দুর্গাপূজা উৎসবকে আমি ঘেন্না করি। আরো বেশি ঘেন্না করি দুর্গা নামক প্রতারক এবং অসৎ দেবীকে, প্রতারণার মাধ্যমে যিনি মহিষাসুর নামক যোদ্ধাকে বধ করেছিলেন।
প্রতিবছরের মত এই বছরও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। হিন্দুদের দেবী দুর্গা নাকি আসবেন, এবং খারাপের বিনাশ করবেন। কিন্তু দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের যুদ্ধের যেই গল্প আমরা জানি, তা একেবারেই একপাক্ষিক গল্প। আমরা জানি, ইতিহাস বিজয়ীরাই রচনা করে৷ বিজয়ীদের ইতিহাসে পরাজিতরা সর্বদাই খারাপ এবং নোংরা হিসেবে চিত্রিত হয়। সেই বিজয়ীদের রচিত ইতিহাস থেকেও কিন্তু একেবারেই ভিন্ন একটি গল্প উঠে আসে৷ আমরা যা জানি, যা শুনি, বহুকাল ধরে যা জেনে এসেছি, তা কতটা নিরপেক্ষ, এবং কতটা সত্য, তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। একজন সভ্য শিক্ষিত মানুষের কাজই তা, প্রেজুডিস ভেঙ্গে পুরনো ধারণাগুলোকে আবারো যাচাই করা। আমরা কী জানি, কেন বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে ঘরে আলো জ্বালায় না? কেন তারা আজও শোক পালন করেন? মহিষাসুরকে বধের এই ঘটনাটি আসলেই কী ছিল? পৌরানিক গল্পের এই শক্তিশালী যোদ্ধা অসুর আসলে কে ছিলেন?
প্রতিটি পৌরানিক গল্পের কিছু আঞ্চলিক সত্যতা থাকে। কোন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া কোন আলোচিত ঘটনাকে পরবর্তীতে লোকের মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে কাহিনীগুলো ডালপালা মেলে। গল্পের রাজাগণ হয়ে ওঠেন এক একজন দেবতা, এক একজন ঈশ্বর বা অবতার। আর পরাজিত বাহিনীর লোকেরা হয়ে ওঠে শয়তান, জ্বীন, দানব, অসুর ইত্যাদি। কিন্তু সেইসব কাহিনীর মাঝেও লুকিয়ে থাকে কিছু বর্বর ইতিহাস, কিছু সত্যতা। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখনো যেই মূর্তিগুলো নির্মান করা হয়, সেখানে মহিষাসুরের গায়ের রঙ কেমন, আর দুর্গা কেমন। কাকে আপনার আপন মনে হয়? এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের গায়ের রঙ কেমন ছিল? দুর্গাপূজা কেন এতটাই বর্ণবাদী পূজা? একজন কালো চামড়ার আদিবাসী যোদ্ধাকে হত্যা করাকে হিন্দুরা কীভাবে উৎসব হিসেবে পালন করে? নরহত্যা কী উৎসবের বিষয় হতে পারে? এমনকি, চরম শত্রুকে হত্যা করেও কী উৎসব করা যায়? রক্তাক্ত মহিষাসুরকে হত্যার মাধ্যমে হিন্দুরা তাদের শিশুদের আসলে কী শিক্ষা দিচ্ছেন? হত্যার মাধ্যেম কী কোন সৎ নীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? মহিষাসুরকে হত্যার যেই মূর্তি নির্মান করা হয়, তা কী সাদা চামড়ার বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী কোন শক্তির হাতে আমাদের আপনজন, আমাদের যোদ্ধাদের প্রতারণার মাধ্যমে নিধনের ইতিহাস?
ভারতের জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা বাগানের কাছেই রয়েছে ৪৫টি অসুর পরিবার। অসুর পরিবার মানে কী? এই যুদ্ধ বিষয়ে তাদের বক্তব্য কী? তাদের বক্তব্য না জেনে মহা ধুমধাম করে দুর্গা দেবীর পূজা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়।
অসুররা হচ্ছে ভারতের একটি আদিম জনগোষ্ঠী। ভারতের অনেক গ্রামে এখনো সেই জনগোষ্ঠির মানুষ বসবাস করেন। ঝোবিপাট, বরপাট, চারুয়াপাট গ্রামের কথাই বলা যেতে পারে। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে তাদের ঘরে বাতি জ্বালানো হয় না, শোক পালন করা হয়। কারণ কী? কারণ তাদের মতে, তাদের পূর্বপুরুষ মহিষ রাজাকে দুর্গা নামের এক ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকারী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে হত্যা করেছিল। শারদীয়া উৎসবের দিনগুলি তাই তাঁদের কাছে শোক পালনের দিন। তারা বেদনার সাথে স্মরণ করেন বীর যোদ্ধা মহিষাসুরকে।
দুর্গাপূজার যেই ইতিহাস আমরা আজকে জানি, বিপুল প্রচারের মাধ্যমে যেসব বলা হয়, এগুলো তার একদম ভিন্ন একটি চিত্র। তা হয়তো আসলে ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের বেদ বিরোধী আদিবাসী মানুষদের নির্যাতনের ইতিহাস। মহিষাসুর এবং দেবী দুর্গার এই যুদ্ধকে হিন্দুরা এখন খারাপের সাথে ভালর যুদ্ধ বলে যতই প্রমাণের চেষ্টা করুক, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে স্বর্গের দেবতাদের বা সেই সময়ের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের প্রতারণা, এবং ইতরামি। মহিষাসুর নামক এক আদিবাসী রাজা বহিরাগত দেবগনের সাথে দীর্ঘসময় যুদ্ধ করে তাদের পরাস্ত করে কথিত স্বর্গ নামক এক রাজ্য অধিকার কেড়ে নেন। যুদ্ধে পরাজিত এবং বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের কাছে ধর্ণা দেন, কারণ তারা কেউই মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধে পেড়ে উঠছিল না। তাই সকল দেবতা বুদ্ধি বের করলেন, একজন নারীকে মহিষাসুরের কাছে পাঠাবার। কারণ অসুর নীতি অনুসারে, মহিষাসুর কখনই কোন নারীকে আঘাত করবেন না। সেই নারীটি হচ্ছে বর্তমান সময়ের পূজনীয় দুর্গাদেবী। সেই সময়ে মহা পরাক্রমশালী রাজা মহিষাসুরকে নিয়ে স্বর্গের দেবতাগণ, মানে সাদা চামড়ার বহিরাগত দেবতাগণ বিপদে পরেছিল। কিছুতেই এই আদিবাসী অসুরকে থামানো যাচ্ছিল না। তাদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এই এক মহিষাসুরই ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছিলেন। সেই সময়ে একজন নারীকে তাই পাঠানো হয়েছিল মহিষাসুরকে বধ করতে। নারীকে আঘাত না করার সুযোগটির পরিপূর্ণ সদব্যবহার করেছিল সেই সময়ের কথিত দেবতাগণ। সম্মুখ যুদ্ধে মহিষাসুরের সাথে সুবিধা করতে না পেরে, কৌশলে একজন নারীকে দিয়ে প্রতারনার মাধ্যমে খুন করিয়েছিল বীর মহিষাসুরকে। শুধু তাই নয়, আদিবাসীদের ওপর চালানো গণহত্যা এবং অমানবিক নিপীড়ন এখনো নানা সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি। হিন্দু পৌরানিক গল্পে যাই লেখা থাকুক না কেন।
অসুরেরা ছিলেন বেদ বিরোধী। তারা বেদ মানতেন না, বেদকে ঐশ্বরিক কেতাব বলে গণ্য করতেন না। তারা ‘ওম’ উচ্চারণে অসম্মত ছিলেন। এমনকি, কোন দেবতার মাতব্বরিই তারা মেনে নেন নি। তারাই ছিলেন এই অঞ্চলের ভূমিপুত্র। হিন্দুদের নানা পৌরানিক কাহিনীতে তাই অসুরদের চিত্রিত করা হয়েছে পশু রূপে, জঘণ্য খারাপ মানুষ রূপে। তাদের কাউকে চিত্রিত করা হয়েছে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক পশু রূপে, কাউকে চিত্রিত করা হয়েছে পশু রূপে। অথচ, তারাই এই অঞ্চলের আদি ভূমিপূত্র। তাদের গায়ের রঙ কালো। তারা আমাদেরই পুর্বপুরুষ।
তাই দুর্গা পূজার ইতিহাস হিন্দুদের এক লজ্জার ইতিহাস। তা এক প্রতারণা এবং আদিবাসীদের ওপর চালানো গণহত্যার সাক্ষর বহন করে। এই নিয়ে হুল্লোর করে হিন্দুরা নিজেদের প্রতারণার ইতিহাসকেই স্মরণ করে।
অনেক আদিবাসী গ্রাম এখনো সেইদিনের স্মৃতি ধরে রেখেছে। তারা এখনো দুর্গাপূজার সময় শোক পালন করেন মহান বীর মহিষাসুরকে মনে করে। স্বর্গ তথা সাদা চামড়ার সাম্রাজ্যবাদী বহিরাগতদের বিরুদ্ধে যিনি একাই রুখে দাঁডিয়েছিলেন। তিনি এই মাটির সন্তান। তিনি এই অঞ্চলের মানুষের সন্তান। যিনি নারীকে আঘাত করবেন না, এই অসুর নীতির পালন করতে গিয়ে দেবতাদের প্রতারণায় জীবন দেন।
তাই আমি এই অসুর নীতিতে আস্থা রাখি। প্রতারণা এবং শঠতাপূর্ণ দেবতাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে নই। প্রতারক, খুনী দুর্গাদেবী এবং তাকে স্মরণ করে এখনো আদিবাসী হত্যা উৎসব করে যাওয়া হিন্দুদের আমি ঘেন্না করি।
Leave a Comment