তথ্য সমূহ – হিন্দু ধর্ম

Print Friendly, PDF & Email

বিভিন্ন সময়ে নানা ধরণের বিতর্ক এবং আলোচনায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন রেফারেন্স আস্তিক নাস্তিক নির্বিশেষে আমাদের সকলেরই প্রয়োজন হয়। দেখা যায়, হিন্দু ধর্মের নানা তথ্য আমাদের মনে আছে কিন্তু তা কোন পুরান বা গ্রন্থে রয়েছে বা কোন খণ্ডে রয়েছে তা মনে নেই। এইসব সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য এই তথ্যভাণ্ডারটি তৈরি করা হচ্ছে।

এই তথ্যভান্ডারটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি। আপনাদের সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ অন্ধভাবে আমাদের অনুসরণ না করে নিজে মিলিয়ে (cross referencing) দেখুন। প্রয়োজনীয় রেফারেন্স, বই এবং লিঙ্ক আমরাই আপনাদের জন্য জোগার করে দেবো। কেউ কোনো তথ্য যুক্ত/সংশোধন করে দিলে আমরা গালাগালি নয়, বিনয়ের সাথে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব।

উল্লেখ্য, এখানে শুধুমাত্র তথ্যসূত্রগুলো উল্লেখ করা হবে। সেগুলো নিয়ে কোন আলোচনা, বা বিতর্ক এখানে অনুগ্রহ করে শুরু করবেন না। শুধুমাত্র আপনারা জানা কোন সংযোজন বা কোন রেফারেন্সে ভুল দেখতে পেলে জানাবেন।

এই তথ্যভাণ্ডারটি সমৃদ্ধ করবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন নাস্তিক্য ডট কমের সম্পাদক বৃন্দ, শুধুমাত্র আপনার সুবিধার জন্য। অনুগ্রহ করে এখান থেকে রেফারেন্স সংগ্রহ করলে আমাদের লিঙ্কটি সাথে যুক্ত করে দেবেন। সেই সাথে, এই লিস্টটি আরো সমৃদ্ধ করতে আপনাদের সহযোগিতা আমাদের কাম্য। আপনাদের কাছে হিন্দু ধর্মের নানা রেফারেন্স রয়েছে, তা নিচে কমেন্ট বক্সে লিখে এই তথ্যভাণ্ডারটি আপনিও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারেন।

সূচিপত্র

স্রষ্টা ব্রহ্মার অজাচার

বৃহদারণ্যক উপনিষদে

বৃহদারণ্যক উপনিষদে প্রজাপতি তার শরীর হতে এক নারীকে উৎপন্ন করে তার সাথে মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করেছিলেন-

“(কিন্তু) তিনি আনন্দ পাইলেন না; সেইজন্য কেহ একা থাকিয়া আনন্দ পায় না। তিনি দ্বিতীয় (সঙ্গী লাভ করিতে) চাহিলেন। স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গিত হইলে যে পরিমাণ হয়, তিনি ততখানিই ছিলেন। তিনি নিজের দেহকে দুইভাগে ভাগ করিলেন। এইভাবে পতি  ও পত্নী হইল।এই জন্য যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন- ‘প্রত্যেকে নিজে অর্ধবিদলের মত’ ; এই জন্য শূন্য স্থান স্ত্রী দ্বারা পূর্ণ হয়। তিনি সেই পত্নীতে মিথুনভাবে উপগত হইয়াছিলেন। তাহার ফলে মানুষের উৎপত্তি হইল।“(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/৩ | হরফ প্রকাশনী

“সেই স্ত্রী এইপ্রকার চিন্তা করিল- ‘আমাকে আপনা হইতে উৎপন্ন করিয়া ইনি কিভাবে আমাতে উপগত হইতেছেন? আমি অদৃশ্য হই।‘ সে গাভী হইল; অন্যজন (প্রজাপতি) বৃষ হইয়া তাহাতেই উপগত হইলেন; এইরূপে গরু উৎপন্ন হইল। একজন অশ্বা হইল, অপরজন অশ্ব হইলেন; একজন গর্দভী, অপরজন গর্দভ হইলেন।তিনি তাহাতে উপগত হইলেন। একজন অজা, অন্যজন অজ হইলেন। এইরূপে ছাগ ও মেষ উৎপন্ন হইল। পিপীলিকা পর্যন্ত যতপ্রকার মিথুন আছে, সেই সবই তিনি এইভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন।“ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/৪| হরফ প্রকাশনী )  

পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে

পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে প্রজাপতি তার কন্যা উষার সাথে মিলিত হতে চেয়েছিলেন-

“প্রজাপতি তার নিজকন্যা উষাকে অধিকার করতে আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। তিনি তার বীজ হারিয়ে ফেলেছিলেন; সেটা পৃথিবীতে পড়ে গিয়েছিল; তিনি সেটাকে শক্তি দিলেন, (এই ভেবে): ‘আমার এটা যেন নষ্ট না হয়’। তিনি এটাকে সঠিকভাবে স্থাপন করলেন এবং এর থেকে গবাদি পশু তৈরি করলেন।“(পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ৮/২/১০) 

শতপথ ব্রাহ্মণে

শতপথব্রাহ্মণেও প্রজাপতি তার কন্যা আকাশ অথবা উষার সাথে সহবাস করেছিলেন-

“১. প্রজাপতি তার কন্যা আকাশ অথবা উষার প্রতি কামার্ত হয়েছিলেন। ‘আমি কি তার সাথে মিলিত হব’ এই ভেবে তিনি তার সাথে মিলিত হলেন। ২. দেবতাদের চোখে এটা অবশ্যই পাপ ছিল। ‘নিজের মেয়ে, আমাদের বোনের প্রতি এমন আচরণ যে করে (সে পাপ করে)’, তারা ভাবলেন। ৩.তারপর দেবতারা পশুদের অধিপতি (রুদ্রকে) বললেন, “নিজের মেয়ের সাথে, আমাদের বোনের সাথে যে এমন আচরণ করে সে নিশ্চয় পাপ করে । বিদ্ধ কর তাকে রুদ্র, লক্ষ্য স্থির করে তাকে বিদ্ধ কর। তার অর্ধেক বীজ মাটিতে পড়েছিল…” (শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৪/১-৩

শিবপুরাণে

শিবপুরাণের জ্ঞানসংহিতার ৪৯ তম অধ্যায়ে ব্রহ্মাকে তার কন্যা সরস্বতীর প্রতি কামাতুর হয়ে পড়তে দেখা যায়।

শিবপুরাণ মতে, বর্তমানে ব্রহ্মা চতুর্মুখ হলেও পূর্বে তিনি পঞ্চ মুখবিশিষ্ট ছিলেন। একবার শিব ও পার্বতীর সামনে স্রষ্টা ব্রহ্মা অপভ্রংশ শব্দ ব্যবহার করেন, এর ফলে শিব তার একটি মুখ কেটে ফেলেন।

পুরাণ বর্ণনাকার সূতের মুখে ব্রহ্মার মাথা হারানোর কাহিনী শুনে মুনিরা জিজ্ঞেস  করেন, “ব্রহ্মার মুখ কেন এমন বিরুদ্ধভাষী হল?” উত্তরে সূত বলেন, “ হে ঋষিগণ! পূর্বকালে ব্রহ্মা নিজ কন্যা সরস্বতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনুসরণ করে কাম বিহ্বল চিত্তে তাকে ‘অয়ি সুন্দরী! গননে নিবৃত্ত হও’ এই কথা বলেছিলেন। তা শুনে সরস্বতী রেগে গিয়ে অভিশাপ দেন , “পিতা হয়ে তুমি যে মুখে ধর্ম বিরুদ্ধ অশুভ কথা বললে, সেই মুখে তুমি বিরুদ্ধভাষী হবে।“(শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা/৪৯ অধ্যায়/৭৭-৭৯| অনুবাদক-শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন )

সরস্বতীর এই অভিশাপের পর থেকে ব্রহ্মা তার মুখ দিয়ে ‘অতি কঠোর দুষ্ট শব্দ’ উচ্চারণ করতেন। আর শিব ও পার্বতীর সামনে এমন দুষ্ট শব্দ ব্যবহারের ফলেই পিতামহ ব্রহ্মা তার পঞ্চম মুখ হারান।

স্কন্দ পুরাণে

নানান পুরাণে যদিও সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা এবং সরস্বতীর সাথে ব্রহ্মা অজাচারে লিপ্ত হয়েছিলেন কিন্তু স্কন্দ পুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে ব্রহ্মাকে গায়ত্রী ও সরস্বতীর পতিরূপে দেখা যায়। তবে স্কন্দ পুরাণেও ব্রহ্মাকে তার ‘বাক’ নামক কন্যার সাথে অজাচারে লিপ্ত হতে দেখা যায়।

পুরাণ বর্ণনাকার সূত বলেন, “ বিপ্রগণ! পূর্বে প্রজাপতি কামুক  হয়ে মোহক্রমে বাক নামের নিজকন্যার প্রতি আসক্ত হন। কন্যা বাক প্রজাপতির কামুক মনোভাব বুঝতে পেরে লজ্জায় মৃগীরূপ ধারণ করেন। তখন ব্রহ্মাও হরিণ হয়ে তার সাথে রমণ করতে অভিলাষী হন। বাগদেবী হরিণীরূপে গমন করলে, মৃগরূপী ব্রহ্মাও তার অনুগমন করেন।“ (স্কন্দ পুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/সেতুমাহাত্ম্য পর্ব/ অধ্যায় ৪০)

দেবতারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে কন্যা সঙ্গমে উদ্যত দেখে তার নিন্দা করতে থাকেন। দেবতারা বলেন, “ এই ব্রহ্মা কন্যাগমনে উদ্যত হয়ে বড়োই অকার্য করছেন।“

ব্রহ্মাকে এই ধরণের অবৈধ কাজে লিপ্ত দেখে শিব ব্যাধের রূপ ধারণ করে মৃগরূপী ব্রহ্মাকে হত্যা করেন।

ব্রহ্মা নিহত হলে , ব্রহ্মার স্ত্রী গায়ত্রী এবং সরস্বতী কঠোর তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। শিব সন্তুষ্ট হলে ব্রহ্মাও আবার জীবিত হয়ে ওঠেন।

ব্রহ্মা জীবিত হয়ে মহেশ্বরকে বলেন, “ হে দেব দেবেশ! হে করুণাকর, শঙ্কর! তোমায় নমস্কার করি। হে প্রভু, করুণা সিন্ধু ! পাপাচরণ হতে আমায় পরিত্রাণ কর। হে শম্ভু, তোমার কৃপায় আমার যাতে কখনো নিষিদ্ধাচরণে পুনরায় আর প্রবৃত্তি না হয়, তুমি আমায় সেভাবে সবসময় রক্ষা কর।“

শিব ব্রহ্মাকে বলেন, “ তথাস্তু! হে বিধি! অতঃপর তুমি আর প্রমাদে পতিত হয়ো না। কুপথে চলা সমস্ত পুরুষদের আমিই সর্বদা শাসন করি। “

কালিকা পুরাণে

বিধাতা ব্রহ্মা, দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণকে সৃষ্টি করে যখন ক্রতু,পুলহ,পুলস্ত,বসিষ্ট,নারদ প্রভৃতি দশ মানস পুত্রকে সৃষ্টি করেন, তখন তার মন থেকে এক পরম রূপবতী উত্তম রমণী আবির্ভূত হন। তিনি সন্ধ্যা নামে বিখ্যাত হন। এই সন্ধ্যাকে সন্ধ্যাবেলায় পূজা করা হয়ে থাকে। (১/২৪-২৫)

তার মত সম্পূর্ণ গুণশালীনি রমণী তখন স্বর্গ, মর্ত্য, পাতলে আর ছিল না, তার আগে অথবা পরে হয়নি, আর হবেও না। (১/২৬)

পুরাণকারের বর্ণনা অনুযায়ী,

  • সন্ধ্যা ‘স্বভাব সুন্দর সুনীল কুন্তল(কেশ) ভারে বর্ষাকালীন ময়ূরীর ন্যায়’ (১/২৭)
  • তার ‘আকর্ণবিলম্বী অলকগুচ্ছ শোভিত আপাটল ললাটদেশ ইন্দ্রধনু বা নবীন শশধরের ন্যায়।‘ (১/২৮)
  • তার চোখ ছিল হরিণীর মত। (১/ ২৯)
  • “যার সৌন্দর্য ও লাবণ্যগুণে বদন মণ্ডলের পরিপূর্ণতা- চিবুকের কাছে আসার জন্যই যেন তার স্তনযুগলের উদ্যম, হে বিপ্রগণ তার সেই কমলকলিকাকৃতি , উত্তঙ্গ পীবর পরস্পর সংযুক্ত শ্যামাগ্র স্তনযুগল দেখলে মুনিরাও মোহিত হতেন।” (১/৩৩)
  • “তার ত্রিবলি শোচিত ক্ষীণ কটিদেশ, বসনের ন্যায় মুষ্টিগ্রাহ্য। তার কটিদেশকে সকলেই কামদেবের শক্তি বলে মনে করেছিল।” (১/৩৪)

এই পরম সুন্দরী যিনি কিনা ব্রহ্মার নিজের কন্যা তাকে দেখে ব্রহ্মা ভাবতে লাগলেন। তাকে দেখে দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ ও ব্রহ্মার মরিচী প্রভৃতি মানসপুত্রগণ অত্যন্ত উৎসুক হয়ে ভাবতে থাকেন। এই রূপবতী কার হবেন, এই নিয়ে সবাই ভাবছিলেন।

ব্রহ্মা এমন চিন্তা করতে করতে এক মনোহর পুরুষ তার থেকে উৎপন্ন হন। সেই পুরুষই কামদেব নামে পরিচিত। ব্রহ্মা তাকে বর দিয়ে বলেন , “তুমি তোমার এই মনোহর মূর্তি ও পুষ্পময় পঞ্চশরে স্ত্রী পুরুষদের মোহিত করে চিরস্থায়ী সৃষ্টির প্রবর্তক হও।”(১/৫৩) ব্রহ্মা বলেন, দেব, দানব,কিন্নর,গন্ধর্ব, মানুষ,পশুপাখি,সাপ,জলজ প্রাণী সকলেই কামদেবের দ্বারা মোহিত হবে। ব্রহ্মা আরো বলেন, “অন্য প্রাণীর কথা দূরে থাক, আমি, বিষ্ণু , এবং মহেশ্বর আমরাও তোমার বশবর্তী হব” (১/৫৭)

ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পাওয়ার পর, কামদেব ব্রহ্মার উপরেই প্রথমে তা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন। কামদেব ভাবলেন,

“ব্রহ্মা আমার যে নিত্যকর্ম স্থির করে দিয়েছেন, তার পরীক্ষা এখানে মুনিদের সামনেই,এই ব্রহ্মার উপরেই করে দেখি। (২/১৭) এখানে মুনিরা আছেন, দক্ষ প্রজাপতি আছেন, স্বয়ং ব্রহ্মাও আছেন, আর  সন্ধ্যাও এখানে আছেন। (২/১৮) এই সকল পুরুষ এবং ব্রহ্মাও আমার শরব্য হবেন।(২/১৯)”

এর পরেই কামদেব কামবাণে সকলকে মোহিত করলেন। “এরপর শরপীড়িত হয়ে সেইসমস্ত মুনি এবং ব্রহ্মা মোহিত হয়ে মনে মনে কিছুটা বিকার প্রাপ্ত হলেন।” (২/২৪-২৫) “তারা সকলে বিকার প্রাপ্ত হয়ে বারবার সন্ধ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন, দেখতে দেখতে তাদের কাম বৃদ্ধি পেল। কেননা রমণী হতেই কাম বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। ” (২/২৬)

তখন সেই দুষ্ট মদন তাদের বারবার মোহিত করে,যাতে তাদের বহিরিন্দ্রিয়ের বিকার হয়,তা করলেন। (২/২৭)

এরপর যখন ব্রহ্মা ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে , সন্ধ্যাকে দেখতে লাগলেন তখন তার শরীর হতে ৪৯ সাত্ত্বিক ভাবের উদয় হল। (২/২৮)

তারা সকলে দৃষ্টিপাত করতে থাকলে সন্ধ্যাও বারবার কটাক্ষপাত ও কটাক্ষসঙ্কোচ প্রভৃতি কামদেবের বাণ সম্ভূত বিবিধ ভাব প্রকাশ করতে লাগলেন। (২/৩০) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ উঠলে মন্দাকিনীর যেমন শোভা হয়, সেইরকম স্বভাব সুন্দরী সন্ধ্যাদেবীও মদন বিকার জনিত সেই ভাবপ্রকাশ করে অত্যন্ত শোভা পেয়েছিলেন।

এরপর  সেই সন্ধ্যাকে দেখতে দেখতে বিধাতার শরীরে স্বেদজলধারা বইতে লাগল।তিনি সন্ধ্যার প্রতি অভিলাষী হলেন। (২/৩২) এরপর মরীচি , অত্রি সেই সমস্ত মুনি এবং দক্ষ প্রমুখ মুনিবরেরাও ইন্দিয়বিকার প্রাপ্ত হলেন। (২/৩৩)

তখন, ব্রহ্মা ও মুনিদের অবস্থা দেখে কামদেব তার ক্ষমতার উপর বিশ্বাস আনলেন।

সেই সময়ে আকাশচারী মহাদেব ব্রহ্মা এবং দক্ষ সদৃশ পুত্রগণকে ওইরকম বিকারপ্রাপ্ত দেখে  উপহাস করতে লাগলেন। (২/৩৬) শিব ধিক্কার জানিয়ে হাসতে হাসতে তাদের লজ্জায় ফেলে দিয়ে বলতে লাগলেন,

“ ওহে ব্রহ্মা! নিজের তনয়াকে দেখে, তোমার কিনা কামভাব উপস্থিত হল। যারা বেদানুসারে চলে, এ কাজ তাদের যোগ্য নয়।“ (২/৩৭-৩৮)

শিব বলেন, “ পুত্রবধূ ও কন্যা মাতৃতুল্য; এটা বেদের সিদ্ধান্ত। তুমি সামান্য কামের প্রভাবে এটা বিস্মৃত হলে কিভাবে?” (২/৩৯)

“ধৈর্য তোমার মনকে সর্বদা সতর্ক করে রাখে। বিধি তারপরেও ক্ষুদ্র কাম কিনা তোমার সেই মন বিগড়ে দিল?” (২/৪০)

শিবের কথা শুনে ব্রহ্মার ঘাম ঝরতে থাকে। “ব্রহ্মা সেই কামরূপিনী সন্ধ্যাকে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হলেও ইন্দ্রিয় বিকার নিয়ন্ত্রণ  করলেন, তাকে আর গ্রহণ করলেন না।“ ২/৪৫

মৎস্য পুরাণে

মৎস্য পুরাণে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তার মেয়ে শতরূপাকে বিয়ে করেছিলেন-

“তিনি (ব্রহ্মা) জপে নিরত আছেন, এমন সময় তার পবিত্র দেহ ভেদ করে অর্ধস্ত্রীরূপ ও অর্ধপুরুষরূপ প্রাদুর্ভূত হল। স্ত্রীরূপার্ধ শতরূপা নামে বিখ্যাত হলেন। হে পরন্তপ!এই শতরূপাই সাবিত্রী,গায়ত্রী,সরস্বতী ও ব্রহ্মাণী নামে প্রসিদ্ধ। ব্রহ্মা তাকে- স্বদেহ-সম্ভূত নারীকে ‘আত্মজা’ রূপে কল্পনা করলেন। এরপর বিভু প্রজাপতি তাকে দেখে পীড়িত ও কামশরে জর্জরিত হয়ে বললেন, অহো ‘কি রূপ!’ কি অপূর্ব রূপ।‘ তখন বশিষ্ঠ প্রমুখ মহর্ষিরা তাকে বোন বলে সম্বোধন করতে লাগলেন। কিন্তু ব্রহ্মা তার মুখপঙ্কজ ছাড়া আর কিছুই  দেখতে পেলেন না। তিনি বারবার ‘অহো কি রূপ! অহো রূপ!’ এই কথাই বলতে লাগলেন। এরপর ব্রহ্মা সেই প্রণাম-নম্রা কন্যকে পুনরায় দেখলেন। সেই বরবর্ণিনী তাকে প্রণাম করে প্রদক্ষিণ করল। তার রূপ দেখবার জন্য ব্রহ্মার একান্তই ইচ্ছা; কিন্তু তাতে তিনি পুত্রদের কাছে বিশেষরূপে লজ্জিত; কাজেই তার দক্ষিণদিকে এক পাণ্ডুবর্ণ মুখ বিকাশ পেল,এরপর বিস্ময়ে  তার পশ্চিমদিকে অন্য এক মুখ বের হল।এরপরে তার কামাতুর চতুর্থ মুখ প্রকটিত হয়ে পড়ল।তার কামাতুরতার কারণে আরও এক মুখ প্রকাশিত হল। এই মুখ সেই উপরের দিকে ওঠা নারীকে দেখার কৌতুহল বশতই নির্গত হল। ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করবার জন্য ভীষণ তপস্যা করেছিলেন; কিন্তু নিজের কন্যা সঙ্গমেচ্ছায় তার তা নষ্ট হয়ে গেল। তার উর্ধদিকে যে পঞ্চম মুখ বিকাশ পেয়েছিল, তা জটাজালে আবৃত হল।এরপর ব্রহ্মা তার পুত্রদের বললেন তোমরা সুর,অসুর ও মানুষী প্রজা সৃজন কর। পিতার এই কথায় তারা সকলেই বিবিধ প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন। তারা সৃষ্টি কার্যের জন্য প্রস্থান করলে বিশ্বাত্মা ব্রহ্মা সেই প্রণামাবনতা অনিন্দিতা শতরূপার পাণিগ্রহণ করলেন। এবং তার সাথে তিনি অত্যন্ত কামাতুর হয়ে কাল কাটাতে লাগলেন। তিনি প্রাকৃত জনের ন্যায় সেই লজ্জিতা ললনার সাথে শতবর্ষ অবধি কমল গর্ভে থেকে রমণ করলেন। এরপর দীর্ঘকাল অতীত হলে তার এক পুত্র জন্মাল। এই পুত্র স্বায়ম্ভুব মনু নামে অভিহিত।আমরা শুনেছি ওই মনুই বিরাট পুরুষ, তার অনুরূপ গুণসমূহযোগে ইনি অধিপুরুষ নামেও নির্দিষ্ট।…”

(মৎস্য পুরাণ/৩য় অধ্যায়| শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত)

শিবলিঙ্গ

শিবপুরাণে

দারুবনে ঋষিরা বাস করতেন। একদিন শিব ঋষিদের কোনোরূপ পরীক্ষা করার জন্য গায়ে ছাই-ভস্ম মেখে নগ্ন হয়ে,বনের মধ্যে প্রবেশ করেন ,বিকৃত মনোবৃত্তি নিয়ে হাতে নিজ লিঙ্গ ধরে ঋষিপত্নীদের মোহিত করতে থাকেন। কোনো কোনো ঋষিপত্নী ব্যাকুল হয়ে শিবের সামনে উপস্থিত হন। কেউ কেউ শিবের হাত ধরে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঋষিরা এসব দেখে অত্যন্ত রেগে যান। তারা শিবকে তার এমন আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তারা শিবকে অভিশাপ দেন- “তোমার লিঙ্গ ভূতলে পতিত হউক।” অভিশাপ মাত্রই শিবের লিঙ্গ মাটিতে খসে পড়ে যায়। ওই লিঙ্গ সামনে যা কিছু পেল তাই দগ্ধ করে। স্বর্গ, মর্ত, পাতালে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দেয় মহাদেবের লিঙ্গ।

এই পরিস্থিতিতে লোকেরা ও ঋষিরা দুঃখিত হন। নিরূপায় হয়ে তারা ব্রহ্মার শরণ নেন। ব্রহ্মা বলেন, “যে পর্যন্ত লিঙ্গ স্থিরভাবে অবলম্বন না করিতেছে, সে পর্যন্ত ত্রিজগতের কোথাও শুভ হইবে না, ইহা সত্য কহিতেছি।” এরপর ব্রহ্মা দেবতা- ঋষিগণকে উপদেশ দেন, ” মঙ্গলদায়িনী গিরিজাদেবীর আরাধনা কর, তিনি যদি প্রসন্না হইয়া যোনিরূপ ধারণ করেন, তাহা হইলে নিয়ম এই প্রকার করিবে।” এরপর ব্রহ্মা বলেন কিভাবে যোনিতে লিঙ্গ স্থাপন করে কোন কোন উপাচারের মাধ্যমে তার আরধনা করতে হবে, “…হে দেবেশ! প্রসন্ন হও, হে জগদলাদায়ক… শান্ত হও। এই প্রকারে করিলে নিশ্চয় স্বাস্থ্য হইবে।”

তারপর শিবের শরণাপন্ন হয়ে দেবতা, ঋষিরা তার আরাধনা করতে থাকেন। আরাধনায় শিব সন্তুষ্ট হন। পার্বতী ছাড়া অন্য কেউ শিবের লিঙ্গ ধারণে সমর্থ হবে না ভেবে দেবতা-ঋষিরা পার্বতীকে সন্তুষ্ট করেন। পার্বতী লিঙ্গ ধারণ করেন। লিঙ্গ স্থাপিত হলে জগতে সুখ হয়।

(শিবপুরাণ/জ্ঞানসংহিতা/অধ্যায় ৪২|অনুবাদক- শ্রী পঞ্চানন তর্করত্ন)

বামনপুরাণে

দক্ষযজ্ঞে সতীর মৃত্যু হলে শিব অস্থির চিত্তে এদিক ওদিক হাটতে থাকেন। তাকে স্ত্রী শোকে কাতর দেখে কামদেব তার পুষ্পশর নিয়ে শিবকে তাড়া করলে শিব দারুবনে প্রবেশ করেন। সেখানে মুনিরা তাদের পত্নীদের সাথে বসবাস করতেন।  তাদের দেখে শিব তাদের কাছে ভিক্ষা চান। মুনিরা শিবের কথার উত্তর না দিলে শিব তাদের আশ্রমে মলত্যাগ করতে থাকেন। যাইহোক, মহাদেবকে আশ্রমে দেখতে পেয়ে ভার্গব ও আত্রেয়ের পত্নীরা ( সতী অরুন্ধতী ও অনুসূয়া বাদে) অত্যন্ত কামার্ত হয়ে পড়েন। তারা মহাদেবের পিছু পিছু যেতে লাগলেন। স্ত্রী হাতি যেমন পুরুষ হাতিকে অনুসরণ করে তারাও ঠিক তেমনিভাবে ঘরের কাজ ফেলে শিবের পিছু পিছু যাচ্ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে ভার্গব ও আঙ্গিরস মুনি শিবকে অভিশাপ দেন যার ফলে তার লিঙ্গ মাটিতে পড়ে যায়। শিবের লিঙ্গ পতিত হলে  তা ত্রিভুবনে উৎপাত  করতে থাকে, সব ধ্বংস করতে থাকে। তা দেখে ব্রহ্মা শঙ্কিত হয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। এরপর ব্রহ্মা ও বিষ্ণু একসাথে লিঙ্গ যে স্থানে পড়েছিল সে স্থানে উপস্থিত হন। বিষ্ণু গরুড়ে চড়ে এবং ব্রহ্মা তার পদ্মযানে চড়ে লিঙ্গের শেষ খোঁজার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু কেউই খুঁজে পান না। নিরুপায় হয়ে তারা স্তব স্তুতি করে শিবকে সন্তুষ্ট করেন। স্তব শেষ হলে শিব উপস্থিত হন। শিবকে দেখে তারা শিবকে তার লিঙ্গ ফিরিয়ে নিতে বলেন। কিন্তু শিব বলেন, এক শর্তে তিনি তার লিঙ্গ ফিরিয়ে নিতে পারেন, যদি তার লিঙ্গের পূজা করা হয়! বামন পুরাণ অনুসারে, এর পর থেকে শিবলিঙ্গের পূজা শুরু হয়।

(বামন পুরাণ/৬ষ্ঠ অধ্যায়)

পদ্মপুরাণে

পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে,রাজা দিলিপ ঋষি বশিষ্টকে জিজ্ঞাসা করেন, “কোন কারণে শিব ও পার্বতীর নিন্দনীয় রূপ দেখা যায়? সেই প্রসিদ্ধ রূপটিতে (শিবলিঙ্গে)  কেন লিঙ্গ ও যোনি দেখা যায়?  শিবের এই নিন্দনীয় রূপের কারণ কি?”

বশিষ্ট বলেন,

পূর্বে স্বায়ম্ভূব মনু মন্দার নামক শ্রেষ্ঠ পর্বতে ঋষিদের সাথে নিয়ে এক দীর্ঘ চমৎকার যজ্ঞ করেছিলেন। কোন দেবতা ব্রাহ্মণের পূজনীয় এটা নিয়ে তর্ক বেধেছিল। কোনো কোনো ঋষি বললেন শিব শ্রেষ্ঠ। কেউ বললেন ব্রহ্মা একাই পূজনীয়। কেউ আবার বিষ্ণুর কথা বললেন। ঋষিরা ভৃগু ঋষিকে বললেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে দেখে  আসতে। এদের মধ্যে যার মধ্যে শুদ্ধ সত্ত্ব গুণ বিরাজ করে তিনিই পূজনীয় হবেন।…

ঋষিদের কথামত ভৃগু, বামদেবের সাথে দেবতাদের দর্শন করতে যান। প্রথমে তারা শিবের আবাসস্থল কৈলাসে গিয়ে উপস্থিত হন। শিবের বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে প্রহরারত নন্দীকে দেখে ভৃগু বলেন-

“আমি শ্রেষ্ঠ দেব শিবের সাথে দেখা করতে এসেছি। তাকে খবর দাও।“

ভৃগুর কথা শুনে নন্দী রুষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে, “ প্রভু এখন ব্যস্ত আছেন। তিনি পার্বতীর সাথে সম্ভোগ করছেন। হে মুনি, প্রাণের মায়া থাকলে, এখান থেকে চলে যাও।“

ভৃগু বহুদিন অপেক্ষা করেও শিবের দেখা পান না। অবশেষে রেগে গিয়ে তিনি শিবকে অভিশাপ দেন-

“ স্ত্রী সংসর্গে মত্ত হয়ে মহাদেব আমাকে অবজ্ঞা করছে। অতএব তাদের উভয়ের শরীর লিঙ্গ ও যোনিরূপ হবে। আমি ব্রাহ্মণ, শিব পাপাচ্ছন্ন হয়ে আমাকে জানতে পারল না। অতএব সে অব্রাহ্মণ হয়ে দ্বিজদের অপূজ্য হবে। আর যারা শিবভক্ত হয়ে অস্থিভস্ম, লিঙ্গমূর্তি ধারণ করবে তারা পাষণ্ড হয়ে বৈদিক ধর্ম হতে বহিষ্কৃত হবে।“

(পদ্মপুরাণ/উত্তরখণ্ড/২৫৫/১-৩৪ | publishers:- MOTILAL BANARSIDASS PUBLISHERS PRIVATE LIMITED)

স্কন্দ পুরাণে

একদিন শিব নগ্ন হয়ে ভিক্ষা করার জন্য দারুবনে গমন করেন।দারুবনের ঋষিরা স্নান করার জন্য অন্য জায়গায় গিয়েছিলেন,কেবলমাত্র ঋষি পত্নীরাই সেইসময়ে আশ্রমে ছিলেন, এমন সময় শিব দারুবনের আশ্রমের দিকে নগ্নভাবে অগ্রসর হন। মহাদেবকে দেখে মুনিপত্নীরা বলেন,” কে এই অপূর্ব দর্শন ভিক্ষুক এখানে আগমণ করিলেন? যাহা হউক আমরা সখীগণ সমভিব্যহারে ইহাকে ভিক্ষা প্রদান করিব।” তারপর তারা শিবকে মনমত ভিক্ষা দেন। এরপর মুনিপত্নীদের শিব জানান ,”আমি ঈশ্বর।”। তখন মুনিপত্নীরা অনুমান করেন, তিনি নিশ্চয় মহাদেবই হবেন। তারপর ঋষি পত্নীরা শিবের কাছে তার  ভিক্ষা করার কারণ জানতে চান। তখন শিব জানান,” পত্নী দাক্ষায়ণীর সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে,তাই আমি দিগম্বর হইয়া বিচরণ করি।” শিব আরো বলেন, তার সতী ভিন্ন অপর কোনো নারীতে তার রুচি নেই।

শিব ভিক্ষা গ্রহণ করে চলে যেতে থাকলে, ঋষিদের পত্নীরাও কামপরবশ হয়ে তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। তারা ঘরের সকল কাজ ছেড়ে শিবের পেছন পেছন চলতে শুরু করেন।
এদিকে ঋষিরা আশ্রমে এসে দেখেন তাদের স্ত্রীরা সেখানে নেই। তখন তারা আশঙ্কা করে বলেন, “আমাদের পত্নীসকল কোথায় গেল, কিছুই জানিতেছি না। কোনো নষ্ট লোক কি তাহাদের সকলকে হরণ করিল?” ঋষিরা আশ্রমের চারদিকে তাদের স্ত্রীদের খুজতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেলেন, তাদের স্ত্রীরা শিবের পেছন পেছন চলে যাচ্ছেন। তা দেখে তারা সকলেই খুব রেগে যান এবং শিবের কাছে গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, মহাদেব কেন তাদের পত্নীদের চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। ঋষিদের কথা শুনেও শিব কিছু না বলে কৈলাশের দিকে চলতে থাকেন। শিবের এমন আচরণ দেখে ঋষিরা অত্যন্ত রেগে যান, তারা শিবকে অভিশাপ দেন ,

“যেহেতু তুমি অব্যয় মহাদেব হইয়াও আমাদের কলত্রাপহরত্তা (স্ত্রী অপহরণকারী) , এইজন্য সত্ত্বর তোমাকে ক্লীব হইতে হইবে।”

মুনিদের অভিশাপের সাথে সাথে শিবের লিঙ্গ মাটিতে পড়ে যায়। ঐ লিঙ্গ মাটিতে পরে বাড়তেই থাকে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সবই লিঙ্গ দ্বারা আবৃত হয়।শিবের লিঙ্গে সকল কিছুই লীন হয়ে যায়। যেহেতু শিবের লিংগে সব কিছু লীন হয়ে যায়, তাই তার নাম হয় লিঙ্গ। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই লিঙ্গের আদি ও অন্ত জানার জন্য পাতাল ও স্বর্গাভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কেউই তার আদি ও অন্ত দেখতে পান না।

ঋষি-দেবতাগন সকলেই ভয় বিহ্বল হয়ে শিবলিঙ্গের স্তুতি করতে থাকেন। বীরভদ্র, দেব ঋষিগণ শিবলিঙ্গের পূজা করে তাকে শান্ত করেন।

(স্কন্দ পুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ডে-কেদারখণ্ডম/৬-৭ অধ্যায়)

কূর্ম পুরাণে

“পূর্বকালে দেবদারু বনে হাজার হাজার মুনি স্ত্রী পুত্রদের নিয়ে তপস্যা করেছিলেন। ঐ মহর্ষিরা নানা প্রকার কাম্য কর্ম করতে প্রবৃত্ত হয়ে বিবিধ যজ্ঞ  আর তপস্যা করতে লাগলেন। তখন কামনাসক্ত চিত্ত মুনিদের দোষ দেখিয়ে দেবার জন্য ভগবান মহাদেব দেবদারু বনে উপস্থিত হলেন।” মহাদেব বিষ্ণুকে সাথে করে দেবদারু বনে গিয়েছিলেন। মহাদেব ২০ বছর বয়সী অত্যন্ত সুঠাম, সুদর্শন পুরুষের রূপ ধারণ করলেন। আর বিষ্ণুও এক সুন্দরী নারীর মূর্তি ধারণ করলেন।নগ্ন মহাদেব ও স্ত্রীবেশধারী বিষ্ণু সবাইকে মোহিত করতে করতে জঙ্গলে বিচরণ করতে লাগলেন। ঋষিদের পতিব্রতা স্ত্রীরাও মহাদেবকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়লেন। “তাদের বস্ত্র ও আভরণ খুলে পড়ে যেতে লাগল। এইভাবে বারাঙ্গনার মত নির্লজ্জ হয়ে তারা শিবের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করতে লাগলেন। ঋষিদের তরুণ পুত্রেরা জিতেন্দ্রিয় ছিলেন কিন্তু এখন কামার্ত হয়ে স্ত্রী বেশধারী হৃষীকেশের (বিষ্ণুর) পেছনে পেছনে যেতে লাগলেন। বিলাসিনী নারীরা পত্নীর সঙ্গে অদ্বিতীয় মহাদেবকে অতি সুন্দর ও অদ্বিতীয় নায়করূপে দেখে নাচতে গাইতে শুরু করলেন আর মাঝে মাঝে ইচ্ছার বশে আলিঙ্গনও করতে লাগলেন… রুদ্র নারীদের আর কেশব (বিষ্ণু) পুত্রদের মোহিত করছেন দেখে মুনিরা ক্রুদ্ধ হলেন।“ অসন্তুষ্ট মুনিদের সাথে এক পর্যায়ে শিবের ঝগড়া বেধে গেল। “ঋষিরাও আবার তাকে দণ্ড, যষ্টি ও মুষ্টির দ্বারা  তাড়না করতে লাগলেন। তারপর শিবকে উলঙ্গ ও বিকৃত চিত্তযুক্ত হয়ে ভ্রমণ করতে দেখে ঋষিরা বললেন, রে দুর্মতি, তুই এই লিঙ্গ উপড়ে ফেল। মহাযোগী শঙ্কর তাদের বললেন, যদি আমার এই লিঙ্গের উপর তোমাদের এতই রাগ , তবে না হয় উপড়েই ফেলছি। এই বলে ভগদেবতার নেত্র উৎপাটনকারী ভগবান লিঙ্গ উপড়ে ফেললেন।“ তারপর শিব ও বিষ্ণু অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপরেই নানা প্রকার দুর্যোগ দেখা দিতে শুরু করে। পৃথিবী কাঁপতে থাকে,সমুদ্র ফুলে উঠতে থাকে। এর পরে ঋষিরা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিলেন-

ব্রহ্মা বললেন, “তার (শিবের) যে লিঙ্গকে তোমরা ভূমিতে পড়ে যেতে দেখেছিলে , সেই লিঙ্গের মত দেখতে আরেকটি লিঙ্গ নির্মাণ কর, তারপর স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে সযত্নে নানা প্রকার বৈদিক নিয়মে পূজা কর। তোমরা বন্ধু আর পুত্রদের সঙ্গে মিলে শতরুদ্রিয় পাঠ আর পরম তপস্যা অবলম্বন করে ঋক,যজুঃ, সামবেদস্থিত শাঙ্কর মন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করে সমাহিতভাবে পূজা কর এবং সকলেই কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবান শূলপানির শরণাপন্ন হও। তাহলেই অসংস্কৃতাত্ম পুরুষেরা যাকে সহজে দেখতে পায় না সেই দেবাধিপতি মহাদেবকে দেখতে পাবে।”

(কূর্ম পুরাণ /উত্তরভাগ/ ৩৭ অধ্যায় । নবপত্র প্রকাশন)  ( Kurma Purana/uttar-bhaga/ 38-39 chapter)

মহাভারতে

” দেবগণ সেই মহেশ্বরের লিঙ্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও লিঙ্গ পূজা করেন নাই ও করিতেছেন না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, আপনি ও অন্যান্য দেবগণ আপনারা সকলেই সেই দেবাদিদেবের লিঙ্গ পূজা করিয়া থাকেন, সুতরাং তিনিই সকল দেবতার অগ্রগণ্য। ব্রহ্মার চিহ্ন পদ্ম, বিষ্ণুর চিহ্ন চক্র ও আপনার চিহ্ন বজ্র বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু প্রজারা আপনাদিগের কাহারই চিহ্নে চিহ্নিত নহে। তাহারা হরপার্বতীর চিহ্নানুসারে লিঙ্গ ও যোনি চিহ্ন ধারণ করিয়াছে । সুতরাং উহারা যে শিব ও শিবা হইতে উদ্ভূত, তাহার আর সন্দেহ নাই। স্ত্রীজাতি পার্বতীর অংশে সম্ভূত হইয়াছে বলিয়া যোনিচিহ্নে চিহ্নিত আর পুরুষেরা মহাদেবের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া লিঙ্গচিহ্নিত হইয়াছে; যাহারা উহাদের উভয়ের চিহ্নেই চিহ্নিত তাহারা ক্লীবপদবাচ্য হইয়া জনসমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয় এই জীবলোকে পুংলিঙ্গধারীরে শিবের ও স্ত্রীলিঙ্গধারীরে পার্বতীর অংশ বলিয়া অবগত হইবে। এই চরাচর বিশ্ব হরপার্বতী দ্বারাই ব্যাপ্ত রহিয়াছে। ”(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/ অনুশাসন পর্ব/ চতুর্দশ অধ্যায়)

জাতিভেদ

চার বর্ণের উৎপত্তি

“সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহূরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।। মনুসংহিতা-১/৮৭
অর্থাৎ : এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ– এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।”

বিভিন্ন বর্ণের কাজ

ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য স্থির করেন অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন ইত্যাদি কর্ম। ( মনুসংহিতা ১/৮৮)

ক্ষত্রিয়দের জন্য প্রজা রক্ষণ, অধ্যয়ণ ইত্যাদি কাজ স্থির করেন। ( মনুসংহিতা ১/৮৯)

বৈশ্যের জন্য স্থির করেন পশুপালন,বাণিজ্য, কৃষিকর্ম ইত্যাদি কাজ। ( মনুসংহিতা ১/৯০)

আর শূদ্রদের জন্য তিন বর্ণের সেবা করার বিধান দেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। ( মনুসংহিতা ১/৯১)

ব্রাহ্মণ্যবাদ

ব্রাহ্মণের কাজ

ব্রহ্মা তপস্যা করে দেবলোক ও পিতৃ লোকের হব্যকব্য বহনের জন্য এবং জগত সংসারের রক্ষার জন্য নিজের মুখ থেকে প্রথমে ব্রাহ্মণকে সৃষ্টি করলেন। মনুসংহিতা ১/৯৪

“অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।। মনুসংহিতা-১/৮৮
অর্থাৎ: অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)– এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন।”

ব্রাহ্মণের কর্মে অন্যান্য বর্ণের অনধিকার

“শাস্ত্রে বলা আছে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য এই তিন দ্বিজাতি সর্বদাই নিজ নিজ ধর্মে নিরত থেকে বেদাধ্যয়ণ করবেন। কিন্তু একমাত্র ব্রাহ্মণই বেদের অধ্যাপনা করবেন। এর থেকেই বোঝা যায় যে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দুই দ্বিজ কখনোই বেদের অধ্যাপনা করবেন না। অর্থাৎ তারা যদি অনাপতকালে অধ্যাপনা করেন তাহলে তাদের অধিক প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।” মনুসংহিতা  ১০/১

“ব্রাহ্মণ বিপদে পড়লে যেমন অন্য জীবিকা গ্রহণ করতে পারেন সেইরূপ ক্ষত্রিয় বিপন্ন হলে অন্য জীবিকা গ্রহণ করবেন। কিন্তু কখনোই ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বন করতে পারবেন না।” মনুসংহিতা ১০/৯৫

ব্রাহ্মণ সকলের জীবিকার উপায় জানেন

“একমাত্র ব্রাহ্মণই সকল বর্ণের শাস্ত্রসম্মত জীবিকার উপায় জানবেন ও সকল বর্ণের মানুষকে উপদেশ দেবেন। উপরন্তু নিজেও সর্বদাই শাস্ত্র সম্মত কর্মে রত থাকবেন।” মনুসংহিতা ১০/২

ব্রাহ্মণের সামাজিক অবস্থান সবার উপরে

”ব্রাহ্মণের নাম হবে মঙ্গলবাচক, ক্ষত্রিয়ের নাম হবে বলবাচক, বৈশ্যের নাম হবে ধনবাচক এবং শুদ্রের নাম হবে নিন্দাবাচক।” মনুসংহিতা ২/ ৩১

”ব্রাহ্মণের নামের সঙ্গে শর্মা,ক্ষত্রিয়ের নামের সাথে বর্মা, বৈশ্যের নামের সাথে ভূতি বা অন্য পুষ্টিবোধক উপাধী যুক্ত হবে। শুদ্রের নাম হবে নিন্দাবাচক।যেমনঃশুভশর্মা,বলবর্মা,বসুভূতি,দীনদাস ইত্যাদি।” মনুসংহিতা ২/ ৩২

”ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারী কৃষ্ণসার মৃগ চর্মের উত্তরীয় ও শণবস্ত্র পরিধান করবেন।ক্ষত্রিয় ব্রহ্মচারীর পরিধান হবে ক্ষৌমবস্ত্র আর রুরু নামক মৃগ চর্মের উত্তরীয়। বৈশ্য ব্রহ্মচারী পড়বেন মেষলোমের তৈরি বস্ত্র এবং ছাগচর্মের তৈরি উত্তরীয়।” মনুসংহিতা ২/৪১

”ব্রাহ্মণের মেখলা অর্থাৎ মধ্যবন্ধনী সুখস্পর্শ যুক্ত সমান তিনগাছি মুঞ্জ তৃণে তৈরি করতে হবে। ক্ষত্রিয়ের জন্য মূরবায় নির্মিত ধনুকের ছিলার মতো এবং বৈশ্যের জন্য শণতন্তুতে তৈরি তিনহারা মেখলা তৈরি করতে হবে।” মনুসংহিতা ২/৪২

”ব্রাহ্মণের উপবীত তৈরি হবে কার্পাস সুতোয়, ক্ষত্রিয়ের শণ সুতোয় এবং বৈশ্যের উপবীত হবে মেষলোমের সুতোয়।সকলের উপবীতই তিনগাছি সুতোয় তৈরি হবে এবং তার ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত লম্বা হবে।” মনুসংহিতা ২/৪৪

”ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারীর দণ্ড হবে বিল্ব বা পলাশের তৈরি। ক্ষত্রিয় ব্রহ্মচারীর হবে বট বা খদিরের দণ্ড এবং বৈশ্য ব্রহ্মচারী পিলু বা  যজ্ঞ ডুমুরের দণ্ড ধারণ করবেন।ব্রাহ্মণের দণ্ড হবে কেশ পর্যন্ত লম্বা, ক্ষত্রিয়ের হবে ললাট পর্যন্ত , বৈশ্যের দণ্ডের পরিমাপ হবে নাসাগ্র পর্যন্ত দীর্ঘ।” মনুসংহিতা ২/৪৫-৪৬

”উপনীত ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারী প্রথমে ভবত শব্দ উচ্চারণ করে অর্থাৎ ভবতি ভিক্ষাং দেহি বলে ভিক্ষা করবেন। ক্ষত্রিয় ব্রহ্মচারী ভবত শব্দ মাঝখানে রেখে অর্থাৎ ভিক্ষাং ভবতি দেহি বলে ভিক্ষা করবেন আর বৈশ্য ব্রহ্মচারী ভবত শব্দ শেষে রেখে ভিক্ষাং দেহি ভবতি বলে ভিক্ষা প্রার্থনা করবেন।” মনুসংহিতা ২/৪৯

ব্রাহ্মণ দেবতা

“ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)– ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।” মনুসংহিতা ১/৯৩

”স্থাবর জঙ্গমে পূর্ণ এই চরাচর জগতের মধ্যে যত সৃষ্ট পদার্থ আছে তার মধ্যে যাদের প্রাণ আছে তারাই শ্রেষ্ঠ। প্রাণীদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি আছে তারা শ্রেষ্ঠ।বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীদের মধ্যে আবার মানুষ শ্রেষ্ঠ এবং মানুষদের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ।” মনুসংহিতা ১/৯৬

”যখন ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করেন তখন তিনি পৃথিবীতে সকলের শ্রেষ্ঠ হয়েই জন্মগ্রহণ করেন। কারণ পৃথিবীতে প্রচলিত সর্ব ধর্ম রক্ষার জন্যই ব্রাহ্মণের উৎপত্তি।” মনুসংহিতা ১/৯৯

“ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।” মনুসংহিতা ১/৯৯

নিজেই নিজেকে জগতের সব ধনস্পত্তির অধিকারী ঘোষণা করে ব্রাহ্মণ মনু বলে-

”জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তি পাবার যোগ্য।” মনুসংহিতা ১/১০০

”জন্ম থেকেই ব্রাহ্মণ মানুষের ও দেবতাদের পূজ্য এবং ইহলোকের প্রমাণ স্বরূপ। সুতরাং ব্রাহ্মণের উপদেশ বেদমূলক।” মনুসংহিতা ১১/৮৫     

”সংস্কৃতই হোক আর অসংস্কৃতই হোক অগ্নি যেমন মহান দেবতা তেমনি বিদ্বানই হোক আর অবিদ্বানই হোক ব্রাহ্মণও মহাদেবতা স্বরূপ।” মনুসংহিতা ৯/৩১৭

”শ্মশানে শবদাহ কালে ব্যাপৃত মহাতেজা অগ্নি যেমন অপবিত্র হয় না বরং যজ্ঞকার্যে আহুতি লাভ করে বৃদ্ধি পান; সেইরূপ ব্রাহ্মণরা যদি নিন্দনীয় কর্মে ব্যাপৃত থাকেন তবুও তারা সকলের কাছে পূজনীয়ই থাকবেন; যেহেতু ব্রাহ্মণ পরম দেবতা স্বরূপ।” মনুসংহিতা ৯/৩১৮-৩১৯

“ব্রাহ্মণ স্বভাবতই জল ও অগ্নির মতো পবিত্র। যেমন অতি পবিত্র গংগাজল অপবিত্র উদকে কখনোই অপবিত্র হয় না, সেইরূপ ব্রাহ্মণের পক্ষে গর্হিত ব্যক্তির অধ্যাপন, যাজন ও প্রতিগ্রহে কোনো দোষ হয় না। এমনকি প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা থাকলেও ব্রাহ্মণ যদি নীচ ব্যক্তির অন্ন গ্রহণ করেন তাহলে আকাশে যেমন পঙ্ক লিপ্ত হয় না সেই ব্রাহ্মণেরও গায়ে কোনো পাপ স্পর্শ করে না।” মনুসংহিতা ১০/১০৩-১০৪

ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হিসাবে বলা হয়

”দেবতারা যে ব্রাহ্মণের মুখ থেকে সর্বদা হবনীয় দ্রব্য ভোজন করেন এবং যাদের মুখ থেকে পিতৃগণও কব্যদ্রব্য অর্থাৎ শ্রাদ্ধে প্রদত্ত অন্ন ভোজন করেন এই পৃথিবীতে সেই ব্রাহ্মণ অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠ আর কে আছে!” মনুসংহিতা ১/৯৫

”বেদের অধ্যয়ণ, অধ্যাপনা ও ব্যাখ্যান বিষয়ে সবিশেষ যোগ্যতা থাকায় এবং উপনয়ন সংস্কারে ক্ষত্রিয়াদি অপেক্ষা বিশিষ্ট হওয়ায় ও সর্ব বর্ণের মধ্যে প্রধান হওয়ায় এবং হিরণ্য গর্ভ ব্রহ্মার উত্তমাঙ্গ থেকে উদ্ভূত হওয়ায় ব্রাহ্মণ সর্বশ্রেষ্ঠ।” মনুসংহিতা ১০/৩

ব্রাহ্মণের অলৌকিক ক্ষমতা

”যাদেরকে আশ্রয় করে ত্রিলোকসমূহ ও স্বর্গের দেবতাগণ অবস্থান করেন; ব্রহ্মই যাদের  একমাত্র সম্পদ বেঁচে থাকাকালীন সেই ব্রাহ্মণদেরকে রাজা হিংসা করবেন না অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যায় পারদর্শী বা ব্রহ্মজ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যজন যাজনের মাধ্যমে পৃথিবী প্রভৃতি ত্রিলোক সমূহের এবং সকল দেবতাকে সন্তুষ্ট করেন। আবার এই ব্রাহ্মণরাই ক্রুদ্ধ হলে অভিশাপ দিয়ে এদের সকলকে বিনষ্ট করতে পারেন। সুতরাং যার বাচার ইচ্ছা আছে তার কখনোই ব্রাহ্মণদের হিংসা করা উচিত নয়।” মনুসংহিতা ৯/৩১৬

”ক্ষত্রিয়রা অত্যন্ত বৃদ্ধি লাভ করে ব্রাহ্মণদের পীড়া দিলে অথবা ব্রাহ্মণদের প্রতিকূল আচরণ করলে ব্রাহ্মণরা তাদের অভিশাপ দিয়ে শাসন করবেন। কারণ ক্ষত্রিয় জাতি ব্রাহ্মণ থেকে উৎপন্ন।” মনুসংহিতা ৯/৩২০

”রাজা অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হলেও কখনোই ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে যাবেন না; কারণ এরূপ করলে ব্রাহ্মণেরা ক্ষুব্ধ হয়ে অভিশাপ দিয়ে শক্তি ও বাহনসহ রাজাকে তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট করবেন।” মনুসংহিতা ৯/৩১৩

”যে ব্রাহ্মণেরা ক্রুদ্ধ হয়ে অগ্নিকে সর্ব ভক্ষ্য করেছেন এবং যারা অগাধ জলের সমুদ্রকে অপেয় করেছেন, যারা চন্দ্রকে ক্ষয় করে পরে পূর্ণ করেছেন সেইরূপ ব্রাহ্মণকে ক্রুদ্ধ করলে তাকে বিনষ্ট হতেই হবে।” মনুসংহিতা ৯/৩১৪

ব্রাহ্মণের সুরক্ষা

মনুসংহিতায় ২১ টি নরকের বর্ণনা  আছে। তার মধ্যে একটি নরকের নাম হল তামিশ্র। মনুসংহিতা ৪/৮৭-৯০

”ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র যদি হত্যা করার জন্য ব্রাহ্মণের উপর দণ্ডাঘাত করেন অথবা কেবলমাত্র দণ্ড উত্তোলন করেন তাহলেও তাকে তামিশ্র নরকে একশো বছর ধরে পরিভ্রমণ করতে হয়।” মনুসংহিতা ৪/১৬৫

”ক্রুদ্ধ হয়ে কিংবা জেনে শুনে যদি কেউ তৃণ দিয়েও ব্রাহ্মণকে তাড়না করে তাহলে সেই পাপে তাকে একুশ জন্ম পাপযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়।” মনুসংহিতা ৪/১৬৬

”অস্ত্রাঘাতে আহত ব্রাহ্মণের শরীর থেকে নির্গত রক্তে যতগুলি ধূলিকণা একত্রিত হয় শোণিতৎপাদক ব্রহ্মঘাতীকে পরলোকে তত সংখ্যক বৎসর ধরে শেয়াল কুকুরে খায়।এই কারণে বিদ্বান ব্যক্তি বিপদগ্রস্ত হলেও কখনোই ব্রাহ্মণের ওপর দন্ডোত্থাপন করবেন না কিংবা তাকে তৃণ দিয়েও আঘাত করবেন না অথবা ব্রাহ্মণের শরীর থেকে রক্তপাত ঘটাবেন না।” মনুসংহিতা ৪/১৬৮-১৬৯

ব্রাহ্মণ হত্যাকারীকে মহাপাতকী বলে ঘোষণা করা হয়। মনুসংহিতা ৯/২৩৫-২৩৬; ১১/২৪০-২৪১; ১১/১৮৩

পৃথিবীতে ব্রাহ্মণ বধের তুলনায় প্রবল পাপ আর কিছুই নেই। এজন্য রাজা কখনোই ব্রাহ্মণকে বধ করার কথা চিন্তা করবেন না। মনুসংহিতা ৮/৩৮১

”যে সকল মহাপাপী ব্রহ্মহত্যা করে তারা বহু বৎসর ধরে ভয়ঙ্কর নরক যন্ত্রণা ভোগ করে এবং পাপ নাশ হলে বক্ষ্যমাণ জন্মবিশেষ প্রাপ্ত হয়।” মনুসংহিতা ১২/৫৪

”ব্রহ্মহত্যাকারীর  নরক ভোগ শেষ হলে, শূকর, কুকুর, গর্ধব, উট, গোরু, ছাগল, মেষ, মৃগ, পক্ষী, চণ্ডাল এবং নিষাদের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত পুক্কস প্রভৃতির যোনি প্রাপ্ত হয়।” মনুসংহিতা ১২/৫৫

”যে ব্যক্তি লোভবশত দেবতার ধন বা ব্রাহ্মণের ধন অপহরণ কর সে পরজন্মে শকুনির উচ্ছিষ্টভোজি হয়।” মনুসংহিতা ১১/২৬

সব যাক গোল্লায়, তবুও বামুন  না মরুক-

“রাজা অর্থাভাবে মরণাপন্ন হলেও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনো কর গ্রহণ করবেন না এবং নিজের রাজ্যে বসবাসকারী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যাতে ক্ষুধাজনিত কষ্ট ভোগ না করেন সে দিকে রাজা সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।” মনুসংহিতা ৭/১৩৩

“রাজা কখনো ব্রাহ্মণের ধন গ্রহণ করবেন না। ব্রাহ্মণের ধন সর্বদাই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ গ্রহণ করবেন এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের অভাবে সামান্য ব্রাহ্মণেরা ওই ধন গ্রহণ করবেন। তবে সকলের অভাব হলে ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্যান্য বর্ণের ধনের ওপর রাজার অধিকার থাকবে।” মনুসংহিতা ৯/১৮৯

“যে রাজার রাজ্যে বেদজ্ঞ ক্ষুধায় কাতর হন সেই রাজ্য অচিরেই দুর্ভিক্ষে পীড়িত হয়।” মনুসংহিতা ৭/১৩৪

“শোত্রিয় ব্রাহ্মণের বেদ বেদাঙ্গের জ্ঞান ও কর্ম বিবেচনা করে রাজা তার উপযুক্ত বৃত্তি প্রদান করবেন এবং পিতা যেমন নিজের ঔরসজাত পুত্রকে সর্বদা রক্ষা করেন সেইরূপ চোর ডাকাতের উপদ্রব থেকে রাজা ঐ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে সর্বদা রক্ষা করবেন।” মনুসংহিতা ৭/১৩৫

ছিনতাইকারী ব্রাহ্মণ

“শাস্ত্রজ্ঞ রাজার রাজ্যে ক্ষত্রিয় যজমানের গৃহে যদি দ্রব্যের অভাবে ব্রাহ্মণের আরাধ্য যজ্ঞের একাঙ্গ অসম্পূর্ণ থাকে তাহলে ঐ ব্রাহ্মণ যে বৈশ্যের বহু ধন আছে অথচ যে যাগযজ্ঞ করে না এবং সোমপানও করে না তার কাছ থেকে যজ্ঞসিদ্ধির জন্য ঐ দ্রব্য বলপূর্বক গ্রহণ করবেন অথবা অপহরণ করে আরদ্ধ যজ্ঞের অঙ্গ সম্পূর্ণ করবেন।” মনুসংহিতা ১১/১১-১২

ব্রাহ্মণের অর্থনৈতিক সুবিধা

“……যদি ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র চারপুত্র এবং একজনই ব্রাহ্মণী কন্যা থাকে তাহলে পৈতৃক ধন চৌদ্দ ভাগে ভাগ করে ভাগের এক অংশ ব্রাহ্মণী কন্যাকে দিয়ে অবশিষ্ট দশভাগের মধ্যে ব্রাহ্মণ চার ভাগ, ক্ষত্রিয় তিনভাগ, বৈশ্য দুভাগ এবং শূদ্র একভাগ নেবে। যদি ব্রাহ্মণ একপুত্র এবং ব্রাহ্মণী এক কন্যা থাকে তাহলে সব ধন আটভাগ করে এক ভাগ ভগিনী পেয়ে থাকে। সাত ভাগ ভাই পাবে।” মনুসংহিতা ৯/১১৮

“ব্রাহ্মণের গর্ভজ সন্তানকে বিভাগের পূর্বে একটি কৃষক, একটি বৃষ, একটি যান, অলঙ্কার ও বাসভবন এবং অন্য বিষয়ের যত অংশ হবে তার মধ্যে একটি প্রধান অংশ উদ্ধার হিসেবে দেবেন। তারপর ব্রাহ্মণী পুত্র তিন অংশ, ক্ষত্রিয়া পুত্র দুই অংশ, বৈশ্য পুত্র দেড় অংশ এবং শূদ্রা পুত্র একাংশ পাবে।” মনুসংহিতা ৯/১৫০-১৫১

“অথবা উদ্ধারভাগ না করে একজন বিভাগ ধর্মবিদ ব্যক্তি সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তিকে দশভাগ করে নিম্নোক্ত নিয়ম অনুযায়ী বিভাগ করবেন। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণী পুত্র চারভাগ, ক্ষত্রিয়া সূত তিনভাগ, বৈশ্য পুত্র দুই ভাগ এবং শূদ্র পুত্র একভাগ পাবে। ব্রাহ্মণী, ক্ষত্রিয়া অথবা বৈশ্যা কারও গর্ভে সন্তান উৎপন্ন হোক বা না হোক শূদ্র গর্ভজ সন্তান একভাগের অতিরিক্ত অংশ পাবে না।” মনুসংহিতা ৯/১৫২-১৫৫

“… নিজের দায়িত্ব বুঝে উত্তমর্ণ বর্ণানুক্রমে ব্রাহ্মণ প্রভৃতি অধমর্ণের কাছ থেকে শতকরা দুই পণ, ক্ষত্রিয়ের কাছ থেকে শতকরা তিন পণ ,বৈশ্যের কাছ থেকে শতকরা চার পণ ও শূদ্রের কাছ থেকে শতকরা পাঁচ পণ সুদ প্রতিমাসে নিতে পারে। মনুসংহিতা ৮/১৪২ 

জগতে যা কিছু সম্পত্তি আছে তা ব্রাহ্মণের নিজস্ব। সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় এবং ব্রহ্মার উত্তম স্থান থেকে উৎপন্ন হওয়ায় ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তি পাবার যোগ্য।” ১/১০০

“ব্রাহ্মণেরা যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরিধান হিসেবে যে পরকীয় বসন ব্যবহার করেন এবং যা দান করেন তা পরকীয় হলেও নিজস্ব। কারণ ব্রাহ্মণের অনুগ্রহে অপরাপর সমস্ত প্রাণী পান ভোজন করে বেঁচে আছে।” মনুসংহিতা ১/১০১

“যদি কেউ ঐ প্রাপ্তধন নিজে পেয়ে অথবা অন্যের লব্ধ ধনকে নিজের মনে করে তাহলে রাজা ঐ ধনস্বামীর গুনাগুণ বিবেচনা করে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত ধনের ছয় বা বারো ভাগ গ্রহণ করবেন এবং অবশিষ্ট অংশ তাকে দান করবেন।” মনুসংহিতা ৮/৩৫

“যদি বিদ্বান ব্রাহ্মণ পূর্ব রক্ষিত কোনো ধন পেয়ে থাকেন তাহলে তার সমগ্রই তিনি নিজে গ্রহণ করবেন,রাজাকে কোনো অংশই দেবেন না। কারণ বিদ্বান ব্রাহ্মণ কি নিজের কি অন্যের সকল ধনেরই অধিপতি।রাজলব্ধ ধন যদি ধনস্বামী নিজের বলে প্রমাণ করতে পারে তাহলে রাজা ঐ ধনের ছয়ভাগ গ্রহণ করবেন কিন্তু বিদ্বান ব্রাহ্মণের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ ধনও রাজা পাবেন না।” মনুসংহিতা ৮/৩৭

“রাজা যদি ভূমির মধ্যে পূর্ব নিহিত কোনো ধন পেয়ে থাকেন তাহলে ঐ ধনের অর্ধেক ব্রাহ্মণদের দেবেন এবং নিজে অর্ধেক নেবেন।” মনুসংহিতা ৮/৩৮

ব্রাহ্মণকে দান করলে পূণ্য বেশি

“অন্যান্য সম্পত্তির মত ব্রাহ্মণ প্রদত্ত ধন ধান্য রূপ ঐ অক্ষয়নিধি কখনো নষ্ট হয় না এবং শত্রু বা চোর কেউই তা অপহরণ করে না।সুতরাং ব্রাহ্মণদের কাছে এই অক্ষয়নিধি দান করা ও তা রক্ষণে যত্নশীল হওয়া রাজামাত্রেরই কর্তব্য।” মনুসংহিতা ৭/৮৩

“আগুনে ঘৃতাহুতি দান করলে কখনো তা গলে নীচে পড়ে যায় , কখনো তা শুষ্ক হয়ে যায় , কখনো বা তা দগ্ধ হয়ে বিনষ্ট হয়।কিন্তু ব্রাহ্মণের মুখে আহুতি অর্থাৎ ব্রাহ্মণের মুখে দান করলে তা গলে যায় না, শুষ্কও হয় না আবার নষ্টও হয় না। সুতরাং অগ্নিহোত্র যজ্ঞ হোমের অপেক্ষা অধিক ফল দান করে।” মনুসংহিতা ৭/৮৪

“ব্রাহ্মণ ছাড়া ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্য কাউকে কিছু দান করলে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী ফললাভ হয় । অর্থাৎ যে দ্রব্য দানে যে ফল শাস্ত্রে উল্লেখিত আছে তাই লাভ হয়। নিরক্ষর ও নিষ্ক্রিয় ব্রাহ্মণকে দান করলে দ্বিগুণ ও বেদাধ্যয়ণকারী ব্রাহ্মণকে দান করলে লক্ষ গুণ ফল লাভ হয়। কিন্তু সকল গুণ ও বেদান্তে পারদর্শী বিপ্রকে দান করলে অনন্ত ফল লাভ হয়।” মনুসংহিতা ৭/৮৫

রাজার ব্রাহ্মণ সেবা

“বয়োবৃদ্ধ ও তপোবৃৃদ্ধ ও বেদবেত্তা দেহে মনে পবিত্র ব্রাহ্মণদের প্রতি রাজা সেবাপরায়ণ হবেন।” মনুসংহিতা ৭/৩৮

“গুরুকূল থেকে প্রত্যাগত বেদবিদ্যাসম্পন্ন গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক ব্রাহ্মণকে রাজা ধন ধান্য দিয়ে পূজা করবেন। কারণ এরূপ পাত্রে প্রদত্ত ধনধান্য  অক্ষয় নিধি রূপে শাস্ত্রে ব্যাখ্যাত হয়েছে।” মনুসংহিতা ৭/৮২

ব্রাহ্মণের কর মকুব

“রাজা প্রতি প্রজার কাছ থেকে বাৎসরিক কর গ্রহণ করবেন। এমনকি যেসকল দুঃখী প্রজা শাকপাতার মত সামান্য বস্তু ক্রয় বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের কাছ থেকেও রাজা বাৎসরিক কর হিসেবে যৎকিঞ্চিত অর্থ গ্রহণ করবেন।” মনুসংহিতা ৭/১৩৭

“রাজা অর্থাভাবে মরণাপন্ন হলেও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনো কর গ্রহণ করবেন না এবং নিজের রাজ্যে বসবাসকারী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যাতে ক্ষুধাজনিত কষ্ট ভোগ না করেন সে দিকে রাজা সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।” মনুসংহিতা ৭/১৩৩

ব্রাহ্মণ ভোজন

“ব্রাহ্মণদের যে সকল অন্ন ব্যঞ্জনে অভিরুচি হয় মাৎসর্য ত্যাগ করে সেই দ্রব্যই ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করবেন। ব্রাহ্মণদের ভোজন কালে তাদের সঙ্গে পরমাত্মা বিষয়ক কথা বলবেন। এতে পিতৃ লোক সন্তুষ্ট হন।” মনুসংহিতা ৩/২৩১

“শ্রাদ্ধকর্তা নিজেই প্রসন্ন চিত্তে প্রিয়বচনে ব্রাহ্মণদের পরিতুষ্ট করবেন। ধীরে ধীরে তাদের ভোজন করাবেন এবং খাদ্যদ্রব্যের গুণকীর্তন করে তা গ্রহণ করার জন্য ব্রাহ্মণদের বারবার অনুরোধ করবেন।” মনুসংহিতা ৩/২৩৩

ব্রাহ্মণের সেবা

“প্রতিদিন প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করে রাজা বয়োবৃদ্ধ ও তপোবৃদ্ধ , বেদজ্ঞ ও নীতি শাস্ত্রাভিজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করবেন এবং তারা যা কিছু আদেশ করবেন তাও সঠিকভাবে প্রতিপালন করবেন।” মনুসংহিতা ৭/৩৭

বিচারব্যবস্থায় ব্রাহ্মণকে ছাড়

“ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পর গালিগালাজ করলে রাজা ব্রাহ্মণকে প্রথম সাহস দণ্ড বা আড়াইশ পণ দণ্ড এবং ক্ষত্রিয়কে মধ্যাম সাহস বা পাঁচশ পণ দণ্ড দেবেন। সেইরূপ বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে পারস্পরিক আক্রোশ বশত যদি গালাগাল চলে তাহলে রাজা বৈশ্যকে প্রথম সাহস ও শূদ্রকে মধ্যম সাহস দণ্ড দেবেন।যদিও পূর্বোক্ত নিয়মে শূদ্রের জিহ্বা ছেদের কথা বলা হয়েছে ,তবু এক্ষেত্রে বৈশ্য,শূদ্রের মধ্যে গালিগালাজ হলে জিহ্বা ছেদ হবে না। একমাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের প্রতি শূদ্র গালিগালাজ করলে তার জিহবাছেদ হবে।” মনুসংহিতা ৮/২৭৬-২৭৭

“ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য বর্ণের কেউ যদি অকামা কন্যাতে গমন করে তাহলে তার লিঙ্গ ছেদনাদিরূপ দণ্ড হবে।……” মনুসংহিতা ৮/৩৬৪

“ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র- এই তিন বর্ণের মানুষ যদি বারবার মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাহলে তাদেরকে পূর্বোক্ত বিধান অনুযায়ী অর্থ দণ্ড করে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু ব্রাহ্মণকে অর্থ দণ্ড না করে কেবলমাত্র নির্বাসন দেওয়া হবে।” মনুসংহিতা ৮/১২৩

” স্বায়ম্ভূব মনু মহা অপরাধে শারীরিক দণ্ড করার জন্য দশটি স্থান নির্দেশ করেছেন। এই শারীরিক দণ্ড কেবল তিন বর্ণের ওপর অর্থাৎ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের ওপর প্রযুক্ত হবে।কিন্তু ব্রাহ্মণকে শারীরিক দণ্ড না দিয়ে অক্ষত শরীরে দেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া হবে।” মনুসংহিতা ৮/১২৪-১২৫

“যজ্ঞের নিমিত্ত বলাৎকারে বা চুরি করে যে ব্রাহ্মণ পরধন অপহরণ করেন রাজা তাকে কোনো দণ্ড দেবেন না। কারণ রাজার মূর্খতা বশতই ব্রাহ্মণ ক্ষুধায় অবসন্ন হন। ক্ষুধায় অবসন্ন ব্রাহ্মণের পরিবার, শাস্ত্রজ্ঞান ও সদাচার জেনে রাজা নিজের কোষ থেকে তার বৃত্তি বিধান করবেন।” মনুসংহিতা ১১/২১-২২

“প্রাণঘাতি দণ্ড না দিয়ে ব্রাহ্মণের মস্তক মুণ্ডন দণ্ড শাস্ত্রে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্যান্য বর্ণের ক্ষেত্রে প্রাণান্ত দণ্ডই বিহিত। সর্ব পাপে পাপী হলেও ব্রাহ্মণকে কখনোই বধ করা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে সমস্ত ধনের সঙ্গে অক্ষত শরীরে তাকে রাজ্য থেকে নির্বাসন দেওয়া উচিত।” মনুসংহিতা ৮/৩৭৯-৩৮০

ব্রাহ্মণের রাজকার্যে অগ্রাধিকার

“রাজা যদি স্বয়ং বিচার করতে না পারেন তাহলে বিদ্যা ও অন্যান্য গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণকে ঐ কাজে নিযুক্ত করবেন। যোগ্য ব্রাহ্মণের অভাব হলে গুণান্বিত ক্ষত্রিয়কে নিয়োগ করবেন। গুণী ক্ষত্রিয় না পাওয়া গেলে গুণবান বৈশ্যকে নিয়োগ করবেন। কিন্তু কখনোই ধার্মিক সর্ব গুণান্বিত শূদ্রকে ওই পদে নিয়োগ করবেন না।” মনুসংহিতা ৮/২০

শূদ্রের অবস্থান

শূদ্রের কাজ

“একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া।। (মনুসংহিতা-১/৯১)

অর্থাৎ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,– তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।

“ব্রহ্মা বিশেষরূপে বলেছেন যে শূদ্র যদি দ্বিজকর্মের অনুষ্ঠান করে এবং দ্বিজ যদি শূদ্রকর্মের অনুষ্ঠান করে তাহলে তারা পরস্পর সমানও হয় না, আবার অসমানও হয় না। কারণ শূদ্রের দ্বিজকর্ম (উচ্চ তিন বর্ণের আচার অনুষ্ঠান) অনধিকার চর্চা। সুতরাং শূদ্রের পক্ষে দ্বিজের সমান হওয়া সম্ভব নয়। আবার দ্বিজের পক্ষে শূদ্রের কর্ম করা নিষিদ্ধ। সুতরাং কেউই কারো সমান নয়। অথচ দুজনেরই অনুচিত আচরণের মধ্যে তুল্যতা আছে।” মনুসংহিতা ১০/৭৩

 শূদ্র নিজ কর্ম থেকে চ্যুত হলে এবং অশাস্ত্রীয় উপায়ে ধন উপার্জন করলে জগতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ( মনুসংহিতা ৮/৪১৮)

স্বর্গ লাভ করতে হলে শূদ্রকে ব্রাহ্মণের আরাধনা করতে হবে। শূদ্র ‘ব্রাহ্মণের আশ্রিত’ অর্থাৎ ‘ব্রাহ্মণসেবক’ এই বিশেষণের মাধ্যমেই শূদ্র কৃতার্থতা লাভ করে।একমাত্র দাসত্বের মাধ্যমেই (ব্রাহ্মণের সেবা করেই) শূদ্র ইহলোক এবং পরলোকে কৃতার্থ হয়। তাই অন্যান্য কর্ম অপেক্ষা ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করাই শূদ্রের প্রকৃষ্ট কর্ম। এছাড়া শূদ্র যেসকল কাজ করে, তা সবই নিস্ফল হয়। ( মনুসংহিতা ১০/১২২-১২৩)
“শূদ্র ভরণপোষণের মাধ্যমে প্রতিপালিত হোক বা না হোক ব্রাহ্মণ শূদ্রকে দিয়েই বিনা দ্বিধায় দাস্যকর্ম করাবেন। কারণ বিধাতা দাস্য কর্ম নির্বাহের জন্যই শূদ্রের সৃষ্টি করেছেন।”  -মনুসংহিতা ৮/৪১২-৪১৩

শূদ্রের নাম নিন্দাবাচক

“ব্রাহ্মণের নাম হবে মঙ্গলবাচক, ক্ষত্রিয়ের নাম হবে বলবাচক, বৈশ্যের নাম হবে ধনবাচক এবং শুদ্রের নাম হবে নিন্দাবাচক।” মনুসংহিতা ২/৩১

“ব্রাহ্মণের নামের সঙ্গে শর্মা,ক্ষত্রিয়ের নামের সাথে বর্মা, বৈশ্যের নামের সাথে ভূতি বা অন্য পুষ্টিবোধক উপাধী যুক্ত হবে। শুদ্রের নাম হবে নিন্দাবাচক।যেমনঃশুভশর্মা,বলবর্মা,বসুভূতি,দীনদাস ইত্যাদি।” মনুসংহিতা ২/৩২

শূদ্র মস্তক মুণ্ডন করবে

“ব্রাহ্মণের শুশ্রূষা পরায়ণ শূদ্র প্রতি মাসে কেশ মুণ্ডন করবে…… এবং ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্ট ভোজন করবে।” মনুসংহিতা ৫/১৪০

ব্রাহ্মণের কখনোই শূদ্রের সেবা করা উচিত নয়-

 শূদ্র সেবার মাধ্যমে যে ব্রাহ্মণ জীবিকা নির্বাহ করে  সেই ব্রাহ্মণকে হব্যকব্যে নিমন্ত্রণ করা উচিত নয়। মনুসংহিতা ৩/১৬৪

শূদ্রের কাছ থেকে যে ব্যাকরণ অধ্যয়ণ করেছে  এবং শূদ্রকে অধ্যয়ণ করান যে ব্রাহ্মণ, এই সকল ব্রাহ্মণকে কখনোই দৈব ও পিতৃ কর্মে  নিযুক্ত করা উচিত নয়। ১/১৫৬

শূদ্রযাজী ব্রাহ্মণ যতগুলো ব্রাহ্মণভোজনের পঙক্তিতে উপবেশন করে সেই সেই পংক্তিগত শ্রাদ্ধীয় ব্রাহ্মণভোজনের ফল থেকে দাতা বঞ্চিত হন। মনুসংহিতা ৩/১৭৭-১৭৮

যে ব্যক্তি শূদ্রের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অগ্নিহোত্রের উপাসনা করে তাকে শূদ্রযাজী বলা হয় এবং ব্রহ্মবাদীদের কাছে সে অত্যন্ত নিন্দার পাত্র হয়ে ওঠে। শূদ্রের কাছ থেকে ধন নিয়ে যারা অগ্নির উপাসনা করে সেই অজ্ঞান ব্যক্তিদের মাথায় পা দিয়ে দাতা শূদ্র নরক থেকে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু যজমানের কোনো ফলই হয় না। মনুসংহিতা ১১/৪২-৪৩

……যে দ্বিজগণ নিষিদ্ধ শূদ্র সেবাকারী তাদের প্রাজাপত্যের প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান দেওয়া হয়েছে। মনুসংহিতা ১১/১৯৩

সাত প্রকার দাস

  1. ধ্বজাহৃত অর্থাৎ যাকে যুদ্ধে জয় করা হয়েছে,
  2. ভক্ত দাস অর্থাৎ যে ভাতের লোভে দাসত্ব স্বীকার করেছে,
  3. গৃহজ অর্থাৎ যে দাসীর পুত্র ,
  4. ক্রীত অর্থাৎ যাকে কেনা হয়েছে ,
  5. দত্রিম অর্থাৎ যে দাসকে অন্য কেউ দান করেছে ,
  6. পৈতৃক বা যে বংশানুক্রমে (পিতৃপিতামহক্রমে) দাসত্ব করছে ,
  7. দণ্ডদাস, যাকে শাস্তি স্বরূপ দাসে পরিণত করা হয়েছে। মনুসংহিতা ৮/৪১৫

শূদ্র শিক্ষা ও ধর্মাচার এর অধিকার বঞ্চিত

শূদ্রের উপনয়ন প্রভৃতি দ্বিজাতি সংস্কার নেই, অগ্নিহোত্র প্রভৃতি যজ্ঞের অধিকার নেই । মনুসংহিতা (১০/৪ ; ১০/১২৬-১২৭)

শূদ্রকে শিক্ষা প্রদান করাকে (যাজন ও অধ্যাপন) অত্যন্ত পাপজনক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে মনুস্মৃতিতে, এবং সেই পাপ জপ ও হোমের মাধ্যমে দূর করার উপায় ও বলে দেওয়া হয়েছে। ( মনুসংহিতা ১০/১১১)

ব্রাহ্মণকে বলা হয়েছে -‘শূদ্রের কাছে কখনো বেদ পড়বেন না।’ মনুসংহিতা ৪/৯৯

আরও বলা হয়েছে,”লৌকিক কোনো ব্যাপারে শূদ্রকে উপদেশ দেবেন না ।ভৃত্য ভিন্ন অন্য শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দেবেন না। যে হব্যের কিয়দংশ হোম করা হয়েছে সেই হবিষ্কৃৃৃত অংশ শূদ্রকে দেবেন না। শূদ্রকে কখনোই (ব্রাহ্মণের) ধর্মোপদেশ দেওয়া উচিত নয়।……” মনুসংহিতা ৪/৮০

শূদ্রকে উপদেশ দিলে কি হবে?

যে ব্রাহ্মণ শূদ্রকে স্বয়ং উপদেশ দান করেন অথবা কোনো ব্রতানুষ্ঠানের আদেশ করেন তিনি সেই শূদ্রের সঙ্গে অসংবৃত নরকে গমন করেন। মনুসংহিতা ৪/৮১

বিচারের কাঠগোড়ায় শূদ্র

সাক্ষী হিসাবে আগত ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্রাদি চতুর্বর্ণকে কিভাবে সম্বোধন করতে হবে, তা মনু নির্দেশ করেছেন এইভাবে-

ব্রাহ্মণকে বলতে হবে, ‘তুমি বলো’ , ক্ষত্রিয়কে বলতে হবে, ‘সত্য করে বল’, বৈশ্যকে বলতে হবে, ‘গো,ধান্য,বীজ ও সুবর্ণের শপথ করে বলো’ আর শূদ্রকে বলতে হবে, ‘‘তুমি মিথ্যা বললে সমুদয় পাপে বধ্য হবে’ মনুসংহিতা ৮/৮৮

বিচারকার্যে কখনো  সাক্ষীর প্রয়োজনে নানাবর্ণের লোকেদের কিভাবে শপথ করাতে হবে মনু তার বিধান  এভাবে দিয়েছেন-

ব্রাহ্মণকে বলা হবে, ‘তুমি সত্য বলো’, ক্ষত্রিয়কে বলাতে হবে, ‘হস্তি, অশ্ব, আয়ুধ যেন আমার নিস্ফল হয়’, বৈশ্যকে বলাতে হবে , ‘গবাদি, পশু,বীজ, কাঞ্চন যেন আমার বিফল হয়’ আর শূদ্রকে বলাতে হবে, ‘সমুদয় পাপ যেন আমার হয়’ অথবা শূদ্রকে ‘অগ্নিপরীক্ষা,জলপরীক্ষা ইত্যাদি কঠিন পরীক্ষা করাতে হবে। নতুবা স্ত্রী পুত্রের মাথা স্পর্শ করিয়েপরীক্ষা করতে হবে। মনুসংহিতা ৮/১১৩-১১৪

এছাড়া নিচের শ্লোকগুলিতে শূদ্রের অন্যান্য দণ্ডের কথা উল্লেখিত আছে-

বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় যদি অরক্ষিতা ব্রাহ্মণীতে গমন করে তাহলে বৈশ্যের পাঁচ পণ ও ক্ষত্রিয়ের সহস্র পণ দণ্ড হবে। আবার বৈশ্য ও ক্ষত্রিয় যদি গুণবতী ও রক্ষণযুক্তা ব্রাহ্মণীতে গমন করে তাহলে তারা শূদ্রের মত দণ্ডনীয় হবে অথবা দর্ভ বা শর দিয়ে তাদের আচ্ছাদিত করে দগ্ধ করতে হবে।ব্রাহ্মণ যদি রক্ষিতা ব্রাহ্মণিতে বলপূর্বক গমন করে তাহলে ব্রাহ্মণের হাজার পণ দণ্ড হবে আর সকামা ব্রাহ্মণী গমনে তার পাচশো পণ দণ্ড হবে। মনুসংহিতা ৮/৩৭৬-৩৭৮

ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণকে গালাগাল দেয় তাহলে ক্ষত্রিয়ের একশ পণ দণ্ড হবে।বৈশ্যের হবে দেড়শো বা দুশো পণ এবং শূদ্রের গুরুলঘুভাবে শারীরিক দণ্ড হবে।কিন্তু ক্ষত্রিয়কে ব্রাহ্মণ যদি অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে তাহলে ব্রাহ্মণের পঞ্চাশ পণ দণ্ড,বৈশ্যকে গালি দিলে হবে পঁচিশ পণ এবং শূদ্রকে গালী দিলে বারো পণ দণ্ড হবে। মনুসংহিতা ৮/২৬৭-২৬৮

অর্থনৈতিক শোষণ

কোনো ব্রাহ্মণ যদি ব্রাহ্মণী,ক্ষত্রিয়া,বৈশ্যা, শূদ্রা- এই চার বর্ণের স্ত্রীকে বিবাহ করে, তবে তাদের পুত্রদের মধ্যে সম্পদের বন্টন কিরূপ হবে মনুসংহিতায় তা বলা আছে এইভাবে-

একজন বিভাগ ধর্মবিদ ব্যক্তি সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তিকে দশ ভাগে ভাগ করবেন, তার মধ্যে ব্রাহ্মণীর পুত্রকে চারভাগ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিনভাগ, বৈশ্যার পুত্র দুইভাগ এবং শূদ্রার পুত্র এক ভাগ পাবে। মনুসংহিতা ৯/১৫২-১৫৫

তবে ব্রাহ্মণী,ক্ষত্রিয়া,বৈশ্যা কারো গর্ভে সন্তান উৎপন্ন হোক বা না হোক শূদ্রার পুত্র যে কখনো একভাগের বেশি পাবে না তা নিশ্চিত করে দেয়া হয়েছে।এছাড়াও বলা হয়েছে, ‘ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের অনূঢ়া শূদ্র গর্ভজ পুত্র ধনভাগী হয় না। তাকে জীবদ্দশায় পিতা যা দেবেন তাই তার ধন হবে।’ মনুসংহিতা ৯/১৫২-১৫৫

শূদ্রার গর্ভে যদি একশ সন্তানও উৎপন্ন হয় তখনো সকলেই দশভাগের একভাগ সম্পত্তিই পাবে, এর অধিক পাবে না। মনুসংহিতা ৯/১৫৬-১৫৭

শূদ্রকে বাকিদের মত সম্পদ সঞ্চয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে

“শূদ্র অর্থ উপার্জনে সক্ষম হলেও পোষ্যবর্গের প্রতিপালনের জন্য এবং মহাযজ্ঞ সাধনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করবে। কখনো তার অধিক অর্থ সঞ্চয় করবে না। কারণ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র অধিক অর্থ সঞ্চয় করলে ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণকে পীড়ন করতে পারে।” মনুসংহিতা ১০/১২৯

“ভার্যা, পুত্র ও দাস এদের তিনজনকেই অধন বলা হয়েছে। অর্থাৎ শাস্ত্রমতে এদের তিন জনের কেউই ধন পাবার যোগ্য নয়। কিন্তু এরা যদি কোনো ধন উপার্জন করে তাহলে এরা যার ভার্যা, যার পুত্র, যার দাস তারই ধন হবে। অর্থাৎ, নিজেদের অর্জিত ধনে এদের কোনো স্বাতন্ত্র থাকবে না। …………” মনুসংহিতা ৮/৪১৬

ব্রাহ্মণ শূদ্রের কাছ থেকে ধন আত্মসাৎ করতে পারে

ব্রাহ্মণ শূদ্রের কাছ থেকে ধন আত্মসাৎ করতে পারে যেহেতু দাস শূদ্রের নিজস্ব বলতে কিছুই নেই। তার সব ধনই ভ্রর্তৃহার্য অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত শূদ্র দাসের কাছ থেকে ব্রাহ্মণ বলাৎকারে (জোর করে) ইচ্ছামতো ধন নিতে পারে। এক্ষেত্রে রাজা ব্রাহ্মণকে কোনো দণ্ড দেবেন না। মনুসংহিতা ৮/৪১৭

সামাজিক বৈষম্য

ব্রহ্মহত্যাকারীর  নরক ভোগ শেষ হলে, শূকর, কুকুর, গর্ধব, উট, গোরু, ছাগল, মেষ, মৃগ, পক্ষী, চণ্ডাল এবং নিষাদের ঔরসে শূদ্রার গর্ভজাত পুক্কস প্রভৃতির যোনি প্রাপ্ত হয়। মনুসংহিতা ১২/৫৫

নট,দর্জি,কর্মকার,নিষাদ,স্বর্ণকার,বেণুবিদারক,রঞ্জক,বস্ত্ররঞ্জক,লৌহবিক্রেতা এদের অন্ন ভোজন না করতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৪/২১৩-২১৬

“ব্রাহ্মণের ঘরে আগত ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রকে অতিথি বলা যায় না যেহেতু তারা ব্রাহ্মণের থেকেও নিকৃষ্ট জাতি। বন্ধু ও জ্ঞাতি আত্মীয়সম বলে এবং গুরু স্থানীয় বলে অতিথি পদবাচ্য নয়, অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের গৃহে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ অতিথি হতে পারে কিন্তু বৈশ্য, শূদ্র অতিথি হবে না। সেইরূপ বৈশ্যের গৃহে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিরাই কেবল অতিথি হবে, শূদ্র নয়।” মনুসংহিতা ৩/১১০

শূদ্রায় ঘৃণা তবে শূদ্রা সুন্দরী হলে ভোগ

দ্বিজাতিগণ মোহবশত যদি কোনো হীন জাতীয় স্ত্রীলোককে বিবাহ করে তাহলে ঐ স্ত্রীতে উৎপন্ন সন্তানদের সঙ্গে দ্বিজাতি সবংশে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন। মনুসংহিতা ৩/১৫

সবর্ণা(নিজ বর্ণের) নারীকে বিবাহ না করে শূদ্রাকে প্রথম বিবাহ করলে ব্রাহ্মণের নরক লাভ হয়। আবার ঐ স্ত্রীতে পুত্র উৎপাদন করলে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্য থাকে না। সুতরাং সবর্ণা বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রাকে বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা উচিত নয়। মনুসংহিতা ৩/১৭

……যে ব্রাহ্মণ সবর্ণাকে বিবাহ করে শূদ্র স্ত্রীকে বিবাহ করেছ………সেই সব ব্রাহ্মণকে দৈব ও পিতৃ কর্মে নিমন্ত্রণ করবেন না। মনুসংহিতা ৩/১৫৫

“স্ত্রী ,রত্ন,বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতকথা এবং বিভিন্ন শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকেই সকল শিক্ষা করতে পারে। কুল্লুকের মতে এখানে স্ত্রী শব্দের উল্লেখে বোঝানো হয়েছে, নিম্নকূল থেকে যেমন স্ত্রী গ্রহণ করা যায় সেইরূপ রত্ন প্রভৃতি মূল্যবান দ্রব্য সব জায়গা থেকেই গ্রহণ করা যেতে পারে।” মনুসংহিতা ২/২৪০

বর্ণসঙ্কর ও অস্পৃশ্যতা

“শূদ্রের ঔরসে বৈশ্যার গর্ভজ সন্তানকে আয়োগব, শূদ্রের ঔরসে ক্ষত্রিয়ার গর্ভ জাত সন্তান ক্ষত্তা এবং শূদ্রের ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত সন্তান চণ্ডাল আখ্যা প্রাপ্ত হয়। শূদ্র থেকে উৎপন্ন এই তিন বর্ণ জাত সন্তান বর্ণ সঙ্কর বলে পরিগণিত হয়ে থাকে।” মনুসংহিতা ১০/১২

শূদ্রের সাথে ব্রাহ্মণীর মিলনে যখন সন্তান হয়, তখন সেই সন্তান চণ্ডাল নাম প্রাপ্ত হয়, তাকে নিকৃষ্ট আখ্যা দেওয়া হয়েছে। চণ্ডাল প্রভৃতি সংকবর্ণের ঔরসে যখন উচ্চতিনবর্ণের স্ত্রীদের সন্তান হয়, তারা  তাদের  পিতার থেকেও‘সহস্রগুণে হীন ও নিন্দারযোগ্য’। ( মনুসংহিতা ১০/৩০)

যে রাজ্যে বর্ণ দূষক বর্ণ সঙ্কর জাতি উৎপন্ন হয় সেই রাজ্য উৎকৃষ্ট প্রজার সঙ্গে অচিরেই বিনষ্ট হয়। সুতরাং রাজ্য থেকে বর্ণ সঙ্কর জাতির নিষ্কাশন অবশ্য কর্তব্য। মনুসংহিতা ১০/৬১

ব্রাহ্মণ প্রভৃতি তিন দ্বিজের স্বজাতি স্ত্রীর গর্ভ সম্ভূত তিন সন্তান অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণীজাত সন্তান, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়াজাত সন্তান ও বৈশ্যের বৈশ্যজাত সন্তান এবং অনুলোমক্রমে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত দুই সন্তান অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ক্ষত্রিয়াজাত  ও বৈশ্যা জাত দুই সন্তান এবং ক্ষত্রিয়ের ঔরসজাত বৈশ্যার সন্তান- এই ছয় সন্তান দ্বিজ ধর্মাবলম্বী হয়। তাই এদের উপনয়ন প্রভৃতি দ্বিজাতির সংস্কার হবে। কিন্তু এই তিন দ্বিজের প্রতিলোমজ সন্তানেরা শূদ্রধর্মী হয়। সুতরাং তাদের উপনয়ন প্রভৃতি কোনো সংস্কারই হবে না। মনুসংহিতা ১০/৪১

 শূদ্রের প্রতিলোমজাত সন্তান অপেক্ষা দ্বিজজাতির প্রতিলোমজ সন্তান উৎকৃষ্ট। মনুসংহিতা ১০/২৭-২৮

“চণ্ডালের থেকে পুক্কসী স্ত্রীর গর্ভে যে পাপিষ্ঠ জাতি জন্মায় তাদের সোপাক বলে। এই জাতি অসাধু ও পাপজনক জল্লাদের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার চণ্ডালের নিষাদী স্ত্রীর গর্ভজাত যে সন্তান তাকে অন্ত্যাবসায়ী বলে। সাধারণত শ্মশানের কাজ করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এরা সকল প্রতিলোম জাতির থেকে নিকৃষ্ট ও ঘৃণার পাত্র। বর্তমান যুগে এদেরকেই মুদাফফরাস বলে।” মনুসংহিতা ১০/৩৮-৩৯

শূদ্রের ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভজ সন্তান (চণ্ডাল) স্বাভাবিক ভাবেই অপকৃষ্ট হয়ে থাকে। মনুসংহিতা মনুসংহিতা ১০/৬৬-৬৭

শূদ্র-চণ্ডাল-অন্ত্যজদের (অস্পৃশ্য) অশূচি- অস্পৃশ্য ঘোষণা করা হয়েছে

প্রতিদিন শ্রাদ্ধ কার্য বা দেবকার্য করার সময় স্নান ও আচমন করে পবিত্র হবার পর যদি চণ্ডাল প্রভৃতি অশূচি দর্শন ঘটে তাহলে উৎসাহের সঙ্গে বেদোক্ত সূর্য মন্ত্র এবং পাবমানী মন্ত্র জপ করতে বলা হয়েছে।  মনুসংহিতা ৫/৮৬

“……শূদ্র থেকে প্রতিলোমক্রমে উৎপন্ন অর্থাৎ শূদ্র থেকে বৈশ্যা স্ত্রীজাত আয়োগব, ব্রাহ্মণী স্ত্রীজাত ক্ষত্তা এবং শূদ্র স্ত্রীজাত চণ্ডাল- এই তিন জাতির পরলৌকিক পিতৃ কার্যে কোনো অধিকার নেই। তাই এদের নরাধম বলে।” মনুসংহিতা ১০/১৫-১৬

“পতিত, চণ্ডাল পুক্কস, মূর্খ, ধনমদে গর্বিত রজক প্রভৃতি নীচু জাতী ও অন্ত্যাবসায়ী- এইসব মানুষদের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যও বসবাস করবেন না।……” মনুসংহিতা ৪/৭৯

“আত্মীয়স্বজন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যগণ কখনোই শূদ্রকে দিয়ে মৃত দেহ বহন করাবেন না।কারণ মৃতদেহ শূদ্র স্পর্শে দূষিত হলে মৃতাত্মার সর্ব বিরোধী দুর্গতি লাভ হয়। সুতরাং যদি আত্মীয় না থাকে তাহলে ক্ষত্রিয়ের সাহায্যে, তার অভাবে বৈশ্যের সাহায্যে, তার অভাবে শূদ্রের সাহায্যে শববহন করা যেতে পারে।” মনুসংহিতা ৫/১০৪

ধান্দাবাজি কেন?

“শ্রদ্ধার সঙ্গে শূদ্রের কাছ থেকেও শ্রেয়স্করী বিদ্যা গ্রহণ করা উচিত। অন্ত্যজদের ( যাদের ছোয়া যায় না, অস্পৃশ্য) কাছ থেকেও পরম ধর্ম লাভ করবে এবং স্ত্রীরত্ন নিজের অপেক্ষা নিকৃষ্ট কুলজাত হলেও বিবাহ করবে।” মনুসংহিতা ২/২৩৮

“স্ত্রী ,রত্ন,বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতকথা এবং বিভিন্ন শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকেই সকল শিক্ষা করতে পারে। কুল্লুকের মতে এখানে স্ত্রী শব্দের উল্লেখে বোঝানো হয়েছে, নিম্নকূল থেকে যেমন স্ত্রী গ্রহণ করা যায় সেইরূপ রত্ন প্রভৃতি মূল্যবান দ্রব্য সব জায়গা থেকেই গ্রহণ করা যেতে পারে।” মনুসংহিতা ২/২৪০

পোষা শূদ্র

“যে যার কৃষিকাজ করে, পুরুষানুক্রমে যে নিজের বংশের বন্ধু, যে যার গো পালন করে; যে যার ভৃত্য এবং যে যার ক্ষৌর কর্ম করে- শূদ্রের মধ্যে এদের অন্ন ভোজন করা যায়। এমনকি যে যার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তার অন্নও ভোজন করা যায়।… ” (কলিযুগে নিষিদ্ধ) মনুসংহিতা ৪/২৫৩-২৫৪

শূদ্রকে কুকুর,মুরগি,শুয়োর প্রভৃতি জন্তুর সাথে তুলনা করে তাড়ানোর কথা বলা হয়েছে-

শুয়োর ঘ্রাণের মাধ্যমে শ্রাদ্ধকর নষ্ট করে,কুক্কুট পক্ষবায়ুর মাধ্যমে ,কুকুর দৃষ্টির মাধ্যমে আর শূদ্র স্পর্শের মাধ্যমে শ্রাদ্ধকর্ম নষ্ট করে। তাই ঘ্রাণযোগ্য স্থান থেকে শূকরকে , পক্ষপবনযোগ্য স্থান থেকে কুক্কুটকে, দৃষ্টি যোগ্য স্থান থেকে কুকুরকে এবং স্পর্শ যোগ্য স্থান থেকে শূদ্রকে বিতাড়িত করবার কথা বলা হয়েছে।  মনুসংহিতা ৩/২৪১

শূদ্রকে মায়াবশত উচ্ছিষ্ট প্রদান করে তার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে

“যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে ভোজন করে পাত্রে অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট অন্ন শূদ্রকে দান করে সেই মূর্খ মৃত্যুর পর কালসূত্র নামক  নরকে অধোমুখে পতিত হয়।” মনুসংহিতা ৩/২৪৯

তবে সরল স্বভাব যে সব ভৃত্য, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি উচ্চ বর্ণের অত্যাচার যারা প্রতিবাদহীন ভাবে মেনে নেয় সেইআলস্যশূণ্য, অকুটিল ভৃত্যদের শ্রাদ্ধের যে উচ্ছিষ্ট অন্ন ভূমিতে পড়ে যায় তা দান করতে বলা হয়েছে।  মনুসংহিতা ৩/২৪৬

সাধারণ অবস্থায় শূদ্রের রান্না করা খাবার খেতে নিষেধ করা হয়েছে

যে ব্রাহ্মণ বেদবেত্তা তিনি পঞ্চযজ্ঞহীন শূদ্রের রান্ন করা খাবার খাবেন না। কিন্তু অন্য অন্ন পাওয়া না গেলে এক রাতের উপযুক্ত অপক্ক অন্ন শূদ্রের কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারেন। মনুসংহিতা ৪/২২৩-২২৪

আরও বলা হয়েছে-

দাস দাসী,চণ্ডাল প্রভৃতি নীচ জাতি, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিকে স্বাক্ষী করা যাবে না।…………চণ্ডালের ধর্ম জ্ঞান না থাকায় এবং বিকলাঙ্গের উপলব্ধি না থাকায় এদের সাক্ষী করা যায় না। মনুসংহিতা ৮/৬৩-৬৬

ভৃত্য ভিন্ন অন্য শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দেবেন না।যে হব্যের কিয়দংশ হোম করা হয়েছে সেই হবিষ্কৃত অংশ শূদ্রকে দেবেন না । মনুসংহিতা ৮/৮০

আত্মীয়স্বজন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যগণ কখনোই শূদ্রকে দিয়ে মৃত দেহ বহন করাবেন না।কারণ মৃতদেহ শূদ্র স্পর্শে দূষিত হলে মৃতাত্মার সর্ব বিরোধী দুর্গতি লাভ হয়। সুতরাং যদি আত্মীয় না থাকে তাহলে ক্ষত্রিয়ের সাহায্যে, তার অভাবে বৈশ্যের সাহায্যে, তার অভাবে শূদ্রের সাহায্যে শববহন করা যেতে পারে। মনুসংহিতা ৫/১০৪

পতিত, চণ্ডাল পুক্কস, মূর্খ, ধনমদে গর্বিত রজক প্রভৃতি নীচু জাতীয় ও অন্ত্যাবসায়ী- এইসব মানুষদের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যও বসবাস করবেন না। (ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্র নারী থেকে যে পুত্রের জন্ম হয় তাকে নিষাদ বলে। এই নিষাদের ঔরসে শূদ্রা নারীতে যে পুত্র জন্মায় তাকে পুক্কস বলে। আর নিষাদপত্নীতে চন্ডালের পুত্র জন্মালে তাকে অন্ত্যাবসায়ী বলে)। মনুসংহিতা ৪/৭৯

শূদ্রের হত্যাকে সামান্য উপপাতক (ছোটোখাটো অপরাধ) বলে বর্ণনা করা হয়েছে

“স্ত্রী হত্যা,বৈশ্য হত্যা, শূদ্র হত্যা এবং নারীহত্যা- এই সকলের প্রত্যেককে উপপাতক বলে।” মনুসংহিতা ১১/৫৯-৬৭

শূদ্রের প্রতি দয়া হলে তাকে চাকরদের সাথে খাওয়ানো যাবে-

“ব্রাহ্মণের ঘরে যদি বৈশ্য ও শূদ্র অতিথি হয়ে আসেন তাহলে তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ভৃত্যদের ভোজনের সময় তাদেরও ভোজন করাবেন।” মনুসংহিতা ৩/১১২

“……আশ্রিত শূদ্রকে ভক্ষণের জন্য ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অন্ন দেবেন, পরিধানের জন্য জীর্ণ বস্ত্র দেবেন, শয়ণের জন্য পুরোনো শয্যা দেবেন এবং ধানের পুলাক অর্থাৎ আগ্রা, ক্ষুদ, কুড়ো প্রভৃতি দান করবেন।” মনুসংহিতা ১০/১২৪-১২৫

কুকুর ও গাধা তাদের একমাত্র সম্পদ

“চন্ডাল এবং শ্বপচ জাতির লোকেরা গ্রামের বাইরে বসবাস করবে এবং এদের জলপাত্র দেওয়া হবে না। কুকুর এবং গাধা এদের একমাত্র সম্পদ। এরা মৃত মানুষের কাপড় পরবে, ভাঙা পাত্রে ভোজন করবে, লোহার তৈরি অলংকার ধারণ করবে এবং একস্থানে অবস্থান না করে সর্বদা পরিভ্রমণ করবে।।” মনুসংহিতা ১০/ ৫১-৫২

শূদ্র কখনোই শাসক নয়!

“রাজা যদি স্বয়ং বিচার করতে না পারেন তাহলে বিদ্যা ও অন্যান্য গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণকে ঐ কাজে নিযুক্ত করবেন। যোগ্য ব্রাহ্মণের অভাব হলে গুণান্বিত ক্ষত্রিয়কে নিয়োগ করবেন। গুণী ক্ষত্রিয় না পাওয়া গেলে গুণবান বৈশ্যকে নিয়োগ করবেন। কিন্তু কখনোই ধার্মিক সর্ব গুণান্বিত শূদ্রকে ওই পদে নিয়োগ করবেন না।……” মনুসংহিতা ৮/২০

শূদ্র রাজার দেশে ব্রাহ্মণেরা বাস করবেন না

“যে দেশে শূদ্র রাজা, যে দেশে অধার্মিক লোকের সংখ্যা বেশি, বেদ বহির্ভূত পাষণ্ডরা যে দেশ আক্রমণ করছে এবং যে দেশে চণ্ডাল প্রভৃতি নীচ জাতির লোকেরা উপদ্রব করে সেই দেশে (দ্বিজাতিরা) বাস করবে না।” মনুসংহিতা ৪/৬১

শূদ্র বিচার করলে যে দোষ হয়

  • “……যে রাজার রাজ্যে শূদ্র ন্যায় অন্যায় ধর্ম বিষয়ক বিচার করে ,পঙ্কে পতিত গোরু যেমন আত্মত্রাণে অক্ষম হয়ে পঙ্কে মগ্ন হয়, সেইরূপ ঐ রাজার রাষ্ট্র অধর্মে অবসন্ন হয়।” মনুসংহিতা ৮/২১

এছাড়াও বলা হয়েছে,

  • “যে রাজার রাজ্য শূদ্র বহুল, নাস্তিক মানুষে আক্রান্ত এবং ব্রাহ্মণশূন্য সে রাজ্য দুর্ভিক্ষ ও বিভিন্ন ব্যাধিতে পীড়িত হয়ে শীঘ্রই বিনষ্ট হয়।” মনুসংহিতা ৮/২২

শূদ্রের দমন

একজাতি অর্থাৎ শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ প্রভৃতি দ্বিজাতিদের প্রতি কঠিন বাক্য প্রয়োগ করে তাহলে  শাস্তিস্বরূপ ওই শূদ্রের জিহ্বা ছেদন করতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা  ৮/২৭০

আর এরূপ দণ্ড প্রদানকে একেবারেই স্বাভাবিক হিসাবে দেখার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে-‘যেহেতু শূদ্রের জন্ম নিকৃষ্ট অঙ্গ থেকেই হয়েছে।’ মনুসংহিতা ৮/২৭০

আর,

নাম এবং জাতি তুলে শূদ্র যদি দ্বিজাতির ওপর আক্রোশ প্রকাশ করে তাহলে ওই অপরাধে তার মুখে দশ আঙ্গুল পরিমিত জ্বলন্ত লৌহময় শঙ্কু নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৮/২৭১-২৭২

আবার দর্প ভরে শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে ধর্মোপদেশ দেয় তাহলে রাজাকে তার মুখে এবং কানে গরম তেল নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৮/২৭১-২৭২

অন্ত্যজ জাতি অর্থাৎ শূদ্র যদি কোনো অঙ্গ দিয়ে কোনো শ্রেষ্ঠ জাতিকে আঘাত করে তাহলে রাজাকে তার সেই অঙ্গ ছেদন করতে বলা হয়েছে।- ‘ইহা মনুর অনুশাসন’। মনুসংহিতা ২/২৭৯

শূদ্র যদি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতিকে আঘাত করার জন্য হাত তোলে তাহলে রাজাকে তার হাত কেটে ফেলতে বলা হয়েছে এবং পা দিয়ে আঘাত করলে পা কেটে ফেলতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা  ৮/২৮০

শূদ্র যদি অহংকার করে ব্রাহ্মণের সঙ্গে এক আসনে অবস্থান করে তাহলে রাজাকে তার কটিদেশ তপ্ত লোহার শলাকা দিয়ে অঙ্কিত করে তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করার কথা বলা হয়েছে অথবা যাতে তার মৃত্যু না হয় সেভাবে তার পশ্চাৎ দেশ কেটে দিতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৮/২৮১-২৮২

আবার দর্প ভরে শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু দেয় তাহলে রাজাকে তার ওষ্ঠাধার ছেদন করতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৮/২৮১-২৮২

সেইরূপ ব্রাহ্মণের গায়ে প্রস্রাব করলে তার লিঙ্গ ছেদন এবং অধোবায়ু ত্যাগ করলে গুহ্যছেদন করার বিধান দেওয়া হয়েছে। মনুসংহিতা  ৮/২৮১-২৮২

যদি শূদ্র অহংকারবশত হাত দিয়ে ব্রাহ্মণের কেশ ধারণ করে তাহলে রাজা তার দুই হাতই ছেদন করবেন। আবার যদি হিংসা করে শূদ্র ব্রাহ্মণের পা,দাড়ি,গ্রীবা কিংবা অণ্ডকোশ গ্রহণ করে তাহলেও রাজা তার দুহাত ছেদন অরবেন। মনুসংহিতা ৮/২৮৩

দ্বিজচিহ্নধারী বা যজ্ঞোপবীতধারী শূদ্রকে হস্তছেদ থেকে প্রাণবধ পর্যন্ত দণ্ড দিতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৯/২২৪

শূদ্র যদি কামবশত ব্রাহ্মণকে শারীরিক বা আর্থিক পীড়া দেয় তাহলে রাজাকে তার হাত, পা, নাক,কান প্রভৃতি ছেদনরূপ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করতে বলা হয়েছে।মনুসংহিতা ৯/২৪৮

“স্বামী কর্তৃক রক্ষিত হোক বা না হোক শূদ্র যদি দ্বিজাতির ওইরূপ স্ত্রীতে গমন করে তাহলে অরক্ষিতা স্ত্রী গমনে শূদ্রের লিংগচ্ছেদ এবং স্বামী রক্ষিত স্ত্রী গমনে বধ ও সর্বস্ব হরণ দণ্ড হবে।…” মনুসংহিতা ৮/৩৭৪-৩৭৫

সীমাহীন অত্যাচারের পর নিম্নবর্ণকে লোভ দেখিয়ে বলা হয়

“গোরু, ব্রাহ্মণ,স্ত্রী এবং বালক বিপদাপন্ন হলে তাদের পরিত্রাণের জন্য যদি কোনো প্রতিলোম জাতিভূত সন্তান পুরস্কারের প্রত্যাশা না করে প্রাণত্যাগ করে তাহলে তার স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটে ।” মনুসংহিতা ১০/৬২

ব্রাহ্মণ্যবাদের মরণফাদ-

ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।

নিসর্গজং হি তৎ তস্য কন্তস্মাৎ  তদপোহতি।।

স্বামী যদি দাস্য কর্ম থেকে শূদ্রকে মুক্ত করে দেয় তাহলেও শূদ্র দাসত্ব থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিমুক্ত হয় না।দাসত্ব কর্মই তার স্বাভাবিক ধর্ম।মরণ পর্যন্ত তার থেকে শূদ্রের মুক্তি নেই।  -মনুসংহিতা ৮/৪১৪

নারী বিষয়ক

নারীর ধর্মাচরণের স্বাধীনতা নেই, নারীরা অপদার্থ

“যেহেতু শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই স্ত্রীজাতির জাতকর্ম সংস্কার পালিত হয় না তাই তাদের অন্তকরণ নির্মল হয় না। স্মৃতি শাস্ত্র ও বেদ প্রভৃতি ধর্ম শাস্ত্রের ওপর স্ত্রীজাতির কোনো অধিকার নেই। তাই তারা ধর্মজ্ঞ হতে পারে না।এমনকি কোনো মন্ত্রের ওপরেও স্ত্রীজাতির অধিকার না থাকায় তারা কোনো পাপ করলে মন্ত্রের সাহায্যে তা ক্ষালন করতে পারে না। তাই শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ।” মনুসংহিতা ৯/১৮

“স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন পৃথক যজ্ঞ নেই। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো ব্রত এবং উপবাস নেই। কেবলমাত্র স্বামীর সেবা করেই স্ত্রীলোক স্বর্গে যেতে পারেন।” মনুসংহিতা ৫/১৫৫

“বিবাহ সংস্কারই স্ত্রীলোকের বৈদিক উপনয়ন সংস্কার। সেখানে স্বামীর সেবাই হল গুরুকূলে বাস এবং স্বামীর গৃহ কর্মই হল প্রাতঃসন্ধ্যাকালীন হোমরূপ অগ্নি পরিচর্যা।” মনুসংহিতা ২/৬৭

নারীর সম্বন্ধে জঘন্য সব মন্তব্য

“ইহলোকে পুরুষদের দূষিত করা স্ত্রীলোকেদের স্বভাব। এই জন্য পন্ডিতেরা স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে অসাবধান হন না।”মনুসংহিতা ২/২১৩

“স্ত্রীগণ সৌন্দর্য বিচার করেন না। যুবা কী বৃদ্ধ সে ব্যাপারেও তাদের কোনো আপত্তি থাকে না। সুরূপই হোক বা কুরূপই হোক পুরুষ পেলেই তারা তার সঙ্গে সম্ভোগ করেন।”মনুসংহিতা ৯/১৪

“পুরুষের দর্শন মাত্রেই স্ত্রীজাতির মনে তার সঙ্গে মিলনের ইচ্ছা জন্মায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের চিত্তচাঞ্চল্য থাকে।”মনুসংহিতা ৯/১৫

“শয়ন, আসন, ভূষণ,কাম, ক্রোধ,পুরহিংসা, কুটিলতা ও কুৎসিত ব্যবহার- এইসকল প্রবৃত্তি স্ত্রীলোকের জন্যই সৃষ্টির সময় মনু কল্পনা করেছেন।অর্থাৎ ওইসকল প্রবৃত্তি নারীদের স্বভাবগত ব্যপার।”মনুসংহিতা ৯/১৭

নারীর ‘অন্তকরণ নির্মল হয় না।’ মনুসংহিতা ৯/১৮

শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ।মনুসংহিতা ৯/১৮

” মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।”মনুসংহিতা ২/২১৪

ঋতুমতী নারী অশুচি

“চণ্ডাল, ঋতুমতী স্ত্রী, ব্রহ্মবধ করেছেন এমন পতিত ব্যক্তি, দশদিন পর্যন্ত নবপ্রসূতা সূতিকা,শব ও শবস্পর্শী- এদের স্পর্শ করলে স্নানের মাধ্যমেই শুদ্ধ হওয়া যায়।” মনুসংহিতা  ৫/৮৫

পুরুষের দোষ আড়াল করে নারীদেরই দোষারোপ-

“ইহ সংসারে দেহধর্মবশত সব মানুষই কাম ক্রোধের বশীভূত। তাই মূর্খই হোক আর বিদ্বানই হোক কাম ক্রোধের বশীভূত পুরুষদের অনায়াসেই বিপথে নিয়ে যেতে কামিনীরা সমর্থ হয়।” মনুসংহিতা ২/২১৪

নারীদের বশে রাখা

“বাল্যকালে স্ত্রীলোক পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বশে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রের বশে থাকবেন।পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ডের বশে থাকবেন। অর্থাৎ স্ত্রীলোক কখনোই স্বাধীনভাবে অবস্থান করবেন না।” মনুসংহিতা ৫/১৪৮

“শাস্ত্রমতে বিবাহের পূর্বে স্ত্রী জাতিকে কন্যা অবস্থায় পিতা রক্ষা করবেন।যৌবন অবস্থায় বিবাহিত স্ত্রীকে স্বামী রক্ষা করবেন। বৃদ্ধ কালে পুত্র রক্ষা করবেন। এমনকি পতিপুত্রহীন নারীকেও নিকটস্থ পিতৃ প্রভৃতিরা রক্ষা করবেন, কোনো অবস্থাতেই স্ত্রী জাতি স্বাধীন থাকবেন না।” মনুসংহিতা ৯/৩

“স্বামী প্রভৃতি আত্মীয় পরিজনেরা দিনরাত্রির মধ্যে কখনোই স্ত্রীজাতিকে স্বাধীনভাবে অবস্থান করতে দেবেন না। বরং সর্বদাই নিষিদ্ধ রূপ ও রসের ব্যাপারে তাদের অনাসক্ত করে তাদেরকে নিজের বশে রাখবেন।” মনুসংহিতা ৯/২

“কী বালিকা, কী যুবতী, কী বৃদ্ধা গৃহে থাকাকালীন কোনো কাজই স্বতন্ত্রভাবে করতে পারবেন না।” মনুসংহিতা ৫/১৪৭

“স্ত্রীলোক কখনোই পিতা,স্বামী বা পুত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করবেন না। কারণ এদের থেকে পৃথক হলে পিতৃকূল ও পতিকূল- উভয় কূলকেই তিনি কলঙ্কিত করবেন।” মনুসংহিতা ৫/১৪৯

নারীদের বশে রাখার উপায়

“কোনো পুরুষই বল প্রয়োগ করে কোনো স্ত্রীকে সৎ পথে রক্ষা করতে পারে না। তবে নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করলে স্ত্রীদের সহজেই রক্ষা করা যায়।” মনুসংহিতা ৯/১০

“অর্থের সংগ্রহ ব্যয় সাধনে, নিজের শরীর ও গৃহ দ্রব্যের শুদ্ধিবিধানে , স্বামীর স্থাপিত অগ্নির শুশ্রুসায়, পাককার্যে এবং বিভিন্ন গৃহ দ্রব্যের পর্যবেক্ষণে স্ত্রী জাতিকে সর্বদা নিযুক্ত রাখা উচিত। এই সকল বিষয়ের কার্যভার স্ত্রীর উপর অর্পণ করলে সর্বদাই সৎ কর্মে ব্যস্ততায় মগ্ন থাকায় কুকর্ম ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে না।” মনুসংহিতা ৯/১১

স্ত্রীর সাথে এক পাত্রে না খাওয়ার কথা

“পত্নীর সঙ্গে কখনোই তিনি (স্নাতক ব্রাহ্মণ) একপাত্রে ভোজন করবেন না ।” মনুসংহিতা ৪/৪৩

স্ত্রীকে প্রহার করা

“স্ত্রী,পুত্র,দাস,শিষ্য এবং সহোদর কনিষ্ট ভাই অপরাধ করলে সূক্ষ্ম রজ্জু দিয়ে অথবা বেণুদল বা বাঁশের বাখারি দিয়ে শাসনের জন্য তাদের আঘাত করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে রজ্জু বা বাখারি দিয়ে শরীরের পৃষ্ঠ দেশেই একমাত্র আঘাত করতে হবে কখনোই উত্তমাঙ্গে বা মস্তকে আঘাত করা যাবে না।” মনুসংহিতা ৮/২৯৮-৩০০

“সা চেদস্মৈ ন দদ্যাৎ কামমনোমবক্রীণীয়াৎ সা চৈদস্মৈ নৈব দদ্যাৎ

কামমেনাং যষ্ট্যা পাণিনা বোপহত্যাতিক্রামেদিন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ

আদদ ইত্যযশা এব ভবতি।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬/৪/৭)

সরলার্থঃ যদি সেই স্ত্রী এই পুরুষকে কামনা না যোগায় তবে সে সেই স্ত্রীলোককে উপহারাদি দ্বারা বশীভূত কতিবে। তাহাতেও যদি সে পুরুষের কামনা চরিতার্থ না করে তবে সেই স্ত্রীকে সে হাত বা লাঠি দ্বারা আঘাত করিয়া বলিবে-‘আমি ইন্দ্রিয়রূপ যশদ্বারা তোমার যশ গ্রহণ করিতেছি।‘ এই বলিয়া তাহাকে বশীভূত করিবে।ইহাতে সেই স্ত্রী যশোহীনা হইবে।”(হরফ প্রকাশনী)

পুরুষের মত নারীর সম্পদের অধিকার নেই

“বন্ধ্যা নারী অর্থাৎ যার স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে গ্রাসাচ্ছাদন বহনোপযোগী অর্থ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে,পুত্রহীন প্রোষিতভর্তৃকা , যে স্ত্রীর কোনো সপিণ্ড অভিভাবক নেই অথচ যে নিজে সাধ্বী, বিধবা এবং রুগ্না স্ত্রী – এদের সকলের ধন অনাথ বালকের সম্পদের মতোই রাজা নিজে রক্ষা করবেন।” মনুসংহিতা ৮/২৮

নারীর বাল্যবিবাহ ও বিবাহে পুরুষের সাথে বয়সবৈষম্য

“তিরিশ বছরের যুবক মনোমতো বারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। চব্বিশ বছরের যুবক মনোমতো আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। কিন্তু যদি ধর্মহানির আশঙ্কা থাকে অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর বেদ গ্রহণ যদি তিরিশ বা চব্বিশ বছরের আগেই শেষ হয় তাহলে আগেই বিবাহ করা যেতে পারে। টীকাকার কুল্লুকের মতে, কন্যার বয়স অপেক্ষা বরের বয়স প্রায় তিন গুণ বেশি হবে- এই মাত্রা জ্ঞাপন করাই এই বচনের তাৎপর্য। কন্যার বয়ঃক্রম নির্ধারণ করা এই বচনের তাৎপর্য নয়।” মনুসংহিতা ৯/৯৪

নিম্নবর্ণের পুরুষের সাথে উচ্চবর্ণের পুরুষের বিবাহ ও সম্পর্ক নিষিদ্ধ

নিকৃষ্ট জাতির কন্যা যদি সম্ভোগের জন্য নিজের থেকে উৎকৃষ্ট জাতির পুরুষকে ভজনা করে তাহলে ঐ কন্যার কিছুই দণ্ড হবে না।কিন্তু সে যদি অপকৃষ্ট জাতির পুরুষকে ভজনা করে তাহলে যে পর্যন্ত তার কাম নিবৃত্তি না হয় সে পর্যন্ত তাকে গৃহে আটকে রাখতে হবে।” মনুসংহিতা ৮/৩৬৫

“উত্তম জাতির সকামা কন্যাকে অধম জাতির পুরুষ যদি ভজনা করে তাহলে ঐ পুরুষের শারীরিক বধ দণ্ড হবে। ” মনুসংহিতা ৮/৩৬৬

পতিসেবাই নারীর একমাত্র ধর্ম

  • “পিতা স্বয়ং যে ব্যক্তির কাছে কন্যা দান করেছেন কিংবা পিতার অনুমতিক্রমে ভাই যে ব্যক্তির কাছে বোনকে দান করেছেন, সেই স্বামীর জীবিতকাল পর্যন্ত তার সেবা করা এবং স্বামীর মৃত্যুর পরও ব্যভিচার না করা স্ত্রীলোকের কর্তব্য।” মনুসংহিতা ৫/১৫১
  • স্ত্রীলোককে গৃহ কর্মে দক্ষ হতে বলা হয়েছে। মনুসংহিতা ৫/১৫০
  • কায়মনোবাক্যে পতিসেবা পরায়ণতাই স্ত্রীজাতির ধর্ম। পতিসেবাপরায়ণ ভক্তিমতী স্ত্রীদের পুরষ্কার স্বরূপ স্বামী-পিতামহের পিণ্ডের উচ্চিষ্ট দান করার কথা বলা হয়েছে। (মনুসংহিতা ৩/২৬২) কায়মনোবাক্যে পতিসেবাপরায়ণ নারীধর্ম পালনকারী নারী ইহলোকে অত্যন্ত সুখ্যাতি পান এবং মৃত্যুর পরে পতিলোকে গমন করেন। (মনুসংহিতা ৫/১৬৬-১৬৭) তাই স্বামীর জীবনকালে, এমনকি মৃত্যুর পরেও স্ত্রীদের অনিষ্টাচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পরেও কখনোই তার মৃত স্বামীর অপ্রিয় আচরণ না করতে বলা হয়েছে। এর ফলেই নাকি স্ত্রী তার উপার্জিত পূণ্যে স্বামীর কাছে স্বর্গে গমন করবেন (মনুসংহিতা ৫/১৫৬) এবং ইহলোকে সাধ্বী স্ত্রীর খেতাব প্রাপ্ত হবেন! (মনুসংহিতা ৯/২৯)
  • স্বামী ধন,মান,কূল,শীলে অপকৃষ্ট হলে স্ত্রীলোকের অন্যকোনো পুরুষকে গ্রহণ করাকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে। (মনুসংহিতা ৫/১৬৩)
  • ‘আমি ধনীর কন্যা’- এরূপ দম্ভরূপে অথবা নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে কোনো নারী স্বামীকে ত্যাগ করে অন্য পুরুষকে গ্রহণ করলে তাকে লোকজনের সামনে কুকুর দিয়ে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে। আর সেই নারী যে পুরুষের সঙ্গ লাভ করেছিল তাকে গরম লৌহ শয্যায় শুইয়ে রেখে পুড়িয়ে মেরে ফেলার কথা বলা হয়েছে এবং যতক্ষণ না সেই পুরুষ পুড়ে ছাই হয়ে যায় ততক্ষণ আগুনে কাঠ নিক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। (৮/৩৭১-৩৭২)

বিধবা বিবাহে নিষেধাজ্ঞা

  • “……বিবাহ সম্বন্ধীয় শাস্ত্রে এমন কোনো বিধি লিখিত নাই যে বিধবাদের পুনর্বিবাহ হতে পারে।” ৯/৬৫

স্ত্রী মারা গেলে স্বামীর পুনর্বিবাহ

  • “সতী সাধ্বী স্ত্রী আগে মারা গেলে তার দাহকার্য ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপ্ত করার পর পুরুষ পুনরায় বিবাহ করবেন এবং পুনরায় অগ্ন্যাধান কর্ম সম্পন্ন করবেন। এইভাবে পূর্বোক্ত বিধান অনুযায়ী নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্পাদন করবেন এবং পুনরায় দার পরিগ্রহ করে পরমায়ুর দ্বিতীয় ভাগে গৃহস্থাশ্রমেই বাস করবেন। “৫/১৬৮-১৬৯

বিধবার প্রতি বৈষম্য

  • “স্বামী মারা গেলে স্ত্রী পবিত্র ফলমূল আহার করে জীবন যাপন করবেন। কিন্তু কখনোই ব্যভিচারের ইচ্ছায় পরপুরুষের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবেন না।” ৫/১৫৭
  • “যতদিন না নিজের মৃত্যু হয় ততদিন পর্যন্ত পতিপরায়ণা স্ত্রী ক্লেশ সহিষ্ণু ও নিয়মচারিণী হয়ে মধু মাংস ও মৈথুন বর্জন করে ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। অর্থাৎ সতী সাধ্বী স্ত্রীলোকের যা অন্যতম পরম ধর্ম সেই ধর্ম পালনেই তিনি একাগ্র হবেন।” ৫/১৫৮
  • ” সদাচারশালী স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু হলে ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করবেন। কিন্তু কখনোই পরপুরুষের সংযোগে পুত্র উৎপাদন করবেন না। কারণ অপুত্রা হলেও উক্ত ব্রহ্মচারীদের (বালখিল্য ঋষি) মতোই তিনিও স্বর্গে গমন করতে পারবেন।”৫/১৬০

নারীর সাথে প্রতারণা

  • “‘তুমি আমার পরম প্রেয়সী,অন্যকে আমি প্রার্থনা করিনি’- এইভাবে সঙ্গ লাভের জন্য কামিনী (নারী) বিষয়ে মিথ্যা শপথ করলে পাপ হয় না। ‘আমি অন্য বিবাহ করবো না’, এইরূপ ক্ষেত্রে বিবাহ বিষয়ে এবং গোরুর ভক্ষ্য বিষয় সম্বন্ধে ,হোমের জন্য কাষ্ঠ আহরণ বিষয়ে এবং ব্রাহ্মণের রক্ষার জন্য মিথ্যা শপথে কোনো পাপ হয় না।” ৮/১১২

নারীর ত্রুটি পেলেই তাকে ত্যাগ করতে বলা হয়েছে

  • মদ্যপানে আসক্ত, দুশ্চরিত্র, পতিবিদ্বষিণী, কঠিন রোগগ্রস্থ, অপকার সাধনে সক্ষম, ধনক্ষয়কারী স্ত্রীকে ত্যাগ করে স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। (মনুসংহিতা ৯/৭৯-৮০)
  • “……স্ত্রী যদি অপ্রিয়ভাষিণী হন তাহলে কালক্ষয় না করে তৎক্ষণাৎ স্বামী বিবাহ করবে।” মনুসংহিতা ৯/৮১
  • “স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হন তাহলে স্বামী স্ত্রীর জন্য এক বৎসর কাল প্রতীক্ষা করবে। তার মধ্যে স্ত্রীর দ্বেষভাব গত না হলে স্বামী তাকে অলঙ্কার প্রভৃতি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তার সহবাস ত্যাগ করবে।” মনুসংহিতা ৯/৭৭
  • ঘরে স্ত্রী থাকার পরেও স্বামী যদি পুনরায় বিবাহ করেন, আর তাতে স্ত্রী যদি নারাজ হয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হন তাহলে সেই স্ত্রীকে অবরুদ্ধ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে মনুস্মৃতিতে অথবা সেই স্ত্রীকে আত্মীয় স্বজনের সামনে ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে। (মনুসংহিতা ৯/৮৩)

পুত্রের জন্য মরিয়া

  • পুত্রের জন্য মানুষ স্বর্গ লাভ করে। পৌত্রের জন্য মানুষ ঐ স্বর্গ লোকে চিরস্থায়িত্ব লাভ করে এবং প্রপৌত্রের জন্য মানুষ সূর্যলোক লাভ করে। মনুসংহিতা ৯/১৩৭
  • “পুত্র যেহেতু পিতাকে পুৎ নামক নরক থেকে ত্রাণ করে তাই ব্রহ্মা স্বয়ং ‘পুত্র’ এই নাম রেখেছেন। পৌত্র এবং দৌহিত্রের মধ্যে এমন কিছু পার্থক্য শাস্ত্রে বলা হয়নি। কারণ দৌহিত্র পরলোকে পৌত্রের মতোই মাতামহকে পরিত্রাণ করে।……” মনুসংহিতা ৯/১৩৮-১৩৯

ক্ষেত্রজ পুত্রের বিধান

  • রাত্রিবেলা মৌনব্রত অবলম্বন করে স্বামী কিংবা অন্য কোনো গুরু কর্তৃক নিযুক্ত ব্যক্তি ঘৃতাক্ত শরীরে বিধবা রমণীতে একটি মাত্র সন্তান উৎপাদন করতে পারবেন। কিন্তু কখনোই দ্বিতীয় সন্তান উৎপাদন করবেন না। মনু সংহিতা ৯/৬০
  • কোনো কোনো আচার্য বলেছেন, এক পুত্র অপুত্রের মধ্যেই গণ্য। অর্থাৎ একটি সন্তান উৎপাদনে নিজেকে নিয়োগের উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রে সফল হতে পারে না। তাই তাদের মতে ঐ স্ত্রীতে নিয়োজিত ব্যক্তি দ্বিতীয় সন্তান উৎপাদন করতে পারবেন। মনুসংহিতা ৯/৬১
  • যদি কোনো ব্যক্তি নিঃসন্তান অবস্থায় সম্পত্তি রেখে পরলোক গমন করেন এবং তার সম্পত্তি যদি তার স্ত্রী রক্ষা করতে না পারেন তাহলে ঐ ব্যক্তির কনিষ্ঠ ভাই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়াতে পুত্র উৎপাদন করে জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের সমস্ত সম্পত্তি ঐ পুত্রকে দেবে। মনুসংহিতা ৯/১৪৬

নারীকে অধিকৃত জমি ও পশুর সাথে তুলনা

  • “যেমন অন্যের গাভী,মহিষী,স্ত্রী উট ও স্ত্রী ঘোড়া প্রভৃতি জন্তুদের সঙ্গে অন্যের বৃষ, মহিষ,উট এবং ঘোড়া প্রভৃতির মিলনে উৎপন্ন সন্তান গাভী প্রভৃতি পশু মালিকদেরই অধিকৃত হয়ে থাকে; বৃষ প্রভৃতি পশু মালিকদের হয় না। সেইরূপ পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে উৎপাদিত সন্তান উৎপাদকের হয় না, ক্ষেত্র স্বামীরই হয়ে থাকে। যার ক্ষেত্র নেই কেবল বীজ আছে সে যদি পরের ক্ষেত্রে বীজ বপন করে তাহলে তার শস্যফল কিছুই লাভ হয় না। ক্ষেত্রস্বামীই ঐ ফল ভোগ করে থাকে।”
  • (মনুসংহিতা ৯/৪৮-৪৯)

নারীর স্বেচ্ছায় ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদনের অধিকার নেই

  • “সন্তান না থাকলে স্বর্গ গমন হয় না একথা ভুল। বালখিল্য প্রভৃতি বহু সহস্র ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণ সন্তান উৎপাদন না করেই কেবলমাত্র ব্রহ্মচর্য বলেই অক্ষয় স্বর্গ লোক লাভ করেছেন। সুতরাং ওই সকল ব্রহ্মচারীর মতোই সাধ্বী স্ত্রী সন্তানবতী না হলেও স্বীয় ব্রহ্মচর্য বলেই স্বর্গ গমন করেন।”  ৫/১৫৯

সীতার অগ্নিপরীক্ষা

সতীদাহ

ঋগ্বেদে

উদীর্ষ্ব নার্ষভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।

হস্তগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ।। (ঋগ্বেদ ১০/১৮/৮)

অর্থাৎ, হে নারী সংসারের দিকে ফিরে চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যার নিকট শয়ন করতে যাচ্ছ সে গতাসু অর্থাৎ মৃত হয়েছে। চলে এস। যিনি তোমার পাণিগ্রহণ করে গর্ভাধান করেছিলেন, সে পতির পত্নী হয়ে যা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলি তোমার করা হয়েছে।

(অনুবাদক-রমেশচন্দ্র দত্ত, হরফ প্রকাশনী)

নিচে ঋগ্বেদ ১৮/৮/৮ এর একটি ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হল-

Rise, come unto the world of life, O woman: come, he is lifeless by whose side thou liest.
Wifehood with this thy husband was thy portion, who took thy hand and wooed thee as a lover.

(Ralph T.H. Griffith’s Translation)

অথর্ব বেদে

ইয়ং নারী পতিলোকং বৃণানা নি পদ্যত উপ ত্বা মর্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনুপালয়ন্তী তস্যৈ প্রজাং দ্রবিণোং চেহ ধেহি।। (অথর্ব বেদ ১৮/৩/১)

অর্থাৎ, এ পুরোবর্তিনী স্ত্রী সহধর্মচারিণী বলে পতির অনুষ্ঠিত যাগাদি কর্মের ফলস্বরূপ স্বর্গাদি লোক বরণ করতে চায়। হে মরণশীল মানুষ, এ স্ত্রী ভূলোক থেকে নির্গত তোমার কাছে অনুমরণের জন্য পুরাতন (স্মৃতি পুরাণাদি প্রসিদ্ধ) ধর্ম অনুপালনের জন্য যাচ্ছে। সে অনুমরণে গমনশীল স্ত্রীর জন্য জন্মান্তরেও এ ভূলোক পুত্রপৌত্রাদি ও ধন দাও।(অথর্ব বেদ সংহিতা- অনুবাদক- শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী, হরফ প্রকাশনী)

অথর্ববেদ ১৮/৩/১ এর ইংরেজি অনুবাদ-

Choosing her husband’s world, O man, this woman lays herself
down beside thy lifeless body.
Preserving faithfully the ancient custom. Bestow upon here both
wealth and offspring.

(griffith’s translation)

অথর্ববেদ ১৮/৩/২ এ বলা হচ্ছে,

উদীষর্ব নার্যভি জীবলোকং গত্যসুমেতমুপ শেষ এহি। হস্তগ্রাভস্য দধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ।।

অর্থাৎ, হে ধর্ম পত্নী, এ জীবলোকের উদ্দেশে পতির কাছ থেকে উঠে এস। যে মৃত পতির কাছে শয়ন করেছ, সেখানে দৃষ্ট প্রয়োজনের অভাবে তার কাছ থেকে চলে এস। তোমার পাণিগ্রহণকর্তা পতি অপত্যাদিরূপে জন্মলাভ করেছে।( অথর্ব বেদ সংহিতা- অনুবাদ শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী, হরফ প্রকাশনী)

১৮/৩/২ এর ইংরেজি অনুবাদ-

Rise, come unto the world of life, O woman: come, he is lifeless
by whose side thou liest.
Wifehood with this thy husband was thy portion who took thy
hand and wooed thee as a lover.

(griffith’s translation)

রামায়ণে

স্বামী দশরথের মৃত্যুর পর কৌশল্যার সহমৃতা হওয়ার ইচ্ছা দেখা যায় রামায়ণে,যদিও কৌশল্যা সহমৃতা হন না । দশরথের মৃত্যুর পর কৌশল্যাকে বলতে শোনা যায়,

“साहमद्यैव दिष्टान्तम् गमिष्यामि पतिव्रता |
इदम् शरीरमालिङ्ग्य प्रवेक्ष्यामि हुताशनम् || २-६६-१२

অর্থাৎ, আজ আমিও পতিব্রতা হয়ে আমার বিধি নির্দিষ্ট অন্তের সাথে সাক্ষাৎ করবো। স্বামীর এই দেহকে আলিঙ্গন করে, আমি অগ্নিতে প্রবেশ করবো। (৩) (Source )

রামায়ণের যুদ্ধ কাণ্ডে রাবণ যখন সীতাকে রামের মায়ামুণ্ডু দেখিয়েছিল, সীতা তখন রামের সাথে সহমৃতা হবার বাসনা করেছিলেন(৩৯) –

शिरसा मे शिरसः च अस्य कायम् कायेन योजय |
रावण अनुगमिष्यामि गतिम् भर्तुर् महात्मनः || ६-३२-३२

“O, Ravana! Join my head with his head and my body with his body. I shall go along the path of my magnanimous Lord.” 

অর্থাৎ, হে রাবণ! আমার মস্তক তাঁর (রামের) মস্তকের সাথে স্পর্শ করিয়ে দাও, আমার শরীর তাঁর শরীরের সাথে স্পর্শ করিয়ে দাও। আমি আমার মহৎ প্রভুর অনুগমন করবো।

বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বেদবতী রাবণকে বলেন তার পিতা মারা গেলে, তার মাতা সহমৃতা হয়েছিলেন-

“পরে বলদৃপ্ত দৈত্যরাজ শুম্ভ আমার পিতার এই সুদৃঢ় সংকল্পে যারপরনাই কুপিত হয় এবং একদা রজনীযোগে নিদ্রিতাবস্থায় তাঁহাকে আসিয়া বিনাশ করে। পরে আমার জননী একান্ত শোকাকুল হইয়া পিতার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করেন।”

(হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ১৭ তম সর্গ)

মহাভারতে

মহাভারতে পান্ডুর মৃত্যুর পর তার পত্নী মাদ্রী সহমৃতা হন।পান্ডুর মৃত্যুর পরে কুন্তি মাদ্রীকে বলেন,

“ ভদ্রে যাহা হইবার হইয়াছে। এক্ষণে তোমার নিকট এক প্রার্থনা করি, শ্রবণ কর। আমি রাজর্ষির জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী; সুতরাং শ্রেষ্ঠ ধর্মফল আমারই প্রাপ্য; অতএব আমি পরলোকগত ভর্তার সহগমণ করিব, তুমি এ বিষয়ে আমাকে নিবারণ করিও না, তুমি গাত্রোত্থান কর। অতি সাবধানে এই সকল সন্তানগুলি প্রতিপালন করিও। আমি মহারাজের মৃতদেহ লইয়া চিতারোহন করি।“

মাদ্রী বলেন,

“ আমি স্বামী সহবাসে অদ্যাপি পরিতৃপ্ত হই নাই, অতএব আমিই ইহার সহগমন করিব। অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এই বিষয়ে অনুমতি করিতে হইবে। আরও দেখ, মহারাজ আমাতে আসক্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত যমভবনে গমন করিয়া তাহার অভিলাষ পরিপূর্ণ করা আমার প্রধান ধর্ম ও অত্যন্ত অবশ্য কর্তব্য কর্ম। বিশেষত আমি যদি জীবিত থাকিয়া আপনার পুত্রদ্বয়ের ন্যায় তোমার পুত্রগণকে স্নেহ করিতে না পারি, তাহা হইলে অবশ্যই আমাকে ইহকালে লোকনিন্দায় ও পরকালে ঘোরতর নরকে নিপতিত হইতে হইবে। অতএব সহগমন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়কল্প। এক্ষণে তোমার নিকট আমার এই ভিক্ষা যে, মহারাজের মৃত দেহের সহিত আমার কলেবর দগ্ধ কর।আমার পুত্রদ্বয়কে আপনার পুত্রগণের ন্যায় স্নেহ ও অপ্রমত্তচিত্তে প্রতিপালন করিও; ইহা ব্যতিত আমার আর কিছুই বক্তব্য নাই।“

এর পর মহাভারতে বলা হচ্ছে, “মদ্ররাজদুহিতা কুন্তিকে এই কথা বলিয়া রাজার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিলেন।“

(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/আদিপর্ব/১২৫ তম অধ্যায়)

আদিপর্বের ১২৬ তম অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“পতিব্রতা মাদ্রীও পতির লোকান্তরপ্রাপ্তি দর্শনে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া তাহার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া পতিলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন।“ (কালিপ্রসন্নের মহাভারত)

কুন্তির একটি কথা বিশেষভাবে লক্ষণীয়- পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার সাথে সহমরণে যাওয়াকে ‘শ্রেষ্ঠ ধর্ম ফল’ হিসাবে বর্ণনা করছেন তিনি। সুতরাং জওহরকে যেমন রাজপুতেরা আজকের যুগেও গৌরবান্বিত করে চলেছে, তেমনি সেযুগেও সতীর চিতায় প্রাণত্যাগ করাকে শ্রেষ্ঠ ধর্মফল হিসাবে দেখানো হত।

মহাভারতের মৌষলপর্বের সপ্তম অধ্যায়ে কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীরা তার সাথে সহমৃতা হন

“পরদিন প্রাতঃকালে প্রবল প্রতাপ মহাত্মা বসুদেব যোগাবলম্বন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিলেন।তখন তাহার অন্তঃপুর মধ্যে ঘোরতর ক্রন্দন শব্দ সমুত্থিত হইয়া সমুদায় পুরী প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। কামিনীগণ মাল্য ও আভরণ পরিত্যাগ পূর্বক আলোলয়িতকেশে বক্ষঃস্থলে করাঘাত করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।তখন মহাত্মা অর্জুন সেই মৃতদেহ বহুমুল্য নরযানে আরোপিত করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। দ্বারকাবাসীগণ দুঃখশোকে একান্ত অভিভূত হইয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ভৃত্যগণ শ্বেতচ্ছত্র ও যাজকগণ প্রদীপ্ত পাবক লইয়া শিবিকাযানের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা নামে বসুদেবের পত্নীচতুষ্টয় তাহার সহমৃতা হইবার মানসে দিব্য অলঙ্কারে বিভূষিত ও অসংখ্য কামিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাহার অনুগামিনী হইলেন। মহাত্মা অর্জুন চন্দনাদি বিবিধ সুগন্ধী কাষ্ঠ দ্বারা পত্নী সমবেত বসুদেবের দাহকার্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সেই প্রজ্জ্বলিত চিতানলের শব্দ সামবেত্তাদিগের বেদাধ্যয়ন ও অন্যান্য মানবগণের রোদনধ্বনি প্রভাবে পরিবর্ধিত হইয়া সেই স্থান প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। অনন্তর তিনি বজ্র প্রভৃতি যদুবংশীয় কুমারগণ ও কামিনীগণের সহিত সমবেত হইয়া বসুদেবের উদকক্রিয়া সম্পাদন করিলেন।“

(কালিপ্রসন্নসিংহের মহাভারত/মৌষল পর্ব/৭ম অধ্যায়)

মহাভারতে কৃষ্ণের অনেক পত্নী সহমৃ্তা হন।

রাজশেখর বসুর মহাভারত অনুযায়ী,

“কৃত বর্মার পুত্র এবং ভোজ নারীগণকে মার্তিকাবত নগরে এবং সাত্যকির পুত্রকে সরস্বতী নদীর নিকটস্থ প্রদেশে রেখে অর্জুন অবশিষ্ট বালক বৃদ্ধ ও রমণীগণকে ইন্দ্রপ্রস্থে আনলেন।কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রকে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্য দিলেন। অক্রূরের পত্নীরা প্রব্রজ্যা নিলেন। কৃষ্ণের পত্নী রুক্মিণী,গান্ধারী, শৈব্যা,হৈমবতী ও জাম্ববতী অগ্নিপ্রবেশ করলেন।সত্যভামা ও কৃষ্ণের অন্য পত্নীগণ হিমালয় অতিক্রম করে কলাপ গ্রামে গিয়ে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। দ্বারকাবাসী পুরুষগণকে বজ্রের নিকটে রেখে অর্জুন সজল নয়নে ব্যাসদেবের আশ্রমে এলেন।“

(রাজশেখর বসুর মহাভারত, মৌষল পর্ব)

কালিপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতে,

“…ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রের প্রতি সমর্পিত হইল। ঐ সময় অক্রূরের পত্নীগণ প্রব্রজ্যা গ্রহণে উদ্যত হইলে, বজ্র বারংবার তাহাদিগকে নিষেধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তাহারা প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। রুক্মিণী,গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও দেবী জাম্ববতী ইহারা সকলে হুতাশনে প্রবেশ পূর্বক প্রাণত্যাগ করিলেন। সত্যভামা প্রভৃতি কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ তপস্যা করিবার মানসে অরণ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ফলমূল ভোজন পূর্বক হিমালয় অতিক্রম করিয়া কলাপ গ্রামে উপস্থিত হইলেন।…”

( কালিপ্রসন্নের মহাভারত/মৌষল পর্ব/ ৭ম অধ্যায়)

মহাভারতের শান্তি পর্বে কপোতের মৃত্যুর পর কপোতিকে আগুনে ঝাপ দিয়ে মারা যেতে দেখা যায়। কপোতির আত্মহত্যার মাধ্যমে মহাভারতে সহমরণের আদর্শকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে

“পতি পরায়ণা কপোতি করুণস্বরে এইরূপে নানাপ্রকার বিলাপ করিয়া পরিশেষে সেই প্রজ্জ্বলিত হুতাশনমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল যে, তাহার ভর্তা বিচিত্র মাল্য, পরিধেয় বস্ত্র ও কেয়ূর প্রভৃতি অলঙ্কার সমুদায়ে বিভূষিত হইয়া পুষ্পক রথে অধিরূঢ় হইয়াছে। পুণ্যকর্মপরায়ণ মহাত্মারা তাহার চতুর্দিকে অবস্থান পূর্বক স্তবস্তুতি করিতেছেন। অনন্তর সেই কপোত স্বীয় পত্নীর সহিত সেই বিমানে আরোহণ পূর্বক স্বর্গে গমন করিয়া তত্রত্য দেবগণের নিকট স্বীয় কর্মানুরূপ সম্মানভাজন হইয়া পরমসুখে বিহার করিতে লাগিলেন।”

(কালিপ্রসন্নের মহাভারত/শান্তি পর্ব/ ১৪৮ অধ্যায়)

ধর্মশাস্ত্রে সতীদাহ

পরাশর সংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“ যে পাত্রের সহিত বিবাহের কথাবার্তা স্থির হইয়াছে, তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইলে, তবে ঐ ভাবী পতি যদি নিরুদ্দেশ হয়, মরিয়া যায়,প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে, ক্লীব বলিয়া স্থির হয় বা পতিত হয়, তবে এই পঞ্চ প্রকার আপদে ঐ কন্যার পাত্রান্তরে প্রদান বিহিত। স্বামীর মরনান্তে যে নারী ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেন, তিনি মৃত্যুর পর ব্রহ্মচারীর ন্যায় স্বর্গ লাভ করেন। আর স্বামীর মরণে যিনি সহমৃতা হন, সেই স্ত্রী মানবদেহে যে সার্দ্ধত্রিকোটি সংখ্যক রোম আছে, তাবৎ পরিমিত কাল স্বর্গ ভোগ করিতে থাকেন ব্যালগ্রাহী (সাপুড়ে) যেমন গর্ত মধ্য হইতে, সর্পকে বলপূর্বক টানিয়া আনে, তেমনি সহমৃতা নারী মৃত পতিকে উদ্ধার করিয়া, তৎসহ স্বর্গসুখ ভোগ করেন।

( ঊনবিংশতি সংহিতা/ পরাশর সংহিতা/অধ্যায় ৪/২৬-২৯ |অনুবাদক- শ্রীপঞ্চানন তর্করত্ন)

পরাশর সংহিতার শ্লোকগুলির যে অনুবাদ উপরে দেওয়া হল, এটা ছাড়াও অন্য রকম একটি অনুবাদ রয়েছে। অনুবাদ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।সেই অনুবাদে বিদ্যাসাগর দেখিয়েছিলেন, বিধবা বিবাহ হিন্দুশাস্ত্র সম্মত। সেই অনুবাদটি হল-

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরান্যো বিধীয়তে।। ৪/২৬

মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী ব্রহ্মচর্য্যে ব্যবস্থিতা।

সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ।।৪/২৭

তিস্রঃ কোট্যোহর্দ্ধকোটি ছ যানি লোমানি মানবে।

তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং ভর্ত্তারং যানুগচ্ছতি।।৪/২৮

অর্থাৎ, স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে,ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগের পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে ব্রহ্মচারীদিগের ন্যায়, স্বর্গলাভ করে। মনুষ্য শরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বর্গে বাস করে।”

এর পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলছেন, “পরাশর কলিযুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিয়াছেন, বিবাহ,ব্রহ্মচর্য ও সহগমন। তন্মধ্যে রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের পক্ষে দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক,ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবেক। কলিযুগে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্রা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।এই নিমিত্তই ভগবান পরাশর সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন। সে যাহা হউক, স্বামীর অনুদ্দেশ প্রভৃতি পাঁচ প্রকার বৈগুণ্য ঘটিলে, স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহের স্পষ্ট বিধি প্রদর্শিত হওয়াতে, কলিযুগে সেই সেই অবস্থায়, বিধবার পুনর্বার বিবাহ করা শাস্ত্রসম্মত কর্তব্য কর্ম বলিয়া অবধারিত হইতেছে।”

বিশেষত পরাশর স্মৃতির উপরোক্ত শ্লোকগুলির ভিত্তিতেই বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কিন্তু তার অনূদিত শ্লোকগুলির মধ্যেও সতীদাহের উল্লেখ পাওয়া যায়।বিদ্যাসাগরের সময়কালে সহমরণ সম্ভব না হওয়ার পিছনে বিদ্যাসাগর যুক্তি দিয়েছেন, “…রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে বিধবাদিগের পক্ষে দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক,ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবেক।”

ব্যাসসংহিতার ২য় অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“পতিব্রতা স্ত্রী স্বামী প্রবাসে থাকিলে দীনভাবে থাকিবে। মৃত ভর্তার সহিত অগ্নিপ্রবেশ করিবে অথবা আজীবন ব্রহ্মচর্য করিবে।“

( ঊনবিংশতি সংহিতা\ব্যাসসংহিতা | অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন )

দক্ষ সংহিতায় বলা হচ্ছে,

“ ভর্তার মৃত্যু হইলে, যে স্ত্রী স্বামীর চিতা আরোহণ করে সেই স্ত্রী সদাচারসম্পন্না হইবে এবং স্বর্গে দেবগণের পূজ্য হইবে। ব্যালগ্রাহী (সাপুড়ে) যেমত গর্ত হইতে বল দ্বারা সর্পগণকে উদ্ধার করে, সেইরূপ পতিসহগামিনী স্ত্রীর পতি যদ্যপি নরকস্থ থাকে, তাহাকেও নিজ পূণ্যবলে উদ্ধার করিয়া পতির সহিত (স্বর্গলোকে) সহর্ষে কালযাপন করে।“

( দক্ষসংহিতা/ অধ্যায় ৪ | ঊনবিংশতি সংহিতা/দক্ষ সংহিতা- অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন )

বিষ্ণু সংহিতায় সতীদাহ

বিষ্ণু সংহিতার ২৫ তম অধ্যায়ে বলা হচ্ছে,

“স্ত্রীলোকের ধর্ম নিরুপিত হইতেছে।ভর্তার সমান ব্রতাচরণ, শ্বশ্রু, শ্বশুর,গুরু, দেবতা ও অতিথির পূজা , গৃহোপকরণ, দ্রব্য সামগ্রীকে বেশ মাজিয়া ঘষিয়া গুছাইয়া রাখা,অমুক্তহস্ততা (অর্থাৎ, অল্পব্যয় করা), ধন-পাত্র সুগোপন করিয়া রাখা, বশিকরণাদি মূলকর্মে অপ্রবৃত্তি। মঙ্গলাচার তৎপরতা, ভর্তা প্রবাসে থাকিলে কেশবিন্যাস না করা, পরগৃহে গমন না করা, দ্বারদেশে বা গবাক্ষে অবস্থান না করা এবং সকল কর্মেই অস্বতন্ত্রতা- (যথাক্রমে) বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্যে- পিতা, ভর্তা ও পুত্রের বশে থাকা, ভর্তার (স্বামী) মৃত্যু হইলে ব্রহ্মচর্য কিংবা ভর্তার সহগমন বা অনুগমন (স্ত্রীলোকের ধর্ম)।(ঊনবিংশতি সংহিতা/বিষ্ণু সংহিতা/২৫ অধ্যায় ।| অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)

JULIUS JOLLY অনূদিত Institutes of Vishnu হতে একই কথা উদ্ধৃত করা হল-

“13.To remain subject, in her infancy, to her father; in her youth, to her husband; and in her old age, to her sons.

14.After the death of her husband, to preserve her chastity, or to ascend the pile after him.” (25/13-14)

অত্রি সংহিতায় সতীদাহ

চিতিভ্রষ্টা তু যা নারী ঋতুভ্রষ্টা চ ব্যাধিতঃ।

প্রাজাপত্যেন শুধ্যেত ব্রাহ্মণান্ তোজয়দ্দেশ।। ২০৯

অর্থাৎ, স্ত্রীলোক সহমরণ বা অনুমরণ করিতে গিয়া চিতা হইতে পতিত হইলে বা রোগ দ্বারা রজোহীন হইলে প্রাজাপত্য ব্রত করিয়া এবং দশজন ব্রাহ্মণ ভোজন করাইয়া শুদ্ধ হইবে।(ঊনবিংশতি সংহিতা/অত্রি সংহিতা/২০৯ শ্লোক | অনুবাদক- পঞ্চানন তর্করত্ন)

পুরাণে সতীদাহ

অগ্নি পুরাণে সতীদাহ

“…একজন নারী দেহ ও আত্নায় শুদ্ধ হবেন, খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হবে এবং পিতা যে ব্যক্তির সাথে তার বিবাহ দিয়েছেন ,বিশ্বাসের সাথে তার সেবা করবেন। স্বামীর মৃত্যুর পর যে বিধবা আত্মনিয়ন্ত্রণ করেন এবং ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তিনি স্বর্গে গমন করেন। একজন বিধবার কোনো অপিরিচিত ব্যক্তির গৃহে বাস করার ইচ্ছা করা অনুচিত, তার ঝগড়াটে স্বভাবের হওয়াও উচিত নয়। একজন বিধবা এবং বিবাহিতা নারীর স্বামী দূরদেশে থাকলে, তাদের কখনো সাজসজ্জা করা উচিত নয়। তারা মন্দিরে বাস করবেন এবং ঈশ্বরের কাছে তাদের স্বামীর ভালোর জন্য প্রার্থনা করবেন। অন্য সময়ে বিবাহিতা নারী স্বামীর মঙ্গলের জন্য কিছু অলঙ্কার পরিধান করবেন। যে বিধবা মৃত স্বামীর চিতায় নিজেকে পোড়ায় তিনি স্বর্গে গমন করেন।”

( Agni Puranam/CCXXII (222) chapter/ 19-23 | translation by: MN DUTT, Cosmo Publication | first published 1904)
কূর্ম পুরাণে সতীদাহ

“কোনো ব্যক্তি পবিত্র কোনো স্থানে মৃত্যু বরণ করলে সকল পাপ থেকে মুক্ত হন।স্বামী যদি ব্রহ্মঘাতক (ব্রাহ্মণকে হত্যাকারী), অকৃতজ্ঞ, পাপীও হয়, তার স্ত্রী তার মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করলে, তাকে উদ্ধার করেন। বিজ্ঞজনেদের মতে, এটা নারীদের জন্য পরম অনুতাপ।”

( kurma purana/ uttarabhaga/34/108-109)
বিষ্ণু পুরাণে সতীদাহ

বিষ্ণুপুরাণ মতে, দুর্বাসার অভিশাপকে সম্মান জানিয়ে মায়াবী কৃষ্ণ হাঁটুর উপরে পায়ের পাতা স্থাপন করে যোগ অবলম্বন করেন। জরা নামে এক ব্যাধ কৃষ্ণকে হরিণ ভেবে তার দিকে তীর নিক্ষেপ করে। এভাবে কৃষ্ণ মৃত্যুবরণ করেন। (৪) কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীরা সহমৃতা হন। বিষ্ণু পুরাণ বলছে-

” পরাশর বললেনঃ কৃষ্ণ এবং রামের মৃতদেহ পাওয়া গেলে অর্জুন তাদের এবং অন্যান্য মৃতদের সৎকার করেন। কৃষ্ণের আট পত্নী, পূর্বে রুক্মিণীর সাথে যাদের নাম নেওয়া হয়েছে, তারা হরিকে আলিঙ্গন করে তার চিতার অগ্নিতে প্রবেশ করেন। হে ধার্মিকগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, রামের মৃতদেহকে আলিঙ্গন করে রেবতিও আগুনে প্রবেশ করেন, স্বামীর সাথে সংস্পর্শের ফলে অগ্নি রেবতীর সুখী হৃদয়ের কাছে শীতল হয়েছিল। সেখানে সব শোনার পর, উগ্রসেন আর বসুদেবের সাথে দেবকী এবং রোহিনী আগুনে প্রবেশ করেন।…”

( Vishnu Puranam/part 5/ section XXXVIII(38) | translation by MN DUTT, printed by H.C Das, Elysium Press, 65/2 Beadon Street, 1896)
গরুড় পুরাণে সহমরণ

“স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, মৃত হলে অথবা ছেড়ে চলে গেলে অথবা নপুংসক অথবা নীচস্বভাবের হলে, এমন জরুরী অবস্থায় একজন নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারেন।”

(garuda puranam 1/107/28 | Motilal Banarsidass Publishers Limited)

“যে নারী তার স্বামীর সাথে সহমৃতা হন, তার স্বামীর শরীরে যত লোম আছে, তত বছর স্বামীর সাথে তিনি স্বর্গে বাস করবেন।”

(garuda puranam 1/107/29 | Motilal Banarsidass Publishers Limited)

গরুড় পুরাণের অন্য স্থানে আবার বলা হচ্ছে-

“যে নারী স্বামীর কাছে পবিত্র এবং বিশুদ্ধ, তার উচিত মৃত স্বামীকে নমস্কার করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শুরু হবার আগে স্বামীর চিতায় আরোহণ করা। যে নারী চিত্তের দৌর্বল্যের কারণে চিতা হতে দূরে সরে যান তার প্রজাপাত্য প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। স্বামীকে অনুসরণ করে যে নারী চিতায় আরোহণ করেন, মানুষের শরীরে যে সাড়ে তিন কোটি লোম আছে, তত বছরই তিনি স্বর্গে বাস করেন। সাপুড়ে যেমন গর্ত থেকে সাপকে বের করে আনে তেমনি সেই নারী তার স্বামীকে নরক থেকে উদ্ধার করেন এবং তার স্বামীর সাথে স্বর্গসুখ ভোগ করেন। যে নারী চিতায় আরোহণ করেন তিনি স্বর্গে যায়। স্বর্গের অপ্সরাদের দ্বারা তিনি প্রশংসিত হন এবং স্বামীর সাথে ,যতসময় ১৪ জন ইন্দ্র স্বর্গে রাজত্ব করেন, ততসময় স্বর্গেসুখ ভোগ করেন। এমনকি যদি পুরুষটি ব্রহ্মঘাতিও (ব্রাহ্মণকে হত্যাকারী) হয়, যদি বন্ধু বা মহৎ কোনো ব্যক্তির খুনিও হয়, তার স্ত্রী চিতায় আরোহণ করলে সে পাপমুক্ত হয়। যে নারী স্বামীর মৃত্যুর পর অগ্নিতে প্রবেশ করেন , তিনি স্বর্গে অরুন্ধতীর মত সুখ্যাতি লাভ করেন। যতক্ষণ কোনো নারী তার স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে দহন না করেন, ততক্ষণ তিনি তার নারীজন্ম থেকে মুক্তি পান না। যে নারী তার স্বামীর অনুগমন করেন, তিনি তার মাতৃকুল, পিতৃকুল ও পতিকুলের তিন পুরুষকে পরিশুদ্ধ করেন।” (৮)

(Garuda Purana II.4.88-97 | Motilal BanarsiDas Publishers Privet Limited)
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে সতীদাহ

পরশুরামের পিতা জমদগ্নিকে মৃত ভেবে তার মাতা রেণুকা সহমরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন-

“পবিত্র রীতিনীতির অনুষ্ঠানকারী রেণুকা যে স্বামির শোকে বিভোর হয়েছিলেন, তিনি তার পুত্রদের ডেকে এই কথাগুলো বললেনঃ ২/৩/৩০/৩৫

রেণুকা বললেনঃ

হে আমার পুত্রেরা আমি তোমাদের স্বর্গীয় মেধাবী পিতার অনুগমণের ইচ্ছা করি। এর অনুমতি প্রদান করা তোমাদের কর্তব্য। ২/৩/২০/৩৬

বৈধব্যের দুর্গতি অসহনীয়।আমি কিভাবে তা সহ্য করবো? স্বামীর দুঃখে শোকার্ত হয়ে আমি পাগল হয়ে যাব। আমি কিভাবে আমার দিনযাপন করবো? ২/৩/৩০/৩৭

তাই আমি আমার প্রিয়তম স্বামীকে অনুসরণ করবো যাতে আমি তার সাথে অন্য জগতে কোনো বাধা ছাড়াই চিরকাল বাস করতে পারি। ২/৩/৩০/৩৮

এই জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করে,কিছু দীর্ঘ সময়ের পরে, পিতৃদের জগতে আমি আমার স্বামীর অতিথি হব। ২/৩/৩০/৩৯

হে পুত্রেরা যদি তোমরা আমার প্রিয় কিছু করতে চাও, তবে আমার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করে অন্য কোন কিছুই প্রকাশ করতে পার না, আগুনে আমার আত্মাহুতিতে তোমাদের সম্মতি ও সমর্থন জানানো ছাড়া।২/৩/৩০/৪০

এই কথাগুলো বলার পরে দৃঢ় সিদ্ধান্তের সাথে রেণুকা তার স্বামীর অনুগমণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। ২/৩/৩০/৪১”

(brahmanda puranam- Publisher- Motilal Banarsi das private limited)
পদ্মপুরাণে সতীদাহ

পদ্মপুরাণে এক ব্রাহ্মণ মারা গেলে তার স্ত্রী দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে। তখন সেখানে নারদ এসে উপস্থিত হলে স্ত্রীটি নারদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে।

“তাকে উঠিয়ে নারদ বিশুদ্ধ নারীটিকে তার মৃত স্বামীর সম্বন্ধে বললেনঃ হে নিষ্পাপ বিশালাক্ষী , দয়াকরে তুমি তোমার স্বামীর কাছে যাও। হে বিশালাক্ষী, তোমার স্বামী তার আত্মীয় দ্বারা পরিত্যক্ত এবং মৃত। হে শুভে, তোমার কাঁদা উচিত নয়। অগ্নিতে প্রবেশ কর ( তোমার স্বামীর চিতায়)।

ব্রাহ্মণ নারীটি বললেনঃ

হে ঋষি, আমাকে যেতে হবে নাকি যেতে হবে না বলুন, যাতে অগ্নিতে প্রবেশের সময় পার না হয়ে যায়।

নারদ বললেনঃ ৫/১০৬/৫৮-৬২ 

ঐ শহরটি এখান থেকে একশ যোজন দূরে। ব্রাহ্মণকে (তোমার স্বামীর মৃতদেহকে) কাল পোড়ানো হবে।

Avyaya (নারীটি) বললেনঃ

হে মুনি! আমি আমার স্বামীর কাছে যেতে চাই, যিনি দূরে আছেন।

তার কথা শুনে নারদ বললেনঃ “তুমি আমার বীণার হাতলে বস। আমি সেখানে এক মুহূর্তে পৌঁছে যাব।” এটা বলতে বলতে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন- সেই দেশে যেখানে মৃত ব্রাহ্মণটি ছিলেন। মুনি Avyaya কে বললেনঃ”যদি তুমি অগ্নিতে প্রবেশ করতে চাও, তবে কেঁদো না।হে কন্যা! যদি তুমি পরপুরুষ সম্ভোগের মত পাপ করে থাকো, তবে শুদ্ধ হবার জন্য এর প্রায়শ্চিত্ত করো। আগুনে প্রবেশের ফলে তোমার ছোটখাটো পাপ বিনষ্ট হয়ে যাবে।আগুনে প্রবেশ ছাড়া মহিলাদের সকল পাপ নিবারণের অন্যকোনো প্রায়শ্চিত্ত আমি দেখি না। 5/106/64-69A

নারীটি নারদকে জিজ্ঞেস করে, অগ্নিতে প্রবেশের সময় নারীদের কি কি করা উচিত?

উত্তরে নারদ বলেন,

তাদের স্নান করতে হবে, নিজেদের পবিত্র করতে হবে,অলঙ্কার পরতে হবে,চন্দনের প্রলেপ দিতে হবে,পুষ্প পরতে হবে, ধূপ, শস্য এবং পবিত্র চাল রাখতে হবে। তাদের একটি সুষম সূত্র পরিধান করতে হবে, পায়ে লাল লাক্ষা লাগাতে হবে।সাধ্য অনুসারে তারা উপহার দান করবে, তারা সম্মতি সূচক বাক্য উচ্চারণ করবে এবং তারা খুশি মুখে থাকবে। তাদের অনেক শুভ গান ও বাদ্যযন্ত্রধ্বনি শুনতে হবে। অবিশ্বস্ততার মত পাপ করে থাকলে , প্রায়শ্চিত্তের জন্য সেই পুরোনো পাপের কথা স্বীকার করতে হবে। তারপর তাদের গয়না পরিধান করতে হবে, এবং ব্রাহ্মণকে তা নিবেদন করতে হবে। অলঙ্কার না থাকলে তারা ব্রাহ্মণকে প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করতে বলতে পারবে না। অন্য কোনো ভাবে, অন্য কোথাও সেই পাপের স্খালন হতে পারে না।

যাইহোক, কিছু কথোপকথন ও ঘটনার পরে,

“ব্রাহ্মণটির দেহ পুড়িয়ে নারদ ব্রাহ্মণটির স্ত্রীকে বলেনঃ হে অভয়া, যাও অগ্নিতে প্রবেশ কর, যদি তোমার ইচ্ছা হয়। তারপর সতী নারীটি সাজগোজ করে, নারদকে ডানদিক থেকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে ,নমস্কার করে, নিজের মন গৌরিকে সমর্পণ করলেন। পার্বতীকে পৃথক ভাবে সন্তুষ্ট করার জন্য , তিনি নিজের সুষম সূত্র, হলুদ, পবিত্র শস্য,ফুল, বস্ত্র,চন্দন, চিরুনি, রকমারী ফল ইত্যাদি স্পর্শ করলেন। সতী নারীটি তিনবার দাউ দাউ করে আকাশ স্পর্শ করা অগ্নিকে তার ডানদিক থেকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং এই কথাগুলো বললেনঃ

হে ইন্দ্র, হে পৃথিবী মাতা, হে সূর্য, ধর্মের মত সকল দেবতা আমার কথা শুনুন, “ যদি বিবাহের দিন থেকে আজ অবধি দিনরাত্রি আমি বাক্য, মন ও কর্মের দ্বারা স্বামীর স্বামীর সেবা করে থাকি এবং যদি বাল্য, যৌবন ও বার্ধক্যে আমি আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে থাকি , তবে আমাকে আমার স্বামীর কাছে প্রেরণ করুন। এই কথা বলে তিনি তার হাতের ফুলটি ফেলে দিলেন এবং জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করলেন।তারপর তিনি সূর্যের মত চমৎকার একটি যান দেখলে যা স্বর্গীয় অপ্সরাদের সঙ্গীতে পূর্ণ ছিল। তিনি বিমানে আরোহন করলেন এবং স্বর্গে স্বামীর কাছে চলে গেলেন। তারপর যম সেই সতী নারীকে সম্মান জানিয়ে বললেন, তুমি স্বর্গে চিরকাল থাকবে। তোমার কোনো পাপ অবশিষ্ট নেই…” (Tr. N.A. Deshpande| Motilal Banarsi Dass Publication)

“রুক্মপুত্রি প্রদ্যুম্নের সাথে, ঊষা অনিরুদ্ধের সাথে আগুনে প্রবেশ করলেন। সকল যাদব নারীরা তাদের স্বামীর শরীরকে সম্মান জানালেন এবং আগুনে প্রবেশ করলেন।” Padma Purana VI.252.89-90  (Tr. N.A. Deshpande | Motilal Banarsi Dass Publication)

দেবীভাগবত পুরাণে সতীদাহ

“একসময় যৌবন ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ মাদ্রী একাকী এক নির্জন স্থানে ছিলেন। তাকে দেখে পাণ্ডু জড়িয়ে ধরেন এবং অভিশাপের কারণে মারা যান।যখন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিতা জ্বলছিল, তখন সতী মাদ্রী অগ্নিপ্রবেশ করেন এবং সতী হয়ে মারা যান।কুন্তিকে এমনটি করতে বারণ করা হয়েছিল, যেহেতু তার ছোট শিশুদের দেখাশোনা করার ছিল।”

(Devi Bhagabatam 6.25.35-50 | Translation: swami Vijanananda |Republished in 2008 by Forgotten Books)

“…তারপর সেই মুনিরা পাণ্ডুকে মৃত জানতে পেরে তাদের মৃতের সৎকারের অবশ্যকর্তব্য পালন করলেন। সেই সময়ে মাদ্রী কুন্তিকে তার দুই পুত্রের ভার অর্পণ করেন এবং তার স্বামীর সাথে সতী প্রথা পালন করে সত্যলোকে গমন করেন।”

( Devi Bhagavatam 2.6.53-71|Translation: swami Vijanananda |Republished in 2008 by Forgotten Books)
শিবপুরাণে সতীদাহ

“২০.যুবতী নারীটি তার স্বামীকে রাক্ষস দ্বারা বন্দি দেখে ভীত হয়ে পড়ে ন এবং তীব্র ক্রন্দনের সাথে তাকে অনুনয় করেন। ২১. বারবার আকুতি করা সত্ত্বেও নরখেকো নিষ্ঠুর রাক্ষসটি ব্রাহ্মণটির মাথা কেটে তাকে খেয়ে ফেলে।২২. এতে দুর্দশাগ্রস্ত, শোকার্ত পবিত্র নারীটি তীব্র বিলাপ করেন। তিনি তার স্বামীর হাড়গুলোকে জড়ো করেন এবং একটা চিতা প্রস্তুত করেন। ২৩. ব্রাহ্মণ নারীটি তার স্বামীর অনুগমনের জন্য চিতায় প্রবেশের বাসনা করলেন এবং রাক্ষস রাজাকে অভিশাপ দিলেন। ২৪. সতী নারীটি এটা বলার পরে অগ্নিপ্রবেশ করলেন- আজকের পর থেকে তুমি কোনো নারীর সাথে মিলিত হলে, মারা যাবে।”

(Siva puranam/Kotirudra samhita/10/20-24| Motilal BanarsiDas Publishers private limited)
শ্রীমদভাগবতে সতীদাহ

“তারপর তিনি কাঠে আগুন জ্বালিয়ে একটি চিতা প্রস্তুত করলেন এবং তার উপর তার স্বামীর মৃতদেহ স্থাপন করলেন। এই কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি তীব্রভাবে বিলাপ করলেন এবং স্বামীর সাথে আগুনে পুড়িয়ে নিজেকে মারার জন্য প্রস্তুত করলেন।” (srimadbhagbatam/4/28/50 Translation: Vaktivedanta swami Prabhupada |The Vaktivedanta Book Trust)

এই শ্লোকের ভাষ্যে প্রভুপাদ বলছেন,

“বিশ্বস্ত স্ত্রীর তার স্বামীর সাতে মারা যাওয়া বৈদিক ব্যবস্থার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য। একে সহমরণ বলা হয়। ভারতে এই প্রথা ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।সেই সময়, যাইহোক, মাঝে মাঝে যে স্ত্রী তার স্বামীর সাথে মরতে প্রস্তুত নয় তাকেও তার আত্মীয়েরা জোর করে তা করতে বাধ্য করতো। পূর্বে ব্যাপারটি এমন ছিল না। স্ত্রী স্বেচ্ছায় অগ্নিতে প্রবেশ করতেন। ব্রিটিশ সরকারকে এই প্রথাকে অমানবিক ভেবে রদ করেছিলেন। যাইহোক, ভারতের ইতিহাসের আদিকাল থেকে আমরা সন্ধান পাই, যখন মহারাজা পাণ্ডুর মৃত্যু হয় তখন তার দুই স্ত্রী বেঁচে ছিলেন, মাদ্রী এবং কুন্তি। প্রশ্ন ছিল, তারা উভয়ে মরবেন, না তাদের একজন মরবেন। মহারাজা পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার স্ত্রীরা স্থির করেন একজন বেঁচে থাকবেন এবং অপরজন সহমরণে যাবেন। মাদ্রী সহমরণে গেলেন এবং পাঁচ পাণ্ডব সন্তানদের দেখাশোনার জন্য কুন্তি বেঁচে থাকলেন। এমনকি ১৯৩৬ সালে আমরা অনুগত স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় তার স্বামীর সাথে আগুনে প্রবেশ করতে দেখেছি।এটি নির্দেশ করে যে একজন ভক্তের স্ত্রীকে এমন আচরণ করার জন্য প্রস্তুত করে রাখতে হবে।একইভাবে আধ্যাত্মিক গুরুর কোনো নিবেদিত শিষ্যের গুরুর লক্ষ্য সম্পাদনে ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে আধ্যাত্মিক গুরুর সাথে মরা ভালো। দেবত্বের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব যেমন ধর্ম সংস্থাপনের জন্যই পৃথিবীতে নেমে আসেন, তেমনি তার প্রতিনিধি, আধ্যাত্মিক গুরুও ধর্মসংস্থাপনের জন্য আসেন। আধ্যাত্মিক গুরুর লক্ষ্যের দায়িত্ব নেওয়া এবং তা সঠিকভাবে পালন করা শিষ্যের দায়িত্ব। অন্যথায়, শিষ্যের তার গুরুর সাথে মরা উচিত। অন্য কথায়, আধ্যাত্মিক গুরুর ইচ্ছা পূরণের জন্য ব্যক্তিগত চিন্তা পরিত্যাগ করে শিষ্যের জীবন দান করতেও প্রস্তুত থাকা উচিত।”

শ্রীমদভাগবতের ৯/৯/৩২ শ্লোক এর ভাষ্যে প্রভুপাদ বলছেন,

“বৈদিক সংস্কৃতিতে সতী বা সহমরণ বলে একটি ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে কোনো নারী তার স্বামীর সাথে মারা যায়। এই ব্যবস্থা অনুসারে, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী স্বেচ্ছায় তার স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে।এখানে, এই শ্লোকে এই সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত কথাগুলি ব্রাহ্মণের স্ত্রীর দ্বারা প্রকাশিত হল। স্বামী ছাড়া কোনো মহিলা মৃতদেহের মত। তাই বৈদিক সংস্কৃতি অনুসারে কোনো নারীর অবশ্যই বিয়ে দিতে হত। এটা তার পিতার দায়িত্ব। কোনো মেয়েকে দান করে দেওয়া যেত এবং স্বামীর একের অধিক স্ত্রী থাকতে পারতো , কিন্তু কোনো নারীর অবশ্যই বিয়ে দিতে হত।এটা বৈদিক সংস্কৃতি। একজন মহিলা সবসময় নির্ভরশীল (অধীন?) থাকবেন, বাল্যকালে পিতার উপর নির্ভরশীল থাকবেন, যৌবনে স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকবেনে এবং বার্ধক্যে জ্যেষ্ঠ সন্তানের উপর নির্ভরশীল থাকবেন। মনুসংহিতা অনুযায়ী, নারী কখনোই স্বাধীন থাকবেন না। মহিলাদের জন্য স্বাধীনতা মানে দুঃখজনক জীবন।আজকের যুগে, কত মেয়েরা অবিবাহিতা থাকে এবং নিজেদের স্বাধীন ভাবার ভ্রম করে, কিন্তু তাদের জীবন হয় দুঃখজনক। এখানে একটি ঘটনা দেখা যায়, যেখানে একজন মহিলা অনুভব করে, স্বামী ছাড়া তার জীবন মৃতদেহের সমান।”

শ্রীমদভাগবত ১/১৩/৫৮ তে, ধৃতরাষ্ট্রের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী গান্ধারী সহমৃতা হন-

“বাইরে যখন তার স্বামীকে রহস্যময় শক্তির আগুনে কুটির সহ জ্বলতে দেখবেন, তখন সতী স্ত্রী আত্মহারা হয়ে আগুনে প্রবেশ করবেন।”

প্রভুপাদ তার ভাষ্যে বলছেন,

“গান্ধারী ছিলেন একজন আদর্শ পবিত্র নারী, তার স্বামীর জীবনসঙ্গিনী, এবং এরপরে যখন তিনি দেখলেন তার স্বামী নিজের রহস্যময় যোগের আগুনে কুটির সহ জ্বলছেন, তিনি মরে গেলেন। একশ পুত্রকে হারানোর পরে তিনি ঘর ছেড়েছিলেন এবং জঙ্গলে তার সবচাইতে প্রিয় স্বামীকে পুড়তে দেখলেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে একাকী বোধ করলেন, তাই তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করলেন এবং মৃত্যুতেও স্বামীকে অনুসরণ করলেন। পবিত্র নারীর মৃত স্বামীর অগ্নিতে প্রবেশের নাম হল সতী প্রথা, এবং এই কাজটি কোনো নারীর জন্য সবচেয়ে যথাযথ বলে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীকালে এই প্রথা এক জঘন্য অপরাধ হয়ে পড়ে কারণ অনিচ্ছুক মহিলাদের উপরও এটা জোর করে চাপানো হচ্ছিল। বর্তমানের অধঃপতিত যুগে কোনো নারীর সতীপ্রথা পালন করা সম্ভব নয়, অতীতে যতটা পবিত্র ভাবে গান্ধারী এবং অন্যান্যরা করেছিলেন। গান্ধারীর মত সতী নারীর কাছে পতির থেকে আলাদা থাকা প্রকৃত অগ্নির চাইতেও জ্বালাময়। এরকম মহিলা স্বচ্ছায় সতীপ্রথা পালন করতে পারেন এবং এখানে কারোর কোনো অপরাধমূলক জোরাজুরি নেই। যখন এই প্রথা কেবল একটা ফর্মালিটি হয়ে উঠেছিল, তখন মহিলাদের এই নিয়ম পালন করতে বাধ্য করা হত, প্রকৃতপক্ষে এটা অপরাধমূলক হয়ে উঠেছিল এবং তাই আইনের দ্বারা এই অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়। নারদ মুনি তার ভবিষ্যদ্বাণীতে যুধিষ্ঠিরকে তার বিধবা মাসির কাছে (মূল ইংরেজি অনুবাদে aunt আছে) যেতে বারণ করেছিলেন।”

“এভাবে ব্রাহ্মণপত্নী রাজা সুদাস যিনি মিত্রসাহা নামে পরিচিত তাকে অভিশাপ দিলেন। তারপর, স্বামীকে অনুসরণ করার জন্য , স্বামীর হাড়গুলো একত্রিত করে তিনি তাতে আগুন ধরালেন এবং সেই আগুনে ঝাপ দিয়ে স্বামীর মতোই একই গতি প্রাপ্ত হলেন।“

(shrimadbhagabatam/9/9/36- translated by prabhupada)

স্কন্দ পুরাণে সতীদাহ

“এর পরেই রাজা Manojava ওই তীর্থের বলে তার দেহ ত্যাগ করে শিবলোকে গেলেন। হে ব্রাহ্মণেরা, তারপর তার স্ত্রী সুমিত্রা তার দেহকে আলিঙ্গন করে তার চিতায় আরোহণ করলেন। তিনিও (সুমিত্রা) একইলোক প্রাপ্ত হলেন।”

(Skanda Purana III.i.12.115-116 |Tr. G.V. Tagare|Motilal BanarsiDass Publication)

“৫৩.যে সতী নারী গৃহ থেকে শ্মশানে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য অবধি তার স্বামীর অনুসরণ করে, প্রতি ধাপে সে নিশ্চয় একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পূণ্য লাভ করে। ৫৪.সাপুড়ে যেমন জোর করে সাপকে গর্ত হতে বের করে আনে, তেমনি সতী নারীও তার স্বামীকে যমদূতের হাত থেকে রক্ষা করে আনে এবং স্বর্গভোগ করে। ৫৫-৫৮. সতী নারীকে দেখে যমদূত পালিয়ে যায়।সতী নারীর দ্যুতি দেখে সূর্যও জ্বালা বোধ করে, এমনকি আগুনও দগ্ধ হয়ে যায়, অন্যান্য আলোর উৎসও ভীত হয়ে ওঠে। একজন সতী নারী তার স্বামীর সাথে তত কোটি দশ হাজার বছর স্বর্গ ভোগ করে, যে সংখ্যক লোম তার শরীরে আছে।” (Skanda Purana III.ii.7.53-56| Motilal BanarsiDass Publication)

৩৮-৪১. তার স্ত্রী অনন্য বৈশিষ্ট্যের সাথে সুন্দরী ছিলেন। তিনি সতী ছিলেন এবং মহান গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি আনন্দের সাথে হাসতেন। তিনি দৃঢ় চিত্তের অধিকারী ছিলেন। যখন তার স্বামীকে হত্যা করা হল, তার অবস্থা করুণ হয়ে পড়ল। পতিবিচ্ছেদে তিনি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি ভয়ানক জংগলের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। সুন্দরী মহিলাটি জ্বালানি ও পাতা সংগ্রহ করে চিতা প্রস্তুত করে স্বামীর সাথে সেই চিতায় আরোহণ করলেন। এই কাজ করে তিনি মানসিক ভাবে তৃপ্তি পেয়েছিলেন।

(Skanda Purana V.i.53.38-41 |Motilal BanarsiDass Publication)

ব্রহ্ম পুরাণে সতীদাহ

ব্রহ্ম পুরাণে কপোত কপোতির উপাখ্যানে কপোত অগ্নিতে ঝাপ দিয়ে মারা গেলে, কপোতিকেও একই কাজ করতে দেখা যায় এবং কপোতির কথায় সহমরণের আদর্শ ফুটে ওঠে। খাঁচায় বদ্ধ কপোতি ব্যাধ লুব্ধককে বলে, “মহাশয়, দয়া করে আমাকে মুক্ত করে দিন। পতিবিহীন এই জীবনে আর কি প্রয়োজন? আমি এখনই এই অগ্নিতে দেহত্যাগ করবো।” ব্যাধ কপোতিকে মুক্ত করে দিলে কপোতি বলে, “সমস্ত অবস্থায় স্বামীর অনুগমন করাই স্ত্রী জাতির ধর্ম। বেদে এবং লোকসমাজে এই পথই প্রশস্ত বলে অভিহিত। পতিব্রতা নারী স্বামীর সাহায্যেই স্বর্গে গমন করে থাকে। যে নারী স্বামীর অনুগমন করে, সে বহুকাল পর্যন্ত স্বর্গে বাস করে।” তারপর সে যখন আগুনে প্রবেশ করল তখন আকাশে জয়ধ্বনি শোনা গেল। সেই পক্ষি দম্পতি সূর্যের মত উজ্জ্বল বিমানে স্বর্গে যেতে যেতে ব্যাধকে বলল- “মহাশয় আমরা দেবলোকে যাচ্ছি। এখন তোমার অনুমতি নিচ্ছি;কারণ তুমি আমাদের অতিথি। তোমার জন্যই আমাদের স্বর্গে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হল। তোমাকে আমরা নমস্কার করি।”

(ব্রহ্ম পুরাণ,৮০ তম অধ্যায় ,অনুবাদক-অন্নদাশঙ্কর পাহাড়ী)

হিন্দু ধর্মে ধর্ষণ

দেবগুরু বৃহস্পতি তার ভ্রাতৃবধূ মমতাকে ধর্ষণ করেন।

(কালিপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদিত মহাভারত / আদিপর্ব / চতুরধিক শততম অধ্যায় (১০৪ অধ্যায়))

সোম অথবা চন্দ্র দেবতা বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে ধর্ষণ করেছিলেন।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এই ঘটনাটি উল্লেখিত আছে –

“তারারে হরণ করে দেব শশধর।

তারাদেবী গর্ভবতী হয় অতঃপর।।

সগর্ভা তারারে হেরি গুরু বৃহস্পতি।

ভর্ৎসনা করিল তারে ক্রোধভরে অতি।।

লজ্জিত হইয়া তারা চন্দ্রে দিল শাপ।

শুন শুন চন্দ্র তুমি করিলে যে পাপ।।

কলঙ্কী হইবে তুমি তাহার কারণ।

তোমার দর্শনে পাপ হবে অনুক্ষণ।।“

(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/ কৃষ্ণ জন্ম খন্ড/৮০ অধ্যায়,অনুবাদক- সুবোধ চন্দ্র মজুমদার)

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অশ্বীনিকুমারের এক ব্রাহ্মণীকে ধর্ষণের ঘটনা উক্ত হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড/১০) বলা হয়েছে,

“শৌনক কহিলা সৌতি না পারি বুঝিতে

অশ্বীনিকুমার কেন রত ব্রাহ্মণীতে।।

সৌতি কহে মুনিবর দৈবের ঘটনা ।

ব্রাহ্মণী তীর্থেতে যায় অতি সুদর্শনা।।

পথশ্রমে ক্লান্ত অতি বিশ্রাম কারণ।

পশিল দেখিয়া এক নির্জন কানন।।

ব্রাহ্মণী বসিয়া আছে বিশ্রামের আশে।

অশ্বীনিকুমার দৈবযোগে তথা আসে।।

তাহারে দেখিয়ে পথে অশ্বীনিকুমার।

সৌন্দর্যবিমুগ্ধ মনে কাম জাগে তার।।

সুন্দরীর রূপ দেখি কাম জাগে মনে।

তাহারে ধরিতে যায় অতি সঙ্গোপনে।।

রূপবতী সতী নারী নিষেধ করিল।

কামার্ত অশ্বীনিপুত্র তাহা না শুনিল।।

নিকটেই মনোহর ছিল পুষ্পোদ্যান।

সবলে আনিয়া সেথা করে গর্ভাধান।।

লজ্জ্বা ভয়ে ব্রাহ্মণী সে গর্ভত্যাগ করে।

তখনি জন্মিল পুত্র ধরার উপরে।।“

(অনুবাদক- সুবোধ চন্দ্র মজুমদার)

বরুণ চন্দ্রের কণ্যা উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রাকে হরণ করেন-

” It so happened, however, that the handsome Varuna had, from a long time before, coveted the girl. Coming to the woods where Utathya dwelt Varuna stole away the girl when she had plunged into the Yamuna for a bath. Abducting her thus, the Lord of the waters took her to his own abode. That mansion was of wonderful aspect. It was adorned with six hundred thousand lakes. There is no mansion that can be regarded more beautiful than that palace of Varuna. It was adorned with many palaces and by the presence of diverse tribes of Apsaras and of diverse excellent articles of enjoyment. There, within that palace, the Lord of waters,
O king, sported with the damsel. A little while after, the fact of the ravishment of his wife was reported to Utathya. ( Mahabrahata/Anushasana Parva/  154, Translated by Pratap Chandra Roy)

সূর্য দেবতা কুন্তিকে ধর্ষণ করেন-

 ”…Surya Deva said :– “O Kunti! What for you called me, by virtue of the Mantra? Calling me, why do you not worship me, standing before you? O beautiful blue one! Seeing you, I have become passionate; so come to me. By means of the mantra, you have made me your subservient so take me for intercourse.” Hearing this, Kunti said:– “O Witness of all! O knower of Dharma! You know that I am a virgin girl. O Suvrata! I bow down to you; I am a family daughter; so do not speak ill to me.” Surya then said :– “If I go away in vain, I will be an object of great shame, and, no doubt, will be laughed amongst the gods; So, O Kunti! If you do not satisfy me, I will immediately curse you and the Brahmin who has given you this mantra. O Beautiful one! If you satisfy me, your virginity will remain; no body will come to know and there will be born a son to you, exactly like me.” Thus saying Surya Deva enjoyed the bashful Kunti, with her mind attracted towards him; He granted her the desired boons and went away. The beautiful Kunti became pregnant and began to remain in a house, under great secrecy. Only the dear nurse knew that; her mother or any other person was quite unaware of the fact. In time, a very beautiful son like the second Sun and Kartikeya, decked with a lovely Kavacha coat of mail and two ear-rings, was born there.” ( Devi Bhagavatam 2.6.13-35 Translated by-  Swami Vijnananda)

দেবরাজ ইন্দ্র গৌতম মুনির স্ত্রী অহল্যাকে ধর্ষণ করেন। ( বাল্মীকি রামায়ণ/ উত্তরকাণ্ড/ ৩০ সর্গ )

বিষ্ণু শঙ্খচূড়ের স্ত্রী তুলসীকে ধর্ষণ করেন-

“কবচ গ্রহণ করি বিষ্ণু অতঃপর।

তুলসীর নিকটেতে চলিলা সত্ত্বর।।

শঙ্খচূড় রূপে সেথা করিয়া গমন।

তুলসীর সতীধর্ম করিলা হরণ।।

না জানিলা দৈত্যপত্নী কি পাপ হইল।

দেবতা ছলনা করি সতীত্ব নাশিল।।

যেইক্ষেত্রে বিষ্ণুদেব করিলা রমণ।

তুলসী উদরে বীর্য হইল পতন।।

সেইক্ষণে মহাদেব দৈববাণী শোনে।

শঙ্খচূড়ে বধ তুমি করহ এক্ষণে।।“

(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ১৩৬ পৃষ্ঠা ,সুবোধচন্দ্র মজুমদারের অনুবাদ)

বিষ্ণু জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দাকে ধর্ষণ করেন। ( স্কন্দ পুরাণ / বিষ্ণুখণ্ড/ কার্ত্তিকমাসের মাহাত্ম্য কথন/ ২০-২১ অধ্যায় )

রাক্ষস বিবাহ

  • হিন্দু শাস্ত্রে আটপ্রকারের বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যথাঃ ব্রাহ্ম,দৈব,আর্য,প্রাজাপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ। (মনুসংহিতা ৩/২৩) 
  • “কন্যাপক্ষের লোকদের হত্যা করে,আহত করে কিংবা তাদের বাসস্থান আক্রমণ করে রোদনরত কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে যে বিবাহ তাকে রাক্ষস বিবাহ বলে। (মনুসংহিতা ৩/৩৩)
  • “… শেষ চারটি বিবাহ অর্থাৎ আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বৈধ”। (মনুসংহিতা ৩/২৩)

রাক্ষস বিবাহকে ধর্মজনক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে

  • “কিন্তু এই মানবশাস্ত্র মতে প্রাজাপত্য,আসুর,গান্ধর্ব,রাক্ষস ও পৈশাচ – এই পাঁচ প্রকারের বিবাহের মধ্যে প্রাজাপত্য,গান্ধর্ব ও রাক্ষস- এই তিনপ্রকার বিবাহ ধর্মজনক।“ (মনুসংহিতা ৩/২৫)
  • “ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব ও রাক্ষস বিবাহ পৃথক পৃথকভাবে অথবা মিশ্রিতভাবে যেভাবেই সম্পাদিত হোক না কেন, দুই প্রকার বিবাহই ধর্মজনক…” (মনুসংহিতা ৩/২৬)

কালিকা পুরাণে নরবলি, গরুবলি ও পশুবলি

বর্তমান যুগে নরবলির নাম শুনলেই বেশিরভাগ লোকেরা আঁতকে ওঠেন। নরবলির প্রথাটি পৃথিবীর অনেক আদিম সভ্যতাতেই প্রচলিত ছিল। হিন্দু ধর্মের নানা গ্রন্থে নরবলির বিধান রয়েছে, তবে আজকের আলোচনা কালিকা পুরাণে বর্ণিত নরবলি নিয়ে।

কালিকা পুরাণের ৫৫ ও ৬৭ এই দুই অধ্যায়ে পশুবলি ও নরবলির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এখানে দেবী

‘কালরাত্রিস্বরূপ, উগ্র মূর্তি,রক্তাস্য, রক্তনয়ন, রক্তমাল্যানুলেপনা, রক্তবস্ত্রধর,পাশহস্ত, সকুটুম্ব,রুধিরপায়ী, মাংসভোজী, কৃষ্ণ বর্ণ’। (৫৫/১৪-১৫)

পশুবলি

কালিকা পুরাণের ৫৫ তম অধ্যায়ের শুরুতে শিব বলছেন-

  • “ ভগবান বলিলেন, তাহার পর দেবীর প্রমোদজনক বলি প্রদান করিবে, কেননা শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে মোদক দ্বারা গণপতিকে, ঘৃত দ্বারা হরিকে, নিয়মিত গীত বাদ্য দ্বারা শঙ্করকে, এবং বলিদান দ্বারা চণ্ডিকাকে নিয়মিত সন্তুষ্ট করিবে।“ (৫৫/১-২)
    দেবী চণ্ডিকা যেহেতু বলি দ্বারাই সন্তুষ্ট হন, তাই এরপরেই বিভিন্ন রকমের বলির পশুর তালিকা দেওয়া হয়েছে-
    “১/ পক্ষী, ২/কচ্ছপ,৩/ কুম্ভীর, ৪/ নবপ্রকার মৃগ যথা- বরাহ, ছাগল, মহিষ, গোধা, শশক, বায়স, চমর, কৃষ্ণসার, শশ, ৫/ এবং সিংহ, মৎস্য, ৬/ স্বগাত্র রুধির, ৭/ এবং ইহাদিগের অভাবে হয় এবং ৮/ হস্তি এই আটপ্রকার বলি শাস্ত্রে নির্দিষ্ট হইয়াছে।“(৫৫/৩-৪)
    এছাড়াও কালিকা পুরাণের নানা স্থলে উপরোক্ত পশু ভিন্ন বিভিন্ন পশুর বলিপ্রদান করার কথাও রয়েছে। পশুবলি বিষয়ক শ্লোকগুলির পরপর উল্লেখ করা হল-
  • সাধক বলিকে বলেন, “তুমি শ্রেষ্ঠ জীব, আমার ভাগ্যে বলিরূপে উপস্থিত হইয়াছ, অতএব সর্ব স্বরূপ বলিরূপী তোমাকে আমি ভক্তিপূর্বক প্রণাম করি। (৫৫/৮)
  • বলিপ্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “ শর্করা, লবলী, নারংগক, ছাগল, মহিষ, মেষ, নিজের শোণিত, পক্ষী আদি পশু, নয় প্রকার মৃগ- এইসকল উপকরণ দ্বারা নিখিল জগতের ধাত্রী মহামায়ার পূজা করিবে, যাহাতে মাংস ও শোণিতের কর্দম হয়।“ (৫৫/৪৭-৫০)
    কালিকা পুরাণে শিব তার পুত্রদের বলির বিধানে বলছেন-
  • “ভগবান বলিলেন- হে পুত্রদ্বয়! বলিদানের ক্রম এবং স্বরূপ অর্থাৎ যে প্রকার রুধিরাদি দ্বারা দেবীর সম্পূর্ণ প্রীতি হয়,তোমাদিগের নিকট কীর্তন করিতেছি।“ (৬৭/১)
  • “মৎস্য ও কচ্ছপের রুধির দ্বারা শিবা দেবী নিয়ত এক মাস তৃপ্তি লাভ করেন এবং গ্রাহ্যদিগের রুধিরাদি দ্বারা তিন মাস তৃপ্তি লাভ করেন।“ (৬৭/৭)
  • “দেবী মৃগ ও মনুষ্য শোণিত দ্বারা আটমাস তৃপ্তি লাভ করেন এবং সর্বদা কল্যাণ প্রদান করেন।“ (৬৭/৮)
  • “গো এবং গোধিকার রুধিরে দেবীর সাংবাৎসরিক তৃপ্তি হয়।“ (৬৭/৯)
  • “কৃষ্ণসার এবং শূকরের রুধিরে দেবী দ্বাদশ বার্ষিকী তৃপ্তি লাভ করেন। “(৬৭/১০)
  • “অজ ও আবিক রুধিরে দেবীর পঞ্চবিংশতি বার্ষিকী এবং মহিষ শার্দূল এবং খড়গ রুধিরে দেবীর শতবার্ষিকী তৃপ্তি লাভ হয়।“ (৬৭/১১)
  • “সিংহ, শরভ এবং স্বীয় গাত্রের রুধিরে দেবী সহস্র বৎসর ব্যাপীয়া তৃপ্তি লাভ করেন।“ (৬৭/১২)
  • “যাহার রুধিরে যাবতকাল তৃপ্তির কথা হইয়াছে, মাংস দ্বারাও ততকাল তৃপ্তি লাভ হয়।“ (৬৭/১৩)
  • “কৃষ্ণসার মৃগ, গণ্ডার, রোহিত মৎস্য, যুগল বারধ্রীণস এই সকল বলি দানের পৃথক পৃথক ফল শ্রবণ কর।“ (৬৭/১৪)
  • “কৃষ্ণসার ও গণ্ডারের মাংসে চণ্ডিকা দেবী পঞ্চশত বর্ষ নিয়ত তৃপ্তি লাভ করেন।“ (৬৭/১৫)
  • “আমার পত্নী দুর্গা, রোহিত মৎস্যের মাংসে এবং বারধ্রিণসের মাংসে তিন শত বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন।“ (৬৭/১৬)
  • “কৃষ্ণসারের বলিদান সময়ে বক্ষ্যমান মন্ত্রের পাঠ করিবে। হে কৃষ্ণ সার ! তুমি ব্রহ্ম মূর্তি এবং ব্রহ্মতেজের পরিবর্ধনকারী।“(৬৭/৬৩)
  • “যে পূজায় গণ্ডার বলি প্রদত্ত হইবে, সেই স্থলে জল দ্বারা অভ্যুক্ষণ করিয়া গুহা হইয়াছে এইরূপ চিন্তা করত একটি মণ্ডল করিবে।“(৬৭/৬১)

গো-মহিষ বলি

কালিকা পুরাণে একটি বিষয় লক্ষ করা যায়, বিভিন্ন প্রকার বলির বিবরণে গোরু-মহিষও পড়ছে-

  • “ পক্ষী সকল, কচ্ছপ, গ্রাহ, মৎস্য, নয় প্রকার মৃগ, মহিষ, অজ, আবিক, গো, ছাগ, রুরু, শূকর,খড়গ, কৃষ্ণ সার, গোধিকা, শরভ, সিংহ, শার্দূল, মনুষ্য এবং স্বীয় গাত্রের রুধির , ইহারা চণ্ডিকা দেবী ও ভৈরবাদির বলিরূপে কীর্তিত হইয়াছে। (৬৭/৩-৫)
  • “যখন ভৈরবী দেবী অথবা ভৈরবীকে মহিষ বলি প্রদান করিবে তখন সেই বক্ষ্যমাণ মন্ত্র দ্বারা পূজা করিবে।“ (৬৭/৫৮)
  • “গো এবং গোধিকার রুধিরে দেবীর সাংবাৎসরিক তৃপ্তি হয়।“(৬৭/৯)
  • “অর্চনা দ্বারা অপরাপর মহিষ প্রভৃতির বলির শরীর বিশুদ্ধিলাভ করে, এই নিমিত্ত দেবী তাহা হইতে রক্ত গ্রহণ করেন।“ (৬৭/৯৬)
  • “সাধক মহিষ এবং মনুষ্যের রক্তের কিঞ্চিত অংশ মধ্যমা এবং অনামিকা দ্বারা উদ্ধৃত করিয়া মহাকৌশিক মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক পূর্ব হইতে নৈঋত কোণে পুতনাদি দেবতার উদ্দেশ্যে মৃত্তিকার উপর বলি প্রদান করিবে।“ (৬৭/১৪৬-১৪৭)
  • বলিপ্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “ শর্করা, লবলী, নারংগক, ছাগল, মহিষ, মেষ, নিজের শোণিত, পক্ষী আদি পশু, নয় প্রকার মৃগ- এইসকল উপকরণ দ্বারা নিখিল জগতের ধাত্রী মহামায়ার পূজা করিবে, যাহাতে মাংস ও শোণিতের কর্দম হয়।“ (৫৫/৪৭-৫০)
  • হে পুত্রদ্বয়! চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বিশেষ চতুর্দশী তিথিতে ছাগ মহিষ প্রভৃতি বলি মধু ও মৎস্য দ্বারা ভৈরবীরূপী আমাকে তুষ্ট করিবে; আমি ইহাতেই সন্তুষ্ট হইব। (৬৭/২০৩)

নরবলি

পশুবলির পাশাপাশি কালিকা পুরাণে নরবলিও দেখা যায়। নিচে নরবলি সংক্রান্ত শ্লোকগুলি উদ্ধৃত করা হল-

  • “ছাগল, শরভ এবং মনুষ্য ইহারা যথাক্রমে বলি, মহাবলি এবং অতিবলি নামে প্রসিদ্ধ।“ (৬৭/৫)
  • যথাবিধি প্রদত্ত একটি নরবলিতে দেবী সহস্র বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন, আর তিনটি নরবলিতে লক্ষ বছর তৃপ্তি লাভ করেন। (৬৭/১৯)
  • মনুষ্য মাংস দ্বারা কামাখ্যা দেবী এবং আমার রূপধারী ভৈরব তিন হাজার বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন। (৬৭/২০)
  • যেহেতু বলির মস্তক এবং মাংস দেবতার অত্যন্ত অভিষ্ট, এই হেতু পূজার সময় বলির শির এবং শোণিত দেবীকে দান করিবে। (৬৭/২১-২২)
  • বিচক্ষণ সাধক ভোজদ্রব্যের সহিত লোমশূণ্য মাংস দান করিবে এবং কখন কখন পূজাপকরণের সহিতও মাংস দান করিবে। (৬৭/২৩)
  • রক্তশূণ্য মস্তক অমৃত তুল্য পরিগণিত হয়।(৬৭/২৪)
  • নরপতি মনুষ্যের রক্ত মৃন্ময় অথবা তৈজস পাত্রে রাখিয়া সর্বদা উৎসর্গ করিয়া দিবে, পত্র নির্মিত দ্রোণাদিতে কখনোই দিবে না।(৬৭/৪৭)
  • এইরূপে পূজা করিয়া পূর্ব তন্ত্র দ্বারা বিধিপূরবক পূজা করিবে। নরবলি পূজিত হইয়া আমার স্বরূপ দিকপালগণ কর্তৃক অধিষ্ঠিত হয়। (৬৭/৯১)
  • এবং ব্রহ্মা প্রভৃতি অন্যান্য সকল দেবগণ কর্তৃক অধিষ্ঠিত হইয়া সেই বলিরূপ নর, পূর্বে পাপাচারী হইলেও নিষ্পাপ হইয়া যায়।(৬৭/৯২)
  • সেই পাপশুণ্য বলিরূপ নরের শোণিত অমৃত তুল্য হয়, উহাদ্বারা জগন্ময়ী জগন্মায়া মহাদেবী প্রীতিলাভ করেন। (৬৭/৯৩)
  • সেই বলিরূপী নর মনুষ্যদেহ পরিত্যাগ করিয়া মরিতে মরিতেই গণদিগের অধিপতি হইয়া আমার অধিক সৎকারের পাত্র হয়।(৬৭/৯৪)
  • এতদ্ব্যতীত অন্যপ্রকার পাপযুক্ত মলমূত্র ও বসাযুক্ত বলি কামাখ্যা দেবী নামমাত্রেও গ্রহণ করেন না। (৬৭/৯৫)
  • পশু-স্ত্রী, পক্ষিণী বিশেষত মনুষ্য স্ত্রীকে কখনোই বলিপ্রদান করিবে না। স্ত্রীকে বলিদান করিলে কর্তা নরকপ্রাপ্ত হয়। (৬৭/১০১)
    গণহারে নরবলির উল্লেখ আমরা নিচের শ্লোকে পাই-
  • যেখানে বিশেষ গণনা না করিয়া একেবারে দলে দলে বলি প্রদান করা হয় সেইস্থলে সমুদয় দল একেবারে অর্চিত করিয়া ভক্তি পূর্বক পশু পক্ষীর স্ত্রী এবং মানুষীকে বলি দিতে পারে। (৬৭/১০২)
  • “শত্রু ভূপতির পুত্র যদি যুদ্ধে বিজিত হয় , তাহা হইলে তাঁহাকে বলি দিতে পারে।“ (৬৭/১০৬-১০৭)
  • ‘মনুষ্যের মস্তকের রুধির দেবীর দক্ষিণদিকে নিবেদন করিবে, ছাগের শিরোরুধির বামদিকে এবং মহিষের শিরোরুধির সম্মুখে নিবেদন করিবে এবং পক্ষীগণের শিরোরুধির বামদিকে নিবেদন করিবে এবং শরীরের শোনিত সম্মুখে নিবেদন করিবে। ’ এরূপ বলা হয়েছে। (৬৭/১১২)
  • রাজপুত্র, অমাত্য, সচিব এবং সৌপ্তিকগণ রাজার সম্পত্তি ও বিভবের নিমিত্ত নরবলি প্রদান করিবে। (৬৭/১২২)
  • কোনোরূপ উপদ্রব উপস্থিত হইলে অথবা যুদ্ধকালে কোনো রাজসম্পর্কীয় পুরুষ ইচ্ছানুসারে মনুষ্যবলি প্রদান করিবে। (৬৭/১২৩)
  • সাধক মহিষ এবং মনুষ্যের রক্তের কিঞ্চিত অংশ মধ্যমা এবং অনামিকা দ্বারা উদ্ধৃত করিয়া মহাকৌশিক মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক পূর্ব হইতে নৈঋত কোণে পুতনাদি দেবতার উদ্দেশ্যে মৃত্তিকার উপর বলি প্রদান করিবে। (৬৭/১৪৬-১৪৭)
  • গণ্ড,ললাট,ভ্রুত মধ্যে করণাগ্র,বাহুদ্বয়,স্তনদ্বয়,উদর,কন্ঠের অধঃ ও নাভির ঊরধস্থিত যাবতীয় হৃদয় ভাগ এবং পার্শ্ব- এই সকল অঙ্গের রুধির দেবিকে দান করিবে। (৬৭/১৬৪-১৬৫)
  • মনুষ্য শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া ঐ রুধির নির্গত করিবার নিমিত্তেই অক্ষুব্ধ চিত্তে আপনার অঙ্গে স্বয়ং আঘাত করিয়া রুধির নির্গত করিয়া পদ্মপুষ্পের পাত্রে , কিংবা সৌবর্ণ পাত্রে অথবা কাংস্যপাত্রে সেই রুধির রাখিয়া পূর্বোক্ত মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক উহা দেবীকে দান করিবে। (৬৭/১৬৭-১৬৮)
  • ক্ষুর, ছুরিকা,খড়গ এবং শংকুল প্রভৃতি যতগুলি অস্ত্র আছে, ইহাদের মধ্যে যত বড় অস্ত্র দ্বারা শরীরে আঘাত করিবে ততই ফলপ্রাপ্ত হইবে।(৬৭/১৬৯)
  • একটি পদ্মফুলের পাপড়িতে যতটুকু রক্ত ধরিতে পারে, সাধক তাহার চারিভাগের অধিক রক্ত কখনোই দান করিবে না এবং একেবারে কোনো অঙ্গের ছেদ করিবে না।(৬৭/১৭০)
  • যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাবশত আপন হৃদয় জাত মাষ প্রমাণ অথবা তিল মুদগ প্রমাণ মাংস দেবীকে অর্পণ করে তাহার ছয় মাসের মধ্যে সমুদয় কামনা সিদ্ধ হয়। (৬৭/১৭১-১৭২)
  • যে সাধক স্নেহপাত্র না লইয়া বাহুদ্বয়, স্কন্ধদ্বয় এবং হৃদয়ে দ্বীপ বর্তী (সলিতা জ্বালিয়া) দেবীকে দান করে , ক্ষণমাত্র তাদৃশ দ্বীপদানের ফল শ্রবণ কর। (৬৭/১৭৩-১৭৪)
  • সে দেবী গৃহে কল্পত্রয় যথেচ্ছাক্রমে বিপুল ভোগ করিয়া পরে সার্বভৌম রাজা হইয়া জন্মগ্রহণ করিবে।(৬৭/ ১৭৫)
  • মহিষের ছিন্ন মস্তকে দ্বীপ জ্বালাইয়া , যে ব্যক্তি উহা হস্ত দ্বারা গ্রহণ করিয়া দেবীর সম্মুখে একটি সমস্ত দিন ও রাত্রি অবস্থান করে।(৬৭/১৭৬)
  • সে ইহলোকে চিরায়ু ও পবিত্রমূরতি হইয়া অখিল মনোরম বস্তু উপভোগ করিয়া অন্তে আমার গৃহে যাইয়া গণাধিপতি প্রাপ্ত হয়।(৬৭/ ১৭৭)
  • যদি সাধক দক্ষিণহস্তে মনুষ্যের মস্তক এবং বামহস্তে রুধিরপাত্র গ্রহণ করিয়া রাত্রিজাগরন করে।(৬৭/১৭৮)
  • তাহা হইলে সে ইহলোকে রাজা হয় এবং অন্তে আমার লোকে গমণ করত গণদিগের অধিপতি হয়।(৬৭/ ১৭৯)
  • যে সাধক বলিদিগের শিরোরক্ত করদ্বয়ে মাখাইয়া দেবীর সম্মুখে ধ্যানস্থ হইয়া অবস্থান করে।(৬৭/১৮০)
  • সে ব্যক্তি ইহলোকে সকল কামনার বস্তু লাভ করিয়া অন্তে দেবীলোকে সম্মানিত হয়।(৬৭/১৮১)
  • হে মহামায়ে ,আপনি জগতের কর্ত্রী এবং সর্ব কামারথ দায়িনী , আপনাকে এই নিজদেহের রুধির দান করিতেছি , আপনি আমার উপর প্রসন্ন হইয়া বর প্রদান করুন।(৬৭/১৮২)
  • এই কথা বলিয়া সিদ্ধ সান্নিভ বিচক্ষণ মানব প্রণাম পূর্বক স্বীয় গাত্রের রুধির প্রদান করিবে।(৬৭ /১৮৩)
  • ঈশ্বর-ভূতিলাভের নিমিত্ত যে সত্য রক্ষা করিয়া আমি আত্মমাংস দান করিতেছি, হে দেবী, সেই সত্য রক্ষা করিয়া তুমি আমাকে নির্বাণ দান কর। হূঁ হূঁ নমঃ নমঃ পণ্ডিত সাধক এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া আপনার মাংস দান করিবে।(৬৭/১৮৪-১৮৫)

কামাখ্যায় নরবলি

কামরূপ কামাখ্যায় নরবলি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় কালিকা পুরাণ থেকে-

  • পীঠ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে যে, নিত্য শ্মশ্মানে বলি প্রদান করিবে। ঐ শ্মশ্মান শব্দে হেরুকনামক শ্মশান, উহা কামাখ্যা দেবীর আবাস শৈলে অবস্থিত। ইহা পূর্বে তন্ত্রের আদিতে বিধিবত প্রতিপাদিত হইয়াছে। (৬৭/৭২-৭৩)
  • ঐ শ্মশান আমার স্বরূপ। উহা ভৈরব নামেও অভিহিত হয়। ঐ শ্মশান তপঃসিদ্ধির নিমিত্ত ত্রিভাগে কল্পিত হইয়াছে।(৬৭/ ৭৪)
  • উহার পূরবাংগ ভৈরব নামে প্রসিদ্ধ, তাহাতে তপস্যা করিলে সদ্য সিদ্ধি লাভ হয়, সে বিষয়য়ে কোনো সন্দেহ নাই। উহার দক্ষিণাংগে
  • ভৈরবীদেবীকে মুণ্ডমালার সহিত মস্তক প্রদান করিবে এবং হেরুক নামক পশ্চিমাংগে রুধির প্রদান করিবে। (৬৭/ ৭৫-৭৬)
  • মনুষ্য বলিকে অর্চন ,দান এবং আগমন ক্রমে পীঠস্থানের শ্মশান ভূমিতে বিসর্জন করিয়া বলদীপক প্রজ্বলিত করিবে। (৬৭/৭৭)
  • এইরূপে যেইখানে মহাবলি প্রদত্ত হইবে, সেইস্থলেই সাধক একস্থানে উৎসর্গ ,একস্থানে ছেদন করিবে এবং অন্যস্থলে মস্তক এবং অন্যস্থলে রুধির প্রদান করিবে। (৬৭/৭৮)
  • আর একবার বিসর্জন করিয়া পুণরায় আর তাহার দিকে অবলোকন করিবে না। (৬৭/৭৯)
  • সুস্নাত,দীপ্ত, পূর্ব দিনে হবিষ্যাশী, মাংস , মৈথুন এবং ভোগ বর্জিত, মালা এবং চন্দন দ্বারা অলঙ্কৃত মনুষ্যকে উত্তরমুখ করিয়া তাহার অবয়ব নিচয়ে দেবতাসকলের পূজা করিবে এবং তাঁহাকে দেবতার সহিত অভিন্ন জ্ঞান করিয়া তাহার পূজা করিবে।(৬৭/ ৮০-৮১)
  • ব্রহ্মরন্ধ্রে ব্রহ্মার পূজা করিবে, নাসিকায় পৃথিবীর পূজা করিবে, কর্ণ দ্বয়ে শক্তি এবং আকাশের পূজা করিবে, জিহবাতে অগ্নির,নেত্রে জ্যোতির, বদনে বিষ্ণুর,ললাটে আমার, দক্ষিণ গণ্ডে ইন্দ্রের, বাম গণ্ডে বহ্নির, গ্রীবায় সমবর্তীর , কেশাগ্রে নিঋতির , ভ্রুদ্বয়ের মধ্যে বরুণের, নাসিকামূলে পবনের,
  • স্কন্দে ধনেশ্বরের এবং হৃদয়ে সর্প রাজের পূজা করিয়া বক্ষ্যমান মন্ত্র পাঠ করিবে। (৬৭/৮২-৮৫)
  • হে মহাভাগ নরশ্রেষ্ট! তুমি সর্ব দেবময় এবং উত্তম, তুমি পুত্র, পশু ও বান্ধবের সহিত শরণাপন্ন আমাকে রক্ষা কর। (৬৭/৮৬)
  • মৃত্যু যখন অপরিহার্য তখন তুমি প্রাণত্যাগ কর, এবং পুত্র, অমাত্য ও বন্ধু বর্গের সহিত আমাকে রক্ষা কর।(৬৭/৮৭)
  • তোমার প্রসাদে রাক্ষস, পিশাচ, বেতালগণ,সরিসৃপগণ , নৃপগণ, রিপুগণ এবং অন্যান্য হিংস্রগণ যেন আমাকে বিনাশ করিতে অক্ষম হয়। (৬৭/৮৯)
  • মরণ যখন অপরিহার্য তখন তুমি পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়া স্বীয় কণ্ঠনাল হইতে গলিত এবং অঙ্গ লগ্ন শোণিতধারা দ্বারা তৃপ্তি লাভ কর।(৬৭/ ৯০)

রক্ত উৎসর্গ

বলির রক্ত যেভাবে দেবীকে উৎসর্গ করা হত-

  • আপনার বিভব অনুসারে রুধির দানের নিমিত্ত সৌবর্ণ, রাজত, তাম্র, বেত্রপাত্রের দোনা, মৃন্ময় খর্পর, কাংস্য অথবা যজ্ঞীয় কাষ্ঠ নির্মিত একটি পাত্র করিবে। (৬৭/৪৪)
  • লৌহপাত্রে, বল্কলে, পিত্তলপাত্রে, রংগের পাত্রে অথবা কাচ পাত্রে কিংবা স্রুক বা স্রুবে বলিদিগের রুধির দান করিবে না। (৬৭/৪৫)
  • ঐশ্বর্যবিলশী মনুষ্য ঘটে, মাটির উপর,ক্ষুদ্র পান পাত্রে রুধির দান করিবে না। (৬৭/৪৬)
  • অর্চনা দ্বারা অপরাপর মহিষ প্রভৃতির বলির শরীর বিশুদ্ধিলাভ করে, এই নিমিত্ত দেবী তাহা হইতে রক্ত গ্রহণ করেন।(৬৭/৯৬)
  • নরপতি মনুষ্যের রক্ত মৃন্ময় অথবা তৈজস পাত্রে রাখিয়া সর্বদা উৎসর্গ করিয়া দিবে, পত্র নির্মিত দ্রোণাদিতে কখনোই দিবে না। (৬৭/৪৭)
  • মাংসভূক পশু ও পক্ষীগণের এবং সর্ব প্রকার জলজ জীবগণের মস্তক ও রুধির বাম পার্শে রাখিয়া নিবেদন করিবে। (৬৭/১১৩)
  • কৃষ্ণসার, কূর্ম, গণ্ডার, শশক, কুম্ভীর এবং মৎস্য ইহাদিগের রুধির সম্মুখে রাখিয়াই নিবেদন করিবে।(৬৭/ ১১৪)
  • সিংহের রুধির এবং গণ্ডারের রুধির দক্ষিণের রাখিয়া নিবেদন করিবে। দেবতার প্রিষ্ট দেশে কোনো বলির শিরোরুধির দান করিবে না। নৈবদ্য দক্ষিণে, বামে,অথবা সম্মুখে রাখিয়া নিবেদন করিতে পার, কিন্তু কখনো প্রিষ্টদেশে নৈবদ্য রাখিবে না। (৬৭/১১৫)
  • ঐশ্বর্য বিলাশী মনুষ্য ঘটে,মাটির উপর, ক্ষুদ্র পানপাত্রে রুধির দান করিবে না। (৬৭/৫৯)

বলির মুণ্ডু কোনোদিকে পড়লে যে ফল হয়

পশুবলি বা নরবলি দেওয়ারসময় বলির ছিন্ন মস্তক কোনোদিকে পড়লে যেরূপ ফল লাভ হয় সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে-

  • ছিন্ন মনুষ্য এবং পশু প্রভৃতির মস্তক যে যে স্থানে পতিত হইয়া শুভ বা অশুভ হয় তা শ্রবণ কর। (৬৭/১৩০)
    মনুষ্যের ছিন্নশির ইশানকোণে বা নৈঋত কোণে পতিত হইলে রাজ্যহানি এবং রাজার বিনাশ সাধন করে। (৬৭/১৩১)
    হে ভৈরব! পূর্ব ,আগ্নেয়, দক্ষিণ, পশ্চিম এবং বায়ুকোণে ঐ ছিন্ন মস্তক পতিত হইলে যথাক্রমে লক্ষ্মী, পুষ্টি,ভর, লাভ, পুত্র লাভ এবং ধন উৎপাদন করে। (৬৭/১৩২)
  • হে ভৈরব! ছিন্ন মহিষের মস্তক উত্তরদিক হইতে এক এক করিয়া বায়ুকোণ অবধি পতিত হইলে যথাক্রমে যে যে ফল লাভ হয় তাহা শ্রবণ কর। ভোগ্য, হানি , ঐশ্বর্য , বিত্ত, রিপুজয়, ভয়, রাজ্যলাভ এবং শ্রী । (৬৭/১৩৩-১৩৪)
  • জলজ এবং অণ্ডজ ভিন্ন ছাগ আদি নিখিল পশুর মস্তক পতনে দিক অনুসারে ঐরূপ ফল লাভ হয় জানিবে। (৬৭/১৩৫)
  • জলজ এবং পক্ষীদিগের ছিন্ন মস্তক দক্ষিণে ও অগ্নিকোণে পতিত হইলে ভয় এবং অন্যদিকে পতিত হইলে শ্রীলাভ হয়। (৬৭/১৩৬)
  • মনুষ্য,পশু, পক্ষী ও কুম্ভিরাদির মস্তক ছিন্ন হইলে যদি দাঁতের কট কট শব্দ হয় তাহা হইলে রোগ উৎপন্ন হয়। (৬৭/১৩৭)
  • যদি মস্তক ছেদ হইবার পর চক্ষু হইতে মল নির্গত হয় , তাহা হইলে যে রাজ্যে এই ঘটনা হয় ঐ রাজ্যের হানি হয়। (৬৭/১৩৮)
  • মহিষের মস্তক ছিন্ন এবং পতিত হইলে যদি নেত্র হইলে লোতক নির্গত হয় , তাহা হইলে প্রতিদ্বন্দি রাজার মৃত্যু হয়। (৬৭/১৩৯)
  • অপরাপর বলি পশু প্রভৃতির মস্তক হইতে নির্গত লোতক অতিশয় ভয় এবং পীড়ার সূচনা করে। (৬৭/১৪০)
  • যদি নরবলির ছিন্নশির হাস্য করে , তাহা হইলে শত্রুর বিনাশ হয় এবং বলিদাতার সর্বদা লক্ষ্মী ও পরমায়ু বৃদ্ধি হয়, সেই বিষয়ে কোনো সংশয় নাই। (৬৭/১৪১)
  • নরবলির ছিন্ন মস্তক যে যে বাক্য উচ্চারণ করে, তাহা অচিরকালেই সফল হয় এবং হুঙ্কার করিলে রাজ্যের হানি হয় এবং শ্লেষ্মস্রাব করিলে কর্তার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়। (৬৭/১৪২)
  • যদি ছিন্ন মস্তক দেবতাদিগের নাম কীর্তন করে, তাহা হইলে বলিদাতা ছয়মাসের মধ্যেই অতুল বিস্তৃতি লাভ করে। (৬৭/১৪৩)
  • রুধির দানকালে যদি ছিন্ন শরীরের উরধ বা অধোভাগ হইতে বিষ্ঠা বা মূত্র নির্গত হয় তাহা হইলে বলিদাতার নিশ্চয় মৃত্যু হয়। (৬৭/১৪৪)
  • ছিন্নদেহ বামপাদের আক্ষেপ করিলে মহারোগ উৎপন্ন হয় এবং অপর চরণের আক্ষেপে কল্যাণ লাভ হয়। (৬৭/১৪৫)

বলির পদ্ধতি

বলির পদ্ধতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে-

  • বলি দেয়ার আগে “হে খরগ তোমার নাম অসি, বিশসন, তীক্ষ্ণধার, দুরাসন, শ্রীগরভ, বিজয় এবং ধর্ম পাল, তোমাকে নমস্কার করি।“ (৫৫/১৬) এরূপ বলে তারপরে ‘আ, হ্রিং, ফট এইমন্ত্র দ্বারা খরগকে পূজা করিয়া সেই বিমল খরগ গ্রহণ করিয়া বলিচ্ছেদ’ করা হত। (৫৫/১৭)
    তারপরে “ছিন্ন বলির রুধির জল, সৈন্ধব, সুস্বাদু ফল,মধু, গন্ধ ও পুষ্পের দ্বারা সুবাসিত করিয়া ওঁ, ঐঁ, হ্রীঁ, শ্রীঁ কৌশিকি এই রুধির দ্বারা প্রীতিলাভ কর, এই মন্ত্র বলিয়া যথাস্থানে রুধির নিক্ষেপ করিয়া ছিন্ন মস্তকের উপর প্রদীপ জ্বালাইয়া” রাখতে হত এবং , ‘এইরূপে সাধক বলির পূর্ণ ফল প্রাপ্ত’ হত। (৫৫/১৮-২০)
  • চন্দ্রহাস বা কর্ত্রী দ্বারা বলিচ্ছেদ করাই প্রশস্ত বলিয়া গণ্য হইয়াছে, দাত্র, অসি, ধেনু, করাত বা শংকুল দ্বারা বলিচ্ছেদ মধ্যম এবং ক্ষুর, ক্ষুরপ্র এবং ভল্ল দ্বারা বলিচ্ছেদ অধম বলিয়া কথিত হইয়াছে। (৬৬/২৬)
  • এতদ্ভিন্ন শক্তি বা বাণ প্রভৃতির দ্বারা কখনোই বলিচ্ছেদ কর্তব্য নয়। বলিদানে যেসকল অস্ত্র উক্ত হইয়াছে , তদ্ভিন্ন অস্ত্র দ্বারা বলিচ্ছেদ করিলে দেবী উহা ভোজন করেন না এবং বলিদানকরতা শীঘ্রই মৃত্যু প্রাপ্ত হয়।(৬৭/২৭)
  • যে সাধক প্রোক্ষিত পশু বা পক্ষীকে হস্ত দ্বারা ছেদ করে, সে অতি দুঃসহ ব্রহ্মহত্যা প্রাপ্ত হয়। (৬৭/২৮)
  • বিচক্ষণ সাধক খড়গকে মন্ত্র দ্বারা আমন্ত্রিত না করিয়া কখনোই বলিযোগ করিবেন না। (৬৭/২৯)

বলিতে অথবা যজ্ঞে বধ, বধ নয়

হিন্দুদের বিভিন্ন শাস্ত্রেই উক্ত হয়েছে যজ্ঞে প্রাণী হত্যা কোনো হত্যা নয় অর্থাৎ এটা কোনোপ্রকার হিংসাই নয়। এইজন্য যজ্ঞকে অহিংস বলা হত। বলা হত ঈশ্বর বলির জন্যই পশুদের সৃষ্টি করেছেন। কালিকা পুরাণেও এমনই বলা আছে-

  • ব্রহ্মা স্বয়ং যজ্ঞের নিমিত্ত সকল প্রকার বলির সৃষ্টি করিয়াছেন, এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বধ করি, এই জন্যে যজ্ঞে পশুবধ হিংসার মধ্যে গণ্য নয়। (৫৫/১০)
  • স্বয়ম্ভূ স্বয়ং যজ্ঞের নিমিত্ত পশুসকল সৃজন করিয়াছেন, এই নিমিত্ত অদ্য তোমার বধ করি। কারণ যজ্ঞে বধ অবধের সমান। (৬৭/৪১)

বলির উদ্দেশ্য

বিভিন্ন ধরণের বিপদ হতে মুক্তি, ভয়ানক জীবজন্তু হতে আত্মরক্ষা, ধন, যশ, রাজ্যলাভ,রোগমুক্তি,ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে পশুবলি ও নরবলি অনুষ্ঠিত হত, কালিকা পুরাণ থেকে এমনটাই জানা যায়। এই বলির বর্ণনায় কোথাও কোথায় জাদু বিশ্বাসের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। নিচে কালিকা পুরাণে উল্লেখিত বলির উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হল-

  • “বলি দ্বারা মুক্তি সাধিত হয়, বলি দ্বারা স্বর্গ সাধিত হয় এবং বলিদান দ্বারা নৃপতি গণ শত্রু নৃপতি গণকে পরাজয় করিয়া থাকেন।“ (৬৭/৬)
  • “তোমার প্রসাদে রাক্ষস, পিশাচ, বেতালগণ,সরিসৃপগণ , নৃপগণ, রিপুগণ এবং অন্যান্য হিংস্রগণ যেন আমাকে বিনাশ করিতে অক্ষম হয়।“ (৬৭/৮৯)
  • “ঐশ্বর্য বিলাশী মনুষ্য ঘটে,মাটির উপর, ক্ষুদ্র পানপাত্রে রুধির দান করিবে না।“ (৬৭/৫৯)
  • যে সাধক বলিদিগের শিরোরক্ত করদ্বয়ে মাখাইয়া দেবীর সম্মুখে ধ্যানস্থ হইয়া অবস্থান করে।(৬৭/১৮০)
  • সে ব্যক্তি ইহলোকে সকল কামনার বস্তু লাভ করিয়া অন্তে দেবীলোকে সম্মানিত হয়।(৬৭/১৮১)
  • যে সাধক স্নেহপাত্র না লইয়া বাহুদ্বয়, স্কন্ধদ্বয় এবং হৃদয়ে দ্বীপ বর্তী (সলিতা জ্বালিয়া) দেবীকে দান করে , ক্ষণমাত্র তাদৃশ দ্বীপদানের ফল শ্রবণ কর। (৬৭/১৭৩-১৭৪)
  • সে দেবী গৃহে কল্পত্রয় যথেচ্ছাক্রমে বিপুল ভোগ করিয়া পরে সার্বভৌম রাজা হইয়া জন্মগ্রহণ করিবে।(৬৭/ ১৭৫)
  • মহিষের ছিন্ন মস্তকে দ্বীপ জ্বালাইয়া , যে ব্যক্তি উহা হস্ত দ্বারা গ্রহণ করিয়া দেবীর সম্মুখে একটি সমস্ত দিন ও রাত্রি অবস্থান করে।(৬৭/১৭৬)
  • সে ইহলোকে চিরায়ু ও পবিত্রমূরতি হইয়া অখিল মনোরম বস্তু উপভোগ করিয়া অন্তে আমার গৃহে যাইয়া গণাধিপতি প্রাপ্ত হয়।(৬৭/ ১৭৭)
  • যদি সাধক দক্ষিণহস্তে মনুষ্যের মস্তক এবং বামহস্তে রুধিরপাত্র গ্রহণ করিয়া রাত্রিজাগরন করে।(৬৭/১৭৮)
  • তাহা হইলে সে ইহলোকে রাজা হয় এবং অন্তে আমার লোকে গমণ করত গণদিগের অধিপতি হয়।(৬৭/ ১৭৯)
  • যে সাধক বলিদিগের শিরোরক্ত করদ্বয়ে মাখাইয়া দেবীর সম্মুখে ধ্যানস্থ হইয়া অবস্থান করে।(৬৭/১৮০)
  • সে ব্যক্তি ইহলোকে সকল কামনার বস্তু লাভ করিয়া অন্তে দেবীলোকে সম্মানিত হয়।(৬৭/১৮১)

এই বলির পিছনে যে একপ্রকার জাদুবিশ্বাস কাজ করতো, তা নিম্নোক্ত শ্লোক সমূহ থেকে সহজেই বোঝা যায়-

  • যখন যখন শত্রুর বৃদ্ধি দেখিবে, তখন তখন তাহার ক্ষয় কামনা করিয়া অপরের শিরচ্ছেদ করিয়া বলিপ্রদান করিবে। (৬৭/১৫৪)
    ঐ বলিরূপ পশুতে শত্রুর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিবে, ঐ বলির ক্ষয় হইলে শত্রুর বিপদ হয়। (৬৭/১৫৫)
  • ‘বিরুদ্ধ রূপিনী চণ্ডিকে। বৈরিণং ত্বং খাদয়স্ব স্বাহা!” এই মন্ত্রের নাম খড়গ মন্ত্র। এই সেই আমার বৈরি যে সর্বদা আমার উপর দ্বেষ করে; হে মহামারি এক্ষণে পশুরূপধারী উহাকে বিনাশ কর। (৬৭/১৫৬-১৫৭)
  • ‘স্ফে স্ফে খাদয় খাদয়’ এই মন্ত্র পাঠ করিয়া সেই বলির মস্তকে পুষ্পদান করিবে। তদনন্তর তাহার রুধির দ্ব্যক্ষর মন্ত্র দ্বারা উৎসর্গ করিয়া দিবে। (৬৭/১৫৮)
  • যব চূর্ণ ময় অথবা মৃন্ময় শত্রুর প্রতিক্রিতি করিয়া যথোক্ত মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক তাহার শিরচ্ছেদন করিয়া বলিপ্রদান করিবে।(৬৭/১৮৭-১৮৮)
  • ……………… রাজা প্রথমে খরগকে আমন্ত্রিত করিয়া শত্রুকে বলি প্রদান করিবে অথবা মহিষ বা ছাগকে শত্রু নামে আমন্ত্রিত করিয়া বলি প্রদান করিবে। (৬৭/১৪৯-১৫২)

কালিকা পুরাণের ডাউনলোড লিংক