শামিমার আইসিসে যোগ দেয়ার কারণ কি সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ?

আইসিসে

শামিমা বেগমের “আইসিসে যোগ দেয়ার কারণে অনুশোচনা নেই” কথাটি নিছকই সন্তান ও নিজের নিরাপত্তা চাওয়া ও কোন জঙ্গিগোষ্ঠী থেকে ফিরে আসা ইডিয়ট নারীর বয়ান নয়। এই কথাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে, একই সাথে এটি পাশ্চাত্য সমাজে (আরও জেনারালাইজ করলে অমুসলিম দুনিয়ায়, যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু) মুসলিম টিনেজ মেয়েদের অবস্থার একটা চিত্র ফুটে ওঠে।

শামিমা বেগমের কেন আইসিসে যোগ দেয়ার পরও কোন অনুশোচনা নেই- এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে যে সে সেখানে একজন স্বামী পেয়েছিল, রোমান্টিক ও সেক্সুয়াল চাহিদাগুলোর পুরণের একটা উপায় পেয়েছিল। সেইসাথে এও হতে পারে যে, এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে একজন শক্ত মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিল। তার কথাগুলো স্বার্থপর ধরণের, কিন্তু বিষয়টির গভীরে গিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে ইংল্যান্ডে কোন ধার্মিক বাংলাদেশী মুসলিম পরিবারের ১৭ বছরের মেয়ের জীবনটা কিরকম হয়।

এরা সবসময়ই তাদের সমবয়সী অমুসলিমদের বা সেক্যুলারদের বা পাশ্চাত্য জীবনযাপনে অভ্যস্তদের জীবনধারাকে পর্যবেক্ষণ করে। তারা দেখে যে সমবয়সী টিনেজরা কিভাবে নিজেদের পছন্দমত জীবন যাপন করছে, কিভাবে তারা ইচ্ছামত সঙ্গি বেছে নিচ্ছে, এডভেঞ্চারাস জীবন যাপন করছে, নিজেদের রোমান্টিক ও সেক্সুয়াল চাহিদাগুলো পুরণ করছে। কিন্তু চাইলেও তারা এরকম জীবন যাপন করতে পারে না। সেরকম আমোদ-প্রমোদ, এডভেঞ্চার, স্ফূর্তি, প্রেম, যৌনতা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। ইংল্যান্ডে অন্যদের বাবা মা তাদের ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা দেয়, তারা বিভিন্ন রকম কাজে যুক্ত হয় যার মাধ্যমে তারা এডাল্ট ও টাফ হয়ে ওঠে। এই মেয়েরা সেটা পায় না। নিজের পরিবারের দেয়া পরাধীন জীবনের জন্য তারা সমাজের মেইনস্ট্রিমে থাকলেও বিচ্ছিন্ন। আর এই অবস্থাটাই এদেরকে টেরোরিজমের দিকে ভালনারেবল করে।

পূর্বের একটি পোস্টে পাশ্চাত্য সমাজের মুসলিমদের টেরোরিজমে জড়ানোর কারণ হিসেবেও বিচ্ছিন্নতাবোধের কথার উল্লেখ করেছিলাম, কিন্তু সেটা মূলত পুরুষকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য সমাজে বা অমুসলিম দেশগুলোতে তরুণীরাও বিচ্ছন্নতাবোধের শিকার হতে পারে, আর এই বিচ্ছিন্নতাবোধ মুসলিম তরুণরা যেভাবে ভোগ করে সেরকমটা নয়, তরুণীদের বিচ্ছিন্নতাবোধ অন্যরকম। মুসলিম তরুণরা পরিবার থেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা পায়, যা তরুণীরা পায় না। আর তাই তাদের তাদের বিচ্ছিন্নতাবোধের সাথে যুক্ত হয় স্বাধীন হবার ইচ্ছা।

পাশ্চাত্য সমাজে মুসলিমদের সংখ্যালঘু হওয়াটা তাদের মধ্যে রক্ষণশীলতার একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুত দ্বারা শোষিত হয় বলে এরকম টেররের সাথে কোপিং করার জন্য তাদের মধ্যে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়। এই রক্ষণশীলতা তাদেরকে সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতিতে প্রবেশে বাঁধা দেয়, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতিতেও একটা পার্থক্য তৈরি হয় এর মধ্য দিয়ে। এই রক্ষণশীলতা যদি তরুণ তরুণীদের বিভিন্ন চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, ফ্যান্টাসিকে রুদ্ধ করতে চায় তবে তার প্রকাশ ঘটে আইসিসের মত জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দান করার মধ্য দিয়ে যেখানে তারা তাদের এডাল্টহুড উদযাপন করতে পারবে, বিভিন্নরকম সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি ফুলফিল করতে পারবে। সেই সাথে যুক্ত হয় জেহাদ, ধর্মযুদ্ধের মত রোমান্টিসিজম, ধর্মীয় নীতিবোধ ও পরকালের সুখ যেগুলো তাদের এরকম সিদ্ধান্তকে জাস্টিফাই করে।

যুক্তরাজ্যের এক প্রবাসীর কাছে লন্ডনে থাকা সিলেটি তরুণিদের ব্যাপারে কিছু কথা শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “মুসলিম সমাজের তরুণীরা স্বাধীনতা পায় না, কিন্তু তারা লুকিয়ে সেটা উপভোগ করে নিতে পারে। শুক্রবার রাতে তারা ওই বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছি বলে বোরখার তলায় জিন্স এবং হাতাকাটা টিশার্ট পরে নাইটক্লাবে যায়। সিগারেট খায় এবং সুযোগ মত গাঁজাও টানে। এক্সট্রা পয়সার জন্য কিছু কিছু মেয়ে শুতেও রাজি থাকে।” কথাটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে এদের অনেকেই দুই জায়গায় দুই ধরণের জীবনযাপন করছে, যা একজন মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে খুব কষ্টকর। এখানে নিজের স্বাধীনতার সাথে যুক্ত হয় নিজের “ট্রু সেলফ”-প্রকাশ করবার ইচ্ছাও। তারা না হতে পারে তাদের বাবামার ইচ্ছায় “মুসলমান নারী” হতে আর না পারে পাশ্চাত্য জীবনধারায় অভ্যস্ত হতে। মনের মধ্যে থাকা এই সংঘাতও তাকে সমাজ ত্যাগ করে টেরোরিস্ট জীবনের এডভেঞ্চারে যোগ দিতে উৎসাহিত করতে পারে যেখানে তারা হয়তো ধর্ম ও এডভেঞ্চার দুটোই একসাথে পাবে।

পাশ্চাত্য সমাজে মুসলিম তরুণ তরুণিদের এই বিচ্ছিন্নতাবোধ দূর করার জন্য এই তরুণ তরুণিদের মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা, তারা কিরকম পরিবেশে বেড়ে উঠছে, আসেপাশে কী কী দেখছে এগুলো নিয়েও বিচার বিশ্লেষণ করা জরুরি। আর এই সমস্যাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করা দরকার পাশ্চাত্যের রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারগুলোকেই। তারা কিভাবে তাদের সন্তানের সাথে আচরণ করছে তাই ঠিক করে দিচ্ছে তাদের সন্তানদের সিদ্ধান্ত কিরকম হবে। তাই একা শামিমাকে দোষ দিয়ে কিছু হবে না। সমস্যার আরও গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে।

আরও পড়ুন:
জঙ্গিবাদ প্রবণতা তৈরির ক্ষেত্রে অনেকাংশেই দায়ী সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ

Leave a Comment