জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) (৮৬৯-৮৮৩ খ্রি.): লোনাজলে রক্তে লেখা এক বিস্মৃত ইতিহাসের আখ্যান
Table of Contents
- 1 ভূমিকা: ইতিহাসের নেপথ্যে লোনাজলে আঁকা এক ধূসর ক্যানভাস
- 2 পটভূমি: বাতিহার লোনাজল ও স্বর্ণযুগের কদর্য রূপ
- 3 নায়ক নাকি খলনায়ক: আলী ইবনে মুহাম্মদ নামের জাদুকর
- 4 রণকৌশল: জলাভূমির গেরিলা যুদ্ধ ও আব্বাসীয়দের ব্যর্থতা
- 5 আল-মুখতারা: যখন দাসেরাও রাষ্ট্র বানায়
- 6 বসরার পতন: মানবিক বিপর্যয়ের এক করুণ অধ্যায়
- 6.1 ধ্বংসলীলা ও প্রতিশোধের আগুন
- 6.2 আল-তাবারির বর্ণনায় নরকের দৃশ্য
- 6.3 প্রভাব ও আব্বাসীয়দের প্রতিক্রিয়া
- 6.4 আল-মুওয়াফফাক: সাম্রাজ্যের পাল্টা আঘাত ও কৌশলের খেলা
- 6.5 অর্থনৈতিক অবরোধ: ক্ষুধা যখন যুদ্ধের হাতিয়ার
- 6.6 নৌ-যুদ্ধ ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ব্যবহার
- 6.7 সাধারণ ক্ষমা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মাস্টারস্ট্রোক
- 7 আল-মুখতারার পতন: একটি স্বপ্নের মৃত্যু
- 8 চূড়ান্ত পরিণতি: ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ
- 9 বিদ্রোহের প্রভাব: কেন এটি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল?
- 10 বিশ্লেষণ: ধূসর এলাকার উপাখ্যান
- 11 তাত্ত্বিক বীক্ষণ: জাঞ্জ বিদ্রোহের সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
- 11.1 ইবনে খালদুন ও আসাবিয়্যাহ: ক্ষমতার চক্রাকার আবর্তন
- 11.2 কার্ল মার্কস ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: বাতিহা যখন শ্রেণি সংগ্রামের রণক্ষেত্র
- 11.3 অরলান্ডো প্যাটারসন ও সামাজিক মৃত্যু: দাসত্বের মনস্তত্ত্ব
- 11.4 জেমস সি. স্কট ও প্রতিরোধের শিল্পকলা: প্রচ্ছন্ন পাণ্ডুলিপি
- 11.5 ফ্রান্তজ ফানো ও সহিংসতার মনস্তত্ত্ব: কলোনিয়াল ট্রমা
- 11.6 এডওয়ার্ড সাঈদ ও ওরিয়েন্টালিজম: ইতিহাসের বয়ান
- 11.7 রণজিৎ গুহ ও গায়ত্রী স্পিভাক: সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ ও নিম্নবর্গের ইতিহাস
- 11.8 মিশেল ফুকো ও বায়োপলিটিক্স: শরীরের রাজনীতি
- 11.9 তত্ত্বের আয়নায় ইতিহাসের প্রতিবিম্ব
- 12 উপসংহার: লোনাজলে মিশে থাকা কালের প্রতিধ্বনি
- 13 তথ্যসূত্র
ভূমিকা: ইতিহাসের নেপথ্যে লোনাজলে আঁকা এক ধূসর ক্যানভাস
ইতিহাস বড়ই অদ্ভুত এক গোলকধাঁধা। এর অলিগলি বড্ড পেঁচানো, যেখানে সত্য অনেক সময় মিথ্যার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকে। প্রচলিত ইতিহাস কেবল বিজয়ীদের কথাই মনে রাখে; যারা হেরে যায়, যারা মাটির নিচে চাপা পড়ে, তাদের দীর্ঘশ্বাস কিংবা হাহাকার ইতিহাসের পাতায় খুব একটা জায়গা পায় না। আমরা যখন আব্বাসীয় খিলাফতের (Abbasid Caliphate) স্বর্ণযুগের কথা বলি, তখন আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে এক অবিশ্বাস্য জৌলুসের ছবি। বাগদাদের ঐশ্বর্য, ‘বাইতুল হিকমা’র (House of Wisdom) জ্ঞানচর্চার ধুম, আরব্য রজনীর জাদুকরী গল্প আর খলিফা হারুন-অর-রশিদের রাজকীয় দরবারের আভিজাত্য – সব মিলিয়ে মনে হয়, আহা! কী চমৎকার এক সময় ছিল সেটি! বিজ্ঞানে, দর্শনে, সাহিত্যে, এবং স্থাপত্যে পৃথিবী তখন যেন নতুন এক আলোর মুখ দেখছিল। দজলা বা টাইগ্রিস নদীর বুকে যখন চাঁদের আলো পড়ত, তখন বাগদাদের প্রাসাদে নর্তকীদের ঘুঙুর আর কবিদের শায়েরি এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করত।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই, প্রদীপের ঠিক নিচেই থাকে গাঢ়, মিশমিশে অন্ধকার। সেই আলোর ঝলকানি আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় বলে অন্ধকারের খবর আমরা কজন রাখি? সভ্যতার চাকা সচল রাখতে গিয়ে, সেই স্বর্ণযুগের ইমারত গড়তে গিয়ে কত মানুষের হাড় গুঁড়ো হয়ে চাকার নিচে পিষ্ট হয়েছে, তার হিসাব কি কোনো রাজকীয় মহাফেজখানায় লেখা আছে? সম্ভবত নেই। কোনো সভাকবি কিংবা ইতিহাসবিদ তাদের কলমে সেই নাম-পরিচয়হীন মানুষগুলোর রক্ত আর ঘামের গল্প লেখেননি।
আজ এমনই এক বিস্মৃত অন্ধকারের গল্প বলব। গল্পটা কেবল লবণের নয়, কাদার নয়; গল্পটা মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা আর অস্তিত্ব রক্ষার। এই গল্প ‘জাঞ্জ বিদ্রোহের’ (Zanj Rebellion)। নবম শতাব্দীর মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্করী ও দীর্ঘস্থায়ী দাস বিদ্রোহ, যা প্রায় পনেরো বছর ধরে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পাঠ্যবই কিংবা ইতিহাসের সাধারণ আলোচনায় এই অধ্যায়টি খুব সংক্ষেপে, অনেকটা দায়সারাভাবে লেখা থাকে। যেন লেখক নিজেও এক ধরণের অস্বস্তিতে ভুগছেন সেই সময়ের ‘আলোকিত’ শাসকদের কলঙ্ক উন্মোচন করতে। অথচ, হাজার হাজার কালো মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি হয়েছিল বাগদাদের বিলাসিতা। সেই হাড়গুলো যখন হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে উঠল, যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমে থাকা ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হলো, তখন কী হয়েছিল? কেন এই বিদ্রোহকে বলা হয় মধ্যযুগের ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী এবং বিভীষিকাময় গৃহযুদ্ধ? চলুন, ইতিহাসের জমে থাকা ধুলো ঝেড়ে সেই লোনাজলের দেশে ফিরে যাই, যেখানে মানুষের জীবনের দাম ছিল এক মুঠো লবণের চেয়েও কম, কিন্তু তাদের স্বপ্নের মূল্য ছিল আকাশের সমান।
পটভূমি: বাতিহার লোনাজল ও স্বর্ণযুগের কদর্য রূপ
সময়টা ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ। স্থান দক্ষিণ ইরাক (Southern Iraq)। দজলা ও ফোরাত (Tigris and Euphrates) নদী যেখানে পারস্য উপসাগরে মেশার আগে জট পাকিয়ে বিশাল এক জলাভূমি তৈরি করেছে, সেই জায়গাটার নাম বাতিহা (The Batihah)। ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চলটি ছিল প্রকৃতির এক অদ্ভুত ও প্রতিকূল খেয়াল। এটি না পুরোপুরি ডাঙা, না পুরোপুরি জল; বরং মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নলখাগড়ার বন (Reed beds), আর তার মাঝে মাঝে অসংখ্য সরু, সর্পিল খাল বা নালার এক জটিল গোলকধাঁধা। এখানকার পরিবেশ মানুষের বাসের জন্য ছিল নরকতুল্য; বাতাস সবসময় ভারী ও আর্দ্র থাকে, একধরণের ভ্যাপসা গরমে শরীর চটচট করে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। দুপুরের সূর্যের তাপ এখানে সরাসরি চামড়া পুড়িয়ে দেয়, আর বাতাসের লোনা ভাব তৃষ্ণা বাড়িয়ে তোলে দ্বিগুণ। এর সাথে যুক্ত হয় মশা-মাছির অসহ্য উপদ্রব; জলাভূমির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের জীবাণু বহনকারী পতঙ্গগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় মৃত্যুর দূতের মতো। অথচ, প্রকৃতির এই রুক্ষতাকে উপেক্ষা করেই এখানে মানুষের কোলাহল শোনা যেত, তবে সেই কোলাহল জীবনের উল্লাসের ছিল না, ছিল মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তনাদ। এই বাতিহা অঞ্চলটিই হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আব্বাসীয় খিলাফতের অর্থনীতির এক গোপন কসাইখানা, যেখানে সভ্যতা নির্মাণের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো মানুষের শরীর।
আব্বাসীয় খিলাফত তখন বাহ্যিক জৌলুসের তুঙ্গে। বাগদাদ তখন আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু বা ‘নাভি’, যেখানে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটছিল। খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় The Thousand and One Nights বা আরব্য রজনীর গল্পগুলো যখন ডালপালা মেলছে, তখন বাগদাদের রাজপথ দিয়ে হেঁটে যেতেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি, দার্শনিক, আর বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্যের, যাকে ঐতিহাসিকরা ইসলামি স্বর্ণযুগ (Islamic Golden Age) বলে অভিহিত করেন, তার অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং রাজকীয় বিলাসিতার ব্যয়ভার বহন করতে দরকার ছিল প্রচুর অর্থ। বাগদাদের প্রাসাদে যে চিনি দিয়ে শরবত তৈরি হতো, কিংবা যে মখমলের কাপড়ে অভিজাতরা গা এলিয়ে দিতেন, তার জোগান আসত এক নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে। বিলাসিতার খরচ মেটানোর জন্য খলিফা এবং ধনিক শ্রেণি ঝুঁকে পড়েছিল কৃষির বাণিজ্যায়নের দিকে, বিশেষ করে আখের চাষ, যা থেকে চিনি উৎপাদন হতো। বিশ্ববাজারে তখন চিনির কদর বা পণ্য পূজা (Commodity Fetishism) বাড়ছে। কিন্তু দক্ষিণ ইরাকের জমি, যা একসময় উর্বর মেসোপটেমিয়ার অংশ ছিল, তা তখন কৃষির অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা লোনা পানি শুকিয়ে এবং সেচ ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী কুফলে মাটির ওপর লবণের এক পুরু, শক্ত আস্তরণ তৈরি হয়েছিল। মৃত্তিকা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় নাইট্রাস সয়েল (Nitrous Soil) বা স্থানীয় কৃষকদের ভাষায় শাবাখ (Shakh)। এই জমি ছিল কার্যত মৃত, যাকে ইসলামি ভূমি আইনে মওয়াত ভূমি (Mawat Land) বা মৃত জমি বলা হতো, যা আবাদযোগ্য করে তুলতে পারলে মালিকানা দাবি করা যেত।
জমিতে ফসল ফলাতে হলে, বিশেষ করে আখ ও অন্যান্য অর্থকরী ফসল উৎপাদন করতে হলে, মাটির ওপরের এই লবণের বিষাক্ত স্তর সরাতে হবে। কাজটি ছিল অমানবিক এবং চরম কায়িক শ্রমনির্ভর। আধুনিক যন্ত্রপাতির যুগেও যা কঠিন, নবম শতাব্দীতে তা ছিল কেবল মানুষের পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল। রোদের তাপে পিঠ পুড়ে যাওয়া, লোনা কাদা ও পানিতে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকার ফলে চামড়া খসে পড়া, এবং পায়ের আঙুলের ফাঁকে ঘা হয়ে পচন ধরা – এটাই ছিল সেই কাজের বাস্তবতা। স্থানীয় আরব বা ইরাকি কৃষকরা, যারা বংশপরম্পরায় সেখানে বাস করত, তারা এই আত্মঘাতী কাজ করতে রাজি ছিল না; তারা বরং গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেত। ফলে আব্বাসীয় ধনিক শ্রেণি, যারা মূলত বাগদাদ ও বসরার অনুপস্থিত জমিদার বা অনুপস্থিত মালিকানা (Absentee Ownership) ভোগকারী ছিল, তারা সস্তা শ্রমের সন্ধানে সাম্রাজ্যের বাইরের দিকে নজর দিল। দৃষ্টি ফেরানো হলো পূর্ব আফ্রিকার (East Africa) উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর দিকে। বর্তমান কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক, মালাউই – এসব এলাকা থেকে আরব বণিকরা দলে দলে দাস ধরে আনতে শুরু করল। মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার ইতিহাসে এই অধ্যায়টি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে, কারণ এখানে দাসদের ব্যবহার করা হয়েছিল বিশাল আকারের কৃষি প্রকল্পে, যা অনেকটা আধুনিক যুগের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা (Capitalist Mode of Production)-এর আদি রূপ।
পূর্ব আফ্রিকা থেকে ধরে আনা এই দাসদের সামগ্রিকভাবে ‘জাঞ্জ’ (Zanj) বলা হতো। শব্দটি সম্ভবত ফার্সি বা কোনো আফ্রিকান উপভাষা থেকে এসেছে, যার সাধারণ অর্থ ‘কালো’ বা ‘কালোদের দেশ’ (Zanjibar থেকে Zanzibar)। তবে বাতিহার প্রেক্ষাপটে ‘জাঞ্জ’ কেবল একটি জাতিগত পরিচয় ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল একটি শ্রেণি পরিচয়, যা সমাজের সবচেয়ে নিম্নবর্গকে নির্দেশ করত। এদের কাজ ছিল একটাই – সারাদিন মাটি থেকে কোদাল দিয়ে লবণের স্তর বা শাবাখ (Shakh) চেঁছে ফেলা এবং সেই বিষাক্ত মাটি পিঠে করে ঝুড়িতে ভরে অন্যত্র সরিয়ে উর্বর জমি বের করা। এই প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত ধীর এবং কষ্টসাধ্য। একেকটি দল বা ‘গ্যাং’-এ শত শত, কখনও কখনও হাজার হাজার দাস কাজ করত। ঐতিহাসিকরা এই বিশেষ ধরনের দাসপ্রথাকে কৃষিভিত্তিক দাসপ্রথা (Plantation Slavery) বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্লেভারি (Industrial Slavery) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (Popovic, 1999)। এটি তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত গৃহস্থালি দাসপ্রথা (Domestic Slavery) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। গৃহস্থালি দাসরা অনেক সময় পরিবারের সদস্যের মতো মর্যাদা পেত, কিন্তু বাতিহার এই দাসরা ছিল কেবলই উৎপাদনের যন্ত্র, যাদের মানবিক সত্তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হতো।
জাঞ্জ দাসদের জীবনযাত্রার দৃশ্যপট কল্পনা করলে গা শিউরে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ, যাদের পায়ে ভারী লোহার শিকল, পিঠে চাবুকের কালসিটে দাগ, এবং রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যাওয়া শরীর। তারা কাজ করত সূর্যের প্রথম কিরণ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, আর ধুঁকে ধুঁকে মরত। তাদের কোনো পরিবার ছিল না, কারণ মালিকরা মনে করত দাসদের পরিবার থাকলে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে এবং বিদ্রোহের ঝুঁকি বাড়বে। তাই নারী ও শিশুদের সংখ্যা ছিল নগণ্য; মূলত কর্মক্ষম পুরুষদেরই ধরে আনা হতো। তাদের মালিকরা তাদের মানুষ বলে গণ্য করত না, বরং মনে করত একেকটা কথা বলা যন্ত্র বা বাকশক্তি সম্পন্ন হাতিয়ার (Instrumentum Vocale), যেমনটা রোমানরা বলত। যন্ত্র নষ্ট হলে যেমন ফেলে দেওয়া হয়, এদেরও শরীর ভেঙে পড়লে বা রোগে আক্রান্ত হলে নির্দয়ভাবে ছুড়ে ফেলা হতো জলাভূমিতে, যেখানে শেয়াল-কুকুর বা জলজ প্রাণী তাদের খুবলে খেত। তাদের খাবারের বরাদ্দ ছিল অতি সামান্য – দিনে কয়েক মুঠো খেজুর, কিছু যব আর অল্প পানি। এই সামান্য খাবার খেয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা ছিল অসম্ভব, ফলে অপুষ্টি ও অনাহারে মৃত্যু ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। রাতে তাদের গাদাগাদি করে রাখা হতো পশুর খামারের মতো নোংরা জায়গায়, যেখানে আলো-বাতাস ঢোকার কোনো উপায় ছিল না। এই বন্দিশালাগুলো ছিল একেকটি রোগের আখড়া।
এই দাসদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য মালিকরা নিয়োগ করত নিষ্ঠুর তদারককারী বা ‘ওয়াকিল’ (Agents), যারা প্রায়শই মুক্ত হওয়া প্রাক্তন দাস বা ভাড়াটে গুন্ডা হতো। তারা মালিকের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য দাসদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত। চাবুক মারা, লোহার রড দিয়ে পেটানো, কিংবা লোনা পানিতে চুবিয়ে রাখা ছিল শাস্তির সাধারণ ধরণ। এই যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, এই যে কান্না, এই যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমানো দীর্ঘশ্বাস – এগুলো কি এমনিতেই ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাবে? নাকি একদিন এই শোষিত মানুষেরা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হবে? সেটাই ছিল সময়ের অপেক্ষা। বাতিহার লোনাজল কেবল লবণ উৎপাদন করছিল না, তা নীরবে তৈরি করছিল এক বারুদ, যা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই জাঞ্জ বিদ্রোহের জন্ম, যা কেবল কোনো সাধারণ দাঙ্গা ছিল না, বরং এটি ছিল শ্রেণি সংগ্রাম (Class Struggle) ও জাতিগত বিদ্বেষের এক চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যেখানে লবণের খনি হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের আঁতুড়ঘর।
জাঞ্জদের এই বিদ্রোহ ও তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বুঝতে হলে আব্বাসীয় অর্থনীতির কাঠামোগত দিকটি বোঝা জরুরি। নবম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খিলাফত একটি বিশাল বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ (Mercantile Capitalism)-এর যুগে প্রবেশ করেছিল। বাগদাদ ও বসরার বণিকরা প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থের মালিক হয়েছিল। ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে যে সাদাসিধে জীবনযাপনের কথা বলা হতো, তা থেকে সরে এসে সমাজ তখন চরম ভোগবাদী হয়ে উঠেছিল। এই ভোগবাদের জন্য দরকার ছিল নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন। আখের চাষ ছিল অত্যন্ত লাভজনক, কিন্তু তা ছিল শ্রমঘন। তাই বাতিহার জলাভূমি পরিষ্কার করার প্রকল্পগুলো ছিল অনেকটা আধুনিক যুগের মেগা-প্রজেক্টের মতো। ধনী ব্যক্তিরা বাসরার গভর্নর বা খলিফার কাছ থেকে ইজারা বা ইকতামা প্রথা (Iqta System)-এর মতো ব্যবস্থায় বিশাল বিশাল জমি লিজ নিতেন। শর্ত থাকত, তারা জমি উদ্ধার করে চাষাবাদ করবেন এবং লাভের একটা অংশ সরকারকে দেবেন। এই মুনাফার লোভে তারা দাসদের ওপর শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দাসদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরোটাই উপযোগবাদী; একজন দাস কতদিন বাঁচল সেটা বড় কথা নয়, সে কতটুকু লবণ সরাতে পারল সেটাই ছিল মুখ্য।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট:
জাঞ্জরা কেবল শারীরিক নির্যাতনের শিকার ছিল না, তারা সামাজিকভাবেও ছিল চরম বিচ্ছিন্ন। তারা এমন এক দেশে এসে পড়েছিল যার ভাষা তারা বুঝত না, যার সংস্কৃতি তাদের কাছে ছিল অচেনা। স্থানীয় আরবরা তাদের নিচু নজরে দেখত। এমনকি মুক্ত হওয়ার পরেও সমাজে তাদের কোনো সম্মানজনক অবস্থান ছিল না। এই সামাজিক মৃত্যু (Social Death)-এর ধারণাটি দাসপ্রথা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ (Patterson, 1982)। একজন দাস যখন তার শেকড়, তার সংস্কৃতি, এবং তার পূর্বপুরুষের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয়, তখন সে সামাজিকভাবে মৃত বলে গণ্য হয়। জাঞ্জদের ক্ষেত্রে এই বিচ্ছিন্নতা তাদের একজোট হতে সাহায্য করেছিল। তাদের সবার শত্রু ছিল এক, সবার যন্ত্রণা ছিল এক। এই অভিন্ন দুঃখবোধ থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক শক্তিশালী সমষ্টিগত চেতনা (Collective Consciousness), যা পরবর্তীকালে আলী ইবনে মুহাম্মদের নেতৃত্বে বিদ্রোহে রূপ নিয়েছিল। - ভৌগোলিক সুবিধা ও বিদ্রোহের কৌশল:
বাতিহার ভৌগোলিক অবস্থান বিদ্রোহের জন্য ছিল আদর্শ। যে জলাভূমি ছিল তাদের নরক, সেটাই হয়ে উঠেছিল তাদের দুর্গ। আব্বাসীয় অশ্বারোহী বাহিনী বা ভারী বর্মধারী সৈন্যরা এই জলাভূমিতে অচল ছিল। কিন্তু জাঞ্জরা বছরের পর বছর এখানে কাজ করে প্রতিটি খাল, প্রতিটি চোরাবালি চিনে ফেলেছিল। তারা জানত কোথায় লুকালে কেউ খুঁজে পাবে না, কোন পথে দ্রুত পালানো যায়। এই ভৌগোলিক জ্ঞান তাদের গেরিলা যুদ্ধ (Guerrilla Warfare)-এর জন্য প্রাকৃতিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। তারা তাদের কাজের হাতিয়ার – কোদাল, কাস্তে, কুঠার – এগুলোকেই মারণাস্ত্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করছিল।
সুতরাং, ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের প্রাক্কালে দক্ষিণ ইরাকের বাতিহা অঞ্চল ছিল বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। একদিকে বাগদাদের বিলাসী জীবন, বাইতুল হিকমার জ্ঞানচর্চা, আর সুফি সাধকদের আধ্যাত্মিক গান; অন্যদিকে লোনাজলে অর্ধমৃত হাজার হাজার কালো মানুষের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর চাপা কান্না। এই বৈপরীত্য, এই চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য (Economic Inequality), এবং মানবিক মর্যাদার চরম অবমাননাই ছিল জাঞ্জ বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনো সভ্যতা মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে, তখনই সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে প্রলয়ঙ্করী বিদ্রোহ। বাতিহার লোনাজল ছিল সেই প্রলয়েরই নীরব সাক্ষী।
নায়ক নাকি খলনায়ক: আলী ইবনে মুহাম্মদ নামের জাদুকর
পৃথিবীর ইতিহাসের চিরায়ত নিয়ম হলো, যখন শোষণ ও অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, ঠিক তখনই ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে একজন ত্রাতার আবির্ভাব ঘটে। অথবা তিনি ঠিক ধ্রুপদী সংজ্ঞায় ‘ত্রাতা’ নন; হয়তো তিনি এক চতুর, উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ, যিনি মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে নিজের ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে জানেন। জাঞ্জ বিদ্রোহের মহানায়ক, বা কারো কারো মতে খলনায়ক, আলী ইবনে মুহাম্মদ (Ali ibn Muhammad) ছিলেন এমনই এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে বিদ্রোহী, ধর্মতাত্ত্বিক, সমরবিদ এবং অসাধারণ বাগ্মী। তাকে ঘিরে যে রহস্যের ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, তা তাকে ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য ‘এনিগমা’ বা ধাঁধায় পরিণত করেছে। তিনি কি সত্যিই নিগৃহীত মানুষের মুক্তিদাতা ছিলেন, নাকি নিজের রাজত্ব গড়ার লোভে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া এক সুবিধাবাদী জাদুকর ছিলেন – সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের তার মনস্তত্ত্ব, কৌশল এবং তৎকালীন সমাজবাস্তবতাকে গভীরভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে হবে।
লোকটা ছিলেন বড়ই রহস্যময়। তিনি আসলে কে ছিলেন, তার শিকড় কোথায় – তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ ও বিতর্ক রয়েছে। আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজে দাবি করতেন তিনি হযরত আলীর বংশধর বা আলিদ (Alid)। তিনি নিজেকে জায়েদ ইবনে আলী, যিনি উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তার বংশধর হিসেবে পরিচয় দিতেন। এই দাবির পেছনে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল; তৎকালীন ইসলামি বিশ্বে শাসকের বৈধতা পাওয়ার জন্য নবীর বংশের সাথে রক্তসম্পর্ক থাকাটা ছিল এক শক্তিশালী যোগ্যতা বা রাজনৈতিক বৈধতা (Political Legitimacy)। কিন্তু অধিকাংশ সুন্নি ঐতিহাসিক এবং তার সমসাময়িক লেখকরা এই দাবি নাকচ করে দেন। তাদের মতে, তিনি ছিলেন পারস্যের (Persian) বংশোদ্ভূত, সম্ভবত আরব উপদ্বীপের রেই (Rayy) নামক এলাকা (বর্তমান তেহরানের কাছে) থেকে এসেছিলেন। তার রক্তে ছিল বিদ্রোহের নেশা, আর চোখে ছিল অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি আরবের কোনো গোত্রপতির সন্তান ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন ভবঘুরে কবি ও শিক্ষক, যিনি সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করতে মরিয়া ছিলেন। তার অতীত জীবন ছিল ব্যর্থতায় ভরা; তিনি এর আগে বাহরাইন এবং বাসরার আশেপাশে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। সমাজের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা, যাদের পেটে ভাত আর পিঠে ছাদ ছিল, তারা তার বিপ্লবী কথাবার্তায় কান দেয়নি। এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা তাকে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় – যাদের হারানোর কিছু আছে, তারা বিপ্লব করে না। বিপ্লব তাদেরই কাজ, যাদের হারানোর মতো কেবল শিকলটুকু অবশিষ্ট আছে। অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন, তাকে যেতে হবে একদম নিচে, সমাজের তলানিতে, যেখানে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না।
কথার জাদুকর ও মনস্তাত্ত্বিক খেলা
আলী ইবনে মুহাম্মদ ছিলেন কথার জাদুকর। তার ছিল অসাধারণ বাকপটুতা এবং মানুষকে সম্মোহিত করার ক্ষমতা। তিনি জানতেন মানুষের মনের গহীনে সুপ্ত বারুদটাকে কীভাবে জাগিয়ে তুলতে হয়। তিনি কোনো অভিজাত মাদরাসা বা বাগদাদের রাজপ্রাসাদ থেকে আসেননি, তিনি এসেছিলেন ধুলোবালি মেখে, সাধারণের বেশে। তিনি বাতিহার সেই লোনাজলের নরকে গিয়ে সরাসরি দাসদের সাথে কথা বললেন। তিনি তাদের এমন এক কথা শোনালেন, যা তারা আগে কখনো শোনেনি। তিনি বললেন, “তোমাদের এই জরাজীর্ণ জীবন, এই চাবুকের দাগ – এসব তোমাদের নিয়তি বা ‘তাকদির’ নয়। আল্লাহ সকল মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের মনিবরা তোমাদের ওপর যে অত্যাচার করছে, তা আল্লাহর আইনের লঙ্ঘন।” তিনি দাসদের মনে বুনে দিলেন আত্মমর্যাদাবোধের বীজ। যেই মানুষটা জানত তার জীবনের মূল্য এক মুঠো খেজুরের সমান, তাকে যখন বলা হলো সে-ও খলিফা হওয়ার যোগ্যতা রাখে, তখন তার শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আলী ইবনে মুহাম্মদ জানতেন, বিদ্রোহ সফল করতে হলে কেবল শারীরিক শক্তি যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মতাদর্শগত অনুপ্রেরণা (Ideological Indoctrination)।
এখানেই আলী ইবনে মুহাম্মদের চাতুর্য প্রকাশ পায়। তিনি দাসদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সমতার স্বপ্ন দেখালেন এক বিশেষ মতবাদ ব্যবহারের মাধ্যমে। তিনি ব্যবহার করলেন খারিজি মতবাদ (Kharijite Ideology), বিশেষ করে এর আজারিকা (Azariqa) উপদলের উগ্র চিন্তাধারা। প্রথাগত সুন্নি বা শিয়া মতবাদে কুরাইশ বংশ বা নবীর বংশের বাইরে খলিফা হওয়ার সুযোগ ছিল সীমিত। কিন্তু খারিজি মতবাদ ছিল সম্পূর্ণ বৈপ্লবিক এবং সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত আধুনিক। এই মতবাদ অনুসারে, খলিফা বা ইমাম হওয়ার জন্য কুরাইশ বা হাশেমী বংশের হওয়ার দরকার নেই। একজন যোগ্য, পরহেজগার ব্যক্তি – এমনকি তিনি যদি একজন ‘ইথিওপিয়ান দাস’ও (Abyssinian Slave) হন – তবুও তিনি খলিফা হতে পারেন এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দিতে পারেন। ভাবুন তো, যেই দাসের পিঠে গতকালও চাবুক পড়েছে, তাকে কেউ বলছে – তুমি আর তোমার মনিব সমান! তুমিও শাসক হতে পারো! এই কথা কি মদের চেয়েও বেশি নেশা ধরায় না? তিনি তাদের বোঝালেন, তোমাদের মনিবরা পাপাচারী, তারা আল্লাহর আইন মানছে না, তাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা কেবল অধিকার নয়, এটি পবিত্র দায়িত্ব বা জিহাদ। এই ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাসদের বিদ্রোহকে একটি নৈতিক ভিত্তি দান করল। তারা এখন আর পলাতক দাস নয়, তারা আল্লাহর সৈনিক।
মসিহ নাকি সুবিধাবাদী?
আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজেকে সরাসরি ‘মাহদি’ বা পথপ্রদর্শক হিসেবে ঘোষণা না করলেও, তার কথাবার্তা ও আচরণে এক ধরণের মসিহবাদ (Messianism)-এর ছায়া ছিল। তার অনুসারীরা তাকে মুক্তির দূত হিসেবেই দেখত। তিনি নিজেকে ডাকতেন ‘সাহিব আল-জাঞ্জ’ (Sahib al-Zanj) বা জাঞ্জদের নেতা। তিনি জানতেন, ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ধর্মের চেয়েও বড় সত্য হলো রুটি এবং নিরাপত্তা। তাই তিনি কেবল পরকালের মুক্তির কথাই বললেন না, তিনি ইহজাগতিক মুক্তির লোভও দেখালেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, যদি তারা বিদ্রোহে যোগ দেয়, তবে তিনি তাদের কেবল দাসত্ব থেকে মুক্তিই দেবেন না, তাদের মালিকদের অঢেল সম্পদও তাদের দিয়ে দেবেন। তিনি বললেন, “আজ যারা মালিক, কাল তারা হবে তোমাদের দাস। তাদের প্রাসাদ হবে তোমাদের ঘর, তাদের নারীরা হবে তোমাদের দাসী।” এই প্রতিশ্রুতি ছিল আগুনের মতো। এটি ছিল এক ধরণের শ্রেণি প্রতিশোধ (Class Vengeance)-এর ডাক।
হাজার হাজার জাঞ্জ দাস, যারা বছরের পর বছর ধরে শোষিত হয়েছে, তারা তাদের কোদাল আর লবণের ঝুড়ি ফেলে আলী ইবনে মুহাম্মদের পতাকার নিচে জড়ো হতে শুরু করল। তারা তাদের মনিবদের হত্যা করে, শিকল ভেঙে পালিয়ে এল বাতিহার দুর্গম জলাভূমিতে। আলী ইবনে মুহাম্মদ তাদের নিয়ে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী গড়ে তুললেন। কিন্তু এখানে একটি নৈতিক প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। আলী ইবনে মুহাম্মদ কি সত্যিই দাসপ্রথা বিলোপ করতে চেয়েছিলেন? ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনি আসলে দাসপ্রথার বিরোধী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তৎকালীন শাসকদের বিরোধী। তার নিজের ঘরেও দাস-দাসী ছিল। তিনি চেয়েছিলেন ক্ষমতার হাতবদল। তিনি শোষিতদের ব্যবহার করেছিলেন পুরনো শোষকদের হটিয়ে নতুন শাসকশ্রেণি তৈরি করতে। একে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে অভিজাতদের সঞ্চালন (Circulation of Elites)-এর একটি রক্তাক্ত প্রচেষ্টা (Pareto, 1935)। তিনি জাঞ্জদের ক্ষোভকে পুঁজি করে নিজের জন্য একটি সাম্রাজ্য গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি হবেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তবুও, একজন সাধারণ আফ্রিকান দাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন দেবতুল্য। কারণ, তার উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, তিনি তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন এবং তাদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন (Talib, 1981)।
নেতৃত্বের কৌশল ও বাতিহার রণসজ্জা
আলী ইবনে মুহাম্মদের সামরিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। তিনি কেবল আবেগ দিয়ে যুদ্ধ করেননি, তিনি যুদ্ধ করেছিলেন মস্তিষ্ক দিয়ে। তিনি জানতেন, আব্বাসীয়দের প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে তার অনভিজ্ঞ দাস বাহিনী টিকতে পারবে না। তাই তিনি বেছে নিলেন অসম যুদ্ধ (Asymmetric Warfare) বা গেরিলা পদ্ধতি। তিনি বাতিহার ভৌগোলিক অবস্থানকে নিজের প্রধান অস্ত্রে পরিণত করলেন। জলাভূমির প্রতিটি খাল, প্রতিটি নলখাগড়ার বন ছিল জাঞ্জদের চেনা, কিন্তু আব্বাসীয় সৈন্যদের কাছে তা ছিল মৃত্যুফাঁদ। তিনি তার অনুসারীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিলেন এবং তাদের শেখালেন কীভাবে অতর্কিত হামলা বা ‘হিট অ্যান্ড রান’ (Hit and run) পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়।
তিনি কেবল সামরিক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসকও। তিনি তার অনুসারীদের জন্য একটি বিকল্প রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্য রসদ ও অর্থনীতির প্রয়োজন। তাই তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও শহরগুলোতে লুটপাট চালিয়ে সম্পদ আহরণ করতেন এবং সেই সম্পদ তার অনুসারীদের মধ্যে বণ্টন করতেন। এই বণ্টন ব্যবস্থা তার প্রতি অনুসারীদের আনুগত্যকে আরও দৃঢ় করেছিল। তিনি জুমার খুতবায় নিজের নামে খুতবা পাঠ করাতেন এবং নিজের নামে মুদ্রাঙ্কন করেছিলেন। মুদ্রায় খোদাই করা থাকত কুরআনের সেই আয়াত: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে” (সূরা আত-তাওবা: ১১১)। এই আয়াতটি ছিল খারিজিদের স্লোগান, যা প্রমাণ করে যে তিনি ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ব্যবহার করেছিলেন।
আলী ইবনে মুহাম্মদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন এক জটিল ব্যক্তিত্ব। তিনি একই সাথে ছিলেন দয়ালু এবং নিষ্ঠুর। নিজের অনুসারীদের প্রতি তিনি ছিলেন উদার, কিন্তু শত্রুদের প্রতি ছিলেন নির্মম। তিনি বন্দীদের হত্যা করতে দ্বিধা করতেন না এবং বিজিত শহরগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেন। তার এই দ্বিমুখী সত্তাই তাকে ইতিহাসের পাতায় ‘নায়ক’ এবং ‘খলনায়ক’ – উভয় পরিচয়েই বাঁচিয়ে রেখেছে। আব্বাসীয় ঐতিহাসিকরা, যেমন আল-তাবারি, তাকে বর্ণনা করেছেন ‘আল্লাহর শত্রু’ এবং ‘শয়তানের দোসর’ হিসেবে। তাদের বর্ণনায় তিনি একজন ধূর্ত প্রতারক, যে অশিক্ষিত দাসদের বিভ্রান্ত করে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে, আধুনিক অনেক ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক তাকে দেখেন একজন আদি-বিপ্লবী বা প্রোটো-সোশ্যালিস্ট (Proto-Socialist) নেতা হিসেবে, যিনি মধ্যযুগের মতো অন্ধকার সময়ে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন। তার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের ভিত্তি যত শক্তিশালীই হোক না কেন, শোষিত মানুষের সম্মিলিত শক্তির কাছে তা নড়বড়ে হতে বাধ্য।
আলী ইবনে মুহাম্মদের জাদুকরী প্রভাব কেবল তার জীবদ্দশায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তার মৃত্যু পরবর্তীকালেও তার মতাদর্শ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিশেষ করে কারমাতী (Qarmatians) সম্প্রদায়ের উত্থানের পেছনে জাঞ্জ বিদ্রোহের সাংগঠনিক ও আদর্শিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ধর্মের প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে গিয়েও মানুষকে সংগঠিত করা সম্ভব এবং সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষও ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়ে দিতে পারে। তার উত্থান ও পতন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, ইতিহাস কেবল রাজাদের কাহিনী নয়, ইতিহাস হলো ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পিষ্ট হওয়া মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর আখ্যান। আলী ইবনে মুহাম্মদ সেই আখ্যানের এক অবিস্মরণীয় ট্র্যাজিক হিরো, যিনি লোনাজলে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লিখেছিলেন, কিন্তু সেই নাম মুছে ফেলার সাধ্য আব্বাসীয়দের ছিল না।
রণকৌশল: জলাভূমির গেরিলা যুদ্ধ ও আব্বাসীয়দের ব্যর্থতা
৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস; মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এক দহনকাল। আব্বাসীয় খিলাফতের প্রান্তে যখন বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠল, তখন বাগদাদের রাজপ্রাসাদে বা সমরবিদদের তাঁবুতে কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি যে, এই আগুন আগামী দেড় দশক ধরে সাম্রাজ্যকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। খলিফা আল-মুহতাদি এবং তার সভাসদদের কাছে এই বিদ্রোহ ছিল কেবল কিছু ‘পলাতক দাস’ বা ‘কালো পিঁপড়ে’র বিশৃঙ্খলা, যাদের কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ নেই, নেই কোনো উন্নত অস্ত্রশস্ত্র। বাগদাদের সমর নায়করা ভেবেছিলেন, খলিফার প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর একটি ছোট দল, কিংবা স্থানীয় কোনো গভর্নরের পুলিশ বাহিনী পাঠালেই এই বিদ্রোহ অঙ্কুরে বিনষ্ট করা সম্ভব হবে। তাদের এই অহমিকাপূর্ণ ধারণা ছিল সাম্রাজ্যবাদী দম্ভ (Imperial Hubris)-এর এক ধ্রুপদী উদাহরণ। আব্বাসীয় সেনাবাহিনী তখন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি। তাদের ছিল তুর্কি বংশোদ্ভূত দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী বাহিনী, যারা গোলাম প্রথা (Ghulam System)বা সামরিক দাসপ্রথার মাধ্যমে ছোটবেলা থেকে কেবল যুদ্ধের জন্যই গড়ে উঠত। তাদের শরীর ঢাকা থাকত দামি ইস্পাতের বর্মে, হাতে থাকত খোরাসানি তলোয়ার, আর তারা চড়ত আরবি বা তুর্কি ঘোড়ায়। তারা খোলা মরুভূমি কিংবা সমতল প্রান্তরে সম্মুখযুদ্ধে ছিল অপরাজেয়। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান সব সময় এক থাকে না, আর প্রতিপক্ষ সব সময় প্রথাগত নিয়ম মেনে যুদ্ধ করে না – এই সহজ সত্যটি বুঝতে আব্বাসীয়দের অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, আর সেই দেরির মাশুল গুনতে হয়েছিল হাজার হাজার সৈন্যের রক্তের বিনিময়ে। আলী ইবনে মুহাম্মদের সামরিক প্রতিভার আসল স্ফুরণ ঘটেছিল এখানেই; তিনি জানতেন, তার এই অভুক্ত, কঙ্কালসার বাহিনী নিয়ে খোলা ময়দানে আব্বাসীয়দের মুখোমুখি হওয়া মানে নিশ্চিত আত্মহত্যা। তাই তিনি যুদ্ধের নিয়ম বদলে দিলেন। তিনি বেছে নিলেন এমন এক রণক্ষেত্র, যেখানে খলিফার অশ্বারোহী বাহিনী অচল, আর তার দাস বাহিনী অপ্রতিরোধ্য – সেটি হলো বাতিহার দুর্গম জলাভূমি।
ভৌগোলিক সুবিধা ও পরিবেশগত নিয়তিবাদ
যুদ্ধের ইতিহাসে ভৌগোলিক অবস্থান কীভাবে একটি দুর্বল বাহিনীকে শক্তিশালী বাহিনীর ওপর বিজয়ী করতে পারে, জাঞ্জ বিদ্রোহ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একে সামরিক ভূ-রাজনীতির ভাষায় পরিবেশগত নির্ধারণবাদ (Environmental Determinism)-এর একটি সামরিক সংস্করণ বলা যেতে পারে। বাতিহার ল্যান্ডস্কেপ বা ভূ-প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। এটি ছিল মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নলখাগড়ার বন, গভীর ও অগভীর জলাশয়, এবং অসংখ্য ছোট-বড় খালের এক জটিল জালি। এখানকার মাটি ছিল কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল এবং কোথাও কোথাও চোরাবালিতে পূর্ণ। আব্বাসীয়দের প্রধান শক্তি ছিল তাদের ভারী অশ্বারোহী বাহিনী বা ক্যাভালরি (Cavalry)। কিন্তু ঘোড়া তো দূরের কথা, ভারী বর্ম পরা একজন পদাতিক সৈন্যের পক্ষেও এই কাদা-জলে হাঁটা ছিল অসম্ভব। আব্বাসীয় সৈন্যরা যখন তাদের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক আর ভারী বর্ম নিয়ে এই জলাভূমিতে প্রবেশ করত, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে আটকা পড়ত। ঘোড়ার খুর কাদায় দেবে যেত, বর্মের ভারে সৈন্যরা পানিতে ডুবে যেত, আর নলখাগড়ার বনে তাদের দীর্ঘ বর্শা বা ল্যান্সগুলো ছিল ব্যবহারের অযোগ্য। অন্যদিকে, জাঞ্জরা ছিল এই কাদামাটির সন্তান। বছরের পর বছর লবণ চেঁছে আর মাটি কেটে তারা এই এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি চিনে ফেলেছিল। তারা জানত কোন খালের পানি কতটুকু গভীর, কোথায় লুকানো পথ আছে, আর কোথায় পা দিলেই চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে হবে। তাদের শরীর ছিল হালকা, পরনে ছিল নামমাত্র কাপড়, ফলে তারা কাদার ওপর দিয়ে দ্রুত নড়াচড়া করতে পারত। আলী ইবনে মুহাম্মদ এই ভৌগোলিক সুবিধাকে তার প্রধান সামরিক কৌশলে রূপান্তর করেছিলেন। তিনি তার বাহিনীকে জলাভূমির গভীরে এমন জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেখানে বড় কোনো জাহাজ বা ঘোড়সওয়ার বাহিনী পৌঁছাতে পারবে না। এটি ছিল আব্বাসীয়দের জন্য এক লজিস্টিক বা রসদ সরবরাহের দুঃস্বপ্ন। অচেনা পথঘাটে ঢুকে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ত, আর ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যখন তারা দুর্বল হয়ে পড়ত, তখনই জাঞ্জরা আঘাত হানত।
অসম যুদ্ধ ও জলজ গেরিলা কৌশল
জাঞ্জ বিদ্রোহীরা যে রণকৌশল অবলম্বন করেছিল, আধুনিক সামরিক পরিভাষায় তাকে বলা হয় অসম যুদ্ধ (Asymmetric Warfare) বা গেরিলা যুদ্ধ (Guerrilla Warfare)। যেহেতু তাদের জনবল এবং অস্ত্রবল আব্বাসীয়দের তুলনায় নগণ্য ছিল, তাই তারা সম্মুখযুদ্ধ বা ‘পিচড ব্যাটল’ (Pitched Battle) এড়িয়ে চলত। তাদের প্রধান কৌশল ছিল অতর্কিত হামলা বা ‘হিট অ্যান্ড রান’ (Hit and Run)। আলী ইবনে মুহাম্মদ তার বাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিয়েছিলেন, যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত। তারা ব্যবহার করত স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ছোট ডিঙি নৌকা। এই নৌকাগুলো ছিল হালকা, দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং অগভীর পানিতে চলাচলের উপযোগী। জাঞ্জরা নলখাগড়ার বনের আড়ালে এই নৌকাগুলো নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকত। যখনই আব্বাসীয়দের কোনো বড় রসদবাহী জাহাজ বা টহল বোট খালের সরু পথে ঢুকত, তখনই তারা চারপাশ থেকে পঙ্গপালের মতো আক্রমণ করত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্বাসীয় সৈন্যরা দেখত তাদের ওপর বৃষ্টির মতো তীর আর বর্শা ছুটে আসছে, অথবা কেউ নৌকা থেকে তাদের পানিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পানিতে একবার পড়ে গেলে ভারী বর্ম পরা আব্বাসীয় সৈন্যদের পক্ষে ভেসে থাকা ছিল অসম্ভব; তাদের মৃত্যু ছিল অবধারিত।
জাঞ্জরা দিনের বেলার চেয়ে রাতের আঁধারকে যুদ্ধের জন্য বেশি পছন্দ করত। তারা জানত, আব্বাসীয় সৈন্যরা রাতে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত নয় এবং জলাভূমির রাতে তারা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। এই মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহীরা রাতের বেলা আব্বাসীয় ক্যাম্পগুলোতে হামলা চালাত। তারা নিঃশব্দে ক্যাম্পের প্রহরীদের হত্যা করত এবং তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিত। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (Psychological Warfare) আব্বাসীয় বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। সৈন্যরা এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, তারা বাতিহার জলাভূমিকে অভিশপ্ত স্থান মনে করতে শুরু করেছিল। জাঞ্জদের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অভিনব। প্রথমদিকে তাদের হাতে ছিল কেবল কোদাল, কাস্তে আর লাঠি। কিন্তু তারা এই কৃষি যন্ত্রপাতিকেই মারণাস্ত্রে পরিণত করেছিল। পরবর্তীতে আব্বাসীয়দের কাছ থেকে লুট করা অস্ত্র দিয়ে তারা নিজেদের সজ্জিত করে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাদের গতি এবং অদৃশ্য থাকার ক্ষমতা। তারা নলখাগড়ার বনের ভেতরে এমনভাবে মিশে থাকত যে, আব্বাসীয় স্কাউটরা তাদের পাশ দিয়ে চলে গেলেও টের পেত না। হঠাৎ করে জলের নিচ থেকে বা ঝোপের আড়াল থেকে আক্রমণ করে তারা মুহূর্তের মধ্যে আবার মিলিয়ে যেত, যেন তারা কোনো ভৌতিক শক্তি।
আব্বাসীয়দের কৌশলগত ব্যর্থতা ও জেনারেলদের পতন
বিদ্রোহের প্রথম কয়েক বছর ছিল আব্বাসীয়দের জন্য লজ্জাজনক পরাজয়ের ইতিহাস। বাগদাদ থেকে একের পর এক বাঘা বাঘা জেনারেল বা সেনাপতি পাঠানো হয়েছিল বিদ্রোহ দমন করতে, কিন্তু তারা সবাই বাতিহার লোনা কাদার ট্র্যাপে বা ফাঁদে পড়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। আব্বাসীয় জেনারেলরা ছিলেন মূলত প্রথাগত যুদ্ধের কারিগর। তারা রোমান বা পারসিয়ানদের বিরুদ্ধে বড় বড় যুদ্ধ জয়ের অভিজ্ঞতা রাখতেন, কিন্তু এই ‘ইঁদুর-বেড়াল’ খেলার অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। তারা বিশাল বাহিনী নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে অভিযান শুরু করতেন, কিন্তু জলাভূমির সীমান্তে এসে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যেত। উদাহরণস্বরূপ, জেনারেলরা তাদের বাহিনীকে বড় ফরমেশনে বা সারিবদ্ধভাবে পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন, যা সরু খাল আর এবড়োখেবড়ো জমিতে ছিল অসম্ভব। ফলে বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং যোগাযোগের চেইন ভেঙে পড়ত। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিত জাঞ্জরা। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন যে, অনেক আব্বাসীয় সেনাপতিকে বিদ্রোহীরা হত্যা করে তাদের মাথা বর্শার আগায় গেঁথে রেখেছিল, যা ছিল খলিফার কর্তৃত্বের প্রতি চূড়ান্ত অপমান।
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল আব্বাসীয়দের গোয়েন্দা তথ্যের অভাব। তারা জানত না শত্রুর সংখ্যা কত, তাদের অবস্থান কোথায়। তারা অন্ধের মতো আক্রমণ করত। অন্যদিকে, আলী ইবনে মুহাম্মদের নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। স্থানীয় গ্রামবাসী, মৎস্যজীবী এবং এমনকি আব্বাসীয় বাহিনীর ভেতরের কিছু চর তাকে নিয়মিত খবর দিত। ফলে আব্বাসীয়রা কখন, কোন পথে আসছে, তা বিদ্রোহীরা আগেই জেনে যেত এবং সেই অনুযায়ী ফাঁদ পাতত। এই কৌশলগত ভুলের কারণে আব্বাসীয়রা কেবল সৈন্যই হারায়নি, তারা হারিয়েছিল প্রচুর সম্পদ। তাদের দামি অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া, এবং রসদপত্র জাঞ্জদের হস্তগত হয়। একসময় যাদের হাতে ছিল কেবল কোদাল, তাদের হাতে এখন উঠে এল উন্নত দামেস্কের তরবারি, বর্শা, ধনুক এবং ঢাল। তারা আব্বাসীয়দের পোশাক পরে, তাদের ঘোড়ায় চড়ে আব্বাসীয়দেরই আক্রমণ করতে শুরু করল। এটি ছিল এক অদ্ভুত দৃশ্য – প্রভুর অস্ত্রেই দাসের হাতে প্রভুর পতন।
সামাজিক জোট ও বিদ্রোহের ব্যাপ্তি
জাঞ্জদের এই অভাবনীয় সামরিক সাফল্য দেখে আশেপাশের অন্যান্য অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীগুলোও নড়েচড়ে বসল। বাতিহা এবং বসরার আশেপাশের বেদুইন আরব গোত্রগুলো, যারা আব্বাসীয়দের কর ব্যবস্থার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল, তারা এই বিদ্রোহকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের সুযোগ হিসেবে দেখল। তারা জাঞ্জদের সাথে অলিখিত মৈত্রী গড়ে তুলল। বেদুইনরা মরুভূমির যুদ্ধে পারদর্শী ছিল এবং তারা জাঞ্জদের ঘোড়া ও উট সরবরাহ করতে শুরু করল। এভাবে একটি দাস বিদ্রোহ ক্রমশ একটি ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক বিপ্লব (Social Revolution)-এর রূপ নিতে শুরু করল। তবে সবচেয়ে বড় আঘাতটি এল আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেই। আব্বাসীয় বাহিনীতে অনেক ‘শকিরিয়া’ (Shakiriyya) বা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ভাড়াটে সৈন্য ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন তারা দেখল যে তাদের প্রতিপক্ষ তাদেরই মতো কালো মানুষ, যারা মুক্তির জন্য লড়াই করছে, তখন তাদের মধ্যে জাতিগত বা বর্ণগত সংহতি (Racial Solidarity) বা ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে উঠল। তারা বুঝতে পারল, তারা আসলে তাদের ভাইদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। ফলে যুদ্ধের ময়দানেই তারা পক্ষ ত্যাগ করে জাঞ্জদের সাথে যোগ দিল। এই দলত্যাগ আব্বাসীয় বাহিনীর জন্য ছিল বড় বিপর্যয়, কারণ এই সৈন্যরা ছিল প্রশিক্ষিত এবং আধুনিক যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী। তারা জাঞ্জদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করল, কীভাবে তীরন্দাজি করতে হয়, কীভাবে তলোয়ার চালাতে হয়। এর ফলে জাঞ্জ বাহিনী একটি অপেশাদার জনতা থেকে একটি আধা-পেশাদার সামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত হলো।
আলী ইবনে মুহাম্মদের রণকৌশল প্রমাণ করেছিল যে, যুদ্ধের ময়দানে কেবল সংখ্যা বা অস্ত্রই শেষ কথা নয়; ভূ-প্রকৃতি, মনোবল এবং সঠিক কৌশল বা স্ট্র্যাটেজিক জিনিয়াস (Strategic Genius) অনেক সময় বড় শক্তিকেও নতজানু করতে পারে। বাতিহার লোনাজল, যা একসময় ছিল দাসদের চোখের জলে লোনা, তা এখন আব্বাসীয়দের রক্তে লাল হতে শুরু করল। এই জলাভূমি হয়ে উঠল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ‘ভিয়েতনাম’, যেখানে একটি পরাশক্তি তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েও দিনের পর দিন কেবল পরাজয়ের গ্লানিই বহন করছিল।
আল-মুখতারা: যখন দাসেরাও রাষ্ট্র বানায়
বিদ্রোহীরা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি; তারা আব্বাসীয় খিলাফতের সমান্তরালে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র বা প্রতি-রাষ্ট্র (Counter-state) গঠন করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল। বাতিহার লোনাজলের বুক চিরে, দুর্গম ও রহস্যময় এক দ্বীপে তারা গড়ে তুলেছিল তাদের স্বপ্নের রাজধানী। এই শহরের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আল-মুখতারা’ (Al-Mukhtarah), যার শাব্দিক অর্থ ‘নির্বাচিত শহর’ বা ‘মনোনীত নগরী’। এই নামটিই ছিল এক রাজনৈতিক বার্তা – এটি খলিফার চাপিয়ে দেওয়া কোনো শহর নয়, এটি বিদ্রোহের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং আল্লাহর দ্বারা নির্বাচিত মানুষদের আবাসস্থল। এই শহরের গোড়াপত্তন ছিল মধ্যযুগের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করলে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়; মাত্র কয়েক বছর আগেও যারা লবণের খনিতে অমানবিক পরিশ্রম করত, যাদের নিজস্ব কোনো নাম বা পরিচয় ছিল না, যাদের জীবনের মূল্য ছিল এক মুঠো যবের চেয়েও কম – আজ তারা একটি স্বাধীন শহরের মালিক! তারা কেবল টিকে থাকার জন্যই লড়াই করছিল না, তারা নির্মাণ করছিল নতুন এক সভ্যতা।
আল-মুখতারা কেবল একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল না; এটি ছিল একটি সচল নগররাষ্ট্র। জলাভূমির কাদা আর ইট দিয়ে সেখানে একের পর এক দালানকোঠা উঠল, মসজিদ নির্মিত হলো, আর শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসল জমজমাট বাজার। খালের ওপর তৈরি হলো সেতু, আর শহরের প্রতিরক্ষার জন্য গড়ে তোলা হলো মজবুত প্রাচীর ও পরিখা। আব্বাসীয়দের চোখ এড়িয়ে কীভাবে এত বড় একটি নগরী গড়ে উঠল, তা আজও ঐতিহাসিকদের বিস্মিত করে। সেখানে তাদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা বা কাজির আদালত (Qadi’s Court) ছিল, যেখানে শরিয়াহ আইন অনুযায়ী বিচার করা হতো, তবে সেই শরিয়াহর ব্যাখ্যা ছিল আলী ইবনে মুহাম্মদের নিজস্ব খারিজি মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, তারা নিজস্ব মুদ্রা বা মুদ্রাঙ্কন (Coinage) চালু করেছিল। মধ্যযুগে নিজস্ব মুদ্রা চালু করা ছিল সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত প্রতীক বা সার্বভৌম ক্ষমতা (Sovereign Power)-এর ঘোষণা। আলী ইবনে মুহাম্মদ জুমার খুতবায় বাগদাদের খলিফার পরিবর্তে নিজের নাম ঘোষণা করলেন। তিনি নিজেকে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা হিসেবে দাবি না করলেও, তার উপাধি ছিল ‘আল-মাহদি’ বা পথপ্রদর্শকের কাছাকাছি। তার নামে যে দিরহাম বা রৌপ্যমুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে কুরআনের একটি বিশেষ আয়াত খোদাই করা ছিল: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে” (সূরা আত-তাওবা: ১১১)। এই আয়াতটি ছিল খারিজিদের স্লোগান এবং তাদের জিহাদের মূলমন্ত্র। এটি কেবল একটি ধর্মীয় বাণী ছিল না, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ইশতেহার – যেখানে বলা হচ্ছে, তাদের এই জীবন আল্লাহর কাছে বিক্রি করা হয়ে গেছে, তাই পার্থিব কোনো শাসকের কাছে তারা মাথা নত করবে না।
শোষিত যখন শাসক: ক্ষমতার মনস্তত্ত্ব ও প্যারাডক্স
আল-মুখতারার উত্থান আমাদের সামনে ক্ষমতার এক জটিল ও অস্বস্তিকর মনস্তাত্ত্বিক চিত্র তুলে ধরে। বিদ্রোহের শুরুতে আলী ইবনে মুহাম্মদ সাম্য ও মানবিক মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছিল? জাঞ্জরা কি সত্যিই দাসপ্রথা বিলোপ করেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা এক হতাশাজনক বাস্তবতার মুখোমুখি হই, যাকে সমাজবিজ্ঞানে নিপীড়িতের নিপীড়ক হয়ে ওঠা (Oppressed becoming Oppressor) বা ক্ষমতার প্যারাডক্স (Paradox of Power) বলা হয়। ঐতিহাসিক সত্য হলো, জাঞ্জরা নিজেদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিল ঠিকই, কিন্তু তারা দাসপ্রথা নামক প্রতিষ্ঠানটিকে বিলুপ্ত করেনি। বরং তারা যুদ্ধের ময়দানে যাদের বন্দী করত – হোক তারা আব্বাসীয় সৈন্য, সাধারণ আরব নাগরিক, কিংবা অভিজাত নারী – তাদের তারা দাস-দাসী হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এটি ছিল ইতিহাসের এক নির্মম কৌতুক। মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পেলে তার আচরণের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না; বরং ক্ষমতার হাতবদল হলে শোষণের কাঠামোটি অনেক সময় অটুট থাকে, কেবল কুশীলবদের পরিবর্তন ঘটে। আলী ইবনে মুহাম্মদ এবং তার শীর্ষ সেনাপতিরা বাসরার লুণ্ঠিত সম্পদ এবং দাসদের নিয়ে আল-মুখতারায় এক ধরণের সামন্ততান্ত্রিক জীবনযাপন শুরু করেছিলেন। শোষিত যখন শাসক হয়, তখন সে অনেক সময় তার পূর্বতন শোষকের রূপই ধারণ করে – এই ঐতিহাসিক সত্যটি আল-মুখতারায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল।
আলী ইবনে মুহাম্মদের এই নতুন রাষ্ট্রেও প্রকট সামাজিক স্তরবিন্যাস (Social Stratification) বিদ্যমান ছিল। সমাজের একদম ওপরে ছিলেন আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজে, তার পরিবার এবং তার ঘনিষ্ঠ পারিষদবর্গ বা ‘কাউন্সিল অব লর্ডস’। তারা রাজকীয় প্রাসাদে থাকতেন, রেশমি পোশাক পরতেন এবং উপাদেয় খাবার খেতেন। তাদের নিচে ছিল উচ্চপদস্থ সামরিক কমান্ডাররা, যারা যুদ্ধের গনীমতের মাল বা লুণ্ঠিত সম্পদের বড় অংশ পেত। তার নিচে ছিল সাধারণ জাঞ্জ যোদ্ধারা, এবং সবশেষে ছিল নতুন করে দাস বানানো যুদ্ধবন্দীরা। বিশেষ করে নারীদের অবস্থা ছিল করুণ। আব্বাসীয় অভিজাত পরিবারের নারীদের বন্দী করে আল-মুখতারার বাজারে বিক্রি করা হতো বা নেতাদের হেরেমে রাখা হতো। এটি ছিল আব্বাসীয়দের সম্মানের ওপর চরম আঘাত। আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজে একাধিক উপপত্নী বা ‘কনকিউবাইন’ রেখেছিলেন। বিপ্লবের নামে শুরু হওয়া এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আরেকটি রাজতান্ত্রিক কাঠামোর দিকেই ধাবিত হচ্ছিল। তবে এই নেতিবাচক দিকগুলো সত্ত্বেও, একজন সাধারণ আফ্রিকান দাসের বা জাঞ্জ যোদ্ধার দৃষ্টিকোণ থেকে আল-মুখতারা ছিল স্বপ্নের স্বর্গপুরী বা ইউটোপিয়া (Utopia)। কারণ, এখানে অন্তত তাকে কেউ চাবুক মেরে পিঠের ছাল তুলে নিচ্ছে না, এখানে তাকে কেউ ‘পশু’ বলে গালি দিচ্ছে না। এখানে সে তার সঙ্গীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে পারছে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারছে। তাদের কাছে আলী ইবনে মুহাম্মদ ছিলেন মসিহ বা ত্রাণকর্তা, যিনি তাদের নরক থেকে উদ্ধার করে এই ‘নির্বাচিত শহরে’ নিয়ে এসেছেন। এই মানসিক মুক্তি বা সাইকোলজিক্যাল লিবারেশন (Psychological Liberation)-এর মূল্য তাদের কাছে ছিল অপরিসীম।
বিকল্প অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো
আল-মুখতারা কেবল একটি প্রতীকী রাষ্ট্র ছিল না; এর একটি সচল এবং কার্যকর প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল। একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কীভাবে বছরের পর বছর ধরে একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করল এবং বিশাল আব্বাসীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেল, তা গবেষণার বিষয়। তাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা ‘গনীমত’ (Booty) এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে আদায় করা কর। বিদ্রোহীরা দক্ষিণ ইরাকের উর্বর কৃষি জমি এবং বাণিজ্যিক রুটগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা দজলা ও ফোরাত নদী দিয়ে যাতায়াতকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো থেকে শুল্ক বা ‘টোল’ আদায় করত। বাগদাদ ও বসরার মধ্যবর্তী বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দিয়ে তারা আব্বাসীয় অর্থনীতিতে ধস নামিয়েছিল। এই অবরোধ বা অর্থনৈতিক অবরোধ (Economic Blockade) ছিল তাদের অন্যতম কৌশল। এছাড়া, আল-মুখতারার ভেতরে তারা নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে জাঞ্জরা খাদ্যশস্য উৎপাদন করত, মাছ ধরত এবং গবাদিপশু পালন করত। তাদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা বা অটুট অর্থনীতি (Autarkic Economy) তাদের দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের মুখে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল।
প্রশাসনিকভাবে আলী ইবনে মুহাম্মদ একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিভিন্ন গোত্র ও জাতিসত্তার মানুষদের এক পতাকার নিচে এনেছিলেন। তার সেনাবাহিনীতে কেবল আফ্রিকান জাঞ্জরাই ছিল না, ছিল বেদুইন আরব, ফার্সি এবং এমনকি দলত্যাগী তুর্কি সৈন্যরাও। এই বৈচিত্র্যময় বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিনি কঠোর শৃঙ্খল এবং ধর্মীয় অনুশাসন বজায় রাখতেন। তার প্রশাসনে দক্ষ লেখিক বা ‘কাতিব’ (Scribes) এবং হিসাবরক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল, যারা কর আদায় এবং রসদ বণ্টনের হিসাব রাখত। এটি প্রমাণ করে যে, আল-মুখতারা কোনো বিশৃঙ্খল দস্যুদের আস্তানা ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক সত্তা বা রাষ্ট্রসত্তা (Polity)। আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজেকে কেবল একজন সেনাপতি হিসেবে নয়, বরং একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি বাসরার মতো বড় শহর দখল করে সেখানে নিজের গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। তিনি আব্বাসীয়দের সাথে কূটনৈতিক আলোচনারও চেষ্টা করেছিলেন, যদিও তা সফল হয়নি। তার লক্ষ্য ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের পাশাপাশি একটি স্বাধীন জাঞ্জ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যা ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত হতে পারত।
স্বপ্নের শহর ও তার পতন
আল-মুখতারা ছিল জাঞ্জদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। জলাভূমির মাঝখানে গড়ে ওঠা এই শহরটি ছিল তাদের ‘কালো’ বা আফ্রিকান পরিচয়ের গর্বের স্থান। এখানে তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, গান এবং নাচের চর্চা করত, যা দাসত্বের শেকলে এতদিন চাপা পড়ে ছিল। ঐতিহাসিকরা একে এক ধরণের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ (Cultural Renaissance) হিসেবেও দেখতে পারেন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, স্বপ্নের শহরগুলো বেশিদিন টেকে না। আল-মুখতারাও টেকেনি। এর পতন ছিল অবধারিত, কারণ এটি দাঁড়িয়ে ছিল যুদ্ধের ওপর, কোনো স্থায়ী অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভিত্তির ওপর নয়। আলী ইবনে মুহাম্মদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আব্বাসীয়দের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে এই শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু যতদিন এটি টিকে ছিল, ততদিন এটি ছিল নিপীড়িত মানুষের কাছে এক আলোকবর্তিকা। এটি প্রমাণ করেছিল যে, দাসরাও রাষ্ট্র বানাতে পারে, দাসরাও শাসক হতে পারে। আল-মুখতারার ইট-পাথর হয়তো আজ আর নেই, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এটি এক অদম্য সাহসের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে। এই শহরটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের স্বপ্ন দেখার এবং তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা কোনো সীমানা মানে না, এমনকি শিকলও তাকে বেঁধে রাখতে পারে না।
বসরার পতন: মানবিক বিপর্যয়ের এক করুণ অধ্যায়
৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর; আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে এক কালো দিন, যা চিরকাল ‘বসরার ধ্বংসযজ্ঞ’ বা বসরার প্রলয় (The Sack of Basra) নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। জাঞ্জ বিদ্রোহের দীর্ঘ ১৫ বছরের ইতিহাসে এই ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর, রক্তক্ষয়ী এবং মানসিকভাবে বিধ্বংসী এক অধ্যায়। বিদ্রোহীরা, যারা এতকাল জলাভূমির কাদামাটিতে লুকিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল, তারা এবার তাদের সমস্ত আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দক্ষিণ ইরাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধশালী বন্দরনগরী বসরার (Basra) ওপর। বসরা কেবল একটি শহর ছিল না; এটি ছিল আব্বাসীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত এই নগরী ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাণিজ্যের মিলনস্থল। এখান থেকেই সিনবাদ নাবিকের মতো বণিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারত, চীন ও আফ্রিকায় যেত। শহরটি ছিল জ্ঞানচর্চার এক পীঠস্থান, যেখানে হাসান আল-বসরী বা রাবেয়া আল-বসরীর মতো সুফি সাধক, বৈয়াকরণবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক এবং কবিরা বসবাস করতেন। বসরা ছিল সভ্যতার আলোয় আলোকিত এক জনপদ। কিন্তু সেই আলো যে এত দ্রুত নিভে যাবে এবং শহরটি এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে, তা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
বসরাবাসীরা ছিল আত্মবিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করত, খলিফার শক্তিশালী বাহিনী তাদের রক্ষা করবে। তারা ভেবেছিল, জাঞ্জদের মতো ‘অসভ্য’ দাসদের পক্ষে বসরার মতো সুরক্ষিত শহরে প্রবেশ করা অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আব্বাসীয় রাজদরবার তখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, তারা বসরার প্রতিরক্ষায় পর্যাপ্ত সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় গভর্নর আল-জু’ফি (Al-Ju’fi) ছিলেন অযোগ্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ। তিনি শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার পরিবর্তে নিজের সম্পদ বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে, আলী ইবনে মুহাম্মদ তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে শহরের প্রতিটি দুর্বলতা সম্পর্কে জানতেন। তিনি জানতেন, শহরের মানুষ ভীত এবং বিভক্ত। ৮৭১ সালের সেই অভিশপ্ত ভোরে, যখন শহরের মানুষ ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই জাঞ্জ বাহিনী পঙ্গপালের মতো শহরের তোরণ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল। এরপর যা ঘটল, তা ইতিহাসের পাতায় মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম উদাহরণ হয়ে আছে।
ধ্বংসলীলা ও প্রতিশোধের আগুন
শহরে ঢুকে পড়ার পর জাঞ্জরা কোনো যুদ্ধের নিয়ম বা মানবিকতার ধার ধারেনি। তারা যেন সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে নেমে এসেছিল। শুরু হলো এক নির্মম গণহত্যা, যা মধ্যযুগের ইতিহাসে বিরল। ঐতিহাসিক আল-তাবারি (Al-Tabari), যিনি এই ঘটনার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, তার মতে সেখানে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। যদিও আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত হতে পারে এবং প্রকৃত সংখ্যা হয়তো ১০,০০০ থেকে ২০,০০০-এর মধ্যে ছিল, তবুও ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জাঞ্জরা শহরের প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি ঘরে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালাল। ধনী-গরিব, নারী-শিশু, বৃদ্ধ-যুবক – কাউকে রেহাই দেওয়া হলো না। যারা একসময় দাসদের মানুষ বলে গণ্য করত না, যারা তাদের ‘কালো কুকুর’ বলে গালি দিত, আজ তারা সেই দাসদের পায়ের নিচে পিষ্ট হলো। জাঞ্জরা তাদের দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ, অপমান আর বঞ্চনার প্রতিশোধ নিল এক পৈশাচিক উল্লাসে। এই ঘটনাকে সমাজতাত্ত্বিকরা পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ (Explosion of Accumulated Rage) হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। যখন একটি শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে অবদমিত থাকে, তখন তাদের মুক্তির সংগ্রাম অনেক সময় অন্ধ আক্রোশে পরিণত হয়।
পুরো শহরটি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। বসরার বিখ্যাত অট্টালিকা, বাজার, লাইব্রেরি – সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ধোঁয়া আর ছাইয়ে আকাশ এতটাই কালো হয়ে গেল যে, দিনের বেলাতেও মনে হতো রাত নেমে এসেছে। বসরার বিখ্যাত জামে মসজিদ, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নামাজ পড়ত এবং জ্ঞানচর্চা করত, তা ধ্বংস করা হলো। মসজিদের মিম্বর ভেঙে ফেলা হলো, পবিত্র স্থানগুলোকে অপবিত্র করা হলো। এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল ভৌত কাঠামোর বিনাশ ছিল না, এটি ছিল একটি সভ্যতার বিনাশ। জাঞ্জরা কেবল মানুষই মারল না, তারা শহরের আত্মাকে হত্যা করল। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষকে, যারা বিলাসিতায় জীবন কাটাত, তাদের বন্দী করে দাসে পরিণত করা হলো। তাদের গলায় শিকল পরিয়ে আল-মুখতারার দাস বাজারে বিক্রি করা হলো। এটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের সম্ভ্রমে এক বড় আঘাত। খলিফা বা তার আমিররা তাদের প্রজা এবং বিশেষ করে তাদের নারীদের সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল – এই বার্তাটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল।
আল-তাবারির বর্ণনায় নরকের দৃশ্য
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল-তাবারি তার কালজয়ী গ্রন্থ তারিখ আল-রসুল ওয়াল-মুলুক (History of the Prophets and Kings)-এ বসরার পতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়লে আজও শিউরে উঠতে হয়। তিনি লিখেছেন, “রাস্তায় লাশের স্তূপ জমে ছিল, এবং সেই লাশগুলো পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। কুকুর এবং শেয়াল দিনের বেলাতেই শহরে ঢুকে সেই লাশগুলো টেনেহিঁচড়ে খাচ্ছিল। কেউ ছিল না যারা তাদের দাফন করবে।” তার বর্ণনায় ফুটে ওঠে এক মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল, কিন্তু জাঞ্জরা তাদের তীর মেরে হত্যা করে। নদীর জল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। আল-তাবারি আরও উল্লেখ করেছেন যে, জাঞ্জরা শিশুদের হত্যা করে তাদের মায়েদের সামনে উল্লাস করত। নারীদের ওপর চালানো হয়েছিল পাশবিক নির্যাতন। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, যুদ্ধ মানুষকে কতটা পশুতে পরিণত করতে পারে। আল-তাবারির এই বিবরণ হয়তো কিছুটা আব্বাসীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল বা বায়াসড (Biased) হতে পারে, কারণ তিনি নিজে একজন সুন্নি পণ্ডিত ছিলেন এবং জাঞ্জদের ধর্মদ্রোহী বা ‘জিনদিক’ মনে করতেন। তবুও, অন্যান্য সমসাময়িক সূত্র থেকেও এই ভয়াবহতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কবিরা বিলাপ করে কবিতা বা মর্সিয়া (Elegy) লিখলেন, যেখানে বলা হলো, “বসরা আর কোনোদিন তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে না। যে শহর ছিল পৃথিবীর বাতিঘর, তা আজ শ্মশানে পরিণত হয়েছে।”
প্রভাব ও আব্বাসীয়দের প্রতিক্রিয়া
বসরার পতন আব্বাসীয় খিলাফতের জন্য ছিল একটি ‘ওয়েক-আপ কল’ বা চরম সতর্কবার্তা। বাগদাদে তখন হাহাকার পড়ে গেল। মানুষ বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ দাঙ্গা বা স্থানীয় বিদ্রোহ নয়; এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সংকট বা অস্তিত্ববাদী হুমকি (Existential Threat)। বসরার পতন আব্বাসীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। কারণ বসরা ছিল প্রধান শুল্ক আদায় কেন্দ্র এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার। এখান থেকে সরকারের আয়ের একটি বিশাল অংশ আসত। শহর ধ্বংস হওয়ার ফলে রাজস্ব আদায় শূন্যের কোঠায় নেমে এল। এছাড়া, এই ঘটনা খলিফার রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। জনগণ ভাবতে শুরু করল, যে খলিফা তার নিজের দেশের অন্যতম প্রধান শহরকে রক্ষা করতে পারে না, সে কীভাবে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দেবে? এই অসন্তোষ খিলাফতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিল।
বসরার পতন আব্বাসীয়দের বাধ্য করল তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে। খলিফার ভাই এবং তৎকালীন ডি-ফ্যাক্টো বা প্রকৃত শাসক আল-মুওয়াফফাক বুঝতে পারলেন, এখন আর হেলাফেলা করার সময় নেই। তিনি বিদ্রোহ দমনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন। বসরার রক্তস্রোত আব্বাসীয়দের নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করল। তারা বুঝতে পারল, জাঞ্জদের সাথে আর কোনো আপস নয়, এবার লড়াই হবে অস্তিত্ব রক্ষার। বসরার ধ্বংসস্তূপ থেকেই আব্বাসীয়দের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ার সূচনা হলো। অন্যদিকে, জাঞ্জদের জন্য এটি ছিল তাদের শক্তির চূড়ান্ত প্রদর্শন। কিন্তু একইসাথে, এই নির্মমতা তাদের নৈতিক ভিত্তিকেও দুর্বল করে দিয়েছিল। অনেক সাধারণ মানুষ, যারা হয়তো শুরুতে বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, তারা এই ভয়াবহতা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। বসরার পতন প্রমাণ করল যে, জাঞ্জরা কেবল শোষণের বিরুদ্ধে লড়ছে না, তারা নিজেরাই এক নতুন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এই ঘটনাটি জাঞ্জ বিদ্রোহের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে।
বসরার এই ট্র্যাজেডি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির কথা। এখানে কোনো পক্ষই পুরোপুরি নির্দোষ ছিল না। আব্বাসীয়দের শোষণ এবং অবহেলাই জাঞ্জদের দানবে পরিণত করেছিল। আবার জাঞ্জদের প্রতিশোধপরায়ণতা নিরীহ মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। বসরার পতন তাই কেবল একটি শহরের পতন নয়, এটি মানবিকতার পতন, যেখানে লোনাজল আর রক্ত একাকার হয়ে গিয়েছিল।
আল-মুওয়াফফাক: সাম্রাজ্যের পাল্টা আঘাত ও কৌশলের খেলা
জাঞ্জ বিদ্রোহ যখন তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে আব্বাসীয় খিলাফতের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল, তখন বাগদাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। সিংহাসনে বসা খলিফারা ছিলেন নামমাত্র শাসক, বা বলা যায় ‘পুতুল খলিফা’, যারা তুর্কি সেনাপতিদের হাতের ইশারায় নড়াচড়া করতেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার দলাদলি, এবং সামারার (Samarra) বিশৃঙ্খল রাজনীতিতে তারা এতটাই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন যে, সাম্রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা বিদ্রোহের আগুনের দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত তাদের ছিল না। এই চরম সংকটময় মুহূর্তে আব্বাসীয় রাজবংশের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন খলিফা আল-মুতামিদের ভাই, আবু আহমদ আল-মুওয়াফফাক (Abu Ahmad Al-Muwaffaq)। যদিও তিনি কাগজে-কলমে খলিফা ছিলেন না, কিন্তু ক্ষমতার প্রকৃত চাবিকাঠি বা ডি ফ্যাক্টো অথরিটি (De facto Authority) ছিল তারই হাতে। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক এবং অত্যন্ত দক্ষ সমরবিদ, যার ধমনীতে ছিল আব্বাসীয় রক্ত আর মস্তিষ্কে ছিল ঠান্ডা মাথার কূটনীতি। ৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিদ্রোহ দমনের পূর্ণ দায়িত্ব এবং সামরিক কমান্ড বা ‘রিজেন্সি’ (Regency) নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, বাতিহার এই বিদ্রোহ কেবল দাসদের একটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলন নয়, এটি এমন এক ক্যানসার যা দ্রুত অপারেশন না করলে পুরো আব্বাসীয় সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। তাই তিনি এই মিশনকে নিলেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ (War of Survival) হিসেবে।
আল-মুওয়াফফাক ছিলেন একজন প্র্যাগমাটিস্ট (Pragmatist) বা বাস্তববাদী নেতা। তিনি আবেগ বা ক্রোধ দিয়ে নয়, বরং নিখুঁত গাণিতিক হিসাব এবং কৌশল দিয়ে যুদ্ধ করতেন। তিনি তার পূর্বসূরিদের ব্যর্থতাগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, জাঞ্জদের বিরুদ্ধে প্রথাগত বা কনভেনশনাল যুদ্ধ (Conventional Warfare) করে জেতা সম্ভব নয়। কারণ বাতিহার জলাভূমি ছিল জাঞ্জদের দুর্গ, যেখানে আব্বাসীয়দের ভারী অশ্বারোহী বাহিনী ছিল অচল। গায়ের জোরে বা কেবল লোকবল দিয়ে এই যুদ্ধে জিততে চাইলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাই তিনি ঠিক করলেন, জাঞ্জদের হারাতে হবে তাদেরই কৌশলে – অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধের জবাব দিতে হবে কাউন্টার-গেরিলা ট্যাকটিক্স দিয়ে, সাথে যোগ করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং চতুর কূটনীতি। তিনি তার পরিকল্পনাকে তিনটি প্রধান স্তম্ভের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন, যা আধুনিক সমরবিদ্যায় COIN (Counterinsurgency) বা প্রতি-বিদ্রোহ কৌশলের আদিরূপ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
অর্থনৈতিক অবরোধ: ক্ষুধা যখন যুদ্ধের হাতিয়ার
আল-মুওয়াফফাকের প্রথম কৌশলটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু কার্যকর। তিনি জানতেন, একটি সেনাবাহিনী পেটে খাবার না থাকলে বেশিক্ষণ যুদ্ধ করতে পারে না। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি “An army marches on its stomach” আব্বাসীয় সেনাপতির অজানা ছিল না। তাই তিনি সরাসরি আক্রমণ না করে প্রথমে বিদ্রোহীদের রসদ বা সাপ্লাই চেইন (Supply Chain) বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একে সমরবিদ্যার ভাষায় বলা হয় অর্থনৈতিক অবরোধ (Economic Blockade) বা এট্রিশন ওয়ারফেয়ার (Attrition Warfare)। তিনি দজলা ও ফোরাত নদীর ওপর কড়া নজরদারি বসালেন। বাগদাদ বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে শস্যবাহী যেসব জাহাজ বাতিহার দিকে যেত, সেগুলো আটকে দেওয়া হলো। নদীর গুরুত্বপূর্ণ মোহনাগুলোতে তিনি বিশাল বিশাল ব্যারিকেড বা প্রতিবন্ধক তৈরি করলেন, যাতে বিদ্রোহীদের কাছে কোনো খাবার বা অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে।
এই অবরোধের ফলে আল-মুখতারা শহরে খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিল। যে শহরটি একসময় লুটপাটের অর্থে রমরমা ছিল, সেখানে এখন মানুষ এক মুঠো খাবারের জন্য হাহাকার করতে লাগল। আল-মুওয়াফফাক জানতেন, ক্ষুধার্ত মানুষ কখনো অনুগত থাকে না। তিনি অপেক্ষা করছিলেন কখন জাঞ্জদের মনোবল ক্ষুধার জ্বালায় ভেঙে পড়ে। তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকেও জাঞ্জদের বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন, যাতে তারা স্থানীয়ভাবেও খাবার সংগ্রহ করতে না পারে। এই কৌশলটি ছিল ধীরগতির, কিন্তু এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি জাঞ্জদের শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল, যা পরবর্তী সামরিক অভিযানের পথ সহজ করে দেয়।
নৌ-যুদ্ধ ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ব্যবহার
আল-মুওয়াফফাক খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাতিহার যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে জলাভূমির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর জলাভূমিতে রাজত্ব করতে হলে দরকার উপযুক্ত নৌ-বাহিনী। আব্বাসীয়দের প্রচলিত বড় যুদ্ধজাহাজগুলো বাতিহার সরু এবং অগভীর খালে চলতে পারত না। তাই তিনি তার নৌ- প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিলেন বিশেষ ধরনের নৌকা তৈরি করতে। তারা তৈরি করল এক ধরণের সমতল তলাবিশিষ্ট নৌকা (Flat-bottomed boats) বা বার্জ (Barges), যা খুব অল্প জলেও সহজে চলাচল করতে পারত। এই নৌকাগুলোকে বলা হতো ‘শাব্বারা’ (Shabbara) বা ‘তায়ার’ (Tayyar)। এগুলো ছিল অনেকটা আধুনিক উভচর যানের আদি সংস্করণ। এই নৌকাগুলোতে তিনি বিশেষ ধরনের র্যাম্প বা সিঁড়ি যুক্ত করলেন, যাতে সৈন্যরা দ্রুত নৌকা থেকে পাড়ে নামতে পারে এবং আবার উঠে আসতে পারে।
তবে তার সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড ছিল রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। তিনি তার নৌকাগুলোতে বিশেষ বাহিনী বা নাফফাতুন (Naffatun) নিয়োগ করলেন, যারা ‘নাফথা’ (Naphtha) বা ‘গ্রিক ফায়ার’ (Greek Fire) নিক্ষেপে পারদর্শী ছিল। এটি ছিল পেট্রোলিয়াম-ভিত্তিক এক ধরণের দাহ্য পদার্থ, যা জলে পড়লেও জ্বলতে থাকত। আব্বাসীয় সৈন্যরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে বিশেষ সিরিঞ্জ বা টিউব ব্যবহার করে জাঞ্জদের ওপর এবং তাদের নলখাগড়ার বন ও ঘরবাড়িতে এই আগুন ছুড়ে মারত। নলখাগড়ার বন যখন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করত, তখন জাঞ্জরা পালানোর পথ পেত না। আগুনের ধোঁয়ায় তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেত অথবা আগুনের ভয়ে জল থেকে ডাঙায় উঠে আসত, যেখানে আব্বাসীয় তীরন্দাজরা তাদের জন্য অপেক্ষা করত। এই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বা প্রযুক্তিগত অসমতা (Technological Asymmetry) যুদ্ধের মোড় সম্পূর্ণ আব্বাসীয়দের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। জাঞ্জদের কাছে এই আগুনের জবাব দেওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি ছিল না। এটি ছিল মধ্যযুগের যুদ্ধে প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের এক অনন্য উদাহরণ।
সাধারণ ক্ষমা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মাস্টারস্ট্রোক
আল-মুওয়াফফাকের তৃতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলটি ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (Psychological Warfare) এবং কূটনীতির ব্যবহার। তিনি জানতেন, আলী ইবনে মুহাম্মদের সেনাবাহিনী কোনো অখণ্ড বা হোমোজিনিয়াস (Homogeneous) বাহিনী নয়। সেখানে অনেক দাস ছিল যারা পরিস্থিতির শিকারে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছে, আবার অনেক সেনাপতি ছিল যারা কেবল ক্ষমতার লোভে আলীর সাথে আছে। তিনি এই ফাটলটিকে কাজে লাগালেন। তিনি তার সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের যেন হত্যা না করা হয়। তিনি ঘোষণা করলেন সাধারণ ক্ষমা (General Amnesty)বা ‘আমান’ (Aman)। তিনি প্রচার করলেন, “যারা অস্ত্র ফেলে আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করবে, তাদের অতীতের সব অপরাধ মাফ করে দেওয়া হবে এবং তাদের আব্বাসীয় সেনাবাহিনীতে সম্মানজনক পদে নিয়োগ দেওয়া হবে, সাথে মিলবে নিয়মিত বেতন ও পুরস্কার।”
এই ঘোষণা ছিল এক জাদুর কাঠির মতো। একজন জাঞ্জ বিদ্রোহীর কাছে এর চেয়ে বড় প্রলোভন আর কী হতে পারে? একদিকে নিশ্চিত মৃত্যু ও অনাহার, অন্যদিকে সম্মানজনক জীবন ও নিরাপত্তা। এই ‘টোপ’ অনেকেই গিলল। বিশেষ করে আলী ইবনে মুহাম্মদের উচ্চপদস্থ সেনাপতিরা, যারা আলীর একনায়কতান্ত্রিক আচরণে বিরক্ত ছিল, তারা একে একে পক্ষ ত্যাগ করতে শুরু করল। বিদ্রোহের অন্যতম শীর্ষ সেনাপতি এবং আলীর ডানহাত বলে পরিচিত ‘লুলু’ (Lu’lu’) তার বিশাল বাহিনী ও নৌবহর নিয়ে আল-মুওয়াফফাকের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। আল-মুওয়াফফাক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাকে আব্বাসীয় বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিলেন। লুলু পরবর্তীতে তার পুরনো কমরেডদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। এই ঘটনা জাঞ্জদের মনোবলের ওপর এক বিশাল আঘাত হানল। তারা একে অপরকে সন্দেহ করতে শুরু করল। আলী ইবনে মুহাম্মদ তার নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই বিশ্বাসঘাতকতা ও দলত্যাগ (Defection and Betrayal) বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। আল-মুওয়াফফাক প্রমাণ করলেন যে, তরবারির চেয়ে অনেক সময় প্রলোভন বা কূটনীতি বেশি কার্যকর অস্ত্র। তিনি জাঞ্জদের ঐক্যকে ভেতর থেকে উইপোকার মতো খেয়ে ফেলেছিলেন।
আল-মুওয়াফফাক কেবল একজন সেনাপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ‘স্টেটসম্যান’। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের পাশাপাশি নিজের সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেও বিশেষ যত্ন নিতেন। তিনি নিজে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত থাকতেন, সৈন্যদের সাথে একই খাবার খেতেন এবং আহতদের সেবা করতেন। এতে সৈন্যরা তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। তার পুত্র আবুল আব্বাস (যিনি পরে খলিফা আল-মুতাদিদ বিল্লাহ নামে পরিচিত হন) তাকে এই যুদ্ধে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেছিলেন। বাবা-ছেলের এই জুটি আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। আল-মুওয়াফফাকের এই ত্রিমুখী কৌশল – অর্থনৈতিক অবরোধ, প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন – জাঞ্জ বিদ্রোহের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, একটি আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র যখন তার সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কোনো বিদ্রোহ দমনে নামে, তখন আবেগ দিয়ে তা প্রতিহত করা সম্ভব নয়।
আল-মুখতারার পতন: একটি স্বপ্নের মৃত্যু
৮৮১ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে এক নতুন ও চূড়ান্ত অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা ছিল জাঞ্জ বিদ্রোহের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মহড়া। বাগদাদের ডিফ্যাক্টো বা প্রকৃত শাসক আল-মুওয়াফফাক, যিনি তার সামরিক বিচক্ষণতা এবং অদম্য ধৈর্যশক্তির জন্য ইতিপূর্বে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন, তিনি এবার সিদ্ধান্ত নিলেন বিদ্রোহের হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলার। তিনি তার বিশাল ও সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে বাতিহার দুর্গম জলাভূমির গভীরে অবস্থিত বিদ্রোহীদের তথাকথিত রাজধানী ‘আল-মুখতারা’র দিকে অগ্রসর হলেন। এই অভিযান কোনো সাধারণ ঝটিকা আক্রমণ ছিল না; এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী অবরোধ যুদ্ধ (Siege Warfare)। আল-মুওয়াফফাক জানতেন, আল-মুখতারা কেবল একটি শহর নয়, এটি একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ, যা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম – উভয় প্রকার প্রতিরক্ষাব্যূহ দ্বারা সুরক্ষিত। তাই তিনি তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে শহরটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার কৌশল নিলেন, অনেকটা বিষধর সাপ যেমন তার শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে মারে। তিনি শহরের বাইরের সংযোগ পথগুলো বন্ধ করে দিলেন এবং টাইগ্রিস নদী ও এর শাখা খালগুলোতে কড়া প্রহরা বসালেন, যাতে একটি মাছিও শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। শুরু হলো এক দীর্ঘস্থায়ী, ক্লান্তিকর এবং স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধ, যা প্রায় দুই বছর ধরে চলেছিল এবং মানব ইতিহাসের অন্যতম করুণ ট্র্যাজেডিতে রূপ নিয়েছিল।
অবরোধের বিভীষিকা ও দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস
আল-মুখতারা অবরুদ্ধ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই শহরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। বাইরের জগত থেকে রসদ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরের অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। শুরুতে বিদ্রোহীদের জমানো শস্য এবং গবাদিপশু দিয়ে কিছুদিন চললেও, শীঘ্রই ভাণ্ডার শূন্য হয়ে আসে। শুরু হয় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যা কেবল ক্ষুধা নয়, মানবিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয় ডেকে আনে। ঐতিহাসিক বর্ণনায় আল-মুখতারার দুর্ভিক্ষের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা এতটাই লোমহর্ষক যে, তা পড়লে সুস্থ মানুষেরও গা গুলিয়ে ওঠে। শোনা যায়, ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে শুরু করেছিল। প্রথমে তারা শহরের কুকুর, বিড়াল এবং ইঁদুর খেয়ে শেষ করে। এরপর তারা ঘাস, লতাপাতা এবং এমনকি পুরনো চামড়ার জুতো সেদ্ধ করে খেতে বাধ্য হয়। কিন্তু ক্ষুধার আগুন যখন পেটের নাড়িভুঁড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন মানুষ আর মানুষ থাকেনি; তারা পরিণত হয়েছিল হিংস্র পশুতে।
ঐতিহাসিক আল-তাবারির বর্ণনা এবং অন্যান্য সমসাময়িক সূত্র মতে, আল-মুখতারায় একপর্যায়ে নরমাংসভোজন (Cannibalism) শুরু হয়েছিল। ক্ষুধার্ত মানুষ মৃতদেহের মাংস খাওয়ার জন্য একে অপরের সাথে লড়াই করত। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো ঘটেছিল নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে। বর্ণনায় পাওয়া যায়, কিছু মা ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণায় উন্মাদ হয়ে তাদের নিজের সন্তানদের খেয়ে ফেলেছিলেন। এটি কেবল একটি শারীরিক ক্ষুধার গল্প নয়, এটি ছিল মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের গল্প। আল-মুখতারা, যা একসময় ‘নির্বাচিত শহর’ বা প্রতিশ্রুত ভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল, তা পরিণত হয়েছিল এক নরককুণ্ডে। শহরের অলিগলিতে লাশের স্তূপ জমে থাকত, কারণ দাফন করার মতো শক্তি বা ইচ্ছা কারোরই অবশিষ্ট ছিল না। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল পচা মাংসের গন্ধে। এই দুর্ভিক্ষ ছিল আল-মুওয়াফফাকের পোড়ামাটি নীতি (Scorched Earth Policy) এবং কঠোর অবরোধের প্রত্যক্ষ ফল। তিনি চেয়েছিলেন অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করার আগেই ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে শত্রুকে দুর্বল করে দিতে। এবং তার এই নিষ্ঠুর কৌশল শতভাগ সফল হয়েছিল। শহরের জনসংখ্যা দ্রুত কমতে শুরু করে, এবং যারা বেঁচে ছিল, তারা ছিল জীবন্ত কঙ্কাল।
আলী ইবনে মুহাম্মদের মনস্তাত্ত্বিক খেলা ও ঐশ্বরিক দাবি
শহরের এই চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তেও জাঞ্জ নেতা আলী ইবনে মুহাম্মদ ছিলেন অবিচল, অথবা বলা ভালো, তিনি ছিলেন এক প্রকার ঘোর বা বিভ্রমের মধ্যে। তার আচরণ ছিল একনায়কতান্ত্রিক এবং রহস্যময়। সাধারণ মানুষ যখন অনাহারে মারা যাচ্ছিল, তখনো তিনি তার সৈন্যদের এবং অনুসারীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (Psychological Warfare) চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জানতেন, এই মুহূর্তে যদি তার অনুসারীরা আশা হারিয়ে ফেলে, তবে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটবে। তাই তিনি ধর্মের আফিম এবং ভয় – উভয়কেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেন। তিনি জুমার খুতবায় দাঁড়িয়ে বলতেন, “এই কষ্ট আল্লাহর পরীক্ষা। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের এভাবেই পরীক্ষা করেন। যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জান্নাত এবং আব্বাসীয়দের বিপুল সম্পদ।” তিনি নিজেকে ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত দাবি করতেন এবং বলতেন যে, তার কাছে ফেরেশতাদের মাধ্যমে বিজয়ের বার্তা আসছে। তার এই ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব (Charismatic Authority) বা সম্মোহনী নেতৃত্ব এতটাই প্রবল ছিল যে, অনেক অনাহারী মানুষও তার কথায় বিশ্বাস করে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিত।
তবে কেবল ধর্মীয় বয়ান দিয়েই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্মম। কেউ যদি পালানোর চেষ্টা করত বা তার আদেশের বিরোধিতা করত, তবে তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো। তিনি শহরের ভেতরে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তার নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনী, যারা তুলনামূলকভাবে ভালো খাবার পেত, তারা সাধারণ মানুষের ওপর কড়া নজরদারি রাখত। আলী ইবনে মুহাম্মদ তার অনুসারীদের বোঝাতেন যে, আব্বাসীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু, তাই লড়াই করে মরে যাওয়াটাই শ্রেয়। তিনি বলতেন, “আমরা দাস ছিলাম, আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমরা কি আবার সেই শিকল পরব?” তার এই আবেগী বক্তৃতাগুলো ক্ষুধার্ত ও মুমূর্ষু মানুষের মনে শেষবারের মতো বারুদ জ্বালিয়ে দিত। কিন্তু পর্দার আড়ালে আলী নিজেও জানতেন যে, সময় ফুরিয়ে আসছে। তার অনেক বিশ্বস্ত সেনাপতি ইতিমধ্যেই পক্ষ ত্যাগ করে আল-মুওয়াফফাকের সাথে যোগ দিয়েছিল। তবুও তিনি তার ব্যক্তিগত জেদ এবং অহমিকার কারণে শহরটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের পূজা (Cult of Personality) শেষ পর্যন্ত তার অনুসারীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আল-মুওয়াফফাকের আঘাত ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিস্ময়
অন্যদিকে, আল-মুওয়াফফাক অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেও কম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। জলাভূমির ভ্যাপসা গরম, মশা-মাছির উপদ্রব এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ক্লান্তি তার সৈন্যদের মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি করছিল। আব্বাসীয় ক্যাম্পে মহামারী দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। এমনকি আল-মুওয়াফফাক নিজেও একপর্যায়ে যুদ্ধের ময়দানে একটি তীরের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। তার বুকের বর্ম ভেদ করে তীরটি ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন ইস্পাতকঠিন মানসিকতার অধিকারী। তিনি চিকিৎসার জন্য বাগদাদে ফিরে যাননি বা যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করেননি। বরং ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় তিনি ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যদের সামনে আসতেন, যাতে তাদের মনোবল না ভাঙে। তার এই সম্মুখসারির নেতৃত্ব (Frontline Leadership) আব্বাসীয় সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা দেখেছিল যে, তাদের নেতা প্রাসাদের আরামে বসে হুকুম দিচ্ছেন না, বরং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্ত ঝরাচ্ছেন।
আল-মুওয়াফফাক বুঝতে পেরেছিলেন যে, আল-মুখতারার দেয়াল ভাঙতে হলে গতানুগতিক আক্রমণ যথেষ্ট নয়। কারণ শহরটি প্রাকৃতিকভাবেই পানি দ্বারা সুরক্ষিত। জাঞ্জরা খালের জলকে পরিখা বা ‘মোউট’ (Moat) হিসেবে ব্যবহার করত, যা আব্বাসীয় পদাতিক এবং অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য ছিল অনতিক্রম্য বাধা। এখানে আল-মুওয়াফফাক তার জীবনের সেরা চালটি চাললেন। তিনি সমরবিদদের সাথে সাথে একদল দক্ষ প্রকৌশলী বা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করলেন। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। তার পরিকল্পনা ছিল হাইড্রোলিক যুদ্ধ (Hydraulic Warfare) বা জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শত্রুকে ঘায়েল করা। আব্বাসীয় প্রকৌশলীরা টাইগ্রিস নদী এবং শহরের আশেপাশের খালগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণ শুরু করলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল জলপ্রবাহ ঘুরিয়ে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া। এটি ছিল সেই সময়ের প্রযুক্তিতে এক অসাধ্য সাধন। হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত কাজ করে খালগুলোর মুখ বন্ধ করে দিল এবং নতুন নালা কেটে জল অন্যদিকে প্রবাহিত করল।
ধীরে ধীরে আল-মুখতারার চারপাশের জলস্তর কমতে শুরু করল। যে গভীর খালগুলো জাঞ্জদের প্রধান প্রতিরক্ষা ছিল, সেগুলো শুকিয়ে কাদা ও বালিতে পরিণত হলো। জাঞ্জদের দ্রুতগামী ডিঙি নৌকাগুলো, যা জলে ছিল অপ্রতিরোধ্য, এখন কাদায় আটকে অচল হয়ে পড়ল। জলের অভাবে তাদের নৌ-বাহিনীর শক্তি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। অন্যদিকে, জল সরে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া শক্ত মাটির ওপর দিয়ে আব্বাসীয় পদাতিক এবং অশ্বারোহী বাহিনী সহজেই শহরের দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেল। এটি ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক বিস্ময়কর সাফল্য, যা প্রমাণ করে যে যুদ্ধে কেবল তরবারি নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিও বড় ভূমিকা রাখে। আল-মুওয়াফফাক প্রকৃতিকে জয় করে জাঞ্জদের শেষ রক্ষাকবচটুকুও কেড়ে নিলেন।
দেয়াল ভাঙার শব্দ ও অন্তিম লগ্ন
৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে, যখন শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে, তখন আল-মুওয়াফফাক চূড়ান্ত আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। আব্বাসীয় বাহিনী তাদের ভারী অবরোধ যন্ত্র বা ব্যালেস্টা ও ক্যাটাপাল্ট (Ballistae and Catapults) নিয়ে এগিয়ে এল। বিশাল বিশাল পাথর এবং জ্বলন্ত গোলক শহরের দেয়ালের ওপর নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। অনাহারে দুর্বল জাঞ্জ সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। একসময় শহরের প্রধান তোরণ এবং দেয়ালের একাংশ ধসে পড়ল। আব্বাসীয় সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করল। আল-মুখতারার পতন তখন ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার। আলী ইবনে মুহাম্মদ তার অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে শেষ প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তা ছিল নিভে যাওয়া প্রদীপের শেষ দপদপানি। একটি স্বপ্ন, যা পনেরো বছর ধরে হাজার হাজার মানুষকে মুক্তির আশা দেখিয়েছিল, তা আব্বাসীয়দের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা, আল-মুওয়াফফাকের কৌশল এবং নির্মম বাস্তবতার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল। আল-মুখতারা পরিণত হলো একটি ধ্বংসস্তূপে, যেখানে মিশে ছিল হাজারো মানুষের রক্ত, কান্না এবং একটি ব্যর্থ বিপ্লবের ইতিহাস।
চূড়ান্ত পরিণতি: ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ
৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস; বাতিহার আকাশ তখন মেঘমুক্ত, কিন্তু বাতাস ছিল ভারী – বারুদের গন্ধ, পচা মাংসের দুর্গন্ধ আর আসন্ন মৃত্যুর শীতল স্পর্শে। দীর্ঘ দুই বছরের শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের পর অবশেষে আল-মুখতারার পতন হলো। এটি কেবল একটি যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঘটনা ছিল না, এটি ছিল একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু, একটি আদর্শের সমাধি। আলী ইবনে মুহাম্মদ, যিনি নিজেকে জাঞ্জদের ত্রাণকর্তা বা ‘সাহিব আল-জাঞ্জ’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি বুঝতে পারছিলেন তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তার একসময়ের বিশ্বস্ত সেনাপতিরা, যারা তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপ্লবের শপথ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই তখন আল-মুওয়াফফাকের সাধারণ ক্ষমার প্রলোভনে বা জীবনের মায়ায় পক্ষ ত্যাগ করেছে। তার চারপাশে তখন কেবল হাতেগোনা কিছু কট্টর অনুসারী, যারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাদের নেতার প্রতি অনুগত ছিল। ১১ আগস্ট, শনিবার, আল-মুওয়াফফাকের বিশাল বাহিনী শহরের শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে। আলী ইবনে মুহাম্মদ পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি পালাননি। তিনি জানতেন, পালিয়ে বাঁচার চেয়ে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুবরণ করা অনেক বেশি সম্মানজনক। তাই তিনি তার অবশিষ্ট ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে আব্বাসীয়দের সমুদ্রসম সৈন্যের বিরুদ্ধে শেষবারের মতো ‘সুইসাইডাল চার্জ’ বা আত্মঘাতী আক্রমণ করলেন।
যুদ্ধটি ছিল অসম, কিন্তু প্রবল। আলী ইবনে মুহাম্মদ বীরের মতো লড়াই করলেন, কিন্তু আব্বাসীয়দের তীরের বৃষ্টি আর তলোয়ারের কোপ থেকে তাকে রক্ষা করার কেউ ছিল না। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি নিহত হলেন। তার মৃত্যু ছিল বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি। আব্বাসীয় সৈন্যরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারা আলী ইবনে মুহাম্মদের মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করল। যেই মস্তকটি একদিন হাজার হাজার মানুষকে সাম্য ও মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল, যেই মুখ থেকে বের হওয়া শব্দে দাসরা তাদের শিকল ভাঙার সাহস পেয়েছিল, সেই মস্তকটি এখন একটি বর্শার ডগায় ঝুলছে – রক্তাক্ত, নিশ্চল এবং পরাজিত। তার মাথাটি বাগদাদে পাঠানো হলো বিজয়ের স্মারক বা ট্রফি অফ ওয়ার (Trophy of War) হিসেবে। বাগদাদের রাজপথে সেই কাটা মাথা নিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রা বের করা হলো। আব্বাসীয় অভিজাতরা, বণিকরা এবং সাধারণ জনতা রাস্তায় নেমে এল সেই দৃশ্য দেখতে। তাদের উল্লাস ছিল বাঁধভাঙা, কারণ তাদের দীর্ঘদিনের এক দুঃস্বপ্ন বা নাইটমেয়ার (Nightmare) শেষ হয়েছে। জাঞ্জ বিদ্রোহ তাদের অস্তিত্বের মূলে যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল, তা থেকে তারা অবশেষে মুক্ত হলো। খলিফা আল-মুতামিদ তার ভাই আল-মুওয়াফফাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতজানু হলেন এবং তাকে ‘আল-নাসির লি-দিন আল্লাহ’ (ধর্মের রক্ষক) উপাধিতে ভূষিত করলেন। এই উপাধিটি ছিল প্রতীকী; এটি প্রমাণ করে যে, আব্বাসীয়রা এই যুদ্ধকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং একটি ধর্মীয় যুদ্ধ বা ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে দেখেছিল।
স্বপ্নভঙ্গ ও দাসত্বের পুনরুজ্জীবন
জাঞ্জদের স্বপ্ন কাঁচের আয়নার মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আল-মুখতারা, যা ছিল তাদের স্বাধীনতার প্রতীক, তা এখন ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু যুদ্ধের পর বেঁচে থাকা জাঞ্জদের ভাগ্য কী হলো? এই প্রশ্নটি ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়। যারা যুদ্ধে মারা যায়নি, তাদের অধিকাংশকেই আবার সেই পুরনো শিকলে বন্দী করা হলো। অনেককে তাদের পুরনো মনিবদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও কঠোর শাস্তি আর নির্যাতন। আব্বাসীয়রা এই বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের প্রতিহিংসার আগুন নেভেনি। তারা চেয়েছিল এই বিদ্রোহের স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে, অথবা এমন এক ভীতি তৈরি করতে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর মাথা তোলার সাহস না পায়। একে বলা হয় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি (Exemplary Punishment)। অনেক বিদ্রোহী নেতাকে জনসমক্ষে ক্রুশবিদ্ধ করা হলো বা বাঘ-সিংহের খাঁচায় ছুড়ে দেওয়া হলো।
তবে আব্বাসীয়দের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বা রিয়েলপলিটিক (Realpolitik)-এর একটি দিক এখানে লক্ষ্যণীয়। তারা সব জাঞ্জকে হত্যা বা দাস বানায়নি। আল-মুওয়াফফাক জানতেন, জাঞ্জরা ভাল যোদ্ধা। তাদের শারীরিক শক্তি এবং সাহসিকতা অতুলনীয়। তাই তিনি অনেক জাঞ্জ সৈন্যকে, বিশেষ করে যারা শেষের দিকে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের আব্বাসীয় সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। তাদের দিয়ে তিনি বিশেষ বাহিনী বা ‘এলিট ফোর্স’ গঠন করলেন। এটি ছিল এক অদ্ভুত বৈপরীত্য – গতকাল যারা রাষ্ট্রের শত্রু ছিল, আজ তারা রাষ্ট্রের পাহারাদার। ইতিহাসবিদরা একে আব্বাসীয়দের সামরিক আত্তীকরণ (Military Assimilation) নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এর মাধ্যমে তারা দুটি কাজ করল: এক, বিদ্রোহের শক্তি কমিয়ে দিল; দুই, নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াল। কিন্তু সাধারণ জাঞ্জদের জন্য, যারা বাতিহার লোনাজলে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল, তাদের জন্য এটি ছিল এক ট্র্যাজেডি। তারা আবার সেই পরাধীনতার গ্লানি মেনে নিতে বাধ্য হলো।
লাশের পরিসংখ্যান ও ইতিহাসের নীরবতা
বাতিহার লোনাজলে আবার আগের মতো নীরবতা নেমে এল। নলখাগড়ার বন আবার বাতাসের দোলায় দুলতে লাগল। কিন্তু এই নীরবতা আর আগের মতো ছিল না। এই নীরবতা ছিল শ্মশানের নীরবতা, যাতে মিশে ছিল হাজার হাজার লাশের গন্ধ। যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা যে পরিসংখ্যান দেন, তা মধ্যযুগের প্রেক্ষাপটে অকল্পনীয়। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়, এই পনেরো বছরের যুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও ২০ লক্ষ সংখ্যাটি অনেকের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে, তবুও এটি নিশ্চিত যে মৃতের সংখ্যা ছিল বিশাল। তৎকালীন ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যার বিচারে এটি ছিল এক ব্যাপক গণহত্যা (Genocide) বা মানবিক বিপর্যয়। দক্ষিণ ইরাকের বিশাল জনপদ জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, গ্রামগুলো ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল ইতিহাসের পাতায়। বিজয়ী আব্বাসীয়রা জাঞ্জদের ইতিহাস মুছে ফেলার সবরকম চেষ্টা করেছিল। তারা আলী ইবনে মুহাম্মদকে চিত্রিত করেছিল একজন ভণ্ড, ধর্মত্যাগী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে। তার কোনো লেখা বা বাণী সংরক্ষণ করা হয়নি। জাঞ্জদের নিজস্ব কোনো বয়ান বা সাবঅল্টার্ন ন্যারেটিভ (Subaltern Narrative) আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। আমরা তাদের গল্প জানি তাদের শত্রুদের জবানিতে – আল-তাবারি বা আল-মাসুদির মতো ঐতিহাসিকদের লেখায়। ফলে তাদের বিদ্রোহের আসল উদ্দেশ্য, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের বীরত্বের অনেক কিছুই ইতিহাসের অতলে হারিয়ে গেছে। একে বলা হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা (Epistemic Violence), যেখানে শাসকরা শোষিতদের কণ্ঠস্বর রোধ করে তাদের নিজেদের মতো করে ইতিহাস লেখে। বাতিহার লোনাজল শুকিয়ে গেছে বহুদিন, কিন্তু সেই মাটিতে মিশে থাকা রক্তের দাগ ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। আধুনিক গবেষকরা এখন সেই ধুলো ঝেড়ে জাঞ্জদের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা করছেন, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক করুণ ট্র্যাজেডি।
বিদ্রোহের প্রভাব: কেন এটি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল?
জাঞ্জ বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সামরিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল; আলী ইবনে মুহাম্মদের কাটা মস্তক বাগদাদের রাজপথে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং বিদ্রোহীরা পুনরায় শৃঙ্খলিত হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের বৃহত্তর ক্যানভাসে এই বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী, গভীর এবং বহুমাত্রিক। এটি কেবল একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অনুঘটক বা ক্যাটালিস্ট (Catalyst), যা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছিল। আব্বাসীয় খিলাফত, যা তখন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি, এই বিদ্রোহের পর আর কখনোই তার আগের শৌর্যবীর্য বা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পায়নি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই বিদ্রোহ ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর ঘণ্টা বা হার্বিঞ্জার অফ ডিক্লাইন (Harbinger of Decline)। এর প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা চারটি প্রধান ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে পারি: অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দাসপ্রথার কাঠামোগত পরিবর্তন, সামাজিক-শ্রেণিগত সংঘাতের নতুন রূপ এবং ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিবর্তন।
অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব ও কৃষি ব্যবস্থার ধস
জাঞ্জ বিদ্রোহের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ এবং ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছিল আব্বাসীয় অর্থনীতির ওপর। পনেরো বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে আব্বাসীয় রাজকোষ বা ‘বাইতুল মাল’ আক্ষরিক অর্থেই শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বিশাল সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ, নৌ-বহর তৈরি এবং যুদ্ধের অন্যান্য ব্যয়ের জোগান দিতে গিয়ে খলিফাকে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হতে হয়েছিল। কিন্তু এর চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন ব্যবস্থায়। দক্ষিণ ইরাক বা ‘সাওয়াদ’ (Sawad) অঞ্চলটি ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ‘রুটির ঝুড়ি’ বা ব্রেড বাস্কেট (Breadbasket) এবং রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। বিদ্রোহীরা তাদের ‘পোড়ামাটি নীতি’র অংশ হিসেবে এবং আব্বাসীয়রা তাদের প্রতি-বিদ্রোহ কৌশলের অংশ হিসেবে এই অঞ্চলের সেচ ব্যবস্থা বা ক্যানেল সিস্টেম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর জটিল সেচ নালাগুলো, যা হাজার বছর ধরে মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রাণ ছিল, তা অবহেলা ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অকেজো হয়ে পড়ে।
অনেক উর্বর কৃষি জমি লোনা জলে প্লাবিত হয়ে চিরতরে লবণাক্ত জলাভূমিতে বা স্যালাইন মার্শল্যান্ড (Saline Marshland)-এ পরিণত হয়। মাটি থেকে লবণ সরানোর যে বিশাল কর্মযজ্ঞ বাতিহাতে চলছিল, তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এখান থেকে আর কোনোদিনই আগের মতো ফসল বা চিনি উৎপাদন সম্ভব হয়নি। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে আব্বাসীয় খিলাফতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ধসে পড়ে। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় বাগদাদ তার বিশাল আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর বেতন দিতে ব্যর্থ হয়, যা পরবর্তীতে তুর্কি সেনাপতিদের বিদ্রোহ এবং কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার পথ প্রশস্ত করে। আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগের যে চাকচিক্য, তা এই অর্থনৈতিক ধস বা ইকোনমিক কলাপ্স (Economic Collapse)-এর কারণেই ম্লান হতে শুরু করে।
দাসপ্রথার কাঠামোগত রূপান্তর: প্ল্যান্টেশন স্লেভারির ইতি
জাঞ্জ বিদ্রোহের সম্ভবত সবচেয়ে বৈপ্লবিক প্রভাব ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দাসপ্রথার ধরণ বদলে দেওয়া। এই বিদ্রোহের আগে, আব্বাসীয় অভিজাতরা মনে করত যে হাজার হাজার দাসকে একসাথে জড়ো করে বড় আকারের কৃষি খামারে বা প্ল্যান্টেশন (Plantation)-এ কাজ করানোই সবচেয়ে লাভজনক। একে বলা হতো প্ল্যান্টেশন স্লেভারি (Plantation Slavery) বা কৃষিভিত্তিক দাসপ্রথা। কিন্তু জাঞ্জ বিদ্রোহ তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, বিপুল সংখ্যক দাসকে এক জায়গায় রাখলে তা কী পরিমাণ নিরাপত্তার ঝুঁকি বা সিকিউরিটি হ্যাজার্ড (Security Hazard) তৈরি করতে পারে। বিদ্রোহীরা যখন একজোট হয়ে তাদের মনিবদের হত্যা করল, তখন মালিক শ্রেণি আতঙ্কে শিউরে উঠল।
ফলে বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারের কৃষিভিত্তিক দাসপ্রথার প্রচলন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মালিকরা তাদের বিনিয়োগের কৌশল পরিবর্তন করে। তারা আর হাজার হাজার পুরুষ দাসকে এক জায়গায় জড়ো করার ঝুঁকি নেয়নি। এর পরিবর্তে তারা ছোট আকারে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাস ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দাসদের মূলত গৃহস্থালি কাজ, কারিগর বা ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়, যাকে ডমেস্টিক স্লেভারি (Domestic Slavery) বা গৃহস্থালি দাসপ্রথা বলা হয়। এছাড়া, কৃষি কাজের জন্য দাসদের পরিবর্তে স্থানীয় কৃষক বা ভূমিদাসদের (Serfs) সাথে বর্গাচাষ বা ভাগচাষের চুক্তিতে যাওয়া হয়। ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুইস (Bernard Lewis) তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, জাঞ্জ বিদ্রোহ কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মতো বিশাল প্ল্যান্টেশন স্লেভারি গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিয়েছিল (Lewis, 1990)। দাসপ্রথা সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়নি, কিন্তু এর প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার ধরণ আমূল বদলে গিয়েছিল, যা ছিল বিদ্রোহের পরোক্ষ কিন্তু স্থায়ী বিজয়।
জাতিগত সংহতি ও শ্রেণি সংগ্রামের আদিরূপ
জাঞ্জ বিদ্রোহকে আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকরা, বিশেষ করে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা, শ্রেণি সংগ্রাম (Class Struggle)-এর একটি আদি ও ধ্রুপদী উদাহরণ হিসেবে দেখেন। যদিও এই বিদ্রোহে ধর্মীয় উপাদান ছিল, কিন্তু এর মূল চালিকাশক্তি ছিল অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক বৈষম্য। বিদ্রোহীরা ছিল সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ – সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত (Proletariat), যারা তাদের শোষক বা বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজে কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন না, কিন্তু তিনি নিজেকে ‘জাঞ্জদের নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তার অনুসারীদের ৯৯ শতাংশই ছিল পূর্ব আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ দাস। এটি প্রমাণ করে যে, নিপীড়ন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন জাতি বা ধর্মের চেয়ে শ্রেণিগত পরিচয় বা ক্লাস আইডেন্টিটি (Class Identity) বড় হয়ে দাঁড়ায়।
এই বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি ছিল এক ধরণের ব্ল্যাক কনশাসনেস (Black Consciousness) বা কৃষ্ণাঙ্গ চেতনার জাগরণ। তারা দেখিয়েছিল যে, তাদের গায়ের রঙ কালো হতে পারে, কিন্তু তাদের রক্ত লাল এবং তাদেরও আঘাত করার ক্ষমতা আছে। বিদ্রোহের সময় তারা কেবল তাদের মনিবদের হত্যা করেনি, তারা বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তারা চেয়েছিল এমন এক সমাজ, যেখানে কোনো মনিব থাকবে না, কোনো দাস থাকবে না। যদিও তাদের সেই স্বপ্ন পুরোপুরি সফল হয়নি এবং তারাও শেষ পর্যন্ত পাল্টা-শোষক হয়ে উঠেছিল, তবুও তাদের এই উত্থান শোষিত মানুষের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এটি প্রমাণ করে যে, মানুষ অপমান সহ্য করতে পারে না এবং অস্তিত্বের সংকটে সে বাঘের মতো গর্জন করতে পারে।
ধর্মতাত্ত্বিক বিবর্তন ও রাজনৈতিক ইসলামের নতুন ধারা
জাঞ্জ বিদ্রোহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আলী ইবনে মুহাম্মদ খুব সুনিপুণভাবে ইসলামের সাম্যবাদী চেতনাকে বিপ্লব বা রেভোলিউশন (Revolution)-এর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি খারিজি মতবাদের সেই বৈপ্লবিক অংশটুকু গ্রহণ করেছিলেন, যেখানে বলা হয় – নেতৃত্ব বংশানুক্রমিক নয়, বরং যোগ্যতাভিত্তিক হওয়া উচিত এবং শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কেবল অধিকার নয়, কর্তব্য। তিনি ধর্মকে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের এক নতুন নজির স্থাপন করেন, যাকে আধুনিক পরিভাষায় পলিটিক্যাল ইসলাম (Political Islam) বা রাজনৈতিক ইসলামের একটি রূপ বলা যেতে পারে।
তার এই মতাদর্শ এবং বিদ্রোহের কৌশল পরবর্তীকালে অনেক শিয়া এবং ইসমাইলি আন্দোলনকে (Ismaili Movement) গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে দশম শতাব্দীতে কারমাতী (Qarmatians) বিদ্রোহের ওপর জাঞ্জ বিদ্রোহের প্রভাব ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কারমাতীরাও আলী ইবনে মুহাম্মদের মতো সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখত এবং তারা আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, জাঞ্জ বিদ্রোহ না হলে কারমাতী বা ফাতিমীয় খিলাফতের উত্থান হয়তো অন্যভাবে হতো। আলী ইবনে মুহাম্মদ দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ইসলামের মূলধারার বাইরে গিয়েও একটি বিকল্প ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বয়ান বা অল্টারনেটিভ ডিসকোর্স (Alternative Discourse) তৈরি করা সম্ভব, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, জাঞ্জ বিদ্রোহ কেবল একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান ছিল না; এটি ছিল এক বিশাল ভূমিকম্প, যার আফটারশক বা পরবর্তী কম্পনগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে অনুভূত হয়েছিল। এটি আব্বাসীয়দের দম্ভ চূর্ণ করেছিল, দাসপ্রথার ধরণ বদলে দিয়েছিল এবং শোষিত মানুষের মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে – রাজার মুকুটও একদিন ধূলোয় লুটাতে পারে।
বিশ্লেষণ: ধূসর এলাকার উপাখ্যান
আমরা যখন ইতিহাসের বিশাল ক্যানভাসে জাঞ্জ বিদ্রোহের মতো প্রলয়ঙ্করী ঘটনার দিকে তাকাই, তখন আমাদের চিরাচরিত নৈতিকতার মানদণ্ডগুলো যেন অকেজো হয়ে পড়ে। স্কুলপাঠ্য বই বা লোককথা আমাদের শেখায় যে ইতিহাসে স্পষ্ট দুটি পক্ষ থাকে – নায়ক এবং খলনায়ক, সাদা এবং কালো, ভালো এবং মন্দ। কিন্তু বাতিহার লোনাজলে ঘটে যাওয়া এই রক্তক্ষয়ী অধ্যায় আমাদের শেখায় যে, ইতিহাস আসলে সরল রেখায় চলে না; এটি এক জটিল বক্ররেখা, যেখানে ন্যায় এবং অন্যায়ের সীমানা প্রায়শই ঝাপসা হয়ে যায়। একে ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক পরিভাষায় বলা হয় নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ (Moral Relativism) বা ধূসর এলাকা (Grey Zone)। এই বিদ্রোহের উপাখ্যান বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা এমন এক গোলকধাঁধায় আটকা পড়ি, যেখানে কাকে চূড়ান্ত দোষী সাব্যস্ত করব আর কাকে নির্দোষ বা মাসুম বলব, তা বিচার করা এক অসম্ভব তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আলী ইবনে মুহাম্মদ কি সত্যিই একজন মহৎ বিপ্লবী ছিলেন, যিনি শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন? নাকি তিনি ছিলেন ইতিহাসের সেই চিরচেনা সুবিধাবাদী জননেতা (Demagogue), যিনি ধর্মের আফিম আর মুক্তির মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার নিরন্ন মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য? অন্যদিকে, আব্বাসীয় খিলাফত – যারা নিজেদের ‘আল্লাহর জমিনে তার প্রতিনিধি’ বা খলিফাতুল্লাহ (Khalifat Allah) বলে দাবি করত, তারা কীভাবে দিনের পর দিন আল্লাহরই সৃষ্টি মানুষকে দিয়ে পশুর মতো কাজ করাত? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা এক অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি হই – ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আসলে কোনো পক্ষই পবিত্র থাকে না।
আলী ইবনে মুহাম্মদ: ত্রাতা নাকি প্রতারক?
আলী ইবনে মুহাম্মদের চরিত্রটি ইতিহাসের অন্যতম জটিল এক ধাঁধা। তিনি নিজেকে জাঞ্জদের নেতা বা ‘সাহিব আল-জাঞ্জ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার নিজের সামাজিক অবস্থান এবং আচরণের মধ্যে ছিল প্রকট স্ববিরোধিতা। তিনি মুখে সাম্যবাদ (Egalitarianism)-এর কথা বলতেন, খারিজি মতবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতেন যে সব মানুষ সমান; অথচ ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটলে দেখা যায়, তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি নিজে দাসী সম্ভোগ করতেন এবং তার হেরেমে বহু নারী বন্দি ছিল। তিনি যখন তার অনুসারীদের বলতেন, “তোমরা স্বাধীন,” তখন তিনি আসলে তাদের এক নতুন ধরণের আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতেন। তার এই দ্বিমুখী আচরণকে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বর্ণিত ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব (Charismatic Authority)-এর নেতিবাচক দিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি তার সম্মোহনী ক্ষমতা ব্যবহার করে এমন এক ব্যক্তিত্বের পূজা (Cult of Personality) গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত আইন। তিনি কি সত্যিই দাসদের দুঃখ বুঝতেন? নাকি তিনি তাদের কেবল দাবার গুটি বা ক্যানন ফডার (Cannon Fodder) হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন? ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যে, যুদ্ধের কঠিন সময়ে যখন রসদ ফুরিয়ে আসত, তখন তিনি সাধারণ সৈন্যদের না খাইয়ে রেখে নিজের এবং তার এলিট গার্ডদের জন্য খাবার মজুদ করতেন। এটি কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরের আচরণ হতে পারে না। বরং এটি মনে করিয়ে দেয় সেই ধ্রুপদী ম্যাকিয়াভেলিয়ান নীতি – উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোনো উপায়ই বৈধ। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন আব্বাসীয়দের হটিয়ে নিজেই মসনদে বসতে, আর সেই সিঁড়ি হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন বাতিহার লোনাজলে ধুঁকতে থাকা হাজার হাজার মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে।
তবুও, মুদ্রার উল্টো পিঠটাও আমাদের দেখতে হবে। আলী ইবনে মুহাম্মদ যদি কেবলই একজন প্রতারক হতেন, তবে কেন হাজার হাজার মানুষ তার জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছিল? কেন তারা পনেরো বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছিল? এর কারণ হলো, তিনি তাদের এমন কিছু দিয়েছিলেন যা আব্বাসীয় সমাজ তাদের দেয়নি – তা হলো আত্মমর্যাদা বা স্বীকৃতি (Recognition)। হেগেলীয় দর্শনের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা (Master-Slave Dialectic) অনুযায়ী, মানুষ কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে না, সে লড়াই করে স্বীকৃতির জন্য। আলী ইবনে মুহাম্মদ সেই স্বীকৃতিটুকু দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বুঝিয়েছিলেন, তারাও মানুষ, তাদেরও রাষ্ট্র গড়ার অধিকার আছে। তাই তার উদ্দেশ্য যতটাই কলুষিত হোক না কেন, তার আন্দোলনের ফলাফল ছিল নিপীড়িত মানুষের মানসিক জাগরণ। তিনি হয়তো সুবিধাবাদী ছিলেন, কিন্তু তার তৈরি করা মঞ্চটি ছিল শোষিতের আর্তনাদ প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। এখানেই তার চরিত্রের ট্র্যাজেডি – তিনি একইসাথে শোষিতের বন্ধু এবং ক্ষমতার লোভে অন্ধ এক উচ্চাভিলাষী শাসক।
আব্বাসীয়দের দ্বিমুখী নীতি ও কাঠামোগত সহিংসতা
অন্যদিকে, আমরা যদি আব্বাসীয় খিলাফতের দিকে তাকাই, তবে সেখানেও আমরা দেখি এক বিশাল নৈতিক শূন্যতা। তারা নিজেদের ইসলামের রক্ষক এবং মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক বলে দাবি করত। বাগদাদে তখন ইসলামের স্বর্ণযুগ চলছে; ইমাম বোখারি হাদিস সংকলন করছেন, আল-কিন্দি দর্শন চর্চা করছেন। কিন্তু এই জ্ঞান ও ধর্মের চর্চা কি তাদের অন্ধ করে দিয়েছিল? তারা কীভাবে দিনের পর দিন বাতিহার জলাভূমিতে হাজার হাজার মানুষকে অমানবিক পরিবেশে খাটিয়ে মারত? একে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় কাঠামোগত সহিংসতা (Structural Violence)। এখানে কোনো একক ব্যক্তি চাবুক মারছে না, বরং পুরো অর্থ-সামাজিক কাঠামোটিই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, তা নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আব্বাসীয়দের বিলাসিতা, তাদের বিশাল প্রাসাদ, তাদের কবি ও গায়িকাদের পেছনে ওড়ানো অঢেল অর্থ – সবই আসত এই দাসদের রক্ত ও ঘাম থেকে। তাদের এই নিষ্ঠুরতা এবং উদাসীনতাই আলী ইবনে মুহাম্মদের মতো লোকের উত্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল। তারা কি একবারও ভাবেনি, এই ‘জাঞ্জ’ বা কালো মানুষগুলোরও প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে, পরিবার আছে? তাদের এই বিমানবিকীকরণ বা ডিহিউম্যানাইজেশন (Dehumanization) প্রক্রিয়াই ছিল বিদ্রোহের মূল বীজ। আব্বাসীয়রা জাঞ্জদের মানুষ মনে করত না, মনে করত ‘কথা বলা যন্ত্র’। যখন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বা তার অধীনস্থ মানুষের মানবিক মর্যাদা কেড়ে নেয়, তখন সেই রাষ্ট্র তার নৈতিক বৈধতা বা মোরাল লেজিটিমেসি (Moral Legitimacy) হারিয়ে ফেলে। তাই জাঞ্জ বিদ্রোহের দায় যতটা না বিদ্রোহীদের, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি আব্বাসীয় শাসকগোষ্ঠীর।
বিপ্লবের দানবীয় রূপান্তর: শোষিত যখন শোষক
ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো, বিপ্লব সব সময় সুন্দর বা রোমান্টিক হয় না। অনেক সময় বিপ্লব দানবীয় রূপ নেয় এবং সেই দানব গ্রাস করে ফেলে তার নিজের আদর্শকেই। জাঞ্জ বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও আমরা এই সত্যের প্রতিফলন দেখি। বিদ্রোহীরা যখন বসরা দখল করল, তখন তারা যা করেছিল তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারা নির্বিচারে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করেছিল। তারা মসজিদ পুড়িয়ে দিয়েছিল, শহর লুট করেছিল। যারা একসময় নির্যাতিত ছিল, তারা রাতারাতি চরম নির্যাতনকারীতে পরিণত হলো। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফানো তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Wretched of the Earth-এ দেখিয়েছেন যে, দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক বা দাসত্বের শোষণের ফলে শোষিত মানুষের মনে এক ধরণের বিধ্বংসী আক্রোশ বা সহিংসতা (Violence) জমা হয়, যা মুক্তির মুহূর্তে আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয় (Fanon, 1963)। জাঞ্জদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তারা কেবল তাদের মনিবদের হত্যা করেনি, তারা পুরো সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানে একটি নৈতিক প্রশ্ন জাগে – শোষিতের সহিংসতা আর শোষকের সহিংসতার কি একই পাল্লায় মাপা যায়? জাঞ্জরা যখন আব্বাসীয় নারীদের দাসী বানাচ্ছিল, তখন তারা কি তাদের বিপ্লবের মূল মন্ত্র ‘সাম্য’ থেকে বিচ্যুত হয়নি? তারা প্রমাণ করেছিল যে, ক্ষমতা হাতে পেলে শোষিতও শোষকের রূপ ধারণ করতে পারে। এটি মানব ইতিহাসের এক অনন্ত চক্র বা সাইকেল অফ ভায়োলেন্স (Cycle of Violence)। আলী ইবনে মুহাম্মদের রাষ্ট্রেও নতুন করে দাসপ্রথা চালু হয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে তারা সিস্টেম বদলাতে চায়নি, তারা কেবল সিস্টেমের চালক বদলাতে চেয়েছিল।
আল-মুওয়াফফাক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নন্দনতত্ত্ব
বিদ্রোহ দমনের নামে আব্বাসীয় সেনাপতি আল-মুওয়াফফাক যা করেছিলেন, তাও ছিল মানবতার চরম লঙ্ঘন। এটি ছিল এক ধরণের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস (State Terrorism)। তিনি চেয়েছিলেন ভীতি প্রদর্শন করে বিদ্রোহ দমন করতে। আধুনিক যুগে আমরা একে বলি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (Psychological Warfare)-এর নৃশংসতম রূপ। যখন তিনি বন্দীদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরে অনেককে হত্যা বা দাস বানিয়েছিলেন, তখন তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাতে যেকোনো অনৈতিক কাজকে জায়েজ করা হয়। আব্বাসীয়রা জাঞ্জদের ‘অসভ্য’ বা ‘বর্বর’ বলে গালি দিত, কিন্তু বিদ্রোহ দমনের সময় তারা নিজেরা যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল, তা কি জাঞ্জদের চেয়ে কম ছিল? আল-মুওয়াফফাকের বিজয় ছিল সামরিক বিজয়, কিন্তু নৈতিকভাবে তিনিও ছিলেন দেউলিয়া। তিনি একটি বিদ্রোহ দমন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি সেই ক্ষতের উপশম করতে পারেননি যা আব্বাসীয় সমাজকে ভেতর থেকে পচিয়ে দিচ্ছিল। তার এই নিষ্ঠুরতা হয়তো সাময়িকভাবে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু তা মানুষের মনে যে ঘৃণার বীজ বুনে দিয়েছিল, তা পরবর্তীকালে কারমাতী বা অন্যান্য বিদ্রোহের মাধ্যমে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
উপসংহারমূলক বিশ্লেষণ: চূড়ান্ত বিচার
পরিশেষে, জাঞ্জ বিদ্রোহের এই উপাখ্যান আমাদের সামনে সাদা-কালো কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না। এখানে আলী ইবনে মুহাম্মদ কোনো নিষ্কলুষ নায়ক নন, আবার আব্বাসীয়রা কেবলই ভিলেন নয় – তারা উভয়েই ছিল নিজ নিজ সময়ের, পরিস্থিতির এবং ক্ষমতার কাঠামোর শিকার ও নির্মাতা। ইতিহাস মানেই পরস্পরবিরোধী বয়ানের সংকলন বা কনফ্লিখটিং ন্যারেটিভস (Conflicting Narratives)। জাঞ্জরা যখন বসরার নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছিল, তখন তারা তাদের নৈতিক অবস্থান হারিয়েছিল। আবার আব্বাসীয়রা যখন বিলাসিতার জন্য মানুষ মারত, তখন তারা তাদের ধর্মীয় ও মানবিক দায়বদ্ধতা বিসর্জন দিয়েছিল। এই বিদ্রোহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, চরমপন্থা – তা সে শাসকের শোষণই হোক বা বিদ্রোহীর প্রতিশোধ – শেষ পর্যন্ত কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। বিপ্লব বা বিদ্রোহ সব সময় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না; অনেক সময় তা কেবল ক্ষমতার হাতবদল আর লাশের পাহাড় তৈরি করে। তবুও, এই ধূসর এলাকার মধ্যেও একটি সত্য উজ্জ্বল হয়ে থাকে – মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। জাঞ্জ বিদ্রোহের রক্তস্রোত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায়, হত্যা করা যায়, কিন্তু তার স্বাধীনতার স্পৃহাকে চিরতরে মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস হয়তো বিজয়ীদের কথা লেখে, কিন্তু বাতিহার লোনাজল আর বাতাস আজও সেই পরাজিত, নামহীন, ধূসর এলাকার মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
তাত্ত্বিক বীক্ষণ: জাঞ্জ বিদ্রোহের সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
জাঞ্জ বিদ্রোহকে কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বা সামরিক সংঘাত হিসেবে পাঠ করা হলে এর গভীরতা ও ব্যপকতা অনুধাবন করা অসম্ভব। নবম শতাব্দীর এই অভ্যুত্থানটি এমন এক জটিল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল যা আধুনিক এবং মধ্যযুগীয় – উভয় সময়ের তাত্ত্বিক কাঠামোর আলোকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক লেন্স বা থিওরেটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক (Theoretical Framework) ব্যবহার করে এই বিদ্রোহের অন্তর্নিহিত কারণ, এর গতিপ্রকৃতি এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এই বিশ্লেষণে ধ্রুপদী মুসলিম সমাজচিন্তা থেকে শুরু করে আধুনিক মার্কসবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব এবং সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের মতো মতবাদগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই বিদ্রোহটি প্রমাণ করে যে, মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে কোনো একটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং এটি বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। নিচে জাঞ্জ বিদ্রোহের সাথে সম্পর্কিত এবং প্রাসঙ্গিক তাত্ত্বিক ও তাদের তত্ত্বগুলোর বিশদ আলোচনা করা হলো।
ইবনে খালদুন ও আসাবিয়্যাহ: ক্ষমতার চক্রাকার আবর্তন
জাঞ্জ বিদ্রোহের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যার নাম সবার আগে উঠে আসে, তিনি হলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun)। তার কালজয়ী গ্রন্থ আল-মুকাদ্দিমাহ (The Muqaddimah)-এ তিনি সভ্যতার উত্থান-পতন এবং ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তা জাঞ্জ বিদ্রোহ বোঝার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। খালদুনের মতে, যেকোনো রাষ্ট্র বা সভ্যতার মূলে থাকে আসাবিয়্যাহ (Asabiyyah) বা গোত্রীয় সংহতি/সামাজিক একাত্মবোধ। আব্বাসীয় খিলাফত যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন তাদের মধ্যে এই সংহতি প্রবল ছিল। কিন্তু নবম শতাব্দীতে এসে আব্বাসীয় শাসকরা বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং তাদের মূল সামাজিক ভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। খালদুনীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন কোনো শাসকগোষ্ঠী বিলাসিতায় মগ্ন হয় এবং করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়, তখন রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আব্বাসীয়রা ঠিক তাই করেছিল; তারা বাতিহার লবণাক্ত জমিতে অধিক উৎপাদনের জন্য দাসদের ওপর অমানবিক চাপ সৃষ্টি করেছিল।
অন্যদিকে, জাঞ্জরা ছিল ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও গোত্র থেকে আসা মানুষ। কিন্তু বাতিহার লোনাজলে তাদের অভিন্ন দুঃখ-কষ্ট এবং আলী ইবনে মুহাম্মদের নেতৃত্ব তাদের মধ্যে এক নতুন ধরণের কৃত্রিম আসাবিয়্যাহ (Asabiyyah) বা সংহতি তৈরি করেছিল। ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন যে, মরুভূমি বা রুক্ষ পরিবেশের মানুষ (বেদুঈন বা এক্ষেত্রে জলাভূমির জাঞ্জরা) শহরের বিলাসী মানুষদের চেয়ে যুদ্ধে বেশি পারদর্শী হয় কারণ তাদের সংহতি বা গ্রুপ সলিডারিটি শক্তিশালী থাকে। জাঞ্জ বিদ্রোহ ছিল মূলত এই ‘বন্য সংহতি’র সাথে ‘শহুরে বিলাসিতা’র সংঘাত। বিদ্রোহীরা যখন আল-মুখতারা গড়ে তুলল, তখন তারা খালদুনের বর্ণিত রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক ধাপে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আলী ইবনে মুহাম্মদ নিজেই রাজকীয় আচরণ শুরু করলেন এবং তার অনুসারীদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন তৈরি হলো, তখন তাদের সেই আসাবিয়্যাহ (Asabiyyah) দুর্বল হতে শুরু করে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইবনে খালদুনের চক্রাকার ইতিহাস তত্ত্ব (Cyclical Theory of History) অনুযায়ী, জাঞ্জ বিদ্রোহ ছিল আব্বাসীয়দের পতনের চক্রের একটি অংশ এবং নতুন শক্তি হিসেবে জাঞ্জদের উত্থানের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
কার্ল মার্কস ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: বাতিহা যখন শ্রেণি সংগ্রামের রণক্ষেত্র
আধুনিক যুগে জাঞ্জ বিদ্রোহ নিয়ে সবচেয়ে বেশি তাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে। কার্ল মার্কস (Karl Marx) এবং তার অনুসারীদের দেওয়া ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) তত্ত্বের আলোকে এই বিদ্রোহকে একটি ধ্রুপদী শ্রেণি সংগ্রাম (Class Struggle) হিসেবে দেখা হয়। মার্কসীয় তত্ত্বে বলা হয়, ইতিহাসের চালিকাশক্তি হলো উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত শ্রেণিগুলোর দ্বন্দ্ব। আব্বাসীয় অর্থনীতির বাতিহা প্রকল্প ছিল একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন পদ্ধতি (Mode of Production), যা অনেকটা আধুনিক পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থা (Capitalist Agriculture)-র আদি রূপ। এখানে জমির মালিকরা (আব্বাসীয় অভিজাত শ্রেণি) উৎপাদনের উপকরণের মালিক ছিল, আর জাঞ্জরা ছিল উৎপাদনের হাতিয়ার, যাদের শ্রমের কোনো মূল্য দেওয়া হতো না। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের মতে, জাঞ্জরা ছিল সেই সময়ের সর্বহারা (Proletariat) শ্রেণি।
সোভিয়েত ঐতিহাসিকরা এবং পরবর্তীতে অনেক আরব মার্কসবাদী তাত্ত্বিক জাঞ্জ বিদ্রোহকে একটি ‘কৃষক ও দাস বিপ্লব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, এটি কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের অনিবার্য জাগরণ। কার্ল উইটফোগেল (Karl Wittfogel) তার ওরিয়েন্টাল ডেসপোটিজম (Oriental Despotism) গ্রন্থে যে হাইড্রোলিক সভ্যতা (Hydraulic Civilization) বা সেচ-নির্ভর সভ্যতার ধারণা দিয়েছেন, তা এখানে প্রাসঙ্গিক। আব্বাসীয়রা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের জল নিয়ন্ত্রণ করে বিশাল কৃষি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। এই জলশক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং লোনাজল সরানোর বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য প্রয়োজন ছিল একনায়কতান্ত্রিক শাসন এবং দাসশ্রম। জাঞ্জ বিদ্রোহ ছিল এই ‘হাইড্রোলিক রাষ্ট্রযন্ত্রে’র বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত। আলী ইবনে মুহাম্মদ যখন গনীমতের সম্পদ সবার মাঝে বণ্টনের কথা বলতেন বা সাম্যের কথা বলতেন, তখন মার্কসবাদীরা তাকে দেখেন একজন আদি-সমাজতান্ত্রিক (Proto-Socialist) নেতা হিসেবে। যদিও মার্কস নিজে জাঞ্জ বিদ্রোহ নিয়ে সরাসরি লেখেননি, কিন্তু তার প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক গঠন (Pre-Capitalist Economic Formations) সংক্রান্ত নোটগুলোতে প্রাচ্যের দাসপ্রথার যে বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তা জাঞ্জ বিদ্রোহের অর্থনৈতিক ভিত্তি বুঝতে সাহায্য করে। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, শিল্প বিপ্লবের বহু আগেই মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম ও পুঁজির এক ভয়াবহ দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল।
অরলান্ডো প্যাটারসন ও সামাজিক মৃত্যু: দাসত্বের মনস্তত্ত্ব
জাঞ্জ বিদ্রোহের মানবিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী অরলান্ডো প্যাটারসন (Orlando Patterson)-এর তত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কালজয়ী গ্রন্থ স্লেভারি অ্যান্ড সোশ্যাল ডেথ (Slavery and Social Death)-এ তিনি দাসত্বের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে সামাজিক মৃত্যু (Social Death)-এর ধারণাটি প্রবর্তন করেন। প্যাটারসনের মতে, দাস কেবল শারীরিকভাবে বন্দী নয়, সে সামাজিকভাবে মৃত। কারণ, তাকে তার জন্মভূমি, সংস্কৃতি, পূর্বপুরুষ এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাতিহার জাঞ্জদের অবস্থা ছিল ঠিক তাই। তাদের পূর্ব আফ্রিকা থেকে ধরে এনে এমন এক পরিবেশে রাখা হয়েছিল যেখানে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না, তারা ছিল ‘নাটালি এলিয়েনেটেড’ বা জন্মগতভাবে বিচ্ছিন্ন।
প্যাটারসনের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ‘সামাজিক মৃত্যু’র অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যই দাসরা বিদ্রোহ করে। জাঞ্জ বিদ্রোহ কেবল শারীরিক মুক্তির লড়াই ছিল না, এটি ছিল তাদের ‘মৃত’ অবস্থা থেকে ‘জীবিত’ অবস্থায় ফিরে আসার লড়াই। আলী ইবনে মুহাম্মদ যখন তাদের নতুন নাম দিলেন, নতুন রাষ্ট্র দিলেন এবং তাদের মনিবদের হত্যা করার নির্দেশ দিলেন, তখন তিনি আসলে তাদের হৃত সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। প্যাটারসন দেখিয়েছেন যে, দাসপ্রথা টিকে থাকে সম্মানের এক অসম বন্টনের ওপর। মনিব সব সম্মানের অধিকারী, আর দাস সব অসম্মানের পাত্র। জাঞ্জ বিদ্রোহ এই সমীকরণটি উল্টে দিয়েছিল। বিদ্রোহীরা যখন আব্বাসীয় নারীদের দাসী বানিয়েছিল বা বসরার সম্ভ্রান্তদের হত্যা করেছিল, তখন তারা আসলে সেই সম্মান ও অসম্মানের খেলাটিই খেলছিল, কেবল পক্ষ পরিবর্তন করে। এই বিদ্রোহ ছিল অস্তিত্বহীন মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণের এক রক্তাক্ত দলিল।
জেমস সি. স্কট ও প্রতিরোধের শিল্পকলা: প্রচ্ছন্ন পাণ্ডুলিপি
জাঞ্জ বিদ্রোহের প্রাথমিক পর্যায় এবং এর গেরিলা কৌশলগুলো বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিক জেমস সি. স্কট (James C. Scott)-এর তত্ত্বগুলো অত্যন্ত কার্যকর। তার বিখ্যাত বই ওয়েপনস অফ দ্য উইক (Weapons of the Weak)-এ তিনি দেখিয়েছেন যে, নিম্নবর্গের মানুষ সব সময় সরাসরি বিদ্রোহ করে না। তারা প্রথমে ছোটখাটো প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে, যাকে তিনি বলেন ইনফ্রা-পলিটিক্স (Infra-politics)। বাতিহার লোনাজলে কাজ করার সময় জাঞ্জরা হয়তো প্রথমে কাজে ফাঁকি দিত, যন্ত্রপাতি নষ্ট করত, বা মনিবদের আড়ালে ব্যঙ্গ করত। স্কট একে বলেছেন গোপন পাণ্ডুলিপি (Hidden Transcript)। আলী ইবনে মুহাম্মদ যখন তাদের সামনে এসে বিদ্রোহের ডাক দিলেন, তখন সেই গোপন পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ্য পাণ্ডুলিপি (Public Transcript)-এ রূপান্তরিত হলো।
স্কটের তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কেন জাঞ্জরা জলাভূমির পরিবেশকে এত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পেরেছিল। তিনি তার আরেকটি বই দ্য আর্ট অফ নট বিইং গভার্নড (The Art of Not Being Governed)-এ দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে থাকা মানুষরা (যেমন জোমিয়ার পাহাড়ি জনগণ বা এক্ষেত্রে বাতিহার জলাভূমির দাসরা) কীভাবে ভৌগোলিক দুর্গমতাকে নিজেদের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করে। জাঞ্জরা বাতিহার জলাভূমিকে ব্যবহার করেছিল আব্বাসীয় রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে পালিয়ে থাকার একটি ‘নন-স্টেট স্পেস’ বা রাষ্ট্রহীন অঞ্চল হিসেবে। আল-মুখতারা শহরটি ছিল স্কটের ভাষায় একটি পলায়নবাদী কৃষি সমাজ (Escape Agriculture Society), যেখানে রাষ্ট্রের কর এবং দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ বাঁচতে চেয়েছিল। স্কটের তত্ত্ব অনুযায়ী, জাঞ্জ বিদ্রোহ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল দৈনন্দিন প্রতিরোধের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ।
ফ্রান্তজ ফানো ও সহিংসতার মনস্তত্ত্ব: কলোনিয়াল ট্রমা
জাঞ্জ বিদ্রোহের নৃশংসতা এবং বসরার গণহত্যাকে ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের তাকাতে হবে উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ফ্রান্তজ ফানো (Frantz Fanon)-এর দিকে। তার গ্রন্থ দ্য রেচেড অফ দ্য আর্থ (The Wretched of the Earth)-এ তিনি দেখিয়েছেন যে, দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শোষণ এবং বিমানবিকীকরণের শিকার মানুষেরা যখন বিদ্রোহ করে, তখন তাদের সহিংসতা হয় তীব্র এবং সর্বগ্রাসী। ফানোর মতে, এই সহিংসতা কেবল ধ্বংসাত্মক নয়, এটি এক ধরণের ক্যাথারসিস (Catharsis) বা মনস্তাত্ত্বিক পরিশুদ্ধি। জাঞ্জরা যখন তাদের মনিবদের হত্যা করছিল বা শহর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, ফানোর তত্ত্ব অনুযায়ী, তারা এর মাধ্যমে নিজেদের হীনম্মন্যতা এবং ভয়ের শিকল ভাঙছিল।
ফানো বলেন, ঔপনিবেশিক শক্তি (এক্ষেত্রে আব্বাসীয় অভিজাতরা) শোষিতদের (জাঞ্জদের) মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয় যে তারা মানুষ নয়, পশু। মুক্তির জন্য শোষিতদের এই বিশ্বাস ভাঙতে হয়, আর সেটার জন্য অনেক সময় চরম সহিংসতার প্রয়োজন হয়। জাঞ্জদের কাছে সহিংসতা ছিল নিজেদের মানুষ হিসেবে দাবি করার একটি ভাষা। আলী ইবনে মুহাম্মদ তাদের শিখিয়েছিলেন যে, মনিবদের রক্ত ঝরানো পাপ নয়, বরং এটি তাদের পবিত্র দায়িত্ব। ফানোর বি-ঔপনিবেশিকীকরণ (Decolonization)-এর ধারণাটি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহার করা যায় – জাঞ্জরা তাদের মন থেকে দাসত্বের উপনিবেশ উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিল। তবে ফানো এও সতর্ক করেছিলেন যে, এই সহিংসতা যদি সঠিক রাজনৈতিক দর্শনে পরিচালিত না হয়, তবে তা নিজের সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে। আল-মুখতারার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ফানোর এই সতর্কবাণীরই প্রতিফলন।
এডওয়ার্ড সাঈদ ও ওরিয়েন্টালিজম: ইতিহাসের বয়ান
জাঞ্জ বিদ্রোহের ইতিহাস আমরা মূলত জানি আব্বাসীয় দরবারের ঐতিহাসিকদের (যেমন আল-তাবারি) লেখা থেকে। আধুনিক যুগে এই ইতিহাস পাঠের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে সাহায্য করে এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said)-এর ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) তত্ত্ব। যদিও সাঈদ মূলত পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু তার তত্ত্বের মূল কথা হলো – যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা ‘অপর’ বা দ্য আদার (The Other)-কে কীভাবে চিত্রিত করে। আব্বাসীয় ঐতিহাসিকরা জাঞ্জদের সব সময় ‘বর্বর’, ‘কালো’, ‘অসভ্য’ এবং ‘শয়তানের দোসর’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তারা বিদ্রোহের রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণগুলোকে অবজ্ঞা করে একে কেবল বিশৃঙ্খলা বা ‘ফিতনা’ হিসেবে দেখিয়েছেন।
সাঈদের তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, ঐতিহাসিক টেক্সটগুলো নিরপেক্ষ নয়। আল-তাবারির বর্ণনায় জাঞ্জদের নৃশংসতার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা হয়তো আব্বাসীয়দের নিজেদের নৃশংসতাকে ঢাকার জন্য অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সাঈদের লেন্স দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, জাঞ্জ বিদ্রোহের প্রচলিত ইতিহাস হলো বিজয়ী ও অভিজাত শ্রেণির তৈরি করা একটি আধিপত্যবাদী বয়ান (Hegemonic Narrative)। এখানে জাঞ্জদের কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত। তারা কেন বিদ্রোহ করেছিল, তাদের আশা কী ছিল – তা তাদের জবানিতে লেখা হয়নি। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা (Epistemic Violence)-এর বিষয়টি সাঈদের তত্ত্বের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রণজিৎ গুহ ও গায়ত্রী স্পিভাক: সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ ও নিম্নবর্গের ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশের সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ (Subaltern Studies) গোষ্ঠীর তাত্ত্বিকরা, বিশেষ করে রণজিৎ গুহ (Ranajit Guha) এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (Gayatri Chakravorty Spivak)-এর কাজ জাঞ্জ বিদ্রোহ বিশ্লেষণের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রণজিৎ গুহ তার এলিমেন্টারি আসপেক্টস অফ পিজ্যান্ট ইনসার্জেন্সি (Elementary Aspects of Peasant Insurgency) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, নিম্নবর্গের বিদ্রোহকে সব সময় ‘প্রাক-রাজনৈতিক’ বা স্বতঃস্ফূর্ত বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখা হয়, যা ভুল। জাঞ্জ বিদ্রোহ কোনো পরিকল্পনাহীন দাঙ্গা ছিল না; গুহর তত্ত্ব অনুযায়ী এর নিজস্ব একটি বিদ্রোহের ব্যাকরণ (Grammar of Rebellion) ছিল। তারা তাদের নিজস্ব প্রতীক, নিজস্ব ভাষা এবং নিজস্ব নেতৃত্বের কাঠামো তৈরি করেছিল। তারা আব্বাসীয়দের অনুকরণ করেনি, বরং তাদের পাল্টা একটি সত্তা তৈরি করেছিল।
অন্যদিকে, গায়ত্রী স্পিভাক তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক? (Can the Subaltern Speak?)-এ যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা জাঞ্জদের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য। ইতিহাসের পাতায় জাঞ্জরা কি কথা বলতে পেরেছে? উত্তর হলো, না। তাদের হয়ে কথা বলেছেন আলী ইবনে মুহাম্মদ (যিনি নিজে অভিজাত শ্রেণির কাছাকাছি ছিলেন) অথবা তাদের শত্রুরা। সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গের মানুষদের নিজস্ব কোনো কণ্ঠস্বর ইতিহাসে থাকে না। আমরা যা জানি, তা হলো তাদের সম্পর্কে অন্যদের ধারণা। স্পিভাকের তত্ত্ব অনুযায়ী, জাঞ্জ বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব, কারণ তাদের কণ্ঠস্বর ইতিহাসের কোলাহলে এবং আব্বাসীয়দের বিজয়ের উল্লাসে হারিয়ে গেছে। আমরা কেবল তাদের ছায়া দেখতে পাই, তাদের আসল অবয়ব দেখি না।
মিশেল ফুকো ও বায়োপলিটিক্স: শরীরের রাজনীতি
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (Michel Foucault)-এর বায়োপলিটিক্স (Biopolitics) এবং শাস্তিমূলক ক্ষমতা (Disciplinary Power)-এর ধারণা জাঞ্জ বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট বুঝতে সাহায্য করে। আব্বাসীয়রা বাতিহাতে যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তা ছিল ফোকাল্ডিয়ান অর্থে মানুষের শরীরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। হাজার হাজার দাসকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে এনে, তাদের সময়, শ্রম এবং জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল বায়োপলিটিক্সের এক আদি রূপ। এখানে মানুষের শরীরকে কেবল একটি উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে দেখা হতো।
জাঞ্জ বিদ্রোহ ছিল এই বায়োপলিটিক্যাল নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে শরীরের বিদ্রোহ। ফুকো তার ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ (Discipline and Punish) বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতা যেখানে প্রযুক্ত হয়, প্রতিরোধও সেখানেই জন্ম নেয়। আব্বাসীয়রা যখন দাসদের শরীরে চাবুকের দাগ দিচ্ছিল, তখন তারা অজান্তেই সেই শরীরগুলোকে প্রতিরোধের আধারে পরিণত করছিল। আল-মুওয়াফফাক যখন বিদ্রোহ দমনের পর হাজার হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করে, তখন তিনি ফুকোর বর্ণিত সার্বভৌম ক্ষমতা (Sovereign Power)-এর সেই আদিম রূপটি প্রদর্শন করছিলেন – যেখানে শাসকের ক্ষমতা প্রদর্শিত হয় মৃত্যু ঘটানোর অধিকারের মাধ্যমে।
তত্ত্বের আয়নায় ইতিহাসের প্রতিবিম্ব
পরিশেষে বলা যায়, জাঞ্জ বিদ্রোহকে বোঝার জন্য এই তাত্ত্বিক লেন্সগুলো অপরিহার্য। ইবনে খালদুন আমাদের শেখান রাষ্ট্র ও গোত্রীয় সংহতির দ্বন্দ্বে কীভাবে সাম্রাজ্য ভাঙে। কার্ল মার্কস দেখান অর্থনীতির চাকা কীভাবে শ্রেণি সংগ্রামকে অনিবার্য করে তোলে। অরলান্ডো প্যাটারসন এবং ফ্রান্তজ ফানো আমাদের নিয়ে যান দাসদের মনোজগতে, যেখানে সামাজিক মৃত্যু এবং সহিংসতার মাধ্যমে তারা অস্তিত্ব খোঁজে। জেমস স্কট, রণজিৎ গুহ এবং গায়ত্রী স্পিভাক আমাদের শেখান কীভাবে নিম্নবর্গের নীরব প্রতিরোধ এবং তাদের হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরকে ইতিহাসের পাতা থেকে উদ্ধার করতে হয়। এই তত্ত্বগুলো কোনোটিই এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিন্তু সবগুলোকে একসাথে করলে আমরা বাতিহার লোনাজলে ঘটে যাওয়া সেই মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাই। জাঞ্জ বিদ্রোহ কেবল অতীতের একটি ঘটনা নয়; এটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মানবিক মুক্তি এবং শোষণের এক শাশ্বত পাঠশালা, যা যুগে যুগে তাত্ত্বিকদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
উপসংহার: লোনাজলে মিশে থাকা কালের প্রতিধ্বনি
আজ যদি আপনি দক্ষিণ ইরাকের সেই বাতিহা অঞ্চলের জলাভূমিতে যান, হয়তো খালি চোখে বিদ্রোহের কোনো চিহ্নই দেখতে পাবেন না। নলখাগড়ার বন আগের মতোই বাতাসে দোল খাচ্ছে, জেলেরা শান্ত মনে মাছ ধরছে, আর দজলা-ফোরাতের জল অবিরাম বয়ে চলছে সাগরের পানে। লবণের সেই অভিশপ্ত খনিগুলো হয়তো এখন আর নেই, অথবা থাকলেও সেখানে আর সেই চাবুকের সপাং সপাং শব্দ কিংবা শিকলের ঝনঝনানি শোনা যায় না। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে মানুষের তৈরি করা ক্ষতগুলো ঢেকে দিয়েছে সবুজ ঘাস আর কাদার আস্তরণে। কিন্তু আপনি যদি একটু কান পাতেন, মনের চোখ দিয়ে দেখেন, তবে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে কি সেই হাজার বছর আগের হাহাকার শুনতে পাবেন না? সেই বাতাস কি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে না লাখো মানুষের আর্তনাদ আর মুক্তির গান?
জাঞ্জ বিদ্রোহের চূড়ান্ত পরিণতি হয়তো পরাজয় ছিল, কিন্তু এর শিক্ষা ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যে কত তীব্র হতে পারে, এই বিদ্রোহ তার এক জ্বলন্ত দলিল। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিকল যত শক্তই হোক, যত ভারীই হোক – মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। মানুষ ক্ষুধা সহ্য করতে পারে, কিন্তু অপমান আর অমানবিকতা অনন্তকাল সহ্য করতে পারে না। যখন তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, যখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন সে আর ফলাফলের পরোয়া করে না; তখন মৃত্যুভয় তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায় আত্মমর্যাদার কাছে।
একইসাথে, এই ইতিহাস আমাদের এও মনে করিয়ে দেয়, ক্ষমতা বড়ই পিচ্ছিল আর মরীচিকার মতো। যারা ক্ষমতার মিনার শীর্ষে বসে থাকে, তারা নিচের মানুষদের দেখতে পায় না, বা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। তাদের এই ঔদ্ধত্য আর অন্ধত্বই শেষ পর্যন্ত তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আব্বাসীয়রা ভেবেছিল তাদের সাম্রাজ্য চিরস্থায়ী, কিন্তু লোনাজলের কাদা থেকে উঠে আসা মানুষেরাই তাদের সেই ভুল ভেঙে দিয়েছিল।
সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, ইতিহাস কেবল অতীতের গল্প নয়, এটি বর্তমানের দর্পণও। এই যে আমরা একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক সভ্যতায় বসে আছি, আমাদের এই আরাম-আয়েশ, প্রযুক্তি আর উন্নয়নের নিচেও হয়তো কোথাও কোনো আধুনিক ‘জাঞ্জ’ শ্রেণি চাপা পড়ে আছে। আমরা তাদের দেখতে পাই না, বা সুবিধাবাদিতার কারণে দেখতে চাই না। তারা হয়তো লবণের খনিতে নেই, কিন্তু তারা আছে কারখানায়, খামারে কিংবা ইটভাটায়। ইতিহাস বারবার ফিরে আসে, কেবল কুশীলবদের নাম, স্থান আর পোশাক বদলায়। জাঞ্জ বিদ্রোহের সেই রক্তমাখা অধ্যায় তাই কেবল অতীতের একটি মৃত ঘটনা নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা। নীরবতারও ভাষা আছে, অন্ধকারেরও গল্প আছে – সেই গল্প শোনার এবং বোঝার ধৈর্য ও মানবিকতা আমাদের থাকা উচিত। বাতিহার লোনাজল শুকিয়ে গেছে বহুদিন, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সেই রক্তের দাগ আজও শুকায়নি। হয়তো কোনো এক অলস বিকেলে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে গিয়ে কেউ একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, আর ভাববে সেই নাম না জানা মানুষগুলোর কথা, যারা লবণের বিনিময়ে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছিল – তারাও মানুষ, পণ্য নয়।
তথ্যসূত্র
- Bonner, M. (2010). Jihad in Islamic History: Doctrines and Practice. Princeton University Press.
- Christides, V. (1993). Naval Warfare in the Eastern Mediterranean (6th–14th Centuries). The Institute for Neohellenic Research.
- Davis, D. B. (2006). Inhuman Bondage: The Rise and Fall of Slavery in the New World. Oxford University Press.
- Donner, F. M. (1998). Narratives of Islamic Origins: The Beginnings of Islamic Historical Writing. Darwin Press.
- Fanon, F. (1963). The Wretched of the Earth. Grove Press.
- Gordon, M. S. (2001). The Breaking of a Thousand Swords: A History of the Turkish Military of Samarra (A.H. 200–275/815–889 C.E.). State University of New York Press.
- Guha, R. (1983). Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India. Oxford University Press.
- Hitti, P. K. (2002). History of the Arabs. Palgrave Macmillan.
- Ibn Khaldun. (1967). The Muqaddimah: An Introduction to History. (F. Rosenthal, Trans.). Princeton University Press.
- Kennedy, H. (2001). The Armies of the Caliphs: Military and Society in the Early Islamic State. Routledge.
- Kennedy, H. (2004). The Prophet and the Age of the Caliphates: The Islamic Near East from the 6th to the 11th Century. Pearson Longman.
- Lapidus, I. M. (2014). A History of Islamic Societies. Cambridge University Press.
- Lewis, B. (1990). Race and Slavery in the Middle East: An Historical Enquiry. Oxford University Press.
- Marx, K. (1964). Pre-Capitalist Economic Formations. International Publishers.
- Nöldeke, T. (1892). Sketches from Eastern History. (J. S. Black, Trans.). Adam and Charles Black.
- Pareto, V. (1935). The Mind and Society. Harcourt, Brace.
- Patterson, O. (1982). Slavery and Social Death: A Comparative Study. Harvard University Press.
- Pipes, D. (1981). Slave Soldiers and Islam: The Genesis of a Military System. Yale University Press.
- Popovic, A. (1999). The Revolt of African Slaves in Iraq in the 3rd/9th Century. Markus Wiener Publishers.
- Said, E. W. (1978). Orientalism. Pantheon Books.
- Scott, J. C. (1985). Weapons of the Weak: Everyday Forms of Peasant Resistance. Yale University Press.
- Scott, J. C. (1990). Domination and the Arts of Resistance: Hidden Transcripts. Yale University Press.
- Scott, J. C. (2009). The Art of Not Being Governed: An Anarchist History of Upland Southeast Asia. Yale University Press.
- Shaban, M. A. (1976). Islamic History: A New Interpretation (Vol. 2). Cambridge University Press.
- Shatzmiller, M. (1994). Labour in the Medieval Islamic World. Brill.
- Sourdel, D. (1970). The Abbasid Caliphate. In The Cambridge History of Islam (Vol. 1A). Cambridge University Press.
- Spivak, G. C. (1988). Can the Subaltern Speak?. In C. Nelson & L. Grossberg (Eds.), Marxism and the Interpretation of Culture. University of Illinois Press.
- Tabari, A. (1992). The History of al-Tabari Vol. 36: The Revolt of the Zanj. (D. Waines, Trans.). SUNY Press.
- Talhami, G. H. (1977). The Zanj Rebellion Reconsidered. The International Journal of African Historical Studies, 10(3), 443–461.
- Talib, Y. (1981). The Zanj Rebellion. In The General History of Africa (Vol. 3). UNESCO.
- Tolan, J. (2013). Europe and the Islamic World: A History. Princeton University Press.
- Wickham, C. (2009). The Inheritance of Rome: A History of Europe from 400 to 1000. Penguin Books.
- Wittfogel, K. A. (1957). Oriental Despotism: A Comparative Study of Total Power. Yale University Press.
- Zanjani, M. (1998). The Rise of the Zanj: A Study in Black Slave Rebellion. Mage Publishers.

