ধর্মের সমাজতত্ত্ব

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ধর্ম কী?

ভূমিকা

ধর্ম একটি মানবীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এটি মানুষের কিছু জীবন জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার চেষ্টা করে যা সে অন্য কোন স্থান থেকে পায়নি বা পাবার চেষ্টা করেনি। এই জগৎ অতিপ্রাকৃতের জগতের উপর নির্ভরশীল না হলেও, মানুষের বিশ্বাস, চিন্তা ও কাজ প্রতিক্ষেত্রে না হলেও অনেকক্ষেত্রেই অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস, বস্তু বা চিন্তার উপর নির্ভরশীল। অতিপ্রাকৃতের এই প্রভাব আদিম বা বর্তমানকালের মানুষের জীবনযাত্রায় এমনিভাবে জড়িয়ে আছে যে কোথায় এর শুরু, কোথায় শেষ, কোথায় তা প্রকৃতিকে অতিক্রম করে অতিপ্রাকৃতে পৌঁছে গেছে তা নির্ধারণ করা কঠিন। এটি মানুষের সমাজজীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে সমাজকে ছেড়ে ধর্ম ও ধর্মকে ছেড়ে সমাজকে অনুধাবন করা যায়না। ধর্মের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনেক গভীর। সমাজবিজ্ঞান তাই ধর্ম কী, ধর্মের উদ্ভব কিভাবে হয়েছে, ধর্মের ফাংশন কী, বর্তমান সমাজে ধর্মের ভূমিকা কী, মানব জীবনে এর ভূমিকা কী এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে। তবে সেইসব প্রশ্নে যাবার আগে সমাজবিজ্ঞানের চোখে ধর্ম কী, ধর্মের দিকগুলো কী, ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো কী তা জানা দরকার।

ধর্মের সংজ্ঞা   

শব্দের ব্যুৎপত্তি – ধর্মের ইংরেজি প্রতিশব্দ religion, যা ল্যাতিন থেকে এসেছে, যা ব্যক্তিজীবনের তথা জাতীয় জীবনের সমার্থ সংগতি আনে তাই ধর্ম। ধৃ ধাতুর সাথে মন প্রত্যয় যোগে সংস্কৃতিতে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। আদিম সমাজের নিয়ান্ডার্থাল মানুষ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত সর্বত্র একটি অন্যতম মৌল সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধর্ম তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

ধর্ম একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, কোন ধর্ম একেশ্বরবাদী, কোনটা বহুঈশ্বরবাদী, আবার কোনটায় ঈশ্বর অনুপস্থিত, কোনটা আত্মায় বিশ্বাসী। তাই ধর্মের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন।

নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেইলর বলেন, ধর্ম হল অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস।

ইয়ঙ্গার (Yinger) বলেন, ধর্ম হল আবেগ, বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার ও অভ্যাসের এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একদল লোক মানব জীবনের বিভিন্ন মৌলিক সমস্যার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে।

ফ্রেজার তার The Golden Bough গ্রন্থে বলেন, ক্ষমতা বা শক্তির আকাঙ্ক্ষা, মানুষের চেয়ে মহৎ যা মানুষের জীবনকে প্রকৃতির অভিশাপ থেকে রক্ষা করে তাই ধর্ম।

প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম তার The Elementary form of Social Life গ্রন্থে বলেন, ধর্ম হচ্ছে পবিত্র জিনিসের সাথে সম্পর্কযুক্ত আচার-ব্যবহার ও বিশ্বাসের একটি সমন্বিত পদ্ধতি।

নৃবিজ্ঞানী লৌঈ (Lowie) তার Primitive Religion গ্রন্থে ধর্মকে অসাধারণ ভীতিপ্রদ সত্তার প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন। তিনি তার সংজ্ঞায় অতিপ্রাকৃতের সাথে মানব মনের বিশেষ প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন।

এম রেভাইলের মতে, ধর্ম হচ্ছে রহস্যাবৃত মনের সাথে মানব মনের সম্পর্ক সৃষ্টির ভাবানুভূতিগত বন্ধনের নির্ধারণী। বিশ্ব ও ব্যক্তির উপর উক্ত শক্তির প্রভাবকে ব্যক্তি স্বীকার করে নেয় ও সে মহাত্মার সাথে নিজের সম্পর্কের কথা ভেবে ব্যক্তিমন পুলকিত হয়।

কার্ল মার্ক্স বলেন, ধর্ম জনগণকে তন্দ্রাবিষ্ট করে রাখে। মানে এখানে ধর্ম মানুষেরই সৃষ্টি, কিন্তু আসলে এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি যা ব্যবহৃত হয় মানুষকে মোহগ্রস্ত ও নিয়ন্ত্রণের জন্য।

সমাজবিজ্ঞানী গেলেস (Gelles) তার An Introduction to Sociology গ্রন্থে বলেন, ধর্ম হল এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস ও চর্চা যা জীবনের নির্দিষ্ট অর্থের সাথে সম্পর্কিত। ধর্ম ঐশ্বরিক, অতিপ্রাকৃত ও অর্থপূর্ণ নীতিমালার উপর ভিত্তি করে সামাজিক আচরণের জন্য একটি নকশা তৈরি করে। মানুষ কেন ধর্ম বিশ্বাস করে তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক আছে।

নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস্লাউ ম্যালিনস্কির মতে, ধর্ম হল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও যোগ্যতার মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণের প্রক্রিয়া। জগতের ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মত মানুষের ক্ষমতা সীমিত। অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে, অদৃশ্য একধরণের শক্তি মানুষ, মাটি, বায়ু, জল সবকিছুকে ধ্বংস করছে। মানুষের তৈরি ও আবিষ্কৃত কোন প্রযুক্তি আবহাওয়া, জলবায়ু, ভূমিকম্প নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, অকালমৃত্যু থামাতে পারছে না। ধর্ম মূলত এসব জীবন-অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির সাথে মানুষকে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ তৈরি করতে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যু দিয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্স (১৯৫২) এর মতে, ধর্ম হল সামাজিক প্রত্যাশাসমূহের সাথে অভিজ্ঞতার শূন্যস্থান পূরণের একটি প্রক্রিয়া। প্রতিটি সমাজে কম বেশি দেখা যায়, সামাজিক প্রত্যাশাগুলো প্রায় সময়ই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, ,দুঃখ ও বঞ্চনা অযাচিতভাবে প্রসারিত হচ্ছে, মাঝেমাঝে নীতি বহির্ভূত কাজ বা নৈতিক মূল্যবোধ লঙ্ঘনকারী গোষ্ঠী বা প্রক্রিয়া পুরস্কৃত হয় ও অসাধারণ অর্জনগুলো ব্যক্তিগত প্রবঞ্চনা বা হার ও পরাজয়ের কারণে অবসান হয়। ধর্ম এসব দুঃখকষ্ট ও অনৈতিক কাজগুলোকে ঐশ্বরিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিকল্পনা বা অংশ হিসেবে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা প্রদান করে।

নৃবিজ্ঞানী ক্লিফর্ড গিরটজ এর মতে (১৯৬৫), মানুষ যখন তার বিশ্লেষণমূলক ও নৈতিক দূরদৃষ্টি দ্বারা কোন ঘটনাকে বা ঘটনাসমূহকে বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়না, তখন সে সীমাবদ্ধতা ও টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টির উপর নির্ভর করে তা হল ধর্ম। তিনি বলেন, মানুষকে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে হবে যে, বিশ্ব একটি যৌক্তিক কাঠামো বা প্রক্রিয়া। এখানে প্রতিটি ঘটনার পিছনে এক বা একাধিক কারণ আছে।

ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, ধর্ম ‘অর্থের সমস্যাসমূহ’ নিয়ে কাজ করে ও এক্ষেত্রে একটি প্রেষণাদায়ী হিসেবে কাজ করে। ধর্মাচরণের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শনের বিষয়ে জানতে হলে আমাদেরকে ৫০০০ বছর পেছনে যেতে হবে। ইউরোপ, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়া, নেদারল্যান্ডস এর মানুষেরা কোন মৃতদেহ কবরস্থ করলে সাথে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি, উপকরণ ও দরকারি জিনিসপত্র দিয়ে দিত। তারা বিশ্বাস করত, মৃত্যুর পর আরেকটি জগৎ আছে যেখানে এগুলোর দরকার পড়বে।

ঐতিহাসিক রেকর্ড ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, বিশ্বের প্রতিটি গোষ্ঠী, ব্যক্তি, মানুষের বিভিন্ন ধর্ম আছে। আর এই ধর্ম বিশ্বাস ও চর্চা একে অন্য থেকে স্বতন্ত্র ও আলাদা। কোন ধর্ম বিশ্বাস পূর্বপুরুষকেন্দ্রিক, কোনটি আবার অতিপ্রাকৃত শক্তি, কোনটি দেব-দেবী ও অসংখ্য দেবতাকে ও কোনটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছন্দময়তাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। এভাবে ধর্মবিশ্বাস স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়।

ধর্মের ৭টি ডাইমেনশন বা দিক

স্কটিশ লেখক ও সেক্যুলার রিলিজিয়াস স্টাডিজের অগ্রদূত নিনিয়ান স্মার্ট ধর্মের ৭টি দিক বা ডাইমেনশনের কথা উল্লেখ করেন, যা প্রত্যেকটি ধর্মের মধ্যেই দেখা যায় –

১। Practical and ritual dimension: ধর্মের মধ্যে আরাধনা, প্রার্থন্যা এসব রিচুয়াল ডাইমেনশন বা আচারগত দিক আছে। ধর্ম থাকলে ধর্মীয় আচার থাকবে, কারও বা কোনকিছুর উদ্দেশ্যে প্রার্থনার ব্যাপারও থাকবে।

২। Experiential and emotional dimension: এইসব আচার ও প্রার্থনার পেছনে থাকে মানসিক চাঞ্চল্য উদ্রেককারী উপাদান, যা হল ধর্মের এক্সপেইয়েনশিয়াল ও ইমোশনাল ডাইমেনশন, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক বা আবেগগত দিক। ধর্ম মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও আবেগের সাথে সম্পর্কিত হয়। মানুষ ধর্মীয় বিষয়গুলোকে যেমন ঈশ্বরকে অনুভব করার জন্য তার ভেতরের অভিজ্ঞতা ও আবেগকে ব্যবহার করে।

৩। Narrative and mythic dimension: ধর্মের একটি ন্যারেটিভ বা মিথিক ডাইমেনশন আছে, মানে একটি আখ্যানগত বা পৌরাণিক দিক আছে। যেমন ইহুদিধর্মে নোয়াহ এর বন্যার কাহিনী, খ্রিস্টধর্মের ইডেনের কাহিনী ইত্যাদি। ধর্ম বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে যার জন্য এইসব আখ্যান বা পুরাণের আবির্ভাব হয়। আবার অনেক পূর্বে তৈরি হওয়া কোন কাহিনী, ঘটনা কালক্রমে বিভিন্ন ধর্ম নিজেদের মধ্যে এডপ্ট করে নেয় ও তা নিজের কাজে লাগায়। ধর্মগুলোর অনেক আচারেই এইসব আখ্যানের প্রতিফলন দেখা যায়।

৪। Doctrinal and philosophical dimension: ধর্মে একটি ডক্ট্রিনাল এন্ড ফিলোসফিকাল ডাইমেনশন অর্থাৎ তাত্ত্বিক ও দার্শনিক দিক আছে। ধর্মগুলোকে জগতের পরমসত্তা কী, ঈশ্বরের স্বরূপ কী, আত্মা কী, চেতনা কী, মানুষের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক কী, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ কী – এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়, আর তা খুঁজতে গিয়ে এগুলোকে ধর্মদর্শন তৈরি করতে হয়, অথবা ইতিমধ্যে কারও দর্শনচিন্তাকে এডপ্ট করে নিতে হয়।

৫। Ethical and legal dimension: ধর্মগুলো মানব নৈতিকতার ধারক ও বাহক হতে চায়। এটি মানুষের নৈতিক ও আইনি ধারণায় এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে মানুষ মনে করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণীই হল নৈতিক, আর যা যা এই প্রতিষ্ঠানের বাইরে যায় তাই অনৈতিক। ধর্ম তার নিজের মত করে মানুষের মধ্যে বিশেষ মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে চায়। আইন ও নৈতিকতার সাহায্যে এটি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে সম্পর্কিত করে কোন কাজকে জাস্টিফাইড বা আনজাস্টিফাইড বলে দাবি করে। এগুল হল ধর্মের নৈতিক ও আইনি দিক।

৬। Social and institutional dimension: ধর্ম সমাজেরই একটি অংশ, মানুষও সমাজের অংশ যাকে ধর্ম প্রভাব ফেলতে চায়। ছোট থেকে বড় হতে মানুষের যে সামাজিকীকরণ বা সোশ্যালাইজেশনের প্রয়োজন হয় সেখানে ধর্মের ভূমিকা থাকে। মানুষের যে সামাজিক চাহিদাগুলো আছে সেগুলো ধর্ম পুরণ করে থাকে। চার্চ, মসজিদ, মন্দিরের মত স্থানে সোশ্যাল গ্যাদারিং এর ব্যবস্থা করে এটি মানুষের সামাজিকতার চাহিদা মেটায়, কোন সামাজিক সংকটের কালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে তাদের স্ট্রেস কমাতে ও কোন দিক নির্দেশনা দিতে, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মগুলো মানুষের বিনোদনের চাহিদাও পুরণ করে। এছাড়া ধর্ম মানুষকে একরকম সেন্স অফ আইডেন্টিটি দান করে। এই বিশেষ আইডেন্টিটির জন্য মানুষ নিজের মানুষ পরিচয়ের আগে নিজেকে একজন হিন্দু, একজন মুসলিম, একজন খ্রিস্টান হিসেবে চেনে। ধর্ম এই আইডেন্টিটি দানের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় আইডেন্টিটির সাথে মিলে যায় এমন মানুষকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়, তাদেরকে আপন ভাবতে শেখায়, আর যাদের ধর্মীয় আইডেন্টিটি তার আইডেন্টিটির সাথে ম্যাচ করে না তাদেরকে পর ভাবতে শেখায়। এগুলো ধর্মের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক।

৭। Material dimension: ধর্মের মেটারিয়াল বা বস্তুগত দিকও আছে। ধর্মগুলো কোন নির্দিষ্ট বিল্ডিংকে পবিত্র বিল্ডিং বা দালান বানিয়ে রাখে, যেমন মন্দির-মসজিদ। এটি কোন শিল্পকে পবিত্র শিল্প বানিয়ে রাখে, কোন কোন চিহ্নকে বানিয়ে রাখে পবিত্র চিহ্ন, কোন কোন গ্রন্থকে বানিয়ে রাখে পবিত্র গ্রন্থ। এইসব বিষয়ে ধর্ম পবিত্রতা আরোপ করে অন্যান্য বিষয়ের সাথে, জনসাধারণের সাধারণ বিষয়গুলোর সাথে বিচ্ছিন্ন করে রাখে যা সেই পবিত্রতার উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনেরই শর্ত হিসেবে কাজ করে। আর এইসব পবিত্র বস্তুগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ব্যক্তিত্বের সাথেও জুড়ে যায় পবিত্রতা, তাদের বাণীও হয়ে ওঠে পবিত্র। এগুলো হচ্ছে ধর্মের বস্তুগত দিক বা মেটারিয়াল ডাইমেনশন।

ধর্মগুলোর মধ্যকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য

নিয়েলস নিয়েলসেন তার রিলিজিয়ন্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে ধর্মগুলোর মধ্যকার ১৩টি সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন –

১। অধিকাংশ ধর্ম অতিপ্রকৃতিকে (spirits, gods, God) বিশ্বাসএর অন্তুর্ভূক্ত করে বা কিছু বাস্তবতার আড়ালের কোন শক্তিকে বিশ্বাস করে যা মানব জ্ঞানের ও অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে, কিন্তু মানুষ এগুলোর সাথে একরকম সম্পর্ক অনুভব করে।
ক. হিন্দুরা ৩৩ কোটি দেবদেবীতে বিশ্বাস করে, কিন্তু আবার তারা পরম ব্রহ্ম নামে এক চূড়ান্ত সত্তা বা আল্টিমেট রিয়ালিটিতেও বিশ্বাস করে।
খ. খ্রিস্টানরা একেশ্বরে বিশ্বাস করলেও ত্রিত্ব বা ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করে, আবার মুসলিমরা একেশ্বরবাদী হলেও তাদের মধ্যে ত্রিত্বে বিশ্বাস নেই, কারণ তারা একে বহুঈশ্বরবাদের ঝুঁকিসম্পন্ন বলে ভেবে থাকে।

২। ধর্ম সময়, স্থান, বস্তু ও মানুষের প্রেক্ষিতে পার্থিব বা সাধারণ বস্তু ও পবিত্র বস্তুর মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি ক. মুসলিমদের কাছে মক্কার গুরুত্ব আর মিলওয়াইকী (আমেরিকার একটি শহর যা বিয়ার ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিখ্যাত) শহরের গুরুত্ব এক নয়।
খ. খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে ক্রিসমাস আর ইস্টার অন্যান্য দিনের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।

৩। ধর্মের জন্য অনুমোদিত আচারিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হয়, যা ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিশ্বাসের সাথে পালন করে।
ক. এই আচার মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও জীবনচক্রের সাথে জড়িত, যা সব ধর্মেই দেখা যায়।
খ. অধিকাংশ ধর্ম পবিত্র কিছু কাহিনী বা ঘটনাকে তুলে ধরে বাৎসরিকভাবে উৎসবের সাথে সেগুলো পালন করে।

৪। ধর্ম সাধারণভাবে একটি নৈতিক বিধিবিধান বা নৈতিক নীতিমালা প্রদান করে যা ব্যক্তি বা সমাজ বাধ্যবাধকতার সাথে মেনে চলে।
ক. বাইবেলের ক্ষেত্রে টেন কমান্ডমেন্টস, ইসলামের ক্ষেত্রে শরিয়ত আইন এর উদাহরণ।
খ. বৌদ্ধরা গৌতম বুদ্ধের পথ অনুসরণ করে।

৫। ধর্মীয় জীবন একটি সাধারণ আবেগগত ও অন্তর্জ্ঞানলব্ধ আনবিক অনুভূতি প্রদান করে।
ক. এই অনুভূতির মধ্যে আছে আশ্চর্যবোধের অনুভূতি, রহস্যময়তার অনুভূতি, আনন্দের অনুভূতি, অপরাধবোধের অনুভূতি, সম্প্রদায়গত বন্ধনের অনুভূতি।
খ. ধর্মীয় প্রার্থনাগুলোতে প্রায়ই অনুসারীদেরকে অপরাধবোধের জন্য ও ক্ষমা ভিক্ষা করতে বলা হয়, একই সাথে আনন্দ ভোগ করতে ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান করতেও বলা হয়।

৬। ধর্ম মানুষের সাথে ঐশ্বরিকতার যোগাযোগকে উৎসাহিত করে, আর এই যোগাযোগের জন্য অনুসারীকে পথপ্রদর্শন করে।
ক. ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে একক ও সমন্বিত প্রার্থনা লক্ষ্য করা যায়।
খ. হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে এই ঐশ্বরিকতা প্রাপ্তির জন্য বিভিন্ন রকমের ধ্যানের উপায় বলা হয়েছে।

৭। পবিত্র কাহিনীর মাধ্যমে ধর্মগুলো একরকম সঙ্গতিপূর্ণ বা সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানের চেষ্টা করে।
ক. বিভিন্ন রকম ক্রিয়েশন মিথ বা সৃষ্টিপূরাণ তৈরি করে বিশ্বজগৎ কিভাবে তৈরি হল, মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীদের উদ্ভব কিভাবে হল এগুলোর ‘যৌক্তিক’ উত্তর দেবার চেষ্টা করা হয়।
খ. অনুসারীদেরকে ধর্মীয় নেতাদের জীবনী পড়ানো বা শেখানো হয়, আর তার মাধ্যমে তাদেরকে ‘সঠিক’, ‘কল্যানকর’ ও ‘পরিপূর্ণ’ জীবনযাপনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়।

৮। ধর্ম এর অনুসারীদের জীবনকে অরগানাইজ বা সংগঠিত করে বা করতে চায়, যার মাধ্যমে মানুষের উপর আরোপ করে পোশাক পরার বিধিবিধান, খাদ্যাভাসের বিধিবিধান, পেশাবিষয়ক বিধিবিধান, ও সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার বিধিবিধান।
ক. একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে গেরুয়া রঙ এর পোশাক পরতে হয়, মাথা নেড়া বা মস্তকমুণ্ডন করতে হয়।
খ. মুসলিম নারীদের উপর হিজাব পরা বা পর্দা অনুসরণ করার বিধান আছে।

৯। ধর্মের প্রয়োজন হয় সামাজিক সংগঠনের ও প্রাতিষ্ঠানিক আকারগুলোর যার সাহায্যে এটি প্রার্থনার জন্য, ক্ষমতার জন্য, জনসাধারণের মধ্যে ধর্মশিক্ষা প্রদানের জন্য, ধর্মীয় আচারগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে।
ক. প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের পোপ নেই, সুন্নি মুসলিমদের নেই আয়াতুল্লাহ খোমেনির মত সুপ্রিম রিলিজিয়াস লিডার (যা শিয়াদের আছে)।
খ. কিন্তু সব সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় কার্যক্রম আছে, ও আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো।

১০। জীবনে উত্থানপতন থাকলেও ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে একরকম অন্তঃস্থ শান্তি (Inner peace), সামঞ্জস্যতা বা সমন্বয়ের (Harmony) প্রতিশ্রুতি দেয়।
ক. বস্তুগত অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে অবস্থিত এমন কোন অর্থ খুঁজে পেয়ে অনেক সময় বিশ্বাসীরা তাদের জীবনের বিভিন্ন রোগ, শোক, অবিচার প্রভৃতি বাধাকে জয় করে।
খ. যেসব ধর্ম অনেক বছর ধরে শত শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টিকে আছে সেগুলো তার অনুসারীদেরকে আশা ও জীবনের বিশেষ রকমের অর্থ প্রদান করে।

১১। কষ্টভোগ (suffering) ও দয়া (compassion) বেশিরভাগ ধর্মের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

১২। ধর্ম নতুন যুগের বা পরকালের মাধ্যমে ভবিষ্যতের একটি আশা প্রদান করে।
ক. বেশিরভাগ ধর্ম মানুষকে আশা দেয় যে ভবিষ্যতে কোন ঐশ্বরিক ব্যক্তি আসতে চলেছেন যিনি মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটিয়ে একটি শান্তির নতুন যুগে নিয়ে যাবে – যেমন ইহুদি ধর্মে মেসিহা, যিশুর দ্বিতীয়বার ফিরে আসা, বিষ্ণুর অবতার কল্কির আগমন, বুদ্ধের শেষ প্রকাশ ইত্যাদি।
খ. অনুসারীদেরকে স্বর্গ বা নতুন পৃথিবী, বা শারীরিক অস্তিত্বের ঊর্ধ্বর কোন অবস্থা যেমন মোক্ষ লাভের মধ্য দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের আশা প্রদান করা হয়।

১৩। ধর্মগুলোকে ধর্মের মধ্যে নতুন নতুন সদস্যের অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ও বিশ্বাসীদের মধ্যে সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে এর প্রসারকে নিশ্চিত করতে হয়।
ক. বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম হল বিশ্বের মূল তিন মিশনারি ধর্ম যেগুলো অন্য ধর্মের লোকেদেরকে তাদের ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করে।
খ. বেশিরভাগ ধর্ম তাদের অনুসারীদের মধ্যে সন্তান উৎপাদনকে উৎসাহিত করে যা সেই ধর্মের নতুন সদস্যদের আগমনের প্রাথমিক উৎস্য।


তথ্যসূত্র

১। ধর্মের সংজ্ঞা নিয়ে তথ্যসূত্র মানে বইগুলোর নাম সেখানেই দেয়া আছে।
২। ধর্মের ৭টি ডাইমেনশন – Smart, Ninian (1968). Secular Education and the Logic of Religion. New York: Humanities Press. ISBN 978-0-571-08284-1.
৩। ধর্মের ১৩টি বৈশিষ্ট্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *