সংশয়বাদবই

আপনি নাস্তিক নাকি ধর্মবিদ্বেষী?

আমি একজন নাস্তিক (Atheist), একজন ধর্ম, ধর্মবাদ ও আস্তিক্যবাদ বিরোধি/ ধর্মবিরোধী/ ধর্মবিদ্বেষী  (Anti-theist) এবং একজন ধর্মনিরপেক্ষ (Secularist) মানুষ। এই বিষয়গুলো দ্বারা আসলে কী বোঝায়? একই সাথে এই তিন ধরণের হওয়াও বা কীভাবে সম্ভব? চেষ্টা করছি সেটা সহজভাবে বুঝিয়ে বলতে- যদিও এগুলো মাঝে মাঝে গোলমেলে মনে হয়। এগুলো প্রতিটি বিষয়ই আলাদা হলেও, একটি অন্যটির পরিপূরক হতে পারে; আবার একই সাথে, কিছু ক্ষেত্রে একটি আরেকটির মতবিরোধীও হতে পারে। তাই বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা থাকা জরুরী।

নাস্তিকতা বা নাস্তিক্যবাদ হচ্ছে একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়। একজন স্বতন্ত্র মানুষের কাছে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ। ঈশ্বর বা ঈশ্বরগণ বা দেবতা বা অলৌকিকত্বে বিশ্বাস সাধারণত ধর্মগুলোর মৌলিক বিষয়- সে কারণে নাস্তিক্যবাদ এবং নিধর্ম বা ধর্মহীনতা প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করে।

  • প্রমাণ এবং যুক্তির ওপর নির্ভর করে একজন মানুষ তার জীবন যাপন করতে পারে এই হাইপোথিসিসের ওপর যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই।
  • একজন মানুষ তার জীবন কীভাবে যাপন করবেন, বা অন্যদের সাথে কীরকম আচরণ করবেন, সেই সম্পর্কে নাস্তিক্যবাদ তাকে কোন নির্দেশনা বা পরামর্শ দেয় না। নাস্তিক্যবাদ শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা যে ক্ষতিকর হতে পারে তা বলে।
  • নাস্তিকদের নৈতিকতা কোথা থেকে আসবে, সেই পুরনো প্রশ্ন থেকে অনেক নাস্তিকই বর্তমান সময়ে নিজেদেরকে মানববাদী বা মানবতাবাদী বলে পরিচয় দেন। নৈতিকতার প্রশ্নে ম্যাট ডিলাহুন্টি এর মন্তব্যটি গুরুত্বপুর্ণ-

” আমার কাজের ফলাফল সম্পর্কে যৌক্তিক পর্যালোচনা “

+++++

ধর্ম, ধর্মবাদ ও আস্তিক্যবাদ বিরোধি (Anti-theist/এণ্টাইথিয়েস্ট) হচ্ছে পুরোপুরি সামাজিক বিষয়। বলা যায় সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে একজন মানুষ ধর্মের বিরোধিতা করতে পারেন। এণ্টাইথিয়েজম হচ্ছে যুক্তিপ্রমাণের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা ধারণা যে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো একই সাথে মিথ্যা ও ক্ষতিকর, এবং সমাজে এর প্রভাব যতটা সম্ভব কমানো জরুরি।

  • একদল মনে করেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক, বাদানুবাদ করে, যুক্তি প্রমাণ তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে সমাজে ধর্মের প্রভাব কমানো যায়।
  • একদল মনে করেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে জোরপুর্বক এই ধারণা জনগণের মধ্যে ঢোকানো যায়। এরকম হলে সেই রাষ্ট্রকে আমরা নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্র বলতে পারি। পৃথিবীতে কয়েকটি নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্র ছিল যারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নাস্তিকতা প্রচার করতে চেয়েছিল। বহু প্রখ্যাত নাস্তিকই এই ধরণের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নাস্তিকতার ধারণা মানুষের মাঝে ঢোকানো নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রের সমালোচনা করেন।
  • একজন এণ্টাইথিয়েস্টের অধিকার হচ্ছে, ধার্মিকদের ধর্মমুক্ত করা। কোন কোন এণ্টাইথিয়েস্টমনে করেন, এটি তাদের কর্তব্যও বটে। এই কারণেই এই ধরণের এণ্টাইথিয়েস্টদেরকে নাস্তিক্যবাদ প্রচারকও বলা যেতে পারে। স্ট্রিট এপিস্টেমোলোজিস্টরা হচ্ছে বিশেষভাবে সেই মানুষেরা, যাদের আসলে এই কাজের প্রশিক্ষণই দেয়া হয়। স্ট্রিট এপিস্টেমোলোজি হচ্ছে, বিভিন্ন আড্ডায় আলোচনায় সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে নানা দার্শনিক আলোচনা এবং যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি করা।
  • সকল এণ্টাইথিয়েস্টই কোন না কোন প্রকারে নাস্তিক হতে পারেন, তবে সকল নাস্তিকই কিন্তু এণ্টাইথিয়েস্ট নয়। প্রচুর সংখ্যক নাস্তিক আছেন যারা ধর্মকে পাত্তা দেন না, অথবা তারা মনে করেন ধর্ম মিথ্যা হলেও ভাল কিছুর প্রেরণা হতে পারে বা তারা ধর্মকে আসলে বিশ্বাস করতে চান। এদেরকে ফেইথিয়েস্টও বলা হয়। ফেইথিয়েস্ট হচ্ছে তারা যারা মনে করেন, বিশ্বাসের সমালোচনা করা উচিত নয়।

+++++

ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম হচ্ছে পুরোপুরি রাজনৈতিক মতাদর্শ। এই মতাদর্শ যা মনে করে, ধর্ম এবং রাষ্ট্র হবে আলাদা এবং বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্র এবং ধর্ম একে অন্যয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে না, বা নিয়ন্ত্রণ করবে না। রাষ্ট্র হবে ধর্মহীন এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সে নাক গলাবে না ( যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে ) ।

  • কোন ধর্মীয় আচরণ বা রীতি বা প্রথা যদি ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত আলোচনা এবং যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সঠিক বা বৈধ বলে প্রমাণ করা যায়, তাহলে সেটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আইন বা নিয়ম বলে গণ্য হতে পারে।
  • অন্যদিকে, কোন ধর্মীয় আচরণ বা রীতি বা প্রথা যদি রাষ্ট্রের কোন প্রচলিত সেক্যুলার আইনের লঙ্ঘন করে, বা ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত যুক্তিতর্ক ও আলোচনায় সঠিক বা বৈধ বলে মনে না হয়, তাহলে সেই ধরণের ধর্মীয় রীতি বা আচরণ নিষিদ্ধ হতে পারে।
  • ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে সকল ধর্মের বা কোন ধর্মেরই নয় এমন মানুষকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ অনুমতি দেয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই রীতি বা আচরণ দেশের প্রচলিত সেক্যুলার আইনের লঙ্ঘন করে।
  • ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কখনই কোন ধর্ম বা নাস্তিকতাকে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ধার্মিক, ধর্মপ্রাণ, নিধার্মিক, ধর্মহীন বা নাস্তিক সকলেই নিজেদের ইচ্ছামত ধর্ম গ্রহণ করতে পারে, পালন না করতে পারে, গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। রাষ্ট্র মানুষের ধর্মবিশ্বাস বিষয়ে মাথা ঘামাবে না।
  • শিশুদের এই অধিকার অবশ্যই দেয়া প্রয়োজন যে, তারা সবগুলো ধর্ম সম্পর্কে জানবে এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তারা যেন নিজেদের পছন্দ করা ধর্মটি পালন করতে পারে। বিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, শিশুদের সবগুলো প্রধান ধর্ম এবং নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কে অবহিত করা, শিক্ষা দেয়া, এবং নিরপেক্ষভাবে শিশুদের সেই বিষয়গুলো বুঝে শুনে বেছে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এটি হচ্ছে, কোন বিশেষ ধর্ম বা নাস্তিক্যবাদের একাধিপত্য বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মান্তরকরণ রুখে দেয়ার জন্য। বা কোন ধর্মকে বিশেষ সুবিধা করে দেয়ার সুযোগ রুখে দেয়ার জন্য।
  • সকল সেক্যুলারিস্ট বা ধর্মনিরপেক্ষগণই যে নাস্তিক বা এণ্টাইথিয়েস্ট হবেন এমন কোন নিয়ম নেই। এমনকি উনারা ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিকও হতে পারেন। এমনকি উনারা এটাও মনে করতে পারেন যে, তার ধর্মটিই অন্য সকলের পালন করা উচিত। তারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের ধর্ম প্রচারও করতে পারেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তা রাষ্ট্র, সরকার বা আইনের লঙ্ঘন করছে।

মূল লেখাঃ Leon Korteweg

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *