সিনক্রেটিজম বা সমন্বয়বাদ (Syncretism): সংস্কৃতির পাঁচমিশালি খিচুড়ির সাতকাহন
Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 সিনক্রেটিজম আসলে কী? তত্ত্বের গভীরে এক ডুব
- 3 সিনক্রেটিজম কেন এবং কীভাবে ঘটে? এর পেছনের চালিকাশক্তি
- 4 ধর্মের উঠানে সিনক্রেটিজম: বিশ্বাসের হাজারো মেলবন্ধন
- 5 আমাদের উঠানে সিনক্রেটিজম: বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের জীবন্ত চালচিত্র
- 6 ধর্মের বাইরেও সিনক্রেটিজম: ভাষা, শিল্প, খাবার আর জীবনের গল্প
- 7 বিতর্কের দাঁড়িপাল্লায় সিনক্রেটিজম: সৃষ্টি না অবক্ষয়?
- 8 এই ডিজিটাল যুগে সিনক্রেটিজম: বিশ্বগ্রামের নতুন খিচুড়ি
- 9 শেষ কথা নয়, বরং এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত
- 10 তথ্যসূত্র
ভূমিকা
রাতের আকাশে কখনো কি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছেন? পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া ফালি চাঁদের ঠিক নিচেই এক ফোঁটা আলোর মতো দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জ্যোতিষ্ক, একজন পৃথিবীর উপগ্রহ, অন্যজন এক জ্বলন্ত গ্রহ। কিন্তু দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ওরা যেন একে অপরের সঙ্গী। কেউ কারও পরিচয় মুছে দিচ্ছে না, কিন্তু দুজনে মিলে যে ছবিটা তৈরি করছে, তা একা চাঁদ বা একা শুকতারার চেয়ে অনেক বেশি মায়াবী, অনেক বেশি রহস্যময়।
কিংবা ধরুন, ছুটির দিনের দুপুরের কথা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, আর আপনার পাতে ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি। চাল আর ডাল একসঙ্গে সেদ্ধ হয়ে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আপনি ঠিক আলাদা করে বলতে পারবেন না কোনটা চাল আর কোনটা ডাল। দুটোই আছে, কিন্তু তারা মিলেমিশে একাকার। এর সঙ্গে যদি একটু বেগুন ভাজা, ডিমের ওমলেট আর আমের আচার থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। প্রতিটি উপাদানের স্বাদ আলাদা, কিন্তু একসঙ্গে তারা এমন এক ঐকতান তৈরি করে যা আমাদের মন ভালো করে দেয়। এই যে খিচুড়ি, এটা কি শুধুই চাল? বা শুধুই ডাল? না, এটা চাল-ডালের ঊর্ধ্বে নতুন এক সৃষ্টি।
আমাদের জীবন, সমাজ, ধর্ম, ভাষা আর সংস্কৃতিও ঠিক এই রকম এক বিশাল রান্নাঘর। এখানে প্রতিনিয়ত কত কিছু এসে মিশে যাচ্ছে, কত কিছু বদলে যাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন রূপ আর স্বাদ। এই যে দুটো বা তারও বেশি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস, ধারণা, সংস্কৃতি বা ধর্মের উপাদান একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একটা নতুন কিছুর জন্ম দেয়, কিন্তু সেই নতুন জিনিসটার মধ্যে পুরোনো উপাদানগুলোর ছাপ বা স্মৃতিচিহ্ন স্পষ্টভাবে থেকে যায় – এই জটিল অথচ সুন্দর প্রক্রিয়াটারই একটা ভারী নাম আছে। সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান (Anthropology) আর ধর্মতত্ত্বের (Theology) ভাষায় একে বলে সিনক্রেটিজম (Syncretism) বা সমন্বয়বাদ।
নামটা শুনে হয়তো কপালে হালকা ভাঁজ পড়তে পারে। মনে হতে পারে, এটা নিশ্চয়ই পণ্ডিতদের আলোচনার বিষয়, আমাদের আটপৌরে জীবনের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। কিন্তু সত্যিটা হলো, আমরা সবাই এই সিনক্রেটিজমের সাগরেই বাস করছি। আমরা এর মধ্যেই ডুবে আছি, এর স্বাদ নিচ্ছি, একে তৈরি করছি – শুধু হয়তো নামটা জানি না। চলুন, আজ এই সিনক্রেটিজমের হাঁড়িটা খুলে দেখা যাক। এর ভেতরে কী কী উপাদান আছে, কীভাবে এর রান্না হলো, এর ইতিহাস কতটা পুরোনো, আর এর স্বাদই বা কেমন – ঝাল, মিষ্টি, নাকি টক? এই দীর্ঘ যাত্রায় আমরা কেবল তত্ত্বের শুকনো কাঠামোর মধ্যে আটকে থাকব না, বরং ডুব দেব গল্পের গভীরে, যেখানে ইতিহাস আর মানুষের বিশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
সিনক্রেটিজম আসলে কী? তত্ত্বের গভীরে এক ডুব
সবচেয়ে সহজ ভাষায় বললে, সিনক্রেটিজম হলো এক ধরনের সাংস্কৃতিক মিশ্রণ (Cultural Blending)। তবে সব মিশ্রণই সিনক্রেটিজম নয়। এর একটা বিশেষত্ব আছে। যখন দুটো ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে একে অপরের কাছাকাছি আসে – হোক তা ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মপ্রচার বা অভিবাসনের মাধ্যমে – তখন তারা সচেতন বা অচেতনভাবে একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু ধার করে। এই আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটা যখন এমন এক সৃজনশীল পর্যায়ে পৌঁছায় যে দুটো ভিন্ন উৎস থেকে আসা উপাদান মিলে একটা নতুন, যৌগিক (Composite) রূপ তৈরি করে, তখনই সিনক্রেটিজমের জন্ম হয় (Stewart & Shaw, 1994)।
ভাবুন তো, একজন ভাস্কর পুরোনো ভাঙা মন্দিরের দুটো মূর্তি আর নতুন কেনা কিছু পাথর একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাস্কর্য তৈরি করলেন। নতুন ভাস্কর্যটিতে পুরোনো মূর্তি দুটোর আদলও বোঝা যাচ্ছে, আবার নতুন পাথরের নিজস্বতাও আছে। কিন্তু পুরোটা মিলে এমন এক শিল্পকর্ম তৈরি হলো, যা আগের কোনোটির মতোই নয়। সিনক্রেটিজম ঠিক এমনই এক শৈল্পিক প্রক্রিয়া। এটি কেবল দুটি জিনিসকে পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া নয়, বরং তাদের মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে নতুন যৌগ তৈরি করা।
তবে এই ধারণাটিকে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে, এর কিছু জ্ঞাতিভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়া দরকার। সংস্কৃতির মিশ্রণ বোঝাতে আরও কয়েকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়, যেগুলোর সঙ্গে সিনক্রেটিজমের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে।
- ১. অ্যাকালচারেশন (Acculturation) বা সংস্কৃতি আত্তীকরণ: যখন একটি সংস্কৃতি (সাধারণত সংখ্যালঘু বা কম প্রভাবশালী) অন্য একটি প্রভাবশালী সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে তার কিছু কিছু উপাদান – যেমন ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস – গ্রহণ করে, কিন্তু নিজের মূল সাংস্কৃতিক পরিচয় ও কাঠামো বজায় রাখে, তাকে বলে অ্যাকালচারেশন। এটা অনেকটা এক বাটি দইয়ের ওপর সামান্য মধু ঢেলে দেওয়ার মতো। দই দই-ই থাকে, মধুও তার স্বাদ ধরে রাখে, কিন্তু একসঙ্গে খেলে একটা নতুন স্বাদ পাওয়া যায়। যেমন, আমরা বাংলাদেশিরা প্যান্ট-শার্ট পরি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের মূল কাঠামোটা এখনো বাঙালিয়ানার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।
- ২. অ্যাসিমিলিয়েশন (Assimilation) বা একীভবন: এটা আরও এক ধাপ এগিয়ে এবং প্রায়শই একতরফা। যখন একটি দুর্বল বা সংখ্যালঘু সংস্কৃতি আরেকটি অত্যন্ত প্রভাবশালী সংস্কৃতির মধ্যে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় এবং নিজের আলাদা পরিচয়, ভাষা, ধর্ম – সবকিছু হারিয়ে ফেলে, তখন তাকে অ্যাসিমিলিয়েশন বলে। এটা অনেকটা এক গ্লাস স্বচ্ছ জলে এক ফোঁটা নীল রং ফেলার মতো। কিছুক্ষণ নাড়া দেওয়ার পর আর নীল রঙের আলাদা অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, পুরোটাই হয়ে যায় হালকা নীল জল। ইতিহাসে অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক (Colonial) শক্তির চাপে পড়ে এভাবেই নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে।
- ৩. সাংস্কৃতিক বিনিময় (Cultural Exchange): দুটো মোটামুটি সমশক্তিশালী ও সমমর্যাদার সংস্কৃতি যখন একে অপরের থেকে উপাদান দেওয়া-নেওয়া করে, তখন তাকে সাংস্কৃতিক বিনিময় বলা যায়। এখানে জোর-জবরদস্তির চেয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আদান-প্রদানটাই মুখ্য। যেমন, ভারতীয় ও পারস্যের সঙ্গীতের মধ্যে যে আদান-প্রদান ঘটেছিল, তা ছিল অনেকটাই এরকম।
- ৪. ট্রান্সকালচারেশন (Transculturation): কিউবার নৃবিজ্ঞানী ফার্নান্দো অরতিজ (Fernando Ortiz) এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি আখের খেতের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, ব্যাপারটা শুধু একদিক থেকে অন্যদিকে যাওয়া নয়, বরং একটি দ্বি-মুখী প্রক্রিয়া। যখন দুটি সংস্কৃতি মেশে, তখন উভয় সংস্কৃতিই পরিবর্তিত হয় এবং একটি নতুন বাস্তবতা বা ‘নিও-কালচারেশন’ (Neoculturation) তৈরি হয়।
সিনক্রেটিজম এই সবকিছুর মাঝখানে এক অদ্ভুত ও আকর্ষণীয় জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এখানে দুটো উপাদানই দৃশ্যমানভাবে টিকে থাকে, কেউ পুরোপুরি হারিয়ে যায় না, আবার তারা একেবারে আলাদাও থাকে না। তারা মিলেমিশে এক নতুন সত্তা তৈরি করে, যা তার পূর্বসূরিদের চেয়ে ভিন্ন, কিন্তু তাদের স্মৃতিচিহ্ন বা ডিএনএ (DNA) গর্বের সঙ্গে বহন করে (van der Veer, 2004)। এটি এক ধরনের সৃজনশীল আপস (Creative Compromise), যেখানে মানুষ তার পুরোনো পৃথিবীর স্মৃতি ও নতুন পৃথিবীর বাস্তবতার মধ্যে একটা সেতু তৈরি করে নেয়।
সিনক্রেটিজম কেন এবং কীভাবে ঘটে? এর পেছনের চালিকাশক্তি
সংস্কৃতি তো আর জাদুঘরের কাচের বাক্সে রাখা কোনো স্থির বস্তু নয়, এ এক বহমান খরস্রোতা নদী। নদীর স্রোতে যেমন পলি, নুড়ি, আবর্জনা – কত কিছু ভেসে আসে, মেশে, সংস্কৃতির স্রোতেও ঠিক তাই হয়। সিনক্রেটিজম ঘটার পেছনে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ বা চালিকাশক্তি (Driving Forces) কাজ করে।
- বাণিজ্য ও যোগাযোগ (Trade and Communication): প্রাচীনকাল থেকেই বণিকরা ছিলেন সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বাহক। তাঁরা শুধু রেশম, মশলা বা মূল্যবান পাথরই বয়ে নিয়ে যাননি, সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তাদের ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস আর লোকাচার। কিংবদন্তির সিল্ক রুট (Silk Route) ছিল এমনই এক বিশাল সিনক্রেটিক হাইওয়ে, যেখানে চীন, ভারত, পারস্য আর ইউরোপের ভাবনার এক অসাধারণ মিলন ঘটেছিল। একইভাবে, সমুদ্রপথে যে মশলার বাণিজ্য (Spice Trade) হতো, তার ফলে উপকূলীয় বন্দর শহরগুলো (Port Cities) হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতির গলনপাত্র (Melting Pot)।
- সাম্রাজ্য ও বিজয় (Empires and Conquests): ইতিহাসজুড়ে দেখা গেছে, যখন একটি জাতি আরেকটি জাতিকে সামরিক শক্তিতে পরাজিত করে শাসন করে, তখন শাসকের সংস্কৃতি প্রায়শই শাসিতের সংস্কৃতির ওপর প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে। কিন্তু শাসিত জনগোষ্ঠীও পাথরের মতো নিষ্ক্রিয় থাকে না। তারা হয়তো সরাসরি বিদ্রোহ করতে পারে না, কিন্তু তারা এক ধরনের নীরব প্রতিরোধ (Passive Resistance) গড়ে তোলে। তারা শাসকের সংস্কৃতিকে পুরোপুরি গ্রহণও করে না, আবার বর্জনও করে না। বরং, তারা শাসকের সংস্কৃতিকে নিজেদের মতো করে ভেঙেচুরে, বদলে নিয়ে নিজেদের পুরোনো বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন রূপ দেয়। নৃবিজ্ঞানী জেমস সি. স্কট (James C. Scott) যাকে বলেছেন ‘গোপন চিত্রনাট্য’ (Hidden Transcript), সিনক্রেটিজম অনেক ক্ষেত্রে সেই গোপন প্রতিবাদেরই এক শৈল্পিক প্রকাশ।
- ধর্মপ্রচার (Proselytization): ধর্মপ্রচারকরা যখন নতুন কোনো অঞ্চলে তাঁদের ধর্মবিশ্বাস প্রচার করতে যান, তখন তাঁরা প্রায়শই দেখেন যে সেখানকার মানুষের ইতোমধ্যেই কিছু নিজস্ব বিশ্বাস, দেব-দেবী ও রীতিনীতি গভীরে প্রোথিত আছে। সেই পুরোনো বিশ্বাসকে এক ঝটকায় উপড়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব। তাই নতুন ধর্মকে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও আপন করে তোলার জন্য, অনেক সময় স্থানীয় সংস্কৃতির কিছু উপাদানকে নতুন ধর্মের কাঠামোর মধ্যে সচেতনভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। স্থানীয় কোনো দেবীকে হয়তো নতুন ধর্মের কোনো সাধ্বীর (Saint) সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হলো, অথবা স্থানীয় কোনো উৎসবের দিনেই নতুন ধর্মের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন শুরু হলো। এটা ছিল এক ধরনের কৌশলগত সমন্বয় (Strategic Syncretism)।
- অভিবাসন ও ডায়াস্পোরা (Migration and Diaspora): মানুষ যখন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে বা মহাদেশে পাড়ি জমায়, তখন সে তার স্যুটকেসে জামাকাপড়ের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে নিজের সংস্কৃতিকেও বয়ে নিয়ে যায়। এই নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এবং নিজেদের পরিচয় টিকিয়ে রাখার জন্য অভিবাসী জনগোষ্ঠী (Immigrant Communities) প্রায়শই স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতির একটা মিশ্রণ ঘটায়। এর ফলে এক ধরনের সংকর বা হাইব্রিড (Hybrid) পরিচয়ের জন্ম হয়, যা না পুরোপুরি স্বদেশের, না পুরোপুরি বিদেশের।
এই প্রক্রিয়াগুলো সচেতন বা অচেতন – দুভাবেই হতে পারে। কখনও মানুষ টিকে থাকার প্রয়োজনে জেনেশুনে দুটো বিশ্বাসকে মেশায়, কখনও তা ঘটে যায় একেবারে অলক্ষ্যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
ধর্মের উঠানে সিনক্রেটিজম: বিশ্বাসের হাজারো মেলবন্ধন
ধর্মের আঙিনাটা এক অদ্ভুত জায়গা। এটা একদিকে যেমন কঠোর নিয়মকানুন, আচার-বিচার আর বিশুদ্ধতার পাঁচিলে ঘেরা, তেমনি অন্যদিকে এটাই আবার মানুষের সবচেয়ে গভীর আবেগ, ভয় আর ভালোবাসার আশ্রয়স্থল। আর ঠিক এই কারণেই, সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জটিল এবং কখনো কখনো প্রচণ্ড বিতর্কিত উদাহরণগুলো এই ধর্মের সুবিশাল উঠানেই খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষ যখন তার পূর্বপুরুষের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে আনা বিশ্বাসকে মন থেকে এক ঝটকায় উপড়ে ফেলতে পারে না, আবার নতুন বা প্রভাবশালী কোনো ধর্মকেও বাস্তবতার কারণে অগ্রাহ্য করতে পারে না, তখন সে তার হৃদয়ের গভীরে এক আশ্চর্য আপস করে। সে দুটোকেই পাশাপাশি রাখার, দুটোকেই ভালোবাসার একটা উপায় খুঁজে বের করে। আর সেই সৃজনশীল সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই জন্ম নেয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিষ্ময়ভরা সব বিশ্বাস, উপাসনার রীতি আর ধর্মীয় দর্শন।
এটা কোনো যান্ত্রিক মিশ্রণ নয়, বরং মানুষের আত্মার এক জীবন্ত প্রতিক্রিয়া। চলুন, ইতিহাসের পাতা উল্টে এই বিশ্বাসের মেলবন্ধনের কয়েকটি অসাধারণ গল্প শুনে আসি।
১. রোমান আর গ্রিকদের দেবদেবীর যুগলবন্দী: সাম্রাজ্যের ঐশ্বরিক আঠা
সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে ক্লাসিক এবং পাঠ্যপুস্তকের উদাহরণ যদি কিছু থাকে, তবে তা হলো গ্রেকো-রোমান দেবদেবীর জগৎ। রোমানরা যখন সামরিক শক্তিতে গ্রিস এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করল, তখন তারা বিজেতা হিসেবে গেলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিল মুগ্ধ ছাত্রের মতো। তারা দেখল, গ্রিকদের কেবল উন্নত দর্শন, সাহিত্য আর শিল্পকলাই নেই, তাদের আছে দেবদেবীর এক বিশাল, সুসংগঠিত ও আকর্ষণীয় পরিবার – এক মহাকাব্যিক প্যান্থিয়ন (Pantheon)। অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায় বসে থাকা জিউস, হেরা, পোসাইডন, আরেস, অ্যাফ্রোদিতি – তাঁদের প্রত্যেকের আছে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, ক্ষমতা আর তাঁদের ঘিরে রয়েছে কত রোমাঞ্চকর, মানবিক ও অতিমানবিক গল্প!
বিপরীতে, আদি রোমানদের দেবতারা ছিলেন অনেকটাই বিমূর্ত, কার্যকরী শক্তি বা নিউমিনা (Numina)। যেমন, দ্বাররক্ষার দেবতা জানুস, বা উনুনের দেবী ভেস্টা। তাঁদের কোনো মানবিক গল্প বা জটিল পারিবারিক সম্পর্ক ছিল না। রোমানরা গ্রিকদের এই প্রাণবন্ত দেবতাদের ফেলে না দিয়ে এক অত্যন্ত চতুর ও কার্যকরী উপায় বের করল। তারা নিজেদের পুরোনো, অপেক্ষাকৃত কম বিকশিত দেবতাদের সঙ্গে এই গ্রিক দেবতাদের সমরূপ স্থাপন করলো বা মিলিয়ে দিল। এই প্রক্রিয়াকে পণ্ডিতরা বলেন ইন্টারপ্রেটাশিও রোমানা (Interpretatio Romana), অর্থাৎ ‘রোমান ব্যাখ্যা’ – অন্য সংস্কৃতির দেবতাকে নিজেদের চেনা ছাঁচে ফেলে বোঝা।
- গ্রিকদের দেবরাজ, বজ্র ও আকাশের দেবতা জিউস (Zeus) হয়ে গেলেন রোমানদের সর্বোচ্চ দেবতা জুপিটার (Jupiter)।
- সমুদ্রের অধিপতি ও জিউসের ভাই পোসাইডন (Poseidon) হলেন রোমানদের নেপচুন (Neptune)।
- ভয়ঙ্কর যুদ্ধের দেবতা আরেস (Ares) হলেন রোমানদের কাছে অনেক বেশি সম্মানিত ও শৃঙ্খলাপরায়ণ যুদ্ধের দেবতা মার্স (Mars)।
- প্রেম, কাম ও সৌন্দর্যের দেবী অ্যাফ্রোদিতি (Aphrodite) হলেন রোমানদের ভেনাস (Venus)।
- জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা (Athena) হলেন মিনার্ভা (Minerva), আর শিকার ও চাঁদের দেবী আর্টেমিস (Artemis) হলেন ডায়ানা (Diana)।
এই মিলন কেবল নাম বদলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর ফলে রোমান দেবতারা গ্রিক দেবতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা এবং তাঁদের নিয়ে প্রচলিত পৌরাণিক গল্পগুলোও পেয়ে গেলেন। এটি ছিল এক অসাধারণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৌশল। এই সিনক্রেটিজম বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় (Shared Identity) তৈরি করতে সাহায্য করেছিল, যা সাম্রাজ্যকে এক সূত্রে বাঁধতে আঠার মতো কাজ করেছিল (Beard et al., 2012)। এর ফলে দুটো সংস্কৃতি মিলেমিশে এমন এক শক্তিশালী গ্রেকো-রোমান (Greco-Roman) সভ্যতা ও ধর্মবিশ্বাসের জন্ম দিল, যা পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য-দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে (Leopold & Jensen, 2012)।
২. খ্রিস্টধর্ম ও ইউরোপীয় প্যাগান ঐতিহ্যের মিশেল: আলোর উৎসবে নক্ষত্রের জন্ম
আজ বিশ্বজুড়ে যে খ্রিস্টধর্ম আমরা দেখি, তার অনেক জনপ্রিয় উৎসব আর আচারের গভীরে কান পাতলে প্রাচীন ইউরোপের অখ্রিস্টান বা প্যাগান (Pagan) সংস্কৃতির পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। ২৫শে ডিসেম্বর তারিখটি সারা বিশ্বে যিশুর জন্মদিন বা বড়দিন (Christmas) হিসেবে মহা ধুমধামে পালিত হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাইবেলের কোথাও যিশুর এই জন্মতারিখের কোনো ধরনের উল্লেখ নেই। প্রথম কয়েক শতাব্দীর খ্রিস্টানরা এই দিনটি পালনও করতেন না। তাহলে তারিখটা এলো কোথা থেকে?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে সিনক্রেটিজমের এক অসাধারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কৌশলের মধ্যে।
- বড়দিন (Christmas) ও শীতকালীন উৎসব: প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে ডিসেম্বরের শেষ দিকে স্যাটারনালিয়া (Saturnalia) নামে এক বিশাল জনপ্রিয় উৎসব হতো। এটি ছিল কৃষিদেবতা স্যাটার্নের সম্মানে আয়োজিত এক আনন্দোৎসব, যেখানে মানুষ খাওয়া-দাওয়া, উপহার বিনিময় এবং সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে কয়েকদিনের জন্য সাম্যের উৎসবে মাতত। একই সময়ে, উত্তর ইউরোপের জার্মানিক ও কেলটিক জাতিগোষ্ঠীর প্যাগানরা বছরের সবচেয়ে ছোট দিন বা উইন্টার সলস্টিসকে (Winter Solstice) ঘিরে আলোর পুনর্জন্মের উৎসব করত, কারণ এর পর থেকেই দিন আবার বড় হতে শুরু করে, যা অন্ধকারের ওপর আলোর বিজয়কে বোঝাত। এছাড়াও, রোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে, ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে সোল ইনভিক্টাস (Sol Invictus) বা ‘অজেয় সূর্য’-এর জন্মদিন পালন করা হতো, যা ছিল এক জনপ্রিয় সূর্য-কেন্দ্রিক ধর্ম (Fletcher, 1997)।খ্রিস্টধর্ম যখন রোমান সাম্রাজ্য ও পরে ইউরোপে ছড়াতে শুরু করল, তখন সাধারণ মানুষকে তাদের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলে নতুন ধর্মে আকৃষ্ট করাটা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাই চতুর্থ শতকের দিকে চার্চ একটি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিল। পোপ গ্রেগরি দ্য গ্রেটের মতো নেতারা ধর্মপ্রচারকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্যাগানদের মন্দির ধ্বংস না করে সেগুলোকে চার্চে রূপান্তরিত করতে এবং তাদের উৎসবগুলোকে খ্রিস্টীয় তাৎপর্য দিয়ে গ্রহণ করতে। এরই অংশ হিসেবে, এই জনপ্রিয় উৎসবের সময়টিকেই ‘জগতের আলো’ যিশুর জন্মদিন হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হলো। উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যেন তাদের পুরোনো উৎসবের আমেজেই নতুন ধর্মের ত্রাণকর্তার জন্মদিন পালন করতে পারে। ক্রিসমাস ট্রি সাজানো (যা ছিল প্যাগানদের কাছে জীবনের প্রতীক), মোমবাতি জ্বালানো (আলোর প্রতীক), উপহার দেওয়া-নেওয়া – এগুলোর অনেক কিছুর সঙ্গেই প্রাচীন প্যাগান শীতকালীন উৎসবের গভীর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় (Stewart & Shaw, 1994)।
- ইস্টার (Easter) ও বসন্তের দেবী: একইভাবে, খ্রিস্টানদের অন্যতম প্রধান উৎসব ইস্টার, যা যিশুর পুনরুত্থানকে কেন্দ্র করে পালিত হয়, তার নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের বসন্ত ও উর্বরতার দেবী ইওস্ত্রের (Eostre) নাম। ইস্টার উৎসবে ডিম (নতুন জীবনের প্রতীক) আর খরগোশ (প্রচুর প্রজনন ক্ষমতার প্রতীক) ব্যবহারের প্রথাটিও সরাসরি প্যাগান উর্বরতার উৎসব থেকে খ্রিস্টীয় আচারে ঢুকে পড়েছে।
- সন্ত ও স্থানীয় দেবদেবী: এর থেকেও গভীর সিনক্রেটিজম দেখা যায় সাধু-সন্তদের (Saints) ক্ষেত্রে। অনেক স্থানীয় প্যাগান দেবদেবী, যাঁদের প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল ছিল, তাঁদের চার্চ ‘খ্রিস্টীয়করণ’ (Christianized) করে সাধু বা সন্তের মর্যাদা দেয়। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো আয়ারল্যান্ডের সেন্ট ব্রিজিড (St. Brigid)। তাঁর উৎসবের দিন (১লা ফেব্রুয়ারি), তাঁর সঙ্গে জড়িত আগুন ও আরোগ্যের ক্ষমতা এবং অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্য হুবহু মিলে যায় প্রাচীন কেলটিক দেবী ব্রিজিডের (Brigid) সঙ্গে। কার্যত, দেবীকে একজন সন্তের পোশাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল।
এই প্রক্রিয়াটি ছিল নতুন ধর্মকে স্থানীয় মানুষের কাছে আরও বেশি আপন, পরিচিত এবং কম ভয়ের করে তোলার এক অসাধারণ কৌশল, যা এর প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।
৩. বৌদ্ধধর্মের বিশ্বযাত্রা: যেখানে গেছে, যেমন দেশ, তেমন বেশ
বৌদ্ধধর্ম যখন তার জন্মভূমি ভারত থেকে বেরিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল, তখন এটি এক আশ্চর্য অভিযোজন ক্ষমতা বা অ্যাডাপ্টেবিলিটি (Adaptability) দেখিয়েছে। এটি কোনো অঞ্চলের সংস্কৃতিকে ধ্বংস না করে, বরং তার সঙ্গে নিজেকে সৃজনশীলভাবে মিলিয়ে নিয়েছে।
- চীন: তাও আর ধ্যানের মিলন: বৌদ্ধধর্ম যখন হান রাজবংশের সময়ে চীনে পৌঁছাল, তখন সেখানে ইতোমধ্যেই দুটি শক্তিশালী দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারা প্রচলিত ছিল – কনফুসীয়বাদ (Confucianism), যা সামাজিক শৃঙ্খলা ও পারিবারিক কর্তব্যের ওপর জোর দিত, এবং তাওবাদ (Taoism), যা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া, সরলতা এবং ‘উ ওয়েই’ (wu wei) বা নিষ্কাম কর্মের কথা বলত। বৌদ্ধধর্ম এই দুটি ধারার সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে, তাদের কিছু ধারণা ও শব্দভান্ডারকে নিজের মধ্যে ধারণ করল। ভারতীয় ‘ধ্যান’ (Dhyana) পদ্ধতির সঙ্গে তাওবাদী প্রকৃতিপ্রেম আর সরলতার এক অপূর্ব মিশ্রণ ঘটল। তাওবাদের ‘তাও’ (Tao) বা ‘পথ’ শব্দটিকেই অনেক সময় বৌদ্ধ ‘ধর্ম’ (Dharma) বোঝাতে ব্যবহার করা হতো। এর ফলে জন্ম নিল এক নতুন ধারা – চ্যান বৌদ্ধধর্ম (Chan Buddhism)। এই চ্যান বৌদ্ধধর্মই পরবর্তীকালে কোরিয়া হয়ে জাপানে পৌঁছায় এবং সেখানে আরও পরিবর্তিত হয়ে সামুরাইদের সংস্কৃতি ও জাপানি নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে মিশে জন্ম দেয় বিশ্ববিখ্যাত জেন বৌদ্ধধর্মের (Zen Buddhism)।
- তিব্বত: বজ্র আর শামানদের জগৎ: বৌদ্ধধর্ম যখন সপ্তম-অষ্টম শতকে হিমালয়ের উচ্চ মালভূমিতে পৌঁছাল, তখন সেখানে বন (Bon) নামে এক শামান-কেন্দ্রিক (shamanistic) প্রাচীন ধর্ম প্রচলিত ছিল। এই ধর্মে স্থানীয় দেব-দেবী, ভয়ঙ্কর ভূতপ্রেত, নাগ আর প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করা হতো। কিংবদন্তি অনুসারে, গুরু পদ্মসম্ভব (Guru Rinpoche) তিব্বতে এসে এই ভয়ঙ্কর স্থানীয় দেবতাদের তন্ত্রের শক্তিতে পরাজিত করেন, কিন্তু তাঁদের ধ্বংস না করে বৌদ্ধধর্মের রক্ষাকর্তা বা ধর্মপাল (Dharmapala) হিসেবে নিযুক্ত করেন। এর ফলে যে স্বতন্ত্র তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের (Tibetan Buddhism) বিকাশ ঘটল, তা মন্ত্র, মণ্ডল, জটিল দেব-দেবী এবং বিভিন্ন তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানে সমৃদ্ধ। এটি ভারতীয় মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং স্থানীয় বন ধর্মের এক শক্তিশালী ও নাটকীয় সিনক্রেটিক রূপ (Lopez Jr., 2008)।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন – যেমন চারটি আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা নির্বাণ – অক্ষুণ্ণ থেকেছে, কিন্তু তার বাহ্যিক প্রকাশভঙ্গি, শিল্পকলা আর আচার-অনুষ্ঠান স্থানীয় সংস্কৃতির রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে, যা এর বিশ্বজনীন আবেদনের অন্যতম কারণ।
৪. আফ্রিকার আত্মার ক্রন্দন: ভুডু, স্যান্টেরিয়া ও প্রতিরোধের ধর্ম
সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে শক্তিশালী, হৃদয়স্পর্শী অথচ করুণ উদাহরণগুলোর একটি হলো আমেরিকা মহাদেশের আফ্রো-ডায়াস্পোরিক (Afro-diasporic) ধর্মগুলো। ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা থেকে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে অমানবিক পরিস্থিতিতে দাস হিসেবে বিক্রির জন্য জাহাজবোঝাই করে কিউবা, হাইতি, ব্রাজিল ও উত্তর আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হলো, তখন তাদের শুধু শারীরিক স্বাধীনতাই কেড়ে নেওয়া হয়নি, কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল তাদের আত্মাকেও। তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রভুদের ধর্ম – ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম। তাদের নিজস্ব দেবদেবী, যাদের বলা হতো ওরিষা (Orishas) বা লোয়া (Loa), তাদের উপাসনা করা, নিজেদের ভাষায় গান গাওয়া বা পবিত্র ড্রাম বাজানো ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কিন্তু মানুষ তার বিশ্বাসকে, তার শেকড়কে এত সহজে ছাড়ে না। এই আফ্রিকান দাসেরা বেঁচে থাকার এবং নিজেদের পরিচয় টিকিয়ে রাখার এক অবিশ্বাস্য উপায় বের করল। তারা এক ধরনের ধর্মীয় ছদ্মবেশের (Religious Camouflage) আশ্রয় নিল। তারা তাদের পুরোনো আফ্রিকান দেবতাদের ক্যাথলিক সন্তদের (Saints) অবয়বের আড়ালে পূজা করতে শুরু করল, কারণ সন্তদের মূর্তি পূজা ক্যাথলিক ধর্মে অনুমোদিত ছিল।
- নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা (Yoruba) জনগোষ্ঠীর বজ্র ও বিদ্যুতের শক্তিশালী, পুরুষালি দেবতা শাঙ্গোকে (Shango) তারা মিলিয়ে দিল সেন্ট বারবারার (Saint Barbara) সঙ্গে, কারণ ক্যাথলিক বিশ্বাসে সেন্ট বারবারাও বজ্রপাত ও আগুনের হাত থেকে রক্ষা করেন।
- প্রেম, সৌন্দর্য, সম্পদ আর নদীর দেবী ওশুন (Oshun) মিশে গেলেন কিউবার অভিভাবক সাধ্বী বা প্যাট্রন সেইন্ট আওয়ার লেডি অফ চ্যারিটির (Our Lady of Charity) ভার্সনের সঙ্গে, কারণ দুজনেই ছিলেন মাতৃস্নেহের প্রতীক।
- মাতৃত্ব আর সুবিশাল সমুদ্রের দেবী ইয়েমাজাকে (Yemayá) চেনা হলো হাভানার প্যাট্রনেস বা অভিভাবিকা সাধ্বী ওয়ার লেডি অফ রেগলার (Our Lady of Regla) রূপে।
- যুদ্ধ ও লোহার দেবতা ওগুনকে (Ogun) মেলানো হলো তরবারি হাতে থাকা যোদ্ধা সন্ত বা ওয়ারিয়র সেইন্ট সেন্ট জর্জ (St. George) বা সেন্ট জেমসের (St. James) সঙ্গে।
বাইরে থেকে প্রভুরা দেখত, তাদের দাসেরা খুব ভক্তিভরে ক্যাথলিক সন্তদের উপাসনা করছে। কিন্তু আড়ালে, সেই সন্তদের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে, নির্দিষ্ট রঙের পোশাক পরে, নির্দিষ্ট ড্রামের তালে গান গেয়ে দাসেরা আসলে ডাকত তাদের আফ্রিকার হারিয়ে যাওয়া দেবতাদের। এই লুকোচুরির খেলা, এই দ্বৈত চেতনার (Double Consciousness) মধ্যে দিয়েই জন্ম নিল হাইতির ভুডু (Voodoo), কিউবার স্যান্টেরিয়া (Santería) বা ব্রাজিলের ক্যান্ডমব্লে (Candomblé)-এর মতো শক্তিশালী এবং জটিল সিনক্রেটিক ধর্ম। এগুলো একদিকে যেমন আফ্রিকান ঐতিহ্য, সঙ্গীত, নাচ, দর্শন এবং ভেষজ জ্ঞানকে নতুন পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রেখেছে, তেমনি ঔপনিবেশিক শক্তির সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক নীরব অথচ প্রচণ্ড শক্তিশালী প্রতিরোধ (Cultural Resistance) হিসেবেও কাজ করেছে (Thompson, 1983; Leopold & Jensen, 2012)। এটা ছিল শেকলে বাঁধা মানুষের আত্মার স্বাধীনতার এক আশ্চর্য ঘোষণা।
আমাদের উঠানে সিনক্রেটিজম: বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের জীবন্ত চালচিত্র
এতক্ষণ তো দেশ-বিদেশের নানা বন্দরে ঘুরে আসা হলো। এবার একটু নিজেদের ঘরের দিকে, নিজেদের উঠানের ভেজা মাটির দিকে তাকানো যাক। আমাদের এই বাংলা, তথা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ হলো সিনক্রেটিজমের এক জীবন্ত, চলমান জাদুঘর। এখানকার মাটির প্রতিটি কণায়, গঙ্গা-পদ্মা-যমুনার প্রতিটি স্রোতে মিশে আছে হাজার হাজার বছরের মিশ্রণের ইতিহাস। এই মাটি কোনো এক জাতির বা এক সংস্কৃতির নয়। এখানে আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, শক, হুন, কুশান, পাঠান, মোগল, ইংরেজ – কত জাতি এসেছে, থেকেছে, শাসন করেছে, আর তাদের সংস্কৃতির অলঙ্ঘনীয় ছাপ রেখে গেছে। আমাদের রক্তে, ভাষায়, ধর্মে, আচারে, সঙ্গীতে সেই বহুস্তরীয়, জটিল মিশ্রণেরই প্রতিচ্ছবি। এই উপমহাদেশ এক বিশাল কড়াই, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা উপাদান একসঙ্গে রান্না হয়ে এক অপূর্ব স্বাদের খিচুড়ি তৈরি হয়েছে।
১. হিন্দুধর্মের ভেতরেই সিনক্রেটিজমের মহাসাগর: বহু স্রোতের মোহনা
যে সনাতন বা হিন্দুধর্মকে আমরা আজ একটি একক ধর্ম হিসেবে দেখি, তা নিজেই হাজার হাজার বছরের সিনক্রেটিজমের এক মহাকাব্যিক ফসল। এর কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা, একক ধর্মগ্রন্থ বা একক উপাসনা পদ্ধতি নেই। এর শক্তিই হলো এর গ্রহণ করার এবং নিজেকে বদলে ফেলার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। এর বিকাশ ঘটেছে বহু স্রোতের মিলনে, যা একে মহাসাগরের মতো বিশাল ও গভীর করেছে।
- বৈদিক ও অবৈদিক মিলন: আর্য ও সিন্ধুর সংগম: হিন্দুধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন স্তরটি হলো বৈদিক ধর্ম, যা যাযাবর আর্যদের সঙ্গে ভারতে এসেছিল। তাদের উপাস্য ছিলেন মূলত প্রকৃতি-কেন্দ্রিক দেব-দেবী – দেবরাজ ইন্দ্র, আকাশের দেবতা বরুণ, আগুনের দেবতা অগ্নি, সূর্য। তাঁদের উপাসনার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সংগঠিত ও মন্ত্রনির্ভর যজ্ঞকেন্দ্রিক। কিন্তু ভারতে আসার পর তাঁরা এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর (সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার (Indus Valley Civilization) নগরবাসী এবং অন্যান্য অনার্য ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর) সংস্পর্শে আসেন। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেমন সীলমোহর ও মূর্তি থেকে আমরা জানতে পারি, এই স্থানীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল মাতৃদেবীর পূজা (Great Mother Goddess), পশুপতি (যাকে অনেক পণ্ডিত আদি-শিব বা Proto-Shiva বলে মনে করেন), লিঙ্গ পূজা, বৃক্ষ ও সর্পপূজার মতো উর্বরতা-কেন্দ্রিক বিশ্বাস।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা – বৈদিক যজ্ঞবাদ আর স্থানীয় উর্বরতার কাল্ট – একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বৈদিক দেবতারা ধীরে ধীরে তাঁদের পুরোনো গুরুত্ব হারাতে থাকেন এবং পৌরাণিক যুগের নতুন দেব-দেবী – ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব (ত্রিমূর্তি) এবং তাঁদের শক্তি হিসেবে দেবীরা (দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী) প্রধান হয়ে ওঠেন। এই দীর্ঘ ও জটিল সিনক্রেটিক প্রক্রিয়াতেই জন্ম নিয়েছে আজকের পৌরাণিক হিন্দুধর্ম (Thapar, 2002)।
- স্থানীয় দেবতাদের আত্তীকরণ: দেবলোকে নতুন সদস্য: হিন্দুধর্মের প্রসারের এবং টিকে থাকার একটি বড় কৌশল ছিল স্থানীয় বা উপজাতীয় (Tribal) দেবতাদের নিজের সুবিশাল প্যান্থিয়নে জায়গা করে দেওয়া। যখনই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম কোনো নতুন অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে, এটি সেখানকার প্রভাবশালী স্থানীয় দেবতাকে ধ্বংস না করে, বরং তাঁকে শিব বা বিষ্ণুর কোনো একটি রূপ বা অবতার হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
- জগন্নাথ: উড়িষ্যার দেবতা জগন্নাথ এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। গবেষকরা মনে করেন, জগন্নাথ মূলত শবর নামক এক আদিবাসী উপজাতির একজন দারুদেবতা বা কাঠের দেবতা ছিলেন, যার নাম ছিল নীলমাধব। পরবর্তীকালে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের মাধ্যমে তাঁকে বিষ্ণুর এক অবতার হিসেবে গ্রহণ করে মূলধারার হিন্দু কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আজও তাঁর পূজার অনেক আচারে (যেমন, নবকলেবর বা পুরোনো মূর্তি বদলে নতুন মূর্তি স্থাপন) সেই আদিবাসী সংস্কৃতির ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট।
- বিঠোবা: মহারাষ্ট্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা বিঠোবা বা বিঠ্ঠলও এর আরেকটি চমৎকার উদাহরণ। তিনি সম্ভবত একজন স্থানীয় পশুপালক দেবতা ছিলেন, যাঁকে পরবর্তীকালে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এই প্রক্রিয়াকে সমাজবিজ্ঞানী এম. এন. শ্রীনিবাস (M. N. Srinivas) ‘সংস্কৃতায়ন’ (Sanskritization) প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে নিম্নবর্গের বা স্থানীয় কোনো গোষ্ঠী উচ্চবর্ণের রীতিনীতি গ্রহণ করে সামাজিক স্তরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু এটি কেবল একমুখী প্রক্রিয়া ছিল না, উচ্চবর্ণের হিন্দুধর্মও টিকে থাকার জন্য স্থানীয় বিশ্বাসকে গ্রহণ করে নিজেকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করেছে।
২. বাংলায় হিন্দু-বৌদ্ধ-তান্ত্রিক সমন্বয়: গুহ্য সাধনার আঁতুড়ঘর
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ছিল সিনক্রেটিজমের এক অসাধারণ পরীক্ষাগার। পাল রাজাদের (আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতক) দীর্ঘ শাসনামলে বাংলা ছিল মহাযান বৌদ্ধধর্মের এক বড় আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। কিন্তু সেই বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্রীয় বা বিশুদ্ধ ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ছিল না। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছিল বাংলার মাটিতে গভীরে প্রোথিত লোকায়ত বিশ্বাস আর গুহ্য সাধনার ধারা – তন্ত্র।
- বজ্রযান ও সহজযান: এই মিশ্রণের ফলেই জন্ম নিয়েছিল বজ্রযান (Vajrayana) আর সহজযান (Sahajayana) নামের নতুন মরমিবাদ। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের কবিরা বা সিদ্ধাচার্যরা (যেমন, লুইপা, কাহ্নপা) ছিলেন এই সহজযানী সাধক। তাঁদের পদে একদিকে যেমন বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদের (Śūnyatā) মতো উচ্চমার্গের দার্শনিক ধারণা আছে, তেমনি আছে দেহকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে খোঁজার মতো তান্ত্রিক দেহসাধনার কথা। তাঁদের কাছে মুক্তি বাইরে কোথাও নেই, মুক্তি আছে নিজের ‘দেহ-ভাণ্ডের’ ভেতরেই।
- দেবদেবীর রূপান্তর: পরবর্তীকালে বাংলায় সেন শাসনামলে যখন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটল এবং তুর্কি আক্রমণে বৌদ্ধবিহারগুলো ধ্বংস হলো, তখন বৌদ্ধধর্ম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু তার বিশ্বাসগুলো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। অনেক বৌদ্ধ দেব-দেবী হিন্দু দেব-দেবীর প্যান্থিয়নে নতুন পরিচয়ে জায়গা করে নিলেন। যেমন, বৌদ্ধধর্মের করুণার দেবী তারা হয়ে গেলেন দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী, বা দেবী দুর্গারই একটি রূপ। আজও বাংলার দুর্গাপূজার অনেক আচারের মধ্যে শাক্ত ও তান্ত্রিক প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। বাংলার ধর্মঠাকুরের (Dharma Thakur) পূজা আরেকটি চমৎকার উদাহরণ, যেখানে কূর্ম বা কচ্ছপের রূপে পূজিত এই দেবতার মধ্যে হিন্দু (বিষ্ণুর কূর্মাবতার), বৌদ্ধ (শূন্যতার প্রতীক) ও আদিবাসী বিশ্বাসের এক জটিল মিশ্রণ ঘটেছে (Dasgupta, 1969)।
৩. ইসলাম ও বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্য: পির, দরবেশ আর লৌকিক দেবতার আশ্চর্য জগৎ
বাংলায় ইসলামের আগমন ও প্রসার ঘটেছিল মূলত তুর্কি শাসকদের সামরিক শক্তির হাত ধরে, কিন্তু এর গভীরে প্রবেশ ঘটেছিল সুফি-দরবেশদের মাধ্যমে, যাঁদের পায়ে হাঁটা পথেই বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে ইসলামের বাণী পৌঁছেছিল। গবেষকদের মতে এই সুফিরা ছিলেন উদারপন্থী, মানবতাবাদী এবং তাঁরা স্থানীয় সংস্কৃতিকে অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা করতেন না।
- সমন্বয়ী ইসলাম: তাঁরা কোরআন-হাদিসের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার পাশাপাশি মানুষের মন বোঝার জন্য স্থানীয় কিংবদন্তি, রূপকথা আর যোগ-দর্শনের পরিভাষাকেও ব্যবহার করতেন। তাঁরা জোর-জবরদস্তির বদলে প্রেম, মানবতা আর আধ্যাত্মিকতার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। ফলে ইসলাম এখানে এসে আরব বা পারস্যের মতো কঠোর শাস্ত্রীয় রূপ না নিয়ে, এক নতুন, মানবিক ও মরমি রূপ পেল, যা বাংলার উর্বর পলিমাটির মতোই কোমল ও গ্রহণক্ষম ছিল।
- পির-সংস্কৃতি: এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় ফসল হলো পির-সংস্কৃতি (Pir Culture)। পিরেরা ছিলেন আধ্যাত্মিক গুরু, যাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করত। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গ্রামের সাধারণ মানুষ অসুখে-বিসুখে, খরা-বন্যায় বা যেকোনো বিপদে-আপদে পিরের দরগায় গিয়ে মানত করত, সিন্নি দিত। এই পিরেরা অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিন্দু যোগী বা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন (Eaton, 1993)।
- লৌকিক দেবদেবী: বনবিবি ও সত্যপীর: এর চেয়েও চমৎকার উদাহরণ হলো বাংলার সীমানারক্ষী লৌকিক দেব-দেবী। সুন্দরবনের মানুষ বাঘের ভয়ে জঙ্গলে কাঠ কাটতে বা মধু সংগ্রহ করতে যায়। তাদের বিশ্বাস, তাদের রক্ষাকর্ত্রী হলেন বনবিবি (Bonbibi)। বনবিবির যে কিংবদন্তি প্রচলিত, তাতে তাঁকে মক্কা থেকে আসা এক পিরের কন্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তাঁর পূজা বা আরাধনার পদ্ধতি, তাঁর নামে যে পালাগান (বনবিবির পালা) অনুষ্ঠিত হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় হিন্দু দেবী সংস্কৃতির মতো। তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলী আর তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, বাঘের দেবতা হিন্দু ঠাকুর দক্ষিণ রায় – এই তিনজনকে ঘিরে যে গল্প, তা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার পারস্পরিক নির্ভরতার এক অসাধারণ দলিল। একইভাবে আছেন সত্যপীর বা সত্যনারায়ণ। মুসলমানরা তাঁকে পির হিসেবে মানেন এবং তাঁর নামে শিরনি দেন, আবার হিন্দুরা তাঁকে নারায়ণেরই এক রূপ হিসেবে ধরে নিয়ে তাঁর পাঁচালি পাঠ করে পূজা করেন। তাঁর নামে যে পাঁচালি পড়া হয়, তার শুরুতে একই সঙ্গে আল্লাহ, নবী এবং হরি, ব্রহ্মা, শিব – সবার বন্দনা করা হয়। এই দেব-দেবী বা পিরেরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের নন, তাঁরা বিভেদের ঊর্ধ্বে, তাঁরা বাংলার মানুষের। তাঁরাই হলেন বাংলার সিনক্রেটিক আত্মার সবচেয়ে বড় প্রমাণ (Eaton, 1993; Stewart, 1995)।
৪. বাউল ও মরমি সাধনা: সব পথের মিলনবিন্দু
বাংলায় সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে গভীর, দার্শনিক ও শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে বাউল ও অন্যান্য মরমি সাধকদের গানে ও জীবনে। বাউলরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের – হিন্দু, মুসলমান বা বৌদ্ধ – কোনোটিরই বেড়াজালে নিজেদের বাঁধেন না। তাঁদের দর্শন ও সাধনা হলো এক মহৎ সঙ্গমস্থল বা মোহনা, যেখানে এসে মিশেছে:
- ইসলামি সুফিবাদের ‘ফানা’ বা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বিলীন হওয়ার প্রেমময় ধারণা।
- সহজযানী বৌদ্ধদের দেহকেন্দ্রিক গুহ্য সাধনা বা ‘দেহতত্ত্ব’।
- বৈষ্ণবদের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের আড়ালে থাকা ‘সহজিয়া’ প্রেমতত্ত্ব।
- হিন্দু তন্ত্রের দেহ-ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা।
বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের একটি গানেই এই দর্শনের সারকথা পাওয়া যায়: “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে / লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।” এই দর্শন জাত-পাত-ধর্মের সংকীর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে এক সমন্বয়ী মানবতার দর্শন। বাউলরা মন্দিরেও যান না, মসজিদেও যান না; তাঁরা তাঁদের আরাধ্য ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান করেন নিজের দেহের মধ্যেই। এই ‘দেহ-ভাণ্ড’ই তাঁদের কাছে ‘ব্রহ্মাণ্ড’। তাঁদের সাধনা আর গান হলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার মাটিতে চলা সমন্বয়ের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী নির্যাস, যা শুধু বাংলার নয়, বিশ্বমানবতারই সম্পদ।
ধর্মের বাইরেও সিনক্রেটিজম: ভাষা, শিল্প, খাবার আর জীবনের গল্প
সিনক্রেটিজমের জাদুকরী প্রভাব কেবল মন্দির-মসজিদ-গির্জার উঁচু বেদিতেই সীমাবদ্ধ নয়। সত্যি বলতে, এর আসল খেলাটা চলে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, আমাদের রান্নাঘরে, বৈঠকখানায়, আমাদের মুখের ভাষায় আর চোখের দেখায়। ধর্ম হয়তো আত্মার খোরাক, কিন্তু সংস্কৃতি হলো আমাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, যা ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই অকল্পনীয়। আর এই সংস্কৃতির প্রতিটি অলিগলিতেই সিনক্রেটিজম এমনভাবে মিশে আছে, যেমন বাতাসে মিশে থাকে অক্সিজেন। চলুন, এবার ধর্মের আঙিনা ছেড়ে আমাদের জীবনের এই আটপৌরে গল্পগুলোর দিকে তাকাই।
১. ভাষার পাঁচমিশালি: আমাদের কথার খিচুড়ি
যেকোনো জীবন্ত ভাষাই হলো একটি চলমান নদী, যা চলার পথে দুই পারের মাটি, নুড়ি, এমনকি আবর্জনাকেও সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলে। যে ভাষা নতুন শব্দ গ্রহণ করতে পারে না, নিজেকে বদলাতে ভয় পায়, সে ভাষা একসময় বদ্ধ জলাশয়ের মতো মরে যায়। আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষাই এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এটি একটি আদর্শ সিনক্রেটিক বা মিশ্র সত্তা।
- কাঠামো ও শব্দভাণ্ডার: এর মূল ব্যাকরণগত কাঠামোটা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বা সংস্কৃত থেকে। কিন্তু এর শব্দভাণ্ডার এক বিশাল, বর্ণিল জাদুঘর, যেখানে সযত্নে রাখা আছে বহু যুগের, বহু সংস্কৃতির স্মৃতি। এর মধ্যে আছে বাংলার মাটির আদিম অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষার শব্দ (যেমন – কুড়ি, পেট, ডিঙি, চুলা, ঢেঁকি), যা আমাদের কৃষিজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এরপর এলো তুর্কি, পাঠান ও মোগল শাসন। তাঁদের সঙ্গে এলো কোরআনের ভাষা আরবি এবং পারস্যের রাজদরবারের অভিজাত ভাষা ফারসি থেকে আসা হাজারো শব্দ, যা আমাদের প্রশাসন, আইন, সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবনে গেঁথে গেছে (যেমন – আদালত, আইন, তারিখ, দাখিল, দোয়াত, কলম, চশমা, জামা, বাবা, দোকান, বাগান, নমুনা, নামায, রোযা)। মোগলদের সঙ্গে আসা তুর্কি শব্দও কম নয় (যেমন – বাবুর্চি, চাকু, তোপ, লাশ)।
- ইউরোপীয় আগমন: এরপর এলো ইউরোপীয় বণিক আর শাসকেরা। তাঁদের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম এসেছিল এবং আমাদের ভাষায় তাদের অনেক ছাপ রেখে গেছে। আমাদের রান্নাঘরের বহু প্রয়োজনীয় জিনিসের নাম পর্তুগিজ – আনারস, আলপিন, আলমারি, চাবি, বালতি, পেঁপে, পাউরুটি। শুধু তাই নয়, বাঙালির প্রিয় মিষ্টি সন্দেশ বা রসগোল্লার মূল উপাদান ‘ছানা’ তৈরির কৌশলটিও পর্তুগিজদের কাছ থেকেই শেখা বলে মনে করেন অনেক খাদ্য-ইতিহাসবিদ (Achaya, 1994)। এরপর এলো ফরাসি (কার্তুজ, কুপন, রেস্তোরাঁ), ওলন্দাজ (হরতন, রুইতন) এবং সবশেষে ইংরেজরা। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, প্রযুক্তি আর প্রশাসনের হাত ধরে আমাদের ভাষায় ঢুকে পড়ল অসংখ্য ইংরেজি শব্দ (টেবিল, চেয়ার, স্কুল, কলেজ, ডাক্তার, পুলিশ, বাস, ট্রেন)।আমরা যখন সহজভাবে বলি, “টাইমলি অফিসে না পৌঁছালে বসের কাছে একটা সিরিয়াস ঝাড়ি খেতে হবে,” – এই এক লাইনের মধ্যেই ইংরেজি, বাংলা আর হয়তো অন্য কোনো দেশি শব্দের এক অপূর্ব সঙ্গম ঘটে যায়। এই মিশ্রণই বাংলা ভাষাকে মৃত ক্লাসিক্যাল ভাষা না বানিয়ে, এক জীবন্ত, গতিশীল ও সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত করেছে।
- বিশ্বের অন্যান্য ভাষা: এই সিনক্রেটিজম কেবল বাংলার একার সম্পত্তি নয়। আজকের বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষা ইংরেজি নিজেই সিনক্রেটিজমের এক মহাকাব্য। এর মূল ভিত্তিটা জার্মানিক (অ্যাংলো-স্যাক্সন), কিন্তু ১০৬৬ সালে নরম্যানদের ইংল্যান্ড বিজয়ের পর এর ওপর ফরাসি এবং ল্যাটিন ভাষার এমন এক বিশাল আস্তরণ পড়েছে যে, আজ এর শব্দভাণ্ডারের অর্ধেকেরও বেশি অ-জার্মানিক উৎস থেকে আসা। ইংরেজি সারা বিশ্ব থেকে শব্দ ধার করেছে – ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে shampoo, bungalow; আফ্রিকা থেকে zombie, safari; চীন থেকে ketchup, typhoon। এই গ্রহণ করার ক্ষমতাই ইংরেজিকে বিশ্ব ভাষায় পরিণত করেছে (Baugh & Cable, 2002)।
২. শিল্প ও স্থাপত্যের জংশন: পাথরে লেখা মিলনের ইতিহাস
শিল্পকলার ইতিহাসও আসলে সিনক্রেটিজমেরই ইতিহাস। শিল্পীরা বরাবরই সীমানা মানতে চান না, তাঁরা নতুন রূপ আর নতুন ভাবনার সন্ধানে থাকেন।
- গান্ধার শিল্প: যখন বুদ্ধের মুখে গ্রিক ছায়া: খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহামতি আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পর উত্তর-পশ্চিম ভারতে (আজকের পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) গ্রিক শিল্পরীতির সঙ্গে ভারতীয় বৌদ্ধ ভাবনার এক অপূর্ব মিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল গান্ধার শিল্প (Gandhara Art)। এই শিল্পরীতিতেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুদ্ধের মানব অবয়বে মূর্তি গড়া হয়। আর সেই মূর্তিগুলো ছিল আশ্চর্যরকমের সিনক্রেটিক। বুদ্ধের মুখমণ্ডলে ছিল গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর মতো নিখুঁত, বাস্তবসম্মত আদল; তাঁর পরনের চীবরে ছিল রোমান টোগার মতো ঢেউ খেলানো নিখুঁত ভাঁজ (যাকে ‘wet drapery’ বলা হয়), আর তাঁর কোঁকড়ানো চুলও ছিল গ্রিক ভাস্কর্যেরই প্রভাব। কিন্তু মূর্তির শান্ত, ধ্যানমগ্ন মুখচ্ছবি, হাতের মুদ্রা (Abhaya Mudra) আর পদ্মাসনে বসার ভঙ্গি – এই সবকিছুই ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। এটি ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পরীতির প্রথম সফল মিলন, যা বৌদ্ধধর্মের বার্তাকে এক নতুন, বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছিল (Dehejia, 1997)।
- মোগল স্থাপত্য: পারস্যের স্বপ্ন আর ভারতের কারিগরি: মধ্যযুগে ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর স্থাপত্যে এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। দিল্লি সালতানাত এবং বিশেষ করে মোগল আমলে যে স্থাপত্যরীতি গড়ে ওঠে, তা হলো ইসলামি (Islamic), পারস্য (Persian), মধ্য এশীয় (Central Asian) আর ভারতীয় হিন্দু-বৌদ্ধ (Hindu-Buddhist) স্থাপত্যরীতির এক অসাধারণ ও মহিমাময় ফিউশন (Fusion)। সম্রাট আকবর তাঁর নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে সচেতনভাবে গুজরাট ও রাজস্থানের হিন্দু ও জৈন স্থাপত্যের উপাদান – যেমন খিলান, স্তম্ভ, বন্ধনী (brackets) – ইসলামি রীতির সঙ্গে মিলিয়েছিলেন, যা তাঁর সমন্বয়ী ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’র মতোই এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্টেটমেন্ট ছিল। এর চূড়ান্ত নিদর্শন হলো তাজমহল। এর বিশাল পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ, সুউচ্চ মিনার আর প্রতিসম নকশা হয়তো তৈমুরি বা পারস্য স্থাপত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এর কারুকার্যে ব্যবহৃত শ্বেতপাথর, লাল বেলেপাথর, অলঙ্করণে পদ্ম, কলস বা স্বস্তিকার মতো মোটিফের ব্যবহার এবং সর্বোপরি এর পেছনে থাকা ভারতীয় কারিগরদের হাজার বছরের দক্ষতা – এই সবকিছুই ছিল একান্তই ভারতীয়। তাজমহলের দেয়ালে যে পিয়েত্রা ডিউরা (pietra dura) বা রত্নখচিত পাথরের কারুকাজ দেখা যায়, তা ইতালির এক কৌশল হলেও মোগলরা তাকে নিজেদের মতো করে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল (Asher, 1992)। মোগল স্থাপত্য হলো সিনক্রেটিক শিল্পের এক কালজয়ী উদাহরণ, যা আজও বিশ্বের বিস্ময় (Eaton, 1993)।
৩. সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও খাদ্যের বৈচিত্র্য: আমাদের রসনার বিশ্বায়ন
আমাদের কান যা শোনে আর জিভ যা স্বাদ নেয়, তার গভীরেও লুকিয়ে আছে সিনক্রেটিজমের দীর্ঘ ইতিহাস।
- সঙ্গীতের সঙ্গম: আমাদের উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ধ্রুপদ-ধামারের মতো প্রাচীন ধারার পাশাপাশি খেয়াল, ঠুমরি বা গজল-এর মতো যে জনপ্রিয় ও রোম্যান্টিক ধারাগুলো বিকশিত হয়েছে, সেগুলোমধ্য এশিয়ার সুফি ও পারস্যের সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় রাগ-রাগিণীর মিলনে তৈরি হয়েছে। কিংবদন্তি আছে, আমির খসরুর মতো সাধক-শিল্পীরাই এই মেলবন্ধনের সূচনা করেছিলেন। আজকের দিনে ফিউশন মিউজিক (Fusion Music) বা ফোক-ফিউশন তো সিনক্রেটিজমেরই আধুনিকতম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণ। পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের ‘কোক স্টুডিও’-র মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে যখন কোনো লোকসংগীত শিল্পী বা বাউল একজন পশ্চিমা-শিক্ষিত রক গিটারিস্টের সঙ্গে গলা মেলান, তখন দোতারা বা সেতারের সঙ্গে ইলেকট্রিক গিটার অবলীলায় একসঙ্গে বেজে ওঠে। এটা কেবল দুটো সুরের মিলন নয়, দুটো পৃথিবীর মিলন।
- খাবারের বিশ্বায়ন: আর খাবারের জগতেও একই গল্প। আমাদের রান্নাঘরটা হলো সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে জীবন্ত পরীক্ষাগার।
- যে খাবারটিকে প্রায়শই ব্রিটেনের জাতীয় খাবার বলা হয়, সেই চিকেন টিক্কা মাসালা, তার জন্ম কিন্তু ভারতে নয়, হয়েছে গ্লাসগো বা বার্মিংহামের কোনো এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। গল্পটা হলো, একজন ব্রিটিশ খদ্দের শুকনো কাবাব খেতে না চেয়ে একটু ‘গ্রেভি’ চেয়েছিলেন। বুদ্ধিমান বাঙালি বা পাঞ্জাবি শেফ তখন টমেটো স্যুপের একটি ক্যান আর দই-মশলা দিয়ে চটজলদি যে সসটি বানিয়েছিলেন, সেটাই আজকের বিশ্ববিখ্যাত ডিশ। এটি একটি নিখুঁত সিনক্রেটিক সৃষ্টি, যা ভারতীয় তন্দুর পদ্ধতির সঙ্গে ব্রিটিশদের গ্রেভি-প্রীতির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে।
- একইভাবে, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপীয়দের হাত ধরে যে আলু, টমেটো, লঙ্কা, ভুট্টা আর কাজুবাদাম এ দেশে এসেছিল, তা ছাড়া আজকের ভারতীয় রান্না কল্পনা করাও অসম্ভব। আলুর দম, টমেটোর চাটনি বা তরকারিতে ঝাঁঝ আনা লঙ্কা – এগুলো এখন এতটাই ‘দেশি’ যে আমরা ভুলেই গেছি এগুলোর উৎস ভিন্ন মহাদেশে। এই বিদেশি সবজিগুলো আমাদের দেশি মশলার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে তা আমাদের রসনাকে চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছে (Achaya, 1994)।
আমাদের মুখের ভাষা থেকে শুরু করে স্থাপত্যের নকশা, গানের সুর থেকে শুরু করে রাতের খাবার – প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা সিনক্রেটিজমের ফসল ভোগ করছি। এটি কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, এটিই আমাদের জীবন্ত, স্পন্দনশীল সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি।
বিতর্কের দাঁড়িপাল্লায় সিনক্রেটিজম: সৃষ্টি না অবক্ষয়?
এতক্ষণ তো সিনক্রেটিজমের জয়গানই গাওয়া হলো। একে সংস্কৃতির প্রাণশক্তি, সহিষ্ণুতার প্রতীক আর মানুষের অফুরন্ত সৃজনশীলতার প্রকাশ হিসেবেই দেখা হলো। এই বর্ণনায় সিনক্রেটিজম যেন এক শিল্পী, যে নানা রঙের সুতো দিয়ে এক অপূর্ব সুন্দর নকশিকাঁথা বুনে চলেছে। কিন্তু মুদ্রার তো আরেকটা পিঠও থাকে। দাঁড়িপাল্লার অন্য দিকটাও দেখতে হয়। সিনক্রেটিজম কি সবসময়ই এমন সৃজনশীল, ইতিবাচক আর মুক্তির পথ? নাকি এই আপাত সুন্দর মিশ্রণের আড়ালেও লুকিয়ে আছে কোনো অন্ধকার দিক, কোনো ক্ষমতার খেলা, কোনো পরিচয়ের সংকট?
এই প্রশ্নটি সিনক্রেটিজম আলোচনার সবচেয়ে জটিল এবং সংবেদনশীল অধ্যায়। এখানে এসে প্রশংসা আর বিতর্ক হাত ধরাধরি করে হাঁটে। সিনক্রেটিজমকে যারা সন্দেহের চোখে দেখেন, তারা একে কোনো নিরীহ মিশ্রণ হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের চোখে, এটি কখনো এক সুন্দর মুখোশ যা কদর্য চেহারা ঢেকে রাখে, আবার কখনো এটি এক বিষাক্ত পানীয় যা সুন্দর পাত্রে পরিবেশন করা হয়। চলুন, এই বিতর্কের দাঁড়িপাল্লার দুই দিকেই সমান ওজন দিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
১. বিশুদ্ধতার অবক্ষয় এবং পরিচয়ের সংকট (Loss of Purity and Identity Crisis)
এই ‘বিশুদ্ধতাবাদীরা’ (Purists) – তাঁরা ধর্মগুরু, জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ বা সাংস্কৃতিক অভিভাবক যেই হোন না কেন – মনে করেন, প্রতিটি ধর্ম বা সংস্কৃতির একটি ‘খাঁটি’, ‘অকৃত্রিম’ (Authentic) এবং মৌলিক রূপ আছে। এই রূপটিই হলো তার আত্মা, যা তার অনুসারীদের জন্য পথপ্রদর্শক, এক ধ্রুবতারার মতো। সিনক্রেটিজম বা মিশ্রণের ফলে সেই মূল বিশ্বাস বা আচারের বিশুদ্ধতা ও মৌলিকতা নষ্ট হয়ে যায়। এটি ধর্মকে ‘পাতলা’ (Diluted) করে ফেলে, তার গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তাৎপর্যকে লঘু করে দেয়। তাঁদের চোখে, সিনক্রেটিজম হলো এক ধরনের অবক্ষয় (Degeneration) বা বিচ্যুতি (Deviation), যা একটি সম্প্রদায়কে তার শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং এক গভীর পরিচয়ের সংকটে নিমজ্জিত করে।
- ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: ঈশ্বরের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভয়:
- ইসলামে: কোনো কট্টরপন্থী ইসলামি চিন্তাবিদ হয়তো বলবেন, পিরের দরগায় মানত করা, মাজারে মোমবাতি জ্বালানো, গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করা (কাওয়ালি) বা মহররমের মিছিলে তাজিয়া বানানো – এগুলো ‘খাঁটি’ ইসলামের অংশ নয়। এগুলো হিন্দু, শিয়া বা অন্য স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে আসা অনুকরণ এবং এগুলো বিদআত (ধর্মের মধ্যে নতুন উদ্ভাবন) বা এমনকি শিরক (ঈশ্বরের একত্বের সঙ্গে অংশীদার স্থাপন)-এর মতো গুরুতর পাপ। উনিশ শতকে আরবে যে ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahhabi Movement) হয়েছিল, এবং আজকের দিনেও যে সালাফি মতাদর্শ দেখা যায়, তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামকে এই ধরনের স্থানীয় ও সুফি প্রভাব থেকে ‘পরিশুদ্ধ’ করে আদি, বিশুদ্ধ রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই বিশুদ্ধতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই অনেক সময় ঐতিহাসিক মাজার বা স্থাপনা ধ্বংস করাকে বৈধতা দেওয়া হয়, কারণ সেগুলো তাদের চোখে ‘অ-ইসলামিক’ মিশ্রণের প্রতীক (Kepel, 2002)।
- হিন্দুধর্মে: একইভাবে, কোনো গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিত হয়তো বলবেন, সত্যনারায়ণের পূজায় ‘শিরনি’ শব্দটি ব্যবহার করা বা আল্লাহের নাম নেওয়া শাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং এটি সনাতন ধর্মের মূল চরিত্রকে বিকৃত করে। আর্য সমাজের মতো উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনগুলো হিন্দুধর্মকে পৌরাণিক ও লোকায়ত আচার থেকে ‘বিশুদ্ধ’ করে এক একেশ্বরবাদী বৈদিক ধর্মে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল। তাদের চোখে, মূর্তি পূজা বা স্থানীয় দেবতাদের আরাধনাও ছিল পরবর্তীকালের অবক্ষয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সিনক্রেটিজম হলো মূল পরিচয় থেকে সরে গিয়ে এক ধরনের খিচুড়ি সংস্কৃতি তৈরি করা, যা না এদিকের, না ওদিকের, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
- সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ: জাতীয় পরিচয়ের অবমাননা: জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সেও এই বিশুদ্ধতার ধারণা অত্যন্ত শক্তিশালী। অনেক সময় একটি দেশের ‘আসল’ সংস্কৃতি কী, তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয় এবং অন্য সংস্কৃতির প্রভাবকে ‘দূষণ’ বা ‘বহিরাগত আগ্রাসন’ হিসেবে দেখা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজের ভাষার মধ্যে অতিরিক্ত বিদেশি শব্দ ব্যবহার করা, বিদেশি পোশাক পরা বা বিদেশি সঙ্গীত শোনা – এই সবকিছুকেই জাতীয় পরিচয়ের জন্য হুমকি বলে মনে করা হতে পারে।
২. আধিপত্যের সূক্ষ্ম হাতিয়ার (A Subtle Tool of Hegemony): নরম ক্ষমতার অদৃশ্য শেকল
সিনক্রেটিজমের সমালোচকদের তূণের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রটি হলো এই যুক্তি যে, সিনক্রেটিজম প্রায়শই ক্ষমতার অসম বিন্যাসের (Unequal Power Dynamics) এক নির্মম ফসল। এটি কোনো দুটি সমান বন্ধুর হাত মেলানো বা দুটি নদীর শান্ত মোহনা নয়। বরং এটি প্রায়শই একটি প্রবল খরস্রোতা নদীর মতো, যা একটি দুর্বল স্রোতকে নিজের মধ্যে গ্রাস করে নেয়, যদিও বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় দুটো স্রোত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সিনক্রেটিজম হলো বিজয়ী বা প্রভাবশালী সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তারের এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কার্যকরী এবং প্রায়শই অদৃশ্য কৌশল। এটি হলো নরম ক্ষমতার (Soft Power) সেই অদৃশ্য শেকল, যা বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী।
ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদ ও হেজিমনি (Hegemony): সম্মতির মাধ্যমে শাসন
যখন একটি প্রভাবশালী, ঔপনিবেশিক বা বিজয়ী সংস্কৃতি স্থানীয় বা বিজিত সংস্কৃতির ওপর চেপে বসে, তখন যে মিশ্রণটা তৈরি হয়, তা আসলে দুর্বল সংস্কৃতিটির পরিচয়কে ধীরে ধীরে মুছে দেওয়ারই একটি প্রক্রিয়া। শাসক তার সংস্কৃতিকে সরাসরি বন্দুকের নলের মুখে চাপিয়ে দেয় না, কারণ বলপ্রয়োগ সবসময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং তা বিদ্রোহের জন্ম দেয়। এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী উপায় হলো, শাসিত জনগোষ্ঠীর মনোজগৎকে এমনভাবে বদলে দেওয়া, যাতে তারা নিজেদের শাসনকে নিজেরাই স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত বলে মনে করতে শুরু করে।
ইতালীয় মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি (Antonio Gramsci) এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ’ বা ‘হেজিমনি’ (Cultural Hegemony) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। হেজিমনির অর্থ হলো, শাসিতদের সম্মতি আদায় করে তাদের ওপর শাসন করা। শাসক শ্রেণি শিক্ষা, ধর্ম, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে নিজেদের worldview বা বিশ্ববীক্ষাকে এমনভাবে সমাজের ‘সাধারণ জ্ঞান’ (common sense) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যে, শাসিত জনগোষ্ঠীও সেই একই চোখে পৃথিবীকে দেখতে শুরু করে এবং নিজেদের অধীনতাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয় (Gramsci, 1971)।
এই প্রেক্ষাপটে সিনক্রেটিজম হেজিমনির এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
- উদাহরণ: ব্রিটিশ ভারত ও ‘ব্রাউন সাহেব’: ব্রিটিশরা ভারতে ঠিক এই কাজটিই করেছিল। তারা জানত, কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে এই বিশাল দেশকে চিরকাল শাসন করা সম্ভব নয়। তাই তারা ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল। লর্ড ম্যাকলের বিখ্যাত ‘মিনিট অন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’ (Minute on Indian Education, 1835)-এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল এমন এক দেশীয় অভিজাত শ্রেণি তৈরি করা, যারা “রক্তে-বর্ণে ভারতীয় কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিতে ইংরেজ হবে” (“a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect”)। এই ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণি, যাদের ব্যঙ্গ করে ‘ব্রাউন সাহেব’ বলা হতো, তাদের মধ্যে যে সিনক্রেটিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল (যেমন, ইংরেজি আদব-কায়দার সঙ্গে দেশীয় পোশাকের মিশ্রণ, বা নিজেদের ভাষায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার), তা ছিল ক্ষমতারই একটি প্রকাশ। এই শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনকে নিজেদের উন্নতির সোপান হিসেবে দেখেছিল এবং সাধারণ মানুষ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। এক্ষেত্রে সিনক্রেটিজম আর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ (Cultural Imperialism)-এর মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে (van der Veer, 2004)।
- খ্রিস্টান মিশনারিদের কৌশল: একইভাবে, অনেক ঔপনিবেশিক দেশে খ্রিস্টান মিশনারিরা স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত করার জন্য সিনক্রেটিক কৌশল ব্যবহার করত। তারা স্থানীয় উৎসব বা দেবদেবীর কিছু উপাদানকে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে জুড়ে দিত, যাতে নতুন ধর্মটিকে কম ‘বিদেশি’ মনে হয়। বাইরে থেকে দেখলে একে সহনশীলতা মনে হতে পারে, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতিরোধকে দুর্বল করে দিয়ে তাকে ভেতর থেকে দখল করা এবং শেষ পর্যন্ত তাকে খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির অধীনে নিয়ে আসা।
দাসত্বের করুণ কৌশল: যখন মিশ্রণ মানেই আত্মসমর্পণ
সিনক্রেটিজম যে ক্ষমতার খেলার সবচেয়ে মর্মান্তিক রূপ নিতে পারে, তার উদাহরণ হলো আমেরিকা মহাদেশের দাসপ্রথা। এখানে সিনক্রেটিজম কোনো সৃজনশীল আনন্দের প্রকাশ ছিল না, ছিল টিকে থাকার এক গভীর বেদনাদায়ক সংগ্রাম, এক অসম যুদ্ধ যেখানে এক পক্ষের হাতে ছিল চাবুক আর অন্য পক্ষের হাতে ছিল কেবল স্মৃতি।
- বাধ্যতামূলক মিশ্রণ: আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাসদের ওপর তাদের প্রভুদের ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের নিজস্ব ধর্ম, ভাষা, সঙ্গীত – সবকিছুকে ‘বর্বর’ ও ‘শয়তানের উপাসনা’ বলে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আফ্রিকানরা তাদের দেবতাদের (ওরিষা বা লোয়া) ক্যাথলিক সন্তদের মূর্তির আড়ালে পূজা করতে শুরু করে। এই মিশ্রণটি তাদের স্বেচ্ছায় করা কোনো সৃজনশীল পরীক্ষা ছিল না; এটি ছিল ধরা পড়লে ভয়াবহ শারীরিক শাস্তির হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। এটি ছিল আত্মসমর্পণের একটি রূপ, যেখানে তারা প্রভুর দেওয়া কাঠামোকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
- নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার: প্রভুরাও অনেক সময় এই মিশ্রণকে সচেতনভাবে প্রশ্রয় দিত। তারা ভাবত, দাসেরা যদি সন্তদের পূজা করে, তাহলে তারা ধীরে ধীরে ‘সভ্য’ হবে এবং খ্রিস্টধর্মের মূল ধারাতে চলে আসবে। এর ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ হবে এবং তাদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা কমে যাবে। তাদের চোখে, এই সিনক্রেটিজম ছিল দাসদের ‘সভ্য’ করার প্রক্রিয়ার একটি ধাপ মাত্র। সুতরাং, এক্ষেত্রে সিনক্রেটিজম দুই পক্ষের জন্যই ছিল এক কৌশল – দাসেদের জন্য টিকে থাকার, আর প্রভুদের জন্য নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার। কিন্তু এই খেলার নিয়মকানুন তৈরি করেছিল প্রভুরাই।
- মানসিক উপনিবেশ (Mental Colonization): এই ধরনের সিনক্রেটিজম এক গভীর মানসিক উপনিবেশ বা ‘Mental Colonization’-এর জন্ম দেয়। ফরাসি মনস্তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফানোঁ (Frantz Fanon) দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে শাসিত মানুষ এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করে এবং নিজের সংস্কৃতিকে নিকৃষ্ট ও শাসকের সংস্কৃতিকে উৎকৃষ্ট বলে মনে করতে শুরু করে (Fanon, 1967)। দাসদের সিনক্রেটিক ধর্মগুলোতেও এই দ্বৈত চেতনার ছাপ স্পষ্ট। একদিকে ছিল নিজেদের আফ্রিকান ঐতিহ্যের প্রতি গোপন ভালোবাসা, অন্যদিকে ছিল প্রভুর সাদা চামড়া ও সংস্কৃতির প্রতি ভয় ও সমীহ মেশানো এক জটিল মনোভাব।
সুতরাং, এই দৃষ্টিকোণ থেকে সিনক্রেটিজম কোনো নিরপেক্ষ বা নিরীহ প্রক্রিয়া নয়। এটি প্রায়শই ক্ষমতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখনই আমরা কোনো সাংস্কৃতিক মিশ্রণ দেখি, আমাদের প্রশ্ন করতে হবে – কে কার সঙ্গে মিশছে? কাদের শর্তে মিশছে? এই মিশ্রণের ফলে কে লাভবান হচ্ছে আর কে তার পরিচয় হারাচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো না করলে সিনক্রেটিজমের আপাত সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আধিপত্যের অদৃশ্য শেকলকে আমরা দেখতে পাব না।
৩. সাংস্কৃতিক স্বত্বাপহরণ (Cultural Appropriation): যখন শ্রদ্ধা পরিণত হয় শোষণে
এই আধিপত্যবাদেরই এক আধুনিক এবং অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক রূপ হলো সাংস্কৃতিক স্বত্বাপহরণ। বিশ্বায়নের যুগে যখন প্রভাবশালী পশ্চিমা সংস্কৃতির কোনো সদস্য অন্য কোনো প্রান্তিক বা সংখ্যালঘু সংস্কৃতির কোনো পবিত্র প্রতীক, পোশাক, সঙ্গীত বা আচারকে তার মূল অর্থ, ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তাকে কেবল ফ্যাশন, বিনোদন বা বাণিজ্যিক লাভের জন্য ব্যবহার করে, তখন তাকে সিনক্রেটিজম না বলে স্বত্বাপহরণ বা কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন বলা হয়।
এখানে মূল সমস্যা হলো অসম ক্ষমতা এবং সম্মানের অভাব। সিনক্রেটিজমে দুটি সংস্কৃতি একে অপরকে প্রভাবিত করে এবং একটি নতুন তৃতীয় সত্তার জন্ম হয়। কিন্তু স্বত্বাপহরণে প্রভাবশালী সংস্কৃতি কেবল ‘cherry-picking’ করে, অর্থাৎ প্রান্তিক সংস্কৃতির আকর্ষণীয় অংশগুলো তুলে নেয়, কিন্তু সেই সংস্কৃতির মানুষগুলোর সংগ্রাম বা ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে।
- উদাহরণ:
- যখন কোনো পশ্চিমা পপ তারকা বা ফ্যাশন মডেল আমেরিকান আদিবাসীদের পবিত্র শিরস্ত্রাণ (war bonnet), যা অর্জন করতে একজন যোদ্ধাকে সারা জীবন সাধনা ও বীরত্বের পরিচয় দিতে হয়, সেটিকে কোনো মিউজিক ফেস্টিভ্যালে কেবল ‘কুল’ বা ‘বোহেমিয়ান’ দেখানোর জন্য পরেন, তখন তা সিনক্রেটিজম নয়। তা হলো একটি জাতির গভীরতম আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক প্রতীককে এক অগভীর ফ্যাশন অনুষঙ্গে পরিণত করা।
- হলিউডের সিনেমায় বা পশ্চিমা ওয়েলনেস ইন্ডাস্ট্রিতে যখন যোগ বা মেডিটেশনকে তার হাজার হাজার বছরের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গভীরতা (যেমন, যম, নিয়ম, ঈশ্বরপ্রণিধান) থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল স্ট্রেস কমানোর বা সুন্দর শরীর পাওয়ার এক বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখানো হয়, এবং এর ভারতীয় উৎসকে প্রায়শই অস্বীকার বা লঘু করে দেওয়া হয়, তখন তা স্বত্বাপহরণের পর্যায়ে পড়ে (Rogers, 2006)।
- একইভাবে, হিন্দুদের কাছে পবিত্র ‘ওঁ’ (OM) চিহ্ন বা মহিলাদের কপালে থাকা ‘বিন্দি’ যখন কোনো অর্থ না জেনেই টি-শার্টে, ট্যাটুতে বা ফ্যাশন অ্যাকসেসরি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা সেই প্রতীকের অবমাননা করে।
এক্ষেত্রে মিশ্রণটি অসম, কারণ এটি প্রান্তিক সংস্কৃতির প্রতি কোনো সম্মান দেখায় না এবং প্রায়শই তাদের ইতিহাস ও সংগ্রামকে অদৃশ্য করে দিয়ে কেবল তাদের সংস্কৃতির ‘শীতল’ অংশটুকু ভোগ করে। এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক চুরি, যা সিনক্রেটিজমের সৃজনশীল ও পারস্পরিক বিনিময়ের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সমর্থকদের যুক্তি: প্রাণশক্তি, প্রতিরোধ আর সহাবস্থানের শিল্প
অন্যদিকে, সিনক্রেটিজমের সমর্থকেরা এই সমালোচনাগুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। তাঁরা এই মিশ্রণকে অবক্ষয় বা দূষণ হিসেবে না দেখে, এর গভীরে লুকিয়ে থাকা মানবীয় শক্তি, সৃজনশীলতা আর টিকে থাকার অবিশ্বাস্য সম্ভাবনাকে তুলে ধরেন। তাঁদের চোখে, সিনক্রেটিজম কোনো রোগ নয়, বরং সংস্কৃতির জীবন্ত থাকার এবং মানিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় লক্ষণ। এটি হলো সেই শিল্প, যা দিয়ে মানুষ ভাঙনের মধ্যেও সেতু গড়ে তোলে।
১. ‘বিশুদ্ধ’ সংস্কৃতির মিথ এবং প্রাণশক্তির লক্ষণ
সিনক্রেটিজমের সমর্থকেরা প্রথমেই যে ধারণাটিকে আক্রমণ করেন, তা হলো ‘বিশুদ্ধ’ বা ‘খাঁটি’ সংস্কৃতির ধারণাটিকেই। তাঁরা বলেন, ‘বিশুদ্ধ’ সংস্কৃতি বলে আদতে কিছু নেই। এটি একটি আধুনিক, রাজনৈতিক ও প্রায়শই বিপজ্জনক ধারণা, যা মূলত উগ্র জাতীয়তাবাদ (Ultra-nationalism) এবং ধর্মীয় মৌলবাদের (Religious Fundamentalism) সঙ্গে যুক্ত। এই ‘বিশুদ্ধতার’ ধারণা ব্যবহার করেই একদল মানুষ অন্য দলকে ‘বহিরাগত’ বা ‘অশুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করে এবং ঘৃণা ও সংঘাতের জন্ম দেয়। এটি একটি কাল্পনিক বা মিথিক্যাল (Mythical) ধারণা, যা একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- সংস্কৃতি এক বহমান নদী, বদ্ধ জলাশয় নয়: প্রতিটি সংস্কৃতিই নদীর মতো বহমান। তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা উৎস, নানা উপনদী থেকে জল গ্রহণ করে নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুন করে গড়ে তুলেছে ও সমৃদ্ধ করেছে। যে নদী নতুন জল গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, সে একসময় শুকিয়ে মরা খাতে পরিণত হয়। সংস্কৃতিও ঠিক তাই। এটি কোনো কাচের বাক্সে রাখা হাজার বছরের পুরনো মমি নয় যে চিরকাল একই রকম থাকবে। যে সংস্কৃতি নিজেকে বদলাতে পারে না, নতুনকে গ্রহণ করতে পারে না, সে একসময় জীবাশ্মে পরিণত হয়, মৃত হয়ে যায়। সিনক্রেটিজম হলো সংস্কৃতির অসুস্থতা নয়, বরং তার প্রাণশক্তি, তার নমনীয়তা (flexibility) এবং তার জীবন্ত থাকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
- উদাহরণ: হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম বা খ্রিস্টধর্ম – প্রত্যেকটিই তার বিকাশের পথে এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার জন্য অসংখ্য সিনক্রেটিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেছে। খ্রিস্টধর্ম যদি প্যাগান উৎসবগুলোকে গ্রহণ না করত, তাহলে হয়তো ইউরোপে তার প্রসার এত মসৃণ হতো না। হিন্দুধর্ম যদি স্থানীয় আদিবাসী দেবতাদের নিজের প্যান্থিয়নে জায়গা না দিত, তাহলে হয়তো এটি কেবল উত্তর ভারতের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ধর্ম হয়েই থেকে যেত, এক বিশাল মহাদেশীয় ধর্মে পরিণত হতে পারত না। এই গ্রহণ করার ক্ষমতাই তাদের দুর্বল করেনি, বরং আরও শক্তিশালী ও সহনশীল করেছে।
- ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ এবং বিশুদ্ধতার রাজনীতি: তাত্ত্বিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন (Benedict Anderson) দেখিয়েছেন, আধুনিক ‘জাতি’ বা ‘Nation’ মূলত একটি ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (Imagined Community)। আমরা একটি জাতির সব সদস্যকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, কিন্তু একটি অভিন্ন পরিচয়ের ধারণার মাধ্যমে আমরা নিজেদের এক মনে করি। এই ‘অভিন্ন পরিচয়’ তৈরি করার জন্যই অনেক সময় এক ‘বিশুদ্ধ’ অতীতের গল্প তৈরি করা হয়, যেখানে অন্য সব প্রভাবকে ‘বহিরাগত’ বলে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সিনক্রেটিজমের সমর্থকেরা বলেন, এই বিশুদ্ধতার খোঁজ আসলে ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকানো নয়, বরং বর্তমানের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার একটি কৌশল (Anderson, 1983)।
২. সৃজনশীলতা ও মানবীয় এজেন্সি: দুর্বলের প্রতিরোধ
সিনক্রেটিজমের সমালোচকেরা যখন একে কেবলই আধিপত্য বা ক্ষমতার প্রকাশ হিসেবে দেখেন, তখন সমর্থকেরা বলেন, এই ব্যাখ্যাটি মানুষের সৃজনশীলতা আর আত্মশক্তিকে অস্বীকার করে। এই পক্ষের তাত্ত্বিকরা বলেন, মানুষ কেবল ক্ষমতার নিষ্ক্রিয় শিকার বা মাটির দলা নয় যে, যে যেমন খুশি তাকে আকার দেবে। সাধারণ মানুষ, এমনকি সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষও, তাদের নিজস্ব সৃজনশীলতা বা ‘এজেন্সি’ (Agency) ব্যবহার করে প্রভাবশালী সংস্কৃতিকে নিজেদের প্রয়োজনে বদলে নিতে পারে। তারা শুধু অনুকরণ করে না, তারা প্রতিরোধ করে, নতুন অর্থ তৈরি করে এবং প্রায়শই প্রভুর সংস্কৃতিকেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
- দুর্বলের অস্ত্র (Weapons of the Weak): সমাজবিজ্ঞানী জেমস সি. স্কট (James C. Scott) তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, নিপীড়িত কৃষকেরা সরাসরি বিদ্রোহ করতে না পারলেও দৈনন্দিন জীবনে নানা উপায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে – যেমন, কাজে ফাঁকি দেওয়া, প্রভুর নামে গুজব ছড়ানো বা তাঁর নির্দেশ ভুলভাবে পালন করা। আফ্রিকার দাসদের সিনক্রেটিজমকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। হ্যাঁ, এটা ছিল দাসত্বের পরিস্থিতিতে তৈরি। কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রতিরোধের এক অবিশ্বাস্য মানসিক শক্তি। বাইরে তারা প্রভুর সন্তকে পূজা করার ভান করত, আর ভেতরে তারা তাদের আফ্রিকান দেবতাদের শক্তিতে নিজেদের বলীয়ান করত। তারা প্রভুর ধর্মকেই ব্যবহার করে নিজেদের ধর্মকে এবং আত্মসম্মানকে টিকিয়ে রেখেছিল। এটা ছিল প্রভুর হাতিয়ার দিয়েই প্রভুর বিরুদ্ধে এক নীরব কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী সাংস্কৃতিক যুদ্ধ (Scott, 1985)। এই প্রক্রিয়ায় তারা এমন এক নতুন, শক্তিশালী ও জটিল ধর্ম তৈরি করেছিল, যা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা ও পরিচয়ের উৎস।
- হাইব্রিডিটি এবং তৃতীয় পরিসর (Hybridity and the Third Space): উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক হোমি কে. ভাবা (Homi Bhabha) এই মিশ্রণের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘হাইব্রিডিটি’ (Hybridity) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে যখন দুটি সংস্কৃতি মেশে, তখন তা কেবল একটি সাধারণ মিশ্রণ হয় না। এটি এমন এক ‘তৃতীয় পরিসর’ (Third Space) তৈরি করে, যা ঔপনিবেশিক ক্ষমতার কেন্দ্রকেই ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। প্রভু চান যে দাস বা শাসিত তাঁর নিখুঁত অনুকরণকারী বা ‘mimic man’ হয়ে উঠুক। কিন্তু শাসিত যখন অনুকরণ করে, তখন তা কখনোই নিখুঁত হয় না, তাতে সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকে যায়। এই ‘almost the same, but not quite’ বা ‘প্রায় এক, কিন্তু ঠিক এক নয়’ – এই অবস্থাই প্রভুর সংস্কৃতি ও ক্ষমতার ‘বিশুদ্ধতা’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে এবং তাকে ব্যঙ্গ করে। ভুডু বা স্যান্টেরিয়া ধর্মগুলো ঠিক এই কাজটিই করেছিল। তারা ক্যাথলিক ধর্মকে অনুকরণ করার ভান করে এমন এক নতুন হাইব্রিড ধর্ম তৈরি করেছিল, যা আর যাই হোক, প্রভুর কাঙ্ক্ষিত বিশুদ্ধ খ্রিস্টধর্ম ছিল না। এটি ছিল এক অন্তর্ঘাতমূলক (subversive) সৃষ্টি (Bhabha, 1994)।
৩. সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের সেতু: বিভাজনের বিপরীতে এক মানবিক উত্তর
সংঘাতময়, বিভাজিত পৃথিবীতে সিনক্রেটিজম মৌলবাদ (Fundamentalism) আর সংঘাতের বিপরীতে এক বাস্তব ও মানবিক বিকল্পের সন্ধান দেয়। যখন মৌলবাদীরা ধর্মের বিশুদ্ধতার নামে বিভেদের পাঁচিল তুলতে চায়, তখন সিনক্রেটিজম সেই পাঁচিলের ইট দিয়েই মিলনের সেতু গড়ে তোলে। এটি সহিষ্ণুতা (Tolerance) আর সহাবস্থানের (Coexistence) পথ খুলে দেয়।
- মিলনের সামাজিক আঠা: এটি দেখায় যে মানুষ কীভাবে ভিন্ন বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার পথ খুঁজে নিতে পারে। বাংলার বনবিবি বা সত্যপীরের মতো চরিত্রগুলো এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই চরিত্রগুলোই ছিল সেই ‘সামাজিক আঠা’ (social glue), যা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে একে অপরের প্রতিবেশী হিসেবে বাঁচতে শিখিয়েছিল। সুন্দরবনের হিন্দু বাওয়ালি আর মুসলমান বাওয়ালি – দুজনেরই ভয় এক বাঘকে, দুজনেরই আশ্রয় এক বনবিবি। এখানে শাস্ত্রের চেয়ে জীবন বড়, তত্ত্বের চেয়ে বাস্তবতা অনেক বেশি শক্তিশালী। এই লোকায়ত বা ব্যবহারিক ধর্ম (Lived Religion) শাস্ত্রীয় ধর্মের কঠোর বিভাজনকে অগ্রাহ্য করে। যখন কট্টরপন্থীরা দুই সম্প্রদায়কে আলাদা করার চেষ্টা করেছে, তখন এই সিনক্রেটিক বিশ্বাসগুলোই সাধারণ মানুষকে এক সূত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছে (Roy, 1993)।
- সংঘাত এড়ানোর কৌশল: অনেক ক্ষেত্রে সিনক্রেটিজম ছিল সংঘাত এড়ানোর এক সচেতন সামাজিক কৌশল। নতুন কোনো প্রভাবশালী ধর্ম বা সংস্কৃতি যখন কোনো অঞ্চলে আসে, তখন সেখানকার মানুষ হয় তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে, নয়তো পুরোপুরি বর্জন করতে পারে। দুটোই সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। সিনক্রেটিজম তৃতীয় একটি পথ খুলে দেয় – গ্রহণ ও বর্জনের মাঝামাঝি এক সৃজনশীল আপসের পথ, যা দুই পক্ষকেই শান্তিতে সহাবস্থান করতে সাহায্য করে।
সুতরাং, বিতর্কের দাঁড়িপাল্লার এই দিকে তাকালে সিনক্রেটিজমকে আর অবক্ষয় বা দূষণ মনে হয় না। মনে হয়, এটি মানুষের টিকে থাকার, মানিয়ে নেওয়ার আর ভালোবাসা ও সহানুভূতির এক অসাধারণ শিল্প। এটি কখনো ক্ষমতার হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু এটি প্রতিরোধের অস্ত্রও বটে। এটি কখনো পরিচয়ের সংকট তৈরি করতে পারে, কিন্তু এটি নতুন, আরও সমৃদ্ধ পরিচয়ের জন্মও দেয়। এর মূল্যায়ন নির্ভর করে – কে, কার সঙ্গে, কোন পরিস্থিতিতে মিশছে তার ওপর। সিনক্রেটিজম এক জটিল, জীবন্ত এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক প্রক্রিয়া, কিন্তু মানব সভ্যতার গল্প থেকে, তার বেড়ে ওঠার কাহিনি থেকে, একে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় নেই। এটি সেই নকশিকাঁথা, যা বোনার সময় সুচের আঘাতে রক্ত ঝরে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা তৈরি হয়, তা এক অপূর্ব সুন্দর ও উষ্ণ আশ্রয়।
এই ডিজিটাল যুগে সিনক্রেটিজম: বিশ্বগ্রামের নতুন খিচুড়ি
আমাদের পূর্বপুরুষদের সিনক্রেটিজম ছিল ধীরগতির, বহমান নদীর মতো। সিল্ক রুটের কোনো বণিকের হাত ধরে একটি ধারণা বা শিল্পরীতি চীন থেকে পারস্যে পৌঁছাতে হয়তো কয়েক মাস বা বছর লেগে যেত। এই দীর্ঘ সময়ে সেই ধারণাটি পথের ধুলোবালি, আবহাওয়া আর নানা সংস্কৃতির ছোঁয়া পেয়ে ধীরে ধীরে নিজের রূপ বদলাত। কিন্তু আমরা এখন বাস করছি এক অভূতপূর্ব বিশ্বায়নের (Globalization) যুগে। আমাদের সিনক্রেটিজম আর ধীরগতির নদী নয়, এটি হলো এক হাই-স্পিড ব্লেন্ডারের মতো, যেখানে এক মুহূর্তে পৃথিবীর সব প্রান্তের উপাদান এসে মিশে যাচ্ছে।
ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া আর দ্রুতগতির যোগাযোগের কল্যাণে পুরো পৃথিবীটা এখন আমাদের বসার ঘরের ড্রয়িং রুমে নয়, বরং আমাদের হাতের তালুতে থাকা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে এসে হাজির হয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে সিনক্রেটিজমের গতি, প্রকৃতি আর মাত্রা – তিনটিই বহুগুণ বেড়ে গেছে এবং আরও জটিল, আরও আকর্ষণীয় ও কখনো কখনো আরও বিপজ্জনক রূপ ধারণ করেছে।
এই নতুন সিনক্রেটিজমের চালিকাশক্তি তিনটি:
- অকল্পনীয় গতি (Unimaginable Speed): একটি মিম (Meme), একটি নাচের চ্যালেঞ্জ বা একটি গানের ক্লিপ এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিওল থেকে সাও পাওলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তথ্যের প্রবাহ এখন প্রায় তাৎক্ষণিক।
- বিশাল ব্যাপ্তি (Massive Scale): একটি ইউটিউব ভিডিও বা টিকটক ক্লিপ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই শত শত মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে, যা আগে কোনো সম্রাট বা ধর্মপ্রচারকের পক্ষেও সম্ভব ছিল না।
- সৃজনশীলতার গণতন্ত্রায়ন (Democratization of Creativity): এখন সংস্কৃতি তৈরি করার ক্ষমতা আর কেবল কিছু অভিজাত শিল্পী বা বুদ্ধিজীবীর হাতে নেই। ঢাকার কোনো গলিতে বসে থাকা এক কিশোর, বা পেরুর কোনো গ্রামের এক তরুণী – প্রত্যেকেই এখন একজন সম্ভাব্য বিশ্ব-সংস্কৃতির নির্মাতা।
এই ডিজিটাল পেট্রি ডিশে (Petri dish) জন্ম নিচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর সব সংকর বা হাইব্রিড সংস্কৃতি।
- জাপানের এক কিশোর হয়তো আমেরিকার ব্রুকলিনের হিপ-হপ (Hip-Hop) গানের বিটের সঙ্গে ভারতের ভরতনাট্যমের (Bharatanatyam) মুদ্রা মিশিয়ে একটা দুর্দান্ত টিকটক ভিডিও বানাচ্ছে, যা দেখে নাইজেরিয়ার কোনো তরুণ অনুপ্রাণিত হয়ে তার সঙ্গে আফ্রো-বিটস (Afro-beats) যোগ করছে।
- কোরীয় পপ বা কে-পপ (K-Pop) তো এই ডিজিটাল সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে সফল বাণিজ্যিক উদাহরণ। এর ফর্মুলাটাই সিনক্রেটিক: এর ভিত্তিটা আফ্রিকান-আমেরিকান সঙ্গীত (R&B, হিপ-হপ), এর ব্যবসায়িক মডেলটা জাপানি জে-পপের (J-Pop) আইডল সিস্টেম থেকে নেওয়া, এর গানের প্রোডাকশন আর মিউজিক ভিডিওর মান পশ্চিমা পপ সঙ্গীতের মতো, কিন্তু এই সবকিছুকে মুড়ে রাখা হয়েছে এক নিখুঁত, চকচকে ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় কোরীয় নন্দনতত্ত্ব আর কঠোর শৃঙ্খলার মোড়কে।
- আমরা বাঙালিরা ইউটিউব দেখে ইতালিয়ান পাস্তা রান্না করছি, কিন্তু তাতে দিয়ে দিচ্ছি আমাদের নিজস্বতার ছোঁয়া – আদা-রসুন বাটা, একটু ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা আর ভাজা জিরার গুঁড়ো। জন্ম নিচ্ছে ‘দেশি পাস্তা’। আবার আমেরিকায় তৈরি হচ্ছে ‘সুশি বুরিতো’ (Sushi Burrito), যেখানে জাপানি সুশিকে মেক্সিকান বুরিতোর আকারে পরিবেশন করা হচ্ছে।
এই বিশ্বায়ন একদিকে যেমন সিনক্রেটিজমের জন্য এক উর্বর ও অফুরন্ত ক্ষেত্র তৈরি করেছে, তেমনি জন্ম দিয়েছে দুটি গভীর ও জটিল আশঙ্কার।
১. সাংস্কৃতিক স্বত্বাপহরণ (Cultural Appropriation): শ্রদ্ধার মুখোশে অসম্মান?
ডিজিটাল সিনক্রেটিজমের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে আলোচিত বিতর্কটি হলো: এই নতুন মিশ্রণ কি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে হচ্ছে, নাকি তা ‘সাংস্কৃতিক স্বত্বাপহরণ’-এরই নামান্তর?
স্বত্বাপহরণ ঘটে তখন, যখন কোনো প্রভাবশালী বা সংখ্যাগুরু সংস্কৃতির মানুষ (সাধারণত পশ্চিমা বিশ্বের শ্বেতাঙ্গরা) অন্য কোনো প্রান্তিক, সংখ্যালঘু বা ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত সংস্কৃতির কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা পবিত্র প্রতীক, পোশাক, প্রথা বা শিল্পকে তার মূল অর্থ, ইতিহাস ও সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এরপর তারা সেটিকে কেবল ফ্যাশন, বিনোদন, ট্রেন্ড বা বাণিজ্যিক লাভের জন্য ব্যবহার করে। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাই মূল বিষয়।
- উদাহরণ:
- যখন কোনো পশ্চিমা পপ তারকা বা ফ্যাশন মডেল আমেরিকান আদিবাসীদের পবিত্র শিরস্ত্রাণ (war bonnet), যা অর্জন করতে একজন যোদ্ধাকে সারা জীবন সাধনা করতে হয়, সেটিকে কোনো মিউজিক ফেস্টিভ্যালে কেবল ‘কুল’ দেখানোর জন্য পরেন, তখন তা সিনক্রেটিজম নয়, তা হলো একটি জাতির সংগ্রাম ও আধ্যাত্মিকতাকে অপমান করা।
- যখন আফ্রিকান সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী চুলের স্টাইল, যেমন ড্রেডলকস (dreadlocks) বা কর্নরো (cornrows), যা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বহু বছর ধরে বৈষম্য ও বিদ্রূপের কারণ ছিল, সেই একই স্টাইল কোনো শ্বেতাঙ্গ মডেল করলে তাকে ‘ট্রেন্ডি’ বা ‘এজি’ (edgy) বলা হয়।
- যখন যোগ বা মেডিটেশনের মতো গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলনকে তার দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল ওজন কমানো বা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের এক দামী বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিক্রি করা হয় এবং তার ভারতীয় উৎসকে প্রায়শই অস্বীকার করা হয়।
ইন্টারনেট এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। একদিকে, এটি স্বত্বাপহরণকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, এই ইন্টারনেটই আবার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। এখন এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রতিবাদ (#CulturalAppropriation) জানানো হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হয়। ডিজিটাল যুগে সিনক্রেটিজম (সৃজনশীল বিনিময়) আর স্বত্বাপহরণ (শোষণমূলক গ্রহণ)-এর মধ্যেকার সূক্ষ্ম রেখাটি এক বিরাট বিতর্কের বিষয় এবং এই বিতর্ক আমাদের শেখাচ্ছে যে, অন্য সংস্কৃতিকে ভালোবাসার আগে তাকে সম্মান করাটা জরুরি।
২. গভীরতা বনাম উপরিতলের মিশ্রণ: বৈশ্বিক একক সংস্কৃতি বা ‘ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন’-এর ভয়
এই যে বিদ্যুতের গতিতে মিশ্রণ ঘটছে, এর সূত্রেই আসে দ্বিতীয় এবং আরও গভীর আশঙ্কাটি। এই মিশ্রণ কি গভীর কোনো দার্শনিক বা শৈল্পিক ভাবনার জন্ম দিচ্ছে, নাকি পুরোটাই ওপর-ওপর, চটকদার কিন্তু তাৎপর্যহীন? আমরা কি এক নতুন, বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ বিশ্ব-সংস্কৃতি তৈরি করছি, নাকি সবকিছু মিশে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এক স্বাদহীন, গন্ধহীন ‘গ্লোবাল মনোকালচার’ (Global Monoculture) বা বৈশ্বিক একক সংস্কৃতির জন্ম হতে চলেছে, যেখানে স্থানীয় স্বাদ, গন্ধ আর বৈচিত্র্যগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে?
আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী জর্জ রিটজার (George Ritzer) এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন’ (McDonaldization) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ম্যাকডোনাল্ডসের ফাস্ট-ফুড চেইনের মূল নীতিগুলো – দক্ষতা (efficiency), পরিমাপযোগ্যতা (calculability), পূর্বাভাসযোগ্যতা (predictability) এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ (control) – এখন কেবল ব্যবসার জগতেই নয়, আমাদের সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে (Ritzer, 2011)।
- সংস্কৃতির ম্যাকডোনাল্ডাইজেশন: এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে একই ধরনের হলিউড সিনেমা, একই পপ গান, একই ফ্যাশন ব্র্যান্ড আর একই ধরনের শহুরে জীবনযাত্রার বিস্তার ঘটছে। প্যারিস থেকে বেইজিং, সব বড় শহরের শপিং মলগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় শিল্প, সঙ্গীত, সিনেমা বা খাদ্যাভ্যাসগুলো ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে এবং এক ধরনের সমরূপ বা হোমোজেনাইজড (homogenized) বিশ্ব-সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। এই আশঙ্কা অনুযায়ী, ডিজিটাল সিনক্রেটিজম আসলে বৈচিত্র্য তৈরি করছে না, বরং বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
তবে এর বিপরীতে আরেকটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ধারণা হলো ‘গ্লোকালাইজেশন’ (Glocalization)। সমাজবিজ্ঞানী রোল্যান্ড রবার্টসন (Roland Robertson) দেখিয়েছেন যে, বিশ্বায়ন কেবল একমুখী প্রক্রিয়া নয়। মানুষ বৈশ্বিক পণ্য বা ধারণাকে নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে না, বরং তারা সেটিকে নিজেদের স্থানীয় সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও প্রয়োজন অনুযায়ী বদলে নেয় এবং তাকে এক নতুন, স্থানীয় অর্থ প্রদান করে (Robertson, 1995)।
- উদাহরণ:
- ভারতে ম্যাকডোনাল্ডস গরুর মাংসের বার্গার বিক্রি করে না, তার বদলে তারা নিয়ে এসেছে ‘ম্যাক আলু টিক্কি’ বার্গার। এটিই গ্লোকালাইজেশন – বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের স্থানীয় রূপান্তর।
- মিশরের তরুণরা আমেরিকান হিপ-হপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু তারা তাদের র্যাপে স্থানীয় রাজনৈতিক সমস্যা আর আরবি ভাষার নিজস্ব ছন্দ ব্যবহার করছে।
- আমাদের ‘দেশি পাস্তা’ও এই গ্লোকালাইজেশনেরই এক চমৎকার উদাহরণ।
সুতরাং, ডিজিটাল যুগের সিনক্রেটিজম আমাদের এক দ্বিমুখী পথের সামনে দাঁড় করিয়েছে। একদিকে আছে সবকিছুকে এক ছাঁচে ফেলে দেওয়ার ম্যাকডোনাল্ডাইজেশনের ভয়, অন্যদিকে আছে বৈশ্বিক আর স্থানীয়ের সৃজনশীল মিলনে নতুন নতুন সংস্কৃতি তৈরির গ্লোকালাইজেশনের আশা। এই ডিজিটাল বিশ্ব একদিকে যেমন আমাদের সংস্কৃতির জন্য এক বিশাল আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখি, তেমনি এটি এক বিশাল পরীক্ষাগারও, যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের নতুন করে তৈরি করছি। ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।
শেষ কথা নয়, বরং এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত
সিনক্রেটিজম কোনো দূরের গ্রহের বা অ্যাকাডেমিক বইয়ের কঠিন তত্ত্ব নয়। এটি আমাদের প্রতিদিনের নিঃশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক এবং আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত প্রক্রিয়া। যখন কোনো রিকশার পেছনে লেখা দেখি “মা-বাবার দোয়া” আর তার পাশেই নিপুণভাবে আঁকা থাকে কোনো সিনেমার নায়িকার ছবি, তখন সেখানেও ধর্মবিশ্বাস আর পপ-কালচারের এক আটপৌরে সিনক্রেটিজম কাজ করে। যখন মুসলিমরা ঈদে হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িতে সেমাইয়ের বাটি পাঠায় আর হিন্দুরা পূজায় মুসলিম প্রতিবেশীদের বাড়িতেনাড়ু বা লুচি দিয়ে আসে, তখন তারা জেনে বা না জেনেই সিনক্রেটিজমেরই চর্চা করে, সহাবস্থানের এক সুন্দর দেয়াল গাঁথে।
সংস্কৃতির এই পাঁচমিশালি খিচুড়ি হয়তো সবসময়, সবার মুখে সমানভাবে রোচে না। কেউ এতে ঝাল বেশি খুঁজে পান, কেউ পান মিষ্টির আধিক্য। কেউ একে বলেন অবক্ষয়, কেউ বলেন সৃষ্টি। কিন্তু এই মিশ্রণ আছে, ছিল এবং থাকবে। কারণ মানুষ স্বভাবতই সৃজনশীল। সে ভাঙতে জানে, আবার গড়তেও জানে। সে তার পুরোনো শিকড়কে আঁকড়ে ধরে রেখেই নতুনের দিকে দুটি হাত বাড়িয়ে দেয়।
রাতের আকাশের সেই চাঁদ আর শুকতারার মতোই, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি হয়তো আলাদা, কিন্তু একসঙ্গে তারা মানব সভ্যতার আকাশকে আরও সুন্দর, আরও রহস্যময় করে তোলে। চাল আর ডাল মিলে যেমন এক অমৃতসমান খিচুড়ি তৈরি হয়, তেমনি নানা ধর্ম, নানা বিশ্বাস, নানা ভাষা আর নানা সংস্কৃতি মিলেই এই মানব সভ্যতাকে এত বৈচিত্র্যময়, এত গতিশীল ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সিনক্রেটিজম হলো সেই অদৃশ্য জাদুকরী সুতো, যা এই আপাত-বিচ্ছিন্ন ভিন্নতাগুলোকে একসঙ্গে গেঁথে এক অপূর্ব নকশিকাঁথা তৈরি করে। এই কাঁথার প্রতিটি ফোঁড় একেকটি গল্প বলে – কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার, কখনো প্রতিরোধের, কিন্তু সব মিলিয়ে তা মানুষের টিকে থাকার আর মিলেমিশে থাকার এক অন্তহীন উপাখ্যান। এই মিলেমিশে থাকার মধ্যেই হয়তো এর আসল সৌন্দর্য আর শক্তি লুকিয়ে আছে।
তথ্যসূত্র
- Achaya, K. T. (1994). Indian Food: A Historical Companion. Oxford University Press.
- Anderson, B. (1983). Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism. Verso.
- Asher, C. B. (1992). Architecture of Mughal India. Cambridge University Press.
- Baugh, A. C., & Cable, T. (2002). A History of the English Language (5th ed.). Routledge.
- Beard, M., North, J., & Price, S. (2012). Religions of Rome: Volume 1, A History. Cambridge University Press.
- Bhabha, H. K. (1994). The Location of Culture. Routledge.
- Dasgupta, S. B. (1969). Obscure Religious Cults. Firma K. L. Mukhopadhyay.
- Dehejia, V. (1997). Discourse in Early Buddhist Art: Visual Narratives of India. Munshiram Manoharlal Publishers.
- Eaton, R. M. (1993). The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760. University of California Press.
- Fanon, F. (1967). Black Skin, White Masks. (C. L. Markmann, Trans.). Grove Press. (Original work published 1952).
- Fletcher, R. (1997). The Barbarian Conversion: From Paganism to Christianity. University of California Press.
- Gramsci, A. (1971). Selections from the Prison Notebooks. (Q. Hoare & G. N. Smith, Eds. & Trans.). International Publishers.
- Kepel, G. (2002). Jihad: The Trail of Political Islam. Harvard University Press.
- Leopold, A. M., & Jensen, J. S. (Eds.). (2012). Syncretism in Religion: A Reader. Routledge.
- Lopez Jr., D. S. (2008). The Story of Buddhism: A Concise Guide to its History and Teachings. HarperOne.
- Ortiz, F. (1995). Cuban Counterpoint: Tobacco and Sugar. (H. de Onís, Trans.). Duke University Press. (Original work published 1940).
- Ritzer, G. (2011). The McDonaldization of Society 6. Pine Forge Press.
- Robertson, R. (1995). Glocalization: Time-Space and Homogeneity-Heterogeneity. In M. Featherstone, S. Lash, & R. Robertson (Eds.), Global Modernities (pp. 25-44). Sage Publications.
- Rogers, R. A. (2006). From Cultural Exchange to Transculturation: A Review and Reconceptualization of Cultural Appropriation. Communication Theory, 16(4), 474–503.
- Roy, A. (1993). The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal. Princeton University Press.
- Scott, J. C. (1985). Weapons of the Weak: Everyday Forms of Peasant Resistance. Yale University Press.
- Scott, J. C. (1990). Domination and the Arts of Resistance: Hidden Transcripts. Yale University Press.
- Stewart, C. (1995). Syncretism and its Synonyms: Reflections on Cultural Mixture. Diacritics, 29(3), 40-62.
- Stewart, C., & Shaw, R. (Eds.). (1994). Syncretism/Anti-Syncretism: The Politics of Religious Synthesis. Routledge.
- Thapar, R. (2002). The Penguin History of Early India: From the Origins to AD 1300. Penguin Books.
- Thompson, R. F. (1983). Flash of the Spirit: African & Afro-American Art & Philosophy. Random House.
- van der Veer, P. (2004). Imperial Encounters: Religion and Modernity in India and Britain. Princeton University Press.

