যেভাবে জীবনের শুরু: সব পথ এসে মিলে গেল শেষে (শেষ পর্ব)
- প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব (একসাথে): যেভাবে জীবনের শুরুঃ পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি
- তৃতীয় পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরুঃ প্রথম স্বয়ম্ভূর খোঁজে
- চতুর্থ পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরু: প্রোটনের শক্তি
- পঞ্চম পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরু: কোষের জন্ম
- মূল প্রবন্ধ:The secret of how life on earth began
বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে প্রাণের উৎস সন্ধানী বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন তত্ত্বে ভাগ হয়ে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বিজ্ঞানীদল তাদের নিজস্ব চিন্তার স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন কিন্তু বেশিরভাগ যুক্তিই ছিল আকাশকুসুম অনুমানের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ কাজে দিয়েছিল এবং আগের অধ্যায়গুলোর পাঠ প্রমাণ করে সফলতাও এসেছিল কিছু কিন্তু প্রাণ বিকাশের প্রতিটি সম্ভাবনাময় ধারণা বা অনুমান শেষ পর্যন্ত আর একটি বড় প্রশ্ন এবং সীমাবদ্ধতার জন্ম দেয়। একারণেই এবার কিছু গবেষক একত্র হয়ে যৌথভাবে প্রাণ বিকাশের এতদিনের অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলেন।
প্রাণ বিকাশের উৎস সন্ধানে একত্রিত কাজ করার প্রয়াস কয়েক বছর আগে বেগবান হয়। একত্রে কাজ করার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীগণ ইতিপূর্বের বহুল চর্চিত “আরএনএ প্রথম নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করেছিল” মতবাদের উপর কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীগণ আবার একটি বড় ধরণের সমস্যার মুখে পড়ে গেলেন। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে ঠিক কীভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা তাদের মতবাদের স্বপক্ষে প্রাণের মৌলিক উপাদান আরএনএ’র নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন। এই আলোচনার তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা যেটা পড়েছি সেখানে দেখতে পাই, পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ মোটেও আরএনএ থেকে সৃষ্টি হয় নি।
ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক জন ডেভিড সুদারল্যান্ড ১৯৮০ সাল থেকে আরএনএ থেকে প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল কিনা এই সমস্যা অথবা সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জন ডেভিড সুদারল্যান্ড বলেন, “আমি মনে করি, আপনি যদি প্রমাণ করে দেখাতে পারেন, আরএনএ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করতে সক্ষম তাহলে সেটা হবে অসাধারণ এক কাজ।” কিছুদিন পরেই সুদারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে গবেষণার চাকরি পান। বেশিরভাগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানই গবেষকদলকে নতুন উদ্ভাবনে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখে কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে‘মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি’ কখনো কাজের জন্য চাপ দেয় না। সুতরাং সুদারল্যান্ড কৃত্রিমভাবে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করা এত দুরূহ কেন সেটা নিয়েই গবেষণা শুরু করলেন এবং বছরের পর বছর পার করে দিলেন কীভাবে বিকল্প উপায়ে আরএনএ সৃষ্টি করা যায়। তার গবেষণার ফলাফল বিদ্যুৎ গতিতে প্রাণ সৃষ্টির নতুন ধারণা সৃষ্টি করে এবং তিনি মন্তব্য করলেন, প্রাণের সমস্ত মৌলিক উপাদান একদা পৃথিবীর প্রথমদিকে একসাথে তৈরি হয়েছিল।
জন সুদারল্যান্ড বলেন, “আরএনএ’র কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ঠিকঠাক কাজ করে না। প্রতিটি আরএনএ নিউক্লিওটাইডের মূলাধারের উপাদান শর্করা এবং ফসফেটে তৈরি। কিন্তু গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, আরএনএ’র মূল উপাদানের সাথে শর্করাকে মেলানো সম্ভব নয়, কারণ মলিকিউলের বেমানান আকার শর্করাকে মিশতে বাধা দেয়।” সুদারল্যান্ড আরও মনে করেছিলেন, প্রাণ সৃষ্টিতে আরএনএ খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও আরএনএ একমাত্র এবং শেষ উপাদান নয়।
সুতরাং সুদারল্যান্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন উপাদান দিয়ে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করার জন্য গবেষণা শুরু করলেন। যথারীতি তার গবেষকদল ভিন্ন ধরণের শর্করা এবং সায়ানাইডের যৌগ সিনামাইডসহ পাঁচটি সাধারণ মলিকিউল দিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। গবেষক দলটি উপাদানগুলোকে কয়েক ধাপের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করলেন ফলশ্রুতিতে দুইটা মলিকিউল থেকে চারটা আরএনএ নিউক্লিওটাইড উৎপন্ন হল। এখানে উল্লেখ্য এই গবেষণায় শর্করা উৎপাদিত হল না। এই গবেষণা প্রাণের বিকাশ অনুসন্ধানে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিলো এবং জন ডেভিড সুদারল্যান্ড সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
অনেক পর্যবেক্ষক সুদারল্যান্ডের গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে আরএনএ ঘরানার বিতর্কের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দিলো। কিন্তু সুদারল্যান্ড নিজে পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যার সাথে একমত ছিলেন না। আরএনএ ঘরানার ঐতিহাসিক বিতর্ক এবং অনুমান বলছে, প্রথম অণুজীবের অভ্যন্তরে প্রাণের স্পন্দনের সব কাজ সম্পাদনা করে আরএনএ। কিন্তু সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার গবেষক, পর্যবেক্ষকদের সেই ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, তাদের মতামত ”হতাশাজনক উচ্চাকাঙ্ক্ষা” সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার বিতর্ক পরিহার করে ইতিমধ্যে পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচিত জ্যাক সোসটাকের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে “আরএনএ প্রথম নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে” এবং ইটালির বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজি প্রস্তাবিত “প্রাণ প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল ধাপে ধাপে” এই দুই তত্ত্বের মধ্যে সমন্বয় এবং একত্রিত করে গবেষণা শুরু করলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড প্রাণ বিকাশের ব্যাখ্যা শুরু করলেন আরও আগে থেকে এবং তিনি প্রকাশ করলেন, “প্রাণের সবকিছুই একবারে প্রাথমিকভাবে সৃষ্টি হয়েছিল।” তিনি চেষ্টা করলেন পারস্পরিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন উপাদান থেকে একবারে স্বয়ং সম্পূর্ণ কোষ সৃষ্টি করতে। তার প্রথম সূত্র নিউক্লিওটাইডের সংশ্লেষণ ছিল কিছুটা বেমানান কিন্তু যেটাকে শুরুতে মনে হয়েছিল আনুষঙ্গিক।
সুদারল্যান্ডের কর্মপ্রক্রিয়ার শেষ ধাপে সুদারল্যান্ড নিউক্লিওটাইডে ফসফেট যুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি গবেষণায় যা পেলেন তা হল বিক্রিয়ার শুরুতেই ফসফেট মিশিয়ে দিলে সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল পেতে পারতেন কারণ এতে নিউক্লিওটাইডের প্রাথমিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিক্রিয়ার জন্য ফসফেট অত্যাবশ্যকীয় হলেও কাজটি ছিল খুব ঝামেলাপূর্ণ কিন্তু সুদারল্যান্ড বিক্রিয়াকালীন সমস্যার মাঝেই দেখতে পেলেন দারুণ সম্ভাবনা। বিক্রিয়াতে ফসফেটের মিশ্রণ যথেষ্ট জটিল এবং মনে করা হচ্ছিল প্রাণ সৃষ্টির সব উপাদান একই সময়ে উৎপাদিত হয়েছিল। এই চিন্তা থেকেই সুদারল্যান্ড ভাবতে শুরু করলেন ফসফেটের মিশ্রণটি ঠিক কতটা জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে। পৃথিবীর শৈশবকালে পৃথিবীতে অবশ্যই শত শত রকমের রাসায়নিক উপাদানের একত্রে উপস্থিতি ছিল এবং এদের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল তরল গাদ বা কাদামাটির মত বস্তু এবং সেগুলো যথাসম্ভব পরস্পর বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। ১৯৫০ সালে স্ট্যানলি মিলার ঠিক একই ধরণের কাদার মিশ্রণ বানিয়েছিলেন যা আমরা ইতিপূর্বে প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হতে দেখেছি। স্ট্যানলি মিলারের কাদার মিশ্রণ ছিল সুদারল্যান্ডের মিশ্রণ থেকেও ঘন। কাদার মধ্যে ছিল অণুজৈবিক মলিকিউল কিন্তু সুদারল্যান্ড বলেন, “কাদার মিশ্রণের মধ্যে প্রচুর অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মিশে ছিল যাদের বেশিরভাগই অজৈবিক।”
সুদারল্যান্ডের নতুন গবেষণার অর্থ দাঁড়ায় মিলারের গবেষণা পদ্ধতি যথেষ্ট ফলপ্রসূ ছিল না। বরং মিলারের গবেষণার প্রক্রিয়া ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ফলে উপকারী রাসায়নিক উপাদানগুলো মিশ্রণের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং সুদারল্যান্ড পৃথিবীর আদি অবস্থায় কী কী রাসায়নিক উপাদান “গোল্ডিলকস কেমিস্ট্রি” খোঁজার জন্য অনুসন্ধান করেন এবং তিনি দেখতে পেলেন যেসব উপাদান বিশৃঙ্খলা ঘটায় না তারা বিক্রিয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয়, তদুপরি তারা এত সাধারণ এবং সংখ্যায় এত কম যে বিক্রিয়াতে প্রভাব বিস্তার করার মতও নয়। সুতরাং সেইসব রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণ যথেষ্ট জটিল বলেই তাদের দ্বারা হয়ত একদা প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল এবং পরে তারা একত্রিত হয়েছিল। অন্যভাবে বলা যেতে পারে চার বিলিয়ন বছর আগেকার আমাদের পৃথিবীটা ছিল উত্তপ্ত পুকুরের মত এবং সেই শৈশবের পৃথিবী সেভাবেই পতিত অবস্থায় ছিল বছরের পর বছর রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রাণের বিকাশের জন্য উপযোগী হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর একসময়ে ধীরে ধীরে প্রথম প্রাণের স্পন্দন দেখা দিতে শুরু করে।
মনে হতে পারে এ-তো অসম্ভব, যেমন-ভাবে মধ্য যুগের রসায়নবিদেরা বলতেন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির অলীক গল্প। তবে সুদারল্যান্ডের তথ্য প্রমাণ কিন্তু ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি দেখাচ্ছেন, একই রাসায়নিক উপাদান যা তার গবেষণার জন্য দুইটা আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করেছিল তারাই অণুজীব প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে সমান ভূমিকা রাখতে পারে।
তাহলে অবশ্যই পরের পদক্ষেপ হবে আরও বেশি আরএনএ নিউক্লিওটাইড উৎপাদন করা। যদিও তিনি অধিক পরিমাণে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে পারলেন না কিন্তু তিনি ২০১০ সালের প্রায় একই ধরণের অণুজীব সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এবং তাদের থেকে সম্ভাব্য নিউক্লিওটাইড উৎপাদন করতে সক্ষম হন। একইভাবে ২০১৩ সালে সুদারল্যান্ড অ্যামিনো এসিডের মূল উপাদান সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এ-পর্যায়ে তিনি গবেষণায় বিক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে আগের রাসায়নিক উপাদানের সাথে কপার সায়ানাইড যুক্ত করে দেন।
সায়ানাইডের সাথে সম্পৃক্ত রাসায়নিক উপাদানে প্রাণের কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রমাণ উঁকি দিয়ে যায় এবং ২০১৫ সালে সুদারল্যান্ড সায়ানাইডযুক্ত রাসায়নিক উপাদান নিয়ে পুনরায় গবেষণা করতে মনোনিবেশ করেন। গবেষণায় তিনি দেখালেন একই রাসায়নিক মিশ্রণও প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিপিড সৃষ্টির পূর্ব শর্ত যা মলিকিউল কোষের দেয়াল তৈরি করে। সুদারল্যান্ডের সব গবেষণার রাসায়নিক বিক্রিয়া অতিবেগুনি আলোর প্রতিফলনে সম্পন্ন করা হয় এবং বিক্রিয়াতে ব্যবহার করা হয় গন্ধক এবং বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ব্যবহৃত হয় তামা।
জ্যাক উইলিয়াম সোসটাক বলেন, “প্রাণ বিকাশের প্রতিটি উপাদান মূলত বিশেষ কিছু অনন্য কিন্তু সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলাফল।” গবেষণার প্রক্রিয়া খুব পরিষ্কার। যদি সুদারল্যান্ডের গবেষণা সঠিক হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে গত চল্লিশ বছর ধরে প্রাণের উৎস সন্ধানে যে গবেষণা চলমান সেটা ভুলভাবে চলছিল। এতদিনের জিজ্ঞাস্য কোষের জটিলতার কিছুটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আদি কোষ কীভাবে ধীরে ধীরে গঠিত হয়েছিল পূর্বোক্ত ধারনার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীগণ গবেষণা করতে লাগলেন। সুদারল্যান্ড আরও বললেন, “ আরএনএ প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল লেসলি ওরগেল’র এমন প্রস্তাবনার পরে গবেষকগণ প্রাণের বিকাশের একেকটি অধ্যায় উন্মোচন করার চেষ্টা করছিলেন এবং পরের স্তর আবিষ্কারের পিছনে ছুটছিলেন অদম্য কৌতূহলে।” কিন্তু সুদারল্যান্ড মনে করলেন, প্রাণের উৎস অনুসন্ধানের সবচেয়ে ভাল উপায় হল খুঁজে দেখা প্রাণের সব উপাদান একইসাথে সৃষ্টি হয়েছিল কী না সেটা আগে দেখা। প্রাণ সৃষ্টির সব মৌলিক উপাদানই একবারেই সৃষ্টি করা সম্ভব বলে সুদারল্যান্ড মনে করেন। আমাদেরকে যেটা করতে হবে সেটা হল একই সাথে প্রাণের সব উপাদান সৃষ্টি হয়েছিল এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা।
সোসটাক সন্দেহ করছিলেন, প্রাণ সৃষ্টির অন্যতম মূল উপাদান মলিকিউল সৃষ্টি এবং উপাদানগুলোকে একত্রিত করে জীবন্ত কোষে পরিণত করার দুইটা গবেষণাকর্ম একই কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় গবেষণায় সেটা খুব পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। সোসটাক বলেন, প্রথম বড় অণুজীবের সাথে আরএনএ’র ভীষণ সাদৃশ্য আছে বলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। বিজ্ঞানীগণ প্রথম দিকে তাদের পছন্দের খুব সামান্য কিছু রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা করতেন এবং পৃথিবীর প্রথমদিকে বিদ্যমান অন্যান্য সব রাসায়নিক উপাদানকে গবেষণার বাইরে রেখেছিলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ডের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে প্রাণের উৎস সন্ধানের রাসায়নিক বিক্রিয়াতে কিছু নতুন বা অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান যোগ করলে বিক্রিয়ার ফলাফলে আরও বৈচিত্রতা এবং বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করা সম্ভব। ২০০৫ সালে আদি কোষ সৃষ্টির প্রয়াসে আরএনএ এনজাইমের উপস্থিতিতে সোসটাক নিজেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় অতিরিক্ত কিছু রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করে গবেষণা করেন। আদি কোষের চারিদিকের পাতলা ঝিল্লির মত আবরণ ভেদ করতে এনজাইমের ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন ছিল।
অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। নির্ভেজাল ফ্যাটি এসিড থেকে ভেসিকল সৃষ্টির পরিবর্তে বিজ্ঞানীগণ রাসায়নিক যৌগের দুটি মিশ্রণ থেকে ভেসিকল সৃষ্টি করলেন। এই নতুন জটিল যৌগের ভেসিকল ম্যাগনেসিয়ামের সাথে টিকে থাকতে পারে এবং তার মানে হল আরএনএ এনজাইমের উপস্থিতিতে তারা স্বচ্ছন্দে বিরাজ করতে পারে। সোসটাক আরও বলেন, প্রথম জিন সম্ভবত এই সময়ে জটিল হতে শুরু করে।
আধুনিক অণুজীব তাদের জিনে নির্ভেজাল ডিএনএ বহন করলেও প্রথমদিকে সম্ভবত নির্ভেজাল ডিএনএ’র অস্তিত্ব ছিল না। তারা সম্ভবত আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণ ছিল। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি প্রথমদিকে নির্ভেজাল ডিএনএ বা আরএনএ সৃষ্টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ২০১২ সালে সোসটাক দেখালেন, আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণ ‘মোজাইকের’ মত দেখতে মলিকিউল একত্রিত করতে সক্ষম এবং তাদের ব্যবহার আচার আচরণ প্রায় আরএন’র মতই। এই আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণের শিকল জালের মত ভাজে ভাজে বিস্তৃত। কিন্তু একটা সমস্যার নিদান সুদারল্যান্ড বা সোসটাক কেউই দিতে পারেন নি এবং সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রথম অণুজীবের অবশ্যই যেকোনো ধরণের বিপাক ক্রিয়ার ব্যবস্থা ছিল। যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন জীবনকে অবশ্যই শক্তি আহরণ এবং গ্রহণ করতে হয় তা না হলে কোষের বেঁচে থাকার কোন আশা নাই।
পরীক্ষাগারে উৎপাদিত আরএনএ’র সামনে বিকল্প আরও পথ খোলা ছিল ঠিক যেমনটা টিএনএ বা পিএনএ’র ক্ষেত্রে ঘটেছিল (তৃতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়ে আমরা আগেই জেনেছি)। আমরা জানি না আরএন, ডিএনএ, টিএনএ বা পিএনএ পৃথিবীতে আদৌ বিদ্যমান ছিল কিনা কিন্তু যদি তাদের উপস্থিতি থাকত তবে প্রথম অণুজীবও আরএনএ ছাড়াও অন্য কোন আমিষ ব্যবহার করত। কিন্তু বাস্তবে এটা কোন আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞান বিশ্ব নয় এই বিজ্ঞানের ক্রমাগত তর্ক, গবেষণা, পরীক্ষা হল বিতর্কের ‘জগাখিচুড়ি’।
এই কয়েক অধ্যায়ের আলোচিত প্রাণের উৎস সন্ধানে পাঠ করে আমরা এই শিক্ষা লাভ করতে পারি যে প্রাণের প্রথম কোষ সৃষ্টিকে প্রথমদিকে যত জটিল কঠিন মনে হয়েছিল বাস্তবে ততটা নয়। কারণ, বিজ্ঞানীগণ এখন জেনে গেছেন, কোষ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারার এক অদ্ভুত দক্ষ স্বয়ংক্রিয় কারখানা। কিন্তু এখন এটা প্রমাণিত হয়েছে যে কোষ এখনও নিয়মিত তাদের প্রতিলিপি সৃষ্টি করছে। যদিও পূর্বের প্রক্রিয়ার মধ্যে এখন বিস্তর ফারাক রয়েছে। কোষের কাছে যাকিছু আছে তাই নিয়েই তারা ক্রমাগত দ্রুত ঘুরছে আর নিজেদের প্রতিলিপি বানিয়ে যাচ্ছে।
কিছু কোষ ছিল যারা অলস এবং কদাকার, তারা প্রথমদিকের পৃথিবীতে টিকে থাকা যুদ্ধে টিকে থাকতে পারে নাই। হয়ত সেই কারণেই সেই কোষগুলোর মাঝে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, বহিঃশত্রুর আক্রমণের কোন ভয় ছিল না। সুতরাং বিভিন্ন দিক বিবেচনায় আনলে মনে হয় বর্তমানের তুলনায় আদিকালের জীবন অনেক সহজ সরল ছিল। সেই সূত্র ধরেই যদি আর কিছু বিবেচনা না করি তাহলে দেখবো, এই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচিত মাইক রাসেল, বিল মার্টিন এবং অন্যান্য কিছু বিজ্ঞানীগণের ‘বিপাক ক্রিয়া’ প্রথম এই তত্ত্বের সাথে সুদারল্যান্ড একাত্বতা ঘোষণা করছেন। সুদারল্যান্ড বলেন, “আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীগণ যখন‘বিপাক ক্রিয়া’ প্রথমে উদ্ভূত হয়েছে এমন ধারণা পোষণকারী বিজ্ঞানীদের সাথে বিজ্ঞানের তর্কযুদ্ধ থাকলেও তাদের দুপক্ষেরই পর্যাপ্ত কারণ, যুক্তি আছে।”
সোশটাক বলেন, “আদি-কোষের অবশ্যই যেকোনো প্রকারেই হোক না কেন বিপাক ক্রিয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাসায়নিক বিক্রিয়ার শক্তির উৎস কোথায় সেটাই হতে যাচ্ছে বিজ্ঞান-সভার পরবর্তী সবচেয়ে বড় প্রশ্ন”। এমনকি যদি মার্টিন এবং রাসেলের তত্ত্ব প্রাণের সূচনা হয়েছিল সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ হওয়া লাভা মিশ্রিত খনিজ পানিতে এমন তত্ত্ব ভুল হয় তবুও প্রাণ বিকাশের প্রাথমিক উপাদানগুলো অবশ্যই সেই পরিবেশেই ছিল এবিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই কারণ প্রাণের বিকাশের অন্যতম উপাদান ধাতু এবং খনিজ।
প্রাকৃতিকভাবেই অনেক এনজাইমের কেন্দ্রে ধাতুর মৌল পাওয়া যায়। অনেক সময় ধাতব অংশটাই এনজাইমের সবথেকে সচল এবং কর্মক্ষম অংশ আর মলিকিউলের বাদবাকি কাঠামো কোষের সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত। প্রথমদিকের প্রাণের এত জটিল এবং উন্নত এনজাইম ছিল না বরং প্রথম প্রাণে সম্ভবত আবরণবিহীন ধাতু প্রভাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু অপরদিকে জার্মান বিজ্ঞানী গুনটার ভাসটারশাওজার দাবি করেন সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা থেকে প্রাণের উৎপত্তি হতে পারে না বরং তিনি সুপারিশ করেন প্রাণের সূচনা হয়েছিল লোহার আকরিকের উপর। একইভাবে রাসেল জোর দাবি তোলেন যেহেতু সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ হওয়া লাভা মিশ্রিত গরম পানিতে প্রচুর পরিমাণ ধাতব খনিজ ছিল এবং সেগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করত সুতরাং সেখানেই প্রাণের বিকাশ সম্ভব। এদিকে মার্টিন তার গবেষণায় দেখান পৃথিবীতে প্রাপ্ত সব প্রাণীর সাধারণ আদি-কোষ পাওয়া গেছে লোহার এনজাইমের উপর এবং তাদের পরিমাণও বিশাল। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সুদারল্যান্ডের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো তামা এবং ক্ষেত্র বিশেষে গন্ধকের উপর নির্ভর করতে হয়। ভাসটারশাওয়ার নিজেও বিক্রিয়াতে গন্ধকের নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং সোসটাকের আদি-কোষের আরএনএ’র জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন হয়।
তবুও সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ হওয়া লাভা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। সোসটাক বলেন,“কেউ যদি আধুনিক কোষের বিপাক ক্রিয়ার দিকে তাকায় তাহলে কোষে লোহা এবং গন্ধকের মিশ্রিত উপস্থিতি লক্ষ্য করতে পারবে। প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার আশেপাশে এই তত্ত্বীয় ধারণার সাথে সোসটাকের দাবি অনেকাংশেই মিলে যায় কারণ সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরি অঞ্চলের উত্তপ্ত পানিতে প্রচুর পরিমাণে লোহা এবং গন্ধকের খনিজ পাওয়া যায়। যদি সুদারল্যান্ড এবং সোসটাকের তত্ত্বীয় ধারণা সঠিকও হয় তবুও সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে প্রবাহিত উত্তপ্ত পানিতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে এমন ধারণা ভুল, কারণ হিসেবে বিরোধী পক্ষের বিজ্ঞানীগণ বলছেন, “গভীর সমুদ্রে কখনো প্রাণের বিকাশ সম্ভব নয়।”
সুদারল্যান্ড বলেন, “আমরা যে রাসায়নিক বিক্রিয়ার রহস্য উন্মোচন করলাম সেটা অতিবেগুনী রশ্মির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। সূর্যই হল অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণের একমাত্র উৎস। সুতরাং পৃথিবীর প্রথমদিকে প্রাণ বিকাশের উপযোগী রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে হবে সূর্যালোকিত খোলা জায়গায়। এভাবেই আরেক দল বিজ্ঞানী সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার আশেপাশে প্রাণের বিকাশ হয়েছিল ধারণাকে নাকচ করে দেন।
সোসটাক স্বীকার করেন নেন, গভীর সমুদ্রে প্রাণের বিকাশ হয় নি। সবচেয়ে অসম্ভবের বিষয় হল সমুদ্রের তলদেশ প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত রাসায়নিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে যেখান থেকে সায়ানাইডের মত প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান যাত্রা শুরু করতে পারে। কিন্তু এই সমস্যার কারণে সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা থেকে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এমন তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। হতে পারে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলো ছিল সমুদ্রের অগভীর পানিতে যেখানে সহজেই সূর্যালোক এবং সায়ানাইড সহজেই প্রবেশ করতে পারে। আরমেন মালকিদজানিয়ান প্রাণ বিকাশের বিকল্প আর একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, সম্ভবত সমতল ভূমিতে বা আগ্নেয়গিরির লাভার কোন অগভীর পুকুরে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।
আরমেন মালকিদজানিয়ান গভীরভাবে কোষের রাসায়নিক গঠন পর্যবেক্ষণ করলেন বিশেষত কোন ধরণের রাসায়নিক উপাদান কোষ নিজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয় আর কোনগুলোকে বাইরে রাখে। তিনি বুঝতে পারলেন, সব ধরণের জৈব কোষ প্রচুর পরিমাণে ফসফেট, পটাশিয়াম এবং আরও কিছু ধাতব খনিজ উপাদান ধারণ করে কিন্তু সেখানে সোডিয়ামের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। এই মুহূর্তে আমার দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে একটা অগভীর হৃদ বা পুকুর যাকে ঘিরে প্রাণের সে কী বাঁধ ভাঙা স্পন্দন!
আধুনিক কালে কোষ অনেক উন্নত হয়েছে, তারা কোষের অভ্যন্তর এবং বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে কিন্তু প্রাথমিক কোষের এই সুবিধা ছিল না কারণ সেই আদি কোষের এমন আবশ্যকীয় কৌশল ছিল না। সুতরাং মানকিদজানিয়ান দাবী করেন আদি কোষ এমন কোন স্থানে বিকশিত হয়েছিল যেখানে আধুনিক কোষ গঠনের মতই রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণের উপস্থিতি ছিল। সুতরাং এখানেই গভীর সমুদ্রে প্রাণের যাত্রা শুরু ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে কারণ, প্রতিটি কোষ অতি উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম এবং ফসফেট বহন করে এবং খুব অল্প পরিমাণ সোডিয়াম কিন্তু সমুদ্রের পানিতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি।
বিজ্ঞানীগণ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা থেকে প্রাণের বিকাশ হয়েছে তত্ত্বের বদলে ভূ-পৃষ্ঠের অগভীর গরম জলাশয়ে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে কারণ এই জলাশয়েই পাওয়া যায় আধুনিক অত্যাবশ্যকীয় ধাতব উপাদানের সমস্ত মিশ্রণ ঠিক যেমনটা প্রাণ বিকাশের জন্য দরকার।
সোসটাক মজা করে বলেন, “এই মুহূর্তে আমার মনে হয় আমার প্রিয় দৃশ্য হতে পারে একটা সমতলে অগভীর বিস্তৃত হ্রদ বা জলাশয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। সেখানে হয়ত গরম তরল প্রবাহ আছে কিন্তু সেগুলো গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরি নয়, বরং অগভীর জলাশয়ের আগ্নেয়গিরি আমেরিকার মনটানা এবং আইডাহো প্রদেশের ইয়েলোস্টোন পার্কের মত।”
পৃথিবীর জন্মের পরে প্রথম পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে শুধু উল্কার আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছিল। সুদারল্যান্ড প্রস্তাবিত প্রাণ সৃষ্টির রসায়ন সম্ভবত এরকম পরিবেশেই উপযুক্ত এবং কার্যকরী ছিল। বসন্তকালেই প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের মেলবন্ধন ঘটে, কারণ তখন পানির স্তর কমে যায় এবং কিছু স্থান শুকিয়ে যায় সময়ের হাত ধরে এবং সেখানে প্রচুর পরিমাণে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি পড়ে। সর্বোপরি সোসটাক বলেন, “অগভীর বিস্তৃত হ্রদ বা জলাশয়ই হতে পারে আদি কোষের আঁতুড় ঘর। হতে পারে আদি কোষ বেশিরভাগ সময় অপেক্ষাকৃত শীতল ছিল আর এই পরিবেশ আরএনএ প্রতিলিপি সৃষ্টি এবং অন্যান্য সরল বিপাক ক্রিয়ার জন্য অতীব প্রয়োজন। কিন্তু যখন তখন আদি কোষ উত্তপ্ত হয়ে যেত এবং উত্তাপের ফলে আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতার মত প্রান্তগুলো আলাদা হয়ে যেত এবং পরের ধাপে কোষ নিজেই নিজের বিভাজিত প্রতিলিপি সৃষ্টি করত। সেই অগভীর বিস্তীর্ণ জলাশয়ে উষ্ণ পানির স্রোত ছিল যা ফলে আদি কোষের বিভাজনে সাহায্য করত। একই বিষয়ের বিভিন্ন আলোচনার পরে সুদারল্যান্ড আমাদের মনোযোগকে প্রাণ সৃষ্টির তৃতীয় একটি সম্ভাবনার দিকে ধাবিত করে দিলেন। তিনি বললেন, “উল্কা পতনের স্থানগুলোতেও প্রাণের বিকাশ হতে পারে।”
আগেই আলোচনা করা হয়েছে পৃথিবীর জন্মের প্রথম পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে শুধু উল্কাপাত ঘটেছিল এবং আমরা এখনো মাঝে মাঝে উল্কা পতন দেখতে পাই। বড়সড় প্রমাণ সাইজের উল্কার আঘাতে সমতলে সৃষ্টি হতো বিশালাকার গর্ত, গর্তে পানি জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় সেখানেই দেখা দেয় মানকিদজানিয়ানের প্রস্তাবিত প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। প্রথমত উল্কাপিণ্ডগুলো ধাতব খনিজ উপাদানে ভরপুর। সুতরাং উল্কাপাতে আঘাতের স্থানে সৃষ্ট গর্তে বিপুল পরিমাণ লোহা এবং গন্ধকের খনিজের উপস্থিতি থাকার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উল্কার আঘাতে এবং অতি উচ্চ তাপে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ গলে গিয়েছিল ফলে ভূপৃষ্ঠ ছিল গরম আর পানি উত্তপ্ত। যদি কোন একটা তত্ত্বকে বাদ দেয়া হয় তাহলে তত্ত্বের সাথে বাদ পড়ে যায় অতি প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান অথবা কোন তত্ত্বের মধ্যে যদি আদি কোষ করার মত কোন উপাদান থাকে তবে তাকেও অপসারণ করা হয়।
সুদারল্যান্ড অনুমান করেন ছোট নদী, স্রোতস্বিনী পানির প্রবাহ উল্কার আঘাতে ধ্বসে যাওয়া ঢালু থেকে নামতে থাকে, পাথর থেকে বয়ে আনা দ্রবণীয় সায়ানাইডের রাসায়নিক খনিজ উপাদান আর উপর থেকে সূর্য ঢালছে অতিবেগুনী রশ্মির আলোর বৃষ্টি। পানি বা আলো প্রতিটি প্রবাহেরই ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রণ আছে ফলে প্রতিটি প্রবাহের মিলনে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে এবং এভাবে সময়ের হাত ধরে জলাধারে উৎপাদিত হচ্ছে প্রথম জীবনের আধার।
শেষ পর্যন্ত রাসায়নিক তরলের প্রবাহ পতিত হচ্ছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির জলাশয়ের তলদেশে আর সেখানে রয়েছে উল্কা পিণ্ডের আঘাতের চিহ্ন। সম্ভবত এরকম একটা জলাশয়ের পরিবেশেই প্রাণের সব উপাদান একত্রে মিলিত হয়েছিল এবং গঠিত হল প্রথম আদি কোষ। সুদারল্যান্ড প্রাণ সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াকে খুবই সুবিন্যস্ত এবং পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত রাসায়নিক বিক্রিয়াকেই প্রাণ সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে বেছে নিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, একমাত্র বিজ্ঞান সমর্থিত রসায়নকেই তিনি যথোপযুক্ত মনে করেন।
সোসটাক কিন্তু এই পথে হাঁটলেন না কিন্তু একমত পোষণ করলেন যে সুদারল্যান্ডের তত্ত্ব সতর্ক পর্যবেক্ষণের যোগ্য দাবীদার। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করি, উল্কাপাতের আঘাতে সৃষ্ট গভীর খাদে জমা পানিতে যথেষ্ট খনিজ মৌল বিদ্যমান এবং সেখানে প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব এবং এই তত্ত্ব যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। একই সাথে আমি এটাও মনে করি সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে নির্গত গরম লাভা মিশ্রিত উষ্ণ পানি থেকেও প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে। দুইটি বিতর্কের স্বপক্ষেই প্রচুর যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি আছে।” অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বিজ্ঞান-সভার বিতর্ক এখন যুক্তির লড়াই মঞ্চের মত চাঙ্গা। কিন্তু মনে হয় না কোন পক্ষই দ্রুত কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। সিদ্ধান্ত হবে রসায়ন এবং আদি কোষের বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে।
এই বিতর্কের ইতিবাচক দিক হল, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম দীর্ঘদিনের চলমান পৃথিবীতে কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল বিতর্কের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখতে যাচ্ছি।
সুদারল্যান্ডের কাছে মনে হয়, মনে হচ্ছে এখনো অনেক অর্জন বাকি। আমরা সর্বোচ্চ যেটা করতে পারি তা হল, “রাসায়নিক পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমরা পৃথিবীর প্রথমদিকের যা বুঝতে পারি এবং বিভিন্ন প্রাচীন প্রাণীর ফসিল যা কিছু বিজ্ঞান উন্মোচন করতে পেরেছে এবং আমাদের কাছে যত নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণ আছে তা দিয়ে গল্পের ইতি টানতে পারি। শেষ পর্যন্ত প্রায় এক শতকের দীর্ঘ বিভিন্ন বিজ্ঞানীগণের খণ্ড খণ্ড গবেষণার মিলিত প্রচেষ্টায় একটা দৃশ্যমান সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছি।” এখন পর্যন্ত সোসটাক এবং সুদারল্যান্ডের প্রস্তাবিত “সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল” তত্ত্ব আমাদের সামনে শুধুই রেখা চিত্রের মত নান্দনিক উপস্থাপনা। কিন্তু এই দুই বিজ্ঞানীদ্বয়ের পদক্ষেপ এত দশকের চলমান গবেষণার সমর্থনে হয়ত সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হবে।“সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল” তত্ত্ব জীবনের যাত্রা শুরুর দরকারি এবং কার্যকরী সব বিষয়ের উপর আলোকপাত করে। এটা প্রতিটি তত্ত্বের ইতিবাচক দিকগুলোকে একই সুতোয় বাঁধার চেষ্টা করে একই সাথে মূল জীবনের উৎস সন্ধানে এতদিনের জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, “সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল” তত্ত্ব রাসেলের সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্গীরন হওয়া লাভা মিশ্রিত গরম পানির স্রোতের এলাকায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল সেই তত্ত্বকেও ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে না বরং বিভিন্ন তত্ত্বের সম্ভাব্য দিকগুলোকে একত্রিত করা হয়।
আমরা প্রকৃতপক্ষে জানি না চারশত আগে ঠিক কী ঘটেছিল।মার্টিন বলেন, “যদি কৃত্রিমভাবে এখন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা যায় এবং এসচেরিচিয়া কলি নামের ব্যাকটেরিয়া উঁকি দেয় অন্য প্রান্তে তবুও প্রমাণ করা সম্ভব নয় কিভাবে প্রাণী বেড়ে উঠেছিল”
অর্থাৎ আমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিভক্তির কাছাকাছি চলে আসছি। পার্থক্য হল একদল মানুষ যারা প্রাণের যাত্রা শুরুর কাহিনী জানে আর যারা জানে না। পৃথিবীতে আজ যারা জীবিত আছে তাদের মাঝে কিছু মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত সততার সাথে বলতে পারবে কোথা থেকে তারা এসেছে। মানুষ জানতে পারছে তাদের পূর্বপুরুষ কারা এবং কোথায় ছিল তাদের বসবাস। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের আগে প্রতিটি মানুষ তাদের জন্ম এবং উৎসের ইতিহাস না জেনে অজ্ঞতার অন্ধকারে থেকেই মরে গেছে কারণ তারা কেউ বিবর্তনের বিন্দু বিসর্গ কিছু জানত না। কিন্তু বর্তমান কালের জীবিত মানুষ এমনকি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী চাইলেই তাদের জন্মের ইতিহাস জানতে পারবে এবং আবিষ্কার করবে প্রাণী জগতের সাথে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। অনুরূপভাবে ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিনের পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর যারা জন্মেছে তারা এমন একটা সমাজে বসবাস করছে যেখানে সবাই মহাবিশ্বে ভ্রমণ করছে। এমনকি আমরা কেউ সশরীরে মহাশূন্যে না গেলেও বিভিন্ন নভোযান কিন্তু ঠিকই বাস্তবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিবর্তন, প্রাণের উৎস সন্ধান, নভোযানের মহাশূন্যে পরিক্রমা ইত্যাদি বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব নীরবে সূক্ষ্মভাবে পালটে দিচ্ছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় এসব বিষয় আমাদেরকে অতীতের থেকে অনেক বেশি তথ্য সমৃদ্ধ করেছে। বিবর্তন আমাদেরকে প্রতিটি প্রাণীকে মূল্যায়ন করতে শিখিয়েছে কারণ মানুষ জানতে পেরেছে সব প্রাণীই তাদের দূর সম্পর্কের বা নিকটাত্মীয়। নভোযান চড়ে এখন আমরা মহাশূন্যে থেকে আমাদের পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছি এবং একই সাথে বুঝতে পারছি আমরা, আমদের প্রাণীজগৎ এবং পৃথিবী কত অনন্য অসাধারণ এবং কত নাজুক ও অসহায়। এই জ্ঞান আমাদের মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। পুরোপুরি বিজ্ঞানের তথ্য, প্রমাণ, গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি কীভাবে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে এবং তাদের উৎস খুঁজতে হবে। একইসাথে বিজ্ঞান গবেষণা আমদেরকে বলছে প্রাণের প্রকৃতি। কিন্তু তারপরেও এখনো আমরা জানতে পারিনি কীভাবে জন্ম নিলো প্রাণের প্রজ্ঞা।
ভাইয়া আপনি চালিয়ে যান
Baler lekha amar