রক্ত স্নাত পৃষ্ঠাঃ বালির ভিতের উপর কি দাঁড়িয়ে আছে হিন্দু ধর্ম?
এখনো অবধি যা কথা হয়েছে তাতে মাংস ভক্ষণের পক্ষে-বিপক্ষে অনেককিছু বলা হয়েছে এবং বলা হয়ে থাকে। এই দৃষ্টি থেকে যদি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অধ্যয়ণ করা হয়, তাহলে অনেক আশ্চর্যজনক এবং বিভৎস তথ্য জানা যায়, যেমন গোহত্যা, গোমাংস ভোজন, চর্বি দিয়ে হবন করা, আলাদা আলাদা মাংসে দেবতা এবং পিতৃদের তৃপ্তির সময়কাল নির্ধারণ করা, ঋষিমুনিদের কুকুর প্রভৃতির , ইত্যাদি।
সূচিপত্র
শুনঃশেপের গল্প
কালক্রম অনুসারে প্রথমে বেদের পর্যালোচনা করা উচিত হবে। ঋগবেদ (১/২৪/১২-১৫) এ শুনঃশেপ নামক ব্যক্তির বর্ণনা রয়েছে, যাকে নরমেধ যজ্ঞে বলি দেওয়ার প্রস্তুতি আছে। মহাভারত (অনুশাসন পর্ব ৩/৬) থেকে জানা যায় যে তিনি ঋচীক ওরফে অজীগর্তের পুত্র ছিলেন। এনাকে রাজা হরিশ্চন্দ্রের যজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল।
মনুস্মৃতি (১০/১০৫) এর ‘মন্বর্থমুক্তাবলী’ নামের এক প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় যে শুনঃশেপকে স্বয়ং তার পিতা অজীগর্ত যজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্য হরিশ্চন্দ্রের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি (অজীগর্ত) ১০০ গরুর বদলে নিজ হাতে যজ্ঞে তাকে (শুনঃশেপের) বলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। এটাই পিতা-পুত্রের মধুর সম্পর্কের শিক্ষা যা আমাদের ‘পূজনীয়’ ধর্মগ্রন্থ আমাদের দেয় আর এসব না পড়েই অধিকাংশ হিন্দুরা এর গুণকীর্তনে ক্লান্ত হয় না।
ঋগবেদের ব্যাখ্যান রূপ ‘ঐতরেয়ব্রাহ্মণ’ এ এই ঘটনা এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যে এখান থেকে অনেক নতুন তথ্য অবগত হওয়া যায়। উক্ত পুস্তকে (সপ্তম পঞ্চিকা, অধ্যায় ৩) লেখা আছে যে রাজা হরিশ্চন্দ্রের কোনো সন্তান ছিল না। এইজন্য তিনি বরুণদেবের উপাসনা করেছিলেন। বরুণ প্রসন্ন হয়ে বর দিয়েছিলেন, ‘সন্তান তো হবে কিন্তু বলি দিতে হবে।’
রাজার রোহিত নামের পুত্র তো হয়েছিল কিন্তু পুত্রকে বলি দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। শেষে রাজা রোগগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। তখন রাজা হরিশ্চন্দ্র অজীগর্ত ঋষির পুত্র শুনঃশেপকে ক্রয় করে তাকে বলি দেওয়ার স্থির করেন। যজ্ঞ আরম্ভ হল। বরুণের স্তুতি করে শুনঃশেপ মুক্তি পেলেন (নইলে তার কাবাব বানিয়ে দেওয়া হত)। হরিশ্চন্দ্রও নিরোগ হলেন। শুনঃশেপও লোভী পিতাকে ত্যাগ করলেন এবং বিশ্বামিত্র তাকে পুত্র হিসাবে স্বীকার করলেন। (বৈদিক সাহিত্য, পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৪)। এই কাহিনীটি এই রূপেই ‘শাঙ্খায়নব্রাহ্মণ’ (১৫/১৭) এবং ব্রহ্মপুরাণ (অধ্যায় ১০৪) এ পাওয়া যায়। এমন প্রসঙ্গই আজ পর্যন্ত মানুষকে দিয়ে লোমহর্ষক নরসংহার করিয়ে এসেছে।
ঋগবেদ (১০/৮৬/১৪) এ ইন্দ্রদেব বলছেনঃ
उ॒क्ष्णो हि मे॒ पञ्च॑दश सा॒कं पच॑न्ति विंश॒तिम् ।
उ॒ताहम॑द्मि॒ पीव॒ इदु॒भा कु॒क्षी पृ॑णन्ति मे॒ विश्व॑स्मा॒दिन्द्र॒ उत्त॑रः
অর্থাৎ আমার জন্য ইন্দ্রাণী প্রেরিত যজ্ঞকর্তারা ১৫-২০ টি বৃষ হত্যা করে রান্না করে, যা খেয়ে আমি স্থূল হই। তারা আমার উদরকে সোম দ্বারাও পূর্ণ করে৷
গোহত্যা
ঋগবেদ (১০/৮৯/১৪) থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে গোহত্যা এমনই সামান্য ব্যাপার ছিল যে কথোপকথনের সময় উপমা হিসেবে তার প্রয়োগ হত। দেখুনঃ
मि॒त्र॒क्रुवो॒ यच्छस॑ने॒ न गावः॑ पृथि॒व्या आ॒पृग॑मु॒या शय॑न्ते
অর্থাৎ হে ইন্দ্র, যেমন গোহত্যা স্থানে গাভী কাটা হয়, তেমনি তোমার এই অস্ত্র দ্বারা মিত্রদ্বেষী রাক্ষসেরা কর্তিত হয়ে পৃথিবীতে সবসময়ের জন্য শয়ন করুক।
ঋগবেদ (৫/২৯/৭, ৮/১২/৮ এবং ৮/৬৬/১০) এ দেবতাদের অনেক মহিষ খাওয়ার বিবরণ রয়েছে। আরো এগোনোর আগে এই সংকেত দেওয়া উচিত হবে যে আর্যরা নিজেদের দেবতাদের উদ্দেশ্যে যা উৎসর্গ করতো বা যা যজ্ঞে ব্যবহার করতো, তা তারা নিজেরাও ভক্ষণ করতো, কেননা যজ্ঞে স্বাহা হওয়ার পর অবশিষ্ট পদার্থ খাওয়া পরমপূণ্য বলে মানা হয় (গীতা ৩/১৩)। বাল্মীকি রামায়ণ থেকে জানা যায় যে মানুষেরা যা ভক্ষণ করে, তাই খায় এমন দেবতাদের কল্পনাও তারা করে। মাংসভোজীরা মাংসভোজী দেবতাদের কল্পনা করে এবং নিরামিষভোজীরা নিরামিষভোজী দেবতাদের।
যজুর্বেদ (২১/৪৩) এ বলা আছে, “অশ্বিনীকুমারদের জন্য ছাগলের তাজা চর্বি দিয়ে যজ্ঞ করা উচিত।“ (উবট এবং মহীধর ভাষ্য) এবং “যে এই সংসারে অনেক পশু সহযোগে হোম করে হুতশেষ ভক্ষণ করে (হোম করার পর অবশিষ্ট সামগ্রী ভক্ষণকারী), বেদবিদ… মানুষ, তারা প্রশংসা লাভ করে।“ (যজুর্বেদ ১৯/২০, স্বামী দয়ানন্দকৃত ভাষ্য)
এখানে আমরা বেদের আধুনিক মহাপণ্ডিত দয়ানন্দের প্রসিদ্ধ পুস্তক ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ এর ১৮৭৫ এর সংস্করণ থেকে একটি উদাহরণ দিলে তা অসঙ্গত হবে না। উক্ত পুস্তকে লেখা আছে, “ যেখানে গোমেধ যজ্ঞ লেখা আছে, সেখানে পুরুষ পশুদের হত্যা করার কথা লেখা আছে, কেননা যেমন পুষ্ট বৃষ প্রভৃতি পুরুষদের মধ্যে আছে, গাভী প্রভৃতিতে তেমন নেই। যেসব গাভী বন্ধ্যা তাদেরও গোমেধ যজ্ঞে হত্যা করার কথা লেখা আছে। (দেখুন, সত্যার্থপ্রকাশ, ১৮৭৫, পৃ. ৩০৩, দয়ানন্দভাবচিত্রাবলী পৃ. ২৮ এ উদ্ধৃত)
যজুর্বেদ (৩১/৯) এ ‘পুরুষমেধ’ যজ্ঞের (যেখানে নরবলি দেওয়া হত) বিবরণ পাওয়া যায় – ভূতকালিক ক্রিয়ায় সেখানে লেখা আছেঃ
तं यज्ञं बर्हिषि प्रौक्षन्पुरुषं जातमग्रत:।
तेन देवा अयजन्त साध्या ऋषयश्व ये।।
অর্থাৎ সেই যজ্ঞার্থ পুরুষরূপী পশুর জল ছিটিয়ে প্রোক্ষণ করলো। তা দিয়ে দেবতারা ও ঋষিরা পূজা করলো।
মন্ত্র (৩১/১৪) এ পুনরায় স্পষ্ট লেখা আছে, “যজ্ঞে পুরুষের মাংসকে হবি বানানো হল।“
यत पुरुषेण हविषा देवा यज्ञमतन्वत
উবট ভাষ্যঃ यत् यस्मात्कारणात् पुरुषेण हविषा हविर्भूतेन देवा ईनद्रादय:, यथा यज्ञं अतन्वत विस्तारितवन्त:।
অর্থাৎ যে কারণে পুরুষ রূপী হবি (হবন সামগ্রী) দ্বারা ইন্দ্রাদি দেবতারা যজ্ঞের বিস্তার করলেনঃ देवा यद् यज्ञं तन्वाना अबन्धपुरुषं पशुम्। (যজুর্বেদ ৩১/১৫)
উবট ভাষ্যঃ देवा इन्द्रादयः यथा यजं पुरुषमेधाख्यं विस्तारयन्तः पुरुषं पशुं अबन्धन् हतवन्त:।
অর্থাৎ ইন্দ্র আদি দেবতারা পুরুষমেধ (নরমেধ) নামক যজ্ঞের বিস্তার করলেন আর তারা পুরুষরূপী পশুর বধ করলেন।
অথর্ববেদ (৬/৭০/১) এ মদ এবং মাংসের এমন উল্লেখ পাওয়া যায় যে, তৎকালীন সমাজে এর মান্যতা যে ছিল তা সহজেই অনুমেয়। সাধারণ কথোপকথনে উপমায় এই দুটি জিনিস স্বচ্ছন্দে ব্যবহৃত হত। যেমনঃ “তোমার মন যেভাবে মাংসে, সুরায় মজে থাকে, তেমনি তোমার মন সন্তানেও মজুক।“
“অপুপ (মালপুয়া) এবং মাংস যুক্ত চরু বেদীর উপর আনো, যেখান থেকে আমাদের দেবতাদের ভাগ দিতে হবে।“ (অথর্ববেদ ১৮/৪/২০)
“তোমার জন্য যে মাখন, ভাত আর মাংস দেই তা তোমার জন্য স্বধ্যাযুক্ত, মধুরতা পূর্ণ এবং ঘি তে পরিপূর্ণ হোক।“ (অথর্ববেদ ১৮/৪/৪২) একইভাবে অথর্ববেদ ১২/২/৭ প্রভৃতিও দ্রষ্টব্য।
গৃহ্যসূত্রে শূলগব যজ্ঞে গোবলি দেওয়ার বিধান আছে। (বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র ২/৭)। শূলগবের অর্থ স্পষ্টভাবে কাঠক গৃহ্যসূত্রের ব্যাখ্যাকার দেবপাল লিখেছেন- এতে গরুর অঙ্গ শূলে পাকানো হয়। শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র (৪/১৭/৩) অনুসারে , এতে ষাঁড়কে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে রূদ্রের যজন করা হত। ধানের তুষ, পশুর লেজ, মাথা এবং পা অগ্নিতে হোম করা হত এবং পশুদের রক্ত সাপেদের অর্পন করা হত। শেষে একটি বাছুর পরবর্তী শূলগবের জন্য ছেড়ে দেওয়া হত।
বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র অনুসারে, অরণ্যে স্থাপিত অগ্নিতে গরুর চর্বি এবং মাংস শূলে গেথে এক ছোটো পাত্রে রান্না করা হত এবং অগ্নির ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হত।
বলিপ্রথা
‘গোপথ ব্রাহ্মণ’ (৩/১৮) এ বলা হয়েছে বলির পশুর কোন অংশ কে পাবে। এর অনুসারে, “জিভ,গলা,কাঁধ,নিতম্ব এবং পা পুরোহিতের। যজমান পিঠের অংশ নেয়, তার পত্নী শ্রোণীচক্রের অংশ নেয়।“ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও’ একই ধরণের বিভাগ চোখে পড়ে। শতপথ ব্রাহ্মণ (৩/১/২/২১) এ গাভীর মাংস খাওয়া উচিত নাকি বৃষের- পুরোহিতদের এই পারম্পরিক বিবাদে যাজ্ঞবল্ক্য সিদ্ধান্ত দেন, ‘উভয়ের মধ্যে যেটা নরম, আমি তো সেটা খাইঃ तदु होवाच यज्ञावल्क्योहश्नाम्येवाहमंसलं चेद् भवतीति।
বেদের এক পুরাতন ভাষ্যকার মহীধর নিজ ভাষ্যে লিখেছেন গোমেধ যজ্ঞে মৃত গরুর রক্ত এবং হাড় থেকে দুধ এবং কপূর তৈরি হয়। এই যজ্ঞের উপর আলোকপাত করে সংস্কৃতের এক বিশ্বকোষ ‘শব্দকল্পদ্রুমে’ লেখা হয়েছে, “ ছাগলের মতই গরুর সম্পূর্ণ প্রয়োগ হওয়া উচিত। গোমেধের ফলে যজমান স্বর্গ এবং মৃত গরু গোলোক লাভ করে।“
এমন কসাইখানার উঠোনের মত মাংস এবং রক্তসিক্ত পৃষ্ঠাকে দেখেও না দেখা শ্রদ্ধান্ধ বৈদিক বলে, “ এসব হিংসা নয়, প্রকৃতপক্ষে অহিংসা; কারণ বেদে কোথাও একে হিংসা বলা হয়নি। হিংসা আর অহিংসার নির্ণয় বেদ করে। যে হিংসার নির্দেশ বেদে আছে বা যজ্ঞে যে হিংসা করা হয়, তা হিংসা নয়।“
নিরুক্ত এর প্রথম অধ্যায় থেকে আমরা আরেক পরস্পরবিরোধী, আত্মপ্রবঞ্চক এবং লোকপ্রবঞ্চক কথা জানতে পারি। সেখানে এক বেদ বিরোধী বলে, “বেদ এবং বেদের বিধান দোষযুক্ত কারণ যজ্ঞে যখন পশু হত্যা করা হয়, তখন যে মন্ত্র পড়া হয় তার অর্থ হলঃ হে খড়গ, এই পশুকে মেরো না।“
এই আক্ষেপের উত্তর দিতে গিয়ে বেদের মর্মজ্ঞ যাস্ক লিখেছেনঃ आम्नायवचनादहिंसाप्रतियेत।
অর্থাৎ বেদের আদেশ এমনই, সুতরাং এটা অহিংসাই।
অর্থাৎ এরা পশুদের হত্যা করেও এটাই বলছে যে পশুগুলো মরেনি, কারণ বেদ একে মৃত বলছে না। উক্ত অংশের ভাষ্যে ছজ্জুরাম শাস্ত্রী বিদ্যাভাস্কর প্রাচীন উদ্ধৃতি দিয়েছেনঃ या वेदविहिता हिंसा न सा हिंसा प्रकीर्तिता।
অর্থাৎ যে হত্যা এবং ধ্বংস বেদ অনুমোদিত, তাকে হত্যা অথবা ধ্বংস বলা যায় না।
‘ব্রহ্মবিদ্যার ভাণ্ডার’ এবং ভারতীয় দর্শনের আধার উপনিষদও এই হত্যার শিক্ষা দেওয়া থেকে বিরত হতে পারেনি। বৃহদারণ্যক উপনিষদে লেখা আছেঃ अथ य इच्छेत्पुत्रो मे पण्डितो विगीतः समितिंगमः शुश्रूषितां वाचं भाषिता जायेत, सर्वान्वेदाननुब्रुवीत, सर्वमायुरियादिति, मांसौदनं पाचयित्वा सर्पिष्मन्तमश्नीयाताम्; ईश्वरौ जनयितवै—अउक्शेण वार्षभेण वा ॥ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬/৪/১৮)
অর্থাৎ যারা চায় তার পুত্র সভায় বাগ্মী, সব বেদে পারঙ্গত হোক এবং শতবর্ষজীবি হোক, সেই দম্পতির বৃষ এবং ষাঁড়ের মাংস রান্না করে তা ঘি এবং ভাতের সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিত।
পথপ্রদর্শক বিধিসংহিতাসমূহ
বৈদিক যুগের পরে গৃহ্যসূত্রের উৎপত্তি, এগুলো গৃহস্থ জীবনের পথপ্রদর্শক বিধি সংহিতা। এতে যজ্ঞ, দৈনিক,মাসিক এবং পাক্ষিক – সব রকমের কর্তব্যের নির্দেশ রয়েছে। এদের অধ্যয়ণ আমাদের বর্তমান বিষয়ে অনেক সহায়তা করতে পারে। আপস্তম্ভ গৃহ্যসূত্রে (রচনাকাল ১৪০০ খ্রিষ্ট পূর্ব, দেখুন বৈদিক সাহিত্য, ৫২২ পৃষ্ঠা) লেখা আছে, “ যখন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, কোনো স্নাতক বা আচার্য ঘরে আসবে, তাকে মধুপর্ক দিয়ে সম্মান করতে হবে। মধুপর্কদাতা গরুকে তার (অতিথির) সম্মুখে নিয়ে আসবে, যদি সে আজ্ঞা দেয় তাহলে ‘गौरस्यपहतपा’ ইত্যাদি মন্ত্র পড়ে গরুটিকে হত্যা করে আগন্তুককে দেবেন।“ (দেখুন উক্ত পুস্তক, ১৩/৫/১৫-১৭)
একইভাবে ‘মানবগৃহ্যসূত্র’ (১/৯/১৯-২২) লেখা আছে, “ মধুপর্কে গরু মেরে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের চার ব্রাহ্মণকে ভোজন করাবেন।“ সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বেদানুসারে মধুপর্ক মাংস ছাড়া হতে পারে না। ( দেখুন ২১ নং সূত্রঃ ‘नामांसो मधुपर्क इति श्रुतिः) এই পুস্তকের সমাবর্তন সংস্কারের বিধানে লেখা আছে, “ পূর্ণিমা এবং আমাবস্যায় পশুযাগ করবেন। যজ্ঞের অবশিষ্ট মাংস, মধু এবং লবণ খেয়ে ফেলবেন।“ (১/৩/১৯-২০)
আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে (রচনাকাল ১২০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ, দেখুন বৈদিক সাহিত্য পৃষ্ঠা ৫২১) লেখা আছে, “ ষাঁড় প্রভৃতির মাংসে তোমাদের যতটা তৃপ্তি হয়, ততটাই বিদ্যাধয়ণেও হোক।“ (১/১/৫) “পশুর শরীরের এগারোটি অংশকে রান্না করে তার হৃৎপিণ্ডকে শূলে বিদ্ধ কর এবং উত্তপ্ত করে স্থালীপাকের পূর্বে হবন কর।“ ( আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/১১/১২) “যখন শিশু ছয় মাসের হয়ে যাবে, তার মুখে অন্ন দেওয়া উচিত। যে অন্নের কামনা করে তার শিশুকে ছাগলের মাংস খাওয়ানো উচিত, যে ব্রহ্মতেজ চায় সে তিত্তির পাখির ঝোল খাওয়াবে” (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/১৬/১-৩) “দ্বিতীয় দিন অষ্টমিতে পশু আর স্থালীপাক দিয়ে হবন করবে।“ (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ২/৪/৭) “ অষ্টমির দিন যে পশু মারা হবে, তার মাংস ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করবে।“ (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ২/৫/২)
মধুপর্ক
পারস্কর গৃহ্যসূত্রে (রচনাকাল ১০০০ খ্রিষ্ট পূর্ব) লেখা আছে, “ আচার্য, ঋত্বিক, বৈবাহ্য,রাজা, প্রিয়জন প্রভৃতি উৎকৃষ্ট জাতির হোক অথবা সমান জাতির হোক, স্নাতক এদের অর্ঘ্য দান করতে হবে। এদের মধ্যে একজন যখন অপরজনের গৃহে আসবে, তখন গৃহপতির তাকে মধুপর্ক প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করা উচিত। মাংস ছাড়া সৎকার হয়না তাই গোবধ করতে বলা হয়েছে।মধুপর্ক খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর গৃহপতি খড়গ এবং গরু পূজ্য ব্যক্তির সামনে নিয়ে আসে। অতিথি যদি মাংস খেতে চায় তখন গোহত্যার অনুমতি দেবে, সে যদি নিরামিষভোজী হয় তাহলে গরুটিকে ছেড়ে দেওয়ার আজ্ঞা দেবে। যজ্ঞ এবং বিবাহের সময় গরুটিকে ছাড়ার আজ্ঞা দেওয়া উচিত নয়। দেখুন পারস্কর গৃহ্যসূত্র, অর্হণ প্রকার নিরূপণ (উত্তররামচরিতম, চৌখম্বা প্রকাশন, ১৯৯৬ এর সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪০৯ এ কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত প্রাধ্যাপক কান্তানাথ তৈলঙ্গ এর টিপ্পনী)
বৈদিক কর্মকাণ্ডের মহাবিদ্বান কুমারিল ভট্টের শিষ্য মহাকবি ভবভূতি তার বিখ্যাত নাটক ‘উত্তররামচরিতম’ এর চতুর্থ অঙ্কের বিষ্কম্ভকে লিখেছেন, ভগবান (?) বাল্মীকির আশ্রমে ভগবান (?) বশিষ্ঠ পৌঁছালে দুই বছরের গরুকে হত্যা করে তার সৎকার করা হয়। দণ্ডায়নের মুখ দিয়ে নাট্যকার বলিয়েছেন, “মধুপর্কে মাংস দেওয়া উচিত। এই বেদবাক্যের বিশেষ সম্মানকারী গৃহস্থেরা বেদজ্ঞ অতিথির জন্য দুই বছরের বাছুর বা বড় বৃষ রান্না করে। ধর্মসূত্রকার এই ধরণের কর্মকে ধার্মিক কর্ম বলেন। “ (দেখুন উক্ত নাটক, চতুর্থ অঙ্ক) ।
এই স্থানের ব্যাখ্যায় ‘চন্দ্রকলা’ নামক সংস্কৃত ব্যাখ্যা ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’ থেকে একটি শ্লোকার্ধ উদ্ধৃত করেছেনঃ महोक्षं वा महाजं वा श्रोत्रियायोपकल्पयेत्।
অর্থাৎ বড় বলদ বা বড় ছাগল শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের খাওয়ার জন্য জোগাড় করবে। (দেখুন চৌখম্বা প্রকাশন এর ‘উত্তররামচরিতম’ চন্দ্রকলা ব্যাখ্যা সহিত এর পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০৭) এই বস্তুস্থিতি হওয়ার পরেও নিজেকে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক মনে করে অনেক তথাকথিত ধার্মিক নেতা প্রায়শই গোরক্ষার নামে উৎপাত করতে থাকে, জীবিত মানুষদের অনিবার্য আবশ্যকতাগুলোকেও অবজ্ঞা করতে থাকে।
এবার আর্যসমাজি সন্ন্যাসী স্বামী বিদ্যানন্দ তার পুস্তকে যা লিখেছেন তা উদ্ধৃত করতে চাইবো। তিনি লিখেছেনঃ
“সর্দার বল্লভভাই পাটেল এর জন্মস্থান করমসদে (গুজরাট) কাঞ্চী কামকোটি পীঠাধীশ জগদগুরু শঙ্করাচার্য শ্রী জয়েন্দ্র সরস্বতী অবস্থান করছিলেন। আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম আর বললাম , যখন আমরা গোহত্যা নিষিদ্ধ করার দাবী করে থাকি তখন প্রায়ই বলা হয়, যখন হিন্দু শাস্ত্রের অনেক জায়গায় গোবধ করার বিধান আছে তখন আপনি কোন মুখে এই দাবী করেন? জগদগুরু হবার কারণে হিন্দু ধর্মে আপনার বিশেষ স্থান রয়েছে, সুতরাং যদি আপনার কাছ হতে নিচের বক্তব্যটি প্রসারিত হয় তাহলে অনেক উপকার হবেঃ
“ হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও গোবধের বিধান নেই। যদি কোথাও এর বিপরীত অর্থাৎ গোবধের প্রতিপাদক উল্লেখ মেলে তবে সেগুলো স্বার্থপর লোকেদের দ্বারা প্রক্ষেপের কারণে অথবা অশুদ্ধ অর্থের কারণে৷ সেগুলোকে প্রমাণ মানা যায় না।“
শ্রী শঙ্করাচার্য মহাশয় উত্তর দিয়েছেন- আমি আমার বক্তব্যে এতটুকুই লিখতে পারি যে, ‘হিন্দু শাস্ত্রে গোমাংস খাওয়ার বিধান নেই.’ যখন আমি তাকে এর স্পষ্টীকরণের কথা বললাম তখন তিনি উত্তর দিলেন যে, ‘বেদাদি শাস্ত্রে যজ্ঞের জন্য গোহত্যার স্পষ্ট বিধান আছে। যেখানে গোহত্যার নিষেধ আছে তা মাংস না খাওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে৷ যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার জন্য গোহত্যার নিষেধ কোথাও নেই। সব জায়গায় এর প্রতিপাদন রয়েছে। শাস্ত্রে গরুদের ভালোর জন্যই এমনটা করা হয়েছে, কেননা যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার জন্য নিহত গরু স্বর্গে গমন করে। “ ( বেদার্থ ভূমিকা, পৃষ্ঠা ২০)
মদ এবং মাংস দিয়ে নদীর পূজা
বাল্মীকি রামায়ণ হতে জানা যায় গঙ্গার মত সাত্বিক নদীর পূজার জন্য মদ এবং মাংস উপযুক্ত সামগ্রী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রামায়ণের নায়িকা সীতা যখন গঙ্গা পার হচ্ছিলেন, তখন তিনি গঙ্গাকে বলেন, “ হে দেবী, আমি এই নগরে ফিরে তোমাকে হাজার কলস মদ এবং মাংস মিশ্রিত অন্ন দিয়ে পূজা করবো। “ (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যা কাণ্ড/ ৫২/৮৯/ গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর প্রকাশন) অন্যস্থানে সীতার শ্বশুর দশরথ সীতার স্বামী এবং দেবরকে উৎপন্ন করার জন্য যে তথাকথিত ‘পুত্রেষ্টিযজ্ঞ’ করেছিলেন তাতে ৩০০ পশু পাখিকে যজ্ঞযূপে বলি দেওয়ার জন্য বাঁধা হয়েছিল৷ শুধু তাই নয়, সেই যজ্ঞে কৌশল্যা তিন বার তলোয়ার চালিয়ে একটি ঘোড়াকে হত্যা করেছিলেন। ওই ঘোড়ার চর্বিকে ঋত্বিক (পুরোহিত) ঋষ্যশৃঙ্গ শাস্ত্র বিধান অনুসারে রান্না করেছিলেন। তার ঘ্রাণে দশরথের সব পাপ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ( দেখুন বাল্মীকি রামায়ণ, বালকাণ্ড, ১৪/৩১-৩৬)
এই রামায়ণের উত্তরকাণ্ড, সর্গ ৪২ থেকে জানা যায় যে, ‘সীতাকে রামচন্দ্র নিজ হাতে মৈরেয় (একপ্রকারের মদ) পান করিয়েছিলেন’ (১৮-১৯), ‘তখন সেবকেরা রামের ভোজনের জন্য নানাপ্রকারের মাংস এবং মিষ্টান্ন নিয়ে এসেছিলেন’ (১৯-২০), অযোধ্যাকাণ্ড (৫৬/২৩) থেকে জানা যায়, রাম মৃগমাংস আনিয়ে পর্ণকুটিরের পূজা করেছিলেন এবং লক্ষ্মণ সেই মৃগ হত্যা করেছিলেন। অরণ্যকাণ্ডে (৪৭/২৩) সীতা রাবণকে বলেন, “ এখনই আমার স্বামী অনেক মৃগ, গোধা, শুকরের মাংস নিয়ে আসবেন।“ অযোধ্যাকাণ্ডে (৯১/৫২) লেখা আছে ভরতের সাথে আসা অযোধ্যাবাসীসের সৎকার করার জন্য ঋষি ভরদ্বাজ মাতালদের মদ এবং মাসভোজীদের ভালো মাংস পরিবেশন করেছিলেন।
মহাভারতে মাংসভক্ষণ
মহাভারত ( এর বর্তমান স্বরূপ ৫০ খ্রিষ্ট পূর্বে বর্তমান ছিল, দেখুন সি.বি. বৈদ এর পুস্তক-মহাভারতঃ এ ক্রিটিসিজম, পৃষ্ঠা ১০) এর শান্তিপর্ব, অধ্যায় ১৪১ এ আছে, বিশ্বামিত্র চণ্ডালের ঘর থেকে মরা কুকুরের মাংস চুরি করে খেয়েছিলেন।এমন অন্য উদাহরণ মনুস্মৃতি (১০/১০৫) থেকে নেওয়া যায়ঃ
অজীগর্ত ঋষি নিজের বিক্রি করে দেওয়া পুত্রের বলিও নিজে দেওয়ার জন্য তৎপর হয়েছিলেন। ঋষি বামদেব কুকুরের মাংস খেয়েছিলেন। (মনুস্মৃতি ১০/১০৬)
মহাভারতে ভীমসেনের জন্য মাংসের ঝুড়ি আনার উল্লেখও স্পষ্ট করে দেয় মানুষ খাদ্য হিসাবে মাংস ভোজন করতো। (দেখুন মহাভারত, শল্য পর্ব, অধ্যায় ৩০, শ্লোক ২৩ এবং ৩৪) মহাভারত, সভাপর্ব (২২/৯) থেকে জানা যায় পশুর মত মানুষও যজ্ঞে বলি দেওয়া হত। যজ্ঞের অবশেষ খাওয়ার বিধান রয়েছেঃ
यज्ञशिष्टाशितः संतों मुच्यंते सर्वकिल्बिषै: (গীতা ৩/১৩)
অর্থাৎ যজ্ঞে স্বাহা করার পর অবশিষ্ট সামগ্রী খেলে সব পাপ নষ্ট হয়ে যায়। তাই হয়তোবা তারা নরমাংসও খেত।
রন্তিদেব নামক মহাদানশীল এবং যজ্ঞকর্তার রান্নাঘরে মাংস রান্না করা হত (মহাভারত শান্তি পর্ব, অধ্যায় ২৯)। শান্তি পর্ব (২৯/১২৭) থেকে জানা যায় একদিন অতিথিদের জন্য ইনি ২১ হাজার গো হত্যা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ইনি গোমেধ যজ্ঞে এত গরু হত্যা করেছিলেন যে তার রক্ত,মাংস আর চর্বি থেকে চর্মণবতী নামে এক নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। (দেখুন মহাভারত, শান্তিপর্ব ২৯/১২৩ এবং মেঘদূত এর ৪৫ তম শ্লোক এর মল্লীনাথের সংস্কৃত ব্যাখ্যা)
পিতামহ ভীষ্ম বলেন, যে মাংস প্রোক্ষণ দ্বারা ( অর্থাৎ মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে) শুদ্ধ করা হয়নি, তা খাওয়া অনুচিত। (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ১১৫) অগস্ত্য নিজ তপের দ্বারা পশুদের প্রোক্ষিত করে পবিত্র বানিয়ে দিয়েছিলেন৷ এর ফলে দেবতা ও পিতৃদের ক্রিয়ায় মাংসের ব্যবহার ভ্রষ্ট এবং পাপজনক থাকে না বরং তা ন্যায়ানুকুল। পিতৃরাও মাংসে প্রসন্ন হন। (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, ১১৫/৫৯-৬০) “ভীষ্ম বলেন, হে পরন্তপ, মাংসরসের চেয়ে উত্তম পদার্থ পৃথিবীতে আর নেই। দুর্বল, দুঃখী এবং ক্লান্তদের জন্য এ ভীষণ উপযোগী।এটা প্রাণকে বর্ধিত করে এবং খুব শীঘ্রই পুষ্টি প্রদান করে। হে পরন্তপ! মাংসের অধিক ভোজনীয় আর কিছু নেই।“ (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব ৬/৭-১০)
মহাভারতের ব্রাহ্মণ-ব্যাধ-সংবাদ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন সময়ের মানুষেরা মাংস ভক্ষণ করতো। মহাভারত থেকে এই বিষয়ে প্রচুর তথ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। এসব বর্ণনা এতটাই মাংস এবং রক্তে সিক্ত যে তা কসাইখানার শিরোণামের মত মনে হয়।
মাংসের ব্যাপারে মনুর সিদ্ধান্ত অনেকস্থানে ভীষণ স্বেচ্ছাচারী। এসব পড়ার পরেও পরম্পরাবাদীরা কেন জানি না একে ‘ধর্মশাস্ত্র’ ই বলে এবং একে মেনে আসছে! মনু এমনও লিখেছেন, “ কুকুর,বানর প্রভৃতি যেসব পশুদের পাচটি নখ থাকে, তাদের মধ্যে শজারু,শল্য,গণ্ডার, গোসাপ, কচ্ছপ এবং এক পাটি দাত বিশিষ্ট পশুদের মধ্যে উট ছাড়া গো প্রভৃতি ভক্ষণ করা যায়।“ (মনুস্মৃতি ৫/১৮)
“প্রজাপতি স্থাবর এবং জঙ্গমের সকল প্রাণীকে খাওয়ার জন্য সৃষ্টি করেছেন। বিচরণশীল পশুরা নিশ্চল তৃণ আহার করে, হস্তযুক্ত হস্তহীনকে ভক্ষণ করে।“ (মনুস্মৃতি ৫/২৯)
“ক্রয় করে বা দেবতাদের ভোগ দিয়ে যে মাংস ভোজন করে তাতে কোনো দোষ হয় না।“ (মনুস্মৃতি ৫/৩২)
“শ্রাদ্ধ এবং মধুপর্কের সময় শাস্ত্রের বিধি বিধান অনুসারে প্রস্তুত মাংস যে না খায়, সে মানুষ ২১ বার পশুযোনিতে জন্মগ্রহণ করে।“ (মনুস্মৃতি ৫/৩৫)
“প্রজাপতি যজ্ঞের জন্য পশুদের সৃষ্টি করেছেন। তাই যজ্ঞে পশু বধ করলে হত্যার দোষ হয় না। যজ্ঞে নিহত পশু, পাখি এবং কচ্ছপ প্রভৃতি জন্তু পরবর্তী যোনিতে উৎকৃষ্ট যোনিতে জন্মগ্রহণ করে।” (মনুস্মৃতি ৫/৩৯)
“মাংস খাওয়ায় কোনো দোষ নেই, এটা প্রাণীদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।“ (মনুস্মৃতি ৫/৫৬)
স্মৃতিতে মাংস ভক্ষণ
শুধু এতটাই নয়, মনু শ্রাদ্ধের প্রসঙ্গে আলাদা আলাদা মাংসে পিতৃদের কতটা কতটা তৃপ্তি হয়, তাও লিখেছেন, “ শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণদের মাছ খাওয়ালে পিতৃরা দুইমাস তৃপ্ত থাকেন এবং হরিণের মাংস খাওয়ালে তিনমাস তৃপ্ত থাকেন।“ (৩/২৬৮) “ছাগলের মাংসে ছয় মাস তৃপ্তি হয়। কচ্ছপ এবং খরগোশের মাংসে ১১ মাস তৃপ্তি হয়। গণ্ডারের মাংসে ১২ বছর অবধি তৃপ্তি হয়।“ (৩/২৬৯-২৭১)
বর্তমানের হিন্দু ধর্ম মূলত পুরাণের উপর ভিত্তি করে চলছে। পুরাণে মাংস খাওয়া কোনো দোষের নয় বরং শুধুমাত্র মাংস খান এমন দেবতাদের কল্পনা করা হয়েছে যেমনঃ ভৈরব, কালিকা, চণ্ডি প্রভৃতি। দেবী কালিকার পূজার সামগ্রী দেখুন- সিংহবাহিনী দেবীকে মালতী ফুল, দীপ,পশুবলি, মদ, মাংস এবং চর্বি দিয়ে পূজা করবে। (দেখুন ভবিষ্যপুরাণ, উত্তরপর্ব ৬১/৫১-৫২)
পুরাণে মাংস ভক্ষণ
‘মার্কন্ডেয় পুরাণের’ ‘দূর্গাসপ্তশতী’ নামে একটি অংশ রয়েছে যাকে একটি স্বতন্ত্র পুস্তক বলা যায়, যেমন গীতা মহাভারতের একটি অংশ হবার পরও স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসাবে পরিচিত। তান্ত্রিক, পৌরাণিক এবং দেবীভক্তদের কাছে এর বড়োই মহিমা। ওই বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে রক্তবীজ অসুরের বধ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে যে কালিকা তার গলা ছিন্ন করে তার গরম রক্ত পান করেছিলেন। (শ্লোক ৫৯)
এই প্রকারের দেব দেবীদের উপাসকেরা নিজেরা যদি মাংস ভক্ষণ করে থাকে তবে কি ভুল অনুমান হতে পারে, কেননা সিদ্ধান্ত হলঃ यदन्नः पुरुषस्तदन्ना स्याद् देवताः (নিদানসূত্র ১০/৯)
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতিখণ্ড (৬১/৯৬) এ লেখা আছে ব্রাহ্মণেরা পাঁচ কোটি গরুর মাংস খায়। এই বইয়ের জন্মখণ্ড, অধ্যায় ১০৫ এ রুক্মিণীর বিবাহে এক লক্ষ গরু, দুই লক্ষ হরিণ, চার লক্ষ খরগোশ, চার লক্ষ কচ্ছপ, দশ লক্ষ ছাগল এবং ষোলো লক্ষ ভেড়া হত্যা করার প্রস্তাব তার ভাই রুক্মী দিয়েছিলেন।
তান্ত্রিক সাহিত্যে মাংস ভক্ষণ
বৌদ্ধ ধর্মের বিকশিত রূপ তান্ত্রিকদের প্রায় সকল সম্প্রদায়- শাক্ত,শৈব,কাপালিক,কালমুখ প্রভৃতি মাংস এবং মদকে সম্মান এবং প্রয়োজনীয়তার দৃষ্টিতে দেখে। এদের নিন্দনীয় উপাসনা পদ্ধতিতে এই দুটি পদার্থের অনন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এদের কালি, ভৈরব প্রভৃতি দেবতা উক্ত দুই পদার্থের সহায়তায় জীবিত থাকেন। আজও অনেক মন্দির এবং তার দেওয়ালের বাইরের দিকে অনেকসময় কালি আর ভৈরবের যে মূর্তি এবং চিত্র দেখা যায় তাতে একহাতে নরমুণ্ড এবং অন্য হাতে রক্ত ভর্তি মাথার খুলি দেখা যায়। এই সম্প্রদায়ের যেসব লিখিত গ্রন্থ আছে তাতেও মাংস প্রভৃতির মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা রয়েছে। ‘কালিতন্ত্র’ নামক পুস্তকে লেখা আছে, “ মদ্য, মাংস, মাছ, মুদ্রা, মৈথুন এই পঞ্চ মকার যুগে যুগে মোক্ষ প্রদান করে।“ (দেখুন, সত্যার্থ প্রকাশ, ১১ সমুল্লাস এ উদ্ধৃত শ্লোক) হঠযোগপ্রদীপিকায় লেখা আছে, “ যে নিত্য গোমাংস খায়, মদ্য পান করে তাকেই আমি প্রকৃত কুলীন বলে মনে করি, বাকিরা তো হল কুলকলঙ্ক।“
गोमांसं भक्षयेन्नित्यं पिबेदमरवारुणीम्।
कुलीनं तमहं मन्ये चेतरे कुलघातकाः ।। (হঠযোগপ্রদীপিকা ৩/৪৭)
তুলসী সম্ভবত স্বয়ং মাংসাহারী ছিলেন না, কিন্তু তিনি তার চরিতনায়ক, আদর্শমানব এর বিষয়ে লিখেছেনঃ
बंधु सखा संग लेहिं बोलाई,
बन मृगया नित खेलहिं जाई.
पाबन मृग मारहीं जिय जानी. (রামচরিতমানস, বাককাণ্ড, দোহা ২০৪ এর পর, পৃষ্ঠা ১৬৪, সটীক, মাঝারি সাইজ, গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর)
অর্থাৎ রাম প্রতিদিন নিজের সাথীদের সাথে মৃগ বধ করতেন।
এই বালকাণ্ডেই (পৃ ১৪০) ভানুপ্রতাপ এই প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ बिबिध मृगन्ह कर आमिष रांधा, तेही महुं विप्र मांसु खल सांधा.
অর্থাৎ অনেক প্রকারের মৃগের মাংস রান্না করা হল, সেখানে নীচ ব্যক্তিরা ব্রাহ্মণদের মাংসও মিশিয়ে দিল।
এই সব থেকে মনে হয় ভারতীয় সংস্কৃতিতে বুদ্ধ এবং মহাবীর এর ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’ এর দেশে মাংস খাদ্যের এক বাঞ্ছনীয় উপাদান ছিল এবং এর জন্য গরু, গোসাপ,খরগোশ,শজারু,গণ্ডার, মৃগ,মাছ, বৃষ, ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল, কচ্ছপ এবং মানুষ সবার গলায় নির্মমভাবে ছুরি চালানো হয়েছিল। একে দেবতা, পিতৃ, বেদজ্ঞ, স্নাতকদের সংস্কারের জন্য উপযুক্ত মনে করা হত।
( ড. সুরেন্দ্র কুমার ‘অজ্ঞাত’ এর রচিত ‘ক্যায়া বালু কি ভিত পর খাড়া হ্যায় হিন্দু ধর্ম?’ নামক গ্রন্থের ‘রক্ত সনে পৃষ্ঠ’ প্রবন্ধটির অনুবাদ এই লেখাটি)
লেখকঃ ড. সুরেন্দ্র কুমার ‘অজ্ঞাত’
অনুবাদকঃ অজিত কেশকম্বলী II
অহিংসা পরম ধর্ম,ধর্মহিংসা তদৈব চ ।” -আর মাংশ খেলে ধর্ম পালন করা যাবেনা এ কেমন ব্যাপার , তাহলে তো পৃথিবীতে মাংসাশী প্রাণী ই প্রকৃতি সৃষ্টি করত না – কিন্তু গাভী নিয়ে ভুল ভাল শ্লোক নিয়ে আসছেন আদি বাল্মীকি রামায়ন ছেড়ে পরবর্তী রামায়ন এর বরননা দিচ্ছেন কেন ?ঋগ্বেদে গোহত্যা নিষেধ-
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ।
প্রনুবোচং চিকিতুষে জনায়, মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।।
(ঋগ্বেদ ৮/১০১/১৫)
অনুবাদঃ গাভী রুদ্র ব্রহ্মচারী বিদ্বানগণের মাতা, নির্মাতা। দুষ্টের রোদনকর্তা বিদ্বান্, সৈনিক, সেনাপতি ইত্যাদিগণ গাভীকে মাতৃতুল্য পূজনীয়া বলে মনে করেন। গাভী বিদ্বান্ বসুগণের পুত্রী। সমাজের সংস্থাপক ব্যবস্থাপক প্রবন্ধক আদির জন্য গাভী পুত্রী-সমা পালনীয়া, রক্ষণীয়া রূপে স্বীকৃত। গাভী অমৃতের কেন্দ্র। গোরক্ষার দ্বারা চিরজীবন সমাজচেতনা লাভ হয়। গো নির্দোষ, নিষ্পাপ, অদিতি, অখণ্ডনীয়, অবধ্য সুতরাং তাকে হত্যা করো না।
যজুর্বেদে গোহত্যা নিষেধ-
ইমং সাহস্রং শতধারমুৎসং বাচ্যমানং সরিরস্যমধ্যে।
ঘৃতং দুহানামদিতিং জনাযাগ্রে মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন্।।(যজুঃ ১৩/৪৯)
অনুবাদঃ- এই গাভী মানুষের অসংখ্য সুখের সাধন, দুগ্ধের জন্য বিভিন্নভাবে পালনীয়া। গো, ঘৃত দুগ্ধ দাতৃ, অদিতি অখণ্ডনীয়া। হে মানব, একে হত্যা করো না।
অজস্রমিন্দুমরুষং ভুরণ্যুমগ্নিমীডে পূর্বচিত্তিং নমোভিঃ। স পর্বাভির্ঋতুশঃ কল্পমানো গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্।।
(যজুর্বেদ ১৩/৪৩)
অনুবাদঃ অক্ষয়, ঐশ্বর্য্যযুক্ত, অক্রোধ, পূর্বতন ঋষিদের দ্বারা গৃহীত অন্ন দ্বারা অগ্নিকে স্তুতি করি। হে অগ্নি, প্রতিপর্বে প্রতিঋতুতে কর্মের সম্পাদক, তুমি অদিতি, নিরীহ গোসমূহকে হত্যা করো না।
অথর্ববেদে গোসমূহের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
সংজগ্মানা অবিভ্যুষিরস্মিন্ গোষ্ঠে করীষিণীঃ।
বিভ্রতীঃ সোম্যং মধ্বনমীবা উপেতন।।
(অথর্ববেদ ৩/১৪/৩)
অনুবাদঃ- এই গোশালায় ধেনু সকল নির্ভয়ে থাকুক, একসঙ্গে মিলিয়া বিচরণ করুক, গোময় উৎপন্ন করুক, অমৃতময় দুগ্ধ ধারণ করুক এবং নীরোগ হইয়া আমার নিকট আসুক।
যূয়ং গাবো মেদয়থা কৃশং চিদশ্রীরং চিৎ কৃণুথা সুপ্রতীকম্।
ভদ্রং গৃহং কৃণুথ ভদ্রবাচো বৃহদ্বো বয় উচ্যতে সভাসু।।
(অথর্ববেদ ৪/২১/৬)
অনুবাদঃ হে ধেনু সকল, তোমরা কৃশ মনুষ্যকে হৃষ্ট পুষ্ট কর। বিশ্রী মানুষকে সুশ্রী কর, গৃহকে মঙ্গলময় কর। তোমাদের রব মঙ্গলময়। সভাসমূহে তোমাদের বহু গুণ বর্ণনা করা হয়।
শুধু তাই নয়, গোহত্যাকারীদের সীসার গুলি দ্বারা হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে –
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পূরুষম্।
তন্ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসি অবীরহা।।
(অথর্ববেদ ১/১৬/৪)
অনুবাদঃ যদি তুমি আমাদের গাভী সকল হত্যা কর, যদি আমাদের ঘোড়া ও পুরুষদের হত্যা কর, তাহলে তোমাকে সীসের গুলি করে ধ্বংস করা হবে যাতে, তুমি আমাদের কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করতে না পারো।
গোঘাতকদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করার আদেশ এবং তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার আদেশ পর্য্যন্ত দেয়া হয়েছে।
বিষং গাং বা যাতুধানা ভবন্তামা বৃশ্চন্তামদিতয়ে দুরেবাঃ।
পরেনৈনান্ দেবঃ সবিতা দদাতু পরা ভাগমোষ ধীনাং জয়ন্তাম্।।
(অথর্ববেদ ৮/৩/১৬)
অনুবাদঃ যদি প্রজার উপর অত্যাচারকারীরা গবাদিপশুকে বিষ দেয় ও গাভীকে কর্তন করে, তবে রাজা এদের রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করুন অথবা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিন এবং তারা যেন অন্ন ও ঔষধের অংশ প্রাপ্ত না হয়।
তাছাড়া যজুর্বেদ ৩০/১৮ তে গোহত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে-
অন্তকায় গোঘাতকম্।।
অর্থাৎ যে গোঘাতক তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।
এর চেয়ে বেশী গোহত্যাকে মহাপাপ ও মহাপরাধ প্রতিপন্ন করার অন্য আদেশ আর কী হতে পারে?
এছাড়া মহাভারতের শান্তিপর্বে ২৬২ অধ্যায়ের ৪৭ শ্লোকে বলা হয়েছে-
অঘ্ন্যা ইতি গাবাং নাম, ক্ব এতা হন্তুমর্হতি।
মহচ্চকারাকুশলং বৃষং গাং বা লভেত্তু যঃ।।
অনুবাদঃ গাভীর অপর নাম অঘ্ন্যা, এরা অবধ্যা। এই সকল গাভী ও বৃষকে হত্যা করে সে মহাপাপ করে।
ব্যাস সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে গোমাংসভোজীদের নীচু, হীন, অন্ত্যজ জাতি বলা হয়েছে।
এরকম অসংখ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় যেখানে গোহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত এবং গোহত্যাকারীদের শাস্তি দিতে বলা হয়েছে। বৈদিক আর্য্য সভ্যতায় বর্তমানে শাকাহারী ও মাংসাহারী দু’ধরনের লোক রয়েছে। যারা শাকাহারী তারা তো মাংস খায়ই না, যারা আর্য সভ্যতায় ঘোরতর মাংসাহারী তারাও গোমাংস ভক্ষণকে মহাপাপ ও অধর্ম বিবেচনা করে। গোহত্যাকারী তথা ওঁ তৎসৎ
#অনেক সনাতনীর মনে প্রায়শঃই প্রশ্ন জাগে যে সনাতনীরা গোমাংস ভক্ষণ করে না কেন? অনেক বিধর্মী তাদের গোমাংস ভক্ষণে প্ররোচিত করে। তারা প্রচার করে বেদে গোমাংস ভক্ষণের কোন নিষেধ নেই বরং গোমাংসভক্ষণের অনুমতি আছে। এ অপপ্রচারটা জাকির নায়েক নামক তথাকথিত পণ্ডিত(যে আদৌ সনাতনের কিছু বুঝে না) তার দ্বারা আরম্ভ হয় এবং তার লেকচার শুনে অনেকে সঠিকটা যাচাই না করে তার বাক্যকে সত্যবচন ভেবে ভুল পথে পা বাড়ায়, গোমাংসভক্ষণ এমনকি সনাতন ধর্মত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাদের জন্য অাকুল আবেদন সনাতন ধর্মের নামে প্রচারিত কুৎসাতে বিশ্বাস না করে নিজেই যাচাই করুন। যারা প্রশ্ন করেন সনাতনীরা গোমাংস ভক্ষণ করে না কেন- তার উত্তর স্বয়ং বেদে পরমেশ্বর প্রদান করেছেন-
ঋগ্বেদে গোহত্যা নিষেধ-
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ।
প্রনুবোচং চিকিতুষে জনায়, মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।।
(ঋগ্বেদ ৮/১০১/১৫)
অনুবাদঃ গাভী রুদ্র ব্রহ্মচারী বিদ্বানগণের মাতা, নির্মাতা। দুষ্টের রোদনকর্তা বিদ্বান্, সৈনিক, সেনাপতি ইত্যাদিগণ গাভীকে মাতৃতুল্য পূজনীয়া বলে মনে করেন। গাভী বিদ্বান্ বসুগণের পুত্রী। সমাজের সংস্থাপক ব্যবস্থাপক প্রবন্ধক আদির জন্য গাভী পুত্রী-সমা পালনীয়া, রক্ষণীয়া রূপে স্বীকৃত। গাভী অমৃতের কেন্দ্র। গোরক্ষার দ্বারা চিরজীবন সমাজচেতনা লাভ হয়। গো নির্দোষ, নিষ্পাপ, অদিতি, অখণ্ডনীয়, অবধ্য সুতরাং তাকে হত্যা করো না।
যজুর্বেদে গোহত্যা নিষেধ-
ইমং সাহস্রং শতধারমুৎসং বাচ্যমানং সরিরস্যমধ্যে।
ঘৃতং দুহানামদিতিং জনাযাগ্রে মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন্।।(যজুঃ ১৩/৪৯)
অনুবাদঃ- এই গাভী মানুষের অসংখ্য সুখের সাধন, দুগ্ধের জন্য বিভিন্নভাবে পালনীয়া। গো, ঘৃত দুগ্ধ দাতৃ, অদিতি অখণ্ডনীয়া। হে মানব, একে হত্যা করো না।
অজস্রমিন্দুমরুষং ভুরণ্যুমগ্নিমীডে পূর্বচিত্তিং নমোভিঃ। স পর্বাভির্ঋতুশঃ কল্পমানো গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্।।
(যজুর্বেদ ১৩/৪৩)
অনুবাদঃ অক্ষয়, ঐশ্বর্য্যযুক্ত, অক্রোধ, পূর্বতন ঋষিদের দ্বারা গৃহীত অন্ন দ্বারা অগ্নিকে স্তুতি করি। হে অগ্নি, প্রতিপর্বে প্রতিঋতুতে কর্মের সম্পাদক, তুমি অদিতি, নিরীহ গোসমূহকে হত্যা করো না।
অথর্ববেদে গোসমূহের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
সংজগ্মানা অবিভ্যুষিরস্মিন্ গোষ্ঠে করীষিণীঃ।
বিভ্রতীঃ সোম্যং মধ্বনমীবা উপেতন।।
(অথর্ববেদ ৩/১৪/৩)
অনুবাদঃ- এই গোশালায় ধেনু সকল নির্ভয়ে থাকুক, একসঙ্গে মিলিয়া বিচরণ করুক, গোময় উৎপন্ন করুক, অমৃতময় দুগ্ধ ধারণ করুক এবং নীরোগ হইয়া আমার নিকট আসুক।
যূয়ং গাবো মেদয়থা কৃশং চিদশ্রীরং চিৎ কৃণুথা সুপ্রতীকম্।
ভদ্রং গৃহং কৃণুথ ভদ্রবাচো বৃহদ্বো বয় উচ্যতে সভাসু।।
(অথর্ববেদ ৪/২১/৬)
অনুবাদঃ হে ধেনু সকল, তোমরা কৃশ মনুষ্যকে হৃষ্ট পুষ্ট কর। বিশ্রী মানুষকে সুশ্রী কর, গৃহকে মঙ্গলময় কর। তোমাদের রব মঙ্গলময়। সভাসমূহে তোমাদের বহু গুণ বর্ণনা করা হয়।
শুধু তাই নয়, গোহত্যাকারীদের সীসার গুলি দ্বারা হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে –
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পূরুষম্।
তন্ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসি অবীরহা।।
(অথর্ববেদ ১/১৬/৪)
অনুবাদঃ যদি তুমি আমাদের গাভী সকল হত্যা কর, যদি আমাদের ঘোড়া ও পুরুষদের হত্যা কর, তাহলে তোমাকে সীসের গুলি করে ধ্বংস করা হবে যাতে, তুমি আমাদের কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করতে না পারো।
গোঘাতকদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করার আদেশ এবং তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার আদেশ পর্য্যন্ত দেয়া হয়েছে।
বিষং গাং বা যাতুধানা ভবন্তামা বৃশ্চন্তামদিতয়ে দুরেবাঃ।
পরেনৈনান্ দেবঃ সবিতা দদাতু পরা ভাগমোষ ধীনাং জয়ন্তাম্।।
(অথর্ববেদ ৮/৩/১৬)
অনুবাদঃ যদি প্রজার উপর অত্যাচারকারীরা গবাদিপশুকে বিষ দেয় ও গাভীকে কর্তন করে, তবে রাজা এদের রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করুন অথবা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিন এবং তারা যেন অন্ন ও ঔষধের অংশ প্রাপ্ত না হয়।
তাছাড়া যজুর্বেদ ৩০/১৮ তে গোহত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে-
অন্তকায় গোঘাতকম্।।
অর্থাৎ যে গোঘাতক তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।
এর চেয়ে বেশী গোহত্যাকে মহাপাপ ও মহাপরাধ প্রতিপন্ন করার অন্য আদেশ আর কী হতে পারে?
এছাড়া মহাভারতের শান্তিপর্বে ২৬২ অধ্যায়ের ৪৭ শ্লোকে বলা হয়েছে-
অঘ্ন্যা ইতি গাবাং নাম, ক্ব এতা হন্তুমর্হতি।
মহচ্চকারাকুশলং বৃষং গাং বা লভেত্তু যঃ।।
অনুবাদঃ গাভীর অপর নাম অঘ্ন্যা, এরা অবধ্যা। এই সকল গাভী ও বৃষকে হত্যা করে সে মহাপাপ করে।
ব্যাস সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে গোমাংসভোজীদের নীচু, হীন, অন্ত্যজ জাতি বলা হয়েছে।
এরকম অসংখ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় যেখানে গোহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত এবং গোহত্যাকারীদের শাস্তি দিতে বলা হয়েছে। বৈদিক আর্য্য সভ্যতায় বর্তমানে শাকাহারী ও মাংসাহারী দু’ধরনের লোক রয়েছে। যারা শাকাহারী তারা তো মাংস খায়ই না, যারা আর্য সভ্যতায় ঘোরতর মাংসাহারী তারাও গোমাংস ভক্ষণকে মহাপাপ ও অধর্ম বিবেচনা করে। গোহত্যাকারী তথা
ওঁ তৎসৎ
#অনেক সনাতনীর মনে প্রায়শঃই প্রশ্ন জাগে যে সনাতনীরা গোমাংস ভক্ষণ করে না কেন? অনেক বিধর্মী তাদের গোমাংস ভক্ষণে প্ররোচিত করে। তারা প্রচার করে বেদে গোমাংস ভক্ষণের কোন নিষেধ নেই বরং গোমাংসভক্ষণের অনুমতি আছে। এ অপপ্রচারটা জাকির নায়েক নামক তথাকথিত পণ্ডিত(যে আদৌ সনাতনের কিছু বুঝে না) তার দ্বারা আরম্ভ হয় এবং তার লেকচার শুনে অনেকে সঠিকটা যাচাই না করে তার বাক্যকে সত্যবচন ভেবে ভুল পথে পা বাড়ায়, গোমাংসভক্ষণ এমনকি সনাতন ধর্মত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাদের জন্য অাকুল আবেদন সনাতন ধর্মের নামে প্রচারিত কুৎসাতে বিশ্বাস না করে নিজেই যাচাই করুন। যারা প্রশ্ন করেন সনাতনীরা গোমাংস ভক্ষণ করে না কেন- তার উত্তর স্বয়ং বেদে পরমেশ্বর প্রদান করেছেন-
ঋগ্বেদে গোহত্যা নিষেধ-
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ।
প্রনুবোচং চিকিতুষে জনায়, মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।।
(ঋগ্বেদ ৮/১০১/১৫)
অনুবাদঃ গাভী রুদ্র ব্রহ্মচারী বিদ্বানগণের মাতা, নির্মাতা। দুষ্টের রোদনকর্তা বিদ্বান্, সৈনিক, সেনাপতি ইত্যাদিগণ গাভীকে মাতৃতুল্য পূজনীয়া বলে মনে করেন। গাভী বিদ্বান্ বসুগণের পুত্রী। সমাজের সংস্থাপক ব্যবস্থাপক প্রবন্ধক আদির জন্য গাভী পুত্রী-সমা পালনীয়া, রক্ষণীয়া রূপে স্বীকৃত। গাভী অমৃতের কেন্দ্র। গোরক্ষার দ্বারা চিরজীবন সমাজচেতনা লাভ হয়। গো নির্দোষ, নিষ্পাপ, অদিতি, অখণ্ডনীয়, অবধ্য সুতরাং তাকে হত্যা করো না।
যজুর্বেদে গোহত্যা নিষেধ-
ইমং সাহস্রং শতধারমুৎসং বাচ্যমানং সরিরস্যমধ্যে।
ঘৃতং দুহানামদিতিং জনাযাগ্রে মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন্।।(যজুঃ ১৩/৪৯)
অনুবাদঃ- এই গাভী মানুষের অসংখ্য সুখের সাধন, দুগ্ধের জন্য বিভিন্নভাবে পালনীয়া। গো, ঘৃত দুগ্ধ দাতৃ, অদিতি অখণ্ডনীয়া। হে মানব, একে হত্যা করো না।
অজস্রমিন্দুমরুষং ভুরণ্যুমগ্নিমীডে পূর্বচিত্তিং নমোভিঃ। স পর্বাভির্ঋতুশঃ কল্পমানো গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্।।
(যজুর্বেদ ১৩/৪৩)
অনুবাদঃ অক্ষয়, ঐশ্বর্য্যযুক্ত, অক্রোধ, পূর্বতন ঋষিদের দ্বারা গৃহীত অন্ন দ্বারা অগ্নিকে স্তুতি করি। হে অগ্নি, প্রতিপর্বে প্রতিঋতুতে কর্মের সম্পাদক, তুমি অদিতি, নিরীহ গোসমূহকে হত্যা করো না।
অথর্ববেদে গোসমূহের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
সংজগ্মানা অবিভ্যুষিরস্মিন্ গোষ্ঠে করীষিণীঃ।
বিভ্রতীঃ সোম্যং মধ্বনমীবা উপেতন।।
(অথর্ববেদ ৩/১৪/৩)
অনুবাদঃ- এই গোশালায় ধেনু সকল নির্ভয়ে থাকুক, একসঙ্গে মিলিয়া বিচরণ করুক, গোময় উৎপন্ন করুক, অমৃতময় দুগ্ধ ধারণ করুক এবং নীরোগ হইয়া আমার নিকট আসুক।
যূয়ং গাবো মেদয়থা কৃশং চিদশ্রীরং চিৎ কৃণুথা সুপ্রতীকম্।
ভদ্রং গৃহং কৃণুথ ভদ্রবাচো বৃহদ্বো বয় উচ্যতে সভাসু।।
(অথর্ববেদ ৪/২১/৬)
অনুবাদঃ হে ধেনু সকল, তোমরা কৃশ মনুষ্যকে হৃষ্ট পুষ্ট কর। বিশ্রী মানুষকে সুশ্রী কর, গৃহকে মঙ্গলময় কর। তোমাদের রব মঙ্গলময়। সভাসমূহে তোমাদের বহু গুণ বর্ণনা করা হয়।
শুধু তাই নয়, গোহত্যাকারীদের সীসার গুলি দ্বারা হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে –
যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পূরুষম্।
তন্ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসি অবীরহা।।
(অথর্ববেদ ১/১৬/৪)
অনুবাদঃ যদি তুমি আমাদের গাভী সকল হত্যা কর, যদি আমাদের ঘোড়া ও পুরুষদের হত্যা কর, তাহলে তোমাকে সীসের গুলি করে ধ্বংস করা হবে যাতে, তুমি আমাদের কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করতে না পারো।
গোঘাতকদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করার আদেশ এবং তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার আদেশ পর্য্যন্ত দেয়া হয়েছে।
বিষং গাং বা যাতুধানা ভবন্তামা বৃশ্চন্তামদিতয়ে দুরেবাঃ।
পরেনৈনান্ দেবঃ সবিতা দদাতু পরা ভাগমোষ ধীনাং জয়ন্তাম্।।
(অথর্ববেদ ৮/৩/১৬)
অনুবাদঃ যদি প্রজার উপর অত্যাচারকারীরা গবাদিপশুকে বিষ দেয় ও গাভীকে কর্তন করে, তবে রাজা এদের রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করুন অথবা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিন এবং তারা যেন অন্ন ও ঔষধের অংশ প্রাপ্ত না হয়।
তাছাড়া যজুর্বেদ ৩০/১৮ তে গোহত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে-
অন্তকায় গোঘাতকম্।।
অর্থাৎ যে গোঘাতক তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক।
এর চেয়ে বেশী গোহত্যাকে মহাপাপ ও মহাপরাধ প্রতিপন্ন করার অন্য আদেশ আর কী হতে পারে?
এছাড়া মহাভারতের শান্তিপর্বে ২৬২ অধ্যায়ের ৪৭ শ্লোকে বলা হয়েছে-
অঘ্ন্যা ইতি গাবাং নাম, ক্ব এতা হন্তুমর্হতি।
মহচ্চকারাকুশলং বৃষং গাং বা লভেত্তু যঃ।।
অনুবাদঃ গাভীর অপর নাম অঘ্ন্যা, এরা অবধ্যা। এই সকল গাভী ও বৃষকে হত্যা করে সে মহাপাপ করে।
ব্যাস সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে গোমাংসভোজীদের নীচু, হীন, অন্ত্যজ জাতি বলা হয়েছে।
এরকম অসংখ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় যেখানে গোহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত এবং গোহত্যাকারীদের শাস্তি দিতে বলা হয়েছে।