আসিফ মহিউদ্দীন অনূদিত ছোটদের জন্য মানববাদ এবং অপপ্রচার প্রসঙ্গে

ছোটদের জন্য মানববাদ

আমাদের সবার পরিচিত আসিফ মহিউদ্দীনের অনুবাদ করা ‘ ছোটদের জন্য মানববাদ ’ শীর্ষক বইটি সবে পড়ে শেষ করলাম। বইটি পড়ার পর এর একটি রিভিউ লেখার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। হিউম্যানিজম ফর চিল্ড্রেন বা শিশুদের জন্য মানববাদ নামক মূল বইটি লিখেছিলেন Nada Perat Radfrau। আসিফ মহিউদ্দীন এর ভাবানুবাদ করেছেন। বইটি অনুবাদ হলেও অনুবাদক একে বাংলা ভাষাভাষীদের উপযোগী করে সাজিয়েছেন। যখন উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে, তখন পারতপক্ষে আমাদের চারপাশের মনীষিদের উদাহরণই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাঙ্গালী মানবতাবাদীদের নিয়েও আলাদাভাবে লিখেছেন আসিফ মহিউদ্দীন। এর ফলে বইটি অনুবাদ হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাভাষী শিশুরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে এর প্রতি যে গভীর একাত্মতা অনুভব করতে সক্ষম হবে, সন্দেহ নেই।

বইটির নামের সাথে মিল রেখেই বইটি মানববাদ দিয়েই শুরু হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে এতে আলোচিত হয়েছে যুক্তি, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি, জীবের উদ্ভব, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রেনেসাঁ, সেক্যুলারিজম, নারীবাদ, জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি, মোরালিটি প্রভৃতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

চারপাশে যখন ধর্মীয় হানাহানি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তখন মানববাদই হতে পারে আমাদের শেষ আশ্রয়। আর এই বইটি মানববাদ প্রসঙ্গে শিশুদের হাতে খড়ি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একটি শিশুর সুস্থ মনন নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য যা জানা একান্ত আবশ্যক, বইটিতে সেসবের দেখা মিলবে।

তবে বইটি শুধু শিশুদের জন্য নয়, বড়দের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে। সত্যি বলতে কি, বইটি পড়ে আমি নিজেও অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছি। বইটিতে যে বিবিধ বিষয় প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে, সেই বিষয়গুলো সম্বন্ধে জানা অনেক সময়ের ব্যাপার, অনেক পড়াশোনার ব্যাপার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল, এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একজায়গায় পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। সম্ভবত, এমন বই খুব কম পাওয়া যাবে। কিন্তু লেখিকা Nada Perat Radfrau ও আসিফ মহিউদ্দীন এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে একসাথে সূত্রবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন।

বইটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলছি।

১) অনেক শিশুরাই ছোটবেলায় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তারা অনেকে হয়তো বুঝতেও পারে না, তাদের সাথে কি ঘটে গিয়েছে। বইটিতে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্বন্ধেও আলোচনা করা হয়েছে। শিশুদের বোঝানো হয়েছে, কোন স্পর্শ তাদের জন্য সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয়।

২) সমাজের অধিকাংশ মানুষই এখনো কোনটা যুক্তি, কোনটা কুযুক্তি তা ঠিকঠাক বোঝে না। এমতাবস্থায় লেখক শিশুদের পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন যুক্তি এবং কুযুক্তির সাথে। যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে কুযুক্তি চেনা কিন্তু ভীষণ জরুরী, কারণ কুযুক্তি নির্ধারণ করতে না পারলে এবং কুযুক্তির প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে না পারলে, কারো পক্ষে যুক্তিতর্ক করা সম্ভব নয়।

৩) আমাদের সমাজ এখনো সহজে ভিন্নতাকে মেনে নিতে পারে না। যারা প্রকৃতিগতকারণে বা চিন্তার ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো কারণে আমাদের মত নয়, তাদেরকে বর্তমান সমাজের একটি বড় অংশ ঘৃণার চোখে দেখে। কোনো ব্যক্তি কিভাবে তার জীবনযাপন করবে, সে কি ভাববে, কি বিশ্বাস করবে, সেটাও সমাজ ( বিশেষত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী) নির্ধারণ করে দিতে চায়; অন্যের উপর প্রভুত্ব করতে চায়। ফলস্বরূপ ভিন্ন মতের অনুসারী সংখ্যালঘুদের নানা নিপীড়নের শিকার হতে হয়। যারা যৌন সংখ্যালঘু আছেন, তাদের উপরও একই রকমের আঘাত নেমে আসে। তারা নানা রকমের নির্যাতন এবং বৈষম্যের শিকার হন। সমাজের এসব যৌন সংখ্যালঘুদের সাথেও এই বইটিতে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা যে বাকি সবার মতই, তারাও যে সমান মর্যাদা ও সমান অধিকারের দাবীদার, তাই এতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৪) আসিফ মহিউদ্দীন দীর্ঘসময় ধরে নানা বিষয়ের পাশাপাশি ধর্ম এবং নাস্তিকতা নিয়ে লেখালেখি করছেন। তাই কারো মনে এই ধরণের চিন্তা আসতে পারে যে, বইটি হয়তো নাস্তিক্যবাদী বা এতে নাস্তিক্যবাদের মহিমাই হয়তো প্রচারিত হয়ছে। তবে আসলে তা নয়। বইটিতে লেখক ধর্ম বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের সাথে শিশুদের প্রাথমিক ভাবে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। এখানে বেশি চোখে পড়ে বর্ণনা করার প্রচেষ্টা, তথ্য প্রদানের প্রচেষ্টা, সমালোচনার নয়। কোনো মতকে হেয় বা সুপিরিয়র প্রমাণ করার প্রবণতা এখানে তেমন চোখে পড়ে না। বইটি কোনো আক্রমণাত্বক সমালোচনামূলক বই নয়। বইটিতে সমালোচনার চাইতে যা বেশি দেখা যাবে, তা হল আলোচনা। বইটির মূল উদ্দেশ্য শিশুদের অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ প্রভৃতির সাথে পরিচয় করে দেওয়া ।

৫) শিশুরা কিভাবে একটি সুন্দর জীবনযাপন করবে তার নির্দেশনা বইটিতে দেয়া হয়েছে। সুন্দর জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবে মানবতা, নীতি, মুক্তচিন্তা, সৃষ্টিশীলতা, সহানুভূতি, পরিবেশ সচেতনতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা প্রভৃতিও আলোচিত হয়েছে। বইটি থেকে সুন্দর জীবনযাপনের দশটি প্রস্তাব সবার জন্য তুলে ধরছিঃ

  • নিজের যত্ন নেওয়া
  • চিন্তায় ও মননে স্বাধীন ও মুক্ত থাকা
  • সুখী ও সুন্দর থাকা
  • একতাবদ্ধ হওয়া
  • অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া
  • সমাজ, পৃথিবী এবং এই বিশ্ব নিয়ে ভাবা
  • যুক্তিবাদী হওয়া
  • ন্যায়পরায়ণ হওয়া
  • দায়িত্বশীল হওয়া
  • সাহসী হওয়া

৬)সমাজ বদলের অনেক উদাহরণও এই বইটিতে চোখে পড়বে, যা শিশুদের জন্য তো অবশ্যই, আমাদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। আমি একটি উদাহরণের উল্লেখ করছি। উদাহরণটি সোফি শোলের। জার্মানিতে নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অপরাধে সোফি শোল সহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একপর্যায়ে নাৎসিরা সোফিকে একটি সুযোগ দিয়েছিল। সুযোগটা এমন ছিলঃ বাকি সদস্যদের উপর দোষারোপ করে সোফি চাইলে রেহাই পেতে পারতেন। কিন্তু সোফি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অমানুষিক অত্যাচার শেষে অন্যান্যদের সাথে সোফিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ফাঁসির আগে সোফি বলেছিলেন, “ কাউকে না কাউকে তো প্রথম পদক্ষেপটা নিতেই হত।“ সোফি আরো বলেছিলেন, “ আমরা কি করে আশা করি যে এই সমাজে শুভ ও সত্যের পরিবেশ থাকবে, যেখানে আমরা নিজেরা কেউই সত্যের জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত নই। কি সুন্দর, ঝকঝকে একটি দিন, আর আজ আমি চলে যাব। এই মৃত্যুর তাৎপর্য কি যদি না হাজারো মানুষের মনে তা রেখাপাত করে, তাদের প্রতিরোধে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করে? “

এই তো গেল বইয়ের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে কথা। কিন্তু তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করার জন্য, বইটিতে কিছু অনিচ্ছাকৃত বানান ভুল থেকে গিয়েছে। তবে, রত্নে যদি অল্প ধূলো লাগে, তাহলে নিশ্চয় তার মূল্য কমে যায় না। যাই হোক, আশা করছি, পরবর্তী সংস্করণে এই ক্ষুদ্র ত্রুটির পরিমার্জন হবে।

বইটি প্রকাশিত হতে না হতেই কিছু দ্বেষপ্রেমী মানুষেরা বইটি নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বইটির ভুয়া স্ক্রিনশট তৈরি করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ‘ছোটদের জন্য মানবাদ’ বইটি ছোটদের জন্য লিখিত হওয়া সত্ত্বেও নাকি এতে ‘নবী মুহাম্মদের যৌনজীবন’ নিয়ে আসা হয়েছে। এই নির্লজ্জ অপপ্রচারের পাশাপাশি অনেকে আসিফ মহিউদ্দীনের ফাঁসিও চেয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। হাসবো নাকি কাঁদবো? ইসলাম সমালোচনা করে বইটি লেখা হয়নি। বইটির মূল বিষয়বস্তু ইসলাম নয় বরং মানববাদ। সবার কাছে অনুরোধ রইলো যাচাই না করে কারো কথায় কান দেবেন না। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনেই চিলের পেছনে দৌড়ানো কোনো বুদ্ধিমান মানুষের কাজ নয়। বইটি কিনুন এবং পড়ুন। যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তার সত্যতা কতটা, তা জানার জন্য হলেও পড়ুন।

মানবিক, যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যা যা প্রয়োজন এই বইয়ে সেই ধরণের সকল রসদ আছে। বইটি ছোটদের ছোটোবেলা থেকেই ভাবতে শেখাবে। বইটি শিশুদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করবে।আর প্রশ্নই সূত্রপাত করে অনুসন্ধানের, আবিষ্কারের। মানুষের ভেতর যে সীমাহীন কৌতূহল আছে, জানার যে অদম্য ইচ্ছা আছে, বইটি যে তার সূত্রপাত করবে, সন্দেহ নেই।

ছোটদের জন্য মানববাদ” বইটি এখন পাওয়া যাচ্ছে বইমেলা ডট কমে।

View Comments (11)

  • মুসলিমদের প্রচার যে হিসেবে প্রচার হচ্ছে তা বলার বাহিরে।
    আমি কলেজে পড়ি আর সেখানে ঢুকতেই "আল্লাহ আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর" ।আর কলেজের সামনে "নামাজ পর" /"মাসাল্লাহ"/"সুবহানাল্লাহ " ইত্যাদি লিখে রাখছে। কি বিরক্তি লাগে! আর আমি বিজ্ঞান প্রচার করতে গেলে আমারে কি অবস্থা হয় কে জানে! বিবর্তন সম্পর্কে লেখলে বা এরকম বিজ্ঞানসম্মত কিছু লেখলে কি হবে আল্লাই ভালো জানে।
    মোটামুটি বলতে গেলে সবার মধ্যে মানসিক প্রেশার ক্রিয়েট করা হচ্ছে এই সমাজকে মৌলবাদী, ধর্মবাদী করার জন্য। তারপর তারা ১৫/১৬ শতকের পাদ্রি খ্রিস্টান দের মতো পুরো সমাজকে অতিষ্ট করে ফেলবে। এবংকি যারা হিজাব পরে না বা আগ্রহী না (হিন্দু সহ) তাদের উপর ও অনেক রকম প্রেশার দেয়। কলেজের বেশিরভাগ মেয়েই চেহারা হাত ঢেকে রাখে এবং চোখ পর্দা করতেও দেখেছি। মেয়েদের সাথে ছেলেরা সাধারন দূরত্ব বজায় রাখতেই পারে কিন্তু এর মানে এই নয় যে তারা বুর্কা নিকাব পরে পুরো আলাদা কিছু হবে গেল। তারা অতিরিক্ত পবিত্র বলে সব ছেলেকে সন্দেহ করবে। ভয় পাবে এবং এর কারনেই তাদের মধ্যে সাভাবিক সম্পর্ক থাকে না। হ্যাঁ এটা সত্যিই মানসিক ব্যাধি। উইগুর মুসলমান এর সাথে তাই যা হচ্ছে আলটিমটলি তা তাদের জন্য ভালো। আমি চাই সমাজে সবাই মিলেমিশে থাকুক(নারী পুরুষ, হিন্দু /মুসলমান নাস্তিক )। আর চাই ওয়াজ আর ইসলামের এত প্রেসার ক্রিয়েটিং প্রচার বন্ধ হোক।

  • দাদা এই বইটার কি পিডিএফ ফাইল দেয়া যাবে।
    দিতে পারলে উপকৃত হবো।

    • বই টি পিডিএফ করে দিলে উপকৃত হব

  • আমি এই বইটি পিডিএফ খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি

    • বইটি পিডিএফ ফাইল দিলে উপকৃত হব

  • ভাই ছোটদের মানববাদ বইটি পি ডি এফ পেলে উপকার হতো। বাচচাকে ও আমি পড়তে পারতাম

  • ছোটদের মানবতাবাদ বইটি পিডিএফ দিলে উপকৃত হতাম

Leave a Comment