বাল্মীকির রাম, ফিরে দেখা
রাম উপাখ্যানে কতগুলো প্রশ্ন জাগে । প্রথমত, বালী বধ বিষয়ে । স্পষ্টতই ক্ষত্রিয় বীরের পক্ষে কাজটা গর্হিত, এক বানররাজাকে আড়ালে লুকিয়ে থেকে হত্যা করা, এটা কোনো নীতিতেই সমর্থন করা যায় না । উত্তরে যদি বলি, সীতাকে খুঁজে পাবার জন্যে সুগ্রীবের সাহায্য অত্যাবশ্যক ছিল, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে যে এতে রামের বীরত্ব সম্বন্ধে জাগে । সম্মুখ-সমরে তাহলে বালীকে হারাবার শক্তি বা সে শক্তি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস রামের ছিল না । এটা এক যশস্বী ক্ষত্রিয়বীরের পক্ষে গ্লানিকর । কাজটা কাপুরুষোচিত, সম্পূর্ণ স্বার্থ প্রনেদিত । এবং আরও কলঙ্ককর হলো, বালীকে নিজের প্রজা বলে শাসন করেছেন বলা, বানর মাংস অভক্ষ্য তবুও বালী হত্যাকে মৃগয়া বলা এবং আনুষঙ্গিক বিস্তর কুযুক্তির অবতারণা করা ।
গুহকের আতিথ্য গ্রহণ না করার মধ্যেও বর্ণ-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে । ফলাহারী ঋষিরাও অন্যের দেওয়া ফল খেতে পারেন, বনবাসকালে রাম কয়েকবার মুনিঋষির আতিথ্য নিয়েওছেন । গুহক চন্ডাল, তাই তার কাছে শুধু পশুর খাদ্যই গ্রহণ করলেন ।
অন্ধমুনি বৈশ্য, তাঁর স্ত্রী শূদ্রা (২/৫৭/৬৩) । তিনি নিজেকে ‘বানপ্রস্থী’ বলছেন কী করে ? তাহলে ‘শম্বুকের সাধনাও তো অশাস্ত্রীয় হয় না ? এই শম্বুককে রাম বধ করেছেন এবং ব্রাহ্মণের অকাল মৃত পুত্রকে বাঁচাতে । তাহলে প্রাণের মূল্য রাম রাজত্বে বর্ণগতভাবে আপেক্ষিক, ব্রাহ্মণ-পুত্রের প্রাণ শূদ্রের প্রাণের চেয়ে দামি ? এটা মেনে নেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রক্ষিপ্ত অংশে । রামরাজ্যে চন্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু কথায় ?যে ফল জল ব্রাহ্মণদের কাছে নেওয়া যায় তা চন্ডাল বন্ধুর কাছে নেওয়া যায় না ? শূদ্র শম্বুক তপস্বী, কৃচ্ছসাধনে রত কিন্তু সাধারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের তুলনায় তার প্রাণের মূল্য কিছু নেই ।
বালীকে বধ করা, শম্বুককে হত্যা করা ছাড়াও যেটি আমাদের বেশি ভাবায় তা হলো সীতা প্রত্যাখ্যান । সুন্দরকান্ডে সীতাহরণের পরে রামের যে বিলাপ তার ভাব সম্পূর্ণতই বিরহার্ত প্রেমিকের, কিন্তু সে কি শুধু অলঙ্কারিক বিরহ ? শুধু সীতাসম্ভোগ-বঞ্চিতের বিলাপ ? নতুবা দীর্ঘ অদর্শনের পরে রামের ‘হৃদয়ান্তর্গতভাব’ এমন হলো কেন যে সীতাকে দেখা মাত্রই তাঁর দুই চক্ষু পীড়িত বোধ করল এবং রাজনন্দিনী রাজকুলবধু সীতাকে শিবিকা থেকে নেমে হেঁটে আসবার হুকুম দিলেন, সীতা আসামাত্রই বললেন, ‘গচ্ছ বৈদেহি’ তোমার জন্য যুদ্ধ করিনি, করেছি ইক্ষবাকু বংশের গৌরব রক্ষার জন্য ? কোথায় ছিল সে ইক্ষবাকু কুলের গর্ব যখন লঙ্কায় প্রকাশ্য সভায় অপ্রমাণিত, অসত্য আশংকায় রাজকুলবধূকে কটু কথা বলেছিলেন ? কোথায় ছিল সে কুলগর্ব যখন দেবতাদের সাক্ষ্য, ঋষি বাল্মীকির শপথ সব অগ্রাহ্য করে পুত্রদের, প্রজাদের, অতিথিদের সামনে ইক্ষবাকু কুলবধূ সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন ? কোথায় রইল সে গর্ব যখন দেবী বসুমতী বারংবার সন্দেহে পীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত কন্যাকে কোলে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন ? কে অপরাধী প্রমাণিত হলো ? অকারণ সন্দেহ এবং তার বশে দণ্ডদানের অপরাধে কলঙ্কিত হলেন না, ইক্ষবাকু-কুলতিলক রামচন্দ্র ? সীতা লক্ষ্মণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন। ‘রামকে বোলো, আমাকে চিরদিনই সম্পূর্ণ নির্দোষ জেনে, রামের হিতব্রতিনী জেনে, শুধু লোকাপবাদের আতঙ্কে ভয় পেয়ে ত্যাগ করলেন তিনি ।’ এতে কি ইক্ষবাকু কুলের গৌরব বাড়ল ? গৌরব বাড়ল অন্যায় দণ্ডদাতা রাজার ? এ-ই রাম রাজ্যের নমুনা ?
========================================================================
কলিতে শূদ্র দ্বিজাতির প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে একথা রামায়ণ মহাভারত উভয় মহাকাব্যের ভার্গব প্রক্ষেপে অত্যন্ত স্পষ্ট । কাজেই এমন আদর্শ রাজার আকল্প নির্মান করতে হবে যিনি কঠোর হাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্রকে দমন করেন, বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায় । সেই আদর্শ রাজা রামচন্দ্র, যিনি শম্বুককে হত্যা করলেও দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন – তুমি দেবতাদের কাজ করেছ । বর্ণগুলোর ক্রম যাতে নষ্ট না হয় সেটা দেখা রাজার কর্তব্য । রাম সেই আদর্শ রাজা, যাঁর এক খড়গাঘাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্র মরল এবং বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রও বাঁচল । কলির আসন্ন সংক্রমণ থেকে যিনি প্রজাকুলকে বাঁচালেন, সমাজকে আশ্বস্ত এবং সুস্থির করলেন ।
পিতৃভক্ত, বন্ধু-বৎসল, প্রজাহিতৈষী, ভ্রাতৃ-বৎসল দেবদ্বিজে ভক্তিমান, সুবিচারক, যজ্ঞকারী – অতএব আদর্শ যুগোচিত নায়ক । শূদ্র যদি ত্রিবর্ণের সেবা ছাড়া অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে তবে বর্ণ-ধর্মরক্ষাকারী রাজা তো তাকে মেরে ফেলবেনই । স্ত্রী যদি অনিচ্ছাতেও পর-পুরুষের দ্বারা স্পৃষ্ট বা অপহৃত হয় – তবে যতই সচ্চরিত্রা হোন না তিনি, অগ্নিপরীক্ষা, নির্বাসন, পুনর্বার পরীক্ষা এইসব অবমাননা তাঁকে নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতেই হবে । সমাজ কখনোই নারীকে ব্যক্তি বল স্বীকার করেনি, ভোগ্যবস্তু পণ্যদ্রব্য এইসব আখ্যা দিয়েছে । …. সীতার সচ্চরিত্রা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হবার পরও তাঁর গর্ভজাত সন্তানদের ইক্ষবাকু কুলের রাজসিংহাসনে অধিকার দেওয়া গেল না । প্রজারা নিশ্চয়ই পুলকিত হলো, আদর্শ রাজা রাজকুল-মর্যাদায় এতটুকু কলুষের বা তার সন্দেহেরও স্পর্শ লাগতে দিলেন না ।
এই যে নতুন আদর্শের প্রজাপালক রাজার নির্মাণ হলো, ইনি কিন্তু মহাকাব্যের নায়ক নন । সে নায়ক ক্ষত্রিয় যোদ্ধা বীর, আদর্শ রাজা হওয়া তাঁর কাছে প্রতীক্ষিত ছিল না । ক্ষত্রিয় নায়কের অঙ্গীকার ও কর্তব্য শেষ হয়েছে যুদ্ধ-জয়ে রাবণ-বধে । তারপর শুরু হলো মহাকাব্যটি ঢেলে সাজানো, আদিকান্ডে প্রথমার্ধে ও উত্তরাকান্ডে এঁর নবকলেবর রূপায়ণ ঘটল । এখন ইনি বর্ণধর্মের পরিপালক রাজা । শূদ্র ও নারীর কোনোরকম স্বাধীনতা, স্পর্ধা বা অধিকার স্বীকার করলে পাছে কলির স্পর্শদোষ ঘটে রাজ্যে, তাই ইনি সমাজের স্থিতবস্থা রক্ষা করেছেন অতন্দ্রভাবে । এর কিছু মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে, এক-পত্নীক রাজা সীতাকে হারালেন । সমাজে নারীর সতীত্ব শুচিতা নিয়ে যে নতুন নিরিখ তৈরি হয়েছে তার কাছে বলি দিতে হলো আপন দাম্পত্য-সুখ । কিন্তু এর মূল্য দিতে তাঁর বিশেষ বাজেনি, কারণ সীতাকে যখন তিনি প্রথম কঠিন কথাগুলো বলেন লঙ্কায়, তখন তা তাঁর হৃদয়ান্তর্গত ভাব । অর্থাৎ, সমাজের নির্মম নির্দেশ তিনি নিজ অন্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই পারলেন ওই কথাগুলি বলতে । এইখানে মহাকাব্যের পরাজয় ঘটল শাস্ত্রকারদের কাছে ।
আজ যখন ‘রামরাজ্য’ সম্বন্ধে একটা স্বপ্নকে পুনর্বার কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করার একটা উগ্র চেষ্টা হচ্ছে এ দেশের লোকমানসে, তখন যেন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি : নারী শূদ্রের ওপর অত্যাচার যে তন্ত্রে অপরিহার্যভাবে গৃহীত, যেখানে ধর্মাকাঙ্ক্ষী শূদ্র ব্রাহ্মণ-পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে বাধ্য হয়, নিষ্পাপ অন্তঃসত্ত্বা নারী অকারণে যেতে বাধ্য হয় নির্বাসনে, দেওরালা-আড়ওয়ালের পরও আমরা কি সেই রাজতন্ত্রই চাই ? এরই নায়ক কি ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ ? অর্থাৎ পুরুষের সর্বোত্তম আদর্শ অসহায়কে বিপন্নকে ও নারীকে রক্ষা করাই তো এতদিন আদর্শ পুরুষদের অবশ্য করণীয় ছিল, তাকে বর্জন করে যে রাজতন্ত্র, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অভিশাপ হয়ে উঠবে না ? তাকে ঠেকানোই কি আজ আমাদের প্রধান কর্তব্য নয় ?
লেখিকাঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য
সুকুমারী ভট্টাচার্য ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য-ইতিহাস-সংস্কৃতির বিদগ্ধ গবেষক ও প্রখ্যাত অধ্যাপক। সারা জীবনে বাংলা ও ইংরাজী ভাষায় সমান দক্ষতায় তিরিশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই সুযোগ্য উত্তরসূরী অধ্যাপনার ক্ষেত্রেও প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন।
মহর্ষি বাল্মিকী রামের চরিত্রটিকে অহেতুক গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করেননি। তাই তার চরিত্রের পক্ষে অবমাননাকর ঘটনাগুলোও বিনা দ্বিধায় তুলে ধরেছেন।
*’সিজারের স্ত্রীকে শুধুমাত্র নিরপরাধ নয় সন্দেহের অতীত হতে হবে।’
এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
*শম্বুক হত্যা রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ।
*বালিকে সামনে হতে বধ করা অসম্ভব। কারন তার বর ছিল যে সামনাসামনি যে তার সঙ্গে লড়াই করবে তার বল বালির দেহে বিলীন হয়ে যাবে।
তবে এধরনের হত্যা যুদ্ধনীতিসম্মত হলেও ধর্মবিরুদ্ধ।
বালির সাথে যে লড়াই করবে তার বল বালির দেহে বিলীন হয়ে যাবে, এই কথার তথ্যসূত্র দিন। আপনি যেহেতু জানেন শম্বুক হত্যা প্রক্ষীপ্ত, মানে বাল্মীকি রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত, তাহলে নিশ্চয় আপনি বালির বল বিলীন হওয়ার ঘটনাটিও বাল্মীকি রায়ামণ থেকেই দেখাবেন!
আশা করছি, আপনি কেবল টিভি সিরিয়াল দেখে মন্তব্য করেন না!
“কারন তার বর ছিল যে সামনাসামনি যে তার সঙ্গে লড়াই করবে তার বল বালির দেহে বিলীন হয়ে যাবে।” How it is even possible. You are trying to establish a superstitious belief “বর “.