কেন আমরা পরিবারকে ভালোবাসি?

Print Friendly, PDF & Email

ছোট বাচ্চাদের কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাপড় ভিজানো, টয়লেট করা, কান্নাকাটি করা এবং এবং বাবা মায়ের অনেক টাকা পয়সা খসিয়ে দেয়া। সাধারণত আপনি কারো সাথে সম্পর্ক করার জন্য এরকম বৈশিষ্ট্যের মানুষ নিশ্চয়ই খুঁজবেন না? তবুও সন্তান যখন থেকেই জন্ম নেয় তখন থেকেই বাবা মা তার জন্য সব কিছু এমনকি তাদের জীবনও দ্বিধা ছাড়াই ছেড়ে দেবে। যদিও কয়েক মাস আগেও তারা এই মানুষটিকে কখনো দেখে নি বা জানত না। কিন্তু কেন?

কারণটা অবশ্যই, “বিবর্তন”।

সুস্থ বংশধর উৎপন্ন করার মত যথেষ্ট সময় জীবিত থেকে আমাদের বৈশিষ্ট্য এই প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই আমরা এই “বিবর্তনের খেলায়” জিততে পারি। এটাই আসল বিষয়। কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন, লম্বা হওয়া, দাগ থাকা অথবা ছয় আঙ্গুল থাকা আমাদের অন্যদের তুলনায় এই খেলায় “জয়ী” হতে সাহায্য করে। এগুলো একটি জীবের বেঁচে থাকার এবং পুনরুত্পাদনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে যাতে তারা ভবিষ্যতে তাদের সংখ্যাধিক্য থাকে। এটা হচ্ছে চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বের মৌলিক নীতিগুলির একটি। পরের প্রজন্মে বৈশিষ্ট্যটি গিয়ে কতটা সফল হবে তা পরিমাপ করা হয় “ফিটনেস” এর মাধ্যমে। একটি বৈশিষ্ট্য যা পাস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তার বেশি ফিটনেস রয়েছে। আর যেটির সম্ভাবনা কম সেটির ফিটনেসও কম।

আজকে আমরা যা জানি এবং ডারউইন যখন তার তত্ত্বটি অনুধাবন করছিলেন, তখনও যা জানতেন না তা হল, এই সকল বৈশিষ্ট্যগুলো কিভাবে নিজেদের এবং পরিবেশের সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাদের শরীর ও আমাদের চিন্তাভাবনা কিভাবে হাজার হাজার জিনগুলোর সামস্টিক ফলাফল। এটা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা আসলে “সারভাইভাল মেশিন”। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আমাদের জিন ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অস্তিত্বমান। বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, জীবনের অর্থ এটাই। আপনার সন্তান আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জিন এর প্রতিনিধিত্ব করে। অন্তত, আপনার অর্ধেকটা জিনের।

এবার ধরুন, হিংস্র প্রাণীর একটি দল আপনার সন্তানকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আক্রমণ করল। আর আপনি আপনার জীবনের বিনিময়ে আপনার সন্তানকে বাঁচালেন। এই আত্মদানটি পরার্থপরতার একটি চরম উদাহরণ। পরার্থপরতা হল, যা আপনি নিজের অনিষ্টের কথা না ভেবে অন্য কারো লাভের জন্য করেন। তবে, এই ধরণের ঝুঁকি বা চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, যখন আপনি বিবর্তনের দিক দিয়ে চিন্তা করবেন, তখন সেটার কারণ তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে না। আমি প্রাণীটির খাদ্য হয়ে গেলে, আমার ভবিষ্যত পুনরুত্পাদন করার সম্ভাবনা এখন শূন্য। কারণ আমি মৃত। তাহলে আমি কেন আমার জিনের ১০০% ত্যাগ করতে প্রস্তুত এমন কারো জন্য যার শরীরে আমার মাত্র অর্ধেক জিন বিদ্যমান? এটা আমার জীবনের দিক থেকে একটি খারাপ বিনিময় মনে হতে পারে, কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যায় যে এটাই যৌক্তিক। এবং কিছু মৌলিক গণিতই এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। একটি ঘটনা প্রবাহে পরার্থপরতা জরুরি কিনা তা দুজনের সম্পর্কের সাথে জড়িত।

জীববিজ্ঞানী ডব্লিউ ডি হ্যামিলটন এই জন্য একটি সমীকরণ তৈরি করেছেন: C < r * B,
যেখানে,

আপনার ক্ষতি, C
অন্যের সুবিধা, B
এবং আপনি কতোটা সম্পর্কিত, r

আসুন এই সমীকরণটি বোঝার চেষ্টা করি। যদি আপনার ক্ষতিটা, অন্যের সুবিধা ও আপনাদের মধ্যে সম্পর্কের গুণফলের চেয়ে কম হয় তাহলে সেই আত্মত্যাগটি বিবর্তনের চোখে সমর্থনযোগ্য। যখন দুটি ব্যক্তি পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় তখন তাদের মধ্যে r হবে 0.

ধরুন, একটি বাস আপনার সাথে সম্পর্কযুক্ত নন এমন একজন ব্যক্তির দিকে এগিয়ে আসছে। আপনি নিজের জীবন দিয়ে তাকে বাঁচালেন। পরদিন সংবাদপত্রে আপনার বীরত্ব নিয়ে হয়ত কিছু খবর ছাপা করতে পারে, কিন্তু টেকনিক্যালি বিবর্তন এ ধরনের কাজে পুরষ্কার দেয় না। কিন্তু সম্পর্কটা যদি 0 এর চেয়ে বেশি হয় তবে জিনিসগুলি ভিন্নভাবে কাজ করে।

এবার ধরুন, বাসটি আপনার আপন কাজিনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এবং আপনি তাকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেলেন। যেহেতু আপনার সাথে আপনার কাজিনের জিনের মিল এক-অষ্ঠমাংশ, সেহেতু r হবে 0.125. এই ক্ষেত্রে, আপনি সম্পূর্ণ জিন হারালেন না। আপনি শুধুমাত্র “সাত-অষ্ঠমাংশ” হারালেন।

এবার আপনি যদি আপনার বোনকে বাসটি থেকে বাঁচাতেন ? আপনার বোন এবং আপনার মধ্যে একই জিনের অর্ধেকটা আছে, তাই আপনি কেবল অর্ধেকটা হারালেন। এই কথার উপর ভিত্তি করে, জীববিজ্ঞানী জেবিএস হ্যালডেন বলেছিলেন যে তিনি, “আটজন কাজিন অথবা দুইজন ভাইয়ের জন্য তার জীবন দিতে প্রস্তুত।”

কিন্তু ধরুন, আপনাকে একটা কঠিন সিদ্বান্ত নিতে দেয়া হল। দুটি বাস, যেটির একটি আপনার সন্তানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অপরটি আপনার ভাইয়ের দিকে। কাকে বাঁচাবেন? আপনার ভাই ও আপনার সন্তান উভয়ই আপনার জিনের ৫০% বহন করে। দুজনের ক্ষেত্রেই আপনি ৫০% হারাবেন। কিভাবে সিদ্ধান্ত নিবেন? আমি সত্যিই আশা করি আপনার এই সিদ্বান্তটি কখনোই নিতে হবে না। কিন্তু আমার মনে হয় বেশিরভাগ বাবা-মাই এই ক্ষেত্রে তাদের সন্তানকে বাঁচাবে । কারন আপনার সন্তান একটা ছোট্ট শিশু যার সারা জীবন তার সামনে পড়ে রয়েছে এবং অন্যদিকে আপনার ভাই ও আপনি হচ্ছেন প্রাপ্তবয়স্ক। এবং আপনাদের মধ্যে আপনার সন্তানটিরই “প্রজনন সম্ভাব্যতা” সবচেয়ে বেশি। অন্যভাবে বললে, আপনাদের মধ্যে আপনার সন্তানটিরই এখন থেকে ভবিষ্যতে সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই হল একটি জায়গা যেখানে আমরা প্রজন্মের মধ্যে জিনের প্রভাব দেখতে পাই। সন্তানটির ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রত্যেকটি আপনার জিনের প্রায় ২৫% বহন করবে। যদি তার দুটি বাচ্চাও হয় তাহলে আপনার বলিদান স্বার্থক, কারণ ৫০% হয়ে গেল। এর চেয়ে বেশি সন্তান যদি সে নেয় তাহলে আপনি সত্যিকার অর্থে এগিয়েও থাকতে পারবেন। এই সকল “সম্ভাব্য” নাতি-নাতনি কিংবা তাদের ছেলেমেয়েদের অর্থ হল আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার কারণে আপনার সন্তানের জন্য আপনার আত্মত্যাগ তুলনামূলক ভাল একটি সিদ্বান্ত।

এখানে আমরা পরার্থপরতার কিছু চরম উদাহরণ দেখলাম। কিন্তু এই কাজগুলো প্রাণীকুলের মধ্যেও অহরহ দেখা যায়। মিরক্যাট “রক্ষীরা” কলোনির উপর নজর রাখে যাতে তারা শিকারী দেখতে পেলে অন্যদের সতর্ক করতে পারে। এই কাজটি তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করে। রক্তখেকো বাদুড় তাদের প্রতিবেশী, যারা পর্যাপ্ত খাবার পায় না তাদের কাছে খাবার সরবরাহ করে এবং স্ক্রাব জে এর বাচ্চারা বড় হয়ে ওঠার পরও বাসা ত্যাগ না করে পর তাদের নতুন ভাইবোনদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। একটি গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা যদি সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কিত না হয় তবে তারা এই কাজ কেন করে এটি ব্যাখ্যা করা কঠিন হবে। কিন্ত, যদি গোস্টির সদস্যরা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়, এমনকি দূরত্বযুক্ত সম্পর্কতেও জিনগুলির মধ্যে যেগুলো পরার্থপরতাজনিত আচরণ যেমন, বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া, দলের সদস্যদের রক্ষা করা, খাদ্য ভাগ করা ইত্যাদি একটি জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির নিজের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা না বাড়িয়ে বরং যাতে করে ওই ব্যাক্তিটির জিন তার আত্মীয়দের মাধ্যমে রক্ষা পায়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলে “কিন সিলেকশন”। “কিন সিলেকশন” আমাদের জটিল মানবিক আচরণগুলো কিভাবে বিবর্তিত হতে পারে তা বোঝার জন্য আমাদের সাহায্য করতে পারে।

অবশ্য আমরা উদাহরণের এই রকম অবস্থায় মাথার মধ্যে সমীকরণ দিয়ে হিসাব করে দেখছি না যে আমাদের কাউকে সাহায্য করা উচিত, কি উচিত না। এবং আমরা ভালবাসা বা উদারতার মত একটি জটিল বিষয়কে দু একটা জিন এ উদাহরণ দিয়ে বুঝতেও পারব না। কিন্তু এটা বুঝতে পারা যায় যে মানুষের আচরণ অন্যান্য প্রাণীদের মতোই একইভাবে বিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অন্যদের সাহায্য করা আমাদেরও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে এবং সেটা শুধু এই প্রজন্মে নয়। এই প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করে যে আমাদের কিছু অংশ এর পরবর্তী, এবং পরবর্তী, এবং পরবর্তী প্রজন্মেও বেঁচে থাকবে।

সুতরাং, কেন আমরা আমাদের পরিবারকে ভালবাসি? কেন আমি বা অন্য কোনো পিতামাতা আমাদের সন্তানদের জন্য সব কিছু উৎসর্গ করবে? এর কারণ, “বিবর্তন”। আংশিক হলেও। এবং আপনি EVOLution বানানও LOVE ছাড়া করতে পারবেন না।

(“Its Okay to Be Smart” ইউটিউব চ্যানেল থেকে অনূদিত।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *