প্রশ্নঃ স্রষ্টা ছাড়া কোন কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না। সব কিছুর জন্যেই একজন স্রষ্টা থাকা জরুরি। যেহেতু আমরা চারপাশে এত সৃষ্টি দেখতে পাচ্ছি, তাই তার পেছনের কারণ হিসেবে একজন স্রষ্টা থাকতেই হবে। নইলে এগুলো সৃষ্টি কীভাবে হলো?
উত্তরঃ প্রাচীনকালে কিছু মানুষ ভাবতো, পৃথিবীটা একটা গরুর শিং এর ওপর অবস্থিত। এরকম ভাবতো তার কারণ হচ্ছে, কেউ হয়তো পৃথিবীটা কীভাবে আছে তা জানতে চাইতো। তাদের জানার আগ্রহ ছিল। এলাকার গুরুজন কিংবা বয়স্ক মানুষদের তখন তারা জিজ্ঞেস করতো এই নিয়ে। ধরুন যারা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, বা রাজনৈতিক নেতা। কারণ তারা ভাবতো, বয়স্ক মানুষ তাদের থেকে যেহেতু বেশি জানেন, তারা এর উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু বয়স্ক বা সেই সময়ের নেতাদেরও এই বিষয়ে কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু তারা তা জানে না, এটা বলাটা তাদের নিজেদের জন্য অপমানজনক। তাই তারা বানিয়ে বলতো, পৃথিবীটা একটা গরুর শিং এর ওপর অবস্থিত। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা ভূমিকম্প সম্পর্কে জানতো। তাই সেটার সাথে মিলিয়ে তারা দাবী করতো গরুটা নড়াচড়া করলে ভূমিকম্প হয়। যেন ভূমিকম্প হওয়াটাই গরুর শিং তত্ত্বের একদম বাস্তব প্রমাণ!
কেউ কেউ হয়তো তাদের কথাটি বিশ্বাস করতো না। তখন তারা তাদেরকে পালটা প্রশ্ন করতো, আমার কথা সত্যি না হলে ভূমিকম্প কেন হয়? বা শিং এর ওপর না থাকলে পৃথিবীটা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে না কেন? যেহেতু এই প্রশ্নের উত্তরও সেই সময়ে মানুষ জানতো না, যে ভূমিকম্প কেন হয় বা পৃথিবীটা নিচের দিকে পরে যাচ্ছে না কেন, তাই তারা গরুর শিং এর ওপর পৃথিবীর দাবীকে মেনে নিতো। বা বলা ভাল, জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য সেই অজ্ঞানতার ধারণাই সেই সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতো।
কিন্তু একজন বুদ্ধিমান লোক হয়তো তখন প্রথম প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, গরুর শিং এর ওপর পৃথিবীটা অবস্থিত তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু গরুটা কিসের ওপর অবস্থিত? তার নিচে কী? সে কেন পড়ে যাচ্ছে না?
তখন যারা এই গরুর শিং এর ওপর পৃথিবী, এই ধারণা বিশ্বাস করতো, বা সেই গরুর নামে ব্যবসা করতো, বা সেই গরুর পূজা করে কিছু টাকা পয়সা কামাই করতো, তারা হয়তো বলতো, তার নিচে আছে আরেকটা গরু। তার নিচে আরেকটা। এভাবে গরু- গরু-গরু-গরু-গরু। শিং-শিং-শিং… কিন্তু তার নিচে কী? সব চাইতে নিচের গরুটার নিচে কী?
খুব ভয়াবহ প্রশ্ন। একদম ব্লাসফেমাস টাইপের। এরকম প্রশ্নের সামনে তারা একটু বিব্রত হয়ে যেতো। তখন বলা হতো, সেই সবচাইতে নিচের গরুটাকে নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ওটা আদি গরু। ওটা কিছুর ওপর অবস্থিত নয়। ওটা এমনি এমনি আকাশে ঝুলে থাকতে পারে। ওটার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। ওটাতে বিশ্বাস করতে হবে। ঐ নিচের গরুটার ক্ষমতা না থাকলে, সে এমনিতেই আকাশে ঝুলে না থাকতে পারলে পৃথিবীটা এমনি এমনি আকাশে ঝুলে আছে কীভাবে? যেহেতু এই প্রশ্নের উত্তর নেই, সেহেতু সেই গরুটিই সত্যি।
অথচ, সেই আদিগরুটা কোন কিছু ছাড়া ঝুলে থাকতে পারলে, পৃথিবীও তো ঝুলেই থাকতে পারে। তার জন্য গরুর শিং তত্ত্বের তো দরকার হয় না। পৃথিবীর ঝুলে থাকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা এমন এক জিনিসের অবতারণা করলো, যেই জিনিস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে শেষে জাদু, অলৌকিক তুকতাকেরই সাহায্য নিতে হলো। তো এতো প্যাঁচাবার প্রয়োজন কী? এতগুলো বেচারা গরুকেই বা কষ্ট দেয়ার দরকার কী! পৃথিবীটাই স্রেফ ঝুলে আছে, বললেই হয়! কিন্তু তা বলা যাবে না! আদিগরু নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সেটার লীলা বোঝা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়!
অর্থাৎ যখন আর প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাচ্ছে না, তখন অলৌকিক কিছু দাবী করে বসতে হবে। এরকমই হয়ে এসেছে সর্বত্র। এরকম বেয়াদপের মত যারা প্রশ্ন করেছিল, প্রচলিত ধারণাকে না মেনে নিয়ে, তারাই নতুন জ্ঞানের সূচনা করেছিল। সন্দেহ, অবিশ্বাস, প্রশ্ন করা, এগুলো হচ্ছে জ্ঞানের ভিত্তি। বিশ্বাস হচ্ছে তার বিপরীত। বিশ্বাস থেকে জ্ঞান সৃষ্টি হয় না। জ্ঞান সৃষ্টি হয় সন্দেহ আর অবিশ্বাস থেকে।
আজকে আমরা জানি, কেন এবং কীভাবে পৃথিবী নামক গ্রহটি মহাকাশে কোন গরুর শিং ছাড়াই ঝুলে আছে। কোন অলৌকিক তুকতাক জাদু টোনা তন্ত্রমন্ত্র ছাড়াই। কারণ মহাবিশ্বে কোন উপর নিচ নেই। নিচে পড়ে যাওয়া তাই সম্ভবই না। এবং এই বিষয়ে আরও বেশি জানতে হলে, আমাদের বিজ্ঞান জানতে হবে। এই পর্যন্ত মহাবিশ্বের কোন কাজে, কোন ঘটনায় কোন অলৌকিক বা ব্যাখ্যাতীত শক্তির প্রমাণ মেলে নি। সবকিছুই নিতান্ত লৌকিক এবং বিজ্ঞানের সূত্রে ঘটেছে। কোথাও কোন অদৃশ্য অদ্ভুত রহস্যময় কিছুর অস্তিত্ব নেই।
আপনার গরুর শিং এর ধারণাকে জাস্টিফাই করার জন্য বলতেই পারেন, বিজ্ঞানের ঐ সূত্রগুলো আসলে গরুর শিং-ই বানিয়েছে। তা ভাবতে পারেন। বিশ্বাসও করতে পারেন। বিশ্বাস করতে তো তেমন কিছুর দরকার হয় না। তবে শিক্ষিত সভ্য মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। আরও জানে। বই পড়ে। গরুর শিং এর উপাসনা করে সেটা হয়তো জানা কঠিন। তার চাইতে রূপকথায় বিশ্বাস করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
নির্বোধদের জন্য।
( উপরের ছবিটি লক্ষ্য করলে দেখবেন, ঈশ্বরের বসবাসের জায়গাটি মানুষের মগজের মত। খুব কৌশলে বলে দেয়া যে, ঈশ্বরের জন্ম এবং বসবাস আমাদের মগজেই। )
Leave a Comment