মেটাল (Metal): এক গোলমেলে শিল্পের ব্যবচ্ছেদ
Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 কোথা থেকে এলো এই ‘গোলমাল’?
- 3 শাখা-প্রশাখার বিস্তার
- 3.1 নিউ ওয়েভ অফ ব্রিটিশ হেভি মেটাল (New Wave of British Heavy Metal – NWOBHM)
- 3.2 থ্র্যাশ মেটাল (Thrash Metal): গতির দানব
- 3.3 গ্ল্যাম মেটাল (Glam Metal): জাঁকজমক এবং পার্টি
- 3.4 ডেথ মেটাল (Death Metal): মৃত্যুর সঙ্গীত
- 3.5 ব্ল্যাক মেটাল (Black Metal): শীতল অন্ধকার
- 3.6 ডুম মেটাল (Doom Metal): ধীরগতির বিষাদ
- 3.7 পাওয়ার মেটাল (Power Metal): আশার জয়গান
- 3.8 প্রগ্রেসিভ মেটাল (Progressive Metal): মস্তিষ্কের ব্যায়াম
- 3.9 গ্রুভ মেটাল (Groove Metal): খাঁজকাটা ভারিত্ব
- 3.10 নু মেটাল (Nu Metal) এবং অল্টারনেটিভ মেটাল (Alternative Metal): প্রজন্মের বিদ্রোহ
- 3.11 আরও কিছু শাখা-প্রশাখা
- 4 একটি মেটাল গানের অ্যানাটমি
- 5 মেটালের দর্শন: যে ভাঙচুর আর চিন্তার গর্ভে জন্ম নিল এক গোলমেলে শিল্প
- 5.1 ইতিহাস ও ভাঙচুরের প্রতিধ্বনি
- 5.2 দার্শনিকদের হাতুড়ি: যে চিন্তারা গড়েছে মেটালের কঙ্কাল (The Philosophers’ Hammer: Ideas That Forged Metal’s Skeleton)
- 5.2.1 ফ্রিডরিখ নিৎশে (Friedrich Nietzsche): ঈশ্বরের মৃত্যু এবং Übermensch-এর উত্থান
- 5.2.2 জঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre) ও অ্যালবেয়ার কামু (Albert Camus): অস্তিত্বের ভার এবং অর্থহীনতার (Absurdity) বিদ্রোহ
- 5.2.3 নস্টিকবাদ (Gnosticism): বস্তুজগতের কারাগার এবং মিথ্যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
- 5.2.4 এইচ. পি. লাভক্র্যাফট (H. P. Lovecraft): মহাজাগতিক আতঙ্ক এবং মানবীয় তুচ্ছতা
- 5.2.5 মার্কি দ্য সাদ (Marquis de Sade): চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘন এবং নৈতিকতার প্রত্যাখ্যান
- 6 সংস্কৃতি, দর্শন এবং বিতর্ক
- 7 শব্দের তরবারি: মেটালের গানে কথা, কবিতা ও দর্শনের ব্যবচ্ছেদ
- 7.1 লিরিক্সের বিষয়বস্তু: অন্ধকারের বর্ণমালা
- 7.2 লিরিক্সের সাহিত্যিক কৌশল এবং তাত্ত্বিক দিক
- 7.2.1 ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি (Intertextuality): অন্য গ্রন্থের প্রতিধ্বনি এবং সাংস্কৃতিক পুঁজি
- 7.2.2 নান্দনিকতা এবং সাবলাইম (Aesthetics and the Sublime): ভয়ের নান্দনিক রূপ
- 7.2.3 পারফর্মেন্স এবং কণ্ঠের ভূমিকা: যখন চিৎকার হয়ে ওঠে অর্থ (Semantics)
- 7.2.4 ম্যাসকুলিনিটি এবং জেন্ডার পারফর্মেন্স: শক্তির বহুবিধ রূপ
- 7.3 চিৎকারের পেছনের কবিতা
- 8 শব্দের আয়নায় সাহিত্য: মেটালের লিরিক্সে কবিতার পদচিহ্ন
- 8.1 রোমান্টিসিজম (Romanticism) এবং তার অন্ধকার যমজ ভাই: গথিক (Gothic)
- 8.2 আধুনিকতাবাদ (Modernism) এবং অস্তিত্ববাদ (Existentialism): ভাঙা পৃথিবীর টুকরো
- 8.3 পরাবাস্তববাদ (Surrealism) এবং বীট জেনারেশন (Beat Generation): যুক্তির শৃঙ্খল ভাঙা
- 8.4 পাল্প ফিকশন, কমিকস এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী: জনসংস্কৃতির সাহিত্য (Pop Culture)
- 9 আমাদের মেটাল
- 10 গোলমালের সংক্রামক প্রতিধ্বনি: যখন মেটালের ছায়া পড়ে অন্য সুরে
- 11 ধর্ম ও মেটাল: অনন্ত যুদ্ধের মিথ ও বাস্তবতা
- 12 গোলমালের নিজস্ব উত্তরাধিকার: মেটাল মিউজিকের প্রভাব
- 13 অ্যাকাডেমিক ব্যবচ্ছেদ ও তাত্ত্বিকদের অবদান: যখন গোলমাল হয়ে ওঠে গবেষণার বিষয়
- 13.1 সমাজতত্ত্ব ও উপ-সংস্কৃতি গবেষণা: ডিনা ওয়াইনস্টিন ও কিথ কান-হ্যারিসের সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান
- 13.2 সঙ্গীততত্ত্ব (Musicology) ও শব্দের ব্যবচ্ছেদ: গোলমালের ব্যাকরণ ও একজন রবার্ট ওয়ালসার
- 13.3 বৈশ্বিক মেটালের ভূ-রাজনীতি, নৃতত্ত্ব ও সংস্কৃতি তত্ত্ব: জেরেমি ওয়ালাক এবং রোসমারি ওভেরেল
- 13.4 দর্শন এবং ‘মেটাল স্টাডিজ’: গোলমালের গভীরে ডুব ও একজন কার্ল স্প্র্যাকলেন
- 13.5 উত্তর-ঔপনিবেশিক (Postcolonial) পাঠ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: গোলমালের ভূ-রাজনীতি
- 14 শেষ কথা: গোলমাল, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু?
- 15 তথ্যসূত্র
ভূমিকা
কোনো এক মেঘলা দুপুর। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। এমন দিনে মনটা কেমন যেন করে। কিছু ভালো লাগে না। এই ভালো না লাগারও একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে। ধরুন, আপনার পাশের বাড়ির কোনো এক ফ্ল্যাট থেকে তীব্র, দুর্বোধ্য কিছু শব্দ ভেসে আসছে। এমন শব্দ যা আপনার পরিচিত জগতের কোনো কিছুর সাথেই মেলে না। মনে হচ্ছে যেন হাজারটা যন্ত্রপাতি একসাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। ড্রামের উন্মত্ত শব্দ, যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে; গিটারের তীব্র চিৎকার, যেন কোনো আহত পশু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে; আর তার সাথে কোনো এক মানুষের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে এমন এক গর্জন যা মানুষের বলে মনে হয় না।
আপনার কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়বে। মনে হবে, এই গোলমালের মানে কী? আজকালকার ছেলেমেয়েদের রুচি বলেও কি কিছু নেই? এই চিৎকারের শিল্প আসলে কী? এর মধ্যে এমন কী অমৃত লুকিয়ে আছে যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে দশকের পর দশক ধরে এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রেখেছে?
ব্যাপারটা অনেকটা প্রথমবার কফি বা তেতো করলার রস খাওয়ার মতো। প্রথম চুমুকেই মুখ বিকৃত হয়ে যায়। তিতকুটে, অদ্ভুত স্বাদ। কিন্তু যারা এর গভীরে প্রবেশ করতে পারে, তাদের জন্য এক নতুন জগৎ উন্মোচিত হয়। মেটাল মিউজিকও ঠিক তেমনই। এর বাইরের আবরণটা রুক্ষ, কর্কশ এবং অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর। কিন্তু সেই আবরণ ভেদ করতে পারলেই দেখা যায় এক জটিল, শৈল্পিক এবং আবেগময় পৃথিবীর সন্ধান। এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে মানুষের তীব্রতম অনুভূতিগুলোর প্রতিচ্ছবি – রাগ, দুঃখ, উল্লাস, হতাশা, একাকীত্ব, শক্তি এবং সর্বোপরি, মুক্তি।
এই লেখাটি সেই গোলমেলে শিল্পের ব্যবচ্ছেদ করার একটি দীর্ঘ এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা। আমরা এর জন্ম-পূর্ববর্তী মুহূর্ত থেকে শুরু করে বর্তমানের বহুধা বিভক্ত রূপ পর্যন্ত ভ্রমণ করব। আমরা এর শাখা-প্রশাখা, বাদ্যযন্ত্রের খুঁটিনাটি, গানের কথার গভীরতা, এর অনুসারীদের সংস্কৃতি এবং একে ঘিরে থাকা বিতর্ক – সবকিছু নিয়েই কথা বলব। চলুন, এই তীব্র শব্দের মহাসাগরে ডুব দেওয়া যাক। আশা করি, এই দীর্ঘ যাত্রার শেষে গোলমালটা আর শুধুই গোলমাল মনে হবে না।
কোথা থেকে এলো এই ‘গোলমাল’?
কোনো কিছুই শূন্য থেকে তৈরি হয় না, সবকিছুরই একটি পূর্ব-ইতিহাস থাকে। মেটাল মিউজিকের জন্মও হঠাৎ করে একদিনে হয়নি। এর শেকড় খুঁজতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে অনেকগুলো দশক। এর ডিএনএ-তে (DNA) মিশে আছে বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন মানুষের দুঃখ, আনন্দ আর বিদ্রোহের গল্প।
ব্লুজ (Blues): দাদা-দাদির দীর্ঘশ্বাস
মেটাল মিউজিকের বংশলতিকা খুঁজতে গেলে সবার আগে যার নাম আসবে, সে হলো ব্লুজ। আমেরিকার মিসিসিপি ডেল্টার (Mississippi Delta) তুলো ক্ষেতে কাজ করা আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাস এবং তাদের উত্তরসূরিদের বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা এক গভীর দীর্ঘশ্বাসের নাম ব্লুজ। তাদের জীবন ছিল সীমাহীন কষ্ট, বঞ্চনা আর শ্রমে ভরা। সেই জীবনের গল্প বলার জন্যই জন্ম হয়েছিল এই সঙ্গীতের। ব্লুজের মধ্যে ছিল এক ধরনের কাঁচা, অকৃত্রিম আবেগ (Raw, Unfiltered Emotion)। এর মূল ভিত্তি ছিল নির্দিষ্ট কিছু স্কেল (Scale), বিশেষ করে পেন্টাটোনিক স্কেল (Pentatonic Scale) এবং ব্লুজ স্কেল (Blues Scale)। এই ব্লুজ স্কেলের একটি বিশেষ নোট, যাকে ‘ব্লু নোট’ (Blue Note) বলা হয়, তা সঙ্গীতে এক ধরনের বিষণ্ণতা এবং চাপা উত্তেজনা তৈরি করত। এই স্কেলগুলোই পরবর্তীকালে রক এবং মেটালের গিটারিস্টদের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
রবার্ট জনসন (Robert Johnson), মাডি ওয়াটার্স (Muddy Waters), হাউলিন’ উলফ (Howlin’ Wolf)-এর মতো শিল্পীদের হাত ধরে ব্লুজ জনপ্রিয় হয়। রবার্ট জনসনের গিটার বাজানো এবং কণ্ঠের মধ্যে যে তীব্র হাহাকার ছিল, তা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। কথিত আছে, তিনি নাকি শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে গিটার বাজানোর অবিশ্বাস্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এই মিথ বা কিংবদন্তি মেটালের অশুভ (Sinister) ভাবমূর্তির সাথেও যেন কোথায় মিলে যায়। ব্লুজই প্রথম শিখিয়েছিল কীভাবে সঙ্গীতকে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মেটালের যে অন্ধকারাচ্ছন্নতা, তার শেকড় এখানেই প্রোথিত।
রক অ্যান্ড রোল (Rock and Roll): বাবার উদ্দাম যৌবন
পঞ্চাশের দশকে এসে এই ব্লুজ আরও দ্রুত লয়, উচ্চ শক্তি এবং বৈদ্যুতিক রূপ নিয়ে জন্ম দিল রক অ্যান্ড রোলের। প্রযুক্তি এখানে এক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। ইলেকট্রিক গিটার এবং অ্যামপ্লিফায়ারের (Amplifier) আবিষ্কার সঙ্গীতকে আরও উচ্চকিত এবং শক্তিশালী করে তুলল। এলভিস প্রিসলি (Elvis Presley), চাক বেরি (Chuck Berry), লিটল রিচার্ড (Little Richard) – এরা শুধু গান গাইতেন না, মঞ্চে তাদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, শক্তি এবং বিদ্রোহী মনোভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শান্ত, রক্ষণশীল সমাজের তরুণ প্রজন্মকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
চাক বেরি ছিলেন একজন প্রদর্শক। তিনি গিটার বাজাতে বাজাতে হাঁসের মতো হাঁটতেন (Duckwalk), যা ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তার গিটার বাজানোর কৌশল, বিশেষ করে তার ডাবল-স্টপ (Double-stop) এবং রিফ-ভিত্তিক বাজনা, পরবর্তী প্রজন্মের সব গিটারিস্টের জন্য পাঠ্যবই হয়ে গেল। রক অ্যান্ড রোলই প্রথম সঙ্গীতকে ‘বিপজ্জনক’ এবং ‘নৈতিকভাবে অবক্ষয়িত’ হিসেবে সমাজের চোখে পরিচিত করে তোলে। বড়রা যা অপছন্দ করত, তরুণরা ঠিক তাই আঁকড়ে ধরত। এই বিদ্রোহী মনোভাব (Rebellious Attitude) মেটাল সংস্কৃতির এক মূল ভিত্তি।
ষাট দশকের সাইকেডেলিক এবং হার্ড রক: ঝড়ের পূর্বাভাস
ষাটের দশকে এসে রক মিউজিক আরও ভারী, আরও পরীক্ষামূলক (Experimental) এবং আরও গোলমেলে হতে শুরু করে। আমেরিকা জুড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা, নাগরিক অধিকার আন্দোলন, সামাজিক অস্থিরতা, এবং তরুণদের মধ্যেকার দ্রোহ – এই সবকিছুই সঙ্গীতে তীব্রভাবে প্রভাব ফেলছিল। এই সময়েই জন্ম নেয় সাইকেডেলিক রক (Psychedelic Rock)। এই ধারার শিল্পীরা এলএসডি-র (LSD) মতো সাইকেডেলিক ড্রাগের প্রভাবে মনের গভীরের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সঙ্গীতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এর ফলে সঙ্গীতে যুক্ত হলো দীর্ঘ এবং ইম্প্রোভাইজড (Improvised) গিটার সোলো, অদ্ভুত সব সাউন্ড এফেক্ট এবং পরাবাস্তব গানের কথা।
এই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন জিমি হেনড্রিক্স (Jimi Hendrix)। তাকে বলা যেতে পারে ইলেকট্রিক গিটারের ঈশ্বর। তিনি গিটারকে শুধু একটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে দেখেননি, তিনি একে বানিয়েছিলেন তার আত্মার, তার আবেগের মুখপাত্র। তিনি গিটার থেকে এমন সব শব্দ বের করতে পারতেন যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যামপ্লিফায়ারের খুব কাছে গিটার নিয়ে গিয়ে তিনি যে ফিডব্যাক (Feedback) তৈরি করতেন, অথবা গিটারের শব্দকে বিকৃত করার জন্য যে ফাজ (Fuzz) এবং ডিসটরশন (Distortion) প্যাডেল ব্যবহার করতেন, তা ছিল যুগান্তকারী। ডিসটরশন হলো গিটারের স্বাভাবিক, পরিষ্কার শব্দকে বৈদ্যুতিকভাবে বিকৃত করে এক ধরনের ভারী, কর্কশ এবং দীর্ঘস্থায়ী টোন (Tone) তৈরি করা। এই ডিসটরশনই হয়ে ওঠে মেটালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোনিক উপাদান। হেনড্রিক্সের ‘Purple Haze’ বা ‘Voodoo Child (Slight Return)’ শুনলে বোঝা যায়, তিনি কতটা এগিয়ে ছিলেন তার সময় থেকে।
একই সময়ে ব্রিটেনে, দ্য কিঙ্কস (The Kinks) তাদের ‘You Really Got Me’ (1964) গানে প্রথম পাওয়ার কর্ড (Power Chord) ব্যবহার করে হার্ড রকের (Hard Rock) দরজা খুলে দেয়। পাওয়ার কর্ড হলো একটি দুই-নোটের কর্ড যা ডিসটরশনের সাথে খুবই শক্তিশালী এবং ভারী শোনায়। এই পাওয়ার কর্ড ছাড়া মেটাল রিফ প্রায় অকল্পনীয়। দ্য হু (The Who) তাদের গানে প্রচণ্ড ভলিউম, গিটারিস্ট পিট টাউনশেন্ডের (Pete Townshend) উইন্ডমিল স্টাইলে (Windmill style) গিটার বাজানো এবং মঞ্চে বাদ্যযন্ত্র ভাঙার উন্মত্ততা, এবং ড্রামার কিথ মুনের (Keith Moon) বাঁধভাঙা ড্রামিং দিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে দিত। তাদের এই ধ্বংসাত্মক পারফরম্যান্স ছিল এক ধরনের শৈল্পিক বিবৃতি। ক্রিম (Cream) ব্যান্ডটি ‘পাওয়ার ট্রিও’ (Power Trio) ফরম্যাটকে জনপ্রিয় করে তোলে, যেখানে গিটার, বেস এবং ড্রামস – এই তিনটি যন্ত্রই সমান গুরুত্ব পায়। এরিক ক্ল্যাপটনের (Eric Clapton) দীর্ঘ ব্লুজ-ভিত্তিক সোলো এবং জ্যাক ব্রুসের (Jack Bruce) ভারী বেসলাইন হার্ড রকের ভিত্তি স্থাপন করে।
এই ব্যান্ডগুলো সবাই মিলে মেটাল নামক শিশুটির জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান তৈরি করে দিচ্ছিল: উচ্চ ভলিউম, বিকৃত গিটারের শব্দ, শক্তিশালী রিদম সেকশন, বিদ্রোহী মনোভাব এবং মঞ্চে প্রদর্শনের প্রবণতা।
“অশুভ ত্রয়ী” (The Unholy Trinity): মেটালের জন্ম
ইতিহাসবিদ এবং সমালোচকদের মতে, তিনটি ব্যান্ডকে মেটাল মিউজিকের প্রকৃত জন্মদাতা বা অগ্রদূত হিসেবে ধরা হয়। এরা হলো ব্ল্যাক সাবাথ (Black Sabbath), লেড জেপেলিন (Led Zeppelin), এবং ডিপ পার্পল (Deep Purple)। মজার ব্যাপার হলো, এই তিনটি ব্যান্ডের কেউই নিজেদের ‘হেভি মেটাল ব্যান্ড’ বলে পরিচয় দেয়নি। তারা নিজেদের রক ব্যান্ডই মনে করত। কিন্তু তাদের সঙ্গীতই হার্ড রকের সীমানা পেরিয়ে এমন এক নতুন এবং ভারী জগতে প্রবেশ করে, যা পরবর্তীকালে হেভি মেটাল নামে পরিচিতি পায়।
১. ব্ল্যাক সাবাথ (Black Sabbath): বৃক্ষের মূল কাণ্ড
যদি মেটালকে একটি বিশাল বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে তার মূল কাণ্ডটি হলো ব্ল্যাক সাবাথ। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের এক বিষণ্ণ, শিল্প-কারখানা ভরা শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা থেকে উঠে আসা এই ব্যান্ডটি রক মিউজিকের ‘ভালোবাসা’ আর ‘শান্তি’র ধারণাটি পুরোপুরি পাল্টে দেয়। তাদের সঙ্গীত ছিল তাদের পারিপার্শ্বিকতার প্রতিচ্ছবি – ধূসর, ভারী এবং হতাশাচ্ছন্ন।
ব্যান্ডের গিটারিস্ট টনি আইওমি (Tony Iommi) হলেন মেটালের স্থপতি। কৈশোরে এক স্টিল কারখানার দুর্ঘটনায় তিনি তার ডান হাতের দুটি আঙুলের ডগা হারান। ডাক্তাররা বলেছিলেন তিনি আর কখনো গিটার বাজাতে পারবেন না। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র তিনি ছিলেন না। তিনি গলানো প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে নিজের আঙুলের জন্য কৃত্রিম ডগা তৈরি করেন এবং গিটার বাজানো চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্ট্রিং-এর ওপর চাপ কমানোর জন্য গিটারের তারগুলোকে ঢিলা করে দেন। অর্থাৎ, তিনি গিটারকে স্ট্যান্ডার্ড টিউনের (Standard E-A-D-G-B-E) চেয়ে নিচু স্কেলে টিউন (Detune) করতেন। এর ফলে গিটার থেকে এক ধরনের ভীষণ ভারী, অন্ধকার এবং অশুভ শব্দ বের হতো। এই শব্দটিই হয়ে ওঠে মেটালের ট্রেডমার্ক সাউন্ড। এটি ছিল একটি দুর্ঘটনা থেকে জন্ম নেওয়া এক যুগান্তকারী আবিষ্কার (Christe, 2003)।
তাদের প্রথম অ্যালবামের (১৯৭০) প্রথম গান ‘Black Sabbath’-এর কথাই ধরা যাক। গানটি শুরু হয় বৃষ্টির শব্দের সাথে একটি গির্জার ঘণ্টার শব্দ দিয়ে। এরপর বেজে ওঠে তিনটি নোটের এক ধীর, অশুভ এবং ভারী রিফ। এই তিনটি নোট মিলে যে সুর তৈরি করে, তাকে সঙ্গীতের ভাষায় বলা হয় একটি ট্রাইটোন (Tritone)। এর সুর এতটাই অশুভ এবং বেখাপ্পা যে মধ্যযুগে গির্জার সঙ্গীতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল এবং একে ‘Diabolus in Musica’ বা ‘সঙ্গীতে শয়তান’ (The Devil in Music) বলা হতো। ব্ল্যাক সাবাথ সচেতনভাবেই এই অশুভ শব্দকেই তাদের সঙ্গীতের ভিত্তি বানায়।
তাদের গানের কথায় থাকত যুদ্ধ (‘War Pigs’), পারমাণবিক ধ্বংসের ভয় (‘Electric Funeral’), মাদকাসক্তি (‘Hand of Doom’), মানসিক বিকার (‘Paranoid’), একাকীত্ব এবং সামাজিক সমালোচনার মতো অন্ধকার বিষয়গুলো, যা তখনকার পপ সঙ্গীতের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ভোকালিস্ট ওজি অসবোর্নের (Ozzy Osbourne) ভৌতিক, আর্তনাদের মতো কণ্ঠ, বেসিস্ট গিজার বাটলারের (Geezer Butler) লেখা গভীর এবং অন্ধকার লিরিকস ও তার ভারী বেসলাইন এবং ড্রামার বিল ওয়ার্ডের (Bill Ward) জ্যাজ-প্রভাবিত শক্তিশালী ড্রামিং মিলে তৈরি হয়েছিল এমন এক সঙ্গীত যা আগে কেউ শোনেনি। ব্ল্যাক সাবাথকে ছাড়া মেটাল মিউজিক কল্পনাই করা যায় না। তারাই প্রথম দেখিয়েছিল যে সঙ্গীত কতটা ভারী এবং অন্ধকার হতে পারে।
২. লেড জেপেলিন (Led Zeppelin): শক্তি এবং জাঁকজমক
লেড জেপেলিন ছিল মেটালের কাঁচা শক্তি এবং রক অ্যান্ড রোলের জাঁকজমকের এক অবিশ্বাস্য মিশ্রণ। তারা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় রক ব্যান্ড, কিন্তু তাদের সঙ্গীতের ডিএনএ-তে মেটালের উপাদানগুলো স্পষ্ট ছিল। জিমি পেজের (Jimmy Page) গিটারের কাজ ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ প্রযোজকও। তিনি জানতেন কীভাবে স্টুডিওতে একটি বিশাল এবং মহাকাব্যিক শব্দ তৈরি করতে হয়। তিনি ব্লুজ, ফোক (Folk), সাইকেডেলিক রক এবং আরব্য সুর মিলিয়ে এক নতুন ধরনের হার্ড রক তৈরি করেন।
রবার্ট প্ল্যান্টের (Robert Plant) উচ্চগ্রামের তীব্র, প্রায় মেয়েলি কণ্ঠ রক ভোকালের সংজ্ঞাই পাল্টে দেয়। তার কণ্ঠ ছিল একই সাথে শক্তিশালী এবং আবেগপ্রবণ। জন পল জোনসের (John Paul Jones) বেস এবং কিবোর্ডের বৈচিত্র্য গানগুলোকে এক অন্য মাত্রা দিত। আর সবশেষে, জন বনহ্যাম (John Bonham)। তাকে অনেকেই রক ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ড্রামার বলেন। তার ড্রামিং শুধু শক্তিশালীই ছিল না, ছিল অবিশ্বাস্যভাবে গ্রুপি (Groovy) এবং জটিল। তার ড্রামের শব্দ ছিল বিশাল, যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। তাদের ‘Immigrant Song’-এর তীব্র রিফ এবং প্ল্যান্টের ভাইকিং-চিৎকার, বা ‘Whole Lotta Love’-এর যৌন আবেদনময় ভারী রিফ, অথবা ‘Achilles Last Stand’-এর গ্যালোপিং রিদম – এই সবকিছুই সরাসরি মেটালের ব্লুপ্রিন্ট। রিফ (Riff), অর্থাৎ একটি ছোট, পুনরাবৃত্তিমূলক মিউজিক্যাল প্যাটার্ন যা একটি গানের মূল ভিত্তি তৈরি করে, তাকে জনপ্রিয় করার পেছনে লেড জেপেলিনের অবদান অনস্বীকার্য।
৩. ডিপ পার্পল (Deep Purple): গতি এবং বাদনশৈলী
ডিপ পার্পল মেটাল মিউজিকে নিয়ে আসে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের (Classical Music) প্রভাব এবং virtuosity বা বাদনশৈলীর চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা। তাদের দুজন সদস্য, কিবোর্ডিস্ট জন লর্ড (Jon Lord) এবং গিটারিস্ট রিচি ব্ল্যাকমোর (Ritchie Blackmore), দুজনেই ছিলেন তাদের নিজ নিজ যন্ত্রে অবিশ্বাস্য দক্ষ। জন লর্ড তার হ্যামন্ড অর্গানকে (Hammond Organ) একটি লেসলি স্পিকার (Leslie Speaker) এবং মার্শাল গিটার অ্যামপ্লিফায়ারের (Marshall Amplifier) মধ্যে দিয়ে বাজিয়ে এমন এক বিকৃত এবং আগ্রাসী শব্দ তৈরি করতেন যা গিটারের সাথে পাল্লা দিত।
রিচি ব্ল্যাকমোর ছিলেন একজন টেকনিক্যাল জিনিয়াস। তিনি ক্লাসিক্যাল স্কেল, বিশেষ করে হারমোনিক মাইনর স্কেল (Harmonic Minor Scale) ব্যবহার করে তার সোলোগুলোকে এক নাটকীয় এবং দ্রুত রূপ দিতেন। জন লর্ড এবং রিচি ব্ল্যাকমোরের মধ্যেকার মঞ্চে গিটার এবং অর্গানের সুরের দ্বৈরথ ছিল তাদের লাইভ পারফরম্যান্সের অন্যতম আকর্ষণ। তাদের ‘Highway Star’ বা ‘Speed King’-এর মতো গানে যে প্রচণ্ড গতি এবং টেকনিক্যাল জটিলতা ছিল, তা পরবর্তীকালে স্পিড মেটাল (Speed Metal) এবং পাওয়ার মেটাল (Power Metal) জঁরার জন্ম দেয়। ভোকালিস্ট ইয়ান গিলানের (Ian Gillan) কান ফাটানো উচ্চগ্রামের চিৎকারও (Scream) পরবর্তী প্রজন্মের মেটাল ভোকালিস্টদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। তাদের ‘Smoke on the Water’ গানের রিফটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত গিটার রিফ।
এই “অশুভ ত্রয়ী” মিলে সত্তরের দশকে হার্ড রকের সীমানা প্রসারিত করে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেখান থেকে জন্ম নেয় একটি নতুন, আরও ভারী, আরও দ্রুত এবং আরও আগ্রাসী সঙ্গীত – হেভি মেটাল (Heavy Metal)।
শাখা-প্রশাখার বিস্তার
আশির দশক থেকে মেটাল মিউজিক আর একটিমাত্র জঁরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি একটি বিশাল বটবৃক্ষের মতো ডালপালা মেলতে শুরু করে। জন্ম নেয় অগণিত সাব-জঁরা (Subgenre), প্রত্যেকটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, শব্দ, দর্শন এবং অনুসারী গোষ্ঠী। এই বৈচিত্র্যই মেটালের আসল শক্তি এবং সৌন্দর্য। এটি প্রমাণ করে যে মেটাল কোনো স্থির শিল্প নয়, এটি একটি জীবন্ত সত্তা, যা সময়ের সাথে সাথে নিজেকে ভেঙেছে এবং নতুন করে গড়েছে। চলুন, এর কিছু প্রধান এবং প্রভাবশালী শাখা-প্রশাখা ঘুরে দেখা যাক।
নিউ ওয়েভ অফ ব্রিটিশ হেভি মেটাল (New Wave of British Heavy Metal – NWOBHM)
সত্তরের দশকের শেষে পাঙ্ক রকের (Punk Rock) উত্থানের ফলে লেড জেপেলিন বা ডিপ পার্পলের মতো বড় বড় হার্ড রক ব্যান্ডগুলোর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গিয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন ভারী সঙ্গীতের দিন শেষ। কিন্তু ব্রিটেনের আন্ডারগ্রাউন্ডে (Underground) এক নতুন আন্দোলন নীরবে দানা বাঁধছিল। ব্ল্যাক সাবাথের ভারিত্ত্ব এবং বিষণ্ণতা, ডিপ পার্পলের গতি এবং পাঙ্কের DIY (Do It Yourself – নিজে করো) নীতি ও কাঁচা শক্তিকে মিলিয়ে কিছু তরুণ ব্যান্ড এক নতুন ধরনের শব্দ তৈরি করতে শুরু করে। এই আন্দোলনকেই সঙ্গীত সাংবাদিক জিওফ বার্টন (Geoff Barton) ‘নিউ ওয়েভ অফ ব্রিটিশ হেভি মেটাল’ বা NWOBHM নামে অভিহিত করেন।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুটি নাম হলো জুডাস প্রিস্ট (Judas Priest) এবং আয়রন মেইডেন (Iron Maiden)।
- জুডাস প্রিস্ট (Judas Priest): বার্মিংহামের আর এক সন্তান জুডাস প্রিস্ট সত্তরের দশকেই তাদের কাজ শুরু করলেও, NWOBHM আন্দোলনের সময় তারা তাদের চূড়ান্ত রূপ পায়। তারা মেটালের সাউন্ড এবং ইমেজ – দুটিকেই সংজ্ঞায়িত করে। তারা তাদের সঙ্গীতে দুটি লিড গিটার (Twin-lead guitar) ব্যবহার করে এক মেলোডিক কিন্তু আগ্রাসী শব্দ তৈরি করে। কে. কে. ডাউনিং (K. K. Downing) এবং গ্লেন টিপটনের (Glenn Tipton) গিটারের যুগলবন্দী ছিল অসাধারণ। তাদের ভোকালিস্ট রব হ্যালফোর্ড (Rob Halford) ছিলেন এক অবিশ্বাস্য প্রতিভা, যার কণ্ঠের পাল্লা (Vocal Range) চারটি অক্টেভ (Octave) ছাড়িয়ে যেত। তিনি যেমন দরাজ গলায় গান গাইতে পারতেন, তেমনি পারতেন কাঁচ ভাঙা চিৎকার করতে। তারাই প্রথম মেটালের সাথে লেদার (চামড়া), মেটাল স্টাড (Metal Studs) এবং মোটরসাইকেলের সংস্কৃতিকে যুক্ত করে। এই ‘লেদার অ্যান্ড স্টাডস’ লুকই পরবর্তীকালে মেটাল ফ্যাশনের সমার্থক হয়ে ওঠে (Walser, 1993)।
- আয়রন মেইডেন (Iron Maiden): এই ব্যান্ডটি NWOBHM-কে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গীত ছিল মহাকাব্যিক। বেসিস্ট এবং মূল গীতিকার স্টিভ হ্যারিসের (Steve Harris) ট্রেডমার্ক গ্যালোপিং বেসলাইন (Galloping Bassline), যা অনেকটা দৌড়ানো ঘোড়ার খুরের শব্দের মতো, তাদের গানে এক অদ্ভুত গতি এবং শক্তি সঞ্চার করত। তাদের গানের গঠন ছিল জটিল এবং দীর্ঘ। গানের কথায় থাকত ইতিহাস (‘The Trooper’), সাহিত্য (‘Rime of the Ancient Mariner’) এবং পৌরাণিক গল্পের (‘Flight of Icarus’) ওপর ভিত্তি করে লেখা গল্প। ভোকালিস্ট ব্রুস ডিকিনসনের (Bruce Dickinson) শক্তিশালী, প্রায় অপেরার মতো কণ্ঠ এবং মঞ্চে তার অফুরন্ত শক্তি ব্যান্ডটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। তাদের ম্যাসকট ‘এডি’ (Eddie the Head) তাদের প্রতিটি অ্যালবামের প্রচ্ছদে এবং মঞ্চে উপস্থিত থাকত। এটা মেটাল সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। শিল্পী ডেরেক রিগসের (Derek Riggs) আঁকা এই প্রচ্ছদগুলো ছিল শিল্পের এক একটি নমুনা।
এই দুটি ব্যান্ড ছাড়াও স্যাক্সন (Saxon), ডায়মন্ড হেড (Diamond Head), অ্যাঞ্জেল উইচ (Angel Witch) এবং মটরহেড (Motörhead)-এর মতো ব্যান্ডগুলো NWOBHM-কে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। মটরহেড, বিশেষ করে, তাদের গতি, কর্কশ শব্দ এবং পাঙ্ক মনোভাবের জন্য পরবর্তীকালে থ্র্যাশ মেটালের অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তাদের নেতা লেমি কিলমিস্টার (Lemmy Kilmister) ছিলেন রক অ্যান্ড রোলের মূর্ত প্রতীক।
থ্র্যাশ মেটাল (Thrash Metal): গতির দানব
আশির দশকের শুরুতে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার বে এরিয়াতে (Bay Area), NWOBHM-এর গতি এবং টেকনিক্যাল দক্ষতা এবং হার্ডকোর পাঙ্কের (Hardcore Punk) সামাজিক সচেতনতা ও কাঁচা আগ্রাসন মিলে জন্ম নেয় এক নতুন, আরও দ্রুত এবং আরও হিংস্র জঁরা – থ্র্যাশ মেটাল। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রচণ্ড গতি, জটিল এবং দ্রুত পাম-মিউটেড (Palm-muted) গিটার রিফ, আগ্রাসী ড্রামিং (বিশেষ করে ডাবল বেস ড্রাম), এবং প্রায়শই চিৎকার করে গাওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতামূলক গানের কথা।
থ্র্যাশ মেটালের “বিগ ফোর” (The Big Four) হিসেবে চারটি ব্যান্ডকে গণ্য করা হয়, যারা এই জঁরাকে সংজ্ঞায়িত এবং জনপ্রিয় করেছে:
- মেটালিকা (Metallica): থ্র্যাশ মেটালকে মূলধারায় নিয়ে আসার সবচেয়ে বড় কারিগর। তাদের প্রথম দিকের অ্যালবাম, যেমন ‘Kill ‘Em All’ (১৯৮৩), ‘Ride the Lightning’ (১৯৮৪) বা ‘Master of Puppets’ (১৯৮৬), থ্র্যাশের বাইবেল হিসেবে পরিচিত। জেমস হেটফিল্ডের (James Hetfield) অবিশ্বাস্য নিখুঁত এবং দ্রুত ডাউন-পিকিং (Down-picking) রিফ এবং লার্স উলরিখের (Lars Ulrich) ড্রামিং এক নতুন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে। তাদের গানে গতি এবং আগ্রাসনের পাশাপাশি মেলোডি এবং জটিল সঙ্গীত কাঠামোরও উপস্থিতি ছিল।
- স্লেয়ার (Slayer): থ্র্যাশের সবচেয়ে আগ্রাসী, দ্রুততম এবং অন্ধকার রূপ। তাদের সঙ্গীতে ছিল চরম বিশৃঙ্খলা, ডিসসোনেন্ট (Dissonant) গিটার সোলো এবং যুদ্ধ, মৃত্যু, সিরিয়াল কিলার এবং স্যাটানিজম নিয়ে লেখা বিতর্কিত গানের কথা। কেরি কিং (Kerry King) এবং জেফ হ্যানিম্যানের (Jeff Hanneman) গিটারের কাজ এবং ডেভ লম্বার্ডোর (Dave Lombardo) অবিশ্বাস্য দ্রুত ড্রামিং ছিল দুঃস্বপ্নের মতো তীব্র। তাদের অ্যালবাম ‘Reign in Blood’ (১৯৮৬) মাত্র ২৮ মিনিটের, কিন্তু এটি এক্সট্রিম মেটালের (Extreme Metal) ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
- মেগাডেথ (Megadeth): মেটালিকা থেকে বের করে দেওয়া গিটারিস্ট এবং ভোকালিস্ট ডেভ মাস্টেইনের (Dave Mustaine) মস্তিষ্কপ্রসূত এই ব্যান্ডটি ছিল টেকনিক্যালি অত্যন্ত জটিল এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন। মাস্টেইনের গিটার বাজানোর দক্ষতা কিংবদন্তিতুল্য এবং তার গানের কথায় থাকত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory), যুদ্ধ এবং সরকারের সমালোচনা। তাদের সঙ্গীত ছিল থ্র্যাশের মধ্যেও সবচেয়ে পরিশীলিত এবং জটিল।
- অ্যানথ্রাক্স (Anthrax): নিউ ইয়র্কের এই ব্যান্ডটি থ্র্যাশের সাথে হার্ডকোর পাঙ্ক এবং হিপ-হপের উপাদানও মেশায়। তাদের সঙ্গীতে এক ধরনের রসিকতা এবং কমিক বইয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখা যেত, যা অন্য থ্র্যাশ ব্যান্ডদের থেকে তাদের আলাদা করে। তারাই প্রথম কোনো মেটাল ব্যান্ড যারা র্যাপ গ্রুপ পাবলিক এনিমির (Public Enemy) সাথে গান করে (‘Bring the Noise’)।
থ্র্যাশ মেটাল শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জার্মানির ‘বিগ ফোর’ বা টিউটনিক থ্র্যাশ (Teutonic Thrash) – ক্রিয়েটর (Kreator), সোডম (Sodom), ডেস্ট্রাকশন (Destruction) এবং ট্যাংকার্ড (Tankard) – আমেরিকান থ্র্যাশের চেয়েও বেশি হিংস্র এবং কাঁচা শব্দ তৈরি করে। ব্রাজিলের সেপালচুরা (Sepultura) তাদের আদিবাসী সংস্কৃতিকে থ্র্যাশের সাথে মিশিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
গ্ল্যাম মেটাল (Glam Metal): জাঁকজমক এবং পার্টি
থ্র্যাশের আগ্রাসনের ঠিক বিপরীত দিকে ছিল গ্ল্যাম মেটাল বা হেয়ার মেটাল (Hair Metal)। আশির দশকে লস অ্যাঞ্জেলেসের সানসেট স্ট্রিপ (Sunset Strip) থেকে এর উত্থান। এই জঁরাটি পপ সঙ্গীতের আকর্ষণীয় মেলোডি এবং হার্ড রকের শক্তিকে একত্রিত করে। এর মূল আকর্ষণ ছিল আকর্ষণীয় এবং সহজে মনে রাখার মতো গিটার রিফ, কোরাসের সাথে গাওয়ার মতো গান (Anthemic Chorus) এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জাঁকজমকপূর্ণ চেহারা। ব্যান্ড সদস্যরা লম্বা চুল ফুলিয়ে (Hairspray-এর ব্যাপক ব্যবহারে), মেকআপ করে এবং রঙিন, আঁটসাঁট পোশাক পরে মঞ্চে আসত। গানের কথায় থাকত মূলত পার্টি, নারী, প্রেম এবং উদ্দাম জীবনযাপনের গল্প। মটলি ক্রু (Mötley Crüe), পয়জন (Poison), বন জোভি (Bon Jovi), ডেফ লেপার্ড (Def Leppard) ছিল এই ধারার সবচেয়ে সফল ব্যান্ড। আশির দশকে এমটিভির (MTV) দৌলতে গ্ল্যাম মেটাল বাণিজ্যিকভাবে মেটালের সবচেয়ে সফল সাব-জঁরা হয়ে ওঠে। যদিও অনেক গোঁড়া মেটালহেডরা তাদের ‘পোজার’ (Poser) বা নকল বলে মনে করত, তাদের সঙ্গীত কোটি কোটি মানুষের কাছে মেটালকে পৌঁছে দিয়েছিল।
ডেথ মেটাল (Death Metal): মৃত্যুর সঙ্গীত
থ্র্যাশ মেটালের চরমপন্থী রূপ হলো ডেথ মেটাল। ফ্লোরিডা এবং সুইডেনে আশির দশকের মাঝামাঝি এর জন্ম। স্লেয়ার, ক্রিয়েটর এবং পোস্টার চাইল্ড পসেসড (Possessed)-এর মতো ব্যান্ডের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু ব্যান্ড সঙ্গীতকে আরও এক ধাপ নিচে, আরও গভীরে নিয়ে যায়। এর বৈশিষ্ট্য হলো:
- গিটার: অত্যন্ত বিকৃত (Heavily distorted) এবং নিচু স্কেলে টিউন করা গিটার। প্রায়শই ট্রেমোলো পিকিং (Tremolo picking) এবং জটিল রিফের ব্যবহার।
- ড্রামস: প্রচণ্ড দ্রুত ড্রামিং, বিশেষ করে ব্লাস্ট বিট (Blast Beat – ড্রামস এবং স্নেয়ারের অত্যন্ত দ্রুত, একটানা বাজনা), যা সঙ্গীতে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।
- ভোকাল: গলার গভীর থেকে আসা গর্জন বা গ্রোল (Growl) ভোকাল। এই ভোকাল স্টাইল গানের কথাকে প্রায় দুর্বোধ্য করে তোলে, কিন্তু এটি সঙ্গীতের হিংস্রতার সাথে পুরোপুরি মানানসই।
- লিরিকস: গানের কথায় থাকে মৃত্যু, শারীরিক বিকৃতি (Gore), জম্বি, ভায়োলেন্স এবং মানব অস্তিত্বের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে গ্রাফিক বর্ণনা।
ফ্লোরিডার ডেথ (Death) ব্যান্ডকে এই জঁরার পথিকৃৎ বলা হয়। তাদের নেতা চাক শুলডিনার (Chuck Schuldiner), যিনি ‘ডেথ মেটালের জনক’ হিসেবে পরিচিত, ছিলেন একজন প্রতিভাবান গিটারিস্ট এবং গীতিকার। তার গানের গঠন এবং লিরিক সময়ের সাথে সাথে আরও দার্শনিক এবং জটিল হতে থাকে, যা ডেথ মেটালকে শুধু হিংস্রতা থেকে শৈল্পিক উচ্চতায় নিয়ে যায়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যান্ডের মধ্যে আছে ফ্লোরিডার মরবিড অ্যাঞ্জেল (Morbid Angel), অবিচুয়ারি (Obituary), ক্যানিবাল করপস (Cannibal Corpse) এবং সুইডেনের এনটুমবড (Entombed) ও ডিসমেম্বার (Dismember)। সুইডিশ ডেথ মেটালের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের গিটার টোন, যা বস (Boss HM-2) প্যাডেলের সব নব সর্বোচ্চতে রেখে তৈরি করা হতো, একে ‘বাজ-স’ (Buzz-saw) সাউন্ড বলা হয়।
ব্ল্যাক মেটাল (Black Metal): শীতল অন্ধকার
মেটালের সবচেয়ে বিতর্কিত, রহস্যময় এবং চরমপন্থী শাখা হলো ব্ল্যাক মেটাল। এর জন্ম আশির দশকে, ইংল্যান্ডের ভেনম (Venom), সুইডেনের বাথোরি (Bathory) এবং সুইজারল্যান্ডের সেল্টিক ফ্রস্ট (Celtic Frost)-এর হাত ধরে। ভেনমই প্রথম তাদের একটি অ্যালবামের নাম ‘Black Metal’ (১৯৮২) রেখে এই টার্মটি তৈরি করে। তাদের সঙ্গীত ছিল কাঁচা, শয়তানি থিমযুক্ত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপভাবে বাজানো। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নরওয়েতে ব্ল্যাক মেটাল এক ভিন্ন এবং কুখ্যাত রূপ ধারণ করে, যা ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ (Second Wave) নামে পরিচিত।
নরওয়ের ব্ল্যাক মেটালের বৈশিষ্ট্য ছিল:
- প্রোডাকশন: ইচ্ছাকৃতভাবে কাঁচা এবং নিম্নমানের প্রোডাকশন (Raw and lo-fi production)। এটি ছিল সেই সময়ের ডেথ মেটালের পরিষ্কার প্রোডাকশনের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ।
- গিটার: অত্যন্ত দ্রুত, পুনরাবৃত্তিমূলক ট্রেমোলো পিকিং (Tremolo Picking) যা এক ধরনের সম্মোহনী, প্রাচীরের মতো শব্দ তৈরি করে। গিটারের শব্দে বেস (Bass) প্রায় থাকত না, পুরোটাই ছিল ট্রেব্ল (Treble) প্রধান।
- ভোকাল: তীক্ষ্ণ, যন্ত্রণাদায়ক চিৎকার বা শ্রিক (Shriek)।
- আবহ: এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এক ধরনের ঠান্ডা, অশুভ, বিষণ্ণ এবং মহাজাগতিক আবহ (Atmosphere) তৈরি করা, যা নরওয়ের শীতের দীর্ঘ, অন্ধকার রাতের প্রতিচ্ছবি।
- লিরিকস: গানের কথায় থাকত প্রকৃতি, শীত, জঙ্গল, নরওয়ের পৌত্তলিকতা (Paganism), মিথোলজি, মানববিদ্বেষ (Misanthropy) এবং স্যাটানিজম।
এই ধারার অগ্রদূত ছিল মেহেম (Mayhem), ডার্কথ্রোন (Darkthrone), বারজাম (Burzum), এম্পেরর (Emperor) এবং ইমমর্টাল (Immortal)। নরওয়ের ব্ল্যাক মেটাল দৃশ্যটি কেবল সঙ্গীতের জন্য নয়, বরং গির্জা পোড়ানো, আত্মহত্যা এবং খুনের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্যও কুখ্যাতি অর্জন করে, যা মেটাল মিউজিকের ওপর এক কালো দাগ ফেলে দেয় (Moynihan & Søderlind, 2003)। তবে এই বিতর্কের বাইরেও, ব্ল্যাক মেটাল এক অত্যন্ত শৈল্পিক এবং প্রভাবশালী জঁরা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে, যা থেকে পরে সিমফোনিক ব্ল্যাক মেটাল, অ্যাটমোস্ফিয়ারিক ব্ল্যাক মেটাল এবং পোস্ট-ব্ল্যাক মেটালের মতো অসংখ্য শাখার জন্ম হয়েছে।
ডুম মেটাল (Doom Metal): ধীরগতির বিষাদ
যেখানে অন্যান্য মেটাল জঁরা গতি এবং আগ্রাসনের দিকে ঝুঁকেছিল, সেখানে ডুম মেটাল ঠিক তার উল্টো পথে হাঁটে। এর একমাত্র অনুপ্রেরণা হলো ব্ল্যাক সাবাথের ধীর, ভারী এবং বিষণ্ণ সঙ্গীত। ডুম মেটালের মূল বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত ধীর গতি (Tempo), ভারী এবং দীর্ঘস্থায়ী গিটার রিফ, পরিষ্কার কিন্তু বিষাদময় বা মহাকাব্যিক ভোকাল এবং গানের কথায় হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণা এবং মানব অস্তিত্বের ভার নিয়ে আলোচনা। আমেরিকার পেন্টাগ্রাম (Pentagram) ও সেন্ট ভাইটাস (Saint Vitus), সুইডেনের ক্যান্ডেলমাস (Candlemass) এবং ইংল্যান্ডের ক্যাথেড্রাল (Cathedral) এই জঁরার পথিকৃৎ। পরবর্তীকালে এর থেকে এপিক ডুম, ফিউনারেল ডুম (Funeral Doom) এবং স্টোনার ডুম (Stoner Doom)-এর মতো আরও ধীর এবং ভারী শাখার জন্ম হয়।
পাওয়ার মেটাল (Power Metal): আশার জয়গান
ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে পাওয়ার মেটাল অত্যন্ত জনপ্রিয়। NWOBHM-এর মেলোডি এবং স্পিড মেটালের গতিকে মিলিয়ে এই জঁরার জন্ম। এর বৈশিষ্ট্য হলো পরিষ্কার এবং অত্যন্ত উচ্চগ্রামের ভোকাল, দ্রুত এবং অত্যন্ত মেলোডিক গিটার সোলো, প্রায়ই ডাবল-বেস ড্রামিং এবং ফ্যান্টাসি-থিমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি কিবোর্ডের ব্যবহার। গানের কথায় থাকে ড্রাগন, তলোয়ার, জাদু, পৌরাণিক কাহিনী এবং সর্বোপরি, আশা ও বিজয়ের গল্প। এটি মেটালের সবচেয়ে ইতিবাচক এবং আনন্দদায়ক শাখা। জার্মানির হ্যালোইন (Helloween)-কে পাওয়ার মেটালের জনক বলা হয়। তাদের ‘Keeper of the Seven Keys’ অ্যালবাম দুটি এই জঁরার ভিত্তি স্থাপন করে। ব্লাইন্ড গার্ডিয়ান (Blind Guardian), স্ট্রাটোভ্যারিয়াস (Stratovarius), হ্যামারফল (HammerFall) এবং ড্রাগনফোর্স (DragonForce) এই জঁরার অন্যান্য জনপ্রিয় ব্যান্ড।
প্রগ্রেসিভ মেটাল (Progressive Metal): মস্তিষ্কের ব্যায়াম
সত্তরের দশকের প্রগ্রেসিভ রক (Progressive Rock) ব্যান্ড যেমন রাশ (Rush), পিঙ্ক ফ্লয়েড (Pink Floyd) বা কিং ক্রিমসন (King Crimson)-এর জটিল সঙ্গীত কাঠামো এবং পরীক্ষামূলক মনোভাবের সাথে মেটালের ভারী শব্দের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে প্রগ্রেসিভ মেটাল বা প্রগ মেটাল (Prog Metal)। এর বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘ এবং বহুমাত্রিক গানের গঠন, অস্বাভাবিক এবং পরিবর্তনশীল টাইম সিগনেচার (Unusual and Shifting Time Signature), অবিশ্বাস্য টেকনিক্যাল বাদনশৈলী এবং গভীর দার্শনিক বা কনসেপচুয়াল (Conceptual) গানের কথা। আমেরিকার ড্রিম থিয়েটার (Dream Theater) এই জঁরার সবচেয়ে পরিচিত নাম। তাদের সদস্যদের অবিশ্বাস্য বাদন দক্ষতা এবং জটিল সঙ্গীত প্রগ মেটালকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। সুইডেনের অপার্থ (Opeth) ডেথ মেটালের হিংস্রতার সাথে অ্যাকোস্টিক গিটারের শান্ত সৌন্দর্যকে মিশিয়ে এক নতুন ধরনের প্রগ মেটাল তৈরি করেছে। টুল (Tool), পোরকুপাইন ট্রি (Porcupine Tree) এবং ফেটস ওয়ার্নিং (Fates Warning) এই ধারার অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যান্ড।
গ্রুভ মেটাল (Groove Metal): খাঁজকাটা ভারিত্ব
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে থ্র্যাশ মেটালের গতি কিছুটা কমিয়ে এবং রিফের মধ্যে এক ধরনের মধ্য-লয়ের খাঁজ বা গ্রুভ (Groove) যোগ করে এই জঁরার জন্ম হয়। টেক্সাসের প্যানটেরা (Pantera) এই জঁরার উদ্ভাবক এবং সবচেয়ে বড় নাম। তাদের গিটারিস্ট ডাইমব্যাগ ড্যারেলের (Dimebag Darrell) তীক্ষ্ণ, ভারী এবং গ্রুভি রিফ ও তার ট্রেডমার্ক গিটার টোন ছিল সম্পূর্ণ নতুন। তাদের অ্যালবাম ‘Vulgar Display of Power’ (১৯৯২) এই জঁরার ভিত্তি স্থাপন করে। এক্সহোর্ডার (Exhorder), মেশিন হেড (Machine Head) এবং সেপালচুরা (তাদের ‘Chaos A.D.’ এবং ‘Roots’ অ্যালবামে) গ্রুভ মেটালের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নু মেটাল (Nu Metal) এবং অল্টারনেটিভ মেটাল (Alternative Metal): প্রজন্মের বিদ্রোহ
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি মেটাল এক নতুন দিকে মোড় নেয়, যা অনেক পুরোনো ভক্তদের কাছে বিতর্কিত ছিল। হিপ-হপ, ফাঙ্ক (Funk), গ্রাঞ্জ (Grunge) এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল (Industrial) মিউজিকের সাথে মেটালকে মিশিয়ে জন্ম নেয় নু মেটাল। কর্ন (Korn), লিম্প বিজকিট (Limp Bizkit), সিস্টেম অফ এ ডাউন (System of a Down), স্লিপনট (Slipknot) এবং ডিস্টার্বড (Disturbed) এই ধারার প্রধান ব্যান্ড। কর্ন তাদের সাত-তারের গিটার (Seven-string guitar) এবং অত্যন্ত নিচু টিউনিং দিয়ে এক নতুন ধরনের ভারী, ডিসসোনেন্ট শব্দ তৈরি করে। জোনাথন ডেভিসের (Jonathan Davis) গানে থাকত ব্যক্তিগত ট্রমা এবং মানসিক যন্ত্রণার কথা। লিম্প বিজকিট র্যাপ এবং মেটালকে পুরোপুরি মিশিয়ে দেয়। স্লিপনট তাদের নয় সদস্যের দল, মাস্ক এবং বিশৃঙ্খল লাইভ শো দিয়ে এক ভীতিকর আবহ তৈরি করে। এই জঁরাটি বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সফল হয় এবং এমটিভিতে প্রচুর প্রচার পায়, কিন্তু অনেক গোঁড়া মেটাল ভক্তদের কাছে এটি ‘প্রকৃত মেটাল’ হিসেবে গৃহীত হয়নি এর সরল রিফ এবং হিপ-হপ প্রভাবের কারণে।
একই সময়ে ফেইথ নো মোর (Faith No More), জেন’স অ্যাডিকশন (Jane’s Addiction) বা অ্যালিস ইন চেইনস (Alice in Chains)-এর মতো ব্যান্ডগুলো অল্টারনেটিভ রক এবং মেটালের মিশ্রণে অল্টারনেটিভ মেটাল তৈরি করে, যা নু মেটালের চেয়ে বেশি শৈল্পিক এবং পরীক্ষামূলক ছিল।
আরও কিছু শাখা-প্রশাখা
মেটালের জগৎ এতই বিশাল যে সব শাখা নিয়ে আলোচনা করা প্রায় অসম্ভব। উপরের জঁরাগুলো ছাড়াও আরও অসংখ্য ছোট-বড় শাখা এবং ফিউশন-জঁরা (Fusion Genre) রয়েছে, যেমন:
- সিমফোনিক মেটাল (Symphonic Metal): মেটালের সাথে ক্লাসিক্যাল এবং পূর্ণাঙ্গ অর্কেস্ট্রাল সঙ্গীতের মিশ্রণ। প্রায়শই নারী অপেরা-গায়িকার কণ্ঠ ব্যবহার করা হয়। নাইটউইশ (Nightwish), এপিকা (Epica), থেরিয়ন (Therion)।
- ফোক মেটাল (Folk Metal): মেটালের সাথে বিভিন্ন দেশের লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র (যেমন বাঁশি, বেহালা, ব্যাগপাইপ) এবং সুরের মিশ্রণ। স্কাইক্ল্যাড (Skyclad), এনসিফেরাম (Ensiferum), এলুভেইটি (Eluveitie)।
- গথিক মেটাল (Gothic Metal): ডুম মেটালের বিষণ্ণতার সাথে গথিক রকের (Gothic Rock) অন্ধকার রোমান্টিসিজমের মিশ্রণ। প্রায়শই ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ (Beauty and the Beast) ভোকাল ব্যবহার করা হয়, যেখানে একজন পুরুষ গ্রোলারের সাথে একজন নারী ক্লিন ভোকালিস্ট গান করেন। প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost), মাই ডাইং ব্রাইড (My Dying Bride), ট্রিস্টানিয়া (Tristania)।
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটাল (Industrial Metal): মেটালের সাথে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিকের যান্ত্রিক শব্দ, স্যাম্পল (Sample) এবং ইলেকট্রনিক বিটের মিশ্রণ। মিনিস্ট্রি (Ministry), ফিয়ার ফ্যাক্টরি (Fear Factory), রামস্টাইন (Rammstein)।
- মেটালকোর (Metalcore) এবং ডেথকোর (Deathcore): হার্ডকোর পাঙ্ক এবং এক্সট্রিম মেটালের মিশ্রণ। মেটালকোরে হার্ডকোরের ব্রেকডাউন (Breakdown) এবং মেটালের রিফ ও সোলো থাকে। কিলসুইচ এনগেজ (Killswitch Engage), অ্যাজ আই লে ডাইং (As I Lay Dying)। ডেথকোর হলো ডেথ মেটাল এবং মেটালকোরের আরও হিংস্র সংস্করণ। সুইসাইড সাইলেন্স (Suicide Silence), হোয়াইটচ্যাপেল (Whitechapel)।
এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে যে মেটাল কোনো সংকীর্ণ শিল্প নয়। এটি একটি বিশ্বজনীন ভাষা, যা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সঙ্গীতের ধারা থেকে উপাদান গ্রহণ করে ক্রমাগত নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
একটি মেটাল গানের অ্যানাটমি
একটি মেটাল গানকে কেন এত আলাদা এবং তীব্র শোনায়? এর পেছনের কারিগরি দিকগুলো কী কী? কেন এটি সাধারণ পপ বা রক গান থেকে ভিন্ন? চলুন, একটি মেটাল গানের বিভিন্ন অংশকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখা যাক।
গিটার: মেটালের হৃৎপিণ্ড এবং আত্মা
মেটাল মিউজিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সংজ্ঞায়নকারী বাদ্যযন্ত্র হলো ইলেকট্রিক গিটার। এটি শুধু সুর বা রিদম বাজায় না, এটি নিজেই একটি কণ্ঠস্বর, একটি চরিত্র। মেটাল গিটারের শব্দ তৈরি করার জন্য কিছু বিশেষ কৌশল এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়:
- ডিসটরশন (Distortion) এবং গেইন (Gain): আগেই বলা হয়েছে, এটি গিটারের শব্দকে বিকৃত করে ভারী, কর্কশ এবং দীর্ঘস্থায়ী (Sustain) করে তোলে। অ্যামপ্লিফায়ারের গেইন নব বাড়িয়ে বা ডিসটরশন প্যাডেল ব্যবহার করে এই শব্দ তৈরি করা হয়। মেটালের প্রায় সব গানেই ডিসটরশন একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি গিটারের শব্দকে একটি মসৃণ, পরিষ্কার স্বর থেকে একটি দাঁতালো, আগ্রাসী গর্জনে রূপান্তরিত করে।
- রিফ (Riff): মেটাল গানগুলো মূলত রিফের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। একটি ভালো, আকর্ষণীয় রিফ একটি পুরো গানকে টেনে নিয়ে যেতে পারে এবং শ্রোতার মাথায় গেঁথে যেতে পারে। ব্ল্যাক সাবাথের ‘Iron Man’, ডিপ পার্পলের ‘Smoke on the Water’বা মেটালিকার ‘Enter Sandman’-এর রিফ শুনলেই বোঝা যায় এর শক্তি কতটা।
- পাওয়ার কর্ড (Power Chord): এটি একটি দুই-নোটের (মূল নোট এবং পঞ্চম নোট) বা তিন-নোটের (মূল, পঞ্চম এবং অক্টেভ) সহজ কর্ড। এর মধ্যে কোনো মেজর বা মাইনর থার্ড (Third) না থাকায় এটি ডিসটরশনের সাথে খুব শক্তিশালী, পরিষ্কার এবং অস্পষ্টতাহীন শোনায়। রক এবং মেটালের এটি একটি মৌলিক বিল্ডিং ব্লক।
- পাম মিউটিং (Palm Muting): গিটারের তারগুলোকে ব্রিজ (Bridge)-এর কাছে হাতের তালুর পাশ দিয়ে হালকা করে চেপে ধরে বাজালে এক ধরনের ভারী, ঠুক ঠুক এবং পারকাসিভ (Percussive) শব্দ তৈরি হয়। থ্র্যাশ এবং ডেথ মেটালের দ্রুত এবং নিখুঁত রিফ বাজানোর জন্য এই কৌশলটি অপরিহার্য। এটি রিফকে এক ধরনের আঁটোসাঁটো এবং নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন দেয়।
- গিটার সোলো (Guitar Solo): মেটাল গানে গিটার সোলো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে গিটারিস্ট তার টেকনিক্যাল দক্ষতা, গতি এবং শৈল্পিকতা প্রদর্শনের সুযোগ পায়। র্যান্ডি রোডস (Randy Rhoads), ইংভি মালমস্টিন (Yngwie Malmsteen), জন পেট্রুচি (John Petrucci) বা জেফ লুমিস (Jeff Loomis)-এর মতো গিটারিস্টরা সোলোকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। দ্রুত স্কেল বাজানো (Shredding), সুইপ পিকিং (Sweep Picking), ট্যাপিং (Tapping), ডাইভ বম্ব (Dive Bomb)-এর মতো বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে তারা অবিশ্বাস্য সোলো তৈরি করেন।
- ডাউন-টিউনিং (Down-tuning) এবং বর্ধিত পরিসরের গিটার (Extended Range Guitars): ব্ল্যাক সাবাথের টনি আইওমি দুর্ঘটনাবশত যা শুরু করেছিলেন, তা এখন একটি সাধারণ কৌশল। গিটারের তারগুলোকে স্ট্যান্ডার্ডের (E Standard) চেয়ে নিচু স্কেলে (যেমন ড্রপ ডি, ডি স্ট্যান্ডার্ড, সি স্ট্যান্ডার্ড) টিউন করলে আরও ভারী, গভীর এবং অন্ধকার শব্দ পাওয়া যায়। ডেথ মেটাল, ডুম মেটাল বা নু মেটালে এটি খুব সাধারণ। কর্ন (Korn) বা মেশুগাহ (Meshuggah)-এর মতো ব্যান্ডগুলো আরও এক ধাপ এগিয়ে সাত-তারের (Seven-string) এবং আট-তারের (Eight-string) গিটার ব্যবহার শুরু করে, যা তাদের আরও নিচু এবং ভারী নোট বাজানোর সুযোগ করে দেয়।
- টুইন-লিড গিটার (Twin-Lead Guitar): জুডাস প্রিস্ট এবং আয়রন মেইডেনের মতো ব্যান্ডগুলো দ্বারা জনপ্রিয় এই কৌশলে দুজন গিটারিস্ট একসাথে ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সম্পর্কিত মেলোডি বা সোলো বাজান, যা এক ধরনের সমৃদ্ধ এবং মহাকাব্যিক শব্দ তৈরি করে।
ড্রামস: চালিকাশক্তি এবং বজ্রধ্বনি
মেটাল ড্রামিং শুধু তাল রাখার জন্য নয়, এটি নিজেই একটি আগ্রাসী শক্তি যা গানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।
- ডাবল বেস ড্রামিং (Double Bass Drumming): মেটাল ড্রামিংয়ের একটি ট্রেডমার্ক কৌশল। ড্রামার দুটি বেস ড্রাম (Bass Drum) বা একটি বেস ড্রামের জন্য দুটি প্যাডেল (Double Pedal) ব্যবহার করে পায়ে দিয়ে দ্রুত এবং একটানা ১৬তম নোট বা ৩২তম নোটের বিট তৈরি করেন। এটি গানে এক ধরনের মেশিন গানের মতো নিরবচ্ছিন্ন শক্তি যোগ করে। ডেভ লম্বার্ডো (Slayer), জিন হগলান (Gene Hoglan), টমাস লাং (Thomas Lang)-এর মতো ড্রামাররা এই কৌশলকে অবিশ্বাস্য গতি এবং সৃজনশীলতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
- ব্লাস্ট বিট (Blast Beat): এক্সট্রিম মেটালে (Extreme Metal) ব্যবহৃত একটি অত্যন্ত দ্রুত ড্রামিং প্যাটার্ন। সাধারণত, বেস ড্রাম এবং স্নেয়ার ড্রাম একসাথে খুব দ্রুত বাজানো হয়, এবং হাই-হ্যাট বা রাইড সিম্বাল সেই গতিকে দ্বিগুণ করে। এটি গানে এক ধরনের চরম বিশৃঙ্খল গতি এবং তীব্রতার প্রাচীর (Wall of intensity) সঞ্চার করে।
- জটিল ফিল (Complex Fills) এবং পলি-রিদম (Polyrhythms): প্রগ্রেসিভ মেটালের ড্রামাররা প্রায়শই জটিল ড্রাম ফিল এবং পলি-রিদম (একই সাথে দুটি ভিন্ন রিদম বাজানো) ব্যবহার করেন, যা গানকে আরও মস্তিষ্ক-উদ্দীপক এবং অপ্রত্যাশিত করে তোলে। মেটালিকার লার্স উলরিখ বা ড্রিম থিয়েটারের মাইক পোর্টনয় (Mike Portnoy) তাদের সৃজনশীল ড্রামিংয়ের জন্য বিখ্যাত।
বেস গিটার (Bass Guitar): অদৃশ্য মেরুদণ্ড
অনেকের কাছে মেটাল গানে গিটারের তীব্র শব্দের নিচে বেস গিটার শোনা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এটি গানের অদৃশ্য মেরুদণ্ড। বেস গিটার সাধারণত গিটারের রিফকে অনুসরণ করে এবং ড্রামের সাথে মিলে গানের ছন্দবদ্ধ এবং হারমোনিক ভিত্তি তৈরি করে। একটি ভালো বেসলাইন গানকে আরও গভীর, পূর্ণাঙ্গ এবং ভারী করে তোলে। স্টিভ হ্যারিস (Iron Maiden) তার গ্যালোপিং বেসলাইন দিয়ে প্রায়শই লিড যন্ত্রের মতো কাজ করেন। ক্লিফ বার্টন (Cliff Burton, ex-Metallica) তার বেস গিটারে ডিসটরশন এবং ওয়াহ-প্যাডেল (Wah-pedal) ব্যবহার করে সোলো বাজাতেন। জাস্টিন চ্যান্সেলর (Tool) বা অ্যালেক্স ওয়েবস্টার (Cannibal Corpse)-এর মতো বেসিস্টরা দেখিয়েছেন যে বেস গিটার কতটা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
ভোকাল (Vocals): আবেগের চরম বহিঃপ্রকাশ
মেটাল ভোকালের বৈচিত্র্য বিশাল এবং এটি প্রায়শই জঁরা নির্ধারণে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এটি শুধু চিৎকার নয়, এটি একটি নিয়ন্ত্রিত এবং অত্যন্ত কঠিন কৌশল (Hart, 2013)।
- ক্লিন ভোকাল (Clean Vocals): সাধারণ, সুর করে গাওয়া। কিন্তু মেটালে এই ক্লিন ভোকালও অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উচ্চ পরিসরের হয়। রনি জেমস ডিও (Ronnie James Dio), ব্রুস ডিকিনসন (Iron Maiden) বা মাইকেল কিসকে (Michael Kiske, Helloween) এর সেরা উদাহরণ।
- গ্রোল (Growl) বা ডেথ গ্রোল (Death Growl): ডেথ মেটালে ব্যবহৃত গভীর, পৈশাচিক গর্জন। এটি কণ্ঠনালী থেকে নয়, বরং ডায়াফ্রাম (Diaphragm) এবং ফলস কর্ড (False Cords) ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রিতভাবে তৈরি করা হয়। ভুলভাবে করলে গলার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। চাক শুলডিনার (Death) বা জর্জ ‘করপসগ্রাইন্ডার’ ফিশার (Cannibal Corpse) এই স্টাইলের জন্য পরিচিত।
- শ্রিক (Shriek): ব্ল্যাক মেটালে ব্যবহৃত তীক্ষ্ণ, যন্ত্রণাদায়ক, আর্তনাদের মতো চিৎকার। এটি গ্রোলের চেয়ে উচ্চ পিচের এবং আরও কাঁচা শোনায়।
- স্ক্রিম (Scream): মেটালকোর বা থ্র্যাশে ব্যবহৃত আগ্রাসী চিৎকার, যা গ্রোলের মতো গভীর নয় আবার শ্রিকের মতো তীক্ষ্ণও নয়।
- মিক্সড ভোকাল (Mixed Vocals): অনেক ব্যান্ড, বিশেষ করে প্রগ্রেসিভ বা গথিক মেটালে, একই গানে ক্লিন এবং এক্সট্রিম ভোকালের মিশ্রণ ঘটায়, যা গানে বৈপরীত্য এবং নাটকীয়তা তৈরি করে। অপার্থের (Opeth) মাইকেল অ্যাকারফেল্ট (Mikael Åkerfeldt) এর একজন মাস্টার।
গানের কাঠামো এবং প্রযোজনা (Song Structure and Production)
সাধারণ পপ গানের মতো মেটাল গান প্রায়শই সরল Verse-Chorus-Verse-Chorus কাঠামো অনুসরণ করে না। বিশেষ করে প্রগ্রেসিভ, ডেথ বা ব্ল্যাক মেটালে গানগুলো দীর্ঘ এবং বিভিন্ন মুড ও টেম্পোর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। একটি ১২ মিনিটের গান হয়তো কোনো পুনরাবৃত্তি ছাড়াই এগিয়ে যেতে পারে, যা অনেকটা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের কম্পোজিশনের মতো।
প্রোডাকশনও জঁরাভেদে ভিন্ন হয়। গ্ল্যাম মেটাল বা পাওয়ার মেটালের প্রোডাকশন খুব পরিষ্কার, পালিশ করা এবং রেডিও-ফ্রেন্ডলি হয়। অন্যদিকে, আর্লি ব্ল্যাক মেটালের ব্যান্ডগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে লো-ফাই (Lo-fi) বা নিম্নমানের প্রোডাকশন ব্যবহার করত একটি কাঁচা এবং অকৃত্রিম আবহ তৈরির জন্য। আবার, আধুনিক ডেথ মেটাল বা প্রগ্রেসিভ মেটালের প্রোডাকশন অত্যন্ত নিখুঁত এবং শক্তিশালী হয়, যেখানে প্রতিটি যন্ত্রের শব্দ পরিষ্কারভাবে শোনা যায়।
এই সমস্ত উপাদান একসাথে মিলে একটি মেটাল গানকে তার স্বতন্ত্র, শক্তিশালী এবং জটিল রূপ দেয়। এটি এমন এক সঙ্গীত যা শুধু শোনার নয়, অনুভব করার।
মেটালের দর্শন: যে ভাঙচুর আর চিন্তার গর্ভে জন্ম নিল এক গোলমেলে শিল্প
আগের লেখাটায় আমরা মেটালের শরীরটাকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখেছিলাম। তার গিটার, ড্রামস, ভোকাল – এইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু শরীরের ভেতরে যেমন একটা মন বা আত্মা থাকে, তেমনি মেটালের এই তীব্র, গোলমেলে শব্দের পেছনেও একটা দর্শন আছে। একটা চিন্তার কাঠামো আছে যা এই শিল্পকে ধরে রাখে। এই দর্শন আকাশ থেকে পড়েনি। এর জন্ম হয়েছে বিশেষ কিছু ঐতিহাসিক ভাঙচুর, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কিছু আগুনখোর দার্শনিকের চিন্তার গর্ভে।
মেটাল মিউজিক শুধু বিদ্রোহের সঙ্গীত নয়, এটি কেন বিদ্রোহ করতে হবে, সেই প্রশ্নটিও করে। এটি শুধু অন্ধকারের কথা বলে না, অন্ধকার কেন এত আকর্ষণীয়, সেই কারণও খোঁজে। চলুন, এবার আমরা মেটালের সেই মন বা আত্মার ব্যবচ্ছেদ করি। খুঁজে দেখি কোন কোন ঐতিহাসিক ক্ষত এবং কোন কোন দার্শনিকের হাতুড়ির ঘা এই অদ্ভুত সুন্দর কঙ্কালটি তৈরি করেছে।
ইতিহাস ও ভাঙচুরের প্রতিধ্বনি
সঙ্গীত তার সময়কে ধারণ করে। চারপাশের রাজনৈতিক আবহাওয়া, সামাজিক হতাশা আর ভাঙনের শব্দ – সবই কোনো না কোনোভাবে সুরের ভেতর ঢুকে পড়ে। মেটালের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময়টা ছিল পৃথিবীর জন্য এক অস্থির সময়। সেই অস্থিরতার প্রতিধ্বনিই মেটালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ (The Vietnam War) ও মোহভঙ্গের প্রজন্ম
ষাটের দশকের আমেরিকা ছিল এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের দেশ। একদিকে ছিল ‘আমেরিকান ড্রিম’ (American Dream)-এর রঙিন বিজ্ঞাপন, অন্যদিকে ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের কর্দমাক্ত বাস্তবতা। টেলিভিশনের পর্দায় যখন প্রথম কোনো যুদ্ধকে এত কাছ থেকে দেখানো শুরু হলো, তখন মানুষের মোহ ভাঙতে শুরু করে। সরকারের বলা ‘ন্যায়ের যুদ্ধ’-এর আড়ালে থাকা নৃশংসতা, মৃত্যু আর অর্থহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই মোহভঙ্গের মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছিল কাউন্টার-কালচার (Counter-culture) বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংস্কৃতি। তরুণরা লম্বা চুল রেখে, সাইকেডেলিক রক শুনে, ভালোবাসার কথা বলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই ‘ভালোবাসা ও শান্তি’-র (Peace and Love) আদর্শও একসময় যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। যুদ্ধের ভয়াবহতা, দেশে ফিরে আসা সৈনিকদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষত, এবং সরকারের ভণ্ডামি দেখে এক ধরনের গভীর রাগ, হতাশা এবং তিক্ততা তৈরি হচ্ছিল।
ব্ল্যাক সাবাথ (Black Sabbath)-এর মতো ব্যান্ডের জন্ম এই তিক্ততার গর্ভ থেকেই। তাদের বিখ্যাত গান ‘War Pigs’-কে বলা যেতে পারে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী সঙ্গীতগুলোর একটি। এখানে রাজনীতিবিদ এবং জেনারেলদের ‘শূকর’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যারা নিজেদের নিরাপদ অফিসে বসে তরুণদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। গানের ভারী, ধীরগতির রিফ যেন যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে চলা ট্যাঙ্কের মতো শোনায়। এই গানে ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ (Flower Power)-এর নরম প্রতিবাদ ছিল না, ছিল সরাসরি ঘৃণা এবং অভিশাপ। লেড জেপেলিনের (Led Zeppelin) ‘Immigrant Song’-এর মতো গানে যে ভাইকিংদের মতো আগ্রাসী মনোভাব, সেটাও ছিল এক ধরনের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তৎকালীন দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে এক ধরনের জবাব। এই সময়টাই মেটালকে তার প্রথম পাঠ দিয়েছিল: প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস কোরো না, তাদের সুন্দর কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কদর্য সত্যকে খুঁজে বের করো।
স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War) ও পারমাণবিক আতঙ্ক (Nuclear Anxiety)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে প্রায় নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পৃথিবী নামক গ্রহটা দুটো বিশাল শক্তির স্নায়বিক লড়াইয়ের মধ্যে জিম্মি ছিল – আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই সময়টাকে বলা হয় স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War)। এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল পারমাণবিক বোমার ভয়। দুই পক্ষের হাতেই ছিল পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করে ফেলার মতো পারমাণবিক অস্ত্র। যে কোনো মুহূর্তে একটা ভুল বোতামে চাপ পড়ে যাওয়া মানেই মানব সভ্যতা শেষ।
এই সার্বক্ষণিক পারমাণবিক ধ্বংসের (Nuclear Annihilation) আতঙ্ক মানুষের মনস্তত্ত্বে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে আশির দশকে, যখন থ্র্যাশ মেটাল (Thrash Metal) তার পূর্ণরূপে বিকশিত হচ্ছে, তখন এই আতঙ্ক তুঙ্গে। থ্র্যাশ মেটালের গতি, আগ্রাসন আর বিশৃঙ্খলার পেছনে এই ধ্বংসের ভয় সরাসরি কাজ করেছে। মেগাডেথ (Megadeth) ব্যান্ডের নামটাই এসেছে ‘megadeath’ শব্দ থেকে, যা পারমাণবিক যুদ্ধে দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে বোঝায়। তাদের ‘Peace Sells… but Who’s Buying?’ অ্যালবামে তারা রাজনৈতিক ভণ্ডামি আর পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদ নিয়ে সরাসরি কথা বলেছে। জার্মানির সোডম (Sodom) ব্যান্ডের ‘Agent Orange’ গানে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত ভয়ঙ্কর রাসায়নিক অস্ত্রের কথা বলা হয়েছে। ক্রিয়েটর (Kreator) ব্যান্ডের ‘Pleasure to Kill’ বা নিউক্লিয়ার অ্যাসল্ট (Nuclear Assault) ব্যান্ডের ‘Critical Mass’ গানগুলো ছিল পারমাণবিক যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর চিত্র।
থ্র্যাশ মেটালের গানের কথায় বারবার ফিরে আসত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory), সরকারের মিথ্যাচার, এবং প্রযুক্তির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়। এই সবকিছুর মূলে ছিল সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের অবিশ্বাস এবং সার্বক্ষণিক মৃত্যুর ছায়ায় বসবাসের অনুভূতি। মেটালের যে দ্রুত, দমবন্ধ করা গতি, তা যেন পারমাণবিক সাইরেন শোনার পর পালানোর চেষ্টার মতোই শ্বাসরুদ্ধকর।
শিল্প-পরবর্তী অবক্ষয় (Post-Industrial Decay): থ্যাচার ও রিগ্যানের যুগ
আশির দশকে আমেরিকা ও ব্রিটেনে যথাক্রমে রোনাল্ড রিগ্যান (Ronald Reagan) এবং মার্গারেট থ্যাচারের (Margaret Thatcher) নেতৃত্বে এক নতুন ধরনের রক্ষণশীল এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির (Free-market Capitalism) উত্থান ঘটে। তাদের নীতির ফলে পুরোনো শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ হতে শুরু করে, শ্রমিক ইউনিয়নগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বেকারত্ব মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল এবং আমেরিকার ‘রাস্ট বেল্ট’ (Rust Belt) অঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণি এক গভীর হতাশা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
ব্ল্যাক সাবাথ বা জুডাস প্রিস্টের (Judas Priest) মতো ব্যান্ডগুলো এসেছিল ইংল্যান্ডের শিল্পনগরী বার্মিংহাম থেকে। তারা কারখানার ধোঁয়া আর শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কষ্টকে কাছ থেকে দেখেছিল। তাদের সঙ্গীতে সেই জীবনের ধূসরতা ফুটে উঠেছিল। আশির দশকে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। নিউ ওয়েভ অফ ব্রিটিশ হেভি মেটাল (NWOBHM) আন্দোলনের জন্মও এই অর্থনৈতিক হতাশার মধ্যেই। তরুণদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না, কোনো আশা ছিল না। এই আশাভঙ্গই তাদের পাঙ্ক (Punk) এবং মেটালের মতো আগ্রাসী এবং নিহিলিস্টিক (Nihilistic) বা শূন্যবাদী সঙ্গীতের দিকে ঠেলে দেয়। পাঙ্কের ‘No Future’ স্লোগানটি মেটালের দর্শনেও ঢুকে পড়ে। মেটালের শক্তি এবং গতি ছিল এই স্থবির, হতাশাজনক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এক ধরনের সোচ্চার প্রতিবাদ। এটি ছিল বলার চেষ্টা যে, “যদি আমাদের জন্য কোনো ভবিষ্যৎ না-ই রাখো, তাহলে আমরা তোমাদের বর্তমানটাকেই গোলমাল দিয়ে ভরিয়ে দেব।” এই সময়কার অর্থনৈতিক বঞ্চনা মেটালকে তার সামাজিক সমালোচনার কণ্ঠস্বরকে আরও ধারালো করতে সাহায্য করেছিল (Kahn-Harris, 2007)।
রোমান্টিসিজম (Romanticism) ও গথিক সাহিত্যের (Gothic Literature) ছায়া
মেটালের দর্শন কেবল রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকেই আসেনি, এর শেকড় সাহিত্যের গভীরেও প্রোথিত। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক (Romantic) এবং গথিক (Gothic) শিল্প আন্দোলন মেটালের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
রোমান্টিসিজম ছিল যুক্তির যুগের (Age of Reason) বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ। রোমান্টিক কবি ও শিল্পীরা যুক্তি বা বুদ্ধির চেয়ে আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা এবং প্রকৃতির শক্তিকে বড় করে দেখতেন। তারা ব্যক্তি মানুষের ভেতরের ঝড়, একাকীত্ব এবং অজানার প্রতি আকর্ষণকে তুলে ধরতেন। প্রকৃতির সুন্দর, শান্ত রূপের পাশাপাশি তার ভয়ঙ্কর, ধ্বংসাত্মক রূপ বা ‘সাবলাইম’ (The Sublime)-এর প্রতিও তাদের গভীর আকর্ষণ ছিল। পাওয়ার মেটাল (Power Metal) বা সিমফোনিক মেটালের (Symphonic Metal) মহাকাব্যিক এবং আবেগঘন সুর, প্রকৃতির বিশালতার বর্ণনা এবং ব্যক্তিগত বীরত্বের গল্পের মধ্যে এই রোমান্টিক ধারার স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়।
এরই একটি অন্ধকার শাখা হলো গথিক সাহিত্য। মেরি শেলির (Mary Shelley) ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, ব্রাম স্টোকারের (Bram Stoker) ‘ড্রাকুলা’ বা এডগার অ্যালান পোর (Edgar Allan Poe) গল্পগুলোর কথা ভাবুন। এগুলোতে ছিল রহস্য, অতিপ্রাকৃত সত্তা, ভাঙা দুর্গ, বিষণ্ণ নায়ক এবং মৃত্যুর এক রোমান্টিক ধারণা। গথিক সাহিত্য মানুষের মনের অন্ধকার দিক, নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা এবং নৈতিকতার ধূসর এলাকাগুলো নিয়ে কাজ করেছে। এই ধারাটি সরাসরি ডুম মেটাল (Doom Metal) এবং গথিক মেটাল (Gothic Metal)-এর জন্ম দিয়েছে। প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost), মাই ডাইং ব্রাইড (My Dying Bride) বা টাইপ ও নেগেটিভ (Type O Negative)-এর মতো ব্যান্ডের গানে বিষণ্ণতা, হারানো প্রেম এবং মৃত্যুর যে কাব্যিক বর্ণনা, তা সরাসরি গথিক সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত। তারা দেখিয়েছে যে অন্ধকারও সুন্দর হতে পারে, বিষাদও শৈল্পিক হতে পারে।
দার্শনিকদের হাতুড়ি: যে চিন্তারা গড়েছে মেটালের কঙ্কাল (The Philosophers’ Hammer: Ideas That Forged Metal’s Skeleton)
মেটাল মিউজিক অনেক গভীর দার্শনিক প্রশ্নের সাথে বোঝাপড়া করে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি? জীবনের মানে কী? নৈতিকতা কী? ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমা কতটুকু? এই প্রশ্নগুলো নতুন নয়। বহু দার্শনিক বহু আগে থেকেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন। তাদের চিন্তাভাবনাই পরোক্ষভাবে মেটালের কঙ্কালটি তৈরি করেছে।
ফ্রিডরিখ নিৎশে (Friedrich Nietzsche): ঈশ্বরের মৃত্যু এবং Übermensch-এর উত্থান
জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিৎশে (Friedrich Nietzsche) সম্ভবত মেটাল মিউজিকের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক। তাকে ছাড়া, বিশেষ করে ব্ল্যাক মেটালের (Black Metal) দর্শন বোঝা প্রায় অসম্ভব। নিৎশে ছিলেন একজন র্যাডিকাল চিন্তাবিদ যিনি সমাজের প্রতিষ্ঠিত সব মূল্যবোধ, বিশেষ করে খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে (Judeo-Christian morality) কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন।
তার বিখ্যাত ঘোষণা ছিল ‘ঈশ্বর মৃত’ (God is dead)। এর মানে এই নয় যে আক্ষরিক অর্থে কোনো ঈশ্বর মারা গেছেন। এর মানে হলো, আধুনিক বিজ্ঞান এবং যুক্তির উত্থানের ফলে পশ্চিমা সমাজে ঈশ্বরের ধারণা তার সর্বময় ক্ষমতা এবং প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এর ফলে মানুষ এক গভীর শূন্যতার (Nihilism) মধ্যে পড়েছে, কারণ যে নৈতিকতার ভিত্তি ছিল ঈশ্বর, সেই ভিত্তিটাই আর নেই। নিৎশে এই শূন্যতাকে ভয় না পেয়ে একে একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, এখন মানুষ দাসত্বের নৈতিকতা (Slave Morality) – অর্থাৎ নম্রতা, দয়া, করুণা – থেকে বেরিয়ে এসে প্রভুর নৈতিকতা (Master Morality) তৈরি করতে পারে। এই নতুন নৈতিকতা হবে জীবনমুখী, শক্তিশালী এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী।
এই শূন্যতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিৎশে ‘উবারমেনশ’ (Übermensch) বা ‘সুপারম্যান/ওভারম্যান’-এর ধারণা দেন। উবারমেনশ হলো এমন এক মানুষ যে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া মূল্যবোধকে অতিক্রম করে নিজের মূল্যবোধ নিজেই তৈরি করে। সে জীবনকে তার সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা এবং আনন্দসহ গ্রহণ করে। ব্ল্যাক মেটালের মানববিদ্বেষ (Misanthropy), প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দর্শনের মূলে রয়েছেন নিৎশে। বারজাম (Burzum) বা ডার্কথ্রোনের (Darkthrone) মতো ব্যান্ডগুলো যখন প্রতিষ্ঠিত ধর্ম এবং সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন তারা নিৎশের দর্শনেরই প্রতিধ্বনি করে। তারা দুর্বল, অনুসরণকারী ‘পাল’ (Herd)-এর অংশ হতে চায় না, তারা হতে চায় একাকী, শক্তিশালী উবারমেনশ। নিৎশের ‘Will to Power’ বা শক্তির প্রতি ইচ্ছার ধারণাটিও মেটালের শক্তির জয়গানের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত (Spracklen, 2020)।
জঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre) ও অ্যালবেয়ার কামু (Albert Camus): অস্তিত্বের ভার এবং অর্থহীনতার (Absurdity) বিদ্রোহ
ফরাসি দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre) এবং অ্যালবেয়ার কামু (Albert Camus) ছিলেন অস্তিত্ববাদ (Existentialism) নামক ফিলোসফিকাল মুভমেন্ট বা দার্শনিক আন্দোলনের প্রধান দুই মুখ। তাদের চিন্তাভাবনা মেটালের অনেক গানের কথায়, বিশেষ করে প্রগ্রেসিভ মেটাল (Progressive Metal) এবং ডেথ মেটালের (Death Metal) দার্শনিক শাখায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।
সার্ত্রের মূল কথা ছিল ‘অস্তিত্ব সারধর্মের আগে আসে’ (Existence precedes essence)। এর মানে হলো, মানুষ কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা প্রকৃতি নিয়ে জন্মায় না। সে প্রথমে এই জগতে নিক্ষিপ্ত হয় (Thrown into the world), এবং তারপর তার নিজের পছন্দ এবং কাজের মাধ্যমে সে নিজেকে তৈরি করে, নিজের সারাৎসার বা অর্থ তৈরি করে। এই স্বাধীনতার ভার অনেক বেশি। কারণ আমাদের সব পছন্দের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী, কোনো ঈশ্বর বা প্রকৃতি নয়। এই একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) এবং স্বাধীনতার ভারের অনুভূতি মেটালের একটি কেন্দ্রীয় থিম। আর্টসেলের ‘অস্তিত্ব’ বা অনেক প্রগ্রেসিভ মেটাল ব্যান্ডের গানে এই অস্তিত্বের সংকট এবং আত্ম-পরিচয় খোঁজার সংগ্রাম বারবার ফুটে ওঠে।
কামু এই জগতকে ‘অ্যাবসার্ড’ (Absurd) বা অর্থহীন বলে মনে করতেন। অ্যাবসার্ড হলো দুটি জিনিসের মধ্যেকার সংঘাত: একদিকে অর্থ খোঁজার জন্য মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এবং অন্যদিকে এই মহাবিশ্বের শীতল নীরবতা ও উদাসীনতা। এই অর্থহীনতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ কী করবে? কামু তিনটি পথের কথা বলেছেন: আত্মহত্যা (যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন), বিশ্বাসে আশ্রয় নেওয়া (যাকে তিনি দার্শনিক আত্মহত্যা বলেন), অথবা বিদ্রোহ (Rebellion)। অ্যাবসার্ডকে মেনে নিয়েই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বেঁচে থাকতে হবে। সিসিফাসের (Sisyphus) পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে তিনি এই ধারণা ব্যাখ্যা করেন। সিসিফাসকে দেবতাদের দ্বারা অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল যে তাকে অনন্তকাল ধরে একটি পাথরকে পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলে তুলতে হবে, এবং পাথরটি বারবার নিচে গড়িয়ে পড়বে। কামু বলেন, সিসিফাস যখন তার এই অর্থহীন কাজের বাস্তবতা মেনে নিয়ে সচেতনভাবে পাথরটি ঠেলেন, তখন তিনি তার ভাগ্যের চেয়ে বড় হয়ে ওঠেন। তার বিদ্রোহই তার বিজয়। মেটালহেডও অনেকটা এই অ্যাবসার্ড হিরোর মতো। সে সমাজের অর্থহীনতা, ভণ্ডামি এবং কষ্টকে দেখে, কিন্তু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে না দিয়ে, সঙ্গীতের তীব্র শক্তির মাধ্যমে সে বিদ্রোহ করে। এই গোলমালটাই তার পাথর ঠেলার মতো বিদ্রোহ।
নস্টিকবাদ (Gnosticism): বস্তুজগতের কারাগার এবং মিথ্যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
মেটালের বিদ্রোহের শেকড় কেবল আধুনিক দর্শনেই নয়, বরং প্রাচীন, গূঢ় রহস্যময় আধ্যাত্মিক আন্দোলগুলোর মধ্যেও প্রোথিত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নস্টিকবাদ বা নস্টিসিজম (Gnosticism)। প্রথম কয়েক শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসা এই চরম দ্বৈতবাদী দর্শন মেটালের অনেক থিমের জন্য এক শক্তিশালী পৌরাণিক ভিত্তি প্রদান করে।
নস্টিকদের মূল বিশ্বাস ছিল যে, এই দৃশ্যমান, বস্তুজগৎ কোনো পরম করুণাময় ঈশ্বর তৈরি করেননি। বরং এটি তৈরি করেছে এক অসম্পূর্ণ, অজ্ঞ বা শয়তান স্রষ্টা, যাকে তারা ‘ডেমিয়ার্জ’ (Demiurge) বলত। এই ডেমিয়ার্জই হলো ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈর্ষাপরায়ণ এবং ক্রোধান্বিত ঈশ্বর। আসল, পরম সত্তা এই বস্তুজগতের অনেক ঊর্ধ্বে এক বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক জগতে (Pleroma) বাস করেন। মানুষের আত্মা হলো সেই পরম সত্তারই এক ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গ, যা এই বস্তুজগতের কারাগারে বন্দি। এই ধারণাটি মেটালের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী এবং বিশেষ করে খ্রিস্ট-বিরোধী মনোভাবের সাথে নিখুঁতভাবে মিলে যায়। এটি সাধারণ স্যাটানিজমের চেয়েও এক গভীর দার্শনিক আক্রমণ। এখানে ঈশ্বরকে কেবল অস্বীকার করা হচ্ছে না, বরং তাকে একজন ভণ্ড, অত্যাচারী কারারক্ষক হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের সেল্টিক ফ্রস্ট (Celtic Frost) বা সামায়েল (Samael)-এর মতো ব্যান্ডের গানে যে গূঢ়, পৌরাণিক এবং ধর্ম-বিরোধী আবহ, তার পেছনে এই নস্টিক চিন্তার গভীর প্রভাব রয়েছে।
এই দর্শন অনুযায়ী, বস্তুজগৎ এবং মানবদেহ হলো আত্মার কারাগার। জীবন মানেই যন্ত্রণা, ক্ষয় এবং মৃত্যু। এই মানববিদ্বেষী (Misanthropic) এবং জীবন-বিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি ব্ল্যাক মেটাল এবং ডুম মেটালের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। এই কারাগার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো ‘নোসিস’ (Gnosis) বা গূঢ় জ্ঞান লাভ করা, যা মানুষকে তার আসল ঐশ্বরিক পরিচয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এই ধারণাটিও মেটাল সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত, যেখানে মেটালহেড নিজেকে সমাজের ‘পাল’ থেকে আলাদা মনে করে, কারণ সে এমন এক সত্য দেখতে পায় যা অন্যরা দেখে না। মেটালের তীব্র সঙ্গীত এবং অন্ধকার লিরিক্স যেন সেই নোসিস বা গোপন জ্ঞান অর্জনেরই একটি মাধ্যম।
এইচ. পি. লাভক্র্যাফট (H. P. Lovecraft): মহাজাগতিক আতঙ্ক এবং মানবীয় তুচ্ছতা
এইচ. পি. লাভক্র্যাফট (H. P. Lovecraft) ঠিক দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান হরর ফিকশন লেখক। কিন্তু তার লেখার পেছনে এক গভীর এবং অন্ধকার দর্শন ছিল, যা ‘কসমিক হরর’ (Cosmic Horror) বা ‘লাভক্র্যাফটিয়ান হরর’ নামে পরিচিত। এই দর্শন মেটাল, বিশেষ করে ডেথ মেটাল এবং কিছু ব্ল্যাক মেটালের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছে।
সাধারণ গথিক হররের মতো লাভক্র্যাফটের ভয় মানুষ বা ভূত-প্রেতকেন্দ্রিক নয়। তার ভয় আসে এক বিশাল, অনুভূতিহীন এবং বোধের অগম্য মহাবিশ্বের ধারণা থেকে। এই মহাবিশ্বে মানুষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী নয়, বরং ধূলিকণার মতো তুচ্ছ। মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে ঘুমিয়ে আছে ‘গ্রেট ওল্ড ওয়ানস’ (Great Old Ones) বা ‘আউটার গডস’ (Outer Gods)-এর মতো প্রাচীন, শক্তিশালী সত্তা (যেমন ক্থুলু – Cthulhu), যাদের কাছে মানব সভ্যতা পোকামাকড়ের মতো। জ্ঞান এখানে মুক্তির পথ নয়, বরং উন্মাদনা এবং ধ্বংসের পথ। কারণ মহাবিশ্বের আসল সত্য জানতে পারলে মানুষের দুর্বল মন তা সহ্য করতে পারবে না।
এই মানবীয় তুচ্ছতার (Human Insignificance) ধারণাটি মেটালের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। এটি ঈশ্বরের ধারণাকে তো বটেই, মানবকেন্দ্রিক (Anthropocentric) সব দর্শনকেই নাকচ করে দেয়। মেটালিকার ‘The Call of Ktulu’ বা ‘The Thing That Should Not Be’, মরবিড অ্যাঞ্জেলের (Morbid Angel) পুরো ডিস্কোগ্রাফি, বা সালফার ইয়ন (Sulphur Aeon)-এর মতো অসংখ্য ব্যান্ড সরাসরি লাভক্র্যাফটের মিথোস (Mythos) থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে। তাদের সঙ্গীতে যে ভারী, শ্বাসরোধী এবং বিশৃঙ্খল আবহ, তা যেন সেই বোধের অতীত সত্তাদের জেগে ওঠার মতোই ভয়ঙ্কর। লাভক্র্যাফটের দর্শন মেটালকে শিখিয়েছে যে সবচেয়ে বড় ভয়টা বাইরে কোথাও নেই, আছে আমাদের নিজেদের তুচ্ছতা এবং এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের অসহায়ত্বের উপলব্ধির মধ্যে (Brown, 2020)।
মার্কি দ্য সাদ (Marquis de Sade): চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘন এবং নৈতিকতার প্রত্যাখ্যান
মার্কি দ্য সাদ (Marquis de Sade) ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর এক ফরাসি অভিজাত এবং লেখক, যার নাম থেকে ‘স্যাডিজম’ (Sadism) শব্দটি এসেছে। তার লেখা এতই বিতর্কিত ছিল যে তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই জেল বা পাগলাগারদে কাটিয়েছেন। সাদ কেবল একজন পর্নোগ্রাফার ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন র্যাডিকাল লিবারটাইন (Libertine) দার্শনিক।
সাদের দর্শন ছিল প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি নিজেই হিংস্র, ধ্বংসাত্মক এবং উদাসীন। প্রকৃতির কাছে ভালো বা মন্দের কোনো ধারণা নেই। তাই মানুষের তৈরি নৈতিকতা, বিশেষ করে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নৈতিকতা, কৃত্রিম এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে। তিনি বিশ্বাস করতেন চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাধীনতায়, যার অর্থ হলো সব ধরনের সামাজিক এবং নৈতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করার অধিকার, বিশেষ করে যৌনতা এবং সহিংসতার ক্ষেত্রে। তার লেখায় তিনি মানুষের অন্ধকারতম, পাশবিক প্রবৃত্তিগুলোকে কোনো রাখঢাক ছাড়া তুলে ধরেছেন।
সাদের এই চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘনের (Transgression) দর্শন এক্সট্রিম মেটালের (Extreme Metal) কিছু শাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা। ক্যানিবাল করপস (Cannibal Corpse)-এর মতো গোরগ্রাইন্ড (Goregrind) বা পর্নোগ্রাইন্ড (Pornogrind) ব্যান্ডের গানে যে অতিমাত্রায় সহিংস এবং যৌন বিকৃত বর্ণনা থাকে, তা সাদের দর্শনেরই এক চরম শৈল্পিক প্রকাশ। ইংল্যান্ডের ব্ল্যাক মেটাল ব্যান্ড ক্রেডল অফ ফিলথ (Cradle of Filth) তাদের গানে এবং অ্যালবামের নামে (যেমন ‘Cruelty and the Beast’) সাদের প্রভাবকে স্পষ্টভাবে স্বীকার করে। এই ধরনের সঙ্গীত সমাজের ‘ট্যাবু’ বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে ধাক্কা দেয় এবং শ্রোতাকে তার নৈতিকতার সীমানা নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে। এটি সুন্দর বা স্বস্তিদায়ক হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি; এর উদ্দেশ্যই হলো অস্বস্তি তৈরি করা এবং ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেওয়া।
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনাগুলোই একসাথে মিলেমিশে মেটালের সেই জটিল এবং প্রায়শই স্ববিরোধী দর্শনকে তৈরি করেছে। এটি একই সাথে শূন্যবাদী এবং জীবনবাদী, ধ্বংসাত্মক এবং সৃজনশীল, মানববিদ্বেষী এবং গভীরভাবে মানবতাবাদী। এই গোলমালের গভীরে লুকিয়ে আছে আমাদের সময়ের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নগুলোর সাথে বোঝাপড়া করার এক সৎ এবং আপসহীন প্রচেষ্টা।
সংস্কৃতি, দর্শন এবং বিতর্ক
মেটাল শুধু একটি সঙ্গীত শৈলী নয়, এটি একটি বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতি (Global Culture) এবং উপ-সংস্কৃতি (Subculture) যার নিজস্ব নিয়মকানুন, প্রতীক এবং আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। এটি একটি জীবনযাত্রাও বটে।
মেটালহেড (Metalhead): এক বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব
মেটাল ভক্তদের ‘মেটালহেড’ বলা হয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই মেটালহেডদের মধ্যে এক ধরনের শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ববোধ এবং একাত্মতা কাজ করে। একজন বাংলাদেশি মেটালহেড হয়তো নরওয়ের একজন মেটালহেডের সাথে ভাষা বা সংস্কৃতির দিক থেকে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আয়রন মেইডেন বা মেটালিকার একটি টি-শার্ট দেখলেই তাদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য সংযোগ তৈরি হয়ে যায়। এর কারণ হলো, মেটালহেডরা প্রায়শই নিজেদেরকে সমাজের মূলধারার বাইরে বা ‘আউটসাইডার’ (Outsider) হিসেবে দেখে। মেটাল মিউজিক তাদের সেই একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে একটি আশ্রয় এবং পরিচিতি দেয় (Weinstein, 2000)।
এই সংস্কৃতির কিছু সাধারণ উপাদান হলো:
- পোশাক এবং চেহারা (The Look): কালো পোশাক, ব্যান্ডের লোগো সম্বলিত টি-শার্ট, ছেঁড়া জিন্স, চামড়ার জ্যাকেট (Leather Jacket), ডেনিম ভেস্ট (Denim Vest) যার ওপর বিভিন্ন ব্যান্ডের প্যাচ (Patch) লাগানো থাকে, এবং লম্বা চুল – এগুলো মেটালহেডদের একটি সাধারণ, প্রায় ইউনিফর্মের মতো পোশাক। এটি শুধু ফ্যাশন নয়, এটি তাদের পরিচিতি এবং কোন ব্যান্ডের প্রতি তাদের আনুগত্য, তার এক নীরব ঘোষণা।
- কনসার্ট (The Concert): মেটাল কনসার্ট বা গিগ (Gig) হলো এই সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু, তাদের তীর্থস্থান। এখানে মেটালহেডরা একত্রিত হয়, তাদের প্রিয় ব্যান্ডের গান শোনে এবং কিছু নির্দিষ্ট আচারে অংশ নেয়। এটি তাদের জন্য এক ধরনের মুক্তির জায়গা।
- কনসার্টের আচার (Concert Rituals):
- হেডব্যাংগিং (Headbanging): গানের তালের সাথে ছন্দে মাথা ঝাঁকানো। এটি সঙ্গীতের তীব্র শক্তির সাথে একাত্ম হওয়ার এক শারীরিক বহিঃপ্রকাশ।
- মশ পিট (Mosh Pit): স্টেজের সামনে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ভক্তদের একে অপরের সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধাক্কাধাক্কি করে এক ধরনের উদ্দাম নাচ। বাইরে থেকে দেখলে এটিকে সহিংস মনে হতে পারে, কিন্তু এর কিছু অলিখিত নিয়ম আছে। যেমন, কেউ পড়ে গেলে তাকে তুলে ধরতে হয়। এটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা।
- হর্নস (Horns) বা শিং দেখানো: তর্জনী এবং কনিষ্ঠা উঁচু করে এবং বাকি আঙুলগুলো ভাঁজ করে এক ধরনের প্রতীক তৈরি করা, যা দেখতে শিং-এর মতো। কিংবদন্তী ভোকালিস্ট রনি জেমস ডিও এই প্রতীকটিকে জনপ্রিয় করেন। তার ইতালীয় দাদি অশুভ শক্তিকে দূরে রাখার জন্য এই প্রতীক ব্যবহার করতেন। ডিও এটিকে দর্শকদের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন, যা এখন মেটাল সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে।
অ্যালবাম আর্ট (Album Art): দৃশ্যমান সঙ্গীত
মেটাল অ্যালবামের প্রচ্ছদগুলো কেবল প্যাকেজিং নয়, এগুলো সঙ্গীতের একটি বর্ধিত এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেক ক্ষেত্রে, প্রচ্ছদটি অ্যালবামের ভেতরের সঙ্গীতের মতোই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এই আর্টওয়ার্কগুলো অ্যালবামের থিম, আবহ এবং দর্শনকে দৃশ্যত ফুটিয়ে তোলে। ডেরেক রিগসের আঁকা আয়রন মেইডেনের ম্যাসকট ‘এডি’-র বিভিন্ন রূপ, এড রেপকা-র (Ed Repka) আঁকা মেগাডেথ বা ডেথ-এর থ্র্যাশ আর্ট, বা এইচ. আর. গিগেরের (H. R. Giger) আঁকা সেল্টিক ফ্রস্টের (Celtic Frost) পরাবাস্তব এবং ভীতিকর প্রচ্ছদগুলো শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। এই প্রচ্ছদগুলো ভক্তদের জন্য অ্যালবামের সঙ্গীত শোনার আগেই এক ধরনের প্রত্যাশা এবং রহস্য তৈরি করে।
বিতর্ক এবং ভুল ধারণা: গোলমালের পেছনের অপবাদ
মেটাল মিউজিক তার জন্মলগ্ন থেকেই নানা ধরনের বিতর্ক এবং ভুল ধারণার শিকার হয়েছে। এর তীব্র এবং আগ্রাসী প্রকৃতির কারণে অনেকেই একে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে।
- স্যাটানিজম (Satanism) বা শয়তানের উপাসনার অভিযোগ: এটি মেটালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে পুরোনো এবং সাধারণ অভিযোগ। ব্ল্যাক সাবাথের অশুভ শব্দ, তাদের ব্যান্ডের নাম এবং অ্যালবামের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত প্রতীক (যেমন উল্টো ক্রুশ) থেকেই এই ধারণার জন্ম। পরবর্তীকালে ভেনম, স্লেয়ার এবং নরওয়ের ব্ল্যাক মেটাল ব্যান্ডগুলো সচেতনভাবে স্যাটানিক থিম ব্যবহার করায় এই ধারণা আরও পোক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মেটালের বিশাল জগতে স্যাটানিক ব্যান্ডের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, শয়তান বা অশুভ প্রতীকগুলো আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয় না, বরং রূপক অর্থে (Metaphorically) ব্যবহৃত হয় – প্রতিষ্ঠিত ধর্ম, সামাজিক নিয়ম এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে (Walser, 1993)।
- সহিংসতা, আত্মহত্যা এবং অপরাধে উস্কানি: আশির দশকে আমেরিকায় PMRC (Parents Music Resource Center) নামে একটি সংগঠন মেটাল এবং রক মিউজিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের অভিযোগ ছিল, এই ধরনের সঙ্গীত তরুণদের মধ্যে সহিংসতা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যায় উস্কানি দিচ্ছে। জুডাস প্রিস্ট বা ওজি অসবোর্নের বিরুদ্ধে তাদের গান শুনে দুজন তরুণ আত্মহত্যা করেছে – এই অভিযোগে আদালতেও মামলা করা হয়েছিল, যা পরে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেটাল ভক্তরা অন্যান্যদের চেয়ে বেশি হতাশ, উদ্বিগ্ন বা সহিংস নয়। বরং, মেটাল মিউজিক তাদের জন্য এক ধরনের ক্যাথারসিস (Catharsis) বা মানসিক ভার মুক্তির স্বাস্থ্যকর উপায় হিসেবে কাজ করে। যারা নিজেদের একা, বিষণ্ণ বা বহিষ্কৃত মনে করে, মেটালের তীব্র শক্তি তাদের সেই রাগ এবং হতাশা প্রকাশ করতে এবং কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, ক্ষতি করার পরিবর্তে (Arnett, 1991)।
- নারীবিদ্বেষ (Misogyny): গ্ল্যাম মেটালের অনেক গানে এবং মিউজিক ভিডিওতে নারীকে যৌন বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে। কিছু এক্সট্রিম মেটাল ব্যান্ডের গানেও নারী নির্যাতনের গ্রাফিক বর্ণনা পাওয়া যায়। এই সমালোচনা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। তবে এটিও পুরো মেটাল জঁরার চিত্র নয়। মেটাল জগতে আর্চ এনিমি (Arch Enemy), নাইটউইশ (Nightwish), জিনজির (Jinjer)-এর মতো অসংখ্য নারী-প্রধান ব্যান্ড রয়েছে। ডোরো পেশ (Doro Pesch)-এর মতো শিল্পীরা কয়েক দশক ধরে মেটাল জগতে দাপটের সাথে কাজ করছেন। মেটাল সংস্কৃতিতে নারীবিদ্বেষের উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী কণ্ঠস্বরও রয়েছে।
- শব্দ দূষণ এবং শৈল্পিকতার অভাব: অনেকের কাছেই এটি নিছকই কান ফাটানো কোলাহল। কিন্তু এই ধারণাটি আসে মূলত অপরিচিতি থেকে। মেটাল মিউজিক শোনার এবং এর জটিলতা বোঝার জন্য এক ধরনের অভ্যস্ততা (Acquired Taste) এবং মনোযোগ প্রয়োজন। এর জটিল গিটার রিফ, দ্রুত ড্রামিং, পরিবর্তনশীল তাল এবং গভীর লিরিক যারা বোঝেন, তাদের কাছে এটি মোৎজার্ট বা বিথোভেনের সিম্ফোনির মতোই শৈল্পিক এবং আবেগময়।
মেটালের দর্শন: বিশৃঙ্খলার মধ্যে অর্থ খোঁজা
মেটাল মিউজিকের এই যে তীব্র, কান ফাটানো গোলমাল, এর গভীরে কি কোনো চিন্তার শৃঙ্খলা আছে? নাকি এটা কেবলই অর্থহীন বিশৃঙ্খলা? বাইরে থেকে দেখলে একে উদ্দেশ্যহীন কৈশোরের রাগ বা অপরিপক্ক বিদ্রোহ মনে হতে পারে। কিন্তু এর রুক্ষ আবরণের নিচে এক ধরনের শক্তিশালী এবং প্রায়শই সামঞ্জস্যপূর্ণ দর্শন কাজ করে। এটি কোনো একক, সুসংহত মতবাদ নয়, যেমনটা কোনো রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর থাকে। বরং, এটি একটি বহুমাত্রিক এবং কখনো কখনো স্ববিরোধী চিন্তার জগৎ, যেখানে কিছু সাধারণ থিম বা স্রোত বারবার ফিরে ফিরে আসে। মেটাল হলো সেই আয়না, যা আধুনিক পৃথিবীর ভাঙাচোরা, বিশৃঙ্খল মুখটাকেই কোনো রাখঢাক ছাড়া আমাদের সামনে তুলে ধরে এবং সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই অর্থ, শক্তি এবং আত্মপরিচয় খোঁজার পথ দেখায়। চলুন, এই দর্শনের মূল স্তম্ভগুলোকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যাক।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (Individualism): পালের বাইরে দাঁড়ানোর স্পর্ধা
মেটালের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের (Individualism) ধারণা। এটি এমন এক দর্শন যা ব্যক্তিকে সমাজের বা গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। মেটাল শেখায় যে, সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম, অন্ধ বিশ্বাস, সামাজিক প্রথা এবং কনফর্মিটি (Conformity) বা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মতো করে ভাবতে এবং বাঁচতে হবে।
এই দর্শনটি নিৎশের (Nietzsche) চিন্তাধারার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। নিৎশে সমাজকে একটি ‘পাল’ (Herd) হিসেবে দেখতেন, যেখানে বেশিরভাগ মানুষই নিরাপদ এবং আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্য নিজেদের স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে ‘পাল-নৈতিকতা’ (Herd morality) অনুসরণ করে। মেটাল এই পালের অংশ হতে অস্বীকার করে। এটি ‘আউটসাইডার’ বা একঘরে হওয়াকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে, শক্তি হিসেবে দেখতে শেখায়। মেটালহেডের লম্বা চুল, কালো পোশাক, ব্যান্ডের টি-শার্ট – এই সবকিছুই কেবল ফ্যাশন নয়, এটি পালের থেকে নিজেকে আলাদা করার এক সচেতন ঘোষণা। এটি বলার চেষ্টা যে, “আমি তোমাদের মতো নই, এবং এ নিয়ে আমি লজ্জিত তো নই-ই, বরং গর্বিত।”
মেটালিকার (Metallica) ‘The Unforgiven’-এর মতো গানে এই থিমটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। গানটি এমন এক ব্যক্তির গল্প বলে, যাকে ছোটবেলা থেকে সমাজের নিয়মের ছাঁচে ঢালার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত সেই শৃঙ্খল ভাঙার চেষ্টা করে। প্যানটেরার (Pantera) ‘Walk’ গানটি তো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এক সরাসরি ইশতেহার, যেখানে বলা হচ্ছে – “Respect, walk! What did you say? Are you talking to me?” এই স্পর্ধা, এই আত্মমর্যাদা মেটালের দর্শনের মূল ভিত্তি। এটি শেখায় যে, অন্যের স্বীকৃতি বা প্রশংসার জন্য বেঁচে থাকার চেয়ে নিজের শর্তে, নিজের সত্য নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক বেশি সম্মানের (Berger, 2005)।
বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া: অন্ধকারের চোখে চোখ রাখা
মূলধারার পপ সঙ্গীত যেখানে প্রায়শই জীবনকে একটি সুন্দর, রঙিন মোড়কে উপস্থাপন করে – যেখানে প্রেমই সব, সব সমস্যার সমাধান আছে – মেটাল সেখানে জীবনের সেই মোড়কটাকে ছিঁড়ে ফেলে। এটি জীবনের অন্ধকার, কদর্য এবং কঠিন দিকগুলোকে এড়িয়ে যায় না, বরং সেগুলোকে সরাসরি মোকাবেলা করে। যুদ্ধ, মৃত্যু, অবিচার, রাজনৈতিক ভণ্ডামি, মানসিক যন্ত্রণা, অস্তিত্বের সংকট – এইসব কঠিন বিষয় নিয়ে সরাসরি, আপসহীন ভাষায় কথা বলার সাহস জোগায় মেটাল।
এটি এক ধরনের অস্তিত্ববাদী (Existentialist) শিল্প। অ্যালবেয়ার কামু (Albert Camus) যেমন বলেছিলেন যে, জীবন ‘অ্যাবসার্ড’ (Absurd) বা অর্থহীন, কারণ আমরা অর্থ খুঁজি কিন্তু এই মহাবিশ্ব নীরব থাকে – মেটালও প্রায়শই এই অর্থহীনতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিন্তু এটি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গীত নয়। ডেথ (Death) ব্যান্ডের চাক শুলডিনার (Chuck Schuldiner) তার গানে মৃত্যু এবং জীবনের ভঙ্গুরতা নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল শ্রোতাকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে এবং উপভোগ করতে উৎসাহিত করা। তার ‘Without Judgement’ গানে তিনি মানুষের বিচার করার প্রবণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, যা এক গভীর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
স্লেয়ার (Slayer)-এর মতো ব্যান্ড যখন যুদ্ধ বা সিরিয়াল কিলারের মতো ভয়ঙ্কর বিষয় নিয়ে গান করে, তখন তারা সহিংসতাকে মহিমান্বিত করে না। বরং, তারা মানব ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়গুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরে, যাতে আমরা সেই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হই। এটি অনেকটা গোইয়ার (Goya) আঁকা ‘Disasters of War’ সিরিজের মতো – ভয়ঙ্কর, কিন্তু জরুরি। মেটাল বলে যে, চোখ বন্ধ করে রাখলেই অন্ধকার চলে যায় না। অন্ধকারের চোখে চোখ রেখেই তাকে জয় করতে হয় (Olson, 2008)।
শক্তি এবং সহনশীলতা: ভাঙা হাড়ের ওপর দাঁড়ানো
মেটালের তীব্র, আগ্রাসী শক্তি কেবল ধ্বংসাত্মক নয়, এটি একই সাথে গঠনমূলকও। এই সঙ্গীত শ্রোতার মধ্যে এক ধরনের মানসিক শক্তি, সহনশীলতা (Resilience) এবং ক্ষমতায়নের (Empowerment) অনুভূতি সঞ্চার করে। এটি দুর্বলতার সঙ্গীত নয়, এটি প্রতিকূলতার মুখে রুখে দাঁড়ানোর এবং টিকে থাকার সঙ্গীত।
সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন যে, মেটাল অনেক তরুণের জন্য এক ধরনের ‘ক্যাথারসিস’ (Catharsis) বা মানসিক ভার মুক্তির উপায় হিসেবে কাজ করে। দিনের পর দিন জমে থাকা রাগ, হতাশা, অবিচারের শিকার হওয়ার অনুভূতি – এই সবকিছু মেটালের তীব্র শক্তির মাধ্যমে এক নিরাপদ পরিসরে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। যখন জেমস হেটফিল্ড (James Hetfield) গর্জন করে ওঠেন বা যখন ড্রামের ডাবল বেস কিক মেশিন গানের মতো বাজতে থাকে, তখন শ্রোতা তার নিজের ভেতরের ক্ষোভের একটি প্রতিধ্বনি খুঁজে পায়। এটি তাকে একা অনুভব করতে দেয় না। এই ভাগ করে নেওয়া রাগ এক ধরনের শক্তি এবং সংহতি তৈরি করে (Arnett, 1996)।
মেটালের লিরিক্সে প্রায়শই প্রতিকূলতাকে জয় করার গল্প বলা হয়। হেইটব্রিড (Hatebreed)-এর মতো ব্যান্ডের গানগুলো তো প্রায় ‘মোটিভেশনাল স্পিচ’-এর মতো। তাদের ‘I Will Be Heard’ গানটি হতাশাগ্রস্ত মানুষের জন্য এক শক্তিশালী মন্ত্র হয়ে উঠেছে। এটি হতাশা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গীত নয়, বরং হতাশার চোখে চোখ রেখে তাকে জয় করার প্রেরণা। এটি বলে, তুমি ভেঙে পড়তে পারো, কিন্তু তোমাকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। তোমার ভাঙা হাড়ের ওপর ভর দিয়েই তোমাকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে।
জন্মলগ্ন থেকেই মেটাল সরকার, ধর্ম এবং সমাজের অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার (Institutional authority) একজন কঠোর সমালোচক। এটি প্রশ্ন করতে শেখায়, অন্ধভাবে কিছু মেনে নিতে নিষেধ করে। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (Michel Foucault) যেমন দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতা কেবল দমন-পীড়নের মাধ্যমে কাজ করে না, বরং জ্ঞান, নিয়ম এবং শৃঙ্খলার মাধ্যমেও আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে – মেটাল এই অদৃশ্য ক্ষমতা-কাঠামোগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
- সরকার ও রাজনীতি: মেটাল ব্যান্ডগুলো প্রায়শই সরকারের মিথ্যাচার, কর্পোরেট লোভ এবং সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে। রেইজ অ্যাগেইনস্ট দ্য মেশিন (Rage Against the Machine) তাদের সঙ্গীতের মাধ্যমে সরাসরি পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করেছে। মেগাডেথের (Megadeth) ডেভ মাস্টেইন (Dave Mustaine) তার গানে প্রায়শই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের (Conspiracy theory) কথা বলেন, যা হয়তো বাস্তবিকভাবে সবসময় সঠিক নয়, কিন্তু এটি ক্ষমতার প্রতি এক গভীর অবিশ্বাস এবং সন্দেহকে প্রকাশ করে।
- ধর্ম: মেটাল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভণ্ডামি, অন্ধ বিশ্বাস এবং মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে আক্রমণ করে। এটি ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতাকে বাতিল করে না, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। ব্ল্যাক মেটাল এই ধারণাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে তারা খ্রিস্টধর্মকে একটি নিপীড়নকারী শক্তি হিসেবে দেখে এবং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
- সামাজিক নিয়ম: মেটাল ‘স্বাভাবিক’ বা ‘সাধারণ’ জীবনযাপনের ধারণাকে প্রশ্ন করে। কেন আমাকে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে পোশাক পরতে হবে? কেন আমাকে একটি ৯-থেকে-৫টার চাকরি করতে হবে? কেন আমাকে সমাজের বেঁধে দেওয়া সাফল্যের সংজ্ঞা মেনে নিতে হবে? মেটাল এই প্রশ্নগুলো করার সাহস জোগায়। এটি বলে যে, তোমার নিজের পথ তৈরি করার অধিকার তোমার আছে, এমনকি যদি সেই পথ সমাজের চোখে ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘বিপজ্জনক’ হয়।
দিনশেষে, মেটালের দর্শন হলো এক ধরনের র্যাডিকাল সততা। এটি জীবনের কোনো দিককেই – তা যতই অন্ধকার বা অস্বস্তিকর হোক না কেন – ফিল্টার করে না। এটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে এবং সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই নিজের অর্থ, নিজের শক্তি এবং নিজের স্বাধীনতা খুঁজে নেওয়ার এক নিরন্তর সংগ্রামের নাম। এটি তাদের জন্য, যারা পালের অংশ হয়ে নিরাপদ জীবন চায় না, বরং একাকী নেকড়ে হয়ে কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
শব্দের তরবারি: মেটালের গানে কথা, কবিতা ও দর্শনের ব্যবচ্ছেদ
সঙ্গীতের শরীর যদি হয় সুর আর রিদম, তবে তার আত্মা হলো কথা বা লিরিক্স (Lyrics)। মেটাল মিউজিকের ক্ষেত্রে এই কথাটি আরও বেশি সত্যি। এর তীব্র, কর্কশ শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় সাহিত্যিক জগৎ। অনেকের কাছে মেটালের ভোকাল কেবল দুর্বোধ্য গর্জন বা চিৎকার মনে হতে পারে, কিন্তু সেই চিৎকারের পেছনে যে শব্দগুলো থাকে, তা প্রায়শই গভীর দর্শন, মহাকাব্যিক গল্প আর তীক্ষ্ণ সামাজিক সমালোচনায় ভরা।
মেটালের লিরিক্স কোনো হালকা চালের প্রেমের কবিতা নয়। এটি তরবারির মতো – তীক্ষ্ণ, ধারালো এবং প্রায়শই রক্তমাখা। এটি জীবনের সেইসব দিক নিয়ে কথা বলে, যা নিয়ে কথা বলতে আমরা ভয় পাই বা অস্বস্তি বোধ করি। চলুন, মেটালের এই শব্দ-তরবারিকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখা যাক। এর বিষয়বস্তু, সাহিত্যিক কৌশল এবং পেছনের তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করা যাক।
লিরিক্সের বিষয়বস্তু: অন্ধকারের বর্ণমালা
মেটাল মিউজিকের লিরিক্স হলো এক বিশাল গ্রন্থাগার, যার প্রতিটি তাক ভিন্ন ভিন্ন অন্ধকার এবং আলো-আঁধারি গল্পে ভরা। এই গ্রন্থাগারের বইগুলোর মলাট হয়তো ভীতিকর, অক্ষরগুলো হয়তো রক্ত দিয়ে লেখা, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে মানব অভিজ্ঞতার এক বিশাল এবং সৎ বর্ণালী। জঁরা (Genre) ভেদে এর থিম বা বিষয়বস্তু পাল্টে যায় – পাওয়ার মেটালের ড্রাগন যেমন ডেথ মেটালের ব্যবচ্ছেদ টেবিল থেকে অনেক দূরে, তেমনি ব্ল্যাক মেটালের বরফ-ঢাকা জঙ্গলও থ্র্যাশ মেটালের পারমাণবিক যুদ্ধক্ষেত্রের থেকে ভিন্ন। কিন্তু এই সমস্ত বৈচিত্র্যের গভীরে একটি সাধারণ স্রোত বয়ে চলে: মেটাল মূলত সেইসব বিষয় নিয়ে কাজ করে যা সমাজের মূলধারা হয় এড়িয়ে চলে, নয়তো চিনির প্রলেপ দিয়ে বা শ্যুগারকোটিং করে উপস্থাপন করে। চলুন, এই অন্ধকারের বর্ণমালা দিয়ে লেখা কিছু প্রধান অধ্যায় আরও গভীরভাবে পাঠ করা যাক।
বিদ্রোহ, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা (Anti-Establishment) এবং সামাজিক সমালোচনা
মেটালের জন্মই হয়েছে একটি বিদ্রোহী চিৎকার হিসেবে। এই চিৎকার সমাজের ভণ্ডামি, অবিচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। তাই এর লিরিক্সে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটি কেন্দ্রীয় এবং চিরস্থায়ী থিম।
- যুদ্ধ, রাজনীতি এবং কর্পোরেট লোভ: মেটাল কখনোই যুদ্ধকে মহিমান্বিত করেনি; বরং যুদ্ধবাজদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা ব্ল্যাক সাবাথের (Black Sabbath) ‘War Pigs’ গানটি আজও প্রাসঙ্গিক। এর লিরিক্সে রাজনীতিবিদদের তুলনা করা হয়েছে কালো জাদুর অনুষ্ঠানে মত্ত ডাইনিদের সাথে, যারা যুদ্ধকে একটি খেলা মনে করে এবং সাধারণ মানুষকে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করে। স্নায়ুযুদ্ধের পারমাণবিক আতঙ্কে লেখা মেগাডেথের (Megadeth) ‘Peace Sells…’ অ্যালবামটি রিগ্যান-যুগের আমেরিকার এক তীক্ষ্ণ সমালোচনা, যেখানে মাস্টেইন প্রশ্ন করছেন, “শান্তি বিক্রি হয়, কিন্তু কিনছেটা কে?”। থ্র্যাশ মেটাল (Thrash Metal) জঁরাটি তো প্রায় পুরোটাই এই সামাজিক ও রাজনৈতিক সমালোচনার ওপর দাঁড়িয়ে। অ্যানথ্রাক্স (Anthrax) তাদের ‘Indians’ গানে আমেরিকার আদিবাসীদের প্রতি ঐতিহাসিক অবিচারের কথা বলেছে, আবার মিনিস্ট্রি (Ministry)-র মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটাল ব্যান্ড তাদের গানে জর্জ বুশ প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেছে। সিস্টেম অফ এ ডাউন (System of a Down)-এর মতো আধুনিক ব্যান্ডগুলো তাদের পরাবাস্তব কিন্তু তীক্ষ্ণ লিরিক্সে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি, মিডিয়ার ভণ্ডামি, কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং পরিবেশ দূষণের মতো জটিল বিষয়গুলোকে একসাথে আক্রমণ করেছে (Bashe, 2011)।
- ধর্মীয় সমালোচনা এবং আধ্যাত্মিক অন্বেষণ: মেটাল ঐতিহাসিকভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে প্রভাবশালী খ্রিস্টধর্মের কঠোর সমালোচক। এই সমালোচনা শয়তানের উপাসনা থেকে আসে না, বরং আসে ধর্মের নামে চালানো ভণ্ডামি, নিয়ন্ত্রণ এবং ঐতিহাসিক নিপীড়নের উপলব্ধি থেকে। ব্ল্যাক সাবাথের ‘After Forever’ গানে প্রশ্ন করা হয়েছে, “Would you like to see the Pope on the end of a rope? Do you think he’s a fool?”। স্লেয়ার (Slayer) তাদের ‘Jesus Saves’ গানে টেলিভিশন ধর্মপ্রচারকদের (Televangelist) লোভ এবং দুর্নীতির কথা বলেছে। ব্ল্যাক মেটাল (Black Metal) এই সমালোচনাকে এক দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছে। নরওয়ের ব্যান্ডগুলো খ্রিস্টধর্মকে একটি বিদেশি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে দেখে, যা তাদের নর্ডিক পৌত্তলিক (Pagan) ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে প্রচণ্ডভাবে ধ্বংস করেছে। তাই তাদের খ্রিস্ট-বিরোধিতা কেবল ধর্মীয় নয়, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিরোধও। তাদের লিরিক্সে প্রায়শই নিৎশের (Nietzsche) দর্শনের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে তারা দাসত্বের নৈতিকতাকে (Slave morality) প্রত্যাখ্যান করে এবং এক শক্তিশালী, প্রকৃতি-ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার সন্ধান করে (Moynihan & Søderlind, 2003)।
অন্ধকার, মৃত্যু এবং মানব অস্তিত্বের সংকট
মেটাল জীবনের কঠিন এবং অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো থেকে পালিয়ে যায় না। এটি এক আয়নার মতো, যা আমাদের নিজেদের নশ্বরতা, একাকীত্ব এবং মানসিক সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
- মৃত্যু, নশ্বরতা এবং জীবনের অর্থ: ডেথ মেটাল (Death Metal) নামের মধ্যেই এর প্রধান বিষয়বস্তু লুকিয়ে আছে। গোড়ার দিকে, পসেসড (Possessed) বা প্রারম্ভিক ডেথ ব্যান্ডের লিরিক্সে মৃত্যু এবং শয়তানি থিম প্রাধান্য পেত। কিন্তু জঁরাটি যত পরিণত হয়েছে, এর লিরিক্সও তত গভীর হয়েছে। চাক শুলডিনারের (Chuck Schuldiner) ব্যান্ড ডেথ (Death) এই বিবর্তনের সেরা উদাহরণ। তাদের শেষ দিকের অ্যালবামগুলোতে মৃত্যু নিয়ে গ্রাফিক বর্ণনার পরিবর্তে মৃত্যুভয়, অনুশোচনা এবং জীবনের ভঙ্গুরতার মুখে দাঁড়িয়ে অর্থ খোঁজার মতো গভীর দার্শনিক প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে। তাদের ‘Symbolic’ বা ‘The Sound of Perseverance’ অ্যালবামের লিরিক্সগুলো যেন অস্তিত্ববাদী (Existentialist) কবিতা, যা শ্রোতাকে ভাবতে বাধ্য করে। ডুম মেটাল (Doom Metal) ব্যান্ড, যেমন মাই ডাইং ব্রাইড (My Dying Bride), তাদের দীর্ঘ, বিষাদময় গানে মৃত্যু এবং শোককে এক রোমান্টিক কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক রূপে উপস্থাপন করে, যা অনেকটা গথিক সাহিত্যের মতো।
- মানসিক যন্ত্রণা, বিষণ্ণতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ (Mental Anguish, Depression, and Alienation): মেটাল সেইসব মানুষের কণ্ঠস্বর, যারা নিজেদের সমাজের মূলধারার সাথে মেলাতে পারে না, যারা একা, বিষণ্ণ এবং বহিষ্কৃত। এই অনুভূতি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে নু মেটাল (Nu Metal) জঁরাতে। কর্ন (Korn)-এর ভোকালিস্ট জোনাথন ডেভিসের (Jonathan Davis) লিরিক্স ছিল তার ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো। সেখানে তার শৈশবের ট্রমা, বুলিং, যৌন নির্যাতন এবং বিষণ্ণতার কাঁচা এবং ফিল্টারবিহীন প্রকাশ ছিল। তার গান ‘Daddy’ এই ধারার এক ভয়ঙ্কর কিন্তু শক্তিশালী উদাহরণ। এই চরম সততা কোটি কোটি তরুণের ব্যক্তিগত যন্ত্রণার সাথে মিলে গিয়েছিল এবং তাদের বুঝিয়েছিল যে, তারা একা নয়। লিঙ্কিন পার্কের (Linkin Park) চেস্টার বেনিংটনের (Chester Bennington) লিরিক্সেও এই মানসিক সংগ্রাম এবং আত্মহত্যার চিন্তার সাথে লড়াইয়ের কথা বারবার ফিরে এসেছে, যা দুঃখজনকভাবে তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আর্টসেলের (Artcell) ‘দুঃখবিলাস’-এর মতো গানেও এই শহুরে একাকীত্ব এবং অস্তিত্বের সংকটের এক কাব্যিক চিত্র ফুটে ওঠে।
ফ্যান্টাসি, মিথোলজি এবং ইতিহাস: বাস্তব থেকে পলায়ন নয়, বিকল্প বাস্তবতার নির্মাণ
মেটাল শুধু বাস্তব পৃথিবীর অন্ধকার নিয়েই কথা বলে না, এটি প্রায়শই আমাদের কল্পনার জগতে নিয়েও যায়। তবে এটি নিছক বাস্তবতা থেকে পলায়ন (Escapism) নয়, বরং এটি বিকল্প জগৎ এবং বীরত্বের গল্পের মাধ্যমে বর্তমানের হতাশার বিরুদ্ধে এক ধরনের রূপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
- মহাকাব্যিক ফ্যান্টাসি এবং সাহিত্য: জে. আর. আর. টলকিনের (J. R. R. Tolkien) ‘দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস’ (The Lord of the Rings) এবং অন্যান্য ফ্যান্টাসি সাহিত্য মেটাল লিরিক্সের জন্য এক অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। লেড জেপেলিনের (Led Zeppelin) ‘Ramble On’ বা ‘The Battle of Evermore’ গানে টলকিনের জগতের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাওয়ার মেটাল (Power Metal) জঁরাটি তো প্রায় পুরোটাই ড্রাগন, তলোয়ার, জাদু এবং মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর লড়াইয়ের গল্প বলে। জার্মানির ব্লাইন্ড গার্ডিয়ান (Blind Guardian) ব্যান্ডটিকে তো ‘মেটালের টলকিন’ বলা হয়। তারা টলকিনের ‘দ্য সিলমারিলিওন’ (The Silmarillion)-এর ওপর ভিত্তি করে একটি পুরো কনসেপ্ট অ্যালবাম (‘Nightfall in Middle-Earth’) তৈরি করেছে। এই গল্পগুলো শ্রোতাকে এক ধরনের শক্তি এবং আশা দেয়, যা তাদের বাস্তব জীবনের লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত করে।
- মিথোলজি এবং ইতিহাস: আয়রন মেইডেন (Iron Maiden) ইতিহাস এবং মিথোলজিকে তাদের লিরিক্সের ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করায় অদ্বিতীয়। তাদের ‘Powerslave’ গানে এক ফারাওয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুকে দেখা হয়েছে, ‘Alexander the Great’ গানে মহান আলেকজান্ডারের বীরত্বগাঁথা বর্ণিত হয়েছে, বা ‘The Trooper’ গানে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের এক সাধারণ সৈনিকের করুণ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। ভাইকিং মেটাল (Viking Metal) ব্যান্ড, যেমন অ্যামন অ্যামার্থ (Amon Amarth) বা এনসিফেরাম (Ensiferum), তাদের গানে নর্স মিথোলজি (Norse Mythology), ভাইকিংদের সমুদ্রযাত্রা এবং যুদ্ধের গল্প বলে। এটি শুধু গল্প বলা নয়, এটি তাদের জন্য নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পরিচয়কে পুনরুজ্জীবিত এবং উদযাপন করার একটি উপায়ও।
সীমা লঙ্ঘন এবং ট্যাবু: নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ
মেটালের কিছু চরমপন্থী শাখা সচেতনভাবেই সমাজের সবচেয়ে নিষিদ্ধ বা ট্যাবু (Taboo) বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। এর উদ্দেশ্য হলো শ্রোতাকে ধাক্কা দেওয়া, অস্বস্তিতে ফেলা এবং সমাজের নৈতিকতার সীমানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
ক্যানিবাল করপসের (Cannibal Corpse) মতো গোরগ্রাইন্ড (Goregrind) ব্যান্ডগুলোর লিরিক্সে মৃত্যু, খুন এবং শারীরিক বিকৃতির যে গ্রাফিক, পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং প্রায়শই হাস্যকর রকম অতিরঞ্জিত বর্ণনা থাকে, তা অনেকটা ৮০-র দশকের স্ল্যাশার (Slasher) বা হরর সিনেমার মতো। তাদের গানের শিরোনাম, যেমন ‘I Cum Blood’ বা ‘Hammer Smashed Face’, ইচ্ছাকৃতভাবেই আঘাত বা শক তৈরি করার জন্য লেখা। সমাজতত্ত্ববিদ কিথ কান-হ্যারিস (Keith Kahn-Harris) একে এক ধরনের ‘ট্রান্সগ্রেসিভ প্লে’ (Transgressive play) বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে শিল্পী এবং শ্রোতা উভয়েই জানে যে এটি একটি ফ্যান্টাসি। এর উদ্দেশ্য বাস্তব সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া নয়, বরং সমাজের ভালো-মন্দের কৃত্রিম বিভাজনকে উপহাস করা এবং আমাদের ভয়ের সীমানাকে পরীক্ষা করা। এটি শিল্পের একটি চরম রূপ, যা দেখায় যে শিল্পের কোনো পবিত্র বা নিষিদ্ধ এলাকা থাকতে পারে না, এবং এটি সবার জন্য নয়, হওয়ার কথাও নয় (Purcell, 2003)। এই সীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে মেটাল তার স্বাধীনতা এবং আপসহীনতাকে প্রকাশ করে।
লিরিক্সের সাহিত্যিক কৌশল এবং তাত্ত্বিক দিক
মেটাল মিউজিকের লিরিক্সকে যদি কেবল তার বিস্ফোরক বিষয়বস্তুর জন্য বিচার করা হয়, তবে এর প্রতি অবিচার করা হবে। এর আসল শক্তি এবং গভীরতা লুকিয়ে আছে এর ভাষা, গঠন এবং উপস্থাপনার কৌশলের মধ্যে। মেটালের গীতিকাররা কেবল গল্প বলেন না, তারা শব্দ দিয়ে ছবি আঁকেন, দর্শন তৈরি করেন এবং মানব অভিজ্ঞতার জটিলতাকে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন সাহিত্যিক ও শৈল্পিক কৌশল ব্যবহার করেন। এই কৌশলগুলোই মেটালের লিরিক্সকে অ্যাকাডেমিক আলোচনার এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছে, যেখানে সাহিত্যতত্ত্ব থেকে শুরু করে দর্শন এবং জেন্ডার স্টাডিজ – সবকিছুরই প্রয়োগ সম্ভব।
ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি (Intertextuality): অন্য গ্রন্থের প্রতিধ্বনি এবং সাংস্কৃতিক পুঁজি
মেটালের লিরিক্স কখনোই একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকে না। এটি প্রায়শই অন্যান্য সাহিত্য, কবিতা, সিনেমা, দর্শন, ইতিহাস বা মিথোলজির সাথে এক ধরনের নিরন্তর সংলাপে লিপ্ত থাকে। সাহিত্যতত্ত্বে এই প্রক্রিয়াকে ‘ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি’ (Intertextuality) বলা হয়, যার মূল কথা হলো – কোনো টেক্সটই শূন্য থেকে তৈরি হয় না, প্রতিটি টেক্সটই তার পূর্ববর্তী টেক্সটগুলোর প্রতিধ্বনি বহন করে।
মেটাল এই কৌশলটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যখন ব্লাইন্ড গার্ডিয়ান (Blind Guardian) জে. আর. আর. টলকিনের (J. R. R. Tolkien) জটিল জগৎ ‘সিলমারিলিওন’ (The Silmarillion)-এর ওপর ভিত্তি করে একটি পুরো কনসেপ্ট অ্যালবাম (‘Nightfall in Middle-Earth’) তৈরি করে, বা যখন আয়রন মেইডেন (Iron Maiden) স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের (Samuel Taylor Coleridge) দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য রাইম অফ দি অ্যানশিয়েন্ট ম্যারিনার’ (‘The Rime of the Ancient Mariner’)-কে প্রায় হুবহু অনুসরণ করে একটি ১৭ মিনিটের মহাকাব্যিক গানে রূপান্তরিত করে, তখন তারা কেবল গল্প ধার করছে না। তারা সেই মূল টেক্সটের সাংস্কৃতিক ওজন (Cultural weight) এবং অর্থকে তাদের সঙ্গীতের সাথে যুক্ত করে একটি নতুন, বহুস্তরীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করছে।
একজন শ্রোতা যে এই মূল টেক্সটগুলো সম্পর্কে জানে, তার কাছে গানটির আবেদন অনেক বেশি গভীর হয়। সে গানের প্রতিটি লাইনের সাথে মূল গল্পের সংযোগ স্থাপন করতে পারে, যা শোনার অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করে। এটি মেটাল সংস্কৃতিতে এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক পুঁজি’ (Cultural capital) তৈরি করে, যা ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ের বুরদিউ (Pierre Bourdieu)-র একটি ধারণা। অর্থাৎ, কোন ব্যান্ড কোন বই বা দর্শন থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছে, তা জানা এবং বোঝা মেটালহেড কমিউনিটির মধ্যে এক ধরনের জ্ঞান এবং সম্মানের প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি মেটালকে একটি ‘শিক্ষিত’ বা ‘জ্ঞানী’ মানুষের সঙ্গীত হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করে, যা কেবল কাঁচা আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং গভীর বৌদ্ধিক চর্চারও ফসল (O’Flynn, 2017)। মেটালিকার (Metallica) ‘For Whom the Bell Tolls’ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের (Ernest Hemingway) উপন্যাস ছাড়া ভাবা যায় না, আবার তাদের ‘One’ ডালটন ট্রাম্বোর (Dalton Trumbo) সিনেমা ‘Johnny Got His Gun’ ছাড়া অসম্পূর্ণ। এই ইন্টারটেক্সচুয়াল সংযোগগুলো মেটালের লিরিক্সকে একটি সাধারণ গানের কথা থেকে সাহিত্যিক টেক্সটের মর্যাদায় উন্নীত করে।
নান্দনিকতা এবং সাবলাইম (Aesthetics and the Sublime): ভয়ের নান্দনিক রূপ
মেটালের লিরিক্সে যে ভয়, বিশালতা, যন্ত্রণা এবং অন্ধকারের বর্ণনা থাকে, তা দার্শনিক নান্দনিকতার (Aesthetics) একটি কেন্দ্রীয় ধারণার সাথে সম্পর্কিত – ‘দ্য সাবলাইম’ (The Sublime)। অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিক এডমান্ড বার্ক (Edmund Burke) এবং ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) ‘সুন্দর’ (The Beautiful) এবং ‘সাবলাইম’-এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য করেছিলেন। সুন্দর হলো তা-ই যা আমাদের ইন্দ্রিয়কে আনন্দ দেয়, যা সুরেলা, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শান্ত। একটি সুন্দর ফুল বা একটি মিষ্টি সুর আমাদের মনে স্বস্তি এনে দেয়। অন্যদিকে, সাবলাইম হলো সেই অভিজ্ঞতা যা আমাদের অভিভূত করে, যা আমাদের বোধ এবং ধারণার সীমানাকে ছাড়িয়ে যায়। এটি বিশাল, শক্তিশালী, বিশৃঙ্খল এবং প্রায়শই ভয়ঙ্কর। যেমন – একটি ভয়াল সামুদ্রিক ঝড়, একটি অগ্ন্যুৎপাত বা অনন্ত মহাকাশের ধারণা। এই অভিজ্ঞতা আমাদের নিজেদের তুচ্ছতা এবং সীমাবদ্ধতাকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করায়, যা একই সাথে ভয় এবং এক ধরনের বিস্ময়কর, প্রায় আধ্যাত্মিক আনন্দের জন্ম দেয়।
মেটালের লিরিক্স এবং সঙ্গীত সচেতনভাবেই এই সাবলাইমের অভিজ্ঞতা তৈরি করার চেষ্টা করে। এইচ. পি. লাভক্র্যাফটের (H. P. Lovecraft) গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা ডেথ মেটাল ব্যান্ডের লিরিক্সে যে মহাজাগতিক আতঙ্কের (Cosmic Horror) বর্ণনা থাকে, যেখানে মানবতা এক বিশাল, অনুভূতিহীন মহাবিশ্বের তুলনায় ধূলিকণার মতো তুচ্ছ, তা শ্রোতাকে সাবলাইমের মুখোমুখি করে। সিমফোনিক মেটালের (Symphonic Metal) বিশাল অর্কেস্ট্রাল আয়োজন এবং অপেরার মতো গায়কী, বা ব্ল্যাক মেটালের সঙ্গীতে প্রকৃতির রুদ্র, বরফ-ঢাকা, অমানবিক রূপের বর্ণনা – এই সবকিছুই শ্রোতাকে একটি সাবলাইম অভিজ্ঞতা দেওয়ার প্রচেষ্টা। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আরামদায়ক জগৎ থেকে বের করে এনে অস্তিত্বের বিশালতা, শক্তি এবং ভয়ঙ্করতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যেও এক ধরনের সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়াই মেটালের নান্দনিকতার একটি বড় অংশ (Kane, 2020)।
পারফর্মেন্স এবং কণ্ঠের ভূমিকা: যখন চিৎকার হয়ে ওঠে অর্থ (Semantics)
মেটালের লিরিক্সকে কেবল বইয়ের পাতায় ছাপা অক্ষরের মতো পড়লে এর অর্ধেক সৌন্দর্যই হারিয়ে যায়। এটি কীভাবে গাওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ এর পারফর্মেন্স (Performance), লিরিক্সের অর্থের একটি অবিচ্ছেদ্য এবং শক্তিশালী অংশ। ডেথ মেটালের গ্রোল (Growl), ব্ল্যাক মেটালের শ্রিক (Shriek) বা হার্ডকোরের স্ক্রিম (Scream) কেবল একটি কণ্ঠের স্টাইল নয়, এটি একটি অর্থপূর্ণ শৈল্পিক পছন্দ।
ভাষাতাত্ত্বিক এবং সঙ্গীততত্ত্ববিদরা যুক্তি দেখান যে, এই ‘অমানবিক’ (Inhuman) বা ‘দানবীয়’ (Monstrous) কণ্ঠস্বরগুলো লিরিক্সের বিষয়বস্তুকে আরও শক্তিশালী এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। যখন একজন ভোকালিস্ট মৃত্যু, যন্ত্রণা বা মহাজাগতিক আতঙ্ক নিয়ে গ্রোল করে, তখন তার কণ্ঠ মানবীয় ভাষার স্বাভাবিক সীমানা পেরিয়ে যায়। এটি যেন সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সরাসরি শারীরিক প্রকাশ, যা কেবল শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। এই কণ্ঠস্বর অনেক সময় লিরিক্সের শব্দগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বোধ্য (Unintelligible) করে তোলে। কিন্তু এর বিনিময়ে এটি গানের আবেগ এবং আবহকে (Atmosphere) হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। এখানে কণ্ঠস্বর কেবল শব্দ বহনকারী একটি বাহন নয়, এটি নিজেই একটি বাদ্যযন্ত্র, যা অনুভূতির টেক্সচার বা বুনন তৈরি করে। এই কণ্ঠস্বর মানবকেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষাকে (Anthropocentric worldview) চ্যালেঞ্জ করে এবং শ্রোতাকে এক আদিম, প্রাক-ভাষাগত (Pre-linguistic) অভিজ্ঞতার জগতে নিয়ে যায়, যেখানে আবেগ শব্দের চেয়েও বেশি শক্তিশালী (Hill, 2011)।
ম্যাসকুলিনিটি এবং জেন্ডার পারফর্মেন্স: শক্তির বহুবিধ রূপ
মেটালের লিরিক্স এবং সংস্কৃতি ঐতিহাসিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত এবং সমালোচিত। শক্তি, আগ্রাসন, যুদ্ধ, বীরত্ব এবং যৌন দক্ষতার মতো থিমগুলো প্রায়শই এক ধরনের হাইপার-ম্যাসকুলিনিটির (Hypermasculinity) প্রকাশ ঘটায়, যা নারী এবং প্রচলিত পুরুষত্বের ধারণার বাইরের সবাইকে প্রান্তিক করে তোলে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক গবেষকরা, বিশেষ করে জেন্ডার স্টাডিজের তাত্ত্বিকরা দেখান যে, মেটালের এই ম্যাসকুলিনিটি একমাত্রিক বা স্থির নয়, বরং এটি বিভিন্ন এবং প্রায়শই স্ববিরোধী রূপে প্রকাশিত হয়।
- বিভিন্ন ধরনের ম্যাসকুলিনিটি: আশির দশকের গ্ল্যাম মেটালের অ্যান্ড্রোজিনাস (Androgynous) বা উভলিঙ্গীয় সাজসজ্জা, মেকআপ এবং গানের কথায় যে প্রেম ও বিরহের মতো সংবেদনশীল বিষয়ের প্রাধান্য, তা রক সঙ্গীতের প্রচলিত মাচো (Macho) পুরুষত্বের ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল। আবার, গথিক (Gothic) বা ডুম মেটালের (Doom Metal) লিরিক্সে যে বিষণ্ণতা, আত্মকরুণা এবং অনুভূতিনির্ভর দুর্বলতার কাব্যিক প্রকাশ, তাও প্রচলিত পুরুষালি শক্তির ধারণার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি দেখায় যে, মেটালের মধ্যেই পুরুষত্বের বিভিন্ন মডেল নিয়ে এক ধরনের নিরন্তর দর কষাকষি চলে।
- নারী শিল্পীদের ভূমিকা এবং জেন্ডারকে চ্যালেঞ্জ: আর্চ এনিমি (Arch Enemy)-র অ্যাঞ্জেলা গসো (Angela Gossow) বা অ্যালিসা হোয়াইট-গ্লাজ (Alissa White-Gluz)-এর মতো নারী শিল্পীরা যখন ডেথ মেটালের মতো একটি চরম পুরুষতান্ত্রিক জঁরায় সফলভাবে গ্রোল করেন, তখন তারা জেন্ডার সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দেন। তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি এবং কণ্ঠ প্রমাণ করে যে, আগ্রাসন, শক্তি বা তীব্রতা কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। জিনজির (Jinjer) ব্যান্ডের তাতিয়ানা শামাইলিয়ুক (Tatiana Shmailyuk) তার অবিশ্বাস্য ভোকাল রেঞ্জ দিয়ে ক্লিন, জ্যাজি সুর থেকে মুহূর্তের মধ্যে হিংস্র গ্রোলে চলে যেতে পারেন, যা নারীত্বের প্রচলিত বাইনারি ধারণাকেই অস্বীকার করে।
মেটালের লিরিক্স এবং পারফর্মেন্স তাই জেন্ডার পারফর্মেন্স (Gender Performance) নিয়ে গবেষণার জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র। এটি দেখায় কীভাবে সঙ্গীতের মাধ্যমে পুরুষত্ব এবং নারীত্বের বিভিন্ন, জটিল এবং প্রায়শই স্ববিরোধী রূপ নির্মিত, প্রদর্শিত এবং চ্যালেঞ্জ করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে, মেটালের জগৎ যতটা পিতৃতান্ত্রিক মনে হয়, তার ভেতরেই সেই পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্ন করার এবং ভাঙার উপাদানও লুকিয়ে আছে।
চিৎকারের পেছনের কবিতা
মেটালের লিরিক্স হলো এক জটিল এবং বহুস্তরীয় জগৎ। এটি একই সাথে মহাকাব্য, রাজনৈতিক ইশতেহার, ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং দার্শনিক প্রবন্ধ। এটি এমন এক সাহিত্য যা পড়া হয় না, বরং অনুভব করা হয় – কানের ভেতর দিয়ে, শরীরের ঝাঁকুনি দিয়ে।
যারা এই গোলমালের চিৎকারের ভয়ে এর থেকে দূরে থাকেন, তারা হয়তো এর ভেতরের কবিতা, গল্প আর চিন্তার বিশাল জগৎটাকে আর আবিষ্কার করতে পারেন না। কিন্তু যারা একবার সেই চিৎকারের পেছনের শব্দগুলোকে শুনতে পায়, তাদের জন্য এটি হয়ে ওঠে এক অফুরন্ত অনুপ্রেরণা এবং গভীর চিন্তার উৎস। মেটালের লিরিক্স প্রমাণ করে যে, সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতাগুলো সবসময় শান্ত স্বরে পাঠ করা হয় না। কিছু কবিতা তরবারির মতো ঝনঝন করে ওঠে, আর কিছু কবিতা ঝড়ের মতো গর্জন করে।
শব্দের আয়নায় সাহিত্য: মেটালের লিরিক্সে কবিতার পদচিহ্ন
মেটাল মিউজিকের লিরিক্স কেবল গানের কথা নয়, এটি এক স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী সাহিত্যিক প্রকাশ। এর তীব্র, কর্কশ শব্দের আড়ালে যে শব্দমালা সাজানো থাকে, তা প্রায়শই নির্দিষ্ট কিছু সাহিত্যিক আন্দোলন (Literary Movement), জঁরা (Literary Genre) এবং শৈলীর (Literary Style) সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যদি আমরা মেটালের গানগুলোকে নিছক সঙ্গীত হিসেবে না দেখে, এক ধরনের ‘পারফর্মড পোয়েট্রি’ (Performed poetry) বা মঞ্চস্থ কবিতা হিসেবে দেখি, তাহলে এর সাহিত্যিক বংশলতিকা খুঁজে পাওয়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
মেটালের গীতিকাররা হয়তো নিজেদের কবি বলে পরিচয় দেন না, কিন্তু তাদের কাজগুলো প্রায়শই সেইসব কবি ও লেখকের চিন্তার প্রতিধ্বনি করে, যারা প্রচলিত সৌন্দর্যবোধকে অস্বীকার করে মানব অভিজ্ঞতার অন্ধকার, বিশৃঙ্খল এবং মহাকাব্যিক দিকগুলোকে তুলে ধরেছেন। চলুন, মেটালের লিরিক্সের বইয়ের তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে দেখি, সেখানে কোন কোন সাহিত্যিক ধারার পদচিহ্ন লেগে আছে।
রোমান্টিসিজম (Romanticism) এবং তার অন্ধকার যমজ ভাই: গথিক (Gothic)
মেটালের সাহিত্যিক ডিএনএ-র (DNA) সবচেয়ে বড় অংশটি সম্ভবত এসেছে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক এবং গথিক আন্দোলন থেকে। এই দুটি ধারা ছিল যুক্তির যুগের (Age of Reason) শীতল, নিয়ন্ত্রিত চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে এক আবেগঘন বিদ্রোহ।
- রোমান্টিসিজম (Romanticism): রোমান্টিক কবিরা – যেমন লর্ড বায়রন (Lord Byron), পার্সি বিশি শেলি (Percy Bysshe Shelley) বা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (William Wordsworth) – ব্যক্তি মানুষের আবেগ, কল্পনা, প্রকৃতি এবং অতিপ্রাকৃতের প্রতি গভীর আকর্ষণকে গুরুত্ব দিতেন। তারা ‘বায়রনিক হিরো’ (Byronic Hero)-র ধারণা তৈরি করেন – একজন বুদ্ধিমান, আবেগপ্রবণ, বিষণ্ণ এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নায়ক, যে নিজের তৈরি নৈতিকতা দিয়ে চলে। মেটালের অনেক লিরিক্সের নায়কই যেন এই বায়রনিক হিরোর আধুনিক সংস্করণ। পাওয়ার মেটালের (Power Metal) মহাকাব্যিক আখ্যান, প্রকৃতির বিশাল এবং প্রায়শই ভয়ঙ্কর রূপের বর্ণনা (যাকে রোমান্টিকরা ‘সাবলাইম’ বলত), এবং ব্যক্তিগত বীরত্ব ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মধ্যে রোমান্টিকতার ছাপ স্পষ্ট। সিমফোনিক মেটাল (Symphonic Metal) ব্যান্ড নাইটউইশ (Nightwish)-এর অনেক গানেই এই রোমান্টিক আবেগ এবং প্রকৃতির প্রতি বিস্ময়বোধ ফুটে ওঠে।
- গথিক সাহিত্য (Gothic Literature): রোমান্টিসিজমের এই আবেগ যখন আরও অন্ধকার, রহস্যময় এবং ভয়ঙ্কর রূপ নেয়, তখনই গথিক সাহিত্যের জন্ম। মেরি শেলির (Mary Shelley) ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, ব্রাম স্টোকারের (Bram Stoker) ‘ড্রাকুলা’, হোরেস ওয়ালপোলের (Horace Walpole) ‘দ্য ক্যাসেল অফ অট্রান্টো’ বা এডগার অ্যালান পোর (Edgar Allan Poe) গল্প ও কবিতাগুলো গথিক সাহিত্যের সেরা উদাহরণ। এর বৈশিষ্ট্য হলো – পুরোনো, ভাঙা দুর্গ; অতিপ্রাকৃত সত্তা (ভ্যাম্পায়ার, ভূত); মানসিক বিকার; মৃত্যু, ক্ষয় এবং নিষিদ্ধ প্রেমের মতো থিম। এই ধারাটি সরাসরি ডুম মেটাল (Doom Metal) এবং গথিক মেটাল (Gothic Metal) জঁরার জন্ম দিয়েছে। প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost), মাই ডাইং ব্রাইড (My Dying Bride) বা টাইপ ও নেগেটিভ (Type O Negative)-এর মতো ব্যান্ডের লিরিক্সে যে বিষণ্ণতা, হারানো প্রেম, মৃত্যুর প্রতি আকর্ষণ এবং ভ্যাম্পায়ারের মতো রূপকের ব্যবহার, তা সরাসরি গথিক সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত। ক্রেডল অফ ফিলথ (Cradle of Filth) তো তাদের পুরো নান্দনিকতাই তৈরি করেছে গথিক হরর এবং ভিক্টোরিয়ান যুগের ক্ষয়িষ্ণু সৌন্দর্যের ওপর ভিত্তি করে (Baddeley, 2002)।
আধুনিকতাবাদ (Modernism) এবং অস্তিত্ববাদ (Existentialism): ভাঙা পৃথিবীর টুকরো
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের ফলে মানুষের পৃথিবী দেখার চোখটাই পাল্টে যায়। এই ভাঙা, খণ্ডিত এবং অর্থহীন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে আধুনিকতাবাদী (Modernist) সাহিত্য এবং অস্তিত্ববাদী (Existentialist) দর্শনে। মেটালের লিরিক্সে এই ভাঙনের প্রতিধ্বনি খুব জোরালো।
- আধুনিকতাবাদ (Modernism): টি. এস. এলিয়ট (T. S. Eliot), এজরা পাউন্ড (Ezra Pound) বা জেমস জয়েসের (James Joyce) মতো আধুনিকতাবাদী লেখকরা পুরোনো, সুসংহত আখ্যানকে ভেঙে দিয়েছিলেন। তাদের লেখায় ছিল খণ্ড-বিচ্ছিন্ন চিত্র, চেতনার স্রোত (Stream of consciousness), বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) এবং একটি অর্থহীন পৃথিবীতে অর্থ খোঁজার সংগ্রাম। মেটালের অনেক লিরিক্স, বিশেষ করে প্রগ্রেসিভ মেটাল (Progressive Metal) বা কিছু অ্যাভান্ট-গার্ড (Avant-garde) মেটালের লিরিক্সে এই আধুনিকতাবাদী কৌশল লক্ষ্য করা যায়। টুল (Tool) ব্যান্ডের মেনার্ড জেমস কিনানের (Maynard James Keenan) লিরিক্স প্রায়শই দুর্বোধ্য, প্রতীকী এবং বহুস্তরীয়, যা শ্রোতাকে নিজের মতো করে অর্থ তৈরি করতে বাধ্য করে। এটি অনেকটা এলিয়টের ‘The Waste Land’ পড়ার মতো অভিজ্ঞতা।
- অস্তিত্ববাদ (Existentialism): জঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre), অ্যালবেয়ার কামু (Albert Camus) বা ফিওদর দস্তয়েভস্কির (Fyodor Dostoevsky) মতো লেখকদের হাত ধরে অস্তিত্ববাদ জনপ্রিয় হয়। এর মূল কথা হলো – এই মহাবিশ্ব উদাসীন এবং ঈশ্বরহীন। মানুষ এই অর্থহীন জগতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এবং তাকে তার নিজের কাজের মাধ্যমেই জীবনের অর্থ তৈরি করতে হবে। এই স্বাধীনতা একই সাথে এক বিশাল ভার। এই অস্তিত্বের সংকট, একাকীত্ব, অ্যাবসার্ডিটি (Absurdity) এবং স্বাধীনতার ভার মেটালের একটি কেন্দ্রীয় থিম। ডেথ (Death) ব্যান্ডের লিরিক্সে এই অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো বারবার ফিরে এসেছে। স্লিপনট (Slipknot)-এর লিরিক্সে যে তীব্র রাগ এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ, তা যেন এক অস্তিত্ববাদী আর্তনাদ – এই অর্থহীন, ভণ্ড পৃথিবীতে আমি আমার অস্তিত্বকে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করব?
পরাবাস্তববাদ (Surrealism) এবং বীট জেনারেশন (Beat Generation): যুক্তির শৃঙ্খল ভাঙা
মেটালের লিরিক্স সবসময় সরলরৈখিক গল্প বলে না। কখনো কখনো এটি যুক্তির জগৎ পেরিয়ে স্বপ্নের, দুঃস্বপ্নের এবং চেতনার গভীরের এক বিচিত্র জগতে প্রবেশ করে।
- পরাবাস্তববাদ (Surrealism): সালভাদর দালি (Salvador Dalí) বা অঁদ্রে ব্রেতোঁর (André Breton) মতো শিল্পীদের হাত ধরে পরাবাস্তববাদের জন্ম হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল অবচেতন মনের (Unconscious mind) জগৎকে কোনো রকম যুক্তি বা নৈতিকতার ফিল্টার ছাড়া সরাসরি প্রকাশ করা। সিস্টেম অফ এ ডাউন (System of a Down)-এর সার্জ ট্যাংকিয়ানের (Serj Tankian) লিরিক্স প্রায়শই পরাবাস্তব। তিনি এমন সব অদ্ভুত এবং সম্পর্কহীন চিত্র পাশাপাশি বসান যা একটি যৌক্তিক অর্থ তৈরি না করলেও, এক ধরনের শক্তিশালী আবেগঘন এবং রাজনৈতিক বার্তা দেয়। যেমন তাদের গান ‘Chop Suey!’-র লিরিক্স যুক্তির চেয়ে বেশি অনুভূতি দিয়ে বুঝতে হয়।
- বীট জেনারেশন (The Beat Generation): পঞ্চাশের দশকের অ্যালেন গিন্সবার্গ (Allen Ginsberg), জ্যাক কেরুয়াক (Jack Kerouac) বা উইলিয়াম এস. বারোজের (William S. Burroughs) মতো লেখকরা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও সাহিত্যিক প্রথার বিরুদ্ধে একদল বিদ্রোহী। তারা স্বতঃস্ফূর্ততা, কাঁচা আবেগ এবং প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে লেখার ওপর জোর দিতেন। বারোজের ‘কাট-আপ’ (Cut-up) টেকনিক, যেখানে তিনি বিভিন্ন টেক্সট কেটে আবার জোড়া লাগিয়ে নতুন অর্থ তৈরি করতেন, তা অনেক অ্যাভান্ট-গার্ড মেটাল ব্যান্ডের লিরিক্স লেখার পদ্ধতিকে প্রভাবিত করেছে। এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী, যাযাবর এবং বিদ্রোহী মনোভাবটি মেটালের মূল দর্শনের সাথেই সম্পর্কিত।
পাল্প ফিকশন, কমিকস এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী: জনসংস্কৃতির সাহিত্য (Pop Culture)
মেটাল কেবল ‘উচ্চ সাহিত্য’ (High literature) থেকেই অনুপ্রেরণা নেয় না। এটি নির্দ্বিধায় জনসংস্কৃতির (Pop culture) বিভিন্ন ধারা, যেমন – পাল্প ফিকশন (Pulp fiction), কমিক বই এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (Science Fiction) থেকেও তার গল্পের উপাদান সংগ্রহ করে।
- পাল্প হরর (Pulp Horror) এবং সায়েন্স ফিকশন: এইচ. পি. লাভক্র্যাফটের (H. P. Lovecraft) মহাজাগতিক আতঙ্কের গল্পগুলো মূলত পাল্প ম্যাগাজিনেই প্রকাশিত হতো। মেটালের ওপর তার প্রভাব অপরিসীম। একইভাবে, রবার্ট ই. হাওয়ার্ডের (Robert E. Howard) ‘কোনান দ্য বারবারিয়ান’ (Conan the Barbarian)-এর মতো ‘সোর্ড অ্যান্ড সর্সারি’ (Sword and Sorcery) গল্পগুলো বহু মেটাল ব্যান্ডের অনুপ্রেরণা। থ্র্যাশ এবং ডেথ মেটালের লিরিক্সে প্রায়শই পারমাণবিক যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবী (Post-apocalyptic world), ভিনগ্রহের প্রাণী এবং প্রযুক্তির ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে লেখা হয়, যা সরাসরি আশির দশকের সায়েন্স ফিকশন সিনেমা এবং সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত। ভয়ভড (Voivod) বা নক্টারনাস (Nocturnus)-এর মতো ব্যান্ডগুলো তো পুরোটাই সায়েন্স ফিকশন থিমের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
- কমিক বই (Comic Books): অ্যানথ্রাক্স (Anthrax) তাদের ‘I Am the Law’ গানটি লিখেছিল ব্রিটিশ কমিক চরিত্র জাজ ড্রেডকে (Judge Dredd) নিয়ে। মনস্টার ম্যাগনেট (Monster Magnet)-এর মতো স্টোনার রক (Stoner Rock) ব্যান্ডগুলো তাদের লিরিক্স এবং অ্যালবামের আর্টওয়ার্কে প্রায়শই মার্ভেল (Marvel) কমিকসের মহাজাগতিক চরিত্রগুলোর উল্লেখ করে। কমিক বইয়ের যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বা অতিরঞ্জিত জগৎ এবং ভালো-মন্দের সরল লড়াই, তা মেটালের মহাকাব্যিক নান্দনিকতার সাথে খুব ভালোভাবে খাপ খেয়ে যায়।
মেটালের লিরিক্স তাই কোনো একটিমাত্র সাহিত্যিক ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এক ecliptic বা গ্রহণকারী শিল্প, যা গথিক দুর্গ থেকে শুরু করে মহাকাশযান পর্যন্ত সর্বত্র বিচরণ করে। এটি এডগার অ্যালান পোর বিষণ্ণ কবিতা থেকে শুরু করে কমিক বইয়ের রঙিন পাতা পর্যন্ত সবকিছুকেই নিজের করে নিতে পারে। এই বৈচিত্র্য এবং সাহিত্যিক গভীরতাই মেটালের লিরিক্সকে কেবল গানের কথা নয়, বরং এক স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী সাহিত্যিক প্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
আমাদের মেটাল
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মেটালের একটি শক্তিশালী, প্রাণবন্ত এবং লড়াকু আন্ডারগ্রাউন্ড দৃশ্যপট রয়েছে। এখানকার জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মেটালের গল্পটা কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু এর আবেগ এবং শক্তি কোনো অংশেই কম নয়।
পথিকৃতের দল: হার্ড রকের সূচনা
বাংলাদেশে ভারী সঙ্গীতের চর্চা শুরু হয় মূলত আশির দশকের শেষে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন ইন্টারনেট ছিল না, বিদেশি ক্যাসেট পাওয়া যেত খুবই কম। মূলত হাতে হাতে রেকর্ডিং করা ক্যাসেট এবং সীমিত কিছু ক্যাসেটের দোকানই ছিল ভরসা। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই রকস্ট্রাটা (Rockstrata), ওয়ারফেজ (Warfaze), এইসেস (Aces)-এর মতো ব্যান্ডগুলো হার্ড রক এবং হেভি মেটালের সূচনা করে। ওয়ারফেজের প্রথম দিকের কাজগুলোতে আয়রন মেইডেন, জুডাস প্রিস্টের স্পষ্ট প্রভাব ছিল। তাদের গিটারিস্ট কমল, বাবনা, রাসেলদের হাত ধরে বাংলাদেশে দ্রুত এবং মেলোডিক গিটার সোলোর চল শুরু হয়। রকস্ট্রাটার ‘শেষ রাতের ডাক’ বা ওয়ারফেজের ‘বসে আছি’ গানগুলো তখনকার তরুণদের কাছে এক নতুন শব্দের জগৎ উন্মোচন করে। এরাই ছিলেন বাংলাদেশের মেটালের অগ্রদূত।
আন্ডারগ্রাউন্ডের উত্থান: নতুন শতাব্দীর গর্জন
নব্ব্বইয়ের দশকের শেষে এবং নতুন শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের মেটাল দৃশ্যপট এক নতুন এবং আরও ভারী দিকে মোড় নেয়। এই সময়েই জন্ম নেয় আর্টসেল (Artcell), ক্রিপটিক ফেইট (Cryptic Fate), পাওয়ারসার্জ (Powersurge), ভাইব (Vibe), ড্রিমল্যান্ড (D’realmed)-এর মতো ব্যান্ডগুলো। তারা শুধু পশ্চিমা ব্যান্ডগুলোকে অনুকরণ করেনি, তারা মেটালের বিভিন্ন সাব-জঁরা, বিশেষ করে প্রগ্রেসিভ, থ্র্যাশ এবং গ্রুভ মেটালকে বাংলা গানের জগতে এক নতুন রূপে উপস্থাপন করে।
- আর্টসেল (Artcell): বাংলাদেশের মেটালকে মূলধারার কাছাকাছি নিয়ে আসার সবচেয়ে বড় কারিগর। তাদের জটিল সঙ্গীত কাঠামো, দ্বৈত গিটারের অসাধারণ যুগলবন্দী এবং বাংলা ভাষায় লেখা গভীর দার্শনিক লিরিক তরুণ প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা পায়। তাদের গান ‘অন্য সময়’, ‘পথ চলা’ বা ‘দুঃখবিলাস’ ছিল একই সাথে ভারী এবং আবেগময়। তারা দেখিয়েছে যে বাংলা ভাষার মতো নরম এবং কাব্যিক ভাষাতেও শক্তিশালী মেটাল গান লেখা সম্ভব।
- ক্রিপটিক ফেইট (Cryptic Fate): বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো এবং সম্মানিত মেটাল ব্যান্ড। তারা তাদের সঙ্গীত নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। তাদের অ্যালবাম ‘শ্রেষ্ঠ’ (২০০২) বাংলাদেশের প্রথম কনসেপ্ট অ্যালবামগুলোর একটি। তাদের ইংরেজি অ্যালবাম ‘নয় মাস’ (Nine Months) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি অসাধারণ কাজ।
- আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্ট সংস্কৃতি: এই সময়েই ঢাকায়, বিশেষ করে রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার (RCC), জার্মান কালচারাল সেন্টার (Goethe-Institut) এবং বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্টের এক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই কনসার্টগুলো ছিল নতুন নতুন ব্যান্ডদের নিজেদের পরিচিত করার এবং মেটালহেডদের একত্রিত হওয়ার একমাত্র জায়গা।
বর্তমান দৃশ্যপট: এক্সট্রিম এবং বৈচিত্র্যময়
বর্তমানে বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ডে মেটালের জগৎ আরও বৈচিত্র্যময় এবং চরমপন্থী হয়েছে। এখন এখানে বিশ্বমানের ডেথ মেটাল, ব্ল্যাক মেটাল, থ্র্যাশ মেটাল এবং মেটালকোর ব্যান্ড সক্রিয়।
- এক্সট্রিম মেটাল: সিভিয়ার ডিমেনশিয়া (Severe Dementia) এবং অরটর (Orator)-এর মতো ব্যান্ডগুলো তাদের ব্রুটাল ডেথ মেটাল এবং থ্র্যাশ মেটাল দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুনাম অর্জন করেছে। তাদের সঙ্গীত প্রমাণ করে যে ভাষাগত এবং ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়েও মেটালের শক্তি কতটা তীব্র হতে পারে।
- নতুন প্রজন্ম: অসংখ্য নতুন ব্যান্ড ক্রমাগত উঠে আসছে, যারা মেটালের বিভিন্ন ফিউশন এবং পরীক্ষামূলক শাখা নিয়ে কাজ করছে। ট্রেনরেক (Trainwreck), ওউনড (Owned), পাওয়ার অফ গ্রাউন্ড (Power of Ground)-এর মতো ব্যান্ডগুলো নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে।
- চ্যালেঞ্জ এবং টিকে থাকা: বাংলাদেশের মেটাল শিল্পীদের পথচলা এখনও মসৃণ নয়। ভালো মানের ভেন্যুর অভাব, যন্ত্রপাতি এবং রেকর্ডিং স্টুডিওর উচ্চমূল্য, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা – এইসব অসংখ্য প্রতিকূলতার সাথে তাদের লড়াই করতে হয়। কিন্তু এই সবকিছুর পরেও, শুধুমাত্র সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা এবং আবেগের জোরেই তারা গান তৈরি করে যাচ্ছে, কনসার্টের আয়োজন করছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তাদের সঙ্গীত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়েছে।
বাংলাদেশের মেটাল দৃশ্যপট হয়তো মূলধারার প্রচারের আলো থেকে দূরে, এক অন্ধকার কোণে রয়েছে, কিন্তু এর শক্তি, আবেগ এবং সৃজনশীলতা কোনো অংশেই কম নয়। এটি প্রমাণ করে যে মেটালের ভাষা সার্বজনীন, এবং তা যেকোনো প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের পথ খুঁজে নিতে পারে।
গোলমালের সংক্রামক প্রতিধ্বনি: যখন মেটালের ছায়া পড়ে অন্য সুরে
সঙ্গীতের ঘরগুলোর দেয়াল বড় পাতলা। এক ঘরের শব্দ অন্য ঘরে উঁকি দেয়। কখনো কখনো সেই শব্দ এতই তীব্র আর সংক্রামক হয় যে, তা দেয়াল ভেদ করে পাশের ঘরের আসবাবপত্রও নতুন করে সাজিয়ে তোলে। মেটাল মিউজিক হলো সেই তীব্র, সংক্রামক শব্দ। যে শিল্পকে একদিন সমাজের মূলধারা একঘরে করে রেখেছিল, তার কর্কশ প্রতিধ্বনি আজ এমন সব জায়গায় শোনা যায়, যা শুনলে অবাক হতে হয়।
ব্যাপারটা অনেকটা ভাইরাসের মতো। মেটালের ডিএনএ (DNA) তার নিজের শরীর ছেড়ে অন্য শিল্পের শরীরেও ঢুকে পড়েছে, এবং সেখানে গিয়ে নতুন নতুন রূপ ধারণ করেছে। এই প্রভাব সবসময় সরাসরি বা বন্ধুত্বপূর্ণ থাকেনি। কখনো কখনো অন্য শিল্পীরা মেটালের শক্তিকে ধার করেছেন, কখনো তার আগ্রাসী মনোভাবকে গ্রহণ করেছেন, আবার কখনো তার নান্দনিকতাকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছেন নিজেদের কথা বলার জন্য। চলুন দেখি, এই গোলমালের ছায়া আর কোন কোন সুরের ওপর পড়েছে।
অল্টারনেটিভ রকের (Alternative Rock) জন্ম এবং গ্রাঞ্জের ধূসর আকাশ
মেটালের সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সরাসরি প্রভাব যদি কোথাও দেখা যায়, তবে তা হলো নব্বইয়ের দশকের অল্টারনেটিভ রক (Alternative Rock) এবং বিশেষ করে গ্রাঞ্জ (Grunge) আন্দোলনে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমেরিকার সিয়াটল শহর থেকে যে সঙ্গীত বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তার শিরায় শিরায় বইছিল মেটালের রক্ত।
আশির দশকের শেষ দিকে গ্ল্যাম মেটালের (Glam Metal) চাকচিক্য এবং অতিরিক্ত প্রদর্শনীতে তরুণদের একটা বড় অংশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা এমন এক সঙ্গীত খুঁজছিল যা আরও সৎ, আরও কাঁচা এবং আরও আবেগঘন। এই খোঁজের উত্তর হিসেবেই গ্রাঞ্জের জন্ম। গ্রাঞ্জের ডিএনএ-তে পাঙ্ক রকের (Punk Rock) DIY বা ‘নিজে করো’ নীতি যেমন ছিল, তেমনি ছিল সত্তরের দশকের হার্ড রক এবং হেভি মেটালের ভারিত্ব।
- ব্ল্যাক সাবাথের (Black Sabbath) দীর্ঘ ছায়া: গ্রাঞ্জের ‘গডফাদার’ বলা হয় ব্ল্যাক সাবাথকে। তাদের ধীর, ভারী, স্লাজি (Sludgy) এবং বিষণ্ণ রিফগুলোই ছিল গ্রাঞ্জের মূল ভিত্তি। মেলভিনস (The Melvins)-এর মতো ব্যান্ড, যারা গ্রাঞ্জের অন্যতম অগ্রদূত, তারা সরাসরি সাবাথের সাউন্ডকে আরও ধীর এবং ভারী করে এক নতুন রূপ দিয়েছিল।
- নির্বানা (Nirvana): কার্ট কোবেইন (Kurt Cobain) নিজে বহুবার ব্ল্যাক সাবাথ এবং লেড জেপেলিনের (Led Zeppelin) প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছেন। নির্বানার গানে পাঙ্কের সরলতার সাথে মেটালের ‘লাউড-কোয়াইট-লাউড’ (Loud-Quiet-Loud) ডাইনামিকসের এক দারুণ মিশ্রণ ছিল। তাদের ‘Smells Like Teen Spirit’ গানের মূল রিফটি বস্টন (Boston) ব্যান্ডের ‘More Than a Feeling’-এর মতো শোনালেও, এর ভারিত্ব এবং আগ্রাসন ছিল মেটাল থেকে ধার করা।
- সাউন্ডগার্ডেন (Soundgarden): এই ব্যান্ডটিকে বলা যেতে পারে লেড জেপেলিন এবং ব্ল্যাক সাবাথের সরাসরি উত্তরসূরি। ক্রিস কর্নেলের (Chris Cornell) অবিশ্বাস্য রেঞ্জের কণ্ঠ এবং কিম থাইলের (Kim Thayil) ভারী, ড্রপ-ডি-টিউনড (Drop-D tuned) গিটার রিফ এবং অদ্ভুত টাইম সিগনেচারের (Odd time signature) ব্যবহার ছিল খাঁটি মেটালের উপাদান। তাদের ‘Black Hole Sun’ বা ‘Outshined’-এর মতো গানগুলো হার্ড রক এবং মেটালের এক নিখুঁত মিশ্রণ।
- অ্যালিস ইন চেইনস (Alice in Chains): গ্রাঞ্জ ব্যান্ডগুলোর মধ্যে এরাই ছিল সবচেয়ে অন্ধকার এবং মেটাল-ঘেঁষা। তাদের সঙ্গীতে ডুম মেটালের (Doom Metal) বিষণ্ণতা, ধীরগতি এবং ভারিত্ব স্পষ্ট ছিল। জেরি ক্যান্ট্রেলের (Jerry Cantrell) গিটারের কাজ এবং লেয়ন স্টেলির (Layne Staley) কণ্ঠের হাহাকার মিলে যে অন্ধকার জগৎ তৈরি হতো, তা ছিল অনন্য।
অনেক গোঁড়া মেটালহেড গ্রাঞ্জকে শত্রু হিসেবে দেখত, কারণ গ্রাঞ্জের উত্থানের ফলেই আশির দশকের মেটাল দৃশ্যপটের পতন ঘটেছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে, গ্রাঞ্জ ছিল মেটালেরই একটি বিবর্তিত এবং সৎ রূপ, যা মেটালের মূল শক্তিকে – অর্থাৎ ভারী রিফ এবং কাঁচা আবেগকে – ফিরিয়ে এনেছিল (Merino, 2017)।
পপ সঙ্গীতের (Pop Music) আলো-আঁধারি মঞ্চ
বড় অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? যে মেটাল একদিন মূলধারার পপ সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল, সেই পপ সংস্কৃতিই আজ বারবার মেটালের দিকে হাত বাড়ায়। তবে এই হাত বাড়ানোটা সঙ্গীতের জন্য ততটা নয়, যতটা না এর নান্দনিকতা (Aesthetics) এবং মনোভাবের (Attitude) জন্য। পপ তারকারা প্রায়শই মেটালের ভাণ্ডার থেকে বিভিন্ন উপাদান ধার করে নিজেদের ‘এজি’ (Edgy) বা সাহসী হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য।
- লেডি গাগা (Lady Gaga): তিনি তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মেটাল এবং রক সংস্কৃতির প্রতি তার ঋণ স্বীকার করেছেন। তার ‘Judas’ গানের মিউজিক ভিডিওতে তিনি যে লেদার, স্টাড এবং বাইকার গ্যাং-এর ইমেজ ব্যবহার করেছেন, তা সরাসরি জুডাস প্রিস্ট (Judas Priest)-এর রব হ্যালফোর্ডের (Rob Halford) আইকনিক লুক থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি তার গানে প্রায়ই ইলেকট্রিক গিটারের ভারী ব্যবহার আনেন এবং তার লাইভ শো-তে আয়রন মেইডেন (Iron Maiden) বা কিস (Kiss)-এর মতো ব্যান্ডগুলোর নাটুকেপনার ছাপ স্পষ্ট।
- পোস্ট মালোন (Post Malone): তিনি একজন সফল পপ/হিপ-হপ শিল্পী হলেও, তার শুরুটা হয়েছিল একটি মেটালকোর (Metalcore) ব্যান্ডে গিটার বাজিয়ে। তিনি প্রায়ই ওজি অসবোর্ন (Ozzy Osbourne) বা মেটালিকার (Metallica) প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেন এবং তাদের সাথে মঞ্চেও পারফর্ম করেছেন। তার সঙ্গীতে রক এবং মেটালের প্রভাব সরাসরি না থাকলেও, তার ট্যাটু-ভরা চেহারা এবং বিদ্রোহী মনোভাবের মধ্যে মেটালের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়।
- পোস্ট-ইন্টারনেট পপ (Post-Internet Pop): পপি (Poppy) বা রিনা সাওয়ায়ামা (Rina Sawayama)-এর মতো আধুনিক পপ শিল্পীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। পপি তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন অদ্ভুত, রোবোটিক ইউটিউব পার্সোনা হিসেবে, কিন্তু পরে তিনি তার সঙ্গীতে সরাসরি নু মেটাল এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটালের (Industrial Metal) উপাদান মেশাতে শুরু করেন। তার ‘I Disagree’ অ্যালবামে মিষ্টি পপ মেলোডির সাথে হঠাৎ করে ডেথ মেটালের (Death Metal) মতো ভারী গিটার রিফ এবং স্ক্রিমিং ভোকাল শুনতে পাওয়া যায়। রিনা সাওয়ায়ামা তার গানে নু মেটালের বাউন্সি রিফ এবং অ্যাংস্ট (Angst) বা কৈশোরের যন্ত্রণাকে একবিংশ শতাব্দীর পপ সংবেদনশীলতার সাথে মিশিয়েছেন।
পপ সঙ্গীত যখন মেটালের উপাদান ব্যবহার করে, তখন তা প্রায়শই এক ধরনের ‘নান্দনিক ধার’ (Aesthetic borrowing) হয়। এটি মেটালের শক্তি, বিদ্রোহ এবং ‘সত্যিকারের’ (Authentic) ইমেজকে ব্যবহার করে পপ তারকার বাণিজ্যিক ভাবমূর্তিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে (Klein, 2009)। যদিও কিছু মেটালহেড একে তাদের সংস্কৃতির অপমান বলে মনে করে, কিন্তু এটিও মেটালের দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক প্রভাবের একটি বড় প্রমাণ।
হিপ-হপের কংক্রিট জঙ্গলে মেটালের গর্জন (Hip-Hop)
বাইরে থেকে দেখলে মেটাল এবং হিপ-হপকে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ বলে মনে হতে পারে। একটি মূলত শ্বেতাঙ্গ, শ্রমিক শ্রেণির রক সঙ্গীত; অন্যটি আফ্রিকান-আমেরিকান শহুরে সংস্কৃতির কণ্ঠস্বর। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই দেখা যায়, দুটির মধ্যেই কিছু সাধারণ মিল রয়েছে – দুটিই প্রতিষ্ঠানবিরোধী, দুটিই সামাজিক অবিচার এবং ক্ষোভের কথা বলে এবং দুটিই শব্দের শক্তিকে গুরুত্ব দেয়। এই মিলের কারণেই দুটি জঁরার মধ্যে বারবার এক ধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
- সূচনালগ্ন: এই ফিউশনের প্রথম দিকের এবং সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো ১৯৮৭ সালে থ্র্যাশ মেটাল ব্যান্ড অ্যানথ্রাক্স (Anthrax) এবং র্যাপ গ্রুপ পাবলিক এনিমি (Public Enemy)-র যৌথ গান ‘Bring the Noise’। এটি ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির ভক্তদের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করেছিল। এর আগে রান-ডিএমসি (Run-D.M.C) এবং অ্যারোস্মিথ (Aerosmith)-এর ‘Walk This Way’ রক এবং র্যাপকে একসাথে এনেছিল, কিন্তু ‘Bring the Noise’ ছিল আরও বেশি আগ্রাসী এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন।
- র্যাপ রক (Rap Rock) এবং নু মেটাল (Nu Metal): নব্বইয়ের দশকে এই ফিউশন পূর্ণ রূপ পায়। রেগে অ্যাগেইনস্ট দ্য মেশিন (Rage Against the Machine) এই ধারার সবচেয়ে সফল এবং শৈল্পিক উদাহরণ। টম মোরেলোর (Tom Morello) গিটারের রিফগুলো ছিল খাঁটি হেভি মেটাল, কিন্তু জ্যাক দ্য লা রোচার (Zack de la Rocha) ভোকাল ছিল র্যাপ। তাদের সঙ্গীত ছিল সরাসরি রাজনৈতিক হাতিয়ার। একই সময়ে কর্ন (Korn), লিম্প বিজকিট (Limp Bizkit) বা লিঙ্কিন পার্ক (Linkin Park)-এর মতো নু মেটাল ব্যান্ডগুলো র্যাপের ছন্দ, ডিজে স্ক্র্যাচিং এবং মেটালের ভারী গিটারকে মিশিয়ে এক নতুন সাউন্ড তৈরি করে, যা সেই প্রজন্মের তরুণদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
- ট্র্যাপ মেটাল (Trap Metal): একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই ফিউশন আরও এক ধাপ এগিয়েছে। সাউন্ডক্লাউড (SoundCloud) প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে আসা কিছু শিল্পী, যেমন ঘোস্টেমেইন (Ghostemane), স্কারলর্ড (Scarlxrd) বা প্রয়াত এক্সএক্সএক্সটেনটাসিওন (XXXTentacion), হিপ-হপের আধুনিক শাখা ট্র্যাপের (Trap) সাথে মেটালের নান্দনিকতাকে মিশিয়েছেন। তারা ট্র্যাপের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিকৃত ৮০৮ বেস (Distorted 808 bass) ব্যবহার করে ভারী গিটার রিফের মতো ইফেক্ট তৈরি করে এবং তার ওপর হার্ডকোর পাঙ্ক বা মেটালের মতো চিৎকার করে র্যাপ করে। তাদের গানের কথায়ও থাকে মেটালের মতো অন্ধকার, বিষণ্ণতা এবং নিইলিজমের (Nihilism) থিম। এটি দেখায় যে, দুটি জঁরার মূল আবেগ – অর্থাৎ রাগ এবং হতাশা – আজও কতটা প্রাসঙ্গিক।
ইলেকট্রনিক জগৎ (The Electronic World) এবং অ্যাভান্ট-গার্ডের (Avant-Garde) পরীক্ষাগার
মেটালের প্রভাব শুধু অ্যাকোস্টিক বাদ্যযন্ত্রের জগতেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি ইলেকট্রনিক সঙ্গীতের জগতেও তার ছাপ ফেলেছে। এখানে প্রভাবটা সরাসরি সুর বা রিফের অনুকরণ নয়, বরং মেটালের তীব্রতা, টেক্সচার এবং সীমানা ভাঙার মনোভাবের।
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল (Industrial) এবং টেকনো (Techno): ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিক, যা কারখানার যান্ত্রিক এবং কর্কশ শব্দ থেকে অনুপ্রেরণা নেয়, তার সাথে মেটালের মিশ্রণে জন্ম নিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটাল। মিনিস্ট্রি (Ministry) বা ফিয়ার ফ্যাক্টরি (Fear Factory)-র মতো ব্যান্ডগুলো মেটালের রিফের সাথে ড্রাম মেশিন এবং স্যাম্পল ব্যবহার করে এক ধরনের ঠাণ্ডা, অমানবিক সাউন্ড তৈরি করেছে। অন্যদিকে, কিছু টেকনো শিল্পী, যেমন অ্যাফেক্স টুইন (Aphex Twin), তাদের কাজে মেটালের মতো চরম বিকৃতি এবং বিশৃঙ্খলা নিয়ে এসেছেন। তার বিখ্যাত গান ‘Come to Daddy’-র মিউজিক ভিডিও এবং তীক্ষ্ণ চিৎকার ও ভাঙাচোরা বিট ছিল যে কোনো ডেথ মেটাল ব্যান্ডের মতোই ভয়ঙ্কর।
- ব্রেককোর (Breakcore) এবং অ্যাভান্ট-গার্ড (Avant-Garde): ব্রেককোর শিল্পীরা ড্রাম অ্যান্ড বেসের (Drum and Bass) দ্রুত বিটকে ভেঙেচুরে তার সাথে মেটালের গিটার স্যাম্পল এবং চিৎকারের শব্দ মিশিয়ে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত ক্যাওস (chaos) তৈরি করেন। ফরাসি শিল্পী ইগরর (Igorrr) এই ধারার এক চূড়ান্ত উদাহরণ। তিনি তার সঙ্গীতে ব্ল্যাক মেটাল, বারোক ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত (Baroque classical music) এবং ব্রেককোরকে এমনভাবে মেশান যা একই সাথে হাস্যকর এবং প্রতিভাদীপ্ত। এটি মেটালের সেই পরীক্ষামূলক মনোভাবেরই এক চরম প্রকাশ।
- অ্যাভান্ট-গার্ড জ্যাজ এবং ক্লাসিক্যাল: জন জর্ন (John Zorn)-এর মতো অ্যাভান্ট-গার্ড জ্যাজ কম্পোজার তার ন্যাকেড সিটি (Naked City) প্রজেক্টে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হার্ডকোর পাঙ্ক, মেটাল এবং জ্যাজের মধ্যে লাফিয়ে বেড়াতেন। এটি ছিল সঙ্গীতের জঁরাগত ধারণাকেই ভেঙে ফেলার এক প্রচেষ্টা। এমনকি আধুনিক ক্লাসিক্যাল কম্পোজাররাও মেটালের তীব্র শক্তি এবং সোনিক টেক্সচার থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছেন।
মেটাল অন্যান্য সঙ্গীত ধারাকে দেখিয়েছে যে, সঙ্গীত কেবল শ্রুতিমধুর হওয়ার জন্য নয়। এটি অস্বস্তিকর, তীব্র, ভারী এবং ভয়ঙ্করও হতে পারে। এটি শব্দের তীব্রতার একটি টুলকিট (Toolkit of intensity) সরবরাহ করেছে, যা অন্য শিল্পীরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারে। এই গোলমালের প্রতিধ্বনি আজ অপ্রত্যাশিত সব জায়গায় শোনা যায়, যা প্রমাণ করে – কোনো শক্তিশালী আবেগ বা শিল্পকে বেশিদিন দেয়ালের ওপারে আটকে রাখা যায় না।
ধর্ম ও মেটাল: অনন্ত যুদ্ধের মিথ ও বাস্তবতা
মেটাল মিউজিকের সুদীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল ইতিহাসের দিকে তাকালে যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে এবং বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, তা হলো ধর্মের সাথে এর এক নিরন্তর, জটিল এবং প্রায়শই বিস্ফোরক সম্পর্ক। সাধারণ মানুষের চোখে, মূলধারার গণমাধ্যমের বয়ানে এবং রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিতে মেটালকে প্রায়শই শয়তানের সঙ্গীত (Devil’s Music) বা ধর্মবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা হিসেবে একপাক্ষিকভাবে চিত্রিত করা হয়, যার মূলে রয়েছে মেটালের জন্মলগ্নে ব্যবহৃত কিছু নির্দিষ্ট অশুভ শব্দশৈলী, যেমন ট্রাইটোন (Tritone) বা মধ্যযুগে নিষিদ্ধ ‘সঙ্গীতে শয়তান’-এর ব্যবহার এবং ব্ল্যাক সাবাথের মতো ব্যান্ডের গানে গা ছমছমে আবহের সচেতন প্রয়োগ। কিন্তু ধর্মের সাথে মেটালের সম্পর্ক কি শুধুই বিদ্বেষের বা অন্ধকারের আরাধনার? নাকি এর গভীরে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো ধর্মতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা, আধ্যাত্মিকতার এক বিকল্প অনুসন্ধান এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এক গভীর সমাজতাত্ত্বিক বিদ্রোহ? মেটাল মিউজিক এবং ধর্মের মধ্যকার এই টানাপোড়েনকে বুঝতে হলে আমাদের কেবল ওপরের আবরণ দেখলে চলবে না, তাকাতে হবে এর ঐতিহাসিক বিবর্তন, নৈতিক ভীতি (Moral Panic), জটিল ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক এবং ধর্মের সমাজতত্ত্বের (Sociology of Religion) তাত্ত্বিক কাঠামোর দিকে। এটি কেবল আস্তিক বনাম নাস্তিকের সরলরৈখিক লড়াই নয়, বরং এটি পবিত্রতা (Sacred) এবং অপবিত্রতার (Profane) সংজ্ঞায়ন নিয়ে আধুনিক সমাজের এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে মেটাল একাধারে আসামী এবং বিচারকের ভূমিকা পালন করে।
মেটাল মিউজিক ঐতিহাসিকভাবেই আব্রাহামিক ধর্মগুলোর, বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মের (Christianity) এক শক্তিশালী এবং আপসহীন সমালোচক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, কারণ পশ্চিমা বিশ্বে মেটালের উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছে খ্রিস্টীয় নৈতিকতার প্রবল প্রতাপের মধ্যেই। তবে এই সমালোচনার ধরন, তীব্রতা এবং উদ্দেশ্য জঁরাভেদে ভিন্ন রূপ নেয়; যেমন থ্র্যাশ মেটাল (Thrash Metal) যেখানে ধর্মের রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক ভণ্ডামি এবং যুদ্ধের উস্কানিদাতার ভূমিকাকে আক্রমণ করে, সেখানে ব্ল্যাক মেটাল (Black Metal) আক্রমণ করে এর আধ্যাত্মিক ভিত্তি, একেশ্বরবাদী দর্শন এবং নৈতিকতাকে। আবার অদ্ভুতভাবে এবং কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, মেটাল নিজেই ধর্মের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য – যেমন সুনির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান, অন্ধ ভক্তি, তীর্থযাত্রা এবং একটি শক্তিশালী সম্প্রদায়ের ধারণা – ধারণ করে একটি অব্যক্ত ধর্ম (Implicit Religion) বা বিকল্প আধ্যাত্মিকতার (Alternative Spirituality) রূপ নেয় যা তার অনুসারীদের জীবনের অর্থ জোগায়। এই অধ্যায়ে আমরা সেই গোলমেলে এবং বহুমাত্রিক সম্পর্কের জট খোলার চেষ্টা করব, যেখানে শয়তানের উপাসনা, গির্জা পোড়ানো, ধর্মপ্রচার এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি – সবই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসেবে উপস্থিত থাকে এবং শ্রোতাকে এক দার্শনিক দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।
শয়তানি আতঙ্ক বা স্যাটানিক প্যানিক: আশির দশকের নৈতিক ভীতি
আশির দশকে আমেরিকা এবং ইউরোপে মেটাল মিউজিককে ঘিরে এক ব্যাপক মাস-হিস্টিরিয়া বা গণউন্মাদনার সৃষ্টি হয়, যা সমাজতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় স্যাটানিক প্যানিক (Satanic Panic) নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক স্ট্যানলি কোহেন (Stanley Cohen) তার গবেষণায় এই ধরনের ঘটনাকে নৈতিক ভীতি (Moral Panic) বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে সমাজ, মিডিয়া এবং ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবে একটি নির্দিষ্ট উপ-সংস্কৃতি বা গোষ্ঠীকে তাদের প্রচলিত মূল্যবোধ, নিরাপত্তা এবং অস্তিত্বের প্রতি চরম হুমকি বা ফোক ডেভিল (Folk Devil) হিসেবে চিহ্নিত করে। আশির দশকের রক্ষণশীল আমেরিকার প্রেক্ষাপটে লম্বা চুলওয়ালা, কালো টি-শার্ট পরা মেটালহেডরা ছিল সেই ‘ফোক ডেভিল’, যাদের দিকে আঙুল তুলে সমাজ তার সমস্ত ব্যর্থতা এবং ভীতির দায় চাপাতে চেয়েছিল। বিভিন্ন রক্ষণশীল খ্রিস্টান গোষ্ঠী, আতঙ্কিত অভিভাবক এবং টিআরপি-লোভী মিডিয়া প্রচার করতে শুরু করে যে, মেটাল মিউজিক কিশোর-কিশোরীদের শয়তানের উপাসনা, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, পশুবলি এবং যাদুবিদ্যার (Occult) দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা ছিল মূলত প্রজন্মের ব্যবধান বা জেনারেশন গ্যাপ থেকে তৈরি হওয়া এক ভিত্তিহীন ভয়।
এই আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি অদ্ভুত এবং প্রযুক্তিগত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যার নাম ব্যাকমাস্কিং (Backmasking), যেখানে অভিযোগ করা হতো যে, মেটাল গানের রেকর্ডগুলো উল্টো করে বাজালে সেখানে শয়তানের প্রতি আনুগত্যের গোপন বার্তা বা সাবলিমিনাল মেসেজ (Subliminal Message) শোনা যায়, যা শ্রোতার অবচেতন মনকে প্রভাবিত করে তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করিয়ে নেয়। এই বিতর্কের চূড়ান্ত এবং নাটকীয় রূপ দেখা যায় যখন বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যান্ড জুডাস প্রিস্টের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়, যেখানে অভিযোগ ছিল যে তাদের ‘Better by You, Better than Me’ গানের প্রভাবে দুই তরুণ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। যদিও দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর ব্যান্ডটি নির্দোষ প্রমাণিত হয় এবং বিচারক স্বীকার করেন যে তথাকথিত ‘গোপন বার্তা’ আসলে মানুষের মনের ভুল বা প্যারেডোলিয়া (Pareidolia) – অর্থাৎ অস্পষ্ট শব্দের মধ্যে পরিচিত অর্থ খোঁজার প্রবণতা – তবুও এই ঘটনা মেটালের গায়ে ‘বিপজ্জনক’ তকমাটি স্থায়ীভাবে লাগিয়ে দেয়। প্যারেন্টস মিউজিক রিসোর্স সেন্টার (PMRC)-এর মতো রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী সংগঠনগুলো মেটাল অ্যালবামের ওপর ‘Parental Advisory: Explicit Lyrics’ স্টিকার লাগানোর ব্যবস্থা করে, যা মেটালকে দমানোর পরিবর্তে তরুণদের কাছে ‘নিষিদ্ধ ফল’ হিসেবে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে এবং মেটালের বিদ্রোহী ভাবমূর্তিকে আরও শক্তিশালী করে (Walser, 1993)। সমাজতাত্ত্বিকরা মনে করেন, এই প্যানিক আসলে মেটালের কারণে তৈরি হয়নি, বরং এটি ছিল তৎকালীন আমেরিকার পরিবর্তনশীল পারিবারিক কাঠামো, বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধি এবং কিশোর অপরাধ নিয়ে বয়স্ক প্রজন্মের ভীতির এক বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মেটালকে বলির পাঁঠা বা স্কেপগোট (Scapegoat) বানানো হয়েছিল (Cowan, 2010)।
মেটালের ধর্মতত্ত্ব: শয়তান যখন স্বাধীনতার প্রতীক
মেটালে শয়তানবাদ (Satanism) বা শয়তানি প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে সাধারণ মানুষের ভীতি এবং ভুল ধারণা থাকলেও, এর দার্শনিক ভিত্তিটি বেশ ভিন্ন এবং অনেক বেশি গভীর। বেশিরভাগ মেটাল ব্যান্ডের কাছে শয়তান কোনো আক্ষরিক বাইবেলে বর্ণিত লাল রঙের শিংওয়ালা দেবতা নয়, বরং একটি শক্তিশালী সাহিত্যিক ও দার্শনিক রূপক বা মেটাফোর যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কবি এবং লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছে। এখানে শয়তান বা লুসিফার হলেন জন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট কাব্যের সেই ট্র্যাজিক হিরো বা চূড়ান্ত বিদ্রোহী, যিনি ঈশ্বরের একনায়কতন্ত্র, অন্ধ আনুগত্য এবং স্বর্গের দাসত্ব মেনে না নিয়ে নিজের রাজত্ব গড়ে তোলার সাহস দেখিয়েছিলেন। অ্যান্থন ল্যাভি (Anton LaVey) এবং তার ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চার্চ অফ স্যাটান (Church of Satan)-এর দর্শনে প্রভাবিত হয়ে অনেক মেটাল ব্যান্ড শয়তানকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, পার্থিব সুখ, জ্ঞানপিপাসা এবং প্রমিথিউসীয় (Promethean) বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। স্লেয়ার (Slayer) বা ভেনম (Venom)-এর মতো ব্যান্ডগুলো তাদের গানে এবং অ্যালবামের প্রচ্ছদে শয়তানি চিত্রকল্প ব্যবহার করেছে মূলত শক ভ্যালু (Shock Value) বা চমক তৈরি করার জন্য এবং সমাজের ভণ্ডামি ও রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য, কোনো শয়তানের পূজা করার জন্য নয়।
তবে, নব্বইয়ের দশকের নরওয়েজিয়ান ব্ল্যাক মেটাল (Black Metal) এই শয়তানি প্রতীককে এক ভিন্ন এবং ভয়ঙ্কর মাত্রায় নিয়ে যায়, যা কেবল গানের কথায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বারজাম (Burzum), মেহেম (Mayhem) বা এম্পেরর (Emperor)-এর মতো ব্যান্ডের সদস্যরা কেবল গানে শয়তানের কথা বলেনি, তারা খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে এক প্রকার সাংস্কৃতিক এবং শারীরিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। তারা গির্জা পোড়ানোকে নিছক ভ্যান্ডালিজম বা ভাঙচুর হিসেবে দেখেনি, বরং একে দেখেছিল নরওয়ের বুক থেকে ‘বিদেশি’ এবং ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা’ খ্রিস্টধর্মকে উচ্ছেদ করে প্রাচীন নর্ডিক পেগানবাদ (Paganism) বা পৌত্তলিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ হিসেবে। ভার্গ ভিকার্নেস (Varg Vikernes) এবং ইউরোনিমাস (Euronymous)-এর মতো বিতর্কিত ব্যক্তিত্বরা খ্রিস্টধর্মকে একটি দুর্বল, করুণানির্ভর এবং দাসত্বের ধর্ম হিসেবে দেখতেন, যা ভাইকিংদের গর্বিত এবং শক্তিশালী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে। তাদের কাছে শয়তানবাদ ছিল খ্রিস্টধর্মের বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো এক শক্তি, যা প্রকৃতি, অন্ধকার, শীত এবং আদিম প্রবৃত্তির জয়গান গায়। এখানে মেটাল হয়ে ওঠে এক ধরনের র্যাডিকাল ট্র্যাডিশনালিজম (Radical Traditionalism), যা আধুনিকতা, বিশ্বায়ন এবং একশ্বেরবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে প্রাচীন মিথলজির এক হিংস্র পুনরুত্থান চায় (Moynihan & Søderlind, 2003)।
হোয়াইট মেটাল: গির্জার ভেতরের গোলমাল এবং ধর্মপ্রচার
মেটাল যখন বাইরে থেকে খ্রিস্টধর্মকে আক্রমণ করছিল এবং তাকে ধ্বংস করার কথা বলছিল, ঠিক তখনই গির্জার ভেতর থেকে এক অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত পাল্টা স্রোতের জন্ম হয়, যা ক্রিশ্চিয়ান মেটাল (Christian Metal) বা হোয়াইট মেটাল (White Metal) নামে পরিচিতি পায়। সত্তর এবং আশির দশকে কিছু ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান মিউজিশিয়ান প্রশ্ন তোলেন: শয়তানের কাছে কেন সব ভালো টিউন থাকবে? তারা মেটালের ভারী শব্দ, ডিসটরশন, গতির ঝড় এবং আগ্রাসনকে ব্যবহার করে যিশুর বাণী প্রচার করার এক অভিনব উদ্যোগ নেন। স্ট্রাইপার (Stryper) ছিল এই ধারার সবচেয়ে সফল এবং বিতর্কিত ব্যান্ড, যারা তাদের হলুদ-কালো ডোরাকাটা পোশাকে মঞ্চে উঠে দর্শকদের দিকে বাইবেল ছুড়ে দিত এবং মেটালের প্রচলিত প্রতীকগুলোকে উল্টে দিয়ে – যেমন ‘শয়তানের শিং’ বা হর্নস প্রতীকের বদলে এক আঙুল উঁচিয়ে ‘এক পথ’ (One Way) বা যিশুর পথের কথা বলে এক নতুন বয়ান তৈরি করত।
হোয়াইট মেটাল-এর অস্তিত্ব মেটাল এবং ধর্ম – উভয় মহলেই এক বিশাল তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক বিতর্কের জন্ম দেয় যা আজও চলমান। সেক্যুলার বা মূলধারার মেটালহেডরা এদের ‘নকল’, ‘ভণ্ড’ বা ‘পোজার’ বলে ঘৃণা করত, কারণ তাদের মতে মেটালের মূল স্পিরিটই হলো বিদ্রোহ এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, যা কোনোভাবেই কোনো ধর্মের দাসত্ব বা প্রচার করতে পারে না। অন্যদিকে, রক্ষণশীল খ্রিস্টানরা মনে করত যে মেটালের মতো ‘অপবিত্র’, ‘হিংস্র’ এবং ‘পার্থিব’ সঙ্গীত ব্যবহার করে ঈশ্বরের পবিত্র বাণী প্রচার করা ধর্মবিরুদ্ধ এবং ধর্মকে কলুষিত করার শামিল। তবুও, পি.ও.ডি (P.O.D), স্কিলেটের (Skillet) মতো ব্যান্ডগুলোর মূলধারায় বিশাল বাণিজ্যিক সাফল্য প্রমাণ করে যে, অনেক ভক্তের কাছে মেটাল এবং ধর্মের সহাবস্থান কেবল সম্ভবই নয়, বরং কাঙ্ক্ষিত। এমনকি ব্ল্যাক মেটালের মতো চরমপন্থী জঁরাতেও আনব্ল্যাক মেটাল (Unblack Metal)-এর জন্ম হয়েছে, যেখানে হোর্ড (Horde) বা অ্যান্টেস্টর (Antestor)-এর মতো ব্যান্ডগুলো ব্ল্যাক মেটালের হিংস্র শব্দশৈলী এবং লিরিক্যাল স্ট্রাকচার ব্যবহার করে শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করে। ধর্মতাত্ত্বিক মার্কাস মোবার্গ (Marcus Moberg) তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ক্রিশ্চিয়ান মেটাল কেবল ধর্মপ্রচার নয়, বরং এটি তরুণ খ্রিস্টানদের জন্য একটি বিকল্প ধর্মীয় পরিচিতি (Alternative Religious Identity) তৈরি করে, যেখানে তারা তাদের বিশ্বাসের সাথে আধুনিক পপ সংস্কৃতির নন্দনতত্ত্বের সমন্বয় ঘটাতে পারে (Moberg, 2009)।
অ-পশ্চিমা ধর্ম ও মেটাল: ব্লাসফেমি এবং প্রতিরোধের রাজনীতি
পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মের সাথে মেটালের সংঘাত মূলত খ্রিস্টধর্মকেন্দ্রিক এবং তাত্ত্বিক হলেও, মুসলিম, হিন্দু বা বৌদ্ধ সমাজে এর রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে জীবন-মরণ সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়ায় মেটাল মিউজিককে প্রায়শই ধর্ম অবমাননা (Blasphemy), পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বা নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে দেখা হয়। এখানে মেটাল চর্চা করা কেবল শখের বিষয় নয়, এটি প্রায়শই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করা এক রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিদ্রোহ। ইরান, সৌদি আরব বা মিশরের মতো দেশে মেটাল ব্যান্ডগুলোকে প্রায়শই ‘শয়তানের উপাসক’ সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের গান নিষিদ্ধ করা হয় এবং সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। অথচ, নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই অঞ্চলের মেটালহেডরা অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক বা অন্ততপক্ষে নাস্তিক নন; তাদের কাছে মেটাল ধর্মের বিরোধিতা নয়, বরং ধর্মীয় কট্টরপন্থা, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা।
ইন্দোনেশিয়ায়, যা বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ, সেখানে মেটাল এবং ইসলামের এক অভূতপূর্ব এবং কৌতূহলোদ্দীপক সহাবস্থান দেখা যায়। বার্গারখিল (Burgerkill) বা জাসাদ (Jasad)-এর মতো ব্যান্ডগুলো তাদের গানে স্থানীয় সংস্কৃতি, সুফি দর্শন এবং ধর্মীয় অনুভূতির সাথে মেটালের আগ্রাসনের এক অনন্য মিশ্রণ ঘটায়। নৃতাত্ত্বিক জেরেমি ওয়ালাক (Jeremy Wallach) দেখিয়েছেন যে, ইন্দোনেশিয়ার তরুণরা মেটালকে তাদের আধুনিক মুসলিম পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে না, বরং তারা মেটালের নৈতিক কোড – যেমন সততা, ভ্রাতৃত্ব, সাহসিকতা এবং ভণ্ডামির বিরোধিতা – কে ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করে (Wallach, 2009)। অন্যদিকে, ভারতে বৈদিক মেটাল (Vedic Metal) নামে এক নতুন ধারার উদ্ভব হয়েছে, যেখানে সিঙ্গাপুরের রুদ্র (Rudra)-র মতো ব্যান্ডগুলো হিন্দু মিথলজি, বেদ এবং উপনিষদের সংস্কৃত শ্লোকগুলোকে ডেথ মেটালের জটিল কাঠামোর সাথে মিশিয়ে এক ধরনের আধ্যাত্মিক মেটাল তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, মেটাল সব সময় ধর্মকে আক্রমণ করে না, বরং কখনো কখনো এটি প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আধুনিক, শক্তিশালী এবং প্রাসঙ্গিক রূপে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করে।
মেটাল যখন নিজেই ধর্ম: অব্যক্ত উপাসনা
ধর্মের সাথে সংঘাতের বাইরেও, আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকরা একটি নতুন এবং গভীর প্রশ্ন তুলেছেন – মেটাল নিজেই কি একটি ধর্মে পরিণত হয়েছে? বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক এডওয়ার্ড বেইলি (Edward Bailey)-র অব্যক্ত ধর্ম (Implicit Religion) তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় যদি মানুষের জীবনে ধর্মের মতো কাজ করে – অর্থাৎ যদি তা জীবনের অর্থ প্রদান করে, আচার-অনুষ্ঠান তৈরি করে এবং একটি শক্তিশালী, নিবেদিতপ্রাণ সম্প্রদায় গড়ে তোলে – তবে তাকেও এক ধরনের ধর্ম বলা যেতে পারে (Bailey, 1997)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, মেটাল সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে একটি ধর্মের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য জোরালোভাবে বহন করে।
মেটালের কনসার্টগুলো কোনো সাধারণ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নয়, এগুলো হলো আধুনিক আচার-অনুষ্ঠান (Ritual) বা উপাসনা। মশ পিটের (Mosh Pit) শারীরিক অভিজ্ঞতাকে প্রাচীন উপজাতীয় নাচের সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা এক ধরনের ট্রান্স (Trance) বা ঘোরলাগা অবস্থায় পৌঁছায় এবং বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইমের ভাষায় এক ধরনের সমষ্টিগত একাত্মবোধ বা কলেক্টিভ এফারভেসেন্স (Collective Effervescence) অনুভব করে। মেটালহেডদের কালো পোশাক, বিশেষ প্রতীক (যেমন পেন্টাগ্রাম বা হর্নস), তীর্থযাত্রা (যেমন জার্মানির ওয়াকেন ওপেন এয়ার ফেস্টিভ্যালে যাওয়া) এবং শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা (যেমন ডাইমব্যাগ ড্যারেল, ক্লিফ বার্টন বা চাক শুলডিনারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন) – সবই একটি সংগঠিত ধর্মের কাঠামোর মতো কাজ করে। ক্রিস্টোফার প্যাট্রিজ (Christopher Partridge)-এর মতে, আধুনিক সেক্যুলার সমাজে মানুষ যখন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বা হতাশ হচ্ছে, তখন মেটালের মতো অকালচার (Occulture) বা গূঢ় সংস্কৃতিগুলো তাদের আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণ করছে। মেটাল তাদের এমন এক জগতের সন্ধান দেয় যেখানে তারা ভয়, মৃত্যু এবং অশুভ শক্তির মুখোমুখি হয়ে জীবনের এক গভীরতর অর্থ খুঁজে পায়, যা প্রচলিত, নিরাপদ ধর্মগুলো দিতে ব্যর্থ হয়েছে (Partridge, 2004)।
গোলমালের নিজস্ব উত্তরাধিকার: মেটাল মিউজিকের প্রভাব
সবকিছুরই একটা আয়ু থাকে। বিদ্রোহেরও থাকে। যে তীব্র আগুন একদিন জ্বলে ওঠে, সময়ের সাথে সাথে তার আঁচ কমে আসে, রূপ বদলায়। যে গোলমালকে একদিন সমাজ বখাটেপনার চূড়ান্ত বলে দাগিয়ে দিয়েছিল, সেই গোলমালও একদিন পুরোনো হয়। কিন্তু কিছু গোলমাল নিভে যায় না, তারা থেকে যায়। তারা শুধু সুর হিসেবে নয়, বরং চিন্তাধারা হিসেবে, সংস্কৃতি হিসেবে এবং এমনকি গবেষণার বিষয় হিসেবেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। মেটাল মিউজিক হলো সেই ঘরানার গোলমাল।
আমরা এর আগে মেটালের শরীর এবং আত্মার ব্যবচ্ছেদ করেছি। দেখেছি কোন ঐতিহাসিক ক্ষত আর কোন দার্শনিকের হাতুড়ির ঘায়ে তার জন্ম। কিন্তু তারপর? সেই জন্মের পর এই শিল্প কী রেখে গেল? তার তীব্র চিৎকারের প্রতিধ্বনি আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? মজার ব্যাপার হলো, যে মেটাল একদিন অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনার বাইরে একঘরে হয়ে ছিল, আজ সেই অ্যাকাডেমিক জগৎই তাকে নিয়ে গবেষণা করছে। সমাজতাত্ত্বিক, সঙ্গীততত্ত্ববিদ এবং দার্শনিকেরা এই গোলমালের ভেতরে এক জটিল সমাজের প্রতিচ্ছবি, এক গভীর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং মানব অস্তিত্বের কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন। এই অধ্যায় ও এর পরের অধ্যায়ে আমরা সেই বিষয়েই আলোচনা করতে যাচ্ছি।
কোনো শিল্প যখন টিকে থাকে, তখন সে কেবল নিজেকেই টিকিয়ে রাখে না, বরং চারপাশের অনেক কিছুকেই বদলে দেয়। মেটাল মিউজিকও তার তীব্র শক্তি দিয়ে সঙ্গীত, প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতির জগতে কিছু স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
শব্দ-প্রযুক্তির পরীক্ষাগার: আরও ভারী, আরও দ্রুত
মেটাল মিউজিকের একটা প্রাথমিক এবং অপরিবর্তনীয় আকাঙ্ক্ষা হলো – আরও ভারী এবং আরও তীব্র শব্দ তৈরি করা। এই আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে মেটাল শিল্পীরা নিজের অজান্তেই মিউজিক টেকনোলজির সীমানা প্রসারিত করেছেন।
- অ্যামপ্লিফায়ার (Amplifier) এবং ডিসটরশন (Distortion): জিমি হেনড্রিক্স (Jimi Hendrix) এবং টনি আইওমি (Tony Iommi) যে ভারী শব্দের সূচনা করেছিলেন, তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্মের মেটাল ব্যান্ডগুলো। মার্শাল (Marshall) অ্যামপ্লিফায়ারের ক্লাসিক ক্রাঞ্চ (Crunch) থেকে শুরু করে মেসা/বুগি (Mesa/Boogie)-র আধুনিক হাই-গেইন (High-gain) সাউন্ড – এই সবকিছুই তৈরি হয়েছে গিটারিস্টদের আরও বেশি ডিসটরশন এবং সাচুরেশন (Saturation)-এর চাহিদার কারণে। র্যান্ডি রোডস (Randy Rhoads) বা ডাইমব্যাগ ড্যারেলের (Dimebag Darrell) মতো গিটারিস্টরা শুধু ভালো বাদকই ছিলেন না, তারা ছিলেন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। তারা নিজেদের প্রয়োজনমতো অ্যামপ্লিফায়ার এবং প্যাডেল (Pedal) মডিফাই করতেন, যা পরে কোম্পানিগুলোকে নতুন নতুন প্রোডাক্ট তৈরিতে উৎসাহিত করে।
- বর্ধিত পরিসরের গিটার (Extended Range Guitars): ভারী শব্দ তৈরির জন্য গিটারকে নিচু স্কেলে টিউন (Detune) করার প্রথা তো ছিলই। কিন্তু নু মেটাল (Nu Metal) ব্যান্ড কর্ন (Korn) যখন প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফলভাবে সাত-তারের গিটার (Seven-string guitar) ব্যবহার শুরু করে, তখন তা গিটার ডিজাইনে এক বিপ্লব নিয়ে আসে। এরপর সুইডিশ ব্যান্ড মেশুগাহ (Meshuggah) আট-তারের গিটার ব্যবহার করে এক অবিশ্বাস্য ভারী এবং জটিল জেন্ট (Djent) নামক এক মাইক্রো-জঁরার জন্ম দেয়। এখন নয় বা দশ-তারের গিটারও বিরল নয়। এই সবকিছুই মেটালের সেই আদিম আকাঙ্ক্ষার ফল।
- রেকর্ডিং কৌশল (Recording Techniques): এক্সট্রিম মেটালের (Extreme Metal) প্রচণ্ড গতি, বিশেষ করে ড্রামিং, স্টুডিওতে ধারণ করা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যার সমাধান হিসেবেই ‘ড্রাম ট্রিগারিং’ (Drum triggering)-এর মতো কৌশলের উদ্ভব হয়, যেখানে অ্যাকোস্টিক ড্রামের শব্দের সাথে একটি ডিজিটাল স্যাম্পল (Sample) যুক্ত করে দেওয়া হয়, যাতে প্রতিটি আঘাত পরিষ্কারভাবে শোনা যায়। আবার, ব্ল্যাক মেটালের (Black Metal) মতো জঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে লো-ফাই (Lo-fi) বা নিম্নমানের রেকর্ডিং কৌশল ব্যবহার করে এক ধরনের কাঁচা এবং ঠাণ্ডা আবহ তৈরি করেছে, যা পরে ইন্ডি রক (Indie Rock) বা লো-ফাই হিপ-হপের মতো অন্য জঁরাকেও প্রভাবিত করেছে।
DIY বা ‘নিজে করো’ নীতির ক্ষমতায়ন
আশির দশকে যখন মূলধারার মিডিয়া এবং রেকর্ড লেবেলগুলো গ্ল্যাম মেটাল (Glam Metal) নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে (Underground) বেড়ে ওঠা থ্র্যাশ, ডেথ বা ব্ল্যাক মেটালের মতো জঁরাগুলোর কাছে নিজেদের সঙ্গীত ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো পথ ছিল না। এই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নেয় এক শক্তিশালী ‘নিজে করো’ বা DIY (Do It Yourself) সংস্কৃতি।
- টেপ ট্রেডিং (Tape Trading): ইন্টারনেট-পূর্ব যুগে ‘টেপ ট্রেডিং’ ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড মেটালের প্রাণ। পৃথিবীর এক প্রান্তের কোনো ভক্ত তার প্রিয় লোকাল ব্যান্ডের ডেমো ক্যাসেট রেকর্ড করে ডাকে পাঠিয়ে দিত অন্য প্রান্তের কোনো ভক্তের কাছে। বিনিময়ে সেও পেত নতুন কোনো ব্যান্ডের ক্যাসেট। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই নরওয়ের একটি ব্ল্যাক মেটাল ব্যান্ড ব্রাজিলে বা ফ্লোরিডার একটি ডেথ মেটাল ব্যান্ড মালয়েশিয়ায় পরিচিতি পেত। এটি ছিল এক ধরনের অ্যানালগ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, যা সম্পূর্ণভাবে ভক্তদের দ্বারা পরিচালিত হতো।
- ফ্যানজাইন (Fanzine): ‘ফ্যানজাইন’ বা সংক্ষেপে ‘জিন’ (Zine) ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডের পত্রিকা। ফটোকপি করা কাগজে হাতে লেখা বা টাইপ করা রিভিউ, ইন্টারভিউ আর খবর থাকত এখানে। এগুলো ছিল মেটাল সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কোনো ব্যান্ডের দর্শন কী, তাদের নতুন অ্যালবামে কী আছে – এইসব খবর ভক্তরা জিন পড়েই পেত।
- ইনডিপেনডেন্ট লেবেল (Independent Labels): এই DIY সংস্কৃতি থেকেই জন্ম নেয় ইয়ারেক (Earache Records), নিউক্লিয়ার ব্লাস্ট (Nuclear Blast) বা পিসভিল রেকর্ডস (Peaceville Records)-এর মতো কিংবদন্তী ইনডিপেনডেন্ট রেকর্ড লেবেল। এরা সেইসব এক্সট্রিম ব্যান্ডকে সই করাত, যাদের মূলধারার লেবেলগুলো ছোঁয়ারও সাহস করত না। Napalm Death থেকে শুরু করে Emperor পর্যন্ত অসংখ্য প্রভাবশালী ব্যান্ডের ক্যারিয়ার তৈরি হয়েছে এই লেবেলগুলোর হাত ধরে।
এই DIY নীতি মেটাল সম্প্রদায়কে এক অবিশ্বাস্য আত্মনির্ভরশীলতা এবং ক্ষমতা দিয়েছে। তারা মিডিয়া বা কর্পোরেট জগতের ওপর নির্ভর না করে নিজেদের জগৎ নিজেরাই তৈরি করেছে। এই মডেল পরবর্তীকালে পাঙ্ক, হিপ-হপ এবং অন্যান্য বহু স্বাধীন শিল্প মাধ্যমের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
এক বিশ্বজনীন উপ-সংস্কৃতি (Subculture) এবং প্রতিবাদের ভাষা
মেটালের সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার সম্ভবত এর বিশ্বজনীনতা। অবাক করার মতো হলেও সত্যি, অ্যাংলো-আমেরিকান জগৎ থেকে জন্ম নেওয়া এই সঙ্গীত শৈলীটি পৃথিবীর প্রায় সব কোণায় পৌঁছে গেছে এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে নতুন নতুন রূপ ধারণ করেছে।
- ব্রাজিলের সেপালচুরা (Sepultura): তারা তাদের ‘Roots’ (১৯৯৬) অ্যালবামে থ্র্যাশ মেটালের সাথে আমাজন জঙ্গলের আদিবাসী জাভান্তে (Xavante) গোত্রের সঙ্গীতকে মিশিয়ে এক অভূতপূর্ব কাজ করে। এটি ছিল শুধু সঙ্গীতের ফিউশন নয়, এটি ছিল ব্রাজিলের রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ।
- ইন্দোনেশিয়ার মেটাল দৃশ্যপট: সমাজতাত্ত্বিক জেরেমি ওয়ালাক (Jeremy Wallach) তার বইয়ে দেখিয়েছেন, ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মেটাল কীভাবে তরুণদের জন্য আধুনিকতার (Modernity) প্রতীক এবং অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণশীল সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক পরোক্ষ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো নিজেও ছিলেন একজন স্বঘোষিত মেটালহেড (Wallach, 2009)।
- বতসওয়ানার কাউবয় মেটালহেড: আফ্রিকার বতসওয়ানার মেটালহেডরা আমেরিকার কাউবয়দের মতো লেদারের পোশাক এবং টুপি পরে। এটি তাদের কাছে কেবল ফ্যাশন নয়, এটি তাদের জন্য এক ধরনের বিদ্রোহী আত্মপরিচয়, যা স্থানীয় সামাজিক প্রথার বাইরে তাদের একটি স্বতন্ত্র সত্তা দেয়।
- মধ্যপ্রাচ্যের মেটাল: ইরান বা সৌদি আরবের মতো দেশে, যেখানে মেটাল সঙ্গীত গাওয়া বা শোনাও বিপজ্জনক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেখানেও আন্ডারগ্রাউন্ডে ব্যান্ডগুলো সক্রিয়। তাদের জন্য মেটাল হলো শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার একমাত্র উপায়।
মেটাল এভাবে একটি পশ্চিমা সঙ্গীত শৈলী হয়েও এক বিশ্বজনীন প্রতিবাদের ভাষায় পরিণত হয়েছে। এটি দেখায় যে, রাগ, হতাশা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষার অনুভূতি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
গোলমাল যখন ইতিহাস হয়ে যায়
সেই যে গোলমালটা একদিন বার্মিংহামের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন কারখানা থেকে শুরু হয়েছিল, তা আজ পৃথিবীর সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু রাস্তাতেই নয়, তার প্রতিধ্বনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে এবং অ্যাকাডেমিক জার্নালেও শোনা যায়। যে শিল্পকে একদিন সমাজ বাতিল করে দিয়েছিল, সেই শিল্পই এখন সমাজকে বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ লেন্সে পরিণত হয়েছে।
মেটালের উত্তরাধিকার এটাই যে, সে দেখিয়েছে – যা কিছু শক্তিশালী, সৎ এবং আপসহীন, তা সময়ের পরীক্ষায় টিকে যায়। সে শিখিয়েছে যে, শিল্পের কাজ শুধু সুন্দর জিনিস তৈরি করা নয়, বরং অস্বস্তিকর সত্যকে সামনে আনাও। সে প্রমাণ করেছে যে, পৃথিবীর সব প্রান্তের ‘আউটসাইডার’ বা একঘরে হয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্য একটি অভিন্ন ভাষা থাকা সম্ভব।
গোলমালটা হয়তো আগের মতোই তীব্র আছে, কিন্তু এখন আমরা জানি, এই গোলমালের একটি ইতিহাস আছে, একটি দর্শন আছে, এবং একটি ভবিষ্যৎও আছে। গোলমালটা এখন নিজেই ইতিহাস।
অ্যাকাডেমিক ব্যবচ্ছেদ ও তাত্ত্বিকদের অবদান: যখন গোলমাল হয়ে ওঠে গবেষণার বিষয়
একসময় মেটাল মিউজিক ছিল অ্যাকাডেমিক জগতের কাছে প্রায় অস্পৃশ্য এক বিষয়। এটি ছিল সমাজের চোখে ‘নিম্ন সংস্কৃতি’ (Low culture)। জ্ঞানী-গুণী, সমাজতাত্ত্বিক বা সঙ্গীততত্ত্ববিদরা একে হয় এড়িয়ে যেতেন, নয়তো তরুণ প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে একপাশে সরিয়ে রাখতেন। কিন্তু সময় বদলেছে। যে গোলমালকে একদিন কেবল বিশৃঙ্খলা বলে মনে করা হতো, আজ সেই গোলমালের ভেতরেই গবেষকরা খুঁজে পাচ্ছেন জটিল সামাজিক কাঠামো, গভীর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এবং শক্তিশালী দার্শনিক বয়ান।
কিছু সাহসী এবং প্রথাবিরোধী তাত্ত্বিক এই পথ দেখিয়েছেন। তারা মেটালহেডদের ভিড়ে মিশেছেন, তাদের কনসার্টে গিয়েছেন, তাদের লিরিক্সকে কবিতার মতো করে পড়েছেন এবং এর তীব্র শব্দকে সঙ্গীতের ব্যাকরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে ‘মেটাল মিউজিক স্টাডিজ’ (Metal Music Studies) নামে একটি স্বতন্ত্র অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্র। চলুন, এমন অ্যাকাডেমিক ফিল্ডগুলোতে মেটালের অবদান নিয়ে জানা যাক। আর সেই সাথে কয়েকজন প্রধান তাত্ত্বিকের সাথে পরিচিত হওয়া যাক, যাদের কাজ আমাদের মেটালকে বোঝার চোখটাই পাল্টে দিয়েছে।
সমাজতত্ত্ব ও উপ-সংস্কৃতি গবেষণা: ডিনা ওয়াইনস্টিন ও কিথ কান-হ্যারিসের সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান
সমাজতাত্ত্বিকরাই প্রথম মেটালকে একটি সামাজিক ঘটনা (Social phenomenon) হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেন। তারা প্রশ্ন করেন, কেন লক্ষ লক্ষ তরুণ এই সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়? এর সামাজিক কাজ কী?
ডিনা ওয়াইনস্টিন (Deena Weinstein): মেটাল সংস্কৃতির প্রথম মানচিত্রকার
সমাজতত্ত্বের জগতে ডিনা ওয়াইনস্টিনকে মেটাল গবেষণার জননী বলা যেতে পারে। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত তার যুগান্তকারী বই Heavy Metal: The Music and Its Culture ছিল এই বিষয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ এবং সহানুভূতিশীল অ্যাকাডেমিক কাজ। এর আগে মেটালকে নিয়ে যা কিছু লেখালেখি হতো, তার বেশিরভাগই ছিল আতঙ্ক ছড়ানো বা নৈতিক বিচারমূলক। ওয়াইনস্টিনই প্রথম মেটালকে একটি গুরুতর সামাজিক ঘটনা হিসেবে বিশ্লেষণ করেন।
- মূল তত্ত্ব: ওয়াইনস্টিন মেটালকে একটি স্বতন্ত্র উপ-সংস্কৃতি (Subculture) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, যার নিজস্ব কোড বা নিয়মকানুন (Code), প্রতীক (Symbol) এবং আচার-অনুষ্ঠান (Ritual) রয়েছে। তিনি যুক্তি দেখান যে, মেটাল সংস্কৃতি মূলত তরুণ, শ্বেতাঙ্গ, শ্রমিক শ্রেণির পুরুষদের জন্য এক ধরনের আশ্রয়স্থল। এটি তাদের প্রাত্যহিক জীবনের একঘেয়েমি, ক্ষমতাহীনতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে মুক্তি দেয়। তিনি মেটালের মূল দর্শনকে গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাসের (Dionysus) সাথে তুলনা করেন, যিনি ছিলেন উচ্ছৃঙ্খলতা, আবেগ এবং নিয়ম ভাঙার দেবতা। তার মতে, মেটালের কনসার্ট হলো এক ধরনের ডায়োনিসিয়ান উৎসব, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা হেডব্যাংগিং বা মশ পিটের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের শৃঙ্খল থেকে সাময়িক মুক্তি পায়।
- গুরুত্ব: ওয়াইনস্টিনের কাজ মেটালকে ‘সামাজিক সমস্যা’র তকমা থেকে মুক্ত করে ‘সাংস্কৃতিক ঘটনা’ হিসেবে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে। তিনি দেখান যে, মেটালের পোশাক, প্রতীক বা আচার-আচরণের পেছনে গভীর সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। তার এই কাঠামোই পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকদের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে দেয়।
কিথ কান-হ্যারিস (Keith Kahn-Harris): এক্সট্রিম মেটালের দৃশ্যপটের গভীরে
ডিনা ওয়াইনস্টিনের কাজ মূলত মূলধারার হেভি মেটালকে কেন্দ্র করে ছিল। কিন্তু মেটাল যখন আরও চরমপন্থী (Extreme) রূপ ধারণ করল, তখন তাকে বোঝার জন্য নতুন ধরনের বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ সমাজতত্ত্ববিদ কিথ কান-হ্যারিস সেই কাজটিই করেছেন তার ২০০৭ সালের বই Extreme Metal: Music and Culture on the Edge-এ।
- মূল তত্ত্ব: কান-হ্যারিস নিজে একজন মেটালহেড এবং বাদক। তিনি অংশগ্রহণকারী পর্যবেক্ষক (Participant observer) হিসেবে এক্সট্রিম মেটাল, বিশেষ করে ব্ল্যাক মেটাল এবং ডেথ মেটালের দৃশ্যপটের (Scene) গভীরে প্রবেশ করেন। তিনি দেখান যে, এই দৃশ্যপটগুলো কেবল সঙ্গীত শোনার জায়গা নয়, এগুলো এক ধরনের সামাজিক জগৎ যেখানে সদস্যরা ‘সাবকালচারাল ক্যাপিটাল’ (Subcultural capital) বা উপ-সাংস্কৃতিক পুঁজি অর্জন করে। অর্থাৎ, কে কতটা ‘ট্রু’ (True) বা খাঁটি, কার কাছে কত দুর্লভ ডেমো আছে, কে কতটা আন্ডারগ্রাউন্ড – এসবের ওপর ভিত্তি করে দৃশ্যপটের মধ্যে সম্মান ও পরিচিতি তৈরি হয়। তিনি আরও যুক্তি দেন যে, এক্সট্রিম মেটালের যে ভয়ঙ্কর এবং সীমা লঙ্ঘনকারী (Transgressive) থিম, তা বাস্তব জগতের সহিংসতা থেকে ভিন্ন। এটি এক ধরনের ‘প্রতীকী সহিংসতা’ (Symbolic violence), যা একটি নিরাপদ সাংস্কৃতিক পরিসরের মধ্যে ঘটে এবং সমাজের ট্যাবুগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে।
- গুরুত্ব: কান-হ্যারিসের কাজ এক্সট্রিম মেটালের মতো একটি দুর্বোধ্য এবং প্রায়শই ভুল বোঝা সংস্কৃতিকে ভেতর থেকে বোঝার সুযোগ করে দেয়। তিনি দেখান যে, এই সংস্কৃতিরও নিজস্ব যুক্তি, নৈতিকতা এবং সামাজিক কাঠামো রয়েছে।
এই সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন যে মেটালহেড হওয়া মানে শুধু গান শোনা নয়, এটি একটি গোষ্ঠীর অংশ হওয়া, একটি জীবনযাত্রাকে গ্রহণ করা।
সঙ্গীততত্ত্ব (Musicology) ও শব্দের ব্যবচ্ছেদ: গোলমালের ব্যাকরণ ও একজন রবার্ট ওয়ালসার
সঙ্গীততত্ত্ববিদরা মেটালের সঙ্গীত কাঠামো এবং বাদনশৈলীকে বিশ্লেষণ করে এর শৈল্পিক জটিলতাকে সামনে এনেছেন। তারা দেখিয়েছেন যে, এটি মোটেও সরল বা একঘেয়ে সঙ্গীত নয়।
সঙ্গীততত্ত্ববিদ রবার্ট ওয়ালসার (Robert Walser) মেটাল মিউজিকের কাঠামোর গভীরতা উন্মোচন করেছেন। তার ১৯৯৩ সালের বই Running with the Devil: Power, Gender, and Madness in Heavy Metal Music দেখায় যে, মেটাল মোটেও সরল বা একঘেয়ে সঙ্গীত নয়। এই বইতে তিনি মেটাল মিউজিকের বাদনশৈলী বা ভার্চুওসিটিকে (Virtuosity) ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি দেখান যে, র্যান্ডি রোডস (Randy Rhoads) বা ইংভি মালমস্টিনের (Yngwie Malmsteen) মতো গিটারিস্টদের কাজে বাখ (Bach), ভিভাল্ডি (Vivaldi) বা পাগানিনির (Paganini) মতো ক্লাসিক্যাল কম্পোজারদের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। তাদের অবিশ্বাস্য গতি এবং টেকনিক্যাল দক্ষতা বা ‘ভার্চুওসিটি’ (Virtuosity) লিসৎ (Liszt) বা মোৎজার্টের (Mozart) মতোই, যারা দর্শকদের মুগ্ধ করার জন্য নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করতেন। ওয়ালসার আরও বিশ্লেষণ করেন, কীভাবে পাওয়ার কর্ড (Power chord), ট্রাইটোন (Tritone), ডিসটরশন (Distortion) এবং বিভিন্ন স্কেলের (যেমন ব্লুজ বা মাইনর স্কেল) ব্যবহার মেটালের মধ্যে শক্তি (Power), অশুভতার (Sinister), আগ্রাসন এবং অন্ধকারের অনুভূতি তৈরি করে।
ওয়ালসারের কাজ মেটালের শৈল্পিক বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে। তিনি প্রমাণ করেন যে, মেটাল কেবল কাঁচা আবেগ নয়, এর পেছনে রয়েছে জটিল সঙ্গীততত্ত্ব এবং বাদকদের কঠোর অনুশীলন ও দক্ষতা। তিনি মেটালকে ‘উচ্চ সংস্কৃতি’ (High culture) এবং ‘নিম্ন সংস্কৃতি’র (Low culture) মধ্যকার দেয়াল ভাঙার একটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। পরবর্তীকালে গবেষকরা মেটালের বিভিন্ন সাব-জঁরার সাংগীতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরও গভীর গবেষণা করেছেন। যেমন, ব্ল্যাক মেটালের ট্রেমোলো পিকিং কীভাবে এক ধরনের সম্মোহনী এবং মহাজাগতিক আবহ তৈরি করে, বা ডেথ মেটালের জটিল রিফ এবং পলি-রিদম কীভাবে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা প্রকাশ করে – এইসব বিশ্লেষণ মেটালের শৈল্পিক গভীরতাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা প্রমাণ করেছেন যে, এই গোলমালেরও একটি নিজস্ব ব্যাকরণ এবং নান্দনিকতা আছে, যা বোঝার জন্য গভীর মনোযোগ প্রয়োজন।
বৈশ্বিক মেটালের ভূ-রাজনীতি, নৃতত্ত্ব ও সংস্কৃতি তত্ত্ব: জেরেমি ওয়ালাক এবং রোসমারি ওভেরেল
মেটাল এখন আর কেবল পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গীত নয়। এটি একটি বিশ্বজনীন ঘটনা। জেরেমি ওয়ালাক (Jeremy Wallach) বা রোসমারি ওভেরেল (Rosemary Overell)-এর মতো নৃতত্ত্ববিদ এবং সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিকরা মেটালের এই বিশ্বায়নের দিকটি নিয়ে কাজ করছেন।
জেরেমি ওয়ালাক তার বই Modern Noise, Fluid Genres: Popular Music in Indonesia, 1997-2001-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মেটাল সঙ্গীত স্থানীয় সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ধর্মের সাথে মিশে এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। এটি তরুণদের জন্য আধুনিকতা এবং বিশ্ব নাগরিক হওয়ার প্রতীক, আবার একই সাথে এটি রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে এক ধরনের পরোক্ষ প্রতিরোধ। রোসমারি ওভারেল তার গবেষণায় অস্ট্রেলিয়ার এক্সট্রিম মেটাল দৃশ্যপটে স্থান (Space) এবং আবেগের (Affect) ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখান যে, মেটাল যখন কোনো নতুন ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে প্রবেশ করে, তখন এটি আর কেবল একটি সঙ্গীত শৈলী থাকে না, এটি হয়ে ওঠে স্থানীয় পরিচয়, রাজনীতি এবং প্রতিরোধের এক জটিল হাতিয়ার।
এই গবেষকরা মেটাল স্টাডিজকে একটি বৈশ্বিক (Global) এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক (Postcolonial) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পথ খুলে দিয়েছেন। তারা প্রশ্ন করছেন, মেটাল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে কি পশ্চিমা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদকে শক্তিশালী করছে, নাকি এটি স্থানীয় সংস্কৃতিগুলোকে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের কথা বলার একটি নতুন ভাষা দিচ্ছে?
দর্শন এবং ‘মেটাল স্টাডিজ’: গোলমালের গভীরে ডুব ও একজন কার্ল স্প্র্যাকলেন
দর্শনের মতো একটি ‘গুরুগম্ভীর’ বিষয়ের সাথে মেটালের মতো একটি ‘গোলমেলে’ শিল্পের সংযোগ স্থাপন করাটা অনেকের কাছেই অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে, দার্শনিকরাও মেটালের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা মেটালের গানের কথা এবং দর্শনের মধ্যে নিৎশে, কামু বা লাভক্র্যাফটের মতো চিন্তাবিদদের চিন্তার প্রতিফলন খুঁজে পাচ্ছেন। এর ফলে ‘ফিলোসফি অফ হেভি মেটাল’ (Philosophy of Heavy Metal) একটি জনপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মেটাল নিয়ে কোর্স পড়ানো হচ্ছে। নিয়মিতভাবে ‘হেভি মেটাল অ্যান্ড পপুলার কালচার’ (Heavy Metal and Popular Culture) শিরোনামে আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে সারা বিশ্বের গবেষকরা তাদের কাজ উপস্থাপন করছেন। The Palgrave Handbook of the Philosophy of Heavy Metal (Spracklen et al., 2020) এর মতো বই প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে দর্শনের বিভিন্ন শাখা – যেমন নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics), নীতিশাস্ত্র (Ethics), রাজনীতি (Politics) – ব্যবহার করে মেটালকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
এই গবেষকরা দেখান যে, মেটাল কেবল বিনোদন নয়, এটি এক ধরনের ফলিত দর্শন (Applied philosophy)। এটি জীবনের বড় বড় প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। যেমন, নরওয়ের ব্ল্যাক মেটাল দৃশ্যপটকে বিশ্লেষণ করে তারা দেখান, কীভাবে নিৎশের ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’র ধারণাটি একটি মডার্ন, সেক্যুলার সমাজে আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি করতে পারে এবং কিছু তরুণকে চরমপন্থী পথের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তারা মেটালের মধ্যে নিইলিজম (Nihilism) বা শূন্যবাদ এবং মানবতাবাদ (Humanism)-এর মধ্যেকার এক জটিল টানাপোড়েনকে আবিষ্কার করেন।
এই বিষয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ব্রিটিশ সমাজতত্ত্ববিদ এবং সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক কার্ল স্প্র্যাকলেন। তিনি দর্শনের সাথে মেটাল শিল্পের সংযোগ স্থাপনের কাজটি সফলভাবে করে চলেছেন। তিনি ‘লিডিং ফিগার’দের একজন, যারা মেটালকে দর্শনের আতসকাঁচের নিচে ফেলে বিশ্লেষণ করছেন।
স্প্র্যাকলেন তার বিভিন্ন লেখা এবং সম্পাদিত গ্রন্থে (যেমন The Palgrave Handbook of the Philosophy of Heavy Metal) দেখিয়েছেন যে, মেটালের লিরিক্স এবং দর্শনের গভীরে নিৎশে (Nietzsche), হাইডেগার (Heidegger) বা সার্ত্রের (Sartre) মতো দার্শনিকদের চিন্তার স্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে। তিনি বিশেষ করে ব্ল্যাক মেটালের সাথে নিৎশের দর্শনের সংযোগ স্থাপন করেছেন। তিনি দেখান, কীভাবে নিৎশের ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’, ‘উবারমেনশ’ (Übermensch) এবং ‘প্রভুর নৈতিকতা’র (Master morality) ধারণাগুলো ব্ল্যাক মেটালের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং খ্রিস্ট-বিরোধিতার দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেছে। তিনি মেটালকে কেবল বিনোদন হিসেবে না দেখে, এক ধরনের ‘সিরিয়াস লেজার’ (Serious leisure) হিসেবে অভিহিত করেন, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা গভীর জ্ঞান এবং দর্শন চর্চা করে।
স্প্র্যাকলেনের কাজ মেটালকে একটি উচ্চ-বৌদ্ধিক (High-intellectual) শিল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, মেটালের গোলমালের গভীরে মানব অস্তিত্বের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে এক নিরন্তর দার্শনিক অন্বেষণ চলছে।
এই তাত্ত্বিকরা এবং আরও অনেকে তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, মেটাল মিউজিক কেবল একটি সঙ্গীত শৈলী নয়। এটি একটি জটিল সাংস্কৃতিক টেক্সট, যা থেকে আমরা সমাজ, রাজনীতি, দর্শন, প্রযুক্তি এবং মানব মনের গভীরের অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারি। তারা আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে গোলমালের ভেতরেও শৃঙ্খলা, চিৎকারের ভেতরেও কবিতা এবং অন্ধকারের ভেতরেও দর্শন খুঁজে নিতে হয়।
উত্তর-ঔপনিবেশিক (Postcolonial) পাঠ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: গোলমালের ভূ-রাজনীতি
সবচেয়ে আধুনিক গবেষণাগুলো মেটালকে একটি বৈশ্বিক ঘটনা হিসেবে দেখছে এবং প্রশ্ন করছে, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে উদ্ভূত এই সংস্কৃতিটি অ-পশ্চিমা বিশ্বে গিয়ে কী রূপ ধারণ করে?
- সাংস্কৃতিক সংকরায়ন (Cultural Hybridization): গবেষকরা দেখান যে, মেটাল বিশ্বায়নের (Globalization) একটি চমৎকার উদাহরণ। এটি যখন কোনো নতুন সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে, তখন এটি সেখানকার স্থানীয় সঙ্গীতের উপাদান, ভাষা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে মিশে যায়। যেমন, জাপানের বেবিমেটাল (Babymetal) ব্যান্ডটি হেভি মেটালের সাথে জাপানি পপ মিউজিক বা জে-পপ (J-Pop)-এর ‘কাওয়াই’ (Kawaii) বা ‘কিউট’ নান্দনিকতাকে মিশিয়ে এক অদ্ভুত এবং বিশ্বজুড়ে সফল হাইব্রিড তৈরি করেছে।
- প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে মেটাল (Metal as a Tool of Resistance): উত্তর-ঔপনিবেশিক (Postcolonial) তাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণ করেন, কীভাবে সাবেক উপনিবেশের দেশগুলোতে মেটাল পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের (Western cultural hegemony) প্রতীক হতে পারে, আবার একই সাথে স্থানীয় স্বৈরাচারী শাসক বা ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের হাতিয়ারও হতে পারে। এটি এক জটিল এবং স্ববিরোধী ভূমিকা পালন করে।
এই গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে মেটালের উত্তরাধিকার একমাত্রিক নয়। এটি বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন মানুষের হাতে পড়ে নতুন নতুন অর্থ এবং তাৎপর্য লাভ করে।
শেষ কথা: গোলমাল, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু?
তাহলে, এই দীর্ঘ আলোচনার শেষে আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? মেটাল মিউজিক কি শুধুই একঘেয়ে, কান ফাটানো গোলমাল?
সম্ভবত না। এটি একটি অত্যন্ত জটিল, গভীর এবং বহুমাত্রিক শিল্প মাধ্যম। এর মধ্যে যেমন রয়েছে বজ্রপাতের মতো গর্জন, তেমনি রয়েছে ভোরের আলোর মতো শান্ত সৌন্দর্য। যেমন রয়েছে মানব অস্তিত্বের গভীরতম অন্ধকার এবং হতাশার কথা, তেমনি রয়েছে অফুরন্ত শক্তি এবং মুক্তির জয়গান। এটি এমন এক সঙ্গীত যা আপনাকে স্বস্তি দেবে না, বরং আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে। আপনাকে আপনার আরামদায়ক জগৎ থেকে বের করে এনে কঠিন প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করাবে। আপনার ভেতরের চাপা পড়ে থাকা অনুভূতিগুলোকে, বিশেষ করে যৌবনের সেই তীব্র রাগ এবং বিভ্রান্তিকে, বের করে আনবে এবং তাকে একটি কণ্ঠ দেবে।
মেটাল মিউজিক সবার জন্য নয়। এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। সব শিল্পই সবার জন্য হয় না। রবিঠাকুরের গান যেমন সবার ভালো লাগে না, তেমনি মেটালও সবার ভালো লাগবে না। কিন্তু যারা এর রুক্ষ, কর্কশ আবরণের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অবিশ্বাস্য বাদনশৈলী, জটিল সঙ্গীত কাঠামো এবং গভীর আবেগকে আবিষ্কার করতে পারে, তাদের জন্য এটি কেবল কিছু গান থাকে না, হয়ে ওঠে জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক ধরনের আশ্রয়। এক ধরনের ভাষা। এক ধরনের দর্শন।
সেই যে মেঘলা দুপুরে পাশের বাড়ির ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসা তীব্র শব্দের কথা বলেছিলাম, সেই ঘরের ভেতর যে কিশোর বা তরুণটি দরজা বন্ধ করে সর্বোচ্চ ভলিউমে মেটাল শুনছে, সে হয়তো উচ্ছন্নে যাচ্ছে না। সে হয়তো সমাজের আর দশটা মানুষের মতো নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না। সে হয়তো এই গোলমালের ভেতরেই নিজের সঙ্গে কথা বলছে, নিজের ভেতরের জমে থাকা ঝড়কে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কারণ দিন শেষে, মেটাল মিউজিক আসলে বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা খোঁজারই এক নিরন্তর শৈল্পিক প্রচেষ্টা।
এক ভয়ংকর সুন্দর, সৎ এবং শক্তিশালী গোলমাল।
তথ্যসূত্র
- Arnett, J. J. (1991). Heavy metal music and reckless behavior among adolescents. Journal of Youth and Adolescence, 20(6), 573–592.
- Arnett, J. J. (1996). Metalheads: Heavy metal music and adolescent alienation. Westview Press.
- Baddeley, G. (2002). Gothic chic: A connoisseur’s guide to dark culture. Plexus Publishing.
- Bailey, E. (1997). Implicit Religion in Contemporary Society. Peeters Publishers.
- Bashe, P. (2011). Heavy metal: The music and its history, from the classics to the new spiritual metal. ECW Press.
- Berger, H. M. (2005). “Arm-waving and fist-pumping”: The rites and rituals of the heavy metal music community. In M. T. Carroll (Ed.), Popular music and communication (2nd ed., pp. 21-42). Ablex Publishing.
- Brown, A. R. (2020). “That is not dead which can eternal lie”: The Cthulhu Mythos in heavy metal. In G. Spracklen, B. R. Hagen, & K. T. V. Krogstad (Eds.), The Palgrave handbook of the philosophy of heavy metal (pp. 209-226). Palgrave Macmillan.
- Christe, I. (2003). Sound of the beast: The complete headbanging history of heavy metal. HarperCollins.
- Cohen, S. (1972). Folk Devils and Moral Panics: The Creation of the Mods and Rockers. MacGibbon and Kee.
- Cowan, D. E. (2010). Sacred Terror: Religion and Horror on the Silver Screen. Baylor University Press.
- Hart, K. (2013). The “Death-Grunt” and the “Sub-Scat”: Monstration in Death Metal and the “A-signifying” Voice. Popular Music and Society, 36(4), 503-520.
- Hill, R. (2011). ‘Then what’s the voice for?’: The screaming voice in extreme metal. In D. Zakarin & N. Mehdizadeh (Eds.), Terror tracks: Music, sound and horror cinema (pp. 165-180). Equinox Publishing.
- Kahn-Harris, K. (2007). Extreme metal: Music and culture on the edge. Berg Publishers.
- Kane, B. (2020). Kant’s sublime and the music of black metal. In G. Spracklen, B. R. Hagen, & K. T. V. Krogstad (Eds.), The Palgrave handbook of the philosophy of heavy metal (pp. 41-58). Palgrave Macmillan.
- Klein, B. (2009). As heard on TV: Popular music in advertising. Ashgate.
- Merino, J. Á. O. (2017). Grunge: A sub-state of the art of rock’n’roll. In J. M. González, M. Á. G. M. S., & M. S. Paradelo (Eds.), The state of the art of the G.E.A.S. journal (pp. 11-30). University of Jaén.
- Moberg, M. (2009). Faster for the Master: Exploring Issues of Religious Expression and Alternative Christian Identity within the Finnish Christian Metal Music Scene. Åbo Akademi University Press.
- Moynihan, M., & Søderlind, D. (2003). Lords of chaos: The bloody rise of the Satanic metal underground (New ed.). Feral House.
- O’Flynn, J. (2017). Heavy metal and the fantastic. In G. Bayer (Ed.), Heavy metal music in Britain (pp. 167-182). Routledge.
- Olson, B. (2008). I’m a monster: The oral history of a ‘shock-rock’ roll ‘n’ roll band. Northeast Ohio College of Massotherapy.
- Partridge, C. (2004). The Re-Enchantment of the West: Alternative Spiritualities, Sacralization, Popular Culture, and Occulture (Vol. 1). T&T Clark International.
- Purcell, N. J. (2003). Death metal music: The passion and politics of a subculture. McFarland.
- Spracklen, G. (2020). Metal music and the re-imagining of masculinity, place, and race. Emerald Publishing Limited.
- Spracklen, G., Hagen, B. R., & K. T. V. Krogstad (Eds.). (2020). The Palgrave handbook of the philosophy of heavy metal. Palgrave Macmillan.
- Spracklen, K. (2020). “To live is to war”: The intellectual foundation of Nietzsche’s philosophy in the music and culture of black metal. In G. Spracklen, B. R. Hagen, & K. T. V. Krogstad (Eds.), The Palgrave handbook of the philosophy of heavy metal (pp. 59-75). Palgrave Macmillan.
- Wallach, J. (2009). Modern noise, fluid genres: Popular music in Indonesia, 1997-2001. University of Wisconsin Press.
- Walser, R. (1993). Running with the Devil: Power, gender, and madness in heavy metal music. Wesleyan University Press.
- Weinstein, D. (2000). Heavy metal: The music and its culture (Revised ed.). Da Capo Press.

