যে বলে ধর্ষন হয় পোশাক দোষে, লাথি মারো সজোরে তার অন্ডকোষে

ধর্ষন 3

পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব ছিলো লাখ বছর আগেও, যখন মানুষের জীবন অন্যান্য প্রাণীর মতোই খাদ্য ও যৌনতায় সীমাবদ্ধ ছিলো। ছিলো নিজের ও সন্তানের সামান্য তৃপ্তির জন্য নিজেদের মধ্যেই লড়াই করার প্রবণতা। ছিলো রাগ ক্ষোভ এবং সামান্য যৌন লালসা মেটানোর জন্য বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর ওপর জোরপূর্বক সঙ্গম করার বা ধর্ষন করার প্রবণতা। যখন মানুষের অস্তিত্ব বলে কিছু ছিলো নাহ তখনও ধর্ষন ছিলো কেননা তখনও পৃথিবীতে পশুপাখি ছিলো, যৌন চাহিদা ছিলো। আজও আমরা পশুপাখির মধ্যে ধর্ষনের ঘটনা দেখতে পাই। বিবর্তনের ধারায় আসা উন্নত মস্তিষ্কের প্রজাতি আধুনিক মানুষ খাদ্য ও যৌনতার জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছে, সভ্যতা গড়েছে, উচিৎ অনুচিত বুঝতে শিখেছে, ন্যায় অন্যায় বুঝতে পারার জ্ঞান তাদের তৈরি হয়েছে। এসেছে বিবেকবোধ বুদ্ধি মনুষ্যত্ব এবং বিবেচনা করার ক্ষমতা। তবুও মানুষের মধ্যে এখনো বিবেকবোধ ও মনুষ্যত্বহীন পশুপাখির অনেক অস্বাভাবিক আচরণই থেকে গেছে। ধর্ষন সেরকম ই ঘটনা যা মানব সভ্যতার শুরুতে অপরাধ বলেই মনে করা হতো নাহ। অর্থাৎ জোরপূর্বক সঙ্গম যে একটি নিষ্ঠুরপ্রকৃতির অপরাধ সেটা মানুষ বুঝতে শিখেছে তারও বেশিদিন হয় নি। যখন মানুষের মনে সতীত্বের ধারণা টা আসে, যখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে কেউ জোরপূর্বক সঙ্গম করলে একজন নারী ব্যবহৃত হয়ে যায় আর বিয়ের পূর্বে একজন নারী ব্যবহৃত হয়ে গেলে তার মান কমে যায় বা সতীত্বই তার সব তখনই মানুষ ধর্ষন কে অপরাধ ভাবতে শুরু করে। জোরপূর্বক সঙ্গম করার জন্য নয়, শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত করার জন্য নয় বরং “মেয়ে টার সব শেষ হয়ে গেলো, এবার মেয়ে টাকে কে বিয়ে করবে” এসব ভেবেই ধর্ষনকে অপরাধ ভাবা হত এবং এখনো এভাবেই অপরাধ ভেবে আসছে অধিকাংশ মানুষই। অপরাধ ভাবতে পারলেও ধর্ষন নামক অপরাধের অপরাধী শুধু ধর্ষক হবে অথচ ধর্ষিতা হবে নাহ, সেটা মেনে নিতে নারাজ পুরুষের কর্তৃত্ব তে তথা পুরুষের স্বার্থে এবং নারীর বশ্যতায় বিশ্বাসী মানুষজন যাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আসলেই তো, একজন মানুষ যদি কারো ওপর বিদ্বেষ থেকে তাকে হত্যা করে তাহলে তো খুনিকেও ফাঁশি দেওয়া হয় আবার মৃতদেহ কেও ফাঁশি দেওয়া হয়, কোথাও যদি নাহ দিয়ে থাকে তাহলে তারা ভুল করেছে! আবার, কেউ যদি নিজের জীবিকানির্বাহের জন্য কারো বাসায় ডাকাতি করে, তাহলে ডাকাত যেমন অপরাধী হয় তেমনি সম্পদের মালিকও অপরাধী হয়! কেউ যদি দ্বিমত করে তাহলে সে যুক্তিহীন কথা বলে কেননা সম্পদশালী নাহ হলে তো আর ডাকাতি হতো নাহ, তাই নাহ?

অবাক হওয়ার কিছু নেই! হ্যা আপনি বুঝতে পেরেছেন কেউ সম্পদশালী হলেই আপনি তার লোকসান করতে পারেন নাহ, জোরজবরদস্তি করে কারো অর্থ আত্মসাৎ করতে পারেন নাহ। তাহলে কেনো একজন মেয়েকে ধর্ষিত হওয়ার পর ধর্ষনের দাঁয় তার ধর্ষকের সাথে ভাগ করে নিতে হবে? কেনো ই বা ধর্ষনের লজ্জা ধর্ষকের হবে নাহ, হবে ধর্ষিতার? নিজের জীবিকানির্বাহের জন্য কারো অর্থ জোরজবরদস্তি করে আত্মসাৎ করা যেমন অপরাধ এবং সেই অপরাধের দায় শুধু অপরাধীর বা কারো ওপর বিদ্বেষ থেকে তাকে হত্যা করা হলে তা যেমন অপরাধ এবং সেই অপরাধের দায় শুধু অপরাধীর ঠিক তেমনি জোরপূর্বক সঙ্গম বা যৌন হয়রানি নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট একটি অপরাধ এবং সেই অপরাধের দায়ও শুধু অপরাধীর! জীবিকানির্বাহের প্রয়োজনে কারো ওপর আক্রমণাত্মক আচরণ করে অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করা যেমন জায়েজ হয়ে দাঁড়ায় নাহ তেমনি যৌন লালসা মেটানোর জন্য জোরপূর্বক সঙ্গম করাও জায়েজ হয়ে যায় নাহ।

নারী স্বাধীনতার ওপর বিদ্বেষ থেকেই হোক বা পুরুষের কর্তৃত্ব তথা পুরুষের স্বার্থে বিশ্বাস থেকেই হোক বা নিজেদের ধর্মীয় পর্দার বিধানকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণের উদ্দেশ্যেই হোক, অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত এবং কথিত শিক্ষিতসহ বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে ‘মেয়েদের চলাফেরা তথা পোশাকপরিচ্ছদ ই ধর্ষন টেনে আনে! নারী যদি নিজেকে পর্দায় ঢেকে রাখে তাহলে তাকে দেখে কারো কাম ভাব জাগবে নাহ আর কাম ভাব নাহ জাগলে তাকে ধর্ষিতও হতে হবে নাহ! আজকাল মেয়েমানুষ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তাই তো ধর্ষন হয়! মেয়েমানুষের আবার বাইরে ঘুরেবেড়ানোর প্রয়োজন কিসের! আর সন্ধ্যার পর কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়ে বাইরে থাকে নাহ’! তারপর যখন দেখা যায় “পোশাক” উচ্চারণ করতে পারে নাহ এমন নারীও ধর্ষিত হয়, পর্দার আড়ালে নিজেকে মানুষ থেকে গোপনীয় সামগ্রীতে পরিণত করাও নারীও ধর্ষিত হয়, ধর্ষক নামক পশুদের সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে দিয়ে নিজেকে ‘আমি মেয়ে, অফিস আদালত বাইরে ঘুরেবেড়ানো আমার জন্য নয়’ বলে খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকা নারীও ধর্ষিত হয়, শিশুবালক এমনকি মৃত লাঁশও ধর্ষিত হয় তখনও তারা বলে পোশাক ই দায়ী! তারা বিশ্বাস করে কোনো এক বেপর্দা নারীকে দেখে পুরুষের কাম ভাব চলে আসে পরে হাতের সামনে যা পায় তাই ধর্ষন করে অথবা ক্ষমতাবান বড়লোকের বেপর্দা মেয়ে জেরিন কে দেখে বা টিভি তে মোবাইলে বেপর্দা বেগানা নারী দেখে পুরুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং পরে ক্ষমতাহীন কোনো গরীবের পর্দাশীল জরিনা কে ধর্ষন করে! এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তারা আপনাকে বুঝিয়ে দেবে ধর্ষনের জন্য পোশাক দায়ী! অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে দুনিয়ার সব মেয়ে যদি পর্দানশীন হতো তাহলে পুরুষ ধর্ষন করতো নাহ!

ধর্ষনে স্বাভাবিকতা টেনে আনা সেসব মানুষজন কে বুঝতে হবে যে ধর্ষন বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর ওপর কাম ভাবের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং ধর্ষন সম্পর্কিত অমনুষ্যত্ব ও বিবেকহীনতার সাথে। পুরুষের মধ্যে যে সবাই ধর্ষক, সবাই ধর্ষনের সুযোগে থাকে এবং সুবিধাজনক পরিবেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পরে তা কিন্তু নয়। আমাদের মধ্যে যেমন ধর্ষক আছে ঠিক তেমনি ভালো পুরুষও আছে যারা ধর্ষন করে নাহ নারী যেরকম পোশাকই পড়ুক নাহ কেনো, যেসময় ই ঘরের বাহিরে থাকুক নাহ কেনো! তারা কেনো ধর্ষন করে নাহ? কারন তাদের বিবেকবোধ তাদের অপরাধ থেকে দূরে রাখে, তারা বুঝতে পারে একাজ নারীর ওপর নিষ্ঠুরতম জুলুম হতে পারে! তারা বুঝতে পারে জীবিকানির্বাহের জন্য কারো ওপর আক্রমণ করে তার অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করা যেমন অপরাধ তেমনি যৌন লালসা মেটানোর স্বার্থে কারো ওপর জোর করাও অপরাধ। মনুষ্যত্বের যে ছিটেফোঁটার জন্য একজন পুরুষ ধর্ষন নামক বর্বরতা থেকে দূরে থাকে, ধর্ষনকে ঘৃনা করে সেই মনুষ্যত্ব যখন একজন পুরুষের মধ্যে থাকে নাহ তখনই সে ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে। তাহলে ধর্ষকের এই অমনুষ্যত্বের দায় নারী স্বাধীনতার ওপর আসবে কেনো?

‘চিনির পাত্র যদি খোলা থাকে তাহলে পিপড়া তো বসবেই’ এধরনের তত্ত্ব সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ধর্ষন নামক অপরাধে অপরাধের শিকার ধর্ষিতাকেই অপরাধী করা হয়! এসব অসাধারণ যুক্তি থেকে অবশ্য ধর্ষক সমর্থকদের অসাধারণ মন মানসিকতাই প্রতিফলিত হয়, প্রকাশ পায় তারা একজন নারীকে নিয়ে, নারীর দেহ নিয়ে কেমন মানসিকতা পোষণ করে। পিপড়া প্রাণী টা মানুষ নয়, তার ভেতর মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই, থাকার প্রয়োজন নেই। পুরুষ মানুষ পিপড়া নয়, পুরুষ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বিবেক থাকা স্বাভাবিক এবং বিবেকহীন একজন পুরুষ মানুষ পিপড়া বা যেকোনো বনের প্রাণীর সমতুল্য! নারী নাহ কোনো চিনির পাত্র, নাহ সে তেঁতুল, নারী পুরুষের মতোই মানুষ। যে মনুষ্যত্বের জন্য মানুষ পিপড়া সমতুল্য নয় সেই মনুষ্যত্ব নাহ থাকা এবং খাদ্য ও প্রজননে সীমাবদ্ধ থাকা পিপড়ার জন্য স্বাভাবিক চিনির পাত্রে প্রবেশ করে চিনি আহরণ করা। কিন্তু পুরুষের জন্য মনুষ্যত্বহীন প্রাণীর মতো নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পরা স্বাভাবিক নয়! মনুষ্যত্বহীন একজন পুরুষই পিপড়ার মতো আচরণ করতে পারে। আর তা পিপড়ার মতো আচরণ করার দায় নারীর নয়। কারন নারী চিনির পাত্র বা তেতুল নয়!

হ্যা নারীর ওপর পুরুষের আকর্ষণ পুরুষের ওপর নারীর আকর্ষণ অপেক্ষা বেশি, নারীকে দেখলেই পুরুষ আকর্ষণ বোধ করে তা বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য। তার অর্থ তো দাঁড়ায় নাহ যে নারী খাদ্য স্বরূপ! তার অর্থ দাঁড়ায় নাহ কামনা জাগলেই ধর্ষন হয় পোশাক দোষে! ধর্ষনকে ঘৃনা করা একজন বিবেকবান পুরুষও আকর্ষণ বোধ করে পর্দায় নাহ থাকা নারীর ওপর। সেই পুরুষকে যে বিবেকবোধ ধর্ষন ঘৃনা করতে শিখায় সেই বিবেকবোধের অনুপস্থিতিই একজন পুরুষকে ধর্ষক বানায়। জীবিকানির্বাহের প্রয়োজন পড়লেই যেমন ডাকাতি করা যাবে নাহ, তেমনি কোনো নারী কে দেখায় কাম ভাব আসলেই ধর্ষন করা যাবে নাহ! নিজেকে একজন মানুষ দাবি করতে হলে এ বোধ টুকু থাকা আবশ্যক! যারা মনে করে ধর্ষন হয় পোশাক দোষে তাদের আমি বলি, আমি যদি আপনার অন্ডকোষে লাথি মারি তাহলে কি আমার সাথে সাথে আপনিও অপরাধী হবেন? কাম ভাব আসার কারনে যদি ধর্ষনে ধর্ষিতা অপরাধী হয় তাহলে রাগ আসার কারনে যার অণ্ডকোষ আঘাতপ্রাপ্ত হলো সেও অপরাধী! আবার, যারা বলে বেপর্দা নারী দেখে পুরুষের কামনা আসে বলেই পর্দানশীন নারী ধর্ষিত হয়, সবাই যদি পর্দানশীন হতো তাহলে ধর্ষন হতো নাহ! তাদের বলি, আমি যদি কারো ওপর আসা রাগ আপনার অণ্ডকোষে লাথি মেরে কমানোর চেষ্টা করি তাহলে যার ওপর আমার রাগ এসেছে সে কি অপরাধী হয়ে যায়? জানিনা এসব প্রশ্ন করলে ধর্ষক পক্ষের উকিলসমাজ কেনো গভীর ভাবনায় ডুবে যায়! তবে যা বুঝতে হবে তা হলো, রাগ আসলেই যেমন আপনি কাউকে আঘাত করতে পারেন নাহ তেমনি কাম ভাব জাগলেই নারীর অমতে তাকে স্পর্শ করতে পারেন নাহ, ধর্ষন তো অনেক দূরের ব্যাপার!

একজন বেপর্দা নারীকে দেখে সব পুরুষ কি আসলেই একইরকম অনুভব করেন? সভ্য এবং উন্নত দেশের একজন বালক যে ছোট থেকে নারীকে যেমন বোন ভাবতে শিখে তেমনি বন্ধুও ভাবতে শিখে! তার কাছে বন্ধু যেমন বোন হতে পারে আবার বোনও বন্ধুও হতে পারে, নারী যেমন হয় তার প্রেমিকা তেমনি নারীই হয় তার সহযাত্রী! ছোট বয়স থেকেই নারীকে ছোট পোশাকে দেখে অভ্যস্ত হওয়া নারীকে মানুষ ভাবার শিক্ষায় বড় হওয়া একজন যুবকের সামনে দিয়ে বিকিনি পড়ে বা ছোট পোশাক পড়ে একজন মহিলা সহজেই হেটে যেতে পারে। তাতে সেই যুবকের যৌনতৃষ্ণা জেগে ওঠে নাহ বা সে চোখ দিয়ে দেহ উপভোগ করে নাহ! অপরদিকে যেসব দেশে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নারীর ওপর বাধ্যতামূলক পর্দা চাপিয়ে দেওয়া হয় বা যেসব দেশে নারী মাত্রই নিষিদ্ধ যৌনবস্তু, নিচুজাত, গোপনীয় সামগ্রী সেসব দেশের পুরুষ নারীর হাত পা বা উঁচু বুক এমনকি চুল দেখলেই যৌনতৃষ্ণায় ভোগে এবং অস্বাভাবিক ভাবে তাকায়! এসমস্ত চরমপন্থার অঞ্চলে যেখানে বাচ্চা মেয়ে থেকে মেয়ে হওয়া মাত্রই নারী পুরুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা হয়, মানুষ থেকে নারীকে আলাদা করে ঘরে ও পর্দার অন্ধকারে থাকা এক গোপনীয় প্রাণী তে পরিণত করা হয় সেখানে নারী ও তার দেহ সম্পর্কে পুরুষের বিকৃত মানসিকতা স্বাভাবিক! এসব দেশের পুরুষ নারীকে সহযাত্রী ভাবার সুশিক্ষা পায়নি আবার, নারীকে ছোট কাপড়ে দেখেও অভ্যস্ত নয়, তাই হটাৎ কোনো ছোট কাপড় পরিহিত নারী দেখলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ছোট থেকেই নারীর প্রতি দূরত্ব তাদের মস্তিষ্কে নারীকে শুধুই যৌনবস্তু করে তোলে, করে তোলে বিবেকহীন, করে তোলে ধর্ষনপ্রবণ অথবা ধর্ষক সমর্থক!

অনেকেই সভ্য উন্নত দেশ গুলোর ধর্ষনের পরিসংখ্যান টেনে নিয়ে এসে বলেন, ‘পশ্চিমা দেশ গুলোতে এতো এতো ধর্ষন হয় অথচ মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য প্রগতিবিরুদ্ধ দেশে ধর্ষনের হার সেই অনুপাতে অনেক কম! তারা ধর্ষনের হার দ্বারা প্রমাণ করতে চান প্রগতিশীল দেশ গুলোর নারী স্বাধীনতাই ধর্ষনের পরিসংখ্যানে তাদের এগিয়ে রাখে এবং মুসলিম বিশ্বের নারীরা পর্দায় থাকে তাই সেখানে ধর্ষনের হার কম! (1) আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ লাখ নারী ধর্ষিত হয়; তবে সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল(CDC) মনে করে এই সংখ্যা ১৩ লাখে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। (2) এদিকে বাংলাদেশে আইন ও সালিশ কেন্দ্র মিডিয়া থেকে জরিপ করে (সম্ভবত পত্রিকার রিপোর্ট থেকে) জানিয়েছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে অগাস্ট পর্যন্ত ৪৬৪ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন, ৫৬ জনের উপর ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। ধর্ষণের পরে ২৭ জন মারা গেছেন, এবং ৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। (3) বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪৪৬ জন শিশু। এখানে অবশ্যই যা বুঝতে হবে তা হলো পরিসংখ্যানে আসা ধর্ষনের হার শুধুমাত্র ধর্ষনের রিপোর্ট সংখ্যা প্রকাশ করতে পারে, আসলেই কতজন ধর্ষিত হয়েছে তা প্রকাশিত হয় নাহ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে অনেক কম ধর্ষনের রিপোর্ট এসেছে তারমানে এটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় নাহ যে বাংলাদেশে আসলেই অনেক কম নারী ধর্ষিত হয়েছে। আমেরিকার মতো প্রগতিশীল দেশের স্বাধীন মেয়েরা ধর্ষন নিয়ে প্রকাশ্যভাবে কথা বলার সাহস রাখে, ধর্ষন নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়, নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য তাদের লজ্জিত হতে হয় নাহ, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার গুরুত্ব বুঝে এবং করে! তাই প্রগতিশীল দেশ গুলোতে ধর্ষনের রিপোর্টও বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইসলামিক দেশ ও অন্যান্য প্রগতিবর্জিত দেশ যেখানে সুশিক্ষার বড় অভাব সেখানে ধর্ষনে ধর্ষকের সাথে সাথে ধর্ষিতাকেও অপরাধী হতে হয়, ধর্ষকের লজ্জা নাহ হলেও ধর্ষিতার লজ্জিত হতে হয়! “সতীত্ব চলে গেছে মানে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, জানাজানি হলে সমাজের চোখে বোঝা হয়ে থাকতে হবে, পরিবারের মান অপমান” এসব ভেবে ধর্ষিতা ও ধর্ষিতার পরিবার ধর্ষন নিয়ে সামনে এসে কথা বলতে চায় নাহ, বলে বলার সুযোগ পায় নাহ। পুলিশের কাছে ধর্ষনের রিপোর্ট করার চেয়ে ধর্ষনের বিষয়টা গোপন করাই শ্রেয় মনে করে তারা। কারন তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ী তাদের শিক্ষা অনুযায়ী ধর্ষন যত টা নাহ অপরাধ তার চেয়েও অনেক বেশি নারীর অপমান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সুইডেনে সর্বোচ্চ ধর্ষণের কেস রিপোর্ট করা হয়। তার কারন সুইডেনের মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরা নয়, কারন ধর্ষনের রিপোর্ট করায় সুইডেনের মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক সাহসী হয়ে উঠেছেন। তাছাড়াও সেখানে যৌন নির্যাতনকে অনেক গুরুত্বের সাথে দেখে কেসগুলোকে ইচ্ছা করেই কিছুটা ভিন্ন ভাবে রিপোর্ট করা হয়। যেমন ধরুন, কোনো বিবাহিত নারী যদি বলেন যে তার স্বামী তাকে এক বছর ধরে ধর্ষণ করে আসছে তাহলে তার বিরুদ্ধে ৩৬৫ টি ধর্ষণের মামলা করা হবে। সে কারণেই সে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় এত বেশী বলে মনে হয় । অথচ কিছু ইসলামিক দেশ আজও ধর্ষিতার চারজন পুরুষ সাক্ষী নাহ থাকলে ধর্ষিতা হয়ে যায় ব্যভিচারিণী, ধর্ষকের বিচারের বদলে বিচার হয় ধর্ষিতার! ধর্ষন যে স্বামীর দ্বারাও হয় সেই ধারনা সেসব দেশে নিষিদ্ধ বলা চলে। সুতরাং নারীর ওপর পর্দা চাপিয়ে দেওয়া দেশগুলোতে ধর্ষনের হার কেন কম সেটা বুঝা টা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নাহ।

বনানী তে যখন দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছিলো তখন অনেক মন্তব্যই চলছিল মেয়ে দুটো কে নিয়ে। কেউ কেউ বলেছে, ‘আমার বোনকে আমি এতো রাতে পার্টিতে যেতে দিতাম নাহ বা আমার বোন কখনোই এতো রাতে পার্টিতে যেতো নাহ’! সরাসরি তারা বলে নাহ এতো রাতে বাইরে বের থাকার জন্যই ধর্ষিত হতে হয়েছে, তবে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে চায় সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকলে ধর্ষিতাও তার ওপর হওয়া বর্বরতার অপরাধী হবে! প্রথমত, এরকম মানসিকতা রাখা মানুষদের বুঝতে হবে, সে চাইলেই তার বোনের পায়ে শিকল দিতে পারে নাহ, তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া বা কোনো ব্যাপারে জোর করা শাসন নয় বরং অবিচার। দ্বিতীয়ত, নিজেদের দিক থেকে অন্যদের বিচার করা যুক্তিহীন ব্যাপার। আপনার বোন রাতে বাইরে বের হয় নাহ মানেই কোনো মেয়ে রাতে ঘোরাফেরা করলে সে খারাপ তা নয়! আপনার বোন বন্ধুদের সাথে পার্টি যায় নাহ তারমানে এই নয় কোনো মেয়ে বন্ধুদের সাথে পার্টিতে গেলে তাকে ধর্ষন করা জায়েজ হয়ে দাঁড়ায়! তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো পার্টি তে যাওয়া অপছন্দ করা মেয়েরাও পার্টিতে কোনো মেয়ে ধর্ষনের শিকার হলে সেই মেয়েকেই অপরাধী মনে করে! হয়তো তারা মনে করে পার্টি গেলে তাদের মতই কোনো নারীর অমতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া জায়েজ হয়ে যায় বা ধর্ষিতাও অপরাধী হয়ে যায়!

‘বাঘ আছে জেনেও বনে গেলে শিকার তো হবেই’ – রাতে বাইরে বের হয়ে বা পার্টিতে যেয়ে যখন একটা মেয়ে ধর্ষিত হয় তখন অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন কেননা তাদের মতে রাতের বেলায় নারী বাইরে থাকলে ধর্ষক সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে তাই রাতে নারীর ঘরে থাকাই ভালো, রাতের বেলা বাইরে গেলে ধর্ষিত হতে পারে জেনেও বাইরে গেলে ধর্ষনে ধর্ষিতাও দায়ী হয়! যদিও বাঘ ধর্ষক অপেক্ষা অনেক ভালো তবুও একজন মানুষ বাঘকে দেখে বুঝতে পারে যে এই প্রাণী টি তার জন্য খুবই বিপদজনক হতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বাঘের মতো ভয় পেয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখবে নাহ সেটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি যেচে বনের বাঘের সামনে যায় তাহলে তার বাঘের খাদ্য হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার! কিন্তু মানুষরূপী বাঘ কে তো আর চেনা যায় নাহ। আর মানুষরূপী বাঘ তো মানুষদের মধ্যেই থাকে, বনে নাহ! তাহলে কি মানুষের বানানো পথঘাটই মানুষরূপী বাঘদের বন? তারমানে মানুষরূপী বাঘদের বাইরের রাজত্ব দিয়ে বাঘের ভয়ে খাঁচায় নিজেকে আটকে রাখবে মানুষ? নাহ বাইরে ধর্ষক ঘুরাঘুরি করে বলে নারী নিজেকে খাঁচায় আবদ্ধ করবে সেটা কোনো সমাধান নয়! বরং মানুষের সমাজে থাকা এসব মানুষরূপী পশুদের মোকাবেলা করা, প্রতিবাদ করাই উত্তম সমাধান। নারী যতো দূর্বল হয়ে ঘরে বসে থাকবে মানুষের সমাজে মানুষরূপী পশুদল ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। নারী যতো অধিকার সচেতন ও প্রতিবাদী হয়ে উঠবে, মানুষরূপী পশুদের ততো দূর্বল হয়ে উঠবে! রাতের বেলা ধর্ষক ঘুরাঘুরি করে ভেবে নারী নিজেকে খাঁচায় আটকানোর মানে দাঁড়ায় মানুষের সমাজে ধর্ষকদের স্বাধীনতায় প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের পরাধীন করে তোলা। বনের পশু হটাৎ সামনে পড়লে কখনো পিছিয়ে যেতে হয় নাহ তাহলে সে প্রাণী দূর্বল বুঝতে পেরে সামনে আগাতে থাকে এবং এক সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে যখন একজন নারী ভয়ে ভয়ে হাটতে থাকে তখন তার দিকে কিছু মানুষরূপী পশু এগিয়ে যায়। যখন দশ/বারজন নারী সাহসিকতার সাথে হাটতে থাকে তখন মানুষরূপী পশু দূর্বল অনুভব করে। তবে যা আবশ্যক তা হলো ধর্ষন হয় দিনে, রাতে, ঘরে, বাইরে যেমন আপনজন দ্বারা তেমনি পরজন দ্বারা। সুতরাং খাঁচায় নিজেকে আটকে রাখা বা পর্দার আড়ালে নিজেকে গোপনীয় সামগ্রীতে পরিণত করা কোনো সচেতনতা হতে পারে নাহ। সচেতনতার সূচনা হোক ছোট থেকেই মেয়েদের মার্সাল আর্ট শিখিয়ে আত্মরক্ষা করা ও আত্মবিশ্বাসী হওয়ার শিক্ষা দিয়ে।

ধর্ষন নামক ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করতে নারী সম্পর্কে সমাজের ধারণা বদলের প্রয়োজন অনেক বেশি। তার জন্য প্রয়োজন ধর্ষন ও নারী সম্পর্কে মানুষের বিকৃত মনোভাব নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার। দুঃখজনক হলো বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষই সহ্য করে থাকার পক্ষে। ধর্মান্ধ বাংলার সবচেয়ে বড় অংশই চায় ধর্ষনকে ব্যাবহার করে নারী স্বাধীনতাকে কালো কাপড়ে ঢেকে দিতে যার পেছনে নারী বিদ্বেষ ছাড়া কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় নাহ।

Reference : (1) usnews.com/news/best-countries/articles/2016-10-20/violence-against-women-in-5-charts

(2) askbd.org/ask/2017/09/14/violence-women-rape-january-august-2017

(3) www.dw.com/a-39738875

View Comments (4)

  • ধন্যবাদ, এত সুন্দর চিন্তার জন্য। আশা করি একদিন আমাদের এই ঘুণে ধরা সমাজের পরিবর্তন হবেই।

  • অসাধারণ লেখা। আমার মতে এই লেখাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের পাঠ দেওয়া উচিত

Leave a Comment