ইসলামী স্বর্ণযুগ (Islamic Golden Age): বিস্মৃতির ধুলো সরিয়ে জ্ঞানের আলোর খোঁজে
Table of Contents
- 1 ভূমিকা: ইতিহাসের এক হারানো অধ্যায়
- 2 স্বর্ণযুগের নেপথ্য কারিগর: রাজনীতি, দর্শন ও শিল্পের প্রবহমান ধারা
- 3 জ্ঞানালোকের শুরু: অনুবাদ আন্দোলন ও বাগদাদ
- 4 গণিত: শূন্য থেকে অসীম এবং বীজগণিতের জন্ম
- 5 জ্যোতির্বিদ্যা: আকাশের মানচিত্র ও মহাবিশ্বের গঠন
- 6 চিকিৎসা বিজ্ঞান: কুসংস্কার থেকে ল্যাবরেটরি
- 7 আলোকবিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি: দেখার নতুন চোখ
- 8 রসায়ন: আলকেমি থেকে কেমিস্ট্রি
- 9 দর্শন ও যুক্তিবাদ: ফালসাফা ও সংঘাত
- 10 সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস: ইবনে খালদুন
- 11 প্রকৌশল ও যন্ত্রকৌশল: আল-জাজারি ও রোবটের পূর্বপুরুষরা
- 12 ভূগোল ও মানচিত্র: বিশ্বকে চেনা ও জানার অভিযাত্রা
- 13 স্বর্ণযুগের কারিগর: ক্ষমতার পালাবদল ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা
- 13.1 আব্বাসীয় খিলাফত: স্বপ্নের শহর ও মস্তিষ্কের কারখানা
- 13.2 আন্দালুসের উমাইয়া খিলাফত: ইউরোপের বুকে এক টুকরো আলো
- 13.3 ফাতেমীয় খিলাফত: কায়রোর প্রতিদ্বন্দ্বী মহিমা
- 13.4 সামানীয় সাম্রাজ্য: পারস্যের নবজাগরণ
- 13.5 বুয়াইহিদ রাজবংশ: পর্দার আড়ালের শক্তি
- 13.6 সেলজুক সাম্রাজ্য: রক্ষণশীলতার ছায়ায় জ্ঞানচর্চা
- 13.7 আয়্যুবীয় রাজবংশ: স্বর্ণযুগের শেষ প্রহর
- 13.8 অটোমান সাম্রাজ্য: স্বর্ণযুগের পর এক দীর্ঘশ্বাস?
- 13.9 তিমুরিদ সাম্রাজ্য ও মুঘল: স্বর্ণযুগের প্রান্তসীমা
- 14 পতনের কারণ: কেন নিভে গেল আলো?
- 15 প্রভাব, উত্তরাধিকার ও বিশ্বসভ্যতার বাঁক বদল
- 15.1 ল্যাটিন অনুবাদের জোয়ার ও ইউরোপের ঘুমভানিয়া গান
- 15.2 দর্শনের ওপর প্রভাব: একুইনাস ও লাতিন অ্যাভেরোইজম
- 15.3 রেনে দেকার্ত ও ভাসমান মানুষের ধাঁধা
- 15.4 বিজ্ঞানে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির জন্ম
- 15.5 কোপার্নিকাস ও জ্যোতির্বিদ্যার বিপ্লব
- 15.6 সাহিত্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার
- 15.7 গণিত ও আধুনিক বিশ্ব
- 15.8 সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের দর্শন
- 15.9 কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে
- 16 স্বর্ণযুগের বিতর্ক: মিথ, বাস্তবতা ও উত্তপ্ত বয়ান
- 17 স্বর্ণযুগের ভাষ্যকার: আধুনিক তাত্ত্বিক ও ইতিহাসতত্ত্বের লড়াই
- 17.1 ওরিয়েন্টালিজম ও এডওয়ার্ড সাঈদ: দেখার চোখ বদলানো
- 17.2 আর্নেস্ট রেনান: বিতর্কের খলনায়ক?
- 17.3 পিয়ের দুহেম ও ধারাবাহিকতার তত্ত্ব
- 17.4 জর্জ সালিবা ও ধ্রুপদী আখ্যানের পতন
- 17.5 এ. আই. সাবরা ও ন্যাচারালাইজেশন তত্ত্ব
- 17.6 মার্শাল হজসন ও ‘ইসলামিকেট’ ধারণা
- 17.7 টোবি হাফ ও প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন
- 17.8 দিমিত্রি গুতাস ও অনুবাদ আন্দোলন
- 17.9 ডেভিড কিং ও ধর্মের সেবায় বিজ্ঞান
- 17.10 দেখার বৈচিত্র্য
- 18 উপসংহার: নতুনের কেতন
- 19 তথ্যসূত্র
ভূমিকা: ইতিহাসের এক হারানো অধ্যায়
মানুষের স্মৃতিশক্তি বড়ই অদ্ভুত। সে যা মনে রাখতে চায়, পাথর খোদাই করে রাখে; আর যা ভুলে যেতে চায়, তা বালির ওপর লেখে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা প্রায়ই একটা ভয়াবহ ভুল করি। আমরা ভাবি, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পৃথিবী বুঝি থমকে গিয়েছিল। ইউরোপ তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, যাকে ওরা বলে ‘অন্ধকার যুগ’ (Dark Ages)। কুসংস্কার, ডাইনি শিকার, প্লেগের কালো ছায়া আর ধর্মীয় গোঁড়ামি গ্রাস করেছিল তাদের। গির্জার বাইরে চিন্তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না, আর ভিন্নমত মানেই ছিল অগ্নিকুণ্ডে মৃত্যু। পৃথিবী তখন চ্যাপ্টা নাকি গোল, সেই তর্কে যখন ইউরোপীয়রা মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, তখন পৃথিবীরই আরেকটা অংশ জেগে ছিল। শুধু জেগেই ছিল না, তারা তখন মহাকাশের নক্ষত্র মাপছে, মানুষের শরীরের ধমনীতে রক্তের গতিপথ খুঁজছে, আর গণিতের জটিল সব সমীকরণের সমাধান করছে।
সময়টা অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী। স্থান – মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষ মরুভূমি থেকে শুরু করে স্পেনের আন্দালুসিয়া হয়ে উত্তর আফ্রিকা। ইতিহাসে এই সময়টার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইসলামি স্বর্ণযুগ’ (Islamic Golden Age)। তবে ‘ইসলামি’ শব্দটা এখানে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মতত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে ব্যবহার করা হচ্ছে না, বরং এটা একটা জিও-পলিটিক্যাল বা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয়। যারা এই জ্ঞানচর্চা করেছিলেন, তাদের সবাই যে খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন, তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ইহুদি, খ্রিস্টান, জরাথুস্ট্রবাদী, সাবিয়ান এবং অবশ্যই এমন অনেকে, যারা প্রচলিত ধর্মের তোয়াক্কা করতেন না, বিশ্বাস করতেন কেবল যুক্তিতে, বস্তুবাদে এবং সংশয়বাদে।
এই সময়টা ছিল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের (Intellectual History) এক চরম উৎকর্ষের সময়। ব্যাপারটা অনেকটা রিলে রেসের (Relay Race) মতো। গ্রিকরা জ্ঞানের যে মশাল জ্বালিয়েছিল, রোমানদের পতনের পর সেটা মাটিতে পড়ে নিভে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। বাগদাদ, কায়রো, দামেস্ক আর কর্ডোবার পণ্ডিতেরা সেই মশালটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন। শুধু কুড়ালেনই না, তাতে আরও তেল ঢাললেন, আলোটা আরও উজ্জ্বল করলেন। তারপর সেই মশাল তারা তুলে দিলেন ইউরোপের হাতে, যা পরে রেনেসাঁ (Renaissance) ঘটাতে সাহায্য করল।
আজ আমরা সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প শুনব। গল্প নয়, নিরেট ইতিহাস। কীভাবে মরুভূমির বুকে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর সেরা লাইব্রেরি? কীভাবে একজন মানুষ লেন্স দিয়ে আলো বাকাতে বাকাতে আবিষ্কার করলেন দেখার নিয়ম? কীভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান জাদুমন্ত্র থেকে বেরিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকল? এই আর্টিকেলটি কোনো অলৌকিক শক্তির জয়গান গাইতে লেখা নয়। এটি মানুষের মস্তিষ্কের জয়গান। মানুষের কৌতূহল, যুক্তি আর অজানাকে জানার যে আদিম আকাঙ্ক্ষা – এটি তারই দলিল। এখানে আমরা দেখব কীভাবে মরুভূমির ধুলোঝড়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল ল্যাবরেটরি, কীভাবে তলোয়ারের ঝনঝনানির চেয়ে কলমের খসখস শব্দ বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
স্বর্ণযুগের নেপথ্য কারিগর: রাজনীতি, দর্শন ও শিল্পের প্রবহমান ধারা
ইতিহাসের কোনো ঘটনাই আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে না। আমরা যখন কোনো সভ্যতাকে চূড়ান্ত শিখরে দেখি, তখন মনে হয় বুঝি জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। কিন্তু পর্দার আড়ালে তাকালে দেখা যায় এক দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব। বাগদাদের সেই জমজমাট জ্ঞানচর্চা, বা স্পেনের কর্ডোবার সেই চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য – এসবের পেছনে ছিল কয়েকশ বছরের রাজনৈতিক উথালপাথাল, হারিয়ে যাওয়া দার্শনিকদের দীর্ঘশ্বাস এবং শিল্পের এক আশ্চর্য বিবর্তন। ইসলামি স্বর্ণযুগ কোনো একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; এটি ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান ও সংস্কৃতির এক বিশাল মোহনা। গ্রিস, পারস্য, ভারত এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য – সবাই যেন তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদটুকু নিয়ে এসে এই মোহনায় ঢেলে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঠিক কোন রাজনৈতিক সমীকরণ, কোন দার্শনিক চিন্তা এবং কোন শিল্প আন্দোলন এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল? কীভাবে মরুভূমির এক নতুন ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রাচীন পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপ থেকে রত্ন কুড়াতে শিখল? এই অধ্যায়ে আমরা সেই নেপথ্য কারিগরদের গল্প শুনব, যারা ইতিহাসের আড়ালে থেকে তৈরি করেছিলেন স্বর্ণযুগের মঞ্চ।
ইতিহাসের রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত ও ক্ষমতার পালাবদল
জ্ঞানচর্চার জন্য সবচেয়ে আগে দরকার একটা পেটভরা সমাজ এবং স্থিতিশীল রাজনীতি, অথবা অন্ততপক্ষে এমন এক রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা জ্ঞানকে ক্ষমতার হাতিয়ার মনে করে। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। এই বদলগুলোই পরোক্ষভাবে দরজা খুলে দিয়েছিল বিজ্ঞান ও দর্শনের। এখানে তলোয়ারের ঝনঝনানি যেমন ছিল, তেমনি ছিল কূটচালের খেলা, যা শেষ পর্যন্ত কলমের কালির পথ প্রশস্ত করেছিল। যেকোনো বড় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের পেছনে থাকে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রস্তুতিপর্ব। গ্রিস থেকে জ্ঞান বাগদাদে উড়ে আসেনি, তার জন্য তৈরি করতে হয়েছিল উপযুক্ত রানওয়ে। আর সেই রানওয়ে তৈরির কাজটা করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির ও গতিশীল রাজনীতি।
বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের ক্লান্তি
ইসলামি স্বর্ণযুগের উত্থান বোঝার জন্য আমাদের তাকাতে হবে তার ঠিক আগের মুহূর্তের দিকে, যাকে ঐতিহাসিকরা বলেন অন্তিম প্রাচীনত্ব (Late Antiquity)। তখন পৃথিবীর দুই পরাশক্তি ছিল রোমান বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্য। এরা একে অপরের সাথে শত শত বছর ধরে যুদ্ধ করছিল। অনেকটা টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের মতো, কিন্তু অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী এবং ধ্বংসাত্মক। ৬০২ থেকে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা তাদের শেষ মহাযুদ্ধটি ছিল চূড়ান্ত সর্বনাশা। এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ দুটো সাম্রাজ্যকেই ভেতর থেকে ফোকলা করে দিয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে তারা দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল, প্লেগ মহামারীতে জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল, আর সাধারণ মানুষ ছিল ক্লান্ত। কৃষকরা অতিরিক্ত করের বোঝায় পিষ্ট ছিল, ধর্মীয় সংখ্যালঘু দলগুলো (যেমন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান বা ইহুদিরা) ছিল রাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ।
ঠিক এই ক্ষমতার শূন্যতা (Power Vacuum)-র সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল আরবরা। তারা যখন মরুঝড়ের মতো ধেয়ে এল, তখন ক্লান্ত ও জরাজীর্ণ এই দুই সাম্রাজ্য তাদের বাধা দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু এই বিজয়ের একটা বড় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব ছিল। যখন আরবরা এই অঞ্চলগুলো দখল করল, তখন তারা দেখল সেখানে ইতিমধ্যে এক বিশাল প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। তারা ছিল যাযাবর বা বেদুইন সংস্কৃতির মানুষ, শহর চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। কিন্তু তারা ছিল বাস্তববাদী। তারা দেখল, পারসিয়ানরা জানে কীভাবে বিশাল আমলাতন্ত্র চালাতে হয়, কীভাবে কর আদায় করতে হয়, কীভাবে সেচ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আর বাইজেন্টাইনরা জানে গ্রিক বিজ্ঞান, দর্শন ও স্থাপত্য। আরবরা এই দুটিকে ধ্বংস না করে আত্মস্থ করে নিল।
বিশেষ করে পারস্যের সাসানীয় আমলাতন্ত্র বা বিউরোক্রেসি (Bureaucracy) আব্বাসীয় খিলাফতের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শাসকরা বুঝলেন, তলোয়ার দিয়ে রাজ্য জয় করা যায়, কিন্তু রাজ্য চালাতে হলে কলমপেশা লোক বা ‘কাতিব’ (Scribes) দরকার। এই প্রশাসনিক প্রয়োজন থেকেই জ্ঞানচর্চার প্রথম ধাপটি তৈরি হয়েছিল। তারা সাসানীয় রাজাদের ‘আদব’ বা শিষ্টাচার সাহিত্য অনুবাদ করল, যা রাজদরবারের আদব-কায়দা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মাবলী শেখাত। ইবনে আল-মুকাফফা (Ibn al-Muqaffa)-র মতো পারসিক পণ্ডিতরা প্রাচীন ফার্সি বইগুলো আরবিতে অনুবাদ করলেন, যা আরব শাসকদের প্রশাসনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্কতা এনে দিল। সাসানীয়দের কর ব্যবস্থা বা দিওয়ান (Diwan) পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে রাষ্ট্রের আয় সুশৃঙ্খল হলো, যা পরে জ্ঞানচর্চায় ব্যয় করার সুযোগ তৈরি করল (Kennedy, 2004)।
আব্বাসীয় বিপ্লব: আরববাদ থেকে বিশ্বজনীনতা
উমাইয়া খিলাফত (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) ছিল মূলত আরবকেন্দ্রিক এবং কিছুটা অভিজাততান্ত্রিক। তারা মনে করত, শাসন করার অধিকার কেবল কুরাইশ বা অভিজাত আরবদের। অনারব মুসলিম বা মাওয়ালি (Mawali)-দের তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করত, যদিও সংখ্যায় তারা ছিল অনেক বেশি। পারসিক, খোরাসানি বা আফ্রিকান মুসলিমরা দেখল, ধর্মে সমানাধিকারের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তারা বৈষম্যের শিকার। এই ক্ষোভ একসময় বিস্ফোরণ ঘটাল, যাকে ইতিহাসে বলা হয় আব্বাসীয় বিপ্লব (Abbasid Revolution)। আবু মুসলিম খোরাসানির নেতৃত্বে খোরাসান থেকে কালো পতাকাবাহী এক বিশাল বাহিনী ধেয়ে এল এবং ৭৫০ সালে উমাইয়াদের পতন ঘটাল।
আব্বাসীয়রা যখন ক্ষমতায় এল, তারা এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল। তারা বলল, ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট জাতির নয়, মেধা ও যোগ্যতা থাকলে জাতি বা বর্ণ কোনো বাধা নয়। এই নীতিকে বলা হয় কসমোপলিটানিজম বা বিশ্বজনীনতা (Cosmopolitanism)। এর ফলে পারসিক, তুর্কি, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ভারতীয় পণ্ডিতরা বাগদাদের রাজদরবারে ভিড় জমাতে শুরু করল। এতদিন জ্ঞান ছিল অভিজাত আরবদের কুক্ষিগত বা অবহেলিত, এবার তা হয়ে গেল সবার। বাগদাদের রাস্তায় একজন পারসিক কবি, একজন তুর্কি সেনাপতি এবং একজন আরব ধর্মতত্ত্ববিদকে একসাথে চা পান করতে দেখা তখন আর কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য ছিল না।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি ছিল ভূ-রাজনৈতিক। রাজধানী দামেস্ক থেকে বাগদাদে সরিয়ে নেওয়াটা ছিল এক বিশাল জিও-পলিটিক্যাল শিফট (Geo-political Shift)। দামেস্ক ছিল ভূমধ্যসাগরের কাছে, গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির বলয়ে। কিন্তু বাগদাদ ছিল প্রাচীন পারস্যের রাজধানী টেসিফোনের খুব কাছে, টাইগ্রিস বা দজলা নদীর তীরে। এর ফলে আরব শাসকরা সরাসরি পারস্যের ঋদ্ধ ও অভিজাত সংস্কৃতির সংস্পর্শে এল। তারা সাসানীয় রাজাদের মতো ‘জ্ঞানী রাজা’ বা ফিলোসফার কিং (Philosopher King) হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, একজন শাসকের মহত্ত্ব কেবল তার রাজ্যের সীমানা দিয়ে মাপা হয় না, মাপা হয় তার দরবারে কতজন জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি আছেন তা দিয়ে। এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন না হলে অনুবাদ আন্দোলন বা বায়তুল হিকমাহ – কোনোটাই হয়তো সম্ভব হতো না। আব্বাসীয়রা বুঝতে পেরেছিল, তাদের ক্ষমতার বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) টিকিয়ে রাখতে হলে কেবল ধর্ম নয়, বিজ্ঞান ও দর্শনের পৃষ্ঠপোষকতাও জরুরি। তারা নিজেদের উমাইয়াদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে চাইল বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ দিয়ে (Bennison, 2009)।
কাগজের যুদ্ধ: তালাস নদীর উত্তরাধিকার
রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি ছোট ঘটনা কীভাবে পুরো সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তার সেরা উদাহরণ হলো ৭৫১ সালের তালাস নদীর যুদ্ধ (Battle of Talas)। আব্বাসীয় খিলাফত তখন পূর্বদিকে বিস্তার লাভ করছে, আর চীনের তাং রাজবংশ (Tang dynasty) পশ্চিমদিকে। মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই পরাশক্তির মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। বর্তমান কিরগিজস্তানের তালাস নদীর তীরে এই যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে আরবরা জিতল বটে, কিন্তু আসল গনিমতের মাল সোনাদানা বা ঘোড়া ছিল না; ছিল কয়েকজন চীনা যুদ্ধবন্দি। এই বন্দিরা জানত কাগজ তৈরির গোপন কৌশল, যা চীনারা শত শত বছর ধরে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল।
এতদিন মধ্যপ্রাচ্যে লেখালেখি হতো প্যাপিরাস বা পার্চমেন্টে (Parchment), যা ছিল ভীষণ ব্যয়বহুল এবং দুর্লভ। এক খণ্ড কুরআন লিখতে এক পাল ভেড়ার চামড়া লাগত। কিন্তু এই রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে আরবরা হাতে পেল সস্তা ও সহজলভ্য লেখার মাধ্যম – কাগজ। রাজনীতি এখানে প্রযুক্তির বাহক হিসেবে কাজ করল। সমরখন্দে এবং পরে বাগদাদে যখন প্রথম কাগজের কল বা পেপার মিল (Paper Mill) বসল, তখন তা আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করল। বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি কোণ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা, করের হিসাব রাখা, এবং দূরবর্তী গভর্নরদের কাছে নির্দেশ পাঠানো – সবকিছু সহজ হয়ে গেল।
কিন্তু এর উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট (By-product) হিসেবে জ্ঞানচর্চা সাধারণ মানুষের নাগালে চলে এল। আগে বই ছিল ধনীদের বিলাসদ্রব্য, এখন তা মধ্যবিত্তের নাগালে এল। বাগদাদে ‘সুক আল-ওয়াররাকিন’ বা বই বিক্রেতাদের বাজার গড়ে উঠল, যেখানে শ’খানেক বইয়ের দোকান ছিল। শাসকরা চাইলেন তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি কোণ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে, আর তার জন্য দরকার ছিল কাগজ। এই প্রশাসনিক ক্ষুধা শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক ভোজসভায় পরিণত হলো। কাগজ না থাকলে অনুবাদ আন্দোলনের হাজার হাজার বই লিখে রাখা বা কপি করা অসম্ভব হতো। এটি ছিল এক তথ্য বিপ্লব (Information Revolution), যা ইন্টারনেটের মতোই তৎকালীন সমাজকে বদলে দিয়েছিল (Bloom, 2001)।
বারমাকি পরিবার: উজিরদের প্রভাব
স্বর্ণযুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে বারমাকি পরিবার (Barmakids)-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এরা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ বা জরাথুস্ট্রবাদী পারসিক পরিবার, যারা পরে ইসলাম গ্রহণ করে এবং আব্বাসীয় খলিফাদের উজির বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। খালিদ ইবনে বারমাক এবং তার ছেলে ইয়াহইয়া ইবনে বারমাক ছিলেন খলিফা হারুন আল-রশীদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারাই মূলত খিলাফতের প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল জ্ঞানচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা বা প্যাট্রনেজ (Patronage)। তারা ছিলেন অঢেল সম্পদের মালিক এবং অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী।
বারমাকিরা ভারত থেকে চিকিৎসকদের বাগদাদে নিয়ে এসেছিলেন, সংস্কৃত বই অনুবাদের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং প্রথম হাসপাতাল বা বিমারিস্তান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবি, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীদের মাসোহারা দিতেন। তাদের পতন (৮০৩ খ্রি.) ছিল করুণ, কিন্তু তারা যে বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি চালু করে গিয়েছিলেন, তা খলিফা আল-মামুন এবং পরবর্তী শাসকরা বজায় রেখেছিলেন। বারমাকিরা প্রমাণ করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য কেবল সামরিক শক্তি নয়, সাংস্কৃতিক শক্তি বা সফট পাওয়ার (Soft Power)-ও সমান জরুরি। তাদের দরবার ছিল মুক্তচিন্তার এক অভয়ারণ্য, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই জ্ঞানের আলোচনায় অংশ নিতে পারত।
খারেজি ও শিয়া বিদ্রোহ: ভিন্নমতের জোগান
রাজনৈতিক অস্থিরতা সবসময় খারাপ নয়, কখনো কখনো তা চিন্তার নতুন দুয়ার খুলে দেয়। আব্বাসীয় শাসনামলে খারেজি (Kharijites) এবং শিয়া (Shia) বিদ্রোহগুলো ছিল নিয়মিত ঘটনা। এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলো কেবল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেনি, তারা কলম দিয়েও যুদ্ধ করেছিল। তারা মূলধারার বা সুন্নি অর্থোডক্সি (Sunni Orthodoxy)-র বিরুদ্ধে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য দর্শন ও যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল। শিয়া ইমামরা, বিশেষ করে ইমাম জাফর আল-সাদিক, ছিলেন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের এক বিশাল আধার। জাবির ইবনে হাইয়ানের মতো বিজ্ঞানীরা তার ছাত্র ছিলেন বলে কথিত আছে।
ইসমাইলি শিয়া বা ফাতেমীয় খলিফারা কায়রোতে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেখানে দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তাদের তৈরি ‘ইখওয়ান আল-সাফা’ বা ব্রেদ্রেন অফ পিউরিটি (Brethren of Purity) নামের গুপ্ত সংগঠনটি ছিল একদল দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর সমষ্টি, যারা বিশ্বাস করতেন যে ধর্ম ও দর্শন একই সত্যের দুই পিঠ। তারা ৫২টি রিসালা বা এপিসল লিখেছিলেন যা তৎকালীন সমস্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে একত্রিত করেছিল। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ভিন্নমত ও বিদ্রোহগুলোও পরোক্ষভাবে জ্ঞানচর্চার বৈচিত্র্য ও গভীরতা বাড়িয়েছিল। শাসকরা তাদের মতাদর্শিক বিরোধীদের মোকাবিলার জন্য আরও বেশি করে যুক্তি ও দর্শনের চর্চা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
চিন্তার পূর্বসূরি ও দার্শনিক ভিত্তি
স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা শূন্য থেকে শুরু করেননি। তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের ওপর। গ্রিক যুক্তিবিদ্যা, পারসিক প্রজ্ঞা এবং ভারতীয় গণিত – এই তিনের সংমিশ্রণ ঘটেছিল তাদের হাতে। ইতিহাস কোনো একক ঘটনা নয়, বরং এক প্রবহমান নদী। সেই নদীতে বিভিন্ন জায়গা থেকে জল এসে মেশে। বাগদাদের বা কায়রোর পণ্ডিতরা সেই নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে আগের সমস্ত জ্ঞানকে ছেঁকে তুলেছিলেন। কিন্তু এই চিন্তাগুলো কীভাবে তাদের কাছে পৌঁছাল? এর পেছনে ছিল কিছু নির্দিষ্ট দার্শনিক মতবাদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা ইসলামের জন্মের বহু আগেই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। গ্রিকদের ‘লোগোস’, পারসিকদের ‘ইশরাক’ বা আলো, এবং ভারতীয়দের ‘গণিত’ – এই তিনে মিলে তৈরি হয়েছিল স্বর্ণযুগের বুদ্ধিবৃত্তিক ডিএনএ।
হেলেনিজম ও আলেকজান্ড্রিয়ার উত্তরাধিকার
গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যখন এশিয়া জয় করেছিলেন, তখন তিনি কেবল মাটির দখল নেননি, তিনি গ্রিক সংস্কৃতি ও দর্শনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। একে বলা হয় হেলেনিজম (Hellenism)। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর বহু শতাব্দী পরেও মিশরের আলেকজান্ড্রিয়া, সিরিয়ার অ্যান্টিওক এবং মেসোপটেমিয়ার শহরগুলোতে গ্রিক দর্শন চর্চা হতো। বিশেষ করে আলেকজান্ড্রিয়া ছিল জ্ঞানের এক বিশাল কেন্দ্র। সেখানে নিওপ্লেটোনিজম বা নব্য-প্লেটোনিকবাদ (Neoplatonism)-এর জন্ম হয়েছিল। প্লটিনাস (Plotinus) এবং তার অনুসারীরা প্লেটোর দর্শনকে এক নতুন আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছিলেন। তারা বলতেন, সমস্ত অস্তিত্ব এক ‘পরম সত্তা’ বা দ্য ওয়ান (The One) থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে। এই ধারণাটি মুসলিম দার্শনিকদের, বিশেষ করে আল-ফারাবি এবং ইবনে সিনাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল, কারণ এটি ইসলামের একেশ্বরবাদের সাথে খাপ খেয়ে যেত। তারা ভাবলেন, গ্রিকদের এই ‘দ্য ওয়ান’ আর কুরআনের ‘আল্লাহ’ আসলে একই সত্তার ভিন্ন দার্শনিক নাম।
যখন মুসলিমরা মিশর ও সিরিয়া জয় করল, তারা এই হেলেনিস্টিক স্কুলগুলো ধ্বংস করেনি। বরং তারা দেখল, এখানকার পণ্ডিতরা যুক্তি বা লজিক (Logic) ব্যবহার করে ঈশ্বর ও মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করছে। এই যুক্তিবিদ্যা মুসলিম ধর্মতত্ত্ব বা কালাম (Kalam)-এর বিকাশে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। গ্রিকদের এই ‘লোগোস’ বা যুক্তির ধারণা পরবর্তীকালে মুসলিম ‘ফালসাফা’-র ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। আলেকজান্ড্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরি আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার জ্ঞান ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের মুখে মুখে, ছোট ছোট পাঠশালায়। মুসলিমরা সেই মৌখিক জ্ঞানকে আবার লিখিত রূপে ফিরিয়ে আনল। তারা টলেমি, গ্যালেন এবং ইউক্লিডের কাজগুলোকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করল এবং তাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণা শুরু করল (O’Leary, 1949)।
গন্ডিশাপুড় একাডেমি: প্রাচীন বিশ্বের মেল্টিং পট
বাগদাদের বায়তুল হিকমাহর ব্লু-প্রিন্ট আসলে তৈরি হয়েছিল অন্য এক জায়গায়, যার নাম গন্ডিশাপুড় একাডেমি (Academy of Gondishapur)। বর্তমান ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই শহরটি ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী। ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে যখন বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান এথেন্সের দার্শনিক স্কুলগুলো বন্ধ করে দেন (কারণ তিনি মনে করতেন ওগুলো প্যাগান বা ধর্মবিরোধী), তখন অনেক গ্রিক পণ্ডিত প্রাণ ভয়ে পারস্যে পালিয়ে আসেন। সাসানীয় রাজা খসরু আনুশিরভান তাদের সাদরে গ্রহণ করেন। গন্ডিশাপুড়ে আগে থেকেই ভারতীয় চিকিৎসকরা ছিলেন। ফলে সেখানে গ্রিক, পারসিক, এবং ভারতীয় জ্ঞানের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটে। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম সত্যিকারের টিচিং হসপিটাল (Teaching Hospital), যেখানে চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণা হতো। এখানে ছাত্ররা হাতে-কলমে রোগী দেখত এবং একই সাথে দর্শনের ক্লাস করত।
মুসলিমরা যখন পারস্য জয় করল, তারা গন্ডিশাপুড়ের এই মডেলটি হুবহু নকল করল। বাগদাদের প্রথম দিকের খলিফাদের ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা ছিলেন এই গন্ডিশাপুড় থেকে আসা জর্জিজ বখতিশু (Jurjis Bukhtishu) এবং তার পরিবারের সদস্যরা। তারা কেবল চিকিৎসাই করতেন না, তারা গ্রিক ও সিরিয়াক ভাষার বইগুলো আরবিতে অনুবাদের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলেন। এই একাডেমির মাধ্যমেই আরবরা প্রথম ভারতীয় আয়ুর্বেদ এবং গ্রিক ইউনানি চিকিৎসার সাথে পরিচিত হয়। গন্ডিশাপুড় না থাকলে বাগদাদের উত্থান হয়তো সম্ভব হতো না, কারণ প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার কাঠামোটা তারা এখান থেকেই পেয়েছিল।
সিরিয়াক ও নেস্টোরিয়ান সংযোগ
গ্রিক জ্ঞান সরাসরি আরবিতে আসেনি। এর মাঝখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ছিল, আর তারা হলেন সিরিয়াক খ্রিস্টান বা নেস্টোরিয়ানরা (Nestorians)। এরা ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়, যাদের ভাষা ছিল সিরিয়াক (অ্যারামাইক ভাষার একটি রূপ)। তারা গ্রিক ভাষা জানতেন ধর্মীয় কারণে, আবার আরবি জানতেন দৈনন্দিন প্রয়োজনে। আব্বাসীয় খলিফারা যখন অনুবাদের ডাক দিলেন, তখন এই নেস্টোরিয়ানরাই এগিয়ে এলেন। তারা ছিলেন নিখুঁত দ্বিভাষী বা বাইলিনগুয়াল (Bilingual)। হুনাইন ইবনে ইশাক, যিনি বায়তুল হিকমাহর প্রধান ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান। তারা প্রথমে গ্রিক বইগুলো সিরিয়াক ভাষায় এবং পরে সেখান থেকে আরবিতে অনুবাদ করতেন। এই মধ্যবর্তী ধাপটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ সিরিয়াক ভাষায় আগে থেকেই গ্রিক পরিভাষাগুলো তৈরি করা ছিল।
তাদের দার্শনিক চিন্তাধারা, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার প্রতি তাদের আগ্রহ, মুসলিম পণ্ডিতদের প্রভাবিত করেছিল। তারা বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বরকে বোঝার জন্য আবেগের চেয়ে যুক্তির প্রয়োজন বেশি। এই স্কলাস্টিক (Scholastic) বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ঐতিহ্য মুসলিম মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গঠনকে প্রভাবিত করেছিল। নেস্টোরিয়ান মঠগুলোতে যে পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হতো (গুরুর পায়ের কাছে বসে ছাত্রের শিক্ষা নেওয়া, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শেখা), সেটাই পরে মুসলিম মাদ্রাসার মডেলে পরিণত হয়। তারা শুধু অনুবাদক ছিলেন না, তারা ছিলেন শিক্ষক। তারা মুসলিম পণ্ডিতদের শিখিয়েছিলেন কীভাবে প্লেটোর রূপক বা অ্যারিস্টটলের যুক্তিকে বুঝতে হয় (Brock, 2004)।
ভারতীয় গণিত ও সিদ্ধান্ত
পশ্চিমে গ্রিস যেমন দর্শনের জোগান দিয়েছিল, পূর্বে ভারত দিয়েছিল গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার রসদ। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় ভারতে গণিতচর্চা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। ৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে একজন ভারতীয় পণ্ডিত বাগদাদে আসেন, যার নাম আরব ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন ‘কনক’ বা ‘কঙ্ক’ হিসেবে। তিনি সাথে নিয়ে এসেছিলেন ব্রহ্মগুপ্তের লেখা ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত। এই বইটি আরবিতে অনূদিত হয় জিজ আল-সিন্ধহিন্দ (Zij al-Sindhind) নামে। এর মাধ্যমেই আরবরা প্রথম হেলিওসেন্ট্রিক বা সূর্যকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার (যদিও আর্যভট্ট পুরোপুরি তা বলেননি, কিন্তু গ্রহের গতির ব্যাখ্যা ছিল) গাণিতিক মডেল এবং ত্রিকোণমিতির সাথে পরিচিত হয়।
ভারতীয়দের সিদ্ধান্ত (Siddhanta) বা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থগুলো আল-খওয়ারিজমি এবং আল-বিরুনির কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। ভারতীয় গণিতের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ‘শূন্য’ এবং দশমিক স্থানিক মান বা ডেসিমেল পজিশনাল সিস্টেম (Decimal Positional System)। গ্রিক গণিত ছিল জ্যামিতিনির্ভর এবং কিছুটা জটিল, কিন্তু ভারতীয় গণিত ছিল বিমূর্ত এবং সংখ্যাভিত্তিক। আরবরা এই দুই পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের গণিত তৈরি করল, যা ছিল আরও শক্তিশালী। ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে ন্যায় (Nyaya) দর্শনের যুক্তিবিদ্যা এবং বৈশেষিক (Vaisheshika) দর্শনের পরমাণুবাদ বা অ্যাটমিজম (Atomism), মুসলিম কালাম শাস্ত্রের কিছু শাখাকে প্রভাবিত করেছিল বলে অনেক গবেষক মনে করেন। বিশেষ করে আশারি এবং মুতাজিলা ধর্মতাত্ত্বিকরা যে পরমাণুবাদে বিশ্বাস করতেন (যেখানে সময় এবং স্থান অবিভাজ্য কণার সমষ্টি), তার সাথে ভারতীয় বৈশেষিক দর্শনের মিল পাওয়া যায় (Kak, 2005)।
পারসিক আদব ও ইশরাকি দর্শন
সাসানীয় পারস্যের বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান কেবল প্রশাসনে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা দর্শনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পারস্যের প্রাচীন ধর্ম জরাথুস্ট্রবাদ (Zoroastrianism)-এর একটি মূল ধারণা ছিল আলো ও অন্ধকারের চিরন্তন সংঘাত। এই ধারণাটি পরবর্তীকালে মুসলিম দর্শনে, বিশেষ করে শিহাব আল-দিন আল-সোহরাওয়ার্দীর ইশরাকি বা আলোকবাদ (Illuminationism)-এ ফিরে আসে। সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, জ্ঞান হলো আলোর বিচ্ছুরণ, আর অজ্ঞানতা হলো অন্ধকার। তার এই দর্শন গ্রিক যুক্তিবিদ্যা এবং পারসিক আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মিলন ছিল।
এছাড়া, পারস্যের আদব সাহিত্য (Adab Literature) বা শিষ্টাচার বিষয়ক গ্রন্থগুলো নৈতিকতা ও রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। ইবনে আল-মুকাফফা অনূদিত কালিলা ওয়া দিমনা (মূলত ভারতীয় পঞ্চতন্ত্র-এর অনুবাদ) কেবল গল্পের বই ছিল না, এটি ছিল রাজাদের জন্য এক ধরনের মিরর ফর প্রিন্সেস বা আয়না (Mirror for Princes), যেখানে নৈতিকতা ও রাজনীতির শিক্ষা দেওয়া হতো। এই সাহিত্যগুলো মুসলিম সমাজে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার (Secular) বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা তৈরি করেছিল, যেখানে ধর্ম নয়, বরং মানবতা ও প্রজ্ঞাই ছিল মূল কথা। নিজামুল মুলকের সিয়াসতনামা (Book of Government) এই ধারারই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
সাবিয়ান ও হাররানের নক্ষত্রপূজারীরা
বাগদাদ থেকে খুব দূরে নয়, হাররান (Harran) নামের এক প্রাচীন শহরে বাস করত সাবিয়ান (Sabians) নামের এক সম্প্রদায়। তারা ছিল নক্ষত্রপূজারি, কিন্তু তাদের ধর্ম ছিল জ্ঞানভিত্তিক। তারা বিশ্বাস করত, নক্ষত্রের গতিবিধি বুঝতে পারলে ঈশ্বরের ভাষা বোঝা সম্ভব। তাই তারা গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করত অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। তারা প্রাচীন গ্রিক জ্ঞানের এক বড় অংশ, বিশেষ করে পিথাগোরাস ও প্লেটোর গাণিতিক দর্শন সংরক্ষণ করে রেখেছিল। থাবিত ইবনে কুররা এবং আল-বাত্তানির মতো মহান বিজ্ঞানীরা এই সম্প্রদায় থেকেই এসেছিলেন। তারা বাগদাদে গিয়ে তাদের গাণিতিক জ্ঞান মুসলিমদের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। সাবিয়ানরা বিশ্বাস করত, মহাবিশ্ব একটি গাণিতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের এই বিশ্বাস মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছিল মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনায় গাণিতিক সূত্র খুঁজতে। তাদের অনুবাদগুলো ছিল অত্যন্ত নিখুঁত এবং উচ্চমানের।
এই সব ধারা – গ্রিক যুক্তি, ভারতীয় গণিত, পারসিক প্রজ্ঞা, সিরিয়াক পাণ্ডিত্য এবং হাররানের নক্ষত্রবিদ্যা – এসে মিশেছিল বাগদাদের মোহনায়। স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা এই সবকিছুর নির্যাস নিয়ে তৈরি করেছিলেন এক নতুন সভ্যতা, যা ছিল বিশ্বজনীন এবং কালজয়ী। তারা কেবল অনুকরণ করেননি, তারা এই সব উপাদানকে নতুন ছাঁচে ঢেলে নতুন কিছু সৃষ্টি করেছিলেন।
শিল্প আন্দোলন ও সংস্কৃতির প্রবহমান ধারা
বিজ্ঞান বা দর্শন যেমন শূন্য থেকে আসে না, শিল্পকলাও তাই। ইসলামি স্বর্ণযুগের স্থাপত্য, ক্যালিগ্রাফি এবং কারুশিল্প হঠাৎ করে মরুভূমিতে গজিয়ে ওঠেনি। এগুলো ছিল পূর্ববর্তী বাইজেন্টাইন, সাসানীয় এবং স্থানীয় লোকজ শিল্পের এক নতুন ফিউশন বা সংমিশ্রণ। শাসকরা চেয়েছিলেন তাদের ক্ষমতা ও জৌলুস প্রকাশ করতে, আর তার জন্য তারা ধার করেছিলেন আগের সাম্রাজ্যগুলোর চাক্ষুষ ভাষা বা ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ (Visual Language)। তারা দেখলেন, একটি নতুন সাম্রাজ্যকে কেবল তলোয়ার দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় না, তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের মনে বিস্ময় জাগাতে হয়, আর সেই বিস্ময় জাগানোর সেরা হাতিয়ার হলো শিল্প। তাই তারা পুরনো ইট-পাথর দিয়ে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন। বাইজেন্টাইনদের জাঁকজমক আর সাসানীয়দের আভিজাত্য – এই দুই ধারা এসে মিশল ইসলামের একেশ্বরবাদী সরলতার সাথে, আর জন্ম নিল এক অনন্য শিল্পরীতি।
বাইজেন্টাইন স্থাপত্য ও মোজাইক শিল্প
উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক যখন জেরুজালেমে ডোম অফ দ্য রক (Dome of the Rock) নির্মাণ করলেন (৬৯১ খ্রি.), তখন তিনি আসলে বাইজেন্টাইনদের সাথে এক স্থাপত্য-যুদ্ধে নেমেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক ইমারত বানাতে যা জেরুজালেমের চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকার (Church of the Holy Sepulchre)-এর চেয়েও সুন্দর হবে, যা খ্রিস্টানদের দেখিয়ে দেবে যে নতুন ধর্মটিও সৌন্দর্যের পূজারি। এই ভবনের গঠন – অষ্টভুজাকৃতি এবং বিশাল সোনালী গম্বুজ – সরাসরি বাইজেন্টাইন চার্চের আদলে তৈরি। এমনকি এর ভেতরের মোজাইক (Mosaic) বা পাথর বসানো নকশাগুলো তৈরি করার জন্য কনস্টান্টিনোপল থেকে বিশেষজ্ঞ কারিগর আনা হয়েছিল। তারা ছোট ছোট কাঁচের টুকরো বা ‘টেসেরা’ দিয়ে দেয়ালের গায়ে এক জাদুকরী জগত তৈরি করেছিল।
কিন্তু এখানে একটি বড় দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক পরিবর্তন ছিল। বাইজেন্টাইন মোজাইকে যিশু, মেরী বা সাধু-সন্তদের ছবি থাকত, কিন্তু ইসলামি শিল্পে প্রাণীর ছবি বা মানবমূর্তি আইকনোক্লাজম (Iconoclasm)-এর কারণে নিষিদ্ধ থাকায় তারা লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা এবং ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করল। এই যে পুরনো টেকনিক ব্যবহার করে নতুন বিষয়বস্তু বা কন্টেন্ট (Content) তৈরি করা – এটাই হয়ে উঠল ইসলামি শিল্পের মূল বৈশিষ্ট্য। দামেস্কের গ্র্যান্ড মসজিদের মোজাইকেও আমরা দেখি বাইজেন্টাইন শিল্পীসুলভ গাছপালা, নদী ও শহরের দৃশ্য, কিন্তু কোনো মানুষ বা প্রাণী নেই। শিল্পীরা জান্নাতের বর্ণনা ফুটিয়ে তুলেছিলেন গাছপালা আর নদীর ছবির মাধ্যমে। এই বিমূর্ততা বা অ্যাবস্ট্রাকশন (Abstraction) পরবর্তীকালে জ্যামিতিক নকশার চরম উৎকর্ষে পৌঁছায়, যা ‘এরাবেস্ক’ (Arabesque) নামে পরিচিত (Ettinghausen et al., 2001)।
সাসানীয় জৌলুস ও ইওয়ান স্থাপত্য
আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসার পর শিল্পের মোড় ঘুরে গেল পারস্যের দিকে। বাগদাদ বা সামারার প্রাসাদগুলো তৈরি হতে লাগল সাসানীয় কায়দায়। সাসানীয় স্থাপত্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ইওয়ান (Iwan) – এক বিশাল খিলানযুক্ত হলঘর যা একপাশে খোলা এবং তিনদিকে দেয়াল। এটি রাজকীয় ক্ষমতার প্রতীক ছিল, যেখানে রাজা সিংহাসনে বসতেন এবং প্রজারা তাকে দেখত। পরবর্তীকালে ইসলামি মসজিদ এবং মাদ্রাসার স্থাপত্যে এই ইওয়ান একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে সেলজুক যুগে ‘চার ইওয়ান’ পদ্ধতির মসজিদ খুব জনপ্রিয় হয়।
এছাড়া সাসানীয়দের ধাতব শিল্প, বিশেষ করে রূপার প্লেট এবং পাত্রের ওপর খোদাই করা নকশাগুলো ইসলামি কারুশিল্পকে প্রভাবিত করে। সাসানীয়রা শিকারের দৃশ্য, পৌরাণিক প্রাণী (যেমন সিমুর্গ বা সেনমুরুভ) এবং রাজকীয় ভোজের দৃশ্য আঁকত। ইসলামি শিল্পীরা এই মোটিফগুলো গ্রহণ করলেন, তবে সেগুলোকে কিছুটা নমনীয় এবং আলঙ্কারিক করে তুললেন। তারা ধাতু বা সিরামিকের পাত্রে ‘লাস্টারওয়্যার’ বা ধাতব আভা আনার কৌশল আবিষ্কার করল, যা সাসানীয়দের রূপার পাত্রের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আব্বাসীয় দরবারের আদব-কায়দা, পোশাক-পরিচ্ছদ, এমনকি খাবার-দাবারের ধরনও ছিল সাসানীয় প্রভাবিত। এই পার্সিয়ানেট কালচার (Persianate Culture) বা পারস্য-ঘেঁষা সংস্কৃতি স্বর্ণযুগের শিল্প ও সাহিত্যের রুচি তৈরি করে দিয়েছিল। বাগদাদের কবিরা সাসানীয় যুগের রোমান্টিকতা আর বিলাসিতাকে তাদের কবিতায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
প্রাক-ইসলামি কবিতা ও ভাষার বিশুদ্ধতা
শিল্প কেবল ইট-পাথরের হয় না, ভাষারও হয়। ইসলামি স্বর্ণযুগের অন্যতম ভিত্তি ছিল আরবি ভাষা। আর এই ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল প্রাক-ইসলামি যুগের জাহেলিয়া (Jahiliyyah) বা অজ্ঞতার যুগের কবিতার মাধ্যমে। মরুভূমির কবিরা তাদের ‘কাসিদা’ বা দীর্ঘ কবিতায় যে শব্দভাণ্ডার এবং ছন্দশৈলী তৈরি করেছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও পরিশীলিত। ইমরুল কায়েস বা লবীদের মতো কবিরা ভাষার যে জাদুকরী বুনন তৈরি করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে আরবি সাহিত্যের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। কুরআন এই ভাষাতেই নাযিল হয়েছিল, যা আরবি ভাষাকে একটি পবিত্র এবং অপরিবর্তনীয় মানদণ্ড বা স্ট্যান্ডার্ড দিয়েছিল।
স্বর্ণযুগে যখন বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চা শুরু হলো, তখন অনুবাদকরা দেখলেন যে তাদের হাতে এমন একটি ভাষা আছে যা অত্যন্ত নমনীয় এবং শব্দগঠনে সক্ষম। গ্রিক বা পারসিক জটিল শব্দগুলোর জন্য নতুন আরবি শব্দ তৈরি করা খুব সহজ ছিল আরবি ব্যাকরণের রুট সিস্টেম (Root System)-এর কারণে। যেমন, ‘ক-ত-ব’ (লেখা) মূল থেকে কিতাব (বই), কাতিব (লেখক), মাকতাব (অফিস/স্কুল) – এভাবে শব্দ তৈরি করা যায়। তাই প্রাক-ইসলামি আরবের সেই মৌখিক সাহিত্য বা ওরাল ট্র্যাডিশন (Oral Tradition) পরোক্ষভাবে বৈজ্ঞানিক গদ্য লেখার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ভাষা যদি দুর্বল হতো, তবে এত বিশাল জ্ঞানের ভার বহন করা সম্ভব হতো না। জাহেলিয়া যুগের কবিতা ছিল আবেগের, আর স্বর্ণযুগের গদ্য ছিল যুক্তির – কিন্তু উভয়ের ভিত্তি ছিল একই শক্তিশালী আরবি ভাষা।
ক্যালিগ্রাফি: অক্ষরের স্থাপত্য
ইসলামি শিল্পে ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের উত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি ছিল কুরআনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ। যেহেতু ঈশ্বরের বাণীকে মূর্তিতে রূপ দেওয়া যায় না, তাই শিল্পীরা চাইলেন অক্ষরগুলোকেই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে। তারা ‘কুফিক’ লিপিকে (যা কুফা নগরীতে উদ্ভূত) জ্যামিতিক রূপ দিলেন। এই লিপি কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি উঠে এল মসজিদের দেয়ালে, সিরামিকের পাত্রে, এমনকি কাপড়ের নকশায়। ক্যালিগ্রাফার ইবনে মুকলা দশম শতাব্দীতে অক্ষরের অনুপাত বা প্রপোশন (Proportion) নির্ধারণের জন্য জ্যামিতিক নিয়ম তৈরি করেন, যাকে বলা হয় ‘আল-খাত আল-মানসুব’। এটি ছিল অক্ষরের স্থাপত্য। তিনি বলেছিলেন, “ক্যালিগ্রাফি হলো হাতের জ্যামিতি।”
ক্যালিগ্রাফির এই বিবর্তন পূর্ববর্তী বাইজেন্টাইন বা সাসানীয় লিপিশিল্প থেকে আলাদা ছিল। এটি হয়ে উঠেছিল ইসলামি পরিচয়ের প্রধান বাহন বা আইডেন্টিটি মার্কার (Identity Marker)। স্পেনের আলহামব্রা প্রাসাদের দেয়ালে যে ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়, তা কেবল লেখা নয়, তা এক ধরনের ভিজ্যুয়াল মিউজিক। সেখানে বারবার লেখা আছে, “আল্লাহ ছাড়া কোনো বিজয়ী নেই” – এই বাক্যটি সেখানে কেবল ধর্মীয় বাণী নয়, এটি প্রাসাদের সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কার্পেট ও বস্ত্রশিল্প: বুননের গল্প
মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্যের কার্পেট বা গালিচা শিল্প স্বর্ণযুগের অর্থনীতির এক বড় অংশ ছিল। যাযাবর উপজাতিদের বুনন কৌশল এবং পারস্যের রাজকীয় নকশা – এই দুইয়ের মিলনে তৈরি হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত সব কার্পেট। এই কার্পেটগুলো ইউরোপে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পীরা তাদের ছবিতে দামী আসবাবের বদলে কার্পেট আঁকতেন আভিজাত্য বোঝাতে। একে বলা হয় ওরিয়েন্টাল কার্পেট ইন রেনেসাঁ পেইন্টিং (Oriental Carpets in Renaissance Painting)। কার্পেটের নকশায় যে বাগান বা ‘প্যারাডাইস গার্ডেন’ ফুটিয়ে তোলা হতো, তা ছিল কুরআনের জান্নাতের বর্ণনার প্রতিফলন। চারবাগ বা চার ভাগে বিভক্ত বাগানের নকশা (যা তাজমহলে দেখা যায়) এই কার্পেট ডিজাইন থেকেই স্থাপত্যে এসেছিল। এছাড়া ‘তিরাজ’ বা রাজকীয় পোশাকের ওপর সুতা দিয়ে নাম বা কুরআনের আয়াত লেখার প্রথাটি ফাতেমীয় এবং আব্বাসীয় খলিফারা খুব জনপ্রিয় করেছিলেন। এটি ছিল ক্ষমতার প্রতীক।
চীনামাটি ও লাস্টারওয়্যার: সিল্ক রোডের উপহার
চীনে তাং রাজবংশের (Tang Dynasty) পোরসেলিন বা চীনামাটির বাসন যখন সিল্ক রোড ধরে বাগদাদে পৌঁছাল, তখন আব্বাসীয় কুমাররা অবাক হয়ে গেল। তারা সাদা মাটির ওই স্বচ্ছতা বা ট্রান্সলুসেন্সি নকল করার চেষ্টা করল। কিন্তু ইরাকের মাটিতে ওই বিশেষ উপাদান (কাওলিন) ছিল না। তখন তারা এক নতুন বুদ্ধি বের করল। তারা সাধারণ মাটির পাত্রের ওপর টিন-অক্সাইডের সাদা প্রলেপ দিয়ে তাকে চীনামাটির মতো দেখাতে চাইল। এভাবেই জন্ম নিল টিন-গ্লেজড পটারি (Tin-glazed Pottery)।
এরপর তারা আবিষ্কার করল লাস্টারওয়্যার (Lusterware)। এটি ছিল সিরামিকের ওপর ধাতব আভা আনার এক জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া। পাত্রের ওপর তামা বা রূপার অক্সাইড দিয়ে নকশা করে অক্সিজেনের অভাব আছে এমন চুল্লিতে পোড়ানো হতো। ফলে পাত্রটি দেখতে সোনার বা রূপার মতো চকচক করত। ইসলামে সোনা বা রূপার পাত্রে খাওয়া অপছন্দ করা হতো বলে এই লাস্টারওয়্যার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ছিল প্রযুক্তি ও ধর্মের এক অদ্ভুত সমাধান। এই প্রযুক্তি পরে স্পেন হয়ে ইতালিতে যায় এবং সেখানে ‘মায়োলিকা’ (Maiolica) সিরামিক শিল্পের জন্ম দেয় (Caiger-Smith, 1985)।
এভাবেই রাজনীতি, দর্শন এবং শিল্পের নানা স্রোত এসে মিশেছিল অষ্টম ও নবম শতাব্দীর বাগদাদে। আলেকজান্ডারের স্বপ্নের হেলেনিজম, পারস্যের প্রশাসনিক দক্ষতা, ভারতের গাণিতিক বিমূর্ততা এবং আরবের ভাষাগত শক্তি – সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা এই উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করেননি, বরং তারা এর ওপর দাঁড়িয়ে নতুন এক আকাশ ছোঁয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। তারা ছিলেন ইতিহাসের সেই সচেতন সন্তান, যারা জানতেন যে নতুনের জন্ম দিতে হলে পুরনোর হাত ধরতে হয়, কিন্তু তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে হয় না। তারা তৈরি করেছিলেন এক ‘গ্লোবাল কালচার’ বা বিশ্বসংস্কৃতি, যার রেশ আজও আমাদের জীবনে রয়ে গেছে।
জ্ঞানালোকের শুরু: অনুবাদ আন্দোলন ও বাগদাদ
ইতিহাসের চাকাটা ঘোরার শুরু আব্বাসীয় খিলাফতের (Abbasid Caliphate) হাত ধরে, তবে এই ঘোরার শব্দটা মোটেও মসৃণ ছিল না, বরং তাতে মিশে ছিল বিপ্লবের রক্তস্রোত আর আমূল পরিবর্তনের হুঙ্কার। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উমাইয়াদের হটিয়ে যখন আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় এল, তখন তারা শুধু শাসকের মুখই বদলাল না, বদলে দিল সভ্যতার গতিপথ। দামেস্কের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তারা তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে টেনে নিয়ে গেল পূর্বে, টাইগ্রিস বা দজলা নদীর তীরে, যেখানে গড়ে উঠল এক স্বপ্নের শহর – বাগদাদ। এই স্থানান্তর কেবল ভৌগোলিক ছিল না, এটা ছিল একটা বিশাল কালচারাল শিফট বা সাংস্কৃতিক রূপান্তর (Cultural Shift)। উমাইয়ারা ছিল মূলত আরব কেন্দ্রিক, তাদের চিন্তা-ভাবনা মরুভূমির গোত্রতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আব্বাসীয়রা চাইল এমন এক সাম্রাজ্য গড়তে যা হবে বিশ্বজনীন বা কসমোপলিটান (Cosmopolitan)। তারা বুঝতে পেরেছিল, তলোয়ার দিয়ে রাজ্য জয় করা যায়, কিন্তু সভ্যতা টেকাতে হলে দরকার মগজের জোর। বাগদাদ শহরটা যখন খলিফা আল-মনসুর (Caliph Al-Mansur) নকশা করলেন, তখন তিনি একে বানিয়েছিলেন নিখুঁত গোল করে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য রাউন্ড সিটি’ (The Round City) বা ‘মাদিনাত আল-সালাম’ (City of Peace)। এই শহরের নকশাটাই ছিল জ্যামিতিক নিখুঁততার এক আশ্চর্য নিদর্শন। মাঝখানে খলিফার প্রাসাদ আর মসজিদ, আর তাকে ঘিরে বৃত্তাকার দেওয়াল, যেন মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। এই শহরটাই খুব দ্রুত হয়ে উঠল পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র বা ইন্টেলেকচুয়াল হাব (Intellectual Hub), যেখানে পূর্বের পারস্য আর পশ্চিমের গ্রিস এসে হাত মিলিয়েছিল। বাগদাদের অলিগলিতে তখন শোনা যেত নানা ভাষার গুঞ্জন – আরবি, ফার্সি, সিরিয়াক, গ্রিক আর হিব্রু। এখানে জ্ঞানচর্চা কোনো শৌখিনতা ছিল না, এটা ছিল বেঁচে থাকার এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক অনুষঙ্গ।
খলিফারা একটা দারুণ কিন্তু ব্যয়বহুল কাজ করলেন, যা তাদের অমর করে রেখেছে। তারা বললেন, যুদ্ধজয়ের চেয়ে জ্ঞানজয় বেশি জরুরি। শুরু হলো এক বিশাল যজ্ঞ, যার নাম ‘অনুবাদ আন্দোলন’ (Graeco-Arabic Translation Movement)। এই আন্দোলন কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না, একে বলা যেতে পারে মানুষের ইতিহাসের অন্যতম বড় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প (Intellectual Project)। গ্রিক, পারসিক, সংস্কৃত, সিরিয়াক – যেখানে যত বই আছে, সব আরবিতে অনুবাদ করতে হবে। জ্ঞান তখন আর কোনো নির্দিষ্ট জাতির সম্পত্তি রইল না, জ্ঞান হয়ে গেল গ্লোবাল বা বৈশ্বিক (Gutas, 1998)। এই আন্দোলনের পেছনে শুধু যে জ্ঞানের প্রতি বিশুদ্ধ প্রেম ছিল তা ভাবলে ভুল হবে, এর পেছনে ছিল রাজনীতির খেলাও। আব্বাসীয়রা নিজেদের উমাইয়াদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে চাইছিল, তারা দেখাতে চাইছিল যে তারা কেবল মুসলিমদের নেতা নয়, বরং তারা প্রাচীন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের উত্তরাধিকারী। তারা সাসানীয় রাজাদের (Sassanian Kings) অনুকরণে নিজেদের জ্ঞানপিপাসু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। অ্যারিস্টটল (Aristotle), প্লেটো (Plato), টলেমি (Ptolemy), গ্যালেন (Galen), ইউক্লিড (Euclid), আর্কিমিডিস (Archimedes) – কাউকে বাদ দেওয়া হলো না। গ্রিক দর্শন আর বিজ্ঞানের এই বিশাল ভাণ্ডারকে তারা নিজেদের করে নিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যখন ইউরোপের খ্রিস্টান চার্চগুলো এই সব ‘পাগান’ বা পৌত্তলিক বইপত্র পুড়িয়ে ফেলছিল বা লুকিয়ে রাখছিল, তখন বাগদাদের মুসলিম শাসকরা সেই ‘পাগান’ জ্ঞানের জন্যই কোটি কোটি দিনার খরচ করছিল। তারা বিশ্বাস করত, সত্য যেখানেই থাকুক, তা কুড়িয়ে নিতে হবে, তা সে যে ধর্মের বা যে জাতিরই হোক না কেন। এই সর্বজনীনতাবাদ (Universalism) ছিল সেই যুগের মূল চালিকাশক্তি।
বায়তুল হিকমাহ: মস্তিষ্কের কারখানা
এই পুরো বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করার জন্য বাগদাদে প্রতিষ্ঠা করা হলো ‘বায়তুল হিকমাহ’ বা ‘হাউজ অফ উইজডম’ (House of Wisdom)। এটি নিছক কোনো লাইব্রেরি ছিল না; আজকের দিনের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র বা থিংক ট্যাংকের (Think Tank) সাথে এর তুলনা চলে। কল্পনা করুন এমন একটা জায়গা, যেখানে বিশাল বিশাল সব হলঘরে হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি রাখা আছে, আর সেখানে বসে আছেন পৃথিবীর সেরা সব পণ্ডিতরা। এক টেবিলে হয়তো বসে আছেন একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান, তার পাশে একজন ইহুদি রাব্বাই, আর উল্টো দিকে একজন মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক বা মুতাযিলা (Mutazila) দার্শনিক। তারা তর্ক করছেন, যুক্তি দিচ্ছেন, আর প্রাচীন গ্রিক টেক্সটগুলোর অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। এখানে ছিল অনুবাদ ব্যুরো, মানমন্দির এবং থাকার জায়গা। এখানে বসে হুনাইন ইবনে ইশাক (Hunayn ibn Ishaq)-এর মতো পণ্ডিতরা দিনের পর দিন গ্রিক পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করে গেছেন। হুনাইন ছিলেন একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান, কিন্তু তাকে বলা হতো ‘অনুবাদকদের শেখ’। তিনি গ্রিক ভাষা জানতেন জলের মতো, আরবি আর সিরিয়াক ভাষায় ছিল তার অগাধ দখল। তিনি আক্ষরিক অনুবাদের বদলে ভাবানুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, যা বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে সহজবোধ্য করে তুলেছিল। তার পারিশ্রমিক ছিল আকাশচুম্বী। শোনা যায়, খলিফা আল-মামুন (Caliph Al-Ma’mun) নাকি অনুবাদের বিনিময়ে বইয়ের ওজনে সোনা দিতেন। কথাটা হয়তো লোকমুখে ফিরতে ফিরতে অতিরঞ্জিত হয়েছে, কিন্তু এর পেছনের সত্যটা হলো – রাষ্ট্র তখন জ্ঞানের জন্য অঢেল অর্থ ঢালতে প্রস্তুত ছিল। আল-মামুন নিজে ছিলেন ঘোর যুক্তিবাদী (Rationalist)। কথিত আছে, তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে এক নীল চোখের বৃদ্ধ মানুষ তার সাথে কথা বলছেন, যিনি নিজেকে অ্যারিস্টটল বলে পরিচয় দেন। এই স্বপ্ন তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি গ্রিক দর্শন বা হেলেনিস্টিক ফিলোসফি (Hellenistic Philosophy) এবং যুক্তিবাদকে ইসলামের সাথে মেলানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। বায়তুল হিকমাহতে কেবল অনুবাদ হতো না, সেখানে মৌলিক গবেষণাও হতো। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান – সব শাখায় নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হচ্ছিল। এটি ছিল এমন এক জায়গা যেখানে আল-কিন্দি (Al-Kindi) বা আল-খওয়ারিজমি (Al-Khwarizmi) তাদের যুগান্তকারী কাজগুলো করেছিলেন।
কাগজ বিপ্লব: জ্ঞানের গণতন্ত্রায়ন
আরেকটা ব্যাপার খুব সাহায্য করেছিল, যাকে বলা যায় প্রযুক্তির এক নীরব বিপ্লব – কাগজ। চীনারা কাগজ বানাতে জানত, কিন্তু সেই প্রযুক্তি তারা অত্যন্ত গোপনে আগলে রেখেছিল। ৭৫১ সালে তালাস নদীর যুদ্ধে (Battle of Talas) কিছু চীনা যুদ্ধবন্দির কাছ থেকে আরবরা কাগজ বানানোর প্রযুক্তি শিখে নেয়। এই ঘটনাটা আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও এর প্রভাব ছিল পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। এর আগে জ্ঞান লেখা হতো প্যাপিরাস বা পার্চমেন্টে (Parchment), যা ছিল অত্যন্ত দামি আর দুর্লভ। একটা মাঝারি সাইজের বই লিখতে গেলে এক পাল ভেড়ার চামড়া লাগত। চামড়া প্রসেস করা, সেটাকে লেখার উপযোগী করা ছিল এক বিশাল ঝক্কির কাজ। ফলে বই ছিল কেবল রাজা-বাদশা আর অতি ধনীদের বিলাসদ্রব্য। জ্ঞান ছিল তালাবদ্ধ সিন্দুকের মতো। কিন্তু কাগজ? কাগজ সস্তা, হালকা এবং সহজলভ্য। পুরনো কাপড়, ছেঁড়া ন্যাকড়া, গাছের ছাল – এসব দিয়েই কাগজ বানানো সম্ভব হলো। বাগদাদে কাগজের কল বসানো হলো, তৈরি হলো বিশাল এক ইন্ডাস্ট্রি। দেখতে দেখতে বাগদাদের ‘সুলাইখ’ এলাকায় গড়ে উঠল বিখ্যাত ‘সুক আল-ওয়াররাকিন’ বা কাগজ ও বই বিক্রেতাদের বাজার (Bennison, 2009)। সেখানে শত শত দোকান, হাজার হাজার বই। হু হু করে বই লেখা শুরু হলো। জ্ঞান চলে এল সাধারণের নাগালের মধ্যে। আগে যেখানে একটা বই কপি করতে মাসের পর মাস লাগত এবং খরচ হতো প্রচুর, এখন সেখানে বই তৈরি করা অনেক সহজ হয়ে গেল। বইয়ের দোকান, কপিয়িস্ট বা অনুলিপিকারকদের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠল। ইউরোপ যখন চামড়ার ওপর লিখতে হিমশিম খাচ্ছে, বাগদাদের রাস্তায় তখন বই বিক্রি হচ্ছে সস্তায় (Bloom, 2001)। কাগজের এই বিপ্লব না হলে জ্ঞানের এই বিস্ফোরণ সম্ভব হতো না। এটি সমাজে তৈরি করল এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা শিক্ষিত এবং বইপ্রেমী। প্রশাসনিক কাজেও এল বিশাল গতি। বিশাল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের হিসাব-নিকাশ, কর আদায়, চিঠিপত্র – সবকিছু কাগজে লিপিবদ্ধ হতে শুরু করল, যা আমলাতন্ত্র বা ব্যুরোক্রেসি (Bureaucracy)-কে শক্তিশালী করল।
অনুবাদের রাজনীতি ও দর্শনের সংঘাত
অনুবাদ আন্দোলন কেবল ভাষাগত ব্যপার ছিল না, এর সাথে জড়িয়ে ছিল গভীর দার্শনিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণ। আব্বাসীয় খলিফারা, বিশেষ করে আল-মামুন, মুতাযিলা (Mutazila) মতবাদের সমর্থক ছিলেন। মুতাযিলা হলো ইসলামের এক বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা বিশ্বাস করত যে ধর্মকে অবশ্যই যুক্তির বা লজিক (Logic)-এর কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হবে। তারা গ্রিক দর্শন, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা (Aristotelian Logic) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিল। তারা মনে করত, মানুষের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ বা ফ্রি উইল (Free Will) আছে এবং ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা মানুষের নিজের বুদ্ধির মধ্যেই নিহিত। এই যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করার জন্য তাদের দরকার ছিল গ্রিক দর্শনের বইগুলো। তাই অনুবাদ আন্দোলন ছিল তাদের জন্য এক ধরনের মতাদর্শগত হাতিয়ার। অন্যদিকে, রক্ষণশীলরা এই ‘বিদেশি জ্ঞান’ বা ফরেইন সায়েন্সেস (Foreign Sciences)-কে সন্দেহের চোখে দেখত। তাদের মতে, সত্য কেবল ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই আসতে পারে, মানুষের ভঙ্গুর যুক্তি দিয়ে সত্যকে মাপা পাপ। এই দুই দলের সংঘাত বাগদাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। তর্কের টেবিলে ঝড় উঠত। হুনাইন ইবনে ইশাক (Hunayn ibn Ishaq) বা থাবিত ইবনে কুররা (Thabit ibn Qurra)-র মতো অনুবাদকরা কেবল শব্দান্তর করতেন না, তারা নতুন নতুন পরিভাষা বা টার্মিনোলজি (Terminology) তৈরি করতেন। আরবি ভাষায় তখনো বিজ্ঞান বা দর্শনের অনেক শব্দের অস্তিত্বই ছিল না। ‘ম্যাটার’ বা পদার্থ, ‘এসেন্স’ বা সারাংশ, ‘অ্যাকসিডেন্ট’ বা গুণ – এগুলোর আরবি প্রতিশব্দ তারা তৈরি করলেন। যেমন – গ্রিক ‘হিউলে’ (Hyle) এর জন্য তারা ব্যবহার করলেন ‘হাইয়ুলা’, ‘নেচার’ বা প্রকৃতির জন্য ‘তাবিয়া’। অর্থাৎ, তারা আরবি ভাষাকেই নতুন করে নির্মাণ করলেন, তাকে বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে উপযুক্ত করে তুললেন (Pormann, 2007)।
বাগদাদের এই স্বর্ণালি সময়ে জ্ঞানচর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পৃষ্ঠপোষকতা বা প্যাট্রনেজ (Patronage)। খলিফা তো ছিলেনই, তার সাথে ছিল বারমাকি পরিবার (Barmakids)। এই পারসিয়ান বংশোদ্ভূত উজিররা ছিলেন বিশাল ধনী এবং বিদ্যোৎসাহী। তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুবাদক ও বিজ্ঞানীদের পুষতেন। তাদের প্রাসাদে নিয়মিত বসত সাহিত্য ও বিজ্ঞানের আসর, যাকে বলা হতো ‘মজলিস’। সেখানে কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না। কে মুসলিম, কে ইহুদি, কে জরাথুস্ট্রবাদী – তা কেউ দেখত না। দেখা হতো কার যুক্তির ধার কত বেশি। এই মুক্ত পরিবেশই বাগদাদকে বানিয়েছিল অনন্য। তবে এই অনুবাদ আন্দোলন কেবল গ্রিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারত থেকেও আসছিল গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যার বই। ব্রহ্মগুপ্ত (Brahmagupta)-র লেখা ‘ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত’ বা ‘খণ্ডখাদ্যক’ বাগদাদে এসে আরবিতে অনূদিত হলো। ভারতীয় পণ্ডিতরা বাগদাদে এসে তাদের জ্ঞানের ঝুলি উজাড় করে দিলেন। সংস্কৃত থেকে আরবিতে অনুবাদের মাধ্যমে আরবরা পেল সেই জাদুকরী ‘শূন্য’ বা জিরো এবং দশমিক পদ্ধতি। অর্থাৎ, বাগদাদ হয়ে উঠেছিল এক বিশাল ‘মেল্টিং পট’ (Melting Pot), যেখানে পূর্ব ও পশ্চিমের জ্ঞান গলে মিশে একাকার হয়ে নতুন এক সভ্যতার জন্ম দিচ্ছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, এই সময় যদি বাগদাদ না থাকত, যদি এই অনুবাদ আন্দোলন না হতো, তবে আজকের আধুনিক বিজ্ঞান হয়তো আরও হাজার বছর পিছিয়ে থাকত। কারণ, গ্রিকদের মূল কাজগুলোর বেশিরভাগই মূল গ্রিক ভাষায় হারিয়ে গিয়েছিল, কেবল আরবি অনুবাদের মাধ্যমেই সেগুলো পরবর্তীকালে ইউরোপে ফিরে গিয়ে রেনেসাঁ ঘটাতে পেরেছিল। বাগদাদ তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীর বুকে একমাত্র জ্বলজ্বলে বাতিঘর, যেখান থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি আজও আমাদের পথ দেখাচ্ছে।
গণিত: শূন্য থেকে অসীম এবং বীজগণিতের জন্ম
গণিত ছাড়া বিজ্ঞান অচল, যেন আত্মা ছাড়া শরীর। মহাবিশ্বের ভাষা হলো গণিত, আর এই ভাষার ব্যাকরণ নতুন করে লিখেছিলেন স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা। গ্রিকরা জ্যামিতিতে ছিল অনবদ্য, তাদের চিন্তাভাবনা ছিল আকার আর আকৃতি কেন্দ্রিক। কিন্তু মহাবিশ্বের সব রহস্য কেবল ত্রিভুজ আর বৃত্ত দিয়ে সমাধান করা যায় না; তার জন্য দরকার বিমূর্ত সংখ্যা আর সমীকরণের এক নতুন জগত। এই জগতটি তৈরি করার কারিগর ছিলেন বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমাহ’-র পণ্ডিতরা। তাদের হাত ধরেই গণিত বাস্তব জীবনের মাটির পৃথিবী থেকে উঠে এল বিমূর্ত চিন্তার আকাশে। এর মধ্যে যার নাম সবার আগে নিতে হয়, তিনি হলেন আল-খওয়ারিজমি (Al-Khwarizmi)। তার পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খওয়ারিজমি। তিনি ছিলেন নবম শতাব্দীর এক বিস্ময়কর প্রতিভা, বায়তুল হিকমাহর প্রধান লাইব্রেরিয়ান ও গণিতবিদ। তার চিন্তার স্বচ্ছতা ছিল হীরকখণ্ডের মতো ধারালো। তিনি যখন কোনো সমস্যার দিকে তাকাতেন, তিনি কেবল সমস্যাটি দেখতেন না, দেখতেন সমাধানের একটি সাধারণ পদ্ধতি বা জেনারেল মেথড (General Method)।
বীজগণিতের জনক ও অজানা রাশির সন্ধানে
তিনি একটা বই লিখলেন, যা ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিল – কিতাব আল-জেবর ওয়াল মুকাবালা (The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing)। এই বইয়ের শিরোনামের ‘আল-জেবর’ শব্দটা থেকেই এসেছে আজকের অ্যালজেবরা (Algebra)। কিন্তু আল-জেবর মানে কী? শাব্দিক অর্থে এর মানে হলো ‘ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো’ বা ‘পুনর্গঠন’। গণিতের ভাষায় এর অর্থ হলো সমীকরণের এক পাশ থেকে ঋণাত্মক রাশিকে অন্য পাশে নিয়ে ধনাত্মক করা। আর ‘আল-মুকাবালা’ মানে হলো দুই পাশের রাশিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনা। খওয়ারিজমি দেখালেন, গণিত মানে শুধু সংখ্যা গোনা বা পাটিগণিত নয়; গণিত মানে সমীকরণ সমাধান করা। তিনি গণিতকে জ্যামিতির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিলেন। অজানা রাশি ‘X’ বা ‘শাই’ (যার অর্থ ‘কিছু একটা’) ধরে সমস্যার সমাধান করার পদ্ধতি তিনি শিখিয়েছিলেন। তিনি বললেন, যদি আমরা কোনো কিছুর মান না জানি, তবে তাকে একটা কাল্পনিক নাম দিয়ে সমীকরণের মধ্যে ফেলে দিলেই সত্য বেরিয়ে আসবে। এটি ছিল বিমূর্ত গণিত (Abstract Mathematics)-এর দিকে মানুষের প্রথম বড় পদক্ষেপ। তিনি বাস্তব জীবনের সমস্যা, যেমন – জমির ভাগ-বাটোয়ারা, জটিল উত্তরাধিকার আইন, খাল খননের হিসাব বা ব্যবসার লাভ-ক্ষতি – সবকিছুকে সমীকরণের মাধ্যমে সমাধান করার পথ দেখালেন। তার আগে গণিত ছিল মূলত জ্যামিতিনির্ভর, তিনি সেটাকে নিয়ে গেলেন লজিক বা যুক্তির স্তরে। তার এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল এর সার্বজনীনতা; অর্থাৎ, একই নিয়ম ব্যবহার করে আপনি হাজার রকম সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। ইউরোপীয়রা যখন এই বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ হাতে পেল, তারা অবাক হয়ে দেখল যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আর জ্যামিতিক ছবি আঁকার দরকার নেই, কেবল কিছু নিয়ম বা রুলস মেনে চললেই উত্তর পাওয়া যায় (Katz, 1998)।
অ্যালগরিদম: ডিজিটাল দুনিয়ার আদি পিতা
আরও একটা মজার এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে, যা আজকের আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি – অ্যালগরিদম (Algorithm)। আজকের কম্পিউটার সায়েন্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল মিডিয়া, গুগল সার্চ – সবকিছু যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই শব্দটা এসেছে খওয়ারিজমির নাম থেকেই। ল্যাটিন ভাষায় তার নাম বিকৃত হয়ে হয়েছিল ‘অ্যালগোরিদমি’ (Algoritmi), সেখান থেকেই অ্যালগরিদম। চিন্তা করা যায়? নবম শতাব্দীর একজন মানুষের নাম জড়িয়ে আছে একবিংশ শতাব্দীর সুপার কম্পিউটারের সাথে। তিনি যদি সেদিন ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানের এই পদ্ধতি বা স্টেপ-বাই-স্টেপ প্রসিডিউর (Step-by-step Procedure) না লিখে যেতেন, আজকের ডিজিটাল দুনিয়া হয়তো তৈরিই হতো না। খওয়ারিজমি শিখিয়েছিলেন যে, যেকোনো বড় সমস্যাকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সমাধান করা সম্ভব। এই যান্ত্রিক বা মেকানিক্যাল (Mechanical) উপায়ে সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিই হলো কম্পিউটারের ভাষা। তিনি যখন তার পাটিগণিতের বই কিতাব আল-জাম ওয়াত-তাফরিক লিখলেন, তখন তিনি অজান্তেই ভবিষ্যতের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছিলেন। তিনি কেবল গণিতবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে ভূগোলবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। খলিফা আল-মামুন যখন তাকে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরির দায়িত্ব দেন, তখন তিনি গণিত ব্যবহার করে টলেমির মানচিত্রকে সংশোধন করেছিলেন (Saliba, 2007)।
শূন্যের শক্তি ও সংখ্যাতত্ত্বের বিপ্লব
সংখ্যা ছাড়া গণিত পঙ্গু। ভারতীয় পণ্ডিতরা আবিষ্কার করেছিলেন শূন্য (Zero) বা ‘শূণ্যতা’-র ধারণা, যা মানব ইতিহাসের অন্যতম সেরা বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন। কিন্তু এই শূন্যকে সংখ্যার সিস্টেমে ঠিকঠাক বসিয়ে ব্যবহার করার কায়দাটা এবং দশমিক পদ্ধতি (Decimal System) বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিল আরবরা। রোমান সংখ্যায় (I, II, III, X, L, C, M) অঙ্ক কষা যে কী যন্ত্রণার, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। রোমান পদ্ধতিতে ১২৮-কে ১৮ দিয়ে গুণ করা ছিল এক দুঃস্বপ্ন। সেখানে ছিল না কোনো স্থানিক মান (Positional Notation) বা প্লেস ভ্যালুর ধারণা। কিন্তু আল-খওয়ারিজমি ও আল-কিন্দি (Al-Kindi) ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতিকে গ্রহণ করলেন এবং তা পরিমার্জন করে বিশ্বকে উপহার দিলেন। আল-কিন্দি চারটি বই লিখেছিলেন সংখ্যার ব্যবহারের ওপর, যা সংখ্যাতত্ত্ব বা নাম্বার থিওরি (Number Theory)-কে শক্তিশালী করেছিল। এই নতুন পদ্ধতিতে ১-এর পর একটা শূন্য বসালে তা ১০ হয়ে যায়, অর্থাৎ তার মান দশগুণ বেড়ে যায় – এই সরল অথচ জাদুকরী ধারণা গণিতকে সহজ ও শক্তিশালী করে তুলল। এই সংখ্যা পদ্ধতিকে ইউরোপে বলা হয় ‘আরবি সংখ্যা’ (Arabic Numerals), যদিও এর মূল উৎস ভারত। দশম শতাব্দীতে দামেস্কের গণিতবিদ আল-উকলিদিসি (Al-Uqlidisi) প্রথমবারের মতো দশমিক ভগ্নাংশ বা ডেসিমেল ফ্র্যাকশন (Decimal Fraction) ব্যবহারের নিয়ম লিখে যান। এর ফলে নিখুঁত হিসাব-নিকাশ করা সম্ভব হলো। আগে যেখানে ১/২ বা ১/৪ দিয়ে কাজ চালাতে হতো, এখন সেখানে ০.৫ বা ০.২৫ এর মতো সূক্ষ্ম হিসাব করা সম্ভব হলো। এই দশমিক বিন্দুর ব্যবহার পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের জটিল হিসাব-নিকাশের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় (Berggren, 1986)।
ত্রিকোণমিতি: নক্ষত্র মাপার স্কেল
গণিতের আরেকটা বিশাল শাখা হলো ত্রিকোণমিতি (Trigonometry), যাকে স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা নিয়ে গেলেন এক অন্য উচ্চতায়। গ্রিকরা জ্যামিতিতে দক্ষ ছিল, কিন্তু তাদের কর্ড বা জ্যা-ভিত্তিক হিসাব ছিল জটিল। ত্রিকোণমিতিকে একটি স্বতন্ত্র এবং পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সায়েন্স (Independent Science) হিসেবে দাঁড় করান মুসলিম গণিতবিদরা। তারা সাইন, কস, ট্যান – এই ধারণাগুলোকে আধুনিক রূপ দেন। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল জ্যোতির্বিদ্যা। মরুভূমির বুকে পথ চলতে কিংবা বিশাল সমুদ্রে জাহাজ ভাসাতে নক্ষত্রের অবস্থান জানাটা ছিল জরুরি। আর আকাশের গোলকের ওপর নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার জন্য দরকার ছিল স্ফেরিক্যাল বা গোলকীয় ত্রিকোণমিতি (Spherical Trigonometry)। এই ক্ষেত্রে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তিনি হলেন আল-বাত্তানি (Al-Battani)। ইউরোপে তিনি ‘আলবাটেনিয়াস’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন জিনিয়াস। তিনি বছরের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেছিলেন ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড, যা আসল সময়ের চেয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের এদিক-ওদিক। কম্পিউটার বা টেলিস্কোপ ছাড়া নবম শতাব্দীতে বসে এই নিখুঁত হিসাব ভাবা যায় না। তিনি সাইন (Sine) এবং ট্যানজেন্ট (Tangent)-এর আধুনিক সংজ্ঞা ও টেবিল তৈরি করেন। তার এই কাজ কোপার্নিকাস ও কেপলারের মতো বিজ্ঞানীদের পথ দেখিয়েছিল (Kunitzsch, 1986)।
তবে ত্রিকোণমিতিকে জ্যোতির্বিদ্যার ছায়া থেকে বের করে এনে তাকে বিশুদ্ধ গণিতের মর্যাদা দিয়েছিলেন নাসির আল-দিন আল-তুসি (Nasir al-Din al-Tusi)। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তিনি লিখলেন কিতাব আল-শাকল আল-কিত্ত্বা বা Treatise on the Quadrilateral। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম বই যেখানে ত্রিকোণমিতিকে জ্যোতির্বিদ্যার অংশ হিসেবে নয়, বরং গণিতের একটি নিজস্ব শাখা হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি সাইন সূত্র বা ল অফ সাইনস (Law of Sines) আবিষ্কার করেন, যা যেকোনো ত্রিভুজের বাহু ও কোণের সম্পর্ক নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। আল-তুসি তার মানমন্দিরে বসে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে গণিতের যে মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন, তা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
ওমর খৈয়াম: কবি যখন গণিতবিদ
আমরা ওমর খৈয়াম (Omar Khayyam)-কে চিনি ‘রুবাইয়াত’-এর কবি হিসেবে, যিনি মদ, প্রেম আর জীবনের নশ্বরতা নিয়ে বিষাদমাখা কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তার সমসাময়িকরা তাকে চিনত একজন উঁচুদরের গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে। কবিতার খাতায় তিনি যেমন জীবনের রহস্য খুঁজতেন, গণিতের খাতায় খুঁজতেন অজানার সমাধান। তিনি ত্রিঘাত সমীকরণ (Cubic Equations) জ্যামিতিক পদ্ধতিতে সমাধান করার উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। যখন x3 বা পাওয়ার তিন থাকে, তখন তা সমাধান করা ভীষণ কঠিন। খৈয়াম বৃত্ত, প্যারাবোলা বা পরাবৃত্ত এবং হাইপারবোলা বা অধিবৃত্তের ছেদবিন্দু ব্যবহার করে এই সমীকরণগুলোর সমাধান বের করেন। তার এই পদ্ধতি ছিল অ্যানালিটিক জ্যামিতি (Analytic Geometry)-র পূর্বসূরি, যা পরে রেনে দেকার্ত (Descartes) পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। খৈয়াম তার ট্রিটিজ অন ডেমোনস্ট্রেশন অফ প্রবলেমস অফ অ্যালজেবরা বইতে ত্রিঘাত সমীকরণের সাধারণ সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন।
তাছাড়া, তিনি যে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা তৈরি করেছিলেন, তার নাম জালালি ক্যালেন্ডার (Jalali Calendar)। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের নির্দেশে তিনি এই কাজ করেন। এটি আজকের বহুল ব্যবহৃত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়েও নিখুঁত ছিল। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩,৩৩০ বছরে একদিনের গরমিল হয়, কিন্তু খৈয়ামের ক্যালেন্ডারে ১০,০০০ বছরে মাত্র একদিনের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তিনি সময়ের হিসাব কষতে গিয়ে এত গভীরে গিয়েছিলেন যে, তার তৈরি পঞ্জিকা আজও ইরানে ও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত হয়। খৈয়ামের গণিতচর্চা প্রমাণ করে যে, একজন মানুষ একই সাথে যুক্তির কঠিন পথ এবং আবেগের নরম পথে হাঁটতে পারেন।
অন্যান্য নক্ষত্র: গণিতের বিবর্তন
স্বর্ণযুগের গণিতচর্চা কেবল এই কজন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দশম শতাব্দীর গণিতবিদ আল-কারাজি (Al-Karaji) ছিলেন আরেক বিস্ময়। তিনি বীজগণিতকে জ্যামিতিক নির্ভরতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রথম পলিনমিয়াল (Polynomials) বা বহুপদী রাশিমালা নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেন এবং x2, x3, x4 – এভাবে অসীম পর্যন্ত ঘাত বা পাওয়ার নিয়ে কাজ করার নিয়মাবলী তৈরি করেন। তার কাজের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে আল-সামাওয়াল (Al-Samawal) বীজগণিতের আরও উন্নতি ঘটান। তিনি বলেছিলেন, বীজগণিত হলো গণিতের সেই শাখা যা দিয়ে জানা রাশি ও অজানা রাশির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। অন্যদিকে, থাবিত ইবনে কুররা (Thabit ibn Qurra) কাজ করেছিলেন অ্যামিকেবল নাম্বার (Amicable Numbers) বা বন্ধু-সংখ্যা নিয়ে। দুটি সংখ্যাকে তখনই বন্ধু-সংখ্যা বলা হয় যখন প্রথমটির ভাজকগুলোর যোগফল দ্বিতীয়টির সমান হয় এবং দ্বিতীয়টির ভাজকগুলোর যোগফল প্রথমটির সমান হয়। থাবিত এই সংখ্যাগুলো বের করার সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যা সংখ্যাতত্ত্বের এক দারুণ চমক।
চতুর্দশ শতাব্দীতে জামশিদ আল-কাশি (Jamshid al-Kashi) পাই (π)-এর মান নির্ণয়ে অবিশ্বাস্য দক্ষতা দেখান। তিনি দশমিকের পর ১৬ ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান নির্ভুলভাবে বের করেছিলেন। তার এই রেকর্ড পরবর্তী ২০০ বছর পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। আল-কাশি দশমিক ভগ্নাংশকে গণনার মূলধারায় নিয়ে আসেন এবং জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যান্ত্রিক যন্ত্র বা অ্যানালগ কম্পিউটার (Analog Computer)-এর আদি সংস্করণ ‘প্লেট অফ কনজাংশন’ তৈরি করেন। এই পণ্ডিতরা গণিতকে কেবল খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারা এই গণিত ব্যবহার করে বিশাল সব অট্টালিকা বানিয়েছেন, যার জ্যামিতিক নকশা বা জিওমেট্রিক প্যাটার্ন (Geometric Pattern) আজও বিস্ময় জাগায়। স্পেনের আলহামব্রা প্রাসাদ বা ইরানের মসজিদগুলোর দেওয়ালে যে জটিল নকশা দেখা যায়, তা আসলে উচ্চতর গণিতের শৈল্পিক রূপ। তারা টাইলিং বা টেসেলেশন (Tessellation) নিয়ে এমন সব কাজ করেছেন, যা আধুনিক ক্রিস্টালোগ্রাফি বা কেলাসবিদ্যার সাথে মিলে যায়।
এই যুগটি ছিল গণিতের এক মহাজাগরণ। গ্রিকরা যদি গণিতের কঙ্কাল তৈরি করে থাকে, তবে বাগদাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের পণ্ডিতরা তাতে রক্ত-মাংস-প্রাণ দিয়েছিলেন। তারা গণিতকে রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা থেকে বের করে এনেছিলেন সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে। জমি মাপা থেকে শুরু করে আকাশের নক্ষত্র মাপা – সবকিছুতেই তারা গণিতের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। শূন্য থেকে শুরু করে অসীম পর্যন্ত তাদের এই যাত্রা মানুষের চিন্তার জগতকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। তারা প্রমাণ করেছিলেন যে, মানুষের মস্তিষ্ক এক অসীম সম্ভাবনার আধার, যা সঠিক পরিবেশ পেলে মহাবিশ্বের যেকোনো রহস্য ভেদ করতে সক্ষম।
জ্যোতির্বিদ্যা: আকাশের মানচিত্র ও মহাবিশ্বের গঠন
মরুভূমির মানুষের কাছে আকাশ ছিল এক বিশাল, রহস্যময় কম্পাসের মতো। দিগন্তজোড়া বালিয়াড়িতে যখন কোনো চিহ্ন থাকে না, তখন মাথার ওপরের নক্ষত্রগুলোই হয়ে ওঠে পথ চলার একমাত্র সঙ্গী। এই নক্ষত্রের ভাষা বুঝতে পারাটা বেদুইনদের কাছে ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন। কিন্তু ইসলামি স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা এই আদিম প্রয়োজনটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকলেন না। তারা আকাশটাকে শুধু দেখতে চাইলেন না, তারা আকাশটাকে ব্যবচ্ছেদ করতে চাইলেন। তারা মহাবিশ্বের নকশাটা বুঝতে চাইলেন, জানতে চাইলেন গ্রহগুলো কেন ওভাবে ঘোরে। এই কৌতূহল থেকেই জন্ম নিল এক বৈপ্লবিক অধ্যায়, যাকে বলা হয় ‘ইলাম আল-হাইয়া’ বা জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy)। এটি আর তখন নিছক ভাগ্যগণনা বা ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র ছিল না; এটি হয়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ গণিত ও পদার্থবিদ্যার এক জটিল সংমিশ্রণ। বাগদাদ, দামেস্ক এবং পরবর্তীকালে সামারখন্দ ও মারাঘায় তারা গড়ে তুলেছিলেন বিশাল সব মানমন্দির বা অবজারভেটরি (Observatory), যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের গবেষণাগার। এই মানমন্দিরগুলো কোনো একলা বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত ছাদ ছিল না; এগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় বা ওয়াকফ (Waqf) অর্থায়নে পরিচালিত বিশাল প্রতিষ্ঠান, যেখানে গ্রন্থাগার, থাকার জায়গা এবং বিশাল সব যন্ত্রপাতি ছিল। এখানে বিজ্ঞানীরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আকাশের দিকে তাকিয়ে ডেটা সংগ্রহ করতেন এবং তৈরি করতেন জিজ (Zij) বা জ্যোতির্বিজ্ঞান সারণী। এই সারণীগুলো ব্যবহার করেই নির্ধারিত হতো ক্যালেন্ডার, উৎসবের তারিখ এবং জাহাজ চলাচলের রুট (King, 1999)।
টলেমির রাজত্বে বিদ্রোহ: সন্দেহের জন্ম
প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানী টলেমি (Ptolemy) ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যার একচ্ছত্র অধিপতি। তার মডেল অনুযায়ী, পৃথিবী স্থির হয়ে আছে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে, আর সূর্য, চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। একে বলা হয় জিওসেন্ট্রিক মডেল (Geocentric Model)। হাজার বছর ধরে মানুষ এটাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে এসেছিল। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টলেমিকে শ্রদ্ধা করতেন, তার বিখ্যাত বই আলমাজেস্ট (Almagest) আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন এবং পাঠ্যবই হিসেবে পড়াতেন। কিন্তু তারা গ্রিকদের মতো অন্ধবিশ্বাসী ছিলেন না। তারা ছিলেন অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism)-এ বিশ্বাসী। যখন তারা তাদের উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন, তারা দেখলেন টলেমির গাণিতিক হিসাবের সাথে বাস্তব পর্যবেক্ষণের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রহগুলোর গতিপথ টলেমির বর্ণিত নিখুঁত বৃত্তাকার পথের সাথে খাপ খাচ্ছে না।
এই অসঙ্গতি প্রথম সাহসের সাথে তুলে ধরলেন ইবনে আল-হাইসাম (Ibn al-Haytham)। তিনি তার যুগান্তকারী বই আল-শুকুক আলা বাতলামিউস (Doubts on Ptolemy) বা ‘টলেমির ওপর সন্দেহ’-তে প্রশ্ন তুললেন – টলেমির মডেলে গণ্ডগোল আছে। তিনি বললেন, টলেমি গ্রহের গতি ব্যাখ্যা করার জন্য ‘ইকুয়েন্ট’ (Equant) নামের যে কাল্পনিক বিন্দুর অবতারণা করেছেন, তা পদার্থবিদ্যার নিয়ম লঙ্ঘন করে। হাইসামের যুক্তি ছিল সোজা – মহাবিশ্ব কেবল গাণিতিক বিমূর্ততা নয়, এর একটি ভৌত বা ফিজিক্যাল রিয়েলিটি (Physical Reality) আছে। যদি গণিত বাস্তবের সাথে না মেলে, তবে গণিতকেই বদলাতে হবে, বাস্তবকে নয়। এই ‘সন্দেহ’ বা স্কেপ্টিসিজম থেকেই জন্ম নিল এক নতুন ধারার জ্যোতির্বিদ্যা, যাকে ইতিহাসবিদরা বলেন মারাঘা বিপ্লব (Maragha Revolution)। এই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল টলেমির মডেলকে শুদ্ধ করা বা নতুন কোনো মডেল দাঁড় করানো যা পর্যবেক্ষণকে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে।
তুসি কাপল: কোপার্নিকাসের অদৃশ্য শিক্ষক
এই বিপ্লবের মহানায়ক ছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারসিয়ান পলিমেথ নাসির আল-দিন আল-তুসি (Nasir al-Din al-Tusi)। মঙ্গোল হালাকু খানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বর্তমান ইরানের মারাঘায় একটি বিশাল মানমন্দির তৈরি করেন। সেখানে বসে তিনি মহাকাশের জ্যামিতি নিয়ে এক গভীর সমস্যায় ডুব দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৃত্তাকার গতির মাধ্যমে গ্রহগুলোর বিষম গতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এর সমাধানের জন্য তিনি তৈরি করলেন এক অভিনব জ্যামিতিক মডেল, যা ইতিহাসে তুসি কাপল (Tusi Couple) নামে পরিচিত। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে দুটি বৃত্ত থাকে – একটি বড়, অন্যটি ছোট। ছোট বৃত্তটি বড় বৃত্তের ভেতরে থাকে এবং উল্টো দিকে ঘোরে। এই ঘূর্ণনের ফলে ছোট বৃত্তের পরিধির ওপর অবস্থিত যেকোনো বিন্দু একটি সরলরেখা বরাবর ওঠানামা করে। অর্থাৎ, তিনি দেখালেন যে কেবল ঘূর্ণন গতি বা সার্কুলার মোশন (Circular Motion) ব্যবহার করেই রৈখিক গতি বা লিনিয়ার মোশন (Linear Motion) তৈরি করা সম্ভব। এটি ছিল টলেমির সমস্যার এক গাণিতিক সমাধান।
মজার এবং রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলো, এর প্রায় দুই-তিনশ বছর পর পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস (Nicolaus Copernicus) যখন তার বিশ্বকাঁপানো সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ (Heliocentrism) প্রচার করলেন, তখন তিনি তার বই ডি রেভোলিউশনিবাস-এ একটি ডায়াগ্রাম ব্যবহার করেছিলেন। আধুনিক গবেষকরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে, কোপার্নিকাসের সেই ডায়াগ্রাম আর নাসির আল-দিন আল-তুসীর আঁকা ডায়াগ্রাম হুবহু এক! এমনকি তুসি তার ছবিতে যে আরবি অক্ষরগুলো ব্যবহার করেছিলেন (আলিফ, বা, জিম), কোপার্নিকাস তার ল্যাটিন প্রতিবর্ণগুলো (A, B, D) ব্যবহার করেছিলেন একই বিন্দুতে। ইতিহাসবিদরা এখন জোরালোভাবে মনে করেন, কোপার্নিকাস হয়তো তুসির কাজ বা তার কোনো ল্যাটিন অনুবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যদিও তিনি তাকে সরাসরি কোনো ক্রেডিট দেননি। শুধু তুসি নন, দামেস্কের জ্যোতির্বিদ ইবনে আল-শাতির (Ibn al-Shatir)-এর নামও এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি বুধ গ্রহ এবং চাঁদের গতিপথের যে মডেল দিয়েছিলেন, কোপার্নিকাস প্রায় হুবহু সেই মডেলই ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ, আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার যে ভিত্তিপ্রস্তর, তা ইউরোপের মাটিতে স্থাপিত মনে হলেও, তার নকশা তৈরি হয়েছিল মারাঘার ধুলোমাখা মানমন্দিরে (Saliba, 2007)।
অ্যাস্ট্রোল্যাব: মধ্যযুগের সুপার কম্পিউটার
তত্ত্বের পাশাপাশি যন্ত্রপাতির দিক দিয়েও তারা ছিলেন অনেক এগিয়ে। তারা গ্রিকদের আবিষ্কার করা অ্যাস্ট্রোল্যাব বা নির্গমযন্ত্র (Astrolabe)-কে এতটাই উন্নত করেছিলেন যে, একে মধ্যযুগের স্মার্টফোন বা সুপার কম্পিউটার বলা যেতে পারে। এটি ছিল পিতলের তৈরি চাকতির মতো একটি যন্ত্র, যার ওপর মহাকাশের মানচিত্র খোদাই করা থাকত। এটি ব্যবহার করে সূর্যের উচ্চতা মেপে সময় বলা যেত, রাতে নক্ষত্রের অবস্থান দেখে দিক নির্ণয় করা যেত, কিবলা বা প্রার্থনার দিক ঠিক করা যেত, এমনকি কোনো পাহাড়ের উচ্চতা বা নদীর প্রস্থও মাপা যেত। স্টেরিওগ্রাফিক প্রজেকশন (Stereographic Projection) নামের এক জটিল জ্যামিতিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এটি কাজ করত। এই যন্ত্রটি তৈরি করা ছিল একাধারে বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা। অ্যাস্ট্রোল্যাব তৈরির কারিগরদের সমাজে খুব সম্মান ছিল। এমনই একজন ছিলেন মরিয়ম আল-আস্তুরলাবি (Mariam al-Asturlabi)। দশম শতাব্দীর সিরিয়ার এই নারী অ্যাস্ট্রোল্যাব তৈরিতে এতই দক্ষ ছিলেন যে, তাকে এই নামেই ডাকা হতো। তার কাজ প্রমাণ করে যে, সেই যুগে নারীরাও জটিল বিজ্ঞানচর্চায় অংশ নিতেন।
আকাশের মানচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হলেন পারস্যের জ্যোতির্বিদ আবদ আল-রহমান আল-সুফি (Abd al-Rahman al-Sufi)। ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি লিখলেন তার বিখ্যাত বই কিতাব সুওয়ার আল-কাওয়াকিব (Book of Fixed Stars)। তিনি খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে নক্ষত্রগুলোর অবস্থান, উজ্জ্বলতা এবং রঙ নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেন। তিনি গ্রিক নক্ষত্রমণ্ডলগুলোর সাথে আরবি নাম জুড়ে দেন। আজকের আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানেও অনেক তারার নাম আরবি শব্দ থেকেই এসেছে। যেমন – আলতাইর (Altair) এসেছে ‘আল-নাসর আল-তাইর’ (উড়ন্ত ঈগল) থেকে, বেটেলজিউস (Betelgeuse) এসেছে ‘ইয়াদ আল-জাউজা’ (ওরিয়নের হাত) থেকে, রিগেল (Rigel) এসেছে ‘রিজল আল-জাব্বার’ (দানবের পা) থেকে। আল-সুফিই প্রথম মানুষ যিনি আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সি ‘অ্যান্ড্রোমিডা’ (Andromeda)-কে শনাক্ত করেছিলেন। তিনি অবশ্য তখন জানতেন না ওটা একটা গ্যালাক্সি, তিনি ওটাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘একটি ছোট মেঘ’ হিসেবে। টেলিস্কোপ আবিষ্কারের প্রায় ৭০০ বছর আগে খালি চোখে এই পর্যবেক্ষণ ছিল বিস্ময়কর (Ragep, 2001)।
আল-বিরুনি এবং পৃথিবীর মাপজোখ
পৃথিবী যে গোল, এই ধারণা গ্রিকদের আমল থেকেই ছিল। কিন্তু পৃথিবী ঠিক কতটা বড়? এর পরিধি কত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একাদশ শতাব্দীর পলিমেথ আল-বিরুনি (Al-Biruni) এক অসাধ্য সাধন করলেন। গ্রিক বিজ্ঞানী এরাতোস্থেনিস পৃথিবীর পরিধি মেপেছিলেন, কিন্তু তার জন্য তাকে মিশরের অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছিল। আল-বিরুনি তখন ভারতে ছিলেন। তিনি ভাবলেন, এত হাঁটাচলার দরকার নেই, গণিত দিয়েই কাজটা করা সম্ভব। তিনি বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের নন্দনা দুর্গের ওপর দাঁড়ালেন। প্রথমে তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাব ব্যবহার করে পাহাড়ের উচ্চতা মাপলেন। এরপর তিনি পাহাড়ের চূড়া থেকে দিগন্তরেখার বা হরাইজন (Horizon)-এর অবনমন কোণ বা ‘ডিপ অ্যাঙ্গেল’ মাপলেন। এরপর ত্রিকোণমিতি (Trigonometry) এবং সাইন ফর্মুলা ব্যবহার করে তিনি পৃথিবীর ব্যাসার্ধ এবং পরিধি বের করলেন।
তার হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ছিল ৬,৩৩৫.৭২৫ কিলোমিটার। আধুনিক স্যাটেলাইট বা লেজার প্রযুক্তিতে মাপা পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হলো ৬,৩৭১ কিলোমিটার। হাজার বছর আগে, কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া আল-বিরুনির এই হিসাব ছিল ৯৯% নিখুঁত। তিনি কেবল পৃথিবীর মাপজোক করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি নিজের সমসাময়িক আরেক মহাতারকা ইবনে সিনার সাথে মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক বা করসপন্ডেন্স (Correspondence) চালিয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন – আলোর গতি কি সসীম নাকি অসীম? শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়াম (Vacuum) কি সম্ভব? পৃথিবী কি স্থির নাকি এটি নিজের অক্ষের ওপর ঘুরছে? আল-বিরুনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে পারে, এবং এটি গাণিতিকভাবে সম্ভব, যদিও তিনি এটি শতভাগ নিশ্চিত করেননি। তার এই মুক্তচিন্তা এবং প্রশ্ন করার সাহস তাকে সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে রেখেছিল (Starr, 2013)।
স্বর্ণযুগের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশকে কেবল কাব্যিক দৃষ্টিতে দেখেননি। তারা আকাশকে দেখেছিলেন একটি বিশাল যন্ত্র হিসেবে, যার প্রতিটি চাকা এবং গিয়ারের গতিবিধি গণিতের নিয়মে বাঁধা। তারা মানমন্দিরগুলোকে বানিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্র। তাদের তৈরি জিজ টেবিল, অ্যাস্ট্রোল্যাব এবং গাণিতিক মডেলগুলোই পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রেনেসাঁয় পথ দেখিয়েছিল। গ্যালিলিও যখন টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখলেন, কিংবা কেপলার যখন গ্রহের গতির সূত্র আবিষ্কার করলেন – তাদের টেবিলের ওপর অদৃশ্যভাবে হলেও খোলা ছিল আল-বাত্তানি, আল-সুফি কিংবা আল-তুসির কোনো না কোনো বই।
চিকিৎসা বিজ্ঞান: কুসংস্কার থেকে ল্যাবরেটরি
মধ্যযুগের ইউরোপে যখন চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিল অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন বাগদাদ, কায়রো আর দামেস্কে ঘটছিল এক নীরব বিপ্লব। ইউরোপে তখন বিশ্বাস করা হতো যে অসুখ মানেই ঈশ্বরের অভিশাপ, পাপের শাস্তি, শয়তানের আছর কিংবা কোনো অশুভ ডাইনির কুদৃষ্টি। সেখানে চিকিৎসার বদলে চলত ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রপাঠ আর রক্তমোক্ষণের মতো অবৈজ্ঞানিক সব পদ্ধতি। গির্জার পাদ্রিরাই ছিলেন ডাক্তার, আর বাইবেল ছিল তাদের প্রেসক্রিপশন। কিন্তু হাজার মাইল দূরে, ইসলামি স্বর্ণযুগের চিকিৎসকরা তখন রোগ নির্ণয় করছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তারা অসুখকে দেখছিলেন প্রাকৃতিক কারণে ঘটা এক জৈবিক বিপর্যয় হিসেবে, যার সমাধান লুকিয়ে আছে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের ভেতরেই। তারা চিকিৎসার জগতকে জাদুমন্ত্র আর কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিলেন ল্যাবরেটরিতে, যেখানে যুক্তি আর পরীক্ষাই ছিল শেষ কথা। এই সময়টাতেই চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি পেশা বা প্রফেশন (Profession) হিসেবে গড়ে ওঠে, যার নিজস্ব নীতি, নৈতিকতা এবং প্রটোকল ছিল।
ইবনে সিনা: চিকিৎসকদের রাজপুত্র
এই বিপ্লবের মহানায়ক ছিলেন ইবনে সিনা (Avicenna)। পাশ্চাত্যে তিনি ‘আভিসেনা’ নামেই বেশি পরিচিত, এবং তাকে সম্মান জানিয়ে বলা হয় ‘চিকিৎসকদের রাজপুত্র’ বা Prince of Physicians। তার মেধা ছিল অতিমানবীয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেছিলেন এবং ১৮ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। তার লেখা বই আল-কানুন ফি আল-তিব্ব (The Canon of Medicine) চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। এই বইটা ছিল পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত এক বিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া, যেখানে প্রায় ১০ লাখ শব্দ ছিল। তিনি তৎকালীন গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির সারাংশ সংগ্রহ করে তাকে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন করে সাজিয়েছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ৬০০ বছর ধরে ইউরোপের সব মেডিকেল স্কুলে – প্যারিস থেকে অক্সফোর্ড পর্যন্ত – এটিই ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান পাঠ্যবই বা ‘মেডিকেল বাইবেল’ (McGinnis, 2010)।
ইবনে সিনা ছিলেন একজন সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষক। তিনি প্রথম মেনিনজাইটিস (Meningitis) রোগটিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করেন এবং এর সাথে অন্যান্য স্নায়বিক রোগের পার্থক্য তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, যক্ষ্মা (Tuberculosis) বা টিবি কোনো বংশগত রোগ নয়, বরং এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ যা বাতাসের মাধ্যমে এক শরীর থেকে আরেক শরীরে ছড়ায়। এই আবিষ্কার ছিল যুগান্তকারী, কারণ তখনো জীবাণু সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। তিনি মাটি বা দূষিত পানি থেকে যে রোগ ছড়াতে পারে, সেই ধারণা জোরালোভাবে দিয়েছিলেন। মহামারী ঠেকানোর জন্য কোয়ারেন্টাইন (Quarantine) বা সঙ্গনিরোধের ধারণাটাও তার হাত ধরেই কিছুটা এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়লে সুস্থ মানুষদের অসুস্থদের কাছ থেকে অন্তত ৪০ দিন আলাদা রাখা উচিত। তিনি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রচুর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা তখনকার দিনে ছিল অকল্পনীয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, শরীরের রোগের সাথে মনের গভীর যোগাযোগ আছে, যাকে আজ আমরা সাইকোসোমাটিক মেডিসিন (Psychosomatic Medicine) বলি। কথিত আছে, তিনি একবার এক ‘লাভ-সিক’ বা প্রেমরোগে আক্রান্ত যুবককে কেবল তার নাড়ির গতি বা পালস রেট মেপে সুস্থ করেছিলেন, তার প্রেমিকার নাম শুনে যুবকের নাড়ির গতি বেড়ে গিয়েছিল।
আল-রাজি: ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের জনক
আরেকজন মহাতারকা ছিলেন আল-রাজি (Rhazes)। তাকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল মেডিসিন (Clinical Medicine)-এর জনক। তিনি ছিলেন ঘোর যুক্তিবাদী এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি গুটিবসন্ত (Smallpox) আর হাম (Measles)-কে দুটি আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার আগে মানুষ এই দুটোকে একই রোগ ভাবত। তার লেখা কিতাব আল-জুদারি ওয়া আল-হাসবা (The Book of Smallpox and Measles) এই বিষয়ে প্রথম প্রামাণ্য দলিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ডাক্তারকে হতে হবে রোগীর বন্ধু, কেবল ওষুধ দিলেই হবে না, রোগীকে মানসিকভাবেও চাঙ্গা রাখতে হবে। তিনি ইথানল বা অ্যালকোহল ব্যবহার করেছিলেন জীবানুনাশক (Antiseptic) হিসেবে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্য, যা ইনফেকশন কমাতে দারুণ সাহায্য করেছিল।
আল-রাজির বৈজ্ঞানিক মনন কতটা প্রখর ছিল, তার একটা চমৎকার উদাহরণ হলো বাগদাদের হাসপাতাল তৈরির গল্প। খলিফা তাকে দায়িত্ব দিলেন বাগদাদে একটা নতুন হাসপাতাল বানানোর জন্য। আল-রাজি চাইলেন এমন এক জায়গা যেখানে বাতাস সবচেয়ে পরিষ্কার। তিনি শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাঁচা মাংসের টুকরো ঝুলিয়ে রাখলেন। কয়েকদিন পর তিনি চেক করলেন কোন মাংসটা কতটা পচেছে। যেখানে মাংসটা পচতে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়েছিল, তিনি বুঝলেন সেখানকার বাতাস সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং জীবাণু কম। সেখানেই তিনি হাসপাতাল বানালেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের বহু আগেই তিনি বাতাসের দূষণ এবং পচনশীলতার সম্পর্ক বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি রোগীদের ‘কেস হিস্ট্রি’ বা রোগের ইতিহাস লিখে রাখার প্রচলন করেন, যা আধুনিক চিকিৎসার অন্যতম প্রধান ধাপ।
আল-জাহরাউই: আধুনিক সার্জারির স্থপতি
চিকিৎসার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা। এই শাখায় যিনি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তিনি হলেন আল-জাহরাউই (Al-Zahrawi), যাকে পাশ্চাত্যে ‘আলবুকাসিস’ (Albucasis) বলা হয়। স্পেনের কর্ডোবায় বসে তিনি লিখেছিলেন তার অমর গ্রন্থ কিতাব আল-তাসরিফ (Kitab al-Tasrif)। এই ৩০ খণ্ডের বিশাল বিশ্বকোষটি ছিল সার্জারির এক সচিত্র ম্যানুয়াল। এই বইয়ে তিনি ২০০-র বেশি সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট বা যন্ত্রপাতির নিখুঁত ছবি ও বর্ণনা দিয়েছিলেন, যার অনেকগুলো তিনি নিজেই ডিজাইন করেছিলেন। আজকের আধুনিক অপারেশন থিয়েটারে যে স্ক্যাল্পেল (Scalpel), বোন স (Bone Saw), ফরসেপস (Forceps) বা কাঁচি ব্যবহার করা হয়, তার নকশা প্রায় হাজার বছর আগে আল-জাহরাউই করে গিয়েছিলেন।
তিনি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন – সেলাইয়ের সুতো বা ক্যাটগাট (Catgut)। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে বিড়ালের অন্ত্র বা নাড়ি দিয়ে তৈরি সুতো শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না এবং কিছুদিন পর নিজে থেকেই শরীরের সাথে মিশে যায়। এর ফলে ভেতরের ক্ষত সেলাই করার পর আর সুতো কাটার দরকার হতো না। আধুনিক সার্জারিতেও এই নীতি ব্যবহার করা হয়। তিনি সিজারিয়ান সেকশন (Caesarean Section), চোখের ছানি অপারেশন এবং দাঁত তোলার পদ্ধতিও জানতেন। হাড় ভাঙলে প্লাস্টার করার পদ্ধতি এবং মূত্রথলি থেকে পাথর বের করার মতো জটিল অপারেশন তিনি সফলভাবে করতেন। তিনি বলতেন, “একজন ভালো সার্জনকে অবশ্যই আগে ভালো ডাক্তার হতে হবে এবং অ্যানাটমি বা শারীরস্থান সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে।” তার এই বই ইউরোপে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে রেনেসাঁ যুগের সার্জনদের প্রধান গাইডবুক হয়ে উঠেছিল।
ইবনে আল-নাফিস: রক্ত সঞ্চালনের প্রকৃত আবিষ্কারক
মানবদেহের অন্যতম বড় রহস্য ছিল রক্ত কীভাবে চলে। গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেন (Galen) বলেছিলেন, রক্ত কলিজায় বা লিভারে তৈরি হয় এবং হৃৎপিণ্ডের সেপ্টাম বা দেয়ালের ছোট ছোট অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে এক পাশ থেকে অন্য পাশে যায়। হাজার বছর ধরে এটাই ছিল ধ্রুব সত্য। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কায়রোর চিকিৎসক ইবনে আল-নাফিস (Ibn al-Nafis) এই মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করলেন। তিনি বললেন, “হৃৎপিণ্ডের দেয়াল নিরেট, সেখানে কোনো ছিদ্র নেই। রক্ত ডান অলিন্দ থেকে ফুসফুসে যায়, সেখানে বাতাসের সাথে মেশে, তারপর বিশুদ্ধ হয়ে বাম অলিন্দে ফিরে আসে।” এটিই হলো ফুসফুসীয় রক্ত সঞ্চালন (Pulmonary Circulation)।
ব্রিটিশ চিকিৎসক উইলিয়াম হার্ভে (William Harvey) রক্ত সঞ্চালন আবিষ্কারের প্রায় ৩০০ বছর আগে ইবনে আল-নাফিস এই প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি তার বই শরাহ তাশরিহ আল-কানুন (Commentary on Anatomy in Avicenna’s Canon)-এ এই তত্ত্ব লিখে যান। তিনি করোনারি সঞ্চালন বা হৃৎপিণ্ডের নিজস্ব রক্ত সরবরাহের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার এই কাজ ল্যাটিনে অনুবাদ না হওয়ায় ইউরোপ অনেকদিন পর্যন্ত অন্ধকারে ছিল। ১৯২৪ সালে একজন মিশরীয় চিকিৎসক বার্লিনের এক লাইব্রেরিতে ইবনে আল-নাফিসের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করার পরই বিশ্ব জানতে পারে যে রক্ত সঞ্চালনের প্রকৃত আবিষ্কারক আসলে কে ছিলেন (West, 2008)।
বিমারিস্তান: মানবতার সেবায় হাসপাতাল
স্বর্ণযুগের চিকিৎসাব্যবস্থার সবচেয়ে উজ্জ্বল মুকুট ছিল ‘বিমারিস্তান’ (Bimaristan) বা হাসপাতাল। ফার্সি শব্দ ‘বিমার’ (অসুস্থ) এবং ‘স্তান’ (স্থান) থেকে আসা এই বিমারিস্তানগুলো কেবল চিকিৎসার জায়গা ছিল না, এগুলো ছিল আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও রিসার্চ সেন্টারের আদি রূপ। বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রো, কর্ডোবায় গড়ে উঠেছিল বিশাল সব হাসপাতাল। দ্বাদশ শতাব্দীতে দামেস্কে নূর আল-দিন হাসপাতাল এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কায়রোতে আল-মনসুরি হাসপাতাল ছিল দেখার মতো। এই হাসপাতালগুলোতে ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম সবার চিকিৎসা হতো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। চিকিৎসার খরচ বহন করা হতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার এবং ধনীদের দেওয়া ওয়াকফ (Waqf) বা অনুদান থেকে।
হাসপাতালগুলো ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। সেখানে আলাদা আলাদা ওয়ার্ড বা বিভাগ ছিল – সার্জারি, মেডিসিন, অপথালমোলজি (চক্ষু), অর্থোপেডিক্স (হাড় ভাঙা), এবং মানসিক রোগ। এমনকি ছোঁয়াচে রোগের জন্য আলাদা আইসোলেশন ওয়ার্ড ছিল। প্রতিটি ওয়ার্ডে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং নার্সরা ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতেন। রোগীদের কেবল ওষুধই দেওয়া হতো না, তাদের পুষ্টিকর খাবার এবং পরিষ্কার পোশাকও দেওয়া হতো। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সময় রোগীকে কিছু টাকা দেওয়া হতো, যাতে কাজ না পেলেও কিছুদিন চলতে পারে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল মানসিক রোগীদের প্রতি তাদের মানবিক আচরণ। ইউরোপে তখন মানসিক রোগীদের শয়তান ভর করেছে ভেবে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো বা মারধর করা হতো। কিন্তু বিমারিস্তানে তাদের রাখা হতো শান্ত ও মনোরম পরিবেশে। তাদের গান শুনিয়ে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, ফোয়ারার জলের শব্দ শুনিয়ে এবং গল্প বলে শান্ত করা হতো। একে বলা হতো মিউজিক থেরাপি (Music Therapy)। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ছিল এক অভূতপূর্ব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
চিকিৎসার মান বজায় রাখার জন্য কঠোর নিয়ম ছিল। ডাক্তারদের নিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স বা ইজাজা (Ijazah) নিতে হতো। এই লাইসেন্স ছাড়া কেউ ডাক্তারি করলে তাকে শাস্তি পেতে হতো। ওষুধ তৈরির জন্য ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান ছিল, এবং সেখানেও পরিদর্শকরা নিয়মিত ওষুধের মান যাচাই করতেন। এই পুরো ব্যবস্থাটি প্রমাণ করে যে, তারা চিকিৎসাকে কেবল পেশা নয়, বরং একটি পবিত্র দায়িত্ব বা ইবাদত হিসেবে দেখতেন। তাদের এই প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল, যার সুফল আজ আমরা ভোগ করছি।
আলোকবিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি: দেখার নতুন চোখ
মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় হলো দৃষ্টিশক্তি। আমরা চোখ মেললেই পৃথিবীটাকে দেখতে পাই – গাছপালা, পাহাড়, প্রিয় মানুষের মুখ। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই দেখা আসলে কীভাবে ঘটে? আজকের যুগে আমরা জানি আলো কোনো বস্তুর ওপর পড়ে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে, রেটিনায় উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি হয়, আর মস্তিষ্ক সেটাকে সোজা করে নেয়। কিন্তু হাজার বছর আগে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। তখন মানুষ ভাবত, দেখা হলো চোখের নিজস্ব ক্ষমতা। আমরা যে আজ স্মার্টফোন বা ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ছবি তুলে ফেলি, কিংবা লেন্স ব্যবহার করে দূরের জিনিস কাছে দেখি – এই সবকিছুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। তিনি ইবনে আল-হাইসাম (Ibn al-Haytham)। পাশ্চাত্যের জগত তাকে চেনে আলহাজেন (Alhazen) নামে। তাকে বলা হয় অপটিকস বা আলোকবিজ্ঞানের জনক। তবে তিনি শুধু আলোর রহস্য ভেদ করেননি, তিনি মানুষকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করতে হয়। তার জীবনটা ছিল কোনো থ্রিলার উপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর এবং তার চিন্তাধারা ছিল সময়ের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।
অন্ধকার ঘরের বন্দি ও আলোর সন্ধান
ইবনে আল-হাইসামের জন্ম হয়েছিল ইরাকের বসরায়, কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি কেটেছিল মিশরের কায়রোতে। তিনি ছিলেন ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিমের সমসাময়িক। খলিফা আল-হাকিম ছিলেন অত্যন্ত মেজাজি এবং খামখেয়ালি শাসক। আল-হাইসাম একবার দাবি করেছিলেন যে তিনি নীল নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় জানেন। খলিফা তাকে ডেকে পাঠালেন এবং দায়িত্ব দিলেন আসোয়ান বাঁধ তৈরি করার। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে হাইসাম বুঝলেন, নীল নদের স্রোত আটকানো তৎকালীন প্রযুক্তিতে অসম্ভব। তিনি প্রমাদ গুনলেন। খলিফার রাগ থেকে বাঁচতে তিনি পাগল সাজার ভান করলেন। খলিফা তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখলেন। এই বন্দিদশা তার জন্য শাপে বর হলো। দীর্ঘ ১০ বছর তিনি বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তার সঙ্গী ছিল কেবল অন্ধকার ঘর, জানলার ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে আলো আর ধুলিকণা। এই নির্জনতাই তাকে ভাবতে বাধ্য করল – আলো আসলে কী? কীভাবে আমরা দেখি? অন্ধকারের সাথে আলোর সম্পর্ক কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি লিখলেন তার যুগান্তকারী গ্রন্থ কিতাব আল-মানাজির (Book of Optics), যা সাত খণ্ডে বিভক্ত। এই বইটি পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া-র মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
চোখ থেকে আলো, নাকি আলো থেকে চোখ?
সে সময় দৃষ্টিশক্তি নিয়ে দুটো প্রধান মতবাদ বা থিওরি প্রচলিত ছিল। প্রথমটি ছিল নির্গমন তত্ত্ব (Emission Theory), যার প্রবক্তা ছিলেন গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিড (Euclid) এবং জ্যোতির্বিদ টলেমি (Ptolemy)। তারা বিশ্বাস করতেন, আমাদের চোখ থেকে লেজার রশ্মির মতো এক ধরনের আলো বা ‘ফায়ার’ বের হয়, যা বস্তুর ওপর পড়ে এবং আমরা দেখতে পাই। অনেকটা সুপারম্যান বা সাইক্লপসের চোখের মতো ব্যাপার। দ্বিতীয়টি ছিল প্রবেশ তত্ত্ব (Intromission Theory), যার কথা বলেছিলেন অ্যারিস্টটল এবং কিছু পরমাণুবাদী দার্শনিক। তারা ভাবতেন, বস্তু থেকে কোনো কিছু বা ‘ফর্ম’ আমাদের চোখে এসে ঢোকে। কিন্তু তাদের কাছে এর কোনো গাণিতিক ব্যাখ্যা ছিল না।
ইবনে আল-হাইসাম এই দুই মতবাদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, “বাজে কথা। যদি চোখ থেকেই আলো বের হতো, তবে রাতে চোখ খুললে আমরা অন্ধকার দেখি কেন? চোখের আলো কি রাতে ফুরিয়ে যায়?” তিনি আরও একটা অকাট্য যুক্তি দিলেন। আমরা যখন প্রখর সূর্যের দিকে তাকাই, আমাদের চোখ ব্যথা করে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যদি চোখ আলো দিত, তবে বাইরের সূর্য তাকে কষ্ট দেবে কেন? তিনি বললেন, আলো চোখ থেকে বের হয় না, বরং আলোর উৎস (যেমন সূর্য বা প্রদীপ) থেকে আলো বস্তুর ওপর পড়ে এবং সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। তিনি জ্যামিতি এবং পদার্থবিদ্যাকে এক সুতোয় গাঁথলেন। তিনি প্রমাণ করলেন যে, আলো সরলরেখায় চলে। একে বলা হয় আলোর ঋজুগতি (Rectilinear Propagation)। তিনি আলোর প্রতিফলন বা রিফ্লেকশন (Reflection) এবং প্রতিসরণ বা রিফ্র্যাকশন (Refraction)-এর নিয়মগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, কেন গোধূলির সময় বা ঊষালগ্নে সূর্য দিগন্তের নিচে থাকলেও আমরা আলো দেখি। তিনি বাতাস বা বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বের কারণে আলোর বেকে যাওয়া বা প্রতিসরণ দিয়ে এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি বায়ুমণ্ডলের উচ্চতাও মেপেছিলেন, যা আধুনিক হিসাবের খুব কাছাকাছি।
পিনহোল ক্যামেরা: আধুনিক ক্যামেরার আদিপিতা
বন্দিদশায় অন্ধকার ঘরে বসে তিনি একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন। জানলার একটা ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে বাইরের আলো ঘরের দেয়ালে পড়ছিল। তিনি দেখলেন, বাইরের দৃশ্য – গাছপালা, মানুষ – সব উল্টো হয়ে দেয়ালে দেখা যাচ্ছে। তিনি অবাক হলেন, কিন্তু ভয় পেলেন না। তিনি এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজলেন। তিনি বুঝলেন, আলো সরলরেখায় চলে বলেই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ওপরের আলো নিচে এবং নিচের আলো ওপরে চলে যায়, ফলে উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। তিনি এর নাম দিলেন ‘আল-বাইত আল-মুজলাম’ বা অন্ধকার কক্ষ। ল্যাটিনে এর অনুবাদ হলো ক্যামেরা অবসকুরা (Camera Obscura)। ‘ক্যামেরা’ মানে কক্ষ আর ‘অবসকুরা’ মানে অন্ধকার। আজকের যে ক্যামেরা দিয়ে আমরা ছবি তুলি, তার নীতি এই অন্ধকার কক্ষের নীতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। তিনি এই নীতি ব্যবহার করে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করার নিরাপদ পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন।
তিনি চোখের গঠন বা অ্যানাটমি (Anatomy) নিয়েও বিস্তারিত কাজ করেছিলেন। যদিও তিনি কোনো শব ব্যবচ্ছেদ করেননি (যা তখন সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল), তিনি গ্যালেনের বর্ণনাকে গাণিতিক যুক্তিতে সাজিয়েছিলেন। তিনি কর্নিয়া, আইরিস, লেন্স এবং রেটিনার কাজ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেছিলেন, চোখ আসলে একটা অপটিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট বা আলোকযন্ত্র। লেন্সের কাজ হলো আলোকে ফোকাস করা। তবে তিনি জানতেন না যে রেটিনাতেও উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি হয় এবং মস্তিষ্ক সেটা সোজা করে; তিনি ভাবতেন লেন্সেই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। এই ছোট ভুলটুকু বাদ দিলে, দৃষ্টিশক্তি নিয়ে তার গবেষণা ছিল নিখুঁত।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি: সত্য যাচাইয়ের মন্ত্র
ইবনে আল-হাইসামের সবচেয়ে বড় অবদান কোনো নির্দিষ্ট আবিষ্কার নয়, বরং আবিষ্কার করার পদ্ধতি। তাকে বলা হয় ‘প্রথম সত্যিকারের বিজ্ঞানী’ বা দ্য ফার্স্ট ট্রু সায়েন্টিস্ট। তার আগে গ্রিক দার্শনিকরা বা অন্য পণ্ডিতরা মূলত চিন্তানির্ভর বা আর্মচেয়ার ফিলোসফি চর্চা করতেন। তারা ভাবতেন, নিখুঁত যুক্তি দিতে পারলেই সত্য জানা যায়, প্রমাণের দরকার নেই। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ভারী বস্তু হালকা বস্তুর চেয়ে দ্রুত নিচে পড়ে। হাজার বছর ধরে সবাই এটা মেনে নিয়েছিল, কেউ ছাদ থেকে দুটো পাথর ফেলে পরীক্ষা করে দেখেনি।
আল-হাইসাম এই প্রথা ভাঙলেন। তিনি বললেন, “যুক্তি থাক, আগে প্রমাণ দাও। পর্যবেক্ষণ করো, ডেটা নাও, তারপর সিদ্ধান্তে আসো।” তিনি বিজ্ঞানে সংশয়বাদ (Skepticism) বা সন্দেহের গুরুত্ব তুলে ধরলেন। তার বিখ্যাত উক্তি হলো: “যে সত্যের সন্ধান করে, তার উচিত প্রাচীন লেখকদের ওপর অন্ধবিশ্বাস না রাখা। বরং তার উচিত তাদের লেখাগুলোকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা এবং প্রশ্ন করা। তাকে শুধু যুক্তি এবং প্রমাণের ওপর নির্ভর করতে হবে, কোনো মানুষের কথার ওপর নয়।”
তিনি বিজ্ঞানচর্চার জন্য একটি নির্দিষ্ট ধাপ বা প্রসেস তৈরি করেছিলেন, যা আজকের সায়েন্টিফিক মেথড (Scientific Method) বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই ধাপগুলো হলো:
- ১. পর্যবেক্ষণ (Observation): প্রকৃতিকে ভালো করে দেখা এবং সমস্যা চিহ্নিত করা।
- ২. সমস্যা বা প্রশ্ন তৈরি: কেন এমন হচ্ছে?
- ৩. অনুকল্প বা হাইপোথিসিস (Hypothesis): একটি সম্ভাব্য উত্তর দাঁড় করানো।
- ৪. পরীক্ষণ (Experimentation): সেই উত্তর সঠিক কি না তা পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা।
- ৫. বিশ্লেষণ (Analysis): পরীক্ষার ফলাফল গণিতের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা।
- ৬. সিদ্ধান্ত (Conclusion): ফলাফল যদি হাইপোথিসিসকে সমর্থন করে তবে তা গ্রহণ করা, না হলে বাতিল করা।
এই যে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) – এটিই আধুনিক বিজ্ঞানকে ধর্ম বা দর্শন থেকে আলাদা করেছে। তিনি বলেছিলেন, “আমি নিজে পরীক্ষা না করা পর্যন্ত এবং গণিত দিয়ে প্রমাণ না করা পর্যন্ত কোনো কিছু বিশ্বাস করি না।” ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon) বা রেনে দেকার্তের (René Descartes) বহু শতাব্দী আগে তিনি এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন (Steffens, 2006)।
ল্যাটিন অনুবাদ ও ইউরোপের জাগরণ
ইবনে আল-হাইসামের কিতাব আল-মানাজির দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। বইটির ল্যাটিন নাম দেওয়া হয় ডি আসপেক্টিবাস (De Aspectibus) বা পার্সপেক্টিভা (Perspectiva)। এই বইটি ইউরোপের বিজ্ঞানজগতে এক বিশাল বোমা ফাটায়। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় পণ্ডিতরা, যেমন – রজার বেকন (Roger Bacon), পোল্যান্ডের উইটেলো (Witelo) এবং ইতালির জন পেকহাম (John Peckham) – সবাই আল-হাইসামের কাজের ওপর ভিত্তি করে তাদের গবেষণা চালিয়েছিলেন। রজার বেকন তো তাকে নিজের ‘গুরু’ বা মাস্টার মানতেন এবং তার বইয়ের পাতায় পাতায় ‘আলহাজেন’-এর নাম উল্লেখ করতেন।
রেনেসাঁ যুগের শিল্পকলাতেও আল-হাইসামের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ইতালীয় চিত্রশিল্পীরা যখন ছবিতে গভীরতা বা পার্সপেক্টিভ (Perspective) আনার চেষ্টা করছিলেন, তখন তারা আল-হাইসামের আলোকবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়েছিলেন। কীভাবে দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসে ত্রিমাত্রিক অনুভূতি তৈরি করা যায়, তা তারা শিখেছিলেন আলোর জ্যামিতি থেকে। লরেঞ্জো গিবার্টি (Lorenzo Ghiberti) এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (Leonardo da Vinci)-র মতো শিল্পীরাও তার কাজের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন (Smith, 2001)।
পরবর্তীকালে সপ্তদশ শতাব্দীতে জোহানেস কেপলার (Johannes Kepler) যখন চোখের রেটিনায় প্রতিবিম্ব তৈরি হওয়ার বিষয়টি আবিষ্কার করেন, তিনি সরাসরি আল-হাইসামের কাজের সূত্র ধরে এগিয়েছিলেন। আর আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton)? নিউটন যখন প্রিজম দিয়ে আলোকে সাত রঙে ভাগ করলেন এবং তার বিখ্যাত আলোকতত্ত্ব দিলেন, তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন এই আরব বিজ্ঞানীর কাঁধের ওপর। নিউটন নিজেও জানতেন, আলোর মৌলিক ধর্মগুলো আল-হাইসামই প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন। এমনকি চাঁদের গর্ত বা ক্রেটার নিয়ে আল-হাইসামের পর্যবেক্ষণ গ্যালিলিওকেও সাহায্য করেছিল। চাঁদে একটি গর্তের নাম রাখা হয়েছে ‘আলহাজেন ক্রেটার’ তার সম্মানে।
ইবনে আল-হাইসাম কেবল লেন্স বা আয়না নিয়ে খেলেননি, তিনি মানুষের চিন্তার আয়নাটাকেই পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন যে, প্রকৃতির নিয়ম কোনো জাদুমন্ত্র নয়, এটি সুনির্দিষ্ট গাণিতিক এবং ভৌত নিয়মে চলে। আর সেই নিয়ম বোঝার চাবিকাঠি হলো প্রশ্ন করা এবং পরীক্ষা করা। বাগদাদ বা কায়রোর সেই গবেষণাগার আজ হয়তো নেই, কিন্তু আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোনের ক্যামেরার লেন্সে কিংবা ল্যাবরেটরির মাইক্রোস্কোপে ইবনে আল-হাইসামের উত্তরাধিকার আজও বেঁচে আছে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন – অন্ধকারের অস্তিত্ব নেই, অন্ধকার মানে কেবল আলোর অভাব; আর অজ্ঞতা হলো জ্ঞানের অভাব, যা দূর করতে হয় যুক্তির মশাল জ্বেলে।
রসায়ন: আলকেমি থেকে কেমিস্ট্রি
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের এক অদ্ভুত নেশা ছিল। সে বিশ্বাস করত, প্রকৃতির সাধারণ বা সস্তা জিনিসকে জাদুমন্ত্র দিয়ে মহামূল্যবান কিছুতে রূপান্তর করা সম্ভব। লোহা বা সীসাকে সোনা বানানোর এই যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা, একেই বলা হতো ‘আলকেমি’ (Alchemy) বা অপরসায়ন। গ্রিক, মিশরীয় এবং চৈনিক সভ্যতায় আলকেমি চর্চা হতো, কিন্তু তা ছিল অনেকটাই জাদুবিদ্যা, আধ্যাত্মিকতা আর কুসংস্কারের এক জগাখিচুড়ি। আলকেমিস্টরা আগুনের ধোঁয়ায় বসে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ত আর ‘পরশপাথর’ বা ফিলোসফার্স স্টোন (Philosopher’s Stone)-এর খোঁজ করত, যা দিয়ে নাকি অমরত্ব লাভ করা যায় এবং যেকোনো ধাতুকে সোনায় পরিণত করা যায়। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর দিকে বাগদাদ ও কুফার ল্যাবরেটরিগুলোতে এই জাদুকরী আবছায়া কাটতে শুরু করল। মুসলিম স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা বললেন, “বস্তুর রূপান্তর জাদুতে হয় না, হয় নির্দিষ্ট নিয়মে।” তারা আগুনের ব্যবহার শিখলেন, কিন্তু মন্ত্র পড়ার জন্য নয়, বরং তাপ দিয়ে পদার্থের ধর্ম বদলানোর জন্য। তারা আলকেমিকে জাদুর জগত থেকে টেনে বের করে নিয়ে এলেন বিজ্ঞানের কঠিন জমিনে। এই রূপান্তরের মহানায়ক ছিলেন জাবির ইবনে হাইয়ান (Jabir ibn Hayyan), যাকে পাশ্চাত্যের জগত চেনে জেবার (Geber) নামে। তাকে বলা হয় আধুনিক রসায়নের জনক। তিনি আলকেমির স্বপ্ন দেখতেন ঠিকই, কিন্তু তার পা ছিল বাস্তবের মাটিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পদার্থের একটা নির্দিষ্ট ধর্ম আছে এবং তা ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তার হাত ধরেই ‘আল-কিমিয়া’ পরিণত হলো ‘কেমিস্ট্রি’-তে।
জাবির ইবনে হাইয়ান: ল্যাবরেটরির প্রথম পুরুষ
জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি ছিলেন একজন সুফি, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী। তার জন্ম বর্তমান ইরানের তুস নগরীতে হলেও তার কর্মজীবন কেটেছে ইরাকের কুফায়। তিনি ছিলেন আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশীদের দরবারের ঘনিষ্ট বারমাকি পরিবারের আশ্রিত। জাবিরের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি রসায়ন চর্চাকে একটি পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান বা এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্স (Experimental Science)-এ রূপান্তর করেন। তার আগে আলকেমিস্টরা রূপক ভাষায় কথা বলতেন, যা বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব ছিল। জাবির বললেন, “রসায়নে দক্ষ হওয়ার প্রথম শর্ত হলো হাতে-কলমে কাজ করা। যে পরীক্ষা করে না, সে কখনো দক্ষ হতে পারে না।” এই একটি বাক্যই বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি কুফায় একটি বিশাল ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার স্থাপন করেছিলেন। সেই ল্যাবরেটরি যখন প্রায় ২০০ বছর পর মাটির নিচ থেকে আবিষ্কৃত হয়, তখন সেখানে পাওয়া গিয়েছিল হামানদিস্তা, চুল্লি এবং কাঁচের তৈরি বকযন্ত্র। জাবির পদার্থের গঠন নিয়ে নিজস্ব এক তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যা সালফার-মারকারি থিওরি (Sulfur-Mercury Theory) নামে পরিচিত। তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর সমস্ত ধাতু মূলত দুটি উপাদানের মিশ্রণ – সালফার (যা আগুনের প্রতীক) এবং মারকারি বা পারদ (যা তরল ও ধাতব ধর্মের প্রতীক)। এই দুইয়ের অনুপাত ঠিকঠাক করতে পারলেই এক ধাতুকে অন্য ধাতুতে রূপান্তর করা সম্ভব। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানে এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু সেই যুগে এটি ছিল পদার্থের গঠন বোঝার প্রথম কাঠামোগত বা স্ট্রাকচারাল চেষ্টা।
তিনি বস্তুর ধর্মকে চারটি ভাগে ভাগ করেছিলেন – গরম, ঠান্ডা, শুষ্ক এবং আর্দ্র। একে তিনি বলতেন নেচারস (Natures)। তার মতে, রসায়নবিদের কাজ হলো এই ধর্মগুলোকে আলাদা করা এবং নতুন অনুপাতে মেশানো। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘ইলাম আল-মিজান’ বা সায়েন্স অফ ব্যালেন্স (Science of Balance)। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে কিতাব আল-কিমিয়া (The Book of Chemistry) এবং কিতাব আল-সাবইন (The Seventy Books) মধ্যযুগীয় রসায়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। ইউরোপীয়রা তার বইগুলো পাগলের মতো অনুবাদ করেছিল এবং শত শত বছর ধরে সেগুলো পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, পরবর্তীকালে ইউরোপের অনেক লেখক নিজেদের বইয়ের কাটতি বাড়ানোর জন্য লেখকের নামের জায়গায় ‘জেবার’ নাম ব্যবহার করতেন। এদেরকে ইতিহাসবিদরা বলেন সিউডো-জেবার (Pseudo-Geber)। জাবির কেবল তত্ত্ব দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি এমন সব রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন যা ছাড়া আজকের আধুনিক শিল্পকারখানা অচল।
পাতন ও আলেম্বিক: বিশুদ্ধতার খোঁজ
রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য দরকার বিশুদ্ধ উপাদান। আর এই বিশুদ্ধকরণের জন্য জাবির এবং তার অনুসারীরা বেশ কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার ও উন্নয়ন করেন, যা আজও অপরিবর্তিত আছে। এর মধ্যে প্রধান হলো পাতন (Distillation)। তরলকে তাপ দিয়ে বাষ্প করা এবং সেই বাষ্পকে ঠান্ডা করে পুনরায় বিশুদ্ধ তরল হিসেবে সংগ্রহ করার নামই পাতন। এই কাজের জন্য জাবির একটি বিশেষ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার নাম আলেম্বিক (Alembic)। আরবি ‘আল-আম্বিক’ থেকে আসা এই যন্ত্রটি কাঁচ বা পিতল দিয়ে তৈরি হতো। এর দুটি অংশ ছিল – নিচে একটি পাত্র যেখানে তরল ফোটানো হতো, আর ওপরে একটি ঢাকনা বা ‘হেড’ যা বাষ্পকে ঘনীভূত করে নলের মাধ্যমে অন্য পাত্রে পাঠাত। আজকের আধুনিক ল্যাবরেটরিতে যে ‘রিটর্ট’ বা ‘ডিস্টিলেশন ফ্লাস্ক’ দেখা যায়, তা আসলে জাবিরের আলেম্বিকেরই নাতিনাতনি। এই যন্ত্রটি আবিষ্কার হওয়ার ফলেই সুগন্ধি বা পারফিউম তৈরি করা, গোলাপ জল বানানো এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – অ্যালকোহল (Alcohol) নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়েছিল।
জাবির কেবল পাতন নয়, আরও অনেকগুলো মৌলিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছিলেন। কেলাসন (Crystallization) – যার মাধ্যমে তরল থেকে কঠিন দানা বা ক্রিস্টাল আলাদা করা হয়; উর্ধ্বপতন (Sublimation) – যেখানে কঠিন পদার্থ গলে না গিয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয় (যেমন কর্পূর); এবং ভস্মীকরণ (Calcination) – ধাতুকে পুড়িয়ে গুঁড়ো বা অক্সাইডে পরিণত করা। তিনি বাষ্পীভবন (Evaporation) এবং পরিস্রাবণ বা ফিল্টারিং (Filtering)-এর কৌশলও শিখিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আগুনের তাপ নিয়ন্ত্রণ করাটাই হলো রসায়নবিদের আসল দক্ষতা। খুব বেশি তাপে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, আবার কম তাপে বিক্রিয়া হবে না। এই তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ বা টেম্পারেচার কন্ট্রোল (Temperature Control) শেখার জন্য তারা বিশেষ ধরনের চুল্লি বা ‘আথানর’ (Athanor) তৈরি করেছিলেন।
এসিডের আবিষ্কার: রাসায়নিক বিপ্লব
জাবির ইবনে হাইয়ানের সবচেয়ে বৈপ্লবিক অবদান হলো শক্তিশালী মিনারেল এসিড বা খনিজ অম্ল (Mineral Acids) আবিষ্কার। তার আগে মানুষ এসিড বলতে চিনত কেবল ভিনেগার বা অ্যাসিটিক এসিড, যা খুব দুর্বল। কিন্তু জাবির ও তার পরবর্তী বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে এমন কিছু তরল তৈরি করলেন যা লোহাকেও গলিয়ে ফেলতে পারে। তিনি ফিটকিরি বা অ্যালাম (Alum) এবং গ্রিন ভিট্রিয়ল (Iron Sulfate) একসাথে পাতন করে তৈরি করলেন সালফিউরিক এসিড (Sulfuric Acid)। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘অয়েল অফ ভিট্রিয়ল’। আজও যেকোনো দেশের শিল্পায়নের মেরুদণ্ড হলো এই সালফিউরিক এসিড। এরপর তিনি তৈরি করলেন নাইট্রিক এসিড (Nitric Acid)। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় চমক ছিল অ্যাকুয়া রিজিয়া (Aqua Regia) বা ‘রাজ অম্ল’। তিনি হাইড্রোক্লোরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিডের মিশ্রণে এমন এক দ্রবণ তৈরি করলেন, যা সোনা বা গোল্ডকেও গলিয়ে ফেলতে পারে। সোনা ছিল রাজধাতু, তাকে কেউ স্পর্শ করতে পারত না, আগুনও না। কিন্তু জাবিরের এই জল সোনাকে গলিয়ে ফেলল। এই আবিষ্কার ধাতুবিদ্যা বা মেটালার্জি (Metallurgy) এবং স্বর্ণকারদের জন্য ছিল এক বিশাল ঘটনা। ধাতুর বিশুদ্ধতা যাচাই করার জন্য এবং খোদাই করার জন্য এই এসিডগুলো অপরিহার্য হয়ে পড়ল। ইতিহাসবিদ ই. জে. হলমিয়ার্ড (Holmyard, 1957) বলেন, “এসিড আবিষ্কারের মাধ্যমে জাবির রসায়নের হাতে এমন এক অস্ত্র তুলে দিলেন, যা আগে কেবল কল্পনাই করা যেত।”
আল-রাজি: বস্তুর শ্রেণীবিন্যাস ও যুক্তিবাদ
জাবিরের পর রসায়নের জগতে যিনি ধুমকেতুর মতো এলেন, তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি (Al-Rhazes)। তিনি ছিলেন নবম-দশম শতাব্দীর মানুষ। জাবির যদি হন তাত্ত্বিক রসায়নের জনক, তবে আল-রাজি হলেন ব্যবহারিক রসায়নের প্রাণপুরুষ। জাবিরের লেখায় কিছুটা রহস্যময়তা বা আধ্যাত্মিকতা ছিল, কিন্তু আল-রাজি ছিলেন পুরোপুরি যুক্তিবাদী ও সেক্যুলার। তিনি রসায়নকে চিকিৎসাবিদ্যার কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তার বিখ্যাত বই কিতাব আল-আসজার বা বুক অফ সিক্রেটস (Book of Secrets) রসায়নের এক আকর গ্রন্থ। এই বইতে তিনি কোনো রূপক ব্যবহার করেননি, সরাসরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বর্ণনা দিয়েছেন। আল-রাজির সবচেয়ে বড় অবদান হলো পদার্থের শ্রেণীবিন্যাস বা ক্লাসিফিকেশন অফ ম্যাটার (Classification of Matter)। তিনি পৃথিবীর সমস্ত পদার্থকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছিলেন: ১. প্রাণীজ (Animal), ২. উদ্ভিজ্জ (Vegetable), এবং ৩. খনিজ (Mineral)। এই বিভাজন আজও জীববিদ্যা ও রসায়নে ব্যবহৃত হয়। খনিজ পদার্থকে তিনি আবার ছয়টি ভাগে ভাগ করেছিলেন – দেহ বা ধাতু (Metals), আত্মা বা উদ্বায়ী পদার্থ (Volatile substances like Sulfur, Mercury), পাথর (Stones), ভিট্রিওল (Vitriols), বোরাক্স (Boraxes) এবং লবণ (Salts)। এই যে গোছানো চিন্তাভাবনা, এটিই তাকে বিজ্ঞানীর মর্যাদা দিয়েছে। তিনি প্রথম পেট্রোলিয়াম বা অপরিশোধিত তেল থেকে কেরোসিন (Kerosene) পাতন করেছিলেন এবং তা দিয়ে প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছিলেন (Partington, 1970)। তিনি চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ তৈরি করেছিলেন, যেমন – পারদ বা মারকারি অয়েন্টমেন্ট। তার ল্যাবরেটরিতে বিকার, ফ্লাস্ক, ফানেল, হামানদিস্তা, ছাঁকনি – সবকিছুই ছিল আধুনিক মানের। তিনি বলতেন, “একজন রসায়নবিদকে অবশ্যই নীরব হতে হবে এবং তাকে তার কাজের প্রতি অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে।”
শব্দের খেলা: আল-কিমিয়া থেকে কেমিস্ট্রি
রসায়নের ভাষায় আজও আমরা আরবি শব্দ ব্যবহার করছি, হয়তো অজান্তেই। ‘কিমিয়া’ শব্দটি এসেছে মিশরীয় শব্দ ‘কেমেত’ (কালো মাটি) থেকে, যা আরবরা গ্রহণ করে ‘আল-কিমিয়া’ বানিয়েছিল। ইউরোপে গিয়ে ‘আল’ বাদ পড়ে তা হয়েছে ‘কেমিস্ট্রি’। আমরা যে ‘অ্যালকোহল’ বলি, তা এসেছে আরবি ‘আল-কুহল’ থেকে। শুরুতে এটি চোখের সাজ বা সুরমা বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, পরে এটি যেকোনো মিহি পাউডার এবং শেষে পাতিত স্পিরিট বা ইথানল বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে। ‘অ্যালকালি’ (Alkali) বা ক্ষার এসেছে আরবি ‘আল-কালি’ থেকে, যার অর্থ পোড়া ছাই। সাবান তৈরির জন্য তারা উদ্ভিদ পুড়িয়ে এই ক্ষার তৈরি করত। ‘ইলিক্সার’ (Elixir) বা অমৃত শব্দটি এসেছে আরবি ‘আল-ইকসির’ থেকে, যার অর্থ ছিল সেই জাদুকরী পাউডার যা রোগ সারাত বা ধাতুকে সোনা বানাত। সোডা (Soda), বোরাক্স (Borax), ট্যালক (Talc), জিপসাম (Gypsum), রিয়েলগার (Realgar) – এই শব্দগুলোর শেকড়ও লুকিয়ে আছে সেই স্বর্ণযুগের ল্যাবরেটরিগুলোতে। এই শব্দগুলোই প্রমাণ করে যে, আধুনিক রসায়ন তার শৈশব এবং কৈশোর পার করেছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে।
তারা কাঁচ, সিরামিক এবং রঞ্জক পদার্থ বা ডাই (Dye) তৈরিতেও বিশাল অবদান রেখেছিলেন। লোহা ও ইস্পাত তৈরির প্রযুক্তিতে, বিশেষ করে দামেস্কের ইস্পাত (Damascus Steel) তৈরিতে তারা রাসায়নিক জ্ঞান প্রয়োগ করেছিলেন। তাদের তৈরি টাইলসের গ্লেজ বা চকচকে প্রলেপ আজও শত শত বছর পর অক্ষত আছে। তারা জানত কোন ধাতুর অক্সাইড মেশালে কী রঙ হবে – কোবাল্ট দিলে নীল, ম্যাঙ্গানিজ দিলে বেগুনি। এই ব্যবহারিক রসায়নই শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। জাবির বা আল-রাজি হয়তো সোনা বানাতে পারেননি, কিন্তু তারা যা দিয়ে গেছেন তা সোনার চেয়েও দামী। তারা মানুষকে শিখিয়েছিলেন যে প্রকৃতির ভাণ্ডার অঢেল, কিন্তু চাবিটা হলো জ্ঞান আর পরীক্ষা। সেই ধোঁয়াচ্ছন্ন ল্যাবরেটরি, আলেম্বিকের টুপ টুপ শব্দে পড়া ফোঁটা, আর সালফারের গন্ধে ভরা ঘরগুলোতেই জন্ম হয়েছিল আজকের আধুনিক রসায়নের, যা আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে।
দর্শন ও যুক্তিবাদ: ফালসাফা ও সংঘাত
মধ্যযুগীয় জ্ঞানচর্চার বিশাল ক্যানভাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অথচ সবচেয়ে বিতর্কিত রঙটি ছিল দর্শন বা ‘ফালসাফা’ (Falsafa)। বাগদাদের বায়তুল হিকমাহতে যখন গ্রিক পাণ্ডুলিপিগুলো অনুদিত হচ্ছিল, তখন কেবল বিজ্ঞান বা গণিত আসছিল না, তার সাথে আসছিল চিন্তার এক নতুন পদ্ধতি। গ্রিকরা, বিশেষ করে অ্যারিস্টটল (Aristotle) এবং প্লেটো (Plato) শিখিয়েছিলেন যে, পৃথিবীকে বুঝতে হলে কেবল অন্ধবিশ্বাস বা প্রচলিত প্রথার ওপর নির্ভর করলে চলবে না; ব্যবহার করতে হবে ‘আকল’ বা বুদ্ধি। এই গ্রিক যুক্তিবাদ যখন ইসলামের একেশ্বরবাদী বিশ্বাসের মুখোমুখি হলো, তখন জন্ম নিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক মহাবিস্ফোরণ। মুসলিম বিশ্বের পণ্ডিতরা দর্শনের প্রেমে পড়ে গেলেন। তারা অ্যারিস্টটলকে বলতেন ‘প্রথম শিক্ষক’ বা দ্য ফার্স্ট টিচার (The First Teacher)। কিন্তু এই প্রেম মসৃণ ছিল না। এটি জন্ম দিয়েছিল এক চিরন্তন সংঘাতের – যুক্তি বনাম বিশ্বাস, এথেন্স বনাম মক্কা। একদল চাইল ধর্মকে বুদ্ধির ছাঁচে ফেলতে, আরেকদল চাইল বুদ্ধিকে ধর্মের সীমানায় বাঁধতে। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াই ইসলামি স্বর্ণযুগকে করে তুলেছিল প্রাণবন্ত ও গতিশীল। দর্শনের এই চর্চা কেবল তাত্ত্বিক ছিল না, এটি ছিল সমাজ, রাষ্ট্র এবং ঈশ্বরের স্বরূপ বোঝার এক মরণপণ লড়াই।
মুতাজিলা: যুক্তির প্রথম মশাল
এই লড়াইয়ের ময়দানে সবার আগে যাদের নাম নিতে হয়, তারা হলেন মুতাজিলা (Mu’tazila) সম্প্রদায়। অষ্টম শতাব্দীতে বাসরা ও বাগদাদে এই গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। তাদেরকে বলা হয় ইসলামের প্রথম র্যাশনালিষ্ট থিওলজিয়ান (Rationalist Theologians) বা যুক্তিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক। তাদের মূলমন্ত্র ছিল – ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন ব্যবহার করার জন্য, আলমারিতে তুলে রাখার জন্য নয়। যদি ধর্মগ্রন্থের কোনো কথা যুক্তির বা রিজন (Reason)-এর বিরোধী মনে হয়, তবে বুঝতে হবে সেটার আক্ষরিক অর্থ ভুল; তখন সেটাকে রূপক বা মেটাফোর (Metaphor) হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে। তারা ঈশ্বরের ন্যায়বিচার বা ডিভাইন জাস্টিস (Divine Justice)-এর ওপর জোর দিতেন। তাদের মতে, ঈশ্বর ন্যায়পরায়ণ, তাই তিনি মানুষকে এমন কোনো কাজের জন্য শাস্তি দিতে পারেন না যা করার ক্ষমতা মানুষের নেই। এখান থেকেই এল তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিতর্কিত তত্ত্ব – স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will)। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষ তার নিজের কাজের স্রষ্টা। মানুষ ভালো বা মন্দ কাজ নিজের ইচ্ছায় করে, ঈশ্বরের নির্দেশে নয়। তাই পাপের দায় মানুষের, ঈশ্বরের নয়। এটি ছিল তৎকালীন রক্ষণশীল বা অর্থোডক্স (Orthodox) মতবাদের সরাসরি বিরোধী, যারা বিশ্বাস করত সবকিছুই ভাগ্যে লেখা বা প্রিডেস্টিনেশন (Predestination)। মুতাজিলারা আরও বলতেন, কুরআন ঈশ্বরের সৃষ্টি, এটি ঈশ্বরের মতো অনাদি বা অনন্ত নয়। খলিফা আল-মামুন এই মতবাদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি একে রাষ্ট্রীয় মতবাদ ঘোষণা করেন এবং বিরোধীদের ওপর ‘মিহনা’ বা ইনকুইজিশন (Inquisition) চাপিয়ে দেন। যদিও পরবর্তীকালে তাদের পতন ঘটে, কিন্তু তারা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে প্রশ্ন করার সাহস কতটা শক্তিশালী হতে পারে।
আল-কিন্দি: আরবদের দার্শনিক
আরবদের মধ্যে যিনি প্রথম বিশুদ্ধ দর্শনের চর্চা শুরু করেন, তিনি হলেন আল-কিন্দি (Al-Kindi)। তাকে বলা হয় ‘আরবদের দার্শনিক’। তিনি ছিলেন বাগদাদের অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং বায়তুল হিকমাহর অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। আল-কিন্দি বুঝতে পেরেছিলেন যে, গ্রিক দর্শন আর ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মধ্যে একটা দেয়াল আছে। তিনি চাইলেন সেই দেয়াল ভেঙে সেতু তৈরি করতে। তিনি যুক্তি দিলেন, সত্য বা ট্রুথ (Truth) একটাই। নবীরা যে সত্য ওহীর মাধ্যমে পান, দার্শনিকরা সেই একই সত্য পান কঠোর পরিশ্রম ও যুক্তির মাধ্যমে। তাই ধর্ম ও দর্শন একে অপরের শত্রু হতে পারে না। তিনি অ্যারিস্টটলের কার্যকারণ তত্ত্ব এবং নিওপ্লেটোনিক বা নব্য-প্লেটোনিক (Neoplatonic) চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটান। তিনি বললেন, ঈশ্বর হলেন ‘প্রথম কারণ’ বা ফার্স্ট কজ (First Cause), যিনি বিশ্বজগতকে অস্তিত্বে এনেছেন। আল-কিন্দি গণিতের ওপর খুব জোর দিতেন। তিনি বলতেন, “যে গণিত জানে না, সে দর্শন বুঝবে না।” তিনি আত্মার অমরত্ব এবং বুদ্ধির স্তরগুলো নিয়ে গভীর আলোচনা করেছিলেন। তার মতে, দর্শন হলো মানুষের সাধ্যমতো জিনিসের বাস্তবতা জানা। তিনি গ্রিকদের জ্ঞানকে ‘বিদেশি জ্ঞান’ বলে নাকচ না করে তাকে আপন করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী দার্শনিকদের জন্য পথ প্রশস্ত করেছিল।
আল-ফারাবি: দ্বিতীয় শিক্ষক ও আদর্শ রাষ্ট্র
আল-কিন্দির পর দর্শনের মশাল যার হাতে জ্বলে উঠল, তিনি হলেন আল-ফারাবি (Al-Farabi)। তিনি ছিলেন একাধারে যুক্তিবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দার্শনিক। দর্শনে তার অবদান এত গভীর ছিল যে, তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘দ্বিতীয় শিক্ষক’ বা দ্য সেকেন্ড টিচার (The Second Teacher)। তিনি অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা এবং প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তাকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। আল-ফারাবি বিশ্বাস করতেন, সমাজ ছাড়া মানুষ অসম্পূর্ণ। তাই তিনি প্লেটোর রিপাবলিক-এর আদলে লিখলেন তার বিখ্যাত বই মাবাদি আরা আহল আল-মাদিনা আল-ফাদিলা (Principles of the Views of the Citizens of the Virtuous City)। তিনি এমন এক ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ বা ভার্চুয়াস সিটি (Virtuous City)-র কল্পনা করলেন, যেখানে শাসকের কাজ হবে মানুষের আত্মার উন্নতি ঘটানো। তার মতে, আদর্শ শাসককে হতে হবে একজন দার্শনিক-রাজা বা ফিলোসফার-কিং (Philosopher-King), যিনি একই সাথে জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ। যদি তেমন কাউকে না পাওয়া যায়, তবে একদল জ্ঞানীর দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া উচিত।
আল-ফারাবি ছিলেন নিওপ্লেটোনিজম (Neoplatonism)-এর ধারক। তিনি বিশ্বসৃষ্টির ব্যাখ্যায় ‘এমানেশন থিওরি’ বা বিচ্ছুরণ তত্ত্ব (Emanation Theory) ব্যবহার করেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ঈশ্বর বিশ্বজগতকে কুমোরের মতো মাটি দিয়ে তৈরি করেননি, বরং সূর্যের আলো যেমন সূর্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি বিশ্বজগত ঈশ্বরের সত্তা থেকে ধাপে ধাপে অস্তিত্বে এসেছে। এই তত্ত্বটি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং বিমূর্ত। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, মানুষ যখন তার বুদ্ধিকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়, তখন সে ‘সক্রিয় বুদ্ধি’ বা অ্যাক্টিভ ইনটেলেক্ট (Active Intellect)-এর সাথে যুক্ত হয়। এই স্তরে পৌঁছালে মানুষ অনেকটা নবীদের মতো জ্ঞান লাভ করতে পারে। আল-ফারাবির এই চিন্তা ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি সঙ্গীতের ওপর কিতাব আল-মুসিকি আল-কুবরা নামে একটি বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন, যা প্রমাণ করে যে তার দর্শন ছিল সুর ও যুক্তির এক অপূর্ব মিলন।
ইবনে সিনা: পূর্ব ও পশ্চিমের মহান শিক্ষক
আল-ফারাবির পর দর্শনের আকাশে যে সূর্যটি উদিত হলো, তার তেজ ছিল সবচেয়ে প্রখর। তিনি ইবনে সিনা (Avicenna)। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি যেমন রাজপুত্র, দর্শনে তিনি ছিলেন ‘শাইখ আল-রইস’ বা প্রধান শিক্ষক। তিনি আল-ফারাবির কাজকে পূর্ণতা দান করেন এবং দর্শনের এমন এক নিজস্ব ধারা তৈরি করেন যা পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে রাজত্ব করেছে। ইবনে সিনা দর্শনকে এতটাই সুশৃঙ্খল করেছিলেন যে, তার দর্শন বুঝতে পারাটাই ছিল বুদ্ধিজীবী হওয়ার মাপকাঠি। তিনি তার বিশাল গ্রন্থ কিতাব আল-শিফা (The Book of Healing)-তে যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, গণিত এবং অধিবিদ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এখানে ‘নিরাময়’ বা হিলিং বলতে তিনি শরীরের নয়, বরং অজ্ঞতার হাত থেকে আত্মার নিরাময় বুঝিয়েছিলেন।
ইবনে সিনার দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো অস্তিত্ব (Existence/Wujud) এবং সত্তা (Essence/Mahiyyah)-র মধ্যে পার্থক্য করা। তিনি বললেন, আমরা চারপাশে যা দেখি (গাছ, মানুষ, পাহাড়), তাদের অস্তিত্ব থাকাটা জরুরি নয়; অর্থাৎ, তারা না থাকলেও পারত। এদের তিনি নাম দিলেন সম্ভাব্য সত্তা বা কন্টিনজেন্ট বিয়িং (Contingent Being)। কিন্তু এই সম্ভাব্য জিনিসগুলো একা একা অস্তিত্বে আসতে পারে না, তাদের অস্তিত্বে আনার জন্য কোনো কারণ দরকার। এভাবে কারণ খুঁজতে খুঁজতে আমরা এমন এক সত্তার কাছে পৌঁছাব, যার অস্তিত্ব থাকাটা অপরিহার্য, তাকে কেউ সৃষ্টি করেনি, বরং তিনিই সবকিছুর অস্তিত্বের কারণ। ইনি হলেন আবশ্যিক সত্তা বা নেসেসারি বিয়িং (Necessary Being), আর ইনিই হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের এই যুক্তিটি বুরুহানে সিদ্দিকিন বা ‘সত্যবাদীদের প্রমাণ’ নামে পরিচিত, যা আজও ধর্মতত্ত্বে ব্যবহৃত হয়।
আত্মা বা সোউল (Soul) নিয়ে তার একটি বিখ্যাত চিন্তন-পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট (Thought Experiment) আছে, যা ‘ফ্লোটিং ম্যান’ বা ভাসমান মানুষ (Floating Man) নামে পরিচিত। তিনি বললেন: কল্পনা করুন, একজন মানুষ শূন্যে ভেসে আছে। তার চোখ বন্ধ, সে কিছুই দেখছে না। তার হাত-পা শরীরের সাথে লেগে নেই, তাই সে স্পর্শও অনুভব করছে না। সে কিছুই শুনছে না। অর্থাৎ, তার কোনো ইন্দ্রিয় কাজ করছে না। এমন অবস্থায় কি সে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবে? ইবনে সিনা বললেন, “হ্যাঁ, সে জানবে যে ‘আমি আছি’।” তার এই সচেতনতা তার শরীর থেকে আসেনি, এসেছে তার আত্মা থেকে। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করলেন যে, আত্মা শরীর থেকে আলাদা এবং স্বাধীন এক সত্তা। তার এই চিন্তা শত শত বছর পর ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” (Cogito, ergo sum)-র পূর্বসূরি ছিল।
আল-গাজালি ও দর্শনের সংকট
ইবনে সিনা দর্শনকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই পতনের শুরু বা অন্ততপক্ষে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার শুরু। এই ধাক্কাটি দিলেন একাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ধর্মতত্ত্ববিদ ইমাম আল-গাজালি (Al-Ghazali)। তিনি ছিলেন বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার প্রধান অধ্যাপক, কিন্তু সত্যের সন্ধানে তিনি সব ছেড়ে সুফি সাধনায় মগ্ন হন। ফিরে এসে তিনি কলম ধরলেন দার্শনিকদের, বিশেষ করে ইবনে সিনা ও আল-ফারাবির বিরুদ্ধে। লিখলেন তার বিখ্যাত বই তাহাফুত আল-ফালাসিফা (The Incoherence of the Philosophers)। এই বইতে তিনি দার্শনিকদের ২০টি মতবাদকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেন এবং ৩টি বিষয়ে তাদের ধর্মত্যাগী বা ‘কাফের’ ঘোষণা করেন – ১. বিশ্বজগত অনাদি বা অনন্ত (Eternity of the World), অর্থাৎ বিশ্ব সর্বদা ছিল, ঈশ্বর কেবল এর রূপ দিয়েছেন – এটি গাজালি মানতে পারেননি। ২. ঈশ্বর মানুষের ব্যক্তিগত বা ক্ষুদ্রতি-ক্ষুদ্র ঘটনাগুলো (Particulars) জানেন না, কেবল সার্বজনীন নিয়ম জানেন। ৩. পরকালে কেবল আত্মার বিচার হবে, শরীরের পুনরুত্থান হবে না।
তবে গাজালির সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল কার্যকারণ সম্পর্ক (Causality)-এর ওপর। ইবনে সিনা বা অ্যারিস্টটলীয় দার্শনিকরা বলতেন, কার্যকারণ সম্পর্ক অমোঘ। দার্শনিকরা বলতেন, আগুনের ধর্মই হলো পোড়ানো, তাই আগুন তুলার সংস্পর্শে এলেই তুলা পুড়বে। গাজালি বললেন, “না। আগুন তুলাকে পোড়ায় না। ঈশ্বর চান বলেই আগুন তুলাকে পোড়ায়। যদি ঈশ্বর না চান, তবে আগুন পোড়াবে না (যেমন ইব্রাহিম নবীর ক্ষেত্রে হয়েছিল)।” একে বলা হয় অকেশনালিম (Occasionalism)। তার মতে, আমরা যাকে প্রকৃতির নিয়ম ভাবি, তা আসলে ঈশ্বরের অভ্যাস। গাজালি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, যুক্তি বা লজিক সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না। তার এই সংশয়বাদ বা স্কেপ্টিসিজম (Skepticism) ডেভিড হিউম (David Hume)-এর শত শত বছর আগের কথা। হিউমও বলেছিলেন যে, আমরা কেবল ঘটনা ঘটতে দেখি (আগুন এবং ধোঁয়া), কিন্তু তাদের মাঝখানের কার্যকারণ শক্তিটা দেখি না। গাজালির এই বই মুসলিম বিশ্বে দর্শনের ভীত নাড়িয়ে দেয়। তিনি যুক্তিবিদ্যা বা গণিতের বিরোধিতা করেননি, কিন্তু তিনি মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে দেন। তার প্রভাবে সুফিবাদ ও ধর্মতত্ত্ব শক্তিশালী হয়, কিন্তু বিশুদ্ধ দর্শনের চর্চা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
ইবনে রুশদ: অ্যারিস্টটলের প্রকৃত শিষ্য ও শেষ রক্ষক
গাজালির আক্রমণের প্রায় একশ বছর পর, দর্শনের নিভু নিভু প্রদীপটি আবার দপ করে জ্বলে উঠল স্পেনের কর্ডোবায়। জ্বালালেন ইবনে রুশদ (Averroes)। তাকে বলা হয় মুসলিম বিশ্বের শেষ বড় দার্শনিক। তিনি ছিলেন একাধারে বিচারক, চিকিৎসক এবং দার্শনিক। দর্শনের ইতিহাসে এক বিশাল এবং কিছুটা ট্র্যাজিক চরিত্র হলেন এই ইবনে রুশদ (Averroes)। দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনের কর্ডোবায় তার জন্ম। তাকে তার জীবন কেটেছে অ্যারিস্টটলের চিন্তাকে রক্ষণশীলদের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। ইউরোপে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘দ্য কমেন্টেটর’ বা ব্যাখ্যাকারক (The Commentator) হিসেবে। কারণ, তিনি অ্যারিস্টটলের বইগুলোর ওপর যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বা কমেন্টারি (Commentary) লিখেছিলেন, তা ছিল অদ্বিতীয়।
ইবনে রুশদ মনে করতেন, আগের দার্শনিকরা, বিশেষ করে ইবনে সিনা, অ্যারিস্টটলকে নিওপ্লেটোনিক চিন্তার সাথে মিশিয়ে কিছুটা বিকৃত করেছেন ও জগাখিচুড়ি পাকিয়েছেন, যা গাজালির আক্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে। ইবনে রুশদ চাইলেন অ্যারিস্টটলের বিশুদ্ধ যুক্তিবাদে ফিরে যেতে। গাজালির আক্রমণের প্রায় একশ বছর পর ইবনে রুশদ তার জবাব দেন। তিনি লেখেন তাহাফুত আল-তাহাফুত (The Incoherence of the Incoherence)। এই বইতে তিনি গাজালির প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, গাজালি নিজেই দর্শনের যুক্তি ব্যবহার করে দর্শনের বিরোধিতা করেছেন। ইবনে রুশদ বলেন, কার্যকারণ সম্পর্ক অস্বীকার করা মানে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা। যদি আগুনের পোড়ানোর ক্ষমতা না থাকে, তবে পৃথিবীতে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে না, আর নিয়ম না থাকলে জ্ঞানার্জন অসম্ভব। তিনি বলেন, ঈশ্বর এই নিয়মগুলো তৈরি করেছেন এবং তিনি সাধারণত এগুলো ভাঙেন না। তিনি ধর্ম ও দর্শনের বিরোধ মেটাতে চাইলেন। তিনি বললেন, ধর্ম আর দর্শন সাংঘর্ষিক নয়, তারা আসলে ‘দুধের দুই বোন’। তার মতে, সত্যে পৌঁছানোর রাস্তা দুটি। একটি হলো সাধারণ মানুষের জন্য, যা ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক বা রূপক বর্ণনার মাধ্যমে আসে। আর অন্যটি হলো বিশেষ জ্ঞানীদের জন্য, যা আসে কঠোর গাণিতিক ও দার্শনিক যুক্তির মাধ্যমে। একে অনেক সময় ভুলভাবে দ্বৈত সত্য তত্ত্ব (Double Truth Theory) বলা হয়, যদিও ইবনে রুশদ নিজে এমন শব্দ ব্যবহার করেননি। ইবনে রুশদের এই বই ছিল যুক্তির এক মাস্টারপিস।
ইবনে রুশদ ছিলেন একজন বিচারক বা ক্বাজি। তিনি আইন এবং দর্শনকে গুলিয়ে ফেলেননি। তিনি বলেছিলেন, নারীরও পুরুষের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা আছে। তিনি প্লেটোর রিপাবলিকের ব্যাখ্যায় লিখেছিলেন যে, নারীদের কেবল সন্তান জন্মদান ও গৃহকর্মে আটকে রাখা হলো সমাজের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। তার মতে, নারীরও পুরুষের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা আছে। তার এই প্রগতিশীল চিন্তা তাকে তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তার জীবন সুখের হয়নি। রক্ষণশীলদের চাপে তাকে কর্ডোবা থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল, তার বই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। তবুও, তার চিন্তা মরেনি। তার বইগুলো গোপনে ইউরোপে চলে যায় এবং ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। প্যারিস এবং ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার চিন্তাধারা অ্যাভেরোইজম (Averroism) নামে এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। এই আন্দোলন চার্চের অন্ধত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং ইউরোপকে রেনেসাঁর পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। টমাস একুইনাস (Thomas Aquinas) তাকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার যুক্তিগুলো ব্যবহার করেই খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বকে সাজিয়েছিলেন, যদিও তারা তাকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন (Fakhry, 2001)।।
ইতিহাসের পরিহাস হলো, ইউরোপ গ্রহণ করল ইবনে রুশদকে আর মুসলিম বিশ্ব গ্রহণ করল গাজালিকে। প্রাচ্যে দর্শন ক্রমশ কালাম (Kalam) বা ধর্মতত্ত্ব এবং সুফিবাদ (Sufism)-এর সাথে মিশে গেল। ইবনে আরাবির (Ibn Arabi) মতো সুফি দার্শনিকরা যুক্তির চেয়ে ‘কাশফ’ বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধির ওপর জোর দিলেন। অন্যদিকে, শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (Suhrawardi) জন্ম দিলেন ইশরাকি বা ইলুমিনেশনিজম (Illuminationism) দর্শনের, যা ছিল আলো ও প্রজ্ঞার এক নতুন ধারা।
আধুনিক গবেষক ফ্রাঙ্ক গ্রিফেল (Griffel, 2009) মনে করেন, গাজালির পর মুসলিম বিশ্বে দর্শন বা বিজ্ঞান মরে যায়নি, বরং তা নতুন রূপ নিয়েছিল। মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে যুক্তিবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান টিকে ছিল। কিন্তু সেই উন্মুক্ত, বেপরোয়া এবং প্রশ্নকাতর দর্শনের চর্চা, যা আল-কিন্দি বা আল-রাজি করেছিলেন, তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। তবুও, এই ‘ফালসাফা’র যুগ প্রমাণ করে যে, একসময় মুসলিম মানসে যুক্তি ও বিশ্বাসের এক তুমুল লড়াই চলেছিল, যা মানবচিন্তার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। সেই তর্কের রেশ আজও কাটেনি; আজও যখন আমরা বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে ভাবি, তখন আমরা আসলে আল-গাজালি আর ইবনে রুশদের সেই পুরনো বিতর্কই চালিয়ে যাই।
সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস: ইবনে খালদুন
ইতিহাস চর্চার গতানুগতিক ধারাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যিনি একে একটি নির্মোহ বিজ্ঞানের মর্যাদা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন চতুর্দশ শতাব্দীর তিউনিসিয়ান পলিমেথ আবদ আল-রহমান ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun)। তার জন্মের আগে এবং তার সমসাময়িক সময়ে ইতিহাস ছিল মূলত রাজা-বাদশাদের তোষামোদ করার দলিল। সেখানে থাকত কেবল যুদ্ধের তারিখ, সিংহাসন আরোহণের সাল, আর কে কাকে হত্যা করল – তার অতিরঞ্জিত বর্ণনা। ঐতিহাসিকরা ছিলেন মূলত ‘ক্রনিকলার’ বা ঘটনাপঞ্জি লেখক, যারা যাচাই-বাছাই ছাড়াই আগের লেখকদের কথা হুবহু নকল করতেন। কিন্তু ইবনে খালদুন বললেন, “না, ইতিহাস মানে শুধু ‘কি ঘটেছিল’ তা জানা নয়, বরং ‘কেন ঘটেছিল’ এবং ‘কিভাবে ঘটেছিল’ – তা বোঝা।” তিনি ইতিহাসের কঙ্কালে সমাজবিজ্ঞানের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। তার অমর সৃষ্টি মুকাদ্দিমা (The Muqaddimah) বা প্রলেগোমেনা নিছক কোনো ইতিহাসের বই নয়; এটি মানব সভ্যতার এক গভীরতম ময়নাতদন্ত। কার্ল মার্কস, এমিল ডুরখেইম, অগাস্ট কোঁৎ বা ম্যাক্স ওয়েবারের জন্মের কয়েকশ বছর আগে উত্তর আফ্রিকার এক দুর্গে বসে তিনি সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মনস্তত্ত্ব নিয়ে এমন সব বিশ্লেষণ করেছিলেন, যা আজও একবিংশ শতাব্দীর সমাজবিজ্ঞানীদের বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। আধুনিক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি তার সম্পর্কে বলেছিলেন, “তিনি এমন এক জীবনদর্শন রচনা করেছেন, যা সর্বযুগের এবং সর্বস্থানের সেরা কাজগুলোর অন্যতম।” ইবনে খালদুন কেবল অতীতচারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম সত্যিকারের দার্শনিক (Philosopher of History) এবং সমাজবিজ্ঞানী (Sociologist)।
মুকাদ্দিমা: নতুন বিজ্ঞানের ইশতেহার
১৩৭৭ সাল। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর অস্থিরতায় ক্লান্ত হয়ে ইবনে খালদুন আশ্রয় নিলেন আলজেরিয়ার এক নির্জন দুর্গে, যার নাম ‘কালআত ইবনে সালামা’। সেখানে চার বছরের একাকিত্বে তিনি রচনা করলেন তার বিশ্ব-ইতিহাস কিতাব আল-ইবার (Book of Lessons)-এর ভূমিকা, যা পরে একটি স্বতন্ত্র বই হিসেবে মুকাদ্দিমা নামে পরিচিতি পায়। এই বইয়ে তিনি ঘোষণা করলেন এক ‘নতুন বিজ্ঞান’ বা ইলম আল-উমরান (Science of Culture/Civilization)-এর। তিনি বললেন, ইতিহাসকে হতে হবে সত্যনিষ্ঠ। কিন্তু সত্য জানব কী করে? তিনি উত্তর দিলেন – সমাজের নিয়মগুলো বুঝতে হবে। যদি কোনো ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, এক রাজা এক রাতেই বিশাল শহর তৈরি করেছেন, তবে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তা যাচাই করতে হবে – তৎকালীন প্রযুক্তি, জনবল এবং অর্থনীতি কি তা সমর্থন করে? যদি না করে, তবে সেই ইতিহাস মিথ্যা। তিনি বললেন, “মানব সমাজ হলো একটি জীবন্ত সত্তা, যার নিজস্ব নিয়ম আছে, জন্ম আছে, যৌবন আছে এবং মৃত্যু আছে।” তিনি ইতিহাসের কার্যকারণ সম্পর্ক বা কজালিটি (Causality) খোঁজার ওপর জোর দিলেন। তিনি দেখালেন যে, ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমষ্টি নয়, বরং এটি পরিবেশ, ভূগোল, অর্থনীতি এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের এক জটিল মিথস্ক্রিয়া। তার এই পদ্ধতি বা মেথডলজি (Methodology) ছিল সম্পূর্ণ আধুনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের পরিবর্তন কোনো দৈব ঘটনা নয়, বরং এটি ভৌত ও সামাজিক পরিস্থিতির অনিবার্য ফল।
আসাবিয়া ও সভ্যতার চক্র
ইবনে খালদুনের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি শব্দ – ‘আসাবিয়া’। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ করা কঠিন, তবে একে সামাজিক সংহতি (Social Cohesion), ‘গোষ্ঠী-চেতনা’ বা ‘গ্রুপ সলিডারিটি’ বলা যেতে পারে। তিনি মানব সমাজকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন: ১. উমরান বাদাবি বা যাযাবর/গ্রামীণ জীবন (Bedouin/Rural Life) এবং ২. উমরান হাদারি বা শহুরে/নাগরিক জীবন (Sedentary/Urban Life)। তিনি লক্ষ্য করলেন, মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশে যারা থাকে, সেই যাযাবরদের মধ্যে ‘আসাবিয়া’ বা একতা থাকে অত্যন্ত প্রবল। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা একে অপরের ওপর নির্ভর করে, তাদের রক্তের সম্পর্ক এবং গোত্রপ্রীতি তাদের ইস্পাতকঠিন ঐক্যে বেঁধে রাখে। এই ঐক্যের কারণেই তারা সাহসী এবং দুর্ধর্ষ হয়। অন্যদিকে, শহরের মানুষ আরাম-আয়েশে থাকে, তারা ভোগবাদী এবং স্বার্থপর হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একতা বা আসাবিয়া দুর্বল হয়ে যায়, তারা নিজেদের রক্ষার জন্য ভাড়াটে সৈন্যের ওপর নির্ভর করে।
ইবনে খালদুন সভ্যতার উত্থান-পতনের একটি চক্রাকার তত্ত্ব (Cyclical Theory) প্রদান করেন। তার মতে, একটি সভ্যতার আয়ুষ্কাল অনেকটা মানুষের জীবনের মতোই। তিনি দেখালেন কীভাবে ইতিহাস বারবার একই পথে হাঁটে:
- ১. উত্থান পর্ব: মরুভূমির প্রবল ‘আসাবিয়া’ সম্পন্ন কোনো যাযাবর গোষ্ঠী দুর্বল হয়ে পড়া কোনো শহরের বা রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেটি দখল করে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে।
- ২. সম্প্রসারণ ও স্থায়িত্ব: বিজয়ী শাসকরা শহরের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং রাজ্য বিস্তার করে। তখন আসাবিয়া ও রাজকীয় ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকে।
- ৩. বিলাসিতা ও অবক্ষয়: কয়েক প্রজন্ম ক্ষমতায় থাকার পর শাসকরা শহরের আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে দেয়। তারা পরিশ্রম বিমুখ হয়ে পড়ে, প্রজাদের ওপর করের বোঝা বাড়ায় এবং জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই পর্যায়ে তাদের ‘আসাবিয়া’ নষ্ট হয়ে যায়, তারা নিজেদের গোত্রের মানুষকে বিশ্বাস না করে বাইরের চাটুকার ও ভাড়াটে সৈন্যদের প্রশ্রয় দেয়।
- ৪. পতন ও ধ্বংস: বিলাসিতা ও দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ে, প্রজারা বিদ্রোহী হয়। রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন মরুভূমি থেকে আবার কোনো নতুন শক্তিশালী গোষ্ঠী (যাদের আসাবিয়া প্রবল) এসে এই জরাজীর্ণ রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। তারপর তারা আবার নতুন রাজবংশ শুরু করে এবং চক্রটি পুনরায় চলতে থাকে।
ইবনে খালদুন বলেছিলেন, সাধারণত একটি রাজবংশ বা সাম্রাজ্য তিন থেকে চার প্রজন্মের বেশি টিকতে পারে না (প্রায় ১২০ বছর)। প্রথম প্রজন্ম হলো নির্মাতা, যারা কষ্ট করে ক্ষমতা অর্জন করে। দ্বিতীয় প্রজন্ম সেই ক্ষমতা ধরে রাখে কিন্তু কিছুটা আয়েশি হয়। তৃতীয় প্রজন্ম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ভুলে যায় এবং বিলাসিতায় মগ্ন হয়। আর চতুর্থ প্রজন্ম সবকিছু ধ্বংস করে। তার এই তত্ত্ব অটোমান সাম্রাজ্য বা পরবর্তী অনেক সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়েছে (Gellner, 1981)।
অর্থনীতি ও রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক
ইবনে খালদুনকে নিঃসন্দেহে অর্থনীতির অন্যতম আদি পিতা বলা যায়। অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith)-এর ওয়েলথ অফ নেশন্স লেখার চারশো বছর আগে তিনি শ্রম, মূল্য এবং কর ব্যবস্থা নিয়ে আধুনিক সব তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কোনো দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয় তাতে ব্যবহৃত শ্রমের পরিমাণ এবং বাজারে তার চাহিদার ওপর। এটি কার্ল মার্কসের শ্রমের মূল্য তত্ত্ব (Labor Theory of Value)-এর এক আদি সংস্করণ। তিনি শ্রম বিভাজন (Division of Labor)-এর গুরুত্ব বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একা মানুষ তার সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না, তাই সমাজে বিভিন্ন পেশার মানুষের সহযোগিতা দরকার। এই সহযোগিতা যত বাড়বে, সভ্যতা তত উন্নত হবে।
তার সবচেয়ে চমকপ্রদ অর্থনৈতিক তত্ত্বটি হলো কর বা ট্যাক্সেশন নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, “রাজবংশের শুরুতে করের হার থাকে কম, কিন্তু রাজস্ব আদায় হয় বেশি। আর রাজবংশের শেষের দিকে করের হার থাকে অনেক বেশি, কিন্তু রাজস্ব আদায় হয় কম।” শুনতে স্ববিরোধী মনে হলেও এটি অর্থনীতির এক ধ্রুব সত্য। কারণ, শুরুতে কর কম থাকলে মানুষ কাজ করতে উৎসাহ পায়, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ে, ফলে মোট অর্থনীতির আকার বড় হয় এবং সরকারের আয় বাড়ে। কিন্তু শাসকরা যখন বিলাসিতার জন্য টাকার লোভে করের হার বাড়িয়ে দেয়, তখন মানুষ কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা ভাবে, লাভের সবটুকুই তো রাজা নিয়ে যাবে, তাহলে খেটে লাভ কী? ফলে উৎপাদন কমে যায়, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের মোট রাজস্ব কমে যায়। আধুনিক অর্থনীতিতে এই ধারণাটি লাফার কার্ভ (Laffer Curve) নামে পরিচিত, যা আশির দশকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তার অর্থনীতিতে প্রয়োগ করেছিলেন। অথচ ইবনে খালদুন এটি চতুর্দশ শতাব্দীতেই লিখে গিয়েছিলেন (Boulakia, 1971)।
তিনি আরও বলেছিলেন যে, সরকার বা রাষ্ট্র যদি নিজেই ব্যবসা শুরু করে বা বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে, তবে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। সরকার যখন বাজারের প্রতিযোগিতায় নামে, সাধারণ ব্যবসায়ীরা তাদের সাথে পেরে ওঠে না। ফলে বাজার ধ্বংস হয়ে যায় এবং করের উৎস শুকিয়ে যায়। তিনি মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন (Inflation) নিয়েও সতর্ক করেছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় খাবারের দাম কেন বাড়ে, তা তিনি জোগান ও চাহিদাও বা সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ড (Supply and Demand)-এর নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
পরিবেশবাদ ও মানুষের মনস্তত্ত্ব
ইবনে খালদুন কেবল সমাজ বা অর্থনীতি নয়, ভূগোল ও পরিবেশের সাথে মানুষের আচরণের সম্পর্ক নিয়েও গবেষণা করেছেন। একে বলা হয় পরিবেশগত নির্ধারণবাদ (Environmental Determinism)। তিনি পৃথিবীকে সাতটি জলবায়ু অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, উত্তরদিকের খুব ঠান্ডা বা দক্ষিণদিকের খুব গরম অঞ্চলের মানুষের চেয়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের (যেমন ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা) মানুষ সভ্যতায় বেশি এগিয়ে। তিনি বলেছিলেন, জলবায়ু মানুষের চরিত্র, গায়ের রঙ এবং মেজাজকে প্রভাবিত করে। গরম দেশের মানুষ সাধারণত চঞ্চল এবং আনন্দপ্রিয় হয়, অন্যদিকে ঠান্ডা দেশের মানুষ গম্ভীর এবং দূরদর্শী হয়। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানে তার সব সিদ্ধান্ত সঠিক নয়, কিন্তু তিনি যে মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের পেছনে কোনো অলৌকিক কারণের বদলে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণ খুঁজেছিলেন, তা ছিল বিপ্লবাত্মক। তিনি মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষ স্বভাবত হিংস্র নয়, আবার শান্তও নয়; মানুষ তার পরিবেশের দাস। শাসকের আচরণের ওপর প্রজাদের চরিত্র নির্ভর করে। যদি শাসক অত্যাচারী হয়, প্রজারা মিথ্যাবাদী ও চাটুকার হয়ে ওঠে বাঁচার তাগিদে। আর শাসক ন্যায়পরায়ণ হলে প্রজারা সাহসী ও সৎ হয়।
এক নিঃসঙ্গ প্রতিভা
ইবনে খালদুন ছিলেন তার সময়ের এক নিঃসঙ্গ প্রতিভা। তার সমসাময়িকরা তার এই ‘নতুন বিজ্ঞান’ বা সমাজতত্ত্বের গভীরতা পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। তিনি এমন এক সময়ে জন্মেছিলেন যখন মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ (Black Death)-এর মহামারী চলছিল। প্লেগে তিনি তার বাবা-মা এবং অনেক শিক্ষককে হারিয়েছিলেন। এই ট্র্যাজেডি তার মনে এক ধরনের বিষাদ এবং নিরাসক্তি তৈরি করেছিল, যা তার লেখায় ফুটে উঠেছে। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে চোখের সামনে শক্তিশালী সব সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। এই বাস্তবতা তাকে ইতিহাসকে রোমান্টিক চোখে না দেখে নির্মম বাস্তববাদী চোখে দেখতে শিখিয়েছিল। তিনি অনেকটা ইতালীয় দার্শনিক নিকোলো মাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli)-র মতো ক্ষমতার রাজনীতিকে নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তবে মাকিয়াভেলি যেখানে কেবল শাসকের টিকে থাকার কৌশল বলেছিলেন, ইবনে খালদুন বলেছিলেন পুরো সমাজের টিকে থাকার বিজ্ঞান।
পাশ্চাত্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন সমাজবিজ্ঞান একটি আলাদা বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন ফরাসি ও জার্মান পণ্ডিতরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন যে, তারা যা নতুন বলে ভাবছেন, তা একজন আরব পণ্ডিত বহু আগেই লিখে গেছেন। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম (Émile Durkheim)-এর ‘সামাজিক সংহতি’ তত্ত্বের সাথে ইবনে খালদুনের ‘আসাবিয়া’র অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পিটার (Joseph Schumpeter) বা ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) তাকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন (Irwin, 2018)। ইবনে খালদুন প্রমাণ করেছেন যে, ইতিহাস কেবল মৃত মানুষের গল্প নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্কবার্তা। তার মুকাদ্দিমা আজও আমাদের শেখায় যে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় এবং ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো সভ্যতা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না।
প্রকৌশল ও যন্ত্রকৌশল: আল-জাজারি ও রোবটের পূর্বপুরুষরা
আধুনিক যুগে আমরা রোবট, অটোমেশন আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খুব মাতামাতি করি। কিন্তু আপনি কি জানেন, আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগে, যখন ইউরোপে চাকা ঘোরানোর প্রযুক্তিও খুব একটা উন্নত ছিল না, তখন একজন মুসলিম প্রকৌশলী এমন সব যন্ত্র বানিয়েছিলেন যা আজকের আধুনিক রোবোটিক্সের পূর্বসূরি? তার নাম বাদি আল-জামান আবুল-ইজ ইবনে আল-রাজ্জাজ আল-জাজারি (Al-Jazari)। দ্বাদশ শতাব্দীর এই মেকানিক্যাল জিনিয়াস বা যান্ত্রিক প্রতিভাকে নিঃসন্দেহে রোবোটিক্স ও অটোমেশনের আদি পিতা বলা যায়। তিনি ছিলেন বর্তমান তুরস্কের দিয়ারবাকির অঞ্চলের আর্তুকিদ রাজবংশের প্রধান প্রকৌশলী। তার কাজ কেবল চাকা ঘোরানো বা জল তোলা ছিল না; তিনি যন্ত্রের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এমন মেশিন বানাতে যা মানুষের কাজ করে দেবে, মানুষকে বিনোদন দেবে এবং সময়কে নিখুঁতভাবে মাপবে। তার এই স্বপ্ন এবং উদ্ভাবনগুলো লিপিবদ্ধ আছে তার অমর গ্রন্থ আল-জামিউ বাইন আল-ইলম ওয়াল-আমাল আল-নাফি ফি সিনাত আল-হিয়াল (The Book of Knowledge of Ingenious Mechanical Devices)-এ। ১২০৬ সালে লেখা এই বইটিতে তিনি ৫০টিরও বেশি জটিল যন্ত্রের নকশা, নির্মাণের পদ্ধতি এবং সেগুলোর কার্যপ্রণালী সচিত্র বর্ণনা করেছেন। এই বইটি প্রকৌশলবিদ্যার ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল, যা প্রমাণ করে যে মধ্যযুগের প্রযুক্তি আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি উন্নত ছিল।
এলিফ্যান্ট ক্লক: বিশ্বজনীনতার প্রতীক
আল-জাজারির সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো এলিফ্যান্ট ক্লক (Elephant Clock) বা হাতি-ঘড়ি। এটি কোনো সাধারণ ঘড়ি ছিল না, এটি ছিল শিল্প, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির এক অনন্য সংমিশ্রণ। প্রায় ২২ ফুট উঁচু এই বিশাল ঘড়িটি কাজ করত পানিপ্রবাহ বা হাইড্রলিক্স (Hydraulics) প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ঘড়িটির গঠন ছিল অদ্ভুত সুন্দর – একটি বিশাল হাতির পিঠে একটি হাওদা, তার ওপর একটি দুর্গ, দুর্গের ওপর একটি গম্বুজ, আর গম্বুজের ওপর একটি ফিনিক্স পাখি। প্রতি আধ ঘণ্টা পরপর ভেতরের মেকানিজম সক্রিয় হতো। ফিনিক্স পাখিটি ঘুরত এবং শিস দিত, একটি ড্রাগন হাতির পিঠ থেকে নিচে নেমে আসত, এবং একজন আরব বেদুঈন মূর্তি হাত তুলে সময় নির্দেশ করত।
কিন্তু এই ঘড়ির সবচেয়ে বড় তাৎপর্য এর মেকানিজম বা প্রযুক্তিতে নয়, এর প্রতীকে। আল-জাজারি এই ঘড়ির মাধ্যমে বিশ্বকে এক সুতোয় গাঁথতে চেয়েছিলেন। হাতিটি ছিল ভারতের প্রতীক, ড্রাগনটি চীনের প্রতীক, ফিনিক্স পাখিটি প্রাচীন মিশরের প্রতীক, পানি দিয়ে চলার প্রযুক্তিটি গ্রিক বিজ্ঞানের প্রতীক, আর বেদুঈন মূর্তিটি আরব সংস্কৃতির প্রতীক। তিনি বুঝিয়েছিলেন, বিজ্ঞান বা প্রকৌশল কোনো এক জাতির সম্পত্তি নয়; এটি সমস্ত মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞানের ফসল। এই ঘড়ির ভেতরে তিনি একটি ভাসমান বাটি বা ফ্লোটিং বোল ব্যবহার করেছিলেন, যার তলায় একটি ছোট ছিদ্র ছিল। এটি আর্কিমিডিসের নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হলেও আল-জাজারি একে আরও নিখুঁত করেছিলেন, যাতে জলের প্রবাহের তারতম্য ঘড়ির সময়কে প্রভাবিত না করে।
অটোমেশন ও রোবোটিক্স: সেবকের বিকল্প
আল-জাজারি কেবল সময় দেখার জন্য নয়, মানুষের দৈনন্দিন আরাম-আয়েশের জন্যও যন্ত্র বানিয়েছিলেন। তিনি এমন সব যন্ত্র বা অটোমেটা (Automata) তৈরি করেছিলেন যা আজকের দিনের হিউম্যানয়ড রোবটের প্রাথমিক সংস্করণ। তিনি একটি ‘ওযু করার মেশিন’ বানিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি মূর্তির মতো দেখতে, যা হাতে জলের জগ ধরে থাকত। যখন কেউ ওযু করতে আসত, যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জল ঢেলে দিত। জল শেষ হলে অন্য একটি হাত তোয়ালে এবং আয়না এগিয়ে দিত। ভাবা যায়? দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন্সর বা ইলেকট্রিসিটি ছাড়াই তিনি এই অটোমেশন করেছিলেন কেবল জল আর গিয়ারের কারিকুরি দিয়ে। তিনি ‘পানীয় পরিবেশনকারী রোবট’ বানিয়েছিলেন, যা রাজদরবারে অতিথিদের গ্লাসে শরবত ঢেলে দিত। গ্লাস পূর্ণ হলে রোবটটি থামত এবং আবার খালি গ্লাস পেলে কাজ শুরু করত।
তার আরেকটি অসাধারণ কাজ ছিল মিউজিক্যাল রোবট ব্যান্ড। এটি ছিল একটি ছোট নৌকার ওপর বসানো চারটি কৃত্রিম মিউজিশিয়ান বা বাদক। জলশক্তি ব্যবহার করে এই বাদকরা ড্রাম, বাঁশি এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজাত। তিনি এর মধ্যে প্রোগ্রামেবল (Programmable) মেকানিজম ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ, ছোট ছোট পিন বা লিভার পরিবর্তন করে তিনি বাদ্যযন্ত্রের ছন্দ বা রিদম পরিবর্তন করতে পারতেন। এটিকেই বলা যায় ইতিহাসের প্রথম প্রোগ্রামেবল ড্রাম মেশিন (Rosheim, 1994)।
ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট ও পাম্প: আধুনিক ইঞ্জিনের পূর্বপুরুষ
খেলনা আর ঘড়ির বাইরে আল-জাজারির সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ারিং অবদান হলো জল তোলার যন্ত্র বা পাম্প। তিনি প্রথমবারের মতো সাকশন পাম্প (Suction Pump) এবং ডাবল-অ্যাকশন পাম্প তৈরি করেছিলেন, যা ভালভ এবং পিস্টন ব্যবহার করে মাটির নিচ থেকে জল তুলতে পারত। কিন্তু তার সবচেয়ে যুগান্তকারী উদ্ভাবন ছিল ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট (Crankshaft) এবং কানেক্টিং রড (Connecting Rod)-এর ব্যবহার। ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট হলো এমন একটি মেকানিজম যা রৈখিক গতি বা লিনিয়ার মোশন (Linear Motion)-কে ঘূর্ণন গতি বা রোটারি মোশন (Rotary Motion)-এ রূপান্তর করে। আবার উল্টোটাও করা যায়। আজকের পৃথিবীর সব গাড়ি, বাস, ট্রাক, জেনারেটর – সবকিছুর ইঞ্জিনে এই ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট অপরিহার্য। আল-জাজারি তার জল তোলার মেশিনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি চাকার ঘূর্ণন গতিকে পিস্টনের ওঠানামার গতিতে রূপান্তর করে পানি পাম্প করেছিলেন। আধুনিক প্রকৌশলবিদ্যার ভিত্তিপ্রস্তর তিনি তখনই স্থাপন করে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ ডোনাল্ড হিল (Donald Hill), যিনি আল-জাজারির বই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, তিনি স্বীকার করেছেন যে বাষ্পীয় ইঞ্জিন বা স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পেছনে আল-জাজারির এই ক্র্যাঙ্ক-কানেক্টিং রড সিস্টেমের পরোক্ষ অবদান রয়েছে (Hill, 1974)।
বানু মুসা ভাইয়েরা: জাদুর কারিগর
আল-জাজারিরও প্রায় ৩০০ বছর আগে, নবম শতাব্দীতে বাগদাদে প্রকৌশলবিদ্যার আরেক বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা করেছিলেন তিন ভাই – মুহাম্মদ, আহমদ এবং আল-হাসান। তাদের একত্রে বলা হয় বানু মুসা ব্রাদার্স (Banu Musa Brothers)। তারা বায়তুল হিকমাহ-র সদস্য ছিলেন এবং খলিফা আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তারা একটি বই লিখেছিলেন যার নাম কিতাব আল-হিয়াল (Book of Ingenious Devices)। এই বইটিতে প্রায় ১০০টি যন্ত্রের বর্ণনা আছে। তাদের বিশেষত্ব ছিল ফ্লুইড মেকানিক্স (Fluid Mechanics) বা তরল বলবিদ্যা। তারা বাতাসের চাপ এবং ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানের নীতি ব্যবহার করে জাদুকরী সব পাত্র বানিয়েছিলেন। যেমন – ‘জাদুকরী জগ’। এই জগে জল ঢাললে তা আর বের হতো না, যতক্ষণ না একটি নির্দিষ্ট ছিদ্র বন্ধ করা হতো। অথবা এমন একটি পাত্র যা থেকে প্রথমে জল, তারপর ওয়াইন এবং শেষে দুটোর মিশ্রণ বের হতো। এগুলো তারা ব্যবহার করতেন মানুষকে অবাক করার জন্য এবং রাজদরবারে বিনোদনের জন্য।
তবে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল অটোমেটিক ফিডব্যাক কন্ট্রোল (Automatic Feedback Control)-এর প্রাথমিক ধারণা। তারা এমন সব ল্যাম্প বা প্রদীপ বানিয়েছিলেন যা তেল ফুরিয়ে গেলে নিজে থেকেই তেলের জোগান দিত এবং বাতাসের তোড়ে শিখা নিভে গেলে আবার জ্বলে উঠত। তারা কৃষিকাজের জন্য স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থা এবং ফোয়ারা তৈরির প্রযুক্তিতেও বিশাল অবদান রেখেছিলেন। তাদের তৈরি ‘হাইড্রলিক অর্গান’ বা জল চালিত বাদ্যযন্ত্র ইউরোপে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তারা গ্যাস মাস্কের মতো একটি যন্ত্রও ডিজাইন করেছিলেন যা বিষাক্ত বাতাসে কাজ করার সময় শ্রমিকদের শ্বাস নিতে সাহায্য করত (Bir, 1990)।
আন্দালুসিয়ার আব্বাস ইবনে ফিরনাস: প্রথম বৈমানিক
প্রকৌশলবিদ্যার আলোচনায় স্পেনের কর্ডোবার বিজ্ঞানী আব্বাস ইবনে ফিরনাস (Abbas ibn Firnas)-এর নাম না নিলে অন্যায় হবে। নবম শতাব্দীর এই পলিমেথ স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষের ওড়ার। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ওড়ার নকশা আঁকার প্রায় ৬০০ বছর আগে, ইবনে ফিরনাস বাস্তবে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রথমে একটি টাওয়ার থেকে কাঠের তৈরি ফ্রেম এবং সিল্কের কাপড় দিয়ে বানানো ডানায় ভর করে লাফ দিয়েছিলেন। এটি ছিল অনেকটা আধুনিক হ্যান্ড গ্লাইডার (Hang Glider)-এর মতো। তিনি বেশ কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে ছিলেন এবং কিছুটা নিয়ন্ত্রণও করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নামার সময় বা ল্যান্ডিং করার সময় তিনি পিঠে আঘাত পান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাখির মতো ওড়ার জন্য কেবল ডানা থাকলেই হবে না, ল্যান্ডিং করার জন্য পাখির মতো লেজও দরকার, যা তিনি বানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। তার এই সাহসিকতা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিমান প্রকৌশলবিদ্যার ইতিহাসে এক মাইলফলক। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চাঁদের একটি গহ্বরের নাম তার সম্মানে রাখা হয়েছে। তিনি পাথর থেকে কাঁচ তৈরি করার প্রযুক্তি (সিলিকা ব্যবহার করে) এবং ‘রিডিং স্টোন’ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাসও আবিষ্কার করেছিলেন, যা চশমার পূর্বসূরি ছিল (Lynn, 2011)।
প্রযুক্তি যখন শিল্পের সাথে মেশে
মুসলিম স্বর্ণযুগের প্রকৌশলীরা কেবল কাজের জন্য যন্ত্র বানাতেন না, তারা যন্ত্রকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আল-জাজারির বইয়ের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে তারা যন্ত্রের নকশাতেও সৌন্দর্য খুঁজতেন। তাদের তৈরি পানির ফোয়ারাগুলো ছিল জ্যামিতিক নকশায় অনন্য। স্পেনের আলহামব্রা প্রাসাদের ‘কোর্ট অফ লায়ন্স’ (Court of Lions)-এর ফোয়ারাটি একটি হাইড্রলিক বিস্ময়। এখানে ১২টি সিংহের মুখ দিয়ে পানি বের হয় এবং তা একটি নির্দিষ্ট ছন্দে ও সময়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। গ্র্যাভিটি বা অভিকর্ষ বল ব্যবহার করে জল সরবরাহের যে জটিল নেটওয়ার্ক বা কানাত (Qanat) তারা তৈরি করেছিল, তা মরুভূমির বুকে শহর গড়ে তোলা সম্ভব করেছিল। ইরানের প্রাচীন এই কানাত সিস্টেম আজও কার্যকরী এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত।
এই প্রকৌশলীরা প্রমাণ করেছিলেন যে, মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির কোনো সীমা নেই। তারা বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে উইন্ডমিল বা বায়ুকল চালিয়েছিল শস্য পেষার জন্য, পানির শক্তি ব্যবহার করে কাগজ তৈরির কল চালিয়েছিল। তারা এমন সব গিয়ার, লিভার, পিস্টন এবং ভালভ তৈরি করেছিল যা আধুনিক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বর্ণমালা। ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে জাদুকরী শক্তি খুঁজছিল, তখন বাগদাদ, দামেস্ক আর কর্ডোবার প্রকৌশলীরা প্রকৃতির শক্তিকে বাগে এনে মানুষের সেবায় লাগাচ্ছিল। আল-জাজারি বা বানু মুসা ভাইদের সেই খেলনা রোবটগুলোই আজকের মঙ্গলে পাঠানো রোভার বা কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইনের রোবটের ডিএনএ বহন করছে।
ভূগোল ও মানচিত্র: বিশ্বকে চেনা ও জানার অভিযাত্রা
মানুষের স্বভাবই হলো অজানাকে জানা। দিগন্তের ওপারে কী আছে – এই কৌতূহল থেকেই মানুষ ঘর ছেড়েছে, পাড়ি দিয়েছে উত্তাল সমুদ্র আর দুর্গম পাহাড়। কিন্তু সেই যাত্রাপথকে মনে রাখা এবং অন্যদের জন্য সহজ করে যাওয়ার তাগিদ থেকেই জন্ম নিয়েছে ভূগোল বা জিওগ্রাফি (Geography) এবং মানচিত্রাঙ্কন বা কার্টোগ্রাফি (Cartography)। ইসলামি স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা এই শাখায় যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, তা ছিল অভূতপূর্ব। তাদের কাছে ভূগোল কেবল পাহাড়-নদীর বর্ণনা ছিল না; এটি ছিল মহাবিশ্বের বুকে মানুষের অবস্থান নির্ণয়ের বিজ্ঞান। যেহেতু ইসলামি ধর্মে প্রতিদিন মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে হয় এবং হজ্জের জন্য মক্কায় যেতে হয়, তাই সঠিক দিক ও পথ জানাটা ছিল অপরিহার্য। এই ধর্মীয় প্রয়োজন আর বাণিজ্যের প্রসার – এই দুইয়ে মিলে মুসলিম বিশ্বকে ভূগোলের ক্ষেত্রে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত করেছিল। তারা গ্রিকদের জ্ঞানকে শুধু অনুবাদই করেনি, তাকে সংশোধন করেছে এবং নতুন নতুন অঞ্চল আবিষ্কার করে পৃথিবীর মানচিত্রকে নতুন করে এঁকেছে। বাগদাদ থেকে কর্ডোবা, সিসিলি থেকে সামারখন্দ – তাদের পদচারণায় মুখর ছিল সেই সময়ের পৃথিবী।
আল-ইদ্রিসি ও তাবুলা রোজারিয়ানা
দ্বাদশ শতাব্দীর কথা। সিসিলি দ্বীপ তখন শাসন করছেন নরম্যান রাজা দ্বিতীয় রজার। তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। তিনি চাইলেন পৃথিবীর একটি নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করতে। কিন্তু তার নিজের রাজত্বে এমন কাউকে পেলেন না। তিনি খবর পাঠালেন মরক্কোর ফেজ নগরীতে, যেখানে বাস করতেন এক বিখ্যাত ভূগোলবিদ – মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি (Al-Idrisi)। রাজা তাকে সিসিলিতে আমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেন, “আমি চাই আপনি আমার জন্য পৃথিবীর এমন একটি মানচিত্র তৈরি করুন যা আগে কেউ দেখেনি।” আল-ইদ্রিসি রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত দিলেন যে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও অঢেল বাজেট দিতে হবে। রাজা রাজি হলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আল-ইদ্রিসি এবং তার দল কাজ করলেন। তারা নাবিকদের সাক্ষাৎকার নিলেন, পর্যটকদের ডায়েরি পড়লেন এবং গণিতের জটিল হিসাব কষলেন।
অবশেষে ১১৫৪ সালে তিনি রাজাকে উপহার দিলেন একটি বিশাল রৌপ্য গোলক বা সিলভার গ্লোব এবং একটি বই, যার নাম নুজহাত আল-মুশতাক ফি ইখতিরাক আল-আফাক (The Excursion of One Who is Eager to Traverse the Regions of the World)। তবে ল্যাটিন বিশ্বে এটি তাবুলা রোজারিয়ানা (Tabula Rogeriana) বা বুক অফ রজার নামেই বেশি পরিচিত। এই মানচিত্রটি ছিল সেই সময়ের এক বিস্ময়। এতে ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার এত নিখুঁত বর্ণনা ছিল যে, পরবর্তী তিনশো বছর ধরে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানচিত্র। মজার ব্যাপার হলো, আল-ইদ্রিসি তার ম্যাপে দক্ষিণ দিককে ওপরে এবং উত্তর দিককে নিচে রেখেছিলেন, যা ছিল তৎকালীন মুসলিম মানচিত্রকরদের প্রথা। তার ম্যাপে নীল নদের উৎস হিসেবে আফ্রিকার গভীর হ্রদগুলোর কথা বলা ছিল, যা ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। কলম্বাস বা ভাস্কো দা গামারাও তাদের সমুদ্রযাত্রায় আল-ইদ্রিসির মানচিত্র বা তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ম্যাপ ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয় (Harley & Woodward, 1992)।
আল-বিরুনি: প্রথম নৃবিজ্ঞানী ও ভারততত্ত্ববিদ
একাদশ শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মাহমুদের সাথে ভারতে এসেছিলেন এক জ্ঞানতাপস। তার নাম আবু রায়হান আল-বিরুনি (Al-Biruni)। তিনি কোনো সাধারণ পর্যটক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পলিম্যাথ – গণিত, জ্যোতির্বিদ্যার পাশাপাশি তিনি মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়েও সমান আগ্রহী ছিলেন। তিনি ভারতে এসে তলোয়ার ধরেননি, ধরেছিলেন কলম। তিনি সংস্কৃত ভাষা শিখলেন, ভারতীয় পণ্ডিতদের সাথে বন্ধুত্ব করলেন এবং তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো মূল ভাষায় পড়লেন। দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি লিখলেন তার মাস্টারপিস তাহকিক মা লি-ল-হিন্দ বা কিতাব আল-হিন্দ (The Book of India)।
এই বইটিকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম নৃবিজ্ঞান (Anthropology) বা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব (Comparative Religion)-এর বই। আল-বিরুনি ভারতীয় সমাজ, বর্ণপ্রথা, ধর্মবিশ্বাস, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং উৎসবগুলো এমন নিরপেক্ষভাবে বর্ণনা করেছিলেন, যা একজন বিদেশীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তিনি কোনো কুসংস্কার বা ঘৃণার চশমা দিয়ে ভারতকে দেখেননি। তিনি বলেছিলেন, “অন্য কোনো জাতিকে বুঝতে হলে তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে এবং তাদের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে হবে।” তিনি ভারতীয়দের মূর্তিপূজার দার্শনিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং একে একেশ্বরবাদের সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি ভারতীয় গণিত ও গ্রিক গণিতের মধ্যে তুলনা করেছিলেন। তাকে বলা হয় ‘ইন্ডোলজি’ বা ভারততত্ত্বের জনক। তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে, তিনি তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আমি এখানে যা সত্য বলে পেয়েছি তাই লিখব, কারো খুশি বা অখুশির জন্য সত্যকে বিকৃত করব না” (Sachau, 1910)।
পর্যটকদের রাজপুত্র: ইবনে বতুতা
ভূগোলের কথা বললে যার নাম সবার আগে মনে আসে, তিনি হলেন মরক্কোর তানজিয়ারের পর্যটক ইবনে বতুতা (Ibn Battuta)। চতুর্দশ শতাব্দীতে তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তিনি উত্তর আফ্রিকা, মিশর, আরব উপদ্বীপ, পারস্য, ভারত, চীন, সুমাত্রা, এমনকি মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাও ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি মোট ৭৫,০০০ মাইল বা ১,২০,০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন, যা মার্কো পোলোর ভ্রমণের প্রায় তিনগুণ। তার ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ আছে রিহলা (Rihla) বা দ্য জার্নি নামের বইটিতে।
ইবনে বতুতার বিবরণ কেবল পথের বর্ণনা নয়, এটি মধ্যযুগীয় বিশ্বের এক জীবন্ত ছবি। তিনি প্রতিটি দেশের সুলতান, সুফি সাধক, সাধারণ মানুষ, খাবার, পোশাক এবং বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি ভারতের সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে কাজি বা বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন, মালদ্বীপে বিয়ে করেছেন, আবার চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার লেখায় আমরা তৎকালীন বাংলা বা ‘বাঙ্গালা’র কথাও পাই। তিনি সোনারগাঁ ও সিলেটে এসেছিলেন এবং হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সাথে দেখা করেছিলেন। তিনি বাংলার প্রাচুর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং একে বলেছিলেন “দোযখপুর আস্ত নিয়ামত” বা ‘অফুরন্ত নিয়ামতে ভরা নরক’ (কারণ আবহাওয়া তার কাছে অসহ্য মনে হয়েছিল)। তার বই ভূগোলবিদদের জন্য তথ্যের এক বিশাল খনি (Dunn, 2005)।
নাবিকদের কম্পাস ও সমুদ্রবিজ্ঞান
আরব নাবিকরা সমুদ্রের বুকে পথ চলায় ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্যের এক বিশাল জাল তৈরি করেছিল। এই নাবিকদের সাহায্য করার জন্য তারা উন্নত করেছিল কম্পাস বা কুতুবনুমা (Qutb-numa)। চীনারা চুম্বকের ব্যবহার জানত, কিন্তু কম্পাসকে দিক নির্ণয়ের যন্ত্র হিসেবে নিখুঁত করেছিল আরবরা। তারা নক্ষত্রের অবস্থান দেখে অক্ষাংশ বা ল্যাটিটিউড (Latitude) মাপার জন্য ‘কামাল’ (Kamal) নামের একটি কাঠের যন্ত্র ব্যবহার করত।
পঞ্চদশ শতাব্দীর বিখ্যাত নাবিক আহমদ ইবনে মাজিদ (Ahmad ibn Majid) ছিলেন সমুদ্রের রাজা। তাকে বলা হয় ‘লায়ন অফ দ্য সি’ বা সমুদ্রের সিংহ। তিনি লোহিত সাগর এবং ভারত মহাসাগরের প্রতিটি ঢেউ চিনতেন। তিনি নাবিকদের জন্য একটি নির্দেশিকা বা এনসাইক্লোপিডিয়া লিখেছিলেন যার নাম কিতাব আল-ফাওয়াইদ (Book of Benefits)। শোনা যায়, ভাস্কো দা গামা যখন ভারতের পথ খুঁজছিলেন, তখন ইবনে মাজিদই তাকে আফ্রিকা থেকে ভারতে আসার পথ দেখিয়েছিলেন। যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু তার লেখা বইগুলো যে পর্তুগিজ নাবিকদের সাহায্য করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। তারা মৌসুমী বায়ু বা মনসুন (Monsoon)-এর গতিপ্রকৃতি খুব ভালো বুঝত এবং সেই অনুযায়ী তাদের পালতোলা জাহাজ বা ধো (Dhow) ভাসাত (Tibbetts, 1971)।
ইয়াকুত আল-হামাউয়ি ও ভৌগোলিক অভিধান
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইয়াকুত আল-হামাউয়ি (Yaqut al-Hamawi) নামের এক প্রাক্তন দাস, যিনি পরে এক বিশাল পণ্ডিতে পরিণত হন, তিনি লিখেছিলেন ভূগোলের এক মহাকাব্যিক গ্রন্থ মুজাম আল-বুলদান (Dictionary of Countries)। এটি কেবল মানচিত্রের বই ছিল না, এটি ছিল একটি ভৌগোলিক অভিধান বা গেজেটিয়ার। তিনি বর্ণানুক্রমিকভাবে বিশ্বের প্রতিটি শহর, গ্রাম, পাহাড় ও নদীর নাম সাজিয়েছিলেন এবং তাদের ইতিহাস, অর্থনীতি ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের তথ্য যোগ করেছিলেন। মঙ্গোল আক্রমণের ঠিক আগে তিনি এই কাজটি শেষ করেছিলেন, ফলে এটি প্রাক-মঙ্গোল ইসলামি বিশ্বের এক অমূল্য রেকর্ড হিসেবে টিকে আছে। তিনি তার বইয়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য লাইব্রেরি থেকে লাইব্রেরিতে ঘুরেছেন এবং প্রচুর ভ্রমণ করেছেন।
জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোলের মিলন
মুসলিম ভূগোলবিদরা ভূগোলকে গণিতের সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলেন, যাকে বলা হয় ম্যাথমেটিক্যাল জিওগ্রাফি (Mathematical Geography)। তারা পৃথিবীর পরিধি, বিভিন্ন শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ বা লঙ্গিটিউড (Longitude) নির্ণয় করেছিলেন। আল-বিরুনি গজনী এবং বাগদাদের দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য বের করেছিলেন। খলিফা আল-মামুন একদল ভূগোলবিদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পৃথিবীর মানচিত্র বা আল-সুরাহ আল-মামুনিয়া তৈরি করতে, যা টলেমির মানচিত্রের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ছিল। তারা কিবলা বা মক্কার দিক নির্ণয়ের জন্য গোলকীয় ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে খুব জটিল সব সমস্যার সমাধান করেছিলেন। এর ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে কাবার সঠিক দিক বের করা সম্ভব হয়েছিল।
এই ভূগোলবিদরা পৃথিবীকে এক নতুন চোখে দেখেছিলেন। তারা জানতেন পৃথিবী গোল, এবং তারা এটাও জানতেন যে এর বিশাল অংশ জুড়ে আছে সমুদ্র। তাদের আঁকা মানচিত্র এবং লেখা বইগুলো ইউরোপীয়দের চোখ খুলে দিয়েছিল। তারা দেখিয়েছিল যে ইউরোপের বাইরেও এক বিশাল, সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় পৃথিবী আছে। এই জ্ঞানই পরে ইউরোপকে ‘আবিষ্কারের যুগ’ বা এজ অফ ডিসকভারি (Age of Discovery)-তে নিয়ে যায়। কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন বা ম্যাগেলান যখন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন, তাদের পকেটে হয়তো কোনো আরব মানচিত্র ছিল না, কিন্তু তাদের মস্তিষ্কে ছিল সেই সাহস ও কৌতূহল, যা তারা পেয়েছিলেন ইবনে বতুতা বা আল-ইদ্রিসির মতো পূর্বসূরিদের কাছ থেকে।
স্বর্ণযুগের কারিগর: ক্ষমতার পালাবদল ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা
বিজ্ঞান বা দর্শন শূন্যে জন্মায় না। জ্ঞান হলো এক নাজুক চারাগাছের মতো; তার বেড়ে ওঠার জন্য দরকার উর্বর মাটি, আলো, বাতাস আর একজন যত্নবান মালী। ইসলামি স্বর্ণযুগের সেই মালীরা ছিলেন তৎকালীন শাসকরা – খলিফা, সুলতান, আমির এবং উজিররা। তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তিগত কৌতূহল এবং একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতাই তৈরি করেছিল সেই উর্বর মাটি, যেখানে জ্ঞানের চারাগাছ মহীরুহে পরিণত হয়েছিল। এই যুগ কোনো একক, অখণ্ড সাম্রাজ্যের অধীনে ঘটেনি। এটি ছিল ক্ষমতার পালাবদলের এক জটিল আখ্যান, যেখানে বাগদাদের আব্বাসীয়রা যখন আলো জ্বালিয়েছে, তখন স্পেনের উমাইয়ারাও এক নতুন সূর্যোদয় ঘটিয়েছে। আবার কায়রোর ফাতেমীয়রা কিংবা বুখারার সামানীয়রাও নিজেদের মতো করে সেই মশাল প্রজ্বলিত রেখেছে। এই অংশে আমরা সেই সব রাজনৈতিক শক্তির গল্প শুনব, যারা কেবল তলোয়ার দিয়ে ইতিহাস লেখেনি, বরং কলম আর কম্পাস দিয়েও নতুন এক পৃথিবীর নকশা এঁকেছিল।
আব্বাসীয় খিলাফত: স্বপ্নের শহর ও মস্তিষ্কের কারখানা
ইসলামি স্বর্ণযুগের কেন্দ্রবিন্দু যদি কিছু থাকে, তবে তা হলো আব্বাসীয় খিলাফত (Abbasid Caliphate, ৭৫০–১২৫৮ CE)। আব্বাসীয়রা যখন উমাইয়াদের হটিয়ে ক্ষমতায় এল, তখন তারা কেবল শাসকই বদলায়নি, বদলে দিয়েছিল সভ্যতার মহাকর্ষ কেন্দ্র। রাজধানী দামেস্ক থেকে সরিয়ে আনা হলো টাইগ্রিস নদীর তীরে নতুন এক স্বপ্নের শহর – বাগদাদে। এই শহর ছিল বিশ্বজনীনতা বা কসমোপলিটানিজম (Cosmopolitanism)-এর এক জীবন্ত প্রতীক। এখানে আরব, পারসিক, তুর্কি, ইহুদি, খ্রিস্টান – সবাই এক হয়ে এক নতুন সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। আব্বাসীয় খলিফারা, বিশেষ করে হারুন আল-রশিদ এবং তার পুত্র আল-মামুন, বুঝতে পেরেছিলেন যে সামরিক শক্তির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি অনেক বেশি টেকসই।
তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই বাগদাদে গড়ে উঠেছিল কিংবদন্তির বায়তুল হিকমাহ (Bayt al-Hikmah) বা হাউস অফ উইজডম। এটি কেবল একটি লাইব্রেরি ছিল না, এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণা কেন্দ্র। এখানেই শুরু হয়েছিল সেই বিখ্যাত অনুবাদ আন্দোলন (Translation Movement), যেখানে গ্রিক, পারসিক এবং ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারকে আরবি ভাষায় নিয়ে আসা হয়। খলিফারা বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান যেখানেই থাকুক, তা কুড়িয়ে নিতে হবে। তাদের এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আল-খওয়ারিজমি (Al-Khwarizmi) গণিতের ভাষা বদলে দিয়েছিলেন, ইবনে আল-হাইসাম (Ibn al-Haytham) আমাদের দেখার চোখ খুলে দিয়েছিলেন, আর আল-কিন্দি (Al-Kindi) ও আল-ফারাবি (Al-Farabi) গ্রিক দর্শনকে নতুন প্রাণ দিয়েছিলেন। আব্বাসীয় বাগদাদ ছিল স্বর্ণযুগের ইঞ্জিন রুম, যেখান থেকে উৎপাদিত জ্ঞান ও প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়েছিল বাকি বিশ্বে। এই সময়েই বিজ্ঞান ও দর্শন এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, যা আগে কখনো ঘটেনি। তবে আব্বাসীয়দের শেষের দিকে খলিফাদের ক্ষমতা কমে আসে এবং সাম্রাজ্য ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়, যা স্বর্ণযুগের বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখে (Kennedy, 2004)।
আন্দালুসের উমাইয়া খিলাফত: ইউরোপের বুকে এক টুকরো আলো
বাগদাদ যখন প্রাচ্যের সূর্য, তখন পশ্চিমে আরেক নতুন সূর্যোদয় ঘটছিল স্পেনে বা আল-আন্দালুসে। আব্বাসীয় বিপ্লবের সময় উমাইয়া বংশের একমাত্র জীবিত রাজকুমার আবদ আল-রহমান পালিয়ে স্পেনে চলে যান এবং সেখানে আন্দালুসের উমাইয়া খিলাফত (Umayyad Caliphate of Córdoba, ৭৫৬–১০৩১ CE) প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ডোবা শহরটি খুব দ্রুত বাগদাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। এটি হয়ে উঠল ইউরোপের বুকে এক টুকরো আলো, যখন বাকি মহাদেশ তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগে’ নিমজ্জিত।
কর্ডোবা, টলেডো এবং গ্রানাডার মতো শহরগুলো জ্ঞানচর্চার এক বিশাল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এখানকার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বহু-সাংস্কৃতিক সহাবস্থান বা কনভিভেনসিয়া (Convivencia)। এখানে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান পণ্ডিতরা একসাথে কাজ করতেন। কর্ডোবার লাইব্রেরিতে চার লক্ষের বেশি বই ছিল, যা তৎকালীন ইউরোপের যেকোনো লাইব্রেরির চেয়ে অনেক বেশি। এই মাটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন আধুনিক সার্জারির জনক আল-জাহরাউই (Al-Zahrawi) এবং অ্যারিস্টটলের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারক ইবনে রুশদ (Averroes)। ইহুদি দার্শনিক মুসা বিন মায়মুন (Maimonides) তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলো কর্ডোবা এবং কায়রোতেই করেছিলেন। আন্দালুসের স্থাপত্য – যেমন কর্ডোবার মসজিদ বা গ্রানাডার আলহামব্রা প্রাসাদ – ইসলামি শিল্পের এক চূড়ান্ত নিদর্শন। এই আন্দালুসই ছিল ইউরোপে রেনেসাঁর বীজ বপন করার প্রধান মাধ্যম। টলেডোর অনুবাদ স্কুলের মাধ্যমে এখানকার আরবি জ্ঞানভাণ্ডার ল্যাটিন ভাষায় চলে যায় এবং ইউরোপের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। একে বলা হয় পশ্চিমের ইসলামি স্বর্ণযুগ (Western Islamic Golden Age) (Menocal, 2002)।
ফাতেমীয় খিলাফত: কায়রোর প্রতিদ্বন্দ্বী মহিমা
আব্বাসীয়রা যখন বাগদাদে সুন্নি ইসলামের ঝাণ্ডা উড়াচ্ছে, তখন তাদের প্রধান রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উত্তর আফ্রিকায় উত্থান ঘটল ফাতেমীয় খিলাফতের (Fatimid Caliphate, ৯০৯–১১৭১ CE)। তারা ছিল শিয়া ইসমাইলি মতবাদের অনুসারী। ফাতেমীয়রা ৯৬৯ সালে মিশর দখল করে এবং ‘আল-কাহিরা’ বা কায়রো নামে এক নতুন রাজধানীর পত্তন করে। কায়রো খুব দ্রুত বাগদাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এক বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হলো। ফাতেমীয়রা জ্ঞানচর্চাকে তাদের রাজনৈতিক বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।
তাদের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ৯৭০ সালে আল-আজহার মসজিদ (যা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়) প্রতিষ্ঠা করা। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া তারা বাগদাদের বায়তুল হিকমাহর আদলে কায়রোতে ‘দার আল-ইলম’ বা জ্ঞানের ঘর প্রতিষ্ঠা করে। এখানেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছিলেন আলোকবিজ্ঞানের জনক ইবনে আল-হাইসাম। ফাতেমীয় শাসকরা বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং দর্শনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের সময়ে কায়রো হয়ে উঠেছিল ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র, যা তাদের অঢেল সম্পদ এনে দিয়েছিল। এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই জ্ঞানচর্চার পরিবেশকে উর্বর করেছিল।
সামানীয় সাম্রাজ্য: পারস্যের নবজাগরণ
স্বর্ণযুগ কেবল আরবদের ছিল না, এর অন্যতম প্রধান কারিগর ছিল পারসিকরা। মধ্য এশিয়ায় (খোরাসান ও মাওয়ারান্নাহর) সামানীয় সাম্রাজ্য (Samanid Empire, ৮১৯–৯৯৯ CE) ছিল পারস্য সংস্কৃতির এক নবজাগরণের কেন্দ্র। যদিও তারা নামে আব্বাসীয় খলিফাদের প্রতি অনুগত ছিল, কার্যত তারা ছিল স্বাধীন। সামানীয় আমিররা ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের বিশাল পৃষ্ঠপোষক। তাদের রাজধানী বুখারা এবং সমরখন্দকে বলা হতো ‘জ্ঞানের গম্বুজ’।
সামানীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান হলো ফার্সি ভাষাকে আরবি ভাষার পাশাপাশি সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত করা। তাদের দরবারেই মহাকবি ফেরদৌসি তার বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামা রচনা শুরু করেছিলেন। এই সময়েই ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে ছিল না। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ইবনে সিনা (Avicenna) এবং আল-বিরুনি (Al-Biruni) তাদের কর্মজীবনের প্রথম অংশ এই সামানীয়দের ছত্রছায়াতেই কাটিয়েছিলেন। বুখারার বিশাল লাইব্রেরি ইবনে সিনাকে অল্প বয়সেই তৎকালীন বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছিল। সামানীয়রা প্রমাণ করেছিল যে, স্বর্ণযুগ কোনো একক কেন্দ্র বা ভাষার ওপর নির্ভরশীল ছিল না, এটি ছিল বহু-কেন্দ্রিক এবং বহু-ভাষিক (Starr, 2013)।
বুয়াইহিদ রাজবংশ: পর্দার আড়ালের শক্তি
দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আব্বাসীয় খলিফাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তখন বাগদাদের ক্ষমতার লাগাম চলে যায় পারস্যের শিয়া বুয়াইহিদ রাজবংশের (Buyid Dynasty, ৯৩৪–১০৬২ CE) হাতে। বুয়াইহিদ আমিররা খলিফাকে কেবল ধর্মীয় নেতা হিসেবে রেখে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও জ্ঞানচর্চা থেমে থাকেনি। বুয়াইহিদ শাসকরা, বিশেষ করে আদুদ আল-দৌলা, ছিলেন বিজ্ঞান ও দর্শনের বড় পৃষ্ঠপোষক। তিনি বাগদাদে একটি বিশাল হাসপাতাল (আল-আদুদি হাসপাতাল) এবং একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার দরবারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং চিকিৎসকদের ভিড় লেগে থাকত। এই সময়েই বিখ্যাত চিকিৎসক আল-রাজি (Rhazes) এবং দার্শনিক ইবনে সিনা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছিলেন। বুয়াইহিদরা দেখিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় খিলাফতের পতন মানেই স্বর্ণযুগের পতন নয়; বরং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
সেলজুক সাম্রাজ্য: রক্ষণশীলতার ছায়ায় জ্ঞানচর্চা
একাদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া থেকে তুর্কি সেলজুক সাম্রাজ্য (Seljuk Empire, ১০৩৭–১১৯৪ CE) এসে বুয়াইহিদদের হটিয়ে দেয় এবং নিজেদেরকে সুন্নি ইসলামের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। সেলজুকদের যুগকে স্বর্ণযুগের শেষ বা রূপান্তর পর্ব হিসেবে দেখা হয়। তাদের বিখ্যাত উজির নিজাম আল-মুলক (Nizam al-Mulk) সাম্রাজ্যজুড়ে নিজামিয়া মাদ্রাসা (Nizamiyya Madrasa) নামে এক চেইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সুন্নি ধর্মতত্ত্বকে শক্তিশালী করা এবং শিয়া ফাতেমীয়দের মতাদর্শগতভাবে মোকাবেলা করা।
এই মাদ্রাসাগুলোতে মূলত ধর্মীয় আইন (ফিকহ) এবং ধর্মতত্ত্ব (কালাম) পড়ানো হতো। এর ফলে দর্শন বা ফালসাফা (Falsafa) কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই যুগেই আবির্ভাব ঘটে বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ইমাম আল-গাজালির (Al-Ghazali), যিনি নিজামিয়া মাদ্রাসার প্রধান ছিলেন। যদিও অনেকে মনে করেন তার দর্শনের সমালোচনার কারণে বিজ্ঞানচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু সেলজুক যুগেই ওমর খৈয়ামের (Omar Khayyam) মতো গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদরা তাদের সেরা কাজগুলো করেছিলেন। অর্থাৎ, বিজ্ঞানচর্চা হয়তো কিছুটা দিক পরিবর্তন করেছিল, কিন্তু পুরোপুরি থেমে যায়নি।
আয়্যুবীয় রাজবংশ: স্বর্ণযুগের শেষ প্রহর
স্বর্ণযুগের একেবারে শেষভাগে এসে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এবং তার প্রতিষ্ঠিত আয়্যুবীয় রাজবংশ (Ayyubid Dynasty, ১১৭১–১২৬০ CE)। এই সময়টা ছিল মূলত যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সংঘাতের। কিন্তু তা সত্ত্বেও কায়রো এবং দামেস্ক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে শক্তিশালী ছিল। সালাহউদ্দিন নিজে একজন বিদ্যোৎসাহী শাসক ছিলেন। তিনি কায়রো এবং দামেস্কে অনেকগুলো মাদ্রাসা ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার সময়ে বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মুসা বিন মায়মুন কায়রোতে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। আয়্যুবীয় যুগকে স্বর্ণযুগের মূল পর্ব হিসেবে ধরা না হলেও, এটি ছিল সেই মহান ঐতিহ্যের এক ধারাবাহিকতা, যা মঙ্গোল আক্রমণের ঠিক আগে পর্যন্ত টিকে ছিল।
অটোমান সাম্রাজ্য: স্বর্ণযুগের পর এক দীর্ঘশ্বাস?
কিছু ইতিহাসবিদ অটোমান সাম্রাজ্য (Ottoman Empire, ১২৯৯–১৯২২)-কে স্বর্ণযুগের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখতে চান, আবার অনেকে একে পোস্ট-গোল্ডেন এইজ বা স্বর্ণযুগ-পরবর্তী সময় হিসেবে বিবেচনা করেন। অটোমানরা নিঃসন্দেহে স্থাপত্য, শিল্পকলা এবং সামরিক প্রযুক্তিতে বিশাল উন্নতি করেছিল। স্থপতি মিমার সিনান (Mimar Sinan)-এর নকশা করা মসজিদগুলো আজও ইস্তাম্বুলের আকাশকে মহিমান্বিত করে রেখেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে তাকি আল-দিন (Taqi al-Din) ইস্তাম্বুলে একটি বিশাল মানমন্দির তৈরি করেছিলেন যা টাইকো ব্রাহের (Tycho Brahe) মানমন্দিরের সমকক্ষ ছিল।
কিন্তু সার্বিকভাবে অটোমান যুগে বিজ্ঞানচর্চা আগের মতো মৌলিক উদ্ভাবনের পথে হাঁটেনি। সবচেয়ে বড় ভুলটি ছিল প্রিন্টিং প্রেস (Printing Press) গ্রহণে অনীহা। প্রায় ৩০০ বছর ধরে তারা আরবি হরফে বই ছাপানো নিষিদ্ধ রেখেছিল, যা ইউরোপের সাথে তাদের এক বিশাল নলেজ গ্যাপ (Knowledge Gap) তৈরি করে দেয়। তাকি আল-দিনের মানমন্দিরটি মাত্র কয়েক বছরের মাথায় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ভেঙে ফেলা হয়। তাই অটোমানদের যুগকে স্বর্ণযুগের ধারাবাহিকতা না বলে, বরং ইসলামিক সায়েন্টিফিক ডিক্লাইন পিরিয়ড (Islamic Scientific Decline Period)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়, যেখানে অতীতের গৌরব থাকলেও নতুন কিছু তৈরি করার প্রেরণা অনেকটাই কমে এসেছিল।
তিমুরিদ সাম্রাজ্য ও মুঘল: স্বর্ণযুগের প্রান্তসীমা
ইসলামি স্বর্ণযুগের মূল আখ্যান যখন বাগদাদ বা কর্ডোবার পতনের সাথে শেষ হয়ে যায়, তখন মধ্য এশিয়া এবং ভারতে জ্বলে ওঠে আরও দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র – তিমুরিদ সাম্রাজ্য (Timurid Empire) এবং মুঘল সাম্রাজ্য (Mughal Empire)। যদিও এদের অনেক সময় ধ্রুপদী স্বর্ণযুগের (অষ্টম-ত্রয়োদশ শতাব্দী) সরাসরি অংশ হিসেবে ধরা হয় না, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক জৌলুসে এরা কোনো অংশে কম ছিল না। কেন এদের স্বর্ণযুগের বাইরে রাখা হয়? মূল কারণ হলো, এই সময়টিতে মৌলিক তাত্ত্বিক বিজ্ঞান বা প্যারাডাইম শিফট (Paradigm Shift)-এর অভাব ছিল। বাগদাদে যেমন গ্রিক বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন তত্ত্ব দেওয়া হয়েছিল, এই যুগে বিজ্ঞানচর্চা হয়ে পড়েছিল অনেক বেশি ব্যবহারিক, রাজকীয় জৌলুস এবং স্থাপত্যকেন্দ্রিক। তবুও, সমরখন্দ, লাহোর বা দিল্লীর আকাশ তখনো জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত ছিল।
তিমুরিদ রেনেসাঁ: উলুগ বেগের মানমন্দির: চতুর্দশ শতাব্দীর শেষে তৈমুর লঙের হাতে প্রতিষ্ঠিত তিমুরিদ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ায় এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটিয়েছিল, যাকে বলা হয় তিমুরিদ রেনেসাঁ (Timurid Renaissance)। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তৈমুরের নাতি উলুগ বেগ (Ulugh Beg)। তিনি ছিলেন একাধারে সুলতান এবং প্রথম সারির গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৪২০ সালে তিনি সমরখন্দে একটি বিশাল মাদ্রাসা এবং তার পাশে একটি মানমন্দির বা অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। তার তৈরি মানমন্দিরটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ। সেখানে তিনি একটি বিশাল সেক্সট্যান্ট (Sextant) বা ফখরি সেক্সট্যান্ট স্থাপন করেছিলেন, যার ব্যাসার্ধ ছিল ৩৬ মিটার। মাটির নিচে খোদাই করা এই বিশাল যন্ত্র দিয়ে তিনি নক্ষত্রের অবস্থান এত নিখুঁতভাবে মেপেছিলেন যে, টেলিস্কোপ আবিষ্কারের আগে তা ছিল অকল্পনীয়। উলুগ বেগ এবং তার সহকর্মীরা (যেমন আল-কাশি এবং কাদি জাদা আল-রুমি) মিলে তৈরি করেছিলেন জিজ-ই-সুলতানি (Zij-i-Sultani) বা সুলতানি সারণী। এতে প্রায় ১০০০ নক্ষত্রের স্থানাঙ্ক দেওয়া ছিল। ত্রিকোণমিতিতে সাইন ও ট্যানজেন্টের মান দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত নিখুঁতভাবে বের করা হয়েছিল। কিন্তু তিমুরিদদের ট্র্যাজেডি হলো, এটি ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। উলুগ বেগের মৃত্যুর পর রক্ষণশীল মোল্লারা তার মানমন্দির ধ্বংস করে দেয়। তিমুরিদ যুগকে স্বর্ণযুগের মূল স্রোতে না ফেলার কারণ হলো, এটি ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আগেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে হারিয়ে গিয়েছিল (Starr, 2013)।
মুঘল সাম্রাজ্য: স্থাপত্যের আড়ালে বিজ্ঞান: ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতে প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্য ছিল তিমুরিদদেরই উত্তরসূরি। বাবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত – মুঘলরা ছিল গানপাউডার এম্পায়ার বা ‘বারুদ সাম্রাজ্য’-এর অন্যতম সেরা উদাহরণ। মুঘলদের স্বর্ণযুগের অংশ না ধরার প্রধান কারণ হলো, তারা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকের চেয়ে প্রযুক্তির নান্দনিক ও বিলাসদ্রব্য তৈরির দিকে বেশি মনযোগী ছিল। তারা তাজমহলের মতো স্থাপত্য বানিয়েছে, যা জ্যামিতি ও হাইড্রলিক্সের মাস্টারপিস, কিন্তু তারা কোনো নতুন গাণিতিক সূত্র বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্ব আবিষ্কার করেনি। তাদের বিজ্ঞান ছিল অ্যাপ্লায়েড আর্ট (Applied Art) বা ফলিত শিল্পের পর্যায়ে। তবুও, মুঘলরা ধাতুবিদ্যায় বিশ্বসেরা ছিল। লাহোরের ধাতুশিল্পীরা লস্ট-ওয়াক্স কাস্টিং (Lost-wax casting) পদ্ধতিতে এমন সব নিখুঁত সীলেস্টিয়াল গ্লোব (Celestial Globe) বা নক্ষত্র-গোলক বানাতেন যা ছিল জোড়াহীন বা সিমলেস (Seamless)। এই প্রযুক্তি বিংশ শতাব্দীর আগে ইউরোপেও আবিষ্কৃত হয়নি। সম্রাট আকবরের দরবারের বিজ্ঞানী ফাতহুল্লাহ শিরাজি মাল্টি-ব্যারেল ক্যানন বা বহু-নল বিশিষ্ট কামানের নকশা করেছিলেন। মুঘলরা জাহাজ নির্মাণ ও রকেট প্রযুক্তিতেও (টিপু সুলতানের আগে) কাজ করেছিল। কিন্তু প্রিন্টিং প্রেস গ্রহণে অনীহা এবং সমুদ্র বাণিজ্যে ইউরোপীয়দের কাছে পিছিয়ে পড়া মুঘলদের বিজ্ঞানচর্চাকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে রেখেছিল। তারা ছিল স্বর্ণযুগের শেষ গোধূলি, যারা আকাশকে রাঙিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নতুন সূর্য আর আনতে পারেনি (Savage-Smith, 1985)।
পতনের কারণ: কেন নিভে গেল আলো?
এতক্ষণ আমরা যে সোনালি সময়ের গল্প শুনলাম, যে জ্ঞানতাপসদের কথা জানলাম, তা যেন কোনো রূপকথার মতো শোনায়। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক – এত কিছু থাকার পরও কেন এই স্বর্ণযুগ টিকে থাকল না? কেন আজ সেই অঞ্চল জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত পিছিয়ে? কেন বাগদাদ, কায়রো বা দামেস্ক আজ আর নতুন কোনো আইনস্টাইন বা নিউটন তৈরি করে না? কেন সেখানে এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ আর দীর্ঘশ্বাস? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। এর কোনো একক বা সরল উত্তর নেই। এটি কোনো একদিনে ঘটেনি; এটি ছিল এক দীর্ঘ, বেদনাদায়ক এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া। ইতিহাসবিদরা এই পতনের পেছনে অনেকগুলো জটিল কারণের একটি জাল বিছিয়ে দেন, যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব এবং প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। কোনো এক অজানা কারণে হঠাৎ আলো নিভে যায়নি, বরং তিলে তিলে ফুরিয়ে এসেছিল সলতে, শুকিয়ে গিয়েছিল তেল। এই পতনকে বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণগুলোর দিকে, যেখানে ভুল সিদ্ধান্ত বা নিষ্ঠুর নিয়তি একটি সভ্যতাকে উন্নতির শিখর থেকে টেনে নামিয়েছিল আস্তাকুঁড়ে।
মঙ্গোল আক্রমণ: টাইগ্রিসের কালো জল ও বুদ্ধিবৃত্তিক গণহত্যা
স্বর্ণযুগের কফিনে শেষ এবং সবচেয়ে বড় পেরেকটা ঠুকেছিল মঙ্গোলরা। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার স্টেপ বা তৃণভূমি থেকে ধেয়ে এল এক মানবস্রোত, যার নেতৃত্বে ছিলেন চেঙ্গিস খান এবং পরে তার নাতি হালাকু খান (Hulagu Khan)। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ধ্বংস। ১২৫৮ সাল। এই সালটি মুসলিম ইতিহাসের জন্য এক বিভীষিকা। হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল বাহিনী বাগদাদ অবরোধ করে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ আত্মসমর্পণ করলেন, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। মঙ্গোলরা বাগদাদে প্রবেশ করে এমন এক ধ্বংসলীলা চালাল যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। তারা শহরটা ধূলিসাৎ করে দিল। খলিফাকে হত্যা করা হলো, রাজপরিবারকে নির্মূল করা হলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো জ্ঞানের। বাগদাদের গর্ব ‘বায়তুল হিকমাহ’ বা হাউজ অফ উইজডম (House of Wisdom)-কে তারা পুড়িয়ে দিল। হাজার বছরের সঞ্চিত জ্ঞান, পাণ্ডুলিপি, মানচিত্র – সব ধ্বংস হয়ে গেল।
বলা হয়, মঙ্গোলরা লাইব্রেরির বইগুলো টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দিয়ে একটি সাঁকো তৈরি করেছিল, যার ওপর দিয়ে তাদের ঘোড়া পার হতো। নদীর পানি নাকি বইয়ের কালির রঙে কালো এবং মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। এটা নিছক রূপক নয়, এটা ছিল এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক গণহত্যা (Intellectual Genocide)। যে জ্ঞান সঞ্চয় করতে ৫০০ বছর লেগেছিল, তা এক নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেল। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মানুষ তখন জান বাঁচাতেই ব্যস্ত, জ্ঞানচর্চা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়াল। মঙ্গোলরা কেবল বই পোড়ায়নি, তারা বাগদাদের শত বছরের পুরনো সেচ ব্যবস্থা বা ক্যানেল সিস্টেম (Canal System) ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, উর্বর জমি মরুভূমিতে পরিণত হয়। অর্থনীতি ধসে পড়ে, আর পেটে ভাত না থাকলে কেউ নক্ষত্র মাপতে যায় না। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর মুসলিম বিশ্ব আর কোনোদিন তার পুরনো আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়নি (Starr, 2013)।
অর্থনীতির মেরুদণ্ড ও সিল্ক রোডের মৃত্যু
সভ্যতা টিকে থাকে অর্থের ওপর। বিজ্ঞানচর্চা একটি ব্যয়বহুল শখ, এর জন্য দরকার রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা বা প্যাট্রনেজ (Patronage)। ইসলামি স্বর্ণযুগের সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি ছিল বাণিজ্য। চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘সিল্ক রোড’ বা রেশম পথের নিয়ন্ত্রণ ছিল মুসলিমদের হাতে। তারা ছিল পৃথিবীর ‘মিডলম্যান’ বা মধ্যস্থতাকারী। মশলা, রেশম, কাগজ – সবকিছুর বাণিজ্যের ওপর তারা কর বসাত। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে দৃশ্যপট বদলে গেল। ইউরোপে তখন শুরু হয়েছে ‘আবিষ্কারের যুগ’ বা এজ অফ এক্সপ্লোরেশন (Age of Exploration)। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করলেন এবং ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা ঘুরে ভারতের সরাসরি সমুদ্রপথ খুঁজে পেলেন।
এই আবিষ্কারগুলো ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির জন্য মৃত্যুদণ্ডতুল্য। বিশ্ব বাণিজ্যের রুট বা ট্রেড রুট (Trade Route) ভূমধ্যসাগর ও স্থলপথ থেকে সরে গেল আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরে। ইউরোপীয়রা এখন আর মুসলিমদের মধ্যস্থতা বা কর দিতে বাধ্য নয়, তারা সরাসরি এশিয়া ও আমেরিকার সাথে বাণিজ্য শুরু করল। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি ধসে পড়ল। সিল্ক রোড তার গুরুত্ব হারাল, ব্যস্ত বাজারগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ল। অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়লে বিজ্ঞানচর্চা হয় না। গবেষণার জন্য যে বিশাল ফন্ডিং দরকার, তা দেওয়ার সামর্থ্য আর সুলতান বা খলিফাদের ছিল না। আগে খলিফারা বিজ্ঞানীদের বইয়ের ওজনে সোনা দিতেন, এখন তারা নিজেদের সৈন্যসামন্ত পালতেই হিমশিম খেতে লাগলেন। অর্থনৈতিক এই স্থবিরতা (Stagnation) বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ রুদ্ধ করে দিল (Chaney, 2016)।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আল-আন্দালুসের পতন
জ্ঞানচর্চার জন্য দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফাদের ক্ষমতা কমার সাথে সাথে বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে গেল। একতা নষ্ট হলো। শাসকরা নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিজ্ঞানের চেয়ে যুদ্ধজয়ের দিকে তাদের নজর বেশি গেল। এর সবচেয়ে করুণ উদাহরণ হলো স্পেন বা আল-আন্দালুস। কর্ডোবা ও গ্রানাডা ছিল ইউরোপের বুকে এক টুকরো স্বর্গ। কিন্তু খ্রিস্টান রাজাদের রিকনকুইস্তা (Reconquista) বা পুর্নদখল অভিযানের মুখে মুসলিম শাসন সংকুচিত হতে থাকে। ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
ক্যাথলিক রাজারা ক্ষমতায় এসে শুরু করলেন ইনকুইজিশন। ইহুদি ও মুসলিম পণ্ডিতদের হয় দেশ ছাড়তে হলো, নয়তো জোর করে ধর্মান্তরিত করা হলো। কর্ডোবার বিশাল লাইব্রেরিগুলোর বই পুড়িয়ে ফেলা হলো। কার্ডিনাল সিমেনেজ (Cardinal Ximenez)-এর নির্দেশে গ্রানাডার চত্বরে হাজার হাজার আরবি বই পোড়ানো হয়েছিল। এটি ছিল জ্ঞানের আরেক বড় ট্র্যাজেডি। যে স্পেন একসময় ছিল বহুসংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র, তা হয়ে উঠল ধর্মীয় গোঁড়ামির আখড়া। এখান থেকে বিতাড়িত হয়ে অনেক পণ্ডিত উত্তর আফ্রিকায় বা অটোমান সাম্রাজ্যে আশ্রয় নিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সৃজনশীল পরিবেশ আর ফিরে পেলেন না।
রক্ষণশীলতার উত্থান ও যুক্তির নির্বাসন
অনেকে মনে করেন, শুধু বাইরের শত্রুই নয়, ভেতরের পরিবর্তনও এই পতনের জন্য দায়ী। একাদশ শতাব্দীর পর থেকে মুসলিম বিশ্বে একটি মতাদর্শগত পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নিজাম আল-মুলক বাগদাদে যে নিজামিয়া মাদ্রাসা (Nizamiya Madrasa) সিস্টেম চালু করেছিলেন, তা শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখলেও, এর কারিকুলাম ছিল মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। সেখানে কুরআন, হাদিস এবং ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের ওপর বেশি জোর দেওয়া হলো। বিজ্ঞান, দর্শন বা যুক্তিবিদ্যাকে দেখা হতে লাগল ‘বিদেশি জ্ঞান’ বা ফরেন সায়েন্সেস (Foreign Sciences) হিসেবে, যা ঈমানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এই পরিবর্তনের তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছিলেন ইমাম আল-গাজালি। তার তাহাফুত আল-ফালাসিফা বইয়ের মাধ্যমে তিনি কার্যকারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করে দর্শনের মূলে আঘাত করেছিলেন। যদিও তিনি বিজ্ঞানকে সরাসরি নিষিদ্ধ করেননি, কিন্তু তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মানুষ মনে করতে শুরু করল, সবকিছুই যখন ঈশ্বরের সরাসরি ইচ্ছায় ঘটে, তখন প্রকৃতির নিয়ম খোঁজার দরকার কী? যুক্তিবাদী মুতাজিলা (Mu’tazila) মতবাদের পতন এবং রক্ষণশীল আশারি (Ash’ari) মতবাদের উত্থান সমাজকে প্রশ্নবিমুখ করে তুলল। ইজতিহাদ (Ijtihad) বা স্বাধীন বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগের দরজা কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হলো। বলা হলো, আগের পণ্ডিতরা যা বলে গেছেন, তাই চূড়ান্ত; নতুন করে ভাবার কিছু নেই। এই ‘তাকলিদ’ বা অন্ধ অনুকরণ প্রথা একটি জীবন্ত সভ্যতাকে স্থবির করে দিল। প্রশ্ন করার সাহস কমে গেল। আর প্রশ্ন না থাকলে বিজ্ঞান বাঁচে না।
প্রিন্টিং প্রেস: ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল
ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুলটি করেছিল উসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্য। ১৪৫০ সালে জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ যখন প্রিন্টিং প্রেস (Printing Press) বা ছাপখানা আবিষ্কার করলেন, ইউরোপে শুরু হলো জ্ঞানের বিস্ফোরণ। বইয়ের দাম কমে গেল, জ্ঞান সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাল। কিন্তু অটোমান সুলতানরা আরবি হরফে ছাপখানা নিষিদ্ধ করলেন। তাদের ভয় ছিল, এতে কুরআনের পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে অথবা হাজার হাজার ক্যালিগ্রাফার বা লিপিকর তাদের চাকরি হারাবে। ১৪৮৫ সালে সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ ছাপখানা নিষিদ্ধ করে ডিক্রি জারি করেন।
এর ফল হলো ভয়াবহ। ইউরোপে যখন লক্ষ লক্ষ বই ছাপা হচ্ছে, নতুন নতুন ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে, তখন মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান সীমাবদ্ধ রইল হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির ধীরগতির মধ্যে। ইউরোপে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব বা সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন হলো এই ছাপখানার ওপর ভর করে। মুসলিম বিশ্ব এই প্রযুক্তি গ্রহণ করতে প্রায় ৩০০ বছর দেরি করেছিল। ১৭২৭ সালের আগে অটোমান সাম্রাজ্যে প্রথম আরবি ছাপখানা বসেনি। এই ৩০০ বছরের গ্যাপ বা নলেজ গ্যাপ (Knowledge Gap) আর কোনোদিন পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ইউরোপ যখন রকেটের গতিতে এগিয়ে গেল, মধ্যপ্রাচ্য তখন কচ্ছপের গতিতে হাঁটতে লাগল। আধুনিক অর্থনীতির ভাষায় একে বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা (Institutional Failure) (Kuru, 2019)।
ঔপনিবেশিকতা: শেষ আঘাত
কফিনের শেষ পেরেকটি ছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা বা কলোনিয়ালিজম (Colonialism)। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নেপোলিয়নের মিশর আক্রমণ এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের দ্বারা মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত দখল এই অঞ্চলের বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কেবল সম্পদ লুণ্ঠন করেনি, তারা তাদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। তারা স্থানীয় ইতিহাস ও অর্জনকে অবজ্ঞা করল এবং একটি হীনম্মন্যতার সংস্কৃতি তৈরি করল। স্থানীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, বিজ্ঞান ও আধুনিকতা কেবল ইউরোপের সম্পত্তি, তাদের পূর্বপুরুষদের কোনো অবদান নেই। এই মানসিক পরাধীনতা আজও কাটেনি।
আজ যখন আমরা সেই স্বর্ণযুগের দিকে তাকাই, তখন কেবল গর্ব নয়, এক গভীর বেদনাবোধ আমাদের আচ্ছন্ন করে। বাগদাদের সেই লাইব্রেরি, কর্ডোবার সেই গবেষণাগার, সমরখন্দের সেই মানমন্দির – সবই আজ স্মৃতি। কিন্তু এই পতন আমাদের শেখায় যে, কোনো সভ্যতাই চিরস্থায়ী নয়। যখন কোনো সমাজ জ্ঞানকে ভয় পায়, প্রশ্নকে দমন করে এবং পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়, তখন তার পতন অনিবার্য। ইতিহাসের এই নির্মম শিক্ষা মনে রাখা জরুরি, কারণ যারা ইতিহাস থেকে শেখে না, তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়।
প্রভাব, উত্তরাধিকার ও বিশ্বসভ্যতার বাঁক বদল
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণাগুলোর মধ্যে একটি হলো রেনেসাঁ বা ইউরোপীয় নবজাগরণকে একটি আকস্মিক ঘটনা বা ‘মিরাকল’ হিসেবে দেখা। যেন হঠাৎ একদিন ইউরোপের ঘুম ভাঙল, আর তারা বিজ্ঞান ও দর্শনের মশাল হাতে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জ্ঞান বিজ্ঞানের এই মশালটি ইউরোপের হাতে তুলে দিয়েছিল বাগদাদ, কর্ডোবা আর কায়রোর পণ্ডিতরা। ইসলামি স্বর্ণযুগ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল না, বরং এটি ছিল এক বিশাল মহাদেশীয় সেতু। গ্রিক ও রোমানদের প্রাচীন জ্ঞান এই সেতুর ওপর দিয়েই আধুনিক ইউরোপে পৌঁছেছিল। তবে তারা কেবল ডাকপিয়নের মতো চিঠি পৌঁছে দেয়নি, তারা সেই চিঠির বিষয়বস্তু নতুন করে লিখেছিল, সংশোধন করেছিল এবং তাতে নিজেদের অভিজ্ঞতার ছাপ রেখেছিল। আজকের আধুনিক জগত – যেখানে আমরা অ্যালগরিদম দিয়ে জীবন চালাই, ল্যাবরেটরিতে ওষুধ বানাই, কিংবা মহাকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করি – তার প্রতিটি ইটের গায়ে সেই স্বর্ণযুগের কারিগরদের নাম খোদাই করা আছে। তাদের প্রভাব কেবল বিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ ছিল না; তা ছড়িয়ে পড়েছিল দর্শন, সাহিত্য, এমনকি ধর্মতত্ত্বেও। টমাস একুইনাস থেকে শুরু করে রেনে দেকার্ত, কিংবা দান্তে থেকে জন লক – সবাই কোনো না কোনোভাবে এই বুদ্ধিবৃত্তিক ঋণের জালে আবদ্ধ। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে সেই মরুভূমির জ্ঞানতৃষ্ণা পাল্টে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীর মানচিত্র।
ল্যাটিন অনুবাদের জোয়ার ও ইউরোপের ঘুমভানিয়া গান
ইউরোপ তখন গভীর ঘুমে। দ্বাদশ শতাব্দী। স্পেনের টলেডো শহরটি তখন খ্রিস্টানদের দখলে চলে এসেছে, কিন্তু শহরটি তখনো আরবি সংস্কৃতিতে ভরপুর। এই টলেডোতেই শুরু হলো ইতিহাসের অন্যতম সেরা বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান, যাকে বলা হয় টলেডো স্কুল অফ ট্রান্সলেটরস (Toledo School of Translators)। আর্চবিশপ রেমন্ড চাইলেন আরবি ভাষায় সঞ্চিত বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারকে ল্যাটিন ভাষায় নিয়ে আসতে। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্ডিতরা ছুটে এলেন টলেডোতে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ইতালির জেরার্ড অফ ক্রিমোনা (Gerard of Cremona)। তিনি এসেছিলেন কেবল টলেমির আলমাজেস্ট বইটি খুঁজতে, কারণ ল্যাটিন ভাষায় এর কোনো কপি ছিল না। কিন্তু টলেডোতে এসে তিনি আরবি বইয়ের বিশাল সমুদ্র দেখে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, বাকি জীবন সেখানেই থেকে গেলেন। তিনি একাই প্রায় ৮৭টি আরবি বই ল্যাটিনে অনুবাদ করেন। এর মধ্যে ছিল আল-খওয়ারিজমির বীজগণিত, ইবনে সিনার ক্যানন এবং আল-রাজির চিকিৎসার বই।
এই অনুবাদ আন্দোলন ইউরোপে এক নতুন জাগরণ নিয়ে এল। এতদিন ইউরোপীয়রা অ্যারিস্টটলকে চিনত কেবল সামান্য কিছু ল্যাটিন নোটের মাধ্যমে। এবার তারা অ্যারিস্টটলের মূল কাজগুলো পেল, তাও আবার ইবনে রুশদ এবং ইবনে সিনার ব্যাখ্যামেত। এই অনুবাদগুলো ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে – প্যারিস, অক্সফোর্ড, বোলোনা – পাঠ্যবই হিসেবে ঢুকে পড়ল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপের শিক্ষাব্যবস্থায় যে স্কলাস্টিসিজম (Scholasticism) বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ দর্শনের জন্ম হলো, তার মূল ভিত্তি ছিল এই আরবি থেকে অনূদিত গ্রন্থগুলো। এই আন্দোলন না হলে ইউরোপ হয়তো আরও কয়েকশ বছর অন্ধকারে থাকত (Burnett, 2001)।
দর্শনের ওপর প্রভাব: একুইনাস ও লাতিন অ্যাভেরোইজম
দর্শনে স্বর্ণযুগের প্রভাব ছিল ভূমিকম্পের মতো। বিশেষ করে কর্ডোবার দার্শনিক ইবনে রুশদ (Averroes) ইউরোপীয় চিন্তাজগতকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তার অ্যারিস্টটলীয় ব্যাখ্যাগুলো ইউরোপে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল অনুসারী তৈরি হলো যাদের বলা হতো ল্যাটিন অ্যাভেরোিস্ট (Latin Averroists)। এদের নেতা ছিলেন সিগার অফ ব্রাবান্ট (Siger of Brabant)। তারা ইবনে রুশদের মতো বিশ্বাস করতেন যে, দর্শন বা যুক্তি ধর্মতত্ত্বের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে পারে এবং বিশ্বজগত অনাদি। এটি ক্যাথলিক চার্চের জন্য ছিল এক বিশাল হুমকি। চার্চ ভয় পেল যে, যুক্তির দাপটে বিশ্বাস হারিয়ে যাবে।
এই সংকট মোকাবেলা করার জন্য এগিয়ে এলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক টমাস একুইনাস (Thomas Aquinas)। তিনি ইবনে রুশদকে বলতেন ‘দ্য কমেন্টেটর’, কিন্তু তার অনেক মতবাদের বিরোধিতা করতেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, একুইনাস ইবনে রুশদের বিরোধিতা করতে গিয়ে ইবনে রুশদেরই পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদের যুক্তিগুলোকে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের সাথে মিলিয়ে এক নতুন সংশ্লেষণ বা সিন্থেসিস (Synthesis) তৈরি করেন। একুইনাসের বিখ্যাত বই সুম্মা থিওলজিকা-তে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য তিনি যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন, তা সরাসরি মুসলিম কালাম শাস্ত্র এবং ইবনে সিনার ‘আবশ্যিক সত্তা’ বা নেসেসারি বিয়িং (Necessary Being)-এর ধারণা থেকে নেওয়া। অর্থাৎ, আধুনিক খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি তৈরিতেও মুসলিম দার্শনিকদের পরোক্ষ অবদান রয়েছে।
রেনে দেকার্ত ও ভাসমান মানুষের ধাঁধা
আধুনিক দর্শনের জনক বলা হয় ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (René Descartes)-কে। তার সেই বিখ্যাত উক্তি “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” (Cogito, ergo sum) – পাশ্চাত্যের দর্শনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দেকার্ত কি আসলেই এটি প্রথম ভেবেছিলেন? ইতিহাসবিদরা এখন দেখছেন যে, দেকার্তের এই চিন্তার সাথে ইবনে সিনার ফ্লোটিং ম্যান (Floating Man) বা ভাসমান মানুষের চিন্তন-পরীক্ষার অদ্ভুত মিল আছে। ইবনে সিনা বলেছিলেন, যদি একজন মানুষ শূন্যে ভাসে এবং তার কোনো ইন্দ্রিয় কাজ না করে, তবুও সে তার নিজের অস্তিত্ব বা ‘সেলফ’ সম্পর্কে সচেতন থাকবে। দেকার্তও ঠিক একই কথা বলেছিলেন – সবকিছু সন্দেহ করা যায়, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব সন্দেহ করা যায় না। যদিও দেকার্ত কখনো স্বীকার করেননি যে তিনি ইবনে সিনা পড়েছেন, কিন্তু ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে এই ধারণাটি তখন ইউরোপে সুপরিচিত ছিল। এটি প্রমাণ করে যে, আধুনিক দর্শনের ‘সেলফ’ বা আত্মসত্তার ধারণাটিও স্বর্ণযুগের চিন্তার ফসল (Druart, 1988)।
বিজ্ঞানে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির জন্ম
আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার পদ্ধতি – সায়েন্টিফিক মেথড (Scientific Method)। আমরা সাধারণত এর জন্য ফ্রান্সিস বেকন বা গ্যালিলিওকে কৃতিত্ব দিই। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক রজার বেকন (Roger Bacon), যাকে ‘ডক্টর মিরাবিলিস’ বলা হতো, তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে তিনি এই পদ্ধতি শিখেছেন আরবদের কাছ থেকে। বেকন অক্সফোর্ডে বসে আরবি বই পড়তেন এবং তার ছাত্রদের বলতেন, “জ্ঞান চাইলে আরবি শেখো।” তিনি ইবনে আল-হাইসাম (Ibn al-Haytham)-এর কিতাব আল-মানাজির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। আল-হাইসাম দেখিয়েছিলেন যে, কেবল যুক্তি দিয়ে নয়, পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য যাচাই করতে হয়। বেকন এই এমপিসিজম (Empiricism) বা অভিজ্ঞতাবাদকে ইউরোপে জনপ্রিয় করেন।
পরবর্তীকালে আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton) এবং জোহানেস কেপলার (Johannes Kepler) আলোকবিজ্ঞান নিয়ে যা কাজ করেছেন, তার ভিত্তি ছিল আল-হাইসামের ল্যাটিন অনুবাদ। নিউটনের প্রিজম পরীক্ষার ধারণা বা কেপলারের রেটিনাল ইমেজের ধারণা – সবকিছুর শেকড় সেই কায়রোর অন্ধকার ঘরে বসে করা আল-হাইসামের পরীক্ষাগুলোতে। এছাড়া উইলিয়াম হার্ভে (William Harvey) রক্ত সঞ্চালন আবিষ্কারের ৩০০ বছর আগে ইবনে আল-নাফিস (Ibn al-Nafis) ফুসফুসীয় রক্ত সঞ্চালন বর্ণনা করেছিলেন। যদিও হার্ভে সরাসরি নাফিসের বই পড়েছিলেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেখানে হার্ভে পড়াশোনা করেছিলেন) তখন ইবনে আল-নাফিসের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হতো। আন্দ্রেয়াস আলপাগো নামের এক গবেষক নাফিসের কিছু কাজ ল্যাটিনে অনুবাদ করেছিলেন যা হার্ভের সময়ের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল।
কোপার্নিকাস ও জ্যোতির্বিদ্যার বিপ্লব
আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার জনক নিকোলাস কোপার্নিকাস (Nicolaus Copernicus)। তিনি পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে সূর্যকে বসিয়েছিলেন। কিন্তু এই গাণিতিক মডেল তিনি পেলেন কোথায়? গবেষণায় দেখা গেছে, কোপার্নিকাসের মডেলে ব্যবহৃত জ্যামিতিক কৌশলগুলো, বিশেষ করে তুসি কাপল (Tusi Couple) এবং উরদি লেমা (Urdi Lemma), হুবহু নাসির আল-দিন আল-তুসি এবং মুয়াইয়াদ আল-দিন আল-উরদির কাজ থেকে নেওয়া। কোপার্নিকাসের হাতে আঁকা ডায়াগ্রাম এবং তুসির ডায়াগ্রামের মিল এতটাই স্পষ্ট যে, এটি কাকতালীয় হতে পারে না। কোপার্নিকাস হয়তো আরবি জানতেন না, কিন্তু তিনি ইতালিতে পড়াশোনা করার সময় বাইজেন্টাইন বা ইহুদি পণ্ডিতদের মাধ্যমে এই তত্ত্বগুলোর ল্যাটিন বা গ্রিক অনুবাদ পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব বা সায়েন্টিফিক রেভোলিউশন ইউরোপকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে নিয়ে এল, তার বারুদ তৈরি হয়েছিল মারাঘার মানমন্দিরে (Saliba, 2007)।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার
স্বর্ণযুগের প্রভাব কেবল বিজ্ঞান বা দর্শনে নয়, সাহিত্যেও ছিল গভীর। ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস মনে করা হয় ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো-কে। এক নির্জন দ্বীপে একা মানুষের বেঁচে থাকার এই গল্প। কিন্তু এরও প্রায় ৫০০ বছর আগে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনের দার্শনিক ইবনে তুফায়েল (Ibn Tufayl) লিখেছিলেন হাই ইবনে ইয়াকজান (Hayy ibn Yaqzan) বা জীবন্তের সন্তান জাগ্রত। এই উপন্যাসেও একটি শিশু নির্জন দ্বীপে একা বড় হয় এবং কেবল নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করে ঈশ্বর ও সত্যকে খুঁজে পায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই বইটি ল্যাটিন ও ইংরেজিতে অনূদিত হয় এবং ইউরোপে বেস্টসেলার হয়। জন লক বা ড্যানিয়েল ডিফো এই বই দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিশেষ করে জন লকের তাবুলা রাসা (Tabula Rasa) বা ‘শিশুর মন একটি সাদা কাগজের মতো’ – এই তত্ত্বটি ইবনে তুফায়েলের উপন্যাসের মূল উপজীব্য ছিল। এটি ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট (Enlightenment) বা আলোকায়নের যুগে মানুষের শেখার ক্ষমতা ও স্বাধীনতার ধারণাকে বদলে দিয়েছিল (Russell, 1994)।
এমনকি দান্তের ডিভাইন কমেডি (Divine Comedy)-র সাথেও ইসলামি ঐতিহ্যের মিল পাওয়া যায়। দান্তে নরক (Purgatory) এবং স্বর্গের যে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, তার সাথে মহানবী (সা.)-এর ইসরা ও মিরাজ (Isra and Mi’raj) বা উর্ধ্বাকাশ ভ্রমণের কাহিনীর আশ্চর্য মিল রয়েছে। স্প্যানিশ পণ্ডিত মিগুয়েল আসিন পালাসিওস (Miguel Asín Palacios) ১৯১৯ সালে দেখিয়েছিলেন যে, দান্তের সময় মিরাজের কাহিনীর ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপে প্রচলিত ছিল এবং দান্তে সম্ভবত সেখান থেকেই তার মহাকাব্যের কাঠামোটি ধার করেছিলেন। যদিও দান্তে তার কাব্যে মুসলিমদের নরকে স্থান দিয়েছিলেন, কিন্তু তার কাব্যের স্থাপত্যটি ছিল ইসলামি উৎস থেকে নেওয়া।
গণিত ও আধুনিক বিশ্ব
আমরা যে সংখ্যা দিয়ে প্রতিদিন বাজার করি বা কম্পিউটারে কোড লিখি, তা ওই স্বর্ণযুগের দান। ইতালির গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি (Leonardo Fibonacci), যিনি ফিবোনাচ্চি ধারার জন্য বিখ্যাত, তিনি আলজেরিয়ার বেজাইয়া শহরে বড় হয়েছিলেন। সেখানে তিনি আরব ওস্তাদদের কাছে গণিত শেখেন। তিনি ইউরোপে ফিরে গিয়ে লিবার আবাকি (Liber Abaci) লেখেন এবং রোমান সংখ্যার বদলে হিন্দু-আরবি সংখ্যাপদ্ধতি (Hindu-Arabic Numeral System) চালু করেন। তিনি বললেন, “রোমান সংখ্যা দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন, আরবদের পদ্ধতি অনেক সহজ।” তার এই প্রচেষ্টায় ইউরোপের বাণিজ্য ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে। এছাড়া বীজগণিত (Algebra) এবং অ্যালগরিদম (Algorithm) ছাড়া আজকের আধুনিক প্রযুক্তি কল্পনাও করা যায় না। আমাদের স্মার্টফোনের প্রতিটি অ্যাপ, ইন্টারনেটের প্রতিটি সার্চ রেজাল্ট – সবকিছুর মূলে আছে আল-খওয়ারিজমির সেই লজিক।
সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের দর্শন
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন সমাজবিজ্ঞান বা সোশিওলজি (Sociology) একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে উঠছিল, তখন ইউরোপীয়রা অবাক হয়ে দেখল যে ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun) বহু আগেই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী লুডভিগ গামপ্লোউইচ (Ludwig Gumplowicz) এবং ফ্রাঞ্জ ওপেনহেইমার (Franz Oppenheimer) ইবনে খালদুনের ‘আসাবিয়া’ তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তারা রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও সংঘাতের তত্ত্বে খালদুনের মডেল ব্যবহার করেন। এমনকি আধুনিক অর্থনীতির ‘সাপ্লাই সাইড ইকোনমিক্স’ বা কর ব্যবস্থা নিয়ে রোনাল্ড রিগ্যানের উপদেষ্টারাও ইবনে খালদুনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। ইতিহাস যে কেবল রাজা-বাদশাদের গল্প নয়, বরং এটি সমাজ ও অর্থনীতির বিবর্তনের গল্প – এই হিস্টোরিওগ্রাফি (Historiography) বা ইতিহাসতত্ত্বের আধুনিক ধারাটি ইবনে খালদুনের কাছে ঋণী।
কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে
স্যার আইজ্যাক নিউটন একবার বলেছিলেন, “আমি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি দূর দেখে থাকি, তবে তা সম্ভব হয়েছে দৈত্যদের কাঁধে চড়ে।” নিউটন যাদের কাঁধে চড়েছিলেন, তাদের মধ্যে কোপার্নিকাস বা গ্যালিলিও যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইবনে আল-হাইসাম, ইবনে সিনা এবং আল-তুসি। ইসলামি স্বর্ণযুগ মানবসভ্যতার ইতিহাসে কোনো বিচ্ছিন্ন অধ্যায় ছিল না। এটি ছিল গ্রিক ও রোমান সভ্যতার সাথে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সংযোগকারী সেতু। এই সেতু না থাকলে রেনেসাঁ হতো কি না সন্দেহ। আধুনিক বিশ্ব আজ যে ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তিবাদ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার বীজ বোনা হয়েছিল বাগদাদ, কর্ডোবা আর কায়রোর সেই মুক্তচিন্তার আসরগুলোতে। তাদের উত্তরাধিকার কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বা জাতির নয়, তা সমগ্র মানবজাতির। আমরা আজ যা জানি, যা ভাবি, এমনকি যেভাবে পৃথিবীকে দেখি – তার অনেকটুকুই সেই বিস্মৃত কারিগরদের দান। তাদের আলো আজ হয়তো নিভে গেছে, কিন্তু সেই আলোর শিখাটি তারা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, যা আজও জ্বলছে ল্যাবরেটরিতে, লাইব্রেরিতে আর মানুষের কৌতূহলী মনে।
স্বর্ণযুগের বিতর্ক: মিথ, বাস্তবতা ও উত্তপ্ত বয়ান
ইসলামি স্বর্ণযুগ নিয়ে আলোচনা যতটা মুগ্ধকর, বিতর্ক ততটাই প্রবল। ইতিহাসের এই অধ্যায়টি নিয়ে পণ্ডিত, ঐতিহাসিক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে মতের অমিল আকাশ-পাতাল। কেউ একে দেখেন মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে, আবার কেউ একে দেখেন নিছক গ্রিক জ্ঞানের অনুবাদ বা নকল হিসেবে। এই বিতর্কগুলো কেবল একাডেমিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো বর্তমান জিওপলিটিক্স, ধর্মীয় পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের সাথেও জড়িয়ে আছে। পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে এই সময়টাকে অবজ্ঞা করে এসেছে, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্ব কখনো কখনো একে অতিরঞ্জিত করে দেখেছে। সত্যটা আসলে কোথায়? এই অধ্যায়ে আমরা সেই বিতর্কিত বিষয়গুলো বা কনটেনশাস ইস্যুজ নিয়ে কাটাছেঁড়া করব। আমরা দেখব ‘ইসলামি’ বনাম ‘আরব’ বিতর্ক, গ্রিক জ্ঞানের কেবল সংরক্ষণ নাকি উদ্ভাবন – এই প্রশ্নগুলো, এবং ইমাম আল-গাজালি কি আসলেই বিজ্ঞানের কবর রচনা করেছিলেন কি না।
কেবল সংরক্ষণকারী নাকি উদ্ভাবক?
পাশ্চাত্যের অনেক পুরনো দিনের ইতিহাসবিদ, যেমন ফরাসি দার্শনিক আর্নেস্ট রেনান (Ernest Renan) বা আধুনিক কিছু সমালোচক মনে করেন, ইসলামি স্বর্ণযুগের পণ্ডিতরা আসলে নতুন কিছু করেননি। তারা ছিলেন কেবল গ্রিক জ্ঞানের ‘ফ্রিজ’ বা সংরক্ষণকারী। তাদের মতে, আরবরা গ্রিক বইগুলো অনুবাদ করেছে, সেগুলোকে সযত্নে লাইব্রেরিতে রেখেছে এবং পরে ইউরোপের হাতে তুলে দিয়েছে। অর্থাৎ, তারা ছিল ডাকপিয়ন বা পোস্টম্যান (Postman), যারা চিঠির বিষয়বস্তু নিজেরা লেখেনি, কেবল পৌঁছে দিয়েছে। এই মতবাদকে বলা হয় রিসেপশন থিওরি বা নিছক গ্রহণবাদ। তাদের যুক্তি হলো, বীজগণিত বা অপটিক্সের মূল ধারণাগুলো গ্রিক বা ভারতীয়দের ছিল, আরবরা শুধু সেগুলোকে সাজিয়েছে।
কিন্তু আধুনিক গবেষকরা, যেমন জর্জ সালিবা (George Saliba) বা আবদেলহামিদ সাবরা (A. I. Sabra), এই মতবাদকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেন। তারা বলেন, এটি একটি ইউরোসেন্ট্রিক বা ইউরোকেন্দ্রিক (Eurocentric) দৃষ্টিভঙ্গি। সাবরা একটি বিখ্যাত তত্ত্ব দিয়েছিলেন যার নাম অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন ভার্সেস ন্যাচারালাইজেশন (Appropriation vs. Naturalization)। তিনি বলেন, মুসলিম বিজ্ঞানীরা গ্রিক জ্ঞানকে কেবল অনুবাদ করেননি, তারা সেগুলোকে ‘ন্যাচারালাইজ’ বা নিজেদের করে নিয়েছিলেন। তারা টলেমির ভুল ধরেছেন, অ্যারিস্টটলের সমালোচনা করেছেন এবং গ্যালেনের অ্যানাটমিকে ব্যবচ্ছেদ করে ভুল প্রমাণ করেছেন। ইবনে আল-হাইসামের আলোকবিজ্ঞান বা আল-খওয়ারিজমির বীজগণিত – এগুলো গ্রিক বিজ্ঞানের নিছক অনুবাদ নয়, এগুলো সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবন। যদি তারা কেবল পোস্টম্যান হতো, তবে ইবনে আল-নাফিস কীভাবে গ্যালেনকে চ্যালেঞ্জ করে রক্ত সঞ্চালন আবিষ্কার করলেন? বা আল-তুসি কীভাবে টলেমির মডেলে ভুল ধরলেন? তাই বর্তমান ঐকমত্য হলো, তারা কেবল সংরক্ষণকারী ছিলেন না, তারা ছিলেন উদ্ভাবক (Innovators) এবং সংশোধনকারী (Correctors) (Sabra, 1987)।
‘ইসলামি’ নাকি ‘আরব’ স্বর্ণযুগ?
এই সময়টাকে কী নামে ডাকা হবে, তা নিয়েও আছে বিশাল বিতর্ক। অনেকে বলেন ‘ইসলামি স্বর্ণযুগ’ (Islamic Golden Age), আবার অনেকে বলেন ‘আরব স্বর্ণযুগ’ (Arab Golden Age)। সমস্যা হলো, এই জ্ঞানচর্চায় যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সবাই আরব ছিলেন না, আবার সবাই মুসলিমও ছিলেন না। ইবনে সিনা, আল-বিরুনি, আল-খওয়ারিজমি – এরা সবাই ছিলেন জাতিতে পারসিক বা পার্সিয়ান। আবার হুনাইন ইবনে ইশাক বা জিবরিল বখতিশু ছিলেন খ্রিস্টান। মুসা বিন মায়মুন (Maimonides) ছিলেন ইহুদি। থাবিত ইবনে কুররা ছিলেন সাবিয়ান। তাহলে একে ‘ইসলামি’ বলা কতটা যৌক্তিক?
যারা ‘ইসলামি’ বলার পক্ষে, তারা যুক্তি দেন যে, যদিও বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধর্মের বা জাতির ছিলেন, কিন্তু এই পুরো জ্ঞানচর্চাটি হয়েছিল একটি ইসলামি সভ্যতা (Islamic Civilization) বা ইসলামি রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়। খলিফারা ছিলেন মুসলিম, এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই এই পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া, আরবি ছিল তখন বিজ্ঞানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা (Lingua Franca) বা সাধারণ ভাষা, যেমনটা আজ ইংরেজি। একজন ইহুদি বা খ্রিস্টান পণ্ডিতও তখন আরবিতে বই লিখতেন। তাই একে ‘ইসলামি’ বা ‘আরব-ইসলামি’ বলাটাই শ্রেয়। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসবিদরা বা আরব জাতীয়তাবাদীরা একে ‘আরব স্বর্ণযুগ’ বলতে পছন্দ করেন, কারণ আরবি ভাষাই ছিল এই যুগের মূল চালিকাশক্তি। তবে ইরানের জাতীয়তাবাদীরা আবার দাবি করেন যে, স্বর্ণযুগের আসল কারিগর ছিল পারসিকরা, আরবরা কেবল শাসক ছিল। এই আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচয়ের রাজনীতি আজও ইতিহাসের পাতায় উত্তাপ ছড়ায়।
আল-গাজালি বিতর্ক: বিজ্ঞানের কি তিনিই ঘাতক?
স্বর্ণযুগের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশি আঙুল তোলা হয় একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ইমাম আল-গাজালি (Al-Ghazali)-র দিকে। পশ্চিমা ইতিহাসবিদ এবং কিছু আধুনিক মুসলিম সংস্কারক দাবি করেন যে, গাজালির লেখা তাহাফুত আল-ফালাসিফা (The Incoherence of the Philosophers) বইটাই মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান ও দর্শনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। তাদের মতে, গাজালি কার্যকারণ সম্পর্ক বা কজালিটি (Causality) অস্বীকার করেছিলেন এবং বলেছিলেন সবকিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটে (অকেশনালিজম)। এর ফলে মানুষ প্রকৃতির নিয়ম খোঁজা বন্ধ করে দেয় এবং বিজ্ঞানচর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী নিল ডিগ্রাস টাইসন (Neil deGrasse Tyson) তার এক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, “গাজালি গণিতকে শয়তানের কাজ বলেছিলেন এবং এরপরই মুসলিম বিজ্ঞান ধসে পড়ে।”
কিন্তু এই দাবিটি নিয়ে আধুনিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক আছে। জর্জ সালিবা, ফ্রাঙ্ক গ্রিফেল বা সোনিয়া ব্রেন্টজেসের মতো গবেষকরা বলেন, এটি একটি ভুল ধারণা বা মিথ (Myth)। প্রথমত, গাজালি গণিত বা বিজ্ঞানকে নিষিদ্ধ করেননি। তিনি বলেছিলেন, গণিত বা সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক করা ধর্মের কাজ নয়, এগুলো গাণিতিক সত্য। তিনি কেবল অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স (Metaphysics) নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দ্বিতীয়ত, গাজালির মৃত্যুর পরেও মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানচর্চা থেমে থাকেনি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নাসির আল-দিন আল-তুসি, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইবনে আল-শাতির এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে উলুগ বেগ বা জামশিদ আল-কাশির মতো বিজ্ঞানীরা গাজালির পরবর্তী যুগের মানুষ। তারা তো বিজ্ঞানচর্চা বাদ দেননি। বরং গাজালি-পরবর্তী যুগেই জ্যোতির্বিদ্যা এবং যন্ত্রকৌশলের স্বর্ণযুগ এসেছিল। তাই গাজালিকে ‘বিজ্ঞানের ঘাতক’ বলাটা ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে মেলে না। বরং মাদ্রাসার কারিকুলাম পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাই ছিল পতনের মূল কারণ, গাজালির দর্শন নয় (Saliba, 2007)।
মাদ্রাসার ভূমিকা: বিজ্ঞানবান্ধব নাকি বিজ্ঞানবিরোধী?
আরেকটি বড় বিতর্কের বিষয় হলো মাদ্রাসা (Madrasa) বা ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। একাদশ শতাব্দীতে নিজাম আল-মুলক যে মাদ্রাসা সিস্টেম চালু করেছিলেন, তা কি বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিয়েছিল নাকি পিছিয়ে দিয়েছিল? প্রথাগত ধারণা হলো, মাদ্রাসাগুলোতে কেবল কুরআন, হাদিস এবং ফিকহ পড়ানো হতো, আর বিজ্ঞান বা দর্শনকে বাদের খাতায় ফেলা হতো। এগুলোকে বলা হতো ‘উলুম আল- আওয়ায়েল’ বা প্রাচীনদের বিজ্ঞান (Sciences of the Ancients), যা মাদ্রাসার সিলেবাসে ছিল না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন না পেয়ে বিজ্ঞানচর্চা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা হাসপাতালের কোণায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, এই চিত্রটি পুরোপুরি সত্য নয়। অনেক মাদ্রাসায় ফারায়েজ বা উত্তরাধিকার আইন শেখানোর জন্য গণিত বা হিসাব (Arithmetic) পড়ানো হতো। নামাজের সময় এবং কিবলা নির্ণয়ের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা বা ইলম আল-মিদাত (Ilm al-Miqat) পড়ানো হতো। একে বলা হয় ফাংশনাল সায়েন্স বা ব্যবহারিক বিজ্ঞান। অর্থাৎ, মাদ্রাসায় ধর্মের প্রয়োজনে বিজ্ঞান পড়ানো হতো। তবে বিশুদ্ধ দর্শন বা তাত্ত্বিক বিজ্ঞান হয়তো কিছুটা কোণঠাসা ছিল। কিন্তু অনেক শিক্ষক মাদ্রাসার বাইরে বা নিজের বাড়িতে বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্লাস নিতেন। তাই মাদ্রাসাকে পুরোপুরি বিজ্ঞানবিরোধী বলা যায় না, তবে এটি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারেনি, এটা সত্য। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল কর্পোরেট বডি, যার আইনি সত্তা ছিল; কিন্তু মাদ্রাসারা ছিল ওয়াকফ ভিত্তিক ট্রাস্ট, যা ব্যক্তিগত দাতার ইচ্ছার ওপর চলত। এই কাঠামোগত দুর্বলতা বা স্ট্রাকচারাল উইকনেস (Structural Weakness) দীর্ঘমেয়াদে বিজ্ঞানের ক্ষতি করেছিল (Makdisi, 1981)।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ: ঋণ কি স্বীকার করা হয়েছে?
ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণ কতটা ইসলামি স্বর্ণযুগের কাছে ঋণী, তা নিয়ে পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি বা ডিনায়াল (Denial) লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাসবিদরা চেষ্টা করেছিলেন ইতিহাসের এই অধ্যায়টাকে মুছে ফেলতে বা ছোট করে দেখাতে। তারা ইতিহাসের একটি কাল্পনিক লাইন টানলেন – গ্রিস থেকে সোজা রোম, আর রোম থেকে সোজা রেনেসাঁ। মাঝখানের এক হাজার বছরকে তারা বললেন ‘অন্ধকার যুগ’, যেন তখন কিছুই হয়নি। ফরাসি দার্শনিক পিয়ের দুহেম (Pierre Duhem) মধ্যযুগীয় বিজ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও ইসলামি বিজ্ঞানকে কেবল ‘গ্রিক বিজ্ঞানের বাহক’ হিসেবে দেখেছিলেন।
তবে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে এই মনোভাব বদলাতে শুরু করে। এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said)-এর ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) বা প্রাচ্যবাদ তত্ত্ব প্রকাশের পর ইতিহাসবিদরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। তারা দেখছেন যে, কোপার্নিকাস, হার্ভে বা নিউটনের কাজের শেকড় আরবি পাণ্ডুলিপিতে। কিন্তু বিতর্কটা হলো – এই ঋণ কি যথেষ্ট স্বীকার করা হয়? আধুনিক পাঠ্যবইগুলোতে গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাসের নাম যতটা উজ্জ্বল, ইবনে আল-হাইসাম বা আল-তুসির নাম ততটা নয়। অনেক মুসলিম পণ্ডিত অভিযোগ করেন যে, এটি একটি ইন্টেলেকচুয়াল থেফট বা বুদ্ধিবৃত্তিক চুরি। কোপার্নিকাস আল-তুসির ডায়াগ্রাম ব্যবহার করেও তার নাম উল্লেখ করেননি – এটি কি কাকতালীয় নাকি ইচ্ছাকৃত? এই প্রশ্ন আজও ইতিহাসের আদালতে অমীমাংসিত।
পতনের কারণ নিয়ে মতভেদ: অভ্যন্তরীণ বনাম বাহ্যিক
স্বর্ণযুগের পতন কেন হলো – মঙ্গোল আক্রমণ নাকি রক্ষণশীলতা? এই বিতর্কটি আজও প্রাসঙ্গিক। একদল (বিশেষ করে পশ্চিমা গবেষক এবং সেক্যুলারিস্টরা) মনে করেন, ইসলামের অভ্যন্তরীণ রক্ষণশীলতা বা ডগমাটিজম (Dogmatism) এবং ইজতিহাদ বন্ধ করে দেওয়াই পতনের মূল কারণ। তারা বলেন, ধর্ম যখন যুক্তিকে গিলে ফেলল, তখনই বিজ্ঞান মরে গেল। অন্যদল (বিশেষ করে মুসলিম এবং পোস্ট-কলোনিয়াল গবেষকরা) মনে করেন, মঙ্গোল আক্রমণ এবং পরবর্তী ঔপনিবেশিক শোষণই এর প্রধান কারণ। তারা বলেন, বাগদাদের লাইব্রেরি ধ্বংস করা এবং অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়ার পর কোনো সভ্যতাই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
আসলে সত্যটা হয়তো মাঝখানে। বাহ্যিক আক্রমণ অবশ্যই বড় আঘাত ছিল, কিন্তু সেই আঘাত সামলে ওঠার মতো অভ্যন্তরীণ শক্তি বা রেজিলিয়েন্স (Resilience) সমাজটির ছিল না। অটোমান বা মুঘল সাম্রাজ্য বিশাল শক্তিশালী হলেও তারা প্রিন্টিং প্রেস গ্রহণ করেনি বা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে অংশ নেয়নি – এটা তো মঙ্গোলদের দোষ নয়, এটা তাদের নিজস্ব নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। তাই অভ্যন্তরীণ স্থবিরতা এবং বাহ্যিক আক্রমণ – দুটোই সমানভাবে দায়ী। এই বিতর্ক আমাদের শেখায় যে, কোনো সভ্যতার পতন কেবল এক কারণে হয় না, এটি অনেকগুলো ভুলের সমষ্টি।
বিতর্কের ইতিরেখা
ইসলামি স্বর্ণযুগ নিয়ে এই বিতর্কগুলো হয়তো কোনোদিন শেষ হবে না। কারণ ইতিহাস সব সময় বিজয়ীর চোখ দিয়ে লেখা হয়, আবার কখনো কখনো পরাজিতরা নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে। তবে এই বিতর্কের ধুলো সরালে একটা সত্য জ্বলজ্বল করে – মধ্যযুগের ওই কয়েকশ বছর পৃথিবী থমকে ছিল না। মানুষ তখনো ভাবত, প্রশ্ন করত এবং উত্তর খুঁজত। সেই উত্তর খোঁজার মশালটা তখন ছিল আরব, পারসিক আর তুর্কিদের হাতে। তারা সেই মশালটা ইউরোপের হাতে তুলে দিয়েছিল বলেই আজ আমরা চাঁদে রকেট পাঠাতে পারি। গাজালি বিজ্ঞানকে মেরে ফেলেছিলেন কি না, বা কোপার্নিকাস তুসির কাছ থেকে চুরি করেছিলেন কি না – এই তাত্ত্বিক কচকচানির চেয়ে বড় সত্য হলো মানুষের জ্ঞানের অখণ্ডতা। জ্ঞান কোনো ধর্মের বা জাতির একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এই বিতর্কগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্য জানা যতটা জরুরি, সত্যকে স্বীকার করার সততাটুকু থাকাও ততটাই জরুরি।
স্বর্ণযুগের ভাষ্যকার: আধুনিক তাত্ত্বিক ও ইতিহাসতত্ত্বের লড়াই
ইতিহাস কেবল অতীতের ঘটনাপঞ্জি নয়; ইতিহাস হলো সেই ঘটনাগুলোকে আমরা কীভাবে দেখছি তার একটা বয়ান। আমরা যখন ইসলামি স্বর্ণযুগ নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা আসলে শত শত বছর আগের কিছু পাণ্ডুলিপি আর ভাঙা মানমন্দির নিয়ে কথা বলছি না; আমরা কথা বলছি আধুনিক যুগের একদল তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদের চশমা দিয়ে দেখা এক জগত নিয়ে। এই জগতটাকে কেউ দেখেছেন মুগ্ধতার চোখে, কেউ দেখেছেন অবজ্ঞার চোখে, আবার কেউ বা ব্যবচ্ছেদ করেছেন সমাজবিজ্ঞানের নির্মোহ ছুরিকাঁচি দিয়ে। এই স্বর্ণযুগ নিয়ে গত দুইশ বছরে যে পরিমাণ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ হয়েছে, তা সম্ভবত বাগদাদের যুদ্ধের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘকাল ধরে চেষ্টা করেছে এই সময়টাকে ইতিহাসের ফুটনোট বা পাদটীকা হিসেবে রাখতে, আর প্রাচ্যের তাত্ত্বিকরা চেষ্টা করেছেন সেই ন্যারেটিভ বা আখ্যান ভেঙে দিতে। এই অধ্যায়ে আমরা পরিচিত হব সেই সব আধুনিক তাত্ত্বিকদের সাথে, যারা ঠিক করে দিয়েছেন আমরা কীভাবে আল-খওয়ারিজমি বা ইবনে সিনাকে মূল্যায়ন করব। তাদের তত্ত্ব, তাদের বিতর্ক এবং তাদের দর্শন আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, জ্ঞান আসলে কেবল ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয় না, জ্ঞান তৈরি হয় ইতিহাসবিদের কলমেও।
ওরিয়েন্টালিজম ও এডওয়ার্ড সাঈদ: দেখার চোখ বদলানো
স্বর্ণযুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি দিয়েছিলেন যিনি, তিনি কোনো বিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said)। ১৯৭৮ সালে তার লেখা বই ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) পশ্চিমা বিশ্বের দেখার চোখটাই বদলে দিয়েছিল। সাঈদ দেখালেন যে, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা পণ্ডিতরা প্রাচ্য বা ‘অরিয়েন্ট’ নিয়ে যা কিছু লিখেছেন, তার পেছনে ছিল এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। তারা প্রাচ্যকে দেখতেন রহস্যময়, অযৌক্তিক এবং প্রগতিবিমুখ হিসেবে। স্বর্ণযুগ নিয়ে তাদের ভাষ্য ছিল এমন – আরবরা গ্রিক জ্ঞান অনুবাদ করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা ছিল মূলত গ্রিকদের ছাত্র, তাদের নিজস্ব কোনো সৃজনশীলতা ছিল না। সাঈদ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বললেন এসেনশিয়ালিজম (Essentialism) বা সারবস্তুবাদ। অর্থাৎ, পশ্চিমারা মনে করত মুসলিম বা আরবদের ‘সত্তা’ই হলো বিজ্ঞানবিমুখ, তারা কেবল আবেগপ্রবণ এবং ধর্মান্ধ। তাদের মতে, বিজ্ঞানচর্চা যা কিছু হয়েছে, তা হয়েছে গ্রিকদের প্রভাবে, আরবদের নিজস্ব কোনো অবদানে নয়।
সাঈদের এই তত্ত্বের পর ইতিহাসবিদরা নড়েচড়ে বসলেন। তারা বুঝতে পারলেন, এতদিন তারা যে চশমা দিয়ে বাগদাদ বা কর্ডোবাকে দেখছিলেন, সেই চশমার কাঁচে রঙের প্রলেপ ছিল। সাঈদের প্রভাবে শুরু হলো পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ (Post-colonial Studies), যেখানে গবেষকরা নতুন করে আরবি পাণ্ডুলিপি ঘাঁটতে শুরু করলেন এবং দেখতে পেলেন যে, এতদিন যাকে ‘অনুবাদ’ বলা হচ্ছিল, তা আসলে ছিল ‘উদ্ভাবন’। তারা দেখলেন, ইবনে আল-হাইসাম কেবল টলেমির বই অনুবাদ করেননি, তিনি টলেমিকে ভুল প্রমাণ করেছেন। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাস চর্চায় এক বিপ্লব নিয়ে এল। গবেষকরা এখন আর প্রশ্ন করেন না যে “আরবরা কীভাবে গ্রিক জ্ঞান রক্ষা করল?”, বরং প্রশ্ন করেন “আরবরা কীভাবে গ্রিক জ্ঞানকে রূপান্তর করল?” (Said, 1978)।
আর্নেস্ট রেনান: বিতর্কের খলনায়ক?
স্বর্ণযুগ নিয়ে বিতর্কের টেবিলে যদি কাউকে ‘খলনায়ক’ বা প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে হয়, তবে তিনি হলেন ফরাসি দার্শনিক ও ভাষাতাত্ত্বিক আর্নেস্ট রেনান (Ernest Renan)। ১৮৮৩ সালে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তার বিখ্যাত বক্তৃতা “Islam and Science”-এ তিনি এক মারাত্মক দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইসলাম ধর্ম হিসেবে বিজ্ঞান ও দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। তার মতে, স্বর্ণযুগে যা কিছু বিজ্ঞানচর্চা হয়েছে, তা ইসলামের কারণে হয়নি, বরং ইসলামের ‘বিরুদ্ধে’ গিয়ে হয়েছে। তিনি দাবি করেছিলেন, এই বিজ্ঞানীরা জাতিতে কেউ আরব ছিলেন না (অধিকাংশই পারসিক বা খ্রিস্টান), এবং তারা মুসলিম শাসনামলে নির্যাতিত ছিলেন। রেনানের এই তত্ত্বকে বলা হয় রেনান থিসিস (Renan Thesis)। তিনি বিশ্বাস করতেন, সেমিটিক জাতিগোষ্ঠী (আরব ও ইহুদি) প্রাকৃতিকভাবেই একেশ্বরবাদী এবং তাদের মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানের জটিলতা বা মিথলজি বোঝার অক্ষম। তার মতে, আর্য জাতি (ইউরোপীয় ও পারসিক) সৃষ্টিশীল, আর সেমিটিক জাতি কেবল অনুকরণকারী।
তার এই জাতিবিদ্বেষী এবং পজিটিভিজম (Positivism) বা দৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা পাঠ্যবইগুলোতে রাজত্ব করেছে। জামাল আল-দিন আল-আফগানির মতো মুসলিম সংস্কারকরা রেনানের এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। আফগানি বলেছিলেন, ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত সব ধর্মেই আছে, কেবল ইসলামে নয়; গ্যালিলিওকেও তো চার্চ শাস্তি দিয়েছিল। কিন্তু রেনানের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আজকের দিনেও যারা দাবি করেন যে “গাজালি বিজ্ঞান ধ্বংস করেছেন” – তারা আসলে অজান্তেই রেনানের সেই পুরনো সুরই গাইছেন। রেনান স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানীদের ‘মুসলিম’ পরিচয় অস্বীকার করে তাদের কেবল ‘মুক্তচিন্তক’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন, যা ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ মাত্র (Renan, 1883)।
পিয়ের দুহেম ও ধারাবাহিকতার তত্ত্ব
ফরাসি পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ পিয়ের দুহেম (Pierre Duhem) ছিলেন আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক, যার কাজ স্বর্ণযুগের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনি মধ্যযুগীয় বিজ্ঞান নিয়ে বিশাল গবেষণা করেন। দুহেম ছিলেন একজন কট্টর ক্যাথলিক, তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে আধুনিক বিজ্ঞান গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাসের হাত ধরে হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি, বরং মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান স্কলাস্টিকদের কাজের ধারাবাহিকতাতেই এসেছে। একে বলা হয় কন্টিনিউইটি থিসিস (Continuity Thesis)। দুহেম আরবি বিজ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু তিনি তাকে দেখেছিলেন কেবল একটি ‘মাধ্যম’ বা ‘চ্যানেল’ হিসেবে। তার মতে, আরবরা গ্রিক জ্ঞানকে সংরক্ষণ করেছে এবং ল্যাটিন দুনিয়ায় পৌঁছে দিয়েছে, ব্যাস এটুকুই। তিনি মুসলিম বিজ্ঞানীদের মৌলিক অবদানকে খুব একটা পাত্তা দেননি।
তবে তার একটি বড় অবদান হলো, তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে ‘অন্ধকার যুগ’ বলে আসলে কিছু নেই। তার কাজের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে গবেষকরা আরবি পাণ্ডুলিপিগুলো ল্যাটিন অনুবাদের সাথে মিলিয়ে দেখার আগ্রহ পান। দুহেমের সীমাবদ্ধতা ছিল তিনি আরবি জানতেন না, তাই তাকে নির্ভর করতে হয়েছিল ল্যাটিন অনুবাদের ওপর। কিন্তু তিনি যে প্রশ্নটি তুলেছিলেন – বিজ্ঞানের ইতিহাসে ধারাবাহিকতা বনাম বিপ্লব – তা আজও প্রাসঙ্গিক। আধুনিক গবেষকরা দুহেমের তত্ত্বকে সংশোধন করে বলছেন, ধারাবাহিকতা অবশ্যই ছিল, কিন্তু সেই সুতোটা কেবল প্যারিস বা অক্সফোর্ডে নয়, বাগদাদ আর কায়রো হয়েও গেছে (Duhem, 1913)।
জর্জ সালিবা ও ধ্রুপদী আখ্যানের পতন
আধুনিক যুগে এসে যিনি স্বর্ণযুগের ইতিহাসকে পুরোপুরি উল্টে দিয়েছেন, তিনি হলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ সালিবা (George Saliba)। তিনি প্রচলিত ক্লাসিক্যাল ন্যারেটিভ (Classical Narrative) বা ধ্রুপদী আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ধ্রুপদী আখ্যান অনুযায়ী – খলিফা আল-মামুন স্বপ্নে অ্যারিস্টটলকে দেখলেন, গ্রিক বই অনুবাদ করলেন, বিজ্ঞানচর্চা হলো, আর তারপর গাজালি এসে সব বন্ধ করে দিলেন। সালিবা বললেন, “এই গল্পটা ভুল।” তার বিখ্যাত বই ইসলামিক সায়েন্স অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ দ্য ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ-তে তিনি দেখালেন যে, অনুবাদ আন্দোলন কোনো স্বপ্নের কারণে শুরু হয়নি, এটি শুরু হয়েছিল আব্বাসীয় আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনে (গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা)। তিনি দেখালেন, স্বর্ণযুগের পতন গাজালির কারণে হয়নি, কারণ গাজালির পরেও ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের সেরা কাজগুলো হয়েছে।
তিনি কোপার্নিকাস এবং নাসির আল-দিন আল-তুসির ডায়াগ্রামের হুবহু মিল তুলে ধরে প্রমাণ করেন যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁ আসলে ইসলামি বিজ্ঞানেরই ফসল। সালিবা এই তত্ত্ব দেন যে, মুসলিম বিজ্ঞানীরা গ্রিক জ্ঞানকে কেবল গ্রহণ করেননি, তারা সেগুলোকে ভুল প্রমাণ করে নতুন মডেল তৈরি করেছিলেন, যাকে তিনি বলেন সায়েন্টিফিক ক্রিটিসিজম (Scientific Criticism)। তিনি দেখান যে, মুসলিম জ্যোতির্বিদরা ‘ইলম আল-হাইয়া’ (জ্যোতির্বিদ্যা)-কে গ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে আলাদা করেছিলেন এবং একে একটি বিশুদ্ধ গাণিতিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সালিবার কাজ প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানচর্চার পতন কোনো ধর্মতাত্ত্বিক কারণে হয়নি, বরং হয়েছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে (Saliba, 2007)।
এ. আই. সাবরা ও ন্যাচারালাইজেশন তত্ত্ব
বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ আবদেলহামিদ ইব্রাহিম সাবরা (A. I. Sabra) ১৯৮০-র দশকে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যার নাম ন্যাচারালাইজেশন (Naturalization) বা আত্মস্থকরণ। তার আগে পশ্চিমা ইতিহাসবিদরা, যেমন পিয়ের দুহেম বা ইগনাস গোল্ডজিহার, মনে করতেন যে গ্রিক বিজ্ঞান ইসলামি সমাজে একটি ‘বিদেশি শরীর’ বা ফরেন বডি (Foreign Body)-র মতো ছিল। তাদের মতে, এটি ছিল একটি বহিরাগত জ্ঞান যা মুসলিম সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি, কেবল কিছু অভিজাত বা দার্শনিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং শেষ পর্যন্ত সমাজ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। সাবরা এই গতানুগতিক মতের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, মুসলিম পণ্ডিতরা গ্রিক জ্ঞানকে কেবল অনুবাদ করেননি, তারা সেগুলোকে ‘ন্যাচারালাইজ’ বা নিজেদের করে নিয়েছিলেন।
সাবরা দেখান যে, মুসলিম পণ্ডিতরা গ্রিক দর্শনকে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের (কালাম) সাথে এবং গ্রিক জ্যোতির্বিদ্যাকে ইসলামি উপাসনার (নামাজ, কিবলা) সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। তারা গ্রিক দেবতাদের নাম বাদ দিয়ে সেগুলোকে ইসলামি পরিভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। অর্থাৎ, বিজ্ঞান আর ‘বিদেশি’ থাকেনি, তা সমাজের নিজস্ব অংশে পরিণত হয়েছিল। সাবরার মতে, স্বর্ণযুগের পতন বা বিজ্ঞানের স্থবিরতা এজন্য হয়নি যে বিজ্ঞান প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, বরং এজন্য হয়েছিল যে বিজ্ঞান এতটাই ‘ন্যাচারালাইজড’ বা মিশে গিয়েছিল যে তার আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না; এটি ধর্ম ও প্রথার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ, বিজ্ঞান তার স্বকীয়তা বা অটোনমি (Autonomy) হারিয়ে ফেলেছিল। সাবরার এই তত্ত্বটি স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানের সামাজিক অবস্থান এবং তার পতনের কারণ বোঝার জন্য খুবই জরুরি, কারণ এটি দেখায় যে সাফল্যই কখনো কখনো ব্যর্থতার কারণ হতে পারে (Sabra, 1987)।
মার্শাল হজসন ও ‘ইসলামিকেট’ ধারণা
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ মার্শাল হজসন (Marshall Hodgson) ছিলেন সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি ইতিহাসবিদ। তার তিন খণ্ডের মহাকাব্যিক গ্রন্থ দ্য ভেঞ্চার অফ ইসলাম (The Venture of Islam) ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হজসন একটি বড় সমস্যার সমাধান করেছিলেন – পরিভাষা বা টার্মিনোলজি। তিনি দেখলেন, স্বর্ণযুগের সব বিজ্ঞানী বা কবি ধার্মিক মুসলিম ছিলেন না। তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ইহুদি (যেমন মুসা বিন মায়মুন), খ্রিস্টান (যেমন হুনাইন ইবনে ইশাক), সাবিয়ান (যেমন থাবিত ইবনে কুররা) বা নাস্তিক (যেমন আল-রাজি)। তাই তাদের কাজকে ‘ইসলামি’ (Islamic) বলাটা ধর্মীয়ভাবে বিভ্রান্তিকর। আবার তাদের ‘আরব’ বলাও ভুল, কারণ অনেকেই জাতিগতভাবে পারসিক বা তুর্কি ছিলেন।
তাই হজসন একটি নতুন শব্দ বা নিওলজিজম (Neologism) তৈরি করলেন – ইসলামিকেট (Islamicate)। তিনি বললেন, ‘ইসলামিক’ (Islamic) মানে যা ধর্মের সাথে সম্পর্কিত (যেমন কুরআন, হাদিস, ফিকহ), আর ‘ইসলামিকেট’ (Islamicate) মানে হলো এমন একটি সংস্কৃতি যা ইসলামি শাসনের অধীনে এবং ইসলামি মূল্যবোধের আবহে গড়ে উঠেছে, কিন্তু তা ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে। যেমন – আরব্য রজনীর গল্প, ইবনে সিনার চিকিৎসা, ওমর খৈয়ামের কবিতা বা আল-খওয়ারিজমির গণিত হলো ‘ইসলামিকেট’ সৃষ্টি, ‘ইসলামিক’ নয়। এই শব্দটি ব্যবহার করার ফলে ইতিহাসবিদরা ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিয়েও স্বর্ণযুগের সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক অর্জনকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করার সুযোগ পেলেন। হজসন দেখালেন যে, এই সভ্যতাটি ছিল একটি বিশ্বব্যবস্থা বা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম (World System), যা আধুনিক গ্লোবালাইজেশনের পূর্বসূরি। তার এই বিশ্লেষণ আমাদের শেখায় যে, একটি সভ্যতাকে বুঝতে হলে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখতে হবে (Hodgson, 1974)।
টোবি হাফ ও প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন
কেন আধুনিক বিজ্ঞান বা মডার্ন সায়েন্স (Modern Science) ইউরোপে জন্মাল, কিন্তু মুসলিম বিশ্বে জন্মাল না – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী টোবি হাফ (Toby Huff) একটি বিতর্কিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব দেন। তার বই দ্য রাইজ অফ আর্লি মডার্ন সায়েন্স-এ তিনি বলেন, সমস্যাটা মেধার ছিল না, সমস্যাটা ছিল প্রতিষ্ঠানের। ইউরোপে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছিল আইনগতভাবে স্বাধীন কর্পোরেশন বা লিগ্যাল কর্পোরেশন (Legal Corporation) হিসেবে। তাদের নিজস্ব নিয়ম তৈরির, ডিগ্রি দেওয়ার এবং পাঠ্যক্রম ঠিক করার ক্ষমতা ছিল। পোপ বা রাজাও সহজে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না।
কিন্তু মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্রগুলো (মাদ্রাসা, হাসপাতাল, মানমন্দির) ছিল ওয়াকফ (Waqf) বা ট্রাস্ট ভিত্তিক। ওয়াকফ চলত দাতার ইচ্ছার ওপর। দাতা যদি দলিলে লিখে দেন যে এখানে কেবল ফিকহ পড়ানো হবে, তবে সেখানে দর্শন পড়ানো আইনত অসম্ভব ছিল। হাফের মতে, এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বা ইনস্টিটিউশনাল ফেইলিয়র (Institutional Failure)-এর কারণেই মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা থাকেনি এবং স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়ে ওঠেনি। যদিও জর্জ সালিবা বা দিমিত্রি গুতাসের মতো সমালোচকরা হাফের তত্ত্বকে ইউরোপকেন্দ্রিক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশে আইনি কাঠামো বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক (Legal Framework)-এর ভূমিকা নিয়ে তার প্রশ্নগুলো আজও প্রাসঙ্গিক (Huff, 2003)।
দিমিত্রি গুতাস ও অনুবাদ আন্দোলন
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিমিত্রি গুতাস (Dimitri Gutas) তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বাগদাদের অনুবাদ আন্দোলন কোনো খলিফার ব্যক্তিগত শখ বা ‘উইজডম লাভিং’ বা জ্ঞানপিপাসার ফল ছিল না। এটি ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রজেক্ট। তার বই গ্রিক থট, অ্যারাবিক কালচার-এ তিনি দেখান যে, আব্বাসীয় খলিফারা, বিশেষ করে আল-মনসুর এবং আল-মামুন, তাদের চিরশত্রু বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।
তারা প্রচার করলেন যে, বাইজেন্টাইনরা (যারা খ্রিস্টান) প্রাচীন গ্রিকদের (যারা প্যাগান ছিল) জ্ঞান ভুলে গেছে এবং বিকৃত করেছে। কিন্তু আব্বাসীয়রা সেই প্রাচীন জ্ঞানের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। গুতাস এই প্রক্রিয়াকে বলেন ইম্পেরিয়াল আইডিওলজি (Imperial Ideology) বা সাম্রাজ্যিক মতাদর্শ। তারা সাসানীয় সম্রাটদের অনুকরণে নিজেদের ‘জ্ঞানী সম্রাট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। গুতাসের এই তত্ত্ব আমাদের বুঝতে শেখায় যে, জ্ঞানচর্চা কখনো রাজনীতি থেকে আলাদা নয়; বাগদাদের লাইব্রেরিগুলো ছিল আসলে কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের হাতিয়ার। তিনি দেখান যে, অনুবাদ আন্দোলনটি ছিল আব্বাসীয় সমাজের বহুত্ববাদ বা প্লুরালিজম (Pluralism)-এর প্রতিফলন, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষ রাষ্ট্রের সেবায় এক হয়েছিল (Gutas, 1998)।
ডেভিড কিং ও ধর্মের সেবায় বিজ্ঞান
বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ডেভিড কিং (David King) স্বর্ণযুগের জ্যোতির্বিদ্যার ওপর বিশাল কাজ করেছেন। তিনি একটি চমৎকার তত্ত্ব দেন – সায়েন্স ইন দ্য সার্ভিস অফ রিলিজিয়ন (Science in the Service of Religion)। তিনি দেখান যে, মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত এত বেশি উন্নত হওয়ার প্রধান কারণ ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। ইসলাম ধর্মে তিনটি বিষয়ের জন্য নিখুঁত সময়ের জ্ঞান দরকার: ১. দিনে পাঁচবার নামাজের সঠিক সময় বের করা (যা সূর্যের ছায়ার ওপর নির্ভর করে), ২. রমজানের চাঁদ দেখা এবং ইসলামি ক্যালেন্ডার ঠিক করা, এবং ৩. মক্কার দিক (কিবলা) নির্ণয় করা।
এই তিনটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই মুসলিমরা স্ফেরিক্যাল ত্রিকোণমিতি (Spherical Trigonometry) এবং জটিল সব যন্ত্রপাতি (যেমন অ্যাস্ট্রোল্যাব ও কোয়াড্র্যান্ট) আবিষ্কার করেছিল। কিং দেখান যে, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে বড় বড় মসজিদগুলোতে একজন পেশাদার জ্যোতির্বিদ নিয়োগ দেওয়া হতো, যাকে বলা হতো ‘মুওয়াক্কিত’ (সময় নির্ধারণকারী)। এই মুওয়াক্কিতরা কেবল ধর্মীয় কাজ করতেন না, তারা জটিল গাণিতিক টেবিল বা জিজ (Zij) তৈরি করতেন। কিংয়ের এই গবেষণা আর্নেস্ট রেনানের সেই পুরনো দাবিকে (যে ধর্ম বিজ্ঞানের শত্রু) ভুল প্রমাণ করে এবং দেখায় যে, ধর্ম অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অনুঘটক বা ক্যাটালিস্ট (Catalyst) হিসেবে কাজ করেছে। তার মতে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাই মুসলিমদের আকাশ দেখতে বাধ্য করেছিল (King, 1993)।
দেখার বৈচিত্র্য
এই তাত্ত্বিকদের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার – ইসলামি স্বর্ণযুগ কোনো সরলরেখা নয়। এটি ছিল বহু রঙের সুতায় বোনা এক জটিল চাদর। এডওয়ার্ড সাঈদ আমাদের শিখিয়েছেন পূর্বধারণা ভাঙতে, সালিবা শিখিয়েছেন তথ্যের গভীরে যেতে, আর হজসন শিখিয়েছেন সংস্কৃতিকে ধর্মের বাইরে এনে দেখতে। রেনান বা দুহেমের মতো সমালোচকরা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ছিলেন, কিন্তু তাদের তোলা প্রশ্নগুলোই পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক উত্তর খুঁজতে বাধ্য করেছে। আজকের দিনে আমরা যখন ইবনে সিনা বা আল-হাইসামকে নিয়ে গর্ব করি, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই গর্বের ভিত্তিপ্রস্তরটি স্থাপন করেছেন এই আধুনিক তাত্ত্বিকরাই, যারা ধুলোমাখা পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধার করেছেন এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার ডিএনএ। তাদের বয়ান বা ডিসকোর্স (Discourse) ছাড়া স্বর্ণযুগ হয়তো কেবল রূপকথার গল্প হয়েই থাকত, ইতিহাস হতো না।
উপসংহার: নতুনের কেতন
ইতিহাস বড় নির্মম। সে বিজয়ীর কথা মনে রাখে, কিন্তু যে সিঁড়ি বেয়ে বিজয়ী ওপরে উঠল, সেই সিঁড়ির কথা প্রায়ই ভুলে যায়। ইউরোপের রেনেসাঁ বা বৈজ্ঞানিক বিপ্লব আকাশ থেকে পড়েনি। এটা কোনো ভোজবাজি ছিল না। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন – তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন ইবনে সিনা, ইবনে আল-হাইসাম, আল-খওয়ারিজমি আর ইবনে রুশদের কাঁধের ওপর। নিউটন বলেছিলেন, “আমি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি দূর দেখে থাকি, তবে তা সম্ভব হয়েছে দৈত্যদের কাঁধে চড়ে।” সেই দৈত্যদের অনেকেই ছিলেন এই স্বর্ণযুগের পণ্ডিত।
ল্যাটিন অনুবাদকরা যদি দ্বাদশ শতাব্দীতে স্পেনের টলেডোতে (Toledo School of Translators) বসে আরবি বইগুলো অনুবাদ না করতেন, তবে ইউরোপের জাগরণ হতে আরও কয়েকশ বছর লাগত, কিংবা হয়তো হতোই না। আমরা আজ যে এলজেবরা করছি, যে অ্যালগরিদম দিয়ে এই লেখাটা আপনার স্ক্রিনে আসছে, যে ক্যামেরায় ছবি তুলছি, যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি – সবকিছুর শেকড় কোনো না কোনোভাবে সেই স্বর্ণযুগের মাটির গভীরে প্রোথিত। আমাদের আধুনিক সভ্যতার ডিএনএ-তে মিশে আছে সেই বিস্মৃত পণ্ডিতদের অবদান।
ইসলামি স্বর্ণযুগ আমাদের একটা বড় শিক্ষা দেয়। জ্ঞান কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের, বর্ণের বা জাতির নয়। জ্ঞান মানুষের। যখন সমাজ মুক্তচিন্তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, ভিন্ন মতকে স্বাগত জানিয়েছে, তখনই সভ্যতা এগিয়েছে। বাগদাদে যখন ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম আর নাস্তিকরা একসাথে বসে তর্ক করত, তখনই সেরা আবিষ্কারগুলো হয়েছিল। আর যখনই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখনই নেমে এসেছে অন্ধকার। জ্ঞানচর্চার জন্য দরকার সহনশীলতা, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।
বাগদাদের সেই লাইব্রেরি আজ আর নেই, সেই মানমন্দিরগুলো ধুলোয় মিশে গেছে। টাইগ্রিস নদী আজ হয়তো অন্য কথা বলে। কিন্তু মানুষের জানার আগ্রহ আজও আছে। ইতিহাস আমাদের শেখায়, আলো এক জায়গায় স্থির থাকে না। সে হাতবদল হয়। একসময় গ্রিস থেকে বাগদাদে গিয়েছিল, বাগদাদ থেকে ইউরোপে, ইউরোপ থেকে আমেরিকায়। কে জানে, ভবিষ্যতে সেই মশাল আবার কোথায় জ্বলবে? হয়তো এশিয়ায়, হয়তো আফ্রিকায়। ইতিমধ্যেই চীন প্রচুর অগ্রগতি দেখাচ্ছে।
মানুষ নশ্বর, কিন্তু মানুষের চিন্তা অবিনশ্বর। ধুলোমাখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপির পাতায় সেই চিন্তারাই বেঁচে থাকে, অপেক্ষা করে নতুন কোনো পাঠকের, যে এসে ধুলো ঝেড়ে আবার তাদের আলোয় উদ্ভাসিত হবে। আমরা যদি সেই যুক্তিবাদী মনন, সেই প্রশ্ন করার সাহস আবার ফিরিয়ে আনতে পারি, তবেই হয়তো আমরা সেই হারানো স্বর্ণযুগের যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারব। মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আজও আমরা যে তারাদের নাম ধরে ডাকি – রিগেল, ডেনেব, আলতাইর – তারা আমাদের সেই সোনালি অতীতের কথাই মনে করিয়ে দেয়, ফিসফিস করে বলে – জানতে চাও, প্রশ্ন করো, থেমো না। পৃথিবী এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে, আর সেই গতির জ্বালানি হলো জ্ঞান।
তথ্যসূত্র
- Adamson, P. (2016). Philosophy in the Islamic World: A History of Philosophy Without Any Gaps. Oxford University Press.
- Al-Khalili, J. (2011). The House of Wisdom: How Arabic Science Saved Ancient Knowledge and Gave Us the Renaissance. Penguin Press.
- Baali, F. (1988). Society, State, and Urbanism: Ibn Khaldun’s Sociological Thought. State University of New York Press.
- Bennison, A. K. (2009). The Great Caliphs: The Golden Age of the ‘Abbasid Empire. Yale University Press.
- Berggren, J. L. (1986). Episodes in the Mathematics of Medieval Islam. Springer-Verlag.
- Bir, A. (1990). The Kitab al-Hiyal of Banu Musa bin Shakir. Research Centre for Islamic History, Art and Culture.
- Bloom, J. M. (2001). Paper Before Print: The History and Impact of Paper in the Islamic World. Yale University Press.
- Boulakia, J. D. C. (1971). Ibn Khaldûn: A Fourteenth-Century Economist. Journal of Political Economy, 79(5), 1105-1118.
- Brock, S. P. (2004). The Syriac Background to Hunayn’s Translation Techniques. Aram Periodical.
- Burnett, C. (2001). The Coherence of the Arabic-Latin Translation Program in Toledo in the Twelfth Century. Science in Context, 14(1-2), 249-288.
- Caiger-Smith, A. (1985). Lustre Pottery: Technique, Tradition and Innovation in Islam and the Western World. Faber and Faber.
- Chaney, E. (2016). Religion and the Rise and Fall of Islamic Science. Harvard University.
- Druart, T. A. (1988). The Soul and Body Problem: Avicenna and Descartes. Arabic Philosophy and the West, 27-49.
- Duhem, P. (1913). Le Système du Monde: Histoire des Doctrines Cosmologiques de Platon à Copernic. Hermann.
- Dunn, R. E. (2005). The Adventures of Ibn Battuta: A Muslim Traveler of the 14th Century. University of California Press.
- Ettinghausen, R., Grabar, O., & Jenkins-Madina, M. (2001). Islamic Art and Architecture: 650–1250. Yale University Press.
- Fakhry, M. (2001). Averroes (Ibn Rushd): His Life, Works and Influence. Oneworld Publications.
- Gellner, E. (1981). Muslim Society. Cambridge University Press.
- Griffel, F. (2009). Al-Ghazali’s Philosophical Theology. Oxford University Press.
- Gutas, D. (1998). Greek Thought, Arabic Culture: The Graeco-Arabic Translation Movement in Baghdad and Early ‘Abbasid Society (2nd-4th/8th-10th centuries). Routledge.
- Halm, H. (1997). The Fatimids and their Traditions of Learning. I.B. Tauris.
- Harley, J. B., & Woodward, D. (1992). The History of Cartography, Volume 2, Book 1: Cartography in the Traditional Islamic and South Asian Societies. University of Chicago Press.
- Hill, D. R. (1974). The Book of Knowledge of Ingenious Mechanical Devices. Reidel Publishing Company.
- Hodgson, M. G. S. (1974). The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization. University of Chicago Press.
- Holmyard, E. J. (1957). Alchemy. Penguin Books.
- Hourani, G. F. (1985). Reason and Tradition in Islamic Ethics. Cambridge University Press.
- Huff, T. E. (2003). The Rise of Early Modern Science: Islam, China, and the West. Cambridge University Press.
- Irwin, R. (2018). Ibn Khaldun: An Intellectual Biography. Princeton University Press.
- Kak, S. (2005). Greek and Indian Cosmology: Review of Early History. arXiv preprint physics/0502101.
- Katz, V. J. (1998). A History of Mathematics: An Introduction. Addison-Wesley.
- Kennedy, H. (2004). The Prophet and the Age of the Caliphates: The Islamic Near East from the 6th to the 11th Century. Pearson Longman.
- King, D. A. (1993). Astronomy in the Service of Islam. Variorum.
- King, D. A. (1999). World-Maps for Finding the Direction and Distance to Mecca: Innovation and Tradition in Islamic Science. Brill.
- Kunitzsch, P. (1986). The Arabs and the Stars. Variorum Reprints.
- Kuru, A. T. (2019). Islam, Authoritarianism, and Underdevelopment: A Global and Historical Comparison. Cambridge University Press.
- Lynn, T. W. (2011). Abbas Ibn Firnas. 1001 Inventions.
- Makdisi, G. (1981). The Rise of Colleges: Institutions of Learning in Islam and the West. Edinburgh University Press.
- McGinnis, J. (2010). Avicenna. Oxford University Press.
- Menocal, M. R. (2002). The Ornament of the World: How Muslims, Jews and Christians Created a Culture of Tolerance in Medieval Spain. Little, Brown.
- Newman, W. R. (2006). The Summa Perfectionis of Pseudo-Geber: A Critical Edition, Translation and Study. Brill.
- O’Leary, D. L. (1949). How Greek Science Passed to the Arabs. Routledge & Kegan Paul.
- Palacios, M. A. (1926). Islam and the Divine Comedy. Frank Cass.
- Partington, J. R. (1970). A History of Chemistry (Vol. 1). Macmillan.
- Pormann, P. E. (2007). Islamic Medicine. Edinburgh University Press.
- Pormann, P. E., & Savage-Smith, E. (2007). Medieval Islamic Medicine. Georgetown University Press.
- Ragep, F. J. (2001). Tusi and Copernicus: The Earth’s Motion in Context. Science in Context, 14(1-2), 145-163.
- Renan, E. (1883). Islam and Science: A Lecture Presented at the Sorbonne. (S. P. Triezenberg, Trans.).
- Rosheim, M. E. (1994). Robot Evolution: The Development of Anthrobotics. John Wiley & Sons.
- Russell, G. A. (1994). The ‘Arabick’ Interest of the Natural Philosophers in Seventeenth-Century England. Brill.
- Sabra, A. I. (1987). The Appropriation and Subsequent Naturalization of Greek Science in Medieval Islam: A Preliminary Statement. History of Science, 25(3), 223-243.
- Sabra, A. I. (1989). The Optics of Ibn al-Haytham. Warburg Institute.
- Sachau, E. C. (1910). Alberuni’s India. Kegan Paul, Trench, Trübner & Co.
- Said, E. W. (1978). Orientalism. Pantheon Books.
- Saliba, G. (2007). Islamic Science and the Making of the European Renaissance. MIT Press.
- Savage-Smith, E. (1985). Islamicate Celestial Globes: Their History, Construction, and Use. Smithsonian Institution Press.
- Smith, A. M. (2001). Alhacen’s Theory of Visual Perception. American Philosophical Society.
- Starr, S. F. (2013). Lost Enlightenment: Central Asia’s Golden Age from the Arab Conquest to Tamerlane. Princeton University Press.
- Steffens, B. (2006). Ibn al-Haytham: First Scientist. Morgan Reynolds Publishing.
- Tibbetts, G. R. (1971). Arab Navigation in the Indian Ocean before the Coming of the Portuguese. Royal Asiatic Society.
- West, J. B. (2008). Ibn al-Nafis, the pulmonary circulation, and the Islamic Golden Age. Journal of Applied Physiology, 105(6), 1877-1880.

