ধর্মের সম্মুখীন হওয়া শিশুদের জন্য বাস্তব ও কল্পনাকে আলাদা করা বেশি কঠিন
শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে যদি একটু চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন, কোন কোন শিশু খুব বেশি কল্পনাবিলাশী হচ্ছে, তারা রূপকথার বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে বেশি ভাবছে, বাস্তবের সাথে এই কল্পনাগুলোকে অনেক সময়ই গুলিয়ে ফেলছে। আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে দেখবেন এই বাস্তব ও কল্পনাকে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা তাদের মধ্যে কম। শিশুদের বাস্তব ও কল্পনাকে আলাদা করার ক্ষমতা নিয়ে ২০১৪ সালের একটি গবেষণা হয়েছিল, আর এর থেকে পাওয়া গিয়েছিল, শিশুরা ধর্মের সাথে কতটা সম্মুখীন হচ্ছে তার উপর তাদের বাস্তব ও কল্পনাকে আলাদা করার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নির্ভর করে। যেসব শিশুরা ধর্মীয় বিদ্যালয়ে বা চার্চে যায় নি তাদের মধ্যে বাস্তব ও কল্পনাকে আলাদা করবার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থাকে। কগনিটিভ সায়েন্স জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষণায় গবেষকগণ ৫ থেকে ৬ বছরের শিশুদের নিয়ে চারটি দল তৈরি করেন। পাবলিক স্কুল এবং চার্চে যায় এমন শিশুদের নিয়ে একটি দল, পাবলিক স্কুলে যায় কিন্তু চার্চে যায় না এমন শিশুদের নিয়ে একটি দল, প্যারোকিয়াল বা ধর্মীয় স্কুলে যায় এবং চার্চে যায় এমন শিশুদের নিয়ে একটি দল, এবং প্যারোকিয়াল স্কুল বা ধর্মীয় স্কুলে যায়, কিন্তু চার্চে যায় না এমন শিশুদের নিয়ে একটি দল, এভাবে চারটি দল বানানো হয়।
এরপর প্রতিটি দলের শিশুদেরকেই তিনটি ভিন্ন রকমের গল্প শোনানো হয়। প্রথম ধরণের গল্প ছিল বিব্লিকাল বা ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কিত; দ্বিতীয় ধরণের গল্প ছিল কল্পনাশ্রয়ী যেখানে রূপকথা বা জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত গল্প ছিল; তৃতীয় ধরণের গল্প ছিল বাস্তব যেখানে কোন রকম অতিপ্রাকৃত চরিত্র বা ঘটনা রাখা হয়নি। এই গল্পগুলো শিশুদের শোনানোর পর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় কোন ঘটনা বা চরিত্রগুলো বাস্তব এবং কোনগুলো কাল্পনিক। তাদের উত্তর এর উপর ভিত্তি করে শিশুদের বাস্তব ও কাল্পনিক চরিত্র বা ঘটনার মধ্যে পার্থক্য করতে পারার ক্ষমতায় ধর্মের প্রভাব বিচার করা হয়।
দেখা গেল বাস্তব ঘটনার ক্ষেত্রে চারটি দলের শিশুরাই বাস্তব চরিত্র ও ঘটনাগুলো বুঝতে পারছে। এগুলো যে আসলেই বাস্তব চরিত্র বা ঘটনা তা বুঝতে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। এর পর তাদেরকে নোয়ার আর্ক বা নুহ এর নৌকার মত ধর্মীয় গল্পগুলো নিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হল। দেখা গেল এক্ষেত্রে শিশুদের বিচার দল ভেদে বিভিন্ন হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে যারা ধর্মের সম্মুখীন হয়েছে, অর্থাৎ ধর্মীয় বিদ্যালয় বা চার্চে গিয়েছে তাদের বেশিরভাগই ধর্মীয় গল্পগুলোর চরিত্র ও গল্পগুলোকে বাস্তব বলে উল্লেখ করে। অন্যদিকে সেক্যুলার শিশুরা, যারা ধর্মীয় স্কুল বা চার্চে যায় নি তাদের বেশিরভাগকেই দেখা যায় এইসব চরিত্র ও গল্পকে কাল্পনিক হিসেবে উল্লেখ করতে।
কাল্পনিক গল্প, অর্থাৎ রূপকথা ও জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন গল্পে এদের প্রতিক্রিয়া যখন বিচার করা হল, দেখা গেল যারা ধর্মীয় স্কুল বা চার্চ অন্তত একটায় গেছে তাদের তুলনায় চার্চে বা ধর্মীয় বিদ্যালয়ে যায়নি এমন শিশুরা কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনাগুলোকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। অর্থাৎ যারা চার্চ বা ধর্মীয় স্কুলে যায় নি তারা যতটা সহজে বুঝতে পারছে যে রূপকথা বা জাদুবিদ্যার গল্প ও চরিত্রগুলো অবাস্তব, তা অন্য শিশুরা সহজে বুঝতে পারছে না। দেখা গেল, ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউন্ডের শিশুরা ধর্মের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে ভুল শনাক্তকরণকে জাস্টিফাই করছে। অর্থাৎ যখন কোন রূপকথার কাল্পনিক চরিত্র বাস্তব না কাল্পনিক জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তারা তখন তাদের মাথায় অনুরূপ কোন ধর্মীয় ঘটনা বা চরিত্রের কথা মাথায় আসছে, আর তার সাথে মিলিয়ে তারা সেই রূপকথার গল্পগুলোকেও বাস্তব বলে মনে করছে।
গবেষণাটি আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে ধর্ম শিশুদের বাস্তব ও কাল্পনিক বিষয়গুলোর পৃথকীকরণ ক্ষমতায় খুব বড় রকমের প্রভাব ফেলে। মানুষের ধর্ম বিশ্বাস বা ধার্মিকতার (religiosity) উপর সমাজ বা পরিবেশ কিরকম প্রভাব ফেলতে পারে সেই বিষয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা।
গবেষকগণ অবশ্য বলছে গবেষণাটির ডিজাইন সম্পূর্ণ পারফেক্ট ছিল না, কেননা ধর্ম ছাড়াও আরও কিছু বিষয় গবেষণাটিতে আনা দরকার ছিল, তাতে ধর্মের সাথে আরও কিছু শিশুদের এরকম আচরণের সাথে জড়িত কিনা জানা যেত। তবে গবেষকগণ বলছেন, শিশুদের এই আচরণে ধর্মই সাম্ভাব্য সব থেকে বেশি অবদানকারী বিষয় ।
তথ্যসূত্র:
Judgments About Fact and Fiction by Children From Religious and Nonreligious Backgrounds