। এই গুপ্ত দর্শনের মূল ভিত্তি হলো এক চরম নস্টিক দ্বৈতবাদ। তাদের মতে, এই সুশৃঙ্খল, কার্যকারণ-নিয়মে বাঁধা মহাবিশ্ব (কসমস – Cosmos) হলো এক কারাগার, যা এক স্থবির, সীমাবদ্ধ স্রষ্টা বা ডেমিয়ার্জের দ্বারা নির্মিত। আর এর বাইরের আদিম, বিশৃঙ্খল, সীমাহীন শূন্যতাই (Chaos) হলো আত্মার আসল উৎস ও মুক্তির স্থান।
    তাদের লক্ষ্য ছিল ‘Chaos-Gnosis’ বা বিশৃঙ্খলার জ্ঞান লাভ করা। এই ‘Chaos-Gnosis’ হলো সেই গুপ্ত জ্ঞান, যা আত্মাকে এই মহাজাগতিক কারাগারের ভ্রম ভেদ করতে এবং তার বিশৃঙ্খল, ঐশ্বরিক উৎসে ফিরে যেতে সাহায্য করে। ব্যান্ডের শেষ অ্যালবাম, ‘Reinkaos’ (Reincarnation of Chaos-এর সংক্ষিপ্ত রূপ), হলো এই দর্শনের এক সম্পূর্ণ সঙ্গীতময় প্রকাশ। এর প্রতিটি গান সেই গুপ্ত আদেশের বিভিন্ন স্তোত্র, যা আত্মার মুক্তির জন্য মহাজাগতিক কারাগার ধ্বংসের আহ্বান জানায় – যা নস্টিকদের প্লেরোমায় ফিরে যাওয়ার ধারণারই এক ভয়ংকর ও অন্ধকার সংস্করণ (Moynihan & Søderlind, 2003)।
  • সামায়েল (Samael): সুইজারল্যান্ডের এই অ্যাভান্ট-গার্ড মেটাল ব্যান্ডটি তাদের নামই নিয়েছে নস্টিক ও ইহুদি পুরাণের এক কেন্দ্রীয় এবং জটিল চরিত্রের কাছ থেকে। সামায়েল হলো নস্টিকদের ডেমিয়ার্জ বা অন্ধ ঈশ্বরের অন্যতম নাম। ব্যান্ডের সঙ্গীত সময়ের সাথে সাথে ব্ল্যাক মেটাল থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালইলেকট্রনিক মেটালে রূপান্তরিত হলেও, তাদের গানের কথায় মহাজাগতিক, দার্শনিক এবং প্রায়শই নস্টিক থিম বারবার ফিরে এসেছে। তাদের গানগুলো মানব অস্তিত্বকে এক মহাজাগতিক নাটকের অংশ হিসেবে দেখে, যেখানে মানুষ দেবতাদের তৈরি করা নিয়তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তাদের অ্যালবাম ‘Ceremony of Opposites’ বা ‘Passage’-এ আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, মহাজাগতিক ভ্রমণ এবং আত্মার রূপান্তরের মতো থিমগুলো অন্বেষণ করা হয়েছে, যা নস্টিক পুরাণের নাটকীয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়।
  • থারিয়ন (Therion): সুইডেনের এই সিমফোনিক মেটাল ব্যান্ডটি হলো গুপ্ত জ্ঞানের এক সঙ্গীতময় বিশ্বকোষ। ব্যান্ডের স্রষ্টা ক্রিস্টোফার জনসন (Christofer Johnsson) বিভিন্ন মরমী ধারা, বিশেষ করে ড্রাগন রুজ (Dragon Rouge) নামক এক গুপ্ত সংঘের সদস্য ছিলেন। তাদের গানে প্রাচীন মিশর, সুমের, ব্যাবিলন থেকে শুরু করে কাব্বালা, আলকেমি এবং নস্টিসিজমের ধারণাগুলো এক মহাকাব্যিক অর্কেস্ট্রার সাথে মিশে যায়। তাদের অ্যালবাম ‘Theli’, ‘Vovin’ এবং বিশেষ করে ‘Sirius B’‘Lemuria’-তে প্লেরোমা, সোফিয়া, ডেমিয়ার্জ এবং আত্মার নির্বাসনের মতো নস্টিক ধারণাগুলো সরাসরি বা রূপকভাবে উঠে এসেছে।

প্রোগ্রেসিভ ও ফিলোসফিক্যাল মেটাল: নোসিসের মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষণ

মেটালের কিছু ধারা সরাসরি ধর্ম-বিরোধিতার চেয়েও বেশি মনোযোগ দেয় মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক অন্বেষণে, যা নস্টিকদের আত্ম-জ্ঞানের ধারণার খুব কাছাকাছি। এই ব্যান্ডগুলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে না, বিদ্রোহ করে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে।

  • টুল (Tool): আমেরিকান প্রোগ্রেসিভ মেটাল ব্যান্ড টুল-এর গানগুলো হলো আধুনিক নোসিসের একেকটি জটিল সেশন। তাদের দীর্ঘ, বহুস্তরীয় এবং গণিত-নির্ভর সঙ্গীত এবং তাদের গূঢ়, প্রতীকী গানের কথা প্রায়শই কার্ল ইয়ুং (Carl Jung)-এর মনোবিজ্ঞান, আলকেমি, মরমীবাদ এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাদের গানগুলো শ্রোতাকে নিজের ছায়া বা ‘শ্যাডো’ (Shadow)-র মুখোমুখি হতে, নিজের ইগো বা অহংকে (যা এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ডেমিয়ার্জ) বিসর্জন দিতে এবং এক উচ্চতর, অখণ্ড চেতনার স্তরে পৌঁছাতে উৎসাহিত করে। তাদের অ্যালবাম ‘Ænima’ বা ‘10,000 Days’-এর মতো কাজগুলো এই অন্বেষণের একেকটি পর্যায়। তবে তাদের ম্যাগনাম ওপাস, ‘ল্যাটারালাস’ (Lateralus), হলো আত্মার এক সর্পিল আরোহণের যাত্রা। অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাকটি ফিবোনাচি ক্রমের (Fibonacci sequence) গাণিতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তৈরি, যা প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঐশ্বরিক শৃঙ্খলার প্রতীক। গানটি আমাদের শেখায় কীভাবে আমাদের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে “spiraling out” বা এক উচ্চতর চেতনার দিকে আরোহণ করা যায় – যা অজ্ঞতার কারাগার থেকে বেরিয়ে মহাজাগতিক চেতনার সাথে একাত্ম হওয়ার এক শক্তিশালী শ্রুতিগত মানচিত্র।
  • সেপটিকফ্লেশ (Septicflesh): গ্রিসের এই সিমফোনিক ডেথ মেটাল ব্যান্ডটি তাদের সঙ্গীতে প্রাচীন পুরাণআধুনিক বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়েছে। তারা গ্রিক, মিশরীয়, মেসোপটেমীয় পুরাণ থেকে শুরু করে নস্টিসিজম এবং আধুনিক কসমোলজির ধারণাগুলোকে এক ভয়ংকর সুন্দর এবং মহাকাব্যিক সাউন্ডস্কেপের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে। তাদের গানে প্রায়শই এমন সব চরিত্রের উল্লেখ থাকে, যারা দেবতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে (প্রমিথিউস) বা মহাজাগতিক সত্যের সন্ধান করে। তাদের অ্যালবাম ‘The Great Mass’ বা ‘Codex Omega’-তে নস্টিকদের সেই মহাজাগতিক সংঘাত, ভ্রান্ত স্রষ্টার ধারণা এবং মানব অস্তিত্বের ট্র্যাজেডির অনুভূতি জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাদের সঙ্গীত শুনলে মনে হয় যেন এক প্রাচীন নস্টিক পুঁথি কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের ভেতরে বসে এক বিশাল অর্কেস্ট্রার মাধ্যমে পাঠ করা হচ্ছে।

মেটাল সঙ্গীত তার চরমপন্থী রূপে কেবল বিনোদন নয়, এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলন। এটি শ্রোতাকে আধুনিক জীবনের আরামদায়ক ভ্রম থেকে বের করে এনে অস্তিত্বের কঠিন, অন্ধকার এবং প্রায়শই বেদনাদায়ক সত্যের মুখোমুখি করে। এটি ডেমিয়ার্জের তৈরি করা সুশৃঙ্খল, মিষ্টি সুরের জগতের বিরুদ্ধে এক বিশৃঙ্খল, কর্কশ আর্তনাদ। এই আর্তনাদই হলো আধুনিক যুগের নস্টিক বিদ্রোহের সবচেয়ে খাঁটি এবং শক্তিশালী প্রকাশ।

প্যানেল, পিক্সেল এবং রঙ: নস্টিসিজমের দৃশ্যগত পুনর্জন্ম

মেটালের পাশাপাশি কমিকস, ভিডিও গেম এবং চিত্রকলাতেও নস্টিসিজম এক শক্তিশালী চাক্ষুষ ভাষা খুঁজে পেয়েছে।

গ্রাফিক নভেল: যখন সুপারহিরোরা নোসিস খোঁজে

  • অ্যালান মুর (Alan Moore): আধুনিক গ্রাফিক নভেলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা অ্যালান মুর-এর প্রায় সমস্ত কাজেই গুপ্ত জ্ঞান এবং মরমীবাদের গভীর প্রভাব রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত সিরিজ প্রমিথিয়া’ (Promethea) হলো নস্টিসিজম এবং কাব্বালার এক সচিত্র পাঠ্যপুস্তক। সিরিজের নায়িকা সোফি ব্যাং এক সাধারণ কলেজ ছাত্রী থেকে ‘প্রমিথিয়া’ নামক এক জীবন্ত ধারণার অবতারে পরিণত হয় এবং এক দীর্ঘ আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রায় তাকে মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্তর (যা কাব্বালার সেফিরোথ এবং নস্টিকদের আর্কন-শাসিত গোলকের সমান্তরাল) অতিক্রম করে পরম বাস্তবতার সাথে মিলিত হতে হয়। এটি হলো নোসিস লাভের এক সম্পূর্ণ দৃশ্যগত বর্ণনা (Moore & Williams III, 1999)।
  • গ্র্যান্ট মরিসন (Grant Morrison): স্কটিশ কমিকস লেখক গ্র্যান্ট মরিসন-এর সাইকেডেলিক সিরিজ ‘দ্য ইনভিজিবল্স’ (The Invisibles) হলো নস্টিসিজমের এক উত্তরাধুনিক, নৈরাজ্যবাদী সংস্করণ। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে ‘দ্য ইনভিজিবল কলেজ’ নামক এক গুপ্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা ‘আর্কন অফ দি আউটার চার্চ’ নামক একদল ভিন-মাত্রিক, নিয়ন্ত্রণকারী সত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই আর্কনরা মিডিয়া, সরকার এবং ধর্মের মাধ্যমে মানবজাতিকে এক ভ্রমময় বাস্তবতায় বন্দী করে রেখেছে। এই কমিকসটি হলো আক্ষরিক অর্থেই আর্কনদের কারাগার থেকে মানব চেতনাকে মুক্ত করার এক যুদ্ধ।

ভিডিও গেম: যখন প্লেয়ার নিজেই ত্রাণকর্তা

  • ব্লাডবোর্ন (Bloodborne): ফ্রমসফটওয়্যার (FromSoftware)-এর এই কাল্ট ক্লাসিক গেমটি হলো কসমিক হরর এবং নস্টিক দর্শনের এক নিখুঁত মিশ্রণ। গেমের কেন্দ্রীয় মেকানিক হলো ‘ইনসাইট’ (Insight) বা অন্তর্দৃষ্টি। প্লেয়ার যত বেশি ইনসাইট অর্জন করে, সে এই জগতের ভয়ংকর, আসল রূপ তত বেশি দেখতে পায় – অদৃশ্য দানব, আকাশে ভিনগ্রহী সত্তা ইত্যাদি। এই ‘ইনসাইট’ হলো নোসিস। এটি জ্ঞান দেয়, কিন্তু সেই জ্ঞান মানুষকে উন্মাদনার দিকেও ঠেলে দেয়। গেমের ‘গ্রেট ওয়ান্স’ (Great Ones) হলো সেই অচেনা, দুর্বোধ্য পরম সত্তা, আর ‘হিলিং চার্চ’-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সেই ডেমিয়ার্জ-সদৃশ শক্তি, যারা মানুষকে মিথ্যা আশা দিয়ে এক ভয়ংকর সত্য থেকে আড়াল করে রাখে (FromSoftware, 2015)।

চিত্রকলা: এইচ. আর. গিগার ও বায়োমেকানিক্যাল কারাগার

সুইস পরাবাস্তব শিল্পী এইচ. আর. গিগার (H. R. Giger)-এর আঁকা দুঃস্বপ্নের মতো জগৎ নস্টিসিজমের এক ভয়ংকর চাক্ষুষ রূপ। তাঁর বিখ্যাত ‘বায়োমেকানিক্যাল’ (Biomechanical) শৈলী, যেখানে মাংস, হাড় এবং যন্ত্র এক ভয়ংকর, অবিচ্ছেদ্য সত্তায় মিশে যায়, তা নস্টিকদের সেই দেহ-কারাগারের ধারণাকে এক নতুন মাত্রা দেয়। তাঁর ছবিতে মানব শরীর প্রায়শই এক শীতল, যান্ত্রিক এবং ভিনগ্রহী প্রযুক্তির দ্বারা শৃঙ্খলিত, শোষিত বা গ্রাস হয়ে যায়। তাঁর জগৎ এক শীতল, আবেগহীন এবং প্রায়শই বিদ্বেষপরায়ণ শক্তির দ্বারা নির্মিত, যেখানে আত্মার কোনো স্থান নেই, আছে কেবল এক অন্তহীন যান্ত্রিক পুনর্জন্ম। গিগার যেন সেই শিল্পী, যিনি ডেমিয়ার্জের কারখানার ভেতরের ছবি এঁকেছেন – এক জগৎ যেখানে আত্মা এবং যন্ত্রের বিভেদ মুছে গেছে, এবং দুটোই এক মহাজাগতিক কারাগারে বন্দী।

এই সমস্ত উদাহরণ প্রমাণ করে, নস্টিসিজম কোনো মৃত দর্শন নয়। এটি এক জীবন্ত ভাইরাস বা মিম (Meme), যা সংস্কৃতির শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে এবং সেইসব শিল্পী ও স্রষ্টাদের সংক্রমিত করছে, যারা এই চেনা বাস্তবতার পর্দার আড়ালে উঁকি দেওয়ার সাহস দেখান।

নস্টিসিজমের সমালোচনা: পলায়নপরতা, অভিজাততন্ত্র ও মহাজাগতিক নৈরাশ্যবাদ

নস্টিসিজম বা জ্ঞানবাদকে সাধারণত ইতিহাসের এক পরাজিত ও নির্যাতিত ধারা হিসেবে দেখা হয়, যা চার্চের বা রাষ্ট্রশক্তির দমনের কারণে হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এই দর্শনের বিলুপ্তির পেছনে কেবল রাজনৈতিক নিপীড়নই একমাত্র কারণ ছিল না। নস্টিক মতবাদের ভেতরেই এমন কিছু তাত্ত্বিক স্ববিরোধিতা, নৈতিক সমস্যা এবং চরমপন্থী প্রবণতা ছিল, যা একে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার অনুপযুক্ত এবং মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকর করে তুলেছিল। প্রাচীনকালের যুক্তিবাদী দার্শনিক থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা নস্টিসিজমের তীব্র সমালোচনা করেছেন, এবং এই সমালোচনাগুলো কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে নয়, বরং মানবিক ও যৌক্তিক অবস্থান থেকে করা হয়েছে। নস্টিসিজমের মূল সমস্যা হলো এর চরম মহাজাগতিক নৈরাশ্যবাদ (Cosmic Pessimism) এবং জগৎ-বিমুখতা (World-Denial), যা মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে বাধা দেয় এবং এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিক পলায়নপরতার দিকে ঠেলে দেয়। এই অধ্যায়ে নস্টিসিজমের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক সমালোচনাগুলোকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হলো, যা প্রমাণ করে যে এই দর্শনটি কোনো ‘হারানো সত্য’ নয়, বরং অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ এক বিপজ্জনক ফ্যান্টাসি।

মহাজাগতিক অকৃতজ্ঞতা: প্লোটিনাসের দার্শনিক আক্রমণ

নস্টিসিজমের বিরুদ্ধে প্রাচীনকালে সবচেয়ে শক্তিশালী, যুক্তিনির্ভর এবং দার্শনিক সমালোচনাটি এসেছিল কোনো খ্রিস্টান ধর্মগুরুর কাছ থেকে নয়, বরং এসেছিল মহান নব্য-প্লেটোনিক দার্শনিক প্লোটিনাস (Plotinus)-এর কাছ থেকে। প্লোটিনাস তাঁর এনিয়েডস (Enneads) গ্রন্থের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে (Ennead II.9), যার শিরোনাম “Against the Gnostics” বা “যারা মনে করে জগৎ এবং এর স্রষ্টা মন্দ, তাদের বিরুদ্ধে”, নস্টিকদের বিশ্ববীক্ষাকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। প্লোটিনাসের দর্শনও মরমী ছিল, তিনিও বিশ্বাস করতেন যে আত্মা এক উচ্চতর জগত থেকে এসেছে, কিন্তু নস্টিকদের সাথে তাঁর পার্থক্য ছিল আকাশ-পাতাল। প্লোটিনাস মনে করতেন, এই দৃশ্যমান জগৎ হলো সেই উচ্চতর, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেরই এক সুন্দর এবং জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। নস্টিকরা যখন দাবি করে যে এই জগৎ এক ‘কারাগার’ এবং এর স্রষ্টা (যাকে তারা ডেমিয়ার্জ বলে) এক ‘অজ্ঞ’ সত্তা, তখন প্লোটিনাস একে কেবল ভুল নয়, বরং চরম ঔদ্ধত্য এবং অকৃতজ্ঞতা বলে অভিহিত করেন। প্লোটিনাসের মতে, নক্ষত্রখচিত এই বিশাল মহাকাশ, সুশৃঙ্খল গ্রহের গতিপথ এবং প্রকৃতির নিয়ম – সবই এক উচ্চতর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ। নস্টিকরা নিজেদেরকে নক্ষত্র বা দেবতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে করে, যা এক ধরনের নার্সিসিজম বা আত্মপূজা। প্লোটিনাস যুক্তি দেন যে, যদি পরম সত্তা বা দ্য ওয়ান (The One) সত্যিই ভালো হয়, তবে তার থেকে উদ্ভূত জগৎ কখনো পুরোপুরি খারাপ হতে পারে না; নস্টিকরা জগতকে ঘৃণা করে মূলত তাদের নিজেদের অক্ষমতা এবং বিদ্বেষ থেকে। তারা মহাবিশ্বের বিশালতাকে বুঝতে ব্যর্থ হয়ে তাকে ‘মন্দ’ বলে দাগিয়ে দেয় এবং নিজেদের এক কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসায়।

আধ্যাত্মিক বর্ণবাদ: নস্টিক অভিজাততন্ত্রের বিপদ

নস্টিসিজমের সমাজতাত্ত্বিক ও নৈতিক সমালোচনার একটি বড় জায়গা হলো এর অন্তর্নিহিত অভিজাততন্ত্র (Elitism)। নস্টিকরা মানবজাতিকে তিনটি কঠোর শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল: হাইলিক (Hylic) বা জড়বাদী, সাইকিক (Psychic) বা মানসিক, এবং নিউম্যাটিক (Pneumatic) বা আধ্যাত্মিক। তাদের মতে, হাইলিকরা হলো মাটির মানুষ, তাদের কোনো আত্মা নেই এবং তারা ধ্বংস হয়ে যাবে; সাইকিকরা সাধারণ বিশ্বাসী যারা কোনোমতে টিকতে পারে; আর একমাত্র নিউম্যাটিকরাই হলো ‘নির্বাচিত’ (Elect), যাদের ভেতরে ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ আছে এবং যারা নিশ্চিতভাবে মুক্তি পাবে। এই বিভাজনটি আধুনিক দৃষ্টিতে এক ধরনের আধ্যাত্মিক বর্ণবাদ (Spiritual Racism) বা অ্যাপারথাইড (Apartheid)। এখানে একজন মানুষের মুক্তি তার কর্ম, নৈতিকতা বা চেষ্টার ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে তার ‘জন্মগত’ প্রকৃতির ওপর – সে কি আলোকের কণা নিয়ে জন্মেছে নাকি কেবল মাটি দিয়ে তৈরি। এই দর্শন মানবজাতির বৃহদাংশকে (হাইলিকদের) কোনো সুযোগ না দিয়েই নরকের দিকে ঠেলে দেয় এবং গুটিকয়েক মানুষকে এক মিথ্যা শ্রেষ্ঠত্ববোধে ভাসিয়ে রাখে। এই ধরনের মতবাদ সমাজে সহমর্মিতা বা সাম্যের ধারণা তৈরি করে না, বরং এক ধরনের গুপ্ত সংঘের জন্ম দেয় যারা বাকি সমাজকে অবজ্ঞা ও ঘৃণার চোখে দেখে। চার্চ ফাদার আইরেনিয়াস (Irenaeus) তাঁর এগেইনস্ট হেরিসিস (Against Heresies) গ্রন্থে অভিযোগ করেছিলেন যে নস্টিকরা নিজেদের ‘পারফেক্ট’ মনে করত এবং সাধারণ খ্রিস্টানদের নির্বোধ ভাবত, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও অহংকারের জন্ম দিয়েছিল।

পলায়নপরতা ও নৈতিক দায়িত্বহীনতা: বস্তুবাদী সমালোচনা

বস্তুবাদী এবং সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নস্টিসিজমের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো এর চরম পলায়নপরতা (Escapism)কার্ল মার্ক্স ধর্মকে “নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস” বলেছিলেন, কিন্তু নস্টিসিজম হলো সেই দীর্ঘশ্বাসেরও এক চরম ও প্যাথলজিক্যাল রূপ। নস্টিকরা যখন বলে যে এই জগতটি একটি ‘ভুল’ বা ‘কারাগার’, তখন তারা আসলে এই জগতের সমস্যাগুলোকে সমাধান করার দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেয়। যদি পৃথিবীটা গোড়াতেই পচা হয়, যদি সমাজ, রাষ্ট্র এবং প্রকৃতি সবই এক মন্দ দেবতার সৃষ্টি হয়, তবে তা সংস্কার করার, দারিদ্র্য দূর করার বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে পার্থিব লড়াই করার কোনো অর্থই থাকে না। নস্টিসিজম মানুষকে শেখায় বাস্তব জগতকে ঘৃণা করতে এবং একটি কাল্পনিক ‘আসল জগত’ বা প্লেরোমা (Pleroma)-র স্বপ্ন দেখতে। এই মনোভাব রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বা অ্যাপাথি (Apathy)-র জন্ম দেয়। সমাজ যখন শোষণে জর্জরিত, নস্টিক তখন বলে, “এটা তো ডেমিয়ার্জের জগৎ, এমনটাই হওয়ার কথা।” এই দর্শন শোষক শ্রেণীর জন্য সুবিধাজনক, কারণ এটি শোষিত মানুষকে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের বদলে এক ব্যক্তিগত, আধ্যাত্মিক পলায়নের পথ দেখায়। এছাড়া, শরীর ও প্রকৃতির প্রতি নস্টিকদের ঘৃণা এক ধরনের পরিবেশ-বিদ্বেষী (Anti-environmental) মনোভাবেরও জন্ম দেয়। তারা প্রকৃতিকে রক্ষা করার বদলে একে ধ্বংস হওয়া বা ত্যাগ করা উচিত বলে মনে করে, কারণ তাদের মতে প্রকৃতি হলো আত্মাকে আটকানোর ফাঁদ।

আধুনিক রাজনৈতিক নস্টিসিজম: এরিক ভোগেলিনের তত্ত্ব

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দার্শনিক এরিক ভোগেলিন (Eric Voegelin) নস্টিসিজমকে কেবল প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব হিসেবে দেখেননি, বরং তিনি আধুনিক যুগের সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক মতবাদগুলোর (যেমন ফ্যাসিজমকমিউনিজম) মূলে নস্টিক চিন্তার কাঠামো শনাক্ত করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য নিউ সায়েন্স অফ পলিটিক্স (The New Science of Politics)-এ ভোগেলিন যুক্তি দেন যে, আধুনিক রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো প্রাচীন নস্টিসিজমেরই এক সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্করণ। প্রাচীন নস্টিকরা বিশ্বাস করত যে এই জগতটি ত্রুটিপূর্ণ এবং বিশেষ জ্ঞানের (নোসিস) মাধ্যমে তারা এই জগত থেকে পালিয়ে যাবে। ভোগেলিনের মতে, আধুনিক নস্টিকরা (যেমন মার্ক্সবাদী বা নাৎসিরা) বিশ্বাস করে যে এই জগতটি ত্রুটিপূর্ণ (শোষণ বা জাতিগত অবিশুদ্ধতার কারণে), কিন্তু তারা পরকালে পালানোর বদলে এই জগতেই এক নিখুঁত স্বর্গ বা ইউটোপিয়া তৈরি করতে চায়। ভোগেলিন এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন “Immanentization of the Eschaton” বা “পরলৌকিক অন্তিম লক্ষ্যকে এই পার্থিব জগতেই নামিয়ে আনা”। এই আধুনিক নস্টিকরা মনে করে, তাদের কাছে ইতিহাসের এক বিশেষ ‘গুপ্ত জ্ঞান’ (যেমন – ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা জাতিগত বিশুদ্ধতার তত্ত্ব) আছে, যা দিয়ে তারা সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়তে পারে। এই প্রচেষ্টাই জন্ম দেয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আর গুলাগের, কারণ নস্টিকরা মনে করে, এক নিখুঁত জগত তৈরির জন্য বর্তমানের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ মানুষ বা শ্রেণীকে ধ্বংস করাটা নৈতিকভাবে সঠিক। ভোগেলিনের এই সমালোচনা দেখায় যে, নস্টিসিজমের ‘জ্ঞান’ এবং ‘নির্বাচিত হওয়ার’ ধারণাটি যখন রাজনীতির ময়দানে আসে, তখন তা কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

শরীর ও যৌনতা: অবদমন ও অনাচারের দ্বান্দ্বিকতা

নস্টিসিজম শরীরকে আত্মার কারাগার বা শত্রু মনে করে, এবং এই দেহ-বিদ্বেষী মনোভাব নস্টিকদের নৈতিক জীবনে দুটি চরম বিপরীতমুখী ও অসুস্থ প্রবণতার জন্ম দিয়েছিল। প্রথমটি হলো চরম কৃচ্ছ্রসাধন বা অ্যাসেটিসিজম (Extreme Asceticism)। অনেক নস্টিক গোষ্ঠী (যেমন – এনক্রাটাইটরা) বিশ্বাস করত যে শরীরকে দুর্বল ও কষ্ট দিলে আত্মা শক্তিশালী হবে। তারা বিবাহ, যৌনতা, এমনকি সুস্বাদু খাবারও বর্জন করত। এই ধরনের জীবনযাপন মানুষকে শারীরিকভাবে অসুস্থ ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তোলে এবং জীবনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও আনন্দকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় প্রবণতাটি ছিল ঠিক এর উল্টো – লিবারটিনিজম (Libertinism) বা অবাধ যৌনাচারকার্পোক্রেটিয়ানদের মতো কিছু গোষ্ঠী যুক্তি দিত যে, যেহেতু শরীরটা জড় পদার্থ এবং আত্মা শরীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তাই শরীর দিয়ে যা খুশি তাই করা যায়; পাপ শরীরকে স্পর্শ করতে পারে না। তারা মনে করত, মুক্তির জন্য সব ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তাই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সামাজিক ও নৈতিক নিয়ম ভাঙত। এই দুটি পথই – চরম অবদমন এবং চরম অনাচার – সুস্থ, স্বাভাবিক মানবজীবনের পরিপন্থী। নস্টিসিজম মানুষের জৈবিক সত্তাকে সম্মান করতে ব্যর্থ হয় এবং শরীর ও মনের মধ্যে এক কৃত্রিম বিভাজন বা সিজোফ্রেনিক (Schizophrenic) ফাটল তৈরি করে, যা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

কল্পকাহিনির আশ্রয়: দার্শনিক আত্মহত্যা

আলবেয়ার কাম্যু নস্টিসিজমকে এক ধরনের দার্শনিক আত্মহত্যা (Philosophical Suicide) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অস্তিত্ববাদী দর্শনের দৃষ্টিতে, নস্টিসিজম হলো সত্যের মুখোমুখি হওয়ার অক্ষমতা। মহাবিশ্ব যে অর্থহীন, বিশৃঙ্খল এবং মানুষের যুক্তির বাইরে – এই কঠিন সত্য বা অ্যাবসার্ড (Absurd)-কে মেনে নেওয়ার সাহস নস্টিকদের ছিল না। তাই তারা এই অর্থহীনতাকে ঢাকার জন্য এক বিশাল, জটিল ও কাল্পনিক মিথোলজি তৈরি করেছিল। তারা ডেমিয়ার্জ, আর্কন, সোফিয়া, ইয়ন এবং প্লেরোমার এক রূপকথার জগত বানিয়েছিল, যাতে তারা নিজেদের বোঝাতে পারে যে তাদের জীবনের একটা ‘লুকানো’ অর্থ বা উদ্দেশ্য আছে। এটি আসলে এক ধরনের সান্ত্বনাদায়ক মিথ্যা বা ফিকশন (Fiction)। নস্টিকরা বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেনি, বরং বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এক সমান্তরাল ফ্যান্টাসি জগতে আশ্রয় নিয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের কষ্টিপাথরে এই মিথোলজির কোনো ভিত্তি নেই। এটি প্রমাণ করে যে, নস্টিসিজম কোনো সত্যের সন্ধান নয়, বরং এটি হলো মানুষের ভীতি, অসহায়ত্ব এবং কল্পনাপ্রবণ মনের এক সৃজনশীল কিন্তু বিভ্রান্তিকর প্রতিক্রিয়া।

এক ব্যর্থ বিদ্রোহ

পরিশেষে, নস্টিসিজমের সমালোচনা করতে গেলে বলতে হয় যে এটি একটি ব্যর্থ বিদ্রোহের দর্শন। এটি জগতের অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল ঠিকই, কিন্তু এর কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান দিতে পারেনি। এটি মানুষকে শিখিয়েছে নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে এবং এক কাল্পনিক পরিত্রাণের আশায় অপেক্ষা করতে। এটি এমন এক দর্শন যা ‘আমি’ বা অহংকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করে (যেহেতু আমিই সেই নির্বাচিত স্ফুলিঙ্গ) এবং বাকি জগতকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। এই ধরনের বিশ্ববীক্ষা ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সমষ্টিগত সামাজিক অগ্রগতির জন্যও বিপজ্জনক। নস্টিসিজমের আকর্ষণ তার রহস্যময়তা ও বিদ্রোহের মধ্যে থাকলেও, এর গভীরে লুকিয়ে আছে এক গভীর শূন্যতা এবং জীবনের প্রতি এক চূড়ান্ত নেতিবাচকতা। ইতিহাস হয়তো নস্টিকদের হারিয়ে দিয়েছে, কিন্তু যুক্তিবাদী বিচারেও তাদের দর্শন এক মৃত গলিপথ ছাড়া আর কিছু নয়।

ধাঁধার কারিগর: যারা হারানো জগতের মানচিত্র এঁকেছেন

একটা হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাকে আমরা কীভাবে খুঁজে পাই? প্রত্নতাত্ত্বিকরা মাটি খুঁড়ে তার ভাঙা পাত্র, পুরোনো মুদ্রা বা ধসে পড়া দেওয়াল খুঁজে বের করেন। কিন্তু একটা হারিয়ে যাওয়া চিন্তার জগৎকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায়? এর জন্য প্রয়োজন ভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক – চিন্তার প্রত্নতাত্ত্বিক। এরা হলেন সেই সব গবেষক, পণ্ডিত ও দার্শনিক, যারা ইতিহাসের ধুলোমাখা পুঁথি, খণ্ডিত পান্ডুলিপি আর শত্রুদের বিদ্বেষপূর্ণ বিবরণের মধ্য থেকে এক বিলুপ্ত বিশ্ববীক্ষার কাঠামোকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন।

নস্টিসিজম (Gnosticism) ছিল এমনই এক হারিয়ে যাওয়া জগৎ। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে এটি ছিল এক ভৌতিক দর্শনের মতো, যার সম্পর্কে প্রায় সমস্ত জ্ঞানই ছিল পরোক্ষ এবং শত্রুভাবাপন্ন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে, বিশেষ করে ১৯৪৫ সালে নাগ হাম্মাদির (Nag Hammadi) আবিষ্কারের পর, এই চিত্রটা আমূল পাল্টে যায়। এই আবিষ্কার এবং তার পরবর্তী গবেষণা নস্টিসিজমকে ইতিহাসের এক অন্ধকার কোণ থেকে তুলে এনে পশ্চিমা চিন্তার জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে।

এই পুনর্জন্মের পেছনে রয়েছেন কিছু অসাধারণ তাত্ত্বিক, যারা কেবল তথ্য সংগ্রহ করেননি, বরং সেই তথ্যের গভীরে প্রবেশ করে নস্টিসিজমের দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। চলুন, সেই ধাঁধার কারিগরদের কয়েকজনের সাথে পরিচিত হওয়া যাক, যারা আমাদের জন্য এই হারানো জগতের মানচিত্র এঁকে দিয়েছেন।

হ্যান্স ইয়োনাস (Hans Jonas): অস্তিত্ববাদী নস্টিক

যদি আধুনিক নস্টিসিজম গবেষণার কোনো একক প্রতিষ্ঠাতার নাম করতে হয়, যিনি এই বিষয়টিকে ইতিহাসের এক অন্ধকার কোণ থেকে তুলে এনে আধুনিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছেন, তবে তিনি হলেন হ্যান্স ইয়োনাস (১৯০৩-১৯৯৯)। ইয়োনাস ছিলেন একজন জার্মান-ইহুদি দার্শনিক, যিনি তাঁর প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই মন – মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger) এবং রুডলফ বুল্টমান (Rudolf Bultmann) – এর অধীনে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেছিলেন। নাৎসিদের উত্থানের পর তিনি জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করেন এবং অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন, যেখানে তিনি নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এ দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শেষ করেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন – নির্বাসন, যুদ্ধ এবং হলোকাস্টের অভিজ্ঞতা – তাঁর দার্শনিক চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

ইয়োনাসের আগে, প্রায় ১৯০০ বছর ধরে নস্টিসিজমকে মূলত খ্রিস্টধর্মের একটি ‘হেরিসি’ বা ভ্রান্ত শাখা হিসেবেই দেখা হতো। অ্যাডলফ ফন হার্নাকের (Adolf von Harnack) মতো প্রভাবশালী গবেষকরা নস্টিসিজমকে ‘খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের এক তীব্র হেলেনীয়করণ’ (acute Hellenization of Christianity) হিসেবে দেখতেন। অর্থাৎ, এটি ছিল গ্রিক দর্শনের দ্বারা কলুষিত খ্রিস্টধর্মের এক বিকৃত রূপ। ইয়োনাসই প্রথম এই ধারণাকে আমূল এবং সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘দ্য নস্টিক রিলিজিয়ন: দ্য মেসেজ অফ দি এলিয়েন গড অ্যান্ড দ্য বিগিনিংস অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি’ (The Gnostic Religion: The Message of the Alien God and the Beginnings of Christianity, 1958)-এ তিনি যুক্তি দেন যে, নস্টিসিজম নিছক কোনো খ্রিস্টীয় বিচ্যুতি নয়, বরং এটি হেলেনিস্টিক যুগের এক স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ধর্মীয়-দার্শনিক আন্দোলন, যার নিজস্ব গভীরতা ও তাৎপর্য রয়েছে। এটি ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তার এক জটিল মিশ্রণ, যা সেই যুগের আধ্যাত্মিক সংকটের এক মৌলিক প্রতিক্রিয়া ছিল।

অস্তিত্ববাদের চশমায় প্রাচীন পুরাণ

ইয়োনাসের সবচেয়ে বড় এবং যুগান্তকারী অবদান হলো, তিনি নস্টিসিজমকে বিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদী দর্শনের (Existentialism) চশমা দিয়ে পাঠ করেছেন। হাইডেগারের ছাত্র হিসেবে তিনি মানব অস্তিত্বের কিছু মৌলিক অনুভূতি বা ‘অস্তিত্বের অবস্থা’ (Existentials) – যেমন ‘নিক্ষেপ’ (Thrownness বা Geworfenheit), অর্থাৎ এই জগতে আমাদের কোনো কারণ বা উদ্দেশ্য ছাড়াই অর্থহীনভাবে নিক্ষিপ্ত হওয়া; বিচ্ছিন্নতা (Alienation); এবং উদ্বেগ (Anxiety বা Angst) – এগুলোর সাথে গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন। ইয়োনাস যখন প্রাচীন নস্টিক পুঁথিগুলো পড়লেন, তখন তিনি চমকে গিয়ে দেখলেন, এই আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ অনুভূতিগুলোর সাথে প্রাচীন নস্টিকদের বিশ্ববীক্ষার এক আশ্চর্য ও গভীর মিল রয়েছে।

  • মহাজাগতিক নির্বাসন ও নিক্ষেপ: ইয়োনাসের মতে, নস্টিকদের পুরাণ হলো মানব আত্মার এই মহাজাগতিক নির্বাসনবোধেরই এক পৌরাণিক প্রকাশ। আত্মা এই জগতে ‘নিক্ষিপ্ত’, সে এই জগতের অংশ নয়। জগৎ তার কাছে এক অচেনা, শত্রুভাবাপন্ন স্থান, এক কারাগার। তার কোনো স্মৃতি নেই, সে জানে না সে কোথা থেকে এসেছে বা কেন এখানে আছে। এই অনুভূতিই হলো হাইডেগারের ‘Geworfenheit’-এর এক মহাজাগতিক সংস্করণ। আধুনিক অস্তিত্ববাদীরা যেখানে এই অবস্থাকে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা হিসেবে দেখেন, নস্টিকরা তাকে এক আক্ষরিক, মহাজাগতিক বাস্তবতা হিসেবে দেখেছিল।
  • জ্ঞান যখন মুক্তি: নস্টিকদের ‘নোসিস’ (Gnosis) বা জ্ঞানকে ইয়োনাস ব্যাখ্যা করেছেন এক অস্তিত্ববাদী জাগরণ হিসেবে। এই জ্ঞান কোনো তত্ত্বের সমষ্টি নয়, যা বই পড়ে শেখা যায়। এটি হলো নিজের আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে এক বিষ্ময়কর, বিদ্যুতের ঝলকানির মতো উপলব্ধি – যে আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, এবং আমি কোথায় বন্দী হয়ে আছি। এই জ্ঞানই মানুষকে তার অর্থহীন, নিয়ন্ত্রিত অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে এবং নিজের মুক্তির পথ তৈরি করতে সাহায্য করে। ‘নোসিস’ মানুষকে তার বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করে তার আসল, ঐশ্বরিক উৎসের সাথে পুনরায় যুক্ত করে।
  • দ্বৈতবাদ যখন স্বাধীনতার প্রকাশ: ইয়োনাস দেখান যে, নস্টিকদের চরম দ্বৈতবাদ – অর্থাৎ, পরম ঈশ্বর এবং এই জগতের স্রষ্টার মধ্যে যে আপোষহীন বিভাজন – তা আসলে মানুষের স্বাধীনতার এক র‍্যাডিকাল ঘোষণারই প্রকাশ। জগৎ এবং তার স্রষ্টাকে ‘অন্য’ (the other) এবং ‘মন্দ’ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে নস্টিক মানুষ নিজেকে এই জগতের সমস্ত নিয়মকানুন, নিয়তি এবং বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত ঘোষণা করে। সে বলে, “এই জগৎ আমার নয়, এর আইন আমার উপর চলে না, কারণ আমি এক ভিন্ন, উচ্চতর জগৎ থেকে এসেছি।”

আধুনিক নিইলিজম ও নস্টিসিজমের ভূত

ইয়োনাস তাঁর বিশ্লেষণকে কেবল প্রাচীন জগতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি যুক্তি দেন যে, নস্টিসিজম হলো পশ্চিমা চিন্তাধারার এক গুপ্ত কিন্তু পুনরাবৃত্তিমূলক স্রোত। তিনি দেখান যে, আধুনিক যুগের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ যখন ঈশ্বরকে মহাবিশ্ব থেকে নির্বাসিত করেছে, তখন যে শূন্যতা, অর্থহীনতা এবং নিইলিজমের (Nihilism) জন্ম হয়েছে, তার সাথে নস্টিকদের জগৎ-বিদ্বেষের এক গভীর কাঠামোগত মিল রয়েছে।

প্রাচীন নস্টিকরা এক মন্দ বা অজ্ঞ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আর আধুনিক নিইলিস্ট মানুষ এক শূন্য, ঈশ্বরহীন, উদাসীন মহাবিশ্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। উভয় ক্ষেত্রেই মানুষ নিজেকে এই মহাবিশ্বে এক নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন এবং বহিরাগত সত্তা হিসেবে আবিষ্কার করে। ইয়োনাসের মতে, সতেরো শতকের বিজ্ঞান (যা জগৎকে এক প্রাণহীন যন্ত্র হিসেবে দেখেছে), প্যাস্কেলের ঈশ্বরহীন মহাবিশ্বের ভয়, এবং সবশেষে নিৎশের ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’ ঘোষণা – এই সবকিছুই হলো সেই পুরোনো নস্টিক দ্বৈতবাদের এক নতুন, ধর্মনিরপেক্ষ প্রকাশ।

ইয়োনাসের এই গভীর ও উস্কানিমূলক ব্যাখ্যা নস্টিসিজমকে কেবল ইতিহাসবিদ বা ধর্মতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় থেকে তুলে এনে দার্শনিকদের আলোচনার টেবিলে স্থাপন করেছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, নস্টিসিজম কোনো অদ্ভুত, সেকেলে ধারণা নয়, বরং এটি মানব অস্তিত্বের এক শাশ্বত ও অন্ধকার সম্ভাবনাকে – এই মহাবিশ্বে চরমভাবে একা এবং বিচ্ছিন্ন বোধ করার সম্ভাবনাকে – প্রকাশ করে। তাঁর কাজের ফলেই নস্টিসিজম আজ আর কেবল ইতিহাসের ফুটনোট নয়, বরং মানব চিন্তার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত।

গার্শম শোলেম (Gershom Scholem): কাব্বালার ভেতরের নস্টিক

গার্শম শোলেম (১৮৯৭-১৯৮২) ছিলেন ইহুদি মরমীবাদ বা কাব্বালার (Kabbalah) গবেষণার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর বন্ধু হ্যান্স ইয়োনাসের মতো সরাসরি নস্টিসিজম নিয়ে গবেষণা করেননি, তাঁর আজীবনের প্রেম ছিল কাব্বালা। কিন্তু কাব্বালার গভীর ও রহস্যময় জগতে ডুব দিয়ে তিনি এমন কিছু মুক্তোর সন্ধান পান, যার ঔজ্জ্বল্যে প্রাচীন নস্টিক চিন্তার ছায়া প্রতিফলিত হচ্ছিল। শোলেম দেখিয়েছেন, নস্টিসিজমের ভূত কেবল খ্রিস্টধর্মের করিডোরেই ঘুরে বেড়ায়নি, তা ইহুদি ধর্মের একেবারে অন্দরমহলেও প্রবেশ করেছিল।

শোলেম ছিলেন একজন জার্মান-ইহুদি বুদ্ধিজীবী, যিনি জায়নবাদের (Zionism) আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জার্মানি থেকে ফিলিস্তিনে চলে যান এবং হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুজালেমে ইহুদি মরমীবাদের প্রথম অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। শোলেমের আগে, উনিশ শতকের যুক্তিবাদী ইহুদি ঐতিহাসিকরা (Wissenschaft des Judentums) কাব্বালাকে মূলত এক অযৌক্তিক, জাদুবিদ্যা-সম্পর্কিত এবং বিব্রতকর অধ্যায় হিসেবে দেখতেন, যা ইহুদি ধর্মের মূল স্রোত থেকে বিচ্যুত। শোলেমই প্রথম এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে দেখান যে, কাব্বালা হলো এক গভীর, জটিল এবং সৃজনশীল ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ব্যবস্থা। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মেজর ট্রেন্ডস ইন জিউইশ মিস্টিসিজম’ (Major Trends in Jewish Mysticism, 1941)-এ তিনি যুক্তি দেন যে, ইহুদি ধর্মের যৌক্তিক, আইন-ভিত্তিক (Halakhic) ধারার পাশাপাশি সর্বদা একটি মরমী, পৌরাণিক এবং প্রায়শই বিদ্রোহী ধারাও (যা তিনি ‘অ্যান্টিনোমিয়ান’ প্রবণতা বলতেন) বিদ্যমান ছিল, এবং কাব্বালাই হলো সেই ধারার সর্বোচ্চ প্রকাশ।

কাব্বালায় নস্টিক উপাদান: এক গুপ্ত উত্তরাধিকার

শোলেম তাঁর গবেষণার মাধ্যমে দেখান যে, প্রাচীন ইহুদি নস্টিসিজমের (যা খ্রিস্টীয় নস্টিসিজমের সমসাময়িক ছিল এবং যার অস্তিত্ব ডেড সি স্ক্রোলস-এর মতো আবিষ্কারের মাধ্যমে আরও স্পষ্ট হয়েছে) অনেক উপাদানই মধ্যযুগীয় কাব্বালার মধ্যে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সাদৃশ্য সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ষোড়শ শতকের আইজ্যাক লুরিয়ার (Isaac Luria) কাব্বালায়

  • মহাজাগতিক বিপর্যয়: শোলেমের মতে, লুরিয়ার সেই নাটকীয় সৃষ্টিতত্ত্ব – অর্থাৎ, ঈশ্বরের নিজেকে সংকুচিত করা (Tzimtzum), ঐশ্বরিক আলো ধারণকারী ‘পাত্রগুলো ভেঙে যাওয়া’ (Shevirat ha-Kelim) এবং ‘আলোর কণাগুলোর নির্বাসন’ – এই পুরো আখ্যানটি নস্টিকদের সোফিয়ার পতন এবং তার ফলে ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের এই জড় জগতে বন্দী হওয়ার পুরাণেরই এক ইহুদি সংস্করণ। উভয় ক্ষেত্রেই, সৃষ্টি কোনো মসৃণ, পরিকল্পিত প্রক্রিয়া নয়, বরং এর সূচনাতেই রয়েছে এক বিপর্যয়, এক সংকট, এক ‘ভুল’।
  • নির্বাসিত ঈশ্বর: নস্টিক পুরাণে যেমন সোফিয়া এবং তার আলোর কণাগুলো প্লেরোমা থেকে নির্বাসিত, ঠিক তেমনি লুরিয়ানিক কাব্বালায় ঈশ্বরেরই একটি অংশ, তাঁর নারী-রূপী উপস্থিতি বা শেখিনা (Shekhinah), তাঁর সৃষ্টির সাথেই নির্বাসিত (in exile)। জগৎটা কেবল মানুষের নির্বাসনের স্থান নয়, এটি ঈশ্বরেরও নির্বাসনের স্থান।
  • দ্বৈতবাদী প্রবণতা: যদিও ইহুদি ধর্ম কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী, শোলেম দেখান যে কাব্বালার গভীরে এক ধরনের দ্বৈতবাদী প্রবণতা কাজ করে। অসীম, অচিন্তনীয় ঈশ্বর ‘এইন সফ’ (Ein Sof) এবং তাঁর প্রকাশিত দশটি গুণ বা ‘সেফিরোট’ (Sefirot)-এর মধ্যে যে পার্থক্য, তা নস্টিকদের পরম পিতা এবং তাঁর থেকে উদ্ভূত এইয়নদের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার, পবিত্র সেফিরোট জগতের বিপরীতে ‘সিত্রা আখরা’ (Sitra Achra – The Other Side) বা অশুভ শক্তির যে জগৎ (Qliphoth) কল্পনা করা হয়, তা নস্টিকদের ডেমিয়ার্জ ও আর্কনদের জগতের সাথে তুলনীয়।

নির্বাসনের পুরাণ: ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি

তাহলে ইহুদি মরমীবাদের গভীরে এই নস্টিক-সদৃশ, ট্র্যাজিক এবং দ্বৈতবাদী পুরাণ নতুন করে জেগে উঠল কেন? শোলেম এর এক গভীর ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, স্পেনে ইহুদিদের উপর নেমে আসা বিপর্যয় – অর্থাৎ, ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে তাদের বহিষ্কার – তাদের যৌথ-চেতনায় এক গভীর নির্বাসনবোধের (Galut) জন্ম দিয়েছিল। তাদের কাছে মনে হয়েছিল, এই নির্বাসন কেবল এক রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গভীর, মহাজাগতিক তাৎপর্য রয়েছে।

লুরিয়ার এই বিপর্যয়কর সৃষ্টিতত্ত্ব ছিল সেই ঐতিহাসিক আঘাতেরই এক আধ্যাত্মিক প্রতিচ্ছবি। এটি ছিল নির্বাসিত এক জাতির জন্য এক নির্বাসিত ঈশ্বরের উপাখ্যান। এটি তাদের শিখিয়েছিল যে, সমগ্র মহাবিশ্বই এক ভাঙা ও নির্বাসিত অবস্থায় আছে, এবং তাদের নিজেদের কষ্ট সেই মহাজাগতিক ভাঙনেরই একটি অংশ। কিন্তু এটি তাদের এক আশাও জুগিয়েছিল: মানুষের কাজের (তিক্কুন ওলাম) মাধ্যমেই এই মহাজাগতিক নির্বাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব।

ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা: এক অমীমাংসিত প্রশ্ন

যদিও শোলেম নস্টিসিজম ও কাব্বালার মধ্যে কোনো সরাসরি ঐতিহাসিক যোগসূত্র (missing link) নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই সাদৃশ্যগুলো আকস্মিক নয়। তিনি মনে করতেন, প্রাচীন নস্টিক ধারণাগুলো ইহুদি মরমীবাদের গভীরে সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং মধ্যযুগের ঐতিহাসিক সংকটের মুহূর্তে সেগুলো নতুন করে জেগে উঠেছিল এবং এক নতুন, ইহুদি রূপ ধারণ করেছিল (Scholem, 1965)।

শোলেমের গবেষণা প্রমাণ করে যে, নস্টিসিজমের প্রভাব কেবল খ্রিস্টধর্মের ‘হেরিটিক্যাল’ শাখাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ইহুদি ধর্মের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতেও প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি দেখিয়েছেন যে, কোনো ধর্মই একাট্টা বা মনোলিথিক নয়; তার ভেতরে সর্বদা নানা ধরনের স্রোত, এমনকি বিপরীত স্রোতও, বহমান থাকে। নস্টিসিজম ছিল সেই গুপ্ত স্রোত, যা ইহুদি মরমীবাদের শান্ত জলের নিচে এক শক্তিশালী আলোড়ন তুলেছিল।

এলেইন পেগেলস (Elaine Pagels): এক নারীবাদী ও রাজনৈতিক পাঠ

নাগ হাম্মাদির আবিষ্কার যদি হয় নস্টিসিজম গবেষণার প্রত্নতাত্ত্বিক বিপ্লব, তবে সেই বিপ্লবকে অ্যাকাডেমিক জগত থেকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবটি ঘটিয়েছিলেন আমেরিকান ইতিহাসবিদ এলেইন পেগেলস (জন্ম ১৯৪৩)। পেগেলস ছিলেন সেই প্রথম গবেষকদের একজন, যারা নাগ হাম্মাদির জটিল পুঁথিগুলোকে নিছক কোনো ধর্মতাত্ত্বিক কচকচানি হিসেবে না দেখে, সেগুলোকে জীবন্ত মানুষের লেখা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের দলিল হিসেবে পাঠ করেছেন। তাঁর বেস্টসেলার গ্রন্থ ‘দ্য নস্টিক গসপেলস’ (The Gnostic Gospels, 1979), যা ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছিল, নস্টিসিজমকে অ্যাকাডেমিক জগৎ থেকে বের করে এনে সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয়ে পরিণত করে।

পেগেলসের গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি নস্টিসিজমকে নিছক কোনো বিমূর্ত দর্শন বা অদ্ভুত পুরাণ হিসেবে দেখেননি। বরং, তিনি দেখেছেন আদি খ্রিস্টীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা-সংগ্রামের (power struggle) এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন কিছু গ্রন্থকে (ম্যাথিউ, মার্ক, লুক, জন) পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বা ক্যাননের (Canon) অন্তর্ভুক্ত করা হলো, আর অন্যগুলোকে (যেমন, টমাস, মেরি, ফিলিপের গসপেল) ‘হেরিটিক্যাল’ বা ভ্রান্ত বলে বাতিল করে দেওয়া হলো? পেগেলসের মতে, এই নির্বাচন কোনো বিশুদ্ধ ধর্মতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের ফল ছিল না, এর পেছনে ছিল গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ। তিনি এক নারীবাদী (feminist) এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নস্টিক গ্রন্থগুলোকে পাঠ করেছেন।

ঈশ্বরের নারী-রূপ: এক বিকল্প ধর্মতত্ত্ব

পেগেলস দেখান যে, অনেক নস্টিক গোষ্ঠীর পুরাণে ঈশ্বরকে কেবল পুরুষ (পিতা) হিসেবেই দেখা হয়নি, তাঁর একটি নারী-রূপও কল্পনা করা হয়েছে। যেখানে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরকে পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার (যাকে সাধারণত পুরুষ হিসেবেই ভাবা হতো) এক পিতৃতান্ত্রিক ত্রিত্ব (Trinity) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছিল, সেখানে নস্টিকরা এক অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) ঈশ্বরের ছবি এঁকেছিল।

  • স্বর্গীয় মা: শেথীয়দের পুরাণে পরম পিতার প্রথম উদ্গীরণ বা প্রকাশ হলেন এক নারী সত্তা, বার্বেলো (Barbelo), যিনি হলেন স্বর্গীয় মা, যাঁর থেকে বাকি সবকিছু জন্মায়। ভ্যালেন্টিনিয়ানদের পুরাণেও পরম পিতার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন নীরবতা (Sige)
  • পবিত্র আত্মা যখন নারী: কিছু নস্টিক গ্রন্থে পবিত্র আত্মাকে (Holy Spirit) সরাসরি মা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ‘দ্য গসপেল অফ দ্য হিব্রুস’-এর একটি খণ্ডে যিশু বলছেন, “আমার মা, পবিত্র আত্মা।”
  • সোফিয়ার প্রজ্ঞা: এবং অবশ্যই, সোফিয়া (Sophia) বা প্রজ্ঞা, যিনি একাধারে স্বর্গীয় এবং পতিত, তিনি নস্টিক পুরাণের এক কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র।

পেগেলসের মতে, ঈশ্বরের এই নারী-রূপের কল্পনা নিছক কোনো পৌরাণিক খেলার বিষয় ছিল না। এটি তাদের সামাজিক কাঠামাকেও প্রভাবিত করত। যদি স্বর্গে একজন মা থাকেন, তবে পৃথিবীতেও নারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ভূমিকা থাকতে পারে। এই ঐশ্বরিক নারী সত্তার উপস্থিতি অর্থোডক্স চার্চের কঠোর পিতৃতান্ত্রিক ঈশ্বর-ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।

নারীর নেতৃত্ব: পিটারের বিরুদ্ধে মেরি ম্যাগডালিন

পেগেলস আরও দেখান যে, নস্টিক সম্প্রদায়গুলোতে নারীরা প্রায়শই এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত, যা অর্থোডক্স চার্চে তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। টারটুলিয়ানের মতো চার্চ ফাদাররা যখন নারীদের গির্জায় কথা বলা বা শিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ করছিলেন, তখন নস্টিক সম্প্রদায়গুলোতে নারীরা নবী, শিক্ষক, এমনকি পুরোহিতের দায়িত্বও পালন করত বলে জানা যায়।

এই মনোভাবের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ ঘটেছে নাগ হাম্মাদির কিছু গ্রন্থে:

  • ‘দ্য গসপেল অফ মেরি’: এই গ্রন্থে মেরি ম্যাগডালিনকে যিশুর একজন প্রধান, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ, শিষ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে, যাকে যিশু এমন কিছু গুপ্ত জ্ঞান দিয়েছিলেন যা অন্য পুরুষ শিষ্যদের, বিশেষ করে পিটারকে (Peter) দেননি। যিশুর মৃত্যুর পর মেরি যখন সেই জ্ঞান বাকি শিষ্যদের সাথে ভাগ করে নিতে চান, তখন পিটার ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, “তিনি কি সত্যিই একজন নারীকে আমাদের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষা দিয়েছেন?” এই সংঘাত ছিল আসলে আদি চার্চের দুটি ভিন্ন ধারার সংঘাত – পিটারের প্রতিনিধিত্ব করা প্রাতিষ্ঠানিক, পিতৃতান্ত্রিক ধারা এবং মেরির প্রতিনিধিত্ব করা মরমী, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ধারা।
  • ‘দ্য গসপেল অফ ফিলিপ’: এই গ্রন্থেও মেরি ম্যাগডালিনকে যিশুর ‘সঙ্গী’ (koinonos) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাকে যিশু অন্য সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।
  • ‘পিস্তিস সোফিয়া’ (Pistis Sophia): এই গ্রন্থেও মেরি ম্যাগডালিনই যিশুর প্রশ্নগুলোর সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দেন এবং তাঁর প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে আবির্ভূত হন।

পেগেলসের মতে, এই গ্রন্থগুলো প্রমাণ করে যে আদি খ্রিস্টীয় সমাজে নারীর ভূমিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক ছিল এবং নস্টিকরা ছিল সেই পক্ষের প্রতিনিধি, যারা নারীর আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিত।

আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের লড়াই: বিশপ বনাম জ্ঞানী

পেগেলসের মতে, নস্টিসিজম এবং অর্থোডক্স চার্চের মধ্যেকার সংঘাতের মূলে ছিল আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব নিয়ে এক মৌলিক লড়াই। কর্তৃত্বের উৎস কী?

  • অর্থোডক্সদের উত্তর: অর্থোডক্সরা বিশ্বাস করত, কর্তৃত্ব আসে বিশপদের এক অবিচ্ছিন্ন ধারার মাধ্যমে, যা ‘অ্যাপোস্টোলিক সাকসেশন’ (Apostolic Succession) নামে পরিচিত। অর্থাৎ, যিশু তাঁর জ্ঞান ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন শিষ্যদের, শিষ্যরা তাদের উত্তরসূরি বিশপদের, এবং এভাবেই সেই কর্তৃত্ব চার্চের মাধ্যমে বাহিত হচ্ছে। এটি একটি বাহ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শ্রেণীবদ্ধ কর্তৃত্বের ধারণা।
  • নস্টিকদের উত্তর: অন্যদিকে, নস্টিকরা বিশ্বাস করত, কর্তৃত্ব আসে ভেতরের অভিজ্ঞতা থেকে – ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বা ‘নোসিস’ থেকে। যে কেউ, সে পুরুষ হোক বা নারী, দাস হোক বা স্বাধীন, যদি ‘নোসিস’ লাভ করে, তবে সে-ই আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের অধিকারী। বিশপ হওয়ার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো ব্যক্তিগত জ্ঞান।

এই দ্বিতীয় ধারণাটি ছিল অনেক বেশি গণতান্ত্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই বিপজ্জনক। যদি যে কেউই সরাসরি ঈশ্বরের জ্ঞান লাভ করতে পারে, তবে চার্চ, বিশপ বা পুরোহিতের মতো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন কী?

পেগেলস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, অর্থোডক্স চার্চ নস্টিসিজমকে দমন করেছিল কেবল ধর্মতাত্ত্বিক কারণে নয়, প্রধানত রাজনৈতিক কারণে। তারা রোমান সাম্রাজ্যের আদলে একটি সুসংগঠিত, পুরুষ-শাসিত এবং শ্রেণীবদ্ধ বা হায়ারার্কিকাল প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চেয়েছিল, যা বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই লক্ষ্যের জন্য নস্টিকদের এই মুক্ত-চিন্তা, নারী নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর জোর দেওয়া ছিল এক বিরাট হুমকি। ক্যানন তৈরি করা, ক্রিড বা বিশ্বাস-সূত্র তৈরি করা এবং ‘হেরিটিক’দের বহিষ্কার করা – এই সবকিছুই ছিল সেই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে সংহত করারই একেকটি ধাপ (Pagels, 1979, 1988)।

পেগেলসের কাজ নস্টিসিজমকে এক নতুন, সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রা দিয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রাচীন এই ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কগুলো নিছক কোনো বিমূর্ত ধারণা নিয়ে ছিল না, এগুলো ছিল ‘খ্রিস্টধর্ম কী হবে’ – এই মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে এক বাস্তব লড়াই।

কার্ট রুডলফ (Kurt Rudolph): এক ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ

যদি হ্যান্স ইয়োনাস নস্টিসিজমকে দর্শনের জগতে এবং এলেইন পেগেলস সামাজিক ইতিহাসের জগতে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন, তবে জার্মান গবেষক কার্ট রুডলফ (১৯২৯-২০২০) ছিলেন সেই স্তম্ভস্বরূপ ব্যক্তিত্ব, যিনি এই বিষয়টিকে ধর্মীয় ইতিহাসের (History of Religions বা Religionswissenschaft) ক্ষেত্রে এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নোসিস: দ্য নেচার অ্যান্ড হিস্ট্রি অফ নস্টিসিজম’ (Gnosis: The Nature and History of Gnosticism, মূল জার্মান সংস্করণ ১৯৭৭)-কে এই বিষয়ের উপর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে সামগ্রিক এবং তথ্যবহুল সারসংক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি অনেকটা নস্টিসিজম গবেষণার বাইবেলের মতো, যা কয়েক দশক ধরে ছাত্র ও গবেষকদের জন্য এক অপরিহার্য সহায়িকা হিসেবে কাজ করেছে।

ইয়োনাস যেখানে ছিলেন দার্শনিক, পেগেলস যেখানে সমাজ-ঐতিহাসিক, রুডলফ সেখানে ছিলেন একজন পুঙ্খানুপুঙ্খ, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং পদ্ধতিগত ধর্মীয় ঐতিহাসিক। তাঁর মূল আগ্রহ কোনো একটি বিশেষ তত্ত্বের (যেমন, অস্তিত্ববাদ বা নারীবাদ) মাধ্যমে নস্টিসিজমকে ব্যাখ্যা করা ছিল না, বরং এর উৎস, বিকাশ, বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন রূপকে ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা ছিল।

সমন্বয়বাদ (Syncretism): এক বহুসাংস্কৃতিক ফসল

রুডলফের গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য হলো তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং সমন্বয়বাদের (Syncretism) উপর জোর দেওয়া। নস্টিসিজমের উৎস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক ছিল – এটি কি মূলত ইহুদি ধর্ম থেকে উদ্ভূত, নাকি গ্রিক দর্শন থেকে, নাকি পারস্যের দ্বৈতবাদ থেকে? রুডলফ এই ধরনের কোনো একক উৎস-ভিত্তিক তত্ত্বকে (single-origin theory) প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বরং, তিনি দেখিয়েছেন যে নস্টিসিজম ছিল হেলেনিস্টিক ও রোমান যুগের সেই উত্তাল, বহুসাংস্কৃতিক পরিবেশের এক জটিল সমন্বয়বাদী ফসল। এটি ছিল এক বিশাল কড়াইয়ের মতো, যেখানে পারস্য, মেসোপটেমীয়, মিশরীয়, ইহুদি এবং গ্রিক – এই সমস্ত প্রাচীন সংস্কৃতির ধর্ম, পুরাণ ও দর্শনের উপাদান একসাথে মিশে এক নতুন ও অনন্য রূপ ধারণ করেছিল।

  • পারস্য থেকে সে নিয়েছিল আলো-অন্ধকারের দ্বৈতবাদ
  • মেসোপটেমীয় ও মিশরীয় ঐতিহ্য থেকে সে নিয়েছিল জ্যোতিষশাস্ত্র এবং আত্মার মহাজাগতিক আরোহণের ধারণা।
  • গ্রিক দর্শন (বিশেষ করে প্লেটোনিজম) থেকে সে নিয়েছিল দুই জগতের তত্ত্ব, দেহকে আত্মার কারাগার মনে করা এবং ডেমিয়ার্জের ধারণা।
  • ইহুদি ধর্ম (বিশেষ করে এর অ্যাপোক্যালিপ্টিক ধারা) থেকে সে নিয়েছিল তার পৌরাণিক আখ্যানের মূল কাঠামো, চরিত্র (আদম, ইভ, সোফিয়া) এবং স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব

রুডলফের মতে, এই উপাদানগুলোর কোনো একটিকে প্রধান এবং অন্যগুলোকে অপ্রধান ভাবা ভুল। নস্টিসিজম এই সমস্ত উপাদানকে গ্রহণ করে সেগুলোকে এমনভাবে রূপান্তরিত করেছিল যে, একটি সম্পূর্ণ নতুন এবং স্বতন্ত্র বিশ্ববীক্ষার জন্ম হয়েছিল।

নস্টিসিজমের সংজ্ঞায়ন: এক স্বতন্ত্র ধর্মীয় প্রপঞ্চ

রুডলফের অন্যতম প্রধান অবদান হলো, তিনি নস্টিসিজমের একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যা গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন নস্টিক গোষ্ঠীর আপাত-বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পুরাণগুলোর পেছনে কিছু সাধারণ কাঠামোগত মিল রয়েছে। তাঁর মতে, নস্টিসিজমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

  1. র‍্যাডিকাল দ্বৈতবাদ: এক পরম, অচেনা, জগতের বাইরের ঈশ্বর এবং এই জগতের অজ্ঞ, নিম্নস্তরের স্রষ্টা বা ডেমিয়ার্জের মধ্যে এক আপোষহীন বিভাজন।
  2. জগতের সৃষ্টি: এই জগৎ কোনো পরিকল্পিত, শুভ সৃষ্টি নয়, বরং এক মহাজাগতিক বিপর্যয় বা পতনের ফল।
  3. মানুষের প্রকৃতি: মানুষের ভেতরে এক ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বা ‘আত্মা’ (self) রয়েছে, যা এই জগতের অংশ নয়, বরং তা উপরের আলোকময় জগৎ থেকে পতিত এবং এই দেহের কারাগারে বন্দী।
  4. মুক্তি: মুক্তি কোনো বিশ্বাস বা ভালো কাজের মাধ্যমে আসে না, আসে এক বিশেষ ধরনের জ্ঞান বা ‘নোসিস’ (Gnosis) থেকে। এই নোসিস হলো নিজের ঐশ্বরিক সত্তা এবং তার উৎস সম্পর্কে এক স্বজ্ঞামূলক উপলব্ধি।
  5. ত্রাণকর্তার ভূমিকা: একজন স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা পৃথিবীতে আসেন এই ঘুমন্ত আত্মাদের জাগিয়ে তুলতে এবং তাদের মুক্তির পথ দেখাতে।
  6. জগৎ প্রত্যাখ্যান: যেহেতু জগৎটা এক কারাগার, তাই এর থেকে পালিয়ে যাওয়াই হলো চূড়ান্ত লক্ষ্য। এর ফলে হয় কঠোর তপস্যা (asceticism) অথবা চরম নিয়ম-বিরোধিতার (libertinism) জন্ম হয়।

এই সুস্পষ্ট কাঠামোর মাধ্যমে রুডলফ নস্টিসিজমকে নিছক খ্রিস্টধর্মের একটি শাখা হিসেবে না দেখে, তাকে একটি স্বতন্ত্র ও বিশ্বজনীন ধর্মীয় প্রপঞ্চ (a universal religious phenomenon) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এটি ছিল প্রাচীন পৃথিবীর শেষভাগের (Late Antiquity) এক অন্যতম প্রধান ধর্ম, যা খ্রিস্টধর্ম এবং নব্যপ্লেটোবাদী দর্শনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তাঁর কাজ নস্টিসিজম গবেষণাকে এক দৃঢ়, ঐতিহাসিক ও তথ্যভিত্তিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছেন। রুডলফের কাছে নস্টিসিজম কোনো অদ্ভুত ব্যতিক্রম ছিল না, ছিল মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ অধ্যায়।

নতুন দিগন্তের কারিগর: পরবর্তী প্রজন্মের তাত্ত্বিকেরা

হ্যান্স ইয়োনাস, গার্শম শোলেম বা কার্ট রুডলফের মতো পথিকৃৎদের দেখানো পথে হেঁটে পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকরা নস্টিসিজম গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ ও সূক্ষ্ম করেছেন। নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরির আবিষ্কার এবং তার পাঠোদ্ধার এই নতুন প্রজন্মের জন্য এক বিশাল সুযোগ তৈরি করে দেয়। এদের মধ্যে তিনজন তাত্ত্বিকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয়, যারা নস্টিসিজমকে বোঝার পদ্ধতিতেই বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।

জিলস কুইস্পেল (Gilles Quispel): ইয়ুং-এর সাথে ইতিহাসের মেলবন্ধন

ডাচ ধর্ম-ইতিহাসবিদ জিলস কুইস্পেল (১৯১৬-২০০৮) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর নস্টিসিজম গবেষণার এক বর্ণময় এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী চরিত্র। তিনি ছিলেন সেই অল্প কজন মানুষের একজন, যারা নাগ হাম্মাদি আবিষ্কারের একেবারে শুরু থেকেই এর সাথে জড়িত ছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনিই ১৯৫২ সালে জুরিখের ইয়ুং ইনস্টিটিউট (Jung Institute)-এর জন্য ‘দ্য গসপেল অফ ট্রুথ’ (The Gospel of Truth)-এর কোডেক্সটি (যা কোডেক্স ইয়ুং নামেও পরিচিত) কিনেছিলেন। এই ঘটনার মাধ্যমেই কার্ল ইয়ুং সরাসরি নাগ হাম্মাদি পুঁথির সংস্পর্শে আসেন এবং নস্টিসিজমের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও গভীর হয়।

কুইস্পেল ছিলেন ইয়ুং-এর ব্যক্তিগত বন্ধু এবং তাঁর দর্শনের গভীর অনুরাগী। কিন্তু তিনি কেবল একজন ইয়ুংগীয় মনোবিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রথম সারির ভাষাতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ। তাঁর গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইয়ুং-এর মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টিকে কঠোর ঐতিহাসিক ও পাঠ্য-ভিত্তিক (textual) গবেষণার সাথে মেলানোর চেষ্টা করেছেন।

  • ইহুদি খ্রিস্টধর্মের উৎস: কুইস্পেলের একটি অন্যতম প্রধান তত্ত্ব হলো, নস্টিসিজমের উৎস কোনো পৌত্তলিক (pagan) বা হেলেনিস্টিক দর্শনে নয়, বরং এর উৎস লুকিয়ে আছে প্রাচীন ইহুদি ধর্মের কিছু ‘হেরিটিক্যাল’ বা প্রচলিত মতবিরোধী শাখার মধ্যে, বিশেষ করে যিশুর ভাই জেমসের (James the Just) অনুসারী ইহুদি-খ্রিস্টানদের (Jewish Christians) মধ্যে। তিনি মনে করতেন, এই গোষ্ঠীগুলোই প্রথম যিশুকে একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখেছিল, যিনি কোনো পাপের জন্য মরতে আসেননি, এসেছিলেন গোপন ‘নোসিস’ বা জ্ঞান দিতে।
  • আত্মার এনসাইক্লোপিডিয়া: কুইস্পেল নস্টিক পুরাণকে ইয়ুং-এর মতোই মানব আত্মার এক প্রতীকী মানচিত্র হিসেবে দেখতেন। তিনি বলতেন, নস্টিকরা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সেই মানুষ, যারা নিজেদের ভেতরের জগৎকে আবিষ্কার করেছিল। তাদের পুরাণ হলো “আত্মার এক এনসাইক্লোপিডিয়া” (an encyclopedia of the soul)। ডেমিয়ার্জ, সোফিয়া, আর্কন – এই সবকিছুই হলো আমাদের নিজেদেরই মনের বিভিন্ন শক্তি ও আদি-প্রতিমান বা আর্কেটাইপের (Archetypes) পৌরাণিক প্রকাশ।
  • ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: কুইস্পেল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, নস্টিসিজমকে কেবল বাইরে থেকে, এক বস্তুনিষ্ঠ গবেষকের দৃষ্টি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এর গভীরে প্রবেশ করতে হলে এর প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি এবং ব্যক্তিগত সংযোগ প্রয়োজন। তিনি প্রায়শই বলতেন, নস্টিসিজম হলো “হৃদয়ের ধর্ম” (a religion of the heart)।

কুইস্পেলের কাজ ইয়োনাসের অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যার পাশাপাশি নস্টিসিজমের এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক পাঠের দরজা খুলে দিয়েছে এবং ইয়ুংগীয় মনোবিজ্ঞানের সাথে নস্টিসিজম গবেষণার এক স্থায়ী সেতু তৈরি করেছে।

জেমস রবিনসন (James M. Robinson): নাগ হাম্মাদির রূপকার

আমেরিকান গবেষক জেমস রবিনসন (১৯২৪-২০১৬) ছিলেন নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরির ইংরেজি অনুবাদের প্রধান রূপকার। যদি নাগ হাম্মাদির আবিষ্কার হয় এক বিপ্লব, তবে রবিনসন ছিলেন সেই বিপ্লবের প্রধান সেনাপতি, যিনি এই গুপ্তধনকে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে নাগ হাম্মাদি কোডেক্সগুলোর একটি ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ এবং অনুবাদ প্রকাশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা হয়। রবিনসন সেই কমিটির আমেরিকান প্রতিনিধি এবং পরে সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, নানা দেশের পণ্ডিতদের রেষারেষি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই প্রকল্পের কাজ অত্যন্ত ধীর গতিতে এগোচ্ছে। তাই তিনি এক বৈপ্লবিক উদ্যোগ নেন।

  • দ্য নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি ইন ইংলিশ: রবিনসন ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লেরমন্ট গ্র্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটিতে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিশ্বের সেরা পণ্ডিতদের একত্রিত করে মূল কপ্টিক পাঠ থেকে সরাসরি ইংরেজিতে একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকল্প শুরু করেন। বহু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর, ১৯৭৭ সালে প্রথমবার ‘দ্য নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি ইন ইংলিশ’ (The Nag Hammadi Library in English) প্রকাশিত হয়। এই একটি মাত্র বই নস্টিসিজম গবেষণার চিত্রটি চিরতরে পাল্টে দেয়। প্রথমবারের মতো, যে কোনো আগ্রহী পাঠক – সে বিশেষজ্ঞ হোক বা সাধারণ মানুষ – নস্টিকদের নিজেদের লেখা গ্রন্থগুলো সরাসরি পড়তে পারার সুযোগ পায়।
  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্মাণ: রবিনসন কেবল অনুবাদক বা সম্পাদকই ছিলেন না, তিনি একজন প্রথম সারির ইতিহাসবিদও ছিলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত মুখবন্ধ এবং বিভিন্ন লেখায় নাগ হাম্মাদি কোডেক্সগুলোর আবিষ্কারের নাটকীয় কাহিনি এবং তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট – অর্থাৎ, চতুর্থ শতাব্দীর মিশরের এক প্যাকোমিয়ান মঠের (Pachomian monastery) সন্ন্যাসীদের দ্বারা এই গ্রন্থগুলো লুকিয়ে রাখার তত্ত্ব – তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ৩৬৭ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রভাবশালী বিশপ অ্যাথানাসিয়াসের (Athanasius) জারি করা এক নির্দেশের (Easter Letter) পরেই এই ‘হেরিটিক্যাল’ বইগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই নির্দেশেই প্রথমবার নিউ টেস্টামেন্টের আজকের ২৭টি বইয়ের তালিকাটিকে একমাত্র বৈধ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

রবিনসনের এই অসাধারণ উদ্যোগ এবং সাংগঠনিক দক্ষতার ফলেই নাগ হাম্মাদি লাইব্রেরি আজ আর কোনো গুপ্ত ভান্ডারে সীমাবদ্ধ নেই, এটি পরিণত হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে।

মাইকেল অ্যালেন উইলিয়ামস (Michael Allen Williams): ‘নস্টিসিজম’ ধারণাটির বিনির্মাণ

সাম্প্রতিক নস্টিসিজম গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী তাত্ত্বিকদের একজন হলেন মাইকেল অ্যালেন উইলিয়ামস। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘রিথিংকিং “নস্টিসিজম”: অ্যান আর্গুমেন্ট ফর ডিসম্যান্টলিং আ ড্যুবিয়াস ক্যাটেগরি’ (Rethinking “Gnosticism”: An Argument for Dismantling a Dubious Category, 1996)-এ তিনি এক বৈপ্লবিক প্রশ্ন তুলেছেন: ‘নস্টিসিজম’ বলে কি আদৌ কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল?

উইলিয়ামস যুক্তি দেন যে, ‘নস্টিসিজম’ শব্দটি উনিশ শতকের পণ্ডিতদের তৈরি করা একটি কৃত্রিম এবং প্রায়শই বিভ্রান্তিকর ক্যাটেগরি। প্রাচীনকালে কোনো গোষ্ঠীই নিজেদেরকে ‘নস্টিক’ বলে পরিচয় দিত না (যদিও ‘gnostikos’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো, তবে তা একটি সাধারণ বিশেষণ হিসেবে, কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের নাম হিসেবে নয়)। আমরা যাদেরকে ‘নস্টিক’ বলি, তারা ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় কিছু গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই হয়তো বেশি ছিল।

  • ‘নস্টিসিজম’ লেবেলের সমস্যা: উইলিয়ামসের মতে, এই ‘নস্টিসিজম’ লেবেলটি আমাদের বাধ্য করে এই সমস্ত বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীগুলোকে একটিমাত্র ছাঁচে ফেলে দেখতে। এটি আমাদের ধরে নিতে বাধ্য করে যে তাদের সবার মধ্যেই কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য (যেমন, র‍্যাডিকাল দ্বৈতবাদ বা জগৎ-বিদ্বেষ) থাকবেই। এর ফলে আমরা প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলোকে দেখতে ব্যর্থ হই।
  • বিকল্প নাম: ‘বাইবেলের ডেমিয়ার্জিয়াল ঐতিহ্য’: উইলিয়ামস ‘নস্টিসিজম’ শব্দটির বদলে এক নতুন, আরও বর্ণনামূলক এবং কম ভারাক্রান্ত পরিভাষা প্রস্তাব করেন: ‘বাইবেলের ডেমিয়ার্জিয়াল ঐতিহ্য’ (the Biblically-based demiurgical tradition)। তাঁর মতে, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রধান মিলটি কোনো বিমূর্ত ‘নোসিস’ নয়, বরং বাইবেলের স্রষ্টা ঈশ্বরকে এক নিম্নস্তরের, ত্রুটিপূর্ণ বা অজ্ঞ সত্তা (ডেমিয়ার্জ) হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা। এই একটি মাত্র উদ্ভাবনী পদক্ষেপ থেকেই তাদের বাকি সমস্ত র‍্যাডিকাল ধারণাগুলোর জন্ম হয়।
  • জগৎ-বিদ্বেষের প্রশ্ন: উইলিয়ামস আরও দেখান যে, আমরা যাদেরকে ‘নস্টিক’ বলি, তাদের সবাই কিন্তু চরম জগৎ-বিদ্বেষী ছিল না। অনেকের লেখাতেই জগৎ বা প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাবও খুঁজে পাওয়া যায়। ‘নস্টিসিজম = জগৎ-বিদ্বেষ’ – এই সরল সমীকরণটি আসলে একটি অতিরঞ্জন।

উইলিয়ামসের এই বিনির্মাণবাদী (deconstructionist) দৃষ্টিভঙ্গি নস্টিসিজম গবেষণায় এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং পণ্ডিতদের বাধ্য করেছে তাদের পুরোনো ধারণাগুলোকে নতুন করে প্রশ্ন করতে। যদিও সবাই তাঁর ‘নস্টিসিজম’ শব্দটি বর্জন করার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, কিন্তু তাঁর কাজ আমাদের শিখিয়েছে যে, অতীতের কোনো চিন্তাধারাকে বোঝার জন্য আমাদের নিজেদের তৈরি করা লেবেলগুলো সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে।

নতুন মানচিত্রের সন্ধানে: এক অসমাপ্ত যাত্রা

এই তাত্ত্বিকেরা – ইয়োনাস, শোলেম, পেগেলস, রুডলফ, কুইস্পেল, রবিনসন এবং উইলিয়ামস – এবং আরও অসংখ্য গবেষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা নস্টিসিজমকে তার নিজস্ব শর্তে বোঝার সুযোগ পেয়েছি। ইয়োনাস এর দার্শনিক গভীরতা উন্মোচন করেছেন, শোলেম এর ইহুদি শিকড়ের সন্ধান দিয়েছেন, পেগেলস এর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য তুলে ধরেছেন, রুডলফ এর ঐতিহাসিক কাঠামোটি নির্মাণ করেছেন, কুইস্পেল এর মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের দরজা খুলেছেন, রবিনসন এর হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরকে আমাদের কানে পৌঁছে দিয়েছেন, এবং উইলিয়ামস আমাদের বাধ্য করেছেন আমাদের নিজেদের মানচিত্রটিকেই প্রশ্ন করতে।

তাদের কাজ আমাদের দেখিয়েছে যে, নস্টিসিজম কোনো অদ্ভুত, অপ্রাসঙ্গিক বিশ্বাস নয়, বরং এটি মানব আত্মার এক গভীর ও শাশ্বত সংকটের – এই অচেনা জগতে নিজের পরিচয় এবং মুক্তির পথ খোঁজার – এক শক্তিশালী, কাব্যিক এবং প্রায়শই বিপজ্জনক প্রকাশ। নাগ হাম্মাদির সেই মাটির কলস থেকে কেবল কিছু পুরোনো পুঁথিই বেরিয়ে আসেনি, বেরিয়ে এসেছে মানব চিন্তার ইতিহাসের এক প্রায়-হারিয়ে-যাওয়া মহাদেশ। আর এই তাত্ত্বিকেরা হলেন সেই সাহসী অভিযাত্রী, যারা আমাদের জন্য সেই নতুন মহাদেশের মানচিত্র আঁকার কঠিন কিন্তু রোমাঞ্চকর কাজটি করে চলেছেন। এই যাত্রা এখনও শেষ হয়নি।

উপসংহার: একটি প্রাচীন মনস্তাত্ত্বিক বিদ্রোহের ব্যবচ্ছেদ

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, নস্টিসিজম কোনো ‘হারানো সত্য’ নয়, বরং এটি মানব ইতিহাসের একটি বিশেষ মুহূর্তে তৈরি হওয়া এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া। প্রাচীন যুগের মানুষ যখন রোগ, মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছিল, তখন তারা এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি কাল্পনিক কাঠামো তৈরি করেছিল। নস্টিসিজম হলো সেই কাঠামোরই নাম। এটি মহাবিশ্বের বিশৃঙ্খলা এবং অন্যায্যতার একটি পৌরাণিক ব্যাখ্যা মাত্র।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে, মহাবিশ্ব ভালো বা মন্দ কোনোটিই নয়; এটি মূলত উদাসীন এবং উদ্দেশ্যহীন। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক কার্যকারণ এবং অর্থ খুঁজতে বিবর্তিত হয়েছে। যখন সে দেখে যে প্রকৃতি নিষ্ঠুর এবং জীবন যন্ত্রণাময়, তখন সে এই অর্থহীনতাকে মেনে নিতে পারে না। নস্টিকরা এই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল ‘ডেমিয়ার্জ’ নামক এক খলনায়ক স্রষ্টাকে কল্পনা করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, এই ডেমিয়ার্জ কোনো বাস্তব সত্তা নয়; এটি হলো প্রকৃতির অন্ধ শক্তি এবং সমসাময়িক অত্যাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি রূপক বা প্রজেকশন (Projection)। নস্টিকরা তাদের পার্থিব অসহায়ত্বকে এক মহাজাগতিক ষড়যন্ত্রের গল্পে রূপান্তরিত করেছিল।

আজকের দিনে নস্টিসিজমের প্রাসঙ্গিকতা এর ধর্মতাত্ত্বিক দাবির মধ্যে নেই, বরং এটি একটি ‘ফিকশন’ বা আখ্যান হিসেবে কতটা শক্তিশালী, তার মধ্যে নিহিত। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মানুষ যখন বিচ্ছিন্নতাবোধে ভোগে, তখন সে আর কোনো দয়ালু ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে নস্টিকদের ‘শত্রুভাবাপন্ন মহাবিশ্ব’-এর ধারণাটি আধুনিক মানুষের অস্তিত্ববাদী সংকটের (Existential Crisis) সাথে মিলে যায়। ফিলিপ কে. ডিক বা দ্য ম্যাট্রিক্স-এর মতো আধুনিক কল্পকাহিনিতে যে নস্টিক উপাদান দেখা যায়, তা কোনো আধ্যাত্মিক সত্যের প্রকাশ নয়; বরং তা হলো মানুষের বন্দী দশা এবং তা থেকে পালানোর চিরকালীন ফ্যান্টাসির শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ।

পরিশেষে, নস্টিসিজমকে কোনো গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান হিসেবে দেখার প্রয়োজন নেই। এটি মানুষের কল্পনাশক্তির একটি নিদর্শন। এটি আমাদের দেখায় যে, মানুষ তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জন্য কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে। নস্টিকরা সমস্যা সমাধানের জন্য বাস্তব জগতকে মেরামত করার বদলে একটি কাল্পনিক ‘আসল জগত’ বা প্লেরোমা তৈরি করে নিয়েছিল। এটি সমস্যার সমাধান নয়, বরং সমস্যা থেকে পলায়নপর মনোবৃত্তির (Escapism) একটি ধ্রুপদী উদাহরণ। তাই নস্টিসিজমের পাঠ আমাদের কোনো মোক্ষ বা মুক্তি দেয় না, বরং এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, অর্থহীন মহাবিশ্বে অর্থ খোঁজার তাড়নায় মানুষ কীভাবে মিথ ও রূপকথা তৈরি করে।

তথ্যসূত্র

  • Armstrong, A. H. (Ed.). (1967). The Cambridge History of Later Greek and Early Medieval Philosophy. Cambridge University Press.
  • Barber, M. (2000). The Cathars: Dualist Heretics in Languedoc in the High Middle Ages. Pearson.
  • Baur, F. C. (1835). Die christliche Gnosis oder die christliche Religions-Philosophie in ihrer geschichtlichen Entwickelung. Osiander.
  • Bloom, H. (1971). The Visionary Company: A Reading of English Romantic Poetry. Cornell University Press.
  • Blumenberg, H. (1983). The Legitimacy of the Modern Age. (R. M. Wallace, Trans.). MIT Press.
  • Boyce, M. (1979). Zoroastrians: Their Religious Beliefs and Practices. Routledge & Kegan Paul.
  • Brakke, D. (2010). The Gnostics: Myth, Ritual, and Diversity in Early Christianity. Harvard University Press.
  • Brown, P. (1988). The Body and Society: Men, Women, and Sexual Renunciation in Early Christianity. Columbia University Press.
  • Bull, C. H. (2018). The Tradition of Hermes Trismegistus: The Egyptian Priestly Figure as a Teacher of Hellenized Wisdom. Brill.
  • Burckhardt, T. (1976). An Introduction to Sufi Doctrine. (D. M. Matheson, Trans.). Thorsons.
  • Camus, A. (1955). The Myth of Sisyphus and Other Essays. (J. O’Brien, Trans.). Knopf.
  • Camus, A. (1956). The Rebel: An Essay on Man in Revolt. (A. Bower, Trans.). Knopf.
  • Casey, M. (2004). The Gospel of Judas: A New Translation and Commentary. T&T Clark.
  • Chadwick, H. (1993). The Early Church. Penguin Books.
  • Cirillo, L. (1987). Elchasai e gli Elchasaiti. Centro Studi L. A. Muratori.
  • Cohen, S. J. D. (1987). From the Maccabees to the Mishnah. Westminster John Knox Press.
  • Collins, S. (1982). Selfless Persons: Imagery and Thought in Theravada Buddhism. Cambridge University Press.
  • Conze, E. (1963). Buddhism and Gnosticism. In Le origini dello gnosticismo: Colloquio di Messina, 13-18 Aprile 1966 (pp. 651-667). Brill.
  • Corbin, H. (1993). History of Islamic Philosophy. (L. Sherrard & P. Sherrard, Trans.). Kegan Paul International.
  • Couliano, I. P. (1991). The Tree of Gnosis: Gnostic Mythology from Early Christianity to Modern Nihilism. HarperSanFrancisco.
  • Cowan, D. E. (2017). America’s Dark Theologian: The Religious Imagination of Stephen King. New York University Press.
  • DeConick, A. D. (2016). The Thirteenth Apostle: What the Gospel of Judas Really Says. Bloomsbury Continuum.
  • Deutsch, E. (1973). Advaita Vedanta: A Philosophical Reconstruction. University of Hawaii Press.
  • Dick, P. K. (1981). VALIS. Bantam Books.
  • Dillon, J. M. (1996). The Middle Platonists: 80 B.C. to A.D. 220. Cornell University Press.
  • Dodds, E. R. (1965). Pagan and Christian in an Age of Anxiety: Some Aspects of Religious Experience from Marcus Aurelius to Constantine. Cambridge University Press.
  • Ehrman, B. D. (2003). Lost Christianities: The Battles for Scripture and the Faiths We Never Knew. Oxford University Press.
  • Filoramo, G. (1990). A History of Gnosticism. Blackwell.
  • Fowden, G. (1986). The Egyptian Hermes: A Historical Approach to the Late Pagan Mind. Cambridge University Press.
  • FromSoftware. (2015). Bloodborne [Video Game]. Sony Computer Entertainment.
  • Grant, R. M. (1961). Gnosticism and Early Christianity. Columbia University Press.
  • Harnack, A. von. (1921). Marcion: The Gospel of the Alien God. (J. E. Steely & L. D. Bierma, Trans.). Labyrinth Press.
  • Haslem, A. (2015). Neon Genesis Evangelion and the Gnostic-Existentialist Dilemma. McFarland & Company.
  • Hoeller, S. A. (1982). The Gnostic Jung and the Seven Sermons to the Dead. Quest Books.
  • Idel, M. (1988). Kabbalah: New Perspectives. Yale University Press.
  • Irenaeus. (1885). Against Heresies. In A. Roberts & J. Donaldson (Eds.), Ante-Nicene Fathers, Vol. 1. Christian Literature Publishing Co.
  • Jonas, H. (1958). The Gnostic Religion: The Message of the Alien God and the Beginnings of Christianity. Beacon Press.
  • Jonas, H. (2001). The Gnostic Religion: The Message of the Alien God and the Beginnings of Christianity (3rd ed.). Beacon Press.
  • Jung, C. G. (1954). Answer to Job. (R. F. C. Hull, Trans.). Routledge & Kegan Paul.
  • Koberlein, K., & Pagels, E. (2007). Reading Judas: The Gospel of Judas and the Shaping of Christianity. Viking Adult.
  • Larson, G. J. (1979). Classical Samkhya: An Interpretation of Its History and Meaning. Motilal Banarsidass.
  • Layton, B. (1987). The Gnostic Scriptures: A New Translation with Annotations and Introductions. Doubleday & Co.
  • Lieu, S. N. C. (1992). Manichaeism in the Later Roman Empire and Medieval China. Mohr Siebeck.
  • Löwy, M. (2005). Fire Alarm: Reading Walter Benjamin’s ‘On the Concept of History’. Verso.
  • Luttikhuizen, G. P. (2006). The Revelation of Elchasai: Investigations into the Evidence for a Mesopotamian Jewish Apocalypse of the Second Century. Mohr Siebeck.
  • MacMullen, R. (1981). Paganism in the Roman Empire. Yale University Press.
  • Massignon, L. (1982). The Passion of al-Hallaj: Mystic and Martyr of Islam. (H. Mason, Trans.). Princeton University Press.
  • Mead, G. R. S. (1906). Thrice-Greatest Hermes: Studies in Hellenistic Theosophy and Gnosis, Volume I. The Theosophical Publishing Society.
  • Mead, G. R. S. (1921). Pistis Sophia: A Gnostic Miscellany. J. M. Watkins.
  • Moore, A., & Williams III, J. H. (1999-2005). Promethea. America’s Best Comics.
  • Moynihan, M., & Søderlind, D. (2003). Lords of Chaos: The Bloody Rise of the Satanic Metal Underground. Feral House.
  • Nadler, S. (2001). Spinoza’s Heresy: Immortality and the Jewish Mind. Oxford University Press.
  • Nasr, S. H. (1964). An Introduction to Islamic Cosmological Doctrines: Conceptions of Nature and Methods Used for Its Study by the Ikhwan al-Safa, al-Biruni, and Ibn Sina. Harvard University Press.
  • Obolensky, D. (1948). The Bogomils: A Study in Balkan Neo-Manichaeism. Cambridge University Press.
  • Pagels, E. (1979). The Gnostic Gospels. Random House.
  • Pagels, E. (1988). Adam, Eve, and the Serpent: Sex and Politics in Early Christianity. Random House.
  • Pagels, E. (1995). The Origin of Satan: How Christians Demonized Jews, Pagans, and Heretics. Random House.
  • Pearson, B. A. (2007). Ancient Gnosticism: Traditions and Literature. Fortress Press.
  • Perkins, P. (1993). Gnosticism and the New Testament. Fortress Press.
  • Plotinus. (1991). The Enneads. (S. MacKenna, Trans.). Penguin Books.
  • Rasimus, T. (2009). Paradise Reconsidered in Gnostic Mythmaking: Rethinking Sethianism in Light of the Ophite Evidence. Brill.
  • Robinson, J. M. (Ed.). (1988). The Nag Hammadi Library in English. Harper & Row.
  • Robinson, J. M. (2014). The Nag Hammadi Story: From the Discovery to the Publication. Brill.
  • Rudolph, K. (1987). Gnosis: The Nature and History of Gnosticism. (R. M. Wilson, Trans.). Harper & Row.
  • Ruh, B. (2014). Stray Dog of Anime: The Films of Mamoru Oshii. Palgrave Macmillan.
  • Saito, K. (2018). The Kyubey Contract: Gnostic Traps and Existential Horror in the Magical Girl Genre. Mechademia Journal, 11(1), 45-62.
  • Śaṅkara. (1921). Vivekachudamani (Trans. Swami Madhavananda). Advaita Ashrama.
  • Scholem, G. (1941). Major Trends in Jewish Mysticism. Schocken Books.
  • Scholem, G. (1965). On the Kabbalah and Its Symbolism. (R. Manheim, Trans.). Schocken Books.
  • Scholem, G. (1974). Kabbalah. Meridian.
  • Scholem, G. (1990). Walter Benjamin and His Angel. In On Jews and Judaism in Crisis: Selected Essays. Schocken Books.
  • Sedley, D. (2007). Creationism and Its Critics in Antiquity. University of California Press.
  • Segal, A. F. (1986). Rebecca’s Children: Judaism and Christianity in the Roman World. Harvard University Press.
  • Shakespeare, W. (1997). King Lear. In The Norton Shakespeare. W. W. Norton & Company.
  • Shaw, D. L. (1976). Borges: “Ficciones”. Grant & Cutler.
  • Stoudt, J. J. (1957). Sunrise to Eternity: A Study in Jacob Boehme’s Life and Thought. University of Pennsylvania Press.
  • Sutin, L. (1989). Divine Invasions: A Life of Philip K. Dick. Harmony Books.
  • Sutin, L. (Ed.). (2011). The Exegesis of Philip K. Dick. Houghton Mifflin Harcourt.
  • Taubes, J. (2009). From Cult to Culture: Fragments of a Critique of Historical Reason. (C. Hollander, Trans.). Stanford University Press.
  • Thompson, L. (1952). Melville’s Quarrel with God. Princeton University Press.
  • Trevett, C. (1996). Montanism: Gender, Authority and the New Prophecy. Cambridge University Press.
  • Turner, J. D. (1991). The Gnostic Seth. In J. D. Turner & A. McGuire (Eds.), The Nag Hammadi Library after Fifty Years. Brill.
  • Twain, M. (1962). Letters from the Earth. Harper & Row.
  • VanderKam, J. C. (2010). The Dead Sea Scrolls and the Bible. Eerdmans.
  • Voegelin, E. (1952). The New Science of Politics: An Introduction. University of Chicago Press.
  • Voegelin, E. (1968). Science, Politics, and Gnosticism: Two Essays. Regnery Gateway.
  • Weeks, A. (1991). Boehme: An Intellectual Biography of the Seventeenth-Century Philosopher and Mystic. State University of New York Press.
  • White, D. G. (Ed.). (2003). Tantra in Practice. Princeton University Press.
  • Widengren, G. (1965). Mani and Manichaeism. (C. Kessler, Trans.). Weidenfeld & Nicolson.
  • Williams, M. A. (1996). Rethinking “Gnosticism”: An Argument for Dismantling a Dubious Category. Princeton University Press.
  • Ziolkowski, T. (1972). Fictional Transfigurations of Jesus. Princeton University Press.
  • Žižek, S. (2000). The Fragile Absolute: Or, Why is the Christian Legacy Worth Fighting For? Verso.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।