আয়িশা এবং আলীর দ্বন্দ্ব

Print Friendly, PDF & Email

বনু মুস্তালিক গোত্রে আক্রমণের সময় মুহাম্মদের স্ত্রী আয়িশা তার সাথে ছিলেন। ফেরার পথে এক স্থানে যখন কাফেলা যাত্রা বিরতি করল তখন আয়িশার গলার হারটি হারিয়ে যায়। আয়িশা প্রাকৃতিক কাজ করার জন্য মাঠের দিকে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন গলার হার হারিয়ে গেছে। তা খোঁজার জন্য তিনি মাঠের দিকে ফেরত গেলেন। এই সময় কাফেলার লোকেরা যাত্রা করল। আয়িশা ছিলেন তখন খুব হালকা-পাতলা এবং অল্পবয়সী। তাই লোকেরা মনে করল আয়িশা উটের উপরেই আছে।

এই সময় সাফওয়ান বিন মুআত্তাল কাফেলার পিছনে চলতেন। আয়িশাকে দেখে তিনি সাথে করে নিয়ে আসেন। কিছু লোক আয়িশাকে সাফওয়ানের সাথে আসতে দেখে নানান কথা বলতে শুরু করলো। অনেকে বললো, আয়িশা ইচ্ছে করেই পরে এসেছে, যেন সাফওয়ানের সাথে তার দেখা হয়। কেচ্ছাকাহিনী দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

মুহাম্মদ এ ব্যাপারে প্রথমে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করলেন। অতঃপর তিনি সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। এই সময়ে হযরত আলী আয়িশাকে তালাক দেয়ার পরামর্শ দিলেন। উল্লেখ্য, এই সময়ে দীর্ঘ একমাস কোন ওহী আসা বন্ধ ছিল। কিন্তু দীর্ঘ একমাস ওহী আসা বন্ধ ছিল কেন? আল্লাহ তো সাথে সাথেই ওহী পাঠিয়ে আয়িশা যে নির্দোষ, তা বলে দিতে পারতেন। নাকি, মুহাম্মদ একমাস অপেক্ষা করেছিল, আয়িশার পিরিয়ড হয় কিনা তা দেখার জন্য? এই বিষয়টির বিবেচনা পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি [1]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৪/ শাহাদাত
পরিচ্ছেদঃ ১৬৫৬. এক মহিলা অপর মহিলার সততা সম্পর্কে সাক্ষ্য দান
২৪৮৫। আবূ রাবী সুলাইমান ইবনু দাউদ (রহঃ) … নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিনী আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মিথ্যা অপবাদকারীরা যখন তার সম্পর্কে অপবাদ রটনা করল এবং আল্লাহ তা থেকে তার পবিত্রতা ঘোষনা করলেন। রাবীগণ বলেন, আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে বের হওয়ার ইচ্ছা করলে স্বীয় সহধর্মিণীদের মধ্যে কুর’আ ঢালার মাধ্যমে সফর সংগিণী নির্বাচন করতেন। তাদের মধ্যে যার নাম বেরিয়ে আসত তাকেই তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এক যুদ্ধে যাওয়ার সময় তিনি আমাদের মধ্যে কুর’আ ঢাললেন, তাতে আমার নাম বেরিয়ে এলো। তাই আমি তার সঙ্গে (সফরে) বের হলাম। এটা পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পরের ঘটনা।
আমাকে হাওদার ভিতরে সাওয়ারীতে উঠানো হতো, আবার হাওদার ভিতরে (থাকা অবস্থায়) নামানো হতো। এভাবেই আমরা সফর করতে থাকলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ যুদ্ধ শেষ করে যখন প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আমরা মদিনার কাছে পৌছে গেলাম তখন এক রাতে তিনি (কাফেলাকে) মনযিল ত্যাগ করার ঘোষণা দিলেন। উক্ত ঘোষনা দেওয়ার সময় আমি উঠে সেনাদলকে অতিক্রম করে গেলাম এবং নিজের প্রয়োজন সেরে হাওদায় ফিরে এলাম। তখন বুকে হাত দিয়ে দেখি আযফার দেশীয় সাদাকালো পাথরের তৈরি আমার একটা মালা ছিড়ে পড়ে গেছে। তখন আমি আমার মালার সন্ধানে ফিরে গেলাম, এবং সন্ধান কার্য আমাকে দেরী করিয়ে দিলো। ওদিকে যারা আমার হাওদা উঠিয়ে দিতো তারা তা উঠিয়ে যে উটে আমি সওয়ার হতাম, তার পিঠে রেখে দিলো। তাদের ধারনা ছিলো যে, আমি হাওদাতেই আছি। তখনকার মেয়েরা হালকা পাতলা হতো, মোটা সোটা হতো না। কেননা খুব সামান্য খাবার তারা থেতে পেতো। তাই হাওদায় উঠতে গিয়ে ভার তাদের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হল না।
তদুপরি সে সময় আমি অল্প বয়স্ক কিশোরী ছিলাম এবং তখন তারা হাওদা উঠিয়ে উট হাকিয়ে রওনা হয়ে গেলো। এদিকে সেনাদল চলে যাওয়ার পর আমি আমার মালা পেয়ে গেলাম। কিন্তু তাদের জায়গায় ফিরে এসে দেখি, সেখানে কেউ নেই। তখন আমি আমার জায়গায় এসে বসে থাকাই মনন্থ করলাম। আমার ধারনা ছিল যে, আমাকে না পেয়ে আবার এখানে তারা ফিরে আসবে। বসে থাকা অবস্থায় আমার দু চোখে ঘুম নেমে এলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সাফওয়ান ইবনু মুআত্তাল, যিনি প্রথমে সুলামী এবং পরে যাকওয়ানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেনা দলের পিছনে (পরিদর্শক হিসেবে) থেকে গিয়েছিলেন। সকালের দিকে আমার অবস্থান স্থলের কাছাকাছি এসে পৌছলেন এবং একজন ঘুমন্ত মানুষের অবয়ব দেখতে পেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। পর্দার বিধান নাযিলের আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। সে সময় তিনি উট বসাচ্ছিলেন, সে সময় তার ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ শব্দে আমি জেগে গেলাম। তিনি উটের সামনের পা চেপে ধরলে আমি তাতে সওয়ার হলাম। আর তিনি আমাকে নিয়ে সাওয়ারী হাকিয়ে চললেন।
সেনাদল ঠিক দুপুরে যখন অবতরণ করে বিশ্রাম করছিল, তখন আমরা সেনাদলে পৌছলাম। সে সময় যারা ধ্বংস হওয়ার, তারা ধ্বংস হল। অপবাদ রটনায় যে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সে হল (মুনাফিকের সরদার) আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালুল। আমরা মদিনায় উপনীত হলাম এবং আমি এসেই একমাস অসুস্থতায় ভোগলাম। এদিকে কিছু লোক অপবাদ রটনাকারীদের রটনা নিয়ে চর্চা করতে থাকল। আমার অসুস্থার সময় এ বিষয়টি আমাকে সন্দিহান করে তুললো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরফ থেকে সেই স্নেহ আমি অনুভব করছিলাম না, যা আমার অসুস্থতার সময় সচরাচর আমি অনুভব করতাম। তিনি শুধু ঘরে প্রবেশ কলে সালাম দিয়ে বলতেন কেমন আছ? আমি সে বিষয়ের কিছুই জানতাম না। শেষ পর্যন্ত খুব দুর্বল হয়ে পড়লাম।
(একরাতে) আমি ও উম্মু মিসতাহ্ প্রয়োজন সারার উদ্দেশ্যে ময়দানে বের হলাম। আমরা রাতেই শুধু সে দিকে যেতাম। এ আমাদের ঘরগুলোর নিকটবর্তী স্থানে পায়খানা বানানোর আগের নিয়ম। জংগলে কিংবা দুরবর্তী স্থানে প্রয়োজন সারার ব্যাপারে আমাদের অবস্থাটা প্রথম যুগের আরবদের মতই ছিলো। যাই হোক, আমি এবং উম্মু মিসতাহ বিনত আবূ রুহম হেটে চলছিলাম। ইত্যবসরে সে তার চাঁদরে পা জড়িয়ে হোচট খেলো এবং (পড়ে গিয়ে) বললো মিসতাহ এর জন্য দুর্ভোগ। আমি তাকে বললাম, তুমি খুব খারাপ কথা বলেছ। বদর যুদ্ধে শরীক হয়েছে, এমন এক লোককে তুমি অভিশাপ দিচ্ছ! সে বলল, হে সরলমান! (তোমার সম্পর্কে) যে সব কথা তারা উঠিয়েছে, তা কি তুমি শুনোনি? এরপর অপবাদ রটনাকারীদের সব রটনা সম্পর্কে সে আমাকে অবহিত করলো।
তখন আমার রোগের উপর রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলো। আমি ঘরে ফিরে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছো? আমি বললাম, আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিন। তিনি (আয়িশা (রাঃ) বলেন, আমি তখন তাদের (পিতা-মাতার) কাছ থেকে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গেলাম। তারপর আমি মাকে বললাম, লোকেরা কি বলাবলি করে? তিনি বললেন, বেটি! ব্যাপারটাকে নিজের জন্য হালকাভাবেই গ্রহন কর। আল্লাহর কসম! এমন সুন্দরী নারী খুব কমই আছে, যাকে তার স্বামী ভালোবাসে আর তার একাধিক সতীনও আছে; অথচ ওরা তাকে উত্ত্যক্ত করে না।
আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ্। লোকেরা সত্যি তবে এসব কথা রটিয়েছে? তিনি (আয়িশা) বলেন, ভোর পর্যন্ত সে রাত আমার এমনভাবে কেটে গেলো যে, চোখের পানি আমার বন্ধ হল না এবং ঘুমের একটু পরশও পেলাম না। এভাবে ভোর হল। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াহীর বিলম্ব দেখে আপন স্ত্রীকে বর্জনের ব্যাপারে ইবনু আবূ তালিব ও উসামা ইবন যায়দকে ডেকে পাঠালেন। যাই হোক; উসামা পরিবারের জন্য তার (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভালোবাসার প্রতি লক্ষ্য করে পরামর্শ দিতে গিয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম (তার সম্পর্কে) ভালো ছাড়া অন্য কিছু আমরা জানিনা, আর আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিছুতেই আল্লাহ্ আপনার পথ সংকীর্ণ করেননি। তাকে ছাড়া আরো অনেক মহিলা আছে। আপনি না হয় বাঁদীকে জিজ্ঞাসা করুন সে আপনাকে সত্য কথা বলবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন (বাঁদী) বারীরাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন। হে বারীরা! তুমি কি তার মধ্যে সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেয়েছ? বারীরা বলল, আপনাকে যিনি সত্যসহ পাঠিয়েছেন, তার কসম করে বলছি, না তেমন কিছু দেখিনি এই একটি অবস্থায়ই দেখেছি যে তিন অল্পবয়স্কা কিশোরী। আর তাই আটা-খামীর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। সেই ফাকে বকরী এসে তা খেয়ে ফেলে। সে দিনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মসজিদে) ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালুলের ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার পরিবারকে কেন্দ্র করে যে লোক আমাকে জ্বালাতন করেছে, তার মুকাবিলায় কে প্রতিকার করবে? আল্লাহর কসম, আমি তো আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভালো ছাড়া অন্য কিছু জানিনা। আর এমন ব্যাক্তিকে জড়িয়ে তারা কথা তুলেছে, যার সম্পর্কে ভালো ছাড়া অন্য কিছু আমি জানিনা আর সে তো আমার সাথে ছাড়া আমার ঘরে কখনও প্রবেশ করত না।
তখন সা’দ ইবনু মু’আয (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আমি তার প্রতিকার করবো। যদি সে আউস গোত্রের কেউ হয়ে থাকে, তাহলে তার গর্দান উড়িয়ে দিব; আর যদি সে আমাদের খাযরাজ গোত্রীয় ভাইদের কেউ হয়, তাহলে আপনি তার ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ দিবেন, আমরা আপনার নির্দেশ পালন করব। খাযরাজ গোত্রপতি সা’দ ইবনু উবাদা (রাঃ) তখন দাঁড়িয়ে গেলেন। এর আগে তিনি ভালো লোকই ছিলেন। আসলে গোত্র প্রীতি তাকে পেয়ে বসেছিলো। তিনি বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহর কসম! তুমি তাকে হত্যা করতে পারনে না, সে শক্তি তোমার নেই। তখনি উসায়িদ ইবনুল হুযাইর (রাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তুমিই মিথ্যা বলছ। আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করে ছাড়ব। আসলে তুমি একজন মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ হয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছে। এরপর আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারে থাকা অবস্থায়ই তারা (লড়াইয়ে) উদ্যত হল। তখন তিনি নেমে তাদের চুপ করালেন। এতে সবাই শান্ত হল আর তিনিও নীরবতা অবলম্বন করলেন।
আয়িশা (রাঃ) বলেন, সেদিন সারাক্ষণ আমি কাঁদলাম, চোখের পানি আমার শুকালনা এবং ঘুমের সামান্য পরশও পেলাম না। আমার পিতা-মাতা আমার পাশে পাশেই থাকলেন। পুরো রাত দিন আমি কেদেই কাটালাম। আমার মনে হল, কান্না বুঝি আমার কলিজা বিদীর্ণ করে দিবে। তিনি (আয়িশা) বলেন, তারা (পিতা-মাতা) উভয়ে আমার কাছেই বসা ছিলেন, আর আমি কাঁদছিলাম। ইতিমধ্যে এক আনসারী মহিলা ভিতরে আসার অনুমতি চাইল। আমি তাকে অনুমতি দিলাম। সেও আমার সঙ্গে বসে কাঁদতে শুরু করল। আমরা এ অবস্থায় থাকতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করে (আমার কাছে) বসলেন, অথচ যে দিন থেকে আমার সম্পর্কে অপবাদ রটানো হয়েছে সেদিন থেকে তিনি আমার কাছে বসেননি। এর মধ্যে একমাস কেটে গিয়েছিল। অথচ আমার সম্পর্কে তার কাছে কোন ওয়াহী নাযিল হল না।
তিনি (আয়িশা) বলেন, এরপর হামদ ও সানা পাঠ করে তিনি বললেন, হে আয়িশা! তোমার সম্পর্কে এ ধরনের কথা আমার কাছে পৌছেছে। তুমি নির্দোষ হলে আল্লাহ্ অবশ্যই তোমার নির্দোষিতা ঘোষনা করবেন। আর যদি তুমি কোন গুনাহে জড়িয়ে গিয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবা ও ইসতিগফার কর। কেননা, বান্দা নিজের পাপ স্বীকার করে তওবা করলে আল্লাহ তাওবা কবুল করেন। তিনি যখন তার বক্তব্য শেষ করলেন, তখন আমার অশ্রু বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি এক বিন্দু অশ্রুও আমি অনুভব করলাম না। আমার পিতাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমার তরফ থেকে জওয়াব দিন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আমি বুঝে উঠতে পারি না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কি বলব? এরপর আমার (মা-কে) বললাম, আমার তরফ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথার জওয়াব দিন। তিনিও বললেন, আল্লাহর কসম! আমি বুঝি উঠতে পারি না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কি বলব?
আমি তখন অল্প বয়স্কা কিশোরী! কুরআনও খুব বেশী পড়িনি। তবুও আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমার জানতে বাকী নেই যে, লোকেরা যা রটাচ্ছে, তা আপনারা শুনতে পেয়েছেন এবং আপনাদের মনে তা বসে গেছে, ফলে আপনারা তা বিশ্বাস করে নিয়েছেন। এখন যদি আমি আপনাদের বলি যে, আমি নিষ্পাপ আর আল্লাহ জানেন, আমি অবশ্যই নিষ্পাপ, তবু আপনারা আমার সে কথা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আপনাদের কাছে কোন বিষয় আমি স্বীকার করি, অথচ আল্লাহ জানেন আমি নিষ্পাপ তাহলে অবশ্যই আপনারা আমাকে বিশ্বাস করে নিবেন। আল্লাহর কসম, ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর পিতার ঘটনা ছাড়া আমি আপনাদের জন্য কোন দৃষ্টান্ত খুজে পাচ্ছি না। যখন তিনি বলেছিলেন, পূর্ণ ধৈর্যধারনই আমার জন্য শ্রেয়। আর তোমরা যা বলছো সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যকারী।
এরপর আমি আমার বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করে নিলাম। এটা আমি অবশ্যই আশা করছিলাম যে, আল্লাহ আমাকে নির্দোষ ঘোষনা করবেন। কিন্তু আল্লাহর কসম! এ আমি ভাবিনি যে, আমার ব্যাপারে কোন ওয়াহী নাযিল হবে। কুরআনে আমার ব্যাপারে কোন কথা বলা হবে, এ বিষয়ে আমি নিজেকে উপযুক্ত মনে করি না। তবে আমি আশা করছিলাম যে, নিদ্রায় আল্লাহর রাসূল এমন কোন স্বপ্ন দেখবেন, যা আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করবে। কিন্তু আল্লাহর কসম! তিনি তার আসন ছেড়ে তখনও উঠে যাননি এবং ঘরের কেউ বেরিয়েও যায়নি, এরই মধ্যে তার উপর ওয়াহী নাযিল হওয়া শুরু হয়ে গেল এবং (ওয়াহী নাযিলের সময়) তিনি যে রূপ কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতেন, সে রূপ অবস্থার সম্মুখীন হন। এমনকি সে মুহুর্তে শীতের দিনেও তার শরীর থেকে মুক্তার ন্যায় ফোটা ফোটা ঘাম ঝরে পড়তো।
যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ওয়াহীর সে অবস্থা কেটে গেল, তখন তিনি হাসছিলেন। আর প্রথম যে বাক্যটি তিনি উচ্চারন করলেন তা ছিল এই যে, আমাকে বললেন, হে আয়িশা! আল্লাহর প্রশংসা করো। কেননা, তিনি তোমাকে নির্দোষ ঘোষনা করেছেন। আমার মাতা তখন আমাকে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে যাও। (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর) আমি বললাম, না, আল্লাহর কসম! আমি তার কাছে যাবো না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রশংসাও করব না। আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন‏إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالإِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ যথন আমার সাফাই সম্পর্কে নাযিল হল তখন আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! নিকটাত্মীয়তার কারণে মিসতাহ্ ইবনু উসাসার জন্য তিনি যা খরচ করতেন, আয়িশা (রাঃ) সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলার পর মিসতার জন্য আমি আর কখনও খরচ করবো না।
তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন‏وَلاَ يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ‏)‏ إِلَى قَوْلِهِ ‏(‏غَفُورٌ رَحِيمٌ‏ তোমাদের মধ্যে যারা নিয়ামতপ্রাপ্ত ও স্বচ্ছল, তারা যেন দান না করার কসম না করে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। তখন আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম। আমি অবশ্যই চাই আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। এরপর তিনি মিসতাহ্ কে যা দিতেন, তা পুনরায় দিতে লাগলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাব বিনতে জাহাশকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি বললেন, হে যায়নাব! (আয়িশা সম্পর্কে) তুমি কি জানো? তুমি কি দেখছো? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার কান, আমি আমার চোখের হিফাজত করতে চাই আল্লাহর কসম তার সম্পর্কে ভালো ছাড়া অন্য কিছু আমি জানিনা। আয়িশা (রাঃ) বলেন, অথচ তিনই আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। কিন্তু পরহেযগারীর কারণে আল্লাহ তার হিফাযত করেছেন।
আবূ রাবী (রহঃ) … আয়িশা ও আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ফুলাইহ্ (রহঃ) … কাসিম ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবূ বকর (রাঃ) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

একইসাথে, ইবনে হিশামের সিরাতুন নবী থেকে জানা যায়, আলী আয়িশার একজন দাসীকে ধরে বেদম প্রহার করে কথা বের করারও চেষ্টা করেন [2]

আলী প্রহার করলেন

এমনকি, আয়িশা হযরত আলীর ওপর একটাই ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, পরবর্তী জীবনে তিনি আলীর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতেন না। যেটি নিচের এই হাদিসটি থেকে বোঝা যায়। লক্ষ্য করে পড়ূন, আয়িশা বর্ণনা করছে, অসুস্থ মুহাম্মদকে দুইজন টেনে নিয়ে এসেছিল। তাদের একজন ইবনু আব্বাস, আরেকজন হচ্ছে আয়িশার ভাষ্যমতে অন্য এক সাহাবী। মানে তিনি ঐ সাহাবীর নাম উচ্চারণ করেন নি। পরবর্তীতে ইবনু আব্বাসের থেকে জানা গেল, ঐ সাহাবীর নাম হযরত আলী [3]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১০/ আযান
পরিচ্ছেদঃ ৪৩১। কি পরিমাণ রোগ থাকা সত্ত্বেও জামা’আতে শামিল হওয়া উচিত।
৬৩২। ইব্রাহীম ইবনু মূসা (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন একেবারে কাতর হয়ে গেলেন এবং তাঁর রোগ বেড়ে গেল, তখন তিনি আমার ঘরে সেবা-শুশ্রূষার জন্য তাঁর অন্যান্য স্ত্রীগণের কাছে সম্মতি চাইলেন। তাঁরা সম্মতি দিলেন। সে সময় দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে (সালাতের জন্য) তিনি বের হলেন, তাঁর দু’পা মাটিতে হেঁচড়িয়ে যাচ্ছিলো। তিনি ছিলেন আব্বাস (রাঃ) ও অপর এক সাহাবীর মাঝখানে। (বর্ণনাকারী) উবায়দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, আয়িশা (রাঃ) এর বর্ণিত এ ঘটনা ইবনু আব্বাস (রাঃ) এর নিকট ব্যক্ত করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো, তিনি কে ছিলেন, যার নাম আয়িশা (রাঃ) বলেন নি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তিনি ছিলেন আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা (রাঃ)

মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে আয়িশা এবং আলীর একটি যুদ্ধ হয়, যেটি উটের যুদ্ধ বা জঙ্গে জামাল নামে পরিচিত। সেই যুদ্ধ সম্পর্কে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। আপাতত এইটুকু জানা থাকলেই চলবে যে, আয়িশা এবং আলীর সম্পর্ক আদৌ খুব ভাল ছিল না।

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৪৮৫ []
  2. সিরাতুন নবী (সাঃ), ইবনে হিশাম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৯, ৩১০ []
  3. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৩২ []
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন