রামায়ণের ঋষি জাবালি কি নাস্তিক ছিলেন?
অনেকে ভারতীয় উপমহাদেশের নাস্তিক্যবাদকে একেবারে হাল আমলের ব্যাপার বলে বর্ণনা করেন। ভাবখানা এই- পশ্চিমের প্রভাবেই যেন উপমহাদেশে নাস্তিক্যবাদের উত্থান হচ্ছে। কিন্তু এই কথাটি সত্য নয়। অনেক প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমান্তরালেই নাস্তিক্যবাদ অবস্থান করেছে; তবে প্রাচীন নাস্তিকদের নিদর্শন স্বরূপ সকল বইপত্রই বর্তমানে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এরপরেও বিরোধীদের বইপত্র থেকে প্রাচীন ভারতের নাস্তিক্যবাদ সম্বন্ধে অনেক কথাই জানা যায়। বিদ্বেষবশত নাস্তিকদের মতবাদকে একসময় ‘অসুর মত’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে নাস্তিক্যবাদ ‘লোকায়ত’ নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কিন্তু এর বিরোধীরা এর নাম বদলে মহাভারতের রাক্ষস ‘চার্বাক’ এর নামে এর নতুন নামকরণ করে। ঈশ্বরহীনদের দর্শনকে নানাভাবে হেয় করা হলেও হিন্দুশাস্ত্রে তাদের দর্শনের প্রমাণ এখনো মেলে। রামায়ণের পাতাতে আজও প্রাচীন নাস্তিকদের দর্শন টিকে আছে, যেখান থেকে তাদের দর্শনের পরিচয় মেলে। রামায়ণের ঋষি জাবালির মুখে চার্বাক এর প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই।
এই জাবালি ও তার মতের বিবরণ শুরু থেকেই শুরু করা যাক।
কোনো এক সময় রাজা দশরথ তার স্ত্রী কৈকেয়ীকে দুটি বর প্রদান করেছিলেন । সুযোগ বুঝে কৈকেয়ী সেই বর দুটির সদ্ব্যবহার করেন। কৈকেয়ী একটি বরে চান পুত্র ভরতের রাজ্যাভিষেক এবং অপর বরে চান রামের ১৪ বছরের বনবাস। রাম যখন দশরথের প্রতিজ্ঞার কথা জানতে পারেন তখন তিনি স্বেচ্ছায় ১৪ বছরের জন্য বনে গমন করেন। পুত্র রামের শোকে পিতা দশরথ প্রাণত্যাগ করেন। মামার বাড়ি থেকে ফিরে এসে ভরত সকল ঘটনা জানতে পারেন। তখন ভরত তার মা কৈকেয়ীকে তার কৃতকর্মের জন্য ভীষণভাবে ভর্ৎসনা করেন। এরপর রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভরত মাতা কৌশল্যা ও অন্যান্য ঋষিদের সাথে নিয়ে বনে গমণ করেন। রামকে ফিরিয়ে আনতে ভরত যেসকল ঋষিদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে জাবালি ঋষি ছিলেন অন্যতম। রাম যাতে বনবাস ত্যাগ করে রাজ্যে ফিরে আসেন এর জন্য ঋষি জাবালি রামকে অনেক উপদেশ দেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল জাবালির উপদেশগুলোর মধ্যে অনেক নাস্তিক্যবাদী কথাও পাওয়া যায়। বিশেষত তার কথাগুলোর সাথে প্রাচীন ভারতের নাস্তিক্যবাদী ‘চার্বাক দর্শন’ এর ভীষণ মিল পাওয়া যায়।
বাল্মীকি রমায়ণের অনেক রকমের পাঠ পাওয়া যায়। উত্তর ভারতের রামায়ণের পাঠ আর দক্ষিণ ভারতের রামায়ণের পাঠ একরকম নয়। এই পাঠগুলোর মধ্যে বেশ প্রভেদ আছে। রাজশেখর বসু রামায়ণের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে মুম্বাই এর নির্ণয় সাগর প্রেস এর সংস্করণ ব্যবহার করেছিলেন। এটাই প্রচলিত সংস্করণ। এটা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতেও চলে। এগুলো ছাড়াও রামায়ণের অনেকরকমের পাঠ পাওয়া যায়, যেগুলোর মধ্যে বিস্তর পাঠভেদ দেখা যায়। যাইহোক, বাল্মীকি রামায়ণের প্রচলিত সংস্করণ হতে জাবালির মতবাদের উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছেঃ
জাবালি রামকে ‘ধর্মবিরুদ্ধ’ এই কথা বলেন, “ ভাল, রাম! তুমি সুবুদ্ধিসম্পন্ন ও তপস্বী, অতএব সামান্য মানুষের মত তোমার পিতৃবাক্য-প্রতিপালন বিষয়ক এইরূপ নিরর্থক বুদ্ধি হওয়া উচিত নয়। দেখ, এই জগতে কে কার বন্ধু? কার কাছ থেকে কোন ব্যক্তি কি পেয়ে থাকে? জীব একাকীই জন্মায়, আর একাকীই বিনষ্ট হয়; অতএব ইনি মাতা, ইনি পিতা এইরকম সম্বন্ধ সংস্থাপন করে যে ব্যক্তি তাতে আসক্ত হয়, তাকে বাতুল (পাগল) বলে মনে কর; বস্তুত কেউই কারো নয়। যেমন কোন লোক অন্য গ্রামে গিয়ে কোন বাড়ির বাইরের দিকে থাকে, পরদিন সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তেমনি পিতা, মাতা, গৃহ ও ধন সম্পত্তি মানুষদের আবাসমাত্র। কাকুৎস! এজন্য সাধুরা বিষয়ে আসক্ত হন না। নরোত্তম! পৈতৃক রাজ্য ছেড়ে দুঃখময় বহু কণ্টকাকীর্ণ বিষম কুপথে বাস করা তোমার অনুচিত। তুমি সমৃদ্ধিশালিনী অযোধ্যাতে রাজপদে অভিষিক্ত হও, বিরহিনীর মত একবেণীধরা নগরী তোমার জন্যই প্রতীক্ষা করছে। নৃপ কুমার! স্বর্গে দেবেন্দ্রের ন্যায় তুমি অযোধ্যাতে মহার্হ রাজভোগ উপভোগ করে পরম সুখে বিহার। দশরথ তোমার কেউই নন, রাজা স্বতন্ত্র, তুমিও স্বতন্ত্র ব্যক্তি; অতএব আমি যা বলছি তা শ্রবণ কর। পিতা জীবনের বীজ অর্থাৎ নিমিত্ত কারণমাত্র। ঋতুমতী মাতার গর্ভে একত্র মিলিত শুক্র ও শোণিতই উপাদান কারণ, অর্থাৎ তাতেই ইহলোকে মানুষের জন্ম হয়। সেই নৃপতি যেস্থানে গিয়েছেন তোমাকেও সেখানে যেতে হবে, সুতরাং তার সাথে তোমার সম্বন্ধ কি? ভূতসকলের স্বভাবই এরূপ, কিন্তু তুমি পুরুষার্থ ভোগে বীতস্পৃহ হয়ে বৃথা নষ্ট হচ্ছ। যারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ রাজ্যাদিরূপ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করে অপ্রত্যক্ষ পরলৌকিক ধর্ম আশ্রয় করতে উৎসুক হয়, আমি তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করি, অন্যের জন্য শোক করি না, কেননা তারা ইহলোকে দুঃখ ভোগ করে পরলোকে অভিলষিত ধর্ম ফলও পায় না। কারণ ফলভোক্তারই সত্ত্বা নেই। অষ্টকা প্রভৃতি পিতৃ দৈবত্য শ্রাদ্ধ করতে যে লোক রত হয়, সে কেবল নিজের ভোগসাধন অন্ন প্রভৃতির বিনাশের কারণ; দেখ, মৃত ব্যক্তি কি ভোজন করবে? এই স্থানে অপর ব্যক্তি ভোজন করিলে সেই ভুক্ত অন্ন যদি অপরের উদরে যায়, তবে প্রবাসস্থ ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ করে অন্ন দান করুক। কই এমন করলে তা পথিকের পাথেয় হয় না। দেব পূজা কর, অন্ন দান কর, যজ্ঞে দীক্ষা গ্রহণ কর, তপস্যা কর, এবং সন্ন্যাস গ্রহণ কর, এই সকল দানের বশীকরণোপায় স্বরূপ বেদ আগম প্রভৃতি গ্রন্থ মেধাবী ধূর্তগণ স্বার্থ সম্পাদনকারক ও পামরগণকে প্রবঞ্চনা করবার জন্য প্রস্তুত করেছে। মহামতে! ইহলোকের পর পরলৌকিক ধর্মাদি কিছুই নেই, তুমি নিজ বুদ্ধিবলে এটা অবগত হও। যা প্রত্যক্ষ তারই অনুষ্ঠান কর, আর অনুমানগ্রাহ্য পরোক্ষকে পরিত্যাগ কর। প্রত্যক্ষবাদী সাধুগণের সর্বলোকসম্মত বুদ্ধিকে সাদরে গ্রহণ করে তুমি ভরত কর্তৃক প্রাসাদিত হয়ে রাজ্যশাসন কর।
জাবালির উপদেশ শুনে রাম বনবাস ত্যাগ করে ফিরে যান না বরং জবালিকে ভর্ৎসনা করে রাম বলতে থাকেন,
” আপনি এইমাত্র যে প্রত্যক্ষবাদী চার্বাক মতের অনুরূপ কথাগুলো বললেন এবং এমন বুদ্ধিতে ধর্মপথ পরিভ্রষ্ট নাস্তিকতা আচরণ করছেন, তাতে বোধহয়, আপনার বুদ্ধি ভ্রংশ হয়েছে, তা জেনেও পিতা আপনাকে যে যজ্ঞকার্যে বরণ করেছিলেন, তার জন্য আমি পিতার সেই কৃত কর্মকে নিন্দা করছি।“
রাম জাবালিকে ভর্ৎসনা করে আরও বলেন,
“চোর যেমন দণ্ডার্হ, বুদ্ধ মতানুসারী তথাগত নাস্তিক এবং আপনিও তেমন দণ্ডার্হ জানবেন। প্রজাদের বুদ্ধি পরিশুদ্ধির জন্য নাস্তিক ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা রাজার কর্তব্য। পণ্ডিত ব্যক্তি অধার্মিক নাস্তিকের সাথে কথাও বলেন না। …যারা ধর্ম নিরত, সৎপুরুষ সহবাসী , তেজস্বী, দানশীল, গুণবান, অহিংসক এবং নির্মল চিত্ত সেইসকল বসিষ্টের মত প্রধান মুনিরাই লোকসমাজে পূজনীয় হন, আপনার মত নাস্তিক মতাবলম্বী মুনি কখনোই পূজ্য নন।“
রামের ধমক শুনে জাবালি তার কথার দিক পরিবর্তন করেন। জাবালি রামকে বলেন,
“ আমি নাস্তিকদের কথা বলছি না, আমি নিজেও নাস্তিক নই, পরোলোক প্রভৃতি কিছুই নেই, তাও নয়; সময়ক্রমে আমি পুনরায় ঈশ্বরবিশ্বাসী হলাম; সময়বশত কখন নাস্তিকও হই, বাস্তবে আমি নাস্তিক নই। যে সময় আমি নাস্তিকদের কথা বলেছিলাম, সে সময় ক্রমশ গত হল। রাম! তোমাকে বনবাস হতে নিবৃত্ত এবং প্রসন্ন করবার জন্যই আমি ঐ কথা বলেছিলাম।“
রামকে ক্রুদ্ধ দেখে বসিষ্ঠ রামকে বলেন, “ রাম! জাবালি নাস্তিক নন, ইনিও লোকের পরলোকগমন ও সেখান হতে ইহলোকে আগমনের বিষয় সম্যক অবগত আছেন। তোমাকে বনবাস হতে নিবৃত্ত করবার মানসেই কেবল ইনি ঐ সব কথা বলেছেন।“
(বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকাণ্ড/ ১০৮-১০৯ সর্গ ; পঞ্চানন তর্করত্ন; নবভারত পাবলিশার্স। এর সাথে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদও দেখতে পারেন)
বাল্মীকি রামায়ণের প্রচলিত সংস্করণে জাবালির রামকে দেওয়া উপদেশগুলোর মধ্যে যেগুলো নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ ১) পিতার শুক্র আর মাতার শোণিতের মিলনের ফলেই মানুষের জন্ম হয়। ২) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। যারা অপ্রত্যক্ষ পরলৌকিক ধর্ম আশ্রয় করে তারা ইহলোকে কষ্টভোগ করে , আবার পরলোকেও কোনো ধর্মফল পায় না। কারণ যে ফল ভোগ করবে তারই অর্থাৎ মানুষেরই তখন অস্তিত্ব থাকে না। ৩) অষ্টকা প্রভৃতি পিতৃদৈবত্য শ্রাদ্ধে মানুষ কেবলই অন্ন নষ্ট করে। যে মারা গেছে সে কিভাবে ভোজন করবে? ৪) শ্রাদ্ধে একজন খেলে যদি তা আরেকজনের পেটে যায় তাহলে বিদেশে বসবাসকারীকে খাওয়ানোর জন্য শ্রাদ্ধ করে অন্যকে খাওয়ালেই তো হয়! কিন্তু এমন করলেও তো তার পেট ভরে না! ৫) যেসমস্ত শাস্ত্রে দেবতার পূজা, যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রভৃতির কথা আছে, ভণ্ডেরা মানুষকে ঠকানোর জন্য সেইসব শাস্ত্র রচনা করেছে। ৬) ইহলোক ছাড়া পরলোক বলে কিছু নেই। যা প্রত্যক্ষ তাকেই গ্রহণ করা উচিত, যা অপ্রত্যক্ষ তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।
উপরে জাবালির যে কথাগুলো ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ নম্বর দিয়ে পর পর উল্লেখ করা হল সেগুলোই চার্বাকদেরই কথা মূলত। চার্বাকেরা হুবহু একই কথা বলতো বলে জানা যায়।রামায়ণের টীকাকাররাও স্বীকার করেছিলেন যে জাবালির কথাগুলো চার্বাক বা লোকায়তদেরই কথা।
তবে জাবালির মুখের সব কথাই চার্বাকদের কথা ছিল না। যেমন জাবালি বলছেন কে কার পিতা, কে কার মাতা? সবাই একা আসে, একা যায়। এসব চার্বাকদের কথা নয়।
এবার মূল প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। জাবালির কথা থেকে চার্বাক মতের পরিচয় পাওয়া গেলেও রামের ধমক খেয়ে তিনি তার মতিগতি বদল করেন। জাবালি বলেন, তিনি আসলে নাস্তিক নন। রামকে বন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যই নাস্তিক হয়েছিলেন। উপদেশ দেওয়া শেষ হলে তিনি আবার আস্তিক হয়ে যান। অর্থাৎ জাবালির কথায় বোঝা যায় জাবালি সুবিধাবাদী। রাম যখন জাবালির উপর ক্রুদ্ধ হন তখন তখন জাবালির পাশে থাকা বসিষ্ঠ ঋষি রামকে বলেন, ‘জাবালি আসলে নাস্তিক নন’। হতে পারে এটাই সত্য, জাবালি নাস্তিক ছিলেন না, কেবল রামকে ফিরিয়ে আনার জন্যই নাস্তিক সেজে ওই কথাগুলো বলছিলেন। আবার এটাও হতে পারে, জাবালি আসলে নাস্তিকই ছিলেন, কিন্তু তৎকালীন সমাজে তার আত্মপ্রকাশের সুযোগ ছিল না। ভুলক্রমে নাস্তিক্যবাদী উপদেশ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই কথা শুনে রাম হুমকি ধামকি দেওয়া শুরু করলে জাবালি দমে যান; বলেন, তিনি নাস্তিক নন। হয়তো প্রাণের মায়ায় জাবালি নিজের নাস্তিক পরিচয় গোপন করেছিলেন!যাইহোক, জাবালি নাস্তিক হোন বা না হোন তার কথায় যে চার্বাক মতের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আগেই বলা হয়েছে, বাল্মীকি রামায়ণের একাধিক পাঠ পাওয়া যায়। আর নানা পাঠের মধ্যে গৌড়ীয় পাঠেই জাবালি সম্বন্ধে সবচাইতে বেশি বিবরণ মেলে; তবে এখানে তাকে হেয় করার কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। বাল্মীকি রামায়ণের প্রচলিত সংস্করণে জাবালিকে সুবিধাবাদী হিসাবে দেখা যায় কিন্তু গৌড়ীয় পাঠে এই বিষয়টি নেই। এমনকি উত্তর- পশ্চিম পাঠেও নেই।কিন্তু গৌড়ীয় পাঠের জাবালি উপাখ্যানেই সবচাইতে বেশি প্রক্ষেপ দেখা যায়, তারপরেও এখানে জাবালিকে সুবিধাবাদী হিসাবে দেখা যায় না।
অমরেশ্বর ঠাকুর বাল্মীকি রামায়ণের গৌড়ীয় পাঠের সম্পাদনা করেছেন। সেখান থেকে জাবালি উপাখ্যানের বাংলা অনুবাদ সকলের জন্য উদ্ধৃত করা হলঃ
“ এরপর, তাদের (সকলের) সম্মানিত রাজনৈতিক সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ধর্ম্মাজ্ঞ ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ জাবালি ভরতকে আশ্বাস প্রদান করে নগরাভিমুখে গমনে অনিচ্ছুক রামচন্দ্রকে ধর্মবিরুদ্ধ এই বাক্য বললেন। ১-২
হে রাঘব, বস্তুত তোমার যেন এমন পরমার্থরহিত বুদ্ধি না হয়, তপস্বীদের বুদ্ধি সাধারণ মানুষের (বুদ্ধির) মত গর্হনীয় ( নিন্দনীয়) হয়ে থাকে। ৩
হে নরশ্রেষ্ঠ, পিতার বাক্য যতদূর পালন করা উচিত , যতদূর তোমার সম্ভব হতে পারে (প্রথম হতে) আরম্ভ করে (শেষ পর্যন্ত) সমস্তই তুমি করেছ। ৪
তপস্যায় ও ধর্মে অনুরাগবশত এবং রাজ্যে নিঃস্পৃহাবশত ( সমুৎপন্ন) নির্ব্বেদে অধিকতর উদ্দীপ্ত হয়ে তুমি ক্লীবত্ব প্রাপ্ত হইও না। ৫
আর হে, বৎস, তিনিই (দশরথই) এই রাজ্য তোমাকে পূর্বে প্রদান করেছিলেন ; (পরে) তিনি যে ভরতের প্রতি রাজ্যভার অর্পণ করেন, সেই ভরতও (এসে এখন রাজ্যভার গ্রহণ করবার জন্য) তোমাকেই অনুরোধ করছে।৬
হে প্রভাবশালীন্, আর যার জন্য তোমার পিতা এই পাপকার্য করেছেন, সুপুত্রা সেই কৈকেয়ীও তোমাকে রাজ্যপ্রদান করছেন। ৭
অতএব তুমি (রাজ্য) গ্রহণ কর, প্রজাসমূহ পালন কর, স্বজনদের সুখী কর; হে বীর লক্ষ্মণ ও দেবী বৈদেহীর দুঃখভার দূর কর। ৮
অতঃপর তুমি আর প্রাজ্ঞজন বিনিন্দিত, আত্মকৃত এই নিষ্ফল বুদ্ধি স্বেচ্ছায় অবলম্বন করো না। ৯
হে বৎস, ঋচীক যেমন সুপুত্র নরশ্রেষ্ঠ শুনঃশেফকে পরিত্যাগ করেছিলেন , তেমনি (প্রায়শই) পিতা কাম ও লোভের বশবর্তী হয়ে পুত্রকে পরিত্যাগ করে থাকেন। ১০
হে বৎস, (তোমার) স্বর্গত পিতা তোমাকে তার আদেশ পালন না করলে তিরস্কার করতে পারবেন না; যেহেতু তিনি বহু শরীরের মধ্যে (এক) অসাধারণ শরীর আস্ফালন করেছেন (যেখানে ক্রোধের অবকাশ নেই) । ১১
কোন ব্যক্তি কার বন্ধু, কার দ্বারা কোন ব্যক্তির কি প্রয়োজন সাধিত হয় ? যেহেতু মানুষ একাকী জন্ম পরিগ্রহ করে , একাকীই কালকবলে পতিত হয়। ১২
অতএব মাতা এবং পিতা উভয়েই গৃহ সদৃশ ( অর্থাৎ, কিছুদিন পিতৃশরীরে ও মাতৃগর্ভে বাস করা হয়েছিল, পুত্রের সাথে পিতামাতার এইমাত্র সম্বন্ধ) যে ব্যক্তি পিতামাতার প্রতি আসক্ত হয় , তাকে উন্মত্তসদৃশ জানবে। ১৩
গ্রামান্তরে গমন প্রবৃত্ত কোনো মানুষ যেমন কোথাও আবাস গ্রহণ করে থাকে এবং পরদিন সেই আবাস পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করে , হে কাকুৎস, মানুষদের পিতা, মাতা, গৃহ এবং ধনও এমন আবাসগৃহতুল্য ( অর্থাৎ এদের সাথে সকলেরই ক্ষণকালের জন্য সমাগম হয়ে থাকে এবং পুনরায় বিশ্লেষ ঘটে থাকে) ; এই সমস্ত বিষয়ে বালকোচিত চিন্তার প্রয়োজন নেই ১৪-১৫
হে বীর ধূলিবিরহিত, ভয়সম্পর্কশূন্য সমতল পথ পরিত্যাগ করে কন্টাকাকীর্ণ কুপথ অবলম্বন করা তোমার কর্তব্য নহে। ১৬
সমৃদ্ধিশালিনী অযোধ্যায় নিজেকে অভিষিক্ত কর , যেহেতু (অযোধ্যা) নগরী (বৈধব্যনিবন্ধন) একবেণীধরা অর্থাৎ প্রোষিতভর্তৃকার ন্যায় তোমার প্রতিক্ষা করছে। ১৭
হে রাজপুত্র! দেবলোকে দেবরাজের মত তুমি অযোধ্যায় মহামূল্য রাজভোগসমূহ সম্ভোগ করে বিহার কর। ১৮
দশরথ তোমার কেহ নন, তুমিও তাহার কেহ নও, রাজা (দশরথ) অন্য ব্যক্তি এবং তুমিও অন্য ব্যক্তি ; অতএব যা বলি (তাহা) কর। ১৯
পিতা প্রাণীদের নিমিত্ত কারণ মাত্র ; পিতার শুক্র মাতার ঋতুকালে রুধিরযুক্ত বায়ুর সহিত মিলিত হয় ; তাতেই পুরুষের স্বীয় জন্মলাভ। ২০
নৃপতি সেই স্থানে (ই) গমন করেছেন, যেস্থানে তার যাওয়া উচিত; এটাই প্রাণীদের স্বাভাবিক পরিণাম ; তুমি বৃথা দুঃখপীড়িত হচ্ছ। ২১
আর, যারা ধর্মজ্ঞ (বলে বিখ্যাত) আমি তাদের বিষয়েই বলছি , অন্যলোকের ( অর্থাৎ সুখভোগপরায়ণ ব্যক্তিগণের) সম্বন্ধে কিছুই বলছি না। (দেখ) তারা ( ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিরা) (ইহলোকে নানাবিধ) দুঃখপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর পর (সুখভোগপরায়ণ ব্যক্তিদের মতোই) অদৃশ্য হয়ে থাকেন। ২২
সকলেই ( পিতৃপুরুষের পরলৌকিক অভ্যুদয়ের নিমিত্ত) অষ্টকা শ্রাদ্ধ এবং সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধ করে থাকে ; (পিতৃপুরুষের ঊর্ধ্বগতি কামনা করে ) লোক অন্যান্য পরলৌকিক কার্যেও প্রবৃত্ত হয়ে থাকে; অন্নের অপচয় দর্শন করে , মৃত্যুর পর কি অবশিষ্ট থাকতে পারে ( অর্থাৎ সমুদায়ই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় , কিছুই অবশিষ্ট থাকে না) ২৩
অন্য ব্যক্তির ভুক্ত দ্রব্য যদি অন্য শরীরে যাওয়া সম্ভব হয়, (তাহলে) বিদেশবাসী ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধায় অন্নদান করা যেতে পারে ( এবং) তার পথে ভোজনের জন্য অন্ন বহন করতে হয় না। ২৪
দেবপূজা কর, দান কর, ( যজ্ঞার্থে) দীক্ষিত হও , চান্দ্রায়ণাদি ব্রতের অনুষ্ঠান কর এবং গৃহ পরিত্যাগ কর ( অর্থাৎ প্রব্রজ্যা গ্রহণ কর) , দান প্রবৃত্তির উৎপাদক এইসমস্ত শাস্ত্র (পরপ্রতারণকুশল) পণ্ডিতবর্গ প্রবর্তন করেছেন। ২৫
হে মহামতে , তত্ত্বজ্ঞ তুমি ‘পরলোক নেই’ এই সিদ্ধান্ত কর; হে রাঘব, পরোক্ষ বস্তুতে বিশ্বাস করো না, প্রত্যক্ষ বস্তুতে বিশ্বাস কর। ২৬
ভরত কর্তৃক প্রার্থিত সেই তুমি সর্বলোকসম্মত ‘প্রত্যক্ষই প্রমাণ’ এমন বুদ্ধি আশ্রয় করে রাজ্য গ্রহণ কর; হে রাজন, রাজ্যপ্রাপ্তির পর তুমি (আত্ম) হিতকর বুদ্ধি অবলম্বন করো (এবং) স্বীয় (ক্ষত্রিয়োচিত) মার্গে বর্তমান থেকো। ২৭
ব্রহ্মার মানসপুত্র মহাযশা ক্ষুপ , মহাভাগ ইক্ষ্বাকু , শত্রুতাপন কাকুৎস, রঘু, দিলীপ, সগর এবং নরশ্রেষ্ঠ দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত তনয় মহাযশা চক্রবর্তী-শ্রীমান ভরত , পুরুকুৎস, শ্রীমান শিবি, ধুন্ধুমার, ভগীরথ, বিষ্বকসেন বজ্রধরসদৃশ রাজা অনরণ্য , ধর্মাত্মা অরিষ্টনেমি এবং বীর্যবান যুবনাশ্ব, বৈশ্রবণোপম যুবনাশ্ব পুত্র রাজা মান্ধাতা , রাজর্ষি যযাতি এবং মহাযশা সম্ভূত , লোকবিশ্রুত সত্যবান নরশ্রেষ্ঠ বৃহদশ্ব – এই সমুদায় এবং অন্যান্য বহুসংখ্যক নৃপতিপ্রবর প্রিয় পুত্র এবং পত্নিদের পরিত্যাগ করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। ২৮-৩৩
বৎস, তাদেরকে , না গন্ধর্ব না যক্ষ না রাক্ষস বলে জানি ( অর্থাৎ তারা মৃত্যুর পর গন্ধর্ব হলেন কি যক্ষ হলেন অথবা রাক্ষস হলেন তা আমরা জানি না) , তারা কোথায় গমন করেছেন তাও জানি না; সমস্ত জগৎ এইভাবে মোহগ্রস্ত হয়ে আছে। ৩৪
এই রাজাদের নামমাত্রই শ্রুত হয় , এদেরকে যিনি যেস্থানে আকাঙ্ক্ষা করেন , তিনি সেইস্থানেই এদেরকে কল্পনা করে নেন। ৩৫
কাজেই এই জগৎ কোথায় অবস্থান করছে ( অর্থাৎ ত্রিজগতে কোন বস্তু কোথায় রয়েছে ) এই বিষয়ে (কোনো) ব্যবস্থা নেই, এই দৃশ্যমান মনুষ্যলোকই পরলোক, অতএব তুমি সুখভোগী হও। ৩৬
ধর্মপরায়ণ সমস্ত ব্যক্তি কেবল সুখভোগেরই যোগ্য হয়না ; হে কাকুৎস, ধর্মশীল ব্যক্তিগণ (প্রত্যুত) অতীব দুঃখভাগী হয়ে থাকে । ৩৭
অধর্মনিরত মানুষদের সুখভাগী হতে দেখা যায় ; এরপরেও বিপরীতাচরণে প্রবৃত্ত এই জগত সর্বপ্রকারেই ব্যকুলিত হচ্ছে। ৩৮
অতএব হে নরশ্রেষ্ঠ, তুমি সমুপস্থিত লক্ষ্মীকে অবমানিতা করো না , বিপক্ষ পরিশূণ্য সুবিস্তীর্ণ নিষ্কন্টক রাজ্য গ্রহণ কর। ৩৯
(অযোধ্যাকাণ্ড, সর্গ ১১৬)
গৌড়ীয় এই পাঠেও আগের মতোই চার্বাকদের বস্তুবাদী কথাগুলো পাওয়া যায়। যদিও আগের মতোই এখানে বলা সকল কথাই চার্বাকদের কথা নয়। যাইহোক, এই পাঠের লক্ষণীয় বিষয় হল, এতে জাবালির প্রসঙ্গে ‘সম্মানিত’, ‘রাজনৈয়ায়িক’ , ‘সর্বশাস্ত্রজ্ঞ’ , ‘ধর্মজ্ঞ’ ‘ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ’ এই বিশেষণগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরেই বলা হয়েছে তার বাক্য ‘ধর্মবিরুদ্ধ’। এই ‘ধর্মবিরুদ্ধ’ র জায়গায় পাঠভেদ রয়েছে। কোথাও আছে মূল সংস্কৃতে ‘ধর্মোপেতম্’, কোথাও আছে ‘ধর্মাপেতম্’। ‘ধর্মোপেতম’ এর মানে হয় ‘নৈতিক বচন’ এবং ‘ধর্মাপেতম্’ এর মানে হয় ‘ ধর্মবিরুদ্ধ’ বাক্য। প্রথম শব্দটি অর্থাৎ ‘ধর্মোপেতম’ শব্দটি যার অর্থ ‘নৈতিক বচন’ সেটিই ঠিক হবার সম্ভাবনা অধিক কারণ ‘ধর্মজ্ঞ’ এর পাশে ‘ধর্মবিরুদ্ধ’ কথা খাপ খায় না।
সুতরাং বাল্মীকি রামায়ণের প্রচলিত পাঠে জাবালিকে হেয় করার প্রচেষ্টা থাকলেও গৌড়ীয় পাঠে জাবালিকে হেয় করার চেষ্টা চোখে পড়ে না এবং জাবালিকে এখানে সুবিধাবাদী হিসেবে অর্থাৎ কখনো আস্তিক, কখনো নাস্তিক হিসেবে দেখা যায় না। আর রামের জাবালিকে বলা, ‘চোর, বৌদ্ধ ও নাস্তিকেরা সম দণ্ডনীয়’ – এই কথাটি প্রচলিত পাঠে থাকলেও গৌড়ীয় পাঠে এটি পাওয়া যায় না। এছাড়া পুথির সাক্ষ্য হতে বোঝা যায় যে এই কথাটি বাল্মীকি রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। কোনো বৌদ্ধ ও নাস্তিক বিদ্বেষী হিন্দু হয়তো এই শ্লোকটি বাল্মীকি রামায়ণে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ-
১/ বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকাণ্ড/ ১০৮- ১০৯ সর্গ ; সম্পাদক- পঞ্চানন তর্কারত্ন
;প্রকাশক- বেণীমাধব শীলস লাইব্রেরি
সহায়ক গ্রন্থঃ-
- বাল্মীকি রামায়ণ
- চার্বাক চর্চা ; লেখক- রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
সারা বিশ্ব ভাবে ভারতবর্ষ একটা আধ্যাত্মিক দেশ।। কিন্তু এই জমি বরাবর ই আধ্যাত্মিক বাদের জন্ম দেয়নি।। নাস্তিক্যবাদ এর ও জন্ম দেয় , সেটা খুব কম জন ই জানে। যেখানে চার্বাক এর মত নিরেট বস্তুবাদী দর্শন ছিল , জৈন বুদ্ধের মত আধা নাস্তিক্যবাদী দর্শন ছিল
অজিতদা, আপনার জ্ঞানের কাছে আমি ধারে কাছেও নাই। তাও বলি, পুরান ছোটবেলা যতগুলো শুনছিলাম বর্তমানে পুরানের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই আছে। এগুলো পুরান লেখা হয়েছে অনেক পরে। যে যার মতো যা ইচ্ছা সেভাবেই লিখছে। এক রাইটারের সাথে আরেক রাইটারের মিল নাই।তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণের সময় যে লিখছিল তা এত বছর পরে এসে বিকৃত হয়ে গেছে।ধর্ম টা যেহেতু হিন্দুধর্ম, তাই এগুলো নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। হিন্দুদের ৮০% সেকুলার। তবে মহাভারত এবং গীতা থেকে যদি কিছু দেখাতে পারেন তবে বিশ্বাস করব।
একই কমেন্ট অহেতুক সবজায়গায় করছেন। এটা রামায়ণ নিয়ে আলোচনা, পুরাণ নিয়ে নয়। লেখা না পড়ে গণহারে একই কমেন্ট করা স্প্যামিং ছাড়া আর কিছু নয় ভাই।
একদম ঠিক বলেছেন।
রামচন্দ্রের মুখ থেকে বুদ্ধের কথা শোনা গেল -এ থেকে ধারণা হয় বুদ্ধদেব রামচন্দ্রের পুর্বে জন্মগ্রহণ করেছিলেন