একটি খুনের স্বপ্ন
জঙ্গিটা চাপাতি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসলো। এসে জিজ্ঞেস করলো, এতদিন কোথায় ছিলেন? বহুদিন ধরে আমাদের স্বপ্ন আপনার কল্লাটা নামিয়ে দেয়া। আজ আমাদের ঈদের দিন। আল্লাহ মেহেরবান! কী সৌভাগ্য আমাদের! আপনার মত বড় নাস্তিককে পেয়ে আমাদের জীবন ধন্য। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে।
জঙ্গি চারজনার হাতে লম্বা বড় গরু জবাইয়ের চাপাতি। বাচ্চা ছেলেপেলেদের কোরবানীর সময় গরু জবাইয়ের দৃশ্য যেন না দেখতে দেয়া হয়, তার কাকুতিমিনতি করে বহুবার লিখেছি। এই ছেলেগুলোর বাবা মা হয়তো লেখাগুলো পড়ে নি। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাগুলোকে সাচ্চা মুসলমান বানাবার চেষ্টায় ঠেলে দেয়া হয়েছিল গরু কোরবানী দেখতে। তাকে বোঝানো হয়েছিল, স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কারো জীবন কেড়ে নেয়া, জবাই দেয়া একটি ভাল কাজ, পবিত্র কাজ। গরু ছাগল জবাই দিতে দিতে হাত পাকিয়ে তারা এখন বড়সড় কোরবানী দিচ্ছে। মানুষ! আজকে আমাকে তারা ছাড়বে না। আজকে তাদের বড় আনন্দের দিন।
পাশের দুইজন মানুষকে তারা কলেমা জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটা কলেমা মনে করতে পারছিল না। ভয়ে, আতঙ্কে। তার চুলগুলো ধরে টেনে হিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে গেল তারা। আল্লাহ হো আকবর, নারায়ে তাকবীর বলে ঘড়ঘড় করে জবাই করলো তারা। ঘড়ঘড় শব্দের মধ্যে কীভাবে জানি মেয়েটার কলেমা মনে পড়ে গেল। জবাইয়ের ঘড়ঘড়ের সাথে কলেমা তৈয়েবা মিলে মিশে কেমন জানি অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছিল। তা শুনে হা হা করে হাসছিল আরেক জঙ্গি। বলছিল, মাশাল্লাহ! চাপাতিটা গলাতে দেয়ার সাথে সাথেই কী সুন্দর কলেমা বাইর হইতাছে। চাপাতির কত বরকত! এইভাবে চাপাতিটা রাষ্ট্রের গলাতে বসাইলেই ঘড়ঘড় কইরা ইসলামী রাষ্ট্র চইলা আসবে। আল্লাহ আমাদের সাথে আছে। আল্লাহো আকবর।
পাশে বসা বামপন্থী বড়ভাইটি থরথর করে কাঁপছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, আসিফ, আমাকেও কি জবাই দেবে? আমি তো সবসময় লিখেছি, জঙ্গিদের কোন দোষ নেই, ওরা নির্দোষ! সব দোষ ইহুদি নাসারা ইসরাইল আমেরিকার। আমাকে কেন মারবে? আমি তো হাজারবার লিখেছি এগুলো, ভারতের চক্রান্ত ইসরাইলের হাত সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ষড়যন্ত্র। তুমি একটু বলবা তাদের? তোমাকে মনে হয় একটু বেশি গুরুত্ব দেয়। তুমি ওদের বলে দাও, আমি তোমার মত খারাপ নাস্তিক না। আমি নামাজ পড়ি। আজ থেকে মার্ক্সবাদ ছেড়ে দিলাম। মার্ক্সের থেকে মুহাম্মদ বড়। সাম্যবাদ থেকে ইসলামবাদ বড়। এখন থেকে ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবো। বলো না তাদের? প্লিজ তোমার পায়ে ধরি।
এগুলো ওদের দলের নেতাটা শুনছিল। শুনে বলছিল, হালা বাম ছাগল, কষ্ট কইরা অপারেশনে যাই আমরা, জবাই দেই আমরা, রিস্ক নিই আমরা, আর তুই ক্রেডিট সব দিয়া দেস ইসরাইল আমেরিকারে? এইবার তোরে খাইছি!
বাম বড় ভাইটিকে সবাই মিলে অনেকক্ষণ ধরে কোপালো। কোপানোর পরে বিসমিল্লাহ বলে ঘাড়ের পেছন থেকে জবাই দিলো। মনে মনে সে কী ভাবছিল? এটা বারাক ওবামার ষড়যন্ত্র? ইসরাইল তাকে জবাই দিচ্ছে? মোসাদ এই জঙ্গিগুলোকে একটা নতুন অবিষ্কৃত ঔষধ খাইয়ে সম্মোহন করে খুনোখুনী করতে বাধ্য করেছে? এই জঙ্গিরা সহি মুসলমান না? এর সাথে ইসলামকে জড়াবেন না? সব জঙ্গি খারাপ নয়? জঙ্গিরা অবুঝ? দুধে ধোয়া তুলসী পাতা? কী জানি!
তারা এবারে এগিয়ে আসলো আমার দিকে। দলের নেতাটি বললো, ব্লগে সবসময় ইসলামের সমালোচনার জন্য, ধর্মের সমালোচনার জন্য, ইসলামিস্টদের দোষ দেয়ার জন্য আপনাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হলো। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। কোন অবস্থাতেই ইসলাম মানুষ হত্যা সমর্থন করে না। কোরান একটি সংবিধান, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আপনাকে জবাই করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো!
জবাই দেয়ার সময় একটা লেখা মাথায় ঘুরছিল। একটা কম্পিউটার পেলে লেখাটা শেষ করা যেতো। চাপাতিটা যখন হাড্ডি স্পর্শ করলো, স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। চাপাতিটা আরো গভীরে ঢুকছিল, আরো গভীরে। জঙ্গি ছেলেগুলোর মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। বহু সাধনার পরে তারা আমাকে জবাই দিতে পারছে। আজ তাদের বড় আনন্দের দিন। আল্লাহো আকবর, আল্লাহো আকবর, আল্লাহো আকবর!
সকাল বেলা তিব্বত(চীনের অধিকারভুক্ত) বাম সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললো সব জঙ্গিরা। পত্রিকায় হেড লাইন আসলো, ইসলাম জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। বিশিষ্ট বাম বুদ্ধিজীবী এই বিষয়ে বললেন, এটা পরিষ্কারভাবেই মোসাদের কাজ। এর সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারায়ে তাকবীর…ইয়ে দুনিয়ার মজদুর…
আমি তখন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলাম!
বিঃদ্রঃ পুরনো লেখা। টাইটেলটি হুমায়ুন আজাদের একটি বই থেকে নেয়া।