শিন্তো ধর্ম (Shinto) : জাপানের আত্মার সন্ধানে এক আদিম ভ্রমণ
Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 শিন্তো শব্দের উৎপত্তি ও দার্শনিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
- 3 কামি (Kami): জাপানি সত্তার বিমূর্ত ও মহাজাগতিক রূপ
- 4 পবিত্রতা ও অপবিত্রতা: শিন্তো দর্শনের দ্বান্দ্বিক সমীকরণ
- 5 জাপানি মিথোলজি: সৃষ্টিতত্ত্ব ও কামিদের বিচিত্র জগত
- 6 তোরিই (Torii): দুই জগতের মাঝখানের এক জাদুকরী দরজা
- 7 জিঞ্জা (Jinja): কামির নিবাস ও নীরবতার স্থাপত্য
- 8 মাৎসুুুুরি (Matsuri): শিন্তো উৎসবের কোলাহল ও দর্শন
- 9 শিন্তো ও প্রকৃতি: প্রাচীন ইকো-স্পিরিচুয়ালিটির দর্শন
- 10 শিনবুৎসু-শুগো: বুদ্ধ ও কামির হাজার বছরের সংসার
- 11 ইতিহাসের বাঁক: বিচ্ছেদ, রাষ্ট্র ও যুদ্ধের দামামা
- 12 স্টেট শিন্তো এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধর্মের রাজনীতিকরণ ও এক বিয়োগান্তক অধ্যায়
- 13 আধুনিক জীবনে শিন্তো: বিশ্বাস, কুসংস্কার নাকি সাংস্কৃতিক ডিএনএ?
- 13.1 বিশ্বাস বনাম আচরণ: অর্থোডক্সি বনাম অর্থোপ্রাক্সি
- 13.2 হাৎসুমোদে: ধর্মনিরপেক্ষ তীর্থযাত্রা
- 13.3 প্রযুক্তি ও কুসংস্কার: সিলিকন চিপের শুদ্ধিকরণ
- 13.4 চি-গো-সান ও ইয়াকুদোশি: জীবনচক্রের মাইলফলক
- 13.5 ইতা-দাকি-মাসু: খাবারের টেবিলে শিন্তো দর্শন
- 13.6 গাড়ি ও ট্রাফিক সেফটি: কোৎসু আনজেন
- 13.7 উপসংহার: শিন্তো যখন বাতাস
- 14 শিন্তো ও পপ কালচার: অ্যানিমে ও মাঙ্গায় লুকানো দেবতার ছায়া
- 15 শিন্তো পরিভাষা ও বস্তু: বিশ্বাসের প্রতীকী ভাষা
- 16 নারী ও শিন্তো: দেবী থেকে দাসী এবং পুনরুত্থানের উপাখ্যান
- 16.1 হিমে-মিকো ব্যবস্থা ও শামানিজম
- 16.2 বৌদ্ধধর্ম ও কনফুসীয়বাদের অনুপ্রবেশ: অপবিত্রতার রাজনীতি
- 16.3 নিওনিন কেক্কাই: নারীদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা
- 16.4 মেইজি যুগ ও স্টেট শিন্তো: চূড়ান্ত আঘাত
- 16.5 যুদ্ধের পর পুনরুত্থান: আবার জেগে ওঠা
- 16.6 আধুনিক মিকো: পপ কালচার বনাম বাস্তবতা
- 16.7 উপসংহার: বৃত্ত কি সম্পূর্ণ হলো?
- 17 উপসংহার
- 18 তথ্যসূত্র
ভূমিকা
জাপান দেশটা বড়ই বিচিত্র, এক ধাধার মতো। আপনি যখন টোকিওর শিবুইয়া বা শিনজুকুর ব্যস্ততম রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন, তখন মনে হবে আপনি বোধহয় সময়ের চেয়ে কয়েকশ বছর এগিয়ে গেছেন। চারপাশে গগনচুম্বী দালান, নিয়ন আলোর তীব্র ঝলকানি, রোবট রেস্টুরেন্ট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর প্রযুক্তির চূড়ান্ত আস্ফালন। মানুষের স্রোত আর যান্ত্রিক কোলাহলে কান পাতা দায়। মনে হবে আপনি কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভির সেটে ঢুকে পড়েছেন, যেখানে আবেগ বা আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নেই। ঠিক তখনই হয়তো আপনার চোখে পড়বে রাস্তার এক কোণায়, দুটো বিশাল দালানের চিপায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এক কাঠের তোরণ। জাপানি ভাষায় যাকে বলে তোরিই (Torii)। উজ্জ্বল লাল রঙের এই তোরণটি যেন দুটি ভিন্ন জগতের সীমানা। এই তোরণ পেরোলেই হঠাৎ শহরের সব কোলাহল যেন জাদুর মতো মিলিয়ে যায়। ভেতরে শান্ত, স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। শতাব্দীপ্রাচীন গাছপালা, পাথরের লণ্ঠন আর শ্যাওলা জমা এক কাঠের ঘর। বাতাসের শব্দ আর কাঠের গন্ধ ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। আধুনিকতার চরম শিখরে বসেও জাপান তার হাজার বছরের পুরনো শেকড়কে এভাবেই আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এই শেকড়ের নাম শিন্তো (Shinto)।
শিন্তো কোনো সাধারণ ধর্ম নয়। অন্তত পশ্চিমা বা প্রচলিত সংজ্ঞায় আমরা ‘ধর্ম’ বা রিলিজিয়ন (Religion) বলতে যা বুঝি – একজন নির্দিষ্ট প্রবর্তক থাকবেন, একটা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বা স্ক্রিপচার (Scripture) থাকবে, নির্দিষ্ট কিছু কঠোর অনুশাসন বা ডগমা থাকবে – শিন্তোতে সেসবের বালাই নেই। যিশু, বুদ্ধ বা মুহাম্মদের মতো কোনো ঐতিহাসিক মহামানব শিন্তো ধর্মের প্রবর্তন করেননি। বাইবেল, ত্রিপিটক বা কুরআনের মতো কোনো একক আসমানি কিতাবও এদের নেই, যা তাদের বলে দেবে কী করা উচিত আর কী অনুচিত। তাহলে শিন্তো আসলে কী? সহজ কথায় বলতে গেলে, শিন্তো হলো জাপানিদের জীবনযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের সংস্কৃতির এক অদৃশ্য সুতো। এটি কোনো তাত্ত্বিক মতবাদ নয়, বরং এটি হলো প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা আর পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। এটি জাপানিদের শেখায় কীভাবে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে, কোনো সংঘাত ছাড়াই বেঁচে থাকা যায় (Ono, 1962)।
জাপানিরা বলে, শিন্তো অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, ঠিক যেমন জাপানের পাহাড়, নদী আর অরণ্য আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন, এই বিশ্বাসের বয়স জাপানের মাটির বয়সের সমান। যখন জাপানে লিপি ছিল না, মানুষ গুছিয়ে কথা বলতে শেখেনি, তখন থেকেই তারা প্রকৃতির বিশালতাকে ভয় পেতে শিখেছে, ভক্তি করতে শিখেছে। সেই আদিম ভয় আর ভক্তি থেকেই শিন্তোর জন্ম। এটি মূলত সর্বপ্রাণবাদ (Animism) বা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাস। এটি এতই প্রাচীন যে, জাপানি ভাষায় ‘শিন্তো’ শব্দটাই এসেছে অনেক পরে, ষষ্ঠ শতাব্দীতে। যখন চীন ও কোরিয়া হয়ে বাইরে থেকে বৌদ্ধধর্ম (Buddhism) জাপানে প্রবেশ করল, তখন জাপানিরা এক সংকটে পড়ল। তাদের নিজস্ব বিশ্বাসের তো কোনো নাম নেই! নবাগত ধর্মের সাথে নিজেদের আদি বিশ্বাসকে আলাদা করার জন্য তখন একটা নামের দরকার পড়ল। তখনই এর নাম দেওয়া হলো ‘শিন্তো’ বা ‘দেবতাদের পথ’। তার আগে পর্যন্ত এর কোনো নামেরও প্রয়োজন হয়নি, কারণ এটি ছিল তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক।
এই আর্টিকেলে আমরা সেই আদিম জাপানি সত্তার গভীরে ডুব দেব। আমরা জানব কামি (Kami) কারা, কেন জাপানিরা লবণের ব্যবহারকে পবিত্র মনে করে, কেন তাদের বিয়ে হয় শিন্তো রীতিতে কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয় বৌদ্ধ রীতিতে। আমরা ঘুরব জাপানের মিথোলজির অলিগলিতে, যেখানে সূর্যদেবী আমাতেরাসু গুহায় লুকিয়ে পড়েন আর ঝড়ের দেবতা তাণ্ডব চালান।
শিন্তো শব্দের উৎপত্তি ও দার্শনিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
শব্দ নিয়ে খেলা করা বা শব্দের গভীরে ডুব দেওয়াটা মানুষের আদিম নেশাগুলোর একটি। ‘শিন্তো’ শব্দটি নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন কেবল একটি ধর্মীয় নামকে বিশ্লেষণ করি না, বরং একটি জাতির হাজার বছরের মনস্তত্ত্ব আর তাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসকেও খুঁড়ে বের করি। শিন্তো শব্দটি জাপানি ভাষার নিজস্ব কোনো শব্দ নয়, এটি একটি ধার করা শব্দ। এর শেকড় প্রোথিত আছে প্রাচীন চীনা ভাষায়। জাপানিরা যখন লিখতে শিখল, তখন তারা চীনা লিপি বা কাঞ্জি (Kanji) ব্যবহার করতে শুরু করল। এই লিপির মাধ্যমেই তারা নিজেদের বিশ্বাসকে একটি নাম দিল। চীনা ভাষার দুটি শব্দ – ‘শিন’ (Shen) এবং ‘তাও’ (Tao) – একত্রিত হয়ে জাপানি উচ্চারণে রূপ নিল ‘শিন্তো’-তে। ‘শিন’ শব্দটির অর্থ হলো ‘কামি’ (Kami) বা আত্মা বা দেবতা, আর ‘তো’ বা ‘দো’ মানে হলো পথ বা মার্গ। শাব্দিক অর্থে শিন্তো হলো ‘দেবতাদের পথ’ বা ‘The Way of the Gods’ (Hardacre, 2017)। তবে এই সরল অনুবাদের আড়ালে লুকিয়ে আছে বিশাল এক দার্শনিক বিভ্রান্তি আর গভীরতা।
এখানে ‘গড’ বা ‘দেবতা’ শব্দটি ব্যবহার করলে বড়সড় একটা ভুল বোঝার অবকাশ তৈরি হয়। পশ্চিমা ধর্মতত্ত্ব বা আব্রাহামিক ধর্মসমূহে আমরা ‘গড’ বলতে যা বুঝি, শিন্তোর ‘কামি’ ঠিক তা নয়। পশ্চিমা দর্শনে ঈশ্বর হলেন ট্রান্সসেনডেন্ট (Transcendent) বা ধরাছোঁয়ার বাইরের এক সত্তা, যিনি মহাবিশ্বের স্রষ্টা এবং বিচারক। কিন্তু শিন্তো ধর্মে কামি’র ধারণাটি সম্পূর্ণ ইমানেন্ট (Immanent) বা অন্তর্নিহিত। অর্থাৎ, স্রষ্টা সৃষ্টির বাইরে কোথাও বসে নেই, বরং সৃষ্টির প্রতিটি অণু-পরমাণুর ভেতরেই তিনি বিদ্যমান। তাই শিন্তো শব্দের অর্থ বুঝতে হলে আমাদের প্রচলিত ‘ধর্ম’ বা রিলিজিয়ন (Religion)-এর চশমা খুলে রেখে, জাপানিদের আদিম বিশ্বাসের লেন্স দিয়ে জগতকে দেখতে হবে। কেন জাপানিরা তাদের বিশ্বাসের নাম দিল ‘শিন্তো’? ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে জাপানে এই বিশ্বাসের কোনো নির্দিষ্ট নাম ছিল না। কারণ, তখন জাপানে অন্য কোনো ধর্ম ছিল না। মানুষ যেভাবে শ্বাস নিত, যেভাবে খেত, ঠিক সেভাবেই তারা প্রকৃতির পূজা করত। এটি ছিল তাদের যাপিত জীবনেরই অংশ, আলাদা কোনো ‘বিশ্বাস’ নয়। কিন্তু যখন ষষ্ঠ শতাব্দীতে কোরিয়া উপদ্বীপ হয়ে জাপানে বৌদ্ধধর্ম (Buddhism) প্রবেশ করল, তখন একটা সংকটের সৃষ্টি হলো। নবাগত এই ধর্মকে বলা হতো ‘বুৎসুদো’ (Butsudo) বা বুদ্ধের পথ। তখন নিজেদের আদিম ও নিজস্ব বিশ্বাসকে আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য একটি নামের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সেই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নিল ‘শিন্তো’ নামটি (Kitagawa, 1987)। অর্থাৎ, ‘শিন্তো’ শব্দটি নিজেই একটি সাংস্কৃতিক দ্বান্দ্বিকতা (Cultural Dialectic)-র ফল। এটি এমন একটি শব্দ যা জাপানিরা নিজেদের জন্য তৈরি করেনি, বরং ‘অন্য’ বা ‘অপর’-এর বিপরীতে নিজেদের পরিচয় টিকিয়ে রাখার জন্য গ্রহণ করেছিল।
কামি (Kami): এক বিমূর্ত ও মহাজাগতিক শক্তি
শিন্তো শব্দের ‘শিন’ বা ‘কামি’ অংশটি বোঝার জন্য আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে। আঠারো শতকের বিখ্যাত জাপানি পণ্ডিত এবং কোকুগাকু (Kokugaku) বা ‘জাতীয় শিক্ষা’ আন্দোলনের পুরোধা মোতোওরি নোরিনাগা (Motoori Norinaga) কামির যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, তা আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত। তিনি বলেছিলেন, এই মহাবিশ্বে যা কিছু সাধারণের চেয়ে আলাদা, যা কিছু আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়, যা কিছু শক্তিশালী – তা-ই কামি। এটি হতে পারে কোনো ভালো শক্তি, আবার হতে পারে কোনো ধ্বংসাত্মক শক্তি। অর্থাৎ, কামি হতে হলে তাকে যে কেবল দয়ালু বা মঙ্গলময় হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কামি হলো এক ধরণের অসামান্য উপস্থিতি (Extraordinary Presence)। এই দর্শন অনুযায়ী, বজ্রপাত, ভূমিকম্প বা ভয়ংকর ঝড় যেমন কামি, তেমনি শান্ত নদী, বিশাল ওক গাছ বা পাহাড়ও কামি। এই ধারণাটি নৃবিজ্ঞানের অ্যানিমিজম (Animism) বা সর্বপ্রাণবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অ্যানিমিজম বা সর্বপ্রাণবাদ বলে যে, প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুরই একটি আত্মা বা প্রাণ আছে। শিন্তো ধর্মে এই আত্মাকে বলা হয় ‘তামা’ (Tama)। যখন কোনো বস্তুর ভেতরের ‘তামা’ বা শক্তি খুব প্রবল হয়, তখন সেটি কামির মর্যাদা পায়।
পশ্চিমা দর্শনে ঈশ্বর এবং শয়তান বা ভালো এবং মন্দের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজন রেখা আছে, যাকে বলা হয় ডুয়েলিজম (Dualism)। কিন্তু শিন্তোর কামি ধারণায় এই বিভাজনটি নেই। এখানে কামিরা একই সাথে সৃজনশীল এবং ধ্বংসাত্মক হতে পারেন। কামির দুটি রূপ বা সত্তা আছে বলে বিশ্বাস করা হয় – একটি হলো ‘নিগিমিতামা’ (Nigimitama) বা শান্ত ও দয়ালু সত্তা, যা মানুষের মঙ্গল করে; এবং অন্যটি হলো ‘আরামিতামা’ (Aramitama) বা উগ্র ও হিংস্র সত্তা, যা ধ্বংস ডেকে আনে (Yamakage, 2006)। একই প্রকৃতির দেবতা যখন সময়মতো বৃষ্টি দিয়ে ফসল ফলায় তখন তিনি নিগিমিতামা, আবার যখন বন্যার তোড়ে গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যান তখন তিনি আরামিতামা। শিন্তো বা ‘কামির পথ’ মানে হলো এই দুই শক্তির ভারসাম্য বজায় রেখে চলা। কামিকে তুষ্ট রাখা, যাতে তার উগ্র রূপটি শান্ত থাকে। শিন্তো শব্দের অর্থের মধ্যে এই যে ‘ভয়’ এবং ‘শ্রদ্ধা’র মিশ্রণ, এটিই এর মূল চালিকাশক্তি। জাপানি ভাষায় একে বলা হয় ‘ওসোরে’ (Osore), যার অর্থ হলো এমন এক অনুভূতি যেখানে ভয়ের সাথে গভীর ভক্তি মিশে আছে।
শিন্তো ধর্মে ‘আট মিলিয়ন কামি’ বা Yaoyorozu no Kami (Eight Million Kami)-র যে ধারণা প্রচলিত আছে, তা আসলে শিন্তো শব্দের ব্যাপ্তিকে নির্দেশ করে। প্রাচীন জাপানি ভাষায় ‘আট’ সংখ্যাটি অসীম বা বহুত্বের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাই আশি লক্ষ কামি মানে আসলে আক্ষরিক অর্থে আশি লক্ষ নয়, বরং অগণিত। এই দর্শনের নাম দেওয়া যেতে পারে পলিথিজম (Polytheism) বা বহুদেববাদ। কিন্তু এটি সাধারণ বহুদেববাদের চেয়েও একটু আলাদা। কারণ এখানে দেবতারা কোনো নির্দিষ্ট স্বর্গে বসে থাকেন না। তারা আমাদের আশেপাশেই থাকেন। শিন্তো বিশ্বাস মতে, এই জগত এবং কামির জগত কোনো আলাদা সত্তা নয়, বরং একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই শিন্তো শব্দের ‘শিন’ অংশটি আমাদের শেখায় যে, পবিত্রতা কোনো দূরের বিষয় নয়, এটি আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে, শুধু দেখার চোখ থাকতে হয়। এই দর্শনকে তাত্ত্বিক ভাষায় প্যানথিজম (Pantheism) বা সর্বেশ্বরবাদের কাছাকাছি মনে হতে পারে, কিন্তু শিন্তো প্যানথিজমের চেয়েও বেশি কিছু। প্যানথিজম বলে সব কিছুই ঈশ্বর, আর শিন্তো বলে সব কিছুর ভেতরেই ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ বা সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, যা বিশেষ মুহূর্তে প্রকাশিত হয়। এই বিশেষ মুহূর্ত বা সংযোগকে বলা হয় মুসুবি (Musubi) বা সৃষ্টির মেলবন্ধন (Kasulis, 2004)।
পথ বা ‘তো’ (To): দর্শন নাকি জীবনপ্রণালী?
শিন্তো শব্দের দ্বিতীয় অংশ ‘তো’ বা ‘দো’ এসেছে চীনা শব্দ ‘তাও’ থেকে। তাওবাদের প্রবক্তা লাও ৎসু (Lao Tzu)-এর দর্শনে ‘তাও’ মানে হলো মহাবিশ্বের চলার ছন্দ বা নিয়ম। কিন্তু জাপানি শিন্তোতে এই ‘পথ’ শব্দটির অর্থ একটু ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এখানে ‘পথ’ মানে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তা নয়, বরং এটি একটি জীবনপদ্ধতি বা আচরণের নিয়মাবলী। ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস বা অর্থোডক্সি (Orthodoxy) এবং আচার বা অর্থোপ্রাক্সি (Orthopraxy) বলে দুটি ধারণা আছে। অর্থোডক্সি মানে হলো সঠিক বিশ্বাস লালন করা (যেমন – ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস)। আর অর্থোপ্রাক্সি মানে হলো সঠিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা। শিন্তো শব্দের ‘তো’ মূলত অর্থোপ্রাক্সির দিকে ইঙ্গিত করে। শিন্তোতে আপনি মনে মনে কী বিশ্বাস করছেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি আচারগুলো সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা। আপনি কামিতে বিশ্বাস না করেও যদি ঠিকঠাক হাত ধুয়ে, মাথা নত করে প্রার্থনা করেন, তবে আপনি শিন্তো ‘পথ’-এ আছেন বলে ধরে নেওয়া হবে।
এই ‘পথ’ ধারণাটি জাপানের অন্যান্য শিল্পকলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন – জুডো (Judo – নমনীয়তার পথ), ক্যেন্ডো (Kendo – তলোয়ারের পথ), সা দো (Sado – চায়ের পথ) বা কোদো (Kodo – সুগন্ধির পথ)। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘দো’ বা পথ মানে হলো নিজেকে নিখুঁত করার নিরন্তর সাধনা। শিন্তো বা ‘কামির পথ’-এ হাঁটার অর্থ হলো নিজের জীবনকে এমনভাবে পরিচালিত করা, যাতে প্রকৃতির সাথে কোনো সংঘাত না হয়। একে বলা হয় কান্নাগারা নো মিচি (Kannagara no Michi)। এটি হলো শিন্তো শব্দটির বিশুদ্ধ জাপানি রূপ। ‘কান্নাগারা’ মানে হলো ‘কামির ইচ্ছা অনুযায়ী’ বা ‘প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ অনুযায়ী’। আর ‘মিচি’ মানে পথ। অর্থাৎ, কোনো জোরজবরদস্তি না করে, নদীর স্রোতের মতো বা বাতাসের গতির মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন যাপন করাই হলো শিন্তো। এখানে কোনো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নেই যা আপনাকে বলে দেবে কী করতে হবে। আপনার নিজের বিবেক বা ‘মাকোতো’ (Makoto – আন্তরিকতা বা সত্যবাদীতা) হলো একমাত্র গাইড। যদি আপনার হৃদয় আয়নার মতো পরিষ্কার থাকে, তবে আপনি নিজেই বুঝবেন কোন পথে চলতে হবে (Nelson, 1996)।
‘শিন্তো’ শব্দের উৎপত্তির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, এটি কেবল একটি নাম নয়, এটি একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক হাতিয়ারও বটে। নিহন শকি (Nihon Shoki), যা ৭২০ খ্রিস্টাব্দে রচিত জাপানের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ইতিহাস গ্রন্থ, সেখানে ‘শিন্তো’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। সেই সময় জাপানের সম্রাটরা চাইছিলেন নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে। তারা দাবি করলেন যে, তারা সরাসরি সূর্যদেবী আমাতেরাসুর বংশধর। এই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ‘শিন্তো’ বা দেবতাদের পথের ধারণাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলো। অর্থাৎ, শিন্তো শব্দের জন্মের সাথে জাপানের রাজতন্ত্র এবং জাপানি জাতীয়তাবাদের জন্মও জড়িয়ে আছে। মেইজি যুগের (১৮৬৮-১৯১২) শাসকরা এই শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন স্টেট শিন্তো (State Shinto) নামক এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মতবাদ প্রচারের জন্য, যেখানে সম্রাটকে জীবন্ত কামি হিসেবে পূজা করা হতো। তখন শিন্তো শব্দের অর্থ দাঁড়িয়েছিল – রাষ্ট্রের প্রতি এবং সম্রাটের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিন্তো আবার তার আদিম, প্রাকৃতিক অর্থে ফিরে এসেছে।
শব্দতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট
শিন্তো শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ভাষা কীভাবে মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। একে বলা হয় লিঙ্গুইস্টিক রিলেটিভিটি (Linguistic Relativity) বা সাপির-হোর্ফ প্রকল্প (Sapir-Whorf Hypothesis)। জাপানিরা যখন তাদের আদি বিশ্বাসকে ‘শিন্তো’ নামে ডাকতে শুরু করল, তখন তারা অবচেতনভাবেই কামি এবং মানুষের মধ্যে একটা সম্পর্ক বা ‘পথ’ তৈরি করে ফেলল। যদি তারা একে ‘শিন্তো’ না বলে অন্য কোনো নাম দিত, হয়তো তাদের ধর্মচরণের ধরণও বদলে যেত। ‘শিন্তো’ নামটির মধ্যে একটা গতিশীলতা বা ডায়নামিজম (Dynamism) আছে। এটি স্থির কোনো গন্তব্য নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ঠিক যেমন ঋতু পরিবর্তন হয়, সূর্য ওঠে এবং ডোবে – শিন্তোও তেমনি প্রবাহমান। পশ্চিমা ধর্মে ‘স্যালভেশন’ বা পরিত্রাণ-এর ধারণা প্রবল, যেখানে মানুষ মনে করে এই জীবন দুঃখময় এবং মৃত্যুর পর শান্তি মিলবে। কিন্তু শিন্তো শব্দের অর্থে এমন কোনো নেতিবাচকতা নেই। শিন্তো বা দেবতাদের পথ হলো এই ইহজাগতিক জীবনকে উদযাপন করার পথ। একে বলা হয় ভাইটালিজম (Vitalism) বা জীবনীশক্তিবাদ। শিন্তো বিশ্বাস করে, জীবন পবিত্র, উৎপাদন পবিত্র, এবং এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই এক বড় আশীর্বাদ।
শিন্তো শব্দের আরেকটি গভীর দিক হলো ‘পবিত্রতা’ বনাম ‘অপবিত্রতা’র ধারণা। কামির পথে চলার প্রধান শর্ত হলো নিজেকে শুদ্ধ রাখা। এখানে পাপ বা সিন (Sin) বলতে কিছু নেই, আছে ‘কেগারে’ (Kegare) বা অপবিত্রতা। ‘কেগারে’ শব্দটি এসেছে ‘কি’ (Ki – জীবনশক্তি) এবং ‘কারে’ (Kare – শুকিয়ে যাওয়া) থেকে। অর্থাৎ, যখন মানুষের জীবনশক্তি শুকিয়ে যায় বা মলিন হয়ে যায়, তখন সে অপবিত্র হয়। শিন্তো শব্দের মর্মার্থ হলো এই শুকিয়ে যাওয়া জীবনীশক্তিকে আবার সজীব করে তোলা। মন্দিরে গিয়ে হাত ধোয়া, লবণ ছিটানো বা ঘণ্টা বাজানো – এ সবই হলো সেই জীবনীশক্তিকে রিচার্জ করার প্রক্রিয়া। তাই শিন্তোকে ধর্মের চেয়ে ‘শুদ্ধিকরণের প্রযুক্তি’ বা টেকনোলজি অফ পিউরিফিকেশন (Technology of Purification) বলাটা বেশি যুক্তিযুক্ত হতে পারে।
পরিশেষে, শিন্তো শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, এটি আসলে জাপানি জাতির আয়না। এই শব্দের ভেতরে তাদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা ফুটে উঠেছে। ‘কামি’ মানে শুধু দেবতা নয়, কামি মানে হলো সেই অদৃশ্য সুতা যা মানুষকে প্রকৃতির সাথে বেঁধে রাখে। আর ‘তো’ বা পথ মানে হলো সেই সুতো ধরে এগিয়ে চলা। শিন্তো কোনো ডগমা বা মতবাদ নয়, এটি একটি অনুভূতি। হাজার বছর ধরে জাপানিরা এই শব্দটিকে বুকে লালন করে আসছে, কারণ এই শব্দের মাধ্যমেই তারা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে পায়। আধুনিকতার চরম শিখরে পৌঁছেও তারা যখন তোরিই গেটের সামনে মাথা নত করে, তখন তারা আসলে সেই আদিম ‘শিন্তো’ বা দেবতাদের পথের কাছেই আত্মসমর্পণ করে, যা তাদের শিখিয়েছে কীভাবে প্রকৃতির বিশালতার সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হয়।
কামি (Kami): জাপানি সত্তার বিমূর্ত ও মহাজাগতিক রূপ
শিন্তো ধর্ম বা জাপানি আধ্যাত্মিকতা বুঝতে হলে আপনাকে প্রথমেই আপনার মনের মধ্যে গেঁথে থাকা ‘ঈশ্বর’ বা ‘গড’ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাগুলোকে একটু দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। আমরা সাধারণত ঈশ্বর বলতে যা বুঝি – তিনি আকাশের কোথাও বসে আছেন, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি বিচারক এবং তিনি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে – শিন্তোর ‘কামি’ (Kami) মোটেও সেরকম কিছু নন। এটি এমন এক ধারণা যা পশ্চিমা বা মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মতত্ত্বের ফ্রেমে ঠিকমতো আটানো যায় না। কামি ধারণাটি এতটাই তরল এবং বহুমাত্রিক যে, একে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা প্রায় অসম্ভব। কামি কোনো একক সত্তা নন, বরং কামি হলো এক ধরণের উপস্থিতি, এক ধরণের শক্তি, যা এই বিশ্বচরাচরের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। জাপানিরা মনে করে, এই দৃশ্যমান জগতের আড়ালে এক অদৃশ্য জগত আছে, যেখানে অসংখ্য শক্তি কাজ করে, আর সেই শক্তিগুলোই হলো কামি। এই কামি ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে, বিশাল হতে পারে, আবার ক্ষুদ্রও হতে পারে। আঠারো শতকের বিখ্যাত জাপানি পণ্ডিত এবং কোকুগাকু (Kokugaku) বা ‘জাতীয় শিক্ষা’ আন্দোলনের পুরোধা মোতোওরি নোরিনাগা (Motoori Norinaga) কামির যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, তা আজ পর্যন্ত এই বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে ধরা হয়। তিনি বলেছিলেন, যা কিছু সাধারণের চেয়ে আলাদা, যা কিছু আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়, যা কিছু শক্তিশালী – তা-ই কামি (Breen & Teeuwen, 2010)।
ব্যাপারটা আরেকটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। নোরিনাগার সংজ্ঞায় ‘বিস্ময়’ বা ‘Awe’ শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন বিশাল কোনো জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়ান, তখন এর গর্জন শুনে আপনার বুকের ভেতর কি একটু কেঁপে ওঠে না? কিংবা গভীর অরণ্যে প্রাচীন কোনো মহীরুহ বা বিশাল গাছের নিচে দাঁড়ালে কি মনে হয় না যে, এই গাছটির একটি নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে? এই যে অনুভূতি – যেখানে ভয়ের সাথে শ্রদ্ধা এবং বিস্ময় মিশে একাকার হয়ে যায় – জাপানিরা একেই কামির উপস্থিতি বলে মনে করে। তাই কামি হতে পারেন জাপানি মিথোলজির প্রধান চরিত্র সূর্যদেবী আমাতেরাসু (Amaterasu), আবার কামি হতে পারে আপনার বাড়ির পাশের সেই জরাজীর্ণ পাহাড়টি। প্রকৃতির যে শক্তি মানুষকে অভিভূত করে, জাপানিরা বিশ্বাস করে তার ভেতরেই এক পবিত্র আত্মা বা শক্তি বসবাস করে, আর সেই শক্তিকেই তারা কামি হিসেবে পূজা করে। এই দর্শনের পোশাকি নাম হলো অ্যানিমিজম (Animism) বা সর্বপ্রাণবাদ। অ্যানিমিজম অনুযায়ী, জড় ও জীব – সব কিছুরই প্রাণ বা আত্মা আছে। তবে শিন্তো ধর্মে সব কিছুই কামি নয়; বরং যার মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ বা ‘মুসুবি’ (Musubi) ঘটে, তাকেই কামি বলা হয়। এটি হতে পারে পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, বজ্রপাত, ঝড়, এমনকি অদ্ভুত আকৃতির কোনো পাথর। অর্থাৎ, কামি ধারণাটি ইমানেন্স (Immanence) বা বিশ্বগত উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে স্রষ্টা বা ঐশ্বরিক শক্তি সৃষ্টির বাইরে নয়, বরং সৃষ্টির ভেতরেই অবস্থান করে (Picken, 1994)।
মানব কামি ও পূর্বপুরুষের উপাসনা
শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষও কামি হতে পারে, আর এটি শিন্তো ধর্মের অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক দিক। পশ্চিমা ধর্মে মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকে, মানুষ কখনোই ঈশ্বর হতে পারে না। কিন্তু শিন্তো বিশ্বাস মতে, মানুষ এবং কামির মধ্যে কোনো দুর্লংঘ্য প্রাচীর নেই। জাপানিরা বিশ্বাস করে, সব মানুষের ভেতরেই কামির অংশ বা ‘মিতামা’ (Mitama) সুপ্ত অবস্থায় থাকে। মৃত্যুর পর মানুষ তার নশ্বর দেহ ত্যাগ করে এবং তার আত্মা কামি বা আত্মায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যাপোথিওসিস (Apotheosis) বা মানুষকে দেবত্ব প্রদান। প্রাচীনকালে জাপানের সম্রাটকে ‘জীবন্ত কামি’ বা ইকিগামি (Ikigami) মনে করা হতো। বিশ্বাস করা হতো, তিনি সূর্যদেবীর সরাসরি বংশধর। তবে কেবল সম্রাট নন, মহান কোনো যোদ্ধা, প্রতিভাবান কবি, কিংবা বিজ্ঞ পণ্ডিত মারা যাওয়ার পর কামি হিসেবে পূজিত হতে পারেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন দশম শতাব্দীর পণ্ডিত সুগাওয়ারা নো মিচিজানে (Sugawara no Michizane)। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি, কিন্তু রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্বাসনে মারা যান। তার মৃত্যুর পর রাজধানীতে একের পর এক দুর্যোগ নামতে শুরু করে – বজ্রপাত, প্লেগ, অকালমৃত্যু। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, মিচিজানের ক্রুদ্ধ আত্মা বা ওনরিও (Onryo) এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাকে শান্ত করার জন্য তাকে ‘তেঞ্জিন’ (Tenjin) বা বিদ্যা ও শিক্ষার কামি হিসেবে পূজা করা শুরু হলো। আজও জাপানি ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার আগে তেঞ্জিন-এর মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করে।
এই যে মৃত মানুষকে কামি হিসেবে পূজা করা, এর মূলে রয়েছে পূর্বপুরুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা বা অ্যানসেস্টর ওয়ারশিপ (Ancestor Worship)। জাপানি পরিবারগুলোতে ‘কামিদানা’ (Kamidana) বা দেবতাদের তাক থাকে, যেখানে তারা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের নামফলক রাখে এবং প্রতিদিন তাদের উদ্দেশ্যে খাবার ও পানীয় নিবেদন করে। তারা মনে করে, মৃত আত্মীয়রা কামি হয়ে তাদের পরিবারের আশেপাশেই আছেন এবং বিপদে-আপদে তাদের রক্ষা করছেন। শিন্তো ধর্মে মানুষকে আদতে পাপী বা অরিজিনাল সিন (Original Sin)-এর অধিকারী মনে করা হয় না, বরং মনে করা হয় জন্মগতভাবে পবিত্র। মানুষের মন বা হৃদয় হলো কামির আয়না। ধুলোবালি জমে যেমন আয়না ঘোলা হয়ে যায়, তেমনি লোভ, মোহ আর দুনিয়াবি মলিনতায় মানুষের সেই পবিত্রতা সাময়িকভাবে ঢাকা পড়ে যায়। শিন্তো আচারের উদ্দেশ্য হলো সেই ধুলো পরিষ্কার করে ভেতরের কামি-সত্তাকে জাগিয়ে তোলা। এই দর্শনের সাথে কনফুসীয়বাদের ফিলিয়াল পায়েটি (Filial Piety) বা পিতৃপুরুষের প্রতি ভক্তির ধারণার একটি চমৎকার মিশ্রণ ঘটেছে, যা জাপানি সমাজকে আজও সংহত করে রেখেছে।
কামির দ্বৈত সত্তা ও মনস্তত্ত্ব
কামির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ঠিক আমাদের কল্পনার ‘নিখুঁত’ বা ‘পরম করুণাময়’ দেবতা নন। কামিদেরও মানুষের মতো আবেগ আছে, রাগ আছে, ক্ষোভ আছে। শিন্তো তত্ত্বে কামির এই দ্বৈত সত্তা বা এমবিভেলেস (Ambivalence)-কে খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। প্রতিটি কামির দুটি দিক বা আত্মা থাকে। একটি হলো নিগিমিতামা (Nigimitama) বা শান্ত, দয়ালু ও কল্যাণকর সত্তা। এই রূপে কামি মানুষকে ফসল দেন, সুস্বাস্থ্য দেন এবং রক্ষা করেন। অন্যটি হলো আরামিতামা (Aramitama) বা উগ্র, হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক সত্তা। যখন কামি রেগে যান বা তাকে অবহেলা করা হয়, তখন তার এই আরামিতামা রূপ প্রকাশ পায় এবং তিনি মহামারী, ভূমিকম্প বা যুদ্ধের মতো দুর্যোগ ডেকে আনেন। এই ধারণাটি জাপানের ভৌগোলিক অবস্থার সাথে খুব ভালোভাবে মিলে যায়। জাপান একটি দ্বীপরাষ্ট্র যেখানে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প, সুনামি আর টাইফুন আঘাত হানে। প্রাচীন জাপানিরা প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ দেখে ভেবেছিল, নিশ্চয়ই কামিরা কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই শিন্তো রিচুয়াল বা আচারের মূল উদ্দেশ্য হলো কামির ‘আরামিতামা’ বা উগ্র রূপকে শান্ত করে ‘নিগিমিতামা’ বা শান্ত রূপে ফিরিয়ে আনা।
এই ধারণা থেকেই শিন্তোতে শুভ এবং অশুভ কামির বিভাজন তৈরি হয়েছে। কিছু কামি আছেন যারা স্বভাবতই ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন, তাদের বলা হয় মাগাতসুহি নো কামি (Magatsuhi no Kami) বা বিপর্যয়ের দেবতা। এরা মানুষের জীবনে দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে। তবে শিন্তো ধর্মে এদের শয়তান বলা হয় না, বরং এরাও প্রকৃতিরই অংশ। এদের দূর করার জন্য বা শান্ত করার জন্য ‘হারাই’ (Harae) বা শুদ্ধিকরণ প্রথা পালন করা হয়। আবার মিথোলজিতে আমরা দেখি, কামিরা মানুষের মতোই ভুল করেন, প্রেমে পড়েন, ঈর্ষান্বিত হন। যেমন – ঝড়ের দেবতা সুসানো (Susanoo) রাগের মাথায় তার বোন সূর্যদেবী আমাতেরাসুর ধানের ক্ষেত নষ্ট করে দিয়েছিলেন এবং পবিত্র তাঁতঘরে মরা ঘোড়া ছুড়ে মেরেছিলেন। ভয়ে ও অপমানে আমাতেরাসু এক গুহার মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিলেন, ফলে পুরো পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। এই গল্পগুলো প্রমাণ করে যে, কামি বা দেবতারা নৈতিকতার উর্ধ্বে নন, বরং তারা মহাজাগতিক শক্তির অ্যানথ্রোপমরফিজম (Anthropomorphism) বা মানবীয় রূপায়ন। অর্থাৎ, মানুষ নিজের দোষ-গুণগুলোকেই কামির চরিত্রের মধ্যে আরোপ করে তাদের বোঝার চেষ্টা করেছে।
আশি লক্ষ কামি ও অসীমত্বের ধারণা
শিন্তো ধর্মে সংখ্যাতত্ত্বের একটা খুব মজার এবং গভীর দার্শনিক ব্যাপার আছে। বলা হয়, জাপানে ‘আট মিলিয়ন কামি’ বা Yaoyorozu no Kami (Eight Million Kami) আছেন। এখানে ‘আট মিলিয়ন’ বা আশি লক্ষ সংখ্যাটি আসলে আক্ষরিক অর্থে বা গণিত মেনে ব্যবহৃত হয় না। প্রাচীন জাপানি সংস্কৃতিতে ‘আট’ সংখ্যাটি ছিল অসীম, বিশালতা বা বহুত্বের প্রতীক। তাই ‘আট মিলিয়ন কামি’ বলার অর্থ হলো – এই বিশ্বচরাচরে কামির কোনো শেষ নেই, তারা অগণিত বা অসংখ্য। এটি পলিথিজম (Polytheism) বা বহুদেববাদের এক চূড়ান্ত রূপ, যেখানে প্রতিটি বস্তুরই কামি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আপনার রান্নার চুলা থেকে শুরু করে বিশাল পর্বত – সবখানেই কামি থাকতে পারে। এই ধারণা জাপানিদের মানসিকতায় বস্তুর প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করেছে। তারা মনে করে, আমরা যে জিনিসগুলো ব্যবহার করি, যেমন – সুঁই, চিরুনি, বা পুতুল, দীর্ঘকাল ব্যবহারের ফলে এগুলোর ভেতরেও এক ধরণের আত্মা তৈরি হয়। একে বলা হয় তসুকুমোগামি (Tsukumogami)। এই বিশ্বাস থেকেই জাপানে পুরনো জিনিস বা নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিস ফেলার আগে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেমন – ‘হারি-কুয়ো’ (Hari-Kuyo) বা ভাঙা সুঁইয়ের শেষকৃত্য। তারা মনে করে, এতদিন সেবা দেওয়ার জন্য এই জড়বস্তুগুলোর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত।
কামির এই অগণিত সংখ্যার পেছনে রয়েছে জাপানিদের স্থানীয় বা আঞ্চলিকতাবোধ। জাপানের প্রতিটি গ্রামের, প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব কামি আছে। গ্রামের রক্ষাকর্তা কামিকে বলা হয় উজিগামি (Ujigami) বা গোত্র দেবতা। প্রাচীনকালে নির্দিষ্ট কোনো গোত্র বা ‘উজি’ (Uji) তাদের পূর্বপুরুষকে কামি হিসেবে পূজা করত। কালক্রমে সেই গোত্র দেবতা ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূখণ্ডের দেবতা বা চিনজু নো কামি (Chinju no Kami)-তে পরিণত হয়। আপনি যদি টোকিও থেকে কিয়োটো যান, দেখবেন সেখানকার কামি আলাদা, তাদের পূজার পদ্ধতিও কিছুটা আলাদা। এই বৈচিত্র্য শিন্তোকে কোনো এককেন্দ্রিক ধর্ম হতে দেয়নি, বরং একে করেছে অত্যন্ত নমনীয় এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়ার উপযোগী। কোনো কোনো কামি আবার সর্বজনীন, যেমন ইনারি (Inari) বা চাল ও ব্যবসার দেবতা। জাপানে ইনারির হাজার হাজার মন্দির আছে, যা প্রমাণ করে যে স্থানীয় কামির পাশাপাশি সর্বজনীন কামির ধারণাও প্রবল। সব মিলিয়ে, কামি ধারণাটি জাপানিদের জগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। তারা একা নয়, বরং তারা প্রতিনিয়ত অসংখ্য অদৃশ্য শক্তির সাথে সহাবস্থান করছে – এই বোধ তাদের নম্রতা ও প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা শেখায়।
পবিত্রতা ও অপবিত্রতা: শিন্তো দর্শনের দ্বান্দ্বিক সমীকরণ
জাপানের সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে, তা হলো পরিচ্ছন্নতা। এই পরিচ্ছন্নতা কেবল ধুলোবালি পরিষ্কার করা বা জীবাণুমুক্ত থাকার আধুনিক স্বাস্থ্যবিধি নয়, এর শেকড় প্রোথিত আছে তাদের হাজার বছরের পুরনো বিশ্বাস শিন্তো ধর্মের গভীরে। শিন্তো ধর্মের পুরো দর্শন এবং ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে মূলত দুটি স্তম্ভের ওপর – একটি হলো পবিত্রতা বা ‘কিয়োম’ (Kiyome), আর অন্যটি হলো অপবিত্রতা বা ‘কেগারে’ (Kegare)। পশ্চিমা বা আব্রাহামিক ধর্মে আমরা ‘পাপ’ বা সিন (Sin) বলতে যা বুঝি – অর্থাৎ ঈশ্বরের আইন অমান্য করা বা নৈতিক স্খলন – শিন্তোতে ঠিক সেই অর্থে কোনো পাপ নেই। শিন্তো বিশ্বাস করে, মানুষ জন্মগতভাবে পবিত্র এবং নিষ্পাপ। তারা মনে করে, মানুষ হলো ‘কামির সন্তান’ বা কামি নো কো (Kami no Ko)। কিন্তু জাগতিক জীবনে চলতে গিয়ে মানুষ বিভিন্ন সময় এমন কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় বা এমন কিছু কাজ করে ফেলে, যা তাদের সেই সহজাত পবিত্রতাকে ঢেকে দেয়। এই সাময়িক মলিনতা বা দূষণকেই বলা হয় ‘কেগারে’। এটি এমন এক অবস্থা যখন মানুষের ভেতরের উজ্জ্বলতা কমে যায় এবং সে কামির সান্নিধ্য লাভের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এই কেগারে দূর করে পুনরায় পবিত্র হওয়ার প্রক্রিয়াই হলো ‘হারাই’ (Harae) বা শুদ্ধিকরণ।
শিন্তো ধর্মে পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ধারণাটি বোঝার জন্য আমাদের নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব (Anthropological Theory)-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী মেরি ডগলাস তার Purity and Danger বইয়ে বলেছিলেন, “Dirt is matter out of place.” অর্থাৎ, নোংরা বা অপবিত্রতা হলো এমন কিছু যা তার সঠিক জায়গায় নেই। শিন্তোতেও ঠিক তাই। রক্ত, মৃত্যু বা রোগ – এগুলো প্রকৃতিরই অংশ, কিন্তু যখন এগুলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বা পবিত্র স্থানের সংস্পর্শে আসে, তখনই তা ‘কেগারে’ বা অপবিত্রতা তৈরি করে। জাপানি শব্দ ‘কেগারে’ নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে চমৎকার কিছু বিশ্লেষণ আছে। অনেকে মনে করেন, শব্দটি এসেছে ‘কি’ (Ki – জীবনীশক্তি বা এনার্জি) এবং ‘কারে’ (Kare – শুকিয়ে যাওয়া বা ম্লান হওয়া) থেকে। অর্থাৎ, ‘কেগারে’ মানে হলো ‘উইদার্ড স্পিরিট’ বা শুকিয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি (Namiki, 2018)। যখন একজন মানুষ মৃত্যু বা শোকের সংস্পর্শে আসে, তখন তার জীবনীশক্তি কমে যায়, সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বল অবস্থাই হলো অপবিত্রতা। শিন্তো আচারের মূল উদ্দেশ্য হলো সেই শুকিয়ে যাওয়া জীবনীশক্তিকে পুনরায় সজীব এবং সতেজ করে তোলা। তাই শিন্তো ধর্মে শুদ্ধিকরণ কোনো নৈতিক প্রায়শ্চিত্ত নয়, বরং এটি একটি সাইকো-সোমাটিক প্রসেস (Psycho-somatic Process) বা মনোদৈহিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার হারানো শক্তি ফিরে পায়।
কেগারে: অপবিত্রতার উৎস ও স্বরূপ
শিন্তো বিশ্বাস মতে, অপবিত্রতা বা কেগারে হলো ছোঁয়াচে রোগের মতো। এটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে, এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রাচীন জাপানি আইন ও রীতিনীতির সংকলন এঙ্গিশিকি (Engishiki), যা দশম শতাব্দীতে সংকলিত হয়েছিল, সেখানে অপবিত্রতার বিভিন্ন উৎসের কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অপবিত্রতা হলো মৃত্যু। মৃত্যুকে শিন্তোতে ‘কালো অপবিত্রতা’ বা কুরো-ফুজো (Kuro-fujo) হিসেবে দেখা হয়। মৃতদেহ, শবযাত্রা বা শ্মশানের সংস্পর্শে আসা যেকোনো কিছু তৎক্ষণাৎ অপবিত্র হয়ে যায়। এই কারণেই জাপানে শিন্তো মন্দিরে সচরাচর কোনো শেষকৃত্য বা ফিউনারেল হয় না। জাপানিরা বলে, “শিন্তো জীবনের জন্য, আর বৌদ্ধধর্ম মৃত্যুর জন্য।” তাই জাপানে ৯৯ শতাংশ মানুষের বিয়ে হয় শিন্তো রীতিতে, কিন্তু মৃত্যু হলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয় বৌদ্ধ রীতিতে। একে বলা হয় ধর্মীয় শ্রমবিভাজন বা রিলিজিয়াস ডিভিশন অফ লেবার (Religious Division of Labor)। প্রাচীনকালে সম্রাটরা, যাদের মনে করা হতো সূর্যদেবীর বংশধর এবং পরম পবিত্রতার প্রতীক, তারা মৃত্যুর ছোঁয়া থেকে নিজেদের যোজন যোজন দূরে রাখতেন। ইতিহাসে এমন নজিরও আছে যে, প্রাসাদে কেউ মারা গেলে বা মহামারী দেখা দিলে সম্রাট সেই প্রাসাদ এমনকি পুরো রাজধানী পরিবর্তন করে ফেলতেন, পাছে সেই স্থানের ‘কেগারে’ তাদের স্পর্শ করে। এই মৃত্যুভীতি থেকেই জাপানি সমাজে লবণ ছিটিয়ে শুদ্ধ করার প্রথা এসেছে। আজও জাপানিরা যখন কোনো শেষকৃত্য অনুষ্ঠান থেকে বাড়ি ফেরে, তখন দরজায় ঢোকার আগে তাদের গায়ে লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়, যাতে মৃত্যুর অপবিত্রতা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে না পারে।
মৃত্যু ছাড়াও রক্ত বা রক্তপাত হলো অপবিত্রতার আরেকটি বড় উৎস, যাকে বলা হয় ‘লাল অপবিত্রতা’ বা আকা-ফুজো (Aka-fujo)। ঋতুস্রাব বা মাসিকের রক্ত এবং সন্তান প্রসবের সময়কার রক্তপাতকে প্রাচীন শিন্তোতে অপবিত্র হিসেবে দেখা হতো। একে বলা হয় ব্লাড টাবু (Blood Taboo)। এই ধারণার কারণে দীর্ঘকাল ধরে নারীদের অনেক পবিত্র পাহাড়ে ওঠা বা নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার পালনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। যেমন – পবিত্র মাউন্ট ওমিনে (Mount Omine)-তে আজও নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। অবশ্য আধুনিক যুগে এই ধারণাগুলোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং একে লিঙ্গবৈষম্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটি ছিল রক্তের প্রতি এক ধরণের ভীতি ও সম্ভ্রম। শিন্তো তত্ত্বে রক্তকে জীবনের উৎস এবং একই সাথে ভীতিকর শক্তি হিসেবে দেখা হয়। এছাড়াও রোগব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পাপ কাজ – যেমন কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটানো বা অন্যের ক্ষতি করা – এগুলোও কেগারেকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রাচীনকালে মানুষ মনে করত, কেউ যদি অপবিত্র অবস্থায় কামির সামনে যায়, তবে কামি রুষ্ট হবেন এবং সমাজে বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই এই ‘কেগারে’ দূর করাটা কেবল ব্যক্তিগত প্রশান্তির বিষয় ছিল না, বরং এটি ছিল এক ধরণের সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সোশ্যাল অবলিগেশন (Social Obligation)।
হারাই (Harae): শুদ্ধিকরণের নান্দনিকতা
অপবিত্রতা থাকলে তা দূর করার উপায়ও শিন্তোতে বাতলে দেওয়া হয়েছে, যাকে বলা হয় ‘হারাই’ বা শুদ্ধিকরণ। শুদ্ধিকরণের সবচেয়ে সহজ এবং প্রধান মাধ্যম হলো জল। জাপানি মিথোলজিতে দেখা যায়, ইজানাগি যখন পাতালপুরী বা মৃতদের জগত থেকে ফিরে এলেন, তখন তিনি নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য নদীর জলে স্নান করেছিলেন। এই স্নান থেকেই জন্ম হয়েছিল প্রধান তিন কামির। এই পৌরাণিক ঘটনা থেকে এসেছে ‘মিসোগি’ (Misogi) বা জল দিয়ে পূর্ণাঙ্গ স্নানের প্রথা। আজও অনেক উৎসবে জাপানিরা বরফশীতল জলপ্রপাতে বা নদীতে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করতে করতে স্নান করে। তারা বিশ্বাস করে, প্রবহমান জল বা রানিং ওয়াটার (Running Water) শরীরের সব ময়লা ও মনের সব গ্লানি ধুয়ে নিয়ে যায়। তবে প্রতিদিন তো আর নদীতে স্নান করা সম্ভব নয়, তাই এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হলো ‘তেমিজু’ (Temizu)। জাপানিরা যখন কোনো শিন্তো মন্দিরে বা ‘জিঞ্জা’ (Jinja)-তে প্রবেশ করে, তখন প্রথমেই তারা তোরণ বা তোরিই পার হয়ে একটি ছোট পাথরের জলাধারের (Temizuya/Chozuya) সামনে দাঁড়ায়। সেখানে কাঠের হাতলওয়ালা পাত্র বা ‘হিশাকু’ দিয়ে জল তুলে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ হতে হয়। প্রথমে বাম হাত ধোয়া হয়, কারণ বাম দিককে বেশি পবিত্র মনে করা হয়। এরপর ডান হাত ধোয়া হয়। তারপর বাম হাতে জল নিয়ে মুখ কুলকুচি করা হয়। সবশেষে পাত্রটি খাড়া করে ধরে হাতলে জল গড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে পরবর্তী ব্যবহারকারীর জন্য হাতলটি পরিষ্কার থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে এবং মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। এই রিচুয়ালের উদ্দেশ্য হলো, ধুলোবালি ও বাইরের জগতের অপবিত্রতা ধুয়ে ফেলে শুদ্ধ হয়ে কামির সামনে দাঁড়ানো (Littleton, 2002)।
জল ছাড়াও শুদ্ধিকরণের আরেকটি শক্তিশালী উপাদান হলো লবণ বা ‘শিও’ (Shio)। জাপানি লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, লবণের রয়েছে অপশক্তিকে শোষণ করার এবং পবিত্রতা রক্ষা করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। আপনারা হয়তো টিভিতে সুমো কুস্তি দেখেছেন। বিশালদেহী সুমো কুস্তিগিররা বা রিকিশি (Rikishi)-রা যখন রিংয়ে বা ‘দোহিও’-তে নামেন, তখন তারা মুঠোভর্তি লবণ শূন্যে ছিটিয়ে দেন। এটি কোনো স্টাইল বা ফ্যাশন নয়, এটি একটি সিরিয়াস ধর্মীয় আচার। সুমো খেলার উদ্ভব হয়েছিল শিন্তো উৎসব থেকে, যেখানে শক্তিশালী মানুষেরা কামিকে তুষ্ট করার জন্য কুস্তি লড়ত। সুমো রিংটি হলো একটি পবিত্র স্থান, আর লবণ ছিটিয়ে কুস্তিগিররা সেই রিংটিকে ‘কেগারে’ মুক্ত করেন এবং নিজেদের শরীর ও মনকে শুদ্ধ করেন। এছাড়াও জাপানের অনেক রেস্টুরেন্ট বা দোকানের সামনে ছোট ছোট পিরামিড আকৃতির লবণের স্তূপ দেখা যায়, যাকে বলা হয় মোরিজিও (Morijio)। এর উদ্দেশ্য হলো খারাপ আত্মাকে দূরে রাখা এবং ভালো ক্রেতা বা ‘শুভ শক্তি’কে আকর্ষণ করা। লবণের এই ব্যবহার প্রমাণ করে যে, শিন্তো ধর্মে পবিত্রতা কোনো বিমূর্ত দর্শন নয়, বরং এটি একটি ম্যাটেরিয়াল কালচার (Material Culture) বা বস্তুগত সংস্কৃতির অংশ।
তসুমি এবং ওহারাই: পাপমোচনের উৎসব
শিন্তোতে ব্যক্তিগত অপবিত্রতার বাইরেও সমষ্টিগত পাপ বা দূষণের একটি ধারণা আছে, যাকে বলা হয় ‘তসুমি’ (Tsumi)। প্রাচীনকালে ‘তসুমি’ বলতে বোঝাত আইন ভঙ্গ করা, প্রকৃতির ক্ষতি করা বা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য কাজ করা। যখন কোনো সমাজে ‘তসুমি’ বা পাপ বেড়ে যায়, তখন বড় আকারের শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন হয়। একে বলা হয় ওহারাই (Oharae) বা মহাবিশুদ্ধিকরণ উৎসব। বছরে দুবার – জুলাই এবং ডিসেম্বরের শেষে – জাপানের বড় বড় মন্দিরগুলোতে এই ওহারাই অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে পুরোহিতরা একটি বিশেষ লাঠি নাড়ান, যার মাথায় কাগজের ফালি ঝোলানো থাকে। একে বলা হয় ওনুসা (Onusa) বা ‘হারাইগুশি’। পুরোহিত যখন ওনুসা নাড়ান, তখন বাতাসের শব্দ হয়, যা কামির উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। বিশ্বাস করা হয়, এই ওনুসা নাড়ানোর ফলে উপস্থিত ভক্তদের শরীর থেকে সব কেগারে বা অপবিত্রতা ঝরে পড়ে এবং ওনুসার কাগজের স্ট্রিপগুলো সেই অপবিত্রতাকে শুষে নেয়। পরে এই কাগজগুলো পুড়িয়ে বা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই আচারটি অনেকটা ঝাড়ফুঁকের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনের দর্শনটি হলো রিনিউয়াল (Renewal) বা নবায়ন। শিন্তো বিশ্বাস করে, সময় গড়ানোর সাথে সাথে পৃথিবী এবং মানুষের মন নোংরা হবেই, এটাই স্বাভাবিক। তাই নিয়মিত বিরতিতে সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করে আবার নতুনের মতো শুরু করাই হলো ওহারাই-এর মূল কথা।
আধুনিক জাপানে এই পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ধারণা তাদের সমাজজীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। জাপানিরা যে বাইরে থেকে এসে জুতা খুলে ঘরে ঢোকে, এর পেছনে ব্যবহারিক কারণের চেয়ে বেশি কাজ করে এই ‘পবিত্র বনাম অপবিত্র’ স্থানের বিভাজন। বাইরের জগত হলো অপবিত্র বা ‘সোতো’ (Soto), আর ঘরের ভেতরটা হলো পবিত্র বা ‘উচি’ (Uchi)। টয়লেটের জন্য আলাদা স্যান্ডেল ব্যবহার করা, প্রতিদিন স্নান করা, এমনকি ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা – এ সবকিছুর পেছনেই অবচেতনভাবে কাজ করে শিন্তোর ‘কেগারে’ এড়ানোর মানসিকতা। পরিবেশবাদী দৃষ্টিকোণ বা এনভায়রনমেন্টাল এথিক্স (Environmental Ethics)-এর জায়গা থেকেও এটি তাৎপর্যপূর্ণ। নদী বা বনকে দূষিত করা শিন্তো মতে কামির শরীরকে অপবিত্র করার শামিল। তাই আধুনিক পরিবেশ সচেতনতার সাথে শিন্তোর পবিত্রতার ধারণার এক মেলবন্ধন ঘটেছে। সব মিলিয়ে, শিন্তোর এই পবিত্রতা ও অপবিত্রতার দর্শন জাপানিদের শিখিয়েছে যে, ঈশ্বর বা কামি কোনো দূরের আকাশে থাকেন না, তিনি থাকেন পরিচ্ছন্নতায়, তিনি থাকেন পবিত্রতায়। শরীর ও মনকে শুদ্ধ রাখাই হলো কামির উপাসনার প্রথম এবং প্রধান ধাপ।
জাপানি মিথোলজি: সৃষ্টিতত্ত্ব ও কামিদের বিচিত্র জগত
পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হলো? মানুষ কোত্থেকে এল? মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাই? এই প্রশ্নগুলো মানুষকে সেই আদিমকাল থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সব ধর্মের, সব সভ্যতার নিজস্ব কিছু উত্তর আছে, আছে নিজস্ব কিছু গল্প। জাপানিদেরও আছে। তবে তাদের গল্পগুলো ঠিক ধর্মগ্রন্থে লেখা বাণীর মতো নয়, বরং এগুলো হলো রূপকথা, ইতিহাস আর লোকগাথার এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি। শিন্তো ধর্মের এই সৃষ্টিতত্ত্ব বা কসমোগনি (Cosmogony) সম্পর্কে আমরা জানতে পারি জাপানের দুটি প্রাচীনতম গ্রন্থ থেকে। একটি হলো কোজিকি (Kojiki), যার অর্থ ‘প্রাচীন ঘটনাবলির রেকর্ড’, যা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয়েছিল। আর অন্যটি হলো নিহন শকি (Nihon Shoki) বা ‘জাপানের ইতিবৃত্ত’, যা লেখা শেষ হয়েছিল ৭২০ খ্রিস্টাব্দে। এই বইগুলো কিন্তু বাইবেল বা কোরআনের মতো আসমানি কিতাব নয় যে এর প্রতিটি শব্দকে ধ্রুব সত্য বলে মানতে হবে। বরং অষ্টম শতাব্দীর জাপানি রাজদরবার বা ‘ইম্পেরিয়াল কোর্ট’ তাদের শাসনের বৈধতা প্রমাণের জন্য এবং নিজেদের সূর্যদেবীর বংশধর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই মিথোলজিগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছিল। একে বলা যেতে পারে পলিটিক্যাল মিথোলজি (Political Mythology)। তবুও, এই গল্পগুলোর সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য অপরিসীম, কারণ এগুলোই জাপানি মানসজগতকে তৈরি করেছে।
গল্পটা শুরু হয় এক মহাজাগতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী বা আকাশ বলে আলাদা কিছু ছিল না। সব কিছু ছিল একাকার, যেন এক বিশাল তেলের সমুদ্র বা জেলিফিশের মতো ভাসমান এক সত্তা। সেই বিশৃঙ্খলা বা ক্যায়োস (Chaos) থেকে ধীরে ধীরে স্বচ্ছ উপাদানগুলো ওপরে উঠে গিয়ে তৈরি হলো আকাশ বা স্বর্গ, যাকে বলা হয় ‘তাকামাগাহারা’ (Takamagahara)। আর ভারী ও অস্বচ্ছ উপাদানগুলো নিচে জমে তৈরি হলো পৃথিবী। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বতস্ফূর্তভাবে জন্ম নিলেন প্রথম প্রজন্মের কামিরা। তারা ছিলেন লিঙ্গহীন এবং তাদের কোনো সঙ্গী ছিল না। এরপর একে একে আরও সাত প্রজন্মের কামি এলেন। এই দীর্ঘ তালিকার একদম শেষে এলেন সেই যুগল, যারা জাপানি মিথোলজির মূল নায়ক-নায়িকা – ইজানাগি (Izanagi – যিনি আমন্ত্রণ জানান) এবং ইজানামি (Izanami – যাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়)। স্বর্গের প্রবীণ কামিরা এই তরুণ দম্পতিকে ডেকে বললেন, “নিচে তাকাও, ওই ভাসমান জগতটাকে শক্ত করো এবং বাসযোগ্য করে তোলো।” তাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো এক জাদুকরী রত্নখচিত বল্লম, যার নাম ‘আমে-নো-নুবোকো’ (Ame-no-nuboko)।
ওনোগোরো দ্বীপ ও প্রথম বিবাহের ট্র্যাজেডি
ইজানাগি এবং ইজানামি স্বর্গের ভাসমান সেতু বা ‘আমে-নো-উকিহাসি’ (Ama-no-ukihashi)-তে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালেন। নিচে শুধুই আদিম সমুদ্রের জল। তারা সেই জাদুকরী বল্লমটি সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে দিলেন এবং ‘কোরো-কোরো’ শব্দ করে জল মন্থন করতে শুরু করলেন। যখন তারা বল্লমটি তুলে আনলেন, তখন বল্লমের ডগা থেকে নোনা জলের ফোঁটা নিচে পড়ে জমাট বেঁধে তৈরি হলো প্রথম দ্বীপ ‘ওনোগোরো’ (Onogoro)। ওনোগোরো মানে হলো ‘যে দ্বীপ নিজেই জমাট বেঁধেছে’। ইজানাগি আর ইজানামি স্বর্গ থেকে সেই দ্বীপে নেমে এলেন। সেখানে তারা একটি বিশাল প্রাসাদ এবং ‘স্বর্গের স্তম্ভ’ বা হেভেনলি পিলার (Heavenly Pillar) স্থাপন করলেন। এবার তারা ভাবলেন, তাদের তো সন্তান দরকার, দেশ দরকার। তাই তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিয়ের নিয়মটা ছিল অদ্ভুত। তারা দুজন সেই স্তম্ভের দুপাশ থেকে ঘুরে এসে একে অপরের মুখোমুখি হবেন। ইজানামি (নারী) বাম দিক থেকে এবং ইজানাগি (পুরুষ) ডান দিক থেকে ঘুরে এলেন। দেখা হওয়ার পর ইজানামি খুশিতে বলে উঠলেন, “ওহ! কী সুন্দর একজন যুবক!” ইজানাগিও বললেন, “ওহ! কী সুন্দরী একজন রমণী!”
কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধল এরপর। তাদের মিলনের ফলে যে সন্তানটি জন্ম নিল, সে ছিল হাড়বিহীন, জেলিফিশের মতো এক অদ্ভুত জীব, যার নাম ‘হিরুকো’ (Hiruko) বা লিচ-চাইল্ড। তারা কান্নাভেজা চোখে সেই বিকলাঙ্গ শিশুটিকে খাগড়ায়ের নৌকায় করে সাগরে ভাসিয়ে দিলেন। কেন এমন হলো? হতাশ হয়ে তারা স্বর্গের বড় কামিদের কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাইলেন। কামিরা গণনা করে বললেন, “তোমাদের রিচুয়ালে ভুল ছিল। নিয়ম হলো পুরুষ আগে কথা বলবে। কিন্তু তোমরা যখন স্তম্ভ প্রদক্ষিণ করেছিলে, তখন নারী আগে কথা বলেছিল। এটা প্রকৃতির নিয়মের উল্টো।” এখানে প্রাচীন জাপানি সমাজের প্যাট্রিয়ার্কি (Patriarchy) বা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। যা-ই হোক, তারা ফিরে এসে আবার নিয়ম মেনে বিয়ে করলেন। এবার ইজানাগি আগে কথা বললেন। এর ফল হলো চমৎকার। একে একে জন্ম নিল জাপানের প্রধান আটটি দ্বীপ এবং পাহাড়, নদী, সমুদ্র, বাতাস ও গাছের কামিরা। ইজানাগি ও ইজানামি কেবল স্বামী-স্ত্রী ছিলেন না, তারা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই জাপানের জনক-জননী।
আগুন, মৃত্যু এবং পাতালপুরীর বিভীষিকা
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক নাটক ছাড়া কি কোনো মহাকাব্য জমে? ইজানামির জীবনে নেমে এল চরম বিপর্যয়। তিনি যখন আগুনের দেবতা ‘কাগুৎসুচি’ (Kagutsuchi)-কে জন্ম দিতে গেলেন, তখন আগুনের প্রচণ্ড তাপে তার যৌনাঙ্গ পুড়ে গেল। তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন এবং চলে গেলেন পাতালে বা ‘ইয়ামি’ (Yomi – Land of the Dead)-তে। ইজানাগি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলেন। রাগে ও দুঃখে তিনি সদ্যোজাত আগুনের দেবতাকে নিজের তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললেন। মিথোলজিতে বলা হয়, সেই রক্তের ছিটা থেকে আরও অনেক কামির জন্ম হলো, যা নির্দেশ করে যে ধ্বংসের ভেতর থেকেও সৃষ্টির জন্ম হতে পারে। কিন্তু ইজানাগির মন শান্ত হলো না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি পাতালে গিয়ে ইজানামিকে ফিরিয়ে আনবেন। গ্রিক মিথোলজির অরফিয়ুসের গল্পের সাথে এই গল্পের অদ্ভুত মিল আছে।
ইজানাগি পাতালপুরীর অন্ধকার গুহায় পৌঁছালেন। দরজার ওপাশ থেকে ইজানামি বললেন, “প্রিয়তম, তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। আমি তো পাতালপুরীর খাবার খেয়ে ফেলেছি। এখন আর আমার ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।” তবুও ইজানাগির পীড়াপীড়িতে ইজানামি বললেন, “ঠিক আছে, আমি পাতালের কামিদের সাথে কথা বলে দেখি। কিন্তু একটা শর্ত, এই সময়ে তুমি আমার দিকে তাকাবে না।” ইজানাগি অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু ধৈর্য হারিয়ে তিনি তার চুলের কাঁটা ভেঙে আগুন জ্বালালেন এবং ভেতরে উঁকি দিলেন। কী দেখলেন তিনি? দেখলেন ইজানামির শরীর পচে গলে এক বীভৎস রূপ ধারণ করেছে, তার শরীরে পোকা কিলবিল করছে এবং তার দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে আটজন বজ্র-দেবতা জন্ম নিচ্ছে। লজ্জায় ও অপমানে ইজানামি চিৎকার করে উঠলেন, “তুমি আমাকে লজ্জিত করেছ!” তিনি তার বীভৎস রূপ নিয়ে ইজানাগিকে ধরার জন্য তাড়া করলেন। ইজানাগি প্রাণভয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন।
পাতালপুরী থেকে বের হয়ে ইজানাগি একটি বিশাল পাথর বা ‘চিবিজি-নো-ইওয়া’ দিয়ে পাতালের প্রবেশপথ বন্ধ করে দিলেন। পাথরের একপাশে ইজানাগি, অন্যপাশে ইজানামি। সেখানেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হলো। ক্ষুব্ধ ইজানামি অভিশাপ দিয়ে বললেন, “আমার স্বামী, তুমি যদি আমাকে এভাবে পরিত্যাগ করো, তবে আমি প্রতিদিন তোমার দেশের এক হাজার মানুষকে হত্যা করব।” ইজানাগি পাল্টা উত্তর দিলেন, “আমার স্ত্রী, তুমি যদি তাই করো, তবে আমি প্রতিদিন পনেরোশো প্রসূতি ঘর তৈরি করব (অর্থাৎ ১৫০০ মানুষের জন্ম দেব)।” এই সংলাপটি শিন্তো দর্শনের একটি মৌলিক বিষয়কে তুলে ধরে। মৃত্যু আছে, ধ্বংস আছে, কিন্তু জীবনের শক্তি বা ভাইটালিটি (Vitality) সবসময় মৃত্যুকে ছাপিয়ে যাবে। এভাবেই পৃথিবীতে জীবন ও মৃত্যুর চক্র বা সাইকেল অফ লাইফ অ্যান্ড ডেথ (Cycle of Life and Death) শুরু হলো।
তিন মহামান্য সন্তান এবং সূর্যদেবীর উত্থান
পাতালপুরীর সেই পচা-গলা দৃশ্য আর মৃত্যুর স্পর্শ থেকে ফিরে এসে ইজানাগি নিজেকে ভীষণ অপবিত্র মনে করতে লাগলেন। শিন্তো ধর্মে মৃত্যুকে সবচেয়ে বড় অপবিত্রতা বা ‘কেগারে’ মনে করা হয়। নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য তিনি একটি নদীতে স্নান করতে নামলেন। এই স্নানের ঘটনাটি শিন্তো ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর একটি, কারণ এখান থেকেই ‘হারাই’ বা ‘মিসোগি’ (Misogi) নামক শুদ্ধিকরণ প্রথার জন্ম। তিনি যখন তার বাম চোখ ধুলেন, তখন জন্ম নিলেন সূর্যদেবী আমাতেরাসু (Amaterasu)। যখন ডান চোখ ধুলেন, তখন জন্ম নিলেন চন্দ্রদেবতা তসুকুয়মি (Tsukuyomi)। আর যখন নাক ধুলেন, তখন জন্ম নিলেন ঝড়ের দেবতা সুসানো (Susanoo) (Picken, 1994)। ইজানাগি এই তিন সন্তানকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং তাদের হাতে মহাবিশ্বের দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন। আমাতেরাসুকে দিলেন স্বর্গের শাসনভার, তসুকুয়মিকে দিলেন রাতের রাজ্য, আর সুসানোকে দিলেন সমুদ্র ও ঝড়ের দায়িত্ব।
কিন্তু ভাইবোনের মধ্যে কি আর ঝগড়া হয় না? সুসানো ছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে আর রাগী স্বভাবের। তিনি তার দায়িত্ব পালন না করে মায়ের (ইজানামির) কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতেন। একবার তিনি স্বর্গে বোন আমাতেরাসুর সাথে দেখা করতে গেলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি ধ্বংসযজ্ঞ চালালেন। আমাতেরাসুর ধানের ক্ষেত নষ্ট করলেন, সেচ নালা ভেঙে দিলেন এবং সবচেয়ে জঘন্য কাজ যেটা করলেন – আমাতেরাসুর পবিত্র তাঁতঘরে একটি ছাল-ছাড়ানো মরা ঘোড়া ছুড়ে মারলেন। ভয়ে ও অপমানে আমাতেরাসু ‘আমে-নো-ইওয়াতো’ (Ama-no-Iwato) বা স্বর্গের পাথরের গুহায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সূর্যদেবী লুকিয়ে পড়ায় পুরো পৃথিবী এবং স্বর্গ অন্ধকারে ডুবে গেল। শস্য ফলল না, চারদিকে হাহাকার পড়ে গেল। দুষ্ট আত্মারা বেরিয়ে এল।
আমাতেরাসুর গুহা এবং জাপানি উৎসবের উৎস
সূর্যদেবীকে গুহা থেকে বের করার জন্য স্বর্গের অন্য আট মিলিয়ন কামি এক জরুরি মিটিংয়ে বসলেন। তারা গুহার সামনে এক বিশাল পার্টির আয়োজন করলেন। আমে-নো-উজুম (Ame-no-Uzume) নামের এক দেবী উলঙ্গ হয়ে বা অর্ধনগ্ন হয়ে অদ্ভুত এক নাচ শুরু করলেন। তার নাচ দেখে বাকি দেবতারা হাসিতে ফেটে পড়লেন। গুহার ভেতরে বসে আমাতেরাসু অবাক হলেন। তিনি ভাবলেন, “আমি নেই, পৃথিবী অন্ধকারে, তবুও এরা এত আনন্দ করছে কেন?” কৌতূহল সামলাতে না পেরে তিনি গুহার পাথর সামান্য সরিয়ে উঁকি দিলেন। তখন দেবতারা তাকে বললেন, “আমরা আনন্দ করছি কারণ আপনার চেয়েও সুন্দরী ও শক্তিশালী এক দেবী এসেছেন।” তারা আমাতেরাসুর মুখের সামনে একটি পবিত্র আয়না বা ইয়ামাতা নো কাগামি (Yata no Kagami) ধরলেন। আয়নায় নিজের উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব দেখে আমাতেরাসু বিস্মিত হয়ে আরেকটু বেরিয়ে এলেন। সেই সুযোগে শক্তিশালী দেবতা তাজিকারাও তার হাত ধরে তাকে বাইরে টেনে বের করলেন এবং গুহার মুখে পবিত্র দড়ি বা ‘শিমেনাওয়্যা’ টানিয়ে দিলেন যাতে তিনি আর ফিরে যেতে না পারেন। আমাতেরাসু ফিরে আসায় পৃথিবী আবার আলোয় ভরে উঠল। মিথোলজির এই গল্পটি কেবল গল্প নয়, এটি সূর্যগ্রহণ বা শীতকালীন অয়নকাল বা উইন্টার সলস্টাইন (Winter Solstice)-এর প্রতীক হতে পারে, যখন সূর্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আবার ফিরে আসে। এছাড়াও জাপানি উৎসব বা ‘মাৎসুুুুরি’-র হইহুল্লোড় আর নাচে-গানের উৎসও এই মিথের মধ্যেই নিহিত।
মর্ত্যে অবতরণ এবং রাজবংশের বৈধতা
জাপানি মিথোলজির শেষ অংশটি সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত। আমাতেরাসু দেখলেন মর্ত্য বা জাপানের দ্বীপগুলো খুব বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার নিজের বংশধরকে সেখানে শাসক হিসেবে পাঠাবেন। তিনি তার নাতি ‘নিনিগি-নো-মিকোতো’ (Ninigi-no-Mikoto)-কে পাঠালেন। নিনিগিকে বিদায় জানানোর সময় তিনি তাকে তিনটি পবিত্র বস্তু বা থ্রি সেক্রেড ট্রেজারস (Three Sacred Treasures) দিলেন: ১) সেই আয়না (যা সত্য ও জ্ঞানের প্রতীক), ২) একটি তলোয়ার বা কুসানাগি নো তুরুগি (Kusanagi no Tsurugi) (যা সাহসের প্রতীক), এবং ৩) একটি বাঁকানো রত্নপাথর বা ইয়াসাকানি নো মাগাতামা (Yasakani no Magatama) (যা দয়া ও উপকারের প্রতীক)। আমাতেরাসু বললেন, “এই আয়নাটিকে ঠিক সেভাবেই দেখবে, যেভাবে তুমি আমাকে দেখো।” নিনিগি কিউশু দ্বীপের তাকাচিহো পর্বতশৃঙ্গে অবতরণ করলেন। এই ঘটনাকে বলা হয় তেনসন কোরিন (Tenson Korin) বা স্বর্গের নাতির অবতরণ।
নিনিগির প্রপৌত্র হলেন জিম্মু তেন্নো (Jimmu Tenno), যাকে জাপানের প্রথম সম্রাট বা ফার্স্ট এম্পেরার (First Emperor) মনে করা হয়। লোকগাথা অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে তিনি জাপানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই মিথোলজিই জাপানি রাজপরিবারকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন একটানা রাজবংশ হিসেবে দাবি করার ভিত্তি দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত জাপানিরা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বাস করত যে তাদের সম্রাট একজন মানুষ নন, বরং তিনি সূর্যদেবীর রক্ত বহনকারী এক জীবন্ত কামি বা আরাহিতোগামি (Arahitogami)। যদিও যুদ্ধের পর সম্রাট হিরোহিতো তার দেবত্ব ত্যাগ করেছিলেন, তবুও জাপানের রক্ষণশীল সমাজে এই মিথোলজির প্রভাব আজও প্রবল। আজও যখন জাপানের নতুন সম্রাট সিংহাসনে বসেন, তখন তাকে সেই তিনটি পবিত্র রত্ন বা ‘ইম্পেরিয়াল রেগালিয়া’ হস্তান্তর করা হয়, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে। এভাবেই মিথোলজি আর বাস্তবতা জাপানে একাকার হয়ে আছে। কোজিকি আর নিহন শকির পাতা থেকে উঠে আসা এই গল্পগুলো জাপানিদের শিখিয়েছে তাদের দেশ কোনো সাধারণ ভূখণ্ড নয়, এটি কামিদের আশীর্বাদপুষ্ট এক পবিত্র ভূমি, যেখানে সূর্যোদয় হয় সবার আগে।
তোরিই (Torii): দুই জগতের মাঝখানের এক জাদুকরী দরজা
জাপানের যেকোনো ছবির দিকে তাকালে আপনার চোখ কি কখনো লাল রঙের অদ্ভুত এক তোরণের ওপর আটকে গেছে? দুটি খাড়া থাম, আর তার ওপর শোয়ানো দুটি বা একটি আড়াআড়ি কাঠ। কোনো দরজা নেই, কোনো কপাট নেই, অথচ এটি দাঁড়িয়ে আছে সদম্ভে। এর নাম ‘তোরিই’ (Torii)। এটি কেবল জাপানি ল্যান্ডস্কেপের সৌন্দর্য বাড়ায় না, এটি শিন্তো ধর্মের সবচেয়ে আইকনিক প্রতীক। আপনি যদি কখনো জাপানে যান, তবে পাহাড়ের চূড়ায়, সমুদ্রের মাঝখানে, গভীর অরণ্যে, এমনকি টোকিওর মতো আল্ট্রা-মডার্ন শহরের দুই দালানের চিপায় এই তোরিই দেখতে পাবেন। কিন্তু তোরিই কোনো সাধারণ গেট নয়। এটি হলো একটি সীমানা, একটি অদৃশ্য দেয়াল। শিন্তো বিশ্বাস মতে, তোরিই-এর একপাশে থাকে আমাদের সাধারণ মানুষের জগত বা প্রোফেন ওয়ার্ল্ড (Profane World), যেখানে আমরা খাই, ঘুমাই, অফিস করি, ঝগড়া করি। আর তোরিই-এর অন্যপাশে থাকে কামির পবিত্র জগত বা সেক্রেড স্পেস (Sacred Space)।
যখনই আপনি মাথা নিচু করে তোরিই পার হন, আপনি আসলে বিশ্বকে একটি বার্তা দিচ্ছেন। আপনি ঘোষণা দিচ্ছেন যে, আপনি আপনার জুতায় লেগে থাকা জাগতিক ধুলোবালি এবং মনের ভেতরে জমে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ বাইরে রেখে এক পরম পবিত্রতার রাজ্যে প্রবেশ করছেন। ধর্মে এই অবস্থাকে বলা হয় লিমিনালিটি (Liminality) বা প্রান্তিকতা। অর্থাৎ, আপনি এমন এক জায়গায় আছেন যা ‘এপার’ও নয়, ‘ওপার’ও নয় – এটি দুই ভুবনের সংযোগস্থল। তোরিই সেই সংযোগস্থলের প্রহরী। তোরিই শব্দটি শুনলেই মনে হতে পারে এটি জাপানি ভাষার নিজস্ব শব্দ। কিন্তু এর উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বেশ বিতর্ক আর রোমাঞ্চকর সব গল্প আছে। তোরিই সাধারণত কাঠ বা পাথর দিয়ে তৈরি হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘ভারমিলিয়ন’ (Vermilion) বা এক ধরনের উজ্জ্বল কমলা-লাল রঙ করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই রঙ অমঙ্গল বা খারাপ আত্মাকে দূরে রাখে। কিন্তু কেন এই রঙ? কেন এই গঠন? এর পেছনে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, মিথোলজি আর স্থাপত্যকলা।
তোরিই শব্দের জন্মকথা: পাখির আড্ডা নাকি ভারতীয় তোরণ?
‘তোরিই’ শব্দটিকে ভাঙলে দুটি জাপানি শব্দ পাওয়া যায়। ‘তোরি’ (Tori) মানে হলো পাখি, আর ‘ই’ (i) মানে হলো বসার জায়গা বা অবস্থান। সব মিলিয়ে অর্থ দাঁড়ায় ‘পাখির বসার জায়গা’ বা ‘বার্ড পার্চ’ (Bird Perch)। এখন প্রশ্ন হলো, দেবতার গেটকে পাখির বাসা বলা হবে কেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমরা আগে যে মিথোলজির গল্পটি বলেছিলাম, তার মধ্যে। মনে আছে সূর্যদেবী আমাতেরাসুর কথা? ভাই সুসানোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি যখন গুহার ভেতরে লুকিয়ে পড়েছিলেন এবং পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল, তখন তাকে বের করার জন্য দেবতারা নানা ফন্দি এঁটেছিলেন। মিথোলজি বা মিথস (Myths) বলে, দেবতারা তখন একটি বড় কাঠের কাঠামো তৈরি করে তার ওপর অনেকগুলো মোরগ বসিয়ে দিয়েছিলেন। মোরগগুলো যখন ডাকতে শুরু করল, তখন আমাতেরাসু ভাবলেন সকাল হয়ে গেছে এবং তিনি কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিলেন। জাপানি সংস্কৃতিতে মোরগ বা পাখিকে কামির বার্তাবাহক বা মেসেঞ্জার অফ গড (Messenger of God) মনে করা হয়। তাই শিন্তো মন্দির বা কামির প্রাসাদের প্রবেশপথে পাখিদের বসার জন্য যে তোরণ বানানো হতো, কালক্রমে সেটাই পবিত্র গেট বা তোরিই হয়ে উঠেছে।
তবে সবাই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। অনেক ইতিহাসবিদ এবং স্থাপত্যবিদ মনে করেন, তোরিই ধারণাটি বিদেশ থেকে আমদানি করা। তাদের মতে, প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ স্তূপের (যেমন সাঁচি স্তূপ) সামনে যে তোরণ বা তোরণ (Torana) থাকত, সেটাই বৌদ্ধধর্মের সাথে সাথে চীন ও কোরিয়া হয়ে জাপানে পৌঁছেছে। চীনে একে বলা হয় ‘পাইলো’ (Pailou) আর কোরিয়ায় ‘হংসালমুন’ (Hongsalmun)। জাপানিরা তাদের স্বভাবসুলভ মিনিমালিস্টিক বা মিনিমালিজম (Minimalism) দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সেই জটিল নকশার তোরণকে সহজ-সরল কাঠের কাঠামোতে রূপান্তর করেছে। উৎস যা-ই হোক, তোরিই আজ জাপানি সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানচিত্রে শিন্তো মন্দির বোঝাতে তোরিই-এর প্রতীক ব্যবহার করা হয়। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাগাসাকিতে যখন পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল, তখন সান্নো শ্রাইন (Sanno Shrine)-এর একটি তোরিই-এর অর্ধেক অংশ বোমার আঘাত সহ্য করেও দাঁড়িয়ে ছিল। সেই ‘একপায়ে’ তোরিই আজও জাপানিদের টিকে থাকার অদম্য ক্ষমতার প্রতীক হয়ে আছে (Turnbull, 2015)।
স্থাপত্যশৈলী: শিনমেই বনাম মিয়োজিন
তোরিই দেখতে খুব সহজ মনে হলেও এর গঠনশৈলী বা আর্কিটেকচারাল স্টাইল (Architectural Style) বেশ জটিল এবং বৈচিত্র্যময়। জাপানে প্রায় ২০ ধরণের ভিন্ন ভিন্ন তোরিই দেখা যায়। তবে এদের প্রধানত দুটি পরিবারে ভাগ করা যায়: ‘শিনমেই’ (Shinmei) এবং ‘মিয়োজিন’ (Myojin)।
শিনমেই পরিবার (Shinmei Family): এটি হলো তোরিই-এর প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সরল রূপ। এই স্টাইলের তোরিইগুলোতে উপরের আড়াআড়ি কাঠটি বা ‘কাসাগি’ (Kasagi) সম্পূর্ণ সোজা থাকে, কোনো বাঁক থাকে না। সাধারণত এই ধরণের তোরিই রঙ করা হয় না, কাঠের স্বাভাবিক রঙেই রাখা হয়। শিন্তো ধর্মের পবিত্রতা এবং প্রকৃতির সাথে মিশে থাকার যে আদি দর্শন, তা এই স্টাইলে ফুটে ওঠে। জাপানের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির ‘ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইন’ (Ise Grand Shrine)-এ এই শিনমেই স্টাইলের তোরিই দেখা যায়।
মিয়োজিন পরিবার (Myojin Family): এটি হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত স্টাইল। আপনি পোস্টকার্ডে বা সিনেমায় যে তোরিই দেখেন, তার ৯৯ ভাগই এই মিয়োজিন স্টাইলের। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উপরের কাঠটি বা ‘কাসাগি’ দুই প্রান্তে ওপরের দিকে ধনুকের মতো একটু বাঁকানো থাকে। এটি দেখতে অনেক বেশি অলঙ্কৃত এবং নান্দনিক। এই তোরিইগুলো সাধারণত লাল বা ভারমিলিয়ন রঙ করা হয় এবং গোড়ায় কালো রঙের সুরক্ষা বলয় বা ‘নেমাকি’ (Nemaki) থাকে। এই বাঁকানো নকশাটি সম্ভবত মহাদেশীয় এশীয় (চীন বা কোরিয়া) স্থাপত্যের প্রভাবে এসেছে।
একটি তোরিই-এর বিভিন্ন অংশের নির্দিষ্ট নাম আছে। দুটি প্রধান থামকে বলা হয় ‘হাশিকা’ (Hashira)। উপরের প্রধান আড়াআড়ি কাঠটিকে বলা হয় ‘কাসাগি’ (Kasagi), তার ঠিক নিচে সমান্তরাল আরেকটি কাঠ থাকলে তাকে বলে ‘শিমাকি’ (Shimaki)। আর দুই থামকে মাঝখান দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে যে কাঠটি, তাকে বলে ‘নুকি’ (Nuki)। অনেক সময় এই দুই কাঠের মাঝখানে মন্দিরের নাম লেখা একটি ফলক ঝোলানো থাকে, যাকে বলা হয় ‘গাকু’ (Gaku)। এই প্রতিটি অংশের অনুপাত এবং নকশা দেখে বলে দেওয়া যায় তোরিইটি কোন যুগের বা কোন কামির জন্য তৈরি।
লাল রঙের রহস্য: ভারমিলিয়ন কেন?
তোরিই বললেই আমাদের চোখে উজ্জ্বল লাল বা কমলা রঙ ভেসে ওঠে। জাপানি ভাষায় এই রঙকে বলা হয় ‘শু-ইরো’ (Shu-iro) বা ভারমিলিয়ন (Vermilion)। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রকৃতিপ্রেমী শিন্তো ধর্মে গাছের স্বাভাবিক রঙ ঢেকে দিয়ে এমন চড়া কৃত্রিম রঙ কেন ব্যবহার করা হয়? এর পেছনে বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার – দুটোই কাজ করছে।
বৈজ্ঞানিক কারণটি হলো কাঠ সংরক্ষণ। প্রাচীনকালে লাল রঙ তৈরি করা হতো পারদ বা মারকারি (Mercury) এবং সালফারের মিশ্রণ ‘সিন্নাবার’ (Cinnabar) থেকে। এই পারদ কাঠের জন্য দারুণ প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করে। জাপান একটি আর্দ্র দেশ, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। উইপোকা আর পচনের হাত থেকে কাঠের তোরিইকে রক্ষা করার জন্য প্রাচীন জাপানিরা এই লাল রঙের প্রলেপ ব্যবহার করত।
আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল (Spiritual) কারণটি আরও গভীর। শিন্তো এবং বৌদ্ধ – উভয় বিশ্বাসেই লাল রঙকে আগুনের প্রতীক মনে করা হয়। আগুন যেমন সবকিছু পুড়িয়ে শুদ্ধ করে, তেমনি লাল রঙও অপশক্তি বা খারাপ আত্মাকে পুড়িয়ে দেয়। একে বলা হয় আপোট্রোপাইক ম্যাজিক (Apotropaic Magic) বা অশুভ তাড়ানোর জাদু। বিশ্বাস করা হয়, লাল তোরিই পার হলে মানুষের শরীরের রোগবালাই এবং মনের কালিমা দূর হয়ে যায়। এছাড়া লাল রঙ সূর্যের প্রতীক, যা জীবনশক্তি এবং উর্বরতাকে নির্দেশ করে। বিশেষ করে ‘ইনারি’ (Inari) বা শস্য ও ব্যবসার দেবতার মন্দিরগুলোতে লাল তোরিই-এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কারণ, লাল রঙ ভালো ফসল এবং ব্যবসায়িক সমৃদ্ধিরও প্রতীক।
বিখ্যাত কিছু তোরিই: জলের ওপর ভাসমান গেট
জাপানের হাজার হাজার তোরিই-এর মধ্যে কিছু তোরিই আছে যা তাদের অবস্থান এবং সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বখ্যাত। এর মধ্যে সবার আগে আসে হিরোশিমার কাছে মিয়াজিমা দ্বীপের ‘ইতসুকুশিমা শ্রাইন’ (Itsukushima Shrine)-এর তোরিই। একে বলা হয় ‘ভাসমান তোরিই’ বা ফ্লোটিং তোরিই (Floating Torii)। বিশাল আকারের এই লাল তোরণটি সমুদ্রের অগভীর জলে দাঁড়িয়ে আছে। জোয়ারের সময় যখন জল বাড়ে, তখন মনে হয় তোরিইটি জলের ওপর ভাসছে। আর ভাটার সময় জল সরে গেলে কাদা মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে এর একদম নিচে যাওয়া যায়। এই তোরিইটি কামির জগত (দ্বীপ) এবং মানুষের জগত (সমুদ্রের ওপার)-এর সীমানা নির্দেশ করে। প্রাচীনকালে সাধারণ মানুষের এই দ্বীপে পা রাখা নিষিদ্ধ ছিল, তাদের নৌকা করে এই তোরিই-এর নিচ দিয়ে গিয়ে দূর থেকে প্রার্থনা করতে হতো (Cali & Dougill, 2013)।
আরেকটি বিস্ময়কর স্থান হলো কিয়োটোর ‘ফুশিমি ইনারি তাইশা’ (Fushimi Inari Taisha)। এখানে একটি বা দুটি নয়, প্রায় দশ হাজারেরও বেশি লাল তোরিই দিয়ে পাহাড়ের ওপর পর্যন্ত একটি সুরঙ্গ বা টানেল তৈরি করা হয়েছে। একে বলা হয় সেনবন তোরিই (Senbon Torii) বা হাজার তোরিই। এই সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা অপার্থিব। সূর্যের আলো লাল থামের ফাঁক দিয়ে এসে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। এই হাজার হাজার তোরিই কোনো রাজা বা সরকারের বানানো নয়। এগুলো সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা দান করেছেন। প্রতিটি তোরিই-এর গায়ে দাতার নাম এবং তারিখ লেখা আছে। কেউ হয়তো ব্যবসায় সফল হয়ে কৃতজ্ঞতা হিসেবে দান করেছেন, কেউ বা সাফল্যের আশায়। এই তোরিইগুলো জাপানিদের ‘বিনিময় প্রথা’ বা রেসিপ্রোসিটি (Reciprocity)-র এক জীবন্ত দলিল – কামির কাছে কিছু চাইলে কামিকে কিছু দিতেও হয়।
তোরিই পার হওয়ার আদবকেতা
আপনি যখন তোরিই-এর সামনে দাঁড়াবেন, তখন হুট করে ভেতরে ঢুকে পড়াটা অভদ্রতা। শিন্তো ধর্মে তোরিই পার হওয়ার কিছু নির্দিষ্ট শিষ্টাচার বা এটিকেড (Etiquette) আছে। প্রথমত, তোরণের সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে ‘বাউ’ (Bow) করতে হয়। এটি অনেকটা কারো ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নেওয়ার মতো। দ্বিতীয়ত, তোরিই-এর ঠিক মাঝখান দিয়ে হাঁটা অনুচিত। পথের মাঝখানের অংশটিকে বলা হয় ‘সেই-চু’ (Sei-chu), যা কামির চলাচলের রাস্তা। মানুষকে তাই বিনয়ের সাথে পথের যেকোনো এক পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হয়।
যখন আপনি তোরিই পার হয়ে ভেতরে ঢুকলেন, তখন আপনি অনুভব করবেন বাইরের কোলাহল যেন কমে গেছে। গাছপালার মর্মর শব্দ আর পাখিদের ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। এই মানসিক পরিবর্তনটাকেই শিন্তো গুরুত্ব দেয়। তোরিই আসলে কোনো জাদুকরী যন্ত্র নয়, এটি একটি সাইকোলজিক্যাল ট্রিগার (Psychological Trigger)। এটি আপনার অবচেতন মনকে সংকেত দেয় যে, “এখন শান্ত হওয়ার সময়, এখন নিজের দিকে তাকানোর সময়।” ফেরার সময়ও একই নিয়ম – তোরিই পার হয়ে আবার সাধারণ জগতে ফিরে আসার আগে মন্দিরের দিকে ফিরে একবার মাথা নত করে বিদায় নিতে হয়। এই আসা-যাওয়ার পথের নামই শিন্তো।
আধুনিক সংস্কৃতি ও তোরিই
আধুনিক যুগে তোরিই কেবল ধর্মীয় প্রতীক নয়, এটি জাপানের পপ কালচারের অংশ হয়ে গেছে। জাপানি ম্যাপে শিন্তো মন্দির বোঝাতে তোরিই-এর আইকন ব্যবহার করা হয়। অ্যানিমে, মাঙ্গা বা ভিডিও গেমসে তোরিইকে প্রায়ই অন্য ডাইমেনশন বা জগতে যাওয়ার পোর্টাল হিসেবে দেখানো হয়। যেমন – বিখ্যাত অ্যানিমে স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (Spirited Away)-তে আমরা দেখি, বাবা-মায়ের সাথে সুজু যখন ভুল করে একটি পুরনো তোরণ পার হয়, তখনই তারা মানুষের জগত থেকে আত্মাদের জগতে চলে যায়। এই ধারণাটি আধুনিক জাপানিদের মনেও গেঁথে আছে। তারা হয়তো নিয়মিত পূজা করে না, কিন্তু তোরিই দেখলে তাদের মনে এক ধরণের সম্ভ্রম জাগে। তারা বিশ্বাস করে, এই গেটগুলো আছে বলেই তাদের দেশ আজও সুরক্ষিত, আজও পবিত্র।
তোরিই আমাদের শেখায় যে, পবিত্রতা কোনো নির্দিষ্ট ঘরে বা দালানে আবদ্ধ নয়। পবিত্রতা হলো একটি মানসিক অবস্থা। আর সেই অবস্থায় পৌঁছাতে হলে আমাদের একটি সীমানা পার হতে হয় – সেটা হতে পারে কাঠের তৈরি তোরিই, অথবা আমাদের মনের ভেতরের কোনো অদৃশ্য দরজা। জাপানের এই লাল তোরণগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোদ, বৃষ্টি আর ঝড় সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষকে সেই কথাটিই মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য – জীবন মানেই এক জগত থেকে আরেক জগতে যাত্রা, আর তোরিই হলো সেই যাত্রাপথের নীরব সাক্ষী।
জিঞ্জা (Jinja): কামির নিবাস ও নীরবতার স্থাপত্য
জাপান দেশটাকে যদি আপনি আধ্যাত্মিকতার একটা বিশাল ক্যানভাস ভাবেন, তবে সেই ক্যানভাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় বিন্দুগুলো হলো ‘জিঞ্জা’ (Jinja) বা শিন্তো মন্দির। জাপানে জিঞ্জার সংখ্যা শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি হিসাব মিলিয়ে এই দ্বীপরাষ্ট্রে প্রায় ৮০,০০০-এর বেশি জিঞ্জা বা শিন্তো মন্দির রয়েছে। টোকিওর মতো ব্যস্ততম মেগাসিটির গলিঘুঁজি থেকে শুরু করে হোক্কাইডোর বরফঢাকা পাহাড়ের চূড়া – কোথায় নেই এই জিঞ্জা? বড় বড় বিখ্যাত মন্দির যেমন ‘ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইন’ (Ise Grand Shrine) বা ‘মেইজি জিঞ্জা’ (Meiji Jinja) যেমন আছে, তেমনি আছে রাস্তার ধারের শতবর্ষী ওক গাছের নিচে গড়ে ওঠা ছোট্ট কাঠের ঘর, যাকে হয়তো স্থানীয় কয়েকজন মানুষই চেনে। সব মিলিয়ে এই জিঞ্জাগুলোই জাপানের আত্মার ধারক। তবে ‘মন্দির’ শব্দটি ব্যবহার করলে আমাদের মনে যে ছবিটা ভাসে – বিশাল সব মূর্তি, ধূপের ধোঁয়া আর মন্ত্রপাঠের গম্ভীর পরিবেশ – জিঞ্জা ঠিক সেরকম নয়। জিঞ্জা শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘দেবতাদের প্রাসাদ’ বা ‘কামির নিবাস’। এটি উপাসনার জায়গার চেয়ে বেশি কামির থাকার ঘর। জাপানিরা মনে করে, কামি বা আত্মারা আমাদের মতোই একটি ঘরে থাকতে পছন্দ করেন, তবে সেই ঘর হতে হবে প্রকৃতির কোলে, শান্ত এবং নির্জন। জিঞ্জার স্থাপত্যশৈলী বা আর্কিটেকচারাল স্টাইল (Architectural Style) এতটাই ছিমছাম আর সাদামাটা যে, এটি দেখে মনে হয় না মানুষ এটি বানিয়েছে, বরং মনে হয় এটি মাটির নিচ থেকে গাছের মতোই গজিয়ে উঠেছে। রংচঙে জাঁকজমক নয়, বরং প্রকৃতির সাথে মিশে থাকাই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ জিঞ্জা তৈরি হয় জাপানি সাইপ্রাস কাঠ বা হিনোকি (Hinoki) দিয়ে, এবং ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে এতে কোনো লোহার পেরেক ব্যবহার করা হয় না। কাঠের খাঁজে কাঠ ঢুকিয়ে এক বিস্ময়কর জ্যামিতিক দক্ষতায় এগুলো বানানো হয়, যা ভূমিকম্পেও সহজে ধসে পড়ে না।
হোনদেন ও হাইদেন: পবিত্রতার দুই স্তর
একটি শিন্তো মন্দিরের গঠনশৈলীকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যা পবিত্রতার স্তরবিন্যাস বা হায়ারার্কি অফ সেক্রেডনেস (Hierarchy of Sacredness) নির্দেশ করে। মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র এবং গোপনীয় অংশটিকে বলা হয় হোনদেন (Honden) বা মূল হল। এটি হলো কামির একান্ত ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ। সাধারণ দর্শনার্থী তো দূরের কথা, মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা কান্নুশি (Kannushi)-রাও বিশেষ পূজা বা উৎসব ছাড়া এই হোনদেনের ভেতরে প্রবেশ করেন না। হোনদেনের দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। তাহলে ভেতরে কী থাকে? সেখানে কি কোনো দেবতার মূর্তি আছে? না, শিন্তো ধর্মে সচরাচর কোনো মানুষের আকৃতির মূর্তি পূজা বা আইডোলেলট্রি (Idolatry) করা হয় না। হোনদেনের ভেতরে থাকে কামির প্রতীক বা আধার, যাকে বলা হয় গো-শিনতাই (Sacred Body) বা পবিত্র শরীর। এটি হতে পারে একটি প্রাচীন ব্রোঞ্জের আয়না, একটি মরচে ধরা তলোয়ার, একটি বিশেষ আকৃতির পাথর, কিংবা একটি কাঠের পুতুল। জাপানিরা বিশ্বাস করে, কামি নিরাকার, কিন্তু পূজার সময় তিনি এই বস্তুটির ওপর ভর করেন বা একে আধার হিসেবে গ্রহণ করেন।
মজার এবং রহস্যময় ব্যাপার হলো, এই গো-শিনতাই (Sacred Body) সাধারণ মানুষ তো নয়ই, এমনকি অনেক সময় পুরোহিতরাও তাদের জীবদ্দশায় কখনো দেখেন না। এটি সযত্নে রেশমি কাপড়ে মোড়ানো থাকে এবং একটির পর একটি বাক্সের ভেতরে লুকানো থাকে। এই যে না দেখা, এই যে রহস্য – এটাই শিন্তো ধর্মের ভক্তি বা শ্রদ্ধার মূল উৎস। দেখা হয়ে গেলে তো ফুরিয়েই গেল, অদেখা আছে বলেই তার প্রতি আকর্ষণ ও ভীতি কাজ করে। হোনদেনের ঠিক সামনেই থাকে আরেকটি ঘর বা মণ্ডপ, যাকে বলা হয় হাইদেন (Haiden) বা প্রার্থনা হল। এটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। পূজারিরা বা দর্শনার্থীরা এই হাইদেনের সামনে দাঁড়িয়েই তাদের প্রার্থনা জানান। হাইদেন এবং হোনদেনের মাঝখানে অনেক সময় একটি নিচু বেড়া বা ‘তামাগাকি’ (Tamagaki) থাকে, যা নির্দেশ করে যে – এই পর্যন্ত মানুষের সীমানা, এর ওপাশে শুধুই কামির রাজত্ব। দর্শনার্থীরা যখন হাইদেনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নত করেন, তারা আসলে বন্ধ দরজার ওপাশে থাকা সেই অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যেই শ্রদ্ধা জানান। এই স্থাপত্যকৌশল মানুষকে শেখায় যে, ঈশ্বরের সবটুকু বোঝা বা দেখা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তাকে অনুভব করতে হয় দূর থেকে, বিনয়ের সাথে (Cali & Dougill, 2013)।
প্রার্থনার পদ্ধতি: নীরব কথোপকথন
শিন্তো মন্দিরে প্রার্থনার পদ্ধতিটি কোনো জটিল মন্ত্রতন্ত্র নয়, বরং এটি একটি সুশৃঙ্খল আচার বা রিচুয়ালিস্টিক বিহেভিয়ার (Ritualistic Behavior)। জাপানিরা একে বলে ‘হাইরেই’ (Hairei) বা ‘সানপাই’ (Sanpai)। এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত ছিমছাম এবং ধাপে ধাপে বিন্যস্ত। একজন দর্শনার্থী যখন জিঞ্জায় প্রবেশ করেন, তিনি নিজের অজান্তেই একটি পবিত্র নাটকের কুশীলব হয়ে ওঠেন।
১. তোরিই-এর সামনে মাথা নত করা: মন্দিরের সীমানায় ঢোকার আগে তোরণ বা তোরিই-এর সামনে দাঁড়িয়ে একবার মাথা নিচু করতে হয়। এটি অনেকটা কারো ড্রইংরুমে ঢোকার আগে অনুমতি চাওয়ার মতো ভদ্রতা।
২. তেমিজুয়া-তে শুদ্ধ হওয়া: এরপর মূল চত্বরে প্রবেশের আগে ‘তেমিজুয়া’ বা পাথরের জলাধারের সামনে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়। শিন্তো ধর্মে শারীরিক পরিচ্ছন্নতাই হলো আধ্যাত্মিক পবিত্রতার প্রথম ধাপ (Littleton, 2002)।
৩. কয়েন বা অফারিং: হাইদেনের সামনে গিয়ে প্রথমেই একটি কাঠের বাক্সে বা ‘সাইসেন-বাকো’ (Saisen-bako)-তে একটি কয়েন ফেলতে হয়। সাধারণত মানুষ ৫ ইয়েন-এর একটি কয়েন ফেলে। কেন জানেন? কারণ জাপানি ভাষায় ৫ ইয়েন বা ‘গো-এন’ (Go-en)-এর উচ্চারণ ‘ভাগ্য’ বা ‘সম্পর্ক’ (En/Go-en) শব্দের সাথে হুবহু মিলে যায়। এটি একটি শব্দজট বা পান (Pun)। অর্থাৎ, ৫ ইয়েন দিয়ে আপনি কামির সাথে একটি ভালো সম্পর্কের বা ভাগ্যের সূচনা করছেন। তবে ১০ ইয়েন ফেলাটা একটু খারাপ চোখে দেখা হয়, কারণ ১০-এর উচ্চারণ ‘তো’ (To), যার মানে ‘অনেক দূরে’। কেউ চায় না তার ভাগ্য দূরে চলে যাক।
৪. ঘণ্টা বাজানো: বাক্সের ঠিক ওপরেই একটি মোটা দড়ি ঝোলানো থাকে, যার মাথায় বিশাল একটি ঘণ্টা বা সুজু (Suzu) বাঁধা থাকে। দড়ি ধরে ঝাঁকি দিয়ে ঘণ্টাটি বাজাতে হয়। এই ঘণ্টার শব্দ মিষ্টি এবং গম্ভীর। বিশ্বাস করা হয়, এই শব্দ কামির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আশেপাশের বাতাস থেকে অশুভ শক্তি দূর করে।
৫. নত হওয়া ও হাততালি: এরপর শুরু হয় প্রার্থনার মূল পর্ব। প্রথমে দুবার গভীরভাবে মাথা নত করতে হয় (Bow)। এরপর বুকের সামনে হাত এনে দুবার জোরে হাততালি দিতে হয়। এই হাততালিকে বলা হয় কাশিওয়াদে (Kashiwade)। হাততালি কেন? এর দুটি কারণ প্রচলিত আছে। এক, এই শব্দে কামি যদি ঘুমিয়ে থাকেন বা অন্যমনস্ক থাকেন তবে তিনি জেগে উঠবেন। দুই, এটি নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া এবং দুষ্ট আত্মাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো। হাততালির শব্দে মনের বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোও সরে যায় এবং মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়।
৬. প্রার্থনা ও বিদায়: হাততালি দেওয়ার পর জোড়হাত করে মনে মনে নিজের প্রার্থনা বা কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। শিন্তোতে লম্বা চওড়া প্রার্থনার চেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রার্থনা শেষে আবার একবার গভীরভাবে মাথা নত করে সম্মান জানিয়ে ফিরে আসতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি করতে হয়তো এক মিনিটও লাগে না, কিন্তু এই এক মিনিটের নীরবতাই একজন জাপানির সারাদিনের রসদ জোগায়।
আয়না এবং কামি: নিজেকে দেখার দর্পণ
অধিকাংশ শিন্তো মন্দিরের হোনদেনের ভেতরে, কামির প্রতীক হিসেবে একটি ব্রোঞ্জের আয়না রাখা থাকে, যাকে বলা হয় শিনকিয়ো (Shinkyo) বা পবিত্র দর্পণ। এই আয়না শিন্তো দর্শনের এক গভীর তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। জাপানি ভাষায় আয়নাকে বলা হয় ‘কাগামি’ (Kagami)। আপনি যদি ‘কাগামি’ শব্দ থেকে মাঝখানের ‘গা’ (Ga) অক্ষরটি বাদ দেন, তবে থাকে ‘কামি’ (Kami)। জাপানি ভাষায় ‘গা’ মানে হলো ‘আমি’ বা অহং বা ইগো (Ego)। অর্থাৎ, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি যদি আপনার নিজের ভেতর থেকে ‘অহং’ বা ইগোকে মুছে ফেলতে পারেন, তবে যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই হলো কামি বা ঈশ্বর। মন্দিরে গিয়ে যখন মানুষ আয়নার দিকে তাকায়, সে আসলে নিজেকেই দেখে। শিন্তো শেখায়, কামি বাইরে কোথাও নেই, কামি আছেন আপনার নিজের ভেতরেই। নিজের বিবেক বা ‘মাকোতো’ (Makoto – আন্তরিকতা)-র মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই হলো আসল পূজা। এই আয়না সূর্যদেবী আমাতেরাসুর প্রতীকও বটে। মিথোলজি অনুযায়ী, আমাতেরাসু তার নাতিকে মর্ত্যে পাঠানোর সময় নিজের হাতে একটি আয়না দিয়ে বলেছিলেন, “যখনই তুমি এই আয়নার দিকে তাকাবে, মনে করবে তুমি আমার আত্মার দিকেই তাকাচ্ছ।” তাই শিন্তো মন্দিরে আয়না কোনো সাজসজ্জার বস্তু নয়, এটি আত্মোপলব্ধির একটি যন্ত্র বা টুল ফর সেলফ-রিফ্লেকশন (Tool for Self-reflection) (Picken, 1994)।
প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান: চিঞ্জু নো মোরি
একটি আদর্শ জিঞ্জা কখনোই কংক্রিটের জঙ্গলে একা দাঁড়িয়ে থাকে না। এর চারপাশে অবশ্যই গাছপালা থাকতে হবে। মন্দিরের চারপাশের এই পবিত্র বন বা জঙ্গলকে বলা হয় চিঞ্জু নো মোরি (Chinju no Mori) বা ‘পবিত্র কুঞ্জবন’। প্রাচীনকালে জাপানিরা বিশ্বাস করত, কামিরা আকাশ থেকে নেমে এসে প্রথমে উঁচু গাছের ডগা বা পাহাড়ের ওপর বিশ্রাম নেন। তাই গাছ হলো কামির অবতরণের সিঁড়ি বা হিমোরোগি (Himorogi)। আধুনিক যুগে যখন নগরায়নের দাপটে জাপানের শহরগুলো থেকে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, তখন এই জিঞ্জাগুলোই হয়ে উঠেছে শেষ আশ্রয়স্থল। টোকিওর মাঝখানে অবস্থিত ‘মেইজি জিঞ্জা’-র কথাই ধরা যাক। এটি আসলে মানুষের তৈরি একটি বিশাল বন, যেখানে ১,৭০,০০০-এর বেশি গাছ আছে। এই বনের তাপমাত্রা বাইরের শহরের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি কম থাকে। শিন্তো মন্দিরগুলো পরিবেশ রক্ষার এক নীরব দুর্গ হিসেবে কাজ করে। এই বন থেকে একটি পাতাও ছেঁড়া নিষেধ। এখানকার গাছগুলো শত শত বছর ধরে বেড়ে ওঠে, কেউ তাদের বিরক্ত করে না। পরিবেশবিজ্ঞানীরা একে বলেন সেক্রেড গ্রোভ কনজারভেশন (Sacred Grove Conservation)। জিঞ্জা আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতিকে শাসন করা ধর্মের কাজ নয়, বরং প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকাই হলো কামির পথ।
সেবক ও সেবিকা: কান্নুশি এবং মিকো
জিঞ্জা পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের বলা হয় কান্নুশি (Kannushi) বা শিন্তো পুরোহিত। তবে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা খ্রিস্টান পাদ্রীদের সাথে এদের পার্থক্য আছে। কান্নুশিরা সংসারত্যাগী নন। তারা বিয়ে করেন, সন্তান সন্ততি নিয়ে সংসার করেন এবং সাধারণ মানুষের মতোই জীবন যাপন করেন। তাদের কাজ কোনো ধর্মপ্রচার করা নয়, তাদের একমাত্র কাজ হলো কামি এবং মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা এবং মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষা করা। পূজার সময় তারা সাদা রঙের পোশাক বা ‘জোই’ (Joe) এবং মাথায় কালো টুপি বা ‘ইবোশি’ (Eboshi) পরেন। হাতে থাকে ‘ওনুসা’ (Onusa) বা শুদ্ধিকরণের লাঠি।
কান্নুশিদের পাশাপাশি মন্দিরে দেখা যায় লাল স্কার্ট (হাকামা) এবং সাদা কিমোনো পরা তরুণীদের। এদের বলা হয় মিকো (Miko) বা শ্রাইন মেইডেন। প্রাচীনকালে মিকরা ছিলেন শামান (Shaman) বা ঐশ্বরিক মাধ্যম। বিশ্বাস করা হতো, কামি তাদের শরীরের ওপর ভর করে কথা বলেন। তারা তখন এক ধরণের ট্রান্সে চলে যেতেন। আধুনিক যুগে মিকরা আর শামান হিসেবে কাজ করেন না, তারা পুরোহিতদের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তারা মন্দিরের দোকান দেখাশোনা করেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন এবং উৎসবের সময় এক বিশেষ ধরণের পবিত্র নাচ পরিবেশন করেন, যাকে বলা হয় কাগুরা (Kagura)। ‘কাগুরা’ মানে হলো ‘দেবতাদের বিনোদন’। মিথোলজিতে দেবী আমে-নো-উজুম গুহার সামনে যে নাচ নেচে সূর্যদেবীকে বের করে এনেছিলেন, সেটাই কাগুরা নাচের আদি উৎস। মিকোদের এই নাচ দেখলে মনে হয় যেন স্বর্গের কোনো অপ্সরা নেমে এসেছে মর্ত্যে, যার প্রতিটি মুদ্রায় জড়িয়ে আছে ভক্তি আর সৌন্দর্য (Bocking, 1997)।
ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইন: চিরনতুনের ধারণা
শিন্তো মন্দিরের আলোচনায় ‘ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইন’ বা ইসে জিঙ্গু (Ise Jingu)-র কথা না বললে এটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এটি জাপানের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির, যা সূর্যদেবী আমাতেরাসুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই মন্দিরের স্থাপত্যে এমন একটি প্রথা আছে যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। একে বলা হয় শিকিনেন সেনগু (Shikinen Sengu)। প্রতি ২০ বছর পর পর এই মন্দিরের মূল ভবনটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয় এবং ঠিক পাশের একটি খালি প্লটে হুবহু একই নকশায়, নতুন কাঠ দিয়ে নতুন করে মন্দির তৈরি করা হয়। গত ১৩০০ বছর ধরে, অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দী থেকে এই প্রথা চলে আসছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৬২তম বারের মতো এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। কেন এই ভাঙা-গড়ার খেলা? এর পেছনে আছে শিন্তোর টোকোওয়াকা (Tokowaka) বা ‘চিরযৌবন’-এর দর্শন। প্রকৃতি যেমন প্রতি বসন্তে নতুন পাতা মেলে ধরে নিজেকে নবায়ন করে, তেমনি কামির নিবাসও সবসময় নতুন এবং পবিত্র হতে হবে। কাঠ পচে যেতে পারে, কিন্তু স্থাপত্যের ধারণা এবং কৌশল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অবিকৃত থাকবে। এই ২০ বছর হলো একটি প্রজন্মের সময়কাল। প্রবীণ কারিগররা এই ২০ বছরে নবীনদের শিখিয়ে দিয়ে যান কীভাবে মন্দির বানাতে হয়। এভাবেই ঐতিহ্য বেঁচে থাকে, কিন্তু বস্তু পাল্টে যায়। এটি বস্তুবাদী বিশ্বের প্রতি এক বড় বার্তা – আসল সত্য বস্তুর মধ্যে নেই, আছে তার নিরন্তর প্রবাহ বা ফ্লো (Flow)-এর মধ্যে (Nelson, 2000)।
মাৎসুুুুরি (Matsuri): শিন্তো উৎসবের কোলাহল ও দর্শন
শিন্তো ধর্ম নিয়ে যারা সামান্য পড়াশোনা করেছেন, তাদের অনেকেরই ধারণা হতে পারে যে এটি কেবল নীরবতা, ধ্যান আর প্রকৃতি পূজার ধর্ম। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠটা দেখলে আপনি চমকে যাবেন। জাপানিরা যেমন শান্ত ও সুশৃঙ্খল, তেমনি তাদের উৎসবগুলো হলো বুনো উল্লাস আর রঙের বিস্ফোরণ। এই উৎসবগুলোকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘মাৎসুুুুরি’ (Matsuri)। মাৎসুুুুরি শব্দটির উৎপত্তি ‘মাৎসুুুু’ (Matsu) ক্রিয়াপদ থেকে, যার অর্থ হলো ‘অপেক্ষা করা’ বা ‘আমন্ত্রণ জানানো’। অর্থাৎ, কামি বা আত্মাদের পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাদের সেবা করাই হলো মাৎসুুুুরির মূল উদ্দেশ্য। শিন্তো ধর্মে উপাসনা বা ওয়ারশিপ (Worship) এবং উৎসব বা সেলিব্রেশন (Celebration) – এই দুটির মধ্যে কোনো স্পষ্ট সীমারেখা নেই। এখানে দেবতার পূজা মানেই হলো হইচই করা, খাওয়া-দাওয়া করা এবং জীবনকে উপভোগ করা। জাপানিরা বিশ্বাস করে, কামি বা দেবতারা মানুষের মতোই আনন্দ পছন্দ করেন। তাই মাৎসুুুুরির সময় জাপানিদের সেই বিখ্যাত গাম্ভীর্য বা ‘তাতামায়ে’ (Tatemae) উধাও হয়ে যায়, বেরিয়ে আসে তাদের ভেতরের প্রকৃত সত্তা বা ‘হোননে’ (Honne)। ঢাকের আওয়াজে, বাঁশির সুরে আর হাজার হাজার মানুষের গর্জনে তখন এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হয়। নৃতাত্ত্বিকরা একে বলেন কলেকটিভ এফারভেসেন্স (Collective Effervescence) বা সমষ্টিগত উত্তেজনা, যেখানে ব্যক্তি তার আমিত্ব ভুলে গিয়ে গোষ্ঠীর বা সমষ্টির সাথে একাত্ম হয়ে যায়।
মাৎসুুুুরি কোনো একক বা কেন্দ্রীয় উৎসব নয়। জাপানে কোনো নির্দিষ্ট দিনে পুরো দেশজুড়ে একই উৎসব পালিত হয় না (নববর্ষ বাদে)। জাপানের প্রতিটি অঞ্চলের, প্রতিটি গ্রামের, এমনকি প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব মাৎসুুুুরি আছে। একেক মাৎসুুুুরির ইতিহাস একেক রকম। কোনোটি ফসল কাটার আনন্দে, কোনোটি মহামারী তাড়াতে, আবার কোনোটি পূর্বপুরুষদের স্মরণে পালিত হয়। সারা বছর ধরে জাপানে প্রায় ১,০০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ মাৎসুুুুরি অনুষ্ঠিত হয়। ছোট গ্রামীণ মেলা থেকে শুরু করে টোকিও বা কিওটোর বিশাল শোভাযাত্রা – সবই মাৎসুুুুরির অংশ। এই বৈচিত্র্যই শিন্তো ধর্মের প্লুরালিজম (Pluralism) বা বহুত্ববাদকে টিকিয়ে রেখেছে। মাৎসুুুুরির মূল আকর্ষণ হলো কামি এবং মানুষের মিলনমেলা। সাধারণ দিনে কামি মন্দিরের গহীনে বা ‘হোনদেন’-এ শান্ত হয়ে বসে থাকেন। কিন্তু মাৎসুুুুরির দিন তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়, যাতে তিনি তার এলাকা বা ‘প্যারিশ’ (Parish) ঘুরে দেখতে পারেন এবং ভক্তদের আশীর্বাদ করতে পারেন। এই যাত্রাকে বলা হয় শিনকো-সাই (Shinko-sai) বা দেবতার শোভাযাত্রা।
মিকোশি: দেবতার ভ্রাম্যমাণ সিংহাসন
মাৎসুুুুরির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ‘মিকোশি’ (Mikoshi)। মিকোশি হলো একটি সুসজ্জিত পালকি বা ছোটখাটো ভ্রাম্যমাণ মন্দির। এটি দেখতে অনেকটা মূল মন্দিরের ছোট সংস্করণের মতো। সোনা, তামা আর রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো এই পালকিটি দেখতে যতটা সুন্দর, ওজনে ততটাই ভারী। একেকটি মিকোশির ওজন এক টনের বেশিও হতে পারে। উৎসবের দিন বিশেষ পূজার মাধ্যমে কামির আত্মাকে মূল মন্দির থেকে এই মিকোশিতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর কয়েক ডজন বা কয়েকশ শক্তিশালী পুরুষ (এবং বর্তমানে নারীরাও) কাঁধে করে এই মিকোশি নিয়ে রাস্তায় বের হন। তারা যখন মিকোশি নিয়ে হাঁটেন, তখন তারা সমস্বরে চিৎকার করেন – “ওয়াসশই! ওয়াসশই!” (Wasshoi)। এই শব্দের সঠিক অর্থ অস্পষ্ট, তবে অনেকে মনে করেন এর মানে হলো “ঐক্যবদ্ধ থাকো” বা “শান্তি বজায় রাখো”। মিকোশি বহনকারীরা ইচ্ছে করেই পালকিটিকে ডানে-বামে বা ওপরে-নিচে ঝাঁকাতে থাকেন। একে বলা হয় তামা-ফুরি (Tama-furi) বা আত্মা ঝাঁকানো। বিশ্বাস করা হয়, এই ঝাঁকুনির ফলে কামির শক্তি জাগ্রত হয় এবং তার জীবনীশক্তি বা ‘কি’ (Ki) চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যা অশুভ শক্তিকে দূর করে এবং ফসলের ফলন বাড়ায়।
মিকোশি বহনের সময় এক ধরণের ট্রান্স (Trance) বা ঘোরের সৃষ্টি হয়। যারা এটি বহন করেন, তারা ক্লান্ত হন, ঘর্মাক্ত হন, কিন্তু থামেন না। এই শারীরিক কষ্ট বা এনডিউরেন্স (Endurance)-কে কামির প্রতি ভক্তি বা ত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অনেক উৎসবে মিকোশিকে নদীতে বা সাগরে নামিয়ে দেওয়া হয়, একে বলা হয় ‘হামাওরি’ (Hamaori)। আবার কোথাও একে আগুনের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই নাটকীয়তা এবং উত্তেজনা মাৎসুুুুরির প্রাণ। মিকোশির যাত্রাপথে স্থানীয় মানুষজন জল ছিটিয়ে বা লবণ ছিটিয়ে রাস্তা পবিত্র করে দেয়। বাচ্চারা ছোট ছোট মিকোশি নিয়ে বড়দের পিছু পিছু হাঁটে। এটি কেবল ধর্মীয় শোভাযাত্রা নয়, এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঐতিহ্য হস্তান্তরের এক জীবন্ত ক্লাসরুম।
গিওন মাৎসুুুুরি: মহামারীর বিরুদ্ধে এক হাজার বছরের যুদ্ধ
জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রাচীন উৎসবগুলোর একটি হলো কিওটোর গিওন মাৎসুুুুরি (Gion Matsuri)। জুলাই মাসজুড়ে চলা এই উৎসবের ইতিহাস বেশ করুণ। ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে জাপানে এক ভয়াবহ মহামারী বা প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষ মরছিল হাজারে হাজারে। তখন সম্রাট নির্দেশ দিলেন কিওটোর ইয়াসাকা শ্রাইন (Yasaka Shrine)-এর কামি ‘সুসানো’-কে তুষ্ট করার জন্য বিশেষ পূজার আয়োজন করতে। ৬৬টি বল্লম বা ‘হোকো’ (Hoko) তৈরি করা হলো জাপানের ৬৬টি প্রদেশের প্রতীক হিসেবে। সেই থেকে এই উৎসব শুরু। আজও গিওন মাৎসুুুুরির প্রধান আকর্ষণ হলো ‘ইয়ামাবোকো’ (Yamaboko) শোভাযাত্রা। এখানে মিকোশির বদলে বিশাল বিশাল কাঠের রথ বা ‘ফ্লোট’ (Float) ব্যবহার করা হয়। একেকটি রথ ২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয় এবং চাকাগুলো হয় মানুষের চেয়েও বড়। এই রথগুলো কাঠের তৈরি এবং কোনো পেরেক ছাড়াই দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। রথের গায়ে ঝোলানো থাকে মহামূল্যবান ট্যাপেস্ট্রি বা কার্পেট, যার অনেকগুলো প্রাচীনকালে পারস্য বা ভারত থেকে সিল্ক রোড হয়ে জাপানে এসেছিল। এই রথগুলোকে বলা হয় ‘চলমান জাদুঘর’ বা মোবাইল মিউজিয়াম (Mobile Museum)।
১৭ই জুলাই এবং ২৪শে জুলাই যখন এই বিশাল রথগুলো কিওটোর রাস্তায় বের হয়, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় জমায়। রথের ওপর বসে থাকা বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরা ‘গিওন বায়াশি’ (Gion Bayashi) নামে এক বিশেষ ধরণের সুর বাজাতে থাকেন। এই উৎসবের পেছনে যে দর্শনটি কাজ করে তা হলো গোরিও শিনকো (Goryo Shinko) বা প্রতিশোধপরায়ণ আত্মার পূজা। প্রাচীন জাপানিরা বিশ্বাস করত, মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় অতৃপ্ত বা রাগী আত্মার কারণে। তাই উৎসবের মাধ্যমে সেই আত্মাদের শান্ত করা বা ‘প্যাসিফাই’ (Pacify) করাই ছিল মূল লক্ষ্য। গিওন মাৎসুুুুরি তাই কেবল আনন্দ নয়, এটি ভয় এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে মানুষের এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।
কান্দা ও সানজা: টোকিওর হৃদস্পন্দন
টোকিও বা প্রাচীন এডো শহরের মাৎসুুুুরিগুলো একটু অন্যরকম। এখানকার মানুষ বা ‘এডোক্কো’ (Edokko)-রা তাদের উগ্র মেজাজ এবং জাঁকজমকের জন্য পরিচিত। টোকিওর কান্দা মাৎসুুুুরি (Kanda Matsuri) হলো এডো যুগের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। ১৭শ শতাব্দীতে তোকুগাওয়া ইয়েয়াসু (Tokugawa Ieyasu) সেকিগাহারা যুদ্ধে জয়লাভ করার পর এই উৎসবকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। কান্দা মাৎসুুুুরির বিশেষত্ব হলো এটি প্রতি বিজোড় বছরে অনুষ্ঠিত হয়। জোড় বছরে অনুষ্ঠিত হয় এর প্রতিদ্বন্দ্বী উৎসব সান্নো মাৎসুুুুরি (Sanno Matsuri)। এই মাৎসুুুুরিগুলোতে সামুরাই যুগের পোশাক পরে শত শত মানুষ ঘোড়ায় চড়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়, যা দেখে মনে হয় টাইম মেশিনে করে ৪০০ বছর পেছনে চলে গেছে টোকিও।
তবে টোকিওর সবচেয়ে বন্য এবং কোলাহলপূর্ণ উৎসব হলো সানজা মাৎসুুুুরি (Sanja Matsuri)। এটি আসাকুসা এলাকার সেনসো-জি (Senso-ji) মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও সেনসো-জি একটি বৌদ্ধ মন্দির, কিন্তু এই উৎসবটি মূলত আসাকুসা শ্রাইন-এর তিন কামির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এখানে শিন্তো এবং বৌদ্ধধর্মের এক চমৎকার সংমিশ্রণ বা সিনক্রেটিজম (Syncretism) দেখা যায়। সানজা মাৎসুুুুরির একটি কুখ্যাত আকর্ষণ হলো ‘ইয়াকুজা’ (Yakuza) বা জাপানি মাফিয়াদের অংশগ্রহণ। তারা তাদের সারা শরীরের উল্কি বা ট্যাটু প্রদর্শন করে মিকোশি বহন করে। যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক আছে, তবুও স্থানীয় সংস্কৃতিতে এটি এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। সানজা মাৎসুুুুরিতে প্রায় ১০০টি মিকোশি বের হয় এবং প্রায় ২০ লক্ষ দর্শক সমাগম হয়। তিন দিনের জন্য আসাকুসা এলাকা এক বিশাল পার্টিতে পরিণত হয়।
ওবন এবং নববর্ষ: পরিবার ও পূর্বপুরুষের উৎসব
মাৎসুুুুরির আলোচনা কেবল রাস্তায় মিকোশি ঘোরানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পারিবারিক পর্যায়েও মাৎসুুুুরির গভীর প্রভাব আছে। যেমন – আগস্ট মাসে পালিত হয় ওবন (Obon) উৎসব। এটি মূলত বৌদ্ধ উৎসব হলেও এর মধ্যে শিন্তো উপাদান প্রচুর। বিশ্বাস করা হয়, এই সময় মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মারা পরকাল থেকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। তাদের পথ দেখানোর জন্য বাড়ির সামনে আগুন জ্বালানো হয় বা লণ্ঠন ঝোলানো হয়, যাকে বলা হয় ‘মুকাইবি’ (Mukaebi)। তিন দিন পর আবার আগুন জ্বালিয়ে বা নদীতে ভাসমান লণ্ঠন ভাসিয়ে তাদের বিদায় জানানো হয়, একে বলে ‘ওকুরিবি’ (Okuribi)। ওবন উৎসবে গ্রামের চত্বরে সবাই গোল হয়ে এক বিশেষ নাচ নাচে, যার নাম বোন ওদোরি (Bon Odori)। এই নাচের মাধ্যমে জীবিতরা মৃতদের সাথে আনন্দ ভাগ করে নেয়। এটি শোকের নয়, বরং স্মৃতির উৎসব।
অন্যদিকে, নববর্ষ (Shogatsu) হলো শিন্তো ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১লা জানুয়ারি থেকে ৩রা জানুয়ারি পর্যন্ত কোটি কোটি জাপানি শিন্তো মন্দিরে ভিড় করে। বছরের প্রথম মন্দির দর্শনকে বলা হয় হাৎসুমোদে (Hatsumode)। মেয়েরা রঙিন কিমোনো পরে, ছেলেরা স্যুট বা হাকামা পরে। সবাই নতুন বছরের জন্য ওমামোরি (তাবিজ) কেনে, পুরনো বছরের তাবিজ আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। মন্দিরে বিশেষ ধরণের মিষ্টি বা ‘মোচি’ (Mochi) খাওয়া হয়। এই সময় জাপানের আধুনিকতা যেন উবে যায়, ফিরে আসে সেই চিরায়ত ঐতিহ্য। হাৎসুমোদে প্রমাণ করে যে, শিন্তো কোনো মৃত ধর্ম নয়, এটি জাপানিদের আধুনিক জীবনের সাথেই তাল মিলিয়ে চলছে।
মাৎসুুুুরি ও কমিউনিটি বন্ডিং
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মাৎসুুুুরির আসল শক্তি হলো এর সামাজিক সংহতি বা সোশ্যাল কোহেসন (Social Cohesion)। আধুনিক যুগে মানুষ যখন একা হয়ে যাচ্ছে, পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীকেও চেনে না, তখন মাৎসুুুুরি তাদের এক সুতোয় বাঁধে। একটি মিকোশি বহন করতে গেলে দলগত সমন্বয় লাগে, উৎসব আয়োজন করতে গেলে পাড়ার সবাই মিলে মিটিং করতে হয়, চাঁদা তুলতে হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ে। জাপানি কোম্পানিগুলোও তাদের কর্মীদের মাৎসুুুুরিতে অংশ নিতে উৎসাহিত করে, যাতে তাদের মধ্যে টিমওয়ার্ক বাড়ে। মাৎসুুুুরি হলো এমন এক স্থান বা স্পেস (Space), যেখানে ধনী-গরিব, বস-কর্মচারী সবাই সমান। মিকোশির নিচে কাঁধ লাগানোর সময় কে সিইও আর কে পিয়ন, তা কেউ দেখে না। সবাই তখন একই কামির সেবক।
মাৎসুুুুরিতে খাবারের স্টল বা ‘ইয়াতাই’ (Yatai)-এর ভূমিকাও কম নয়। তাকিওয়াকি (Takoyaki), ইয়াকিসোবা (Yakisoba) বা ওকোনোমিয়াকি (Okonomiyaki)-র গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গোল্ডফিশ স্কুপিং (Goldfish Scooping) বা বেলুন ফিশিং-এর মতো গেমগুলোতে বাচ্চারা মেতে ওঠে। এই মেলা বা কার্নিভালের আবহ মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি বা এসকেপিজম (Escapism) দেয়। শিন্তো শেখায়, জীবনটা কষ্টকর হতে পারে, কিন্তু তার মাঝেও আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। মাৎসুুুুরি হলো সেই আনন্দ উদযাপনের পবিত্র অজুহাত।
নগ্ন উৎসব: হাদাকা মাৎসুুুুরি
শিন্তো উৎসবের সবচেয়ে অদ্ভুত এবং আলোচিত দিক হলো হাদাকা মাৎসুুুুরি (Hadaka Matsuri) বা নগ্ন উৎসব। এর মধ্যে ওকাইয়ামার ‘সাইদাইজি ইয়েও’ (Saidaiji Eyo) সবচেয়ে বিখ্যাত। শীতের রাতে প্রায় ১০,০০০ পুরুষ কেবল একটি নেংটি বা ‘ফুনদোশি’ (Fundoshi) পরে মন্দিরে জড়ো হয়। পুরোহিত ওপর থেকে দুটি পবিত্র লাঠি বা ‘শিঙ্গি’ (Shingi) ছুড়ে দেন। বিশ্বাস করা হয়, যে এই লাঠিটি ধরতে পারবে, সারা বছর তার ভাগ্য ভালো যাবে। হাজার হাজার মানুষের ধস্তাধস্তি, ঘাম আর বাষ্পে এক আদিম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও একে নগ্ন উৎসব বলা হয়, কিন্তু তারা সম্পূর্ণ নগ্ন হন না। এই উৎসবের দর্শন হলো – মানুষ মায়ের পেট থেকে যেভাবে এসেছে, কামির সামনে সেভাবেই দাঁড়ানো উচিত, কোনো আভিজাত্য বা পোশাকের আড়াল ছাড়া। এটি পুরুষত্বের পরীক্ষা এবং পবিত্র হওয়ার এক চরমপন্থা।
পরিশেষে বলা যায়, মাৎসুুুুরি হলো জাপানি সংস্কৃতির হৃৎস্পন্দন। এটি কেবল ধর্ম নয়, এটি আর্ট, এটি মিউজিক, এটি থিয়েটার। মাৎসুুুুরি না থাকলে শিন্তো হয়তো কবেই জাদুঘরে স্থান পেত। এই উৎসবগুলোই কামিকে জীবন্ত রেখেছে। যখন কোনো জাপানি যুবক মাথায় ফিতা বেঁধে, গায়ে হাপ্পি কোট (Happi Coat) জড়িয়ে মিকোশি কাঁধে নেয়, তখন সে আসলে তার তিন হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের ভারই কাঁধে তুলে নেয়। মাৎসুুুুরি আমাদের শেখায় – ধর্ম মানে কেবল ভয়ে কুঁকড়ে থাকা নয়, ধর্ম মানে উৎসবে ফেটে পড়াও।
শিন্তো ও প্রকৃতি: প্রাচীন ইকো-স্পিরিচুয়ালিটির দর্শন
আজকের পৃথিবীতে যখন পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ (Climate Change) এবং বনভূমি উজাড় নিয়ে বিজ্ঞানীরা এবং সমাজকর্মীরা সোচ্চার, তখন জাপানের প্রাচীন শিন্তো দর্শন আমাদের সামনে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। শিন্তোকে নির্দ্বিধায় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং শক্তিশালী পরিবেশবাদী দর্শন বা ইকো-ফিলোসফি (Eco-philosophy) বলা যেতে পারে। তবে এটি আধুনিক পরিবেশবাদের মতো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং এটি মানুষের অস্তিত্বের সাথে প্রকৃতির এক গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগ। শিন্তো ধর্মতত্ত্বের মূল কথা হলো – মানুষ প্রকৃতির মালিক বা শাসক নয়, বরং মানুষ প্রকৃতিরই একটি ক্ষুদ্র অংশ। বাইবেল বা আব্রাহামিক ধর্মে যেখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব বা ডোমিনিয়ন (Dominion) দিয়েছেন, শিন্তো সেখানে ঠিক উল্টো কথা বলে। শিন্তো বিশ্বাস করে, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি নদী, প্রতিটি পাহাড় এবং প্রতিটি পাথরের নিজস্ব প্রাণ বা আত্মা আছে, যাকে তারা ‘কামি’ বলে ডাকে। তাই প্রকৃতির ক্ষতি করা মানে খোদ কামির বা দেবতার ক্ষতি করা, যা কেবল পাপ নয়, বরং এক ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এই বিশ্বাস বা অ্যানিমিজম (Animism)-ই শিন্তোকে প্রকৃতির সাথে মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য এবং সম্মানজনক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। প্রকৃতি এখানে কোনো জড় বস্তু বা রিসোর্স (Resource) নয়, প্রকৃতি এখানে জীবন্ত এবং পবিত্র।
শিন্তো ধর্মে প্রকৃতির সাথে মানুষের এই সম্পর্ককে বলা হয় ‘মুসুবি’ (Musubi)। ‘মুসুবি’ শব্দের অর্থ হলো সংযোগ, বৃদ্ধি বা সৃজনশীল শক্তি যা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটি এমন এক শক্তি যা মানুষ, কামি এবং প্রকৃতিকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে। জাপানিরা মনে করে, বনের গাছ যখন অক্সিজেন দেয়, নদীর জল যখন তৃষ্ণা মেটায়, তখন তারা আসলে কামির আশীর্বাদই গ্রহণ করে। তাই প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা বা গ্র্যাটিটিউড (Gratitude) প্রকাশ করাই হলো শিন্তো উপাসনার মূল নির্যাস। আপনি যদি জাপানের গ্রামীণ এলাকায় যান, তবে দেখবেন কৃষকরা ধান কাটার আগে ক্ষেতের কোণায় ছোট একটি পূজা দেয়, জেলে বা জেলেনিরা সাগরে জাল ফেলার আগে সাকে (চাল থেকে তৈরি মদ) ঢেলে সমুদ্রের কামিকে তুষ্ট করে। এগুলো হলো প্রকৃতির কাছ থেকে নেওয়ার আগে তার অনুমতি নেওয়া এবং তার প্রতি সম্মান জানানো। এই মানসিকতাই জাপানিদের হাজার বছর ধরে তাদের দ্বীপরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদ নিয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।
ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইন ও সাইক্লিক্যাল নেচার
প্রকৃতির সাথে শিন্তোর সম্পর্কের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বিস্ময়কর উদাহরণ হলো ‘ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইন’ (Ise Grand Shrine) বা ইসে জিঙ্গু (Ise Jingu)-র পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া, যার কথা একটু আগেই বলা হলো। এই মন্দিরটি জাপানের সবচেয়ে পবিত্র স্থান, যা সূর্যদেবী আমাতেরাসুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, ইতিমধ্যেই যেমনটা উল্লেখ করেছি, এই মন্দিরটি কখনোই ২০ বছরের বেশি পুরনো হয় না। প্রতি ২০ বছর পর পর মন্দিরের মূল ভবনগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয় এবং ঠিক পাশের একটি খালি প্লটে হুবহু একই নকশায়, নতুন কাঠ দিয়ে নতুন করে মন্দির তৈরি করা হয়। এই প্রথাকে বলা হয় শিকিনেন সেনগু (Shikinen Sengu)। ৬৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত, প্রায় ১৩০০ বছর ধরে এই প্রথা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে (যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধের কারণে মাঝে কিছু বিরতি ছাড়া)। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৬২তম বারের মতো এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রথাটির মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সাইক্লিক্যাল টাইম (Cyclical Time) বা চক্রাকার সময়ের ধারণা। পশ্চিমা দর্শনে সময় হলো রৈখিক বা লিনিয়ার (Linear) – অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে সোজা চলে। কিন্তু শিন্তো এবং প্রাচ্যের দর্শনে সময় হলো ঋতুচক্রের মতো – বসন্ত আসে, শীত আসে, আবার বসন্ত ফিরে আসে। নতুনের মধ্যে পুরনো ফিরে আসে।
ইসে জিঙ্গু বানাতে প্রায় ১০,০০০-এর বেশি জাপানি সাইপ্রাস বা হিনোকি (Hinoki) গাছের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে কিছু গাছের বয়স হতে হয় অন্তত ২০০ থেকে ৪০০ বছর। এখন প্রশ্ন হলো, প্রতি ২০ বছর পর পর এত বিশাল সংখ্যক গাছ কাটলে কি বন ধ্বংস হয়ে যাবে না? এখানেই শিন্তোর দূরদর্শিতা বা সাসটেইনেবিলিটি (Sustainability)-র প্রমাণ মেলে। মন্দির কর্তৃপক্ষ বা ‘জিঙ্গু প্রশাসন’ তাদের নিজস্ব বনে গাছ কাটার সাথে সাথেই নতুন চারা রোপণ করে। তারা এমন একটি পরিকল্পনা বা ফরেস্ট্রি প্ল্যান (Forestry Plan) মেনে চলে, যাতে ২০০ বছর পর যখন আবার মন্দির বানানোর দরকার হবে, তখন যেন পর্যাপ্ত গাছ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, প্রকৃতি থেকে যা নেওয়া হচ্ছে, তা আবার সুদসহ প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একে বলা হয় রিসিপ্রোকাল রিলেশনশিপ (Reciprocal Relationship) বা পারস্পরিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক। এই বনকে বলা হয় ‘মিসোমাসায়ামা’ (Misomasayama) বা পবিত্র পর্বত, যেখানে মানুষের প্রবেশ নিষেধ এবং গাছপালা তাদের আপন গতিতে বেড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থাটি প্রমাণ করে যে, ধর্ম এবং পরিবেশ সংরক্ষণ একে অপরের পরিপূরক হতে পারে (Teeuwen & Breen, 2017)।
চিনজু নো মোরি: পবিত্র বনের বাস্তুতন্ত্র
প্রতিটি শিন্তো মন্দির বা জিঞ্জাকে ঘিরে যে ছোট বা বড় বন থাকে, তাকে বলা হয় চিনজু নো মোরি (Chinju no Mori) বা ‘গ্রামের রক্ষক দেবতার বন’। জাপানে প্রায় ৮০,০০০ জিঞ্জা আছে, এবং প্রায় সবগুলোরই নিজস্ব ‘চিনজু নো মোরি’ আছে। প্রাচীনকালে জাপানিরা বিশ্বাস করত, কামি বা দেবতারা আকাশ থেকে নেমে এসে প্রথমে উঁচু গাছের ডগায় বা পাহাড়ের চূড়ায় বিশ্রাম নেন। তাই গাছ হলো কামির মর্ত্যে অবতরণের সিঁড়ি বা হিমোরোগি (Himorogi)। এই কারণে মন্দিরের চারপাশের গাছগুলো কাটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি মরা গাছের ডালও অনেক সময় পোড়ানো হয় না, মাটিতে মিশে যেতে দেওয়া হয়। এই ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার ফলে জাপানের নগরায়নের বা আরবানাইজেশন (Urbanization)-এর প্রবল চাপের মধ্যেও এই ছোট ছোট বনগুলো টিকে আছে। টোকিওর মতো কংক্রিটের জঙ্গলে ‘মেইজি জিঞ্জা’ (Meiji Jinja)-র বনটি যেন এক টুকরো ফুসফুস। ১৯২০ সালে যখন মেইজি মন্দির তৈরি করা হয়েছিল, তখন সারাদেশ থেকে ১,০০,০০০ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে ১,৭০,০০০-এর বেশি গাছ লাগিয়েছিল। তারা এমন সব প্রজাতির গাছ বেছে নিয়েছিল যা প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে উঠবে এবং মানুষের কোনো পরিচর্যা ছাড়াই শত শত বছর টিকে থাকবে। আজ এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem), যেখানে বিরল প্রজাতির পাখি ও কীটপতঙ্গ আশ্রয় পেয়েছে।
পরিবেশবিজ্ঞানী আকিরা মিয়াত্তয়াকি (Akira Miyawaki) শিন্তো মন্দিরের এই বনগুলো নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন যে, এগুলো জাপানের আদিম ও চিরহরিৎ বনের বা লরেল ফরেস্ট (Laurel Forest)-এর শেষ অবশিষ্টাংশ। তিনি এই ‘চিনজু নো মোরি’র আদলে বিশ্বজুড়ে বনায়ন বা এফরেস্টেশন (Afforestation)-এর জন্য ‘মিয়াত্তয়াকি পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেছেন। অর্থাৎ, শিন্তো মন্দিরের বনগুলো কেবল ধর্মীয় স্থান নয়, এগুলো হলো বায়োডাইভার্সিটি বা জীববৈচিত্র্য (Biodiversity)-এর হটস্পট। সুনামির মতো দুর্যোগেও এই বনগুলো ঢাল হিসেবে কাজ করে। ২০১১ সালের তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামির পর দেখা গেছে, যেসব গ্রামে সমুদ্র উপকূলে প্রাচীন শিন্তো মন্দিরের বন ছিল, সেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। গাছের গভীর শেকড় মাটিকে ধরে রেখেছিল এবং জলোচ্ছ্বাসের গতি কমিয়ে দিয়েছিল। জাপানিরা তখন নতুন করে উপলব্ধি করল যে, তাদের পূর্বপুরুষরা কেন উপকূলীয় এলাকায় এই ‘চিনজু নো মোরি’গুলো রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পবিত্র পাহাড় ও জল: সাঙ্গাকু শিনকো
শিন্তো ধর্মে পাহাড়ের গুরুত্ব অপরিসীম। জাপানের ভূখণ্ডের ৭০ শতাংশই পাহাড়ি। প্রাচীন কাল থেকেই জাপানিরা পাহাড়কে কামির শরীর বা বাসস্থান মনে করে আসছে। একে বলা হয় সাঙ্গাকু শিনকো (Sangaku Shinko) বা পর্বত উপাসনা। মাউন্ট ফুজি (Mount Fuji) হলো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ফুজি শান কেবল একটি আগ্নেয়গিরি নয়, এটি নিজেই একজন কামি, যার নাম ‘কোনোহানা সাকুয়া-হিমে’ (Konohana Sakuya-hime) বা ‘চেরি ফুলের মতো সুন্দরী দেবী’। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ফুজি পাহাড়ে চড়ে, যা তাদের কাছে তীর্থযাত্রা। তারা পাহাড়ে ওঠার সময় ‘রোক্কন শোজো’ (Rokkon Shojo) জপ করে, যার অর্থ ‘ছয়টি ইন্দ্রিয় পবিত্র হোক’। পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যোদয় দেখা বা ‘গোরাইকো’ (Goraiko) হলো এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। পাহাড় ছাড়াও ঝর্ণা বা জলপ্রপাত শিন্তোতে খুব পবিত্র। মিসোগি বা জল দিয়ে শুদ্ধিকরণের জন্য জাপানিরা প্রায়ই পবিত্র জলপ্রপাতের নিচে দাঁড়িয়ে ধ্যান করে। নাচি জলপ্রপাত (Nachi Falls) হলো এমন এক স্থান, যেখানে জলপ্রপাতটিকেই কামি বা দেবতা হিরো-গোঞ্জেন (Hiro-Gongen) হিসেবে পূজা করা হয়। এখানে কোনো মূর্তি নেই, জলপ্রপাতটিই বিগ্রহ।
এই পর্বত ও জল উপাসনার পেছনে একটি গভীর পরিবেশগত জ্ঞান লুকিয়ে আছে। পাহাড় হলো নদীর উৎস, আর নদী হলো কৃষিকাজের বা ধান চাষের প্রাণ। তাই পাহাড় ও বন রক্ষা করা মানেই হলো জলের উৎস বা ওয়াটারশেড (Watershed) রক্ষা করা। প্রাচীন জাপানিরা হয়তো আধুনিক হাইড্রোলজি বা জলবিজ্ঞান (Hydrology) জানত না, কিন্তু তারা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝেছিল যে পাহাড়ের গাছ কাটলে নদীতে জল থাকবে না, বন্যা হবে। তাই তারা পাহাড়কে ‘পবিত্র’ ঘোষণা করে সেখানে কুঠার চালানো নিষিদ্ধ করেছিল। এই ধর্মীয় ট্যাবু বা টাবু (Taboo) আসলে ছিল পরিবেশ রক্ষার এক আদিম আইনি ব্যবস্থা।
শিমেনাওয়্যা: পবিত্রতার সীমানা
শিন্তো এবং প্রকৃতির বন্ধনের আরেকটি দৃশ্যমান প্রতীক হলো শিমেনাওয়্যা (Shimenawa)। এটি হলো ধান গাছের খড় দিয়ে পাকানো মোটা দড়ি, যাতে সাদা কাগজের জিগজ্যাগ স্ট্রিপ বা ‘শিদে’ (Shide) ঝোলানো থাকে। আপনি জাপানে অনেক বিশাল ওক বা সিডার গাছের গায়ে এই দড়ি প্যাঁচানো দেখবেন। এর মানে হলো, এই গাছটি সাধারণ কোনো গাছ নয়, এটি কামির বাসস্থান বা ইওরিহিরো (Yorishiro)। একবার কোনো গাছে শিমেনাওয়্যা পরানো হলে, সেই গাছ কাটা মহাপাপ। এমনকি সেই গাছের পাতা ছেঁড়াও নিষেধ। অনেক সময় বিশাল কোনো পাথর বা ‘ইওয়াকুরা’ (Iwakura)-র গায়েও এই দড়ি দেখা যায়। যেমন – মিয়াজিমা দ্বীপের কাছে সমুদ্রে জেগে থাকা দুটি পাথর, যাদের বলা হয় ‘মেওতো ইওয়া’ (Meoto Iwa) বা স্বামী-স্ত্রী পাথর, তারা শিমেনাওয়্যা দিয়ে একে অপরের সাথে বাঁধা। এটি প্রকৃতির দুটি উপাদানের (পুরুষ ও নারী, বা ইন ও ইয়াং) মিলনের প্রতীক। এই শিমেনাওয়্যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির কিছু কিছু জায়গায় মানুষের হাত দেওয়া উচিত নয়, সেগুলোকে তাদের মতো থাকতে দেওয়া উচিত। একে বলা হয় স্যাক্রেড স্পেস (Sacred Space) বা পবিত্র স্থানের প্রতি সম্ভ্রম।
আধুনিক জাপানে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে অনেক ‘চিনজু নো মোরি’ ধ্বংস হয়ে গেছে বা ছোট হয়ে এসেছে। বাঁধ নির্মাণের ফলে অনেক পবিত্র নদীর গতিপথ বদলে গেছে। কিন্তু শিন্তো পুরোহিতরা এবং পরিবেশবাদীরা এখন নতুন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। তারা বলছেন, “বন ছাড়া কামি বাঁচবে না, আর কামি ছাড়া মানুষ বাঁচবে না।” শিন্তো সংগঠনগুলো এখন গাছ লাগানো, নদী পরিষ্কার করা এবং পারমাণবিক শক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করছে। তারা প্রাচীন ‘সাতোয়ামা’ (Satoyama) বা গ্রাম-বনের সহাবস্থানের মডেলটি আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে। সাতোয়ামা হলো এমন এক ব্যবস্থা যেখানে মানুষ বনের প্রান্তসীমানায় বাস করে এবং বন থেকে কেবল প্রয়োজনীয় কাঠ বা মাশরুম সংগ্রহ করে, কিন্তু বনের মূল ক্ষতি করে না। এটি সাসটেইনেবল লিভিং (Sustainable Living)-এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত (Rots, 2017)।
পরিশেষে, শিন্তো আমাদের শেখায় যে প্রকৃতি কোনো ‘জিনিস’ বা ‘বস্তু’ নয় যা আমরা ইচ্ছামতো ভোগ করব। প্রকৃতি আমাদের খুব কাছের। এর সাথে যখন মানুষ নিজেকে একাত্ম বা হারমোনাইজ (Harmonize) করতে পারে, তখনই প্রকৃত শান্তি আসে। ইসে গ্র্যান্ড শ্রাইনের সেই ২০ বছরের চক্র আমাদের মনে করিয়ে দেয় – ধ্বংসের পর সৃষ্টি আসে, মৃত্যুর পর জীবন আসে, যদি আমরা প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলি। আজকের এই বিপর্যস্ত পৃথিবীতে শিন্তোর এই সবুজ বার্তাটি হয়তো আমাদের বাঁচার নতুন পথ দেখাতে পারে।
শিনবুৎসু-শুগো: বুদ্ধ ও কামির হাজার বছরের সংসার
জাপানের আধ্যাত্মিক ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং সম্ভবত সবচেয়ে জটিল অধ্যায়টি হলো বৌদ্ধধর্ম এবং শিন্তোর মিলন। আমরা সচরাচর ধর্মকে দেখি এক্সক্লুসিভ বা এক্সক্লুসিভিজম (Exclusivism)-এর চশমা দিয়ে – অর্থাৎ আপনি হয় মুসলিম, নয় হিন্দু; হয় খ্রিস্টান, নয় ইহুদি। একই সাথে দুটি নৌকায় পা দেওয়া যায় না। কিন্তু জাপানিরা এই হিসেবকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। তারা এমন এক ধর্মীয় বাস্তুতন্ত্র বা রিলিজিয়াস ইকোসিস্টেম (Religious Ecosystem) তৈরি করেছিল, যেখানে কামি (শিন্তো দেবতা) এবং বুদ্ধ (বৌদ্ধ মহাপুরুষ) কেবল পাশাপাশি থাকতেন না, বরং তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। এই অদ্ভুত সংমিশ্রণ বা সিনক্রেটিজম (Syncretism)-কে জাপানি ভাষায় বলা হয় শিনবুৎসু-শুগো (Shinbutsu-shugo), যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘কামি ও বুদ্ধের একত্রীকরণ’। এটি কোনো একদিনের ঘটনা নয়, এটি ছিল হাজার বছরের এক ধীরলয় প্রক্রিয়া। ৫৩৮ বা ৫৫২ খ্রিস্টাব্দে যখন কোরিয়ার বেকেজ রাজ্য থেকে জাপানে বুদ্ধমূর্তি ও সূত্র বা সুত্র (Sutras) এল, তখন জাপানিদের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল ভীতি ও কৌতূহলের মিশ্রণ। তারা নতুন এই দেবতাকে নাম দিল ‘বিদেশি কামি’ বা আদাসিকুনি নো কামি (Adashikuni no Kami)। তাদের ভয় ছিল, এই নতুন কামিকে পূজা করলে দেশের আদি কামিরা যদি রেগে যান? কিন্তু জাপানিরা বরাবরই বাস্তববাদী। তারা দেখল, বৌদ্ধধর্মের সাথে আসছে উন্নত চীনা সভ্যতা, চিকিৎসাবিদ্যা, স্থাপত্যকলা এবং লেখার পদ্ধতি। এগুলোকে তো আর ফেরানো যায় না। তাই তারা এক মধ্যপন্থা খুঁজে বের করল। তারা ঠিক করল, কামি এবং বুদ্ধ – উভয়কেই তারা গ্রহণ করবে, তবে ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে। এই গ্রহণ করার প্রক্রিয়াই জাপানি ধর্মতত্ত্বের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
জিঞ্জুজি: কামির উদ্ধারের জন্য বৌদ্ধ মন্দির
শিনবুৎসু-শুগোর প্রাথমিক পর্যায়ে জাপানিরা এক অদ্ভুত ধারণা পোষণ করতে শুরু করল। বৌদ্ধ দর্শনে সংসার (Samsara) বা জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া বা নির্বাণ লাভ করাই হলো মূল লক্ষ্য। ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর দিকে জাপানিরা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, কামিরা বা শিন্তো দেবতারাও আসলে এই জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আটকে আছেন। কামিরা অমর নন, তারা কেবল মানুষের চেয়ে শক্তিশালী এবং দীর্ঘজীবী এক সত্তা, কিন্তু তারাও দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে নন। তাদেরও উদ্ধারের বা স্যালভেশন (Salvation)-এর প্রয়োজন আছে। এই চিন্তা থেকেই অষ্টম শতাব্দীর দিকে জাপানে এক নতুন ধরণের ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে উঠল, যার নাম জিঞ্জুজি (Jinguji) বা ‘শিন্তো মন্দিরের ভেতরের বৌদ্ধ বিহার’। ব্যাপারটি একটু বুঝিয়ে বলা যাক। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শিন্তো মন্দিরে বা জিঞ্জায় যেতেন এবং কামির মূর্তির সামনে বসে বৌদ্ধ সূত্র পাঠ করতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কামিকে বৌদ্ধধর্মের জ্ঞান দেওয়া, যাতে কামি নির্বাণ লাভ করতে পারেন এবং শান্তি পান। বিনিময়ে কামি হতেন বৌদ্ধধর্মের রক্ষাকর্তা বা ধর্মপাল (Dharmapala)।
এই প্রথাটি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে ‘হাচিমান’ (Hachiman) দেবতার ক্ষেত্রে। হাচিমান ছিলেন মূলত কিউশু অঞ্চলের এক স্থানীয় শিন্তো দেবতা এবং যুদ্ধের কামি। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে তাকে ‘হাচিমান দাইবোসাৎসু’ (Hachiman Daibosatsu) বা ‘মহা-বোধিসত্ত্ব হাচিমান’ উপাধি দেওয়া হলো। অর্থাৎ, একজন শিন্তো দেবতা অফিশিয়ালি বৌদ্ধ সন্ত বা বোধিসত্ত্ব (Bodhisattva)-এর মর্যাদা পেলেন। তোদাই-জি (Todai-ji) মন্দিরে যখন বিশাল বুদ্ধমূর্তি বা দাইবুৎসু (Daibutsu) তৈরি করা হচ্ছিল, তখন বলা হয় হাচিমান কামি স্বপ্নে এসে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি এই মূর্তি তৈরিতে সাহায্য করবেন। এটি ছিল শিন্তো ও বৌদ্ধধর্মের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক মৈত্রী। এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, কামি এবং বুদ্ধ একে অপরের শত্রু নন, বরং তারা একই টিমের খেলোয়াড়। মানুষ ইহজাগতিক সমস্যার জন্য (যেমন – ফসল, বৃষ্টি, রোগবালাই) কামির কাছে যেত, আর পরলৌকিক মুক্তির জন্য বুদ্ধের শরণাপন্ন হতো। এই ব্যবস্থাকে বলা হতো ফাংশনাল ডিফারেন্সিয়েশন (Functional Differentiation) বা কার্যগত বিভাজন।
হনজি-সুইজাকু: আসল সত্য বনাম ছায়া
নবম ও দশম শতাব্দীর দিকে এসে এই মিলন কেবল আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রইল না, এটি এক গভীর দার্শনিক তত্ত্বে রূপ নিল। এই তত্ত্বের নাম হনজি-সুইজাকু (Honji Suijaku)। ‘হনজি’ (Honji) মানে হলো ‘আসল জমি’ বা ‘মূল সত্তা’ বা অরিজিনাল গ্রাউন্ড (Original Ground)। আর ‘সুইজাকু’ (Suijaku) মানে হলো ‘পায়ের ছাপ’ বা ‘ছায়া’ বা ট্রেস ম্যানিফেস্টেশন (Trace Manifestation)। এই তত্ত্বে বলা হলো, বুদ্ধরা হলেন মহাজাগতিক সত্য বা মূল সত্তা (হনজি)। কিন্তু জাপানের সাধারণ মানুষ বুদ্ধের সেই গভীর ও জটিল দর্শন বুঝতে সক্ষম নয়। তাই জাপানিদের করুণা করে বুদ্ধরা নিজেদের রূপ পরিবর্তন করে জাপানে অবতীর্ণ হয়েছেন। জাপানে তারা যে রূপ ধারণ করেছেন, সেটাই হলো কামি (সুইজাকু)। সহজ কথায়, কামিরা হলেন বুদ্ধদের জাপানি সংস্করণ বা অবতার।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, শিন্তো সূর্যদেবী আমাতেরাসু হলেন আসলে মহাজাগতিক বুদ্ধ বা মহাবৈরোচন (Mahavairocana) বা জাপানি ভাষায় ‘দাইনিচি নিওরাই’-এর এক জাগতিক প্রকাশ। অর্থাৎ, আমাতেরাসু এবং দাইনিচি নিওরাই আলাদা কেউ নন, তারা একই সত্তার দুই পিঠ। একইভাবে, অন্যান্য কামিদেরও কোনো না কোনো বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বের অবতার হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। এই তত্ত্বের ফলে শিন্তো কামিদের মর্যাদা এক লাফে অনেক বেড়ে গেল, আবার একই সাথে তারা বৌদ্ধ কসমোলজি বা কসমোলজি (Cosmology)-র অধীনস্থ হয়ে পড়লেন। দৃশ্যত মনে হতে পারে এতে শিন্তোর স্বকীয়তা ক্ষুণ্ন হলো, কিন্তু বাস্তবে এটি শিন্তোকে টিকে থাকতে সাহায্য করল। বৌদ্ধধর্মের বিশাল দার্শনিক কাঠামোর ভেতরে ঢুকে গিয়ে কামিরা অমরত্ব পেলেন। মধ্যযুগের জাপানি মানচিত্রে বা মণ্ডল বা ম্যান্ডালা (Mandala)-তে আমরা দেখি, শিন্তো মন্দিরের ওপরে বুদ্ধরা বসে আছেন। যেমন – বিখ্যাত কাসুগা ম্যান্ডালা (Kasuga Mandala)-তে হরিণের পিঠে শিন্তো দেবতাদের বদলে বুদ্ধদের বসে থাকতে দেখা যায়। এটি ছিল হনজি-সুইজাকু তত্ত্বের ভিজ্যুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন (Teeuwen & Rambelli, 2003)।
রিউবু শিন্তো এবং সান্নো ইচিজিতসু: দুটি প্রধান ধারা
হনজি-সুইজাকু তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে মধ্যযুগে শিন্তোর দুটি প্রধান দার্শনিক ধারা গড়ে ওঠে, যা বৌদ্ধধর্মের দুটি প্রধান সম্প্রদায় – শিনগন (Shingon) এবং তেনদাই (Tendai)-এর সাথে মিশে গিয়েছিল।
১. রিউবু শিন্তো (Ryobu Shinto): এটি ছিল শিনগন বৌদ্ধধর্মের সাথে শিন্তোর সংমিশ্রণ। ‘রিউবু’ মানে হলো ‘দুই জগত’ বা ডুয়াল শিন্তো (Dual Shinto)। শিনগন বৌদ্ধধর্মে দুটি মণ্ডল খুব গুরুত্বপূর্ণ – গর্ভধাতু বা উম্ব রিয়েলম (Womb Realm) এবং বজ্রধাতু বা ডায়মন্ড রিয়েলম (Diamond Realm)। রিউবু শিন্তো তাত্ত্বিকরা বললেন, জাপানের দুটি প্রধান শিন্তো তীর্থস্থান – ইসে জিঙ্গুর ‘ইনার শ্রাইন’ (Inner Shrine) এবং ‘আউটার শ্রাইন’ (Outer Shrine) – আসলে এই দুই বৌদ্ধ মণ্ডলেরই পার্থিব রূপ। তারা সূর্যদেবী আমাতেরাসুকে দাইনিচি নিওরাই বুদ্ধের সাথে একাকার করে দিলেন। এই মতবাদ এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, ইসে জিঙ্গুর পুরোহিতরাও গোপনে বৌদ্ধ আচার পালন করতেন।
২. সান্নো ইচিজিতসু শিন্তো (Sanno Ichijitsu Shinto): এটি গড়ে উঠেছিল মাউন্ট হিয়েই (Mount Hiei)-এর তেনদাই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা। মাউন্ট হিয়েই-এর রক্ষাকর্তা বা কামি ছিলেন ‘সান্নো’ (Sanno) বা পর্বতরাজ। তেনদাই পণ্ডিতরা বললেন, এই সান্নো কামি আসলে শাক্যমুনি বুদ্ধের (ঐতিহাসিক বুদ্ধ) অবতার। তারা প্রচার করলেন যে, কামি এবং বুদ্ধের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তারা ‘একই সত্য’ বা ওয়ান ট্রুথ (One Truth)। এই মতবাদ শিন্তোকে এক গভীর তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছিল, যা আগে ছিল না।
শুগেন্দো: পাহাড়ের জাদুকরী সাধনা
শিনবুৎসু-শুগোর সবচেয়ে বন্য, রোমাঞ্চকর এবং প্র্যাকটিক্যাল রূপটি হলো শুগেন্দো (Shugendo)। এটি কোনো কেতাদুরস্ত লাইব্রেরি-ভিত্তিক ধর্ম নয়, এটি হলো পাহাড়, অরণ্য আর জলপ্রপাতের ধর্ম। সপ্তম শতাব্দীতে এন নো গিয়োজা (En no Gyoja) নামের এক কিংবদন্তি সন্ন্যাসী এই পথের প্রবর্তন করেন। শুগেন্দো হলো শিন্তোর পর্বত-পূজা, বৌদ্ধধর্মের তন্ত্র বা এসোটেরিক বুদ্ধিজম (Esoteric Buddhism) এবং তাওবাদের জাদুকরী বিদ্যার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। যারা এই পথ অনুসরণ করতেন, তাদের বলা হতো ইয়ামাবুশি (Yamabushi) বা ‘পাহাড়ের মধ্যে শায়িত ব্যক্তি’ (Mountain Ascetic)।
ইয়ামাবুশিরা বিশ্বাস করতেন, পাহাড়ের গভীরে কঠোর তপস্যা করলে অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা যায়। তারা শিন্তো কামিদের (যেমন – পাহাড়ের দেবতা বা টেনগু) পূজা করতেন, কিন্তু তাদের মন্ত্রগুলো ছিল সংস্কৃৃত ও জাপানির মিশ্রণ। তারা আগুনের ওপর দিয়ে নগ্ন পায়ে হাঁটতেন (ফায়ার ওয়াকিং), কনকনে শীতে বরফজমা জলপ্রপাতের নিচে দাঁড়িয়ে ধ্যান করতেন। সাধারণ মানুষের কাছে এই ইয়ামাবুশিরা ছিলেন ওঝা বা আধ্যাত্মিক ডাক্তার। গ্রামে মহামারী লাগলে বা কাউকে ভূতে ধরলে মানুষ এদের ডাকত। শুগেন্দো প্রমাণ করে যে, কামি আর বুদ্ধের মিলন কেবল তাত্ত্বিক ছিল না, এটি জাপানের লোকজ সংস্কৃতির বা ফোক রিলিজিয়ন (Folk Religion)-এর হাড়ে হাড়ে মিশে গিয়েছিল। এই ইয়ামাবুশিরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের লেবেল গায়ে লাগাতেন না; তারা ছিলেন প্রকৃতির সন্তান, যারা বুদ্ধের জ্ঞান দিয়ে কামির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন (Faure, 2015)।
মধ্যযুগীয় শিল্পকলা ও স্থাপত্যে প্রভাব
শিনবুৎসু-শুগোর প্রভাব জাপানি স্থাপত্য ও শিল্পকলায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল। শিন্তো মন্দির বা জিঞ্জাগুলো আগে ছিল খুব সাদামাটা, প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে শিন্তো মন্দিরগুলো আরও জাঁকজমকপূর্ণ হতে শুরু করল। শিন্তো মন্দিরের ভেতরে লাল তোরণ বা তোরিই-এর পাশাপাশি বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা (Pagoda) তৈরি হতে লাগল। অনেক মন্দিরে ঘণ্টা বা বোনশো (Bonsho) ঝোলানো হলো, যা মূলত বৌদ্ধ ঐতিহ্য। কামিদের মানুষের মতো রূপ দেওয়া শুরু হলো। আগে কামি ছিলেন নিরাকার বা বিমূর্ত, কিন্তু বৌদ্ধ মূর্তি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কামিদের কাঠের মূর্তি বা শিঞ্জো (Shinzo) তৈরি করা শুরু হলো। এই মূর্তিগুলোতে কামিদের দেখা যেত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পোশাকে অথবা রাজকীয় পোশাকে, যা তাদের দ্বৈত সত্তার বা ডুয়াল আইডেন্টিটি (Dual Identity)-র প্রতীক।
চিত্রশিল্পে ‘কাসুগা ম্যান্ডালা’ বা ‘কুমানো ম্যান্ডালা’র মতো বিখ্যাত সব কাজ সৃষ্টি হলো। এই ছবিগুলোতে দেখা যেত জাপানের মানচিত্র, যেখানে পাহাড়-নদী সব আঁকা আছে, আর তার ওপর বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বরা ভেসে বেড়াচ্ছেন। এর মানে হলো, জাপানের এই মাটি বা ভূখণ্ড বা স্যাক্রেড জিওগ্রাফি (Sacred Geography) স্বয়ং বৌদ্ধ স্বর্গেরই নামান্তর। জাপানিরা বিশ্বাস করতে শুরু করল, তাদের দেশ হলো দেবতাদের দেশ বা শিনকোকু (Shinkoku), কারণ বুদ্ধরা নিজেরাই এই দেশটিকে বেছে নিয়েছেন তাদের লীলাক্ষেত্র হিসেবে।
বিচ্ছেদের ট্র্যাজেডি: ১৮৬৮ সালের বিভাজন
এই যে কামি আর বুদ্ধের হাজার বছরের সংসার, এটি এক নিমিষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ১৮৬৮ সালে। মেইজি রিস্টোরেশন বা মেইজি সংস্কার (Meiji Restoration)-এর সময় নতুন সরকার চাইল জাপানকে এক করতে এবং সম্রাটের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে। তারা ভাবল, বৌদ্ধধর্ম বিদেশি, তাই একে শিন্তো থেকে আলাদা করতে হবে। জারি করা হলো কুখ্যাত আদেশ শিনবুৎসু বুনরি (Shinbutsu Bunri) বা ‘কামি ও বুদ্ধের পৃথকীকরণ’। এটি ছিল এক ধরণের সাংস্কৃতিক সার্জারি, যা করতে গিয়ে জাপানি ঐতিহ্যের শরীর থেকে অনেক রক্তপাত হলো। হাজার হাজার জিঞ্জুজি বা শিন্তো-বৌদ্ধ যৌথ মন্দির ভেঙে ফেলা হলো। শিন্তো মন্দির থেকে বৌদ্ধ মূর্তিগুলো বের করে নদীতে ফেলে দেওয়া হলো বা পুড়িয়ে দেওয়া হলো। ভিক্ষুদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। মাউন্ট হিয়েই বা ইসে জিঙ্গু থেকে বৌদ্ধ প্রভাব মুছে ফেলার জন্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো ধ্বংস করা হলো। এই আন্দোলনকে বলা হয় হাইবুৎসু কিশাকু (Haibutsu Kishaku) বা ‘বুদ্ধকে বাতিল করো’।
আজকের আধুনিক জাপানে আমরা শিন্তো মন্দির (তোরিই গেটওয়ালা) এবং বৌদ্ধ মন্দির (প্যাগোডাওয়ালা)-কে সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখি। কিন্তু এই আলাদা সত্তাটি কৃত্রিম এবং খুব সাম্প্রতিক। সাধারণ জাপানি মানুষের মনে আজও শিনবুৎসু-শুগোর রেশ রয়ে গেছে। তাই তারা নববর্ষে শিন্তো মন্দিরে গিয়ে হাততালি দেয়, আবার ওবন উৎসবে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে পূর্বপুরুষের জন্য ধূপ জ্বালায়। তাদের ঘরের কামিদানা (শিন্তো বেদী) এবং বুৎসুদান (বৌদ্ধ বেদী) অনেক সময় একই ঘরে পাশাপাশি থাকে। তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিকভাবে তাদের আলাদা করা গেলেও, জাপানি আত্মার গভীরে কামি এবং বুদ্ধ আজও হাত ধরাধরি করে বাস করছেন। এই সিনক্রেটিজম বা মিশ্রণই জাপানি মানসিকতাকে দিয়েছে এক বিশেষ নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটি (Flexibility), যার ফলে তারা যেকোনো নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে পারে কিন্তু নিজের শেকড়কে ভোলে না (Sueki, 2007)।
ইতিহাসের বাঁক: বিচ্ছেদ, রাষ্ট্র ও যুদ্ধের দামামা
আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি কীভাবে প্রায় হাজার বছর ধরে জাপানে কামি এবং বুদ্ধ এক ছাদের তলায় শান্তিতে সংসার করেছেন। শিন্তো এবং বৌদ্ধধর্মের সেই অদ্ভুত মিলন বা শিনবুৎসু-শুগো (Shinbutsu-shugo) জাপানি সংস্কৃতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো, কোনো স্বর্ণযুগই চিরকাল টেকে না। বিশেষ করে যখন ধর্মের সাথে রাজনীতি মিশে যায়, তখন বিশ্বাসের জমিন ফেটে চৌচির হয়ে যায়। জাপানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। হাজার বছরের এই মধুর সম্পর্ক বা হারমনি (Harmony) এক নিমিষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে। এই ভাঙনের পেছনে কোনো ধর্মীয় কারণ ছিল না, ছিল বিশুদ্ধ রাজনৈতিক স্বার্থ এবং অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ১৮৫৩ সালে যখন আমেরিকান কমোডর ম্যাথু পেরি তার বিশাল কালো জাহাজ বা ব্ল্যাক শিপস (Black Ships) নিয়ে টোকিও উপসাগরে নোঙর ফেললেন, তখন জাপানিদের পিলে চমকে উঠল। তারা দেখল, তাদের তলোয়ার আর সামুরাই কোড দিয়ে এই আধুনিক পশ্চিমা শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। জাপানকে আধুনিক হতে হবে, শক্তিশালী হতে হবে, নাহলে পশ্চিমারা তাদের গিলে খাবে। এই অস্তিত্ব সংকট থেকেই শুরু হলো জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মোড় ঘোরানো অধ্যায় – মেইজি রিস্টোরেশন (Meiji Restoration) বা মেইজি সংস্কার।
১৮৬৮ সালে আড়াইশো বছরের তোজুগাওয়া শোগুনেইট বা সামন্ততান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে তরুণ সম্রাট মেইজি ক্ষমতা দখল করলেন। নতুন সরকারের উপদেষ্টারা বা ইন্টেলেকচুয়ালস (Intellectuals) ভাবলেন, দেশকে এক করতে হলে এবং পশ্চিমাদের মতো শক্তিশালী হতে হলে জাপানিদের একটি একক জাতীয় সত্তার অধীনে আনতে হবে। তারা দেখলেন, খ্রিস্টান দেশগুলোতে মানুষ ঈশ্বর এবং গির্জার নামে একতাবদ্ধ। জাপানের তো তেমন কিছু নেই। বৌদ্ধধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত এবং এর শেকড় ভারতে। তাই তারা নজর দিলেন শিন্তোর দিকে। শিন্তো জাপানের নিজস্ব, এর শেকড় এই মাটিতেই। কিন্তু সমস্যা হলো, শিন্তো তো বৌদ্ধধর্মের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো – এক হাজার বছরের এই সমন্বয় বা সিনক্রেটিজমকে ভেঙে শিন্তোকে ‘বিশুদ্ধ’ করতে হবে। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই জাপানের আধ্যাত্মিক জগতকে ওলটপালট করে দিল।
শিনবুৎসু বুনরি: হাজার বছরের সংসারের ইতি
১৮৬৮ সালে নতুন মেইজি সরকার এক ঐতিহাসিক এবং বিতর্কিত আদেশ জারি করল, যার নাম শিনবুৎসু বুনরি (Shinbutsu Bunri)। এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘কামি ও বুদ্ধের পৃথকীকরণ আদেশ’। এটি ছিল জাপানি সংস্কৃতির ওপর এক বিশাল সার্জারি। সরকার নির্দেশ দিল, এখন থেকে শিন্তো মন্দিরে কোনো বৌদ্ধ মূর্তি রাখা যাবে না, কোনো বৌদ্ধ ভিক্ষু শিন্তো আচার পালন করতে পারবে না এবং মন্দিরগুলোকে পরিষ্কার করে ‘বিশুদ্ধ জাপানি’ রূপ দিতে হবে। এতদিন যেসব মন্দির বা জিঞ্জুজি (Shrine-Temple Complexes)-তে মানুষ কামি এবং বুদ্ধকে একসাথে পূজা করত, সেখানে দেয়াল তুলে দেওয়া হলো। বলা হলো, কামিরা হলেন জাতীয় বীর এবং রক্ষাকর্তা, আর বুদ্ধরা হলেন বিদেশি দেবতা।
এই আদেশের ফলে সারা জাপানে এক ভয়াবহ সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো, যাকে বলা হয় হাইবুৎসু কিশাকু (Haibutsu Kishaku)। এর অর্থ হলো “বুদ্ধকে বাতিল করো, শাক্যমুনিকে ধ্বংস করো।” উগ্র শিন্তোবাদী এবং স্থানীয় গুণ্ডারা মিলে হাজার হাজার মন্দিরে হামলা চালাল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংরক্ষিত অমূল্য বৌদ্ধ মূর্তিগুলোর মাথা কেটে ফেলা হলো, কাঠের মূর্তি পুড়িয়ে ফেলা হলো এবং ব্রোঞ্জের মূর্তি গলিয়ে কামান বা ঘণ্টা বানানো হলো। বিখ্যাত কোফুকু-জি (Kofuku-ji) মন্দিরের অধিকাংশ অংশ মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো। মাউন্ট হিয়েই বা ইসে জিঙ্গু থেকে বৌদ্ধ প্রভাব মুছে ফেলার জন্য প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলো ধ্বংস করা হলো। ভিক্ষুদের জোর করে সংসারধর্মে ফেরত পাঠানো হলো, তাদের আমিষ খেতে বাধ্য করা হলো। এই সময়কালে জাপানিরা যেন এক সাময়িক উন্মাদনায় পেয়ে বসেছিল। তারা তাদের ইতিহাসের অর্ধেকটা মুছে ফেলে নতুন করে ইতিহাস লিখতে চাইল। আজকের দিনে আমরা জাপানে শিন্তো মন্দির (তোরিই গেটওয়ালা) এবং বৌদ্ধ মন্দির (প্যাগোডাওয়ালা)-কে যে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখি, এই বিভাজনটা আসলে খুব সাম্প্রতিক – মাত্র ১৫০ বছর আগের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল (Ketelaar, 1990)।
স্টেট শিন্তো: ধর্ম যখন রাষ্ট্রের হাতিয়ার
মেইজি সরকার শিন্তোকে কেবল বৌদ্ধধর্ম থেকে আলাদা করেই ক্ষান্ত হলো না, তারা একে এক ভয়ংকর রাজনৈতিক এবং জাতীয়তাবাদী হাতিয়ারে রূপ দিল। এর নাম দেওয়া হলো স্টেট শিন্তো (State Shinto) বা কোক্কা শিন্তো (Kokka Shinto)। সরকার খুব চতুরতার সাথে ঘোষণা দিল, “শিন্তো কোনো ধর্ম নয়।” তারা বলল, খ্রিস্টধর্ম বা বৌদ্ধধর্ম হলো ‘ধর্ম’, কিন্তু শিন্তো হলো জাপানিদের প্রাচীন রীতিনীতি, নৈতিক কর্তব্য এবং দেশপ্রেমের অংশ। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারল। একদিকে সংবিধানে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’র কথা লিখে বিশ্বকে দেখাল যে তারা আধুনিক, অন্যদিকে জাপানের প্রতিটি নাগরিককে (সে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা নাস্তিক যা-ই হোক) শিন্তো মন্দিরে গিয়ে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করল। যুক্তিটা ছিল – যেহেতু শিন্তো ধর্ম নয়, তাই মন্দিরে যাওয়া মানে ধর্মান্তরিত হওয়া নয়, বরং নাগরিক দায়িত্ব পালন করা।
এই সময় শিন্তো পুরোহিতদের সরকারি কর্মকর্তা বা গভর্নমেন্ট অফিশিয়াল (Government Official)-এর মর্যাদা দেওয়া হলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষ বিভাগ খোলা হলো, যারা ঠিক করে দিত কোন মন্দিরে কী মন্ত্র পড়া হবে। শিন্তো মিথোলজিকে – যেমন ইজানাগি-ইজানামির গল্প বা আমাতেরাসুর গল্পকে – স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ‘সত্য ইতিহাস’ হিসেবে পড়ানো শুরু হলো। বলা হলো, জাপান হলো ঈশ্বরের দেশ বা ডিভাইন ল্যান্ড (Divine Land) এবং সম্রাট হলেন জীবন্ত ঈশ্বর বা আরাহিতোগামি (Arahitogami)। এই মতবাদ বা আইডিওলজি (Ideology) জাপানিদের মগজধোলাই করার জন্য ব্যবহার করা হলো। শিশুদের শেখানো হলো, সম্রাটের জন্য প্রাণ দেওয়া হলো সর্বোচ্চ পুণ্য। এই স্টেট শিন্তো ছিল মূলত একটি কৃত্রিমভাবে তৈরি ধর্ম, যার উদ্দেশ্য ছিল জাপানিদের অনুগত প্রজা এবং দুর্ধর্ষ সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলা (Hardacre, 1989)।
স্টেট শিন্তো এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ধর্মের রাজনীতিকরণ ও এক বিয়োগান্তক অধ্যায়
ধর্ম যখন রাজনীতির হাতিয়ার হয়, তখন তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার ধ্রুপদী উদাহরণ হলো জাপানের স্টেট শিন্তো (State Shinto) বা কোক্কা শিন্তো (Kokka Shinto)। শিন্তো ধর্মের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি হাজার বছর ধরে ছিল প্রকৃতির পূজা, ধানক্ষেতের উৎসব আর পূর্বপুরুষের স্মরণের এক নিরীহ লোকজ বিশ্বাস। কিন্তু ১৮৬৮ সালের পর থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত – এই প্রায় ৮০ বছর ধরে শিন্তো তার সেই আদিম সরলতা হারিয়ে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মতবাদে রূপান্তরিত হয়েছিল। মেইজি সরকার বা মেইজি অলিগার্কি (Meiji Oligarchy) খুব সচেতনভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে শিন্তোকে ব্যবহার করেছিল জাপানি জাতিকে এক পতাকার নিচে আনার জন্য এবং তাদের যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে শেখানোর জন্য। এই সময়কালে শিন্তো আর কোনো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় ছিল না, এটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাপানি হওয়ার প্রধান শর্ত। সরকার প্রচার করতে শুরু করল যে, শিন্তো কোনো ধর্ম নয়, বরং এটি হলো জাপানিদের জাতীয় নৈতিকতা বা ন্যাশনাল মোরালিটি (National Morality) এবং নাগরিক দায়িত্ব। এই কৌশলের মাধ্যমে তারা একদিকে সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা লিখে রাখল, অন্যদিকে সব ধর্মের মানুষকে শিন্তো আচারে অংশ নিতে বাধ্য করল। যুক্তিটা ছিল অদ্ভুত – যেহেতু শিন্তো ধর্ম নয়, তাই শিন্তো মন্দিরে মাথা নোয়ানো মানে অন্য ধর্ম পালন করা নয়, বরং দেশের প্রতি সম্মান দেখানো। এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল এক বিশাল সামরিক সাম্রাজ্য, যা শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার মাধ্যমে ধূলিসাৎ হয়েছিল।
কোকুতাই এবং জীবন্ত ঈশ্বর: মগজধোলাইয়ের মনস্তত্ত্ব
স্টেট শিন্তোর মূল ভিত্তি ছিল কোকুতাই (Kokutai) বা ‘জাতীয় সত্তা’র ধারণা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জাপান অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ, কারণ এই দেশটি শাসন করেন এমন এক সম্রাট যিনি স্বয়ং দেবতাদের বংশধর। ১৮৮৯ সালের মেইজি সংবিধানে সম্রাটকে স্যাক্রেড অ্যান্ড ইনভায়লেবল (Sacred and Inviolable) বা পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় ঘোষণা করা হলো। তবে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হলো যে, সম্রাট কেবল শাসক নন, তিনি হলেন আকিৎসুমিকামি (Akitsumikami) বা ‘মর্ত্যে প্রকাশিত কামি’ – অর্থাৎ জীবন্ত ঈশ্বর। ভাবুন তো ব্যাপারটা, আপনি যে দেশে বাস করেন, সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে যদি সাক্ষাৎ ভগবান মনে করা হয়, তবে তার যেকোনো আদেশ অমান্য করাটা কি কেবল আইনলঙ্ঘন থাকে? না, সেটা হয়ে যায় মহাপাপ বা ধর্মদ্রোহিতা। মেইজি সরকার শিক্ষার মাধ্যমে এই বিশ্বাসটি শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। ১৮৯০ সালে জারি করা হলো ইম্পেরিয়াল রিস্ক্রিপ্ট অন এডুকেশন (Imperial Rescript on Education) বা শিক্ষার রাজকীয় ঘোষণা। জাপানের প্রতিটি স্কুলে সম্রাটের ছবি বা ইম্পেরিয়াল পোর্ট্রেট (Imperial Portrait) রাখা বাধ্যতামূলক করা হলো। প্রতিদিন সকালে ছাত্রছাত্রীদের সেই ছবির সামনে গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে হতো এবং সেই ঘোষণাটি মন্ত্রের মতো মুখস্থ বলতে হতো। সেখানে শেখানো হতো – বাবা-মায়ের প্রতি ভক্তি আর সম্রাটের প্রতি আনুগত্য একই সূত্রে গাঁথা। কেউ যদি দেশের জন্য বা সম্রাটের জন্য প্রাণ দেয়, তবে সেটা হবে তার জীবনের সর্বোচ্চ সার্থকতা।
এই ইন্ডক্ট্রিনেশন (Indoctrination) বা মতাদর্শিক দীক্ষা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, জাপানিরা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, জাপানের মাটি পবিত্র, জাপানের বাতাস পবিত্র এবং জাপানকে রক্ষা করা মানে খোদ মহাবিশ্বের পবিত্রতা রক্ষা করা। সরকার শিন্তো পুরোহিতদের সরকারি কর্মকর্তা বা সিভিল সার্ভেন্টস (Civil Servants)-এর মর্যাদা দিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিশেষ বিভাগ খোলা হলো, যার নাম ‘জিঞ্জা ব্যুরো’ বা মন্দির অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তর ঠিক করে দিত কোন মন্দিরে কোন কামির পূজা হবে এবং পূজার মন্ত্রে কী বলা হবে। অর্থাৎ, কামি বা দেবতাদেরও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হলো। স্থানীয় ছোটখাটো অনেক লোকজ দেবতাকে নিষিদ্ধ করা হলো, কারণ তারা রাষ্ট্রীয় শিন্তোর আখ্যানের বা ন্যারেটিভ (Narrative)-এর সাথে খাপ খাচ্ছিল না। হাজার হাজার ছোট মন্দিরকে জোর করে বড় মন্দিরের সাথে একীভূত করা হলো, যার পোশাকি নাম ছিল শ্রাইন মার্জার পলিসি (Shrine Merger Policy)। এর ফলে গ্রামের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি নষ্ট হলো ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র পেল এক কেন্দ্রীভূত ধর্মীয় কাঠামো, যা দিয়ে সহজেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় (Fridell, 1973)।
ইয়াসুকুনি শ্রাইন: মৃত্যুকে মহিমান্বিত করার কারখানা
স্টেট শিন্তোর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিতর্কিত প্রতীক হলো টোকিওর ইয়াসুকুনি শ্রাইন (Yasukuni Shrine)। ১৮৬৯ সালে সম্রাট মেইজি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গৃহযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের আত্মার শান্তির জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি হয়ে উঠল জাপানি সামরিকবাদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র বা স্পিরিচুয়াল সেন্টার (Spiritual Center)। সাধারণ শিন্তো বিশ্বাসে মৃত্যু হলো অপবিত্র বা ‘কেগারে’। কিন্তু ইয়াসুকুনিতে এক নতুন ধর্মতত্ত্ব বা থিওলজি (Theology) তৈরি করা হলো। বলা হলো, যারা সম্রাটের জন্য যুদ্ধে প্রাণ দেবে, তারা আর সাধারণ প্রেতাত্মা হয়ে থাকবে না, তারা হয়ে যাবে ‘কামি’ বা দেবতা। এবং সবচেয়ে বড় কথা, স্বয়ং সম্রাট বা জীবন্ত ঈশ্বর এই মন্দিরে এসে তাদের পূজা করবেন। একজন সাধারণ জাপানি কৃষক বা শ্রমিকের জন্য এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে? এই বিশ্বাসটি সৈন্যদের মনে মৃত্যুভয় দূর করে দিয়েছিল। তারা যুদ্ধের ময়দানে একে অপরকে বিদায় জানানোর সময় বলত, “ইয়াসুকুনিতে আবার দেখা হবে” (See you at Yasukuni)।
ইয়াসুকুনি শ্রাইন মৃত্যুকে এক রোমান্টিক এবং পবিত্র রূপ দিয়েছিল। এখানে নিহতদের নাম একটি পবিত্র খাতায় বা সোল রেজিস্টার (Soul Register)-এ লিখে রাখা হয় এবং তাদের দেবত্ব প্রদান করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো নৈতিক বিচার করা হয় না – সে ব্যক্তি ভালো ছিল না খারাপ ছিল, সেটা বিবেচ্য নয়; সে দেশের জন্য মরেছে, এটাই যথেষ্ট। এই অন্ধ দেশপ্রেমের কারণেই জাপানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করার চেয়ে মরে যাওয়াকে শ্রেয় মনে করত। তারা বিশ্বাস করত, আত্মসমর্পণ করা মানে নিজের পরিবার এবং পূর্বপুরুষের মুখে চুনকালি দেওয়া। ইয়াসুকুনি তাদের শিখিয়েছিল যে, জীবন নশ্বর, কিন্তু নাম অবিনশ্বর। এই মন্দিরের প্রভাবেই জাপানি সমাজে এক ধরণের নেক্রোফিলিক ন্যাশনালিজম (Necrophilic Nationalism) বা মৃত্যু-আসক্ত জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল, যেখানে জীবিতদের চেয়ে মৃতরা বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কামিকাজে: ঐশ্বরিক বাতাসের ট্র্যাজেডি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন স্টেট শিন্তো তার চূড়ান্ত ও ভয়ংকর রূপে আত্মপ্রকাশ করল। ১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে জাপান যখন প্রশান্ত মহাসাগরে মিত্রশক্তির কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, তখন তারা গঠন করল এক বিশেষ আত্মঘাতী বাহিনী, যার নাম টোক্কোতাই (Tokkotai) বা স্পেশাল অ্যাটাক ইউনিট। পশ্চিমে এরা পরিচিত কামিকাজে (Kamikaze) নামে। ‘কামিকাজে’ শব্দের অর্থ হলো ‘ঐশ্বরিক বাতাস’ বা ডিভাইন উইন্ড (Divine Wind)। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোলরা যখন জাপান আক্রমণ করেছিল, তখন নাকি এক অলৌকিক ঝড়ে মঙ্গোলদের জাহাজডুবি হয়েছিল এবং জাপান রক্ষা পেয়েছিল। সেই ঝড়ের নাম ছিল কামিকাজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা বিশ্বাস করল, এবারও সেই ঐশ্বরিক বাতাস তাদের রক্ষা করবে। তবে এবার বাতাস কোনো ঝড় নয়, বাতাস হলো তাদের দেশের তরুণরা, যারা নিজেদের বিমান নিয়ে শত্রুর জাহাজে আছড়ে পড়বে।
এই তরুণ পাইলটরা, যাদের অনেকের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বা ১৮ বছর, তারা কি স্বেচ্ছায় মরত? নাকি তাদের বাধ্য করা হতো? এর উত্তর জটিল। তাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছিল যে, সম্রাটের জন্য প্রাণ দেওয়া হলো চেরি ফুলের মতো ঝরে পড়া – সুন্দর এবং পবিত্র। এই নান্দনিকতা বা এস্থেটিকস অফ ডেথ (Aesthetics of Death) ছিল স্টেট শিন্তোর দান। তারা মাথায় সাদা ফিতা বাঁধত, যাতে জাপানের পতাকার লাল সূর্য আঁকা থাকত। শেষ যাত্রার আগে তারা এক কাপ ‘সাকে’ (পবিত্র মদ) পান করত এবং ইয়াসুকুনি মন্দিরের দিকে মুখ করে শেষ প্রণাম জানাত। তাদের বলা হতো, “তোমরা মরবে না, তোমরা কামি হয়ে জাপানের আকাশ বাতাস রক্ষা করবে।” নৃতাত্ত্বিক এমিকো ওহনুকি-টিয়ারনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই পাইলটদের অনেকেই ডায়েরিতে দর্শনের কথা, ভালোবাসার কথা লিখে যেতেন, কিন্তু রাষ্ট্রের চাপে বা পিয়ার প্রেশার (Peer Pressure)-এ পড়ে তারা এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হতেন। তাদের মৃত্যুকে বলা হতো গিওকুসাই (Gyokusai) বা ‘রত্নপাথরের মতো চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া’। অর্থাৎ, অক্ষত অবস্থায় কাঁচের মতো টিকে থাকার চেয়ে রত্ন হয়ে ভেঙে যাওয়া অনেক সম্মানের। এই শব্দচয়নগুলো প্রমাণ করে, কীভাবে ভাষাকে ব্যবহার করে মৃত্যুকে মহিমান্বিত করা হয়েছিল (Ohnuki-Tierney, 2002)।
১৯৪৫: বিভ্রমের পতন ও নতুন শুরু
১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা পড়ল। সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ ঘোষণা করল। জাপান বুঝতে পারল, কামিরা তাদের বাঁচাতে আসছে না। ১৫ই আগস্ট সম্রাট হিরোহিতো রেডিওতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন, যা জিয়োকুওন-হোসো (Gyokuon-hoso) বা ‘রত্নকন্ঠের সম্প্রচার’ নামে পরিচিত। তিনি জাপানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেন। জাপানিরা তাদের জীবনে এই প্রথম সম্রাটের কন্ঠস্বর শুনল। তারা কান্নায় ভেঙে পড়ল – না, হেরে যাওয়ার দুঃখে যতটা না, তার চেয়ে বেশি তাদের বিশ্বাসের পৃথিবীটা ভেঙে যাওয়ার দুঃখে। এতদিন তারা জেনে এসেছে তাদের দেশ অপরাজেয়, তাদের সম্রাট ঈশ্বর। সেই ঈশ্বর যখন বললেন, “আমরা হেরে গেছি,” তখন তাদের মানসিক জগত ওলটপালট হয়ে গেল।
মিত্রশক্তি বা অ্যালাইড ফোর্সেস (Allied Forces)-এর সুপ্রিম কমান্ডার জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার জাপানে এসে বুঝলেন, জাপানি সামরিকবাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হলে স্টেট শিন্তোকে ভাঙতে হবে। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি জারি করলেন বিখ্যাত শিন্তো নির্দেশিকা (Shinto Directive)। এই নির্দেশের মাধ্যমে রাষ্ট্র থেকে শিন্তো ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা করা হলো। স্কুলগুলোতে শিন্তো মতবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ হলো। ইয়াসুকুনি শ্রাইন এবং অন্যান্য মন্দিরগুলোর সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং সেগুলোকে বেসরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল ১৯৪৬ সালের ১লা জানুয়ারি। সম্রাট হিরোহিতো এক রাজকীয় ঘোষণার মাধ্যমে নিজের দেবত্ব ত্যাগ করলেন। একে বলা হয় নিনগেন-সেনগেন (Ningen-sengen) বা ‘মানবতার ঘোষণা’। তিনি বললেন, “সম্রাট এবং জনগণের মধ্যে যে বন্ধন, তা পারস্পরিক বিশ্বাস ও স্নেহের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কোনো মিথ বা কুসংস্কারের ওপর নয়। এই ধারণা ভুল যে সম্রাট একজন ঈশ্বর এবং জাপানিরা অন্য জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ।”
সম্রাটের এই একটি কথায় স্টেট শিন্তোর কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হলো। তবে এখানে রাজনীতির এক সূক্ষ্ম খেলা ছিল। আমেরিকা সম্রাটকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করেনি বা তাকে সরিয়ে দেয়নি। তারা ভেবেছিল, সম্রাটকে সরিয়ে দিলে জাপানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে এবং কমিউনিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাই তারা সম্রাটকে ‘মানুষ’ বানিয়ে ক্ষমতায় রেখে দিল, যাতে জাপানিরা মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে। যুদ্ধের পর শিন্তো আবার তার আদি রূপে ফিরে গেল। এটি আর ‘স্টেট শিন্তো’ রইল না, হয়ে গেল ‘শ্রাইন শিন্তো’ বা জিঞ্জা শিন্তো (Jinja Shinto)। মানুষ আবার মন্দিরে যেতে শুরু করল, তবে এবার আর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, এবার কেবল শান্তি খোঁজার জন্য।
স্টেট শিন্তোর ইতিহাস আমাদের শেখায়, বিশ্বাস যখন অন্ধ হয় এবং রাষ্ট্র যখন সেই অন্ধত্বকে পুঁজি করে, তখন মানবতা হেরে যায়। আজকের জাপানেও ইয়াসুকুনি শ্রাইন নিয়ে বিতর্ক আছে, উগ্র ডানপন্থী বা ফার রাইট-উইং (Right-wing) গোষ্ঠীগুলো মাঝে মাঝে শব্দ করে, কিন্তু সাধারণ জাপানিরা সেই কালো দিনগুলো ভুলে যায়নি। তারা এখন আর চেরি ফুলের মতো ঝরে পড়তে চায় না, তারা চায় চেরি ফুলের মতো প্রতি বসন্তে নতুন করে বাঁচতে। শিন্তো আজ আর যুদ্ধের দামামা নয়, বরং শান্তির এক নীরব প্রার্থনা।
আধুনিক জীবনে শিন্তো: বিশ্বাস, কুসংস্কার নাকি সাংস্কৃতিক ডিএনএ?
একবিংশ শতাব্দীর জাপানের দিকে তাকালে আপনি এক অদ্ভুত প্যারাডক্স বা বৈপরীত্যের মুখোমুখি হবেন। একদিকে এটি রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বুলেট ট্রেনের দেশ, যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনের প্রতিটি কোণ দখল করে নিয়েছে। অন্যদিকে, সেই একই দেশের মানুষ পকেটে একটি কাপড়ের তাবিজ বা ওমামোরি (Omamori) নিয়ে ঘোরে, নতুন রকেট উৎক্ষেপণের আগে পুরোহিত ডেকে পূজা দেয় এবং পরীক্ষার আগে মন্দিরে গিয়ে ভাগ্যগণনার কাগজ বা ওমিকুজি (Omikuji) কেনে। আপনি যদি একজন সাধারণ জাপানি তরুণকে রাস্তায় থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি ধার্মিক?” বা “আপনি কি শিন্তো ধর্মে বিশ্বাস করেন?” তবে নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে উত্তর আসবে একটি নির্লিপ্ত “না”। পরিসংখ্যানও তাই বলে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, জাপানের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ নিজেদের মুশুকিও (Mushukyo) বা ‘ধর্মহীন’ বলে দাবি করে। তারা বলে, ঈশ্বরে বিশ্বাস বা পরকালে বিশ্বাস – এসব তাদের কাছে তেমন কোনো অর্থ বহন করে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই একই মানুষটি নতুন বছরের প্রথম প্রহরে হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শিন্তো মন্দিরে প্রার্থনা করছে। বাচ্চার বয়স ৩, ৫ বা ৭ বছর হলে তারা হাজার হাজার ইয়েন খরচ করে ‘চি-গো-সান’ উৎসব পালন করছে। নতুন গাড়ি কিনলে মন্দিরে গিয়ে শুদ্ধ করিয়ে আনছে, পাছে অ্যাক্সিডেন্ট হয়। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? তারা কি ভণ্ড? নাকি তারা নিজেরাও জানে না তারা আসলে কী বিশ্বাস করে? সমাজবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে নাম দিয়েছেন রিলিজিয়াস এথিজম (Religious Atheism) বা ‘ধর্মীয় নাস্তিকতা’। আসলে জাপানিদের কাছে শিন্তো কোনো ‘বিশ্বাস’ বা ফেইথ (Faith) নয়, এটি একটি ‘কালচার’ বা সংস্কৃতি। তারা এটাকে ধর্মের মোড়কে দেখে না। তারা মনে করে, এটাই জাপানি হওয়ার নিয়ম, এটাই তাদের সামাজিক শিষ্টাচার।
বিশ্বাস বনাম আচরণ: অর্থোডক্সি বনাম অর্থোপ্রাক্সি
আধুনিক জাপানিদের এই দ্বৈত আচরণ বুঝতে হলে আমাদের ধর্মের দুটি তাত্ত্বিক দিক বুঝতে হবে: অর্থোডক্সি (Orthodoxy) এবং অর্থোপ্রাক্সি (Orthopraxy)। অর্থোডক্সি মানে হলো সঠিক বিশ্বাস লালন করা – যেমন একজন খ্রিস্টান বা মুসলিম হতে হলে আপনাকে কিছু নির্দিষ্ট ডগমা বা তত্ত্বে বিশ্বাস করতেই হবে। অন্যদিকে, অর্থোপ্রাক্সি মানে হলো সঠিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা, সেখানে আপনি মনে মনে কী বিশ্বাস করছেন সেটা গৌণ। শিন্তো হলো পুরোপুরি অর্থোপ্রাক্সি-নির্ভর ধর্ম। এখানে কামি বা দেবতারা আপনার কাছে কোনো অন্ধ বিশ্বাস দাবি করেন না, তারা চান আপনি রিচুয়ালগুলো ঠিকঠাক পালন করুন। একজন জাপানি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, “এই পাথরটার মধ্যে দেবতা থাকা অসম্ভব,” কিন্তু সামাজিকভাবে তিনি ওই পাথরের সামনে মাথা নত করবেন, কারণ তার বাপ-ঠাকুরদা এটা করেছেন এবং এটা করাই সমাজের নিয়ম। অধ্যাপক ইয়ান রিডার তার বিখ্যাত বই Religion in Contemporary Japan-এ বলেছেন, জাপানিদের কাছে ধর্ম মানে কোনো সত্যের সন্ধান নয়, বরং ধর্ম মানে হলো সমস্যা সমাধানের উপায় এবং সামাজিক বন্ধন রক্ষার মাধ্যম। তারা বিপদে পড়লে কামির কাছে যায়, ঠিক যেমন অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যায়। কাজ মিটে গেলে তারা আবার ভুলে যায়। একে বলা হয় টার্ন টু দ্য গডস ইন টাইমস অব ট্রাবল (Turn to the Gods in Times of Trouble) বা জাপানি প্রবাদ অনুযায়ী ‘কুরুশি তোকি নো কামিদানোমি’। তাই আধুনিক জাপানে শিন্তো কোনো আধ্যাত্মিক সাধনা নয়, বরং এটি একটি কালচারাল টুলকিট (Cultural Toolkit) যা মানুষ প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে (Reader, 1991)।
হাৎসুমোদে: ধর্মনিরপেক্ষ তীর্থযাত্রা
আধুনিক জীবনে শিন্তোর টিকে থাকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো হাৎসুমোদে (Hatsumode) বা নববর্ষের প্রথম মন্দির দর্শন। ১লা জানুয়ারি থেকে ৩রা জানুয়ারি পর্যন্ত জাপানের প্রায় ১০ কোটি মানুষ (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ) শিন্তো মন্দির বা বৌদ্ধ মন্দিরে ভিড় করে। টোকিওর মেইজি জিঞ্জা বা কিওটোর ফুশিমি ইনারি তাইশাতে এই তিন দিনে যে জনস্রোত দেখা যায়, তা বিশ্বের যেকোনো ধর্মীয় জমায়েতের সাথে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু যারা এখানে আসেন, তারা কি সবাই মুক্তি বা মোক্ষ লাভের জন্য আসেন? একদমই না। তরুণ-তরুণীদের কাছে হাৎসুমোদে হলো একটি ডেটিং ইভেন্ট বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার উপলক্ষ। মেয়েরা রঙিন কিমোনো পরে ছবি তোলে, ইনস্টাগ্রামে আপলোড করে। তারা মন্দিরের স্টল থেকে ইয়াকিসোবা (Yakisoba) খায়, ভাগ্যগণনার কাগজ বা ওমিকুজি কেনে। যদি কাগজে ‘দারুণ ভাগ্য’ বা দাইকিচি (Daikichi) লেখা থাকে, তবে তারা খুশিতে পকেটে পুরে রাখে। আর যদি ‘খারাপ ভাগ্য’ বা কিও (Kyo) লেখা থাকে, তবে মন্দিরের নির্দিষ্ট গাছে বা দড়িতে বেঁধে রেখে আসে, যাতে খারাপ ভাগ্য সেখানেই আটকে থাকে। এই পুরো ব্যাপারটিই এক ধরণের ‘প্লেফুল রিলিজিয়ন’ বা লুডিক রিলিজিয়ন (Ludic Religion)। এখানে ভয়ের চেয়ে আনন্দ বেশি, গাম্ভীর্যের চেয়ে উৎসব বেশি। তবুও, যখন তারা মূল বেদীর সামনে দাঁড়ায়, তখন সেই দুই সেকেন্ডের জন্য তারা ঠিকই চোখ বন্ধ করে, হাততালি দেয় এবং মনে মনে প্রার্থনা করে – “হে কামি, এই বছরটা যেন ভালো যায়, বয়ফ্রেন্ডের সাথে যেন ব্রেকআপ না হয়, চাকরিতে যেন প্রমোশন পাই।” এই ক্ষণস্থায়ী প্রার্থনাটুকুই শিন্তোর আধুনিক রূপ। তারা হয়তো কামিকে ‘ঈশ্বর’ মানে না, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে যে প্রকৃতির কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের কথা শুনছে।
প্রযুক্তি ও কুসংস্কার: সিলিকন চিপের শুদ্ধিকরণ
শিন্তো যে কেবল পুরনো দিনের চাষাবাদ বা মাছ ধরার সাথে যুক্ত, তা ভাবলে ভুল হবে। শিন্তোর সবচেয়ে বড় গুণ হলো এর নমনীয়তা বা অ্যাডাপ্টিবিলিটি (Adaptability)। আধুনিক প্রযুক্তির সাথেও শিন্তো দিব্যি খাপ খাইয়ে নিয়েছে। টোকিওর বিখ্যাত ‘কান্দা মিয়োজিন’ (Kanda Myojin) মন্দিরের কথাই ধরুন। এটি আকিহাবারা ইলেকট্রনিক্স ডিস্ট্রিক্টের খুব কাছে। এই মন্দিরে এখন বিক্রি হয় বিশেষ আইটি ওমামোরি (IT Omamori) বা তথ্যপ্রযুক্তির তাবিজ। এই তাবিজগুলো দেখতে মাইক্রোচিপ বা এসডি কার্ডের মতো। কম্পিউটার প্রোগ্রামার, আইটি কোম্পানির মালিকরা এই মন্দিরে আসেন তাদের সার্ভার বা কম্পিউটারকে ভাইরাস এবং বাগ (Bug) থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রার্থনা করতে। শুনতে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু জাপানের বড় বড় টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোও তাদের নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ করার আগে শিন্তো পুরোহিত ডেকে শুদ্ধিকরণ করায়। তারা মনে করে, প্রযুক্তির মধ্যেও কামির শক্তি বা ‘কি’ (Ki) আছে। যদি সেই শক্তি নেতিবাচক হয়, তবে প্রযুক্তি মানুষের ক্ষতি করবে।
একইভাবে, জাপানে নতুন কোনো কনস্ট্রাকশন কাজ শুরু করার আগে জিচিনসাই (Jichinsai) বা ভূমি-পূজা করা বাধ্যতামূলক। হোক সেটা কোনো সাধারণ বাড়ি, কিংবা টোকিও স্কাইট্রি-র মতো গগনচুম্বী টাওয়ার। ইঞ্জিনিয়াররা মাটির কম্পন মাপেন, আর্কিটেক্টরা নকশা করেন, কিন্তু কাজ শুরু করার আগে একজন শিন্তো পুরোহিত এসে মাটি খুঁড়ে সেখানে সাকে (Sake) ঢালেন এবং জমির কামির কাছে ক্ষমা চান – “আমরা আপনার শান্তি নষ্ট করছি, দয়া করে আমাদের ওপর রাগ করবেন না, বিল্ডিংটা যেন ভেঙে না পড়ে।” এটি কি কেবল কুসংস্কার? নাকি এটি প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিনয়? জাপানিরা একে দেখে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট (Risk Management) বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি আধ্যাত্মিক ধাপ হিসেবে। তারা ভাবে, বিজ্ঞান দিয়ে যা সম্ভব তা তো করলামই, কিন্তু যা আমার হাতে নেই, তার জন্য কামির সাথে একটা চুক্তি করে রাখা ভালো। একে বলা যেতে পারে পাস্কালস ওয়েজার (Pascal’s Wager)-এর জাপানি সংস্করণ – ঈশ্বর বা কামি থাকলে লাভ, না থাকলে তো ক্ষতি নেই!
চি-গো-সান ও ইয়াকুদোশি: জীবনচক্রের মাইলফলক
ব্যক্তিজীবনে শিন্তোর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় বিভিন্ন বয়সের মাইলফলকগুলোতে। এর মধ্যে অন্যতম হলো চি-গো-সান (Shichi-Go-San), যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘সাত-পাঁচ-তিন’। প্রতি বছর ১৫ই নভেম্বর তারিখে ৩ ও ৭ বছরের মেয়ে এবং ৩ ও ৫ বছরের ছেলেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাচীনকালে জাপানে শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি ছিল। বলা হতো, সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা মানুষের জগতের বাসিন্দা নয়, তারা ‘কামির সন্তান’। সাত বছর পার হলে তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গণ্য হতো। সেই ঐতিহ্য মেনে আজও বাবা-মায়ের জন্য এটি একটি বড় উৎসব। তারা প্রার্থনা করে যেন তাদের সন্তান সুস্থ থাকে। বাচ্চারা এই দিনে লম্বা এক ধরণের ক্যান্ডি খায়, যার নাম চিতোসে আমে (Chitose Ame) বা ‘হাজার বছরের ক্যান্ডি’, যা দীর্ঘায়ুর প্রতীক। আধুনিক জাপানিরা হয়তো প্রাচীন মৃত্যুভয় ভুলে গেছে, কিন্তু এই উৎসবটি তাদের পারিবারিক অ্যালবামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছুটা ভীতিকর বিশ্বাস হলো ইয়াকুদোশি (Yakudoshi) বা ‘দুর্ভাগ্যের বছর’। শিন্তো ও জাপানি সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের জীবনে কিছু নির্দিষ্ট বয়স খুব বিপজ্জনক। পুরুষদের জন্য ২৫, ৪২ ও ৬১ বছর এবং নারীদের জন্য ১৯, ৩৩ ও ৩৭ বছর। এর মধ্যে পুরুষদের ৪২ এবং নারীদের ৩৩ বছরকে বলা হয় তাইয়াকু (Taiyaku) বা মহাবিপদ। আধুনিক, শিক্ষিত জাপানিরাও এই বয়সগুলো পার করার সময় মানসিকভাবে চাপে থাকেন। তারা মন্দিরে গিয়ে বিশেষ প্রার্থনা বা ‘ইয়াকুয়োকে’ (Yakuyoke) করান এবং তাবিজ কেনেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে হয়তো এর কোনো ভিত্তি নেই, কিন্তু জাপানিরা বলে, এই বয়সে মানুষের শরীরে ও জীবনে বড় পরিবর্তন আসে, তাই সাবধান থাকা ভালো। এই বিশ্বাসটি এতটাই প্রবল যে, অনেক সময় কোম্পানিগুলো এই বয়সের কর্মীদের ওপর কাজের চাপ কমিয়ে দেয় বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করে। এখানে শিন্তো কাজ করে একটি সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট সিস্টেম (Psychological Support System) হিসেবে।
ইতা-দাকি-মাসু: খাবারের টেবিলে শিন্তো দর্শন
শিন্তো ধর্মে কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই, কিন্তু জাপানিদের দৈনন্দিন ভাষার মধ্যেই শিন্তো দর্শন লুকিয়ে আছে। জাপানিরা খেতে বসার আগে দুই হাত জোড় করে বলে ইতাদাকিমাসু (Itadakimasu)। আমরা সাধারণত এর অনুবাদ করি “খাবার জন্য ধন্যবাদ” বা “চলুন খাওয়া শুরু করি”। কিন্তু এর প্রকৃত এবং গভীর অর্থ হলো – “আমি (আপনার জীবন) বিনীতভাবে গ্রহণ করছি।” শিন্তো ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ বা কামি আছে। আমরা যখন মাছ, মাংস বা সবজি খাই, তখন আমরা তাদের জীবন কেড়ে নিই নিজেদের বাঁচার জন্য। এই ‘ইতাদাকিমাসু’ হলো সেই উৎসর্গীকৃত প্রাণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং এক ধরণের ক্ষমা প্রার্থনা। এটি কোনো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া নয়, বরং এটি সেই মাছ বা ধানগাছটিকে ধন্যবাদ দেওয়া, যে আমার জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছে। একইভাবে, খাওয়া শেষে তারা বলে গোচিসৌসামা দেশিতা (Gochisosama deshita), যার অর্থ হলো – “এই খাবার প্রস্তুত করতে অনেকের অনেক কষ্ট হয়েছে (তাই ধন্যবাদ)।” আধুনিক জাপানিরা হয়তো শিন্তোর তাত্ত্বিক দিকগুলো জানে না, কিন্তু ছোটবেলা থেকে এই শব্দগুলো বলতে বলতে তাদের মনের অজান্তেই প্রকৃতির প্রতি এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। এই শ্রদ্ধাবোধই হলো শিন্তোর নির্যাস, যা ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে বেঁচে আছে (Ama, 2005)।
গাড়ি ও ট্রাফিক সেফটি: কোৎসু আনজেন
জাপানের রাস্তায় আপনি প্রায় প্রতিটি গাড়ির পেছনে বা ড্যাশবোর্ডে একটি স্টিকার বা ঝোলানো তাবিজ দেখতে পাবেন। এতে লেখা থাকে কোৎসু আনজেন (Kotsu Anzen) বা ‘ট্রাফিক সেফটি’। এটি কোনো ইনস্যুরেন্স কোম্পানির স্টিকার নয়, এটি কোনো শিন্তো মন্দিরের দেওয়া কবচ। জাপানিরা যখন নতুন গাড়ি কেনে, তখন তারা শোরুম থেকে সোজা মন্দিরে চলে যায়। সেখানে পুরোহিত গাড়ির চারপাশ ঘুরে মন্ত্র পড়েন, ওনুসা (কাগজ লাগানো লাঠি) দিয়ে ঝাড়ু দেন এবং দরজা-জানালা সব খুলে দেন যাতে ভেতরের দুষ্ট আত্মা বেরিয়ে যায়। টোকিওর কাছেই ‘তানিনোইয়ামা ফুদোসন’ নামে একটি মন্দির আছে যা কেবল এই গাড়ি শুদ্ধিকরণের জন্যই বিখ্যাত। সেখানে প্রতিদিন শত শত গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। এমনকি বড় বড় লজিস্টিক কোম্পানি বা বাস কোম্পানিগুলোও তাদের পুরো ফ্লিট বা গাড়িবহরকে বছরে একবার শুদ্ধ করায়। তারা মনে করে, ড্রাইভারের দক্ষতা যতই থাকুক, রাস্তায় এমন অনেক কিছু ঘটে যা মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। সেই অনিয়ন্ত্রিত বা আনকন্ট্রোলড ভেরিয়েবল (Uncontrolled Variable)-কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই কামির দরকার। এটি চালককে এক ধরণের মানসিক প্রশান্তি দেয়, যা হয়তো পরোক্ষভাবে দুর্ঘটনা কমাতেও সাহায্য করে।
উপসংহার: শিন্তো যখন বাতাস
বিখ্যাত শিন্তো গবেষক জিনো ব্রেসানি শিন্তোকে তুলনা করেছিলেন বাতাসের সাথে। তিনি বলেছিলেন, “বাতাসকে দেখা যায় না, কিন্তু যখন গাছের পাতা নড়ে, তখন বোঝা যায় বাতাস আছে।” আধুনিক জাপানে শিন্তোর অবস্থাও ঠিক তাই। এটি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা অর্গানাইজড রিলিজিয়ন (Organized Religion) হিসেবে নেই, এটি আছে জীবনযাপনের পদ্ধতি বা ওয়ে অফ লাইফ (Way of Life) হিসেবে। জাপানিরা একে আলাদা করে ‘ধর্ম’ মনে করে না বলেই তারা বলতে পারে যে তারা ধার্মিক নয়। কিন্তু তাদের জন্ম, বিয়ে, উৎসব, ব্যবসা, এমনকি মৃত্যুচিন্তা – সবকিছুর সাথেই শিন্তো জড়িয়ে আছে। তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে ‘কামিদানা’ (Kamidana – ঘরের ছোট শিন্তো বেদী)-তে একটু মাথা নোয়ায়, বা পূর্বপুরুষের ছবির সামনে এক গ্লাস জল রাখে। এই ছোট ছোট কাজগুলো তাদের বিশৃঙ্খল জীবনে একটি রুটিন বা শৃঙ্খলা এনে দেয়।
পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, জাপান সেখানে দেখায়, মানুষ একই সাথে অতি-আধুনিক এবং অতি-ঐতিহ্যবাহী হতে পারে। তারা ল্যাবরেটরিতে বসে ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করতে পারে, আবার সেই গবেষণার সাফল্যের জন্য কামির কাছে প্রার্থনাও করতে পারে। যতদিন জাপানিরা প্রকৃতিকে ভালোবাসবে, যতদিন তারা ভাত খাওয়ার আগে ‘ইতাদাকিমাসু’ বলবে, এবং যতদিন তারা নতুন বছরে মন্দিরে গিয়ে হাততালি দেবে, ততদিন শিন্তো বেঁচে থাকবে – বিশ্বাস হিসেবে নয়, জাপানি সত্তার নিঃশ্বাস হিসেবে।
শিন্তো ও পপ কালচার: অ্যানিমে ও মাঙ্গায় লুকানো দেবতার ছায়া
জাপানি পপ কালচার, বিশেষ করে অ্যানিমে এবং মাঙ্গা আজ কেবল জাপানের সীমানায় আটকে নেই; এটি আজ এক বৈশ্বিক উন্মাদনা বা গ্লোবাল ফেনোমেনন (Global Phenomenon)। ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক, প্যারিস থেকে সাও পাওলো – সব জায়গাতেই তরুণ প্রজন্মের কাছে জাপানি অ্যানিমে এক বিশাল বিনোদনের উৎস। কিন্তু আপনারা কি জানেন, আপনারা যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নারুতো (Naruto) বা ডেমন স্লেয়ার (Demon Slayer) দেখছেন, তখন আসলে অজান্তেই আপনারা জাপানের প্রাচীনতম ধর্ম শিন্তোর পাঠ নিচ্ছেন? বিষয়টি শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু এটাই সত্য। শিন্তো ধর্মে যেহেতু কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই এবং কোনো নবী-রাসূল নেই, তাই এটি টিকে আছে জাপানিদের গল্প বলার ধরণে, তাদের শিল্পকলায় এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে। আধুনিক যুগে অ্যানিমে এবং মাঙ্গা হলো সেই গল্প বলারই ডিজিটাল মাধ্যম। অ্যানিমের জাদুকরী জগতে আমরা যে অদ্ভুত সব প্রাণী, শক্তি বা জাদুর খেলা দেখি, তার প্রায় সবকিছুর শেকড় প্রোথিত আছে শিন্তো মিথোলজি এবং দর্শনের গভীরে। শিন্তো বিশ্বাস করে যে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের প্রাণ আছে এবং দৃশ্যমান জগতের আড়ালে এক অদৃশ্য জগত বা স্পিরিট ওয়ার্ল্ড (Spirit World) আছে। অ্যানিমে নির্মাতারা এই বিশ্বাসটিকেই তাদের ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করেন। বিখ্যাত অ্যানিমে গবেষকরা একে বলছেন টেকনো-অ্যানিমিজম (Techno-animism), যেখানে প্রাচীন বিশ্বাস আর আধুনিক প্রযুক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শিন্তো আজ কোনো মন্দিরের চার দেয়ালে বন্দি নয়, এটি আজ পিক্সেল আর অ্যানিমেশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
হায়াও মিয়াজাকি: শিন্তো দর্শনের আধুনিক রূপকার
শিন্তো এবং অ্যানিমের সম্পর্কের কথা উঠলে সবার আগে যে নামটি আসবে, তিনি হলেন কিংবদন্তি অ্যানিমে নির্মাতা হায়াও মিয়াজাকি এবং তার স্টুডিও জিবলি। মিয়াজাকির প্রতিটি সিনেমায় শিন্তো দর্শন এতটাই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, তাকে আধুনিক যুগের শিন্তো প্রচারক বললেও ভুল হবে না। তার অস্কারজয়ী সিনেমা স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (Spirited Away)-এর কথাই ধরুন। এই সিনেমাটি শিন্তো ধর্মের কামি বা আত্মাদের জগতের এক নিখুঁত চিত্রায়ন। সিনেমার মূল ঘটনা ঘটে একটি বিশাল বাথহাউস বা স্নানাগারে, যেখানে রাতের বেলা নানা ধরণের অদ্ভুত সব প্রাণী স্নান করতে আসে। এই প্রাণীরা আর কেউ নয়, এরা সবাই কামি। জাপানি লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কামিদেরও মানুষের মতো বিশ্রাম এবং শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন হয়। সিনেমার একটি আইকনিক দৃশ্যে দেখা যায়, এক বিশাল দুর্গন্ধযুক্ত কাদা মাখা দৈত্য বা ‘স্টিঙ্ক স্পিরিট’ বাথহাউসে আসে। সবাই গন্ধে পালায়, কিন্তু গল্পের নায়িকা চিহিরো তাকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। ধোয়ার পর দেখা যায়, এটি আসলে কোনো দৈত্য নয়, এটি একটি নদীর কামি বা রিভার স্পিরিট (River Spirit)। মানুষ নদীতে ময়লা ফেলে তাকে দূষিত করেছিল বলেই তার এই দশা। ময়লা পরিষ্কার হওয়ার পর কামি তার আসল রূপ ফিরে পায় এবং হাসিমুখে বিদায় নেয়। এই দৃশ্যটি শিন্তোর পবিত্রতা বা ‘কিয়োম’ এবং আধুনিক পরিবেশ সচেতনতার এক অসাধারণ রূপক (Wright & Clode, 2005)।
মিয়াজাকির আরেকটি কালজয়ী সৃষ্টি হলো মাই নেইবার তোতোরো (My Neighbor Totoro)। এখানে বিশাল গাছের কোটরে বাস করা তোতোরো নামের যে লোমশ ও আদুরে প্রাণীটিকে দেখানো হয়েছে, সে আসলে বনের কামি বা ফরেস্ট স্পিরিট (Forest Spirit)। সিনেমায় দেখা যায়, ছোট্ট মেয়ে মেই যখন বনের গভীরে হারিয়ে যায়, তখন সে তোতোরোর দেখা পায়। তোতোরো তাকে ভয় দেখায় না, বরং তার সাথে খেলে। এটি শিন্তোর সেই মূল বিশ্বাসের প্রতিফলন – প্রকৃতি ভয়ের জায়গা নয়, বরং ভালোবাসার জায়গা, যদি আপনি তাকে সম্মান করেন। সিনেমার বাবা চরিত্রটি যখন জানতে পারে যে তার মেয়েরা তোতোরোকে দেখেছে, সে তাদের পাগল বলে উড়িয়ে দেয় না। বরং সে তাদের নিয়ে বনের সেই বিশাল গাছটির কাছে যায় এবং মাথা নত করে ধন্যবাদ জানায় – “আমার মেয়েদের রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ।” এই দৃশ্যটি জাপানি বাবা-মায়ের শিন্তো মানসিকতার পরিচায়ক। এছাড়াও প্রিন্সেস মনোনোকে (Princess Mononoke) মুভিতে শিন্তোর অন্ধকার দিক বা কামির ‘আরামিতামা’ (উগ্র রূপ) দেখানো হয়েছে। মানুষ যখন বন ধ্বংস করে লোহা বা সম্পদ আহরণ করতে যায়, তখন বনের শান্ত কামিরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাতারিগামি (Tatarigami) বা অভিশপ্ত দানবে পরিণত হয়। এটি দর্শকদের এই বার্তাই দেয় যে, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করলে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নেবে (Napier, 2005)।
মাকোতো শিনকাই এবং ‘মুসুবি’র দর্শন
মিয়াজাকির পর বর্তমান সময়ে যিনি অ্যানিমে জগত কাঁপাচ্ছেন, তিনি হলেন মাকোতো শিনকাই। তার ব্লকবাস্টার মুভি ইয়র নেম (Your Name) বা জাপানি ভাষায় কিমি নো না ওয়া (Kimi no Na wa) শিন্তো দর্শনের এক আধুনিক মাস্টারপিস। এই সিনেমার পুরো গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে শিন্তোর একটি মৌলিক তাত্ত্বিক ধারণার ওপর, যার নাম মুসুবি (Musubi)। সিনেমায় মিৎসুহার গ্র্যান্ডমা তাকে সুতো বোনার সময় বলেন, “সুতাকে প্যাঁচানো, একে জোড়া লাগানো, আবার একে খোলা – সবই মুসুবি। সময়ও ঠিক তাই।” মুসুবি মানে হলো সংযোগ বা বন্ধন। শিন্তো বিশ্বাস করে, মহাবিশ্বের সবকিছু এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। মানুষ, সময়, প্রকৃতি – সবাই একে অপরের সাথে সংযুক্ত। সিনেমায় নায়ক টাকি এবং নায়িকা মিৎসুহার শরীর অদলবদল হওয়া এবং সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে একে অপরের সাথে দেখা করা – সবই এই মুসুবি বা মহাজাগতিক সংযোগের ফল।
সিনেমায় মিৎসুহা এবং তার ছোট বোনকে শিন্তো মন্দিরের সেবিকা বা মিকো (Miko) হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারা মন্দিরে এক বিশেষ ধরণের নাচ নাচে, যার নাম কাগুরা (Kagura)। তাদের হাতে থাকে ঘণ্টার ছড়া বা ‘সুজু’। এই নাচ কোনো বিনোদন নয়, এটি কামিকে তুষ্ট করার রিচুয়াল। সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে দেখানো হয় ‘কুচিকামিজাকে’ (Kuchikamizake) তৈরির দৃশ্য। এটি চাল চিবিয়ে লালা মিশিয়ে তৈরি এক ধরণের প্রাচীন মদ বা সাকে। আধুনিক দর্শকদের কাছে এটি ঘেন্নার মনে হতে পারে, কিন্তু প্রাচীন শিন্তো ধর্মে এটি ছিল কামির সাথে মানুষের আত্মিক মিলনের প্রতীক। নিজের শরীরের অংশ (লালা) দিয়ে তৈরি এই পানীয় কামিকে নিবেদন করার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে কামির কাছে সমর্পণ করত। মাকোতো শিনকাই অত্যন্ত নিপুণভাবে এই হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন প্রথাগুলোকে পপ কালচারের মোড়কে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছেন। এর ফলে আধুনিক জাপানি তরুণরা, যারা হয়তো আগে মন্দিরমুখী হতো না, তারা এখন এই মুভির লোকেশনগুলো দেখতে বা অ্যানিমে পিলগ্রিমেজ (Anime Pilgrimage) করতে সেই প্রত্যন্ত শিন্তো মন্দিরগুলোতে ভিড় করছে।
অ্যাকশন অ্যানিমে এবং শিন্তো মিথোলজি
কেবল রোমান্টিক বা ফ্যান্টাসি মুভি নয়, মারদাঙ্গা অ্যাকশন অ্যানিমে বা শোনেন অ্যানিমে (Shonen Anime)-তেও শিন্তোর উপস্থিতি প্রবল। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় নারুতো (Naruto) সিরিজের কথাই ধরুন। এই সিরিজের চরিত্ররা যেসব বিশেষ শক্তি বা ‘জুৎসু’ ব্যবহার করে, তার অনেকগুলোর নাম সরাসরি শিন্তো মিথোলজি থেকে নেওয়া। উচিহা ইতাচি বা সাসুকে যখন তাদের চোখের শক্তি ব্যবহার করে কালো আগুন তৈরি করে, তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমাতেরাসু’ (সূর্যদেবী)। তাদের বিভ্রম তৈরি করার শক্তির নাম ‘তসুকুয়মি’ (চন্দ্রদেবতা)। আর তাদের চূড়ান্ত প্রতিরক্ষামূলক দানবীয় সত্তার নাম ‘সুসানো’ (ঝড়ের দেবতা)। এমনকি ইজানাগি এবং ইজানামি নামগুলোও সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে ভাগ্য পরিবর্তনকারী শক্তি হিসেবে। যদিও অ্যানিমের গল্পের সাথে আসল মিথোলজির মিল নেই, কিন্তু এই নামগুলো ব্যবহার করার ফলে বিশ্বজুড়েই কোটি কোটি ভক্ত অজান্তেই জাপানি দেবতাদের নাম মুখস্থ করে ফেলছে। তারা হয়তো জানে না সুসানো আসলে কে, কিন্তু তারা জানে সুসানো খুব শক্তিশালী। এভাবেই পপ কালচার প্রাচীন মিথোলজিকে বাঁচিয়ে রাখে।
আরেকটি জনপ্রিয় অ্যানিমে নোরাগামি (Noragami)-তে শিন্তো ধর্মের কামিদের জীবনযাপনকে এক অদ্ভুত হাস্যরসাত্মক কিন্তু তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে। এখানে ইয়াতো নামের এক গরিব কামিকে দেখানো হয়, যার কোনো মন্দির নেই, তাই তার কোনো ভক্তও নেই। শিন্তো বিশ্বাস মতে, মানুষের ভক্তি বা প্রার্থনা ছাড়া কামি বাঁচতে পারে না। মানুষ ভুলে গেলে কামি মিলিয়ে যায় বা মারা যায়। এই অ্যানিমেটি শিন্তোর সেই দার্শনিক সত্যকেই তুলে ধরে – ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টি, এবং মানুষ যতদিন মনে রাখবে, ততদিনই ঈশ্বর থাকবেন। এখানে কামিদের জগতকে এক বিশাল আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা ব্যুরোক্রেসি (Bureaucracy) হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা জাপানি সমাজের করপোরেট সংস্করনেরই এক ঐশ্বরিক রূপ। কামিরা মিটিং করেন, রিপোর্ট জমা দেন, এবং দুষ্ট আত্মা বা ‘আয়াকাশি’দের শিকার করেন। এই আধুনিকীকরণ শিন্তোকে তরুণদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বা রিলেটেবল করে তুলেছে।
ইয়োকাই এবং পোকেমন: পকেটের ভেতর দেবতা
জাপানি লোকগাথায় ইয়োকাই (Yokai) বা অদ্ভুত দর্শন সব আত্মা বা দানবের কথা বলা হয়েছে। শিন্তো ধর্মে এদেরকে কামিরই এক নিম্নতর বা ভিন্ন রূপ মনে করা হয়। এই ইয়োকাইদের ধারণা থেকেই জন্ম হয়েছে বিশ্বখ্যাত গেম এবং অ্যানিমে পোকেমন (Pokemon)-এর। পোকেমনের স্রষ্টা সাতোশি তাজিরি ছোটবেলায় পোকা ধরতেন এবং জঙ্গলে ঘুরতেন। তার সেই অভিজ্ঞতা এবং শিন্তো অ্যানিমিজমের ধারণা থেকেই পোকেমনের জন্ম। পোকেমনে আমরা দেখি, পিকাচু বা চারিজার্ডের মতো হাজারো ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী বা ‘মনস্টার’ আছে, যাদের প্রত্যেকের আলাদা শক্তি। এরা মানুষের সাথে বন্ধু হিসেবে থাকে। এটি শিন্তোর সেই দর্শনকেই প্রতিধ্বনিত করে যে, মানুষ প্রকৃতির মালিক নয়, বরং প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানকারী। মানুষ যেমন পোকে বলের ভেতর পোকেমনকে রাখে এবং যত্ন করে, তেমনি প্রাচীন জাপানিরা ছোট ছোট কাঠের বাক্সে কামির প্রতীক রাখত। পোকেমন বা ডিজিমন (Digimon)-এর মতো সিরিজগুলো শিশুদের শেখায় যে, আমাদের চারপাশের প্রতিটি প্রাণী, গাছ বা এমনকি জড় বস্তুর মধ্যেও এক বিশেষ সত্তা লুকিয়ে থাকতে পারে। এই ধারণাটিকে বলা যায় শিন্তো অ্যানিমিজম (Shinto animism) থেকে উৎসারিত এক ধরনের আধুনিক সাংস্কৃতিক রূপায়ণ, যা কাওয়াই কালচার (Kawaii Culture)-এর নান্দনিকতার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা, সহাবস্থান ও বন্ধুত্বের ধারণাকে শিশু-কিশোরদের জন্য সহজ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে (Allison, 2006)।
সাইবারপাঙ্ক এবং টেকনো-শিন্তো
ভবিষ্যৎ বা ফিউচারিস্টিক অ্যানিমেগুলোতে, যেমন ঘোস্ট ইন দ্য শেল (Ghost in the Shell) বা নিওন জেনেসিস ইভানজেলিয়ন (Neon Genesis Evangelion)-এ শিন্তো দর্শন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ঘোস্ট ইন দ্য শেল-এ সাইবর্গ বা রোবটদের মধ্যে ‘ঘোস্ট’ বা আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। শিন্তো ধর্মে যেহেতু বলা হয় জড় বস্তুরও (যেমন তলোয়ার বা আয়না) কামি হতে পারে, তাই একটি উন্নত রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেন কামি বা আত্মা থাকবে না? এই অ্যানিমেগুলোতে মানুষের চেতনা এবং মেশিনের মেমোরির সীমারেখা মুছে ফেলা হয়েছে, যা শিন্তোর সর্বপ্রাণবাদ বা প্যানসাইকিজম (Panpsychism)-এরই এক আধুনিক রূপ। এখানে দেখানো হয় যে, প্রযুক্তির চরম শিখরে পৌঁছেও মানুষ আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্তি পায় না, বরং আধ্যাত্মিকতা প্রযুক্তির ভেতর দিয়ে নতুন রূপে প্রকাশিত হয়। বিশাল বিশাল রোবট বা ‘মেকা’ (Mecha)-গুলোকে দেখলেও মনে হয় তারা যেন প্রাচীনকালের কোনো দৈত্যাকার কামি বা রক্ষাকর্তা, যারা শহরকে রক্ষা করতে নেমে এসেছে। জাপানিরা রোবটকে ভয় পায় না (যেমনটা পশ্চিমা সায়েন্স ফিকশনে দেখা যায়), বরং তারা রোবটকে বন্ধু বা সাহায্যকারী মনে করে। এই মানসিকতার পেছনেও কাজ করছে শিন্তোর সেই বিশ্বাস – সবকিছুর ভেতরেই ভালো কিছু থাকার সম্ভাবনা আছে।
পরিশেষে বলা যায়, অ্যানিমে এবং মাঙ্গা কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এগুলো হলো জাপানের ‘সফট পাওয়ার’ বা সাংস্কৃতিক কূটনীতি (Cultural Diplomacy)। এগুলোর মাধ্যমে শিন্তো ধর্ম তার দ্বীপরাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে সারা বিশ্বের ড্রইংরুমে ঢুকে পড়েছে। একজন বিদেশী দর্শক হয়তো শিন্তো মন্দিরে কীভাবে পূজা করতে হয় তা জানে না, কিন্তু সে স্পিরিটেড অ্যাওয়ে দেখে নদীর পবিত্রতা রক্ষা করার শিক্ষা পায়, ইয়র নেম দেখে মহাজাগতিক সংযোগের কথা ভাবে। পপ কালচার শিন্তোকে এক নতুন জীবন দিয়েছে, একে করেছে সর্বজনীন। শিন্তো কামিরা আজ আর কেবল কাঠের মন্দিরে বন্দি নন, তারা আজ অ্যানিমেশনের রঙিন জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর কোটি কোটি ভক্তের মনে অবচেতনেই গেঁথে দিচ্ছেন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আর জীবনের প্রতি বিস্ময়।
শিন্তো পরিভাষা ও বস্তু: বিশ্বাসের প্রতীকী ভাষা
শিন্তো ধর্ম কেবল অদৃশ্য কামি বা দেবতাদের পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর রয়েছে এক বিশাল বস্তুগত সংস্কৃতি বা ম্যাটেরিয়াল কালচার (Material Culture)। জাপানিরা বিশ্বাস করে, আধ্যাত্মিক শক্তি কেবল ধ্যানে বা প্রার্থনায় পাওয়া যায় না, বরং কিছু বিশেষ বস্তু বা চিহ্নের মাধ্যমে সেই শক্তিকে ধারণ করা এবং বহন করা সম্ভব। এই বস্তুগুলো শিন্তো দর্শনের মূর্ত প্রতীক। মন্দিরে গেলে আপনি এমন অনেক ছোটখাটো জিনিস বা আচার দেখবেন, যা আপনার কাছে প্রথমে হয়তো কেবল স্যুভেনিয়ার বা খেলনা মনে হতে পারে। কিন্তু জাপানিদের কাছে এগুলোর প্রত্যেকটির গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। এই বস্তুগুলো কামি এবং মানুষের মধ্যে সংযোগের সেতু বা মিডিয়াম (Medium) হিসেবে কাজ করে। এগুলো মানুষকে দৈনন্দিন জীবনে সুরক্ষা, আশা এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। নিচে শিন্তো ধর্মের এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা এবং বস্তুর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো, যা জাপানি জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ওমামোরি (Omamori): পকেটে রাখা ঐশ্বরিক সুরক্ষা
আপনি যদি জাপানের রাস্তায় কোনো স্কুলপড়ুয়া ছাত্রের ব্যাগের দিকে বা কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভারের রিয়ার-ভিউ মিররের দিকে তাকান, তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই একটি ছোট রঙিন কাপড়ের থলি ঝুলতে দেখবেন। একে বলা হয় ‘ওমামোরি’ (Omamori)। ‘মামোরি’ শব্দটি এসেছে ‘মামোরু’ ক্রিয়াপদ থেকে, যার অর্থ ‘রক্ষা করা’। আর ‘ও’ হলো সম্মানসূচক উপসর্গ। অর্থাৎ, ওমামোরি মানে হলো ‘সম্মানিত রক্ষক’। এগুলো মূলত শিন্তো মন্দিরের পুরোহিতদের মন্ত্রপুত করা তাবিজ বা সুরক্ষকবচ। সিল্ক বা ব্রোকেড কাপড়ের তৈরি এই সুন্দর থলিগুলোর ভেতরে থাকে একটি ছোট কাগজ বা এক টুকরো কাঠ, যাতে কামির নাম বা বিশেষ প্রার্থনা লেখা থাকে। তবে সাবধান! ওমামোরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো – এটি কখনো খোলা যাবে না। জাপানিরা বিশ্বাস করে, কৌতূহলবশত থলিটি খুললে এর ভেতরের পবিত্র শক্তি বা ‘কি’ (Ki) বেরিয়ে যায় এবং এটি তখন একটি সাধারণ কাপড়ের টুকরোয় পরিণত হয়। এই ‘না দেখা’ বা রহস্যময়তাই ওমামোরির শক্তির উৎস।
আধুনিক জাপানে ওমামোরির বৈচিত্র্য দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। আগে মানুষ কেবল রোগবালাই বা ভূতপ্রেত থেকে বাঁচার জন্য ওমামোরি কিনত। এখন জীবনের প্রায় প্রতিটি সমস্যার জন্য আলাদা আলাদা ওমামোরি পাওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার আগে কেনে ‘গাকুগিও জোজু’ (Gakugyo Joju) বা ভালো রেজাল্টের ওমামোরি। প্রেমিক-প্রেমিকারা কেনে ‘এন-মুসুবি’ (En-musubi) বা ভালো সম্পর্কের ওমামোরি। গাড়ি চালকরা কেনে ‘কোৎসু আনজেন’ (Kotsu Anzen) বা ট্রাফিক সেফটির ওমামোরি। এমনকি ব্যবসায়ীদের জন্য ‘শৌবাই হানজো’ (Shobai Hanjo) বা ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির ওমামোরিও আছে। কিছু আধুনিক মন্দিরে এখন ‘আইটি সুরক্ষা’ বা কম্পিউটার ভাইরাস থেকে বাঁচার ওমামোরিও পাওয়া যায়! ওমামোরি কিন্তু সারাজীবনের জন্য নয়। এর মেয়াদ সাধারণত এক বছর। জাপানিরা মনে করে, এক বছর ধরে ওমামোরিটি আপনার চারপাশের সব নেতিবাচক শক্তি বা নেগেটিভ এনার্জি (Negative Energy) শুষে নেয়, ফলে এটি ‘নোংরা’ বা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই এক বছর পর পুরনো ওমামোরিটি মন্দিরে ফেরত দিয়ে নতুন একটি কিনতে হয়। পুরনো ওমামোরিগুলো মন্দিরে এক বিশেষ আগুনের উৎসবে বা ‘দোন্দোয়াকি’ (Dondoyaki)-তে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যাতে এর ভেতরের কামি আবার স্বর্গে ফিরে যেতে পারেন (Swanger, 1981)।
এমা (Ema): কামির কাছে লেখা চিঠি
শিন্তো মন্দিরের এক কোণায় আপনি হয়তো দেখবেন একটি কাঠের কাঠামোতে হাজার হাজার ছোট ছোট কাঠের ফলক ঝুলছে। বাতাসে দোল খাওয়া এই ফলকগুলোকে বলা হয় ‘এমা’ (Ema)। ‘এ’ মানে ছবি, আর ‘মা’ মানে ঘোড়া। অর্থাৎ, এমা মানে হলো ‘ঘোড়ার ছবি’। কিন্তু কাঠের ফলকে ঘোড়ার ছবি কেন? এর পেছনে আছে এক মজার ইতিহাস। প্রাচীনকালে জাপানিরা বিশ্বাস করত, ঘোড়া হলো কামিদের বাহন। তাই কোনো বড় প্রার্থনা পূরণ করার জন্য বা কামিকে খুশি করার জন্য ধনী ব্যক্তিরা মন্দিরে জ্যান্ত ঘোড়া দান করতেন। কিন্তু সবার তো আর ঘোড়া দান করার সামর্থ্য ছিল না, আর মন্দিরের পক্ষেও এত ঘোড়া পালন করা সম্ভব ছিল না। তাই নারা যুগে (৭১০-৭৯৪ খ্রি.) মানুষ আসল ঘোড়ার বদলে কাঠের ফলকে ঘোড়ার ছবি এঁকে দান করা শুরু করল। সেই থেকেই এই প্রথার নাম হয়ে গেল ‘এমা’। কালক্রমে ঘোড়ার ছবির বদলে সেখানে রাশিচক্রের প্রাণী বা মন্দিরের কামির ছবি আঁকা শুরু হলো।
আজকের দিনে ‘এমা’ হলো কামির কাছে মনের ইচ্ছা জানানোর মাধ্যম। আপনি মন্দিরের কাউন্টার থেকে একটি এমা কিনবেন (সাধারণত ৫০০ থেকে ১০০০ ইয়েন), তার পেছনের খালি অংশে মার্কার পেন দিয়ে আপনার প্রার্থনা লিখবেন, এবং তারপর নির্দিষ্ট স্থানে ঝুলিয়ে দিয়ে আসবেন। কামিরা নাকি অবসরে এগুলো পড়েন! এমাগুলোতে লেখা প্রার্থনাগুলো পড়লে মানুষের মনের বিচিত্র সব ইচ্ছে জানা যায়। কেউ লিখছে, “প্লিজ, আমি যেন টোকিও ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাই।” কেউ লিখছে, “আমার মা যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে।” আবার কেউ বা লিখছে, “আমার বয়ফ্রেন্ড যেন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।” বিদেশিরাও এখন এমা লিখতে খুব পছন্দ করে। অনেক মন্দিরে এখন ইংরেজি, চাইনিজ বা কোরিয়ান ভাষায় লেখা এমাই বেশি দেখা যায়। এমা হলো মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক উন্মুক্ত প্রদর্শনী বা পাবলিক ডিসপ্লে অফ হোপ (Public Display of Hope)। বছর শেষে পুরোহিতরা এই সব এমা সংগ্রহ করে আগুনের মাধ্যমে স্বর্গে পাঠিয়ে দেন, যাতে কামিরা সেগুলো গ্রহণ করতে পারেন (Reader, 1991)।
ওমিকুজি (Omikuji): ভাগ্যের লটারি
মন্দিরে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ জানতে কার না ইচ্ছে করে? এই কৌতূহল মেটানোর জন্যই আছে ‘ওমিকুজি’ (Omikuji)। এটি হলো ভাগ্য গণনার কাগজ বা লটারি। শিন্তো মন্দিরের সামনে ছোট ছোট কাঠের বাক্স রাখা থাকে। আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা (সাধারণত ১০০ বা ২০০ ইয়েন) বাক্সে ফেলে সেই কাঠের বাক্সটি ঝাঁকাবেন। বাক্সের গায়ে একটি ছোট ছিদ্র থাকে। ঝাঁকুনির ফলে সেই ছিদ্র দিয়ে একটি সরু বাঁশের কাঠি বেরিয়ে আসবে। সেই কাঠির গায়ে একটি নম্বর লেখা থাকে। আপনি সেই নম্বরটি মন্দিরের সেবিকা বা মিকোকে বললে বা ড্রয়ার থেকে মিলিয়ে নিলে একটি কাগজ পাবেন। সেই কাগজটিই হলো আপনার ওমিকুজি। এতে আপনার স্বাস্থ্য, প্রেম, ব্যবসা, বা যাত্রা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী লেখা থাকে। এটি অনেকটা আমাদের দেশের টিয়া পাখির ভাগ্য গণনার আধুনিক সংস্করণ।
ওমিকুজিতে ভাগ্যের বিভিন্ন স্তর বা লেভেলস অফ লাক (Levels of Luck) থাকে। সবচেয়ে ভালো ভাগ্যকে বলা হয় ‘দাইকিচি’ (Daikichi) বা মহাসৌভাগ্য। এরপর আছে ‘কিচি’ (Kichi) বা ভালো ভাগ্য, ‘চুকিচি’ (Chukichi) বা মাঝারি ভাগ্য, এবং সবার শেষে ‘কিও’ (Kyo) বা খারাপ ভাগ্য। যদি আপনার কাগজে ‘দাইকিচি’ ওঠে, তবে আপনি সেটি খুশিতে পকেটে নিয়ে বাড়ি যাবেন। কিন্তু যদি ‘কিও’ বা খারাপ ভাগ্য ওঠে? চিন্তার কিছু নেই! শিন্তো ধর্মে সমস্যার সমাধানও আছে। আপনি সেই খারাপ ভাগ্যের কাগজটি সাথে না নিয়ে মন্দিরের নির্দিষ্ট পাইন গাছে বা টানানো দড়িতে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে আসবেন। জাপানি ভাষায় পাইন গাছকে বলা হয় ‘মাৎসু’, যার উচ্চারণ ‘অপেক্ষা করা’ (Matsu) শব্দের মতো। এর মানে হলো, আপনি খারাপ ভাগ্যকে মন্দিরে অপেক্ষা করতে বললেন, যাতে সেটি আপনার সাথে বাড়ি না যায়। এই বেঁধে রাখার প্রথাটি এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি বা সাইকোলজিক্যাল রিলিফ (Psychological Relief) দেয়। মানুষ মনে করে, বিপদটা ওখানেই আটকে গেল।
শিমেনাওয়্যা (Shimenawa): পবিত্রতার সীমারেখা
শিন্তো মন্দিরে বা জাপানের কোনো পবিত্র প্রাকৃতিক স্থানে গেলে আপনি মোটা খড়ের দড়ি দেখতে পাবেন, যাকে বলা হয় ‘শিমেনাওয়্যা’ (Shimenawa)। এটি কোনো সাধারণ দড়ি নয়, এটি পবিত্রতা এবং অপবিত্রতার মাঝখানের সীমানা নির্দেশ করে। ‘শিমে’ মানে হলো দখল করা বা চিহ্নিত করা, আর ‘নাওয়্যা’ মানে দড়ি। প্রাচীনকালে যখন কেউ কোনো জমি দখল করত, তখন দড়ি দিয়ে সীমানা দিত। শিন্তোতে এর অর্থ হলো, এই দড়ির ভেতরের জায়গাটি কামির দখলে, অর্থাৎ এটি অত্যন্ত পবিত্র। শিমেনাওয়্যা সাধারণত ধান গাছের খড় দিয়ে তৈরি হয় এবং এটি পাকানোর একটি বিশেষ নিয়ম আছে – এটি বাম দিক থেকে ডান দিকে পাকানো হয়, যা সাধারণ দড়ির উল্টো। এর সাথে প্রায়ই জিগজ্যাগ আকৃতির সাদা কাগজের ফালি ঝোলানো থাকে, যাকে বলা হয় ‘শিদে’ (Shide)। এই কাগজগুলো বজ্রপাতের প্রতীক, যা কামির শক্তি এবং উর্বরতাকে নির্দেশ করে।
শিমেনাওয়্যা বিভিন্ন আকারের হতে পারে। ঘরের কামিদানা বা বেদীতে ব্যবহারের জন্য সরু দড়ি থেকে শুরু করে ইজুমো তাইশা (Izumo Taisha) মন্দিরের বিশাল দড়ি পর্যন্ত – যার ওজন কয়েক টন! অনেক সময় বিশাল ওক গাছ বা অদ্ভুত আকৃতির পাথরের গায়ে এই দড়ি প্যাঁচানো থাকে। একে বলা হয় ‘ইওরিহিরো’ (Yorishiro) বা কামির অবতরণ স্থল। যখন আপনি কোনো গাছে শিমেনাওয়্যা দেখবেন, তখন বুঝবেন যে এটি কোনো সাধারণ গাছ নয়, এটি একটি জীবন্ত কামি। তখন সেই গাছ কাটা বা তার ক্ষতি করা মহাপাপ। জাপানি সুমো কুস্তিগিররা, বিশেষ করে সর্বোচ্চ র্যাংকধারী ‘ইয়োকোজুনা’ (Yokozuna)-রা তাদের কোমরে এই শিমেনাওয়্যা পরে রিংয়ে নামেন। এর মানে হলো, তারা নিজেরাই তখন জীবন্ত কামি বা পবিত্র সত্তা হিসেবে গণ্য হন।
কামিদানা (Kamidana): ঘরের ভেতরের মন্দির
শিন্তো ধর্ম কেবল মন্দিরে সীমাবদ্ধ নয়, এটি জাপানিদের ঘরের ভেতরেও বিদ্যমান। প্রায় প্রতিটি ঐতিহ্যবাহী জাপানি পরিবারে এবং অনেক আধুনিক অফিস বা দোকানেও দেয়ালের উঁচুতে একটি ছোট কাঠের তাক দেখা যায়, যাকে বলা হয় ‘কামিদানা’ (Kamidana)। এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘দেবতাদের তাক’ বা গডশেলফ (Godshelf)। এটি আসলে একটি মিনিয়েচার বা ক্ষুদ্রাকৃতির শিন্তো মন্দির। এখানে পরিবারের রক্ষাকর্তা কামি এবং ইসে জিঙ্গু (সূর্যদেবীর মন্দির)-র বিশেষ তাবিজ বা ‘ওফাদা’ (Ofuda) রাখা হয়। প্রতিদিন সকালে বাড়ির কর্তা বা গিন্নী ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে কামিদনার সামনে দাঁড়ান। তারা সেখানে টাটকা জল, রান্না করা ভাত, লবণ এবং সাকে (মদ) নিবেদন করেন। এরপর দুবার মাথা নত করেন, দুবার হাততালি দেন এবং প্রার্থনা করেন।
কামিদানা হলো পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি পরিবারের সদস্যদের মনে করিয়ে দেয় যে কামি তাদের সাথেই আছেন, তাদের দেখছেন। দোকান বা ব্যবসার জায়গায় কামিদানা রাখা হয় ব্যবসার সমৃদ্ধি কামনায়। কামিদানা সবসময় মানুষের চোখের লেভেলের ওপরে এবং পরিষ্কার জায়গায় স্থাপন করতে হয়। এর ওপরে যেন কেউ না হাঁটে, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। যদি কামিদানা দোতলার নিচে থাকে এবং ওপরেও থাকার ঘর থাকে, তবে কামিদনার ওপরের ছাদে ‘কু-মো’ (Kumo) বা ‘মেঘ’ লেখা এক টুকরো কাগজ লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর মানে হলো – “এর ওপরে আর কিছু নেই, শুধুই আকাশ।” এটি কামির প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান বা আল্টিমেট রেসপেক্ট (Ultimate Respect)-এর নিদর্শন।
হাকুশুই ও মিসোগি: শুদ্ধিকরণের অনুষঙ্গ
শিন্তো রিচুয়ালে হাততালি দেওয়ার পদ্ধতিকে বলা হয় ‘হাকুশুই’ (Hakushu) বা কাশিওয়াদে (Kashiwade)। শিন্তো ধর্মে শব্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাততালির তীক্ষ্ণ শব্দটি কামির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বাতাসের অশুভ তরঙ্গ বা ভাইব্রেশন (Vibration) ভেঙে দেয়। বৌদ্ধধর্মে বা খ্রিস্টধর্মে প্রার্থনার সময় নীরব থাকা হয়, কিন্তু শিন্তোতে শব্দ করে প্রার্থনা শুরু করতে হয়। অন্যদিকে, ‘মিসোগি’ (Misogi) হলো জল দিয়ে শরীর ও মন শুদ্ধ করার প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত নদী, ঝর্ণা বা সমুদ্রের জলে সম্পূর্ণ শরীর ডুবিয়ে করা হয়। তবে দৈনন্দিন জীবনে মন্দিরে প্রবেশের আগে ‘তেমিজু’ (Temizu) বা হাত-মুখ ধোয়া হলো মিসোগির সংক্ষিপ্ত রূপ। এই শুদ্ধিকরণ ছাড়া কামির কাছে যাওয়া যায় না।
এই সব পরিভাষা এবং বস্তু মিলে শিন্তো ধর্মের এক বিচিত্র জগত তৈরি করেছে। ওমামোরি, এমা বা ওমিকুজি – এগুলো হয়তো আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না, কিন্তু এগুলো মানুষের মনে যে আশা বা হোপ (Hope) জাগিয়ে রাখে, তার মূল্য অপরিসীম। এগুলো জাপানি সংস্কৃতিকে দিয়েছে এক অনন্য নান্দনিকতা বা এস্থেটিকস (Aesthetics), যা হাজার বছর ধরে তাদের টিকিয়ে রেখেছে।
নারী ও শিন্তো: দেবী থেকে দাসী এবং পুনরুত্থানের উপাখ্যান
শিন্তো ধর্মের ইতিহাসের দিকে তাকালে একটা অদ্ভুত প্যারাডক্স বা প্যারাডক্স (Paradox) চোখে পড়ে। পৃথিবীর অধিকাংশ প্রধান ধর্মে সৃষ্টিকর্তা বা প্রধান সত্তাকে পুরুষ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে – সেটা জিউস হোক, ওডিন হোক, কিংবা আব্রাহামিক ধর্মের ঈশ্বর। কিন্তু শিন্তো ধর্মে জাপানি মিথোলজির সর্বোচ্চ আসনে যিনি বসে আছেন, তিনি একজন নারী – সূর্যদেবী আমাতেরাসু। জাপানের রাজপরিবার থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক, সবাই হাজার বছর ধরে এই দেবীর পায়েই মাথা ঠুকে এসেছে। অথচ, সেই একই ধর্মে একটা দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের ‘অপবিত্র’ বা ‘দূষিত’ মনে করা হয়েছে এবং তাদের মন্দিরের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে, তাই না? একদিকে দেবী হিসেবে পূজা, অন্যদিকে রক্তমাংসের নারীকে অস্পৃশ্য ভাবা – এই দ্বান্দ্বিকতা বা ডায়ালেক্টিকস (Dialectics)-ই হলো শিন্তো ধর্মে নারীদের ইতিহাসের মূল উপজীব্য। প্রাচীন জাপানে নারীদের যে ক্ষমতা বা স্পিরিচুয়াল অথরিটি (Spiritual Authority) ছিল, তা মধ্যযুগে এসে হারিয়ে যায়, আবার আধুনিক যুগে তা নতুন রূপে ফিরে আসছে। এই চড়াই-উতরাইয়ের গল্পটা কেবল ধর্মের গল্প নয়, এটি জাপানি সমাজের বিবর্তনেরও গল্প। প্রাক-ঐতিহাসিক জাপানে নারীরা কেবল গৃহকোণে আবদ্ধ ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন সমাজের চালিকাশক্তি। তখন সমাজটা ছিল অনেকটাই মাতৃতান্ত্রিক (Matriarchal) বা অন্ততপক্ষে মাতৃসূত্রীয় (Matrilineal)। কিন্তু ইতিহাসের চাকা যখন ঘুরল, তখন বৌদ্ধধর্ম ও কনফুসীয়বাদের প্রভাবে নারীদের সেই আসন টলে গেল। তবুও, জাপানি নারীরা পুরোপুরি হারিয়ে যাননি; তারা ‘মিকো’ বা সেবিকা হয়ে, কিংবা আধুনিক যুগে পুরোহিত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন।
হিমে-মিকো ব্যবস্থা ও শামানিজম
প্রাচীন জাপানের ধর্মব্যবস্থা ছিল মূলত শামানিজম (Shamanism)-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। শামান হলেন এমন ব্যক্তি যিনি আত্মাদের সাথে কথা বলতে পারেন এবং তাদের নিজের শরীরে ধারণ করতে পারেন। আর এই কাজটি পুরুষদের চেয়ে নারীরাই ভালো পারতেন বলে বিশ্বাস করা হতো। জাপানি ইতিহাসে আমরা ‘হিমিকো’ (Himiko) বা ‘পিমিকো’ নামের এক রহস্যময়ী রানীর কথা জানতে পারি। তৃতীয় শতাব্দীর চীনা ঐতিহাসিক দলিলে তার উল্লেখ আছে। তিনি ছিলেন ‘ইয়ামাতাই’ (Yamatai) রাজ্যের রানী এবং একজন শক্তিশালী শামান। বলা হয়, তিনি জনসমক্ষে খুব একটা বের হতেন না, কিন্তু তার জাদুকরী ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি বহু বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহ থামিয়ে রাজ্যে শান্তি বজায় রেখেছিলেন। হিমিকো একা নন, প্রাচীন জাপানে শাসক এবং প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব প্রায়ই ভাই-বোনের মধ্যে ভাগ করা থাকত। একে বলা হতো হিমে-মিকো সিস্টেম (Hime-Miko System)। বোন (হিমে) হতেন প্রধান শামান বা আধ্যাত্মিক নেতা, যিনি কামির বাণী শুনতেন। আর ভাই (মিকো) হতেন রাজনৈতিক প্রশাসক, যিনি বোনের নির্দেশ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের মূল সিদ্ধান্ত আসত নারীর মুখ থেকেই, কারণ তিনিই ছিলেন কামির মাধ্যম বা মিডিয়াম (Medium)।
এই আধ্যাত্মিক নারীদের বলা হতো মিকো (Miko)। আজকের দিনে শিন্তো মন্দিরে আমরা লাল স্কার্ট বা ‘হাকামা’ পরা যে তরুণী মেয়েদের দেখি, যারা মূলত সহকারীর কাজ করে, প্রাচীনকালের মিকোদের সাথে তাদের আকাশ-পাতাল তফাৎ। প্রাচীন মিকোরা ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তারা এক ধরণের ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন, যাকে বলা হয় কামিগাকারি (Kamigakari) বা ‘ঈশ্বরের ভর করা’। এই অবস্থায় তারা যা বলতেন, তাকেই কামির আদেশ বা ওরাকল (Oracle) বলে গণ্য করা হতো। দশম শতাব্দী পর্যন্ত জাপানি রাজদরবারে মিকোদের বিশাল প্রভাব ছিল। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও মিকোদের নিয়ে যাওয়া হতো, যাতে তারা শত্রুর গতিবিধি বা যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। এই সময়কালকে জাপানি নারীদের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে, যেখানে তাদের পবিত্রতাকে সম্মানের চোখে দেখা হতো, ভয়ের চোখে নয় (Ambros, 2015)।
বৌদ্ধধর্ম ও কনফুসীয়বাদের অনুপ্রবেশ: অপবিত্রতার রাজনীতি
নারীদের এই ক্ষমতায়ন ধাক্কা খেল যখন ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইরে থেকে বৌদ্ধধর্ম এবং পরে কনফুসীয়বাদ জাপানে প্রবেশ করল। বৌদ্ধধর্মের কিছু কিছু ধারায় নারীকে আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে দেখা হতো। বিশেষ করে, নারীর শরীর এবং যৌনতাকে মায়ার বাঁধন বা ইলিউশন (Illusion) মনে করা হতো। এর সাথে যুক্ত হলো কনফুসীয়বাদের কঠোর পিতৃতান্ত্রিক বা প্যাট্রিয়ার্কাল (Patriarchal) অনুশাসন। কনফুসীয়বাদ শেখাল যে, নারীর তিনটি আনুগত্য থাকতে হবে – বাবার প্রতি, স্বামীর প্রতি এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের প্রতি। কিন্তু শিন্তোর ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি এল ‘রক্ত’ বা ব্লাড টাবু বা ব্লাড পলিউশন (Blood Pollution)-এর ধারণা থেকে। শিন্তো ধর্মে রক্ত সবসময়েই ভীতিপ্রদ ছিল, কিন্তু প্রাচীনকালে এটি ছিল শক্তির প্রতীক। সন্তান প্রসবের রক্তকে নতুন জীবনের আগমনী বার্তা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম ও শিন্তোর মিলনে তৈরি হওয়া নতুন দর্শনে মাসিকের রক্ত বা ঋতুস্রাব এবং প্রসবকালীন রক্তপাতকে ‘অপবিত্র’ বা কেগারে (Kegare) হিসেবে চিহ্নিত করা হলো।
মধ্যযুগে জাপানে একটি বৌদ্ধ সূত্র বা সুত্র (Sutra) খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার নাম ব্লাড বোল সুত্র বা কেৎসুবন কিও (Ketsubon Kyo)। এই বইটিতে বলা হলো, নারীরা যেহেতু মাসিক বা ঋতুস্রাবের মাধ্যমে পৃথিবী ও পবিত্র জল অপবিত্র করে, তাই মৃত্যুর পর তাদের নরকের রক্তভর্তি পুকুরে হাবুডুবু খেতে হবে। এই ধারণাটি জাপানি সমাজে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। শিন্তো মন্দিরেও এর প্রভাব পড়ল। যে নারীরা একসময় প্রধান পুরোহিত ছিলেন, তাদের ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হলো। বলা হলো, নারীরা ‘মাসে সাত দিন’ অপবিত্র থাকেন, তাই তারা সব সময় কামির সেবা করতে পারবেন না। ফলে মন্দিরের নেতৃত্ব চলে গেল পুরুষদের হাতে। নারীদের ভূমিকা সংকুচিত হয়ে গেল কেবল সহকারীর কাজে। এই পরিবর্তন একদিনে হয়নি, কয়েকশ বছর ধরে ধীরে ধীরে নারীদের হাত থেকে ধর্মের চাবিকাঠি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। একে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন রিলিজিয়াস মার্জিনালাইজেশন (Religious Marginalization) বা ধর্মীয় প্রান্তিকীকরণ।
নিওনিন কেক্কাই: নারীদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা
রক্ত ও অপবিত্রতার এই ধারণা থেকেই জন্ম নিল নিওনিন কেক্কাই (Nyonin Kekkai) বা ‘নারীদের জন্য নিষিদ্ধ সীমানা’ প্রথা। জাপানের অনেক পবিত্র পাহাড়, যা শিন্তো এবং শুগেন্দো (পাহাড়ি সাধনা) ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে নারীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো। মাউন্ট ফুজি, মাউন্ট তোগাকুশি এবং মাউন্ট ওমিনে – এগুলো ছিল পুরুষ তপস্বীদের বিচরণক্ষেত্র। যুক্তি দেখানো হলো দুটি। প্রথমত, নারীদের ঋতুস্রাব পাহাড়ের পবিত্রতা নষ্ট করবে। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা সাধারণত নারী হন (যেমন মাউন্ট ফুজির দেবী)। অন্য নারী সেখানে গেলে দেবী ঈর্ষান্বিত বা জেলাস (Jealous) হতে পারেন এবং দুর্যোগ ঘটাতে পারেন। ভাবুন একবার, একজন দেবী আরেকজন সাধারণ নারীকে দেখে হিংসে করবেন – এই অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে নারীদের প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত রাখা হলো।
মাউন্ট ফুজিতে নারীদের ওঠার নিষেধাজ্ঞা ১৮৬৮ সালে মেইজি সরকার তুলে নিয়েছিল। কিন্তু নারা প্রিফেকচারের মাউন্ট ওমিনে (Mount Omine) বা মাউন্ট সানজো-তে আজও নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই পাহাড়ের প্রবেশপথে একটি বড় পাথরের স্তম্ভ আছে, যেখানে বড় বড় করে লেখা – “নারীদের প্রবেশ নিষেধ।” আজও প্রতি বছর হাজার হাজার পুরুষ শুগেন্দো সাধক এই পাহাড়ে ওঠেন, কিন্তু নারীদের পাহাড়ের নিচেই অপেক্ষা করতে হয়। আধুনিক নারীবাদী সংগঠনগুলো এবং মানবাধিকার কর্মীরা এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলছেন, এটি লিঙ্গবৈষম্য এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের নিয়মবিরোধী। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিতরা এবং স্থানীয় রক্ষণশীল সমাজ তাদের অবস্থানে অনড়। তারা বলেন, “এটি বৈষম্য নয়, এটি ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশন (Tradition)। পুরুষ এবং নারীর আধ্যাত্মিক পথ আলাদা।” ১৩০০ বছর ধরে চলে আসা এই নিষেধাজ্ঞা আধুনিক জাপানের বুকেও এক প্রাচীন ক্ষত হয়ে আছে। এটি প্রমাণ করে যে, শিন্তো ধর্মে পবিত্রতার ধারণা কতটা গভীরভাবে লিঙ্গ-রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে (Kawahashi, 1995)।
মেইজি যুগ ও স্টেট শিন্তো: চূড়ান্ত আঘাত
নারীদের শিন্তো থেকে দূরে সরানোর কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয় ১৮৬৮ সালের মেইজি রিস্টোরেশন বা মেইজি সংস্কার (Meiji Restoration)-এর সময়। মেইজি সরকার চাইল জাপানকে একটি শক্তিশালী, পিতৃতান্ত্রিক জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে, যেখানে সম্রাটই সব। তারা ‘ইয়ে’ (Ie) বা ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ব্যবস্থাকে আইনি রূপ দিল, যেখানে পরিবারের কর্তা হবেন পুরুষ। ১৮৬৮ সালের ৪ঠা মে সরকার একটি আদেশ জারি করে আনুষ্ঠানিকভাবে নারীদের শিন্তো পুরোহিত হওয়া নিষিদ্ধ করে দিল। যুক্তি দেওয়া হলো, নারীদের প্রধান কাজ হলো ‘ভালো স্ত্রী ও বিজ্ঞ মা’ বা রিওসাই কেনবো (Ryosai Kenbo) হওয়া। তাদের কাজ মন্দিরে নয়, ঘরে। এমনকি প্রাচীন আমল থেকে চলে আসা অনেক মিকো বা শামানিক প্রথাকেও ‘কুসংস্কার’ ও ‘অসভ্য’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হলো। মিকোদের বলা হলো, তারা আর ভর বা পজেশন (Possession)-এর অভিনয় করতে পারবে না, তাদের কাজ হবে কেবল সুন্দর করে নাচা এবং পুরোহিতদের সাহায্য করা।
এই সময় শিন্তো মন্দিরগুলোতে নারীদের অবস্থান একেবারেই গৌণ হয়ে গেল। অথচ মজার ব্যাপার হলো, মেইজি সরকার যে সূর্যদেবী আমাতেরাসুকে তাদের ক্ষমতার উৎস বলে দাবি করত, তিনি তো নারীই ছিলেন! কিন্তু আমাতেরাসুর নারীসত্তাকে ধামাচাপা দিয়ে তাকে কেবল ‘সম্রাটের পূর্বপুরুষ’ হিসেবেই বেশি ফোকাস করা হতো। নারীদের হাত থেকে পৌরহিত্য কেড়ে নেওয়ার ফলে শিন্তো তার কোমলতা বা ফেমিনিন আসপেক্ট (Feminine Aspect) হারিয়ে অনেকটাই সামরিক ও পুরুষালি ধর্মে পরিণত হলো, যা পরবর্তীকালে যুদ্ধের ইন্ধন জুগিয়েছিল।
যুদ্ধের পর পুনরুত্থান: আবার জেগে ওঠা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সমাজব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন আসে। ১৯৪৫ সালে আমেরিকা যখন জাপানের সংবিধান নতুন করে লিখে দিল, তখন সেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলো। ১৯৪৬ সালে শিন্তো মন্দিরগুলোর প্রধান সংস্থা জিঞ্জা হোনচো (Jinja Honcho) বা অ্যাসোসিয়েশন অফ শিন্তো শ্রাইনস গঠিত হলো। তারা বুঝতে পারল, আধুনিক যুগে নারীদের আর আটকে রাখা যাবে না। তাছাড়া যুদ্ধের কারণে অনেক পুরুষ পুরোহিত মারা গিয়েছিলেন, ফলে মন্দিরগুলো চালানোর লোক ছিল না। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ১৯৪৬ সালেই নারীদের আবার পুরোহিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। এটি ছিল জাপানি ধর্মের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। প্রায় ৮০ বছর পর নারীরা আবার ‘কান্নুশি’ বা পুরোহিতের সাদা পোশাক পরার অধিকার পেলেন।
বর্তমানে জাপানে প্রায় ২৫,০০০ শিন্তো পুরোহিতের মধ্যে প্রায় ৩,০০০ জন নারী। সংখ্যাটা খুব বড় না হলেও, এটি বাড়ছে। নারীরা এখন কেবল ছোটখাটো গ্রাম্য মন্দিরের দায়িত্বে নেই, অনেক বড় বড় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা গুজি (Guji) হিসেবেও কাজ করছেন। ২০১৪ সালে জাপানের রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্সেস নরিকো বিয়ে করার পর রাজপদবী হারান, কিন্তু পরে তিনি ইজুমো তাইশা (Izumo Taisha) মন্দিরের সাথে যুক্ত হন। এছাড়া রাজপরিবারের আরেক সদস্য, বর্তমান সম্রাটের মেয়ে প্রিন্সেস আইকো-কে নিয়েও জল্পনা-কল্পনা আছে যে ভবিষ্যতে নারী সম্রাট হতে পারবে কি না। যদিও শিন্তো রক্ষণশীলরা নারী সম্রাটের ঘোর বিরোধী, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে নারীদের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন বাড়ছে।
আধুনিক মিকো: পপ কালচার বনাম বাস্তবতা
আধুনিক যুগে ‘মিকো’ বা শ্রাইন মেইডেনদের ভূমিকাও পাল্টেছে। এখন আর তাদের শামান বা জাদুকর ভাবা হয় না। অধিকাংশ মিকো হলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পার্ট-টাইম ছাত্রী। বিশেষ করে নববর্ষের সময় মন্দিরে প্রচণ্ড ভিড় সামলাতে অনেক মিকো নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের কাজ হলো ওমামোরি (তাবিজ) বিক্রি করা, মন্দির পরিষ্কার রাখা এবং ‘কাগুরা’ নাচ পরিবেশন করা। অ্যানিমে বা মাঙ্গাতে মিকোদের প্রায়ই জাদুকরী ক্ষমতা বা ম্যাজিকাল পাওয়ার (Magical Power)-এর অধিকারী হিসেবে দেখানো হয় (যেমন ইনুয়াসা বা ইয়োর নেম অ্যানিমেতে)। পপ কালচারের এই চিত্রায়ন তরুণ প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে মিকো হওয়ার আগ্রহ তৈরি করেছে। অনেক বিদেশি পর্যটকও এখন ‘মিকো এক্সপেরিয়েন্স’ নিতে চান। তবে এর নেতিবাচক দিকও আছে। মিকোদের এখন অনেক সময় কেবল ‘ভিজুয়াল আইকন’ বা ফেটিশ (Fetish) হিসেবে দেখা হয়, যা তাদের প্রাচীন আধ্যাত্মিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে। তবুও, লাল হাকামা পরা মিকোদের উপস্থিতি শিন্তো মন্দিরকে এক স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দেয়, যা মনে করিয়ে দেয় যে – যতই বাধা আসুক, শিন্তো থেকে নারীদের মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
উপসংহার: বৃত্ত কি সম্পূর্ণ হলো?
নারী ও শিন্তোর সম্পর্ক একটি পূর্ণ বৃত্তের মতো। প্রাচীনকালে নারীরা ছিলেন কেন্দ্রে (আমাতেরাসু ও হিমিকো), মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগের শুরুতে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল পরিধিতে বা পেরিফেরি (Periphery)-তে, আর এখন আবার তারা কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে আসছেন। মাউন্ট ওমিনেতে হয়তো নারীরা আজও উঠতে পারেন না, কিন্তু জাপানের হাজার হাজার মন্দিরে নারীরাই এখন ঘণ্টা বাজাচ্ছেন, মন্ত্র পড়ছেন। শিন্তো ধর্ম এখন বুঝতে পারছে যে, প্রকৃতির ধর্ম কখনো লিঙ্গভেদে আলাদা হতে পারে না। কামির সামনে নারী ও পুরুষ – উভয়ই সমান। যে সূর্যদেবী আমাতেরাসু গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করেছিলেন, জাপানি নারীরাও আজ দীর্ঘদিনের সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার গুহা থেকে বেরিয়ে আসছেন। তাদের এই যাত্রাই শিন্তোকে আগামী দিনের জন্য প্রাসঙ্গিক করে রাখবে।
উপসংহার
শিন্তো ধর্মের সামগ্রিক বিশ্লেষণ করলে যে চিত্রটি ফুটে ওঠে, তা কোনো অলৌকিক বা রোমান্টিক আখ্যান নয়, বরং এটি একটি জাতির সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের এক বাস্তব দলিল। যুক্তিবিদ্যা বা লজিক (Logic) দিয়ে বিচার করতে গেলে শিন্তোকে অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিকতার সাথে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, যখন মানুষ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করছে, তখন পাথরের সামনে মাথা নত করা বা নতুন গাড়ি কেনার পর তা ঝাড়ফুঁক করানোকে নিছক কুসংস্কার বা সুপারস্টিশন (Superstition) বলে উড়িয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায়, শিন্তো জাপানি সমাজে ধর্ম হিসেবে যতটা না টিকে আছে, তার চেয়ে বেশি টিকে আছে একটি সাংস্কৃতিক প্রথা বা কালচারাল প্র্যাকটিস (Cultural Practice) হিসেবে। এখানে ‘বিশ্বাস’ বা ঈশ্বরে ভক্তির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘অংশগ্রহণ’। জাপানিরা শিন্তো আচার পালন করে না কারণ তারা কামিকে ভয় পায়, বরং তারা এটি পালন করে কারণ এটি তাদের সামাজিক পরিচিতি বা আইডেন্টিটি (Identity)-র অংশ। এটি এমন এক ব্যবস্থা যা একটি হাইপার-মডার্ন সমাজে মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ কমিয়ে এক ধরণের সমষ্টিগত সংহতি তৈরি করে। শিন্তো কোনো পরম সত্যের সন্ধান দেয় না, কোনো পরকালের লোভ দেখায় না; এটি কেবল ইহজাগতিক জীবনকে শৃঙ্খল ও সুন্দরভাবে যাপন করার কিছু রিচুয়াল বা আচার সরবরাহ করে। তাই জাপানিদের কাছে এটি কোনো ঐশ্বরিক পথ নয়, বরং এটি জাপানি হওয়ারই একটি সামাজিক ব্যাকরণ।
পরিবেশগত দর্শনের জায়গা থেকেও শিন্তোকে আবেগবর্জিতভাবে দেখা প্রয়োজন। শিন্তো প্রকৃতিকে ‘পবিত্র’ বলে ঘোষণা করেছে ঠিকই, কিন্তু এর মূলে রয়েছে আদিম সর্বপ্রাণবাদ (Animism), যা বলে মানুষ প্রকৃতির মালিক বা মাস্টার (Master) নয়, বরং সে প্রকৃতির এক নগণ্য অংশীদার। আজকের জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে এই দর্শনটি প্রাসঙ্গিক হতে পারে, তবে শিন্তোকে কেবল একটি ‘পরিবেশবাদী ধর্ম’ বললে ভুল হবে। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, এই একই ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে বন কেটেছে বা পাহাড় কেটে শিল্পায়ন করেছে। তবে তাত্ত্বিকভাবে, গাছ, পাথর ও নদীর প্রতি শিন্তোর যে সম্মানবোধ, তা আধুনিক কনজ্যুমারিজম বা ভোগবাদের লাগাম টানার জন্য একটি বিকল্প চিন্তাধারা বা অল্টারনেটিভ প্যারাডাইম (Alternative Paradigm) হতে পারে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা একটি বিশাল বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম (Ecosystem)-এর অন্তর্গত, এবং প্রকৃতির সাথে আমাদের সম্পর্কটি হওয়া উচিত পারস্পরিক আদান-প্রদানের, শোষণের নয়। এই বোধটি কোনো নৈতিকতা থেকে আসে না, আসে টিকে থাকার আদিম প্রবৃত্তি থেকে।
পরিশেষে, আধুনিক জাপানে শিন্তোর অবস্থান বিচার করলে দেখা যায়, এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরিপূরক। জাপানি সমাজ দেখিয়েছে যে, মানুষ একই সাথে যুক্তিবাদী এবং আচার-সর্বস্ব হতে পারে। রোবট বা রকেটের যুগেও যে তারা পকেটে ওমামোরি (Omamori) বা রক্ষাকবচ রাখে, তা তাদের অন্ধবিশ্বাস নয়, বরং এটি অনিশ্চয়তাকে মোকাবেলা করার একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল বা কোপিং মেকানিজম (Coping Mechanism)। কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই, কোনো মিশনারি তৎপরতা নেই, কোনো কঠোর অনুশাসন নেই – তবুও শিন্তো টিকে আছে, কারণ এটি জাপানি জাতির অবচেতন মনের গভীরে প্রোথিত এক সাংস্কৃতিক ডিএনএ, যা তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে এক অদৃশ্য সুতোয় গেঁথে রেখেছে।
তথ্যসূত্র
- Allison, A. (2006). Millennial Monsters: Japanese Toys and the Global Imagination. University of California Press.
- Ama, T. (2005). Why Are the Japanese Non-Religious? Japanese Spirituality: Being Non-Religious in a Religious Culture. University Press of America.
- Ambros, B. (2015). Women in Japanese Religions. New York University Press.
- Ashkenazi, M. (1993). Matsuri: Festivals of a Japanese Town. University of Hawaii Press.
- Aston, W. G. (Trans.). (1896). Nihongi: Chronicles of Japan from the Earliest Times to A.D. 697. Tuttle Publishing.
- Blacker, C. (1975). The Catalpa Bow: Essays on Shamanistic Folk Practices in Japan. George Allen & Unwin.
- Bocking, B. (1997). A Popular Dictionary of Shinto. Routledge.
- Bowring, R. (2005). The Religious Traditions of Japan: 500-1600. Cambridge University Press.
- Boyd, J. W., & Nishimura, T. (2016). Shinto Perspectives in Miyazaki’s Anime Sketches. Journal of Religion and Popular Culture, 28(3).
- Breen, J. (1996). The Imperial Oath of April 1868: Ritual, Power, and Politics in Restoration Japan. Monumenta Nipponica, 51(4).
- Breen, J., & Teeuwen, M. (2010). A New History of Shinto. Wiley-Blackwell.
- Cali, J., & Dougill, J. (2013). Shinto Shrines: A Guide to the Sacred Sites of Japan’s Ancient Religion. University of Hawaii Press.
- Chamberlain, B. H. (Trans.). (1882). The Kojiki: Records of Ancient Matters. Tuttle Publishing.
- Douglas, M. (1966). Purity and Danger: An Analysis of Concepts of Pollution and Taboo. Routledge.
- Faure, B. (2015). Protectors and Predators: Gods of Medieval Japan. University of Hawaii Press.
- Fridell, W. M. (1973). Japanese Shrine Mergers, 1906-12: State Shinto Moves to the Countryside. Sophia University.
- Grapard, A. G. (1992). The Protocol of the Gods: A Study of the Kasuga Cult in Japanese History. University of California Press.
- Hardacre, H. (1989). Shinto and the State, 1868-1988. Princeton University Press.
- Hardacre, H. (2017). Shinto: A History. Oxford University Press.
- Hearn, L. (1904). Japan: An Attempt at Interpretation. Macmillan.
- Heldt, G. (Trans.). (2014). The Kojiki: An Account of Ancient Matters. Columbia University Press.
- Holtom, D. C. (1922). The Political Philosophy of Modern Shinto: A Study of the State Religion of Japan. Asiatic Society of Japan.
- Kalland, A. (2002). Holism and Sustainability: Lessons from Japan. In Encyclopedia of Global Environmental Change. Wiley.
- Kasulis, T. P. (2004). Shinto: The Way Home. University of Hawaii Press.
- Kawahashi, N. (1995). Jizoku (Priests’ Wives) in Soto Zen Buddhism: An Ambiguous Category. Japanese Journal of Religious Studies, 22(1-2).
- Ketelaar, J. E. (1990). Of Heretics and Martyrs in Meiji Japan: Buddhism and Its Persecution. Princeton University Press.
- Kitagawa, J. M. (1987). On Understanding Japanese Religion. Princeton University Press.
- Kuroda, T. (1981). Shinto in the History of Japanese Religion. Journal of Japanese Studies, 7(1).
- Littleton, C. S. (2002). Shinto: Origins, Rituals, Festivals, Spirits, Sacred Places. Oxford University Press.
- Namiki, K. (2018). Kegare: The Japanese Concept of Pollution and Impurity. Japan Publishing Industry Foundation for Culture.
- Napier, S. J. (2005). Anime from Akira to Howl’s Moving Castle: Experiencing Contemporary Japanese Animation. Palgrave Macmillan.
- Nelson, J. K. (1996). A Year in the Life of a Shinto Shrine. University of Washington Press.
- Nelson, J. K. (2000). Enduring Identities: The Guise of Shinto in Contemporary Japan. University of Hawaii Press.
- Ohnuki-Tierney, E. (2002). Kamikaze, Cherry Blossoms, and Nationalisms: The Militarization of Aesthetics in Japanese History. University of Chicago Press.
- Okano, H. (1993). Women’s Image in Japanese Religions. In Pacific Friend. Jiji Gaho Sha.
- Ono, S. (1962). Shinto: The Kami Way. Tuttle Publishing.
- Philippi, D. L. (Trans.). (1969). Kojiki. University of Tokyo Press.
- Picken, S. D. B. (1994). Essentials of Shinto: An Analytical Guide to Principal Teachings. Greenwood Press.
- Plutschow, H. E. (1996). Matsuri: The Festivals of Japan. Routledge.
- Rambelli, F. (2001). Buddhist Materiality: A Cultural History of Objects in Japanese Buddhism. Stanford University Press.
- Reader, I. (1991). Religion in Contemporary Japan. University of Hawaii Press.
- Rots, A. P. (2017). Shinto, Nature and Ideology in Contemporary Japan: Making Sacred Forests. Bloomsbury Academic.
- Schnell, S. (1999). The Rousing Drum: Ritual Practice in a Japanese Community. University of Hawaii Press.
- Shimazono, S. (2005). From Salvation to Spirituality: Popular Religious Movements in Modern Japan. Trans Pacific Press.
- Shimazono, S. (2009). State Shinto in the Lives of the People: The State, Shinto, and Religion. Japanese Journal of Religious Studies, 36(2).
- Smyers, K. A. (1999). The Fox and the Jewel: Shared and Private Meanings in Contemporary Japanese Inari Worship. University of Hawaii Press.
- Sueki, F. (2007). Japanese Buddhism: A Cultural History. Kosei Publishing.
- Swanger, E. R. (1981). Omamori: A Preliminary Study of the Production and Use of Charms in Contemporary Japan. Asian Folklore Studies, 40(2).
- Teeuwen, M., & Breen, J. (2017). A Social History of the Ise Shrines: Divine Capital. Bloomsbury Academic.
- Teeuwen, M., & Rambelli, F. (Eds.). (2003). Buddhas and Kami in Japan: Honji Suijaku as a Combinatory Paradigm. Routledge.
- Turnbull, S. (2015). Japan’s Sexual Gods: Shrines, Roles and Rituals of Procreation and Protection. Brill.
- Wright, A., & Clode, J. (2005). Shinto and Anime: The Spirit of Japan. Palgrave Macmillan.
- Yamakage, M. (2006). The Essence of Shinto: Japan’s Spiritual Heart. Kodansha International.

