ফেরাউনের কীর্তি
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে উল্লিখিত মোশি (হজরত মুসা আ.) ও ফরৌণ (ফেরাউন) সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাচ্ছে। ফরৌণ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করতে হলে প্রথমেই জেনে নেওয়া আবশ্যক — ফরৌণ কি বা কে। কারো কারো মতে ফরৌণ কোনো এক ব্যক্তির নাম। আসলে তা নয়। ফরৌণ মিশররাজদের উপাধিমাত্র। এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হচ্ছে, প্রথমত মোশি ও পরে ফরৌণ সম্বন্ধে।
মোশির সর্বোচ্চ গৌরব ও সম্মানজনক উপাধি হলো ‘কালীমুল্লাহ অর্থাৎ ঈশ্বরের সহিত কথোপকথনকারী। মোশি মিশর দেশ থেকে সবংশে কেনান দেশে যাবার পথে সীনয় পর্বতের (তুর পর্বতের) পাদদেশে যখন ছাউনী ফেলছিলেন, তখন নাকি জাভে (ইহুদীদের ঈশ্বর) তাঁর সাথে বাক্যালাপ করার উদ্দেশ্যে উক্ত পর্বতের উপরে নেমেছিলেন এবং তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন নানান প্রসঙ্গে। মোশি সেখানে সদলে অবস্থান করেছিলেন ১১ মাস ১৯ দিন। (যাত্রাপুস্তক ১৯ ; ১ ও গণনাপুস্তক ১০; ১১) অর্থাৎ প্রায় এক বছর। এ সময় ঈশ্বর একনাগাড়ে ওখানেই ছিলেন, না অন্যত্র যাওয়া-আসা করছিলেন, তা জানি না। তবে মোশির সাথে নাকি তাঁর কথাবার্তা চলছিল প্রতিদিন।
,পবিত্র বাইবেল পাঠে বোঝা যায় যে, ‘জাভে’ নামক ঈশ্বরটির ইউরোপ আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি মহাদেশ ও চীন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদির অধিবাসীদের জন্য যেনো কোন মাথাব্যথা নেই, তিনি যেনো ইহুদী জাতি তথা বনি-ইস্রায়েলদের সমাজ ও ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত। তিনি যেনো শুধু ইহুদী জাতির ঈশ্বর, অন্য কারো নয়। নিরাকার ও সর্বব্যাপী ঈশ্বর নির্দিষ্ট একটি স্থানে দাড়িয়ে থাকতে ও মানুষের মতো কথাবার্তা বলতে পারেন — এ শুনে চিন্তাবিদ দার্শনিকগণ তো বটেই, কোনো বিবেকবান ব্যক্তিও হাসি সামলাতে পারেন না। মোশির আর একটি বিভূতি হলো — ইহুদী ধর্মের প্রাণকেন্দ্র তৌরিত ‘কেতাব’ ও ‘দশ আদেশ প্রাপ্তি। ঈশ্বর নাকি তুরপর্বতে বসে দশটি উপদেশবাণী দুখানা পাথরে লিখে মোশি প্রদান করেছিলেন বনিইস্রায়েল সমাজে প্রচার করার জন্য। আদেশ দশটি এই –
আমার সাক্ষাতে তোমার অন্য খোদা না থাকুক।
তুমি খোদিত প্রতিমা বানাইও না।
তুমি অনৰ্থক ঈশ্বরের নাম লইও না।
বিশ্রামদিন পালন করিও।
মাতাপিতাকে সমাদর করিও।
নরহত্যা করিও না।
ব্যভিচার করিও না।
চুরি করিও না।
প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না।
তোমার প্রতিবাসীর গৃহে লোভ করিও না।
উক্ত আদেশগুলোর মর্মবাণী যাই হোক, ‘পরমেশ্বরের নিজ হাতের লেখা বলেই ওগুলোর অতিশয় কদর ইহুদী ধর্মরাজ্যে। পরমেশ্বরের হাত আছে এবং লেখার জন্য তিনি মানুষের মতোই কালি, কলম, পাত্র ইত্যাদি ব্যবহার করেন – মনে হয় যে, আধুনিক কালের একান্ত ধর্মভীরু কোনো ব্যক্তিও এ কথা মেনে নিতে পারেন না। কেননা ওরূপ প্রস্তরে লিখিত বা খোদিত শিলালিপি বর্তমানে অসংখ্য পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। মোশির প্রাপ্ত দশ আদেশ সম্বলিত পাথর দুখানা অতীতের কোনো শিলালিপি হওয়াই স্বাভাবিক, নয় কি?
লক্ষাধিক নবী-আম্বিয়ার মধ্যে মোশি সর্বপ্রধান নবী নন এবং তুর পর্বতও চিরপবিত্র স্থান নয়। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন হজরত মোহাম্মদ (দ:) এবং চিরপবিত্র স্থান হলো মক্কা শহর, হেরা পর্বত, বিশেষত কাবা ঘর। সেই সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর সাথে আলাপ আলোচনার জন্য মক্কা শহরে, হেরা পর্বতে বা চিরপবিত্র কাবা ঘরে জাভে পদার্পণ করলেন না একদিনও, কথা বললেন দূতের মারফতে। পক্ষান্তরে সাক্ষাত আলোচনার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নবীকেই একদিন যেতে হলো ‘জাভোএর নিকটে, মেরাজে। অথচ একজন সাধারণ পয়গম্বরের সাথে বাক্যালাপের জন্য ‘জাভেই এলেন বনবাদাড় ও শৈলাকীর্ণ তুর পর্বতের শিখরে। এ বিষয়টি সংগতিহীন, নয় কি?
ফরৌণ বলতে যারা কোনো একব্যক্তিকে বোঝেন, তাঁদের মতে, ফরৌণের সর্বোচ্চ কুখ্যাতি হলো যে, তিনি নিজেকে নাকি ঈশ্বর বলে দাবী করেছিলেন এবং তিনি নাকি বেঁচেও ছিলেন হাজার বছর। এরূপ দাবী যদি কোনো ফরেীণ করেও থাকেন, তবে তিনি কোন ফরেীণ, সত্যিই এরূপ দাবী করেছেন কি-না, তা ভালোভাবে জেনে নেওয়া আবশ্যক। কেননা ফরৌণ তো আর দু-চারজন ছিলেন না।
ঐতিহাসিকদের মতে, খৃ: পূ: ৩২০০ অব্দে সম্রাট মেনেস মিশরে ১ম রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং খ. পূ. ৩৩২ অব্দে সম্রাট আলেকজাণ্ডার মিশর অধিকার করার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ বছর মিশরে ৩১টি রাজবংশ রাজত্ব করে। এর মধ্যে বহু ব্যক্তি মিশরের রাজ-তত্বে আরোহণ করেন এবং যখনই যিনি আরোহণ করেন, তখন তিনিই ‘ফরেীণ আখ্যায় আখ্যায়িত্ব হন। বলা বাহুল্য যে, এতোধিক ফরেীণগণ যে সবাই একই চরিত্রের মানুষ ছিলেন, নিশ্চয়ই তা নয় এবং তাঁরা যে সবাই একই গুণে গুণী বা একই দোষে দোষী ছিলেন তাও নয়।
মিশরে এক জনদরদী ফরৌণ ছিলেন ১ম আহমিস (খৃ: পূ: ১৬১০ অব্দে মৃত্যু)। সেকালে মিশরে দাসপ্রথা ছিলো অত্যন্ত ব্যাপক। মিশরের অধিকাংশ ফরেীণরাই সাধারণ প্রজা ও দাসদের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার ও নানাবিধ জুলুম করে তাদের জীবন বিষময় করে তুলতো। কিন্তু ফরেীণ ১ম আহমিস ছিলেন তার বিপরীত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রজাবৎসল রাজা। দুঃস্থ জনগণের সুখ-শান্তি ও মঙ্গল বিধানই ছিলো তাঁর জীবনের ব্রত। তাই মিশরীয়রা তাঁকে দেবতা ঈেশ্বর) জ্ঞানে ভক্তি-অর্ঘ্য দান করতো। এমনকি মৃত্যুর পর তাঁর মূর্তিমিশরবাসীগণ পরবর্তী প্রায় হাজার বছর কাল (অর্থাৎ খ, পু ৫২৫ অব্দে পারস্য রাজশক্তি মিশর অধিকার করার পূর্ব পর্যন্ত) ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করতো। কোনো ফরেীণই হাজার বছর জীবিত ছিলেন না, ফরেীণ আহমিসও না। তবে তাঁর উপাধি ও মূর্তিপূজা অক্ষুন্ন ছিলো প্রায় হাজার বছর। বোধহয় যে, তা থেকেইজন্ম নিয়েছে ফরেীণের খোদায়ী দাবীর ও হাজার বছর বাঁচার প্রবাদবাক্যটি।
মৃত্যুর পরেও যদি কোনো ব্যক্তির নাম, মূর্তি, ছবি, ব্যবহারিক বস্তু, সমাধি ইত্যাদি জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করে, তবে তা কি তাঁর মহত্ত্বের পরিচয় নয়? রাশিয়ানরা মহামতি লেনিনের শবদেহ সমাধিস্থ করেননি, পরম যত্নে রক্ষা করেছেন “দর্শনীয়রূপে। রোজ সেখানে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয় এবং সবাই তাঁকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানায়। এটা তাঁর অপরাধ নয়, মহত্ত্ব।
মিশরবাসীগণ আহমিসকে দেবত্ব দিয়েছে এবং শ্রদ্ধাভরে তাঁর পূজা করেছে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই। আহমিস নিজে কখনো দেবত্ব দাবী করেননি এবং বলপূর্বক তার পূজোও চাপিয়ে দেননি কারো মাথার উপর। আর বলপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে থাকলে তা তাঁর মৃত্যুর পরেই বন্ধ হয়ে যেতো, প্রচলিত থাকতো না হাজার বছর কোনক্রমেই। তবে কথায় না হলেও ইঙ্গিতে কিছুটা দাবী করেছিলেন অপর একজন। তিনি হলেন ফরেীণ চতুর্থ আমেন হোটেপ (খৃ: পূ: ১৪২৮—১৩৮৮)।
সেকালের মিশরীয়দের মনে আল্লাহ, খোদা, নিরাকার ব্রক্ষ, পরম ঈশ্বর ইত্যাদির মতো একেশ্বর-কল্পনা ছিলো না, ছিলো বহু দেব-দেবী বা বহু ঈশ্বরের কল্পনা ও প্রচলিত ছিলো বহুবিধ পূজা। পুরোহিতরা ছিলেন ঈশ্বরদের প্রতিনিধি। জনসাধারণের বিশ্বাস ছিলো যে, পুরোহিতরা যা বলেন, দেবতারা তা-ই শোনেন, মানেন ও করেন। এরূপ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সুচতুর পুরোহিতরা নিবোধ জনগণের পক্ষ হয়ে তাদের সার্বিক মঙ্গল সাধন ও অমঙ্গল থেকে রক্ষার জন্য দেবতাদের কাছে (যজমানকে শুনিয়ে শুনিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে) আবেদন-নিবেদন করতেন এবং তার বিনিময়ে প্রচুর অর্থ আদায় করতেন (এরূপ কৌশলে অর্থ আদায়ের প্রথা এ যুগেও আছে)। পুরোহিতরা তাবিজ-কবচ বিক্রি করেও অর্থ আদায় করতেন দেদার। সবচেয়ে বেশী মূল্য ছিলো পরকালের তাবিজ-এর পুরোহিতরা এমন একটি তাবিজ লিখে দিতেন, যা মৃতের সঙ্গে (গলায় বা অন্য কোন স্থানে বেঁধে) দিলে কবরে বা পরলোকে মৃত ব্যক্তির কোনরূপ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয় না। সহজেই অনুমেয় যে, এরূপ একটি তাবিজ (ঈশ্বরের কাছে চিঠি)-এর মূল্য কতো বেশী। সারাজীবন অসৎকাজ করেও কায়ক্লেশে এরূপ একটি তাবিজ খরিদ করতে পারলেই ব্যস। এভাবে নানা উপায়ে অর্থ উপার্জন করে মিশরীয় পুরোহিতরা এমনই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন যে, তাঁরা শুরু করেন সম্রাটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে, তার কাজে হস্তক্ষেপ করতে।
দেশের জনগণের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধমীয় অধঃপতন এবং পুরোহিতকুলের ঔদ্ধত্য দর্শনে অতিষ্ঠ হয়ে ফরৌণ আমেন হােটেপ সংস্কারমূলক এক নতুন ফরমান জারি করেন। তাতে তিনি বহু দেবদেবীর পূজা বন্ধ করে দেন এবং একমাত্র সূর্যদেবতা এটন-এর পূজার প্রচলন করেন, সারা দেশে নির্মাণ করেন এটনের নামে মন্দির। তিনি সমস্ত মন্দির থেকে অন্যান্য সব দেবদেবী এবং প্রস্তরফলক থেকে তাদের নাম নষ্ট করে ফেলেন। তিনি সব পুরোহিতকে মদির থেকে তাড়িয়ে দেন, নিজেকে এটন-এর প্রতিনিধি বলে দাবী করেন এবং স্বয়ং আমেন হোটেপ’ নাম পরিবর্তন করে ‘ইখনাটন অর্থাৎ এটনের প্রিয়জন — এই নাম ধারণ করেন। বোধ হয় যে, এখান থেকেও ফরৌণের ঈশ্বরত্বের দাবী বা খোদায়ী দাবী, এ প্রবাদবাক্যটির উৎপত্তি হতে পারে।
ফরৌণ ইখনাটন এটনকে ঈশ্বর বলেছেন, এবং নিজেকে তাঁর ‘প্রিয়জন বলে দাবী করেছেন। আর এরূপ দাবী তো প্রায় সকল ধর্মবেত্তাই করেছেন। তাঁরা নিজেকে কেউ বলেছেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, কেউ বলেছেন প্রিয়জন, কেউ বলেছেন বন্ধু (দোস্ত) এবং কেউ তো পুত্রত্বেরও দাবী করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ-ই ঈশ্বরের ঈশ্বরত্বের দাবী করেননি, ইখনাটনও তা করেননি।
১. পবিত্র কোরান – সূরায়ে আনআম, রু ৯, ৭৯ আ ।
ইখনাটন মিশরে একেশ্বরবাদ প্রচার করেছেন, এটনকে (সূর্যকে) ঈশ্বর) বলেছেন, দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেছেন এবং ঈশ্বরের নামে মন্দির ড়েছেন। এ প্রসংগে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনাখ্যান তুলনা করা যেতে পারে। তিনিও কেনানে একেশ্বরবাদ প্রচার করেছেন, সূর্যদেবকে ঈশ্বর বলেছেন? (অবশ্য সে মতটি পরে পাল্টেছেন), দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেছেন এবং ঈশ্বরের নামে মন্দির (কাবা গৃহ) গড়েছেন। উভয়ে একই প্রকার কাজই করেছেন। অথচ তাদের একজন পেলেন পয়গম্বরী, আরেকজন হলেন কাফের।
এ যাবত যে সকল বিষয় আলোচনা করা হলো, তা সবই অতীত কাহিনী। বর্তমান প্রসঙ্গ হলো মোশি ও ফরৌণকে নিয়ে। এ হলো ইখনাটনের শতাধিক বছর পরের ঘটনা। মোশির সময় যিনি মিশরের ফরেীণ ছিলেন, তার নাম দ্বিতীয় রামেসিস (খৃ: পূ: ১৩১৭–১২৫১)। তার চরিত্র ছিলো ইখনাটনের চরিত্রের বিপরীত। ইখনাটনকে ধাৰ্মিক বললে রামেসিসকে বলতে হয় বিধমী। নতুবা ইখনাটনকে বিধমী বললে রামেসিসকে বলতে হয় ধাৰ্মিক ব্যক্তি। মূলত রামেসিস ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসনকর্তা। তিনি মিশরীয়দের ধর্মকর্মে পুনঃ স্বাধীনতা দান করেছিলেন। জবরদস্তি করে কোনো দেবতার পূজা করতে বলেননি বা নিষেধ করেননি কাউকে তিনি ইখনাটনের মতো। ধর্মের স্বাধীনতা পেয়ে মিশরীয়রা পুনঃ নানা দেবদেবীর পূজা শুরু করলো এবং পুরোহিতরা তাঁদের সাবেক মর্যাদা ও ক্ষমতা ফিরে পেলেন।
রামেসিস কারো ধর্মাধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাননি মোটেও, আধুনিক কালের শাসকদের মতোই। তিনি মনোযোগী ছিলেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, অর্থ ও শিলেপান্নতি বিধানে এবং রাজ্যবিস্তারে। তাঁর প্রধান কীর্তি হলো একটি পিরামিড ও দুটাে মদির নির্মাণ।
মিশরের পিরামিডসমূহ পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম। তারই একটি পিরামিডের নির্মাতা ফরৌণ রামেসিস। তাঁর নির্মিত পিরামিডটি আজো অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান আছে, হয় তার গর্ভে আছে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরাতন তাঁর মৃতদেহটিও। তিনি যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও ঐশ্বর্যে অতি উন্নত ছিলেন, তাঁর নির্মিত একটি পিরামিড ও মন্দির দুটােই তার জুলন্ত প্রমাণ। নিম্নোক্ত বিবরণটি দ্বারা উক্ত মদিরদ্বয়ের স্থাপকের যোগ্যতার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে।
রাজা রামেসিস দুটাে মদির গড়িয়েছিলেন নীলনদের তীরে উত্তর মিশরের আবু-সিম্বিলে। বড়টাতে আছে রাজার চারটি মূর্তি। লম্বায় এক একটা ষাট ফুট। আসোয়ান বাঁধ তৈরী করার সময় নীলনদের জলধারার স্ফীতির হাত থেকে মদির দুটােকে বাঁচাবার প্রশ্ন উঠে। আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার ফলে ইউনেসকোর (UNESCO) তত্ত্বাবধানে পাশ্চাত্য প্রকৌশলীদের মিলিত চেষ্টায় মদির দুটােকে ঠাইনাড়া করে ১৮০ ফুট ওপরে বসানো হয়। কয়েক বছর ধরে মাপজোক, হিসেবনিকেশ, আঁকা-জোকাতো ছিলোই, তার ওপর ছিলো নানা প্রাযুক্তিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্ন। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি এলো, কিন্তু পরিবহনের নানা যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও বিশাল সেই প্রস্তরদানবকে বয়ে নিয়ে যাবার জন্যই তৈরী করতে হলো আরো অনেকগুলো যন্ত্র। মূর্তিগুলোকে কেটে ফেলতে হলো টুকরো টুকরো করে, কেননা পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রেনেরও সাধ্য ছিলো না সে দানবদের নড়াবার, ১৮০ ফুট ওপরে টেনে তোলা তো দূরের কথা।
যাই হােক, কাটা টুকরোগুলোকে নম্বর দিয়ে তাদের নতুন জায়গায় নিয়ে আবার জোড়া লাগানো হলো। আধুনিক যন্ত্রপাতির বিরাট সমাবেশ যারা দেখেছিলেন, তাঁরা অবাক মনে প্রশ্ন করেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি ছাড়াই সেই প্রাচীন মিশরীয়রা প্রকাণ্ড এ মদির কেমন করে খাড়া করেছিলেন?”
ফরেীণ দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন মোশির সমকালীন মিশরের শাসনকর্তা। তাঁর জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য-বীৰ্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গুণ-গরিমা বিসর্জন দিয়ে তাকে এক কুৎসিৎ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘খোদায়ী দাবীদার বলে। এর কারণ অনুমান করা চলে যে, তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ ছিলেন না, ছিলেন ‘মুক্তমন-এর অধিকারী। মানব সমাজের বিভিন্ন দেশে এরূপ বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেখানে বহু প্রতিভাবান ব্যক্তির যাবতীয় গুণগরিমা ও সৌরভ-গৌরবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বাস্তবাদিতার অপরাধে ।
মোশির সর্বপ্রধান বিভূতি ছিলো নাকি তাঁর হস্তের আসা (লাঠি)। তিনি তাঁর হাতের আসাখানি ভূমিতে ছেড়ে দিলে তা নাকি সৰ্প হয়ে যেতো এবং জীবন্ত সপের ন্যায় চলাফেরা করতে পারতো ও শক্রকে তাড়া করতো। মোশির জন্ম খ. পূ. ১৩৫৯ সালে এবং হযরত ইব্রাহিমের জন্ম খ. পূ, ২৩৪০ সালে। সুতরাং হযরত ইব্রাহিমের জন্ম মোশির জন্মের ৯৮১ বছর পূর্বে। সেই হযরত ইব্রাহিমের হাতে নির্মিত পবিত্র কাবা গৃহখানা আজও বিদ্যমান আছে। কিন্তু মোশির হাতের আসাখানা গেল কই?
লেখকঃ আরজ আলী মাতুব্বর