কল্কি বৌদ্ধদের হত্যা করার জন্য আসবেন!

কল্কি

সাধারণ হিন্দুরা মনে করেন, কলি যুগে কল্কি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন সকল অন্যায়, অনাচার দূর করার জন্য। কিন্তু তারা কি জানেন, কল্কি পুরাণ অনুসারে, কল্কির পৃথিবীতে অবতরণের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য- বৌদ্ধদের ধ্বংস করা?

কল্কি পুরাণে কলিবংশের নানা পাপচারের বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘ এদের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা শূদ্র সেবাপরায়ণ’, ‘তারা ধর্ম নিন্দুক’, ‘এরা বেদ বর্জিত’(1) , ‘এরা বর্ণ সঙ্করকারক’(2) , ‘মঠ নিবাসী’, ‘ তারা সবসময় নীচদের সাথেই মেলামেশা করতে চায়’ (3)

‘মঠ নিবাসী’ শব্দে অনুমান হয়, এখানে হয়তো বৌদ্ধদের কথা বলা হচ্ছে। এখানে ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও পরে স্পষ্ট হয়ে যাবে ব্যাপারটি।

এছাড়া কল্কিপুরাণে কলিযুগের বিভিন্ন অধর্ম গুলির মধ্যে পড়ছে-

  • এই সময় শূদ্রেরা প্রতিগ্রহপরায়ণ হবে অর্থাৎ অন্যের দান গ্রহণ করবে এবং পরস্বাপহারী হবে অর্থাৎ অন্যের ধন অপহরণ করবে। (4)
  • এই কালে বর-কনের পরস্পর স্বীকার মাত্রই বিবাহ  সম্পন্ন হয়ে যাবে। (4)
  • ব্রাহ্মণেরা পরান্নলোলুপ হবে। তারা চণ্ডালের পুরোহিত হতেও অস্বীকার করবে না।(5)
  • স্ত্রীলোক আর বিধবা হবে না। তারা স্বেচ্ছাচারিণী হবে।(5)
  • কলির তৃতীয় পাদে বর্ণ সঙ্কর হতে থাকবে, (6)
  • চতুর্থ পাদে সকলে একবর্ণ হবে… (6)
  • কল্কির পিতা বিষ্ণুযশও কলিকালে ব্রাহ্মণের দুরবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন ব্রাহ্মণেরা, ‘শূদ্র সেবক হয়েছেন’।(7)

অবাক হবার কিছু নেই, কলিযুগের অনেকানেক অধর্মের মধ্যে এগুলিও অধর্মের মধ্যে পড়ছেঃ কলিযুগে বর্ণ বৈষম্য থাকবেনা, শূদ্র-চণ্ডালদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, স্ত্রীলোক বিধবা হবে না, বর-কনের সম্মতি মাত্রে বিবাহ হবে।এই ধরণের ঘোর অনাচার দূর করে সত্য যুগের মতো জাতিভেদ, সহমরণ বা বিধবার আচরণীয় কঠোর ব্রহ্মচর্য ইত্যাদি ফিরিয়ে আনার জন্যই কি তাহলে কল্কি আসবেন?

কল্কিকে শিক্ষাদান শেষে তার গুরু পরশুরাম তাকে বলেন,

“তুমি দিগ্বিজয় করতে বের হয়ে ধর্ম বিবর্জিত কলিপ্রিয় রাজাদের পরাস্ত করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংহার করে দেবাপি ও মরু নামক দুই ধার্মিককে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করবে”।(8)

কল্কির স্তব করতে গিয়ে রাজারা কল্কিকে বলেন,

“এখন আপনি কলিকুল ধ্বংস করার জন্য এবং বৌদ্ধ,পাষণ্ড,ম্লেচ্ছ প্রভৃতিকে শাসনের জন্য কল্কি রূপে অবতীর্ণ হয়ে বৈদিক ধর্মরূপ সেতু রক্ষা করছেন।” (9)

সুতরাং কল্কি যে আসলে বৌদ্ধদের ধ্বংস করার জন্যই আসবেন, এটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল।

এরপরই কল্কি তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অর্থাৎ বৌদ্ধদের ধ্বংস করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। লক্ষ্যস্থল কীকটপুর, যেখানে অসংখ্য বৌদ্ধদের বাস। কল্কিপুরাণ থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দেয়া যাক-

“পরে তিনি (কল্কি) সেনাসমূহে পরিবৃত্ত হয়ে প্রথমত কীকটপুর (জয় করার জন্য) বহির্গত হলেন।(10) এই কীকটপুর অতীব বিস্তীর্ণ নগর।এটা বৌদ্ধদের প্রধান বাসস্থল। এই দেশে বৈদিক ধর্মের অনুষ্ঠান  নেই। এখানকার লোকেরা পিতৃ অর্চনা বা দেব অর্চনা করে না, এবং পরলোকের ভয়ও করে না। (11)এই দেশের অনেকেই শরীরে আত্মাভিমান করে। তারা দৃশ্যমান শরীর ছাড়া অন্য আত্মা স্বীকার করে না। তাদের কুলাভিমান বা জাত্যাভিমান কিছুমাত্র নেই। তারা ধনবিষয়ে, স্ত্রীপরিগ্রহ বিষয়ে বা ভোজন বিষয়ে সকলকে সমান জ্ঞান করে, কাউকেও উচু-নীচু মনে করে না।(12)

সুতরাং বৌদ্ধদের প্রধান দোষ হল- তারা হিন্দুদের বৈদিক ধর্মে বিশ্বাসী নয়, তারা পিতৃ অর্চনা করে না, তাদের পরলোকের ভয় নেই,তারা আত্মা স্বীকার করে না এবং সর্বোপরি তাদের ‘কুলাভিমান বা জাত্যাভিমান’ নেই, তারা সকলকে সমান জ্ঞান করে, কাউকে উচু নিচু মনে করে না।
বোঝার আর বাকি থাকে না , কল্কি আসলে যে পরধর্ম ধ্বংসকারী হিসেবেই অবতীর্ণ হবেন এবং পুনরায় সত্যযুগের মত বর্ণপ্রথার সংস্থাপন করবেন, যেখানে শূদ্র-চণ্ডালেরা নির্যাতিত হবে,উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ আবার সৃষ্টি হবে।

এরপরে কল্কির সাথে বৌদ্ধদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বর্ণনা কল্কিপুরাণে আছে, যেখানে বৌদ্ধদের পরাজিত করে বৌদ্ধ ধর্মের ধ্বংস সাধন করা হবে। যুদ্ধের বিবরণে বৌদ্ধদের এক সেনাপতির নাম দেখা যায় ‘জিন’। জৈন তীর্থঙ্করেরাই কিন্তু ‘জিন’ নামে সমধিক পরিচিত। তাহলে এর মধ্যে কি জৈনদের প্রতি বিদ্বেষও লুকিয়ে আছে?

কিকটপুরে উপস্থিত হয়ে কল্কি বৌদ্ধদের আক্রমণ করেন-

“… এরপর সিংহ যেমন হাতিকে আক্রমণ করে, তেমনি পাপাপহারী সর্ববিজয়ী বিষ্ণু কল্কি , সেই বৌদ্ধ সেনাকে আক্রমণ করলেন।(13)

কল্কির আক্রমণে বৌদ্ধ সৈন্যেরা পলায়ণে উদ্যত হলে কল্কি বলে ওঠেন,
“ওরে বৌদ্ধরা ! তোমরা রণাঙ্গন হতে পলায়ণ করো না, নিবৃত্ত হও, যুদ্ধ কর,তোমাদের যতদূর ক্ষমতা আছে, তা দেখাতে ভুলে যেও না। (14)

এরপর যুদ্ধের বিবরণ (15)হতে খানিকটা উদ্ধৃত করছি-

“মহাশক্তি কল্কি তুরঙ্গম ও শূলব্যথা পরিহার পূর্বক সংগ্রাম ভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে লাফ দ্বারা , ভ্রমণ দ্বারা, পদাঘাত দ্বারা, দন্তাঘাত দ্বারা ,কেশর বিক্ষেপ দ্বারা বৌদ্ধসেনাদের শত শত সহস্র সহস্র বিপক্ষকে ক্রোধভরে বিনাশ করলেন। কোনো কোনো যোদ্ধা (উক্ত ভীষণ তুরগের) নিশ্বাস বায়ুদ্বারা উড়তে উড়তে  অন্য দ্বীপে পতিত হল, কেঊ বা ঐ নিশ্বাসবায়ু দ্বারা প্রক্ষিপ্ত হওয়া মাত্র হাতি, ঘোড়া , রথ প্রভৃতিতে প্রতিহত হয়ে অন্য দ্বীপে গিয়ে পড়লো, কেউবা ঐ নিশ্বাসবায়ু দ্বারা প্রক্ষিপ্ত হওয়ামাত্র হাতি, ঘোড়া, রথ প্রভৃতিতে প্রতিহত হয়ে রণভূমিতেই পতিত হতে লাগল। গর্গ্য ও তার অনুচরেরা অল্প সময়ের মধ্যে ছয় হাজার বৌদ্ধসেনা বিনাশ করলেন। সসৈন্য ভর্গ্যও এক কোটি এক নিযুত সৈন্য সংহার করেন। বিশাল ও তার সেনারা পঁচিশ হাজার বৌদ্ধসেনাকে পরাজিত করেন। কবি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়ে  দুই পুত্রের সাহায্যে দুই অযুত বিপক্ষসেনার সংহার করেন।এভাবে প্রাজ্ঞ দশ লক্ষ ও সুমন্ত্রক পাঁচ লক্ষ সৈন্যকে পরাজিত করে রণশায়ী করেন। এরপর কলি হাসতে হাসতে জিনকে বলেন, ওরে দুর্মতি! পালিয়ে যেও না, সামনে এসো। সর্বত্র শুভাশুভ ফলদাতা অদৃষ্ট স্বরূপ আমাকে বিবেচনা করবে। তুমি এখনই আমার শরনিকরদ্বারা বিদীর্ণদেহ হয়ে পরলোকে গমন করবে, সেসময় কেউই তোমার সাথে যাবে না। অতএব তুমি বন্ধু বান্ধবদের সুন্দর মুখ দেখে নাও।”

এরপর (16)যুদ্ধে কল্কি বৌদ্ধ সেনাপতি জিনকে হত্যা করেন-

“এরপর পাগল হাতি যেমন তাল গাছ ভঙ্গ করে , তেমনি মহাযোদ্ধা কল্কি পদাঘাত দ্বারা জিনের কটিদেশ ভঙ্গ করে তাকে মাটিতে ফেলেন। বৌদ্ধ সেনারা জিনকে (রণভূমিতে) পতিত দেখে হা! হা! শব্দে চিৎকার করতে লাগল। ব্রাহ্মণগণ! শত্রু নিপাত হওয়াতে কল্কির সেনাদের আর আহ্লাদের পরিসীমা রইলো না।”

এরপর অবশিষ্ট বৌদ্ধ সৈন্যদেরও হত্যা করা হয়। বৌদ্ধদের পরাজয়ে দেবতারা প্রীত হন-

“(ধর্ম নিন্দুক গণ পরাস্ত হওয়াতে) পুনরায় যজ্ঞের আগুনে আহুতি দেওয়া হবে ভেবে দেবতারা পরম প্রীত হলেন।”(17)

বৌদ্ধসেনারা নিহত হলে, তাদের স্ত্রীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে উপস্থিত হন। বৌদ্ধদের স্ত্রীদের দেখে কল্কি যে ভাষার প্রয়োগ করেন, তাতে তাকে লম্পট ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না।

কল্কি বলেন,

“ অবলারা! আমি তোমাদের হিত ও উত্তম বাক্য বলছি ,শ্রবণ কর। নারীদের সাথে পুরুষদের যুদ্ধ করতে নেই। তোমাদের এই চাঁদের মত মুখে  অলকরাজি শোভা বিস্তার করছে।এটা দেখে সকলেরই মনে আনন্দ হয়।এখন কোন পুরুষ এই মুখে প্রহার করবে? এই মুখচন্দ্রে দীর্ঘাপাঙ্গ  বিশিষ্ট প্রফুল্ল কমল সদৃশ নয়নে তারা রূপ ভ্রমর ভ্রমণ করছে।কোন পুরুষ এমন মুখে প্রহার করবে? তোমাদের এই স্তন দুটির উপর থাকা হার  শিবের গলায় থাকা সাপের মতন শোভা পাচ্ছে । এসব দেখে  কামদেবের দর্পও চূর্ণ হয়, অতএব কোন পুরুষ এমন স্থানে প্রহার করতে পারবে? চঞ্চল অলোকরূপ চকোর দ্বারা যার চন্দ্রিকা আক্রান্ত হয়েছে, এমন কলঙ্ক হীন মুখচন্দ্রে কোন পুরুষ প্রহার করতে সমর্থ হবে? তোমাদের এই স্তনভারাক্রান্ত নিতান্ত ক্ষীন সূক্ষ্ম-লোম-রাজি বিরাজিত এই মধ্যদেশে কোন পুরুষ প্রহার করতে সমর্থ হবে? তোমাদের এই নয়নানন্দদায়ক অংশুক সমাচ্ছাদিত দোষ-স্পর্শ পরিশূন্য পরম রমনীয় সূঘন জঘনে কোন পুরুষ বানাঘাত করতে সমর্থ হবে?”(18)

কল্কির বৌদ্ধ-ম্লেচ্ছদের হত্যা ও পরাজিত করার পর কল্কি পুরাণে বলা হচ্ছে-

“যারা এই ম্লেচ্ছজয় ও বৌদ্ধবিনাশের বিষয় আদর পূর্বক কীর্তন বা শ্রবণ করবেন, তাদের সকল দুঃখ দূর হবে। তারা সর্বদা কল্যাণভাজন হবেন। মাধবের প্রতি তাদের ভক্তি জন্মাবে; সুতরাং তাদের পুনরায় জন্ম বা মৃত্যু হবে না। এই বিষয় শ্রবণ দ্বারা সমুদায় সম্পত্তি লাভ হয়, মায়ামোহ নিরাকৃত হয়ে যায়, সংসারের তাপ আর সহ্য করতে হয় না।”(19)

তথ্যসূত্র-
(1) ১/১/২৪
(2) ১/১/২৬
(3) ১/১/২৭
(4) ১/১/৩০
(5) ১/১/৩৪
(6)( ১/১/৩৮
(7) ১/২/৪৭
(8) ১/৩/১০
(9) ২/৩/৩০
(10) ২/৬/৪০
(11) ২/৬/৪১
(12) ২/৬/৪২
(13) ২/৭/১
(14) ২/৭/৩
(15) ২/৭/১০ – ২/৭/১৬
(16) ২/৭/২৬ – ২/৭/২৭
(17) ২/৭/৫১
(18) ৩/১/২০ – ৩/১/২৬
(19) ৩/১/৪৪

সহায়ক গ্রন্থ-

জগন্মোহন তর্কালঙ্কার কর্তৃক অনুবাদিত কল্কি পুরাণ

প্রাসঙ্গিক লেখা-

বেদবিরোধী বুদ্ধকে কেন বিষ্ণুর অবতার বানানো হল? 

View Comments (7)

  • মানা গেলো না ,কারণ বুদ্ধ দেব হিন্দু ধর্মের দশ জন অবতারের মধ্যে একজন ,প্রত্যেক হিন্দু বুদ্ধ দেব কে পূজা করে

  • Website এ কি রাইট ক্লিক কাজ করে না ? ট্যাব দিয়ে ওপেন করতে গিয়া দেখি কাজ করে না।

  • রং ইনফো। কারণ কল্কি পুরাণ ব্যাস লিখেন নাই। কারণ কল্কি তখনও আসেন নাই ।

    • কল্কি তখন এসেছে কে বললো?

  • না , আমি এটা বিশ্বাস করিনা যে ভবিষ্যতে এটা ঘটবে! কিন্তু এই পুরাণে ভবিষ্যদ্বাণীর দাবী করা হয়েছে। দেখার বিষয় হল, এই ভবিষ্যদ্বাণীতে বৌদ্ধদের প্রতি বিদ্বেষ একদম সুস্পষ্ট। সেই বিদ্বেষের পটভূমিতেই কল্কি পুরাণ লেখা হয়েছিল এবং এতে কল্কি বৌদ্ধদের ধ্বংস করবেন ,এমন দেখানো হয়েছে। হিন্দু আর বৌদ্ধদের মধ্যে প্রাচীনকালের প্রতিযোগীতা ও বিদ্বেষের কথা অনেক লোকেই জানেন না, তাদের জ্ঞাতার্থেই এটা লেখা।

Leave a Comment