লালসালু – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
০৫. মজিদ অপেক্ষা করছিল
মজিদ অপেক্ষা করছিল। বেহারারা পালকিটা মাজার ঘরের দরজার কাছে আস্তে নামিয়ে রাখল।
ব্যাপারী মজিদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আস্তে বলে,—নামবো?
মজিদ আজ লম্বা কোর্তা পরেছে, মাথায় ছোটখাটো একটা পাগড়িও বেঁধেছে। মুখ গম্ভীর। বলে,–তানারে নামায়া মাজার ঘরের ভিতরে লইয়া যান। থেমে বলে,–তানার ওজু আছে নি?
ব্যাপারী ছুটে যায় পালকির কাছে। পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে নিচু গলায় প্রশ্ন করে,–আছে নি ওজু?
অস্পষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আমেনা বিবি জানায়, আছে।
–তয় নামেন।
মজিদ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ সে চিকন সুরে দোয়া দরূদ পড়তে শুরু করে, গলায় বিচিত্ৰ সূক্ষ্ম কারুকার্যের খেলা হতে থাকে। কিন্তু তাতে চোখের তীক্ষ্ণতা কাটে না। চোখ হঠাৎ তার তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। পালকির পর্দা ফাঁক করে নামবার জন্যে আমেনা বিবি যখন এক পা বাড়ায় তখন সূচের তীক্ষ্ণতায় তার দৃষ্টি বিদ্ধ হয় সে-পায়ে। সাদা মসৃণ পা, রোদ-পানি বা পথের কাদামাটি যেন কখনো স্পর্শ করেনি। মজিদের গলার কারুকাৰ্য আরো সূক্ষ্ম হয়।
হলুদ রঙের বুটিদার চাদরটা আমেনা বিবি ঘোমটার ওপরে টান করে ধরে রেখেছে। তবু পালকি থেকে নেমে সে যখন মাজার ঘরে গিয়ে দাঁড়ায় তখন আড়াচোখে তার পানে তাকিয়ে মজিদ কিছুটা বিস্মিত হয়। নেতুন বউ-এর মতো চোখ তার বোজা। তবে লজ্জায় যে নয় তা দ্বিতীয়বার তাকালেই বোঝা যায়। লজ্জায় ম্রিয়মাণ নোতুন, বউ-এর আত্মসচেতন রক্তাভা তাতে নেই। সে-মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য, এবং সে-মুখে দুনিয়ার ছায়া নেই।
আমেনা বিবি কয়েক মুহুর্তের জন্যে চোখটা আধাআধি খোলে। ঘরে ইতিমধ্যে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছে। দুটো মোমবাতি মানভাবে আলো ছড়ায়। সে-আলোর সামনে সে দেখে ঝালরওয়ালসালু কাপড়ে আবৃত চিরনীরব মাজারটি। সে-নীরবতা যেন বিস্ময়করভাবে শক্তিমান। আর সে-শক্তি বিদ্যুৎ-চমকের মতো শতফলায় বিচ্ছুরিত হয়। প্ৰতি মুহুর্তে। মানুষের রক্তস্রোত যদি থেমেও থাকে। তবে তার আঘাতে আশা ও বিশ্বাসের জোয়ার আসে ধমনিতে। তথাপি মহা আকাশের মতো সে মাজার প্রগাঢ় নীরব, আর মহা আকাশের মতোই বিশাল ও অন্তহীন সে-নীরবতা। যে-আমেনা বিবি চোখ আধা খুলে তাকায় সেদিকে, সে আর পলক ফেলে না।
মজিদ আবার আড়াচোখে তাকায় তার পানে। কী দেখে আমেনা বিবি? মাজারকে আমন করে কাউকে সে দেখতে দেখেনি। তার ঠোঁট বিড়বিড় করে, গলায় তেমনি সূক্ষ্ম সুরের লহরি খেলে। কিন্তু এবার সে থামে, জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে গলা কাশে।
–তানারে বইবার কন।
ব্যাপারী বিবিকে বলে,–বহেন।
মাজারের ধারাটিতে আমেনা বিবি আস্তে বসে। তাকায় না কারো পানে। মাজারের নীরবতা যেন তার বুক ভরিয়ে দিয়েছে- সে আবার চোখ বুজে থাকে। মনে হয় তার শাস্তি, হয়েছে, আর আশা নেই। সস্তানের কামনা এক বৃহৎ সত্যের উপলব্ধির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে, লোভ। বাসনার অবসান হয়েছে। তাই হয়তো মজিদের ভয় হয়। সে আর তাকায় না। এদিকে। তবু বিড়বিড় করে। নিজের ক্ষুদ্র কোটরাগত চোখে চমক জাগে থেকে থেকে।
ঘরের কোণে একটি পাত্রে পানি ছিল। এবার সেটি তুলে নিয়ে মজিদ অন্য ধারে গিয়ে বসে। পানি পড়বে, যে-পড়াপানি খেয়ে আমেনা বিবি পাক দেবে। তার ঠোঁট তেমনি বিড়বিড় করে, হাতে পানির পাত্রটা তুলে নেওয়ায় হয়তো-বা তা ঈষৎ দ্রুততর হয়। ঘরের মধ্যে প্ৰগাঢ় নিঃশব্দত। এ-নিঃশব্দতার মধ্যে তার গলার অস্পষ্ট মিহি আওয়াজ কোনো আদিম সাপের গতির মতো জীবন্ত হয়ে থাকে। তার কণ্ঠে যদি সাপের গতি থাকে। তবে তার মনেও এক উদ্যত সাপ ফণা তুলে আছে ছোবল মারবার জন্যে। আমেনা বিবির বোজা চোখ মজিদের ভালো লাগে না, কিন্তু পালকি থেকে নামবার সময় তার যে সাদা সুন্দর পা-টা দেখেছিল, সে-পা-ই তার মনে সাপকে জাগিয়ে তুলেছে। সাপ জেগে উঠেছে ছোবল মারবার জন্যে। তার জিহবা লিকলিকা করে, উদ্যত দীর্ঘ গলা বেয়ে উঠে আসে বিষ। সুন্দর পা–দেখে স্নেহ-মমতা উঠে না এসে, আসে বিষ। স্নেহ-মমতাই যদি গলাগলিয়ে, গদগদ হয়ে জোগে উঠত। তবে মজিদ রূপালী ঝালরওয়ালা চমৎকার সালু কাপড়টাই ছিড়ে এখানকার ঘরবাড়ি ভেঙে অনেক আগে প্ৰাণের ভয়ে পালিয়ে যেত। এবং যেত সেখানেই যেখানে নির্মল আলো হাওয়া রোগ-জীবাণুভরা লালাসিক্ত কেতাবের জালির মধ্যে দিয়ে নিঃসৃত হয়ে আসে না, আসে। উন্মুক্ত বিশাল আকাশ পথে–যেখানে কাদামাটি লাগেনি এমন পা দেখে অন্তরে বিষাক্ত সাপ জেগে উঠে ফণা ধরে না।
থেকে থেকে মজিদ পানিতে ফুঁ দেয়। আর আবছা আলোয় তার ক্ষুদ্র চোখ চক্কর খায়। কখনো তার দৃষ্টি খালেক ব্যাপারীর ওপরও নিবদ্ধ হয়। আজ তার পানে তাকিয়ে মজিদের মনে হয়, ব্যাপারীর মেদবহুল স্ফীত উদরসম্বলিত দেহটি কেমন যেন অসহায়। একটু তফাতে সে যে মাথা নিচু করে বসে আছে, সে-বসে থাকার মধ্যে শক্তি নেই। সে কেমন ধ্বসে আছে, বিস্তর জমিজমাও ঠেস দিয়ে ধরে রাখতে পারেনি তার স্কুল দেহটা। চোখ আবার ঘোরে, চক্কর খায়। হলুদ রঙের বুটিদার চাদরে ঢাকা মুখটা এখান থেকে নজরে পড়ে না। তবু থেকে থেকে সেখানেই ঠক্কর খায় মজিদের ঘূর্ণমান দৃষ্টি।
এক সময় মজিদ উঠে দাঁড়ায়। গলা কেশে আস্তে বলে,—পানিটা দেন।
ব্যাপারীও তার লস্থূ দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে এসে পানিটা নেয়, তারপর আমেনা বিবির মৃত মানুষের মতো স্তব্ধ মুখের সামনে সেটা ধরে। আমেনা বিবি চোখ খুলে তাকায়, আস্তে, পাপড়ি খোলার মতো। তারপর চাদরের তলে একটা হাত নড়ে। সে হাতটি ধীরে ধীরে বেরিয়ে পাত্রটি যখন নেয় তখন একবার তার চুড়িতে অতি মৃদু ঝঙ্কার ওঠে।
আমেনা বিবি পত্রিটি কয়েক মুহুর্ত মুখের সামনে ধরে থাকে। তারপর তুলে ঠোঁটের কাছে ধরে। একটু পরে প্রগাঢ় নীরবতায় মজিদের সজাগ কানে সাবধানী বেড়ালের দুধ খাওয়ার মতো চুকচুক আওয়াজ এসে বাজে৷। পান করায় অধীরতা নেই। খোদার নামছোয়া পানি; তালাবের সাধারণ পানি নয়। তাছাড়া তৃষ্ণার পানিও নয় যে, শুষ্ক গলা নিমেষে শুষে নেবে সবটা। ধীরে ধীরে পান করে সে, বুকটা শীতল হয়। তারপর মুখ না ফিরিয়ে আস্তে শূন্য পাত্রটা বাড়িয়ে ধরে। পায়ের মতো সুন্দর হাত। মোমবাতির ম্লান আলোয় মনে হয়, সে-হাত শুধু সাদা নয়, অদ্ভুতভাবে কোমল।
হাতটি যখন আবার চাদরের তলে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন মজিদ বলে,—তানারে উঠবার কন। এহন পাক দেওন লাগবো।
আমেনা বিবি উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই মনে হয় বসে পড়বে, কিন্তু সামান্য দুলেই স্থির হয়ে যায়।
–আমি দোয়া-দরূদ পড়তাছি। তানারে পাক দিবার কন। ডান দিক থিকা পাক দিবেন, আগে ডাইন পা বাড়াইবেন। বাড়ানের আগে বিসমিল্লাহ কইবেন।
মজিদ কোণে বসে। একবার সামনে দিয়ে যখন আমেনা বিবি ঘুরে যায়। তখন তার চোখ চকচক করে ওঠে আবছা অন্ধকারে। কালো রঙের পাড়ের তল থেকে আমেনা বিবির পা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। একবার ডান পা আরেকবার বা। শব্দ হয় না। কাছাকাছি। যখন আসে তখন মজিদের ভেতরে সাপের গলাটা সামান্য চমকে পেছনে যায়, যেন ছোবল দেবে। মজিদ একবার ঢোক গেলে, তারপর কণ্ঠের সুর আবে মিহি করে তোলে।
একপাক, দুইপাক। আমেনা বিবি স্বপ্নের ঘোরে যেন হাঁটে। যে স্তব্ধতায় তার মুখ জমে আছে, সে-স্তব্ধতায় বিন্দুমাত্ৰ প্ৰাণ নেই। ও মুখ কখনো যেন কথা কয়নি, হাসেনি, কাঁদেনি। মনেও তার কিছু নেই। অতীতের স্মৃতির মতো মনে পড়ে কী একটা বাসনার কথা-বছরে বছরে যে-বাসনা অপূৰ্ণ থেকে আরো তীব্রতর হয়েছে। কী একটা অভাবের কথা, কী একটা শূন্যতার কথা। কিন্তু সে-সব অতীতের স্মৃতির মতো অস্পষ্ট। একটা মহাশক্তির সন্নিকটে এসে মানুষ আমেনা বিবির আর সুখ-দুঃখ অভাব-অভিযোগ নেই। একটা প্রখর, অত্যুজ্জল আলো তার ভেতরটা কানা করে দিয়েছে। সেখানে তার নিজের কথা আর চোখে পড়ে না।
একপাক, দুইপাক। তারপর তিন পাকে অর্ধেক। ক-পা এগুলেই মজিদকে পেরিয়ে যাবে। কিন্তু এমন সময় হঠাৎ বৈশাখী মেঘের আকস্মিক আবির্ভাবের মতো কী একটা বৃহৎ ছায়া এসে আমেনা বিবিকে অন্ধকার করে দিলো। অর্থ না বুঝে মুখ ফিরিয়ে স্বামীর পানে তাকাবার চেষ্টা করল, হয়তো-বা তাকে আলিঝালি দেখলাও। কিন্তু তারপর আর কিছু দেখল না, জানল না ক-প্যাঁচ পড়েছে তার পেটে, জানল না। মাজারের মধ্যে শায়িত শক্তিশালী লোকটির কী বলবার আছে, কপাক দিলে তাঁর অন্তরে দয়া উথলে উঠত।
ব্যাপারী বিদ্যুৎগতিতে উঠে পড়ে অস্ফুট কণ্ঠে অর্তেনাদ করে বলে,–কী হইল?
চোখের সামনে আমেনা বিবি মুছা গেছে। বুটিদার চাদরটা আর হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি বলে তার মুখটা খোলা। সে মুখে দাঁত লেগে আছে।
বাইরে মাজারে রহীমা আসে না। আজি আমেনা বিবি এসেছে বলে হয়তো আসত যদি না সঙ্গে থাকত ব্যাপারী। মাজার ঘরের বেড়ার ফুটোতে চোখ পেতে সে ব্যাপারটা দেখছিল। সঙ্গে হাসুনির মা-ও ছিল। রহীমা মনে মনে স্থির করেছিল, পাক দেওয়াচুকে গেলে আমেনা বিবিকে ভেতরে নিয়ে যাবে, সখা করে যে ফিরনিটা করেছে তা দেবে খেতে, তারপর দুয়েক খিলি পান চিবোতে চিবোতে দু’দণ্ড সুখ-দুঃখের গল্পও করবে। নিজে সে স্বল্প-ভাষী মানুষ, কিন্তু আমেনা বিবির হৃদয়ের সঙ্গে তার হৃদয়ের কোথায় যেন সমতা, যা-ই কথা হোক না কেন দেখতে দেখতে আলাপ জমে ওঠে। কিন্তু ফুটে দিয়ে রহীমা যে-দৃশ্য দেখল তারপর গল্পগুজবের আশা তাকে ত্যাগ করতে হলো। ব্যাপারীর লজ্জা কাটিয়ে বাইরে এসে সে আর হাসুনির মা অতিথিকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নিয়ে গেলো পাজাকোলে করে, মুখে কথা ফোটাবার উদ্দেশ্যে। সখ করে তৈরী করা ফিরনির কথা বা পান খেয়ে দুদণ্ড গল্প করার কথা ভুলে গেলো।
মজিদ আর ব্যাপারী মাজার ঘরেই চুপ হয়ে বসে রইল, দু’জনের মুখে চিন্তার রেখা। তারপর মজিদ আস্তে উঠে অন্দর ঘরের বেড়ার পাশে বৈঠকখানায় গিয়ে হুঁকা ধরিয়ে আবার ফিরে এসে ব্যাপারীকে ডেকে নিয়ে গেলো। দুজনেই এক এক করে হুঁকা টানে, কথা নেই কারো মুখে।
মজিদ ভাবে এক কথা। যে-আমেনা বিবির পীরের পানিপীড়া খাবার সখ হয়েছিল সে-আমেনা বিবির ওপর–আকার-ইঙ্গিতে বা মুখের ভাবে প্ৰকাশ না করলেও–মজিদের মনে একটা নিষ্ঠুর রাগ দেখা দিয়েছিল। তবে একটা নিষ্ঠুর শাস্তিও সে স্থির করেছিল। আজ সন্ধ্যার আবছা অস্পষ্ট আলোয় আমেনা বিবির সাদা কোমল পা দেখে শাস্তি বিধানের সে-প্রবল ইচ্ছা বিন্দুমাত্র প্রশমিত না হয়ে বরঞ্চ আরো নিষ্ঠুরতমভাবে শাণিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অপ্ৰত্যাশিতভাবে অসময়ে আমেনা বিবির মূছ যাওয়া সমস্ত কিছু যেন গোলমাল করে দিলো। মুঠোর মধ্যে এসেও সে যেন ফস্কে গেলো, যে-মজিদের ক্ষমতাকে সে এতদিন উপেক্ষা করেছে তার প্রতি আজও অবজ্ঞা দেখাল, তাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করতে সুযোগ দিয়েও দিলো না। দিয়েও দিলো না বলে মেয়েলোকটি যেন চরম বাহাদুরি দেখাল, সমস্ত আস্ফালনের মুখে চুন দিলো।
হুঁকাটা রেখে হঠাৎ এবার ব্যাপারী কথা বলে। বলে,—দিনভর রোজা রাখনে বড় দুর্বল হইছিল তানি।
মজিদ কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকে। তারপর গভীর কণ্ঠে বলে,- রোজা রাখনে দুর্বল হইছিল কথাডা ঠিক, কিন্তু আমি যে পানিপড়াডা দিলাম।–তা কিসের জন্য? শরীলে তাকত হইবার জন্য না? এমন তাছির হেই পানিপড়ার যে পেটে গেলে একমাসের ভুখা মানুষও লগে লগে চাঙ্গা হইয়া ওঠে। শরীলের দুর্বলতার জন্য তিনি অজ্ঞান হন নাই। মজিদ থামে। কী একটা কথা বলেও বলে না। ব্যাপারী মুখ ফিরিয়ে তাকায় মজিদের পানে, কতক্ষণ তার চিন্তিত-ব্যথিত চোখ চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর প্রশ্ন করে,–তায় ক্যান তানি অজ্ঞান হইছেন?
আপনে তানার স্বামী–ক্যামনে কই মুখের উপরে?
হঠাৎ ব্যাপারীর চোখ সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে এবং তা একবার কানিয়ে চেয়ে লক্ষ্য করে দেখে মজিদ। ব্যাপারীর চোখে সন্দেহের জোয়ার আসুক, আসুক ক্রোধের অনল-কণা। মজিদ আস্তে হুঁকাটা তুলে নেয়। তাকে ভাবতে সময় দিতে হবে। বাইরে কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যময় জ্যোৎস্না। তার আলোয় ঘরের কুপিটার শিখা মনে হয় এক বিন্দু রক্ত—টাট্কা লাল টকটকে। খোলা দরজা দিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন ম্লান জ্যোৎস্নার পানেই চেয়ে থাকে মজিদ, দৃষ্টিতে মানুষের জীবনের ব্যর্থতার বোঝা। তাতে বিদ্বেষ নেই, পতিতের প্রতি ক্ৰোধ-ঘূণা নেই, আছে শুধু অপরিসীম ব্যথা, হত প্রশ্নের নিশ্চুপতা।
আচমকা ব্যাপারী মজিদের একটি হাত ধরে বসে। তার বয়স্ক গলায় শিশুর আকুলতা জাগে। বলে,–কন, ক্যান তানি অজ্ঞান হইছেন? ভিতরে কী কোনো কথা আছে?
একবার বলে বলে ভাব করে মজিদ, তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে রসনা সংযত করে। মাথা নেড়ে বলে,–না। কওন যায় না। থেমে আবার বলে, তয় একটা কথা আমার কওন দরকার; তানারে তালাক দেন।
আমেনা বিবিকে সে তালাক দেবে! তেরো বছর বয়সে ফুটফুটে যে মেয়েটি এসে তার সংসারে ঢোকে এবং যে এত বছর যাবৎ তার ঘরকন্ন করছে, তাকে তালাক দেবে সে? সত্যি কথা, বড় বিবির প্রতি তার তেমন মায়া-মহব্বত নাই। কিছু থাকলেও তানু বিবির আসার পর থেকে তা ঢাকা পড়ে আছে, কিন্তু তবু বহুদিনের বসবাসের পর একটা সম্বন্ধ আড়ালে-আবডালে গজিয়ে না উঠেছে এমন নয়। তাই হঠাৎ তালাক দেবার কথা শুনে ব্যাপারী হ’কচাকিয়ে ওঠে তারপর কতক্ষণ সে বজ্ৰাহতের মতো বসে থাকে।
মজিদ কিছুই বলে না। বাইরের মান জ্যোৎস্নার পানে বেদনাভারী চোখে চেয়ে তেমনি স্থিরভাবে বসে থাকে। আর অপেক্ষা করে। অনেকক্ষণ সময় কাটলেও ব্যাপারী যখন কিছু বলে না। তখন সে আলাগোছে বলে,
-কথাডা কইতাম, কিন্তু এক কারণে এখন না কওনই স্থির করছি। তহুর বাপের কথা মনে আছে নি?
ব্যাপারী ভারী গলায় আস্তে বলে,–হে তহুর বাপের কথা মাইনষের ভুইলা গেছে। এমন কী তার রক্তের পোলা-মাইয়ারাও ভুইলা গেছে। কিন্তু আমি ভুলবোর পারি নাই। ক্যান জানেন?
যন্ত্রচালিতের মতো ব্যাপারী প্রশ্ন করে,–ক্যান?
–কারণ হেই ব্যাপার থিকা একটা সোনার মতো মূল্যবান কথা শিখছি আমি। কথাডা হইল। এই : পাক দিল আর গুণাগার দিল। এক সুতায় বাঁধা থাকে। আর কেউ যদি গুণাগার দিলের শাস্তি দিবার চায় তখন পাক দিলই শাস্তি পায়। তহুর বাপের দিল সাফ আছিল, তাই শাস্তি পাইল হেই। এদিকে তারে কষ্ট দিয়া আমি গুণাগার হইলাম।
বর্তমানে মনটা বিক্ষিপ্ত হলেও ব্যাপারী কথাটা বোঝে। তার ও আমেনা বিবির দিল এক সুতায় বাধা। আমেনা বিবিকে শাস্তি দিতে হলে আগে সে-বন্ধন ছিন্ন করা চাই। অতএব তাকে তালাক দেওয়া প্রয়োজন। মজিদ একবার ভুল করে একজন নিষ্পাপ লোককে এমন নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে যে, সে-কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্যে অবশেষে তাকে আত্মহত্য করতে হয়েছে। তাকে কষ্ট দিয়ে মজিদ নিজেও গুণাগার হয়েছে, পাপীও ভালো মানুষের ওপর দুষ্ট আত্মার মতো ভর করে শাস্তি থেকে বেঁচে গেছে। এমন ভুল মজিদ আর কখনো করবে না। মজিদের হাত তখনো ব্যাপারী ছাড়েনি। সে-হাতে একটা টান দিয়ে ব্যাপারী অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলে,—আপনে কী কিছু সন্দেহ করেন?
সন্দেহের কোনো কথা নাই। পানিপড়াডা খাইয়া তানি যখন সাত পাক দিবার পারলেন না, মুছা গেলেন, তখন তাতে সন্দেহের আর কোনো কথা নাই। খোদার কালামের সাহায্যে যে-কথা জানা যায় তা সূর্যের রোশনাইয়ের মতো সাফ। আর বেশী আমি কিছু কমু না। তানারে তালাক দেন।
এই সময়ে হাসুনির মা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোমটা টেনে তেরছাভাবে দাড়াল। ব্যাপারী প্রশ্ন করে,–কী গো বিটি?
–তানার হুস হইছে। বাড়িতে যাইবার চাইতাছেন।
মজিদের হাত ছেড়ে ব্যাপারী উঠে দাঁড়াল। মুখ কঠিন। বেহারাদের ডেকে পালকিটা অন্দরে পাঠিয়ে দিলো।
আমেনা বিবিকে নিয়ে সে পাঙ্কি যখন কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যময় চাঁদের আলোর মধ্যে দিয়ে চলে কিছুক্ষণ পরে গাছগাছলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলো, তখন মজিদ বৈঠকখানা ঘরের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। অন্যমনস্কভাবে খেলাল দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে, দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তার ভাব। কোনো কথা না কয়ে হঠাৎ ব্যাপারী চলে গেলো। তার মনের কথা জানা গেলো না।
হঠাৎ এক সময়ে একটা কথা স্মরণ হয় মজিদের। কথা কিছু না, একটা দৃশ্য–আবছা আলোয় দেখা কালো পাড়ের নিচে একটি সাদা কোমল পা। সে-পা দ্বিতীয়বার দেখল না বলে হঠাৎ বুকের মধ্যে কেমন আফসোস বোধ করে মজিদ। তারপর মনে মনেই সে হাসে। দুনিয়াটা বড় বিচিত্র। যেখানে সাপ জাগে সেখানে আবার কোমলতার ফুল ফোটে। কিন্তু সে ফুল শয়তানের চক্রান্ত। মজিদ শক্ত লোক। সাত জন্মের চেষ্টায়ও শয়তান তাকে কোনো দুর্বল মুহূর্তে আচম্বিতে আক্রমণ করতে পারবে না। সে সদা হুঁশিয়ার।
কণ্ঠে দোয়া-দরূদের মিহি সুর তুলে মজিদ ভেতরে যায়।
০৬. এতবড় সমস্যা ব্যাপারীর জীবনে
এতবড় সমস্যা ব্যাপারীর জীবনে কখনো দেখা দেয়নি। নিজের চোখে কোনো গুরুতর অন্যায় দেখে যদি শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠত। তাহলে ব্যাপারটা সমস্যাই হতো না। আসল কথা জানে না, আবার একটা কিছু গোলযোগ যে আছে। এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মানুষ মজিদের কথা না হয় অবিশ্বাস করা যেত, কিন্তু যে-কথা জেনেছে মজিদ তা তার নিজের বুদ্ধির জোরে জানেনি। খোদার কালামের সাহায্যেই সে-কথা জেনেছে এবং মানুষ মজিদ তার অন্তরের বিবেচনার জন্যেই তা খুলে বলতে পারেনি। হাজার হলেও তারা বন্ধু মানুষ। ব্যাপারী কষ্ট পাবে এমন কথা কী করে বলে।
বৈঠকখানা হুঁকার নীলাভ ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে ওঠে। ব্যাপারীর চোখে ধোঁয়া ভাসে, মগজেও কিছু গলিয়ে ঢুকে তার অন্তরভৃদৃষ্টি আবছা করে দেয়। ব্যাপারী ভাবে আর ভাবে। মানুষের সঙ্গে হু-হা করে কথা কয়, দশ প্রশ্নে এক জবাব দেয়। একটা কথাই মনে ঘোরে। এক সময়ে সেটা সোজা মনে হয়, এক সময়ে কঠিন। একবার মনে হয় ব্যাপারটা হেস্তনেস্ত হয় একটি মাত্র শব্দের তিনবার উচ্চারণেই, আরেকবার মনে হয়, সে শব্দটা উচ্চারণ করাই ভয়ানক দুরূহ ব্যাপার। জিহবা খসে আসবে। তবু সেটা বেরিয়ে আসবে না। মুখ থেকে।
গ্রোরো বছর বয়স থেকে যে তার ঘরে বসবাস করছে, তার জীবনের অলি-গলির সন্ধান করে। যদি কিছু নজরে পড়ে যায় হঠাৎ। দীর্ঘ বসবাসের সরল ও জানা পথ ছেড়ে ঝোপঝাড় খোঁজে, ডালপালা সরিয়ে অন্ধকার স্থানে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু আপত্তিকর কিছুই নজরে পড়ে না। আমেনা বিবি রূপবতী, কিন্তু কোনোদিন তার রূপের ঠাট ছিল না, সৌন্দর্যের চেতনা ছিল না; চলনে বলনে বেহায়াপনাও ছিল না। ঠাণ্ডা, শীতল, ধৰ্মভীরু ও স্বামী ভীরু মানুষ। সে এমন কী অন্যায় করতে পারে?
প্রশ্নটা মনে জাগতেই মজিদের একটা কথা হুঙ্কার দিয়ে যেন তাকে সাবধান করে দেয়। কথাটা মজিদ প্রায়ই বলে। বলে মানুষের চেহারা বা স্বভাব দেখে কিছু বিচার করা যায় না। তাকে দিয়ে কিছু বিশ্বাসও নেই। এমন কাজ নেই দুনিয়াতে যা সে না করতে পারে এবং করলে সব সময়ে যে সমাজের কাছে ধরা পড়বে এমন নয়। কিন্তু খোদার কাছে কোনো ফাঁকি নেই। তিনি সব দেখেন। সব জানেন, কথাটা ভাবতেই ব্যাপারীর কান দুটোতে রঙ ধরে। পশুপক্ষীকেও না জানতে দিয়ে কোনো গর্হিত কাজ ব্যাপারী কী কখনো করেনি? ব্যাপারীর মতো লোকও করেছে, যদিও আজ বললে হয়তো অনেকে তা বিশ্বাস করবে: না। কিন্তু সে-কথা খোদাতালা ঠিক জানেন। তাঁর কাছে ফাঁকি চলে না।
না, মজিদের কথায় ভুল নেই। সহসা খালেক ব্যাপারী মনস্থির করে ফেলে।
এবং এর তিন দিন পর যে-আমেনা বিবি হঠাৎ সন্তান কামনায় অধীর হয়ে উঠেছিল সে-ই সমস্ত কামনা-বাসনা বিবর্জিত একটা স্তব্ধ, বাজাহত মন নিয়ে সে-দিনের পাল্কিতে চড়ে বাপের বাড়ি রওয়ানা হয়। বহুদিন বাপের বাড়ি যায়নি। তবু সেখানে যাচ্ছে বলে মনে কিছু আনন্দ নেই। পাল্কির ক্ষুদ্র সংকীর্ণতায় চোখ মেলে নাক বরাবর তাকিয়ে থাকে বটে কিন্তু তাতে অশ্রুও দেখা দেয় না।
তবে পথে একটা জিনিস দেখলে হয়তো হঠাৎ তার বুক ভাসিয়ে কান্না আসত। সেটা হলো থেতামখা তালগাছটা। বহুদিনের গাছ, ঝড়েপানিতে আরো লোহা হয়ে উঠেছে যেন। প্রথম যৌবনে নাইয়র থেকে ফিরবার সময় পাব্ধির ফাঁকি দিয়ে এ-গাছটা দেখেই সে বুঝতে যে, স্বামীর বাড়ি পৌঁছেছে। ওটা ছিল নিশান, আনন্দের আর সুখের।
সেদিন রাতে কে যেন একটা মস্ত মোমবাতি এনে জ্বলিয়ে দিয়েছে মাজারের পাদদেশে, ঘরটা রোশনাই হয়ে উঠেছে। সে-আলোয় রূপালী ঝালরটা আজ অত্যধিক উজ্জ্বল দেখায়। মজিদ কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কিন্তু হঠাৎ তার নজরে পড়ে একটা জিনিস। ঝালারের একদিকে ঔজ্জ্বলা যেন কম, উজ্জ্বলতার দীর্ঘ পাতের মধ্যে ঐখানে কেমন একটু অন্ধকার! কাছে গিয়ে হাতে তুলে দেখে, ঝালরটার রূপালী ঔজ্জ্বল্য সেখানে বিবৰ্ণ হয়ে গেছে, সুতাগুলো খসে এসেছে। দেখে মুহুর্তে মজিদের মন অন্ধকার হয়ে আসে। তার ভুরু কুঁচকে যায়, ঝালারের বিবৰ্ণ অংশটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। তার জীবনে সৌখিনতা কিছু যদি থাকে। তবে তা এই কয়েক গজ রূপালী চাকচিক্য। এর ঔজ্জ্বল্যই তার মনকে উজ্জল করে রাখে, এর বিবৰ্ণতা তার মনকে অন্ধকার করে দেয়।
অবশ্য দুবছর তিন বছর অন্তর মাজারের গাত্রাবরণ বদলানো হয়, এবং বদলাবার খরচ বহন করে খালেক ব্যাপারই। খরচ করে তার আফসোস হয় না। বরঞ্চ সুযোগটা পেয়ে নিজেকে শতবার ধন্য মনে করে। এদিকে মজিদও লাভবান হয়, কারণ পুরানো গাত্রাবরণটি কেনবার জন্যে এ-গ্রামে সে-গ্রামে অনেক প্ৰাথী গজিয়ে ওঠে এবং প্রার্থীদের মধ্যে উপযুক্ততা বিচার করে দেখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সে বেশ চড়া দামে বিক্রি করে সেটা। কাজেই ঝালরটার কোনোখানে যদি রঙ ঢটে যায়, বা সালু-কাপড়ের কোনো স্থানে ফাট ধরে তবে মজিদেব চিন্তা করার কারণ নেই। কিন্তু তবু জিনিসটার প্ৰতি কী যে মায়া–তার সামান্য ক্ষতি নজরে পড়লেও বুকটা কেমন কেমন করে ওঠে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মজিদের সামনেই রহীম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমেনা বিবির জন্যে সারাদিন আজ মনটা ভারী হয়ে আছে। একটা প্রশ্ন কেবল ঘুরে ফিরে মনে আসে। কেউ যদি হঠাৎ কিছু অন্যায় করে ফেলেও, তার কী ক্ষমা নেই? কী অন্যায়ের জন্যে আমেনা বিবির এত বড় শাস্তিটা হলো তা অবশ্য জানে না, তবু সে ভাবতে পারে না। আমেনা বিবি কিছু গর্হিত কাজ করতে পারে। আবার করেনি এ-কথাও বা ভাবে কী করে? কারণ খোদাই তো জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে সে অন্যায়ের কথা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহীমা বিড়বিড় করে বলে,–তুমি এত দয়ালু। খোদা, তবু তুমি কী কঠিন।
সে বিড়বিড় করে আর আওয়াজটা এমন শোনায় যেন মাজারের সালু কাপড়টা ছেড়ে ফড়িফড় করে। মুহূর্তের জন্যে চমকে ওঠে মজিদ। মন তার ভারী। রূপালী ঝালারের বিবৰ্ণ অংশটা কালো করে রেখেছে সে-মন।
হাওয়ায় ক-দিন ধরে একটা কথা ভাসে। মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটি ইস্কুল বসাবে। আক্কাস বিদেশে ছিল। বহুদিন। তার আগে করিমগঞ্জের ইস্কুলে নিজে নাকি পড়াশুনা করেছে কিছু। তারপর কোথায় পাটের আড়াতে না তামাকের আড়ােত চাকরি করে কিছু পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরেছে কেমন একটা লাটবেল টেব ভাব নিয়ে। মোদকেবর মিঞা ছেলের প্রত্যাবর্তনে খুশিই হয়েছিল। ভেবেছিল, এবার ছেলের একটা ভালো দেখে বিয়ে দিলে বাকী জীবনটা নিশ্চিন্ত মনে তসবি টিপতে পারবে। বিয়ে দেবার তাগিদটা এই জন্যে আরো বেশী বোধ করল যে, ছেলেটির রকম-সকম মোটেই তার পছন্দ হচ্ছিল না। ছোটবেলা থেকে আক্কাস কিছুটা উচৰ্কা ধরনের ছেলে। কিন্তু আজকাল মুরুব্বিদের বুদ্ধি সম্পর্কে পর্যন্ত ঘোরতর সন্দেহ নাকি প্ৰকাশ করতে শুরু করেছে। তবে তাকে পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়তে দেখে মুরুব্বিারা একেবারে নিরাশ হবার কোনো কারণ দেখল না। ভাবলে, বিদেশী হাওয়ায় মাথাটায় একটু গরম ধরেছে। তা দুদিনেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
কিন্তু নিজে ঠাণ্ডা হবার লক্ষণ না দেখিয়ে আক্কাস অন্যের মাথা গরম করবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগে গেলো। বলে, ইস্কুল দেবে। কোথেকে শিখে এসেছে ইস্কুলে না পড়লে নাকি মুসলমানদের পরিত্রাণ নেই। হ্যাঁ, মুরুব্বির স্বীকার করে, শিক্ষা ব্যাপারটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিন্তু গ্রামে কী দু-দুটো মক্তব বসানো হয়নি? সে-কি বলতে পারবে এ-কথা যে, গ্রামবাসীদের শিক্ষার কোনোখান দিয়ে কিছুমাত্র অবহেলা হচ্ছে?
আক্কাস যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। সে ঘুরতে লাগল চরকির মতো। ইস্কুলের জন্যে দস্তুর মতে চান্দা তোলার চেষ্টা চলতে লাগল, এবং করিমগঞ্জে গিয়ে কাউকে দিয়ে একটা জোরাল গোছের আবেদন-পত্ৰ লিখিয়ে এনে সেটা সিধা। সে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিলো। কথা এই যে, ইস্কুলের জন্যে সরকারের সাহায্য চাই।
বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। কাজেই একদিন মজিদ ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে উঠল। কোনো প্ৰকার ভনিতার প্রয়োজন নেই বলে সরাসরি প্রশ্ন করল, -কী হুনি ব্যাপারী মিঞা।
ব্যাপারী বলে–কথাডা ঠিকই।
অতএব সন্ধ্যার পর বৈঠক ডাকা হলো। আক্কাস এল, আক্কাসের বাপ মোদাব্বের এল।
আসল কথা শুরু করার আগে মজিদ আক্কাসকে কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখল। দৃষ্টিটা নিরীহ আর তাতে আপন ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে থাকার অস্পষ্টতা।
সভা নীরব দেখে আক্কাস কী একটা কথা বলবার জন্যে মুখ খুলেছে–এমন সময় মজিদ যেন হঠাৎ চেতনায় ফিরে এল। তারপর মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠল তার মুখ, খাড়া হয়ে উঠল কপালের ব্লগ। ঠাস করে চড় মারার ভঙ্গিতে সে প্রশ্ন করলে,–তোমার দাড়ি কই মিঞা?
আক্কাস সর্বপ্ৰকার প্রশ্নের জন্য তৈরী হয়ে এসেছিল, কিন্তু এমন একটা অপ্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য মোটেই প্ৰস্তুত ছিল না। ইস্কুল হবে কী হবে না।–সে আলোচনাই তো হবার কথা। তার সঙ্গে দাড়ির কী সম্বন্ধ?
সভায় উপস্থিত সকলের দিকে তাকাল আক্কাস। দাড়ি নেই এমন একটি লোক নেই। কারো ছাটা, কারো স্বভাবত হাল্কা ও ক্ষীণ; কারো বা প্রচুর বৃষ্টিপানিসিঞ্চিত জঙ্গলের মতো একরাশ দাড়ি। মজিদ আসার আগে গ্রামের পথে-ঘাটে দাড়িবিহীন মানুষ নাকি দেখা যেত। কিন্তু সেদিন গেছে।
পূর্বোক্ত সুরে মজিদ আবার প্রশ্ন করে,—তুমি না মুসলমানের ছেলে–দাড়ি কই তোমার?
একবার আক্কাস ভাবে যে বলে, দাড়ির কথা তো বলতে আসেনি এখানে। কিন্তু মুরুব্বির সামনে আর যাই হোক, বেয়াদপিটা চলে না। কাজেই মাথা নত করে চুপ করে থাকে সে।
দেখে মোদকেবর মিঞা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গা টিলা করে। এতক্ষণ সে নিশ্বাস রুদ্ধ করে ছিল এই ভয়ে যে, উত্তরে বেয়াড় ছেলেটা কী না জানি বলে বসে। মোদকেবর মিঞা বলে,–আমি কত কই দাড়ি রাখা ছ্যামড়া দাড়ি রাখ–তা হের কানে দিয়াই যায় না কথা।
খালেক ব্যাপারী বলে,–হে নাকি ইংরাজি পড়ছে। তা পড়লে মাথা কী আর ঠাণ্ডা থাকে?
ইংরাজি শব্দটার সূত্র ধরে এবার মজিদ আসল কথা পাড়ে। বলে যে, সে শুনেছে আক্কাস নাকি একটা ইস্কুল বসাবার চেষ্টা করছে। সে-কথা কী সত্যি?
আক্কাস অমান বদনে উত্তয় দেয়,–আপনি যা হুনছেন তা সত্য।
মজিদ দাড়িতে হাত বুলাতে শুরু করে। তারপর সভার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,–তা এই বদ মতলব কেন হইল?
–বদ মতলব আর কী? দিনকাল আপনারা দেখবেন না? আইজকাইল ইংরাজি না পড়লে চলবো ক্যামনে?
শুনে মজিদ হঠাৎ হাসে। হেসে এধাব ওধার তাকায়। দেখে আক্কাস ছাড়া সভার সকলে হেসে ওঠে। এমন বেকুফির কথা কেউ কী কখনো শুনেছে? শোনো শোনো, ছেলের কথা শোনো একবার–এই রকম একটা ভাব নিয়ে ওরা হো-হে করে হাসে।
হাসির পর মজিদ গম্ভীর হয়ে ওঠে। তারপর বলে, আক্কাস মিঞা যে-দিনকালের কথা কইল তা সত্য। দিনকাল বড়ই খারাপ। মাইনষের মতিগতির ঠিক নাই, খোদার প্ৰতি মন নাই, তবু যাহোক আমি থাকনে লোকদের একটু চেতনা হইছে!
সকলে একবাক্যে সে-কথা স্বীকার ক্রে। মানুষের আজ যথেষ্ট চেতনা হয়েছে বই কি। সাধারণ চাষাভূষা পর্যন্ত আজ কলম জানে। তাছাড়া লোকেরা নামাজ পড়ে পাঁচ ওক্ত, রোজার দিনে রোজা রাখে। আগে শিলাবৃষ্টির ভয়ে শিরালিকে ডাকত আর শিরালি জপ তপ পড়ে নগ্ন হয়ে নাচত; কিন্তু আজ তারা একত্র হয়ে খোদার কাছে দোয়া করে,–মাজারে শিরনি দেয়, মজিদকে দিয়ে খতম পড়ায়। আগে ধান ভানতে ভানতে মেয়েরা সুর করে গান গাইত, বিয়ের আসরে সমস্বরে গীত ধরত–আজকাল তাদের মধ্যে নারীসুলভ লাজশরাম দেখা দিয়েছে। আগে ঘরে ঢোকা নিত্যকার ব্যাপার ছিল, কিন্তু মজিদের একশ দররার ভয়ে ও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে মজিদ হাক ছাড়ে,–ভাই সকল! পোলামাইনষের মাথায় একটা বদ খেয়াল ঢুকছে— তা নিয়া আর কী কমু। দেয়া করি তার হেদায়েত হোক। কিন্তু একটা বড় জরুরী ব্যাপারে আপনাদের আমি আইজ ডাকছি। খোদার ফজলে বড় সমৃদ্ধশালী গেরাম আমাগো। বড় আফসোসের কথা, এমন গোরামে একটা পাকা মসজিদ নাই। খোদার মজি এইবার আমাগো ভালো ধান-চাইল হইছে, সকলের হাতেই দুই-চারটা পয়সা হইছে। এমন শুভ কাম আর ফেলাইয়া রাখা ঠিক না।
সভার সকলে প্ৰথমে বিস্মিত হয়। আক্কাসের বিচার হবে, তার একটা শাস্তিবিধান হবে–এই আশা নিয়েই তো তারা এসেছে। কিন্তু তবু তারা মজিদের নতুন কথায় মুহুর্তে চমৎকৃত হয়ে গেলো। ব্যাপারীর নেতৃত্বে কয়েকজন উচ্ছসিত হয়ে উঠে বলে,—বাহবা, বড় ঠিক কথা কইছেন।
মজিদ খুশিতে গদগদ। দাড়িতে হাত বুলায় পরম পুলকে। আর বলে, আমার খেয়াল, দশ গোরামের মধ্যে নাম হয় এমন একটা মসজিদ করা চাই। আর সে-মসজিদে নামাজ পইড়া মুসল্লীদের বুক যানি শীতল হয়।
শুনে সভার সকলে চেচিয়ে ওঠে, বড় ঠিক কথা কইছেন–আমাগো মনের কথাডাই কইছেন।
এক সময়ে আক্কাস ক্ষীণ গলায় বলে,–তয় ইস্কুলের কথাডা?
শুনে সকলে এমন চমকে উঠে তার দিকে তাকায় যে, এ-কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, সভায় তার উপস্থিতি মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। তার বাপ তো রেগে ওঠে। রাগলে লোকটি কেমন তো তলায়। ধমকে তো তো করে বলে,
—চুপ কর ছ্যামড়া, বেত্তমিজের মতো কথা কইস না। মনে মনে সে খুশি হয় এই ভেবে যে, মসজিদের প্রস্তাবের তলে তার অপরাধের কথাটা যাহোক ঢাকা পড়ে গেছে।
মসজিদের আকৃতি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা হচ্ছে এমন সময়ে আক্কাস আস্তে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কেউ দেখে কেউ দেখে না, কিন্তু তার চলে যাওয়াটা কারো মনে প্রশ্ন জাগায় না। যে গুরুতর বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে তাতে আক্কাসের মতো খামখেয়ালী বুদ্ধিহীন যুবকের উপস্থিতি একান্ত নিষ্প্রয়োজনীয়।
মসজিদের কথা চলতে থাকে। এক সময়ে খরচের কথা ওঠে। মজিদ প্ৰস্তাব করে, গ্রামবাসী সকলেরই মসজিদটিতে কিছু যেন দান থাকে, প্রতিটি ইট বড়গা হুড়কায় কারো না কারো যেন যৎকিঞ্চিৎ হাত থাকে। সেটা অবশ্য বাস্তবে সম্ভব নয়। কারণ একটা কানাকড়িও নেই এমন গ্রামবাসীর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তারা অর্থ দিয়ে সাহায্য না। করলেও গতির খাটিয়ে সাহায্য করতে পারে। তারা এই ভেবে তৃপ্তি পাবে যে, পয়সা দিয়ে না হলেও শ্রম দিয়ে খোদার ঘরটা নির্মাণ করেছে।
এমন সময় খালেক ব্যাপারী তার এক সকাতর আর্জি পেশ করে। বলে যে, সকলেরই কিছু না কিছু দান থাক মসজিদ নির্মাণের ব্যাপারে, কিন্তু খরচের বারো আনা তাকে যেন বহন করতে দেওয়া হয়। তার জীবন আর কী-দিন। আর খায়েশ-খোয়াব বা আশা-ভরসা নেই, এবার দুনিয়ার পাট গুটাতে পারলেই হয়। যা সামান্য টাকা পয়সা আছে তা ধর্মের কাজে ব্যয় করতে পারলে দিলে কিছু শান্তি আসবে।
দিলের শান্তির কথা কেমন যেন শোনায়। আমেনা বিবির ঘটনা সে-দিন মাত্র ঘটল। কান-ঘূষায় কথাটা এখনো জীবন্ত হয়ে আছে। শুধু জীবন্ত হয়ে নেই, ডালপালা শাখা-প্ৰশাখায় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই থেকে মানুষের মনে যেন একটা নোতুন চেতনাও এসেছে। যাদের ঘরে বাজা মেয়ে তাদের আর শান্তি নেই। অবশ্য ধর্মের ঘরে গিয়ে কষ্টিপাথরে ঘষলে জানা যায় আসল কথা, কিন্তু সে তো সব সময়ে করা সম্ভব নয়। তাই একটা হিড়িক এসেছে, সংসার থেকে বাঁজা বউদের দূর করার, আর গণ্ডায় গণ্ডায় তারা চালান যাচ্ছে বাপের বাড়ি।
তবু যাহোক, মানুষের দিল বলে একটা বস্তু আছে। দীর্ঘ বসবাসের ফলে মানুষে মানুষে মায়া হয়। তাই পরমাত্মীয়ের কোনো অন্যায়ে বুকে কঠিনতম আঘাত লাগে। ব্যাপারী আঘাত পেয়েছে। সে আঘাত এখনো শুকায়নি। তাই হয়তো দিলে শান্তি চায়।
মজিদ সভাকে প্রশ্ন করে,—ভাই সকল, আপনাদের কী মত?
ব্যাপারীকে নিরাশ করবে–এমন কথা কেউ ভাবতে পাবে না। কাজেই তার আবেদন মঞ্জুর হয়।
মজিদ সুবিচারক। অতএব স্থির হলো, এমনভাবে চাঁদা তোলা ইবে যে, আধখান আর অস্তই হোক–একজন লোক অন্তত একটা খরচ যেন বহন করে।
সভা ক্ষান্ত হবার আগে একবার আক্কাসের বদখেয়ালের কথা ওঠ। কিন্তু মোদকেবর মিঞার তখন জোশ এসে গেছে। রেগে উঠে সে বলে যে, ছেলে যদি আমন কথা ফের তোলে। তবে সে নিজেই তাকে কেটে দু-টুকরো করে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবে।
যতটা সুদৃশ্য করা হবে বলে কল্পনা করা হয়েছিল ততটা সুদৃশ্য না হলেও একটা পাকা গম্বুজওয়ালা মসজিদ তৈরী হতে থাকে। শহর থেকে মিস্ত্রী কারিগর এসেছে, আর গতব খাটাবার জন্য তৈরী গ্রামের যত দুস্থ লোক। মজিদ সকাল-বিকাল তদারক করে, আর দিন গোনে কবে শেষ হবে।
একদিন সকালে সে মসজিদের দিকে যাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ মাঠের ধারে ফাল্গুনের পাগলা হাওয়া ছোটে। এত আকস্মিক তার আবির্ভাব যে, ঝকঝকে রোদাভাস আকাশের তলে সে-দমকা হাওয়া কেমন বিচিত্ৰ ঠেকে। তাছাড়া শীতের হাওয়া শূন্য জমজমাট ভাবের পর আচমকা এই দমকা হাওয়া হঠাৎ মনের কোনো এক অতল অঞ্চলকে মথিত করে জাগিয়ে তোলে। ধুলো-ওড়ানো মাঠের দিকে তাকিয়ে মজিদেব স্মরণ হয় তার জীবনের অতিক্রান্ত দিনগুলোর কথা। কত বছর ধরে সে বসবাস করছে। এ-দেশ? দশ, বারো? ঠিক হিসাব নেই, কিন্তু এ-কথা স্পষ্ট মনে আছে যে, এক নিরাক-পড়া শ্রাবণের দুপুরে সে এসে প্ৰবেশ করেছিল এই মহব্বতনগর গ্রামে। সে-দিন ছিল ভাগ্যান্বেষী দুস্থ মানুষ, কিন্তু আজ সে জোতজমি সম্মান-প্ৰতিপত্তির মালিক। বছরগুলো ভালোই কেটেছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও এমনি কাটবে। এখন সে ঝড়ের মুখে উড়ে-চলা পাতা নয়, সচ্ছলতায় শিকড়গাড়া বৃক্ষ।
অ্যাজ দমকা হওয়ার আকস্মিক আগমনে তার মনে ভবিষ্যতের কথাই জাগে। এবং তাই সারাদিন মনটা কেমন কেমন করে। লোকদের সঙ্গে আলাপ করে ভাসা-ভাসাভাবে, কইতে কইতে সে সহসা কেমন আনমনা হয়ে যায়।
সারাদিন হাওয়া ছোটে। সন্ধ্যার পরে সে হাওয়া থামে। যেমনি আচমকা তার আবির্ভাব হয়েছিল তেমনি আচমকা থেমে যায়। দোয় দরূদ পড়ছিল মজিদ, এবার নিস্তব্ধতার মধ্যে গলাটা চড়া ও কেমন বিসদৃশ শোনাতে থাকে। একবার কেশে নিয়ে গলা নামিয়ে এধার ওধার দেখে অকারণে, তারপর মাছের পিঠের মতো মাজারটার দিকে তাকায়। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে চমকে ওঠে। রূপালী ঝালরওয়ালা সালু কাপড়টা এক কোণে উল্টে আছে।
সত্যিই সে চমকে ওঠে। ভেতরটা কিসে ঠক্কর খেয়ে নড়ে ওঠে, স্রোগে, ভাসমান নৌকার চড়ে ধাক্কা খাওয়ার মতো ভীষণভাবে ঝাকুনি খায়। কারণ, ঘরের মান আলোয় কবরের সে-অনাবৃত অংশটা মৃত মানুষের খোল। চোখের মতো দেখায়।
কার কবর এটা? যদিও মজিদের সমৃদ্ধির, যশ-মান ও আর্থিক সচ্ছলতার মূল কারণ এই কবরই; কিন্তু সে জানে না কে চিরঘুমে শায়িত এর তলে। যে-কবরের পাশে আজ তার একযুগ ধরে বসবাস এবং যে-কবরের সত্তা সম্পর্কে সে প্ৰায় অচেতন হয়ে উঠেছিল, সে কবরই ভীত করে তোলে তার মনকে। কবরের কাপড় উল্টানো নগ্ন ংশই হঠাৎ তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মৃত লোকটিকে সে চেনে না। এবং চেনে না বলে আজ তার পাশে নিজেকে বিস্ময়করভাবে নিঃসঙ্গ বোধ করে। এ-নিঃসঙ্গত কালের মতো আদি অন্তহীন–যার কাছে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ অর্থহীন অপলাপ মাত্ৰ।
সে-রাতে রহীমা স্বামীর পা টিপতে টিপতে মজিদের দীর্ঘশ্বাস শোনে। চিরকালের স্বল্পভাষিণী রহীমা কোনো প্রশ্ন করে না, কিন্তু মনে মনে ভাবে।
এক সময়ে মজিদই বলে,–বিবি, আমাগো যদি পোলাপাইন থাকত!
এমন কথা মজিদ কখনো বলে না। তাই সহসা রহীমা কথাটার উত্তর খুজে পায় না। তারপর পা টেপা ক্ষণকালের জন্য থামিয়ে ডান হাত দিয়ে ঘোমটাটা কানের ওপর চড়িয়ে সে আস্তে বলে,–আমার বড় সখ হাসুনিরে পুষ্যি রাখি। কেমন মোটা-তাজা পোলা।
প্ৰথমে মজিদ কিছুই বলে না। তারপর বলে,—নিজের রক্তের না হইলে কী মন ভরে? কথাটা বলে আর মনে মনে অন্য একটা কথার মহড়া দেয়। মহড়া দেওয়া কথাটা শেষে বলেই ফেলে। বলে, তাছাড়া তার মায়ের জন্মের নাই ঠিক!
তারপর তারা অনেকক্ষণ নীরব হয়ে থাকে। মজিদের নীরবতা পাথরের মতো ভারী। যে-নিঃশব্দ তা আজ তার মনে ঘন হয়ে উঠেছে সে-নিঃশব্দতা সত্যিকার, জীবনের মতো তা নিছক বাস্তব। এবং কথা হচ্ছে, পুষ্ট্যি ছেলে তো দূরের কথা, রহীমাও সে-নিঃশব্দতাকে দূর করতে পারে না। দূর হবে। যদি মনে নেশা ধরে। মজিদের নেশার প্ৰয়োজন।
ব্যথাবিদীর্ণ কণ্ঠে মজিদ আবার হাহাকার করে ওঠে,–আহা, খোদা যদি আমাগো পোলাপাইন দিত!
মজিদের মনে কিন্তু অন্য কথা ঘোরে। তখন মাজারের অনাবৃত কোণটা মৃত মানুষের চোখের মতো দেখাচ্ছিল। তা দেখে হয়তো তার মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও স্মরণ হয়েছিল যে, জীবনকে সে উপভোগ করেনি। জীবন উপভোগ না করতে পারলে কিসের ছাই মান-যশ-সম্পত্তি? কার জন্যে শরীরের রক্ত পানি করা, আয়েশ-আরাম থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা?
পরদিন সকালে মজিদ যখন কোরান শরীফ পড়ে তখন তার অশা? আত্মা সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে মিহি চিকণ কণ্ঠের ঢালা সুরে। পড়তে পড়তে তার ঠোঁট পিচ্ছিল ও পাতলা হয়ে ওঠে, চোখে আসে এলোমেলো হাওয়ার মতো অস্থিরতা।
বেলা চড়লে তার কোরান পাঠ খতম হয়। উঠানে সে যখন বেরিয়ে আসে তখনো কিন্তু তার ঠোঁট বিড়বিড় করে–তাতে যেন কোরান পাঠের রেশ লেগে আছে।
উঠানের কোণে অ।ওলাঘরের নীচু চালের ওপর রহীমা কদুর বিচি শুকাবার জন্যে বিড়িয়ে দিচ্ছিল। সে পেছন ফিরে আছে বলে মজিদ আড়াচোখে চেয়ে চেয়ে তাকে দেখে কতক্ষণ। যেন অপরিচিত কাউকে দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলে না।
রাতে মজিদ রহীমাকে বলে,–বিবি, একটা কথা।
শুনবার জন্যে রহীমা পা টেপা বন্ধ করে। তারপর মুখটা তেরছাভাবে ঘুরিয়ে তাকায় স্বামীর পানে।
–বিবি,আমাগো বাড়িটা বড়ই নিরানন্দ। তোমার একটা সাখী আনুম? সাখী মানে সতীন। সে-কথা বুঝতে রহীমার এক মুহূর্ত দেরী হয় না। এবং পলকের মধ্যে কথাটা বোঝে বলেই সহসা কোনো উত্তর আসে না মুখে।
রাহীমাকে নিরুত্তর দেখে মজিদ প্রশ্ন করে,–কী কও?
–আপনে যেমুন বোঝেন।
তারপর আর কথা হয় না। রহীমা আবার পা টিপতে থাকে বটে কিন্তু থেকে থেকে তার হাত থেমে যায়। সমস্ত জীবনের নিস্ফলতা ও অন্তঃসারশূন্যতা এই মুহূর্তে তার কাছে হঠাৎ মন্ত বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু বলবার তার কিছুই নেই।
০৭. মজিদের দ্বিতীয় বিয়ে
জ্যৈষ্ঠের কড়া রোদে মাঠ। ফাটছে আর লোকদের দেহ দানা-দানা হয়ে গেছে। ঘামচিতে, এমন সময় মসজিদের কাজ শেষ হয়। এবং তার কিছু দিনের মধ্যেই মজিদের দ্বিতীয় বিয়েও সম্পন্ন হয় অনাড়ম্বর দ্রুততায়। ঢাকঢোল বাজে না, খানাপিনী মেহমান অতিথ-এর হৈহুলস্থূল হয় না, অত্যন্ত সহজে ব্যাপারটা চুকে যায়।
বউ হয়ে যে মেয়েটি ঘরে আসে যে যেন ঠিক বেড়ালছানা। বিয়ের আগে মজিদ ব্যাপারীকে সংগোপনে বলেছিল যে, ঘরে এমন একটি বউ আনবে যে খোদাকে ভয় করবে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয়, সে খোদাকে কেন সব কিছুকেই ভয় করবে, মানুষ হাসিমুখে আদর করতে গেলেও ভয়ে কেঁপে সারা হয়ে যাবে।
নোতুন, বউ-এর নাম জমিলা। জমিলাকে পেযে রহীমার মনে শাশুড়ির ভাব জাগে। স্নেহ-কোমল চোখে সাবক্ষণ তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে, আর যাত্র দেখে তেওঁ ভােলা লাগে তাকে। আদর-যত্নে করে খাওয়ায় দাওয়ায় তাকে। ওদিকে মজিদ ঘনঘন দাঁড়িতে হাত বুলায়, আর তার আশপাশ আ৷ তারের গন্ধে ভুর ভুর করে।
এক সময় গলায় পুলক জাগিয়ে মজিদ প্রশ্ন করে,—হে নামাজ জানে নি?
রহীমা জমিলার সঙ্গে একবার গোপনে আলাপ করে নেয়। তারপর গলা চড়িয়ে বলে,–জানে।
–জানলে পড়ে না। ক্যান?
জমিলার সঙ্গে আলাপ না করেই রহীমা সরাসরি উত্তর দেয়,–পড়বে আর কী ধীরে-সুস্থে।
আড়লে রহীমাকে মজিদ প্রশ্ন করে,—তোমার হে মানসন্মান করে নি?
—করে না? খুব করে। একরাত্তি মাইয়া, কিন্তু বড় ভালা। চোখ পর্যন্ত তোলে না।
তারা দুজনেই কিন্তু ভুল করে। কারণ দিন কয়েকের মধ্যে জমিলার আসল চরিত্ৰ প্ৰকাশ পেতে থাকে। প্ৰথমে সে ঘোমটা খোলে তারপর মুখ আড়াল করে হাসতে শুরু করে। অবশেষে ধীরে ধীরে তার মুখে কথা ফুটতে থাকে। এবং একবার যখন ফোটে তখন দেখা যায় যে, অনেক কথাই সে জানে ও বলতে পারে–এতদিন কেবল তা ঘোমটার তলে ঢেকে রেখেছিল।
একদিন বাইরের ঘর থেকে মজিদ হঠাৎ শোনে সোনালী মিহিসুন্দর হাসির ঝঙ্কার। শুনে মজিদ চমকিত হয়। দীর্ঘ জীবনের মধ্যে এমন হাসি সে কখনো শোনেনি। রহীমা জোরে হাসে না। সালু আবৃত মাজারের আশেপাশে যারা আসে তারাও কোনোদিন হাসে না। অনেক সময় কান্নার রেল ওঠে, কত জীবনের দুঃখবেদনা বরফ-গলা নদীর মতো হুহু করে ভেসে আসে আর বুকফাটা দীর্ঘশ্বাসের দমক। হাওয়া জাগে, কিন্তু এখানে হাসির ঝঙ্কার ওঠে না কখনো! এখানকার কথা ছেডে দিলেও, আগেই-ব৷ মজিদ কবে এমন হাসি শুনন্তে। জীৰ্ণ গোয়’লঘরের মতে। মক্তবে খিটখিঢ়ে মেজাজের মৌলবীর সামনে প্রাণভয়ে তার স্বাবে আমিসিপির পাড়া হতে শুরু করে অন্ন সংস্থানের জন্য তিক্তি তম সংগ্ৰ মের দিনগুলির মধ্যে কোথাও হাসির লেশমাত্ৰ আভাস নেই। তাই কয়েক মুহুর্ত বিমুগ্ধ মানুষের মতো মজিদ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর সামনের লোকটির পানে তাকিয়ে হঠাৎ সে শক্ত হয়ে যায়। মুখের পেশী টান হয়ে ওঠে, আর কুঁচকে যায় ভুরু।
পরে ভেতরে এসে মজিদ বলে,—কে হাসে অমনি কইরা?
জমিলা আসার পর আজ প্রথম মজিদের কণ্ঠে রুষ্টত শোনা যায়। তাই যো-জামিল মজিদকে ভেতরে আসতে দেখে ওপারে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছিল। লজ্জায়, সে তাড়ষ্ট হয়ে যায় ভয়ে। কেউ উত্তর দেয় না।
মজিদ আবার বলে,–মুসলমানের মাইয়ার হাসি কেউ কখনো হুনে না। তোমার হাসিও যানি কেউ হুনে না।
রহীমা এবার ফিসফিস করে বলে,—হুনলা নি? আওয়াজ কইরা হাসন নাই।
জমিলা আস্তে মাথা নাড়ে। সে শুনেছে। একদিন দুপুরে জমিলাকে নিয়ে রহীমা পাট বুনতে বসে। বাইরে আকাশে শঙ্খচিল ওড়ে, ‘আর অদূরে বেড়ার ওপরে বসে দুটো কাক ডাকাডাকি করে অবিশ্রান্তভাবে।
বুনতে বনতে জমিলা হঠাৎ হাসতে শুরু করে। মজিদ বাড়িতে নেই, পাশেব গ্রামে গেছে এক মরণাপন্ন গৃহস্থকে ঝাড়তে। তবু সভয়ে চমকে উঠে রহীমা বলে,–জোরে হাইস না বইন, মাইনষে হুনবো।
ওর হাসি কিন্তু থামে না। বরঞ্চ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বিচিত্ৰভাবে জীবন্ত সে হাসি, ঝরনার অনাবিল গতির মতো ছন্দময় দীর্ঘ সমাপ্তিহীন ধারা।
আপন থেকে হাসি যখন থামে। তখন জমিলা বলে,–একটা মজার কথা মনে পড়ল বইলাই হাসলাম বুবু।
হাসি থেমেছে দেখে রহীমা নিশ্চিন্ত হয়। তাই এবার সহজ গলায় প্ৰশ্ন কবে,–কী কথা বইন?
–কমু? বলে চোখ তুলে তাকায় জমিলা। সে-চোখ কৌতুকে নাচে।
–কও না!
বলবার আগে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে কী যেন ভাবে। তারপর বলে,
–তানি যখন আমারে বিয়া করবার যায় তখন খোদেজা বুবু বেড়ার ফাঁক দিয়া তানারে দেখাইছিল।
-কারে দেখাইছিল?
–আমারে। তয় দেইখা আমি কই, দ্যুত, তুমি আমার লগে মস্কার কর খোদেজা বুবু। কারণ কী আমি ভাবলাম, তানি বুঝি দুলার বাপ। আর–হঠাৎ আবার হাসির একটা দমক আসে, তবু নিজেকে সংযত কোরে সে বলে–আর, এইখানে তোমারে দেইখা ভাবলাম তুমি বুঝি শাশুড়ী।
কথা শেষ করেছে কী আমনি জমিলা আবার হাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু সে-হাসি থামতে দেরী হলো না। রহীমার হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সে আচমকা থেমে গেলো।
সারা দুপুর পাটি বোনে, কেউ কোনো কথা কয় না। নীরবতার মধ্যে এক সময়ে জমিলার চোখ ছলছল কোরে ওঠে, কিসের একটা নিদারুণ অভিমান গলা পর্যন্ত উঠে। ভারী হয়ে থাকে। রহীমার অলক্ষ্যে ছাপিয়ে ওঠা অশ্রুর সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই কোরে জমিলা তারপর কেঁদে ফেলে।
হাসি শুনে রহীম। যেমন চমকে উঠেছিল। তেমনি চমকে ওঠে তার কান্না শুনে। বিস্মিত হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে জমিলার পানে। জমিলা কাঁদে আর পাটি বোনে, থেকে থেকে মাথা ঝোঁকে চোখ-নাক মেছে।
রহীমা আস্তে বলে,–কাঁদো ক্যান বইন?
জমিলা কিছুই বলে না। পশলাটি কেটে গেলে সে চোখ তুলে তাকায় রহীমার পানে, তারপর হাসে। হেসে সে একটি মিথ্যা কথা বলে।
বলে যে, বাড়ির জন্যে তার প্রাণ জ্বলে। সেখানে একটা নুলা ভাইকে ফেলে এসেছে, তার জন্যে মনটা কাঁদে। বলে না যে, রহীমাকে হঠাৎ গম্ভীর হতে দেখে বুকে অভিমান ঠেলে এসেছিল এবং একবার অভিমান ঠেলে এলে কান্নাটা কী কোরে আসে সব সময়ে বোঝা যায় না। রহীমা উত্তরে হঠাৎ তাকে বুকে টেনে নেয়, কপালে আস্তে চুমা খায়।
জমিলাই কিন্তু দুদিনের মধ্যে ভাবিয়ে তোলে মজিদকে। মেয়েটি যেন কেমন! তার মনের হদিশ পাওয়া যায় না। কখন তাতে মেঘ আসে, কখন উজ্জল আলোয় ঝলমল করে–পূর্বাহ্নে তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া দুষ্কর। তার মুখ খুলেছে বটে কিন্তু তা রহীমার কাছেই। মজিদের সঙ্গে এখনো সে দুটি কথা মুখ তুলে কয় না। কাজেই তাকে ভালোভাবে জানিবারও উপায় নেই।
একদিন সকালে কোথেকে মাথায় শনের মতো চুলওয়াল খ্যাংটাঙ্ক বুড়ী মাজারে এসে তীক্ষ্ম আর্তনাদ শুরু করে দিলো। কী তার বিলাপ, কী ধারাল তার অভিযোগ। তার সাতকুলে কেউ নেই, এখন নাকি তার চোখের মণি একমাত্র ছেলে যাদুও মরেছে। তাই সে মাজারে এসেছে খোদার অন্যায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করতে।
তার তীক্ষ্ম বিলাপে সকালটা যেন কাঁচের মতো ভেঙে খান-খান হয়ে গেলো। মজিদ তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ওর বিলাপ শেষ হয় না, গলার তীক্ষ্ণতা কিছুমাত্র কোমল হয় না। উত্তরে এবার সে কোমরে গোজ আনা পাঁচেক পয়সা বের কোরে মজিদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,–সব দিলাম। আমি, সব দিলাম। পোলাটার এইবার জান ফিরাইয়া দেন।
মজিদ আরো বোঝায়। তাকে–ছেলে মরেছে, তার জন্যে শোক করা উচিত নয়। খোদার যে বেশী পেয়ারের হয় সে আরো জলদি দুনিয়া থেকে প্ৰস্থান করে। এবার তার উচিত মৃত ছেলের রাহ-এর জন্যে দোয় করা; সে যেন বেহেস্তে স্থান পায়, তার গুণাহ যেন মাফ হয়ে যায়–তার জন্যে দোয় করা।
কিন্তু এ-সব ভালো নছিহতে কান নেই বুড়ীর; শোক আগুন হয়ে জড়িয়ে ধরেছে তাকে, তাতে দাউ-দাউ কোরে পুড়ে মরছে। মজিদ আর কী করে। পয়সাটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে আসে। অন্দরে আসতে, দেখে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জমিলা, পাথরের মতো মুখ্য-চোখ। মজিদ থমকে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ তার পানে চেয়ে থাকে, কিন্তু তার হুঁশ নেই।
সেই থেকে মেয়েটির কী যেন হয়ে গেলো। দুপুরের আগে মজিদকে নিকটে কোনো এক স্থানে যেতে হয়েছিল, ফিরে এসে দেখে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে গালে হাত চেপে জমিলা মূর্তির মতো বসে আছে, ঝুরে আসা চোখে আশপাশের দিশ নাই।
রহীমা বদনা কোরে পানি আনে, খড়ম জোড়া রাখে পায়ের কাছে। মুখ ধুতে-ধুতে সজোরে গলা সাফ করে মজিদ, তারপর আবার আড়চোখে চেয়ে দেখে জমিলাকে। জমিলার নড়াচড় নেই। তার চোখ যেন পৃথিবীর দুঃখ বেদনার অর্থহীনতায় হারিয়ে গেছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মজিদ দরজার কাছাকাছি একটা পিাড়িতে এসে বসে। রহীমার হাত থেকে হুকটা নিয়ে প্রশ্ন করে,—ওইটার হইছে কী?
রহীমা একবার তাকায় জমিলার পানে। তারপর আঁচল দিয়ে গালের ঘাম মুছে আস্তে বলে,–মন খারাপ করছে।
ঘন ঘন বার কয়েক হুঁকায় টান দিয়ে মজিদ আবার প্রশ্ন করে,–কিন্তু–ক্যান খারাপ করছে?
রহীমা সে-কথার জবাব দেয় না। হঠাৎ জমিলার দিকে তাকিয়ে ধমকে ওঠে–ওঠ ছেমড়ি, চৌকাঠে ঐ রকম কইরা বসে না।
মজিদ হুক টানে আর নীলাভ ধোয়ার হাল্কা পর্দা ভেদ করে তাকায় জমিলার পানে। জমিলা যখন নড়বার কোনো লক্ষণ দেখায় না। তখন মজিদের মাথায় ধীরে ধীরে একটা চিনচিনে রাগ চড়তে থাকে। মন খারাপ হয়েছে? সে যদি হতো নানারকম দায়িত্ব ও জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন কাটানো মস্ত সংসারের কত্রী–তবে না হয় বুঝত মন খারাপের অর্থ। কিন্তু বিবাহিতা একরাত্তি মেয়ের আবার ওটা কী ঢঙ? তাছাড়া মানুষের মন খারাপ হয় এবং তাই নিয়ে ঘর সংসারের কাজ করে, কথা কয়, হাঁটে-চলে। জমিলা যেন ঠাটাপড়া মানুষের মতো হয়ে গেছে।
হঠাৎ মজিদ গর্জন করে ওঠে। বলে, আমার দরজার থিক। উঠবার কও তারে। ও কী ঘরে বালা আনবার চায় নাকি? চায় নাকি আমার সংসার উচ্ছন্নে যাক, মড়ক লাগুক ঘরে?
গর্জন শুনে রহীমার বুক পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। জমিলাও এবার নড়ে। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে কেমন অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় এদিকে, তারপর হঠাৎ উঠে সিড়ি দিয়ে নেমে গোয়াল ঘরের দিকে চলে যায়।
সে-রাতে দূরে ডোমপাড়ায় কিসের উৎসব। সেই সন্ধ্যা থেকে একটানা ভেঁাতা উত্তেজনায় ঢোলক বেজে চলেছে। বিছানায় শুয়ে জমিলা এমন আল গাছে নিঃশব্দ হয়ে থাকে, যেন সে বিচিত্ৰ ঢোলকের আওয়াজ শোনে কান পেতে। মজিদও অনেকক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে পড়ে থাকে। একবার ভাবে, তাকে জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে তার, কিন্তু একটা কুল-কিনারাহীন অর্থই প্রশ্নের মধ্যে নিমজ্জিত মনের আভাস পেয়ে মজিদের ভেতরটা এখনো খিটখিটে হযে আছে। প্রশ্ন করলে কী একটা অতল তার প্রমাণ পাবে–এই ভয় মনে। মাজারের সান্নিধ্যে বসবাস করার ফলে মজিদ এই দীর্ঘ এক যুগকাল সময়েব মধ্যে বহু ভগ্ন, নির্মমভাবে আঘাত-পাওয়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছে। তাই আজ সকালে ঐ সাতকুল খাওয়া শনের মতো চুল মাথায় বুড়াটার ছুরি বা মতো ধারাল তীক্ষ্ম বিলাপ মজিদের মনকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি।। কিন্তু সে-বিলাপ শোনার পর থেকেই জমিলা যেন কেমন হয়ে গেছে। কেন?
মনে মনে ক্ৰোধে বিড়বিড় কোরে মজিদ বলে, যেন তার ভাতার মরছে!
ডোমপাড়ায় অবিশ্রান্ত ঢোলক বেজে চলে; পৃথিবীর মাটিতে অন্ধকারের তলানি গাঢ় হতে গাঢ়তর হয়। মজিদের ঘুম আসে না; ঘুমের আগে জমিলার গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে খানিক আদর করা প্ৰায় তার অভ্যাস হয়ে দাড়ালেও আজ তার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। হয়তো এই মুহুর্তে দুনিয়ার নির্মমতার মধ্যে হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠা জমিলার অন্তর একটু আদরের জন্য, একটু স্নেহ-কোমল সান্থনার জন্য বা মিষ্টি মধুর আশার কথার জন্য খা-খ্যা করে, কিন্তু মজিদের আজ আব্দর শুকিয়ে আছে। তার সে-শুষ্ক হৃদয় ঢোলকের একটানা আওয়াজের নিরন্তর খোচায় ধিধিক-ধিকি কোরে জ্বলে, মনের অন্ধকারে স্ফুলিঙ্গর ছটা জাগে। সে ভাবে, নেশার লোভে কাকে সে ঘরে আনল? যার কচি কোমল লতার মতো হাল্কা দেহ দেখে আর এক ফালি চাঁদের মতো ছোট মুখ দেখে তার এত ভালো লেগেছিল— তার এ কী পরিচয় পাচ্ছে ধীরে ধীরে?
তারপর কখন মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছিল। মধ্যরাতে ঢোলকের আওয়াজ থামলে হঠাৎ নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা ভারী হয়ে এল। তারই ভারিত্বে হয়তো চিন্তাক্ষত মজিদের অস্পষ্ট ঘুম ছুটে গেলো। ঘুম ভাঙলেই তার একবার আল্লাহু আকবর বলার অভ্যাস। তাই অভ্যাসবশত সোঁ-শব্দ দুটো উচ্চারণ করে পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখে জমিলা নেই। কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বুঝল না, তারপর ধাঁ কোরে উঠে বসল। তারপর নিজেকে অপেক্ষাকৃত সংযত করে আকম্পিত হাতে দেশলাই জালিয়ে কুপিটা ধরাল।
পাশের বারান্দার মতো ঘরটায় রহীমা শোয়। সেখানেই রহীমার প্ৰশস্ত বুকে মুখ গুঁজে জমিলা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কুপিটার লালচে আলো মুখে পড়তেই তার ঠোঁটটা একটু নড়ে উঠল–যেন মাই খেতে খেতে ভুল থেমে গিয়েছিল, আলো দেখে হঠাৎ স্মরণ হলো সে-কথা।
পরদিন জমিলার মুখের অন্ধকারটা কেটে যায়। কিন্তু মজিদের কাটে না। সে সারাদিন ভাবে। রাতে রহীমা যখন গোয়াল ঘরে গামলাতে হাত ডুবিয়ে নুনপানি মেশানো ভুষি গোলায় তখন বাইরের ঘর থেকে ফিরবার মুখে মজিদ সেখানে এসে দাঁড়ায়। রহীমার মুখ ঘামে চকচক করে আর ভন ভন কোরে মশায় কাটে তার সারা দেহ। পায়ের আওয়াজে চমকে উঠে রহীমা দেখে, মজিদ। তারপর আবার মুখ নিচু করে ভুষি গোলায়।
মজিদ একবার কাশে। তারপর বলে,–জমিলা কই?
–ঘুমাইছে বোধ হয়।
জমিলার সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘুমোবার অভ্যাস। মজিদ বলা কওয়াতে সে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু প্ৰায়ই এশার নামাজ পড়া তার হয়ে ওঠে না, এই নিদারুণ ঘুমের জন্য। নামাজ তো দূরের কথা, খাওয়াই হয়ে ওঠে না। যে-রাতে অভুক্ত থাকে তার পরদিন অতি ভোরে উঠে ঢাকাঢোকা যা বাসী খাবার পায় তাই খায় গরগর করে।
মজিদ এবার চাপা গলায় গর্জে ওঠে,–ঘুমাইছে? তুমি কাম করবা, হে লালবিবির মতো খাটে চইড়া ঘুমাইবো বুঝি? ক্যান, এত ক্যান? থেমে আবার বলে, নামাজ পড়ছে নি?
নামাজ সে আজ পড়েছে। মগরেবের নামাজের পরেই ঢুলতে শুরু করেছিল, তবু টান হয়ে বসেছিল আধা ঘণ্টার মতো। তারপর কোনো প্রকারে এশার নামাজ সেরেই সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুম দিয়েছে। কিন্তু তখন রহীমা পেছনে ছাপড়া দেওয়া ঘরটিতে বসে বান্না কবছিল বলে
–কী জানি, বোধ হয় পড়েছে।
–বোধ হয় বুধ হয় জানি না। খোদার কামে ঐসব ফাইজলামি চলে না। যাও, গিয়া তারে ঘুম থিক তোল, তারপর নামাজ পড়বার কও।
রহীমা নিরুত্তরে ভুষি গোলানো শেষ করে। গাইটা নাসারন্ধ ডুবিয়ে র্সো-র্সে আওয়াজ করে। ভুষি খেতে শুরু করে, কুপির আলোয় চকচক করে তার মস্ত কালো চোখজোড়া। সে-চোখের পানে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে রহীমা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, পেছনে পেছনে যায় মজিদ।
হাত ধুয়ে এসে ঠাণ্ড সে-হাত দিয়ে জমিলার দেহ স্পর্শ করে রহীমা, যখন ধীরে ধীরে ডাকে তখনো মজিদ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা অধীরতায় তার চোখ চকচক করে। কিন্তু সে অধীর হলে কী হবে, জমিলার ঘুম কাঠের মতো। সে-ঘুম ভঙে না। রহীমার গলা চড়ে, ধাক্কানি জোরাল হয়, কিন্তু সে যেন মরে আছে। এই সময়ে এক কাণ্ড করে মজিদ। হঠাৎ এগিয়ে এসে একহাত দিয়ে রহীমাকে সরিয়ে একটানে জমিলাকে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। তার শক্ত মুঠির পোষণে মেয়েটির কাজার কচি হাড় হয়তো মড়মড় করে ওঠে।
আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘরে ডাকাত পড়েছে ভেবে জমিলার চোখ ভীতবিহবল হয়ে ওঠে। প্ৰথমে। কিন্তু ক্রমশ শ্রবণশক্তি পরিষ্কার হতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে মজিদের রুষ্ট কথাগুলোর অর্থও পরিষ্কার হতে থাকে। কেন তাকে উঠিয়েছে সে-কথা এখন বুঝলেও জমিলা বসেই থাকে, ওঠার নামটি করে না।
সে ল্যাট মেরে বসেই থাকে। হঠাৎ তার মনে বিদ্রোহ জেগেছে। সে উঠবেও না, কিছু বলবেও না। কোনো কথাই সে বলে না। নামাজ যে পড়েছে, এ-কথাও না।
ক্ষণকালের জন্য মজিদ বুঝতে পারে না। কী করবে। মহব্বতনগরে তার দীর্ঘ রাজত্বকালে আপন হোক পর হােক কেউ তার হুকুম এমনভাবে জামান্য করেনি। কোনোদিন। আজ তার ঘরের এক রাত্তি বউ–যাকে সে সে-দিনমাত্র ঘরে এনেছে একটু নেশার ঝোঁক জেগেছিল বলে–সে কিনা তার কথায় কান না দিয়ে আমন নির্বিকারভাবে বসে আছে।
সত্যিই সে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। অন্তরে যে-ক্ৰোধ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সে-ক্ৰোধ ফেটে পড়বার পথ না পেয়ে অন্ধ সাপের মতো ঘুরতে থাকে, ফুসতে থাকে। তার চেহারা দেখে রহীমার বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। দীর্ঘ বারো বছরের মধ্যে স্বামীকে সে অনেকবার রাগতে দেখেছে, কিন্তু তার এমন চেহারা সে কখনো দেখেনি। কারণ সচরাচর সে যখন রাগে তখন তার রাগান্বিত মুখে কেমন একটা সমবেদনার, সমাজ ও ধর্মসংস্কারের সদিচ্ছার কোমল আভি ছড়িয়ে থাকে। আজ সেখানে নির্ভেজাল নিষ্ঠুর হিংস্ৰতা।
ভীতকণ্ঠে রহীমা বলে,–ওঠ বইন ওঠ, বহুত হইছে। নামাজ লইয়া কী রাগ করা যায়?
–রাগ? কিসের রাগ? মজিদ। আবার গর্জে ওঠে। এই বাড়িতে আহিলাদের জায়গা নাই। এই বাড়ি তার বাপের বাড়ি না।
তবু জমিলা ঠায় বসে থাকে। সে যেন মূর্তি।
অবশেষে আগ্নেয়গিরির মুখে ছিপি দিয়ে মজিদ সরে যায়। আসলে সে বুঝতে পারে না। এর পর কী করবে। হঠাৎ এমন এক প্ৰতিদ্বন্দ্বর সম্মুখীন হয় যে, সে বুঝে উঠতে পারে না তাকে কীভাবে দমন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে, দীর্ঘকাল অন্দরে-বাইরে রাজত্ব করেও যে-সতর্কতার গুণটা হারায়নি, সে-সতর্কতাও সে অবলম্বন করে। ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত সে ভেবে দেখতে চায়।
যাবার সময় একটি কথা বলে মজিদ,–ওর দিলে খোদার ভয় নেই। এইটা বড়ই আফসোসের কথা।
অর্থাৎ তার মনে পৰ্ব্বতপ্ৰমাণ খোদার ভীতি জাগাতে হবে। ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত ভেবে দেখবার সময় সে-লাইনেই মজিদ ভাববে।
পরদিন সকালে কোরান পাঠ খতম করে মজিদ অন্দরে এসে দেখে, দরজার চৌকাঠের ওপর ক্ষুদ্র ঘোলাটে আয়নাটি বসিয়ে জমিলা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সিথি কাটছে। তেল জব্বজবে পাট করা মাথাটি বাইরের কড়া রোদের ঝলক লেগে জ্বলজ্বল করে। মজিদ যখন পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢোকে তখন জমিলা পিঠটা কেবল টান করে যাবার পথ করে দেয়, তাকায় না। তার দিকে।
এ-সময়ে মজিদ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেছোয়াক করে। মেছোয়াক করতে করতে ঘরময় ঘোরে, উঠানে পায়চারি করে, পেছনে গাছগাছলার দিকে চেয়ে কী দেখে। দীর্ঘ সময় নিয়ে সযত্নে মেছোয়াক করে–দাঁতের আশে-পাশে, ওপরে-নীচে। ঘষতে-ঘষতে ঠোঁটের পাশে ফেনার মতো থুথু জমে ওঠে। মেছোয়াকের পালা শেষ হলে গামছাটা নিয়ে পুকুরে গিয়ে দেহ রগড়ে গোসল কোরে আসে।
একটু পরে একটা নিমের ডাল দাঁতে কামড়ে ধরে জমিলার দেহ ঘে যে আবার বেরিয়ে আসে মজিদ। আড়চোখে একবার তাকায় বউ-এর পানে। মনে হয়, ঘোলাটে আয়নায় নিজেরই প্ৰতিচ্ছবি দেখে চকচক করে মেয়েটির চোখ। সে-চোখে বিন্দুমাত্র খোদার ভয় নেই।–মানুষের ভয় তো দূরের কথা।
মেছোয়াক করতে করতে উঠানে চক্কর খায় মজিদ। এক সময়ে সশব্দে থুথু ফেলে সে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজায় পাকা সিঁড়ি নেই। পুকুর ঘাটে যেমন থাক থাক কোরে কাটা নারকেল গাছের গুড়ি থাকে, তেমনি একটা গুড়ি বসানো। তারই নিচের ধাপে পা রেখে মজিদ আবার থুথু ফেলে, তারপর বলে,—রূপ দিয়া কী হইবো? মাইনষের রূপ ক-দিনের? ক-দিনেরই বা জীবন তার?
ক্ষিপ্ৰগতিতে জমিলা স্বামীর পানে তাকায়। শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখের মতোই সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখ।
মজিদ বলে চলে,—তোমার বাপ-মা দেখি বড় জাহেল কিছিমের মানুষ। তোমারে কিছু শিক্ষা দেয় নাই। অবশ্য তার জন্যে হাশরের দিনে তারাই জবাবদিহি দিবো। তোমার দোষ কী?
জমিলা শোনে, কিছু বলে না। মজিদ কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা কোরে বলে,–কাইল যে কামটি করছ, তা কী শক্ত গুণার কাম জানো নি, ক্যামনে করলা কামটা? খোদারে কী ডরাও না, দোজখের আঁগরে কী ডরাও না?
জমিলা পূর্ববৎ নীরব। কেবল ধীরে ধীরে কাঠের মতো শক্ত হয়ে ওঠে তার মুখটা।
–তাছাড়া, এই কথা সর্বদা খেয়াল রাখিও যে, যার-তার ঘরে আস নাই তুমি! এই ঘর মাজার পাকের ছায়ায় শীতল, এইখানে তাঁনার রূহ-এর দোয়া মানুষের শান্তি দেয়, সুখ দেয়। তাঁনার দিলে গোসা আসে এমন কাম কোনো দিন করিও না।
তারপর আর একবার সশব্দে থুথু ফেলে মজিদ পুকুর ঘাটের দিকে রওনা হয়।
জমিলা তেমনি বসে থাকে। ভঙ্গিটা তেমনি সতর্ক,কান খাড়া কোরে রাখা সশঙ্কিত হরিণের মতো। তারপর হঠাৎ একটা কথা সে বোঝে। কঁচা গোস্তে মুখ দিতে গিয়ে খট কোরে একটা আওয়াজ শুনে ইদুর যা বোঝে, হয়তো তেমনি কিছু একটা বোঝে সে। সে যেন খাচায় ধরা পড়েছে।
তারপর এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। দপ করে জমিলার চোখ জ্বলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, নাসারন্ধ বিস্ফারিত হয়, দাউ দাউ করা শিখার মতো সে দীর্ঘ হয়ে ওঠে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই শান্ত হয়ে অধিকতর মনোযোগ সহকারে জমিলা সিঁথি কাটতে থাকে।
সে-দিন বাদ-মগরের শিরনি চড়ানো হবে। যে-দিন শিরনি চড়ানো হবে বলে মজিদ ঘোষণা করে সে-দিন সকাল থেকে লোকেরা চাল-ডাল মশলা পাঠাতে শুরু করে। সে-চাল-ডাল মজিদ ছুয়ে দিলে রহীমা তা দিয়ে খিচুড়ি রাধে। অন্দরের উঠানে সে-দিন কাটা চুলায় ব্যাপারীর বড় বড় ডেকচিতে বান্না হতে থাকে। ওদিকে বাইরে জিকির হয়। জিকিরের পর খাওয়া-দাওয়া।
মজিদ পুকুরঘাট থেকে ফিরে এলে প্ৰথম চাল-ডাল-মশলা এল ব্যাপারীর বাড়ি থেকে। সেই শুরু। তারপর একসের-আধাসের কোরে নানাবাড়ি থেকে তেমনি চাল-ডাল-মশলা আসতে থাকে। অপরাহের দিকে অন্দরে উঠানে চুলা কাটা হলো। শীঘ্ৰ সে-চুলা গানগন কোরে উঠবে আগুনে।
মগরেবের পর লোকেরা এসে বাহিরা-ঘরে জমতে লাগল। কে একজন মোমবাতি এনেছে কটা, তাছাড়া আগরবাতিও এনেছে এক গোছা। বিছানো সাদা চাদরের ওপর মজিদ বসলে তার দুপাশে রাখা হলো দুটো দীর্ঘ মোমবাতি, আর সামনে এক গোছা আগরবাতির জ্বলন্ত কাঠি। কাঠিগুলো একভাণ্ড চালের মধ্যে বসানো।
মজিদ আজ লম্বা সাদা আলখাল্লা পরেছে। পিঠ টান করে হাঁটু গেড়ে বসে সেটা গুজে দিয়েছে পায়ের নিচে পর্যন্ত। আর মাথায় পরেছে আধা পাগড়ি, পেছন দিকটায় তার বিঘৎ খানেক লেজ।
যথেষ্ট দোয়া-দরূদ পাঠের পর জিকির শুরু হয়। প্ৰথমে অতি ধীরে ধীরে প্রশান্ত সমুদ্রের বিলম্বিত ঢেউয়ের মতো। কারণ লোকেরা তখন পরস্পরের নিকট হতে দূরে দূরে ছড়িয়ে আছে যোগশূন্য হয়ে। কিন্তু এই যোগশূন্যতার মধ্যে এ-কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবার জন্যই তারা ভাসতে শুরু করেছে, উঠতে-নামতে শুরু
করেছে।
টিমেতে তাল ঢেউয়ের মতো ভাসতে ভাসতে তারা ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে পরস্পরের সন্নিকটে .। এ-ধীরগতিশীল অগ্রসর হবার মধ্যে চাঞ্চল্য নেই এখনো, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বও নেই। খোদার অস্তিত্বের মতো তাদের লক্ষ্যের অবস্থান সম্পর্কে একটা নিরুদ্বিগ্ন বিশ্বাস।
সন্ধ্যাটি হাওয়াশূন্য। মোমবাতির শিখা স্থির ও নিষ্কম্প। অদূরে সালু কাপড়ে আবৃত মাছের পিঠের মতো মাজারটি মহাসত্যের প্রতীক স্বরূপ অটুট জমাট পাথরে নীরব, নিশ্চল।
কিন্তু ধীরে ধীরে এদের গলা চড়তে থাকে। ক্রমে ক্ৰমে দুনে চড়ে জিকির। প্ৰত্যেকে পরস্পরের সন্নিকটে আসতে থাকে, এবং যে-মহা অগ্নিকুণ্ডের স্মৃষ্টি হবে শীঘ্ৰ, তারই ছিটেফোটা ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে ঘনিষ্ঠতার সংঘর্ষণে।
মজিদের চোখ ঝিমিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে বারবার দেহ ঝুকে আসে। মুখের কথা আধা বুকে বিধে যায় আর তার অন্তর-খনন গভীরতর হতে থাকে। ভেতর থেকে ক্রমশ বলকে-বলকে একটা অস্পষ্ট, বিচিত্র আওয়াজ বেরোয় শুধু। আর কতক্ষণ? পরস্পরের দাহ্য-চেতনা এইবার মিলিত হবে-হচ্ছে করছে। একবার হলে মুহুর্তে সমস্ত কিছু মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, দুনিয়ার মোহ আর ঘরবসতির মায়া-মীম তা জ্বলে ছরখার হয়ে যাবে।
আওয়াজ বিচিত্ৰতর হতে থাকে। হু হু হু। আবার; হু হু হু। আবার…
অন্দরে উঠানে মজিদ নিজের হাতে যে-শিরনি চড়িয়ে এসেছে, তার তদারক করার ভার রহীমা-জমিলার ওপর। চাদহীন রাতে ঘন অন্ধকারের গায়ে বিরাট চুলা গানগন করে, আর কালো হাওয়া ভালো চালের মিহি-মিষ্টি গন্ধে ভুরভুর করে।
কাজের মধ্যে জমিলা উবু হয়ে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে বড় ডেকচিটাতে বলক-ওঠা চেয়ে চেয়ে দেখে। সাহায্য করতে পাড়ার মেয়েরা যারা এসেছে তারা অশরীরীর মতো নিঃশব্দে ঘুরে ঘুরে কাজ করে। ধোয়া-পাকলা করে, লাকড়ি ফাড়ে, কিন্তু কথা কয় না কেউ।
বাইরে থেকে ঢেউ আসে জিকিরের। ডেকচিতে বলক আসা দেখে জমিলা, আর সে-ঢেউয়ের গর্জন কান পেতে শোনে। সে-ঢেউ যখন ক্রমশ একটা অবক্তব্য উত্তাল ঝড়ে পরিণত হয় তখন এক সময়ে হঠাৎ কেমন বিচলিত হয়ে পড়ে জমিলা। সে-ঢেউ তাকে আচম্বিতে এবং অত্যন্ত রূঢ়ভাবে আঘাত করে। তারপর আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকে। একটা সামলিয়ে উঠতে না উঠতে আরেকটা। সে আর কত সহ্য করবে! বালুতীরে যুগযুগ আঘাত পাওয়া শক্ত-কঠিন পাথর তো সে নয়। হঠাৎ দিশেহারা হয়ে সে পিঠ সোজা কোরে বসে, তারপর বিভ্ৰান্ত দৃষ্টিতে এধার-ওধার চেয়ে শেষে রহীমার পানে তাকায়। গনগনে আগুনের পাশে কেমন চওড়া দেখায় তাকে, কিন্তু কানের পাশে গোজা ঘোমটায় আবৃত মাথাটি নিশ্চল; চোখ তার বাষ্পের মতো ভাসে।
পানিতে ডুবতে থাকা মানুষের মতো মুখ তুলে আবার শরীর দীর্ঘ করে জমিলা, থাই পায় না কোথাও। শেষে সে রহীমাকে ডাকে,—বুবু!
রহীমা শোনে কি শোনে না! সে ফিরে তাকায়ও না, উত্তরও দেয় না। এ-দিকে ঢেউয়ের পর আরো ঢেউ আসে, উত্তাল উত্তঙ্গ ঢেউ। হু হু হু। আবার; হু হু হু। দুনিয়া যেন নিশ্বাস রুদ্ধ কোরে আছে, আকাশে যেন তারা নেই।
তারপর একটি পরে চীৎকার ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়কর দ্রুততায় আসতে থাকা পৰ্দাত প্রমাণ অজস্র ঢেউ ভেঙে ছত্ৰখান হয়ে যায়। মুহুর্তে কী যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, মারাত্মক বন্যাকে যেন অবশেষে কারা রুখতে পারে না। এবার ভেসে যাবে জনমানব-ঘরবসতি, মানুষের আশা ভরসা।
বিদ্যুৎগতিতে জমিল উঠে দাঁড়ায়। ক্ষীণদেহে বৃদ্ধ বৃক্ষের মতো কঠিনভাবে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট কণ্ঠে আবার ডাকে,—বুবু!
এবার রহীম। মুখ তুলে তাকায়। তার চওড়া দেহটি শান্ত দিনের নদীব মতো বিস্তু • আপ নিস্তরঙ্গ। উজ্জ্বল্পলৈ চোখ ঝলমল করছে বটে। কিন্তু তাও শান্ত, স্পষ্ট। সে-চোখের দিকে জমিলা তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহুর্ত, কিন্তু অবশেষে কিছু বলে না। তারপর সে দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে, উঠান পেরিয়ে বাইরের দিকে।
জিকির করতে করতে মজিদ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। এ হয়েই থাকে। তবু লোকেরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ হাওয়া করে, কেউ বুকফাটা আওয়াজে হা-হা কোরে আফসোস করে, কেউ বা এ-হট্টগোলের সুযোগে মজিদের অবশ্য পদযুগল মত্ত চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত কোরে দেয়। কেবল ক্ষয়ে আসা মোমবাতি দুটো তখনো নিষ্কম্প স্থিরতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে।
হঠাৎ একটি লোকের নজর বাইরের দিকে যায়। কেন যায় কে জানে, কিন্তু বাইরে গাছতলার দিকে তাকিয়ে সে মুহুর্তে স্থির হয়ে যায়। কে ওখানে? আলিঝালি দেখা যায়, পাতলা একটি মেয়ে, মাথায় ঘোমটা নেই। সে আর দৃষ্টি ফেরায় না। তারপর একে একে অনেকেই দেখে। তবু মেয়েট নড়ে না। অস্পষ্ট অন্ধকারে ঘোমটাশূন্য তার মুখটা ঢাকা চাঁদের মতো। রহস্যময় মনে হয়।
শীঘ্ৰ মজিদের জ্ঞান হয়। ধীরে ধীরে সে উঠে বসে তারপর চোখে অর্থহীন অবসাদ নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবার দিকে তাকায়। এক সময়ে সেও দেখে মেয়েটিকে। সে তাকায়, তারপর বিমূঢ় হয়ে যায়। বিমূঢ়তা কাটলে দপ কোরে জ্বলে ওঠে চোখ।
অবশেষে কী কোরে যেন মজিদ সরল কণ্ঠে হাসে। সকল দিকে চেয়ে বলে,–পাগলী ঝিট। একটু থেমে আবার বলে, নোতুন বিবির বাড়ির লোক, তার সঙ্গে আসছে।
তারপর হাততালি দিয়ে উচু গলায় মজিদ হাঁকে, এই বিটি ভাগ! ঠোঁটে তখনো হাসির রেখা, কিন্তু সে-দিকে তাকিয়ে চোখ তার দপদপ করে জ্বলে।
হয়তো তার চোখের আগুনের হল্কা লেগেই ঘোর ভাঙে জমিলার। হঠাৎ সে ভেতরের দিকে চলতে থাকে, তারপর শীঘ্ৰ বেড়ার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আবার জিকির শুরু হয়। কিন্তু কোথায় যেন ভাঙন ধরেছে, জিকির আর জমে না। লোকের মাথা দোলায় বটে। কিন্তু থেকে থেকে তাদের দৃষ্টি বিদ্যুৎ-ক্ষিপ্ৰতায় নিক্ষিপ্ত হয় গাছতলার দিকে। কঙালের মতো তাদের দৃষ্টি কী যেন হাতড়ায়। মহাসমুদ্রের ডাককে অবহেলা কোরে বালুতীরে কী যেন খোঁজে।
অবশেষে মজিদ মুখ তুলে তাকায়। জিকিরের ধ্বনিও সেই সঙ্গে থামে। ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতি দুটো নিষ্কম্পভাবে জ্বলে, কিন্তু আগরবাতির কাঠিগুলো চালের মধ্যে কখন গুঁড়িয়ে ভস্ম হয়ে আছে।
কিছু বলার আগে মজিদ একবার কাশে। কেশে একে একে সকলের পানে তাকায়। তারপর বলে,–ভাই সকল, আমার মালুম হইতেছে কোনো কারণে আপনারা বেচইন আছেন। কী তার কারণ?
কেউ উত্তর দেয় না। কেবল উত্তর শোনার জন্য তারা পরস্পরের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। কতক্ষণ অপেক্ষা করে মজিদ তারপর বলে,–আইজ জিকির ক্ষান্ত হইল।
খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়। অন্যান্য দিন জিকিরের পর লোকেরা প্ৰচণ্ড ক্ষিধে নিয়ে গোগ্রাসে খিচুড়ি গেলে, আজ কিন্তু তেমন হাত চলে না তাদের। কিসের লজ্জায় সবাই মাথা নিচু করে রেখেছে, আর কেমন বিসদৃশভাবে চুপচাপ।
নিবন্ত চুলার পাশে রহীম। তখনো বসে আছে, পাশে নামিয়ে রাখা খিচুড়ির ডেকচি। বুড়ো আওলাদ অন্দরে-বাইরে আসা-যাওয়া করে। এবার খালি বর্তন নিয়ে আসে ভেতরে।
একটু পরে মজিদও আসে। রহীমা আলগোছে ঘোমটা টেনে সিধা হয়ে বসে। ভাবে, রান্না ভালো হলো কী খারাপ হলো এইবার মতামত জানাবে মজিদ। কাছে এসে মজিদ। কিন্তু রান্না সম্পর্কে কোনো কথাই বলে না। কেমন চাপ কৰ্কশ গলায় প্রশ্ন করে,–হে কই?
রহীমা চারধারে তাকায়। কোথাও জমিলা নেই। মনে পড়ে, তখন সে যে হঠাৎ উঠে চলে গেলো তারপর আর সে এ-দিকে আসেনি। আস্তে রহিমা বলে,–বোধ হয় ঘুমাইছে।
দাঁত কিড়ামিড় কোরে এবার মজিদ বলে,–ও যে একদম বাইরে চইলা গেলো, দেখলা না তুমি?
মুহুর্তে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় রহীম। জমিলা বাইরে গিয়েছিল? কতক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে গালে হাত দিয়ে
প্ৰশ্ন করে,–হে বাইরে গেছিল?
তখনো দাঁত কিড়মিড় করে মজিদের। উত্তরে শুধু বলে,–হ!
তারপর হনহানিয়ে ভেতরে চলে যায়। রহীমা অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকে। তার হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে আসে।
পরে সে-দিনকার মতো জমিলাকে ডাকতে সাহস হয় না। নিবন্ত হুঁকাটা পাশে নামিয়ে রেখে সিড়ির কাছাকাছি গুম হয়ে বসে ছিল মজিদ। তার দিকে চেয়ে ভয় হয় যে, ডাকার আওয়াজে সহসা সে জেগে উঠবে, চাপা ক্ৰোধ হঠাৎ ফেটে পড়বে, নিশ্বাসরুদ্ধ-করা আশঙ্কার মধ্যে তবু যে-নীরবতা এখনো অক্ষুন্ন আছে তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তাই উঠানটা পেরুতে গিয়ে সতর্কভাবে হাটে রহীম, নিঃশব্দে আর আলাগোছে। কিন্তু এ-দিকে তার মাথা বিমঝিম করে। জমিলার বাইরে যাওয়ার কথা যখনই ভাবে তখনই তার মাথা ঝিমঝিম কোরে ওঠে। মনে মনে কেমন ভীতিও বোধ করে। লতার মতো মেয়েটি যেন এ-সংসারে ফাটল ধরিয়ে দিতে এসেছে। ঘরে সে যেন বালা ডেকে আনবে। আর মাজার-পাকের দোয়ায় যে-সংসার গড়ে উঠেছে সে-সংসার ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
ওদিক থেকে রহীমা সিড়ির দিকে এলে মজিদ হঠাৎ ডাকেবিবি, শোনো! তোমার লগে কথা আছে।
সে নিরুত্তরে পাশে এসে দাড়ালে মজিদ মুখ তুলে তাকায় তার পানে। সংকীর্ণ দাওয়ার ওপর একটি কুপি বসানো। তার আবছা আলো কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রহীমার মুখকে অস্পষ্ট কোরে তোলে। সে-দিকে তাকিয়ে মজিদের ঠোঁট যেন কেমন থর থর কোবে কেঁপে ওঠে।–বিবি, কারে বিয়া করলাম? তুমি কী বদদোয়া দিছিলা নি?
শেষোক্ত কথাটা তড়িৎবেগে আহত করে রহীমাকে। তৎক্ষণাৎ সে ক্ষুঃ কণ্ঠে উত্তর দেয়,–তওবা-তাওবা, কী যে কেন। কিন্তু তারপর তার কথা গুলিয়ে যায়। মুখ তুলে তাকিয়েই থাকে মজিদ। অস্পষ্ট আলোর মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রহীম। মুখের একপাশে গাঢ় ছায়া, চোখ দুটো ভেজা মাটির মতো নরম। মৃত্যুর্তের মধ্যে মজিদ উপলব্ধি করে যে, চওড়া ও রঙ-শূন্য নিম্পূহ মানুষ রহীমা মনে নেশা না জাগালেও তারই ওপর সে নির্ভর করতে পারে। তার আনুগত্য এপ্রুবতারার মতো অনড়, তার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল। সে তার ঘরের খুটি।
হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো নিশ্বাস ফেলে জীবনে প্রথম হয়তো কোমল হয়ে এবং নিজের সপ্তার কথা ভুলে গিয়ে সে রহীমাকে বলে,—কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে যানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও।
রাতের ঘনিষ্ঠতার মধ্যেও কখনো এমন সহজ সরল পরমাত্মীয়ের কথা মজিদ বলে না! তাই ঝট করে রাহীমা তার অর্থ বোঝে না। অকারণে মাথায় ঘোমটা টানে, তারপর ঈষৎ চমকে উঠে তাকায় স্বামীর পানে। তাকিয়ে নোতুন। এক মজিদকে দেখে। তার শীর্ণ মুখের একটি পেশীও এখন সচেতনভাবে টান হয়ে নেই। এতদিনের সহবাসের ফলেও যে-চোখের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেনি সে-চোখ এই মুহুর্তে কেমন অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে নির্ভেজাল হৃদয় নিয়ে যেন তাকিয়ে আছে। দেখে একটা অভূতপূর্ব ব্যথাবিদীর্ণ আনন্দভােব ছেয়ে আসে রহীমার মনে, তারপর পুলক শিহরণে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। সে পুলক শিহরণের অজস্র ঢেউয়ের মধ্যে জমিলার মুখ তলিয়ে যায়, তারপর ডুবে যায় চোখের আড়ালে।
হঠাৎ ঝামটা দিয়ে রহীমা বলে,–কী কামু মাইয়াড যানি কোমুন। পাগলী। তা আপনে এলেমদার মানুষ। দোয়াপানি দিলে ঠিক হইয়া যাইবো নি সব।
পরদিন থেকে শিক্ষা শুরু হয় জমিলার। ঘুম থেকে উঠে বাসি খিচুড়ি গোগ্রাসে গিলে খেয়ে সে উঠানে নেমেছে এমন সময় মজিদ ফিরে আসে বাইরে থেকে। এ-সময়ে সে বাইরেই থাকে। ফজরের নামাজ পড়ে সারা সকাল কোরান শরীফ পাঠ করে। আজ নামাজ পড়েই সোজা ভেতরে চলে এসেছে।
মজিদের মুখ গম্ভীর। ততোধিক গম্ভীর কণ্ঠে জমিলাকে ডেকে বলে, কাইল তুমি আমার বে-ইজ্জত করছি! খালি তা না, তুমি তানারে নারাজ করছি। আমার দিলে বড় ডর উপস্থিত হইছে। আমার উপর তানার এৎবার না থাকলে আমার সর্বনাশ হইবো। একটু থেমে মজিদ আবার বলে,–আমার দয়ার শরীল। অন্য কেউ হইলে তোমারে দুই লাথি দিয়া বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দিত। আমি দেখলাম, তোমার শিক্ষা হয় নাই, তোমারে শিক্ষা দেওন দরকার। তুমি আমার বিবি হইলে কী হইবো, তুমি নাজুক শিশু।
জমিলা আগাগোড়া মাথা নিচু করে শোনে। তাব চোখের পাতাটি পর্যন্ত একবার নড়ে না। তার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মজিদ একটু রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করে,–হুনছ নি কী কইলাম?
কোনো উত্তর আসে না জমিলার কাছ থেকে। তার নিবাক মুখের পানে কতক্ষণ চেয়ে থেকে মজিদের মাথায় সেই চিনচিনে রাগটা চড়তে থাকে। কণ্ঠস্বর আরো রুক্ষ করে সে বলে,–দেখো বিবি, আমারে রাগাইও না। কাইল যে কামটা করছি, তার পরেও আমি চুপচাপ আছি। এই কারণে যে আমার শরীলটা বড়ই দয়ার। কিন্তু বাড়াবাড়ি করিও না কইয়া দিলাম।
কোনো উত্তর পাবে না জেনেও আবার কতক্ষণ চুপ করে থাকে মজিদ। তারপর ক্ৰোধ সংযত করে বলে,—তুমি আইজ রাইতে তারাবি। নামাজ পড়বা। তারপর মাজারে গিয়া তানার কাছে মাফ চাইবা। তানার নাম মোদচ্ছের। কাপড়ে ঢাকা মানুষবে কোরানেব ভাষায় কয় মোদচ্ছের। সালু-কাপড়ে ঢাকা মাজারের তলে কিন্তু তানি ঘুমাইয়া নাই। তিনি সব জানেন, সব দেখেন।
তারপর মজিদ একটা গল্প বলে। বলে যে, একবার রাতে এশার নামাজের পর সে গেছে মাজার-ঘরে। কখন তার অজু ভেঙে গিয়েছিল খেয়াল করেনি। মাজার-ঘরে পা দিতেই হঠাৎ কেমন একটি আওয়াজ কানে এল তার, যেন দূর জঙ্গলে শত-সহস্ৰ সিংহ একযোগে গর্জন করছে। বাইরে কী একটা আওয়াজ হচ্ছে ভেবে সে ঘর ছেড়ে বেরুতেই মুহুর্তে সে-আওয়াজ থেমে গেলো। বড় বিস্মিত হলো সে, ব্যাপারটার আগামাথা না বুঝে কতক্ষণ। হতভম্বর মতো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। একটু পরে সে যখন ফের প্রবেশ করল মাজার-ঘরে তখন শোনে আবার সেই শত-সহস্ৰ সিংহের ভয়াবহ গর্জন। কী গর্জন, শুনে রক্ত তার পানি হয়ে গেলে ভয়ে। আবার বাইরে গেলো, আবার এল ভেতরে। প্রত্যেকবারই একই ব্যাপার। শেষে কী করে খেয়াল হলো যে, অজু নেই তার, নাপাক শরীবে পাক মাজার-ঘরে সে ঢুকেছে। ছুটে গিয়ে মজিদ তালাবে অজু বানিয়ে এল। এবার যখন সে মাজার-ঘরে এল তখন অব কোনো আওয়ােজ নেই। সে-রাতে দরগার কোলে বসে অনেক অশ্রু বিসর্জন করল মজিদ।
গল্পটা মিথ্যে। এবং সজ্ঞানে ও সুস্থদেহে মিথ্যে কথা বলেছে বলে মনে মনে তওবা কাটে মজিদ। যা-হোক, জমিলার মুখের দিকে চেয়ে মজিদের মনের আফসোস ঘোচে। যে অত কথাতেও একবার মুখ তুলে তাকায়নি সে মাজার-পাকের গল্পটা শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে তার পানে। চোখে কেমন ভীতির ছায়া। বাইরে অটুট গাম্ভীৰ্য বজায় রাখলেও মনে মনে মজিদ কিছু খুশি না হয়ে পারে না। সে বোঝে, তার শ্রম সার্থক হবে, তার শিক্ষা ব্যর্থ হবে না।
—তয় তুমি আইজ রাইতে নামাজ পড়বা তারাবির, আর পরে তানার কাছে মাফ চাইবা।
জমিলা ততক্ষণে চোখ নামিয়ে ফেলেছে। কথার কোনো উত্তর দেয় নাই।
তারাবিই হোক আর যাই হোক, সে-রাতে দীর্ঘকাল সময় জমিলা জয়নামাজেঞ্চ ওঠা বসা করে। ঘরসংসারের কাজ শেষ করে রহীমা যখন ভেতরে আসে তখনো তার নামাজ শেষ হয়নি। দেখে মন তার খুশিতে ভরে ওঠে। ওঘরে মজিদ হুঁকায় দম দেয়। আওয়াজ শুনে মনে হয় তার ভেতরটাও কেমন তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে। রহীমা অজু বানিয়ে এসেছে, সেও এবার নামাজটা সেরে নেয়। তারপব পা টিপতে হবে কিনা এ-কথা জানার অজুহাতে মজিদের কাছে গিয়ে আভাসে-ইঙ্গিতে মনের খুশির কথা প্ৰকাশ করে। উত্তরে মজিদ ঘন ঘন হুঁকায় টান মারে আর চোখটি পিটপিট করে আত্মসচেতনতায়।
রহীমা কিছুক্ষণের জন্য স্বতঃপ্ৰবৃত্ত হয়ে স্বামীর পা টেপে। হাড়সম্বল কঠিন পা, মৃতের মতো শীতল শুষ্ক তার চামড়া। কিন্তু গভীর ভক্তিভরে সে-পা টেপে রহীমা, ঘুণধরা হাড়ের মধ্যে যে-ব্যথার রস টনটন করে, তার আরাম করে।
সুখভোগ নীরবেই করে মজিদ। হুঁকায় তেজ কমে এসেছে, তবু টেনে চলে। কানটা ওধারে। নীরবতার মধ্যে ওঘর হতে থেকে থেকে কঁচের চুড়ির মৃদু ঝঙ্কার ভেসে আসে। সে কান পেতে শোনে সে ঝঙ্কার।
সময় কাটে। রাত গভীর হয়ে ওঠে বাঁশঝাড়ে, গাছের পাতায় আর মাঠে-ঘাটে। একসময়ে রহীমা আস্তে উঠে চলে যায়। মজিদের চোখেও একটু তন্দ্রার মতো ভাব নামে। একটু পরে সহসা চমকে জেগে উঠে সে কান খাড়া করে। ওধারে পরিপূর্ণ নীরবতা।–সে-নীরবতার গায়ে আর চুড়ির চিকন আওয়াজ নেই।
ধীরে ধীরে মজিদ ওঠে। ওঘরে গিয়ে দেখে, জায়নামাজের ওপর জমিলা সেজদা দিয়ে আছে। এখুনি উঠবে–এই অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে মজিদ। জমিলা কিন্তু ওঠে না।
ব্যাপারটা বুঝতে এক মুহুর্ত বিলম্ব হয় না। মজিদের। নামাজ পড়তে পড়তে সেজদায় গিয়ে হঠাৎ সে ঘুমিয়ে পড়েছে। দস্যুর মতো আচমকা এসেছে সে-ঘুম, এক পলকের মধ্যে কাবু করে ফেলেছে তাকে।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মজিদ, বোঝে না। কী করবে। তারপর সহসা আবার সেই চিনচিনে ক্ৰোধ তার মাথাকে উত্তপ্ত করতে থাকে। নামাজ পড়তে পড়তে যার ঘুম এসেছে তার মনে ভয় নেই। এ-কথা স্পষ্ট। মনে নিদারুণ ভয় থাকলে মানুষের ঘুম আসতে পারে না কখনো। এবং এত কোরেও যার মনে ভয় হয়নি, তাকেই এবার ভয় হয় মজিদের।
হঠাৎ দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে সেদিনকার মতো এক হাত ধরে হ্যাচক টান মেরে বসিয়ে দেয় জমিলাকে। জমিলা চমকে উঠে তাকায় মজিদের পানে, প্ৰথমে চোখে জাগে ভীতি, তারপর সে-চোখ কালো হয়ে আসে।
মজিদ গোঁ গোঁ করে ক্ৰোধে। রাতের নীরবতা এত ভারী যে, গলা ছেড়ে চীৎকার করতে সাহস হয় না, কিন্তু একটা চাপা গর্জন নিঃসৃত হয় তার মুখ দিয়ে। যেন দূর আকাশে মেঘ গৰ্জন করে গড়ায়, গড়ায়।
–তোমার এত দুঃসাহস? তুমি জায়নামাজে ঘুমাইছ? তোমার দিলে একটু ভয়ডর হইবো না?
জমিলা হঠাৎ থারথার করে কাঁপিতে শুরু করে। ভয়ে নয়, ক্ৰোধে। গোলমাল শুনে রহীমা পাশের বিছানা থেকে উঠে এসেছিল, সে জমিলার কঁপুনি দেখে ভাবল দুরন্ত ভয় বুঝি পেয়েছে মেয়েটার। কিন্তু গর্জন করছে মজিদ, গর্জন করছে খোদাতালার ন্যায়বাণী, তাঁর নাখোশ দিল। মজিদের ক্ৰোধ তো তাঁরই বিদ্যুৎচ্ছটা, তাঁরই ক্ৰোধের ইঙ্গিত। কী আর বলবে রহীমা। নিদারুণ ভয়ে সেও অসাড় হয়ে যায়। তবে জমিলার মতো কাঁপে না।
বাক্যবাণ নিৰ্ম্মফল দেখে আরেকটা হ্যাচক টান দেয় মজিদ। শোয়া থেকে আচমকা একটা টানে যে উঠে বসেছিল, তাকে তেমনি একটা টান দিয়ে দাঁড় করাতে বেগ পেতে হয় না। ববঞ্চ কিছু বুঝে উঠবার আগেই জমিলা দেখে যে, সে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও খুব শক্তভাবে নয়। তারপর সে আপন শক্তিতে সুস্থির হয়ে দাড়াল, এবং কাঁপিতে থাকা ঠোঁটকে উপেক্ষা করে শান্ত দৃষ্টিতে একবার নিজের ডান হাতের কঞ্জিব পানে তাকাল। হয়তো ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু ব্যথার স্থান শুধু দেখল। তাতে হাত বুলাল না। বুলাবার ইচ্ছে থাকলেও অবসর পেল না। কারণ আরেকটা হ্যাচক টান দিয়ে মজিদ তাকে নিয়ে চললে বাইরের দিকে।
উঠানটা তখনো পেরোয়নি, বিভ্ৰান্ত জমিলা হঠাৎ বুঝলে, কোথায় সে যাচ্ছে। মজিদ তাকে মাজারে নিয়ে যাচ্ছে। তারাবির নামাজ পড়ে মাজারে গিয়ে মাফ চাইতে হবে সে-কথা মজিদ আগেই বলেছিল, এবং সেই থেকে একটা ভয়ও জেগে উঠেছিল জমিলার মনে। মাজারের ত্ৰিসীমানায় আজ পর্যন্ত ঘেষেনি সে। সকালে আজ মজিদ যে-গল্পটা বলেছিল, তারপর থেকে মাজারের প্রতি ভয়টা আরো ঘনীভূ৩ হয়ে উঠেছে।
মাঝ-উঠানে হঠাৎ বেঁকে বসল জমিলা। মজিদের টানে স্রোতে ভাসা তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাচ্ছিল, এখন সে সমস্ত শক্তি সংযোগ করে মজিদের বজ্রমুষ্টি হতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও হাত যখন ছাড়াতে পারল না। তখন সে অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ সিধে হয়ে মজিদের বুকের কাছে এসে পিচ কবে তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল।
পেছনে পেছনে রহীমা আসছিল কম্পিত বুক নিয়ে। আবছা অন্ধকারে ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না; এও বুঝল না, মজিদ আমন বজ্রাহত মানুষের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন। কিছু না বুঝে সে বুকের কাছে আঁচল শক্ত করে ধরে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মজিদ যেন সত্যি বজ্রাহত হয়েছে। জমিলা এমন একটা কাজ করেছে যা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কেউ করতে পারে। যার কথায় গ্রাম ওঠে-বসে, যার নির্দেশে খালেক ব্যাপারীর মতো প্ৰতিপত্তিশালী লোকও বউ তালাক দেয়। দ্বিরুক্তি মাত্র না করে, যার পা খোদিভাবমত্ত লোকেরা চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত করে দেয়, তার প্রতি এমন চরম অশ্রদ্ধা কেউ দেখাতে পারে সে-কথা ভাবতে না পারাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে মজিদ রহীমার পানে তাকাল। তাকিয়ে অদ্ভুত গলায় বলল,—হে আমার মুখে থুথু দিলো!
একটু পরে অন্ধকার থেকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল রহীমা,–কী করলা বইন তুমি, কী করলা!
তার আর্তনাদে কী ছিল কে জানে, কিন্তু ক্ৰোধে থারথার করে কাঁপিতে থাকা জমিলা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলে মনে-প্ৰাণে। কী একটা গভীর অন্যায়ের তীব্ৰতায় খোদার আরশ পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠেছে।
মজিদ রহীমার চীৎকার শুনল কী শুনল না, কিন্তু ওধারে তাকাল না, কোনো কথাও বলল না। আরো কিছুক্ষণ সে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ হাতকাটা ফতুয়ার নিম্নাংশ দিয়ে মুখটা মুছে ফেলল। ইতিমধ্যে তার ডান হাতের বজকঠিন মুঠোর মধ্যে জমিলার হাতটি টিলা হয়ে গেছে; সে-হা ৩ ছাড়িয়ে নেবার আর চেষ্টা নেই, বন্দী হয়ে আছে বলে প্ৰতিবাদ নেই। তার হাতের লাইট্টা মাছের মতো হাড়গোডহীন তুলতুলে নরম ভাব দেখে মজিদ অসতর্ক হবার কোনো কারণ দেখল। না। সে নিজের বজমুষ্টিকে আরো কঠিনতর করে তুলল। তারপর হঠাৎ দু-পা এগিয়ে এসে এক নিমেষে তাকে পাজকেল করে শূন্যে তুলে আবার দ্রুতপায়ে ঠাঁটতে লাগল, বাইরের দিকে। ভেবেছিল, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করবে। জমিলা, কিন্তু তার ক্ষুদ্র অপরিণত দেহটা নেতিয়ে পড়ে থাকল মজিদের অর্ধচক্রাকারে প্রসারিত দুই বাহুতে। এত নরম তার দেহের ঘনিষ্ঠত যে তারার ঝালকানির মতো এক মুহূর্তের জন্য মজিদের মনে ঝলকে ওঠে একটা আকুলতা; তা তাকে তার বুকের মধ্যে ফুলের মতো নিষ্পেষিত করে ফেলবার। কিন্তু সে-ক্ষুদ্র লতার মতো মেয়েটির প্রতিই ভয়টা দুৰ্দান্ত হয়ে উঠল। এবারেও সে অসতর্ক হলো না। এখন গা-ঢেলে নিস্তেজ হয়ে থাকলে কী হবে বিষাক্ত সাপকে দিয়ে কিছু বিশ্বাস নেই।
জমিলাকে সোজা মাজার-ঘরে নিয়ে ধপাস করে তার পাদপ্রান্তে বসিয়ে দিলে মজিদ। ঘর অন্ধকার। বাইরে থেকে আকাশের যে অতি মান আলো আসে তা মাজার-ঘরের দরজাটিবে ই কেবল রেখায়িত করে রাখে, এখানে সে আলো পৌছায় না। এখানে যেন মৃত্যুর আর ভিন্ন অপরিচিত দুনিয়ার অন্ধকার; সে-অন্ধকারে সূর্য নেই, চাদ–তারা নেই, মানুষের কুপি-লণ্ঠন বা চকমকির পাথর নেই। খুন হওয়া মানুষের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনে অন্ধের চোখে দৃষ্টির জন্য যে-তীব্র ব্যাকুলতা জাগে তেমনি একটা ব্যাকুলতা জাগে অন্ধকারের গ্রাসে জ্যোতিহীন জমিলার চোখে। কিন্তু সে দেখে না কিছু। কেবল মনে হয়, চোখের সামনে অন্ধকারই যেন অধিক তাঁর গাঢ় হয়ে রয়েছে।
তারপর হঠাৎ যেন ঝড় ওঠে। অদ্ভুত ক্ষিপ্ৰতায় ও দুবন্ত বাতাসের মতো বিভিন্ন সুরে মজিদ দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করে। বাইরে আকাশ নীরব, কিন্তু ওর কণ্ঠে জেগে ওঠ দুনিয়ার যত অশান্তি আর মরণভীতি, সর্বনাশা ধ্বংস থেকে বাঁচবার তীব্র ব্যাকুলত।
মজিদের কণ্ঠের ঝড় থামে না। জমিলা স্তব্ধ হয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে, মাছের পিঠের মতো একটা ঘনবর্ণ স্তৃপ রেখায়িত হয়ে ওঠে সামনে। মাজারের অস্পষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জমিলার ভীত-চঞ্চল মনটা কিছু স্থির হয়ে এসেছে এমনি সময়ে বুক ফাট কণ্ঠে মজিদ হে। হে করে উঠল। তার দুঃখের তীক্ষ্ণ তার সে কী ধার। অন্ধকারকে যেন চিড়াচড় করে দুফাঁক করে দিলে। সভয়ে চমকে উঠে জমিলা তাকাল স্বামীর পানে। মজিদের কঠে। তখন আবার দোয়া-দরূদের ঝড় জেগেছে, আর ঝড়ের মুখে পড়া ক্ষুদ্রপল্লবের মতো ঘূর্ণমান তার অশান্ত উদভ্ৰান্ত চোখ।
একটু পরে হঠাৎ জমিলা আর্তনাদ করে উঠল। আওয়াজটা জোরাল নয়, কারণ একটা প্ৰচণ্ড ভীতি তার গলা দিয়ে যেন আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর সে চুপ করে গেলো। কিন্তু ঝড়ের শেষ নেই। ওঠা-নমা আছে, দিক পরিবর্তন আছে, শেষ নেই। এবং শেষ নেই বলে মানুষের আশ্বাসের ভরসা নেই।
ধাঁ করে জমিলা উঠে দাঁড়াল। কিন্তু মজিদও ক্ষিপ্ৰভাবে উঠে দাঁড়াল। জমিলা দেখল পথ বন্ধ। যে-ঝড়ের উদ্দামতার জন্য নিশ্বাস ফেলবার যে নেই; সে-ঝড়ের আঘাতেই ডালপালা ভেঙে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। একটু দূরে খোলা দরজা, তারপর অন্ধকার আর তারাময় আকাশের অসীমতা। এইটুকুন পথ পেরোবার উপায় নেই।
জমিলাকে বসিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দোয়া-দবাদ পড়া বন্ধ করে মজিদ। এই সময় সে বলে,–দেখো আমি যেই ভাবে বলি সেইভাবে কর। আমার হাত হইতে দুষ্ট আত্মা, ভূত-প্রেতও রক্ষা পায় নাই। এই দুনিয়ার মানুষরা যেমন আমারে ভয় করে শ্রদ্ধা করে, তেমনি ভয় করে, শ্রদ্ধা করে অন্য দুনিয়ার জিন-পরীরা। আমার মনে হইতেছে, তোমার ওপর কারো আছর আছে। না হইলে মাজার পাকের কোলে বইসাও তোমার চোখে এখনো পানি আইল না কেন, কেন তোমার দিলে একটু পাশেমানির ভাব জাগল না? কেনই-বা মাজার পাক তোমার কাছে আগুনের মতো অসহ্যু লাগিতাছে?
এই বলে সে একটা দড়ি দিয়ে কাছাকাছি একটা খুটির সঙ্গে জমিলার কোমর বাঁধল। মাঝখানের দড়িটি টিলা রাখল, যাতে সে মাজারের পাশেই বসে থাকতে পারে। তারপর ভয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া জমিলার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,—তোমার জন্য আমার মায়া হয়। তোমারে কষ্ট দিতেছি তার জন্য দিলে কষ্ট হইতেছে। কিন্তু মানুষের ফোড়া হইলে সে-ফোড়া ধারাল ছুরি দিয়া কাটতে হয়, জিনের আছর হইলে বেত দিয়া চাবকাইতে হয়, চোখে মরিচ দিতে হয়। কিন্তু তোমারে আমি এই সব করুম না। কারণ মাজার পাকের কাছে রাতের এক প্রহর থাকলে যতই নাছোড় বান্দা দুষ্ট আত্মা হোক না কেন, বাপ-বাপ। ডাক ছাড়ি পলাইবো। কাইল তুমি দেখবা দিলে তোমার খোদার ভয় আইছে, স্বামীর প্রতি ভক্তি আইছে, মনে আর শয়তানি নাই।
মনে মনে মজিদ আশঙ্কা করেছিল, জমিলা হঠাৎ তারস্বরে কঁদতে শুরু করবে। কিন্তু আশ্চৰ্য, জমিলা কাঁদলও না, কিছু বললেও না, দরজার পানে তাকিয়ে মূর্তির মতো বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে গলা উঁচিয়ে বলল,—ঝাপটা দিয়া গেলাম। কিন্তু তুমি চুপ কইরা থাইকো না। দোয়াদরূদ পড়ো, খোদার কাছে আর তানার কাছে মাফ চাও।
তারপর সে বাপ দিয়ে চলে গেলে।
ভেতরে বেড়ার কাছে তখনো দাঁড়িয়ে রহীমা। মজিদকে দেখে সে অক্ষুট কণ্ঠে প্রশ্ন করলে,–হে কই?
–মাজারে। ওর ওপর আছর আছে। মাজারে কিছুক্ষণ থাকলে বাপ-বাপ ডাক ছাড়ি পালাইবো হে-জিন।
—ও ভয় পাইবো না?
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মজিদ। বিস্মিত হয়ে বললে,–কী যে কও তুমি বিবি? মাজার পাকের কাছে থাকলে কিসের ভয়? ভয় যদি কেউ পায় তা ঐ দুষ্ট জিনটাই পাইবো, যে আমার মুখে পর্যন্ত থুথু দিছে। কথাটা মনে হতেই দাঁত কড়মড় করে উঠল মজিদের। দম খিচে ক্ৰোধ সংবরণ করে সে আবার বললে,—তুমি ঘরে গিয়া শোও বিবি।
রহীমা ঘরে চলে গেলো। গিয়ে ঘুমাল কী জেগে রইল তার সন্ধান নেবার প্রয়োজন বোধ করল না মজিদ। মধ্যরাতের স্তব্ধতার মধ্যে সে ভেতরের ঘরের দাওয়ার ওপর চুপচাপ বসে রইল। যে-কোনো মুহূর্তে বাইরে থেকে একটা তীক্ষ্ম আর্তনাদ শোনা যাবে–এই আশায় সে নিজের শ্বসনকে নিঃশব্দ-প্ৰায় করে তুলল। কিন্তু ওধারে কোনো আওয়াজ নেই। থেকে থেকে দূরে প্যাঁচ ডেকে উঠছে, আরো দূরে কোথাও একটা দীঘ গাছের আশ্রয়ে শকুনের বাচ্চ নবজাত মানবশিশুর মতো অবিশ্রান্ত কেঁদে চলেছে, অন্ধকারের মধ্যে একটা বাদুড় থেকে থেকে পাক খেযে যাচ্ছে। রাতটা গুমোট মেরে আছে, গাছের পাতাব নড়াচড় নেই। বাইরে বসেও মজিদের কপালে ঘাম জমছে বিন্দু বিন্দু।
সময় কাটে, ওধারে তবু কোনো আওয়াজ নেই। মুমূর্ষ রোগীর পাশে শেষনিশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায় অনাত্মীয় সুহৃদ লোক যেমন নিশ্চল হয়ে বসে থাকে, তেমনি বসে থাকে৷ মজিদ, গাছের পাতার মতো তারও নড়াচড় নেই।
আরও সময় কাটে। এক সময় মজিদ-বয়সের দোষে বসে থেকেই একটু আলগোছে ঝিমিয়ে নেয়, তারপর দূর আকাশে মেঘগজনি শুনে চমকে উঠে চোখ মেলে তাকায় দিগন্তের দিকে। যে-রাত সেখানে এখন অপেক্ষাকৃত তরল হয়ে আসার কথা সেখানে ঘনীভূত মেঘস্তৃপ। থেকে থেকে বিজলি চমকায়, আর শীঘ্ৰ বিষ্কারবিরে শীতল হওয়া বয়ে আসতে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। দেহের আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে মজিদ, মুখে পালকস্পর্শের মতো সে-সিরসিরে শীতল হওয়া বেশ লাগে, এবং সেই আরামে কয়েক মুহূর্ত চোেখও বোজে সে। কিন্তু ক’ন খাড়া হয়ে ওঠার সাথে সাথে ঢোখট ও তার খুলে যায়। সে দেখে না। কিছু, শোনেও লা কিছু! মেঘ দেখা। সারা, এবার সে শুনতে চায়। কিন্তু ওধারে এখনো প্ৰগাঢ় নীরবতা।
আর কতক্ষণ! নড়েচড়ে ভাবে মজিদ, তারপর নিরলস দৃষ্টি দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ হতে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসতে থাকা ঘন কালো মেঘের পানে তাকিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে রহীমা একবার ছায়ার মতো এসে ঘুরে যায়। ওর দিকে মজিদ তাকায়ও না একবার, না ঘুমিয়ে অত রাতে সে কেন ঘুরছে।-ফিরছে। এ-কথা জিজ্ঞাসা করবারও কোনো তাগিদ। বোধ করে না। তার মনে যেন কোনো প্রশ্ন নেই, নেই অস্থিরতা, অপেক্ষা থাকলেও এবং সে অপেক্ষী যুগযুগ ব্যাপী দীর্ঘ হলেও কোনো উদ্বেগ আসবে না। কিছু দেখবার নেই বলেই যেন সে বসে বসে মেঘ দেখে।
মেঘগর্জন নিকটতর হয়। এবার যখন বিদ্যুৎ চমকায় তখন সারা দুনিয়া ঝলসে উঠে সাদা হয়ে যায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য উদ্ভাসিত অত্যুজ্জল আলোর মধ্যে নিজেকে উলঙ্গ বোধ হলেও মজিদ চিবে দুফাঁক হয়ে যাওয়া আকাশ দেখে এ-মাথা থেকে সে-মাথা, তারপর প্যাচার মতো মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারের পানে। সে-অন্ধকাবে। তবু চোখ পিটপিট করে আশায় আর আকাজক্ষায়। সে-আশা-আকাজক্ষা অবসর উপভোগীর অলস বিলাস মাত্ৰ। চোখ তার পিটপিট করে আর পুনর্বার বিদ্যুৎ চমকানোর অপেক্ষায় থাকে। খোদার কুদবত, প্ৰকৃতির লীলা দেখবাব জন্যই যেন সে বসে আছে ঘুম না গিয়ে, আরাম না। কোরে। হয়তো-বা। সে এবাদত করে। এবাদতের রকমের শেষ নেই। প্ৰকৃতির লীলা চেয়ে চেয়ে দেখাও এক রকম এবাদত।
আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় আকাশ অনেকক্ষণ থমথম ক্রে। রাতও কাটি-কাটি করে কাটে না, পাড়াগাঁয়ের থিয়েটারের যবনিকার মতো সময় পেরিয়ে গেলেও রাত্ৰির যবনিকা ওঠে না। প্ৰকৃতি-অবলোকনোর এবাদতই যদি কোরে থাকে মজিদ। তবে ঈষৎ বিরক্তি ধরে যেন, কারণ ভ্রূর কাছটা একটু কুঁচকে যায়।
তারপর হঠাৎ ঝড় আসে; দেখতে না দেখতে সারা আকাশ ছেয়ে যায় ঘন কালো মেঘে, তীব্র হওয়ার ঝাপটায় গাছপালা গোঙায়, থবথর কোরে কঁপে মানুষের বাডিঘর। মজিদ উঠে আসে ভেতবে। ভাবে, ঝড় থামুক। কারণ আব্ব দেরী নয়, ওধাবে মেঘের আড়ালে প্ৰভাত হয়েছে। সুবোহ সাদেক। নিৰ্মল, অতি পবিত্র তার বিকাশ। যে রাতে অসংখ্য দুষ্ট আত্মারা ঘুরে বেড়ায় সে-রাতের শেষ; নোতুন দিনের শুরু। মজিদের কণ্ঠে গানের মতো গুনগুনিয়ে ওঠে পাঁচ পদের ছুরা আল-ফালাক। সন্ধ্যার আকাশে অস্তগামী সূর্য দ্বারা ছড়ানো লাল আভাকে যে-কুৎসিত ভয়াবহ অন্ধকার মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, সেঅন্ধকারের শয়তানি থেকে আমি আশ্রয় চাই, চাই তোমারই কাছে হে খোদা, হে প্ৰভাবে মালিক। আমি বাঁচতে চাই যাত অন্যায় থেকে, শয়তানের মায়াজাল থেকে আর যত দুর্বলতা থেকে, হে দিনাদির অধিকারী।
এ-দিকে প্ৰভাতের বাহ্যিক লক্ষণ দেখা যায় না। ঝড়ের পরে আসে জোব ল বৃষ্টি। ভ্ৰাসংখ্য তীরের ফলার মতো সে-বৃষ্টি বিদ্ধ করে মাটিকে! তারপর “অপ্ৰত্যাশিতভাবে আসে শিলাবৃষ্টি। মজিদের ঢেউ-তোলা টিনের ছাদে যখন পথভ্ৰষ্ট উষ্কার মতো প্ৰথম শিলাটি এসে পড়ে তখন হঠাৎ মজিদ সোজা হয়ে উঠে বসে, কান তার খাড়া হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কেত শুনে। শীঘ্ৰ অজস্র শিলাবৃষ্টি পড়তে শুরু করে।
তড়িৎবেগে মজিদ উঠে দাঁড়ায়। ভয়ে তার মুখটা কেমন কালো হয়ে গেছে। দুপা এগিয়ে ওধারে তাকিয়ে সে বলে, বিবি শিলাবৃষ্টি শুরু হইছে!
পরিষ্কার প্রভাতের অপেক্ষায় রহীমা গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। সে কোনো উত্তর দেয় না। মজিদ আরেকটু এগিয়ে যায়, তারপর আবার উৎকণ্ঠিত গলায় বলে,–বিবি, শিলাবৃষ্টি শুরু হইছে!
রহীমা এবারও উত্তর দেয় না। তার আবছা চোখের পানে চেয়ে মনে হয়, সে-চোখ যেন জমিলার সে-দিনকার চোখের মতো হয়ে উঠেছে–যে-দিন সাতকুল খাওয়া খ্যাংটা, বুড়ী এসে আর্তনাদ করেছিল।
এ-দিকে আকাশ থেকে ঝরতে থাকে। পাথরের মতো খণ্ড খণ্ড বরফের অজস্র টুকরো, হয় জমাট বৃষ্টিপাত। দিনের বেলা হলে বাছুরগুলো দিশেহারা হয়ে ছুটত, এক-আধটা হয়তে আঘাত খেয়ে শুয়েও পড়ত। কাদের মিঞার পেটওয়ালা ছাগলটা ডাকতে ডাকতে হয়রান হতো। বউরা আসত বেরিয়ে, ছেলেরা ছুটত বাইরে, লুফে লুফে খেত খোদার ঢিল। কাবণ শয়তানকে তাড়াবার জন্যই তো শিলা ছোড়ে খোদা।
ছেলে-ছোকরার আনন্দ করলেও বয়স্ক মানুষের মুখ কালো হয়ে আসে।–তা দিন-রাতের যখনই শিলাবৃষ্টি হোক না কেন। কারণ মাঠে মাঠে নধর কচি ধান ধ্বংস হয়ে যায়, শিলার আঘাতে তার শীষ ঝরে ঝরে পড়ে মাটিতে। যারা দোয়া-দরূদ জানে তারা তখন ঝড়ের মুখে পড়া নৌকোর যাত্রীদের মতো আকুলকণ্ঠে খোদাকে ডাকে; যারা জানে না। তারা পাথর হয়ে বসে থাকে।
রহীমার কাছে উত্তর না পেয়ে এলেমদার মানুষ মজিদ খোদাকে ডাকতে শুরু করে। একবার ছুটে দরজার কাছে যায়, সর্ষের মতো উঠানে ছেয়ে যাওয়া শিলা দেখে, তারপর আবার দোয়া-দরূদ পড়ে পায়চারি করে দ্রুতপদে। এক সময়ে রহীমার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বলে,–কী হইল তোমার? দেখো না শিলাবৃষ্টি পড়ে!
একবার নড়বার ভঙ্গি করে রহীম, কিন্তু তবু কিছু পালে না। পোষা জীবজন্তু একদিন আহার মুখে না দিলে যো-রহীম। অস্থির হয়ে ওঠে দুশ্চিন্তায়, দুটা ভাত অযথা নষ্ট হলে যে আফসোস করে বাঁচে না, সে-ই মাঠে মাঠে কচি-নধর ধান নষ্ট হচ্ছে জেনেও চুপ করে থাকে। এবং যে-রহীমার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল, যার আনুগত্য ধ্রুবতারার মতো অনড়, সে-ই যেন হঠাৎ মজিদের আড়ালে চলে যায়, তার কথা বোঝে না!
মজিদ আবার ওর সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,–কী হইল তোমার বিবি?
রহীমা হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে। তারপর স্বামীর পানে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে,–ধান দিয়া কী হইবো, মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।
কী একটা কথা বলতে গিয়েও মজিদ বলে না। তারপর শিলাবৃষ্টি থামলে সে বেরিয়ে যায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখনো, আকাশ এ মাথা থেকে সে-মোথা পর্যন্ত মেঘাবৃত। তবু তা ভেদ করে একটা ধূসর আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারধারে।
ঝাপটা খুলে মজিদ দেখল। লাল কাপড়ে আবৃত কবরেব পাশে হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা, চোখ বোজা, বুকে কাপড় নেই। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বলে সে-বুকটা বালকের বুকের মতো সমান মনে হয়। আর মেহেদি দেওয়া তার একটা পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। পায়ের দুঃসাহস দেখে মজিদ মোটেই ক্রুদ্ধ হয় না; এমন কী তার মুখের একটি পেশীও স্থানান্তরিত হয় না। সে নত হয়ে ধীরে ধীরে দড়িটা খোলে, তারপর তাকে পাঁজাকোল করে ভেতরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিতেই রহীমা স্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করে,—মরছে নাকি?
প্রশ্নটি এই রকম যে, মজিদের ইচ্ছে হয় একটা হুঙ্কার ছাড়ে। কিন্তু কেন কে জানে সে কোনো উত্তর দিতে পারে না! শেষে কেবল সংক্ষিপ্তভাবে বলে,–না। একটি থেমে আস্তে বলে, ওর ঘোর এখনো কাটে নাই। আছের ছাড়লে এই একমটা হয়।
সে-কথায় কান না দিয়ে জমিলার কাছে দাঁড়িয়ে রহীম। তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর কী একটি। প্রবল আবেগের বশে সে তার দেহে ঘনঘন হাত বুলতে শুরু করে। মায়। যেন ছলছল করে জেগে উঠে হঠাৎ বন্যার মতো দুবাব হয়ে ওঠে, তার কম্পমান আঙিলে সে-বন্যার উচ্ছাস জাগে; তারই আবেগে বার বার বুজে আসে চোখ।
মজিদ। অদূরে বিমূঢ় হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে কেয়ামত হবে। মুহুর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেন একটা ওলট-পালট হয়ে যাবার উপক্রম করে, একটা বিচিত্র জীবন আদিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে ক্ষণকালের জন্য প্ৰকাশ পায় তার চোখের সামনে, আর একটা সত্যের সীমানায় পৌঁছে জন্মবেদনার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করে মনে মনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাল খেয়ে সে সামলে নেয় নিজেকে।
গলা কেশে মজিদ বলে,–দুনিয়াটা বিবি বড় কঠিন পরীক্ষাক্ষেত্র। দয়া-মায়া সকলেরই আছে। কিন্তু তা যেন তোমারে আঁধা না করে।
তারপর সে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে মাঠের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ক্ষেতের প্রান্তে লোক জমা হয়েছে অনেক। কারো মুখে কথা নেই। মজিদকে দেখে কে একজন হাহাকার করে উঠে বলে।–সব তো গেলো! এইবার নিজেই বা খামু কী, পোলাপানদেরই বা দিমু কী?
মজিদের বিনিদ্র মুখটা বৃষ্টিঝরা প্ৰভাতের ম্লান আলোয় বিবৰ্ণ কাঠের মতো শক্ত দেখায়। সে কঠিনভাবে বলে,–নাফরমানি করিও না। খোদার উপর তোয়াক্কল রাখো।
এরপর আর কারো মুখে কথা জোগায় না। সামনে ক্ষেতে ক্ষেতে ব্যাপ্ত হয়ে আছে ঝরে-পড়া ধানের ধ্বংসস্তুপ। তাই দেখে চেয়ে চেয়ে। চোখে ভাব নেই। বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে-চোখ।