সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra): ইতিহাসের ধুলো, ক্ষমতার নগ্ন খেলা আর এক মৃত্যু উপত্যকা
Table of Contents
- 1 ভূমিকা: আনন্দ যখন আতঙ্কে রূপ নেয়
- 2 পটভূমি: বাগদাদ থেকে পলায়ন এবং বাঘের পিঠে সওয়ার
- 3 খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল: অরাজকতার বীজ বপন
- 4 সেই অভিশপ্ত রাত: রক্তে ভেজা প্রাসাদ
- 5 প্রথম পুতুল: আল-মুনতাসির (৮৬১-৮৬২)
- 6 দ্বিতীয় অঙ্ক: আল-মুস্তাইন এবং গৃহযুদ্ধের দাবানল
- 7 তৃতীয় অঙ্ক: আল-মু’তাজ – সবচেয়ে কনিষ্ঠ, সবচেয়ে হতভাগ্য
- 8 চতুর্থ অঙ্ক: আল-মুহতাদির সংস্কারের ব্যর্থ চেষ্টা
- 9 অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়: সাম্রাজ্যের ধসে পড়া
- 10 অরাজকতার সমাপ্তি: মুসা ইবনে বুগা এবং আল-মুওয়াফফাক
- 11 ক্ষমতার কাঠামো এবং তুর্কি গার্ডদের মনস্তত্ত্ব
- 12 সামারার নৈরাজ্যের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
- 13 সামারার নৈরাজ্য: তাত্ত্বিকদের চোখে
- 13.1 ইবনে খালদুন এবং ‘আসাবিয়াহ’-র পতন
- 13.2 ম্যাক্স ভেবার এবং কর্তৃত্বের সংকট
- 13.3 ম্যাকিয়াভেলি এবং ক্ষমতার নির্মম পাঠ
- 13.4 কার্ল মার্ক্স এবং শ্রেণি ও শোষণের দ্বন্দ্ব
- 13.5 রবার্ট রোটবার্গ এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের তত্ত্ব (Robert Rotberg and the Theory of State Failure)
- 13.6 স্যামুয়েল হান্টিংটন এবং সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক (Samuel Huntington and Civil-Military Relations)
- 13.7 ডগলাস নর্থ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির পাঠ (Douglass North and the Lessons of Institutional Economics)
- 13.8 উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব এবং পরিচয়ের রাজনীতি (Post-Colonial Theory and the Politics of Identity)
- 14 উপসংহার: ইতিহাসের আয়নায় সামারা
- 15 তথ্যসূত্র
ভূমিকা: আনন্দ যখন আতঙ্কে রূপ নেয়
ইতিহাস বড়ই অদ্ভুত এক গোলকধাঁধা। এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে মানুষের চরম বুদ্ধিমত্তার ছাপ, আবার ঠিক তার পাশেই লেপ্টে আছে বোকামি, লোভ আর নিষ্ঠুরতার জঘন্য সব দলিল। আমরা যখন অতীত নিয়ে কথা বলি, তখন প্রায়শই রাজরাজড়াদের শৌর্যবীর্যের গল্প করি। সোনালী দিনগুলোর কথা বলি। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠটা বড় অন্ধকার। আব্বাসীয় খিলাফতের (Abbasid Caliphate) ইতিহাসে নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এমন এক অন্ধকার নেমে এসেছিল, যা সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড গুঁড়ো করে দিয়েছিল। সময়টা খুব বেশি দীর্ঘ নয়, ৮৬১ থেকে ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ – মহামহিম মহাকালের হিসেবে এই নয় বছর হয়তো চোখের পলক ফেলার মতো সময়। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে টাইগ্রিস নদীর তীরের এক চকচকে শহরে যা ঘটেছিল, ঐতিহাসিকরা তার নাম দিয়েছেন ‘সামারার নৈরাজ্য’ (Anarchy at Samarra)।
শহরটার নাম ছিল ‘সুররা মান রা’আ’ (Surra Man Ra’a)। আরবি এই বাক্যাংশের কাব্যিক অর্থ হলো – ‘যে দেখল সে-ই আনন্দিত হলো’। কী দারুণ নাম, তাই না? নাম শুনে মনে হয় স্বর্গের কোনো টুকরো। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যে শহর তৈরি হয়েছিল আনন্দ দেওয়ার জন্য, শান্তি আর নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে, সেটাই পরিণত হলো ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা আর রক্তের এক ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে। এই নয় বছরে চারজন খলিফা সিংহাসনে বসেছেন, আর তাদের প্রত্যেককেই হয় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, নয়তো অপমানিত করে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তাদের জীবন ছিল পুতুলনাচের মতো, সুতো ছিল অন্যদের হাতে।
এই গল্পটা কোনো অলৌকিক বা দৈব ঘটনার নয়। এখানে কোনো অদৃশ্য শক্তি কলকাঠি নাড়েনি। যা ঘটেছে, তা বিশুদ্ধ রাজনৈতিক স্বার্থপরতা, সামরিক বাহিনীর লাগামহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর শাসকদের অযোগ্যতার ফল। মানুষ যখন ক্ষমতার জন্য অন্ধ হয়ে যায়, তখন সে নিজের জন্মদাতা পিতাকে হত্যা করতেও দুবার ভাবে না। আবার সেই পিতৃহন্তারক ছেলেও শান্তিতে এক দণ্ড ঘুমাতে পারে না। এক অদ্ভুত বিষাক্ত চক্র। ক্ষমতার এই চক্রে একবার ঢুকলে বের হওয়ার আর কোনো পথ থাকে না, একমাত্র মৃত্যুই সেখান থেকে ছুটি দিতে পারে।
এই দীর্ঘ আলোচনায় আমরা সেই সময়টার ধুলোবালি মাখা রাস্তায় হাঁটব। দেখব কীভাবে প্রবল প্রতাপশালী তুর্কি গার্ডরা (Turkish Guard) বিশাল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের খলিফাদের হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলেছিল। কীভাবে এক সময়ের বিশ্বসেরা সাম্রাজ্য ভেতর থেকে উইপোকার মতো খেয়ে ফেলা হলো। পাঠকের সুবিধার্থে বলে রাখি, এটি কোনো ধর্মীয় আখ্যান নয়, এটি একটি নিখাদ পলিটিক্যাল থ্রিলার (Political Thriller), যেখানে মানবিক ট্র্যাজেডি আর ক্ষমতার লোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এখানে নায়ক নেই, সবাই খলনায়ক, অথবা সবাই পরিস্থিতির শিকার। আসুন, ইতিহাসের সেই ধুলো পড়া পাতাগুলো একটু ঝেড়েপুছে দেখা যাক (Gordon, 2001)।
পটভূমি: বাগদাদ থেকে পলায়ন এবং বাঘের পিঠে সওয়ার
ইতিহাসের এক অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক এবং একই সাথে করুণ অধ্যায়ের দিকে আমরা তাকাতে যাচ্ছি। গল্পের শুরুটা এই নৈরাজ্যের বা সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra)-এর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে, যখন খলিফা আল-মু’তাসিম (Al-Mu’tasim) ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন। হারুনুর রশিদের নাম তো সবাই জানেন, আরব্য রজনী (The Arabian Nights) বা আলফ লায়লা ওয়া লায়লার গল্পের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী খলিফা। আল-মু’তাসিম ছিলেন তারই সন্তান। কিন্তু বাবার মতো মসনদ পেলেও, সেই মসনদের নিচের মাটি যে কতটা নড়বড়ে ছিল, তা তিনি হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছিলেন। খলিফা হওয়ার পরপরই তিনি এক অদ্ভুত অস্তিত্বসংকটে বা এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস (Existential Crisis)-এ পড়লেন। তিনি দেখলেন, তার চারপাশের আরব গোত্রগুলোর ওপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। আরবরা তখন বড্ড বেশি রাজনীতি সচেতন এবং নিজেদের গোত্রীয় স্বার্থ (Tribal Interest) নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, খলিফার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন তাদের ধাতে সইছিল না। তারা প্রশ্ন করতে শিখেছে, তারা দাবি করতে শিখেছে – যা একজন স্বৈরাচারী শাসকের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। অন্যদিকে আব্বাসীয় প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া পারসিক বা ইরানি আমলা ও খোরাসানি সৈন্যদের প্রভাবও তিনি কমাতে চাইছিলেন। এই খোরাসানিরা একসময় আব্বাসীয় বিপ্লবে সাহায্য করেছিল ঠিকই, কিন্তু এখন তারা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব চাইছিল। খলিফা ভাবলেন, আমার এমন একদল সৈন্য দরকার, যারা হবে আক্ষরিক অর্থেই আমার ‘নিজস্ব’। যাদের কোনো পিছুটান থাকবে না, যাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন বা শ্বশুরবাড়ি এই বাগদাদে থাকবে না, যারা স্থানীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝবে না, যারা চিনবে শুধু তাদের প্রভুকে। এই ধারণাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পেট্রিমনিয়ালিজম (Patrimonialism) বা পৈতৃক শাসনব্যবস্থার এক চরম রূপ, যেখানে শাসক রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে চান।
এই ভাবনা থেকেই তিনি দৃষ্টি ফেরালেন সুদূর উত্তরের দিকে, মধ্য এশিয়ার রুক্ষ স্টেপ অঞ্চলের দিকে। সেখান থেকে তিনি তুর্কি দাসদের কিনে আনতে শুরু করলেন। এদের বলা হতো গিলমান (Ghilman) বা বহুবচনে মামলুক (Mamluks)। ইতিহাসের পাতায় এই মামলুক ফেনোমেনন (Mamluk Phenomenon) এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। এরা ছিল জন্মগতভাবে যোদ্ধা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তীব্র গতিতে ছুটতে ছুটতে নিখুঁত নিশানায় তীর চালানোয় এদের জুড়ি মেলা ভার। শারীরিকভাবে এরা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, কষ্টসহিষ্ণু এবং আবেগের দিক থেকে কিছুটা নিরাবেগ। আল-মু’তাসিম এদের ছোটবেলা থেকে বা কৈশোর থেকে দাস হিসেবে কিনে আনতেন। তারপর তাদের কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণে গড়ে তুলতেন। এই প্রশিক্ষণের মূল মন্ত্রই ছিল খলিফার প্রতি অন্ধ আনুগত্য। খলিফা ভাবলেন, এরা যেহেতু বিদেশি, এদের ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা এবং এরা দাস, তাই এরা একমাত্র খলিফার অনুগত থাকবে। এই সমাজে এদের কোনো শেকড় নেই, তাই ডালপালা মেলার সুযোগও নেই। তিনি তাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করলেন এবং নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করলেন। তাদের পরিয়ে দিলেন দামী সব পোশাক, হাতে তুলে দিলেন সেরা সব অস্ত্র। কিন্তু তিনি একটা জিনিস বুঝতে ভুল করেছিলেন, যা ইতিহাসের সব স্বৈরাচারী শাসকরাই ভুল করেন। বাঘের পিঠে চড়া খুব সহজ, কিন্তু বাঘের পিঠ থেকে নামাটা অসম্ভব কঠিন। তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য যে প্রাইটোরিয়ান গার্ড (Praetorian Guard) বা ব্যক্তিগত রক্ষীবাহিনী তৈরি করলেন, তারাই যে একদিন ভক্ষক হয়ে দাঁড়াবে, তা তার সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না (Kennedy, 2004)।
বাগদাদের রাজপথ: সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতা
সমস্যা শুরু হলো বাগদাদের রাস্তায়। এই তুর্কি সৈন্যরা ছিল বেশ উগ্র এবং আদব-কায়দা বর্জিত। তারা শহরের সভ্যতার সাথে পরিচিত ছিল না। বাগদাদের সরু এবং জনাকীর্ণ রাস্তায় তারা বেপরোয়াভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে দিত। তাদের ঘোড়ার খুরের আঘাতে হয়তো কোনো বৃদ্ধের দোকান উল্টে গেল, কিংবা কোনো শিশু আহত হলো – সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তারা বাগদাদের নারীদের উত্যক্ত করত, বাজারে গিয়ে জোর করে জিনিসপত্র নিয়ে নিত। তাদের আচরণে এক ধরণের মিলিটারি অ্যারোগেন্স (Military Arrogance) বা সামরিক ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেত। বাগদাদের সাধারণ জনতা, যারা ছিল অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা এবং গর্বিত, তারা এই বর্বর আচরণ মেনে নিতে পারল না। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। প্রতিদিন দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই থাকত। সাধারণ মানুষ তুর্কিদের দেখলেই ঘৃণাভরে তাকাত, সুযোগ পেলেই পাথর ছুড়ত। এমনকি খলিফা যখন ঈদের নামাজ বা জুমার নামাজে যেতেন, তখন রাস্তার দুপাশ থেকে সাধারণ মানুষ তার তুর্কি গার্ডদের লক্ষ্য করে গালিগালাজ করত। এটি ছিল খলিফার জন্য এক চরম অপমান। তিনি বুঝতে পারলেন, তার নিজের রাজধানীতেই তিনি পরবাসী হয়ে যাচ্ছেন। তার রক্ষীবাহিনীর কারণে তিনি প্রজাদের ভালোবাসা হারিয়েছেন। এটি ছিল এক ধরণের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (Social Alienation), যা খলিফাকে তার প্রজাদের থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিচ্ছিল।
পরিস্থিতি এমন অসহনীয় পর্যায়ে গেল যে, খলিফা আল-মু’তাসিম বাধ্য হলেন রাজধানী সরাতে। ভাবুন একবার, বাগদাদ – যা ছিল সেই সময়ের বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র – সেই সোনার শহর ছেড়ে খলিফাকে পালাতে হচ্ছে কেবল তার আদরের সৈন্যদের রক্ষা করার জন্য। বাগদাদ থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার উত্তরে টাইগ্রিস নদীর তীরে এক জনমানবহীন প্রান্তরে গড়ে তোলা হলো এক নতুন ঝকঝকে শহর – সামারা। এই শহর তৈরির সিদ্ধান্তটি ছিল আব্বাসীয় ইতিহাসের এক ‘টার্নিং পয়েন্ট’। খলিফা চেয়েছিলেন এমন এক জায়গা, যেখানে তার তুর্কি সৈন্যরা থাকবে লোকালয় থেকে দূরে, তাদের নিজস্ব এক জগতে। তারা সাধারণ মানুষের সাথে মিশবে না, ফলে কোনো দাঙ্গাও হবে না। এই পরিকল্পনাকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় সেগ্রিগেশন (Segregation) বা পৃথকীকরণ বলা যেতে পারে। কিন্তু এই পৃথকীকরণ শেষ পর্যন্ত খলিফাকেই একঘরে করে ফেলল।
সুররা মান রা’আ: মরূদ্যানের মরীচিকা
সামারা ছিল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, এক অকল্পনীয় প্রজেক্ট। খলিফার আদেশে রাজকোষের মুখ খুলে দেওয়া হলো। মাইলের পর মাইল জুড়ে তৈরি হতে লাগল বিশাল সব প্রাসাদ, চওড়া রাস্তা, সুদৃশ্য বাগান, কৃত্রিম ঝরনা আর চিড়িয়াখানা। তুর্কি সৈন্যদের জন্য তৈরি হলো আলাদা আলাদা ক্যান্টনমেন্ট বা কলোনি। একেকটি তুর্কি ইউনিটের জন্য একেকটি এলাকা বরাদ্দ ছিল, যাতে তাদের মধ্যেও কোনো কোন্দল না বাঁধে। শহরের স্থাপত্য ছিল চোখ ধাঁধানো। পৃথিবী বিখ্যাত সব স্থপতি, প্রকৌশলী আর কারিগরদের ধরে আনা হলো এই শহর বানাতে। শহরের নাম দেওয়া হলো ‘সুররা মান রা’আ’ – যার অর্থ ‘যে দেখল সে-ই আনন্দিত হলো’। কিন্তু এই নামের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক গভীর বিষাদ। এই শহর সাধারণ মানুষের জন্য ছিল না, এটি ছিল একটি বিশাল সামরিক ক্যাম্প, যাকে সাজানো হয়েছিল শহরের মোড়কে।
খলিফা আল-মু’তাসিম ভাবলেন, যাক, বাঁচা গেল। বাগদাদের ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে এই নতুন শহরে তিনি নিরাপদে থাকবেন। তার তুর্কি বাহিনী তাকে ঘিরে থাকবে, কেউ তার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু আসলে সমস্যা সমাধান হলো না, বরং সমস্যাটি একটি বদ্ধ পাত্রে বা প্রেশার কুকারে (Pressure Cooker) স্থানান্তরিত হলো। বাগদাদে খলিফার একটা সুবিধা ছিল – সেখানে সাধারণ জনগণ বা সিভিলিয়ান পপুলেশন ছিল, যারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি বাফার জোন (Buffer Zone) হিসেবে কাজ করত। জনমতের একটা চাপ সেখানে ছিল। কিন্তু সামারায় খলিফা হয়ে পড়লেন তুর্কি গার্ডদের হাতে আক্ষরিক অর্থেই বন্দি। এখানে খলিফা আর তার সেনাবাহিনী মুখোমুখি। মাঝখানে কোনো দেওয়াল নেই, কোনো জনগণ নেই। খলিফা নিজেকে রক্ষা করতে চাইলেন যাদের দিয়ে, শেষমেশ তাদের হাত থেকেই বাঁচার জন্য তাকে পালাতে হলো নিজের তৈরি শহরে। আর সেই শহরই হয়ে উঠল তার এবং তার বংশধরদের জন্য সোনার খাঁচা। ঐতিহাসিকরা এই ঘটনাকে তুলনা করেন রোমান সাম্রাজ্যের প্রাইটোরিয়ান গার্ডদের সাথে, যারা সম্রাটকে রক্ষা করার বদলে সম্রাটকেই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছিল। সামারা হয়ে উঠল সেই ষড়যন্তের আঁতুড়ঘর (Sourdel, 1970)।
তুর্কি বাহিনীর গঠন ও মনস্তত্ত্ব
সামারায় এই তুর্কি বাহিনী কীভাবে সংগঠিত হতো, তা একটু গভীরভাবে দেখা দরকার। আল-মু’তাসিম কেবল দাস কিনে তাদের হাতে তরবারি ধরিয়ে দেননি, তিনি তাদের সামাজিকভাবেও একটি বিশেষ শ্রেণীতে পরিণত করেছিলেন। এই তুর্কিদের বিয়ে দেওয়া হতো তুর্কি দাসীদের সাথে। তাদের সন্তানরা আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দিত। এভাবে সামারার ভেতরেই একটি বিচ্ছিন্ন সমাজ বা এনক্লেভ (Enclave) গড়ে ওঠে। তারা আরবি শিখত ঠিকই, কিন্তু নিজেদের মধ্যে তুর্কি ভাষায় কথা বলত। তারা স্থানীয় আরব বা পারসিক সংস্কৃতির সাথে মিশত না। এই বিচ্ছিন্নতা তাদের মনে একটি উই ভার্সেস দেম (Us vs. Them) বা ‘আমরা বনাম তারা’ মনোভাব তৈরি করে। তারা মনে করত, পুরো সাম্রাজ্যে তারাই একমাত্র শক্তি, আর বাকিরা সব দুর্বল ও অকেজো। খলিফা ছিলেন তাদের কাছে কেবল বেতনের যোগানদাতা। যতদিন খলিফা তাদের পকেট ভারী রাখতেন, ততদিন তারা অনুগত। কিন্তু যেদিনই বেতনের টান পড়ত, সেদিনই তাদের আসল রূপ বেরিয়ে আসত।
তুর্কিদের এই উত্থান ছিল মধ্যযুগীয় ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক নতুন সংযোজন। এর আগে সেনাবাহিনী গঠিত হতো গোত্রীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে। কিন্তু আল-মু’তাসিম প্রবর্তন করলেন পেশাদার সেনাবাহিনী (Professional Army)। কিন্তু এই পেশাদারিত্বের সাথে যখন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মিশে গেল, তখনই তা বিষাক্ত হয়ে উঠল। সামারার বিশাল প্রাসাদগুলোতে খলিফা যখন আরাম-আয়েশে মগ্ন থাকতেন, তখন বাইরে তার জেনারেলরা ছক কষত – কীভাবে খলিফাকে আরও বেশি কোণঠাসা করা যায়। জেনারেল ওয়াসিফ, বুগা বা পরবর্তীতে বায়েকবাক – এরা কেউই জন্মগতভাবে অভিজাত ছিল না। এরা ছিল দাস। কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরে তারা হয়ে উঠল সাম্রাজ্যের আসল মালিক। তাদের এই মানসিকতা বোঝা জরুরি – একজন দাস যখন হঠাৎ করে অসীম ক্ষমতার মালিক হয়, তখন তার মধ্যে এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতা এবং একই সাথে চরম লোভ কাজ করে। তারা জানত, তাদের এই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, তাই তারা চাইত যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু লুটেপুটে নিতে। এই লুটপাটের মানসিকতাই সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra)-এর মূল চালিকাশক্তি ছিল।
অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
সামারা শহর তৈরির অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল ভয়াবহ। বাগদাদ থেকে রাজধানী সরানোর ফলে প্রশাসনিক কাজে বিশাল ব্যাঘাত ঘটে। বাগদাদের ব্যবসায়ীরা সামারায় যেতে চাইত না। ফলে সামারার বাজারগুলো চলত মূলত সৈন্যদের লুটের টাকায় বা খলিফার ভর্তুকিতে। এটি ছিল একটি পরজীবী অর্থনীতি (Parasitic Economy)। সামারা শহরটি কোনো প্রাকৃতিক বা বাণিজ্যিক কারণে গড়ে ওঠেনি, এটি গড়ে উঠেছিল কেবল একটি রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রয়োজনে। ফলে যখনই খলিফার রাজকোষে টান পড়ল, তখনই এই শহরটি একটি মৃত শহরে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে গেল। খলিফা আল-মু’তাসিম যখন এই শহর বানাচ্ছিলেন, তিনি হয়তো ভাবেননি যে এই ইমারতগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে কী পরিমাণ অর্থ লাগবে। সৈন্যদের বেতন, প্রাসাদের খরচ, দাস-দাসীদের ভরণপোষণ – সব মিলিয়ে সামারা ছিল এক সাদা হাতি।
তাছাড়া, বাগদাদ থেকে খলিফার সরে যাওয়াটা সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে ভুল বার্তা দিল। তারা ভাবল, খলিফা হয়তো বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। এই ধারণা থেকেই পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে ইরানের তাহিরিদরা (Tahirids) বাগদাদে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। খলিফা সামারায় বসে নিজেকে নিরাপদ ভাবছিলেন, কিন্তু আসলে তিনি নিজেকে মূল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক নিঃসঙ্গ দ্বীপের রাজা।
এই পটভূমিটুকু না বুঝলে আমরা সামারার পরবর্তী নয় বছরের হত্যা আর ষড়যন্ত্রের ইতিহাস বুঝতে পারব না। আল-মু’তাসিমের বাঘের পিঠে চড়ার সিদ্ধান্তটি ছিল এক ট্র্যাজিক ভুল। তিনি চেয়েছিলেন অনুগত দাস, পেলেন উচ্চাভিলাষী প্রভু। তিনি চেয়েছিলেন শান্তি, পেলেন গৃহযুদ্ধ। তিনি চেয়েছিলেন নিরাপত্তা, পেলেন এক মৃত্যু উপত্যকা। সামারার ধুলোবালি আজও সেই ভুলের সাক্ষ্য বহন করছে। ইতিহাস সাক্ষী, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তৈরি করা বাহিনী শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষমতারই টুঁটি চেপে ধরে। সামারার পতন আসলে শুরু হয়েছিল এর উত্থানের মুহূর্ত থেকেই – যেদিন প্রথম তুর্কি ঘোড়সওয়ারটি বাগদাদের রাস্তায় তার ঘোড়া ছুটিয়েছিল এবং যেদিন খলিফা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পলায়ন করার।
খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল: অরাজকতার বীজ বপন
৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ। আব্বাসীয় ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ। খলিফা আল-ওয়াথিকের মৃত্যুর পর সামারার ক্ষমতার করিডোরে তখন এক অদ্ভুত নীরবতা। পরবর্তী খলিফা কে হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো আরব অভিজাত বা রাজপরিবারের প্রবীণ সদস্যের হাতে ছিল না; উত্তরটি ছিল তুর্কি জেনারেলদের তরবারির ডগায়। তারা এমন একজনকে খুঁজছিলেন যাকে হাতের পুতুল করে রাখা যাবে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করতে পারবেন। তাদের পছন্দ গিয়ে পড়ল আল-মুতাওয়াক্কিল (Al-Mutawakkil)-এর ওপর। তিনি ছিলেন হারুনুর রশিদের নাতি এবং আল-মু’তাসিমের আরেক ছেলে। তুর্কিরা ভেবেছিল, এই বিলাসী রাজপুত্রটি হয়তো হারেম আর মদের পেয়ালাতেই ডুবে থাকবে, আর রাজ্য চালাবে তারা। কিন্তু ইতিহাসের চিত্রনাট্য সবসময় সোজা পথে চলে না। আল-মুতাওয়াক্কিল ক্ষমতায় এসেই নিজের চরিত্র বদলাতে শুরু করলেন। তিনি ছিলেন এক অত্যন্ত বর্ণিল এবং স্ববিরোধী চরিত্রের মানুষ। একদিকে তিনি ছিলেন স্থাপত্য, শিল্পকলা এবং চরম বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আসক্ত, অন্যদিকে তিনি ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির এক বড় পৃষ্ঠপোষক। তার মনস্তত্ত্ব বোঝা বড় দায়। তিনি জানতেন, তুর্কিদের বুটের তলায় তার ঘাড় আটকে আছে, তাই তিনি চেয়েছিলেন প্রজাদের সমর্থন আদায় করতে। এর জন্য তিনি তার আগের খলিফাদের অনুসৃত মুতাজিলা মতবাদ বা যুক্তিিবাদ (Rationalism) থেকে সরে এসে কট্টর সুন্নি মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিনের ধর্মীয় বিতর্ক বা ‘মিহনা’ (Inquisition) বন্ধ করে দেন, যা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। এটি ছিল তার এক ধরণের পপুলিস্ট স্ট্র্যাটেজি (Populist Strategy), যার মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীর বিপরীতে জনগণের সমর্থন বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সামারার দিগন্তজোড়া বড় বড় মসজিদ, বিশেষ করে গ্রেট মস্ক অফ সামারা (Great Mosque of Samarra) এবং এর বিখ্যাত প্যাঁচানো মিনার বা মালউইরা, যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে – এসবই ছিল তার ক্ষমতার প্রতীকী প্রকাশ। তিনি স্থাপত্য দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আল-মুতাওয়াক্কিল ছিলেন একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান শাসক, কিন্তু তার অস্থিরতা তাকে ডুবিয়েছিল। তিনি হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছিলেন যে, তার পূর্বসূরিরা তুর্কি জেনারেলদের মাথায় তুলে দিয়ে এক ঐতিহাসিক ভুল করে গেছেন। বিশেষ করে দুইজন তুর্কি জেনারেল – ওয়াসিফ (Wasif) এবং বুগা (Bugha) – তখন ছায়ার মতো খলিফাকে ঘিরে থাকত। এই দুই জেনারেলের ক্ষমতা এতটাই অসীম ছিল যে, তাদের ইশারা ছাড়া খলিফা এক গ্লাস পানিও পান করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি নিয়োগে, প্রতিটি বরখাস্তে তাদের নাক গলানো খলিফার কাছে অসহ্য ঠেকছিল। খলিফা ছিলেন নামেমাত্র শাসক, আর আসল রাষ্ট্রযন্ত্র বা ডিপ স্টেট (Deep State) নিয়ন্ত্রণ করত এই তুর্কিরা। আল-মুতাওয়াক্কিল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যদি এখনই কিছু না করেন, তবে আব্বাসীয় খিলাফত অচিরেই একটি তুর্কি সালতানাতে পরিণত হবে। এই ভয় থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সাপদের ফণা থেঁতলে দেওয়ার। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, বিষধর সাপের লেজে পা দিলে সে ছোবল মারবেই। তিনি তুর্কিদের প্রভাব কমানোর জন্য এক বহুমুখী পরিকল্পনা বা মাল্টি-প্রংড অ্যাপ্রোচ (Multi-Pronged Approach) গ্রহণ করেন, যা শেষ পর্যন্ত তার জন্যই বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়।
দামেস্ক অভিযান এবং ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা
খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল তার শাসনকালের শুরুতে এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চাইলেন রাজধানী সামারা থেকে সরিয়ে দামেস্কে নিয়ে যেতে। এই সিদ্ধান্তটি কেবল ভৌগোলিক ছিল না, এটি ছিল গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দামেস্ক ছিল উমাইয়াদের পুরনো রাজধানী, যেখানে আরব সংস্কৃতি এবং আরব গোত্রগুলোর প্রভাব তখনো প্রবল ছিল। খলিফা ভেবেছিলেন, তুর্কিদের তাদের মূল ঘাঁটি বা পাওয়ার বেস (Power Base) অর্থাৎ সামারা থেকে বের করে আনলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। দামেস্কে স্থানীয় আরবরা তুর্কিদের দাপট সহ্য করবে না, ফলে খলিফা সেখানে নতুন করে নিজের ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে পারবেন। এটি ছিল এক ধরণের জিওপলিটিক্যাল ম্যানুভারিং (Geopolitical Maneuvering)। ৮৫৮ সালে তিনি সদলবলে দামেস্কে গেলেন। কিন্তু হায়! দামেস্কের আবহাওয়া তার এবং তার সভাসদদের সহ্য হলো না। সেখানকার আর্দ্রতা এবং বাতাস তাদের অসুস্থ করে তুলল। তার চেয়ে বড় কথা, তুর্কি জেনারেলরা এই পরিবর্তনের ঘোর বিরোধিতা শুরু করল। তারা বুঝতে পারল, সামারা ছাড়লে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তাদের চাপে এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় খলিফা মাত্র দুই মাস পর আবার সামারায় ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। এই ব্যর্থতা তুর্কিদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দিল। তারা বুঝে গেল, খলিফা চাইলেই তাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। তিনি তাদের খাঁচায় বন্দি।
দামেস্ক পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর আল-মুতাওয়াক্কিল অন্য পথে হাঁটলেন। তিনি তুর্কি সেনাবাহিনীর একচেপিয়া ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি ‘কাউন্টার-ফোর্স’ বা পাল্টা শক্তি তৈরি করতে চাইলেন। তিনি উত্তর আফ্রিকা থেকে বারবার এবং আরব বংশোদ্ভূত সৈন্যদের নিয়োগ দিতে শুরু করলেন, যাদের বলা হতো ‘মাঘারিবা’ (Maghariba)। এছাড়াও তিনি ফারগানা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে অ-তুর্কি সৈন্যদের নিয়ে ‘শাকিরিয়া’ (Shakiriyya) ও ‘জুনদ’ বাহিনী গঠন করলেন। তিনি চেয়েছিলেন এই নতুন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে তুর্কিদের চেকমেট করতে। এই নীতিটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (Balance of Power) বা ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্বের সাথে মিলে যায়। খলিফা এই নতুন বাহিনীগুলোকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দিলেন, তাদের জন্য আলাদা জমি বরাদ্দ করলেন। এতে তুর্কিরা চরম ঈর্ষান্বিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা দেখল, তাদের রুটি-রুজিতে ভাগ বসাতে অন্যরা চলে এসেছে। খলিফা এখানেই থামলেন না। তিনি তুর্কি জেনারেলদের অপমান করার কৌশল নিলেন। তিনি তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিতে লাগলেন। তাদের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করলেন। বিশেষ করে ইতাহ (Itakh) নামের এক শক্তিশালী জেনারেলকে তিনি হজ্জে পাঠানোর নাম করে বাগদাদে আটকে রেখে হত্যা করান। এই ঘটনাটি ওয়াসিফ এবং বুগাকে সতর্ক করে দিল। তারা বুঝল, আজ ইতাহ গেছে, কাল তাদের পালা। খলিফা যে তাদের একে একে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষছেন, তা তাদের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। খলিফা বুঝতে পারেননি, যার হাতে নগ্ন তরবারি থাকে, তাকে অপমান করতে নেই, যদি না নিজের হাতে তার চেয়েও বড় এবং ধারালো তরবারি থাকে। তার এই অপরিণামদর্শী আচরণ তুর্কিদের কোণঠাসা বিড়ালের মতো বা কর্নারড অ্যানিমেল (Cornered Animal)-এর মতো হিংস্র করে তুলল।
পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং উত্তরাধিকারের রাজনীতি
খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের পতনের সবচেয়ে বড় কারণটি বাইরের শত্রুর চেয়ে ঘরের ভেতরের শত্রুই বেশি ত্বরান্বিত করেছিল। আর এই শত্রুতা তৈরি হয়েছিল তার নিজের ঔরসজাত সন্তানদের মধ্যে। আল-মুতাওয়াক্কিলের বড় ছেলে আল-মুনতাসির (Al-Muntasir) ছিলেন সিংহাসনের স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী। কিন্তু খলিফা তাকে পছন্দ করতেন না। তার অত্যধিক স্নেহ ছিল তার দ্বিতীয় ছেলে আল-মু’তাজ (Al-Mu’tazz)-এর প্রতি। আল-মু’তাজের মা ছিলেন কাবিহা, যিনি ছিলেন খলিফার অত্যন্ত প্রিয় উপপত্নী এবং পরবর্তীতে স্ত্রী। কাবিহার প্রভাব এবং খলিফার ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে তিনি আল-মুনতাসিরকে ডিঙিয়ে আল-মু’তাজকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে দেখতে চাইতেন। এই পারিবারিক পক্ষপাতিত্ব বা নেপোটিজম (Nepotism) রাজপরিবারের ভেতরে এক ভয়াবহ ফাটল তৈরি করে। ভরা দরবারে আল-মুনতাসিরকে অপমান করা ছিল খলিফার নিত্যদিনের বিনোদন। তিনি আল-মুনতাসিরকে ‘আল-মুস্তা’জিল’ বা ‘অধৈর্য’ বলে ডাকতেন, কারণ খলিফা মনে করতেন সে তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। এমনকি এক মদ্যপানের আসরে খলিফা তার সভাসদ ও ভাঁড়দের নির্দেশ দিয়েছিলেন আল-মুনতাসিরকে নিয়ে উপহাস করতে। খলিফার আদেশে তার এক ভাঁড় আল-মুনতাসিরের সামনে নেচে-গেয়ে তাকে অপমান করেছিল। ভাবুন একবার, একজন রাজপুত্র, যার শিরায় খলিফার রক্ত বইছে, তাকে হাজার হাজার মানুষের সামনে তার বাবার আদেশে অপমানিত হতে হচ্ছে! এই মানসিক যন্ত্রণা এবং ক্ষোভ আল-মুনতাসিরকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। এটি ছিল এক ধরণের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার (Psychological Warfare) যা বাবা তার নিজের ছেলের বিরুদ্ধে চালাচ্ছিলেন।
তুর্কি জেনারেলরা ছিল ধূর্ত শেয়ালের মতো। তারা রাজপরিবারের এই ফাটলটি নিখুঁতভাবে কাজে লাগাল। ওয়াসিফ এবং বুগা বুঝতে পারল, আল-মুতাওয়াক্কিল বেঁচে থাকলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। আবার আল-মুতাওয়াক্কিলের পর যদি তার প্রিয়পাত্র আল-মু’তাজ ক্ষমতায় আসে, তবে সেও তুর্কিদের ছেড়ে দেবে না। কারণ আল-মু’তাজ তার বাবার নীতিতেই বিশ্বাসী। তাই তুর্কিদের একমাত্র তুরুপের তাস ছিল অপমানিত এবং অবহেলিত আল-মুনতাসির। তারা আল-মুনতাসিরের কাছে গেল। তারা তার ক্ষতবিক্ষত ইগোতে সুড়সুড়ি দিল। তারা তাকে বোঝাল, “তোমার বাবা তোমাকে ঘৃণা করেন। তিনি তোমাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে তোমার ছোট ভাইকে সব দিয়ে দেবেন। আর যেদিন তোমার ভাই খলিফা হবে, সেদিনই তোমার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। তুমি কি তোমার মৃত্যু চেয়ে চেয়ে দেখবে? নাকি নিজের ভাগ্য নিজের হাতে গড়ে নেবে?” শয়তানের এই প্ররোচনা আল-মুনতাসিরের মনে গেঁথে গেল। ক্ষমতার লোভ আর প্রাণের ভয় – মানুষের আদিমতম এই দুই প্রবৃত্তি মিলে তাকে অন্ধ করে দিল। সে ভুলে গেল ইসলামের শিক্ষা, ভুলে গেল পিতা-পুত্রের পবিত্র সম্পর্ক। সে রাজি হলো তার জন্মদাতা পিতাকে খুন করতে। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কাজ করেছিল এক জটিল ম্যাকিয়াভেলিয়ান (Machiavellian) রাজনীতি, যেখানে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোনো জঘন্য পন্থা অবলম্বন করা বৈধ মনে করা হয়। তুর্কিরা তাকে প্রতিশ্রুতি দিল যে, বাবাকে সরিয়ে দিলে তারা তাকেই খলিফা বানাবে এবং তাকে পূর্ণ সমর্থন দেবে। আল-মুনতাসির তখন এতটাই কোণঠাসা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন যে, তিনি শয়তানের সাথে হাত মেলাতেও দ্বিধা করলেন না।
ষড়যন্তের চূড়ান্ত রূপ এবং হত্যা
৮৬১ সালের ডিসেম্বরের সেই অভিশপ্ত রাতটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। খলিফা তখন মহরম নামক এক প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। তুর্কি জেনারেলরা তাদের বিশ্বস্ত ঘাতক বাঘির (Baghir)-কে প্রস্তুত করে রেখেছিল। খলিফা সেদিন খুব বেশি মদ্যপান করেছিলেন। তার সাথে ছিল তার একনিষ্ঠ বন্ধু ফাতহ ইবনে খাকান। ফাতহ ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত, কিন্তু তিনি ছিলেন খলিফার প্রতি অত্যন্ত অনুগত এবং সংস্কৃতিমনা। তুর্কি জেনারেলরা জানত, ফাতহ বেঁচে থাকলে তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যেতে পারে, তাই তাকেও তাদের হিটলিস্টে রাখা হয়েছিল। রাত গভীর হলে, যখন প্রাসাদের বেশিরভাগ প্রহরী ঘুমিয়ে বা নেশায় আচ্ছন্ন, তখন আল-মুনতাসিরের ইঙ্গিতে তুর্কি ঘাতক দল খলিফার খাস কামরায় প্রবেশ করে। তাদের হাতে ছিল খোলা তরবারি। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল হয়তো সেই মুহূর্তে বুঝতেও পারেননি যে তার নিজের রক্ষীরাই আজ তার যমদূত হয়ে এসেছে। ফাতহ ইবনে খাকান খলিফাকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু পেশাদার খুনিদের সামনে তার সেই আত্মত্যাগ কেবল ইতিহাসেই জায়গা পেয়েছে, বাস্তবে খলিফাকে বাঁচাতে পারেনি। খলিফা এবং ফাতহ – দুজনকেই টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। রক্তে ভেসে যায় প্রাসাদের মেঝে।
এই হত্যাকাণ্ড কেবল একজন শাসকের মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের পবিত্রতার মৃত্যু। খলিফা যে ‘ঈশ্বরের ছায়া’ বা শ্যাডো অফ গড (Shadow of God) – এই ধর্মীয় বিশ্বাসটি সেই রাতে সামারার মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। আল-মুনতাসির তার বাবার রক্তমাখা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে খলিফা হলেন, কিন্তু তিনি আসলে হয়ে গেলেন তুর্কিদের হাতের পুতুল। তিনি বুঝতে পারেননি যে, পিতৃহত্যার পাপ তাকে কখনোই শান্তিতে থাকতে দেবে না। আর তুর্কিরা? তারা হাসল বিজয়ের হাসি। তারা প্রমাণ করল, তরবারি যার, ক্ষমতা তার। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল চেয়েছিলেন অরাজকতা থামাতে, কিন্তু তার ভুল পদক্ষেপ এবং অহংবোধ উল্টো অরাজকতার বীজ বুনে দিয়ে গেল, যা পরবর্তী নয় বছর ধরে বিষবৃক্ষ হয়ে পুরো সাম্রাজ্যকে গ্রাস করেছিল (Gordon, 2001)।
সেই অভিশপ্ত রাত: রক্তে ভেজা প্রাসাদ
৮৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের পাতায় এটি কেবল একটি সাধারণ তারিখ নয়, বরং আব্বাসীয় ইতিহাসের এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত, যেদিন বাগদাদ ও সামারার ভাগ্যাকাশে এক দীর্ঘস্থায়ী কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছিল। শীতের রাত। টাইগ্রিস নদীর হিমশীতল বাতাস সামারার প্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে হাহাকার করে ফিরছিল। এই রাতটি ছিল একাধারে উৎসবের এবং মৃত্যুর। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল তখন অবস্থান করছিলেন তার স্বপ্নের প্রাসাদ ‘আল-জাফরিয়া’ বা আল-মাচুজায়। এই প্রাসাদটি তিনি তৈরি করেছিলেন বিপুল অর্থ ব্যয় করে, নিজের নামকে চিরস্থায়ী করার এক অদম্য বাসনা থেকে। প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে ছিল কারুকার্যময় টাইলস, মেঝেতে পারস্যের দামী গালিচা, আর বাতাসে ভাসছিল সুগন্ধি এবং দামী মদের ঘ্রাণ। খলিফা তখন তার ব্যক্তিগত মহলে বা ‘মজলিস আল-শরাব’-এ মদ্যপান করছিলেন। চারদিকে গায়িকাদের সুরের মূর্ছনা, বাদ্যযন্ত্রের ঝনঝনানি আর চাটুকারদের কৃত্রিম হাসির শব্দ। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল ছিলেন একজন চরম আমোদপ্রিয় মানুষ, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি নিংড়ে উপভোগ করতে চাইতেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, এই আনন্দ-আয়োজন আসলে তার শেষকৃত্যের প্রস্তুতি। তিনি এতটাই নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলেন যে, প্রাসাদের বাইরের এবং ভেতরের থমথমে পরিস্থিতি তার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। তার চোখের সামনে তখন কেবল রঙিন পানীয় আর নর্তকীদের নৃত্যের হিল্লোল, অথচ তার পিঠের পেছনেই শান দেওয়া হচ্ছিল ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার তরবারি।
খলিফার এই ব্যক্তিগত আসরে তার সাথে ছিলেন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরামর্শদাতা এবং উজির, ফাতহ ইবনে খাকান (Fath ibn Khaqan)। ফাতহ কেবল একজন সভাসদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন খলিফার অল্টার ইগো (Alter Ego) বা দ্বিতীয় সত্তা। তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ফাতহ ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত, কবি এবং সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ছিলেন খলিফার গ্রন্থাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্গী। খলিফা এবং ফাতহ-এর সম্পর্কটি ছিল এক গভীর হোমোসোশ্যাল বন্ডিং (Homosocial Bonding)-এর উদাহরণ, যেখানে বিশ্বাস এবং নির্ভরতা ছিল প্রশ্নাতীত। তুর্কি জেনারেলরা জানত, খলিফাকে একা করা সম্ভব নয়, কারণ ফাতহ সবসময় ঢাল হয়ে তার পাশে থাকেন। তাই তাদের হত্যার তালিকায় খলিফার নামের ঠিক পাশেই ছিল ফাতহ ইবনে খাকানের নাম। রাত যত গভীর হচ্ছিল, প্রাসাদের পরিবেশ ততই ভারী হয়ে উঠছিল। প্রহরীরা, যারা ছিল মূলত তুর্কি, তারা একে একে তাদের ডিউটি পোস্ট ছেড়ে সরে যাচ্ছিল। এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। প্রাসাদের প্রধান ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে কেউ পালাতে না পারে, আবার কেউ সাহায্য করতেও না আসতে পারে। এক অদ্ভুত নির্জনতা গ্রাস করছিল আল-জাফরিয়াকে, যেন পুরো প্রকৃতি এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হওয়ার জন্য দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল।
আল-মুনতাসির: পিতৃহন্তারকের মনস্তত্ত্ব
এই হত্যাকাণ্ডের নাটকের অন্যতম কুশীলব ছিলেন খলিফার নিজের ছেলে, আল-মুনতাসির। তিনি হয়তো তখন পাশের কোনো কক্ষে বা প্রাসাদের কোনো অন্ধকার বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। তার মনের ভেতরে তখন এক তুমুল ঝড়। একদিকে পিতার প্রতি সন্তানের সহজাত ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা – যা হয়তো তখনো অবশিষ্ট ছিল – আর অন্যদিকে তুর্কি জেনারেলদের দেওয়া মৃত্যুভয় এবং ক্ষমতার অদম্য লোভ। তুর্কিরা তাকে এমন এক পরিস্থিতিতে বা ক্যাচ-২২ (Catch-22) অবস্থায় ফেলেছিল যেখান থেকে বের হওয়ার আর কোনো পথ ছিল না। তারা তাকে বুঝিয়েছিল, “তোমার বাবা আজ রাতেই তোমাকে হত্যা করার হুকুম দেবেন। তুমি কি মরবে, নাকি রাজত্ব করবে?” আল-মুনতাসিরের মনস্তত্ত্বে তখন কাজ করছিল এক গভীর প্যাট্রিসাইডাল ইম্পালস (Patricidal Impulse) বা পিতৃহত্যার তাড়না, যা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে এক জটিল মানসিক অবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। তিনি জানতেন, এই রাত পার হলে তিনি আর সাধারণ রাজপুত্র থাকবেন না; তিনি হবেন হয় লাশ, নয়তো খলিফা। তার এই সিদ্ধান্তহীনতা এবং ভীরুতাকে তুর্কিরা তাদের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তারা তাকে বানিয়েছিল তাদের রাজনৈতিক দাবা খেলার এক নগণ্য পন (Pawn) বা বোড়ে। আল-মুনতাসির তার বাবাকে ঘৃণা করতেন তার অপমানের জন্য, কিন্তু তাকে হত্যা করার সাহস তার ছিল না। সেই সাহস বা দুঃসাহস জুগিয়েছিল ওয়াসিফ এবং বুগা। তারা আল-মুনতাসিরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সুরক্ষার, কিন্তু আসলে তারা তাকে ঠেলে দিচ্ছিল এক অনন্ত নরকের দিকে।
ঘাতকদের আগমন: বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত মুহূর্ত
রাত যখন মধ্যগগনে, তখন তুর্কি ঘাতক বাহিনী তাদের পদক্ষেপ শুরু করল। তাদের নেতৃত্বে ছিল বাঘির (Baghir) নামের এক তুর্কি অফিসার, যার চোখে ছিল খুনির ঠান্ডা চাউনি। বাঘির এবং তার দল নিঃশব্দে খলিফার খাস কামরার দিকে এগিয়ে গেল। তাদের পায়ে ছিল নরম জুতোর আচ্ছাদন যাতে কোনো শব্দ না হয়, হাতে ছিল খোলা তরবারি, যা মশাল বা মোমবাতির আলোয় ঝকঝক করছিল। খলিফা তখনো নেশার ঘোরে বেসামাল। হঠাৎ করে খোলা তরবারি হাতে একদল ভিনদেশি, উগ্র চেহারার সৈন্যকে তার ব্যক্তিগত কক্ষে ঢুকতে দেখে তিনি হয়তো চমকে উঠেছিলেন। প্রথমে হয়তো ভেবেছিলেন এটি কোনো কৌতুক বা তার রক্ষীবাহিনীর কোনো মহড়া। তিনি হয়তো অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেসও করেছিলেন, “তোমরা এখানে কেন?” কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ঘাতকরা মনে করেনি। তাদের নীরবতা ছিল মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। মুহূর্তের মধ্যে উৎসবের আমেজ পাল্টে গেল আতঙ্কে। গায়িকা এবং নর্তকীরা ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কেউ কেউ জ্ঞান হারাল, কেউবা কোণায় লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে একজন মানুষ স্থির ছিলেন – ফাতহ ইবনে খাকান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তিনি জানতেন, নিরস্ত্র অবস্থায় এই সশস্ত্র বাহিনীর সাথে লড়াই করা অসম্ভব। তবুও তিনি পালিয়ে যাননি। তিনি জানতেন, তার বন্ধুর জীবন এখন তার হাতে। ফাতহ চিৎকার করে খলিফাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি খলিফাকে নিজের দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন, যেন নিজের শরীর দিয়ে একটি বর্ম তৈরি করবেন। তিনি ঘাতকদের উদ্দেশ্যে হয়তো বলেছিলেন, “তোমরা খলিফাকে স্পর্শ করার আগে আমাকে হত্যা করো।” এটি ছিল বন্ধুত্বের এবং আনুগত্যের এক বিরল ও ট্র্যাজিক নিদর্শন। কিন্তু রাজনীতির নির্মম খেলায় আবেগের কোনো স্থান নেই। ঘাতক বাঘির এবং তার সঙ্গীরা কোনো দ্বিধা করল না। তাদের তরবারি সজোরে নেমে এল ফাতহ-এর ওপর। প্রথমে ফাতহকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো, যাতে খলিফা তার শেষ আশ্রয়টুকুও হারান। ফাতহ-এর উষ্ণ রক্তে খলিফার রাজকীয় পোশাক ভিজে গেল। এরপর ঘাতকরা তাদের মূল লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ দিল। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল, যিনি এক সময় অর্ধ পৃথিবীর শাসক ছিলেন, তিনি এখন তার নিজের প্রাসাদের মেঝেতে এক অসহায় প্রাণী। তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। তার শরীরে এতগুলো আঘাত করা হয়েছিল যে, পরবর্তীতে তাকে শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। রক্তে ভেসে গেল প্রাসাদের দামী পারসিক গালিচা, মদের পেয়ালা উল্টে গিয়ে রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল। এই দৃশ্যটি ছিল আব্বাসীয়দের শৌর্যবীর্যের পতনের এক প্রতীকী চিত্র।
আব্বাসীয় পবিত্রতার বিনাশ ও ‘ডিভাইন রাইট’-এর পতন
এই হত্যাকাণ্ডটি কেবল একজন মানুষের মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু। ইসলামি খিলাফতের ইতিহাসে খলিফাকে মনে করা হতো ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা এবং ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তার শরীরে হাত তোলা ছিল অমার্জনীয় অপরাধ বা স্যাক্রিলেজ (Sacrilege)। এর আগে খলিফারা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছেন, বা গোপনে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু এভাবে নিজ প্রাসাদে, নিজের রক্ষীবাহিনীর হাতে প্রকাশ্যে এবং পৈশাচিক কায়দায় খলিফাকে হত্যা করার নজির ছিল না। ৮৬১ সালের এই রাতটি সেই পবিত্রতার ধারণা বা স্যাংটিটি (Sanctity)-কে চুরমার করে দিল। সাধারণ মানুষ এবং সৈন্যরা দেখল, খলিফা কোনো অলৌকিক সত্তা নন, তিনি রক্তমাংসের মানুষ এবং তাকেও জবাই করা সম্ভব। এই ঘটনাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ডিভাইন রাইট অফ কিংস (Divine Right of Kings) বা রাজাদের দৈব অধিকার তত্ত্বের ওপর এক বিশাল আঘাত। খলিফা এখন আর ঈশ্বরের ছায়া নন, তিনি এখন সেনাবাহিনীর হাতের খেলনা।
হত্যাকাণ্ডের পর আল-মুনতাসির যখন বাবার রক্তমাখা লাশের পাশে এসে দাঁড়ালেন, তার অনুভূতি কী ছিল তা ইতিহাস সঠিকভাবে বলতে পারে না। তবে অনুমান করা যায়, তিনি এক গভীর শূন্যতা অনুভব করেছিলেন। তুর্কিরা তাকে অভিনন্দন জানাল, তাকে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলে সম্বোধন করল। কিন্তু সেই সম্বোধনে সম্মানের চেয়ে ব্যঙ্গই ছিল বেশি। তারা সাথে সাথে নতুন ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করল। তারা প্রচার করল যে, খলিফা মদ্যপ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন, অথবা ফাতহ ইবনে খাকান খলিফাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এবং আল-মুনতাসির বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে ফাতহকে হত্যা করেছেন। এই মিথ্যাচার বা হিস্টোরিক্যাল রিভিজনিজম (Historical Revisionism) ছিল তাদের ক্ষমতা দখলের কৌশলের অংশ। প্রাসাদের অন্য কর্মকর্তাদের জোর করে আল-মুনতাসিরের প্রতি আনুগত্য বা বাইয়াত (Bay’ah) গ্রহণ করানো হলো। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেল না, কারণ চোখের সামনেই পড়ে ছিল খলিফা ও তার উজিরের ছিন্নভিন্ন লাশ।
এই অভিশপ্ত রাতটিই সূচনা করেছিল ‘সামারার নৈরাজ্য’-এর। এটি ছিল সেই টিপিং পয়েন্ট (Tipping Point), যেখান থেকে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য আর কখনোই পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল চেয়েছিলেন তার ক্ষমতা সুসংহত করতে, কিন্তু তার রক্ত দিয়েই লেখা হলো পতনের ইতিহাস। আল-জাফরিয়া প্রাসাদ, যা তৈরি হয়েছিল আনন্দ আর উল্লাসের জন্য, তা হয়ে রইল এক ভৌতিক স্মৃতিস্তম্ভ। শোনা যায়, আল-মুনতাসির খলিফা হওয়ার পর ওই প্রাসাদে আর থাকতে পারেননি, তিনি পুরাতন প্রাসাদে ফিরে গিয়েছিলেন। কারণ, বাবার রক্তমাখা মেঝে এবং সেই রাতের বিভীষিকা তাকে প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে বেড়াত। পাপ কখনো তার জনককে ছাড়ে না, এবং সামারার এই হত্যাকাণ্ড ছিল সেই পাপের এক মহাকাব্যিক শুরু (Kennedy, 2001; Gordon, 2001)।
প্রথম পুতুল: আল-মুনতাসির (৮৬১-৮৬২)
বাবার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে খলিফা হলেন আল-মুনতাসির। ইতিহাসের মঞ্চে তার প্রবেশটা হলো এক ট্র্যাজিক নায়কের মতো, যার হাতে বিজয়মুকুট আছে, কিন্তু সেই মুকুটে লেগে আছে নিজের জন্মদাতা পিতার তাজা রক্ত। ৮৬১ সালের সেই কালরাতের পর যখন ভোরের আলো ফুটল, তখন সামারার প্রাসাদ আর আগের মতো রইল না। আল-মুনতাসির সিংহাসনে বসলেন, তার মাথায় খলিফার পাগড়ি, কোমরে রাজকীয় তরবারি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি সফল। তিনি তার বাবাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছেন, যেমনটা ইতিহাসের অনেক উচ্চাভিলাষী রাজপুত্র করে থাকেন। কিন্তু সিংহাসন কি ফুলের বিছানা? বিশেষ করে যখন সেই সিংহাসন কেনা হয়েছে জঘন্যতম অপরাধ বা পিতৃহত্যা (Patricide)-র বিনিময়ে? আল-মুনতাসির নামে খলিফা হলেন বটে, কিন্তু তিনি খুব দ্রুতই আবিষ্কার করলেন যে তিনি আসলে খলিফা নন, তিনি হলেন একটি দাবার বোর্ডের রাজা, যার কোনো নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। আসল চাবিকাঠি বা ডি ফ্যাক্টো পাওয়ার (De Facto Power) রইল সেই দুই তুর্কি জেনারেল – ওয়াসিফ (Wasif) এবং বুগা (Bugha)-র হাতে। তারাই এখন সব। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সামান্য দারোয়ান নিয়োগ – সবকিছুই তাদের ইশারায় হতে লাগল। আল-মুনতাসির কেবল সিলমোহর মারার যন্ত্রে পরিণত হলেন। এই পরিস্থিতিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পুতুল সরকার (Puppet Government), যেখানে শাসকের বৈধতা থাকে কিন্তু কর্তৃত্ব থাকে অন্যের হাতে। আল-মুনতাসির হয়ে উঠলেন আব্বাসীয় ইতিহাসের প্রথম পুতুল খলিফা, যার মাধ্যমে শুরু হলো এক দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক পঙ্গুত্ব।
আল-মুনতাসিরের শাসনকালকে শাসনকাল না বলে একটি দীর্ঘশ্বাস বলা যেতে পারে। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ছয় মাস, কিন্তু এই ছয় মাস ছিল তার জন্য এক অনন্ত নরকবাস। তুর্কি জেনারেলরা তাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করত না। তারা জানত, আল-মুনতাসির যদি কোনোভাবে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পান বা অনুশোচনায় ভোগেন, তবে তাদের বিপদ হতে পারে। তাই তারা তাকে ঘিরে রাখত তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে। খলিফা চাইলেই তার পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারতেন না, চাইলেই রাজকোষ থেকে অর্থ ব্যয় করতে পারতেন না। ওয়াসিফ এবং বুগা তাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতেন, “আমরাই তোমাকে এই সিংহাসনে বসিয়েছি, আমাদের কথা না শুনলে তোমার বাবার যে পরিণতি হয়েছে, তোমারও তাই হবে।” এই ধ্রুবক হুমকি বা কনস্ট্যান্ট থ্রেট (Constant Threat)-এর মধ্যে বাস করা একজন মানুষের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। আল-মুনতাসির হয়তো ভেবেছিলেন বাবাকে সরালে তিনি স্বাধীন হবেন, কিন্তু তিনি দেখলেন তিনি এক কারাগার থেকে আরেক বৃহত্তর কারাগারে প্রবেশ করেছেন। তার অবস্থা ছিল অনেকটা সেই বাঘের মতো, যার দাঁত ও নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং যাকে সার্কাসে খেলার জন্য রাখা হয়েছে। তুর্কিরা তাকে ব্যবহার করত তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য – তাদের বেতন বৃদ্ধি, তাদের আত্মীয়দের বড় বড় পদে বসানো এবং তাদের বিরোধী পক্ষকে দমন করার জন্য খলিফার সিলমোহর ব্যবহার করা হতো নির্বিচারে।
বিবেকের দংশন এবং ম্যাকবেথীয় ট্র্যাজেডি
মানসিকভাবে আল-মুনতাসির পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন। শেক্সপিয়ারের নাটক ম্যাকবেথ (Macbeth)-এ আমরা যেমন দেখি রাজা ডানকানকে হত্যা করার পর ম্যাকবেথ আর লেডি ম্যাকবেথ বিবেকের দংশনে দগ্ধ হতে থাকেন, আল-মুনতাসিরের অবস্থাও ছিল ঠিক তেমনই। শোনা যায়, তিনি রাতে ঘুমাতে পারতেন না। ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা তাকে গ্রাস করেছিল। যখনই তিনি চোখ বন্ধ করতেন, বাবার রক্তমাখা মুখ তাকে তাড়া করে বেড়াত। ফাতহ ইবনে খাকানের আর্তনাদ তার কানে বাজত। প্রাসাদের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি থাম যেন তাকে ধিক্কার দিত। বিবেকের দংশন বা গিল্ট কমপ্লেক্স (Guilt Complex) মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়। আল-মুনতাসির তার পারিষদদের কাছে প্রায়ই বলতেন যে তিনি স্বপ্নে দেখেন তার বাবা তাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। এই মানসিক অস্থিরতা তার শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। তিনি ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন, তার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছিল। তিনি মদের মধ্যে আশ্রয় খুঁজতেন, কিন্তু মদ তাকে সাময়িক বিস্মৃতি দিলেও শান্তি দিতে পারত না। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তিনি এক ঐতিহাসিক ভুল করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন ক্ষমতা, কিন্তু পেলেন আজীবন গ্লানি। তার এই মানসিক অবস্থা তুর্কিদের জন্য সুবিধাজনক ছিল না। তারা চাইছিল একজন শক্ত-সমর্থ পুতুল, যে তাদের আদেশ পালন করবে হাসিমুখে। কিন্তু আল-মুনতাসির হয়ে উঠছিলেন একজন বিষাদগ্রস্ত, অনুতপ্ত মানুষ।
আল-মুনতাসিরের এই অনুশোচনা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা জনসমক্ষেও প্রকাশ পেত। তিনি প্রায়ই জুমার নামাজে ইমামতি করার সময় কেঁদে ফেলতেন। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতেন, যদিও তিনি স্পষ্ট করে বলতেন না কেন তিনি ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু বাগদাদ ও সামারার মানুষ বোকা ছিল না। তারা জানত প্রাসাদে কী ঘটেছে। তারা জানত তাদের খলিফা তার বাবাকে খুন করেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের মনে খলিফার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা ছিল না, ছিল করুণা এবং ঘৃণা। এই জনসমর্থনহীনতা (Lack of Public Support) আল-মুনতাসিরকে আরও বেশি তুর্কিদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিল। তিনি জানতেন, তুর্কিরা হাত সরিয়ে নিলে জনতা তাকে ছিঁড়ে ফেলবে। এই পরাধীনতা এবং গ্লানির দ্বৈত চাপ তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। তিনি হয়তো মনে মনে মৃত্যুই কামনা করতেন, কারণ একমাত্র মৃত্যুই তাকে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারত।
উত্তরাধিকারের সমীকরণ এবং ভাইদের বিদায়
তুর্কি জেনারেলদের এজেন্ডা তখনও শেষ হয়নি। আল-মুনতাসিরকে খলিফা বানানো ছিল তাদের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ মাত্র। তাদের আসল ভয় ছিল আল-মুতাওয়াক্কিলের অন্য দুই ছেলে – আল-মু’তাজ (Al-Mu’tazz) এবং আল-মুওয়াইয়াদ (Al-Mu’ayyad)-কে নিয়ে। বিশেষ করে আল-মু’তাজ ছিলেন তার বাবার অত্যন্ত প্রিয় এবং ঘোষিত উত্তরাধিকারী। তুর্কিরা জানত, আল-মুনতাসিরের মৃত্যুর পর (তা স্বাভাবিক হোক বা অস্বাভাবিক) যদি আল-মু’তাজ ক্ষমতায় আসেন, তবে তিনি অবশ্যই তার বাবার হত্যার প্রতিশোধ নেবেন এবং তুর্কিদের ধ্বংস করবেন। এই ভীতি বা প্যারাভয়া (Paranoia) থেকে তুর্কিরা সিদ্ধান্ত নিল যে, উত্তরাধিকারের লাইন থেকে এই দুই ভাইকে সরাতে হবে। এবং এই জঘন্য কাজটি তারা করাল আল-মুনতাসিরকে দিয়েই। তারা খলিফাকে চাপ দিল তার ভাইদের ডেকে পাঠাতে এবং জনসমক্ষে তাদের উত্তরাধিকারের দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য করতে। এটি ছিল এক নির্মম রাজনৈতিক খেলা বা রিয়েলপলিটিক (Realpolitik), যেখানে আবেগের কোনো স্থান নেই।
আল-মুনতাসির প্রথমে রাজি হননি। তিনি তার ভাইদের ভালোবাসতেন এবং তাদের ক্ষতি করতে চাননি। কিন্তু ওয়াসিফ এবং বুগা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “হয় তুমি তোমার ভাইদের সরাবে, নয়তো আমরা তোমাদের তিন ভাইকেই সরিয়ে দেব।” প্রাণের ভয়ে আল-মুনতাসির রাজি হলেন। তিনি তার দুই ভাইকে দরবারে ডেকে পাঠালেন। সেই দৃশ্যটি ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আল-মু’তাজ এবং আল-মুওয়াইয়াদ বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা জানতেন, প্রতিবাদ করলে তাদের সেখানেই হত্যা করা হবে। তাই তারা লিখিতভাবে জানালেন যে তারা খলিফা হওয়ার অযোগ্য এবং তারা স্বেচ্ছায় উত্তরাধিকার ত্যাগ করছেন। এই স্বীকারোক্তি নেওয়ার সময় আল-মুনতাসির নাকি সিংহাসনে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন। ভাইদের জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে ক্ষমা করো, আমি নিরুপায়।” কিন্তু এই কান্না ছিল অর্থহীন। তুর্কিরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিল। তারা আব্বাসীয় রাজপরিবারের ঐক্যের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল। ভাইদের সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আল-মুনতাসির নিজেকে এবং নিজের বংশধরদের আরও বেশি অরক্ষিত করে ফেললেন। তিনি হয়ে গেলেন তুর্কিদের একমাত্র বাজি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য ক্ষমতার পথ রুদ্ধ করে তিনি তুর্কিদের ক্ষমতাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ (Institutionalization) করার সুযোগ করে দিলেন।
প্রশাসনিক স্থবিরতা এবং তুর্কি লুটপাট
আল-মুনতাসিরের ছয় মাসের শাসনামলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছিল। তুর্কি জেনারেলরা রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়ে রাজকোষ লুটের দিকেই বেশি মনোযোগী ছিল। তারা খলিফাকে দিয়ে একের পর এক ডিক্রি জারি করাত, যার মাধ্যমে তারা বিশাল বিশাল জমিদারি বা ইকতা (Iqta) দখল করে নিত। ইকতা ব্যবস্থা ছিল মূলত সামরিক কর্মকর্তাদের বেতন বা ভাতার বদলে জমির রাজস্ব ভোগ করার অধিকার দেওয়া। কিন্তু আল-মুনতাসিরের সময়ে এটি হয়ে দাঁড়াল প্রকাশ্য লুটপাট। জেনারেলরা উর্বর জমিগুলো দখল করে নিল, কৃষকদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দিল। অন্যদিকে বাগদাদের আমলাতন্ত্র, যা ছিল আব্বাসীয় শাসনের মেরুদণ্ড, তা স্থবির হয়ে পড়ল। অভিজ্ঞ পারসিক আমলারা দেখলেন যে তাদের কোনো ক্ষমতা নেই, সব ক্ষমতা অশিক্ষিত তুর্কি সৈন্যদের হাতে। ফলে তারা কাজ করা বন্ধ করে দিলেন বা কেবল নামমাত্র কাজ করতে লাগলেন। এর ফলে রাজস্ব আদায় কমে গেল, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলো। সামারার বাইরে প্রদেশগুলোতে বিদ্রোহের ধুম্রজাল দেখা দিতে লাগল। খলিফা আল-মুনতাসির এসব জানতেন, কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। তিনি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখতেন কীভাবে তার পূর্বপুরুষদের তিলে তিলে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য উইপোকার মতো খেয়ে ফেলা হচ্ছে।
তুর্কিদের এই অরাজকতা কেবল অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। তারা বাগদাদ ও সামারার বুদ্ধিজীবী, কবি ও শিল্পীদের অবজ্ঞা করত। আল-মুতাওয়াক্কিলের সময় যে সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু হয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে গেল। আল-মুনতাসির নিজেও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন, কিন্তু তার দরবারে এখন আর কবিদের আসর বসত না, বসত ষড়যন্ত্রের আসর। তুর্কি জেনারেলরা খলিফার দরবারকে পরিণত করেছিল একটি সামরিক ব্যারাকে। সেখানে শিষ্টাচারের কোনো বালাই ছিল না। জেনারেলরা খলিফার সামনেই উচ্চস্বরে কথা বলত, হাসাহাসি করত। খলিফার মর্যাদা বা ডিগনিটি (Dignity) বলতে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। এই অপমানজনক পরিস্থিতি আল-মুনতাসিরকে আরও বেশি কোণঠাসা করে ফেলেছিল। তিনি ছিলেন তার নিজের প্রাসাদে এক অবাঞ্ছিত অতিথি।
রহস্যজনক মৃত্যু: অসুস্থতা নাকি বিষ?
মাত্র ছয় মাস। হ্যাঁ, মাত্র ছয় মাস তিনি এই মানসিক ও রাজনৈতিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। ৮৬২ সালের জুন মাসে, গ্রীষ্মের এক দাবদাহের দিনে, আল-মুনতাসির হঠাৎ করেই মারা যান। তার বয়স তখন মাত্র পঁচিশ বছর। একজন যুবক মানুষ, যার কোনো দৃশ্যমান শারীরিক অসুস্থতা ছিল না, তিনি হঠাৎ করে মারা গেলেন – এটি স্বাভাবিক কোনো ঘটনা ছিল না। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো যে খলিফা হৃদরোগে বা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কেউ কেউ বলল, তিনি তার বাবার মতোই অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ঐতিহাসিকরা এবং সামারার গুঞ্জনে উঠে এল অন্য কথা। বেশিরভাগের বিশ্বাস ছিল, তুর্কিরা তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিল। কেন? কারণ আল-মুনতাসির হয়তো শেষের দিকে কিছুটা অবাধ্য হয়ে উঠছিলেন। অথবা তুর্কিরা মনে করেছিল, এই শোকগ্রস্ত এবং দুর্বল খলিফাকে দিয়ে আর কাজ হবে না। তাদের দরকার আরও কম বয়সী, আরও অনভিজ্ঞ এবং আরও নমনীয় কাউকে। অথবা তারা ভয় পাচ্ছিল যে আল-মুনতাসির হয়তো গোপনে অন্য কোনো জেনারেলের সাথে হাত মিলিয়ে ওয়াসিফ ও বুগাকে সরানোর পরিকল্পনা করছেন। এই ডিসপোজিবিলিটি (Disposability) বা যখন প্রয়োজন তখন ব্যবহার করো এবং প্রয়োজন শেষে ফেলে দাও – এটি ছিল তুর্কিদের রাজনীতির মূলনীতি।
একটি প্রচলিত গল্প আছে যে, খলিফার পিঠে ব্যথা ছিল এবং তার চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ‘হিজামা’ বা রক্তমোক্ষণ (Cupping/Bloodletting) করানো হচ্ছিল। এই কাজে ব্যবহৃত ল্যানসেট বা ছুরিতে নাকি বিষ মাখানো ছিল। সেই বিষাক্ত ছুরির ছোঁয়ায় খলিফার মৃত্যু হয়। এই কাজটি নাকি করিয়েছিলেন তুর্কি জেনারেলরা খলিফার চিকিৎসকের মাধ্যমে। ঘুষ বা ভয় দেখিয়ে চিকিৎসককে তারা তাদের দলে ভিড়িয়েছিল। আল-মুনতাসির মৃত্যুর আগে নাকি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, “আমি আমার বাবাকে হত্যা করেছি অল্প কিছুদিন বাঁচার জন্য, এখন আমাকেও যেতে হচ্ছে।” এটি ছিল এক চূড়ান্ত কাব্যিক সুবিচার বা পোয়েটিক জাস্টিস (Poetic Justice)। তার মৃত্যুতে কেউ কাঁদল না। তার কোনো জানাজা বা শোকমিছিল হলো না ধুমধাম করে। তাকে তড়িঘড়ি করে দাফন করা হলো। সামারার আকাশে কালো মেঘ আরও ঘনীভূত হলো। একটি জীবন শেষ হলো, একটি পাপের অধ্যায় শেষ হলো, কিন্তু অরাজকতা শেষ হলো না। বরং আল-মুনতাসিরের মৃত্যু অরাজকতার আগুনকে আরও উস্কে দিল। তার মৃত্যুর সাথে সাথে সামারায় ক্ষমতার লড়াই বা পাওয়ার ভ্যাকুয়াম (Power Vacuum) তৈরি হলো, যা পরবর্তী গৃহযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করল (Yücesoy, 2009; Gordon, 2001; Kennedy, 2004)।
দ্বিতীয় অঙ্ক: আল-মুস্তাইন এবং গৃহযুদ্ধের দাবানল
আল-মুনতাসিরের আকস্মিক এবং রহস্যজনক মৃত্যুর পর সামারার আকাশ থেকে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ সরল না, বরং তা বজ্রঝড়ের পূর্বাভাস হয়ে দেখা দিল। খলিফার লাশ তখনো কবরে নামেনি, অথচ ক্ষমতার করিডোরে শুরু হয়ে গেল পরবর্তী দাবার চাল। তুর্কি জেনারেলরা – যাদের হাতে তখন আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের চাবি – আবার এক গোপন বৈঠকে বসল। এই বৈঠকটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য এক ষড়যন্ত্রের আসর, যেখানে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছিল কয়েকজন উগ্র সেনাপতির মর্জিমাফিক। ওয়াসিফ (Wasif), বুগা (Bugha) এবং বাঘির (Baghir) – এই ত্রয়ী তখন ক্ষমতার শীর্ষে। তাদের সামনে প্রধান সমস্যা ছিল – পরবর্তী খলিফা কে হবেন? রাজপরিবারের ভেতরে আল-মুতাওয়াক্কিলের আরেক ছেলে আল-মু’তাজ (Al-Mu’tazz) ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রার্থী। কিন্তু তুর্কিদের কাছে যোগ্যতা বা জনপ্রিয়তার কোনো মূল্য ছিল না, তাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ছিল তাদের নিজেদের নিরাপত্তা বা সারভাইভাল (Survival)। তারা জানত, আল-মু’তাজকে সিংহাসনে বসানো মানে নিজেদের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করা। আল-মু’তাজ কখনোই ভুলবেন না যে এই তুর্কি জেনারেলরাই তার বাবাকে হত্যা করেছে এবং তার ভাইকে সরিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রতিশোধস্পৃহা বা ভেনডেটা (Vendetta) এক প্রবল চালিকাশক্তি, এবং তুর্কিরা সেই ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না।
তাই তারা রাজপরিবারের বংশলতিকা বা জেনেওলজি (Genealogy) ঘেঁটে এমন একজনকে খুঁজতে লাগল যাকে তারা ইচ্ছেমতো নাচাতে পারবে। তাদের দরকার ছিল এমন এক ব্যক্তিত্বহীন মানুষ, যার নিজস্ব কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, যার কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই এবং যে হবে একান্তই তাদের আজ্ঞাবহ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের নজর পড়ল আহমদ ইবনে মুহাম্মদের ওপর, যিনি ইতিহাসে আল-মুস্তাইন (Al-Musta’in) নামে পরিচিত হবেন। আল-মুস্তাইন ছিলেন খলিফা আল-মু’তাসিমের নাতি। তিনি রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে একরকম বন্দি এবং বিলাসী জীবন যাপন করতেন। রাজনীতির কুটিল মারপ্যাঁচ, যুদ্ধের দামামা কিংবা প্রশাসনিক জটিলতা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। তিনি ছিলেন নরম স্বভাবের, আরামপ্রিয় এবং কিছুটা ভীতু প্রকৃতির। তুর্কি জেনারেলরা ভাবল, এই তো আমাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁস! একে সিংহাসনে বসালে আমরাই হব আসল রাজা বা কিংমেকার (Kingmaker)। ৮৬২ সালে তারা আল-মুস্তাইনকে খলিফা ঘোষণা করল। আল-মুস্তাইন হয়তো তখনো বুঝতে পারেননি যে তিনি আসলে খলিফা হচ্ছেন না, হচ্ছেন এক বলির পাঁঠা। তাকে সিংহাসনে বসিয়ে তুর্কিরা নিশ্চিত হলো যে, তাদের লুটপাটের রাজত্ব আরও কিছুদিন চলবে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে, ইতিহাস বারবার তার নিজের পুনরাবৃত্তি করে না, মাঝে মাঝে সে নতুন এবং ভয়ংকর সব মোড় নেয়।
সামারার রাজপথে বারুদ ও পলায়ন
আল-মুস্তাইন খলিফা হলেন বটে, কিন্তু সামারার পরিস্থিতি তখন বারুদের স্তূপের মতো। রাজকোষ বা ট্রেজারি (Treasury) তখন প্রায় শূন্য। গত কয়েক বছরের অরাজকতা, খলিফা বদল এবং জেনারেলদের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছিল। তুর্কি জেনারেলরা নিজেদের পকেট ভারী করতে ব্যস্ত ছিল, তারা বিশাল সব ইকতা বা জমিদখল করে নিয়েছিল, কিন্তু সাধারণ সৈন্যদের বেতন দেওয়ার মতো টাকা রাজকোষে ছিল না। সামারার সামরিক বাহিনী তখন আর কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনী ছিল না, তা পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত এক দাঙ্গাবাজ জনতায়। তুর্কি, মাঘারিবা (উত্তর আফ্রিকান), এবং শাকিরিয়া (মধ্য এশীয়) – এই তিন প্রধান সামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হলো প্রবল রেষারেষি। সাধারণ সৈন্যরা দেখল তাদের নেতারা প্রাসাদে বিলাসিতায় মগ্ন, অথচ তাদের ঘরে খাবার নেই। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বা ক্লাস স্ট্রাগল (Class Struggle) সামরিক বাহিনীর ভেতরেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিল।
৮৬৩ সালের দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। ক্ষিপ্ত সৈন্যরা বেতনের দাবিতে রাজপথে নেমে এল। তারা জেনারেলদের প্রাসাদে হামলা চালাল, দোকানপাট লুট করল। ওয়াসিফ এবং বুগা – যারা এতদিন নিজেদের অপরাজেয় ভাবতেন – তারা দেখলেন তাদের নিজেদের লোকেরাই তাদের মারার জন্য খুঁজছে। প্রাণভয়ে তারা লুকিয়ে বেড়াতে লাগলেন। খলিফা আল-মুস্তাইন প্রাসাদের জানালা দিয়ে দেখলেন তার স্বপ্নের রাজধানী জ্বলছে। তিনি বুঝতে পারলেন, সামারায় তার নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কেউ নেই। যে তুর্কি গার্ডরা তাকে রক্ষা করার কথা, তারাই আজ ঘাতক হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় খলিফা এক চরম সিদ্ধান্ত নিলেন – তিনি সামারা ছেড়ে পালাবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? তার মনে পড়ল পুরনো রাজধানী বাগদাদের কথা। বাগদাদ তখনো আব্বাসীয় ঐতিহ্যের ধারক, সেখানে তুর্কিদের প্রভাব কিছুটা কম এবং সেখানে আছেন শক্তিশালী গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (যিনি বিখ্যাত তাহিরিদ বংশের সদস্য)। খলিফা ভাবলেন, বাগদাদই হতে পারে তার শেষ আশ্রয়স্থল। ৮৬৫ সালের এক গভীর রাতে, ছদ্মবেশে এবং অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে খলিফা আল-মুস্তাইন এবং তার দুই প্রধান সেনাপতি (যারা সৈন্যদের ভয়ে পালাচ্ছিল) সামারা ত্যাগ করলেন। তারা নৌকায় করে টাইগ্রিস নদী ধরে দক্ষিণে বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। একজন খলিফা, যার আদেশে একসময় পৃথিবী কাঁপত, তিনি আজ চোরের মতো নিজের রাজধানী ছেড়ে পালাচ্ছেন – এটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের এক করুণ দৃশ্য বা মেলানকলিক স্পেকট্যাকল (Melancholic Spectacle)।
বাগদাদ বনাম সামারা: এক সাম্রাজ্য, দুই খলিফা
খলিফা আল-মুস্তাইন যখন বাগদাদে পৌঁছালেন, তখন তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হলো। বাগদাদের মানুষ সামারার তুর্কি শাসনকে ঘৃণা করত। তারা মনে করত তুর্কিরা হলো বর্বর, যারা তাদের খলিফাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে। তাই যখন খলিফা নিজেই বাগদাদে ফিরে এলেন, তখন বাগদাদবাসী ভাবল এবার বুঝি তাদের সুদিন ফিরবে। গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ খলিফাকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় উৎসব শুরু হলো। মানুষ ভাবল, এবার তুর্কিদের হাত থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু তারা জানত না, এই আনন্দ আসলে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের বা সিভিল ওয়ার (Civil War)-এর প্রারম্ভিকা মাত্র। বাগদাদে খলিফার উপস্থিতির খবর সামারায় পৌঁছাতে দেরি হলো না। সামারার তুর্কি জেনারেলরা, যারা খলিফার পলায়নে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, তারা দ্রুতই সম্বিৎ ফিরে পেল। তারা বুঝতে পারল, খলিফা যদি বাগদাদে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং তাহিরিদদের সাথে হাত মেলান, তবে সামারার তুর্কিদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। খলিফা ছাড়া তাদের কোনো বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) নেই। তাই তারা পাল্টা চাল চালল।
সামারার জেলখানায় বা গৃহবন্দি অবস্থায় তখনো ধুঁকছিলেন আল-মুতাওয়াক্কিলের আরেক ছেলে আল-মু’তাজ। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! কিছুদিন আগেই এই তুর্কিরা আল-মু’তাজকে জোর করে উত্তরাধিকার থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। আর আজ, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে, তারাই আল-মু’তাজকে জেল থেকে বের করে আনল। তারা তাকে গোসল করাল, রাজকীয় পোশাক পরাল এবং নতুন খলিফা হিসেবে তার প্রতি আনুগত্য বা বাইয়াত (Bay’ah) গ্রহণ করল। আল-মু’তাজ জানতেন এরা বিশ্বাসঘাতক, কিন্তু তার কাছেও আর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি হলেন তুর্কিদের তুরুপের তাস। সামারা ঘোষণা করল যে, আল-মুস্তাইন পলাতক এবং তিনি খিলাফতের অযোগ্য, তাই আল-মু’তাজই হলেন একমাত্র বৈধ খলিফা। একই সাম্রাজ্য, একই ধর্ম, কিন্তু এখন দুইজন খলিফা – একজন বাগদাদে, একজন সামারায়। ইসলামের ইতিহাসে এটি ছিল পঞ্চম ফিতনা বা ফিফথ ফিতনা (Fifth Fitna)-এর সূচনা। সামারা থেকে বাগদাদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, মুসলিমের বিরুদ্ধে মুসলিমের যুদ্ধ – ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বে ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধের কোনো স্থান ছিল না।
বাগদাদ অবরোধ: দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি ও ধ্বংসলীলা
৮৬৫ সাল। সামারা থেকে বিশাল তুর্কি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী মাঘারিবা সৈন্যরা বাগদাদের দিকে ধেয়ে এল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আল-মু’তাজের ভাই আবু আহমদ (যিনি পরে আল-মুওয়াফফাক নামে পরিচিত হন)। বাগদাদ তখন এক অবরুদ্ধ নগরী। গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ বাগদাদকে রক্ষা করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। শহরের চারপাশে পরিখা খনন করা হয়েছিল, প্রাচীরগুলো মেরামত করা হয়েছিল এবং টাইগ্রিস নদীর ওপরের ব্রিজগুলো কেটে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সামারার বাহিনী ছিল পেশাদার এবং নিষ্ঠুর। তারা বাগদাদকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল। শুরু হলো ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত ‘বাগদাদ অবরোধ’ (Siege of Baghdad)। এই অবরোধ চলেছিল প্রায় এক বছর ধরে। অবরোধের কৌশল ছিল দুটি – একদিকে সামরিক আক্রমণ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবরোধ বা ইকোনমিক ব্লকেড (Economic Blockade)। বাগদাদে খাবার ঢোকার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। টাইগ্রিস নদী দিয়ে আসা শস্যবাহী নৌকাগুলো দখল করে নেওয়া হলো।
শহরের ভেতরে পরিস্থিতি দ্রুতই ভয়াবহ আকার ধারণ করল। খাদ্যের অভাবে বাগদাদের মানুষ না খেয়ে মরতে লাগল। এক টুকরো রুটির দাম সোনার চেয়েও বেশি হয়ে গেল। মানুষ গাছের পাতা, বিড়ালের মাংস, এমনকি মৃতদেহ খাওয়ার কথাও শোনা যায়। অন্যদিকে, সামারার বাহিনী বাগদাদের ওপর বৃষ্টির মতো পাথর এবং জ্বলন্ত ন্যাপথ বা গ্রিক ফায়ার (Greek Fire) নিক্ষেপ করতে লাগল। বাগদাদের সুন্দর সুন্দর সব স্থাপত্য, যা হারুনুর রশিদের সময় তৈরি হয়েছিল, তা কামানের (Manganels/Catapults) গোলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। বিশেষ করে বাগদাদের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের সংযোগকারী ব্রিজগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হলো।
এই অবরোধে বাগদাদের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ‘আইয়ুন’ বা আইয়ারুন (Ayyarun) নামে পরিচিত এক শ্রেণীর লুম্পেন বা ভবঘুরে গোষ্ঠী এক অদ্ভুত ভূমিকা পালন করেছিল। এরা ছিল মূলত শহরের মাস্তান বা গ্যাং, কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা দেশপ্রেমিক যোদ্ধায় পরিণত হলো। তারা কোনো বর্ম বা উন্নত অস্ত্র ছাড়াই কেবল লাঠি, পাথর এবং ন্যাপথ ভর্তি বোতল নিয়ে তুর্কিদের সুশৃঙ্খল বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারা নিজেদের বলত ‘নগ্ন যোদ্ধা’, কারণ তাদের গায়ে কোনো বর্ম থাকত না। তাদের এই বীরত্ব বাগদাদকে অনেকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিল। এটি ছিল এক ধরণের অ্যাসিমেট্রিকাল ওয়ারফেয়ার (Asymmetrical Warfare), যেখানে পেশাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিল সাধারণ জনতা। কিন্তু আবেগ দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। ক্ষুধার কাছে শেষ পর্যন্ত বাগদাদ হার মানতে শুরু করল (Lassner, 1980)।
রাজনৈতিক দাবার শেষ চাল ও বিয়োগান্তক পরিণতি
অবরোধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছিল, বাগদাদের গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর মনোবল ততই ভেঙে পড়ছিল। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, এই যুদ্ধে আল-মুস্তাইন জিততে পারবেন না। তাছাড়া, শহরের বণিক শ্রেণী এবং অভিজাতরা যুদ্ধের কারণে তাদের সম্পদ হারাচ্ছিল, তারা শান্তির জন্য চাপ দিচ্ছিল। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ গোপনে সামারার জেনারেলদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। তিনি নিজের এবং নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিনিময়ে খলিফা আল-মুস্তাইনকে বলির পাঁঠা বানাতে রাজি হলেন। এটি ছিল রাজনীতির এক জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা বা বিট্রেয়াল (Betrayal)। আল-মুস্তাইন বুঝতে পারলেন তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। যে গভর্নরের ভরসায় তিনি সামারা ছেড়েছিলেন, সেই গভর্নরই এখন তাকে বিক্রি করে দিচ্ছে।
৮৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে, আল-মুস্তাইন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। তিনি সিংহাসন ত্যাগ করলেন এবং আল-মু’তাজকে বৈধ খলিফা হিসেবে মেনে নিলেন। শর্ত ছিল একটাই – আল-মুস্তাইনকে প্রাণে মারা যাবে না এবং তাকে মক্কায় নির্বাসনে পাঠানো হবে, যেখানে তিনি বাকি জীবন ইবাদত বন্দেগি করে কাটাবেন। সামারার জেনারেলরা এবং আল-মু’তাজ এই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। আল-মুস্তাইনকে নিরাপত্তার চাদর বা ‘আমান’ (Aman) দেওয়া হলো। কিন্তু আগেই বলেছি, ইতিহাসে পরাজিতদের জন্য কোনো দয়া বরাদ্দ থাকে না, আর প্রতিশ্রুতি সেখানে কেবলই বাতাসের শব্দ। আল-মুস্তাইনকে মক্কার বদলে পাঠানো হলো ওয়াসিত নামক এক জায়গায়। সেখানে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হলো।
কয়েক মাস পর, আল-মু’তাজ সিদ্ধান্ত নিলেন যে আল-মুস্তাইন বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে আবার বিদ্রোহ হতে পারে। ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো ‘লুজ এন্ড’ বা Loose End রাখা বিপজ্জনক। তিনি গোপনে এক ঘাতককে পাঠালেন ওয়াসিতে। ঘাতক যখন আল-মুস্তাইনের কক্ষে প্রবেশ করল, তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন। নামাজের অবস্থাতেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তার মাথাটি কেটে একটি ঝুড়িতে ভরে সামারায় পাঠানো হলো।
ইতিহাসের এক হাড়হিম করা দৃশ্যের বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে। আল-মুস্তাইনের কাটা মাথা যখন খলিফা আল-মু’তাজের কাছে নিয়ে আসা হলো, তখন আল-মু’তাজ তার পারিষদদের সাথে দাবা খেলছিলেন। সৈনিকরা ঝুড়িটি তার সামনে রাখল এবং ঢাকনা খুলে দিল। ভেতরে আল-মুস্তাইনের নিষ্প্রাণ, রক্তমাখা মুখ। আল-মু’তাজ দাবার বোর্ড থেকে চোখ তুলে একবার মাথাটির দিকে তাকালেন। তার চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না, কোনো অনুশোচনা বা ভয়ের চিহ্ন ছিল না। তিনি কেবল মাথাটি সরিয়ে নিতে বললেন এবং আবার খেলায় মন দিলেন। তিনি বললেন, “খেলা এখনো শেষ হয়নি।” ক্ষমতার নেশা মানুষকে কতটা অমানবিক এবং অনুভূতিহীন বা ডিসেনসিটাইজড (Desensitized) করে তোলে, এটি তার এক উৎকৃষ্ট এবং ভয়াবহ উদাহরণ। আল-মুস্তাইনের এই করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে সামারার গৃহযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটল, কিন্তু রেখে গেল এক বিভীষিকাময় ক্ষত, যা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে ভেতর থেকে পুরোপুরি পচিয়ে দিল (Gordon, 2001; Kennedy, 2001; Bosworth, 1996)।
তৃতীয় অঙ্ক: আল-মু’তাজ – সবচেয়ে কনিষ্ঠ, সবচেয়ে হতভাগ্য
আল-মু’তাজ (Al-Mu’tazz) – নামটি ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে সোনার হরফে নয়, বরং অশ্রু আর রক্তের কালিতে। ৮৬৬ সালে যখন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে একক খলিফা হিসেবে সিংহাসনে বসলেন, তখন তার বয়স মাত্র উনিশ বছর। আব্বাসীয় ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী খলিফা। তিনি ছিলেন অকল্পনীয় সুপুরুষ, তার চেহারা ছিল কোনো ধ্রুপদী ভাস্কর্যের মতো নিখুঁত। তিনি ছিলেন কবিমনা, রুচিশীল এবং সাহিত্যের অনুরাগী। তার পোশাক-পরিচ্ছদ, কথা বলার ধরণ – সবকিছুতেই ছিল এক আভিজাত্যের ছাপ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই রাজপুত্রটি এমন এক সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন যখন সৌন্দর্য বা রুচিবোধের কোনো মূল্য ছিল না, মূল্য ছিল কেবল নিষ্ঠুরতা আর চক্রান্তের। তার মানসিক জগত ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। শৈশব থেকেই তিনি দেখেছেন কেবল রক্ত আর বিশ্বাসঘাতকতা। চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে দেখেছেন, বড় ভাইকে মরতে দেখেছেন, নিজেও জেল খেটেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন বহুবার। এই ট্রমা বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) তাকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল। তিনি জানতেন, তার চারপাশে যারা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে, তারাই আসলে তার ঘাতক। এই চরম অবিশ্বাস বা প্যারাভয়া (Paranoia) তাকে প্রতি মুহূর্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তিনি কাউকে বিশ্বাস করতে পারতেন না – না তার উজিরকে, না তার সেনাপতিকে, এমনকি তার নিজের মাকেও না।
আল-মু’তাজের শাসনকাল শুরু হয়েছিল এক ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকটের বা ফিসকাল ক্রাইসিস (Fiscal Crisis)-এর মধ্য দিয়ে। আল-মুস্তাইনের সাথে চলা দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ বা ‘ফিতনা’ রাজকোষকে একেবারে দেউলিয়া করে দিয়েছিল। যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে আগের খলিফারা সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছিলেন। অথচ যুদ্ধের পর তুর্কি সৈন্যদের দাবি আরও বেড়ে গিয়েছিল। তারা মনে করত, আল-মু’তাজকে তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাই তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া খলিফার দায়িত্ব। প্রতিদিন সকালে প্রাসাদের সামনে হাজার হাজার সৈন্য জড়ো হতো। তাদের হাতে থাকত খোলা তরবারি, মুখে গালিগালাজ। তারা চিৎকার করে বলত, “আমাদের বকেয়া বেতন দাও, নইলে তোমার মাথা নেব।” খলিফা প্রাসাদের অলিন্দ থেকে সেই দৃশ্য দেখতেন আর ভয়ে কাঁপতেন। রাজকোষে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে, কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার টাকা নেই, সৈন্যদের দাবি মেটানো তো দূরের কথা। খলিফা তার ব্যক্তিগত আসবাবপত্র, ঘোড়া, এমনকি প্রাসাদের দরজার সোনা গলিয়েও কিছু টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা ছিল সমুদ্রের কাছে এক ফোঁটা জলের মতো।
কাবিহা: মাতৃস্নেহ বনাম সম্পদের মোহ
এই ট্র্যাজিক নাটকের অন্যতম জটিল এবং বিতর্কিত চরিত্র হলেন খলিফার মা, কাবিহা (Qabiha)। তিনি ছিলেন আল-মুতাওয়াক্কিলের প্রিয়তম উপপত্নী এবং পরবর্তীতে স্ত্রী। গ্রিক বংশোদ্ভূত এই নারী ছিলেন অসামান্য সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল তাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, তাকে বিপুল ধনসম্পদ উপহার দিয়েছিলেন। কাবিহার কাছে ছিল মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত এবং সোনার এক বিশাল ভাণ্ডার। তিনি জানতেন সামারার রাজনীতি কতটা অনিশ্চিত, তাই তিনি তার এই বিপুল সম্পদ মাটির নিচে গোপন কুঠুরিতে বা সিক্রেট ভল্ট (Secret Vault)-এ লুকিয়ে রেখেছিলেন। আল-মু’তাজ যখন সৈন্যদের চাপে দিশেহারা, তখন তিনি মায়ের কাছে ছুটে যেতেন। তিনি মায়ের পায়ে ধরে কাঁদতেন, “মা, আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে কিছু টাকা দাও, আমি ওদের মুখ বন্ধ করি।” কিন্তু কাবিহা ছিলেন এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্বের অধিকারী। তিনি ছেলেকে ভালোবাসতেন, কিন্তু নিজের জমানো সম্পদকে হয়তো তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। অথবা তার মনে হয়তো এই ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে, একবার টাকা দেওয়া শুরু করলে তুর্কিদের লোভের আগুন আরও বেড়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত টাকাও যাবে, ছেলেও যাবে।
কাবিহার এই আচরণকে আধুনিক মনোবিজ্ঞানে হোর্ডিং ডিসঅর্ডার (Hoarding Disorder) বা সম্পদের প্রতি অন্ধ মোহ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তিনি ভাবতেন, এই টাকা তার শেষ বয়সের সম্বল, তার ক্ষমতার উৎস। তিনি ছেলেকে মিথ্যে বলতেন, বলতেন তার কাছে কোনো টাকা নেই, সব খরচ হয়ে গেছে। অথচ মাটির নিচেই ছিল কোটি কোটি টাকার সম্পদ। মা ও ছেলের এই সম্পর্কের টানাপড়েন ছিল গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো। ছেলে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে সাহায্য চাইছে, আর মা মিথ্যে অজুহাত দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কাবিহা হয়তো ভেবেছিলেন, আল-মু’তাজ কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যাবে, অথবা তিনি হয়তো তুর্কিদের সাথে কোনো গোপন সমঝোতার আশা করছিলেন। কিন্তু তার এই কৃপণতা বা দূরদর্শিতার অভাব শেষ পর্যন্ত তার ছেলের করুণ মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। ইতিহাস কাবিহাকে ক্ষমা করেনি, তাকে চিহ্নিত করেছে একজন স্বার্থপর মা হিসেবে, যিনি নিজের সন্তানের রক্তের বিনিময়ে সোনা আগলে রাখতে চেয়েছিলেন।
বিভাজনের রাজনীতি এবং সালিহ ইবনে ওয়াসিফের উত্থান
টাকা নেই, সৈন্য নেই, বন্ধু নেই – এই অবস্থায় আল-মু’তাজ বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে বেছে নিলেন সেই পুরনো কৌশল: ডিভাইড অ্যান্ড রুল (Divide and Rule) বা বিভাজন ও শাসন নীতি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তুর্কিরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে তার কোনো আশা নেই। তাই তিনি তুর্কিদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করলেন। তিনি তুর্কিদের এক দলের বিরুদ্ধে আরেক দলকে উস্কে দিলেন। আবার তুর্কিদের বিরুদ্ধে উত্তর আফ্রিকান ‘মাঘারিবা’ (Maghariba) এবং ফারগানা থেকে আসা ‘শাকিরিয়া’ (Shakiriyya) সৈন্যদের লেলিয়ে দিলেন। তিনি গোপনে মাঘারিবা নেতাদের বললেন, “তুর্কিরা তোমাদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, তোমরা ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াও।” আবার শাকিরিয়াদের বললেন, “তুর্কিরা তোমাদের নিচু চোখে দেখে।” এই কৌশলে সাময়িকভাবে কাজ হলো। সামারার রাস্তায় শুরু হলো রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। প্রতিদিনই এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের মারামারি হতো, লাশ পড়ত। খলিফা ভাবলেন, ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে দুর্বল হয়ে পড়লে তিনি তার ক্ষমতা ফিরে পাবেন।
কিন্তু এই খেলার এক নতুন এবং ভয়ংকর খেলোয়াড়ের আবির্ভাব হলো – সালিহ ইবনে ওয়াসিফ (Salih ibn Wasif)। সালিহ ছিলেন সেই পুরনো ঘাতক ওয়াসিফের ছেলে, যে আল-মুতাওয়াক্কিলকে হত্যা করেছিল। বাবার মতোই সালিহ ছিলেন নিষ্ঠুর, উচ্চাভিলাষী এবং খলিফাদের প্রতি চরম বিদ্বেষপরায়ণ। তিনি ছিলেন তুর্কি উগ্রবাদের নতুন মুখ। সালিহ বুঝতে পারলেন যে খলিফা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। তিনি তুর্কিদের একতাবদ্ধ করলেন এবং তাদের বোঝালেন যে তাদের আসল শত্রু খলিফা আল-মু’তাজ। সালিহ হয়ে উঠলেন খলিফার প্রধান প্রতিপক্ষ। তিনি প্রকাশ্যেই খলিফাকে অপমান করতেন। দরবারে এসে খলিফার মুখের ওপর বলতেন, “তুমি আমাদের গোলাম, আমরা যা বলব তাই তোমাকে করতে হবে।” সালিহ ইবনে ওয়াসিফ এবং তার সহযোগী বায়েকবাক (Bayakbak) মিলে খলিফাকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেললেন। তারা খলিফার ব্যক্তিগত রক্ষীদের সরিয়ে দিয়ে নিজেদের লোক বসালেন। আল-মু’তাজ বুঝতে পারলেন, তিনি বাঘের খাঁচায় বন্দি এবং বাঘটি এখন ক্ষুধার্ত।
অমানবিক নির্যাতন এবং মৃত্যু
৮৬৯ সালের জুলাই মাস। ইরাকের গ্রীষ্মকাল মানেই নরকতুল্য গরম। তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে যায়। এই সময়েই আল-মু’তাজের জীবনের শেষ অঙ্কটি অভিনীত হলো। তুর্কি সৈন্যরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বায়েকবাক ও সালিহের নেতৃত্বে প্রাসাদে হামলা চালাল। তারা খলিফাকে তার সিংহাসন থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাল। যে খলিফাকে এক নজর দেখার জন্য মানুষ ভিড় করত, তাকেই একদল অশিক্ষিত, বর্বর সৈন্য লাথি মারল, তার মুখে থুথু দিল। তারা তার রাজকীয় পোশাক ছিঁড়ে ফেলল। এরপর শুরু হলো এক অমানবিক নির্যাতন, যা শুনলে আজও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
সৈন্যরা আল-মু’তাজকে প্রাসাদের উঠোন বা চত্বরে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখল। মধ্যদুপুরের গনগনে সূর্যের নিচে খালি পায়ে, খালি মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা। তিনি পানির জন্য আর্তনাদ করছিলেন, কিন্তু কেউ তাকে এক ফোঁটা পানি দিল না। ঘামে এবং তৃষ্ণায় তিনি বারবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন, আর সৈন্যরা তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আবার দাঁড় করাচ্ছিল। তারা তাকে বলছিল, “টাকা কোথায়? তোর মায়ের গুপ্তধন কোথায়?” খলিফা তখনো জানতেন না তার মায়ের কাছে কত টাকা আছে, অথবা জানলেও বলার শক্তি তার ছিল না। এই দৃশ্যটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের চূড়ান্ত অবমাননার বা হিউমিলিয়েশন (Humiliation)-এর প্রতীক। খলিফা, যিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের নেতা, তিনি আজ পথের কুকুরের চেয়েও খারাপ অবস্থায়।
নির্যাতনের এক পর্যায়ে খলিফা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু তুর্কিদের রাগ তখনো কমেনি। তারা তাকে টেনে নিয়ে গেল প্রাসাদের এক নির্জন অংশে, যেখানে ছিল একটি হাম্মামখানা বা বাথরুম (Hammam)। হাম্মামখানাগুলো সাধারণত গরম বাষ্পে পূর্ণ থাকে। তারা আল-মু’তাজকে সেই ছোট, বদ্ধ ঘরে ঢুকিয়ে দিল এবং বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। সেখানে কোনো খাবার ছিল না, পানি ছিল না, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না। প্রচণ্ড গরম, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় তিলে তিলে মৃত্যু হলো এই চব্বিশ বছর বয়সী তরুণের। তার মৃত্যু কোনো দ্রুত মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া। তিন দিন পর যখন দরজা খোলা হলো, তখন দেখা গেল খলিফার মৃতদেহ কুঁকড়ে পড়ে আছে। তার শরীরে নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন। তুর্কিরা প্রচার করল যে খলিফা অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন, এমনকি তারা কিছু ভুয়া সাক্ষীও জোগাড় করল যারা বলল খলিফা স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন। কিন্তু সামারার প্রতিটি ইট জানত আসল সত্যটা কী।
কাবিহার পরিণতি: সম্পদের অসারতা
আল-মু’তাজের মৃত্যুর খবর যখন কাবিহার কাছে পৌঁছাল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন তার এতদিনের জমানো সম্পদ, তার এত পরিকল্পনা – সবই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি জানতেন তুর্কিরা এবার তার খোঁজে আসবে। তিনি তার গুপ্তকুঠুরি থেকে সোনাদানা, হীরা-জহরত বস্তায় ভরে পালানোর চেষ্টা করলেন। তিনি সামারা থেকে পালিয়ে মক্কায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পালানোর পথেই তিনি ধরা পড়লেন। তুর্কি সৈন্যরা তাকে আটক করল এবং তার সাথে থাকা বিপুল সম্পদ দেখে তারা নিজেরাই হতভম্ব হয়ে গেল। ঐতিহাসিকরা বলেন, কাবিহার কাছে এত পরিমাণ সোনা এবং মণি-মুক্তা ছিল যে তা দিয়ে কয়েক বছরের জন্য পুরো সেনাবাহিনীর বেতন দেওয়া যেত।
তুর্কিরা যখন কাবিহাকে প্রশ্ন করল, “তোমার ছেলের যখন এই অবস্থা, তখন তুমি কেন এই টাকা দাওনি?” তখন কাবিহা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। হয়তো তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সম্পদের মোহ তাকে অন্ধ করে রেখেছিল। তুর্কিরা তার সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিল। কাবিহাকে তারা হত্যা করেনি, কিন্তু তাকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দিল। এক সময়ের প্রতাপশালী রাজমাতা, যার ইশারায় অনেক কিছু হতো, তিনি শেষ জীবনে বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, মানুষের কাছে হাত পাততেন। তার এই পরিণতি ছিল এক মহাকাব্যিক নেমেসিস (Nemesis) বা কর্মফলের উদাহরণ। আল-মু’তাজের মৃত্যু এবং কাবিহার পতন প্রমাণ করল যে, অর্থ বা ক্ষমতা কিছুই মানুষকে বাঁচাতে পারে না যদি না সময় এবং ভাগ্য সহায় থাকে। আল-মু’তাজের এই ট্র্যাজেডি আব্বাসীয় ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়, যা মনে করিয়ে দেয় ক্ষমতার চূড়া থেকে পতনের গভীরতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে (Shaban, 1976; Gordon, 2001; Kennedy, 2004)।
চতুর্থ অঙ্ক: আল-মুহতাদির সংস্কারের ব্যর্থ চেষ্টা
আল-মু’তাজের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সামারার তুর্কি জেনারেলরা আবার এক বৈঠকে বসল। তাদের হাতে এখন খলিফা নির্বাচনের চাবি, কিন্তু সমস্যা হলো, আব্বাসীয় রাজপরিবারের যোগ্য বা অনুগত কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা বেছে নিল আল-মুহতাদি (Al-Muhtadi)-কে। তিনি ছিলেন খলিফা আল-ওয়াথিকের ছেলে এবং আল-মু’তাসিমের নাতি। ৮৬৯ সালের জুলাই মাসে তাকে সিংহাসনে বসানো হলো। আল-মুহতাদির চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব ছিল তার পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি ছিলেন সামারার এই রক্তমাখা নাটকের এক প্রকৃত ট্র্যাজিক হিরো (Tragic Hero)। আব্বাসীয় ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে যখন সবাই দুর্নীতি, বিলাসিতা আর চক্রান্তে মগ্ন, তখন আল-মুহতাদি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, ব্যক্তিগত জীবনে সৎ এবং অসামান্য সাহসী। তার মধ্যে ছিল উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় উমর বা উমর ইবনে আব্দুল আজিজের ছায়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, খলিফা হওয়া মানে ভোগবিলাস নয়, বরং এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব বা ডিভাইন ট্রাস্ট (Divine Trust)। তিনি চেয়েছিলেন আব্বাসীয় খিলাফতকে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে এবং ইসলামি অনুশাসন মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। কিন্তু তিনি এমন এক সময়ে এবং এমন এক স্থানে এই মহৎ স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে স্বপ্নের কোনো স্থান ছিল না, ছিল কেবল দুঃস্বপ্ন।
ক্ষমতায় বসার পরপরই আল-মুহতাদি এক আমূল পরিবর্তন বা র্যাডিক্যাল রিফর্ম (Radical Reform) শুরু করলেন। তিনি সামারার প্রাসাদের জাঁকজমক কমিয়ে দিলেন। তিনি দেখলেন রাজকোষ শূন্য, অথচ প্রাসাদে শত শত গায়িকা, নর্তকী এবং বাদ্যযন্ত্র বাদক পোষা হচ্ছে। তিনি তাদের সবাইকে বিদায় করে দিলেন। প্রাসাদের ভেতরের চিড়িয়াখানা, যেখানে সিংহ ও অন্যান্য বন্য প্রাণী পোষা হতো এবং যার পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় হতো, তিনি সেগুলো বন্ধ করে দিলেন এবং পশুগুলোকে মেরে ফেলার বা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। মদ্যপান নিষিদ্ধ করলেন কঠোরভাবে। তিনি নিজে রেশমি পোশাক বা সোনার অলংকার পরতেন না, পরতেন সাধারণ সুতির বা পশমি পোশাক। তার খাবার ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। তিনি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে সাধারণ মানুষের জন্য দরবার বসাতেন, যাকে বলা হতো ‘মাজালিম কোর্ট’ বা কোর্ট অফ গ্রিভেন্সেস (Court of Grievances)। সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে সাধারণ মানুষের অভিযোগ শুনতেন এবং তাৎক্ষণিক বিচার করতেন। তার এই আচরণ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তার সৃষ্টি করল। মানুষ ভাবল, এতদিন পর বুঝি একজন সত্যিকারের ‘আমিরুল মুমিনিন’ পাওয়া গেল। কিন্তু আল-মুহতাদি ভুলে গিয়েছিলেন যে, সামারা বাগদাদ নয় এবং তার ক্ষমতার উৎস জনগণ নয়, বরং সেনাবাহিনী। তার এই সংস্কারগুলো তুর্কি জেনারেলদের বিলাসী জীবনে আঘাত হানল এবং তারা খলিফাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল।
সংস্কার বনাম কায়েমি স্বার্থ: এক অসম লড়াই
আল-মুহতাদির মূল লক্ষ্য ছিল তুর্কিদের প্রভাব খর্ব করে খলিফার হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই তুর্কি সেনাবাহিনী রাষ্ট্রকে রক্ষা করছে না, বরং উইপোকার মতো ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে। তিনি জানতেন, যতদিন তুর্কি জেনারেলরা – যেমন মুসা ইবনে বুগা (Musa ibn Bugha), বায়েকবাক (Bayakbak) এবং সালিহ ইবনে ওয়াসিফ (Salih ibn Wasif) – ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে, ততদিন কোনো সংস্কারই টিকবে না। তাই তিনি এক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় নামলেন। তিনি চাইলেন তুর্কিদের ভেতরের কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে তাদের ধ্বংস করতে। এটি ছিল ম্যাকিয়াভেলিয়ান (Machiavellian) রাজনীতির এক ধ্রুপদী চাল, কিন্তু এর জন্য দরকার ছিল অত্যন্ত ধূর্ততা এবং সামরিক শক্তি, যা আল-মুহতাদির ছিল না। তার ছিল কেবল নৈতিক সাহস, যা রাজনীতির নোংরা খেলায় সবসময় যথেষ্ট নয়।
এই সময় মুসা ইবনে বুগা হামাদান থেকে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে সামারায় ফিরছিলেন। মুসা ছিলেন আল-মু’তাজের হত্যাকারীদের অন্যতম এবং তিনি আল-মুহতাদির সংস্কার পছন্দ করছিলেন না। আল-মুহতাদি তখন সালিহ ইবনে ওয়াসিফকে ব্যবহার করে মুসাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সালিহ নিজেই তখন তুর্কিদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন না, কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত লোভী এবং নিষ্ঠুর। সালিহ এক পর্যায়ে পালিয়ে যান এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়। সালিহের মৃত্যুর পর আল-মুহতাদি ভাবলেন তিনি হয়তো মুসার সাথে হাত মিলিয়ে বায়েকবাককে সরাতে পারবেন। বায়েকবাক তখন সামারার গভর্নর এবং অত্যন্ত শক্তিশালী। খলিফা বায়েকবাককে প্রাসাদে ডেকে এনে হত্যার পরিকল্পনা করলেন। এটি ছিল এক ডেসপারেট মুভ। খলিফা ভাবলেন, বায়েকবাক মারা গেলে তার অনুগত সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে এবং মুসা ইবনে বুগা খলিফার অনুগত থাকবেন। কিন্তু তুর্কিদের মনস্তত্ত্ব খলিফা বুঝতে ভুল করেছিলেন। তাদের কাছে এথনিক লয়্যালটি (Ethnic Loyalty) বা জাতিগত আনুগত্য খলিফার প্রতি আনুগত্যের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। বায়েকবাককে হত্যা করা হলেও তার সৈন্যরা খলিফার পক্ষে এল না, বরং তারা মুসা ইবনে বুগার সাথে হাত মিলিয়ে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। তারা দেখল, খলিফা তাদের একে একে মেরে ফেলছেন, তাই তাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধের পুনরাবৃত্তি
৮৭০ সালের জুন মাস। সামারার রাজপথে আবার রক্তগঙ্গা বইল। তুর্কি সৈন্যরা, যারা এতদিন নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল, তারা এবার একজোট হয়ে খলিফার প্রাসাদের দিকে ধেয়ে এল। তাদের সাথে যোগ দিল ফারগানা এবং অন্যান্য অঞ্চলের সৈন্যরাও। আল-মুহতাদি দেখলেন তার পরিকল্পনা ব্যুমেরাং হয়েছে। কিন্তু তিনি পালিয়ে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন আব্বাসীয়দের মধ্যে অন্যতম সাহসী যোদ্ধা। তিনি তার ব্যক্তিগত রক্ষী, কিছু মাঘারিবা সৈন্য এবং সাধারণ জনতার সাহায্য নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজে তরবারি হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নামলেন। সামারার ইতিহাসে খলিফাকে এভাবে সরাসরি যুদ্ধ করতে খুব কমই দেখা গেছে। তিনি ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন, “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো, এই বিদ্রোহীদের দমন করো।” কিন্তু তার এই বীরত্ব ছিল অসম। তার বাহিনী ছিল ছোট এবং অপর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, অন্যদিকে তুর্কিরা ছিল পেশাদার এবং সংখ্যায় অনেক বেশি।
যুদ্ধ চলাকালীন আল-মুহতাদি আশা করেছিলেন যে সাধারণ মানুষ এবং বাগদাদ থেকে কোনো সাহায্য আসবে। তিনি বাগদাদের জনতার কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সাহায্যের আবেদন জানিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, “আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, আমাকে সাহায্য করো।” কিন্তু বাগদাদ তখনো আগের গৃহযুদ্ধের ক্ষত সামলে উঠতে পারেনি, তাই সেখান থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য সাহায্য এল না। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আল-মুহতাদির নিজের রক্ষীরাই তাকে ত্যাগ করল। তারা দেখল পরাজয় নিশ্চিত, তাই তারা প্রাণ বাঁচাতে তুর্কিদের সাথে মিশে গেল। খলিফা একা হয়ে পড়লেন। তবুও তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। তুর্কিরা তাকে ঘিরে ফেলল এবং তাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে বন্দি করল। বন্দি অবস্থায় তাকে নির্মমভাবে অপমান করা হলো। তাকে একটি গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে সামারার রাস্তায় ঘোরানো হলো, যাতে সবাই দেখতে পায় খলিফার পরিণতি কী। এটি ছিল ক্ষমতার দম্ভের এক পৈশাচিক প্রদর্শনী বা স্পেকট্যাকল অফ পাওয়ার (Spectacle of Power)।
নির্মম হত্যা এবং একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু
বন্দি খলিফাকে নিয়ে যাওয়া হলো আল-জাওসাক প্রাসাদে। সেখানে তুর্কি জেনারেলরা তাকে ঘিরে ধরল। তারা তাকে জোরপূর্বক সিংহাসন ত্যাগ করার জন্য চাপ দিল। তারা একটি পদত্যাগপত্র বা অ্যাবডিকেশন ডকুমেন্ট (Abdication Document) তৈরি করে রেখেছিল, যেখানে লেখা ছিল যে আল-মুহতাদি স্বেচ্ছায় এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে ক্ষমতা ত্যাগ করছেন। কিন্তু আল-মুহতাদি ছিলেন ইস্পাতকঠিন মগ্নোবলের অধিকারী। তিনি সেই কাগজে সই করতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, “আমি আল্লাহর প্রতিনিধি, আমি কোনো বিদ্রোহীর কাছে মাথা নত করব না। তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারো, কিন্তু আমার আত্মাকে কিনতে পারবে না।” তার এই অনমনীয়তা তুর্কিদের আরও ক্ষিপ্ত করে তুলল। তারা তাকে মারধর শুরু করল। শোনা যায়, তারা তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল, তার গায়ে লাথি মেরেছিল। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার হাতের আঙুলগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল, যাতে তিনি আর কখনো তরবারি ধরতে না পারেন। তার সুন্দর চেহারাটি মারধরের চোটে চেনা যাচ্ছিল না।
অবশেষে, ৮৭০ সালের ২১ জুন, আল-মুহতাদিকে হত্যা করা হলো। তাকে সম্ভবত শ্বাসরোধ করে বা বিষাক্ত কোনো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর তুর্কিরা প্রচার করল যে তিনি স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন, কিন্তু তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্নগুলো ছিল স্পষ্ট। আল-মুহতাদির মৃত্যু কেবল একজন খলিফার মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সম্ভাবনার মৃত্যু। তিনি ছিলেন সেই শেষ খলিফা যিনি সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে শাসন করতে চেয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রকে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তার ব্যর্থতা প্রমাণ করল যে, সামারার রাজনৈতিক কাঠামো বা সিস্টেম (System) এতটাই পচে গিয়েছিল যে সেখানে কোনো ভালো মানুষের টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। ব্যবস্থাটি নিজেই ছিল একটি দানব, যা তার সংস্কারককে চিবিয়ে খেয়ে হাড়গোর সুদ্ধ উগড়ে দিল। আল-মুহতাদির ট্র্যাজেডি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাজনীতিতে কেবল সদিচ্ছা বা সততা বা ইন্টেগ্রিটি (Integrity) যথেষ্ট নয়; তার সাথে প্রয়োজন হয় ধূর্ততা, সম্পদের জোগান এবং অনুগত সামরিক শক্তি। এই তিনটি জিনিসের অভাবেই আল-মুহতাদির মহৎ স্বপ্ন এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সামারার নৈরাজ্য তার চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে করুণ অধ্যায়টি শেষ করল, এবং পথ তৈরি হলো আল-মু’তামিদ এবং আল-মুওয়াফফাকের আগমনের, যারা অবশেষে এই অরাজকতার অবসান ঘটাতে পেরেছিলেন, যদিও তার জন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল (Kennedy, 2004; Gordon, 2001; Cobb, 2014)।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়: সাম্রাজ্যের ধসে পড়া
সামারার প্রাসাদে যখন খলিফা ও জেনারেলরা ক্ষমতার কদর্য খেলায় মত্ত, তখন প্রাসাদের বাইরে বিশাল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তরগুলো একে একে ধসে পড়ছিল। এই নয় বছরের অরাজকতা বা সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra) কেবল রাজনৈতিক সংকট ছিল না, এটি ছিল একটি সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়। একটি রাষ্ট্র টিকে থাকে তার অর্থনীতির ওপর, আর সেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও বণিকরা। কিন্তু সামারার অরাজকতায় এই চাকাটিই অচল হয়ে গিয়েছিল। আব্বাসীয় অর্থনীতি মূলত দাঁড়িয়েছিল কৃষি বা এগ্রারিয়ান ইকোনমি (Agrarian Economy) এবং বাণিজ্যের ওপর। বিশেষ করে দক্ষিণ ইরাকের উর্বর কৃষি জমিগুলো ছিল সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার বা ব্রেড বাস্কেট (Breadbasket)। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী এই পলিমাটি সমৃদ্ধ অঞ্চলটি হাজার বছর ধরে মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল। কিন্তু এই জমিগুলোর উর্বরতা ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল সেচ ব্যবস্থা বা ইরিগেশন সিস্টেম (Irrigation System)। হাজার হাজার খাল, নালা, বাঁধ ও স্লুইস গেট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দরকার ছিল নিয়মিত সরকারি নজরদারি এবং বিপুল অর্থ বরাদ্দ। কিন্তু সামারায় যখন সবাই কামড়াকামড়ি করছে, তখন এই সেচ ব্যবস্থার দিকে তাকানোর মতো কেউ ছিল না। জেনারেলরা রাজকোষের সব টাকা নিজেদের বেতন ও বিলাসিতায় খরচ করে ফেলছিলেন, ফলে খাল খনন বা বাঁধ মেরামতের জন্য কোনো বাজেট ছিল না।
এর ফলাফল হলো ভয়াবহ। অবহেলার কারণে খালগুলো পলি পড়ে বন্ধ হয়ে গেল। পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলো। আর সবচেয়ে বড় বিপদ হলো লবণাক্ততা বা স্যালিনিটি (Salinity)। দক্ষিণ ইরাকের জমিগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এবং পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাটির নিচ থেকে লোনা পানি ওপরে উঠে এল। মাইলের পর মাইল সবুজ শস্যখেত সাদা লবণের স্তরে ঢেকে গেল। উর্বর জমি পরিণত হলো বন্ধ্যা ভূমিতে। কৃষকরা তাদের জমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে গেল। বাগদাদ ও সামারার বাজারে খাদ্যের জোগান কমে গেল। শস্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। এই কৃষি বিপর্যয় কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল না, এটি ছিল এক বিশাল মানবিক বিপর্যয়, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিকে আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় সিস্টেমিক কোলাপস (Systemic Collapse) বলা যেতে পারে, যেখানে একটি ভুলের চেইন রিয়্যাকশনে পুরো সিস্টেম ভেঙে পড়ে।
জাঞ্জ বিদ্রোহ: শোষিতের হাহাকার
এই কৃষি বিপর্যয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল আরেকটি বারুদের স্তূপ – জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion)। দক্ষিণ ইরাকের এই জলাভূমিগুলোতে কাজ করানোর জন্য পূর্ব আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ দাস বা ‘জাঞ্জ’ ধরে আনা হয়েছিল। এদের কাজ ছিল অত্যন্ত অমানবিক। এরা লোনা মাটির ওপরের স্তর বা ‘শোরা’ পরিষ্কার করত যাতে সেখানে চাষাবাদ করা যায়। এদের বসবাসের কোনো সুব্যবস্থা ছিল না, খাবার ছিল নগণ্য এবং তাদের ওপর চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। সামারার অরাজকতার সময় যখন কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ল এবং প্রভুরা নিজেদের দ্বন্দ্বে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তখন এই দাসরা বিদ্রোহ করার সুযোগ পেল। আলী ইবনে মুহাম্মদ নামক এক রহস্যময় নেতার নেতৃত্বে ৮৬৯ সালে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। তিনি নিজেকে আলীর বংশধর দাবি করতেন এবং দাসদের মুক্তির স্বপ্ন দেখাতেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার জাঞ্জ দাস তাদের কোদাল ও বেলচা ফেলে অস্ত্র তুলে নিল।
এই বিদ্রোহ ছিল আব্বাসীয়দের কফিনে শেষ পেরেকগুলোর একটি। বিদ্রোহীরা বসরার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নিল, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করল এবং আব্বাসীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিল। বাগদাদ থেকে পাঠানো সেনাবাহিনী বারবার এই বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হতে লাগল, কারণ সামারার তুর্কি জেনারেলরা তখনো নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে ব্যস্ত ছিল। তারা জাঞ্জ বিদ্রোহকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি, ভেবেছিল এটি সামান্য দাঙ্গা। কিন্তু যখন তাদের হুঁশ ফিরল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই বিদ্রোহ প্রায় পনেরো বছর ধরে চলেছিল এবং এটি আব্বাসীয় খিলাফতকে এতটাই দুর্বল করে দিয়েছিল যে, তারা আর কখনোই তাদের হারানো গৌরব ফিরে পায়নি। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, সামাজিক অবিচার বা সোশ্যাল ইনজাস্টিস (Social Injustice) এবং অর্থনৈতিক শোষণ কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না; একদিন না একদিন শোষিতের হাহাকার প্রলয় হয়ে ফিরে আসে। কার্ল মার্ক্সের শ্রেণিসংগ্রাম (Class Struggle) তত্ত্বের এক ধ্রুপদী উদাহরণ ছিল এই জাঞ্জ বিদ্রোহ।
কেন্দ্র ও প্রান্তের বিচ্ছেদ: স্বাধীন রাজ্যের উত্থান
সামারার নৈরাজ্যের আরেকটি বড় প্রভাব ছিল কেন্দ্র বা সেন্টার (Center) এবং প্রান্ত বা পেরিফেরি (Periphery)-র মধ্যে বিচ্ছেদ। আব্বাসীয় সাম্রাজ্য ছিল বিশাল – স্পেন থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করা হতো বাগদাদ বা সামারা থেকে। প্রদেশগুলোর গভর্নররা নিয়মিত কর বা ট্যাক্স পাঠাতেন এবং খলিফার আদেশ মেনে চলতেন। কিন্তু যখন গভর্নররা দেখলেন যে সামারায় খলিফারা তুর্কিদের হাতের পুতুল এবং সেখানে কোনো স্থিতিশীলতা নেই, তখন তারা ভাবলেন, “আমরা কেন এই অরাজক সরকারকে টাকা দেব?” ট্যাক্স কালেকশন বা রেভিনিউ কালেকশন (Revenue Collection) প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। দূরবর্তী প্রদেশগুলো নিজেদের মতো চলতে শুরু করল। এটি ছিল সাম্রাজ্যের বিকেন্দ্রীকরণ বা ডিসেন্ট্রালাইজেশন (Decentralization)-এর এক বিশৃঙ্খল রূপ।
মিশরে আহমদ ইবনে তুলুন (Ahmad ibn Tulun) ছিলেন এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তিনি ছিলেন একজন তুর্কি জেনারেলের ছেলে, যাকে মিশরের গভর্নর করে পাঠানো হয়েছিল। সামারার অরাজকতার সুযোগে তিনি নিজেকে কার্যত স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করলেন। তিনি বাগদাদে ট্যাক্স পাঠানো বন্ধ করে দিলেন এবং সেই টাকা দিয়ে নিজের সেনাবাহিনী গঠন করলেন এবং মিশরের উন্নয়নে ব্যয় করলেন। তিনি কায়রোতে বিখ্যাত ইবনে তুলুন মসজিদ নির্মাণ করলেন। বাগদাদের খলিফা কিছুই করতে পারলেন না, কারণ তার নিজের ঘরই তখন জ্বলছে। একইভাবে ইরানের খোরাসানে সাফফারিয়রা (Saffarids) এবং উত্তর আফ্রিকায় আঘলাবিরা (Aghlabids) স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করল। আব্বাসীয় খিলাফত তখন কেবল নামেমাত্র খিলাফত, বাস্তবে তা খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছিল। খলিফার ক্ষমতা কেবল বাগদাদ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই রাজনৈতিক বিভাজন বা ফ্র্যাগমেন্টেশন (Fragmentation) মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছিল।
মুদ্রাস্ফীতি এবং নাগরিক জীবনের অবক্ষয়
সামারার অরাজকতায় সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। তুর্কি সৈন্যরা কেবল নিজেদের বেতন নিয়ে চিন্তিত ছিল। যখনই বেতন বাকি পড়ত, তারা বাজার লুট করত। ব্যবসায়ীরা ভয়ে দোকানপাট বন্ধ রাখত। জিনিসপত্রের জোগান কমে যাওয়ায় এবং মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় দেখা দিল ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি বা হাইপারইনফ্লেশন (Hyperinflation)। টাকা বা দিনার তখন কাগজের মতো মূল্যহীন হয়ে পড়ল। এক বস্তা গম কিনতে এক থলে দিনার লাগত। মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা ছিল সমাজের ভিত্তি, তারা নিঃস্ব হয়ে গেল। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী – যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একসময় বাগদাদ জ্ঞানের শহরে পরিণত হয়েছিল – তারা দেখলেন তাদের কদর করার কেউ নেই। খলিফারা এখন আর কবিদের পুরস্কার দেন না, বরং তাদের মাথা কেটে নেন। ফলে বুদ্ধিজীবীরা দরবার ছেড়ে পালিয়ে যেতে লাগলেন। কেউ মিশরে ইবনে তুলুনের দরবারে, কেউবা স্পেনে উমাইয়াদের কাছে আশ্রয় নিলেন। বাগদাদ ও সামারা থেকে মেধা পাচার বা ব্রেন ড্রেন (Brain Drain) হতে শুরু করল।
সামাজিক কাঠামোতেও বড় পরিবর্তন এল। মানুষ দেখল যে সততা বা বিদ্যার কোনো মূল্য নেই, মূল্য আছে কেবল পেশিশক্তির। সমাজে মাস্তানতন্ত্র বা গ্যাং কালচার (Gang Culture)-এর উত্থান হলো। বাগদাদের ‘আইয়ারুন’ বা ভবঘুরে যুবকরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। তারা ধনীদের কাছ থেকে চাঁদা নিত এবং গরিবদের সাহায্য করার ভান করত। এটি ছিল রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার চূড়ান্ত লক্ষণ। নারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলো। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হলো। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো খালি পড়ে রইল। একসময়ের জমজমাট নগরীগুলো পরিণত হলো ভুতুড়ে নগরীতে বা গোস্ট টাউন (Ghost Town)-এ। সামারার যে বিশাল প্রাসাদগুলো তৈরি হয়েছিল কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধসে পড়তে লাগল। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ল, বাগানের গাছ মরে গেল। এই ধ্বংসস্তূপগুলো যেন নীরবে বলছিল – ক্ষমতার দম্ভ এবং অবিচার দিয়ে কোনো সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না। সামারার পতন আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইবনে খালদুনের সেই বিখ্যাত তত্ত্ব আসাবিয়াহ (Asabiyyah) বা সামাজিক সংহতির কথা; যখন শাসকরা বিলাসিতায় মগ্ন থাকে এবং জনগণের সাথে তাদের সংহতি নষ্ট হয়ে যায়, তখন সেই সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য।
অরাজকতার সমাপ্তি: মুসা ইবনে বুগা এবং আল-মুওয়াফফাক
৮৭০ খ্রিস্টাব্দ। সামারার আকাশে তখনো রক্তের গন্ধ। আল-মুহতাদির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তুর্কি জেনারেলরা আবার নতুন পুতুলের সন্ধানে নামল। এবার তাদের পছন্দ আল-মুতাওয়াক্কিলের আরেক জীবিত পুত্র, যার নাম আহমদ, যিনি ইতিহাসে আল-মু’তামিদ (Al-Mu’tamid) নামে পরিচিত। আল-মু’তামিদ ছিলেন স্বভাবগতভাবেই আমোদপ্রিয়, অলস এবং রাজনীতিবিমুখ। তুর্কিরা ভেবেছিল, একে দিয়েই কাজ হবে। খলিফা মদের পেয়ালা নিয়ে পড়ে থাকবেন, আর আমরা দেশ চালাব। কিন্তু ইতিহাসের মঞ্চে এবার এক নতুন চরিত্রের আবির্ভাব ঘটল, যিনি সমস্ত সমীকরণ বদলে দিলেন। তিনি হলেন খলিফার আপন ভাই, আবু আহমদ, যিনি আল-মুওয়াফফাক (Al-Muwaffaq) উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। আল-মুওয়াফফাক খলিফা ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন খিলাফতের প্রকৃত রক্ষাকবচ বা ডি ফ্যাক্টো রুলার (De Facto Ruler)। তার মধ্যে ছিল হারুনুর রশিদের রাজকীয় গাম্ভীর্য এবং আল-মু’তাসিমের সামরিক প্রতিভা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সামারার এই অরাজকতার মূল কারণ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, বরং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। তুর্কিরা এতকাল ধরে খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে কারণ খলিফাদের পাশে কোনো শক্ত খুঁটি ছিল না। আল-মুওয়াফফাক নিজেই সেই খুঁটি হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি সিংহাসনে বসেননি ঠিকই, কিন্তু সিংহাসনের পেছনের আসল শক্তি ছিলেন তিনিই। তার এবং খলিফা আল-মু’তামিদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা জাপানি ইতিহাসের শোগুন ও সম্রাটের মতো; সম্রাট ছিলেন প্রতীকী প্রধান, আর শোগুন ছিলেন প্রকৃত শাসক। এই ডায়ার্কি (Dyarchy) বা দ্বৈত শাসনব্যবস্থাই আব্বাসীয়দের পতনের হাত থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা করেছিল।
আল-মুওয়াফফাকের প্রথম কাজ ছিল সামারার পাগলা ঘোড়া বা তুর্কি সেনাবাহিনীকে বশে আনা। তিনি জানতেন, এদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করা মানে আত্মহত্য। তাই তিনি বেছে নিলেন কূটনীতির পথ। তিনি তুর্কিদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী জেনারেল মুসা ইবনে বুগা (Musa ibn Bugha)-কে টার্গেট করলেন। মুসা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ সমরনায়ক কিন্তু তিনিও ক্লান্ত ছিলেন এই নিত্যদিনের মারামারি ও অনিশ্চয়তা নিয়ে। আল-মুওয়াফফাক মুসার সাথে এক ঐতিহাসিক সমঝোতা বা পলিটিক্যাল ডিল (Political Deal) করলেন। তিনি মুসাকে বোঝালেন, “যদি আমরা একে অপরের সাথে লড়াই চালিয়ে যাই, তবে জাঞ্জ বিদ্রোহীরা আমাদের দুজনকেই গিলে খাবে। আসো, আমরা ক্ষমতা ভাগ করে নিই।” মুসা ইবনে বুগা রাজি হলেন। তাকে সেনাপ্রধানের পদে বহাল রাখা হলো এবং তাকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলো। বিনিময়ে মুসা খলিফা ও আল-মুওয়াফফাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং অন্যান্য বিদ্রোহী ছোট ছোট তুর্কি দলগুলোকে দমন করতে সাহায্য করলেন। এই জোট ছিল আব্বাসীয়দের ঘুরে দাঁড়ানোর চাবিকাঠি। আল-মুওয়াফফাক তুর্কিদের বুঝিয়ে দিলেন যে, খলিফা তাদের শত্রু নন, বরং তাদের অস্তিত্বের জন্যই খলিফাকে প্রয়োজন। তিনি তাদের বেতন নিয়মিত করার ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু একই সাথে তাদের লুটপাটের সুযোগ বন্ধ করে দিলেন। এটি ছিল এক ধরণের গাজর ও লাঠি নীতি (Carrot and Stick Policy)।
জাঞ্জ বিদ্রোহ দমন এবং সামরিক পুনর্গঠন
অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে আল-মুওয়াফফাক মনোযোগ দিলেন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় ক্ষত – জাঞ্জ বিদ্রোহের দিকে। দক্ষিণ ইরাকের জলাভূমিতে জাঞ্জরা তখন এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তারা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, তারা বাগদাদের দিকেও চোখ দিচ্ছিল। আল-মুওয়াফফাক নিজেই সেনাপতির দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। তিনি টাইগ্রিস নদী দিয়ে এক বিশাল নৌবহর নিয়ে জাঞ্জদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেন। এই যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং দীর্ঘস্থায়ী। জাঞ্জরা ছিল গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী। তারা জলাভূমির ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আব্বাসীয় বাহিনীকে বারবার পরাস্ত করছিল। কিন্তু আল-মুওয়াফফাক ছিলেন ধৈর্যশীল। তিনি জাঞ্জদের রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলেন। তিনি জাঞ্জদের নেতা আলী ইবনে মুহাম্মদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি আল-মুখতারা অবরোধ করলেন। বছরের পর বছর ধরে চলল এই অবরোধ। অবশেষে ৮৮৩ সালে, দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, আল-মুওয়াফফাক জাঞ্জদের পরাজিত করলেন। আলী ইবনে মুহাম্মদের কাটা মাথা বাগদাদে নিয়ে আসা হলো। এই বিজয় আল-মুওয়াফফাককে এক অবিসংবাদিত নায়কের মর্যাদায় আসীন করল। মানুষ তাকে ‘আল-নাসির লি-দিন আল্লাহ’ বা আল্লাহর ধর্মের সাহায্যকারী হিসেবে ডাকতে শুরু করল। এই বিজয়ের মাধ্যমে আব্বাসীয়রা কেবল দক্ষিণ ইরাক পুনরুদ্ধার করল না, বরং হারানো আত্মবিশ্বাসও ফিরে পেল।
সামরিক বাহিনীতেও আল-মুওয়াফফাক ব্যাপক সংস্কার আনলেন। তিনি তুর্কিদের একচেপিয়া আধিপত্য কমানোর জন্য বাহিনীতে বৈচিত্র্য আনলেন। তিনি আবার আরব, বারবার এবং কুর্দি সৈন্যদের নিয়োগ দিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড বা হায়ারার্কি (Hierarchy) পুনর্গঠন করলেন। জেনারেলদের ক্ষমতা কমিয়ে তাদের সরাসরি তার বা তার বিশ্বস্ত লোকেদের অধীনে আনলেন। তিনি গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করলেন যাতে সেনাবাহিনীতে কোনো বিদ্রোহের চক্রান্ত হলে তা আগেই জানা যায়। তার এই পদক্ষেপগুলো আব্বাসীয় সেনাবাহিনীকে আবার একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে পরিণত করল। যদিও তুর্কিদের প্রভাব পুরোপুরি শেষ হয়নি, কিন্তু তারা আর আগের মতো কিংমেকার হতে পারেনি। আল-মুওয়াফফাক প্রমাণ করলেন যে, একজন দক্ষ নেতা বা স্ট্রংম্যান (Strongman) বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন।
সামারার বিদায় এবং বাগদাদে প্রত্যাবর্তন
আল-মুওয়াফফাকের মৃত্যুর পর (৮৯১ সালে) তার ছেলে আল-মু’তাদিদ (Al-Mu’tadid) ক্ষমতায় আসেন। আল-মু’তাদিদ ছিলেন তার বাবার মতোই দক্ষ এবং দূরদর্শী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সামারা শহরটি একটি অভিশপ্ত স্থান। এই শহরের প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধূলিকণা ষড়যন্ত্র আর রক্তের সাক্ষী। এখানে থাকলে খলিফারা কখনোই নিরাপদ বোধ করবেন না। তাছাড়া, সামারার ভৌগোলিক অবস্থানও প্রশাসনিক কাজের জন্য খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। তাই তিনি এবং তার উত্তরসূরি খলিফা আল-মু’তামিদ সিদ্ধান্ত নিলেন রাজধানী আবার বাগদাদে ফিরিয়ে নেওয়ার। ৮৯২ সালে, দীর্ঘ ছাপ্পান্ন বছর পর, আব্বাসীয় খিলাফতের কেন্দ্রবিন্দু আবার বাগদাদে স্থানান্তরিত হলো। এই সিদ্ধান্তটি ছিল সামারার কফিনে শেষ পেরেক।
রাজধানী সরে যাওয়ার সাথে সাথেই সামারার জৌলুস কমতে শুরু করল। খলিফা, তার দরবার, আমলা, সেনাপতি এবং তাদের সাথে সাথে হাজার হাজার ব্যবসায়ী, শিল্পী ও কারিগর বাগদাদে চলে গেল। সামারা জনশূন্য হতে লাগল। যে বিশাল সব প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো খালি পড়ে রইল। কেউ আর সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করল না। মরুভূমির বালুঝড় এসে প্রাসাদগুলোর জাঁকজমক ঢেকে দিল। ছাদ ধসে পড়ল, দেয়াল ভেঙে পড়ল। চোর-ডাকাতরা এসে প্রাসাদের দামী মার্বেল পাথর, কাঠের দরজা খুলে নিয়ে গেল। এক সময়ের কোলাহলমুখর শহরটি পরিণত হলো এক নীরব ধ্বংসস্তূপে বা রুইনস (Ruins)-এ। সামারার এই দ্রুত উত্থান এবং পতন ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে একটি বিশ্বমানের শহর তৈরি হলো এবং আবার মিলিয়ে গেল। আজ প্রত্নতাত্ত্বিকরা সামারার মাটি খুঁড়ে সেই সময়ের অসামান্য সব কারুকার্য, মৃৎশিল্প এবং স্থাপত্যশৈলী আবিষ্কার করেন, যা প্রমাণ করে যে শিল্পকলায় সামারা কতটা উন্নত ছিল। কিন্তু রাজনীতির বিষবাষ্প সেই শিল্পকেও বাঁচাতে পারেনি। সামারা আজ ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, কিন্তু এটি একই সাথে মানুষের অহংকারের পতনের এক জীবন্ত জাদুঘর।
ইতিহাসের শিক্ষা: কৃত্রিমতার পতন
সামারার পতন এবং বাগদাদে প্রত্যাবর্তন আমাদের একটি গভীর ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষা দেয়। সামারা ছিল একটি কৃত্রিম শহর বা আর্টিফিশিয়াল সিটি (Artificial City)। এটি কোনো প্রাকৃতিক প্রয়োজনে, বাণিজ্যের কারণে বা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গড়ে ওঠেনি। এটি গড়ে উঠেছিল একজন শাসকের খেয়ালখুশিতে এবং একটি নির্দিষ্ট সমস্যা (তুর্কিদের আলাদা রাখা) সমাধানের জন্য। শহরটির কোনো নিজস্ব আত্মা বা সোল (Soul) ছিল না। এর অর্থনীতি ছিল পরজীবী, যা পুরোপুরি খলিফার ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাই যখনই খলিফা সরে গেলেন, শহরটিও মরে গেল। অন্যদিকে বাগদাদ ছিল একটি অর্গানিক বা জৈব শহর (Organic City)। এটি ছিল বাণিজ্যের কেন্দ্র, সংস্কৃতির মিলনস্থল। তাই বাগদাদ হাজার বছর ধরে টিকে আছে, কিন্তু সামারা হারিয়ে গেছে।
আল-মুওয়াফফাক এবং আল-মু’তাদিদের সময়কালকে আব্বাসীয়দের ‘শরৎকালীন রেনেসাঁ’ বা অটামনাল রেনেসাঁ (Autumnal Renaissance) বলা হয়। তারা সাময়িকভাবে পতন ঠেকিয়েছিলেন, কিন্তু রোগের মূল কারণ – সামরিক বাহিনীর রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা – পুরোপুরি সারাতে পারেননি। সামারার অরাজকতা আব্বাসীয়দের ডিএনএ-তে এমন পরিবর্তন এনেছিল যা আর কখনোই ঠিক হয়নি। খলিফার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, প্রদেশগুলো স্বাধীন হতে শিখেছিল। আল-মুওয়াফফাক কেবল সেই অনিবার্য পতনকে কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র। তবুও, এই অরাজকতার সমাপ্তি ছিল এক স্বস্তির নিঃশ্বাস। মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, বাগদাদের লাইব্রেরিগুলো আবার সরব হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের পাঠকরা জানেন, এই শান্তি ছিল ঝড়ের আগের নীরবতা মাত্র। কারণ দশম শতাব্দীতেই বুয়াইদ (Buyids) এবং পরে সেলজুকদের (Seljuqs) আগমনে খলিফারা আবার পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। সামারার ভূত আব্বাসীয়দের পিছু ছাড়েনি।
সামারার অরাজকতার ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষা (Check and Balance) কতটা জরুরি। যখন কোনো একটি গোষ্ঠী (এখানে সেনাবাহিনী) অন্য সব প্রতিষ্ঠানের (খলিফা, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ) ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে, তখন রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। সামারা ছিল সেই ব্যর্থতার এক মহাকাব্যিক ল্যাবরেটরি। আজ যখন আমরা সেই সময়ের দিকে তাকাই, তখন আমরা কেবল কিছু নাম আর তারিখ দেখি না, আমরা দেখি মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লোভ, ভয় আর সাহসের এক জটিল সংমিশ্রণ। আমরা দেখি মুসা ইবনে বুগার মতো সুবিধাবাদী জেনারেলকে, আল-মুহতাদির মতো ট্র্যাজিক হিরোকে, কাবিহার মতো অন্ধ মাকে এবং আল-মুওয়াফফাকের মতো বাস্তববাদী নেতাকে। এরা সবাই ইতিহাসের দাবার ঘুঁটি, কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালস্রোতে সবাই ভেসে গেছে। টিকে আছে কেবল তাদের গল্প, আর মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা সামারার সেই অদ্ভুত প্যাঁচানো মিনার, যা আকাশের দিকে আঙুল তুলে হয়তো আজও কোনো এক অজানা বিচার চাইছে (Kennedy, 2004; Gordon, 2001; Waines, 1992).
ক্ষমতার কাঠামো এবং তুর্কি গার্ডদের মনস্তত্ত্ব
সামারার ইতিহাস পাঠ করার সময় আমাদের মনে একটি খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে – তুর্কি গার্ডরা কি আসলেই কোনো শয়তানি শক্তি বা ম্যালভোলেন্ট ফোর্স (Malevolent Force) ছিল? নাকি তারা ছিল পরিস্থিতির শিকার? ইতিহাসকে যখন আমরা সাদা-কালো চশমা দিয়ে দেখি, তখন আমরা অনেক জটিল সত্য মিস করে যাই। তুর্কি গার্ডদের বা ‘গিলমান’দের গল্পটা আসলে এক গভীর ট্র্যাজেডি এবং মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনের গল্প। তাদের আনা হয়েছিল দাস হিসেবে, মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্টেপ বা তৃণভূমি থেকে। তাদের শিকড় বা রুটস (Roots) উপড়ে এনে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল টাইগ্রিস নদীর তীরের এক অপরিচিত মাটিতে। তাদের ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, এমনকি তাদের চেহারাও স্থানীয় আরব বা পারসিকদের থেকে ভিন্ন। তারা ছিল বহিরাগত বা আউটসাইডার (Outsider)। এই বহিরাগত হওয়ার অনুভূতি বা এলিয়েনেশন (Alienation) তাদের মনস্তত্ত্বে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তারা জানত, এই সমাজে তাদের কেউ ভালোবাসে না। বাগদাদের রাস্তায় যখন তারা হাঁটত, তখন সাধারণ মানুষ তাদের দিকে ঘৃণার চোখে তাকাত, তাদের ‘অসভ্য’ বা ‘বর্বর’ বলে গালি দিত। স্থানীয় অভিজাতরা তাদের নিচু জাতের বলে অবজ্ঞা করত। এই সামাজিক ঘৃণা বা সোশ্যাল স্টিগমা (Social Stigma) তাদের মধ্যে এক ধরণের প্রতিরক্ষামূলক মানসিকতা বা ডিফেন্সিভ মেকানিজম (Defensive Mechanism) তৈরি করেছিল। তারা বুঝেছিল, এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে হলে তাদের একমাত্র ভরসা হলো তাদের হাতের তরবারি এবং নিজেদের মধ্যকার ঐক্য।
তাদের কাছে ক্ষমতা ধরে রাখাটা কোনো বিলাসিতা ছিল না, এটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন বা এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস (Existential Crisis)। তারা জানত, যেদিন তাদের হাত থেকে অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে, যেদিন খলিফা বা স্থানীয় আরবরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে, সেদিন তাদের কচুকাটা করা হবে। বাগদাদের দাঙ্গায় তারা দেখেছে জনতা কীভাবে তুর্কিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই তাদের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ছিল ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ বা যোগ্যতমের টিকে থাকা (Survival of the Fittest)-র লড়াই। তারা খলিফাদের ওপর ছড়ি ঘোরাত, কারণ তারা ভয় পেত খলিফা শক্তিশালী হলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবার বন্দি করবেন। এই ভয় বা ফিয়ার সাইকোসিস (Fear Psychosis) থেকেই তারা একের পর এক খলিফা হত্যা করেছে, যাতে কেউ তাদের ওপর চড়াও হতে না পারে। তাদের সহিংসতাকে যদি আমরা কেবল ক্ষমতার লোভ হিসেবে দেখি, তবে ভুল হবে; এর পেছনে ছিল গভীর নিরাপত্তাহীনতা। তারা ছিল এমন এক বাঘ, যে জানে খাঁচা থেকে বেরোলেই শিকারিরা তাকে মেরে ফেলবে, তাই সে খাঁচার ভেতরেই রাজত্ব করতে চায়।
কিংমেকার সিনড্রোম এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা
তুর্কি গার্ডদের মনস্তত্ত্বে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বনাম রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব। তারা কখনোই খিলাফত ব্যবস্থা বা খিলাফত ইন্সটিটিউশন (Caliphate Institution)-কে ধ্বংস করতে চায়নি। তারা চাইত না আব্বাসীয় বংশের পতন হোক। কারণ তারা জানত, তাদের বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) আসে খলিফার কাছ থেকে। খলিফা হলেন ধর্মীয় নেতা, তার নামে খুতবা পড়া হয়, তার নামাঙ্কিত মুদ্রা বাজারে চলে। তুর্কিরা যদি খিলাফত ধ্বংস করে নিজেরা সিংহাসনে বসত, তবে মুসলিম বিশ্ব তাদের মেনে নিত না। তাদের ‘কাফের’ বা ধর্মত্যাগী ঘোষণা করা হতো এবং চারদিক থেকে বিদ্রোহ শুরু হতো। তাই তারা চাইত আব্বাসীয় বংশেরই কেউ ক্ষমতায় থাকুক, কিন্তু সে হবে দুর্বল, ব্যক্তিত্বহীন এবং তাদের হাতের পুতুল। তারা চাইত ‘কিং’ হতে নয়, বরং ‘কিংমেকার’ বা রাজা নির্মাতা (Kingmaker) হতে। তারা পেছনের সিটে বসে গাড়ি চালাতে চাইত। এই মানসিকতাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডিপ স্টেট (Deep State) বা রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে অনির্বাচিত সামরিক বা আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করে।
কিন্তু তাদের এই কৌশলে একটি বিশাল গলদ বা ফ্ল (Flaw) ছিল। তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল যে, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে তাদের নিজেদের স্বার্থই বিঘ্নিত হবে। তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে জবাই করে ফেলেছিল। ঘন ঘন খলিফা বদল, গৃহযুদ্ধ এবং অরাজকতা রাষ্ট্রের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। আর রাষ্ট্র না থাকলে, রাজকোষে টাকা না থাকলে, তাদের বেতন কে দেবে? এই সহজ সমীকরণটি তারা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ বা শর্ট-টার্ম গেইন (Short-term Gain)-এর জন্য উপেক্ষা করেছিল। তাদের এই অদূরদর্শিতা বা মায়োপিয়া (Myopia) ছিল আত্মঘাতী। তারা যখন বেতন না পেয়ে দাঙ্গা করত, তখন তারা বুঝত না যে এই বেতন না পাওয়ার কারণ তাদেরই তৈরি করা অস্থিতিশীলতা। তারা ভাবত খলিফারা টাকা লুকিয়ে রাখছে, তাই তারা খলিফাদের ওপর আরও বেশি চড়াও হতো, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করত। এটি ছিল এক দুষ্টচক্র বা ভিসিয়াস সাইকেল (Vicious Cycle), যা থেকে বের হওয়ার বুদ্ধি বা শিক্ষা তাদের ছিল না। তারা ছিল দুর্দান্ত যোদ্ধা, কিন্তু বাজে রাজনীতিবিদ।
সামরিক দাসত্বের প্যারাডক্স
তুর্কি গার্ডদের এই আচরণের মূলে ছিল মধ্যযুগীয় ইসলামিক বিশ্বের এক অনন্য প্রথা – সামরিক দাসত্ব বা মিলিটারি স্লেভারি (Military Slavery)। আল-মু’তাসিম যখন এদের কিনে এনেছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন দাসরা হবে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত। কারণ দাসের কোনো পরিবার নেই, সমাজ নেই, তার সবটুকু আনুগত্য কেবল তার প্রভুর প্রতি। এই তত্ত্বটি কাগজে-কলমে ঠিক ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টো। দাসরা যখন সংখ্যায় অনেক বেশি হলো এবং তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো, তখন তারা একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গোষ্ঠী বা সোশ্যাল ক্লাস (Social Class)-তে পরিণত হলো। তাদের নিজেদের মধ্যে বিয়ে-শাদী হলো, সন্তান হলো। তখন তাদের আনুগত্য খলিফার প্রতি না থেকে নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতি বা কর্পোরেট লয়্যালটি (Corporate Loyalty)-তে স্থানান্তরিত হলো। তারা দেখল খলিফা তাদের ব্যবহার করছেন, তাই তারাও খলিফাকে ব্যবহার করতে শুরু করল।
এই পরিবর্তনকে ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল পাইপস তার বই স্লেভ সোলজার্স অ্যান্ড ইসলাম (Slave Soldiers and Islam)-এ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, সামরিক দাসরা যখন বুঝতে পারে যে রাষ্ট্রের টিকে থাকা তাদের ওপর নির্ভরশীল, তখন তারা আর দাস থাকে না, তারা প্রভুতে পরিণত হয়। কিন্তু তাদের নামের সাথে ‘দাস’ বা ‘মামলুক’ শব্দটি থেকে যায়, যা তাদের সামাজিকভাবে নিচু করে রাখে। এই সামাজিক হীনম্মন্যতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সংমিশ্রণ তাদের আচরণকে জটিল এবং হিংস্র করে তোলে। তারা সবসময় প্রমাণ করতে চায় যে তারা নিচু নয়, তারা শক্তিশালী। সামারার তুর্কি জেনারেলরা – যেমন ওয়াসিফ, বুগা বা বায়েকবাক – সবাই ছিলেন এই প্যারাডক্সের শিকার। তারা প্রাসাদে বাস করত, রেশমি পোশাক পরত, কিন্তু অভিজাত আরবরা তাদের আড়ালে ‘গোলাম’ বলে ডাকত। এই অপমান তাদের আরও বেশি বেপরোয়া করে তুলত। তারা ভাবত, “আমরা গোলাম হতে পারি, কিন্তু আমাদের হাতেই তোমাদের জীবন-মরণ।” এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সামারার রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের এক বড় কারণ।
গোষ্ঠী সংহতি বা ‘আসাবিয়াহ’-র বিকৃত রূপ
ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত মুকাদ্দিমাহ (Muqaddimah) গ্রন্থে আসাবিয়াহ (Asabiyyah) বা সামাজিক সংহতির কথা বলেছেন, যা একটি রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য গড়ার মূল ভিত্তি। সামারার তুর্কিদের মধ্যেও এক প্রবল ‘আসাবিয়াহ’ ছিল, কিন্তু তা ছিল রাষ্ট্রের পক্ষে নয়, বরং রাষ্ট্রের বিপক্ষে। তাদের এই সংহতি ছিল জাতিগত বা এথনিক সলিডারিটি (Ethnic Solidarity)। একজন তুর্কি সৈন্য আরেকজন তুর্কি সৈন্যের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু খলিফার জন্য নয়। যখনই কোনো তুর্কি জেনারেল বিপদে পড়ত, বা কোনো তুর্কি সৈন্যের বেতন বকেয়া থাকত, তখন পুরো তুর্কি বাহিনী এক হয়ে যেত। এই ঐক্যই তাদের এত শক্তিশালী করেছিল। খলিফারা বারবার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে (যেমন আল-মু’তাজ বা আল-মুহতাদি করেছিলেন), কিন্তু তুর্কিদের এই জাতিগত বন্ধন বা ট্রাইবালইজম (Tribalism) ছিল অনেক বেশি মজবুত। তারা জানত, একা একা তারা দুর্বল, কিন্তু একসাথে তারা অপরাজেয়।
তবে তাদের এই সংহতিরও একটা সীমা ছিল। যখন লুটের মালের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে প্রশ্ন আসত, তখন তারা নিজেদের মধ্যেও মারামারি করত। সামারার অরাজকতার সময় আমরা দেখেছি তুর্কিদের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে (যেমন মুসা ইবনে বুগা বনাম সালিহ ইবনে ওয়াসিফ)। কিন্তু যখনই বাইরের কোনো শক্তি (যেমন বাগদাদের তাহিরিদরা বা মাঘারিবা সৈন্যরা) তাদের ওপর আঘাত হেনেছে, তারা সব ভুলে এক হয়ে গেছে। তাদের এই আচরণ ছিল অনেকটা মাফিয়া পরিবার বা ক্রাইম সিন্ডিকেট (Crime Syndicate)-এর মতো। নিজেদের মধ্যে কোন্দল থাকলেও পুলিশ বা বাইরের শত্রুর সামনে তারা এক। এই বিকৃত সংহতি আব্বাসীয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে অকেজো করে দিয়েছিল, কারণ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যদি রাষ্ট্রের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখে, তবে সেই রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য।
সামারার শিক্ষা: সামরিকায়নের বিপদ
সামারার এই ঘটনাপ্রবাহ এবং তুর্কিদের ভূমিকা আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ দেয় – মিলিটারাইজেশন অফ পলিটিক্স (Militarization of Politics) বা রাজনীতির সামরিকায়নের বিপদ। যখন সিভিল প্রশাসন দুর্বল হয় এবং সেনাবাহিনী রাজনীতির চালকের আসনে বসে, তখন কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সামারা তার ধ্রুপদী উদাহরণ। তুর্কিরা যোদ্ধা হিসেবে ছিল বিশ্বসেরা, কিন্তু দেশ চালানোর কোনো যোগ্যতা বা প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না। তারা অর্থনীতি বুঝত না, কূটনীতি বুঝত না, বিচারব্যবস্থা বুঝত না। তারা কেবল বুঝত বলপ্রয়োগ বা ব্রুট ফোর্স (Brute Force)। ফলে তারা জটিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চাইত তরবারি দিয়ে, যা সমস্যাকে আরও জটিল করত। আল-মুস্তাইনের সময় যখন অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিল, তখন তারা খরচ কমানোর বা রাজস্ব বাড়ানোর কোনো টেকসই পরিকল্পনা না করে খলিফাকে চাপ দিল টাকা দেওয়ার জন্য। খলিফা টাকা দিতে না পারায় তারা তাকে সরিয়ে দিল। এই যে সমস্যার মূলে না গিয়ে কেবল ক্ষমতার রদবদল – এটি সামরিক শাসনের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
সামারার অরাজকতা প্রমাণ করে যে, বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস হতে পারে, কিন্তু তা স্থায়িত্বের উৎস নয়। তুর্কিরা সাময়িকভাবে ক্ষমতা ভোগ করেছে, বিপুল ধনসম্পদ লুট করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা একটি ধ্বংসস্তূপের ওপর রাজত্ব করেছে। তাদের নিজেদের সন্তানরা বা পরবর্তী প্রজন্মও এই অরাজকতার শিকার হয়েছে। আব্বাসীয় খিলাফত, যা একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বাতিঘর ছিল, তা তুর্কিদের হাতে পড়ে একটি রুগ্ণ ও পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত হলো। এই ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, ক্ষমতা এবং দায়িত্ব বা পাওয়ার অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটি (Power and Responsibility) একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তুর্কিরা ক্ষমতা চেয়েছিল, কিন্তু দায়িত্ব নিতে চায়নি। আর দায়িত্বহীন ক্ষমতা বা আনএকাউন্টেবল পাওয়ার (Unaccountable Power) শেষ পর্যন্ত কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে – শাসক এবং শাসিত উভয়ের জন্যই। (Pipes, 1981; Crone, 1980; Gordon, 2001).
সামারার নৈরাজ্যের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর সত্য হলো, কোনো বড় বিপর্যয়ই কেবল সেই মুহূর্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; তার রেশ বা ‘আফটারশক’ (Aftershock) চলতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ৮৬১ থেকে ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ – এই নয় বছরের সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra) আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে ঠিক তেমনই এক ভূমিকম্প ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, আল-মুওয়াফফাকের মতো একজন দক্ষ নেতার আগমনে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহ দমিত হয়েছে, রাজধানী আবার বাগদাদে ফিরেছে, খলিফার নামে আবার খুতবা পড়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ছিল ওপরের প্রলেপ মাত্র। ভেতরে ভেতরে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ডটি এমনভাবে ভেঙে গিয়েছিল যা আর কখনোই জোড়া লাগেনি। একটি বিশাল ইমারতের ভিত্তি নড়ে গেলে যেমন তা মেরামত করা যায় না, কেবল ভেঙে পড়ার অপেক্ষা করতে হয়, আব্বাসীয়দের অবস্থাও হয়েছিল তাই। এই নয় বছরের রক্তপাত, ষড়যন্ত্র আর অবিশ্বাস রাষ্ট্রযন্ত্রের ডিএনএ বা জেনেটিক কোড (Genetic Code) বদলে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা যে আব্বাসীয় ইতিহাস দেখি, তা আর হারুনুর রশিদের সেই গৌরবময় সাম্রাজ্য নয়, বরং তা ছিল একটি ক্ষয়িষ্ণু এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুপথযাত্রী রাষ্ট্র। এই পতনের পেছনে সামারার নৈরাজ্যের তিনটি প্রধান দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ছিল, যা মুসলিম বিশ্বের রাজনীতির গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছিল।
১. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা: কেন্দ্র বিমুখিনতা ও প্রাদেশিক স্বাধীনতা
সামারার নৈরাজ্যের সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং তাৎক্ষণিক প্রভাব ছিল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক এবং প্রশাসনিক অখণ্ডতা নষ্ট হওয়া। আব্বাসীয় সাম্রাজ্য ছিল বিশাল – পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা থেকে পূর্বে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিশাল ভূখণ্ড শাসন করা হতো একটি অত্যন্ত শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার বা সেন্ট্রালাইজড গভর্নমেন্ট (Centralized Government)-এর মাধ্যমে, যার কেন্দ্র ছিল বাগদাদ বা সামারা। কিন্তু সামারায় যখন খলিফারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন দূরবর্তী প্রদেশের গভর্নররা এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন। তারা দেখলেন, কেন্দ্র দুর্বল, খলিফা অসহায় এবং সেনাবাহিনী বিভক্ত। এই সুযোগে তারা নিজেদের অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসন করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। একে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পলিটিক্যাল ফ্র্যাগমেন্টেশন (Political Fragmentation) বা রাজনৈতিক খণ্ডীকরণ। এটি কোনো আনুষ্ঠানিক বিদ্রোহ ছিল না, বরং এটি ছিল এক নীরব বিচ্ছিন্নতা।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মিশর। মিশর ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার এবং সবচেয়ে ধনী প্রদেশ। মিশরের নীল নদের উর্বর পলিমাটি থেকে যে বিপুল পরিমাণ শস্য উৎপাদিত হতো এবং লোহিত সাগর দিয়ে যে বাণিজ্য হতো, তার ট্যাক্স বা রাজস্ব ছিল বাগদাদের রাজকোষের প্রধান উৎস। কিন্তু সামারার অরাজকতার সময় মিশরে পাঠানো হলো আহমদ ইবনে তুলুন (Ahmad ibn Tulun) নামের এক তুর্কি গভর্নরকে। ইবনে তুলুন ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তিনি দেখলেন সামারায় তার প্রভুরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। তিনি ভাবলেন, “আমি কেন এই পাগলদের কাছে মিশরের কষ্টার্জিত টাকা পাঠাব?” তিনি বাগদাদে কর পাঠানো বন্ধ করে দিলেন অথবা নামমাত্র উপহার পাঠাতে শুরু করলেন। সেই জমানো টাকা দিয়ে তিনি মিশরে নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন, কায়রোতে নিজের নামে বিশাল মসজিদ (ইবনে তুলুন মসজিদ) তৈরি করলেন এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করলেন। কার্যত, তিনি মিশরে এক স্বাধীন রাজবংশ – তুলুনিদ রাজবংশ (Tulunid Dynasty) – প্রতিষ্ঠা করলেন। বাগদাদের খলিফা বা আল-মুওয়াফফাক এটা জানতেন, কিন্তু তাদের কিছু করার ছিল না। কারণ ইবনে তুলুনকে দমন করার মতো শক্তি বা অর্থ তাদের ছিল না। এভাবেই আব্বাসীয়দের হাত থেকে তাদের সবচেয়ে ধনী প্রদেশটি ফসকে গেল।
একই ঘটনা ঘটল পূর্বে, ইরানে। সেখানে ইয়াকুব ইবনে আল-লাইস আল-সাফফার (Ya’qub ibn al-Layth al-Saffar) নামে এক সাধারণ তামার কারিগর বা কপারস্মিথ (Coppersmith) বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তিনি কোনো অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন না, ছিলেন মাটির মানুষ। তিনি সামারার তুর্কিদের ঘৃণা করতেন এবং বলতেন যে আব্বাসীয়রা ইসলামের পথ থেকে সরে গেছে। তিনি ইরানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে সাফফারিয় রাজবংশ (Saffarid Dynasty) প্রতিষ্ঠা করলেন। ইয়াকুব এতটাই সাহসী ছিলেন যে তিনি বাগদাদ দখলের জন্যও এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও আল-মুওয়াফফাক তাকে পরাজিত করেছিলেন, কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করল যে, খলিফার খাস তালুক বা কোর ল্যান্ড (Core Land)-এর বাইরে তার আর কোনো কর্তৃত্ব নেই। সামারার অরাজকতা প্রদেশগুলোকে শিখিয়েছিল যে, বাগদাদ বাঘ নয়, কাগজের বাঘ। ফলে আব্বাসীয় খিলাফত একটি একক সাম্রাজ্য বা ইউনিটারি স্টেট (Unitary State) থেকে পরিণত হলো একটি শিথিল কমনওয়েলথে, যেখানে খলিফা কেবল নামেমাত্র প্রধান, আর আসল ক্ষমতা স্থানীয় রাজাদের হাতে।
২. খলিফার মর্যাদা হানি: ঐশ্বরিক ছায়া থেকে মাটির পুতুল
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিটি হয়েছিল মনস্তাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে। ইসলামের ইতিহাসে খলিফাকে দেখা হতো এক অতিমানবিক উচ্চতায়। খলিফা ছিলেন ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা, নবীর প্রতিনিধি এবং পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের ছায়া বা শ্যাডো অফ গড (Shadow of God)। সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস ছিল যে, খলিফার শরীরে খোদায়ী নূর বা অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা তার গায়ে হাত তোলা মহাপাপ বা স্যাক্রিলেজ (Sacrilege)। হারুনুর রশিদের সময় খলিফাকে দেখা হতো ভক্তি এবং ভয়ের মিশ্রণে। কিন্তু সামারার নয় বছরে যা ঘটল, তা এই মিথ বা বিশ্বাসকে চুরমার করে দিল।
মানুষ দেখল, তাদের ‘পবিত্র’ খলিফাকে তার নিজের রক্ষীরাই মাতাল অবস্থায় খুন করছে (আল-মুতাওয়াক্কিল)। তারা দেখল, খলিফাকে রোদে দাঁড় করিয়ে লাথি মারা হচ্ছে এবং পিপাসায় তিনি মারা যাচ্ছেন (আল-মু’তাজ)। তারা দেখল, খলিফার কাটা মাথা ঝুড়িতে করে পাঠানো হচ্ছে এবং আরেক খলিফা তা দেখে দাবা খেলছেন। এই দৃশ্যগুলো সাধারণ মানুষের মন থেকে খলিফার প্রতি ভক্তি, ভয় এবং সম্ভ্রম মুছে ফেলল। একে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার-এর ভাষায় বলা যায় ডিসএনচ্যান্টমেন্ট (Disenchantment) বা মোহভঙ্গ। খলিফা যে কোনো অলৌকিক সত্তা নন, বরং তিনিও যে রক্তমাংসের দুর্বল মানুষ, তা জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। খলিফার এই মর্যাদা হানি মুসলিম সমাজের ধর্মীয় কাঠামোতেও পরিবর্তন আনল। মানুষ দেখল খলিফারা দুর্নীতিপরায়ণ এবং দুর্বল, তাই তারা ধর্মীয় নির্দেশনার জন্য খলিফার বদলে আলেম বা উলামা (Ulama) সমাজের দিকে ঝুঁকতে শুরু করল। এতদিন খলিফা ছিলেন একই সাথে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা। কিন্তু সামারার পর থেকে ধর্মীয় কর্তৃত্ব বা রিলিজিয়াস অথরিটি (Religious Authority) চলে গেল আলেমদের হাতে, আর খলিফা হয়ে রইলেন কেবল এক রাজনৈতিক পুতুল। এই বিভাজন বা সেপারেশন অফ পাওয়ার (Separation of Power) মুসলিম ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
এই সময়কার সাহিত্য এবং কবিতাতেও এই হতাশার ছাপ পাওয়া যায়। বিখ্যাত সাহিত্যিক আল-জাহিজ (Al-Jahiz) বা কবি আল-বুহতুরি (Al-Buhturi) – যারা সামারার দরবারে ছিলেন – তাদের লেখায় আমরা দেখি এক তীব্র বিদ্রূপ এবং হাহাকার। তারা খলিফাদের প্রশংসা করতেন টাকার জন্য, কিন্তু তাদের কবিতায় লুকিয়ে থাকত করুণা। আল-বুহতুরি তার কবিতায় সামারার ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়ে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক হতাশা বা ইন্টেলেকচুয়াল ডেসপেয়ার (Intellectual Despair) আব্বাসীয় সমাজের সৃজনশীলতাকেও ভোঁতা করে দিয়েছিল। মানুষ আর রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করত না, তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল। খলিফার দরবার আর জ্ঞানের কেন্দ্র নয়, বরং ষড়যন্তের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
৩. সামরিক বাহিনীর রাজনীতি: প্রিটোরিয়ানিজমের স্থায়ী সংস্কৃতি
সামারার নৈরাজ্যের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং স্থায়ী লিগ্যাসি বা উত্তরাধিকার হলো রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি, যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রিটোরিয়ানিজম (Praetorianism) বলা হয়। রোমান সাম্রাজ্যে প্রাইটোরিয়ান গার্ডরা যেমন সম্রাটদের ওঠাত এবং নামাত, সামারার তুর্কি গার্ডরা ঠিক একই ভূমিকা পালন করেছিল। আল-মু’তাসিম যে দিন তুর্কি দাসদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের রাজনীতির অংশীদার করেছিলেন, সেদিনই তিনি মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য এক বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছিলেন। সামারার এই নয় বছর প্রমাণ করল যে, যার হাতে তরবারি আছে, সেই আসল ক্ষমতার মালিক। কলমের জোর বা বংশমর্যাদা – সবই তরবারির কাছে তুচ্ছ।
এই ‘সামারা মডেল’ পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সাম্রাজ্য এবং সালতানাতে অনুসৃত হয়েছে। দশম শতাব্দীতে যখন বুয়াইদ (Buyids) রাজবংশ বাগদাদ দখল করে, তখন তারা খলিফাকে হত্যা করেনি, বরং তাকে প্রাসাদে বন্দি রেখে নিজেরা ‘সুলতান’ বা ‘আমির আল-উমারা’ উপাধি নিয়ে দেশ শাসন করেছে। এটি ছিল সামারার তুর্কিদের শিখিয়ে যাওয়া কৌশল – খলিফাকে রাখো বৈধতার জন্য, কিন্তু ক্ষমতা রাখো নিজের হাতে। এরপর এল সেলজুকরা (Seljuqs), তারাও একই পথে হাঁটল। আর মিশরে তো মামলুকরা (Mamluks) সরাসরি ক্ষমতাই দখল করে নিল। মামলুক সালতানাত, যারা প্রায় তিনশ বছর মিশর ও সিরিয়া শাসন করেছে, তারা ছিল সামারার তুর্কি গার্ডদের সরাসরি উত্তরসূরি। তাদের শাসনব্যবস্থা, তাদের দাসপ্রথা, তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ – সবই ছিল সামারার সেই গিলমান ব্যবস্থার উন্নত সংস্করণ। এমনকি পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের জেনিসারি (Janissaries) বাহিনীও ছিল এই একই দর্শনের ফসল। জেনিসারিরাও ছিল দাস, যারা সুলতানের অনুগত থাকার শপথ নিত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সুলতানদেরই হত্যা করতে শুরু করে।
এই ব্যবস্থা বা মিলিটারি প্যাট্রোনেজ স্টেট (Military Patronage State)-এর উত্থান মুসলিম বিশ্বে সিভিলিয়ান বা বেসামরিক রাজনীতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল সেনাবাহিনীর সম্পত্তি। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রকে রক্ষা করার বদলে রাষ্ট্রকে লুট করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। সামারায় তুর্কিরা যে বেতনের জন্য দাঙ্গা করত, সেই একই দৃশ্য আমরা দেখেছি পরবর্তী শতকগুলোতে কায়রোতে, ইস্তাম্বুলে, দিল্লিতে। সামারার অরাজকতা তাই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এটি ছিল এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্মলক্ষণ। এই সংস্কৃতি বলে – আইন নয়, শক্তিই সব।
উপসংহার: এক অনিবার্য পতনের পাঠ
সামারার নৈরাজ্য আমাদের শেখায় যে, ক্ষমতা যখন জবাবদিহিতার বাইরে চলে যায়, তখন তা আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। আব্বাসীয়রা চেষ্টা করেছিল বিদেশি দাসদের দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে আনুগত্য কেনা যায় না, তা অর্জন করতে হয়। তারা রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করেছিল জনগণ থেকে, আর তার ফল হয়েছিল ভয়াবহ। আল-মুওয়াফফাক হয়তো সাময়িকভাবে আব্বাসীয়দের বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যে রাষ্ট্র রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল পঙ্গু। সেই রাষ্ট্রের শরীর ছিল, কিন্তু আত্মা ছিল না। খলিফা ছিলেন, কিন্তু খিলাফত ছিল না।
আজ যখন আমরা মধ্যপ্রাচ্যের বা মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন আমরা দেখি সামারার সেই প্রেতাত্মা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামরিক শাসন, গৃহযুদ্ধ, ধর্মীয় নেতার অবমূল্যায়ন, বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভরতা – এই সবকিছুরই আদি রূপ আমরা খুঁজে পাই নবম শতাব্দীর সেই ধূলিমাখা সামারায়। সামারার পতন তাই কেবল একটি শহরের মৃত্যু নয়, এটি ছিল একটি স্বপ্নের মৃত্যু – যে স্বপ্ন দেখেছিল একটি ন্যায়পরায়ণ এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজের। সেই স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল তুর্কি ঘোড়সওয়ারদের খুরের নিচে, আর সেই ভাঙা টুকরোগুলো আজও আমাদের ইতিহাসকে রক্তাক্ত করে চলেছে। ইতিহাসবিদ হিউ কেনেডি যথার্থই বলেছেন, “সামারা ছিল আব্বাসীয়দের জন্য এক সোনার খাঁচা, যা শেষ পর্যন্ত তাদের কফিনে পরিণত হয়েছিল।” (Yücesoy, 2009; Lapidus, 2014; Crone, 2004).
সামারার নৈরাজ্য: তাত্ত্বিকদের চোখে
ইতিহাস কেবল ঘটনার ধারাবিবরণী নয়, বরং সমাজ ও ক্ষমতার কার্যকারণ সম্পর্ক বোঝার এক গবেষণাগার। সামারার নৈরাজ্যের মতো জটিল ঐতিহাসিক ঘটনাকে গভীরভাবে বুঝতে হলে নিছক তথ্য যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন হয় তাত্ত্বিক কাঠামোর। এই অধ্যায়ে আমরা ইবনে খালদুন, ম্যাক্স ভেবার, ম্যাকিয়াভেলি থেকে শুরু করে রবার্ট রোটবার্গ ও স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতো ধ্রুপদী এবং আধুনিক তাত্ত্বিকদের লেন্স ব্যবহার করব। তাদের তত্ত্বের আলোকে আমরা দেখব, সামারার সেই বিপর্যয় কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিল না, বরং তা ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিছু মৌলিক সূত্রের এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যা ইতিহাসের পাতায় বারবার ফিরে আসে।
ইবনে খালদুন এবং ‘আসাবিয়াহ’-র পতন
চতুর্দশ শতাব্দীর বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun)-কে ছাড়া মুসলিম বিশ্বের কোনো সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন বোঝা প্রায় অসম্ভব। তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুকাদ্দিমাহ (The Muqaddimah)-তে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আসাবিয়াহ (Asabiyyah) নামক একটি ধারণা। ‘আসাবিয়াহ’-র সহজ কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই, তবে একে বলা যেতে পারে সামাজিক সংহতি, গোষ্ঠী চেতনা বা এক ধরণের উগ্র একতা। ইবনে খালদুনের মতে, যেকোনো রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয় একদল মানুষের প্রবল ‘আসাবিয়াহ’-র ওপর ভর করে। সাধারণত যাযাবর বা পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই গুণটি বেশি থাকে, কারণ কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদের একতাবদ্ধ থাকতে হয়। আব্বাসীয়রা যখন উমাইয়াদের হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তখন তাদের পেছনে ছিল খোরাসানি আরব ও পারসিকদের এক শক্তিশালী ‘আসাবিয়াহ’।
কিন্তু ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো রাজবংশ যখন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং শাসকরা যখন শহুরে বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে, তখন তাদের সেই আদি ‘আসাবিয়াহ’ বা সংগ্রামী চেতনা নষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম থেকেই শাসকরা আরামপ্রিয়, দুর্বল এবং পরস্পরের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। আব্বাসীয়দের ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছিল। হারুনুর রশিদের সময়কাল ছিল আব্বাসীয়দের সর্বোচ্চ শিখর, কিন্তু তারপর থেকেই তাদের ‘আসাবিয়াহ’ ক্ষয় হতে শুরু করে। খলিফা আল-মু’তাসিম যখন দেখলেন তার চারপাশের আরব ও পারসিকদের ওপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না, তখন তিনি আসলে তার নিজের রাজবংশের ‘আসাবিয়াহ্’-র অবক্ষয়ই দেখছিলেন। এই শূন্যতা পূরণ করার জন্য তিনি যাযাবর তুর্কিদের ভাড়া করে আনলেন। তুর্কিদের মধ্যে তখন ছিল এক সতেজ এবং উগ্র ‘আসাবিয়াহ্’। তারা ছিল কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী এবং নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতি চরম অনুগত।
এখানেই ইবনে খালদুনের তত্ত্বের এক ট্র্যাজিক সত্য নিহিত। আল-মু’তাসিম ভেবেছিলেন তিনি তুর্কিদের এই নতুন ‘আসাবিয়াহ্’-কে নিজের সিংহাসন রক্ষার কাজে ব্যবহার করবেন। কিন্তু ইবনে খালদুন বলেন, একটি ক্ষয়িষ্ণু ‘আসাবিয়াহ্’ কখনোই একটি নতুন এবং শক্তিশালী ‘আসাবিয়াহ্’-কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নতুন ‘আসাবিয়াহ্’ একসময় পুরনোটাকে গ্রাস করে ফেলে। সামারার নৈরাজ্য ছিল ঠিক এই প্রক্রিয়ারই এক রক্তাক্ত মঞ্চায়ন। তুর্কিরা দেখল, খলিফারা দুর্বল এবং তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো একতা নেই। অন্যদিকে তুর্কিরা নিজেদের জাতিগত পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ। ফলে তারা আর ভাড়াটে সৈন্য বা মারসেনারি (Mercenary) থাকতে চাইল না, তারা নিজেরাই ক্ষমতার চালক হয়ে বসল। তারা আব্বাসীয় খিলাফতকে ধ্বংস করেনি, কারণ তাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না। তারা কেবল ক্ষয়িষ্ণু আব্বাসীয় কাঠামোর ওপর চড়ে বসে নিজেদের ‘আসাবিয়াহ্’-র দাপট প্রতিষ্ঠা করেছিল। সামারার এই ঘটনা ইবনে খালদুনের সেই বিখ্যাত চক্রাকার তত্ত্ব (Cyclical Theory of Dynasties)-কে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে, যেখানে এক রাজবংশের পতনের ছাই থেকেই জন্ম নেয় আরেক নতুন শক্তি, যা একসময় নিজেই বিলাসী হয়ে পতনের দিকে এগিয়ে যায়।
ম্যাক্স ভেবার এবং কর্তৃত্বের সংকট
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার (Max Weber) রাষ্ট্রের ক্ষমতার উৎস নিয়ে কাজ করেছেন। তার মতে, ক্ষমতা বা পাওয়ার (Power) এবং কর্তৃত্ব বা অথরিটি (Authority) এক জিনিস নয়। ক্ষমতা হলো বলপ্রয়োগের সামর্থ্য, আর কর্তৃত্ব হলো সেই ক্ষমতাকে বৈধ হিসেবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা। ভেবার তিন ধরণের বৈধ কর্তৃত্বের কথা বলেছেন:
১. ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব (Traditional Authority): যা বংশপরম্পরায় বা প্রথা অনুযায়ী প্রাপ্ত হয়। যেমন – রাজতন্ত্র।
২. ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব (Charismatic Authority): যা কোনো ব্যক্তির অসাধারণ গুণাবলি বা ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে।
৩. আইন-যুক্তিভিত্তিক কর্তৃত্ব (Legal-Rational Authority): যা আইন বা সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আব্বাসীয় খলিফাদের কর্তৃত্ব ছিল মূলত ঐতিহ্যবাহী। তারা নবীর বংশধর (যদিও তা বিতর্কিত) এবং দীর্ঘদিন ধরে শাসন করে আসছে – এই প্রথাই ছিল তাদের ক্ষমতার ভিত্তি। কিন্তু সামারার নৈরাজ্যে এই ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। যখন খলিফাকে তার নিজের রক্ষীরাই খুন করতে পারে, তখন বংশমর্যাদার আর কোনো মূল্য থাকে না। ভেবারের তত্ত্ব অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব ভেঙে পড়লে শাসকের টিকে থাকার জন্য ক্যারিশমা বা ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আল-মু’তাজ বা আল-মুস্তাইনের মতো খলিফাদের সেই ক্যারিশমা ছিল না। তারা ছিলেন দুর্বল এবং ভীতু। একমাত্র আল-মুহতাদি চেষ্টা করেছিলেন নিজের সততা এবং ধার্মিকতা দিয়ে এক ধরণের ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব (Charismatic Authority) প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।
এই সময়ে তুর্কিদের ছিল নগ্ন ক্ষমতা বা কোয়েরসিভ পাওয়ার (Coercive Power), কিন্তু তাদের কোনো বৈধ কর্তৃত্ব ছিল না। জনগণ বা আলেম সমাজ কেউই তাদের শাসক হিসেবে মেনে নেয়নি। এই বৈধতার সংকট (Legitimacy Crisis)-এর কারণেই তুর্কিরা কখনোই খলিফাদের পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে নিজেরা সিংহাসনে বসেনি। তারা জানত, তাদের এই ক্ষমতা অবৈধ। ভেবারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো মোহভঙ্গ (Disenchantment)। সামারার নৈরাজ্য ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের চূড়ান্ত মোহভঙ্গের মুহূর্ত। মানুষ দেখল, খলিফা কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি নন, তিনিও রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ। এই মোহভঙ্গের ফলে খলিফার পদটি তার পবিত্রতা হারাল এবং নিছক একটি রাজনৈতিক পদে পরিণত হলো, যা যেকোনো সেনাপতি দখল করতে পারে। ভেবারের পৈতৃক শাসনব্যবস্থা (Patrimonialism) তত্ত্বটিও এখানে প্রাসঙ্গিক। খলিফারা রাষ্ট্রকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং তুর্কি দাসদের তাদের ব্যক্তিগত ভৃত্য মনে করতেন। কিন্তু এই ভৃত্যরা যখন শক্তি সঞ্চয় করে প্রভুর বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরল, তখন পুরো প্যাট্রিমনিয়াল কাঠামোটিই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল (Weber, 1947)।
ম্যাকিয়াভেলি এবং ক্ষমতার নির্মম পাঠ
ইতালির রেনেসাঁস যুগের দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli)-র বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য প্রিন্স (The Prince) হলো ক্ষমতার এক নির্মম পাঠ। ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন, একজন শাসককে টিকে থাকার জন্য নৈতিকতা বা ধর্মের চেয়ে বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। তাকে হতে হয় সিংহের মতো সাহসী এবং শিয়ালের মতো ধূর্ত। সামারার খলিফাদের যদি আমরা ম্যাকিয়াভেলির মানদণ্ডে বিচার করি, তবে দেখব তারা সবাই ছিলেন ব্যর্থ ‘প্রিন্স’।
ম্যাকিয়াভেলি তার বইতে ভাড়াটে সৈন্য বা মারসেনারি ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে শাসকদের বারবার সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ভাড়াটে সৈন্যরা কেবল টাকার জন্য যুদ্ধ করে, তাদের কোনো আনুগত্য থাকে না এবং সুযোগ পেলেই তারা শাসকের বিরুদ্ধে চলে যায়। সামারার তুর্কি গার্ডরা ছিল এই তত্ত্বের এক জীবন্ত উদাহরণ। আল-মু’তাসিম যে ভুলটি করেছিলেন, তা হলো তিনি নিজের প্রজাদের ওপর আস্থা না রেখে বিদেশি ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ম্যাকিয়াভেলির মতে, একজন শাসকের নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকতে হয়, যা গঠিত হবে তার নিজের দেশের নাগরিকদের নিয়ে, যাদের থাকবে দেশপ্রেম এবং শাসকের প্রতি আনুগত্য।
আল-মুতাওয়াক্কিল চেষ্টা করেছিলেন সিংহের মতো সাহসী হতে, কিন্তু তিনি শিয়ালের মতো ধূর্ত ছিলেন না। তিনি তুর্কিদের ক্ষমতা খর্ব করার পরিকল্পনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো শক্তি বা কৌশল তার ছিল না। তিনি শত্রুকে দুর্বল না করেই আঘাত করেছিলেন, যা ছিল ম্যাকিয়াভেলির নীতির পরিপন্থী। অন্যদিকে, আল-মুহতাদি চেষ্টা করেছিলেন একজন নৈতিক এবং সদ্গুণসম্পন্ন শাসক হতে। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি বলেন, পৃথিবীতে সবাই যেখানে খারাপ, সেখানে একজন শাসকের পক্ষে সবসময় ভালো থাকা সম্ভব নয়। তাতে কেবল নিজের বিনাশই ডেকে আনা হয়। আল-মুহতাদির করুণ পরিণতি ম্যাকিয়াভেলির এই নির্মম সত্যকেই প্রমাণ করে।
তবে এই নাটকের একজন চরিত্র ছিলেন, যিনি হয়তো ম্যাকিয়াভেলির প্রশংসা পেতেন – তিনি হলেন আল-মুওয়াফফাক। তিনি খলিফা ছিলেন না, কিন্তু তিনি জানতেন কীভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়। তিনি বুঝেছিলেন যে তুর্কিদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা সম্ভব নয়, তাই তিনি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা মুসা ইবনে বুগার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন (শিয়ালের মতো ধূর্ততা)। আবার যখন প্রয়োজন হয়েছে, তখন তিনি জাঞ্জদের বিরুদ্ধে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছেন (সিংহের মতো সাহস)। তিনি নৈতিকতার ধার ধারেননি, বরং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বা স্টেট স্ট্যাবিলিটি (State Stability)-কেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। আল-মুওয়াফফাকের সাফল্য প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার খেলায় টিকে থাকতে হলে আদর্শবাদের চেয়ে বাস্তববাদ বা রিয়ালপলিটিক (Realpolitik) অনেক বেশি কার্যকর (Machiavelli, 1532)।
কার্ল মার্ক্স এবং শ্রেণি ও শোষণের দ্বন্দ্ব
জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স (Karl Marx)-এর তত্ত্ব দিয়েও সামারার নৈরাজ্যকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, যদিও মার্ক্সীয় তত্ত্ব মূলত আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের জন্য তৈরি। মার্ক্সের মূল বক্তব্য হলো, ইতিহাস হলো শ্রেণিসংগ্রাম (Class Struggle)-এর ইতিহাস। সামারার ঘটনাপ্রবাহকে যদি আমরা জাতিগত দ্বন্দ্বের বদলে শ্রেণিদ্বন্দ্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তবে এক নতুন চিত্র ফুটে ওঠে।
সামারার সামরিক বাহিনী একটি একশৈলিক বা মনোলিথিক (Monolithic) গোষ্ঠী ছিল না। এর ভেতরেও শ্রেণি বিভাজন ছিল। ওপরে ছিল মুষ্টিমেয় জেনারেল (ওয়াসিফ, বুগা), যারা ছিল শাসক শ্রেণি বা রুলিং ক্লাস (Ruling Class)। তারা খলিফাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদ – জমি, কর, বাণিজ্য – ভোগ করত। তাদের জীবন ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল। আর নিচে ছিল হাজার হাজার সাধারণ তুর্কি সৈন্য, যারা ছিল অনেকটা সর্বहारा বা প্রলেতারিয়েত (Proletariat)-এর মতো। তাদের নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না, তাদের জীবন ছিল অনিশ্চিত। সামারায় আমরা যে বারবার সৈন্যদের দাঙ্গা করতে দেখি, তা আসলে ছিল এই শোষিত সৈন্য শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষক জেনারেল শ্রেণির এক ধরণের বিদ্রোহ। যখন সাধারণ সৈন্যরা বেতন না পেয়ে খলিফার প্রাসাদ আক্রমণ করত, তখন তারা আসলে খলিফার চেয়ে বেশি ঘৃণা করত তাদের নিজেদের জেনারেলদের, যারা তাদের প্রাপ্য বেতন আত্মসাৎ করত।
এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ আমরা দেখি জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion)-এ। জাঞ্জরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই দাস শ্রেণি, যাদের কোনো মানবিক অধিকার ছিল না। দক্ষিণ ইরাকের লবণাক্ত জমিতে তাদের যেভাবে খাটানো হতো, তা ছিল পুঁজিবাদের আদিম সঞ্চয়ন বা প্রিমিটিভ একিউমুলেশন (Primitive Accumulation)-এর এক ধ্রুপদী উদাহরণ। তাদের শ্রম শোষণ করে যে সম্পদ তৈরি হতো, তা ভোগ করত আরব ও পারসিক ভূস্বামীরা। জাঞ্জ বিদ্রোহ ছিল ইতিহাসের অন্যতম সফল দাস বিদ্রোহ, যা প্রমাণ করে যে শোষণের মাত্রা যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন শোষিত শ্রেণি রুখে দাঁড়ায়। যদিও এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত দমন করা হয়েছিল, কিন্তু এটি আব্বাসীয়দের অর্থনৈতিক ভিত্তি চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছিল। মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সামারার নৈরাজ্য ছিল আব্বাসীয়দের উৎপাদন ব্যবস্থা (Mode of Production)-র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল, যেখানে সামরিক অভিজাততন্ত্র এবং দাসভিত্তিক কৃষি – উভয় ব্যবস্থাই নিজের ভারে ভেঙে পড়ছিল (Marx & Engels, 1848)।
রবার্ট রোটবার্গ এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের তত্ত্ব (Robert Rotberg and the Theory of State Failure)
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যর্থ রাষ্ট্র (Failed State) ধারণাটি খুব প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রবার্ট রোটবার্গ (Robert Rotberg) হলেন এই তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। রোটবার্গের মতে, একটি রাষ্ট্র তখনই ‘ব্যর্থ’ হয় যখন সে তার নাগরিকদের মৌলিক রাজনৈতিক সুবিধা বা পলিটিক্যাল গুডস (Political Goods) প্রদান করতে পারে না। এই সুবিধাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তা। এছাড়া রয়েছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। যদি আমরা রোটবার্গের এই চেকলিস্টটি হাতে নিয়ে নবম শতাব্দীর সামারার দিকে তাকাই, তবে দেখব এটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের পাঠ্যবইয়ের উদাহরণের মতো।
- নিরাপত্তার অভাব (Lack of Security): রোটবার্গের মতে, রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো তার সীমানার ভেতরে এবং বাইরে থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া। সামারার আব্বাসীয় রাষ্ট্র ঠিক এর উল্টোটা করছিল। খলিফা নিজেই তার প্রাসাদে নিরাপদ ছিলেন না। সাধারণ নাগরিকরা রাস্তায় বেরোলে তুর্কি সৈন্যদের হাতে খুন বা লুটের শিকার হতো। রাষ্ট্র যাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছিল (সেনাবাহিনী), তারাই হয়ে উঠেছিল প্রধান হুমকি। এটি হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব (Sovereignty)-র চূড়ান্ত অবক্ষয়।
- কর্তৃত্বের অবক্ষয় (Erosion of Authority): একটি সফল রাষ্ট্রে সরকারের কর্তৃত্বকে জনগণ বৈধ বা লেজিটিমেট (Legitimate) বলে মেনে নেয়। সামারায় খলিফার কোনো কর্তৃত্বই ছিল না। একের পর এক খলিফাকে হত্যা বা অপমান করার মাধ্যমে তুর্কিরা খলিফার পদটিকে একটি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছিল। জনগণও রাষ্ট্রকে আর সম্মান বা ভয় করত না। বাগদাদের ‘আইয়ারুন’ বা মাস্তানদের উত্থান প্রমাণ করে যে, যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে, তখন অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি বা নন-স্টেট অ্যাক্টর (Non-State Actor) সেই শূন্যস্থান পূরণ করে।
- জনপরিষেবার অনুপস্থিতি (Absence of Public Services): রোটবার্গ বলেন, একটি কার্যকর রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য রাস্তাঘাট, সেচ ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো মৌলিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করে। আমরা দেখেছি, সামারার নৈরাজ্যে দক্ষিণ ইরাকের সেচ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল, যা ভয়াবহ কৃষি বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষের জন্ম দেয়। রাষ্ট্র তার সবচেয়ে মৌলিক অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছিল।
- অর্থনৈতিক বিপর্যয় (Economic Collapse): একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষণ হলো লাগামহীন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের স্থবিরতা। সামারার রাজকোষ ছিল শূন্য, তুর্কি জেনারেলরা প্রকাশ্য দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল, এবং মুদ্রাস্ফীতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে মুদ্রা তার মূল্য হারিয়েছিল।
রোটবার্গের তত্ত্ব অনুযায়ী, সামারার আব্বাসীয় খিলাফত তখন আর একটি কার্যকর রাষ্ট্র ছিল না; এটি পরিণত হয়েছিল এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে (Failed State)। এই তত্ত্বটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, সামারার সংকট কেবল কয়েকজন খলিফা বা জেনারেলের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ছিল না, এটি ছিল একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা বা ইনস্টিটিউশনাল ফেলিওর (Institutional Failure), যেখানে রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলোই ধসে পড়েছিল (Rotberg, 2004)।
স্যামুয়েল হান্টিংটন এবং সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক (Samuel Huntington and Civil-Military Relations)
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (Samuel P. Huntington) তার বিখ্যাত বই দ্য সোলজার অ্যান্ড দ্য স্টেট (The Soldier and the State)-এ সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে যুগান্তকারী তত্ত্ব দিয়েছেন। হান্টিংটনের মতে, একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ (Objective Civilian Control)। এর মানে হলো, সেনাবাহিনীকে হতে হবে সম্পূর্ণ পেশাদার এবং রাজনীতি নিরপেক্ষ বা অরাজনৈতিক (Apolitical)। সেনাবাহিনীর কাজ হবে দেশের সীমান্ত রক্ষা করা এবং বেসামরিক সরকারের নির্দেশ পালন করা, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানো নয়। সেনাবাহিনী যত বেশি পেশাদার হবে, তারা তত বেশি নিজেদের সামরিক কাজে মনোনিবেশ করবে এবং রাজনীতির লোভ থেকে দূরে থাকবে।
হান্টিংটনের এই আদর্শ পৃথিবীর ঠিক উল্টো চিত্র ছিল সামারার নৈরাজ্য। সামারার তুর্কি গার্ডরা কোনো পেশাদার সেনাবাহিনী ছিল না; তারা ছিল একটি রাজনৈতিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বা পলিটিক্যাল মিলিশিয়া (Political Militia)। খলিফা আল-মু’তাসিম যখন তাদের তৈরি করেছিলেন, তখন তিনি হান্টিংটনের ‘বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ’-এর পথে হাঁটেননি। বরং তিনি চেষ্টা করেছিলেন ব্যক্তিগত বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ (Subjective Civilian Control) প্রতিষ্ঠা করতে। অর্থাৎ, তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের প্রতি নয়, বরং ব্যক্তিগত তার প্রতি অনুগত থাকুক। হান্টিংটন এই ধরণের নিয়ন্ত্রণকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করেন, কারণ এতে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজেদের একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে ভাবতে শুরু করে।
সামারায় ঠিক তাই হয়েছিল। তুর্কিরা খলিফার ব্যক্তিগত রক্ষী হিসেবে শুরু করলেও, তারা দ্রুতই নিজেদের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবিষ্কার করে। তাদের আনুগত্য আর খলিফার প্রতি রইল না, রইল তাদের নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতি। তারা রাজনীতিতে এতটাই জড়িয়ে পড়ল যে, খলিফা নির্বাচন করা থেকে শুরু করে উজির নিয়োগ – সবই তারা নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এই অবস্থাকে হান্টিংটন বলেছেন প্রিটোরিয়ানিজম (Praetorianism), যেখানে সামরিক বাহিনীই হয়ে ওঠে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এবং রাষ্ট্র হয়ে পড়ে তাদের খেলার মাঠ। হান্টিংটনের তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, আল-মু’তাসিমের সেই আদি ভুল – সেনাবাহিনীকে রাজনীতির অংশীদার করা – কীভাবে এক অনিবার্য চেইন রিয়্যাকশনের মাধ্যমে পুরো রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সামারার ইতিহাস হলো সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের সীমা লঙ্ঘনের এক নির্মম পাঠ (Huntington, 1957)।
ডগলাস নর্থ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির পাঠ (Douglass North and the Lessons of Institutional Economics)
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ডগলাস নর্থ (Douglass North) দেখিয়েছেন যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি কেবল তার প্রাকৃতিক সম্পদ বা প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে তার প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশন (Institution)-এর ওপর। নর্থের মতে, প্রতিষ্ঠান হলো সমাজের খেলার নিয়ম বা রুলস অফ দ্য গেম (Rules of the Game)। এই নিয়মগুলো যদি হয় স্বচ্ছ, স্থিতিশীল এবং সবার জন্য সমান, তবে মানুষ বিনিয়োগ করতে, ব্যবসা করতে এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে উৎসাহী হয়। একে তিনি বলেছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান (Inclusive Institutions)। অন্যদিকে, নিয়মগুলো যদি হয় অস্বচ্ছ, খামখেয়ালি এবং কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থে তৈরি, তবে সমাজে কোনো অর্থনৈতিক উন্নতি হয় না। একে তিনি বলেছেন শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান (Extractive Institutions)।
সামারার নৈরাজ্য ছিল শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানের এক চরম উদাহরণ। সেখানে কোনো আইনের শাসন ছিল না, ছিল তরবারির শাসন। কোনো ব্যবসায়ীর যদি অনেক লাভ হতো, তবে তুর্কি জেনারেলরা যেকোনো মুহূর্তে তার সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারত। কোনো কৃষকের যদি ভালো ফসল হতো, তবে সৈন্যরা এসে তা লুট করে নিয়ে যেত। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করবে? কেউ কেন নতুন খাল খনন করবে বা নতুন কারখানা বানাবে? সমাজের ইনসেনটিভ স্ট্রাকচার (Incentive Structure) বা প্রণোদনার কাঠামোটিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একমাত্র লাভজনক ‘ব্যবসা’ ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে লুটপাট করা।
নর্থের তত্ত্ব অনুযায়ী, সামারার অর্থনৈতিক বিপর্যয় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না, এটি ছিল মনুষ্যসৃষ্ট – দুর্বল এবং শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানের ফল। খলিফারা যখন নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য তুর্কিদের হাতে রাষ্ট্রকে ইজারা দিয়ে দিলেন, তখন তারা আসলে সমাজের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্বার্থকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। তুর্কিদের কোনো আগ্রহ ছিল না সেচ ব্যবস্থা ঠিক রাখার বা বাণিজ্য পথ নিরাপদ রাখার। তাদের একমাত্র আগ্রহ ছিল নগদ টাকা আদায় করা। এই শর্ট-টার্ম (Short-term) বা স্বল্পমেয়াদী মানসিকতা পুরো সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ডগলাস নর্থের কাজ আমাদের শেখায় যে, রাজনীতি এবং অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যদি ভেঙে পড়ে, তবে তার অর্থনৈতিক পতনও অনিবার্য (North, 1990)।
উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব এবং পরিচয়ের রাজনীতি (Post-Colonial Theory and the Politics of Identity)
যদিও আব্বাসীয় খিলাফত কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না, কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক বা পোস্ট-কলোনিয়াল (Post-Colonial) তত্ত্বের কিছু ধারণা সামারার তুর্কিদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। এই তত্ত্ব মূলত ক্ষমতা, সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। তুর্কিদের আনা হয়েছিল ‘অপর’ বা দ্য আদার (The Other) হিসেবে। তারা ছিল সাংস্কৃতিকভাবে এবং জাতিগতভাবে আরব-পারসিক অভিজাততন্ত্র থেকে ভিন্ন। তাদের দেখা হতো ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে, সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে নয়। এই ‘অপরকরণ’ বা আদারিং (Othering)-এর প্রক্রিয়া তাদের মধ্যে এক তীব্র গোষ্ঠী চেতনা এবং প্রতিরক্ষামূলক মানসিকতা তৈরি করে।
গায়ত্রী চক্রবর্তীর মতো চিন্তাবিদরা সাবঅল্টার্ন (Subaltern) বা নিম্নবর্গীয় শ্রেণির কথা বলেছেন, যাদের কণ্ঠস্বর ইতিহাসের পাতায় শোনা যায় না। সামারার তুর্কিরা ছিল সেই সাবঅল্টার্ন, যারা একসময় প্রভুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে নিজেরাই ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। কিন্তু ক্ষমতায় এলেও তারা তাদের সেই আদি পরিচয় বা আইডেন্টিটি (Identity) থেকে মুক্তি পায়নি। তারা জানত, অভিজাত সমাজ তাদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। এই হীনম্মন্যতা এবং ক্ষমতার দম্ভের এক অদ্ভুত মিশেল তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করত। তারা একদিকে যেমন খলিফাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য, অন্যদিকে তেমনি খলিফার প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখত নিজেদের বৈধতা আদায়ের জন্য।
তাদের এই দ্বৈত আচরণ – একই সাথে ধ্বংসকারী এবং রক্ষাকর্তা – পরিচয়ের রাজনীতি (Identity Politics)-র এক জটিল উদাহরণ। তারা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অংশ হতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের কখনোই পুরোপুরি অংশ হতে দেওয়া হয়নি। এই প্রত্যাখ্যানই তাদের আরও বেশি হিংস্র এবং ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিল। উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, ক্ষমতা কেবল অর্থনীতি বা রাজনীতির বিষয় নয়, এটি সংস্কৃতি এবং পরিচয়েরও বিষয়। সামারার তুর্কিদের গল্প আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
বিভিন্ন কালের এবং বিভিন্ন দেশের তাত্ত্বিকদের তত্ত্বগুলো যখন একত্রিত হয়, তখন তা সামারার নৈরাজ্যকালের এক সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে। ইবনে খালদুনের ‘আসাবিয়াহ’-র পতন, ওয়েবারের কর্তৃত্বের সংকট, ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতার নির্মম পাঠ এবং রোটবার্গের ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ তত্ত্ব – সবই আমাদের দেখায় যে এই বিপর্যয় ছিল প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের ফল। এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে মূল শিক্ষাটি হলো, রাষ্ট্র যখন তার প্রতিষ্ঠান, পারস্পরিক আস্থা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য হারায়, তখন তার পতন অনিবার্য। তুর্কিরা ছিল সেই পতনের অনুঘটক মাত্র। সামারার ধ্বংসস্তূপ তাই কেবল অতীতের গল্প নয়, বর্তমানের জন্যও এক চিরন্তন সতর্কবার্তা।
উপসংহার: ইতিহাসের আয়নায় সামারা
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, সামারার এই অরাজকতা কেবল কিছু খলিফা আর সেনাপতির গল্প নয়। এটি ক্ষমতার এক চিরন্তন ট্রাজেডি। মানুষ যখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চায়, তখন সে নিজের অজান্তেই নিজের বিনাশ ডেকে আনে। আল-মুতাওয়াক্কিল চেয়েছিলেন তুর্কিদের সাইজ করতে, প্রাণ দিলেন তিনি। তুর্কিরা চাইল আজীবন ক্ষমতা ভোগ করতে, কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যেও কোন্দল আর হত্যার শেষ রইল না। কাবিহা চেয়েছিলেন টাকা বাঁচাতে, হারালেন ছেলে ও সম্পদ দুটোই।
সামারা আজ এক ধূলিকণাময় স্মৃতি। এর বিখ্যাত প্যাঁচানো মিনার বা মালউইরা মিনার (Malwiya Minaret) আজও মরুভূমির বুকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুতদর্শন সেই মিনার, যেন সেই সময়ের এক নীরব সাক্ষী। সেখানে এখন আর তুর্কি ঘোড়সওয়ারদের দাপট নেই, তরবারির ঝনঝনানি নেই, খলিফাদের আর্তনাদ নেই। আছে কেবল বাতাসের হাহাকার আর ধ্বংসস্তূপ। মানুষ ভাবে তারা ইতিহাস তৈরি করছে, তারা অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু আসলে তারা ইতিহাসের স্রোতে ভেসে যাওয়া খড়কুটো মাত্র।
এই সময়টা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কোনো সাম্রাজ্যই চিরস্থায়ী নয়। রাষ্ট্রের ভিত্তি যদি ন্যায়বিচার, অর্থনীতি আর সুশাসনের ওপর না হয়ে কেবল পেশিশক্তি আর ষড়যন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তা তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে। সেটা নবম শতাব্দীর সামারা হোক কিংবা একবিংশ শতাব্দীর কোনো আধুনিক রাষ্ট্র। ক্ষমতার সমীকরণ বদলায়, পাত্র বদলায়, কিন্তু মানুষের লোভ, হিংসা আর ভুলের ধরণগুলো একই থেকে যায়। সামারার ধ্বংসস্তূপের নিচে কান পাতলে হয়তো আজও সেই অরাজকতার ফিসফিসানি শোনা যায় – এক সতর্কবাণী হিসেবে, যা আমরা বারবার শুনেও শুনি না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, কিন্তু মানুষের স্বভাব হলো ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়া। আর তাই, চক্রাকারে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকে।
তথ্যসূত্র
- Bianquis, T. (1998). Autonomous Egypt from Ibn Tulun to Kafur, 868-969. In C. F. Petry (Ed.), The Cambridge History of Egypt, Vol. 1: Islamic Egypt, 640-1517 (pp. 86-119). Cambridge University Press.
- Bosworth, C. E. (1996). The New Islamic Dynasties: A Chronological and Genealogical Manual. Columbia University Press.
- Chejne, A. G. (1982). Ibn Hazm. Kazi Publications.
- Cobb, P. M. (2014). The Race for Paradise: An Islamic History of the Crusades. Oxford University Press.
- Crone, P. (1980). Slaves on Horses: The Evolution of the Islamic Polity. Cambridge University Press.
- Crone, P. (2004). God’s Rule: Government and Islam. Columbia University Press.
- El-Hibri, T. (1999). Reinterpreting Islamic Historiography: Harun al-Rashid and the Narrative of the Abbasid Caliphate. Cambridge University Press.
- Gordon, M. S. (2001). The Breaking of a Thousand Swords: A History of the Turkish Military of Samarra (A.H. 200–275/815–889 C.E.). State University of New York Press.
- Huntington, S. P. (1957). The Soldier and the State: The Theory and Politics of Civil-Military Relations. Harvard University Press.
- Ibn Khaldun. (1967). The Muqaddimah: An Introduction to History (F. Rosenthal, Trans.). Princeton University Press.
- Kennedy, H. (2001). The Armies of the Caliphs: Military and Society in the Early Islamic State. Routledge.
- Kennedy, H. (2004). The Prophet and the Age of the Caliphates: The Islamic Near East from the 6th to the 11th Century (2nd ed.). Pearson Longman.
- Lapidus, I. M. (2014). A History of Islamic Societies (3rd ed.). Cambridge University Press.
- Lassner, J. (1980). The Topography of Baghdad in the Early Middle Ages: Text and Studies. Wayne State University Press.
- Machiavelli, N. (2008). The Prince (W. K. Marriott, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1532)
- Marx, K., & Engels, F. (2002). The Communist Manifesto (S. Moore, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1848)
- Melchert, C. (1996). Religious Policies of the Caliphs from al-Mutawakkil to al-Muqtadir, AH 232-295/AD 847-908. Islamic Law and Society, 3(3), 316-342.
- North, D. C. (1990). Institutions, Institutional Change and Economic Performance. Cambridge University Press.
- Northedge, A. (2007). The Historical Topography of Samarra. British School of Archaeology in Iraq.
- Pipes, D. (1981). Slave Soldiers and Islam: The Genesis of a Military System. Yale University Press.
- Popovic, A. (1999). The Revolt of African Slaves in Iraq in the 3rd/9th Century. Markus Wiener Publishers.
- Rotberg, R. I. (Ed.). (2004). When States Fail: Causes and Consequences. Princeton University Press.
- Shaban, M. A. (1976). Islamic History: A New Interpretation, Vol. 2: A.D. 750-1055 (A.H. 132-448). Cambridge University Press.
- Sourdel, D. (1970). The Abbasid Caliphate. In P. M. Holt, A. K. S. Lambton, & B. Lewis (Eds.), The Cambridge History of Islam (Vol. 1A, pp. 104–139). Cambridge University Press.
- Tabari, A. (1989). The History of al-Tabari Vol. 34: Incipient Decline: The Caliphates of al-Wathiq, al-Mutawakkil, and al-Muntasir, A.D. 841-863/A.H. 227-248 (J. L. Kraemer, Trans.). SUNY Press.
- Tabari, A. (1992). The History of al-Tabari Vol. 36: The Revolt of the Zanj, A.D. 869-879/A.H. 255-265 (D. Waines, Trans.). SUNY Press.
- Turner, J. P. (2013). Inquisition in Early Islam: The Competition for Political and Religious Authority in the Abbasid Empire. I.B. Tauris.
- Waines, D. (Trans.). (1992). The History of al-Tabari Vol. 36: The Revolt of the Zanj, A.D. 869-879/A.H. 255-265. SUNY Press.
- Weber, M. (1947). The Theory of Social and Economic Organization (A. M. Henderson & T. Parsons, Trans.). Free Press.
- Yücesoy, H. (2009). Messianic Beliefs and Imperial Politics in Medieval Islam: The ʻAbbāsid Caliphate in the Early Ninth Century. University of South Carolina Press.

