প্রসঙ্গঃ নবীগিরি কি এবং কিভাবে

Print Friendly, PDF & Email

আমার মনে হয় নবী শব্দটার অর্থ এবং তাৎপর্য বর্তমানকালে যা বোঝায় অতীতকালে সেটা তেমন ছিল না, তা ছিল ভিন্ন রকম।

অজানাকে জানার মাধ্যম হিসেবে বর্তমান কালে সর্বসম্মতভাবে আমরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করি, কিন্তু বিজ্ঞান এসেছে মাত্র কিছু শতাব্দি হল, মানুষ আগে জানতো না কোনটাকে বিশুদ্ধ জ্ঞান বলা যেতে পারে কিংবা জ্ঞানের সংজ্ঞা কি । বিশেষায়িত জ্ঞান বা বিজ্ঞান চর্চার প্রক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে যদিও চালু ছিল সর্বসম্মতিক্রমে সবার মধ্যে তার প্রতি এতটা আস্থা ছিল না। সেই সাথে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীত-সন্ত্রস্ত জনগণের ছিল অজানাকে জানার তীব্র আগ্রহ । সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কে জানবার কৌতুহল।

যদিও বললে হাস্যকর শোনাবে বর্তমান কালে গবেষণাগারে সাদা পোশাকধারী বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে আমরা যেভাবে অজানাকে জানতে চেষ্টা করছি আদিমকালে কুসঙস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এরা হয়তো গুহার মধ্যে ধ্যান কারী ব্যক্তির ধ্যান বলে অজানাকে জানার প্রক্রিয়ার প্রতি তেমনি ভাবে আস্থা করেছে। কারন এর চেয়ে ভাল কোন বিকল্প তাদের জানা ছিল না। বর্তমানকালে বিজ্ঞানীরা যেমন intellectual হিসেবে বিবেচিত হয় তৎকালীন সময়ে নবী-রাসূল ও intellectual হিসেবে বিবেচিত হতো ।

বর্তমানকালে একটি শিশুকে দেখে আপনি হয়তো তাকে উৎসাহ দিয়ে বলবেন তুমি বড় হয়ে একজন বিজ্ঞানী হবে বলে আমি মনে করি একই রকমভাবে কুসংস্কারের যুগে, আপনি হয়তো একটি শিশুকে দেখে বলতেন “তুমি বড় হয়ে একজন নবী হবে” বা “ঈশ্বরের স্বীকৃতপ্রাপ্ত নেতা হবে” । একজন ছেলেকে যদি আপনি উৎসাহ দিতে থাকেন শৈশব থেকে যে তুমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে সে হয়তো পড়ালেখা করে একসময় বিজ্ঞানী হয়ে যাবে একই রকমভাবে আদিম যুগ গুলিতে যদি কাউকে শৈশবে বলা হয় যে তুমি বড় হয়ে নবী (“intellectual” কিংবা তৎকালীন সময়ের শব্দ অনুযায়ী ‘নবী”) হবে হয়তো সেও অনুপ্রাণিত হবে ভবিষ্যতে নবী হবার জন্য সে হয়তো একসময় ঘুহার মধ্যে ধ্যানচর্চা শুরু করবে নিজের অজান্তে অবচেতন মনে নিজের মানসিক রোগ এবং বিভ্রম গুলোকে ব্যবহার করবে যাকে কাল্পনিক ঈশ্বর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। আমি জানিনা এটাকে multiple personality disorder বলা যায় কিনা আমি একজন মনোবিজ্ঞানী নই তবে আমি যথেষ্ট প্রমাণ জানি যে একজন মানুষ নিজের ভিতর অন্য একটি সত্তা কল্পনা করে ফেলতে পারে। নিজের মাথার ভেতরে অন্যের কাল্পনিক কণ্ঠস্বর শুনতে পারে। এখনকার যুগে জ্বীনে ধরার মতো করে তখনকার সময় হয়ত সিদ্ধান্তে আসতো যে সে নবী হয়ে গিয়েছে।

এর পেছনে অন্য একটা অবচেতন উদ্দেশ্য পরিষ্কার যে এর মাধ্যমে সে সমগ্র এলাকার নেতৃত্ব দাবি করতে পারবে ক্ষমতাবান হতে পারবে কিংবা এর পেছনে মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে যেমন সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করতে পারা, সমাজে থেকে কিছু অন্যায় দূর করতে পারা । নেতা বা রাজা হবার অন্য দুইটা প্রক্রিয়া হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক যার তখনো সর্বসম্মত স্বীকৃতি ছিল না দ্বিতীয় টা হচ্ছিল পৈত্রিক সূত্রে রাজার পুত্র রাজা হওয়ার তরিকা। তবে যে কোন প্রক্রিয়ায় প্রতিস্ঠিত রাজার সাথে টেক্কা দেবার জন্য নিজেকে নবী দাবি করা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদিম সমাজে নির্ভরযগ্য পন্থা। কারণ বর্তমান শাসকের অন্যায়ের কার্যকরী প্রতিবাদ করার জন্য এমন একজন নেতা দরকার লাগে যে কিনা সবার আস্থা অর্জন করতে পারে এই বলে যে তার পেছনে ঈশ্বরের স্পেশাল সাপোর্ট আছে।

আমার আলোচনার এই পর্যায়ে আমি আপনাদের একজন বিশেষজ্ঞের সাথে “পুনরায় পরিচয়” করিয়ে দিতে চাচ্ছি। দার্শনিক নোম চমস্কি আমাদের অনেকের মধ্যে পরিচিত । আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ তাকে একজন ইজরাইলি এবং আমেরিকান পলিসির কট্টর সমালোচক হিসেবে জানেন । অনেকেই হয়তো জানেন না বা ভুলে যান যে সে একজন জন্মসূত্রে ইহুদি (অর্থাৎ আদি একেশ্বরবাদী ধর্মটির বংশে জন্মগ্রহণকারী)। তবে পেশাগত জীবনে তার বড় পরিচয় তিনি একইসাথে একজন ভাষাবিদ (linguist), একজন দার্শনিক (philosopher), একজন কোগ্নিতিভ সাইন্টিস্ট (cognitive scientist) এবং একজন ঐতিহাসিক হিসেবে । তাকে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ঐতিহাসিক যখন তার নিজ জাতিগত হিব্রু ভাষা র আদি শব্দ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেন তা আমাদের আগ্রহ উদ্রেক করার যথেষ্ট কারণ আছে। উনার মতানুসারে “নবী” NAVI শব্দটি ইহুদিদের প্রাচীন হিব্রু ভাষায় কিভাবে দেখা হইত তা সম্পর্কে একটু ধারনা নিতে পারি। তার একটা ইন্টারভিউর কিছু অংশ আমি original ইংরেজিতে কপি পেস্ট করলাম যাতে বিষয়টা সুস্পষ্ট হয় । “ ইংরেজি prophet শব্দটি অস্পষ্ট হিব্রু শব্দ নাভি (NAVI) শব্দটির খুবই দুর্বল একটি অনুবাদ (bad translation)। কেউই জানেনা আসলে শব্দটার অর্থ কি । বর্তমানকালে এই শব্দের অর্থ “ভিন্ন মতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী” dissident intellectuals বলা যেতে পারে । তারা জিও পলিটিকাল analysis করত এই অর্থে যে তারা বলত বর্তমান শাসকের কার্যাবলী কেন সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তারা অসাধু রাজার কার্যাবলীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। এবং তারা এতিম এবং বিধবাদের জন্য দয়া এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করতো। “
“The word “prophet” is a very bad translation of an obscure Hebrew word, navi. Nobody knows what it means. But today they’d be called dissident intellectuals. They were giving geopolitical analysis, arguing that the acts of the rulers were going to destroy society. And they condemned the acts of evil kings. They called for justice and mercy to orphans and widows and so on.”
(Noam Chomsky interviewed by David Samuels )

যারা বিজ্ঞান বোঝেন বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে তারা ইতিমধ্যে আমার প্রতি রাগান্বিত হয়ে গিয়েছেন এই কারণে যে আমি বিজ্ঞানীদের সাথে নবীদের তুলনা করছি। আর তাই এই দুইটি পেশার মধ্যে একটু পার্থক্য বলে রাখা দরকার । বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞানী যখন অনেক গবেষণার পর কোনো কিছু আবিষ্কার করেন তা তিনি বিজ্ঞানের জার্নালে প্রকাশ করবেন, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তা ভুল প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ পাবে এবং সঠিক বা বা সত্য কি তা সবাই সামগ্রিকভাবে একত্রে উপলব্ধ করবে – এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে যাবে। কোন একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে যা সত্য তা যাচাই-বাছাই না করে অন্যরা মেনে নেবে না। একজন নবী যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হন বা ঐশ্বরিক বাণী প্রাপ্ত হন উনি তখন তার নিকটস্থ অন্য একজন নবী দাবীকারী ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে তার হাতে পাওয়া ঐশ্বরিক বানীর সাথে অন্যের ঐশ্বরিক বাণীর তুলনা করে, ভেরিফাই করতে যাবেন না।

উদাহরণ স্বরূপ নবী মুহাম্মদের সময় আরবদের মধ্যে আরো বেশ কিছু একেশ্বরবাদী নবী ছিল, তবে তারা এসে মহানবীর সাথে বসে তাদের পাওয়া ঈশ্বরের বানীর পর্যালোচনা করার জন্য একসাথে মিটিংএ বসেন নি। বরং নিজ নিজ এলাকায় একা একা ধর্ম প্রচারের অধিকার দাবি করেছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত মুসাইলামা। ইবনে ইসহাক সহ অনেক ঐতিহাসিকদের মতে যিনি কিনা নবী মুহাম্মদ এর কিছু সময় আগে নবী গিরি শুরু করেছিলেন। যদিও নবী মুহাম্মদ তার নিজের মক্কা নগরীতে নবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি মুসাইলামা তাকে তার নিজের শহরে ঠিকই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে সাজ্জাহ নামে একজন নারীও নবীত্ব দাবি করেছিলেন এবং তার অঞ্চলে সে বেশ পরিমাণ অনুসারী সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই দুই জন নবী নবী মুহাম্মদ এর মতই একেশ্বরবাদী শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। দশম হিজরীতে নিজেদের ক্ষমতা ভাগাভাগি করার আশায় নবী মুসাইলামা থেকে নবী মোহাম্মদকে পাঠানো একটা চিঠির ভাষা দেখলে বোঝা যায় দুইজনের চিন্তা-ভাবনার ধরন। (আমার অনুবাদের দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে উইকিপিডিয়াতে পাওয়া মূল ইংরেজি টি কপি পেস্ট করে রেখেছি।)

“আল্লার নবী মুসাইলামা থেকে আল্লাহর নবী মোহাম্মদের প্রতি সালাম। আমাকে নবুওত বিষয়ে আপনার সাথে অংশ শেয়ার করতে দেয়া হয়েছে। অর্ধেক পৃথিবী আমাদের জন্য আর অর্ধেক পৃথিবী কোরায়েশদের। কুরাইশরা ই আক্রমনকারী।”
“From Musaylimah, Messenger of God, to Muhammad, Messenger of God. Salutations to you. I have been given a share with you in this matter. Half the earth belongs to us and half to the Quraish. But the Quraish are people who transgress.””

নবী মুহাম্মদ এর জবাব ছিল অনেকটা এরকম “আল্লার নবী মোহাম্মদ থেকে ডাহা মিথ্যুক মুসাইলামা প্রতি। আল্লাহর নির্দেশনার অনুসারীদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। পৃথিবীটা হচ্ছে আল্লাহর এবং এবং আল্লাহ তাকে তার দাসদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছেন। চূড়ান্ত ফায়সালা যারা আল্লাহকে ভয় পায় তাদের উপর।”
Muhammad, however, replied back: “”From Muhammad, the Messenger of God, to Musaylimah, the arch-liar. Peace be upon him who follows (God’s) guidance. Now then, surely the earth belongs to God, who bequeaths it to whom He will amongst his servants. The ultimate issue is to the God-fearing.”

নবী মুহাম্মদ বরাবরের মতোই অত্যন্ত বিনয়ের ভাষার মধ্য দিয়ে তার উদ্ধত প্রকাশ এবং হুমকি প্রদান করেছেন। যাতে উনি একাই নবিগিরি চালায়া যেতে পারেন। অবশেষে নবীজির শিখিয়ে যাওয়া তরবারি দিয়ে টেক্কা দেবার (কোপাকুপি) নীতির বলে মুসলমানরা খলিফা আবুবকরের সময় অন্যসব নবী দাবিকারী দের দমন করেছেন । অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে এই সব নবীদের কেউই সহিংসতার আশ্রয় নেননি বরং তারা একে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে কাজ করতে চেয়েছে। বাস্তবে বলতে গেলে আরবদের মধ্যে যুদ্ধবাজ নবী হিসেবে একমাত্র মুহাম্মদ কে ই পাওয়া যায়। মানসিক প্রক্রিয়া জনিত কারনে এবং তৎকালীন মানব সভ্যতার প্রেক্ষাপটে নিজের ভেতরে ঐশ্বরিক বাণী আবিষ্কারের বিষয়টা হয়তো অস্বাভাবিক নয় কিন্তু ভয়ানক বর্বরতা এবং যুদ্ধবাজ মূলক কার্যাবলীর মাধ্যমে নিজের অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টা অস্বাভাবিক এবং এই এবং অস্বাভাবিক কাজটাই আমাদের নবী মোহাম্মদ করে গেছেন।

নরমপন্থী

আমি মূলত একজন নরমপন্থী নাস্তিক। http://facebook.com/noromponthir

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *