সূচনা
ইরাম (إِرَم), কোরআনের সূরা আল-ফাজরের সপ্তম আয়াতে উল্লেখিত একটি শব্দ। বর্তমান সময়ের কিছু ইসলাম প্রচারকের দাবি, কোরআনের আয়াতে ইরাম শব্দটি একটি মিরাকল। কেন? তাদের বক্তব্য অনুসারে, কোরআনে উল্লেখিত ইরাম শব্দটি এমন একটি শহরের নাম, যার ব্যাপারে কেউ জানতোনা, যার কথা পৃথিবীর কোনো ইতিহাসে বলা ছিলনা। অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, যে ইরাম শহরের ব্যাপারে কেউ জানতোনা, যে ইরাম শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিলনা, সেই শহরের নাম কোরআনে এলো কিভাবে? সেই প্রশ্নের উত্তরেই এই প্রবন্ধ।
দাবি
এই তথাকথিত মিরাকলের একজন উল্লেখযোগ্য প্রচারক হচ্ছেন কানাডীয় গণিতবিদ ড. গ্যারি মিলার, একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম এবং প্রাক্তন খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক। কোরআনকে একটি ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলে প্রমাণ করার চেষ্টায় তিনি তার “দ্যা আমেজিং কোরআন” বইতে লিখেছেন, [1]
উপরন্তু, কোরআনের ৮৯তম সূরা (সূরা আল-ফাজর ৮৯:৭) ইরাম নামে একটি শহরের কথা উল্লেখ করে, যার পরিচিতি প্রাচীন ইতিহাসে ছিলনা এবং ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে যার কোনো অস্তিত্ব ছিলনা। যাইহোক, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর সংখ্যা সামনে এনেছিল কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য যা উল্লেখ করেছিল যে ১৯৭৩ সালে, সিরিয়ায় এবলা শহর খনন করা হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, শহরটি ৪৩০০ বছরের পুরোনো। কিন্তু, সেটাই সবচেয়ে বিষ্ময়কর নয়। গবেষকেরা এবলা লাইব্রেরিতে একটি তালিকা পেয়েছিলেন যেখানে এবলার সাথে ব্যবসা করা সকল শহরের নাম ছিল। বিশ্বাস করুন বা না করুন সেই তালিকায় ছিল ইরাম শহরের নাম। এবলার লোকেরা ইরামের লোকদের সাথে ব্যবসা করেছিলো।
উপসংহারে, আমি আপনাদেরকে নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে অনুরোধ করি (কোরআন ২৯:৫০-৫১),
“তারা বলেঃ রবের নিকট হতে তার প্রতি নিদর্শন প্রেরিত হয়না কেন? বলঃ নিদর্শন আল্লাহর ইচ্ছাধীন, আমিতো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র। এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার নিকট কুরআন অবতীর্ণ করেছি যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়? এতে অবশ্যই মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে।”
বিশ্লেষণ
সূরা আল-ফাজর আয়াত ৭ একটি অপূর্ণ বাক্য, যার প্রথমাংশ রয়েছে তার আগের আয়াতে। তাই, আগের আয়াতটি না পড়ে আয়াতটি বোঝা সম্ভব নয়।
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ ٦
you not considered how your Lord dealt with ʿAad –
— Saheeh Internationalতুমি কি দেখনি তোমার রাব্ব কি করেছিলেন ‘আদ বংশের –
— Sheikh Mujibur Rahmanতুমি কি দেখনি তোমার রব কিরূপ আচরণ করেছেন ‘আদ জাতির সাথে?
— Rawai Al-bayanআপনি দেখেননি আপনার রব কি (আচরণ) করেছিলেন ‘আদ বংশের—
(কোরআন ৮৯:৬)
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
إِرَمَ ذَاتِ ٱلْعِمَادِ ٧
(With) Iram – who had lofty pillars,
— Saheeh Internationalইরাম গোত্রের প্রতি, যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের?
— Sheikh Mujibur Rahmanইরাম গোত্রের সাথে, যারা ছিল সুউচ্চ স্তম্ভের অধিকারী?
— Rawai Al-bayanইরাম গোত্রের প্রতি [১]— যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের?—
(কোরআন ৮৯:৭)
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
লক্ষ্য করুন, প্রথম আয়াতটির সূচনাই হয়েছে, “তুমি কি দেখনি” বাক্যাংশটি দিয়ে। যা প্রকাশ করে যে এখানে কোনো অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এথেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে ১৪০০ বছর আগে ইরাম নামটি আরবদের কাছে অপরিচিত ছিলনা। আমরা সেই ঘটনাই স্মরণ করতে পারি যে ঘটনার সাথে আমরা আগে থেকেই পরিচিত থাকি। যে ঘটনার কথা আপনি কখনোই শোনেননি সেই ঘটনা আপনি কখনোই স্মরণ করতে পারবেননা।
১৪০০ বছর আগের আরবরা যে ইরাম নামটির সাথে পরিচিত ছিলেন তার প্রমাণ বহন করে আরব মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক রচিত সিরাতগ্রন্থ “সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)”, [2] যা সিরাতশাস্ত্রের ওপর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো, প্রামাণ্য এবং গ্রহণযোগ্য সিরাতগ্রন্থ।
আল্লাহ যখন মর্জি করলেন, তিনি প্রকাশ্যে তাঁর ধর্ম প্রকাশ করবেন, তাঁর নবীকে মহিমান্বিত করবেন, রাসুলের কাছে প্রদত্ত তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণ করবেন, তখন একসময় এক মেলায় রাসুলে করিমের (সা.) সঙ্গে দেখা হলো একদল আনসারের। অভ্যাসবশে তিনি একদিন আপন সম্প্রদায়ের কাছে আল্লাহর বাণী প্রচার করছিলেন, তখনই দেখা হলো একদল খাজরাজের সঙ্গের আল-আকাবায়। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাদের তিনি অনুগ্রহ করবেন।
আপন সম্প্রদায়ের কতিপয় শেখের নাম ধরে আসিম ইবনে উমর ইবনে কাতাদা আমাকে বলেছেন, তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর রাসুলে করিম (সা.) জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছিলেন খাজরাজদের এই দলটি ইহুদিদের মিত্র ভাবাপন্ন ছিল। তিনি তাদের সঙ্গে বসতে আমন্ত্রণ জানালেন। তারপর তাদের কাছে ইসলাম ধর্ম বুঝিয়ে দিলেন। কোরআন শরিফ পাঠ করে শোনালেন। আল্লাহ তাদের ইসলামের জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন, কারণ তারা ইহুদিদের পাশাপাশি বাস করত। এবং ইহুদিরা ছিল গ্রন্থের মানুষ, জ্ঞানের মানুষ আর তারা ছিল বহু-ঈশ্বরবাদী ও পৌত্তলিক। ওরা প্রায়ই তাদের এলাকায় গিয়ে তাদের আক্রমণ করত। এমনি করে কখনো মন-কষাকষি চললে ইহুদিরা তাদের বলত, ‘শিগগিরই আসবেন একজন রাসুল। তাঁর দিন সমাপন্ন। আমরা তাঁর পথ অনুসরণ করব, তাঁর সাহায্য নিয়ে তোমাদের হত্যা করব, যেমন করে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল আদ এবং ইরাম (তেমনি তোমরা শেষ হয়ে যাবে)।’
কাজেই রাসুলের (সা.) বাণীর কথা শুনেই তারা বলাবলি করল, ‘তিনিই সেই রাসুল, ইহুদিরা যার কথা আমাদের বলাবলি করত। সাবধান, ওরা যেন তাঁর কাছে আমাদের আগে পৌঁছাতে না পারে।’
ওরা রাসুলের (সা.) শিক্ষা গ্রহণ করল, মুসলমান হলো। বলল, ‘আমরা আমাদের লোকজনকে ত্যাগ করলাম। এত ঘৃণা এত হিংসা আর কোনো সম্প্রদায়ে নেই। হয়তো আল্লাহ আপনার মাধ্যমে তাদের একত্র করবেন। তাহলে চলুন আমরা তাদের কাছে যাই, আপনার ধর্মের দিকে আমন্ত্রণ জানাই। এভাবে তাদের যদি একত্রিত করেন আল্লাহ, তাহলে আপনার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ হতে পারবে না।’
… ওরা মদিনায় ফিরে সবাইকে রাসুলে করিমের (সা.) খবর দিল, ইসলাম গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করল। এমনি করে সবখানে রাষ্ট্র হয়ে গেল ইসলাম ছাড়া আনসারদের আর কোনো বাড়ি নেই এবং তার মধ্যে রাসুলে করিমের (সা.) আছে এক নির্দিষ্ট স্থান।
উপরিউক্ত উদ্ধৃতিটি প্রমাণ করে যে মদিনায় বসবাসরত ইহুদিগণ যখন ইসলামের নবীকে চিনতেন না তখনও তারা ইরামের গল্পটি জানতেন। তিনি হয়তো মদিনাবাসীদের থেকেই ইরামের গল্পটি শুনেছিলেন।
কোরআনের রচয়িতা আদৌ ইরাম শব্দটিকে একটি শহরের নাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অধিকাংশ অনুবাদকই ইরামকে একটি গোত্র বুঝেছেন। তাই এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে কোরআনের রচয়িতা জানতেন যে ইরাম নামে একটি শহর ছিল।
উপসংহার
কোরআনে উল্লেখিত ইরাম শব্দটিকে কেন্দ্র করে গ্যারি মিলারের মতো ইসলাম প্রচারকরা যে মিরাকলের কথা বলেন তার কোনো ভিত্তি নেই। কেননা, স্বয়ং কোরআনই প্রমাণ করে যে নবীর সমসাময়িক লোকেরা ইরামের সাথে পরিচিত ছিলেন। ইসলাম প্রচারকরা কেবল কোরআনে ইরাম নামটি উল্লেখিত হওয়ার বিষয়েই জোর দেন, কিন্তু নামটি কিভাবে উল্লেখিত হয়েছে সেটি এড়িয়ে যান।
আরব মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক রচিত নবীর প্রাচীনতম জীবনীগ্রন্থ সিরাতে রাসুলুল্লাহ থেকেও জানা যায় যে নবীর সাথে মদিনাবাসীদের পরিচয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই তারা ইরামের নিঃশেষ হওয়ার গল্পটি জানতেন। যারা মনে করেন কোরআনের আয়াতে ইরাম শব্দটি কোরআনকে ঐশীগ্রন্থ প্রমাণ করে, তাদের ইসলাম সম্পর্কে আরও পড়াশোনা করা উচিত।
আরও পড়ুন
তথ্যসূত্র
- Miller, G. The Amazing Quran. Abul-Qasim Publishing House (AQPH), 1992. p. 60. [↑]
- Akhand, S. Sirate Rasulullah (S): Mohanobir Prothom Bishod Jiboni, translation of Ibn Ishaq’s Sira Rasul Allah. Prothoma Prokashan, 1987. pp. 233-234 [↑]
Leave a Comment