দর্শনবাংলায় ধর্মের ইতিহাস

বিবর্তনবাদের বিভিন্ন দর্শন, একই পাল্লায় বার্গসোঁ ও রবীন্দ্রনাথ

এই লেখাটা লিখেছিলাম মূলত রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্যবাদী চিন্তাধারার একটা দিককে তুলে ধরবার জন্য, কিন্তু এখানে বিবর্তন বা এখন যা কিছু দেখছি তার সব কিছুর ক্রমবিকাশ নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা সম্পর্কেও লেখা হয়েছে। বিবর্তনবাদের এই দর্শনগুলোর মধ্যে একমাত্র যান্ত্রিক বিবর্তনই বস্তুবাদী, কেবল একেই বিজ্ঞান গ্রহণ করেছে, এবং কেবল এটাই সত্য। অন্যগুলো ভাববাদী বা আস্তিক্যবাদী। এইসব ভাববাদী ও আস্তিক্যবাদী বিবর্তন সম্পর্কে দর্শনে আগ্রহীদের, বিশেষ করে নাস্তিকদের জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। তাহলে আস্তিকগণ ও ভাববাদীগণ কিভাবে সব কিছুর ক্রমবিকাশ নিয়ে চিন্তা করে তার ধারণা পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এখানে বাঙ্গালী ভাববাদী দার্শনিক অরবিন্দ ঘোষের বিবর্তনচিন্তা সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি অনলাইনে এক আলোচিত কবির কিছু কথার প্রেক্ষিতে একজনকে লিখতে দেখেছিলাম, কবিদের পক্ষে দর্শন চর্চা কঠিন কাজ। এখানে আলোচিত সেই কবি সম্পর্কে কিছু বলছি না, কিন্তু কবিদের দর্শন চর্চার ব্যাপারটা আমাকে একটু ভাবালো। কবিদের পক্ষে দর্শন চর্চা করা কঠিন কিনা জানিনা, তবে অনেক কবি দর্শন চর্চা করেন। এদের অনেকের দর্শনজ্ঞান সীমিত থাকলেও তাদের লেখায় দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ের ছাপ পড়তে পারে। আর তিনি যদি কোন বড় মাপের কবি হন তাহলে অনেকে তাকে দার্শনিক হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন। অনেকে বলেন, একজন বড়মাপের কবি অবশ্যই একজন দার্শনিক। এই কথাটা কবি কোলরিজও বলে গেছেন, “No man was ever yet a great poet, without being at the same time a profound philosopher”।

তো কবির দার্শনিক হবার ব্যাপারটা যখন আসলই, তখন এক বিখ্যাত কবির কবিতার সাথে সমসাময়িক এক বিখ্যাত দার্শনিকের চিন্তাধারার মিল সম্পর্কে বলতে ইচ্ছা করছে। যে কবির কথা বলছি তিনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর যে দার্শনিকের কথা বলছি তিনি হচ্ছেন হেনরী বার্গসোঁ। আইডিয়ায় মিল ছাড়াও এদের দুজনের মধ্যে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মিল আছে। সেটা হল হেনরী বার্গসোঁও নোবেল পুরস্কার জেতেন, তাও আবার সাহিত্যেই, ১৯২৭ সালে।

যাই হোক, এই দুইজনের আইডিয়ার মিলের কথা বলার শুরুতে বার্গসোঁর দর্শন সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নেই। বার্গসোঁ একজন বিবর্তনবাদী ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন। বিবর্তনবাদী হয়েও ভাববাদী, এই কথাটা শুনে অবাক হতে পারেন। ডারউইন ও স্পেনসার যে বিবর্তনবাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন তা ভাববাদী ছিল না, সম্পূর্ণ বস্তুবাদী ছিল। কিন্তু বিবর্তনবাদের ধারণা কেবল এই ডারউইন আর স্পেনসারের মতাদর্শতেই থেমেছিল না, আরও বিভিন্ন দার্শনিক বিবর্তনবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের মত দিতে থাকেন।

দর্শনে সৃজনবাদের বিপরীতে আসে বিবর্তনবাদের ধারণাটি, যেখানে বর্তমান সব কিছু হঠাৎ করে একজন সৃষ্টি করে দেয় নি, বরং ধীরে ধীরে সরল থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের এই জটিল অবস্থাটির সৃষ্টি হয়েছে। বিবর্তনবাদের ধারণাটি মূলত এরকমই। কিন্তু কিভাবে এই বিবর্তন সংঘটিত হল সে বিষয়ে সব দার্শনিক একমত হন নি, কেউ কেউ স্পেন্সার-ডারউইনের মত সম্পূর্ণ বস্তুবাদীভাবে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করল, কেউ কেউ ভিন্ন আঙ্গিকে একে দেখল, ব্যাখ্যা করার জন্য ভাববাদকে সামনে আনল, অনেকে আবার ধর্মের সাথে এর সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করল। আর এসবের জন্যই বিবর্তনবাদ মূলত চারটি শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যায়। এগুলোকে এভাবে বলা যায়:

১। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ: চার্লস ডারউইনের ডারউইনিজম, হার্বার্ট স্পেনসারের স্পেনসারিয়ানিজম, সোশ্যাল ডারউইনিজম এই ধরণের বিবর্তনের মধ্যে পড়ে। এটি বস্তুবাদী বিবর্তনবাদ, যেখানে এই বিবর্তনের পেছনে ঐশ্বরিক হাত নেই, আর চেতনা জড় থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ডারউইন এই বিবর্তনবাদ দিয়ে জীবজগৎ এবং স্পেনসার এই বিবর্তনবাদের সাহায্যে জড় জগৎ ও সমাজের বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেন। সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যতমদের উদবর্তন এর মাধ্যমে স্পেনসার ও ডারউইন এই বিবর্তনবাদকে ব্যাখ্যা করেন। এই মতবাদ অনুসারে আকষ্মিকভাবেই নতুন বিভিন্ন বৈষিষ্ট্য ও বিষয়ের উদ্ভব হয়, এবং এদের মধ্যে যেগুলো যোগ্যতম সেগুলোই টিকে থাকে, অন্যগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর এভাবেই জীব ও জড় জগতে সরল থেকে জটিলতার উদ্ভব।

২। উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ: এই ধরণের বিবর্তন একটা ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য অনুযায়ী সামনে এগোয়। এটি গোল-ডিরেক্টেড ইভোল্যুশন, অর্থোজেনেসিস, প্রোগ্রেশনিজম ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই বিবর্তনবাদ সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে আছে নৌয়ি এর টেলেফাইনালিজম, সিনোর টেলিজম মতবাদ ইত্যাদি। তারা খ্রিষ্টধর্মের সাথে বিবর্তনবাদী ধারণার ঐক্যসাধন করতে চেয়েছিলেন।

৩। সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ: এই বিবর্তনবাদ ফরাসী দার্শনিক হেনরী বার্গসোঁ এর দেয়া। এই বিবর্তনবাদ অনুসারেই তিনি তার “ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন” বইতে জীবজগৎ, জড়জগৎ উভয়েরই বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেন। (রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সাথে মিলের কারণে তার দর্শন নিয়ে আলাদাভাবে আজকে আলোচনা করা হবে)।

৪। উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ: এটি ইমারজেন্টিজম বা ইমারজেন্ট ইভোল্যুশন নামে পরিচিত। এই ধরণের বিবর্তন সম্পর্কে মতবাদ দেন লয়েড মর্গান তার ইমারজেন্ট ইভোল্যুশন গ্রন্থে, আর স্যামুয়েল আলেকজান্ডার তার স্পেস, টাইম এন্ড ডেইটি গ্রন্থে। এই মতবাদ অনুসারে, পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে নতুন অবস্থার রূপান্তর ঘটে, আর যে নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে সম্পূর্ণ নতুন গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়। এই প্রক্রিয়ার সর্বনিম্নস্তরে থাকে “দেহজ পরমাণু” (physical events on swarm of atoms), যাকে স্থান-কাল বা স্পেসটাইম হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়। এখানে সর্বোচ্চ স্তরে জীব দেহ বা জীবন থেকে মন বা চেতনার উন্মেষ লাভ করে। মর্গান এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুমান করেন, আর অন্যদিকে স্যামুয়েল আলেকজান্ডারের চিন্তাটা আরেকটু ইন্টারেস্টিং ও অভিনব ছিল। আলেকজান্ডারের মতে এই দেশকাল বা স্পেসটাইমই বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি, আর বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে ঈশ্বরের উন্মেষ ঘটে। অর্থাৎ, ঈশ্বরও এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফসল। এখানে উল্লেখ্য যে স্যামুয়েল আলেকজান্ডার তার স্পেস, টাইম এন্ড ডেইটি গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ১৯২০ সালে, আর তিনি আইনস্টাইন দ্বারা প্রভাবিত হন নি। লয়েডের মতে বিবর্তনের ধারা হচ্ছে, দেহজ পরমাণু, দেশ-কাল থেকে সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে জড়, সেখান থেকে জীবদেহ বা জীবন, আর সেখান থেকে মন। অন্যদিকে আলেকজান্ডারের বিবর্তনের ধারা হচ্ছে দেশ-কাল থেকে সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে জড়, সেখান থেকে জীবদেহ বা জীবন, সেখান থেকে মন, আর সেখান থেকে সব শেষে ঈশ্বর।

এই চারটি বিবর্তন প্রক্রিয়া ছাড়াও ইতিহাসে আরও একধরণের বিবর্তনবাদ খুঁজে পাওয়া যায় আরেক দার্শনিকের চিন্তায়। সেটাকেও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তন বলা যায়, কারণ সেটাও টেলিওলজিকাল, কিন্তু পার্থক্যটা হচ্ছে এই দার্শনিকের বিবর্তনের টেলেওলজিটা অন্যান্য উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের মত মেকানিস্টিক বা ডিটারমিনিস্টিক না (অনন্ত কুমার গিরির মতে এই টেলিওলজি বরং অন্তর্নিহিত সমস্ত সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ)। এই দার্শনিক হচ্ছেন, বাঙ্গালি ভাববাদী দার্শনিক অরবিন্দ ঘোষ (Sri Aurobindo)। তিনি ভারতীয় আস্তিক ধারার দর্শন অদ্বৈত বেদান্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার মতে সত্তার তিনটি নীতি- অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দ। তার মতে, পরমসত্তার এই আনন্দের মধ্যেই বিবর্তনের উৎস্য নিহিত, দ্য লাইফ ডিজাইন গ্রন্থে তিনি লেখেন, এই জগতের অস্তিত্ব যেন শিবের (ঈশ্বরের) তন্ময়তাপূর্ণ নৃত্যু, যার ফলে ঈশ্বরের দেহ অগুণতিভাবে বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধি কিভাবে কোথায় হয় তা বলা যায় না, কিন্তু নৃত্যের আনন্দই এখানে মূল। কাজেই অরবিন্দের দর্শনে, বিশ্বজগৎ হচ্ছে পরমসত্তার আনন্দের অভিব্যক্তি যেখানে এই পরমসত্তা স্বেচ্ছায় জগতে পরিণতি লাভ করে। অদ্বৈতবাদী দর্শনের মত এখানে ঈশ্বর নিজেই জগতে পরিণত হয়।

এখানে বার্গসোঁ এর সাথে অরবিন্দের দর্শনে একটা মিল আছে। বার্গসোঁর দর্শনে মাঝে মাঝে বিবর্তন নিম্নমুখী হয়, যার ফলে উচ্চস্তরের প্রাণ থেকে আবার নিম্নস্তরের জরের উৎপত্তি ঘটে (এই বিষয়ে পরে আলোচনা করছি)। এরকম চিন্তা অরবিন্দের দর্শনেও দেখা যায়, যেখানে বিবর্তনের সমুন্নতি পর্যায়ে পরমসত্তার চেতনা থেকে জড়ের উৎপত্তি ঘটে, এরপর সেখান থেকে মানসিক পরিবর্তন (mental change), আর অধিমানস পরিবর্তন (super mental change) ঘটে সত্তা অধিমানস (supermind) পর্যায়ে গিয়ে বিবর্তনের সর্বোচ্চ স্তর প্রাপ্ত হয়। আর এখানে প্রাণ জড়ের স্তরে নেমে না আসলে (সাহায্য না করলে বলা যায়), জড় সম্পূর্ণভাবে প্রাণের স্তরে উন্নীত হতে পারে না, আবার মন প্রাণের স্তরে নেমে আসলে প্রাণ মনে উন্নীত হয়, আর এভাবে মনও অধিমানসে উন্নীত হয়। আলেকজান্ডারের উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদের সাথে অরবিন্দের বিবর্তনবাদের মধ্যে মিলটা হল, সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে আলেকজান্ডার যেমন মন থেকে ঈশ্বরের বিবর্তনের কথা বলেছেন, তেমনি অরবিন্দও মন থেকে একটা উচ্চতর সত্তায় বিবর্তনের কথা বলেছেন যাকে তিনি নাম দেন অধিমানস বা সুপারমাইন্ড। তবে এই সুপারমাইন্ড ঈশ্বর বা পরমসত্তা নয়, বরং পরমসত্তা ও জগতের (বস্তু, মন ও জীবন) মধ্যকার একটি অন্তর্বর্তী অবস্থা।

এই বিভিন্ন রকমের বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনা নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হল, যাতে বিভিন্ন ধরণের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হয়, আর এদের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। এখানে উল্লিখিত বিভিন্ন ধরণের বিবর্তনবাদের মধ্যে কেবল স্পেনসার আর ডারউইনের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদই বস্তুবাদী, আর বাদবাকি সবই ভাববাদী বিবর্তনবাদ। এখানে কেবল ডারউইনের যান্ত্রিক বিবর্তনবাদী আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক সমাদৃত হয়, আর সেই সাথে এই পরবর্তীতে আরও বিভিন্ন পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর উন্নয়ন ঘটে, যেকারণে আজ ডারউইন আশ্রিত বিবর্তনগত জীববিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা, এবং একটি বিজ্ঞান স্বীকৃত ফ্যাক্ট। এদিকে ভাববাদী বিবর্তনবাদী ধারণাগুলো বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ও ভাববাদের তার নিজের জায়গা ছেড়ে দেবার সাথে সাথে আজ অনেকটাই বিস্মৃত। তবে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে বা এর ইতিহাস জানার জন্যই হোক, সমাজের বিভিন্ন চিন্তাধারা, মতের ও বিশ্বাসের মানুষের চিন্তাধারা বোঝার জন্যই হোক, সমাজ ও মানুষের চিন্তাধারার বিবর্তনের ইতিহাস জানার জন্যই হোক আর বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের লেখার বিশ্লেষণ করার জন্যই হোক, ভাববাদী বিবর্তনবাদগুলো সম্পর্কে জানবার একটা গুরুত্ব থাকেই। ধরুন, আজকের লেখাটাও এরকম কোন উদ্দেশ্যেই।

তো যেটা বলছিলাম, এই হেনরি বার্গসোঁ এককালে ডারউইন আর স্পেনসারের দর্শন পড়ে ধর্ম-বিদ্বেষী ও জড়বাদী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে তিনিই আবার তাদের সমালোচক হয়ে যান। বার্গসোঁর বিবর্তনবাদী ধারণাটাকে তার বস্তুবাদী ধারণার খণ্ডনপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নিয়ে আসছি। বার্গসোঁ তার ম্যাটার এন্ড মেমরি গ্রন্থে দেখাতে চেষ্টা করেন, জড়, প্রাণ ও মন এক জিনিস নয়, আর মন ও মস্তিষ্ক ভিন্ন জিনিস। ভিন্ন জিনিস বলতে, মন, চেতনা এগুলোকে কেবল মস্তিষ্কের মত জড় পদার্থের কার্যকলাপ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তার মতে, সচেতনতা বা চেতনা আমাদের মস্তিষ্কের কোন যান্ত্রিক কার্য নয়, বরং বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত একটি গুণ, আর এই সচেতনতা মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হলেও, মস্তিষ্কই যে এর একমাত্র কারণ তা ব্যাখ্যা করা যায় না।

এপ্রসঙ্গে তিনি একটি তুলনা নিয়ে আসেন। খাদ্য হজম করার জন্য আমাদের পেট রয়েছে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে পেট ছাড়া খাদ্য হজম করা সম্ভব নয়। আমরা যদি সরল এককোষী জীব এমিবার দিকে তাকাই তবে দেখা যায় এরা তাদের একটি কোষ দিয়ে খাদ্য পরিপাকের কাজগুলো করছে। এখানে এমিবার দেহের জৈবিক কোষের ভর থেকে তার হজমের কাজটিকে আর পার্থক্য করা যায় না, একটা কোষেই সব কিছু হচ্ছে। কিন্তু জীবদেহে জটিলতা যত বৃদ্ধি পায়, তত বেশি শ্রমবিভাজন দেখা যায়, আর হজমের কাজটিও এর ফলে শরীরের মধ্যকারই কোন বিশেষ কোষ, বা বিশেষ কলা বা বিশেষ তন্ত্রের কাজ হয়ে যায়, যার কারণে আমারা মানুষের বেলায় হজমের কাজটি কেন্দ্রিভূত হয়েছে উদরে বা পেটে, আর আমাদের পাকস্থলি, অন্ত্রকে এই একটি মাত্র কাজ করতে হয় বলে এই কাজটিও ভাল হয়। একইভাবে বার্গসোঁ চেতনা সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত টানেন। এভাবেই বর্তমানে মানুষের চেতনা নিঃসন্দেহেই মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও সেটাই যে চেতনার জন্য সব কিছু, তা বলা যায় না। এখন আমাদের চেতনা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে কেন্দ্রিভূত হলেও, মানুষ থেকে, ইতর প্রাণী হয়ে যত নিম্নস্তরে যাওয়া যায়, চেতনার বিষয়টি তত সরলীকৃত হতে হতে একটা সময়ে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছয় যেখানে একটি জৈবিক কোষীয় ভরের মধ্যে চেতনার আলাদা অস্তিত্বকে আর সনাক্তই করা যায় না, এর পার্থক্যও করা যায় না।

এভাবেই বার্গসোঁ সিদ্ধান্তে আসেন যে, সব রকমের স্নায়ু উপাদান যখন একাত্ম ছিল, যখন পৃথকীকরণ অসম্ভব ছিল, তখনও সেখানেই সচেতনতার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তখন তা ছিল বিশৃঙ্খল, কিন্তু তার যে কোন অস্তিত্ব ছিল না একথা বলা যায় না। আর তাই ধরে নেয়া যায় যে প্রত্যেক জীবন্ত বস্তুই সচেতন, আর সচেতনতা জীবনের সাথে অনিবার্য সম্পর্কে সম্পর্কিত। তার মতে, তাই জড় দ্বারা সচেতনতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, জগতের সবকিছুর মূলে জড় নয়, বরং এক প্রাণপ্রবাহ, বার্গসোঁ যার নাম দেন এলোঁ ভিতাল (élan vital)। বার্গসোঁ এর মতে এই প্রাণপ্রবাহই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন সৃষ্টি সাধন করে চলেছে। এই বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ঊর্ধ্বমুখী, যেখানে সরল থেকে জটিল জীবের সৃষ্টি হয়। এই ঊর্ধ্বমুখী প্রক্রিয়ায় জড়ের কোন ভূমিকা নেই, আর জড়ের উদ্ভবও হয় না। তবে তার মতে, বিবর্তন মাঝেমধ্যে নিম্নমুখীও হয়ে থাকে যার ফলে সর্বনিম্নস্তরের জড়েরও সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই বার্গসোঁ মনে করেন, প্রাণপ্রবাহের এক ব্যতিক্রম ধারায় জড়ের উদ্ভব হয়।

বার্গসোঁ উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তন আর যান্ত্রিক বিবর্তন সম্পর্কে সমালোচনা করে বলেন, উভয় মতবাদই একই দোষে দুষ্ট, আর তা হল এই দুটোই নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী। এখানে যান্ত্রিকতাবাদী মতবাদগুলো যান্ত্রিক কার্যকারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে, আর উদ্দেশ্যবাদ কোন উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেটা একটা উল্টো যান্ত্রিকতাবাদ। যান্ত্রিকতাবাদগুলোতে, যেমন যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে অতীত দ্বারা ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নির্ধারিত হয়, অন্যদিকে উদ্দেশ্যবাদে, যেমন উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদে ভবিষ্যৎ দ্বারা বর্তমান ও অতীত নির্ধারিত হয়। বার্গসোঁর কাছে এই দুই মতবাদই বিকাশ বিবর্জিত মতবাদ, এদিকে বার্গসোঁর মতে বিবর্তন প্রক্রিয়া সবসময় নতুনের জন্ম দেয়, তাই এটা সম্পূর্ণ স্বাধীন, বন্ধনহীন এক অনন্ত গতিময় অবস্থা। বার্গসোঁর মতে এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় পরিচালক শক্তি প্রাণপ্রবাহ, যা কোন জড় নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক শক্তি। এলোঁ ভিতাল ছাড়াও তিনি এই প্রাণপ্রবাহকে কখনও কখনও লাইফ, পিওর ডিউরেশন, ভাইটাল সার্জ, ভাইটাল ইমপেটাস বলেও উল্লেখ করেছেন।

বার্গসোঁর দর্শন নিয়ে আরও অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু আপাতত এই পর্যন্তই থাক। বরং রবীন্দ্রনাথের সাথে বার্গসোঁর চিন্তাভাবনার মিল নিয়েই কিছু বলা যাক এখন। রবীন্দ্রনাথ বার্গসোঁর সমসাময়িক ছিলেন। কবিগুরুর বিভিন্ন কবিতায়, বিশেষ করে তার “বলাকা” কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় বার্গসোঁর চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এই কেউ কেউদের দলের হয়েই আজকে দুজনের চিন্তার এই মিলের ব্যাপারটা টানছি। কেউ যদি বার্গসোঁর দর্শন পড়ে কবিগুরুর বলাকা হাতে নিয়ে বসেন, তাহলে হয়তো তার মনে হবে, বার্গসোঁর প্রাণপ্রবাহের সকল গতি যেন বলাকার ডানায় ভর করে উড়ে এসেছে প্রাচ্যের আকাশে।

বার্গসোঁর ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন বইটি প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সালে, যারপর সুনাম সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর ১৯১৪ সালে তার লেখা গ্রন্থগুলো Index Expurgatorius এ স্থান পায়, আর তিনি ফরাসি একাডেমীর সম্মানিত সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বার্গসোঁ তার প্রাণপ্রবাহ সম্পর্কিত গভীর অনুধ্যান ও ধারণাগুলোকে দক্ষতার সাথে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন বলে ১৯২৭ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পান।

এদিকে বলাকা হচ্ছে ১৯১৬ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গতিচেতনা বিষয়ক কাব্য, যেখানে রবীন্দ্র কবি মানসের বিবর্তন ধারাপথে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রাক-বলাকা কাব্যে কবির অনুভূতি আবেগের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত ছিল, কিন্তু বলাকা কাব্যে সেই অনুভূতির প্রকাশ হয়েছে যেন বোধি ও বুদ্ধি, জ্ঞান ও অনুভবে এবং দ্রুতি ও দীপ্তির মাধ্যমে- বিষয়ের সঙ্গে একাত্মতায় ও নতুন চেতনায়। এটি রচনার পশ্চাতে তিনটি বিষয় কবিগুরুকে অনুপ্রাণিত করেছিল; ক. কবির ইউরোপ ভ্রমণ, খ. কবির নোবেল পুরস্কার লাভ, গ. সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি ও প্রথম মহাযুদ্ধ। ১৯১২ সালে কবিগুরু ইউরোপ যাত্রা করেন। ইংল্যান্ডে চার মাস থেকে গেলেন আমেরিকায়। এরপর নিউইয়র্ক, আর্বানা-শেম্পেন, শিকাগো, বোস্টন, কেমব্রিজ প্রভৃতি স্থানে গিয়ে তিনি সেখানকার মনীষী, সাধারণ মানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদের সংস্পর্শে আসেন। ইউরোপ ও আমেরিকার নবজীবন প্রবাহ, প্রাণশক্তি ও আভ্যন্তরীণ আত্মিক শক্তি এবং আমেরিকাবাসীর বিজ্ঞান-রাষ্ট্র-সমাজচিন্তা তাঁর চিত্ত ও চেতনায় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আর এরই ফলে প্রতিভার সঙ্গে কবি মানসে সঞ্চারিত হয় গভীর এক অনুপ্রেরণার। দ্বিতীয়ত নোবেলপ্রাপ্তীর ফলে প্রাচ্য জীবনচেতনার গুরুত্ব ও গৌরব বিশ্বসভায় ও বিশ্বের মনীষীদের কাছে মূল্যায়ন হয়েছে-এই নব উপলব্ধি কবিকে নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্বোধিত করে। তৃতীয়ত সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি ও প্রথম মহাযুদ্ধ। তাছাড়াও কবি মনে করেন- ‘আমরা মানবের এক বৃহৎ যুগসন্ধিতে এসেছি, এক অতীত রাত্রি অবসান প্রায়। মৃত্যু, দুঃখ ও বেদনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নবযুগের রক্তাভ অরুণোদয় আসন্ন। সেজন্য মনের মধ্যে অকারণ উদ্বেগ ছিল।’

এই বিভিন্ন আঙ্গিকের, বিভিন্ন বিষয়ের অনুপ্রেরণা কবিমনের চিত্ত চেতনায় যে আলোড়ন সৃষ্টি করল তারই প্রকাশ আমরা দেখতে পেলাম তার ১৯১৬ সালে রচিত কাব্য বলাকায়। তিনি পূর্বে বার্গসোঁর রচনা পড়েছিলেন কিনা তা জানা নেই, তবে বার্গসোঁ যেভাবে জগতের গতিময়তাকে এক প্রাণপ্রবাহের প্রভাবে চলা বন্ধনহীন, অন্তহীন সৃজনমূলক বিবর্তনের ফল হিসেবে বিচার করতেন, কবিমনের মানষ্পটেও হয়তো সেরকম ধারনার জন্ম হয়েছিল। হয়তো তখন বার্গসোঁর সম্পর্কে না জানলেও পরে তিনি তার সম্পর্কে জেনেছিলেন, আর নিজের ভাবনার সাথে বার্গসোঁর ভাবনার মিলের কারণে তিনি পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের বিদেশ ভ্রমণের কালে তিনি চিন্তার আদান প্রদান করতে বার্গসোঁর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। ততদিনে বার্গসোঁ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন, পূর্বে যদি রবীন্দ্রনাথ বার্গসোঁ নাও পড়ে থাকেন, বার্গসোঁর নোবেল প্রাপ্তির পর তার চিন্তাধারা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পড়ার কথা। কবিগুরুর লেখায় বার্গসোঁ প্রভাব থাক বা না থাক, কিন্তু বার্গসোঁর দর্শনের যে বিষয়গুলো কবিগুরুর লেখাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে সেসম্পর্কে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি।

আমরা দেখেছি, হেনরী বার্গসোঁ জগতের বিবর্তন প্রক্রিয়াকে অবিরামভাবে গতিশীল বলে চিহ্নিত করেন। এই অবিরাম গতির ধারণা রবীন্দ্রনাথের বলাকাতেও বিধৃত হয়:

“হে বিরাট নদী,
অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল
চলে নিরবধি।
………………..
উন্মত্ত সে-অভিসারে
তব বক্ষোহারে
ঘন ঘন লাগে দোলা—ছড়ায় অমনি
নক্ষত্রের মণি;
………………………..
শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও
উদ্দাম উধাও;
ফিরে নাহি চাও,…”


এলাহাবাদ। ৩ পৌষ ১৩২১, রাত্রি

বার্গসোঁর মতে, বিবর্তনের যে অবিরাম ধারা প্রবাহমান তার কোন নির্দিষ্ট গতিবিধি নেই। এটা সম্পূর্ণ অজানা অভিসারে ধাবমান। রবীন্দ্রনাথও বলাকায় যেন একই রকম অভিমত প্রকাশ করেছেন:

“…মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা,
দেখিতেছি আমি আজি
এই গিরিরাজি,
এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।
……………….
ধ্বনিয়া উঠিছে শুন্য নিখিলের পাখার এ গানে—
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে।”


শ্রীনগর। কার্তিক ১৩২২

“… হে ভৈরবী, ওগো বৈরাগিণী,
চলেছ যে নিরুদ্দেশ সেই চলা তোমার রাগিণী,
শব্দহীন সুর।
অন্তহীন দূর
তোমারে কি নিরন্তর দেয় সাড়া।
সর্বনাশা প্রেমে তার নিত্য তাই তুমি ঘরছাড়া।…”


এলাহাবাদ। ৩ পৌষ ১৩২১, রাত্রি

বার্গসোঁর মতে, বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সর্বদা নতুনের আবির্ভাব হচ্ছে, পুরনো জিনিসগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে, বর্তমানের ধ্বংসস্তূপে আসীন হচ্ছে ভবিষ্যৎ। এদিকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:

“… ওগো নটী, চঞ্চল অপ্সরী,
অলক্ষ্য সুন্দরী
তব নৃত্যমন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি
তুলিতেছে শুচি করি
মৃত্যুস্নানে বিশ্বের জীবন।……”


এলাহাবাদ। ৩ পৌষ ১৩২১, রাত্রি

বার্গসোঁ তার বিবর্তন প্রক্রিয়ার মূলে যে সত্তাকে অনুমান করেন তা হচ্ছে এলোঁ ভিটাল বা প্রাণপ্রবাহ। এটা বার্গসোঁর কাছে একটি সম্পূর্ণ অজড় সত্তা। একে কখনও তিনি আখ্যায়িত করেছেন ভাইটাল ইমপালস হিসেবে, কখনও পিওর ডিউরেশন বা বিশুদ্ধ প্রবাহ বলে। জড় ও জীব, ইতর প্রাণী সব কিছুই বার্গসোঁর মতে প্রাণপ্রবাহের বিশুদ্ধ প্রবাহে সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথও বোধ হয় জগতের সবকিছুর মূলে এমন জড় সত্তার কল্পনা করেছেন। বলাকায় তিনি বলেন:

“…স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;
বস্তহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে
পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে;…”


এলাহাবাদ। ৩ পৌষ ১৩২১, রাত্রি

এখানে রবীন্দ্রনাথ যে ‘বস্তুহীন প্রবাহ’ এর কথা বলছেন তার সাথে বার্গসোঁর প্রাণপ্রবাহের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

বার্গসোঁর মতে, বিবর্তনের স্বাভাবিক গতি চেতন সত্তার দিকে, কিন্তু বিবর্তন প্রক্রিয়া যখন বাঁধাপ্রাপ্ত হয়, আর তার ফলে যখন এটি নিম্নগতি বা বিরুদ্ধ গতিতে নিপতিত হয় তখন জড়ের সৃষ্টি হয়। তাই জড়কে বার্গসোঁ বলেন বিপরীত গতি, যা বিবর্তনের ব্যতিক্রম। বিবর্তন প্রক্রিয়ার হঠাৎ বাঁধার ফলেই যে জড়ের উৎপত্তি ঘটে তা রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও ফুটে উঠেছে:

“…যদি তুমি মুহূর্তের তরে
ক্লান্তিভরে
দাঁড়াও থমকি,
তখনি চমকি
উচ্ছ্রিয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বতে;
পঙ্গু মূক কবন্ধ বধির আঁধা
স্থূলতনু ভয়ংকরী বাধা
সবারে ঠেকায়ে দিয়ে দাঁড়াইবে পথে;
অনুতম পরমানু আপনার ভারে
সঞ্চয়ের অচল বিকারে
বিদ্ধ হবে আকাশের মর্মমূলে
কলুষের বেদনার শূলে।…”


এলাহাবাদ। ৩ পৌষ ১৩২১, রাত্রি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন কবি, আর বার্গসোঁ একজন পেশাদার দার্শনিক। এদের মধ্যে প্রকৃতিগত অনেক পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কবিগুরুর বলাকা কাব্যে যে বিবর্তন সম্পর্কিত যে দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থিত মনে হয়েছে, ভাববাদী বিবর্তনবাদ নিয়ে আলোচনার উদ্দেশে এখানে তাই একটু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, তবে রবীন্দ্রনাথের দর্শনচিন্তা কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ না। তার লেখায় আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দার্শনিক তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সে যাই হোক, মনে হয় কোলরিজের কথাটির যথার্থতা নির্ণয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখায় ভাববাদী বিবর্তনবাদী তত্ত্বের এই মিল নিয়ে লেখাটি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *