ডারউইন ও বিবর্তন: যে গল্পটা আমাদের সবার
সূচিপত্র
- 1 ভূমিকা
- 2 ডারউইনের পেছনের পৃথিবী: যে ভাবনারা জন্ম দিয়েছিল বিবর্তনের
- 3 এক কৌতূহলী তরুণের সমুদ্রযাত্রা
- 4 তত্ত্বের জন্ম—প্রাকৃতিক ও যৌন নির্বাচন
- 5 পাথরের পাতায় লেখা ইতিহাস—বিবর্তনের প্রমাণ
- 6 আমাদের গল্প—মানব বিবর্তনের পথ
- 7 ভুল ধারণার কুয়াশা এবং বিতর্কের ঝড়
- 8 ডারউইনের পরেও বিবর্তন: যে গল্পটা এখনও শেষ হয়নি
- 9 বিবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ: যে অদৃশ্য স্রোত আমাদের জীবনকে চালাচ্ছে
- 9.1 চিকিৎসাবিজ্ঞান: জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে বিবর্তনের পাঠ
- 9.2 কৃষি ও খাদ্য সুরক্ষা: আমাদের প্লেটে বিবর্তনের ছাপ
- 9.3 সংরক্ষণ জীববিজ্ঞান: বিপন্ন প্রজাতিকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়
- 9.4 কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: সিলিকনে লেখা বিবর্তনের কোড
- 9.5 মনোবিজ্ঞান: আমরা কেন এমন, তার উত্তর সন্ধানে
- 9.6 মহাকাব্যের চলমান অধ্যায়
- 10 সমাজবিজ্ঞানে ডারউইনের ভূত: এক বিপজ্জনক ভাবনার জন্ম ও বিবর্তন
- 11 উপসংহার: এক বিস্ময়কর সংযোগের গল্প
- 12 তথ্যসূত্র
ভূমিকা
পৃথিবীর বয়স কত? কিংবা এই যে আমরা মানুষ, আমাদের শুরুটা কোথায়? আপনার আমার উঠানে যে শালিক পাখিটা রোজ সকালে কিচিরমিচির করে, তার পূর্বপুরুষ কে ছিল? পুকুরের জলে ভেসে বেড়ানো ছোট্ট শৈবাল কিংবা সুন্দরবনের রাজকীয় বাঘ—এদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে?
এসব প্রশ্ন শুনলে আমাদের মাথায় হয়তো অনেক কিছুই খেলে যায়। কেউ হয়তো বলবেন, এ আর এমন কী কঠিন প্রশ্ন! সৃষ্টিকর্তা সব সৃষ্টি করেছেন, ব্যস, হয়ে গেল। ব্যাপারটা শুনতে খুব সহজ শোনায়, মনকে এক ধরনের আরাম দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানের পথটা আরামের নয়, সে চলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে, উত্তর খুঁজে খুঁজে। তার পথটা কণ্টকাকীর্ণ, সন্দেহে ভরা, কিন্তু সেই পথেই সে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছায়। আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে একজন মানুষ আমাদের ভাবনার জগতে একটা বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নাম চার্লস রবার্ট ডারউইন।
আজকের গল্পটা তাঁকেই নিয়ে। আর তাঁর দেওয়া সেই তত্ত্বটি নিয়ে, যা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের দিকে তাকানোর দৃষ্টিভঙ্গিটাই আমূল বদলে দিয়েছে। চলুন, খুব ধীরে সুস্থে, গল্পের মতো করে পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক। এই গল্পে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কারণ যে গল্পটা বলতে যাচ্ছি, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে প্রায় চারশো কোটি বছর।
ডারউইনের পেছনের পৃথিবী: যে ভাবনারা জন্ম দিয়েছিল বিবর্তনের
কোনো বড় নদীর উৎস খুঁজতে গেলে যেমন একটিমাত্র ঝর্ণা পাওয়া যায় না, বরং অসংখ্য ছোট ছোট জলধারা মিলেমিশে এক বিশাল স্রোতের জন্ম দেয়, ঠিক তেমনি কোনো যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পেছনেও থাকে বহু মানুষের চিন্তা, দর্শন আর সময়ের স্রোত। চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা প্রায়ই ডারউইনকে একজন একাকী প্রতিভাবান হিসেবে কল্পনা করি, যিনি বিগল জাহাজে করে বিশ্ব ঘুরে এসে হঠাৎ করেই এক মহান সত্য আবিষ্কার করে ফেললেন। গল্পটা শুনতে ভালো লাগলেও, পুরোপুরি সত্যি নয়।
সত্যিটা হলো, ডারউইন যে সময়ে বেড়ে উঠছিলেন, সেই ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ড এবং ইউরোপ ছিল এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া এক তোলপাড় করা জায়গা। তাঁর তত্ত্বটি ছিল সেই সময়ের নানা দার্শনিক ধারা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং অর্থনৈতিক চিন্তার এক অসাধারণ সংশ্লেষণ। চলুন, সবার শুরুতে আমরা সেই অদৃশ্য জলধারাগুলোর খোঁজ করি, যেগুলো মিলেমিশে ডারউইনের চিন্তার নদীকে পুষ্ট করেছিল।
বিপ্লবের আগের পৃথিবী
ডারউইনের গল্প বলার আগে, তাঁর সময়ের পৃথিবীটা কেমন ছিল, সেটা একটু জেনে নেওয়া দরকার। কারণ কোনো বিপ্লবই শূন্য থেকে জন্ম নেয় না। ডারউইনের তত্ত্বটি আকাশ থেকে পড়েনি, বরং বহু পুরনো চিন্তার দেওয়ালে এটি ছিল শেষ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাত।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমা দুনিয়া মূলত বাইবেলের বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই নিজেদের ও পৃথিবীর ইতিহাসকে বুঝত। তাদের ধারণা ছিল, পৃথিবী খুব বেশি পুরনো নয়, মাত্র কয়েক হাজার বছরের এর বয়স। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি ছিল প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তা (Fixity of Species)। অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা সমস্ত জীবজন্তুকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, তারা ঠিক সেভাবেই আছে। একটি বাঘ চিরকাল বাঘই ছিল, একটি প্রজাপতি চিরকাল প্রজাপতি। তাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি, হবেও না। অ্যারিস্টটলের সময় থেকে চলে আসা ‘স্ক্যালা ন্যাচুরা’ (Scala Naturae) বা ‘প্রকৃতির মই’-এর ধারণা অনুযায়ী, জীবজগৎ একটি মইয়ের মতো সাজানো, যার সবচেয়ে নিচের ধাপে রয়েছে সরল জীব এবং সবার উপরে রয়েছে মানুষ। এই মই স্থির, অপরিবর্তনীয়।
তবে এই স্থির ধারণার দেওয়ালে ফাটল ধরছিল একটু একটু করে। ভূতত্ত্ববিদরা মাটির স্তর খুঁড়ে এমন সব প্রাণীর জীবাশ্ম (Fossil) খুঁজে পাচ্ছিলেন, যাদের মতো কোনো প্রাণী পৃথিবীতে বেঁচে নেই। এই বিলুপ্ত প্রাণীরা এল কোথা থেকে? ফরাসি প্রকৃতিবিদ জর্জেস কুভিয়ে (Georges Cuvier) এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘ক্যাটাস্ট্রোফিজম’ (Catastrophism) বা ‘মহাপ্রলয় তত্ত্ব’ এর অবতারণা করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় বিপর্যয় বা মহাপ্রলয় (যেমন মহাপ্লাবন) এসেছে, যাতে বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং পরে নতুন করে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে (Cuvier, 1813)। এই তত্ত্ব জীবাশ্মের ব্যাখ্যা দিলেও প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তার মূল ধারণাটিকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।
এরই মধ্যে আরেক ফরাসি বিজ্ঞানী জ্যাঁ-বাপতিস্ত ল্যামার্ক (Jean-Baptiste Lamarck) একটি বৈপ্লবিক ধারণা নিয়ে হাজির হলেন। তিনিই প্রথম জোরালোভাবে বলেন যে, প্রজাতি অপরিবর্তনীয় নয়, তারা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। ১৮০৯ সালে, যে বছর ডারউইনের জন্ম, সে বছরই ল্যামার্ক তাঁর বই প্রকাশ করেন। তাঁর তত্ত্বটি পরিচিত ‘অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার’ (Inheritance of Acquired Characteristics) নামে। তাঁর বিখ্যাত উদাহরণটি ছিল জিরাফকে নিয়ে। ল্যামার্ক মনে করতেন, জিরাফের পূর্বপুরুষদের গলা খাটো ছিল। উঁচু ডালের পাতা খাওয়ার জন্য তারা ক্রমাগত গলা লম্বা করার চেষ্টা করত। এই চেষ্টার ফলে তাদের গলা সামান্য লম্বা হতো। এই ‘অর্জিত’ বৈশিষ্ট্যটিই নাকি তাদের সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হতো। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চেষ্টা করতে করতে জিরাফের গলা আজকের মতো লম্বা হয়ে গেছে।
আজ আমরা জানি, ল্যামার্কের তত্ত্বটি ভুল। কারণ ব্যায়াম করে শরীর বানালে বা কোনো অঙ্গের বেশি ব্যবহার করলে সেই বৈশিষ্ট্য ডিএনএ-তে পরিবর্তন আনে না, তাই তা পরবর্তী প্রজন্মেও যায় না। কিন্তু ল্যামার্কের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। তিনিই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ বিবর্তনবাদী তত্ত্ব দিয়েছিলেন এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের কথা বলেছিলেন, যা ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একটি চিন্তা (Lamarck, 1809)।
এইরকম এক প্রেক্ষাপটেই আমাদের গল্পের নায়ক চার্লস ডারউইনের আগমন। পৃথিবীটা তখন বদলাচ্ছিল, পুরনো বিশ্বাসে চিড় ধরছিল, আর বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারগুলো এক বিরাট পরিবর্তনের মঞ্চ প্রস্তুত করছিল।
যুক্তির আলো ও জ্ঞানদীপ্তির উত্তরাধিকার
শুধু পাথরের প্রমাণ বা জিরাফের গলাই যথেষ্ট ছিল না। ডারউইনের তত্ত্বের জন্য প্রয়োজন ছিল এক নতুন ধরনের মানসিকতার, যা প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে ভয় পায় না এবং প্রকৃতির ঘটনার জন্য প্রকৃতিতেই ব্যাখ্যা খোঁজে। এই মানসিকতার জন্ম দিয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানদীপ্তি বা এনলাইটেনমেন্ট (Enlightenment)।
ভলতেয়ার, রুশো, ডেভিড হিউম, ইমানুয়েল কান্টের মতো দার্শনিকেরা ইউরোপের চিন্তার জগতে এক ঝড় তুলেছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, সত্য জানার জন্য কোনো ঐশ্বরিক বাণী বা প্রাচীন গ্রন্থের ওপর অন্ধভাবে নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। মানুষের যুক্তি (Reason), পর্যবেক্ষণ (Observation) এবং অভিজ্ঞতা (Experience)-ই হলো জ্ঞান অর্জনের সেরা পথ। এই যুক্তিবাদী মানসিকতা এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার জন্ম দেয়। এর ফলেই ভূতত্ত্ববিদ চার্লস লায়েল বাইবেলের সময়গণনাকে অগ্রাহ্য করে পৃথিবীর বয়সকে লক্ষ লক্ষ বছর পিছিয়ে দেওয়ার সাহস পেয়েছিলেন। ডারউইন ছিলেন এই জ্ঞানদীপ্তিরই সুযোগ্য উত্তরসূরি। তিনি প্রকৃতির বিশাল নাটকের পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ককে বুঝতে চেয়েছিলেন, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির সাহায্য ছাড়াই। তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃতির নিয়ম দিয়েই প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে।
প্যালির ঘড়ি ও নকশার মহাচ্যালেঞ্জ
ডারউইনের সামনে সবচেয়ে বড় দার্শনিক চ্যালেঞ্জটি ছিল ‘প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব’ (Natural Theology)। এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন উইলিয়াম প্যালি (William Paley)। ডারউইন কেমব্রিজে পড়ার সময় প্যালির লেখা বই খুঁটিয়ে পড়েছিলেন এবং মুগ্ধও হয়েছিলেন। প্যালির যুক্তিটি ছিল খুবই শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয়, যা ‘নকশার যুক্তি’ (Argument from Design) বা ‘ওয়াচমেকার অ্যানালজি’ (Watchmaker Analogy) নামে পরিচিত।
প্যালি বললেন, ধরুন আপনি একটি মাঠ দিয়ে হাঁটার সময় একটি পাথর খুঁজে পেলেন। কেউ যদি প্রশ্ন করে পাথরটি ওখানে কীভাবে এল, আপনি হয়তো বলবেন, ওটা চিরকাল ওখানেই ছিল। কিন্তু যদি আপনি একটি ঘড়ি (watch) খুঁজে পান, তাহলে কি একই কথা বলবেন? নিশ্চয়ই না। ঘড়ির জটিল কলকব্জা, কাঁটা, স্প্রিং—সবকিছু যেভাবে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে (সময় দেখানো) কাজ করার জন্য নিখুঁতভাবে সাজানো, তা দেখেই আপনি বুঝবেন যে এর পেছনে একজন বুদ্ধিমান নির্মাতা বা ঘড়ির কারিগর (watchmaker) আছেন। ঘড়িটি নিজে নিজে তৈরি হতে পারে না (Paley, 1802)।
প্যালি এই যুক্তিটি প্রকৃতির ওপর আরোপ করলেন। তিনি বললেন, একটি চোখের গঠন ঘড়ির চেয়েও অনেক বেশি জটিল ও নিখুঁত। তাহলে এই চোখ কি নিজে নিজে তৈরি হতে পারে? নিশ্চয়ই এর পেছনেও একজন মহান নকশাকার বা ঐশ্বরিক কারিগর (Divine Watchmaker) রয়েছেন, যিনি হলেন সৃষ্টিকর্তা। এই যুক্তিটি ছিল প্রজাতির অপরিবর্তনীয়তা এবং ঐশ্বরিক সৃষ্টির পক্ষে সবচেয়ে জোরালো বুদ্ধিবৃত্তিক স্তম্ভ।
ডারউইন এই যুক্তির শক্তি বুঝতেন। তিনি জানতেন, শুধু প্রজাতির পরিবর্তন হয়—এটা বলাই যথেষ্ট নয়। তাঁকে দেখাতে হবে কীভাবে কোনো ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়, চোখের মতো জটিল অঙ্গ তৈরি হতে পারে। তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি ছিল প্যালির এই চ্যালেঞ্জেরই প্রত্যক্ষ জবাব। ডারউইন দেখালেন, প্রকৃতির কোনো বুদ্ধিমান কারিগরের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কোনো পূর্বপরিকল্পনার। অন্ধ, উদ্দেশ্যহীন এবং ধাপে ধাপে কাজ করা একটি প্রক্রিয়া—প্রাকৃতিক নির্বাচন—হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে কাজ করে চোখের মতো জটিল নকশা তৈরি করতে পারে। তিনি এক অর্থে একজন ‘অন্ধ কারিগর’ (Blind Watchmaker)-এর সন্ধান দিয়েছিলেন, যিনি কোনো কিছু না দেখেই, না বুঝেই নিখুঁত জিনিস তৈরি করে চলেন (Dawkins, 1986)।
পরিবারের উত্তরাধিকার: ইরাসমাস ডারউইনের অস্পষ্ট ছায়া
বিবর্তনের চিন্তা ডারউইনের রক্তেই ছিল, বললে খুব ভুল হবে না। তাঁর নিজের দাদু, ইরাসমাস ডারউইন (Erasmus Darwin), ছিলেন তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক, কবি এবং প্রকৃতিবিদ। চার্লসের জন্মের অনেক আগেই, ১৭৯৪ সালে লেখা তাঁর ‘জুওনোমিয়া’ (Zoonomia) বইতে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে, সমস্ত উষ্ণরক্তের প্রাণী হয়তো একটিমাত্র জীবন্ত সূত্র (a single living filament) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, “Would it be too bold to imagine, that in the great length of time, since the earth began to exist… that all warm-blooded animals have arisen from one living filament…?” (E. Darwin, 1794)। অর্থাৎ, “এই কল্পনা করা কি খুব বেশি সাহসী হয়ে যাবে যে, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে… সব উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণী একটাই জীবন্ত সুতার (filament) থেকে উদ্ভূত হয়েছে?”
ইরাসমাস ডারউইন তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তিনি প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, যৌন নির্বাচন, এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো ধারণার কথাও বলেছিলেন। তবে তিনি এর কোনো সুস্পষ্ট কার্যকারণ বা মেকানিজম ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তাঁর চিন্তাগুলো ছিল অনেকটা কাব্যিক এবং দার্শনিক, কঠোর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতো নয়। কিন্তু তাঁর এই ধারণা প্রমাণ করে যে, প্রজাতির পরিবর্তনের চিন্তাটি ডারউইনের পারিবারিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলেই উপস্থিত ছিল। চার্লস ডারউইন হয়তো সরাসরি তাঁর দাদুর কাজ দ্বারা প্রভাবিত হননি বলে দাবি করতেন, কিন্তু ছোটবেলা থেকে দাদুর খ্যাতি এবং তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তার গল্প যে তাঁর অবচেতন মনে কোনো ছাপ ফেলেনি, তা বলা কঠিন।
কারখানার চিমনি ও অর্থনীতির অদৃশ্য হাত
ডারউইনের তত্ত্বকে শুধু দার্শনিক বিতর্ক বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে বোঝা যাবে না। এর শেকড় লুকিয়ে ছিল ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার গভীরে। ডারউইন যে ইংল্যান্ডে বাস করতেন, তা ছিল শিল্প বিপ্লবের (Industrial Revolution) কেন্দ্র। বাষ্পীয় ইঞ্জিন, নতুন নতুন কারখানা, গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের ঢল—সব মিলিয়ে এক তুমুল পরিবর্তন চলছিল।
এই নতুন শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদের (Industrial Capitalism) মূলমন্ত্র ছিল প্রতিযোগিতা (Competition)। পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল এবং এক নতুন বণিক শ্রেণি উঠে আসছিল। সমাজে টিকে থাকার জন্য এবং উন্নতি করার জন্য চলছিল এক নিরন্তর লড়াই। কে বেশি দক্ষ, কে বেশি উদ্ভাবনী, কে কঠোর পরিশ্রম করতে পারে—তার ওপরই নির্ভর করত সাফল্য। এই পরিবেশে বেড়ে ওঠা ডারউইনের পক্ষে প্রকৃতির মধ্যেও একই ধরনের প্রতিযোগিতা ও সংগ্রামকে দেখতে পাওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কারখানার চিমনি থেকে বের হওয়া ধোঁয়া আর শ্রমিকদের কঠিন জীবন—এই সবই ছিল ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’ (Struggle for Existence)-এর এক জীবন্ত উদাহরণ।
এই অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছিলেন অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith)। তাঁর বিখ্যাত বই ‘দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস’ (The Wealth of Nations)-এ তিনি ‘অদৃশ্য হাত’ (Invisible Hand)-এর ধারণা দেন। তিনি বলেন, একটি মুক্ত বাজারে (free market) যখন প্রত্যেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করে, তখন একটি ‘অদৃশ্য হাত’ যেন পুরো সমাজের মঙ্গল নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ সামগ্রিক উন্নতি ঘটে (Smith, 1776)। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সাথে এর এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতিতে প্রতিটি জীব নিজের টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করে, কিন্তু এর সামগ্রিক ফল হয় প্রজাতির অভিযোজন এবং নতুন প্রজাতির উদ্ভব। অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’ যেন ডারউইনের প্রকৃতিতে এক প্রাকৃতিক ও নৈর্ব্যক্তিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
তবে যে অর্থনীতিবিদের চিন্তা ডারউইনকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিল, তিনি হলেন টমাস ম্যালথাস (Thomas Malthus)। ডারউইন নিজেই স্বীকার করেছেন, ম্যালথাসের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রবন্ধটিই (An Essay on the Principle of Population) তাঁর তত্ত্বের চাবিকাঠি খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। ম্যালথাসের তত্ত্বটি ছিল বেশ নৈরাশ্যবাদী। তিনি দেখিয়েছিলেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে (১, ২, ৪, ৮, ১৬…), কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে (১, ২, ৩, ৪, ৫…)। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং যুদ্ধ। অর্থাৎ, জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রকৃতির নিজস্ব কিছু নির্মম উপায় আছে এবং মানুষের জীবন এক নিরন্তর সংগ্রামের নামান্তর (Malthus, 1798)।
ম্যালথাসের এই বিষণ্ণ পর্যবেক্ষণ মূলত মানুষের সমাজ নিয়েই ছিল এবং এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। তৎকালীন ইংল্যান্ডে গরিবদের জন্য যে সাহায্য (Poor Laws) দেওয়া হতো, ম্যালথাস তার বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, গরিবদের সাহায্য করলে তারা আরও বেশি সন্তান জন্ম দেবে, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে। ডারউইন ম্যালথাসের এই প্রতিযোগিতামূলক এবং নির্মম মডেলটিকে পুরো জীবজগতের ওপর প্রয়োগ করলেন। তিনি বুঝলেন, এই ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’ শুধু মানুষের সমাজে নয়, প্রতিটি গাছপালা ও পশুপাখির জীবনেও সত্য। আর এই সংগ্রামের কারণেই প্রকৃতির সামান্য সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যও টিকে থাকার লড়াইয়ে বিরাট পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্র
সর্বোপরি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ (British Imperialism)-এর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এইচ.এম.এস. বিগলের মতো জরিপ জাহাজগুলো ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসারের হাতিয়ার। তাদের কাজ ছিল নতুন সমুদ্রপথের মানচিত্র তৈরি করা, প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ করা এবং ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তার করা। এই সাম্রাজ্যবাদী প্রসারের কারণেই ডারউইনের মতো প্রকৃতিবিদরা বিশ্বের দূর-দূরান্তের প্রায় অজানা সব জীববৈচিত্র্যের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের অদ্ভুত ফিঞ্চ পাখি বা অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারু—এই বিপুল বৈচিত্র্য ইউরোপের চেনা জগতের বাইরে ছিল। এই বৈশ্বিক তথ্যভান্ডারই ডারউইনকে স্থানীয় ও অপরিবর্তনীয় প্রজাতির ধারণার অসারতা বুঝতে সাহায্য করেছিল এবং একটি সর্বজনীন, গতিশীল তত্ত্ব গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সাম্রাজ্য না থাকলে বিগলের সফর হতো না, আর বিগলের সফর না হলে ডারউইনের তত্ত্ব হয়তো অন্য কোনো রূপে, অন্য কোনো সময়ে আসত।
ভাবনার সংশ্লেষণ
তাহলে দেখা যাচ্ছে, চার্লস ডারউইন কোনো শূন্যতার মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁর তত্ত্ব আবিষ্কার করেননি। তিনি ছিলেন সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকা একজন অসাধারণ মেধাবী মানুষ, যিনি তাঁর সময়ের বিভিন্ন স্রোতকে এক বিন্দুতে মেলাতে পেরেছিলেন।
জ্ঞানদীপ্তির যুক্তিবাদ তাঁকে প্রশ্ন করার সাহস জুগিয়েছিল। প্যালির নকশার যুক্তি তাঁকে একটি সমাধানযোগ্য, বড় সমস্যা দিয়েছিল। তাঁর দাদুর অস্পষ্ট ধারণা তাঁকে একটি পারিবারিক উত্তরাধিকার দিয়েছিল। আর শিল্প বিপ্লবের প্রতিযোগিতা, অ্যাডাম স্মিথের অর্থনৈতিক মডেল এবং ম্যালথাসের নির্মম জনসংখ্যাতত্ত্ব তাঁকে সেই সমস্যার সমাধানের মূল সূত্রটি—প্রাকৃতিক নির্বাচন—খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁকে দিয়েছিল সেই সূত্রের সত্যতা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় বৈশ্বিক তথ্য।
ডারউইন এই সবগুলোকে একসাথে গেঁথে এক অসামান্য মালায় পরিণত করেছিলেন, যার নাম ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’। তাঁর প্রতিভা কোনো অলৌকিক কিছু ছিল না, বরং ছিল একজন মহান সংশ্লেষকের প্রতিভা, যিনি বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ধারণার মধ্যেকার সংযোগটি দেখতে পেয়েছিলেন। এই গল্প আমাদের শেখায় যে, বিজ্ঞান শুধু গবেষণাগারের চার দেওয়ালে তৈরি হয় না, তার শেকড় ছড়িয়ে থাকে সমাজের দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতির গভীরে। আজকের দিনের যে ধারণাগুলো আমাদের সমাজকে চালাচ্ছে, হয়তো ভবিষ্যতের কোনো ডারউইন সেই ধারণাগুলোর মধ্যেই খুঁজে পাবেন প্রকৃতির আরও কোনো গভীর রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি। কে জানে!
এক কৌতূহলী তরুণের সমুদ্রযাত্রা
গল্পের শুরুটা করতে হবে ১৮৩১ সাল থেকে। ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারের ছেলে চার্লস ডারউইন। বাবা রবার্ট ডারউইন ছিলেন একজন সফল চিকিৎসক। তিনিও চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ডাক্তার হোক। কিন্তু ডারউইনের রক্তে মিশে ছিল প্রকৃতিপ্রেম। তাঁর ভালো লাগত বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে, পোকামাকড় আর প্রজাপতি সংগ্রহ করতে, নদীর ধারের পাথর খুঁটিয়ে দেখতে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে তিনি অপারেশনের দৃশ্য দেখে ভয়ে ও বিতৃষ্ণায় পালিয়ে আসতেন। রক্ত তাঁর সহ্য হতো না।
বাবার হতাশাকে পাশ কাটিয়ে ডারউইন গেলেন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে, ধর্মতত্ত্ব পড়ে পাদ্রি হওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানেও তাঁর মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়াল প্রকৃতিবিজ্ঞান। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন স্টিভেন্স হেনস্লো (John Stevens Henslow) এবং ভূতত্ত্বের অধ্যাপক অ্যাডাম সেজউইক (Adam Sedgwick)-এর সান্নিধ্যে আসেন। তাঁরাই ডারউইনের ভেতরের প্রকৃতিবিজ্ঞানীকে চিনতে পারেন এবং তাকে আরও উসকে দেন।
এমনই এক সময়ে তাঁর জীবনে এল এক অভাবনীয় সুযোগ। ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর জরিপ জাহাজ ‘এইচ.এম.এস. বিগল’ (HMS Beagle) দক্ষিণ আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে এক লম্বা সফরে বের হবে। তাদের দরকার একজন প্রকৃতিবিদ (Naturalist), যিনি যাত্রাপথে বিভিন্ন অঞ্চলের গাছপালা, পশুপাখি, মাটি আর পাথরের নমুনা সংগ্রহ করবেন এবং সেগুলো নিয়ে গবেষণা করবেন। অধ্যাপক হেনস্লো ডারউইনকে এই পদের জন্য সুপারিশ করলেন। কিন্তু ডারউইনের বাবা এই ‘লক্ষ্মীছাড়া’ সফরে ছেলেকে পাঠাতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে, এটি ছিল ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার একটি পাঁয়তারা। শেষ পর্যন্ত মামা জোসায়া ওয়েজউড (Josiah Wedgwood II)-এর হস্তক্ষেপে বাবা রাজি হলেন।
২২ বছর বয়সী ডারউইন একরাশ উত্তেজনা আর সামান্য ভয় নিয়ে বিগলে চড়লেন। তিনি নিজেও জানতেন না, এই পাঁচ বছরের সফর শুধু তাঁর নিজের জীবন নয়, পুরো মানবজাতির চিন্তার ইতিহাসকেই বদলে দেবে। এই সফরে তিনি যেমন প্রকৃতির বিশালতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তেমনই হয়েছিলেন একাকীত্বের। ভয়ঙ্কর সমুদ্রপীড়া (seasickness) ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁর কৌতূহলকে দমাতে পারেনি।
বিগল ভেসে চলল সমুদ্রে। ডারউইন অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাস। ব্রাজিলের বৃষ্টিভেজা অরণ্য (Rainforest), আর্জেন্টিনার বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আন্দিজ পর্বতমালার সুউচ্চ চূড়া—সবকিছুই তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন আর ডায়েরিতে নোট নিতেন।
আর্জেন্টিনার পাম্পাস অঞ্চলে তিনি কিছু অদ্ভুত জীবাশ্ম খুঁজে পেলেন। এগুলো ছিল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছু বিশাল স্তন্যপায়ী প্রাণীর কঙ্কাল। যেমন, আজকের দিনের ছোট্ট আর্মাডিলোর (Armadillo) মতো দেখতে কিন্তু আকারে প্রায় একটা গাড়ির সমান এক বিলুপ্ত প্রাণী ‘গ্লিপটোডন’ (Glyptodon)-এর জীবাশ্ম। তিনি আজকের দিনের স্লথ (sloth)-এর পূর্বপুরুষ ‘মেগাথেরিয়াম’ (Megatherium)-এর জীবাশ্মও খুঁজে পান, যা ছিল হাতির সমান বড়। ডারউইন ভাবতে শুরু করলেন, কেন আজকের আর্মাডিলো আর বিলুপ্ত গ্লিপটোডনের মধ্যে এত মিল? কেন একই অঞ্চলে একই ধরনের কিন্তু ভিন্ন আকারের প্রাণী অতীতে ছিল এবং বর্তমানে আছে? এরা কি কোনোভাবে সম্পর্কিত? কেনই বা গ্লিপটোডনের মতো বিশাল প্রাণীগুলো আজ আর নেই? এই প্রশ্নগুলো তাঁর মাথায় ‘প্রজাতির পরিবর্তন’ ধারণার বীজ বুনে দিয়েছিল।
এরপর বিগল পৌঁছাল আন্দিজ পর্বতমালায়। সেখানে পর্বতের প্রায় ১৩,০০০ ফুট উঁচুতে তিনি সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম খুঁজে পেলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, সমুদ্রের প্রাণী পর্বতের চূড়ায় এল কীভাবে? ততদিনে তিনি ভূতত্ত্ববিদ চার্লস লায়েল (Charles Lyell)-এর লেখা যুগান্তকারী বই ‘প্রিন্সিপাল্স অফ জিওলজি’ (Principles of Geology) বইটি পড়ছেন। লায়েল তাঁর বইতে ‘ইউনিফর্মিট্যারিয়ানিজম’ (Uniformitarianism) বা ‘ধীর ও নিয়মিত পরিবর্তনবাদ’ তত্ত্বের কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, পৃথিবী আজকের চেহারায় এসেছে কোনো আকস্মিক মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে নয়, বরং খুব ধীরে ধীরে, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলা বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তনে, যেমন—ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ক্ষয় ইত্যাদির মাধ্যমে। যে শক্তিগুলো আজ পৃথিবীতে কাজ করছে, সেই একই শক্তি অতীতেও কাজ করত। ডারউইন লায়েলের তত্ত্বের বাস্তব প্রমাণ দেখতে পেলেন। তিনি বুঝলেন, পৃথিবী আসলে অনেক অনেক প্রাচীন, বাইবেলে বর্ণিত কয়েক হাজার বছরের নয়। এই ‘গভীর সময়’ (Deep Time) ধারণাটি ছিল বিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। কারণ প্রজাতির পরিবর্তন হতে যে বিপুল পরিমাণ সময় লাগে, লায়েলের তত্ত্ব সেই সময়ের যোগান দিয়েছিল (Lyell, 1830)।
তবে ডারউইনের ভাবনার জগতে সবচেয়ে বড় নাড়া দিয়েছিল গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ (Galápagos Islands)। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা এই দ্বীপগুলো যেন ছিল প্রকৃতির এক জীবন্ত গবেষণাগার। তিনি দেখলেন, প্রতিটি দ্বীপের পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন এবং সেখানকার পশুপাখিরাও অদ্ভুতভাবে নিজেদের সেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তিনি বিভিন্ন দ্বীপের মকিংবার্ড (Mockingbird) ও কচ্ছপদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ্য করেন। একেক দ্বীপের কচ্ছপদের খোলসের আকৃতি একেক রকম।
কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল ফিঞ্চ (Finch) পাখিরা। ডারউইন লক্ষ্য করলেন, দ্বীপভেদে ফিঞ্চ পাখিদের ঠোঁটের গঠনে বেশ পার্থক্য। কোনো দ্বীপের পাখিদের ঠোঁট বেশ শক্ত ও মোটা, যা দিয়ে তারা শক্ত বীজ ভেঙে খেতে পারে। আবার অন্য দ্বীপের পাখিদের ঠোঁট চিকন ও লম্বা, যা পোকামাকড় বা ক্যাকটাসের রস খাওয়ার জন্য সুবিধাজনক। তিনি মোট ১৩ প্রজাতির ফিঞ্চ পাখি সংগ্রহ করলেন এবং অবাক হয়ে ভাবলেন, কেন এত কাছাকাছি থাকা দ্বীপগুলোতে এত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফিঞ্চ পাখি তৈরি হলো? প্রথমে তিনি এদেরকে একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ ভেবেছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে পাখি বিশেষজ্ঞ জন গোল্ড (John Gould) তাঁকে জানান যে, এগুলো শুধু ভিন্ন রূপ নয়, বরং স্বতন্ত্র প্রজাতি।
তখনই ডারউইনের মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো ভাবনাটা খেলে গেল। হয়তো কোনো এক জাতের ফিঞ্চ পাখি অনেক কাল আগে মূল ভূখণ্ড দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে এসে পড়েছিল। তারপর ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে তাদের ঠোঁটের গড়নে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এসেছে এবং কালক্রমে তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে (Species) পরিণত হয়েছে (Darwin, 1845)।
এই ভাবনাটা ছিল বৈপ্লবিক। তখন পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল, সব প্রজাতিকে সৃষ্টিকর্তা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, তারা ঠিক সেভাবেই আছে। কিন্তু ডারউইনের পর্যবেক্ষণ বলছিল অন্য কথা। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, প্রজাতি অপরিবর্তনশীল (immutable) নয়, বরং তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে। এই ধারণাটিকেই তিনি পরবর্তীতে নাম দিয়েছিলেন ‘ডিসেন্ট উইথ মডিফিকেশন’ (Descent with Modification) বা ‘পরিবর্তনসহ বংশানুক্রম’।
তত্ত্বের জন্ম—প্রাকৃতিক ও যৌন নির্বাচন
পাঁচ বছরের সফর শেষে ১৮৩৬ সালে ডারউইন ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন। কিন্তু তাঁর আসল সফরটা যেন কেবল শুরু হলো। গ্যালাপাগোসের ফিঞ্চ পাখি, আর্মাডিলোর পূর্বপুরুষ আর আন্দিজের জীবাশ্ম তাঁর মাথায় হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। তিনি তাঁর নোটবুকগুলোতে আঁকতে শুরু করলেন জীবনের শাখা-প্রশাখা ভরা বৃক্ষ—‘ট্রি অফ লাইফ’ (Tree of Life)। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তিনি খুব বড় কিছুর সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু কীভাবে এই পরিবর্তনটা ঘটে? এর পেছনের মূল চালিকাশক্তিটা কী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ডারউইন প্রায় ২০ বছর ধরে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি শুধু একজন পর্যটক ছিলেন না, ছিলেন একজন অসম্ভব খুঁতখুঁতে এবং পরিশ্রমী বিজ্ঞানী। তিনি কবুতর পালকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি দেখেন, পালকেরা, মানে যারা কবুতরদের পালন করছেন তারা নিজেদের পছন্দমতো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের (যেমন—লেজের আকৃতি, গলার রঙ) কবুতরদের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে নতুন নতুন জাতের কবুতর তৈরি করছেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কৃত্রিম নির্বাচন (Artificial Selection)। ডারউইন ভাবলেন, মানুষ যদি নিজের ইচ্ছামতো কয়েকটি প্রজন্মেই প্রাণীর চেহারায় এত পরিবর্তন আনতে পারে, তবে প্রকৃতি কি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এমন কিছু করতে পারে না? কিন্তু প্রকৃতিতে তো কোনো পালক নেই যে সে নিজের পছন্দমতো প্রাণী নির্বাচন করবে। তাহলে প্রকৃতির নির্বাচক কে?
এই প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়েছিলেন ১৮৩৮ সালে, অর্থনীতিবিদ টমাস ম্যালথাস (Thomas Malthus)-এর একটি লেখা ‘অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অফ পপুলেশন’ পড়ার সময়। ম্যালথাস তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, যেকোনো জীবের বংশবৃদ্ধির হার (যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে) তার খাদ্য উৎপাদনের হারের (যা গাণিতিক হারে বাড়ে) চেয়ে অনেক বেশি। এর অনিবার্য ফল হলো খাদ্যের অভাব এবং বেঁচে থাকার জন্য একটা নিরন্তর সংগ্রাম (Struggle for Existence) (Malthus, 1798)।
ম্যালথাসের লেখা পড়ার পর ডারউইনের মনে যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল। তিনি তাঁর তত্ত্বের মূল চালিকাশক্তিকে খুঁজে পেলেন। তিনি এর নাম দিলেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ (Natural Selection)।
তত্ত্বটা আসলে কয়েকটি সহজ যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। আসুন, আমরা তত্ত্বের মূল ভিত্তিগুলো ধাপে ধাপে বোঝার চেষ্টা করি।
- ১. প্রকরণ বা ভিন্নতা (Variation): যেকোনো একটি প্রজাতির দুটি প্রাণী কখনোই হুবহু একরকম হয় না। তাদের মধ্যে ছোটখাটো অনেক পার্থক্য থাকে। যেমন, আমাদের মধ্যেই কেউ লম্বা, কেউ খাটো; কারও গায়ের রঙ ফর্সা, কারও শ্যামলা। এই ভিন্নতাগুলো বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হতে পারে।
- ২. অতিরিক্ত উৎপাদন ও অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম (Overproduction and Struggle for Existence): সব প্রাণীই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সন্তান জন্ম দেয়। একটি সর্ষের গাছ হাজার হাজার বীজ তৈরি করে, একটি মাছ লক্ষ লক্ষ ডিম পাড়ে। কিন্তু এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রতিকূল পরিবেশে বা খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে কিংবা অন্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয়ে মারা যায়। অর্থাৎ, বেঁচে থাকার জন্য তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা বা সংগ্রাম চলে।
- ৩. যোগ্যতমের ঊদ্বর্তন (Survival of the Fittest): এই সংগ্রামের মধ্যে তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ পায়, যাদের মধ্যে এমন কিছু সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য (advantageous traits) থাকে যা তাদের ওই নির্দিষ্ট পরিবেশে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সুবিধা দেয়। ‘ফিটেস্ট’ (Fittest) বা ‘যোগ্যতম’ বলতে এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী বা সবচেয়ে বড় প্রাণী বোঝানো হচ্ছে না। ‘যোগ্যতম’ মানে হলো, যে তার পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে (best adapted)। যেমন, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের সময়কার পেপার্ড মথ (Peppered Moth)-এর কথা ধরা যাক। শিল্পায়নের আগে গাছের বাকল ছিল লাইকেনে ঢাকা, সাদা রঙের। তখন সাদা মথগুলো সহজেই ক্যামোফ্লেজ করতে পারত, আর কালো মথগুলো পাখিদের চোখে পড়ত বেশি। ফলে সাদা মথদের সংখ্যাই বেশি ছিল। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর দূষণে গাছের বাকল কালো হয়ে গেলে পরিস্থিতি উল্টে গেল। এবার কালো মথগুলো ক্যামোফ্লেজের সুবিধা পেতে শুরু করল এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এখানে ‘যোগ্যতম’ হলো সেই, যার রঙ পরিবেশের সাথে মিলে যায়।
- ৪. বংশগতি ও নতুন প্রজাতির উদ্ভব (Inheritance and Speciation): যে প্রাণীগুলো টিকে গেল, তারা তাদের সেই সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে। মানে, সন্তান পিতামাতার বৈশিষ্ট্য থেকেই কিছু বৈশিষ্ট্য পায়, আর যদি পরিবেশ বা প্রকৃতির চাপের কারণে এমন কিছু প্রাণীই বেশি টিকে থাকে যাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এবং তারাই সন্তান জন্ম দেওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মে সেই বৈশিষ্ট্যেরই প্রাণীর সংখ্যা বাড়তে থাকে—কারণ তাদের বাবা-মা টিকে থাকার ফলে বংশবিস্তারের সুযোগ বেশি পেয়েছিল। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ওই সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যগুলো আরও প্রকট হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে, হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছর পর, ওই প্রাণীগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে এতটাই আলাদা হয়ে যায় যে তারা একটি নতুন প্রজাতিতে পরিণত হয়।
এই পুরো প্রক্রিয়াটিই হলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন। কিন্তু ডারউইন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করেছিলেন। কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা প্রাণীকে টিকে থাকতে সরাসরি সাহায্য করে না, কিন্তু প্রজননে সাহায্য করে। যেমন, ময়ূরের পেখম। এত বড় ও জমকালো পেখম ময়ূরকে শিকারির হাত থেকে পালাতে সাহায্য করার বদলে অসুবিধাই তৈরি করে। তাহলে এমন বৈশিষ্ট্য কেন টিকে আছে?
এই ধাঁধার সমাধান করতে ডারউইন ‘যৌন নির্বাচন’ (Sexual Selection) নামে আরেকটি তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, কিছু বৈশিষ্ট্য টিকে থাকে কারণ সেগুলো বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করে বংশবিস্তারের সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। এটি দুইভাবে কাজ করে:
- আন্তঃলিঙ্গ নির্বাচন (Intersexual Selection): এখানে একটি লিঙ্গ (সাধারণত স্ত্রী) অন্য লিঙ্গের সদস্যদের মধ্য থেকে সঙ্গী নির্বাচন করে। ময়ূরীর পছন্দের কারণেই পুরুষ ময়ূরের সুন্দর ও বড় পেখম বিবর্তিত হয়েছে।
- অন্তঃলিঙ্গ নির্বাচন (Intrasexual Selection): এখানে একই লিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে সঙ্গীর জন্য সরাসরি প্রতিযোগিতা হয়। যেমন, দুটি পুরুষ হরিণের মধ্যে লড়াই করে বিজয়ী হরিণটিই স্ত্রী হরিণের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। এই কারণেই হরিণের বিশাল শিং বিবর্তিত হয়েছে (Darwin, 1871)।
ডারউইন প্রায় ২০ বছর ধরে তাঁর এই তত্ত্বের সপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর এই যুগান্তকারী কাজ প্রকাশ করতে দ্বিধা করছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর এই তত্ত্ব তৎকালীন ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক ধ্যানধারণায় প্রচণ্ড আঘাত হানবে। তিনি তাঁর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, প্রজাতির পরিবর্তনশীলতার কথা স্বীকার করাটা অনেকটা ‘খুনের কথা স্বীকার করার মতো’ (like confessing a murder)।
কিন্তু ১৮৫৮ সালে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (Alfred Russel Wallace) নামের আরেকজন তরুণ প্রকৃতিবিদ, যিনি মালয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছিলেন, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ডারউইনের মতো একই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছান এবং তাঁর গবেষণাপত্রটি ডারউইনের কাছে পাঠান পর্যালোচনার জন্য। ওয়ালেসের লেখা পড়ে ডারউইন স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না। তাঁর বন্ধু লায়েল ও হুকারের পরামর্শে, ১৮৫৮ সালের ১লা জুলাই, লন্ডনের লিনিয়ান সোসাইটিতে ডারউইনের সংক্ষিপ্তসার এবং ওয়ালেসের গবেষণাপত্রটি একসাথে পাঠ করা হয়। এই ঘটনায় ডারউইন ও ওয়ালেস দুজনকেই তত্ত্বের সহ-প্রবক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
অবশেষে ১৮৫৯ সালের ২৪শে নভেম্বর তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ—‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ (On the Origin of Species by Means of Natural Selection) বা সংক্ষেপে ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’—প্রকাশিত হয় (Darwin, 1859)। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্বান সমাজে এক তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। একদিকে যেমন অনেক বিজ্ঞানী ডারউইনের তত্ত্বকে সাদরে গ্রহণ করেন, তেমনই অন্যদিকে ধর্মীয় নেতারা ও রক্ষণশীল সমাজ এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। কিন্তু ডারউইন যে প্রমাণ আর যুক্তির পাহাড় দাঁড় করিয়েছিলেন, তাকে অগ্রাহ্য করা সহজ ছিল না।
পাথরের পাতায় লেখা ইতিহাস—বিবর্তনের প্রমাণ
ডারউইনের তত্ত্বটি কি নিছকই একটি অনুমান? নাকি এর পেছনে শক্ত প্রমাণ আছে? গত ১৬০ বছরে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে এত বিপুল পরিমাণ প্রমাণ পাওয়া গেছে যে বিবর্তন আজ বিজ্ঞানের জগতে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য (fact) হিসেবে গণ্য হয়। চলুন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক।
১. জীবাশ্ম বা ফসিলের প্রমাণ (Evidence from Fossils): জীবাশ্ম হলো পাথরের বুকে সংরক্ষিত অতীত দিনের প্রাণের ছাপ। পৃথিবীর বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক স্তরে পাওয়া জীবাশ্মগুলো যেন বিবর্তনের এক জীবন্ত দলিল। জীবাশ্মের রেকর্ড থেকে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণের রূপ বদলেছে। আমরা অনেক ‘অন্তর্বর্তীকালীন জীবাশ্ম’ (Transitional Fossils) খুঁজে পেয়েছি, যা দুটি ভিন্ন প্রাণীগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
- আর্কিওপটেরিক্স (Archaeopteryx): এর গায়ে ছিল পাখির মতো পালক ও ডানা, আবার মুখে ছিল সরীসৃপের মতো দাঁত এবং লেজে ছিল হাড়। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে পাখিরা সরীসৃপ-জাতীয় ডায়নোসর থেকে বিবর্তিত হয়েছে।
- টিকটালিক (Tiktaalik): এটি ছিল মাছ ও চতুষ্পদী স্থলচর প্রাণীর মধ্যবর্তী একটি প্রাণী। এর ছিল মাছের মতো আঁশ ও ফুলকা, আবার ছিল চতুষ্পদীদের মতো ঘাড় এবং পা-সদৃশ পাখনা, যা দিয়ে সে হয়তো অগভীর জলে হেঁটে বেড়াত। টিকটালিক আমাদের দেখায়, কীভাবে জল থেকে প্রাণের ডাঙায় উত্তরণ ঘটেছিল (Shubin, 2008)।
- তিমির বিবর্তন: জীবাশ্ম থেকে আমরা জানতে পারি যে, তিমির পূর্বপুরুষ ছিল স্থলচর, নেকড়ের মতো দেখতে ‘পাকিটেসাস’ (Pakicetus) জাতীয় প্রাণী। সময়ের সাথে সাথে তাদের বংশধররা (যেমন অ্যাম্বুলোসিটাস বা ‘হাঁটা-তিমি’) ক্রমশ জলের জীবনের সাথে অভিযোজিত হয়েছে, তাদের পেছনের পা ছোট হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সামনের পা ফ্লিপারে পরিণত হয়েছে।
- ঘোড়ার বিবর্তন: উত্তর আমেরিকায় পাওয়া জীবাশ্মের সারি থেকে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগেকার একটি ছোট, কুকুরের মতো আকারের, জঙ্গলে বাস করা প্রাণী (Hyracotherium) থেকে আজকের বিশাল, এক-খুরযুক্ত, ঘাসজমির বাসিন্দা ঘোড়ার উদ্ভব হয়েছে।
২. তুলনামূলক অঙ্গসংস্থান (Comparative Anatomy): বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের গঠন তুলনা করেও বিবর্তনের শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায়।
- সমসংস্থ অঙ্গ (Homologous Structures): মানুষের হাত, বাদুড়ের ডানা, তিমির ফ্লিপার আর ঘোড়ার সামনের পা—এগুলোর কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এদের ভেতরের হাড়ের গঠন বা নকশা (bone structure) আশ্চর্যজনকভাবে এক। প্রতিটিতেই একটি হিউমেরাস, একটি রেডিয়াস, একটি আলনা, কারপাল, মেটাকারপাল ও ফ্যালাঞ্জেস রয়েছে। এই মিল এটাই প্রমাণ করে যে, এরা সবাই কোনো এক সাধারণ পূর্বপুরুষ (Common Ancestor) থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে অভিযোজিত হতে গিয়ে এদের অঙ্গগুলোর বাহ্যিক রূপ বদলে গেছে।
- সমবৃত্তীয় অঙ্গ (Analogous Structures): কিছু অঙ্গ আছে যাদের কাজ এক কিন্তু গঠন ও উৎস ভিন্ন। যেমন, পাখির ডানা এবং পতঙ্গের ডানা, দুটোই ওড়ার কাজে লাগে। কিন্তু পাখির ডানা হাড় দিয়ে তৈরি, আর পতঙ্গের ডানা কাইটিন দিয়ে। এই ধরনের সাদৃশ্য সাধারণ পূর্বপুরুষের কারণে নয়, বরং ‘অভিসারী বিবর্তন’ (Convergent Evolution)-এর ফলে হয়, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী একই ধরনের পরিবেশে একই রকম সমস্যার সমাধানে একই রকম অঙ্গ তৈরি করে।
- নিষ্ক্রিয় অঙ্গ (Vestigial Structures): অনেক প্রাণীর দেহে এমন কিছু অঙ্গ পাওয়া যায় যা তাদের পূর্বপুরুষের দেহে সক্রিয় ছিল কিন্তু বর্তমানে তাদের কোনো কাজ নেই বা থাকলেও খুব সামান্য। যেমন—তিমির পেলভিক হাড়। তিমির তো পা নেই, তাহলে তার দেহে পায়ের কঙ্কালের অংশবিশেষ কেন থাকবে? কারণ, তিমির পূর্বপুরুষ ছিল স্থলচর এবং তাদের পা ছিল। মানুষের অ্যাপেন্ডিক্স, আক্কেল দাঁত, বা শীতে কাঁটা দিয়ে ওঠা (goosebumps) পেশী—এগুলোও নিষ্ক্রিয় অঙ্গের উদাহরণ।
৩. ভ্রূণতত্ত্বের প্রমাণ (Evidence from Embryology): বিবর্তনের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রমাণগুলোর একটি পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রাণীর ভ্রূণের বিকাশের মধ্যে। মাছ, কচ্ছপ, মুরগি, খরগোশ এবং মানুষের ভ্রূণ প্রাথমিক অবস্থায় দেখতে প্রায় একই রকম হয়। সবারই প্রাথমিক ভ্রূণে লেজের মতো গঠন এবং গলবিলের কাছে ফুলকার মতো খাঁজ (pharyngeal slits) দেখা যায়। যদিও পরে মানুষ বা মুরগির ভ্রূণে ফুলকা তৈরি হয় না, কিন্তু এই সাদৃশ্য প্রমাণ করে যে, সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণী এক সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং তাদের সবার বিকাশের প্রাথমিক ধাপগুলো একই জিনগত ‘রেসিপি’ অনুসরণ করে (Gilbert, 2000)।
৪. জীবভূগোলের প্রমাণ (Evidence from Biogeography): পৃথিবীতে প্রাণের ভৌগোলিক বণ্টনও বিবর্তনকে সমর্থন করে। ডারউইন যেমনটা গ্যালাপাগোসে দেখেছিলেন, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের প্রাণীরা সাধারণত নিকটবর্তী মূল ভূখণ্ডের প্রাণীদের তুলনায় বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারু বা প্লাটিপাসের মতো মার্সুপিয়াল বা থলিযুক্ত স্তন্যপায়ীদের অস্তিত্বও মহাদেশীয় সঞ্চারণ (continental drift) এবং বিচ্ছিন্ন পরিবেশে বিবর্তনের এক চমৎকার উদাহরণ। আরেকটি চমৎকার উদাহরণ হলো ‘রিং স্পিসিস’ (Ring Species)। যেমন, মধ্য এশিয়ার তিব্বত মালভূমির চারপাশে গ্রিনিশ ওয়ারব্লার (Greenish Warbler) পাখিদের দেখা যায়। এই পাখিরা মালভূমির একপাশ থেকে অন্যপাশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রতিটি অঞ্চলের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে তাদের রঙ ও গানের ধরনে সামান্য পরিবর্তন এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই শৃঙ্খলের এক প্রান্তের পাখিরা তাদের পাশের পাখিদের সাথে প্রজনন করতে পারে, কিন্তু শৃঙ্খলের দুই প্রান্তের পাখিরা যখন সাইবেরিয়ায় এসে মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরকে চিনতে পারে না এবং প্রজননও করে না—যেন তারা দুটি ভিন্ন প্রজাতি। এটি আমাদের চোখের সামনেই প্রজাতির উদ্ভবের একটি জীবন্ত উদাহরণ।
৫. আণবিক জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের প্রমাণ (Evidence from Molecular Biology and Genetics): ডারউইনের সময়ে ডিএনএ (DNA) বা জিন (Gene) সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে জেনেটিক্সের আবিষ্কার বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অকাট্য প্রমাণ হাজির করেছে।
- সার্বজনীন জেনেটিক কোড (Universal Genetic Code): ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত প্রায় সকল জীবের জেনেটিক ‘বই’ একই ভাষায় লেখা। ডিএনএ-তে থাকা চারটি বেস (A, T, C, G) যে পদ্ধতিতে প্রোটিন তৈরির সংকেত পাঠায়, তা প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই। এটি একটি শক্তিশালী প্রমাণ যে, পৃথিবীর সমস্ত জীব এক আদি কোষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
- জেনেটিক সাদৃশ্য (Genetic Similarity): দুটি প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনের সম্পর্ক যত কাছের, তাদের ডিএনএ-র মধ্যে মিলও তত বেশি। যেমন, মানুষের ডিএনএ-র সাথে শিম্পাঞ্জির ডিএনএ-র প্রায় ৯৮.৮% মিল রয়েছে (The Chimpanzee Sequencing and Analysis Consortium, 2005)। এই মিল কাকতালীয় হতে পারে না।
- সিউডোজিন (Pseudogenes): এগুলো হলো ‘ভাঙা’ বা ‘নকল’ জিন। আমাদের জিনোমে এমন অনেক জিন আছে যেগুলো কোনো একসময় সক্রিয় ছিল, কিন্তু মিউটেশনের কারণে এখন আর কাজ করে না। যেমন, ভিটামিন সি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় GULO জিনটি বেশিরভাগ স্তন্যপায়ীর দেহে সক্রিয়, কিন্তু মানুষ এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের দেহে এটি একটি সিউডোজিন। এর কারণ, আমাদের পূর্বপুরুষরা ফলমূল খেয়ে প্রচুর ভিটামিন সি পেত, তাই এই জিনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোমে ঠিক একই জায়গায় একই ধরনের ভুলসহ এই ভাঙা জিনটির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের দেহেই জিনটি ভেঙে গিয়েছিল।
- এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস (Endogenous Retroviruses – ERVs): রেট্রোভাইরাস তার নিজের জেনেটিক কোডকে পোষক কোষের ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। কখনও কখনও এই ভাইরাসগুলো জননকোষকে আক্রমণ করে, ফলে ভাইরাসের ডিএনএ-টি পোষকের ডিএনএ-র অংশ হয়ে বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোমে ঠিক একই জায়গায় একই ERV-র ‘জীবাশ্ম’ খুঁজে পেয়েছেন। এটিও সাধারণ পূর্বপুরুষের এক অকাট্য প্রমাণ (Johnson & Coffin, 1999)।
আমাদের গল্প—মানব বিবর্তনের পথ
ডারউইনের তত্ত্বের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকটি ছিল মানুষের উদ্ভব নিয়ে। ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ (The Descent of Man) বইতে ডারউইন দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, মানুষও বিবর্তনেরই ফসল এবং আমাদের পূর্বপুরুষ হলো আফ্রিকা মহাদেশের প্রাইমেট (Primate) জাতীয় প্রাণী। এই ধারণাটি ভিক্টোরীয় সমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে। কিন্তু গত শতাব্দীর জীবাশ্ম ও জেনেটিক্সের গবেষণা ডারউইনের অনুমানকেই সত্য প্রমাণ করেছে।
তাহলে আমাদের গল্পটা ঠিক কী?
গল্পের শুরু প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগে, আফ্রিকায়। তখন আমাদের এবং শিম্পাঞ্জিদের সাধারণ পূর্বপুরুষের একটি জনগোষ্ঠী বাস করত। কোনো এক কারণে (সম্ভবত পরিবেশগত পরিবর্তন) এই জনগোষ্ঠী দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি শাখা ঘন জঙ্গলে থেকে যায় এবং তাদের বংশধরেরা বিবর্তিত হয়ে আজকের শিম্পাঞ্জি ও বনোবোতে পরিণত হয়। অন্য শাখাটি চলে আসে খোলা তৃণভূমিতে, সাভানায়। এই নতুন ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদের মধ্যে কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি ছিল দুই পায়ে হাঁটা বা বাইপেডালিজম (Bipedalism)।
- অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus): প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগেকার এই প্রজাতির জীবাশ্ম, যার মধ্যে বিখ্যাত ‘লুসি’ (Lucy) অন্যতম, আমাদের দেখায় যে এরা ছিল দুই পায়ে হাঁটতে সক্ষম, যদিও তাদের মস্তিষ্ক ছিল ছোট (Johanson & Edey, 1981)। দুই পায়ে হাঁটার ফলে তাদের হাত দুটি মুক্ত হয়ে যায়, যা দিয়ে তারা খাবার সংগ্রহ, সন্তান বহন বা হাতিয়ার ব্যবহারের মতো কাজ করতে পারত।
- হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis): প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে এদের উদ্ভব। ‘হ্যাবিলিস’ শব্দের অর্থ ‘Handy Man’ বা ‘দক্ষ মানুষ’। এরাই প্রথম পাথরের হাতিয়ার তৈরি করতে শেখে। হাতিয়ার ব্যবহারের ফলে তাদের খাদ্য তালিকায় মাংস যুক্ত হয়, যা মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus): প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে এদের আগমন। এদের মস্তিষ্ক ছিল আরও বড়, শরীর ছিল আধুনিক মানুষের কাছাকাছি। এরাই প্রথম আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত এরাই প্রথম আগুনের ব্যবহার শিখেছিল, যা ছিল মানব সভ্যতার পথে এক বিশাল লাফ।
- হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস (Homo neanderthalensis): আমাদের সবচেয়ে কাছের বিলুপ্ত আত্মীয় হলো নিয়ান্ডারথাল। তারা ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় বাস করত, আমাদের চেয়েও বড় মস্তিষ্কের অধিকারী ছিল, হাতিয়ার ব্যবহার করত, মৃতের সৎকার করত এবং সম্ভবত তাদের ভাষাও ছিল। প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আধুনিক জেনেটিক্স প্রমাণ করেছে যে, ইউরেশিয়ার আধুনিক মানুষের ডিএনএ-তে ১-৪% নিয়ান্ডারথাল জিন রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে তাদের প্রজনন ঘটেছিল।
- হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens): আমরা, অর্থাৎ আধুনিক মানুষ, প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় বিবর্তিত হই। আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বড় ও জটিল মস্তিষ্ক, যা আমাদের ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও জটিল সামাজিক কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম করেছে। প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে অন্য সকল মানব প্রজাতিকে প্রতিস্থাপিত করে।
এই গল্পটা কোনো সরলরৈখিক সিঁড়ি নয়, বরং একটি ঝোপালো গাছের মতো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানব প্রজাতি পৃথিবীতে একসাথে বাস করেছে। আমরা সেই গাছের একটিমাত্র টিকে থাকা শাখা।
ভুল ধারণার কুয়াশা এবং বিতর্কের ঝড়
বিবর্তন তত্ত্বটি বিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী তত্ত্বগুলোর একটি হলেও এটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।
- ভুল ধারণা ১: “বিবর্তন নিছকই একটি তত্ত্ব (theory)।”
- বাস্তবতা: সাধারণ কথায় ‘তত্ত্ব’ মানে হলো ‘অনুমান’। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় ‘থিওরি’র অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজ্ঞানে থিওরি হলো প্রকৃতির কোনো একটি দিক সম্পর্কে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত, বারবার পরীক্ষিত এবং বহুবিধ প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত একটি ব্যাখ্যা। বিবর্তনও তেমনই একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
- ভুল ধারণা ২: “মানুষ বানর থেকে বিবর্তিত হয়েছে।”
- বাস্তবতা: বিবর্তন তত্ত্ব বলে না যে মানুষ আজকের দিনের কোনো বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে এসেছে। বরং মানুষ এবং আজকের দিনের শিম্পাঞ্জিরা লক্ষ লক্ষ বছর আগে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সম্পর্কটা কাজিনের মতো, আপনি আপনার কাজিন থেকে আসেননি, বরং আপনারা দুজনেই একই গ্র্যান্ডপা-গ্র্যান্ডমা থেকে এসেছেন।
- ভুল ধারণা ৩: “বিবর্তনে ‘হারানো সূত্র’ বা ‘মিসিং লিঙ্ক’ (Missing Link) পাওয়া যায়নি।”
- বাস্তবতা: ‘মিসিং লিঙ্ক’ শব্দটিই আসলে একটি ভুল ধারণা দেয়। জীবাশ্ম রেকর্ড স্বাভাবিকভাবেই অসম্পূর্ণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আর্কিওপটেরিক্স, টিকটালিক, লুসির মতো অসংখ্য অন্তর্বর্তীকালীন জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছি। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এমন জীবাশ্ম খুঁজে পাচ্ছি।
- ভুল ধারণা ৪: “বিবর্তন দৈবচয়নের ওপর নির্ভরশীল, তাই এটি এত জটিল জীব তৈরি করতে পারে না।”
- বাস্তবতা: এটি একটি অর্ধসত্য। বিবর্তনের কাঁচামাল, অর্থাৎ মিউটেশন (Mutation), দৈবচয়ন ভিত্তিতে ঘটে। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন দৈবচয়নের ওপর নির্ভরশীল নয়। এটি একটি ফিল্টারের মতো কাজ করে, যা দৈবক্রমে সৃষ্ট হওয়া ভিন্নতাগুলোর মধ্যে থেকে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছেঁকে নেয়। এই অ-দৈবচয়ন (non-random) প্রক্রিয়াটিই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জটিল অঙ্গ ও জীব তৈরি করতে সক্ষম।
তত্ত্বটি প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক ও ধর্মীয় বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ১৮৬০ সালের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিবর্তন বিতর্ক, যেখানে বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স এবং টমাস হেনরি হাক্সলি (যিনি ‘ডারউইনের বুলডগ’ নামে পরিচিত ছিলেন) বিতর্কে জড়ান, তা ছিল এর প্রতীকী শুরু। আমেরিকায় ১৯২৫ সালের ‘স্কোপস মাঙ্কি ট্রায়াল’ (Scopes Monkey Trial) বিবর্তন শিক্ষাকে আইনি লড়াইয়ের মুখে ফেলে। আজও বিশ্বের অনেক জায়গায় সৃষ্টিবাদ (Creationism) বা এর আধুনিক রূপ ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ (Intelligent Design)-এর প্রবক্তারা বিবর্তনকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। তবে বৈজ্ঞানিক মহলে বিবর্তন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কারণ এর সপক্ষে প্রমাণ অপ্রতিরোধ্য।
ডারউইনের পরেও বিবর্তন: যে গল্পটা এখনও শেষ হয়নি
কোনো অসাধারণ গল্পের শেষটা যেমন আরেকটি নতুন গল্পের শুরু হয়, বিজ্ঞানের জগতেও ঠিক তাই। চার্লস ডারউইন তাঁর ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ দিয়ে জীববিজ্ঞানের যে মহাকাব্য শুরু করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যায়নি। সত্যি বলতে, আসল উত্তেজনার শুরুটা হয়েছিল এর পরেই। ডারউইন আমাদের হাতে একটি শক্তিশালী চাবি ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যার নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। কিন্তু সেই চাবি দিয়ে যে তালাটা খুলতে হবে, সেই তালার ভেতরের কলকব্জা—অর্থাৎ বংশগতি বা হেরিডিটি (Heredity)—সম্পর্কে তাঁর নিজেরই কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম—আপনি জানেন যে একটি গাড়ি চলে, কিন্তু এর ইঞ্জিনটা কীভাবে কাজ করে, পেট্রোল পুড়ে কীভাবে চাকাকে ঘোরায়, তা আপনার অজানা। ডারউইন দেখেছিলেন যে, সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যগুলো বংশপরম্পরায় টিকে থাকে, কিন্তু কীভাবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে যায়, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। তাঁর সময়ের সবচেয়ে বড় এই ধাঁধাটির কারণেই ডারউইনের মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য তাঁর তত্ত্ব এক ধরনের সংকটে পড়ে, যা বিজ্ঞানীরা ‘ডারউইনবাদের গ্রহণকাল’ (The Eclipse of Darwinism) বলে থাকেন।
কিন্তু বিজ্ঞানের সৌন্দর্য এখানেই। যেখানে একটি প্রশ্ন শেষ হয়, সেখান থেকেই হাজারো নতুন অনুসন্ধানের জন্ম হয়। আর ডারউইনের রেখে যাওয়া সেই বিশাল শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এল জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা।
আধুনিক সংশ্লেষণ: ডারউইন ও মেন্ডেলের ঐতিহাসিক মিলন
গল্পের এই পর্যায়ে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে অস্ট্রিয়ার এক নিভৃতচারী ধর্মযাজক গ্রেগর মেন্ডেল (Gregor Mendel)-এর দিকে। ডারউইন যখন তাঁর তত্ত্ব নিয়ে বিশ্ব কাঁপাচ্ছেন, তখন মেন্ডেল তাঁর গির্জার বাগানে মটরশুঁটি নিয়ে গবেষণা করে বংশগতির কিছু যুগান্তকারী সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর কাজ সেই সময়ে কারও নজরেই পড়েনি। প্রায় ৩৫ বছর পর, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞানীরা নতুন করে মেন্ডেলের সূত্রগুলো খুঁজে পান এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন করেন।
তখনই ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং মেন্ডেলের বংশগতির সূত্র—এই দুটি আসলে একই গল্পের দুটি ভিন্ন অংশ। এদেরকে একসাথে জুড়তে পারলেই বিবর্তনের সম্পূর্ণ চিত্রটা পাওয়া যাবে। ১৯৩০ ও ৪০-এর দশকে রোনাল্ড ফিশার (Ronald Fisher), জে.বি.এস. হ্যালডেন (J.B.S. Haldane) এবং সিউয়াল রাইট (Sewall Wright)-এর মতো বিজ্ঞানীরা গণিত ও জনসংখ্যা জেনেটিক্স (Population Genetics) ব্যবহার করে এই দুটি ধারণাকে সফলভাবে একীভূত করেন। এই নতুন ও পরিবর্ধিত রূপটিই আধুনিক সংশ্লেষণ (Modern Synthesis) বা নয়া-ডারউইনবাদ (Neo-Darwinism) নামে পরিচিত (Huxley, 1942)।
আধুনিক সংশ্লেষণ আমাদের দেখিয়েছে যে, বিবর্তন কোনো একক প্রাণীর ওপর কাজ করে না, বরং এটি কাজ করে একটি জনগোষ্ঠীর (Population) ওপর। এই তত্ত্বের মূল ভিত্তিগুলো হলো:
- পরিব্যক্তি (Mutation): প্রাণের কাঁচামাল: ডারউইন যে ‘প্রকরণ’ বা ‘ভিন্নতা’র কথা বলেছিলেন, আধুনিক সংশ্লেষণ তার মূল উৎসকে চিহ্নিত করল। এর উৎস হলো ডিএনএ-র পরিব্যক্তি বা মিউটেশন। ডিএনএ হলো প্রাণের ‘রেসিপি বই’। মিউটেশন হলো এই বইয়ের কোনো শব্দে হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটি ‘টাইপিংয়ের ভুল’ (Typo)। এই ভুলগুলো সম্পূর্ণ দৈবচয়ন ভিত্তিতে, মানে র্যান্ডমলি (randomly) ঘটে। এদের অধিকাংশই হয় নিরপেক্ষ (neutral) বা ক্ষতিকর (harmful)। কিন্তু অতি অল্প কিছু মিউটেশন দৈবক্রমে সুবিধাজনক (advantageous) হতে পারে। যেমন, কোনো একটি মিউটেশন হয়তো একটি পোকাকে কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করল। এই নতুন বৈশিষ্ট্যই হলো বিবর্তনের কাঁচামাল, যার ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচন তার ছাঁকনি চালাতে পারে।
- প্রাকৃতিক নির্বাচন: অন্ধ কিন্তু দক্ষ কারিগর: প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে না, কিন্তু এটি দৈবচয়নের ওপরও নির্ভরশীল নয়। এটি একটি অ-দৈবচয়ন (non-random) প্রক্রিয়া। এটি সেই দৈবক্রমে সৃষ্ট হওয়া মিউটেশনগুলোর মধ্যে থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকা এবং বংশবৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে উপযোগী বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছেঁকে নেয়। যে পোকাটি কীটনাশক-প্রতিরোধী মিউটেশনের অধিকারী, সে অন্যদের চেয়ে বেশিদিন বাঁচবে এবং বেশি সন্তান জন্ম দেবে। ফলে, পরবর্তী প্রজন্মে ওই প্রতিরোধী জিনের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি জনগোষ্ঠীকে তার পরিবেশের সাথে আরও ভালোভাবে অভিযোজিত (adapted) করে তোলে।
- জিন প্রবাহ (Gene Flow): সীমানা ভাঙার খেলা: কোনো জনগোষ্ঠীই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকে না। যখন এক জনগোষ্ঠীর সদস্যরা অন্য জনগোষ্ঠীতে গিয়ে সেখানকার সদস্যদের সাথে মিলিত হয়, তখন তাদের মধ্যে জিনের আদান-প্রদান ঘটে। একেই বলে জিন প্রবাহ। ব্যাপারটি অনেকটা দুটি আলাদা রঙের বালতিতে জল মেশানোর মতো। জিন প্রবাহ দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার জেনেটিক পার্থক্য কমায় এবং তাদেরকে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
- জেনেটিক ড্রিফট (Genetic Drift): ভাগ্যের নির্মম পরিহাস: প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি জেনেটিক ড্রিফট হলো বিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। তবে এটি সম্পূর্ণ দৈবচয়ন বা চান্সের ওপর নির্ভরশীল। ছোট জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুব বেশি। ধরুন, একটি দ্বীপে একই প্রজাতির ১০টি লাল এবং ১০টি নীল রঙের পোকা আছে। হঠাৎ একটি পাখি উড়ে এসে দৈবক্রমে ৫টি নীল পোকা খেয়ে ফেলল। এর ফলে ওই জনগোষ্ঠীর জিনের ঘটন সংখ্যা (gene frequency) কিন্তু বদলে গেল, যদিও নীল রঙটি টিকে থাকার জন্য কোনো অসুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য ছিল না। এখানে ‘জিনের ঘটন সংখ্যা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা একটু ব্যাখ্যা করি। ধরুন, পোকাগুলোর রঙ (লাল না নীল) নির্ধারণ করে এমন একটি নির্দিষ্ট জিন আছে, যার দুটি ভিন্ন রূপ বা অ্যালিল (allele)—একটি লাল রঙের জন্য, আরেকটি নীল রঙের জন্য। অর্থাৎ, অ্যালিল হচ্ছে একই জিনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এখন দেখবেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনের এই অ্যালিলগুলো কত সংখ্যক প্রাণীর মধ্যে রয়েছে—মানে, কতগুলো প্রাণী লাল অ্যালিল বহন করছে আর কতগুলো নীল অ্যালিল বহন করছে—এই অনুপাতকেই বলা হয় সেই জিনের ‘ঘটন সংখ্যা’ বা জিন ফ্রিকুয়েন্সি (gene frequency)। ধরুন, কোনো পাখি আসার আগে ১০টি পোকা লাল অ্যালিল এবং ১০টি পোকা নীল অ্যালিল বহন করছিল। অর্থাৎ, তখন লাল ও নীল অ্যালিলের জিন ফ্রিকুয়েন্সি সমান ছিল। কিন্তু পাখিটি এসে ৫টি নীল অ্যালিলযুক্ত পোকা খেয়ে ফেলায়, এখন নীল অ্যালিলের বাহক রইল মাত্র ৫টি। এর ফলে সেই জিনের ফ্রিকুয়েন্সি বা ‘ঘটন সংখ্যা’ বদলে গেল। এই পরিবর্তনকেই বলা হয় ‘জেনেটিক ড্রিফট’ (genetic drift)। পাখিটি না এলে পোকাগুলোর বিবর্তন এক পথে এগোতো, কিন্তু পাখির আগমনের কারণে সেই পথ বদলে গেল। এখন যেহেতু লাল অ্যালিলধারীরা অপেক্ষাকৃত বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকছে, তারা ভবিষ্যতের প্রজন্মে বেশি প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতোই জেনেটিক ড্রিফটেও পরিবেশগত ঘটনাবলি নির্ধারণ করছে কারা টিকে থাকবে, আর কারা বিলুপ্ত হবে। যাই হোক, জেনেটিক ড্রিফটের দুটি চমৎকার উদাহরণ হলো:
- বটলনেক এফেক্ট (Bottleneck Effect): কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন—বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত) বা মহামারীর কারণে যদি একটি জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ সদস্য মারা যায়, তবে বেঁচে থাকা অল্প কিছু সদস্যের জিন পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নাও করতে পারে। ফলে, জনগোষ্ঠীর জেনেটিক বৈচিত্র্য (genetic diversity) মারাত্মকভাবে কমে যায়।
- ফাউন্ডার এফেক্ট (Founder Effect): যখন কোনো বড় জনগোষ্ঠী থেকে অল্প কিছু সদস্য বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নতুন জায়গায় (যেমন—নতুন দ্বীপ) গিয়ে বসতি স্থাপন করে, তখন তাদের জিনই ওই নতুন জনগোষ্ঠীর ভিত্তি স্থাপন করে। এই ছোট প্রতিষ্ঠাতা গোষ্ঠীর (founder population) জিনের ফ্রিকুয়েন্সি মূল জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন হতে পারে, যার ফলে বিবর্তনের পথও ভিন্ন দিকে চালিত হতে পারে।
সংশ্লেষণের পরে: গল্প যখন আরও জটিল হলো
আধুনিক সংশ্লেষণ বিবর্তন তত্ত্বকে এক শক্ত গাণিতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করালেও গল্পটা এখানেই শেষ নয়। গত ৫০-৬০ বছরে বিজ্ঞানীরা এমন সব নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছেন যা আমাদের বিবর্তন সম্পর্কে ধারণাকে আরও গভীর ও সূক্ষ্ম করেছে।
- বিরামচিহ্নিত সাম্যাবস্থা (Punctuated Equilibrium): ডারউইন মনে করতেন, বিবর্তন একটি ধীর, স্থির এবং ধারাবাহিক (gradual) প্রক্রিয়া। কিন্তু ১৯৭২ সালে জীবাশ্মবিদ নাইল্স এলড্রেজ ও স্টিফেন জে গুল্ড (Eldredge & Gould, 1972) একটি ভিন্ন মডেলের প্রস্তাব করেন। জীবাশ্ম রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা বলেন, বিবর্তন সবসময় ধীরগতিতে ঘটে না। অনেক সময় প্রজাতিগুলো লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রায় অপরিবর্তিত থাকে (সাম্যাবস্থা বা Stasis)। তারপর অপেক্ষাকৃত অল্প ভূতাত্ত্বিক সময়ে (হয়তো কয়েক হাজার বছর) দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। এই সময়টাকেই তাঁরা বলেছেন ‘বিরামচিহ্ন’ বা ‘Punctuation’। তাঁদের মতে, বিবর্তনের ইতিহাস কোনো মসৃণ ঢালু পথের মতো নয়, বরং এটি অনেকটা সিঁড়ির মতো—অনেকক্ষণ একই ধাপে থেকে হঠাৎ এক লাফে পরের ধাপে ওঠা।
- ইভো-ডেভো (Evo-Devo): প্রাণের কারখানার নকশা: বিবর্তনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর শাখাগুলোর একটি হলো ‘বিবর্তনমূলক বিকাশমান জীববিজ্ঞান’ বা ইভো-ডেভো (Evolutionary Developmental Biology)। এই শাখাটি আমাদের দেখাচ্ছে, কীভাবে ভ্রূণের বিকাশের নিয়ন্ত্রক জিনগুলোর (developmental regulatory genes) সামান্য পরিবর্তন প্রাণীর শারীরিক গঠনে (body plan) বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের সবার দেহেই এক সেট ‘মাস্টার জিন’ বা ‘জেনেটিক টুলকিট’ (genetic toolkit) আছে, যেমন—হক্স জিন (Hox genes)। এই জিনগুলো ভ্রূণ অবস্থায় ঠিক করে দেয়, কোথায় মাথা হবে, কোথায় পা হবে বা কোথায় ডানা গজাবে। মজার ব্যাপার হলো, মাছি থেকে মানুষ পর্যন্ত সবার দেহেই এই হক্স জিনগুলো প্রায় একই রকম, শুধু সংখ্যা ও বিন্যাসেই যা আলাদা। ইভো-ডেভো দেখাচ্ছে যে, নতুন জিন তৈরি হওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পুরনো জিনগুলোকে নতুন উপায়ে ব্যবহার করা। হক্স জিনের কার্যকারিতার সময় বা স্থানের সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়েই একটি জলচর প্রাণীর পাখনা থেকে স্থলচর প্রাণীর পা তৈরি হওয়া সম্ভব (Shubin, 2008)।
- এপিজেনেটিক্স (Epigenetics): ল্যামার্কের ভূতের প্রত্যাবর্তন? ল্যামার্ক বলেছিলেন, অর্জিত বৈশিষ্ট্য বংশগতি লাভ করে। আধুনিক সংশ্লেষণ এই ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছিল, কারণ পরিবেশের প্রভাবে আমাদের ডিএনএ-র কোডে কোনো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু এপিজেনেটিক্স এসে গল্পে এক নতুন মোড় যোগ করেছে। এপিজেনেটিক্স হলো ডিএনএ-র ক্রম (sequence) পরিবর্তন না করে জিনের কার্যকলাপের পরিবর্তন। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম: আপনার ডিএনএ হলো একটি বিশাল রান্নার বই। এপিজেনেটিক্স হলো সেই বইয়ের বিভিন্ন রেসিপির ওপর লাগানো ‘হাইলাইটার’ বা ‘পোস্ট-ইট নোট’, যা কোষকে বলে দেয় কোন রেসিপিটি এখন ব্যবহার করতে হবে আর কোনটি নয়। পরিবেশগত বিভিন্ন কারণ, যেমন—খাদ্যাভ্যাস বা মানসিক চাপ, এই এপিজেনেটিক চিহ্নগুলো (epigenetic marks) তৈরি করতে পারে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই চিহ্নগুলো পরবর্তী প্রজন্মেও সঞ্চারিত হতে পারে (Jablonka & Lamb, 2014)। এটি ল্যামার্কের তত্ত্বের আক্ষরিক প্রত্যাবর্তন না হলেও, এটি প্রমাণ করে যে পরিবেশ ও বংশগতির সম্পর্ক ডারউইন বা আধুনিক সংশ্লেষণের প্রবক্তারা যা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল ও রহস্যময়।
বিবর্তন তত্ত্ব আজ আর শুধু ডারউইনের তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এক বিশাল ও ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞানের ক্ষেত্র, যা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। গল্পটা চলছে, আর আমরা সেই গল্পের এক চলমান অধ্যায়ের সাক্ষী।
বিবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ: যে অদৃশ্য স্রোত আমাদের জীবনকে চালাচ্ছে
বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ডায়নোসরের কঙ্কাল, পাথরের বুকে আঁকা জীবাশ্মের ছাপ, কিংবা লুসির মতো আমাদের কোনো আদি পূর্বপুরুষের চেহারা। আমাদের মনে হয়, বিবর্তন বুঝি অনেক পুরনো, ধুলোমাখা এক ইতিহাস। লক্ষ লক্ষ বছর আগে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার গল্প, যার সাথে আজকের দিনের ব্যস্ত, আধুনিক জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু এই ধারণাটা কি সত্যি? বিবর্তন কি শুধু অতীতের গল্প? একদমই না।
সত্যিটা হলো, বিবর্তন কোনো থেমে যাওয়া ঘটনা নয়। এটি একটি চলমান, জীবন্ত প্রক্রিয়া—এক অদৃশ্য স্রোতের মতো, যা এই মুহূর্তে, আমাদের চারপাশে, এমনকি আমাদের নিজেদের শরীরের ভেতরেও কাজ করে চলেছে। এই স্রোতকে বোঝা শুধু জ্ঞানীদের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল মেটানোর জন্য নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবন, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার জন্যও এটি অপরিহার্য। এটি শুধু জীববিজ্ঞানীদের বিষয় নয়; এটি প্রকৌশলী, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী এবং এমনকি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। চলুন, কিছু বাস্তব উদাহরণের মধ্যে দিয়ে এই অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী শক্তিটির গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করা যাক।
চিকিৎসাবিজ্ঞান: জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে বিবর্তনের পাঠ
আমাদের জীবনের সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো স্বাস্থ্য। আর আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিত্তিই দাঁড়িয়ে আছে বিবর্তন তত্ত্বের ওপর। একে ছাড়া সংক্রামক রোগ থেকে শুরু করে ক্যানসারের মতো ভয়াবহ ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব।
- অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance): আমাদের সময়ের প্লেগ: ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। ধরুন, আপনার ব্যাকটেরিয়াঘটিত কোনো সংক্রমণ হলো। ডাক্তার আপনাকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। ওষুধ খাওয়ার পর আপনার বেশ আরাম হলো। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার শরীরের ভেতরে তখন কী ঘটেছে? অ্যান্টিবায়োটিকটি লক্ষ লক্ষ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে হয়তো ৯৯.৯৯% কেই মেরে ফেলেছে। কিন্তু দৈবক্রমে, কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে এমন একটি মিউটেশন (mutation) ছিল, যা তাদের ওই নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তারা হলো এই পরিস্থিতিতে ‘যোগ্যতম’ (fittest)। এখন কী হবে? আপনি হয়তো কোর্স শেষ না করেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। বেঁচে যাওয়া ওই কয়েকটি ‘সুপারবাগ’ (superbug) তখন কোনো বাধা ছাড়াই দ্রুত বংশবৃদ্ধি শুরু করবে। কিছুদিনের মধ্যেই আপনার পুরো শরীর ছেয়ে যাবে এমন সব ব্যাকটেরিয়ায়, যাদের ওপর ওই অ্যান্টিবায়োটিকটি আর কোনো কাজই করবে না। এটাই হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স—প্রাকৃতিক নির্বাচনের এক প্রকট এবং ভয়াবহ উদাহরণ, যা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে আজকের দিনের অন্যতম বড় জনস্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে (WHO, 2021)। বিবর্তন তত্ত্ব ছাড়া আমরা বুঝতেই পারতাম না, কেন আমাদের অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করা উচিত বা কেন অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা এত বিপজ্জনক।
- ভাইরাসের সাথে ইঁদুর-বিড়াল খেলা (The Viral Arms Race): ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু ভাইরাসের টিকা আমাদের প্রতি বছর কেন নতুন করে নিতে হয়, ভেবেছেন? কিংবা কোভিড-১৯ এর নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট—আলফা, ডেল্টা, ওমিক্রন—কীভাবে তৈরি হয়? এর উত্তরও লুকিয়ে আছে বিবর্তনে। ভাইরাস, বিশেষ করে আরএনএ (RNA) ভাইরাসগুলো, অত্যন্ত দ্রুত মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেদের রূপ বদলাতে পারে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system) বা টিকা যখন কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের স্ট্রেইনকে চিনে ফেলে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন ভাইরাসটি বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ‘ছদ্মবেশ’ ধারণ করে। এই নতুন স্ট্রেইনটিকে আমাদের শরীর আর চিনতে পারে না, ফলে আমরা আবার আক্রান্ত হই। এটি অনেকটা ভাইরাস ও আমাদের মধ্যে এক অন্তহীন প্রতিরক্ষার লড়াই (evolutionary arms race)-এর মতো (Lauring & Hodcroft, 2021)। এই লড়াই বোঝার জন্য এবং নতুন টিকা বা ওষুধ তৈরির জন্য ভাইরাসের বিবর্তনের পথ অনুসরণ করা ছাড়া বিজ্ঞানীদের আর কোনো উপায় নেই।
- ক্যানসার: আমাদের শরীরের ভেতরের বিবর্তন: ক্যানসারকে এখন বিজ্ঞানীরা ক্রমবর্ধমানভাবে একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। একটি টিউমার কোনো একক সত্তা নয়, বরং এটি হলো অসংখ্য কোষের একটি জনগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে প্রচুর ভিন্নতা বা প্রকরণ (variation) থাকে। যখন একজন রোগীকে কেমোথেরাপি (chemotherapy) দেওয়া হয়, তখন সেটি একটি শক্তিশালী নির্বাচন চাপ (selection pressure) হিসেবে কাজ করে। কেমোর বিষক্রিয়ায় টিউমারের বেশিরভাগ কোষই মারা যায়। কিন্তু কিছু কোষ হয়তো দৈবক্রমে এমন কোনো মিউটেশনের অধিকারী হয়, যা তাদের কেমো থেকে বাঁচিয়ে দেয়। এই প্রতিরোধী কোষগুলোই তখন দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং রোগটি আবার ফিরে আসে, যা প্রায়ই চিকিৎসার নাগালের বাইরে চলে যায়। ক্যানসারের এই বিবর্তনীয় চরিত্র বুঝতে পারাটা নতুন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি, যেমন ‘অ্যাডাপটিভ থেরাপি’ (adaptive therapy), তৈরিতে সাহায্য করছে, যেখানে লক্ষ্য থাকে ক্যানসারকে পুরোপুরি নির্মূল করার বদলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা (Gatenby & Brown, 2020)।
- বিবর্তনীয় অমিল (Evolutionary Mismatch) ও আধুনিক রোগ: কেন আজকের পৃথিবীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা হৃদরোগের মতো অসংক্রামক ব্যাধি এত বাড়ছে? এর একটি বড় কারণ হলো ‘বিবর্তনীয় অমিল’ বা ইভোল্যুশনারি মিসম্যাচ। (Evolutionary Mismatch) আমাদের শরীর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে এক শিকারী-সংগ্রাহক (hunter-gatherer) পরিবেশে, যেখানে খাবার ছিল অনিয়মিত এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করতে হতো। আমাদের জিনগুলো সেই পরিবেশের জন্যই তৈরি। কিন্তু গত কয়েক হাজার বছরে, বিশেষ করে শিল্প বিপ্লবের পর, আমাদের জীবনযাত্রা আমূল বদলে গেছে। আমরা এখন উচ্চ-ক্যালোরিযুক্ত, প্রক্রিয়াজাত খাবার খাই এবং প্রায় সারাদিন বসেই কাটাই। আমাদের শরীর এই নতুন পরিবেশের জন্য তৈরি নয়। আমাদের প্রাচীন জিন (ancient genes) এবং আধুনিক জীবনযাত্রার (modern lifestyle) এই অমিল বা মিসম্যাচের কারণেই আজকের দিনের অনেক রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছে (Lieberman, 2013)।
কৃষি ও খাদ্য সুরক্ষা: আমাদের প্লেটে বিবর্তনের ছাপ
আমরা প্রতিদিন যা খাই, তার প্রায় প্রতিটি দানাই হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফসল। তবে এই বিবর্তন প্রাকৃতিক নয়, বরং কৃত্রিম।
- ফসলের উন্নতি ও কৃত্রিম নির্বাচন: আজ আমরা যে ভুট্টা খাই, তার আদি পূর্বপুরুষ ছিল ‘টিওসিন্টে’ (teosinte) নামের এক বুনো ঘাস, যার শস্য ছিল পাথরের মতো শক্ত এবং আকারে খুবই ছোট। হাজার হাজার বছর ধরে কৃষকেরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শুধুমাত্র বড় ও নরম শস্যযুক্ত টিওসিন্টে গাছগুলোর মধ্যে প্রজনন ঘটিয়েছেন। এটি ডারউইনের বর্ণিত কৃত্রিম নির্বাচন (Artificial Selection)-এর এক ধ্রুপদী উদাহরণ। একইভাবে, একটিমাত্র বুনো সরিষা (wild mustard) গাছ থেকে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ তৈরি করেছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, কেল (kale) এবং আরও অনেক সবজি। বিবর্তনের এই নীতিকে কাজে লাগিয়েই বিজ্ঞানীরা আজও খরা-সহনশীল, রোগ-প্রতিরোধী বা উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন জাত তৈরি করছেন।
- কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে লড়াই: কৃষিক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মতো ঘটনা ঘটে। যখন কোনো ফসলের খেতে বার বার একই কীটনাশক স্প্রে করা হয়, তখন পোকামাকড়ের মধ্যে সেই কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। যে কয়েকটি পোকা দৈব মিউটেশনের কারণে বেঁচে যায়, তারাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দেয়। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই পুরো কীটনাশকটি অকেজো হয়ে পড়ে। এই সমস্যা মোকাবেলায় বিজ্ঞানীরা এখন ‘ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট’ (Integrated Pest Management) বা সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার কথা বলছেন, যা বিবর্তনের নীতিকে কাজে লাগিয়ে কীটনাশকের ব্যবহার কমায় এবং প্রতিরোধের গতিকে শ্লথ করে দেয়।
সংরক্ষণ জীববিজ্ঞান: বিপন্ন প্রজাতিকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়
কোনো প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যও বিবর্তনের জ্ঞান অপরিহার্য।
- জেনেটিক বৈচিত্র্য ও টিকে থাকার লড়াই: একটি প্রজাতির টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি উপাদান হলো তার জেনেটিক বৈচিত্র্য (genetic diversity)। একটি জনগোষ্ঠীর জিনের ভাণ্ডারে যত বেশি ভিন্নতা থাকবে, ভবিষ্যতে পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও তত বেশি হবে। যখন কোনো প্রজাতির সদস্য সংখ্যা খুব কমে যায়, তখন তাদের জেনেটিক বৈচিত্র্যও কমে যায় (যাকে বলে জেনেটিক বটলনেক – genetic bottleneck)। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আফ্রিকার চিতা (Cheetah)। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সকল চিতার জিনোম প্রায় একই রকম, কারণ অতীতে কোনো এক সময়ে তাদের সংখ্যা খুব কমে গিয়েছিল। এই জেনেটিক বৈচিত্র্যের অভাবে তারা বিভিন্ন রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনেই তাদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানীরা একটি প্রজাতির জেনেটিক স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিন প্রবাহ (gene flow) ঘটিয়ে তাদের বৈচিত্র্য বাড়ানোর চেষ্টা করেন, যাতে তারা বিবর্তনের পথে টিকে থাকতে পারে।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: সিলিকনে লেখা বিবর্তনের কোড
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, বিবর্তনের নীতিগুলো আজ জীববিজ্ঞানের গণ্ডি পেরিয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। ‘জেনেটিক অ্যালগরিদম’ (Genetic Algorithm) হলো এর সেরা উদাহরণ। ধরুন, কোনো প্রকৌশলীকে একটি উড়োজাহাজের সবচেয়ে কার্যকর পাখা ডিজাইন করতে হবে। এর কোটি কোটি সম্ভাব্য ডিজাইন হতে পারে। সবগুলো পরীক্ষা করা অসম্ভব। এখানে জেনেটিক অ্যালগরিদম কাজে লাগানো হয়। কম্পিউটার প্রথমে দৈবচয়ন ভিত্তিতে শত শত ভিন্ন ভিন্ন পাখার ডিজাইন (এদেরকে বলা হয় ‘ক্রোমোজোম’) তৈরি করে। তারপর একটি সিমুলেশনের মাধ্যমে প্রতিটি ডিজাইনকে পরীক্ষা করা হয় (এটি হলো ‘পরিবেশ’)। যে ডিজাইনগুলো সবচেয়ে ভালো কাজ করে (অর্থাৎ, ‘যোগ্যতম’), সেগুলোকে ‘প্রজনন’ করার সুযোগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, তাদের কোডগুলোকে মিলিয়ে এবং সামান্য ‘মিউটেশন’ ঘটিয়ে নতুন প্রজন্মের ডিজাইন তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি হাজার হাজার বার চালানোর পর, কম্পিউটার এমন সব কার্যকর ডিজাইন ‘বিবর্তিত’ করে, যা হয়তো কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না (Holland, 1992)। এই পদ্ধতি আজ প্রকৌশল, অর্থনৈতিক মডেলিং, রোবোটিক্স এবং আরও অনেক জটিল সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মনোবিজ্ঞান: আমরা কেন এমন, তার উত্তর সন্ধানে
বিবর্তন আমাদের শরীরকে যেমন রূপ দিয়েছে, তেমনই দিয়েছে আমাদের মনকেও। ‘বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান’ (Evolutionary Psychology) আমাদের আচরণ, অনুভূতি এবং চিন্তার পেছনের গভীর কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কেন আমরা সাপ বা মাকড়সাকে সহজাতভাবে ভয় পাই, কিন্তু গাড়ি বা বিদ্যুৎকে ততটা পাই না, যদিও আধুনিক পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি অনেক বেশি বিপজ্জনক? কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য সাপ বা মাকড়সার ভয় ছিল টিকে থাকার জন্য জরুরি একটি বৈশিষ্ট্য (adaptive trait)। যারা ভয় পেত, তারা বেঁচে থাকত এবং তাদের জিন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিত। একইভাবে, আত্মীয়দের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বা পরোপকার (altruism)-এর মতো আচরণের ব্যাখ্যাও ‘আত্মীয় নির্বাচন’ (Kin Selection) তত্ত্ব দিয়ে দেওয়া যায়। এই শাখাটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, আমরা কেন এমনভাবে অনুভব করি বা আচরণ করি।
মহাকাব্যের চলমান অধ্যায়
বিবর্তনকে বোঝা মানে শুধু অতীতকে জানা নয়, বরং বর্তমানকে বিশ্লেষণ করা এবং ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করার চাবিকাঠি খুঁজে পাওয়া। এটি আমাদের শেখায়, জীবন স্থির নয়, পরিবর্তনই জীবনের একমাত্র ধ্রুবক। অ্যান্টিবায়োটিকের একটি বড়ি থেকে শুরু করে ক্যানসারের চিকিৎসা, আমাদের প্লেটের খাবার থেকে শুরু করে কম্পিউটারের অ্যালগরিদম, এমনকি আমাদের ভয় ও ভালোবাসা পর্যন্ত—সবকিছুর পেছনেই কাজ করে চলেছে বিবর্তনের এই সর্বব্যাপী নিয়ম।
এই অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী স্রোতটিকে অস্বীকার করা মানে হলো, যে নদীতে আমরা সবাই ভেসে চলেছি, সেই স্রোতের দিকেই চোখ বন্ধ করে রাখা। বিবর্তন আমাদের শুধু জীব হিসেবে আমাদের উৎসই দেখায় না, এটি আমাদের এই বিশাল জীবজগতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আমাদের স্থানটিকেও চিনিয়ে দেয়। এই উপলব্ধি আমাদের বিনয়ী করে তোলে এবং প্রকৃতির প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। এই মহাকাব্যের গল্প এখনও শেষ হয়নি, আর আমরা সবাই সেই গল্পের এক জীবন্ত চরিত্র।
সমাজবিজ্ঞানে ডারউইনের ভূত: এক বিপজ্জনক ভাবনার জন্ম ও বিবর্তন
বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব কি কখনো শুধু বিজ্ঞানের পাতায় আটকে থাকে? নাকি তা সুযোগ পেলেই গবেষণাগারের চার দেওয়াল টপকে আমাদের বসার ঘরে, রাজনীতির মঞ্চে, আর সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে? চার্লস ডারউইনের তত্ত্বের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। এটি একটি দ্বিধারী তরবারির মতো; একদিকে যেমন এটি জীববিজ্ঞানের মহাবিশ্বকে আলোকিত করেছে, তেমনই এর ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার মানব সমাজের ইতিহাসে কিছু অন্ধকারতম অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানে তাঁর তত্ত্বের ব্যবহার সেই আলো আর ছায়ারই এক অদ্ভুত, বিপজ্জনক এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষণীয় খেলা।
সমাজের সিঁড়ি: ধ্রুপদী সামাজিক বিবর্তনবাদ (Classical Social Evolutionism)
ডারউইনের তত্ত্ব প্রকাশের আগেই, এমনকি জ্ঞানদীপ্তির (Enlightenment) সময় থেকেই, ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয় ছিল—তা হলো, মানব সমাজ একটি সরল অবস্থা থেকে ক্রমশ উন্নত ও জটিল অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই ‘প্রগতির ধারণা’ (Idea of Progress) ছিল উনিশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিক আবহের একটি কেন্দ্রীয় সুর। ডারউইনের কাজ এই পুরনো ধারণাটিকে এক নতুন ‘বৈজ্ঞানিক’ পোশাক পরিয়ে দিল।
নৃবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের একেবারে শুরুর দিকে লুইস হেনরি মরগান (Lewis Henry Morgan), এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর (Edward Burnett Tylor) এবং হার্বার্ট স্পেন্সারের মতো চিন্তাবিদরা মানব সমাজের ইতিহাসকে বোঝার জন্য একটি বিবর্তনীয় কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করেন। তাঁদের এই ধারাটিই ‘ধ্রুপদী সামাজিক বিবর্তনবাদ’ নামে পরিচিত। তাঁদের মূল ধারণাটি ছিল একরৈখিক বিবর্তন’ (Unilineal Evolution)। তাঁরা মনে করতেন:
- সমস্ত মানব সমাজ একই পথ ধরে বিবর্তিত হয় এবং সকলকেই কিছু নির্দিষ্ট, পর্যায়ক্রমিক ধাপ (stages) অতিক্রম করতে হয়।
- এই ধাপগুলো সাধারণত তিনটি স্তরে ভাগ করা হতো: বর্বরতা (Savagery) → অসভ্যতা (Barbarism) → সভ্যতা (Civilization)।
- কোনো সমাজ কোন ধাপে আছে, তা নির্ধারণ করা হতো তাদের প্রযুক্তি (যেমন—আগুন, তীর-ধনুক, মৃৎশিল্প, লিখন পদ্ধতি), পারিবারিক কাঠামো (যেমন—মাতৃতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক) এবং ধর্মীয় বিশ্বাস (যেমন—সর্বপ্রাণবাদ, বহু-ঈশ্বরবাদ, একেশ্বরবাদ) দিয়ে (Tylor, 1871; Morgan, 1877)।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন সমাজগুলো আসলে একই ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের প্রতিচ্ছবি। আমাজনের কোনো আদিবাসী গোষ্ঠী হয়তো ‘বর্বরতা’র ধাপে আছে, যা কিনা ইউরোপীয়দের সুদূর অতীতের একটি চিত্র। আর ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ড হলো এই বিবর্তনের সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপ—‘সভ্যতা’।
ডারউইনের প্রভাব এখানে সরাসরি ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রয়োগের মাধ্যমে ছিল না, বরং একটি শক্তিশালী সাদৃশ্য (analogy) হিসেবে ছিল। ডারউইন যেমন দেখিয়েছিলেন, কীভাবে সরল জীব থেকে জটিল জীবের উদ্ভব হয়, সামাজিক বিবর্তনবাদীরাও তেমনই দেখাতে চেয়েছিলেন, কীভাবে সরল সামাজিক কাঠামো থেকে জটিল রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। তবে তাঁদের মডেলটি ডারউইনের শাখা-প্রশাখা যুক্ত ‘জীবন বৃক্ষ’ (Tree of Life)-এর মতো ছিল না, বরং ছিল একটি সরলরৈখিক মই বা সিঁড়ির (ladder) মতো, যেখানে সবাইকেই একই ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে হবে।
এই তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানব সমাজের বৈচিত্র্যকে একটি বৈজ্ঞানিক সূত্রের মধ্যে ফেলা এবং ইতিহাসের একটি সার্বজনীন নিয়ম আবিষ্কার করা। এটি সামাজিক ডারউইনবাদের মতো সরাসরি নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতাকে মহিমান্বিত করেনি। কিন্তু এর একটি বড় সমস্যা ছিল—এটি ছিল মারাত্মকভাবে জাতি-কেন্দ্রিক (Ethnocentric)। এটি ইউরোপীয় সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিবর্তনের চূড়ান্ত মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়েছিল এবং বাকি সমস্ত সংস্কৃতিকে ‘পিছিয়ে পড়া’ বা ‘অনুন্নত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই ধারণাটি পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে পরোক্ষভাবে নৈতিক বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিল।
এই মারাত্মক জাতি-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফ্রানৎস বোয়াস (Franz Boas)-এর মতো নৃবিজ্ঞানীরা এর তীব্র সমালোচনা করেন এবং বহু দশক ধরে সমাজবিজ্ঞানে বিবর্তনের ধারণা একরকম পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু বিবর্তনের ধারণাটি পুরোপুরি মরে যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, পুরোনো ভুলের ছাই থেকে জন্ম নিল এক নতুন ধারা, যা নব্য-বিবর্তনবাদ (Neoevolutionism) নামে পরিচিত। এর অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ছিলেন লেসলি হোয়াইট (Leslie White)। তিনি বললেন, সমাজের অগ্রগতির মাপকাঠি কোনো অস্পষ্ট নৈতিক ধারণা (‘সভ্যতা’ বা ‘বর্বরতা’) নয়, বরং তা হলো একটি বস্তুনিষ্ঠ, পরিমাপযোগ্য বিষয়: শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা (Energy Capture)। হোয়াইটের মতে, একটি সংস্কৃতি কতটা উন্নত, তা নির্ভর করে সেই সংস্কৃতি মাথাপিছু বছরে কী পরিমাণ শক্তি কাজে লাগাতে পারে তার ওপর। তিনি একটি বিখ্যাত সূত্র দেন: C = E × T, যেখানে C হলো সংস্কৃতির বিকাশের মাত্রা, E হলো ব্যবহৃত শক্তির পরিমাণ, এবং T হলো সেই শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা (White, 1949)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ (যেখানে শুধু মানুষের পেশিশক্তি ব্যবহৃত হয়) থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজ (যেখানে পশুর শক্তি ও আগুনের ব্যবহার শুরু হয়) এবং সবশেষে শিল্প সমাজ (যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়) পর্যন্ত যাত্রাটি হলো শক্তি ব্যবহারের দক্ষতারই একটি বিবর্তন।
আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ, জুলিয়ান স্টিওয়ার্ড (Julian Steward), বিষয়টিকে আরও সূক্ষ্মভাবে দেখেন। তিনি হোয়াইটের মতো সার্বজনীন নিয়মে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বহু-রৈখিক বিবর্তন (Multilineal Evolution) এবং সাংস্কৃতিক বাস্তুবিদ্যা (Cultural Ecology)-র ধারণা দেন। স্টিওয়ার্ড বলেন, সব সমাজ একই পথে এগোয় না। বরং কোনো একটি সংস্কৃতি কীভাবে বিবর্তিত হবে, তা নির্ভর করে তার নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেই পরিবেশ থেকে সম্পদ আহরণের জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তির ওপর। একই ধরনের পরিবেশে থাকা দুটি ভিন্ন সমাজ একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং প্রায়ই একই ধরনের সমাধান ‘বিবর্তিত’ করে (Steward, 1955)।
সুতরাং, নব্য-বিবর্তনবাদ ধ্রুপদী তত্ত্বের সরলরৈখিক সিঁড়িকে বাতিল করে দিয়ে বিবর্তনীয় চিন্তাকে আরও বৈজ্ঞানিক ও কম জাতি-কেন্দ্রিক একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল। এটিই পরবর্তীতে আধুনিক সাংস্কৃতিক বিবর্তন তত্ত্বের পথ তৈরি করে দেয়।
ডারউইনের অন্ধকার ছায়া: সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism)
ডারউইন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করার পর পরই কিছু সমাজচিন্তাবিদ প্রকৃতির নিয়মকে সরাসরি মানব সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার এক বিপজ্জনক খেলায় মেতে ওঠেন। এই বিকৃত প্রয়োগটিই ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ নামে কুখ্যাত। মজার ব্যাপার হলো, এই চিন্তার প্রধান প্রবক্তা ডারউইন নিজে ছিলেন না, ছিলেন তাঁর সমসাময়িক ব্রিটিশ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer)। বস্তুত, ডারউইনের বহু আগেই স্পেন্সার সমাজকে একটি জীবন্ত প্রাণীর মতো কল্পনা করতেন, যা সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থায় বিবর্তিত হয়। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব তাঁর হাতে যেন একটি মোক্ষম ‘বৈজ্ঞানিক’ অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, যা দিয়ে তিনি তাঁর পুরনো সামাজিক দর্শনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
স্পেন্সারই প্রথম ‘যোগ্যতমের ঊদ্বর্তন’ (Survival of the Fittest) কথাটি ব্যবহার করেন, যা ডারউইন পরে তাঁর বইয়ের পঞ্চম সংস্করণে যুক্ত করেছিলেন (Spencer, 1864)। কিন্তু স্পেন্সারের কাছে ‘যোগ্যতম’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। তাঁর মতে:
- মানব সমাজও প্রকৃতির মতোই এক নিরন্তর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। এখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির মধ্যে টিকে থাকার লড়াই চলছে।
- এই লড়াইয়ে যারা সফল—অর্থাৎ যারা ধনী, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান—তারাই হলো ‘যোগ্যতম’। আর যারা গরিব, দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া, তারা হলো ‘অযোগ্য’ (unfit)। প্রকৃতির নিয়মেই তাদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত।
- সমাজের উন্নতি করতে হলে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে কোনো বাধা দেওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র বা সমাজের উচিত নয় গরিবদের জন্য সাহায্য, ত্রাণ, জনস্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো বিশেষ কোনো সুযোগ তৈরি করা। কারণ তা করলে ‘অযোগ্য’রা কৃত্রিমভাবে টিকে যাবে এবং সমাজের সামগ্রিক বিবর্তন বা উন্নতি ব্যাহত হবে।
ভেবে দেখুন, কী ভয়ঙ্কর কথা! এই ধারণাটি উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ল্যাসে-ফেয়ার পুঁজিবাদ (Laissez-faire Capitalism), বর্ণবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের জন্য এক অসাধারণ নৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আমেরিকার ইস্পাত-সম্রাট অ্যান্ড্রু কার্নেগি বা তেল-সম্রাট জন ডি. রকফেলারের মতো শিল্পপতিরা প্রকাশ্যে বলতেন, তাঁদের বিপুল সম্পদ হলো প্রকৃতিরই পুরস্কার, কারণ তাঁরাই ‘যোগ্যতম’। এই দর্শন কারখানার মালিকদের বলত, শ্রমিকদের দুর্দশা তাদের নিজেদের ‘অযোগ্যতা’র ফল, এতে মালিকের কোনো দায় নেই।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এই তত্ত্বকে আরও ভয়ানকভাবে ব্যবহার করে। তারা বলতে শুরু করে, অন্য জাতিকে উপনিবেশ বানানো বা শাসন করা তাদের অধিকার, কারণ তারা ‘যোগ্যতর’ জাতি এবং পশ্চাৎপদ জাতিগুলোকে ‘সভ্য’ করে তোলা তাদের নৈতিক দায়িত্ব, যা ‘শ্বেতাঙ্গদের বোঝা’ (The White Man’s Burden) নামে পরিচিত।
এই চিন্তাধারার সবচেয়ে বীভৎস ও যৌক্তিক পরিণতি আমরা দেখতে পাই বিংশ শতাব্দীর ‘ইউজেনিক্স’ (Eugenics) বা ‘সুপ্রজননবিদ্যা’ আন্দোলনে। এর প্রবক্তা ছিলেন ডারউইনেরই নিজের কাজিন, ফ্রান্সিস গ্যালটন (Francis Galton)। তাঁর মতে, যেহেতু কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে পশুপাখির উন্নত জাত তৈরি করা যায়, তাহলে মানুষের ক্ষেত্রেও তা করা সম্ভব। ‘পজিটিভ ইউজেনিক্স’ বলত, সমাজের ‘যোগ্য’ (ধনী, শিক্ষিত, শ্বেতাঙ্গ) মানুষদের বেশি করে সন্তান উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। আর ‘নেগেটিভ ইউজেনিক্স’ বলত, ‘অযোগ্য’ (গরিব, মানসিক রোগী, অপরাধী বা ভিন্ন জাতি) মানুষদের সন্তান উৎপাদনে বাধা দিতে হবে, প্রয়োজনে জোর করে বন্ধ্যাকরণ (forced sterilization) করতে হবে (Galton, 1883)। এই আন্দোলন আমেরিকার ৩০টিরও বেশি রাজ্যে আইন হিসেবে গৃহীত হয়েছিল এবং হাজার হাজার মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে, যেখানে ‘অযোগ্য’ বা ‘নিকৃষ্ট’ জাতি (যেমন ইহুদি, জিপসি) এবং প্রতিবন্ধীদের পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করাকে প্রকৃতির নিয়ম বলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল (Hofstadter, 1944)।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা খুব জরুরি। ডারউইন নিজে কি একজন সামাজিক ডারউইনবাদী ছিলেন? উত্তর হলো, না। তিনি তাঁর ‘দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান’ (The Descent of Man) বইতে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন যে, মানুষের ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতা’র একটি বড় অংশ হলো তার সামাজিক প্রবৃত্তি (social instincts), সহানুভূতি (sympathy), এবং পরোপকার (altruism)। তিনি মনে করতেন, যে সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নৈতিকতার বন্ধন যত দৃঢ়, সেই সমাজই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে ‘যোগ্য’ হিসেবে টিকে থাকবে (Darwin, 1871)। অর্থাৎ, তিনি প্রকৃতির নির্মমতাকে নয়, বরং মানুষের সহযোগিতাকেই তার সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম দিকটি সামাজিক ডারউইনবাদীরা সুবিধামত এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
আলোর পথে ফেরা: আধুনিক বিবর্তনীয় সমাজবিজ্ঞান
সামাজিক ডারউইনবাদের কলঙ্কময় অধ্যায়ের কারণে বহুদিন পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞানে বিবর্তনের ধারণা একরকম নিষিদ্ধ বিষয় ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা নতুন ও অনেক বেশি পরিশীলিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন, সমাজকে প্রকৃতির অন্ধ অনুকরণ হিসেবে দেখাটা ভুল, কিন্তু মানুষের সামাজিক আচরণের পেছনে যে একটি বিবর্তনীয় ভিত্তি থাকতে পারে, তা অস্বীকার করাও অবৈজ্ঞানিক। এই নতুন ধারার দুটি প্রধান শাখা হলো:
সমাজজীববিজ্ঞান (Sociobiology) ও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান (Evolutionary Psychology): ১৯৭৫ সালে জীববিজ্ঞানী ই.ও. উইলসন (E. O. Wilson) তাঁর বিখ্যাত এবং বিতর্কিত বই ‘সোসিওলজি: দ্য নিউ সিন্থেসিস’ প্রকাশের মাধ্যমে এই শাখার জন্ম দেন (Wilson, 1975)। তিনি বলেন, শুধু শারীরিক গঠনই নয়, প্রাণীদের (এবং মানুষের) সামাজিক আচরণেরও একটি জিনগত ও বিবর্তনীয় ভিত্তি রয়েছে। আমাদের পরোপকার, সঙ্গী নির্বাচন, সন্তান বাৎসল্য, আগ্রাসন—এই সবকিছুর পেছনেই কাজ করে এমন সব কৌশল, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের টিকে থাকতে এবং বংশবিস্তার করতে সাহায্য করেছিল। যেমন, ‘আত্মীয় নির্বাচন’ (Kin Selection) তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, কেন আমরা আমাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে প্রস্তুত থাকি। কারণ তাদের বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের জিনের অনুলিপিকেই রক্ষা করি। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান এই ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে বলে যে, আমাদের মস্তিষ্ক হলো আমাদের শিকারী-সংগ্রাহক পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বিবর্তিত হওয়া কিছু মানসিক ‘মডিউল’-এর সমষ্টি।
সাংস্কৃতিক বিবর্তন (Cultural Evolution) বা দ্বৈত উত্তরাধিকার তত্ত্ব (Dual Inheritance Theory): এটি সমাজবিজ্ঞানে বিবর্তনের সবচেয়ে আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা, যেমন রবার্ট বয়েড ও পিটার রিচার্সন (Boyd & Richerson, 2005), বলেন যে, মানুষ এক অনন্য প্রাণী। কারণ আমাদের উত্তরাধিকারের দুটি পথ আছে:
- জিনগত উত্তরাধিকার (Genetic Inheritance): যা আমরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে ডিএনএ-র মাধ্যমে পাই। এটি ধীর এবং অনমনীয়।
- সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার (Cultural Inheritance): যা আমরা শেখার মাধ্যমে (imitation, teaching) অন্যদের কাছ থেকে অর্জন করি। যেমন—ভাষা, বিশ্বাস, প্রযুক্তি, রীতিনীতি। এটি অত্যন্ত দ্রুত এবং নমনীয়।
সাংস্কৃতিক বিবর্তন তত্ত্ব বলে, আমাদের সংস্কৃতিও অনেকটা জিনের মতোই বিবর্তিত হয়। এখানেও প্রকরণ (variation), নির্বাচন (selection) এবং উত্তরাধিকার (inheritance) কাজ করে। ধরুন, দুটি ভিন্ন ধরনের তীর-ধনুক বানানোর কৌশল। যে কৌশলটি দিয়ে শিকার করতে বেশি সুবিধা হবে, সেটিই মানুষ বেশি করে অনুকরণ করবে এবং শিখবে। ফলে, কম কার্যকর কৌশলটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে এবং উন্নততর কৌশলটি ছড়িয়ে পড়বে। এটাই হলো সাংস্কৃতিক নির্বাচন।
এটি সামাজিক ডারউইনবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ এটি বর্ণনামূলক (descriptive), নির্দেশমূলক (prescriptive) নয়। এটি বলে না যে কোনো সংস্কৃতি অন্যটির চেয়ে ‘উত্তম’। এটি শুধু ব্যাখ্যা করে, কীভাবে ধারণা, বিশ্বাস বা প্রযুক্তি একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়ায় বা পরিবর্তিত হয়। এটি আমাদের জিন-সংস্কৃতি সহ-বিবর্তন (Gene-Culture Coevolution) বুঝতে সাহায্য করে। এর সেরা উদাহরণ হলো প্রাপ্তবয়স্কদের ল্যাকটোজ হজম করার ক্ষমতা (Lactose Tolerance)। অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী শৈশবের পর দুধ হজম করতে পারে না। কিন্তু যেসব মানব জনগোষ্ঠী হাজার হাজার বছর ধরে পশুপালন ও দুগ্ধপান করার সাংস্কৃতিক অভ্যাস গড়ে তুলেছিল, তাদের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচন সেইসব মানুষকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে যাদের দেহে ল্যাকটোজ হজম করার জিনটি সক্রিয় ছিল। এখানে একটি সাংস্কৃতিক অভ্যাস একটি জিনগত বিবর্তনকে চালিত করেছে।
সুতরাং, ডারউইনের তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের জগতে এক রোলার-কোস্টার যাত্রার জন্ম দিয়েছে। প্রথমে এটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল ভয়ঙ্কর বৈষম্য এবং নির্যাতনের মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু সেই অন্ধকার যুগ পেরিয়ে আজ বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বকে ব্যবহার করছেন মানুষের সামাজিকতার জটিল ও রহস্যময় নকশা বোঝার এক শক্তিশালী ও সূক্ষ্ম চাবি হিসেবে। এটি আমাদের দেখায়, আমরা শুধু জিনের তৈরি পুতুল নই, আবার সংস্কৃতির শূন্য স্লেটও নই। আমরা এই দুই উত্তরাধিকারের এক অসাধারণ মিশ্রণ, যার গল্পটা এখনও লেখা হচ্ছে।
উপসংহার: এক বিস্ময়কর সংযোগের গল্প
ডারউইনের তত্ত্ব আমাদের শুধু জীববিজ্ঞানের কিছু নতুন তথ্য দেয়নি, এটি আমাদের নিজেদের এবং এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ভাববার এক নতুন জানালা খুলে দিয়েছে। এটি আমাদের শিখিয়েছে যে, আমরা এই পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নই। আমাদের ডিএনএ-র প্রতিটি অণুতে লেখা আছে কোটি কোটি বছরের এক দীর্ঘ অভিযাত্রার ইতিহাস। আমাদের উঠানের শালিক পাখি, পুকুরের মাছ, গাছের পাতা—সবার সাথেই আমাদের এক গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা সবাই একই জীবন বৃক্ষের ভিন্ন ভিন্ন শাখা।
বিবর্তনকে বোঝা মানে প্রকৃতির প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এটি আমাদের অহংকারকে চূর্ণ করে দিয়ে এক ধরনের বিনয় এনে দেয়। আমরা জানতে পারি, আমরা এই গল্পের শেষ চরিত্র নই, কেবল একটি চলমান অধ্যায়ের অংশ মাত্র। এই উপলব্ধিটা কি হতাশাজনক? নাকি আরও বেশি বিস্ময়কর?
হয়তো দ্বিতীয়টাই সত্যি। এই যে আমরা এক কোষী জীব থেকে শুরু করে লক্ষ কোটি বছরের পথ পাড়ি দিয়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি, এই মহাবিশ্বকে নিয়ে ভাবতে পারছি, ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারছি—এই পুরো ব্যাপারটা কি এক অবিশ্বাস্য আশ্চর্য নয়? গল্পটা এখনও শেষ হয়নি। বিবর্তনের চাকা ঘুরছে, জীবন বদলাচ্ছে, এবং এই মহাকাব্যিক আখ্যান এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। আমরা সবাই সেই গল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তথ্যসূত্র
- Boyd, R., & Richerson, P. J. (2005). Not by genes alone: How culture transformed human evolution. University of Chicago Press.
- Coyne, J. A. (2009). Why evolution is true. Viking.
- Cuvier, G. (1813). Recherches sur les ossemens fossiles de quadrupèdes (Essay on the Theory of the Earth). Deterville.
- Darwin, E. (1794). Zoonomia; or, the laws of organic life. J. Johnson.
- Darwin, C. (1845). Journal of researches into the natural history and geology of the countries visited during the voyage of H.M.S. Beagle round the world, under the Command of Capt. Fitz Roy, R.N. (2nd ed.). John Murray.
- Darwin, C. (1859). On the origin of species by means of natural selection, or the preservation of favoured races in the struggle for life. John Murray.
- Darwin, C. (1871). The descent of man, and selection in relation to sex. John Murray.
- Dawkins, R. (1986). The blind watchmaker: Why the evidence of evolution reveals a universe without design. W. W. Norton & Company.
- Dawkins, R. (2009). The greatest show on Earth: The evidence for evolution. Free Press.
- Eldredge, N., & Gould, S. J. (1972). Punctuated equilibria: an alternative to phyletic gradualism. In T.J.M. Schopf (Ed.), Models in Paleobiology (pp. 82-115). Freeman, Cooper and Company.
- Galton, F. (1883). Inquiries into human faculty and its development. Macmillan.
- Gatenby, R. A., & Brown, J. S. (2020). The evolution of cancer treatment resistance. Cold Spring Harbor Perspectives in Medicine, 10(6), a039589. https://doi.org/10.1101/cshperspect.a039589
- Gilbert, S. F. (2000). Developmental biology (6th ed.). Sinauer Associates.
- Hofstadter, R. (1944). Social Darwinism in American thought, 1860-1915. University of Pennsylvania Press.
- Holland, J. H. (1992). Genetic algorithms. Scientific American, 267(1), 66–73.
- Huxley, J. (1942). Evolution: The modern synthesis. Allen & Unwin.
- Jablonka, E., & Lamb, M. J. (2014). Evolution in four dimensions: Genetic, epigenetic, behavioral, and symbolic variation in the history of life (Revised ed.). MIT Press.
- Johanson, D. C., & Edey, M. A. (1981). Lucy: The beginnings of humankind. Simon and Schuster.
- Johnson, W. E., & Coffin, J. M. (1999). Constructing primate phylogenies from ancient retrovirus sequences. Proceedings of the National Academy of Sciences, 96(18), 10254–10260. https://doi.org/10.1073/pnas.96.18.10254
- Lamarck, J.-B. (1809). Philosophie zoologique. Dentu.
- Lauring, A. S., & Hodcroft, E. B. (2021). Genetic variants of SARS-CoV-2: What do they mean? JAMA, 325(6), 529–531. https://doi.org/10.1001/jama.2020.27124
- Lieberman, D. E. (2013). The story of the human body: Evolution, health, and disease. Pantheon Books.
- Lyell, C. (1830). Principles of geology, being an attempt to explain the former changes of the Earth’s surface, by reference to causes now in operation. John Murray.
- Malthus, T. R. (1798). An essay on the principle of population. J. Johnson.
- Morgan, L. H. (1877). Ancient society. Henry Holt and Company.
- Paley, W. (1802). Natural theology: or, evidences of the existence and attributes of the Deity, collected from the appearances of nature. R. Faulder.
- Shubin, N. (2008). Your inner fish: A journey into the 3.5-billion-year history of the human body. Pantheon Books.
- Smith, A. (1776). An inquiry into the nature and causes of the wealth of nations. W. Strahan and T. Cadell.
- Spencer, H. (1864). Principles of biology. Williams and Norgate.
- Steward, J. H. (1955). Theory of culture change: The methodology of multilinear evolution. University of Illinois Press.
- The Chimpanzee Sequencing and Analysis Consortium. (2005). Initial sequence of the chimpanzee genome and comparison with the human genome. Nature, 437(7055), 69–87. https://doi.org/10.1038/nature04072
- Tylor, E. B. (1871). Primitive culture: Researches into the development of mythology, philosophy, religion, art, and custom. John Murray.
- White, L. A. (1949). The science of culture: A study of man and civilization. Farrar, Straus and Giroux.
- Wilson, E. O. (1975). Sociobiology: The new synthesis. Belknap Press of Harvard University Press.
- World Health Organization. (2021, November 17). Antimicrobial resistance. https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/antimicrobial-resistance
- Zimmer, C. (2018). The tangled tree: A radical new history of life. Simon & Schuster.