ধর্মে নারীর সম্মানের ধারণা আসলেই সম্মান নাকি বেনেভোলেন্ট সেক্সিজম?
বেনেভোলেন্ট সেক্সিজম এর কথা শুনেছেন কেউ?
সেক্সিজম বলতে সেক্স ও জেন্ডার সম্পর্কিত বৈষম্য ও পূর্বসংস্কার (prejudice) বোঝায়। সেক্সিজম কেবল বৈষম্য নয় যাকে সেক্সুয়াল ডিসক্রিমিনেশন বা লিঙ্গবৈষম্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই সেক্সিজম এর দ্বারা সেক্স ও জেন্ডার বিষয়ক বিভিন্ন প্রিজুডিসকেও বোঝানো হয় যা অনেক সময় আমাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে, এই বিষয়টিকে কেবল “লিঙ্গবৈষম্য” শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, তাই সেক্সিজম নামে একটি নতুন ধারণার দরকার হয়। এর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে “লিঙ্গবাদ” (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর দর্শন বিভাগের ডক্টর প্রদীপ রায় ও সংস্কৃত বিভাগের মালবিকা বিশ্বাস এর সম্পাদিত “পরিভাষা অভিধান: কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান” বইটি থেকে এই “লিঙ্গবাদ” শব্দটি পেয়েছি)।
(সম্প্রতি তসলিমা নাসরিন তার একটি লেখায় “সেক্সিজম” শব্দটির ব্যবহার করলে, কোন একটি সংবাদপত্রে শব্দটির অর্থ হিসেবে লেখা হয় “যৌনতা”। সেক্সিজম বা লিঙ্গবাদ সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা না থাকার ও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা চর্চা না হবারই ফল এটি। তাই এই বিষয়ে বেশি করে লেখালিখি ও বেশি বেশি চর্চা হওয়া দরকার।)
সেক্সিজম শব্দটির সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হই ১৯৬৫ সালে ফ্রেড শাপিরো এর দ্বারা। তিনি সেক্স ও জেন্ডার বিষয়ক প্রিজুডিস এর দিকে নজর দিয়েছিলেন। আর প্রিজুডিস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ১৯২০ সাল থেকে, তখন হোয়াইট সুপ্রিমেসি নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল একাডেমিক অঙ্গনে। যাই হোক, ১৯৫৪ সালে আলপোর্ট প্রিজুডিসকে “antipathy based upon a faulty and inflexible generalization” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। অর্থাৎ তিনি বলেন, ভুল ও অনমনীয় সরলীকরণ এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বিদ্বেষই প্রিজুডিস।
তবে বিষয়টা যখন সেক্সিজম তখন এই প্রিজুডিস এর অর্থ যেন একটা নতুন মাত্রা লাভ করে। এখানে সেক্স ও জেন্ডার সম্পর্কিত প্রিজুডিসগুলো সবসময় প্রত্যক্ষ এন্টিপ্যাথি বা বিদ্বেষ থেকেই আসে না। পিটার ফ্লিক ও সুজান ফ্লিস্কে তাদের গবেষণায় এরকম কিছু উদাহরণ দেন, যেমন তারা বলেন, যখন পুরুষ তার নারী কোওয়ার্কার বা অধস্তনকে তার কাজগুলো নিয়ে কোন মূল্যায়ন না করে তার চেহারা, সৌন্দর্য ইত্যাদির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে, তখন তা সেই নারীকে চাকরির ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা দান করতে পারে; আবার যখন কেউ বলেন “পুরুষের দায়িত্ব নারীর খেয়াল রাখা, নারীর দায়িত্ব নেয়া” তখন আপাতভাবে কোন নারী নিরাপত্তা বোধ করতে পারে। কিন্তু আসলে এইসব কথার ভেতরে গতানুগতিক স্টেরিওটাইপিং ও পুরুষ আধিপত্য নিহিত থাকে। গ্লিক ও ফিসকে বলেন, এগুলোকে পূর্বসংস্কার এর প্রমাণ সংজ্ঞায় ফেলা যায় না, কিন্তু এগুলোও লিঙ্গবাদ। গ্লিক ও ফিস্কে তাদের ১৯৯৬ সালের পেপারে লিঙ্গবাদের এই এম্বিভ্যালেন্স বা দ্বিমুখিতার বিষয়টি সামনে আনেন, আর এই দ্বিমুখিতার উপর ভিত্তি করে তারা লিঙ্গবাদকে দুইভাগে ভাগ করেন, হস্টাইল সেক্সিজম (প্রতিকূল লিঙ্গবাদ) ও বেনেভোলেন্ট সেক্সিজম (অনুকূল লিঙ্গবাদ)।
বেনেভোলেন্ট সেক্সিজম বা অনুকূল লিঙ্গবাদ শব্দযুথকে দেখে এটা মনে করার কারণ নেই যে শব্দটার দ্বারা লিঙ্গবাদের কিছু উপাদানকে নারীর জন্য উপকারী বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, ব্যাপারটা বরং উলটো। গ্লিক ও ফিস্কে নিজেরাই একে নেতিবাচক হিসেবে দেখতেন, আপাতভাবে উপকারী আচরণে যে লিঙ্গবাদ লুকিয়ে থাকে সেই বিষয়ে আলোকপাত করাই গ্লিক ও ফিস্কের উদ্দেশ্য ছিল।
গ্লিক ও ফিস্কের কাজ খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে এত কিছু নিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে লিখতে চাই, যাকে অনেক গবেষকই পরবর্তিকালে তাদের গবেষণায় ব্যবহার করেছিলেন। এটি হচ্ছে এম্বিভ্যালেন্ট সেক্সিজম ইনভেন্টরি। এই ইনভেন্টরিতে হস্টাইল সেক্সিজম বা প্রতিকূল লিঙ্গবাদের জন্য ১১টি ফ্যাক্টর লোডিং ও বেনেভলেন্ট সেক্সিজম বা অনুকূল লিঙ্গবাদের জন্য ১১টি ফ্যাক্টর লোডিং রয়েছে। এই ফ্যাক্টর লোডিংগুলোকে মানুষ কিভাবে গ্রহণ করছে তার উপর ভিত্তি করে তাদের মধ্যকার সেক্সিজম এর একটি স্কোর দাঁড় করানো হয়, যা হিসাব করে নির্ণয় করা যায় একটি স্যাম্পলের সেক্সিজমের মাত্রা। এই মোট ২২টা ফ্যাক্টর লোডিং এখানে লিখব কেননা এগুলো জানলে আপনারা প্রতিকূল ও অনুকূল লিঙ্গবাদকে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন।
সূচিপত্র
প্রতিকূল লিঙ্গবাদ (Hostile sexism) এর ১১টি ফ্যাক্টর লোডিং:
১। কর্মক্ষেত্রে নারীরা বিভিন্ন সমস্যাকে বাড়িয়ে বলে।
২। নারীরা খুব সহজেই বিক্ষুব্ধ (offended) হয়।
৩। বেশিরভাগ নারীই নিরপরাধ ও সহজ সরল মন্তব্যকে লিঙ্গবাদী বলে মনে করে।
৪। নারীরা ন্যায্যভাবে পরাজিত হলেও সেটাকে লিঙ্গবৈষম্য হিসেবে দাবি করে।
৫। সমতার ছদ্মবেশে নারীরা বিশেষ সুবিধা চায়।
৬। নারীবাদীরা যৌক্তিক দাবি করে। (রিভার্স স্কোরিং)
৭। নারীবাদীরা পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতা দাবি করে না। (রিভার্স স্কোরিং)
৮। নারীরা পুরুষের উপর কর্তৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে।
৯। কিছু নারী পুরুষকে যৌনতাসূচকভাবে উত্যক্ত করে (Sexually teasing)। (রিভার্স স্কোরিং)
১০। পুরুষ নারীর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেলে, নারী তাকে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে গেলে।
১১। পুরুষেরা নারীদের জন্য যা যা করে, নারীরা সেগুলোর মূল্যায়ন করতে পারে না।
এই ১১টি বিবৃতিই হচ্ছে প্রতিকূল লিঙ্গবাদ সম্পর্কিত ফ্যাক্টর লোডিং। ব্যক্তিকে এই সব বিবৃতির সাথে নিজের মনোভাব মিললে তাতে টিক চিহ্ন বা অনুরূপ কোন চিহ্নের দ্বারা তাকে চিহ্নিত করতে হয়। এরপর সেগুলো গণনার মাধ্যমে তার স্কোর ঠিক করা হয়, তাতে বোঝা যায় ব্যক্তি কতটা লিঙ্গবাদী। যেসব বিবৃতির পাশে বন্ধনিতে “রিভার্স স্কোরিং” কথাটা লেখা নেই, সেসব ক্ষেত্রে টিক চিহ্ন দিলে স্কোর বৃদ্ধি পায়, যেসব বিবৃতির পাশে “রিভার্স স্কোরিং” কথাটি লেখা আছে সেগুলোর পাশে টিক চিহ্ন দিলে স্কোরিং রিভার্স বা নেগেটিভ হয়ে যায়, তাতে সে কম লিঙ্গবাদী হয়।
অনুকূল লিঙ্গবাদ (Benevolent Sexism) এর ১১টি ফ্যাক্টর লোডিং:
অনুকূল লিঙ্গবাদকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ফ্যাক্টর লোডিংগুলোও এই তিনটি ভাগের বিভিন্ন ভাগে পড়ে যায়।
প্রোটেক্টিভ প্যাটারনালিজম (সুরক্ষামূলক পিতৃবাদ, মানে নারীকে পিতৃসুলভ সুরক্ষা দেয়ার জন্য যেসব অনুকূল লিঙ্গবাদ দেখা যায় এখানে সেগুলো পাওয়া যাবে):
১। একজন ভাল নারীকে সম্মানের বেদীতে (pedestal) বসানো উচিৎ।
২। পুরুষের উচিৎ নারীকে খেয়াল রাখা ও তাকে রক্ষা করা।
৩। নারীর জন্য পুরুষের ত্যাগ স্বীকার করা উচিৎ।
৪। দুর্যোগের সময় নারীকে সবার আগে উদ্ধার করা প্রয়োজনীয় নয়। (রিভার্স স্কোরিং)
কমপ্লিমেন্টারি জেন্ডার ডিফারেনসিয়েশন (প্রশংসাসূচক লৈঙ্গিক পৃথকীকরণ, এসব বিবৃতিতে নারীকে প্রশংসা করে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করা হয়):
৫। নারীর নৈতিক সংবেদনশীলতা বা নৈতিক দায়িত্ববোধ উন্নতমানের।
৬। নারীর মধ্যে যে পবিত্রতার গুণ থাকে তা খুব কম পুরুষের মধ্যেই দেখা যায়।
৭। সংস্কৃতি ও রুচির ক্ষেত্রে নারীর অনুভূতি অধিক পরিশীলিত।
হেটেরোসেক্সুয়াল ইন্টিমেসি (বিষমকামী ঘনিষ্ঠতা, এই অনুকূল লিঙ্গবাদ পুরুষ ও নারীর মধ্যকার প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক ভিত্তিক):
৮। প্রতিটি পুরুষেরই ভালোবাসার জন্য কোন নারীকে দরকার।
৯। পুরুষেরা নারী ছাড়া সম্পূর্ণ। (রিভার্স স্কোরিং)
১০। অভীষ্টলাভ করার পরও বা প্রতিষ্ঠিত হবার পরও পুরুষেরা নারী ছাড়া অসম্পূর্ণ।
১১। বিষমকামী প্রেম ছাড়া মানুষ প্রায়ই সুখী হয়। (রিভার্স স্কোরিং)
রিভার্স স্কোরিং বলতে কী বোঝায় তা আগেই বলেছি। অনেক মানুষের মনেই এই অনুকূল লিঙ্গবাদ প্রোথিত থাকে। তারা মনে করে, এভাবেই নারীকে সম্মান করা হয়। অনেক নারী মোহিত হয়, পুরুষের থেকে এরকম “সম্মান” দাবি করে, আবার অনেক পুরুষও মনে করে এভাবে সে নারীকে রক্ষা করছে ও তাতে নারী আনন্দিত হচ্ছে। খেয়াল করে দেখবেন, বিভিন্ন ধর্ম যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তাদের ধর্মকে নারী বান্ধব ও নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয় বলে দাবি করে, সেগুলো মূলত এরকম অনুকূল লিঙ্গবাদ। উদাহরণ হিসেবে, দেনমোহর, পর্দা, পবিত্রতা, মাতৃত্ব প্রভৃতির কথা বলে নারীর উপর মহত্ব আরোপ করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যারা বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থের বাণীসমূহ নিয়ে ভাল জানেন ও সেসব নিয়ে লেখালিখি করেন তারা ধর্মের এরকম অনুকূল লিঙ্গবাদী ধারণাগুলো নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করতে পারেন। (সেরকম কোন তালিকা সম্বলিত প্রবন্ধ দেয়া হলে তার লিংক এই নিবন্ধের সাথে করে দেব।)
অনুকূল লিঙ্গবাদের উৎস্য সন্ধানে
অনুকূল লিঙ্গবাদের উৎস্য এর ব্যাপারে সামান্য কিছু কথা বলে শেষ করছি। গ্লিক ও ফিস্কে এই অনুকূল লিঙ্গবাদ এর উৎস্যেরও সন্ধান করেছেন। এই উৎস্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন গুটেনবার্গ ও সেকর্ড এর ১৯৮৩ সালের একটি গবেষণার। গুটেনবার্গ ও সেকর্ড বলেছিলেন, নারী তার প্রজননের জন্য একরকম “ডায়াডিক ক্ষমতা” (dyadic power) লাভ করে। ডায়াডিক পাওয়ার বা ক্ষমতা হচ্ছে সেই ক্ষমতা যা দুজন মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ফলে একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে পুরুষেরা সন্তানদের লালন-পালন ও তাদের যৌন সন্তুষ্টির জন্য নারীর উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। এছাড়াও কিছু গবেষণা বলে, পুরুষেরা নারীর দ্বারা মনস্তাত্ত্বিক ঘনিষ্ঠতার চাহিদার পূরণ করার চেষ্টা করে। পুরুষ তার এইসব চাহিদা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কোন পুরুষের দ্বারা মেটাতে পারত না, কেননা সকল পুরুষই এসবের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হত। কাজেই এসবের জন্য পুরুষকে নির্ভর করতে হয়েছে নারীর উপরেই। গুটেনবার্গ ও সেকর্ড বলেছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর এই ডায়াডিক ক্ষমতা একটি সামাজিক মতবাদে (social ideology) পরিণত হয়, যার কারণে পুরুষেরা তাদের এই প্রয়োজনগুলোর জন্য নারীদেরকে আকৃষ্ট করতে এরকম অনুকূল লিঙ্গবাদী ধারণার পোষণ করা শুরু করে। পিতৃতন্ত্র একেই সমর্থন দেয়। আর এভাবে পুরুষের ভেতরে এরকম সরলীকরণ মনোভাব বা লিঙ্গ বিষয়ক পূর্বসংস্কার বা অনুকূল লিঙ্গবাদী আচরণ প্রবেশ করে।
গুটেনবার্গ ও সেকর্ড যে পিতৃতন্ত্রের (patriarchy) এর কথা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো সেই পিতৃতন্ত্রেরই সৃষ্টি বলে দাবি করা হয়। অনুকূল লিঙ্গবাদ সম্পর্কিত সামাজিক মতবাদই পরবর্তীতে বিভিন্ন ধর্মে স্থান লাভ করে, যা পরবর্তী শতকগুলোতে নারী ও পুরুষ সম্পর্কিত স্টিরিওটাইপ ও পূর্বসংস্কার এর ধারণাগুলোকে বজায় রাখার চেষ্টা করে এসেছে।
গবেষণার সূত্র: The Ambivalent Sexism Inventory: Differentiating Hostile and Benevolent Sexism