সীতা হওয়ার মূল্য কি? অগ্নিপরীক্ষা? আত্মহত্যা?
আজকাল ভারত রামরাজ্যের দাবীতে ভরে উঠেছে। বিশ্বাসীর চোখে রামরাজ্য ন্যায়-শান্তির রাজত্ব।রাম তাদের কাছে কাছে ভগবান। অন্ধভক্ত অবিবেচকের মত আজকের যুগে এসেও রামরাজ্য হয়তো চাইতে পারে কিন্তু রামায়ণ পড়া কোনো নারীর পক্ষে রামের রাজত্ব চাওয়া সম্ভব নয়! রামরাজ্যের নাম শুনলেই তার আঁতকে ওঠার কথা। অন্তত অবতার শ্রী রামচন্দ্র তার স্ত্রী সীতার সাথে কি রকম আচরণ করেছিলেন সেটা জানার পর, সে রামরাজ্য চাইবে না নিশ্চিত। রামের ন্যায় স্বামীও যে চাইবে না এই বিষয়েও তেমন সন্দেহ নেই।
যাইহোক রামায়ণের ঘটনা শুরু করা যাক।
জনকের কন্যা সীতাকে হরধনু ভঙ্গ করে স্বয়ম্বর সভা থেকে বিবাহ করে এনেছিলেন রাম। তার সাথে বেশ কিছু দিন সংসারও করেছেন।একদিন তার রাজ্যাভিষেকের সময়ে বিমাতা কৈকেয়ী তার পুত্র ভরতকে রাজা করার জন্য দশরথকে কৈকেয়ীকে দেওয়া পূর্বের বরের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। রামচন্দ্র কামুক পিতা দশরথের প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য ১৪ বছরের বনবাসে গমন করেন। এই দুঃসময়ে সীতা রামের সঙ্গ দেন, স্বামীর সাথে একসাথে বনে গমন করেন।
বনবাসকালীন সময়ে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে বসেন রাম-লক্ষ্মণ দুইভাই।রামকে লঙ্কার রাজা রাবণের নিজ বোন শূর্পণখার ভালো লাগলে, সে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে রামের কাছে উপস্থিত হয়। রাম তাকে প্রত্যাখ্যান করে তার ভাই লক্ষ্মণের কাছে তাকে প্রেরণ করে।রাম -লক্ষ্মণ এক স্ত্রীর ভাবাবেগ নিয়ে এভাবে খেলার পর, অকারণে তার নাক,কান কেটে রক্তাক্ত করে অনার্য জাতির প্রতি তাদের মনের অন্তর্নিহিত জ্বালা মেটায়। (বাল্মীকিতে বলা আছে, শূর্পনখা নাকি এক পর্যায়ে রাম-লক্ষ্মণদের খাওয়ার জন্য আক্রমণ করেছিল, কিন্তু অনার্যদের প্রতি বিতৃষ্ণা বশত,তাদের যে রাক্ষস প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা আর্যদের ছিল, তা তাদের সাহিত্য পাঠে সহজেই বোঝা যায়।)
বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে লঙ্কার রাজা রাবণ একসময় সীতাকে অপহরণ করে। সীতাকে বিবাহের শত প্রস্তাব দেওয়া সত্ত্বেও,সীতা রামের নাম স্মরণ করেই রামের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
একসময় দলবল নিয়ে রাবনকে হত্যা করে সীতাকে উদ্ধার করেন রাম।
হিন্দুদের মধ্যে সতীত্বের জন্য সাবিত্রী-সীতারা বেশ জনপ্রিয়। লোকসমাজে তাদের মত হতেই নারীদের শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এই সতীত্ব অথবা পতিব্রাত্যের প্রকৃত মূল্য কি তা সীতাকে না দেখলে বোঝা যায় না।
সীতার অগ্নিপরীক্ষা
রাবণ বধের পরে সীতা ও রাম মুখোমুখি হন।সীতাকে দর্শনমাত্র রাম বলেন,
“ভদ্রে! আমি রণস্থলে শত্রু জয় করিয়া তোমাকে উদ্ধার করিলাম, পৌরুষবলে যাহা করিতে হয়,তাহা সমস্তই করিলাম। ক্রোধের পার প্রাপ্ত হইয়াছি; তোমার অবমাননা জন্য কলঙ্ক মোচন করিলাম।আজ আমার পৌরুষ দেখান হইল। আজ আমার শ্রম সফল হইল।আজ আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হইল, আজ আমি স্বাধীন। আমি অনুপস্থিত থাকায় চলচিত্ত রাক্ষস তোমায় হরণ করিয়াছিল, সে দৈবকৃত দোষ,আমি মানুষ হইয়া দৈবকৃত দোষ দূর করিলাম। যে ব্যক্তি অবমানিত হইয়া সেই অপমান স্খলন না করে সেই লঘুচিত্ত ব্যক্তির পুরুষাকারে কি প্রয়োজন? হনুমান সমুদ্র লঙ্ঘন এবং লঙ্কা দহনাদি যে সকল শ্লাঘনীয় কার্য করিয়াছিল আজ তাহা সার্থক হইল। সসৈন্য সুগ্রীব যে হিতজনক মন্ত্রণা প্রদান এবং যুদ্ধে পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন আজ তাহার সেই শ্রম সফল হইল।”
“তোমার ধর্ষণা স্খালন করিবার জন্য মনুষ্যের যাহা কর্তব্য আমি নিজের মান রক্ষার জন্য রাবণকে বধ করিয়া তাহা করিয়াছি। ঋষি শ্রেষ্ঠ অগস্ত্য যেরূপ দুর্জয় দক্ষিণদিক জয় করিয়াছিলেন, সেইরূপ আমিও রাবণের সহিত যুদ্ধ করিয়া তোমাকে জয় করিয়াছি।ভদ্রে! তুমি জানিও আমি সুহৃদ গণের বীর্য বলে যে দারুণ রণপরিশ্রম করিয়াছি , ইহা তোমার কারণ নহে। তোমার হরণ জনিত অপবাদ অপনয়ন এবং বিখ্যাত বংশের মর্যাদা রক্ষা করিবার জন্যই আমি এইরূপ কার্য করিয়াছি।
রামের কথায় স্পষ্ট হয়, রাবণ রামের কোনো সম্পদ নিয়ে গিয়েছিল, যার ফলে তার পৌরুষ আহত হয়, তাই রাম কেবল তার পৌরুষ প্রদর্শনের জন্যই রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার জন্য যে তিনি রাবণের সাথে যুদ্ধ করেছেন সেরূপ নয়! রাম কেবলই নিজের মান রক্ষার জন্য সীতাকে জয় করেন। তাই সীতাকে রাম পরিষ্কার করেই জানিয়ে দেন,
“ভদ্রে! তুমি জানিও আমি সুহৃদ গণের বীর্য বলে যে দারুণ রণপরিশ্রম করিয়াছি , ইহা তোমার কারণ নহে।”
রাম কেবলই তার অপবাদ মোচনের জন্য সম্পদরূপ সীতাকে জয় করেন,’ঋষি শ্রেষ্ঠ অগস্ত্য যেরূপ দুর্জয় দক্ষিণদিক জয় করিয়াছিলেন’,সেইরূপ।
আমার জানা মতে, সীতা উদ্ধারের আরেকটি কারণ রাম সীতার কাছে প্রকাশ করেননি, সেটি হল- রামের কামুকতা। সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর রাম অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তার বিষাদের প্রকৃত কারণ প্রেম নয় খুব সম্ভবত (কেননা, সীতার প্রতি রামের প্রেম কিরূপ এখানে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি), কামাতুর হয়েই রাম সীতার জন্য অনেক বিলাপ করেছেন, আর এই কামের তাড়নাই খুব সম্ভবত তাকে সীতা উদ্ধারে প্রেরণা জুগিয়েছে।
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত বাল্মীকি রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডের ত্রিংশ সর্গে দেখা যায়-
“এদিকে রাম একান্ত কামার্ত; শরতের পাণ্ডুবর্ণ আকাশ,নির্মল চন্দ্রমন্ডল ও জ্যোৎস্নাধবল রজনী দর্শন করিলেন;সুগ্রীবের সুখভোগে আসক্তি এবং জানকীর অনদ্দেশের কথা চিন্তা করিলেন,বুঝিলেন,সৈন্যের উদযোগকাল অতীত হইয়াছে।তিনি যারপারনাই কাতর হইয়া মোহিত হইলেন এবং ক্ষণবিলম্বে সংজ্ঞালাভ করিয়া হৃদয়বাসিনী সীতাকে ভাবিতে লাগিলেন।…………”
তাই রামের কাম কেটে গেলে রাম তার মূল চরিত্রে ফিরে আসেন। রাম বলেন,
সীতে! তোমার চরিত্রে আমার সন্দেহ জন্মিয়াছে, অতএব তুমি আমার সম্মুখে থাকিয়া নেত্ররোগগ্রস্থ ব্যক্তির সম্মুখস্থিত দীপশিখার ন্যায় আমাকে যারপারনাই কষ্ট দিতেছ। অতএব ভদ্রে! জনকাত্মজে! এই যে দশদিক দেখিতেছ, ইহার যে দিকে ইচ্ছা হয় তুমি যাও; তোমাতে আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই।
সীতা অপহৃতা হওয়াতে রাম সীতার চরিত্রেই দোষারোপ করলেন, সীতা যদি রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হতেন তবে রামের কিরকম প্রতিক্রিয়া হত তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমান সমাজেও কিছু নিম্নশ্রেণীর লোক দেখতে পাবেন, যৌন নিপীড়ন অথবা ধর্ষণের পর তারা অত্যাচারীতাকেই দোষারোপ করতে থাকে; তার পরনে পর্যাপ্ত পোশাক ছিল কিনা (কতটা হলে যে পর্যাপ্ত তা তারাই জানবে, ঘোমটা দেওয়া,বোরখা পরা মহিলারাও তো রেহাই পান না অনেক সময়েই তাদের হাত থেকে) তা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। কাপড়েও যদি ত্রুটি খুঁজে না পায় তখন তারা তার চরিত্র,অসময়ে ঘরের বাইরে বেরোনো ইত্যাদি একের পর এক ছিদ্র অন্বেষণ করতেই থাকে, কিন্তু ধর্ষক অথবা নিপীড়কের প্রতি তাদের কিঞ্চিত আক্রোশও প্রকাশিত হয় না। এসব হয়তো তারা তাদের অবতার রামচন্দ্রের কাছ থেকেই শিখে থাকবেন!
সীতার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। রামচন্দ্র বলেন,
যে স্ত্রী বহুকাল পরগৃহে বাস করিয়াছে, কোন সদ্বংশজাত তেজস্বীপুরুষ, সুহৃদবোধে সেই স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করিতে পারে? রাবণ কুদৃষ্টিতে তোমাকে দেখিয়াছে, ক্রোড়ে করিয়াছে, সুতরাং আমি তোমাকে পুনরায় গ্রহণ করিয়া আমার সমহান কুল কলঙ্কিত করিতে পারি না। যে কারণ তোমাকে উদ্ধার করিয়াছি আমার সেই উদ্দেশ্য সফল হইয়াছে, সুতরাং তোমাতে আর আমার প্রয়োজন নাই, যথায় ইচ্ছা চলিয়া যাও।
এমনকি সীতাকে বিদ্রুপ করে রাম বলেন,
ভদ্রে সীতে! আমি বিবেচনা পূর্বক যাহা বলিবার তাহা বলিলাম, এক্ষণে লক্ষণ, ভরত বা শত্রুঘ্নের নিকটে থাকিতে তোমার ইচ্ছা হয় তাই কর, অথবা সুগ্রীব কিংবা বিভীষণকেও আত্মসমর্পণ করিতে পার। তুমি অনেকদিন রাবণের ঘরে বাস করিয়াছিলে অতএব সে তোমার লোকাতীত মনোহর রূপ দেখিয়া তোমাকে যে ক্ষমা করিয়াছে এরূপ বোধ হয় না।”
রামের এরূপ কথা শুনে জানকি কাঁদতে থাকেন।সীতা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
” বীর! ভদ্রেতর ব্যক্তি আর্যেতরা মহিলাকে যেরূপ বলিয়া থাকে, সেরূপ আপনি আমাকে নিদারুণ কথা শুনাইতেছেন কেন? মহাবাহো! আপনি আমাকে যেরূপ মনে করিতেছেন আমি সেরূপ নহি।আমি আমার চরিত্রের দিব্য করিয়া বলিতেছি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন।আর্যেতরা সাধারণ রমণীর চরিত্র দেখিয়া আপনি স্ত্রীজাতির ওপরে আশঙ্কা করিতেছেন,কিন্তু আপনি আমাকে অনেকবার পরীক্ষা করিয়াছেন সুতরাং এ আশঙ্কা দূর করুন।”
সীতা বলেন,
প্রভো! আমি আত্মবশে না থাকায় রাবণের সহিত আমার যে শরীর সংস্পর্শ ঘটিয়াছিল, তাহা আমার ইচ্ছাকৃত নহে, দৈবই সেই বিষয়ে অপরাধী …… গাত্রসকল আমার বশীভূত নহে। অতএব রক্ষক না থাকায় রাবণ তা স্পর্শ করিয়াছে, তাহাতে আমার অপরাধ কি?
সীতার একটি বাক্য খুবই মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়েছে আমার,
নাথ যাহা আমার অধীন সেই হৃদয়কে তো কেহ স্পর্শ করিতে পারেন নাই।
রামের হৃদয় থাকলে তবেই তো তিনি বুঝতে পারতেন,সীতার অন্তরকে রাবণ স্পর্শ করতে পারেনি। যার অন্তর নেই, তিনি কি করে বুঝবেন, সীতা!
সীতা অসহায়ের মতো বলে গিয়েছে,
“হায়! বহুকাল একত্রিত থাকিয়া আমাদের অনুরাগ এককালে সংবর্ধিত হইয়াছিল। কিন্তু আপনি যে তাহাতেও আমার চরিত্র অবগত হইতে পারেন নাই। আমি তাহাতেই অপার দুঃখে পরিলাম। রাজ শার্দুল! আপনি ক্রোধান্বিত হইয়া সাধারণের ন্যায় ,আমার কেবল স্ত্রীত্বই বিবেচনা করিলেন।আমি রাজর্ষি জনকের যজ্ঞভূমি হইতে উৎপন্ন বলিয়াই লোকে আমাকে জানকী বলিয়া থাকে,প্রকৃত পক্ষে জনকের ঔরসজাতা নহী, পৃথিবীর গর্ভে আমার জন্ম। ক্রিতজ্ঞ!আপনি আমার চরিত্র সম্বন্ধে সমুচিত সম্মাননা করিলেন না; বাল্যকালে শাস্ত্রানুসারে, আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাও আপনি দেখিলেন না, আপনার প্রতি আমার ভক্তি এবং আমার কিরূপ স্বভাব তাহাও বিবেচনা করিলেন না ।”
সীতা আক্ষেপের সাথে প্রশ্ন করে, সীতার চরিত্র সম্বন্ধে রামের যদি সন্দেহ জন্মে থাকে তবে কেন তিনি লঙ্কাতেই সীতাকে ত্যাগ করলেন না, কেন বৃথা পরিশ্রম করে ভয়ানক যুদ্ধ করলেন?-
বীর আপনি যখন বীরবর হনুমানকে লঙ্কা মধ্যে আমাকে দেখিতে পাঠাইয়াছিলেন তখন কেন পরিত্যাগ করেন নাই? হনুমান আমাকে আপনার সেই পরিত্যাগ সংবাদ শুনাইলেই আমি সে দণ্ডে ইহার সম্মুখেই প্রাণত্যাগ করিতাম। রাঘব! তাহা হইলে আপনাকে এরূপ প্রাণসংশয় স্বীকার পূর্বক অকারণে সুহৃদ বর্গকে কষ্ট দিয়া এরূপ যুদ্ধ শ্রম করিতে হইত না।
বেচারী সীতা কি তখনো বুঝতে পারেননি, রাম তাকে ভালোবাসেন না, তিনি রামের কাছে কেবলই সম্পত্তি যা আরেকজন চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় রামের আত্মসম্ভ্রম আহত হয়, তার ফলেই তিনি যুদ্ধ যাত্রা করেন!
তারপর বিষন্ন সীতা লক্ষ্মণকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
”সৌমিত্রে এরূপ মিথ্যা অপবাদগ্রস্থ হইয়া আমি আর প্রাণধারণ করিতে ইচ্ছা করি না। এক্ষণে চিতাই এই ঘোরতর বিপদের একমাত্র ঔষধ, অতএব তুমি চিতা প্রস্তুত করো। স্বামী আমার গুণে অসন্তুষ্ট হইয়া জনসমূহের মধ্যে আমাকে পরিত্যাগ করিলেন সুতরাং আমি এক্ষণে অগ্নিতে প্রবেশ করিয়া আমার কর্মানুরূপ গতি লাভ করি।”
সীতার কথা শুনে লক্ষণ ক্রোধভরা দৃৃষ্টিতে রামের দিকে তাকান,কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে রামের মনের ভাব জানতে পেরে লক্ষ্মণ চিতা প্রস্তুত করেন। চিতা প্রস্তুত হলে রাম মুখ নিচু করে বসে থাকেন। রামকে প্রদক্ষিণ করে সীতা অগ্নিকে বলেন-
“যখন আমার মন কখনো রাম হইতে বিচলিত হয় নাই, তখন লোকসাক্ষী সর্ব শুচি অবশ্যই আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করিবেন। আমার চরিত্র বিশুদ্ধ হইলেও স্বামী যেরূপে আমাকে দুষ্টা মনে করিতেছেন, সেইরূপ সকল লোকের পাপ পূণ্যের সাক্ষী ভগবান পাবক আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। আমি কায়, মন ও বাক্যে কখনও ধর্মজ্ঞ রঘুনন্দনকে অতিক্রম করি নাই, সুতরাং বিভাবসু আমাকে রক্ষা করুন।“
এই বলে সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করলেন।
সীতা আগ্নিতে প্রবেশ করলে, অগ্নিদেব জানকিকে কোলে নিয়ে উঠে আসেন। পরে লোকসাক্ষী অগ্নিদেব সীতাকে রামের নিকট দিয়ে বলেন,
” রাম এই তোমার বৈদেহীকে (সীতাকে) গ্রহণ কর। ইহাতে পাপের লেশমাত্র নাই। চরিত্র গরবিন, এই শুভলক্ষণা সচ্চরিত্রা সীতা, বাক্য মন , বুদ্ধি,অথবা চক্ষু দ্বারাও কখন তোমাকে অতিক্রম করেন নাই। যখন ইনি নির্জন কাননে একাকিনী ছিলেন , সেই সময় তোমার অনুপস্থিতি বশতঃ বীর্যোন্মত্ত রাক্ষস রাবণ বলপূর্বক ইহাকে হরণ করিয়া, তাহার অন্তপুরে অবরুদ্ধ করিয়াছিল। তথায় ঘোরবুদ্ধি ঘোররূপ রাক্ষসী গণ বারবার প্ররোচিতা এবং প্রলোভিতা করিলেও, একমাত্র তোমাতেই অনুরক্তা জানকী ক্ষণমাত্রও রাবণকে চিন্তা করেন নাই। তিনি নিরন্তর এক মনে তোমাকেই ধারণ করিতেন। রাঘব! আমি আদেশ করিতেছি এই পাপহীনা বিশুদ্ধস্বভাবা সীতাকে গ্রহণ কর। ইহাকে আর কোনো কথা বলিও না।”
তারপর রাম অগ্নিকে বলেন,
“জানকি যে লোকসকলের মধ্যে সমাধিক পবিত্রা, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ইনি রাবণের অন্তঃপুরে বহুকাল বাস করিয়াছিলেন, সুতরাং আমি যদি বিশুদ্ধরূপে পরীক্ষা না করিয়াই ইহাকে লইতাম, তাহা হইলে লোকে বলিত যে, ‘দশরথ পুত্র রাম নিতান্ত কামপরতন্ত্র এবং সাংসারিক ব্যবহারে একান্ত অনভিজ্ঞ।‘
রাম যদি অবতার হয়ে থাকেন, তবে তার কি লোককে সঠিক পথ দেখানো উচিত ছিল না? নাকি রক্ষণশীল, গোঁড়া লোকেদের দেখানো পথে তার চলা উচিত ছিল? রাম যদি আগেই জেনে থাকেন, সীতা সচ্চরিত্রা তবে তাকে সকলের সামনে হেনস্থা করে রাম সবাইকে কি শিক্ষা দিয়ে গেলেন? আর তার অপহৃতা পত্নীকে ফিরে পাওয়ার চাইতে তার কাছে তার তথাকথিত সতীত্ব বড় হল? রাম যে সীতাকে একদমই ভালোবাসতেন না, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
যাইহোক,এর পরে রাম সীতাকে গ্রহণ করেন।
সীতার অগ্নিপরীক্ষা অথবা অগ্নিতে প্রবেশ করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা কোনো লৌকিক ঘটনা বলে মনে হয় না। এই ঘটনা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আক্ষরিক অর্থে সত্যি হতে পারে না,কারণ বাস্তবে অগ্নিদেব কখনো কাউকে কোলে নিয়ে উঠে আসেন না। কবি তার কাব্যে অলৌকিকতা মিশ্রণ করে এইসব বর্ণনা করেছেন। রামায়ণের কাহিনীতে যদি ইতিহাস আছে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলা যায় সীতাকে হয়তো তৎকালীন কোনো ডাক্তারী পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়ে নিজের সতীত্বের প্রমাণ দিতে হয়েছিল। আর রামায়ণের কাহিনী যদি কবির নিছক কল্পনা হয়ে থাকে তাতেও তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান কেমন ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়।
যাইহোক, সীতার সতীত্ব পরীক্ষাতেই সম্পূর্ণ গল্প শেষ হয়ে যায় না….
সীতার পাতাল প্রবেশ
সীতার সতীত্ব নিয়ে রামরাজ্যে কানাঘুষো শুরু হয়, এখানে ওখানে আলোচনা চলতে থাকে।রামচন্দ্র তার সভাসদ ভদ্রের কাছ থেকে তা জানতে পারেন। ভদ্র বলেন,
“ রাজন! বন, উপবন, দোকান, প্রাঙ্গন এবং পথিমধ্যে পুরবাসীরা যেসকল ভালো এবং মন্দ কথা বলে, আপনি তা শুনুন, ‘রাম সাগরে দুষ্কর সেতু বন্ধন করিয়াছেন, ইহা কি রাজা, কি দানব, কি দেবতা কেহই কখনো শুনে নাই। রাম সৈন্য এবং বাহনের সহিত দুর্ধর্ষ রাবণকে বধ করিয়াছেন, এমনকি ভল্লুক রাক্ষস এবং বানরগণকে আপনার বশে আনিয়াছেন। রঘুনন্দন রাম রাবণকে নিহত করিয়া , রাবণ যে সীতাকে স্পর্শ করিয়াছিল, তার জন্য কিছুমাত্র কুপিত না হইয়া সীতাকে নিজ পুরীতে আনিয়াছেন। রাবণ পূর্বে সীতাকে বলপূর্বক হরণ করিয়া লঙ্কা পুরীতে লইয়া যাওয়া সত্ত্বেও রামের হৃদয়ে সীতা সম্ভোগ জনিত সুখ কি প্রকারে হইতেছে? সীতা রাক্ষসগণের বশীভূত হইয়া অশোক কাননে ছিলেন তথাচ রাম কেন তাহাকে ঘৃণা করেন না?”
রামরাজ্যের নিম্ন মানসিকতার লোকজনের কাছে সীতার অপহৃত হওয়া যেন সীতার নিজেরই অপরাধ! তাই তারা রামের আচরণে বিস্মিত, ‘রাম কেন সীতাকে ঘৃণা করেন না!’ তারা হয়তো জানে না, ইতিপূর্বেই রাম, যার মানসিকতা, চিন্তাধারা তাদেরই মত নিম্নমানের, তিনি সীতার সতীত্ব পরীক্ষা করেই তাকে নিজ গৃহে এনেছেন। কে জানে! তারা জানতেও পারে, রাম নাকি লোকলজ্জ্বার ভয়ে সীতার সতীত্ব পরীক্ষা করেছিলেন! তাহলে এই ঘটনা লোকের অজানা থাকার কথা নয়। তারপরেও রামরাজ্যের তৃতীয় শ্রেণির বসবাসকারীদের অভ্যন্তরীন চুলকুনি শেষ হয় না। তারপরেও তারা বিস্মিত,
” তথাচ রাম কেন তাহাকে ঘৃণা করেন না”
ভদ্রের ভাষ্য অনুযায়ী রাজ্যবাসীরা বলতে থাকে, (অবশ্য, রাজ্যবাসী বলতে অধিকাংশক্ষেত্রেই সেই রাজ্যবাসীরা পুরুষ হয়ে থাকবে যারা এইধরণের কথা বলে)
সীতা রাক্ষসগণের বশীভূত হইয়া অশোকবনে ছিলেন, তারপরেও রাম কেন তাকে ঘৃণা করেন না। রাজা যাহা করেন, প্রজারা তাহারই অনুসরণ করিয়া থাকে, সুতরাং আমাদিগকেও স্ত্রীগণের এরূপ দোষ সহিতে হইবে।“
সীতার অপহৃতা হওয়ায়,রাবণের অশোক কাননে বন্দি থাকায়, সীতার দোষ কোথায় সেটা বোধগম্য হয় না। রাম ও তার রাজ্যের পুরুষেরা নিজেদের চরিত্রের চাইতে তাদের স্ত্রীদের চরিত্র নিয়ে দেখি অতিমাত্রায় চিন্তিত। তারা একের পর এক বিবাহ করেছে; রামের পিতা দশরথেরই বহু পত্নী ছিল। তাদের জন্য পতিতালয়,বারাঙ্গনা,দাসী সবই রয়েছে,তারপরেও তাদের চরিত্র কলুষিত হয় না! আর একজন নারী কোনো পুরুষের নিকট অপহৃতা-বন্দি অবস্থায় থাকায় তার চরিত্র নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ থাকে না! সীতা যদি রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হতেন, তবে যে রাম ও তার ‘রামরাজ্যবাসীদের’ কিরকম প্রতিক্রিয়া হত তা সহজেই অনুমেয়।
সভাসদ ভদ্রের কথা শোনার পর রাম তার ভাইদের ডেকে এনে বলেন,
“ তোমরা সকলেই শাস্ত্রার্থ পারদর্শী সুতরাং বুদ্ধি দ্বারা স্থির নিশ্চয় করিয়া আমি যে কথা বলিব তোমরা তাহার অনুসরণ করিবে।“
এবার সীতাকে ত্যাগের কারণ হিসাবে, রাম বলেন,
“তোমাদের মঙ্গল হউক, আমার ইচ্ছার অন্যথাচারণ করিও না। পুরবাসীরা সীতার সম্বন্ধে যাহা বলিয়া থাকে তাহা শুন- “ আমি মহাত্মা ইক্ষ্বাকুদিগের মহান বংশে জন্মিয়াছি, সীতাও মহাত্মা জনকের পবিত্রকূলে জন্মিয়াছেন। সুতরাং পুরবাসীরা ও জনপদবাসীরা আমার নামে যে নিরতিশয় অপবাদ দেন, সেই নিন্দাবাদই আমার মর্ম বেদনা দিতেছে। সৌম্য! বিজন দণ্ডকাননে রাবণ যেরূপে সীতাকে হরণ করিয়াছিল এবং যেরূপে আমি তাহাকে বধ করিয়াছি, তাহা তুমি সকলই জান। সেই সময়ে জনক দুহিতা সীতার সম্বন্ধে আমার এরূপ মনে উদয় হইয়াছিল যে, ‘সীতাকে কিরূপে ঘরে লইয়া যাব? লক্ষণ! সীতা তখন পতিব্রাত্যধর্মের পরীক্ষা দিবার জন্য তোমার সাক্ষাতেই অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন; তখন অগ্নি দেবতাগণের নিকটে মৈথেলীকে নিষ্পাপ বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলেন। অধিক কি, চন্দ্র, সূর্য এবং বায়ুও পূর্বে দেবতাদিগের নিকটে জানকীর পবিত্রতার পরিচয় দিয়াছিলেন। দেবরাজ মহেন্দ্র লঙ্কাদ্বীপে এইরূপ পবিত্র চরিত্রা সীতাকে আমার করে সমর্পণ করেন। বিশেষত আমার অন্তরাত্মাও সীতাকে শুদ্ধ বলিয়া জানে। এই জন্যই আমি সীতাকে লইয়া অযোধ্যায় আসিয়াছি। কিন্তু পুরবাসী ও জনপদবাসী ব্যক্তিগণের এইরূপ ঘোরতর নিন্দাবাদ শুনিলে আমার হৃদয়ে যৎপরোনাস্তি কষ্ট হইয়া থাকে। দেবগণ অকীর্তির নিন্দা করেন এবং কীর্তি সকল লোকেই পূজিতা হয়, এই কারণে মহাত্মাগণ কীর্তির জন্যই নিয়ত লালায়িত।আমি লোকনিন্দাভয়ে জীবন এবং তোমাদিগকেও পরিত্যাগ করিতে পারি, জানকীর ত কথাই নাই। এক্ষণে তোমরা দেখ আমি কিরূপে অকীর্তির শোকসাগরে পড়িয়াছি। বিশেষতঃ ইহা অপেক্ষা অধিক দুঃখ কোনজীবেই কিছুমাত্র দেখি না।
সীতার সতীত্ব পরীক্ষার পরও রাম পুরবাসীদের নিন্দা অপবাদ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। রামের কাছে নিজের নিরপরাধ পত্নীর চাইতে নির্বোধ পুরবাসীর দেয়া অপবাদ মুখ্য হয়ে ওঠে এবং রামচন্দ্র নিজমুখেই বলেন, “মহাত্মাগণ কীর্তির জন্যই নিয়ত লালায়িত”, কীর্তি রক্ষার খাতিরে এবং অকীর্তি হতে মুক্তির জন্য রামচন্দ্র সীতাকে এমনকি নিজের ভাইদেরও ত্যাগ করতে পারেন! অবতার হিসাবে যেখানে রামের সাধারণ পুরবাসীকে সঠিক পথ দেখানো উচিত, সেখানে রাম পুরবাসীদের পথেই গা ভাসিয়ে দেন। তার কাজকর্ম দেখে আর যাই মনে হউক, কোনো ন্যায়নিষ্ঠ ভগবান একদমই মনে হয় না।
তারপরে রাম লক্ষণকে বলেন, সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে ত্যাগ করে আসতে। এবং এই বিষয়ে লক্ষ্মণকে একপ্রকার বাধ্যই করেন বলা চলে। রাম লক্ষ্মণকে বলেন-
সীতার পরিত্যাগ বিষয়ে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করিবে না। আমার কথা পালন কর। লক্ষ্মণ এই বিষয়ে কোনোরূপ স্থির না করিয়াই তুমি সীতাকে লইয়া প্রস্থান কর, কেননা আমার এই আদেশমত কার্য না করিলে, আমার প্রতি অবজ্ঞা দেখান হইবে। আমি তোমাদিগকে আমার পাদদ্বয় এবং প্রাণের দিব্য দিয়া বলিতেছি, যাহারা আমার কথায় কিছুমাত্র প্রতিবাদ করিবে, তাহারা আমার অহিতাচারী বলিয়া পরিগণিত হইবে। তোমরা যদি আমার শাসনে থাকিতে চাও তো সমাদরে আমার কথা পালন কর- অদ্যই এখান হইতে সীতাকে লইয়া যাও।
সীতা পূর্বে রামকে বলেছিলেন, তিনি গঙ্গার পাড়ের মুনিদের আশ্রম দেখতে ইচ্ছুক। রাম সীতাকে আশ্রম দেখানোর নাম করে ,সীতাকে সেখানে ত্যাগ করে আসতে বলেন লক্ষ্মণকে।
রামের কথা মত লক্ষ্মণ সীতাকে গিয়ে বলেন,
“ দেবী আপনি পূর্বে মহারাজের নিকট আশ্রম দর্শনের প্রার্থনা করিয়াছিলেন, এতএব আপনাকে আশ্রমে লইয়া যাইবার জন্য আমার প্রতি আদেশ করিয়াছেন সুতরাং দেবী আপনি গঙ্গাতীরে মুনিগণের পবিত্র আশ্রমে অবিলম্বে গমন করুন। আমি রাজার শাসনানুসারে আপনাকে মুনিনিযেবিত তপোবনে লইয়া যাইব।”
লক্ষ্মণের কথা শুনে সীতা অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং লক্ষ্মণের সাথে আশ্রম দেখতে যেতে সম্মত হন।
তারপর লক্ষ্মণ সীতাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। নৌকায় করে তারা গঙ্গা পার হন।
গঙ্গা অতিক্রম করে লক্ষ্মণ সীতাকে বলেন,
“ বৈদেহী! ধীমান আর্য তোমাকে লোকনিন্দিত নিদারুণ এই ক্রুর কার্যে নিযুক্ত করিয়া লোকসমাজে আমাকে নিন্দাভাজন করিয়াছেন। সুতরাং আমার হৃদয়ে সুমহাত শল্য বিদ্ধ হইতেছে। এখন এই অবস্থায় আমার মূর্ছা বা মৃত্যুই শ্রেয়ঃ তথাপি এইরূপ লোক নিন্দিত কার্যে নিযুক্ত থাকা উচিত নহে। সুতরাং শোভনে আমার প্রতি দোষ লইবেন না, আমার প্রতি প্রসন্ন হউন।”
লক্ষ্মণ এইকথা বলে হাতজোড় করে মাটিতে পড়েন।
সীতা লক্ষ্মণের এইরূপ অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,
“ লক্ষ্মণ! আমি তোমার ক্রন্দনের কোনো কারণই বুঝিতেছি না, সুতরাং কি হইয়াছে যথার্থ করিয়া বল, তোমাকেও অস্বস্ত দেখিতেছি,- মহারাজের মঙ্গল তো? আমার বোধ হইতেছে রাজা তোমাকে অভিসম্পাত করিয়াছেন, তাহাতেই তুমি এইরূপ শোকে অধীর হইতেছ। আমি তোমাকে অনুরোধ করিতেছি আমার নিকটে সকল কথা বল”।
লক্ষ্মণ, সীতার এই কথা শুনে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে মাথা নিচু করে বলেন,
“জনক তনয়ে! নগরে এবং জনপদে আপনার নিদারুণ অপবাদের কথা সভামধ্যে শুনিয়া রাম সর্বতোভাবে সন্তপ্ত হইয়া আমার নিকট ব্যক্ত করত গৃহে প্রবেশ করিয়াছেন। দেবী রাজা ক্রোধে যেসকল কথা মুখ থেকে বাহির করিয়াছেন, তাহা আমি আপনার নিকটে বলিতে পারিব না।অতএব, সেই সকল কথা বলিতে বিরত হইলাম। দেবী রাজা আমার নিকটে আপনার নির্দোষিতার কথা বলেছেন কেবল পুরবাসী নিন্দাভয়ে আপনাকে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। সুতরাং আপনি তাহা প্রকৃত বলিয়া মনে করিবেন না। গর্ভিণীর দেহাদপূরণ রাজার আজ্ঞাপালন অবশ্য কর্তব্য । ইহা আমি জানি এই কারণে আমি আশ্রমপ্রান্তে আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইব। শুভে! গঙ্গা তীরে মহর্ষি গণের তপোবন, ইহা পরম রমণীয় এবং পবিত্র, সুতরাং আপনি এখানে থাকুন, দুঃখিত হইবেন না। মহাযশা, দ্বিজবর, মুনিপুংগব বাল্মীকি আমার পিতা মহারাজ দশরথের পরম বন্ধু, সুতরাং দেবী আপনি সেই মহর্ষির পাদমূলে উপনিতা হইয়া একাগ্রচিত্তে উপাসনা করত সুখে বাস করুন। দেবী আপনি পাতিব্রাত্য ধর্ম অবলম্বন করিয়া হৃদয়ে সর্বদা রামের ধ্যান ক্রুন, তাহা হইলেই আপনার পরম মঙ্গল হইবে।
সীতা লক্ষ্মণের নিদারুণ কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। পরে জ্ঞান ফিরলে কাঁদতে কাঁদতে লক্ষ্মণকে বলতে থাকেন,
“লক্ষ্মণ! বিধাতা দুঃখভোগের জন্যই আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন; সেই কারণে আজ আবার দুঃখরাশি মূর্তিমান হইয়া আমার নিকটে উপস্থিত হইল। বোধহয় আমি পূর্ব জন্মে কোনো মহাপাপ করিয়াছিলাম, কোনো ব্যক্তির স্ত্রীবিচ্ছেদ ঘটাইয়া দিয়াছিলাম! সেই কারণ বশতঃ আমি সতী এবং পবিত্র স্বভাবা হইলেও রাজা আমাকে পরিত্যাগ করলেন। পূর্বে আমি স্বেচ্ছায় বনবাস ক্লেশ সহিয়াও, রামের সহিত রামের পাদচ্ছায়ায় বাস করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম। সৌম! এখন আমি প্রিয়জন বিরহে একাকিনী কিরূপে আশ্রমে বাস করিব এবং একান্ত দুঃখিতা হইয়াই বা বিজন বনে কাহাকে নিজের দুঃখের কথা বলিব? প্রভো মহাত্মা রঘুনন্দন রামচন্দ্র তোমাকে কিজন্য পরিত্যাগ করিয়াছেন? তুমিই বা কি অসৎ কার্য করিয়াছ? মুনিগণ এইকথা যখন জিজ্ঞাসা করিবেন, তখন আমি তাহাদিগকে কি উত্তর দিব? লক্ষ্মণ আমার গর্ভে সন্তান রহিয়াছে সুতরাং এক্ষণে প্রাণত্যাগ করিলে আমার স্বামীর বংশলোপ হইবে; তাহা না হইলে আজই জাহ্নবী জলে প্রাণ বিসর্জন করিতাম। লক্ষ্মণ রাজা তোমাকে যেইরূপ আদেশ করিয়াছেন, তাহা তুমি পালন কর, আমি নিতান্ত দুঃখিনী সুতরাং আমাকে অরণ্যে পরিত্যাগ করিয়া রাজ আদেশ পালন কর।”
সীতা চরিত্রের মধ্যে বিন্দুমাত্র বিদ্রোহ পরিলক্ষিত হয় না। এতটা যাতনা সহ্য করার পরেও সীতা প্রতিবাদী হয় না। তার মস্তিষ্কও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সতীত্ব,পতিব্রাত্য ইত্যাদিতে ভরপুর। সীতা নীরবে সব সহ্য করে যান বলেই হিন্দুসমাজে সীতার মত নারীরই কদর রয়েছে, যারা মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করে যেতে পারে।
এইবলে একাকিনী সীতা বনের মধ্যে বিলাপ করতে থাকেন।
তখন মুনিকুমারেরা সীতাকে বিলাপ করতে দেখে ঋষি বাল্মীকির কাছে উপস্থিত হন। বাল্মীকিকে সীতার কথা জানালে, বাল্মীকি সীতাকে আশ্রয় দেন।
সীতাকে পরিত্যাগ করে ফেরার সময় লক্ষ্মণ অনুতাপ করে বলেন,
পূর্বে পিতার অনুজ্ঞাক্রমে দণ্ড নামক ঘোর অরণ্যে চতুর্দশ বৎসর বাস করিয়া রাম যে দুঃখ ভোগ করিয়াছিলেন, তাহা তাহার উচিতই হইয়াছিল, কারণ তাহাতে পিতার আদেশ প্রতিপালিত হইয়াছে। কিন্তু পুরবাসীগণের কথায় রামচন্দ্র যে, সীতাদেবীকে পুনরায় নির্বাসিত করিলেন ইহা অতি নৃশংস কার্য বলিয়া মনে করিতেছি। সুমন্ত্র! পৌরগণের অন্যায় কথায় সীতা পরিত্যাগ রূপ কার্য করিয়া রাম কোন ধর্ম রক্ষা করিলেন?
আমাদের মনেও একই প্রশ্ন জাগে-
পৌরগণের অন্যায় কথায় সীতা পরিত্যাগ রূপ কার্য করিয়া রাম কোন ধর্ম রক্ষা করিলেন?
বাল্মীকির আশ্রমে সীতা দুটি পুত্র প্রসব করেন। বাল্মীকি তাদের নাম রাখেন লব ও কুশ।
এভাবে অনেকদিন কেটে যায়। একদিন রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলে তাতে বাল্মীকি ,লব-কুশ ও অন্যান্য শিষ্যদের নিয়ে হাজির হন।
বাল্মীকি লব-কুশকে বলেন রামায়ণ গান করতে। লব কুশ রামায়ণ গান করতে থাকে। লবকুশের রামায়ণ গান শুনে রাম জানতে পারেন লব কুশ তারই পুত্র। রাম তার দূতকে বলেন,
“ তোমরা বাল্মীকির কাছে গিয়ে এই কথা গুলি বল, ‘জানকীর চরিত্র যদি বিশুদ্ধ ও নিষ্পাপ হয় তাহা হইলে তিনি মহর্ষির অনুমতি নিয়ে তার বিশুদ্ধতার পরিচয় দিন। তোমরা মহর্ষি এবং সীতার মনোগত অভিপ্রায় জানিয়া সীতা যদি বিশুদ্ধতার পরিচয় দিতে সম্মত হন, তাহলে শীঘ্র আমাকে আসিয়া বলিবে। তাহলে কাল সকালেই জানকী সভামধ্যে শপথ করুন।“
আবারো রামের মনে সীতার সতীত্ব নিয়ে সংশয় জাগে। তিনি নিজেই লক্ষ্মণকে তার পিতার বয়সি বাল্মীকির আশ্রমে সীতাকে ত্যাগ করে আসতে বলেছিলেন। এখন তিনি সীতা ও বাল্মীকির মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই হল দেবতা!এনার চিন্তাধারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কোনো সাধারণ পুরুষের ব্যতিক্রম নয়! এই অবতারেরা নাকি ধর্ম সংস্থাপন করার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন! কিন্তু এরা তো দেখি, নারীদের জীবনকে নরক বানিয়ে রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই পৃথিবীতে আসেন!
দূত বাল্মীকির কাছে গিয়ে রামের কথা জানালে বাল্মীকি রামের মনোভাব বুঝতে পেরে বলেন,
“ তোমাদের মঙ্গল হউক, পতিই স্ত্রীলোকের দেবতা সুতরাং রামচন্দ্র যাহা বলিয়াছেন, তাহাই হইবে, সীতা সভামধ্যে শপথ করিবেন”।
পতিই স্ত্রীলোকের দেবতা- এই কথাটির আরেকটি অর্থ করা যায়, পতিরাই (পুরুষেরাই) এইসব পিতৃতান্ত্রিক দেবতাদের স্রষ্টা। তাই তো সেই সমাজের দেবতার চিন্তাধারা পুরুষদের চিন্তাধারার সাথে এতটা মিলে যায়!
যাইহোক, দূত বাল্মীকির কথা গিয়ে রামকে জানান, রাম আনন্দিত হয়ে সভাস্থ মহর্ষি ও রাজাদের বলেন,
“ ভগবন, মহর্ষি গণ ও তাদের অনুচরগণ! আপনারা এবং আর যাহার ইচ্ছা হয় সকলেই সীতাকে শপথ করিতে দেখিবেন”।
নিজের স্ত্রীকে অন্যদের সামনে হেনস্থা করার মত পৈশাচিক আনন্দ কেবল রামই জানবেন!উনিই এরূপ কাজ বারে বারে করতে পারেন।
রামচন্দ্রের এই কথা শুনে মহর্ষিরা সাধু সাধু বলে ওঠেন, মহাবল রাজারা রামচন্দ্রের প্রশংসা করে বলেন,
“ এইরূপ কার্য আপনাতেই সম্ভবপর হইতে পারে”।
আহা কি মহৎ কার্য! স্ত্রীজাতির এরূপ অবমাননা, হেনস্থার অপেক্ষা মহৎ কার্য আর কি হতে পারে! সাধু! ঋষিগণ সাধু!
যাইহোক, ঋষিরা বিদায় নিলে পরদিন প্রভাতে রামচন্দ্র বশিষ্ট, জাবালি, কশ্যপ, বিশ্বামিত্র, দুর্বাসা, নারদ সকলের সাথে উপস্থিত হন। নানান স্থানের লোক একত্রিত হন সীতার সতীত্ব পরীক্ষা দেখবে বলে। সবাই উপস্থিত হলে পরে বাল্মীকি সভায় উপস্থিত হন এবং সীতা রামকে মনে মনে স্মরণ করতে করতে বাল্মীকির পেছন পেছন সভায় উপস্থিত হন। বাল্মীকি রামকে সকলের সামনে বলেন,
“দাশরথি রাম, সীতা পতিব্রতা ধর্মচারিণী হইলেও তুমি লোকনিন্দার ভয়ে ইহাকে আমার আশ্রমে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, কিন্তু মহাব্রত! তুমি লোকাপবাদ ভয়ে ভীত , অতএব লোকাপবাদ যাতে দূর হয় তিনি এমন প্রত্যয় দিবেন, তুমি তাকে অনুমতি দাও। রাম আমি সত্য বলিতেছি, জানকীর গর্ভ জাত দুর্ধর্ষ যমজ তোমারই তনয়। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি সীতা যদি দুশ্চরিত্রা হন তবে আমি বহুসহস্র বৎসর ধরিয়া যে তপস্যা করিয়াছি তাহা নষ্ট হবে। জানকী যদি নিষ্পাপা না হন , তাহলে আমি কায়মনোবাক্যে যে পাপকর্ম করি নাই তাহার বল পাব। রাম, সীতার পঞ্চভূতের সমষ্টিরূপ মন শরীর এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে বিন্দুমাত্র পাপ নাই,ইহা আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিয়াই ইহাকে আমার আশ্রমে স্থান দিয়াছিলাম। তুমি লোকাপবাদভয়ে ভীত হইয়াছ বলেই এই শুদ্ধচারিণী নিষ্পাপা পতিদেবতা সীতা আজ তোমার সম্মুখে প্রত্যয় করিবেন”।
বাল্মীকির কথা শোনার পরেও সীতার সতীত্ব পরীক্ষার জন্য জোর দিয়ে রাম বলেন,
“ মহাভাগ! হে ব্রহ্মজ্ঞ! আপনি যা বললেন, সেইরূপই বটে। আপনার নির্মল বাক্যে আমার বিশ্বাস হইয়াছে। ব্রহ্মন! বৈদেহী পূর্বেও দেবগণের সমক্ষে প্রত্যয় প্রদান এবং শপথ করিয়াছিলেন বলিয়াই আমি ইহাকে গৃহে আনিয়াছিলাম। ব্রহ্মন! লোকনিন্দা অতি বলবান, সেই ভয়েই আমি সীতাকে নিষ্পাপা জানিয়াও পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। এক্ষণই আপনি আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। এই যমজাত কুশ এবং লব যে আমারই পুত্র তাহাও আমি জানি,তথাপি বৈদেহী ত্রিভুবনবাসী সকলের নিকট বিশুদ্ধা বলিয়া পরিচিতা এবং আমার প্রীতিভাজন হউন।
সীতার সতীত্ব-পরীক্ষা দেখতে সকলেই উপস্থিত হয়েছেন দেখে রাম পুনরায় বলতে থাকেন,
“ দেবগণ! মহর্ষি গণ! রাজাগণ! মুনিবরগণ! যদিও বাল্মীকির নির্মল বাক্যে সীতার বিশুদ্ধতা বিষয়ে আমার অনুমাত্রও সন্দেহ নাই তথাপি আপনারা সকলে ইহার শপথ দেখিতে আসিয়াছেন সুতরাং সীতা আপনাদের নিকটে বিশুদ্ধ বলিয়া পরিচিত হইয়া আমার প্রীতি প্রার্থী হউন।
“মহর্ষি! রাজাগণ! সীতা এক যন্ত্রবিশেষ। এই যন্ত্রের নাম সতীযন্ত্র। এই যন্ত্রের সুইচ টিপে দিলেই বারে বারে সতীত্বের পরীক্ষা দেখানো শুরু করে দেয়! আর আপনারা সকলে যখন সীতারূপ সতীযন্ত্রের শপথ দেখতে এসেছেনই,তখন সেই শপথ দেখেই যান! আমি সুইচ টিপে দিলাম”- রাম হয়তোবা এইজাতীয় কিছুই বলতে চাইছিলেন!
সীতা সকলকে উপস্থিত দেখে নতমুখে ভূতলে তাকিয়ে করজোড়ে বলতে থাকেন,
“ আমি রাম ভিন্ন অন্য কাহাকেও কখনো মনেও স্থান দিই নাই, এই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তাহার গর্ভে বিবর দান করুক। আমি কায়মনোবাক্যে সতত কেবল রামেরই অর্চনা করিয়াছি। সেই সত্যবলেই ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তার গর্ভে স্থান দান করুক।”
সীতা এরূপ শপথ করলে পৃথিবী বিদীর্ণ হয়, পাতাল থেকে এক সিংহাসন উঠে আসে। সীতা সেই সিংহাসনে আরোহণ করে রসাতলে (পাতালে) প্রবেশ করেন।
রামায়ণের কাহিনীকে যদি সত্যি বলে ধরা হয়, তাহলে সীতার পাতালে প্রবেশ হয়তো তার আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না! এই ঘটনাই হয়তো সীতার পাতাল প্রবেশের আবরণে উল্লেখিত হয়েছে।একজন মানুষের পক্ষে আর কত অপমান সহ্য করা সম্ভব! অপমানিত,লাঞ্ছিত হতে হতে আর সহ্য করতে না পেরেই সীতা আত্মহত্যা করেন।রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলেও সীতাকে এতটা যন্ত্রণা কখনো দেননি,এতটা অপমান কখনো করেননি, যতটা রাম করেছেন। আর কাব্যকে বাস্তবের আতস কাচ দিয়ে দেখার প্রচেষ্টা না করে যদি কবির অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিতেই দেখা হয় তাহলে বলতে হয় সীতা সত্যি সত্যিই পাতালে প্রবেশ করেছিলেন!
এহেন রামচরিত্র সমাজকে কি শিক্ষা দিয়ে গেল নারী নির্যাতন ছাড়া? সত্যই রামকে নারী নির্যাতনকারীদের ভগবান, নারী নির্যাতনকারীদেরই পথপ্রদর্শক ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না!
–
–
তথ্যসূত্রঃ
১/ সীতার অগ্নিপরীক্ষা- বাল্মীকি রামায়ণ/লঙ্কাকাণ্ড/ ষোড়শাধিকশততম সর্গ-বিংশত্যাধিকশততম সর্গ| বেণীমাধব শীলস লাইব্রেরী|অনুবাদকঃ পঞ্চানন তর্করত্ন
২/ সীতার পাতালপ্রবেশ- বাল্মীকি রামায়ণ/উত্তরকান্ড/ষড়ধিকশততম সর্গ- একাদশাধিকশততম সর্গ | বেণীমাধব শীলস লাইব্রেরী|অনুবাদকঃ পঞ্চানন তর্করত্ন
আরও দেখুন- হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য কর্তৃক অনুবাদিত বাল্মীকি রামায়ণ
–