নাটকঃ শয়তানের জবানবন্দি

Print Friendly, PDF & Email

মূলঃ আরজ আলী মাতুব্বর। সম্পাদনা ও চিত্রনাট্যঃ আসিফ মহিউদ্দীন

সম্পাদকের কথা

আরজ আলী মাতুব্বরের শয়তানের জবানবন্দী যখন প্রথম পড়ি, সেই সময়েই মনে হয়েছিল, পুরো ঘটনাটি যেন আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম। চলচ্চিত্রে যেভাবে দেখি, ঠিক সেভাবেই যেন সবকিছু চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। সেই থেকে এই গল্পটিকে নাটক বা সিনেমা রূপে দেখার একটি সুপ্ত ইচ্ছা মনে দানা বেঁধেছিল। পরে অনেক সময় চলে যায়, কাউকে এমন পেলাম না যে, এই গল্পটির একটি চিত্রনাট্য তৈরি করবেন। এরকম একটি মাস্টারপিস নিয়ে নাটক সিনেমা তৈরি হতে পারতো। কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র খুবই সীমিত, তাই সেরকম কিছুই হয়নি। কেউ হয়তো সাহসই করবে না, কারণ সবারই ভয় আছে। তাই অন্য কারো জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই লিখে ফেললাম, একটি চিত্রনাট্য। যদিও আমি জীবনে চিত্রনাট্য লিখিনি, তাই এই বিষয়ে আমি নিতান্তই অপরিপক্ক। তারপরেও, চেষ্টা করলাম। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ এই নাটকটি মঞ্চায়ন করার সাহস করবেন, এই প্রত্যাশা নিয়ে। উল্লেখ্য, এই চিত্রনাট্য কোথাও ব্যবহার করতে হলে আমার অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া এই লেখাটি অনুগ্রহ করে ব্যবহার করবেন না।

প্রস্তাবনা

মানব সভ্যতায় গল্পের সূচনা যেদিন থেকে হলো, সেই দিন থেকেই একটি খল বা দুষ্টু চরিত্রের প্রয়োজন দেখা দিলো। একটি গল্পকে পূর্ণতা দিতে একটি খলচরিত্রের কোন বিকল্প নেই। মূলত সুপ্রাচীনকাল ধরেই দুঃখ দুর্দশা হতাশা আর জীবনের নানা জটিলতায় আক্রান্ত মানুষ একজন সুপারহিরো কিংবা মহান ক্যারিশমাটিক নেতা অথবা একজন ত্রাণকর্তার স্বপ্ন দেখে। তাকে নিয়ে গল্প কবিতা গান রচনা করে, যিনি আবির্ভূত হয়ে তাদের রক্ষা করবেন। এটি মানুষের অন্যতম আদিম এক চাওয়া। এই নিয়ে মানুষ যুগে যুগে লক্ষ লক্ষ গল্প সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সেই গল্পটি সুন্দর করতে, আকর্ষণীয় করতে সবসময়ই দরকার হয় একজন জাঁদরেল খলনায়কের। যেই খলনায়ক অত্যন্ত খারাপ চরিত্র, যার কারণে মানুষের নানা দুর্দশা। যাকে সকল সমস্যার জন্য দায়ী এবং দোষী সাব্যস্ত করে অন্যরা দায় এড়াতে পারে। যেই খলনায়ক সমানে সমানে নায়কের সাথে যুদ্ধ করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত যেন নায়কের জয় হয়। মানুষের দুঃখদুর্দশার অবসান হয়। এরকম একজন খলনায়ক ছাড়া কোন গল্পই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। একটি গল্পে কাউকে না কাউকে সকল সমস্যার জন্য দায়ী করা খুবই জরুরি। একজন ভাল গল্পকারের অবশ্যই তাই গল্পে একজন খলনায়ক রাখতে হয়, এবং শেষে খলনায়কের পরাজয় ঘটাতে হয়। নায়ক যেন নায়িকাকে অথবা অসহায় মানুষকে উদ্ধার করে, সেইদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।

বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন জাতিতে বিভিন্ন ভাষায় এই পর্যন্ত যত খল বা দুষ্টু চরিত্র তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে সম্ভবত সবচাইতে বৈচিত্র্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি পৌরাণিক চরিত্র হচ্ছে ইবলিশ বা শয়তান। এত হাজার হাজার ভাষায় এই চরিত্রটি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রূপে রয়েছে, যা অন্য আর কোন চরিত্রের ক্ষেত্রে সম্ভবত ঘটেনি। কোন গল্পের চরিত্র বা ঘটনাকে পর্যালোচনা করতে গেলে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, সেটি হচ্ছে সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া, সকলের সাথে ইনসাফ করা। রামায়ণের লেখক রাবণকে যত কুৎসিতভাবেই চিত্রিত করুক না কেন, রাবণ আসলে তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মেধাবী এবং প্রজ্ঞাবান, তা রামায়ণের লেখক ঠিকই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। দশ মাথার রাবণ তো আসলে দশ মাথার মত বুদ্ধিমান মানুষেরই প্রতীক। দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলিমদের মধ্যে তাদের গ্রন্থে লিখিত এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র, শয়তান- তাঁর কোন বক্তব্য ফুটিয়ে তোলা হয় না। ধর্মগ্রন্থগুলোতে একপেশে ভাবে এবং শয়তানকে দোষারোপ করে সকল বক্তব্য দেয়া হয়। ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটিও শয়তানকে কোন ধর্মগ্রন্থেই দেয়া হয়নি। আমাদের নাটকটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই পৌরাণিক গল্পটিতে শয়তানের চরিত্রটিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ করে দেয়া, এবং একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। যেন কারো সাথেই অন্যায় না হয়, এমনকি শয়তান চরিত্রটির সাথেও যেন ইনসাফ হয়। কারণ আমরা যদি শয়তানের সাথে ইনসাফ করতে না পারি, তাকে তাঁর কথা বলার সুযোগ না দিই, তাহলে আমাদের ভেতরকার শয়তানই তো জয়ী হবে। তাই আজ আমরা কাল্পনিকভাবে শয়তানকে বলতে দেবো, শয়তানের না বলা কথাগুলো। তাঁর আত্মকথা। তাঁর না বলা স্মৃতি। তাঁর সবকিছু।

এই গল্পের মূল লেখক আরজ আলী মাতুব্বর, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে শুরু করছি।

মধ্যদুপুর

বৈশাখ মাসের মধ্যদুপুর, আকাশ পরিষ্কার। গ্রামের বৈঠকখানায় বসে আছেন আরজ আলী। বৈঠকঘরের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছেন, গরমে উনার ঘুম আসছে না। বৈঠকখানার দেয়ালে একপাশে সক্রেটিস, এপিকুরাস আর গৌতম বুদ্ধের ছবি, অন্যপাশে ডারউইন, ইবনে খালদুন আর আইনস্টাইনের ছবি। বিছানার পাশে একটি টেবিল, টেবিলের ওপর সাজানো রয়েছে অনেকগুলো বই। কোরআন, বাইবেল, ভগবতগীতা, ত্রিপিটক একসাথে রাখা। আরেক তাকে ইমানুয়েল কান্টের Critique of Pure Reason, বার্ট্রান্ড রাসেলের ক্রিটিক অফ ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি, সোফির জগত, বুখারী মুসলিমের হাদিস এবং আরো কিছু বই।

আগন্তুক

দৃশ্য -০১
স্থানঃ আরজ আলীর কুঁড়েঘর
সময়ঃ দুপুর
চরিত্রঃ আরজ আলী, আগন্তুক
ঘটনাঃ আরজ আলী শুয়ে আছেন, শুয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে। তার ঘরে জানালা দিয়ে রোদ পড়ছে। একজন বুজুর্গ আলেম চেহারার আগন্তুকের আগমন। 

দৃশ্যের শুরু। আরজ আলী দূর থেকে দেখতে পেলেন একজন আগন্তুক দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এক সম্ভ্রান্ত সৌম্য বুজুর্গ ব্যক্তি। পরনে সাদা পাজামা, গায়ে সাদা জুব্বা, মাথায় (লেজওয়ালা) সাদা পাগড়ী এবং বুক ভরা সাদা দাড়ি, সুঠাম সুডৌল তেজোদীপ্ত তীক্ষ্ম চেহারা। তাঁর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে আনন্দ ও বুদ্ধির জ্যোতি। চোখ দেখলে মনে হয়, অন্তরাত্মা পর্যন্ত তিনি পড়ে নিচ্ছেন। আরজ আলী জীবনে এমন মানুষ কখনো দেখেননি। কোনরূপ সংকোচহীন, আবেগ-উৎকণ্ঠাহীন, শান্ত এক চেহারা। যেন সদ্যই হিমালয় পর্বতের চুড়া থেকে শত বছর ধ্যান করে নেমে এসেছেন। এই ঘরটিতে যে তিনি প্রথমবার আসলেন, প্রথমবার আসায় একজন মানুষের স্বাভাবিক যে এদিক সেদিক তাকানোর প্রয়াস থাকে, সেগুলো কিছুই নেই। যেন চিরচেনা এক ঘরেই তিনি প্রবেশ করেছেন। মনে হচ্ছে, এখানকার পথঘাট, গাছপালা ও ঘরবাড়ি যেন তার হাতের রেখার মত চেনা। বহু বছর তিনি এখানে ছিলেন।

আরজ আলী বিছানা থেকে উঠে বসলেন।

আরজ আলীঃ (হতচকিত কণ্ঠে) আসসালামু ওয়ালাইকুম!

আগন্তুকঃ ওয়া-আলাইকুমুস সালাম ওয়া-রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

আরজ আলীঃ জনাব কি আমার কাছে এসেছেন?

আগন্তুকঃ জ্বি হ্যাঁ, আপনার কাছেই এসেছি।

আরজ আলীঃ (চেয়ার এগিয়ে দিয়ে) বসুন জনাব। তশরিফ রাখুন।

আগন্তুকঃ (চেয়ারে বসতে বসতে। একবারও ঘরের চেয়ার টেবিল আসবাবপত্রের দিকে কোন দৃষ্টি না দিয়ে। যেন সবকিছু তার অনেক চেনা।) আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ জনাব। গরমে একদম ঘেমে গেছেন দেখছি।

আরজ আলীঃ ও কিছু নয়। আজকাল ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না, গরমে খুব কষ্ট পাই। তা জনাবের পরিচয়?

আগন্তুকঃ (খুব ঠাণ্ডা এবং একদৃষ্টে চোখের দিকে তাকিয়ে) আমার পরিচয় জানতে চান? আমাকে আপনি জানেন।

আরজ আলীঃ কিন্তু জনাব, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, আপনাকে কীভাবে চিনি।

আগন্তুকঃ আমার পরিচয় আপনি ভালো করেই জানেন। আর আপনি একাই নন, আমার পরিচয় সকল মানুষই জানে এবং ভালোভাবেই জানে।

আরজ আলীঃ কিন্তু জনাব, আমি তো ঠিক মনে করতে পারছি না। যদি অনুগ্রহ করে বলতেন, আপনি কে?

আগন্তুকঃ মনে থাকার কথা নয়। আপনি আমাকে জানেন বটে, তবে চেনেন না। কারণ আজ পর্যন্ত আপনি কেন, আমাকে কেউই দেখেনি। যদিও পৃথিবীর জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সবখানে আমার অবাধ গতি। আমি সকল মানুষের সাথেই মেলামেশা করতে চাই, চাই ভালোবাসা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার সাথে কেউ মেলামেশা করতে চায় না।

আরজ আলীঃ মেলামেশা করতে চাইবো না কেন? আপনি তো সজ্জন মানুষই মনে হচ্ছে।

আগন্তুকঃ কারণ বলছি। তার আগে আমি কে সেটি বলে নিই। বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন ভাষায় আমাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। কেউ বলে প্রমিথিউস, কেউ বা বলে আযাযিল, কেউ বলে আনঘা মাইনু , কেউ বলে আহরিমান, অনেকে বলে সেদিম বা দিয়াবল।

আরজ আলীঃ মানে? এগুলো তো সবই প্রাচীনকালের পৌরাণিক চরিত্র। আপনি বলতে চান আপনি একজন পৌরাণিক চরিত্র? আপনার পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?

আগন্তুকঃ জন্মসূত্রে আমার নাম মকরম। প্রথম জীবনে ছিলাম জ্বীন। পরে লক্ষ লক্ষ বছর আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে হয়েছিলাম আল্লাহর ফেরেশতা বাহিনীর সর্দার। সময়ের পরিক্রমায় হয়েছি ইবলিশ এবং হাল নাম শয়তান।

আগন্তুকের নামটি শুনে আরজ আলী খানিকটা বোকার মত হাসতে লাগলেন। (মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এই লোক নির্ঘাত ফাজলামি করতে এসেছেন। ইবলিশ শয়তান মানুষের রূপ ধরে তার কাছে কেন আসবে? কিন্তু এত বয়ঃবৃদ্ধ একজন মানুষ, তার সাথে ভরদুপুরে কেন ফাজলামি করবেন?)

আরজ আলীঃ (উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে) জনাব, ভরদুপুরে এসব ফাজলামি আসলে ভাল লাগছে না। আপনার কোন সাহায্য দরকার হলে বলুন, কিন্তু আমি নিজেও হতদরিদ্র মানুষ। বিশেষ কোন সাহায্য করা সম্ভব নয়। কোন কিছু বিক্রি করতে চাইলে, সেক্ষেত্রেও আপনি ভুল জায়গাতে এসেছেন। আমার সাবান শ্যাম্পু কিছুই প্রয়োজন নেই। আমি নিতান্তই একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষ।

আগন্তুকঃ (মুচকি হেসে) আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনার কাছ থেকে আমি কিছুই চাইতে আসিনি। শুধু কিছুটা সময় চাচ্ছি। আমি জানি, আপনার সেই সময়টুকু আছে। সে কারণেই আসা। হয়তো, আপনি মনে মনে যেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন, সেগুলোর উত্তর পেয়ে যাবেন।

আরজ আলীর মৌনভাব দেখে আগন্তুক যেন তার মনের কথা সমস্তই বুঝতে পারলেন এবং অনর্গল বলে যেতে লাগলেন,

আগন্তুকঃ যে কোন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে মুরব্বি বলা হয় এবং তাবৎ মানুষ জাতির মধ্যেই মুরব্বি ব্যক্তি সম্মানের পাত্র। মানুষের মধ্যে কারো কোনো মুরব্বি ব্যক্তির বয়সের জ্যেষ্ঠতা সচরাচর দশ-বিশ কিংবা পঞ্চাশ-ষাট বছর, কদাচিৎ একশ’। কিন্তু আপনাদের আদি পিতা আদম যখন সৃষ্ট হন, আমি তখন বেশ সেয়ানা এবং আজো বেঁচে আছি। সুতরাং বয়সের হিসাবে শুধু আপনারই নয়, আমি সমস্ত মানুষ জাতির মুরুব্বী।

আরজ আলীঃ ভরদুপুরে এসব কী বলছেন জনাব? আপনি কি কোন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত? আপনার এসব এলোমেলো কথাবার্তা থেকে কিন্তু এমনই মনে হচ্ছে।

আগন্তুকঃ এলোমেলো কথা বলছি না জনাব। আপনার মনে অনেক প্রশ্ন দানা বেঁধে আছে। সেই জট খোলার চেষ্টা করছি। শুনুন, এরপরে আমার কথাগুলো ভেবে দেখুন। হয়তো অনেক জট খুলে যাবে।

আরজ আলীঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি মানব জাতির প্রধান শত্রু সেই বিখ্যাত ইবলিশ? মানুষের রূপে আজ আমার মত একজন মানুষের সাথে খোশগল্প করতে এসেছেন?

আগন্তুকঃ জ্বি, আমিই সেই। আপনাদের শিরায় শিয়ায় যার বসবাস [1]। যার জীবন আল্লাহর, মরণ আল্লাহর। যার জান্নাত জাহান্নাম সবই আল্লাহর নামে সঁপে দেয়া। আমিই সেই সত্ত্বা, যার ভয়ে নবীরাসুলগণ পর্যন্ত ভীত ছিল। এই পৃথিবীর সবকিছু আমারই কর্মের ফলাফল।

আরজ আলীঃ কি বলছেন এসব! আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম!

ইবলিশের তাওহীদ

দৃশ্য -০২
স্থানঃ আরজ আলীর কুড়েঘর
সময়ঃ দুপুর
চরিত্রঃ আরজ আলী, আগন্তুক
ঘটনাঃ আরজ আলী মৃদু হাসছেন, তবে চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ। আগন্তুকের চেহারায় আত্মবিশ্বাস আর খানিকটা অহংকার।

আরজ আলীঃ আপনার কথা শুনে আগ্রহ বোধ করছি, যদিও বিশ্বাস করছি না। আপনি কি চা বা কফি কিছু খাবেন?

আগন্তুকঃ জ্বি না জনাব। ওসব কিছুরই আমার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু আমার কথাগুলো বলতে এসেছি।

আরজ আলীঃ হ্যাঁ, আপনি বলুন। আমি মনোযোগ দিয়েই শুনছি।

আগন্তুকঃ আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম ফেরেশতা বানিয়েছেন, পরে জ্বীন বানিয়েছেন এবং সর্বশেষে বানিয়েছেন আদমকে। ইসায়ীরা সৃষ্টিকর্তাকে পিতা বলেই সম্বোধন করে। কাজেই একই ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে আদমকে আমার ভাইও বলতে পারি, তবে বয়সে কনিষ্ঠ। আপনাদের সমাজে বা মানব সমাজে কারো ছোট ভাইকে সিজদা করবার রীতি আছে কি? হয়তো নেই। তা হলে আদমকে সিজদা না করে আমি নীতিবহির্ভূত কাজ করিনি। তাছাড়া আল্লাহ স্বয়ং নিজ মুখে নির্দেশ দিয়েছেন ফেরেশতাদের সিজদা করতে। আমি তো ফেরেশতা ছিলাম না। আল্লাহ বলেছেন [2]

আর যখন আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। অতঃপর তারা সিজদা করল, ইবলিশ ছাড়া। সে ছিল জ্বীনদের একজন। 

আরজ আলীঃ কিন্তু আল্লাহ তো পরের এই আয়াতেই বলেছেন, আপনি নির্দেশ অমান্য করেছেন। এই আয়াতে আসলে আল্লাহ উপস্থিত সকলকেই বুঝিয়েছেন। বিভিন্ন ভাষায় এরকম শব্দের ব্যবহার আছে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, অথচ সবাইকেই বোঝানো হয়। একে তাগ্লীব বলা হয়।

আগন্তুকঃ এ ধরণের শব্দগত ত্রুটি বিচ্যুতি মানুষের ক্ষেত্রে মেনে নেয়া যায়, কারণ মানুষের জ্ঞান ও ভাষা সীমাবদ্ধ। তাই সাধারণ আলাপচারিতায় এই ধরণের ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও অনেক সময় আমরা বক্তার মূল ভাবটি বুঝে নিই। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে কীভাবে মেনে নিচ্ছেন? যেই গ্রন্থটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির বহু আগে স্বয়ং আল্লাহ পাক লিখে রেখেছেন [3], দাবী অনুসারে এটি নির্ভুল এবং বিস্তারিতভাবে [4] [5] বর্ণিত, সেটিতে এরকম ত্রুটি থাকে কীভাবে? ব্যাপারটি তো অন্যরকমও হতে পারে, তাই না? একটার পর একটা সূত্র মিলিয়ে দেখেছেন? খুব সহজেই তিনি কোরআনে লিখতে পারতেন, আমি উপস্থিত সকলকে সিজদা করতে আদেশ করলাম। সেটি না বলে তিনি বললেন, আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম। একটি শব্দের ব্যবহারেই তো পুরো নির্দেশনার অর্থ বদলে যেতে পারে।

আরজ আলীঃ আপনি ছোটখাট ভাষাগত ভুলত্রুটি ধরে এখন মূল বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। আল্লাহ আপনাকে সহই সিজদা করতে বলেছিলেন, এটাই তো পুরো বিবরণটি পড়লে বোঝা যায়।

আগন্তুকঃ তাহলে কোরআনে আল্লাহ একই আয়াতে পরের বাক্যে কেন বললেন, সে ছিল জ্বীনদের একজন? ভাবুন তো, আল্লাহ জান্নাত জাহান্নাম সৃষ্টি করলেন, এরপরে কেনই বা শুধু ফেরেশতাদের সিজদা করতে বলবেন? একজন পথভ্রষ্টকারী ছাড়া তিনি জাহান্নাম ভর্তি করতেন কী দিয়ে [6] ? আর এখানে তার নির্দেশ অমান্য কোথায় হলো? তাহলে আল্লাহরই উচিত ছিল ঠিকভাবে নির্দেশনাটি দেয়ার। উনি নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে এরকম ভুলভ্রান্তি করার ব্যক্তি তো নন। ধরুন, আপনার ৪ জন ছেলে আর ১ জন মেয়ে আছে। আপনি একটি কেক এনে বললেন, ছেলেরা, এক টুকরো করে নাও। আসলে আপনি ছেলেমেয়ে সবাইকেই বুঝিয়েছেন। একজন মানুষের এরকম ছোটখাট ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর নয়। তারপরেও তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, এখানে আপনি ছেলে বলতে সবাইকে কেক নিতে বলেছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও মেয়েটির তো এই বিষয়ে আপত্তির সুযোগ থাকে, তাই না? যে কেন তাকে কেক নেয়ার কথা আপনি বলেননি। আপনার কথা শুনে সে কেক না নিলে, তাকে তো আপনি দোষারোপ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, আপনার বক্তব্যটিই সঠিক ছিল না। আপনারই উচিত ছিল ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের কথাই বলা।

আরজ আলীঃ আপনি অতি সামান্য একটি শব্দ নিয়ে শব্দের খেলা করছেন। চালাকি করছেন।

আগন্তুকঃ এক্ষেত্রেও আল্লাহ সবচাইতে বড় চালাক [7]। কোরআনেই তা বলা আছে, তার সাথে চালাকি করে সুবিধা করা যায় না। আল্লাহর চালাকিটুকু আপনি ধরতে পারেননি। আল্লাহর হুকুম ছিল ফেরেশতাগণ সিজদা করবে। সেটিই কিন্তু বাস্তবায়ন হলো। অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম তামিল হলো। আল্লাহর কথার বরখেলাপ হলো না। আর একইসাথে, আমি জ্বীন হওয়ায় সিজদা করলাম না, এতে আল্লাহর মহাপরিকল্পনারও বাস্তবায়ন হলো। মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ প্রতিটি বস্তুর তাকদীর লিখে রেখেছেন [3]। আমার তাকদীরও তো লিখিত [8]। আমার জান্নাত জাহান্নামও তো পূর্বেই নির্ধারিত। আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন, সেটিই বাস্তবায়ন হলো, আর আল্লাহর এই হুকুমও বাস্তবায়ন হলো। আল্লাহ তো আমার তাকদীর না জেনে শুধুমাত্র ফেরেশতাদের সিজদা করতে বলেননি। আমার তাকদীর আমার জন্মের বহু আগেই নির্ধারিত [9]

আরজ আলীঃ এগুলো আপনার শয়তানি ব্যাখ্যা, আমাকে ইমানহারা করার কৌশল। আমার কথা হচ্ছে, আপনি অহংকারী। জন্মসূত্রে তো কেউ সম্মানের দিক দিয়ে ছোট বড় হতে পারে না। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তার কাছে তাকওয়া হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। বয়সে কে ছোট কে বড়, কার জন্ম কোথায়, তা দিয়ে কি আসে যায়? আমরাও একটি প্রবচন সর্বদাই বলে থাকি, জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল। তাহলে আদম মাটির তৈরি কিংবা আপনার পরে জন্মেছে বলে তাকে সিজদা করবেন না?

আগন্তুকঃ জন্মসূত্রে কেউ যদি বড় ছোট না হয়, আমার জন্ম কীভাবে তা যদি বিবেচ্য না হয়, আমার কর্মই যদি আল্লাহর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে আমি আদমের চাইতে বহুগুন শ্রেষ্ঠ ছিলাম। আমার ইবাদত ফেরেশতাদেরও অধিক। ইবাদত আর আল্লাহ প্রেমে আমি ছিলাম ফেরেশতাদের নেতা।

আরজ আলীঃ কিন্তু আল্লাহ তো মানুষকে তার খলিফা নির্বাচিত করেছিলেন। আল্লাহর খলিফাকে সিজদা করা তো আপনার কর্তব্য ছিল।

আগন্তুকঃ নির্বাচিত করেছিলেন কি আদমের কোনো কর্মের ভিত্তিতে, নাকি আল্লাহর ইচ্ছে অনুসারে? জন্ম দ্বারা যদি শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ না-ই হয়, আদম কীভাবে জন্মের আগে আল্লাহর খলিফা নির্বাচিত হলেন [10]? কোন কর্ম ছাড়াই?

আরজ আলীঃ আপনি বারবারই ভুল বলছেন। আল্লাহ সেই শুরুতেই একটি পরীক্ষা নেন। সেই পরীক্ষায় প্রতিটি বস্তুর নাম জিজ্ঞেস করা হয়। আদম ছাড়া আর কেউই সেই পরীক্ষায় ভাল করতে পারেনি।

আগন্তুকঃ এটি আপনি জেনে থাকলে আপনি নিশ্চয়ই এটিও জানেন যে, আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পরে প্রতিটি বস্তুর নাম শিক্ষা দেন। এরপরে সবাইকে ডেকে প্রতিটি বস্তুর নাম জিজ্ঞেস করেন। স্বাভাবিকভাবেই, আদম বাদে কেউই বস্তুগুলোর নাম বলতে পারেনি। কীভাবে পারবে, আল্লাহ তো শুধু আদমকেই শিক্ষা দিয়েছেন [11]। সেখানে আদমের কৃতিত্ব কোথায়? ধরুন আপনি একটি স্কুলের শিক্ষক, সেখানে একজন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াবার সময় সব শেখান। অন্য ছাত্ররা প্রাইভেট পড়ে না, স্কুলের ক্লাসেও আপনি তাদের শেখান না। এখন আপনার কাছে প্রাইভেট পড়া ছাত্রটি পরীক্ষায় প্রথম হলে, সেখানে সেই ছাত্রটির কৃতিত্ব কতটুকু? সেই সময়ে ফেরেশতাদের উত্তর কী ছিল, আপনার স্মরণ আছে? ফেরেশতারা বলেছিল,

আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই।

আরজ আলীঃ আল্লাহ তো বিশেষ উদ্দেশ্যেই আদমকে বিশেষ কুদরতে সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লাহ পাক বলেছেন, তিনি জ্বীন জাতি এবং মানুষ জাতিকে তার ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছেন [12]

আগন্তুকঃ সেই বিশেষ উদ্দেশ্য যে ইবাদত, তা কি আপনি নিশ্চিতভাবে জানেন? ফেরেশতারাই তো যথেষ্ট ছিল, আল্লাহর ইবাদতের জন্য। আল্লাহ চাইলে আরো কোটি কোটি ফেরেশতা বানিয়ে তার উপাসনা করাতে পারতেন। সেখানে আলাদাভাবে মানুষের সৃষ্টি কেন? মানুষকেই বা আশরাফুল মাখলুকাত বলে ঘোষণা করা কেন? মানুষকে আলাদাভাবে সৃষ্টির কারণই তো, আল্লাহ চান না যে, রোবটের মত কিছু বুদ্ধিহীন যন্ত্র তার আদেশ পালন করুক। বরঞ্চ আল্লাহ চেয়েছেন, তার বিশেষ এই সৃষ্টি নিজের জ্ঞান ব্যবহার করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখুক। নইলে আদমকে সৃষ্টির পরে তাকে শিক্ষাদীক্ষা দেয়ার প্রয়োজন কেন হলো [13] [14]?

আরজ আলীঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন গায়েবে অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়, মানবিক সীমাবদ্ধ জ্ঞান বুদ্ধির ব্যবহার করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে? কিন্তু আল্লাহ তো বলেছেন আল্লাহ জ্বীন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তার ইবাদতের উদ্দেশ্যে।

আগন্তুকঃ পৃথিবীটি মানুষের জন্য পরীক্ষাকেন্দ্র, কথাটির গুঢ় অর্থ আপনি আজও বোঝেননি জনাব। অনেক সময় পিতা তার সন্তানদের মুখে এক কথা বলেন, অন্তরে চান সন্তান সেই কাজটি না করুক। যেমন ধরুন, আল্লাহ পিতাকে স্বপ্নাদেশ দিলো যে, প্রিয়তম বস্তু নিজ পুত্রকে হত্যা করো। অথচ আল্লাহর ইচ্ছে এটি নয় যে, পিতা আসলেই নিস্পাপ সন্তানকে হত্যা করবে। শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য হুকুমটি দেয়া। বলুন তো ঘটনাটি পরিচিত মনে হচ্ছে কিনা?

আরজ আলীঃ হ্যাঁ, এটি নবী ইব্রাহীমের কাহিনী।

আগন্তুকঃ তার মানে আল্লাহ মাঝে মাঝে এমন কাজের নির্দেশনা দিতে পারেন, যেটি আসলেই ঘটুক তিনি তা চান না। শুধু পরীক্ষার জন্য তিনি এরকম নির্দেশ মাঝে মাঝে দেন, তাইতো? পিতাকে যে অন্তর দিয়ে ভালবাসে, সে-ই পিতার অন্তরের গোপন কথাটি বোঝে। আর যে পিতার কাছ থেকে খেলনা উপহার পাওয়ার জন্য পিতাকে খুশি করতে চায়, সে পিতার অন্তরের খবর নেয় না। সে অন্ধভাবে পিতার আদেশ পালন করে খেলনাটি পেতে চায়। পিতার মনে কী আছে সে সেটি টের পায় না। আদম বা মানুষকে সৃষ্টির অর্থই হচ্ছে, আল্লাহ অন্ধভাবে তার হুকুম পালনকারীদের দ্বারা কোটি কোটি বছর এভাবে উপাসনা পেতে ভাল বোধ করেননি। তিনি অন্তরে চেয়েছেন, তার আদেশ অন্ধভাবে না পালন করে মানুষ জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বিচার বিবেচনা করুক। সেটিই যদি হয়, তাহলে আমি আল্লাহর আদেশের বিপরীতে নিজের বিচার বুদ্ধি ব্যবহার করে অপরাধ করেছি, নাকি আল্লাহর সুপ্ত ইচ্ছাটির বাস্তবায়ন করেছি? যেই ইচ্ছেটি হচ্ছে, তার বান্দা অন্ধভাবে তার আদেশ না মেনে বিচার বুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেক।

আরজ আলীঃ অনেক সুফীবাদী এই ধরণের কথা বলে বটে। তবে আমাদের দিনশেষে কোরআন এবং হাদিসের কাছেই ফিরে যেতে হবে। কারণ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল সেভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে চললেই আমাদের জান্নাত প্রাপ্তি হবে। এত জটিল যুক্তিতর্ক আসলে প্রকৃত মোমিনের কাছে কোন অর্থই বহন করে না। ইসলামের মূল বিষয় হচ্ছে ইমান।

আগন্তুকঃ অর্থ বহন না করুক, আমার কথা মানতেও তো বলছি না। শুধু শুনতে বলছি। শুনলেই যে মানতে হবে, এমন তো নয়। বলুন তো, আল্লাহর উদ্দেশ্য যদি মানুষের ইবাদত পাওয়াই হয়ে থাকে, এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি?

আরজ আলীঃ আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আপনি আল্লাহকে ইবাদত পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন? কিন্তু আল্লাহ তো বলেছেন আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন।

আগন্তুকঃ অবশ্যই সাহায্য করি। কিন্তু সে কথায় পরে আসছি। মুখাপেক্ষী না হলে তার ইবাদত পাওয়ার আকাঙ্খা থাকতো না। কোন আকাঙ্খা থাকাটিই মুখাপেক্ষীতার প্রমাণ বহন করে। আপনার গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা পাওয়ার আকাঙ্খা রয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে আপনি নানা বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। অমুখাপেক্ষী সত্ত্বার কোন আকাঙ্খা থাকে না।

আরজ আলীঃ হাহ হা হা, এখন আবার বলছেন আল্লাহ কোরআনে আমাদের মিথ্যা বলেছেন? তিনি আমাদের প্রার্থনার আকাঙ্খা করেন, অর্থাৎ তিনি আমাদের মুখাপেক্ষী? আপনি তো আল্লাহর আদেশের লঙ্ঘন করেছিলেন। নিজের দোষ ঢাকার জন্য এখন আল্লাহকে মিথ্যাবাদী বানাচ্ছেন?

আগন্তুকঃ আল্লাহ সবসময় সত্য বলেন নাকি মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মিথ্যাও বলেন, সেই বিষয়ে পরে আসছি। হ্যাঁ, আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘনের বিষয়ে আপনি ঠিক বলেছেন। আদমকে সিজদা না করা ছিল আল্লাহতালার মৌখিক আদেশের লঙ্ঘন। কিন্তু আদেশ যিনি করেছেন, তা লঙ্ঘন করার শক্তিও তিনিই দান করেছেন। জগতে কারো এমন কোনো শক্তি নেই, যে সে শক্তি দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাশক্তিকে পরাস্ত করে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কার্যকরী করতে পারে। কোরআনেও বলা আছে, আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন [15]

আরজ আলীঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার কোন ইচ্ছের স্বাধীনতা ছিল না?

আগন্তুকঃ আমি বলছি না। আল্লাহই বলেছেন, কোন সৃষ্টি এমন কোন ইচ্ছে করতেই পারে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তার জন্য সেটি ইচ্ছে করেন। এর অর্থ কী?

আরজ আলীঃ এগুলো কাফেরদের বানানো কথা। এর অর্থ আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া বান্দার নিজস্ব কোন ইচ্ছে নেই? কিন্তু এর তো আরো অনেক অর্থ হতে পারে।

আগন্তুকঃ তা পারে। কিন্তু কোরআনে যা সরাসরিই বলা আছে, তা অস্বীকার করবেন কীভাবে? আমি আরো অনেকভাবেই আমার কথার প্রমাণ দিতে পারবো। ধীরে ধীরে বলছি। ধৈর্য্য ধারণ করুন, কারণ আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের ভালবাসেন। আল্লাহ জানতেন যে, আমি তাঁর হুকুমে আদমকে সিজদা করবো না। তিনি এটিও জানতেন যে, আদম তাঁর নিষেধ মেনে নিষিদ্ধ ফল খাওয়া ত্যাগ করবে না। নইলে জান্নাতের বাগানে এরকম একটি নিষিদ্ধ ফল তাদের সম্মুখে রাখবারই বা প্রয়োজন কি? বাচ্চাদের সামনে চকলেট রাখলে তারা সেটি খেতে চাইবেই, আপনি শত নিষেধ করলেও চাইবে। আপনার দায়িত্ব চকলেট এমন স্থানে রাখা, বাচ্চারা যেন তার নাগাল না পায়।

আরজ আলীঃ কিন্তু আদমকে যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেটি তো পালন করতে হবে।

আগন্তুকঃ আপনার বাসায় ধারালো ছুরি আছে? বাসায় বাচ্চারা খেলাধুলো করলে সেগুলো কী আপনি টেবিলের ওপর রেখে ঘুমাতে যাবেন? আপনি বুঝবেন না, শত নিষেধ করলেও বাচ্চাদের আকর্ষণ থাকবে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতিই? আপনারই কি দায়িত্ব নয়, ছুরিটি এমন জায়গাতে রাখা যেন বাচ্চারা সেটি ধরতে না পারে?

আরজ আলীঃ কিন্তু আদম তো বাচ্চা ছিলেন না। তিনি বুদ্ধিমান মানুষই ছিলেন। কেন এই কাজ করতে গেলেন?

আগন্তুকঃ প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের বুদ্ধির তুলনায় একজন বাচ্চার বুদ্ধিমত্তা যেমন কম, আল্লাহর বুদ্ধির তুলনায় আদমের বুদ্ধি তার চাইতেও অনেক কম। আল্লাহ ভালভাবেই জানতেন, আদম সেই ফল খাবে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশিই থাকে। এরকম একটি গাছ জান্নাতে রাখারই কোন অর্থ হয় না, যদি না আল্লাহর কোন বৃহৎ পরিকল্পনা থেকে থাকে। তিনি এটিও জানতেন যে, আদমের আওলাদরা তাঁর আদেশ-নিষেধ কেউ মানবে, কেউ মানবে না। তা না জানলে তিনি আদমকে সৃষ্টি করার পূর্বে, বিশেষত আমাকে শয়তান বানাবার পূর্বে বেহেস্ত-দোযখ নির্মাণ করলেন কী করে, কী জন্য ?

আরজ আলীঃ আল্লাহ পাক আপনাকে যা আদেশ করেছেন, সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই তো ছিল আপনার ধর্ম। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিষয়গুলো বিবেচনা না করে, নিজের মগজ না খাটিয়ে আপনার উচিত ছিল আল্লাহর আদেশের পালন করা।

আগন্তুকঃ তাওহীদ কাকে বলে আপনি কি জানেন? পৃথিবীতে আল্লাহর লক্ষাধিক নবী ও রাসুল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তা আপনি জানেন? সেটি হচ্ছে তাওহীদের প্রচার। তাওহীদ হচ্ছে মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুর ওপর আল্লাহর একত্বকে মনে প্রাণে স্বীকার করা, আর সিজদা পাওয়ার একমাত্র মালিক হিসেবে তার কাছে আত্মসমর্পণ করা। আপনাদের মানুষের মধ্যেই একজন প্রখ্যাত সুফী, আহমদ গাজ্জালী, আপনাদের ইমাম গাজ্জালি নন কিন্তু, কী বলেছেন আপনি পড়েছেন? তাদের তো আপনারা কাফের বলেন, যদিও তারা কেউই আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নন। আমি লাখো লাখো বছর আল্লাহকে সিজদা করে এসেছি, এখনো করি। মহাবিশ্বের এমন কোন স্থান অবশিষ্ট নেই যেখানে আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করিনি। আমি বেঁচে থাকতে আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করবো না, এ কথা আল্লাহ ভালভাবেই জানেন। কোন মূর্তি, কোন দেবদেবী, কোন শক্তি, কোন মানুষ, কোন জ্বীন, কোন ফেরেশতা, কারো কাছেই এই মাথা কোনদিন নত হবে না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। আমার সামনে সারা মহাবিশ্বের সবকিছু এনে দিলেও আমি আমার তাওহীদের থেকে এক চুল নড়বো না, এটি আল্লাহর চাইতে ভাল আর কে জানে! তাওহীদের প্রমাণে নিজের সর্বস্ব আমার মত আর কে কবে বিলিয়ে দিতে পেরেছে? নিজের মান মর্যাদা সম্মান পদমর্যাদা সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে পোড়ার কথা জেনেও কে কবে তাওহীদের জন্য আমার মত আত্মত্যাগ করতে পেরেছে?

আরজ আলীঃ তাওহীদ বলতে আসলে আপনি কী বোঝাচ্ছেন? আল্লাহর হুকুম পালনই তো তাওহীদ।

আগন্তুকঃ তাওহীদের সঠিক বাঙলা হতে পারে, একত্ববাদ। আসলে একত্ববাদ শব্দটি দ্বারাও তাওহীদ শব্দটিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। বলতে পারেন, সিজদা পাওয়ার একমাত্র মালিক হিসেবে আল্লাহকে মনে করা। এই অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। শুধুমাত্র এই বাক্যটিই আল্লাহর প্রেরিত সকল ধর্মের মূল মন্ত্র। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত কোরো না। শুধু তারই উপাসনা করো। কারণ সিজদার একমাত্র মালিক আল্লাহ।

আরজ আলীঃ কিন্তু আল্লাহ তো আদমকে সিজদা করতে বলেছিল সম্মান প্রদর্শনের জন্য। ইবাদতের জন্য নয়।

আগন্তুকঃ বিভিন্ন দেশে মৃতদের সম্মান জানাবার জন্য যেইসব সৌধ নির্মাণ করা হয়, মূর্তি তৈরি করা হয়, সেগুলো তো তাদের উপাসনার জন্য করা হয় না। সম্মান জানাবার জন্য করা হয়। সেগুলো কি ইসলামে হালাল? ধরুন আপনাদের দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার জন্য ইসলামিক দলওগুলো আন্দোলন করছিল, শেখ মুজিবের মূর্তি কি উপাসনার জন্য তৈরি হয়েছিল, নাকি সম্মান জানাবার জন্য? সম্মান জানাবার জন্য হয়ে থাকলে, ইসলামী দলওগুলো সেগুলো ভাঙ্গতে চাচ্ছে কেন? ইসলামিক আলেম ওলামা এবং অন্যান্য দলগুলো বলছে, সম্মান জানাবার জন্যেও মূর্তি তৈরি করা যাবে না। আপনাদের দেশে পীরদের লোকে সিজদা করে। তারা বলে এই সিজদা উপাসনার উদ্দেশ্যে নয় বরঞ্চ সম্মান জানাবার উদ্দেশ্যে। সহিহ আকীদার লোকজন বলে সম্মান জানাবার জন্যও সিজদা করা যাবে না। আদমের ঘটনার পূর্বে লক্ষাধিক বছর আমি যে সিজদা করেছিলাম, সেগুলো কী ছিল? ফেরেশতাগণ যে সিজদা করতো, সেগুলোই বা কী ছিল? শুধুই সম্মান প্রদর্শন? আর সম্মান প্রদর্শনের জন্য তো সালাম দেয়াই যথেষ্ট। সিজদা কেন করতে হবে, যা শুধুমাত্র আল্লাহর হক? আল্লাহ নিজেই তো বলেছেন, আমাকে ভিন্ন অন্য কাউকে সিজদা কোরো না। কোরআনেও বলা আছে, “তোমরা না সূর্যকে সিজদা করবে, না চাঁদকে। আর তোমরা আল্লাহকে সিজদা কর যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদাত কর” [16]। আল্লাহর আসনে অন্য কাউকে বসালে তাতে তার গৌরব বাড়ে কি-না, তা তিনিই বোঝেন। তারপরেও তিনি আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের হুকুম করার কারণ – এটা তার অন্তরের কথা নয়। আল্লাহ অন্তরে চেয়েছেন একরকম, মুখে বলেছেন আরেক রকম।

আরজ আলীঃ আপনি যেই আয়াতগুলো বলছেন সেগুলো সত্য বটে, তবে আমাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছেন। বানিয়ে বানিয়ে ব্যাখ্যা করলেই তো হবে না। নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য সব অপরাধীই তো এরকম যুক্তি দেখাতে পারে। আপনি কিন্তু নাস্তিকদের মত করেই কথা বলছেন।

আগন্তুকঃ আমি নাস্তিকদের মত কথা বলছি? এই জগত সংসারে আমার চাইতে বড় আস্তিক আর কে আছে, যে মহাবিশ্বের সকল স্থানে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করেছে? আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা বা নবী রাসুলগণের সকলেই ছিল আল্লাহর মনোনীত। কেউই নিজ অধ্যাবসায় বা যোগ্যতায় ইবাদত বন্দেগী করে ফেরেশতা হননি, বা নবী রাসুলও হননি। আমি একমাত্র যে আল্লাহর আশীর্বাদে নিজ যোগ্যতা আর অনন্তকালের উপাসনার জোরে ফেরেশতাদের সর্দারের পদমর্যাদা পেয়েছিলাম। জ্বীন হয়ে জন্ম নিয়ে অনন্তকাল উপাসনার জোরে ফেরেশতাদের সর্দার হওয়াকে আপনি হেলাফেলা করবেন না। তাহলে আমার চাইতে আস্তিক মহাবিশ্বে আর কে আছে? নাস্তিক শব্দটি যদি আপনি তাচ্ছিল্যের কারণে ব্যবহার করে থাকেন, মনে রাখবেন, এই দিক দিয়ে আমি তো আল্লাহর চাইতেও এগিয়ে। কারণ সংজ্ঞানুসারে আল্লাহ পাক একজন নাস্তিক, যিনি তার কোন স্রষ্টায় বিশ্বাসী নন।

আরজ আলীঃ নাউজুবিল্লাহ, কী বলছেন এসব!

আগন্তুকঃ আমি ভুল কোথায় বললাম, অনুগ্রহ করে ধরিয়ে দেবেন। আল্লাহ কি নাস্তিক নন? আর আমি কোথায় কবে নাস্তিক হলাম, বলতে পারেন?

আরজ আলীঃ আসলে আপনি হচ্ছেন অহংকারী। আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না। আপনার অহংকারের জন্যেই আপনার আজ এই দুর্দশা।

আগন্তুকঃ আত্মসম্মানবোধকে যদি আপনি অহংকার বলে গণ্য করেন, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আমার কাছে যা আত্মসম্মান, আপনাদের কাছে সেটি অহংকার। ধরুন, আপনি এক জায়গাতে চাকরি করেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অসম্ভব পরিশ্রম করে আপনি সেই অফিসে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। অফিসের মালিক হঠাৎ একদিন তার এক আত্মীয়কে ধরে এনে কোন যোগ্যতা ছাড়াই আপনার উপরের পোস্টে বসিয়ে দিলো, আপনাকে বললো তাকে সিজদা করতে। আপনার আত্মসম্মানে এতে আঘাত লাগবে না?

আরজ আলীঃ সেটি লাগবে বটে। কিন্তু যেহেতু আল্লাহই ঐ অফিসের মালিক, সেহেতু তার হুকুম তো মানতেই হবে।

আগন্তুকঃ আমি যার উপাসনা করি, সে হচ্ছে ইনসাফের মালিক। আমার অন্তর তিনি জানেন। যদি ইনসাফ করতে না পারেন, তিনি আমার উপাসনা পাওয়ার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলবেন।

(গান শুরু হবে)

আশেক বিনে ভেদের কথা কে আর পোছে।
শুধালে খলিফা সবে রাসুল বলেছে।
মাশুকে যে হয় আশেকী
খুলে যায় তার দিব্য আঁখি
নফস আল্লা নফস নবী
দেখবে অনায়াসে।

বান্দার তাকদির

দৃশ্য -০৩
স্থানঃ আরজ আলীর কুড়েঘর
সময়ঃ দুপুর
চরিত্রঃ আরজ আলী, আগন্তুক
ঘটনাঃ আরজ আলীর চেহারায় এখন আত্মবিশ্বাস। আগন্তুকের মৃদু হাসি নিয়ে কথা বলছেন।

আরজ আলীঃ আল্লাহ পাক আপনাকে যেই সময়ে আদমকে সিজদা করতে বলেছিলেন, সেই সময়ে তো আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা শিরক বলে গণ্য হতো না। সে তো অনেককাল আগের কথা।

আগন্তুকঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহ পাক আগে নিজেই শিরক করতে হুকুম দিতেন, কালের বিবর্তনে আল্লাহর মনে পরিবর্তন আসলো, এরপরে সেই তিনিই শিরককে সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে গণ্য করলেন? সেই একই শিরক করার জন্য যুগে যুগে আল্লাহ লক্ষ কোটি মানুষ হত্যা করলেন? নারী শিশু বৃদ্ধ প্রতিবন্ধী মানুষ সহ? নূহ নবীর গল্প মনে পড়ে?

আরজ আলীঃ প্রসঙ্গ বদলাবেন না। আমি সেটি বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, আল্লাহর হুকুম পালন করাই হচ্ছে বান্দার একমাত্র কাজ। আপনি সেটি করতে গিয়ে নিজের অহংকার, বা আপনার ভাষায় আত্মসম্মানবোধকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।

আগন্তুকঃ আপনি কি শেষ নবীর হাদিসগ্রন্থগুলো পড়েছেন? সেখানে কয়েকটি হাদিস পাবেন, যেগুলো আদম এবং মুসার বিতর্ক সম্পর্কে [17]। সেই হাদিসগুলোতে বর্ণিত আছে, আল্লাহর রাসুল মেরাজে গিয়ে আদম এবং মুসার বিতর্ক শুনে এসেছিলেন। সেখানে মুসা আদমকে মানুষের ইহকালীন দুঃখ দুর্দশা আর পরীক্ষার জন্য দোষারোপ করছিলেন। আদম এসব কথা শুনে মুসাকে বলেছিলেন, আপনি কি আমাকে সেই দোষে দায়ী করবেন, যা আল্লাহ আমার জন্মের চল্লিশ বছর পূর্বে লিখে রেখেছেন? সেই বিতর্কে আল্লাহর শেষ নবী সাক্ষী, আদম জয়ী হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে, যেই অপরাধে আদমকে দায়ী করা হয়েছিল, সেই অপরাধে আদম আসলে অপরাধী নন। কারণ তা আল্লাহ দ্বারা পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। এবারে আপনি বলুন তো, আদমকে সেই কাজে দায়ী করা যাবে না, কারণ আল্লাহ তা আগেই লিখে রেখেছিলেন- তাহলে আমি যে সিজদা করবো না, সেটি কি আল্লাহ লিখে রাখেননি? আদমের বেলায় এটি গ্রহণযোগ্য, আমার বেলায় অনন্তকাল জাহান্নাম?

আরজ আলীঃ কিন্তু আল্লাহ পাক তো জানেন বিধায় লিখে রেখেছেন। আপনাকে তো আল্লাহ করতে বাধ্য করেননি। তিনি তো আপনাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, নিজের ইচ্ছেমত কাজের। আপনি সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছেন।

আগন্তুকঃ না, আপনি সম্ভবত হাদিস শাস্ত্র পাঠ করেননি। হাদিস শরীফের একটি সহিহ হাদিসে শেষ নবী কর্তৃক বর্ণিত আছে, মহান আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন তখন তার দ্বারা জান্নাতবাসীদের কাজই করিয়ে নেন। শেষে সে জান্নাতীদের কাজ করেই মারা যায়। আর আল্লাহ এর বিনিময়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। আর যখন তিনি কোনো বান্দাকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তার দ্বারা জাহান্নামীদের কাজ করিয়ে নেন। অবশেষে সে জাহান্নামীদের কাজ করে মারা যায়। অতঃপর এজন্য তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করান [18]। আল্লাহ যদি আমাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেন, আমার মত সামান্য সৃষ্টির পক্ষে সেটি কি না করে থাকা সম্ভব?

আরজ আলীঃ আপনি হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আল্লাহ কখনোই কাউকে দিয়ে কিছু করান না। কোরআন থেকে দেখান, আল্লাহ আপনাকে দিয়ে এই অন্যায় কাজটি করিয়ে নিয়েছে।

আগন্তুকঃ কোরআনেও একই কথাই বিভিন্ন স্থানে বলা আছে। আপনি পড়েননি, পৃথিবীতে ও তোমাদের জানের উপর যে বিপদই আসুক না কেন আমরা তা সৃষ্টি করার আগেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে [19]? আমার ওপর এই বিপদের কথা আল্লাহ আগেই কি নির্ধারণ করে রাখেননি? আল্লাহ আরো বলেছেন, আল্লাহ যাকে সৎপথে চালান, সে-ই সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার জন্যে পথপ্রদর্শনকারী ও সাহায্যকারী পাবেন না [20]। আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে [21]

কাউকে যদি তার অসৎ কাজ সুশোভিত করে দেখানো হয় অতঃপর সে ওটাকে ভাল মনে করে, কেননা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন আর যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন; অতএব তাদের জন্য আফসোস করে নিজে ধ্বংস হয়ো না।

বলুন তো, আমাকে যদি মন্দ কাজটি সুশোভিত করে আল্লাহ দেখান এই ইচ্ছায় যে, তিনি আমাকে গোমরাহ করবেন, তাহলে আমার কাছে তো সেই মন্দ কাজটিই ভাল মনে হবে, তাই না? আমি তো তখন উত্তম কাজ মনে করে সেই মন্দ কাজটিই করবো, কারণ আল্লাহই তা ইচ্ছে করেছেন। আল্লাহ যদি ইচ্ছে করে আমাকে পথভ্রষ্ট না করতো, তাহলে আমার মত সামান্য সৃষ্টির পক্ষে কুপথে চলে আসা সম্ভব? সেই সময়ে তো শয়তান বলে কেউ ছিল না। তাহলে আমাকে পথভ্রষ্ট কে করেছিল, ভেবে দেখেছেন?

আল্লাহ আরো বলেছেন, আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন [22]। তাহলে বলুন তো, আল্লাহর ইচ্ছে ছাড়া আমার মনে কোন ইচ্ছে আসা সম্ভব কিনা? সেইদিন আমি আল্লাহকে একটি কথা বলেছিলাম। কথাটি আপনি কোরআনেও পাবেন। বলেছিলাম, ‘আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, সে কারণে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আপনার সোজা পথে বসে থাকব‘ [23]। কোরআনেও আল্লাহ স্বীকার করে নিয়েছেন, আমার এই কথাটি সত্য ছিল। আল্লাহই আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিলেন। নইলে আল্লাহ কি কোরআনে আল্লাহর ওপর কোন মিথ্যা অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতেন?

আরজ আলীঃ এই আয়াত এবং হাদিসগুলোর নিশ্চয়ই ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা রয়েছে। আপনি ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না। আপনি আপনার চিরাচরিত শয়তানি আমার সাথেও করে যাচ্ছেন। আমাকে পথভ্রষ্ট করার আপনার এই ইচ্ছে কোনদিন সফল হবার নয়।

আগন্তুকঃ সেটিও আসলে আপনার হাতে নয়। আল্লাহরই হাতে। আপনাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না। তবে পর্যালোচনা করতে পারেন। আমি জানি আমার কথা আপনাদের কাছে কোন গুরুত্ব বহন করবে না। শুধুমাত্র একপাক্ষিক কথা শুনে যদি আপনারা আমাকে শূলে চড়ান, সেটি ইনসাফ হতে পারে না। আপনারা শুধু আমার সম্পর্কে কুৎসা এবং অপবাদ শুনে বিচার করে যাচ্ছেন, আমাকে গালি দিয়ে যাচ্ছেন হাজার বছর ধরে। এই যদি আপনাদের ইনসাফ হয়, তাহলে শয়তান আসলে কে?

আরজ আলীঃ আচ্ছা, ঠিক আছে আপনি আপনার কথা বলুন। আমি শুনছি। কিন্তু আগেই বলে রাখি, আমি আল্লাহ এবং নবী রাসুলের পথেই থাকবো। একমাত্র আল্লাহর পথেই রয়েছে মুক্তি এবং জান্নাত।

আগন্তুকঃ জান্নাতের লোভে আপনি ন্যায়বিচার থেকে সরে যাবেন জনাব? যদি আগেই বিচারের রায় বা সিদ্ধান্ত তৈরি থাকে, তাহলে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের তো কোন অর্থই হয় না। সাড়ে চোদ্দশত বছর ধরে প্রতি হজ্বে হাজার হাজার মানুষ মিলে আমাকে উদ্দেশ্য করে বৃথাই পাথর মেরে যাচ্ছেন, অথচ আমার কোন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগই না দিয়ে। আর তাছাড়া, যেই পক্ষে সর্বশক্তিমান আল্লাহ, তার অসংখ্য ফেরেশতাবাহিনী, তার হাজার হাজার নবী রাসুল, লক্ষ লক্ষ ওলী আউলিয়া, অন্যদিকে আমি। আমার মুখ থেকে কোন কথা না শুনেই সিদ্ধান্ত নেবেন? এছাড়া আল্লাহ এত এত আসমানি কিতাব পাঠিয়ে আপনাদের কাছে আমার নামে কুৎসা রটনা করেছেন, আমার কয়টি কেতাব পড়েছেন আপনারা? বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় মিডিয়া ব্যবহার করে অনেক স্বৈরশাসকগণই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন, জানেন তো!

আরজ আলীঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহ এত এত আসমানি কিতাব পাঠিয়ে আসলে মিডিয়া ক্যু এর মাধ্যমে আপনার নামে মিথ্যা লিখেছেন?

আগন্তুকঃ কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যে, সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে কার চোখ দিয়ে আপনি দেখছেন। মানুষের ইতিহাস রচনা করেছেন বিজয়ীরা। সেই ইতিহাসে সবসময়ই আপনি বিজয়ী নেতাদের প্রশংসা আর পরাজিত নেতাদের কুৎসা খুঁজে পাবেন। হাজার হাজার বছর ধরে আসমানি কিতাবসমূহে আপনি আল্লাহর চোখ দিয়ে দেখেছেন, এবারে আমার চোখ দিয়েও একবার দেখুন।

আরজ আলীঃ আচ্ছা, ঠিক আছে আপনি আপনার কথা বলুন।

আগন্তুকঃ বলছি। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার সাথে এই আলোচনাই আমার একমাত্র আত্মপক্ষ সমর্থন। এর বিরুদ্ধে বিরোধীপক্ষ ফুঁসে উঠতে পারে, আমার আত্মপক্ষ সমর্থনটিও বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে পারে। আপনি কি আমার এই কথাগুলো পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করবেন?

আরজ আলীঃ অঙ্গীকার করতে পারছি না, এমনকি আমি এগুলো সবাইকে জানালে আমার কথাগুলো কেউ বিশ্বাস করবে, এর কোন গ্যারান্টিও দিতে পারছি না। তবে আমি আপনার কথা শুনতে আগ্রহী। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে সব কথা শোনার।

আগন্তুকঃ আচ্ছা। আল্লাহ পাক সাতটি দোযখ বানিয়েছেন, সবগুলোতে মানুষ থাকার জন্য। তিনি কি চান যে, আমি আমার পথভ্রষ্ট করার কাজ বন্ধ করি, আর তার দোযখগুলো খালি থাক? তা তিনি চান না, চাইতে পারেন না। চাইলে তাঁর দোযখ বানাবার সার্থকতা ক্ষুন্ন হয়। আল্লাহর ইচ্ছা যে, কিছুসংখ্যক মানুষ দোযখবাসী হোক। আর আমাকে কৌশলে বুঝিয়েছেন, তার সেই ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করতে। এ কাজ আমার পক্ষে করা ফরজ, না করা হারাম? আল্লাহ চান আমি যেন মানুষকে ধোঁকা দিই, পথভ্রষ্ট করি। কারণ হাদিসে শেষ নবী বলেছেন, “যদি তোমরা গুনাহ না করতে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে সরিয়ে এমন জাতিকে সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করত ও আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা চাইত। আর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন” [24]। এখন বলুন তো, আমি ছাড়া আর কে মানুষকে দিয়ে গুনাহ করাবে? আর গুনাহ না করলে, আল্লাহ মানুষ নামক এই আশরাফুল মাখলুকাতকে সরিয়ে কি অন্য জাতি সৃষ্টি করতেন না? তাহলে মানুষ জাতির অস্তিত্ব কি আমার অনুগ্রহেই টিকে নেই? তাহলে আমি কি আসলে মানুষকেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করছি না? আল্লাহর কাজে সাহায্য করছি না?

আরজ আলীঃ আপনি ক্রমাগত হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন। আল্লাহর নবী কী বুঝিয়েছেন আর আপনি কী বলছেন!

আগন্তুকঃ ভুল ব্যাখ্যা শুদ্ধ ব্যাখ্যা, সেটিও নির্ভর করে কার চোখ দিয়ে আপনি দেখছেন- অন্ধবিশ্বাসীর, নাকি যুক্তির। আমি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না, কেউই পারে না। বহু চেষ্টা করেও কোনো নবী-আম্বিয়া, দরবেশকে আমি দোযখবাসী করতে পারিনি। কেননা তাঁরা দোযখবাসী হোন, তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। পক্ষান্তরে হজরত ইব্রাহিম নমরুদকে, হযরত মুসা ফেরাউনকে এবং শেষ নবী (দ:) আবু জেহেলকে হেদায়েত করে বেহেশতের তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। কেননা তা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। বলুন তো, আবু লাহাব যে শেষ নবীর সাথে শত্রুতা করবে, এটি আল্লাহ পাক কবে ঠিক করে রেখেছিলেন? একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ পাক আবু লাহাব সূরাটি আসমান ও জমিন সৃষ্টির পূর্বে লিখে রেখেছিলেন [3]। তাহলে আবু লাহাবের কি শেষ নবীর সাথে শত্রুতা করা ভিন্ন অন্য কোন পথ খোলা ছিল? আবু লাহাব ইমানদার হয়ে গেলে আল্লাহর লিখিত কেতাব তো মিথ্যা হয়ে যেতো! আবু লাহাবের মত সামান্য মানুষ কি আল্লাহর বিধান উল্টে দিতে পারে? সেইসাথে, কোরআনেও তো বলা রয়েছে, নবীদের সাথে তাদের সময়ের শত্রুদের মনের শত্রুভাব আল্লাহই সৃষ্টি করে দিয়েছেন [25]। তাহলে নবী রাসুলদের সময়ের সেই সব শত্রুদের অপরাধ কোথায়?

আরজ আলীঃ আপনি আবারো মিথ্যা বলছেন। মানুষ শুধুমাত্র তার স্বাধীন ইচ্ছার দিয়ে করা আমলের মাধ্যমেই জান্নাত জাহান্নামে যেতে পারে। অন্য কোন উপায়ে নয়।

আগন্তুকঃ আপনি তাই মনে করেন? তাহলে বলুন তো, শেষ নবী কি নিজ যোগ্যতায়, নিজ কর্ম ও ধর্মে শেষ নবী হয়েছিলেন, নাকি আল্লাহই তাকে শেষ নবী মনোনীত করে পাঠিয়েছিলেন? বাল্যকালে তার সিনা সাফ করা হয়েছিল, তার কোন ভাল কাজের বদৌলতে? আপনার আমার সিনা সাফ করা হলো না কেন? শেষ নবীর কন্যা ফাতিমা জান্নাতে নারীদের সর্দার হবেন [26] কোন যোগ্যতায়? শেষ নবীর কন্যা হওয়াটি কি যোগ্যতা? নবীর দুই নাতি জান্নাতে যুবকদের সর্দার হবে [27], সেটি কোন যোগ্যতায়? নবীর রক্ত শরীরে থাকায়? আপনাদের দেশে কোন বড় নেতার ছেলে মেয়েরা পিতার মৃত্যুর পরে ক্ষমতায় বসেন। যে কোন স্বৈরশাসকের বেলাতেই একই রকম ঘটনা ঘটে। আপনারা এটাকে বলেন পরিবারতন্ত্র। কিন্তু ধর্মেও কি পরিবারতন্ত্র চলে? অন্যদিকে খিজির যেই বালকটিকে বাল্যকালে কোন পাপ করার পূর্বেই হত্যা করেছিল, সে ছিল জন্মগতভাবেই কাফের। তার কাফের হওয়া বা জাহান্নামে যাওয়া কোন অযোগ্যতায়? সে তো এমনকি প্রাপ্তবয়স্কও হয়নি [28] [29] [30]। তাহলে তার সাথে ইনসাফ হলো কোথায়? এমনকি, হাদিস শরীফে এটিও বলা আছে, আমলের মাধ্যমে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, করবে শুধুমাত্র আল্লাহর রহমতের মাধ্যমে [31]। আল্লাহ তো তার নিজের ইচ্ছেমত সব করেন। কোরআনেও বলা আছে, আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং (যা ইচ্ছা) মনোনীত করেন [32]

বান্দার রিজিক

দৃশ্য -০৪
স্থানঃ আরজ আলীর কুঁড়েঘর
সময়ঃ দুপুর
চরিত্রঃ আরজ আলী, আগন্তুক
ঘটনাঃ আরজ আলীর চেহারায় এখন একটু চাপা রাগ বা ক্ষোভ। আগন্তুকের হাসি আরেকটু বৃদ্ধি পেয়েছে। 

আরজ আলীঃ যারা কাফের তাদের অন্তরে আল্লাহ সিলমোহর মেরে দেন। তারা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত, সে কারণেই তারা জাহান্নামে যাবে। আর নিশ্চয়ই আমরা মুসলমানেরা আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্ত।

আগন্তুকঃ (মৃদু হাসি দিয়ে) আপনারা মনে করেন যে, আল্লাহর যতো সব রহমত মানুষের উপরই বর্ষিত হয়। বস্তুত তা নয়। আল্লাহর রহমত আমার উপর অনেক বেশী, আপনাদের মত মানুষদের তুলনায়। আদমকে সৃষ্টি করার কতো লাখ বছর পূর্বে আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তা তিনিই জানেন। অথচ আল্লাহর রহমতে আমি আজও বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে মাত্র ৬০, ৭০ কিংবা ১০০ বছর। তদুপরি শিশুমৃত্যু-অপমৃত্যু হয় যথেষ্ট পরিমাণে। আমার সুদীর্ঘ জীবনে আজ পর্যন্ত আমি কোনোরূপ রোগ, শোক বা অভাব ভোগ করিনি, আল্লাহর রহমতে। কিন্তু মানুষ অসংখ্য রোগ, শোক ও অভাবে জর্জরিত। ফেরেশতারা আমাকে লক্ষ্য করে ক্ষেপনাস্ত্র ছোঁড়েন আবহমান কাল থেকে [33]। অথচ আল্লাহর রহমতে আমি নিরাপদেই থাকি। কিন্তু উল্কাপাতে নতুবা বজ্রপাতে ধ্বংস হয় পৃথিবীর বাড়িঘর, মরে কিছু মানুষ। পবিত্র মক্কায় গিয়ে হাজী সাহেবরা আবহমানকাল আমায় লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়েন। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তা আজ পর্যন্ত আমার গায়ে পড়েনি একটিও। সেই পাথর উল্টোদিকে গিয়ে মারা যায় হাজীগণ! সমুদ্রে জাহাজ ডুবে, হজ্বে যাওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনায়, লাখো মানুষের চাপে পিষ্ট হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য হজযাত্রী মারা যান, আল্লাহর রহমতে।

আর অন্যদিকে আমি আল্লাহর রহমতেই নিমেষে বিশ্বভ্রমণ করতে পারি, অদৃশ্যকে দেখতে, শ্ৰবণাতীতকে শুনতে, নিজে অদৃশ্য থেকে অন্যের মনের খবর জানতে পারি। দুদিন অনিদ্রা-অনাহারে থাকলে মানুষ ঝিমিয়ে-নেতিয়ে পড়ে। আর আমি লাখ লাখ বছর ধরে অনিদ্রা-অনাহারেও সুস্থ সবল আছি, সে তো আল্লাহর রহমতেই।

আরজ আলীঃ কিন্তু মানুষ তো ওর অনেক কিছুই আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের সুচনা করেছে তো মানুষই। অণুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, রেডিও, টেলিভিশন, রকেট, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি যন্ত্র দিয়ে মানুষ এখন অদৃশ্যকে দেখছে, শ্রবণাতীতকে শুনছে, আকাশে-পাতালে ভ্রমণ করছে, অনাহারে বেঁচে থাকার গবেষণা চালানো হচ্ছে। এই তো কয়েকদিন আগেই, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের সাহায্যে এখন মহাশূন্যের ১৩৫০ কোটি বছর আগের বিরল ছবিও প্রকাশ করেছে।

আগন্তুকঃ এসব মানুষ আয়ত্ত্ব করছে সত্য, হয়তো আরো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করবে। কিন্তু সে সমস্ত যারা করেছেন ও করবেন, তাঁরা তো আমারই শিষ্য। বলুন তো, অন্ধ আনুগত্যের বিপরীতে সর্বপ্রথম কে যুক্তি দেখিয়েছিল? আর বিজ্ঞানের পিতা যে যুক্তি বা দর্শন, এটা তো আপনার অজানা নয়।

আরজ আলীঃ তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, এই বিজ্ঞানের যুগ, এই মানব সভ্যতার অগ্রগতি, এগুলো সবই অভিশপ্ত শয়তানের আশীর্বাদ?

আগন্তুকঃ এগুলো যুক্তি আর দর্শনের আশীর্বাদ। আর আমিই যুক্তিবাদের পিতা বা জনক। আমার পূর্বে কেউ কোথাও যুক্তি প্রয়োগ করেনি।

আরজ আলীঃ আপনি আবারো প্রতারণার আশ্রয় নিলেন। মহান আল্লাহ আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন বলেই আজকে আমরা মানুষ এত উন্নত। এই যে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো, এগুলো গবেষণার জন্য যেই মেধা আর শ্রম প্রয়োজন ছিল, সেগুলো কে দিলো? আজকে যেই ঔষধে আমরা রোগমুক্ত হচ্ছি, সেগুলো তো আসলে আল্লাহই ঘটাচ্ছেন?

আগন্তুকঃ তাহলে বলুন তো, ভুল চিকিৎসায় যখন রোগী মারা যায়, তখন ডাক্তারের বিচার দাবী করেন কেন? জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে হয়ে থাকলে, ঐ ভুল চিকিৎসার জন্য কী ডাক্তারকে দায়ী করবেন, নাকি আল্লাহই সেই রোগীর মৃত্যু সেই সময়ে লিখে রেখেছেন ভেবে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসাকে মেনে নেবেন?

আরজ আলীঃ সেটির জন্য অবশ্যই সেই ডাক্তারই দায়ী। কারণ আল্লাহ তো আর তাকে দিয়ে ভুল চিকিৎসা করাবেন না। এখানে হয় সে দায়ী, নতুবা আপনি।

আগন্তুকঃ তাহলে আজরাইলকে জান কবচ করাবার জন্য কে পাঠায়? আমি, নাকি সেই ডাক্তার নিজেই…

আরজ আলীঃ ভুল চিকিৎসার দায় সেই ডাক্তারেরই। সঠিক চিকিৎসা হলে শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রে কৃতিত্ব আল্লাহর। ডাক্তারের ভুলের দায় আল্লাহ কেন নেবেন?

আগন্তুকঃ ও আচ্ছা। তাহলে আল্লাহ কেন বললেন, “আমিই জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই এবং আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী।” [34]। ঠিক আছে, আপনার কথাই ধরে নিচ্ছি। তাহলে বলুন তো, চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ কোন রোগের ঔষধ আবিষ্কারের আগে কি আল্লাহ তার কুদরতে মানুষকে সুস্থ করে তোলেন? এই কয়েকশ’ বছর আগেও, পোলিও, কলেরাতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেতো। শিশু মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল ভয়াবহ। আল্লাহ তখন মানুষকে বেশি আয়ু দিতেন না। আজরাইলের আনাগোনা ছিল খুবই বেশি। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে, আল্লাহর ক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। আল্লাহ এখন অনেক মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারছে। আজরাইলও হাসপাতাল আর আধুনিক ঔষধের কল্যাণে একটু অবসর পাচ্ছে।

আরজ আলীঃ আল্লাহর ক্ষমতা আগেও ছিল, এখনো আছে। আল্লাহ শুধু সেইসব মানুষের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।

আগন্তুকঃ তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহর ইচ্ছা এখন মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে? আগে ইচ্ছেমত যাকে ইচ্ছে মৃত্যু দিতে পারতেন, আজকাল চিকিৎসাবিজ্ঞানের কারণে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে?

আরজ আলীঃ আমি সেটি বলিনি। আপনার সাথে বিতর্ক করার সাধ্য আমার নেই। আপনি বলুন, আপনি মানুষের অকল্যাণ চান কেন?

আগন্তুকঃ কোনো মানুষের অকল্যাণ আমার কাম্য নয় এবং তা করিও না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে এমন কতোগুলো বিধি-নিষেধ রয়েছে, যা মানুষের অকল্যাণই করে এসেছে আবহমান কাল থেকে। এই যেমন ধরুন, যুদ্ধবন্দী নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে দাসদাসী বানানো [35], এটি প্রায় সকল ধর্মেই একটি ভয়ঙ্কর কুপ্রথা। মানুষের কল্যাণ কামনায় সে সব বিধি-নিষেধ অমান্য করার জন্য আমি মানুষকে প্রেরণা দিয়েছি। তারা আমার প্রেরণাতেই জেনেভা কনভেনশন তৈরি করেছে, জাতিসংঘ গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দী নারীদের ধর্ষণ হওয়ার হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমি ধর্মের বিধান অমান্য করার প্রেরণা না দিলে বর্তমানের এই তাগুতি মানবাধিকার সনদগুলোর উদ্ভব হতো কোথা থেকে [36]? কেননা ধর্মের বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করার জন্য মানুষকে প্রেরণা দেওয়াই আমার কাজ। আবার ধরুন, অল্পবয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু বৃদ্ধি পায়। মেয়েদের শারীরিক নানাধরণের সমস্যা হয়। ধর্মগুলো বলেছে, বেশি বেশি সন্তান নিতে [37]। মানুষের তৈরি আইনগুলো এখন অতিরিক্ত সন্তান নিতে নিষেধ করছে।

আরজ আলীঃ মানুষের তৈরি আইনের নানা ভুল রয়েছে। আল্লাহর আইনে কোন ভুল থাকতে পারে না।

আগন্তুকঃ আদম হাওয়ার ঘটনায় হাওয়াকেই মূল অপরাধী সাব্যস্ত করে যুগ যুগ ধরে তাদের নির্যাতন আর অধিকার হরণের পথ তৈরি করে রাখা হয়েছে [38]। ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম [39]। কিন্তু আপনারা এখন নারী পুরুষের সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করছেন। এগুলো করতে আপনাদের কে প্রেরণা দিচ্ছে? বা ধরুন, মুরতাদের শাস্তির বিষয়টি [40]। ইসলাম বলছে কেউ ইসলাম ত্যাগ করলে তাকে হত্যা করতে হবে। আজকের মানবাধিকার আইনগুলো বলছে প্রতিটি মানুষের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তার বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে কেউ কোন হুমকি বা শাস্তি বা জোর করতে পারবে না। ধর্মের বিরুদ্ধের এই বিধানগুলো আপনাদের সভ্য দেশগুলোতে এখন প্রতিষ্ঠিত।

আবার ধরুন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ [41]। সভ্য পৃথিবীতে এখন কার কী ধর্ম সেটি মোটেও বিবেচ্য নয়। কাজের মাধ্যমেই মানুষের মূল্যায়ন হয়। কে মুসলিম কে হিন্দু, রাষ্ট্র সেগুলো দেখবে না। একজন মুসলিমও যেই সুযোগ সুবিধা পাবে, একজন খ্রিষ্টান বা ইহুদি বা হিন্দু বা নাস্তিকও সেটিই পাবে। কেউ তার ধর্মের কারণে কোন বেশি সুবিধা ভোগ করবে না। এগুলো তো সবই আল্লাহর শরীয়তের বাইরে মানুষের তৈরি তাগুতি বিধান, যা থেকে মানুষকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। এবং আল্লাহর বিধানগুলো থেকে সরে গিয়ে সভ্য সমাজ ক্রমশই এইসব তাগুতি বিধানই সমাজে প্রয়োগ করছে [36]। আর তারই ফল আধুনিক জগতে মানব জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্রমোন্নতি। মেয়েরা এখন মহাকাশে চলে যাচ্ছে, স্যাটেলাইটের ইঞ্জিন ঠিক করছে, যেখানে ধর্মের বিধান হচ্ছে মেয়েদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করতে হবে।

আরজ আলীঃ কিন্তু মেয়েরা এতবেশি বাইরে বের হলে পরিবারগুলো তো ভেঙ্গে যাবে। আমাদের সমাজ তাহলে টিকবে কীভাবে?

আগন্তুকঃ পরিবার টেকাবার দায় শুধু নারীকে কেন নিতে হবে? পুরুষেরও এখন সমান দায়িত্ব নেয়ার সময় এসেছে। ধর্ম মেয়েদের সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার ছেলের অর্ধেক নির্ধারণ করেছে। অনেক ধর্মে সম্পত্তিই পায় না। স্ত্রী অবাধ্য হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তাকে প্রহার করার অনুমতিও দেয়া হয়েছে। আধুনিক তাগুতি সমাজ এইসব নিয়মই পরিবর্তন করে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চাইছে। এগুলো কার অনুপ্রেরণায় হচ্ছে? কোরআনে সূরা কাহফে বলা আছে [42], জুলকারনাইন পূর্ব ও পশ্চিমে পৃথিবীর দুই শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। অথচ পৃথিবীর পূর্ব পশ্চিমে কোন শেষ প্রান্ত নেই। আবার হাদিসেও বলা হয়েছে সূর্য রাতের বেলায় আল্লাহর আরশের নিচে গিয়ে ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকে [43] [44] [45] [46] [47] [48] [49] [50] [51] [52] [53]। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে সূর্য রাতের বেলা কোথাও যায় না। পৃথিবী গোলাকার হওয়ার কারণে অপর প্রান্তের মানুষের কাছে সূর্য দৃশ্যমান হয়। নবীর কথার বিপরীতে এইসব তাগুতি জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষকে কে আসওয়াসা দিলো? যা পড়লে ইসলাম সম্পর্কে মনে সন্দেহ আসে, যুক্তি তথ্য প্রমাণ দিয়ে সেগুলো পর্যালোচনা এবং সেগুলো আবিষ্কারের জন্য কে ইন্ধন যোগাচ্ছে?

আরজ আলীঃ কিন্তু এইসব কোরআন হাদিসের নিশ্চয়ই অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে। এগুলো গায়েবী জ্ঞান, মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই। হয়তো গায়েবীভাবে সূর্য রাতের বেলা আল্লাহর আরশের নিচে চলে যায়। বা এগুলোকে অন্য কোনভাবে বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে।

আগন্তুকঃ কোরআন হাদিসকে মানুষের তৈরি অর্থাৎ তাগুতি বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা আপনি যখনই করতে যান, সেখানেই আপনি বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব মেনে নেন। অর্থাৎ মানুষের তৈরি বিজ্ঞান আপনার সত্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড, সেই মানদণ্ড দিয়ে আপনি আল্লাহর কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ব্যাখ্যা করছেন! এটি খুবই হাস্যকর যে, আল্লাহ ও রাসুলের বাণীকে সঠিক সরলভাবে গ্রহণ না করে আপনারা তাঁদের বক্তব্য বিকৃত করে জোড়াতালি দিয়ে ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞানের সাথে মেলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানের সার্টিফিকেট দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর বাণীকে আপনাদের ব্যাখ্যা করে চাপাচাপি করে আল্লাহকে তাগুতি বিজ্ঞান পরীক্ষায় পাশ করাতে হচ্ছে, এটিই তো আমার বিজয়। বিজয় মানুষের জ্ঞানের, বিজয় সংশয়ের, বিজয় যুক্তির। সত্য হচ্ছে, তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে আকাশতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব ইত্যাদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য যাবতীয় তত্ত্বালোচনা অনেকটাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ঘোষিত হয়েছে স্বর্গ ও নরক-তত্ত্ব, পৌরাণিক গল্পকথা। আবার ধরুন, আমার প্রেরণা ছাড়া আজকে যেই সঙ্গীত আপনাকে মুগ্ধ করে, যেই চিত্রকলা আপনার চোখ জুড়ায়, সেগুলো কিছুই তো সম্ভব ছিল না।

আরজ আলীঃ সঙ্গীত, হ্যাঁ আমি সঙ্গীত ভালবাসি। ইসলামে বাদ্যবাজনা সহকারে সঙ্গীত নিষিদ্ধ [54]। নিষিদ্ধ চিত্রকলাও [55]। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণা তো নিষিদ্ধ নয়।

আগন্তুকঃ সংশয় সমস্ত জ্ঞানের জন্মদাতা। মানুষ আজ সমুদ্রতলে বিচরণ করে, আকাশে পাড়ি জমায়, পরমাণুগর্ভে প্রবেশ করে এবং কতো অসাধ্য সাধন করে, কিন্তু এর কোনোটাই ধর্ম বা ধমীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে শিক্ষা দেয়নি, বরং বলেছে বিনা প্রমাণে বিশ্বাস করতে। আমার কর্তব্য বিধায় আমিই ওসব শিক্ষার প্রেরণা দিয়েছি ও দিচ্ছি মানুষকে। প্রথমে দিয়েছি যুক্তি আর দর্শনের মাধ্যমে, এরপরে দিয়েছি বিজ্ঞান [56], বর্তমানে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু তাতে শুধু অধাৰ্মিকরাই লাভবান হয়নি, ধার্মিকগণও ভোগ করছেন তার সুযোগ-সুবিধাগুলো। জল, স্থল ও হাওয়াই যানের সাহায্য ছাড়া শুধু পদব্রজে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালনে হাজীদের সংখ্যা কতোজন হতো, তা হিসেব করে দেখেছেন কি? বর্তমানে ওয়াজে, আজানে, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে, জানাজার নামাজেও মাইক, রেডিও, টেলিভিশন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পুণ্যের মাত্রা নিশ্চয়ই বাড়ছে। সুতরাং শুধু পাপকর্মের দ্বারা দোযখে যাবার জন্যই নয়, পুণ্যকর্মের দ্বারা বেহেশতে যাবার জন্যও আমি মানুষকে সহায়তা করছি না কি? এছাড়া আমি হামেশা আল্লাহকে স্মরণ করি, তাঁর হুকুম পালন করি, তাঁর ইবাদত করি, কিন্তু দোযখ থেকে পরিত্রাণ বা বেহেস্ত লাভের প্রত্যাশায় তা করি না। কেননা দোযখের শাস্তি ও বেহেশতের সুখ আমার কাছে অকেজো। জান্নাতের লোভ বা জাহান্নামের ভয় না থাকায় সুখাদ্য ফল, সুপেয় পানীয়, স্বর্ণপুরী, সুন্দরী ললনা- হুর-গেলমান ইত্যাদি কিছু নিয়েই আমার কোন আগ্রহ নেই। পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি জীবমাত্রেই আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। কিন্তু তারাও দোযখের ভয়ে বা বেহেশতের লোভে তা করে না। অথচ মানুষ তা-ই করে থাকে। ধর্মের নিশানধারীদের মধ্যে হাজারে বা লাখে এমন একজন মানুষ মিলবে কি-না সন্দেহ, যিনি নিছক আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পুণ্যকাজ করেন, যার সাথে বেহেস্ত দোযখের সম্পর্ক নেই। যারা দোযখের ভয়ে বা বেহেশতের লোভে পুণ্যকাজ করে, তারা আমার চেয়ে অধম, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট। লোভ আর ভয়ের কারণে মানুষ যা করে, আমি লোভ ভয়ের উর্ধ্বে তার চাইতে অনেক বেশিই করি।

আরজ আলীঃ সবাই তো আর জান্নাতের লোভে দ্বীনের পথে চলে না। অনেকেই আছেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালবেসে দ্বীনকে পালন করেন।

আগন্তুকঃ সেটিও কিন্তু আল্লাহ পুর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। এবং যারা দ্বীন সঠিকভাবে পালন করে, তাদের জন্য আল্লাহই দ্বীন পালনকে সহজ করে দিয়েছেন বলেই তারা সেটি করতে পারে। আল্লাহর নবী বলেছেন, প্রতিটি লোক ঐ আমলই করে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা যা তার জন্য সহজ করা হয়েছে [57]। কারো জন্য আমল সহজ করে দিলে আর কারো জন্য কঠিন করে দিলে তো ন্যায়বিচার বলে কিছুই থাকে না। আর আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের বিরুদ্ধে দাগা দিয়ে কোনো মানুষকে আমি দোযখী বানাতে পারি না এবং কোনো ধর্মপ্রচারকও হেদায়েত করে কোনো মানুষকে বেহেস্তবাসী করতে পারেন না। আমি শুধু তাকেই গুমরাহ করতে পারি যার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম ওয়াজিব করে রেখেছেন [58]। তবে সাময়িক মনের পরিবর্তন ঘটানো যায় মাত্র। কোনো কম্পাসের কাঁটাকে নেড়েচেড়ে বা জোর করে মেরুভ্রষ্ট করা হলে, ছুট পেলে পুনঃ যেমন সাবেক মেরুতে চলে যায়, মানুষের মানসকাঁটাও তদ্রূপই সুমেরুমুখী কোনো মানুষকে পথভ্রষ্ট ক’রে তার দ্বারা আমি অসৎকাজ করাতে পারি, এমন কি তাকে ‘কাফের’ নামে আখ্যায়িত করাতেও পারি। কিন্তু পারি না তার জীবনসন্ধ্যায় তওবা পড়ে মোমেন হয়ে বেহেশতে যাওয়া রোধ করতে। অনুরূপভাবেই কুমেরুমুখী কোনো মানুষকে হেদায়েত-নছিহত করে তার দ্বারা কোনো ধর্মপ্রচারক সৎকাজ করাতে পারেন এবং তাকে আখ্যায়িত করতে পারে মোমেন নামে। কিন্তু তিনি পারেন না তার অন্তিম মুহুর্তে ‘বেঈমান‘ হয়ে দোযখে যাওয়া রোধ করতে। এভাবে অনেক মানুষের চোখে কাফের বেহেশতে যাবে। আবার সমাজের চোখে মোমেন যাবে দোযখে।

আরজ আলীঃ মোমেন আসলে তারাই, যারা যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে আল্লাহকে বিশ্বাস করেছে, তাঁর দ্বীনকে সত্য পেয়েছে। আসলে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে ভাবলেই ইসলামের সত্যতা প্রকাশ পাবে।

আগন্তুকঃ মোমেনের এই সংজ্ঞা আপনি কোথায় পেয়েছেন জানিনা। তবে ইসলামের শেষনবী কিন্তু বলেছেন, মোমেন হচ্ছে নাকে দড়ি বাঁধা উটের মত। যে নবী ও খুলাফায়ে রাশেদীন যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাসের সাথে কামড়ে ধরে রাখে এবং কোন অবস্থাতেই ছাড়ে না [59]। এই উপমার অর্থ তো সহজেই অনুমেয় [60]

আল্লাহ জান্নাতের জন্য যেসকল মোমেনদের সৃষ্টি করেন, দোযখবাসী করতে চান না, আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে দোযখী বানাতে পারি না। লক্ষাধিক নবী-আম্বিয়াদের প্রত্যেককেই আমি পথভ্রষ্ট করতে চেষ্টা করেছি এবং কিছু কিছু সফলও হয়েছি। কিন্তু আমি কাউকে দোযখী বানাতে পারিনি। আমার ধোঁকায় পড়ে তারা সামান্য গুনাহ যা করেছেন, আল্লাহ তার শাস্তি প্রদান করেছেন এ দুনিয়াতেই, পরকালে তাঁরা সবাই থেকেছেন নিষ্পাপ। যেমন – হযরত আদমের বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় নির্বাসন, হযরত ইউনুসের মৎস্যগর্ভে বাস, হযরত আইউবের বিমার, শেষ নবী এর দন্ত শহিদ হওয়া [61] ইত্যাদি উক্তরূপ পাপেরই শাস্তি।

আরজ আলীঃ তাহলে সকল নবী রাসুলের মত আপনিও তো আল্লাহর কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে পারতেন। আল্লাহ পরম করুনাময়। নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দিতেন।

আগন্তুকঃ আজ পর্যন্ত আমি আল্লাহতালার মাত্র একটি হুকুমই অমান্য করেছি। তাঁর হুকুমে আদমকে সিজদা না করে। আর অন্য সকলে তো তাঁর অসংখ্য হুকুম অমান্য করেছে এবং করে যাচ্ছে। নবী রাসুলগণও করেছেন। কিন্তু সেজন্য তিনি রাগ করেননি বা কাউকে অনন্তকালের শাস্তি দেননি। জিব্রাইল, মিকাইল ও ইসরাফিল ফেরেশতাত্রয়কে আল্লাহ হুকুম করেছিলেন পৃথিবী থেকে মাটি নেবার জন্য, আদমকে বানাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু একে একে তিন ফেরেশতাই আল্লাহর হুকুম খেলাপ করে ফিরে গেলেন তাঁর কাছে খালি হাতে, মাটির অসম্মতির জন্য। অবশেষে আজরাইল ফেরেশতা আল্লাহর আদেশ মোতাবেক জোরপূর্বক কিছু মাটি নেওয়ায় তা দ্বারা আদমকে বানানো হলো। কিন্তু চারবার আদেশ অমান্য সত্ত্বেও আল্লাহ মাটিকে আগুনে পোড়ালেন না, বরং পানি দিয়ে কাদা বানিয়ে মহানন্দে আদমের মূর্তি বানালেন ও তাতে প্রাণদান করলেন। আর তিন ফেরেশতা যে তাঁর হুকুম অমান্য করলেন তুচ্ছ মাটির কথা মেনে, তা যেন তাঁর খেয়ালই হলো না। পক্ষান্তরে তাঁর হুকুম অমান্যের দায়ে আমাকে নাকি দিলেন অভিশাপ, আমার গলায় দিলেন লানতের তাওক এবং নির্বাসিত করলেন বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় চিরকালের জন্য। এসব কি তাঁর পক্ষপাতিত্ব বা ন্যায়বিরোধী কাজ নয়? না, এতে তিনি এতটুকু পক্ষপাতিত্ব বা অন্যায় করেননি। না, তিনি অন্যায়কারী নন। তিনি তো সকলের শেষ আশ্রয়স্থল। বরং অন্যায় করেছে মানুষই, তাঁর গোপন ইচ্ছে ও উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে।

অভিশপ্ত শয়তান

দৃশ্য -০৫
স্থানঃ আরজ আলীর কুঁড়েঘর
সময়ঃ দুপুর
চরিত্রঃ আরজ আলী, আগন্তুক
ঘটনাঃ আরজ আলীর চেহারা খানিকটা অসহায়। আগন্তুকের চেহারায় ভরপুর আত্মবিশ্বাস । 

আরজ আলীঃ আপনি জানেন, আপনাকে আমরা মুসলমানেরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কত অজস্র অভিশাপ দিই, গালি দিই, আপনার কাছ থেকে মহান আল্লাহর কাছে পানাহ চাই?

আগন্তুকঃ সেটি আপনারা করেন, তারপরেও আমি আপনাদের অকল্যাণ করি না। বরঞ্চ জন্মমূহুর্ত থেকেই কল্যাণ করি। হাদিসে বর্ণিত আছে, জন্মের সময় শয়তানের স্পর্শের কারণেই নবজাতক শিশু চিৎকার করে কাঁদে [62]। বলুন তো, আমি স্পর্শ না করলে, নবজাতক শিশুরা জন্মের সময় কাঁদতো না, এতে কী সমস্যা হতো? আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে, নবজাতক শিশুর কান্না অত্যন্ত জরুরি বিষয়। একটি নবজাতক শিশুর শ্বাসনালী পরিষ্কার করার, তাদের ফুসফুস প্রসারিত করার এবং তাদের প্রথম শ্বাস নেওয়ার জন্য কান্না একটি স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া। জন্মের পর পর নবজাতক শিশু যদি না কাঁদে, তখন দেখবেন উপস্থিত চিকিৎসকগণ সাধারণত তাদের পিঠে বা পায়ে আলতোভাবে ঘষে বা তাদের মুখ ও নাক থেকে শ্লেষ্মা চুষে শিশুটিকে উদ্দীপিত করে। এই কাজগুলি শিশুকে তাদের প্রথম শ্বাস নিতে এবং কাঁদতে শুরু করতে উত্সাহিত করার জন্য করা হয়। অনেক কারণে নবজাতক শিশুটি শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হতে পারে, বা তার শ্বাসনালী অবরুদ্ধ থাকতে পারে, যার কারণে শিশুরা জন্মের পরই কাঁদে না। এটি একটি জন্মগত অস্বাভাবিকতা হতে পারে যার চিকিৎসা প্রয়োজন। তাহলে ভেবে দেখুন, জন্মের দিন প্রথম মুহুর্ত থেকেই তো আমি আপনাদের সাহায্য করছি। আপনাকে নিশ্বাস নিতে এবং শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে, ফুসফুস সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করছি। তাই না? বিনিময়ে আপনারা আমাকে অভিশাপ দিতে থাকুন, তারপরেও প্রতিটি নবজাতককে আমি সাহায্য করেই যাবো।

আরজ আলীঃ আপনি প্রসঙ্গে থাকুন। এটা তো আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে, আপনি অভিশপ্ত, তিরস্কৃত ও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নির্বাসিত।

আগন্তুকঃ এগুলো তো সত্য নাও হতে পারে।

প্রথমতঃ আমি আল্লাহর বিরাগভাজন ও অভিশপ্ত হয়ে থাকলে তিনি আমাকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করতে পারতেন, পারতেন রোগ, শোক, দুঃখ-কষ্ট ও অভাব ভোগ করাতে, যেমন করেছেন হারুৎ-মারুৎ ফেরেশতাদ্বয়কে। সর্বোপরি পারতেন মৃত্যু ঘটিয়ে জগত থেকে আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে। কোথাও আর আমার কোন অস্তিত্বই থাকতো না। কিন্তু তিনি তার একটিও করেননি। বরং উল্টোই করেছেন। আমাকে দিয়েছেন অসাধারণ ক্ষমতা। যদি কেউ কাউকে বলে, ‘তুমি রোগ, শোক, দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করো‘ – তাহলে সেটা কী তার পক্ষে আশীৰ্বাদ না অভিশাপ? আল্লাহ আমাকে কোনো রোগ দেননি, শোক দেননি, অপমৃত্যু দেননি, কোনো অভাব দেননি, বরং দীর্ঘায়ু দান করেছেন। এসবের মধ্যে অভিশাপ কোনটি?

দ্বিতীয়ত বলা হয়ে থাকে যে, আমি তিরস্কৃত হয়েছি। অর্থাৎ আল্লাহ আমার কণ্ঠে লানতের তাওক দান করেছেন। এ কথাটিও পুরো ঠিক নয়। আমি ‘তাওক’ একটি পেয়েছি ঠিকই। তবে সেটা কাঠের না লোহার না স্বর্ণের তৈরি, কেউ তা দেখেননি বা শোনেননি কারো কাছে আজ পর্যন্ত। ওটা কারাবাসীর কণ্ঠে যেমন তিরস্কার, তেমন বিজয়ীর কণ্ঠে পুরস্কার সূচিত করে। তারতম্য শুধু গঠন ও উপকরণে। এ বিষয় পরে বলবো।

তৃতীয়ত বলা হয় যে, আমি বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হয়েছি, নির্বাসিত হয়েছি পৃথিবীতে। আল্লাহর আদেশে পৃথিবীতে আসা-যাওয়া অথবা স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাঁর নির্দেশিত কর্তব্য তো অন্যান্য ফেরেশতাগণও পালন করে থাকে। তারাও কি নির্বাসিত ? জিবরাইল ফেরেশতা সংবাদ বহন ও আজরাইল ফেরেশতা মানুষের জান কবজ করার উদ্দেশ্যে না হয় পৃথিবীতে আসে ও চলে যায়। কিন্তু মিকাইল ফেরেশতা পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না আবহাওয়া বিভাগের কাজ বন্ধ করে। কেরামান ও কাতেবীন ফেরেশতাদ্বয় ডাইরি লেখা ছেড়ে দিয়ে মানুষের কাঁধ থেকে এক পা বাইরেই দিতে পারে না এবং মনকির ও নকিরকে তো জীবন কাটাতে হচ্ছে মানুষের কবরে কবরেই পৃথিবীতে। এরা যদি নির্বাসিত বলে সাব্যস্ত না হন, তবে আমি নির্বাসিত হই কোন বিচারে? আমিও তো আল্লাহর আদেশে আমার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছি পৃথিবীতে বসে। বরঞ্চ আমি ওদের প্রত্যেকের চেয়ে মুক্ত ও স্বাধীন।

আরজ আলীঃ আপনার দাবী হচ্ছে, আপনি ফেরেশতাদের থেকেও ক্ষমতাবান?

আগন্তুকঃ আমি কোথায় তা বললাম? আল্লাহই তো বলেছেন। জিবরাইল ফেরেশতা সংবাদবাহক। সে আল্লাহর সকালের আদেশ কারো কাছে বিকেলে পৌঁছাতে পারে না। সীরাত পড়ে দেখুন, কতবার জিব্রাইল দেরী করে এসেছে। নবীকে বিষ দেয়ার সময়ও ফেরেশতার আগমন হয় বিষযুক্ত খাবার মুখে দেয়ার পরে [63] [64] [65] [66]। একবার তো আয়িশার খাটের নিচে কুকুর থাকায় ঘরে ঢুকতেই পারলো না [67]। ভেবে দেখুন, আল্লাহর ওহীর মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে তিনি চলে গেলেন ঘরে কুকুর থাকায়! বাইরে একটু অপেক্ষা করলেও তো পারতেন, তাই না? মিকাইল ফেরেশতা আবহাওয়া পরিচালক ও খাদ্য পরিবেশক। সে আল্লাহর সকালের আদেশের বৃষ্টি বিকেলে এবং বাংলাদেশের বৃষ্টি আরবদেশে বর্ষাতে পারে না, পারে না ধনীর খাদ্য গরীবকে দান করতে। এভাবে প্রত্যেক ফেরেশতাই আছে তাদের নিজ নিজ কর্তব্যের নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ, কিন্তু একজনার কাজেরও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কিন্তু আমার কর্তব্য আল্লাহর পরীক্ষা নেয়ার কাজ সম্পাদনে আল্লাহ আমাকে এরূপ কোনো নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেননি। আমার পরীক্ষা কাজের সকাল-বিকাল নেই বা শীত-বসন্ত নেই, এশিয়া-ইউরোপ নেই। নেই যুব-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব পার্থক্যের নির্দেশ। বস্তুত আমি বিতাড়িত বা নির্বাসিত নই, অন্যান্য ফেরেশতাদের মতোই আমি কর্তব্যের খাতিরে প্রেরিত হয়েছি পৃথিবীতে। আমি আল্লাহর মনোনীত শিক্ষক – বিশ্ববাসীর বিশ্বাসের পরীক্ষক। এবং কোনদিন আমি আমার কাজে কোন গাফিলতি করিনি। আল্লাহ সাক্ষী।

আরজ আলীঃ এগুলো সর্বৈব মিথ্যা কথা। আদমকে সিজদা না করায় আপনি ঘৃণিত ও অধঃপতিত হয়েছেন, সেই কারণেই আপনি শত্রুতাবশতঃ আদমকে নিষিদ্ধ ফল খাইয়ে আদমকেও অধঃপতিত করেছেন। আল্লাহ পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছেন, শয়তান মানুষের শক্র। এটিই সত্য।

আগন্তুকঃ অভিশপ্ত এবং অধঃপতিত কেউ কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়, বলতে পারেন? আমার ক্ষমতা আমি কোথা থেকে পাই? আমি অধঃপতিত, নাকি পুরস্কৃত হয়েছি ও পদোন্নতি লাভ করেছি এবং মানবকুলের বন্ধুর কাজই করেছি? বুঝতে পারছি, আমার কথা শুনে আপনি একটু বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে একটু বুঝিয়ে বলি।

ফেরেশতারা নূরের তৈরি। তাই পাক-সাফ বটে, তবে ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি নেহাত কম। বাসার যন্ত্রপাতি কিংবা আসবাবপত্রের চাইতে বেশি বুদ্ধি তাদের নেই। নিজেরা কোনো কাজই করতে পারে না আল্লাহর হুকুম তামিল করা ছাড়া। ’জ্বি হুজুর’ ছাড়া ’না হুজুর’ বলার ওদের অভ্যাস নেই। তবে একদিন বেচারারা অনেক সাহস জুটিয়ে ’না হুজুর’ বলেছিল বটে, কিন্তু সেটিও খাটেনি। আল্লাহ পৃথিবীতে মানবজাতি সৃষ্টির পরিকল্পনা ঠিক করে আদমকে বানাবার পূর্বে ফেরেশতাগণের আক্কেল পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তাতে তারা আল্লাহকে বলেছিলেন, “মানুষ আপনার হুকুম-আহকাম মানবে না বা ইবাদত করবে না। সুতরাং আদম সৃষ্টি না করাই উত্তম।“ [68]

আরজ আলীঃ আপনি এখন ফেরেশতাদেরও অপমান করছেন।

আগন্তুকঃ অপমান কোথায়? আপনার বাসার চেয়ার টেবিল কিংবা খাটকে আপনি নিজের আরামের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যার নিজস্ব চিন্তাভাবনা কিংবা যুক্তিবোধ বলতে কিছু নেই। মানুষ এখন রোবট বানাচ্ছে, বাসার কাজ করার জন্যে। সেগুলোর নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি নেই। যা হুকুম করা হয়, যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় সেগুলো সেভাবেই কাজ করে। ফেরেশতারাও তো সেরকমই। আপনি বলুন, তাদের নিজস্ব বিচার বিবেচনা বলে কি কিছু আছে? আর একটা যন্ত্র তা সে যত দামী পদার্থ দিয়েই তৈরি হোক না কেন, বিবেক বুদ্ধি না থাকলে তার মূল্য কতটুকু?

ইবলিশের সততা

দৃশ্য -০৬
স্থানঃ আরজ আলীর কুঁড়েঘর
সময়ঃ দুপুর
চরিত্রঃ আরজ আলী, আগন্তুক, আরজ আলীর স্ত্রী
ঘটনাঃ আরজ আলী বিতর্কে জেতার জন্য মরিয়া। আগন্তুকের চেহারায় আগের চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাস আর অহংকার। 

আগন্তুকঃ আল্লাহকে খুশি করার জন্য আমি মিথ্যা সিজদাও কিন্তু করতে পারতাম। অন্তরে ঘৃণা আর বাইরে খুশি মনে সিজদা করলে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিতে পারতেন না।

আরজ আলীঃ আপনি মুখে এক আর অন্তরে ভিন্ন কিছু ভাবলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনার অন্তরের কথা জেনে ফেলতেন। আল্লাহর সাথে চালাকি করে আপনি রেহাই পেতেন না।

আগন্তুকঃ আপনার কি মনে হয়, অন্য ফেরেশতাগণ আদম সন্তানের কর্মকান্ডে খুব খুশী? তা তো নয়। তারা তো আদম সৃষ্টির সময়ই ঘোরতর বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু আল্লাহকে খুশী করার জন্যেই অন্তরের কথা অন্তরে রেখে বাইরে তারা সিজদা করেছিল। তাদের অন্তরে ছিল এক, বাইরে আরেক। আমার অন্তর বাহির সমান। সেইদিন অন্তরে কার কী আছে, আল্লাহ তো সেটি দেখেননি। দেখেছেন কে সিজদা করে, আর কে করে না। একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষই কোনদিন এমন কিছু করবেন না, যাতে তার আত্মসম্মান নষ্ট হয়। আর আমি তো বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন একজন জ্বীন। কীভাবে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিই?

আরজ আলীঃ আপনি যত যাই বলেন, আল্লাহ তো কোরআনে আর মিথ্যা কথা লিখবেন না। আপনি কি বলতে চান, কোরআনে আল্লাহ মিথ্যা বলেছেন?

আগন্তুকঃ সূরা আনফালের ৪৩ নম্বর আয়াত আপনি পড়েছেন জনাব? সেখানে কী বলা আছে, বলুন তো? আয়াতটির প্রেক্ষাপট এবং ঘটনাবলী ভালভাবে পড়ে দেখেছেন? স্বপ্নযোগে কাফেরদের সংখ্যা কম করে দেখানো, মুসলিমদের মনোবল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, এটি কি মিথ্যা নয়? তাহলে কীভাবে বলছেন, আল্লাহ প্রয়োজনে মিথ্যা বা ছলনার আশ্রয় নেন না?

আরজ আলীঃ জনাব, এখন কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। সূরা আনফালের ৪৩ নম্বর আয়াতে যেটি বলা হয়েছে, আল্লাহ মুমিনদের প্রয়োজনেই নবীকে একটি মিথ্যা স্বপ্ন দেখাইয়াছিলেন। তাই বলে কি কোরআন মিথ্যা হয়ে যাবে?

আগন্তুকঃ সূরা আল ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াত আপনি পড়েননি? সেখানেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কূটকৌশলকারী। আল্লাহ চাইলে কূটকৌশলের আশ্রয়ও নিতে পারেন। কোরআনই এর সাক্ষ্য দিচ্ছে।

আরজ আলীঃ আপনি বলতে চাচ্ছেন, আল্লাহ প্রতারণাও করেন? আল্লাহ আসলে আপনাকে শাস্তি দিয়ে উচিত কাজটিই করেছেন। এই কারণেই আল্লাহ আপনাকে জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল পোড়াবেন।

আগন্তুকঃ সেটি আপনি বলতেই পারেন। আল্লাহ আছেন আমি জানি, আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন তাও আমি ভালভাবেই জানি। সেই শাস্তির সত্যতা জেনে বুঝেই নিজেকে উৎসর্গ করেছি, আল্লাহর অন্তরের ইচ্ছেটি বাস্তবায়ন করতে। আদমকে বানিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বললেন – তোমরা আদমকে সিজদা করো। আল্লাহর হুকুম পেয়ে সব ফেরেশতা একযোগে অর্থাৎ জামাতের সহিত আদমকে কেবলা বানিয়ে সিজদা করলো। কিন্তু আমি সে সিজদা করলাম না। আল্লাহর আসনে আদমকে বসিয়ে তাকে সিজদা করতে আমার বিবেক বাধা দিলো। আমার বিবেক বললো যে, আল্লাহ পরিস্কার ভাষায় বলেছেন, “আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা কোরো না।“ তবে সেদিন কেন আদমকে সিজদা করতে বললেন? হয়তো এর কারণ ফেরেশতাদের আক্কেল পরীক্ষা করা। আল্লাহ দেখতে চান যে, ওদের তুচ্ছ করা আদমকে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ফেরেশতারা সিজদা করতে আপত্তি করে কি-না।

আরজ আলীঃ কিন্তু সেই সময়ে এটি তো আপনার যুক্তি ছিল না। আপনি অহংকার করে সিজদা করেননি।

আগন্তুকঃ জনাব, আমি কী কারণে সিজদা করিনি, সেটি তো আমিই সবচাইতে ভাল বলতে পারবো। আমার আত্মপক্ষ সমর্থনটি কি আপনারা কোনদিন আমার কাছ থেকে শুনতে চেয়েছেন? নাকি আল্লাহর পাঠানো গ্রন্থ থেকে আমার বক্তব্যটি পড়েছেন? ন্যায়বিচার তো হবে, আমার কথাটি আমার কাছ থেকেই শুনলে। অন্যের মুখ থেকে আমার অপরাধের কথা শুনলে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনটি শোনাও আপনার কর্তব্য নয় কি?

মনে করুন – কোনো এক ব্যক্তি তার পাঁচটি ছেলেকে ডেকে জনৈক পথিককে দেখিয়ে বললো, তোমরা সবাই ওকে বাবা বলে ডাকো। পিতার আদেশ পালন করা কর্তব্য, এ নীতিবাক্যটি পালন করে চারটি ছেলেই সেই পথিককে ‘বাবা‘ বলে ডাকলো। কিন্তু একটি ছেলে ডাকলো না। সে ভাবলো, ‘পিতা‘ কখনো দুজন হতে পারে না। পথিককে ‘বাবা‘ বললে তা হবে মিথ্যে কথা বলা। আর ‘পিতা‘ তো আগেই বলেছেন, কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। আমার মুখে পথিককে বাবা ডাকার মধুর শব্দটি শুনে পিতা খুশি হবার জন্য নিশ্চয়ই এ কথাটি বলেননি, বলেছেন আমাদের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্য। সুতরাং পিতার এ আদেশটি অন্ধভাবে না মানাই শ্রেয়। এ ভেবে সে ছেলেটি তার জীবনের মহাকর্তব্য পালন করলো, কপট পিতাকে মিথ্যা ‘বাবা‘ ডাকলো না। ছেলেদের পিতা তার চার ছেলের অজ্ঞতা দেখে কষ্ট পেলেন এবং এক ছেলেকে বিজ্ঞতার পুরস্কার বাবদ তাকে দিলেন পুরস্কার।

আরজ আলীঃ আপনার এসব কথার কোন অর্থই হয় না। কারণ আল্লাহর হুকুম পালন করার চাইতে অন্য কোন কিছুই গুরুত্বপুর্ণ হতে পারে না।

আগন্তুকঃ আল্লাহ কি মনের বিচার করেন, নাকি শুধু কাজের বিচার? আপনি গাড়ি চালাবার সময় না চাইতেও কাউকে মেরে ফেললেন, একটি বাচ্চা ছেলে নিজের দোষেই গাড়ির নিচে চলে আসলো। আল্লাহ কি বুঝবেন না, আপনার অন্তরের কথা? আল্লাহ হলেন অন্তর্যামী। মানুষ বা ফেরেশতা কারো বাহ্যিক আচার-আচরণ দেখে তিনি তুষ্ট হন না, বিচার করেন মনের। আদমকে সিজদা করার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ ফেরেশতাগণের আক্কেলের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আমি তাতে উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি আমাকে দান করেছেন বিজয়ের একটি নিশানা। কেউ কেউ বলে এটি নাকি আমার পরাজয়ের নিশানা বা লানতের তাওক। বস্তুত আল্লাহ আমাকে দান করেছেন বিজয়ের নিদর্শনস্বরূপ অসাধারণ ক্ষমতা।

আরজ আলীঃ আমরা মুমিনেরা বিশ্বাস করি যে, আপনি আদমের শক্র, আদম জাতির শক্র। কেননা নিষিদ্ধ ফল খাইয়ে আপনি আদমকে বেহেশত ছাড়া করেছেন। এটাই তো কেয়ামত পর্যন্ত আপনার সাথে শত্রুতার জন্য যথেষ্ট কারণ।

আগন্তুকঃ বেহেস্ত হলো চিরপবিত্র স্থান। সেখানে ওসব নাপাকীর কোনো স্থান নেই। যৌনক্রিয়ায় নাকি মানুষ নাপাক হয়ে যায়। কাজেই আদম-হাওয়া বেহেশতে থাকলে তাদের যৌনক্রিয়া আজীবন বন্ধ রাখতে হতো। ফলে আদম থাকতেন নিঃসন্তান ও নির্বংশ। আদমের প্রেমাসক্তি সম্পূরণ ও বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ আদম-হাওয়াকে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীতে তাদের বংশবৃদ্ধির গরজে।

আরজ আলীঃ এই তো ভুল বললেন। জান্নাতে যৌনক্রিয়া নিষিদ্ধ হয়ে থাকলে আমরা মুমিন বান্দাগণ জান্নাতে যেই হুর লাভ করবো, তাদের সাথে সঙ্গম করবো কীভাবে? হাদিসে বর্ণিত আছে, আমরা সেই সব সুন্দরী যুবতী হুরীদের সাথে অনন্তকাল যৌনলীলা চালাতে পারবো।

আগন্তুকঃ আদিকালের জান্নাতে হুরীগণ ছিল না, আপনি সেটিও জানেন না দেখছি। মনে পড়ে, আদমের নিঃসঙ্গতা কাটাবার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর বুকের বাম পাজর থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন [69] ? বলুন তো, সেই জান্নাতে হুরীগণ থাকলে, আদম কেন নিঃসঙ্গ বোধ করছিল? বেহেশতের মধ্যে তখন তিন জাতীয় ফলের গাছ ছিলো। প্রথমত সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ, এর ফলগুলো ছিলো সাধারণ খাদ্য। অর্থাৎ জীবনধারণের উপযোগী খাদ্য। দ্বিতীয়ত জীবন বৃক্ষ। এর ফলগুলো ছিলো অমরত্বের প্রতীক। অর্থাৎ পরমায়ুবর্ধক। তৃতীয়ত জ্ঞানদায়ক বৃক্ষ। অর্থাৎ জ্ঞানবৃদ্ধির সহায়ক। এই জ্ঞানদায়ক ফলটিই সেই নিষিদ্ধ ফল।

আরজ আলীঃ আর সেই ফলটি আপনার কারণেই আদম হাওয়াকে খেতে হলো! আপনার কারণেই তো আমাদের মানে মানুষের আজ এই দুর্দশা। আপনি সেদিন মা হাওয়াকে ধোঁকা না দিলে আজ আমরা জান্নাতের ফুল বাগানে খেলা করতাম।

আগন্তুকঃ আপনি ভুল ভাবছেন। আদমকে যখন বানানো হলো, তখন তিনি ছিলেন নির্জীব মাটির পুতুল এবং আল্লাহ যখন প্রাণদান করলেন, তখন হলেন তিনি সজীব পুতুল। তখন জ্ঞান বলে তার মধ্যে কিছুই ছিলো না। এমন কি লজ্জা-জ্ঞানও না। আদম-হাওয়া ছিলেন উলঙ্গ। ইতর প্রাণী ও মানুষের প্রধান পার্থক্য হলো লজ্জাজ্ঞান। আদম-হাওয়ার সেই লজ্জাজ্ঞান জন্মালো নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের পর। ক্রমে জন্মালো ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিবিধ জ্ঞান, নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের ফলে। অর্থাৎ নীতি নৈতিকতার জ্ঞান, যা মানুষকে সত্যিকারের বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মর্যাদা দান করে, সেটিই অর্জিত হলো। পরাজয় হলো অন্ধ আনুগত্যের, অন্ধবিশ্বাসের। সেখানে জন্ম নিলো যুক্তিবোধের, জ্ঞানের। সেই নিষিদ্ধ ফল ছেঁড়ার ফলে বিবি হাওয়া হলেন রজঃস্বলা। নারী লাভ করলো তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা, মা হওয়ার এবং সন্তানকে ভালবাসার। কাজেই নিষিদ্ধ ফল না খেলে হযরত আদম থাকতেন জ্ঞানশূন্য আর বিবি হাওয়া থাকতেন বন্ধ্যা। আদমের জ্ঞান ও বিবি হাওয়ার সন্তানোৎপাদক শক্তি জন্মালো নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ফলে। সুতরাং নিষিদ্ধ ফল খাইয়ে আমি শুধু আদম-হাওয়ারই নয়, তাবৎ মানবজাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বংশবিস্তারের সহায়তাই করেছি, যা অন্য কোনো ফেরেশতা করেননি। কার্যত আমি মানুষের পিতার চেয়ে ভক্তির পাত্র এবং গুরুর চেয়ে মান্যবর। আমি না থাকলে আপনাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকতো না। দুঃখের বিষয় এই যে, কতক মানুষ তা বাহ্যত মানতে চান না, তবে কার্যত মেনে চলেন। আর তাতেই আমি সন্তুষ্ট কেননা একজন বিশ্বাসী মানুষ দিনেরাতে নানা কারণে যতবার আমার নামটি মুখে উচ্চারণ করেন, মনে হয় যে, ততোবার তার বাবার নামও উচ্চারণ করেন না। বিশেষত আমার নামটি তাদের প্রাতঃস্মরণীয় ও অগ্রপাঠ্য।

আরজ আলীঃ আপনার কথা না মানলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, কথা বলে আনন্দ পাচ্ছি। এত বিরাট কর্মযজ্ঞ, এত বিশাল কাজ করা চাট্টিখানি কথা নয়।

আগন্তুকঃ আপনি ভাবছেন, এ বিরাট পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে পথভ্রষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় কিভাবে? আপনার এ ভাবনাটা অমূলক নয়। আসলে ও কাজটা ততো কঠিন নয় আমার পক্ষে। কেননা আমি দুনিয়ার সকল অঞ্চলের সকল মানুষকে পথভ্রষ্ট করি না, করি ঈমানদারদেরকে। অর্থাৎ যারা আমাকে বিশ্বাস করে তাদেরকে। আমার উপর যাদের ঈমান নেই, অর্থাৎ আমি আছি বা আমার অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করেন, তারা তো কাফের। কেননা পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন “শয়তান আছে“ এবং হাদিসেও নবী বলেছেন, “শয়তান আছে“। এরপরেও কোনো ব্যক্তি যদি বলে, “শয়তান নেই“, তবে পবিত্র কোরআন-হাদিসের বাণী অমান্যকারী সে ব্যক্তি কি কাফের নয়?

আরজ আলীঃ আপনি কি কাফেরদেরও পথভ্রষ্ট করেন, নাকি শুধু মুমিনদের?

আগন্তুকঃ কাফেরের ঔরসে যে জন্মলাভ করে, সে তো জন্মসূত্রেই কাফের এবং সে নানারকম শেরেকি আর কুফরি কাজে লিপ্ত থাকে আমাকে ছাড়াই। আল্লাহর দৃষ্টিতে তাঁর যাবতীয় ভাল কাজই বৃথা এবং সে জাহান্নামি। তাঁকে তাঁর কৃতকর্মে বাধা দানের অর্থ হয় অসৎকাজে অর্থাৎ পাপকাজে বাধাদান করা। আল্লাহ তো কারো অসৎকাজে আমাকে বাধা দিতে বলেন নি। তাই আল্লাহর আদেশ মেনেই আমি কোনো বিধর্মীকে পথভ্রষ্ট করি না। কারণ পথভ্রষ্টকে আবারো পথভ্রষ্ট করলে সে তো সঠিক পথেই চলে আসবে। অর্থাৎ আমার অস্তিত্বের উপর যাদের ঈমান নেই, তাদের আমি পথভ্রষ্ট করি না, এমনকি তাদের কোনো সৎকাজেও না। তাইতো বর্তমান দুনিয়ায় ঈমানদারদের চেয়ে বেঈমানদার কাফেরগণই সৎকাজ করেন বেশী। খেয়াল করলে দেখবেন, ইউরোপের নাস্তিক প্রধান দেশগুলোতে মানুষ অপেক্ষাকৃত সৎ, দুর্নীতিমুক্ত, সমাজগুলো সুন্দর, ট্রাফিক সিগন্যালও কেউ ভাঙ্গে না। নেদারল্যান্ডসের মত অনেকগুলো দেশে বড় বড় জেলখানা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অপরাধীর অভাবে। পৃথিবীর সব মানুষই ইউরোপ আমেরিকার ভিসা পাওয়ার জন্য পাগল, কিন্তু মুসলমানের কাফের নাস্তিকদের দেশে যাওয়ার জন্য কেন এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে? অন্যদিকে, ধর্মপ্রবণ দেশগুলো দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানিতে শীর্ষে আছে। বাঙলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান দুর্নীতিতে পৃথিবীর সেরা।

আমাকে যেমন সকল মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে হয় না, তেমন সকল জায়গায় আমি সমভাবে অবস্থানও করি না। বিশ্বাসীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনা মন্দির ও ধর্মধামেই আমাকে সময় কাটাতে হয় বেশী। কেননা ওগুলোই হচ্ছে আমার প্রধান কর্মকেন্দ্র। মাদ্রাসায় আজকাল শিশুদের সাথে কী হয়, তা তো আপনি ভালভাবেই জানেন। মাদ্রাসার হুজুরগণ আমার সবচাইতে প্রিয় খদ্দের।

আরজ আলীঃ কিন্তু আপনি যে মানুষের সাথে থাকা সত্ত্বেও তারা আপনাকে দেখতে বা আপনার অস্তিত্বই অনুভব করতে পারে না, এর কারণ কী? আপনি কোথায় বসে মানুষকে পথভ্রষ্ট করেন?

আগন্তুকঃ আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা দান করেছেন মানুষের দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে এবং শিরায় শিরায় চলতে। যখন আমি কোনো ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করতে চাই, তখন তাকে বাইরে থেকে ডেকে বলি না যে, তুমি এ কাজটি কোরো না এবং ও কাজটি করো। আমি তখন প্রবেশ করি তার দেহের কেন্দ্রস্থল মস্তিষ্কে। সেখানে বসে আমি তার অবচেতন মনকে প্রলুব্ধ করি কোনো কাজ করতে বা না করতে। আমার কর্মকেন্দ্র মানুষের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে অবস্থিত। তাই দুষ্ট লোকেরা বলে টুপির নিচে শয়তান থাকে। তাদের সে কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কেননা আমার অধিষ্ঠানটি টুপির নিচেই, উপরে নয়।

আরজ আলীঃ কিন্তু এভাবে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে আপনার লাভ কী? আমরা নাহয় জান্নাতের লোভে কিংবা জাহান্নামের ভয়ে সব কাজ করি। আপনি কী কারণে এত বছর ধরে এই শয়তানি করে যাচ্ছেন?

আগন্তুকঃ ইসলামের সর্বোচ্চ আকীদা হচ্ছে, আল্লাহ সকল কিছুর ওপর কর্তৃত্বশীল, সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক। আমি আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না, কেউ পারে না। আমি যা কিছু করি তা দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছাকেই পূরণ করি এবং অন্যেরাও তা-ই করে থাকে। দুঃখের বিষয় এই যে, বিশ্বাসীরা তা পুরাপুরি মানেন না। তারা আল্লাহকে বলেন সর্বশক্তিমান, আবার কোনো কাজে আমার উপর দোষ চাপান। শুধু তাই নয়, তারা আরও বলেন, ‘শুভ কাজের কর্তা আল্লাহতা’লা এবং অশুভ কাজের কর্তা শয়তান।’ যদি তা-ই হয়, তবে “আল্লাহ সার্বভৌমত্বের মালিক, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বশক্তিমান – এ কথাটির সার্থকতা কী? এতে কি আমাকে ‘আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী ও দ্বিতীয় শক্তিধর বলে প্রমাণিত হয় না? বস্তুত তা নয়। আমার সমস্ত কাজেই আছে আল্লাহতালার অন্তরের সমর্থন। আল্লাহর সমর্থন ছাড়া এক মুহূর্ত আমি টিঁকে থাকতাম না।

আরজ আলীঃ আমি যতদূর ধর্মগ্রন্থ পড়েছি, আমার মনে হয়েছে আল্লাহ দুনিয়ার সব কাজ করবার ক্ষমতাই মানুষকে দান করেছেন। হায়াত, মউত, রিজিক ও অর্থসম্পদ, এ চারটি বিষয় রেখেছেন নিজের হাতে। এই যে, খুন-খারাবী, চুরি-ডাকাতি ও ব্যভিচার, এগুলো আসলে আপনিই মানুষকে দিয়ে করাচ্ছেন বা প্রলুব্ধ করছেন।

আগন্তুকঃ তাই যদি হয় অর্থাৎ আমার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে যদি কোনো এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে আহত ব্যক্তির জান কবজ করতে আজরাইল ফেরেশতার সেখানে আসবার কথা না। আর জান কবজ করতে আজরাইল না আসলে সেই ব্যক্তি তো মরবেও না। যদি তার ঐদিনই মৃত্যু হয়, তাহলে ঐ দিনটি মৃতব্যক্তির হায়াতের শেষ দিন নয় কি? কলেরা-বসন্তাদি রোগে অসংখ্য মানুষ মরে জীবাণুদের আক্রমণে। এই যে আপনাদের পৃথিবী কিছুদিন আগেই করোনা ভাইরাসে জর্জরিত হলো। সেই জীবাণুদের ক্ষমতা দেয় কে? জীবাণুদের রিজিকের ব্যবস্থা কে করেন?

আরজ আলীঃ সমস্ত জীবের খাদ্য বা রিজিক দান করেন স্বয়ং আল্লাহতালা। কিন্তু আল্লাহপাক রিজিক দিলেও অনেক সময় কিছু খারাপ লোক অন্যের রিজিক চুরি করে নিয়ে যায়। এর দায় তো আল্লাহর নয়, ঐ মানুষের।

আগন্তুকঃ তাই? তাহলে তো ঐ রিজিক আল্লাহ গৃহস্থের ভাগ্যে লেখেনইনি। লিখেছিলেন চোরের ভাগ্যেই। চোর-ডাকাতের রিজিক দান করেন কে? মন্ত্রীরা যে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করে, জনগণের টাকায় আমোদ ফূর্তি করে, সেইসব রিজিক তো আল্লাহই তাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহ যার রিজিক ও দৌলত যেখানে রেখেছেন, যে কোনও উপায়েই হোক সেখান থেকে এনে সে তা ভোগ করবেই। চোর চুরি করে বটে, কিন্তু আসলে সে তার আল্লাহর বরাদ্দকৃত খাদ্যই খায়। আমি যদি পথভ্রষ্ট করে চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে একের রিজিক অন্যকে খাওয়াতে পারি, তাতে তো আল্লাহর অক্ষমতায় প্রকাশ পায়। আল্লাহ কি আমার কাছে অসহায় যে, আমি আল্লাহর দেয়া রিজিক জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের ঘরে নেয়াচ্ছি? অন্যান্য জীবের রিজিকও আল্লাহতালাই জোগান। গেরস্ত বাড়ির হাঁস-মোরগ ও খাদ্যাদি চুরি করে শেয়াল-কুকুরে খায়। তাদের পথভ্রষ্ট করে কে?

আরজ আলীঃ আপনার খপ্পরে পড়েই তো মানুষ যিনা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। এগুলো আপনারই অপকর্ম। এর জন্যেও আপনি আল্লাহকে দায়ী করবেন?

আগন্তুকঃ যদি তাই হয়, তবে জারজ সন্তানের প্রাণদান করে কে? মানব সৃষ্টোত্তর কালে আল্লাহ যখন মানুষের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকেই তিনি জানেন যে, কোন প্রাণ কখন কোথায় জন্ম নিবে, কে কি কাজ করবে এবং অন্তিমে কে কোথায় যাবে, অর্থাৎ বেহেস্ত না দোযখে। তিনি এ-ও জানতেন যে, কে কার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। পবিত্র হাদিস গ্রন্থেই বলা আছে, আল্লাহ যার তাকদীরে যেটুকু যিনা নির্ধারণ করে রেখেছে, তা সে করবেই করবে [70]। তিনি ইচ্ছা করলে ব্যভিচারীদ্বয়কে দাম্পত্যবন্ধন দান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে জারজ সন্তানদের জন্য প্রাণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। জারজ সন্তানদের প্রাণদান করেন আল্লাহ ইচ্ছা করেই। ব্যভিচার ঘটিয়ে আমি আল্লাহর সেই ইচ্ছা এবং তাকদীরের লিখনকে পূরণ করি মাত্র।

আরজ আলীঃ আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ যুক্তিবাদী, আপনার সাথে যুক্তিতে পেরে ওঠা মুশকিল। ঈমানই আপনার যুক্তির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে। তবে আমার বিশ্বাস এই যে, আপনি না থাকলে মানবজাতির অনেক মঙ্গল হতো।

আগন্তুকঃ আরে, আমার নির্দেশিত পথে চলেই বর্তমান জগতের মানুষের যতো সব আয়-উন্নতি এবং তারই সাহায্যে চলছে ধর্মের বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য। আজ যদি আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই বা আমার পথভ্রষ্ট করার কাজ বন্ধ করি, তাহলে মানবসমাজে যে বিপর্যয় দেখা দেবে তা থেকে রক্ষা পাবে না বিশ্বাসীরাও।

প্রথমত কতিপয় রাষ্ট্ৰীয় দপ্তর থাকবে না। ফলে মন্ত্রিত্ব হারাবে অনেকে এবং রাজ্যশাসনে বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ হবে কর্মহীন। সুরশিল্পী, চিত্রশিল্পী থাকবে না, থাকবে না মাদকদ্রব্যের ব্যবসা। এছাড়া থাকবে না সুদ, ঘুষ, কালোবাজারী ইত্যাদির পেশা। আর এতে মানবসমাজে যে ভয়াবহ বেকারত্ব ও আর্থিক সংকট দেখা দেবে, তার প্রতিক্রিয়া হবে ধর্মরাজ্যেও। কেননা ঐসব অসৎবৃত্তির আয় দ্বারাই তো হচ্ছে যতো মসজিদ-মাদ্রাসার ছড়াছড়ি ও হজ্জ্বযাত্রীদের সংখ্যাবৃদ্ধি। হাদিসটি কিন্তু আগেই একবার আপনাকে বলেছি, মানুষ যদি গুনাহ না করতো, আল্লাহ মানুষ জাতিকে ধ্বংস করে এমন জাতি সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করে এবং তওবা করে।

আরজ আলীঃ আপনার সব কথাই আমি শুনছি, কিন্তু মানছি না। আপনি আমার মাথা অনেকটাই উল্টোপাল্টা করে দিয়েছেন, সেটি সত্য। তবে আমি এত সহজে ইমানহারা হবো না। আপনার কাছ থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাচ্ছি। আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম। আচ্ছা আপনি বলুন, হাজার হাজার বছর ধরে এসব শয়তানি কর্ম করতে আপনার একটুও কষ্ট লাগে না?

আগন্তুকঃ কোনো কিছুর অভাব আমার নেই তাই কোন দুঃখও আমার নেই। একটিমাত্র দুঃখ এই যে, মানুষ আল্লাহকে না জানার ফলে এবং তাঁর কুদরৎ অনুধাবন করতে না পেরে অযথা আমার উপর দোষারোপ করে। আল্লাহ ইচ্ছাময় ও সুমহান। এখন আর বেশী কথা বলার সময় নেই। শেষে একটি কথা বলে যাই, রামায়ণ মানুষ পড়ে কারণ রামায়ণ গল্পে রাবণ আছেন। রাবণ ছাড়া রামায়ণের কোন অর্থই হয় না। স্ট্রেঞ্জ কেইস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড নামে একটি দারুণ বই আছে, বইটি পড়বেন। আগে পড়া থাকলে আরো একবার পড়বেন। নামাজের সময় হচ্ছে, মসজিদে যাই।

আরজ আলীঃ শেষ একটি কথার উত্তর দিয়ে যান। আপনার মধ্যে কি আসলেই অহংকার নেই?

আগন্তুকঃ ভালভাবে কোরআন পড়ুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। ভালবাসার মানুষ একসাথে থাকলে বা কারো প্রতি প্রবল প্রেম থাকলে একের বৈশিষ্ট্য আরেকজনকে প্রভাবিত করে। ধীরে ধীরে একজন আরেকজনার বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে থাকে। ছাত্ররা যে শিক্ষককে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, মনের অজান্তেই তাঁর মত হতে শুরু করে। একজন শিক্ষকের তাই উচিত নয়, শিক্ষাদানের সময় ধুমপান করা। যার ফলে অবচেতনভাবেই ছাত্ররা সেটি শিখে যেতে পারে। আর আমি তো কোরআনের নির্দেশনাই অনুসরণ করেছি। আমি তো আল্লাহর রঙ গ্রহণ করলাম। আর রঙ এর দিক দিয়ে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক সুন্দর? আর আমি তো তাঁরই ইবাদাতকারী [71]। এখন যাই। আস-সালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।

আগন্তুক লোকটি চলে গেলেন মসজিদের দিকে।

আরজ আলীর স্ত্রীর প্রবেশ।

আরজ আলীর স্ত্রীঃ এতক্ষণ কারসাথে কথা বললেন?

আরজ আলীঃ ঠিক বুঝতে পারলাম না। লোকটা আশেকে খোদা, ইবলিশ শয়তান নাকি নিজেই আল্লাহ।

আরজ আলীর স্ত্রীঃ কি পাগলের মত বলছেন এসব। কাউকে তো আসতে দেখলাম না। যার সাথে কথা বললেন তিনি কোথায় গেলেন?

আরজ আলীঃ মসজিদে। কিন্তু নামাজ পড়তে না মুসুল্লিদের পথভ্রষ্ট করতে ঠিক জানি না।

আরজ আলীর স্ত্রীঃ গরমে আপনার বোধহয় মাথাটা গরম হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা কিছু খাবেন?

আরজ আলীঃ নাহ। মাথাটা কেমন জানি ঝিমঝিম করছে। যাই নামাজটা পড়ে আসি।

কথাটি বলার সাথে সাথেই মাইকে আজান দিতে শুরু করলো। জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে, রোদ সরাসরি গিয়ে পড়ছে টেবিলে রাখা বইগুলোর ওপর।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক হবে)

তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর
সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়
তুমি বাঁচাও তুমি মার।
তুমি বিনে কেহ নাই আল্লাহ, তুমি বিনে কেহ নাই।।

শয়তান

তথ্যসূত্রঃ

  1. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৫৪৯১ []
  2. সূরা কাহফ, আয়াত ৫০ []
  3. সূনান তিরমিজী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২১৫৮ [][][]
  4. সূরা আন’আম, আয়াত ৯৭ []
  5. সূরা আন’আম, আয়াত ৯৮ []
  6. সূরা ছোয়াদ, আয়াত ৮৫ []
  7. সূরা আল ইমরান, আয়াত ৫৪ []
  8. ইসলামের অন্যতম ভিত্তি তাকদীর প্রসঙ্গে []
  9. সূরা ক্বামার, আয়াত ৪৯ []
  10. সূরা বাকারা, আয়াত ৩০ []
  11. সূরা বাকারা, আয়াত ৩১৩২ []
  12. সূরা যারিয়াত, আয়াত ৫৬ []
  13. সূরা বাকারা, আয়াত ৩১ []
  14. সূরা আলাক, আয়াত []
  15. সূরা তাকভীর, আয়াত ২৯ []
  16. সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ৩৭ []
  17. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৫০১ []
  18. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), আল্লামা আলবানী একাডেমী, হাদিস নম্বরঃ ৪৭০৩ []
  19. সূরা হাদীদ, আয়াত ২২ []
  20. সূরা কাহফ, আয়াত ১৭ []
  21. সূরা ফাতির, আয়াত []
  22. সূরা তাকভীর, আয়াত ২৯ []
  23. সূরা আরাফ, আয়াত ১৬ []
  24. মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), হাদিস নম্বরঃ ২৩২৮ []
  25. সূরা আন’আম, আয়াত ১১২ []
  26. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৪৪৭ []
  27. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বরঃ ১১৮ []
  28. সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিস নম্বরঃ ৬৬৫৯ []
  29. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৫৯৪৯ []
  30. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৫৯৪৮ []
  31. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৮৫২ []
  32. সূরা কাসাস, আয়াত ৬৮ []
  33. সূরা আল মূলক, আয়াত []
  34. সূরা হিজর, আয়াত ২৩ []
  35. ইসলামে অমানবিক দাসপ্রথা []
  36. সূরা নাহল, আয়াত ৩৬ [][]
  37. জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুতে ইসলামের ভূমিকা []
  38. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নম্বরঃ ৩৩৩০ []
  39. ইসলাম ও নারী – সর্বোচ্চ সম্মান এবং সুমহান মর্যাদা! []
  40. ইসলাম কি ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে? []
  41. ইসলামি শরিয়া রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার []
  42. সূরা কাহফ, আয়াত ৮৬-৯০ []
  43. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৯৭২ []
  44. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৪৩৯ []
  45. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৪৪০ []
  46. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৯৬ []
  47. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৯৮ []
  48. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ২৯৯ []
  49. সহীহ হাদিসে কুদসি, হাদিস নম্বরঃ ১৬১ []
  50. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৮০২ []
  51. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৮০৩ []
  52. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৭৪৩৩ []
  53. সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিস নম্বরঃ ২৮৯ []
  54. হাদীস সম্ভার, হাদিস নম্বরঃ ২৩০৯ []
  55. চিত্রশিল্প বা ছবি বিষয়ে ইসলামের বিধান []
  56. ইসলাম এবং বিজ্ঞান শিক্ষার দ্বন্দ্ব []
  57. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৫৯৬ []
  58. সূনান আবু দাউদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৪৫৩৯ []
  59. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বরঃ ৪৩ []
  60. ইসলাম কি যাচাই করার সুযোগ দেয়? []
  61. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৭৭৬ []
  62. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বরঃ ৩৪৩১ []
  63. সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ), অনুবাদ, শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৫৫৭ []
  64. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিস নম্বরঃ ৪৫১৩ []
  65. সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিস নম্বরঃ ৪৫১২ []
  66. নবী মুহাম্মদের করুণ মৃত্যু []
  67. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৫৩৩৩ []
  68. সূরা বাকারা, আয়াত ৩০ []
  69. মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), হাদিস নম্বরঃ ৩২৩৮ []
  70. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বরঃ ৬৫১৩ []
  71. সূরা বাকারা, আয়াত ১৩৮ []

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

4 thoughts on “নাটকঃ শয়তানের জবানবন্দি

  • December 20, 2023 at 2:08 AM
    Permalink

    এক কথায় দুর্দান্ত।

    Reply
  • January 30, 2024 at 12:58 AM
    Permalink

    ধন্যবাদ

    Reply
  • January 30, 2024 at 1:22 AM
    Permalink

    বিশাল সংখ্যাক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ( বিজনেস ও স্বাথ সহ ) খুবই সহজ উপায় হলো ধম ।
    যারা বছরের পর পর আমাদের মতন সহজ সরল মানুষ রয়েছে ,,, যারা ধম কে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করি ।
    আমরা কখনোই আমাদের মধ্য এই চিন্তা টা ব্রইনে আনতে পারি না ,, ধম হলো প্রবিএ ও সম্মান এর স্থান ।
    তাহলে আমাদের সমাজে যেই ধমের মানুষ ই থাকুক না কেন ,,, ধমের জন্য হিংস্রতা ও সহিংসতা আসবে কেন।
    যারা আমাদের সুকৌশলে নিয়ন্ত্রিত করে আসছে তারা কখনোই আমাদের চিন্তা করতে সময় টুকু পযন্ত দেয় না ।
    এই ধমের গোলকধাঁধা য় কারা লাভবান এটা কি কখনো ভেবে দেখেছি ।
    লাভবান হচ্চে নিয়ন্ত্রিত হওয়া হাজার মানুষের মধ্য কয়েকজন যারা সুকৌশলে আমাদের লিড করে শোষন করে যাচ্চে।
    কারন ধম হলো প্রবিএ তাহলে এখানে সংহিতা’র অথ কি ।
    যদি এই রকম প্রশ্ন আসে ,,, তাহলে খুবই সহজ সমাধান
    খারাপ যা কিছু হয় তা শয়তানে করায় �🤭🤭🤭 🤭🤭🤭🤭

    Reply
  • February 16, 2024 at 10:31 PM
    Permalink

    দারুন, এক কথায় অসাধারণ লিখেছেন ভাই, লেখাটা পড়ে তো আমি পুরাই স্তব্ধ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *