ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যা

আত্মহত্যা

আত্মহত্যা করা প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাক্তিই মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ততায় ভুগে যা মুলতঃ আত্মহত্যার সবথেকে প্রচলিত কারণ। মানসিক চাপে বিষাদগ্রস্হ মানুষটি একটা সময় মনে করেন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। মোটকথা আত্মহত্যার মাধ্যমে যন্ত্রণার স্থায়ী অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়ার এক অনড় বিশ্বাস ব্যাক্তির চিন্তায় গেঁথে যায়। আমরা প্রত্যেকেই ব্যাক্তিগত জীবনের কোন না কোন সময় কিংবা লম্বা সময় ধরে মানসিক চাপে কিংবা বিষন্নতায় ভুগি। আমরা যারা আধুনিক তারা অনেকেই হয়তো বিষন্নতা বুঝতে অসুবিধায় পরব, কিন্তু ডিপ্রেশন বুঝতে অসুবিধা হবেনা। মানসিক চাপ থেকেই একটা মানুষের ডিপ্রেশনের শুরু হয় যার চরম পর্যায়ে ব্যাক্তি মরে গিয়ে সকল জঞ্জাল থেকে মুক্তি পেতে চায়। হয়তো কিছুক্ষেত্রে এক্সেপশনাল হতে পারে তবে এক্সেপশনাল কখনো উদাহরণ হতে পারেনা।

এখন জেনে নেই ডিপ্রেশন কি?
ডিপ্রেশন হল একধরনের ইমোশনাল ইলনেস। আমরা সাধারণত মন খারাপকেই ডিপ্রেশন বলে থাকি। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞনে ডিপ্রেশন বলতে মন খারাপ থেকেও বেশি কিছু। ব্যাক্তির স্বাভাবিক অনুভূতি কিংবা মেজাজের অবনতিকেই মুলত ডিপ্রেশন বলে। এটাকে ‘মেজর ডিপ্রেসিভ ইলনেস’ও বলা হয়। এটা এক ধরণের মেন্টাল্লি ডিসর্ডার যা বিভিন্ন মাত্রায় হতে পারে। তবে ডিপ্রেশনের মানসিক অসুস্থতা আর মানষিক ভারসাম্যহীনতা এক নয়। মানসিক ভারসাম্যতাও এক ধরণের মানসিক রোগ কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাক্তির চিন্তা চেতনা সম্পুর্ন লোপ পায়। কিন্তু ডিপ্রেশনে থাকা ব্যাক্তির চিন্তা চেতনা কিছুটা প্রভাবিত হলেও ৯৫% স্বাভাবিক থাকে। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে সবাই কম বেশি ডিপ্রেশনে ভুগে থাকি। গবেষনায় দেখা যায় প্রতি পাঁচ জনের এক জন জীবনের কোন না কোন সময়ে ডিপ্রেশনে ভুগে থাকে। সেক্ষেত্রে আপনি যদি মানষিক ভারসাম্যহীন ভেবে বসেন তাহলে বলতে হবে পৃথিবীর ১৪০ কোটি মানুষ মানসিক ভারসাম্যহীন পাগল।

গত কিছুদিন ধরেই ছোট বড় নারীবাদীদের দেখেছি আত্মহত্যা করা ব্যাক্তিকে মানসিক রোগি থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথচ তারা জানেই না এই মানসিক রোগ আর ভারসাম্যহীন আলাদা জিনিস। আমি তাদের উদ্দেশ্য বলি, মানসিক রোগি বলতে যা বুঝাতে চেয়েছেন তা কি আদৌ একজন আত্মহত্যাকারী ব্যাক্তি? বিষন্নতার কারনে ব্যাক্তি নিজেকে অর্থহীন ভাবতে শুরু করে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তখন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই তার কাছে সহজ এবং সমাধানের মনে হয়। যারা আত্মহত্যাকে মানসিক ভারসাম্যহীনের সাথে মিলাচ্ছেন তাদের মধ্যেও হয়তো অনেকেই কখনো না কখনো আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন কিংবা এটেম্পট করেছেন। যারা আত্মহত্যার এটেম্পটের পরও বেঁচে ফিরেছেন তাদের আচরণ কি মানসিক ভারসাম্যহীনদের মত?

যদিও ডিপ্রেশন একটি বায়োলজিক্যাল ইলনেস ভিত্তিক, মানসিক এবং সামাজিক কারণ এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সাইকলজি বা স্নায়ুতন্ত্রের শারীরবৃত্ত বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা যায় যে নিউরোট্রান্সমিটারস, যেমন নোরেপাইনফ্রাইন এবং সেরোটোনিনের কার্যকলাপের স্তর দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতায় পরিবর্তন করে। এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধগুলি এই ধরনের “রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা” সংশোধনে করে কাজ করে।

ডিপ্রেশন এক ধরণের আবেগজনিত মানসিক সমস্যা ধরা হয়। দুঃখবোধের মত সাধারণ আবেগ কোন ব্যাক্তিকে অযৌক্তিক, তীব্র ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী ঘিরে থাকে তখন তার স্বাভাবিক জীবনযাপন, কর্মতৎপরতা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে, এবং ডিপ্রেশনের শুরু সুচনা হয়। এধরনের ডিপ্রেশনকে ‘রিএকটিভ’ ডিপ্রেশন বলে। এতে মস্তিষ্কের ‘সেরোটনিন’ জাতীয় রাসায়নিক পদার্থের গুণগত ও পরিমাণগত তারতম্য ঘটে। যে কেউ যেকোনো সময় এতে আক্রান্ত হতে পারে। ধর্ম-বর্ণ, আর্থসামাজিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, কেউই বিষণ্নতার ঝুঁকিমুক্ত নয়। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ।

ডিপ্রেশনের অনেক কারন হতে পারে। তার মধ্যে; পারিবারিক ও সম্পর্কের সমস্যা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, একাকিত্ব, গর্ভকালীন ও প্রসবপরবর্তী সময়, বিবাহবিচ্ছেদ, প্রবাসজীবন, অভিবাসন, মাদকসেবন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কোন কোন সময় ডিপ্রেশন বিনা কারনেও হতে পারে। শরীর ও মনের ভেতর থেকে এক ধরণের ‘এন্ডোজেনাস’ ডিপ্রেশনের উৎপত্তি ঘটায়। ডিপ্রেশন অতমাত্রায় হলে আত্মহত্যার মত ঘঠনাও ঘটতে পারে।

ডিপ্রেশনের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে একে তিন স্তরে ফেলা যেতে পারে; মৃদু, মাঝারি ও গুরুতর। ডিপ্রেশনের লক্ষনীয় কারনগুলো হতে পারে- কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা, কোনো কিছু করতে ভালো না লাগা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হঠাৎ রেগে যাওয়া, আগে যেসব কাজ বা বিনোদন করতে ভালো লাগত এখন সেগুলো ভালো না লাগা, মনোযোগ কমে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ করা, ঘুমের সমস্যা (যেমন—খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয় বা ঘুম না হওয়া অথবা বেশি ঘুম হওয়া), রুচির সমস্যা (যেমন—খেতে ইচ্ছে না করা, খিদে না থাকা বা বেশি বেশি খাওয়া), যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, সাধারণ বিষয় ভুলে যাওয়া, সব সময় মৃত্যুর চিন্তা করা, নিজেকে অপরাধী ভাবা, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা করা ইত্যাদি। এ ছাড়া কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না—এমন কিছু শারীরিক সমস্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়; বিশেষত নারী রোগীদের মধ্যে, যেমন—মাথাব্যথা, মাথায় অস্বস্তি, মাথা-শরীর-হাত-পা জ্বালা করা, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা, শরীরব্যথা, ঘাড়ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বুক জ্বালা, বুকব্যথা, নিঃশ্বাসে কষ্ট ইত্যাদি। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব শারীরিক সমস্যার কারণ পাওয়া যায় না। নিজেকে খুব ছোট ও অপাঙেক্তয় মনে হতে পারে, উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আচরণের অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণের সব কটি একসঙ্গে একজনের মধ্যে সব সময় থাকবে না আবার কয়েকটি লক্ষণ থাকলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে কারও মধ্যে বিষণ্নতা সৃষ্টি হয়েছে। নির্ণয়ের জন্য অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সাইকোথেরাপি(ধারণা ও আচরণ পরিবর্তনের চিকিৎসা) ও বিষন্নতারোধী ঔষধ। রাতারাতি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এরকম ভাবাটা সম্পুর্ণ ভুল। এর জন্য যথেষ্ট সময় ও ধৈর্য দুই’ই প্রয়োজন। আবার অনেকেই মনে।করেন শুধুমাত্র মনোবিজ্ঞানীর দ্বারা সাইকোথেরাপির মাধ্যমেই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, এটা মোটেও নয়। গবেষনায় দেখা গেছে; শুধুমাত্র সাইকোথেরাপির মাধ্যমে ডিপ্রেশনে কোন পরিবর্তন আসেনা তবে ডিপ্রেশনরোধী ঔষধের মাধ্যমে ডিপ্রেশন থেকে আংশিক ফল পাওয়া যায় । পুরোপুরি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে হলে ঔষধ এবং সাইকোথেরাপি দুই’ই প্রয়োজন।

View Comments (1)

  • আমি জানতে চাই, মনবিজ্ঞান সেকশ্যনে যারা বিভিন্ন লেখা দিয়েছে, তাঁরা কি মনবিদ অথবা মনবিজ্ঞানী? নাকি, ব্যক্তিগত স্তরে, পড়াশোনার ভিত্তি থেকেই তাঁরা লেখার সুযোগ পেয়েছেন? আমার প্রশ্নের উত্তর যদি, ইমেলেই পাই, আমার খানিক সুবিধা হয়।

Leave a Comment