বাংলায় ধর্মের ইতিহাস

জাফর খাঁ গাজী ও ত্রিবেণীতে তার মসজিদের ইতিহাস

(লেখাটির বেশিরভাগ তথ্য নেয়া হয়েছে বিনয় ঘোষ রচিত “পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড থেকে)

জাফর খাঁ গাজীর মসজিদ ও হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন অবশেষ

সবার প্রথমে বলি জাফর খাঁ এর মসজিদটি হল বাংলার সর্বপ্রাচীন মসজিদ যা এখনও টিকে আছে। গঙ্গার তীরে বিশাল একটি উঁচু স্থূপের উপর জাফর খাঁর আস্তানা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত। জাফর খাঁর আস্তানা ও মসজিদের এলাকার মধ্যে প্রবেশ করলে চারদিকে ছড়ানো অজস্র পাথরের খণ্ড দেখা যায়, এমনকি দেয়ালের গায়েও পাথরের খণ্ডগুলোকে গাঁথা অবস্থায় দেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এর প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই ডানপাশে সমাধিস্তম্ভ বা আস্তানা দেখা যায় এবং সামনে কয়েকগজ দূরে সাতগম্বুজ জাফর খাঁর মসজিদ দেখা যায়। আস্তানাটি দুইভাগে ভাগ করা, পূর্বভাগে জাফর খাঁ, তার পুত্র ও পুত্রবধূ এবং পশ্চিমভাগে বড় খাঁ গাজী ও তার পুত্ররা সমাধিস্থ।

জাফর খাঁর সমাধিগৃহের চারটি দরজা, যার প্রত্যেক দরজাতে হিন্দু ভাস্কর্যের পর্যাপ্ত নিদর্শন রয়েছে। দরজার দুইপাশে নিচের দিকে ছােটো-ছােটো মন্দিরের মধ্যে দণ্ডায়মান দেবীমূর্তি এবং তার পাশে দুটি যক্ষমূর্তি খােদাই করা অবস্থায় দেখা যায়। আস্তানার বাইরের দেয়ালে বড়াে-বড়াে পাথরখণ্ডের উপরে সারি-সারি প্যানেলের মতাে বিষ্ণুমূর্তি , নবগ্রহ মূর্তি, ফুললতাপাতা ইত্যাদি খােদাই করা আছে। আস্তানা ও মসজিদে পাথরগুলি যেভাবে গাঁথা হয়েছে তা দেখে বোঝা যায় একখণ্ড পাথরও জাফর খাঁর জন্য কোনাে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী বাইরে থেকে আনা হয়নি ও পাথরগুলাে কোনাে স্থাপত্যের নিয়মানুযায়ীও সাজানাে বা গাঁথা হয়নি, যেমন হাতের কাছে পাওয়া গেছে, ঠিক তেমনি তাড়াহুড়াে করে কোনােরকমে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায় – দেবদেবীর মূর্তি-খােদাই-করা পাথরের প্যানেলগুলির প্রায় সবই উল্টিয়ে গাঁথা হয়েছে। বিষ্ণুমূর্তির শ্রেণী, নবগ্রহ ও অন্যান্য মূর্তি খােদিত প্যানেল অধিকাংশ উল্টানাে, এখানে বড়াে-বড়াে দেবদেবীর মূর্তি পেছন ফিরিয়ে (অর্থাৎ উল্টিয়ে) গেঁথে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের গায়ে, বিশেষ করে মসজিদের ভেতরের দেয়ালে এরকম একাধিক মূর্তির নিদর্শন লক্ষ করা যায়, প্রার্থনাকক্ষের আশেপাশে অনেক মূর্তির পেছন দিকে লিপিও উৎকীর্ণ করা হয়েছে দেখা যায়। মসজিদের ভিতরের লিপিগুলি অধিকাংশই দেবমূর্তির পেছনে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। দেবদেবীর মূর্তিগুলি বেশ বড়াে-বড়াে মূর্তি ছিল, তিন-চারফুট পর্যন্ত লম্বা। জাফর খাঁর সমাধিগৃহের দরজার দু-পাশে যেসব ভাস্কর্যের নিদর্শন রয়েছে তাতে মনে হয়, আস্তানাটি হিন্দুমন্দির ছিল, এবং সমাধিগৃহটি সেই মন্দিরের গর্ভগৃহ ছিল, এবং মন্দিরের গর্ভগৃহকেই সােজাসুজি সমাধিকক্ষে পরিণত করা হয়েছে।

বড়খাঁ গাজীর সমাধির অভ্যন্তরে কয়েকটি প্রাচীন লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় একশাে বছর আগে মনিসাহেব ত্রিবেণী পরিদর্শন করতে গিয়ে বাংলা অক্ষরেই খােদাই করা এই লিপিগুলির সন্ধান পান। ব্রিটিশ শাসনামলে হুগলির সিভিল সারভেন্ট ডি. মানি (D. Money) তার পাঠোদ্ধার করেন (এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নাল, ১৮৪৭ সাল, প্রথম ভাগ)। পরে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই পাঠ কিছু সংশােধন করে প্রকাশ করেন (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৫ বর্ষ, ১ সংখ্যা)। রাখালদাসের সংশােধিত পাঠে, এখানে লেখা আছে – ১। শ্রীসীতানিব্বাসঃ–, ২।অভিষেক, ৩। শ্রীরামেণ রাবণ বধঃ, ৪। – র্য্যুদ্ধম, ৫। দৃষ্টদ্যুম্ন দুঃশাসনয়োর্য্যুদ্ধম্‌। এছাড়া আরও দুটি লিপি রাখালদাস উদ্ধার করেছেন – ১। খরত্রিশিরসােৰ্ব্বধঃ-, ২। বস্ত্রহরণঃ। এইসব টুকরাে-টুকরাে লিপি থেকে বােঝা যায় যে, জাফর খাঁর আস্তানাটি পূর্বে একটি বিষ্ণুমন্দির ছিল। মন্দিরের গায়ে রামায়ণ ও মহাভারতের অসংখ্য চিত্রাবলী খােদাই করা ছিল – রাম-রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য, বস্ত্রহরণের দৃশ্য ইত্যাদি। সুতরাং মন্দিরটি যে সাধারণ বিষ্ণুমন্দির ছিল না, রীতিমত বড়াে কারুকার্যশােভিত বিষ্ণুমন্দির ছিল। আস্তানার বাইরে বিষ্ণুমূর্তি, নবগ্রহ ইত্যাদির প্যানেলগুলিও তার সাক্ষী। মন্দিরের গ্রাউণ্ডপ্ল্যান ও পাদপীঠ অক্ষুন্ন রেখেই তার উপর সমাধিস্তম্ভ গড়া হয়েছে এবং মন্দিরের গর্ভগৃহকে করা হয়েছে সমাধিকক্ষ। কিন্তু এখানে শুধু একটি বিষ্ণুমন্দির ছিল বলে মনে হয় না। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, যা মসজিদে ও আস্তানায় রয়েছে, তাই থেকে মনে হয়, এখানে একাধিক মন্দির ছিল—বিষ্ণুমন্দির, সূর্যমন্দির, শিবমন্দির ইত্যাদি। তীর্থস্থান ত্রিবেণীতে এই স্থানটিই ছিল আসল তীর্থক্ষেত্র এবং গঙ্গার তীরে বলে উঁচু টিলার মতাে স্থানে দেবালয়গুলি গড়া হয়েছিল। উঁচু স্থানে গড়ার উদ্দেশ্য হল, প্রথমত গঙ্গার দৃশ্য যাতে মন্দির-প্রাঙ্গণ থেকে উপভােগ করা যায়, দ্বিতীয়ত গঙ্গায় বন্যা হলেও যাতে দেবালয়গুলি মাথা তুলে থাকতে পারে। একাধিক মন্দির ছিল একথা এইজন্যই মনে হয় যে, একটি মন্দিরে এতগুলি দেবদেবীর মূর্তি এবং এত বিচিত্র দেয়াল-ভাস্কর্যের নিদর্শন সাধারণত থাকে না। তাই মনে হয়, এই স্থানটি ত্রিবেণীর প্রধান দেবালয়কেন্দ্র ছিল। ডি. মানি লিখেছিলেন (অনুবাদ): “এছাড়াও উত্তর ও পূর্ব প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি কিছু হিন্দু দেবতার ছবি আছে, যেমন নরসিংহ, বরাহ, রাম, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী ইত্যাদি, তাদের অধিকাংশই অনেক বিকৃত… এটা পরিষ্কার যে ভবনটি এখন তার মূল অবস্থায় নেই, এবং পূর্বে এটি অবশ্যই হিন্দু মন্দির ছিল।” (J.A.S. May 1847) রাখালদাস মনিকে সমর্থন করেছেন।

ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তি বা দেবালয়ের ভাস্কর্যের নিদর্শন ছাড়াও ত্রিবেণীর মসজিদের স্তম্ভগাত্রে ভূমিস্পর্শ মুদ্রাবিশিষ্ট বুদ্ধমূর্তি খােদিত রয়েছে দেখা যায়। মসজিদের মধ্যে দুটি করে স্তম্ভের সারি আছে, প্রত্যেক সারিতে ছয়টি করে স্তম্ভ। এই স্তম্ভের মধ্যে একটিতে বুদ্ধমূর্তি খােদিত আছে। অন্যান্য স্তম্ভের তুলনায় এই স্তম্ভটির বৈশিষ্ট্যও আছে। অন্যান্য স্তম্ভের মতাে অষ্টকোণাকার বা ষষ্ঠ-কোণাকার নয়, বরং এটি চতুষ্কোণার স্তম্ভ, যা থেকে বােঝা যায় এটি আলাদা কোনাে দেবালয়ের স্তম্ভ, যা এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। বুদ্ধমূর্তির এই নিদর্শন ছাড়াও জৈনমূর্তির নিদর্শনও এখানে পাওয়া গেছে। বড়খাঁ গাজীর সমাধির দক্ষিণদ্বারের পাশে আরবীভাষায় লেখা একটি পাথরের খণ্ড আছে। তার অপর পার্শ্বে একটি মূর্তির চিহ্ন দেখা যায়। সেখানে পাদদ্বয় ও পিছনের নাগের কুণ্ডলী ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। রাখালদাস এটিকে জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি বলে মনে করেছিলেন। বৌদ্ধ ও জৈনমূর্তির এইসব নিদর্শন দেখে মনে হয় ত্রিবেণীতে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মন্দির ছাড়াও বৌদ্ধ ও জৈন দেবদেবীর মন্দিরও ছিল। বিষ্ণুমন্দির বা সূর্যমন্দির বা শিবমন্দিরে ভূমিস্পর্শমুদ্রায় উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি-খােদিত স্তম্ভ থাকতে পারে না, অথবা জৈন তীর্থঙ্করের কোনাে মূর্তি থাকাও সম্ভব নয়। বাইরে থেকে হঠাৎ দু-একটি বৌদ্ধস্তম্ভ বা জৈনমূর্তি যে মসজিদ বা আস্তানা গড়ার সময় বহন করে আনা হয়েছিল, তাও অনুমান করার কোনাে যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। তাই হতেই পারে বিষ্ণু মন্দির হবার আগে এটি বৌদ্ধ ও জৈনদের মন্দির ছিল, আবার হতে পারে ত্রিবেণী ছিল বাংলার বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু—সকল সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান ছিল। হিন্দু-দেবালয়ের মতাে বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরও সেখানে ছিল।

জাফর খাঁর আস্তানার মধ্যে রেখ মন্দিরের একটি ছােট্ট মডেল পাওয়া গেছে। এটি অবশ্য রেখদেউলের মডেল নয়, কোনাে বড়াে রেখদেউলের মিনিয়েচারই অলঙ্কার। এই অলঙ্কার কোনাে বাংলা-মন্দিরের গায়ে থাকা সম্ভব নয়, কোনাে রেখদেউলের গণ্ডিতেই এরকম অলঙ্কার থাকতে পারে, যেমন বর্ধমান জেলায় বরাকরের দেউলে আছে। ত্রিবেণীর এই আস্তানা ও মসজিদ প্রাঙ্গণেই একটি পাথরের রেখদেউল ছিল বলে মনে হয়। ত্রিবেণী অঞ্চল এয়ােদশ শতাব্দীতে কিছুকাল উড়িষ্যারাজের অধীন ছিল। উড়িষ্যারাজ যিনি ত্রিবেণীর ঘাট তৈরি করেছিলেন, তিনিই ত্রয়ােদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনােসময় একটি রেখদেউলও তৈরি করে দিয়ে থাকতে পারেন। তারপর ত্রয়ােদশ শতাব্দীর শেষে জাফর খাঁ গাজীর ধর্মযুদ্ধে অন্যান্য দেবালয়ের সঙ্গে এই রেখদেউলটিরও ধ্বংস হয়ে যায়।

সব মিলিয়ে যেটা মনে হয় তা হল, ত্রিবেণী ছিল বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের একটি সম্মিলিত তীর্থক্ষেত্র। স্থানীয় হিন্দুসামন্তরা হয়তাে পালযুগ থেকেই এই অঞ্চলে দেবালয় ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। লক্ষণ সেনের সভাকবি ধােয়ী বর্ণিত পবনদূত কাব্যের বিজয়পুর রাজধানী ত্রিবেণীরই কাছাকাছি গঙ্গার পুর্বে-পশ্চিমে, কোথাও ছিল। এইসময় ত্রিবেণীতে বিশাল বিষ্ণুমন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হয়তো। সেন-আমলে তীর্থকেন্দ্ররূপে ত্রিবেণীর প্রাধান্য খুব বেড়েছিল। সেন-আমলের শেষদিকে ভূদেব নৃপতির পূর্বপুরুষরা হয়তাে ত্রিবেণী অঞ্চলের সামন্তরাজা ছিলেন (ভূদেব নৃপতির কথায় পরে আসছি)। অথবা বখতিয়ারের নদিয়া-অভিযানের পর স্থানীয় কোনাে সামন্ত এই অঞ্চল দখল করে কর্তৃত্ব বিস্তার করেছিলেন। তিনি বা তার বংশধর হয়তাে ভূদেব। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর গােড়া থেকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অভিযান হওয়া সত্ত্বেও, হুগলি জেলার ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম-পাণ্ডুয়া-মহানাদ অঞ্চল প্রায় একশতাব্দীকাল আক্রমণমুক্ত ছিল। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি উড়িষ্যারাজের আধিপত্য যখন ত্রিবেণী পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তখন ত্রিবেণীর ঘাট এবং উড়িষ্যার মন্দিরের অনুকরণে দেখদেউল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ত্রয়ােদশ শতাব্দীর শেষে জাফর খাঁ গাজী ও তার পরবর্তী যােদ্ধারা ত্রিবেণী সপ্তগ্রাম অভিযান করে দখল করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর গােড়াতে ত্রিবেণী মুসলমান-অধিকৃত হয়। স্থানীয় দেবালয়, দেবদেবী ইত্যাদি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে অনেক কাল যাবৎ ত্রিবেণীতে কোনাে হিন্দু দেবালয় গড়া হয়নি। মনে হয় ত্রিবেণী পরে জাফর খাঁ গাজীর সমাধি ও মসজিদ নিয়ে মুসলমানদের অন্যতম তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হওয়াতে কোনাে হিন্দু-রাজা বা জমিদার বেশি অর্থ ব্যয় করে আর ভাল মন্দির সেখানে নির্মাণ করেননি। তা না করলেও দীর্ঘকাল ত্রিবেণী তার পরেও হিন্দুদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান ছিল। মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বর্ণনা থেকে বােঝা যায় যে পরে হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্ক মধুর হয়েছিল এবং হিন্দুরা ঘরে-ঘরে নানা দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে নিরাপদে পূজার্চনও করতেন। হিন্দু-পণ্ডিতরাও নিরুদ্বেগে ত্রিবেণীকে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ বিদ্যাকেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন (এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে)।

জাফর খাঁ গাজীর কিংবদন্তী

অনেক কিংবদন্তী ও কাহিনি জাফর খাঁ গাজীর ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বকে কেন্দ্র করে পল্লবিত হয়ে উঠেছে, যার সবটা ইতিহাস না হলেও অনেকটাই ইতিহাস। তার কাহিনীর সাথে যে দুজন হিন্দু নৃপতি – মান-নৃপতি ও ভূদেব-নৃপতির কথা জানা যায়, তাদের জীবনও রহস্যাবৃত। ত্রিবেণীতে জাফর খাঁর মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমাধির জীর্ণ নিদর্শন আজও রয়েছে। তার মসজিদ ও সমাধিস্তম্ভ যেন মুসলিম শিলালিপি এবং হিন্দু মন্দির-মূর্তি ভাস্কর্যের মিউজিয়াম। জাফর খাঁ গাজীর জীবনকথা কেউ লিপিবদ্ধ করে যাননি। শিলালিপি যা পাওয়া গেছে তাতে জাফর খাঁর কীর্তির সামান্য উল্লেখ ছাড়া বিশেষ বৃত্তান্ত কিছু নেই। শান্তিপুরনিবাসী মহীউদ্দিন ওস্তাগরের পড়ুয়ার কেচ্ছা-কাব্যের মধ্যে ত্রিবেণীর জাফর খাঁর নামটুকু ছাড়া আর কিছু নেই – “জাফর খাঁ গাজী রহিল ত্রিবেণী স্থানে।/ গঙ্গা যারে দেখা দিল ডাক শুনি কানে।”

১৮৪৭ সালে, মনিসাহেব, জাফর খাঁর মসজিদ পরিদর্শন করতে গিয়ে মসজিদের মুতওয়াল্লীদের বা খাদেমদের কাছে রক্ষিত জাফর খাঁর একটি কুরসীমা (বংশলতা) উদ্ধার করেছিলেন। সেই কুরসীনামা অবলম্বন করে তিনি জাফর খাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকথা এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেন (D. Money: An Account of the Temple of Triveni near Hugli, J.A.S May 184)। এই বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, চালা মুকসুদাবাদ, পরগনা কোনওয়ারের অন্তর্ভুক্ত মুণ্ডগাঁ থেকে জাফর খাঁ গাজী তার ভাগনে বা ভাইপাে পাণ্ডুয়ার শাহ সুফীর সঙ্গে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম অঞ্চলে ইসলামধর্ম প্রচারের জন্য আসেন। প্রথমে তিনি মান-নৃপতিকে ধর্মান্তরিত করে দীক্ষা দেন এবং পরে মহানাদের কাছে ভূদেব-নৃপতির সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। তাঁর মুণ্ডটি যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকে এবং দেহটি ত্রিবেণীতে সমাধিস্থ করা হয়। এরপর তার পুত্র উলুগ খাঁ সপ্তগ্রামের হিন্দু রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে রাজবংশের সকলকে ধর্মান্তরিত করেন এবং রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। কিছুদিন পরে উলুগ খাঁও মারা যান এবং তাকেও ত্রিবেণীতে সমাধিস্থ করা হয়। এদের বংশধররা ত্রিবেণীতে আজও আছেন এবং ফিরােজ শাহের কাছ থেকে তারা ‘খাঁ’ উপাধি পান।

দুই শিলালিপির দুই জাফর খাঁ এর সমস্যা ও তাদের ইতিহাস

সুলতান শামসুদ্দিন ফিরােজ শাহের (১৩০১-১৩২২ খ্রিঃ) তিনটি শিলালিপি পাওয়া গেছে, দুটি বিহারে, একটি বাংলায়। বাংলার শিলালিপিটি ১৩১৪ খ্রিস্টাব্দের ও তা পাওয়া গেছে ত্রিবেণীর জাফর খাঁর সমাধিস্তম্ভ থেকে। এই শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, সাতগাঁ বা সপ্তগ্রামের শাসনকর্তা সাহাবুদ্দিন জাফর খাঁ খান-ই-জাহান ত্রিবেণীতে একটি মাদ্রাসা (‘দার-উল-খয়রাৎ’ নামে) তৈরি করেছিলেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শিলালিপির অনুবাদ করেন (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৫ বর্ষ, ১ সংখ্যা): “যিনি প্রশংসার পাত্র তাহার প্রশংসা হউক। দানের কর্তা, মুকুট ও শীলমােহরের অধিকারী, পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়াস্বরূপ, দাতা, সদাশয়, মহানুভব, সকল জাতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, পৃথিবী ও ধর্মের সূর্যস্বরূপ জগতের পালনকর্তা, ঈশ্বরের দয়ার বিশেষ পাত্র, সুলেমানের রাজ্যের উত্তরাধিকারী রাজা আবুল মুজঃফর ফিরােজ শাহ সুলতান, ঈশ্বর সর্বদা তাহার রাজ্য রক্ষা করুন। তাহার রাজত্বকালে দয়ার গৃহ নামক এই বিদ্যালয়। মহানুভব খাঁ সম্মানিত দাতা, প্রশংসাযােগ্য দানবীর সদাশয়, ইসলামধর্মের ও মানবজাতির সাহায্যকারী, সত্য ও ধর্মের ধূমকেতুস্বরূপ রাজা ও রাজ্যাধিকারিগণের সহায়স্বরূপ, সত্যবিশ্বাসিগণের অভিভাবকস্বরূপ খাঁ মহম্মদ জাফর খাঁ, ঈশ্বর তাহাকে শত্রুগণ কর্তৃক জয়ী করিলেন (অর্থাৎ শত্রুগণ পরাভূত হইয়া তাহার জয়ের কারণ হইল) ও তাহাকে তাঁহার আত্মীয়স্বজনের নিকট ফিরাইয়া আনিলেন…তাহাদের আদেশে নির্মিত হইল।” (হিজরি সন ৭১৩)

৭১৩ হিজরি বা ১৩১৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এই ‘দয়ার গৃহ’ ছাড়াও ত্রিবেণীতে আর একটি মাদ্রাসা জাফর খাঁ গাজী নির্মাণ করেছিলেন পনেরাে বছর আগে, ৬৯৮ হিজরি বা ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে। এই শিলালিপির মমার্থ হল : “তুর্ক (তুরর্ক জাতীয়) সিংহবিক্রম জাফর খাঁ.. বীরসমূহের পরে সর্বাপেক্ষা দয়ালু গৃহনির্মাতা…রাজদ্রোহী অবিশ্বাসীগণকে খঙ্গ ও ভল্ল দ্বারা নিহত করিয়া প্রত্যেক..কোষ্ঠাগার হইতে দান করিলেন…ও সত্যধর্মের শিক্ষিত ব্যক্তিগণকে সম্মান করা এবং ঈশ্বরের পতাকা উন্নত করিবার জন্য নির্মিত হইল।” (৬৯৮ হিঃ)”

দেখা যাচ্ছে ১২৯৯ সালের শিলালিপিতে সিংহবিক্রম জাফর খাঁ এবং ১৩১৪ সালের শিলালিপিতে খাঁ মহম্মদ জাফর খাঁর কথা লেখা হচ্ছে। ধারণা করা হয় এই দুজন একই ব্যক্তি নন। ডি মনি (এশিয়াটিক সােসাইটি জার্নাল, ১৮৪৭), স্টেপলটন (এশিয়াটিক সােসাইটি জার্নাল ১৯২২), ওমালি (হুগলি গেজেটিয়ার) এবং হুগলি জেলার কাহিনি-রচয়িতারা সকলেই দুই জাফর খাঁকে অভিন্ন মনে করে ভুল করলেও এই দুই জাফর খাঁ একই ব্যক্তি নন। শিলালিপি ভাল করে অনুধাবন করলে দুই জাফর খাঁর চারিত্রিক স্বাতন্ত্র পরিষ্কার বােঝা যায়। গাজী জাফর খাঁ হলেন ‘সিংহবিক্রম’ জাফর খাঁ যিনি রাজদ্রোহী, বিধর্মীদের ‘খঙ্গ ও ভল্ল দ্বারা নিধন করেছিলেন’। দ্বিতীয় জাফর খাঁ হলেন ‘রাজা ও রাজাধিকারীগণের সহায়স্বরূপ’ খান-ই-জাহান জাফর খাঁ। গাজী জাফর খাঁ কোথাও রাজা ও রাজ্যাধিকারীদের সহায়স্বরূপ বলে নিজের পরিচয় দেননি। সুতরাং দুইজন জাফর খাঁ যে একই ব্যক্তি নন তা পরিষ্কার বােঝা যায়। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার সর্বপ্রথম এই দুই জাফর খার রহস্য ভেদ করে বলেছেন (অনুবাদ) : “সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজের রাজত্বের এই জাফর খান, জাফর খানের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি ১৫ বছর আগে একই এলাকায় (ত্রিবেণী) একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন।” (History of Bengal, Dacca University, Vol. II p. 77)

ত্রিবেণীতে দুটি মাদ্রাসা তৈরি হয়েছিল পনেরাে বছরের মধ্যে। গাজী জাফর খাঁ-ই প্রথম ত্রিবেণী সপ্তগ্রাম অঞ্চল জয় করেন এবং তার সঙ্গেই মান ও ভুদেব-নৃপতির যুদ্ধ হয়। কৈকাসের রাজত্বকালে এই ঘটনা ঘটে। এই যুদ্ধেই গাজী জাফর খাঁ নিহত হন। কুরসীমায় যে উগওয়া খাঁর কথা বলা হয়েছে (গাজীর পুত্র বলে যদুনাথ সরকার মনে করেন) তিনি লক্ষ্মীসরাই শিলালিপিতে উল্লিখিত জিয়াউদ্দিন উলুগ খাঁ। শামসুদ্দীন ফিরােজ শাহ রাজ্য দখল করার পর, মনে হয়, জিয়াউদ্দিন মুঙ্গের থেকে উলুগ খাঁকে সপ্তগ্রামে পাঠিয়েছিলেন, গাজী জাফর খাঁর শুরু করা কাজ শেষ করার জন্য। উলুগ খাঁ সাতগাঁয়ের হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং ত্রিবেণীতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সুলতান ফিরােজ শাহ সাতগাঁর শাসনভার সাহাবুদ্দিন জাফর খাঁকে অর্পণ করেন (এই জাফর খাঁ কৈকাসের রাজত্বকালে দেবকোটের শাসনকর্তা ছিলেন)। এই খান-ই-জাহান্ জাফর খাঁই ১৩১৪ সালে ত্রিবেণীতে দ্বিতীয় মাদ্রাসা দার-উল-খয়রাৎ নির্মাণ করেছিলেন। সেইজন্যই শিলালিপিতে তাকে ‘রাজা ও রাজাধিকারীগণের সহায় স্বরূপ’ বলা হয়েছে।

আমাদের আলােচ্য গাজী জাফর খাঁর কীর্তির কতকটা আভাস পাওয়া যায় ১২৯৯ সালের শিলালিপি থেকে। গাজী সাহেবকে ‘সিংহবিক্রম’ বলা হয়েছে এবং তিনি যে খঙ্গ ও ভল্ল দিয়ে অবিশ্বাসীদের নিধন করেছিলেন, তাও লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর শেষে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম অঞ্চলে স্থানীয় হিন্দু রাজা মান-নৃপতি ও ভূদেব-নৃপতির সৈন্যদলের সঙ্গে গাজী জাফর খাঁ ও তার অনুগামীদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল। মান-নৃপতির ধর্মান্তরিত হওয়ার কাহিনি হয়তাে মিথ্যা নাও হতে পারে। কিন্তু ভূদেব-নৃপতি যে রীতিমতাে প্রতিরােধ করেছিলেন তা কুরসীনামা ও শিলালিপি থেকে বােঝা যায়। ভূদেব-নৃপতি ঐতিহাসিক ব্যক্তি, কিন্তু কে তিনি, তার অন্য পরিচয় কি জানা যায় না। মনে হয় তিনি সেন আমলের শেষ দিকে, লক্ষ্মণসেন নদিয়া ছেড়ে চলে যাবার পরে, এই দিককার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে স্বাধীন-সামন্ত বাজার মতাে রাজত্ব করেছিলেন। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর শেষে ও চতুর্দশ শতাব্দীর গােড়াতে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম-পাণ্ডুয়া-মহানাদ অঞ্চলে যখন প্রথম মুসলমান অভিযান হয়, তখন গাজী সাহেবাই তাতে প্রধান অংশ গ্রহণ করেন। জাফর খাঁ গাজী তার মধ্যে আদি ও অন্যতম। ভূদেব-নৃপতির সঙ্গে যুদ্ধে গাজী জাফর খাঁ যে সম্পূর্ণ জয়ী হতে পারেননি এবং যুদ্ধে যে তিনি নিহত হয়েছিলেন তাও কুরসীনামা ও শিলালিপি থেকে বােঝা যায়। পরে উলুগ খাঁ সেই সংগ্রাম চালিয়েছিলেন এবং খান-ই-জাহান জাফর খাঁও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।

শেষ কথা

সুতরাং জাফর খাঁ গাজীর অভিযানের সময় ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম-পাণ্ডুয়া-মহানাদ অঞ্চলে যে হিন্দু সামন্তরাজাদের প্রবল আধিপত্য ছিল, তা পরিষ্কার বােঝা যায়। সপ্তগ্রাম ও ত্রিবেণী তখন সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু স্থান ছিল, বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে সপ্তগ্রাম এবং ধর্মতীর্থ ও বিদ্যাকেন্দ্র হিসেবে। ত্রিবেণী ত্রয়ােদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই অঞ্চলে কিছুদিন উড়িষ্যার রাজবংশও আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন এবং স্থানীয় বাঙালি হিন্দু রাজারা তাতে বাধা দেননি; কারণ তখন মুসলমান অভিযান কাছেই আরম্ভ হয়েছিল। উড়িষ্যারাজ মুকুন্দদেব শােনা যায় ত্রিবেণীতে তীর্থযাত্রীদের জন্য ঘাট ও মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। মান-নৃপতি এই উড়িষ্যারাজেরই কোনাে বংশধর ছিলেন কিনা বলা যায় না। ত্রিবেণীতে হিন্দু রাজাদের পােষকতায় তৈরি বহু দেবালয় ছিল, পশ্চিমবাংলার অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান ত্রিবেণীতে দেবদেবী ও দেবালয়ের সংখ্যাও প্রচুর পরিমাণে থাকা স্বাভাবিক। এখন সেই দেবালয় ও দেবদেবীর বিশেষ কোনাে অস্তিত্ব নেই কোথাও। জাফর খাঁ গাজী ও তার পরবর্তী যােদ্ধাদের যুদ্ধের সময় সেইসব দেবালয় ও দেবমূর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। তার বিস্তৃত নিদর্শন ত্রিবেণীর জাফর খান মসজিদ ও সমাধিস্তম্ভের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।

জাফর খার মসজিদের আর একটি গুরুত্ব আছে। বর্তমানে বাংলায় মুসলমান আমলের যত মসজিদ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হল ত্রিবেণীর জাফর খাঁর মসজিদ। ‘তবকৎ-ই-নাসিরী’তে বলা হয়েছে যে লক্ষণাবতীতে মহম্মদ-ই-বখতিয়ার (১১৯৯ – ১২০৫ খ্রি.) এবং হুসান্‌উদ্দিন ইওরাজ (১২১৫ – ১২২৮ খ্রি.) মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তার কোনাে চিহ্ন কোথাও নেই। বাংলায় মসজিদ-নির্মাণ সম্বন্ধে সবচেয়ে পুরানাে শিলালিপি পাওয়া গেছে মালদহ জেলার গঙ্গারামপুর থেকে, তারিখ ১২৪৮ সাল। এই মসজিদেরও কোনাে চিহ্ন নেই এখন। এর পরেই হল ১২৯৮ সালের ত্রিবেণীর মসজিদ। সুতরাং ত্রিবেণীর জাফর খাঁর মসজিদই বর্তমানে বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। (M. Chakraborty : Pre-Mughal Mosques of Bengal, J.AS.B. VI. VL.1910)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এর ৫ বছর পরেই পীর শাহজালাল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ জালাল দরগা মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটাকে বর্তমান বাংলায় টিকে থাকা ২য় প্রাচীনতম মসজিদ বলা যায়।

জাফর খাঁর সমাধির পূর্বারে পাথরসংলগ্ন একটি লৌহখণ্ড আছে, স্থানীয় লােক বলে ‘গাজীর কুড়ুল’। গাজার কুড়ুল নড়েচড়ে, কিন্তু পড়ে না। সিংহবিক্রম জাফর খাঁ যে খঙ্গ ও ভল্প নিয়ে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, গাজীর কুড়ুল তারই স্মৃতি বহন করছে। কিন্তু রূপান্তরিত স্মৃতি। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে আজ জাফর খাঁ ও তার বংশধররা দেবতার মতাে পূজা পান। শােনা যায়, সিংহবিক্রম জাফর খাঁও নাকি গঙ্গাদেবীর মূর্তিদর্শন করে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে কোরানের বদলে গঙ্গাস্তোত্র আবৃত্তি করেছিলেন। স্তোত্রটি এই – “সুরধুনি মুনিকন্যে তারয়েঃ পুণ্যবন্তং সা তরতি নিজ পুণ্যৈস্তত্র কিস্তে মহম্।। যদি চ গতিবিহীনং তারয়েঃ পাপিনং মাম্‌ তদপি তব মহত্ত্বং তন্মহত্ত্ব মহম্।।” কোরানের বদলে গঙ্গাস্তব। ধর্মযােদ্ধা গাজী এইভাবে অবিশ্বাসীদের গঙ্গাদেবীকে বরণ করে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই বরেণ্য হয়েছেন। বাংলার মাটিতে এইভাবেই মানুষ একধর্মের সঙ্গে অন্যধর্মের সমন্বয় করে নিয়েছেন। বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতির এইটাই প্রধান বিশেষত্ব।

(ব্লকম্যানের মতে জাফর খাঁ গাজীর পুত্র হচ্ছেন বড় খাঁ গাজী। বড় খাঁ গাজী হচ্ছেন বাংলার লৌকিক পীরবাদের অন্যতম প্রধান চরিত্র, যিনি হিন্দু ও মুসলিম সকলের ধর্মের সাথেই মিশে গেছেন। এছাড়া তার ভাগনে শাহ্‌ সুফীও খুব বিখ্যাত যিনি পাণ্ডুয়ার (হুগলির) সুফি পীর ছিলেন। এদের কথা সম্ভব হলে পরে লিখব।)

2 thoughts on “জাফর খাঁ গাজী ও ত্রিবেণীতে তার মসজিদের ইতিহাস

  • halder_prajnadipa

    চমৎকার লাগলো। খুবই ইনফর্মেটিভ লেখা।

    Reply
  • হিন্দু ধর্মযোদ্ধা

    সুন্দর তথ্যবহুল লেখা। একটি বিষয় খুব মর্মান্তিক ছিল, মন্দিরের গর্ভগৃহে বিধর্মী রক্তপিপাসু যোদ্ধাদের মৃতদেহ সমাহিত করা। ভাবলেই মাথা খারাপ। আর আপনি লেখা শেষ করছেন “বাংলার মাটিতে এইভাবেই মানুষ একধর্মের সঙ্গে অন্যধর্মের সমন্বয় করে নিয়েছেন। বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতির এইটাই প্রধান বিশেষত্ব।”

    বিশেষত্ব!!! চমৎকার বিশেষত্ব! শক্তের ভক্ত, নরমের যম, এই হচ্ছে হিন্দু বাঙালি জাতি। যে হিন্দু মন্দিরগুলি এখনও অক্ষত রয়েছে, আসুন সবাই মিলে সেগুলি ভেঙ্গে পুনরায় তার মধ্যে এইসব নরপশুদের সমাহিত করবার ব্যবস্থা করি। যত্তসব!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *