স্যাটায়ার

প্যারানয়েড বিশ্বাসের গল্প!

সুপারম্যান সমাচার

আমাদের পাশের বাসায় একটা বাচ্চাছেলে থাকতো, ডাকনাম সাজিদ। খুবই প্রাণবন্ত ছেলে। ছেলেটা হাসিখুশি, সবার সাথেই তার ভাল বন্ধুত্ব হয়, তার আসলে সবকিছুই ভাল। এই বয়সের ছেলেদের যা হয় আরকি। খালি একটি বিষয়ে ছেলেটির খুব আদিখ্যেতা। ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ কার্টুন ভক্ত। কার্টুন বা কমিকস বলতে অজ্ঞান। সেটি আসলে তেমন কোন সমস্যা নয়, সমস্যা অন্যত্র। সমস্যাটি হচ্ছে, সে ডিসি কমিকসের একটি সুপারহিরো ক্যারেকটার সুপারম্যানে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে! হ্যাঁ, সে আসলেই মনে করে সুপারম্যান বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে। খুবই দৃঢ় বিশ্বাস তার। মানে যেই সেই রকম বিশ্বাস না, একদম সিরিয়াসলি বিশ্বাস করে। শুধু বিশ্বাসই না, যাকে বলে একদমই ভয়াবহভাবে বিশ্বাস। তার কাছে যদিও সুপারম্যানের অস্তিত্বের সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই, তারপরেও। বাচ্চাছেলে, অবুঝ, তাই কেউ আর কিছু বলে না। ভাবে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চারা এরকম অনেক কিছুতেই তো বিশ্বাস করে।

সাজিদ রোজ স্কুলে যায়। স্কুলে তো যেতেই হবে। পড়ালেখা করতেই হবে। কিন্তু কোনদিন স্কুলে পড়া না পারলে বা কোন বিপদ হলেই সে সুপারম্যানকে ডাকে। সুপারম্যানকে ডাকার আবার তার এক বিশেষ পদ্ধতি আছে। নাকটা আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বন্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে কপালটা সে মাটিতে ঠেকায়, এই পদ্ধতিতে প্রার্থনা করলে নাকি সুপারম্যান তার কথা শুনতে পায়। অন্য কোনভাবে সুপারম্যানকে ডাকলে নাকি সুপারম্যান শুনতে পায় না, বা শুনলেও বিশেষ পাত্তা দেয় না। সৌভাগ্যক্রমে মাঝে মাঝে শিক্ষক তাকে পড়া ধরে না। যেদিন তাকে পড়া ধরে না, সে ভেবে নেয়, সুপারম্যান নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করছে, সে কারণেই শিক্ষক সেদিন পড়া ধরেনি। আবার মাঝে মাঝে শিক্ষক পড়া ধরে ফেলে। সে পড়া পারে না এবং ধমক খায়। মাঝে মাঝে পিট্টিও খায়। সে সেইদিন মন খারাপ করে ভাবে, নিশ্চয়ই সুপারম্যান সে সময়ে অন্য কোন বিপদগ্রস্তকে রক্ষা করতে ব্যস্ত ছিল। মন খারাপের কিছু নাই। পরেরবার ঠিকই তাকে সাহায্য করবে সুপারম্যান। সুপারম্যানের তো অনেক কাজ। একলা বেচারা আর কতদিক সামাল দেবে? তাছাড়া, পিট্টি খেলে সেখানে সুপারম্যানের কী দোষ? দোষ তো ঐ টিচারের। দোষ তো তার নিজের। সে নিজেই তো পড়া করে নি। পড়া করে আসলে নিশ্চয়ই সুপারম্যান তাকে সাহায্য করতো। কিন্তু হোমওয়ার্ক ঠিকমত করে আসলে আর সুপারম্যানের সাহায্যের কী প্রয়োজন, সেটি অবশ্য সে বোঝে না।

তার বাড়াবাড়ি রকমের বিশ্বাস দেখে মজাই লাগতো, আবার হাসিও পেতো। তো একদিন তাকে বোঝাবার জন্য বললাম, সুপারম্যান হচ্ছে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জন্য রূপকথা, ফিকশন। সেগুলো আসলে সত্যি কিছু না। সে এ কথা শুনে বেশ রেগেই গেল মনে হলো। বললো, সুপারম্যান কোন বিশ্বাস নয়। সুপারম্যানের অস্তিত্বের পক্ষে অনেক প্রমাণ রয়েছে।

আমি একটু অবাক হলাম। ভাবলাম, এ আবার কী প্রমাণ রে বাবা! বললাম, সুপারম্যান যে আসলেই আছে তার প্রমাণ কী?

সে বেশ রাগের সুরেই বললো, তোমার বাবা যে আসলেই তোমার বাবা, তার কোন প্রমাণ কী আছে? তুমি সেটা বিশ্বাস করো। ভবিষ্যতেও করবে। সুপারম্যানে অস্তিত্বে বিশ্বাসটাও ঠিক এমনই। এটাকে প্রশ্ন করা যায়না। সন্দেহ করা যায়না। এটাকে হৃদয়ের গভীরে ধারন করতে হয়। এটার নামই বিশ্বাস। তোমার যে মগজ আছে তার প্রমাণ দাও দেখি…

আমি বললাম, কিন্তু মগজের প্রমাণ তো রয়েছে। যেকেউ অসুস্থ হলে মগজের সার্জারি করে। সেখানে দেখাই যায়। অনেকসময় যন্ত্র দিয়েও পরীক্ষা করা হয় মানুষের মস্তিষ্ক। আর আমার বাবাকে আমরা বাবা ডাকি, কারণ ছোটবেলা থেকেই আমাদের এরকম শেখানো হয়। সবসময় সকলের বেলায় এটি সত্য নাও হতে পারে। উপযুক্ত প্রমাণ পেলে আমরা প্রমাণ সাপেক্ষেই অন্য কাউকে নিজেদের জনক বলে মেনে নিবো। কিন্তু একটু আগেই যে বললে, সুপারম্যানের প্রমাণ আছে? সেটি তো দেখালে না।

সে একটু ঘাড় বাঁকা করে তার কমিকস বইগুলো নিয়ে আসলো। এনে খুব বিজ্ঞের হাসি হেসে বললো, সুপারম্যান না থাকলে এগুলো কী? এগুলো তাহলে কীভাবে লেখা হলো বলতো? এই সেই কমিকস যাতে কোন সন্দেহ নেই! পারবে, এরকম একটা বই লিখে দেখাতে? কক্ষনো না!

আমি মনে মনে হাসি। কিন্তু তাকে বুঝতে দিই না। বুঝে ফেললে তার অনুভূতিতে না আঘাত লেগে যায়। বেচারা এখনো শিশু। জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা তোমার সুপারম্যান কী কী পারে? মানে সে কি অনেক শক্তিশালী নাকি?

সে খুব খুশি হয়ে হাতপা নেড়ে বলতে থাকে, সুপারম্যান আকাশে উড়তে পারে। এক ঘুষিতে পাহাড় ভেঙ্গে ফেলতে পারে। চোখ দিয়ে একরকম আলো বের হয় যেটা সব পুড়িয়ে ফেলতে পারে। এমনকি, সে এত জোরে উড়তে পারে যে, ঘুরতে ঘুরতে অতীতে চলে যেতে পারে। এমনকি বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে এটা সম্ভব।

আমি বলি, তাই? বিজ্ঞান আজকাল সুপারম্যানের কাজকর্ম প্রমাণ করছে নাকি?

সে বললো, কেন বিজ্ঞান কী প্রমাণ করতে পেরেছে যে সুপারম্যান নেই?

আমি আমতা আমতা করতে করতে বললাম, তা অবশ্য না। কারণ বিজ্ঞান এরকম বিষয় নিয়ে ডিল করে না। কোন বাচ্চা কী বিশ্বাস করলো, তা প্রমাণ বা অপ্রমাণের দায় তো বিজ্ঞানের নয়। ধরো, বিজ্ঞান তো আর শাকচুন্নী বা মামদো ভুতের অস্তিত্ব প্রমাণে ব্যস্ত নেই। তার আরো অনেক কাজ আছে। কিন্তু বিজ্ঞান কীভাবে প্রমাণ করলো সুপারম্যানকে, সেটাই বলো না।

সে বললো, ডিসি কমিকস বইতে অনেক বিজ্ঞান লুকানো আছে। এখনকার বিজ্ঞানীরা তো ডিসি কমিকসের বই পড়েই বিজ্ঞান আবিষ্কার করে। খোদ নাসাই স্বীকার করে নিয়েছে, ডিসি কমিকসে যেসব কথা লেখা সেগুলো সত্যই। তারা প্রমাণ পেয়েছে।

আমি বললাম, তাই নাকি? তা নাসা কবে কোথায় এরকম বললো? কোন পত্রিকার নিউজ হয়েছে নাকি এরকম?

সে বললো, আরে নাহ! বললে তো সবাই জেনেই যাবে। নাসা লুকিয়ে লুকিয়ে ডিসি কমিকস বইগুলো গবেষণা করে বিজ্ঞান আবিষ্কার করে। সেগুলো কাউকে জানতে দেয় না। জানলে তো আর তাদের এত মাতব্বরি থাকবে না। বুঝলে? তাছাড়া নাসার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানীদের বেডরুমে সুপারম্যানের কমিকস পাওয়া যায়, কেন পাওয়া যায়?

আমি ঢোঁক গিলে বললাম, ও আচ্ছা, তাই নাকি! তাতে প্রমাণ হয় নাসার বিজ্ঞানীরা কমিকস পড়ে বিজ্ঞান আবিষ্কার করে? বেশ! সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার! তা বলতো, সুপারম্যান আসলো কোথা থেকে?

সে বললো, সুপারম্যান এসেছে ক্রিপটন গ্রহ থেকে। সেই গ্রহটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তার বাবা মা তাকে একটা স্পেসশিপে করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমি বললাম, যেহেতু সুপারম্যান অতীতে চলে যেতে পারে, তাহলে অতীতে গিয়ে তার গ্রহটাকে রক্ষা করছে না কেন? তাহলেই তো হলো।

এই কথা শুনে সে কটমট করে তাকিয়ে থাকলো। উত্তর তার জানা ছিল না। কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপরে সে রেগে গেল। যেহেতু তার কাছে কোন উত্তর ছিল না। ক্ষেপে বলতে লাগলো, আমি নাকি নাস্তিক। আমার মনে কোন বিশ্বাস নেই। আমি খুবই খারাপ প্রকৃতির একজন মানুষ। সুপারম্যান না থাকলে আমাদের কে রক্ষা করবে? বিজ্ঞান কী পেরেছে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে? বিজ্ঞান কি পেরেছে একটা জ্যান্ত হাতিকে পিপড়ার মত বানিয়ে ফেলতে? সেটা না পারলে, বিজ্ঞান সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে সুপারম্যানকে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? কেন এত অবিশ্বাস? কেন আমি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছি? শান্তির এই বিশ্বাসে কেন আমি এভাবে আঘাত করছি? কেন কটূক্তি করছি? সবকিছু কি যুক্তি দিয়ে চলে?

যাইহোক। এরকম নানা অভিযোগ সে করতেই লাগলো। এতটুকুতেই চুপ থাকলে হতো। কিন্তু রাত্রেবেলা রান্নাঘর থেকে ছুরিটা এনে আমার গলাতেও বসাবার চেষ্টা করলো। সুপারম্যানে অবিশ্বাস করায় নাকি আমি অভিশপ্ত হয়ে গেছি। আমার আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই! সব দেখেশুনে মনে মনে ভাবলাম, সুপারম্যানে বিশ্বাস একটি শান্তির বিশ্বাসই বটে।

বিশ্বাস 1

হাল্ক সবচেয়ে বড়, হাল্ক সবচেয়ে সেরা

অনেকদিন পরে আজকে আবারো তার সাথে দেখা। বাসার সামনে রাস্তার ধারে খেলছিল। আমাকে দেখেই রাগে গজগজ করতে লাগলো। অবিশ্বাসী নাস্তিক কাফের মুরতাদ দেখলে এরকম অবশ্য একটু করেই বিশ্বাসীরা। আমি একটু হেসে বললাম, কী খবর? কেমন আছো?

সে তার ঘাড়টা বাঁকা করে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, তোমার ওপর সুপারম্যান অভিশাপ দিচ্ছে। তুমি তা জানো না। দেখবে একদিন তোমাকে সুপারম্যান খুব শাস্তি দেবে। সেদিন আর রক্ষা পাবে না। আগুনে পুড়িয়ে দিলে তখন বুঝবে।

আমি হেসে বলি, এত রাগ করছো কেন? আমি তো শুধু কেমন আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম!

সে আরো রেগে বলতে লাগলো, তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। সুপারম্যানে যারা বিশ্বাস করে না, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাও উচিত নয়। তুমি একদিন বুঝবে। হু হু। বুঝবে মজা। খুব মজা হবে। সেদিন সুপারম্যান আমাকে আকাশে উড়াতে নেবে। আমি আর সুপারম্যান গ্রহে গ্রহে ঘুরে বেড়াবো। কত আনন্দ সেখানে। অনেক চকলেট দেবে আমাকে। একটা দুইটা চকলেট না, গুনে গুনে একদম ৭২ টা চকলেট। মজার মজার। আর তোমাকে একদম মেরেই ফেলবে। তখন বিশ্বাস হবে ঠিকই। কিন্তু তখন আর সময় থাকবে না।

আমি কোন রকমে হাসি চেপে বাসায় ঢুকে গেলাম। শুনেছি পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভাবলাম, যাই তাদের সাথে একটু খোশগপ্প করে আসি গে।

যেই ভাবা সেই কাজ। সে বাসায় গিয়ে তাদের সাথে আড্ডা জুড়ে দিলাম। আমি এমনিতেই বেশ আড্ডাবাজ মানুষ। ঐ বাসাতে দেখি, ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে সব মারভেল কমিকস ছড়ানো ছিটানো। আয়রন ম্যান ক্যাপ্টেন আমেরিকা হাল্ক ইত্যাদি। বুঝলাম এই বাসাতেও আরেকটা বাচ্চা আছে। তার সাথেই আড্ডা দেয়া যায় কিনা দেখা দরকার।

নতুন বাচ্চাটা আরেক শহর থেকে এসেছে। ওর নাম পিনু। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, সে আবার খুব দৃঢ়ভাবে হাল্কে বিশ্বাস করে। সে মনে করে, হাল্ক সবচাইতে শক্তিশালী। তার সাথে কেউ যুদ্ধে পারবে না। আমি অবিশ্বাসী টাইপের বোকা মানুষ! বোকার মত জিজ্ঞেস করলাম, হাল্ক এত বড় আর বিশাল দেহের হয়ে গেলে তার পায়জামাটা অক্ষত থাকে কীভাবে? বড় হওয়ার পরে তার তো নেঙ্টু থাকার কথা। এত ইলাস্টিক প্যান্ট সে কোথা থেকে কেনে?

ছেলেটা আমার কথা শুনে ক্ষেপে গেল। গজগজ করতে লাগলো। বলতে লাগলো, আমি নাকি অবিশ্বাসী নাস্তিক! আরো বললো, হাল্ককে রাগিও না কিন্তু। কটূক্তি করো না। সে রেগে গেলে সর্বনাশ। একদম ঘুষি মেরে ভর্তা বানিয়ে দেবে। এসব শুনে আমি বোকার মত হাসি। কী বলবো ভেবে পাই না। পাছে আবার ওর হাল্কানুভূতি আহত হয়। তাই বললাম, পাশের বাসায় আরেকটা ছেলে আছে। সেও কমিকস পড়ে। তোমার সাথে ভাল মিলবে। চলো, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

এরপরে দুইজনার পরিচয় করিয়ে দিলাম। ভাবলাম যেহেতু তারা দুইজনই কমিকস ক্যারেক্টারের ফ্যান, তাই মিলবে ভালই। আমি অবিশ্বাসী পাপীতাপী মানুষ, আমার এদের মধ্যে না থাকাই উত্তম। এসব ভেবে বাড়ি ফিরে এলাম। ভাবতে লাগলাম, মানুষ আসলে সেই প্রাচীনকাল থেকেই নানা ধরণের সুপারহিরোর কল্পনা করে আসছে। যখনই মানুষ প্রকৃতির কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব টের পেতো, বুঝতে পারতো যে অনেক অবস্থাতেই তার হাতে আসলে সব নিয়ন্ত্রণ নেই, তখনই সে কল্পনায় এমন এক চরিত্র তৈরি করতো, যা সব কিছু করতে পারে। মানুষ যা পারে না, সেই সব বৈশিষ্ট্য দিয়ে সে সেইসব চরিত্র তৈরি করতো। এই কারণেই প্রাচীন কাল থেকেই আমরা জিউস, থর, হারকিউলিস, আল্লাহ, ভগবান, শিব, কৃষ্ণ, কালী, দূর্গা, আমনরা ইত্যাদি সব চরিত্র সৃষ্টি করেছে। এবং এসব চরিত্র তৈরি করে নিজেদের অসয়াহত্ব ঢাকার চেষ্টা করেছে। সমস্যা হচ্ছে, এগুলো নিয়ে রক্তারক্তিও কম হয়নি।

ক’দিন পরে জানতে পারলাম, ঐ ছেলেদুটো নাকি মারামারি করে রীতিমত রক্তারক্তি ঘটিয়ে ফেলেছে। তাদের বাবা মা এই নিয়ে মহা মুসিবতে আছে। একজন আরেকজনকে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একেবারে যাচ্ছেটাই অবস্থা। কী ঘটনা, কিছুই বুঝলাম না। বাচ্চা দুটো ছেলে, খেলবে ঘুরবে আনন্দ করবে, বয়সটাই তো বন্ধুত্বের, আনন্দের, খেলাধুলোর। তা না করে এক জন আরেকজনকে খুন করে ফেলতে চাইছে! কী অবাক কাণ্ড!

অনেক চিন্তাভাবনা করেও বোধগম্য হলো না, ঘটনা কী হতে পারে? তারা কেন একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলতে চাচ্ছে?

পরে বুঝলাম, সম্ভবত এরা সহি সুপারম্যান এবং হাল্ক ভক্ত নহে।

বিশ্বাস 3

মুরতাদের শাস্তি ও বিশ্বাসে জোরাজুরি নেই

আজকে সুপারম্যানের ফ্যান বাচ্চা ছেলেটা, মানে সাজিদের বাবার সাথে দেখা। বাবার নাম ইমরান। সে খুব রেগেমেগে আমার কাছে এসে বলেছে, আমি নাকি বাচ্চা ছেলে দুটোর মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছি। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি কীভাবে যুদ্ধ লাগালাম? যুদ্ধ তো ওরা নিজেরাই করলো, কি সব কমিকস ক্যারেকটার নিয়ে মাথা ফাটাফাটি। এখানে আমার কী দোষ?

সে মুখটা ব্যাজার করে গজগজ করে বলতে লাগলো, কমিকস ক্যারেকটার নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করা যেমন খারাপ, তেমনি কমিকস ক্যারেকটারকে মিথ্যা বলাও খারাপ, খুব ক্ষতিকর। দুই পক্ষই দুষ্টু। দুইজনই দোষী। দুইজনই সমান উগ্র। তাই দুইজনকেই শাস্তি পেতে হবে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমাকে কেন শাস্তি পেতে হবে? আমি কার মাথা ফাটালাম?

সে বলতে লাগলো, মাথা ফাটাও নি তো হয়েছে কী? কমিকস ক্যারেকটারের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তো করেছো। সুপারম্যানের অবমাননা তো করেছো। করো নি?

আমি মিনমিন করে বললাম, তা বটে। কিন্তু সেটা কী শাস্তিযোগ্য অপরাধ?

সে বলতে লাগলো, অবশ্যই। বরঞ্চ এটা মাথা ফাটাফাটির চাইতে বড় অপরাধ। তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। তবে যেহেতু তুমি মানুষ ভাল, তাই তোমাকে স্বাধীন ইচ্ছা দেয়া হবে, শাস্তি বেছে নেয়ার।

আমি বললাম, আচ্ছা, কী বেছে নিতে হবে বল।

সে বললো, তোমাকে হয় সুপারম্যানে বিশ্বাস করতে হবে, একটা সুপারম্যানের ছবি ঘরে লাগিয়ে রোজ নাকটা আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে বন্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে কপালটা সে মাটিতে ঠেকিয়ে সম্মান করতে হবে, নতুবা তোমাকে আমি গুলি করে মেরে ফেলবো। এই দুটোর একটা বেছে নাও। এই কথা বলে সে পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করলো!

– “তবে তোমাকে বেছে নেয়ার সম্পুর্ণ সুযোগ আমি দিচ্ছি। যে কোনটা বেছে নিতে তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং মুক্ত।”- চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে সে পিস্তলটা আমার কপালে ঠেকিয়ে বললো, “সে বিষয়ে কোন ধরণের চাপ, বা ভয়ভীতি আমি প্রদর্শন করে তোমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি না। কারণ সুপারম্যান নিজেই বলেছে, যার যার বিশ্বাস তার তার। শান্তির বিশ্বাসে জোরাজুরি নেই। সুপারম্যান শান্তির কথাই বলেন। তুমি নিজের ইচ্ছায় যেকোন একটা বেছে নিতে পারো। হয় সুপারম্যানে বিশ্বাস করো, নয়তো গুলি খেয়ে মরো। পরে আবার বলতে পারবে না, যে তোমাকে স্বাধীনভাবে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয় নি! “

আমি ভয় পেয়ে ঢোক গিলতে গিলতে মিনমিন করে বললাম, আমি সুপারম্যানে বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। এইমাত্রই আমার বিশ্বাস ফিরে এলো। জয় সুপারম্যান! আল্লা, স্যরি সুপারম্যান হো আকবর…

শুনে ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, দেখলে তো, সুপারম্যানে বিশ্বাসে কোন জোর জবরদস্তি নেই। কারণ এটা একটি শান্তির বিশ্বাস। আমি সাথে সাথে ভয়ে ভয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতিসূচক সায় দিতে লাগলাম। আসলেই তো, সুপারম্যানে বিশ্বাসে কোনই জোর জবরদস্তি নেই। কত শান্তিপুর্ণ একটি বিশ্বাস!

সব মারভেল কমিকসের ষড়যন্ত্র

তো এরপরে আমি তো মোটামুটি সহিহ সুপারম্যান ফ্যান হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝেই অন্যদের সাথে একত্রে বসে জামাতের সহিত ডিসি কমিকস পড়া, সিনেমা দেখা ছিল আমাদের সাপ্তাহিক প্রার্থনা। দিনশেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাদের প্রার্থনা করতে হতো, হে সুপারম্যান, ঘুমের ভেতরে দুষ্টু দানবদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। সকালে উঠে আবার প্রার্থনা, আমার সারাদিন যেন ভাল কাটে হে শক্তিমান সুপারম্যান। একজন আরেকজনার সাথে দেখা হলেই, “সুপারম্যান তোমার ওপর শান্তি ঢেলে দিক” বলে সম্ভাষণও করতে হতো। এমনকি হাগু করতে বসলেও বলতাম, হে সুপারম্যান, হাগুটা যেন বেশি কষা না হয়! এরকম নানান ধরণের সুরা আবিষ্কার হতো প্রতিদিন। দাঁত ব্রাশ করার দোয়া, অলসভাবে কান চুলকাবার দোয়া, গলায় মাছের কাটা ঢুকে গেলে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার দোয়া, সবই আছে। একদম পরিপূর্ণ জীবন বিধান আর কী! সবাই আবার তা খুব ভক্তিশ্রদ্ধা সহকারে আবৃত্তিও করতো।

মাঝে মাঝে সবাই মিলে নানা অলৌকিক খবর পড়তাম পত্রিকায়, যেমন আজকে এক্সিডেন্টে ৫০ জন লোক মারা গেছে, কিন্তু একটা শিশু বেঁচে গেছে। আমরা খুব খুশী হয়ে মাথা ঝাঁকাতাম, বলতাম, দেখলে তো? সুপারম্যান যাকে ইচ্ছা রক্ষা করে আর যাকে ইচ্ছা মরতে দেয়। সুপারম্যান অসীম করুণাময়। মাঝে মাঝে মনের ভুলে মনে হতো, আচ্ছা, এতই করুণাময় সুপারম্যান বাকি ৫০ জনকে মারলো কেন? সাথে সাথে বিদ্যুৎ শকের মত লাফ দিয়ে উঠতাম! এসব নাস্তিকীয় চিন্তা মাথা থেকে দূর করে ফেলতাম। সুপারম্যানের শত্রু ডার্কসাইড নিশ্চয়ই এসব চিন্তা আমার মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বেশি বেশি সুরা কালাম পড়তাম, যেন এসব দুষ্টু চিন্তা মাথায় না আসে। এগুলো ডার্কসাইড শয়তানের কারসাজি। আমার বিশ্বাস ভাঙ্গার জন্য। ভাবতাম, ঐ ৫০ জনার মৃত্যুর জন্য ওরা নিজেরাই দায়ী। এতে স্যুপারম্যানের কোন দোষ থাকতেই পারে না। নিশ্চয়ই তারা প্রকৃত সুপারম্যানে বিশ্বাসী ছিল না, নতুবা কোন খারাপ কাজ করেছিল। সুপারম্যান আসলে একজন ভাল বিচারক। ঐ ৫০ জনার উচিত বিচার হয়েছে! সুপারম্যানের লীলা বোঝা বড় দায়! সুপারম্যান হয়তো বাকি ৫০ জনার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন।

তো এভাবেই দিন যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে আমরা সুপারম্যানের অসীম লীলা মানুষকে বোঝাবার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে সুপারম্যানের কমিকস দিয়ে আসতাম। অনেকেই হাসাহাসি করতো, তখন আমরা বলতাম, সুপারম্যান না থাকলে এই কমিকসগুলো কে লিখেছে? পারবে, এরকম একটা কমিকস লিখে দেখাতে? পারবে না কিছুতেই! তো একদিন সুপারম্যানের ফ্যানদের মধ্যে একজন বলে বসলো, ব্যাটম্যান কিন্তু একবার সুপারম্যানকে যুদ্ধে পরাজিত করেছে। তারমানে ব্যাটম্যানই হচ্ছে আসল সুপারহিরো। এই শুনে আমরা হাঁরে রেঁ রেঁ করে তাকে মারতে ছুটে গেলাম। বললাম, এসব কাফেরদের ষড়যন্ত্র। এগুলো বিশ্বাস করতে নেই। তওবা পড়ো জলদি, নইলে কিন্তু খবর আছে। যে বলেছিল, সে ভয়ে ভয়ে তওবা পড়ে নিলো। কিন্তু আমাদের মনে সন্দেহ গেল না। সে আসলেই সুপারম্যানের ফ্যান তো? নাকি সে মুরতাদ হয়ে গেছে? আমরা গোপনে শলা পরামর্শ করতে লাগলাম। তার ওপর কড়া নজর রাখতে লাগলাম।

আমরা যে অনর্থক সন্দেহ করছিলাম না, খুব তাড়াতাড়িই সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। তার ব্যাগে একদিন পাওয়া গেল ব্যাটম্যানের একটা সিরিজ কার্টুন। আর যায় কোথায়? এত্তবড় সাহস? এত্তবড় বুকের পাটা? শালার আজকে একদিন তো কালকে দুইদিন!

নারায়ে তাকবীর, সুপারম্যান হো আকবর!
“সুপারম্যান ছাড়া কোন সুপারহিরো নাই, জেরি শিগেল হচ্ছে সুপারম্যানের রাসুল!”

কয়েকদিন পরে তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার হলো বাসা থেকে। আমরা বলাবলি করতে লাগলাম, সব ইসরাইলের ইহুদীদের, স্যরি, মারভেল কমিকস ফ্যানদের ষড়যন্ত্র! ওরা খুবই দুষ্টু আর খারাপ! ওরা ঐ লোকটাকে মেরে এখন আমাদের বদনাম করতে চাচ্ছে। সবই ষড়যন্ত্র!

ছিঃ, ওরা আসলেই খুব খারাপ।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

2 thoughts on “প্যারানয়েড বিশ্বাসের গল্প!

  • Siamuzzaman Mahin (Sam)

    শিক্ষামূলক একটি আর্টিকেল, সত্যিই অসাধারণ

    Reply
  • শহিদুল ইসলাম

    মুগ্ধ!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *