দর্শন

দৃষ্টবাদ (Positivism): যা দেখা যায়, কেবল তা-ই কি সত্য? নাকি আমাদের চোখের দেখাও এক ধরনের ধোঁকা?

সূচিপত্র

ভূমিকা

এক অদ্ভুত বর্ষার দুপুর। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, টিনের চালে তার একটানা কনসার্ট চলছে। আপনি বারান্দার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন। হাতে গরম চায়ের কাপ। চারপাশটা কেমন যেন ঘোর লাগানো, স্বপ্নময়। আপনার বছর পাঁচেকের ছোট্ট ছেলে বা মেয়েটি হঠাৎ দৌড়ে এসে আপনার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, আকাশটা নীল কেন? অন্য কোনো রঙের নয় কেন?”

প্রশ্নটা খুব সহজ, কিন্তু উত্তরটা সহজ নয়। আপনি এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বিজ্ঞের মতো করে বলতে শুরু করলেন, “দেখো বাবা, আমাদের মাথার ওপর যে বাতাস আছে, তাতে অনেক ধুলোবালি আর গ্যাসের ছোট ছোট কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্যের আলো, যা দেখতে সাদা মনে হলেও আসলে সাতটি রঙের মিশ্রণ, যখন ওই কণাগুলোর ওপর দিয়ে আসে, তখন নীল রঙের আলোটা সবচেয়ে বেশি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়া নীল আলোই আমাদের চোখে এসে লাগে, তাই আমরা আকাশকে নীল দেখি।”

এটি একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক উত্তর। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে আলোর বিচ্ছুরণ (Rayleigh Scattering)। এখানে প্রতিটি ধাপ—সূর্যের আলো, তার রঙ, বায়ুমণ্ডলের কণা—সবই যন্ত্র দিয়ে মাপা যায়, পরীক্ষা করা যায়, প্রমাণ করা যায়। এই উত্তরের মধ্যে কোনো রহস্য নেই, আছে কেবল কারণ এবং তার ফল।

এবার চলুন, টাইম মেশিনে চেপে কয়েকশ বছর পেছনে ফিরে যাই। ভাবুন তো, তখন এমন প্রশ্নের কী উত্তর দেওয়া হতো? হয়তো কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি বলতেন, “নীল হলো ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় রঙ। তাই তিনি তাঁর ভালোবাসার চাদর হিসেবে আকাশকে নীল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন।” অথবা, কোনো লোককথার গল্পে হয়তো বলা হতো, “ওই আকাশে নীলপরী নামে এক দেবী থাকেন। আকাশটা তার নীল শাড়ির আঁচল।”

এই দুই ধরনের উত্তরের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, ঠিক সেখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের আজকের আলোচনার মূল চাবিকাঠি—এক শক্তিশালী ও বিতর্কিত দর্শন, যার নাম দৃষ্টবাদ (Positivism)। প্রথম উত্তরটি হলো দৃষ্টবাদী চিন্তার ফসল, আর দ্বিতীয়টি হলো ধর্মতাত্ত্বিক বা অধিবিদ্যক (Theological or Metaphysical) চিন্তার ফসল।

দৃষ্টবাদ কোনো জটিল বা দুর্বোধ্য বিষয় নয়, যদিও এর নামটা শুনতে একটু ভারী। এর মূল কথাটা খুব সোজা। অনেকটা গ্রামের বয়স্ক লোকেদের কথার মতো, “যা নিজ চোখে দেখব না, হাতে ধরে পরখ করব না, তা এক বর্ণও বিশ্বাস করব না।” তবে দৃষ্টবাদীরা এর সঙ্গে আরও একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দেন—শুধু চোখে দেখলেই হবে না, তাকে যৌক্তিকভাবে বা গাণিতিকভাবে প্রমাণ করতেও পারতে হবে। জ্ঞান কেবল তা-ই, যা আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয় (Five Senses) দিয়ে অনুভব করা যায়, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা যায়, এবং যার ভিত্তিতে একটি নিশ্চিত ও বস্তুনিষ্ঠ (Objective) সিদ্ধান্তে আসা যায়। এর বাইরের জগতের গল্প, কল্পনা বা অনুমান—যেমন আত্মা, ঈশ্বর, ভাগ্য, পরকাল, স্বর্গ-নরক—এগুলো নিছকই অর্থহীন কথাবার্তা (Meaningless Statements)। কারণ, এগুলোর অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেওয়া যায় না। এগুলোকে ওজন করা যায় না, মাপা যায় না, এদের ছবি তোলা যায় না।

এই দীর্ঘ লেখাটিতে আমরা এই দৃষ্টবাদের অলিগলিতে ঘুরতে বেরোব। একটা লম্বা সফরে আমরা দেখব, এই প্রভাবশালী চিন্তার জন্ম হলো কীভাবে, এর পেছনের কারিগর কারা ছিলেন, এটি কীভাবে আমাদের বিজ্ঞান, সমাজ, রাজনীতি আর দৈনন্দিন জীবনকে বদলে দিয়েছে, এবং কেনই বা এই চিন্তাকে নিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক, এত সমালোচনা। চলুন, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আমাদের এই দার্শনিক ভ্রমণ শুরু করা যাক।

বিপ্লবের ছাই থেকে জন্ম নেওয়া এক দর্শন: দৃষ্টবাদের পেছনের গল্প

মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আমরা সবসময় একটা নিশ্চিত আশ্রয়ের খোঁজে থাকি। এমন এক ভিত্তি, যার ওপর আস্থা রেখে বলা যায়—‘হ্যাঁ, এটাই সত্য। এটাই ধ্রুব।’ একসময় এই আশ্রয় ছিল ধর্ম। ঈশ্বরের কথাই ছিল শেষ কথা। তারপর এল যুক্তি, এল দর্শন। কিন্তু সেখানেও হাজারটা মত, হাজারটা পথ। এই চরম অনিশ্চয়তার দোলাচল থেকেই একদল মানুষ বললেন, “থামো! আর কল্পনা বা অনুমান নয়। জ্ঞান হবে সেটাই, যা আমরা সরাসরি দেখতে পাই, মাপতে পারি, পরীক্ষা করতে পারি। এর বাইরে সব অর্থহীন।” এই যে একরোখা, কিছুটা জেদি এবং অসম্ভব প্রভাবশালী চিন্তা—এরই নাম দৃষ্টবাদ (Positivism)। এই দর্শন দাবি করে, আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাই (Empirical Experience) হলো জ্ঞানের একমাত্র বৈধ উৎস। এই দর্শন আকাশ থেকে পড়েনি। এর পেছনে ছিল রক্তের দাগ, বিপ্লবের আগুন আর কয়েকশ বছরের দার্শনিক প্রস্তুতি। চলুন, সেই গল্পটাই আজ শোনা যাক। গল্পটা একটা ভাঙা পৃথিবীর, আর সেই ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগানোর এক মরিয়া চেষ্টার।

রাজনৈতিক কড়াই: যখন পুড়ছিল গোটা ইউরোপ

কোনো বড় দর্শনের জন্ম বুঝতে হলে তার সময়টাকে বুঝতে হয়। দৃষ্টবাদের জন্ম হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন ইউরোপের রাজনৈতিক কড়াই টগবগ করে ফুটছিল। আর সেই ফুটন্ত কড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফ্রান্স।

ভাবুন তো ফরাসি বিপ্লবের (French Revolution, 1789) কথা। ঘটনাটা কেবল একজন রাজার পতন বা একটা জেলখানা ভাঙার গল্প নয়। এটা ছিল হাজার বছরের পুরনো এক পৃথিবীর মৃত্যু। যে পৃথিবীতে রাজা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, অভিজাতদের রক্ত ছিল সাধারণের চেয়ে নীল, আর চার্চের কথাই ছিল আইন। বিপ্লব এসে সেই বিশ্বাসের দুর্গে ডিনামাইট লাগিয়ে দিল। ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী’র (Liberty, Equality, Fraternity) স্লোগানে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস। মানুষ ভাবল, এতদিন ধরে চলে আসা সব অন্যায় আর কুসংস্কারের আঁধার কেটে গিয়ে এক নতুন সকাল আসছে।

কিন্তু সকালটা তেমন সুখের হলো না। বিপ্লবের পরপরই ফ্রান্সে যে চরম বিশৃঙ্খলা আর রক্তপাত শুরু হলো, ইতিহাসে তা ‘ত্রাসের রাজত্ব’ (Reign of Terror) নামে পরিচিত। শত শত, হাজার হাজার মানুষকে গিলোটিনে চড়িয়ে দেওয়া হলো—কখনো সন্দেহের বশে, কখনো ব্যক্তিগত আক্রোশে। যে বিপ্লব এসেছিল মুক্তি দিতে, সেই বিপ্লবই হয়ে উঠল এক দানব। পুরনো পৃথিবীটা তো ভাঙল, কিন্তু নতুন যে পৃথিবীটা গড়া হবে, তার নকশাটা কী হবে? কিসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে নতুন সমাজ?

এই প্রশ্নটাই তৎকালীন চিন্তাবিদদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাঁরা দেখলেন, শুধু ঈশ্বরের নামে যেমন সমাজ চালানো যায় না, তেমনি শুধু ‘স্বাধীনতা’ বা ‘যুক্তি’র মতো বিমূর্ত আদর্শের ওপর ভর করেও একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়া সম্ভব নয়। এই চরম অস্থিতিশীলতা আর নিরাপত্তাহীনতা থেকে মানুষের মনে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মাল—স্থিতিশীলতা (Order) এবং প্রগতি (Progress)। এমন এক সমাজব্যবস্থা দরকার, যা হবে মজবুত, সুশৃঙ্খল এবং যার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে।

ঠিক এখানেই বিজ্ঞানের সাফল্য তাঁদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। একদিকে যখন সমাজ আর রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা, অন্যদিকে তখন প্রকৃতি বিজ্ঞানের জগতে চলছে জয়জয়কার।

স্যার আইজ্যাক নিউটন (Sir Isaac Newton) দেখিয়ে দিয়েছেন, বিশাল মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্র কিছু নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম মেনে চলে। তাঁর মহাকর্ষ সূত্র (Law of Universal Gravitation) দিয়ে আপেলের পতন থেকে শুরু করে গ্রহের কক্ষপথ পর্যন্ত সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়, এমনকি ভবিষ্যদ্বাণীও করা যায়। রসায়নে ল্যাভয়সিয়ে (Antoine Lavoisier) বস্তুর নিত্যতা সূত্র আবিষ্কার করছেন। জীববিজ্ঞানে নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে।

এই সাফল্য দেখে তৎকালীন চিন্তাবিদদের মনে একটি যুগান্তকারী ধারণা জন্মাল। তাঁরা ভাবলেন, প্রকৃতি জগতের যদি এমন সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকতে পারে, তাহলে মানব সমাজের কেন থাকবে না? সমাজেরও নিশ্চয়ই এমন কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম (Natural Laws of Society) আছে! সেই নিয়মগুলো যদি একবার বিজ্ঞানের পদ্ধতি ব্যবহার করে আবিষ্কার করা যায়, তাহলেই তো কেল্লাফতে! তাহলেই সমাজের সব রোগ নির্ণয় করে তার প্রতিকার করা সম্ভব হবে। বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি নিখুঁত, বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল সমাজ গড়া যাবে।

এই স্বপ্নই ছিল দৃষ্টবাদের রাজনৈতিক গর্ভগৃহ। এটি ছিল বিপ্লব-পরবর্তী বিশৃঙ্খলার একটি সরাসরি প্রতিক্রিয়া। এটি ছিল স্থিতিশীলতা খুঁজে পাওয়ার জন্য এক মরিয়া বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা (Pickering, 1993)।

দর্শনের অস্ত্রশস্ত্র: যে হাতিয়ারে শান দিয়ে জন্মাল দৃষ্টবাদ

বিপ্লবের আগুন যেমন রাজনৈতিক জমিন তৈরি করেছিল, তেমনি কয়েকশ বছর ধরে ইউরোপের দার্শনিকেরা সেই জমিনে চাষ করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করছিলেন। দৃষ্টবাদ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনো আগাছা নয়, এর শেকড় ছিল অনেক গভীরে—ইউরোপের নবজাগরণ (Renaissance) আর আলোকায়নের (Enlightenment) উর্বর মাটিতে।

অন্ধকার মধ্যযুগে জ্ঞান ছিল ধর্ম আর দর্শনের এক সুরক্ষিত দুর্গে বন্দী। বাইবেলে যা লেখা আছে, তার বাইরে যাওয়া ছিল মহাপাপ। পৃথিবী নয়, সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে—এই বিশ্বাস ছিল প্রশ্নাতীত। এই কথাটির বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ তুলে ধরার জন্য জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এবং গ্যালিলিও গ্যালিলিকে সারাজীবন গৃহবন্দী হয়ে কাটাতে হয়েছিল।

কিন্তু ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকে একটা বড় ঝাঁকুনি আসতে শুরু করল। চিন্তার জগতে একদল বিপ্লবী মানুষের আবির্ভাব ঘটল। এঁদের বলা হতো অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricists)

ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon): প্রকৃতির বই পড়ার কারিগর: ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন এসে যেন জ্ঞানের দরজায় প্রথম শাবলের ঘা দিলেন। তিনি বললেন, জ্ঞান পুরনো বইয়ের পাতায় বা ধর্মগুরুর মুখে থাকে না, জ্ঞান লুকিয়ে আছে প্রকৃতির বুকে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে আরোহী পদ্ধতির (Inductive Method) মাধ্যমে। অর্থাৎ, আগে অনেকগুলো নির্দিষ্ট ঘটনাকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করো, তারপর সেগুলোর ভিত্তিতে একটি সাধারণ সূত্রে পৌঁছাও। যেমন, একটি, দুটি, দশটি, হাজারটা কাককে কালো দেখে সিদ্ধান্তে আসা যে, সম্ভবত পৃথিবীর সব কাকই কালো। এটাই হলো বিজ্ঞানের পথ। বেকন কুসংস্কার, ঐতিহ্য এবং দর্শনের তৈরি করা ‘মনের মূর্তি’ (Idols of the Mind) ভেঙে ফেলে বিশুদ্ধ পর্যবেক্ষণ থেকে জ্ঞানার্জনের কথা বলেন (Bacon, 1620/2000)। তাঁর কাছে, জ্ঞান মানে ক্ষমতা—প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা।

জন লক (John Locke): মনের সাদা কাগজের তত্ত্ব: এরপর এলেন জন লক। তিনি বললেন, মানুষ জন্মের সময় তার মনটা থাকে একটা সাদা কাগজের (Tabula Rasa or Blank Slate) মতো। সেখানে কিছুই লেখা থাকে না। ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো ধারণা বা জ্ঞান নিয়ে আমরা জন্মাই না। জন্মের পর থেকে তার যত অভিজ্ঞতা হয়—যা সে দেখে, শোনে, অনুভব করে—সেগুলোই ধীরে ধীরে সেই সাদা কাগজে জ্ঞান ও ধারণা হয়ে লেখা হতে থাকে। অর্থাৎ, অভিজ্ঞতাই (Experience) জ্ঞানের একমাত্র উৎস (Locke, 1689/1997)। আমাদের মনে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ন্যায়’-এর মতো জটিল ধারণাও শেষ পর্যন্ত সরল ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার সমষ্টি মাত্র। এই চিন্তাটি ছিল মারাত্মক বিপ্লবী, কারণ এটি অভিজাততন্ত্রের মূলে আঘাত করেছিল। যদি জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকেই আসে, তাহলে রাজা বা অভিজাতদের জ্ঞান সাধারণ মানুষের চেয়ে জন্মগতভাবে উন্নত—এই দাবির কোনো ভিত্তি থাকে না।

ডেভিড হিউম (David Hume): অধিবিদ্যার চূড়ান্ত শত্রু: তবে এই অভিজ্ঞতাবাদের সবচেয়ে কট্টর এবং প্রভাবশালী প্রবক্তা ছিলেন স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম। তিনি এসে যেন পুরো দর্শনের টেবিলটাই উল্টে দিলেন। হিউম অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বললেন, আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার বাইরে যা কিছু আছে, তা নিয়ে কথা বলাই সময় নষ্ট। যে কোনো ধারণা বা শব্দকে তিনি অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করতে চাইতেন। তিনি এক বিখ্যাত উক্তিতে বলেন, “যখন আমরা কোনো বই হাতে নিই, ধরা যাক ধর্মতত্ত্ব বা অধিবিদ্যার, তখন আমাদের প্রশ্ন করতে হবে: এতে কি পরিমাণ বা সংখ্যা সংক্রান্ত কোনো বিমূর্ত যুক্তি আছে? (যেমন গণিত) অথবা, এতে কি ঘটনা ও অস্তিত্ব সংক্রান্ত কোনো পরীক্ষামূলক যুক্তি আছে? যদি দুটোর একটিও না থাকে, তবে এটিকে আগুনে নিক্ষেপ করো: কারণ এতে ছলচাতুরী ও বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না” (Hume, 1748)। হিউম এমনকি কার্যকারণ সম্পর্ক (Causation) নামে যেটিকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিই, সেটিকেও আক্রমণ করলেন। আমরা দেখি, একটি বিলিয়ার্ড বল (বল-ক) এসে আরেকটি বলকে (বল-খ) ধাক্কা দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বলটা চলতে শুরু করে। আমরা ধরে নিই, বল-ক-এর ধাক্কাটাই হলো বল-খ-এর চলার ‘কারণ’। হিউম বললেন, আমরা আসলে কী দেখি? আমরা শুধু দেখি দুটি ঘটনা পরপর ঘটছে (Constant Conjunction)—প্রথমে প্রথম বলের গতি, তারপর দ্বিতীয় বলের গতি। এই দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো ‘আবশ্যিক সম্পর্ক’ (Necessary Connection) বা অদৃশ্য শক্তি আমরা দেখতে পাই না। এটা আমাদের মনের একটা অভ্যাস মাত্র, যা বারবার দুটি ঘটনাকে একসঙ্গে ঘটতে দেখে একটিকে অন্যটির কারণ বলে ধরে নেয়। এই চরম সংশয়বাদ (Skepticism) এবং অধিবিদ্যার (Metaphysics) প্রতি তীব্র অনাস্থা—এটাই দৃষ্টবাদের জন্য চূড়ান্ত জমি প্রস্তুত করে দিয়েছিল। হিউম যা কিছু প্রমাণ করা যায় না, তাকে জ্ঞানের জগৎ থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন।

স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি: যারা দৃষ্টবাদের ইমারত গড়লেন

এই উত্তাল রাজনৈতিক আবহাওয়া আর শানিত দার্শনিক হাতিয়ার নিয়ে মঞ্চে এলেন একদল চিন্তাবিদ। তাঁরা চাইলেন সমাজকে নতুন করে গড়তে।

অঁরি দ্য সাঁ-সিমোঁ (Henri de Saint-Simon): বৈজ্ঞানিক সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা: দৃষ্টবাদের আনুষ্ঠানিক জন্মের আগে এর সবচেয়ে বড় স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ফরাসি চিন্তাবিদ সাঁ-সিমোঁ। তিনি ছিলেন একজন অভিজাত, যিনি ফরাসি বিপ্লবকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি চাক্ষুষ করেছিলেন বিপ্লবের বিশৃঙ্খলা। সাঁ-সিমোঁ প্রথম স্পষ্টভাবে বলেন যে, পুরনো ‘ধর্মতাত্ত্বিক-সামরিক’ (Theological-Military) সমাজ ভেঙে পড়ছে এবং তার জায়গায় একটি নতুন ‘বৈজ্ঞানিক-শিল্প’ (Scientific-Industrial) সমাজ আসছে (Manuel, 1962)। তাঁর মতে, এই নতুন সমাজের নেতৃত্ব দেবে পুরোহিত বা অভিজাতরা নয়, বরং বিজ্ঞানীরা, প্রকৌশলীরা, শিল্পপতিরা এবং ব্যাংকাররা। অর্থাৎ, যাঁরা কাজ করেন, উৎপাদন করেন এবং জ্ঞানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি নতুন বিজ্ঞানের কথা বলেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘সামাজিক পদার্থবিদ্যা’ (Social Physics)। এই বিজ্ঞানের কাজ হবে সমাজের নিয়মগুলো আবিষ্কার করা এবং সেই অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করা। তিনি এক নতুন ধরনের খ্রিস্টধর্মেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার মূল ভিত্তি হবে বিজ্ঞান ও মানবপ্রেম। যদিও তাঁর চিন্তাগুলো কিছুটা অগোছালো ছিল, তিনিই প্রথম সমাজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অধ্যয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিয়েছিলেন।

ওগ্যুস্ত কোঁত (Auguste Comte): নতুন বিজ্ঞানের জনক: সাঁ-সিমোঁর একসময়ের শিষ্য এবং সহকারী ওগ্যুস্ত কোঁত এই অগোছালো স্বপ্নকে একটি সুসংহত দার্শনিক ব্যবস্থায় পরিণত করেন। তিনিই প্রথম ‘দৃষ্টবাদ’ (Positivism) শব্দটি ব্যবহার করেন এবং সাঁ-সিমোঁর ‘সামাজিক পদার্থবিদ্যা’র নাম বদলে রাখেন ‘সমাজবিজ্ঞান’ (Sociology)। কোঁত তাঁর বিখ্যাত স্তরত্রয়ের সূত্রের (Law of Three Stages) মাধ্যমে দেখান যে, মানব সমাজ ও জ্ঞান অনিবার্যভাবে তিনটি স্তরের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়—ধর্মতাত্ত্বিক (Theological), অধিবিদ্যক (Metaphysical) এবং সবশেষে দৃষ্টবাদী বা বৈজ্ঞানিক (Positive)। তাঁর মতে, ফরাসি বিপ্লবের কারণ ছিল পুরনো ধর্মতাত্ত্বিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, কিন্তু নতুন বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা তখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই দুইয়ের মাঝখানের অধিবিদ্যক স্তরটাই ছিল সব বিশৃঙ্খলার মূল। কোঁতের স্বপ্ন ছিল সমাজবিজ্ঞানকে ‘বিজ্ঞানের রানী’ (Queen of the Sciences) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এই বিজ্ঞানের পুরোহিত হবেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাঁরাই সমাজের নিয়মকানুন আবিষ্কার করে সরকারকে পরামর্শ দেবেন এবং একটি সুশৃঙ্খল ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলবেন। কোঁতের মূলমন্ত্র ছিল: “ভালোবাসাকে নীতি হিসেবে, স্থিতিশীলতাকে ভিত্তি হিসেবে, আর প্রগতিকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করো” (Love as a principle, order as the basis, and progress as the goal)। তাঁর লক্ষ্য ছিল ফরাসি বিপ্লবের ‘ধ্বংসাত্মক’ কাজ শেষ করে একটি ‘গঠনমূলক’ অধ্যায় শুরু করা।

ইতিহাসের ছাঁচে ঢালা এক দর্শন

তাহলে দেখা যাচ্ছে, দৃষ্টবাদ কোনো নিছক দার্শনিক তত্ত্ববিলাস ছিল না। এটি ছিল তার সময় ও পরিস্থিতির একটি অনিবার্য ফসল। এর রক্তে-মাংসে মিশে ছিল ফরাসি বিপ্লবের আগুন, ত্রাসের রাজত্বের ভয়, আর একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য তীব্র আকুতি। এর মস্তিষ্কে ছিল বেকন, লক ও হিউমের মতো দার্শনিকদের দেওয়া শানিত অস্ত্র, যা দিয়ে অধিবিদ্যা আর ধর্মতত্ত্বের কাল্পনিক জগৎকে কেটে ফেলা যায়। আর এর হৃদয়ে ছিল সাঁ-সিমোঁ আর কোঁতের মতো স্বপ্নদ্রষ্টাদের ইউটোপিয়া—বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এক নতুন, নিখুঁত পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন।

এই দর্শন আমাদের শিখিয়েছে প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু বিশ্বাস না করতে। এটি আধুনিক বিজ্ঞান, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যুক্তিবাদী চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করেছে। কিন্তু এই দর্শনের জন্ম যে এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রয়োজনে হয়েছিল, সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। বিশৃঙ্খলার ভয় থেকেই জন্ম নিয়েছিল স্থিতিশীলতার প্রতি এই তীব্র টান। হয়তো এজন্য দৃষ্টবাদ মানুষের আবেগ, কল্পনা আর যে বিষয়গুলোকে মাপা যায় না, সেগুলোকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখে। কারণ, ওগুলো বড় গোলমেলে জিনিস, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই!

মূল কারিগর: ওগ্যুস্ত কোঁত এবং তাঁর ত্রয়ী সূত্রের জগৎ

ওগ্যুস্ত কোঁত (Isidore Auguste Marie François Xavier Comte, 1798-1857) ছিলেন একজন অসাধারণ মেধাবী কিন্তু কিছুটা খামখেয়ালি প্রকৃতির ফরাসি দার্শনিক। তাঁকে প্রায়ই সমাজবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক জনক (Father of Sociology) হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়। কোঁত ফরাসি বিপ্লবের পরের সেই বিশৃঙ্খল সময়ে বড় হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমাজের এই অস্থিরতা দূর করে একটি নতুন স্থিতিশীল ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পুরনো ধর্ম বা রাজতন্ত্রের ভিত্তিতে নয়, বরং নতুন বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর। আর এই নতুন সমাজ গড়ার মূল হাতিয়ার হিসেবে তিনি যে দর্শনকে তুলে ধরলেন, তার নামই দিলেন ‘পজিটিভিজম’ (Positivism) বা দৃষ্টবাদ (Comte, 1853)।

‘পজিটিভ’ (Positive) শব্দটার মানে এখানে ‘হ্যাঁ-সূচক’ বা ‘ভালো’ কিছু নয়। কোঁতের কাছে ‘পজিটিভ’ শব্দের কয়েকটি নির্দিষ্ট অর্থ ছিল—যা কিছু বাস্তব (Real), যা নিশ্চিত (Certain), যা সুনির্দিষ্ট (Precise), যা কাজের (Useful) এবং যা আপেক্ষিক (Relative) (অর্থাৎ চূড়ান্ত বা পরম নয়)। জ্ঞানকে হতে হবে এই গুণগুলোর অধিকারী।

কোঁতের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে তাঁর বিখ্যাত স্তরত্রয়ের সূত্র (Law of Three Stages)। তাঁর মতে, মানব সমাজের জ্ঞান, মানুষের মন, এমনকি প্রতিটি বিজ্ঞান—সবকিছুই অনিবার্যভাবে এই তিনটি কাল্পনিক স্তরের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়। এই সূত্রটি হলো মানব প্রগতির এক সার্বজনীন ইতিহাস।

১. ধর্মতাত্ত্বিক বা কাল্পনিক স্তর (Theological or Fictitious Stage): এটা হলো মানব জ্ঞানের শৈশবকাল। এই স্তরে মানুষ জগতের সব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করত কোনো না কোনো অতিপ্রাকৃত (Supernatural) শক্তি, দেবতা বা ঈশ্বরের ইচ্ছার ফল হিসেবে। মানুষের মনে ছিল ভয়, বিস্ময় আর কল্পনা। বজ্রপাত কেন হয়? কারণ, স্বর্গের কোনো দেবতা রেগে গিয়ে তাঁর অস্ত্র ছুঁড়ে মেরেছেন। ভূমিকম্প কেন হয়? কারণ, পৃথিবী যে ষাঁড়ের শিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে তার মাথা নাড়াচ্ছে। মহামারী কেন হয়? কারণ, মানুষ পাপ করায় ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিচ্ছেন। এই স্তরেরও আবার তিনটি উপস্তর ছিল:

  • ফেটিশিজম (Fetishism): এটা হলো সবচেয়ে আদিম অবস্থা। যখন মানুষ ভাবত, সবকিছুর মধ্যেই—গাছ, পাথর, নদী, পাহাড়—সবার মধ্যেই আত্মা বা প্রাণ আছে। তারা এই বস্তুর পূজা করত।
  • বহুঈশ্বরবাদ (Polytheism): এরপর মানুষ একটু উন্নত হলো। তারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির জন্য বিভিন্ন দেব-দেবীর কল্পনা করতে শুরু করল। যেমন: গ্রিকদের ছিল জিউস (বজ্রের দেবতা), পসাইডন (সমুদ্রের দেবতা); হিন্দুদের আছে ইন্দ্র (বৃষ্টির দেবতা), অগ্নি (আগুনের দেবতা)।
  • একেশ্বরবাদ (Monotheism): সবশেষে মানুষ চিন্তার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণায় পৌঁছাল। এই একজন ঈশ্বরই এই সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন এবং একাই নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন: ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মে ঈশ্বরের ধারণা।

২. অধিবিদ্যক বা বিমূর্ত স্তর (Metaphysical or Abstract Stage): এটা হলো জ্ঞানের কৈশোরকাল। এই স্তরটি বেশ গোলমেলে এবং পরিবর্তনশীল। এখানে মানুষ দেব-দেবীকে সরাসরি দায়ী না করে বিভিন্ন বিমূর্ত ধারণা (Abstract Ideas) বা অপ্রত্যক্ষ শক্তির সাহায্যে জগৎকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করত। ঈশ্বরের জায়গা নেয় ‘প্রকৃতি’ (Nature), ‘সত্তা’ (Essence), ‘প্রাণশক্তি’ (Vital Force) বা ‘অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য’ (Ultimate Purpose)-এর মতো অস্পষ্ট ধারণা। এটা অনেকটা ধর্মতাত্ত্বিক স্তর থেকে বৈজ্ঞানিক স্তরে যাওয়ার একটা দুর্বল সাঁকোর মতো। বজ্রপাতের কারণ হিসেবে বলা হলো, এটা প্রকৃতির এক অপরিহার্য শক্তি, যা দুটি মেঘের সংঘর্ষের ফলে অনিবার্যভাবে তৈরি হয়। ব্যাখ্যাটা আগের চেয়ে একটু উন্নত, যুক্তির ছোঁয়া আছে, কিন্তু এখনো পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষানির্ভর নয়। এই স্তরে দার্শনিকরা জগতের মূল কারণ নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলতেন, কিন্তু তার কোনো বাস্তব প্রমাণ দিতে পারতেন না। আলকেমিস্টরা যেমন বস্তুর ‘আসল সত্তা’ পরিবর্তন করে লোহাকে সোনা বানানোর চেষ্টা করতেন, তা এই স্তরের চিন্তার এক ভালো উদাহরণ।

৩. দৃষ্টবাদী বা বৈজ্ঞানিক স্তর (Positive or Scientific Stage): অবশেষে মানব জ্ঞান তার প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছায়। এই স্তরে এসে মানুষ সব ধরনের কাল্পনিক দেবতা বা বিমূর্ত ধারণা বাদ দিয়ে দেয়। সে তখন শুধু এবং শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ (Observation), পরীক্ষণ (Experimentation) আর যৌক্তিক বিশ্লেষণের (Logical Analysis) ওপর নির্ভর করে। সে আর জানতে চায় না ‘কেন’ (Why) এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে বা এর পেছনের উদ্দেশ্য কী—এই প্রশ্নগুলো তার কাছে অর্থহীন। সে জানতে চায় ‘কীভাবে’ (How) এই জগৎ কাজ করে। অর্থাৎ, ঘটনার পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বের করা এবং তার ভিত্তিতে সার্বজনীন নিয়ম (Universal Laws) আবিষ্কার করা। বজ্রপাত কেন হয়—এই প্রশ্নের উত্তরে সে এখন বলবে, মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিপুল পরিমাণ স্থির বিদ্যুৎ (Static Electricity) তৈরি হয় এবং একটি নির্দিষ্ট বিভব পার্থক্যে (Potential Difference) পৌঁছালে তা বায়ুমণ্ডলের প্রতিরোধ ভেঙে ভূমিতে বা অন্য মেঘে চলে আসে, একেই আমরা বজ্রপাত বলি। এই ব্যাখ্যাটি প্রমাণযোগ্য, গাণিতিকভাবে প্রকাশযোগ্য এবং এর ভিত্তিতে পূর্বাভাসও দেওয়া সম্ভব।

কোঁতের মতে, ইউরোপীয় সমাজ তাঁর সময়ে এই পজিটিভ স্তরে প্রবেশ করছিল। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান—এগুলো সবই পজিটিভ বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সমাজের আলোচনা তখনো অধিবিদ্যক স্তরেই আটকে ছিল। কোঁতের স্বপ্ন ছিল সমাজকেও এই পজিটিভ স্তরে নিয়ে আসা। আর এই কাজটি যে নতুন বিজ্ঞান করবে, তারই নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘সমাজবিজ্ঞান’ (Sociology), যা ল্যাটিন শব্দ Socious (সমাজ) এবং গ্রিক শব্দ Logos (জ্ঞান) মিলিয়ে তৈরি।

কোঁত এখানেই থামেননি। তিনি বিজ্ঞানের একটি সোপানক্রম বা মইয়ের মতো স্তরবিন্যাস (Hierarchy of Sciences) তৈরি করেছিলেন। তাঁর এই মইয়ের একেবারে নিচের ধাপে ছিল সবচেয়ে সরল, বিমূর্ত ও সাধারণ বিজ্ঞান—গণিত (Mathematics)। এরপর ধাপে ধাপে ওপরে উঠেছে জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy), পদার্থবিদ্যা (Physics), রসায়ন (Chemistry), জীববিজ্ঞান (Biology), এবং সবশেষে, মইয়ের একেবারে চূড়ায়—সবচেয়ে জটিল ও সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান—সমাজবিজ্ঞান (Sociology)

কেন সমাজবিজ্ঞান সবার ওপরে? কারণ, এটি সবচেয়ে জটিল বিষয়—অর্থাৎ মানব সমাজ—নিয়ে কাজ করে, যা অন্য সবকিছুর ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি বিজ্ঞান তার নিচের বিজ্ঞানটির মূলনীতির ওপর নির্ভর করে। যেমন, জীববিজ্ঞান বুঝতে রসায়ন আর পদার্থবিদ্যার নিয়ম জানা দরকার। রসায়ন বুঝতে পদার্থবিদ্যা আর গণিত জানা দরকার। তেমনি, সমাজকে বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে হলে জীববিদ্যা (মানুষ একটি জৈবিক প্রাণী), রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি সবকিছুরই জ্ঞান প্রয়োজন। কোঁত তাই সমাজবিজ্ঞানকে ‘বিজ্ঞানের রানী’ (Queen of the Sciences) বলে ঘোষণা করেন। তিনি সমাজের দুটি দিক নিয়ে গবেষণার কথা বলেন:

  • সামাজিক স্থিতিবিদ্যা (Social Statics): যা সমাজের স্থিতিশীলতার দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ, সমাজের সেই অংশগুলো যা সমাজকে একত্রে ধরে রাখে, যেমন: পরিবার, ধর্ম, ভাষা, শ্রম বিভাজন।
  • সামাজিক গতিবিদ্যা (Social Dynamics): যা সমাজের পরিবর্তন ও প্রগতির নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করে। তাঁর স্তরত্রয়ের সূত্রটিই হলো সামাজিক গতিবিদ্যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

মজার ব্যাপার হলো, জীবনের শেষ দিকে এসে কোঁত নিজেই তাঁর দর্শনের সঙ্গে এক অদ্ভুত আপস করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রিয়তমা ক্লোতিলদ দ্য ভো (Clotilde de Vaux)-এর অকালমৃত্যুর পর তিনি আবেগের গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, কেবল শুষ্ক বিজ্ঞান দিয়ে মানুষের সামাজিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের জয়গান গাইতে গাইতে তিনি এক নতুন ধরনের ‘মানবতার ধর্ম’ (Religion of Humanity) প্রবর্তন করতে চাইলেন। এই ধর্মে কোনো ঈশ্বর থাকবেন না, উপাসনা করা হবে এক মহান বিমূর্ত সত্তা ‘মানবতার’ (Humanity)—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষের সমষ্টি। এই নতুন ধর্মে থাকবেন পুরোহিত (যাঁরা হবেন সমাজবিজ্ঞানী), নিজস্ব ক্যালেন্ডার, আচার-অনুষ্ঠান, এমনকি সাধুসন্তের তালিকা (যেমন: নিউটন, গ্যালিলিও, শেক্সপিয়ার)। অনেকেই মনে করেন, তাঁর এই উদ্যোগ ছিল তাঁর নিজেরই পজিটিভ দর্শনের সঙ্গে এক চরম স্ববিরোধিতা, যা বিজ্ঞানকে ধর্মের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।

দৃষ্টবাদের শানিত রূপ: যৌক্তিক দৃষ্টবাদ ও ভিয়েনা চক্রের বিপ্লব

কোঁতের দৃষ্টবাদ ছিল উনিশ শতকের সৃষ্টি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই চিন্তা আরও ধারালো, আরও কঠোর এবং আরও আক্রমণাত্মক রূপ নিয়ে ফিরে আসে। নতুন এই রূপের নাম হলো যৌক্তিক দৃষ্টবাদ (Logical Positivism), এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের একদল মেধাবি দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও গণিতবিদের নাম। এই গোষ্ঠীর নাম ছিল ভিয়েনা চক্র (Vienna Circle)। ১৯২০-এর দশকে এই চক্রের সদস্যরা প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একত্রিত হতেন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ভাষার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। মরিৎস শ্লিক (Moritz Schlick), রুডলফ কারনাপ (Rudolf Carnap), অটো নিউরাথ (Otto Neurath) ছিলেন এই চক্রের মধ্যমণি। লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের (Ludwig Wittgenstein) প্রাথমিক দর্শন তাঁদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানকে সমস্ত আবর্জনা ও ধোঁয়াশা থেকে মুক্ত করা। তাঁরা তৎকালীন জার্মান দর্শন, বিশেষ করে হেগেল বা হাইডেগারের মতো দার্শনিকদের দুর্বোধ্য ও অধিবিদ্যক আলোচনা দেখে বিরক্ত ছিলেন। তাঁদের মতে, দর্শনের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস হলো অর্থহীন প্রশ্ন আর ভাষাগত বিভ্রান্তির ইতিহাস। এই জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য তাঁরা একটি ধারালো অস্ত্র তৈরি করলেন। এই অস্ত্রের নাম যাচাইযোগ্যতার নীতি (Verification Principle of Meaning)

কথাটা শুনতে কঠিন মনে হলেও, ধারণাটা বেশ সোজাসাপ্টা। তাঁরা বললেন, একটি বাক্য বা উক্তি অর্থপূর্ণ (Meaningful) হবে কেবল এবং কেবল দুটি শর্তে:

১. যদি বাক্যটি একটি বিশ্লেষণী স্বতঃসত্য (Analytic Tautology) হয়। যেমন: “সকল অবিবাহিত পুরুষই ব্যাচেলর” বা “একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণ আছে” বা “২+২=৪”। এই বাক্যগুলো সত্য হওয়ার জন্য বাইরের জগতের দিকে তাকানোর কোনো দরকার হয় না। এরা নিজেদের সংজ্ঞার মধ্যেই সত্য। ‘অবিবাহিত পুরুষ’ আর ‘ব্যাচেলর’ একই কথা। এগুলো আমাদের ভাষার গঠন বা যুক্তির নিয়ম মাত্র।

২. অথবা, যদি বাক্যটি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নীতিগতভাবে যাচাইযোগ্য (Empirically Verifiable in Principle) হয়। যেমন: “আমার টেবিলের ওপর একটি লাল বই আছে।” এই বাক্যটি সত্য না মিথ্যা, তা আমি আমার টেবিলে গিয়ে দেখলেই বুঝতে পারব। “চাঁদের উল্টো পিঠে পাহাড় আছে”—এই বাক্যটি হয়তো আমি এই মুহূর্তে যাচাই করতে পারছি না, কিন্তু নীতিগতভাবে একটি মহাকাশযান পাঠিয়ে এটি যাচাই করা সম্ভব। তাই এটিও একটি অর্থপূর্ণ বাক্য। প্রথমে তাঁরা কঠোর যাচাইকরণের (Strong Verification) কথা বললেও পরে বুঝতে পারেন যে, “সব কাক কালো” এর মতো বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলো কখনোই চূড়ান্তভাবে যাচাই করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা দুর্বল যাচাইকরণের (Weak Verification) ধারণা আনেন, যেখানে বলা হয় একটি বাক্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সম্ভাব্য বা সমর্থিত হলেই চলবে।

এই নীতির সবচেয়ে বড় এবং বিধ্বংসী শিকার হলো দর্শন, ধর্ম, নীতিবিদ্যা এবং নন্দনতত্ত্বের হাজার হাজার বছরের পুরনো প্রশ্নগুলো। যেমন:

  • “ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।” — যৌক্তিক দৃষ্টবাদীরা বলবেন, এই বাক্যটি কীভাবে যাচাই করবেন? কোনো যন্ত্র দিয়ে? ল্যাবরেটরিতে? টেলিস্কোপে? যেহেতু এর কোনো অভিজ্ঞতামূলক যাচাই সম্ভব নয়, এবং এটি কোনো স্বতঃসত্যও নয়, সুতরাং এই বাক্যটি সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়; এটি একটি অর্থহীন (Meaningless) বা আক্ষরিক অর্থে ননসেন্স। এটা কোনো তথ্য দেয় না, এটা কেবল একটি আবেগ প্রকাশ করে।
  • “মানুষের আত্মা অমর।” —একইভাবে, ‘আত্মা’ বা তার ‘অমরত্ব’—কোনোটিই ইন্দ্রিয় দিয়ে পরখ করার উপায় নেই। তাই এটিও অর্থহীন।
  • “চুরি করা খারাপ।” বা “সৎ থাকা ভালো।” — ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ জিনিসটা কী? এদের কি কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব আছে? এদের কি ওজন বা রঙ আছে? যায় না। তাই তাঁদের মতে, এটি কোনো বাস্তব ঘটনার বর্ণনা নয়। ব্রিটিশ দার্শনিক এ. জে. আয়ার (A. J. Ayer) তাঁর বিখ্যাত বই Language, Truth and Logic (1936)-এ এই ধারণাগুলোকে অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই ধরনের নৈতিক বাক্যগুলো আসলে বক্তার একটি অনুভূতি বা আবেগের প্রকাশ মাত্র। একে বলা হয় আবেগবাদ (Emotivism)। “চুরি করা খারাপ” বলার অর্থ আসলে “চুরি! ছিঃ!”—যা দিয়ে বক্তা নিজের একটি নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করছেন এবং অন্যকেও সেই কাজ থেকে বিরত থাকতে প্রভাবিত করতে চাইছেন।

যৌক্তিক দৃষ্টবাদীদের লক্ষ্য ছিল একটি একীভূত বিজ্ঞান (Unified Science) তৈরি করা, যেখানে সব জ্ঞানকে পদার্থবিদ্যার ভাষায় প্রকাশ করা যাবে এবং দর্শন পরিণত হবে বিজ্ঞানের একজন যৌক্তিক পরিচারকে, যার কাজ হবে ভাষার ভুল ব্যবহারগুলোকে ধরিয়ে দেওয়া। অধিবিদ্যা (Metaphysics) তাঁদের কাছে ছিল সবচেয়ে বড় শত্রু, যা ভাষার অপব্যবহারের ফলে জন্ম নেওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক রোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।

দৃষ্টবাদের ঢেউ: আধুনিক চিন্তার তীরে তীরে যার ছাপ

দৃষ্টবাদ শুধু দর্শনের বইয়ের পাতায় আটকে থাকা কোনো শুকনো তত্ত্ব ছিল না। এটি একটি শক্তিশালী স্রোতের মতো আধুনিক চিন্তার প্রায় প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাদের পদ্ধতি ও লক্ষ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

  • সমাজবিজ্ঞান (Sociology): কোঁতের দেখানো পথ ধরে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim) সমাজবিজ্ঞানকে একটি পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। তাঁর বই The Rules of Sociological Method-এ তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত ‘সামাজিক ঘটনা’কে (Social Facts) বস্তুর মতো করে দেখা (Treat social facts as things)। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত আবেগ, ধারণা বা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে নয়, বরং সমাজের বাহ্যিক, পর্যবেক্ষণযোগ্য এবং বাধ্যতামূলক দিকগুলো (যেমন: আইন, প্রথা, মুদ্রা ব্যবস্থা) নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে গবেষণা করতে হবে। তাঁর বিখ্যাত গবেষণা Suicide (আত্মহত্যা)-তে তিনি দেখান যে, আত্মহত্যা, যা আপাতদৃষ্টিতে একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত কাজ বলে মনে হয়, আসলে তা নয়। বিভিন্ন দেশের আত্মহত্যার হারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান যে, এটি সমাজের বিভিন্ন উপাদানের (যেমন: সামাজিক সংহতি, ধর্মীয় পরিচয়, পারিবারিক অবস্থা) সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত একটি সামাজিক ঘটনা (Durkheim, 1897)। প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ক্যাথলিকদের চেয়ে বেশি, কারণ প্রোটেস্ট্যান্ট সমাজে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়, যা সামাজিক সংহতিকে দুর্বল করে। এটিই ছিল সামাজিক গবেষণায় দৃষ্টবাদী পদ্ধতির এক ক্লাসিক উদাহরণ।
  • মনোবিজ্ঞান (Psychology): মনোবিজ্ঞানে দৃষ্টবাদের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী ফসল হলো আচরণবাদ (Behaviorism)জন বি. ওয়াটসন (John B. Watson) বা বি. এফ. স্কিনার (B. F. Skinner)-এর মতো আচরণবাদীরা বলেন, মন (Mind), চেতনা (Consciousness), অনুভূতি (Feeling)—এগুলো হলো একটি ‘কালো বাক্স’ (Black Box)। এর ভেতরে কী ঘটছে, তা দেখা যায় না, মাপা যায় না, বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তাই এগুলো নিয়ে কাজ করা অবৈজ্ঞানিক। মনোবিজ্ঞানের কাজ হলো কেবল পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ (Observable Behavior) নিয়ে গবেষণা করা। অর্থাৎ, কোন উদ্দীপকের (Stimulus) ফলে পরিবেশে কী প্রতিক্রিয়া (Response) হয়, শুধু সেটুকুই তাদের গবেষণার বিষয়। স্কিনারের বিখ্যাত ‘স্কিনার বক্স’-এ ইঁদুর বা পায়রাকে নির্দিষ্ট আচরণ করলে খাবার দেওয়ার মাধ্যমে তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার পরীক্ষা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
  • আইন (Law): আইনশাস্ত্রে জন্ম নেয় ‘আইনি দৃষ্টবাদ’ (Legal Positivism)জন অস্টিন (John Austin) বা এইচ. এল. এ. হার্ট (H. L. A. Hart)-এর মতো তাত্ত্বিকরা এই মতবাদের প্রবক্তা। তাঁদের মূল কথা হলো, আইন কী ‘হওয়া উচিত’ (নৈতিকতার প্রশ্ন), তা বিচার্যের বিষয় নয়। আইন হলো তা-ই, যা একটি দেশের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ (যেমন: সংসদ বা রাজা) নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তৈরি করেছে এবং যা বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়। আইন ভালো না মন্দ, নৈতিক না অনৈতিক, তা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু যতক্ষণ একটি নিয়ম আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে তৈরি হয়েছে, ততক্ষণ তা-ই আইন। এটি আইনকে নৈতিকতা ও ধর্ম থেকে পৃথক করার একটি প্রচেষ্টা।
  • রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি: এই বিষয়গুলোতেও পরিমাণগত গবেষণা (Quantitative Research), পরিসংখ্যানগত মডেলিং (Statistical Modeling), ভোটদানের আচরণ বিশ্লেষণ এবং ডেটা-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে বিপুল বাড়বাড়ন্ত, তার পেছনে দৃষ্টবাদী দর্শনের গভীর প্রভাব রয়েছে। অর্থনীতিতে জটিল গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে বাজার বা ভোক্তার আচরণকে পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যা প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়ম আবিষ্কারের চেষ্টারই সমতুল্য।

এককথায় বলতে গেলে, আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি নীতি নির্ধারণী দপ্তর পর্যন্ত, আমরা যে গবেষণার কাঠামো দেখি—যেখানে তথ্যের সংগ্রহ (Data Collection), ডেটার বিশ্লেষণ (Data Analysis), প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত (Evidence-based Decision Making) এবং বস্তুনিষ্ঠতার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়—তার গভীরে রয়েছে দৃষ্টবাদী মানসিকতা।

সমালোচনার ধারালো কাঁটা: যে কারণে দৃষ্টবাদের দুর্গ কেঁপে উঠেছিল

দৃষ্টবাদ জ্ঞানকে একটি পাথরের মতো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিল, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তার নিজের ভিত্তিই একসময় বালির মতো ধসে পড়তে শুরু করে। এর বিরুদ্ধে যে সমালোচনাগুলো উঠে আসে, সেগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুতর এবং যুক্তিযুক্ত।

১. মানুষ কি গবেষণাগারের জড়বস্তু? ব্যাখ্যার গভীরতা এবং ‘ভার্সিটহেন’ (Verstehen)-এর গুরুত্ব: দৃষ্টবাদের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা হলো, এটি প্রকৃতি বিজ্ঞান (Natural Sciences) আর সমাজ বিজ্ঞানের (Social Sciences) মধ্যে মৌলিক পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। পদার্থ বা রসায়নের গবেষণার বিষয় হলো অণু-পরমাণু বা জড়বস্তু, যাদের কোনো ইচ্ছা, আবেগ, চেতনা বা নিজস্ব উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় হলো মানুষ—চিন্তাশীল প্রাণী, যাদের ইচ্ছা আছে, বিশ্বাস আছে, সংস্কৃতি আছে, এবং যারা নিজেদের জগৎকে নিজেরাই ব্যাখ্যা করে।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম পুরোধা ম্যাক্স ভেবার (Max Weber) দৃষ্টবাদের এই যান্ত্রিক পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, মানুষের সামাজিক আচরণকে শুধু বাইরে থেকে একটি বস্তুর মতো পর্যবেক্ষণ করলেই চলবে না, তার ভেতরের আত্মগত অর্থ (Subjective Meaning) এবং উদ্দেশ্যটাও বুঝতে হবে। একই আচরণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে। যেমন, একজন মানুষ তার একটি চোখ দ্রুত বন্ধ করে আবার খুলল। এটা কি চোখের মাংসপেশির একটি অনিচ্ছাকৃত খিঁচুনি (twitch)? নাকি সে কাউকে চোখ মারছে (wink)? নাকি সে কোনো গোপন সংকেত দিচ্ছে? এটা শুধু বাইরে থেকে দেখে বোঝা অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সেই ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে তার পরিস্থিতিকে বোঝা, তার সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করা। ভেবার এই পদ্ধতিকে বলেছেন ‘ভার্সতেহেন’ (Verstehen), যার জার্মান অর্থ হলো ‘সহানুভূতিশীল বোঝা’ (Empathetic Understanding) (Weber, 1922)। দৃষ্টবাদ মানুষের এই জটিল, অর্থপূর্ণ এবং আত্মগত জগতটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে, যা সমাজ ও মানুষকে বোঝার জন্য অপরিহার্য। এটি গুণগত গবেষণার (Qualitative Research) ভিত্তি স্থাপন করে। সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্টনি গিডেন্স এই পার্থক্যকে “দ্বৈত হার্মিনিউটিক্স” (Double Hermeneutic) বলে ব্যাখ্যা করেন। প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা একটি জগৎকে ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানীরা এমন একটি জগৎকে ব্যাখ্যা করেন যা সেই জগতের মানুষেরা নিজেরাই প্রতিনিয়ত ব্যাখ্যা করে চলেছে। এবং সমাজ বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা আবার সেই মানুষদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে, যা প্রকৃতি বিজ্ঞানে ঘটে না।

২. যাচাইযোগ্যতার নীতির আত্মঘাতী প্রকৃতি: যৌক্তিক দৃষ্টবাদীদের যে মূল অস্ত্র—যাচাইযোগ্যতার নীতি—সেটিই বুমেরাং হয়ে তাদের দিকে ফিরে আসে। সমালোচকরা, বিশেষ করে কার্ল পপারের মতো দার্শনিকরা, একটি সরল কিন্তু বিধ্বংসী প্রশ্ন করলেন: “‘একটি বাক্য অর্থপূর্ণ হবে কেবল যদি তা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যাচাইযোগ্য হয়’—এই বাক্যটি নিজে কি যাচাইযোগ্য?” একটু ভাবলেই উত্তরটা পরিষ্কার হয়ে যায়। উত্তর হলো, ‘না’। এই নীতিটি কোনো গাণিতিক স্বতঃসত্যও নয়, আবার কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে এর সত্যতা যাচাই করাও সম্ভব নয়। এটি নিজেই একটি দার্শনিক বা অধিবিদ্যক দাবি, যা যাচাইয়ের ঊর্ধ্বে। সুতরাং, যৌক্তিক দৃষ্টবাদীদের নিজেদের নীতি অনুযায়ী, তাদের দর্শনের মূল ভিত্তিটাই একটি অর্থহীন বাক্য! এটি একটি পারফর্মেটিভ কন্ট্রাডিকশন বা স্ব-বিরোধী উক্তি। এটা ছিল তাদের কফিনে সবচেয়ে বড় এবং শেষ পেরেক।

৩. বিজ্ঞানের সরলীকৃত চিত্র এবং প্যারাডাইম শিফট: দৃষ্টবাদীরা বিজ্ঞানকে একটি অত্যন্ত সরলরৈখিক, যুক্তিনিষ্ঠ এবং সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ (Value-free and Objective) প্রক্রিয়া হিসেবে এঁকেছিলেন। তাঁদের মতে, বিজ্ঞানীরা শুধু তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সেই তথ্য থেকে ধীরে ধীরে সত্যের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক টমাস কুন (Thomas Kuhn) তাঁর যুগান্তকারী বই The Structure of Scientific Revolutions (1962)-এ দেখালেন যে, বিজ্ঞান আসলে মোটেও সেভাবে কাজ করে না।

কুন বলেন, বিজ্ঞানীরা সবসময় একটি নির্দিষ্ট ‘প্যারাডাইম’ (Paradigm) বা চিন্তার কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করেন। এই প্যারাডাইম হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কিছু মৌলিক বিশ্বাস, তত্ত্ব, পদ্ধতি আর অলিখিত নিয়মের সমষ্টি। একটি প্যারাডাইম যখন প্রতিষ্ঠিত থাকে, তখন বিজ্ঞানীরা সেই কাঠামোর ভেতরে ছোট ছোট সমস্যা সমাধান করেন, যাকে কুন বলেছেন ‘সাধারণ বিজ্ঞান’ (Normal Science)। কিন্তু একসময় এমন কিছু অসঙ্গতি বা অ্যানোমালি (Anomaly) সামনে আসে, যা প্রচলিত প্যারাডাইম দিয়ে আর ব্যাখ্যা করা যায় না। তখন একটি সংকট (Crisis) তৈরি হয় এবং বৈপ্লবিক উপায়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্যারাডাইম পুরনোটিকে হটিয়ে তার জায়গা দখল করে। যেমন, টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের মডেল (প্যারাডাইম) থেকে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেলে (নতুন প্যারাডাইম) উত্তরণ, অথবা নিউটনের চিরায়ত পদার্থবিদ্যা থেকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদে উত্তরণ। কুন দেখালেন, বিজ্ঞান শুধু বিশুদ্ধ যুক্তির খেলা নয়, এর মধ্যে সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক উপাদানও গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। বিজ্ঞানের সত্যও চূড়ান্ত নয়, তা সময়ের প্যারাডাইমের ওপর নির্ভরশীল। এই ধারণা দৃষ্টবাদের সরলরৈখিক প্রগতির ধারণাকে ভেঙে দেয়।

৪. যাচাই নয়, ভুল প্রমাণের চেষ্টা: কার্ল পপারের দর্শন: ভিয়েনা চক্রের সমসাময়িক আরেকজন প্রভাবশালী দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) দৃষ্টবাদের যাচাইকরণ নীতির বিরুদ্ধে এক নতুন ধারণা নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞানের কাজ কোনো তত্ত্বকে যাচাই বা প্রমাণ (Verification) করা নয়, বরং একটি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণের জন্য কঠোরভাবে চেষ্টা করা (Falsification)। একটি তত্ত্ব ততক্ষণই বৈজ্ঞানিক বলে গণ্য হবে, যতক্ষণ তাকে ভুল প্রমাণ করার একটি নীতিগত সুযোগ থাকবে। যেমন, “পৃথিবীর সকল রাজহাঁস সাদা”—এই তত্ত্বটি আপনি লক্ষ লক্ষ সাদা রাজহাঁস দেখেও চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ, হতেই পারে পৃথিবীর কোনো এক অজানা কোণে একটি কালো রাজহাঁস লুকিয়ে আছে। কিন্তু একটি মাত্র কালো রাজহাঁস খুঁজে পেলেই তত্ত্বটি সঙ্গে সঙ্গে ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়। পপারের মতে, যে তত্ত্বকে ভুল প্রমাণের কোনো উপায়ই নেই (যেমন: “ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে” বা “ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্স”), তা অবৈজ্ঞানিক (Popper, 1959)। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বৈজ্ঞানিক কারণ এটি এমন কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যা ভুল প্রমাণিত হতে পারত (কিন্তু হয়নি)। অন্যদিকে, মনোবিশ্লেষণ বা জ্যোতিষশাস্ত্র যেকোনো ঘটনাকেই নিজেদের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে, তাই এগুলো অবৈজ্ঞানিক।

৫. ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ও স্থিতাবস্থার দর্শন: জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল (Frankfurt School)-এর সমালোচনামূলক তাত্ত্বিকরা (Critical Theorists) যেমন ম্যাক্স হোর্খাইমার, থিওডোর অ্যাডোর্নো এবং ইয়ুর্গেন হাবেরমাস—দৃষ্টবাদের একটি গভীর রাজনৈতিক সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, দৃষ্টবাদ কোনো নিরীহ বা নিরপেক্ষ দর্শন নয়। এটি আসলে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো এবং সামাজিক স্থিতাবস্থাকে (Status Quo) টিকিয়ে রাখার একটি সূক্ষ্ম হাতিয়ার। কারণ, দৃষ্টবাদ শুধু ‘যা আছে’ (What is) তার ওপর মনোযোগ দেয় এবং সেটিকে বস্তুনিষ্ঠ সত্য বলে প্রচার করে। এটি কখনোই ‘যা হওয়া উচিত’ (What ought to be) বা কীভাবে সমাজকে আরও ন্যায়সঙ্গত ও মুক্ত করা যায়, সেই প্রশ্ন তোলে না। যা কিছু পরিমাপযোগ্য নয়—যেমন স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা—সেগুলোকে এটি জ্ঞানের জগৎ থেকে বের করে দেয়। হাবেরমাস যুক্তি দেখান যে, জ্ঞানের পেছনে মানুষের তিন ধরনের স্বার্থ কাজ করে: প্রযুক্তিগত স্বার্থ (Technical Interest), যা পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় (দৃষ্টবাদ এরই ফসল); ব্যবহারিক স্বার্থ (Practical Interest), যা মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে চায় (যেমন ভার্সতেহেন); এবং মুক্তির স্বার্থ (Emancipatory Interest), যা মানুষকে শোষণ ও দমন থেকে মুক্ত করতে চায়। দৃষ্টবাদ কেবল প্রথম স্বার্থটিকেই বৈধতা দেয় এবং বাকিগুলোকে অস্বীকার করে। ফলে, এটি মানুষকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে সমাজকে দেখতে বাধা দেয় এবং বিদ্যমান শোষণ ও বৈষম্যকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে উৎসাহিত করে।

এই সব সমালোচনার ঝড়ে দৃষ্টবাদের দুর্গ ভেঙে পড়ে। এর পর থেকে দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানে যে নতুন চিন্তার জন্ম হয়, তাকে সামগ্রিকভাবে দৃষ্টবাদ-উত্তর তত্ত্ব বা উত্তর-দৃষ্টবাদ (Post-positivism) বলা হয়। পোস্ট-পজিটিভিস্টরা বিজ্ঞানের গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু তাঁরা দেখিয়েছেন যে, জ্ঞান কখনোই সম্পূর্ণ নিশ্চিত, চূড়ান্ত বা মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ (Value-free) হতে পারে না। জ্ঞান সবসময়ই আংশিক, সম্ভাবনাময় এবং গবেষকের নিজস্ব অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত।

উত্তর-দৃষ্টবাদ: যখন বিজ্ঞানীরাও মানলেন, ‘আমরা সবজান্তা নই’

ভাবুন তো, একদল আত্মবিশ্বাসী নাবিক ঘোষণা করল, তাদের কাছে এমন এক নিখুঁত মানচিত্র আর কম্পাস আছে যা দিয়ে তারা পৃথিবীর যেকোনো অজানা দ্বীপ খুঁজে বের করতে পারবে। কোনো ভুল হওয়ার সুযোগই নেই। এই আত্মবিশ্বাসী নাবিকদের দলটাই হলো দৃষ্টবাদ (Positivism)। তারা বিশ্বাস করত, বিজ্ঞানের পদ্ধতি হলো সেই নিখুঁত কম্পাস, যা দিয়ে জগতের সব রহস্য ভেদ করে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছানো সম্ভব। 

কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল, তাদের কম্পাস মাঝে মাঝে ভুল দিক দেখাচ্ছে, মানচিত্রে কিছু গড়বড় আছে, আর সমুদ্রের আবহাওয়াও সবসময় নিয়ম মেনে চলছে না। কিছু কিছু দ্বীপ কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন এক নতুন প্রজন্মের নাবিকেরা এল। তারা পুরনো নাবিকদের একেবারে বাতিল করে দিল না। তারা বলল, “মানচিত্র আর কম্পাস খুবই দরকারি জিনিস, কিন্তু এগুলো নিখুঁত নয়। আমাদের বুঝতে হবে, এগুলোরও সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে, আরও বিনয়ী হতে হবে এবং মেনে নিতে হবে যে, আমরা হয়তো দ্বীপটার একটা কাছাকাছি ধারণা পাব, কিন্তু তার পুরোটা কখনোই একবারে দেখতে পাব না।”

এই নতুন, বিনয়ী এবং আত্ম-সমালোচক নাবিকদের দলটাই হলো উত্তর-দৃষ্টবাদ (Post-Positivism)

‘পোস্ট’ (Post) শব্দটার মানে এখানে ‘বিরোধী’ নয়, এর মানে হলো ‘পরে’ বা ‘ঊর্ধ্বে’। উত্তর-দৃষ্টবাদীরা বিজ্ঞানকে ছুঁড়ে ফেলে দেননি। বরং, তাঁরা দৃষ্টবাদের কঠোর এবং অতি-সরলীকৃত ধারণাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিজ্ঞানকে একটি আরও বাস্তবসম্মত ও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছেন। দৃষ্টবাদের দুর্গ যখন কার্ল পপার, টমাস কুন এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের মতো চিন্তাবিদদের সমালোচনার ঝড়ে কেঁপে উঠেছিল, সেই ভাঙা দুর্গের ইট-পাথর দিয়েই উত্তর-দৃষ্টবাদ তার নতুন ইমারত গড়ে তোলে।

বাস্তবতা আছে, কিন্তু আমাদের চশমায় সামান্য রঙ লেগে আছে (বাস্তবতার নতুন ধারণা)

দৃষ্টবাদের মূল কথা ছিল, জগৎ আমাদের বাইরে একটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা (Objective Reality) হিসেবে বিদ্যমান এবং আমরা বিশুদ্ধ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেই বাস্তবতা সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করতে পারি।

উত্তর-দৃষ্টবাদীরা এই কথার প্রথম অংশের সাথে একমত। তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে, আমাদের মন বা চেতনার বাইরে একটি বাস্তব জগতের অস্তিত্ব আছে। এই বিশ্বাসকে বলা হয় বাস্তববাদ (Realism)। কিন্তু তাঁরা দ্বিতীয় অংশের সাথে তীব্রভাবে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, আমরা কখনোই সেই বাস্তব জগৎকে সরাসরি বা পুরোপুরি জানতে পারি না। আমাদের জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া কখনোই সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ বা নিরপেক্ষ (Neutral) হতে পারে না।

কেন পারে না? কারণ আমরা, অর্থাৎ জ্ঞান অন্বেষণকারী গবেষকরা, রোবট নই। আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা এবং একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। এই সবকিছু একটা অদৃশ্য রঙিন চশমার মতো কাজ করে, যা দিয়ে আমরা জগৎকে দেখি। আমাদের তত্ত্ব, আমাদের অনুমান, এমনকি আমরা কী প্রশ্ন করব—এই সবকিছুই আমাদের এই চশমার রঙ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই, বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা থাকলেও, আমাদের পক্ষে তাকে সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠভাবে জানা অসম্ভব। এই অবস্থানকে বলা হয় সমালোচনামূলক বাস্তববাদ (Critical Realism) (Bhaskar, 1975/2008)।

উত্তর-দৃষ্টবাদীরা বলেন, আমাদের লক্ষ্য চূড়ান্ত সত্য আবিষ্কার করা নয়, বরং সেই সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি একটি ধারণা তৈরি করা। আমাদের জ্ঞান সবসময়ই আংশিক, সাময়িক এবং সংশোধনযোগ্য।

‘ভুল প্রমাণ’-ই বিজ্ঞানের আসল শক্তি (পপারের উত্তরাধিকার)

দৃষ্টবাদীরা মনে করতেন, বিজ্ঞানের কাজ হলো তত্ত্বকে প্রমাণ (Verification) করা। যত বেশি প্রমাণ পাওয়া যাবে, একটি তত্ত্ব তত বেশি সত্য বলে গণ্য হবে।

দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) এই ধারণাকে উল্টে দেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞানের আসল শক্তি প্রমাণ করায় নয়, বরং ভুল প্রমাণের চেষ্টায় (Falsification) নিহিত। একটি তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক হতে হলে তাকে অবশ্যই এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে তাকে ভুল প্রমাণের একটি সুযোগ থাকে। যে তত্ত্বকে কোনোভাবেই ভুল প্রমাণ করা যায় না, তা অবৈজ্ঞানিক।

উত্তর-দৃষ্টবাদীরা পপারের এই ধারণাকে লুফে নেন। তাঁদের মতে, বিজ্ঞানীরা কোনো তত্ত্বকে চিরকালের জন্য ‘সত্য’ বলে প্রমাণ করেন না। তাঁরা কেবল একটি তত্ত্বকে বারবার কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। যে তত্ত্বটি এখন পর্যন্ত সকল ভুল প্রমাণের চেষ্টাকে সফলভাবে মোকাবেলা করে টিকে আছে, আমরা সেটুকুকে সাময়িকভাবে ‘সত্য’ বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে ধরে নিই। কিন্তু আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকি যে, ভবিষ্যতে নতুন কোনো প্রমাণ বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই তত্ত্বটিও ভুল প্রমাণিত হতে পারে (Popper, 1959/2002)। এই ধারণাটি বিজ্ঞানের জগতে এক ধরনের বিনয় নিয়ে আসে এবং একে অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে।

তত্ত্ব ছাড়া পর্যবেক্ষণ অন্ধ (জ্ঞানের নতুন বোঝাপড়া)

দৃষ্টবাদীদের একটি সরল বিশ্বাস ছিল যে, আমরা প্রথমে বিশুদ্ধ তথ্য (Data) বা ঘটনা (Facts) পর্যবেক্ষণ করি এবং তারপর সেই তথ্য থেকে ধীরে ধীরে একটি তত্ত্ব (Theory) গড়ে তুলি।

কিন্তু টমাস কুন (Thomas Kuhn) এবং অন্যান্যরা দেখান যে, পর্যবেক্ষণ কখনোই তত্ত্ব-নিরপেক্ষ (Theory-neutral) হয় না। আমাদের সকল পর্যবেক্ষণই আসলে তত্ত্ব-ভারাক্রান্ত (Theory-laden)। অর্থাৎ, আমরা কী দেখছি বা কোনটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ বলে মনে করছি, তা নির্ভর করে আমাদের পূর্ব-বিদ্যমান জ্ঞান ও তাত্ত্বিক কাঠামোর ওপর।

একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন জ্যোতির্বিদ এবং একজন সাধারণ মানুষ রাতের আকাশে তাকিয়ে কী দেখেন? সাধারণ মানুষ হয়তো কিছু জ্বলজ্বলে বিন্দু দেখেন, কিন্তু জ্যোতির্বিদ দেখেন নক্ষত্র, গ্রহ, নীহারিকা—কারণ তাঁর মস্তিষ্কে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো রয়েছে। একই ঘটনা দেখেও ভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানুষ ভিন্ন উপসংহারে পৌঁছাতে পারে। তাই, উত্তর-দৃষ্টবাদীরা মনে করেন, তথ্য বা ফ্যাক্টস কোনো পবিত্র বা অস্পৃশ্য জিনিস নয়; এগুলোও আমাদের তাত্ত্বিক লেন্সের মাধ্যমে গঠিত হয় (Kuhn, 1962)।

এক মাপের জুতো সবার পায়ে লাগে না (পদ্ধতিগত বহুত্ববাদ)

যেহেতু চূড়ান্ত সত্য পাওয়া সম্ভব নয় এবং আমাদের সকল পর্যবেক্ষণই তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত, তাই উত্তর-দৃষ্টবাদীরা কোনো একটি নির্দিষ্ট গবেষণা পদ্ধতিকে (Research Methodology) একমাত্র সঠিক বলে মনে করেন না। দৃষ্টবাদ মূলত পরিমাণগত গবেষণার (Quantitative Research) ওপর জোর দিয়েছিল—অর্থাৎ, সংখ্যা, পরিসংখ্যান, জরিপ ইত্যাদির মাধ্যমে জ্ঞানার্জন।

কিন্তু উত্তর-দৃষ্টবাদীরা মনে করেন, সামাজিক বাস্তবতার জটিলতা বোঝার জন্য পরিমাণগত পদ্ধতির পাশাপাশি গুণগত গবেষণাও (Qualitative Research) সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের অভিজ্ঞতা, তার দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতির অর্থ—এই বিষয়গুলো সংখ্যা দিয়ে মাপা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সাক্ষাৎকার (Interview), নিবিড় পর্যবেক্ষণ (Participant Observation) বা কেস স্টাডি (Case Study)

উত্তর-দৃষ্টবাদীরা তাই পদ্ধতিগত বহুত্ববাদে (Methodological Pluralism) বিশ্বাসী। তাঁরা প্রায়শই একটি সমস্যাকে বিভিন্ন দিক থেকে বোঝার জন্য একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রায়াঙ্গুলেশন (Triangulation)। অনেকটা যেমন পুলিশ কোনো অপরাধের সত্যতা যাচাই করার জন্য একাধিক সাক্ষীর জবানবন্দি নেয়, তেমনি গবেষকরাও একটি বিষয়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্য নেন (Phillips & Burbules, 2000)।

বিনয়ী সত্যসন্ধানী

তাহলে উত্তর-দৃষ্টবাদ আমাদের কী দিল? এটি আমাদের কাছ থেকে জ্ঞানের অহংকার কেড়ে নিয়ে তার বদলে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা ও বিনয় দিয়েছে। এটি আমাদের শিখিয়েছে যে:

  • বাস্তবতা আছে, কিন্তু আমাদের জ্ঞান সেই বাস্তবতার একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি মাত্র।
  • আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত পক্ষপাতকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাকে স্বীকার করে নিয়ে যথাসম্ভব কমানোর চেষ্টা করা।
  • কোনো জ্ঞানই চূড়ান্ত নয়; সবই সাময়িক এবং ভবিষ্যতের জন্য উন্মুক্ত।
  • সত্যের কাছে পৌঁছানোর কোনো রাজপথ নেই; বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে কেবল তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করা যায়।

উত্তর-দৃষ্টবাদী গবেষক হলেন সেই গোয়েন্দা, যিনি জানেন যে তাঁর ম্যাগনিফাইং গ্লাসে সামান্য আঁচড় আছে, তাঁর নিজের স্মৃতিও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়, এবং তাঁর প্রাথমিক অনুমানগুলোও ভুল হতে পারে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাগুলো জেনেও তিনি হাল ছেড়ে দেন না। বরং, তিনি আরও বেশি সতর্ক, আরও বেশি সমালোচক এবং আরও বেশি অধ্যবসায়ী হয়ে ওঠেন—সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি সংস্করণটি খুঁজে বের করার জন্য। দৃষ্টবাদ যেখানে একটি নিশ্চিত উত্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, উত্তর-দৃষ্টবাদ সেখানে একটি অন্তহীন, বিনয়ী এবং সৎ অনুসন্ধানের আহ্বান জানায়।

চিন্তার উত্তরাধিকার: দৃষ্টবাদের ভূত এবং তার রেখে যাওয়া ছায়া

পুরনো জমিদারবাড়ির কথা ভাবুন। জমিদার নেই, তাঁর দাপটও নেই। বাড়িটা হয়তো ভেঙে পড়ছে, দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, জানালায় মাকড়সার জাল। কিন্তু বাড়ির বাতাসে এখনো কেমন যেন একটা অদৃশ্য উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হয়, পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলা হঠাৎ করে বেজে ওঠে পুরনো ঘড়িটা। জমিদার মরে গেছেন, কিন্তু তাঁর ভূতটা রয়ে গেছে। কিছু কিছু দার্শনিক চিন্তাও ঠিক এই জমিদারবাড়ির ভূতের মতো। তত্ত্ব হিসেবে হয়তো তার কদর কমে গেছে, একাডেমিক আলোচনায় তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার প্রভাব বা ‘ভূত’ আমাদের চিন্তার জগতে, আমাদের সমাজে, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও ঘুরে বেড়ায়। দৃষ্টবাদ (Positivism) হলো দর্শনের সেই রকম এক প্রভাবশালী ভূত। ওগ্যুস্ত কোঁত যে দৃষ্টবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিল তার সময় ও পরিস্থিতির ফসল। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ঢেউ কেবল উনিশ শতকেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা আছড়ে পড়েছে পরবর্তীকালের চিন্তার প্রায় প্রতিটি তীরে। কিছু তাত্ত্বিক সেই ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে নিজেদের তরীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, আবার কেউ কেউ সেই ঢেউয়ের বিরুদ্ধে সাঁতরে নতুন দ্বীপের সন্ধান করেছেন। কিন্তু কেউই সেই ঢেউকে উপেক্ষা করতে পারেননি। চলুন, দৃষ্টবাদের এই দীর্ঘ ছায়া আর তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারের গল্পটা শোনা যাক।

সরাসরি উত্তরাধিকার: যারা দৃষ্টবাদের ঝান্ডা বয়ে নিয়ে গেছেন

দৃষ্টবাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল এটি সমাজকে অধ্যয়ন করার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রস্তাব করেছিল। এই প্রস্তাবটি অনেক চিন্তাবিদকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।

এমিল ডুর্খাইম (Émile Durkheim): সমাজবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক স্থপতি: যদি কোঁতকে সমাজবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক জনক বলা হয়, তবে এমিল ডুর্খাইম হলেন সেই ব্যক্তি যিনি বিষয়টিকে বাস্তবিক অর্থে একটি বিজ্ঞানের মর্যাদা দিয়েছেন। ডুর্খাইম কোঁতের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন, বিশেষ করে সমাজের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নের ধারণাটি তাঁকে আলোড়িত করেছিল।

ডুর্খাইম তাঁর বিখ্যাত বই The Rules of Sociological Method-এ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত ‘সামাজিক ঘটনাকে বস্তুর মতো করে দেখা’ (Treat social facts as things) (Durkheim, 1895/1982)। এর মানে কী? এর মানে হলো, সমাজের যে ঘটনাগুলো—যেমন আইন, প্রথা, ধর্ম, মুদ্রা ব্যবস্থা—এগুলো আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার বাইরে বিদ্যমান এবং আমাদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। এগুলোকে ব্যক্তিগত অনুভূতি বা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝা যাবে না। এদেরকে বস্তুনিষ্ঠভাবে, পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অধ্যয়ন করতে হবে, ঠিক যেমন একজন পদার্থবিজ্ঞানী কোনো বস্তুকে নিয়ে গবেষণা করেন।

তাঁর ক্লাসিক গবেষণা ‘আত্মহত্যা’ (Suicide) এর এক চমৎকার উদাহরণ। আত্মহত্যাকে আমরা সাধারণত একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার বলে মনে করি। কিন্তু ডুর্খাইম বিভিন্ন দেশের আত্মহত্যার হারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, এটি আসলে একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি প্রমাণ করলেন, সামাজিক সংহতির (Social Integration) মাত্রা আত্মহত্যার হারকে প্রভাবিত করে। যে সমাজে সংহতি খুব বেশি (যেমন আদিম সমাজে) বা খুব কম (যেমন আধুনিক শিল্প সমাজে), সেখানে আত্মহত্যার হার বেশি। এটি ছিল সামাজিক গবেষণায় দৃষ্টবাদী পদ্ধতির এক যুগান্তকারী প্রয়োগ, যা দেখিয়েছিল যে মানব আচরণকেও প্রাকৃতিক ঘটনার মতো নিয়মের অধীনে আনা সম্ভব (Durkheim, 1897/1951)।

জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill): যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন: ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলও কোঁতের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যদিও তিনি কোঁতের ‘মানবতার ধর্মে’র মতো বিষয়গুলোর তীব্র সমালোচক ছিলেন, কিন্তু সমাজের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নের ধারণাকে তিনি সমর্থন করেন। তাঁর বিখ্যাত বই A System of Logic-এ তিনি আরোহী যুক্তির (Inductive Logic) বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন, যা সামাজিক বিজ্ঞানে কারণ অনুসন্ধানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে (Mill, 1843/1882)। মিল বিশ্বাস করতেন, মানব আচরণ যদিও জটিল, তবু তা প্রাকৃতিক ঘটনার মতোই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। সেই নিয়মগুলো আবিষ্কার করতে পারলে একটি উন্নততর সমাজ গড়া সম্ভব।

প্রতিক্রিয়ার জন্ম: যারা দৃষ্টবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন

মজার ব্যাপার হলো, একটি তত্ত্বের প্রভাব কেবল তার অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় একটি তত্ত্ব এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়েই নতুন এবং শক্তিশালী চিন্তার জন্ম হয়। দৃষ্টবাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছিল। এর যান্ত্রিক ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই জন্ম নিয়েছিল সমাজ ও মানুষকে বোঝার কিছু নতুন দিগন্ত।

ম্যাক্স ভেবার (Max Weber): অর্থের সন্ধানে: জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার ছিলেন ডুর্খাইমের সমসাময়িক, কিন্তু তাঁর চিন্তার পথ ছিল অনেকটাই ভিন্ন। ভেবার দৃষ্টবাদের এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন যে, মানুষকে জড়বস্তুর মতো করে বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করলেই তার সবটা বোঝা যায়। তিনি বললেন, মানুষ অর্থসন্ধানী প্রাণী। তার প্রতিটি কাজের পেছনে একটি আত্মগত অর্থ (Subjective Meaning) লুকিয়ে থাকে। 

ভেবারের মতে, সামাজিক বিজ্ঞানীর কাজ শুধু ঘটনার বর্ণনা দেওয়া নয়, সেই ঘটনার পেছনের অর্থটাকেও বোঝা। এই পদ্ধতিকে তিনি বলেছেন ‘ভার্সতেহেন’ (Verstehen), যার জার্মান অর্থ হলো ‘সহানুভূতিশীল বোঝা’ (Empathetic Understanding) (Weber, 1922/1978)। যেমন, একজন ব্যক্তি কুড়াল দিয়ে কাঠ কাটছে। দৃষ্টবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ। কিন্তু ভেবার বলবেন, আমাদের জানতে হবে সে কেন কাঠ কাটছে? সে কি নিজের বাড়ির জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করছে? সে কি একজন কাঠুরে হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে? নাকি সে রাগের বশে কাঠ কাটছে? এই ‘কেন’ বা অর্থের উত্তর না জানলে তার আচরণকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। এভাবেই ভেবার দৃষ্টবাদের বস্তুনিষ্ঠতার বিপরীতে ব্যাখ্যামূলক সমাজবিজ্ঞানের (Interpretive Sociology) ভিত্তি স্থাপন করেন।

ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল (The Frankfurt School): দৃষ্টবাদ как একটি মতাদর্শ: জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সমালোচনামূলক তাত্ত্বিকরা (Critical Theorists) যেমন ম্যাক্স হোর্খাইমার (Max Horkheimer) এবং থিওডোর অ্যাডোর্নো (Theodor Adorno) দৃষ্টবাদের একটি গভীর রাজনৈতিক সমালোচনা হাজির করেন। তাঁদের মতে, দৃষ্টবাদ কোনো নিরীহ বা নিরপেক্ষ (Value-free) দর্শন নয়। এটি আসলে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো এবং পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার একটি সূক্ষ্ম হাতিয়ার।

তাঁরা যুক্তি দেখান, দৃষ্টবাদ কেবল ‘যা আছে’ (what is) তার ওপর মনোযোগ দেয় এবং তাকেই একমাত্র বাস্তবতা বলে ধরে নেয়। এটি কখনোই ‘যা হওয়া উচিত’ (what ought to be) বা কীভাবে সমাজকে আরও ন্যায়সঙ্গত ও শোষণমুক্ত করা যায়, সেই প্রশ্ন তোলে না। যা কিছু পরিমাপযোগ্য নয়—যেমন স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা—সেগুলোকে এটি জ্ঞানের জগৎ থেকে বের করে দেয়। তাঁরা এই ধরনের যুক্তিকে ‘যান্ত্রিক যুক্তি’ (Instrumental Reason) বলে অভিহিত করেন, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো প্রকৃতি ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা ও ব্যবহারের বস্তুতে পরিণত করা (Horkheimer & Adorno, 1944/2002)। এই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেখায় যে, জ্ঞান কখনোই ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

দৃষ্টবাদের প্রেতাত্মা: আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক, নাকি জাদুঘরের কাঁচের ঘরে?

তাহলে এত দীর্ঘ আলোচনা আর সমালোচনার পর দৃষ্টবাদের কী অবশিষ্ট রইল? কোঁতের সেই আদি দৃষ্টবাদ বা ভিয়েনা চক্রের সেই কঠোর যৌক্তিক দৃষ্টবাদকে আজ আর কোনো দার্শনিক বা সমাজবিজ্ঞানী হুবহু মেনে চলেন না। দর্শন বা সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় এটি এখন একটি ঐতিহাসিক মতবাদ হিসেবেই বেশি পরিচিত, যাকে পাশ কাটিয়ে আধুনিক তত্ত্ব বোঝা সম্ভব নয়।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, দর্শন হিসেবে মৃত্যু হলেও দৃষ্টবাদ একটি ‘মনোভাব’, একটি ‘পদ্ধতি’ বা একটি ‘প্রেতাত্মা’ হিসেবে আমাদের আধুনিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। এর প্রভাব এতটাই গভীর যে আমরা অনেক সময় তা টেরও পাই না।

আপনি যখন কোনো নতুন মোবাইল ফোন কেনার আগে ইন্টারনেটে দশটা ওয়েবসাইটের রিভিউ পড়েন, বিভিন্ন ব্যবহারকারীর রেটিং (ডেটা) তুলনা করেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন, আপনি আসলে একটি দৃষ্টবাদী কাজ করছেন। আপনি অন্যের অভিজ্ঞতার (পর্যবেক্ষণযোগ্য ডেটা) ওপর ভিত্তি করে একটি বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।

সরকার যখন কোনো বড় প্রকল্প (যেমন: একটি নতুন সেতু) নেওয়ার আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই (Feasibility Study) করে, জনগণের ওপর তার প্রভাব নিয়ে জরিপ (Survey) চালায় বা অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির পরিসংখ্যান দেখে, সেটাও দৃষ্টবাদী পদ্ধতিরই সরাসরি প্রয়োগ।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘প্রমাণ-ভিত্তিক ঔষধ’ (Evidence-based Medicine)-এর ধারণাটি দৃষ্টবাদেরই আধুনিক রূপ। এখানে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা অনুমানের চেয়ে বড় বড় ক্লিনিকাল ট্রায়াল থেকে পাওয়া বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।

আজকের ‘বিগ ডেটা’ (Big Data) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) যুগ তো আক্ষরিক অর্থেই দৃষ্টবাদের চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণা করছে। গুগল, ফেসবুক বা অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলো কোটি কোটি মানুষের অনলাইন আচরণ (ক্লিক, লাইক, সার্চ) বিশ্লেষণ করে তাদের পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ভবিষ্যৎ আচরণ সম্পর্কে যে নিখুঁত পূর্বাভাস দিচ্ছে, তার পেছনেও রয়েছে সেই একই মৌলিক বিশ্বাস—পর্যবেক্ষণযোগ্য ডেটাই হলো জ্ঞানের মূল উৎস এবং এর মাধ্যমে মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি এই নতুন বিশ্বাসকে ‘ডেটাইজম’ (Dataism) বলে অভিহিত করেছেন, যা মানব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির চেয়ে ডেটা ফ্লো এবং অ্যালগরিদমের ওপর বেশি আস্থা রাখে। ক্রেডিট স্কোরিং, বীমা প্রিমিয়াম নির্ধারণ বা চাকরির জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের মতো ক্ষেত্রে অ্যালগরিদমের ব্যবহার দৃষ্টবাদী চিন্তারই চরম প্রয়োগ।

তবে আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক এবং জ্ঞানী। আমরা এখন জানি যে, শুধু সংখ্যা আর ডেটা দিয়ে মানুষকে বা সমাজকে পুরোপুরি বোঝা যায় না। পরিমাণগত গবেষণার (Quantitative Research) পাশাপাশি গুণগত গবেষণারও (Qualitative Research) প্রয়োজন আছে। মানুষের গল্প শোনা, তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া, তার সংস্কৃতি ও অনুভূতির জগৎকে বোঝা—এগুলোও জ্ঞানের সমান গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শ্রেষ্ঠ গবেষণা হলো তা-ই, যা এই দুটি পদ্ধতির মেলবন্ধন ঘটাতে পারে। দৃষ্টবাদের ভূত হয়তো আমাদের কাঁধের ওপর বসে ফিসফিস করে বলে, “প্রমাণ কই?” আর তার সমালোচকরা মনে করিয়ে দেয়, “ভেতরের গল্পটা কী?” এই দুই প্রশ্নের টানাপোড়েনেই হয়তো আধুনিক জ্ঞানের পথচলা।

উপসংহার: যেখানে বিজ্ঞান আর কবিতা হাত ধরে

আমাদের এই দীর্ঘ সফরের শেষে চলুন, আবার সেই বর্ষার দুপুরের বারান্দায় ফিরে যাই। আপনার ছোট্ট শিশুটির সেই সরল কিন্তু গভীর প্রশ্ন—”আকাশটা নীল কেন?”

বৈজ্ঞানিক উত্তরটি (আলোর বিচ্ছুরণ) আমাদের জানায় জগৎটা ‘কীভাবে’ কাজ করে। এটা আমাদের জ্ঞান বাড়ায়, আমাদের কৌতূহল মেটায় এবং এই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেয়। এটা দৃষ্টবাদী জ্ঞানের এক চমৎকার উদাহরণ। এটি প্রয়োজনীয়, শক্তিশালী এবং কার্যকর।

কিন্তু এই নিঁখুত, বস্তুনিষ্ঠ উত্তরের পরেও কি মনের মধ্যে একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায় না? আকাশের ওই অসীম নীলিমা, মেঘের ভেসে যাওয়া, বৃষ্টির গন্ধ—এগুলো কি আমাদের মনে কোনো কবিতা জাগায় না? কোনো গান বা কোনো গভীরতর দার্শনিক প্রশ্ন তৈরি করে না? “জীবন কী?”, “আমি কে?”, “এই সৌন্দর্যের অর্থ কী?”—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তো বিজ্ঞানের কাছে নেই। তার জন্য আমাদের যেতে হয় শিল্প, সাহিত্য, দর্শন বা এমনকি নিজের গভীরতম অনুভূতির কাছে।

দৃষ্টবাদ আমাদের শিখিয়েছে, বাস্তবতার শক্ত মাটিতে পা রেখে কীভাবে চলতে হয়। আর এর সমালোচকরা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, মানুষ শুধু মাটির জীব নয়, তার মন প্রায়ই দূর আকাশের তারার দিকে উঁকি মারে। হয়তো চূড়ান্ত সত্য এই দুইয়ের মাঝখানে কোথাও একটা লুকিয়ে আছে। যা দেখা যায়, যা প্রমাণ করা যায়, তা অবশ্যই সত্যের একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যা দেখা যায় না, যা অনুভব করতে হয়, যার অর্থ খুঁজে নিতে হয়, তার আবেদনও হয়তো পুরোপুরি অর্থহীন নয়। এই বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা আর মানবিক অনিশ্চয়তার টানাপোড়েন নিয়েই হয়তো আমাদের পথচলা। আর এই পথচলাই সম্ভবত জীবন। দৃষ্টবাদ জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়তো এটাই যে, মানব জীবনের কিছু কিছু ‘অশুদ্ধি’ বা ‘অর্থহীনতা’ই তাকে এত সুন্দর ও রহস্যময় করে তোলে।

তথ্যসূত্র

  • Ayer, A. J. (1936). Language, truth, and logic. Victor Gollancz Ltd.
  • Bacon, F. (2000). The new organon (L. Jardine & M. Silverthorne, Eds. & Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1620).
  • Bhaskar, R. (2008). A realist theory of science. Routledge. (Original work published 1975).
  • Comte, A. (1853). The positive philosophy of Auguste Comte (Vols. 1-2, Trans. H. Martineau). J. Chapman.
  • Durkheim, É. (1982). The rules of sociological method (W. D. Halls, Trans.). The Free Press. (Original work published 1895).
  • Durkheim, É. (1951). Suicide: A study in sociology (J. A. Spaulding & G. Simpson, Trans.). The Free Press. (Original work published 1897).
  • Horkheimer, M., & Adorno, T. W. (2002). Dialectic of enlightenment: Philosophical fragments (E. Jephcott, Trans.). Stanford University Press. (Original work published 1944).
  • Hume, D. (1748). An enquiry concerning human understanding. A. Millar.
  • Kuhn, T. S. (1962). The structure of scientific revolutions. University of Chicago Press.
  • Locke, J. (1997). An essay concerning human understanding (R. Woolhouse, Ed.). Penguin Classics. (Original work published 1689).
  • Manuel, F. E. (1962). The new world of Henri Saint-Simon. Harvard University Press.
  • Mill, J. S. (1882). A system of logic, ratiocinative and inductive: Being a connected view of the principles of evidence and the methods of scientific investigation. Harper & Brothers. (Original work published 1843).
  • Popper, K. R. (2002). The logic of scientific discovery. Routledge. (Original work published 1934).
  • Phillips, D. C., & Burbules, N. C. (2000). Postpositivism and educational research. Rowman & Littlefield Publishers.
  • Pickering, M. (1993). Auguste Comte: An intellectual biography (Vol. 1). Cambridge University Press.
  • Weber, M. (1978). Economy and society: An outline of interpretive sociology (G. Roth & C. Wittich, Eds. & Trans.). University of California Press. (Original work published 1922).

One thought on “দৃষ্টবাদ (Positivism): যা দেখা যায়, কেবল তা-ই কি সত্য? নাকি আমাদের চোখের দেখাও এক ধরনের ধোঁকা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *