ইতিহাসইতিহাসে ধর্মইসলামধর্মধর্ম ও রাজনীতিধর্মের মনস্তত্ত্বধর্মের সমাজতত্ত্ববাংলায় ধর্মের ইতিহাস

সুফি ঐতিহ্যে সহিংসতার ইতিহাস (History of Violence in the Sufi Tradition): মুদ্রার উল্টোপিঠের অজানা গল্প

Table of Contents

ভূমিকা

আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলোতে কিছু ছবি খুব শক্তপোক্তভাবে গেঁথে থাকে। যেমন – সুফিবাদ বা সুফিজম (Sufism) শব্দটা কানে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক পরম প্রশান্তির দৃশ্য। গেরুয়া বা সাদা আলখেল্লা পরা একদল মানুষ, হয়তো একতারা হাতে গান গাইছেন, অথবা মৌলভি রুমির (Rumi) অনুসারীদের মতো ঘোরলাগা অবস্থায় ঘুরছেন। আমরা অবচেতনভাবেই ধরে নিই, সুফিবাদ মানেই শুধুই প্রেম, শুধুই মানবতা, আর জাগতিক সব সংঘাত থেকে শতহস্ত দূরে থাকা এক আধ্যাত্মিক দ্বীপ। সাধারণ ধারণা হলো, ইসলামের ইতিহাসে মূলধারার রাজনীতি বা যুদ্ধবিগ্রহ যখন তরবারি হাতে রাজ্য জয়ে ব্যস্ত, সুফিরা তখন লোকালয়ের বাইরে কোনো এক নির্জনে বসে আত্মশুদ্ধি বা তাজকিয়াতুন নফস (Purification of the Self) করছেন। তাদের জগতটা যেন পার্থিব ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অনেক ঊর্ধ্বে। এই ধারণাটি খুব রোমান্টিক, শুনতে এবং ভাবতেও বেশ আরামদায়ক। মনে হয়, আহা! পৃথিবীর সব হাঙ্গামার মাঝেও অন্তত একটা দল আছে যারা শান্তির বার্তা নিয়ে বসে আছে। কিন্তু ইতিহাসের রাস্তাটা জ্যামিতির সরলরেখায় চলে না, বরং তা বড়ই আঁকাবাঁকা এবং খানাখন্দে ভরা।

বাস্তবতা হলো, সুফি ঐতিহ্যের চাদরটি যতটা ধবধবে সাদা মনে করা হয়, ইতিহাসের আতশি কাঁচের নিচে ধরলে তাতে রক্তের দাগও কম পাওয়া যায় না। সুফিরা কি শুধুই খানকায় (Khanqah) বসে ধ্যান করেছেন? তসবিহ টিপেছেন আর সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মগ্ন থেকেছেন? ইতিহাস খুব নির্মমভাবে বলছে – না। তারা কখনো কখনো খানকা ছেড়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ঘোড়ায় চেপেছেন। কখনো সাম্রাজ্য গড়তে তলোয়ার ধরেছেন, আবার কখনো ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে রাজা-বাদশাহদের বৈধতা দেওয়ার (Legitimization) কাজটিও তারা করেছেন সুনিপুণভাবে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এক হাতে তসবিহ আর অন্য হাতে তলোয়ার – এমন দৃশ্য সুফি ঐতিহ্যে খুব একটা বিরল নয়। ধর্মতাত্ত্বিকরা হয়তো বলবেন, সুফিরা শুধু মনের ভেতরের বাঘ মারতেই ব্যস্ত ছিলেন, যাকে বলা হয় ‘জিহাদ আল-আকবর’ (Greater Jihad)। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ বলছে, তারা বাইরের শত্রুর সাথে সম্মুখ সমরেও পিছপা হননি।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় এই ‘অস্বস্তিকর’ ইতিহাস। আমরা সুফিবাদের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য বা সাহিত্যিক গভীরতাকে অস্বীকার করছি না, তবে ইতিহাসের যে পাতাগুলো সচরাচর ওল্টানো হয় না, যেখানে ভক্তি আর সহিংসতার (Violence) এক অদ্ভুত মিশেল ঘটেছে, সেই গল্পগুলোই আজ শোনা যাক। কেন একজন সাধক অস্ত্র হাতে তুলে নেন? কেন প্রেমের ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামতে হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। এখানে কোন অলৌকিকতা নেই, আছে শুধুই মানুষের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, টিকে থাকার লড়াই এবং পরিস্থিতির নির্মম বাস্তবতা। এই আর্টিকেলে আমরা সুফিদের সেই যোদ্ধা-সন্ন্যাসী (Warrior-Monk) রূপটি দেখব, যা আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।

সুফি ও জিহাদ: তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি বনাম বাস্তবতা

শুরুতেই একটা বিষয় খুব পরিষ্কার হওয়া দরকার, কারণ আমাদের সাধারণ বোঝাপড়ায় বেশ বড়সড় একটা গলদ রয়ে গেছে। আমরা যখনই সুফিবাদের কথা বলি, আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে এক পরম শান্তির প্রতিচ্ছবি, যেখানে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। কিন্তু সুফি সাহিত্যেইতিহাসে জিহাদ (Jihad) শব্দটির ব্যবহার এবং প্রয়োগ নিয়ে যে ধ্রুবক বিভ্রান্তি রয়েছে, তা দূর না করলে ইতিহাসের এই অধ্যায়টি বোঝা অসম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে সুফি দর্শনে জিহাদকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো জিহাদ আল-আকবর (Greater Jihad) বা নিজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই, আর অন্যটি হলো জিহাদ আল-আসগার (Lesser Jihad) বা শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে পশ্চিমা ও প্রাচ্যের উদারতাবাদী তাত্ত্বিক আলোচনায়, সুফিবাদের বয়ান তৈরি করার সময় সচেতনভাবেই জিহাদ আল-আকবর (Greater Jihad)-এর ওপর সবটুকু আলো ফেলা হয়। বলা হয়, সুফিরা তো মনের বাঘ মারতে ব্যস্ত, বনের বাঘ বা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় বা ইচ্ছা তাদের কই? এই ধারণাটি শুনতে খুবই চমৎকার এবং বর্তমান সময়ের ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ বা রাজনৈতিকভাবে সঠিক অবস্থানের সাথে বেশ মানানসই। কিন্তু মধ্যযুগের বা প্রাক-আধুনিক যুগের সুফিদের কাছে এই বিভাজনরেখাটি এতটা স্পষ্ট বা পরষ্পরবিরোধী ছিল না। তারা মনে করতেন, ভেতরের শত্রুকে বা নফস (Ego/Self)-কে দমন করা যেমন জরুরি, বাইরের শত্রুকে (তা সে বিধর্মী হোক বা ধর্মভ্রষ্ট শাসক) দমন করাও সমান জরুরি এবং অনেক ক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক।

ইতিহাসের ধুলোবালি ঘাঁটলে দেখা যায়, সুফিবাদের বিকাশের আদিপর্বে এই তাত্ত্বিক অবস্থানটি ছিল বেশ নমনীয়। সুফি তাত্ত্বিকরা মনে করতেন, একজন সাধক যখন নিজের নফসকে পুরোপুরি বশে আনতে পারেন, তখনই তিনি প্রকৃত যোদ্ধা হতে পারেন। কারণ, নফস বা অহমিকা বেঁচে থাকলে যুদ্ধটা হয় নিজের আক্রোশ মেটানোর জন্য, আর নফস মরে গেলে যুদ্ধটা হয় শুধুই স্রষ্টার নির্দেশে বা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। বিখ্যাত সুফি তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক আবু হামিদ আল-গাজালি (Abu Hamid al-Ghazali) তার কালজয়ী গ্রন্থ ইহইয়া উলুম আল-দীন (The Revival of the Religious Sciences)-এ জিহাদের আধ্যাত্মিক দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, কিন্তু তিনি কখনোই সশস্ত্র জিহাদকে বাতিল করে দেননি। বরং প্রাক-আধুনিক যুগে সুফিরা নিজেদের দেখতেন আধ্যাত্মিক যোদ্ধা (Spiritual Warriors) হিসেবে, যাদের লড়াইটা একই সাথে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য জগতে চলে। ইতিহাসবিদ নাইল গ্রিন (Nile Green) তার গবেষণায় অত্যন্ত জোরালোভাবে দেখিয়েছেন যে, সুফিবাদের শুরুর দিকে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে, সুফিরা ছিলেন অনেকটা ‘যোদ্ধা-সন্ন্যাসী’ (Warrior-Monks) গোছের মানুষ। তাদের এক হাতে থাকত তসবিহ বা জপমালা, আর অন্য হাতে থাকত উন্মুক্ত তরবারি। এই চিত্রটি আমাদের প্রচলিত ‘শান্তিকামী সুফি’ ইমেজের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই ছিল সেই সময়ের রূঢ় বাস্তবতা (Green, 2012)।

রিবাত: দুর্গ যখন খানকা, খানকা যখন দুর্গ

এই যোদ্ধা-সন্ন্যাসী (Warrior-Monk) ধারণাটি সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় রিবাত (Ribat) নামক প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এবং মধ্যযুগে সাম্রাজ্যের সীমানা যখন হু হু করে বাড়ছে, তখন সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তৈরি হয়েছিল এই রিবাতগুলো। শাব্দিক অর্থে রিবাত মানে হলো ‘ঘোড়া বাঁধার স্থান’ বা সীমান্ত ঘাঁটি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এটি ছিল এক ধরণের দুর্গ-আশ্রম। উত্তর আফ্রিকায়, মধ্য এশিয়ায় কিংবা বাইজেন্টাইন সীমান্তে এই রিবাতগুলো ছিল সুফি ও গাজীদের (Ghazis) মিলনকেন্দ্র। কল্পনা করুন, মরুভূমির প্রান্তে পাথরের তৈরি এক দুর্গ, যেখানে একদল মানুষ দিনের বেলা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধবিদ্যা অনুশীলন করছেন, তীর-ধনুক শানাচ্ছেন, আর রাত নামলেই আগুনের পাশে বসে জিকির বা ধ্যানে মগ্ন হচ্ছেন। এদের বলা হতো মুরাবিতুন (Murabitun) বা যারা রিবাতে অবস্থান করেন। এই মুরাবিতুনরাই ছিলেন সুফিবাদের প্রাথমিক যুগের অন্যতম ধারক ও বাহক। এখান থেকেই আমরা দেখতে পাই, সুফিবাদের সঙ্গে সামরিকতন্ত্রের (Militarism) এক আদিম ও অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ।

এই রিবাতগুলোতে যারা আসতেন, তারা অনেকেই ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী। তারা বিশ্বাস করতেন, সীমান্তে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং দুর্গের ভেতরে বসে আত্মশুদ্ধি করা – দুটোই সমান সওয়াবের কাজ। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণকাহিনিতে এমন অনেক রিবাতের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে তিনি সুফি ও যোদ্ধাদের একসাথে বসবাস করতে দেখেছেন। উত্তর আফ্রিকার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই রিবাত প্রথা থেকেই পরবর্তীতে বিশাল রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, আলমোরাভি বা আল-মুরাবিতুন (Al-Murabitun) সাম্রাজ্যের কথা বলা যায়। এই সাম্রাজ্যের নামই এসেছে ‘রিবাত’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ, একটি সুফি-সামরিক আশ্রম কালক্রমে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের জন্ম দিল, যারা স্পেন থেকে সেনেগাল পর্যন্ত শাসন করত। তাই সুফিদের শুধুই খানকার চার দেয়ালে বন্দি ভাবুক মনে করাটা ইতিহাসের এক বিশাল অপপাঠ। ব্যাপারটা অনেকটা এমন – সুফি সাধকরা বিশ্বাস করতেন, তরবারির ধার যেমন লোহাকে কাটে, তেমনি জিকিরের ধার অন্তরের কলুষতাকে কাটে; আর একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের জন্য দুটোরই প্রয়োজন আছে (Bonner, 2006)।

রিবাত ব্যবস্থাটি প্রমাণ করে যে, সুফিবাদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কেবল ধ্যানের জন্য হয়নি, বরং যুদ্ধের প্রয়োজনেও হয়েছে। অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর দিকে মধ্য এশিয়ায় মুসলিম বিজয়ের সময় খোরাসানট্রান্সঅক্সিয়ানার সীমান্তে হাজার হাজার সুফি স্বেচ্ছাসেবক জড়ো হয়েছিলেন। তারা নিজেদের বলতেন ‘গাজী’ (Ghazi) বা ধর্মযোদ্ধা। মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তী সময়ে অটোমান সাম্রাজ্য বা মুঘল ভারতে আমরা যে সুফি তরিকগুলোর বিকাশ দেখি, তাদের অনেকের শেকড় এই সীমান্ত ঘাঁটিগুলোতে প্রোথিত। অর্থাৎ, সুফিবাদের ডিএনএ-তে এক ধরণের লড়াকু মানসিকতা সুপ্ত ছিল শুরু থেকেই। আধুনিক গবেষকরা এই বিষয়টিকে ‘সীমান্তের আধ্যাত্মিকতা’ (Frontier Spirituality) বলে অভিহিত করেছেন। সীমান্তে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের ব্যবধান খুব সামান্য, তাই সেখানে বসবাসকারী সুফিদের কাছে জীবন উৎসর্গ করা বা ‘শহীদ’ হওয়া ছিল পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। তারা মৃত্যুকে ভয় পেতেন না, বরং মৃত্যুকে মনে করতেন স্রষ্টার সাথে মিলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত। এই মনস্তত্ত্বই তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্ধর্ষ করে তুলেছিল।

গাজী ও দরবেশ: তলোয়ারের ধার এবং আধ্যাত্মিকতা

সুফি ও জিহাদের এই সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ফুতুওয়াহ (Futuwwa) বা আধ্যাত্মিক বীরত্বের ধারণা। ফুতুওয়াহ শব্দটি এসেছে ‘ফাতা’ থেকে, যার অর্থ যুবক বা বীর। সুফি দর্শনে ফুতুওয়াহ বলতে বোঝাত এমন এক ধরণের নৈতিক কোড বা আচরণবিধি, যা একজন যোদ্ধাকে মহৎ করে তোলে। এটি অনেকটা মধ্যযুগীয় ইউরোপের ‘শিভালরি’ (Chivalry) বা নাইটদের বীরত্বগাথার মতো। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসির এই ফুতুওয়াহ আদর্শকে ব্যবহার করে একটি আধা-সামরিক সুফি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনের সদস্যরা ছিলেন সুফি ভাবধারায় দীক্ষিত যোদ্ধা, যারা খলিফার রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষায় এবং সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অস্ত্র ধারণ করতেন। এখানে আমরা দেখি, সুফি দর্শন কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির পথ নয়, বরং একটি সংঘবদ্ধ আধা-সামরিক সংগঠন (Paramilitary Organization) পরিচালনার নৈতিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

বিশেষ করে আনাতোলিয়া বা বর্তমান তুরস্কে সুফি ও গাজীদের সম্পর্ক ছিল সবচাইতে গভীর। তুর্কিরা যখন মধ্য এশিয়া থেকে আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করছে, তখন তাদের সাথে ছিল একদল বিচিত্র সুফি সাধক, যাদের বলা হতো ‘বাবা’ বা ‘আবদাল’। এই দরবেশরা সাধারণ কোনো ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। তারা সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে থাকতেন। ইতিহাসবিদ সেমাল কাফাদার (Cemal Kafadar) তার বিখ্যাত তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, অটোমান রাষ্ট্র গঠনের মূল চালিকাশক্তি ছিল এই ‘গাজী নীতি’ (Ghazi Ethos), যেখানে সুফি মরমীবাদ এবং যাযাবর তুর্কিদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। একজন গাজী যখন যুদ্ধ করতেন, তিনি মনে করতেন তিনি কেবল জমি দখল করছেন না, বরং একটি ঐশ্বরিক দায়িত্ব পালন করছেন। তার এই বিশ্বাসকে জ্বালানি জোগাতেন সাথে থাকা সুফি পীরেরা। অনেক ক্ষেত্রে পীর নিজেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন। যেমন, শেখ এদেবালি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানের শ্বশুর এবং আধ্যাত্মিক গুরু। ওসমানের প্রতিটি সামরিক অভিযানের পেছনে শেখ এদেবালির আধ্যাত্মিক সমর্থন ও নির্দেশনা ছিল। এটাকে কি আমরা নির্লিপ্ত সুফিবাদ বলব? নাকি বলব রাজনৈতিক ইসলামসুফিবাদের এক চতুর সংমিশ্রণ?

আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, নকশবন্দি (Naqshbandi) তরিকার মতো সুফি তরিকগুলো জিহাদকে কখনোই রূপক অর্থে সীমাবদ্ধ রাখেনি। ককেশাস অঞ্চলে উনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠেছিল, তার পুরোধা ছিলেন নকশবন্দি সুফিরা। ইমাম শামিল, যিনি ছিলেন একজন নকশবন্দি শেখ, তিনি প্রায় তিন দশক ধরে রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ইমাম শামিল তার অনুসারীদের বা মুরিদদের (Murids) শিখিয়েছিলেন যে, পরাধীনতার শৃঙ্খল পায়ে দিয়ে তাসাউফ চর্চা করা সম্ভব নয়। তাই আগে আজাদি, পরে ধ্যান। তার এই আন্দোলন ইতিহাসে ‘মুরিদ যুদ্ধ’ (Murid War) নামে পরিচিত। এখানে সুফি তরিকার শৃঙ্খল বা সিলসিলা (Silsila) এবং পীরের প্রতি মুরিদের নিঃশর্ত আনুগত্য বা বাইয়াত (Bay’ah)-কে সামরিক চেইন অব কমান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। একজন সাধারণ সেনাপতি তার সৈন্যদের ওপর যতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন, একজন পীর তার মুরিদদের ওপর তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। কারণ মুরিদের কাছে পীরের আদেশ হলো আল্লাহর আদেশের নামান্তর। এই মনস্তাত্ত্বিক সুবিধাটি সুফি নেতাদের ভয়ংকর শক্তিশালী সামরিক নেতায় পরিণত করেছিল (Gammer, 1994)।

সুতরাং, সুফি ও জিহাদের সম্পর্ককে কেবল ‘শান্তি বনাম যুদ্ধ’ – এই বাইনারি বা দ্বৈত সত্তা দিয়ে বিচার করা বোকামি। বাস্তবতা হলো, সুফিবাদ পরিস্থিতির প্রয়োজনে বারবার রূপ বদলেছে। যখন সময় হয়েছে ধ্যানের, তারা গুহায় ঢুকেছেন; যখন সময় হয়েছে লেখনীর, তারা কিতাব লিখেছেন; আর যখন সময় হয়েছে প্রতিরোধের, তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। সুফি সাহিত্যে যুদ্ধের এই বৈধতা দেওয়ার জন্য অনেক সময় ‘কারামাত’ (Miracles) বা অলৌকিক ক্ষমতার গল্পও প্রচার করা হয়েছে। বলা হতো, অমুক পীর যুদ্ধের ময়দানে অলৌকিক ভাবে শত্রুর চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছেন বা গায়েবি সাহায্যে জয়লাভ করেছেন। এই গল্পগুলো সাধারণ মানুষকে সুফি নেতৃত্বে জিহাদে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করত। অর্থাৎ, অলৌকিকতা এবং সহিংসতা এখানে হাত ধরাধরি করে চলেছে। আমরা আধুনিক চশমা দিয়ে দেখে হয়তো ভাবি, ‘এ কেমন সুফি?’ কিন্তু সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন সুফি একই সাথে ‘ওলী’ (বন্ধু/সাধক) এবং ‘গাজী’ (যোদ্ধা) হতে পারতেন, এতে কোনো বিরোধ ছিল না। বরং যিনি জিহাদের ময়দানে শহীদ হতেন, তাকে সুফি সমাজে সর্বোচ্চ সম্মানের চোখে দেখা হতো। তাই তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি যা-ই থাকুক, ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো – সুফি ঐতিহ্যে তলোয়ারের ঝনঝনানি তসবিহের দানার শব্দ থেকে খুব একটা দূরে ছিল না।

তুর্কি দরবেশ এবং অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান

গল্পটা আরেকটু জমজমাট করা যাক। ইতিহাসের বইয়ের পাতা ওল্টালে আমরা সাধারণত দেখি, অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের (Ottoman Empire) উত্থান মানেই হলো একদল দুর্দান্ত অশ্বারোহী যোদ্ধা, যাদের হাতে বাঁকানো তলোয়ার আর মাথায় পাগড়ি। কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্য গড়ার পেছনের কারিগর বা আর্কিটেক্ট কি শুধুই এই যোদ্ধারা ছিলেন? সুফিদের ভূমিকা কি এখানে কেবল দোয়া-দরুদ পড়া আর বরকত কামনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? মোটেও না। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে আনাতোলিয়ায় বা এশিয়া মাইনরে যখন তুর্কিরা দলে দলে প্রবেশ করছে, তখন তাদের সঙ্গে বা কখনো কখনো তাদের আগেই সেখানে হাজির হয়েছিল একদল বিচিত্র সুফি সাধক। এদের বলা হতো ‘বাবা’ (Baba), ‘আবদাল’ (Abdal), বা ‘আখিস’ (Akhis)। এরা প্রচলিত অর্থে কোনো শান্তশিষ্ট ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। এদের জীবনযাপন, বেশভূষা এবং কার্যকলাপ ছিল অদ্ভুত এবং অনেক ক্ষেত্রে ভীতিজাগানিয়া। ইতিহাসবিদরা এদের বলছেন ‘দরবেশ উপনিবেশকারী’ (Dervish Colonizers)। অটোমান রাষ্ট্রযন্ত্রের যে বিশাল ইমারত আমরা দেখি, তার ভিত্তিমূলে সিমেন্ট হিসেবে কাজ করেছে এই সুফিদের রক্ত ও ঘাম। এখানে আধ্যাত্মিকতা এবং রাজ্যবিস্তার বা সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism) এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে, আলাদা করা দুষ্কর।

আনাতোলিয়ার সেই সময়কার পরিবেশটা ছিল অনেকটা ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’-এর মতো – আইনহীন, বিশৃঙ্খল এবং ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য তখন ক্ষয়িষ্ণু, আর মঙ্গোলদের আক্রমণে পূর্বদিক থেকে পালিয়ে আসা তুর্কিরা খুঁজছে নতুন আশ্রয়। এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে সুফিরা নিলেন এক বৈপ্লবিক ভূমিকা। বিখ্যাত তুর্কি ইতিহাসবিদ ওমর লুৎফি বারকান (Ömer Lütfi Barkan) তার যুগান্তকারী গবেষণায় এই সুফিদের নাম দিয়েছেন ‘উপনিবেশকারী তুর্কি দরবেশ’ (Colonizing Turkish Dervishes)। বারকান দেখিয়েছেন, অটোমান সুলতানরা কোনো এলাকা দখল করার আগেই সেখানে এই দরবেশদের পাঠিয়ে দিতেন। এই দরবেশরা জনমানবহীন পাহাড়ের চূড়ায়, বা বিপজ্জনক গিরিপথে তাদের ‘জাবিয়া’ (Zawiya) বা খানকা স্থাপন করতেন। তারা সেখানে চাষাবাদ করতেন, পথিকদের আশ্রয় দিতেন এবং স্থানীয় খ্রিস্টানদের সাথে মিশতেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো তারা সমাজসেবা করছেন, কিন্তু আদতে তারা ছিলেন অটোমান রাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’ বা সাংস্কৃতিক অগ্রদূত। তারা স্থানীয় মানুষের মন জয় করে অটোমান শাসনের পথ প্রশস্ত করতেন। আর যখন প্রয়োজন হতো, তখন এই দরবেশরাই লাঙল ফেলে অস্ত্র ধরতেন। তাদের মাজারগুলো বা ‘তেক্কে’ (Tekke) কেবল উপাসনালয় ছিল না, সেগুলো ছিল একেকটি সামরিক আউটপোসট বা গোয়েন্দা কেন্দ্র (Barkan, 1942)।

বেকতাশি ও জেনিসারি: ব্যারাকের সুফি

অটোমান সামরিক মেশিনারির সবচাইতে বিস্ময়কর এবং সম্ভবত সবচাইতে ভয়ংকর অংশটি হলো জেনিসারি (Janissaries) বা ‘নতুন সৈন্য’ বাহিনী। সুলতানদের এই এলিট ফোর্স ছিল ইউরোপের বুকে ত্রাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই দুর্ধর্ষ বাহিনীটি আক্ষরিক অর্থেই একটি সুফি তরিকার মুরিদ বা শিষ্য ছিল। সেই তরিকাটির নাম বেকতাশি (Bektashi)। ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুফি সাধক হাজি বেকতাশ ভেলি (Haji Bektash Veli)-র নামানুসারে এই তরিকার নামকরণ। তিনি ছিলেন খোরাসান থেকে আসা এক মরমী সাধক, যার শিক্ষা ছিল বেশ উদার এবং লোকজ। কিন্তু অটোমান রাষ্ট্রযন্ত্র খুব চতুরতার সাথে এই তরিকাকে তাদের সামরিক বাহিনীর অফিশিয়াল মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। জেনিসারিরা ছিল মূলত বলকান অঞ্চল থেকে ধরে আনা বা সংগ্রহ করা খ্রিস্টান শিশু, যাদের ইসলামে দীক্ষিত করে সুলতানের ব্যক্তিগত গোলাম হিসেবে বড় করা হতো। তাদের পরিবার ছিল না, তাদের কোনো পিছুটান ছিল না। তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল – তারা সুলতানের দাস এবং বেকতাশি পীরের মুরিদ।

প্রতিটি জেনিসারি ব্যারাকে বা ‘ওদাক’-এ একজন করে বেকতাশি সুফি বা ‘বাবা’ নিযুক্ত থাকতেন। এই বাবাদের কাজ ছিল সৈন্যদের আধ্যাত্মিক দীক্ষা দেওয়া এবং যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। জেনিসারিরা যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার আগে বিশেষ দোয়ার মাহফিল করত, যাকে বলা হতো ‘গুলবাং’ (Gulbang)। এই দোয়ায় তারা আল্লাহ, রাসুল এবং পীর হাজি বেকতাশ ভেলির নামে শপথ নিত। তাদের পতাকায় আঁকা থাকত জুলফিকার (হযরত আলীর তলোয়ার) এবং সুফি প্রতীক। জেনিসারিদের হেডগিয়ার বা টুপির পেছনের কাপড়টি ঝুলে থাকত কাঁধ পর্যন্ত, যা হাজি বেকতাশ ভেলির আলখেল্লার আস্তিনের প্রতীক বলে মনে করা হতো। এখানে সহিংসতা আর আধ্যাত্মিকতা একাকার হয়ে গিয়েছিল। একজন জেনিসারি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে তলোয়ার চালাত বা কামানের গোলা দাগাত, সে মনে করত সে তার পীরের নির্দেশ পালন করছে এবং এটি একটি পবিত্র ইবাদত। সেমাল কাফাদার (Cemal Kafadar) তার বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, জেনিসারি কালচারে ভক্তি এবং হত্যার এক অদ্ভুত সহাবস্থান ছিল। তারা তাদের রান্নার ডেকচি বা ‘কাজান’ (Kazan)-কে পবিত্র মনে করত। বিদ্রোহ করার সময় তারা এই ডেকচি উল্টে দিত। অর্থাৎ, তাদের বিদ্রোহ এবং আনুগত্য – দুটোই আবর্তিত হতো সুফি প্রতীকের চারপাশে। একটি সুফি তরিকা সরাসরি একটি সামরিক বাহিনীর মটো এবং মোটিভেশন হিসেবে কাজ করছে – আধুনিক যুগের কোনো সেনাবাহিনীতে এমনটা কল্পনা করাও কঠিন।

বেকতাশি তরিকা জেনিসারিদের শিখিয়েছিল যে, সুলতানের সেবা করা আর পীরের সেবা করা একই। এই সুফিবাদের প্রভাবে জেনিসারিরা হয়ে উঠেছিল মৃত্যুভয়হীন। কারণ বেকতাশি দর্শনে মৃত্যুকে দেখা হতো ‘হক’-এর সাথে মিলন হিসেবে। তবে এই সম্পর্কের শেষটা ছিল করুণ। ১৮২৬ সালে যখন সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয় জেনিসারি বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন (যাকে ইতিহাসে ‘শুভ ঘটনা’ বা Auspicious Incident বলা হয়), তখন হাজার হাজার জেনিসারির সাথে সাথে বেকতাশি সুফিদেরও হত্যা করা হয় এবং তাদের খানকাগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্র যখন দেখেছে সুফিবাদের এই সামরিক রূপটি তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন তারা সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি, যা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছিল (Goodwin, 1998)।

আবদাল ও গাজীদের ‘কাষ্ঠ তরবারি’

অটোমান ইতিহাসের শুরুর দিকে আরেক দল সুফির দেখা পাওয়া যায়, যাদের বলা হতো রুমের আবদাল (Abdals of Rum)। ‘রুম’ বলতে এখানে আনাতোলিয়া বা রোমান সাম্রাজ্যের প্রাক্তন ভূখণ্ড বোঝানো হতো। এই আবদালরা ছিলেন এক ধরণের ভবঘুরে সুফি, যারা শরীরে উল্কি আঁকতেন, অদ্ভুত পোশাক পরতেন এবং হাতে থাকত কাঠের তলোয়ার বা ‘তাহতা কিলিচ’ (Tahta Kılıç)। শুনতে রূপকথার মতো মনে হলেও, অটোমান লোকগাথায় এবং প্রাথমিক ইতিহাসে এই ‘কাষ্ঠ তরবারি’ধারী সুফিদের বীরত্বগাথা ছড়িয়ে আছে। জনশ্রুতি আছে যে, এই দরবেশরা কাঠের তলোয়ার দিয়েই শত্রুর লোহার বর্ম ভেদ করতে পারতেন। এটি রূপক হতে পারে, কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতা হলো – এই সুফিরা তাদের আধ্যাত্মিক কারিশমা বা বারাকা (Baraka) দিয়ে সাধারণ তুর্কি উপজাতিদের যুদ্ধের জন্য উন্মাদ করে তুলতেন।

বিখ্যাত সুফি সারী সালতুক (Sari Saltuk)-এর কথাই ধরা যাক। তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা-দরবেশ, যিনি বলকান অঞ্চলে ইসলাম প্রচার এবং অটোমান বিজয়ের পথ তৈরি করেছিলেন। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একাই হাজার শত্রুর মোকাবেলা করতে পারতেন। অটোমান সুলতানরা এই দরবেশদের খুব খাতির করতেন, কারণ তারা জানতেন, এই দরবেশরা সেনাবাহিনীর চেয়েও দ্রুতগতিতে মানুষের মন জয় করতে পারেন। তবে এই আবদালরা সবসময় শান্ত ছিলেন না। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই ভবঘুরে সুফি বা কালান্দার (Qalandars)-রা প্রায়ই রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতেন। তাদের কোনো নির্দিষ্ট নিবাস ছিল না, তারা কোনো কর দিত না এবং তারা প্রচলিত শরিয়তের ধার ধারত না। রাষ্ট্র যখনই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, তখনই সংঘাত বেধেছে। অর্থাৎ, সুফিবাদের এই ধারাটি ছিল সহজাতভাবেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং বিপ্লবী। তারা সুলতানকে সাহায্য করেছে ঠিকই, কিন্তু সুলতানের গোলাম হতে চায়নি কখনো (Karamustafa, 1994)।

শেখ বদরুদ্দিনের বিদ্রোহ: সুফি সমাজতন্ত্রের রক্তাক্ত অধ্যায়

সুফি ঐতিহ্যে সহিংসতার ইতিহাসের সবচাইতে নাটকীয় এবং মর্মান্তিক উদাহরণ সম্ভবত শেখ বদরুদ্দিনের বিদ্রোহ (Revolt of Sheikh Bedreddin)। শেখ বদরুদ্দিন ছিলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর একজন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত সুফি পণ্ডিত এবং বিচারক বা কাজি। তিনি ছিলেন ইবনে আরাবি (Ibn Arabi)-র দর্শন বা ওয়াহদাতুল উজুদ (Unity of Being)-এর কট্টর অনুসারী। কিন্তু তার এই আধ্যাত্মিক দর্শন তাকে এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে নিয়ে যায়। তিনি প্রচার করতে শুরু করেন যে, নারী ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত সম্পদে মানুষের সমান অধিকার রয়েছে। জমি, খাদ্য, বস্ত্র – সবকিছু সবার। ধর্ম, বর্ণ বা জাতিভেদ বলতে কিছু নেই; মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি সবাই সমান। তার এই মতবাদটি ছিল অনেকটা আধুনিক সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের আদি রূপ, যা উঠে এসেছিল সুফি আধ্যাত্মিকতা থেকে।

১৪১৬ সালের দিকে, অটোমান সাম্রাজ্য যখন তৈমুরের আক্রমণের পর গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত, তখন শেখ বদরুদ্দিন এবং তার প্রধান দুই শিষ্য – বোরকলুজে মোস্তফা (Börklüce Mustafa) এবং তোরলাক কেমাল (Torlak Kemal) – এর নেতৃত্বে পশ্চিম আনাতোলিয়া এবং বলকান অঞ্চলে এক বিশাল কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। হাজার হাজার গরিব কৃষক, সুফি দরবেশ, এবং অমুসলিম প্রজা এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। তারা অটোমান সুলতান প্রথম মেহমেদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এটি কোনো সাধারণ দাঙ্গা ছিল না; এটি ছিল একটি সুসংগঠিত যুদ্ধ। শেখ বদরুদ্দিনের অনুসারীরা অটোমান বাহিনীকে বেশ কয়েকবার পরাজিত করে। এখানে আমরা দেখি, একজন সুফি নেতা কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তিই খুঁজছেন না, তিনি রাষ্ট্রক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছেন এবং একটি শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তলোয়ারের জোরে।

সুলতান মেহমেদ বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন। হাজার হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়। বোরকলুজে মোস্তফাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় এবং শেখ বদরুদ্দিনকে শেষপর্যন্ত বন্দি করে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ভারিদাত (Varidat)-এ তিনি তার এই বিপ্লবী চিন্তাধারা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। শেখ বদরুদ্দিনের ঘটনা প্রমাণ করে যে, সুফিরা কেবল খানকায় বসে থাকার পাত্র ছিলেন না। তারা প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতে পারতেন এবং সেই প্রক্রিয়ায় চরম সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারতেন। তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমেত পরবর্তীতে এই শেখ বদরুদ্দিনকে নিয়েই তার মহাকাব্যিক কবিতা লিখেছিলেন, যেখানে তাকে দেখানো হয়েছে একজন বিপ্লবী নায়ক হিসেবে। অটোমান ইতিহাস শেখ বদরুদ্দিনকে ‘কাফেরবা ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করলেও, আধুনিক ইতিহাসবিদরা তাকে দেখছেন একজন সুফি বিপ্লবী (Sufi Revolutionary) হিসেবে, যিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন (Inalcik, 1973)।

আখি ভ্রাতৃত্ব: সুফি গিল্ড এবং রাষ্ট্রগঠন

অটোমান সাম্রাজ্য গঠনের পেছনে আরেকটু ভদ্রস্থ কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা ছিল আখি (Akhi) সম্প্রদায়ের। ‘আখি’ শব্দটি আরবি ‘আখ’ (ভাই) অথবা তুর্কি ‘আকি’ (উদার) থেকে এসেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আনাতোলিয়ায় এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে, যা ছিল মূলত কারিগর, ব্যবসায়ী এবং সুফিদের একটি গিল্ড বা সমবায় সমিতি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আখি এভরান (Ahi Evran), যিনি নিজেও একজন সুফি সাধক ছিলেন। আখিরা ছিল শহরের রক্ষক। যখন কোনো কেন্দ্রীয় শাসন থাকত না, তখন আখি নেতারা বা ‘আখি বাবা’রা শহরের শাসনভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিতেন। তাদের নিজস্ব মিলিশিয়া বা সশস্ত্র বাহিনী ছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজীর উত্থানের পেছনে এই আখি সুফিদের অবদান অনস্বীকার্য। ওসমানের শ্বশুর এবং আধ্যাত্মিক গুরু শেখ এদেবালি (Sheikh Edebali) ছিলেন একজন প্রভাবশালী আখি নেতা। ওসমান গাজী নিজে আখি সংগঠনের সদস্য ছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিক এবং সামরিক সমর্থন পেয়েছিলেন। আখিদের দর্শন ছিল ফুতুওয়াহ (Futuwwa) বা বীরত্বের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। তারা তাদের সদস্যদের শেখাত – হাতে হুন্নার (শিল্প), কোমরে তলোয়ার এবং অন্তরে আল্লাহ। অর্থাৎ, একজন আখি সুফি দিনের বেলা জুতো সেলাই বা কামারের কাজ করবেন, আর প্রয়োজন হলে শহর রক্ষার জন্য যুদ্ধ করবেন। অটোমানদের প্রাথমিক বিজয়ের অনেকগুলোতে আখি মিলিশিয়ারা নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে। তারা ছিল আধা-সামরিক, আধা-বেসামরিক এবং পুরোপুরি সুফি ভাবধারায় পুষ্ট এক সামাজিক শক্তি। রাষ্ট্র এবং ধর্মের এই যে মিথস্ক্রিয়া, যেখানে সুফিবাদ হয়ে উঠছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা অটোমান ইতিহাসের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সুতরাং, অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সুফিদের অবস্থান কোনোভাবেই একপেশে ছিল না। বেকতাশিরা জেনিসারিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের খড়গ হয়ে উঠেছিল, আবদালরা ছিল অনিয়ন্ত্রিত ঝড়ের মতো, শেখ বদরুদ্দিনের মতো সুফিরা চেয়েছিলেন রাষ্ট্রকে উল্টে দিতে, আর আখিরা চেয়েছিলেন রাষ্ট্রকে গড়তে। এদের সবার মধ্যেই একটি সাধারণ সুতো ছিল – তা হলো, আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য বা জাগতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংসতার ব্যবহারকে তারা অনৈতিক মনে করতেন না। বরং সুফি দর্শনের আলোকেই তারা তাদের তলোয়ারের বৈধতা খুঁজে নিতেন।

সাফাভিদ সাম্রাজ্য: যখন সুফি তরিকা হলো রাজবংশ

সহিংসতা ও সুফিবাদের সবচাইতে নাটকীয়, লোমহর্ষক এবং সম্ভবত সবচাইতে সুদূরপ্রসারী উদাহরণ হলো সাফাভিদ সাম্রাজ্য (Safavid Empire)। আজকের ইরান যে শিয়া মতাদর্শের ওপর শক্তপোক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল এই সাফাভিরা। কিন্তু ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে তাদের আবির্ভাব কোনো রাজা বা সামরিক জান্তা হিসেবে হয়নি, হয়েছিল অত্যন্ত নিভৃতচারী এবং শান্তিকামী একটি সুফি তরিকা হিসেবে। এই তরিকাটির নাম ছিল সাফাভিয়া (Safaviyya)। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে, মঙ্গোলদের ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী সময়ে, শেখ সাফি আল-দীন আরদাবিলি (Sheikh Safi al-Din Ardabili) নামের একজন সাধক বর্তমান ইরানের আরদাবিল শহরে এই তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। মজার ব্যাপার হলো, শুরুর দিকে এই তরিকাটি ছিল সুন্নি (Sunni) শাফি মাজহাবের অনুসারী এবং শেখ সাফি আল-দীন নিজে ছিলেন একজন পুরোদস্তুর সুফি সাধক, যিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করতেন। তার খানকায় ধনী-গরিব সবাই আসত আত্মশুদ্ধির জন্য। কিন্তু সুফিবাদের ইতিহাসে এটি একটি বড় প্যারাডক্স বা কূটাভাস যে, যে তরিকার কাজ ছিল মানুষের মন জয় করা, তারা শেষমেশ মানুষের গলা কাটতে দ্বিধা করল না ক্ষমতার প্রয়োজনে।

শেখ সাফি আল-দীনের মৃত্যুর পর, এই সুফি তরিকার নেতৃত্ব বংশানুক্রমিকভাবে তার পরিবারের হাতেই থাকে। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে, বিশেষ করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে, এই তরিকাটি তার আধ্যাত্মিক খোলস পাল্টে একটি উগ্র সামরিক সংগঠনে (Military Organization) রূপ নিতে শুরু করে। শেখের পরবর্তী বংশধররা, যেমন শেখ জুনায়েদ এবং শেখ হায়দার, খানকার গদি ছেড়ে ঘোড়ার পিঠে চড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তারা নিজেদের কেবল পীর বা মুর্শিদ (Guide) ভাবতেন না, বরং রাজনৈতিক নেতা এবং সেনাপতি হিসেবেও জাহির করতে শুরু করলেন। তারা তাদের অনুসারীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, কেবল তসবিহ টিপে আল্লাহকে পাওয়া যাবে না; বিধর্মীদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ককেশাস অঞ্চলের খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ বা জিহাদ (Jihad) করাও ইবাদতের অংশ। এভাবেই একটি মরমী ভ্রাতৃত্ববোধ ধীরে ধীরে একটি সশস্ত্র মিলিশিয়ায় পরিণত হলো। আর এই রূপান্তরের চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেল শাহ ইসমাইল (Shah Ismail)-এর উত্থানের মধ্য দিয়ে (Babayan, 2002)।

কিজিলবাশ: লাল টুপির উন্মাদ বাহিনী

সাফাভিদদের এই উত্থানের পেছনে প্রধান শক্তি ছিল একদল গোড়া এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, যাদের বলা হতো কিজিলবাশ (Qizilbash)। তুর্কি ভাষায় এর অর্থ ‘লাল মাথা’ বা ‘Red Heads’। এদের এমন নামকরণের কারণ হলো, এরা এক বিশেষ ধরণের লাল টুপি বা পাগড়ি পরত, যাতে বারোটি ভাঁজ বা কলি থাকত। এই বারোটি ভাঁজ শিয়া ইসলামের বারো ইমামের (Twelve Imams) প্রতীক। কিজিলবাশরা মূলত ছিল পূর্ব আনাতোলিয়া, সিরিয়া এবং আজারবাইজানের বিভিন্ন তুর্কমেন যাযাবর উপজাতি। কিন্তু তাদের পরিচয় কেবল উপজাতি বা গোত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তাদের মূল পরিচয় ছিল তারা সাফাভিদ পীরের মুরিদ।

শাহ ইসমাইল যখন ১৫০-এর দশকে এই বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি ছিলেন নিতান্তই এক কিশোর। কিন্তু এই কিজিলবাশদের কাছে তিনি ছিলেন রক্তমাংসের মানুষের চেয়েও বেশি কিছু। সাফাভিদ মতাদর্শে, বিশেষ করে গুলাত (Ghulat) বা চরমপন্থী শিয়া বিশ্বাস অনুযায়ী, শাহ ইসমাইলকে মনে করা হতো ঈশ্বরের ছায়া, বা কখনো কখনো স্বয়ং ঈশ্বরের অবতার। কিজিলবাশরা বিশ্বাস করত, তাদের মুর্শিদ বা নেতা অভ্রান্ত এবং অমর। এই বিশ্বাস তাদের এতটাই অন্ধ করে দিয়েছিল যে, তারা যুদ্ধের ময়দানে বর্ম পরার প্রয়োজন মনে করত না। তারা ভাবত, তাদের পীরের আধ্যাত্মিক ক্ষমতাই তাদের রক্ষা করবে। শাহ ইসমাইলের প্রতি তাদের ভক্তি ছিল ‘শাহসেভানি’ (Shahsevani) বা শাহের প্রতি নিঃশর্ত প্রেম। যুদ্ধের সময় তারা ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ ধ্বনির চেয়ে ‘শাহ, শাহ’ ধ্বনি বেশি দিত।

এখানে আমরা দেখি সুফিবাদের ফানা ফিল শাইখ (Annihilation in the Master) বা গুরুর সত্তায় বিলীন হয়ে যাওয়ার ধারণাটিকে কীভাবে সামরিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। একজন সাধারণ সেনাপতি তার সৈন্যদের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ রাখেন, শাহ ইসমাইল তার মুরিদদের ওপর তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। কারণ, একজন সেনাপতি কেবল শাস্তির ভয় দেখাতে পারেন, কিন্তু একজন পীর পরকালের মুক্তির চাবিকাঠি ধারণ করেন। ফলে, শাহ ইসমাইল যখন কোনো আদেশ দিতেন – তা যত নিষ্ঠুর বা অযৌক্তিকই হোক না কেন – কিজিলবাশরা তা পালন করত ধর্মীয় উন্মাদনার সাথে। এটি ছিল এমন এক বাহিনী, যারা ভক্তি আর সহিংসতার এক অদ্ভুত ককটেল পান করে সবসময় নেশাগ্রস্তের মতো থাকত (Savory, 1980)।

শাহ ইসমাইল: কবি, সুফি এবং নির্দয় বিজেতা

১৫০১ সালে শাহ ইসমাইল যখন তাবরিজ (Tabriz) শহর দখল করেন এবং নিজেকে ‘শাহানশাহ’ বা রাজাদের রাজা ঘোষণা করেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বা ১৫ বছর। ভাবা যায়? একজন টিনএজার, যিনি একই সাথে একটি বিশাল সুফি তরিকার প্রধান এবং একটি নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা! ইসমাইল ছিলেন একাধারে কবি এবং যোদ্ধা। তিনি খাতাই (Khata’i) ছদ্মনামে তুর্কি ভাষায় চমৎকার সব সুফি কবিতা লিখেছেন। তার কবিতায় তিনি নিজেকে হযরত আলীর বংশধর, কখনো যিশু, আবার কখনো আলেকজান্ডার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই রোমান্টিক কবিসত্তার আড়ালে ছিল এক নির্মম ও নিষ্ঠুর শাসক।

তাবরিজ দখলের পর তিনি এক ঐতিহাসিক এবং ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে, এখন থেকে এই সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইশনা আশারিয়া (Twelver Shi’ism) বা বারো ইমামিয়া শিয়া মতবাদ। সমস্যা হলো, সেই সময় ইরানের জনসংখ্যার বিশাল অংশ, সম্ভবত দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি, ছিল সুন্নি। তার উপদেষ্টারা তাকে সতর্ক করে বললেন, “হুজুর, তাবরিজ-এর জনগণ সুন্নি, তারা এই নতুন ধর্ম মেনে নেবে না। বিদ্রোহ হতে পারে।” উত্তরে কিশোর ইসমাইল যে কথাটি বলেছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় রক্তের অক্ষরে লেখা আছে। তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহ এবং বারো ইমাম আমার সহায় আছেন। আমি কারো পরোয়া করি না। যদি জনগণ আপত্তি করে, তবে আমি আমার তলোয়ার কোষমুক্ত করব এবং একজন মানুষকেও জীবিত রাখব না।”

এবং তিনি ঠিক তাই করেছিলেন। তিনি সুন্নি জনসংখ্যাকে জোরপূর্বক শিয়া মতবাদে দীক্ষিত করার এক নারকীয় অভিযান শুরু করলেন। যারা এই মতবাদ মেনে নিতে অস্বীকার করল, তাদের ওপর নেমে এল চরম সহিংসতা। মসজিদ থেকে সুন্নি ইমামদের বের করে দেওয়া হলো, সাহাবীদের অভিশাপ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলো (যাকে বলা হয় তাবাররা), এবং হাজার হাজার সুন্নি আলেম, সুফি এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হলো। সুফিবাদের ইতিহাসে এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা। যে সুফিরা একসময় বলতেন ‘সবার সাথে শান্তি’ (সুলহ-ই-কুল), তারাই এখন বলছেন ‘হয় আমার মতো হও, নয়তো মরো’। শাহ ইসমাইল কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেননি, তিনি মানুষের আত্মার দখল নিতে চেয়েছিলেন তরবারির ডগায়। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট ধর্মান্ধতা (State-Sponsored Fanaticism), যার জ্বালানি আসত একটি সুফি তরিকার অন্ধ ভক্তি থেকে (Newman, 2006)।

মড়ার খুলির পানপাত্র: সহিংসতার নান্দনিকতা (!)

শাহ ইসমাইলের সহিংসতার মাত্রা বোঝার জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি, যা লোককথা নয়, ঐতিহাসিক সত্য। ১৫১০ সালে মার্ভের যুদ্ধে তিনি উজবেক নেতা মুহাম্মদ শায়বানি খানকে পরাজিত ও হত্যা করেন। শায়বানি খান ছিলেন একজন সুন্নি শাসক এবং ইসমাইলের কট্টর শত্রু। ইসমাইল কেবল তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি শায়বানি খানের মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে তার রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেন প্রদর্শনী হিসেবে। আর শায়বানি খানের মাথার খুলিটি তিনি নিজের কাছে রেখে দেন।

তিনি সেই খুলিটি পরিষ্কার করে, সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে একটি পানপাত্র বা গবলেট (Goblet) বানালেন। উৎসবের সময় শাহ ইসমাইল এই খুলির পাত্রে মদ পান করতেন এবং তার বিশেষ অতিথিদেরও পান করাতেন। ভাবুন একবার দৃশ্যটা! একজন সুফি পীর, যিনি আধ্যাত্মিকতার কথা বলেন, তিনি তার শত্রুর খুলিতে মদ পান করছেন। এটি কেবল প্রতিহিংসা ছিল না, এটি ছিল ক্ষমতার এক বীভৎস প্রদর্শনী। এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিতেন, সাফাভিদদের বিরুদ্ধাচরণ করার পরিণাম কী হতে পারে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সাফাভিদ সুফিবাদ বা সাফাভিদ কট্টরপন্থা (Safavid Extremism) প্রচলিত সুফিবাদের শান্ত রূপ থেকে কতটা দূরে সরে গিয়েছিল। এখানে ভক্তি, রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ একাকার হয়ে গিয়েছিল।

চালদিরান এবং অলৌকিকতার পতন

তবে এই ‘অপরাজেয়’ সুফি রাজার পতন ঘটেছিল বাস্তবতার কঠিন পাথরে ধাক্কা খেয়ে। ১৫১৪ সালে চালদিরানের যুদ্ধে (Battle of Chaldiran) অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম (যিনি ছিলেন কট্টর সুন্নি) শাহ ইসমাইলের মুখোমুখি হন। অটোমানরা ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত – তাদের ছিল কামান এবং মাস্কেট (বন্দুক)। অন্যদিকে কিজিলবাশরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করাকে কাপুরুষতা মনে করত। তারা বিশ্বাস করত, তাদের পীর শাহ ইসমাইল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তাই কামানের গোলা তাদের স্পর্শ করতে পারবে না।

ফলাফল হলো ভয়াবহ গণহত্যা। অটোমান কামানের সামনে কিজিলবাশ অশ্বারোহীরা কচুকাটা হলো। শাহ ইসমাইল নিজে আহত হয়ে কোনোক্রমে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন। এই পরাজয় সাফাভিদদের জন্য ছিল এক বিশাল মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা। কিজিলবাশরা বুঝতে পারল, তাদের পীর আসলে দেবতা নন, তিনিও রক্তমাংসের মানুষ এবং কামানের গোলার সামনে দোয়া বা আধ্যাত্মিকতা কাজ করে না। এই যুদ্ধের পর শাহ ইসমাইল আর কখনোই কোনো যুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি। তিনি গভীর বিষণ্নতায় ডুবে যান এবং মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। তবে ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে – ইরান পুরোপুরি শিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং সুফি তরিকাটি একটি শক্তিশালী রাজবংশে রূপান্তরিত হয়েছে।

সাফাভিদ সাম্রাজ্যের এই ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, সুফিবাদ বা তাসাউফ (Tasawwuf) সবসময় নির্জনতার সাধনা নয়। সঠিক (বা ভুল) নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থাকলে একটি আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীও পৃথিবীর বুকে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। সাফাভিরা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার এবং রাজনীতিকে ধর্মের বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তাদের এই লিগ্যাসি বা উত্তরাধিকার আজও মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে প্রবলভাবে উপস্থিত।

মুঘল ভারত ও বাংলার সুফি বাস্তবতা

এবার একটু নিজেদের অঞ্চলের দিকে তাকাই, অর্থাৎ আমাদের এই পরিচিত দক্ষিণ এশিয়ায়। আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়, এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কৃতিত্ব একচেটিভাবে সুফি দরবেশদের। প্রচলিত বয়ানটি হলো – ‘তলোয়ারে নয়, সুফিদের ভালোবাসায় মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে।’ এই বাক্যটি শুনতে খুবই মধুর এবং আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষার সাথে বেশ মানানসই। আমরা ভাবি, মুসলিম শাসকরা যখন সিংহাসন নিয়ে কামড়াকামড়ি করছিলেন, সুফিরা তখন গ্রামের সাধারণ মানুষের দুঃখ মোচনে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন (Richard Eaton) তার যুগান্তকারী গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বিষয়টা আসলে এত সরলরৈখিক বা রোমান্টিক নয়। বাংলার বদ্বীপ থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের মালভূমি পর্যন্ত, সুফিবাদের ইতিহাসের সাথে ক্ষমতা, কৃষি এবং সংঘাত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ইটনের বিখ্যাত তত্ত্ব অনুযায়ী, বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাথে কৃষিজমির বিস্তার বা কৃষিভিত্তিক উপনিবেশায়ন (Agrarian Colonization)-এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আর যেখানেই জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করা হয়েছে, সেখানেই প্রকৃতির সাথে এবং স্থানীয় অনার্য বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীর সাথে সংঘাত হয়েছে অবধারিতভাবে (Eaton, 1993)।

গাজী পীর ও বনের রাজা: মিথ বনাম ইতিহাস

বাংলায় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে সুন্দরবন ও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অনেক ‘গাজী পীর’ (Ghazi Pir) বা যোদ্ধা পীরের মাজার ও লোকগাথা প্রচলিত আছে। গ্রামবাংলার পুঁথিসাহিত্যে আমরা দেখি গাজী পীর বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই চিত্রকল্পটি রূপক হতে পারে, কিন্তু এর ঐতিহাসিক ভিত্তিটি বেশ শক্ত এবং সংঘাতময়। এই পীরেরা অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন সেই সব সুফি বা আধ্যাত্মিক নেতা, যারা মুসলিম শাসকদের সেনাবাহিনীর সাথে এসেছিলেন অথবা নিজেরাই ছোটখাটো লস্কর বা সেনাবাহিনী নিয়ে দুর্গম বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলায় ‘গাজী’ উপাধিটি কেবল যোদ্ধাদের জন্য ছিল না, এটি এমন সুফিদের জন্যও ব্যবহৃত হতো যারা ‘অবিশ্বাসী’ বা প্রকৃতির প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন।

উদাহরণ হিসেবে ত্রিবেনীর জাফর খান গাজীর কথা বলা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তিনি যখন বাংলায় আসেন, তখন তার ভূমিকা ছিল একাধারে একজন সুফি ধর্মপ্রচারকের এবং একজন সেনাপতির। স্থানীয় হিন্দু রাজাদের সাথে তার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধগুলোর বর্ণনা সমসাময়িক শিলালিপি এবং সাহিত্যে পাওয়া যায়। সেখানে জাফর খান গাজীকে ‘কাফেরদের নিধনকারী’ এবং ‘মসজিদ নির্মাতা’ হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে। অর্থাৎ, একজন সুফি সাধক এখানে সরাসরি তরবারি হাতে রাজ্য জয়ে অংশ নিচ্ছেন। সুন্দরবনের খান জাহান আলীর কথাও ধরুন। তিনি বাগেরহাটে যে বিশাল স্থাপত্যকীর্তি গড়ে তুলেছিলেন, তা কেবল অলৌকিক ক্ষমতায় হয়নি। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক ও সেনাপতি, যিনি তৎকালীন সুলতানের হয়ে ভাটি অঞ্চল আবাদ করেছিলেন। জঙ্গল পরিষ্কার করা, বাঘ-কুমির তাড়ানো এবং স্থানীয় দস্যুদের দমন করা – সবই ছিল তার মিশনের অংশ। এই প্রক্রিয়াটি ছিল মূলত একটি সামরিক ও কৃষিভিত্তিক অভিযান (Military-Agrarian Expedition)। সুফি খানকাগুলো ছিল সেই অভিযানের দুর্গ বা নিউক্লিয়াস। তাই সুফিদের ভূমিকা এখানে কেবল তসবিহ পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তারা ছিলেন ফ্রন্টিয়ার বা সীমান্তের লড়াকু নায়ক।

সিলেটের শাহজালাল: দরবেশ যখন সেনাপতি

আমাদের অঞ্চলের সুফি ইতিহাসের সবচাইতে আইকনিক চরিত্র হলেন হযরত শাহজালাল সিলেটে তার মাজার জিয়ারত করাকে অনেকে পরম পুণ্যের কাজ মনে করেন। জনশ্রুতি আছে যে, তিনি ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে সিলেটে এসেছিলেন এবং রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করেছিলেন। সাধারণ মানুষ ভাবে, হয়তো শাহজালাল কোনো অলৌকিক ক্ষমতার বলে রাজাকে পরাস্ত করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিল, বিশেষ করে ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি এবং পরবর্তীকালের ফার্সি পাণ্ডুলিপিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান। ১৩০৩ সালে যখন সিলেট বিজয় সম্পন্ন হয়, তখন শাহজালাল এর সাথে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সেনাবাহিনী যুক্ত ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিকান্দার খান গাজী

তবে মজার ব্যাপার হলো, এই যুদ্ধের মূল অনুপ্রেরণা এবং নৈতিক নেতৃত্ব ছিলেন শাহজালাল নিজেই। তিনি ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন এবং পথিমধ্যে দিল্লি হয়ে আসার সময় নিজামুদ্দিন আউলিয়া এর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক অনুমোদন নিয়েছিলেন। কিন্তু তার সাথী ৩৬০ জন আউলিয়া কেবল দরবেশ ছিলেন না, তারা ছিলেন সশস্ত্র মুজাহিদ। রাজা গৌর গোবিন্দর বিরুদ্ধে যুদ্ধটি হয়েছিল বেশ কয়েকটি ধাপে এবং এটি ছিল অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী। শাহজালাল এর কারামাত বা অলৌকিকতার গল্পগুলো (যেমন জায়নামাজে নদী পার হওয়া) যুদ্ধের ভয়াবহতাকে ঢেকে দিলেও, ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো – এখানে ধর্মপ্রচার এবং ভূখণ্ড দখল হাতে হাত রেখে চলেছিল। বিজয়ের পর শাহজালাল এর সঙ্গীরা সিলেটের বিভিন্ন পরগনায় ছড়িয়ে পড়েন এবং সেখানে শাসনভার ও ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব নেন। এটি প্রমাণ করে যে, সুফি তরিকা বা সিলসিলা (Silsila) এখানে একটি প্রশাসনিক ও সামরিক নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করেছে (Digby, 1986)।

মুঘল রাজনীতি ও নকশবন্দি প্রতিক্রিয়া

এবার দৃশ্যপট পরিবর্তন করে মুঘল ভারতের দিকে তাকানো যাক। মুঘল সম্রাট আকবর যখন তার ‘সুলহ-ই-কুল’ (Sulh-i-kul) বা ‘সকলের সাথে শান্তি’র নীতি এবং দীন-ই-ইলাহি (Din-i Ilahi) প্রবর্তন করলেন, তখন এর সবচাইতে কট্টর বিরোধিতা এসেছিল সুফিদের একটি বিশেষ অংশের কাছ থেকে। এরা ছিলেন নকশবন্দি (Naqshbandi) তরিকার অনুসারী। এই তরিকাটি মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল এবং এরা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাকে ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করত। এই আন্দোলনের মধ্যমণি ছিলেন শেখ আহমেদ সিরহিন্দি (Sheikh Ahmad Sirhindi), যাঁকে তার অনুসারীরা ‘মুজাদ্দিদ-ই-আলফ-ই-সানি’ বা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক বলে ডাকেন।

শেখ আহমেদ সিরহিন্দি আকবরের উদারনীতিকে ইসলামের জন্য হুমকি মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সুফিবাদের নামে হিন্দুদের সাথে মেলামেশা বা শিয়াদের প্রতি নমনীয়তা দেখানো শরিয়ত (Sharia) বিরোধী। তিনি মুঘল দরবারের প্রভাবশালী আমির-ওমরাহদের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতেন, যা মাকতুবাত (Maktubat) নামে পরিচিত। এই চিঠিগুলোতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলতেন যে, অমুসলিমদের অপদস্থ করা ইসলামের গৌরব বৃদ্ধির অংশ। তিনি লিখছেন, “ইসলামের সম্মান কুফরের অপমানের মধ্যে নিহিত।” হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব বা গরুর মাংস ভক্ষণ নিয়ে আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে যে বিধিনিষেধ ছিল, সিরহিন্দি তার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্র যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে কট্টর সুন্নি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে। এখানে একজন শীর্ষস্থানীয় সুফি নেতা কলমকে ব্যবহার করছেন সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করতে এবং রাষ্ট্রকে সহিংসতার দিকে উসকে দিতে।

তাত্ত্বিক সংঘাত: উজুদ বনাম শুহুদ

শেখ আহমেদ সিরহিন্দি কেবল রাজনৈতিকভাবেই সক্রিয় ছিলেন না, তিনি সুফি দর্শনেও এক বিশাল পরিবর্তন এনেছিলেন যা পরোক্ষভাবে অসহিষ্ণুতাকে বৈধতা দিয়েছিল। আকবরের আমলে এবং তারও আগে ভারতীয় সুফিদের মধ্যে ওয়াহদাতুল উজুদ (Wahdat al-Wujud) বা ‘সত্তার একত্ব’ (Unity of Being)-এর তত্ত্ব খুব জনপ্রিয় ছিল। ইবনে আরাবির এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি এক ও অভিন্ন সত্তার প্রকাশ। এই দর্শনটি হিন্দু অদ্বৈত বেদান্তের সাথে বেশ মিলে যায় এবং এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করত। কারণ, সবকিছুই যদি খোদার অংশ হয়, তবে রাম আর রহিমের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

সিরহিন্দি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে এক নতুন তত্ত্ব দাঁড় করালেন, যার নাম ওয়াহদাতুল শুহুদ (Wahdat al-Shuhud) বা ‘প্রত্যক্ষর একত্ব’ (Unity of Witness)। তিনি বললেন, সৃষ্টি এবং স্রষ্টা এক নয়। স্রষ্টা অসীম এবং পবিত্র, আর সৃষ্টি বা জগত হলো কেবল তার ছায়া। তাই ছায়াকে আসল বলে ভুল করা যাবে না। তার মতে, হিন্দুদের দেব-দেবী বা শিয়াদের ইমামরা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত। এই শুহুদ (Shuhud) তত্ত্বটি সুফিবাদের মরমী উদারতাকে সংকুচিত করে ফেলল এবং একটি কট্টরপন্থি রূপ দিল। সিরহিন্দির এই দর্শন পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আওরঙ্গজেবের সময়ে যে মন্দির ধ্বংস বা শিয়া বিরোধী অভিযানগুলো হয়েছিল, তার পেছনে নকশবন্দি সুফিদের এই তাত্ত্বিক সমর্থন বা বুদ্ধিবৃত্তিক সহিংসতা (Intellectual Violence) বড় ভূমিকা রেখেছিল (Friedmann, 2003)।

আওরঙ্গজেব ও সুফি রাজনীতি

সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের কথা না বললে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। তাকে প্রায়ই একজন গোঁড়া মোল্লা হিসেবে চিত্রিত করা হয়, কিন্তু তিনি নিজেও সুফি ভাবধারার প্রতি অনুগত ছিলেন, বিশেষ করে নকশবন্দি তরিকার প্রতি। তার ছেলেবেলা কেটেছে সুফি শিক্ষকদের সান্নিধ্যে। তিনি যখন দারা শিকোহকে (যিনি ছিলেন কাদিরিয়া তরিকার অনুসারী এবং উদারপন্থী সুফি) হত্যা করে সিংহাসনে বসলেন, তখন এটি কেবল দুই ভাইয়ের ক্ষমতার লড়াই ছিল না। এটি ছিল দুটি ভিন্ন সুফি দর্শনের লড়াই। দারা শিকোহ চেয়েছিলেন উপনিষদ এবং কুরআনের মিলন ঘটাতে, যাকে তিনি বলেছিলেন মাজমা-উল-বাহরাইন (Majma-ul-Bahrain) বা দুই সমুদ্রের মিলন। আর আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন শরিয়তভিত্তিক রাষ্ট্র।

দারা শিকোহকে যখন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তখন উলেমাদের ফতোয়ার সাথে সাথে নকশবন্দি সুফিদের সমর্থনও ছিল। দারা শিকোহকে ‘ধর্মত্যাগী’ বা মুলহিদ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, একজন সুফি শাহজাদাকে হত্যা করা হচ্ছে আরেক দল সুফির সম্মতিতে। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সংগীত নিষিদ্ধ করা বা সুফিদের নাচ-গান (সামা) বন্ধ করে দেওয়া – এগুলো ছিল নকশবন্দি সংস্কারের অংশ। তাই আমরা দেখি, মুঘল ভারতের রাজনীতিতে সুফিরা সবসময় শান্তির পায়রা হয়ে ওড়েননি। তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন, ষড়যন্ত্রে ছিলেন এবং প্রয়োজনে নিজের ভাইয়ের রক্ত ঝরাতে বা ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করতে পিছপা হননি।

বাংলার মাটিতে এবং মুঘল ভারতের রাজদরবারে সুফিবাদের এই ইতিহাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করা কত কঠিন। সুফিরা কখনো বাঘের সাথে লড়াই করে জঙ্গল আবাদ করেছেন, কখনো তরবারি হাতে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, আবার কখনো কলম হাতে নিয়ে ঘৃণার চাষাবাদ করেছেন। তাদের এই বহুমাত্রিক রূপটি না জানলে আমাদের ইতিহাসের পাঠ অসম্পূর্ণ এবং কিছুটা বিভ্রান্তিকরই থেকে যাবে।

চামকাউরের যুদ্ধ: জিন্দা পীর, নকশবন্দি প্রভাব এবং পবিত্র শপথের অবমাননা

ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু যুদ্ধ আছে যা সৈন্যসংখ্যার সাধারণ গণিত দিয়ে মাপা যায় না, বরং তা মাপা হয় আদর্শিক সংঘাতের তীব্রতা দিয়ে। চামকাউরের যুদ্ধ (Battle of Chamkaur) ঠিক তেমনই এক ঘটনা। ১৭০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের হাড় কাঁপানো শীত। পাঞ্জাবের রোপার জেলার এক জরাজীর্ণ মাটির কেল্লা বা হাভেলি। একদিকে মাত্র ৪০ জন শিখ যোদ্ধা এবং তাঁদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ, আর অন্যদিকে মুঘল সুবেদার ওয়াজির খানের নেতৃত্বে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্যের বিশাল বাহিনী। সাধারণ দৃষ্টিতে একে মনে হতে পারে এক অসম এবং নিশ্চিত আত্মঘাতী লড়াই। কিন্তু আমাদের আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সংঘাতের বারুদ তৈরি হয়েছিল তৎকালীন মুঘল দরবারের কট্টরপন্থি সুফি দর্শন এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের এক জটিল সংমিশ্রণে। সম্রাট আওরঙ্গজেব, যাঁকে তাঁর অনুসারীরা ডাকত ‘জিন্দা পীর’ (Living Saint) বা জীবন্ত সাধক বলে, তাঁর শাসনকালে সুফিবাদের একটি বিশেষ ধারা কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সহিংসতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, চামকাউরের যুদ্ধ তার এক জ্বলন্ত দলিল। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, যখন আধ্যাত্মিকতাকে রাষ্ট্রীয় গোঁড়ামি (State Orthodoxy) প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করা হয়, তখন তা কতটা নির্মম হতে পারে।

নকশবন্দি প্রতিক্রিয়া এবং আওরঙ্গজেবের ‘পবিত্র’ যুদ্ধ

চামকাউরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনে তাকাতে হবে। মুঘল সম্রাট আকবর যে ‘সুলহ-ই-কুল’ (Universal Peace) বা সর্বজনীন শান্তির নীতি প্রবর্তন করেছিলেন, তা ছিল চিশতিয়া সুফি দর্শনের প্রভাবিত। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময় এই উদারনীতির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হয়। এর পেছনে প্রধান তাত্ত্বিক শক্তি ছিল নকশবন্দি-মুজাদ্দিদি (Naqshbandi-Mujaddidi) সুফি তরিকাশেখ আহমেদ সিরহিন্দির ভাবশিষ্যরা এবং তৎকালীন প্রভাবশালী সুফি আলিমরা আওরঙ্গজেবকে বুঝিয়েছিলেন যে, একজন সাচ্চা মুসলিম শাসকের প্রধান কাজ হলো শরিয়ত (Sharia)-এর শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং বিদআত বা ধর্মীয় উদ্ভাবন নির্মূল করা। শিখ ধর্মের উত্থান, বিশেষ করে গুরু গোবিন্দ সিংহ যখন খালসা (Khalsa) পন্থ বা পবিত্র সেনাবাহিনী গঠন করলেন, তখন মুঘল দরবারের সুফি প্রভাবিত ওলেমা এবং আমিররা একে সরাসরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং ইসলামের বিশুদ্ধতার প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করলেন।

আওরাঙ্গজেব নিজে একজন সুফি সাধকের মতো জীবনযাপন করতেন – তিনি টুপি সেলাই করতেন, নিজের হাতে কুরআন নকল করতেন এবং রাজকোষের অর্থ ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করতেন না। কিন্তু তাঁর এই ব্যক্তিগত সাধুতা বা ‘দরবেশি’ (Dervishhood) তাঁকে নিষ্ঠুর হতে বাধা দেয়নি। বরং, তাঁর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসই তাঁকে শিখদের বিরুদ্ধে চরম সহিংস পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি এবং তাঁর সেনাপতিরা বিশ্বাস করতেন, ‘কাফের’ বা ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করা কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব (Sacred Duty)। একেই সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন পবিত্র সহিংসতা (Sacred Violence), যেখানে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা হত্যার লাইসেন্স বা বৈধতা হিসেবে কাজ করে। ওয়াজির খান যখন বিশাল বাহিনী নিয়ে আনন্দপুর সাহিব অবরোধ করেছিলেন, তখন তাঁর সৈন্যদের মনোবল বা মোটিভেশন ছিল এই যে, তারা ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ করছে। অথচ বাস্তবে এটি ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

কুরআন ছুঁয়ে শপথ এবং সুফি নৈতিকতার স্খলন

চামকাউরের ট্র্যাজেডির শুরু হয়েছিল এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে, যা সুফি নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মুঘল বাহিনী এবং তাদের সহযোগী পাহাড়ি রাজারা আনন্দপুর সাহিব অবরোধ করে রেখেছিল মাসের পর মাস। খাদ্য নেই, পানি নেই। তখন মুঘল সেনাপতিরা আওরঙ্গজেবের নাম করে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে গুরু গোবিন্দ সিংহকে বার্তা পাঠায়: “যদি আপনি কেল্লা ছেড়ে চলে যান, তবে আপনার এবং আপনার অনুসারীদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। আমরা আল্লাহর নামে শপথ করছি।” সুফি ঐতিহ্যে ‘আহদ’ (Covenant) বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ঈমানের অঙ্গ। বিশেষ করে যখন কুরআনের নামে শপথ করা হয়, তখন তা ভঙ্গ করা অকল্পনীয়।

গুরু গোবিন্দ সিংহ জানতেন যে এই শপথ মিথ্যা, কিন্তু তিনি কেল্লা ত্যাগ করলেন। এবং ঠিক যা ভাবা হয়েছিল, তাই ঘটল। মুঘল বাহিনী তাদের ‘পবিত্র শপথ’ ভঙ্গ করে পেছন থেকে শিখদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখানে আমরা দেখি, রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োজনে ধর্মীয় পবিত্রতাকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যে সুফিবাদ সত্য এবং বিশ্বাসের কথা বলে, সেই সুফি ভাবধারায় পুষ্ট শাসকরাই যুদ্ধের কৌশলে তাকিয়া (Strategic Deception) বা প্রতারণার আশ্রয় নিল। সিরসা নদী পার হওয়ার সময় তুমুল যুদ্ধ হলো, শিখদের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর গুরু মাত্র ৪০ জন শিখকে নিয়ে চামকাউরের কাঁচা গাদিতে (হাভেলিতে) আশ্রয় নিলেন। মুঘল বাহিনী যখন কেল্লা ঘিরে ফেলল, তখন তাদের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক (সমসাময়িক সূত্র মতে)। এই অসম যুদ্ধে মুঘল সৈন্যদের উস্কানি দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে, শিখদের হত্যা করলে তারা গাজীর মর্যাদা পাবে। অর্থাৎ, সুফি পরিভাষা ‘গাজী’ এখানে ব্যবহৃত হলো শপথভঙ্গকারী ঘাতকদের উৎসাহিত করার জন্য।

চামকাউরের রক্তস্রোত: শাহাদাত বনাম সংখ্যাধিক্য

১৭০৪ সালের সেই রাতে চামকাউরের কাঁচা কেল্লায় যা ঘটেছিল, তা যেকোনো ট্র্যাজেডি বা মহাকাব্যকে হার মানায়। মুঘল বাহিনী বারবার আক্রমণ চালাচ্ছিল, আর শিখরা ছোট ছোট দলে বা ‘জাথা’য় বিভক্ত হয়ে কেল্লা থেকে বেরিয়ে এসে বীরের মতো যুদ্ধ করে শহীদ হচ্ছিলেন। গুরু গোবিন্দ সিংহ উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে তীর ছুড়ে শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখছিলেন। এই যুদ্ধে গুরুর দুই বড় ছেলে – সাহিবজাদা অজিত সিংহ (১৮ বছর) এবং সাহিবজাদা জুঝার সিংহ (১৪ বছর) – বাবার চোখের সামনে শহীদ হলেন। সুফি তাত্ত্বিকরা প্রায়ই কারবালার যুদ্ধের উদাহরণ দেন ত্যাগের মহিমা বোঝাতে। চামকাউরে যেন সেই কারবালারই পুনরাবৃত্তি ঘটল, কিন্তু এখানে অত্যাচারীর ভূমিকায় ছিল তথাকথিত ‘ইসলামি’ বা সুফি-প্রভাবিত রাষ্ট্রশক্তি।

মুঘল সেনাপতিরা অবাক হয়ে দেখল, মৃত্যুকে কীভাবে আলিঙ্গন করা যায়। শিখদের এই মৃত্যুবরণ ছিল ‘চড়দি কলা’ (Chardi Kala) বা চিরউন্নত শিরের মানসিকতা প্রসূত। অন্যদিকে মুঘল বাহিনীতে থাকা অনেক সৈন্য ছিল সুফি পীরদের মুরিদ। তারা বিশ্বাস করত, পীরের দোয়ায় তারা সুরক্ষিত। কিন্তু তাদের এই ভক্তি ছিল অন্ধ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা ম্যানিপুলেটেড। চামকাউরের যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, সংখ্যায় বেশি হলেই বা মুখে ধর্মের বুলি আউড়ালেই সত্যের জয় হয় না। মুঘলরা সেদিন কেল্লা দখল করেছিল ঠিকই, কিন্তু তারা নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ মুঘল সাম্রাজ্যের নৈতিক ভিত্তি বা মোরাল অথরিটি (Moral Authority) ধসিয়ে দিয়েছিল।

পীর বুদ্ধু শাহ: সুফিবাদের ভিন্নস্বর

তবে চামকাউরের যুদ্ধের আলোচনায় সুফিদের ভূমিকা একতরফাভাবে নেতিবাচক ছিল না। সুফিবাদের ভেতরেই যে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদী ও মানবিক ধারা ছিল, তার প্রমাণ হলেন পীর বুদ্ধু শাহ (Pir Buddhu Shah)। তিনি ছিলেন সাধৌরা অঞ্চলের একজন বিখ্যাত সুফি সাধক এবং ইসলামি পণ্ডিত। তিনি গুরু গোবিন্দ সিংহের বন্ধু ছিলেন এবং গুরুর আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ ছিলেন। চামকাউরের যুদ্ধের আগেই, ভাঙ্গানির যুদ্ধে পীর বুদ্ধু শাহ তাঁর মুরিদ এবং নিজের ছেলেদের নিয়ে গুরুর পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। সেখানে তাঁর দুই ছেলে শহীদ হন।

চামকাউরের যুদ্ধের সময় এবং তার পরেও পীর বুদ্ধু শাহ এবং তাঁর অনুসারীরা মুঘল কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গুরুকে সাহায্য করেছিলেন। মুঘলরা যখন জানতে পারল যে একজন মুসলিম পীর হয়ে তিনি ‘কাফের’ শিখ গুরুর সাহায্য করেছেন, তখন সুবেদার উসমান খান তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। পীর বুদ্ধু শাহের এই আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে, সুফিবাদের একটি অংশ সবসময়ই সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিল। তাঁরা ‘সুলহ-ই-কুল’ (Peace with All) নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মুঘল রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া কট্টরপন্থার বিরোধী ছিলেন। পীর বুদ্ধু শাহ এবং আওরঙ্গজেব – দুজনেই সুফি ঐতিহ্যের দাবিদার, কিন্তু একজন দাঁড়িয়েছিলেন প্রেমের পক্ষে, আরেকজন ক্ষমতার পক্ষে। চামকাউরের যুদ্ধ ছিল মূলত এই দুই ধরণের সুফিবাদের – রাষ্ট্রীয় সুফিবাদ (State Sufism) বনাম জনগণের সুফিবাদ (Popular Sufism) – এর সংঘাত।

জাফরনামা: জিন্দা পীরের মুখোশ উন্মোচন

চামকাউরের যুদ্ধের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অধ্যায়টি রচিত হয়েছিল যুদ্ধের অব্যবহিত পরে। গুরু গোবিন্দ সিংহ অলৌকিকভাবে সেই কেল্লা থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর তিনি দীনা কাঙ্গড় থেকে আওরঙ্গজেবকে উদ্দেশ্য করে একটি দীর্ঘ ফার্সি চিঠি লেখেন, যা ইতিহাসে জাফরনামা (Zafarnama) বা ‘বিজয়ের চিঠি’ নামে পরিচিত। এই চিঠিতে গুরু কোনো অনুনয়-বিনয় করেননি, বরং তিনি আওরঙ্গজেবের ‘সুফি’ বা ধার্মিক ভাবমূর্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এটি ছিল এক ধরণের জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রতিরোধ (Epistemic Resistance)

গুরু লেখেন, “তুমি কেমন ধার্মিক রাজা? তুমি কুরআনের শপথ ভঙ্গ করেছ। তোমার তসবিহ এবং নামাজ সবই লোক দেখানো, যদি তোমার অন্তরে ন্যায়বিচার না থাকে।” জাফরনামা-তে গুরু স্পষ্ট করেন যে, আওরঙ্গজেব নিজেকে যতই ‘জিন্দা পীর’ ভাবুন না কেন, তিনি আসলে আল্লাহকে চেনেন না। কারণ আল্লাহ কখনো শপথ ভঙ্গকারীকে পছন্দ করেন না। গুরু আরও লেখেন, “চুন কার আজ হামা হিলাতে দার গুযাস্ত, হালাল আস্ত বুরদান বা শামশিল দাস্ত” (যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব উপায় ব্যর্থ হয়, তখন তলোয়ার ধারণ করা বৈধ)। আওরঙ্গজেব, যিনি নিজেকে আল্লাহ-ওয়ালা মনে করতেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এই চিঠি পড়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। এখানে আমরা দেখি এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক লড়াই – একজন ক্ষমতাধর সম্রাট যিনি সুফিবাদের মোড়কে সহিংসতা চালাচ্ছেন, আরেকজন নিঃস্ব ফকির-সম্রাট (গুরু গোবিন্দ সিংহ) যিনি কলম দিয়ে সেই সহিংসতার নৈতিক ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন।

উচ দা পীর: সুফি পরিচয়ের প্যারাডক্স

যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সুফিবাদের আরেকটি বিচিত্র এবং আইরনিক রূপ আমরা দেখতে পাই। গুরু গোবিন্দ সিংহ যখন মাছিওয়ারা জঙ্গলে একা এবং ক্লান্ত অবস্থায় ঘুরছিলেন, তখন মুঘল সৈন্যরা তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। সেই সময় তাঁকে রক্ষা করেন দুই পাঠান ভাই – গণি খান এবং নবী খান। তাঁরা ছিলেন গুরুর ভক্ত। কিন্তু গুরুকে মুঘল চেকপোস্ট পার করার জন্য তাঁরা এক অভিনব ছদ্মবেশ ধারণ করান। তাঁরা গুরুকে নীল রঙের আলখেল্লা পরিয়ে পালকিতে বসান এবং প্রচার করেন যে, ইনি হলেন ‘উচ দা পীর’ (Uch da Pir) বা উচ শরীফের (দক্ষিণ পাঞ্জাবের একটি বিখ্যাত সুফি কেন্দ্র) এক মহান সুফি সাধক

মুঘল সেনাপতিরা এবং সৈন্যরা, যারা সুফি সাধকদের প্রতি অত্যন্ত ভক্তিপরায়ণ ছিল, তারা পালকি থামিয়ে এই ‘পীর’ সাহেবের দোয়া চাইল, তাঁকে নজরানা দিল এবং সসম্মানে যেতে দিল। ভাবা যায়? যে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং যে ভাবাদর্শ (কট্টর সুফিবাদ) গুরুকে হত্যা করার জন্য চামকাউরের মতো অসম যুদ্ধ বাধাল, সেই একই ভাবাদর্শের (লোকজ সুফিবাদ) ছদ্মবেশেই গুরু প্রাণ বাঁচালেন। ইতিহাসের এই প্যারাডক্স (Paradox) বা কূটাভাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, সুফিবাদের সামাজিক ক্ষমতা বা সোশ্যাল ক্যাপিটাল (Social Capital) কত প্রবল ছিল। গণি খান এবং নবী খান জানতেন যে তাঁরা ধরা পড়লে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত, কিন্তু ‘ইশক’ বা প্রেমের কাছে তাঁরা সেই ভয়কে তুচ্ছ করেছিলেন। এটি ছিল সুফিবাদের সেই মানবিক মুখ, যা ক্ষমতার রাজনীতির ঊর্ধ্বে। চামকাউরের যুদ্ধ এবং এই পলায়নপর্ব আমাদের শেখায়, ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা যখন রাষ্ট্রের হাতে থাকে তখন তা হয় তলোয়ার, আর যখন মানুষের হাতে থাকে তখন তা হয় ঢাল।

ঔপনিবেশিক বিরোধী লড়াই ও সুফি প্রতিরোধ

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব মানচিত্রের দিকে তাকালে আমরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাই। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো – তা সে ব্রিটিশ সিংহ হোক, ফরাসি মোরগ হোক, কিংবা রাশিয়ার ভালুক – তখন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো গিলে খাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাদের কাছে ছিল আধুনিক সব মারণাস্ত্র, সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এবং ‘সভ্যতা’ শেখানোর অহংকার। কিন্তু এই দানবীয় শক্তির সামনে যখন স্থানীয় রাজ-রাজড়ারা অসহায় আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন প্রতিরোধের দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন একদল দরবেশ। সুফিবাদের ইতিহাসে এই অধ্যায়টি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ, কারণ এখানে সুফি খানকাগুলো একেকটি সেনা ব্যারাকে রূপান্তরিত হয়েছিল। আধ্যাত্মিকতার সাধনা আর স্বাধীনতার সংগ্রাম এখানে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই লড়াইটা ছিল অস্তিত্ব রক্ষার, যাকে বলা যায় প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ (Defensive Jihad)। এই পর্বে আমরা দেখব, কীভাবে তসবিহ হাতে নেওয়া হাতগুলোই দখলদারদের বিরুদ্ধে রাইফেল তুলে নিয়েছিল এবং বছরের পর বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিল।

ককেশাসের মুরিদ যুদ্ধ: ঈগল এবং ভালুকের লড়াই

রাশিয়ান জার সাম্রাজ্য যখন ককেশাস পর্বতমালা – অর্থাৎ আজকের চেচনিয়া এবং দাগেস্তান – দখল করার জন্য হাত বাড়াল, তখন তারা ভেবেছিল এটি হবে কয়েক দিনের মামলা। কিন্তু তারা জানত না, পাহাড়ের প্রতিটি কন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নকশবন্দি-খালিদিয়া (Naqshbandi-Khalidiyya) তরিকার সুফিরা। এই প্রতিরোধের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ইমাম শামিল (Imam Shamil)। তিনি ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত আলেম এবং নকশবন্দি সুফি শেখ। ১৮৩৪ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা ‘মুরিদ যুদ্ধ’ (Murid War) নামে পরিচিত।

ইমাম শামিল খুব ভালোভাবেই জানতেন যে, রাশিয়ার আধুনিক কামানের সামনে তার অনুসারীদের তলোয়ার দিয়ে সম্মুখযুদ্ধ করা আত্মহত্যার শামিল। তাই তিনি বেছে নিলেন গেরিলা পদ্ধতি। আর এই যুদ্ধের জন্য তিনি ব্যবহার করলেন সুফিবাদের সাংগঠনিক কাঠামো বা মুরিদবাদ (Muridism) নকশবন্দি তরিকায় পীর বা শাইখের প্রতি মুরিদের আনুগত্য হতে হয় প্রশ্নাতীত। শামিল এই আধ্যাত্মিক আনুগত্যকে সামরিক শৃঙ্খলায় রূপান্তর করলেন। তিনি দাগেস্তান ও চেচনিয়ার বিবদমান গোত্রগুলোকে এক করলেন শরিয়ত এবং সুফিবাদের পতাকাতলে। তিনি গড়ে তুললেন ‘ইমামাত’ (Imamate) নামক এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে মদ্যপান, জুয়া এবং রক্তক্ষয়ী জাতিগত দাঙ্গা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলো।

রাশিয়ান জেনারেলরা শামিলকে সমীহ করতেন। শামিলের যোদ্ধারা পাহাড়ের আড়াল থেকে ঝটিকা আক্রমণ করত এবং নিমেষেই মিলিয়ে যেত। এই যোদ্ধারা বা ‘মুরিদ’রা বিশ্বাস করত, ইমামের আদেশে জীবন দেওয়া মানেই জান্নাত। শামিল নিজে ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তিনি দিনের বেলা ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, আর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজে চোখের জল ফেলতেন। ১৮৫৯ সালে যখন তিনি গুনিবের দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে শেষমেশ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন, তখনো তার বীরত্ব অম্লান ছিল। রাশিয়ার জারের কাছে তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর চরিত্র – যিনি একাধারে সুফি সাধক এবং সামরিক জিনিয়াস। ককেশাসের এই প্রতিরোধ প্রমাণ করে যে, সুফিবাদের কঠোর রিয়াজত (Asceticism) বা কৃচ্ছ্রসাধন মানুষকে যুদ্ধের কঠিনতম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করতে পারে (Zelkina, 2000)।

আলজেরিয়ায় আব্দুল কাদির: মরমিবাদ এবং আধুনিক রাষ্ট্র

ফরাসিরা যখন ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া আক্রমণ করে, তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দেন আমির আব্দুল কাদির (Emir Abdelkader)। তিনি ছিলেন কাদিরিয়া (Qadiriyya) সুফি তরিকার প্রধান। কিন্তু তিনি কেবল একজন সুফি পীর ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কবি, দার্শনিক এবং আধুনিক আলজেরিয়ার জনক। ফরাসি জেনারেলরা তাকে ডাকত ‘মরুভূমির নেপোলিয়ন’। আব্দুল কাদির বিশ্বাস করতেন, ইসলামি আইন এবং সুফি দর্শন মেনেও একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। তিনি ফরাসিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যুদ্ধ করেন, কিন্তু তার যুদ্ধ ছিল নীতি-নৈতিকতায় পরিপূর্ণ।

আব্দুল কাদিরের চরিত্রটি ছিল বড়ই বিচিত্র। যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন নির্মম, কিন্তু যুদ্ধবন্দিদের প্রতি তিনি ছিলেন দয়ালু। ফরাসিরা যখন আলজেরিয়ান গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল এবং বন্দিদের হত্যা করছিল, আব্দুল কাদির তখন ফরাসি বন্দিদের খাইয়ে-দাইয়ে রাখতেন। তিনি বলতেন, “আমি ফরাসিদের শরীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে নয়।” তার এই আচরণের মূলে ছিল সুফি দর্শনের ফুতুওয়াহ (Futuwwa) বা আধ্যাত্মিক বীরত্বের ধারণা। তিনি মনে করতেন, একজন সত্যিকারের মুজাহিদ বা যোদ্ধা কখনোই পশুর মতো আচরণ করতে পারে না।

সবচাইতে চমকপ্রদ তথ্য হলো, যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও তিনি পড়াশোনা ছাড়েননি। তার লাইব্রেরি ছিল তার ঘোড়ার পিঠে। দিনের যুদ্ধ শেষে তাবুতে ফিরে তিনি ডুবে যেতেন ইবনে আরাবি (Ibn Arabi)-র জটিল দর্শন ফুতুহাত আল-মাক্কিয়া (The Meccan Revelations) পাঠে। তিনি নিজেকে ইবনে আরাবির আধ্যাত্মিক সন্তান মনে করতেন। ১৮৪৭ সালে আত্মসমর্পণের পর তিনি যখন দামেস্কে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন, তখন ১৮৬০ সালের খ্রিস্টান-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি হাজার হাজার খ্রিস্টানকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। একজন সুফি নেতা, যিনি একসময় ফরাসি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন, তিনিই আবার মানবতার খাতিরে খ্রিস্টানদের রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এই দ্বান্দ্বিক চরিত্রটি সুফিবাদের গভীরতা এবং পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে (Etienne, 2012)।

লিবিয়ার সানুসি আন্দোলন: মরুভূমির সিংহ ও ‘জাবিয়া’ নেটওয়ার্ক

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন ইতালির ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনি লিবিয়াকে ইতালির উপনিবেশ বা ‘চতুর্থ তটরেখা’ বানাতে চাইলেন, তখন তার সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল একটি সুফি তরিকা – সানুসি (Sanusi)। এই তরিকাটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত ইসলামকে শুদ্ধ করার লক্ষ্যে, অনেকটা ওয়াহাবি আন্দোলনের মতো, কিন্তু এর শিকড় ছিল সুফি আধ্যাত্মিকতায়। সানুসিরা সাহারা মরুভূমির দুর্গম এলাকায় তাদের জাবিয়া (Zawiya) বা খানকা স্থাপন করেছিল। এই জাবিয়াগুলো ছিল একাধারে স্কুল, কৃষি খামার, এবং সামরিক ঘাঁটি।

এই প্রতিরোধের কিংবদন্তি নায়ক ছিলেন ওমর আল-মুখতার (Omar al-Mukhtar)। তিনি ছিলেন একজন সানুসি শেখ এবং কুরআন শিক্ষক। যখন তিনি ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, তখন তার বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। তাকে বলা হয় ‘মরুভূমির সিংহ’। ইতালিয়ানদের ছিল আধুনিক ট্যাংক, বিমান এবং মেশিনগান। আর মুখতারের বেদুঈন বাহিনীর সম্বল ছিল ঘোড়া, পুরনো রাইফেল এবং মরুভূমির ধুলোঝড়। কিন্তু ওমর আল-মুখতার এই অসম যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন প্রায় ২০ বছর। সানুসি তরিকার জাবিয়াগুলো ছিল এই যুদ্ধের নার্ভ সেন্টার। সেখান থেকেই রসদ আসত, সেখান থেকেই গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান হতো।

সানুসি সুফিবাদ ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং অনাড়ম্বর। তারা নাচ-গান বা মাজার জিয়ারতের বিরোধী ছিল, কিন্তু জিহাদের ব্যাপারে ছিল আপোষহীন। ওমর আল-মুখতারের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, যা তিনি ইতালিয়ান আদালতে বিচারকের সামনে বলেছিলেন, “আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আমরা জিতব অথবা মরব।” ১৯৩১ সালে তাকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয়, তখন তিনি শান্তভাবে কুরআনের আয়াত পাঠ করছিলেন। তার এই শাহাদাত সানুসি তরিকাকে লিবিয়ার জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত করে। এখানে সুফিবাদ কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে থাকেনি, তা হয়ে উঠেছিল একটি অ্যান্টি-কলোনিয়াল বা উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (Anti-Colonial Nationalist Movement) (Evans-Pritchard, 1949)।

সুদানের মাহদি: ত্রাণকর্তার তরবারি

সুফি প্রতিরোধ আন্দোলনের সবচাইতে উগ্র এবং মেসিয়ানিক বা ত্রাণকর্তা-কেন্দ্রিক রূপটি দেখা যায় সুদানে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে সুদান ছিল তুর্কি-মিশরীয় শাসনের অধীনে, যার কলকাঠি নাড়ত ব্রিটিশরা। এই সময় সাম্মানিয়া (Sammaniya) সুফি তরিকার একজন দরবেশ, মুহাম্মদ আহমদ, নিজেকে ‘মাহদি’ (The Mahdi) বা প্রতীক্ষিত পথপ্রদর্শক হিসেবে ঘোষণা করেন। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, শেষ জামানায় মাহদি এসে পৃথিবীকে অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত করবেন। মুহাম্মদ আহমদ দাবি করলেন, তিনি সেই মাহদি এবং ব্রিটিশ ও তুর্কিদের মতো ‘কাফের’দের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করাই তার কাজ।

মুহাম্মদ আহমদের এই ঘোষণা সুদানের নির্যাতিত মানুষের মনে বারুদের মতো কাজ করল। হাজার হাজার মানুষ, যারা নিজেদের ‘আনসার’ (The Helpers) বা সাহায্যকারী বলত, তারা মাহদির পতাকাতলে সমবেত হলো। এরা ছিল মূলত সুফি ভাবধারায় বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ, যারা মাহদিকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করত। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত মাহদির বাহিনী একের পর এক বিজয় ছিনিয়ে আনে। তাদের অস্ত্র ছিল বর্শা আর তলোয়ার, কিন্তু তাদের মনে ছিল ধর্মীয় উন্মাদনা বা জিহাদিজম (Jihadism)

এই যুদ্ধের ক্লাইম্যাক্স ছিল ১৮৮৫ সালে খার্তুম অবরোধ। ব্রিটিশ জেনারেল চার্লস গর্ডন খার্তুম রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন। মাহদির অনুসারীরা গর্ডনের কাটা মাথা বর্শার আগায় গেঁথে মাহদির সামনে নিয়ে এসেছিল। যদিও মাহদি বলেছিলেন গর্ডনকে জীবিত ধরতে, কিন্তু যুদ্ধের উন্মাদনায় তা সম্ভব হয়নি। খার্তুম পতনের কিছুদিন পরেই মাহদি মারা যান, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত ‘মাহদিয়া রাষ্ট্র’ আরও একযুগ টিকে ছিল। এখানে আমরা দেখি, সুফিবাদ বা মরমীবাদ কীভাবে একটি চরমপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে বা মেসিয়ানিক আন্দোলন (Messianic Movement)-এ রূপান্তরিত হতে পারে। মাহদিবাদী আন্দোলন প্রমাণ করে যে, সুফিবাদের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে দিয়েও বড় বড় সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া সম্ভব (Holt, 1970)।

প্রতিরোধের মনস্তত্ত্ব ও সুফি ঐতিহ্য

প্রশ্ন জাগতে পারে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কেন মূলধারার ওলামাদের চেয়ে সুফিরা বেশি সফল ছিলেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে সুফিবাদের সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতরে। প্রথমত, সুফি তরিকাগুলো ছিল আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের মতো। এক দেশ থেকে আরেক দেশে তাদের যোগাযোগ ছিল। দ্বিতীয়ত, সুফিদের ছিল সামাজিক পুঁজি (Social Capital)। তারা সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতেন, তাদের ভাষায় কথা বলতেন। ফলে মানুষকে একজোট করা তাদের জন্য সহজ ছিল। তৃতীয়ত, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাইয়াত (Bay’ah) বা আনুগত্যের শপথ। একজন মুরিদ তার পীরের আদেশে আগুনে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত থাকেন। যুদ্ধের ময়দানে এই নিরঙ্কুশ আনুগত্যই ছিল তাদের সবচাইতে বড় অস্ত্র।

এই উদাহরণগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, খানকার নিরিবিলি পরিবেশ ছেড়ে সুফিরা প্রয়োজনে মেশিনগান বা তলোয়ার কাঁধে তুলে নিতে পিছপা হননি। তাদের এই সহিংসতা ছিল রাজনৈতিক এবং অস্তিত্ব রক্ষার, কিন্তু এর জ্বালানি আসতো সুফি মতাদর্শ থেকে। তারা প্রমাণ করেছেন, ধ্যান বা মোরাকাবা মানুষকে কাপুরুষ বানায় না, বরং ন্যায়ের জন্য লড়াই করার ইস্পাতকঠিন মানসিকতা তৈরি করে দেয়।

আধুনিক যুগে সুফি সহিংসতা: বেরলভি বনাম অন্যান্য

আমরা যদি ইতিহাসের ধুলোমাখা পাতা থেকে চোখ সরিয়ে বর্তমান সময়ের, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের দিকে তাকাই, তবে দেখব সুফিবাদের সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক এখনো শেষ হয়ে যায়নি; বরং তা এক নতুন এবং জটিল রূপ ধারণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত ধারণা হলো, ইসলামি উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদের কপিরাইট বুঝি কেবল দেওবন্দি বা সালাফি মতাদর্শের গোষ্ঠীগুলোর (যেমন তালেবান বা আল-কায়েদা) হাতে। এর বিপরীতে বেরলভি (Barelvi) মতাদর্শকে সাধারণত সুফি-ঘেঁষা, মাজার-কেন্দ্রিক এবং নরমপন্থী বা অহিংস (Non-violent) মনে করা হয়। পশ্চিমা বিশ্ব এবং পাকিস্তানের উদারপন্থীরা দীর্ঘকাল ধরে ভেবে এসেছে যে, তালেবানদের কট্টরপন্থার বিপরীতে এই সুফি ভাবধারার বেরলভিরাই হতে পারে শান্তির ঢাল। কারণ, এরা গান-বাজনা, কাওয়ালি এবং জাঁকজমকপূর্ণ উরস বা উৎসবে বিশ্বাসী। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ধারণাটি কাঁচের গ্লাসের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা দেখেছি ‘তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান’ (Tehreek-e-Labbaik Pakistan) বা টিএলপি-র মতো সংগঠনের নাটকীয় এবং সহিংস উত্থান। এই সংগঠনটি প্রমাণ করেছে যে, প্রেমের আতিশয্য যখন রাজনৈতিক রূপ নেয়, তখন তা বারুদের চেয়েও বেশি বিস্ফোরক হতে পারে।

ইশক-ই-রাসুল: প্রেমের যখন রাজনৈতিক বারুদ

বেরলভি মতাদর্শের মূল ভিত্তি হলো নবী মুহাম্মদের প্রতি অত্যধিক ভক্তি ও প্রেম, যাকে বলা হয় ইশক-ই-রাসুল (Love for the Prophet)। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আহমেদ রেজা খান বেরলভি (Ahmed Raza Khan Barelvi) এই আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। তিনি দেওবন্দি এবং ওয়াহাবি সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন এবং নবীর আধ্যাত্মিক মর্যাদা বা নূর-ই-মুহাম্মদি (Light of Muhammad) প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এতদিন এই ‘ইশক’ বা প্রেম ছিল একান্তই ব্যক্তিগত এবং আধ্যাত্মিক বিষয়। একজন সুফি বা ভক্ত নবীর প্রেমে কাঁদবেন, কবিতা লিখবেন – এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই প্রেমকে রাজপথে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং একে ব্যবহার করা হয়েছে সহিংসতার বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) দেওয়ার জন্য।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি এই পরিবর্তনের সবচাইতে বড় উদাহরণ। ২০১১ সালে সালমান তাসির যখন পাকিস্তানের ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা আইনের কিছু সংস্কারের কথা বলেছিলেন (তিনি আইন বাতিলের কথা বলেননি, অপপ্রয়োগ রোধের কথা বলেছিলেন), তখন তাকে গুলি করে হত্যা করেন তারই নিজস্ব দেহরক্ষী মমতাজ কাদরি। মমতাজ কাদরি কোনো তালেবান জঙ্গি ছিলেন না; তিনি ছিলেন পুলিশ বাহিনীর এলিট ফোর্সের সদস্য এবং সুফি ভাবধারায় বিশ্বাসী একজন বেরলভি মুসলিম। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাসুলের শানে সামান্যতম বেয়াদবি বা অবমাননা সহ্য করা মানে ঈমান হারানো। এখানে ‘মান সাব্বা নাবিয়্যান’ (Whoever insults a Prophet) বা নবীকে অবমাননাকারীর শাস্তির বিধানকে মমতাজ কাদরি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

সবচাইতে ভয়ের ব্যাপারটি ঘটল হত্যাকাণ্ডের পরে। মমতাজ কাদরি যখন আদালতে হাজিরা দিতে এলেন, তখন হাজার হাজার আইনজীবী তার ওপর গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে তাকে বরণ করে নিলেন। বেরলভি সুফি পীর এবং আলেম সমাজ, যারা এতদিন শান্তির কথা বলতেন, তারা মমতাজ কাদরিকে ‘গাজী’ বা বীরের মর্যাদা দিলেন। এখানে ‘নামুস-ই-রিসালাত’ (Honor of the Prophethood) বা নবুওয়াতের সম্মান রক্ষার দোহাই দিয়ে একটি ঠান্ডা মাথার খুনকে পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হলো। এই ঘটনাটি আধুনিক সুফিবাদের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। এটি দেখাল যে, সুফিবাদের ‘ফানা’ বা বিলীন হওয়ার ধারণাটি যখন ধর্মীয় আবেগের সাথে মিশে যায়, তখন একজন সাধারণ মানুষও আত্মঘাতী হত্যাকারীতে পরিণত হতে পারে। প্রেমের উন্মাদনা বা প্যাশন (Passion) এখানে যুক্তিবোধকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছিল (Philippon, 2011)।

খাদিম রিজভি ও টিএলপি: গালি যখন বিপ্লবের ভাষা

মমতাজ কাদরীর ফাঁসির পর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন খাদিম হোসাইন রিজভি (Khadim Hussain Rizvi)। তিনি ছিলেন একজন বেরলভি আলেম এবং দুর্দান্ত বক্তা। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি)। রিজভি সাহেব সুফিবাদকে খানকা থেকে টেনে এনে সরাসরি ভোটের রাজনীতি এবং রাস্তার দাঙ্গায় পরিণত করেন। তার ভাষা ছিল অত্যন্ত উগ্র এবং অনেক সময় অশ্লীল, কিন্তু তার অনুসারীদের কাছে সেটাই ছিল ‘সত্যের ভাষা’। তিনি আল্লামা ইকবালের সুফি কবিতা আবৃত্তি করতেন আর তার পরপরই বিরোধীদের মাথা কেটে ফেলার হুমকি দিতেন। তার বিখ্যাত স্লোগান, “গুস্তাখ-ই-রাসুল কি এক হি সাজা, সর তন সে জুদা” (নবীর অবমাননাকারীর একটাই শাস্তি, দেহ থেকে মাথা আলাদা) – পুরো পাকিস্তানে এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে।

২০১৭ সালে ফয়জাবাদে টিএলপি-র ধর্না বা অবস্থান কর্মসূচি পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রকে কার্যত অচল করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং সরকার তাদের সাথে আপস করতে বাধ্য হয়। এটি ছিল আধুনিক যুগে সুফি রাজনৈতিক শক্তির বা বেরলভি সক্রিয়তাবাদের (Barelvi Activism) এক বিশাল বিজয়। এখানে দেখা গেল, দেওবন্দি বা সালাফি জঙ্গিরা যেমন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করে (যেমন টিটিপি), বেরলভিরা ঠিক তেমনটা করে না। তারা অস্ত্র হাতে পাহাড়ে যায় না, বরং তারা আবেগকে পুঁজি করে লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে রাষ্ট্রকে জিম্মি করে ফেলে। তাদের সহিংসতা হলো মব ভায়োলেন্স (Mob Violence) বা গণপিটুনি এবং ভাংচুরশিয়ালকোটে শ্রীলঙ্কান ম্যানেজার প্রিয়ান্থা কুমারাকে যখন উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে মারল, তখন সেই জনতার মুখে টিএলপি-র স্লোগানই ছিল। অর্থাৎ, সুফি ভাবধারার একটি অংশ এখন মনে করে, নবীর প্রেমে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বৈধ। এটি সুফিবাদের চিরায়ত সহনশীলতার বয়ানের ঠিক বিপরীত মেরুর বাস্তবতা (Sareen, 2017)।

লক্ষ্যবস্তু যখন সুফি: মাজারের রক্তস্রোত

মুদ্রার উল্টো পিঠটাও আমাদের দেখতে হবে, যা সমানভাবে সত্য এবং মর্মান্তিক। আধুনিক যুগে সুফিরা যেমন সহিংসতার জন্ম দিয়েছেন, তেমনি তারা নিজেরাও সহিংসতার অন্যতম প্রধান শিকার। সালাফি, ওয়াহাবি বা দেওবন্দি কট্টরপন্থীরা, বিশেষ করে আইসিস (ISIS) বা তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (TTP), সুফি মাজার এবং খানকাগুলোকে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ মনে করে। তাদের মতে, মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করা, ফুল দেওয়া বা কাওয়ালি গাওয়া হলো শিরক (Shirk) বা আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করা। আর যারা শিরক করে, তাদের হত্যা করা এই উগ্রবাদী মতাদর্শে বৈধ মনে করা হয়, যাকে বলা হয় তাকফির (Takfir) বা কাউকে কাফের ঘোষণা করা।

এই মতাদর্শিক সংঘাতের বলি হয়েছে পাকিস্তানের এবং আফগানিস্তানের শত শত সুফি মাজার। ২০১৭ সালে সিন্ধু প্রদেশের সেহওয়ান শরিফে লাল শাহবাজ কালান্দরের মাজারে যখন সুফি ভক্তরা ধামাল বা আধ্যাত্মিক নাচে মগ্ন ছিলেন, তখন আইসিসের এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রায় ৯০ জন নিহত এবং ৩০০ জনের বেশি আহত হন। লাল শাহবাজ কালান্দর ছিলেন এমন এক সুফি সাধক, যার মাজারে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই যেত। এই হামলাটি ছিল মূলত সুফিবাদের বহুত্ববাদী বা প্লুরালিস্টিক (Pluralistic) চরিত্রের ওপর আঘাত। একইভাবে লাহোরের দাতা দরবার, বেলুচিস্তানের শাহ নূরানি মাজার এবং করাচির আব্দুল্লাহ শাহ গাজীর মাজারে বারবার হামলা হয়েছে।

এই হামলাগুলোর মনস্তত্ত্ব হলো – সুফি সংস্কৃতি বা ফোক ইসলাম (Folk Islam) কে নির্মূল করা। উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো মনে করে, বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই মাজার সংস্কৃতি ধ্বংস করতে হবে। ফলে সুফিরা এখানে এক অস্তিত্বের সংকটে পড়েছেন। একদিকে তারা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে চাইছেন, অন্যদিকে টিএলপি-র মতো সংগঠনের কারণে তাদের গায়েও উগ্রবাদের তকমা লেগে যাচ্ছে। এটি এক অদ্ভুত দ্বিমুখী সংকট। সুন্নি ইসলামের ভেতরেই এখন চলছে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বা সেক্টারিয়ান ভায়োলেন্স (Sectarian Violence), যেখানে একদল আল্লাহু আকবার বলে মাজারে বোমা মারছে, আর অন্যদল ইয়া রাসুলুল্লাহ বলে রাস্তায় গাড়ি ভাঙছে (Abbas, 2018)।

বেরলভি বনাম দেওবন্দি: আধিপত্যের লড়াই

আধুনিক পাকিস্তানের রাজনীতি এবং সমাজকে বুঝতে হলে বেরলভি এবং দেওবন্দি – এই দুই প্রধান সুন্নি ধারার দ্বন্দ্বকে বোঝা জরুরি। আশির দশকে আফগান যুদ্ধের সময় সৌদি আরব এবং আমেরিকার টাকায় দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে এবং তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়। তখন বেরলভি সুফিরা নিজেদের কোণঠাসা মনে করতে থাকেন। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকার ক্ষোভ থেকেও আধুনিক বেরলভি সহিংসতার জন্ম হয়েছে। টিএলপি-র উত্থানকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী দেখছেন ‘বেরলভি পুনর্জাগরণ’ (Barelvi Revivalism) হিসেবে। তারা বোঝাতে চাইছে – আমরা আর নীরব থাকব না, আমরাও শক্তি দেখাতে জানি।

করাচির রাজনীতিতে একসময় এমকিউএম (MQM) বা মুহাজির কওমি মুভমেন্টের আধিপত্য ছিল। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এখন এগিয়ে এসেছে সুফি ভাবধারার সংগঠনগুলো। অর্থাৎ, ধর্ম এখানে কেবল পরকালের মুক্তির পথ নয়, ইহকালে ক্ষমতা দখলের এবং নিজের গোষ্ঠীর দাপট বজায় রাখার হাতিয়ার। সুফি মাজারগুলো, যা একসময় ছিল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র, এখন অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রচারণার মঞ্চ। পীর সাহেবরা এখন আর কেবল মুরিদদের আত্মশুদ্ধির ছবক দেন না, তারা বলে দেন কোন দলকে ভোট দিতে হবে বা কবে রাস্তায় নামতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক যুগে সুফিবাদের সাথে সহিংসতার সম্পর্কটি বহুমাত্রিক। এটি কখনো ‘ইশক’ বা প্রেমের নামে আক্রমণকারী, আবার কখনো ‘শিরক’ বা কুসংস্কারের অভিযোগে আক্রান্ত। মমতাজ কাদরি এবং লাল শাহবাজ কালান্দরের মাজারের লাশ – দুটোই এই জটিল সমীকরণের ফল। সুফিবাদ এখানে আর কোনো নিটোল শান্তির দ্বীপ নয়, বরং উত্তাল রাজনৈতিক সমুদ্রের এক বিক্ষুব্ধ ঢেউ।

মজনু শাহ এবং ফকির বিদ্রোহ: সুফি প্রতিরোধের এক বিস্মৃত অধ্যায়

বাংলার ইতিহাসের দিকে আরেকবার ফিরে তাকানো যাক, তবে এবার আমরা এমন এক অধ্যায় খুলব যা পাঠ্যপুস্তকে প্রায়ই পাদটীকায় হারিয়ে যায়। পলাশীর যুদ্ধের পর যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করে এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের করাল গ্রাস বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে, ঠিক সেই সময়ে, ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যবর্তী চার দশক ধরে বাংলা ও বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এক দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র আন্দোলন চলেছিল। ইতিহাসে এটি ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ (Fakir-Sannyasi Rebellion) নামে পরিচিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নথিপত্রে এই বিদ্রোহীদের নিছক ‘ডাকাত’ বা ‘লুটেরা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, কিন্তু আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এটি ছিল বাংলার শোষিত মানুষের, বিশেষ করে কৃষক ও কারিগর শ্রেণির এক স্বতঃস্ফূর্ত এবং সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ। আর এই প্রতিরোধের পুরোভাগে ছিলেন একদল সশস্ত্র সুফি ফকির, যাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মজনু শাহ (Majnu Shah)। তিনি কোনো সাধারণ ডাকাত সর্দার ছিলেন না; তিনি ছিলেন মাদারিয়া (Madariyya) সুফি তরিকার একজন প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক গুরু এবং একজন চতুর গেরিলা যোদ্ধা। তার নেতৃত্বে হাজার হাজার ফকির এবং তাদের হিন্দু সহযোগী সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশ কুঠি, খাজনা আদায়ের কেন্দ্র এবং অত্যাচারী জমিদারদের কাচারিগুলোতে আক্রমণ চালাতেন। এখানে সুফি পরিচয় এবং বিদ্রোহী পরিচয় একাকার হয়ে গিয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে সুফিরা কেবল খানকায় বসে থাকার মানুষ ছিলেন না, প্রয়োজনে তারা গণমানুষের অধিকার আদায়ে অস্ত্র ধরতেও জানতেন (Dasgupta, 1992)।

মাদারিয়া তরিকা এবং সশস্ত্র ফকির বাহিনী

মজনু শাহের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড বুঝতে হলে আগে তার সুফি প্রেক্ষাপটটি বোঝা জরুরি। তিনি ছিলেন মাদারিয়া তরিকার অনুসারী, যা পনেরো শতকে শাহ মাদার দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। এই তরিকাটি ছিল প্রচলিত বা প্রথাগত সুফি তরিকগুলোর চেয়ে বেশ আলাদা। মাদারিয়া ফকিররা ছিলেন অনেকটা বাউল বা ভবঘুরে প্রকৃতির, যারা দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতেন এবং আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি শরীরচর্চা ও লাঠিখেলায় পারদর্শী ছিলেন। তারা চুলে জট রাখতেন, গায়ে ভস্ম মাখতেন এবং হাতে লোহার চিমটা বা লাঠি রাখতেন। মুঘল আমল থেকেই তারা বাংলার সুলতান ও জমিদারদের কাছ থেকে নিষ্কর জমি বা ‘লাখেরাজ’ (Rent-free land) ভোগ করতেন এবং তীর্থযাত্রার সময় বাৎসরিক ভিক্ষা বা ‘মাগনের’ অধিকার পেতেন।

কিন্তু ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসার পর এই ব্যবস্থায় আঘাত হানে। তারা ফকিরদের তীর্থযাত্রার ওপর কর বসায় এবং তাদের অবাধ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ব্রিটিশদের দৃষ্টিতে এই সশস্ত্র ফকিররা ছিল রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ফলে ফকিরদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। এই সংকটই তাদের বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়। মজনু শাহ তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই ফকির গোষ্ঠীগুলোকে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর রূপ দেন। তার দলে কেবল মুসলমান ফকিররাই ছিলেন না, বরং গিরি ও পুরী সম্প্রদায়ের হিন্দু নাগা সন্ন্যাসীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। এটি ছিল বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে ধর্ম ভিন্ন হলেও শত্রু ছিল এক – ব্রিটিশ বেনিয়া এবং তাদের দেশীয় দোসররা। এই ফকির বাহিনী ছিল অত্যন্ত গতিশীল। তারা বর্ষাকালে নৌকা নিয়ে এবং শীতাকালে পায়ে হেঁটে দ্রুত এক জেলা থেকে অন্য জেলায় সরে যেতে পারত। তাদের আক্রমণের ধরণ ছিল আচমকা বা ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতির। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরত, কিন্তু ফকিররা স্থানীয় কৃষকদের সহযোগিতায় সহজেই গা ঢাকা দিত (Chandra, 1977)।

সামাজিক দস্যুতা বনাম রাজনৈতিক সংগ্রাম

ব্রিটিশরা মজনু শাহ এবং তার অনুসারীদের ‘ডাকাত’ বললেও, ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম (Eric Hobsbawm)-এর বিখ্যাত তত্ত্ব অনুযায়ী, তাদের কার্যকলাপকে ‘সামাজিক দস্যুতা’ (Social Banditry) হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। সামাজিক দস্যুরা আইনত অপরাধী হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তারা নায়ক। রবিন হুডের মতো মজনু শাহও ছিলেন বাংলার কৃষকদের কাছে একজন ত্রাণকর্তা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় যখন ব্রিটিশরা জোর করে খাজনা আদায় করছিল, তখন মজনু শাহ কোম্পানির কুঠি লুট করে সেই ধনসম্পদ গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তিনি অত্যাচারী জমিদার এবং মহাজনদের বাড়ি আক্রমণ করে তাদের ঋণের দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলতেন। ফলে গ্রামীণ সমাজের নিচুতলার মানুষ – কৃষক, তাতি এবং কামাররা – ফকিরদের আশ্রয় দিত এবং গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সাহায্য করত।

মজনু শাহের রাজনৈতিক দূরদর্শিতাও ছিল লক্ষণীয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এককভাবে ব্রিটিশদের হারানো সম্ভব নয়। তাই তিনি স্থানীয় জমিদারদের, বিশেষ করে নাটোরের রানী ভবানীর মতো প্রভাবশালী জমিদারদের সাথে জোট বাধার চেষ্টা করেছিলেন। ১৭৭২ সালে তিনি রানী ভবানীকে চিঠি লিখে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়েছিলেন। যদিও জমিদাররা ব্রিটিশদের ভয়ে সরাসরি সাহায্য করতে পারেননি, কিন্তু অনেকেই গোপনে ফকিরদের সমর্থন দিতেন। মজনু শাহের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল কোম্পানির রেশম কুঠি এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো। তিনি জানতেন, ব্রিটিশদের শক্তির উৎস হলো তাদের বাণিজ্য। তাই তিনি সেই বাণিজ্যে আঘাত হেনে তাদের দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। ১৭৭৬ সাল থেকে ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া এবং মালদহ জেলাগুলোতে ফকিরদের দাপট ছিল এতটাই বেশি যে, ব্রিটিশ কালেক্টররা মফস্বলে যেতে ভয় পেতেন। ওয়ারেন হেস্টিংস নিজে এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য বিশেষ সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু মজনু শাহের গেরিলা কৌশলের কাছে তারা বারবার ব্যর্থ হয় (Khan, 1999)।

মজনু শাহ: এক রহস্যময় সুফি যোদ্ধা

মজনু শাহের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না, যা তাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। তার আসল নাম ছিল সম্ভবত বোরহান উদ্দিন। তিনি মেওয়াত অঞ্চল থেকে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয় এবং পরবর্তীতে বগুড়ার মাদারগঞ্জে তার প্রধান আস্তানা বা খানকা স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন একজন ক্যারিশম্যাটিক লিডার। তার অনুসারীরা তাকে ‘পীর’ এবং ‘রাজা’ – উভয় সম্বোধনেই ডাকত। তিনি যখন ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের পর গ্রাম পার হতেন, তখন হাজার হাজার মানুষ তাকে একনজর দেখার জন্য ভিড় করত। তার দলে পাঠান, রাজপুত এবং স্থানীয় বাঙালি – সব ধরণের যোদ্ধা ছিল। তাদের অস্ত্র ছিল তলোয়ার, বর্শা, গাদা বন্দুক এবং রকেট বা হাওয়াই বাজি।

১৭৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর, বগুড়ার কালেসরের যুদ্ধে ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট ব্রেবানের বাহিনীর সাথে মজনু শাহের এক ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মজনু শাহের বাহিনী বীরত্বের সাথে লড়লেও আধুনিক ব্রিটিশ মাস্কেটের সামনে টিকতে পারেনি। মজনু শাহ মারাত্মকভাবে আহত হন। তার অনুসারীরা তাকে কাঁধে করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদে নিয়ে যায়। এই আঘাত থেকেই সম্ভবত ১৭৮৭ সালের মে মাসে বিহারের মাকানপুরে তার মৃত্যু হয়। মজনু শাহের মৃত্যুর পর তার ভাইপো মুসা শাহ এবং চেরাগ আলী শাহ বিদ্রোহ চালিয়ে যান, কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে মজনু শাহ প্রমাণ করে গেছেন যে, একজন সুফি ফকির কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তির দিশারী নন, তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার স্বপ্নদ্রষ্টাও হতে পারেন।

বিদ্রোহের মনস্তত্ত্ব ও সুফি আদর্শ

ফকির বিদ্রোহের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর পেছনে কাজ করেছে সুফিবাদের ইনসান-ই-কামিল (Perfect Man) বা পূর্ণাঙ্গ মানুষের ধারণা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা। সুফি দর্শনে বলা হয়, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিনিধি বা ‘খলিফা’ হিসেবে। তাই যখন কোনো শাসক প্রজা সাধারণের ওপর জুলুম করে, তখন সেই শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মুমিনের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। মজনু শাহ এবং তার অনুসারীরা মনে করতেন, ব্রিটিশরা এবং তাদের দালালরা আল্লাহর দেওয়া রুজি বা জীবিকায় হস্তক্ষেপ করছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একটি পবিত্র কাজ বা জিহাদ

এছাড়া, মাদারিয়া তরিকার সুফিদের জীবনদর্শন ছিল অনেকটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী। তারা জাগতিক সম্পদ বা ক্ষমতার তোয়াক্কা করতেন না। এই নির্লিপ্ততাই তাদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এত সাহসী করে তুলেছিল। তারা জানতেন, তাদের হারানোর কিছু নেই। মৃত্যু হলে তারা শহীদ, আর বেঁচে থাকলে তারা গাজী। এই মনস্তত্ত্বটি তাদের ব্রিটিশদের আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। তাদের যুদ্ধকৌশলে সুফিবাদের শৃঙ্খলা বা আদব (Adab) এর প্রভাব ছিল স্পষ্ট। আক্রমণের সময় তারা ‘আল্লাহু আকবার’ এবং ‘দিন! দিন!’ (ধর্ম! ধর্ম!) ধ্বনি দিতেন, যা তাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখত।

মজনু শাহ এবং ফকির বিদ্রোহের ইতিহাস আমাদের প্রচলিত সুফি বয়ানের বিপরীতে এক নতুন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সুফিবাদ মানেই সবসময় শান্তি বা আপসকামিতা নয়। পরিস্থিতির প্রয়োজনে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুফিরাও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিতে পারেন এবং বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারেন। ফকির বিদ্রোহ ছিল বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে সুফিবাদের জৈবিক সম্পর্কের এক অনন্য দলিল। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এটি দেখিয়ে দিয়েছিল যে, সুফিরা কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন না, মাটির দিকে তাকিয়ে মানুষের কান্নাও শুনতে পান এবং সেই কান্না মোছানোর জন্য রক্ত দিতেও প্রস্তুত থাকেন।

সহিংসতার মনস্তত্ত্ব ও সুফি দর্শন

আমাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন খুব জোরেসোরে ধাক্কা দেয়। যে দর্শনের ভিত্তিপ্রস্তরই হলো সুলহ-ই-কুল (Sulh-i-kul) বা ‘সকলের সাথে শান্তি’, সেই দর্শনের অনুসারীরা কেন এবং কোন মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণে সহিংসতার পথ বেছে নিলেন? আমরা সচরাচর ভাবি, যারা প্রেম ও ভক্তির কথা বলেন, তারা মাছি মারতেও দ্বিধা করবেন। কিন্তু ইতিহাস আমাদের যে রক্তাক্ত বয়ান শোনাল, তার ব্যাখ্যা খুঁজতে হলে আমাদের ঢুকতে হবে মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বে এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। সুফিবাদের ভেতরে এমন কিছু তাত্ত্বিক এবং মনস্তাত্ত্বিক উপাদান বা সাইকোলজিক্যাল এলিমেন্টস (Psychological Elements) লুকিয়ে আছে, যা সঠিক ট্রিগার বা উদ্দীপক পেলে একজন শান্ত মানুষকেও ভয়ংকর যোদ্ধায় পরিণত করতে পারে। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও, এর পেছনে কাজ করে গভীর এক বিশ্বাস এবং আত্মত্যাগের নেশা। এই অধ্যায়ে আমরা সেই ‘অস্বস্তিকর’ মনস্তত্ত্বের ব্যবচ্ছেদ করব।

প্রথমত, আমাদের এই রোমান্টিক ধারণাটি ভাঙতে হবে যে সুফিরা সমাজের বাইরের কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী। তারা সমাজেরই অংশ এবং সমাজের আর দশজন মানুষের মতোই তারা জাগতিক ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বারা প্রভাবিত হন। যখন সমাজ, রাষ্ট্র বা নিজের সম্প্রদায় অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, তখন একজন সুফি আর কেবল ধ্যানের আসনে বসে থাকতে পারেন না। তার ভেতরে কাজ করে সামষ্টিক দায়িত্ববোধ (Collective Responsibility)। সুফি নেতারা বা পীরেরা সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাদের এক ইশারায় হাজার হাজার মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে। আর মানুষকে যখন কোনো একটি আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত করা হয়, তখন সেখানে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় গ্রুপ ডাইনামিক্স (Group Dynamics)। যখন কোনো গোষ্ঠী মনে করে তাদের ‘পবিত্র ভূমি’ বা ‘পবিত্র বিশ্বাস’ আক্রান্ত হচ্ছে, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র এবং সহিংস। এই সহিংসতাকে তারা অপরাধ মনে করেন না, বরং মনে করেন এটি এক ধরণের ‘পবিত্র পরিশোধন’ বা সার্জারি। মধ্যযুগের সুফিদের কাছে কাফের বা অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা ছিল সমাজের ক্যানসার কোষ অপসারণ করার মতোই একটি জরুরি চিকিৎসা।

ফানা: বিলীন হওয়ার বিপজ্জনক আনন্দ

সুফিবাদের সবচাইতে শক্তিশালী এবং একই সাথে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ ধারণাটি হলো ফানা (Fana) বা বিলীন হয়ে যাওয়া। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে ভক্ত বা মুরিদ (Disciple) নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে যান এবং তার পীর বা মুর্শিদ (Master)-এর সত্তায় বিলীন হয়ে যান। একে বলা হয় ফানা ফিল শাইখ (Annihilation in the Sheikh)। তাত্ত্বিকভাবে, এটি আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি ধাপ, যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত স্রষ্টায় বিলীন হওয়া বা ফানা ফিল্লাহ (Annihilation in God) অর্জিত হয়। কিন্তু এর একটি বাস্তব এবং ভয়ংকর প্রয়োগিক দিক রয়েছে। একজন মুরিদ যখন তার পীরের নির্দেশে নিজের বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি এবং বিবেক বিসর্জন দেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন একটি রোবটের মতো।

মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে বলা যেতে পারে ডি-ইন্ডিভিজুয়েশন (Deindividuation) বা ব্যক্তিসত্তার বিলোপ। যখন একজন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ভুলে কোনো নেতার বা গোষ্ঠীর আদেশে কাজ করে, তখন সে এমন সব কাজ করতে পারে যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় কখনোই করত না। পীর যদি বলেন, “এই যুদ্ধ আল্লাহর হুকুম,” মুরিদ তখন আর প্রশ্ন করেন না যে কেন বা কীভাবে। তার কাছে পীরের মুখ নিঃসৃত বাণীই হলো চূড়ান্ত সত্য। এই নিঃশর্ত আনুগত্য বা বাইয়াত (Bay’ah) সুফি তরিকগুলোকে একেকটি শক্তিশালী মিলিশিয়ায় রূপান্তর করতে সাহায্য করেছে। একজন সাধারণ সেনাপতি তার সৈন্যদের ওপর ভয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু একজন সুফি পীর নিয়ন্ত্রণ করেন ভালোবাসার মাধ্যমে। আর ভয়ের চেয়ে ভালোবাসার কারণে মানুষ অনেক বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। কারণ, ভয়ের কারণে মানুষ পালায়, কিন্তু ভালোবাসার কারণে মানুষ হাসিমুখে মরে এবং মারে (Buehler, 1998)।

হাশাশিন সিনড্রোম: ভক্তির অন্ধকার গলি

যদিও ইতিহাসবিদরা হাশাশিন (Assassins) বা নিজারি ইসমাইলিদের সরাসরি মূলধারার সুফি বলতে চান না, কিন্তু তাদের সাংগঠনিক কাঠামো এবং ভক্তির ধরণ সুফি তরিকগুলোর মতোই ছিল। হাসান-ই-সাব্বাহর এই ফিদাই বাহিনী ভক্তি এবং সহিংসতার এক চরম দৃষ্টান্ত। তারা তাদের নেতা বা ‘পাহাড়ে বৃদ্ধ’-এর নির্দেশে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে গিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালাতে প্রস্তুত ছিল। এই মানসিকতাটিকেই আমরা বলতে পারি ‘ফিদাই মনস্তত্ত্ব’ (Fidayeen Mentality)। অনেক সুফি তরিকায়, বিশেষ করে সামরিকীকৃত তরিকাগুলোতে (যেমন সাফাভিদ বা মাহদিবাদী), আমরা এই একই ধরণের মানসিকতা লক্ষ্য করি।

এখানে কাজ করে পরকালমখী পুরস্কারের (Otherworldly Reward) ধারণা। সুফি বা ফিদাইরা মনে করেন, এই জাগতিক জীবন বা ‘দুনিয়া’ হলো তুচ্ছ। আসল জীবন হলো পরকাল। তাই আল্লাহর রাস্তায় বা পীরের নির্দেশে জীবন দেওয়া বা নেওয়া কোনো বড় ব্যাপার নয়। বরং এটি হলো অনন্ত সুখের চাবিকাঠি। যখন মৃত্যুকে আর ভয়ের বস্তু হিসেবে দেখা হয় না, বরং একে ‘শাব-ই-উরুস’ বা বাসর রাত (স্রষ্টার সাথে মিলনের রাত) হিসেবে দেখা হয়, তখন যুদ্ধের ময়দানে সেই যোদ্ধাকে থামানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অটোমান জেনিসারিরা বা ইমাম শামিলের মুরিদরাও এই বিশ্বাস থেকেই যুদ্ধ করত। তারা মনে করত, তাদের তলোয়ারের প্রতিটি কোপ আল্লাহর ইবাদত। এই যে সহিংসতাকে আধ্যাত্মিকতার মোড়কে আবৃত করা বা স্পিরিচুয়ালাইজেশন অফ ভায়োলেন্স (Spiritualization of Violence) – এটিই হলো সুফি সহিংসতার মূল মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি (Lewis, 1967)।

জালাল বনাম জামাল: স্রষ্টার রৌদ্র ও ছায়া

সুফি দর্শনে স্রষ্টার দুটি রূপ বা গুণাবলি কল্পনা করা হয়। একটি হলো জামাল (Jamal) বা সৌন্দর্য, যা দয়া, প্রেম ও শান্তির প্রতীক। অন্যটি হলো জালাল (Jalal) বা গাম্ভীর্য ও প্রতাপ, যা ন্যায়বিচার, ক্রোধ এবং যুদ্ধের প্রতীক। সুফিরা বিশ্বাস করেন, একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ বা ইনসান-ই-কামিল (Perfect Man)-এর মধ্যে এই দুটি গুণেরই প্রতিফলন থাকতে হবে। অর্থাৎ, তিনি যেমন ফুলের মতো কোমল হবেন, তেমনি প্রয়োজনে বজ্রের মতো কঠোরও হবেন।

আমরা সচরাচর সুফিদের কেবল ‘জামালি’ বা কোমল রূপে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু ইতিহাসের অনেক সুফি, বিশেষ করে নকশবন্দি এবং সোহরাওয়ার্দী তরিকার সুফিরা, ‘জালালি’ গুণের চর্চা করেছেন। তারা মনে করতেন, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে কেবল ভালোবাসা যথেষ্ট নয়, কখনো কখনো তরবারির ‘জালালি’ আঘাতও প্রয়োজন। এই দর্শনটি তাদের সহিংসতাকে তাত্ত্বিক বৈধতা দিত। একজন সুফি যখন যুদ্ধ করেন, তিনি মনে করেন তিনি নিজে যুদ্ধ করছেন না; বরং তার হাত দিয়ে স্রষ্টার গজব (Wrath) বা ন্যায়বিচার প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি নিজেকে কেবল একটি মাধ্যম বা ‘উসিলা’ মনে করেন। এই মানসিক অবস্থানটি তাকে অপরাধবোধ বা গিল্ট (Guilt) থেকে মুক্তি দেয়। একজন সাধারণ খুনি খুন করার পর অনুশোচনায় ভোগে, কিন্তু একজন ধর্মযোদ্ধা বা সুফি মুজাহিদ মানুষ হত্যা করার পর প্রশান্তি অনুভব করেন, কারণ তিনি মনে করেন তিনি স্রষ্টার ইচ্ছাই পূরণ করেছেন। এই ডিভাইন অ্যাট্রিবিউশন (Divine Attribution) বা ঐশ্বরিক আরোপণ সহিংসতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে।

রাজনৈতিক বৈধতা এবং পবিত্রতার জিগির

মধ্যযুগে এবং প্রাক-আধুনিক যুগে সুফিদের সহিংসতার আরেকটি বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক। রাজদরবারে সুফিরা কেবল আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন না, তারা ছিলেন কিংমেকার (Kingmakers)। শাসকরা জানতেন, সাধারণ মানুষের ওপর সুফিদের প্রভাব অপরিসীম। তাই নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বা লেজিটিমাইজেশন (Legitimization)-এর জন্য তারা সুফিদের ব্যবহার করতেন। আবার সুফিরাও শাসকদের ব্যবহার করতেন নিজেদের তরিকা প্রচার এবং শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য।

এই পারস্পরিক লেনদেনের সম্পর্কে প্রায়ই ‘ধর্মরক্ষা’ বা পবিত্রতা রক্ষার জিগির তোলা হতো। সুফি উপদেষ্টারা সুলতানদের বোঝাতেন যে, রাজ্যে ‘ফিতনা’ বা বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য কঠোর হওয়া প্রয়োজন। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অভিযানে অনেক সময় সুফিরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শেখ আহমেদ সিরহিন্দির মতো সুফিরা মনে করতেন, আকবরের মতো উদার শাসকরা ইসলামের পবিত্রতা নষ্ট করছেন। এই ‘পবিত্রতা’ ফিরিয়ে আনার জন্য তারা অসহিষ্ণুতা এবং সহিংসতার পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করেননি। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, একে বলা যায় পিউরিটানিকাল জিল (Puritanical Zeal) বা বিশুদ্ধতাবাদের উন্মাদনা। যখন কেউ মনে করে যে, কেবল তার বিশ্বাসই সঠিক এবং বাকি সব ভুল বা ভেজাল, তখন সে সেই ‘ভেজাল’ দূর করার জন্য যেকোনো সহিংস পন্থা অবলম্বন করতে পারে।

তাছাড়া, সুফিদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইও কম ছিল না। এক তরিকা অন্য তরিকাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য বা খানকার দখল নেওয়ার জন্য সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। এখানে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে টেরিটোরিয়াল ডমিনেন্স (Territorial Dominance) বা এলাকা দখলের মনস্তত্ত্ব বেশি কাজ করেছে। পীরতন্ত্র যখন বংশানুক্রমিক বা পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়, তখন সেখানে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে ক্ষমতার রাজনীতিই মুখ্য হয়ে ওঠে।

পরিশেষে, সুফি দর্শনের সহিংসতার মনস্তত্ত্বটি কোনো একরৈখিক বিষয় নয়। ভক্তি, প্রেম, দায়িত্ববোধ, এবং পরকালীন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা – সব মিলিয়ে এক জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে মানুষের মনে। পীরের প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং মৃত্যুকে জয় করার নেশা সুফিদের ইতিহাসের পাতায় কখনো বীর, আবার কখনো ভিলেন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আমরা বাইরে থেকে যা দেখি, তা হলো রক্তপাত; কিন্তু তাদের ভেতরে যা চলে, তা হলো এক ধরণের আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। এই তৃপ্তিই সুফি সহিংসতার সবচাইতে বড় জ্বালানি।

তাত্ত্বিকদের চোখে সুফি সহিংসতা: রোমান্টিসিজম বনাম ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পাঠ

ইতিহাসের ধুলোমাখা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এতক্ষণ যে ঘটনাপ্রবাহ দেখলাম – রক্তাক্ত প্রান্তর, গাজীদের হুঙ্কার আর খানকার ভেতরের ষড়যন্ত্র – এগুলো কেবল বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এসব ঘটনার পেছনে কাজ করেছে গভীর সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সমীকরণ। আমরা সাধারণ পাঠকরা যা খালি চোখে দেখি, ইতিহাসের তাত্ত্বিক বা থিওরিস্টরা তা দেখেন আতশি কাঁচ দিয়ে। তারা ঘটনার পেছনের কারণ খোঁজেন, মেলাতে চান অংকের সমীকরণ। সুফিবাদের সাথে সহিংসতার এই যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তা নিয়ে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েকজন বাঘা বাঘা ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী তাদের চমকপ্রদ সব তত্ত্ব বা থিওরি হাজির করেছেন। তাদের এই তত্ত্বগুলো আমাদের প্রচলিত রোমান্টিক ধারণার বেলুনটি ফুটো করে দেয়। আমরা ভাবি সুফিরা কেবল প্রেম বিলিয়েছেন, কিন্তু তাত্ত্বিকরা বলছেন, সুফিরা আসলে ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব ক্ষমতার এক জটিল নেটওয়ার্ক (Network)-এর অংশ। এই অংশে আমরা সেই সব তাত্ত্বিকদের চশমা দিয়ে সুফিবাদের সহিংস রূপটি দেখার চেষ্টা করব, যাঁরা আমাদের শেখান যে ভক্তি আর শক্তি আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

সাইমন ডিগবি এবং ‘বিলায়াত’ এর দ্বৈত ধারণা

সুফিবাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সহিংসতার কাঠামোগত দিকটি বোঝার জন্য ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সাইমন ডিগবি (Simon Digby)-র তত্ত্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিগবি মধ্যযুগের ভারতে সুফি ও সুলতানদের সম্পর্কের ওপর গভীর গবেষণা করেছেন। তার তত্ত্বে উঠে এসেছে ‘বিলায়াত’ (Wilayat) বা আধ্যাত্মিক ভূখণ্ডের ধারণা। সুফি পরিভাষায় ‘বিলায়াত’ মানে হলো একজন সুফি পীরের আধ্যাত্মিক এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা। কিন্তু ডিগবি দেখিয়েছেন, এই আধ্যাত্মিক এলাকা এবং সুলতানের রাজনৈতিক এলাকা বা ‘মামলাকাত’ (Mamlakat) একে অপরের পরিপূরক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। ডিগবি তার বিখ্যাত প্রবন্ধে, যেটি The Sufi Shaikh as a Source of Authority in Medieval India শিরোনামে প্রকাশিত, সেখানে যুক্তি দেখান যে, মধ্যযুগের মানুষেরা বিশ্বাস করত সুলতানের তলোয়ারের জোর ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ তার পেছনে কোনো শক্তিশালী সুফি পীরের আধ্যাত্মিক সমর্থন থাকে।

ডিগবির মতে, সুফি শেখরা নিজেদের মনে করতেন আধ্যাত্মিক জগতের সুলতান। তারা তাদের খানকায় বসে ঠিক করতেন কে সিংহাসনে বসবে আর কে নামবে। যখনই কোনো সুলতান সুফিদের এই ‘অদৃশ্য ক্ষমতা’ বা ইনভিজিবল পাওয়ার (Invisible Power)-কে চ্যালেঞ্জ করতেন, তখনই সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ত। ডিগবি দেখিয়েছেন যে, সুফিরা তাদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য প্রায়ই সহিংস পথ বেছে নিতেন বা সহিংসতাকে উসকে দিতেন। চিশতিয়া তরিকাকে আমরা সাধারণত শান্তিকামী মনে করি, কিন্তু ডিগবি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, নিজামুদ্দিন আউলিয়া এবং আলাউদ্দিন খলজি বা গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার (Cold War) ছিল মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। যখন কোনো বহিরাগত শক্তি আক্রমণ করত, তখন সুফিরা তাদের মুরিদদের ব্যবহার করতেন সুলতানের পক্ষে বা বিপক্ষে জনমত গঠন করতে। ডিগবির তাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী, সুফি খানকাগুলো ছিল অল্টারনেটিভ পাওয়ার সেন্টার (Alternative Power Centers) বা বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্র। আর যেখানে একাধিক ক্ষমতার কেন্দ্র থাকে, সেখানে সহিংসতা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সুফিদের এই ‘টেরিটোরিয়াল’ বা এলাকাভিত্তিক আধিপত্যের মানসিকতাই অনেক সময় যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াত।

রিচার্ড ইটন এবং কৃষিভিত্তিক উপনিবেশায়ন তত্ত্ব

দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলায় সুফিবাদের প্রসার এবং এর সাথে সংঘাতের সম্পর্ক নিয়ে সবচাইতে বৈপ্লবিক তত্ত্বটি দিয়েছেন মার্কিন ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন (Richard Eaton)। তার কালজয়ী গ্রন্থ The Rise of Islam and the Bengal Frontier-এ তিনি প্রচলিত ‘ধর্মপ্রচার তত্ত্ব’ বা কনভারশন থিওরি (Conversion Theory)-কে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। ইটনের মতে, সুফিরা বাংলায় এসে কেবল ওয়াজ-নসিহত করে মানুষকে মুসলিম বানাননি। বরং তারা ছিলেন এক ধরণের ‘কালচারাল ব্রোকার’ (Cultural Broker) এবং ভূমি আবাদকারী। ইটনের তত্ত্বটির নাম দেওয়া যেতে পারে কৃষিভিত্তিক উপনিবেশায়ন (Agrarian Colonization)। তিনি দেখান যে, মুঘল আমলে বাংলার ভাটি অঞ্চল বা পূর্ব বঙ্গে প্রচুর জঙ্গল ছিল। সুফি পীরেরা, যাঁদের অনেককেই ‘গাজী’ বলা হতো, তারা এই জঙ্গল পরিষ্কার করে ধানি জমি তৈরি করার উদ্যোগ নেন।

ইটনের তত্ত্বে ‘সহিংসতা’ বিষয়টি আসে প্রকৃতির সাথে লড়াই এবং আদিম জনবসতির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। জঙ্গল কাটার সময় বাঘ-কুমিরের সাথে লড়াই যেমন ছিল, তেমনি স্থানীয় অনার্য বা অরণ্যচারী মানুষের সাথেও সংঘাত ছিল। সুফিরা এই স্থানীয় মানুষদের কৃষিকাজ শিখিয়ে এবং একই সাথে ইসলামের ছায়াতলে এনে এক নতুন সমাজ গড়েন। ইটন দেখিয়েছেন, এই পীরেরা কেবল ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, তারা ছিলেন মুঘল রাষ্ট্রের এজেন্ট বা প্রতিনিধি। তারা জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করতেন, আর রাষ্ট্র তাদের সেই জমির মালিকানা বা লাখেরাজ (Rent-free land) দিত। বিনিময়ে তারা রাষ্ট্রকে আনুগত্য এবং রাজস্ব দিতেন। অর্থাৎ, সুফিবাদ এখানে সাম্রাজ্য বিস্তারের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ইটনের এই বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বা মেটেরিয়ালিস্টিক ইন্টারপ্রিটেশন (Materialistic Interpretation) আমাদের বোঝায় যে, শাহজালাল বা খান জাহান আলীর অভিযানগুলো কেবল আধ্যাত্মিক মিশন ছিল না, এগুলো ছিল সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অভিযান। যেখানেই নতুন জমি ও সম্পদ দখলের বিষয় থাকে, সেখানেই সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের বিষয়টি চলে আসে, তা সে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হোক বা কাঠামোগত পরিবর্তন হোক।

নাইল গ্রিন এবং ধর্মীয় অর্থনীতির বাজার

সুফিবাদের ইতিহাসকে একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এবং কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখেছেন ইতিহাসবিদ নাইল গ্রিন (Nile Green)। তার Sufism: A Global History গ্রন্থে তিনি সুফিবাদকে দেখেছেন একটি ‘ধর্মীয় অর্থনীতি’ (Religious Economy) বা বাজারের অংশ হিসেবে। গ্রিনের তত্ত্ব অনুযায়ী, সুফিরা হলেন এক ধরণের আধ্যাত্মিক উদ্যোক্তা বা স্পিরিচুয়াল এন্ট্রাপ্রেনার (Spiritual Entrepreneur), যারা মানুষের ভক্তি এবং আনুগত্য অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এই ‘মার্কেট’ বা বাজারে টিকে থাকার জন্য সুফিদের কখনো অলৌকিকতা দেখাতে হয়, কখনো গ্রন্থ লিখতে হয়, আবার কখনো তলোয়ার ধরতে হয়। গ্রিন যুক্তি দেন যে, প্রাক-আধুনিক যুগে সুফিদের ‘যোদ্ধা’ রূপটি ছিল তাদের টিকে থাকার কৌশলের অংশ।

গ্রিন দেখিয়েছেন, মধ্যযুগে মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর সীমান্ত এলাকায়, যাকে তিনি বলছেন ‘ফ্রন্টিয়ার জোন’ (Frontier Zone), সেখানে রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকত না। এই সব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাণিজ্য পথগুলো নিরাপদ রাখা এবং স্থানীয় দস্যুদের দমন করার দায়িত্ব সুফি তরিকাগুলো নিজেদের কাঁধে তুলে নিত। ফলে খানকাগুলো হয়ে উঠত একেকটি দুর্গের মতো, আর সুফিরা হয়ে উঠতেন ‘যোদ্ধা-সন্ন্যাসী’ (Warrior-Monks)। গ্রিনের মতে, আমরা আধুনিক যুগে বসে সুফিদের ‘শান্তিকামী’ হিসেবে যে ট্যাগ দিই, তা আসলে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবিদদের তৈরি করা ধারণা। তারা চেয়েছিলেন একটি ‘ভালো ইসলাম’ খুঁজে বের করতে, তাই তারা সুফিদের যুদ্ধের ইতিহাসকে সচেতনভাবে চেপে গেছেন। কিন্তু গ্রিন ঐতিহাসিক দলিল ঘেঁটে দেখান যে, সুফিরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী তরিকা বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালাতে দ্বিধা করতেন না। এই সহিংসতা ছিল তাদের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বাড়ানোর এবং অনুসারীদের সুরক্ষা দেওয়ার একটি উপায়। তার তত্ত্বে উঠে আসে যে, সুফিবাদ কোনো বিমূর্ত দর্শন নয়, বরং এটি রক্ত-মাংসের মানুষের বেঁচে থাকার এবং ক্ষমতা অর্জনের লড়াই।

সেমাল কাফাদার এবং গাজীদের রূপান্তর

অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান এবং সুফিদের ভূমিকা নিয়ে সবচাইতে প্রভাবশালী তত্ত্বটি দিয়েছেন তুর্কি ইতিহাসবিদ সেমাল কাফাদার (Cemal Kafadar)। তার Between Two Worlds: The Construction of the Ottoman State গ্রন্থে তিনি পল উইটেক (Paul Wittek)-এর পুরোনো ‘গাজী থিসিস’ (Ghazi Thesis)-কে নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন। পুরোনো তত্ত্বে বলা হতো, গাজীরা ছিল কেবল ধর্মান্ধ যোদ্ধা। কিন্তু কাফাদার দেখান যে, আনাতোলিয়ার সীমান্তে যে সুফি ও গাজীরা ছিল, তাদের পরিচয় ছিল অত্যন্ত তরল বা ফ্লুইড আইডেন্টিটি (Fluid Identity)। তারা সকালে সুফি, বিকেলে যোদ্ধা, আবার সন্ধ্যায় হয়তো স্থানীয় খ্রিস্টানদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। এই সুফি-গাজীদের মধ্যে কোনো কট্টরপন্থা ছিল না, কিন্তু ছিল এক অদম্য বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা।

কাফাদারের তত্ত্বে উঠে আসে ‘মেটামরফোসিস’ (Metamorphosis) বা রূপান্তরের ধারণা। তিনি দেখান, কীভাবে বেকতাশি বা আখি সুফিরা একটি ছোট যাযাবর গোষ্ঠীকে বিশাল সাম্রাজ্যে রূপান্তর করল। এই প্রক্রিয়ায় সহিংসতা ছিল একটি অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু এই সহিংসতা নিছক ধ্বংসের জন্য ছিল না, এটি ছিল নতুন কিছু গড়ার জন্য। সুফি মতাদর্শ এই যোদ্ধাদের একটি লক্ষ্য বা পারপাস (Purpose) ঠিক করে দিয়েছিল। কাফাদার যুক্তি দেন যে, অটোমান সুফিরা যুদ্ধের ময়দানে ‘শাহাদাত’ বা শহীদ হওয়ার যে ধারণা প্রচার করত, তা ছিল মূলত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য আধ্যাত্মিক প্রণোদনা। সুফি দরবেশরা সৈন্যদের বোঝাতেন যে, সুলতানের জন্য যুদ্ধ করা আর আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করা একই। এই পলিটিকো-রিলিজিয়াস সিন্থেসিস (Politico-Religious Synthesis) বা রাজনৈতিক-ধর্মীয় সংমিশ্রণই অটোমানদের অজেয় করে তুলেছিল। কাফাদারের তত্ত্ব আমাদের শেখায়, সুফি সহিংসতাকে কেবল ‘ধর্মযুদ্ধ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, এর পেছনে ছিল রাষ্ট্রগঠনের জটিল প্রক্রিয়া।

ক্যাথরিন বাবায়ান এবং চরমপন্থী মরমীবাদ

সাফাভিদ ইরানের প্রেক্ষাপটে সুফি সহিংসতা এবং চরমপন্থার বিশ্লেষণ করেছেন ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন বাবায়ান (Kathryn Babayan)। তার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু হলো ‘গুলাত’ (Ghulat) বা বাড়াবাড়ি/চরমপন্থা। শিয়া সুফিবাদের ইতিহাসে গুলাতরা হলো তারা, যারা তাদের ইমাম বা পীরকে মানুষের ঊর্ধ্বে, এমনকি ঈশ্বরের অবতার মনে করে। বাবায়ান তার Mystics, Monarchs, and Messiahs গ্রন্থে দেখান যে, শাহ ইসমাইল এবং তার কিজিলবাশ অনুসারীরা ছিলেন এই গুলাত মতবাদের অনুসারী। বাবায়ানের তত্ত্বে উঠে আসে ‘মেসিয়ানিক ভায়োলেন্স’ (Messianic Violence) বা ত্রাণকর্তা-কেন্দ্রিক সহিংসতার ধারণা।

বাবায়ান বিশ্লেষণ করেন যে, সাফাভিদ যুগে সুফিবাদ শরীর ও আত্মার এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করেছিল। শাহ ইসমাইলের শরীরকে মনে করা হতো পবিত্র এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতার আধার। তাই কিজিলবাশরা যুদ্ধের ময়দানে শাহের নামে এতটাই উন্মাদ হয়ে যেত যে, তারা নরমাংস ভক্ষণ পর্যন্ত করেছে বলে ঐতিহাসিক নজির আছে (শত্রুর কলিজা চিবিয়ে খাওয়া)। বাবায়ান যুক্তি দেন, এই সহিংসতা কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল এক ধরণের পারফরম্যান্স অফ ফেইথ (Performance of Faith) বা বিশ্বাসের প্রদর্শনী। ভক্তরা তাদের পীরের প্রতি কতটা অনুগত, তা প্রমাণ করার জন্য চরমতম সহিংসতা প্রদর্শন করত। এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, সুফি সহিংসতা সবসময় যুক্তির বা রাজনীতির ধার ধারে না; অনেক সময় তা হয় সম্পূর্ণ আবেগীয় এবং আধ্যাত্মিক উন্মাদনাপ্রসূত। বাবায়ানের মতে, সাফাভিদ সুফিরা তাদের সহিংসতাকে দেখত ‘কসমিক ওয়ার’ বা মহাজাগতিক যুদ্ধের অংশ হিসেবে, যেখানে তারা আলোর পক্ষ হয়ে অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়ছে।

মার্ক জুরগেনসমায়ার এবং মহাজাগতিক যুদ্ধ

যদিও মার্ক জুরগেনসমায়ার (Mark Juergensmeyer) সরাসরি সুফিবাদের ইতিহাসবিদ নন, কিন্তু ধর্মীয় সহিংসতা বা রিলিজিয়াস ভায়োলেন্স (Religious Violence) নিয়ে তার তত্ত্ব আধুনিক সুফি সহিংসতা (যেমন টিএলপি বা বেরলভি আন্দোলন) বোঝার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তার বিখ্যাত বই Terror in the Mind of God-এ তিনি ‘কসমিক ওয়ার’ (Cosmic War) বা মহাজাগতিক যুদ্ধের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। জুরগেনসমায়ার বলেন, যখন কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী মনে করে যে তারা কোনো সাধারণ রাজনৈতিক লড়াই করছে না, বরং শয়তানের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের হয়ে যুদ্ধ করছে, তখন সেই যুদ্ধ আর কোনো মানবিক আইন বা নীতির তোয়াক্কা করে না। তখন সহিংসতা হয়ে ওঠে পবিত্র।

আধুনিক পাকিস্তানের মমতাজ কাদরি বা খাদিম রিজভির অনুসারীদের মনস্তত্ত্ব জুরগেনসমায়ারের এই তত্ত্ব দিয়ে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। বেরলভি সুফিরা যখন ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে, তারা মনে করে তারা রাসুলের সম্মানের জন্য যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধ তাদের কাছে পার্থিব জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে, এটি একটি মহাজাগতিক দায়িত্ব। জুরগেনসমায়ার দেখান যে, এই ধরণের সহিংসতায় সিম্বলিজম (Symbolism) বা প্রতীকের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাথা কেটে ফেলা, প্রকাশ্যে হত্যা করা – এগুলো হলো সেই প্রতীকি বার্তা দেওয়ার মাধ্যম। সুফিরা যখন সহিংস হন, তখন তারা এই মহাজাগতিক যুদ্ধের সৈনিক হিসেবেই নিজেদের কল্পনা করেন। জুরগেনসমায়ারের তত্ত্ব আমাদের বলে, সুফি সহিংসতা বা যেকোনো ধর্মীয় সহিংসতা হলো মূলত আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ওপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি মরিয়া চেষ্টা।

আলিক্স ফিলিপন এবং বেরলভি সক্রিয়তাবাদ

আধুনিক সুফি রাজনীতির ওপর খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী আলিক্স ফিলিপন (Alix Philippon)পাকিস্তানে বেরলভি সুফিবাদের রাজনীতিকরণ নিয়ে তার গবেষণা চোখ খুলে দেওয়ার মতো। ফিলিপন দেখিয়েছেন যে, আমরা সুফিবাদকে যেভাবে ‘এপলিটিক্যালবা রাজনীতিবিমুখ ভাবি, তা ভুল। তিনি ‘সুফি অ্যাক্টিভিজম’ (Sufi Activism) বা সুফি সক্রিয়তাবাদের তত্ত্ব হাজির করেন। তার মতে, মাজার এবং খানকাগুলো হলো এক ধরণের পাবলিক স্ফিয়ার (Public Sphere), যেখানে জনমত গঠিত হয়।

ফিলিপন যুক্তি দেন, আধুনিক রাষ্ট্রে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য সুফিরা এখন ‘ব্লাসফেমি কার্ড’ বা ধর্মীয় অনুভূতির কার্ড খেলছেন। টিএলপি-র মতো সংগঠনগুলো সুফিবাদের চিরায়ত ‘প্রেম’-এর ধারণাকে রাজনৈতিক ‘ক্ষোভ’-এ রূপান্তরিত করেছে। তিনি একে বলছেন ‘পলিটিকস অফ লাভ’ (Politics of Love) বা প্রেমের রাজনীতি, যা শুনতে মধুর হলেও প্রয়োগে অত্যন্ত সহিংস। ফিলিপনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মতে, বেরলভিরা দেওবন্দি বা সালাফিদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যই এই উগ্রপন্থা বেছে নিয়েছে। অর্থাৎ, এটি একটি আইডেন্টিটি পলিটিকস (Identity Politics) বা পরিচয়ের রাজনীতি। সুফি পরিচয় মানেই যে কেবল গান-বাজনা নয়, বরং রক্তপাতও হতে পারে – ফিলিপনের গবেষণা সেই রূঢ় সত্যটিই সামনে আনে।

মিশেল ফুকো এবং ক্ষমতার শরীরতত্ত্ব

পরিশেষে, সুফি সহিংসতাকে আমরা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (Michel Foucault)-র ক্ষমতার তত্ত্ব দিয়েও কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারি। ফুকো যদিও সুফিবাদ নিয়ে কাজ করেননি, কিন্তু তার ‘বায়োপলিটিকস’ (Biopolitics) এবং ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’ (Disciplinary Power) বা শৃঙ্খলামূলক ক্ষমতার ধারণা সুফি তরিকগুলোর কাঠামোর সাথে মিলে যায়। সুফি খানকায় পীর তার মুরিদদের শরীর ও মনের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, তা ফুকোর বর্ণনাকৃত ‘প্যানোপটিকন’ বা সর্বক্ষণ নজরে রাখার ব্যবস্থার মতো। মুরিদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতিটি চিন্তা পীরের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এই চরম নিয়ন্ত্রণ বা সাবজুগেশন (Subjugation)-এর ফলে মুরিদ একটি আজ্ঞাবহ শরীরে পরিণত হয়। যখন পীর আদেশ দেন, তখন মুরিদের শরীর সেই আদেশ পালনে যান্ত্রিকভাবে সাড়া দেয়, তা সে ধ্যানের আসনে বসা হোক বা শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হোক। সুফি ঐতিহ্যে সহিংসতা তাই ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, বরং এটি একটি সুশৃঙ্খল ক্ষমতার প্রকাশ। ফুকোর দৃষ্টিতে দেখলে, সুফিদের এই সহিংসতা হলো ক্ষমতার এক ধরণের রিচুয়াল (Ritual) বা আচার, যার মাধ্যমে আধিপত্য বজায় রাখা হয়।

সারসংক্ষেপে, এই তাত্ত্বিকরা আমাদের শেখান যে, সুফিবাদকে কোনো একরঙা চশমা দিয়ে দেখা ঠিক নয়। রিচার্ড ইটনের জঙ্গল পরিষ্কার করা গাজী, সাইমন ডিগবির ক্ষমতাধর শেখ, নাইল গ্রিনের ধর্মযোদ্ধা, কিংবা ক্যাথরিন বাবায়ানের মসিহ-রূপী রাজা – এরা সবাই ইতিহাসের অকাট্য বাস্তবতা। তাত্ত্বিকদের এই বিশ্লেষণগুলো আমাদের রোমান্টিক বুদবুদ ফাটিয়ে দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় এক কঠিন সত্যের সামনে। আর তা হলো – সুফিবাদ কেবল আকাশের পানে তাকিয়ে থাকা কোনো বিমূর্ত দীর্ঘশ্বাস নয়, বরং মাটির পৃথিবীতে ক্ষমতা, সম্পদ এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক নিরন্তর ও প্রায়শই রক্তাক্ত সংগ্রাম।

উপসংহার

ইতিহাসের এই লম্বা ভ্রমণে আমরা দেখলাম, সুফিবাদ মানেই কেবল নির্জনতা বা আধ্যাত্মিকতা নয়। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বারুদের গন্ধ, রক্তের দাগ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। গাজীদের হুঙ্কার, জেনিসারিদের কুচকাওয়াজ, সাফাভিদের তরবারি, কিংবা মজনু শাহের বিদ্রোহ – সবই সুফি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যে প্রশান্ত সুফিবাদের কথা জানি, তা হয়তো মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে আছে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ (Political Ambition) এবং সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ আখ্যান। সমাজ যখনই কোনো বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বা যখনই কোনো বহিঃশত্রুর আক্রমণ এসেছে, সুফিরা তখন আর কেবল আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বসে থাকেননি। তারা হয়ে উঠেছেন সেনাপতি, নির্দেশদাতা, কিংবা বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা।

তবে এই আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে যে, সুফিবাদ আদতে সহিংসতা শেখায় বা এটি একটি যুদ্ধবাজ মতবাদ। বরং সত্যটা হলো, সুফিবাদ একটি বিশাল এবং বিচিত্র জগত। এখানে যেমন রুমির প্রেম আছে, তেমনি ইমাম শামিলের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধও আছে। পরিস্থিতি মানুষকে যেমন আচরণ করতে বাধ্য করে, সুফিরাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারা কখনো প্রেম দিয়ে বিশ্ব জয় করতে চেয়েছেন, আবার কখনো প্রয়োজন মনে করলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। ঔপনিবেশিকতা (Colonialism) বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে অনেক সময় তাদের সহিংস পথ বেছে নিতে হয়েছে, যা তাদের অনুসারীদের কাছে ছিল পবিত্র দায়িত্ব। আবার কখনো কখনো শুধুই সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে সুফি তরিকাকে ব্যবহার করা হয়েছে।

আমরা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অতীতকে বিচার করি আমাদের মতো করে। আমরা চাই সবকিছু সাদা-কালোয় ভাগ করতে – কে ভালো, কে মন্দ। কিন্তু মানুষের ইতিহাস ধূসর। সেখানে ভালো এবং মন্দের সীমানা প্রায়ই ঝাপসা হয়ে যায়। সুফি ঐতিহ্যের সহিংসতা সেই ধূসর এলাকারই (Grey Area) গল্প। এই গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই, সে যে মতাদর্শেরই আলখেল্লা পরুক না কেন। তার ভেতরে যেমন দেবত্ব জাগার সম্ভাবনা থাকে, তেমনি দানবীয় প্রবৃত্তিও সুপ্ত অবস্থায় থাকে – অপেক্ষায় থাকে শুধু সঠিক বা ভুল মুহূর্তের। ইতিহাস বড়ই নির্মম, সে কাউকেই রেহাই দেয় না, এমনকি সাধকদেরও না। সুফিবাদের এই রক্তাক্ত অধ্যায়গুলো (Bloody Chapters) আমাদের শেখায় যে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা কখনোই রাজনীতি ও সমাজের জটিল সমীকরণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।

তথ্যসূত্র

  • Abbas, H. (2018). Pakistan’s Nuclear Bomb: A Story of Defiance, Deterrence and Deviance. Oxford University Press.
  • Babayan, K. (2002). Mystics, Monarchs, and Messiahs: Cultural Landscapes of Early Modern Iran. Harvard University Press.
  • Barkan, Ö. L. (1942). Kolonizatör Türk Dervişleri. Vakıflar Dergisi.
  • Bonner, M. (2006). Jihad in Islamic History: Doctrines and Practice. Princeton University Press.
  • Buehler, A. F. (1998). Sufi Heirs of the Prophet: The Indian Naqshbandiyya and the Rise of the Mediating Sufi Shaykh. University of South Carolina Press.
  • Chandra, A. N. (1977). The Sannyasi Rebellion. Ratna Prakashan.
  • Dasgupta, A. (1992). The Fakir and Sannyasi Uprisings. K.P. Bagchi & Co.
  • Digby, S. (1986). The Sufi Shaikh as a Source of Authority in Medieval India. Purusartha, 9, 55-77.
  • Eaton, R. M. (1993). The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760. University of California Press.
  • Eaton, R. M. (2019). India in the Persianate Age: 1000-1765. Penguin Allen Lane.
  • Etienne, B. (2012). Abdelkader. Hachette Littératures.
  • Evans-Pritchard, E. E. (1949). The Sanusi of Cyrenaica. Oxford University Press.
  • Friedmann, Y. (2003). Shaykh Ahmad Sirhindi: An Outline of His Thought and a Study of His Image in the Eyes of Posterity. Oxford University Press.
  • Gammer, M. (1994). Muslim Resistance to the Tsar: Shamil and the Conquest of Chechnya and Daghestan. Frank Cass.
  • Grewal, J. S. (1998). The Sikhs of the Punjab. Cambridge University Press.
  • Goodwin, J. (1998). Lords of the Horizons: A History of the Ottoman Empire. Henry Holt and Company.
  • Green, N. (2012). Sufism: A Global History. Wiley-Blackwell.
  • Heck, P. L. (2007). Sufism and Politics: The Power of Spirituality. Markus Wiener Publishers.
  • Holt, P. M. (1970). The Mahdist State in the Sudan, 1881-1898. Oxford University Press.
  • Inalcik, H. (1973). The Ottoman Empire: The Classical Age 1300–1600. Weidenfeld & Nicolson.
  • Juergensmeyer, M. (2000). Terror in the Mind of God: The Global Rise of Religious Violence. University of California Press.
  • Kafadar, C. (1995). Between Two Worlds: The Construction of the Ottoman State. University of California Press.
  • Karamustafa, A. T. (1994). God’s Unruly Friends: Dervish Groups in the Islamic Later Middle Period, 1200-1550. University of Utah Press.
  • Khan, M. I. (1999). The Role of the Sufis in the Sannyasi and Fakir Rebellion. Asiatic Society of Bangladesh.
  • Lewis, B. (1967). The Assassins: A Radical Sect in Islam. Weidenfeld & Nicolson.
  • Newman, A. J. (2006). Safavid Iran: Rebirth of a Persian Empire. I.B. Tauris.
  • Philippon, A. (2011). Sunnis against Sunnis: The politicization of Barelvi Sufism in Pakistan. The Muslim World, 101(2), 347-368.
  • Rizvi, S. A. A. (1978). A History of Sufism in India (Vol. 1). Munshiram Manoharlal Publishers.
  • Sareen, S. (2017). The Jihad Factory: Pakistan’s Islamic Revolution in the Making. Har-Anand Publications.
  • Savory, R. (1980). Iran under the Safavids. Cambridge University Press.
  • Singh, P. (2005). Empire of the Sikhs: The Life and Times of Maharaja Ranjit Singh. Peter Owen Publishers.
  • Trimingham, J. S. (1971). The Sufi Orders in Islam. Oxford University Press.
  • Zelkina, A. (2000). In Quest for God and Freedom: The Sufi Response to the Russian Advance in the North Caucasus. Hurst & Company.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।