প্রশ্নোত্তর

কেন আমি নাস্তিক? – ভগৎ সিং

কোনও সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের ওপরে আমার বিশ্বাস নেই। এটা আমার উদ্ধত গর্ব আর অহংকারের জন্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। আমি কখনই ভাবিনি যে কোনও দিন আমি এইধরনের বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ব। আমার বন্ধুদের সাথে আলোচনার সময় – যদি আমার বন্ধুত্বের দাবি অনায্য না হয় – আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাকে শুধু অল্প সময়ের জন্য চিনেই , তাঁদের কেউ কেউ খুব তড়িঘড়ি আমার সম্বন্ধে এই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আমার নাস্তিকতা আমার মূর্খামি আর এটা আমার অহংকারের ফলশ্রুতি। তা হয়ে থাকলেও এটা একটা গম্ভীর সমস্যা। আমি এইরকম বড়াই করি না যে আমি এইসব মানুষসুলভ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে। কারণ , আর যাই হোক , আমি একজন মানুষ আর এর থেকে বেশি কিছুই না। আর কেউই এর থেকে বেশি কিছু হওয়ার দাবি করতে পারে না। আমার ব্যক্তিত্বে একটা দুর্বলতা আছে কারণ আমার যেসব মানুষসুলভ লক্ষনগুলো আছে তার মধ্যে গর্ব একটা। আমার বন্ধুদের মধ্যে আমি একনায়ক বলে পরিচিত।

কখনো কখনো আমাকে বড়াইকরনেওয়ালাও বলা হয়। কেউ কেউ সবসময় অভিযোগ করেন যে আমি ছড়ি ঘোরাই আর অন্যদের আমার মতামত মেনে নিতে বাধ্য করি। হ্যাঁ , এটা কিছুটা সত্যি। আমি এ অভিযোগ অস্বীকার করছি না। আমরা এর জন্য দম্ভ শব্দটা ব্যবহার করতে পারি। যদি আমাদের সমাজের ঘৃণ্য , মরচে ধরা আর পচে যাওয়া মূল্যবোধগুলোর নিরিখে দেখা হয় , তবে আমি একজন আদ্যোপান্ত সংশয়বাদী। কিন্তু প্রশ্নটা শুধু আমি মানুষটাকে নিয়ে নয়। এটা আমার আদর্শ , আমার চিন্তাভাবনাকে নিয়ে গর্বিত হওয়ার ব্যাপারে। এটাকে ফাঁকা গর্ব বলা যাবে না। গর্ব বা দম্ভ – দুটো শব্দই বোঝায় কারও নিজের সম্বন্ধে ফাঁপানো উঁচু ধারণা। আমার নাস্তিকতা কি অহেতুক গর্বের ফলে না আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করা ছেড়েছি দীর্ঘ আর গভীর চিন্তাভাবনার পরে ? আমি আমার চিন্তাভাবনা আপনাদের সামনে রাখব। কিন্তু প্রথমে গর্ব আর দম্ভর মধ্যে ফারাকটা দেখা যাক।

আমি কখনই বুঝে উঠতে পারিনা যে একজন কি করে ভিত্তিহীন , অযৌক্তিক গর্ব বা ফাঁকা দম্ভের জন্য ভগবানে বিশ্বাস করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। আমি তখনই একজন সত্যিকারের মহান ব্যক্তির মহানতাকে অস্বীকার করতে পারি যদি আমি কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু না করেই খ্যাতির অধিকারী হয়ে যাই বা আমার যদি মহান হওয়ার মতো উঁচুদরের মানসিক ক্ষমতা না থাকে। এটা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব যে একজন আস্তিক তার দম্ভের কারণে নাস্তিক হয়ে যাবে ? শুধু দুটো কারণ থাকতে পারে – হয় সেই ব্যক্তি মনে করেন তিনি ঈশ্বরীয় ক্ষমতার অধিকারী নয়তো আরেকধাপ এগিয়ে তিনি নিজেকেই ঈশ্বর বলে ঘোষণা করতে পারেন। দুটো ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে সত্যিকারের নাস্তিক বলে দাবি করতে পারেন না। প্রথমক্ষেত্রে তিনি ভগবানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন না আর দ্বিতীয়ক্ষেত্রে তিনি মহাবিশ্বে যে ক্রিয়াকলাপ চলছে তার জন্য কোন অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অস্তিত্বকে দায়ী বলে মনে করছেন। তিনি নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করুন বা ঈশ্বরকে নিজের সত্তার থেকে উঁচুতে অবস্থানকারী কোন বাস্তবতা বলে মনে করুন তাতে আমাদের বিতর্কে কোন প্রভাব পড়বে না। কারন দুটো ক্ষেত্রেই তিনি একজন বিশ্বাসী , একজন আস্তিক – নাস্তিক নন। আমি এই ব্যাপারটা আপনাদের বোঝাতে চাইছি। আমি এই দুই রকমের কোনটাই নই। আমি একজন সর্বত্রবিরাজমান , সর্বশক্তিমান , সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করি। কেন ? সেকথায় পরে আসছি। এখানে আমি এই ব্যাপারটায় জোর দিতে চাই যে আমি উদ্ধত বা গর্বিত বা দাম্ভিক বলে নাস্তিক নই – আমি কোন ঈশ্বরসুলভ কিছু নই – কোন অবতার নই – আর হ্যাঁ , আমি নিজেও ঈশ্বর নই। অন্তঃত একটা ব্যাপার পরিষ্কার করতে পারলাম যে আমি গর্ব বা দম্ভের কারনে নাস্তিক নই। প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার জন্য সত্যিটা বলা যাক। আমার বন্ধুরা বলেন যে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা আর দিল্লী বোমা কান্ডর পর আমি খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যাই আর এই ব্যাপারটা আমার মাথা ঘূরিয়ে দিয়েছে। দেখা যাক এই অভিযোগটা ঠিক কিনা। আমি এই ঘটনাগুলোর পর নাস্তিক হইনি। আমি যখন অপরিচিত ছিলাম তখন থেকেই নাস্তিক। একজন কলেজ ছাত্রর অন্তঃত নিজের সম্বন্ধে কোন ফোলানো ফাঁপানো ধারনা থাকতে পারেনা যা তাকে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যাবে। এটা ঠিক যে আমি কিছু অধ্যাপকের প্রিয় ছিলাম আবার কিছু অধ্যাপক আমাকে অপছন্দও করতেন। আমি কখনই পরিশ্রমী পড়ুয়া ছিলাম না। আমার গর্বিত হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না।

আমার আচরণ নিয়ে আমি সতর্ক থাকতাম আর আমার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কিছুটা হতাশা ছিল। বিশ্বাসের দিক থেকে আমি পুরোপুরি নাস্তিক ছিলাম না। আমি ঠাকুর্দার যত্ন আর সুরক্ষায় বড় হয়েছি। তিনি ছিলেন একজন গোঁড়া আর্যসমাজী। একজন আর্যসমাজী অনেক কিছুই হতে পারেন কিন্তু তিনি কখনই একজন নাস্তিক নন। আমার প্রাথমিক পড়াশোনার পর আমাকে লাহোরের দয়ানন্দ আর্য বৈদিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হল। আমি একবছর একটা ছাত্রাবাসে ছিলাম। ভোরে আর সন্ধ্যায় প্রার্থনা করা ছাড়াও আমি ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রপাঠ করতাম। সেই সময় আমি পুরোপুরি আস্তিক ছিলাম। তারপর আমি বাবার সাথে থাকতাম। তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সহিষ্ণু। তাঁর শিক্ষার ফলেই আমি দেশকে মুক্ত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি নাস্তিক ছিলেন না। তাঁর কাছে ঈশ্বর ছিলেন এক সর্বব্যাপী সত্তা। তিনি আমাকে বলতেন রোজ প্রার্থনা করতে। এইভাবে আমি বেড়ে উঠেছি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমি ন্যাশানাল কলেজে ভর্তি হই। এই কলেজে পড়ার সময় আমি সবধরনের ধর্মীয় বিতর্ক নিয়ে খুব চিন্তাভাবনা করি। এর ফলে আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠি। তবুও ঈশ্বরের উপরে আমার আস্থা ছিল দৃঢ় আর জোরালো। আমি শিখ ধর্ম অনুযায়ী দাড়ি আর কেশ (আছাঁটা চুল) রেখেছিলাম। এসব সত্ত্বেও আমি শিখ বা অন্য কোন ধর্মের উপযোগিতা সম্বন্ধে নিজেকে বোঝাতে পারতাম না। কিন্তু ঈশ্বরের উপর আমার বিশ্বাস ছিল অবিচল আর অকম্প্র।

তারপর আমি বিপ্লবী দলে যোগ দিই। প্রথম যে নেতার সাথে পরিচয় হয় তাঁর নিজেকে খোলাখুলিভাবে নাস্তিক বলে স্বীকার করার সাহস ছিল না। তিনি এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি। যখনই আমি তাঁকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন করতাম , তিনি জবাব দিতেন “ যদি তোমার ইচ্ছে হয় তবে বিশ্বাস করতে পার ”। দ্বিতীয় যে নেতার সংস্পর্শে আসি তিনি ছিলেন গোঁড়া বিশ্বাসী। তাঁর নামটা বলা উচিত। তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় সহযোদ্ধা শচীন্দ্র নাথ সান্যাল। করাচী ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর যাব্বজীবন কারাদন্ড হয়েছিল। তাঁর একমাত্র বই ‘বন্দী জীবন’এর একেবারে প্রথম পাতা থেকেই তিনি ঈশ্বরের মহিমার প্রশংসা গেয়েছেন। বইটির দ্বিতীয় ভাগের শেষ পাতায় ঈশ্বরের উপর প্রশংসা বর্ষণ করেছেন একজন অতীন্দ্রিয়বাদীর মত। এটা তাঁর চিন্তাভাবনার পরিষ্কার প্রতিফলন।

বাদীপক্ষের মতে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে যে বিপ্লবী প্রচারপত্র বিলি হয়েছিল তা ছিল শচীন্দ্র নাথ সান্যালের লেখা। বিপ্লবীদের কাজকর্মে এটা অনেক সময়েই হয়ে থাকে যে একজন নেতা তাঁর খুব পছন্দের ধারণাগুলোর প্রচার করেন আর তার সাথে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও অন্য কর্মীদের তা মেনে নিতে হয়। ওই প্রচারপত্রে একটা পুরো অনুচ্ছেদ জুড়ে ঈশ্বর আর তাঁর কাজকর্মের , যা আমরা মানুষেরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না , তার প্রশংসা করা হয়েছে। এটা পুরোপুরি অতীন্দ্রিয়বাদ। আমি এটাই বলতে চাইছি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করার কথা বিপ্লবী দলেও ভাবা হয়নি। বিখ্যাত কাকোরি শহীদদের চারজনই শেষ দিনগুলো প্রার্থনা করে কাটিয়েছিলেন। রাম প্রসাদ বিসমিল ছিলেন গোঁড়া আর্য সমাজী। সমাজবাদ আর কমিউনিজম সম্বদ্ধে প্রচুর পড়াশোনা করে থাকলেও রাজেন লাহিড়ী উপনিষদ আর গীতার শ্লোক আবৃত্তি করার ইচ্ছে চেপে রাখতে পারেননি। মাত্র একজনই ছিলেন যিনি ধর্মীয় আচরন পালন করতেন না। তিনি বলতেন “ ধর্ম হচ্ছে মানুষের দুর্বলতার অথবা সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ফল ”। তিনি যাব্বজীবন কারাদন্ড ভোগ করছেন। কিন্তু তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার সাহস কখনো দেখাননি।

ওই সময় পর্যন্ত আমি ছিলাম শুধুই এক আবেগপ্রবণ বিপ্লবী যে শুধু নেতাদের অনুসরন করে চলত। তারপর সময় এলো পুরো দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার। কিছু সময়ের জন্য একটা তীব্র বিরোধিতা দলের অস্তিত্বটাকেই বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। অনেক নেতা এমনকি অনেক উৎসাহী সহযোদ্ধারাও দলকে বিদ্রুপের কষাঘাত করতে লাগলেন। তাঁরা আমাদের ব্যঙ্গ করতেন। আমার মনে হচ্ছিল যে কোনওদিন আমিও হয়ত এটাকে একটা নিষ্ফল আর সময় নষ্টের কাজ ভাবব। এটা ছিল আমার বিপ্লবী জীবনের একটা মোড় ঘোরার সময়। পড়াশোনা করার একটা অদম্য ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসল। নিজেকে বললাম ‘আরও পড় , আরও পড়’ যাতে বিরোধীদের যুক্তির মোকাবিলা করতে পারি। নিজেকে বললাম ‘তোমার দৃষ্টিভঙ্গীকে অকাট্য যুক্তির সমর্থন যোগাতে পড়’। আর আমি পড়াশোনায় ডুবে গেলাম। আমার পুরনো বিশ্বাস আর প্রত্যয়গুলোর আমূল পরিবর্তন হল। আমাদের পূর্বসুরীদের উগ্র সহিংসতার আবেগ ছেয়ে রেখেছিল। এখন বাস্তববাদ ওই ধরনের চিন্তাভাবনাকে বিদায় জানাল। আর অতীন্দ্রিয়বাদ নয়। আর অন্ধ বিশ্বাস নয়। এখন বাস্তববাদ আমাদের চিন্তার ধারা হল। প্রচন্ড দরকারের সময় আমরা চরম পন্থা নিতে পারি কিন্তু গণআন্দোলনে হিংসা অবাঞ্ছিত ফলের জন্ম দেয়। আমাদের পন্থা নিয়ে অন্য জায়গায় অনেক কথাই বলেছি। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আমরা যে লম্বা লড়াই চালাচ্ছিলাম তার আদর্শের একটা পরিষ্কার ধারনা দেওয়া গেল। যেহেতু নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও কাজ চলছিল না , আমি বিভিন্ন লেখকের নানারকম চিন্তাভাবনা নিয়ে পড়াশোনা করার প্রচুর সুযোগ পেলাম। আমি নৈরাজ্যবাদী নেতা বাকুনিনের লেখা পড়লাম। কমিউনিজমের জনক মার্ক্সের কিছু বই পড়লাম। লেনিন , ট্রটস্কি ও আরও অনেকে যাঁরা নিজেদের দেশে সফলভাবে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তাঁদের লেখাও পড়লাম। তাঁদের সবাই ছিলেন নাস্তিক। বাকুনিনের ‘ঈশ্বর ও রাষ্ট্র’র ধারনাগুলো ছাড়া ছাড়া হলেও আগ্রহ জাগায়। এরপর পড়লাম নির্লম্ব স্বামীর লেখা ‘সাধারন জ্ঞান’। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীটা ছিল একধরনের অতীন্দ্রিয় নাস্তিকতা। আমার এই ব্যাপারে আরও আগ্রহ জন্মাল। ১৯২৬এর শেষের দিকে আমি নিশ্চিত হলাম যে এক সর্বশক্তিমান মহান সত্তা যিনি মহাবিশ্বকে বানিয়েছেন আর নিয়ন্ত্রন করেন সেই তত্ত্বের কোনও জোরালো ভিত্তি নেই। আমি বন্ধুদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম। নিজেকে খোলাখুলিভাবে নাস্তিক বলে ঘোষণা করলাম। তার ফল কি হল বলছি।

১৯২৭এর মে মাসে আমি লাহোরে গ্রেপ্তার হলাম। এই গ্রেপ্তারটা আমাকে খুব অবাক করেছিল। আমি বিন্দুমাত্রও আঁচ পাইনি যে পুলিশ আমাকে খুঁজছে। আমি একটা পার্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আর হঠাৎই পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেলে। ওইসময় আমি এত শান্ত ছিলাম যে আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার নিজের উপর পুরো নিয়ন্ত্রন ছিল। আমাকে পুলিশ হেপাজতে নিয়ে যাওয়া হল। পরের দিন আমাকে নিয়ে যাওয়া হল রেল পুলিশের হাজতে আর গোটা এক মাস সেখানে রাখা হল। পুলিশের সাথে অনেকদিন আলোচনার পর আন্দাজ করলাম ওদের কাছে আমার কাকোরি দলের সাথে জড়িত থাকার কিছু খবর আছে। মনে হল বিপ্লবী আন্দোলনে আমার অন্যান্য কাজকর্মের কিছু হদিশও বোধহয় ওরা পেয়েছে। ওরা আমাকে বলল যে কাকোরি দলের বিচারের সময় অভিযুক্তদের উদ্ধার করার কোন উপায় বার করার জন্যই আমি লখনৌয়ে ছিলাম। ওরা এও বলল যে পরিকল্পনাটা তৈরী করার পর আমরা কিছু বোমা যোগাড় করি আর বোমাগুলো কেমন কাজে দেবে তা পরীক্ষা করার জন্যই ১৯২৬এর দশেরার মিছিলে ভীড়ের মধ্যে একটা বোমা ছোঁড়া হয়েছিল। ওরা বলল যে আমি যদি বিপ্লবী দলের কাজকর্ম সম্বন্ধে একটা বিবৃতি দেই তাহলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এইভাবে আমি শুধু ছাড়াই পাব না , আমাকে পুরস্কারও দেওয়া হবে আর আমাকে আদালতে রাজসাক্ষী হিসাবেও পেশ করা হবে না। আমি ওদের প্রস্তাবে শুধু হাসলাম। ওদের সব কথাই ছিল ভুল। আমাদের মত আদর্শ যাঁদের আছে তাঁরা কখনও নিজের দেশের নিরপরাধ লোকেদের উপর বোমা ছোঁড়েন না। একদিন গোয়েন্দা বিভাগের বরিষ্ঠ অধিকর্তা মিঃ নিউম্যান এলেন। অনেক সহানুভুতিপূর্ণ কথার পর তিনি বললেন যে তাঁর একটা খারাপ খবর দেওয়ার আছে। আমি যদি তাদের কথামত বিবৃতি না দেই তবে তারা বাধ্য হবেন কাকোরি মামলার সূত্রে রাষ্ট্রদোহিতার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার আর দশেরা সমাবেশে নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে। তিনি এটাও জানালেন যে তাঁর কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে আমাকে দোষী প্রমাণিত করে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য।

আমি পুরোপুরি নির্দোষ ছিলাম কিন্তু এটাও বিশ্বাস করতাম যে পুলিশের হাতে এতটাই ক্ষমতা আছে যে ওরা চাইলেই আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারে। সেইদিনই কিছু পুলিশ কর্তা জোর করলেন যাতে আমি নিয়মিত রোজ দুবেলা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। আমি একজন নাস্তিক। আমি দেখলাম এটাই আমার ফয়সলা করার সময় যে আমি শুধু শান্তি আর সুখের সময়ই নাস্তিক বলে বড়াই করতে পারি নাকি কঠিন সময়েও নিজের বিশ্বাসে অবিচল থাকতে পারি। নিজের সাথে লম্বা বিতর্কের পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে আমি বিশ্বাসী হবার ভানও করতে পারব না আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাও করতে পারব না। না আমি কখনই সেটা করিনি। ওটা ছিল পরীক্ষার সময় আর আমাকে সফল হতে হবে এই ছিল আমার চিন্তা। একমুহুর্তের জন্যেও আমার নিজের জীবন বাঁচানোর ইচ্ছা হয়নি। তাই আমি তখন একজন সাচ্চা নাস্তিক ছিলাম আর আজকেও আমি নাস্তিক। ওই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা সহজ ছিল না। বিশ্বাস কঠিন পরিস্থিতিকে হাল্কা করে দেয় , এমনকি মধুরও করে তোলে। একজন ঈশ্বরের মধ্যে জোরালো সমর্থন খূঁজে পেতে পারেন। তাঁর নামে উদ্দীপনায় ভরা সান্ত্বনা খূঁজে পেতে পারে। যদি আপনার ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকে তবে নিজের উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প থাকে না। ঝড় আর ঝঞ্ঝার মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোন ছেলেখেলা নয়। কঠিন সময়ে দম্ভ থাকলেও তা উবে যায় আর মানুষ প্রচলিত শ্রদ্ধেয় বিশ্বাসগুলোর বিরোধিতা করার সাহস হারিয়ে ফেলে। যদি একজন এইসব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সত্যিকারের বিদ্রোহ করে তবে এটাই বুঝতে হবে যে তিনি দম্ভের বশে এটা করছেন না , তাঁর নিশ্চিতভাবে কোন অসাধারণ শক্তি আছে। এখন পরিস্থিতিটা ঠিক তাই। প্রথমতঃ সবারই এটা জানা যে রায় কি হতে যাচ্ছে। আর সপ্তাহখানেক পরেই রায় বেরোবে। আমি একটা মহান উদ্দেশ্যর জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করতে যাচ্ছি। এর থেকে বড় সান্ত্বনা আর কি হতে পারে! একজন ঈশ্বরবিশ্বাসী হিন্দু রাজা হয়ে পুনর্জন্মের আশা রাখতে পারেন ; একজন মুসলিম বা খ্রীস্টান তাঁর কষ্টভোগ আর ত্যাগের জন্য পুরস্কার হিসাবে স্বর্গে বিলাসিতা উপভোগ করার স্বপ্ন দেখতে পারেন। আমি কি আশা রাখছি ? আমি জানি যে যখনই আমার গলায় ফাঁসটা শক্ত করে এঁটে দেওয়া হবে আর পায়ের তলা থেকে তক্তা সরিয়ে নেওয়া হবে , সেটাই আমার শেষ। আরও নিখুঁত করে ধর্মীয় পরিভাষায় বলতে হলে বলতে হয় সেটা হবে আমার পরম বিনাশের মুহুর্ত , আমার প্রাণের আর কিছুই থাকবে না। যদি আমি ব্যাপারটাকে ‘পুরস্কার’এর আলোতে দেখার সাহস করি তবে আমি দেখব আমার ‘পুরস্কার’ একটা ছোট সংগ্রামী জীবন যার কোন মহান পরিনতি নেই। ব্যস , এইটুকুই। আমি স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে পুরোপুরি নিঃস্বার্থভাবে জীবন সমর্পণ করেছি , এখানে বা পরে কোন পুরস্কার পাওয়ার স্বার্থপর উদ্দেশ্য ছাড়াই। আমি অন্যভাবে চলতে পারতাম না। যেদিন মহিলা আর পুরুষদের একটা বড় অংশ সাহসের সাথে মানুষকে সেবা করার আর দুর্দশা ও নিপীড়ণ থেকে মুক্তি দেওয়ার ধারণা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন যে তাঁদের সামনে এই কারণের জন্য জীবন সমর্পণ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই , সেদিন মুক্তির এক নতুন যুগের শুরু হবে। তাঁরা তাঁদের নিপীড়নকারী , অত্যাচারী আর শোষকদের বিরুদ্ধে লড়বেন রাজা হওয়ার জন্য নয় , এখানে বা পরের জন্মে বা মৃত্যুর পর স্বর্গে কোন পুরস্কার পাওয়ার জন্য নয় , তাঁরা লড়বেন দাসত্বের জোয়ালটা ছুঁড়ে ফেলার জন্য। তাঁরা এই বিপজ্জনক কিন্তু মহান পথে হাঁটবেন মুক্তি আর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁরা তাঁদের মহান কাজের জন্য যে গর্ব বোধ করবেন তাকে দম্ভ বলা হবে ? কে এতটা উদ্ধত যে এইরকম বলবেন ? তাকে আমি বলি হয় তিনি নির্বোধ নয়ত বদমাশ। এইরকম ব্যক্তির কথা বাদ দিন কারণ সেই হৃদয়ে যে গভীরতা , উচ্ছাস , আবেগ আর মহান অনুভুতির বিস্ফোরণ ঘটছে তা বোঝার ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর হৃদয় মৃত – স্রেফ একটা অনুভুতিহীন মাংসের দলা। তাঁর বিশ্বাসগুলো নড়বড়ে আর আবেগগুলো দুর্বল। তাঁর স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য তিনি সত্যকে দেখতে অক্ষম। আমাদের প্রত্যয় থেকে আমরা যে শক্তি পাই তার দিকে ‘দম্ভ’ বিশেষণটাই সবসময় ছুঁড়ে দেওয়া হয়।

আপনি জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যান ; একজন জননায়ক বা মহান ব্যক্তি যাঁকে সাধারনত সমালোচনার উর্ধে বলে মনে করা হয় তাঁর সমালোচনা করে দেখুন কি হয়। কেউ আপনার প্রশ্নের যুক্তিসংগত উত্তর দেবেন না। বরং আপনাকে দাম্ভিক বলা হবে। এর কারন হচ্ছে মানসিক নিষ্প্রভতা। নির্দয় সমালোচনা আর স্বাধীন চিন্তা হচ্ছে একজন বিপ্লবীর দুটি অতি আবশ্যক গুণ। যেহেতু মহাত্মাজী মহান তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে। যেহেতু তিনি একটা উঁচু জায়গায় পৌঁছেচেন , তিনি রাজনীতি , ধর্ম বা নৈতিকতার ক্ষেত্রে যা কিছু বলবেন সবই অভ্রান্ত। আপনি মানুন চাই না মানুন , আপনি সেটাকে সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য। এটা গঠনমূলক চিন্তা নয়। এভাবে আমরা সামনের দিকে এগোই না , অনেকধাপ পিছিয়ে যাই।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা একধরনের পরম সত্তায় বিশ্বাস করতেন। তাই যদি কেউ সেই বিশ্বাসের যৌক্তিকতাকে প্রশ্ন করার সাহস দেখান অথবা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন , তাঁকে বলা হবে কাফের বা স্বধর্মত্যাগী। যদি তাঁর যুক্তিগুলো এত জোরালো হয় যে সেগুলো খন্ডন করা অসম্ভব , যদি তাঁর সাহস এত প্রচন্ড হয় যে সর্বশক্তিমানের ক্রোধের ফলে তাঁর উপর যে দুর্ভাগ্য নেমে আসবে তার ভয় দেখিয়েও তাঁকে নত করা যাচ্ছে না , তবে তাঁকে দাম্ভিক বলা হবে। তবে কি দরকার এই ধরণের আলোচনায় সময় নষ্ট করে ? এই প্রশ্নটা জনসাধারণের সামনে প্রথমবারের জন্য এসেছে। তাই এই লম্বা আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আর উপযোগীতা।

আমার মনে হয় প্রথম প্রশ্নটার উত্তরে আমি পরিষ্কার করে দিতে পেরেছি যে দম্ভের কারনে আমি নাস্তিক হইনি। আমি নই , আমার পাঠকরাই শুধু ঠিক করতে পারবেন যে আমার যুক্তিতে ওজন আছে কিনা। আমি জানি আমি যদি বিশ্বাসী হতাম , বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার জীবন অনেকটা সহজ হত ; বোঝাটা অনেক হাল্কা হত। আমার ঈশ্বরে অবিশ্বাস পুরো পরিস্থিতিকে খুব কঠিন করে তুলেছে আর পরিস্থিতিটা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। একটু অতীন্দ্রিয়বাদী হতে পারলে পরিস্থিতিটা মোলায়েম হতে পারত। কিন্তু আমার অন্তিম পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমার কোন আফিমের প্রয়োজন নেই। আমি একজন বাস্তববাদী। আমার মধ্যেকার এই প্রবণতাকে আমি অতিক্রম করতে চাই ‘যুক্তি’র সাহায্যে। আমি সবসময় এই চেষ্টায় সফল হইনা। কিন্তু মানুষের কর্তব্য হচ্ছে চেষ্টা করা আর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সফলতা তো নির্ভর করে সুযোগ আর পরিস্থিতির উপরে।

এখন আসা যাক দ্বিতীয় প্রশ্নে। দম্ভ যদি কারণ না হয় তবে ঈশ্বরে হাজার হাজার বছরের পুরনো বিশ্বাস নাকচ করার পিছনে কোন দৃঢ় কারণ তো থাকা উচিত। হ্যাঁ , আমি সেই প্রশ্নেই আসছি। আমি মনে করি যে কোন মানুষেরই কিছু না কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে যার সাহায্যে তিনি সবসময় তাঁর চারপাশের জীবন আর মানুষজনকে বোঝার চেষ্টা করেন। যেখনে প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব সেখানেই অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শন ঢুকে পড়ে। যেমন আগে বলেছি , আমার বিপ্লবী বন্ধুদের একজন বলতেন “ দর্শন হচ্ছে মানুষের দুর্বলতার ফলশ্রুতি ”। আমাদের পূর্বপুরুষদের পৃথিবীর রহস্য – এর অতীত , বর্তমান আর ভবিষ্যত , এর কি আর কেন – সমাধান করার অবসর ছিল কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রচন্ড অভাব থাকার জন্য তাঁদের প্রত্যেকে নিজের মত করে সমাধান করার চেষ্টা করেন। সেইজন্য আমরা বিভিন্ন ধর্মমতের মূলনীতিগুলোতে বিস্তর ফারাক দেখতে পাই। অনেকসময়ই সেগুলো ভীষন প্রতিদ্বন্ধী আর সংঘর্ষপুর্ণ আকার নেয়। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে ফারাক আছে। আবার একই গোলার্ধে বিভিন্ন মতের মধ্যে ফারাক আছে। এশীয় ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম ধর্ম হিন্দু ধর্মের সাথে পুরোপুরি অসংগতিপুর্ণ। ভারতে বৌদ্ধ আর জৈন ধর্ম কিছু কিছু ব্যাপারে ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের থেকে পুরোপুরি আলাদা। আবার ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের মধ্যেই আর্য সমাজ আর সনাতন ধর্মের মত দুটো পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায় দেখতে পাব। আবার চার্বাকও আছেন। তিনি প্রাচীন যুগের একজন স্বাধীন চিন্তাবিদ যিনি ঈশ্বরের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই সব বিশ্বাসগুলোর মধ্যেই বিভিন্ন মূল প্রশ্নে অনেক ফারাক আছে কিন্তু প্রত্যেকটিই দাবি করে সেটাই একমাত্র সঠিক ধর্ম। এটাই সব গন্ডগোলের মূল। প্রাচীন চিন্তাবিদদের চিন্তাভাবনা আর পরীক্ষানিরীক্ষাকে আরও উন্নত করে নিজেদেরকে ভবিষ্যত সংগ্রামের জন্য মতাদর্শগত হাতিয়ারের যোগান না দিয়ে আমরা – অলসতা , ঢিলেমি আর গোঁড়ামির শিকার হয়ে – প্রাচীন ধর্মকে আঁকড়ে থেকে মানুষের জেগে ওঠার সম্ভাবনাকে একটা বদ্ধ পুকুরে পর্যবসিত করি।

যাঁরা প্রগতির পক্ষে , তাঁদের প্রত্যেকের উচিত পুরনো বিশ্বাসের প্রতিটি নীতিকে খূঁটিয়ে দেখা। পুরনো বিশ্বাসের প্রতিটি উপাদানের কার্যকারিতাকে একটা একটা করে পরীক্ষা দেখা উচিত। তাঁকে সবকিছু বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করতে আর বুঝতে হবে। যদি নির্মম কাঁটাছেড়ার পরও কেউ কোন দর্শনের তত্ত্বে বিশ্বাস করার যুক্তি খুঁজে পান , তবে তাঁর বিশ্বাস প্রশংসনীয়। তাঁর যুক্তি ভুল হতে পারে , এমনকি অমূলকও হতে পারে। কিন্তু তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা আছে নিজেকে ঠিক করে নেওয়ার কারন তাঁর জীবন পরিচালনা করার নীতি হচ্ছে যুক্তিবাদ। কিন্তু বিশ্বাস , আমার বলা উচিত অন্ধবিশ্বাস , ভয়ংকর ক্ষতি করে। তা একজনের কোনও কিছুকে বোঝার ক্ষমতাকে নষ্ট করে আর ফলে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন প্রগতির বিরুদ্ধে।

কেউ যদি নিজেকে বাস্তববাদী বলে দাবী করেন তাঁকে পুরনো বিশ্বাসগুলোর সত্যতাকে প্রশ্ন করতে হবে। যুক্তির আক্রমণ সহ্য করতে না পারলে বিশ্বাস ধ্বসে পড়বে। এরপরে তাঁর কাজ হবে নতুন দর্শনের জমি তৈরী করা। এটা হল নেতিবাচক দিক। এরপর আসবে ইতিবাচক কাজ যখন পুরনো দিনের কিছু উপাদান নতুন দর্শন গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমার কথা যদি ধরেন তবে স্বীকার করতেই হবে যে এই ব্যাপারে আমার যথেষ্ট পড়াশোনা নেই। আমার প্রাচ্য দর্শন অধ্যয়ন করার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু তা করার যথেষ্ট সুযোগ বা সময় পেলাম না। কিন্তু আমি যে প্রাচীন বিশ্বাসগূলোকে বাতিল করি তা কোন একটা বিশ্বাস দিয়ে অন্য আরেকটা বিশ্বাসকে বাতিল করা নয় , বরং আমি পুরনো বিশ্বাসের কার্যকারিতাকে প্রশ্ন করি জোরালো যুক্তির জোরে। আমরা প্রকৃতিতে বিশ্বাস করি আর বিশ্বাস করি যে প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের মাত্রার উপরেই মানুষের প্রগতি নির্ভর করে। এর পিছনে কোন সচেতন শক্তি নেই। এটাই আমাদের দর্শন।

একজন নাস্তিক হিসাবে আমি আস্তিকদের কিছু প্রশ্ন করছি

আপনারা বিশ্বাস করেন একজন সর্বশক্তিমান , সর্বত্রবিরাজমান , সর্বজ্ঞ ইশ্বর এই মহাবিশ্ব আর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তবে প্রথমে অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন কেন তিনি এই দুঃখ , শোক আর অগুন্তি দুর্দশা ভরা পৃথিবীটার সৃষ্টি করেছেন যেখানে একটা মানুষও শান্তিতে নেই ?

অনুগ্রহ করে বলবেন না এটা তাঁর নিয়ম। যদি তিনি কোন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়ে থাকেন , তবে তিনি সর্বশক্তিমান নন। অনুগ্রহ করে বলবেন না এটা তাঁর ইচ্ছে। নেরো একটা রোম জ্বালিয়েছিলেন। তিনি একটা সীমিতসংখক মানূষকে হত্যা করেছিলেন। তাঁর অসুস্থ আনন্দের জন্য অল্প কিছু বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তাঁর জায়গা কোথায়? তাঁকে আমরা কিভাবে মনে রেখেছি? সবধরণের অপমানজনক বিশেষণ তাঁর জন্য বরাদ্দ আছে। ইতিহাসের পাতার পর পাতা নেরোর নিন্দায় ব্যবহার করা ভর্তসনাপূর্ণ সমালোচনায় কালো হয়ে আছে। নেরো অত্যাচারী , নির্দয় , দুষ্ট , নীতিহীন ইত্যাদি।

এক চেঙ্গিস খান আনন্দের খোঁজে কয়েক হাজার মানূষকে হত্যা করেছিলেন আর তাই আমরা ওই নামটাকেই ঘৃণা করি। এখন কি করে আপনি আপনার সর্বশক্তিমান , শ্বাশত নেরোকে যৌক্তিক ভাবেন যিনি প্রতিটি দিন , প্রতিটি মুহুর্তে তাঁর মানুষের অন্যায় হত্যার আমোদ-প্রমোদ চালিয়ে যাচ্ছেন ? কি করে আপনি তাঁর কীর্তিকলাপকে সমর্থন করেন যা মানুষের উপর নামিয়ে আনা নিষ্ঠুরতা আর দুর্দশার বিচারে চেঙ্গিস খানকেও ছাড়িয়ে যায় ? আমি প্রশ্ন করছি যে সর্বশক্তিমান কেন এই পৃথিবীর সৃষ্টি করেছিলেন যা একটা জীবন্ত নরক ছাড়া আর কিছুই নয় , একটা সবসময়ের তিক্ত অস্থিরতার জায়গা। কেন তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন যখন তাঁর তা না করারও ক্ষমতা ছিল ? আপনাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর আছে ? আপনারা বলবেন যে তিনি পরের জন্মে অন্যায়কারীদের শাস্তি আর ভুক্তভোগীদের পুরস্কার দেবেন। বেশ , বেশ। একজন যিনি আপনাদের সারা দেহ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করার পর যত্ন করে মোলায়েম আর আরামদায়ক মলম লাগিয়ে দেন তাঁকে আপনারা কতটা যৌক্তিক মনে করেন ? গ্ল্যাডিয়েটরদের দ্বন্ধযুদ্ধের আয়োজক আর সমর্থকরা আধপেটা সিংহের সামনে গ্ল্যাডিয়েটরদের ছুঁড়ে দিতেন। যদি গ্ল্যাডিয়েটররা এই ভয়ানক মৃত্যুর থাবা এড়াতে পারতেন , তবে তাঁদের ভাল করে যত্নআত্তি আর দেখভাল করা হত। তাই আমি প্রশ্ন করছি – মানুষকেও কি এইধরনের আনন্দ পাওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি ? তবে তাঁর আর নেরোর মধ্যে ফারাক কোথায় ?

হিন্দু দর্শন আরও একটা যুক্তি দেবার চেষ্টা করবে। আপনারা যাঁরা মুসলমান ও খ্রীষ্টান , তাঁদের প্রশ্ন করছি , আপনারা আগের প্রশ্নটার কি উত্তর দেবেন ? আপনারা গতজন্মে বিশ্বাস করেন না। হিন্দুদের মত আপনারা দৃশ্যতঃ পুরোপুরি নির্দোষ ভুক্তভোগীদের গতজন্মের দুষ্কর্মের যুক্তি দিতে পারবেন না। আমি প্রশ্ন করছি , কেন সর্বশক্তিমান ছয়দিন ধরে পরিশ্রম করলেন শব্দের মাধ্যমে জগত সৃষ্টি করার জন্য আর প্রতিদিনই বললেন যে সব ঠিক আছে। আজ তাঁকে ডাকুন। অতীত ইতিহাস দেখান। বর্তমান পরিস্থিতিটা পর্যবেক্ষণ করতে দিন। দেখা যাক তিনি বলতে সাহস পান কি না , “ সব ঠিক আছে ”।

চোখদুটো খুলুন। দেখতে পাবেন কারাগারের বিকট অন্ধকার কুঠরির থেকেও নোংরা কুঁড়েঘর আর বস্তিতে কোটি কোটি লোক খিদের জ্বালায় মরছেন। শান্ত বা উদাসীনভাবে দেখুন কিভাবে ধনী পিশাচেরা শ্রমিকদের রক্ত চুষছেন। মানুষের শক্তির এই ভীষণরকম অপচয় দেখে সামান্যতম বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিও আতঙ্কে কেঁপে উঠবেন। স্রেফ দেখুন ধনী দেশগুলো কিভাবে তাদের বাড়তি উৎপাদন গরীব , বঞ্চিত দেশগুলোর মধ্যে না বিলিয়ে সাগরে ফেলে দিচ্ছে। দেখুন কিভাবে মানুষের হাড়ের ভিতের উপর রাজাদের প্রাসাদ তৈরী হয়েছে। এই সবকিছু দেখে বলুন “ঈশ্বরের রাজত্বে সব ঠিক আছে”। আমার প্রশ্ন এইরকম কেন? আপনারা চুপ করে আছেন । বেশ , আমি পরের বক্তব্যে যাই।

আপনারা – হিন্দুরা – বলবেন এই জন্মে যিনি কষ্টভোগ করছেন তিনি অবশ্যই গত জন্মে পাপী ছিলেন। এটা বলার মানে এখন যাঁরা অত্যাচারী তাঁরা গত জন্মে মহান মানুষ ছিলেন। শুধুমাত্র সেই কারনে তাঁদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে। আমাকে মানতেই হবে যে আপনাদের পূর্বপুরুষরা ধূর্ত মানূষ ছিলেন। তাঁরা জনসাধারনের থেকে যুক্তিবিচারের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সবসময় নিকৃষ্ট ছল উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। দেখা যাক এই যুক্তিতে কতটা ওজন আছে।

আইনবিজ্ঞান বিশারদরা অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়ার পক্ষে তিনটি যুক্তি দেন। সেগুলো হচ্ছে প্রতিশোধ , সংশোধন আর প্রতিরোধ। এখন সব চিন্তাবিদরাই প্রতিশোধ তত্ত্ব অপছন্দ করেন। প্রতিরোধ তত্ত্বর খুঁতগুলোর জন্য সমালোচনা হচ্ছে। সংশোধন তত্ত্বই এখন বহুলভাবে গৃহীত হয়েছে আর মানুষের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় মনে করা হচ্ছে। সংশোধন তত্ত্বর লক্ষ্য অপরাধীর মধ্যে পরিবর্তন এনে তাঁকে শান্তিকামী নাগরিকে পরিণত করা। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি কোন দুষ্কর্ম করেও থাকেন তবে ঈশ্বর তাঁকে যে সাজা দেন তার স্বরুপটা কিরকম ? তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক একজন তাঁর গতজন্মে কোন অপরাধ করেছিলেন যার জন্য ঈশ্বর তাঁকে এই জন্মে গাছ , বিড়াল বা অন্য কোন জন্তু করে পাঠালেন। আপনাদের মতে ঈশ্বরীয় শাস্তির এইসব রকমফেরের সংখ্যা কমপক্ষে চুরাশী লক্ষ। আমাকে বলুন শাস্তির নামে এই যে ভাঁড়ামি চলছে তাতে মানূষের উপর কোন সংশোধনাত্মক প্রভাবটা পড়েছে ? কতজনের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে যাঁরা গতজন্মে গাধা ছিলেন তারও পিছনের জন্মের পাপের জন্য ? একজনও নয়। তথাকথিত ‘পুরাণ’এর তত্ত্ব রুপকথা ছাড়া আর কিছু নয়। ওই অকথ্য আবর্জনাগুলো নিয়ে আলোচনার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আপনারা জানেন কি পৃথিবীর সবথেকে জঘন্যতম অপরাধ কি ? গরীব হওয়া। হ্যাঁ , গরীবি একটা পাপ। গরীবি একটা শাস্তি। সেই তত্ত্ববিদ , আইনজ্ঞ অথবা আইনপ্রণয়নকারী নিপাত যান যিনি মানুষকে আরও ঘৃণ্য পাপের চোরাবালিতে ঠেলে দেবার বন্দোবস্ত করেন। আপনাদের সর্বজ্ঞ ঈশ্বর কি এটা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি ? নাকি আরও কোটি কোটি মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে না গেলে তাঁর সত্যোপলব্ধি হবে না ? যিনি নীচু জাতের পরিবারে , ধরা যাক চামার বা ঝাড়ুদার পরিবারে , জন্মেছেন তাঁর ভাগ্যটা আপনাদের তত্ত্ব অনুযায়ী কি? তিনি গরীব তাই পড়াশোনা করতে পারবেন না। তাঁকে উঁচু জাতের লোকেরা বর্জন আর ঘৃণা করবেন। তাঁর অজ্ঞতা , গরীবি আর অন্যদের থেকে পাওয়া তাচ্ছিল্য সমাজের প্রতি তাঁর হৃদয়কে কঠিন করে তুলবে। ধরা যাক তিনি একটা অপরাধ করলেন। তার দায়টা কার উপর বর্তাবে ? ঈশ্বরের না তাঁর নিজের না সমাজের বিদ্বজ্জনদের উপর ? স্বার্থপর ও উদ্ধত ব্রাহ্মণরা ইচ্ছাকৃতভাবে যাঁদেরকে অজ্ঞ করে রাখেন , তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া শাস্তিগূলো সম্বন্ধে আপনাদের মত কি ? যদি এই গরীব জীবেরা আপনাদের পবিত্র গ্রন্থ বেদের দু-চারটে শব্দ ভুলক্রমে শুনে ফেলতেন , ব্রাহ্মণেরা তাঁদের কানে গলন্ত সীসা ঢেলে দিতেন। যদি নীচু জাতির মানুষেরা অপরাধ করে থাকেন তবে তার দায়িত্ব কার ? কে তার ফল ভোগ করবে ? আমার প্রিয় বন্ধুরা , এইসব তত্ত্ব সুবিধাভোগী শ্রেণীদের তৈরী করা। সম্ভবতঃ আপটন সিনক্লেয়ার ( ভগত সিং সিনক্লেয়ারের লেখা পুস্তিকা ‘ধর্মের লাভ’(Profit of Religion)এর কথা বলছেন – অনুবাদক , মার্ক্সীয় আন্তর্জাতিক সংঘ ) কোথাও লিখেছিলেন “মানুষকে শুধু তাঁর আত্মার অমরত্বে দৃঢ় বিশ্বাস করিয়ে দিন। তারপর তাঁর যা কিছু আছে সব কেড়ে নিতে যান , তিনি স্বেচ্ছায় সবকিছু দিয়ে দেবেন”। ধর্মীয় প্রচারক আর ক্ষমতার অধিকারীদের মধ্যে নোংরা কুটুম্বিতার ফলে সমাজ কারাগার , ফাঁসিকাঠ , চাবুক আর সর্বোপরি ওইসব ঘুণধরা তত্ত্ব আশীর্বাদ হিসাবে পেয়েছে।

আমি প্রশ্ন করছি আপনাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কেন একজন মানুষ যখন অপরাধ বা পাপ করতে যান তাঁকে আটকে দেন না ? তাঁর কাছে তো এটা সামান্য ব্যাপার। কেন তিনি যুদ্ধবাজদের হত্যা করেন না ? কেন তিনি তাঁদের মাথা থেকে যুদ্ধবাসনা মুছে দেন নি ? এটা করে তিনি তো মানবতাকে অনেক ভয়ানক আতঙ্ক আর দুর্বিপাক থেকে বাঁচাতে পারতেন। কেন তিনি ব্রিটিশদের মধ্যে মানবতার আবেগ সঞ্চারিত করেন না যাতে তাঁরা স্বেচ্ছায় ভারত ছেড়ে চলে যান ? আমি প্রশ্ন করছি কেন তিনি পুঁজিবাদী শ্রেণীর হৃদয় পরার্থপর মানবতার আবেগে পূর্ণ করেন না যাতে তাঁরা উৎপাদনের উপায়গুলোর ব্যক্তিমালিকানা ছেড়ে দিয়ে গোটা খেটে-খাওয়া শ্রেণীকে অর্থের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন ? আপনি সাম্যবাদের ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক করতে চান। আমি ব্যাপারটা আপনাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপরে ছেড়ে দিচ্ছি লাগু করার জন্য। সাধারনতঃ লোকে সাম্যবাদকে জনকল্যাণের পক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা বলে মেনে নেন কিন্তু তার বিরোধিতাও করেন কারন তাঁদের মতে সাম্যবাদ লাগু করা অসম্ভব। আমি সর্বশক্তিমানকে আহ্বান করছি – আসুন , এসে সবকিছু ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দিয়ে যান। আর যুক্তির কচকচানির দরকার হবে না। আমি আপনাদের বলছি ব্রিটিশ শাসন এখানে ঈশ্বর চেয়েছেন বলে নেই। বরং আছে আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিরোধ করার ইচ্ছা আর সাহসের অভাব আছে বলে। ব্রিটিশরা আমাদেরকে ঈশ্বরের অনুমতিবলে পরাধীন করে রাখেন নি , পরাধীন করে রেখেছেন বন্দুক আর রাইফেল , বোম আর বুলেট , পুলিশ আর সেনাবাহিনীর জোরে , আর সবার উপরে আমাদের কোন হেলদোল নেই বলে। এই কারনে ব্রিটিশরা সবচাইতে জঘন্য অপরাধটা সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। এক দেশকে আরেক দেশের শোষণ হচ্ছে সবচাইতে জঘন্য অপরাধ। কোথায় ঈশ্বর ? কি করছেন তিনি ? তিনি কি এর থেকে অসুস্থ আনন্দ উপভোগ করছেন ? এক নেরো ! এক চেঙ্গিস খান ! তিনি নিপাত যান !

এখন আরেকটা উদ্ভাবিত যুক্তি দেখা যাক। আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন কিভাবে আমি এই পৃথিবী আর মানুষের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করি। চার্লস ডারউইন এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বই পড়ুন। সোহন স্বামীর ‘সাধারণ জ্ঞান’ও দেখুন। সন্তোষজনক উত্তর পাবেন। এটা জ়ীববিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক ইতিহাসের ব্যাপার। এটা প্রাকৃতিক ঘটনা। নীহারিকার মত বিভিন্ন বস্তুর আকস্মিক সংমিশ্রন এই পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। কবে ? এটা জানতে ইতিহাস পড়ুন। একই প্রক্রিয়ার ফলে প্রাণীদের বিবর্তন ঘটেছে। আর সেটাই আরও দীর্ঘদিন চলার ফলে মানুষ এসেছে। ডারউইনের ‘প্রজাতির উদ্ভব’ পড়ুন। পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত অগ্রগতি হয়েছে তা সবই প্রকৃতির সাথে মানুষের লাগাতার সংঘর্ষ আর প্রকৃতিকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করার মানুষের চেষ্টার ফলে। এটাই এই ঘটনার সংক্ষিপ্ততম ব্যাখ্যা।

আপনাদের পরের প্রশ্ন হবে কেন একটি শিশু অন্ধ বা পঙ্গু হয়ে জন্মাবে যদি তাঁর গতজন্মের পাপ না থাকে ? জীববিজ্ঞানীরা এই সমস্যাটার সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন নিতান্তই জৈবিক ঘটনা বলে। তাঁদের মতে পুরো দায়টা বর্তায় বাবা-মার উপর যাঁরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে এমন কিছু করেন যার ফলে জন্মানোর আগেই শিশুটির অঙ্গহানি ঘটে।

আপনারা আরও একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেন , যদিও এটা একেবারেই ছেলেমানুষি। প্রশ্নটা হচ্ছে : ঈশ্বর যদি নাই থাকেন তবে এত মানুষ কেন তাঁকে বিশ্বাস করে ? আমি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছি। মানুষ ভুত আর অশুভ আত্মায় যেমন বিশ্বাস করতে শিখেছে , তেমনই ঈশ্বরেও বিশ্বাস করতে শিখেছে। তফাতটা শুধু এই যে ঈশ্বরে বিশ্বাসটা প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় আর এর আনুষঙ্গিক হিসাবে যত্ন করে বিশাল ধর্মতত্ত্বের দর্শন গড়ে তোলা হয়েছে। তবে , আমি প্রগতিপন্থীদের দর্শনের সাথে একমত নই। প্রগতিপন্থীরা বলেন যে শোষকরা তাঁদের উর্বর মস্তিষ্ক খাটিয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছেন যাতে এক পরম সত্তার অস্তিত্ব প্রচার করে সাধারণ মানূষকে নিজেদের তাঁবে রাখতে পারেন এই বলে যে তাঁরা যে আরাম আর সুবিধা ভোগ করছেন তার পিছনে সেই পরম সত্তার অনুমোদন আছে। আমি প্রগতিপন্থীদের সাথে মূল প্রশ্নে একমত যে সব ধর্ম , বিশ্বাস , ধর্মতত্ব , ধর্মমত আর এই ধরনের সব প্রতিষ্ঠানই শেষপর্যন্ত অত্যাচারী ও শোষক প্রতিষ্ঠান বা মানুষ বা শ্রেণীর সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সব ধর্মেই পাপ বলে বিবেচিত হয়েছে।

ঈশ্বরের উৎপত্তি সম্বন্ধে আমার মত হল , মানুষ নিজের দুর্বলতা , সীমাবদ্ধতা আর ত্রুটিগুলো দেখে কল্পনায় ঈশ্বরের সৃষ্টি করেছিল। এইভাবে সে সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সাহস পেত। জীবনের বিপদগুলোর মুখোমুখি হওয়ার শক্তি জোগাড় করত। আর স্বাচ্ছল্য ও সমৃদ্ধিতেও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে চেষ্টা করত। ঈশ্বরের খামখেয়ালী নিয়ম আর পিতৃসুলভ উদারতার ছবিটা মানুষ নিজের কল্পনার রামধনুর রঙে এঁকেছে। যখন ঈশ্বরের ক্রোধ ও বিধিনিয়মের ক্রমাগত বিস্তার ঘটানো হচ্ছিল , তখন ঈশ্বরের ধারনাকে ব্যবহার করা হয়েছিল একটা প্রতিরোধক উপায় হিসাবে যাতে মানুষ সমাজের জন্য বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে। ঈশ্বর ছিলেন দুর্দশাগ্রস্তদের আর্তনাদ কারন বিশ্বাস করা হত যখন একজন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে একা আর অসহায় হয়ে পড়ে তিনি পাশে দাঁড়ান বাবা-মার মত , ভাই-বোনেদের মত , বন্ধুর মত। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুই করতে পারেন। একজন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে ঈশ্বরের ধারনাটা আশ্বাসজনক।

সমাজ যেমন মূর্তিপূজা আর অন্যান্য ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তেমনই এই ঈশ্বর বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে। এইভাবেই মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। বাস্তববাদী হতে হলে মানুষকে এইসব বিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলতে হবে। সাহস আর বিক্রমের সাথে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। আমার মনের অবস্থা ঠিক এটাই। আমার বন্ধুরা , এটা আমার দম্ভ নয় ; আমার চিন্তাধারাই আমাকে নাস্তিক করেছে। আমি মনে করি না যে ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করে বা তাঁর কাছে রোজ প্রার্থনা জানিয়ে ( আমি মনে করি এটা মানুষের পক্ষে সবচাইতে মর্যাদাহানিকর কাজ ) আমি আমার পরিস্থিতির কোন উন্নতি বা অবনতি করতে পারব। আমি অনেক নাস্তিকদের কথা পড়েছি যাঁরা সাহসের সাথে সবরকমের সমস্যা মোকাবিলা করেছেন। তাই আমিও চেষ্টা করছি শেষ পর্যন্ত , এমনকি ফাঁসিকাঠ অব্দি , একজন সত্যিকারের মানুষের মত মাথা উঁচু আর সোজা করে রাখতে।

দেখা যাক , আমি কতটা দৃঢ়চেতা। আমার এক বন্ধু আমাকে প্রার্থনা করতে বলছিলেন। তাঁকে আমার নাস্তিকতার কথা জানানোয় , তিনি বললেন – “ তোমার অন্তিম সময়ে তুমি বিশ্বাস করবে ”। আমি বললাম “না , বন্ধু , সেটা কখনই হবে না। আমি সেটাকে অধঃপতন আর নীতিহীনতা মনে করি। এইরকম তুচ্ছ স্বার্থপর উদ্দেশ্যে আমি কখনই প্রার্থনা করব না।” পাঠক ও বন্ধুগণ , এটা কি দম্ভ ? যদি হয় , আমি এর পক্ষে।

ডাউনলোড লিঙ্ক

One thought on “কেন আমি নাস্তিক? – ভগৎ সিং

  • Anoy Talukder

    এখানে বিপ্লবী ভগৎ সিং বলেছেন তার দাদু ছিলো আর্যসমাজী। তিনি তো শিখ ছিলেন। শিখ হয়ে তিনি কিভাবে আর্যসমাজী হলেন। আর এই আর্যসমাজ জিনিসটাই বা কি?

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *