ধর্ম

ধর্মের প্রকারভেদ (Classification of Religion): বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এক মানবীয় মানচিত্র

Table of Contents

ভূমিকা

মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মহাবিশ্বের অসীম বিশালতা, প্রকৃতির রুদ্ররোষ আর জীবনের নশ্বরতা মানুষকে এক গভীর ও অমীমাংসিত বিস্ময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আদিম গুহাচারী মানুষ যখন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাদের বিন্যাসে নিজের ভাগ্য খুঁজতে চেয়েছে, কিংবা ঝড়ের রাতে অদৃশ্য কোনো শক্তির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছে – তখন থেকেই মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে ‘অতিপ্রাকৃত’-এর ধারণা। এই অদৃশ্য শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের অনিশ্চয়তা, এবং জাগতিক দুঃখ-কষ্টের সান্ত্বনা খোঁজার প্রয়াস থেকেই বিবর্তিত হয়েছে ‘ধর্ম’ নামক এক জটিল ও বহুুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান। ধর্ম কেবল উপাসনা, আচার-অনুষ্ঠান বা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী নয়; এটি মানুষের সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, মনস্তত্ত্ব এবং নৈতিকতার এক অবিচ্ছেদ্য বুনন। এটি একই সাথে ব্যক্তিকে দেয় অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি, আবার সমাজকে বাঁধে সংহতির কঠোর বন্ধনে।

তবে ‘ধর্ম’ শব্দটিকে কোনো একটিমাত্র সংজ্ঞার ফ্রেমে বন্দি করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের সাধারণ ধারণায় ধর্ম বলতে আমরা প্রায়শই একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, কিছু নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ এবং পরকালের বিচারব্যবস্থাকে বুঝি। কিন্তু ধর্মের বিশ্বজনীন মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই ধারণাটি নিতান্তই খণ্ডচিত্র মাত্র। সাইবেরিয়ার বরফাবৃত প্রান্তরে একজন ওঝা যখন আত্মার সাথে কথা বলেন, আমাজনের গহীনে যখন প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে পূজা করা হয়, কিংবা জাপানের কোনো জেন বৌদ্ধ মঠের নিস্তব্ধতায় যখন ঈশ্বরহীন ধ্যানের মাধ্যমে শূন্যতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা চলে – তখন ধর্মের প্রচলিত সংজ্ঞাগুলো ভেঙে পড়ে। কোথাও ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, কোথাও তিনি বহু এবং বিচিত্র, আবার কোথাও ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই – আছে কেবল নৈতিকতা ও আত্মমুক্তির সাধনা।

বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এই বিশাল, বর্ণিল এবং প্রায়শই বিভ্রান্তিকর জগতকে বোঝার জন্যই প্রয়োজন একটি সুশৃঙ্খল তাত্ত্বিক কাঠামোর। জীববিজ্ঞানী যেমন প্রাণীজগতকে বিভিন্ন পর্ব ও শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেন, তেমনি ধর্মতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা মানুষের এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করেছেন। এই নিবন্ধটি ধর্মের সেই তাত্ত্বিক শ্রেণীবিন্যাস বা প্রকারভেদের এক বিস্তারিত অনুসন্ধান। এখানে আমরা ঈশ্বর ধারণার সংখ্যার ভিত্তিতে একেশ্বরবাদ থেকে বহুদেবতাবাদ, ঈশ্বরের প্রকৃতির ভিত্তিতে সর্বেশ্বরবাদ থেকে সর্বপ্রাণবাদ, এবং সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তিতে চার্চ থেকে কাল্ট বা লোকধর্ম – এমন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মকে বিশ্লেষণ করব। একইসাথে আমরা দেখব আধুনিক যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে কীভাবে সনাতন বিশ্বাসের রূপ বদলে গিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘আধ্যাত্মিক কিন্তু ধার্মিক নয়’-এর মতো নতুন ধারণা। এটি কেবল ধর্মের তালিকা নয়, বরং মানুষের চেতনার বিবর্তনের এক বুদ্ধিবৃত্তিক মানচিত্র।

ধর্মের প্রাথমিক প্রকারভেদ: ঈশ্বর ধারণার রকমফের

ধর্ম বলতেই আমাদের মনে যে দাড়িওয়ালা, সিংহাসনে বসা একজন একেশ্বরবাদী ঈশ্বরের ধারণা আসে, সেটি আসলে বিশ্বাসের বিশাল বর্ণালীর একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃত সত্তার ধারণা এবং মহাবিশ্বের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে ধর্মগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলো তাত্ত্বিক আলোচনার সুবিধার্থে তৈরি, বাস্তবে অনেক ধর্মই একাধিক বিভাগের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এই সীমানাগুলো প্রায়শই অস্পষ্ট ও চলমান।

ঈশ্বর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে (Based on the Number of Gods):

ঈশ্বরের সংখ্যা সম্ভবত ধর্মকে শ্রেণীবদ্ধ করার সবচেয়ে প্রাচীন এবং সহজবোধ্য উপায়। মানুষের মন যখনই অতিপ্রাকৃত জগৎ নিয়ে ভেবেছে, তখনই তাকে এই মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে – শক্তি কি এক, নাকি বহু? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বিশ্বাসের বিচিত্র সব কাঠামো।

একেশ্বরবাদ (Monotheism): এক এবং অদ্বিতীয়ের ধারণা

একেশ্বরবাদ হলো সেই বিশ্বাস ব্যবস্থা যেখানে শুধুমাত্র একজন, এবং কেবল একজন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। এই ঈশ্বরকে সাধারণত সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে দেখা হয়। একেশ্বরবাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী উদাহরণ হলো মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নেওয়া তিনটি ধর্ম, যা একত্রে আব্রাহামিক ধর্ম (Abrahamic Religions) নামে পরিচিত: ইহুদিধর্ম (Judaism), খ্রিস্টধর্ম (Christianity) এবং ইসলাম (Islam)। এছাড়াও শিখধর্ম (Sikhism) এবং বাহাই বিশ্বাসও (Baháʼí Faith) কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী। এই ধর্মগুলোতে ঈশ্বরকে একজন ব্যক্তি-সত্তা (Personal God) হিসেবে কল্পনা করা হয়, যিনি মানুষের প্রার্থনা শোনেন, ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করেন এবং ভালো-মন্দের বিচার করেন।

ঐতিহাসিকভাবে, কঠোর একেশ্বরবাদের উত্থান মানব সভ্যতার জন্য একটি বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল। জার্মান দার্শনিক কার্ল ইয়াসপার্স (Karl Jaspers) খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে ২০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়কালকে ‘অক্ষীয় যুগ’ (Axial Age) বলে অভিহিত করেছেন, যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে (চীন, ভারত, পারস্য, গ্রিস, ইসরায়েল) মানব চেতনার এক অভূতপূর্ব উল্লম্ফন ঘটেছিল (Jaspers, 1953)। এই যুগেই পারস্যে জরাথুস্ট্র, ভারতে বুদ্ধ, মহাবীর, উপনিষদের ঋষিদের এবং ইসরায়েলে একেশ্বরবাদী নবীদের আবির্ভাব ঘটে, যারা প্রচলিত পৌরাণিক ও বহুদেবতাবাদী বিশ্ববীক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

একেশ্বরবাদী ঈশ্বরের চরিত্র প্রায়শই কয়েকটি নির্দিষ্ট দার্শনিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়:

  • সর্বশক্তিমান (Omnipotent): তাঁর ক্ষমতার কোনো সীমা নেই।
  • সর্বজ্ঞ (Omniscient): তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছু জানেন।
  • সর্বব্যাপী (Omnipresent): তিনি একই সাথে সর্বত্র বিরাজমান।
  • পরম করুণাময় (Omnibenevolent): তিনি চূড়ান্তভাবে ভালো এবং নৈতিকতার উৎস।
  • অতীন্দ্রিয় (Transcendent): তিনি এই ভৌত জগতের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। তিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে সেই জগতের অংশ নন।
  • ব্যক্তি-সদৃশ (Personal): তিনি কোনো বিমূর্ত শক্তি নন, বরং তাঁর নিজস্ব ইচ্ছা, চেতনা এবং ব্যক্তিত্ব রয়েছে। তিনি মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং নবীদের মাধ্যমে তাদের পথ দেখান।

এই গুণাবলীগুলো একত্রিত হয়ে একটি গভীর দার্শনিক সমস্যার জন্ম দেয়, যা ‘অশুভের সমস্যা’ (The Problem of Evil) বা থিওডিসি (Theodicy) নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাসের নামে প্রচলিত যুক্তিটি হলো: ঈশ্বর যদি অশুভ দূর করতে ইচ্ছুক হন কিন্তু সক্ষম না হন, তবে তিনি সর্বশক্তিমান নন। তিনি যদি সক্ষম হন কিন্তু ইচ্ছুক না হন, তবে তিনি পরম করুণাময় নন। তিনি যদি সক্ষম এবং ইচ্ছুক উভয়ই হন, তবে পৃথিবীতে অশুভের অস্তিত্ব কেন? আর তিনি যদি সক্ষমও না হন এবং ইচ্ছুকও না হন, তবে তাঁকে ঈশ্বর বলার দরকার কী? এই প্রশ্নটি হাজার হাজার বছর ধরে একেশ্বরবাদী ধর্মতাত্ত্বিকদের ভাবিয়েছে এবং এর জবাবে অগণিত গ্রন্থ রচিত হয়েছে (Hick, 1966)।

একেশ্বরবাদের দুটি প্রধান রূপ দেখা যায়:

  • একচেটিয়া একেশ্বরবাদ (Exclusive Monotheism): এই মতানুযায়ী, কেবল একজন ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব আছে এবং অন্য কোনো দেবতার অস্তিত্বকে স্বীকার করা বা তাদের পূজা করা একটি গুরুতর পাপ বা শিরকআব্রাহামিক ধর্মগুলো এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে প্রায়শই অন্য দেবতাদের উপাসনার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এই ‘একমাত্র সত্যের দাবি’ একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রচারমুখী (Proselytizing) করে তুলেছে। তবে, এই বর্জনশীলতার একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, এই দাবি প্রায়শই অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ এবং ধর্মযুদ্ধের (Crusades, Jihads) জন্ম দিয়েছে।
  • সমন্বয়ী একেশ্বরবাদ (Inclusive Monotheism): এই মতবাদে একজন পরম ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়, কিন্তু অন্যান্য দেবতাদের সেই এক ঈশ্বরেরই বিভিন্ন রূপ বা প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়। কিছু হিন্দু ধর্মতত্ত্ব, যেমন – স্মার্ত ঐতিহ্য বা বৈষ্ণব দর্শনের কিছু ধারা, এই চিন্তার কাছাকাছি। তারা মনে করে, বিভিন্ন নামে ও রূপে যে দেবতাদের পূজা করা হয়, তা শেষ পর্যন্ত এক পরম সত্তার কাছেই পৌঁছায়।

একেশ্বরবাদের উত্থানকে মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বাঁক হিসেবে দেখা হয়। কারেন আর্মস্ট্রং (Karen Armstrong) তার A History of God (1993) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে একেশ্বরবাদের ধারণা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। এটি প্রায়শই বহুইশ্বরবাদী দেবতাদের ক্রমবর্ধমান বিমূর্তায়ন এবং একীকরণের মাধ্যমে ঘটেছে। যেমন, মিশরীয় ফারাও আখেনাতেন (Akhenaten) খ্রিস্টপূর্ব ১৪শ শতকে সূর্যদেবতা আতেনকে (Aten) একমাত্র উপাস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটি ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, যা ইতিহাসের প্রথম একেশ্বরবাদী বিপ্লবগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। একেশ্বরবাদ বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্থানীয়, উপজাতীয় দেবতাদের ধারণাকে ছাপিয়ে একটি সার্বজনীন, বিমূর্ত এবং নৈতিক ঈশ্বরের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে, যা সাম্রাজ্য গঠন এবং বিভিন্ন জাতিকে একীভূত করার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভাবাদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

বহুদেবতাবাদ (Polytheism): দেবতাদের বর্ণময় জগৎ

বহুদেবতাবাদ হলো একাধিক দেব-দেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস। একেশ্বরবাদের উত্থানের পূর্বে এটিই ছিল মানব সমাজের সাধারণ বিশ্বাস। প্রাচীন গ্রিস, রোম, মিশর, মেসোপটেমিয়া, নর্ডিক দেশসমূহ এবং প্রি-কলাম্বিয়ান আমেরিকার ধর্মগুলো সবই ছিল বহুদেবতাবাদী। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় বহুদেবতাবাদী ধর্ম হলো হিন্দুধর্ম (Hinduism), যদিও এর ভেতরে একেশ্বরবাদী এবং সর্বেশ্বরবাদী ধারাও প্রবলভাবে বিদ্যমান। জাপানের শিন্তো (Shinto) ধর্মও বহুদেবতাবাদী, যেখানে অগণিত প্রাকৃতিক শক্তি বা ‘কামি’ (Kami)-কে পূজা করা হয়।

বহুদেবতাবাদী দেবমণ্ডলী বা প্যান্থিয়ন (Pantheon) প্রায়শই একটি রাজকীয় দরবার বা একটি বিশাল পরিবারের মতো কাঠামোবদ্ধ থাকে। সেখানে দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার একটি স্তরবিন্যাস (Hierarchy) থাকে। যেমন, গ্রিক প্যান্থিয়নের প্রধান ছিলেন জিউস, ঠিক যেমন নর্ডিক প্যান্থিয়নের প্রধান ছিলেন ওডিন। এই প্রধান দেবতারা প্রায়শই ‘আকাশ-পিতা’ (Sky Father) হন, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী সংস্কৃতিগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য (যেমন: সংস্কৃত ‘দ্যৌষ-পিতৃ’, গ্রিক ‘জিউস pater’, ল্যাটিন ‘জুপিটার’)।

বহুদেবতাবাদী দেবতারা সাধারণত একেশ্বরবাদী ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান বা সর্বজ্ঞ হন না। তারা শক্তিশালী, কিন্তু তাদের ক্ষমতা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। জিউস বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, কিন্তু সমুদ্রের উপর তার কোনো কর্তৃত্ব ছিল না – সেটি ছিল তার ভাই পসাইডনের এলাকা। দেবতারা অমর, কিন্তু তাদের মধ্যে মানুষের মতোই আবেগ – ভালোবাসা, ঘৃণা, ঈর্ষা, ক্রোধ, লালসা – বিদ্যমান। তাদের গল্পগুলো প্রায়শই নাটকীয়তায় পূর্ণ থাকে, যা মানুষের জীবনেরই এক মহাজাগতিক প্রতিফলন। প্লেটোর (Plato) মতো দার্শনিকরা এই কারণে হোমারের দেবতাদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তাদের আচরণ মানুষের জন্য কোনো নৈতিক আদর্শ স্থাপন করতে পারত না (Plato, Republic, Book II)।

বহুদেবতাবাদী ধর্মগুলোতে মানুষের সাথে দেবতাদের সম্পর্ক ছিল মূলত চুক্তিভিত্তিক বা লেনদেনমূলক (do ut des – ‘আমি দিচ্ছি যাতে তুমিও দাও’)। সঠিক আচার-অনুষ্ঠানবলিদানের মাধ্যমে দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তারা মানুষের জীবনে কৃপা করবেন বলে বিশ্বাস করা হতো। এই কারণে বহুদেবতাবাদী ধর্মগুলো সাধারণত একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সমন্বয়বাদী (Syncretic) এবং সহনশীল হয়। যখন দুটি বহুদেবতাবাদী সংস্কৃতির সাক্ষাৎ হয়, তখন তারা একে অপরের দেবতাদের সহজেই গ্রহণ করে নিতে পারে। রোমানরা যখন গ্রিকদের সংস্পর্শে আসে, তারা তাদের নিজেদের দেবতা জুপিটারকে গ্রিক জিউসের সাথে, মার্সকে এরিসের সাথে এবং ভেনাসকে অ্যাফ্রোদিতির সাথে এক করে নেয়। মিশরীয় দেবী আইসিসের পূজা রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। নতুন কোনো দেবতাকে নিজেদের প্যান্থিয়নে জায়গা করে দিতে তাদের বিশেষ কোনো দার্শনিক বাধা থাকে না।

হিন্দুধর্মকে (Hinduism) প্রায়শই বহুইশ্বরবাদী বলা হয়, কারণ এখানে অনেক দেব-দেবীর পূজা করা হয়। তবে এই শ্রেণীবিন্যাসটি অতি সরলীকরণ। অনেক হিন্দু দার্শনিক মনে করেন, এই বিভিন্ন দেব-দেবী আসলে এক পরম, নিরাকার সত্তা ব্রহ্মের (Brahman) বিভিন্ন সাকার রূপ। তাই হিন্দুধর্মের এই দিকটি বেশ জটিল এবং একে এক ধরনের বহুরূপী একেশ্বরবাদ (Polymorphic Monotheism) বা একেশ্বরোপাসনাও (Henotheism) বলা যেতে পারে।

সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism): সমগ্র অস্তিত্বই ঈশ্বর

সর্বেশ্বরবাদ একটি গভীর দার্শনিক অবস্থান, যা প্রচলিত ঈশ্বর-ভাবনা থেকে আমূল ভিন্ন। এই মতানুসারে, ঈশ্বর কোনো ব্যক্তি-সদৃশ সত্তা নন যিনি মহাবিশ্বের বাইরে থেকে একে পুতুলের মতো পরিচালনা করছেন। বরং, সমগ্র মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর অভিন্ন (God is the Universe and the Universe is God)। এই চেয়ার, টেবিল, গাছপালা, নক্ষত্র, ছায়াপথ, এবং আমরা নিজেরা – এই সবকিছু মিলেই সেই এক ঐশ্বরিক সত্তা। এখানে ঈশ্বর এবং প্রকৃতি সমার্থক। সর্বেশ্বরবাদে, ঈশ্বর প্রার্থনা শোনেন না বা অলৌকিক ঘটনা ঘটান না; মহাবিশ্বের অপরিবর্তনীয় নিয়মকানুনগুলোই হলো ঈশ্বর।

পশ্চিমা দর্শনে, ওলন্দাজ দার্শনিক বারুখ স্পিনোজা (Baruch Spinoza) ছিলেন সর্বেশ্বরবাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রবক্তা। স্পিনোজা ঈশ্বরকে বলতেন ‘Deus sive Natura’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বর অথবা প্রকৃতি’। তাঁর মতে, মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক নিয়মকানুনগুলোই হলো ঈশ্বরের শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় ইচ্ছা। এখানে অলৌকিকতার কোনো স্থান নেই, কারণ প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কোনো কিছুই ঘটতে পারে না (Spinoza, 1677/1996)। আলবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein) প্রায়শই বলতেন যে তিনি আব্রাহামিক ধর্মের ব্যক্তি-সদৃশ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, বরং তিনি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, “যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন অস্তিত্বের সুশৃঙ্খল সামঞ্জস্যের মধ্যে, মানুষের ভাগ্য এবং কার্যকলাপ নিয়ে চিন্তিত কোনো ঈশ্বরে নয়।” প্রাচীন স্টোয়িক (Stoic) দর্শনেও একই ধরনের ধারণা পাওয়া যায়, যেখানে বিশ্বাস করা হতো যে সমগ্র মহাবিশ্ব এক ঐশ্বরিক যুক্তি বা লোগোস (Logos) দ্বারা পরিব্যাপ্ত এবং মানুষের লক্ষ্য হলো এই মহাজাগতিক যুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করা।

হিন্দুধর্মের অদ্বৈত বেদান্ত (Advaita Vedanta) দর্শনেও সর্বেশ্বরবাদের শক্তিশালী অনুরণন পাওয়া যায়। আদি শঙ্করাচার্য প্রচারিত এই দর্শন অনুযায়ী, একমাত্র সত্য বা বাস্তব সত্তা হলো ব্রহ্ম (Brahman)। আমাদের চোখের সামনের এই জগৎ এবং আমাদের পৃথক ‘আমি’ বা আত্মা (Atman) আসলে মায়ার (Illusion) কারণে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। জ্ঞান লাভের মাধ্যমে যখন এই মায়ার আবরণ সরে যায়, তখন সাধক উপলব্ধি করেন যে ‘আত্মা’ এবং ‘ব্রহ্ম’ আদতে অভিন্ন। ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ (আমিই ব্রহ্ম) বা ‘তত্ত্বমসি’ (তুমিই সেই) – এই মহাবাক্যগুলো সেই চূড়ান্ত অদ্বৈত উপলব্ধিরই প্রকাশ। তাওবাদ এবং কিছু বৌদ্ধ দর্শনেও সর্বেশ্বরবাদী চিন্তার অনুরণন পাওয়া যায়।

সর্বাত্মবাদ বা প্যানএনথেইজম (Panentheism): জগৎ ঈশ্বরে, কিন্তু ঈশ্বর জগতের ঊর্ধ্বে

এই ধারণাটি সর্বেশ্বরবাদের (Pantheism) একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিমার্জিত রূপ। যদি সর্বেশ্বরবাদ বলে যে ‘মহাবিশ্বই ঈশ্বর’, তবে সর্বাত্মবাদ বলে যে, ‘সমগ্র মহাবিশ্ব ঈশ্বরের মধ্যে অবস্থিত, কিন্তু ঈশ্বর কেবল এই মহাবিশ্বেই সীমাবদ্ধ নন’ (All is in God, but God is more than the All)। এর অর্থ হলো ‘সর্ব-ঈশ্বরের-মধ্যে’ (All-in-God)।

একটি সহজ উপমা দিয়ে বোঝা যেতে পারে। ধরুন, ঈশ্বর হলেন একটি অসীম মহাসাগর, আর মহাবিশ্ব হলো সেই মহাসাগরের মধ্যে ভাসমান একটি স্পঞ্জ। স্পঞ্জটি জল দিয়ে পরিপূর্ণ এবং জলের মধ্যেই অবস্থিত, অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা ঐশ্বরিক সত্তায় পূর্ণ (Immanent)। কিন্তু মহাসাগরটি স্পঞ্জের বাইরেও অসীমভাবে বিস্তৃত, অর্থাৎ ঈশ্বর এই মহাবিশ্বের ঊর্ধ্বেও বিরাজমান (Transcendent)।

এই ধারণাটি একই সাথে ঈশ্বরের অসীমতা এবং জগতের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এটি সর্বেশ্বরবাদের এই সমস্যাকে এড়াতে চায় যে, যদি জগৎই ঈশ্বর হয়, তাহলে জগতের মধ্যেকার মন্দ বা অসম্পূর্ণতাও ঈশ্বরের অংশ হয়ে যায়। প্যানএনথেইজমে, জগৎ ঈশ্বরের অংশ হলেও, ঈশ্বরের সামগ্রিক সত্তা জগতের অসম্পূর্ণতা দ্বারা সীমিত নয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রসেস থিওলজি (Process Theology), যা দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড (Alfred North Whitehead) এবং চার্লস হার্টশর্ন (Charles Hartshorne)-এর কাজের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, প্যানএনথেইজমের একটি প্রভাবশালী রূপ। এই দর্শন অনুযায়ী, ঈশ্বর স্থির ও অপরিবর্তনীয় নন, বরং তিনি মহাবিশ্বের সাথে একটি গতিশীল ও সৃজনশীল সম্পর্কে আবদ্ধ। ঈশ্বর এবং জগৎ একে অপরকে ক্রমাগত প্রভাবিত করে চলেছে (Hartshorne, 1967)।

হেনোথেইজম (Henotheism): মুহূর্তের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ

এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জার্মান ভারততত্ত্ববিদ এবং ধর্মতত্ত্ববিদ ম্যাক্স মুলার (Max Müller), মূলত প্রাচীন ভারতের বৈদিক ধর্মকে ব্যাখ্যা করার জন্য। হেনোথেইজম হলো এমন একটি বিশ্বাস যেখানে একাধিক দেবতার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করা হয়, কিন্তু উপাসনার মুহূর্তে একজন নির্দিষ্ট দেবতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ, এমনকি একমাত্র কার্যকর দেবতা হিসেবে স্তুতি করা হয়।

হেনোথেইজমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর পরিস্থিতি-নির্ভর (Situational) বা পরিবর্তনশীল শ্রেষ্ঠত্ব। উপাসক যখন বৃষ্টির জন্য ইন্দ্রের স্তুতি করছেন, তখন ইন্দ্রই তার কাছে মহাবিশ্বের অধিপতি। আবার যখন তিনি আগুনের কাছে প্রার্থনা করছেন, তখন অগ্নিই হয়ে ওঠেন দেবতাদের মধ্যে প্রধান। এটি অনেকটা একটি বড় কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের মতো; যখন আপনি মার্কেটিং বিভাগে যাবেন, তখন সেখানকার প্রধানই আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আপনি ফাইন্যান্স বা এইচআর বিভাগের প্রধানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন।

মুলার ঋগ্বেদের সূক্তগুলো বিশ্লেষণ করে এই প্রবণতাটি লক্ষ্য করেন। একটি নির্দিষ্ট সূক্তে একজন দেবতাকে (যেমন – ইন্দ্র, বরুণ বা অগ্নি) এমনভাবে প্রশংসা করা হয়েছে যেন তিনিই একমাত্র সর্বশক্তিমান সত্তা, যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং অন্য সব দেবতাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিন্তু ঠিক পরের সূক্তেই হয়তো আরেকজন দেবতাকে একই ধরনের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। এই আপাত স্ববিরোধিতাকেই মুলার “হেনোথেইজম” বা “ক্যাথেনোথেইজম” (Kathenotheism – একবারে একজন দেবতার উপাসনা) বলে অভিহিত করেন (Müller, 1878)। এটি একটি সমন্বয়বাদী এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিভিন্ন দেবতার গুরুত্বকে স্বীকার করে নেয়, কারণ এখানে কোনো একজন দেবতার প্রতি স্থায়ী আনুগত্য নেই।

মনোলেট্রি (Monolatry): আমাদের জন্য কেবল একজন

মনোলেট্রি বা একেশ্বরপূজা হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে অনেক দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা হলেও, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতি শুধুমাত্র একজন দেবতাকে পূজা করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে।

মনোলেট্রি হেনোথেইজমের মতো পরিবর্তনশীল নয়। এখানে একজন দেবতাকে স্থায়ীভাবে নিজেদের ‘জাতীয়’ বা ‘গোষ্ঠীর’ দেবতা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এবং তার প্রতি একচ্ছত্র আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়। অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর দেবতাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় না, কিন্তু তাদের পূজা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, কারণ তা নিজেদের দেবতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হয়। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার চেয়ে আনুগত্য এবং চুক্তির (Covenant) ধারণাটিই প্রধান।

প্রাচীন ইসরায়েলের প্রাথমিক ইহুদিদের ধর্মকে মনোলেট্রিজমের সর্বোত্তম উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের অনেক অংশে (বিশেষ করে এক্সোডাস থেকে বিচারকদের বিবরণ বা বুক অফ জাজেস পর্যন্ত) দেখা যায়, ইসরায়েলীয়রা ইয়াহওয়েকে (Yahweh) নিজেদের একমাত্র উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, যিনি তাদের মিশর থেকে উদ্ধার করেছেন এবং তাদের সাথে একটি বিশেষ চুক্তি করেছেন। বিখ্যাত ‘টেন কমান্ডমেন্টস’-এর প্রথম আজ্ঞাটি হলো, “Thou shalt have no other gods before me” (আমার আগে তোমার আর কোনো দেবতা থাকবে না) – এখানে ‘অন্যান্য দেবতা’-র অস্তিত্বকে স্বীকার করেই তাদের উপাসনা করতে নিষেধ করা হচ্ছে। তারা যখন কেনানীয় দেবতা বাল (Baal) বা দেবী আশেরার (Asherah) পূজা করতো, তখন তাকে ‘ব্যভিচার’ বা চুক্তিভঙ্গ হিসেবে দেখা হতো। বাইবেল বিষয়ক পণ্ডিত মার্ক এস. স্মিথের (Mark S. Smith) মতে, প্রাচীন ইসরায়েলের ধর্ম ধীরে ধীরে মনোলেট্রি থেকে একেশ্বরবাদের দিকে বিবর্তিত হয়েছে, বিশেষ করে ব্যাবিলনীয় নির্বাসনের (Babylonian Exile) সময়কালে যখন জাতীয় পরিচয় রক্ষার জন্য ইয়াহওয়েকে একমাত্র বিশ্বজনীন ঈশ্বরে রূপান্তরিত করার প্রয়োজন দেখা দেয় (Smith, 2002)।

হেনোথিজমের সাথে মনোলেট্রির তুলনা করলে বলতে হয়, হেনোথেইজম হলো পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেবতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া, আর মনোলেট্রি হলো স্থায়ীভাবে এক দেবতার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে অন্য দেবতাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করা। দুটোই বিশ্বাসের ইতিহাসে বহুদেবতাবাদ থেকে একেশ্বরবাদের দিকে যাত্রার গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

ঈশ্বরহীন বা নিরীশ্বরবাদী ধর্ম (Non-theistic Religions): ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতে মুক্তির সন্ধান

‘ধর্ম’ শব্দটি শুনলেই সাধারণত আমাদের মনে একজন স্রষ্টা ঈশ্বরের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু বিশ্বাসের বর্ণালী এতটাই বিচিত্র যে, এমন অনেক প্রভাবশালী ধর্ম ও দর্শন রয়েছে যেখানে কোনো সর্বশক্তিমান স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণা কেন্দ্রীয় নয়, বা পুরোপুরি অনুপস্থিত। এই ধর্মগুলোকে নিরীশ্বরবাদী (Non-theistic) বলা হয়। এরা অতিপ্রাকৃত সত্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন না করে বরং মানবীয় প্রচেষ্টা, নৈতিকতা, দর্শন, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং আত্ম-মুক্তির উপর সর্বোচ্চ জোর দেয়।

বৌদ্ধধর্ম (Buddhism): প্রজ্ঞা ও করুণার পথ

বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তি হলো খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতমের শিক্ষা, যিনি ‘বুদ্ধ‘ বা ‘আলোকিতজন’ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম, যার নিজস্ব সৃষ্টিতত্ত্ব, নৈতিকতা এবং মুক্তির পথ রয়েছে, কিন্তু এর কেন্দ্রে কোনো স্রষ্টা ঈশ্বর নেই।

  • ঈশ্বরের অনুপস্থিতি: বৌদ্ধধর্মে কোনো সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণা পাওয়া যায় না। বুদ্ধকে যখন মহাবিশ্বের উৎপত্তি বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তিনি এই প্রশ্নগুলোকে ‘অব্যাখ্যাত’ (Unexplained Questions) বলে এড়িয়ে যেতেন। তার বিখ্যাত ‘বিষাক্ত তীরের উপমা’ (Parable of the Poisoned Arrow) দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন: একজন মানুষ যদি বিষাক্ত তীরে বিদ্ধ হয়, তবে তার প্রথম কাজ হলো তীরটি বের করে চিকিৎসা করা, নাকি কে তীর ছুড়েছে, তার জাত কী, তীরটি কী দিয়ে তৈরি – এইসব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করা? তেমনি, মানব জীবনের মূল সমস্যা হলো দুঃখ (Dukkha), এবং আমাদের কাজ হলো সেই দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করে তা দূর করা, মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে অহেতুক জল্পনা-কল্পনা করা নয় (Rahula, 1959)।
  • মহাবিশ্বের ধারণা: বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী, মহাবিশ্ব অনাদি এবং অন্তহীন কার্যকারণ চক্র (Cycle of Cause and Effect) বা প্রতীত্যসমুৎপাদ (Pratītyasamutpāda) দ্বারা চালিত। এখানে কোনো কিছুই শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না বা পুরোপুরি ধ্বংস হয় না, সবকিছুই পূর্ববর্তী কারণের ফল এবং পরবর্তী ঘটনার কারণ।
  • মুক্তির পথ: বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হলো জীবনের চারটি আর্য সত্য (Four Noble Truths) অনুধাবন করা: (১) জীবনে দুঃখ আছে, (২) দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা বা আসক্তি (Taṇhā), (৩) এই দুঃখ দূর করা সম্ভব, এবং (৪) দুঃখ দূর করার পথ হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ (Noble Eightfold Path) অনুসরণ করা। এই পথটি হলো নৈতিকতা (Sīla), ধ্যান (Samādhi), এবং প্রজ্ঞা (Prajñā)-র একটি সমন্বিত অনুশীলন। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নির্বাণ (Nirvana) বা পরম মুক্তি লাভ করা, যা হলো সকল তৃষ্ণা, ঘৃণা এবং অজ্ঞতার নির্বাপণ। এটি ঈশ্বরের কৃপার উপর নির্ভরশীলতা নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং প্রজ্ঞার পথ।
  • দেবতাদের অবস্থান: বৌদ্ধধর্মে দেবতাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় না। বৌদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বে বিভিন্ন স্বর্গ এবং দেবতাদের (Devas) বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এই দেবতারা স্রষ্টা নন এবং তারা সর্বশক্তিমানও নন। তারাও কর্মের নিয়মের অধীন এবং তাদেরও পুনর্জন্ম হয়। মানুষের চেয়ে তাদের জীবন দীর্ঘ এবং সুখময় হতে পারে, কিন্তু তারাও নির্বাণ লাভ করেনি এবং তাই মুক্তির দিক থেকে তারা মানুষের চেয়ে উন্নত নয়। মহাযান বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্বদের (Bodhisattvas) মতো প্রায়-ঐশ্বরিক সত্তার ধারণা রয়েছে, কিন্তু তারা স্রষ্টা নন, বরং করুণার মূর্ত প্রতীক যারা নিজেরা নির্বাণ লাভের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও অন্য সকল জীবের মুক্তির জন্য এই সংসারে ফিরে আসেন।

জৈনধর্ম (Jainism): অহিংসা ও আত্মার শুদ্ধি

জৈনধর্ম ভারতের একটি প্রাচীন ধর্ম, যা বৌদ্ধধর্মেরও সমসাময়িক বা সম্ভবত তার চেয়েও পুরনো। এটিও একটি কঠোরভাবে নিরীশ্বরবাদী ধর্ম।

  • স্রষ্টার প্রত্যাখ্যান: জৈনধর্ম দ্ব্যর্থহীনভাবে একজন স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের যুক্তি হলো, একজন নিখুঁত এবং অপরিবর্তনীয় সত্তা (ঈশ্বর) কোনো কিছু সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করতে পারেন না, কারণ ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা একটি অপূর্ণতার লক্ষণ। মহাবিশ্ব শাশ্বত এবং এর কোনো শুরু বা শেষ নেই।
  • মহাবিশ্বের গঠন: এটি ছয়টি শাশ্বত পদার্থ (Six Dravyas) দ্বারা গঠিত: জীব (আত্মা), পুদ্গল (বস্তু), ধর্ম (গতির মাধ্যম), অধর্ম (স্থিতির মাধ্যম), আকাশ (স্থান), এবং কাল (সময়)। এই পদার্থগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলেই মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক নিয়মে চালিত হয়।
  • মুক্তির পথ: জৈনধর্মের মূল লক্ষ্য হলো আত্মার শুদ্ধি এবং কর্মের (Karma) বন্ধন থেকে মুক্তি (মোক্ষ) লাভ করা। জৈন দর্শনে, কর্মকে কেবল কাজের ফল হিসেবে দেখা হয় না, বরং এক ধরনের সূক্ষ্ম বস্তু কণা হিসেবে দেখা হয় যা আত্মার উপর আবরণ তৈরি করে এবং তাকে সংসার চক্রে আবদ্ধ রাখে। সঠিক বিশ্বাস (Samyak Darshana), সঠিক জ্ঞান (Samyak Jnana), এবং সঠিক আচরণ (Samyak Charitra) – এই ত্রিরত্ন (Triratna) অনুসরণের মাধ্যমে আত্মাকে কর্মমুক্ত করা সম্ভব।
  • মূল নীতি: জৈনধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো অহিংসা (Ahimsa)। এটি কেবল মানুষ বা পশুর ক্ষেত্রেই নয়, উদ্ভিদ এবং এমনকি বায়ু ও জলের ক্ষুদ্রতম জীবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই কারণেই কঠোর জৈন সাধুরা মুখে কাপড় বেঁধে রাখেন, যাতে নিঃশ্বাসের সাথে কোনো ক্ষুদ্র জীব হত্যা না হয়। এর পাশাপাশি, অনেকান্তবাদ (Anekantavada – সত্যের বহুবিধ দিক) এবং অপরিগ্রহ (Aparigraha – আসক্তিহীনতা) এই ধর্মের মূল ভিত্তি।

কিছু তাওবাদ (Some forms of Taoism): প্রকৃতির পথে চলা

চীনের তাওবাদ ধর্ম এবং দর্শন উভয় রূপেই বিদ্যমান। এর দার্শনিক রূপে (Philosophical Taoism), যা লাওৎসে (Laozi)-র ‘তাও তে চিং’ (Tao Te Ching) এবং ঝুয়াংজি (Zhuangzi)-র লেখার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কোনো ব্যক্তি-সদৃশ ঈশ্বরের ধারণা নেই।

  • ‘তাও’ (Tao): ‘তাও’ বা ‘পথ’ হলো মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক, স্বতঃস্ফূর্ত এবং অন্তর্নিহিত নিয়ম। এটি কোনো ব্যক্তি-সত্তা বা ঈশ্বর নয়, বরং একটি বিমূর্ত, অবর্ণনীয় এবং নৈর্ব্যক্তিক নীতি। ‘তাও’ থেকেই মহাবিশ্বের সকল কিছুর উদ্ভব হয়েছে এবং সবকিছুই পরিশেষে ‘তাও’-এর মধ্যেই ফিরে যায়।
  • ‘উ ওয়েই’ (Wu Wei): তাওবাদের লক্ষ্য হলো ‘তাও’-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করা। এর উপায় হলো ‘উ ওয়েই’ বা নিষ্ক্রিয় কর্ম (Effortless Action)। এর অর্থ অলসতা নয়, বরং প্রকৃতির স্রোতের বিরুদ্ধে না গিয়ে, তার সাথে তাল মিলিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করা, যেমন জল কোনো বাধা পেলে তার পাশ দিয়ে বয়ে যায়।
  • ধর্মীয় তাওবাদ: সময়ের সাথে সাথে, তাওবাদ বৌদ্ধধর্ম এবং স্থানীয় লোকবিশ্বাসের সাথে মিশে একটি ধর্মীয় রূপ (Religious Taoism) লাভ করে, যেখানে বিভিন্ন দেবতা, অমর সত্তা (Immortals) এবং আচার-অনুষ্ঠানের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এর মূল দার্শনিক ভিত্তিটি নিরীশ্বরবাদীই থেকে যায়।

এই নিরীশ্বরবাদী ধর্মগুলো প্রমাণ করে যে, জীবনের গভীরতম প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য, একটি নৈতিক ও অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করার জন্য, বা এমনকি মুক্তি বা মোক্ষ লাভের জন্যেও একজন স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণা অপরিহার্য নয়। এরা মানবীয় প্রজ্ঞা, প্রচেষ্টা এবং করুণার উপর আস্থা স্থাপন করে এক ভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান দেয়।

মহাবিশ্বের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক ভিত্তিক প্রকারভেদ

ঈশ্বরের প্রকৃতি বা সংখ্যা ছাড়াও, তিনি এই জগতের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত – এই প্রশ্নের উত্তরের উপর ভিত্তি করেও ধর্ম ও দর্শনকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। ঈশ্বর কি জগতের প্রতিটি ঘটনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত? নাকি তিনি জগৎ সৃষ্টি করে দিয়ে দূরে সরে গেছেন? নাকি জগৎ নিজেই ঈশ্বরের অংশ? এই প্রশ্নগুলো বিশ্বাসের কাঠামোর গভীরে প্রবেশ করে।

আস্তিক্যবাদ (Theism): সক্রিয় এবং সংশ্লিষ্ট ঈশ্বর

এটি একটি ব্যাপক ধারণা যা এক বা একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসকে বোঝায়, যারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং পরিচালনার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। একেশ্বরবাদ এবং বহুইশ্বরবাদ উভয়ই আস্তিক্যবাদের (Theism) অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বরবাদের মূল কথা হলো, ঈশ্বর কেবল একজন দূরবর্তী স্রষ্টা নন, তিনি একজন সক্রিয় নিয়ন্ত্রক এবং বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের সাথে তিনি সংশ্লিষ্ট (Immanent)।

বৈশিষ্ট্য:

  • সক্রিয় সম্পৃক্ততা: আস্তিক্যবাদীরা মনে করেন, ঈশ্বর/দেবতারা মানুষের জীবনে এবং ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করেন।
  • প্রার্থনা ও প্রত্যাদেশ: তারা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বর মানুষের প্রার্থনা শোনেন এবং তার জবাব দেন। তিনি নবীদের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ (Revelation) পাঠিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
  • অলৌকিক ঘটনা (Miracles): আস্তিক্যবাদ অনুযায়ী, ঈশ্বর প্রাকৃতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে এবং তিনি ইচ্ছা করলে সেই নিয়ম স্থগিত করে অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন।

উদাহরণ: আব্রাহামিক ধর্মগুলো (ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম) আস্তিক্যবাদের ক্লাসিক উদাহরণ। এই ধর্মগুলোর পবিত্র গ্রন্থগুলো ঈশ্বরের সক্রিয় হস্তক্ষেপের কাহিনীতে পূর্ণ – তিনি সাগরকে বিভক্ত করেন, মৃতকে জীবন দেন, এবং তার নির্বাচিত জাতিকে পথ দেখান। একইভাবে, বহুইশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেও দেবতারা পৃথিবীতে নেমে আসেন, মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।

ডিইজম বা ঈশ্বরবাদ (Deism): দূরবর্তী ঘড়ি-নির্মাতা

ডিইজম বা ঈশ্বরবাদ হলো এমন একটি বিশ্বাস যা মনে করে, একজন স্রষ্টা ঈশ্বর মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর পরিচালনার জন্য অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়মকানুন স্থাপন করে দিয়েছেন, কিন্তু তারপর থেকে তিনি আর মহাবিশ্বের কার্যকলাপে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করেন না।

বৈশিষ্ট্য:

  • একমাত্র হস্তক্ষেপ – সৃষ্টি: ডিইস্টরা ঈশ্বরের একমাত্র কাজ হিসেবে সৃষ্টিকে স্বীকার করেন।
  • প্রত্যাদেশ ও অলৌকিকতার অস্বীকৃতি: তারা ধর্মগ্রন্থ, নবী বা কোনো ধরনের অলৌকিক ঘটনাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, ঈশ্বর নিজেকে প্রকৃতির নিয়মের মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন, কোনো বিশেষ গ্রন্থের মাধ্যমে নয়। তাই, মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য যুক্তি (Reason) এবং বিজ্ঞানই একমাত্র পথ।
  • ‘মহাজাগতিক ঘড়ি-নির্মাতা’ (Cosmic Watchmaker): ডিইস্টরা ঈশ্বরকে একজন ‘মহাজাগতিক ঘড়ি-নির্মাতা’র সাথে তুলনা করেন, যিনি ঘড়িটি নিখুঁতভাবে তৈরি করে দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন এবং এটি এখন নিজের নিয়মে চলছে। ঘড়িটি ঠিকমতো চলার জন্য নির্মাতার আর কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ডিইজম আঠারো শতকের জ্ঞানালোকের যুগে (Age of Enlightenment) ইউরোপ এবং আমেরিকায় অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের (যেমন – ভলতেয়ার, টমাস পেইন, টমাস জেফারসন) কাছে জনপ্রিয় ছিল। এটি ছিল বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা। নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো মহাবিশ্বকে একটি সুশৃঙ্খল, নিয়মমাফিক যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। ডিইজম এই বৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টির সাথে একজন স্রষ্টার ধারণাকে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ধর্মের অলৌকিক এবং অযৌক্তিক দাবিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ দিয়েছিল (Walters, 1992)।

দ্বৈতবাদ (Dualism): ভালো ও মন্দের চিরন্তন সংগ্রাম

দ্বৈতবাদী বিশ্বাস ব্যবস্থায় জগৎকে দুটি মৌলিক, শাশ্বত এবং পরস্পরবিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়। এই দুটি শক্তি সাধারণত ভালো ও মন্দ, আলো ও অন্ধকার, আত্মা ও জড়, বা শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক।

বৈশিষ্ট্য:

  • দুই আদি শক্তি: দ্বৈতবাদে ভালো এবং মন্দ কোনো একটি পরম সত্তার সৃষ্টি নয়, বরং উভয়ই আদি এবং মৌলিক শক্তি।
  • অশুভের সমস্যার সমাধান: দ্বৈতবাদ একেশ্বরবাদের ‘অশুভের সমস্যা’র (Problem of Evil) একটি সহজ সমাধান দেয়। পৃথিবীতে মন্দের অস্তিত্ব আছে কারণ ঈশ্বরের সমকক্ষ একজন প্রতিপক্ষ শক্তি রয়েছে, যিনি সক্রিয়ভাবে বিশৃঙ্খলা এবং দুঃখ সৃষ্টি করছেন। ঈশ্বর মন্দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন, কিন্তু তিনি এখনও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেননি।
  • নৈতিক আহ্বান: এই মহাজাগতিক সংগ্রামে মানুষকে একটি পক্ষ বেছে নিতে হয়। প্রতিটি মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছার (Free Will) মাধ্যমে বেছে নিতে পারে সে কি ভালোর পক্ষে লড়বে, নাকি মন্দের। সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য এবং সৎ কর্মের মাধ্যমে মানুষ ভালোর বাহিনীকে শক্তিশালী করে।

উদাহরণ:

  • জরাথুস্ট্রবাদ (Zoroastrianism): এর ক্লাসিক উদাহরণ হলো প্রাচীন পারস্যের জরাথুস্ট্রবাদ নবী জরাথুস্ট্র কর্তৃক প্রচারিত এই ধর্মানুসারে, মহাবিশ্বের শুরুতে দুটি আদি আত্মা বা শক্তি ছিল। একদিকে আছেন সর্বোচ্চ ভালো, প্রজ্ঞাময় এবং সৃষ্টিকর্তা দেবতা আহুরা মাজদা (Ahura Mazda), যিনি আলো, সত্য, জীবন এবং শৃঙ্খলার প্রতীক। তাঁর বিপরীতে রয়েছে অশুভ এবং ধ্বংসাত্মক শক্তি আংরা মাইনিউ বা আহরিমান (Ahriman), যে অন্ধকার, মিথ্যা, মৃত্যু এবং বিশৃঙ্খলার প্রতীক। সমগ্র মানব ইতিহাস হলো এই দুই শক্তির মধ্যে এক মহাজাগতিক সংগ্রামের কাহিনী, যা শেষ পর্যন্ত আহুরা মাজদার বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হবে।
  • নস্টিসিজম (Gnosticism): নস্টিসিজম হলো দ্বৈতবাদের আরেকটি শক্তিশালী উদাহরণ, যা আদি খ্রিস্টীয় শতকগুলোতে প্রচলিত ছিল। নস্টিকরা বিশ্বাস করত যে, এই ভৌত জগৎ কোনো কল্যাণময় (benevolent) ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট নয়, বরং এটি ডেমিয়ার্জ (Demiurge) নামক এক অজ্ঞ বা অশুভ গৌণ দেবতা (lesser deity) দ্বারা সৃষ্ট এক কারাগার। মানুষের আত্মা হলো সেই পরম ঐশ্বরিক জগতের অংশ যা এই জড় জগতের কারাগারে বন্দী হয়ে আছে। মুক্তি (Salvation) আসে বিশেষ গুপ্ত জ্ঞান বা নোসিস (Gnosis)-এর মাধ্যমে, যা মানুষকে তার আসল ঐশ্বরিক উৎস সম্পর্কে সচেতন করে তোলে (Pagels, 1979)।
  • ম্যানিকাইজম (Manichaeism): তৃতীয় শতকে পারস্যে নবী ‘মানি’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই ধর্মটি ছিল জরাথুস্ট্রবাদ, বৌদ্ধধর্ম এবং খ্রিস্টধর্মের এক সমন্বিত রূপ এবং এটি কঠোরভাবে দ্বৈতবাদী ছিল। এটি একসময় রোমান সাম্রাজ্য থেকে চীন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।

জরাথুস্ট্রীয় দ্বৈতবাদের প্রভাব পরবর্তীকালের আব্রাহামিক ধর্মগুলোর উপর, বিশেষ করে তাদের পরকালতত্ত্ব বা এস্ক্যাটোলজি (Eschatology)-এর উপর, অত্যন্ত গভীর। ঈশ্বর ও শয়তানের দ্বন্দ্ব, স্বর্গ ও নরকের ধারণা, শেষ বিচার বা কিয়ামতের দিন এবং মৃতদের পুনরুত্থানের ধারণার মধ্যে অনেক পণ্ডিত জরাথুস্ট্রীয় প্রভাব খুঁজে পান (Boyce, 1984)। এছাড়াও, দর্শনের জগতেও দ্বৈতবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যেমন রেনে দেকার্তের (René Descartes) বিখ্যাত মন-শরীর দ্বৈতবাদ (Mind-Body Dualism), যা মন (অ-জড়, চিন্তাশীল সত্তা) এবং শরীরকে (জড়, বিস্তৃতিশীল বস্তু) দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদার্থ হিসেবে দেখে।

এই প্রকারভেদগুলো দেখায় যে, ঈশ্বরের ধারণা কেবল তার সংখ্যা বা প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি এই দৃশ্যমান জগতের সাথে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করেন – সেই ধারণাও বিশ্বাসের কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক ভিত্তিক প্রকারভেদ

এই ধারার শ্রেণীবিন্যাসটি অতিপ্রাকৃত সত্তার প্রকৃতি বা সংখ্যার উপর ততটা জোর দেয় না, যতটা দেয় মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক এবং প্রকৃতির মধ্যে অতিপ্রাকৃত শক্তির অবস্থান নিয়ে। এটি প্রায়শই লোকধর্ম এবং আদিবাসী বিশ্বাস ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

সর্বপ্রাণবাদ (Animism): জগতের প্রতিটি বস্তুই জীবন্ত

সর্বপ্রাণবাদ সম্ভবত মানববিশ্বাসের সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানের জনক স্যার এডওয়ার্ড টাইলর (Sir Edward Tylor) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Primitive Culture’-এ একেই ধর্মের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন (Tylor, 1871)। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, কেবল মানুষ বা পশুপাখি নয়, বরং প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান – নদী, পাহাড়, পাথর, গাছ, বাতাস, সূর্য, চন্দ্র – সবকিছুরই নিজস্ব আত্মা বা প্রাণশক্তি (Spirit or Soul) রয়েছে।

টাইলরের তত্ত্ব অনুযায়ী, আদিম মানুষ স্বপ্ন, মৃত্যু এবং ঘোরের অভিজ্ঞতা থেকে আত্মার ধারণা লাভ করে এবং পরে সেই ধারণা প্রকৃতির অন্যান্য বস্তুর উপরও আরোপ করে। যদিও টাইলরের এই বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা (যেখানে অ্যানিমিজমকে ধর্মের একটি ‘আদিম’ বা ‘ভুল’ পর্যায় হিসেবে দেখা হয়) আধুনিক নৃবিজ্ঞানে অনেকাংশে পরিত্যক্ত, কিন্তু ‘অ্যানিমিজম’ শব্দটি এখনও এমন একটি বিশ্ববীক্ষাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যেখানে জগৎকে জড় বস্তুর সমষ্টি হিসেবে না দেখে, বরং বিভিন্ন ধরনের জীবন্ত সত্তার এক বিশাল সম্প্রদায় হিসেবে দেখা হয়। আধুনিক নৃবিজ্ঞানী গ্রাহাম হার্ভে (Graham Harvey) অ্যানিমিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: এটি এমন একটি বিশ্ববীক্ষা যেখানে জগৎ ব্যক্তিতে (persons) পরিপূর্ণ, যাদের মধ্যে কেবল কিছু ব্যক্তিই মানুষ, এবং জীবন সবসময়ই অন্যান্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যাপিত হয় (Harvey, 2005)।

  • প্রকৃতির সচেতনতা: সর্বপ্রাণবাদী সংস্কৃতিতে প্রকৃতিকে একটি নিষ্ক্রিয়, জড় বস্তু হিসেবে দেখা হয় না, বরং একে একটি জীবন্ত, সচেতন জগৎ হিসেবে দেখা হয়, যা বিভিন্ন আত্মা বা স্পিরিটে পরিপূর্ণ। এই আত্মাদের নিজস্ব ইচ্ছা, ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। কিছু আত্মা মানুষের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সাহায্যকারী, কিছু বিদ্বেষী এবং ক্ষতিকারক, আবার কিছু উদাসীন। মানুষের ভাগ্য, শিকারের সাফল্য, ফসলের প্রাচুর্য, রোগ-ব্যাধি – এই সবকিছুই নির্ভর করে এই আত্মাদের সন্তুষ্ট বা রুষ্ট করার ওপর।
  • পারস্পরিক সম্পর্ক: মানুষ এই আত্মা জগতের একটি অংশ মাত্র, এর প্রভু নয়। তাই, প্রকৃতির সাথে মানুষের একটি গভীর এবং পারস্পরিক (Reciprocal) সম্পর্ক রয়েছে। একটি গাছ কাটার আগে বা একটি প্রাণী শিকার করার আগে, সেই গাছ বা প্রাণীর আত্মার কাছে অনুমতি চাওয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একটি সাধারণ রীতি।
  • আত্মা জগতের সাথে যোগাযোগ: এই সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন শামান (Shaman) বা ওঝা। শামানরা সাধারণ মানুষ নন। তারা বিশেষ প্রশিক্ষণ বা জন্মগত ক্ষমতার মাধ্যমে নিজেদের চেতনাকে এমন এক স্তরে নিয়ে যেতে পারেন, যেখানে তারা আত্মিক জগতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। তারা ঘোরের (Trance) মধ্যে আত্মাদের জগতে ভ্রমণ করেন, অসুস্থ ব্যক্তির হারিয়ে যাওয়া আত্মাকে ফিরিয়ে আনেন, ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেন এবং মানুষের পক্ষ থেকে আত্মাদের সাথে বোঝাপড়া করেন।

উদাহরণ: সাইবেরিয়া, আমাজন বা পাপুয়া নিউ গিনির অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এখনও এই বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচলিত। জাপানের শিন্তো ধর্মেও ‘কামি’র (Kami) ধারণাটি সর্বপ্রাণবাদের খুব কাছাকাছি, যেখানে পাহাড়, নদী, গাছ এবং এমনকি অসাধারণ ব্যক্তিদেরও কামি হিসেবে পূজা করা হয়। আধুনিক পরিবেশবাদী আন্দোলনের মধ্যেও এক ধরনের নতুন-সর্বপ্রাণবাদী (Neo-animist) চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে প্রকৃতিকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে সম্মান করার কথা বলা হয়।

অ্যানিমেটিজম (Animatism): নৈর্ব্যক্তিক মহাজাগতিক শক্তি

নৃবিজ্ঞানী রবার্ট ম্যারেট (Robert Marett) দ্বারা প্রস্তাবিত এই ধারণাটি সর্বপ্রাণবাদ (Animism) থেকে কিছুটা ভিন্ন। তিনি মনে করতেন, টাইলরের ‘আত্মা’র ধারণাটি অতি বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক। তার মতে, ধর্মের আদিমতম রূপটি ছিল আরও বেশি আবেগপ্রসূত এবং বিমূর্ত।

বৈশিষ্ট্য:

  • নৈর্ব্যক্তিক শক্তি: এখানে কোনো নির্দিষ্ট আত্মা বা স্পিরিটে বিশ্বাস করা হয় না, বরং এক ধরনের বিমূর্ত, নৈর্ব্যক্তিক এবং পরিব্যাপ্ত অতিপ্রাকৃত শক্তিতে (Impersonal Supernatural Force) বিশ্বাস করা হয়, যা মহাবিশ্বের সর্বত্র বিদ্যমান।
  • ‘মানা’ (Mana): এর সর্বোত্তম উদাহরণ হলো পলিনেশীয়দের বা মেলানেশীয়দের ‘মানা’র ধারণা। ‘মানা’ হলো এক ধরনের পবিত্র বা অতিপ্রাকৃত শক্তি যা কোনো ব্যক্তি (যেমন – একজন সফল যোদ্ধা বা নেতা), বস্তু (যেমন – একটি বিশেষ অস্ত্র বা পাথর) বা স্থানের মধ্যে থাকতে পারে। যার বা যার মধ্যে ‘মানা’ আছে, সে শক্তিশালী, প্রভাবশালী এবং সৌভাগ্যবান হয়। ‘মানা’ অর্জন করা যায়, আবার হারিয়েও ফেলা যায়।
  • ‘ট্যাবু’ (Taboo): ‘মানা’র ধারণার সাথেই ‘ট্যাবু’র ধারণাটি জড়িত। ‘ট্যাবু’ হলো এমন কিছু ব্যক্তি, বস্তু বা কাজ যা অত্যন্ত পবিত্র বা বিপজ্জনক (কারণ তাতে প্রচুর ‘মানা’ আছে) এবং তাই সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ।

উদাহরণ: পলিনেশীয়দের ‘মানা’ ছাড়াও উত্তর আমেরিকার ইরোকোয়া ইন্ডিয়ানদের ‘ওরেন্ডা’ (Orenda) বা অ্যালগনকুইয়ানদের ‘ম্যানিটু’ (Manitou) একই ধরনের নৈর্ব্যক্তিক শক্তির উদাহরণ। ম্যারেট মনে করতেন, এই বিমূর্ত শক্তির ধারণাই পরবর্তীতে নির্দিষ্ট আত্মায় (সর্বপ্রাণবাদ) এবং অবশেষে দেবতায় (বহুইশ্বরবাদ) রূপান্তরিত হয়েছে (Marett, 1909)।

এই প্রকারভেদগুলো থেকে বোঝা যায় যে, ‘ধর্ম’ শব্দটি একটি বিশাল ছাতার মতো, যার নিচে নানা ধরনের বিশ্বাস, দর্শন এবং জীবনব্যবস্থা আশ্রয় নিয়েছে, যা মানুষের কল্পনার বৈচিত্র্য এবং গভীরতাকে তুলে ধরে। এটি কোনো একক ধারণা নয়, বরং মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্নগুলোর বিচিত্র সব উত্তরের এক বিশাল সংগ্রহশালা।

বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়

বিশ্বের হাজার হাজার ধর্মের মধ্যে কয়েকটি ধর্ম জনসংখ্যা, ঐতিহাসিক প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক বিস্তারের দিক থেকে প্রধান হয়ে উঠেছে। এরা কেবল কোটি কোটি মানুষের জীবনদর্শনকেই নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং বিশ্ব ইতিহাস, রাজনীতি এবং সভ্যতার গতিপথকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এখানে তাদের একটি সংক্ষিপ্ত ও নিরপেক্ষ পরিচয় তুলে ধরা হলো, যা তাদের মূল বিশ্বাস, ইতিহাস এবং শাখাগুলোর উপর আলোকপাত করবে।

আব্রাহামিক ধর্ম (Abrahamic Religions): মধ্যপ্রাচ্যের তিন ফসল

এই ধর্মগুলো নবী আব্রাহাম (Abraham/Ibrahim) এবং তার বংশধরদের থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। এদের মধ্যে অনেক সাধারণ মিল রয়েছে, যেমন – কঠোর একেশ্বরবাদ, স্বর্গ-নরকের ধারণা, শেষ বিচারের (Final Judgment) বিশ্বাস, এবং নবীদের মাধ্যমে ঈশ্বরের বাণী প্রেরণের ধারণা। এই ধর্মগুলো ইতিহাসকে একটি সরলরৈখিক পথে দেখে, যার একটি শুরু (সৃষ্টি) এবং একটি শেষ (শেষ বিচার) আছে।

ইহুদি ধর্ম (Judaism)

এটি প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মধ্যে একটি, যার ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো।

  • মূল বিশ্বাস: একজনই ঈশ্বর (ইয়াওয়ে বা হাসেম), যিনি সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা এবং তিনি আব্রাহাম ও তার বংশধর, অর্থাৎ ইসরায়েলের জনগণের সাথে একটি বিশেষ চুক্তি বা বিধান (Covenant) করেছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইহুদিরা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি এবং তাদের দায়িত্ব হলো ঈশ্বরের আইন (তোরাহ) মেনে চলা। এই ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধারণাটি কোনো জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব নয়, বরং একটি বিশেষ দায়িত্ব পালনের আহ্বান।
  • প্রধান ধর্মগ্রন্থ: প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো ‘তানাখ’ (Tanakh), যা একটি অ্যাক্রোনিম – তোরাহ (আইন), নেভিয়িম (নবীগণ), এবং কেতুভিম (অন্যান্য লেখা) নিয়ে গঠিত। এটি খ্রিস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রায় অনুরূপ। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তোরাহ (Torah), যা ঈশ্বরের দ্বারা সিনাই পর্বতে মোশিকে (Moses) প্রদত্ত আইন এবং এটি বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই (Genesis, Exodus, Leviticus, Numbers, Deuteronomy) নিয়ে গঠিত। এছাড়াও, তালমুদ (Talmud) হলো ইহুদি আইন, ঐতিহ্য এবং রাব্বিদের ব্যাখ্যার একটি বিশাল সংকলন, যা ইহুদি জীবনযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • ইতিহাস ও ঐতিহ্য: ইহুদি ইতিহাস নির্বাসন (Exile) এবং প্রত্যাবর্তনের কাহিনীতে পূর্ণ। ব্যাবিলনীয় নির্বাসন, রোমানদের দ্বারা জেরুজালেম মন্দির ধ্বংস (৭০ খ্রিস্টাব্দ), এবং পরবর্তী ডায়াস্পোরা (বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া) তাদের পরিচয় গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। হলোকাস্ট (Holocaust) বিংশ শতাব্দীতে তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়।
  • প্রধান শাখা: আধুনিক ইহুদি ধর্ম মূলত তিনটি প্রধান ধারায় বিভক্ত:
    • অর্থোডক্স (Orthodox) ইহুদি ধর্ম: যা তোরাহকে ঈশ্বরের আক্ষরিক এবং অপরিবর্তনীয় বাণী হিসেবে দেখে এবং ঐতিহ্যবাহী আইনগুলোকে কঠোরভাবে মেনে চলে।
    • কনজারভেটিভ (Conservative) ইহুদি ধর্ম: যা ঐতিহ্যকে সম্মান করে কিন্তু মনে করে যে, সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় আইনের কিছু পরিবর্তন এবং অভিযোজন সম্ভব।
    • রিফর্ম (Reform) ইহুদি ধর্ম: যা আধুনিক যুগের সাথে সঙ্গতি রেখে ধর্মীয় আইনকে পরিবর্তনযোগ্য এবং ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় মনে করে। এটি নৈতিকতার উপর বেশি জোর দেয়।

খ্রিস্টধর্ম (Christianity)

বিশ্বের বৃহত্তম এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২.৪ বিলিয়ন।

  • মূল বিশ্বাস: যিশু (Jesus of Nazareth) হলেন ঈশ্বরের পুত্র এবং মানবজাতির ত্রাণকর্তা (Savior)। কেন্দ্রীয় বিশ্বাস হলো ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদ (Trinity), যা অনুযায়ী ঈশ্বর এক, কিন্তু তিনি তিনটি সত্তায় (Persons) প্রকাশিত – পিতা (Father), পুত্র (Son – যিশু), এবং পবিত্র আত্মা (Holy Spirit)। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং মৃত্যুর তিন দিন পর পুনরুত্থান (Resurrection) মানবজাতিকে তাদের আদি পাপ (Original Sin) থেকে মুক্তি দিয়েছে।
  • প্রধান ধর্মগ্রন্থ: বাইবেল (Bible), যা দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত: ওল্ড টেস্টামেন্ট (Old Testament), যা মূলত ইহুদিদের তানাখ; এবং নিউ টেস্টামেন্ট (New Testament), যা যিশুর জীবন, শিক্ষা, এবং তার শিষ্যদের (Apostles) কার্যকলাপ নিয়ে লেখা। নিউ টেস্টামেন্টের চারটি গসপেল (ম্যাথিউ, মার্ক, লুক, জন) যিশুর জীবনের প্রধান আখ্যান।
  • ইতিহাস ও বিভাজন: খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে অনেক বিভাজন ঘটেছে। প্রথম বড় বিভাজনটি ঘটে ১০৫৪ সালে (The Great Schism), যখন রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ একে অপর থেকে আলাদা হয়ে যায়। দ্বিতীয় বড় বিভাজনটি হলো ষোড়শ শতকের সংস্কার আন্দোলন (Protestant Reformation), যার নেতৃত্বে ছিলেন মার্টিন লুথার (Martin Luther), জন ক্যালভিন (John Calvin) প্রমুখ।
  • প্রধান শাখা: প্রধান শাখাগুলো হলো:
    • রোমান ক্যাথলিক (Roman Catholic): যা পোপের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম শাখা।
    • ইস্টার্ন অর্থোডক্স (Eastern Orthodox): যা মূলত পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত এবং এদের নিজস্ব বিশপদের কাউন্সিল রয়েছে।
    • প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestantism): যা পোপের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে এবং ‘কেবল বিশ্বাস’ (Sola Fide) ও ‘কেবল ধর্মগ্রন্থ’ (Sola Scriptura) নীতির উপর জোর দেয়। এর অধীনে লুথারানিজম, ক্যালভিনিজম, অ্যাংলিকানিজম, ব্যাপ্টিস্ট, মেথডিস্ট সহ হাজারো উপশাখা রয়েছে।

ইসলাম (Islam)

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দ্রুততম বর্ধনশীল ধর্ম, যার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২ বিলিয়ন।

  • মূল বিশ্বাস: আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় (তাওহিদ)। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। মুহাম্মদ হলেন তার প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল বা নবী। ইসলাম শব্দের অর্থ হলো ‘আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ’।
  • প্রধান ধর্মগ্রন্থ: কুরআন (Quran), যা মুসলমানরা আল্লাহ বা ঈশ্বরের বাণী হিসেবে বিশ্বাস করে এবং এটি ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে প্রায় ২৩ বছর ধরে মুহাম্মদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। হাদীস (Hadith) হলো নবী মুহাম্মদের বাণী ও কাজের সংকলন, যা কুরআনের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
  • প্রধান শাখা: ইসলামের প্রধান দুটি শাখা হলো সুন্নি (Sunni) এবং শিয়া (Shia)। এই বিভাজনের মূল কারণ হলো মুহাম্মদের মৃত্যুর পর কে মুসলিমদের নেতা (খলিফা) হবেন, তা নিয়ে বিতর্ক।
    • সুন্নি (Sunni): (সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রায় ৮৫-৯০%) মনে করে নেতা নির্বাচিত হওয়া উচিত এবং তারা প্রথম চার খলিফাকে (আবু বকর, উমর, উসমান, আলী) রাশিদুন বা ন্যায়নিষ্ঠ খলিফা হিসেবে মানে।
    • শিয়া (Shia): মনে করে নেতৃত্ব মুহাম্মদের পরিবারের মধ্যেই থাকা উচিত, বিশেষ করে তার জামাতা আলী এবং তার বংশধরদের (ইমাম) মধ্যে।
  • মরমি ধারা: সুফিবাদ (Sufism) ইসলামের একটি মরমি এবং আধ্যাত্মিক ধারা, যা সুন্নি ও শিয়া উভয় শাখার মধ্যেই বিদ্যমান। সুফিরা ঈশ্বরের সাথে ব্যক্তিগত এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর জোর দেন।

ভারতীয় বা ধার্মিক ধর্ম (Dharmic Religions): কর্ম ও পুনর্জন্মের দর্শন

এই ধর্মগুলোর উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশে এবং এদের মধ্যে কর্ম (Karma – কাজের ফল), ধর্ম (Dharma – নৈতিক দায়িত্ব বা প্রাকৃতিক নিয়ম), সংসার (Samsara – জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের চক্র), এবং মোক্ষ বা নির্বাণ (Moksha/Nirvana – এই চক্র থেকে মুক্তি) এর মতো কিছু সাধারণ দার্শনিক ধারণা রয়েছে। এরা পশ্চিমা আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মতো ইতিহাসকে সরলরৈখিক (Linear) হিসেবে না দেখে, বরং মহাজাগতিক সময়কে চক্রাকার (Cyclical) হিসেবে দেখে।

হিন্দুধর্ম (Hinduism)

এটি বিশ্বের প্রাচীনতম জীবন্ত ধর্মগুলোর মধ্যে একটি, যার কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা, একক প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ বা কেন্দ্রীয় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ নেই। এই কারণে একে একটি একক ধর্মের চেয়ে বরং একটি ধর্মীয় ঐতিহ্যের পরিবার বা ‘সনাতন ধর্ম’ (Sanātana Dharma – শাশ্বত নিয়ম) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর উৎস সিন্ধু সভ্যতা এবং বৈদিক যুগের বিশ্বাস ও আচারের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে নিহিত।

  • মূল বিশ্বাস: হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, তবে কিছু কেন্দ্রীয় ধারণা এর বিভিন্ন শাখাকে একত্রিত করে।
    • ব্রহ্ম (Brahman): হিন্দু দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্রহ্মের ধারণা। ব্রহ্ম হলেন পরম, চূড়ান্ত বাস্তবতা – এক, অদ্বিতীয়, নিরাকার, অসীম এবং শাশ্বত সত্তা। অদ্বৈত বেদান্তের মতো দর্শন অনুযায়ী, এই ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। তাকে বলা হয় নির্গুণ ব্রহ্ম (Nirguna Brahman) বা গুণাবলীহীন পরম সত্তা। তবে ভক্তদের উপাসনার সুবিধার জন্য, এই নিরাকার ব্রহ্মই বিভিন্ন সগুণ রূপে (Saguna Brahman) নিজেকে প্রকাশ করেন, যারা হলেন ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা), বিষ্ণু (সংরক্ষক), এবং শিব (ধ্বংসকারী) – এই ত্রিমূর্তি (Trimurti) সহ অসংখ্য দেব-দেবী। এই ধারণাটিই হিন্দুধর্মের একেশ্বরবাদ এবং বহুদেবতাবাদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যে দ্বন্দ্ব, তার সমাধান করে (Flood, 1996)।
    • কর্ম ও সংসার (Karma and Samsara): কর্ম হলো নৈতিক কার্যকারণের এক মহাজাগতিক নিয়ম। প্রতিটি শারীরিক ও মানসিক কর্মের একটি ফল রয়েছে, যা এই জীবনে বা পরবর্তী জীবনে ভোগ করতে হয়। এই কর্মফলের জন্যই আত্মা বা জীবাত্মা (Jivatman) জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের এক অন্তহীন চক্রে, অর্থাৎ সংসারে, আবদ্ধ থাকে।
    • মোক্ষ (Moksha): হিন্দু জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মোক্ষ বা সংসার চক্র থেকে মুক্তি লাভ করা এবং জীবাত্মার তার মূল উৎস পরব্রহ্মের সাথে মিলিত হওয়া। মোক্ষ লাভের জন্য বিভিন্ন পথের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে প্রধান তিনটি হলো: কর্ম মার্গ (Karma Marga) বা নিঃস্বার্থ কর্মের পথ, জ্ঞান মার্গ (Jnana Marga) বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পথ, এবং ভক্তি মার্গ (Bhakti Marga) বা ঈশ্বরপ্রেম ও আত্মসমর্পণের পথ।
    • পুরুষার্থ (Purusharthas): হিন্দুধর্ম অনুসারে মানবজীবনের চারটি প্রধান লক্ষ্য বা পুরুষার্থ হলো – ধর্ম (Dharma) বা নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন, অর্থ (Artha) বা জাগতিক সমৃদ্ধি অর্জন, কাম (Kama) বা বাসনা ও আনন্দের উপভোগ, এবং পরিশেষে মোক্ষ (Moksha) বা আধ্যাত্মিক মুক্তি।
  • প্রধান ধর্মগ্রন্থ: এর ধর্মগ্রন্থের ভান্ডার বিশাল এবং দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: শ্রুতি (Shruti – যা শোনা হয়েছে, অর্থাৎ ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ) এবং স্মৃতি (Smriti – যা স্মরণ করা হয়েছে, অর্থাৎ মানব রচিত)।
    • শ্রুতি: সবচেয়ে প্রাচীন ও পবিত্র হলো চারটি বেদ (Vedas) – ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ। বেদের শেষাংশে থাকা দার্শনিক আলোচনাগুলো উপনিষদ (Upanishads) নামে পরিচিত, যা বেদান্ত দর্শনের ভিত্তি।
    • স্মৃতি: এর মধ্যে রয়েছে পুরাণ (Puranas), যেখানে দেব-দেবী, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত; ধর্মশাস্ত্র, যা সামাজিক আইনকানুন নির্ধারণ করে; এবং দুটি মহাকাব্যরামায়ণ (Ramayana)মহাভারত (Mahabharata)ভগবদ্গীতা (Bhagavad Gita), যা মহাভারতের অংশ, একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী গ্রন্থ যা কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির পথকে সমন্বয় করে।
  • প্রধান শাখা: উপাস্য প্রধান দেবতার উপর ভিত্তি করে হিন্দুধর্মের মধ্যে বিভিন্ন ঐতিহ্য ও দর্শন রয়েছে। প্রধান ধারাগুলো হলো: শৈব (Shaivism) যারা শিবকে পরমেশ্বর হিসেবে উপাসনা করে, বৈষ্ণব (Vaishnavism) যারা বিষ্ণু ও তার অবতারদের (যেমন রাম ও কৃষ্ণ) উপাসনা করে, শাক্ত (Shaktism) যারা দেবী বা মহাশক্তিকে পরম সত্তা হিসেবে পূজা করে, এবং স্মার্ত (Smartism), যারা পঞ্চদেবতার (বিষ্ণু, শিব, দেবী, গণেশ, সূর্য) উপাসনা করে এবং এদেরকে এক ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ বলে মনে করে।

বৌদ্ধধর্ম (Buddhism)

খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে উত্তর ভারতে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম (বুদ্ধ) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্ম ও দর্শন, যা কর্ম, পুনর্জন্ম এবং সংসার চক্র থেকে মুক্তির ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কিন্তু হিন্দুধর্মের আত্মা (Atman) এবং ঈশ্বরের ধারণাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা বা প্রত্যাখ্যান করে।

  • মূল বিশ্বাস: বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি চারটি আর্য সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
    • চারটি আর্য সত্য (Four Noble Truths): (১) জীবনে দুঃখ (Dukkha) আছে; (২) এই দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা বা আসক্তি (Taṇhā); (৩) এই দুঃখের নিরোধ বা অবসান ঘটানো সম্ভব; এবং (৪) দুঃখ নিরোধের পথ হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ (Noble Eightfold Path) অনুসরণ করা।
    • অষ্টাঙ্গিক মার্গ: এটি হলো জীবনযাপনের একটি নির্দেশিকা, যা তিনটি ভাগে বিভক্ত: প্রজ্ঞা (Prajñā) (সঠিক দৃষ্টি ও সঠিক সংকল্প), শীল (Sīla) (সঠিক বাক্য, সঠিক কর্ম ও সঠিক জীবিকা), এবং সমাধি (Samādhi) (সঠিক প্রচেষ্টা, সঠিক স্মৃতি ও সঠিক সমাধি বা ধ্যান)।
    • নির্বাণ (Nirvana): এই পথ অনুসরণ করার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নির্বাণ লাভ করা, যা হলো সকল তৃষ্ণা, ঘৃণা এবং অজ্ঞতার বিলুপ্তি এবং সংসার চক্র থেকে পরম মুক্তি। এটি কোনো স্বর্গীয় স্থান নয়, বরং চেতনার এক পরম শান্ত অবস্থা।
    • অনাত্মা ও অনিত্যতা (Anatta and Anicca): বৌদ্ধধর্মের একটি কেন্দ্রীয় এবং বিপ্লবী ধারণা হলো অনাত্মা বা ‘No-self’। এটি হিন্দুধর্মের স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় আত্মার (Atman) ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী, কোনো স্থায়ী ‘আমি’ বা আত্মা নেই; যা আছে তা হলো পাঁচটি উপাদানের (Skandhas) এক ক্ষণস্থায়ী সমষ্টি মাত্র। জগতের সবকিছুই অনিত্য বা পরিবর্তনশীল (Anicca)। এই অনিত্য বস্তুর প্রতি আসক্তিই দুঃখের মূল কারণ (Rahula, 1959)।
  • প্রধান ধর্মগ্রন্থ: ত্রিপিটক (Tripitaka) বা পালি ক্যানন হলো বৌদ্ধধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ, যার অর্থ “তিনটি ঝুড়ি”। এগুলো হলো: বিনয় পিটক (সন্ন্যাসীদের জন্য নিয়মকানুন), সূত্র পিটক (বুদ্ধের মূল শিক্ষা ও প্রবচন), এবং অভিধর্ম পিটক (শিক্ষার দার্শনিক বিশ্লেষণ)।
  • প্রধান শাখা: সময়ের সাথে সাথে বৌদ্ধধর্মে বিভিন্ন শাখা ও উপশাখার উদ্ভব হয়েছে। এর প্রধান দুটি শাখা হলো:
    • হীনযান বা থেরবাদ (Theravada – “প্রাচীনদের পথ”): এটি শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস এবং মিয়ানমারে প্রচলিত। এটি বুদ্ধের মূল শিক্ষাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে বলে দাবি করে এবং ব্যক্তিগত মুক্তির উপর জোর দেয়। তাদের আদর্শ হলো ‘অর্হৎ’ (Arhat) হওয়া, অর্থাৎ যিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাণ লাভ করেছেন।
    • মহাযান (Mahayana – “বৃহৎ যান”): এটি চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং তিব্বতে প্রচলিত। থেরবাদের ব্যক্তিগত মুক্তির ধারণার বিপরীতে, মহাযান করুণার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে। তাদের আদর্শ হলো ‘বোধিসত্ত্ব’ (Bodhisattva) – এমন এক সত্তা যিনি নিজে নির্বাণ লাভের যোগ্যতা অর্জন করেও সকল জীবের মুক্তির জন্য স্বেচ্ছায় এই সংসারে ফিরে আসেন। মহাযান থেকে বজ্রযান (Vajrayana) বা তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম এবং জেন (Zen) বৌদ্ধধর্মের মতো প্রভাবশালী শাখার উদ্ভব হয়েছে।

জৈনধর্ম (Jainism)

জৈনধর্ম ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্ম, যা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে তার বর্তমান রূপ লাভ করলেও, এর অনুসারীরা একে অনাদি এবং অনন্ত বলে বিশ্বাস করে। বৌদ্ধধর্মের সমসাময়িক হলেও, জৈনধর্মের দার্শনিক ভিত্তি এবং জীবনবোধ অত্যন্ত স্বকীয়। এটি স্রষ্টার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আত্ম-সংযম ও অহিংসার মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি ও মুক্তির পথ প্রদর্শন করে।

  • তীর্থঙ্কর ও ইতিহাস: জৈন বিশ্বাস অনুসারে, সময় চক্রাকার এবং প্রতিটি কালচক্রে ২৪ জন তীর্থঙ্কর (Tirthankaras) বা ‘সেতু নির্মাতা’ আবির্ভূত হন, যারা মানবজাতিকে মোক্ষ বা মুক্তির পথ দেখান। চব্বিশতম এবং শেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর (Mahavira) (খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯-৫২৭), যিনি বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। মহাবীর কোনো নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেননি, বরং তিনি পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর, বিশেষ করে ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত ও সুসংগঠিত করেছিলেন।
  • মূল বিশ্বাস:
    • অনেকান্তবাদ (Anekantavada): জৈন দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো অনেকান্তবাদ বা ‘বহুত্ববাদ’। এর অর্থ হলো, সত্য এবং বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল এবং এর বহুবিধ দিক রয়েছে। কোনো একটি দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যকে সম্পূর্ণরূপে জানা বা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটি ‘অন্ধের হাতি দেখা’র গল্পের মতো – প্রত্যেকে সত্যের একটি অংশ মাত্র দেখতে পায়, পূর্ণ সত্য নয়। এই ধারণাটি জৈনদের পরমতসহিষ্ণুতার ভিত্তি।
    • অহিংসা (Ahimsa): অহিংসা বা কোনো প্রাণীর ক্ষতি না করা জৈনধর্মের সর্বোচ্চ নৈতিক নীতি (“অহিংসা পরম ধর্ম”)। জৈনরা বিশ্বাস করে যে, মানুষ, পশু, পাখি, এমনকি গাছপালা, জল, বাতাস ও আগুনের মধ্যেও জীব বা আত্মা রয়েছে। তাই তারা কায়মনোবাক্যে কোনো জীবের ক্ষতি না করার জন্য সচেষ্ট থাকে। এই কারণেই জৈন সন্ন্যাসীরা অত্যন্ত কঠোরভাবে নিরামিষভোজী হন এবং অণুজীব হত্যার ভয়ে মুখে কাপড় বেঁধে রাখেন বা খালি পায়ে চলেন।
    • কর্ম ও সংসার: হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের মতো জৈনধর্মও কর্ম এবং পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। তবে জৈন মতে, কর্ম কোনো বিমূর্ত নিয়ম নয়, বরং এক ধরনের সূক্ষ্ম জড় পদার্থ বা ধূলিকণা (Karmic matter)। যখন আমরা রাগ, লোভ বা হিংসার বশবর্তী হয়ে কাজ করি, তখন এই কর্ম-কণাগুলো আমাদের আত্মার সাথে আঠার মতো লেগে যায় এবং আত্মাকে ভারী করে তোলে, ফলে আত্মা সংসার চক্রে আটকে থাকে।
    • মোক্ষ: জৈন জীবনের লক্ষ্য হলো এই কর্ম-কণাগুলো থেকে আত্মাকে মুক্ত করা। কঠোর তপস্যা, আত্ম-সংযম এবং ত্রিরত্ন – সম্যক দর্শন (সঠিক বিশ্বাস), সম্যক জ্ঞান (সঠিক জ্ঞান) এবং সম্যক চরিত্র (সঠিক আচরণ) – অনুসরণের মাধ্যমে কর্মের বন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব। যখন আত্মা সম্পূর্ণ কর্মমুক্ত হয়, তখন তা ‘সিদ্ধ শিলা’ নামক মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ করে এবং অনন্ত সুখ, অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত শক্তির অধিকারী হয়।
  • প্রধান শাখা: জৈনধর্ম প্রধানত দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত: দিগম্বরেরা (Digambaras), যাদের সন্ন্যাসীরা সকল জাগতিক আসক্তি ত্যাগের প্রতীক হিসেবে নগ্ন থাকেন (“আকাশ যাদের বস্ত্র”), এবং শ্বেতাম্বররা (Shvetambaras), যাদের সন্ন্যাসীরা সাদা পোশাক পরিধান করেন। যদিও তাদের মূল দার্শনিক বিশ্বাস একই, তবে আচার-অনুষ্ঠান এবং ধর্মগ্রন্থের প্রামাণিকতা নিয়ে তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে (Dundas, 2002)।

শিখধর্ম (Sikhism)

পঞ্চদশ শতকে পাঞ্জাব অঞ্চলে গুরু নানক (Guru Nanak) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। এটি এমন এক সময়ে গড়ে উঠেছিল যখন ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ভক্তি আন্দোলন এবং ইসলামী সুফিবাদের মধ্যে এক ধরনের আদান-প্রদান চলছিল। শিখধর্ম উভয় ঐতিহ্য থেকে উপাদান গ্রহণ করলেও এটি একটি স্বতন্ত্র এবং স্বকীয় বিশ্বাস ব্যবস্থা।

  • মূল বিশ্বাস:
    • এক ওঙ্কার (Ek Onkar): শিখধর্মের মূল ভিত্তি হলো কঠোর একেশ্বরবাদ। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, যাকে ‘এক ওঙ্কার’ (একই স্রষ্টা) বলে অভিহিত করা হয়। তিনি নিরাকার (Nirankar), সর্বব্যাপী এবং শাশ্বত। লিঙ্গ, বর্ণ, বা ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, কারণ সকলেই সেই এক ঈশ্বরেরই সৃষ্টি।
    • গুরু পরম্পরা: শিখরা দশজন মানব গুরুর শিক্ষাকে অনুসরণ করে, গুরু নানক থেকে শুরু করে দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং (Guru Gobind Singh) পর্যন্ত। গুরুরা ছিলেন ঈশ্বরের বার্তার বাহক। গুরু গোবিন্দ সিং মানব গুরুর পরম্পরা শেষ করে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, গুরু গ্রন্থ সাহেবকে, জীবন্ত গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
    • তিনটি মূল স্তম্ভ: শিখ জীবনযাত্রার ভিত্তি তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত: নাম জপনা (ঈশ্বরের নাম স্মরণ ও ধ্যান করা), কিরত করনী (সৎ পথে উপার্জন করা), এবং ভান্দ চাকনা (দুঃস্থদের সেবা করা এবং নিজের সম্পদ অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়া)।
    • সেবা ও সাম্য: জাতিভেদ প্রথার কঠোর বিরোধিতা, নারী-পুরুষের পূর্ণ সমানাধিকার, এবং নিঃস্বার্থ সেবা (Sewa) শিখধর্মের মূল ভিত্তি। এই আদর্শের সর্বোত্তম প্রকাশ দেখা যায় গুরুদ্বারে (শিখ উপাসনালয়), যেখানে ‘লঙ্গর’ বা গণরান্নাঘরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হয়।
  • প্রধান ধর্মগ্রন্থ: গুরু গ্রন্থ সাহেব (Guru Granth Sahib), যা শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং একাদশ বা জীবন্ত গুরু হিসেবে মানা হয়। এটি কেবল শিখ গুরুদের বাণীই সংকলন করে না, বরং কবির এবং রবিদাসের মতো হিন্দু ও মুসলিম ভক্তিবাদী ও সুফি সাধকদের বাণীও অন্তর্ভুক্ত করে, যা এর সার্বজনীন আবেদনকে তুলে ধরে (McLeod, 1997)।
  • বৈশিষ্ট্য: ১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিং ‘খালসা’ (Khalsa – “বিশুদ্ধদের সম্প্রদায়”) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি বিশেষ দীক্ষাপ্রাপ্ত শিখ সম্প্রদায়, যারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ‘সন্ত-সিপাহী’ (Saint-Soldier)-এর আদর্শ গ্রহণ করে। খালসা শিখরা পাঁচটি ‘ক’ (Five K’s) ধারণ করার শপথ নেয়: কেশ (অকর্তিত চুল, যা আধ্যাত্মিকতার প্রতীক), কাঙ্ঘা (চুল পরিষ্কার রাখার জন্য চিরুনি), কারা (হাতে পরার জন্য লোহার ব্রেসলেট, যা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক), কৃপাণ (ছোট তলোয়ার, যা আত্মরক্ষা ও ন্যায়ের প্রতীক), এবং কাচ্ছেরা (বিশেষ ধরনের অন্তর্বাস, যা আত্মসংযমের প্রতীক)।

পূর্ব এশীয় ধর্ম (East Asian Religions): দর্শন ও জীবনের পথ

এই বিশ্বাস ব্যবস্থাগুলো, যা চীন ও জাপানে উদ্ভূত হয়েছে, প্রায়শই পশ্চিমা “ধর্ম” ধারণার সাথে পুরোপুরি খাপ খায় না। এদের মধ্যে ধর্ম, দর্শন এবং জীবনযাপনের পদ্ধতির সীমানা প্রায়শই অস্পষ্ট। পারলৌকিক মুক্তির চেয়ে ইহলৌকিক জীবনে সামাজিক সম্প্রীতি, নৈতিকতা এবং প্রকৃতির সাথে একাত্মতার উপর এখানে বেশি জোর দেওয়া হয়। চীনে তাওবাদকনফুসিয়ানিজম এবং জাপানে শিন্তো প্রায়শই বৌদ্ধধর্মের সাথে সহাবস্থান করে এবং একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে এক জটিল আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছে।

তাওবাদ (Taoism)

চীনের একটি প্রাচীন দর্শন ও ধর্ম, যার কিংবদন্তী প্রতিষ্ঠাতা হলেন লাওৎসে (Laozi) এবং এর মূল ভিত্তি হলো তার লেখা বলে কথিত গ্রন্থ তাও তে চিং (Tao Te Ching)। এটি চীনের বিশৃঙ্খল সময়ে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৪র্থ শতক) সামাজিক নিয়মকানুনের কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে এক প্রাকৃতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত জীবনধারার প্রস্তাবনা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

  • মূল বিশ্বাস ও ধারণা:
    • তাও (Tao): তাওবাদের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো ‘তাও’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘পথ’। তবে এটি কোনো সাধারণ পথ নয়। এটি মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত, অবর্ণনীয়, নৈর্ব্যক্তিক এবং প্রাকৃতিক নিয়ম বা প্রবাহ। এটি সকল কিছুর উৎস এবং সকল কিছুই পরিশেষে এতেই ফিরে যায়। তাও কোনো ব্যক্তি-সদৃশ ঈশ্বর নয়; এটি এক রহস্যময় শক্তি যা ব্যাখ্যাতীত কিন্তু প্রকৃতির প্রতিটি কাজে দৃশ্যমান। তাও তে চিং-এর প্রথম লাইনটিই বলে, “যে তাও-কে ভাষায় প্রকাশ করা যায়, তা শাশ্বত তাও নয়।”
    • উ ওয়েই (Wu Wei): তাওবাদী জীবনের আদর্শ হলো ‘উ ওয়েই’ বা ‘নিষ্ক্রিয় কর্ম’ (Effortless Action)। এর অর্থ অলসতা বা কর্মহীনতা নয়, বরং প্রকৃতির স্রোতের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ না করে, তার সাথে তাল মিলিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করা। এটি হলো জলের মতো হওয়া – জল কঠিন পাথরের বিরুদ্ধে লড়াই করে না, বরং তার পাশ দিয়ে বয়ে যায়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই পাথরকেই ক্ষয় করে দেয়।
    • ইন এবং ইয়াং (Yin and Yang): তাওবাদ প্রকৃতির চক্র এবং বিপরীত শক্তির মধ্যেকার গতিশীল ভারসাম্যকে গুরুত্ব দেয়। ইন (Yin) হলো অন্ধকার, নিষ্ক্রিয়, নারীসুলভ এবং গ্রহণকারী শক্তি, আর ইয়াং (Yang) হলো আলো, সক্রিয়, পুরুষসুলভ এবং সৃষ্টিকারী শক্তি। এরা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরিপূরক। এদের ভারসাম্যেই মহাবিশ্বের সম্প্রীতি বজায় থাকে।
    • দার্শনিক বনাম ধর্মীয় তাওবাদ: সময়ের সাথে সাথে তাওবাদ দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়েছে। দার্শনিক তাওবাদ (Daojia), যা লাওৎসে এবং ঝুয়াংজি (Zhuangzi)-র লেখার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, মূলত আত্ম-অনুসন্ধান, সরল জীবনযাপন এবং প্রকৃতির সাথে একাত্মতার উপর জোর দেয়। অন্যদিকে, ধর্মীয় তাওবাদ (Daojiao) লোকবিশ্বাস, জাদুবিদ্যা এবং শারীরিক অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষার সাথে মিশে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, যেখানে বিভিন্ন দেবতা, পুরোহিত এবং আচার-অনুষ্ঠানের উদ্ভব ঘটেছে (Kohn, 2009)।

কনফুসিয়ানিজম (Confucianism)

এটিও চীনের একটি নৈতিক ও দার্শনিক ব্যবস্থা, যা কনফুসিয়াস (Confucius বা Kong Fuzi) (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১-৪৭৯) এর শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি কোনো পারলৌকিক ধর্ম নয়, বরং একটি মানবতাবাদী দর্শন যা একটি সুশৃঙ্খল, নৈতিক এবং স্থিতিশীল সমাজ গঠন করার উপায় নির্দেশ করে। কনফুসিয়াসের মূল উদ্দেশ্য ছিল তার সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় দূর করে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা।

  • মূল বিশ্বাস ও ধারণা:
    • স্রষ্টার ধারণা: স্রষ্টা বা পারলৌকিক জগৎ এখানে গৌণ। কনফুসিয়াস অতিপ্রাকৃত বিষয়ে আলোচনা করতে অনাগ্রহী ছিলেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল এই পৃথিবীতে মানুষের সম্পর্ক এবং সমাজকে কীভাবে উন্নত করা যায়।
    • পাঁচটি মূল নীতি (Five Constants):
      • রেন (Ren – 仁): মানবিকতা, সহানুভূতি বা benevolence। এটিই কনফুসীয় দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। এর সারমর্ম হলো, “অন্যের উপর এমন কিছু আরোপ করো না, যা তুমি নিজের জন্য চাও না।”
      • ই (Yi – 義): ন্যায়পরায়ণতা বা righteousness। এটি হলো সামাজিক ভূমিকা নির্বিশেষে নৈতিকভাবে সঠিক কাজটি করা।
      • লি (Li – 禮): আচার-আচরণ বা propriety। এটি ‘রেন’-এর বাহ্যিক প্রকাশ। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক রীতিনীতি, শিষ্টাচার এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, যা সামাজিক সম্পর্কগুলোকে মসৃণ করে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখে।
      • ঝি (Zhi – 智): জ্ঞান বা wisdom। এটি হলো ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা।
      • শিন (Xin – 信): সততা বা integrity।
    • পারিবারিক ভক্তি (Xiao – 孝): পরিবার হলো সমাজের ভিত্তি। তাই বাবা-মা ও পূর্বপুরুষদের প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করা সর্বোচ্চ কর্তব্য। এই পারিবারিক সম্পর্কই অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কের (যেমন – শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক) মডেল হিসেবে কাজ করে।
    • জুনজি (Junzi – 君子): কনফুসীয় আদর্শ হলো ‘জুনজি’ বা ‘সজ্জন ব্যক্তি’ (Gentleman or Superior Person) হয়ে ওঠা, যিনি আত্ম-অনুশীলনের মাধ্যমে এই সমস্ত গুণে গুণান্বিত এবং সমাজের সেবা করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
    • প্রভাব: কনফুসিয়ানিজম দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের (এবং কোরিয়া, জাপান ও ভিয়েতনামের) রাষ্ট্রীয় দর্শন ছিল। এটি এই অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা, সরকার এবং পারিবারিক কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে (Fingarette, 1972)। এর প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো The Analects, যেখানে কনফুসিয়াসের বাণী সংকলিত হয়েছে।

শিন্তো (Shinto)

জাপানের নিজস্ব এবং সবচেয়ে প্রাচীন লোকধর্ম। ‘শিন্তো’ শব্দের অর্থ “দেবতাদের পথ”। এই নামটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল জাপানে বৌদ্ধধর্মের আগমনের পর, বৌদ্ধধর্ম (“বুদ্ধের পথ”) থেকে নিজেদের দেশীয় বিশ্বাসকে আলাদা করার জন্য। এটি কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা বা কঠোর ধর্মগ্রন্থ-ভিত্তিক ধর্ম নয়, বরং জাপানের প্রকৃতি, পূর্বপুরুষ এবং পৌরাণিক কাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধার এক সমন্বিত রূপ।

  • মূল বিশ্বাস ও ধারণা:
    • কামি (Kami – 神): শিন্তো ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘কামি’র ধারণা। কামি হলো বিভিন্ন আত্মা, দেবতা বা পবিত্র শক্তি। এরা পশ্চিমা একেশ্বরবাদী ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান বা নৈতিকভাবে নিখুঁত নয়। কামিরা প্রকৃতিতে (যেমন – পাহাড়, নদী, জলপ্রপাত, বাতাস), বিশেষ স্থানে, অসাধারণ প্রাকৃতিক বস্তুতে এবং এমনকি মৃত পূর্বপুরুষদের (বিশেষ করে রাজপরিবারের) মধ্যেও বাস করে বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রকৃতির প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধাই শিন্তো ধর্মের মূল ভিত্তি।
    • আমাতেরাসু ওমিকামি (Amaterasu Omikami): সূর্যদেবী আমাতেরাসু হলেন প্রধান এবং সবচেয়ে সম্মানিত কামি। জাপানের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, তিনি জাপানের রাজপরিবারের পূর্বসূরি, যা ঐতিহাসিকভাবে জাপানের সম্রাটকে এক ধরনের ঐশ্বরিক বৈধতা প্রদান করত।
    • পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা (Purity and Cleanliness): শিন্তোতে পাপের ধারণার চেয়ে পবিত্রতা (Hare) এবং অপবিত্রতা (Kegare)-র ধারণা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যু, রক্ত, অসুস্থতা ইত্যাদি বিষয়কে অপবিত্র বলে মনে করা হয়। তাই শিন্তো উপাসনালয়ে (Jinja) প্রবেশের আগে জল দিয়ে হাত ও মুখ ধুয়ে নিজেকে পবিত্র করার মতো শুদ্ধিকরণ আচার (Harai) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
    • উপাসনালয় ও উৎসব (Shrines and Festivals): শিন্তো উপাসনালয় বা ‘জিঞ্জা’ (Jinja) হলো কামিদের বাসস্থান। প্রতিটি জিঞ্জার প্রবেশপথে একটি ‘তোরি’ (Torii) নামক তোরণ থাকে, যা সাধারণ জগৎ থেকে পবিত্র জগতের সীমানা নির্দেশ করে। ‘মাৎসুরি’ (Matsuri) বা উৎসব হলো শিন্তো জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে কামিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে (Hardacre, 2017)।
    • বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্ক: জাপানে শিন্তো এবং বৌদ্ধধর্ম শত শত বছর ধরে একে অপরের সাথে মিলেমিশে বিকশিত হয়েছে। অনেক জাপানি নিজেদের একই সাথে শিন্তো এবং বৌদ্ধ উভয় হিসেবেই পরিচয় দেয়। জন্ম ও বিবাহের মতো আনন্দময় অনুষ্ঠানগুলো শিন্তো রীতিতে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো বিষাদময় অনুষ্ঠানগুলো বৌদ্ধ রীতিতে পালন করা একটি সাধারণ ব্যাপার।

এই প্রধান ধর্মগুলো ছাড়াও পৃথিবীতে আরও হাজারো ধর্ম ও বিশ্বাস ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, যা মানুষের চিন্তার বৈচিত্র্য এবং গভীরতাকে তুলে ধরে।

ধর্মের কাঠামোগত বৈচিত্র্য: প্রতিষ্ঠান থেকে লোকবিশ্বাস

ধর্মগুলোকে কেবল তাদের ঈশ্বর ধারণা বা ভৌগোলিক উৎস দিয়ে ভাগ করলেই চলে না, তাদের সাংগঠনিক কাঠামো এবং চর্চার পদ্ধতির মধ্যেও বিশাল পার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো ধর্ম অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক, যা একটি বহুজাতিক কর্পোরেশনের মতো কাজ করে। আবার কোনোটি সম্পূর্ণ লোকায়ত, অসংগঠিত এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল, যা একটি স্থানীয় পরিবারের গল্পের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজমান্তরে বাহিত হয়। এই বৈচিত্র্যকে বোঝা ধর্মকে বোঝার জন্য অপরিহার্য।

প্রাতিষ্ঠানিক বা সংগঠিত ধর্ম (Organized Religion): বিশ্বাসের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

যখন আমরা ‘ধর্ম’ শব্দটি ব্যবহার করি, তখন সাধারণত আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেই বুঝি। এর কিছু সাধারণ এবং সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এটিকে লোকবিশ্বাস থেকে আলাদা করে। এই কাঠামো ধর্মকে সময়ের স্রোতে টিকিয়ে রাখতে, ভৌগোলিকভাবে বিস্তার লাভ করতে এবং লক্ষ লক্ষ অনুসারীকে একটি অভিন্ন পরিচয়ের অধীনে আনতে সাহায্য করে।

  • নির্দিষ্ট ও প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ (Canonized Sacred Texts): প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের একটি মূল ভিত্তি হলো তার লিখিত ধর্মগ্রন্থ। এদের একটি বা একাধিক গ্রন্থ থাকে, যা ঐশ্বরিক বাণী বা সর্বোচ্চ সত্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থগুলো সাধারণত চূড়ান্ত এবং অপরিবর্তনীয় (Canonized) বলে মনে করা হয় (যেমন – বাইবেল, কুরআন, বেদ)। এই গ্রন্থগুলোই ধর্মের মূল মতবাদ, আইন, ইতিহাস এবং নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ক্যাননাইজেশনের প্রক্রিয়াটি প্রায়শই দীর্ঘ এবং বিতর্কিত হয়, যেখানে ধর্মীয় নেতারা সিদ্ধান্ত নেন কোন লেখাগুলো পবিত্র এবং প্রামাণ্য এবং কোনগুলো নয়।
  • পুরোহিততন্ত্র ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ (Priesthood/Clergy): একদল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকেন (যেমন – পাদ্রী, ইমাম, পুরোহিত, রাব্বি, ভিক্ষু), যারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা দেন, এবং সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন। তাদের একটি সুস্পষ্ট পদমর্যাদা (Hierarchy) থাকতে পারে, যেমন – ক্যাথলিক চার্চে পোপ, কার্ডিনাল, আর্চবিশপ ইত্যাদি। এই বিশেষজ্ঞ শ্রেণীটি ধর্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এবং সাধারণ অনুসারী (Laity) এবং পবিত্র জগতের (Sacred Realm) মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
  • আনুষ্ঠানিক উপাসনালয় (Formal Places of Worship): প্রার্থনা বা উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট এবং প্রায়শ-ই স্থাপত্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান থাকে (যেমন – গির্জা, মসজিদ, মন্দির, সিনাগগ)। এই স্থানগুলো কেবল উপাসনার জন্যই নয়, সামাজিক জমায়েত, ধর্মীয় শিক্ষা এবং সম্প্রদায়ের কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। এদের স্থাপত্য শৈলী প্রায়শই সেই ধর্মের বিশ্বদৃষ্টিকে প্রতিফলিত করে।
  • কঠোর ও সুনির্দিষ্ট মতবাদ (Dogma and Doctrine): এদের সুস্পষ্ট এবং প্রায়শই অলঙ্ঘনীয় কিছু বিশ্বাস বা মতবাদ থাকে, যা অনুসারীদের মেনে চলতে হয়। কে এই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত এবং কে নয়, তা এই মতবাদগুলোর ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়। এই মতবাদগুলো ধর্মীয় সম্মেলন বা কাউন্সিল (যেমন – খ্রিস্টধর্মের নিসিয়ার কাউন্সিল) দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে। যারা এই মতবাদগুলোকে অস্বীকার করে, তাদের প্রায়শই ধর্মদ্রোহী (Heretic) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
  • কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ও আমলাতন্ত্র (Central Authority and Bureaucracy): অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকে, যা বিশ্বজুড়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর সর্বোত্তম উদাহরণ হলো রোমান ক্যাথলিক চার্চ, যার কেন্দ্র ভ্যাটিকান এবং নেতৃত্বে রয়েছেন পোপ। এই কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় মতবাদের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে, সম্পত্তি পরিচালনা করে এবং বিশ্বজুড়ে ধর্মপ্রচার (Missionary) কার্যক্রম সমন্বয় করে।

সমাজবিজ্ঞানী রডনি স্টার্ক এবং উইলিয়াম বেইনব্রিজ (Stark & Bainbridge, 1985) ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে তাদের সামাজিক উত্তেজনার (Tension with society) মাত্রার উপর ভিত্তি করে চার্চ (Church), সম্প্রদায় (Denomination), উপদল (Sect), এবং কাল্ট (Cult) এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। চার্চ হলো প্রতিষ্ঠিত এবং সমাজের সাথে সম্পৃক্ত, আর কাল্ট বা উপদলগুলো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রায়শ-ই সংঘাতময়।

অসংগঠিত বা লোকধর্ম (Unorganized or Folk Religion): ঐতিহ্যের প্রবাহ

সংগঠিত ধর্মের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অসংখ্য লোকধর্ম প্রচলিত আছে, যেগুলোর কোনো কেন্দ্রীয় কাঠামো, লিখিত ধর্মগ্রন্থ বা আনুষ্ঠানিক পুরোহিততন্ত্র নেই। এগুলো সাধারণত স্থানীয় সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে থাকে, যেন মাটির গন্ধমাখা ঘাসের মতো।

  • মৌখিক ঐতিহ্য (Oral Tradition): এই ধর্মগুলোর বিশ্বাস, পুরাণ (Mythology), এবং কাহিনীগুলো লিখিত রূপের বদলে মুখে মুখে, গল্প, গান এবং আচারের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজমান্তরে বাহিত হয়। এর ফলে এই বিশ্বাসগুলো অনেক বেশি পরিবর্তনশীল এবং স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
  • স্থানীয় বিশ্বাস (Local Beliefs): এগুলো কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার (যেমন – একটি গ্রাম, একটি উপত্যকা) মানুষের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে (যেমন – কৃষিকাজ, শিকার, রোগ নিরাময়) অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে। এদের দেবতারাও প্রায়শই স্থানীয় – একটি নির্দিষ্ট নদী, পাহাড় বা জঙ্গলের আত্মা।
  • প্রকৃতি পূজা (Nature Worship): অনেক লোকধর্মে প্রকৃতিকে (যেমন – সূর্য, চন্দ্র, নদী, পর্বত, জঙ্গল) দেবতা বা পবিত্র আত্মা হিসেবে পূজা করা হয়। প্রকৃতিকে জীবন্ত এবং সচেতন সত্তা হিসেবে দেখা হয়।
  • পূর্বপুরুষ পূজা (Ancestor Worship): বিশ্বাস করা হয় যে, মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মারা জীবিতদের জীবনে ভালো বা মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে, তাই তাদের সম্মান, পূজা বা উৎসর্গ করা হয়। এটি পরিবার এবং বংশের ধারাবাহিকতাকে গুরুত্ব দেয়।
  • সমন্বয়বাদ (Syncretism): লোকধর্মগুলো প্রায়শ-ই অন্যান্য, বিশেষ করে প্রভাবশালী সংগঠিত ধর্মগুলোর সাথে মিশে গিয়ে একটি সমন্বিত রূপ ধারণ করে। যেমন, ল্যাটিন আমেরিকায় আফ্রিকান ঐতিহ্যবাহী ধর্মগুলো (যেমন – ইয়োরুবা ধর্ম) ক্যাথলিক ধর্মের সাধুদের (Saints) সাথে মিশে গিয়ে ভুডু (Voodoo) বা স্যান্টেরিয়া (Santería) এর মতো সমন্বয়বাদী ধর্মের জন্ম দিয়েছে। একইভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক লোকবিশ্বাসে হিন্দু বা ইসলামী উপাদানের সাথে স্থানীয় বিশ্বাসের মিশ্রণ দেখা যায়।

এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো:

  • সর্বপ্রাণবাদ (Animism): এটি সম্ভবত মানুষের প্রাচীনতম বিশ্বাস ব্যবস্থা। সর্বপ্রাণবাদীরা মনে করেন যে, কেবল মানুষ বা প্রাণী নয়, গাছপালা, পাথর, নদী, বাতাস – সবারই আত্মা বা চেতন সত্তা (Spirit/Soul) আছে। নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টাইলর (Edward Tylor) তার “Primitive Culture” (1871) গ্রন্থে এই ধারণাটিকে ধর্মের উৎপত্তির মূল ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাইবেরিয়া, আমাজন বা পাপুয়া নিউ গিনির অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে এখনও এই বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তাদের কাছে পুরো প্রকৃতিই জীবন্ত এবং আত্মাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা তাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
  • শামানিজম (Shamanism): এটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক চর্চা যা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পাওয়া যায়। শামানিজমে ‘শামান’ (Shaman) নামক একজন বিশেষ ব্যক্তি থাকেন, যিনি আত্মা জগতে (Spirit World) ভ্রমণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তিনি পরিবর্তিত চেতনার অবস্থায় (Altered State of Consciousness) প্রবেশ করে (যা প্রায়শই নাচ, গান, বা সাইকোঅ্যাকটিভ উদ্ভিদের মাধ্যমে অর্জিত হয়) আত্মা বা দেবতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং অসুস্থদের নিরাময়, ভবিষ্যতের পূর্বাভাস বা গোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান করেন। নৃবিজ্ঞানী মির্চা এলিয়াদ (Mircea Eliade) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “Shamanism: Archaic Techniques of Ecstasy” (1964)-এ দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শামানিক চর্চার মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে, যা এর একটি গভীর মানবীয় ভিত্তি নির্দেশ করে।
  • টোটেমবাদ (Totemism): এটি এমন একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা যেখানে একটি গোষ্ঠী বা বংশ নিজেদের কোনো নির্দিষ্ট প্রাণী, উদ্ভিদ বা প্রাকৃতিক বস্তুর (টোটেম) সাথে একটি বিশেষ রহস্যময় সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করে। এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim) মনে করতেন, টোটেম হলো সেই গোষ্ঠীরই প্রতীক, এবং টোটেমকে পূজা করার মাধ্যমে গোষ্ঠীটি আসলে নিজেদের সংহতিকেই পূজা করে।

এই লোকধর্মগুলো আধুনিক, সংগঠিত ধর্মগুলোর মতো প্রভাবশালী না হলেও, এগুলো মানুষের বিশ্বাসের বিবর্তনের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং মানব সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের এক অসাধারণ নিদর্শন।

সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস

ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সমষ্টি নয়; এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠানও বটে। মানুষ যেভাবে একত্রিত হয়ে তাদের বিশ্বাসকে প্রকাশ করে, সেই সংগঠনের ধরণই ধর্মের সামাজিক চরিত্রকে রূপ দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মকে তার সামাজিক সংগঠন, সদস্যপদ লাভের ধরণ, নেতৃত্বের কাঠামো এবং সমাজের মূলধারার সংস্কৃতির সাথে তার সম্পর্কের ভিত্তিতেও কয়েকটি আদর্শ ধরনে (Ideal Types) ভাগ করেছেন। এই শ্রেণীবিন্যাসটি মূলত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার (Max Weber) এবং তাঁর ছাত্র আর্নস্ট ট্রোলশ (Ernst Troeltsch) -এর কাজের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (Troeltsch, 1911/1992)। ট্রোলশ ‘চার্চ’ এবং ‘সেক্ট’-এর মধ্যে যে পার্থক্য নিরূপণ করেছিলেন, তা আজও সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞানীরা এই কাঠামোকে আরও পরিমার্জিত করে ‘ডিনোমিনেশন’ এবং ‘কাল্ট’ বা ‘নতুন ধর্মীয় আন্দোলন’ (NRM)-কে এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন। যেমন আগেই উল্লেখ করেছি, সমাজবিজ্ঞানী রডনি স্টার্ক এবং উইলিয়াম বেইনব্রিজ (Stark & Bainbridge, 1985) ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে তাদের সামাজিক উত্তেজনার (Tension with society) মাত্রার উপর ভিত্তি করে চার্চ (Church), সম্প্রদায় (Denomination), উপদল (Sect), এবং কাল্ট (Cult) এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এক্ষেত্রে চার্চ হলো প্রতিষ্ঠিত এবং সমাজের সাথে সম্পৃক্ত, আর কাল্ট বা উপদলগুলো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রায়শ-ই সংঘাতময়।

একলেসিয়া বা চার্চ (Ecclesia/Church)

সমাজতাত্ত্বিক পরিভাষায়, চার্চ বা একলেসিয়া হলো একটি বৃহৎ, সুসংগঠিত, আমলাতান্ত্রিক এবং প্রভাবশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা সমাজের মূলধারার সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং তাকে সমর্থন করে। এটি সমাজের বিদ্যমান সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধকে ঐশ্বরিকভাবে বৈধতা দেয়।

  • রাষ্ট্রের সাথে একীভূত: এর চূড়ান্ত রূপ হলো রাষ্ট্রধর্ম (State Religion), যেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে। রাষ্ট্র চার্চকে আর্থিক ও আইনি সহায়তা দেয়, এবং বিনিময়ে চার্চ রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ঐশ্বরিক অনুমোদন বা বৈধতা (Legitimacy) প্রদান করে। এক্ষেত্রে, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সীমানা প্রায় মিলে যায়। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক জন্মসূত্রে এই ধর্মের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ধর্মীয় ভিন্নমতকে প্রায়শই রাজনৈতিক বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হয়।
  • আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ: এখানে সদস্যপদ অর্জনের জন্য গভীর ব্যক্তিগত ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বা ধর্মান্তরের প্রয়োজন হয় না। একটি নির্দিষ্ট সমাজে বা পরিবারে জন্ম নেওয়াই সদস্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ধর্ম পালন এখানে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের চেয়েও বেশি একটি সামাজিক কর্তব্য। ভেবার যেমনটি উল্লেখ করেছেন, চার্চ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ ‘জন্মগ্রহণ করে’, স্বেচ্ছায় যোগদান করে না (Weber, 1922/1963)।
  • পেশাদার ও স্তরবিন্যাসযুক্ত পুরোহিত শ্রেণী: এর একটি প্রশিক্ষিত, পেশাদার এবং কঠোর স্তরবিন্যাসযুক্ত (Hierarchical) পুরোহিত শ্রেণী থাকে (যেমন: পোপ, কার্ডিনাল, বিশপ, পাদ্রী)। এই পুরোহিত শ্রেণী ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং সাধারণ মানুষের উপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার দায়িত্বে থাকে। তাদের ক্ষমতা আসে তাদের পদ বা অফিস থেকে, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা থেকে নয়।
  • উদাহরণ: মধ্যযুগীয় ইউরোপের রোমান ক্যাথলিক চার্চ ছিল একলেসিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, যা সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করত। আধুনিক উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের অ্যাংলিকান চার্চ (Church of England), ডেনমার্কের লুথারান চার্চ, সৌদি আরবের ওয়াহাবি ইসলাম বা থাইল্যান্ডের থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম

ডিনোমিনেশন (Denomination)

ডিনোমিনেশনও একটি বৃহৎ এবং সুসংগঠিত ধর্মীয় গোষ্ঠী, কিন্তু এটি একলেসিয়ার মতো রাষ্ট্রের সাথে একীভূত নয় এবং সমাজের উপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে না। এটি সাধারণত একটি ধর্মীয়ভাবে বহুত্ববাদী (Pluralistic) সমাজে অন্য অনেক গোষ্ঠীর পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে। সমাজবিজ্ঞানী এইচ. রিচার্ড নাইবুর (H. Richard Niebuhr) ডিনোমিনেশনকে দেখেছেন আমেরিকায় ইউরোপীয় চার্চ মডেলের একটি অভিযোজন হিসেবে, যেখানে কোনো একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর একাধিপত্য নেই (Niebuhr, 1929)।

  • রাষ্ট্র থেকে পৃথক: এটি রাষ্ট্রধর্ম নয় এবং রাষ্ট্রের সাথে এর কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের যে নীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা ডিনোমিনেশনাল কাঠামোর বিকাশের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
  • সহনশীলতা ও বহুত্ববাদ: ডিনোমিনেশনগুলো সাধারণত অন্য ডিনোমিনেশনের অস্তিত্বকে মেনে নেয় এবং তাদের প্রতি সহনশীল হয়। তারা নিজেদের মতবাদকে সঠিক বলে বিশ্বাস করলেও, সাধারণত নিজেদেরকে একমাত্র সত্যের ধারক বলে দাবি করে না এবং অন্য গোষ্ঠীর বৈধতাকে স্বীকার করে নেয়।
  • স্বেচ্ছাসেবী কিন্তু পারিবারিক: যদিও সদস্যপদ মূলত স্বেচ্ছাসেবী, তবে বেশিরভাগ সদস্যই পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে একটি নির্দিষ্ট ডিনোমিনেশনের অংশ হয়। এখানে চার্চের মতো জন্মসূত্রে স্বয়ংক্রিয় সদস্যপদ নেই, আবার সেক্টের মতো কঠোর ধর্মান্তরের অভিজ্ঞতাও বাধ্যতামূলক নয়।
  • উদাহরণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপ্টিস্ট, মেথডিস্ট, প্রেসবিটেরিয়ান, লুথারান ইত্যাদি বিভিন্ন খ্রিস্টান গোষ্ঠী হলো ডিনোমিনেশনের ক্লাসিক উদাহরণ। এরা প্রত্যেকেই খ্রিস্টধর্মের বৃহত্তর ঐতিহ্যের অংশ, কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, উপাসনার পদ্ধতি এবং সাংগঠনিক কাঠামোতে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইসলামের মধ্যে শিয়াসুন্নিদের বিভিন্ন উপগোষ্ঠী (যেমন: হানাফী, মালেকী) বা হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় (যেমন: বৈষ্ণব, শৈব)-কেও সমাজতাত্ত্বিকভাবে ডিনোমিনেশন হিসেবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

সেক্ট (Sect)

সেক্ট হলো মূল ধর্মীয় ধারা (চার্চ বা ডিনোমিনেশন) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী। ট্রোলশ-এর মতে, চার্চ যেখানে সমাজের সাথে আপোস করে, সেক্ট সেখানে সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

  • প্রতিবাদী চরিত্র: সেক্টের জন্মই হয় প্রতিবাদের মাধ্যমে। এরা মনে করে যে, মূল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি তার আদি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, জাগতিক ক্ষমতার সাথে আপোস করে ‘দূষিত’ হয়ে পড়েছে এবং পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতির পাপপূর্ণতাকে গ্রহণ করেছে। তাই তারা ধর্মের একটি ‘বিশুদ্ধ’, ‘আদি’ বা ‘অকৃত্রিম’ রূপে ফিরে যেতে চায়, যা তারা তাদের ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যায় খুঁজে পায়।
  • সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা: এরা প্রায়ই পারিপার্শ্বিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে নেতিবাচক ও শত্রুভাবাপন্ন দৃষ্টিতে দেখে এবং নিজেদের কিছুটা আলাদা করে রাখে। তারা নিজেদের একটি বিশেষ নির্বাচিত বা পবিত্র গোষ্ঠী (Elect Group) বলে মনে করে, যারা ঈশ্বরের চোখে অন্যদের চেয়ে আলাদা। এই বিচ্ছিন্নতা পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস বা জীবনযাত্রার বিশেষ রীতিনীতির মাধ্যমেও প্রকাশ পেতে পারে।
  • কঠোর সদস্যপদ ও নেতৃত্ব: সেক্টে সদস্যপদ জন্মসূত্রে পাওয়া যায় না, বরং এটি প্রাপ্তবয়স্কদের স্বেচ্ছাকৃত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় একটি গভীর ব্যক্তিগত ধর্মান্তর বা ‘নতুন জন্ম’-এর অভিজ্ঞতা এবং গোষ্ঠীর কঠোর নৈতিক নিয়মকানুন মেনে চলার অঙ্গীকার। এদের নেতৃত্ব প্রায়শই পেশাদার পুরোহিতদের পরিবর্তে ক্যারিশম্যাটিক এবং সাধারণ সদস্যদের মধ্য থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের হাতে থাকে।
  • গতিপথ: সেক্ট থেকে ডিনোমিনেশনে রূপান্তর: সমাজবিজ্ঞানী রডনি স্টার্ক এবং উইলিয়াম বেইনব্রিজ (Stark & Bainbridge, 1985) দেখিয়েছেন যে, সফল সেক্টগুলো সময়ের সাথে সাথে তাদের তীব্রতা হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মে এসে, সদস্যরা আর তাদের পূর্বপুরুষদের মতো সমাজ-বিরোধী থাকে না, তারা জাগতিক সাফল্য অর্জন করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গোষ্ঠীর কঠোরতা হ্রাস পায়। ফলে, সেক্টটি একটি ডিনোমিনেশনে রূপান্তরিত হয়। এই চক্রাকার প্রক্রিয়াটি ধর্মের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মেথডিজম বা পেন্টেকোস্টালিজম একসময় অ্যাংলিকান চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সেক্ট হিসেবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু আজ তারা বিশ্বজুড়ে সুপ্রতিষ্ঠিত ডিনোমিনেশন।

কাল্ট বা নতুন ধর্মীয় আন্দোলন (Cult or New Religious Movement – NRM)

‘কাল্ট’ শব্দটি সমাজবিজ্ঞানের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং ভুল বোঝা ধারণাগুলোর মধ্যে একটি। গণমাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের কাছে শব্দটি প্রায়ই একটি অত্যন্ত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয় (যেমন: ব্রেনওয়াশিং, যৌন নিপীড়ন, যৌথ আত্মহত্যা ইত্যাদি)। জোনসটাউন বা হেভেন’স গেট-এর মতো ঘটনা এই নেতিবাচক ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই নেতিবাচক অনুষঙ্গের কারণে, সমাজবিজ্ঞানীরা আজকাল এই শব্দটি এড়িয়ে চলেন এবং এর পরিবর্তে আরও নিরপেক্ষ শব্দ ‘নতুন ধর্মীয় আন্দোলন’ (New Religious Movement – NRM) ব্যবহার করতে পছন্দ করেন (Barker, 1989)।

একটি NRM এবং সেক্টের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, সেক্ট মূল ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাকে ‘শুদ্ধ’ করতে চায়, অন্যদিকে একটি NRM পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতির মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন বা বিদেশী একটি ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে আসে।

  • নতুন বা বিজাতীয় বিশ্বাস: একটি NRM-এর বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান পারিপার্শ্বিক সমাজের কাছে সম্পূর্ণ নতুন, অদ্ভুত বা বিজাতীয় (Alien) বলে মনে হয়। এটি হতে পারে কোনো পুরনো ধর্মের একটি আমূল নতুন ব্যাখ্যা (যেমন: ইউনিফিকেশন চার্চ), অথবা বিভিন্ন ধর্মের ধারণার এক অভিনব মিশ্রণ বা সিনক্রেটিজম (যেমন: থিওসফি), অথবা সম্পূর্ণ নতুন কোনো প্রত্যাদেশ বা ভিনগ্রহের প্রাণীর বার্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বিশ্বাস (যেমন: সায়েন্টোলজি বা রায়েলিজম)।
  • ক্যারিশম্যাটিক নেতা (Charismatic Leader): NRM-গুলোর নেতৃত্বে প্রায়শই একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী, সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং দেবতুল্য নেতা থাকেন, যার কথাকে সদস্যরা চূড়ান্ত বলে মনে করে এবং প্রশ্নাতীতভাবে অনুসরণ করে। ম্যাক্স ভেবার (Max Weber) এই ধরনের কর্তৃত্বকে ‘ক্যারিশম্যাটিক অথরিটি’ বলে অভিহিত করেছেন, যা ঐতিহ্যগত বা আইনগত কর্তৃত্বের বাইরে এক ধরনের বিপ্লবী শক্তি হিসেবে কাজ করে।
  • সমাজের সাথে সংঘাত: তাদের নতুন এবং অপ্রচলিত বিশ্বাস ও জীবনযাত্রার কারণে NRM-গুলো প্রায়শই সমাজের মূল স্রোত, গণমাধ্যম এবং এমনকি পরিবারের সদস্যদের সাথেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। গণমাধ্যম প্রায়শই এদেরকে বিপজ্জনক ‘কাল্ট’ হিসেবে চিত্রিত করে, যা এদের সম্পর্কে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে।
  • অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ: বেশিরভাগ NRM-ই তাদের ক্যারিশম্যাটিক নেতার মৃত্যুর পর বিলুপ্ত হয়ে যায়, কারণ ক্যারিশমা সহজে হস্তান্তরযোগ্য নয়। এই সমস্যাকে ভেবার ‘ক্যারিশমার রুটিনাইজেশন’ (Routinization of Charisma) বলে অভিহিত করেছেন। যদি কোনো NRM টিকে থাকতে চায়, তবে তাকে তার প্রতিষ্ঠাতার ক্যারিশমাকে একটি স্থায়ী আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, নিয়মকানুন এবং ঐতিহ্যের মধ্যে রূপান্তরিত করতে হয়। যদি এটি সফল হয়, তবে কালক্রমে এটিও একটি ডিনোমিনেশন বা এমনকি একটি নতুন বিশ্বধর্মে পরিণত হতে পারে। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর প্রায় সব বড় ধর্মই – খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম – তাদের ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে একটি ছোট, প্রান্তিক এবং সমাজের চোখে ‘বিজাতীয়’ গোষ্ঠী বা NRM হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিল।

এই চারটি আদর্শ ধরন আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, ধর্ম কেবল বিশ্বাসের একটি সেট নয়, এটি একটি সামাজিক জীব, যা সমাজের সাথে বিভিন্ন উপায়ে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়।

ধর্মের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রূপ: এসোটেরিসিজম ও এক্সোটেরিসিজম (Esotericism and Exotericism)

ধর্মের শ্রেণীবিন্যাস বা প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করার সময় আমরা সাধারণত একেশ্বরবাদ, বহুদেবতাবাদ কিংবা সর্বপ্রাণবাদের মতো কাঠামোবদ্ধ ভাগগুলোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিই। কিন্তু ধর্মের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর বিভাজনরেখা রয়েছে, যা ধর্মের অনুভূমিক (Horizontal) বিস্তৃতির পরিবর্তে এর উলম্ব (Vertical) গভীরতাকে নির্দেশ করে। এই বিভাজনটি হলো এক্সোটেরিসিজম (Exotericism) বা ধর্মের বাহ্যিক, প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক রূপ এবং এসোটেরিসিজম (Esotericism) বা ধর্মের অভ্যন্তরীণ, গূঢ় ও গুপ্ত রূপের মধ্যে পার্থক্য। গ্রিক শব্দ ‘Exo’ (বাহির) এবং ‘Eso’ (ভেতর) থেকে উদ্ভূত এই শব্দদ্বয় নির্দেশ করে যে, প্রতিটি প্রধান ধর্মেরই দুটি সত্তা রয়েছে: একটি হলো তার খোলস বা শরীর, যা সমাজের সকলের জন্য উন্মুক্ত; আর অন্যটি হলো তার শাঁস বা আত্মা, যা কেবল দীক্ষাপ্রাপ্ত বা আধ্যাত্মিক যোগ্যতাসম্পন্ন অল্প কিছু মানুষের জন্য সংরক্ষিত। এই দ্বৈততাকে প্রায়শই একটি বৃত্তের উপমায় ব্যাখ্যা করা হয়। ইসলামের উদাহরণ দিয়েই বলা যাক। এখানে বৃত্তের পরিধি হলো এক্সোটেরিক শরিয়াহ বা আইন, যা সবাইকে ঘিরে রাখে; বৃত্তের ব্যাসার্ধ হলো এসোটেরিক পথ বা তরিকত, যা পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে যায়; আর বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হলো পরম সত্য বা হাকিকত। ধর্মের এই গঠনগত বিভাজন বুঝতে পারাটা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি আমাদের দেখায় কীভাবে একই ধর্মের ছাতার নিচে কট্টর আইনবাদী এবং উদার মরমী সাধক – উভয়েই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সত্যের দাবি করতে পারেন।

এক্সোটেরিসিজম (Exotericism): প্রকাশ্য ও সার্বজনীন ধর্ম

এক্সোটেরিসিজম (Exotericism) হলো ধর্মের সেই রূপ যা সাধারণ জনসাধারণের জন্য অভিপ্রেত এবং যা সমাজের সকলের কাছে সহজবোধ্য ও পালনযোগ্য। এটি ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এবং আইনগত কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এখানে ধর্মের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তিগত মোক্ষ লাভের চেয়েও বেশি সামাজিক সংহতি রক্ষা করা এবং একটি নৈতিক ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করা। এক্সোটেরিসিজম (Exotericism) বিশ্বাস করে যে, মানুষের মুক্তির জন্য ঈশ্বরপ্রদত্ত বা প্রথাগত আইনকানুন, আচার-অনুষ্ঠান এবং নৈতিক বিধিনিষেধ মেনে চলাই যথেষ্ট। এই স্তরে ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা সাধারণত আক্ষরিক (Literal) হয়ে থাকে এবং বিশ্বাসীদের কাছে ঈশ্বরকে একটি বাহ্যিক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যিনি বিচারক ও শাসনকর্তা। এখানে ঈশ্বর এবং মানুষের সম্পর্কটি মূলত ‘প্রভু ও দাসের’ সম্পর্ক।

এক্সোটেরিক ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এর ডগমা বা মতবাদ (Dogma), আনুষ্ঠানিক আচার বা রিচুয়াল (Ritual), এবং একটি সুসংগঠিত সম্প্রদায়। যেহেতু এটি সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য – যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সমান নয় – তাই এর শিক্ষাগুলো সহজ, স্পষ্ট এবং সর্বজনীন হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামে শরিয়াহ (Sharia), ইহুদিধর্মে হালাখা (Halakha) বা ধর্মীয় আইন, হিন্দুধর্মে বর্ণাশ্রম ধর্ম (Varnashrama Dharma)কর্মকাণ্ড (Karma Kanda), এবং খ্রিস্টধর্মে চার্চের ক্যানন ল (Canon Law) বা ধর্মীয় অনুশাসনগুলো হলো এক্সোটেরিসিজমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই আইন ও নিয়মগুলো সমাজকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করে এবং ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে রেখে পাপ থেকে বিরত রাখে। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim) ধর্মের এই সামাজিক ও সংহতিমূলক দিকটির উপরই জোর দিয়েছিলেন, যেখানে আচার-অনুষ্ঠানগুলো সমষ্টিগত চেতনা বা কালেক্টিভ কনশাসনেস (Collective Consciousness) তৈরি করে। এক্সোটেরিক ধর্মে ‘বিশ্বাস’ (Faith/Belief) বা ঈমানের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এখানে সত্যকে সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানার চেয়ে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের (যেমন: ধর্মগ্রন্থ বা পুরোহিত) কথার ওপর আস্থা স্থাপন করাই প্রধান। তবে এর সীমাবদ্ধতা হলো, এটি প্রায়শই খুব বেশি যান্ত্রিক বা আইনসর্বস্ব (Legalistic) হয়ে পড়তে পারে, যেখানে আচারের বাহ্যিক দিকটি মুখ্য হয়ে ওঠে এবং আধ্যাত্মিক নির্যাসটি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এসোটেরিসিজম (Esotericism): গূঢ় ও গোপন জ্ঞান

অন্যদিকে, এসোটেরিসিজম (Esotericism) হলো ধর্মের সেই অভ্যন্তরীণ মাত্রা যা বাহ্যিক রূপ বা আচারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীরতর সত্যকে উন্মোচন করতে চায়। এটি কেবল বিশ্বাস বা আচারের সমষ্টি নয়, বরং এটি হলো নোসিস (Gnosis) বা অপরোক্ষ জ্ঞানের পথ। এসোটেরিকরা মনে করেন, ধর্মগ্রন্থ বা আচারের বাহ্যিক রূপটি হলো কেবল একটি প্রতীক (Symbol) বা সংকেত, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক শাশ্বত সত্য। এই সত্যকে কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক পড়াশোনা বা তর্কের মাধ্যমে জানা যায় না; একে জানতে হলে প্রয়োজন আত্ম-রূপান্তর এবং আধ্যাত্মিক সাধনা। তাই এসোটেরিসিজম প্রায়শই দীক্ষা (Initiation) বা বায়াত গ্রহণের উপর নির্ভর করে, যেখানে একজন গুরুর তত্ত্বাবধানে শিষ্যকে গোপন জ্ঞানের অধিকারী করা হয়। এখানে ঈশ্বর কোনো দূরবর্তী বিচারক নন, বরং তিনি মানুষের আত্মার গভীরে বা প্রকৃতির প্রতিটি অণুতে সুপ্ত অবস্থায় বিরাজমান এক পরম সত্তা।

এসোটেরিসিজমের মূল কথা হলো, মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য কেবল স্বর্গে যাওয়া বা নরক থেকে মুক্তি পাওয়া নয়, বরং নিজের প্রকৃত সত্তাকে উপলব্ধি করা এবং সেই পরম উৎসের সাথে একীভূত হওয়া – যাকে সুফিরা ফানা (Fana), বৈদান্তিকরা মোক্ষ (Moksha), বা খ্রিস্টান মরমীরা ইউনিও মিস্টিকা (Unio Mystica) বলেন। এটি সর্বজনীন নয়, বরং এটি তাদের জন্যই যারা সাধারণ আচারের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস ও যোগ্যতা রাখেন। ঐতিহাসিকভাবে, এসোটেরিক জ্ঞানকে প্রায়শই গোপন রাখা হতো (Arcane discipline), কারণ মনে করা হতো যে, অপ্রস্তুত বা অযোগ্য ব্যক্তির হাতে এই জ্ঞান পড়লে তা ভুল বোঝা হতে পারে বা ধর্মের সামাজিক কাঠামোকে (এক্সোটেরিক দিক) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামের অভ্যন্তরে সুফিবাদ (Sufism) বা তাসাউফ, ইহুদিধর্মে কাবালাহ (Kabbalah), খ্রিস্টধর্মে নস্টিসিজম (Gnosticism) ও মরমীবাদ, এবং হিন্দুধর্মে বেদান্ত (Vedanta) বা উপনিষদের দর্শন হলো এসোটেরিক ধারার ধ্রুপদী উদাহরণ। তবে এসোটেরিসিজম বা গুহ্যবাদের একটি বিপদ হলো, এটি যদি বাহ্যিক আইন বা এক্সোটেরিক কাঠামোকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, তবে তা অ্যান্টিনোমিয়ানিজম (Antinomianism) বা নৈতিকতা-বিবর্জিত স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নিতে পারে। তাই ইতিহাসে দেখা যায়, শ্রেষ্ঠ মরমী সাধকরা – যেমন আল-গাজ্জালি (Al-Ghazali) বা আদি শঙ্করাচার্য (Adi Shankara) – সর্বদাই শরিয়াহ বা বাহ্যিক আচরণের সাথে অভ্যন্তরীণ সাধনার একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।

বিভিন্ন ধর্মে এসোটেরিক ও এক্সোটেরিক ধারা

পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখব, এই দুটি ধারা কীভাবে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়েছে এবং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। আবার কখনো কখনো এদের মধ্যে তীব্র সংঘাতও তৈরি হয়েছে, যেখানে এক্সোটেরিকরা এসোটেরিকদের ধর্মদ্রহী বা নাস্তিক বলে অভিযুক্ত করেছে।

  • ইসলাম: ইসলামের ইতিহাসে এই দ্বৈততা অত্যন্ত স্পষ্ট। একদিকে রয়েছে শরিয়াহ (Sharia), যা কুরআনহাদিসের স্পষ্ট নির্দেশাবলীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইন ব্যবস্থা। এটি হলো ইসলামের এক্সোটেরিক বা প্রকাশ্য রূপ, যা সালাত, সাওম, জাকাত ইত্যাদি আচারের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে একত্রিত রাখে। অন্যদিকে রয়েছে তরিকত (Tariqa) বা সুফিবাদ, যা ইসলামের এসোটেরিক বা বাতেনি দিক। সুফিরা কুরআনের আয়াতগুলোর রূপক বা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা (Ta’wil) খোঁজেন। বিখ্যাত সুফি দার্শনিক ইবনুল আরাবি (Ibn Arabi) তাঁর ওয়াহদাতুল উজুদ (Wahdat al-Wujud) বা ‘সত্তার একত্ব’ তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, বাহ্যিক বৈচিত্র্যের আড়ালে একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন চূড়ান্ত বাস্তবতা। তবে মূলধারার সুফিরা বিশ্বাস করেন, শরিয়াহ হলো সেই নৌকা যার মাধ্যমে তরিকতের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হাকিকত বা সত্যের দ্বীপে পৌঁছানো যায়; নৌকা ছাড়া সমুদ্র পাড়ি দেওয়া যেমন অসম্ভব, শরিয়াহ ছাড়াও আধ্যাত্মিকতা অর্থহীন।
  • ইহুদিধর্ম: ইহুদিধর্মে এক্সোটেরিক দিকটি তোরাহ (Torah) এবং তালমুদের (Talmud) কঠোর আইনের মধ্যে নিহিত। কিন্তু এর গভীরে রয়েছে কাবালাহ (Kabbalah) নামক এক অত্যন্ত জটিল ও সমৃদ্ধ এসোটেরিক ঐতিহ্য। মধ্যযুগে স্পেনে রচিত জোহর (The Zohar) গ্রন্থে কাবালিস্টিক দর্শনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। কাবালাহ অনুযায়ী, তোরাহর প্রতিটি অক্ষর ও শব্দের গাণিতিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ রয়েছে। তারা সেফিরত (Sefirot) বা ঐশ্বরিক গুণাবলীর দশটি স্তরের মাধ্যমে অসীম ঈশ্বর (Ein Sof) থেকে সসীম জগত সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। বিশিষ্ট গবেষক গারশম শোলেম (Gershom Scholem) দেখিয়েছেন যে, কীভাবে কাবালাহ ইহুদি আইনের শুষ্ক কাঠামোর ভেতরে প্রাণের সঞ্চার করেছিল এবং ইহুদিদের নির্বাসিত জীবনের দুঃখকষ্টকে এক মহাজাগতিক নাটকের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল (Scholem, 1995)।
  • হিন্দুধর্ম: হিন্দুধর্মের গঠন কিছুটা ভিন্ন, কারণ এখানে এক্সোটেরিক ও এসোটেরিক সীমানা অস্পষ্ট। তবুও, বেদের কর্মকাণ্ড (Karma Kanda) অংশটি – যা যজ্ঞ, বলিদান এবং সামাজিক বর্ণপ্রথার নিয়মাবলী নিয়ে গঠিত – তাকে এক্সোটেরিক বলা যেতে পারে। অন্যদিকে, জ্ঞানকাণ্ড (Jnana Kanda) বা উপনিষদ ও আরণ্যক অংশটি – যা আত্ম-উপলব্ধি, ব্রহ্মজ্ঞান এবং ধ্যানের কথা বলে – তা হলো এসোটেরিক। অদ্বৈত বেদান্ত (Advaita Vedanta) দর্শনে এই পার্থক্যটি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে সাকার ঈশ্বরের পূজা বা ভক্তিকে চিত্তশুদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় মনে করা হয় (যা এক্সোটেরিক), কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তির জন্য নিরাকার ব্রহ্মের জ্ঞান বা ‘আমিই ব্রহ্ম’ (অহং ব্রহ্মাস্মি) এই উপলব্ধিকে অপরিহার্য বলা হয় (যা এসোটেরিক)।
  • খ্রিস্টধর্ম: খ্রিস্টধর্মে চার্চের প্রাতিষ্ঠানিক মতবাদ, স্যাক্রামেন্ট এবং বাইবেলের নৈতিক শিক্ষাগুলো হলো এক্সোটেরিক। কিন্তু এর বিপরীতে প্রথম থেকেই নস্টিসিজম (Gnosticism) বা জ্ঞানমার্গী এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন মরমী ধারার (Christian Mysticism) উদ্ভব ঘটেছিল। মধ্যযুগীয় মরমী সাধক মেইস্টার একহার্ট (Meister Eckhart) এমন সব কথা বলেছিলেন যা চার্চের প্রচলিত ধারণার বাইরে ছিল। তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরের ধারণার (God) বাইরেও এক ‘গডহেড’ (Godhead) বা নির্বিশেষ সত্তা আছে, যেখানে মানুষের আত্মা বিলীন হয়ে যায়। একহার্টের এই ধরনের এসোটেরিক চিন্তাধারা তাকে চার্চের সাথে সংঘাতে জড়িয়েছিল, কারণ তা সাধারণ মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে ছিল।

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি: ঐতিহ্যবাদী স্কুল (Traditionalist School)

বিংশ শতাব্দীতে এসোটেরিসিজম ও এক্সোটেরিসিজমের সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে গভীর তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন রেনে গেনোঁ (René Guénon) এবং ফ্রিটজফ শুয়োন (Frithjof Schuon)-এর মতো দার্শনিকরা, যারা সম্মিলিতভাবে ঐতিহ্যবাদী স্কুল (Traditionalist School) বা পেরেনিয়ালিস্ট স্কুল (Perennialist School) নামে পরিচিত। তাঁরা দাবি করেন যে, পৃথিবীর সকল প্রধান ধর্মের মূলে এক শাশ্বত জ্ঞান বা সোফিয়া পেরেনিস (Sophia Perennis) রয়েছে।

ফ্রিটজফ শুয়োন (Frithjof Schuon) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Transcendent Unity of Religions (১৯৪৮)-এ যুক্তি দেন যে, ধর্মগুলোর মধ্যে বাহ্যিক বা এক্সোটেরিক স্তরে (Dogmatic level) পার্থক্য ও বিরোধ থাকাটাই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। কারণ প্রতিটি ধর্ম একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, সময় এবং জাতির মানসিকতা অনুযায়ী অবতীর্ণ হয়েছে। তাই খ্রিস্টধর্মের ডগমা এবং ইসলামের শরিয়াহর মধ্যে পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু এসোটেরিক বা আধ্যাত্মিক স্তরে (Metaphysical level) গিয়ে সকল ধর্ম এক বিন্দুতে মিলিত হয়। তিনি একে একটি পাহাড়ের উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন: পাহাড়ের পাদদেশে (এক্সোটেরিক স্তর) বিভিন্ন রাস্তা একে অপরের থেকে অনেক দূরে এবং ভিন্ন ভিন্ন দিকে অবস্থিত। কিন্তু যতই উপরে ওঠা যায় (এসোটেরিক সাধনা), রাস্তাগুলো একে অপরের তত কাছাকাছি আসতে থাকে। এবং অবশেষে চূড়ায় (পরম সত্য) গিয়ে সব রাস্তা এক হয়ে যায় (Schuon, 1984)। রেনে গেনোঁ (René Guénon) মনে করতেন, আধুনিক বিশ্বের প্রধান সংকট হলো মানুষ কেবল বস্তুজগত এবং ধর্মের বাহ্যিক খোসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং এই আদি ও অকৃত্রিম এসোটেরিক জ্ঞান বা ‘মেটাফিজিক্স’ হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর মতে, প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিকতা (Intellectuality) মানে কেবল যুক্তিতর্ক নয়, বরং তা হলো সেই অতিজাগতিক সত্যকে প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা যা আধুনিক পশ্চিমে লুপ্তপ্রায় (Guénon, 2001)।

পশ্চিমা গুহ্যবাদ (Western Esotericism): একটি ভিন্ন প্রেক্ষিত

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এতক্ষণ আমরা যে এসোটেরিসিজম নিয়ে আলোচনা করলাম, তা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ‘ভেতরের দিক’ বা মরমীবাদ। কিন্তু আধুনিক ধর্মতত্ত্বে এবং ইতিহাসের আলোচনায় ওয়েস্টার্ন এসোটেরিসিজম (Western Esotericism) নামে একটি স্বতন্ত্র গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যা কিছুটা ভিন্ন অর্থ বহন করে। এটি কেবল ধর্মের অভ্যন্তরীণ দিক নয়, বরং এটি রেনেসাঁস সময় থেকে ইউরোপে গড়ে ওঠা বিশেষ কিছু বিকল্প আধ্যাত্মিক ধারাকে নির্দেশ করে, যা চার্চের মূলধারা এবং আধুনিক বিজ্ঞান – উভয় থেকেই আলাদা। এর মধ্যে রয়েছে আলকেমি (Alchemy), জ্যোতিষশাস্ত্র (Astrology), হারমেটিসিজম (Hermeticism), রোজিক্রুশিয়ানিজম (Rosicrucianism), ফ্রিম্যাসনরি (Freemasonry) এবং পরবর্তীতে থিওসফি (Theosophy)

বিশিষ্ট ফরাসি পণ্ডিত অঁতোয়ান ফাভ্রে (Antoine Faivre) পশ্চিমা এসোটেরিসিজমকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য চারটি প্রধান এবং দুটি গৌণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এসোটেরিক চিন্তাধারার মূলে রয়েছে: ১) করেসপন্ডেন্স (Correspondences) বা অনুষঙ্গ – অর্থাৎ বিশ্বাস করা যে মহাবিশ্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তুর মধ্যে (যেমন: নক্ষত্র ও মানুষের ভাগ্য, ধাতু ও গ্রহ) এক প্রতীকী ও বাস্তবিক সংযোগ রয়েছে (“As above, so below”); ২) লিভিং নেচার (Living Nature) – অর্থাৎ প্রকৃতি কোনো মৃত যন্ত্র নয়, বরং এটি এক জীবন্ত সত্তা যা জাদুকরী শক্তিতে পূর্ণ; ৩) ইমাজিনেশন ও মিডিয়শন (Imagination and Mediations) – অর্থাৎ মানুষের কল্পনাশক্তি এবং মধ্যস্থতাকারী প্রতীক বা অ্যাঞ্জেলের মাধ্যমে উচ্চতর স্তরের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব; এবং ৪) ট্রান্সমিউটেশন (Transmutation) – অর্থাৎ বস্তুর রূপান্তর (যেমন আলকেমিতে সিসা থেকে সোনা) বা আত্মার রূপান্তরের মাধ্যমে পুনর্জন্ম লাভ করা (Faivre, 1994)। আধুনিক ঐতিহাসিক উটার হানেগ্রাফ (Wouter Hanegraaff) এই ধারাটিকে “প্রত্যাখ্যাত জ্ঞান” (Rejected Knowledge) হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ জ্ঞানালোকের যুগ (Enlightenment) এবং প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের পর এই ধরনের চর্চাগুলোকে কুসংস্কার বা অযৌক্তিক বলে মূলধারা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল (Hanegraaff, 2013)। তবুও, নিউ এজ (New Age) আন্দোলন এবং আধুনিক আধ্যাত্মিকতার বিকাশে এই পশ্চিমা গুহ্যবাদের প্রভাব অপরিসীম।

খোলস ও শাঁসের অপরিহার্যতা

পরিশেষে বলা যায়, এসোটেরিসিজম ও এক্সোটেরিসিজম হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এক্সোটেরিসিজম ছাড়া ধর্ম নিরাশ্রয়, আর এসোটেরিসিজম ছাড়া ধর্ম প্রাণহীন। বিশিষ্ট ইসলামি দার্শনিক সাইয়্যেদ হোসেইন নসর (Seyyed Hossein Nasr)-এর মতে, ধর্মের এই দুই দিকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হলো ঐতিহ্যগত সমাজের বৈশিষ্ট্য। যখন কোনো সমাজ কেবল এক্সোটেরিক বা বাহ্যিক আচারের ওপর জোর দেয়, তখন তা ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের জন্ম দেয়, কারণ সেখানে দয়া, প্রেম ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির স্থান থাকে না। আবার যখন কোনো গোষ্ঠী বাহ্যিক অনুশাসনকে তুচ্ছজ্ঞান করে কেবল এসোটেরিক বা গোপন জ্ঞানের দাবি করে, তখন তা অনেক সময় সিউডো-স্পিরিচুয়ালিটি (Pseudo-spirituality) বা বিভ্রান্তিকর কাল্টে পরিণত হয় (Nasr, 1981)। একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় জীবনের জন্য প্রয়োজন এক্সোটেরিক শৃঙ্খলার কঠোর পাত্র এবং এসোটেরিক জ্ঞানের অমৃত সুধা – উভয়েরই সহাবস্থান। আধুনিক যুগে মানুষের বিশ্বাসের সংকট ও আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাতে এই দুই ধারার পারস্পরিক সম্পর্ক ও গুরুত্ব অনুধাবন করা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আধুনিক যুগে বিশ্বাসের নতুন রূপ: সংকট ও সম্ভাবনা

বিশ্বায়ন, বিজ্ঞান, ইন্টারনেট এবং ধর্মনিরপেক্ষতার (Secularism) যুগে বিশ্বাসের ধারণাটিও স্থির নেই। এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, ভাঙছে এবং নতুন রূপ নিচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য আজ এক নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। আধুনিকতার শক্তিগুলো – বিশেষ করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism), ভোক্তা সংস্কৃতি (Consumer Culture) এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ – এক ধরনের “আধ্যাত্মিক বাজার” (Spiritual Marketplace) তৈরি করেছে। এই বাজারে মানুষ আর শুধুমাত্র জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছে না; তারা সক্রিয়ভাবে এমন বিশ্বাস ও জীবনদর্শন খুঁজছে যা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় দুটি প্রধান ধারার জন্ম হয়েছে। একদিকে যেমন মৌলবাদের (Fundamentalism) উত্থান ঘটছে, যা আধুনিকতার আপেক্ষিকতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক এবং অপরিবর্তনীয় সত্যের মধ্যে নিরাপত্তা খোঁজে, তেমনই অন্যদিকে বিশ্বাসের জগৎ আরও বেশি ব্যক্তিগত, সংকলনধর্মী এবং অ-প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠছে। মানুষের অর্থ খোঁজার আকাঙ্ক্ষা কমেনি, বরং সেই আকাঙ্ক্ষা নতুন নতুন পথে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অধ্যায়ে আমরা বিশ্বাসের এই আধুনিক রূপগুলো – এবং তাদের সংকট ও সম্ভাবনা – নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

নতুন ধর্মীয় আন্দোলন (New Religious Movements – NRMs)

বিগত দুই শতাব্দীতে, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর থেকে, অনেক নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে, যেগুলোকে সমাজবিজ্ঞানীরা সম্মিলিতভাবে NRM হিসেবে চিহ্নিত করেন। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এদের অনেক সময় ‘কাল্ট’ (Cult) বলে হেয় করা হয়, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই শব্দটি নিরপেক্ষ এবং এটি এমন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বোঝায় যার বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান তার পারিপার্শ্বিক প্রভাবশালী সংস্কৃতি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন।

  • উৎপত্তি ও আবেদন:
    সমাজবিজ্ঞানী ব্রায়ান উইলসন (Bryan Wilson) দেখিয়েছেন যে, দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন, ধর্মনিরপেক্ষায়ন, এবং সাংস্কৃতিক সংকট বা অ্যানোমি (Anomie – অর্থাৎ, সামাজিক নিয়মকানুন ও পরিচয়ের ভাঙন)-র প্রেক্ষাপটে NRMs-এর আবির্ভাব ঘটে (Wilson, 1982)। যখন প্রচলিত ধর্মগুলো আধুনিক মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় – যখন তাদের আচার-অনুষ্ঠান প্রাণহীন এবং মতবাদগুলো আধুনিক জীবনের জটিলতার সাথে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় – তখন NRMs সেই শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করে। এরা প্রায়শই একটি শক্তিশালী, ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়, জীবনের একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য এবং এক ধরনের বিশেষ জ্ঞান বা মুক্তির পথ প্রদান করে, যা আধুনিক বিচ্ছিন্ন এবং অর্থহীনতার সংকটে ভোগা সমাজে অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় মনে হয়। সমাজবিজ্ঞানী রডনি স্টার্ক (Rodney Stark) এবং উইলিয়াম বেইনব্রিজ (William Bainbridge) তাদের “ধর্মের যুক্তিসঙ্গত পছন্দ তত্ত্ব” (Rational Choice Theory of Religion)-তে যুক্তি দেন যে, NRMs বাজারে এমন এক চাহিদা পূরণ করে যা মূলধারার ধর্মগুলো উপেক্ষা করে গেছে।
  • বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ:
    NRMs-এর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন – এগুলোর নেতৃত্বে সাধারণত একজন সম্মোহনী বা ক্যারিশম্যাটিক নেতা (Charismatic Leader) থাকেন, এদের বিশ্বাস প্রায়শই সমন্বয়বাদী (Syncretic) হয় (অর্থাৎ, বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন থেকে উপাদান গ্রহণ করে), এবং এরা সমাজের মূলধারার সাথে এক ধরনের উত্তেজনার (Tension) মধ্যে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী রয় ওয়ালিস (Roy Wallis) তাদের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে NRMs-কে তিনটি আদর্শ ধরনে ভাগ করেছেন (Wallis, 1984):
    1. জগৎ-প্রত্যাখ্যানকারী (World-Rejecting): এই আন্দোলনগুলো পারিপার্শ্বিক সমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত, পাপপূর্ণ এবং ধ্বংসের পথে ধাবমান বলে মনে করে। তাই তারা সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে একটি সাম্প্রদায়িক জীবনযাপন করে। এদের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রায়শই পারলৌকিক মুক্তি। পিপলস টেম্পল (জোনসটাউন) বা হেভেন’স গেট এর চরম উদাহরণ।
    2. জগৎ-স্বীকারকারী (World-Affirming): এরা জগৎকে প্রত্যাখ্যান করে না, বরং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সক্ষমতাকে বিকশিত করে এই জগতেই সাফল্য, সুখ এবং পরিপূর্ণতা অর্জনের উপায় বাতলে দেয়। এরা প্রায়শই ধর্মের চেয়ে থেরাপি বা আত্ম-উন্নয়ন পদ্ধতির মতো কাজ করে। সাইন্টোলজি বা ট্রান্সসেন্ডেন্টাল মেডিটেশন (TM) এর উদাহরণ।
    3. জগৎ-অভিযোজনকারী (World-Accommodating): এই আন্দোলনগুলো জগৎকে পরিবর্তন বা প্রত্যাখ্যান করতে চায় না, বরং তারা ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধর্মীয় জীবন এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার উপর জোর দেয়। এরা ব্যক্তির জাগতিক জীবনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আনার দাবি করে না। নব্য-পেন্টেকস্টালিজম (Neo-Pentecostalism) এর একটি উদাহরণ।
  • উদাহরণ:
    • সাইন্টোলজি (Scientology): কল্পবিজ্ঞান লেখক এল. রন হাবার্ড (L. Ron Hubbard) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এটি এক ধরনের মনো-আধ্যাত্মিক থেরাপি বা ‘অডিটিং’ (Auditing)-এর মাধ্যমে মানুষকে তার অতীতের মানসিক আঘাতের ছাপ (Engrams) থেকে মুক্ত করে তার প্রকৃত আধ্যাত্মিক সত্তা বা ‘থেটান’ (Thetan) সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করে বলে দাবি করে। এটি একটি জগৎ-স্বীকারকারী NRM-এর আদর্শ উদাহরণ, যা তার অনুসারীদের উন্নততর যোগাযোগ দক্ষতা এবং কর্মজীবনে সাফল্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
    • রায়েলিজম (Raëlism): ফরাসি সাংবাদিক ক্লদ ভরিলহন (Claude Vorilhon) বা ‘রায়েল’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ইউএফও (UFO) ধর্ম। তারা বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীর সমস্ত জীবন ‘এলোহিম’ (Elohim) নামক একদল উন্নত ভিনগ্রহের বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরীক্ষাগারে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর নবীরা (যেমন – যিশু, মুহাম্মদ, বুদ্ধ) ছিলেন এলোহিমেরই প্রেরিত দূত।
    • উইকা (Wicca): এটি একটি আধুনিক পৌত্তলিক (Pagan) ধর্ম, যা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে জেরাল্ড গার্ডনার (Gerald Gardner) দ্বারা জনপ্রিয় হয়। এটি প্রাক-খ্রিস্টীয় ইউরোপীয় লোকবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং প্রকৃতি, একজন দেবী (Goddess) এবং একজন শিংযুক্ত দেবতার (Horned God) উপাসনার উপর জোর দেয়। এটি নারীবাদ, পরিবেশবাদ এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের ধারণার সাথে গভীরভাবে জড়িত এবং এর মধ্যে জাদুবিদ্যা (Witchcraft)ঋতু-ভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠানের চর্চা রয়েছে।

আধ্যাত্মিকতা কিন্তু ধর্ম নয় (Spiritual but Not Religious – SBNR)

আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বে এবং বিশ্বজুড়ে শহুরে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ধারণাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই গোষ্ঠীর মানুষেরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কঠোর নিয়মকানুন (Dogma), প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো (Institution), এবং প্রায়শই এর সাথে জড়িত রাজনৈতিক ও সামাজিক রক্ষণশীলতাকে প্রত্যাখ্যান করে। তবে তারা নিজেদের নাস্তিক বা পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষও মনে করে না। তারা জীবনের এক গভীরতর অর্থ বা আধ্যাত্মিক মাত্রায় বিশ্বাসী।

  • বৈশিষ্ট্য ও চর্চা:
    SBNR অনুসারীরা ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, আত্ম-আবিষ্কার, এবং মহাবিশ্বের সাথে একাত্মতা অনুভবের উপর সর্বোচ্চ জোর দেয়। তাদের কাছে আধ্যাত্মিকতা একটি ব্যক্তিগত যাত্রা, কোনো প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বা আরোপিত বিশ্বাসের সমষ্টি নয়। এই যাত্রায় তারা বিভিন্ন উৎস থেকে নিজেদের পছন্দমতো উপাদান সংগ্রহ করে একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস ব্যবস্থা তৈরি করে, যা অনেকটাই সংকলনধর্মী (Eclectic)। এই উপাদানগুলো হতে পারে:
    • পূর্বদেশীয় দর্শন: বৌদ্ধ ধ্যান (Mindfulness Meditation), হিন্দু যোগব্যায়াম (Yoga), বা তাওবাদী দর্শন
    • প্রকৃতির সাথে সংযোগ: হাইকিং, বন-স্নান (forest bathing) বা পরিবেশবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রকৃতির মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক সংযোগ অনুভব করা।
    • ব্যক্তিগত আচার: নিজস্ব অর্থপূর্ণ আচার তৈরি করা, যেমন – জার্নালিং, ক্রিস্টাল ব্যবহার করা, বা ট্যারোট কার্ড পড়া
    • শিল্প ও সঙ্গীত: শিল্পকলা বা সঙ্গীতের মাধ্যমে এক ধরনের অতীন্দ্রিয় (Transcendent) অভিজ্ঞতা লাভ করা।
  • সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট:
    সমাজবিজ্ঞানী গ্রেস ডেভি (Grace Davie) এই প্রবণতাকে “believing without belonging” বা “সম্পৃক্ত না হয়ে বিশ্বাস” বলে বর্ণনা করেছেন (Davie, 1994)। মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস হারাচ্ছে, কিন্তু আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে পুরোপুরি ত্যাগ করছে না। সমাজবিজ্ঞানী পল হিলাস (Paul Heelas) এবং লিন্ডা উডহেড (Linda Woodhead) তাদের বিখ্যাত Kendal Project গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, পশ্চিমা সমাজে এক ধরনের “আধ্যাত্মিক বিপ্লব” (Spiritual Revolution) ঘটছে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী ধর্মের স্থান নিচ্ছে “আত্মার জগৎ” (The Holistic Milieu), যা ব্যক্তির ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা এবং আত্ম-উন্নয়নের উপর জোর দেয় (Heelas & Woodhead, 2005)। এই প্রবণতাটি দেখায় যে, মানুষের অর্থ খোঁজার আকাঙ্ক্ষা এখনও প্রবল, কিন্তু সেই অর্থ খোঁজার পদ্ধতি আরও বেশি ব্যক্তিগত, অ-প্রাতিষ্ঠানিক এবং ভোক্তা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। তবে এর সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, এই ধরনের “DIY (Do-it-yourself) spirituality” প্রায়শই গভীরতাহীন, আত্মকেন্দ্রিক এবং কোনো দীর্ঘস্থায়ী সম্প্রদায় বা সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।

ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (Secular Humanism)

এটি একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা বা জীবন-দর্শন, যা কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা, ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ বা পারলৌকিক জীবনের উপর নির্ভর না করে মানবীয় যুক্তি (Reason), সহানুভূতি (Compassion), নৈতিকতা (Ethics), এবং ন্যায়বিচারের (Justice) উপর ভিত্তি করে একটি অর্থপূর্ণ ও নৈতিক জীবনযাপনে উৎসাহিত করে।

  • মূল বিশ্বাস:
    মানবতাবাদীরা মনে করেন যে, মানুষই তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে এবং একটি ভালো সমাজ তৈরি করতে সক্ষম। একটি নৈতিক জীবনযাপনের জন্য কোনো ঐশ্বরিক নির্দেশনা বা পারলৌকিক পুরস্কার ও শাস্তির ধারণার প্রয়োজন নেই।
    • জ্ঞানের উৎস হিসেবে যুক্তি ও বিজ্ঞান: মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য বিজ্ঞান এবং যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধানই সর্বোত্তম পদ্ধতি।
    • নৈতিকতার উৎস হিসেবে মানবতা: নৈতিকতার ভিত্তি হলো মানুষের সাধারণ চাহিদা, সহানুভূতি এবং একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজে একসাথে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা। প্লেটোর ইউথিফ্রো-তে উত্থাপিত বিখ্যাত দ্বিধার মতো, মানবতাবাদীরা প্রশ্ন করেন: “কোনো কাজ কি ঈশ্বর আদেশ দিয়েছেন বলে ভালো, নাকি কাজটি অভ্যন্তরীণভাবে ভালো বলেই ঈশ্বর তার আদেশ দেন?” মানবতাবাদীরা দ্বিতীয় অবস্থানটি গ্রহণ করেন।
    • জীবনের লক্ষ্য: তাদের লক্ষ্য পরলোকের মুক্তি নয়, বরং এই পৃথিবীতেই মানবীয় সমৃদ্ধি (Human Flourishing), ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা এবং একটি উন্নত, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক সমাজ গঠন করা।
    • ইতিহাস ও ঘোষণা: এর আধুনিক রূপটি মূলত অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানালোকের যুগে (Enlightenment) প্রোথিত, তবে এর শিকড় প্রাচীন গ্রিক দর্শন পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মূলনীতিগুলো হিউম্যানিস্ট মেনিফেস্টো (Humanist Manifestos) এর মতো বিভিন্ন ঘোষণাপত্রে লিপিবদ্ধ আছে।

নাস্তিক্যবাদ, অজ্ঞেয়বাদ এবং উদাসীনতাবাদ (Atheism, Agnosticism, and Apatheism)

বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের বর্ণালীর এই প্রান্তটি আধুনিক যুগে, বিশেষ করে ইন্টারনেট এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের কারণে, ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান এবং সোচ্চার হয়ে উঠছে।

  • নাস্তিক্যবাদ (Atheism): নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। এটিকে সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
    • নেতিবাচক/দুর্বল নাস্তিক্যবাদ (Negative/Weak Atheism): এটি ঈশ্বরের অস্তিত্বে ‘বিশ্বাসের অভাব’। এটি হলো ডিফল্ট অবস্থান – যতক্ষণ না ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে, ততক্ষণ বিশ্বাস স্থাপন না করা। এটি কোনো সক্রিয় দাবি নয়।
    • ইতিবাচক/শক্তিশালী নাস্তিক্যবাদ (Positive/Strong Atheism): এটি সক্রিয়ভাবে এই দাবি করা যে, কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। এর জন্য প্রমাণের দায় (Burden of Proof) দাবি উত্থাপনকারীর উপর বর্তায়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে “নব্য নাস্তিক্যবাদ” (New Atheism) নামে একটি আন্দোলনের উদ্ভব হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন রিচার্ড ডকিন্স (Richard Dawkins), স্যাম হ্যারিস (Sam Harris), ক্রিস্টোফার হিচেন্স (Christopher Hitchens) এবং ড্যানিয়েল ডেনেট (Daniel Dennett)। তারা কেবল ব্যক্তিগতভাবে অবিশ্বাসীই ছিলেন না, বরং তারা সক্রিয়ভাবে ধর্মের সমালোচনা করেছেন এবং জনপরিসরে বিজ্ঞান ও যুক্তির পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন।
  • অজ্ঞেয়বাদ (Agnosticism): অজ্ঞেয়বাদ শব্দটি জীববিজ্ঞানী টমাস হেনরি হাক্সলি (Thomas Henry Huxley) দ্বারা ১৮৬৯ সালে উদ্ভাবিত। এই শব্দটি দ্বারা একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক (Epistemological) অবস্থানকে বোঝায়। এটি দাবি করে যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তা মানুষের জ্ঞানের বাইরে বা বর্তমানে জানা সম্ভব নয়। অজ্ঞেয়বাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেন না, বরং তারা বলেন, “আমি জানি না, এবং আমার পক্ষে বা অন্য কারোর পক্ষে এটি নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভবও নয়।” এটি সংশয়বাদের একটি রূপ, যা চূড়ান্ত দাবির বিষয়ে রায়দান স্থগিত রাখে।
  • উদাসীনতাবাদ (Apatheism): এটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা, যা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। উদাসীনতাবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নটিকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে কঠিন বা মিথ্যা বলে মনে করেন না, বরং তারা একে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক (Irrelevant) বা গুরুত্বহীন মনে করেন। তাদের বক্তব্য হলো, ঈশ্বর থাকুন বা না থাকুন, তাতে তাদের জীবনযাত্রা, নৈতিক সিদ্ধান্ত বা মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাদের বিস্ময়বোধের কোনো পরিবর্তন হবে না। তারা এই প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা বা সমর্থন না করে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে।

এই নতুন রূপগুলো প্রমাণ করে যে, মানুষের বিশ্বাসের জগৎ স্থির নয়। এটি আধুনিক বিশ্বের জটিলতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির প্রতিক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত, বিকশিত এবং খণ্ডিত হচ্ছে। ধর্ম হয়তো বিলুপ্ত হচ্ছে না, কিন্তু এটি রূপান্তরিত হচ্ছে – কখনো মৌলবাদী প্রতিক্রিয়ায়, কখনো বা ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার অসীম বৈচিত্র্যে।

শ্রেণীবিন্যাসের সীমাবদ্ধতা এবং আধুনিক বিশ্বে ধর্মের নতুন রূপ

এতক্ষণ আমরা ধর্মকে বোঝার জন্য বিভিন্ন কাঠামো বা বাক্স তৈরি করলাম। একেশ্বরবাদ থেকে সর্বপ্রাণবাদ, চার্চ থেকে কাল্ট – এই শ্রেণীবিন্যাসগুলো নিঃসন্দেহে উপকারী। এগুলো আমাদের সেই অচেনা মহাদেশের একটি মানচিত্র দেয়, যা ছাড়া আমরা সহজেই হারিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বাস্তবতা সবসময় তত্ত্বের চেয়ে অনেক বেশি জটিল, অগোছালো এবং জীবন্ত। ধর্মের মতো একটি পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চকে কয়েকটি নিশ্ছিদ্র বাক্সে বন্দী করা প্রায় অসম্ভব। ম্যাক্স ভেবারের (Max Weber) ভাষায়, এগুলো হলো ‘আদর্শ ধরন’ (Ideal Types) – বাস্তবতাকে পরিমাপ করার জন্য কিছু তাত্ত্বিক মাপকাঠি, যা বাস্তবে বিশুদ্ধ রূপে প্রায় কখনোই পাওয়া যায় না। এই অধ্যায়ে আমরা এই শ্রেণীবিন্যাসগুলোর সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্বায়ন ও আধুনিকতার প্রেক্ষাপটে ধর্মের বদলে যাওয়া চেহারা নিয়ে আলোচনা করব।

শ্রেণীবিন্যাসের সমস্যা: যখন বাক্সগুলো উপচে পড়ে

আমাদের তৈরি করা তাত্ত্বিক কাঠামো বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে প্রায়শই নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ধর্মের জীবন্ত রূপটি প্রায়শই আমাদের নির্ধারিত গণ্ডি অতিক্রম করে যায়।

  • ধর্মের সংমিশ্রণ ও সমন্বয়বাদ (Syncretism): অনেক ধর্মই একাধিক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা তাদের কোনো একটি নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলা কঠিন করে তোলে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিন্দুধর্ম। একে কি বলবেন? এর মধ্যে বহুদেবতাবাদ (অসংখ্য দেব-দেবী), একেশ্বরবাদ (পরম সত্তা হিসেবে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ধারণা), সর্বেশ্বরবাদ (অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন), হেনোথেইজম (বৈদিক সূক্তে একেক দেবতাকে সর্বোচ্চ হিসেবে স্তুতি) এবং সর্বপ্রাণবাদ (গ্রাম্য লোকধর্মে গাছ, নদী বা সাপের পূজা) – সবকিছুরই উপাদান রয়েছে। এটি একটি একক ধর্ম না হয়ে বরং একটি ধর্মীয় ঐতিহ্যের পরিবার বা ‘ধর্মের মহাসাগর’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। একইভাবে, খ্রিস্টধর্মের ত্রিত্ববাদ (Trinity)পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার ধারণা – কি বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদ? মুসলমান এবং ইহুদিদের দৃষ্টিতে এটি একেশ্বরবাদের সাথে এক ধরনের আপোস। সমালোচকরা একে এক ধরনের ‘ছদ্ম-বহুদেবতাবাদ’ বলেও আখ্যা দেন। ধর্মের এই মিশ্রণ, যাকে সমন্বয়বাদ বা সিঙ্ক্রেটিজম (Syncretism) বলা হয়, বিশ্বজুড়েই দেখা যায়। যেমন, হাইতির ভোদূ (Vodou) ধর্মে পশ্চিম আফ্রিকার ইওরুবা ধর্মের দেবতাদের (Orisha) সাথে রোমান ক্যাথলিক সাধুদের (Saints) মিলিয়ে ফেলা হয়েছে। কিউবার সান্তেরিয়া (Santería) বা ব্রাজিলের ক্যান্ডোমব্লে (Candomblé)-ও একই ধরনের আফ্রো-ক্যাথলিক সমন্বয়বাদী ধর্মের উদাহরণ।
  • আনুষ্ঠানিক ধর্ম বনাম লোকধর্ম (Official vs. Folk Religion): ধর্মগ্রন্থ, ধর্মতাত্ত্বিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পুরোহিত শ্রেণী যা বলে, সাধারণ মানুষ প্রায়শই সেভাবে ধর্ম পালন করে না। সমাজবিজ্ঞানীরা প্রায়শই একটি সংস্কৃতির ‘মহান ঐতিহ্য’ (Great Tradition) এবং ‘ক্ষুদ্র ঐতিহ্য’ (Little Tradition)-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। মহান ঐতিহ্য হলো শিক্ষিত অভিজাতদের দ্বারা চর্চিত আনুষ্ঠানিক, পুঁথিগত এবং বিশ্বজনীন ধর্ম। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র ঐতিহ্য হলো সাধারণ মানুষের দ্বারা চর্চিত লোকধর্ম (Folk Religion), যা মূলত মৌখিক, স্থানীয় এবং দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবিক সমস্যা সমাধানের উপর কেন্দ্রীভূত (Redfield, 1956)। আনুষ্ঠানিক ইসলাম কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী, কিন্তু অনেক মুসলিম দেশেই পীর বা সুফি সাধকদের মাজারে গিয়ে সাহায্য চাওয়া বা মানত করার মতো লোকবিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে, যা কট্টরপন্থীদের চোখে শিরক বা বহুদেববাদের সামিল। একইভাবে, আনুষ্ঠানিক বৌদ্ধধর্ম নিরীশ্বরবাদী এবং নির্বাণ লাভের উপর জোর দেয়, কিন্তু অনেক বৌদ্ধ দেশেই (যেমন: থাইল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কা) মানুষ নিজেদের জাগতিক সমস্যা সমাধানের জন্য – যেমন রোগমুক্তি বা ব্যবসায় সাফল্য – বিভিন্ন স্থানীয় দেবতা বা আত্মার পূজা করে থাকে। এই লোকধর্ম আনুষ্ঠানিক ধর্মের সমান্তরালে বা তার ভেতরেই টিকে থাকে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ করে, যা হয়তো উচ্চমার্গের দর্শন বা ধর্মতত্ত্ব করতে পারে না।
  • সময়ের সাথে পরিবর্তন ও গতিশীলতা: ধর্ম স্থির বা অপরিবর্তনীয় নয়। এটি একটি জীবন্ত সত্তার মতো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী এইচ. রিচার্ড নাইবুর (H. Richard Niebuhr) ‘সেক্ট-চার্চ চক্র’ (Sect-Church Cycle)-এর ধারণা দিয়েছেন, যেখানে একটি প্রতিবাদী ও সমাজবিচ্ছিন্ন সেক্ট সময়ের সাথে সাথে তার সন্তানদের প্রজন্মে এসে জাগতিক সাফল্য লাভ করে, সমাজের সাথে আপোস করে এবং ধীরে ধীরে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ডিনোমিনেশন বা চার্চে রূপান্তরিত হয় (Niebuhr, 1929)। মেথডিস্টদের ইতিহাস এর একটি আদর্শ উদাহরণ। আবার, একটি বহুদেবতাবাদী ধর্ম ঐতিহাসিক কারণে একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকতে পারে, যেমনটি প্রাচীন ইহুদিধর্মের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। বাইরের সংস্কৃতির প্রভাবে একটি ধর্মে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হতে পারে, অথবা ঐতিহাসিক কোনো আঘাত (Trauma), যেমন হলোকাস্টের ঘটনা, একটি ধর্মের (ইহুদিধর্ম) ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক ধর্মতত্ত্বকে আমূল বদলে দিতে পারে।

আধুনিক বিশ্বে ধর্মের নতুন মুখ: ঐতিহ্য ও পরিবর্তনের দ্বন্দ্ব

বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রসার এবং ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার উত্থান ধর্মের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ তৈরি করেছে। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ধর্মের চেহারাও বদলে যাচ্ছে।

  • ধর্মনিরপেক্ষকরণ (Secularization): একটি বিতর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী: উনিশ শতকের ক্লাসিক্যাল সমাজবিজ্ঞানীরা (যেমন: মার্ক্স (Marx), ভেবার (Weber), ডুর্খাইম (Durkheim)) প্রায় সবাই একমত ছিলেন যে, আধুনিকায়ন অনিবার্যভাবে ধর্মের সামাজিক গুরুত্বকে হ্রাস করবে। এই তত্ত্বটি ধর্মনিরপেক্ষকরণ তত্ত্ব (Secularization Thesis) নামে পরিচিত। এর মূল যুক্তি হলো, বিজ্ঞানের উত্থান যেমন প্রাকৃতিক ঘটনার অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে (ভেবারের ভাষায় ‘Disenchantment of the world’), তেমনই রাষ্ট্র, শিক্ষা, আইন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন (Differentiated) হয়ে উঠবে এবং ধর্ম ক্রমশ একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়ে পরিণত হবে (Privatization)। পশ্চিমা ইউরোপের মতো কিছু অঞ্চলে এই তত্ত্ব অনেকাংশে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে, যেখানে গির্জায় মানুষের উপস্থিতি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এবং ধর্ম জনজীবন থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
  • ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সমালোচনা ও ধর্মের পুনরাগমন: কিন্তু এই তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বব্যাপী সত্য হয়নি। সমাজবিজ্ঞানী পিটার বার্গার (Peter Berger), যিনি একসময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের একজন বড় প্রবক্তা ছিলেন, পরবর্তীকালে তার মত পরিবর্তন করে ঘোষণা করেন যে, “এই ধারণা যে আধুনিক জগৎ ধর্মনিরপেক্ষ, তা ভুল… আজকের পৃথিবী আগের মতোই প্রচণ্ডভাবে ধার্মিক।” (Berger, 1999)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব আজও প্রবল। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম শুধু টিকেই থাকেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হিসেবে এর প্রভাব আরও বেড়েছে। সমাজবিজ্ঞানী হোসে ক্যাসানোভা (José Casanova) দেখিয়েছেন যে, ধর্ম ব্যক্তিগত পরিসর থেকে বেরিয়ে এসে আবারও জনপরিসরে (Public Sphere) প্রবেশ করছে এবং নৈতিক ও রাজনৈতিক বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যাকে তিনি ‘ধর্মের ডি-প্রাইভেটাইজেশন’ (Deprivatization of religion) বলে অভিহিত করেছেন (Casanova, 1994)।
  • মৌলবাদের উত্থান (The Rise of Fundamentalism): ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধর্মে মৌলবাদের (Fundamentalism) উত্থান ঘটেছে। মৌলবাদ কেবল সনাতনপন্থা বা রক্ষণশীলতা নয়। এটি একটি আধুনিক ঘটনা, যা আধুনিকতার বিরুদ্ধেই আধুনিক সরঞ্জাম (যেমন: গণমাধ্যম, ইন্টারনেট) ব্যবহার করে লড়াই করে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘The Fundamentalism Project’-এর পরিচালকদের মতে, মৌলবাদীরা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখে এবং তারা এই আপেক্ষিকতাবাদীবহুত্ববাদী জগতের বিরুদ্ধে একটি নিখুঁত, অপরিবর্তনীয় এবং আক্ষরিক সত্যের প্রাচীর গড়ে তুলতে চায় (Marty & Appleby, 1991)। তারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে আক্ষরিক অর্থে অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করে এবং ধর্মের একটি ‘বিশুদ্ধ’ ও আদি রূপে ফিরে যেতে চায়, যা দিয়ে তারা আধুনিক সমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে প্রতিহত করতে পারবে এবং রাজনীতি ও সমাজকে পুনরায় ধর্মীয় আইনের অধীনে আনবে। খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি, হিন্দু, শিখ – প্রায় সব প্রধান ধর্মেই এই মৌলবাদী আন্দোলনের উত্থান লক্ষ্য করা যায়।
  • আধ্যাত্মিক কিন্তু ধার্মিক নয় (Spiritual But Not Religious – SBNR): আধুনিক বিশ্বে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে, একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের (চার্চ, মসজিদ, মন্দির) প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন, কিন্তু তারা জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য এবং আধ্যাত্মিকতার খোঁজ ছাড়েননি। তারা নিজেদের ‘আধ্যাত্মিক কিন্তু ধার্মিক নয়’ (Spiritual But Not Religious – SBNR) বলে পরিচয় দেন। সমাজবিজ্ঞানী গ্রেস ডেভি (Grace Davie) এই পরিস্থিতিকে ‘বিশ্বাস করা কিন্তু অন্তর্ভুক্ত না হওয়া’ (Believing without Belonging) বলে বর্ণনা করেছেন (Davie, 1994)। এই ব্যক্তিরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কঠোর নিয়মকানুন, স্তরবিন্যাস এবং প্রায়শই অসহিষ্ণু মনোভাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। পরিবর্তে, তারা একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সংকলনধর্মী আধ্যাত্মিক পথ বেছে নেন। তারা হয়তো বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে তাদের পছন্দের উপাদানগুলো (যেমন: বৌদ্ধ ধ্যান, হিন্দু যোগব্যায়াম, সুফি কবিতা, নেটিভ আমেরিকান শামানবাদ) গ্রহণ করে নিজের মতো করে একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস ব্যবস্থা তৈরি করে নেন। একে এক ধরনের ‘DIY (Do-It-Yourself) Religion’ বা ‘খুচরা ধর্ম’ বলেও অভিহিত করা হয়, যা আধুনিক ভোক্তাবাদী সংস্কৃতিরই একটি আধ্যাত্মিক প্রতিফলন। নিউ এজ (New Age) আন্দোলন এই ধারার একটি বড় উদাহরণ।

এই নতুন রূপগুলো আমাদের দেখায় যে, ধর্ম আধুনিকতার মুখে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বরং এটি নতুন এবং অপ্রত্যাশিত উপায়ে নিজেকে অভিযোজিত ও রূপান্তরিত করে চলেছে।

বিশ্বাসের শ্রেণীবিন্যাস – ধর্মের রকমফের সন্ধানে তাত্ত্বিক অভিযাত্রা

তত্ত্ব বা থিওরি শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে হয় খটমটে কিছু, যা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মাথা ঘামানোর বিষয়। কিন্তু আদতে, তত্ত্ব হলো এক ধরনের চশমা। একেকটা চশমা দিয়ে দেখলে জগৎটাকে একেক রকম লাগে। ধর্ম অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। কিছু তাত্ত্বিক ধর্মের উৎস বা কারণ নিয়ে ভেবেছেন, যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু আরেক দল চিন্তাবিদ আছেন, যারা এই হাজার হাজার ধর্ম আর বিশ্বাসকে দেখে অভিভূত হয়েছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন – এদের কি কোনোভাবে সাজানো যায়? কোনো ছকে ফেলা যায়? জীববিজ্ঞানী যেমন করে বিশাল প্রাণীজগৎকে পর্ব, শ্রেণী, বর্গে ভাগ করেন, তেমনি এই তাত্ত্বিকরা চেয়েছেন বিশ্বাসের বিশাল জগৎটাকে একটা সুশৃঙ্খল বিন্যাসে আনতে। তাদের কাজটা ধর্মের উৎপত্তির কারণ খোঁজা নয়, বরং ধর্মের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রূপের শ্রেণীবিন্যাস করা। চলুন, এই অসাধারণ মানচিত্র নির্মাতাদের কয়েকজনের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।

বিবর্তনবাদী মানচিত্র নির্মাতারা: সরল থেকে জটিলের পথে

উনিশ শতকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ কেবল জীববিজ্ঞানেই নয়, সমাজবিজ্ঞানের জগতেও এক ঝড় তুলেছিল। অনেক চিন্তাবিদ মানব সমাজ এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে (যেমন – ধর্ম, পরিবার) একটি সরলরৈখিক বিবর্তনের ফসল হিসেবে দেখতে শুরু করেন। তাদের মতে, ধর্মও আদিম, সরল রূপ থেকে ধীরে ধীরে জটিল এবং ‘উন্নত’ রূপে বিবর্তিত হয়েছে।

এডওয়ার্ড টাইলর (Edward Tylor): আত্মার ক্রমবিকাশ

আমরা আগেই এডওয়ার্ড টাইলরের (Edward Tylor, ১৮৩২-১৯১৭) নাম জেনেছি ধর্মের উৎসের আলোচনায়। কিন্তু তার তত্ত্বটি একই সাথে ধর্মের প্রকারভেদের একটি আদিম বিবর্তনীয় মডেল। টাইলর মনে করতেন, ‘সভ্যতার’ অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের ধর্মীয় চিন্তাও বিকশিত হয়েছে। তার এই মডেলটিকে একটি সিঁড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে:

  • প্রথম ধাপ: সর্বপ্রাণবাদ (Animism): সিঁড়ির সর্বনিম্ন ধাপে আছে সর্বপ্রাণবাদ। টাইলরের মতে, এটিই ধর্মের সবচেয়ে আদিম এবং মৌলিক রূপ। এই পর্যায়ে মানুষ বিশ্বাস করতো যে, জড়বস্তু, উদ্ভিদ, প্রাণী – সবারই আত্মা আছে। স্বপ্ন বা মৃত্যুর মতো ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আত্মা’র ধারণা তৈরি হয় এবং এই ধারণাই সর্বত্র প্রসারিত হয় (Tylor, 1871)।
  • দ্বিতীয় ধাপ: বহুইশ্বরবাদ (Polytheism): ধীরে ধীরে মানুষ বিভিন্ন আত্মাকে সংগঠিত করতে শুরু করে। কিছু আত্মা অন্যদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলে বিবেচিত হতে থাকে। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে (যেমন – সূর্য, বৃষ্টি, সমুদ্র) নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পৃথক পৃথক দেবতা বা দেবীর কল্পনা করা হয়। এভাবেই জন্ম নেয় বহুইশ্বরবাদ বা বহুদেবতাবাদ, যেখানে দেবতাদের একটি সংগঠিত জগৎ বা প্যানথিয়ন (Pantheon) থাকে, যেমনটা ছিল প্রাচীন গ্রিস বা রোমে।
  • সর্বশেষ ধাপ: একেশ্বরবাদ (Monotheism): বিবর্তনের সর্বোচ্চ ধাপে, মানুষ এই বহু দেবতার ধারণা থেকে সরে এসে এক, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণায় উপনীত হয়, যাকে বলে একেশ্বরবাদ। টাইলরের মতে, এটি ছিল মানব যুক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ।

টাইলরের এই মডেলটি তার সময়ের জন্য যুগান্তকারী হলেও, আজ এটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত। এর প্রধান দুর্বলতা হলো এটি অত্যন্ত ‘ইউরোপ-কেন্দ্রিক’ (Eurocentric) এবং সরলরৈখিক। এটি ধরে নেয় যে, পশ্চিমা একেশ্বরবাদী ধর্মই হলো বিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায় এবং অন্য সব বিশ্বাস ব্যবস্থা ‘আদিম’ বা ‘অনগ্রসর’। বাস্তবে, ধর্মীয় বিবর্তন এত সরল পথে এগোয়নি।

রবার্ট বেলা (Robert Bellah): বিবর্তনের এক নতুন পাঠ

আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট বেলা (Robert Bellah, ১৯২৭-২০১৩) টাইলরের মতো বিবর্তনবাদী ধারাকেই অনুসরণ করেছেন, কিন্তু তার মডেলটি অনেক বেশি পরিশীলিত এবং কম সরলরৈখিক। তিনি ধর্মের বিবর্তনকে নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ‘উন্নতি’ হিসেবে না দেখে, বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক জটিলতার সাথে ধর্মের অভিযোজন হিসেবে দেখেছেন। তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “Religious Evolution” (1964)-এ তিনি ধর্মের পাঁচটি আদর্শ পর্যায় (Ideal Stages) বর্ণনা করেছেন।

  • আদিম ধর্ম (Primitive Religion): এই ধর্মের জগৎ পৌরাণিক কাহিনীতে পরিপূর্ণ। এখানে মানুষ এবং প্রকৃতি, পবিত্র এবং অপবিত্র জগতের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট বিভাজন নেই। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ‘স্বপ্নকাল’ (Dreamtime) এর একটি উদাহরণ। সবকিছুই এক তরল, মিথস্ক্রিয় জগতের অংশ।
  • প্রাচীন ধর্ম (Archaic Religion): কৃষির বিকাশের সাথে সাথে সমাজ জটিল হতে শুরু করে। এই পর্যায়ে দেব-দেবীর উদ্ভব হয়, যাদের পূজা-অর্চনা করা হয়। পুরোহিত শ্রেণীর জন্ম হয় এবং বলিদান একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার হয়ে ওঠে। মেসোপটেমীয় বা প্রাচীন গ্রিক ধর্ম এর উদাহরণ।
  • ঐতিহাসিক ধর্ম (Historic Religion): এই পর্যায়টি মানব ইতিহাসে একটি বড় ধরনের উল্লম্ফন। এখানে প্রথমবারের মতো একটি দ্বৈতবাদী (Dualistic) বিশ্বদৃষ্টির জন্ম হয়। এই জগৎ এবং পারলৌকিক জগৎ – এই দুইয়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করা হয়। ইহলৌকিক জীবনকে দেখা হয় পারলৌকিক মুক্তির জন্য একটি প্রস্তুতি হিসেবে। এই পর্যায়ে একেশ্বরবাদ, সার্বজনীন নৈতিকতা এবং ধর্মগ্রন্থের উদ্ভব ঘটে। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম – এই সবই ঐতিহাসিক ধর্মের উদাহরণ।
  • প্রাক-আধুনিক ধর্ম (Early Modern Religion): প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন (Protestant Reformation) এই পর্যায়ের সূচনা করে। এখানে ব্যক্তি এবং ঈশ্বরের মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের উপর জোর দেওয়া হয়। পুরোহিত বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থতাকে অস্বীকার করা হয়। ব্যক্তি নিজেই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
  • আধুনিক ধর্ম (Modern Religion): বেলা মনে করেন, আমরা এখন এই পর্যায়ে প্রবেশ করছি। এখানে ধর্মীয় মতবাদ বা প্রতীকের আক্ষরিক ব্যাখ্যাকে প্রশ্ন করা হয়। ধর্ম হয়ে ওঠে আরও বেশি ব্যক্তিগত, প্রতীকী এবং পরিবর্তনশীল। ব্যক্তি নিজেই তার বিশ্বাস ব্যবস্থাকে বিভিন্ন উৎস থেকে উপাদান নিয়ে তৈরি করে। ‘আধ্যাত্মিক কিন্তু ধার্মিক নয়’ (SBNR) ধারণাটি এই পর্যায়ের একটি প্রকাশ।

বেলার মডেলটি দেখায় যে, ধর্মের প্রকারভেদ স্থির নয়, এটি সময়ের সাথে সাথে সমাজের গঠনের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয় (Bellah, 1964)।

সমাজতাত্ত্বিক স্থপতিগণ: সমাজ ও ধর্মের সম্পর্ক

এই ধারার তাত্ত্বিকরা ধর্মকে তার সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে ভাগ করেছেন। তাদের মূল প্রশ্ন হলো, একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী কি সমাজের অংশ, নাকি সমাজের বিরোধী? এটি কি প্রতিষ্ঠিত, নাকি বিদ্রোহী?

ম্যাক্স ভেবার (Max Weber): গির্জা বনাম উপদল

ম্যাক্স ভেবার (Max Weber, ১৮৬৪-১৯২০) কেবল পুঁজিবাদের আত্মা নিয়েই ভাবেননি, তিনি ধর্মীয় সংগঠনগুলোর প্রকারভেদ নিয়েও মৌলিক কাজ করেছেন। তার কাছে সব ধর্মীয় গোষ্ঠী এক রকম নয়। তিনি দুটি আদর্শ প্রকার বা ‘আইডিয়াল টাইপ’ (Ideal Type) এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন: চার্চ বা গির্জা (Church) এবং উপদল বা সেক্ট (Sect)

  • চার্চ (Church):
    • এটি একটি বৃহৎ, আমলাতান্ত্রিক এবং প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় সংগঠন।
    • এটি সমাজের মূলধারার সাথে অঙ্গীভূত এবং প্রায়শই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে এর সুসম্পর্ক থাকে।
    • সদস্যপদ সাধারণত জন্মসূত্রে পাওয়া যায়। এতে যোগদানের জন্য কঠোর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত।
    • এটি ধর্মীয় আবেগের চেয়ে আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠিত মতবাদের উপর বেশি জোর দেয়। উদাহরণ: রোমান ক্যাথলিক চার্চ, চার্চ অফ ইংল্যান্ড।
  • উপদল (Sect):
    • এটি একটি অপেক্ষাকৃত ছোট, বিদ্রোহী এবং আবেগপ্রবণ ধর্মীয় গোষ্ঠী।
    • এটি প্রায়শই একটি প্রতিষ্ঠিত চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি হয়, কারণ তারা মনে করে মূল চার্চটি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
    • এটি সমাজের মূলধারা থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখে এবং প্রায়শই বৃহত্তর সমাজের সাথে এর সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ থাকে।
    • সদস্যপদ স্বেচ্ছায় এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সচেতন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। এর জন্য উচ্চ মাত্রার অঙ্গীকার এবং প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। উদাহরণ: আদি খ্রিস্টান সম্প্রদায়, অ্যানাব্যাপ্টিস্ট, বা অনেক আধুনিক ইভানজেলিকাল গোষ্ঠী

ভেবার মনে করতেন, এই দুটি প্রকারের মধ্যে একটি গতিশীল সম্পর্ক রয়েছে। একটি উপদল সময়ের সাথে সাথে সফল এবং বড় হলে, তা ধীরে ধীরে তার আবেগ এবং বিদ্রোহী চরিত্র হারিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত চার্চ বা সম্প্রদায়ে (Denomination) পরিণত হতে পারে (Weber, 1922/1978)।

স্টার্ক ও বেইনব্রিজ (Stark and Bainbridge): উত্তেজনার মাপকাঠিতে ধর্ম

রডনি স্টার্ক (Rodney Stark) এবং উইলিয়াম সিমস বেইনব্রিজ (William Sims Bainbridge) ভেবারের ‘চার্চ-সেক্ট’ তত্ত্বকে আরও পরিমার্জিত এবং প্রসারিত করেছেন। তারা ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সমাজের সাথে তাদের ‘উত্তেজনা’র (Tension) মাত্রার উপর ভিত্তি করে একটি ধারাবাহিকতায় (Continuum) সাজিয়েছেন। ‘উত্তেজনা’ বলতে বোঝায় একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিশ্বাস, অনুশীলন এবং জীবনযাত্রা সমাজের প্রভাবশালী সংস্কৃতির থেকে কতটা ভিন্ন।

  • চার্চ (Church): এদের সমাজের সাথে উত্তেজনা সর্বনিম্ন বা প্রায় শূন্য। এরা সমাজের মূল্যবোধকে সমর্থন করে।
  • উপদল (Sect): এদের সমাজের সাথে উচ্চ মাত্রার উত্তেজনা থাকে। এরা সমাজের অনেক মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যান করে।
  • কাল্ট বা নতুন ধর্ম (Cult/New Religious Movement): এদেরও সমাজের সাথে উচ্চ মাত্রার উত্তেজনা থাকে, কিন্তু উপদলের সাথে এদের পার্থক্য হলো – উপদলগুলো সমাজের প্রভাবশালী ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি হয় (যেমন – খ্রিস্টধর্মের মধ্যেই একটি নতুন গোষ্ঠী), কিন্তু কাল্টগুলো একটি সমাজের জন্য সম্পূর্ণ নতুন বা বিদেশী ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে আসে। যেমন, পশ্চিমা সমাজে বৌদ্ধধর্ম বা হরে কৃষ্ণ আন্দোলনকে প্রাথমিকভাবে কাল্ট হিসেবে দেখা যেতে পারে (Stark & Bainbridge, 1985)।

এই মডেলটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, কেন কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সমাজ সহজে গ্রহণ করে নেয়, আর কেন অন্যদের বিদ্রোহী বা বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হয়।

প্রপঞ্চবাদী পর্যবেক্ষকগণ: ধর্মের ভেতরের জগৎ

প্রপঞ্চবাদীরা (Phenomenologists) ধর্মের সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণ নিয়ে মাথা ঘামান না। তাদের লক্ষ্য হলো ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে তার নিজের শর্তে বোঝা – অর্থাৎ, একজন বিশ্বাসীর কাছে ধর্ম বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা বর্ণনা করা। তারা ধর্মের ভেতরের গঠন এবং প্রকাশ নিয়ে আগ্রহী।

জোয়াকিম ওয়াখ (Joachim Wach): ধর্মীয় অভিজ্ঞতার তিন প্রকাশ

জার্মান-আমেরিকান ধর্মতত্ত্ববিদ জোয়াকিম ওয়াখ (Joachim Wach, ১৮৯৮-১৯৫৫) মনে করতেন, সকল ধর্মীয় অভিজ্ঞতার তিনটি সার্বজনীন প্রকাশের রূপ রয়েছে। যেকোনো ধর্মকে বিশ্লেষণ করতে হলে এই তিনটি দিককে দেখতে হবে।

  • তাত্ত্বিক প্রকাশ (Theoretical Expression): এটি হলো ধর্মের ‘কথার’ দিক – অর্থাৎ, ধর্ম কী বলে বা বিশ্বাস করে। এর মধ্যে রয়েছে:
    • পুরাণ (Myth): মহাবিশ্বের উৎপত্তি, মানবজাতির সৃষ্টি বা দেবতাদের কাহিনী সম্পর্কিত পবিত্র গল্প।
    • মতবাদ (Doctrine): পুরাণগুলোকে যখন পদ্ধতিগত, যৌক্তিক এবং দার্শনিক কাঠামোতে সাজানো হয়, তখন তা মতবাদে পরিণত হয় (যেমন – খ্রিস্টধর্মের ত্রিত্ববাদ)।
  • ব্যবহারিক প্রকাশ (Practical Expression): এটি হলো ধর্মের ‘কাজের’ দিক – অর্থাৎ, বিশ্বাসীরা কী করে। এর মধ্যে রয়েছে:
    • উপাসনা ও পূজা (Cult/Worship): ঈশ্বর বা পবিত্র সত্তার প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া, যেমন – প্রার্থনা, স্তব, ধ্যান।
    • আচার-অনুষ্ঠান (Ritual): জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে (জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ) চিহ্নিত করার জন্য বা পবিত্র জগতের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রতীকী কাজ।
  • সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশ (Sociological Expression): এটি হলো ধর্মের ‘গোষ্ঠীবদ্ধতার’ দিক – অর্থাৎ, বিশ্বাসীরা কীভাবে সংগঠিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
    • ধর্মীয় সম্প্রদায় (Community): যেমন – চার্চ, উম্মাহ, সংঘ।
    • ধর্মীয় বিভাজন: যেমন – পুরোহিত ও সাধারণ মানুষ, নারী ও পুরুষ, বা বিভিন্ন উপদল।

ওয়াখের এই মডেলটি একটি অত্যন্ত কার্যকর বিশ্লেষণাত্মক হাতিয়ার। এটি ব্যবহার করে আমরা যেকোনো ধর্মকে – সেটি সংগঠিত হোক বা লোকধর্ম – তার অভ্যন্তরীণ গঠন অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস এবং তুলনা করতে পারি (Wach, 1944)।

বহু চশমায় এক বাস্তবতা

এই তাত্ত্বিকদের কাজ আমাদের দেখায় যে, ধর্মের প্রকারভেদ করার কোনো একটিমাত্র ‘সঠিক’ উপায় নেই। টাইলর ও বেলার বিবর্তনবাদী চশমা দিয়ে দেখলে আমরা ধর্মের ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে দেখতে পাই। ভেবার বা স্টার্কের সমাজতাত্ত্বিক চশমা দিয়ে দেখলে আমরা ধর্ম ও সমাজের মধ্যেকার ক্ষমতার টানাপোড়েনকে বুঝতে পারি। আর ওয়াখের প্রপঞ্চবাদী চশমা আমাদের ধর্মের ভেতরের জগতে নিয়ে যায়, যেখানে বিশ্বাস, কাজ এবং সম্প্রদায় একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

এই শ্রেণীবিন্যাসগুলো কোনো চূড়ান্ত সত্য নয়, বরং এগুলো হলো কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক সরঞ্জাম। এগুলো আমাদের সাহায্য করে বিশ্বাসের বিশাল, বিশৃঙ্খল জগৎটাকে একটু গুছিয়ে ভাবতে। প্রতিটি মডেলই বাস্তবতার একটি নির্দিষ্ট দিককে আলোকিত করে, আবার অন্য দিকগুলোকে হয়তো অন্ধকারে রেখে দেয়। একজন সত্যিকারের অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে আমাদের কাজ হলো, এই বিভিন্ন চশমাগুলো পর্যায়ক্রমে পরে দেখা এবং বিশ্বাসের বর্ণালীর প্রতিটি রঙকে তার নিজস্ব বৈচিত্র্য এবং জটিলতায় উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। এই তাত্ত্বিক অভিযাত্রা হয়তো কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায় না, কিন্তু পথ চলার আনন্দেই এর সার্থকতা।

উপসংহার

ধর্মের প্রকারভেদ এবং বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এই তাত্ত্বিক পর্যালোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ধর্ম বা বিশ্বাস কোনো অপরিবর্তনীয় বা স্থবির ধারণা নয়। সমাজতাত্ত্বিক ও নৃবিজ্ঞানীরা আলোচনার সুবিধার্থে একেশ্বরবাদ, বহুদেবতাবাদ, নিরীশ্বরবাদ কিংবা সর্বপ্রাণবাদের মতো বিভিন্ন শ্রেণীতে ধর্মকে বিন্যস্ত করেছেন। ম্যাক্স ভেবার, এডওয়ার্ড টাইলর বা রবার্ট বেলার মতো তাত্ত্বিকদের দেওয়া এই কাঠামো বা ‘মডেল’গুলো ধর্মকে বিশ্লেষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক লেন্স সরবরাহ করে। তবে বাস্তবিক ক্ষেত্রে মানুষের আচার ও বিশ্বাস প্রায়শই এই তাত্ত্বিক সীমারেখাগুলোকে অতিক্রম করে যায়। ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সামাজিক আচারের সংমিশ্রণ এতটাই জটিল যে, একে সবসময় নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞার ফ্রেমে বন্দী করা সম্ভব হয় না।

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ‘সেক্যুলারাইজেশন থিসিস’-এর প্রবক্তারা ধারণা করেছিলেন যে, আধুনিকায়ন ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে ধর্মের সামাজিক গুরুত্ব হ্রাস পাবে এবং একসময় তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। ধর্ম বিলুপ্ত হয়নি, কিন্তু এর কাঠামোগত ও কার্যগত পরিবর্তন ঘটেছে। একদিকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতা বা ‘স্পিরিচুয়ালিটি’র নতুন নতুন ধারার বিকাশ ঘটছে। প্রাতিষ্ঠানিক উপাসনালয়ের গুরুত্ব কমলেও মানুষের অর্থ খোঁজার প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন বিমূর্ত ও ব্যক্তিগত আচারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এই রূপান্তরগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ধর্ম কেবল একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা নয়, বরং এটি সমাজ ও মনস্তত্ত্বের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত একটি প্রপঞ্চ। মানুষের পরিচয় গঠন, সামাজিক সংহতি এবং অনিশ্চয়তার মোকাবেলায় ধর্ম ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের বিশ্বাসের ধরন আরও পরিবর্তিত হতে পারে, অথবা নতুন কোনো মতাদর্শ ধর্মের স্থান দখল করে নিতে পারে। ধর্মের ভবিষ্যৎ গতিপথ কী হবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে মানব সমাজ, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের বিবর্তনকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য বিশ্বাসের এই তাত্ত্বিক শ্রেণীবিন্যাস ও বৈচিত্র্যকে অনুধাবন করা অপরিহার্য।

তথ্যসূত্র

  • Armstrong, K. (1993). A History of God: The 4,000-Year Quest of Judaism, Christianity and Islam. Alfred A. Knopf.
  • Atran, S. (2002). In Gods We Trust: The Evolutionary Landscape of Religion. Oxford University Press.
  • Barbour, I. G. (1990). Religion in an Age of Science. Harper & Row.
  • Barker, E. (1989). New Religious Movements: A Practical Introduction. Her Majesty’s Stationery Office.
  • Barrett, J. L. (2004). Why Would Anyone Believe in God?. AltaMira Press.
  • Becker, E. (1973). The Denial of Death. Free Press.
  • Bellah, R. N. (1964). Religious Evolution. American Sociological Review, 29(3), 358–374.
  • Bellah, R. N. (1967). Civil Religion in America. Daedalus, 96(1), 1-21.
  • Berger, P. L. (Ed.). (1999). The Desecularization of the World: Resurgent Religion and World Politics. Wm. B. Eerdmans Publishing.
  • Boyce, M. (1984). Zoroastrians: Their Religious Beliefs and Practices. Routledge & Kegan Paul.
  • Boyer, P. (2001). Religion Explained: The Evolutionary Origins of Religious Thought. Basic Books.
  • Casanova, J. (1994). Public Religions in the Modern World. University of Chicago Press.
  • Davie, G. (1994). Religion in Britain Since 1945: Believing Without Belonging. Blackwell.
  • Dawkins, R. (1976). The Selfish Gene. Oxford University Press.
  • De Waal, F. (2009). The Age of Empathy: Nature’s Lessons for a Kinder Society. Harmony Books.
  • Dundas, P. (2002). The Jains (2nd ed.). Routledge.
  • Durkheim, É. (1995). The Elementary Forms of the Religious Life (K. E. Fields, Trans.). The Free Press. (Original work published 1912)
  • Eliade, M. (1964). Shamanism: Archaic Techniques of Ecstasy. Princeton University Press.
  • Fingarette, H. (1972). Confucius: The Secular as Sacred. Harper & Row.
  • Faivre, A. (1994). Access to Western Esotericism. State University of New York Press.
  • Flood, G. D. (1996). An Introduction to Hinduism. Cambridge University Press.
  • Freud, S. (1961). The Future of an Illusion (J. Strachey, Trans.). W. W. Norton & Company. (Original work published 1927)
  • Gould, S. J. (1999). Rocks of Ages: Science and Religion in the Fullness of Life. Ballantine Publishing Group.
  • Guénon, R. (2001). The Crisis of the Modern World (M. Pallis & A. Osborne, Trans.). Sophia Perennis. (Original work published 1927)
  • Guthrie, S. E. (1993). Faces in the Clouds: A New Theory of Religion. Oxford University Press.
  • Hanegraaff, W. J. (2013). Western Esotericism: A Guide for the Perplexed. Bloomsbury Academic.
  • Hardacre, H. (2017). Shinto: A History. Oxford University Press.
  • Harris, S. (2010). The Moral Landscape: How Science Can Determine Human Values. Free Press.
  • Hartshorne, C. (1967). A Natural Theology for Our Time. Open Court.
  • Harvey, G. (2005). Animism: Respecting the Living World. C. Hurst & Co. Publishers.
  • Heelas, P., & Woodhead, L. (2005). The Spiritual Revolution: Why Religion is Giving Way to Spirituality. Blackwell Publishing.
  • Hick, J. (1966). Evil and the God of Love. Macmillan.
  • Jaspers, K. (1953). The Origin and Goal of History (M. Bullock, Trans.). Yale University Press.
  • Jung, C. G. (1969). Archetypes and the Collective Unconscious (R. F. C. Hull, Trans.). Princeton University Press. (Original work published 1938)
  • Kohn, L. (2009). Introducing Daoism. Routledge.
  • Marett, R. R. (1909). The Threshold of Religion. Methuen & Co.
  • Marty, M. E., & Appleby, R. S. (Eds.). (1991). Fundamentalisms Observed (The Fundamentalism Project, Vol. 1). University of Chicago Press.
  • Marx, K. (1975). Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right. In K. Marx & F. Engels, Collected Works (Vol. 3). International Publishers/Progress Publishers. (Original work published 1844)
  • McLeod, W. H. (1997). The Sikhs: History, Religion, and Society. Columbia University Press.
  • Müller, F. M. (1878). Lectures on the Origin and Growth of Religion. Longmans, Green, and Co.
  • Nasr, S. H. (1981). Knowledge and the Sacred. State University of New York Press.
  • Niebuhr, H. R. (1929). The Social Sources of Denominationalism. Henry Holt and Company.
  • Norenzayan, A. (2013). Big Gods: How Religion Transformed Cooperation and Conflict. Princeton University Press.
  • Pagels, E. (1979). The Gnostic Gospels. Random House.
  • Plato. (2000). The Republic (G.R.F. Ferrari, Ed.; T. Griffith, Trans.). Cambridge University Press.
  • Plato. (2007). The Republic (D. Lee, Trans.). Penguin Classics.
  • Rahula, W. (1959). What the Buddha Taught. Grove Press.
  • Redfield, R. (1956). Peasant Society and Culture: An Anthropological Approach to Civilization. University of Chicago Press.
  • Scholem, G. (1995). Major Trends in Jewish Mysticism. Schocken Books.
  • Schuon, F. (1984). The Transcendent Unity of Religions. Quest Books.
  • Smith, M. S. (2002). The Early History of God: Yahweh and the Other Deities in Ancient Israel (2nd ed.). William B. Eerdmans Publishing Company.
  • Solomon, S., Greenberg, J., & Pyszczynski, T. (2015). The Worm at the Core: On the Role of Death in Life. Random House.
  • Spinoza, B. (1996). Ethics (E. Curley, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1677)
  • Stark, R., & Bainbridge, W. S. (1985). The Future of Religion: Secularization, Revival, and Cult Formation. University of California Press.
  • Troeltsch, E. (1992). The Social Teaching of the Christian Churches (O. Wyon, Trans.). Westminster John Knox Press. (Original work published 1911)
  • Tylor, E. B. (1871). Primitive Culture: Researches into the Development of Mythology, Philosophy, Religion, Language, Art, and Custom. John Murray.
  • Wach, J. (1944). Sociology of Religion. University of Chicago Press.
  • Wallis, R. (1984). The Elementary Forms of the New Religious Life. Routledge & Kegan Paul.
  • Walters, K. (1992). The American Deists: Voices of Reason and Dissent in the Early Republic. University Press of Kansas.
  • Weber, M. (1963). The Sociology of Religion (E. Fischoff, Trans.). Beacon Press. (Original work published 1922)
  • Weber, M. (1978). Economy and Society: An Outline of Interpretive Sociology (G. Roth & C. Wittich, Eds.). University of California Press. (Original work published 1922)
  • Weber, M. (2001). The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism (S. Kalberg, Trans.). Roxbury Publishing Company. (Original work published 1905)
  • Wilson, B. R. (1982). Religion in Sociological Perspective. Oxford University Press.
  • Wilson, D. S. (2002). Darwin’s Cathedral: Evolution, Religion, and the Nature of Society. University of Chicago Press.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।